মানালি থেকে কাজা

‘স্পিতি’ শব্দটির অনুবাদ করলে মোটামুটি দাঁড়ায় ‘মধ্যদেশ’। এ নামের কারণ খুঁজতে অবশ্য অসুবিধা হবার কথা নয়। স্পিতির অবস্থান ও ঐতিহ্য– ভারত ও তিব্বতের প্রেক্ষিতে বিচার করলে এ নামকরণ সমর্থন করতেই হয়। এই অঞ্চল জুড়ে বয়ে গেছে অনেকগুলি দ্রুত স্রোতস্বিনী ছোটো নদী, আর প্রধান নদী স্পিতি প্রায় সমগ্র অঞ্চলের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত হয়ে ‘খাব’ অঞ্চলে শতদ্রুর সঙ্গে মিলিত হয়েছে। স্পিতি হল এক শীতল মরুভূমি। বর্ষাকালে কখনও বৃষ্টি হয় না, ফলে এ অঞ্চলের রুক্ষ ভয়ংকর সৌন্দর্য উন্মোচিত হয় সুউচ্চ পর্বতশৃঙ্গ এবং সংকীর্ণ উপত্যকাগুলির মধ্যে।

রুডিয়ার্ড কিপলিং ‘স্পিতি’ সম্পর্কে বলেছিলেন ‘আ ওয়ার্ল্ড উইদিন আ ওয়ার্ল্ডড’ আর ‘আ প্লেস হোয়্যার গডস লিভ’ অর্থাৎ পৃথিবীর অন্দরে আর-এক নতুন পৃথিবী, যেখানে দেবতাদের আবাস। এখনও বোধহয় এই কথা ফেলে দেওয়া যাবে না। স্পিতি যেন চাঁদের পাহাড়, তার খাঁজে খাঁজে বৌদ্ধ গুম্ফাগুলির অবস্থিতি, মাঝে ছোটো ছোটো গ্রাম, অসাধারণ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের ব্যাপ্তি। ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে অনেকগুলি সরোবর। অনেকেই স্পিতির তাই নাম দিয়েছেন ‘ছোটো লাদাখ’। এবার আমরা চলেছি সেই আশ্চর্য দেশের সন্ধানে।

ঠিক হল চণ্ডীগড় পর্যন্ত আমরা বিমানেই যাব। এর ফলে লম্বা ট্রেন জার্নির ক্লান্তি অনেকটাই কমবে। কারণ এর পরে রয়েছে কষ্টসাধ্য সফর। কলকাতা থেকে বিমান দিল্লি হয়ে ঠিক সময়েই এসে নামল চণ্ডীগড় বিমানবন্দরে। তারপর পূর্বনির্ধারিত গাড়ি খুঁজে মালপত্র চাপিয়ে যাত্রা শুরু হল। প্রথম গন্তব্য মানালি। চণ্ডীগড় থেকে দূরত্ব ৩২০ কিমি। সময়টা জুলাই মাসের শেষ সপ্তাহ, লাহুল স্পিতি ভ্রমণের উপযুক্ত সময়। কারণ এসব অঞ্চলে বর্ষায় বৃষ্টি হয় না, বছরের মধ্যে পাঁচ-ছয় মাস থাকে বরফের নীচে, যানবাহন চলে না। বরফ গললে পাস খুললে, জুন থেকে অক্টোবর মাসে এসব অঞ্চলে কর্মচাঞ্চল্য।

‘কাজা হল স্পিতি উপত্যকার প্রধান শহর– মহকুমা সদর। স্পিতি মহকুমা লাহুল স্পিতি জেলার অন্তর্ভুক্ত। জেলা শহর হল কেলং, কাজা থেকে ১৮৮ কিমি দূরে আর মানালির থেকে কাজার দূরত্ব ২০১ কিমি। স্পিতি মানে শুধু পাহাড় আর পাহাড়– মধ্য ও বৃহত্তর হিমালয়ের অংশ যার শীর্ষ অনেক জায়গাতেই ৬০০০ মিটার অতিক্রম করেছে আর গড় উচ্চতা প্রায় সাড়ে চার হাজার মিটার। স্পিতির বসবাসকারীদের ভৌগোলিক অবস্থান অনুযায়ী চার অংশে ভাগ করা যায়– ‘সাম’ নীচের দিকের অংশ, ‘পিন’– পিন নদীর অববাহিকা অংশ ‘ভার’ মধ্যবর্তী অংশ আর ‘টুড’ বেশি উচ্চতার অংশ বলে পরিচিত। স্পিতি নদী এই অঞ্চলের প্রধান নদী, কুনঝুম পর্বতমালার বরফ গলা জল বয়ে নিয়ে প্রায় পুরো অঞ্চল ধরে প্রবাহিত। এই মূল নদীর সঙ্গে মিলিত হয়েছে অসংখ্য উপনদী– পিন, চিয়ামো, বাটাং, লাংজে, মানে, হানসে, কাজা, লিংটি, টাবো প্রভৃতি। অধিকাংশ নদীর উপত্যকাগুলি খুবই সংকীর্ণ। একমাত্র ব্যতিক্রম, স্পিতি নদীর অববাহিকার কিছু অংশের প্রায় ৩ কিমি পর্যন্ত বিস্তৃতি দেখা যায়। এ অঞ্চলে গাছপালা, চাষের জমি খুবই সীমিত। বড়ো গাছ বলতে সামান্য অংশে পপলার, উইলো গাছ দেখা যায়। আর চাষ বলতে সামান্য জমিতে আলু, কড়াইশুঁটির চাষ হয় আর বছরের মধ্যে ছ’মাসই তো বরফের নীচে থাকে এই স্পিতি অঞ্চল। কুনঝুম পাস হল লাহুল ও স্পিতির মধ্যে একমাত্র সংযোগ। এই পাস বছরের মধ্যে ছ’মাসের বেশি সময় তুষারপাতের জন্য বন্ধ থাকে। এছাড়া কিন্নর প্রদেশের মধ্যে দিয়ে স্পিতির সঙ্গে সিমলার যোগাযোগ আছে। বাস্তবিক পক্ষে ভৌগোলিক বিচ্ছিন্নতার কারণে স্পিতির ছিল অর্ন্তমুখী সংস্কৃতি যা সেখানকার মানুষকে টেনে এনেছিল শুধুমাত্র বৌদ্ধ গুম্ফাগুলির কর্মকাণ্ডের মধ্যে। ‘নোনো’ নামের উজির দ্বারা শাসিত হতো এ অঞ্চল। তবে প্রায়শ স্পিতিকে বহির্শত্রুর আক্রমণে বিব্রত হতে হয়েছে। কুলু ও লাদাখের রাজন্যবর্গের যুদ্ধবিগ্রহ ছাড়াও ১৮৪১ সালে জম্মু কাশ্মীরের সেনাপতি গুলাম খান ও রহিম খান স্পিতির নানা অংশ আক্রমণ করে বিপর্যস্ত করেছে। ১৮৪৬ সালে স্পিতির শাসনভার ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি গ্রহণ করলেও, সেই পুরোনো ঐতিহ্য অনুযায়ী ‘নোনো’ এই শাসনকার্য চালিয়ে গেছে। স্পিতির অধিবাসী

অধিকাংশই বৌদ্ধ গেলুকপা গোষ্ঠীভুক্ত। ধর্ম এদের জীবনে একটা বড়ো অংশ জুড়ে বিরাজ করে। ‘ওম মনিপদ্মে হুম’ এই মানুষদের বীজমন্ত্র। রাত্রি ৯টা নাগাদ আমরা পৌঁছে গেলাম মানালির হোটেলে। পরদিন সকাল ৯টায় আমরা বেরিয়ে পড়লাম মানালি থেকে ব্রেকফাস্ট সেরে। পথে কোথাও মধ্যাহ্নভোজ সারতে হবে। আজকের গন্তব্য চন্দ্রতাল দর্শন সেরে লোসারে রাত্রিযাপন। সময়টা জুলাই মাসের শেষ মানালিতে বর্ষাকাল। সকালে আকাশ মেঘলা, কাল রাতে বৃষ্টি হয়ে গেছে।

গাড়ি মানালি শহর ছাড়িয়ে বিপাশা নদীর হাত ধরে রোটাং পাসের পথে চড়াই উঠতে শুরু করল। মানালি থেকে রোটাং পাসের দূরত্ব ৫২ কিমি। মানালি থেকে লাহুল স্পিতি বা লেহুর পথে যেতে হলে এই রোটাং পাস অতিক্রম করতেই হবে। রোটাং-এর উচ্চতা বারো হাজার ফুটেরও বেশি। যতই ওপরে উঠছি ততই ঠান্ডা বাড়ছে। শন শন করে হাওয়াও বইছে। তবে আশেপাশে বরফের চিহ্ন খুব বেশি নেই। আর বরফচূড়া তো সব মেঘের অন্তরালে। মাঝে আবার ছোটোখাটো ধসের জন্য কিছুক্ষণের জন্য যাত্রাপথে বিঘ্ন। পথ ঠিক হতে আধ ঘণ্টা, আবার গাড়ির কনভয় এগিয়ে চলে। তবে অধিকাংশ গাড়ির গন্তব্য ওই রোটাং পাস পর্যন্ত।

রোটাং শীর্ষ পেরিয়ে আমরা এগিয়ে চলি তবে এবার উৎরাই পথে। রাস্তা এঁকেবেঁকে নেমে গেছে লাহুল উপত্যকার দিকে। প্রায় ১৩ কিমি পথ পাড়ি দিয়ে পৌঁছে গেলাম গ্রামফু (১০,৪৬০ ফুট)। আকাশ ধীরে ধীরে পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে। আমরা বৃষ্টিচ্ছায়া অঞ্চলে প্রবেশ করছি– এসব অঞ্চল সুউচ্চ পাহাড়ের আড়ালে থেকে মৌসুমী বায়ুর নাগালের বাইরে থাকে। পির পাঞ্জাল শ্রেণির তুষারশৃঙ্গগুলি আকাশে ধীরে ধীরে আত্মপ্রকাশ করছে।

২১ নং জাতীয় সড়ক কেলং হয়ে লেহ-র পথে চলে গেছে। গ্রামফু থেকে সে পথ বাঁদিকে আর ডানদিকের পথ কুনঝুম পাস পেরিয়ে চলে গেছে স্পিতি উপত্যকার দিকে। আমরা ডানদিকের পথ ধরলাম। চন্দ্রা নদী এখন আমাদের সঙ্গী। রাস্তার অবস্থাও ভালো নয়। আকাশ নীল, তুষারশৃঙ্গগুলি দৃশ্যমান। পথ খারাপ হলেও বেশ বৈচিত্র্যপূর্ণ। পাহাড়ের গা বেয়ে নেমে এসেছে হিমবাহ, আবার তা গলে গলে তৈরি হয়েছে ঝরনা। এমনই এক বিশাল ঝরনার বিপদসঙ্কুল স্রোতের মধ্যে দিয়ে গাড়ি পার হয়ে এল। রাস্তা তো নেই, বোল্ডারের ওপর দিয়ে লাফাতে লাফাতে গাড়ি অতিক্রম করছে পথ। এ জন্যেই এ পথে শুধুমাত্র বড়ো গাড়িই ব্যবহার করা হয়, এছাড়া এপথে বাস, ট্রাক তো চলছেই।

পথের এই ভয়ংকর রূপের জন্য গাড়ির গতি অনেক কমে গেছে। তবে প্রকৃতি থেকে এখনও সবুজ অন্তর্হিত হয়নি। পাহাড়ের ঢালে সবুজ ঘাস জমিতে এখনও ভেড়ার পালের বিচরণ দেখা যাচ্ছে। গ্রামফু থেকে ১৭ কিমি পেরিয়ে ছত্রু। ড্রাইভার জানাল এরপর আর খাওয়ার জায়গা পাওয়া যাবে না। ছত্রুতে রয়েছে একটি পিডাব্লুডি রেস্ট হাউস আর অস্থায়ী কয়েকটি ধাবা। এই ধাবা চালু থাকবে যতদিন এই পথে বাস চলাচল চালু থাকবে ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত। এরপরই বরফ পড়া শুরু হবে– ঢেকে যাবে সব বরফের চাদরে।

নুডলস, ডিমভাজা খেয়েই আবার বেরিয়ে পড়ি। ড্রাইভার অনিল একদম সময় নষ্ট করতে চাইছে না। চন্দ্রা নদীর ওপরের ব্রিজ পেরিয়ে গাড়ি এগিয়ে চলে। তবে এখন পথের আর কোনও অস্তিত্ব নেই। কখনও বোল্ডার, কখনও ধুলো-পাথরের প্রান্তর, কখনও বা মাটির ও গাড়ির চাকার দাগ– এই সব হল পথের নির্দেশ। রোদ এখন ঝকঝক করছে, চন্দ্রা নদী এখনও সঙ্গে রয়েছে তবে এ পথে আর সবুজের অস্তিত্ব নেই– শুধু পাথর পাথর আর পাথর শুধু পাথরের মরুভূমি। পাহাড়ের শীর্ষে এখনও বরফের আস্তরণ, কখনও বা পাহাড়ের গায়ে বরফের আল্পনা, বরফ গলতে শুরু করলেই পাহাড়ের গা বেয়ে নেমে আসে জলের ধারা, সৃষ্টি হয় অসংখ্য ঝরনা, তারই টানে নেমে আসে পাথরের টুকরো, বোল্ডার। তার ফলে পথ মাঝে মাঝে হয়ে যায় অবরুদ্ধ।

এ পথে গাড়ির সংখ্যা বড়োই নগণ্য। এক-একটা গাড়ির দর্শনে মনে ভরসা জাগে। আর এ পথে গাড়ি খারাপ হলে কি দুর্ভোগ হবে তা চিন্তা করা যায় না! এরপর পথে আবার পড়ল এক প্রবাহমানা ঝরনা। তারই পাশে একটি মালবাহী ট্রাক পাথরে ধাক্বা খেয়ে বিকল। অতএব গাড়ি থেকে নেমে পড়তে হল। বহু কসরত করে গাড়ি এই রাস্তাটুকু পার হলে আবার গাড়িতে ওঠা।

আর একটু পরেই পৌঁছে গেলাম ছোটোধারা। ছত্রু থেকে মাত্র ১৫ কিমি কিন্তু এই পথ অতিক্রম করতে দেড়ঘণ্টার বেশি সময় লেগেছে। গ্রামের কোনও অস্তিত্ব চোখে পড়ল না, একটা রেস্টহাউস রয়েছে রাস্তার ধারে কিন্তু কোনও লোকজনের দেখা নেই যেন শ্মশানপুরী, শুধুই পাথরের রাজ্য। চন্দ্রা নদী কখনও হাতের কাছে, আবার কখনও অনেক নীচ দিয়ে বয়ে যাচ্ছে। কোনও সবুজের ছিটেফোঁটাও এ পথে নেই। পাহাড়-নদী-পথ সবই যেন মিলেমিশে গেছে। পাথরের রঙের বৈচিত্র্যও যেন চোখে পড়ার মতো। গাড়ি এখন একেবারে নেমে এসেছে শুকনো নদীর খাতে। চারদিকে খোলা প্রান্তর– ঘিরে রেখেছে বরফের নকশা কাটা পাহাড়ের দেয়াল। চন্দ্রা নদী এখানে বেশ সংকীর্ণ, পাশাপাশি চলেছে তার আপন ছন্দে।

পৌঁছে গেলাম বাতাল। এখানে মিলিটারি ক্যাম্প রয়েছে তবে আমাদের বিশ্রামের কোনও সুযোগ নেই। ছোটোধারা থেকে ১৬ কিমি এই বাতাল। চলেছি এখন চন্দ্রতালের উদ্দেশ্যে। দিনের আলো থাকতে থাকতে চন্দ্রতাল দর্শন করে ফিরে আসতে হবে। বাতাল থেকে একটি পথ গেছে উধর্বমুখী কুনঝুম পাসের দিকে আর একটি সংকীর্ণ পথ গেছে চন্দ্রতালের দিকে। বাতাল থেকে চন্দ্রতাল ১৪ কিমি, তার মধ্যে ১২ কিমি গাড়িতে যাওয়া যাবে বকিটা পদব্রজে। গাড়ির এই পথ সমতল, তবে মুখোমুখি দুটি গাড়ি এসে গেলে বিপদ। আমাদের যাত্রাপথে সৌভগ্যবশত বিপরীত দিক থেকে কোনও গাড়ি আসেনি।

১০ কিমি পথ পেরিয়ে রাস্তার ধারে সবুজ ঘাসের জমি, চোখে পড়ে ভেড়ার পাল নিয়ে মেষপালকের আনাগোনা। মাঠে রংবেরঙের টেন্টের সারি। চন্দ্রতালের ভ্রমণার্থীদের জন্য এইসব টেন্ট। তবে অধিকাংশই বিদেশি পর্যটক। এরপরই গাড়ির পথ শেষ। জায়গাটা সমতল, মাঝে মাঝে ঘাসজমি, পুরো অঞ্চলটাই ঘিরে রেখেছে বরফে মোড়া পাহাড়গুলো। ন্যাড়া পাহাড়ও আছে যেখানে বরফের আল্পনা নেই আবার সবুজেরও চিহ্ন নেই। মাত্র ২ কিমি হাঁটা পথ প্রায় সমতল, সরোবরের দিকে একটা ঢাল আছে। তবে উচ্চতাজনিত কারণে (৪২৭০ মিটার) অনেকের অসুবিধা হতে পারে। সরোবরের জলে পাহাড়ের প্রতিবিম্ব। জলের রং পান্না সবুজ তার সঙ্গে একটু নীলের ছোঁয়া। বিদায়ি সূর্যালোকের রশ্মির ‘কনে দেখা আলোয়’ চন্দ্রতাল যেন আরও মোহময়ী। দৈর্ঘ্যে প্রায় ২ কিমি, পরিধি ৪ কিমি, সরোবরের ধার ধরে পরিক্রমা পথ তৈরি করা হয়েছে। তবে সে সময় আমাদের নেই। ঠান্ডা বাতাসের দাপট রয়েছে। সূর্য হেলে পড়ছে আর পাহাড়ের ছায়াও যেন ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে সরোবরের জল থেকে। ব্রাহ্মণী হাঁসের দল ভেসে  বেড়ায় তালের জলে। এবার ফেরার পথ ধরতে হবে, আমরা গাড়ির দিকে হাঁটা লাগাই।

এবার কুনঝুম পাসের দিকে গিরিশিরা ধরে গাড়ি উঠতে থাকে। এখন পাখির চোখে চন্দ্রা নদীকে দেখা যাচ্ছে রুপোলি ফিতের মতো। ৪৫৫১ মিটার উঁচু কুনঝুম গিরিবর্ত্ম শীর্ষ, মানালি-কাজার পথে সর্বোচ্চ বিন্দু। অধিকাংশ সময়ে বরফে ঢাকা থাকে। হিমাচল প্রদেশের বৃহত্তম জেলা লাহুল-স্পিতিকে ভাগ করেছে এই পাস। সাধারণত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত যাতায়াত করা যায়। তবে কুনঝুম পাসে এখন বরফ নেই, তবে প্রচণ্ড ঠান্ডা ও ঝড়ের মতো হাওয়া দিচ্ছে। এখন আকাশ পরিষ্কার চারদিকে ঘিরে রেখেছে বরফমোড়া পাহাড়ের সারি। ড্রাইভার অনিল শৃঙ্গগুলির নাম গড়গড় করে বলে গেল– বড় সিগরি, ছোটা সিগরি, চন্দ্রভাগা ইত্যাদি। কুনঝুম মাতার মন্দিরে প্রণাম ও প্রদক্ষিণপর্ব চুকল। বৌদ্ধ চোর্তেনগুলো ঘিরে রঙিন পতাকাগুলি ঝোড়ো হাওয়ায় পতপত করে উড়ছে। বেশি হাঁটাচলায় শ্বাসকষ্ট হচ্ছে আর বেশিক্ষণ এখানে থাকা যাবে না। সন্ধ্যা ছটা বেজে গেছে তবে এখনও সোনালি রঙের রোদ রয়েছে। এগিয়ে চলি লোসারের পথে। পথেই স্পিতি উপত্যকার অভ্যর্থনা ‘ওয়েলকাম টু স্পিতি ভ্যালি’।

পথ নেমে গেছে ১৮ কিমি দূরের লোসারে। পথের অবস্থা প্রায় সেরকমই। বোল্ডার আর উঁচুনীচু পাথুরে রাস্তা, তারই ওপর দিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে গাড়ি এগিয়ে চলেছে। কুনজুম পর্যন্ত আমাদের সঙ্গী ছিল চন্দ্রা নদী এখন স্পিতি নদী আমাদের নতুন সঙ্গী। লাহুল উপত্যকা থেকে এখন আমরা স্পিতি উপত্যকায়। পাহাড়ের গঠনশৈলীরও যেন পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। সবুজের দেখা নেই তবে পাথরের রঙে যে কত বৈচিত্র থাকতে পারে তা এখানে না এলে বোঝা যেত না। হলুদ, বেগুনি, বাদামি, কমলা, কালচে এসব রং তো প্রত্যক্ষ করাই যায়।

এরপরে আর এক বৈচিত্র, হাওয়ার দাপটে ভূমিক্ষয়ে পাহাড়ের পাথরগুলি অনন্য সব আকৃতি নিয়েছে। এগিয়ে আসছে লোসার, সূর্যের আলো এখনও রয়েছে। কমলা রঙের পাথরের গায়ে নানা ধরনের প্রাকৃতিক কারুকার্য। নানা ধরনের পাথরের দেয়ালে ফোল্ডিং-এর উদাহরণ যেন ভূতত্বের পাঠ্যপুস্তক থেকে উঠে এসেছে। এই কমলা পাথরের পাহাড়ের মাথায় সাদা বরফের মুকুটও রয়েছে। পৌঁছে গেছি লোসার গ্রামের উপকণ্ঠে।

ছোট্ট তিব্বতি উপজাতিদের গ্রাম এই লোসার। মূল রাস্তা দিয়ে গ্রামের মুখে একটি তোরণ। তিব্বতি ভাষায় স্বাগত জানানো হয়েছে। এই অঞ্চলে সবুজের উচ্ছ্বাস কিন্তু স্তব্ধ হয়নি। চাষবাস হয়, দোকানপাট, স্কুল, পুলিশ চৌকি, বৌদ্ধ গুম্ফা, সেনা ছাউনি আর রাত্রিবাসের জন্য কয়েকটি তিব্বতি গেস্টহাউস রয়েছে। সামনে যে সর্পিল পথে নদী বয়ে চলেছে তা স্পিতি নদী। এখানেই আজকে আমাদের রাত্রিবাসের ঠিকানা। গেস্টহাউস খুবই সাধারণ মানের তবে এ পথে এর থেকে ভালো কিছু পাওয়ার কোনও সম্ভাবনা নেই। সূর্যের আলোর মধ্যেই চাঁদের উদয়। প্রায় ১৩ হাজার ফুট উচ্চতায় এই গ্রাম।

সকলেরই উচ্চতাজনিত কিছু শারীরিক সমস্যা হচ্ছে। রাতে খাওয়ার কোনও ইচ্ছাই হল না। হোটেলে বানিয়েছিল রুটি ও বেগুনের বিস্বাদ ঝোল। কয়েকটা বিস্কিট আর জল খেয়েই রাতের খাওয়া সাঙ্গ হল। পরদিন পূর্ণিমা, তাই চাঁদের আলোয় ভেসে যাচ্ছে লোসারের পাহাড় উপত্যকা। রাতে ভালো ঘুম হল না। ভোরে লোসারে আবার নীল আকাশে রোদের ঝলমলে প্রকৃতি। হোটেলের সামনেই কয়েকটা দোকান এই ভোরেই খুলে গেছে– নানা ধরনের শাল, সোয়েটার, টুপি, মাফলার, মেয়েদের গয়না ইত্যাদি বিক্রি হচ্ছে। মেয়েরা সেদিকেই মন দিয়েছে। ব্রেকফাস্ট সেরেই আমরা বেরিয়ে যাব। টিলার মাথায় এই গ্রামের যে মনাস্ট্রি তথা বৌদ্ধ গুম্ফা রয়েছে তাই পা চালিয়ে দেখে এলাম। গুম্ফাটি বেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন, বুদ্ধমূর্তিটি আকর্ষণীয় আর গুম্ফার উচ্চতা থেকে প্রকৃতির এক অনন্য রূপ ধরা পড়ে।

আবার এগিয়ে চলা। তার আগে লোসারে টোস্ট-অমলেট, কফির ভরপেট ব্রেকফাস্ট হয়েছে। আজ আমাদের গন্তব্য কাজা। লোসার থেকে দূরত্ব প্রায় ৬০ কিমি। এখন পথ প্রায় সমতলের মধ্যে দিয়ে। তবে মাঝে মাঝেই আত্মপ্রকাশ করছে পাহাড়ের সারি মাথায় তুষারমুকুট আবার কখনও বা পাথরের গায়ে তুষারের আলপনা। স্পিতি নদীও সঙ্গে রয়েছে আগাগোড়া। পাথরের রঙের বৈচিত্র্য আবার চোখে পড়ছে। লালচে, খয়েরি, হলদে অথবা বেগুনি নানা রঙের সমাহার আর তার সঙ্গে পাথরের সব অনন্যসাধারণ ভাস্কর্য। তবে এই ভাস্কর্য মানুষের তৈরী নয় সবই প্রাকৃতিক। কখনও মনে হয় রাজপ্রাসাদ। কখনও বা কোনও জীবজন্তুর অবয়ব, কখনও বা পাথরের থাম আবার কখনও বা ফলফুলের ঝালর।

রাস্তার অবস্থা আগের থেকে অনেক ভালো, চড়াই-উৎরাই প্রায় নেই বললেই চলে। নদীর পাড়ের কাছেও এই বায়ুক্ষয়ের ভাস্কর্য। আকাশের রং নীল তাতে সাদা মেঘের ভেলা, এখানে বর্ষার নামগন্ধও নেই। লোসার থেকে ১৫ কিমি দূরে হানসে গ্রাম। ছোটো গ্রাম হলেও সবুজের ছোঁয়া রয়েছে– আলু ও কড়াইশুঁটির ছোটোছোটো খেত। এছাড়া সেই ন্যাড়া পাথরের পাহাড়। মাটির রং ধূসর তামাটে আর হলুদ মেশানো। এখানেও রাস্তার যানবাহন চলাচল খুবই সীমিত। পর্যটকের দেখাও কদাচিৎ মেলে।

এরপর মোবাং গ্রাম। এখানে প্রায় প্রতিটি গ্রামে রয়েছে তাদের নিজস্ব মনাস্ট্রি। গ্রামে লোকসংখ্যা খুবই কম। কয়েকটি মাত্র পাথরের ব্লকে তৈরি বাড়ি। বাংলার গ্রামের সঙ্গে কোনও তুলনাই হয় না। গাড়ি এবার প্রবেশ করল বিশাল বিশাল প্রকৃতিক স্তম্ভ আর খিলানের মাঝখানে– পাথরের এই সব প্রাকৃতিক ভাস্কর্যের অতুলনীয় বিশালত্বে মুগ্ধ হতে হয়। স্পিতি নদীর ওপারে পাহাড়ের গায়ে যেন লেপটে রয়েছে ‘কী মনাস্ট্রি’। বিশাল স্তূপের মতো হলদে রঙের পাহাড়ের গায়ে অসংখ্য খোপের মতো সাদা বাড়িগুলি মনে হয় যেন আঠা দিয়ে সেঁটে দেওয়া হয়েছে। এরপরে রংরিক গ্রাম। পাথরের স্তম্ভের মাথায় বিশাল বুদ্ধমূর্তি। রংরিক গ্রাম থেকে কাজা আর মাত্র ৮ কিমি পথ। কাজার দিকে যত এগোচ্ছি দূরের পাহাড়গুলি তত বড়ো চেহারায় ধরা দিচ্ছে। পাহাড়ের গায়ে অনেকটা তুষারশূণ্য, মাথায় তুষারমুকুট তবে অনেকটাই এলোমেলো বরফের আল্পনা।

পৌঁছে গেলাম কাজা। কাজা স্পিতি– মহকুমার সদর শহর। উপত্যকার নানা দিকে সড়ক যোগাযোগের প্রধান কেন্দ্র। চারধারে রংচঙে ন্যাড়া পাহাড় আর বহু ধারায় বিভক্ত স্পিতি নদী। কড়াইশুঁটির কয়েকটি খেতের টুকরো, টেলিফোন ও পেট্রল পাম্পের সুবিধা, টুরিস্ট লজ ও বড়ো কয়েকটি হোটেল রয়েছে ওপরের ধাপে, নীচের দিকে ঘিঞ্জি বাজার এলাকা ও কয়েকটি হোম-স্টে হোটেল ও সাধারণ বাড়িঘর। শহরের ঔজ্জ্বল্য বলে সেরকম কিছু চোখে পড়ে না বরং এক শান্ত সমাহিত রূপই প্রতীয়মান হয়।

আমরা স্পিতি ভ্যালি হোটেলে উঠেছি। হোটেলটি ভালোই, বারান্দা থেকে পাহাড়ের অপূর্ব দৃশ্য চোখে পড়ে। স্পিতি নদীকে দেখা না গেলেও শোনা যায় তার প্রবাহের ঝংকার। কাজার উচ্চতা ৩৬০০ মিটার, অক্সিজেনের অভাব এখানেও রয়েছে। বিশ্বের সর্বোচ্চ পেট্রল পাম্প এই কাজাতেই। ড্রাইভার গাড়িতে তেল ভরে আনল কারণ দিনের নির্দিষ্ট সময়ে কয়েক ঘণ্টার জন্য এই পাম্প খোলা থাকে। তেল আবার পাওয়া যাবে কেলং-এর আগে তান্ডিতে।

কাজাতে সেরকম দর্শনীয় বিশেষ দ্রষ্টব্য নেই বললেই চলে। আমাদের হোটেলের পাশেই বিশাল বর্ণময় কাজা মনাস্ট্রি ও রাস্তার ওপারে কয়েকটি সুদৃশ্য চোর্তেন। ২০০৯ সালে এই নতুন মনাস্ট্রির উদ্বোধন হয়েছে। অন্দর খুবই সুসজ্জিত, বুদ্ধমূর্তি প্রাণময়, মোমবাতি ও প্রদীপের আলোয় এক স্নিগ্ধ পরিবেশ। নতুন মনাস্ট্রির পিছনে অনেক সিঁড়ি ডিঙিয়ে পৌঁছোতে হবে ভগ্ন পুরোনো মনাস্ট্রিতে। এখানে টুরিস্টের সংখ্যা খুবই কম। সামান্য কয়েকজন বিদেশি টুরিস্ট। কয়েকজন দেখলাম মোটর সাইকেলের পিছনে মালপত্র চাপিয়ে হিমালয় দর্শনে বেরিয়েছে। মনাস্ট্রি দর্শনের পর হাতে তখনও অনেক সময়, দিনের আলোও রয়েছে যথেষ্ট। বাজার ও গ্রামে এক চক্বর ঘোরা। সবই পাথরের বাড়ি, বাড়ির ছাদে গাছের গুঁড়ি, ডালপালা কেটে কেটে এখনই জমা করা হচ্ছে। সবই শীতের রসদ। যখন বরফে ঢেকে যাবে চারদিক, আগুন জ্বালিয়ে জল গরম, ঘর গরম, রান্না সবই করতে হবে এই কাঠের সাহায্যে।

স্পিতি এলাকায় ভূপ্রকৃতি ও জনজীবন দুদিক থেকেই বৈশিষ্টপূর্ণ। হিমাচলের অন্যান্য এলাকা থেকে তা অনেকটাই স্বতন্ত্র। পরের দিন সকালে আবার যাত্রা শুরু– ‘কী’ গুম্ফা আর কিব্বের গ্রামের উদ্দেশে। স্পিতি উপত্যকার প্রধান বৈশিষ্ট্য শুধু তুষারশিখর নয়, তার সঙ্গে শুষ্ক কঠিন ভূমিরূপ। স্পিতি নদী এখানে খুব চওড়া না হলেও স্রোত খুব আর নদীর খাতে শুকনো পাথরে ভর্তি। গাড়ির পথে ‘কী’ গুম্ফা কাজা থেকে মাত্র ১২ কিমি দূরে। পথের সৌন্দর্য একইরকম– পাহাড়ের গায়ে পাথরের প্রাকৃতিক ভাস্কর্য, আকাশ নীল, রোদ ঝকমকে প্রকৃতি, আকাশে তুষারশৃঙ্গের উঁকিঝুঁকি।

গ্রামের মধ্যে টিলার মাথায় ‘কী’ গুম্ফার অবস্থিতি। কিছুটা দূর থেকে মনে হয় ‘কী’ গুম্ফা যেন পাহাড়ের গায়ে খাঁজে খাঁজে আঠা দিয়ে কেউ আটকে দিয়েছে উই ঢিবির আকারে। কাজা থেকে ‘কী’ হয়ে কিব্বের গ্রামের দিকে দিনে একটা বাস যায়, তবে এই বাসের অপেক্ষায় বসে থাকলে যাওয়া-আসা সবই অনিশ্চিত হয়ে পড়বে। পাথরের নানা রং এ পথেও প্রত্যক্ষ করা গেল। বাঁকে বাঁকে এগিয়ে গুম্ফার দরজায় গাড়ি পৌঁছে দিল। বাসে এলে শেষ ৩ কিমি চড়াই ভেঙ্গে উঠতে হবে। ঢোকার মুখে এক গ্রামীণ কিউরিও দোকান– মেয়েদের কিছুটা সময় সেখানে কাটে কেনাকাটায়।

প্রাচীন এই ‘কী’ গুম্ফা এক কেল্লার মতো ধাপে ধাপে উঠে গেছে ওপরে। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন অংশের নির্মাণের ফলে নির্মাণ স্থাপত্যে কিছুটা অসঙ্গতি চোখে পড়ে। বিরাট একটি ঘরের একপ্রান্তে সুবিশাল এক বুদ্ধমূর্তি। এছাড়া রয়েছে দুষ্প্রাপ্য থাঙ্কাচিত্র এবং প্রাচীন বাদ্যযন্ত্রের এক অনন্য সংগ্রহ। প্রাচীন পুঁথি, পাণ্ডুলিপি ইত্যাদির সংগ্রহও রয়েছে এখানে। এই গুম্ফা নানা সময়ে বহিঃশত্রুর আক্রমণে ও প্রাকৃতিক কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল আর তার পুনর্নির্মাণ হয়েছে। ‘কী’ গুম্ফার নির্মাণকাল নিয়ে মতভেদ রয়েছে। কারও মতে এটি অন্তত এক হাজার বছরের প্রাচীন আবার অন্যের মতে এটি পঞ্চদশ শতকে নির্মিত। যাইহোক ১৪,৪০০ ফুট উচ্চতায় নির্মিত এই গুম্ফা এক অনন্য স্থাপত্য এবং এটির সাংস্কৃতিক ও ধার্মিক গুরুত্বও স্বীকার করে নিতে হবে। এই গুম্ফায় বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের বাসকক্ষ যেমন রয়েছে তেমনি রয়েছে সাধারণের অতিথিশালা। সন্ন্যাসীদের ব্যবহার বেশ মধুর।

আমাদের প্রথমে নিয়ে যাওয়া হল প্রার্থনাকক্ষে যার বিবরণ আগেই দিয়েছি। সেখানে গুরুগম্ভীর পরিবেশে পূজাপাঠ চলছে, বিশাল মোমবাতি জ্বলছে, ধূপের এক অচেনা গন্ধে ভরে গেছে কক্ষর অন্দর। কক্ষের বাইরে কিছু চিত্রাবলী। দুই সন্ন্যাসী আমাদের নিয়ে গেলেন অন্দরের এক কক্ষে সেখানে এক অনন্য স্বাদের চা খাওয়ালেন। সেই চায়ের উপকরণ– হার্বাল চা পাতা ছাড়া রয়েছে পুদিনা, আদা, দারচিনি, এলাচ, তুলসী ও চিনি। এরপর প্রসাদ হিসেবে খেলাম ছাতু, বার্লি, চিনি ও ঘিয়ের মিশ্রণে তৈরি এক মণ্ড। খেতেই পেট ভরে গেল। ধন্যবাদ জানিয়ে গেলাম এবার গুম্ফার ওপরতলায় ছাদে। ছাদে দাঁড়িয়ে পাখির চোখে দেখা গেল কাজা উপত্যকা– স্পিতি নদীর অববাহিকার এক অপূর্ব দৃশ্য। নদীর ধারে ‘কী’ গ্রামের বাড়িঘরও দেখা যায় খেলনা বাড়ির মতো। এবার ‘কী’ গুম্ফা থেকে বিদায় নিয়ে যাত্রা করি কিব্বের গ্রামের পথে। দূরত্ব ৭ কিমি।

পৃথিবীর উচ্চতম গ্রাম বলে পরিচিত কিব্বের, যেখানে স্থায়ীভাবে মানুষ বসবাস করে। উচ্চতা ১৪,৭১০ ফুট (৪২০৫ মিটার) তবে বর্তমানে উচ্চতম গ্রামের শিরোপা পেয়েছে গেট্টে (৪২৭০ মিটার) তবে সে গ্রামে নাকি মাত্র পাঁচ ঘরের মানুষের বসবাস। ‘কী’ থেকে পথ ঊধর্বমুখী। রাস্তার অবস্থা খুব একটা ভালো নয়। ন্যাড়া পাহাড়গুলির পিছনে তুষারশৃঙ্গের উঁকিঝুঁকি। আকাশ হঠাৎই মেঘে ঢেকে গেছে, বৃষ্টি পড়ার উপক্রম যা এই অঞ্চলে খুবই ব্যতিক্রমী ঘটনা। কিব্বের কিন্তু সবুজে ভরা– গ্রামে ঢোকার মুখে এক ছোট্ট টিলা, সেখান থেকে একদিকে সবুজ চাষের ক্ষেত্র আর একদিকে রুক্ষ পাহাড়ি গ্রামের দিকে চলে গেছে। খেতে কড়াইশুঁটি, আলুর চাষ হচ্ছে তার সঙ্গে গমের খেতও চোখে পড়ে। ফুলে ভর্তি গাছও স্পিতি ভ্রমণে প্রথম দেখা হল। গ্রামের মধ্যে দিয়ে হাঁটতে থাকি, বেশ কয়েকটা হোটেল, হোম-স্টে, গেস্টহাউস, স্কুল, পোস্ট অফিস, এসটিডি বুথ, বাজার-দোকানও রয়েছে ছড়িয়ে ছিটিয়ে। তবে রাস্তায় গ্রামের মানুষদের যাতায়াত খুব একটা চোখে পড়ে না, মূলত বিদেশি টুরিস্ট– ট্রেকারদেরই ঘোরাফেরা।

গ্রামের বাড়িগুলি বেশ রংচঙে, পাথর ও মাটি দিয়ে তৈরি। চড়াই পথ উঠে গেছে গ্রামের শেষে এক গুম্ফায়। বাতাসে অক্সিজেনের অভাব, দ্রুত হাঁটলে দমের কষ্ট হচ্ছে। এক রেস্তোরাঁয় বসে মেমো খেলাম। দু এক ফোঁটা বৃষ্টি পড়ছে। এখানে বৃষ্টি একেবারেই স্বাভাবিক নয়। রেস্তোরার কর্মী জানাল এখানে অধিকাংশ মাটির বাড়ি তাই বৃষ্টি হলে ক্ষতি হবে অনেক। এখানে বছরের পর বছর বৃষ্টি হয় না। কিব্বের-এর বসতি বেশ প্রাচীন। এই বসতি গড়ে উঠেছিল তিব্বতের সঙ্গে বাণিজ্যের কেন্দ্র হিসেবে। বাড়ির মাথায় জমা করা কাঠের স্তূপ, আর লাল শুকনো ঘাস– আসন্ন শীতকালের মানুষ ও পশুর সংস্থান আর কি!

এবার কাজা ফেরার পালা। দুপুরে মধ্যাহ্নভোজ সেরে আবার পথে। বৃষ্টি আর হয়নি তবে আকাশ মেঘে ঢাকা। এবার চলেছি কোমিক গ্রামের পথে, লাংজা, হিক্বিম হয়ে তবে কোমিক গ্রাম। কাজা থেকে লাংজা ১৮ কিমি, লাংজা থেকে হিক্বিম ১০ কিমি আর হিক্বিম থেকে কোমিক আরও ৩ কিমি পথ। পাহাড় টপকে টপকে এগিয়ে চলা, পাহাড়ের গায়ে অতুলনীয় প্রাকৃতিক ভাস্কর্য তবে সেই শুষ্ক, রুক্ষ রূপই এখানেও প্রধান। স্পিতি নদী পেরিয়ে আবার পাহাড় চড়া তবে আকাশে এখনও মেঘের ঘনঘটা। পথ গেছে কালো রঙের পাহাড়ের মধ্যে দিয়ে।

যতই লাংজা গ্রামের দিকে এগিয়ে চলেছি ততই প্রকৃতিতে সবুজের সমারোহ বাড়ছে। প্রায় ৪৫ মিনিটের মধ্যে পৌঁছে গেলাম লাংজা গ্রামে। চারদিক পাহাড় দিয়ে ঘেরা, তার মধ্যে অনেকগুলিরই শীর্ষ বরফে মোড়া। তবে আকাশে মেঘের জন্য নীল আকাশে বরফ-চূড়ার কাঙ্খিত রূপ পাওয়া গেল না। গ্রামটি তারের বেড়া দিয়ে ঘেরা, তাই যে-কোনও দিক দিয়ে ঢোকা যাবে না, ঘুরে আসতে হবে প্রবেশপথের কাছে। দূর থেকেই দেখা যায় গ্রামের মধ্যে বিশাল এক বুদ্ধমূর্তি। গ্রাম কিন্তু সবুজে ভরা। সরকারের বিশেষ যোজনায় এই গ্রামে সবুজের সমারোহ।

অবশেষে গ্রামে প্রবেশের পথ পাওয়া গেল। আলু, ধনে, কড়াইশুঁটি, সরষে, গমের চাষ হচ্ছে। সুন্দর সাজানো গোছানো গ্রাম। এইরকম শুষ্ক পরিবেশে এই সবুজের সমারোহ অভূতপূর্ব। চোদ্দো হাজার ফুট উচ্চতায় আইবেক্স দেখা পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ড্রাইভার অনিল জানাল শীতের সময় এ অঞ্চলে দলে দলে আইবেক্স ঘুরে বেড়ায়। গ্রামের সর্বোচ্চ অংশে গুম্ফা। এখন রং করা হচ্ছে। তবে ভেতরে প্রবেশের কোনও বাধা নেই। গুম্ফা দর্শন করে বেরোতেই গ্রামের বাচ্চা ছেলেমেয়েরা ঘিরে ধরল– ‘ফসিল’ কেনার জন্য অনুরোধ– ৫০ টাকা/১০০ টাকা দর। জানা গেল এই অঞ্চলে পাথরের মধ্যে ফুলের ও নানা ধরনের পোকামাকড়ের ফসিল (জীবাস্ম) পাওয়া যায়। গ্রামের পথে পথে একটু ঘোরা– ঘুরতে ঘুরতে সেই বিশাল বুদ্ধমূর্তির পায়ের কাছে পৌঁছে গেলাম। এবার ফেরার পালা। সময়াভাবে আর হিক্বিম আর কোমিক গ্রামে যাওয়া হল না। ফিরে আসি কাজায়।

পরদিন আমরা যাব কাজা থেকে টাবোর উদ্দেশে। পথে পড়বে আর-এক বিখ্যাত গুম্ফা ধানকড়। ঘুরে নেব পিনভ্যালির পথে প্রান্তরে। তবে সে অভিজ্ঞতার কথা তো অন্য এক গল্প, তা আর একদিন হবে!

প্রয়োজনীয় তথ্য

(১) হাওড়া থেকে দু-রাত কালকা মেলে কাটিয়ে খুব ভোরে চন্ডীগড়। চন্ডীগড় থেকে বাসে বা গাড়িতে মানালি (৩২০ কিমি)। বিমানে চন্ডীগড় চলে এলে সময় অনেকটাই কমে।

(২) মানালি থেকে গাড়ি ভাড়া করে সরাসরি চলে আসা যায় কাজা। সময় ১২/১৩ ঘণ্টা লাগবে। যাঁরা চন্দ্রতাল দেখে আসতে চান (মানালি থেকে ১৪০ কিমি) তাঁরা চন্দ্রতালের ধারে টেন্ট অথবা লোসারের গেস্ট হাউসে থাকতে পারেন। টেন্টে থাকা খাওয়া জনপ্রতি ১৫০০/২০০০ টাকা বুকিং ৯৮৭৪৩৭৩৩৮০/ ৯৪৩৩৮১৩৬৭৮

সিমলা থেকে কিন্নর হয়েও কাজা পেৌঁছোনো যায়।

(৩) স্পিতি অঞ্চলের প্যাকেজের জন্য যোগাযোগ করতে পারেন হিমাচল প্রদেশ হেল্পলাইন টুরিজমের সঙ্গে। কলকাতার ঠিকানা ৬ সি আর অ্যাভিনিউ (ম্যাগনেট হাউস) রুম নং ১০৪, ফোন ৬৪৫৯৭০৫২

(৪) কাজায় থাকার জন্য রয়েছে এইচপিটিডিসির টুরিস্ট লজ, পিডব্লুডি’র রেস্ট হাউস ছাড়াও কয়েকটি প্রাইভেট হোটেল।

(৫) সেরা সময় জুন–অক্টোবর তবে কুনঝুম-রোটাং পাস কখন খোলা থাকছে জেনে পথে নামা উচিত

(৬) বিশদ বিবরণের জন্য

হিমাচল প্রদেশ পর্যটন উন্নয়ন নিগম

২ এইচ, ইলেকট্রনিক্স সেন্টার (২ তল)

১/১এ বিপ্লবী অনুকূল চন্দ্র স্ট্রিট

কলকাতা – ৭০০০১২

ফোন – ২১১২-৬৩৬১/৯০৭২

 

অল্পচেনা সুন্দরী বারোট

এবার আমাদের সফর হিমাচল প্রদেশ। বিশদ ভাবে বলতে গেলে পশ্চিম হিমাচল। প্রথমে তো জায়গাগুলি নির্বাচন করে পৌঁছে গেলাম হিমাচল প্রদেশের হেল্পলাইন টুরিজমের অফিসে। এরা হোটেল ও গাড়ির ব্যবস্থা করে দেবে। আমাদের গন্তব্যের তালিকা দেখে সংস্থার কর্ণধার নবীনবাবু বললেন, আমি পরপর সব সাজিয়ে দিচ্ছি। তবে আমি সাজেস্ট করছি, এর সঙ্গে বারোট জায়গাটি যোগ করে দিন।

বারোট সম্পর্কে এর আগে উৎসাহব্যঞ্জক বা নেতিবাচক কিছুই শুনিনি, তাই একটু দোনামোনা করছিলাম। নবীনবাবু বললেন, আমার কথা শুনুন আপনারা, ঠকবেন না। অগত্যা বারোট আমাদের ভ্রমণ তালিকায় ঢুকে গেল। ভ্রমণের পর্যায়ক্রম অনুয়ায়ী বারোট রয়ে গেল ভ্রমণ তালিকার একেবারে শীর্ষে।

আমাদের প্রথম গন্তব্য ধর্মশালা বিমানবন্দর। তবে কলকাতা থেকে ধর্মশালার কোনও উড়ান নেই। তাই প্রথমে কলকাতা থেকে দিল্লি। দিল্লি বিমানবন্দরে পৌঁছে আমাদের অপেক্ষা করতে হবে ঘন্টাচারেক ধর্মশালাগামী বিমানের জন্য। তার জন্যে আবার টার্মিনাল পরিবর্তন করতে হবে। এ পথের বিমানগুলি সব ছোটো। তবে, বিমানে উঠে দেখা গেল সব সিট ভর্তি।

ঘন্টাখানেকের বিমানযাত্রায় আমরা পৌঁছে গেলাম ধর্মশালা বিমানবন্দরে। এই বিমানবন্দরের প্রচলিত নাম ধর্মশালা। টিকিটেও সেই নাম লেখা আছে। কিন্তু সরকারি ম্যাপে এই বিমানবন্দরের নাম গাগ্গল আর বিমানবন্দরে লেখা কাংড়া এয়ারপোর্ট। নামের এই গোলকধাঁধার রহস্য অবশ্য ভেদ করতে পারলাম না।

এয়ারপোর্টে আমাদের ভ্রমণসংস্থা নিযোজিত বাহন নিয়ে ড্রাইভার মনোজ উপস্থিত। ট্রাভেরা গাড়িতে আমাদের ৫ জনের বসার কোনও অসুবিধা নেই। গাড়ির মাথায় মালপত্র চাপিয়ে যাত্রা শুরু করলাম।

আজকে আমাদের গন্তব্য বারোট তবে পথে হয়তো আরও কিছু দ্রষ্টব্য আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। কাংড়া থেকে আমাদের রুট হবে পালামপুর, বৈজনাথ, যোগিন্দরনগর হয়ে ১৩২ কিলোমিটার রাস্তা পাড়ি দিয়ে তবেই পৌঁছব বারোট। রাস্তায় মাঝে মাঝেই যানজট হচ্ছে কারণ রাস্তা তো বেশি চওড়া নয়।

 

যাত্রাপথে আমাদের প্রথম স্টপ হল কাংড়ার বিখ্যাত চামুণ্ডা দেবী মন্দির। মন্দিরটির অবস্থান বড়ো রাস্তা থেকে কয়েক পাক নেমে একেবারে নদীর ধারে। নদীকে ঘিরে রয়েছে পাহাড় আর সেই পাহাড়ের গায়ে ঠাসা পাইনবন ও অন্যান্য গাছের চিরসবুজ উপস্থিতি। নদীর নাম বাণগঙ্গা। পাথরে ভরা তার বুক আর সেই বুক চিরে চলেছে জলপ্রবাহ। সেই জলে অনেকেই মনের আনন্দে স্নান করছে। এলাকাটি পুণ্যার্থী ও ভ্রমণার্থীদের ভিড়ে ঠাসা। কাংড়া শহরে এই মন্দিরের আশেপাশে অনেক হোটেল, লজ, আশ্রম রয়েছে। অর্থাৎ এই অঞ্চলে জনসমাগম ভালোই হয়।

মন্দিরের প্রেক্ষাপটে রয়েছে ধৌলাধার রেঞ্জ, তবে মেঘের আনাগোনায় অত উদ্ভাসিত নয়। এখন রোদের তেজ বেশ প্রবল, বেশ গরম হচ্ছে। এই চামুণ্ডা মন্দির সম্পর্কে রয়েছে পুরাণের কাহিনী। কথিত আছে দুই দানব চণ্ড ও মুণ্ড দুজনে দেবী অম্বিকাকে খুবই বিরক্ত করত। তখন অম্বিকাদেবী তাঁর দুই ভ্রু জোড়া একসঙ্গে যুক্ত করলেন। এই ভাঁজ থেকে সৃষ্টি হল এক ভযংকর কালীর রূপ। সেই ভযংকররূপিনী কালী ওই দানবদ্বয়কে বধ করেন। খুশি হয়ে অম্বিকা দেবী স্থির করলেন কালী এখানে চামুণ্ডা নামে পূজিত হবেন।

একটি দৃষ্টিনন্দন সেতু মন্দিরের সামনে এপার-ওপার করেছে নদীকে। মাঝে তৈরি হয়েছে স্নানের ঘাট, নদী থেকে জল এনে এখানে স্নানের ব্যবস্থা রয়েছে কিন্তু বর্তমানে তা শুকনো খটখটে। মন্দির ও দেবী দর্শন সেরে আমরা এগিয়ে চলি। চামুণ্ডা থেকে পথ গেছে পালামপুরের দিকে দূরত্ব ২৫ কিলোমিটার।

পালামপুরের পথে গোপালপুর, তার খ্যাতি মুক্ত চিড়িয়াখানার জন্য। সেখানে বন্যপ্রাণী থাকে মুক্ত অবস্থায় আর দর্শক থাকে জালের মধ্যে। দেখার ইচ্ছে থাকলেও সময়াভাবে গোপালপুরে আমাদের নামা হল না। পথে বিশাল যানজট। তার কারণ অবশ্য একটু পরেই বোঝা গেল। রাস্তার দুপাশেই পসরা নিয়ে বসে গেছে হাজারো দোকানদার। বিরাট এলাকা জুড়ে বসেছে মেলা। তারই অঙ্গ হিসাবে এইসব মেলার স্টল।

মেলার পসরার মধ্যে ঘরগেরস্থালির জিনিসপত্র, পোশাক-পরিচ্ছদ, মেয়েদের গয়নাগাঁটি থেকে আরম্ভ করে জিলিপি, পকোড়ার দোকানেরও কমতি নেই। স্থানীয় মানুষেরা বিশেষ করে মহিলা সমাগমে মেলা জমজমাট। ফলে গাড়ির গতি মাঝেমাঝেই নিথর হয়ে যাচ্ছে। মেলা পেরিয়ে গাড়ির টানা দৌড় পালামপুর পেরিয়ে বৈজনাথ। এ যাত্রায় পালামপুর শহরের মধ্যে আমরা প্রবেশ করিনি, এক ঝলক চা-বাগানের দৃশ্য দেখেই সন্তুষ্ট হতে হল।

বৈজনাথ বিখ্যাত শিবের মন্দিরের জন্য। গাড়ি থেকে নেমে আমরা সেই শিব মন্দিরের দিকে এগিয়ে চলি। পালামপুর থেকে মাত্র ১৬ কিলোমিটার দূরে এই বৈজনাথ মন্দির। সামান্য হেঁটেই মন্দিরের কাছাকাছি। সূর্য পশ্চিমদিকে অনেকটাই হেলে পড়েছে। সূর্যের বিদায়ী রশ্মি পড়েছে ধৌলাধার পর্বতমালার রুপোলি শৃঙ্গে। যদিও ধৌলাধার মেঘের ছায়ায় অনেকটা ম্লান।

১৩৬০ মিটার উচ্চতায় এই মন্দির দেবতা বৈদ্যনাথের প্রতি উৎসর্গীকৃত। কথিত, দ্বাদশ জ্যোর্তিলিঙ্গের অন্যতম এই শিবমন্দির। দূর থেকেও দেখা যাচ্ছে এই মন্দিরের উঁচু শিখর। মন্দিরের সামনে লন ও ফুলের বাগান। লন থেকেই দেখা যাচ্ছে অস্তগামী সূর্যের আলোয় উদ্ভাসিত ধৌলাধার ও হিমালয়ের অন্যান্য পর্বতশ্রেণী। মন্দিরের অনেকটা নীচে দিয়ে বয়ে চলেছে বিনয়া নদী। তারও সৌন্দর্য মোহময়। উপর থেকে পাথরের সিঁড়ি নেমে গেছে নদীর কিনারা পর্যন্ত। নদীর বেশ স্রোত, পাথরের বোল্ডারের ওপর দিয়ে বয়ে চলেছে। আমরা মন্দিরের সামনে, পাথরের নন্দী মূর্তি শোভা পাচ্ছে। মন্দিরটি খুবই প্রাচীন, নির্মাণকাল আনুমানিক ৮০৪ খ্রিস্টাব্দ। গর্ভগৃহে শিবলিঙ্গের উপর সাপের উদ্যত ফণা। পাথরের দেয়ালে নানা ভাস্কর্য।

মন্দির দর্শন শেষে আমরা এখন ২০ নম্বর জাতীয় সড়ক ধরে যোগিন্দরনগরের দিকে এগিয়ে চলেছি। বৈজনাথ থেকে যোগিন্দরনগর ২৩ কিলোমিটার। সন্ধ্যা হয়ে গেছে, অন্ধকারের মধ্যে নৈসর্গিক রূপ দেখার আর সুযোগ নেই। চোখের পাতা একটু বুজে এসেছে। ঘুম ভাঙল মনোজের ডাকে, স্যার আমরা এসে গেছি।

আমরা বারোটে আমাদের নির্ধারিত হোটেলে পৌঁছলাম। হোটেলের লোকজন গাড়ি থেকে লাগেজ নামিয়ে রাখছে। বরাদ্দ হয়েছে একতলার পরপর তিনটে ঘর। ঘড়িতে দেখি রাত প্রায় ১০টা বাজে। পরিচয় হল হোটেলের মালিক বলবীর সিং-এর সঙ্গে। সামরিক বাহিনীতে চাকরি জীবন কাটিয়ে এখন হোটেল খুলেছেন।

অল্প সময়ের মধ্যে আমাদের ডাক পড়ল ডাইনিং হলে। খিদের মুখে গরম গরম রুটি, ডাল, মিক্সড ভেজ, চিকেন, স্যালাড আর আচার যেন অমৃত। বারোটে এই জুন মাসেও বেশ ঠান্ডা। খাওয়াদাওয়া সেরে আমরা লেপের তলায়। নদী নিশ্চয়ই খুব কাছে, তাই কুলকুল শব্দ শুনতে শুনতে আমরা ঘুমের দেশে চলে গেলাম।

নদীর ধ্বনিতেই আবার পরের দিন ভোরে ঘুম ভাঙল। ঘর থেকে বেরিয়ে দেখি সবে রোদ উঠছে চারদিক ঝলমল করছে। হোটেলের ধারেই পাহাড় উঠেছে সেখানে চির, পাইনের জঙ্গল। আজ সকাল থেকে আমাদের বারোট ভ্রমণ শুরু হবে। বলবীর সিং-এর কাছ থেকে পথনির্দেশ নিয়ে নিলাম। তাঁর কাছেই শুনলাম, হোটেল থেকে ৫০০ মিটারের মধ্যেই পাহাড়ি নদী ওল বয়ে চলেছে। তারই বয়ে চলার শব্দ শুনছি এই কুলকুল ধ্বনি। ব্রেকফাস্ট শেষ করে গাড়ি করে আমরা বেরিয়ে পড়েছি বারোটের পথে।

দুমিনিটের মধ্যেই এসে গেলাম নদীর তীরে। সামনেই অনিন্দ্যসুন্দর ওল নদী পাথরের মধ্যে দিয়ে তীব্র গতিতে বয়ে চলেছে। মাঝে মাঝে এই নদী বাঁক নিয়ে তার সৌন্দর্য বাড়িয়েছে। নদীর ওপারে চির, পাইনের জঙ্গল যেন আকাশকে ছুঁতে চাইছে। সামনেই এক লম্বা পাইপ থেকে জল ছিটিয়ে ভিজিয়ে দিচ্ছে চারপাশ। এমনই ব্যবস্থা যে, ফোয়ারার জল সামান্য সময়ে অন্তর তার জল ছিটানোর কাজ করে চলেছে। নদীর পাড়ে সিমেন্টের বেদি, সেখানে বসে নদী, পাহাড়ের সৌন্দর্য দেখতে থাকি। এ যেন মানালির বিপাশা নদীর এক ছোটো সংস্করণ। অনেকেই জলের কাছে চলে গেছে। সেখানে জলে পা ডুবিয়ে নদীর উচ্ছলতাকে স্পর্শ করছে।

নদীর তীরে কিছুক্ষণ কাটিয়ে এবার নজরে এল, এ পারেই রয়েছে একটা ছোটো মন্দির। পায়ে পায়ে সেদিকে এগোই। মন্দিরের বাইরে লোহার গেট, তবে তালা দেওয়া নেই। গেট খুলে প্রবেশ করে দেখি এটি দুর্গা মন্দির। মনে হয় হাল আমলের নির্মাণ। মন্দিরে কোনও দর্শনার্থীর দেখা মিলল না। প্রতিমা দর্শন করে মন্দির থেকে বেরিয়ে নজরে এল, মন্দিরের পাশ দিয়ে উঁচু-নীচু এক পথ চলে গেছে চির, পাইনের জঙ্গলের দিকে।

চির-পাইনের জঙ্গল ভেদ করে পাথরের ফাঁক দিয়ে এক ঝরনা নেমেছে। রাস্তা থেকে কিছুটা ভিতরে, তাই সহজে নজর পড়বে না। বোল্ডার টপকে টপকে ঝরনার কাছে পৌঁছে তার সৌন্দর্য উপভোগ করে ছবি তুলে ফিরে আসি গাড়ির কাছে। এবার গাড়ি সোজা পথে এগিয়ে চলল।

নদীর অপর পাড়ে বেশ কয়েকটি হোটেল চোখে পড়ল। সেখানে বিজ্ঞাপনী প্রচারে বিশেষ ভাবে ট্রাউট মাছ খাওয়ার আমন্ত্রণ। ড্রাইভার মনোজ জানাল, এই নদীতে প্রচুর ট্রাউট মাছ পাওয়া যায়। আর একটু এগিয়ে একটা স্কুল তারপরই ড্যাম আর শ্যানন পাওয়ার স্টেশন। এখানে নদীর জল ছাড়ার নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা রয়েছে। সামনেই ড্যামের জলাধার, তবে খুব একটা বড়ো নয়। এ পথে রাস্তা এখানেই শেষ।

গাড়ি ঘুরিয়ে একটু এগিয়ে ডানদিকে বাঁক নিল। এখন আমাদের পথ ওল নদীর হাত ধরে। একদিকে খাদ ও প্রবহমান নদী আর অন্যদিকে পাহাড়ের প্রাচীর। পাথরের মধ্যে দিয়ে নদী যেন নাচতে নাচতে চলেছে। নদী কখনও অনেক নীচে নেমে গেছে তখন উপর থেকে সরু এক ফিতের মতো লাগছে আবার কখনও প্রায় রাস্তার সমতলে চলে আসছে।

চির, পাইনের জঙ্গল সব সময়ে আমাদের সাক্ষী, তবে চির গাছের সংখ্যাই বেশি। মাঝে মাঝে গাড়ি থামিয়ে ছবি তুলছি। এ পথে যানবাহনের সংখ্যা খুবই কম। হঠাৎই দুপাহাড়ের মাঝে আত্মপ্রকাশ করল বরফে ঢাকা পাহাড়ের চূড়া। সবুজের মাঝে হঠাৎই শুভ্রতার ছোঁয়া। সৌন্দর্যের আকর্ষণ যেন অনেকটাই বেড়ে গেল। এখানে সবটাই প্রকৃতি, আলাদা কোনও সাইটসিইং নেই। শুধু পাহাড়, জঙ্গল, নদী, জল আর আকাশ।

এবার একটু যাত্রাবিরতি। রাস্তার ডানদিকে বেশ বড়ো একটা জলপ্রপাত। প্রায় শখানেক ফুট ওপর থেকে জল ঝাঁপিয়ে পড়ছে। প্রপাতের ঠিক নীচে একটা পুল সৃষ্টি হয়েছে। তবে এখন সেখানে কোনও স্নানার্থী নেই। পাশেই একটা টিলার উপর ক্যাম্পিং-এর ব্যবস্থা রয়েছে। দেখলাম, নাইলন টেন্ট খাটানোই রয়েছে।

আবার এগিয়ে চলা। একটা ছোটো গ্রাম লোহারডি। এই পথে প্রথম বসতির সন্ধান পাওয়া গেল। দোকানপাটও রয়েছে বেশ কয়েকটা। নদী কখনও বা দৃষ্টিগোচর হচ্ছে আবার চোখের আড়ালে হারিয়ে যাচ্ছে। অনেকটা নীচে কাঠের এক ঝুলন্ত সেতু। ঠিক যেন শিল্পীর ইজেলে আঁকা একটা ছবি। আর একটু এগিয়ে এবার রাস্তা বন্ধ। বোর্ডে লেখা থেকে জানা গেল এখানে একটা পাওয়ার স্টেশন নির্মাণপর্ব চলছে।

গাড়ি নতুন পথ ধরে। এবার যাব বারোটের শেষ প্রান্তে বড়াগাঁও গ্রামে। দূরত্ব ১৫ কিলোমিটার। প্রথম গ্রাম পড়ল বাকলগ। রাস্তার ধারেই একটা ঝরনা। বিরাট এক পাথরের গা বেয়ে অনেক উঁচু থেকে জল নামছে। রাস্তায় সে জল পড়ে নালা দিয়ে গড়িয়ে যাচ্ছে। ঝরনার অনেকগুলি ধারা হলেও জলের পরিমাণ বেশ কম। আরও এগিয়ে চলি, নজরে আসে শস্যক্ষেত্র। পাহাড়ের ঢালে ধাপচাষ পদ্ধতিতে চাষ হয়। গম আর ভুট্টার চাষই প্রধান। শাকসবজিও হয় কিছু কিছু।

পরের গ্রাম দেওট, তারপরে কোটিকোহার। এখানে একটা বড়ো স্বাস্থ্যকেন্দ্র রয়েছে। তারপরে নলহোটা গ্রাম। বড়াগাঁও পৌঁছোতে আধ ঘন্টা সময় লাগল। গাড়ি এর পর আর এগোবে না। একটু দূরে টিলার মাথায় অনেক ঘরবাড়ি এটাই বড়াগাঁও। একটা উঁচু জমির উপর ক্যাম্পিং গ্রাউন্ড। এখান থেকে একদল ট্রেকার যাত্রার প্রস্তুতি নিচ্ছে। তাদের গন্তব্য সাড়ে পাঁচ কিলোমিটার দূরে রাজগন্ধা। এদের সঙ্গে গ্রাম পর্যন্ত হেঁটে আবার ফিরে আসি। মেঘের পর্দা সরিয়ে তুষারপর্বত আত্মপ্রকাশ করছে। এবার একই পথে হোটেলে ফেরা।

বিকেলে আবার হাঁটতে হাঁটতে নদীর ধারে। এখন সেখানে অনেক পর্যটকের ভিড়। রাস্তার ধারে অনেক খাবারের স্টল বসে গেছে। প্রায় ১ কিলোমিটার হাঁটার পর নজরে এল অ্যাডভেঞ্চার স্পোর্টসের একটি স্টল। এখানে নদীর ধারে ক্যাম্পিং, ট্রাউট মাছ ধরা, নদী পারাপারের ব্যবস্থা এসবের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। সূর্য অস্ত যাচ্ছে। ওল নদীর জল সোনালি বর্ণ ধারণ করেছে।

পরের দিন সকালে ব্রেকফাস্ট সেরে বারোটকে বিদায় জানাই। এখানকার সুন্দর প্রকৃতি আমাদের মুগ্ধ করেছে। ধন্যাবাদ জানাই নবীনবাবুকে যাঁর প্রেরণায় আমরা বারোট ভ্রমণে এসেছি।

কীভাবে যাবেন : কলকাতা থেকে দিল্লি হয়ে কাংড়া (গাগ্গল) বিমানবন্দর। এরপর কাংড়া, পালামপুর, বৈজনাথ, যোগিন্দরনগর হয়ে বারোট। দূরত্ব ১৩২ কিলোমিটার। ট্রেনে গেলে পাঠানকোট। সেখানে থেকে সড়কপথে যেতে হবে।

কখন যাবেন : ভ্রমণের সেরা সময় হল বর্ষা ছাড়া সারা বছর। আর শীতে গেলে পর্যাপ্ত গরম বস্ত্র সঙ্গে রাখতে ভুলবেন না।

 

ধৌলাধার-এর রত্নরাজি

ভোর সাড়ে চারটেয় চাক্বিবাঁক স্টেশনে নেমে অটোয় চেপে পাঠানকোট বাস স্ট্যান্ডে পৌঁছেছি পাঁচটা নাগাদ। এই সফরে আমাদের প্রথম গন্তব্য হিমাচল প্রদেশের চাম্বা। এইচপিএসটিসি-র চাম্বাগামী বাসের প্রথম যাত্রী আমরা।

যাত্রার শুরুতেই জানাই, ‘ধৌলাধার’ বা ‘লেসার হিমালয়’-এর বিস্তৃতি ডালহৌসি থেকে একদিকে বিপাশার তীরে কুলু পর্যন্ত, অন্যদিকে তা গাড়োয়ালের বদ্রিনাথ পর্যন্ত। এই পাহাড়ের গঠনে কালচে গ্রানাইট ও শ্লেট পাথরের আধিক্য। মাঝে মাঝে লাইমস্টোন ও স্যান্ডস্টোনও চোখে পড়ে। ধৌলাধার পর্বত শৃঙ্গগুলির উচ্চতা ৩৫০০ থেকে ৬০০০ মিটারের মধ্যে।

পাঠানকোট থেকে চাম্বার দূরত্ব ১২০ কিলোমিটার। আমরা বসেছি জানলার পাশের সিট সমেত চারটি আসনে। প্রথম সকালে প্রকৃতি যেন ভারি নরম, ভারি সুন্দর! প্রকৃতির মায়াময় সৌন্দর্যকে দেখা ও উপলব্ধি করার এটাই তো সেরা সময়। পাঠানকোট ছোটো এক তহশিল। বাস থেকে দেখছি সেনাবাহিনীর প্রশিক্ষণ শিবির, প্যারেড গ্রাউন্ড ইত্যাদি। মামুন্ মিলিটারি স্টেশন, সাই ইকবাল ইন্সটিটিউট পেরিয়ে বাস বাজার এলাকা ছাড়াতেই শুরু হ’ল সবুজের সমারোহ। রাস্তার দুইপাশে আম, বট আর ইউক্যালিপটাসই চোখে পড়ছে বেশি। বাস এসে পৌঁছোল দুনেরা-তে। চাম্বা থেকে দূরত্ব ৭৬ কিলোমিটার। এখানে ১০ মিনিটের যাত্রাবিরতি। বাস থেকে নেমে পথের ধারের এক দোকান থেকে চা নিলাম। চুমুক দিতেই মনে হল চায়ের স্বাদটা কেমন যেন অন্যরকম! পরে জেনেছিলাম, হিমাচল প্রদেশের এই অঞ্চলে চায়ে পানমৌরি মেশানোর চল আছে।

বাস চলছে ধীর গতিতে। উচ্চতা বাড়তেই শুরু হল পাইন গাছের রাজত্ব। আধ ঘন্টা পরে পৌঁছোলাম নৈনীখণ্ডে। পথের পাশে চোখে পড়ল বেগুনি রঙের কৃষ্ণচূড়া, নাম গুলমোহর। মনে পড়ল, প্রথমবার এই ফুল দেখে মুগ্ধ হয়েছিলাম গাড়োয়ালের গোপেশ্বর-চামোলীতে। বাস এসে থামল বানিক্ষেত-এ। এই সফরে প্রথমবার দেখলাম, দিগন্তে বরফঢাকা পর্বতশৃঙ্গ। ভালোলাগাটা বেড়ে গেল তখনই। বেলা ১০ টা ৪৫ মিনিট নাগাদ পৌঁছোলাম চাম্বা বাস স্ট্যান্ডে। তিন মিনিটের হাঁটাপথে চলে এলাম এইচপিডিসি-র ‘হোটেল ইরাবতী’-তে। চাম্বায় থাকার সেরা জায়গা। অগ্রিম বুকিং ছিল না, তবু সৌভাগ্যবশত দোতলায় পেয়ে গেলাম সুসজ্জিত একটি ঘর। ভাড়া একটু বেশি হলেও সঙ্গে পাওয়া গেল একটি কমপ্লিমেন্টারি বেড। ব্যালকনিতে চেয়ারে বসে চা-পান করার সময় দেখি সামনেই প্রশস্ত ‘চৌগান’ (চৌগান-কে অনেকে ‘শোগান’ উচ্চারণ করেন), চাম্বা শহরের প্রাণকেন্দ্র।

স্নান সেরে বেলা সাড়ে বারোটায় নীচের ডাইনিং রুমে এলাম। বড়ো বড়ো কাচের জানলায় সুরুচিপূর্ণ পর্দা ঝোলানো। লাঞ্চ সারলাম চিকেন কারি, মিক্সড্ ভেজিটেবল্স, গরম রুটি ও ফ্রায়েড রাইস-এ। ক্যামেরা ও জলের বোতল নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম রাস্তায়। রাভি বা ইরাবতী নদীর তীরে ছোট্ট শহর এই চাম্বা সমুদ্রতল থেকে ৯৯৬ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত। সেই ৯২০ সালে ব্রহ্মপুর (ভারমৌর)-এর শেষ রাজা সাহিল ভার্মা রাজধানী স্থানান্তর করেন এই চাম্বায়। প্রিয় কন্যা চম্পাবতীর নামেই এই জনপদের নাম রাখেন ‘চম্বা’ (চাম্বা)।

সেই চাম্বার প্রাণকেন্দ্র চৌগান-এর পাশ দিয়ে হেঁটে এসে আমরা পৌঁছোলাম হরিরাই মন্দিরে। একাদশ শতাব্দীতে তৈরি শিখরধর্মী এই মন্দির ভগবান বিষ্ণু (চতুর্মুখ)-র প্রতি উৎসর্গীকৃত। হাঁটতে হাঁটতে চলে এলাম ভুরি সিং মিউজিয়ামে। চৌগান-এর নির্মাতা রাজা সাম সিং-এর পুত্র রাজা ভুরি সিং তাঁর বংশের সংগৃহীত সমস্ত চিত্রকলা দান করেন এই মিউজিয়ামে, যা জনসাধারণের জন্য উন্মোচিত হয় ১৯০৮ সালে। মিউজিয়ামে রক্ষিত কাংড়া ও চাম্বা স্টাইলের চিত্রকলা সত্যিই মুগ্ধ করে। মিউজিয়ামের দেয়ালে টাঙানো চাম্বার রাজাদের বংশানুক্রমিক পোর্ট্রেটগুলিও সবার নজর কেড়ে নেয়।

মিউজিয়াম থেকে বেরিয়ে রাস্তা পার হয়ে চলে এলাম চৌগান-এর বিপরীতে। মিনিট পাঁচেক হেঁটে, কিছুটা চড়াই ভেঙে, পৌঁছোলাম চম্পাবতী মন্দিরে। দশম শতাব্দীর এই মন্দির রাজা সাহিল ভার্মা তাঁর প্রিয় কন্যা চম্পাবতীর স্মৃতির উদ্দেশ্যে নির্মাণ করান। মন্দিরের শান্ত পরিবেশ ভালো লাগে, তবে রক্ষণাবেক্ষণের অভাব চোখে পড়ে। এর পর চললাম অদূরেই অবস্থিত চাম্বার প্রধান দ্রষ্টব্য লক্ষ্মীনারায়ণ মন্দির দেখতে। শিখরধর্মী এই মন্দিরগুলোও রাজা সাহিল ভার্মার রাজত্বকালে তৈরি। মূল মন্দিরে রয়েছেন লক্ষ্মী-দামোদর এবং নন্দী। প্রতিটা মন্দিরেই রয়েছে গর্ভগৃহ ও মণ্ডপ। অনেকটা সময় কাটালাম মন্দির চত্বরে। মনে হচ্ছিল, কালের সোপান বেয়ে ইতিহাস বুঝি আজ হাত ধরতে চায় বর্তমানের!

এবার ধীরে ধীরে পৌঁছোলাম শহরের উত্তর কোণে অবস্থিত হাজার বছরের পুরোনো ব্রজেশ্বরী মন্দিরে। কাঠের ছত্রী সমেত এই মন্দিরও শিখরধর্মী। ফিরে এলাম চৌগানে। ক্লান্ত পা-দুটিকে বিশ্রাম দিতে বসে পড়লাম মাঠের সবুজ ঘাসে। দেখি, রোদ পড়ে আসছে। সন্ধ্যা সমাগত ছোট্ট পাহাড়ি শহর চাম্বায়।

পরদিন সকালের বাসে আমরা ভারমৌর (অনেকে বলেন ‘ভারমোর’) যাব। তাই শ্রান্ত শরীরে আর গেলাম না পাহাড়ের মাথায় চামুন্ডা দেবীর মন্দিরে। বরং আবার রাস্তায় বার হলাম, রাতের চাম্বাকে আর একবার দেখে নিতে। চৌগান-এর পাশ দিয়ে সোজা রাস্তা। ট্যাক্সি স্ট্যান্ডকে ডান পাশে রেখে হাঁটতে লাগলাম। দোকান-পাট প্রায় সবই বন্ধ হয়ে গিয়েছে। পৌঁছে গেলাম পথের শেষ প্রান্তে, চাম্বার রিজিওনাল হস্পিটালের কাছে। বাঁ দিকে ঘুরতেই দুপুরে দেখা ভুরি সিং মিউজিয়াম। সেটা পেরিয়ে বৃত্তাকার পথে চলে এলাম চৌগানে। ভাবছিলাম, একদা রাজাদের প্রমোদ উদ্যান এই চৌগান আজও চাম্বার প্রাণকেন্দ্র। খেলাধূলা ও হেঁটে বেড়ানোর আদর্শ জায়গা। দেখি, পূর্ণিমার আকাশে আসন্ন পূর্ণিমার গেলে চাঁদ। ভারি ভালো লাগছিল রাতের নিস্তব্ধ চাম্বাকে! চৌগানের একপাশে, পাহাড়ের কোলে রাজপ্রাসাদ, যা অতীত এবং বর্তমানের স্মৃতি ও গৌরবকে বহন করে দাঁড়িয়ে আছে আজও।

সকাল ৭টায় উঠে পড়েছি বিছানা ছেড়ে। স্নান সেরে সবাই তৈরি হয়ে নিলাম। সরাসরি ভারমৌর যাবার জন্য এইচপিএসটিসি-র বাস সকাল সাড়ে আটটায়। বাস স্ট্যান্ডে পৌঁছে গিয়েছি আটটার আগেই। দেখি, একটি প্রাইভেট বাসের কনডাক্টর যাত্রী ওঠাচ্ছে ভারমৌর নিয়ে যাবার জন্য। আমরা কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই সে প্রায় জামাই আদরে আমাদের বাসে উঠিয়ে নিল লাগেজ সমেত। এত চকিতে পুরো ব্যাপারটা ঘটল যে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগটাও পেলাম না। ৮টা বাজতেই বাস ছেড়ে দিল। চাম্বা থেকে ভারমৌরের দূরত্ব ৬২ কিলোমিটার। বাসে সময় লাগে প্রায় সাড়ে তিন ঘন্টা। ভারমৌর যাবার রাস্তা খুবই খারাপ এবং যথেষ্ট বিপৎসংকুল। মিনিট ১৫ বাস যাত্রার পর হঠাৎ কনডাক্টর এসে জানাল, বাস ভারমৌর পর্যন্ত যাবে না। ১০ কিলোমিটার আগে খাড়ামুখ-এ নেমে অন্য গাড়িতে পৌঁছোতে হবে ভারমৌর। আমি তাতে অসন্তোষ প্রকাশ করায় সে কথা দিল, খাড়ামুখ থেকে ভারমৌর যাবার ব্যবস্থা নিজদায়িত্বে করে দেবে।

বাস আরও কিছুক্ষণ চলার পর এল এক ছোট্ট জনপদ, নাম মুগলা। তারপরেই এল মেখলা। রাস্তা বিপজ্জনক– এক পাশে পাহাড়ের উঁচু প্রাচীর, অন্য পাশে গভীর খাদ। সেখানে বয়ে চলেছে ইরাবতী– এখানে বলে রাভি। নদীর পাশেই আবার খাড়া পাহাড়। এক ভয়ানক সৌন্দর্য! স্বল্প পরিসর রাস্তায় মাঝে মাঝেই চলেছে মেরামতের কাজ। তার ওপর ছিল চমেরা পাওয়ার স্টেশন তৈরির মহাযজ্ঞ, তাই মহাব্যস্ততা। সংর্কীণ পথে উলটোদিক থেকে আগত গাড়িকে জায়গা দেবার জন্য মাঝে মধ্যেই যে ভয়ানক পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছিল, সে কথা চিন্তা করলে আজও মনে শিহরণ জাগে।

ঘন্টা দেড়েক যাত্রার পর কাছে এল আর এক পাহাড়ি জনপদ, নাম গৈহারা। তার পরেই দুনালি। গা-শিরশির করা ভয়টা কেটে গেছে ততক্ষণে। এরপর একে একে লুনা, ঢাকোগ্ পেরিয়ে প্রায় তিন ঘন্টা পরে এসে পৌঁছোলাম খাড়ামুখ-এ। বাসের কনডাক্টর কথা রেখে ভারমৌরগামী এক জিপে আমাদের যাবার ব্যবস্থা করে দিল। লাহাল্ জনপদ পেরিয়ে ভারমৌর পৌঁছোতে লাগল প্রায় ৪০ মিনিট। ২১৩০ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত ভারমৌর-এ বেলা সাড়ে এগারোটাতেও বেশ ঠান্ডা।

শ্রাবণ মাসে ‘মণিমহেশ যাত্রা’র সময় ছাড়া ভারমৌরে আগত পর্যটকের সংখ্যা নিতান্তই কম। কারণ, অবশ্যই পথের দুর্গমতা। জিপচালক আমাদের নামিয়ে দিল একেবারে পিডব্লুডি গেস্টহাউসের সামনে। কেয়ারটেকারকে একটু অনুরোধ করতেই পেয়ে গেলাম ত্রিশয্যার একটি ঘর। কাঠ-পাথর-সিমেন্টে তৈরি সাদা, দোতলা বাংলোটা দেখতে ভারি সুন্দর। লাগেজ ঘরে রেখেই ক্যামেরা নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম পথে।

একে মেঘলা আবহাওয়া, সঙ্গে ঠান্ডা হাওয়া। প্রথমেই সামনের এক ধাবায় গিয়ে গরম চায়ে শীত কাটালাম। ধাবাতেই লাঞ্চের অর্ডার দিয়ে এগিয়ে চললাম ভারমোর-এর ‘চৌরাশি’ মন্দির কমপ্লেক্স দেখতে। ৬-৭ মিনিট হেঁটে আরও প্রায় ২০০ ফুট উঁচুতে উঠে পৌঁছোলাম সুপ্রাচীন ‘চৌরাশি’ মন্দিরে। চারিদিকেই দেখি সুউচ্চ পর্বতের বিস্তার। কোনও কোনও শৃঙ্গে জমাট বাঁধা বরফ। ‘শিবভূমি’ নামে সার্থকতা। উপলব্ধি করলাম হূদয়ে। একে একে দেখে নিলাম মহাদেব মন্দির, নৃসিংহ মন্দির এবং ধর্মেশ্বর মন্দির। আরও দেখলাম হরিহর, মণিমহেশ ও লক্ষ্মণাদেবীর মন্দির। সবশেষে এলাম ব্রাহ্মণী মাতার মন্দিরে, যাঁর নামানুসারে একদা এই স্থানের নাম ছিল ব্রহ্মপুরা। অনুভব করলাম, বিশাল মন্দির চত্বরে এক অখন্ড শান্তি বিরাজমান। মন্দিরগুলির রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে এএসআই। চারিদিকের প্রাকৃতিক দৃশ্য এত সুন্দর যে তাকে ভাষায় প্রকাশ করার চেষ্টা নিরর্থক। ধৌলাধার-এর বরফঢাকা পর্বতশিখরের ছবি শুধু নয়, রুক্ষ এবং সবুজ পাহাড়ের ছবিও তুললাম সাধ মিটিয়ে।

মন্দির চত্বর থেকে বেরিয়ে সোজা পৌঁছোলাম ধাবায়। গরম রুটি, ডাল-মাখানি ও পনির মশলায় লাঞ্চ সারলাম। গেস্টহাউসে ফিরে বিশ্রাম নিলাম ঘন্টাখানেক। দু’পশলা বৃষ্টির পর আকাশ একেবারে পরিষ্কার, উজ্জ্বল নীল। ভারমৌর থেকে একটা পথ সোজা গিয়েছে হাড্সার-এ। সেখান থেকে ধান্চো, বান্দরঘাটি ও গৌরীকুণ্ড পেরিয়ে চলে গেছে মণিমহেশ পর্যন্ত।

বিকেল সাড়ে তিনটে বেজেছে। নির্জন পাহাড়ি পথে হাঁটতে হাঁটতে ভাবছিলাম ভারমৌর-এর অতীত কথা। বহুপূর্বে এই স্থানের নাম ছিল ব্রহ্মপুরা, যা প্রায় ৪০০ বছর ধরে প্রাচীন চাম্বা রাজ্যের রাজধানী ছিল। বর্তমান ভারমৌর-এর অবস্থান চাম্বার ৬০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে বুধিল উপত্যকায়, রাভি ও চেনাব-এর মাঝে, প্রায় ৭০০০ ফুট উচ্চতায়। গদ্দি উপজাতিদের বাসস্থান বলে এই স্থানের আর এক নাম ‘গদ্দেরান’। অযোধ্যা রাজবংশজাত রাজা মারু ও তাঁর কনিষ্ঠ পুত্র জয়স্তম্ভ তৎকালীন রাণাদের পরাজিত করে উচ্চ ইরাবতী উপত্যকা জয় করেন এবং এই ব্রহ্মপুরে রাজধানী স্থাপন করেন ষষ্ঠ শতাব্দীতে। রাজা মারুর পর আরও অনেক রাজা রাজত্ব করেন ব্রহ্মপুরে। শেষ রাজা সাহিল ভার্মা নিম্ন ইরাবতী উপত্যকা জয় করে চাম্বায় রাজধানী স্থানান্তর করেন। মনোরম পরিবেশ, দু’পাশে সুউচ্চ পর্বতরাজির হাতছানি। এক স্বর্গীয় অনুভূতি আমাদের মনে।

শিবভূমি ভারমৌর-এ প্রকৃতিই প্রথম ও শেষ কথা। পুণ্যার্থীদের জন্য চৌরাশি মন্দির মন ভরাবে অবশ্যই। পড়ন্ত বিকেলে আবার চললাম মন্দির দর্শনে। অস্তগামী সূর্যের হালকা আলোয় মন্দির চত্বরে তখন ছোটো ছেলেমেয়েদের মিলন মেলা। সকলেই খেলায় ব্যস্ত। সকালের ধ্যানগম্ভীর ভাবের পরিবর্তে তখন হাসি-খেলার হালকা পরিবেশ। ধাবায় ডিনার সেরে রাত সাড়ে ন’টার মধ্যেই ফিরে এলাম গেস্টহাউসে। পরদিন সকাল সাড়ে ছ’টায় চাম্বা ফেরার বাস। প্রায় নিস্তব্ধ, নির্জন গেস্টহাউসে আমরাই শুধু বাইরের লোক। বেশ গা-ছমছমে পরিবেশে কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম সবাই।

ভোর সাড়ে পাঁচটায় উঠে একে একে তৈরি হয়ে নিলাম। লাগেজ নিয়ে বেরিয়ে এলাম গেস্টহাউস থেকে। ভারমৌর তখনও ঘুমে আচ্ছন্ন। সওয়া ছ’টা নাগাদ পৌঁছোলাম বাস স্টপ-এ। উলটোদিকে এক চায়ের দোকান দেখে খুশি হলাম। গরম চায়ে চুমুক দিয়ে তীব্র ঠান্ডা থেকে রেহাই পেলাম কিছুটা। চাম্বাগামী প্রথম বাসটি চলে গেছে ভোর সাড়ে পাঁচটায়। দ্বিতীয় বাসটাও প্রায় খালি। লাগেজ যথাস্থানে রেখে বাসের সামনের অংশে ৪-টে আসনে বসলাম। রাস্তা ফাঁকা, তাই বাস ছুটছিল বেশ জোরে। চেনা রাস্তায় ইরাবতী সর্বক্ষণের সঙ্গী। সকাল ৯ টা ৪৫ মিনিটে পৌঁছে গেলাম চাম্বায়।

সামনে চৌগান, যেখানে চাম্বার অধিবাসীরা প্রতি বছর পালন করে মিনজার উৎসব ও সুহিমাতা মেলা। হিমাচলের ছোট্ট শহর চাম্বা আমাদের আপন করে নিয়েছিল একদিনেই। ট্যাক্সি স্ট্যান্ড থেকে একটা মারুতি বুক করে রওনা দিলাম ধৌলাধার-এর আর এক রত্ন খাজিয়ার-এর পথে। ২৪ কিলোমিটার পাহাড়ি পথে নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক দৃশ্যের সাক্ষী হয়ে মাত্র ৪৫ মিনিটে পৌঁছে গেলাম খাজিয়ার বনবিভাগের মাঝে। গাড়ি এসে থামল এইচপিটিডিসি-র ‘হোটেল দেওদার’-এর সামনে। বহুবার টিভির পর্দায় বা ইন্টারনেটে দেখা পাইন-দেওদারে ঢাকা, পাহাড়ঘেরা খাজিয়ার-এর সবুজ উপত্যকা একেবারে চোখের সামনে। উপত্যকার গায়ে লাগানো কটেজগুলির ১ নম্বর ঘরটি পছন্দ হল আমাদের, যেখান থেকে খাজিয়ার-এর তিনদিকের রূপই প্রত্যক্ষ করা যায়।

খাজিয়ার যেন প্রকৃতির এক আশ্চর্য সৃষ্টি! আয়তনে সে যতটা ছোটো, রূপে সে ততটাই অসাধারণ! নরম ঘাসে ঢাকা সবুজ গালিচার মতো এই উপত্যকার তিনদিকেই পাইন-দেওদারে ঢাকা পাহাড়। জঙ্গলে আরও দেখা যায় ওর্ক, বার্চ ইত্যাদি। সম্পূর্ণ উপত্যকা প্রদক্ষিণ করতে করতে ছবি তুললাম অনেক। খাজিয়ার-এর রূপে আমরা একেবারে বিস্ময়াবিষ্ট। দেখে নিলাম দ্বাদশ শতকে তৈরি প্যাগোডাধর্মী খাজ্জিনগ মন্দির এবং হালে তৈরি জগদম্বা মন্দির। আমরা এবার কটেজ-এর বারান্দায়, হাতে কফির কাপ নিয়ে। সন্ধে ঘনিয়ে আসতেই দেখি একে একে সব টুরিস্ট কার, জিপ বা বাসে চেপে চলে গেলেন খাজিয়ার ছেড়ে। আমরা কিন্তু থেকে গেছি এক মায়াবি রাতের অপেক্ষায়। রাত ৮টা। আমরা চলে এসেছি খাজিয়ার-কালাটপ বনবিভাগের নির্জন রাস্তায়। আকাশে পূর্ণিমার গোল চাঁদ। স্নিগ্ধ চাঁদের দুধ-সাদা আলোয় এবং বিশাল সব দেওদারের ছায়ায় এক অপার্থিব পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছে চরাচরে। নীচে, কিছুটা দূরে আবছা কটেজগুলো এবং আরও দূরে উপত্যকার প্রান্তে, পাহাড় ও দেওদার বনের অন্ধকার মিলে তৈরি হয়েছে যেন এক মায়াবি পরিবেশ! প্রকৃতির এই অনন্য আলো-আঁধার রূপ আমি দেখিনি কখনও।

রাত সাড়ে ৯টায় ডিনার সেরে কটেজে যখন ফিরছি, মনে হচ্ছে যেন রাত দুটো। এতটাই নিস্তব্ধ চারিদিক। সকলে শুয়ে পড়লে, ঘরের আলো নিভিয়ে বসলাম জানলার পাশে। পর্দা সরিয়ে জানলার কাচ দিয়ে দেখতে লাগলাম চন্দ্রালোকিত প্রকৃতির বাঁধভাঙা সৌন্দর্য। দূরে মাঝে মাঝে কুকুর ডাকছিল রাতের গভীরতাকে জানান দিয়ে। ভাবছিলাম, খাজিয়ারে রাত না কাটালে কি এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা অধরা থেকে যেত আমাদের কাছে।

লাগেজ গুছিয়ে, স্নান সেরে সকাল ৯টার মধ্যে আমরা তৈরি। ড্রাইভার শর্মাকে বলেছি, বেলা ১০টার মধ্যে কটেজে গাড়ি নিয়ে চলে আসতে। সামনে ধাবায় গিয়ে সেরে নিলাম ব্রেকফাস্ট। যথাসময়ে শর্মা তার সাদা অল্টো নিয়ে হাজির। রূপসী খাজিয়ারকে বিদায় জানাতে গিয়ে বুঝলাম, বড়ো ভালোবেসে ফেলেছি তাকে! এবার গন্তব্য কালাটপ স্যাংচুয়ারি। শর্মা জানাল, স্যাংচুয়ারি দেখিয়ে সে নিয়ে যাবে ডাইনকুণ্ডে। এই অঞ্চলের উচ্চতম ও সুন্দরতম স্থান।

গাড়ি ছেড়ে দিল। আমরা চলেছি ১২ কিমি দূরের লক্বরমন্ডীতে, কালাটপ অরণ্যের প্রবেশদ্বার। গাড়ি চলেছে খাজিয়ার-কালাটপ স্যাংচুয়ারির অন্তর্গত খাজিয়ার বনবিভাগের রাস্তায়। দু’পাশে ওক, দেওদার, স্প্রুস এবং নানা পর্ণমোচী উদ্ভিদের জঙ্গল। মিনিট ১৫ চলার পর গাড়ি এসে থামল পীরপাঞ্জাল পয়েন্ট-এ। এখান থেকে কিছুটা নীচে দেখা যাচ্ছে পুরো খাজিয়ার উপত্যকাকে। এক অনবদ্য সুন্দর ছবি! আকাশে মেঘ থাকায় পীরপাঞ্জাল পর্বতশ্রেণিকে পরিষ্কার দেখতে পেলাম না। তবে দিগন্তে দৃষ্টি মেলে আভাষ পেলাম তার সুউচ্চতার।

লক্বরমন্ডীতে এসে গাড়ি থামতেই পৌঁছোলাম স্যাংচুয়ারির টিকিট ঘরে। জানলাম, অরণ্যে গাড়ি নিয়ে গেলে ২০০ টাকা প্রবেশ কর দিতে হবে। পায়ে হেঁটে প্রবেশ করতে কোনও কর লাগে না। আমরা গাড়ি নিয়ে ঢুকলাম স্যাংচুয়ারির ভিতরে।

লক্বরমন্ডী থেকে জঙ্গল পথে মাত্র ৩ কিলোমিটার অন্য রাস্তা ধরে উপরে আরও ১০ কিলোমিটার গেলে ডালহৌসি। দেখছি কয়েকজন অল্পবয়সি ছেলেমেয়ে হেঁটে চলেছে রেস্ট হাউসের দিকে, আবার কয়েকজন মাঝবয়েসি পর্যটক ফিরে আসছেন লক্বরমন্ডীর দিকে। মিনিট ২০ চলার পর আমাদের গাড়ি এসে থামল স্যাংচুয়ারির প্রধান প্রবেশদ্বারে। গাড়ি বাইরে রেখে আমরা ঢুকলাম ভিতরে, আর শর্মা গাড়িতেই থেকে গেল লাগেজ সমেত।

প্রথম দর্শনেই মুগ্ধ হলাম স্যাংচুয়ারির রূপ দেখে। বেশ অনেকটা জায়গা নিয়ে বন বিশ্রামাগার, উলটোদিকেই পাশাপাশি কয়েকটি ট্রেকারস্ হাট। রেস্ট হাউস ও ট্রেকারস্ হাট সমেত পুরো জায়গাটাই ধাতব তার দিয়ে ঘেরা। রেস্ট হাউস সংলগ্ন বাগানে চেয়ার-টেবিল পাতা রয়েছে। চারপাশে প্রাচীন দেওদার-পাইনের জঙ্গল, সঙ্গে রয়েছে ওক আর স্প্রুস। সূর্যের আলোও সহজে প্রবেশ করতে পারে না এই ঘন জঙ্গলে। সত্যি, এক শান্ত সম্ভ্রম জাগানো পরিবেশ!

চারিদিকে ঘুরে ঘুরে ছবি তুলছিলাম। ট্রেকারস্ হাট সংলগ্ন কয়েকটি কিচেন থেকে ধোঁয়া উঠছে দেখে বুঝতে পারলাম সেখানে টুরিস্ট আছেন। রেস্ট হাউস ও ট্রেকারস্ হাটগুলির অবস্থান এত সুন্দর পরিবেশে যে দেখেই মনে হবে, অন্তত একটা পুরো দিন যদি কাটানো যেত এই জায়গায়। কয়েক প্রজাতির প্রজাপতি উড়ছিল এদিকে সেদিকে। বনবিশ্রামাগার-এর দেয়ালে টাঙানো এক বোর্ডে এই অঞ্চলের যাবতীয় প্রজাপতিগুলির নাম ও ছবি দেওয়া আছে। প্রসঙ্গত জানাই, হিমাচল প্রদেশের স্টেট বার্ড, অ্যানিমেল ও ফ্লাওয়ার যথাক্রমে ওয়েস্টার্ন ট্র্যাগোপান, স্নো-লেপার্ড এবং পিংক রডোডেনড্রন।

রেস্ট হাউসের এক কর্মচারী জানালেন, এই জঙ্গলে আছে অনেক প্রকার ফল ও ওষধি গাছ। পশুপাখির সংখ্যাও নেহাত কম নয় জঙ্গলে। উচ্চতাভেদে দেখতে পাওয়া যায় স্নো-লেপার্ড, ভালুক, হরিণ, কাঠবিড়ালি, শিয়াল, লেঙ্গুর প্রভৃতি। এই স্যাংচুয়ারির পাখিদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হোয়াইট-উইঙ্গড্ ব্ল্যাক বার্ড, ইউরেশিয়ান জে, চেস্টনাট বিল্ড রক থ্রাঙ্গ ইত্যাদি। আমরা দেখতে পেয়েছি শুধু ব্ল্যাক হেডেড্ জে এবং গ্রে হেডেড্ ফ্লাই ক্যাচার। মনে হচ্ছিল, কোনও এক স্বর্গরাজ্যে এসে পড়েছি আমরা। রেস্ট হাউসের বাগানে, জঙ্গলের প্রেক্ষাপটে চা-পান করা মনে থাকবে চিরকাল। এই অরণ্য ছেড়ে যেতে মন চাইছিল না, তবু গিয়ে বসতে হল অপেক্ষমান গাড়িতে। শর্মা অল্টো স্টার্ট করল আমরা ধীরে ধীরে সেই দৃষ্টিনন্দন অরণ্য ছেড়ে বেরিয়ে এলাম।

লক্বরমন্ডী থেকে ডালহৌসির পথে কিছুদূর এগিয়ে, বাঁক নিয়ে অন্য পথে এগোল গাড়ি। এবার গন্তব্য ডাইনকুণ্ড। শর্মা জানাল, এই পথের সৌন্দর্য নাকি তুলনাহীন। আমাদের গাড়ি এগোচ্ছিল ধীর গতিতে, কারণ পথের উচ্চতা ক্রমশই বাড়ছিল। উচ্চতার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়ে চলেছে পথের সৌন্দর্য। কোথাও পাইনের সারি, কোথাও আবার সুউচ্চ দেওদার বৃক্ষরাজি বাড়িয়ে তুলেছে এ পথের সৌন্দর্য। গাড়ি ডাইনকুণ্ডের নীচে এক মিলিটারি চৌকির কাছে এসে থামল। শর্মা জানাল, আমরা ৮০০০ ফুট উচ্চতায় চলে এসেছি। মানে, ডাইনকুণ্ড আরও ১৫০০ ফুট উঁচুতে। দুপুর দেড়টা বাজে। ভয়ংকর চড়াই রাস্তা। গরম লাগছিল একটু। দিগন্তে গগনচুম্বী পর্বতশ্রেণির প্রেক্ষাপটে পাইন-দেওদারের মাঝ দিয়ে চড়াই পথ। পথের অবর্ণনীয় সৌন্দর্য এবং মাঝে মাঝেই ঠান্ডা হাওয়া পথ চলার কষ্ট ভুলিয়ে দিচ্ছিল। আমরা প্রায় ৯০০০ ফুট উচ্চতায় চলে এসেছি। ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্রহরী রাডারগুলো একেবারে হাতের কাছে চলে এসেছে। সেগুলোর ছবি তোলা মানা।

প্রকৃতির ক্যানভাসে পট পরিবর্তন প্রায়শই। উত্তুঙ্গ চড়াই-এর উলটোদিকেই সুগভীর খাদ। শর্মার নির্দেশে আমরা এসে দাঁড়ালাম এমন এক জায়গায়, যেখান থেকে সুউচ্চ পীরপাঞ্জাল পর্বতশ্রেণিকে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছিল। আমরা দারুণ খুশি। তখনও জানতাম না, চমকের বাকি ছিল আরও। মাথার উপরে সুনীল আকাশ। আরও কিছুটা এগোলাম। দেখি, দিগন্তে তুষারমন্ডিত শৃঙ্গরাজির মাঝে এক অপূর্ব সুন্দর পর্বতশৃঙ্গ। শর্মা জানায়, ওই শৃঙ্গই সুমহান মণিমহেশ। বাকরুদ্ধ আমরা শ্রদ্ধায় মাথা নত করলাম। শর্মাকে জানালাম আমাদের আন্তরিক কৃতজ্ঞতা।

আরও কিছুটা উপরে উঠে শর্মা দেখাল ডাইনকুণ্ডের সঠিক অবস্থান, যদিও সেই জায়গা মিলিটারি নো-এন্ট্রি-জোন-এর মধ্যে। পথ আরও উপরে উঠে পৌঁছেছে শ্রীপোহ্লানী মাতা মন্দিরে। ১০,০০০ ফুট উচ্চতায় সেই মন্দির। প্রকৃতির অপার সৌন্দর্যের মধ্যেও এবার চড়াই ভাঙতে বেশ কষ্ট হচ্ছিল। ধীরে, দৃঢ় পদক্ষেপে আমরা উপরে উঠছিলাম। কয়েকজন স্থানীয় পুণ্যার্থী মায়ের দর্শন সেরে ফিরে আসছিল হাসি মুখে। তাদের দেখে আমরাও পেলাম নতুন উৎসাহ। বেলা সোয়া দুটো নাগাদ আমরা পৌঁছে গেলাম মহাকালী শ্রীপোহ্লানী মাতা মন্দিরে।

ছোটো, সাদামাঠা কালীমন্দির। পূজাস্থল দেখে বুঝলাম, সকাল থেকে অনেকেই পুজো দিয়ে গেছেন। মন্দিরের নীচে একটা ছোটো প্রায় সমতল জায়গায় চা-বিস্কুট-নুড্ল্স-এর দোকান। সামনে পাতা রয়েছে প্লাস্টিকের চেয়ার-টেবল। শর্মাকে নিয়ে আমরাও বসে পড়লাম চেয়ারে। চা খাওয়ার সময় দোকানির কাছ থেকেই জানতে পারলাম কেন এই জায়গার নাম ডাইনকুণ্ড। বহুকাল পূর্বে এখানে নাকি এক ভীষণ পরাক্রমশালী ডাইনের বাস ছিল। ডাইনের অত্যাচারে যখন এই অঞ্চলের মানুষেরা অতিষ্ঠ, তখন তাদেরই প্রার্থনায় আবির্ভূতা হন মহাকালী। দোকানি এবার কোনাকুনি ভাবে প্রায় ১০০ ফুট উঁচুতে পাহাড়ের গায়ে পোঁতা এক ত্রিশূলকে দেখাল। সে জানায়, ওই স্থানেই নাকি দেবীর আবির্ভাব এবং ওই ত্রিশূলেই বহুক্ষণ যুদ্ধ করে তিনি বধ করেন মায়াবি ওই ডাইনকে। দোকানি এবার বহুদূরে নির্দেশ করে বলে, ওই দূরে এক কুণ্ডে গিয়ে পড়েছিল সেই ডাইন-এর মৃতদেহ। সেই থেকে ওই কুণ্ডের নাম ডাইনকুণ্ড। আজও নাকি সেই ডাইন-এর অতৃপ্ত আত্মা ঘুরে বেড়ায় এই অঞ্চলে। তাই দেবী মহাকালী এই মন্দিরে অধিষ্ঠিত হয়ে সর্বদা রক্ষা করেন এই অঞ্চলের অধিবাসীদের। ডাইন-এর সঙ্গে অসাধারণ বীরত্বের যুদ্ধজয়ের শেষে দেবীর নাম হয় শ্রীপোহ্লানী মাতা।

কিছুক্ষণ বিশ্রামের পরে আমরা সেই স্বপ্নময় পথের উৎরাইয়ে নামতে লাগলাম। মনের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছিল পোহ্লানী মাতা ও ডাইনের যুদ্ধের উপকথা। আধ ঘন্টার মধ্যেই পৌঁছে গেলাম মিলিটারি চৌকির কাছে, যেখানে পার্ক করা আছে আমাদের গাড়ি। শর্মাকে আবার ধন্যবাদ জানালাম এত সুন্দর স্থান দেখানোর জন্য। বিকেল তিনটে বাজে। গাড়িতে উঠে বসলাম সবাই, যাব ১০ কিলোমিটার দূরে ডালহৌসির পথে। ধীরে ধীরে এগিয়ে চলল আমাদের অল্টো। পিছনে পড়ে রইল অনিন্দ্যসুন্দর ডাইনকুণ্ড।

কিছু প্রয়োজনীয় তথ্য

চাম্বা, ভারমৌর, খাজিয়ার এবং সঙ্গে কালাটপ-ডাইনকুণ্ড দেখে ফিরে আসা যায় ১০ দিনের মধ্যে। নীচে দেওয়া হল উপরোক্ত জায়গাগুলিতে কীভাবে যাবেন এবং কোথায় থাকবেন।

চাম্বা – কলকাতা বা দিল্লি থেকে জম্মুগামী যে কোনও ট্রেনে চেপে চলে আসুন চাক্বিবাঁক স্টেশনে, সেখান থেকে অটো বা কারে চেপে পাঠানকোট বাস স্ট্যান্ড। এখান থেকে চাম্বার সরাসরি বাস পাবেন ভোর সাড়ে পাঁচটা থেকে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত। বাসে সময় লাগবে প্রায় ৫ ঘন্টা, কার বা জিপে সাড়ে তিন ঘন্টা। দূরত্ব ১২০ কিলোমিটার।

কোথায় থাকবেন – হিমাচল রাজ্য পর্যটনের হোটেল ইরাবতী।

ভারমৌর – চাম্বা থেকে ভারমৌর যাবার বাস পাবেন সকাল সাড়ে ছ’টা থেকে দুপুর আড়াইটা পর্যন্ত। রাস্তা খারাপ, তাই বাসে পৌঁছোতে সময় লাগে প্রায় ৪ ঘন্টা, কারে বা জিপে ৩ ঘন্টা। দূরত্ব মাত্র ৬২ কিলোমিটার।

কোথায় থাকবেন – রাজ্য পর্যটনের হোটেল গৌরীকুণ্ড। এছাড়া আছে পিডব্লুডি গেস্টহাউস।

খাজিয়ার – চাম্বা থেকে দূরত্ব ২৪ কিমি, গাড়িতে সময় লাগবে ৪৫ মিনিট। ডালহৌসি থেকে দূরত্ব মাত্র ২২ কিমি। বাসে সময় লাগে ১ ঘন্টা, কারে ৪০ মিনিট।

কোথায় থাকবেন – সেরা জায়গা রাজ্য পর্যটনের হোটেল দেওদার।

কালাটপ ও ডাইনকুণ্ড – এই দুটি জায়গায় যেতে হলে সঙ্গে গাড়ি থাকা চাই। খাজিয়ার বা ডালহৌসি থেকে জায়গা দুটি খুবই কাছে।

কোথায় থাকবেন – কালাটপ স্যাংচুয়ারির ফরেস্ট রেস্ট হাইস বা ট্রেকারস্ হাট-এ থাকতে চাইলে যোগায়োগ করুন ডিএফও, চাম্বা-র সঙ্গে। ডাইনকুণ্ডে থাকার জায়গা নেই। বর্ষায় কালাটপ-এ এবং শীতে ডাইনকুণ্ডে না যাওয়াই শ্রেয়।

 

পড়ার জন্য সীমাহীন গল্প-নিবন্ধসাবস্ক্রাইব