রাজর্ষির বয়স মাত্র ৮ বছর। কিন্তু ও, ওর বয়সের বাচ্চাদের থেকে স্বভাবে একেবারেই আলাদা। খেলাধুলা করার সময় বেশিরভাগ দিন অন্যান্য খেলার সঙ্গীদের মেরে ধরে ভয় দেখিয়ে নিজের জয় নিশ্চিত করে নেয়। ওর মা-বাবাও ওকে কখনও ভালো ভাবে, কখনও বকে অনেক বুঝিয়েছেন কিন্তু অবাধ্যতা করা ওর স্বভাব হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমনকী মা-বাবার মুখে মুখে তর্ক করা, বাড়ির জিনিসপত্র ছুড়ে ভেঙে দেওয়াও ওর এই বয়সেই অভ্যাস হয়ে দাঁড়িয়েছে।

রাজর্ষির মা-বাবা দুজনেই কর্মরত। কর্মজীবনে প্রচুর স্ট্রেস থাকার ফলে বাড়িতে মাঝেমধ্যেই নিজেদের মধ্যে তর্ক-বিতর্ক হয় এমনকী চিৎকার-চ্যাঁচামেচিও কখনও-সখনও হয়েই থাকে। এমনও হয়েছে রাজর্ষির সামনেই বাবা রাগের মাথায় ওর মায়ের উপর হাত তুলেছেন। প্রথম প্রথম ও চমকে উঠত কিন্তু ধীরে ধীরে এটাই ওর মনে বসে গেল যে এই ধরনের ব্যবহারই সঠিক। প্রথমে শুরু করল মা-বাবার সঙ্গে চেঁচিয়ে কথা বলা, বাড়ির জিনিসপত্র ভাঙা। ধীরে ধীরে স্কুল এবং পাড়ার বন্ধুদের সঙ্গেও একই ব্যবহার করা শুরু করল।

রাজর্ষির এই ব্যবহারের জন্য ওর মা-বাবা অনেকটাই দায়ী। প্রথমদিকে কান্নাকাটি করে অথবা একদম চুপ হয়ে গিয়ে নিজের প্রতিক্রিয়া জানাবার চেষ্টা করত কিন্তু ওর মা-বাবা কখনওই ওর কথা বোঝার চেষ্টা করেননি। নিজেদের মধ্যে লড়াইতে ব্যস্ত থেকেছেন। ফল দাঁড়িয়েছে রাজর্ষির অসম্ভব জেদি এবং রাগি হয়ে ওঠা।

প্রত্যেক শিশুর কাছে তার মা-বাবাই হল রোল মডেল। মা-বাবার থেকে ভালো সে আর কাউকেই মনে করে না। সুতরাং যখন বাচ্চার সামনেই তার অভিভাবকদের মধ্যে ঝগড়া-বিবাদের সৃষ্টি হয়, কদর্য ভাষার ব্যবহার চলে– তখন বাচ্চার মানসপটে আঁকা মা-বাবার ছবি কলুষিত হয়ে পড়ে। মা-বাবার আচরণে নিজেকে ঢেলে সাজাবার চেষ্টা করে।

সাইকোলজি-তে রয়েছে ইমিটেশন থিওরি। যার দ্বারা প্রমাণ হয় যে, বাচ্চা মা-বাবার কাছ থেকেই সামাজিক ব্যবহার শিখে বড়ো হয়। যদিও সব অভিভাবকেরাই চান বাচ্চাকে সুশিক্ষা দিতে তবুও কখনও কখনও বাচ্চার সামনেই এমন কিছু ভুল করে বসেন যাতে বাচ্চার উপর খু ব খারাপ প্রভাব পড়ে।

এমনও ঘটনা অনেক সময় ঘটে থাকে যেখানে অভিভাবকেরা নিজেদের মধ্যে ঝগড়া করার পর নিজেকে বাচ্চার কাছে সঠিক প্রমাণিত করতে একে অপরের বিরুদ্ধে দোষারোপ করতে থাকে বাচ্চার সরল মনকে অপরের প্রতি বিষিয়ে তুলতে। এর ফলে বাচ্চা আরও বেশি বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে।

মা-বাবার ঝগড়ার প্রভাব বাচ্চার মনে নিয়ে আসে অবসাদ অর্থাৎ ডিপ্রেশন – যে-বাচ্চারা সবসময় মা-বাবার মধ্যে ঝগড়া মারামারি দেখে বড়ো হয় তাদের মধ্যে ডিপ্রেশনের সমস্যা হতে পারে। এর কারণ তারা হাসিখুশি পরিবেশ পায় না এবং একটা নেতিবাচক পরিস্থিতির মধ্যে তার মানসিক বিকাশ ঘটে।

ভয়ে ভয়ে থাকা – বাচ্চার সামনে লড়াই ঝগড়া, বাজে শব্দ ব্যবহার করা বা মারধর করার সময় মা-বাবা ভুলে যান তাদের এই ব্যবহার বাচ্চার উপর কী প্রভাব ফেলতে পারে। বেশিরভাগ সময়েই মা-বাবাকে লড়াই করতে দেখলে বাচ্চার মনে ভয় চেপে বসে।

মানসিক সমস্যা – ঝগড়া-বিবাদের পরিবেশে বাচ্চা বড়ো হতে থাকলে, বাচ্চার মানসিক সমস্যা দেখা দিতে পারে। বাচ্চার ইনোসেন্স হারিয়ে যায়, বাচ্চা জেদি এবং খিটখিটে মেজাজের হয়ে ওঠে। মা-বাবাও এই ক্ষেত্রে বাচ্চা এই ধরনের আচরণের কারণ খুঁজে পান না। তারা বোঝার চেষ্টাই করেন না যে, তাদের কারণেই বাচ্চার মধ্যে এতটা পরিবর্তন হচ্ছে।

জীবনে বড়ো ক্ষতির সম্মুখীন হওয়া – বাড়ির অশান্তি, ঝগড়ার পরিবেশে বাচ্চার মানসিক বিকাশ ঠিক মতো হয় না ফলে অন্য বাচ্চাদের তুলনায় খেলধুলো, পড়াশোনায় সে পিছিয়ে পড়তে থাকে।

নিজেকেই দোষী ভাবতে শুরু করে – বাড়িতে রোজ বড়োদের ঝগড়া দেখতে দেখতে বাচ্চার মনে হতে থাকে সে-ই এই ঝগড়ার মূল কারণ। এরপর বাচ্চা নিজেকে গুটিয়ে নেয় এবং চুপচাপ থাকতে শুরু করে। অনেক বাচ্চা আবার আত্মহননের পথও বেছে নেয়।

ভরসা করা ছেড়ে দেয় – বড়োদের মধ্যে ঝগড়ায় বাচ্চার শিশুমন নিরাশায় ডুবে যায়। কোনও কিছুতে ভালো লাগা তার জীবন থেকে হারিয়ে যায়। কাউকে ভরসা করতে পারে না। কেউ ভালোবাসলেও সেটা তার কাছে মিথ্যা বলে মনে হয়।

অল্প বয়সি বাচ্চাদের উপর লড়াই ঝগড়ার প্রভাব – ছোটো বাচ্চারা মা-বাবার কথোপকথন খুব একটা বুঝতে না পারলেও ওদের ইমোশন, মুড খুব সহজে বুঝতে পারে। লক্ষ্য করা গেছে যেসব পরিবারে দম্পতির মধ্যে সবসময় ঝগড়া লেগে থাকে সেখানে বাচ্চা খুব ভয়ে ভয়ে থাকে। তাদের মনে হয়, এই বুঝি মা-বাবা আলাদা হয়ে যাবে আর ওর সঙ্গে কেউ থাকবে না। নিজেকে অসুরক্ষিত মনে করতে আরম্ভ করে। এমনকী বাইরে মেলামেশা করা বা কোথাও যাওয়া আসাও বন্ধ করে দেয়।

একটু বেশি বয়সি বাচ্চার উপর লড়াইয়ের প্রভাব – বাচ্চা একটু বড়ো হয়ে গেলে মা-বাবা আশা করেন নিজেদের ঝগড়ায় বাচ্চা কারও একটা পক্ষ নেবে। কিন্তু বাচ্চার সাইকোলজি এই ক্ষেত্রে একটু অন্যরকম, সে বরং মনে করে জবরদস্তি সে এই সিচুয়েশনে আটকে পড়েছে। গ্লানি অনুভব করে। এই সিচুয়েশনের জন্য নিজেকেই দায়ী করে।

আমেরিকায় একটি রিসার্চ-এর ফলাফল অনুসারে মা-বাবার ঝগড়ার প্রভাব বাচ্চার শরীরের ইমিউন সিস্টেমের উপরেও গভীর ভাবে পড়ে। এর ফলে বাচ্চার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল হয়ে পড়ে। ছোটো থেকেই লড়াই ঝগড়ার পরিবেশে বড়ো হতে থাকলে অথবা মা-বাবার মধ্যে কথাবর্তা বন্ধ থাকলে বা ডিভোর্স কেস দীর্ঘ সময় ধরে চলতে থাকলে বাচ্চার মনের উপর খুব গভীর প্রভাব পড়ে। শুধু শৈশবেই নয় বড়ো হয়েও বাচ্চা এর নেতিবাচক প্রভাব থেকে বেরোতে পারে না। পড়াশোনাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ঝগড়া হওয়া খুবই স্বাভাবিক। কারণ দুটো মানুষ দুটো ভিন্ন ভিন্ন পরিবেশ থেকে আসে ফলে তাদের চিন্তা-ভাবনা আলাদা হতেই পারে। কিন্তু সামান্য তর্ক-বিতর্ক, মারপিটে পৌঁছে গেলে অথবা কেস ডিভোর্স অবধি পৌঁছোলে, তার মারাত্মক প্রভাব পড়তে পারে সন্তানের উপর।

বাচ্চার মানসিক বিকাশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। নানারকম মানসিক বিকার উৎপন্ন হতে পারে। নয় সে ভীতু স্বভাবের হয়ে ওঠে আর নয়তো সঠিক পথ থেকে সরে দাঁড়ায়। তাই নিজেদের মধ্যে ঝগড়া হলেও, বাচ্চাকে নিজেদের ঝগড়া থেকে দূরে রাখাটাই সকলের জন্য বাঞ্ছনীয়। তাহলেই বাচ্চার পালন-পোষণ সঠিক ভাবে হতে পারবে।

মা-বাবার জন্য টিপস     

ক) নিজের অহংকার বজায় রাখার বদলে সন্তানের কথা ভাবুন

খ) দম্পতির মধ্যে ঝগড়া হওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু যখন একজন রেগে রয়েছে অন্যজনের উচিত চুপ করে যাওয়া, যাতে ঝগড়া আরও না বাড়ে

গ) নিজেদের ঝগড়ায় বাচ্চাদের শামিল করা উচিত নয়

ঘ) কোনও ব্যাপারে বড়োদের সম্মতি একসঙ্গে না হলেও বাচ্চার সামনে একে অপরকে অসম্মান করা ঠিক নয়

ঙ) বাচ্চার সামনে খারাপ ভাষা ব্যবহার করা উচিত নয়। চিৎকার-চ্যাঁচামেচি বা গালিগালাজ দিয়ে কথা কখনওই বলা শোভনীয় নয়

চ)  যদি স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ঝগড়া কিছুতেই না থামে তাহলে কাউন্সিলার-এর পরামর্শ নিন

 

 

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...