সিঙ্গাপুর বেড়াতে গিয়ে বাজার, সেনটোসা আইল্যান্ড, নাইট সাফারি, পর্যটন পয়েন্ট ঘুরে এসে সকলেই তারিফ করেন কিন্তু ডাউনটাউন এলাকা সেই হিসেবে ব্রাত্য-ই বলা চলে। একসময় সিঙ্গাপুরের কর্মচারীদের চিত্তবিনোদনের জন্য তৈরি করা হয়েছিল যে-ক্লাব, এখন সেটাই পুরোদস্তুর রিসর্ট হিসেবে গড়ে উঠেছে। এখানে ওয়াটার গেম থেকে শুরু করে খাওয়াদাওয়ার ব্যাপক আয়োজন রয়েছে। এই অঞ্চল সিঙ্গাপুরের স্ট্রিক্ট অনুশাসনের বাইরে হলেও, এখানকার পরিবেশ অত্যন্ত মনোমুগ্ধকর।এককথায়, এই গোটা অঞ্চল নিজের মধ্যেই স্বতন্ত্র একটি ছোটো শহর এবং এখানে এলে আর কোথাও যাওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। এর মধ্যে দিয়ে না কোনও রাস্তা রয়েছে না ট্র্যাফিকের হই-হট্টগোল।
বিভিন্ন স্তরের পর্যটকদের জন্য থাকার নানারকম সুবিধে যেমন রয়েছে সিঙ্গাপুরে, তেমনি দেশি খাবারেরও অঢেল সুবিধে চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে।নদীর ধারে কয়েক একর জমি নিয়ে গড়ে ওঠা সতেজ সবুজের সমারোহে ডাউনটাউন ইস্ট, মেন সিঙ্গাপুর থেকে অনেকটাই আলাদা মনে হবে। ডাউনটাউনের দূরত্ব ছাঙ্গি বিমানবন্দর থেকে বেশি দূর নয় এবং থাকা-খাওয়াও অনেক সস্তা। ২-৩ দিনের বিশ্রামের জন্য পর্যটকদের কাছে এই স্থানের জনপ্রিয়তা গগনচুম্বী।
যা যা দেখবেন
ডাউনটাউন ইস্ট-এর প্রধান আকর্ষণ হল ওখানকার ওয়াইল্ড ওয়েট ওয়াটার পার্ক। পার্কে রয়েছে টিউব থেকে বেরোনো জলের টার্বো টুইস্টার, যেটি ভোরটেক্স নামে পরিচিত। এর বিশেষত্ব হল উঁচু থেকে গড়িয়ে পড়া জলে রয়েছে ব্রোকেন রেসার্স। ভোরটেক্স-এর উচ্চতা ১৮.৫ মিটার পর্যন্ত এবং স্লাইড ১৩৪ মিটারের যাতে স্লিপ করার সময় স্পিড উঠে যায় মিনিটে ৬০০ মিটার। শরীরের ওজন একটু বেশি হলেও ক্ষতি নেই, ১৩৬ কিলোগ্রাম ওজন পর্যন্ত পর্যটকরা অনুমতি পাবেন চড়ার। ব্রোকেন রেসার্স ১৩ মিটারের এবং স্লাইড ৯১ মিটারের।
ওয়াটার পার্কে এনজয় করতে পারেন রয়েল ফ্লাশ, যেখানে জলের ঘূর্ণি থ্রিলিং অনুভূতি উৎপন্ন করবে। এটির উচ্চতাও ১৬ মিটার। আর একটি ওয়াটার স্পোর্ট হল ফ্রি ফল, যেটি সোজা জলের সঙ্গে আপনাকে ভাসিয়ে নিয়ে আসবে এবং প্রতি ঘন্টায় ৫৫ কিলোমিটার স্পিডে আপনাকে আছড়ে ফেলবে একটি বড়ো পুকুরে।
যদি কেউ মনে করেন বাচ্চাদের জন্য এই স্পোর্টগুলি সামান্য ঝুঁকিপূর্ণ, তাহলে কচিকাঁচাদের জন্য রয়েছে কিড্স জোন, ওয়েট অ্যান্ড ওয়াইল্ড ফাউন্টেন, স্প্ল্যাশ প্লে ইত্যাদি। বিশ্রামের জন্য টেন্টও রয়েছে।৫০-এর বেশি রেস্তোরাঁ রয়েছে ডাউনটাউন ইস্ট-এ যেখানে দেশি খাবারও পাওয়া যায়।শপিং-এর শখ থাকলে সস্তা এবং ভালো জিনিসের ভরপুর ভাণ্ডার পাবেন। পোশাক থেকে শুরু করে, বাড়ির ঘরোয়া সামগ্রী, জুয়েলারি, জুতো, চশমা সবই পাবেন –এমনকী বিউটি ট্রিটমেন্ট-ও করাতে পারবেন। চিয়ার্স কনভিনিয়েন্স স্টোর ২৪ ঘন্টা খোলা থাকে গ্রাহকদের সুবিধার জন্য। লন্ড্রি লফ্ট থেকে জামাকাপড় কাচিয়ে নেবার সুবিধা থাকলেও ভারতীয় মুদ্রায় খরচা তুলনামূলক একটু বেশি। গ্যাজেট মিক্স থেকে নতুন ইলেকট্রনিক গ্যাজেট কেনা যেতে পারে। সিংগটেল থেকে প্রয়োজনে লোকাল সিম কার্ডও ভরিয়ে নিতে পারেন।
যদিও ডাউনটাউন ইস্ট, সিঙ্গাপুরের হাজারের উপরে কর্মচারীদের শপিং এবং মনোরঞ্জনের কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা হয়েছিল, কিন্তু এখন সেটাই হয়ে উঠেছে আবিশ্বের মানুষের কাছে হই-হুল্লোড় আনন্দে কয়েকটা দিন কাটাবার আদর্শ জায়গা।
লিটল ইন্ডিয়া
পিকক চক্ অর্থাৎ ময়ূর চক্-এর পাশেই লিটল ইন্ডিয়া নামে একটা জায়গা রয়েছে যেটাকে সিঙ্গাপুরের সেন্টার বলা হয়। এই এলাকাটি ভারতীয় পর্যটকদের খুব পছন্দের জায়গা, কারণ জায়গাটির নামের সঙ্গে আমাদের দেশের নাম জড়িয়ে রয়েছে এবং দ্বিতীয়ত এই এলাকাটিতে বহু ভারতীয়ের বসবাস এবং তাদের কর্মক্ষেত্রও বটে। এখানকার পরিবেশও ভারতবর্ষের কথাই বারবার মনে করায়।
লিটল ইন্ডিয়ায় বেশিরভাগ মাদ্রাজিদের দোকান রয়েছে। পঞ্জাবি খাবারও খুব সহজে পাওয়া যায়। একটি বিশাল ‘মল’-ও রয়েছে এই অঞ্চলে যেখানে সব ধরনের জিনিস পাওয়া যায়। মলের নাম ‘মুস্তাফা। সপ্তাহের সাতদিন চব্বিশ ঘন্টাই খোলা পাবেন মলটি। মলে যারা কাজ করেন তাদের বেশিরভাগই ভারতীয় এবং পাকিস্তানি।
হিন্দি, তামিল এবং পঞ্জাবি ভাষায় কথা বলার লোকের অভাব নেই লিটল ইন্ডিয়ায়। ইংরেজি ভাষা জানা না থাকলেও নিজের ভাষায় কথা বলা বা শোনা এখানে খুব একটা কঠিন নয়। যেসব ভারতীয় সিঙ্গাপুরে থাকে, কাজ করে, তারাও শনি, রবিবারের ছুটির দিনে ওখানে বেড়াতে যায়, শপিং করে।
এই অঞ্চলে প্রচুর ভারতীয় এবং পাকিস্তানি হোটেল রয়েছে যেখানে পছন্দমতো ভারতীয় এবং পাকিস্তানি কুইজিনের স্বাদ গ্রহণ করতে পারেন পর্যটকেরা। এমনকী বিদেশিরাও ভারতীয় এবং পাকিস্তানি খাবারের স্বাদ নিতে হোটেলগুলিতে ভিড় জমান। ‘আনন্দভবন’ নামে একটি মাদ্রাজি রেস্তোরাঁও রয়েছে যেখানে সঠিক দামে সুস্বাদু খাবার পাওয়া যায়।
ক্রাইম রেট এখানে নেই বললেই চলে। এখানকার মানুষ খুব সৎ। সিঙ্গাপুরে সর্বত্র সিসিটিভি ক্যামেরা লাগানো রয়েছে। অপরাধ করে পালিয়ে যাওয়ার উপায় নেই, তাই হয়তো এই দেশ এখনও পর্যন্ত অপরাধমুক্ত। ‘পকেটমার থেকে সাবধান’ এই ধরনের সতর্কবার্তা কোথাও চোখে পড়বে না। ইন্টারনেট পরিষেবা অত্যন্ত উন্নত। তবে এই দেশের নিজস্ব উৎপাদন বলতে প্রায় কিছুই নেই, সবই আসে বিদেশ থেকে। জল আসে মালয়েশিয়া থেকে, দুধ, ফল, সবজি নিউজিল্যান্ড অথবা অস্ট্রেলিয়া থেকে, চাল-ডাল, দৈনন্দিনের প্রয়োজনীয় বস্তু-ও আসে থাইল্যান্ড ও ইন্দোনেশিয়া থেকে।
সিঙ্গাপুর যেতে হলে পাসপোর্ট করানো সব থেকে আগে দরকার। কলকাতা থেকেও সিঙ্গাপুরের ফ্লাইট নেওয়া যায়। ভারতীয়দের হোটেল বুক করার আগে ভালো করে জেনে নেওয়া জরুরি যে, তাদের নির্ধারণ করা হোটেলটির অবস্থান লিটল ইন্ডিয়া এরিয়ার মধ্যে কিনা। এর ফলে শপিং এবং ঘোরাফেরা করতে সুবিধা হবে।
পিকক চক্-এর এক পাশে যেমন লিটল ইন্ডিয়া, তেমনি অন্য পাশে রয়েছে বুগ্গি স্ট্রিট, যেখানে বড়ো বাজার রয়েছে। সেখানে হরেক রকমের জিনিসের দোকান। সারাদিন খরিদ্দারদের ভিড় লেগেই থাকে। সিঙ্গাপুর যেহেতু পর্যটন প্রধান দেশ তাই নানা দেশের পর্যটকদের দেখা মেলে ওখানে।
যাতায়াতের সুবিধা
সিঙ্গাপুরের যাতায়াত ব্যবস্থা আন্তর্জাতিক স্তরের। রাস্তাগুলো অত্যন্ত সুন্দর এবং চারিদিকে সুব্যবস্থা স্পষ্ট চোখে পড়বে। বড়ো এবং ছোটো গাড়ির জন্য আলাদা আলাদা লেন করা রয়েছে। হাঁটা চলার জন্য এবং সাইকেল আরোহীদের জন্যও আলাদা রাস্তা করা হয়েছে। যারা হেঁটে যাতায়াত করছেন তাদের জন্য রাস্তায় অল্প অল্প দূরত্বে বিশ্রাম নেওয়ার জন্য কাচের ওয়াটারপ্রুফ শেড এবং বড়ো বড়ো ওয়াটারপ্রুফ টেন্ট লাগানো রয়েছে যার নীচে বর্ষায় এবং গরমে শুয়ে বা বসে, মানুষ খানিকটা বিশ্রাম নিয়ে নিতে পারে।
সিঙ্গাপুর যেহেতু পর্যটনের জন্য বিখ্যাত, তাই এখানে দেখার এবং ঘোরার জায়গা প্রচুর। যেমন সিঙ্গাপুর শহর, সিঙ্গাপুর ফ্লায়ার, ইউনিভার্সাল স্টুডিও, সি অ্যাকোয়ারিয়াম, স্যান্টোসা, বিচ, মেরিনা বে, জু, নাইট সাফারি, জোরাং বার্ড পার্ক, কেবল কার রাইড, স্কাই রাইড, গার্ডেন বাই দ্য বে ইত্যাদি। মূলত সিঙ্গাপুরের সৌন্দর্য মানুষেরই সৃষ্টি এবং পর্যটকদের আকর্ষণ করার জন্যই নানা ধরনের এন্টারটেইনমেন্ট-এর বন্দোবস্ত করা হয়েছে। প্রত্যেকটি দর্শনীয় স্থান এবং দেখার জিনিস আধুনিক ডিজাইনের উপর নির্ভর করে বানানো হয়েছে, যাতে মানুষের উৎসাহে ভাটা না পড়ে।
যেতে ভুলবেন না
লিটল ইন্ডিয়া ছাড়াও. ভারতীয়দের জন্য আরেকটি আকর্ষণ হল সিঙ্গাপুর ফ্লায়ার, যেটি এশিয়ার সব থেকে উচ্চতম জায়ান্ট অবজার্ভেশন হুইল। এটির উচ্চতা ৫১৪ ফুট। এটিতে ২৮টি বাতানুকূল ক্যাপসুল লাগানো রয়েছে যার এক-একটিতে ২৮ জন করে লোক একসঙ্গে বসতে পারে।
মারলায়ন পার্ক শহরের ঠিক মধ্যেখানে অবস্থিত। এখানে সবসময় পর্যটকদের ভিড় লেগে থাকে। এখানে একটি স্ট্যাচু রাখা আছে যেটার মুখ সিংহের এবং বাকি শরীরটা মাছের আকৃতি। স্ট্যাচুর মুখ থেকে নিরন্তর জলের ধারা গড়িয়ে পড়ছে। ছবি তোলার জন্য আদর্শ জায়গা। স্ট্যান্টোসা-র কেবল কার রাইড খুব জনপ্রিয়। লোহার তৈরি বাতানুকূল কেবিনগুলিতে একসঙ্গে ৮ জন বসে সফর করতে পারে। এই কেবল কার মাউন্ট ফো বার থেকে স্যান্টোসা পর্যন্ত যেতে ১৫ মিনিটে সময় নেয়। এই রোপওয়েটি ১৬৫০ মিটার লম্বা। কেবিন থেকে নীচে সমুদ্র দেখা যায় এবং কেবিনের কাচের চার দেয়ালের বাইরে বিস্তৃত সবুজ জঙ্গলের শোভা দর্শকদের মুগ্ধ করে। মডার্ন টেকনোলজি সমৃদ্ধ কেবিনগুলি সম্পূর্ণ সুরক্ষিত। এছাড়াও স্যান্টোসার আর একটি আকর্ষণ হল মাদাম তুসো মিউজিয়াম, ইমবাহ্, যেখানে লাইট এবং সাউন্ডের মাধ্যমে সিঙ্গাপুর দেশটির উত্থানের কাহিনি বর্ণিত করা হয়। এতে ভারতীয়দের অবদানও কিছু কম নয়। মিউজিয়ামে প্রসিদ্ধ ব্যক্তিদের অনুকরণে মোমের পুতুল তৈরি করে রাখা হয়েছে যা দেখে দর্শকরা আনন্দ পান। মিউজিয়ামের একেবারে পাশেই রয়েছে স্কাই রাইড।
৪ জনের চেয়ারযুক্ত এই রাইড নিলে পাখির চোখে সিঙ্গাপুরের সৗন্দর্য অবলোকন করার যেমন সুযোগ ঘটবে তেমনি সাউথ চায়না সি সহ স্যান্টোসা আইল্যান্ডের প্রাকৃতিক সম্পদও আপনার চোখে ধরা পড়বে। এটিও সম্পূর্ণ ভাবে সুরক্ষিত একটি রাইড।
এছাড়াও স্যান্টোসা-তে দেখে নিতে পারেন উইংগস অফ টাইম যেটি লেজার রশ্মির সাহায্যে প্রস্তুত করা হয়। আলোর খেলা বলেই সন্ধেবেলায় এই শো প্রস্তুত করা হয়। স্যান্টোসার সিলিসি বিচে সমুদ্রের জলে হাওয়ার সাহায্যে উঁচু উঁচু ঢেউ তুলে তার উপর লেজার রে ফেলে, ফিল্ম-এর মতো এই শো প্রস্তুত করা হয়।
ইউনিভার্সাল স্টুডিও এশিয়ার সেকেন্ড লার্জেস্ট থিম বেস পার্ক। ৪৯ একর জায়গা নিয়ে পার্কটি তৈরি করা হয়েছে। পার্কটিতে ২রটি রাইডের মধ্যে ৬টি রোলার রাইড এবং ২টি ওয়াটার রাইড রয়েছে। রাইডগুলি চড়তে যথেষ্ট সাহসের দরকার। গার্ডেন বাই দ্য বে, একটি প্রাকৃতিক উদ্যান। এটি সিঙ্গাপুরের মধ্য মেরিনা বে-তে স্থিত। পিকনিক স্পট হিসেবে সব বয়সিদের কাছেই এটি খুবই জনপ্রিয়।
জোরাং বার্ড পার্ক নামটাই স্পষ্ট করে দেয় এটি মূলত পাখিদের উদ্যান। কোথাও খাঁচা, কোথাও দাঁড়, কোথাও আবার খোলা আকাশের নীচে, কিংবা ঝিল-ও তৈরি হয়েছে পাখিদের রাখার জন্য ওদের স্বভাব অনুসারে। চারিপাশে রয়েছে জঙ্গলের পরিবেশ।
নাইট সাফারি করতে হলে সন্ধে পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। মধ্য রাত পর্যন্ত পর্যটকদের জন্য এটি খোলা থাকে। এখানে প্রায় ১২০ রকমের ১০৪০টি প্রাণী এই জঙ্গলে রয়েছে। প্রায় চার লক্ষ স্কোয়্যার মিটার বর্গক্ষেত্র নিয়ে এই জঙ্গলের বিস্তৃতি। ৭টি জোনে জঙ্গলটি ভাগ করা হয়েছে। চাঁদনি রাতে জঙ্গলের রোমাঞ্চ জাগানো হাতছানি আপনাকে করবে বিস্ময়-বিমুগ্ধ।