কলেজ পড়ুয়া রিয়াকে খুব বিভ্রান্ত লাগছিল। মুখমণ্ডলে আশঙ্কার ছাপ। কথা বলে জানা গেল, রিয়া এমন এক সমস্যায় পড়েছে, যা ওর সামাজিক জীবনে খারাপ প্রভাব ফেলতে পারে।
আসলে রিয়া জানতে পেরেছে, যে-শপিং মল-এর জামাকাপড়ের শোরুম-এ প্রায়-ই কেনাকাটা করতে গিয়ে সে ট্রায়াল রুম ব্যবহার করেছে, সেই ট্রায়াল রুম-এ এতদিন রাখা ছিল হিডেন ক্যামেরা। ওই শোরুমের কর্তাব্যক্তিদের গ্রেফতার হওয়ার খবর প্রকাশ্যে আসতেই কপালে দুঃশ্চিন্তার ভাঁজ পড়ে রিয়ার। কারণ রিয়ার মনে হয়, ওই হিডেন ক্যামেরায় ধরা ফুটেজ যদি কোনও ভাবে ভাইরাল হয়ে যায়, তাহলে তা রিয়ার সামাজিক জীবনে কুপ্রভাব ফেলবে।
তবে শুধু রিয়া নয়, এমন ঘটনায় আশঙ্কিত হতে দেখা গেছে অনেককেই। কোথায় কীভাবে যে হিডেন ক্যামেরা রাখা রয়েছে, তা সাধারণ ভাবে বোঝা দুষ্কর। কখনও হোটেলে, কখনও ট্রায়াল রুম-এ, আবার কখনও ওয়াটার পার্কের চেঞ্জিং রুম-এ হিডেন ক্যামেরা রাখার খবর শুনলেই তাই ভয়ে হাড় হিম হয়ে যায় মেয়েদের।
একটি শোরুম-এ ট্রায়াল রুম ব্যবহার করতে গিয়ে এক গৃহবধূ দেখতে পান, বৈদ্যুতিক আলোর হোল্ডার-এর নীচে রয়েছে বোতামের মতো ছোট্ট একটি লেন্স। ভালো ভাবে পরীক্ষা করে ওই গৃহবধূ বুঝতে পারেন, ওই ক্যামেরা থেকে একটি তার বেরিয়ে বাইরে চলে গেছে। কাউকে কিছু না বলে পুলিশে খবর দেন ওই গৃহবধূ। পুলিশ এসে দেখে, ওই হিডেন ক্যামেরা একটি ল্যাপটপ-এর সঙ্গে জোড়া। ল্যাপটপ-এ স্টোর হয়েছে প্রচুর আপত্তিকর ভিডিয়ো। তদন্ত করে পুলিশ জানতে পারে, ওই দুষ্কর্ম শোরুম-এর কর্মীদের। এরপর ৩প্তচ্ছ্র, ৩প্তচ্ছ্র-সি ধারা এবং আইটি অ্যাক্ট অনুযায়ী অপরাধীদের শাস্তি হয়।
কিছুদিন আগে এক লেডিস হোস্টেলেও এভাবেই বাথরুম-এ তিনটি হিডেন ক্যামেরা রাখার অপরাধে শাস্তি পায় কয়েকজন পুরুষ কর্মী।
এক তরুণী শোরুম-এর ট্রায়াল রুম-এ তিনটি টপ্ ট্রায়াল দেওয়ার পর দেখতে পায় ক্যামেরার লেন্স। শুরু হয় হইচই। পুলিশ এসে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেয় কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে। এরকম অনেক ঘটনার খবরই পাওয়া যায় মাঝেমধ্যে। বিজেপি নেত্রী স্মৃতি ইরানিও এই ঘটনার শিকার হয়েছেন একসময়। একটি ব্র্যান্ড-এর শোরুম-এর ট্রায়ালরুম-এ বসানো হিডেন ক্যামেরা হাতেনাতে ধরেন স্মৃতি। কম্পিউটার হার্ডডিস্ক চেক করে পুলিশ জানতে পারে, পোশাক চেঞ্জ করার সময় মহিলাদের উর্ধাঙ্গের ছবি তুলে রাখা হতো ওই হিডেন ক্যামেরার মাধ্যমে।
বিভিন্ন ঘটনা-প্রবাহ থেকে প্রমাণিত হয়েছে, ট্রায়ালরুম, চেঞ্জিং রুম, লেডিস হোস্টেল-এর বাথরুম, হোটেল প্রভৃতি জায়গায় যে-কেউ যে-কোনও সময় হিডেন ক্যামেরার শিকার হতে পারেন। অতএব সাবধান! কারণ, অসতর্ক থাকলে আপনার স্বল্পাবাস কিংবা একান্ত ব্যক্তিগত মুহূর্তের ছবি হিডেন ক্যামেরার মাধ্যমে সংগ্রহ করে পর্ণ ওয়েবসাইট কিংবা সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে দেওয়া হতে পারে। মনে রাখবেন, ট্রায়ালরুম-এ কিংবা বাথরুম-এ রাখা আয়নারও চোখ থাকতে পারে। অর্থাৎ, অত্যাধুনিক ছোটো ক্যামেরা বসানো থাকতে পারে আয়নার পিছনে। এই ক্যামেরা আয়নার সামনে দাঁড়ালে বুঝতে পারবেন না কিন্তু সেই ক্যামেরা আড়ালে থেকে আপনার বিশেষ মুহূর্তের ছবি স্টোর করে রাখতে পারে।
কীভাবে বাঁচবেন
অপরাধীরা অনেক সময় অশ্লীল ছবি তুলে রেখে এমএমএস করার ভয় দেখায়। এইরকম যদি কেউ ব্ল্যাকমেলিং করতে চায় তাহলে অযথা ভয় না পেয়ে পুলিশকে জানান এবং অপরাধপ্রবণ ব্যক্তিকে উপযুক্ত শাস্তি দিন।
‘যদি আমার সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক করো তাহলে ওই বিশেষ মুহূর্তের ছবি ডিলিট করে দেব, আর যদি রাজি না হও তাহলে ওই ছবি ভাইরাল করে দেব’ –এমন হুমকিও পেয়েছেন অনেক মহিলা। আবার অনেক অপরাধী সরাসরি টাকাও দাবি করে। এক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে, ভয় না পেয়ে এবং অপরাধীকে বুঝতে না দিয়ে গোপনে তার সমস্ত তথ্য সংগ্রহ করে পুলিশকে জানান। এই ধরনের অপরাধের ক্ষেত্রে পুলিশের সাইবার ক্রাইম ব্রাঞ্চ দ্রুত ব্যবস্থা নেবে অভিযুক্তের বিরুদ্ধে।
কোথাও হিডেন ক্যামেরা আছে কিনা তা আন্দাজ করা যায় কয়েকটি উপায়ে। যেমন, যেখানে হিডেন ক্যামেরা ব্যবহার করা হয়, সেই জায়গার দেয়ালের রং সাদা কিংবা উজ্জ্বল রাখা হয় না। ক্যামেরার উপস্থিতি যাতে কেউ টের না পান, তার জন্য দেয়ালের রং গাঢ় রাখা হয়। কোনও শো-পিস, ফুলদানি কিংবা একাধিক লাইট, ফ্যান অথবা সুইচ, অকেজো টিভি-রিমোট প্রভৃতি থাকলে অবশ্যই সতর্ক হোন। কারণ, ওইসব উপকরণকে ক্যামেরা রাখার মাধ্যম করা হয়। তাই সন্দেহ হলে যেমন সবকিছু ভালো ভাবে চেক করে নেবেন, ঠিক তেমনই আপনার সঙ্গে থাকা মোবাইল ফোন থেকে যে-কোনও নাম্বার-এ কল করে দেখুন নেটওয়ার্ক পাচ্ছেন কিনা। যদি ওই জায়গায় হিডেন ক্যামেরা থাকে তাহলে মোবাইল ফোন থেকে কাউকে কল করা প্রায় অসম্ভব। অএতব হিডেন কামেরা আছে কিনা, তা তদন্ত করার জন্য মাধ্যম করুন আপনার মোবাইল ফোনটিকে।
হিডেন ক্যামেরার উপস্থিতি যদি টের পান কিংবা সন্দেহ হয়, তাহলে তখন-ই একা প্রতিবাদ করবেন না। কারণ, এতে অভিযুক্ত তথ্য প্রমাণ লোপাট করার চেষ্টা করবে পুলিশ আসার আগেই। শুধু তাই নয়, একা প্রতিবাদ করতে গেলে আপনাকে হেনস্থাও করতে পারে অভিযুক্ত। তাই লোকজন নিয়ে তখনই থানায় গিয়ে লিখিত অভিযোগ করুন এবং পুলিশকে ব্যবস্থা নিতে বলুন। আর লোকাল থানা যদি ব্যবস্থা নিতে গড়িমসি করে, তাহলে পুলিশের স্পেশাল ক্রাইম ব্রাঞ্চ-এ গিয়ে অভিযোগ জানান তখনই অথবা ১০০ ডায়াল করে বিষয়টি জানান। দেখবেন, ভয় না পেয়ে প্রতিবাদ কিংবা অভিযোগ জানালে, অভিযুক্ত শাস্তি পাবেই।