জীবন বহমান। কিন্তু এগিয়ে চলার ক্ষেত্রে পরিস্থিতি সবসময় অনুকূল থাকবে এমন কোনও নিশ্চয়তা নেই।

যে-কোনও সময় প্রতিকূল পরিস্থিতির শিকার হতে পারি আমরা। এটাই বাস্তব। এই যেমন কয়েক মাস আগেও আমরা বুঝতে পারিনি আজকের ঘোর দুর্যোগের কবলে পড়ার বিষয়টি। কিন্তু হঠাৎই আমাদের জীবনের সবকিছু ওলটপালট করে দিয়েছে করোনা ভাইরাস। অনেকে আবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন ঝড়ের তাণ্ডবে। আবার বিভিন্ন সংবাদ-মাধ্যমকে ভূ-তত্ত্ববিদরা জানিয়েছেন, কলকাতা-সহ পশ্চিমবঙ্গের আরও কয়েকটি জেলা ভূমিকম্পের কবলে পড়তে পারে পুজোর আগেই।

এ যেন বিরামহীন দুর্যোগের ঘনঘটা! আর এই সংকটপূর্ণ পরিস্থিতিতে দেখা দিয়েছে আর্থিক মন্দা। কেউ কর্মহীন, কারও কমেছে আয়। যাদের কিছু সঞ্চয়  ছিল তারা কিছুটা হলেও পরিস্থিতি সামলাতে পারছেন, আর যাদের ভাঁড়ার শূন্য, তারা আজ দিশাহারা। সেইসঙ্গে, গোদের উপর বিষফোঁড়া-র মতো বেড়েই চলেছে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণের মাত্রা। কেউ হয়তো স্বাস্থ্যসংকট কাটিযে উঠেছেন, কেউ-বা হযতো এখনও রয়েছেন স্বাস্থ্য-সংকটে। কেউ আবার করোনায় আক্রান্ত হতে পারেন এমন আশঙ্কায় দিন কাটাচ্ছেন। সব মিলেমিশে এ এক অস্থির, সংকটময় পরিস্থিতি। চলছে বেঁচে থাকার কঠিন লড়াই।

অবশ্য এ তো গেল বিশেষ সংকটের বিষয়। ধরে নিন এই বিশেষ সংকট জীবনে হয়তো ঘন ঘন আসবে না। কিন্তু এ ছাড়াও তো রয়েছে অনিবার্য প্রযোজন মেটানোর তাগিদ, রয়েছে সাধারণ সংকটে পড়ার সম্ভাবনা। যেমন ধরুন স্থায়ী বাসস্থানের প্রয়োজন মেটানোর তাগিদ, বার্ধক্যে খেয়ে পরে থাকার নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, সন্তানের বিয়ে কিংবা হঠাৎ করে পরিবারের কেউ বড়ো কোনও দুর্ঘটনা কিংবা অসুখে পড়লে তার থেকে বাঁচার উপায় প্রভৃতি। এছাড়া জীবনের শখ-আহ্লাদ পূরণ এবং সামাজিকতা রক্ষার জন্য ব্যয় বরাদ্দ করার বিষয়টি তো রয়েছেই। অতএব, অনিবার্য প্রয়োজন মেটানো এবং সংকটমোচনের জন্য সঠিক বিনিয়োগ, সঞ্চয়, স্বাস্থ্য ও জীবনবিমা করার পরিকল্পনা করতেই হবে। অন্তত বর্তমান সংকটপূর্ণ পরিস্থিতি থেকে শিক্ষা নিয়ে বিনিযোগের মাধ্যমে সঞ্চয় এবং স্বাস্থ্যরক্ষার জন্য বিমা করা বাঞ্ছনীয়।

বিনিয়োগের ধরন

সবচেয়ে আগে নিশ্চিত করতে হবে আপনার উপার্জন এবং তারপর ভাবতে হবে বিনিয়োগের বিষয়টি। চাকরি কিংবা ব্যাবসা যাই করুন না কেন, যদি আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত থাকে, তাহলে কোনও চিন্তা নেই। কিন্তু তা যদি না থাকে, তাহলে উদ্যোগ নিতে হবে নতুন ভাবে। আপনার শিক্ষা এবং অভিজ্ঞতাকে মাথায় রেখেই নতুন করে জীবিকা নির্বাচন করতে হবে। যদি চাকরি না পান, তাহলে ভাবতে হবে ব্যাবসার কথা। কিন্তু ব্যবসাযয়ক ক্ষেত্র যদি আপনার কাছে নতুন হয়, তাহলে বন্ধু, আত্মীয় কিংবা বিশেষজ্ঞের মাধ্যমে যথেষ্ট খোঁজখবর নিয়ে নামতে হবে ময়দানে।

বর্তমান সংকটময় পরিস্থিতিতে লাভজনক হতে পারে এডুকেশনাল কিংবা হেল্থ রিলেটেড ব্যাবসা। কোনও কোচিং সেন্টার কিংবা ওষুধের হোলসেল বা রিটেল বিজনেস করতে পারেন। পুঁজি কম থাকলে কিংবা না থাকলে হতে পারেন সাপ্লায়ার। অর্থাৎ, ওষুধ কিংবা অন্যান্য নিত্যপ্রয়জনীয় সামগ্রী বাড়ি বাড়ি পৌঁছে দেওয়ার পরিষেবা দিয়ে অর্থ উপার্জন সুনিশ্চিত করতে পারেন। খুব কম অর্থব্যয় করার উপায় কিংবা ভাবনা থাকলে খুলতে পারেন হেয়ার-কাটিং সেন্টার। দুই থেকে তিনজন হেয়ার-কাটার কমিশনের ভিত্তিতে নিয়োগ করলে ভালো লাভ থাকবে। এছাড়া, বহুতল আবাসনে কংক্রিট, প্লাম্বিং, ইলেক্ট্রিক্যাল প্রভৃতির রিপিয়ারিং-এর কাজ চুক্তিভিত্তিক নিয়ে উপযুক্ত পেশাদারদের দিয়ে করিয়ে ভালো আয়ের ব্যবস্থা করতে পারেন।

মোট কথা, নানা ভাবে আয় সুনিশ্চিত করে তারপর বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আর মনে রাখা দরকার, বিনিয়োগ এবং সঞ্চয় দুটি আলাদা শব্দ বা বিষয় হলেও, সঠিক বিনিয়োগ-ই সঞ্চয়ের পথ প্রশস্ত করে, সুনিশ্চিত করে।

অর্থনীতি বিশেষজ্ঞের মতে, বিনিয়োগ-কে মূলত তিনটি ভাগে ভাগ করে নেওযা উচিত। শর্ট, মিডিয়াম এবং লং টার্ম এই তিনটিই হল বিনিয়োগের ধরন। যদি গাড়ি কিনে কোনও অ্যাপ-ক্যাব কোম্পানিকে ভাড়ায় দেন, তাহলে এটা শর্ট-টার্ম বিনিযোগ। কারণ, গাড়ি কেনার জন্য যে-টুকু টাকা ঋণ নিতে হবে, তা দুই থেকে তিন বছরের মধ্যে শোধ করে দিয়ে আয় বাড়ানো যায়।

মিডিয়াম টার্ম-এর মধ্যে রয়েছে বাড়ি কেনা, হোল সেল ডিস্ট্রিবিউশন নিয়ে আয় করা ইত্যাদি। এক্ষেত্রে বাড়ি কিনে বাড়ি ভাড়া দিয়ে কিংবা হোলসেল ডিস্ট্রিবিউটরশিপ নিয়ে আয় সুনিশ্চিত করতে গেলে যে-পরিমাণ অর্থ ঋণ নিতে হবে, তা পরিশোধের জন্য পাঁচ থেকে দশ বছর সময় লাগবে।

আর সন্তানের উচ্চশিক্ষার জন্য ঋণ নিয়ে ব্যয়, স্থায়ী আমানত (ফিক্সড ডিপোজিট) প্রভৃতি হল লং-টার্ম ইনভেস্টমেন্ট। কারণ, সন্তানের উচ্চশিক্ষা নিয়ে উপার্জন করতে যেমন দীর্ঘ সময় লাগবে, ঠিক তেমনই সে কর্মজীবনে প্রবেশের পর দীর্ঘজীবন উপার্জন করবে। স্থায়ী আমানতের ক্ষেত্রেও বিষযটি একই। এককালীন অনেক টাকা ব্যাংক-এ দীর্ঘদিন রাখতে পারলে, অবসরকালীন দীর্ঘ জীবনের জন্য সঞ্চয় সুনিশ্চিত করা যাবে।

তবে ব্যাংকিং-বিনিযোগ-এর মধ্যেও আবার তিনটি ভাগ আছে। একটা লিকুইড ফান্ড, দ্বিতীয়টি মানিব্যাক পলিসি এবং তৃতীয়টি হল রিটাযারমেন্ট পলিসি। এর মধ্যে লিকুইড ফান্ড-এর মধ্যে পড়ে মিউচুয়াল ফান্ড। কারণ, এই টাকা একদিনের নোটিশে তুলে ফেলা যায়। আর মাসে মাসে কিংবা বছরে দুই বা চার পর্বে টাকা জমা রেখে মাঝেমধ্যে সুদের টাকা হাতে পাওযার বিষয়টি হল মানিব্যাক পলিসি।

এছাড়া, চাকরি কিংবা উপার্জনের শুরু থেকে প্রতি মাসে কিছু টাকা ৬০ বছর পর্যন্ত জমিয়ে তার সুদ এবং আসল টাকা অবসরকালীন জীবনে কাজে লাগানোর বিষয়টি হল রিটায়ারমেন্ট প্ল্যান বা পলিসি। এই প্রসঙ্গে জানিয়ে রাখার প্রয়োজন, একমাত্র গাড়ির ব্যাবসার জন্য বিনিয়োগ কিছুটা ঝুঁকি সাপেক্ষ।

বিমার সুবিধা

মনে রাখবেন, বিমার কোনও নেতিবাচক দিক নেই। এর পুরোটাই ইতিবাচক। বলা যায়, সংকটমোচনের অন্যতম সহায়ক মাধ্যম। একবার কষ্ট করে এককালীন কিছু টাকা ব্যয় করতে পারলেই, বিপদের মুহূর্তে ভালো বন্ধুর ভমিকা পালন করবে।

বিমার-ও অনেকগুলি ধরন রয়েছে। গাড়িবিমা, বাড়িবিমা, স্বাস্থ্যবিমা এবং জীবনবিমা ইত্যাদি। একমাত্র স্বাস্থ্যবিমা ছাড়া বাকি সবরকম বিমা-ই দুর্ঘটনাসাপেক্ষে। কিন্তু স্বাস্থ্যবিমার ক্ষেত্রে দুর্ঘটনা ছাড়াও, গুরুতর অসুস্থতা এবং সার্জারির ক্ষেত্রেও ক্যাশলেস-এর সুবিধা পাওয়া যায়।

গাড়ি এবং বাড়িবিমার ক্ষেত্রে দুর্ঘটনাজনিত ক্ষতিপূরণ পাওয়া  যায়। বিবাহবিমা-র ক্ষেত্রে শুধু বিয়ের দিন যদি চুরি, ডাকাতি কিংবা জীবনহানি ঘটে, তাহলে সেই ক্ষতিপূরণ দেবে বিমা কোম্পানি। এক্ষেত্রে বিবাহবাসরে থাকা অর্থ-সম্পত্তির পরিমাণের লিখিত বিবরণ দিতে হয় এবং সেই অনুযায়ী বিমার জন্য প্রদেয় অর্থ ধার্য হয়। শুধু তাই নয়, বিবাহবাসরে উপস্থিত কতজনের জীবনবিমা করছেন তার উপরও নির্ভর করবে বিমার জন্য প্রদেয় অর্থের পরিমাণ।

আর ভ্রমণবিমা এবং জীবনবিমার ক্ষেত্রে দুর্ঘটনা এবং জীবনহানির জন্য পাওয়া যায় এককালীন আর্থিক ক্ষতিপূরণ। তবে এসবের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল স্বাস্থ্যবিমা। কারণ, বর্তমান পরিস্থিতি কিন্তু তেমনই ইঙ্গিত দিচ্ছে। অবশ্য এই অতিমারী ছাড়াও মানুষের সাধারণ রোগভোগও বাড়ছে। আর চিকিৎসার ক্রমবর্ধমান খরচ সামলাতে হলে স্বাস্থ্যবিমা ছাড়া গতি নেই। তবে স্বাস্থ্যবিমা করার সময় সতর্ক থাকা জরুরি।

এখন বাজারে কিছু প্রতারক বিমাসংস্থাও গজিয়ে উঠেছে। তারা আপনার অর্থ আত্মসাৎ করতে পারে কিংবা আপনাকে ঠিকমতো পরিষেবার ব্যবস্থা থেকে বঞ্চিত করতে পারে। অতএব, জেনেবুঝে এবং রেপুটেশন-এর বিষয়ে খোঁজখবর নিয়ে তবেই স্বাস্থ্যবিমা করা উচিত। আর স্বাস্থ্যবিমা করার আগে দেখে নেবেন, ওই বিমাসংস্থার চুক্তির তালিকায় ভালো হাসপাতাল এবং ক্যাশলেস-এর ব্যবস্থা আছে কিনা।

বযস বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে স্বাস্থ্যবিমার জন্য প্রদেয় অর্থের পরিমাণও বেড়ে যাবে। এ প্রসঙ্গে এক বিমাসংস্থার প্রতিনিধি সঞ্জয সরকার জানিয়েছেন, ব্যক্তিগত স্বাস্থ্যবিমা করার থেকে পারিবারিক স্বাস্থ্যবিমা করা বেশি লাভদায়ক। কারণ, একজনের জন্য যে-টাকা ব্যয় করতে হবে স্বাস্থ্যবিমার ক্ষেত্রে, তুলনায় কম খরচ পড়বে পারিবারিক স্বাস্থ্যবিমায়। তবে,স্বাস্থ্যবিমার বাৎসরিক পরিষেবার জন্য বরাদ্দ মোট অর্থের পরিমাণ এবং বিমাকারীর বয়সের উপর নির্ভর করবে প্রিমিয়াম-এর অঙ্ক।

ধরুন, ৩৫ থেকে ৪৫ বছর বয়সের কোনও ব্যক্তি যদি বছরে এক লক্ষ টাকার ব্যক্তিগত স্বাস্থ্যবিমা করেন, তাহলে তাকে এককালীন দিতে হবে ৪,৬০০ টাকার মতো। আবার তিনি যদি বছরে পাঁচ লক্ষ টাকা স্বাস্থ্যবিমা করেন, তাহলে তাকে দিতে হবে প্রায ৬,৫০০ টাকার মতো। কিন্তু যদি ৩৫-৪৫ বছর বয়সের মধ্যে স্বামী-স্ত্রীর বয়স হয় এবং তাদের ১২ বছর বয়সের সন্তানের একসঙ্গে পারিবারিক স্বাস্থ্যবিমা করতে চান, তাহলে বছরে এক লক্ষ টাকার বিমার জন্য ব্যয় করতে হবে প্রায় ৮০০০ টাকা এবং পাঁচ লক্ষ টাকার স্বাস্থ্যবিমার জন্য ব্যয় করতে হবে প্রায় ১২,০০০ টাকা।

অবশ্য স্বাস্থ্যবিমার জন্য প্রদেয় অর্থের পরিমাণ কমবেশি হবে সংস্থাভেদে। প্রত্যেকেরই এক্ষেত্রে আলাদা আলাদা পরিষেবার সুবিধা রয়েছে, অর্থাৎ কে সারা দেশে কতগুলি হাসাপাতালে ক্যাশলেস পরিষেবা দিতে পারবেন, তার উপর নির্ভর করে বরাদ্দ থাকে প্রদেয় অর্থের পরিমাণ। তাই স্বাস্থ্যবিমা করার আগে, যাচাই করে নেওযা আবশ্যক।

——-

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...