মাথা নীচু করে ক্লাসে ঢুকতেই শুনতে পেলাম একজন ক্লাসমেট-এর মন্তব্য— শালা ভিখারির বাচ্চাটা এসে গেছে।

আর একজনের কটূক্তি শব্দভেদী বানের মতো অতর্কিতে ছুটে এল আমার দিকে– ব্যাটার হিরো হওয়ার শখ একেবারে ঘুচে গেছে।

আমি ওদের কথায় কান না দিয়ে পাস কাটিয়ে লাস্টবেঞ্চের এক কোণে বসলাম। এখন শুধু কটূক্তি শোনার পালা, র্যালা মারার দিন আমার শেষ। আমি শেকসপিয়রের জুলিয়াস সিজারের মতো পরাজিত রোমান সম্রাট। আমার চারপাশে ব্রুটাসের দল আমাকে হেনস্থা করার জন্য ওত পেতে আছে। আমার পরাজয়েই তাদের সুখ। তাদের আনন্দ।

রাগে আমার গা রি রি করছে। অথচ কিছু করার নেই। ক্লাসের সমস্ত সিলিং ফ্যানগুলো ফুল স্পিডে চলা সত্ত্বেও আমার গা দিয়ে দরদর করে ঘাম ঝরছে। অথচ এটা গ্রীষ্মকাল নয়, ভরা শ্রাবণ। শরৎ আসতে আর দেরি নেই। এর মধ্যেই একটু ঠান্ডা ভাব এসে গেছে। ভোরের দিকে শীত শীত মনে হয়। আকাশে বাতাসে পুজো পুজো গন্ধ। ভোরের দিকে শিউলির গন্ধ টের পাই।

কী শীত কী গ্রীষ্ম, সব সময়েই আমার গা দিয়ে ঘাম ঝরে। মনে হয় আমার শরীরে নুনের পরিমাণ একটু বেশি আছে। যাই হোক,

জিন্স-এর ট্রাউজারের পকেটে হাত ঢুকিয়ে ঘাম মোছার জন্য রুমালটা বার করতে যেতেই শূন্য হাতটা উঠে এল। অর্থাৎ আমার রুমাল হাওয়া। বেশ মনে আছে বাড়ি থেকে বেরোবার সময় সুগন্ধি লাল রুমালটা পাঞ্জাবির বাঁ পকেটে যত্ন করে রেখেছিলাম। পকেটে এখনও সেন্টের গন্ধ ম-ম করছে। এই, এই একটা জিনিস পকেটে রাখতে কখনও ভুল করি না। ও আমার নিত্য সহচর। একান্ত আপন।

একবার ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের গার্ডেনে কলেজ থেকে কাট মেরে আমি আর নন্দিতা বসে গল্প করছিলাম। একবার গল্প শুরু হলে বাড়ি ফেরার কথা আমাদের মনেই থাকত না। হঠাৎ অস্তমিত সূর্যের কিরণ চোখে এসে পড়তেই নন্দিতা তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়িয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল– এই রে দেরি হয়ে গেছে। তাড়াতাড়ি চল বাড়ি ফিরতে হবে। বাড়িতে বলেছি অনার্সের স্পেশাল ক্লাস আছে। দেরি হলেই মা চিন্তা করবে।

নন্দিতা সবুজ ঘাসের ওপর যে রুমালটা পেতে বসেছিল সেটা না নিয়েই উঠে পড়েছিল। আমি ওর অলক্ষ্যে সেই রুমালটা কুড়িয়ে পকেটে পুরেছিলাম। যেন সাত রাজার ধন এক মানিক কুড়িয়ে পেয়েছি। ট্রেনে জানলার ধারে বসে গরমে ঘাম মুছতে গিয়ে তার মনে পড়েছিল রুমালটার কথা। মনে পড়া মাত্রই সে তার নিজস্ব ভঙ্গিতে বলে উঠেছিল, ‘এইরে ভিক্টোরিয়ার মাঠে রুমালটা ফেলে এসেছি।’

আমি আমার রুমালটা ওর দিকে বাড়িয়ে দিয়ে চাপাস্বরে বলেছিলাম, ‘ওটা আমার পকেটে আছে।’

–তা হলে তোরটা কেন, আমার রুমালটা দে।

–ওটা আর তোকে দেব না। তুই যখন আমার পাশে থাকবি না তখন এই রুমালটার সুগন্ধ তোর কথা আমায় মনে করিয়ে দেবে। তোর ঘামে ভেজা শরীরের সুগন্ধ ওই রুমালটার মধ্যেই খুঁজে পাব।

আমার কথা শুনে নন্দিতা বলেছিল, ‘রুমাল নিলে কিন্তু প্রেম টেকে না। ছাড়াছাড়ি হয়।’

বলেছিলাম, ‘সেই জন্যই তো এখন থেকে তোর একটা স্মৃতি নিয়ে রাখলাম।’

আমার বেশ মনে আছে বাড়ি থেকে বেরোবার সময় রুমালটা পকেটে রেখেছিলাম। সেটা কোথায় হারিয়েছি কে জানে। আজ যে এরকম অঘটন হবে বুঝতেই পারিনি। সকালে কার মুখ দেখে উঠেছিলাম কে জানে।

আজ শনিবার। মনে হয় আজ আমার ওপর শনির কোপ পড়েছে। বাড়ি থেকে বেরোবার সময় যথারীতি মা তারার ফটোকে ভক্তি ভরে প্রণাম করেছি। তবে কোন পাপে আমার এই দশা হল। মনে করতে চেষ্টা করলাম আজ সকাল থেকে এ পর্যন্ত কী কী পাপ করেছি। যতদূর মনে পড়ে একটাও মিথ্যে কথা বলিনি। কাউকে কটু কথা বলিনি। এমনকী কারও বাড়া ভাতে ছাই দিইনি। বরং শেওড়াফুলি স্টেশনের বুকিং কাউন্টারের সামনে বসা ভিখারিকে আজ এক টাকার একটা কয়েন দিয়েছি। তাকে দেখলেই কেন জানি না আমার মৃত ঠাকুমার কথা মনে পড়ে। আমার ঠাকুমার মুখের সঙ্গে তার হুবহু মিল আছে।

হঠাৎ মনে পড়ে গেল আজ সকালে ঘুম থেকে উঠেই পাশের বাড়ির মাকুন্দ নিতাইয়ের মুখ দেখেছি। লোকে বলে ওর মুখ দেখলেই নাকি দিনটা খারাপ যায়। হলও তাই। একটা অপয়া লোকের মুখ দেখার জন্যই আমার রুমাল হারিয়ে গেছে। রুমাল হারানোর কথা ভাবতে গিয়ে হঠাৎ আমার মাথার বাঁদিকে মৃদু যন্ত্রণা শুরু হল। চোখে অন্ধকার দেখলাম। একটা অ্যানাসিন পেলে হতো। হাতের কাছে তা যখন নেই, তখন জলই খাওয়া ভালো। ফোলিও ব্যাগের চেনটা খুলে প্লাস্টিকের বোতল বার করে ঢকঢক করে খানিকটা জল খেয়ে নিলাম। তাতেও আমার যন্ত্রণা কমল না বরং বেড়ে গেল। যন্ত্রণাটা মাথার না মনের কিছুই বুঝে উঠতে পারলাম না।

আমার পাশে বসা সুনীতি ব্যানার্জী হঠাৎ বলে উঠল, ‘কিরে ভাস্কর তোর মুখটা অমন শুকনো লাগছে কেন? কি হয়েছে তোর? এনিথিং রঙ?’

ওর কথা কানে ভেসে আসতেই আমার তন্ময়তা কাটল। আমি এতক্ষণ একটা ঘোরের মধ্যে ছিলাম। বুঝতেই পারিনি কখন ইংরেজির প্রফেসর পড়ানো শেষ করে ক্লাস থেকে চলে গেছেন। কখন গুলতানি শুরু হয়েছে ক্লাসে।

বললাম, ‘জানিস আজ আমার রুমালটা হারিয়ে গেছে। ওটা আমার ভীষণ পয়া ছিল।’

ব্যস পাগলকে দিয়েছি সাঁকো নাড়া দিতে। সুনীতি আমার কথা শুনে ব্ল্যাক বোর্ডের কাছে গিয়ে গলা চড়িয়ে বক্তৃতার ঢঙে বলল, ‘লেডিজ এ্যান্ড জেন্টলম্যান, আজ আমাদের ভাস্কর স্যান্যালের রুমাল হারিয়ে গেছে। ওর মন খারাপ। তাই ওর শোকাচ্ছন্ন মনের শান্তির জন্য এসো আমরা এক মিনিট নীরবতা পালন করি।’

তার কথা শুনে ক্লাস শুদ্ধু সকলের সে কি হাসি। চন্দননগরের মেয়ে কস্তুরী সিন্হা হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ল। আমার এখন ইচ্ছে করছে এক ঘুসি মেরে ওর বত্রিশ পাটি দাঁত ফেলে দিতে। ও আগে বিধান কলেজে পড়ত। হঠাৎ কি খেয়াল হল ওখানে এক বছর পড়ে আমাদের কলেজে উড়ে এসে জুড়ে বসেছে। অনেকের মুখে শুনেছি রিষড়ার বিধান কলেজের অনেক ছেলের মাথা খেয়ে আমাদের কলেজে ঢুকেছে। এক নম্বর ছেলেবাজ।

কস্তুরী আমাদের কলেজে ভর্তি হওয়ার পর থেকেই অনেকেরই চিত্তচাঞ্চল্য বেড়ে গেছে। চারটে বাজলেই যারা পালাই পালাই করত, তারা পাঁচটা পর্যন্ত কলেজে থাকে। আসলে কস্তুরীর মেয়েদের চাইতে ছেলে বন্ধু বেশি। কস্তুরী যেখানে ছেলেরাও সেখানে। এ যেন সেই চিটে গুড়। যেখানে রাজ্যের মাছি ভন ভন করে। অথচ কস্তুরীকে দেখতে এমন কিছু আহামরি নয়। খুবই সাধারণ। গায়ের রং কালো, মুখটা লম্বা মতন, চোখ দুটো বড়ো বড়ো। দেহে মেদের পরিমাণ বেশি। দূর থেকে দেখলে মনে হবে একেবারে সাক্ষাৎ মা কালি। তবু কি আশ্চর্য সে আমাদের কলেজের অনেক ছেলের চোখে বিশ্ব সুন্দরী, মিস ইউনিভার্স। টিফিনের সময় ক্যান্টিনে গেলেই কলেজের ছেলেগুলো ওর সামনে মাছির মতো লেপটে থাকে।

ওদের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা লেগে যায় কস্তুরীর পাশের চেয়ারে কে বসবে। পাশে বসলে কস্তুরীর শরীরের অল্প বিস্তর স্পর্শ সুখ ফাউ পাওয়া যায়। আমি ওই প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ভুলেও অংশগ্রহণ করি না। ওরা যখন অফ পিরিয়ডে খোশ মেজাজে গল্প করে আমি তখন এক কোণে বসে বাংলা অনার্সের রেফারেন্স বইয়ের ভেতর ডুবে থাকি। ওদের আলোচনার বিষয় হল পরচর্চা আর রাজনীতি যা আমার একেবারেই ভালো লাগে না। আমি আসলে হই হট্টগোল পছন্দ করি না। তা ছাড়া যেখানে একজন মেয়ের সঙ্গ অনেকে কামনা করে, আমি তাদের থেকে সব সময় দূরে থাকি।

তবু চক্ষুলজ্জার মাথা খেয়ে কস্তুরী যখন ইংরেজি সাহিত্যের ইতিহাস সম্পর্কে আলোচনা করতে আসে, আমার তখন বুকের মধ্যে ধুক-পুকুনি শুরু হয়। আমি তখন ইষ্টনাম জপ করতে থাকি। ক্লাসের ছেলেগুলো বিষদৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। মনে হয় কস্তুরী ওদের যেন ব্যক্তিগত সম্পত্তি। ওদের জিনিসে ভাগ বসাব এমন ইচ্ছে আমার কখনও হয়নি। কস্তুরী যদি সেধে আমার সঙ্গে গল্প করতে আসে আমি কী করব?

একদিন লাইব্রেরি রুমে ও আমাকে বলেছিল, ‘তোমার গায়ে প্রেম প্রেম গন্ধ। তুমি অনেক মেয়ের সঙ্গে প্রেম করবে।’

বলেছিলাম, ‘প্রেমের আবার আলাদা গন্ধ আছে না কি?’

কস্তুরী বলেছিল, ‘তোমার কথাবার্তায়, চালচলনে তো অনুভব করা যায়। তা ছাড়া তুমি তো আমাদের পাত্তাই দাও না।’

বলেছিলাম, ‘ওটা তোমাদের ভুল ধারণা। তোমাদের সঙ্গে নিজেকে ঠিক খাপ খাওয়াতে পারি না। তা ছাড়া আমি একটু নির্জনতা পছন্দ করি।’

কস্তুরী তখন বলেছিল, ‘বলো কোন নির্জন জায়গায় তুমি যেতে চাও? জু গার্ডেন, মিলেনিয়াম পার্ক, ভিক্টোরিয়া, প্রিন্সেপ ঘাট। যেখানে শুধু আমি আর তুমি সারাদিন মজা করে কাটাব।’

বলেছিলাম, ‘ঠিক আছে। পরে ভেবে বলব।’

হঠাৎ রঙ্গমঞ্চে গদা হাতে ভীমের প্রবেশের মতো পলিটিক্যাল সায়েন্সের প্রফেসর এন দে, এসে হাজির। উনি সাধারণত ঘন্টা পড়ার সঙ্গে সঙ্গে আসেন না। আজ হঠাৎ এসে গেলেন। ওকে ঢুকতে দেখে ক্লাসের সব ছেলে মেয়েরা হাসি বন্ধ করে ক্লাস নোটের খাতা খুলে বসল। ভয়ে কস্তুরীর মুখ এতটুকু হয়ে গেল।

প্রফেসর এন দে তাঁর চেয়ারে বসে প্রথমেই বললেন, ‘আমি জানতে চাই তোমাদের হাসির কারণটা কি?’

শঙ্কর উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘স্যার আমাদের ভাস্কর স্যান্যাল

মা-আ-নে…’

প্রফেসর এন দে আমার দিকে ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন, ‘কি ব্যাপার ভাস্কর।’

আমি উঠে দাঁড়িয়ে মাথা নীচু করে বললাম, ‘স্যার আমার একটা রুমাল হারিয়ে গেছে। শুনে ওরা সবাই হাসছিল।’

আমার কথা শুনে ক্লাসের সকলকে উদ্দেশ্য করে এন দে বললেন, ‘মনে রেখো এটা কলেজ। ক্লাবঘর নয়। আর যেন কখনও এরকম না হয়। তোমাদের মনে রাখা উচিত পাশের ঘরে আর একটা ক্লাস চলছে। অসভ্যতা তোমাদের এখনও গেল না।’

কলেজ ছুটির পর মন খারাপ করে বাড়ি ফিরলাম। আজ কিছুই ভালো লাগছে না। না ভালো লাগছে টিফিন খেতে, না ভালো লাগছে পার্ট টু-এর পড়া করতে। মাকে শরীর খারাপের অজুহাত দেখিয়ে রাতে কিছু না খেয়েই বিছানায় শুয়ে পড়লাম। বারবার লাল রুমালটার কথা মনে পড়ল। নন্দিতার সব চিঠি পুড়িয়ে ফেললেও রুমালটা ফেলে দিতে পারিনি। লেডিস রুমালটা আমার রক্ত মাংস, মেদ মজ্জার সঙ্গে একাত্ম হয়েছিল। আজ সেটা হারিয়ে যেতে মনে হচ্ছে এত দিন নন্দিতার যে স্মৃতি উজবুকের মতো বয়ে বেড়িয়েছি, আজ তা থেকে মুক্তি পেলাম। স্বপ্নে দেখতে পেলাম নন্দিতার লাল রুমালটা রাজপথে অযত্নে পড়ে আছে। পথচারীরা রুমালটা মাড়িয়ে আমার প্রেমকে দুপায়ে থেঁতলে চলে যাচ্ছে।

হঠাৎ মাঝরাতে বাড়ির ফোনটা বেজে উঠতেই ঘুমটা ভেঙে গেল। মিউজিক থামার পর ফোনটা ধরতেই ক্লাসমেট সুনীতি ব্যানার্জীর গলা ভেসে এল, ‘হ্যালো ভাস্কর সুখবর আছে।’

–সুখবর?

–হ্যাঁ, নন্দিতার সঙ্গে বলাই-এর ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে।

–কেন ?

–বলাই এখন রীনার প্রেমে মেতেছে। বড়োলোকের প্রেম মানেই চায়ের ভাঁড়ে চুমুক দিয়ে ফেলে দেওয়া।

–খবরটা দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ। গুড নাইট, বলে আমি বিরক্ত হয়ে ফোনটা ছেড়ে দিয়ে শুয়ে পড়লাম।

সোমবার প্রফেসর প্রতাপরঞ্জন হাজরার ক্লাস ছিল এগারোটায় কিন্তু আমি চলে এলাম পৌনে দশটায়। এত আগে আমার কলেজে আসার কথা নয়। কিন্তু কেন জানি না আমি খানিকটা ঘোরের মধ্যে এক ঘন্টা আগে চলে এসেছি। ঘোরের মধ্যেই কখন জিন্স-এর ট্রাউজারের বদলে পাজামা পাঞ্জাবি পরেছি খেয়াল নেই। এই কেন-র উত্তর আমার জানা নেই। কে জানে কেন আজ সকাল হতেই একজনের মুখ আমার অবচেতন মনে ভেসে উঠেছিল। তাকে দেখার জন্যই কি আজ আমি সাত তাড়াতাড়ি কলেজে চলে এসেছি। কে জানে হয় তো তাই। কিন্তু যে আমাকে বিট্রে করেছে তার জন্য কেন এত ভেবে মরছি। ভালোবাসা কি এতই ঠুনকো।

যাইহোক সাত তাড়াতাড়ি যখন কলেজে এসেই পড়েছি তখন রেফারেন্স বই দেখে নোটটা লিখে ফেলা যাক। কারণ বইটা আর একদিন রাখলেই লাইব্রেরিতে আমাকে ফাইন দিতে হবে। এখনও কলেজে কোনও ছাত্র আসেনি। নিরিবিলিতে রেফারেন্স বই দেখে যতটা লেখা যায়। সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠে একেবারে কোণের ক্লাস রুমের ভেজানো দরজা ঠেলতেই চোখ পড়ল লাস্ট বেঞ্চে কে যেন আধশোয়া অবস্থায় রয়েছে। আধো আলো আধো অন্ধকারে দূর থেকে দেখা গেল বেঞ্চের নীচে গোলাপি ফলস্ পাড় ঝুলছে।

বুকটা আমার ছ্যাঁত করে উঠল। অশরীরী প্রেতাত্মা নয় তো? দু’বছর আগে পার্ট ওয়ানের একজন ছাত্রী ফাইনাল পরীক্ষায় রেজাল্ট খারাপ হয়েছিল বলে গলায় ওড়নার ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যা করেছিল। যে ঘরে সে আত্মহত্যা করেছিল আমি এখন সেই ঘরের দরজার সামনে একা দাঁড়িয়ে। মেয়েটার নাম সুমনা রায়। শ্রীরামপুরে বাড়ি। খুব হাসিখুশি মেয়ে ছিল। অনেকেই নাকি সন্ধের পর তাকে তিন তলার ছাদে ঘুরতে দেখেছে। কাঁধে শান্তিনিকেতনি চামড়ার ব্যাগ, চুলে বিনুনি। দু’বছর আগে মারা গেলেও সে এখনও কোন্নগর হীরালাল পাল কলেজের মায়া ছাড়তে পারেনি।

আমি যে এক ছুটে তাড়াতাড়ি নীচে নেমে যাব তার উপায় নেই। কে যেন আমার পায়ে পেরেক ঠুকে এখানে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। হঠাৎ নারী কণ্ঠের মৃদু গোঙানির শব্দ ভেসে আসতেই চমকে উঠলাম। আমি মনে মনে সাহস সঞ্চয় করে এগিয়ে দেখলাম নন্দিতা হাঁটু মুড়ে কপালে হাত রেখে শুয়ে আছে। মাথার নীচে বইয়ের ব্যাগ। জল ভরা প্ল্যাস্টিকের বোতল রয়েছে পাশের বেঞ্চিতে। মেহগনি গাছের ফাঁক দিয়ে একফালি রোদ্দুর জানলা দিয়ে টপকে তার মেক-আপ করা মুখে এসে পড়েছে।

আমি তার যন্ত্রণা কাতর মুখটা দেখে বললাম, ‘এই তোর কি হয়েছে?’

আমাকে দেখে তার কাজল টানা চোখ দিয়ে টসটস করে জল পড়তে লাগল। এর আগে নন্দিতাকে কলেজে অনর্গল কথা বলতে দেখেছি, হাসতে দেখেছি। কখনও এরকম কাঁদতে দেখিনি। কাঁদলেও যে তোকে কত মধুর লাগে তা এই প্রথম দেখলাম। সে চোখের জল মুছে বলল, আজ সকাল থেকে এ্যাপেন্ডিসাইটিসের ব্যথাটা হচ্ছে।

বললাম, ‘ডাক্তার দেখাসনি কেন?’

‘দেখিয়েছিলাম। পার্ট টু পরীক্ষা হলেই অপারেশন করতে হবে’, বলে নন্দিতা কপাল থেকে হাতটা সরাল।

হাতটা সরাতেই তার লাল কাচের চুড়ির শব্দে মল্লার রাগ বেজে উঠল। কোথা থেকে একটা পায়রা ডানা ঝাপটিয়ে ভেন্টিলেটারে গিয়ে বসল। মুখে মুখ লাগিয়ে তার প্রেমিকার সঙ্গে বকবকম শুরু করে দিল।

 

আমি তার পায়ের কাছে বসে বললাম, ‘তোর পেটে একটু হাত বুলিয়ে দিই। দেখবি ভালো লাগবে।’

 

সে কোনও কথা না বলে শুধু তার পেটের কাছ থেকে শাড়ির অাঁচলটা সরিয়ে দিল। যন্ত্রণা কমানোর উদ্দেশ্যে আমি তার মাখনের মতো নরম ফরসা পেটে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললাম, ‘জানিস তোর রুমালটা কাল হারিয়ে গেছে।’

সে কথা শুনে নন্দিতা উঠে বসে আমার গলা জড়িয়ে ধরে বলল, ‘রুমাল হারিয়েছে তো কী হয়েছে? আমাকে তো পেয়েছিস।’

আমি কিছু বলার আগেই সে তার উষ্ণ চুম্বনে আমার ঠোঁট দুটো পুড়িয়ে দিল। ভুলিয়ে দিল রুমাল হারানোর কষ্টটা।

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...