সাউথ ফেসিং অ্যাপার্টমেন্ট। জি-প্লাস ফোর ফ্ল্যাট। সুনন্দের ফ্লাটটা ঠিক মাঝখানে। ব্যালকনিটাও সাউথ ফেসিং। সামনে ছোটো একটা মাঠ। তারপরে সবুজ বনানী। আগাছা জঙ্গল ভরা নয়। নানা রকম বাহারি ফুল, বাহারি জঙ্গল। বনানি দেখভালের জন্য একজন মালিও নিয়োজিত। তারও ওপারে একটা দিঘি। কাচের মতো স্বচ্ছ তার জল। সুইমিং, বোটিং। গোটা কতক দশাসই আমগাছ তুলে এনে ‘ইনস্টল’ করা হয়েছে। নতুন নাম ‘মাঝের গাঁ’। এ সবই খদ্দের পটানোর বন্দোবস্ত।

একটা লম্বা হাই তুলে সুনন্দ ব্যালকনির ইজি চেয়ারটাতে বসেছে। দুপুরের ভাত ঘুম। পাতলা ঘুম। পাতলা ঘুম অতল স্পর্শ করে না। অগভীর ঘুমে মনের সুখ বাসনাগুলি ছেঁড়া ছেঁড়া পেঁজা তুলার মতো ভাসতে থাকে। বাসনার বিপরীত মুখী হয়ে অবচেতন মনের সামনে বিরক্তি ঘটায়। না পাওয়ার অস্বস্তিতে হতাশা আসে। বাইরে প্রকৃতির অনাবিল রূপের ডালি! সুনন্দর নজর সেদিকে নেই। আকাশে মেঘ নেই। সুনন্দর মুখে আছে। এক রাশ ঘনীভূত আষাঢ়ের মেঘ। ঝরব ঝরব করছে। ঝরেনি। বাইরে অসহায়ের মতো ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে।

পড়ন্ত বিকেল। সূর্য এক অত্যাচারী শাসক। সারাদিন রক্তচক্ষু দিয়ে জগৎ শাসন করেছে। বসুন্ধরার রক্তরস ছিবড়ে করে নিজেই ক্লান্ত। বিশ্রামের জন্য পশ্চিমে রওনা হয়েছে।

হাতে এক কাপ চা। মধুছন্দা দেবী ব্যালকনির দরজায় দাঁড়িয়ে। টের পায়নি। –কী দেখছিস ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে? ব্যাবসার কথা ভাবছিস? ভাবিস না। সব ঠিক হয়ে যাবে।

একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বলে –নাঃ তেমন কিছু না। মাথা তুলতেই মায়ের দৃষ্টি এড়ায় না।

–ও মা এ কি! চোখ দুটো অমন লাল কেন? মুখ খানাও কেমন গোমড়া। ব্যাবসায় আরও কিছু ক্ষতি হ’ল নাকি?

–না সেসব কিছু না। একটা আজেবাজে স্বপ্ন দেখে মনটা খারাপ হয়ে গেল। মায়ের মন অস্থির হয়ে ওঠে।

–ও মা সে কি? কী বাজে স্বপ্ন? কু-স্বপ্ন মনে চেপে রাখতে নেই। বলে দে। মায়ের পীড়াপীড়ি এড়াতে পারে না।

মেঘমুক্ত আকাশ। পশম মেঘ। বুনো মেঘ। গোটা আকাশে কিছু নেই। হঠাৎ কোথা থেকে কচিকাঁচা মেঘেরা মুক্ত আকাশে খেলতে নেমেছে। আমাকে হাত ধরে টানাটানি। আমি বললাম– আরে আমি কি তোদের সাথে খেলতে পারব?

–এসো না। খুব পারবে।

ওদের সঙ্গে লুকোচুরি খেলতে লাগলাম। তারপর যা হওয়ার তাই। অল্প সময়েই হাঁপিয়ে পড়লাম। ওরা বলল– এসো তবে কিছু জলযোগ করে নিই। বলে আমাকেও চাট্টি মুড়ি দিল। আমি পরমানন্দে খেতে লাগলাম। তারপরই হঠাৎ ঘুমটা ভেঙে গেল।

–ওহ, এটা আবার দুঃস্বপ্ন কীসের?মুড়ি তো ভালো জিনিস। এতে মুখ গোমড়া করে বসে থাকার কি হয়েছে?

–না আমি ভাবছি অন্য কথা। তারপরই মাকে প্রশ্ন করে –আচ্ছা মা, মেঘেদের খাবার কিনতে শুধু খাবার কেন কোনও কিছুই জোগাড় করতে তো পয়সা লাগে না। এত ভালো ভালো খাবার থাকতে শুধু মুড়ি। তাই ভাবছি বাকি জীবনটা কি তাহলে আমাকে মুড়ি…।

–ছিঃ বাবা অমন কথা বলতে নেই। ঘুমটা ভালো হয়নি তো! পাতলা ঘুমে ওরকম হিজিবিজি স্বপ্ন দেখে মানুষ। ওসব কথা মনে করে কষ্ট পেতে নেই।

ড. ডি কে বাসু! এটা কেতাবি নাম! বাপ-মায়ের দেওয়া নাম দিলীপ কুমার বোস। বিদেশে গিয়ে সাহেবি নাম হয়েছে। প্রথম নামটি। বার্কিংহাম ইউনিভার্সিটিতে অর্থনীতির প্রফেসরের পাশাপাশি গোটা ইউরোপ ঘুরে জ্ঞানের ঝুলিটা ফুলে ফেঁপে লাউ। জ্ঞানের ঝুলিটা যত ভারী, দাম্ভিকতার তবলা সমপরিমাণে টিউনিং। মুখে লেগে থাকে নেটিভ ইন্ডিয়ান। ইন্ডিয়ান কালচারটা একেবারে বস্তাপচা। জ্ঞানের ভান্ডার দিয়ে ইউরোপকে সমৃদ্ধ করেছে, মাতৃভূমিকে ছড়িয়েছে বিষাক্ত নিঃশ্বাস।

কৌতুকবশত সুনন্দ বলেছিল– মামা, তুমি গেঞ্জিটা উলটো পরেছ।

ড. বাসু একগাল তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলে– আসলে কি জানিস, ইন্ডিয়ানরা কমফর্ট ব্যাপারটা ঠিক বোঝে না। সেলাইয়ের দিকটা ভেতরে থাকলে কমফর্ট ব্যাপারটা ডিসটার্ব হয়। এ গল্পে ড. বাসুর প্রবল আত্মকেন্দ্রিকতা, মাতৃভূমির উপর ঘৃণা, ইউরোপিয়ান আদব-কায়দা ইত্যাদি বিশ্লেষণ করা। এসব একান্তই অনাবশ্যক ছিল! যদি না দীর্ঘ পঞ্চাশ বছর পর দেশের মাটিতে পদার্পণ ঘটিয়ে, বোনের বাড়িতে সটান এসে স্বঘোষিত অভিভাবক হয়ে না উঠত।

সুনন্দের হাতে এখন অঢেল সময়। ডিমনিটাইজেশনের জেরে ট্রাভেলিং-এর ব্যাবসা যত তলানিতে ঠেকছে বিশ্রামের সময় ততই বাড়ছে। ব্যাবসা এখন চড়ায় আটকে যাওয়া নৗকার মতো। পরিশ্রম কম হলে ঘুম আসে না। পায়চারি করে।

ব্যালকনির কর্নারে একটা টব। গোলাপ গাছ। বেচারা। অনাদরে অবহেলায় শুকিয়ে কঙ্কাল। সময় আছে যথেষ্ট। উৎসাহে গলগ্রহ। সেই গলগ্রহে গাছটার অকাল প্রয়াণ। পাশ দিয়ে আরও এক অবহেলিত অনাহুত গাছ মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। পথ শিশুদের আদর যত্নের প্রয়োজন হয় না।

জাত ধর্ম সবারই আছে। গাছেরও আছে। শুধু অনাহুত গাছটা শনাক্ত কেউ করতে পারল না। কৗতুহলটা ঘরের চৗকাঠ পেরিয়ে দোতলা তিনতলা। গোটা অ্যাপার্টমেন্টময় ছড়িয়ে পড়ে।

অবশেষে এলেন পরান হালদার। উড়িষ্যার জঙ্গল। আদিবাসীপাড়া। ঝাড়ফুক। তুকতাক। ঘরবন্ধন। ভূত ছাড়ানো। এসবে হাত যশ আছে। সব ছাড়িয়ে পয়সার ঝোলাটা আরও ভারী।

পরান হালদার গাছটা দেখেই অাঁতকে ওঠে। কি সর্বনাশ! এ-তো এক ভয়ংকর বিপদের ইঙ্গিত। গাছটা তোমরা চিনতে পারলে না? –সুনন্দের কৗতুহল বাড়তে থাকে।

–কেন কি গাছ?

–আরে, এ-তো ভূতের বাসস্থান।

–সেটাই তো জানতে চাইছি। এটা কি গাছ? ভূতেরা আবার আলাদা গাছে থাকে না কি?

–থাকে বাবা থাকে। তোমরা শিক্ষিত। এ যুগের ছেলে। ওসব বুঝবে না।

–না, বলছি গাছটার একটা নাম তো আছে?

–আছে বাবা আছে। এটা শ্যাওড়া গাছ। বলে দাঁড়ায় না। পাঞ্জাবির পকেট থেকে রুমাল বের করে মুখে চাপা দিয়ে হন্ হন্ করতে করতে বের হয়ে যায়। পরানবাবু ভয় পেয়েছে। নাক মুখ দিয়ে সুরুৎ করে ভুতের বাচ্চা শরীরে ঢুকে গেলে আর রক্ষে নেই।।

সুনন্দ ভাবছে। নোট জেলে বন্দি। কবে ছাড়া পাবে কে জানে। ট্যুরিস্টেরের পকেটে নেই টাকা। তাই গাড়ির ঘোরেও না চাকা। নোট বন্দি। না বাক্বন্দি। বাক্বন্দি না জীবনবন্দি। ধ্যাৎ! যত্তসব! ঘরের ভিতরটা কেমন গুমোট হয়ে আসছে। মাথার পেছনটা কেমন ভারী ভারী লাগছে। কোন আগন্তুকের পদশব্দ! সুনন্দ চমকে ওঠে।

একটা কিশোর। বয়স বছর বারো তেরো। খালি গা। পরনে ছেঁড়া হাফ প্যান্ট। গায়ে খড়ি উঠে গেছে। তেল সাবান বহুদিন পড়েনি বোধ হয়। মাথায় শেষ কবে চিরুনি পড়েছিল কে জানে! চোখ দুটো অস্বাভাবিক রকম জ্বল জ্বল করছে। তবু কেমন নিরীহ নিরীহ লাগে।

সুনন্দ ধড়মড় করে উঠে বসে। –আরে রে রে। তুই কোথা থেকে এলি? দরজা তো বন্ধ।

–ওই তো দরজা খুলে।

সুনন্দ ভাবছে বাঁ দিকে ব্যালকনির দরজাটা খোলা। কিন্তু সেদিক থেকে দোতলা উঠবে কি করে! আরও এক ঝলক ভাবে– ডানদিকের দরজা এখনও বন্ধ। লক করা ছিল না হ্যান্ডেল লকটা খুলল। ঢুকল। আবার বন্ধ করল। আমি কিছুই টের পেলাম না। সে যাক্।

–এখানে এসেছিস কেন?

–একটু থাকতে দেবে দাদাভাই?

–তোর বাড়ি কোথায়? নামটাই বা কি?

–জন্ম উড়িষ্যায়। এখন থাকি ফুটপাথে। আর নাম লালু! লালু নায়েক ছিল। এখন যে যা বলে তাই।

–কী করে চলে? মানে খাস কি?

–ভিক্ষা করে। তা-ও ঠিক হচ্ছে না।

তারপরেই লালু পা-দু’টো ধরে বলে– দাও না দাদাভাই একটু থাকতে। আমি তোমাদের সব কাজ করে দেব। এই ধরো হাট বাজার। ঘরের কাজ সব কিছু পারি। ছেলেটার কথায় একটা মাদকতা আছে। সুনন্দ নরম হয়। তারপরই বলে– সবই তো বুঝলাম। কিন্তু তুই এখন যা বাপু! আমার এখন কাজের লোক রাখার সামর্থ্য নেই। আর তা ছাড়া থাকবিই বা কোথায়? আমাদের তো মাত্র তিনটে বেডরুম। লালু মনের ভাব বুঝতে পারে। বলে, –দাদাভাই তোমাদের এঁটো কাঁটা যা দেবে তাতেই আমার হবে। আর থাকার কথা বলছ, সে তোমাদের স্টোররুমেই চলে যাবে। থাকতাম তো ফুটপাথে।

সুনন্দ বিরক্ত হয়। ভাবছে, আচ্ছা মুশকিলে ফেলল তো ছেলেটা। ওকে বোঝাই কি করে। ছড়িয়ে ছিটিয়ে খাওয়ার মতো অবস্থাতেও আমি নেই।

কথার শব্দে মধুছন্দার ভাত ঘুমটা ভাঙে। হাঁটুর আড়ষ্ঠতা কাটিয়ে সুনন্দর ঘরে ঢুকে বলে, ‘ও মা এ ছেলেটা কে? কী চায়?’

লালু মধুছন্দার পা জড়িয়ে বলে, – মা, ওমা, একটু থাকতে দাও। দাদাভাইকে একটু বলো না। মায়ের মন। ‘মা’ সম্বোধনে গলে জল!

সুনন্দ বিরক্ত হয়ে বলে– আচ্ছা ঝামেলায় পড়া গেল তো। কোথা থেকে এসে কাঙালিপনা করছে। একে কীভাবে বিদায় করি বলো তো?

–থাক। থাক। মা বলে ডেকেছে। ও আমি সামলে নেব। দু’মুঠো কম খেলে আমার কিছু হবে না। তাছাড়া ঘরের কাজ সামলে বাজার হাট করা। এখন শরীর দেয় না। হাঁটুর ব্যথাটাও ইদানীং বড্ড বেড়েছে।

মধুছন্দা আঁচলের খুট থেকে পঞ্চাশ টাকার নোটটা দিয়ে লালুকে বলে– যা তো বাবা এক কেজি চাল আর এই শিশিতে একটু সরষের তেল নিয়ে আয়। লালু কাগজের ঠোঙায় চাল আর তেলের শিশিটা ধরিয়ে দিয়ে কোথায় ফুড়ুত করে হাওয়া। আপতত আর দেখা গেল না।

কাজ কম তাই হিজিবিজি ভাবনাটা বেশি। সুনন্দ ভাবছে। ঘরটা কেমন নির্জন নীরব মনে হচ্ছে কেন? তিন জনের সংসারে এখন চারজন। মামা থেকেও নেই। দুপুরে বেরোয়। গভীর রাতে দুলে দুলে ঘরে ফেরে। অশীতিপর বৃদ্ধ। চলাফেরায় এখন আর বলিষ্ঠতা নেই। লালুটা কখন যে কোথায় থাকে বোঝা ভার। অথচ ডাকলেই হাজির। গোটা ঘরটা এক অদ্ভূত রকমের রহস্যময় লাগছে।

জ্যৈষ্ঠের দুপুর। দূরে একটা তৃষ্ণার্ত কাকের ‘কা’ ‘কা’ শব্দে সুনন্দের গলা শুকিয়ে আসছে। টেবিলের উপর বোতলগুলো সার সার খালি। মাকে বিরক্ত করতে মন সায় দেয় না। ডাকে– লালু একটু আয় তো। সাড়া নেই। এবার তৃতীয় স্বরে– লালু। নিস্তব্ধ। এবার সপ্তমে চড়িয়ে ডাকে– লালু। নাঃ ছেলেটা গেল কোথায় এই ভরদুপুরে। ছেলেটা মনে হয় ঘুমোচ্ছে। স্টোর রুমের দরজাটা খুলতেই আঁতকে ওঠে। উফ্। এ-কি দেখলাম। ক্যাম্প খাটে যেটা শুয়ে আছে সেটা কি? একটা কঙ্কাল! গোটা শরীরটা হিম হয়ে আসছে। পা দুটো অসাড়। কোনওরকমে মাতালের মতো টলতে টলতে নিজের ঘরে ঢুকতেই লালু বলে– দাদাভাই ডাকছিলে? একটু বাইরে গেছিলাম।

সুনন্দের ঠোট দুটো তখনও কাঁপছে। অনেক কষ্টে স্বর বেরোয় –তোর ঘরের খাটে ওটা কী?

–কী?

–একটা কঙ্কাল। ওটা কোথা থেকে এল?

তুই এনেছিস?

–কই না-তো।

চল তো দেখি! পা দুটো তখনও কাঁপছে। সাহসের ভাঁড়ার শূন্য। লালু হাতটা ধরে জোর করেই নিয়ে গেল। দরজা খোলাই ছিল। ক্যাম্প খাটের দিকে তাকাতেই তাজ্জব।

–একি! বিছানা শূন্য। ছাপা বেডশিট পরিপাটি করে সাইড মোড়া। এ বিছানায় আজ কেন, দু’চার দিনেও কেউ গা দিয়েছে বলে মনে হয় না। তাহলে তখন…। বার বার চোখ কচলে নেয় সুনন্দ। অদ্ভুত! সুনন্দ স্তম্ভিত। সমস্ত জমাট বাঁধা রক্ত যেন ঝরঝর করে নীচে নেমে যাচ্ছে। লালু হাতটা ধরে ঝাঁকুনি দিয়ে বলে– হি হি, হি হি। দাদাভাই তুমি ভুল দেখেছিলে। কাল রাতে মনে হয় ভূতের স্বপ্ন দেখেছ।

মধুছন্দার বয়স বেড়েছে। নানা কাজে ভুল হচ্ছে। রান্না ঘরে ঢুকে অাঁচলের খুট খুলতে গিয়ে কী মনে হয়, চালের টিন খুলেই তাজ্জব! টিন প্রায় ভর্তি চাল। ষোলো কিলোর টিন। তিন দিন খেয়েও টিন প্রায় ভর্তি। তেলের শিশির দিকে তাকিয়ে দেখে সামান্য খালি। কি হচ্ছে এসব! মাথাটা আমার গেছে! এত দিন সংসার করছি…।

লালুকে ডেকে বলে– তোকে কবে চাল আনতে বলেছি, আর ক’কেজি?

–কেন পরশু। এক কেজি চাল এনে দিলাম। দুশো সরষের তেল। মনে নেই মা? কেন?

–তা-তো ঠিক। কিন্তু টিন ভর্তি চাল। তেলের শিশি ভর্তি…।

–তাহলে চাল, তেল সব আগে থেকেই ছিল। তুমি ভুল করেই আবার আনতে দিয়েছ।

–হবেও হয়তো। মধুছন্দা ভাবে। নাই ঘরে চাহিদা বেশি। শুধু নাই নাই মন।

আওয়াজটা প্রথমে মধুছন্দাই পেয়েছে। দাদার ঘর থেকে একটা গোঙানির শব্দ। দৗড়ে গিয়ে দেখে গলা দিয়ে কেমন ঘড় ঘড় আওয়াজ। মুখ দিয়ে কালো রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। উদভ্রান্ত মধুছন্দা সুনন্দকে ফোন করে। সুনন্দ শিগগির ঘরে আয়। তোর মামার শরীর খুব খারাপ।

সুনন্দ বিভ্রান্ত। তর তর করে সিঁড়ি দিয়ে নীচে নেমে ছুটোছুটি করতে থাকে। যাকে দেখছে বলছে– দাদা একটা অ্যাম্বুল্যান্স জোগাড় করে দিতে পারেন? আচমকাই সুনন্দের নজরে পড়ে গলি দিয়ে এমার্জেন্সি হর্ন বাজিয়ে একটা অ্যাম্বুলেন্স তীব্র গতিতে এগিয়ে আসছে। বাঁদিকের জানালা দিয়ে একটা কচি হাত বার করে ইশারা করছে। সুনন্দ বুঝতে পারছে না। সামনে আসতেই গাড়ি থেকে বেরিয়ে এল লালু। বলে– দাদাভাই আমি রাস্তাতেই খবর পেয়েছি। তাই অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে এলাম।

নার্সিংহোমে যখন পৗঁছোল রাত দশটা। ডাক্তার এস দত্ত বললেন– পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে। রেডি থাকুন।

ভোর রাতে সুনন্দকে ডাক্তার বলে– কে হন ইনি?

– আমার মামা।

– সরি। উই আর কমপ্লিটলি হেল্পলেস।

অনেকদিন পর আজ সুনন্দ ঘুমিয়েছে। যাকে বলে একেবারে সাউন্ডস্লিপ। সেই ঘুমে সুনন্দের সামনে এক ছায়ামূর্তি। ছায়ামূর্তি বলছে – দাদাভাই আমি চলে যাচ্ছি। আমার কাজ শেষ। তবে বিশ্বাস করো। মামাবাবুকে আমি মারিনি। শুধু আমার স্বরূপ দেখিয়েছি। বোধহয় তাতেই…। সেটা তুমি স্টোররুমেই সেদিন দেখেছ। আমি তোমাকে হ্যালুসিনেশনের লেবেল সেঁটে দিয়েছিলাম। এছাড়া আমার কোনও গতি ছিল না। তোমার মামাবাবুর অঢেল টাকা। কলকাতায় দু’টো ফ্ল্যাট, ব্যাংক অ্যাকাউন্ট নিয়ে আনুমানিক প্রায় দশ কোটি। তোমরা হয়তো জানো না। মামাবাবু দুপুরে বেরিয়ে কোথায় যেতেন! রেসের মাঠে। অঢেল টাকা ওড়াতেন। আরও অনেক বাজে অভ্যেস ছিল। অথচ তোমাদের এই সংকটে পাশে দাঁড়াননি। আমি জানি তোমার ব্যাবসা এখন ডুবন্ত নৗকা। অবশ্য একটা মহৎ কাজ তিনি করেছেন। সেটা পরে বুঝবে। আর একটা কথা। টবের গাছেই আমি থাকতাম। টবটা এখুনি ফেলে দাও। গাছটা আমি নিয়ে গেলাম। ভালো থেকো।

সুনন্দ খাটে শুয়ে আছে। ভাবছে। বিষয়- লালুর আগমন নিঃস্্ক্রমণের হেতু। কলিং বেলটা ডিং ডং আওয়াজ। সুনন্দ দরজা খুলতেই কালো কোট প্যান্ট পরা এক অপরিচিত মানুষ। হাঁ করে তাকিয়ে থাকে। নীরবতা নব আগন্তুকই ভাঙে।

–নমস্কার। আমি অ্যাডভোকেট পার্থ সান্যাল। বারাসাত কোর্টে প্র্যাকটিস করি। এসেছি মধুছন্দা দেবীর কাছে। যদি ভুল না করি আপনি…।

– একমাত্র ছেলে সুনন্দ ঘোষ।

–একটু বসতে পারি?

– ওহ, নিশ্চই।

তাহলে মাকে একটু ডেকে দিন।

অ্যাডভোকেট বলছে– ড. ডি কে বাসু আমার ক্লায়েন্ট। উনি একটা উইল করে গেছেন। ওর সমস্ত সম্পত্তি দান করেছেন। সম্পত্তির আনুমানিক মূল্য প্রায় দশ কোটি। অবশ্য কিছু শর্ত সাপেক্ষে। ওর শেষ জীবনে যে বা যারা দেখভাল করবে সে সম্পত্তি তারই প্রাপ্য। এ-ও উল্লেখ করেছেন বর্তমানে তার বোন শ্রীমতী মধুছন্দা ঘোষ-এর বাড়িতেই বসবাস করছেন। ডিটেলসটা পরে নেবেন। সম্মতি থাকলে প্রসিডিংস-টা স্টার্ট করি?

সুনন্দ ধড়মড় করে উঠে পড়ে। ছুটে যায় ব্যালকনিতে। আশ্চর্য! কালকেও দক্ষিণা হাওয়ায় গাছটার পাতাগুলো পত পত করে দোল খাচ্ছিল। এখন গাছটা শুকিয়ে দড়ি হয়ে আছে। সুনন্দের চোখ দিয়ে ঝর ঝর করে জল পড়ে গাছের গোড়াটা সিক্ত করে দিল।

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...