স্কুল থেকে এসে ব্যাগটা খাটে ছুড়ে দিয়ে এনসিসি-র ড্রেসটা খুলতে থাকে উপল। মা পেছন থেকে এসে বলে, ওই ঘেমো জামাকাপড়গুলো বিছানায় তুলবি না, যত রাজ্যের নোংরা লেগে আছে।

উপল ঘেমো শরীরেই মাকে জড়িয়ে ধরে, জানে মা এতে আরও বেশি রেগে যায়। মা-র এই রাগটুকু উপল উপভোগ করে, পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হয়ে নিলেই মা খুশি। গরিবের সংসারে পঞ্চব্যাঞ্জন না হোক, শাকপাতা দিয়ে মা যা রান্না করে, তাই উপলের অমৃত লাগে।

দেরি না করে কলপাড়ে হুড়োহুড়ি করে স্নানটা সেরে নেয় উপল। দুষ্টুমি করে চাতালে বসে থাকা কাকটাকে ভিজিয়ে দেয়। কা কা করে উড়ে কাকটা প্রতিবাদ করে যায়।

মা রান্নাঘরের দাওয়ায় বসে উপলের সুন্দর, সুঠাম চেহারা দেখে! ছেলেটা দেখতে দেখতে বড়ো হয়ে গেল। শরীরচর্চায় খুব উত্সাহ, পুলিশ বা মিলিটারিতে যাওয়ার ইচ্ছে আছে। সবসময় বলে, দেশের জন্য কিছু করর, লড়াইয়ে ময়দানে সামনের সারিতে থাকব। ছেলের এরকম ইচ্ছেতে মায়ের মন সায় দেয় না। তবে বড়ো হচ্ছে, ওর মতকেও তো গুরুত্ব দিতে হবে।

গত বছর, পাড়ার ক্লাবের পাশের ঝিলে একটা ছেলে ডুবে যাচ্ছে শুনে, এক ডাকে বেরিয়ে গেছিল, গিয়ে দ্যাখে আশেপাশের লোকেরা ঘিরে মজা দেখছে, কারুর নামার সাহস হচ্ছে না। উপল এক লাফে জলে নেমে, খাবি খেতে খেতেও ওকে উদ্ধার করে এনেছিল।

স্কুলের শারীরশিক্ষার শিক্ষক দীপেনবাবু উপলকে বিশেষ স্নেহ করেন। উপলের সততা, সুন্দর ব্যবহার আর টিম স্পিরিট সকলের নজর কাড়ে। বিবেকানন্দ মিশন স্কুলের দশম শ্রেণির ছাত্র উপল, স্যারদের ডান হাত। কোনও কাজেই পিছপা হয় না। কারও বিপদ শুনলে ওইটুকু ছেলে ঝাঁপিয়ে পড়ে।

চন্দনা ওদের ক্লাসের ফার্স্ট গার্ল। উপল যা যা পারে, চন্দনা তা পারে না বলে উপলের ওপর ওর বাড়তি আগ্রহ। উপলের বোন আইরিন একই স্কুলে ক্লাস ফাইভে পড়ে। দাদা যে সকলের প্রিয়, এতে ওর প্রচ্ছন্ন গর্ব আছে। চন্দনা ক্লাসের অন্য ছেলেদের কাছে ঘেঁষতে দেয় না। কিন্তু উপল কিছু বলুক, একবার বললেই করে দেবে।

মাধ্যমিকে উপল টায়-টায় ফার্স্ট ডিভিশন পেল, চন্দনার সবেতেই লেটার মার্কস। আরও ভালো স্কুলে একাদশে ভর্তি হতে পারত। বেচারি, উপলের জন্য একই স্কুলে রয়ে গেল।

কৈশোর অতিক্রম করে উপলের ব্যাপারে চন্দনার আগ্রহ এখন নিখাদ ভালোবাসায় পরিণত হয়েে। কীসে উপলের ভালো হয়, পড়াশোনায় ওকে কতটা সাহায্য করা যায় এসবই চন্দনার ধ্যানজ্ঞান। উপল স্কুলের ফুটবল, ক্রিকেট দলের সদস্য, পাড়ার ক্লাবে জিমও করে, লক্ষ্য এখনও পর‌্যন্ত স্থির। চন্দনা চায় উপল পড়াশোনা করে শিক্ষকতা বা ব্যাংক-এ চাকরি করুক। তবু উপলের পছন্দের উপর প্রভাব খাটাতে পারে না। যাহোক দুটো বছর একসঙ্গে পড়াশোনা করবে, চন্দনার কাছে এই-ই অনেক।

চন্দনা বিজ্ঞান নিয়েে, উপল কমার্স। টিউশনির ব্যস্ততা চন্দনার অনেক বেশি, তাও নিয়ম করে উপলের খোঁজ নেয়। বাংলা, ইংরেজি তো ওদের দুজনেরই আছে। যত প্রশ্নোত্তর চন্দনা তৈরি করে, নোটস সব উপলকে দেয়। মনের আশা, ওগুলো পড়ে যদি উপল একটু ভালো রেজাল্ট করে।

এদিকে পাড়ায় ব্লাড ডোনেশন ক্যাম্প হোক কিংবা কোথাও রিলিফ দেওয়ার ব্যাপার সবার আগে হাজির উপল। মা মনে মনে ভাবে, তাদের মতো ছাপোষা সংসারে ছেলেটা যেন কেমন অন্যরকম। সারাদিনের খাটাখাটনির পর, ক্লান্ত শরীরে উপলের বাবার আর কিছু ভাবার ক্ষমতা থাকে না। এভাবেই দিন গড়িয়ে চলে।

উপলদের পাড়ায় এক বৃদ্ধ দম্পতি আছেন, উপল তাঁদের দাদু-ঠাকুমা বলে ডাকে। কদিন আগে ঠাকুমা পড়ে গিয়ে আর উঠতে পারেন না। কে তুলবে? কে নিয়ে যাবে? উপল হাজির ঠাকুমার সেবায়। প্লাস্টার করিয়ে আনা, রোজকার নিত্যকর্মে সাহায্য করা, এমনকী রান্না করে খাওয়ানো অবধি, উপল একাই করেছে।

মা-র মনে মনে শংকা হয়, এত উদার, এত ভালো ছেলে। কোনও স্বার্থপরতা ওকে স্পর্শ করেনি। যেন দেবতা, মানুষ নয়!

ঠাকুমা তো সুস্থ হয়ে সে কথা জনে জনে বলেন, আমার নিজের ছেলে-বউ,

নাতি-নাতনিরা খোঁজ নিল না। এই প্রাণটুকু কে বাঁচালে? ওই তো উপল।

দেখতে দেখতে দুবছর অতিক্রান্ত হল উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা সামনে। চন্দনার অভিভাবকরা চান ও ডাক্তারি পড়ুক, তাই এসময় তার চাপটা একটু বেশি। উপল যথা পূর্বং তথা পরং। সবকিছুর সঙ্গে মানিয়ে ওর পড়াশোনা।

পরীক্ষার রেজাল্ট বেরোনোর পর দেখা গেল, উপল টেনেটুনে ফার্স্ট ডিভিশন আর চন্দনা সবেতে লেটার পেয়েছে। উপল জানে চন্দনা ডাক্তারিতেও চান্স পাবে। ওর দিক থেকে চন্দনাকে দখল করে রাখার কোনও চেষ্টা নেই। সময় গড়িয়ে যা হবার হবে, আগে ওর লক্ষ্যপূরণ।

দেশের-দশের কাজ করার সুযোগ আছে, এমন একটা চাকরি পাওয়া খুব জরুরি। পুলিশ, মিলিটারি দুইয়েই প্র‌্যাক্টিক্যাল পরীক্ষা খুব কঠিন হয়, উপল জানে। শরীরকে তৈরি রাখতে হয়, কতজন দৌড়ানোর ট্র‌্যাকে অজ্ঞান হয়ে যায়। তবে, স্নাতক হয়ে পরীক্ষাগুলো দেবে, তাহলে সুযোগও বাড়বে।

চন্দনা এখন কলকাতা মেডিকেল কলেজের স্টুডেন্ট, মাঝে মাঝে উপল ওকে কলেজেও পেঁছে দেয়। চন্দনার বাবা-মা-ও উপলকে মেনে নিয়েেন, ওর সততা, সুন্দর ব্যবহারের জন্য। উপলের মায়ের অবশ্য আশংকা, অমন মেধাবী মেয়ে তার সাধারণ ছেলেকে শেষ অবধি বিয়ে করবে তো? মায়ের চিন্তা ছেলে যেন কোনও ভাবে দুঃখ না পায়। তবে সাদাসিধে চন্দনাকে ভালোও লাগে। মেযোর সরলতা সবাইকে মুগ্ধ করে। সবচেয়ে বড়ো কথা, এই পরিবারের ওপর ওর টান, যেন এটা ওর নিজেরই পরিবার।

উপল সিটি কলেজে যায়, কলেজ টিমের হয়ে ইন্টারকলেজ কম্পিটিশনে খেলে।

লং-জাম্প-এ ডিস্ট্রিক্ট চ্যাম্পিয়ন। কলেজ মিটে কলকাতা কমিশনিয়ারেট-এর কর্তাব্যক্তিরা উপলের শারীরিক সক্ষমতার প্রশংসা করে, ওকে চাকরির প্রস্তাবও দেয়।

উপল মেঘ না চাইতে জল পায়, খুশি হয়ে আইরিনের জন্য ফ্রক আর বাড়ির জন্য মিষ্টির প্যাকেট নিয়ে ঘরে ঢোকে। মা মিষ্টি হাতে নিয়ে চোখের জলে ভাসেন। খুশি হবেন নাকি দুঃখ পাবেন, বুঝে উঠতে পারেন না। আইরিন নতুন ফ্রক পেয়ে তিড়িংবিড়িং করে লাফাতে থাকে। মায়ের পীড়াপীড়িতে চন্দনাকে কলেজ ফেরত আসতে বলে, একসঙ্গে খাওয়াদাওয়া করে সেলিব্রেট করবে বলে।

 

পার্ট-টু পরীক্ষার রেজাল্ট বেরোতে উপল কলকাতা পুলিশের ট্র‌্যাফিক গার্ডে সার্জেন্ট হিসেবে জয়ে করে। নিয়মমাফিক সব শারীরিক পরীক্ষা উপলকেও দিতে হয়। চন্দনা অবশ্য তেমন খুশি নয়। তারা যখন ঘরে আরাম করবে, উপলকে তখন রোদে গরমে ডিউটি করতে হবে। মনে মনে ভাবে আরও পড়তে পারত। মুখে কিছু বলে না। ওর আনন্দের সঙ্গে তার নিজের আনন্দকে মিলিয়ে নিতে হবে, এতেই তার সুখ।

চাকরিসূত্রে উপলকে কলকাতা চষে বেড়াতে হয়। শুধু ইন্টার অফিস মিট থাকলে খেলার জন্য ছাড় পায়। কখনও গার্ডেনরিচ তো কখনও বেহালার রাস্তায় ট্র‌্যাফিক সামলাতে দেখা যায় তাকে। বেনিয়ম করে গাড়ি দাঁড় করানো, কি ঘুস নেওয়া, এসবে দেখা যায় না উপলকে। চাকরি জগতেও তার বিরল স্বভাবের নিদর্শন চলতে থাকে। চন্দনা এমবিবিএস ফাইনাল দেবে এ বছর, হাজার ব্যস্ততাতেও উপলের খবর রাখে। ওর ক্ষমতায় যতটুকু কুলায় পরামর্শ দেয়।

সেদিন হেদুয়ার সামনে ডিউটি করছিল উপল। উলটো দিকে বেথুন থেকে কলেজ ফেরত মেযো বেরোচ্ছিল। রাস্তায় দাঁড়িয়ে তিন রোমিও ওদের দিকে বিশ্রী অঙ্গভঙ্গি করছিল। উপলের ব্যাপারটা নজরে আসে। ডিউটির পোশাকে সরাসরি মারধর তো করতে পারে না। গিয়ে ধমক দিয়ে এলাকা ছাড়া করেছিল ছেলেগুলোকে। তখনকার মতো চলে গেলেও,ওরা উপলকে পরে দেখে নেবে বলে শাসিয়ে ছিল।

উপলের কষ্ট হয় এই ভেবে, যে আইরিনও তো দুদিন পরেই কলেজ যাতায়াত করবে আর এইসব ইভটিজারদের খপ্পরে পড়বে। এরা মেয়েের নূ্যনতম সম্মানটুকু করে না, এরা কি আমাদের দেশের পরম্পরা, ঐতিহ্য জানে? কোন ধাতু দিয়ে গড়া, নরকের কীট সব!

চন্দনাকে ফোনে ওইদিনের অভিজ্ঞতা শেয়ার করায়, ওর ভয় দ্বিগুন হল। এমনিতেই উপলকে নিয়ে সবসময় ভয়ে ভয়ে থাকে। উপল চন্দনার মধ্যে ওর মায়ের ছায়া দ্যাখে। সকলের স্বাভাবিক চলাফেরা নিশ্চিন্ত করার জন্য, পুলিশের যে বিশেষ ভূমিকা আছে, ওকথা অস্বীকার করার উপায় নেই। চোখের সামনে অপরাধ দেখে যে চুপ করে বসে থাকা যায় না, তা চন্দনাকে বোঝাতে পেরেছিল।

উপল জোর করে বাবাকে ভিআরএস নেওয়া করিয়েছে। সংসারের পুরো দাযিত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েে। আইরিনকে অনেক দূর পড়ানোর স্বপ্ন দ্যাখে। পরদিন পুলিশ মিট উপলক্ষ্যে ধানবাদ যেতে হবে। আজকে নাইট ডিউটি কলেজ স্ট্রিটে। পরদিন রাতে ধানবাদ যাওয়ার ট্রেন। বিকেলে চন্দনার সঙ্গে দেখা করে নিতে হবে। দু-তিন দিনের জন্য বাইরে গেলে এটা উপলের আবশ্যিক কর্তব্যের মধ্যে পড়ে।

চন্দনাকে বাড়িতেই ডেকে নিল উপল। চন্দনার এ বাড়িতে যাতায়াত এখন স্বাভাবিক ব্যাপার। চন্দনা এল। একটা গোলাপি রঙের সালোয়ার কামিজ পরেছে। আজ কেন যেন উপলের দুচোখ ভরে চন্দনাকে দেখতে ইচ্ছে করছে। চন্দনা অবাক হয় উপলের এই আবেগ দেখে।

মায়ের বানানো লুচি তরকারি দিয়ে দুজনে বিকেলের জলখাবার সারে। দুজনেই হাক্লান্ত, ক্ষিদেও পেয়েছিল বেশ। খেয়ে নিযে উপলের চুলের গোছা নেড়ে দিয়ে চন্দনা বেরোল। বারবার পেছন ফিরে দেখছিল। বেরোনর আগে, ধানবাদ পৌঁছে খবর দেওয়ার কথা বলেছিল। চন্দনা চলে যেতে, আইরিনকে কটা অঙ্ক বুঝিয়ে রাতের ডিউটিতে যাওয়ার জন্য তৈরি হয়ে নিল উপল।

 

মা আজ পাড়ায় কীর্তন শুনতে যাবেন। তাও ছেলের কাচা পোশাক, সবকিছু গুছিয়ে দিলেন। কী মনে হতে উপল ঢিপ করে মাকে একটা প্রণাম করে নিল। সংসার চালানোয় মায়ের নিপুণতা উপলকে মুগ্ধ করে। চন্দনাকে ঘিরেও স্বপ্নের বীজ বোনে। বড়ো শ্রীমযী চন্দনা, অফুরন্ত ভালোবাসা দেয় তাকে।

আজ ডিউটিতে উপল ছাড়াও আরও দুজন সার্জেন্ট আছে। রাতের রাস্তা আস্তে আস্তে ফাঁকা হচ্ছে, ভারী গাড়ির আনাগোনা এসময় বেশি। দুজন সঙ্গী কাছের দোকানে চা খেতে গেল। উপল সতর্ক চোখে তাকিয়ে আছে। হঠাত্, ওকি!

বাইকের পেছনে একজন তরুণী, চালাচ্ছে এক যুবক। পাশে একটা গাড়ি থেকে বাইকটাকে ডিসটার্ব করা হচ্ছে। তরুণীর ওড়নাটাকেও টেনে ধরেছে।

গাড়িটাকে দাঁড় করাল উপল। ভেতর থেকে মদ্যপদের খিস্তি, খেউড় ভেসে আসছে। ওরা নেমে এসে উপলের ওপর চড়াও হল। চারজনে মিলে লাগাতার মেরে চলেছে ওকে। একা অভিমনু্য় যেন জগতের সব লাঞ্ছনা মুছে দিতে চাইছে। নাক দিয়ে রক্ত ঝরছে, পা ভেঙে গিয়েে, কেউ সাহায্য করতে এগিয়ে আসছে না। এমনকী, যে-বাইকআরোহীদের বাঁচাতে সে এগিয়েিল, তারাও না। উপলের দৃষ্টি ক্রমশ ঝাপসা হচ্ছে। চোখের সামনে ভাসছে চন্দনার মুখ, কানে বাজছে আইরিনের দাদা ডাক, মায়ের কাতরতা। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের অভিমনু্যর মতোই ক্ষতবিক্ষত, রক্তস্নাত হয়ে পথেই পড়ে রইল সে।

সঙ্গী দুজন ফিরে আসার আগেই শয়তানগুলো পালিয়েে। পুলিশের গাড়িতে চলেছে ভারতমাতার সাহসী সন্তান। নারী লাঞ্ছনার প্রতিবাদে যে নিজের প্রাণটাই বাজি রেখেছে। কাছাকাছি কলকাতা মেডিকেল কলেজে নিয়ে যাওয়া হল উপলকে। ডিউটি নার্স ওকে দেখেই চমকে উঠলেন। কারণ চন্দনার সঙ্গে উপলকে আগে দেখেছেন আর ও যে পুলিশে আছে সে কথাও জানেন।

ওয়ার্ডবয়ে সাহায্যে দ্রুত ট্রমা কেয়ারের আইসিইউতে নিয়ে চললেন। এক ফাঁকে ফোনে চন্দনাকে সব জানালেন। ডাক্তারি শপথ কি আর প্রিয়জনদের ক্ষেত্রে খাটে? আবেগ কি প্রশমিত করা যায়? চন্দনাও পারল না, শোকে মূর্ছিতাপ্রায় হয়ে বান্ধবীদের সঙ্গে এসে পৌঁছোল। ওর স্যারেরাও জান-প্রাণ লড়িয়ে দিলেন। প্রশাসনিক মহল থেকেও বিশেষ তত্পরতা দেখা গেল। ঘটনাস্থলে প্রচুর ব্লিডিং হয়েিল। তাই অরগ্যানস-এ, বিশেষ করে মাথায় অক্সিজেনের ঘাটতি এমন পর‌্যায় পৌঁছেছে যে, কোনও ওষুধই ঠিকমতো কাজ করছে না। উপল গভীর কোমায় চলে যাচ্ছে। উপলের আত্মীয়পরিজনেরাও এসেছেন ওর মাকে সামলানোর জন্য।

দৈনন্দিন জীবনে যে-যার সমস্যায় ব্যস্ত থাকে কিন্তু বিপদ এলে রক্তের সম্পর্ককে উপেক্ষা করা যায় না। ডাক্তারির অভিজ্ঞতায় চন্দনাও বুঝতে পারছে, শেষের সে ক্ষণ আসন্ন। আগামী চিরবিচ্ছেদের আশঙ্কার মধ্যেও ওর চোয়াল শক্ত হয়, রাস্তার গুন্ডাগুলোর কথা ভেবে। আইসিইউ-এর কাচের বাইরে উপলের দিকে স্থির চোখে তাকিয়ে আছে চন্দনা।

চোখের সামনে অদৃশ্য পর্দায় ভেসে উঠছে তাদের ছোটোবেলা, কৈশোর ও যৌবনে একসঙ্গে কাটানো মুহূর্তগুলো। ভেতরে নদীর পাড় ভাঙা টের পাচ্ছে, কেমন জীবন হবে তার উপলকে ছাড়া? মাসিমা, আইরিনকেই বা কীভাবে সামলাবে? ভাবনার ছন্দপতন হল বোস স্যার কাঁধে হাত রাখলেন, হি ইজ নো মোর মাই চাইল্ড, বলে মাথা নীচু করলেন।

ওরা উপলকে ঢেকে দিচ্ছে, এক ছুটে ঢুকল চন্দনা। শেষবারের মতো উপলের চুলে বিলি কেটে দিতে হবে না! ও তো সব দুঃখ, কষ্ট, যন্ত্রণা, অপমান থেকে বহুদূরে আরামে ঘুমোতে যাচ্ছে।

স্কুল জীবনের বন্ধুবান্ধবরাও অনেকে খবর পেয়ে এসেছে, চন্দনার সঙ্গে সঙ্গে থাকছে। শোকেরও তো সুযোগ নেই! পোস্টমর্টেম না হলে তো বডি দেবে না। চন্দনার বাবা-মাও আছেন, সবারই বাড়ি ফেরা স্থির হল। পরদিন আসতে হবে।

চোখের জলে ভেসে, বাবা-মার কাঁধে ভর দিয়ে চন্দনা বেরিয়ে আসে তার রোজকার ফেরার করিডর দিয়ে যে-করিডরে উপলও অনেক দিন তাকে সঙ্গ দিয়েে। মাসিমাকে দূর থেকে দেখতে পায়, উপলের মামাদের সঙ্গে। ওদের দাযিত্ব তো উপল তার ওপরে ছেড়েই অকালে বিদায় নিল।

পরদিন কাচের গাড়িতে উপল চলল সেইসব রাস্তা দিয়ে যে-রাস্তায় একনিষ্ঠতার সঙ্গে ডিউটি করেছে সে। পেরিয়ে যায় ওর কলেজ, থানায় গার্ড অফ অনার নিয়ে চলল পঞ্চভূতে লীন হতে।

চন্দনা মাসিমার সঙ্গে সেঁটে আছে, আইরিনই দাদার মুখাগ্নি করল। ইলেকট্রিক চুল্লির অন্ধকারে মিলিয়ে গেল, আলোকিত এক প্রাণ তার সমস্ত জাগতিক সম্ভাবনা নিয়ে চন্দনা চোখের জল মুছে শক্ত হল। তার এখন অনেক কাজ। প্রথম কাজ হল উপলের ওপর ঘটে যাওয়া জঘন্য অপরাধের প্রতিবিধান করা। প্রশাসন কী কী পদক্ষেপ করছে, তার ওপর কড়া নজর রাখবে সে। সঙ্গে উপলের চাকরির জায়গার পাওনা-গন্ডা পরিবার ঠিকমতো পাচ্ছে কিনা দেখা। ডিউটিরত অবস্থায় যখন ঘটনা ঘটেছে, তখন বিশেষ ক্ষতিপূরণও মাসিমা পাবেন।

খবর এল অপরাধী চারজন ধরা পড়েছে, তবে জেল-আদালতে চক্কর কাটা ছাড়া তো কোন সুরাহা হবে না। চন্দনা ওর এক বান্ধবীকে আইরিনকে পড়াবার দাযিত্ব দিয়েে। সবকিছুর মাঝে উপলের তার বোনকে ঘিরে দেখা স্বপ্নটা নষ্ট না হয়ে যায়। আদালতে সাক্ষ্য দেওয়ার লোকই তো পাওয়া যাচ্ছে না! এক চলমান শহরে, ছুটে চলে যাওয়া সাক্ষীদের কোথায় পাওয়া যাবে?

ওদিকে অপরাধী পক্ষ, সমাজে প্রভাবশালী হওয়ায়, টাকা ছড়িয়ে মিথ্যে সাক্ষী ধরে ধরে নিয়ে আসছে। চন্দনা ওর নেটওয়ার্ককে কাজে লাগিয়েে, ওই বাইকআরোহী আর মেযোকে খুঁজে বার করার জন্য। প্রাইভেট ডিটেক্টিভও লাগিয়েে। পুলিশ চেষ্টা করছে কিন্তু চন্দনা ভরসা রাখতে পারছে না। প্রভাবশালীদের হস্তক্ষেপে যদি খোঁজার আন্তরিকতা না থাকে। আদালতে সরকারি উকিল ছাড়াও ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় ভালো উকিল ঠিক করে রেখেছে।

নিজস্ব নেটওয়ার্কের মাধ্যমে ওই বাইকআরোহী আর মেযোর খোঁজ পেয়েে। একদিন লুকিয়ে দেখা করতে গেল। বুঝিয়ে বলল, উপলের মা, বোনের কথা। তার নিজের দুঃখের কথা। মেযো লজ্জা, অপমান, অনাগত আশংকায় কিছুতে রাজি হচ্ছে না সাক্ষ্য দিতে। চন্দনা অনেক চেষ্টা করল, ওর বিবেককে জাগ্রত করার। শেষে সব পরিস্থিতি চন্দনা সামলাবে, পুলিশও পাশে থাকবে এসব বলে যখন ফিরছে দূর থেকে দেখল ওই বাড়িতে কারা যেন ঢুকছে।

পরদিন অপরাধীদের সনাক্তকরণ প্যারেডে আনা হল, ম্যাজিস্ট্রেটের কক্ষে। গোপন জবানবন্দিতে মেযো জানাল, অপরাধী বলে যাদের আনা হয়েে তাদের সে চেনে না। কোনও দিন দেখেনি আর ঘটনার সময় ঘটনাস্থলে ভালো আলো ছিল না বলে, পরিষ্কার ভাবে সে কিছু বোঝেনি। তাকে যেন ভবিষ্যতে আর বিরক্ত করা না হয়।

শেষ আশাও বিফলে যাওয়ায় চন্দনা মাথা নীচু করে বসে আছে। এ সময় ওর কাঁধে কে হাত রাখল। আরে আইরিন! নিঃশব্দে কাঁদছে আইরিন। শক্ত করে ধরেছে চন্দনার হাত। সব আশ্বাস যেন ওই হাতেই আছে। আইরিনের মধ্যেই যেন উপলকে দেখতে পেল চন্দনা।

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...