শিশুর মন হল একতাল মাটির মতো। তাকে কী আকার দেবেন সেটা নির্ভর করছে আপনার উপর। বাচ্চা বড়ো হয়ে ভালো ব্যক্তিত্বের অধিকারী হোক, জীবনে উন্নতি করুক, মা-বাবার নাম উজ্জ্বল করুক এই ইচ্ছা সব মা-বাবার মনেই থাকে। এটা তখনই সম্ভব যখন বাচ্চার বেড়ে ওঠায় মা-বাবা সম্পূর্ণ সচেতন থাকবেন।

বাচ্চাকে সম্মান দিন

  শিশুর সম্পূর্ণ খেয়াল রাখলেও বেশিরভাগ অভিভাবকই একটি বিষয়ে গুরুত্ব দেন না –সেটা হল বাচ্চাকে সম্মান দেওয়া।শিশুকে কখনও তার ছোটো ভাই বা বোনের সামনে বকবেন না ৷ আপনার সন্তান যদি আপনার কথামতো কাজ না করে অথবা কোনও দুষ্টুমি করে থাকে, পরীক্ষায় নম্বর কম পায় কিংবা বাচ্চার মুখে মিথ্যা শুনে আপনার প্রচণ্ড রাগ হয়– যেটাই ঘটুক না কেন, বাচ্চাকে কখনও তার ছোটো ভাই বা বোনের সামনে অপমান করবেন না। বড়ো ভাই, বোনকে যদি ছোটোরা মা-বাবার কাছে বকাঝকা, মার খেতে দেখে, তাহলে একটা পর্যায়ে এসে তারা বড়োদের সম্মান করা ছেড়ে দেবে। তাদের নিয়ে ঠাট্টা, ইয়ার্কি করবে, ফলে বড়ো সন্তানটি ক্রমশ আত্মবিশ্বাস হারাতে থাকবে। তাদের মানসিক বিকাশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তাই শাসন করার হলে সন্তানকে সকলের সামনে নয়, একা ডেকে শাসন করুন।

অপরের সামনে মেজাজ হারাবেন না

 মনে করুন আপনার সন্তান আপনার কোনও দামি জিনিস হারিয়ে দিয়েছে অথবা বড়োসড়ো কোনও একটা অন্যায় করে ফেলেছে যেটা সম্পর্কে আপনি বাইরের কারও কাছ থেকে জানতে পারলেন। খবরটা জানতে পেরেই সঙ্গে সঙ্গে বাচ্চার উপর চ্যাঁচামেচি করা কখনওই উচিত নয়। বাইরের লোকজনের সামনেও বাচ্চাকে কখনও বকাঝকা করা উচিত নয়। বাচ্চাকে একলা ডেকে ওর সঙ্গে কথা বলুন। মেজাজ ঠান্ডা রেখে ও কী অন্যায় করেছে সেটা ওকে বলুন এবং ও কী উত্তর দেয় ধৈর্য ধরে শুনুন। এমনও হতে পারে পরিস্থিতি আপনার সন্তানকে বিপথে যেতে বাধ্য করেছে। ওই বিষয়ে ওর কী বলার আছে সেটা ওকে বলার সুযোগ দিন। ওর কথা পুরোটা শোনার পরই সিদ্ধান্ত নিন আপনার বাচ্চার দোষ আছে কি নেই। ওর যদি দোষ থাকে, তাহলেও সন্তানকে মারধর না করে মৌখিক ভাবে বোঝাবার চেষ্টা করুন। ওর অন্যায় কী, সেটা ওকে বোঝান এবং ওকে দিয়ে প্রতিজ্ঞা করান যাতে ও এই কাজ আর কখনও না করে। ভালোবেসে কোনও কথা বোঝানো হলে সেটার প্রতিক্রিয়া অনেক গভীর হয়। মারধর, বকাঝকা করলে বাচ্চার মধ্যে ক্ষোভ এবং বিদ্রোহের সৃষ্টি হয় আর নয়তো বাচ্চা অবসাদের শিকার হয়ে পড়ে।

বাচ্চার মনে নেতিবাচক ভাবনা নিয়ে আসবেন না

বাচ্চাকে নিজের নেতিবাচক মানসিকতায় প্রভাবিত করবেন না। এমন কথা বলে ওকে সম্বোধন করবেন না যা, বাচ্চার নরম মনকে আঘাত করতে পারে। ‘তুই কিছু পারিস না, অলস, গাধা, বজ্জাত, শয়তান’ ইত্যাদি শব্দ বাচ্চার সঙ্গে ব্যবহার করবেন না। যত আপনি এসব কথা বাচ্চাকে বলতে থাকবেন, বাচ্চার খামতিগুলো বারবার বাচ্চার চোখে আঙুল দিয়ে দেখাতে থাকবেন, ততই বাচ্চার বিপথে চলে যাওয়ার সম্ভাবনা বাড়তে থাকবে। অনেক বাড়িতেই, মা-বাবা বাচ্চাদের খালি দোষ ধরতে থাকেন। বাইরের লোক, প্রতিবেশী এবং আত্মীয়স্বজনদের সামনেও বাচ্চাদের খামতিগুলো তারা তুলে ধরেন। এর ফলে বাচ্চাদের মধ্যে নেতিবাচক ভাবনা মাথাচাড়া দেয়। বরং যদি বাচ্চার গুণগুলো সকলের সামনে প্রকাশ করে বাচ্চার প্রশংসা করা হয়, তাহলে বাচ্চার মধ্যে সদর্থক মানসিকতা বাড়বে। আরও ভালো ভালো কাজ করে বেশি প্রশংসা পাওয়ার লোভ বৃদ্ধি পাবে। বাচ্চার মনে ক্ষোভ, গ্লানি, প্রতিযোগিতার মনোভাব উৎপন্ন হওয়ার বদলে উৎসাহ, চেষ্টা এবং হেলদি কম্পিটিশন-এর মনোভাব বাড়বে।

বাচ্চার ইচ্ছার মর্যাদা রাখুন

প্রত্যেকটি বাচ্চা একে অপরের থেকে আলাদা। প্রত্যেকটি বাচ্চার মধ্যেই আলাদা আলাদা গুণ রয়েছে। আলাদা সম্ভাবনা রয়েছে। বাচ্চার যেদিকে ইন্টারেস্ট, বাচ্চা যেটা করতে পছন্দ করে, ভবিষ্যতে সে যেটা হতে চায়– সেটাতে ওকে নানা ভাবে সাহায্য করুন। সে যা হতে চায় সেটাই ওকে হতে দিন। অনেক বাড়িতেই, ছোটো বলে বাচ্চার ইচ্ছা দাবিয়ে রাখা হয়। তাকে বোঝানো হয় ভালো-মন্দের জ্ঞান তার হয়নি। কিন্তু বড়োদের এই আচরণ বাচ্চাকে সঠিক দিশা দেখাতে পারে না। সন্তানের উপর নিজের মতামত চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করবেন না। সম্মানের সঙ্গে তাকে নিজের জীবন এবং জীবনের সঙ্গে যুক্ত যে-কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়ার স্বাধীনতা দিন যাতে বড়ো হয়ে ফ্রাস্ট্রেশন এবং রাগের বদলে তার আত্মবিশ্বাস তৈরি হয়। তার জীবন খুশিতে, আনন্দে ভরে ওঠে এবং অন্যকেও আনন্দে ভরিয়ে তোলে।

যা নাম সেই নামেই সম্বোধন করুন

অনেক ক্ষেত্রেই মা-বাবা এমনকী আত্মীয়স্বজনেরা বাচ্চার যা নাম সেই নামে না ডেকে, আসল নামটাকে ভেঙেচুরে একটা ছোটো নাম নিজেরাই ঠিক করে নেন নিজেদের সুবিধার্থে। সেটা অনেক সময়ই অপভ্রংস হয়ে একটা বিধঘুটে নাম হয়ে দাঁড়ায়৷ জনসমক্ষে এ নামে ডাকলে বাচাচা অস্বস্তিতে পড়ে৷কন্যা সন্তানের ক্ষেত্রেও এই একই নিয়ম খাটে। এমনকী শারীরিক দুবর্লতা বিচারেও নামের তারতম্য ঘটে। যেমন বাচ্চা কালো হলে বা মোটা হলে কালু, মোটু ইত্যাদি যা নাম মুখে আসে সেই নামেই বড়োরা বাচ্চাকে সম্বোধন করে। মনে রাখবেন ভুলেও বাচ্চাকে এরকম নামে ডাকবেন না এবং পরিচিত কাউকে যদি এমন করতে দেখেন তৎক্ষণাৎ তাকে বারণ করুন। এই ধরনের নামে বাচ্চাকে সম্বোধন করলে তার প্রভাব অবশ্যই সেই বাচ্চার ব্যক্তিত্বের উপর পড়বে। সুতরাং বাচ্চার সঠিক নামেই তাকে ডাকুন যাতে বাচ্চার ভিতর ইতিবাচক এনার্জি প্রবাহিত হতে পারে।

বাচ্চার সঙ্গে শালীন ভাষায় কথা বলুন

অনেক সম্ভ্রান্ত পরিবারে দেখা যায় বড়োরা বাচ্চাদের সঙ্গে অত্যন্ত কুরুচিকর ভাষায় কথা বলেন। এর ফলে বাচ্চার মধ্যে শিষ্টাচার এবং সভ্য ব্যবহারের ভিত গড়ে ওঠে না। বাচ্চাদের সামনে গালিগালাজ দিয়ে কথা বললে বাচ্চাও, শিখবে ওটাই ৷ওই ভাষা অন্যদের সঙ্গে,এমনকী আপনার সামনেও  প্রয়োগ করবে। এর ফলে বাইরের লোকের কাছে আপনাকে লজ্জিত হতে হবে। সুতরাং বাচ্চাকে সম্মান দিন, বিনিময়ে বাচ্চাও আপনাকে সম্মান করবে।

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...