চুলের ব্যাবসা করবি?

প্রশ্ন শুনে বেটাকে আচ্ছা করে গাল পাড়ল তারাপদ। শ’কার, ব’কার, খ’কার, কিছুই বাদ গেল না।  হয়তো মেরেই দিত। চুলের আবার ব্যাবসা কী?  মশকরা করার জায়গা পায় না? আর পঙ্গু মানুষকে নিয়ে কেউ মশকরা করে? নেহাত পুরোনো বন্ধু তাই বেশি কিছু বলল না। বিড়ি ধরিয়ে রাস্তায় মন দিল।

বাসন্তী হাইওয়ে পিচঢালা, মসৃণ। পাশেই খাল। অবজ্ঞা, অবহেলা সয়েও একনিষ্ঠ। নিঃশব্দে বহন করে চলেছে কলকাতার নিকাশি। ওপারে ধাপা। আবর্জনার পাহাড়ে যেন বাঁকুড়া, পুরুলিয়া। সায়েন্সসিটি ব্রিজের নীচে পুবমুখী রাস্তাটাই বাসন্তী হাইওয়ে। সোজা চলে গিয়েছে বাসন্তী। সেখান থেকে মাতলা পেরিয়ে গোসাবা হয়ে সুন্দরবন, অথবা রাজারহাট-বসিরহাট-বনগাঁ হয়ে বাংলাদেশ। মাঝে বানতলা, বামনঘাটা, ভোজেরহাট, ঘটকপুকুর, ভাঙ্গড়, মালঞ্চ। রাজনৈতিক মানচিত্রে জায়গা করে নিয়েছে নিজগুণে। মারামারি, খুনোখুনি লেগেই আছে। অঞ্চলের বেশিরভাগটাই ভেড়ি। মিষ্টিতে যেমন পিঁপড়ে, মাছের ভেড়িতে তেমনি ক্রিমিনাল।

দুপুর সময়টা বড়োই গ্যাঁড়াকলের। নিষ্কর্মা মানুষকে উদোম করে দেয়। সকালটা কাটিয়ে দেওয়া যায় প্রাতঃকৃত্য, চুল-দাড়ি কাটা, স্নান, চায়ের দোকান, এটা-সেটা করে। খবরের কাগজ তো ত্রাতা মধুসূদন। ‘অনেক কাজ পড়ে আছে’ বা ‘যেতে হবে বহু দূর’ও মানানসই। কে আর সত্যান্বেষণ করছে! আঁধার তো খুবই সুবিধের। দিব্যি লোকচক্ষুর আড়াল হওয়া যায়। যা হোক দুটি পেটে ফেলে শুয়ে পড়লেই হল। ঘুম আসুক না আসুক, সুখনিদ্রার ভানে অসুবিধে নেই। ঘুম অবশ্য দুপুরেও দেওয়া যায়। তবে লাভ নেই। কর্মব্যস্ত ধরণীতে দ্বিপ্রাহরিক নিদ্রা একান্তই দৃষ্টিকটু। নিষ্কর্মার শ্রেষ্ঠ উদাহরণ। তা ছাড়া অত ঘুমও কি মানুষের আসে? কাঁহাতক ভালো লাগে মটকা মেরে শুয়ে থাকতে?

রোজ দুপুরে বানতলা বাজারে এসে বসতেই হয় তারাপদকে। গাছতলা, পুকুরপাড়, ভাঙা মন্দির, কোনওটাই তেমন জুতসই নয়। যেন আরও উদোম হওয়া। তার চেয়ে রাস্তার ধারই ভালো। গাড়িঘোড়া, মানুষজনের মাঝে দিব্যি মিশে থাকা যায়। চোখে লাগে না অতটা। ভরদুপুরে মানুষজন সামান্যই। গাড়িই ভরসা। গুনতি করে সময় মন্দ কাটে না। তবে মুশকিলও আছে। বেকার মানুষ পেলেই লোকের উপদেশ দেবার বাসনা উশখুশ করে। সেই কারণেই বটকেষ্টর, ‘চুলের ব্যাবসা করবি?’

কলকাতার এত কাছে, তবুও জীবন যেন এখানে থমকে আছে। হাইওয়ের উপর বিশাল চর্মনগরী, ছোটোখাটো কারখানা বা দু’একটা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল থাকলেও, গ্রামের ভিতরে প্রায় উলটো চিত্র। বিদ্যুৎ থাকলেও সব রাস্তা পাকা নয়! সর্বসাধারণের স্কুল মাধ্যমিক পর্যন্ত। কাছের হাসপাতাল বলতে পার্কসার্কাসের চিত্তরঞ্জন। মানুষের রোজগার মূলত ভেড়ি থেকে। এখনও হাট বসে। রাস্তার দু’ধারে সার দেওয়া ‘কাঁটা, ওজন করার যন্ত্র। আশপাশের ভেড়ি থেকে মাছ এসে কাঁটায় ওঠে। শুরু হয় ‘অকশন। যার ডাক বেশি সেই দাবিদার। মিষ্টি জলের রুই, কাতলা, ট্যাংরা, ভেটকি, পাড়ি দেয় গড়িয়াহাট, লেকমার্কেট, যদুবাবু বা মানিকতলা বাজারে। হইচই, হল্লাগুল্লায় হাট সরগরম। ঝগড়াঝাঁটি লাগলেও, বাজারে মাছ পৌঁছোনোর তাড়ায় আমল পায় না। মাছের সঙ্গে তরিতরকারিও থাকে। কলকাতার বাবুরা চলে আসে টাটকা মাছ-সবজির সন্ধানে। সস্তাও হয়! শপিং মল বা ফুডমার্টের চেয়ে তো বটেই। শুধু একটু চিনতে আর দরদাম করতে হয়। তাছাড়া গাড়ি হাঁকিয়ে হাটে আসার অ্যাডভেঞ্চার তো আছেই। সাইট সিয়িং ফাউ।

সার দেওয়া কাঁটাগুলো বিশ্রামে! জেগে উঠবে সকালে। নির্ধারণ করবে লাভ-লোকশান। দীর্ঘশ্বাস ফেলল তারাপদ। আবার বিড়ি ধরাল। বিড়িও অন্যতম অবলম্বন। ‘কিছু একটা করছি’বা ,শেষ করেই যাব অন্যখানে। দু’টান মেরেই ফেলে দিল। মুখটা তিতকুটে। মনও। এই হাটেই একসময় কোথা দিয়ে যে সময় কেটে যেত টেরও পেত না। মানিকতলা বাজারের বিধু সাহার মাছ সওদা করত। অগাধ আস্থা ছিল বিধুর। মাছ চেনার ব্যাপারে তারাপদরও জুড়ি ছিল না। কোন কাঁটায় কারচুপি আছে সেও ছিল নখদর্পণে। ফলে সেরা দামের সঠিক ওজনের মাছ চালান যেত বিধুর আড়তে। বিধুও গুণীর কদর করত। মাস গেলে প্রাপ্য মেটাতে কসুর করত না।

বিধু কদর করলেও, ভেড়িওয়ালারা তারাপদর গুণপনায় অতিষ্ঠ। বিধুর মতো বড়ো খরিদ্দারের কাছে মাছ গছাতে পারলে একসঙ্গে অনেকটা মাছেরই হিল্লে হয়। কিন্তু তারাপদর জ্বালায় সে উপায় নেই। সেরা মাছ ছাড়া তুলবে না। ওজনেও একচুল এদিক-ওদিক করবার জো নেই। ভগবানও বোধহয় ব্যাপারীদের সহায়। একসময় দুটো পা’ই অসাড় হতে লাগল তারাপদর। ডাক্তারবাবুরাও ধরতে পারল না অসুখটা। হেকিমি, কবিরাজিতেও লাভ হল না। ধীরে ধীরে দ্বিপদ থেকে চতুস্পদ বনে গেল তারাপদ।

কোনও যুক্তি না পেলে সহজতম গ্রাম্য সমাধান, ‘কেউ কিছু খাইয়ে দিয়েছে’ অথবা ‘বাণ মেরেছে’। এক্ষেত্রেও অন্যথা হল না। তবে কারওরই ‘কেউ’ বা ‘কিছু’ সম্বন্ধে সম্যক ধারণা নেই। বাণ জিনিসটাও ভজকট। তন্ত্রের সঙ্গে সম্বন্ধ থাকলেও, কেউই চাক্ষুষ করেনি কখনও। তাই পরিবার ভেড়িওয়ালাদের দিকে আঙুল তুললেও, প্রমাণ করতে পারল না কিছুই। বিধু অবশ্য বিকল্প ব্যবস্থা করেছিল। সহকারী রেখে তারাপদ তদারকি করবে। করলও কিছুদিন। তারপরে আস্তে আস্তে ভাটা পড়ল। কাঁহাতক আর ভালো লাগে অন্যের বোঝা হতে? তা ছাড়া গুরুত্বও কমছিল। সবার চোখেই দয়া, করুণা, অনুকম্পা। একদিন যেখানে দাপিয়ে বেড়িয়েছে, সেখানে এই দুর্দশা মেনে নিতে পারল না। লাইনই ছেড়ে দিল। তারপর কাঠ বেকার।

‘একবার ভেবে দেখলে পারতিস। লাইনটা খারাপ কিছু নয়। বসেই তো থাকিস…’

তেলেবেগুনে জ্বলে উঠল তারাপদ। শব্দ করে একদলা থুতু ছেটাল।

‘আমি বসে থাকি তো তোর বাপের কী রে? তুই কি খাওয়াস না পরাস?’, মনে মনে গজরাল। চৈত্রের গনগনে রোদে তর্ক জুড়তে ইচ্ছে হল না।

‘প্রথম প্রথম একটু অসুবিধে হবে। তারপর দেখবি সব ঠিক হয়ে গেছে। ইনকামও মন্দ নয়’, বটকেষ্ট নাছোড়বান্দা।

‘তা সে ইনকাম তুই কর না। আমার পেছনে পড়েছিস কেন?’, না বলে পারল না তারাপদ।

‘আমি তো চৌবাগা, ভিআইপি বাজার, পঞ্চান্নগ্রাম, এই এলাকাগুলো দেখছি। তুই এদিকটা দেখ না, বটকেষ্টর প্রস্তাব।

‘কেন রে শালা, আমি ছাড়া কি আর লোক নেই?’ পোঁদ ঘষটে আমাকেই গাঁয়ে গাঁয়ে ঘুরতে হবে?’, খিঁচিয়ে উঠল তারাপদ। হাঁটাচলা বলতে দু’হাতে ভর দিয়ে ঘষে ঘষে চলা। সব জেনেও বটা এইরকম প্রস্তাব দিচ্ছে? নাকি মজা করছে?

বটকেষ্ট পাকা ব্যাবসাদার। এ অঞ্চলে ব্যাবসা করা বিরাট ঝকমারি। লাইন দিয়ে টাকা নেবার লোক দাঁড়িয়ে। তোলা না দিয়ে এক পা-ও এগোনোর উপায় নেই। শালাগুলো কাজ-কম্ম কিছু করবে না, শুধু পরের ধনে পোদ্দারি মেরে মদ-মাংস খাবে। খাওয়া বেশি হলে পড়শির বউ-মেয়ের হাত ধরে টানবে। তবে তারাপদর কথা আলাদা। একে পঙ্গু তায় গ্রামের লোক। দয়া, করুণা, তাচ্ছিল্য যাই করুক না কেন, তোলা চাইবে না! ‘খোঁড়াটা আর কতই বা কামাবে’র যুক্তিতে ছাড়পত্র পাবে। এতসব না বলে হাসি মুখে বলল, ‘তুই আমার বন্ধু বলেই বলছি। তেমন হলে আমি নয় তোকে চাকা লাগানো গাড়ি বানিয়ে দিচ্ছি। ঠেলে ঠেলে ঘুরতে অসুবিধে হবে না।’

বিড়ি ধরাল তারাপদ। একটা হাতে চালানো সাইকেল গাড়ির জন্য কত তদবিরই না করেছে। নেতা থেকে এমএলএ পর্যন্ত। আশ্বাস ছাড়া জোটেনি কিছুই। অথচ ভোটটা কিন্তু ওই পার্টিকেই দিয়েছিল। কে জানে কেন, তালিকায় নাম আর উঠল না।।

তারাপদ চুপ করাতে বটকেষ্ট যেন ভরসা পেল। এদিককার গ্রামগুলো ছড়ানো-ছেটানো। দু’চারটে ঘুরতেই দিন কাবার। পড়তায় পোষায় না। লোক রেখেও সুবিধে হয় না। সকলেরই নজর ঘন বসতিপূর্ণ এলাকা, যেখানে গৃহস্থের সঙ্গে বিউটি পার্লারও আছে। একলন্ধে চুল মেলে অনেকটা। তাই তারাপদ যদি রাজি হয়, তা হলে গাড়ি দিয়েও লাভ। পাশ ঘেঁসে বসে মোলায়েম স্বরে বলল, ‘নিজের কথা নয় নাই ভাবলি তোরা। সংসারের কথা তো একটু ভাবতে হয়। দু’পয়সা রোজগার করলে সংসারটার কি একটু সুরাহা হবে না?’

‘দু’পয়সা রোজগার করলে সংসারটার কি একটু সুরাহা হবে না?’ বটার এই কথাটাই টলিয়ে দিল তারাপদকে! সংসার বলতে বউ মালতী আর মেয়ে ঝুমুর। জমিজমা না থাকলেও বাড়িটা নিজের। একতলা। ইটের গাঁথনি, অ্যাসবেস্টসের চাল। প্লাস্টার বা রং করা হয়ে ওঠেনি। জমির প্রতি মোহ কোনওদিনই ছিল না তারাপদর। রক্ষণাবেক্ষণ ভয়ানক ঝামেলার। ব্যাংকে যাবারও প্রয়োজন বোধ করেনি কখনও। ঈশ্বর যখন বিশেষ ক্ষমতার অধিকারী করেছেন, তখন চিন্তা কী? এক বিধু গেলে অন্য বিধু আসতে সময় লাগবে না।

খাটা-খাটনিও তেমন কিছু নয় যে শরীর ভেঙে পড়বে। সকালে খানিক দৌড়ঝাঁপ, খিস্তি-খেউড়, হম্বিতম্বি, তারপরেই অখণ্ড বিশ্রাম। ম্যাটাডোরে মাল চাপিয়ে বোতল খুলে বসা। নিখরচায়। দায় ভেড়িওয়ালাদের। তোয়াজ, তোষামোদে গদগদ। উদ্দেশ্য সিদ্ধ হোক না হোক, শনি দেবতাকে তুষ্ট রাখতেই হয়। আমোদ-আাদে তোফা কাটছিল দিনগুলো। যেন রাজা-বাদশা!

গোল বাধল পায়ের অসুখটার পর। আচমকাই রুঢ় বাস্তবের মুখোমুখি। টাকার জোগান থাকলে অনেক কিছুই চোখে পড়ে না। যেমন পড়েনি মালতীকে। দিব্যি হাসিখুশি গৃহকর্মনিপুণা! ভালো-মন্দ রান্না করা, ঘর-দোর গুছিয়ে রাখা, আত্মীয়-কুটুম্বিতা দরাজ হাতে। চারিদিকে ধন্য ধন্য, ‘বউ বটে তারাপদর!’ তারাপদও কোনও ফাঁক পায়নি। শরীর, মন দুইয়েরই চাহিদা মিটেছে অগাধ। বেসামাল অবস্থায় যত্ন-আত্তি তো দেখার মতো! জামা-জুতো খুলে, গা-হাত-পা মুছিয়ে, মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে ঘুম পাড়াত। পরম তৃপ্তিতে মনে হতো, ‘যাক, শেষ বয়সটায় কষ্ট পেতে হবে না!’

বোঝা যায়নি। হয়তো যায়ও না। সবুজে ভরা বনভূমি দেখে কি মরুভূমির আঁচ পাওয়া যায়? নাকি টলটলে নদীতে চরের পূর্বাভাস থাকে? সুউচ্চ মিনার আচমকা ভূমিকম্পে ধূলিসাৎ হবে, তা কী ভাবা যায়? না গেলেও, গেল একসময়। অভাব তাণ্ডব শুরু করতেই মালতী যেন ধূধূ মরুভূমি, রুক্ষ চর। প্রত্যাশার মিনার গুঁড়িয়ে চুরমার। শুরুতে মন দিয়েই চিকিৎসা করাচ্ছিল। আশা ছিল সুদিনের। যখন বুঝতে পারল দুর্দিন নিশ্চিত, তখনই ধৈর্যের বাঁধ ভাঙল। প্রথমে ভাগ্যকে দোষারোপ, তারপর মানুষকে। তারাপদর মতো অবিবেচক মানুষ নাকি জীবনে দেখেনি। অথচ প্রতি রাত-সোহাগেই তারাপদর দিলদরিয়া স্বভাবের গুনগুনানি ছিল অনিবার্য। অনেক ভাগ্য করলে নাকি এমন স্বামী পাওয়া যায়।

বউয়ের তাগাদা, খ্যাচখ্যাচ, মুখঝামটায় ঠোঙা বানানোর কাজে হাত লাগাল তারাপদ। কিন্তু সারাদিন ঘরে বসে ঠোঙা বানানো পোষায়? কাজটাও ঘ্যানঘ্যানে, ম্যাদামারা টাইপের। মাছের কারবারের ছিটেফোঁটা উত্তেজনাও নেই। আর বানিয়েই বা লাভ কী? সব রোজগারই তো ঢুকবে সংসার ‘গভ্ভে’। এক ছিপি মালও বরাদ্দ হবে না নিজের জন্য। সবদিক বিবেচনা করে ঝিম মারল তারাপদ। হাজার মুখ ঝামটাতেও রা নেই। যেন বোবা, বধির।

ঠোঙা বানানো ছিল ফ্যামিলি বিজনেস। প্রথমে মেয়ে তারপর বাপ-মেয়েই ছিল প্রধান কারিগর। মালতী ঘরের কাজ সেরে হাত লাগাত। তারাপদ গুটিয়ে যাবার পর মসৃণ অ্যাসেম্বলি লাইনে ছেদ পড়ল। মা মেয়ের পক্ষে সামাল দেওয়া মুশকিল। মেয়ে হোলটাইমার হলেও মাকে ব্যস্ত থাকতে হয় ‘গুষ্টির গেলার জোগাড়ে’! আলুটা মুলোটা চেয়ে, গেঁড়ি-গুগলি জোগাড় করে তবে রান্না। মাঝেমধ্যে মরা মাছ জুটলেও, ভাতের বড়োই আকাল। উপায় না দেখে একসময় মালতী রান্নার কাজ নিল। আনন্দপুরের দিকটায় বড়ো-বড়ো ফ্ল্যাটবাড়ি। পয়সার কমতি নেই কারও! সেরকমই তিনটে বাড়িতে কাজ জোটাল। সাত সকালে বেরিয়ে মাঝ দুপুরে ফেরা। একবেলা খাওয়ার সঙ্গে হাজার পাঁচেক মাইনে। কোনওরকমে দিন গুজরান।

টাকার চেয়ে বড়ো জোর আর কিছুই নেই। এতএব ‘জোর যার মুলুক তার’ – এই যুক্তিতেই সংসারের রাশ মালতীর হাতে। তারাপদ যেন কীটাণুকীট, অপাংতেয়। নেহাত তাড়িয়ে দেওয়া যায় না বলে সহ্য করা। তারাপদও মেনে নিল বউয়ের অহংকার, ঔদ্ধত্য। না মেনে উপায়ই বা কী? আত্মহত্যা? সম্ভব নয়! বড়ো ভয় জলে ডুবতে, গায়ে আগুন লাগাতে অথবা আচমকা গাড়ির সামনে পড়তে। দিনে দিনে আরও গুটিয়ে গেল। পারতপক্ষে রাতের আগে বাড়ি ফেরে না। ফিরেও চোরের মতো দুটো মুখে দিয়েই ঘুম। ঘুম মানে চোখ বুজে থাকা। মেয়েই খেতে দেয়। রাতে ঘুম না এলে পাশে এসে বসে কখনও-সখনও। মায়ের চোখে পড়লে মুখঝামটা, গালাগাল।

‘স্বামী তো নয়, শত্তুর।’

মেয়ে যেন আক্ষরিক অর্থেই গলার কাঁটা। রূপ না থাকলেও বেশিরভাগ মেয়েরই আলগা চটক বা লালিত্য থাকে। ঝুমুর যেন কুরুপার অধিক। চটক তো নেই-ই, লালিত্যের ছিটেফোঁটাও নেই। আলকাতরার মতো রং, খরখরে চামড়া, মুখের দিকে না তাকালেই স্বস্তি! গুণ বলতে নম্র, গৃহকর্মনিপুণা, সরলমতি। একেবারে খাদহীন। কাদার তাল যেন! ওইসবের কদর বাপ-মায়ের কাছে থাকলেও, বাইরের লোকের দায় পড়েনি নজর করবার।

পায়ের গোলমাল শুরু হতেই মনে কু ডেকেছিল তারাপদর। মেয়ের বিয়েটা এইবেলা না দিলেই নয়। পাত্রী পছন্দ হবার প্রশ্ন নেই, তাই প্রথম থেকেই টাকার চার ফেলেছিল। মাছও এল! ছেলের বাড়ি জয়নগর। রাজমিস্ত্রীর জোগাড়ে। দিল্লি, মুম্বাইতেও যায়। বাড়িতে বিধবা মা। জমিজমা না থাকলেও অভাব নেই। দেরি করল না তারাপদ। পঞ্চাশ হাজার টাকা বরপণে রাজি হয়ে গেল। সঙ্গে মোটরবাইক। দয়াপরবশ হয়ে হাজার তিরিশেক টাকা দিল বিধু সাহা। বোধহয় লাইফ টাইম অ্যাচিভমেন্ট। বাকিটা মহাজনের কাছে ধার! মোটরবাইকও ধারে। পড়শি নগেন পালের কাছে বিনা সুদে। আয়োজন তেমন কিছু ছিল না। কালীঘাটে বিয়ে আর বাড়িতে জনা পঞ্চাশের নিমন্ত্রণ। কাজ উতরাল নির্বিঘ্নে। ট্রেনে চড়ে মেয়ে চলে গেল শ্বশুরবাড়ি। দ্বিরাগমনেও এল। বর ছ’মাসের জন্য দিল্লি যাচ্ছে। ফিরে এসে নিয়ে যাবে। সেই যে জামাই গেল, তিন বছর পার হতে চলল ফিরল না এখনও। জয়নগরে খোঁজ নিয়ে লাভ হয়নি। শাশুড়ির কাছেও হদিশ নেই। মোবাইল সুইচড-অফ। শুরু হল শবরীর প্রতীক্ষা।

শ্বশুরবাড়ি থেকে ফিরে ঝুমুরও যেন পালটে গেল। যে-মেয়ে সাজগোজের ধারপাশ দিয়েও যেত না, সে নানারকম আবদার শুরু করল। ইচ্ছে থাকলেও সামর্থ্য আর নেই। চিকিৎসা, বিয়েতে সর্বস্বান্ত। মালতীকে টানতে হচ্ছে মোটরবাইক, মহাজনের ধার। ঝুমুরেরও যেন তাড়া নেই শ্বশুরবাড়ি ফেরার। রহস্য উদ্ঘাটন হল ছ’মাস পার হবার পর। বর নানারকম দাওয়াই বাতলে দিয়েছে ফরসা হবার। টিভিতে চাক্ষুষ করিয়েছে সিনেমার হিরো হিরোইনদের রূপ রহস্য। আশ্বাস দিয়েছে ফরসা হলেই ফেরত নিয়ে যাবে। নইলে সমাজে মান রাখাই দায়। ঝুমুরও বিশ্বাস করেছে সরল মনে! উপায় বাতলালেও, সংস্থানের কোনও ব্যবস্থা করেনি পতিদেবতা। অগত্যা পাড়ার মেয়েদের থেকে চেয়ে-চিন্তে ক্রিম, সাবান জোগাড় করে ঝুমুর। মনে দুর্বার আকাঙক্ষা। হবে সাধের উত্তরণ।

চোখে জল এসেছিল তারাপদর। তীব্র অভিমান হয়েছিল ঈশ্বরের উপর। মনটার মতো মেয়েটার চেহারাটা একটু সাদা করতে পারল না? কালো মনের সাদা মানুষ তো আকছার! বেশ বুঝতে পারল টোপ গিললেও মাছ বঁড়শিতে গাঁথেনি! মেয়ে আজও কুমারী। হয়তো আজীবনই থাকবে। টাকা, বাইকের সংস্থান হতেই পালিয়েছে জামাই বাবাজি। সেই থেকেই ঝুমুর একনিষ্ঠ রূপ সাধনায় ব্রতী। পাড়ার লোকে হাসে, ব্যঙ্গ করে, আবার কৗতূহলে খয়রাতিও করে। অপেক্ষা করে চূড়ান্ত ক্লাইম্যাক্সের। মিলনান্তক না বিয়োগান্তক? মিলনান্তক হলে, ‘আমিই তো…’, অন্যথায় মুখ বেঁকিয়ে ‘বোকার হদ্দ কোথাকার। সাধ্য নেই, সাধ আছে ষোলোআনা’। ঝুমুর অতশত বোঝে না। যে যা দেয় তাই নিয়েই খুশি। চালায় নিরলস প্রচেষ্টা। ডাক আসবে প্রিয়তমের।

নিরুত্তাপ, নিস্তরঙ্গ জীবনেও একসময় সিঁদুরে মেঘ দেখল তারাপদ। মালতীর শরীর ভেঙে পড়ছে। আজকাল প্রায়ই হাঁপ ধরে, বুক ধড়ফড় করে। অপুষ্টি, অধিক পরিশ্রমে শরীর কাহিল। মেজাজও তিরিক্ষি। স্বামীর উপর ক্ষোভ উগরেও শান্তি হয় না। মেয়েকেও জুড়ে নেয়। এমন বাপ-মেয়ের জন্যই নাকি জীবনটা দুর্বিষহ হল। বাপ-মেয়ে দুজনেই সর্বংসহা। এতএব মেজাজ আরও তিরিক্ষি! তবে ঠান্ডা হলে ঠোঙা বানানোয় হাত লাগায়। তারাপদ হাত উঠিয়ে নিলেও, মা-মেয়েতেই চালাচ্ছে ফ্যামিলি বিজনেস। মোটরবাইক, মহাজনের ধার এখনও চলছে। শুধু রান্নার কাজের মাইনেতে বাড়িতে রান্না চড়ানো মুশকিল। কিন্তু মালতী হঠাৎ অসুস্থ হলে? কেমন করে বাঁচাবে হাবাগোবা মেয়েটাকে?

‘ঘুম আসছে না বাবা?’

চমকে উঠল তারাপদ। সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে খেয়ালই করেনি কখন ঝুমুর শিয়রে এসে বসেছে। এদিক-ওদিক তাকিয়ে মালতীকে খুঁজল। চাপা স্বরে বলল, ‘এই ঘুমব… তুই এখন যা। মা দেখতে পেলে অযথা মুখঝামটা শুনবি!’

‘মা তো ঘুমিয়ে পড়েছে, ঝুমুর হাসি মুখে জানায়।

নিশ্চিন্ত হল তারাপদ। মেয়ের হাতে হাত রেখে বলল, ‘বুঝলি মা, এবার একটা নতুন কারবারে হাত দিচ্ছি।’

‘কীসের কারবার?’

‘চুলের।’

চুল নিয়ে যে কারবার হয়, তারাপদর ঘুণাক্ষরেও জানা ছিল না। খদ্দের দেখে তাজ্জব হয়ে গেল। বুঝল মহিলা মহলে এই ব্যাবসা খুবই জনপ্রিয়। নিজের মাথার ঝড়তি-পড়তি চুল বেচে যদি দুটো পয়সা মেলে, মন্দ কী? তাই ফেলে না দিয়ে কাচের শিশি বা প্লাস্টিকে জমায়। পরিমাণমতো হলে বেচে দেয়। দেড় থেকে তিন হাজার টাকা কিলো।

তারাপদকে পেয়ে মহিলা মহল যেন বর্তে গেল। খাপছাড়া গ্রামগুলোয় কোনও ক্রেতা না থাকায় বাড়ির পুরুষ মানুষদের শরণাপন্ন হতেই হতো। বিস্তর সাধাসাধি, তোষামোদ। তারপর নেহাতই দয়াপরবশ হয়ে দায়িত্ব গ্রহণ! তাও সব সময় যে সঠিক পয়সা ঘরে আসবে এমনটা নয়। ব্যস্ত পুরুষকুল উপকারের বিনিময়ে মাঝেমধ্যেই এক বান্ডিল বিড়ি বরাদ্দ করে নেয়। ঝরা চুল কিলোখানেক হবার প্রশ্ন নেই। সাকুল্যে হয়তো কয়েকগ্রাম। সেটুকুতেও যদি নজর পড়ে, সহ্য হয়! বলতে গেলে পালটা রাগ, দায়িত্ব অস্বীকারের হুমকি। সেদিক দিয়ে তারাপদ শ্রেষ্ঠ অবলম্বন। চোখের সামনে পুরো পয়সা মিলবে। তা ছাড়া চেনা লোক, ওজনে মারবে না ধরেই নেওয়া যায়। তবে কেউ কেউ নগদের বদলে বাসন প্রত্যাশী। কারও কারও নগদ নিয়েও অসন্তোষ। তারাপদ নাচার। ছোটো গাড়িতে বাসনের বোঝা বয়ে বেড়ানো দুঃসাধ্য। নগদ বাড়াবারও উপায় নেই। তা হলে নিজের বাড়া ভাতেই ছাই পড়ে। তা ছাড়া সবাইকে সমান নগদ দেওয়াও যায় না। দাম মেলে চুলের দৈর্ঘ্য অনুয়ায়ী। তবুও হাতের কাছে অন্য ক্রেতা না মেলায় তারাপদর কপালেই বরাত জোটে। নেই মামার চেয়ে কানা মামা ভালো।

সময় মন্দ কাটে না তারাপদর। বটকেষ্টর দেওয়া গাড়িটা বেশ মজবুত। কাঠের তক্তার উপর চাকা লাগানো। হাত দিয়ে ঠেলে দিব্যি গড়গড়িয়ে যাওয়া যায়। অন্যদের মতো ডুগডুগিও দিতে চেয়েছিল। এক কথায় নাকচ করেছে তারাপদ। চেনা লোকজনের মাঝে ডুগডুগি বাজিয়ে ফেরি করবে। এ কি ব্যাবসা নাকি বাঁদর নাচ দেখানো? জোর করেনি বটকেষ্ট। এলাকায় পরিচিতি এবং অন্য ক্রেতা না থাকার সুবাদে তেমন অসুবিধে হবে না তারাপদর। ‘চুল দেবেন গো’ হাঁক পাড়ারও দরকার পড়বে না। মেয়ে-বউরা এমনিই উজিয়ে আসবে। তাই গাড়ির সঙ্গে শুধু ওজন করবার সূক্ষ্ম যন্ত্রটা দিয়েছে, যাতে কয়েক গ্রামও অনায়াসে ওজন করা যায়। আর দিয়েছে ধার হিসেবে দশটাকার বান্ডিল। বেশিরভাগের প্রাপ্যই পঞ্চাশ, একশো ছাড়ায় না। খুচরো রাখতেই হয়। তারাপদ ঠকায় না কাউকেই। সেই কারণেই হয়তো বাড়তি খাতির মেলে। চাইলে জল পাওয়া যায়। সঙ্গে বাতাসাও আসে কখনও।

‘তুই করিস কী চুলগুলো দিয়ে?’

‘বেচে দি।’

‘কাকে?’

‘সে খোঁজে তোর দরকার কী? তুই কামাচ্ছিস কামা না’, বটকেষ্টর সাফ জবাব। এই হল মানুষের দোষ। নিজেরটুকু নিয়ে সন্তুষ্ট থাকবে না, অন্যের দিকে নজর । একেবারে নিশ্চিত, পরের প্রশ্ন দাম সম্বন্ধীয়।

‘তুই কী দাম পাস?’

হো-হো করে হেসে উঠল বটকেষ্ট! মানুষ ঘাঁটা সার্থক। তারাপদর পিঠে চাপড় মেরে বলল, ‘তোর তাতে দরকার কি রে শালা? তোকে একটা লাইন চেনালাম, গাড়ি বানিয়ে দিলাম, হাজার টাকা ধার দিলাম, এই নিয়েই সন্তুষ্ট থাক না। জাহাজের খবর জেনে তুই আদার ব্যাপারী কী করবি?’

চুপসে গেল তারাপদ। নেহাতই কৗতূহলী জিজ্ঞাসা। বটা যে কিছু মনে করবে ভাবেনি।

‘শোন, তোকে আর একটা রোজগারের উপায় বাতলাই’, পরিস্থিতি হালকা করতে চাইল বটকেষ্ট। চুলের জট ছাড়িয়ে, সাবান দিয়ে ধুয়ে সাইজ অনুযায়ী আলাদা আলাদা বান্ডিল করবি। এ বাবদও কিছু পাবি। বিড়ি খরচটা উঠে যাবে।’

বিড়ির কথা উঠতেই হাত পাতল তারাপদ। দুটো আয়েশি টান মেরে বলল, ‘চুলগুলো কী কাজে লাগে বলবি?’

‘পরচুলা বানায়। বিদেশেও নাকি যায়। আমি সব জানিও না।’

চুলের জট ছাড়ানোর কাজটা বেশ পছন্দ হল তারাপদর। রোজগারও আছে, সময়ও কাটবে। পরে অনেকবারই বিড়ি বা ঠোঙা বানানোয় হাত লাগাবার কথা ভেবেছে। কিন্তু মালতীর রণংদেহি মেজাজের সামনে পড়তে মন চায়নি। তা ছাড়া, আবার যদি ভালো না লাগে? এবার আর রেয়াত করবে না মালতী। হয়তো ঘাড় ধাক্বা দিয়ে বেরই করে দেবে। কী দরকার যেচে ঝামেলায় জড়ানোর! তার চেয়ে অনন্ত সময় ধরে জট ছাড়ানো ঢের ভালো। যেন মা-মেয়ের সঙ্গে অলিখিত প্রতিযোগিতা। নিজের অস্তিত্ব বজায় রাখার মরিয়া চেষ্টা। সামান্য হলেও কিছু টাকা তো দিচ্ছে সংসারে। তবে লাভ যৎসামান্যই। একবার কেনার পর বেশ কিছুদিন অপেক্ষা করতেই হয়। গ্রামগুলোও বেশি বড়ো নয়। গাড়ি ঠেলে দূরে যাওয়াও মুশকিল।

ইদানীং মালতীর আচরণ যেন অদ্ভুত! দূরছাইও করে আবার টাকাও নেয়। যেন ধার দিয়েছিল। টাকা অবশ্য মেয়ের হাতে দেয় তারাপদ! খামোখা সন্মুখ সমরে লাভ কী? তা হলেও, একটু সহানুভূতি পেতে মন চায়। শুনতে চায় সুবুদ্ধির প্রশংসা। আগেরই সেই মাখোমাখো ভাব না থাকলেও, প্রত্যাশা করে নরম সুর। মরুভূমি সবুজ না-ই হতে পারে, তা বলে কী মেঘের ছায়াটুকুও প্রাপ্য নয়? দু’ফোটা বৃষ্টিও কী বেশি চাওয়া হল? হাজার হলেও স্বামী তো! প্রত্যাশার ধারপাশও মাড়ায় না মালতী। মেজাজ রুক্ষতর। দিনগত পাপক্ষয়ে ক্লান্ত। তারাপদ হতাশ। নিজের কর্মকাণ্ডে অতিমনোযোগী। খেয়াল থাকে না, মরা নদীতে জোয়ার আসে না।

ঝুমুর যেন বৈশাখী বাতাস। খরা-মনে শান্তির প্রলেপ। মা ঘুমিয়ে পড়লে চুপিচুপি আসে। জট ছাড়াতে হাত লাগায়। ধুয়েও দেয়। তারাপদ বিশ্রাম নেয়। মেয়েলি হাতে কাজ এগোয় তরতরিয়ে। একদিন কাজ করতে করতেই বলল,

‘বাবা… আমাকে একটা জিনিস এনে দেবে?’

‘কী’? তারাপদর প্রশ্রয়। সারা জীবনে মেয়েকে দেওয়া হয়নি কিছুই। কাজ আর মদ খাওয়ার ব্যস্ততায় ফুরসতও মেলেনি! বিয়েটাও দিয়েছিল যত না মেয়ের জন্য, তার চেয়ে বেশি দায়মুক্ত হতে।

ভাঁজ করা একটা কাগজ এগিয়ে দিল ঝুমুর। তারাপদ দেখল পাতা জোড়া ক্রিমের বিজ্ঞাপন। সাত দিনেই বদলে যাবে ত্বকের রং! মেয়ে জুলজুল চোখে তাকিয়ে। মায়া হল তারাপদর। কত না স্বপ্ন মেয়েটার চোখে। ক্রিম লাগাবে, ফরসা হবে, বর নিয়ে যাবে শ্বশুরবাড়ি। গড়ে উঠবে সংসার, আসবে সন্তান, সার্থক হবে নারী জনম!

ভাবনার মাঝেই মাথা নীচু করে ঝুমুর বলল, ‘অনেক দাম জিনিসটার। পাড়ায় কারও কাছে নেই। তুমি…’

‘তুই ভাবিস না মা! আমি নিশ্চয়ই কিনে দেব।’

‘দুশো টাকা!’

দাম শুনে আঁতকে উঠল তারাপদ। এ সপ্তাহে দুশো টাকাই জুটেছে। মালতী নিশ্চয়ই প্রত্যাশা করবে। না পেলে কী কাণ্ড বাধাবে কে জানে! যা হয় হবে, মেয়ের শখপূরণ আজ করবেই। কত আশা করে রয়েছে মেয়েটা! জিনিসটা পেলেই হাসিতে ভরে উঠবে মুখ! মেয়ের হাসি মুখকে গুরুত্ব দিয়েই ক্রিমটা কিনে ফেলল তারাপদ। ঝড়-ঝাপটা যা আসে আসুক। ঠিক সামলে নেবে।

 

বাড়ির কাছাকাছি এসে কান্নার আওয়াজ পেল তারাপদ। তবে কি জামাই এল? মেয়ে চলে যাবে বলে মালতী কাঁদছে? নিশ্চয়ই তাই । ভগবান সবাইকেই একসময় সুখের মুখ দেখান। এবার নিশ্চয়ই মেয়ের কথা মনে পড়েছে! হয় জামাইয়ের মত বদল ঘটেছে অথবা মা অসুস্থ হবার কারণে বউয়ের প্রয়োজন পড়েছে। দুটোই মেয়ের পক্ষে মঙ্গল। শ্বশুরবাড়ি গেলে অনেকটাই নিশ্চিন্তি। একটা পেট কমলে মালতীর ভারও খানিকটা লাঘব হবে। অসুবিধে হবে তারাপদর। মেয়ের কল্যাণে যে দু’বেলা জুটত, সেটা হয়তো জুটবে না। চলতে হবে বউয়ের মর্জিমাফিক। সে হোক, মেয়ের সুখের জন্য এটুকু সওয়াই যায়। শুধু ক্রিমটার জন্য মন খচখচ করল। জামাই নিতে এসেছে মানে ওটার আর প্রয়োজন নেই। ফেরত না নিলে খামোখা গচ্চা।

বাড়ি পৌঁছে তারাপদ অবাক। সারা পাড়া ভেঙে পড়েছে উঠোনে। পড়শিদেরও নিশ্চয়ই মন খারাপ। দেখতে যেমনই হোক, সরল ব্যবহারে মেয়েটা সকলেরই মন টেনে নেয়। তাই চলে যাবার আগে সবাই দেখা করতে এসেছে। তারাপদরও দেখতে ইচ্ছে করল মেয়েকে। শ্বশুরবাড়ি যাবার আগে নিশ্চয়ই লজ্জা লজ্জা মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে। অথবা কান্না জুড়েছে মায়ের সঙ্গে। কান্না বড়োই সংক্রামক। কিছুতেই বাঁধ দেওয়া যায় না। তবে শুভক্ষণে কাম্য নয় একেবারেই। খামোখা অমঙ্গলের আহ্বান। মা-মেয়েকে সামলাতে এগিয়ে গেল তারাপদ।

‘ও কে ওখানে!’

দোরগোড়ায় বসে মালতী কাঁদছে। সামনে শুয়ে ঝুমুর।

‘ও ওরকম ভাবে শুয়ে আছে কেন?’ মাথায় কিছুই ঢুকল না তারাপদর।

মালতীর কান্নার তোড় হঠাৎই বাড়ল।

সেই কান্নাই তারাপদকে জানিয়ে দিল, ঈশ্বরের বিধান সকলের জন্য সমান নয়। কাউকে কাউকে তিনি পৃথিবীতে পাঠান শুধুমাত্র দুঃখভোগের জন্যই। নইলে বাপ-মাকে সন্তানের মৃত্যু দেখতে হয়? আচমকাই তারাপদর পৃথিবী যেন থমকে গেল। বাতাস বইছে না, পাখি ডাকছে না, চোখের সামনে শুধুই অন্ধকার। হতভম্বের মতো বসে রইল কিছুক্ষণ। খানিক বাদে বুঝল, পৃথিবী চলছে আপন গতিতে, শুধু তার মেয়েটাই থেমে গিয়েছে।

‘আর সাতটা দিন, তারপরেই শাপমুক্তি।’

ঘুম থেকে উঠেই মাকে বলেছিল ঝুমুর! বাবা আনবে বিশল্যকরণী। দীর্ঘশ্বাস ফেলেছিল মালতী। সরল মেয়েটার জন্য বুক ফেটেছিল। গড়িয়ে পড়েছিল দু’ফোঁটা জল। সবাই শুধু বাইরেটাই দেখল, ভিতরটায় ভুলেও চোখ বোলাল না কেউ। দুঃখ চাপা দিতেই যে রাগ, বোঝাতেও পারল না কাউকে। সন্তানের ব্যর্থতার দায়ভার তো বাপ-মায়েরই। রাগ হয়, কষ্ট হয়, অনুশোচনায় জর্জরিত হয় মন। কিছু করার থাকলে সান্ত্বনা মেলে, নয়তো তীব্র আক্রোশ! একমাত্র মুক্তি আত্মপীড়নে। সেও বা কতক্ষণ? কাঁহাতক আর না খেয়ে অক্লান্ত পরিশ্রমে নিজেকে কষ্ট দেওয়া যায়? তাই রাগ গিয়ে পড়ে আপনজনদের উপর। অকারণেই রুঢ় ব্যবহার করে ফেলে মেয়েটার সঙ্গে। স্বামী যদি সহমর্মী হতো, তা হলে হয়তো মনের ভার কিছুটা কমত। কিন্তু সে মানুষটাও দুর্ভোগ, দুর্দশায় অনুভূতিহীন। দুর্বিপাকে কি মানুষ পড়ে না? পড়লে আবার কাটিয়েও তো ওঠে। কিন্তু মানুষটার কোনও চেষ্টাই নেই। সব কিছু ছেড়ে-ছুড়ে নির্বিকার, নির্লিপ্ত। ইদানীং চেষ্টা অবশ্য করছে। কতদিন স্থায়ী হয় কে জানে! আঁচলে ঠোঁট চেপে বিছানা ছেড়েছিল মালতী। তবে ভালো লেগেছিল মেয়ের প্রতি বাবার সামান্যতম দায়িত্ব পালন। কিছু তো করুক!

 

খবরটা দিয়েছিল বারুইবাড়ির ছোটো-বউ। বাপের বাড়ি জয়নগরে। নিজের চোখে দেখে এসেছে জামাইয়ের নতুন বউ। দিল্লি থেকে বিয়ে করে দিন সাতেক হল ফিরেছে। বিশ্বাস করেনি ঝুমুর। ছোটো বউ যেন প্রস্তুত হয়েই ছিল। অন্যের দুর্ভাগ্যে নিজেকে সৌভাগ্যবতী মনে করার সুযোগ ছাড়তে চায়নি। মোবাইলে ছবি তুলে এনেছিল। ঝুমুরের ছবিও তুলল। সতিন দেখার ফাস্ট রিয়েকশন। ছবি দেখে চুপ মারল ঝুমুর। তারপর দৌড়। মালতী, তারাপদ দুজনেই কাজে। ফাঁকা বাড়িতে গলায় দড়ি দিল।

মুখে কথা জোগাল না তারাপদর। হাতে তখনও বিশল্যকরণী। বুক ঠেলে কান্না উঠতে চাইলেও, কাঁদল না। কেনই বা কাঁদবে? তেমন করে আর মেয়েকে ভালোবাসল কই যে, হারাবার অনুতাপ করবে? ঝুমুরের মাথার কাছে ক্রিমের কৌটোটা রেখে দাওয়ায় বসল। পুলিশ এল খানিক বাদে। লাশ চলে গেল লাশকাটা ঘরে। প্রতিবেশিরা দু’একজন গেল সঙ্গে। বাকিরা নিজ নিজ কাজে। শূন্য উঠোনে সন্তানহারা বাপ-মা একাকী ।

ঝুমুর ফিরল পরদিন। খাটে শুয়ে, ফুলের মালা পরে। পাড়ার লোকেরাই ব্যবস্থা করেছে। শ্মশানে যাওয়ার ডাক পড়ল তারাপদর।

‘কোথায় যাচ্ছিস মুখপুড়ি? ধার শোধ না করে এক পা-ও নড়তে পারবি না তুই’ , হাউহাউ কান্নায় বলে উঠল মালতী। যদি আটকানো যায়!

রক্ত চলকে উঠল তারাপদর! ঘষটাতে ঘষটাতে ঘরে ঢুকল। বেরিয়ে এল হাঁসুয়া নিয়ে! সবাই হতবাক। মেয়ের শোকে পাগল হয়ে গেল নাকি বাপটা?

কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই তারাপদ পৌঁছে গেল মেয়ের শিয়রে। নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে। হাসি পেল ঈশ্বরের লীলায়। মেয়েটাকে সামান্যতম রূপ না দিলেও, দিয়েছেন এক মাথা চুল। কোমর ছাড়িয়ে প্রায় হাঁটু পর্যন্ত। ক্ষিপ্র হাতে হাঁসুয়া চালাল তারাপদ। প্রায় গোড়া শুদ্ধ উঠে এল এক ঢাল চুল।

সেই চুলের গোছা হাতে চিৎকার করে উঠল তারাপদ,

‘ধার শোধ…’

 

 

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...