জিনিসপত্র নামিয়ে পরিষ্কার করতে করতে হঠাৎই শ্রেয়ার চোখ পড়ল অবহেলায় পড়ে থাকা ছোট্ট আংটির কৗটোটার উপর। ও জানে এতেই বিপুলের দেওয়া হিরের আংটিটা রয়েছে যেটা বিয়ের রাতে যত্ন করে শ্রেয়ার আঙুলে পরিয়ে দিয়েছিল বিপুল। পুরোটাই আজ দুঃস্বপ্ন মনে হয় শ্রেয়ার। কবে থেকে চেষ্টা করছে এটাকে মন থেকে মুছে ফেলতে কিন্তু পারছে কই? মনের গভীরে আজও বিপুল নামের কাঁটাটা কোথাও যেন খচখচ করে বাধে। একসময় যাকে নিজের সর্বস্ব দিয়ে শ্রেয়া ভালোবেসেছিল আজ সে-ই তার সবথেকে বড়ো দুঃখের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
কী করে ভুলবে শ্রেয়া নিজের সাতাশতম জন্মদিনের আগের দিনের সন্ধেটাকে, যেদিন বিপুলের সঙ্গে সঙ্গে নিজের বোনকেও সারাজীবনের মতো হারিয়ে ফেলেছিল ও।
সেই বোন যাকে কিনা মায়ের স্নেহে আগলে রেখেছিল শ্রেয়া, যার জন্য সারা পৃথিবীর সঙ্গে লড়ে যাওয়ার সাহস রাখত সেই-ই কিনা বিপুলকে ওর কাছ থেকে কেড়ে নিল। বিপুলের কাছেও শ্রেয়া কতবার স্বীকার করেছে যে পরমা শুধু ওর বোন নয়, সন্তানও বটে। প্রচণ্ড ভালোবাসত ওকে, ওর কষ্ট শ্রেয়া সহ্য করতে পারত না। একবারও তো ওর মনে হয়নি সেই বোনকেই মাধ্যম করে বিপুল ওকে এমন কষ্টের মুখে এনে দাঁড় করিয়ে দেবে যে, জীবনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়াটাই অকারণ হয়ে দাঁড়াবে শ্রেয়ার জন্য।
মনটা অদ্ভুত এক বিতৃষ্ণায় ভরে ওঠে। প্রতিবার এমনটাই হয়। বিপুল আর পরমার কথা মনে হতেই পুরোনো স্মৃতি তাজা হয়ে ওঠে। ‘শ্রেয়া… শ্রেয়া… কী হল তোমার?’ পিছন থেকে সৌম্যর ডাকে ঘোর কাটে শ্রেয়ার। সম্বিতে ফিরে আসে ও। বর্তমানে এসে দাঁড়ায়, যেখানে ওর স্বামী সৌম্য আর ছেলে বুবাই অস্থির হয়ে ওর অপেক্ষা করছে।
‘শ্রেয়া, তুমি বোধহয় ভুলে গেছ আমাদের অর্ঘ্যর ওখানে যাওয়ার কথা’, সৌম্য মনে করায়।
‘অ্যারে, হ্যাঁ আমি ভুলেই গিয়েছিলাম। দশ মিনিট দাও, আমি চট্ করে তৈরি হয়ে নিচ্ছি’, বলে শ্রেয়া সবকিছু ছেড়ে বাথরুমের দিকে পা বাড়ায়।
তৈরি হতে হতে নিজেকেই দোষারোপ করতে থাকে, কেন ও আজ আবার পুরোনো ঘটনার স্মৃতি হাতড়াতে শুরু করেছিল? কেন বিপুলকে ও পুরোপুরি ভুলতে পারছে না? বিপুল কোনওদিনও ওর অনুভূতির তোয়াক্বা করেনি বরং বিশ্বাসঘাতকতাই করেছে। পরমাকে ফুসলে নিয়ে গেছে, দ্বিতীয়বার আর ফিরে আসেনি। সৌম্যই বরং ধৈর্য এবং ভালোবাসা দিয়ে শ্রেয়াকে অবসাদ কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করেছে।
বিপুলের বিশ্বসঘাতকতা যতবারই শ্রেয়ার মনে পড়ে, সৌম্যর প্রতি নিজের ভালোবাসা আরও যেন একটু গাঢ় হয়ে ওঠে। আজও তার অন্যথা হল না। সৌম্যর পছন্দের নীল রঙের শাড়ি সঙ্গে ম্যাচিং শৃঙ্গার সেরে শ্রেয়া তৈরি হয়ে নিল।
শ্রেয়াকে দেখে সৌম্যর মুখে মিষ্টি একটা হাসি ফুটে উঠল। অনেকদিন পর আজ ওরা তিনজন একসঙ্গে কোথাও বেরিয়েছে। সারাটা রাস্তা বুবাইয়ের দুষ্টুমি আর সৌম্যর মজা করার অভ্যাস, শ্রেয়াকে তিক্ততা ভুলিয়ে আনন্দে ভাসিয়ে দিল। অর্ঘ্যর ছেলের উপনয়ণ উপলক্ষে বেশ ভালোই অতিথি সমাগম হয়েছিল সুতরাং সৌম্যরাও সেই ভিড়ে মিশে গেল। সকলের সঙ্গে কথাবার্তায় দুজনেই ব্যস্ত হয়ে উঠল। বুবাইও বন্ধু পেয়ে খেলায় জমে গেল।
হঠাৎই ওই ভিড়ের মধ্যে কেউ শ্রেয়ার পিঠে হাত ছোঁওয়াতে চমকে ও পিছনে তাকাল। ওর ঠিক পিছনেই একজন বয়স্ক মহিলা দাঁড়িয়ে। মহিলার মুখের দিকে তাকাতেই শ্রেয়ার মুখ রক্তশূন্য হয়ে পড়ল, গলা দিয়ে কোনও আওয়াজ বেরোল না।
মহিলাকে চিনতে এতটুকুও দেরি হয়নি শ্রেয়ার যদিও বহু বছর পর আবার দেখা। উনি বিপুলের মা। আজও ওনার চোখদুটি স্নেহ ও মমতায় ভরা। হঠাৎই পুরোনো আবেগ শ্রেয়ার দু’চোখে ফুটে উঠল। নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারল না শ্রেয়া, বড়ো বড়ো দুটো চোখে জল ভরে উঠল। কিছু না ভেবেই বিপুলের মা-কে দুই হাতে জড়িয়ে ধরতে হু হু করে চোখে জল এসে পড়ল শ্রেয়ার।
বিপুল ছেড়ে চলে যাওয়ার পর এই প্রথম শ্রেয়া বিপুলের মাকে এভাবে জড়িয়ে ধরে স্বান্তনা খুঁজতে চাইল। বিপুলের মা-ও শ্রেয়াকে বুকের মধ্যে চেপে ধরলেন যেন ওর দুঃখকে তিনি নিজের হৃদয় দিয়ে সম্পূর্ণ মুছে ফেলতে বদ্ধপরিকর। শ্রেয়াই নিজে এই দূরত্ব তৈরি করেছিল। শুধু ওনার সঙ্গেই নয়, বিপুলের সঙ্গে সম্পর্ক রয়েছে এমন সবকিছু থেকেই ও দূরত্ব বাড়িয়ে নিয়েছিল। ও চাইত না কেউ ওকে বিপুলের কথা মনে করাক কিন্তু আজ হঠাৎ কী হল, ও টের পেল সেই পুরোনো স্মৃতির অতলস্পর্শী গহ্বরে ও ধীরে ধীরে তলিয়ে যাচ্ছে।
হঠাৎ-ই শ্রেয়ার হুঁশ ফিরল। এটা ও কী করছে? না, ও কারও কাছেই নিজের দুর্বলতা প্রকাশ করতে চায় না… পুরোনো স্মৃতি এভাবে আঁকড়ে ধরে থাকলে জীবনের নতুন অধ্যায়-কে কিছুতেই এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবে না।
এক ঝটকায় শ্রেয়া নিজেকে বিপুলের মায়ের আলিঙ্গন থেকে মুক্ত করে নিল। সৌম্য-র দিকে চোখ পড়তেই খেয়াল হল, সৌম্য ওর দিকেই তাকিয়ে আছে। কোনওরকমে চোখের জল লুকিয়ে শ্রেয়া দৌড়ে ওয়াশরুমের দিকে এগিয়ে গেল। সৌম্য ব্যস্ত হয়ে পড়ল বিপুলের মায়ের সঙ্গে কথা বলতে।
বাড়ি ফেরার পথে সারাটা রাস্তা শ্রেয়া অতীতের স্মৃতি আঁকড়ে পড়ে রইল। মনের ভিতরে ওঠা ঝড়ের আঁচ বাইরে কারও গায়েই লাগল না। যাকে নিয়ে একদিন ও স্বপ্ন দেখেছিল, সেই-ই নিজে থেকে নির্মম ভাবে ওকে তার জীবন থেকে উপড়ে ফেলে দিয়েছিল।
সারাটা রাত না চাইতেও শ্রেয়া বিপুলের কথা ভেবে কাটাল। চোখের সামনে পুরোনো ঘটনাগুলো একের পর এক সরে যেতে থাকল। একে অপরের হাত ধরে সারা জীবন একসাথে পথ চলার প্রতিজ্ঞা, ভবিষ্যতের সোনালি স্বপ্নে একসাথে বিভোর হয়ে যাওয়া– সবকিছুই মনের মধ্যে এসে ভিড় করতে লাগল।
বিপুল বরাবরই অল্প কথার মানুষ এবং অন্তর্মূখী প্রকৃতির। শ্রেয়া এতদিনেও বুঝতে পারেনি কবে থেকে হঠাৎ-ই বিপুল আর পরমা এতটা কাছাকাছি চলে এল যে, পরমাই বিপুলের জীবনের সর্বস্ব হয়ে উঠল এবং শ্রেয়াকে দুধে পড়া মাছির মতো নিজের জীবন থেকে ছুড়ে ফেলে দিল।
বিপুলের উপর শ্রেয়ার এতটাই ভরসা ছিল যে, ও কখনওই ভাবেনি বিপুল ওর সঙ্গে কোনওরকম অন্যায় করতে পারে অথবা ওর আদরের বোন ওর সঙ্গে এরকম একটা বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারে। তখন পরমা গ্র্যাজুয়েশন পরীক্ষার জন্য তৈরি হচ্ছিল। শ্রেয়াই বিপুলকে রাজি করিয়েছিল পরমাকে একটু পরীক্ষার জন্য তৈরি করে দেওয়ার জন্য। তখন ও কি একবারও ভেবেছিল ও নিজেই নিজের পায়ে কুড়ুল মারছে?
সেই দিনটা আজও শ্রেয়ার চোখের সামনে ভেসে ওঠে। সন্ধেবেলায় বিপুলের ফেরার অপেক্ষায় ছিল শ্রেয়া। কথা ছিল বিপুলই অফিস ফেরতা পরমাকে ওর বন্ধুর বাড়ি থেকে নিয়ে আসবে। ক্লান্ত হয়ে পরমা বাড়ি ফিরতেই শ্রেয়াকে দেখে ওর গলা জড়িয়ে ধরে পরমা কাঁদতে শুরু করে দিল। পিছনে দাঁড়িয়ে বিপুল পরমাকে চেয়ারে বসতে ইশারা করল। তারপর শ্রেয়ার মুখোমুখি হয়ে বলল, ‘শ্রেয়া আমি তোমাকে একটা কথা বলতে চাই।’
‘সেটা পরেও বলা যেতে পারে, আগে দেখি পরমার আবার কী হল…ও আবার কেন কান্নাকাটি করছে?’
‘আমিই কারণ, শ্রেয়া’, বিপুল শ্রেয়ার একেবারে সামনে এসে বলল।
‘মানে?’ চমকে ওঠে শ্রেয়া।
‘মানে, পরমা আমার কারণেই কাঁদছে।’
‘তোমার কারণে কাঁদছে মানে কী?’ শ্রেয়া কিছুই বুঝতে পারে না।
‘আমি জানি শ্রেয়া, এটা তোমার পক্ষে মেনে নেওয়া খুব মুশকিল কিন্তু ব্যাপারটা আর চেপে রাখা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আমি পরমাকে ভালোবাসি, ওকে আমি বিয়ে করতে চাই।
শ্রেয়ার মনে হল ও কিছু ভুল শুনল বা ওর কিছু বোঝার ভুল হচ্ছে। অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘কী? তুমি পরমাকে ভালোবাসো? আর আমি? আমি তোমার বিয়ে করা বউ। আমাকে তুমি ভালোবেসেই বিয়ে করেছিলে। আমি তোমার এই কথা একেবারেই বিশ্বাস করছি না।’
শ্রেয়া বিপুলের সামনে থেকে সরে এসে পরমার সামনে এসে দাঁড়াল, ‘বিপুল কী বলছে পরমা? এসব কী? তুই ঠিক করে বল, বিপুলের প্রতিটা কথা মিথ্যা না-রে? তুই সত্যিটা আমাকে বলতো…’।
‘দিদি, আমি নিজেই জানি না আমার জীবনে কী হতে চলেছে? তাহলে আমি তোকে আর কী বলব?’
‘শুধু এটুকু বল, তুই আর বিপুল কি একে অপরের সঙ্গে সারাটা জীবন কাটাতে চাস? বিপুল যেটা বলল সেটা কি সব সত্যি?’
পরমা দিদির দিকে চোখ তুলে তাকাতে পারে না। মাথা নীচু করে সায় দেয়। শ্রেয়া আর কিছু বলতে পারে না। ছিটকে সরে দাঁড়ায় একপাশে। জলে ভেসে যেতে থাকে ওর দুই চোখ।
এই ঘটনার পর বিপুল শ্রেয়ার চোখে চোখ রেখে কথা বলাও বন্ধ করে। শ্রেয়ার
মা-বাবা না থাকাতে, পরের দিনই শ্রেয়া নিজের এক বন্ধুর বাড়িতে আশ্রয় নিল। বন্ধুর চেষ্টায় একটা চাকরি জোটাতেও খুব বেশি কষ্ট করতে হল না। পড়াশোনাতে শ্রেয়া বরাবরই তুখোড় ছিল। বন্ধুর সাহায্যেই ডিভোর্সের জন্য কোর্টে আবেদন জানাল। ছয় মাসের মধ্যে বিপুলের সঙ্গে সব সম্পর্ক ত্যাগ করে নিলেও মন থেকে কিছুতেই ভুলতে পারল না শ্রেয়া।
এদিকে ডিভোর্স পাবার পর বিপুল পরমা-কে নিয়ে শহর ছেড়ে অন্যত্র কোথাও চলে গেল কাউকেই প্রায় না জানিয়ে। শ্রেয়া খবর প্রায় বিপুল অন্য শহরে ট্রান্সফার নিয়েছে। চেনা পরিচিত সকলের সঙ্গেই বিপুল আর পরমা সমস্ত সম্পর্ক ত্যাগ করে। বিপুল একবারের জন্যেও শ্রেয়ার সঙ্গে কোনও কথা বলার চেষ্টা করে না। শ্রেয়া এবং বিপুলের সম্পর্কের ইতি ঘটে এভাবেই।
এর পরপরই শ্রেয়ার জীবনে আসে সৌম্য। বন্ধুদের চাপে সৌম্যকে বিয়ে করায় মনস্থ করলেও, নিজের মন-কে বোঝানো কঠিন হয়ে পড়ে শ্রেয়ার জন্য। এদিকে সৌম্য স্বভাবে এবং ব্যবহারে শ্রেয়ার মন জয় করে নিতে পারলেও, ভালোবাসার প্রতি একটা অসীম উদাসীনতা এবং ব্যথা শ্রেয়ার হূদয়ে পাকাপাকি জায়গা করে নেয়, হাজার চেষ্টা সত্ত্বেও মনের শূন্যতা সহজে ভরাতে পারল না শ্রেয়া। বছর কেটে তৃতীয় বছরের মাথায় ওদের ছোট্ট পরিবারে নতুন সদস্য যোগ হল বুবাই।
সকালে উঠে শ্রেয়ার মনে হল, ওর মাথার উপর কেউ যেন একটা ভারী পাথর চাপা দিয়ে রেখেছে। ভাবল, সৌম্য বুবাই-কে স্কুলে পৌঁছে দিয়ে অফিস চলে গেলে একটা ওষুধ খেয়ে ও আবার শুয়ে পড়বে। একটু ঘুমোলে হয়তো শরীরটা হালকা লাগবে। বাড়ির কাজ কিছুটা গুছিয়ে নিতে নিতে বারোটা বেজে গেল। ক্লান্ত হয়ে শুতে যাবে, দরজার বেলটা বেজে উঠল। এ-সময়ে আবার কে এল, ভাবতে ভাবতে আনমনে উঠে গিয়ে সদর দরজা খুলতেই শ্রেয়ার মুখ ফ্যাকাশে হয়ে উঠল।
সামনে দাঁড়িয়ে বিপুল। ক্লান্ত, চিন্তিত যেন বহুদিন ধরে অসুস্থ। এক সেকেন্ড লেগে গিয়েছিল শ্রেয়ার বিপুলকে চিনে উঠতে। মাথার চুল অবিন্যস্ত, বেশির ভাগই সাদা হয়ে গেছে। চোখের নীচে কেউ যেন কালি ঢেলে দিয়েছে। ফরসা টকটকে রং তামাটে বর্ণ ধারণ করেছে।
শ্রেয়া নিজেকে শক্ত করে। স্বাভাবিক ভাবে জিজ্ঞেস করে, ‘তুমি… এখানে? হঠাৎ কী ব্যাপার? কেন এসেছ? আমি তোমার সঙ্গে কোনও কথা বলতে চাই না।’
ক্লান্ত স্বরে বিপুল বলে, ‘ঠিক আছে শ্রেয়া, আমি শুধু এই চিঠিটা তোমাকে দিতে এসেছি’, বলতে বলতে বিপুলের চোখ জলে ভরে আসে। কোনওমতে চিঠিটা শ্রেয়ার হাতে ধরিয়েই দ্রুত শ্রেয়ার চোখের সামনে থেকে সরে গিয়ে রাস্তার ভিড়ে মিশে যায়।
পাথরের মতন খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে শ্রেয়া দৃষ্টি প্রসারিত করে। যার কথা মনে করতে ওর এতদিন ঘেন্না করত সেই-ই আজ কিছুক্ষণ আগে ওর চোখের সামনে দাঁড়িয়ে ছিল। মনে মনে ও সব সময় চেয়েছে, যে মানুষটা ওর জীবন কান্নায় ভরিয়ে দিয়ে গেছে, সে কখনও যেন জীবনে সুখী হতে না পারে। কিন্তু আজ চোখের সামনে বিপুলকে দেখে আর ওর চোখের জল শ্রেয়াকে ভিতর থেকে নাড়িয়ে দিল। ও কোনওমতে দরজা বন্ধ করে বিছানায় এসে বসল। বিপুলের এমন হাল কী করে হল জানতে মনটা ছটফট করতে লাগল। কিন্তু জানার উপায় কী তা কিছুই বুঝে পেল না। হঠাৎ-ই চিঠিটার কথা মনে পড়তে, বিছানায় পড়ে থাকা চিঠিটা খুলে বসল শ্রেয়া। পরমার হাতের লেখা দেখে ওর মন কেঁদে উঠল কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে পুরোনো কথাও আবার মনে পড়ে যেতে নিজেকে সামলে নিল শ্রেয়া। কিছুটা অন্যমনস্ক হয়েই চিঠিটা পড়া শুরু করল ও।
পরমা লিখেছে, ‘দিদি, আমি জানি ক্ষমা চাইবার আমার কোনও অধিকার নেই, তবুও আমি তোর কাছে ক্ষমা চাইছি। হয়তো যতক্ষণে তুই চিঠিটা হাতে পাবি আমি তখন আর এই পৃথিবীতে থাকব না। এতদিন আমি তোর কাছে অনেক কিছু লুকিয়েছি, কিন্তু আর নয়। তোকে সত্যিটা বলে আমি কিছুটা শান্তি পেতে চাই যাতে নিশ্চিন্তে আমি সকলকে ছেড়ে যেতে পারি।
তোর বিপুলকে আমি কোনওদিনই ভালোবাসতাম না। ও সবসময় তোরই ছিল, এখনও তোরই আছে। তোকেই ও ভালোবাসে। আর সেইজন্যই তোর আদরের বোনের জীবন বাঁচাতে ও এতবড়ো বলিদান দিতে সেদিন প্রস্তুত হয়ে গিয়েছিল, মানে আমাকে বিয়ে করেছিল।’
‘দিদি, কলেজেরই একটি ছেলে মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়ে আমাকে ব্যবহার করে। প্রথম প্রথম আমি খুবই ভেঙে পড়েছিলাম কিন্তু পরে ঠিক করি ছেলেটিকে আমি ঠিক কোনও ভাবে রাজি করিয়ে নিতে পারব আমাকে বিয়ে করতে। কিন্তু তার আগেই একটি দুর্ঘটনায় ছেলেটি মারা যায় আর তার ঠিক দুই-তিনমাস বাদেই আমি নিশ্চিত হয়ে যাই যে আমি অন্তঃস্বত্ত্বা। ডাক্তারের কাছে গিয়েও লাভ হয়নি কারণ ডাক্তার পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছিলেন যে গর্ভপাত করানো হলে আমার জীবনসংশয় হতে পারে।
সেদিন হাসপাতাল থেকে বেরোনোর সময় বিপুলের মুখোমুখি হয়ে পড়ি। ও ওর কোনও এক বন্ধুকে নিয়ে এসেছিল ডাক্তার দেখাতে। সেদিন আমি ঠিকই করেছিলাম বিষ খাব কিন্তু বিপুল তোর কথা তুলে আমার কাছ থেকে পুরো ঘটনা জেনে নেয়। আমি ভীষণ ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম যে এটা জানাজানি হলে তোরাও সমাজে মুখ দেখাতে পারবি না।
বিপুলই আমাকে সাহস দেয়। তোদের নতুন বিয়ে হয়েছিল কিন্তু বিপুলের মনে হয় তোকে ছেড়ে যদি আমাকে বিয়ে করে তাহলে তুই পরে অন্য কাউকে বিয়ে করতে পারিস কিন্তু আমাকে কেউ বিয়ে করতে রাজি হবে না। ও আমার সন্তানকে নিজের নাম দিতে রাজি হয়ে যায়। তোর কথা ভেবেই ও এই বলিদান দিতে রাজি হয়ে যায়। আর এই কারণেই ও ট্রান্সফার নেয় অন্য শহরে যাতে কেউ জানতে না পারে যে বিয়ের আগেই আমি গর্ভবতী হয়ে পড়েছি।
আমি ভেবেছিলাম সব ঠিকঠাক হয়ে গেলে তোর কাছে ফিরে আসব আর যা সত্যি সেটা তোকে বলে দেব। কিন্তু বিপুল আমাকে আটকে দেয় এই বলে যে, সব সত্যি জানতে পারলে তুই আর বিয়ে করবি না আর সারাটা জীবন একা একাই কাটিয়ে দিবি। তোর বিয়ের খবর পেয়ে আমরা ফিরে আসব ঠিক করি কিন্তু তার পরপরই আমার শরীর খারাপ হওয়া শুরু হয়। আর তোর সামনে গিয়ে দাঁড়াবার সাহসও কিছুতেই করতে পারছিলাম না।
প্লিজ দিদি, আমাকে ক্ষমা করে দিস। তুই যাকে মন থেকে চেয়েছিস তাকেই আমি তোর থেকে দূর করে দিয়েছি। কিন্তু বিশ্বাস কর আজ পর্যন্ত বিপুল আমাকে ছোঁয়নি পর্যন্ত। ও আজও পুরোপুরি তোর।
ইতি তোর বোন পরমা’।
চিঠি পড়তে পড়তে চোখের জলে ভাসতে থাকে শ্রেয়া। বিপুলের বিশ্বাসঘাতকতা যেমন ওর মনকে পুড়িয়ে দগ্ধ করেছিল, তেমনি ওর আত্মত্যাগ আজ শ্রেয়ার মনে একটা শীতল পরশ বুলিয়ে দিল। কিন্তু বোনের ব্যথা অশ্রু হয়ে শ্রেয়ার চোখ বেয়ে অঝোরে ঝরে পড়তে লাগল।
খালি মনে হতে লাগল, কী করে ও জানতে পারবে বিপুল আর ওর বোনের ঠিকানা? ভাবতে ভাবতেই চোখ বুজে বিছানায় শুয়ে পড়ল শ্রেয়া। কখন ঘুমের অতলে তলিয়ে গেল হুঁশ রইল না ওর। যখন ঘুম ভাঙল, দেখল সৌম্য অফিস থেকে ফিরে এসেছে, নিজেই চা বানাতে ব্যস্ত। গ্লানি অনুভব করল শ্রেয়া, কী করে ও সৌম্যর ফেরা বুঝতে পারল না। তাড়াহুড়ো করে উঠতে গিয়ে মাথাটা ঘুরে গেল ওর। ও এসে আবার খাটে শুয়ে পড়ল।
তখনই চা নিয়ে ঢুকল সৌম্য। শ্রেয়ার চা-টা বিছানার পাশে টেবিলে দিতে দিতে শ্রেয়াকে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘চা খেয়ে তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নাও, আমাদের বেরোতে হবে।’
শ্রেয়া উদাস চোখে সৌম্যর চোখে চোখ রাখল, ‘না, আমার কোথাও যেতে ইচ্ছে করছে না। তুমি চলে যাও। বুবাই-ও টিউশন থেকে এখনই চলে আসবে। কাউকে তো একটা বাড়িতে থাকতে হবে।’
‘বুবাই-র ব্যবস্থা আমি করে দিয়েছি। পাশের বাড়ির অনিতাদি ওকে নিয়ে এসে ওখানেই রাখবে। ওর ছেলের সঙ্গে দিব্যি বুবাই থেকে যাবে। তোমাকে আমার সঙ্গে যেতেই হবে’, সৌম্য জোর দিয়ে বলে।
সুতরাং কোনও উপায় দেখতে না পেয়ে অনিচ্ছা সত্ত্বেও শ্রেয়া সৌম্যর সঙ্গে যাওয়ার জন্য তৈরি হয়ে নেয়। বিরসমুখে সোজা সৌম্যর সঙ্গে গাড়িতে গিয়ে বসে। জিজ্ঞাসা করতেও ইচ্ছা করে না, সৌম্য ওকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে? গাড়ি এসে একটা নার্সিংহোমের সামনে দাঁড়ায়। চোখে প্রশ্ন নিয়ে শ্রেয়া স্বামীর দিকে তাকায়।
‘শ্রেয়া চলো, পরমা-কে দেখতে চাও না তুমি?’
সৌম্যর গম্ভীর স্বরে শ্রেয়ার ঘোর ভাবটা কেটে যায়। চমকে ওঠে ও। অস্ফুট স্বরে প্রশ্ন করে, ‘সত্যিই পরমা হাসপাতালে…’, বলতে বলতে মিলিয়ে যায় শ্রেয়ার স্বর।
সৌম্য শ্রেয়ার ঠান্ডা হাতটা নিজের হাতে তুলে নিয়ে সামান্য চাপ দেয় যেন নিজের শরীরের উষ্ণতা ছড়িয়ে দিতে চায় শ্রেয়ার দেহ-মনে। বলে, ‘কিছু চিন্তা কোরো না শ্রেয়া, ব্যস তাড়াতাড়ি চলো। পরমার কাছে সময় খুব কম।’
প্রায় দৌড়েই ওরা দু’জন নার্সিংহোমের ভিতরে এসে ঢোকে। পরমা বিছানার সঙ্গে প্রায় মিশে গেছে। জীবনযুদ্ধে পরাজয়ের যন্ত্রণা ওর সারা মুখে। যে অপরাধবোধ ওর মনে বোঝা হয়ে চেপে বসেছে সেটাই আজ ক্যান্সার হয়ে আঘাত হেনেছে ওর দেহে।
পরমাকে দেখে শ্রেয়ার গলা দিয়ে একটা আওয়াজও বেরোল না। কিন্তু ওর হাতের স্পর্শ পেতেই পরমা চোখ খুলে তাকাল। শ্রেয়াকে দেখেই ‘দিদি’ বলেই ওর চোখ জলে ভরে উঠল, ‘আমাকে ক্ষমা করে দে দিদি… নয়তো আমি মরেও শান্তি পাব না।’
‘না পরমা কথা বলিস না। তোর কোনও দোষ নেই। যা হওয়ার তাই হয়েছে। এতে তোর কী দোষ? তুই নিজেকে কেন শুধু শুধু দোষ দিচ্ছিস?’ শ্রেয়া থেমে থেমে বলে।
‘আমি আর ভালো হব না-রে দিদি। ক্যান্সারের লাস্ট স্টেজ। তোকে দেখব বলেই আমার নিশ্বাস এতদিন আটকে ছিল। শুধু তুই বিপুলকে ক্ষমা করে দে’, বলে পরমা বিপুলের হাতটা তুলে দেয় শ্রেয়ার হাতে।
বিপুলের কান্নাভেজা চোখের দিকে এক ঝলক তাকিয়েই শ্রেয়া বলে, ‘পরমা, বিপুল তো কোনও ভুল করেইনি। ও তো শুধু স্যাক্রিফাইস-ই করেছে। সেক্ষেত্রে আমি ক্ষমা করার কে?’
শ্রেয়ার কথা শুনে পরমার চোখের অস্থিরতা মুহূর্তে কেটে গেল যেন একটা গভীর অপরাধবোধ থেকে মুক্ত হয়ে নতুন জীবনে পা রাখল ও। অনেকক্ষণ পর্যন্ত শ্রেয়া পরমার হাত নিজের হাতে নিয়ে চুপচাপ বসে রইল।
ডাক্তার আগেই জবাব দিয়ে দিয়েছিল। সেই রাতটা শ্রেয়া পরমার সঙ্গে থাকতে চাইছিল কিন্তু সৌম্যর বলাতে বাড়ি আসতে রাজি হয়ে গেল।
রাস্তায় আসতে আসতে গাড়িতে বসে শ্রেয়া পরমার চিন্তাতে ডুবে গেল। আজ এতগুলো বছর পর বোনটাকে দেখতে পেয়ে অদ্ভুত একটা প্রশান্তিতে ছেয়ে গেছে ওর মন। ওর নিজের প্রতি বিপুলের অটল ভালোবাসা অনুভব করে শ্রেয়া মনে মনে আবার নতুন করে বিপুলের প্রতি আকর্ষণ বোধ করতে লাগল। আজ কারও বিরুদ্ধে ওর কিছু বলার ছিল না, শুধু বিপুল আর পরমার প্রতি ভালোবাসা ছাড়া আর কোনও আবেগ অনুভূত হল না।
তখনই হঠাৎ ওর মনের ভিতর প্রশ্ন জাগল, ও সৌম্যর সঙ্গে কোনওরকম অন্যায় করতে যাচ্ছে না তো? ‘সৌম্য, তুমি কী করে জানলে পরমা ওই নার্সিংহোমে ভর্তি রয়েছে?’ শ্রেয়া জিজ্ঞাসা করে।
সৌম্য একটু থেমে উত্তর দেয়, ‘তুমি কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়েছিলে, বিছানার উপর খোলা চিঠিটা পড়েছিল। চিঠিটা পড়তেই সবকিছু পরিষ্কার হয়ে যায় আমার কাছে। আমি চিন্তা করছিলাম পরমার কাছে তোমাকে কী করে নিয়ে যাব। তখনই হঠাৎ বিপুলের মায়ের কথা মনে পড়ে। সেদিন পার্টিতে আমি ওনার ফোন নম্বর নিয়ে নিয়েছিলাম। ওনাকে ফোন করেই জানতে পারি পরমা এখানেই অ্যাডমিট রয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে আমি…’
শ্রেয়া সৗম্য কাঁধে মাথা রাখতে রাখতে বলে, ‘সৌম্য তোমাকে কীভাবে ধন্যবাদ জানাব আমি জানি না…।’
‘আমাকে নয় শ্রেয়া, বিপুলকে ধন্যবাদ দাও। ও তোমার জন্য নিজেকে নিঃস্বার্থ ভাবে উজাড় করে দিয়েছে। পরমার যদি কিছু হয়ে যায় ওকে আর হারিয়ে যেতে দিও না শ্রেয়া। আমাদের বাড়ির কাছাকাছি কোথাও একটা থাকার জায়গা দেখে ওকে ওখানে থাকার জন্য তোমাকেই ওকে বাধ্য করতে হবে। এতে আমাদের সঙ্গে ওর সম্পর্কটাও টিকে থাকবে আর বিপুলও এই পৃথিবীতে সম্পূর্ণ একা হয়ে পড়বে না। এছাড়াও পরমা-র সন্তানের দেখাশোনার ভারও তুমি নিজের উপর তুলে নিতে পারবে।’
সৌম্যর মতামত শুনে শ্রেয়ার মন থেকে একটা ভারী পাথর সরে গেল। ও নিশ্চিন্ত হয়ে সৌম্যর কাঁধে মাথা রাখল। এখন বিপুলের প্রতি ওর যেটুকু কর্তব্য সেটা বিনা বাধায় ও পালন করতে পারবে। ওর স্বামী ওকে বিশ্বাস করে, সুতরাং তাদের এই সম্পর্কটাকে স্বাধীনতা দিতে সৌম্যর বিন্দুমাত্র দ্বিধাবোধ হয়নি। বিপুলের সঙ্গে নিজের সম্পর্কটাকে শ্রেয়া যতটা না ভালো করে বুঝতে পেরেছে, শ্রেয়া নিশ্চিত যে তার থেকে অনেক ভালো করে সৌম্য সেটা বুঝতে পেরেছে।