হাতে স্বর্গ পেল নীলমাধব। আজ তার সরকারের দেওয়া ৩৫ বছরের জীবনের শেষ দিন। একটু আগেভাগেই অফিস যাবে। প্রতিদিনের মতো শুধু নিজের চেয়ার টেবিল মুছে, টেবিলের কাচের নীচে রাখা কালি ঠাকুরকে পেন্নাম ঠুকে, এক গেলাস জল ঢক ঢক করে গলায় ঢালা শুধু নয়, আজ তার অফিসের চেয়ারের চারটে পায়ে প্রণাম করবে। টেবিলে খানিকটা মাথা ঠুকবে। ভেবে রেখেছে একটু কাঁদবেও। চোখের জল দিলে দেবতা খুশি হন।
ওই চেয়ার-টেবিল তো তার ভগবান। অফিসের লোকজন আসার আগেই সেসব আচার করে ফেলতে হবে। লোকজনের সামনে করলে হাসাহাসি হবে। এ জীবনে তার জন্য তো আর কোনও চেয়ার অপেক্ষা করে থাকবে না। কত মায়া ছিল ওই কাঠের চেয়ারটার। ডেলি-রেটেড মজদুর হিসেবে ঢুকে নিজের অধ্যবসায় আর মিষ্টি ব্যবহার দিয়ে সকলের মন জয় করে আজ ক্লার্ক হয়ে রিটায়ার করছে।
হ্যাঁ, সকাল সকাল অফিস যাবে বলে একটু আগেই চানঘরে ঢুকে গেছে নীলমাধব। সঙ্গে অভ্যাসমতো খবরের কাগজ। কমোডের উপরে বসে খবরের কাগজ পড়া তার অন্যতম বিলাসিতা। ভাঁজ খুলতেই হলুদ কাগজের একটা ছোটো প্যামফ্লেট সড়সড় করে নেমে মেঝেয় পড়ে গেল। না ভেজেনি। নীলমাধব ঝুঁকে কাগজের টুকরাটো হাতে নিয়ে চোখ বোলাতেই তড়াক করে লাফিয়ে উঠল। কয়েকদিন ধরে মনের ভেতর ঢুকে আসতে থাকা অন্ধকার ফিকে হয়ে আসছে যেন। নগ্ন, নির্মেদ প্রায় ছয় ফিটের শ্যামবর্ণ শরীর নিজের অক্ষের উপর চরকি মারল। তার চোখে পড়েছে। প্যামফ্লেটের একেবারে নীচের দুটি লাইন– একটিমাত্র ফোন আপনার জীবনের পরিবর্তন আনতে পারে। রত্না ঘোষ, ফোন- ৯৭৬৮৫৫৪২৭২।
বউ ঘোষণা করে দিয়েছিল অনেক আগেই, ‘সারাদিন বাড়িতে বসে ট্যাঙস ট্যাঙস করে কথার ফোড়ন কাটবে, সেটি হবেনি। হাত-পা মজবুত আছে, কাজ-কাম করোগে যাও।’
নীলমাধব জানে, ওই ঘোষণা মানে আদেশ। সত্যি সত্যি সারাটা দিন তাকে সইতে পারবে না বউ। এ-কথার পিঠে সে-কথা, তারপর তো বাড়ি মাথায় করে কুরুক্ষেত্র। আর সেসব এড়াতে রাস্তায় রাস্তায় উদ্দ্যেশ্যহীন কতদিন আর ঘুরে বেড়াতে পারবে! সে এবার খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে প্যামফ্লেট পড়তে থাকে। হ্যাঁ হ্যাঁ আলো।
লেখা আছে, ‘ইউ এস মাল্টিন্যাশানাল কোম্পানি কলকাতায় তাদের ব্যাবসা বাড়াবার জন্য চাকরির অফার দিচ্ছে।’
নীলমাধব আতিপাতি করে খুঁজল কোনও শিক্ষাগত যোগ্যতার কথা বলেছে কিনা। সেখানে সে আটকে যেতে পারে। সে তো মাত্র উচ্চ মাধ্যমিক পাস। আর এখন মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে চাকরি করার জন্য সোনার টুকরো সব ছেলেমেয়েরা বসে আছে। অফিসের বড়োবাবুর ছেলে তো বেঙ্গালুরু থেকে পাশ করেই ইনফোসিস না কি কোম্পানিতে চাকরি করতে চলে গেল, সে-ও মাল্টিন্যাশনাল।
পেট ও মনের যুগপত আরাম হয়ে এসময় নীলমাধবের চোখে পড়ল প্যামফ্লেট-এর দুই নম্বর খোপটিতে লেখা আছে গৃহবধূ, রিটায়ার্ড ব্যক্তি, ভিআরএস।
তার যোগ্যতা রিটায়ার্ড ব্যাক্তি। মানে কাল থেকে সে এই কোম্পানিতে কাজ করার যোগ্য। তবে কালকের জন্য নীলমাধব অপেক্ষা করবে না। আজকেই ফোন করে জেনে রাখবে সব। যাতে কালই বউয়ের কথা মেনে অফিসের সময়েই ঘরের বাইরে পা দেয়া যায়।
অফিসটা কেমন হবে! শুনেছে সে, এসব অফিস খুব সাজানো গোছানো হয়। সরকারি অফিসের মতো নোংরা আর অন্ধকার যেখানে সেখানে জমে থাকে না। ঝাঁ চকচকে, সেন্ট্রালি এসি। আর সেখানে কাঠের চেয়ার টেবিলের বালাই নেই, খোপে খোপে ডেস্ক আর গদি দেওয়া রিভল্ভিং স্টিলের চেয়ার।
একটা লম্বা করে শ্বাস নেয় নীলমাধব। কমোডে বসে থেকেই তার মনে হল এসব অফিসের ড্রেস কোডের কথা। অসীম-দার বউ কাজ করে ‘বোম্বাই প্রেস অ্যান্ড অ্যাডভার্টাইসমেন্ট -এর কলকাতা অফিস ১১১ পার্ক স্ট্রিটে। একদিন কী একটা কাজ নিয়ে অসীমদার সাথে সেই অফিসে গিয়েছিল। ওয়েটিং-এ তাদের জন্য যে মেয়েটি দামি ট্রেতে করে কফির কাপ, জলের গেলাস এনে দিল, তার দিকে চেয়ে তো বুকে কাঁপন ধরে গেছিল। সাদা ধবধবে পা হাঁটুর উপর পর্যন্ত যেন মাখন দিয়ে গড়া। লাল স্কার্ট, লাল হাই হিল আর টকটকে লাল ঠোঁট-ই যথেষ্ট, মাথা ঘুরিয়ে দিতে। তার উপর জামার উপরের একটা বোতাম খোলা আর কফির কাপ নামিয়ে রাখার সময় ঝুঁকে পড়তেই দুটি সোনার ফসলের অনেকটা চোখের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল যেন। মেয়েটা চলে যেতেই অসীমদা ফিসফিস করে বলেছিল, ‘কী রে একেবারে ফিদা হয়ে গেছিস?’
নীলমাধব ধরা পড়ে যাবার বিড়ম্বনায়, তো তো করে অজুহাত খুঁজতে যেতেই অসীমদা চোখে মুখে হাসি ছড়িয়ে বলেছিল, ‘ঝানু ঝানু পার্টিকে এভাবেই আতিথেয়তার প্রথম মুহূর্ত থেকেই বধ করে ফেলে। মতামতকে নিজেদের অনুকূলে নিয়ে যাবার জন্য এটা একটা প্রাচীনতম হিপনোটাইজিং ফ্যাক্টর।’
অসীমদাকে সিনিয়র হিসেবে শুধু নয়, তার নানা বিষয়ে জানাশোনার জন্য নীলমাধব মনে মনে শ্রদ্ধা করে। অসীমদা বেশ ইন্টেলেকচুয়াল। শুনেছে কফি হাউসে নাকি আড্ডা আছে তার। চাকরি ছাড়াও সংবর্ত নামে নাটকের দলে নাটক করে।
অসীমদা আবার কানের কাছে মুখটি নিয়ে ফিসফিস করে, ‘ওই যে মেয়েটার চলকে ওঠা বুকের উপর থেকে চোখ ফেরাতে পারছিলি না…।’
‘না না কী যে বলো তুমি…।’ নীলমাধব নিজেকে বাঁচানোর আপ্রাণ চেষ্টা করে।
অসীমদা বলে, ‘শোনই না, এদের অধিকাংশেরই নিজের বুক না, লিফট করা বুক। আর এরা মুখের সঙ্গে সঙ্গে ক্রিম, রং বুকেও মাখে। দেখলি না কেমন গলা মোমের মতো লাবণ্য ঝরছিল সেখানে!’
‘যাঃ, তুমি না বাজে কথার জাদুকর।’
‘আরে আমি না জেনে বলছি নাকি! আমার বউ এলে দেখবি, তার-ও বুক ফেটে পড়ছে মনে হবে। কিন্তু দুটো দামড়া দামড়া ছেলের মা অমন ঢাউস বুক পাবে কোথায়! সবই নিউ মার্কেটের প্যাডেড ব্রা-র কেরামতি। আমি তো জানি, এই এতটুকু।’বলে অসীমদা হাতের আঙুল পাঁচটি দিয়ে একটা কমলালেবুর আকৃতি করল।
নীলমাধব ভাবনার ভালোলাগায় তলিয়ে ছিল। সে একটু নিজত্বে এসে ভাবল, তাহলে নিজেকেও তো সাজিয়ে গুছিয়ে নিতে হবে। অনেকদিন থেকেই নন্দিনী বলছে ভালো এক সেট জামা কাপড় কিনতে। এই ক্যাবলাকান্তপনা জামা কাপড়ে চলছে না। দামি কোনও শোরুমে নিয়ে গিয়ে সে-ই কিনে দেবে সব। কিন্তু নীলমাধব তানা নানা করে ঠেকিয়ে রেখেছে।
নন্দিনী নীলমাধবের ফুসফুস। সংসারে খরখরে গ্রীষ্মযাপনের মধ্যে নন্দিনী তার মরুদ্যান। না না বাড়িয়ে বলা নয়। আহিরিটোলা ঘাটের কাঠের জেটিতে কম দামের বুট ঠুকে সন্ধ্যার অল্প আলোয় কচুরিপানার স্রোতকে ভাটার টানে ছুটে যেতে দিয়ে নন্দিনীর গায়ে গা ঘেঁষে থেকে সে মাঝে মধ্যেই বলে, ‘বেঁচে থাকার সুখটুকু তোমার জন্যই পাচ্ছি, বিশ্বাস করো আর না-ই করো।’
অফিসে-বাড়িতে ইঁদুরের মতো থাকতে অভ্যস্ত নীলমাধব এই একটুকু সময় নদীর উদারতার সামনে বুক চিতিয়ে দাঁড়ায়। গঙ্গার হাওয়া নন্দিনীর শরীরের গন্ধ নিয়ে তার বুকের ভেতর ঢোকে। আবার তাকে একটা দিন বাঁচার প্রেরণা দেয়। হেরে যাওয়া জীবনে এই একজনই তাকে সমর্থন করে। শুধু তো সমর্থন নয়, এই একজনই যে নিজেকে তার কাছে সমর্পণ করে বসে আছে।
দুই
বউ বলেছে দাদাকে ফোন করে দিচ্ছে, দাদা ঠিক একটা জুটিয়ে দেবে। বলেছে, বাসন্তীতে ১৫০ দিনের কাজে তার দাদা যে কত লোককে কাজে ঢুকিয়ে দিয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। মাটি-কাটার কাজ আছে। চিংড়ির মীন ধরে আড়তে দেবার লোক – একটা না একটা জুটে যাবে। তবে কাজের আগে পাত্তিটাত্তি ছাড়তে হতে পারে। তার দাদা, বোনের বর বলে ছেড়ে দেবে না।
নীলমাধব থ মেরে যায় বউয়ের কথায়। এখন সে মাটি-কাটার কাজ করতে পারবে! ওদের গাঁয়ের মেয়েবউদের সাথে লুঙ্গি পরে জলে নেমে মীন ধরবে! সারাজীবন অফিসে চেয়ার-টেবিলে কাজ করার পর এই এত বয়সে লেবারের কাজ করতে যাবে! মাথাটা খারাপ হয়ে গেছে বউয়ের। কিন্তু বউয়ের যা গোঁ, কিছু একটা না করলে যদি ধরে-বেঁধে বাসন্তীতে পাঠিয়ে দেয়!
নীলমাধব চান শুরু করার আগে প্যামফ্লেটের শেষ অংশটুকুও পড়ে নিল, ‘বাড়ি থেকে অথবা অফিসে বসে কাজ।’
হ্যাঁ হ্যাঁ অফিসে বসেই কাজ করতে চায়। বাড়িতে বসে কাজ করতে বললে সে করবে না। মনে মনে ঠিক করে, পার্ট টাইম বা ফুল টাইম-এর মধ্যে, সে ফুল টাইমই নেবে।
একজন জহরকোট গায়ে দেওয়া ভদ্রলোক, মুখে ও হাতে শ্বেতির দাগ, প্রোজেক্টরের আলো এড়িয়ে এসে দাঁড়ালেন। কল টাইম ছিল বেলা তিনটে। ছোটো হল ঘরটা ভর্তি হয়ে গেছে। নীলমাধব থার্ড রো-তে মাঝামাঝি বসেছে। মাঝামাঝি থাকার নানা সুবিধে সে জানে। তার বাঁদিকে বসা পৃথুলা মেয়েটি অযথা কনুই দিয়ে চাপছে।
‘আমার নাম পি আচারিয়া।’ জহরকোট বলে উঠল। জহরকোট আরও বলল, ‘আসুন আমরা একসাথে তাল দি, প্রজেক্টরে একটা বিট বাজছিল।
নীলমাধব দেখল উপস্থিত সবাই ওই ভদ্রলোককে অনুসরণ করে হাততালি দিচ্ছে। এবং সে নিজেও।
‘এই কোম্পানির নাম হার্বলাইফ।’
পাওয়ার-পয়েন্টে প্রেজেন্টেশন পড়ছে পর্দায় আর মিঃ আচারিয়া নামে ওই জহরকোট বলে চলেছে, ‘এই কোম্পানির বয়স ৩৪ বছর। মানে যুবক এখন। এখন তার এক্সপ্যানশনের সময়। বিশ্বের ৯৬টা দেশে এই কোম্পানি কাজ করছে। সাড়ে দশ কোটি লোক এই কোম্পানির প্রোডাক্ট ইউজ করে।’
একমাথা লম্বা চুল যেন তাকে বিব্রত করছে, এরকম ভঙ্গিতে মাঝে মাঝে সে হাত দিয়ে মাথার চুল সরিয়ে দিলেও আবার সেসব চোখে মুখের উপর নেমে আসছে। নীলমাধবের মনে হল, পি আচারিয়া নামে ওই লোকটা তার চুলের অবিন্যস্ত অবস্থানটি নিশ্চই উপভোগ করে।
‘আমাদের প্রোডাক্ট উপভোক্তাদের কথা বলছিলাম, পর্দায় দেখুন, রোনাল্ডো, ওই যে ঢকঢক করে খেয়ে খেলায় নেমে গেল। গোল করল। বিরাট কোহলির জামায় দেখুন, লেখা রয়েছে হার্বলাইফ। ওই যে দেখুন, সাইক্লিস্টরা হার্বলাইফ-এর ড্রিংক খেয়ে নেমে পড়ছে রেসে।’
মাঝে মাঝে তিনি নেক্সট বলছেন, আর পাওয়ার-পয়েন্টে ছবি পালটে যাচ্ছে। একটা ছবিতে দেখানো হল একজন মোটা মেয়ে এই হেলথড্রিংক নিয়ে কীভাবে রোগা হয়েছে। ছবি থেকে দর্শক ও শ্রোতাদের দৃষ্টি সরিয়ে দিয়ে কমেন্ট্রেটর ভদ্রলোক একজন গৃহবধূকে সামনে ডেকে নিয়ে তার হাতে মাইক্রোফোন ধরিয়ে দিলেন। সেই বধূটি স্কিন টাইট পোশাকে স্ফিত বক্ষদেশের নীচে নিজের ক্ষীণ কোমরে হাত দেখিয়ে এবং বুক দুলিয়ে বললেন, এই ড্রিংক খেয়েই তিনি এরকম সিনেমার নায়িকার মতো শরীর তৈরি করতে পেরেছেন আর তিনি নাকি এই কোম্পানির একজন মার্কেটিং ম্যানেজার হয়ে মাসে লক্ষ লক্ষ টাকা রোজগার করেন এবং দেশে-বিদেশে কোম্পানির হয়ে ঘুরে বেড়াতে পারেন।
নীলমাধব মাথা ঠান্ডা রেখেছিল। পাশের মেয়েটি নোট নেবার সময়, হাততালির সময় যেন ইচ্ছে করেই ছুঁয়ে দিচ্ছিল। খুব ছোটো ছোটো চেয়ার। ডানদিকের হাতলে রাইটিং স্পেস। মেয়েটা একসময় তার শরীরের উপরের অংশ এতটা ঝুঁকিয়ে দিয়েছে যে, নীলমাধবের বাহুতে তার বুকের ভারী অংশ ঘষা লাগছে।
কী চায় মেয়েটি! নীলমাধব জানে চেহারায় তাকে চল্লিশোর্ধ মনে হয়। এই মেয়েটা ফাঁসাবে নাকি! ও কি জেনে গেছে রিটায়ারমেন্ট বেনিফিটের অনেক টাকা তার হাতে আসতে চলেছে! নীলমাধব আরও কুণ্ডলী পাকায়। নিজের ছোট্ট চেয়ারে। আর যুবতির শরীরের নরম অংশের ছোঁয়ায় উত্তেজিত বোধ করলে ভাবনাকে অন্য দিকে গড়িয়ে দিয়ে নিষ্কৃতি পেতে চায়।
অন্য কি বা তার আছে নন্দিনী ছাড়া! নন্দিনী পই পই করে বলেছে চাকরি খুঁজতে গিয়ে ভুলভাল জায়গায় যেন না যায়।
গত বছর একটা ভুল জায়গায় সে চলে গিয়েছিল। অবশ্য সেটা নন্দিনীর সাথেই। নন্দিনীর সাথে চলতে তার কোনও ভাবনা হয় না। সব ভাবনা নন্দিনীর। নন্দিনী সঙ্গে থাকলে সে ফুরফুর করে ওড়ে। মেপে কথা বলা, মেপে চলা, কিচ্ছুটি করতে হয় না। কিন্তু অন্য সময় নীলমাধব শংকিত, সঙ্কুচিত থাকে, এই বুঝি কেউ তাকে ঠকাল, এই বুঝি কেউ তাকে অপমান করতে আসছে।
গত বছর নন্দিনী-ই নিয়ে গেল। ডিসেম্বরের মাঝামাঝি। তাকে কিচ্ছুটি করতে হয়নি। শুধু কথামতো অফিস কেটে পৌনে দশটায় হাওড়া স্টেশনে বড়ো ঘড়ির নীচে নন্দিনী টিকিট কেটে দাঁড়িয়েছিল। দশটার কাটোয়া লোকাল।
‘আমার না খুব থ্রিল হচ্ছে জানো, এই প্রথম কলকাতার বাইরে কোথাও যাচ্ছি, তোমার সাথে। তোমার ভালো লাগছে তো! না কি আমি জোর করেছি বলে তুমি এলে?’
নন্দিনী জানালার পাশে বসেছে, হাওয়ায় তার কথা ভেসে যেতে পারে ভেবে সে অনেকখানি নীলমাধবের গায়ের ভেতর ঢুকে এসে কথা বলছে। তার ৩১ বছরের মাখন শরীর নীলমাধবের ছোঁয়া পেতে ব্যাকুল যেন। নীলমাধবের স্বপ্নে জড়ানো দুটি চোখের উপর থেকে চোখ সরাচ্ছে না। কামরার দু-একজন তো নন্দিনীর সৌন্দর্য থেকে চোখ ফেরাতেই পারছে না।
নীলমাধব নন্দিনীর কথার উত্তরে শুধু বলতে পেরেছিল, ‘স্বপ্ন যে সত্যি হয়, তা আমি বুঝতে পারছি আজ। কতদিন মনে মনে ভেবেছি, তোমার সাথে দূরে কোথাও বেড়াতে গেলে বেশ হয়। দূরের ট্রেনে পাশাপাশি যাওয়ার যে কি আনন্দ তা এই লোকাল ট্রেনেই টের পাচ্ছি।’
সোমড়াবাজার স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে মাঝদুপুরে নেমেছে মাত্র পাঁচ-সাতজন। নীলমাধব প্ল্যাটফর্মে নেমে ডাবের কাঁদি দেখে লোভে পড়ে কিনে ফেলল দুটি। বেশ মিষ্টি জল। ডাব খেতে খেতেই জেনে নিয়েছে নন্দিনী সবুজদ্বীপের টোটো কোথায় মিলবে, কত ভাড়া।
সুবল হালদারের ডিঙিনৌকায় উঠে নন্দিনী প্রায় কিশোরীর মতো আচরণ শুরু করে। জলের ভেতর হাত দিয়ে জলে শব্দ তোলে। নীলমাধবের কোলে শুয়ে ভর দুপুরে নিজের প্রিয় গানটা গুনগুন করে, ‘নিশি রাত বাঁকা চাঁদ আকাশে।’ কবে যেন একবার নীলমাধব নন্দিনীর রূপের প্রশংসা করতে গিয়ে বাঁকা চাঁদ বলেছিল তাকে। সেই থেকে সুযোগ পেলেই নন্দিনী গীতা দত্তকে নকল করে দু’কলি শুনিয়ে দেয়।
বেহুলা নদীর বয়স্ক মাঝি এসব দেখতে অভ্যস্ত। সে গা করে না। শহরের মানুষজনের আদেখলাপনা সে জানে। বদলে সে গল্প করে এমন ভাবে যেন নীলমাধবদের ওই শারীরিক খুনসুটি কিছুই নয়। মাঝি জানে বাবু খুশি হলে ফেরার সময় ভাড়া ১০০-র জায়গায় ১৫০ করতে ভাববে না।
বেহুলা নদীর বাঁক ঘুরতেই চওড়া জলরাশির গঙ্গা। মাঝি জানায় উলটোদিকে নবদ্বীপ। নীলমাধবের চোখে পড়ে খানিকটা দূরে জলের উপর মাথা তুলে দাঁড়িয়ে রয়েছে বনরাজি। এই তবে দ্বীপ। সবুজদ্বীপ।
অর্জুন গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে নদী দেখছিল নীলমাধব। নন্দিনী হঠাৎ পিঠ জাপটে ধরে ইশারা করল। শুকনো ঘাসের ঝোপের পাশে খসখস শব্দ। একটু ভয় পায় নীলমাধব। তবে কি সাপ! নন্দিনীর চোখ অনুসরণ করে নীলমাধব দেখল এক জোড়া ছেলে-মেয়ে শরীরী প্রেম করছে। ছেলেটা মেয়েটার ব্লাউজ খুলে ফেলেছে। স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে মেয়েটার ধবধবে বুক। নীলমাধব নন্দিনীর বাহু ধরে টেনে নিয়ে আসে। এখানে থাকা ঠিক হবে না। নন্দিনী ওই দৃশ্যে উত্তেজিত। সে একটু সরে এসে নীলমাধবের ঠোঁট কামড়ে রক্ত বের করে দিয়েছিল। সে চাইছিল ওই ছেলে-মেয়েটির মতো বন্যতা।
‘এই যে মশাই, মেয়ে নিয়ে এসে বেশ ফুর্তি-ফার্তা করছেন। কিছু মালকড়ি ছাড়ুন তো, আমরাও একটু মস্তি করি।’যেন মাটি ফুঁড়ে বেরিয়ে এল তিন-চারটে ছেলে। নীলমাধব ভয় পেয়ে গেছে। তার মুখ থেকে কথা সরছে না। সে ভাবছে এইসব মাস্তানেরা মেরে ধরে সব কেড়েকুড়ে নিয়ে, তারপর হয়তো আরও ঘন বনের মধ্যে নন্দিনীকে টেনে নিয়ে গিয়ে গ্যাং রেপ করে দেবে।
নন্দিনী হঠাৎ কোমরে শাড়ি জড়িয়ে রানি লক্ষ্মীবাই হয়ে যায়। সে গলা সপ্তমে তুলে একেবারে বস্তির মেয়ের মতো অভিনয় করে দেয়। ‘আমি ওকে চুমু খেয়েছি, তোর বাপের কীরে? তুই যখন ওইদিকে ঝোপের আড়ালে একটা মেয়েকে ন্যাংটো করে মাটিতে ফেলে ঠাসছিলি, তখন আমি বলতে গেছি?’
চ্যাঁচাতে চ্যাঁচাতে সে খপ করে ছেলেটির হাতের কবজি ধরে খানিকটা টেনে নিয়ে যায়। ‘চল, গার্ডের কাছে। গিয়ে বল, ওই মেয়েটা তোর বউ কিনা! আর যদি বউ হয়, দিনে-দুপুরে লোকজনের মাঝে চিত করেছিলি কেন!’
ছেলেটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়। অন্য ছেলেগুলোও কেমন অবাক চোখ করে তাদের পান্ডাকে রেখেই গুটিগুটি কেটে পড়ে। নন্দিনী ছেলেটার কবজি কিছুতেই ছাড়ে না।
‘না না, তেমন কিছু করিনি।’ ছেলেটা তোতলাতে থাকে।
নীলমাধবই ছাড়াতে চায়, ‘দাও ছেড়ে দাও।’
‘অমনি অমনি ছাড়ব, পুলিশের হাতে দেব না! বেড়ানোর জায়গা কি দুষ্কৃতীদের স্বর্গ হবে, শুধোতে হবে না গেটের পুলিশ ভাইকে?’
ছেলেটা এবার পরিত্রাহি মুখ খোলে, ‘না না, এবার ছেড়ে দিন, আর কোনওদিন হবে না এরকম।’
তিন
কিছুতেই ছাড়তে চাইছে না। নীলমাধবের পাশের সেই পৃথুলা মেয়েটির স্বর কাঁদো কাঁদো। সে বলছে, ‘না, নেই তো, আমার কাছে কোনও টাকা নেই।’
‘টাকা না নিয়ে এসেছ কেন? সামান্য ১০০০ টাকা থাকে না ব্যাগে!’ কোম্পানির সুন্দরী মেয়েটির ডাকাতে মুর্তি। তার কলেই অনেকে এসেছে এখানে। চাকরি পাবার শর্ত হিসেবে একটা পরীক্ষায় বসতে হবে। ফিজ ১০০০ টাকা। নিজের নিজের কনসালটেন্সির সময় এই টাকা নিয়ে নেওয়া হচ্ছে।’
সেই সুন্দরী আবার দাঁত-মুখ খিঁচোয়, ‘ব্যাগে এটিএম কার্ড নেই? যাও আমাদের লোক দিচ্ছি সঙ্গে, টাকা তুলে নিয়ে এসো।’
ভিড়ের চাপে নীলমাধব দরজার কাছেই এসে পড়েছিল। সে কাউন্সিলিং-এর ডাক আসার আগেই কাউকে না বলে সটকে পড়ে। সিঁড়ি দিয়ে নেমে ব্রড স্ট্রিটে পা রেখে হাঁফ ছাড়ে। চাকরি না-পাবার বিষণ্ণতায় গ্রাস হতে দেয় না ওই ১০০০ টাকা বাঁচিয়ে ফেলার আনন্দ। সন্ধেবেলায় গড়িয়াহাটে চায়ের দোকানে বসার আগে ভেবে নিল, নতুন কাজ জুটিয়ে ফেলার আগে শ্যালকের কাছে না হয় ঢুঁ মেরে আসবে খন। তাতে বউকেও খুশি করা যাবে আর যদি হিল্লে একটা হয়েই যায়। তবে হ্যাঁ, হাজার টাকার উপরে সে উঠবে না। শ্যালককে হাজার টাকাই দেবে।
হাজারেই হল। কিন্তু অত সকালে যেতে হবে! পারবে কি নীলমাধব! নীলমাধব নিজের মনে ভাবে কী এমন কাজ! সকালে পুরসভার গাড়ি নিয়ে অনেকেই বাঁশি বাজিয়ে ময়লা নিয়ে চলে যায়। ওই নোংরা কাজ করতে হবে না তো!
স্বস্তি পেয়েছে নীলমাধব। না নোংরা ফেলার কাজ নয়। মাছের সার ছড়ানোর কাজ। জায়গা পালটে পালটে যেতে হয়। বাসন্তীর কাজ শেষ করে, হেড়োভাঙায় করেছে, সাতজালিয়ায় করেছে। এমাসের দশ দিন গোসাবায় কাজ।
একটা জলঢোঁড়া খপ করে একটা মোটা চিংড়িকে বাগে নিয়ে নিল। অন্ধকার আর আবছা আলোর মিশেলে চোখে পড়েছে ঠিক। নীলমাধব দু-পা পিছিয়ে আসে। পঞ্চনাগ মনসাকে স্মরণ করে। আকাশের কোণটা লাল লাল লাগছে। ব্যাগের ভেতর এখনও অনেকটা মাছের খাবার। এত বড়ো বড়ো পুকুর যে এক পাক খেতেই ঘণ্টাখানেক সময় লেগে যায়। ঘুঘু চেপে, মানে ডিঙিনৌকোয় করে জলের মাঝখানে খানিক ছড়াতে হয়। কিন্তু জলে শব্দ তোলা বারণ, তাই বেশিটাই পাড় ধরে। সুশান্তদা পইপই করে বলেছে, জলের কোনও কোণ যেন ফাঁকা না থাকে। ছেলেবেলায় স্কুল-স্পোর্টসে যেমন চুনের দাগ টানতে হতো সমান করে, তেমনি। নীলমাধব হাত আর পা দুটোতেই গতি আনতে চায়।
হু হু করে টাকা আসছে। কিন্তু কাঁচা টাকা পেয়ে নীলমাধবের মাথা ঘুরে যায়নি। কাজ করতে করতে তার মনে প্রশ্ন জেগেছে। সে প্রশ্ন সুশান্তদাকে করবে, সে সাহস নেই তার। তবে ছক্বাকে অনেকবার শুধিয়েছে, ‘হ্যারা ভাইডি, এই যে আমরা মাছের চাষে সাহায্য করি, মানে জলায় জলায় মাছের সার দিই ভূতির মতো রাত থাকতি, তা দিনির বেলা দিলি কী ক্ষেতি?’ কলকাতায় থাকতে থাকতে দক্ষিণের ভাষা চলে গিয়েছিল। এই মাস তিনেক এদের সঙ্গে থেকে তা আবার ফিরে এসেছে। খুবই মিষ্টি, আর প্রাণের ভাষা।
ছক্বা বাইকের ধোঁয়া সুর্যের লাল-পানা মুখটার উপর ছড়িয়ে যেতে দিয়ে বলল, ‘তা অতো কতা আমি জানি! তবে শুনিছি সারারাত ঘুমনোর পর পোভাত কালে মাছের দেবতাদের খুব খিদে পায়, ত্যাকোন খাতি পালি তারা ধাই ধাই করে লম্বা হতি পারে।’
বাইকের পেছনে বসে বিড়ি ধরিয়ে ছক্বার মুখে গুঁজে দিতে দিতে নীলমাধব ভাবে, হ্যাঁ সে-ও তো শুনেছে বাগদা মাছের মীনগুলো অ্যান্টিবাওটিক পেলে ধা করে বড়ো হয়ে যায়। বালিগঞ্জের স্টেশন বাজারে দেখেছে বেশ বড়ো বড়ো চিংড়ি। দাম-ও তেমন নয়, ৩০০/৩৫০। সাধ্যের মধ্যে।
এপ্রিল মাস। মাঠ-ঘাঠ শুকিয়ে যাচ্ছে রোজ। সুশান্তদা, ইসমাইল ভাই গত সপ্তাহে বাজারের ক্লাব ঘরে ডেকেছিল নীলমাধবকে। শ্যালক-ও ছিল সেখানে। সে-ই ডেকে নিয়ে গেছে। বলেছে, দাদা নাকি নীলমাধবের কাজে খুব খুশি। এবার টাকা-পয়সা বাড়ায়ে দেবানে।
‘আর কত বাড়াবে!’ মুখ থেকে বেরিয়ে গেছল কথা। নিজের মুখে হাত চাপা দিয়ে নীলমাধব কথার বদলে জব্বর করে একটা হাই তোলে। শ্যালকের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। সে জানে, যে কথা পেড়েছে সে-ই পুরোটা কবে আনে, না ক’লি তার শান্তি নাই।।
বড়ো শ্যালক বলল, ‘নীলু, এতদিন মাছের কাজ করিছ, এবার চাষের কাজ। প্রাণ-মন দিয়ে করতি হবে। আর আরও একটু রাত থাকতি টেমি জ্বালায়ে কাজ শেষ করতি হবে। ভেড়ির বাঁধ কাটেকুটে চাষের মাঠে জল ঢোকাতি হবে রাতারাতি, যাতে দিনেরবেলায় ট্রাক্টর চালায়ে ভেজা মাটি উল্টি দেয়া যায়।’
খাটনি একটু বেশি হচ্ছে বটে, কিন্তু নীলমাধব প্রতিদিনই তিনটি হাজার টাকা নিয়ে বাড়ি ফিরছে সকাল ১০টার মধ্যে। তারপর দুপুরে খেয়ে দেয়ে জম্পেস করে ঘুম। রাতের শেষ ট্রেনে ক্যানিং। সেখানে খানিকটা সময় ক্লাব ঘরে চা আর বিড়ি-টিড়ি খেয়ে বিশ্রাম নিয়ে বেরিয়ে পড়া ছক্বার বাইকে। কোন কোন বাঁধ কাটতে হবে তার লিস্ট থাকে ছক্বার কাছে।
আজ বেশি কষ্ট হয়নি। এই বাঁধের উপর দিয়ে লোক চলাফেরা করে না বলে মাটি নরম। তাড়াতাড়ি কেটে দেয়া গেছে। জল হুড়মুড় করে ঢুকছে জমিতে। নীলমাধব সেই জলের তোড়ে কোদালে লাগা মাটি ধুয়ে নেয়। নিজের হাত-পা ধুয়ে নেয়। এসময় ভেড়ির উলটো দিকে কয়েকটা আলোর ফুটকির নড়া-চড়া দেখে অবাক হয়। ছক্বা ছুটে এসে বলে, ‘নীলুদা, এক মুহূর্ত দেরি কোরো না। ওই দ্যাখো আলোগুলো ছুটি আসতিছে এদিকপানে।’
এক হ্যাঁচকা টান দেয় ছক্বা। ‘ওঠো, ওঠোদিনি, বাইকের পেছনে ওঠো।’
ছুটন্ত আলোগুলোর সাথে এবার পায়ের শব্দও কাছাকাছি। ছক্বা বাইকে ঝড় তুলে দেয়। সে ক্যানিং স্টেশনে যায় না। গলি-ঘুজি রাস্তা দিয়ে একেবারে বাইপাসে। হাফ-প্যান্ট, গেঞ্জি পরে আর কোদাল-সাবল হাতে নীলমাধবের মাথা ফাঁকা হয়ে গেছে। বাইকের আয়নার দিকে তাকিয়ে হঠাৎ ছক্বা বলে, কুদাল আর সাফল ফেলি দাও ওই ডোবার ভেতরে নীলুদা। সামনে একটা চায়ের দোকানে দাঁড়াতিছি, সেখানে চা-খেতি খেতি তুমি ব্যাগ থেকে জামাপ্যান্ট বের করি পরি নাও। না হলে যমের কাছ থেকে ছাড়া পেয়ে, যমের অরুচির হাতে, মানে পুলিশের হাতে গিয়ে পড়বানে।’
নীলমাধব কিচ্ছুটি বুঝে ওঠেনি। ঘটনার ল্যাজা-মুড়ো সে কিচ্ছুটি জানে না। নীলমাধবের চোখ জোড়া প্রশ্ন অনেক আগেই পড়তে পেরেছে ছক্বা। সে চায়ের গেলাসে চুমুক দিয়ে একটা বিড়ি ধরাল। এই বয়স্ক মানুষটাকে কেন যেন বিপদের ভেতর ছেড়ে দিতে ইচ্ছে করছে না। নিজের বিপদটা আজ চোখের উপরে নেমে আসতে দেখেছে। দু’জন মেয়েছেলেকে বাঁধের উপরে অত ভোরে ঘোরাঘুরি করতে দেখে সন্দেহ আগেই হয়েছিল। তবে প্রথমে ভেবেছিল অন্ধকারে মেয়েছেলেরা মাঠকাজ সারতে এসেছে। কিন্তু খানিক বাদেই ওদের শঙ্খ বাজানো আর দূরে আলোর ফুটকিগুলোর নড়াচড়া ছক্বাকে বিপদের গন্ধ টের পাইয়ে দিয়েছে। প্রায় ধরে ফেলেছিল আর কি! আর ধরা পড়লে এতক্ষণে গণপিটুনিতে কী যে হতো, ভাবলেও শিউরে উঠছে। গতবছরে মেহতাব-এর তালগোল পাকানো লাশ পড়ে থাকতে দেখেছিল বাসন্তী বাজারে। মেহতাব-এর নামে পুলিশও কাঁপত, তার লাশ।
‘ভাইডি, কোনও পব্লেম আছে?’
নীলমাধব ছক্বার পাশে বসে তার বন্ধ চোখের দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে শুধোয়। ভোরের মিঠে হাওয়ায় বিড়ির তীব্র গন্ধ প্রকট হয়ে উঠেছে।
‘নীলুদা, তোমার মতো গেঁয়োলোক আমি দেকিনি। তুমি ক্যানো বুজতি চাওনা বহুৎ বেইমানির কাজ এডা।’
‘কেন কেন! এই যে সুশান্ত-দা কলো, এডা হলো গে সমাজসেবার কাজ। সুন্দরবনের ডেভলপমেন্ট নিয়ে এই এনজিও কাজ করতিছে। দেশ-বিদেশ থেকে নাকি ট্যাকা আসে!’
‘মিছে কতা। সাধারণ মানষির পেটে লাথি মারি সুশান্তদার মতো কয়ডা মানষির উন্নতি হতিছে এহানে।’
‘কিন্তু, এই যে আমারে এত ট্যাকা দিতিছে, তা পাতিছে কোত্থেকে!’ নীলমাধব কিছুতেই অবিশ্বেস করতে চায় না।
‘তোমারে দিতিছে, আমারে দিতিছে, আরো কয়েকজনকে। যেখানে যেখানে প্রণামি দিলি নিঃশব্দে রাতের অন্ধকারে সবকিছু হতি পারে, সেখানে দিতিছে। সব দিয়ে থুয়েও ওদের হাতে বিস্তর ট্যাকা। এত ট্যাকা যে একটা নতুন দ্বীপ কিনতি পারবে, সেখানে শহর গড়তি পারবে।’
নীলমাধবের শরীরে কাঁপুনি এসেছে, সে ছক্বার হাতটা ধরে কাঁপুনি থামাতে চায়। মনের ভেতরের অপাপভূমি থেকে সমর্থনের ইশারা পেতে চায়। ‘কিন্তু ছ্যামড়া, আমি তো কোনও অন্যায় কাজ করি নাই, আমি গায়ে খেটে ট্যাকা নিছি, হারামের কিছুডি নিই নাই। নিজের গতর নিংড়ে মাছের গতর গড়ছি।’
মুখে হাত চাপা দিয়ে হাসল ছক্বা। লোকজনের নজরে পড়তে চায় না। সে ফিসফিস করে, ‘ছাই! তোমার ওষুধে মাছ বাড়ত না, মরত।’
তা কেন, আমি তো আমাদের রেলবাজারে গিয়ে শুনছি, মাছের ফলন বাড়িছে, তা-ই দাম কম মাছের। আমার তো বেশ ভালো লাগত। সাধারণ মানুষ এই যে কম দামে মাছ পাতিছে, সিকেনে আমার ভূমিকা আছে।’
‘আছেই তো।’ছক্বার গলার স্বর কেমন ধাতব। সে হিসহিসায়, ‘বাসন্তীতে এত বেকার পোলাপান থাকতি তোমারে ক্যান কাজে নিল, তা কি একবারও ভাবিছ!’
নীলমাধব কাঁচুমাচু মুখে কথা ফেলে, ‘হাদুই শোন দিন, তা তো কই ভাবি নাই। ভাবছি শউড়ের পো কয়েছে তাই শান্তনুদা কাজটা দেছে।’
হ্যাঁ, শান্তনুদা তোমার মতো একটা সাদাসিদে লোক খুঁজতিছিল, যে বেশি খপর রাহে না। এলাকার বাইরের লোক হলি সুবিধা। পাঁচকান হবার ভয় নাই।’
‘ক্যান, কীসের ভয়?’ নীলমাধবের অবাক গলা।
ছক্বা নীলমাধবের কাছে আরো ঝুঁকে আসে। হ্যাঁ, সবটা জানিয়ে দেওয়া ঠিক হবে। মাস খানেক ধরেই তার মনে হচ্ছিল, বড়ো বিপদ আসতে চলেছে। আসলাম সানিকে অত লোকের মাঝে অপমান করেছিল শান্তনুদা। সেটা ঠিক হয়নি। গত সাত-আট বছর একসাথে রাজনীতি করে শান্তনুদার ঘাঁত-ঘোঁত সব জানে আসলাম। বাসন্তী, গোসাবা, কুলতলির প্রায় ৪৫ শতাংশ মানুষ মুসলিম। সন্দেশখালির দিকে এক একটা গাঁ তো পুরোটাই। আসলাম এই সব জায়গার ভোট জড়ো করত নানা কৌশলে। সে কি সহজে হজম করবে! গত সপ্তাহে শান্তনুদার এক স্যাঙাত উদয় মণ্ডলকে সোনারপুরে কুপিয়েছে আসলামের ছেলেরা। মাটি-কাটা নিয়ে বিবাদ। ছক্বা এতদিন এদের সাথে থেকে দেখেছে, পায়ে পা দিয়ে ঝগড়া বাধিয়ে শত্রু নিকেশ করত শান্তনু-আসলাম জুটি। এখন আসলাম বুড়ো আঙুল চুষবে!
ছক্বা বলল, ‘নীলুদা, তুমি জালায় মাছের সার দিতে না, বিষ দিতে।’
‘অ্যাঁ কী কতিছিস ছ্যমড়া! আমি তো নিজের চোখে দেখিছি, মাছেরা ডাঙার কাছে এসে মুখ চিবোয়।’
‘ঠিক দেখিছ নীলুদা। তবে মাছে যে খাচ্ছে, তা ঠিক না। তোমার ছড়ানো সারে এমন অল্প করে বিষ থাকত, যে মাছ জলের ভেতর থাকতি না পেরে ছটফট করতি করতি ডাঙার কাছ ঘেঁষে সব মুখ বাড়ায়, আঁকুপাঁকু করে নিশ্বাস নেয়। মরে না। ঝুড়ি ঝুড়ি মাছ। কুইন্টল কুইন্টল মাছ। একসঙ্গে এত মাছ কিনবে কে! ভেড়ির মালিক জলের দরে তুলে দেয় নন্দীবাবু, দাসবাবু, ইমতিয়াজদের হাতে। এরা সবাই উঁচু উঁচু মান্যি জনের লোক। কাঁটায় যে দাম এরা হাঁকে, সেই দামেই ছাড়ি দিতি হয়। লাভের ট্যাকার মোটা অংশ শান্তনুদার ঘরে ঢোকে।’
নীলমাধব কথা হারিয়ে ফেলেছে। সে ছক্বার কবজি শক্ত করে ধরে আছে। সে তোতলায়, ‘কি কিন্তু আজ তো মাছে বিষ দিতি যাই নাই, সিকেনে আজ অত মানষি তাড়া করল, ক্যান?’
‘আজ কী করছিলে বলো?’
‘কেন, আজ তো কোনও দোষ করি নাই, মাঠে চাষের জন্য জল দিতিছিলাম।’
ছক্বার গলায় শ্লেষ, ‘কেন, তুমি কি সেচ দফতরের কর্মী নাকি, যে শ্যালো চালায়ে জল তুলে দেবা চাষিদের!’
ছক্বা থামে না, সে বলে চলে, ‘মাঠে কী জল ছাড়ছিলে?’
‘মীনের ভেড়ির জল।’
‘চিংড়ির মীন কোন জলে চাষ হয়? মিঠা জলে না নোনা জলে?’
‘নোনা জলে।’
‘ধান, পটল চাষের জন্যি কী জল লাগে?’
নীলমাধব মুখ চুন করে বলে ‘কেন, মিঠা জল।’
‘তালে বলো নীলুদা, তুমি ভেড়ির নোনা জল চাষের মাঠে ঢুকিয়ে চাষির কোন উপকারটা করলে!’
‘ভাইডি, আমারে যে কলো, রুখা জমি চাষের জন্যি বানাতি হবে। ভোর ভোর জল ঢুকালে চাষের সুবিধা। জমি নরম হবেনে। রোদ ওঠার আগে চাষ দিতি পারবে চাষি।’
‘তুমি বড্ড কাঁচা লোক গো নীলুদা। কিচ্ছু খপর রাখো না। এখন শহরের লাগোয়া আর জমিন নাই যে ঘরবাড়ি আর ফ্ল্যাট বানান যায়। সক্বলেই তাই জলা জমি, চাষের জমির দিকে হাত বাড়ায়ে আচে।’
নীলমাধবের গলা শুকিয়ে এসেছে। তাহলে সে এতদিন একটাও ভালো কাজ করেনি! নীলমাধবের পায়ের তলা থেকে ঝুরঝুর করে মাটি সরে সমুদ্রের নোনা জলের দিকে চলে যাচ্ছে। তার বুকে এখন হাউ হাউ করছে কান্না। কান্না চেপে সে অস্ফুট আওয়াজ বের করল, ‘কিন্তু চাষের জমিনে ভেড়ির নোনা জল ঢুকায়ে প্রামোটারের কী লাভ?’
‘আছে নীলুদা। সব সময় লাভ চোখের উপর দেখতি পাবা না। একটু তলায় থেকে সময় হলেই সে ভুস করে মাথা তোলে।’ চায়ের গেলাসে শেষ লম্বা চুমুক দিয়ে আবার বিড়িতে টান দেয় ছক্বা। তারপর বিড়ির টুকরোর উপর সব রাগ ঝেড়ে মাটিতে আছাড় মেরে থক করে একগাদা থুতু ফেলে।
‘ফ্ল্যাট বাড়ি বানানো দেহিছ নীলুদা? ফাঁকা জমিতে মাটি কেটে ইট-বালি-সিমেন্ট সব মাটির ভেতর সেঁধোয়। পেত্থমে মনে হয় রাশি রাশি ট্যাকা মাটির বুকি ঢুকি যাতিছে। কিন্তু খানিক বাদে দেখবানে লকলক করি ধানের চারার মতো মাথা তুলি দাঁড়াতিছে এক একটা ফ্লোর, মানে লাখে লাখে ট্যাকা। তেম্বায়, ঠিক তেম্বায় শান্তনুদা চাষের জমিতে নোনা জল ঢুকোয়ে চাষিরে বাধ্য করে ভেড়ি বানাতে। জমিতে নোনা লেগে গেলে আর যে ফসল হবে না গো।’
ছক্বা কথা থামায়। সে দেখে নীলমাধব ঝরঝর করে কাঁদছে। ‘কী হল, কাঁদতিছ ক্যান?’
‘ভাইডি, তালে তো আমি কত লোকের ক্ষেতি করে দিলাম, না! কত চাষির কপাল খালাম, হায় হায় রে।’
ছক্বা ধমকাল, ‘কী ন্যাকামিটা করতিছ! এখানে লোকজন জড়ো করি সব জানায়ে দেবা বুঝি! হাড়গোড় একখানাও আস্ত থাকবেআনে ভাবিছ? চুপটি করে বাইকের পেছনে ওঠোদিন। তোমারে আজ বাড়িতে ছেড়ে দে আসতিছি। কেলো ফোনে খপর দেছে শ’দুয়েক লোক শান্তনুদার বাড়ি ঘিরে ফেলিছে। কী হয় কে জানে! আমারে তো কলো, ডুব মারতি।’
খুবই বিধবস্ত দেখাচ্ছে বাসন্তীর রুস্তম ছক্বাকে। সে সুশান্তদার নানা কারবারে জড়িত। নিজে কিছুই করে না, কিন্তু বাইকবাহনে চেপে নজরদারি করে। ভালো চেহারা। চোখে কালো চশমা, কানে দুল। গ্রামের গরিব মানুষেরা সমীহ করে। একটু থাকা, একটু কড়া চোখে তাকানো, তাতেই অনেকটা কাজ হয়ে যায়। সুশান্তদা বদলে মাস গেলে ৩০ হাজার দেয়।
এখন ছক্বার মনে হচ্ছে, দাদার গোলামিটা না করে, মানে জমি দখল করা, অন্যদলের মানুষের ইটভাটা বন্ধ করে দেওয়া, বাজার থেকে তোলা আদায় করা, মাটি বিক্রি করা –মানে হাজার একটা সুশান্তদার বেআইনি কাজে নিজেকে না জড়িয়ে, যদি এরকম একটা চায়ের দোকানও করত, শান্তিতে দু-মুঠো ভাত খেতে পারত। এতক্ষণে হয়তো গণ ধোলাইতে সুশান্তদা-র নাড়িভুড়ি বেরিয়ে গেছে। এখন পুলিশে গুঁতোলেও গুঁতোবে, নয়তো ওই আসলামের লোকজন মেরে পেট চিরে মাতলায় ভাসিয়ে দেবে। মরণ তার বাঁধা।
ভাবতে ভাবতে বাইকে স্টার্ট দেয় ছক্বা। বাইকের পেছনে বসা এক নিতান্ত ভালোমানুষকে মৃত্যুর হাত থেকে ছিনিয়ে আনা তার এ জীবনের একমাত্র ভালো কাজ। রুবির মোড়ে এসে ছক্বার হঠাৎ মনে হল, নীলমাধবদার বাড়িতে তো কিছুদিন সে লুকিয়ে থাকতে পারে। সেসময় ছক্বার মুখের উপর ভোরের সূর্য এসে বসেছে। তক্ষুনি বাইকের পেছনে বসা ভেঙে-চুরে যাওয়া নীলমাধবের চোখে পড়ল বড়োই ফ্যাকাশে এক বাঁকা চাঁদ পশ্চিমের আকাশে শুয়ে আছে। আর ছুটন্ত বাইকের পেছনে সোঁ সোঁ হাওয়ার ভেতর তার কানে এসে যেন বাজল নন্দিনীর গলা, ‘নিশি রাত বাঁকা চাঁদ আকাশে।’