ছোটো বোন বিদিশার হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ার খবর, বিস্ময়বিমূঢ় করে দিল নন্দাকে। তা-ও যেমন-তেমন রোগ নয়, ক্যানসার। দেশটার নাম আমেরিকা, এই যা এক বাঁচোয়া! আধুনিক চিকিৎসার যাবতীয় সুযোগ সেখানে হয়তো পাওয়া যাবে! কিন্তু, বিদিশার অসহায়ত্ব নন্দাকে কষ্ট দিল। অথচ, ফোন করে দু’বেলা খবর নেওয়া ছাড়া তো অন্য কোনও উপায়ও নেই! ভারত থেকে আমেরিকা যেতে হ্যাপা কত! কত ধরনের প্রমাণপত্র লাগে! যাতায়াত-খরচ না হয় বাদই রইল। তবু সে-ও তো বিপুল।
এই দুঃসময়ে বিদেশবিভুঁইয়ে বোনের পাশে থাকতে না পারার কষ্টটা ভিতরে ভিতরে অস্থির করে তুলল নন্দাকে। বিদিশার স্বামী দেব, প্রায়ই ফোন করে বিদিশার খবরাখবর জানায়। কিন্তু কেবল মুখের কথায় কি কোনও মানসিক উদ্বেগ দূর হওয়ার? নন্দার থেকে মাত্র একবছরের ছোটো বিদিশা। দুজনে পিঠোপিঠি বেড়ে উঠেছে। ছোটোবেলার দিনগুলি একে অন্যের বান্ধবী হয়ে কেটেছে। বিদিশার যখন বিয়ের সম্বন্ধ আসে এবং জানা যায় বিয়ের পর স্বামীর সঙ্গে ওকেও বিদেশে চলে যেতে হবে, কত রাত যে ঘুমোতে পারেনি সে! চোখের জল ফেলেছে। বিদিশার বিয়ের সময়ও, সকলে যখন আনন্দ করছে, সে কিছুতেই নিজেকে স্বান্তনা দিতে পারেনি। আত্মীয়স্বজনরা বলেছেন, ‘কী মেয়ে রে তুই? এখন যদি কেঁদে ভাসাস, বিদিশার মনের অবস্থাটা কি হবে, ভাবতে পারছিস? তার প্রাণের এত কাছাকাছি থাকা বিদিশা আজ ক্যানসারে ভুগে অসহায়। এ কথা জেনেও কীভাবে শান্ত থাকে নন্দা?
সে দেশের নিয়ম অনুযায়ী, যে-কেউ গিয়ে আমেরিকায় পা রাখতে পারে না। অনুমতি লাগে। কারণ দেখাতে হয়। দু-দেশেরই নানারকম আইনি বাধানিষেধ থাকে। নন্দার আমেরিকা যাত্রা বিদিশা ‘স্পনসর’ করায় শেষপর্যন্ত সমস্যার জট খুলল।
নন্দা আমেরিকায় পৌঁছোনোর আগেই বিদিশা হাসপাতালে দীর্ঘ চিকিৎসার পর বাড়ি ফিরে এসেছে। নন্দা দেখে চমকে উঠল। এ কী চেহারা হয়েছে বিদিশার! ভীষণ রোগা হয়ে গিয়েছে এক লপ্তে। চোখের তলায় কালি পড়েছে। মাথায় কালো চুলের ঢল নেই মোটে। তাতে তার রুগ্নতা স্পষ্ট হয়েছে আরও। শরীর অত্যন্ত দুর্বল। হাসপাতালের ডাক্তার কড়া গলায় বলে দিয়েছেন, এখন বেশ কয়েকমাস শরীরকে কোনওরকম স্ট্রেস দেওয়া চলবে না। আসলে, বিদিশা রয়েছে হাসপাতালের ডাক্তারবাবুদের কড়া নেকনজরে। পনেরো দিন অন্তর ওকে বেশ কয়েকবার পরীক্ষা করে তবে ওঁরা বুঝবেন, ইমপ্রুভমেন্ট সত্যিই কিছু হচ্ছে কিনা। তবে ফের স্বাভাবিক জীবনে ফেরার প্রশ্ন!
নন্দা দেখল, দেব কোথাও কোনও খামতি রাখেনি। বিদিশার জন্য চব্বিশ ঘণ্টার অ্যাটেন্ড্যান্ট রয়েছে। মাঝারি উচ্চতার কমবয়সি কালো মেয়ে, ধবধবে পোশাক পরে সর্বক্ষণ বিদিশার ঘরে বসে থাকে। রান্নার লোক আগে থেকেই ছিল। পরিবার বলতে তো বিদিশা, দেব আর তাদের পোষা একটি কুকুর। যাকে বলে ঝাড়া হাত-পা সংসার।
ইতিমধ্যেই দেব অবশ্য অসাধ্যসাধন করেছে। আমেরিকান রাঁধুনিকে সে আলুপোস্ত, উচ্ছে ভাজা, মাছের ঝোল করা শিখিয়েছে বেশ যত্ন করে। হেসে বলল, ‘আমার বন্ধুরা বলে, এই মেয়েটিকে আর বেশিদিন আমাদের রান্নাঘরে আটকে রাখা যাবে না। যা রান্না করছে ইদানীং, তাতে ছোটোখাটো বাঙালি রেস্তোরাঁ এখনই খুলে বসতে পারেঃ!’
‘আর, তখন আমাদের জন্য ফ্রি খাওয়া, তার উপর হোম ডেলিভারি, কী তাই না অ্যানি?’ গৃহকর্তার রসিকতায় অ্যানি নামের কৃষ্ণকলি মেয়েটি সাজানো সাদা দাঁত দেখিয়ে হাসল।
বিদিশার পরিবারে মানুষ কেবল দুজন। সে আর দেব। আর একজন আছে অবশ্য, সে মানুষ না হলেও যত্নআত্তির দিক দিয়ে মানুষের থেকে ঢের এগিয়ে। সেটি একটি কুকুর। বাদামি রঙের লোমওলা সরল চোখের কুকুরটির নাম বিদিশাই সাধ করে রেখেছে, কায়া। নন্দাকে কায়ার বোধহয় বেশ পছন্দই হল। কেন-না থেকে থেকেই সে নন্দার চারপাশে লোমশ লেজ দুলিয়ে তার আনন্দ প্রকাশ করে গেল। আমেরিকান কুকুর হলেও আনন্দ প্রকাশের ধরনটা আদিম ও অকৃত্রিম।
কেবল কায়ার পরিচর্যাতেই একজন দক্ষ লোকের দরকার! বিদিশা নিজের হাতে এসব করত। সে অসুস্থ থাকায় অতঃপর নন্দাতেই বর্তালো কায়ার ভার। আমেরিকায় পৌঁছোনোর পর চতুর্থ দিনই সন্ধ্যায় কায়াকে নিয়ে ঘুরতে বের হল নন্দা। এ দেশে কুকুর নিয়ে রাস্তা চলারও বেশ কিছু নিয়মকানুন আছে। সেদিন বিদিশা, গোটা দুপুর ধরে নন্দাকে পাশে বসিয়ে রীতিমতো ক্লাসই নিয়ে ফেলল একটা।
বলল, ‘সবসময় লক্ষ্য রাখবি কায়ার উপর। কাউকে দেখে যেন ঘেউ ঘেউ না করে। কায়ার গলার চেনটা সবসময় শক্ত করে হাতে ধরে থাকবি। ছাড়বি না। কায়া যেন রাস্তা নোংরা না করে। নোংরা করা মানে, কী বলতে চাইছি, বুঝতে পারছিস তো? আর-একটা ব্যাপার খেয়াল রাখবি। কায়ার গলার নম্বর প্লেটটা যেন লাগানো থাকে। দস্তানা আর শক্ত একটা কার্ড সঙ্গে রাখতে ভুলিস না।’
বিদিশার শেষ কথাটায় অবাক হল নন্দা। বলল, ‘বাকি সবই তো বুঝলাম। কিন্তু, দস্তানা আর কার্ড কীসের জন্য লাগবে, সেটা তো বুঝলাম না!’
‘সেটা তোকে বলিনি বোধহয়, তাই না?’ বিদিশা ম্লান হেসে বলল, ‘কুকুর যদি রাস্তা নোংরা করে ফেলে তাহলে এ দেশের নিয়ম অনুযায়ী কুকুরের মালিককেই সেই নোংরা পরিষ্কার করে দিতে হয়, তা-ও নিজের হাতে। ওই শক্ত কাগজে তুলে কাছাকাছি কোনও ভ্যাটে ফেলে আসতে হয়। এটা না করলে কী হবে জানিস? মোটা টাকা ফাইন!’
ভাবতেই গুলিয়ে উঠল নন্দার গোটা শরীরটা। বলল, ‘আরে থাম! থাম দিকিনি! আমাদের দেশে কুকুর তো কোন ছার, মানুষ পর্যন্ত যেখানে-সেখানে… কই সেখানে তো ফাইন দিতে হয় না! বেশি উপদেশ দিস নাঃ!’
‘উপদেশ দিচ্ছি না রে, এখানকার আইনের কথা বলছি,’ বিদিশা শান্ত গলায় বলে, ‘এখানকার আইন মানুষের পাশাপাশি পোষা জন্তুজানোয়ারদেরও সমানাধিকার দিয়েছে। এখানে তো লোকে নিজেদের সন্তানদের মতোই এদের ভালোবাসে। অন্য কারু পোষা কুকুরের গায়ে তুই এখানে হাত পর্যন্ত দিতে পারবি না। কত কোর্টকাছারি পর্যন্ত হয়ে যায় এই সামান্য ঘটনা নিয়ে! ফাইন তো আছেই!’
অসহিষ্ণু গলায় নন্দা বলে ওঠে, ‘বুঝেছি, বুঝেছি। আচ্ছা, তাহলে বেরোচ্ছি এখন। যবে থেকে এসেছি, ঘরেই বন্ধ হয়ে আছি।’ আজ একটু মুক্ত হাওয়ায় ঘুরে আসি। দেখে আসি দেশটা কেমন!’
কায়ার গলার চেনের প্রান্ত শক্ত করে ধরে রাস্তায় নেমে এল নন্দা।
এ দেশে এখন বসন্তকাল। গাছে গাছে রঙিন ফুল ফুটে আছে। বাচ্চারা পার্কে ছুটোছুটি করে খেলাধূলা করছে। বেশ কয়েকজন বৃদ্ধ মানুষও, কেউ হাতের লাঠিতে ভর দিয়ে, কেউ-বা এমনিই, সান্ধ্যভ্রমণে বেরিয়েছেন। মনে মনে খুব খুশি হয়ে উঠল নন্দা। কায়ার গলার চেন হাতের মুঠিতে নিয়ে হেঁটে গেল বেশ খানিকটা দূর। কায়াও ছুটছিল মনের আনন্দে। চেনে টান পড়ছিল জোরে। পরে বোঝা গেল তার এত উৎসাহের কারণটা।
উলটোদিক থেকে এক বৃদ্ধ ভদ্রলোক আসছিলেন। তার হাতে ধরা চেনে একটি সাদা বেড়াল। সেটিকে দেখতে পেয়েই রাগে লাফালাফি করতে শুরু করল কায়া। এক ঝটকায় নন্দার হাত ছাড়িয়ে নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল বেড়ালটির উপর। নন্দার মনে পড়ে গেল বিদিশার কথা। কায়ার ঘেউ-ঘেউ শুনে ভয়ে বুক কেঁপে উঠল তার সাদা বেড়ালটির গায়ে উদ্যত থাবার আঁচড় কাটতে লাগল কায়া। বেড়ালটি আকারেও ছোটো। সে কায়ার শক্তিশালী মুষ্টিযোগের সামনে কি দাঁড়াতে পারে? অচিরেই সেটিকে মাটিতে ফেলে তার উপর এক-পা রেখে বিজয়ীর ভঙ্গিমায় দাঁড়াল কায়া।
কায়ার কাণ্ড দেখে বৃদ্ধ ভদ্রলোক রাগে গজরাতে লাগলেন। একেই এদেশের মানুষজন ফরসা। তার উপর ক্রোধে তার মুখ আরও থমথমে আর লাল দেখাতে থাকল। বিরস মুখে ভদ্রলোক প্রায় চিৎকার করে উঠলেন, ‘আপনার কুকুরটাকে বাঁধুন। এখানকার আইন জানা নেই আপনার?’
কায়া তখনও ফুঁসছে। নন্দা কোনওরকমে তার গলার চেন ধরে টেনে তাকে সামলায়। তারপর কাঁচুমাঁচু মুখে বলে ওঠে, ‘আমাকে মাপ করবেন। আমি খুব দুঃখিত!’
ভদ্রলোক সে কথায় কোনও আমল না দিয়ে, পকেট থেকে এক টুকরো কাগজ আর পেন বের করে বলে উঠলেন, ‘আপনার ঠিকানা আর ফোন নম্বরটা আমায় দিন। পুলিশকে তো বিষয়টা জানাতে হবে!’
ভদ্রলোক বলতে গেলে বাধ্যই করলেন ঠিকানা ও ফোন নম্বর দিতে। আর বেশি দূর হাঁটার মানসিকতাটাই রইল না। বাড়ির পথ ধরল নন্দা। বেশ বুঝতে পারছিল, কায়ার এমন কাণ্ডের জন্য বিদিশা আর দেবকে অযাচিতভাবে সমস্যায় পড়তে হবে! নিজেকে অপরাধীও মনে হল, কেন-না এই ঘটনা ঘটার জন্য সে নিজেও অনেকটাই দায়ী।
বিদিশা সব শুনে ম্লান হেসে বলল, ‘কায়াটা খুব অসভ্য হয়ে গেছে ইদানীং। কী আর করা যাবে! এখন এই নিয়ে একটা কেস হবে, ফাইন দিতে হবেঃ!’
আধঘণ্টাও হয়নি, তারই মধ্যে কলিংবেল বেজে উঠেছে। দরজা খুলে নন্দা দেখে সেই বৃদ্ধ ভদ্রলোক, সঙ্গে দুজন গোমড়ামুখো পুলিশ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। পুলিশ দুজন কায়ার লাইসেন্স দেখতে চাইল। এখানে পোষ্যপ্রাণী রাখতে গেলেও লাইসেন্সে লাগে। লাইসেন্সে অনৈতিক কিছু বেরোয় না। ফলে তারা কায়ার কেস হিস্ট্রির ফাইলটা নিয়ে আসতে বলে। কেস হিস্ট্রির ফাইলে কায়ার যাবতীয় প্রেসক্রিপশন, খাবারদাবারের বিবরণ ইত্যাদি রয়েছে। ফাইলটা উলটেপালটে দেখে ফিরে গেল তারা।
নন্দা হাঁফ ছেড়ে ভাবল, এখানেই ঘটনাটার পরিসমাপ্তি ঘটে গেল! যদিও মোটেই সেরকম কিছু হল না। পরের দিন যথারীতি কোর্ট থেকে নোটিশ পৌঁছোল বাড়িতে। সঙ্গে বৃদ্ধ ভদ্রলোকের পোষা বেড়ালটির ডাক্তার-খরচ, ওষুধপত্রের বিল। পাঁচশো ডলার জরিমানার সঙ্গে এই দুশো ডলারও গুনাগার দিয়ে, তবে ছুট মিলল। জরিমানার কারণ, পোষা কুকুর অন্যের বেড়ালকে আক্রমণ করেছে এবং আক্রমণকারী কুকুরের মালিকও তার দায়বদ্ধতা সঠিকভাবে পালন করেননি।
কায়াকে একদিন বাইরে বেড়াতে নিয়ে যাওয়ার জন্য এত টাকা অনাবশ্যক গচ্চা দিতে হবে, এ কথা স্বপ্নেও ভাবেনি নন্দা। হতাশ গলায় সে বিদিশাকে বলল, ‘তোদের আমেরিকা সত্যি এক আজব দেশ! কুকুর তো ঘেউ-ঘেউ করবেই। না তো কি সে ম্যাও-ম্যাও করবে? কাউকে কামড়ায়নি কিছু না, কেবল একটা বেড়ালের গায়ে থাবা তুলেছে। তাতেই এতবড়ো ডাক্তারি-বিল? মোট কত দিতে হল বল তো?’
‘সাতশো ডলার, মানে মোটামুটি ২৮ হাজার টাকা’, বিদিশা অল্প হেসে বল ওঠে।
‘বলিস কী? ২৮ হাজার? হার্ট অ্যাটাক হওয়ার জোগাড় দেখছি!’
‘এখানে এরকমই হয়। তুই এসব নিয়ে বৃথা চিন্তা করিস না তো!’
বিদিশা বলে ওঠে, ‘এরপর থেকে কেবল মনে রাখবি, কায়াকে চেনে বেঁধে রাখতে হবে শক্ত করে, ছাড়া চলবে না।’
নন্দা মাথা নেড়ে চিন্তিত মুখে বলল, ‘হ্যাঁ, এরপর থেকে আরও সতর্ক থাকতে হবে এ ব্যাপারে। আর এমন ভুল হবে না!’
‘তবে, এবার আমরা অল্পেই ছাড়া পেয়েছি, বুঝলি? বাঁচোয়া এটাই যে, কায়া ওই বেড়ালটিকেই কেবল আক্রমণ করেছে। যদি এর ফলে কোনওভাবে বৃদ্ধ ভদ্রলোকের চোট লেগে যেত, তাহলে কয়েক হাজার ডলারের জরিমানা হওয়াও কোনও আশ্চর্যের বিষয় হতো না।’– বিদিশা ম্লান হেসে জানায়।
হেসে ফেলে নন্দাও, বলে, ‘বাঃ রে আমেরিকা, ধন্য তুমি। ধন্য তোমার দেশের কুকুরেরা।’
কায়াকে নিয়ে বেড়াতে বেরোনো নন্দার রোজকার কাজ হয়ে পড়ল। তবে এখন আগের চেয়ে সে অনেক সতর্ক থাকে। কোনও অবস্থাতেই কায়ার গলার চেন ধরা মুঠি আলগা হতে দেয় না। অন্য দিকে মন যেতে চাইলেও দৃষ্টি কেবল কায়ার উপরই নিবদ্ধ থাকে।
আজকাল নন্দার মনে হয়, কায়াকে নিয়ে বেড়াতে বেরোনোও একটা সাধনার মতো। যেহেতু, সমস্ত চেতনা, ধ্যান, ভাবনা কেবল কায়ার উপরেই নিবন্ধ থাকে। নন্দার সামান্য ভুলচুকে, কায়া কী কাণ্ড ঘটিয়ে বসবে তা কে জানে!
দিন কয়েক আর কোনও ঘটনা ঘটল না। কায়াও শান্তশিষ্টের মতো রাস্তা চলে। নন্দারও কোনও সমস্যা হয় না। কিন্তু একদিন আবার একটা অপ্রীতিকর বিষয়ের মুখোমুখি হতে হল নন্দাকে।
কায়ার শরীরটা সেদিন সকাল থেকেই খারাপ যাচ্ছিল। দেব ওকে ডাক্তারের কাছেও নিয়ে গেল। বিকেলে অবশ্য ওকে দেখে ততটা খারাপ মনে হচ্ছিল না! বিদিশা বলল, ‘কায়াকে নিয়ে একটু ঘুরে আয়। ওর শরীরটা তো এখন ভালো বলেই মনে হচ্ছে!’
নন্দা বের হল কায়াকে সঙ্গে নিয়ে। অল্প কিছু দূর হেঁটেই বোঝা গেল কায়ার শরীরটা এখনও সম্পূর্ণ সারেনি। রাস্তার একপাশে গিয়ে বমি করল কায়া। তারপর অসহায় চোখে ধুঁকতে থাকল। নন্দা নিজেও অসহায়বোধ করতে লাগল। একে তো রাস্তাটা নোংরা করে ফেলেছে কায়া, তার উপর ওর শরীরের অবস্থাটাও মোটেই সুবিধার বলে মনে হচ্ছে না। তার মনে পড়ল বিদিশার সাবধানবাণী। কায়ার বর্জ্য তাকেই সাফ করে দিতে হবে। একে তো সেটা মোটেই কোনও সুখকর অভিজ্ঞতা হবে না, তার উপর কায়ার চেনটি হাতে ধরে রেখে রাস্তা সাফ করা একরকম অসম্ভব। কায়াকেও কিছুতেই ছেড়ে রাখা চলবে না। বড়োই সমস্যার মধ্যে পড়ে গেল নন্দা। ত্রস্ত চোখে চারপাশটা একবার দেখল। শুনশান রাস্তা। জনমনিষ্যি চোখে পড়ে না। এখন, মানে মানে সরে পড়লেও কেউ হয়তো দেখবে না। যেমন ভাবনা, তেমন-ই কাজ। কায়ার গলার চেন শক্ত মুঠিতে নিয়ে নন্দা বাড়ির দিকে ফিরল। সে খানিকটা নিশ্চিন্ত, কেন-না রাস্তাটা নোংরা হতে সম্ভবত দেখেনি কেউ। সাতপাঁচ ভেবে পা বাড়াতে গিয়ে আটকে গেল নন্দা। সে স্পষ্ট দেখল, জনশূন্য রাস্তাকে পিছনে রেখে বিরাট চেহারার উর্দিধারী এক পুলিশ তারই দিকে এগিয়ে আসছে। তার ভারী বুটের শব্দ ক্রমশ জোরালো হয়ে এল। জড়ানো ইংরেজিতে গম্ভীর গলায় লোকটি বলল, ‘আপনার কুকুর রাস্তাটা নোংরা করল দেখেও আপনি সেটা সাফ না করে চলে যাচ্ছেন? এ দেশের আইন অনুযায়ী এটা অপরাধ। আপনাকে এজন্য জরিমমানা করা হবে। আগে নোংরাটা সাফ করুন তারপর ফাইন দিন।’
নন্দা কাতর চোখে তাকাল লোকটির দিকে। তারপর কায়াকে দেখিয়ে বলল, ‘ওকে একটু ধরুন। আমি পরিষ্কার করে দিচ্ছি। আসলে আমি বাইরে থেকে এ দেশে এসেছি। এখানকার সব আইনকানুন আমার জানা নেই।’
এবার লোকটির পাথুরে মুখে মৃদু হাসির আভাস দেখা গেল। সে বলল, ‘আপনি ইন্ডিয়া থেকে এসেছেন, তাই না? সেই জন্যেই…!’ বলে সে বিজ্ঞের মতো মাথা নাড়ে।
‘সেই জন্যেই… কী?’ অবাক হয়ে প্রশ্ন করে নন্দা।
‘সেই জন্যেই পরিচ্ছন্নতার কোনও ধারণাই নেই।’
নন্দার আঁতে লাগল। রুখে দাঁড়িয়ে বলল, ‘কতটুকু জানেন আপনি ইন্ডিয়া সম্পর্কে? পরিচ্ছন্নতা আমরাও ভালোবাসি!’
‘অনেকটাই জানি,’ লোকটি বলে ওঠে, ‘আপনার দেশে মানুষজন রাস্তায় দাঁড়িয়ে প্রকাশ্যে নোংরা করে। সরকারও কিছু বলে না।’
লোকটির কথা অনেকাংশেই সত্যি। নন্দা তাই চুপ করে গেল। তাড়া দিল পুলিশটি, ‘তাড়াতাড়ি করুন। নোংরা পরিষ্কার করে কার্ডটা ভ্যাটে ফেলে দিয়ে আসুন।’
নন্দা যন্ত্রচালিতের মতো সেটাই করে। কাজ হয়ে গেলে পুলিশকর্মীটি ফোন নম্বর আর বাড়়ির ঠিকানা জেনে নিল।
বাড়িতে ফিরে বিদিশাকে গোড়া থেকে সব ঘটনা জানিয়ে নন্দা কাঁদোকাঁদো গলায় জিজ্ঞেস করলছ ‘এবার কী হবে রে বিদিশা?’
‘কী আবার হবে,’ বিদিশা প্রবোধ দেয়, ‘কোর্ট থেকে নোটিশ আসবে। আবার ফাইন দিতে হবে!’
‘উফ্, এ দেশের লোকগুলোকে কি সুখে থাকতে ভূতে কিলোয়, যে, কুকুর পুষতে যায়? তোরাই বা কী? বিচ্ছু কুকুর পুষেছিস একটা,’ কায়ার দিকে তাকিয়ে অগ্নিবর্ষণ করে নন্দা, ‘এটার নাম কায়া পালটে জরিমানা করে দে–!’
সোফার একপাশে আধশোয়া হয়ে, নির্লিপ্ত মুখে কায়া জুলজুল করে নন্দাকে দেখতে থাকে।
পরের দিনই কোর্ট থেকে নোটিশ এল দেবের নামে। একশো ডলার জরিমানা, সেইসঙ্গে শ্লেষ দু-চার লাইন ‘এটি আপনার প্রথম অপরাধ। তাই কেবল জরিমানা আদায় করেই আপনাকে ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে। যদি দ্বিতীয়বার এমন অপরাধ করা হয়, তাহলে আপনার কুকুর-পালকের লাইসেন্স কেড়ে নেওয়া হবে।’
দেখতে দেখতে সপ্তাহ ফুরিয়ে এল। এ দেশে উইক এন্ড-টা বড়োই হাস্যে-লাস্যে কাটায় সকলে। কায়ার শরীরটাও এ’কদিনে বেশ সেরে উঠেছে। রবিবার সকালে ওকে ডগ পার্লারে নিয়ে যাওয়া ঠিক হল। বিদিশা বলল, ‘দেব তো যাচ্ছেই। তুই-ও যা। গিয়ে দেখে আয়, কুকুরদের গা-হাত-পা কী করে সাফসুতরো করে ওরা।’
বিদিশা হেসে বলল, ‘অবশ্যই যাব। আমেরিকার কুকুরদেরও বড়ো হিংসে হচ্ছে রে–!’
ডগ পার্লার দশ কিলোমিটার দূরে। কায়া বোধহয় বুঝতে পারছিল ওর যত্নআত্তির ব্যবস্থা হচ্ছে। গাড়িতে যেতে যেতে আনন্দে লেজ নাড়তে থাকল প্রবল বেগে।
পার্লারে প্রথমে কায়ার পেডিকিয়োর আর ম্যানিকিয়োর করা হল। থাবার নীচে থাকা নখগুলি কেটে এবড়োখেবড়ো ভাব ঘুচিয়ে দেওয়া হল। এবার কায়া গেল শ্যাম্পু-বাথ নিতে। ড্রায়ার দিয়ে গায়ের জল শুকোনো হল। ব্রাশ দিয়ে ঝেড়ে দেওয়া হল রোম। সবশেষে গলায় বেঁধে দেওয়া হল সুন্দর লাল রঙের একটি বো। পরিচর্যার পর দিব্যি ফুরফুরে মেজাজে বাইরে এল কায়া। দেব আর নন্দা কাউন্টারে গেল পরিচর্যার খরচ জমা দিতে। সুন্দরী রিসেপশনিস্ট চাঁপার কলির মতো মার্জিত আঙুলে পাঁচশো ডলার গুনে নিয়ে কম্পিউটারে বিল বানিয়ে দিলেন।
বিলটা হাতে নিয়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ল নন্দা। পাঁচশো ডলার মানে কুড়ি হাজার টাকা। ভাবা যায়?
এবার কায়া খাওয়াদাওয়া করবে। ডগ পার্লার থেকে বেরিয়েই ডগ মল। সেখানে কায়ার জন্য দামি খাবার কেনা হল। চোখ ঘুরিয়ে মলটাকে দেখে হতবাকই হয়ে গেল নন্দা। কেবল কুকুরদের জন্য এমন এলাহি বন্দোবস্ত? কী নেই সেখানে? কুকুরদের খাবারদাবার থেকে শুরু করে রূপচর্চার জিনিস পর্যন্ত থরে থরে সাজানো আছে। মহা স্ফূর্তিতে নিজেদের ভাষায় সেখানে গল্পগুজব করছে উইক এন্ডের কুকুররা। কায়াও সেই পার্টিতে যোগ দিল সোৎসাহে।
সত্য সেনুকাস, কা বিচিত্র এই দেশ !