এই যাত্রাতেও কুম্ভ এক্সপ্রেস সময় মেনে দুপুর ঠিক ১টায় স্টেশন ছাড়ল। মানকড় স্টেশনে ট্রেন এসে পৌঁছোল ২টো ৩৫ মিনিটে। মনে পড়ল, কয়েক বছর আগে এখান থেকেই গিয়েছিলাম যমুনাদিঘি ও ভালকি মাচান বেড়াতে। জানলার বাইরে শরতের আবহাওয়া! হাওয়ায় দুলছে কাশফুল। উজ্জ্বল সূর্যলোকে ঝলমল করছে সবুজ মাঠ। ট্রেনের কামরায় বাংলা গান পুজোর গন্ধকে ছড়িয়ে দিয়েছে সবার মাঝে। বেশ ভালো লাগছে কাচের জানলায় চোখ রাখতে –পুকুরে ফুটে রয়েছে অজস্র পদ্মফুল, আর বকগুলো সাদা পাখা মেলে উড়ে চলেছে আকাশের দিকে। গাড়ি আসানসোল, যোশিডি হয়ে পৌঁছোল ঝাঝা স্টেশনে। স্লখান থেকেই আমাদের ৩ এসি কামরা আপামর জনসাধারণের এক্তিয়ারে চলে এসেছে। আমরাই এখন সংখ্যালঘু! রাত সাড়ে ৯টায় বাড়ি থেকে আনা খাবারে ডিনার সেরে শুয়ে পড়লাম।
সকাল ৭টায় উঠে চায়ে চুমুক দিতেই ট্রেন এসে পৌঁছোল লখনউ স্টেশনে। বেরিলি আসতে পৗনে ১টা। হরিদ্বারে গাড়ি পৌঁছোল ঠিক সময়েই। লাগেজ পিঠে নিয়ে প্লাটফর্মের বাইরে আসতেই দেখি ঝিরঝির করে বৃষ্টি পড়ছে। এসবিআই এটিএম-এ কাজ সেরেই চলে এলাম এক চা-দোকানে। হরিদ্বারে মামুলি কিছু কাজ ছিল। কিন্তু বিরামহীন বৃষ্টিতে পরিকল্পনা পালটে নিয়ে সোজা বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছোলাম এবং ঋষিকেশগামী বাসে চড়ে বসলাম। বাস ছাড়ল সাড়ে ৫টায়, গন্তব্যে পৌঁছোলাম সন্ধে ৭টায়। মদমহেশ্বর যাত্রার সময় যে প্ল্যান করেছিলাম, এবারেও তাই। বাসস্ট্যান্ডের কাছেই স্লক গেস্ট হাউস-এর দোতলায় একটি ঘরে এসে উঠলাম লাগেজ সহ। সেবার অবশ্য ছিলাম বাসস্ট্যান্ড সংলগ্ন অন্য স্লক লজ-এ। এবারের ব্যবস্থাটা কৌলীন্যে একটু উঁচুতে। উদ্দেশ্য একটাই, ভোরে গোপেশ্বরগামী প্রথম বাসটা ধরা। ডিনার সেরে শুয়ে পড়লাম রাত ১টায়।
গোপেশ্বর যাবার প্রথম বাস ভোর ৪টেয়। লাগেজ বাসের ডিকিতে ঢুকিয়ে অপেক্ষা করতে থাকি। ইতিমধ্যে, প্রাতঃকালীন চা-বিস্কুট খাওয়া হয়ে গেছে। আধঘণ্টা পরে বাসের কনডাক্টর জানায়, যাত্রী সংখ্যা কম বলে এই বাস ছাড়বে না। পরবর্তী বাস ভোর সাড়ে ৫টায়। রুদ্রপ্রয়াগগামী বাসটাই যাবে গোপেশ্বর পর্যন্ত। বড়ো ব্যাগ ডিকিতে রেখে ছোটো ব্যাগ সঙ্গে নিয়ে বসেছি। পতিতপাবনী গঙ্গাকে পিছনে ফেলে, সূর্যের নরম আলো গায়ে মেখে বাস চলতে লাগল পাহাড়ি পথে। ঘণ্টা দুই পরে আমরা দেবপ্রয়াগ এসে পৌঁছোলাম। এখানে যাত্রা বিরতি ২০ মিনিটের। বাস থেকে নেমে এক দোকানে বসে গরম গরম আলুপরোটা ও চায়ে প্রাতরাশ সারলাম। সকাল সাড়ে ৮টা নাগাদ ভাগিরথী-অলকনন্দার সঙ্গমস্থল ছেড়ে বাস আবার চলতে শুরু করল। বেলা ১টায় বাস এসে পৌঁছোল রুদ্রপ্রয়াগ। দুই বছর আগের যাত্রার স্মৃতি ভেসে আসে মনে– সেবারে এখান থেকেই বাস পরিবর্তন করতে হয়েছিল। এখানেও যাত্রাবিরতি, তাই বাস থেকে নেমে কিছুদূর এগিয়ে মন্দাকিনী ও অলকনন্দার সঙ্গমের ছবি নিলাম। গোচর ছাড়িয়ে বাস কর্ণপ্রয়াগ-এ পৌঁছোল দুপুর সোয়া ১টায়। রুদ্রপ্রয়াগ-এর মতো কর্ণপ্রয়াগও আজ চামোলী জেলার এক ব্যস্ত, বড়ো শহর। এখানে অলকনন্দার মিলন ঘটেছে পিণ্ডারী নদীর সঙ্গে। এই জায়গা মহাভারতের মহাবীর কর্ণের তপস্যাস্থল। আমার সবচেয়ে প্রিয় এই প্রয়াগে অনেকটা সময় কাটিয়েছিলাম।
নন্দপ্রয়াগ এসে পৌঁছোলাম দুপুর দেড়টা নাগাদ– এই স্থানে মন্দাকিনী মিলিত হয়েছে অলকনন্দার সঙ্গে। পরিচিত পথে চামোলী শহর পেরিয়ে গোপেশ্বর এসে পৌঁছোলাম দুপুর ৩টেয়। লাগেজ নামাতেই নজরে এল অপেক্ষারত এক জিপের। মাথা পিছু ২০ টাকা ভাড়া দিয়ে পৌঁছোলাম ৫ কিলোমিটার দূরে সাগর গ্রামে, আমাদের প্রথম গন্তব্যস্থল। গাড়ি থেকে মালপত্র নামিয়ে চেক-ইন করলাম হোটেলে। ঘড়িতে তখন বিকেল ৩টে বেজে ৫মিনিট।
অ্যাটাচ্ড বাথরুম সহ ঘর বেশ পরিষ্কার।নিজেদের মোবাইল ও পাওয়ার ব্যাংক চার্জ করতে দিয়ে সামনের ডাইনিং হলে এসে বসলাম। এরপর চায়ের গেলাস হাতে নিয়ে বাইরে এলাম। কিছু দূরেই সগরেশ্বর মহাদেব মন্দির দেখা যাচ্ছে। একটু পরে হোটেল থেকে কিছুটা এগিয়ে পথের ধারে এক জায়গায় এলাম। সেখান থেকে সিঁড়ি নেমে গেছে নীচে ঘুরে ঘুরে। দেখছি, ধাপে ধাপে ফসলের চাষ– ধান, গম, মনুয়া, কলাই ও তিল। মন্দিরের পিছনে পাহাড়, সামনে ও দুই পাশে চাষজমি। উপরের পাহাড় থেকে আগত কয়েকটি ঝরনাধারা প্রতিটি ধাপের চাষজমিকে ভিজিয়ে দিয়ে নীচে নেমে আসছে এবং সেই জমা জলকে পুনরায় চাষের কাজে লাগানো হচ্ছে। এক অনুপম প্রাকৃতিক জলসেচ ব্যবস্থা! ধীরে ধীরে পৌঁছোলাম প্রাচীন সকলেশ্বর (সগরেশ্বর) মন্দিরে। কয়েক বছর আগেই সংস্কার করা হয়েছে সকলেশ্বর মহাদেব মন্দির এবং পাশেই অবস্থিত মা চণ্ডিকা দেবী ও লক্ষ্মীনারায়ণ মন্দিরে। জানলাম, সূর্যবংশীয় রাজা বাহু-র পুত্র মহারাজ সগর-এর জন্মভূমি, ক্রীড়াভূমি, শিক্ষাস্থল ও উপাসনাস্থল এই সাগর গ্রাম। সগর রাজা শিব ও শক্তি (মা চণ্ডিকা)-র উপাসনা করে পুনরায় অযোধ্যা রাজ্য জয় করেন। তাঁর উপাসনাস্থলেই রয়েছে ওই প্রাচীন তিন মন্দির। মন্দিরের শান্ত পরিবেশ সহজেই মন কেড়ে নেয়। মন্দির থেকে ফেরার পথে আমরা আলাপ করলাম চাষের কাজে ব্যস্ত রমণীদের সঙ্গে। তারাই দেখাল, কোন জমিতে কোন ফসলের চাষ হচ্ছে।
হোটেলে ফিরে আর এক দফা চা খেয়ে লাগেজ গুছোতে শুরু করলাম। ঠিক হল, একটা রুকস্যাকে আমাদের দুজনের প্রয়োজনীয় জিনিস নিয়ে গাইড রুদ্রনাথের পথে এগোবে। বাকি জিনিস সমেত অন্য রুকস্যাকটা থাকবে এই হোটেলেই। ট্রেকিং শেষে আমাদের ফোন পেলেই স্লই হোটেল থেকে লাগেজ পাঠিয়ে দেওয়া হবে মণ্ডলে ঠিক করা হোটেল-স্ল। রাতে গরম রুটি, ডাল ও সবজিতে ডিনার সেরে নিয়ে শুয়ে পড়লাম। কাল ভোর সাড়ে ৪টেয় উঠতে হবে।
আমাদের গাইড প্রদীপ সিং রানা ভোর হতেই চলে এসেছে হোটেলে। আমরাও গরম জলে স্নান সেরে, চা-বিস্কুট খেয়ে তৈরি হয়ে নিয়েছি ৬টার মধ্যে। হোটেল মালিক-এর সামনেই ঠিক হল, গাইডকে পারিশ্রমিক এবং থাকা-খাওয়ার খরচ দেওয়া হবে। প্রদীপ স্থানীয় গাড়োয়ালি যুবক। সে রুকস্যাক পিঠে তুলে নিল, আমাদের পিঠে ন্যাপস্যাক ও হাতে লাঠি। ঠিক সকাল সোয়া ৬টায় হোটেল ছেড়ে বের হলাম। একটু এগিয়েই এক দোকান থেকে
২ প্যাকেট ধূপ কিনে নিলাম, কারণ মন্দির চত্বরে কিছুই পাওয়া যাবে না। সাড়ে ৬টায় রুদ্রনাথ যাত্রার প্রবেশদ্বারে পৌঁছোলাম এবং চতুর্থ কেদারের উদ্দেশ্যে প্রণাম জানিয়ে যাত্রা শুরু করলাম।
গ্রাম পেরিয়ে, ঘাস জমিকে নীচে রেখে, পাহাড়ি পথে উপরে উঠতে লাগলাম। সকাল ৭টা ৪০ মিনিটে, পৌঁছোলাম চন্দ্রকোঠি। সেখানে গজেন্দ্র সিং-এর ধাবায় বসে চা খাওয়ার সময় জানলাম, দোকানে প্রায় ৩ঙ্মজন যাত্রীর রাত কাটানোর ব্যবস্থা রয়েছে। ১৫ মিনিটের বিরতি নিয়ে আবার চলা শুরু করলাম। এবার পাথুরে পথ এগিয়েছে হালকা জঙ্গলের মধ্য দিয়ে। গাছের পাতা চুঁইয়ে সূর্যের নরম আলো শরীর ছুঁয়ে যাচ্ছে। নিস্তব্ধ বনপথ, চড়াই ক্রমশ বেড়ে চলেছে।
গত রাতে বৃষ্টি না হলেও আগের ২-৩ দিন প্রচুর বৃষ্টি হয়েছিল। ফলে পথ বেশ পিছল। দু’পাশেই ফার্ন-এর জঙ্গল, ভিজে পাথরের ওপর মসের আস্তরণ। ক্বচিৎ কখনও পাখির ডাক। বাঁ-দিকে সবুজ পাহাড় রোদে উজ্জ্বল। বনে বিশাল সব ওক, মাঝারি সাইজের ব্রাস এবং নাম না জানা অজস্র বুনো গাছ। শুনে চলেছি ঝিঁঝি পোকার একটানা কলতান।
পুঙ বুগিয়ালে এসে পৌঁছোলাম ৯টা নাগাদ। প্রায় ৩প্তঙ্ম০ ফুট উঁচুতে অবস্থিত ছোট্ট বুগিয়ালটি ভারি সুন্দর, তিন দিকে পাহাড় দিয়ে ঘেরা। সাগর থেকে ৩ কিলোমিটার দূরে এই বুগিয়ালে এক রঙিন ছাতার নীচে বসার ব্যবস্থা। তাঁবু খাটানো ধাবার মালিক দেবেন্দ্র সিং এগিয়ে এসে আমাদের আমন্ত্রণ জানালেন। শিশিরভেজা ঘাসের ওপর বড়ো পলিথিনের চাদর পেতে দিলেন। আমরা সেখানে লাগেজ রেখে হাত-পা ছড়িয়ে বসলাম। সঙ্গে আনা কিছু শুকনো খাবার খেয়ে আরাম করে চা পান করলাম। ছবি নিলাম বুগিয়ালের, দেবেন্দ্র সিংকে সঙ্গে নিয়ে। উল্লেখ্য, পুঙ বুগিয়ালে বন বিভাগের তৈরি একটি শৗচালয়ও আছে।
এবার চড়াই আরও কঠিন। ধীরে ধীরে হাঁটছি। প্রথম বার দেখলাম গাছের ডালে হনুমানের সতর্ক উপস্থিতি। খরস্রোতা ঝরনার ওপর নির্মিত পুল পার হ’লাম। অসাধারণ সুন্দর জায়গা। বেলা বেড়েছে, গাছের ফাঁক দিয়ে সূর্যের আলো এসে চলার পথকে আলোকিত করেছে। পথের ধারে সাদা বুনো ফুল, মাথার ওপরে গাছে হলুদ ফুল। স্যাঁতসেঁতে গাছের গায়েও মসের আস্তরণ। দ্স্তুর চড়াই অতিক্রম করে বেলা ১রটা ১প্তমিনিটে চক্রগনি-তে এসে পৌঁছোলাম। এখানে ১৫ মিনিটের চা-বিরতি।
আবার হাঁটা শুরু করলাম ধীর লয়ে। পরবর্তী গন্তব্য মৗলি খড়ক, প্রায় ২ কিলোমিটার দূরে। জঙ্গলে উড়ে বেড়াচ্ছে নানা রং-এর প্রজাপতি। পাহাড়ের চূড়ায় নেমে এসেছে সাদা মেঘ। চারিদিক একেবারে নিশ্চুপ। শুধু দূর থেকে ভেসে আসছে ঝরনার জলের একটানা শব্দ। পথের দু’পাশেই বহু রডোডেনড্রন, যদিও ফুল আসেনি গাছে। ভয়ংকর চড়াই ভেঙে দুপুরে পৌঁছোলাম মৗলি খড়ক-এ। এখানে থাকার কোনও জায়গা নেই। তাই একটু থেমেই আবার হাঁটতে শুরু করলাম। চড়াই ক্রমশই বাড়ছে। তাই আমাদের হাঁটার গতি আরও মন্থর হয়েছে। জঙ্গলের ঘনত্ব কমেনি একটুও। আকাশে হঠাৎই মেঘের উপস্থিতি। বহু কষ্টের পর লিউটি বুগিয়াল-এ এসে পৌঁছোলাম।
কিষাণ সিং বিস্ত-এর ধাবায় লাগেজ নামিয়ে রাখতেই বৃষ্টি শুরু হল। পুঙ বুগিয়াল থেকে কম করেও ৫ কিলোমিটার হেঁটে এসেছি এখানে। শরীর আর চলছিল না। তাই জুতো খুলে বসে পড়লাম কম্বলের ওপরে। গরম চায়ের সঙ্গে মশলা-মুড়ি খেতে খেতে অপেক্ষা করছি যদি বৃষ্টি থেমে যায় তাড়াতাড়ি। ইতিমধ্যে কয়েকটি মিশমিশে কালো কাক চলে এসেছে ধাবার উঠোনে। আবহাওয়া আরও খারাপ হল, সঙ্গে আরও বৃষ্টি। আমাদের লক্ষ্য ছিল, সন্ধের আগে পানার বুগিয়ালে পৗঁছোনো। বিকেল সাড়ে ৪টে বেজে গেল, কিন্তু বৃষ্টি থামল না। দিনের আলোয় পানার-এ পৗঁছোনোর সময় হাতে আর রইল না। গাইড প্রদীপও চাইছিল না আর এগোতে। মনকে শান্ত করলাম, লিউটি বুগিয়ালেই রাত কাটাব।
বিকেল ৫টা নাগাদ বৃষ্টি থেমে গেল। বাইরে এসে দাঁড়ালাম। পাহাড়ের ঠিক নীচেই এই ছোট্ট বুগিয়াল। দেখছি আকাশে মেঘের খেলা। সন্ধে ঘনিয়ে আসছে। কিষাণ সিং-এর বউ তাদের গরুগুলোকে সামনের গোশালায় ঢুকিয়ে দিয়ে এল। ঠিক তখনই বিশাল, পোষা পাহাড়ি কুকুরটা চলে এল ধাবার উঠোনে, রাতে পাহারা দেবার জন্য। সন্ধেবেলায় পুজো সেরে রান্নার কাজে বসলেন কিষাণ সিং। তিনি কাজের ফাঁকে গল্প করতে লাগলেন আমাদের সঙ্গে। জানালেন, সকাল ৬টায় আলো ফোটার আগে আমাদের বুগিয়াল ছেড়ে যাওয়া ঠিক হবে না। তাছাড়া লিউটি থেকে পানার বুগিয়ালের দূরত্ব প্রায় ৪ কিলোমিটার, দুই ঘণ্টার বেশি সময় লাগবে না। রাত ৮টায় সয়াবিন-এর বড়ি সহযোগে মিক্সড ভেজিটেবল্স ও রুটি দিয়ে ডিনার সেরে নিলাম। ক্লান্ত আমরা, ৯ টার আগেই শুয়ে পড়লাম।
ভোর সাড়ে ৫টায় বিছানা ছেড়ে উঠে পড়েছি। হাত-মুখ ধুয়ে, পরিষ্কার হয়ে, ব্যাগ গুছিয়ে নিলাম। গরম চা পান করে সকাল সাড়ে ৬টার মধ্যে লিউটি বুগিয়াল ছেড়ে বেরিয়ে পড়লাম। আমাদের গন্তব্য পানার বুগিয়াল। এই পথের সবচেয়ে বড়ো ও সুন্দর বুগিয়াল। গত রাতের বিশ্রাম আমাদের হাঁটার গতিকে বাড়িয়ে দিয়েছে। প্রথম সকালে হিমালয়ের স্নিগ্ধ রূপ দেখব না দ্রুত হেঁটে লক্ষ্যে পৌঁছোব, ঠিক করতে পারছি না। প্রায় ৪৫ মিনিট ধরে চড়াই ভাঙার পর জঙ্গল হালকা হল। আমরা দ্রুত এগিয়ে চললাম। আরও আধ ঘণ্টা হাঁটার পর কিছু দূরে দেখা পাওয়া গেল এক সবুজ বুগিয়ালের। বুঝলাম, গন্তব্য আর বেশি দূরে নয়। আরও কিছুদূর হেঁটে ঠিক পৗনে ৮টায় পৌঁছে গেলাম এক বিশাল বুগিয়ালে। চোখের সামনে পানার বুগিয়াল। গিরিরাজ হিমালয়ের কোলে এ যেন এক স্বর্গরাজ্য! বহুদিন মনে পোষণ করার পর আজ সে ধরা দিয়েছে তার অনিন্দ্য সুন্দর রূপকে সম্পূর্ণ উন্মোচন করে। সুবিস্তৃত, ঢালু, সবুজ প্রান্তরের পিছনে বিভিন্ন উচ্চতায় বিশাল সব প্রস্তরখণ্ড মাটি ফুঁড়ে বেরিয়ে পড়েছে। তারও পিছনে তুষার শুভ্র হিমালয়ের বিখ্যাত সব শৃঙ্গরাজি। মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে কিছুক্ষণ বুগিয়ালের রূপ উপভোগ করে এগিয়ে গেলাম দিলওয়ার সিং-এর ধাবায়। এখানে ট্রেকারদের থাকা-খাওয়ার জন্য ভালো ব্যবস্থা আছে। ধাবার পিছনে বনবিভাগের তৈরি একটি শৌচালয়ও আছে। অর্জুন সিং জানাল, ধাবায় থাকা-খাওয়া-শোওয়া-র ভালো ব্যবস্থা আছে। বেশ খিদে পেয়েছিল। চেয়ারে বসে আরাম করে খেলাম গরম ম্যাগি ও চা।এরপর পানার বুগিয়ালের ছবি নিলাম বিভিন্ন স্থান থেকে।
আধ ঘণ্টা বিশ্রামের পর আবার হাঁটা শুরু করলাম। এবার গন্তব্য ৩ কিলোমিটার দূরে পিত্রাধর টপ্। অনেকটা পথ হাঁটলাম হালকা চড়াইয়ে। সামনে তাকালে দেখা যাচ্ছে সুউচ্চ শৃঙ্গগুলি– ত্রিশূল, দ্রোণাগিরি, হাতি, ঘোড়ি, নন্দাদেবী ও নন্দাঘুণ্টি। যত এগোচ্ছি, যত চড়াই ভাঙছি, হিমালয়ের শৃঙ্গগুলি ততই যেন বিভিন্ন আঙ্গিকে ধরা দিচ্ছে চোখের সামনে! ওপর থেকে দেখছি, সবুজ পাহাড়ি ঢাল ক্রমশ মিশে গিয়েছে বুগিয়ালে।
এইবার খাড়া চড়াই শুরু হল। সে চড়াই-এর যেন শেষ নেই। ঘণ্টা দেড়েক পরে, অনেকটা উঁচুতে দেখতে পেলাম পিত্রাধর-এর
লাল-হলুদ পতাকা। আবার উজ্জীবিত হয়ে হাঁটতে লাগলাম। ভয়ংকর চড়াই শেষে সকাল স্লগারোটা নাগাদ পৌঁছে গেলাম পিত্রাধর টপ্-এ। কয়েক মিনিট সেখানে দাঁড়িয়ে আবার হাঁটা শুরু করলাম। হঠাৎই কোথা থেকে একখণ্ড মেঘ এসে আমাদের ছুঁয়ে গেল। পঞ্চগঙ্গার পথে চড়াই কম, বেশিটাই উতরাই। মোটামুটি দ্রুত হাঁটছি আমরা। এখান থেকে পথের দু’পাশেই রডোডেনড্রনের জঙ্গল। ঘড়িতে ১টা ৪৫ মিনিট। আমরা এসে পড়েছি ২ কিলোমিটার দূরে পরের গন্তব্যে। দেখছি পথের ধারে ছোটো-বড়ো পাথরে বাঁধানো এক জায়গা থেকে নলের মাধ্যমে জল পড়ছে, সেখানে লেখা ‘পঞ্চ গঙ্গা’। সামনে এগোলেই একটি ধাবা। তার উলটো দিকে পাথরে তৈরি সুন্দর এক বসার জায়গা। আমরা সেখানেই লাগেজ নামিয়ে বসলাম।
চা-বিরতি প্রায় ২০ মিনিটের। ফটো তোলার সুযোগও পাওয়া গেল।
পঞ্চগঙ্গা থেকে রুদ্রনাথ-এর দূরত্ব প্রায় ৩ কিলোমিটার। এবার অনেকটা পথ উতরাইয়ে। দু’পাশে শুধু রডোডেনড্রনের বন। মাসখানেক পরে ফুলে ফুলে ভরে যাবে এই জায়গা। বাঁদিকে পাহাড়ের গায়ে ঘাস বন– সেখানে বেগুনি, হলুদ ও সাদা ফুলের ছড়াছড়ি। রুদ্রনাথ মন্দিরের আধ কিলোমিটার আগেই থাকা-খাওয়ার জায়গা ‘যাত্রী নিবাস’। সেখানে পৌঁছোলাম দুপুর ২টো নাগাদ। লাগেজ নামিয়েই মন্দির দর্শন করলাম।
মন্দিরের দরজা তখন বন্ধ, খুলবে বিকেল সাড়ে ৪টেয়। মন্দিরের কাছাকাছি কয়েকটি পবিত্র কুণ্ডের অবস্থান– সূর্য কুণ্ড, চন্দ্র কুণ্ড, তারা কুণ্ড, মানা কুণ্ড, যোধা কুণ্ড ইত্যাদি। মন্দিরের কিছুটা নীচে বয়ে চলেছে বৈতরণী নদী যাকে রুদ্রগঙ্গাও বলা হয়। আকাশ পরিষ্কার। দেখতে পাচ্ছি ত্রিশূল, নন্দাদেবী, দেবস্থান, হাতি পর্বত, নন্দাঘুণ্টি এবং আরও কয়েকটি অজানা শৃঙ্গ।
রুদ্রনাথে প্রচণ্ড ঠান্ডা এই সময়ে। সাড়ে ৩টে নাগাদ গরম ম্যাগি ও চায়ে খিদে ও তৃপ্তি মেটালাম। তখনই আলাপ হ’ল মালয়েশিয়া থেকে আগত দু’জন তামিল যুবকের সঙ্গে। তারা দুজনেই ধর্মপ্রাণ এবং একই সঙ্গে পঞ্চকেদার পরিক্রমা করছে। আরও আলাপ হ’ল দিল্লিবাসী রাজেন্দ্র সিং রাওয়াত ও তাঁর পত্নীর সঙ্গে। পরে জেনেছিলাম, রাজেন্দ্রজি দেশের প্রায় সব শিবতীর্থই দর্শন করে ফেলেছেন। সকলেই সন্ধে সাড়ে ৬টার মধ্যে পৌঁছে গেলাম রুদ্রনাথের গুহামন্দিরে আরতি দর্শনের জন্য।
অসাধারণ পরিবেশ মন্দিরে। ভক্তগণ সমবেত হয়েছেন নীরবে। ঠিক সন্ধে ৬টা ৪৫ মিনিটে আরতি শুরু হ’ল। গুহামন্দিরের সঙ্গে যুক্ত ঘরের ছাদ থেকে ঝুলছে বিভিন্ন আকারের ১ঙ্ম-রচ্টি ঘণ্টা। আরতি শুরু হতেই ভক্তজনেরা ঘণ্টা বাজিয়ে যোগদান করলেন। বর্তমান পূজারি সৗম্যদর্শন হরিশ ভাট, গাড়োয়ালেরই বাসিন্দা। প্রথমে তিনি ধুনুচি নিয়ে এবং তারপর পঞ্চপ্রদীপ-এ আরতি করতে লাগলেন। এবার চামর দুলিয়ে এবং শেষে ডুগডুগি বাজিয়ে আরতি সম্পন্ন করলেন শুদ্ধ মন্ত্রোচ্চারণের সঙ্গে। মহাদেবের বাঁ পাশে পিতলের সাপ, ডান পাশে পিতলের কমণ্ডলু ও ত্রিশূল। আরতি শেষে আমরা সকলেই দীপশিখার ওম্ স্পর্শ করলাম।
আরতির পরে এবার মন্ত্রোচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে পূজারিজি মুখরূপী, স্বয়ম্ভূ শিবলিঙ্গ থেকে ধীরে ধীরে, এক এক করে খুলে নিলেন মালা ও রাজ (রুদ্র) বেশ। আমার অনন্ত প্রতীক্ষার অবসান ঘটল। চোখের সামনে উন্মোচিত হলেন চতুর্থ কেদার, তাঁর শান্ত ক্ষমাশীল, সমাহিত রূপে। আমি অপলক দৃষ্টিতে সেই অনুপম রূপ অবলোকন করে ধন্য হলাম। ধীরে ধীরে মন্দিরের বাইরে এলাম এবং ফিরে চললাম পুষ্পিন্দর সিং-এর ধাবায়। রাতে আমাদের ইচ্ছে অনুযায়ী গরম খিচুড়ি পরিবেশন করা হল আলুভাজা ও পাঁপড় ভাজা সহ। আজ রাতে যাত্রীনিবাস বিভিন্ন বয়সের তীর্থযাত্রীতে ভর্তি। দুই পোর্টার-এর সঙ্গে কিছুক্ষণ গল্প করে শুয়ে পড়লাম।
সকাল ৬টায় উঠে পড়লাম। মুখ ধুয়ে প্রথমে গরম চা খেয়ে নিলাম। এবার পোশাক পরিবর্তন করে ৭টার মধ্যেই মন্দিরে পৗঁছে গেলাম। রুদ্রনাথের অভিষেক ক্রিয়া শুরু হল সকাল সাড়ে ৭টায়। পূজারিজি শিবলিঙ্গ শোধন করে পরম যত্নে এক এক করে সমস্ত অলংকার পরাতে লাগলেন– পিছন থেকে তাঁর সহকারীর মন্ত্রোচ্চারণ চলতে লাগল। মহাদেব ধারণ করলেন রুদ্ররূপ। অভিষেক ক্রিয়া সম্পূর্ণ হল দুই ঘণ্টা পরে। বেলা ১ঙ্মটায় আমরা পুজো দিলাম। আমাদের সঙ্গে আনা রুপোর বিল্বপত্র শোভিত হল মহাদেবের মস্তকে। এরপর হোম চলল প্রায় এক ঘণ্টা ধরে। ফুল ও প্রসাদ নিয়ে আমরা যখন ধাবায় ফিরলাম, তখন ঘড়িতে বেলা সোয়া ১টা। বুঝলাম, অনেক দেরি হয়ে গেছে। আজ আর কোনওভাবেই মণ্ডল পৌঁছোনো যাবে না। লাগেজ গুছিয়ে নিয়ে দ্রুত রুটি-সবজি ও চা খেয়ে নিলাম। ধাবার বিল মিটিয়ে পিঠে স্যাক ও হাতে লাঠি নিয়ে আমরা ফিরতি যাত্রা শুরু করলাম ঠিক দুপুর ১টায়।
শীতকালে মহাদেবের প্রতীকী অবয়ব গোপেশ্বরে নিয়ে এসে পূজা করা হয়। ডোলিযাত্রা গোপেশ্বর থেকে শুরু হয়ে সাগর, লিউটি, পানার পেরিয়ে পিত্রাধর এসে পৌঁছোয়। সেখানে পূর্বপুরুষদের পুজো করা হয়। ধালাবনি ময়দান পেরিয়ে ডোলি রুদ্রনাথ এসে পৗঁছোয়। সেখানে প্রথমে বনদেবী-র পুজো করা হয়, যাঁকে অঞ্চলের রক্ষাকর্ত্রী বলে মানা হয়। শ্রাবণ মাসে রাখী পূর্ণিমার দিন বার্ষিক মেলা উদ্যাপিত হয় রুদ্রনাথ মন্দিরে।
যাত্রীনিবাস থেকে পঞ্চগঙ্গা পর্যন্ত প্রায় পুরোটাই চড়াই পথ। দু’পাশে রডোডেনড্রনের বন ও ঘাস জমি। আমরা এগোচ্ছি ধীর পায়ে। পঞ্চগঙ্গা পৌঁছোতে দুপুর সোয়া ১টা বেজে গেল। সেখানে ১০ মিনিট বিশ্রাম করে, একেবারে খাড়া চড়াই ভেঙে পাহাড়ের শীর্ষদেশে পৌঁছোলাম আধ ঘণ্টায়। হঠাৎই আবহাওয়া খারাপ হয়ে গেল। আকাশ জুড়ে শুধু মেঘ আর মেঘ। গাইড প্রদীপের পিছু পিছু বিপজ্জনক শৈলশিরা ধরে বাঁদিকে এগিয়ে গেলাম, কোনও ভাবে ঘাসের গোছা আঁকড়ে ধরে। হঠাৎ গাইডের খেয়াল হয়, সে ভুল পথে চলে এসেছে। বহু কষ্টে সেই শৈলশিরা ধরে ফিরে আসি পূর্বস্থানে। বৃষ্টিতে দেখা যাচ্ছে না পথ। ভাগ্যক্রমে, নীচে এক জায়গা থেকে স্থানীয় এক ব্যক্তি আমাদের গাইডকে সঠিক রাস্তা দেখিয়ে দিল। ভুলের জন্য আধ ঘণ্টা অমূল্য সময় নষ্ট হল। এবার ডান দিক ধরে চলতে শুরু করলাম অনসূয়ার উদ্দেশ্যে। মিনিট দশেক হাঁটার পরেই শিলাবৃষ্টি শুরু হল। ছোটো বড়ো শিলা পড়তে শুরু করল মাথায়। তাড়াতাড়ি মাথা ও লাগেজ ঢেকে নিলাম পলিথিনের চাদরে। কখনও জঙ্গল পথে, কখনও ঘাসবনের মধ্য দিয়ে ভয়ানক বিপজ্জনক পথে নামতে লাগলাম আমরা। নীচে তাকালে রক্ত হিম হয়ে যায়! অন্তত তিন-চার হাজার ফুটের ভয়ংকর উতরাই। অবিরাম শিলাবৃষ্টি হয়ে চলেছে। গত কয়েকদিনের বৃষ্টিতে ঘাসঝোপের অস্বাভাবিক বাড়-বাড়ন্ত! পথ খুঁজে পাওয়াই মুশকিল হয়ে পড়ছে। প্রত্যেকেরই গলা শুকিয়ে কাঠ, নিজেদের দুর্বল মনে হচ্ছে। এবার একটু সুরক্ষিত স্থানে এসে পাহাড়ের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়ালাম। প্রত্যেকেই কিছুটা করে শুকনো ফল খেয়ে জলে গলা ভেজালাম।
এবার আবার শুরু হল জঙ্গল পথ। পিছল পথে ক্রমশ নীচে নেমে চলেছি। প্রায় দেড় ঘণ্টা ধরে নীচে নেমে আসার পর আরও কিছুটা নীচে নজরে এল ছোট্ট এক বুগিয়াল। আমরা অনেকটা নীচে নেমে এসেছি। মনে আশা, কোনওরকমে ওই বুগিয়ালে পৌঁছোতে হবে যেখানে দেখা যাচ্ছে দুটি পাতা ছাওয়া ঘর। হয়তো কোনও একটাতে মিলে যাবে রাতে থাকার আশ্রয়। গাইড দ্রুত নেমে গেল খোঁজ নিতে। আমরা টলতে টলতে বুগিয়ালের কাছে এসে পৌঁছোলে গাইড জানায়, ঘর দুটি মেষপালকদের, যেখানে ট্রেকারদের জন্য থাকা-খাওয়ার কোনও ব্যবস্থা নেই। আশাহত হ’লাম ভীষণ ভাবে। আমরা সেখানে গিয়ে বসলে একজন মেষপালক পাঁচ মিনিটের মধ্যে গরম চা নিয়ে চলে এল। বেশি মিষ্টি চা আমাদের শরীরে জোগাল প্রয়োজনীয় শর্করা। আমরা জোর করে তাকে কিছু টাকা দিয়ে আবার হাঁটা শুরু করলাম। বুগিয়ালের লোকেরা জানাল, নিকটবর্তী কাণ্ডাই বুগিয়াল আরও ৩ কিলোমিটার দূরে। আরও জানাল, পিত্রাধর থেকে নাওলা পাস হয়ে এলে আমরা পৌঁছোতাম হানসা বুগিয়ালে।
ঘড়িতে সন্ধে পৗনে ৬টা। তাই, আরও ঘণ্টাখানেক আলো থাকবে পথে। কিন্তু মেঘলা আবহাওয়ায় আধ ঘণ্টার মধ্যেই অন্ধকার ঘনিয়ে এল। জঙ্গলপথে আর কিছুই দেখা যাচ্ছে না। বৃষ্টিতে আলগা, পিছল মাটি। এর মাঝে আমরা প্রত্যেকেই এক-দুই বার করে পিছলে পড়েছি মাটিতে। যেখানে সেখানে বড়ো গাছ উলটে পড়ে হাঁটা পথ আটকে দিয়েছে। টর্চ-এর আলোই একমাত্র ভরসা। কখনও হামাগুড়ি দিয়ে, কখনও বুকে হেঁটে, কখনও বা উলটে পড়া গাছের ওপর চড়ে আমরা এগোচ্ছি। পথ যেন আর শেষ হয় না। এখনও পর্যন্ত আনুমানিক ৯০ কিলোমিটার হেঁটেছি চরম প্রতিকূল অবস্থায়। গাইড যদিও বলে চলেছে, আমরা ঠিক পথেই চলেছি, তবু আমাদের মনে বেশ
সংশয়। বহু চেষ্টার পরে গাইড মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করতে সমর্থ হয় কাণ্ডাই বুগিয়ালে ধাবার মালিকের সঙ্গে। তার কথা মতো আমাদের অবস্থান বোঝাতে বার বার গাছের মাথায় টর্চের আলো ফেলতে লাগলাম। প্রায় আধ ঘণ্টা পর কাণ্ডাই ধাবা থেকে ছুটে এল নন্দন সিং বিস্ত। এবার তাকে অনুসরণ করে আরও প্রায় ৪৫ মিনিট পরে রাত ৮টা নাগাদ আমরা এসে পৌঁছোলাম কাণ্ডাই বুগিয়ালে, পঞ্চগঙ্গা থেকে যার দূরত্ব ১১ কিলোমিটার। মনে হল, আমরা যেন নতুন জীবন ফিরে পেলাম!
ছোট্ট ধাবায় আমাদের স্বাগত জানালেন রাওয়াতজি। আমরা খুশি হ’লাম পরিচিত ব্যক্তিকে দেখে। হাত-পা ধুয়ে প্রথমেই গরম চায়ে একটু চাঙ্গা হবার চেষ্টা করলাম। আধভেজা পোশাক পরিবর্তন করে ডিনারে বসলাম। তার পরেই ক্লান্ত শরীরকে বিছানায় এলিয়ে দিলাম।
সকালে উঠে ধাবা থেকে বাইরে এলাম। মন ভরে গেল প্রকৃতির অপার সৗন্দর্যে। ধ্যান মগ্ন হিমালয়ের মাঝে নিজেকে ধন্য মনে করলাম। দূরে, অনেকটা নীচে দেখতে পাচ্ছি অনসূয়া মন্দির ও সংলগ্ন ঘরবাড়ি। ঠিক সকাল সাড়ে ৭টায় দুই গাইডের সঙ্গে আমরা ৭জন যাত্রা শুরু করলাম গহন জঙ্গলের মাঝ দিয়ে।
রাতের বিশ্রাম চলার শক্তি দিয়েছে আবার। আজ ভারি ভালো লাগছে জঙ্গলের শান্ত রূপ! ক্বচিৎ শুনছি পাখির ডাক, নয়তো দূরে বয়ে চলা ঝরনার কলতান। সামনে চলেছে দুই গাইড, পেছনে আমরা চারজন। এবার পার হ’লাম খরস্রোতা এক ঝরনার ওপরে বানানো একটি সেতু। আরও ১৫ মিনিট হাঁটার পর পৌঁছোলাম অত্রিমুনির আশ্রমে যাওয়ার পথে। প্রদীপ সকলের লাগেজ নিয়ে উপরে থেকে গেল। আমরা অন্য গাইডকে অনুসরণ করে সিঁড়ি দিয়ে নীচে নেমে চলে এলাম অত্রিগঙ্গার কাছে। কাছেই একটি গুহায় বিশালদেহী এক মৗনীবাবার বাস। নদীতে প্রচণ্ড স্রোত। গাইডের সাহায্যে বিশাল পাথরগুলোর ওপর সতর্ক পা ফেলে একে একে নদী পার হ’লাম। ঘড়িতে তখন বেলা ১রটা। ধীরে ধীরে আশ্রমের ঠিক নীচে গিয়ে পৌঁছোলাম। উপরে তাকিয়ে দেখি, অত্রিগঙ্গা বিপুল জলধারায় পাহাড় থেকে নীচে ঝাঁপিয়ে পড়ছে। উপরে গুহা আশ্রমে পৌঁছোনোর পথ এই বর্ষায় অত্যন্ত বিপজ্জনক। তাই, নীচে দাঁড়িয়েই মহর্ষির উদ্দেশ্যে প্রণাম জানালাম এবং একই পথে সাবধানে ফিরে গেলাম নদীর অপর পাড়ে।
আবার হাঁটা লাগালাম বনপথে। প্রায় ঘণ্টাখানেক হেঁটে দুপুর সোয়া ১টায়। পৌঁছোলাম ছবির মতো সুন্দর গ্রাম অনসূয়াতে। প্রথমেই চলে এলাম হোটেলে। গত দিনের বর্ষাতে ভিজে যাওয়া পোশাক ও জুতো রোদে শুকোতে দিলাম। তারপর সবাই মিলে গল্প করতে করতে চা খেলাম। লাঞ্চের অর্ডার দিয়ে চললাম অনসূয়া দেবী মন্দিরে। সেখানেও থাকা-খাওয়ার জন্য মন্দির কমিটির ধর্মশালা রয়েছে। আমাদের দেখে পুরোহিত মশাই এসে মন্দিরের দরজা খুলে দিলেন। দর্শন করলাম অনসূয়া দেবীর অপূর্ব সুন্দর মূর্তি।
এরপর গেলাম দত্তাত্রেয় মন্দিরে। ঋষি দত্তাত্রেয়-র মূর্তিটিও অতি সুন্দর। ছোট্ট গ্রামটিতে যেন এক অপার শান্তি! ফিরে এলাম লজে। পিছনে স্নানের জায়গায় গিয়ে সাবান দিয়ে হাত-পা-মুখ ধুয়ে পরিষ্কার হ’লাম। সকলে মিলে লাঞ্চ সারলাম ভাত, কারি ও শাকভাজায়।
৬ কিলোমিটার দূরে মণ্ডলের পথে যাত্রা শুরু করলাম আড়াইটে নাগাদ।
শুরুতে অনেকটা পথ পাথরে বাঁধানো, হাঁটলে পায়ে লাগে। এরপর আবার শুরু হল জঙ্গল, সঙ্গে বৃষ্টি। প্রায় ২ কিলোমিটার হাঁটার পর এএসআই দ্বারা রক্ষিত এক প্রাচীন শিলালিপি দেখতে পেলাম পথের পাশেই। অনুমান করা হয়, এই শিলালিপি ষষ্ঠ শতকের, যখন সেখানে (সির্কা) রাজত্ব করতেন মৌখান রাজ সরবর্মন । শিলালিপির ছবি তুলে আবার এগিয়ে চললাম।
কিছুক্ষণ হাঁটার পর এক চা-দোকান দেখে সকলে বসে পড়লাম সেখানে। চা খাওয়ার সময় লক্ষ্য করলাম, পাহাড়ের গায়ে অনেক উঁচুতে দাঁড়িয়ে আছে হরিণ প্রজাতির দুই প্রতিভু। বিকেল সাড়ে ৪টের সময় পৌঁছোলাম বর্ধিষ্ণু গ্রাম মণ্ডল-এ এবং আরও ১৫ মিনিট পরে বাস রাস্তার পাশে আমাদের রাতের আশ্রয় ভগৎ সিং বিস্ত-এর হোটেলে। দোতলায় একটি ঘরে আমাদের থাকার ব্যবস্থা। ঘরটা ভালোই, সবরকম সুবিধে যুক্ত। ব্যালকনিতে দাঁড়ালে রাস্তা সহ মণ্ডল গ্রামের অনেকটা দেখা যায়। হালকা গরম জলে স্নান করে নীচে চলে এলাম এবং গরম চায়ে ক্লান্তি দূর করলাম। একটু আগেই জেনেছি, প্রায় সমগ্র গাড়োয়াল অঞ্চলে ছোটো গাড়ি (জিপ, ট্যাক্সি)-র ধর্মঘট চলছে গত তিন দিন ধরে। বুঝলাম, পরদিন সকালে আমাদের জন্যও দুর্ভোগ থাকতে পারে। ইতিমধ্যে, সন্ধেবেলার লোকাল বাসে আমাদের
‘লেফ্ট-লাগেজ’ চলে এল হোটেলে।
ঘরে ফিরে আমরা নিজের নিজের রুকস্যাক গুছিয়ে নিলাম। মোবাইল ও পাওয়ার ব্যাংক-এও যতটা সম্ভব চার্জ দিয়ে নিলাম। রাত সাড়ে ৮টায় ডিনার করতে নীচে নামলাম। মেনুতে ছিল মনুয়া ও গমের রুটি, ভাত, ডাল, আলু, কপির তরকারি। অন্যান্য তীর্থযাত্রীদের সঙ্গে গল্প করতে করতে ডিনার সারলাম। এখনও আমার মন জুড়ে শুধুই রুদ্রনাথ! সত্যিই তো, চতুর্থ কেদার একমাত্র স্বয়ম্ভু লিঙ্গ যার মাধ্যমে দেবাদিদেব-এর অনুপম, ক্ষমাশীল মুখমণ্ডলের প্রকাশ। আমি প্রকৃতই ভাগ্যবান সেই রূপ দর্শন করে। পরদিন মণ্ডল থেকেই যাত্রা শুরু করব কেদারনাথ অভিমুখে।
কীভাবে যাবেন ছ হরিদ্বার বা ঋষিকেশ থেকে গোপেশ্বর আসুন। সেখান থেকে আরও ৫ কিলোমিটার দূরে সাগর গ্রামে অথবা
১৩ কিলোমিটার দূরে মণ্ডল গ্রামে চলে আসুন। সাগর অথবা মণ্ডল থেকে ট্রেকিং শুরু করুন। সাগর থেকে যাত্রা শুরু করে একই পথে নির্বিঘ্নে ফিরে আসুন ২০ কিলোমিটার দূরত্ব। মণ্ডল থেকে ট্রেক করলে চড়াই অতি ভয়ানক, উতরাই আরও বিপজ্জনক, প্রায় ২৪ কিলোমিটারের পথ।
কোথায় থাকবেনঃ সাগর থেকে ট্রেক শুরু করলে থাকুন ‘হোটেল রুদ্র’-তে। পাশেই ‘হোটেল হরি ওম’।
মণ্ডল থেকে ট্রেক শুরু করলে থাকুন ‘হোটেল অনুসূয়া’তে।
কখন যাবেনঃ মে থেকে অক্টোবর পর্যন্ত। বর্ষায় যাত্রা কিছুটা বিপজ্জনক।