‘স্পিতি’ শব্দটির অনুবাদ করলে মোটামুটি দাঁড়ায় ‘মধ্যদেশ’। এ নামের কারণ খুঁজতে অবশ্য অসুবিধা হবার কথা নয়। স্পিতির অবস্থান ও ঐতিহ্য– ভারত ও তিব্বতের প্রেক্ষিতে বিচার করলে এ নামকরণ সমর্থন করতেই হয়। এই অঞ্চল জুড়ে বয়ে গেছে অনেকগুলি দ্রুত স্রোতস্বিনী ছোটো নদী, আর প্রধান নদী স্পিতি প্রায় সমগ্র অঞ্চলের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত হয়ে ‘খাব’ অঞ্চলে শতদ্রুর সঙ্গে মিলিত হয়েছে। স্পিতি হল এক শীতল মরুভূমি। বর্ষাকালে কখনও বৃষ্টি হয় না, ফলে এ অঞ্চলের রুক্ষ ভয়ংকর সৌন্দর্য উন্মোচিত হয় সুউচ্চ পর্বতশৃঙ্গ এবং সংকীর্ণ উপত্যকাগুলির মধ্যে।

রুডিয়ার্ড কিপলিং ‘স্পিতি’ সম্পর্কে বলেছিলেন ‘আ ওয়ার্ল্ড উইদিন আ ওয়ার্ল্ডড’ আর ‘আ প্লেস হোয়্যার গডস লিভ’ অর্থাৎ পৃথিবীর অন্দরে আর-এক নতুন পৃথিবী, যেখানে দেবতাদের আবাস। এখনও বোধহয় এই কথা ফেলে দেওয়া যাবে না। স্পিতি যেন চাঁদের পাহাড়, তার খাঁজে খাঁজে বৌদ্ধ গুম্ফাগুলির অবস্থিতি, মাঝে ছোটো ছোটো গ্রাম, অসাধারণ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের ব্যাপ্তি। ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে অনেকগুলি সরোবর। অনেকেই স্পিতির তাই নাম দিয়েছেন ‘ছোটো লাদাখ’। এবার আমরা চলেছি সেই আশ্চর্য দেশের সন্ধানে।

ঠিক হল চণ্ডীগড় পর্যন্ত আমরা বিমানেই যাব। এর ফলে লম্বা ট্রেন জার্নির ক্লান্তি অনেকটাই কমবে। কারণ এর পরে রয়েছে কষ্টসাধ্য সফর। কলকাতা থেকে বিমান দিল্লি হয়ে ঠিক সময়েই এসে নামল চণ্ডীগড় বিমানবন্দরে। তারপর পূর্বনির্ধারিত গাড়ি খুঁজে মালপত্র চাপিয়ে যাত্রা শুরু হল। প্রথম গন্তব্য মানালি। চণ্ডীগড় থেকে দূরত্ব ৩২০ কিমি। সময়টা জুলাই মাসের শেষ সপ্তাহ, লাহুল স্পিতি ভ্রমণের উপযুক্ত সময়। কারণ এসব অঞ্চলে বর্ষায় বৃষ্টি হয় না, বছরের মধ্যে পাঁচ-ছয় মাস থাকে বরফের নীচে, যানবাহন চলে না। বরফ গললে পাস খুললে, জুন থেকে অক্টোবর মাসে এসব অঞ্চলে কর্মচাঞ্চল্য।

‘কাজা হল স্পিতি উপত্যকার প্রধান শহর– মহকুমা সদর। স্পিতি মহকুমা লাহুল স্পিতি জেলার অন্তর্ভুক্ত। জেলা শহর হল কেলং, কাজা থেকে ১৮৮ কিমি দূরে আর মানালির থেকে কাজার দূরত্ব ২০১ কিমি। স্পিতি মানে শুধু পাহাড় আর পাহাড়– মধ্য ও বৃহত্তর হিমালয়ের অংশ যার শীর্ষ অনেক জায়গাতেই ৬০০০ মিটার অতিক্রম করেছে আর গড় উচ্চতা প্রায় সাড়ে চার হাজার মিটার। স্পিতির বসবাসকারীদের ভৌগোলিক অবস্থান অনুযায়ী চার অংশে ভাগ করা যায়– ‘সাম’ নীচের দিকের অংশ, ‘পিন’– পিন নদীর অববাহিকা অংশ ‘ভার’ মধ্যবর্তী অংশ আর ‘টুড’ বেশি উচ্চতার অংশ বলে পরিচিত। স্পিতি নদী এই অঞ্চলের প্রধান নদী, কুনঝুম পর্বতমালার বরফ গলা জল বয়ে নিয়ে প্রায় পুরো অঞ্চল ধরে প্রবাহিত। এই মূল নদীর সঙ্গে মিলিত হয়েছে অসংখ্য উপনদী– পিন, চিয়ামো, বাটাং, লাংজে, মানে, হানসে, কাজা, লিংটি, টাবো প্রভৃতি। অধিকাংশ নদীর উপত্যকাগুলি খুবই সংকীর্ণ। একমাত্র ব্যতিক্রম, স্পিতি নদীর অববাহিকার কিছু অংশের প্রায় ৩ কিমি পর্যন্ত বিস্তৃতি দেখা যায়। এ অঞ্চলে গাছপালা, চাষের জমি খুবই সীমিত। বড়ো গাছ বলতে সামান্য অংশে পপলার, উইলো গাছ দেখা যায়। আর চাষ বলতে সামান্য জমিতে আলু, কড়াইশুঁটির চাষ হয় আর বছরের মধ্যে ছ’মাসই তো বরফের নীচে থাকে এই স্পিতি অঞ্চল। কুনঝুম পাস হল লাহুল ও স্পিতির মধ্যে একমাত্র সংযোগ। এই পাস বছরের মধ্যে ছ’মাসের বেশি সময় তুষারপাতের জন্য বন্ধ থাকে। এছাড়া কিন্নর প্রদেশের মধ্যে দিয়ে স্পিতির সঙ্গে সিমলার যোগাযোগ আছে। বাস্তবিক পক্ষে ভৌগোলিক বিচ্ছিন্নতার কারণে স্পিতির ছিল অর্ন্তমুখী সংস্কৃতি যা সেখানকার মানুষকে টেনে এনেছিল শুধুমাত্র বৌদ্ধ গুম্ফাগুলির কর্মকাণ্ডের মধ্যে। ‘নোনো’ নামের উজির দ্বারা শাসিত হতো এ অঞ্চল। তবে প্রায়শ স্পিতিকে বহির্শত্রুর আক্রমণে বিব্রত হতে হয়েছে। কুলু ও লাদাখের রাজন্যবর্গের যুদ্ধবিগ্রহ ছাড়াও ১৮৪১ সালে জম্মু কাশ্মীরের সেনাপতি গুলাম খান ও রহিম খান স্পিতির নানা অংশ আক্রমণ করে বিপর্যস্ত করেছে। ১৮৪৬ সালে স্পিতির শাসনভার ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি গ্রহণ করলেও, সেই পুরোনো ঐতিহ্য অনুযায়ী ‘নোনো’ এই শাসনকার্য চালিয়ে গেছে। স্পিতির অধিবাসী

অধিকাংশই বৌদ্ধ গেলুকপা গোষ্ঠীভুক্ত। ধর্ম এদের জীবনে একটা বড়ো অংশ জুড়ে বিরাজ করে। ‘ওম মনিপদ্মে হুম’ এই মানুষদের বীজমন্ত্র। রাত্রি ৯টা নাগাদ আমরা পৌঁছে গেলাম মানালির হোটেলে। পরদিন সকাল ৯টায় আমরা বেরিয়ে পড়লাম মানালি থেকে ব্রেকফাস্ট সেরে। পথে কোথাও মধ্যাহ্নভোজ সারতে হবে। আজকের গন্তব্য চন্দ্রতাল দর্শন সেরে লোসারে রাত্রিযাপন। সময়টা জুলাই মাসের শেষ মানালিতে বর্ষাকাল। সকালে আকাশ মেঘলা, কাল রাতে বৃষ্টি হয়ে গেছে।

গাড়ি মানালি শহর ছাড়িয়ে বিপাশা নদীর হাত ধরে রোটাং পাসের পথে চড়াই উঠতে শুরু করল। মানালি থেকে রোটাং পাসের দূরত্ব ৫২ কিমি। মানালি থেকে লাহুল স্পিতি বা লেহুর পথে যেতে হলে এই রোটাং পাস অতিক্রম করতেই হবে। রোটাং-এর উচ্চতা বারো হাজার ফুটেরও বেশি। যতই ওপরে উঠছি ততই ঠান্ডা বাড়ছে। শন শন করে হাওয়াও বইছে। তবে আশেপাশে বরফের চিহ্ন খুব বেশি নেই। আর বরফচূড়া তো সব মেঘের অন্তরালে। মাঝে আবার ছোটোখাটো ধসের জন্য কিছুক্ষণের জন্য যাত্রাপথে বিঘ্ন। পথ ঠিক হতে আধ ঘণ্টা, আবার গাড়ির কনভয় এগিয়ে চলে। তবে অধিকাংশ গাড়ির গন্তব্য ওই রোটাং পাস পর্যন্ত।

রোটাং শীর্ষ পেরিয়ে আমরা এগিয়ে চলি তবে এবার উৎরাই পথে। রাস্তা এঁকেবেঁকে নেমে গেছে লাহুল উপত্যকার দিকে। প্রায় ১৩ কিমি পথ পাড়ি দিয়ে পৌঁছে গেলাম গ্রামফু (১০,৪৬০ ফুট)। আকাশ ধীরে ধীরে পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে। আমরা বৃষ্টিচ্ছায়া অঞ্চলে প্রবেশ করছি– এসব অঞ্চল সুউচ্চ পাহাড়ের আড়ালে থেকে মৌসুমী বায়ুর নাগালের বাইরে থাকে। পির পাঞ্জাল শ্রেণির তুষারশৃঙ্গগুলি আকাশে ধীরে ধীরে আত্মপ্রকাশ করছে।

২১ নং জাতীয় সড়ক কেলং হয়ে লেহ-র পথে চলে গেছে। গ্রামফু থেকে সে পথ বাঁদিকে আর ডানদিকের পথ কুনঝুম পাস পেরিয়ে চলে গেছে স্পিতি উপত্যকার দিকে। আমরা ডানদিকের পথ ধরলাম। চন্দ্রা নদী এখন আমাদের সঙ্গী। রাস্তার অবস্থাও ভালো নয়। আকাশ নীল, তুষারশৃঙ্গগুলি দৃশ্যমান। পথ খারাপ হলেও বেশ বৈচিত্র্যপূর্ণ। পাহাড়ের গা বেয়ে নেমে এসেছে হিমবাহ, আবার তা গলে গলে তৈরি হয়েছে ঝরনা। এমনই এক বিশাল ঝরনার বিপদসঙ্কুল স্রোতের মধ্যে দিয়ে গাড়ি পার হয়ে এল। রাস্তা তো নেই, বোল্ডারের ওপর দিয়ে লাফাতে লাফাতে গাড়ি অতিক্রম করছে পথ। এ জন্যেই এ পথে শুধুমাত্র বড়ো গাড়িই ব্যবহার করা হয়, এছাড়া এপথে বাস, ট্রাক তো চলছেই।

পথের এই ভয়ংকর রূপের জন্য গাড়ির গতি অনেক কমে গেছে। তবে প্রকৃতি থেকে এখনও সবুজ অন্তর্হিত হয়নি। পাহাড়ের ঢালে সবুজ ঘাস জমিতে এখনও ভেড়ার পালের বিচরণ দেখা যাচ্ছে। গ্রামফু থেকে ১৭ কিমি পেরিয়ে ছত্রু। ড্রাইভার জানাল এরপর আর খাওয়ার জায়গা পাওয়া যাবে না। ছত্রুতে রয়েছে একটি পিডাব্লুডি রেস্ট হাউস আর অস্থায়ী কয়েকটি ধাবা। এই ধাবা চালু থাকবে যতদিন এই পথে বাস চলাচল চালু থাকবে ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত। এরপরই বরফ পড়া শুরু হবে– ঢেকে যাবে সব বরফের চাদরে।

নুডলস, ডিমভাজা খেয়েই আবার বেরিয়ে পড়ি। ড্রাইভার অনিল একদম সময় নষ্ট করতে চাইছে না। চন্দ্রা নদীর ওপরের ব্রিজ পেরিয়ে গাড়ি এগিয়ে চলে। তবে এখন পথের আর কোনও অস্তিত্ব নেই। কখনও বোল্ডার, কখনও ধুলো-পাথরের প্রান্তর, কখনও বা মাটির ও গাড়ির চাকার দাগ– এই সব হল পথের নির্দেশ। রোদ এখন ঝকঝক করছে, চন্দ্রা নদী এখনও সঙ্গে রয়েছে তবে এ পথে আর সবুজের অস্তিত্ব নেই– শুধু পাথর পাথর আর পাথর শুধু পাথরের মরুভূমি। পাহাড়ের শীর্ষে এখনও বরফের আস্তরণ, কখনও বা পাহাড়ের গায়ে বরফের আল্পনা, বরফ গলতে শুরু করলেই পাহাড়ের গা বেয়ে নেমে আসে জলের ধারা, সৃষ্টি হয় অসংখ্য ঝরনা, তারই টানে নেমে আসে পাথরের টুকরো, বোল্ডার। তার ফলে পথ মাঝে মাঝে হয়ে যায় অবরুদ্ধ।

এ পথে গাড়ির সংখ্যা বড়োই নগণ্য। এক-একটা গাড়ির দর্শনে মনে ভরসা জাগে। আর এ পথে গাড়ি খারাপ হলে কি দুর্ভোগ হবে তা চিন্তা করা যায় না! এরপর পথে আবার পড়ল এক প্রবাহমানা ঝরনা। তারই পাশে একটি মালবাহী ট্রাক পাথরে ধাক্বা খেয়ে বিকল। অতএব গাড়ি থেকে নেমে পড়তে হল। বহু কসরত করে গাড়ি এই রাস্তাটুকু পার হলে আবার গাড়িতে ওঠা।

আর একটু পরেই পৌঁছে গেলাম ছোটোধারা। ছত্রু থেকে মাত্র ১৫ কিমি কিন্তু এই পথ অতিক্রম করতে দেড়ঘণ্টার বেশি সময় লেগেছে। গ্রামের কোনও অস্তিত্ব চোখে পড়ল না, একটা রেস্টহাউস রয়েছে রাস্তার ধারে কিন্তু কোনও লোকজনের দেখা নেই যেন শ্মশানপুরী, শুধুই পাথরের রাজ্য। চন্দ্রা নদী কখনও হাতের কাছে, আবার কখনও অনেক নীচ দিয়ে বয়ে যাচ্ছে। কোনও সবুজের ছিটেফোঁটাও এ পথে নেই। পাহাড়-নদী-পথ সবই যেন মিলেমিশে গেছে। পাথরের রঙের বৈচিত্র্যও যেন চোখে পড়ার মতো। গাড়ি এখন একেবারে নেমে এসেছে শুকনো নদীর খাতে। চারদিকে খোলা প্রান্তর– ঘিরে রেখেছে বরফের নকশা কাটা পাহাড়ের দেয়াল। চন্দ্রা নদী এখানে বেশ সংকীর্ণ, পাশাপাশি চলেছে তার আপন ছন্দে।

পৌঁছে গেলাম বাতাল। এখানে মিলিটারি ক্যাম্প রয়েছে তবে আমাদের বিশ্রামের কোনও সুযোগ নেই। ছোটোধারা থেকে ১৬ কিমি এই বাতাল। চলেছি এখন চন্দ্রতালের উদ্দেশ্যে। দিনের আলো থাকতে থাকতে চন্দ্রতাল দর্শন করে ফিরে আসতে হবে। বাতাল থেকে একটি পথ গেছে উধর্বমুখী কুনঝুম পাসের দিকে আর একটি সংকীর্ণ পথ গেছে চন্দ্রতালের দিকে। বাতাল থেকে চন্দ্রতাল ১৪ কিমি, তার মধ্যে ১২ কিমি গাড়িতে যাওয়া যাবে বকিটা পদব্রজে। গাড়ির এই পথ সমতল, তবে মুখোমুখি দুটি গাড়ি এসে গেলে বিপদ। আমাদের যাত্রাপথে সৌভগ্যবশত বিপরীত দিক থেকে কোনও গাড়ি আসেনি।

১০ কিমি পথ পেরিয়ে রাস্তার ধারে সবুজ ঘাসের জমি, চোখে পড়ে ভেড়ার পাল নিয়ে মেষপালকের আনাগোনা। মাঠে রংবেরঙের টেন্টের সারি। চন্দ্রতালের ভ্রমণার্থীদের জন্য এইসব টেন্ট। তবে অধিকাংশই বিদেশি পর্যটক। এরপরই গাড়ির পথ শেষ। জায়গাটা সমতল, মাঝে মাঝে ঘাসজমি, পুরো অঞ্চলটাই ঘিরে রেখেছে বরফে মোড়া পাহাড়গুলো। ন্যাড়া পাহাড়ও আছে যেখানে বরফের আল্পনা নেই আবার সবুজেরও চিহ্ন নেই। মাত্র ২ কিমি হাঁটা পথ প্রায় সমতল, সরোবরের দিকে একটা ঢাল আছে। তবে উচ্চতাজনিত কারণে (৪২৭০ মিটার) অনেকের অসুবিধা হতে পারে। সরোবরের জলে পাহাড়ের প্রতিবিম্ব। জলের রং পান্না সবুজ তার সঙ্গে একটু নীলের ছোঁয়া। বিদায়ি সূর্যালোকের রশ্মির ‘কনে দেখা আলোয়’ চন্দ্রতাল যেন আরও মোহময়ী। দৈর্ঘ্যে প্রায় ২ কিমি, পরিধি ৪ কিমি, সরোবরের ধার ধরে পরিক্রমা পথ তৈরি করা হয়েছে। তবে সে সময় আমাদের নেই। ঠান্ডা বাতাসের দাপট রয়েছে। সূর্য হেলে পড়ছে আর পাহাড়ের ছায়াও যেন ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে সরোবরের জল থেকে। ব্রাহ্মণী হাঁসের দল ভেসে  বেড়ায় তালের জলে। এবার ফেরার পথ ধরতে হবে, আমরা গাড়ির দিকে হাঁটা লাগাই।

এবার কুনঝুম পাসের দিকে গিরিশিরা ধরে গাড়ি উঠতে থাকে। এখন পাখির চোখে চন্দ্রা নদীকে দেখা যাচ্ছে রুপোলি ফিতের মতো। ৪৫৫১ মিটার উঁচু কুনঝুম গিরিবর্ত্ম শীর্ষ, মানালি-কাজার পথে সর্বোচ্চ বিন্দু। অধিকাংশ সময়ে বরফে ঢাকা থাকে। হিমাচল প্রদেশের বৃহত্তম জেলা লাহুল-স্পিতিকে ভাগ করেছে এই পাস। সাধারণত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত যাতায়াত করা যায়। তবে কুনঝুম পাসে এখন বরফ নেই, তবে প্রচণ্ড ঠান্ডা ও ঝড়ের মতো হাওয়া দিচ্ছে। এখন আকাশ পরিষ্কার চারদিকে ঘিরে রেখেছে বরফমোড়া পাহাড়ের সারি। ড্রাইভার অনিল শৃঙ্গগুলির নাম গড়গড় করে বলে গেল– বড় সিগরি, ছোটা সিগরি, চন্দ্রভাগা ইত্যাদি। কুনঝুম মাতার মন্দিরে প্রণাম ও প্রদক্ষিণপর্ব চুকল। বৌদ্ধ চোর্তেনগুলো ঘিরে রঙিন পতাকাগুলি ঝোড়ো হাওয়ায় পতপত করে উড়ছে। বেশি হাঁটাচলায় শ্বাসকষ্ট হচ্ছে আর বেশিক্ষণ এখানে থাকা যাবে না। সন্ধ্যা ছটা বেজে গেছে তবে এখনও সোনালি রঙের রোদ রয়েছে। এগিয়ে চলি লোসারের পথে। পথেই স্পিতি উপত্যকার অভ্যর্থনা ‘ওয়েলকাম টু স্পিতি ভ্যালি’।

পথ নেমে গেছে ১৮ কিমি দূরের লোসারে। পথের অবস্থা প্রায় সেরকমই। বোল্ডার আর উঁচুনীচু পাথুরে রাস্তা, তারই ওপর দিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে গাড়ি এগিয়ে চলেছে। কুনজুম পর্যন্ত আমাদের সঙ্গী ছিল চন্দ্রা নদী এখন স্পিতি নদী আমাদের নতুন সঙ্গী। লাহুল উপত্যকা থেকে এখন আমরা স্পিতি উপত্যকায়। পাহাড়ের গঠনশৈলীরও যেন পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। সবুজের দেখা নেই তবে পাথরের রঙে যে কত বৈচিত্র থাকতে পারে তা এখানে না এলে বোঝা যেত না। হলুদ, বেগুনি, বাদামি, কমলা, কালচে এসব রং তো প্রত্যক্ষ করাই যায়।

এরপরে আর এক বৈচিত্র, হাওয়ার দাপটে ভূমিক্ষয়ে পাহাড়ের পাথরগুলি অনন্য সব আকৃতি নিয়েছে। এগিয়ে আসছে লোসার, সূর্যের আলো এখনও রয়েছে। কমলা রঙের পাথরের গায়ে নানা ধরনের প্রাকৃতিক কারুকার্য। নানা ধরনের পাথরের দেয়ালে ফোল্ডিং-এর উদাহরণ যেন ভূতত্বের পাঠ্যপুস্তক থেকে উঠে এসেছে। এই কমলা পাথরের পাহাড়ের মাথায় সাদা বরফের মুকুটও রয়েছে। পৌঁছে গেছি লোসার গ্রামের উপকণ্ঠে।

ছোট্ট তিব্বতি উপজাতিদের গ্রাম এই লোসার। মূল রাস্তা দিয়ে গ্রামের মুখে একটি তোরণ। তিব্বতি ভাষায় স্বাগত জানানো হয়েছে। এই অঞ্চলে সবুজের উচ্ছ্বাস কিন্তু স্তব্ধ হয়নি। চাষবাস হয়, দোকানপাট, স্কুল, পুলিশ চৌকি, বৌদ্ধ গুম্ফা, সেনা ছাউনি আর রাত্রিবাসের জন্য কয়েকটি তিব্বতি গেস্টহাউস রয়েছে। সামনে যে সর্পিল পথে নদী বয়ে চলেছে তা স্পিতি নদী। এখানেই আজকে আমাদের রাত্রিবাসের ঠিকানা। গেস্টহাউস খুবই সাধারণ মানের তবে এ পথে এর থেকে ভালো কিছু পাওয়ার কোনও সম্ভাবনা নেই। সূর্যের আলোর মধ্যেই চাঁদের উদয়। প্রায় ১৩ হাজার ফুট উচ্চতায় এই গ্রাম।

সকলেরই উচ্চতাজনিত কিছু শারীরিক সমস্যা হচ্ছে। রাতে খাওয়ার কোনও ইচ্ছাই হল না। হোটেলে বানিয়েছিল রুটি ও বেগুনের বিস্বাদ ঝোল। কয়েকটা বিস্কিট আর জল খেয়েই রাতের খাওয়া সাঙ্গ হল। পরদিন পূর্ণিমা, তাই চাঁদের আলোয় ভেসে যাচ্ছে লোসারের পাহাড় উপত্যকা। রাতে ভালো ঘুম হল না। ভোরে লোসারে আবার নীল আকাশে রোদের ঝলমলে প্রকৃতি। হোটেলের সামনেই কয়েকটা দোকান এই ভোরেই খুলে গেছে– নানা ধরনের শাল, সোয়েটার, টুপি, মাফলার, মেয়েদের গয়না ইত্যাদি বিক্রি হচ্ছে। মেয়েরা সেদিকেই মন দিয়েছে। ব্রেকফাস্ট সেরেই আমরা বেরিয়ে যাব। টিলার মাথায় এই গ্রামের যে মনাস্ট্রি তথা বৌদ্ধ গুম্ফা রয়েছে তাই পা চালিয়ে দেখে এলাম। গুম্ফাটি বেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন, বুদ্ধমূর্তিটি আকর্ষণীয় আর গুম্ফার উচ্চতা থেকে প্রকৃতির এক অনন্য রূপ ধরা পড়ে।

আবার এগিয়ে চলা। তার আগে লোসারে টোস্ট-অমলেট, কফির ভরপেট ব্রেকফাস্ট হয়েছে। আজ আমাদের গন্তব্য কাজা। লোসার থেকে দূরত্ব প্রায় ৬০ কিমি। এখন পথ প্রায় সমতলের মধ্যে দিয়ে। তবে মাঝে মাঝেই আত্মপ্রকাশ করছে পাহাড়ের সারি মাথায় তুষারমুকুট আবার কখনও বা পাথরের গায়ে তুষারের আলপনা। স্পিতি নদীও সঙ্গে রয়েছে আগাগোড়া। পাথরের রঙের বৈচিত্র্য আবার চোখে পড়ছে। লালচে, খয়েরি, হলদে অথবা বেগুনি নানা রঙের সমাহার আর তার সঙ্গে পাথরের সব অনন্যসাধারণ ভাস্কর্য। তবে এই ভাস্কর্য মানুষের তৈরী নয় সবই প্রাকৃতিক। কখনও মনে হয় রাজপ্রাসাদ। কখনও বা কোনও জীবজন্তুর অবয়ব, কখনও বা পাথরের থাম আবার কখনও বা ফলফুলের ঝালর।

রাস্তার অবস্থা আগের থেকে অনেক ভালো, চড়াই-উৎরাই প্রায় নেই বললেই চলে। নদীর পাড়ের কাছেও এই বায়ুক্ষয়ের ভাস্কর্য। আকাশের রং নীল তাতে সাদা মেঘের ভেলা, এখানে বর্ষার নামগন্ধও নেই। লোসার থেকে ১৫ কিমি দূরে হানসে গ্রাম। ছোটো গ্রাম হলেও সবুজের ছোঁয়া রয়েছে– আলু ও কড়াইশুঁটির ছোটোছোটো খেত। এছাড়া সেই ন্যাড়া পাথরের পাহাড়। মাটির রং ধূসর তামাটে আর হলুদ মেশানো। এখানেও রাস্তার যানবাহন চলাচল খুবই সীমিত। পর্যটকের দেখাও কদাচিৎ মেলে।

এরপর মোবাং গ্রাম। এখানে প্রায় প্রতিটি গ্রামে রয়েছে তাদের নিজস্ব মনাস্ট্রি। গ্রামে লোকসংখ্যা খুবই কম। কয়েকটি মাত্র পাথরের ব্লকে তৈরি বাড়ি। বাংলার গ্রামের সঙ্গে কোনও তুলনাই হয় না। গাড়ি এবার প্রবেশ করল বিশাল বিশাল প্রকৃতিক স্তম্ভ আর খিলানের মাঝখানে– পাথরের এই সব প্রাকৃতিক ভাস্কর্যের অতুলনীয় বিশালত্বে মুগ্ধ হতে হয়। স্পিতি নদীর ওপারে পাহাড়ের গায়ে যেন লেপটে রয়েছে ‘কী মনাস্ট্রি’। বিশাল স্তূপের মতো হলদে রঙের পাহাড়ের গায়ে অসংখ্য খোপের মতো সাদা বাড়িগুলি মনে হয় যেন আঠা দিয়ে সেঁটে দেওয়া হয়েছে। এরপরে রংরিক গ্রাম। পাথরের স্তম্ভের মাথায় বিশাল বুদ্ধমূর্তি। রংরিক গ্রাম থেকে কাজা আর মাত্র ৮ কিমি পথ। কাজার দিকে যত এগোচ্ছি দূরের পাহাড়গুলি তত বড়ো চেহারায় ধরা দিচ্ছে। পাহাড়ের গায়ে অনেকটা তুষারশূণ্য, মাথায় তুষারমুকুট তবে অনেকটাই এলোমেলো বরফের আল্পনা।

পৌঁছে গেলাম কাজা। কাজা স্পিতি– মহকুমার সদর শহর। উপত্যকার নানা দিকে সড়ক যোগাযোগের প্রধান কেন্দ্র। চারধারে রংচঙে ন্যাড়া পাহাড় আর বহু ধারায় বিভক্ত স্পিতি নদী। কড়াইশুঁটির কয়েকটি খেতের টুকরো, টেলিফোন ও পেট্রল পাম্পের সুবিধা, টুরিস্ট লজ ও বড়ো কয়েকটি হোটেল রয়েছে ওপরের ধাপে, নীচের দিকে ঘিঞ্জি বাজার এলাকা ও কয়েকটি হোম-স্টে হোটেল ও সাধারণ বাড়িঘর। শহরের ঔজ্জ্বল্য বলে সেরকম কিছু চোখে পড়ে না বরং এক শান্ত সমাহিত রূপই প্রতীয়মান হয়।

আমরা স্পিতি ভ্যালি হোটেলে উঠেছি। হোটেলটি ভালোই, বারান্দা থেকে পাহাড়ের অপূর্ব দৃশ্য চোখে পড়ে। স্পিতি নদীকে দেখা না গেলেও শোনা যায় তার প্রবাহের ঝংকার। কাজার উচ্চতা ৩৬০০ মিটার, অক্সিজেনের অভাব এখানেও রয়েছে। বিশ্বের সর্বোচ্চ পেট্রল পাম্প এই কাজাতেই। ড্রাইভার গাড়িতে তেল ভরে আনল কারণ দিনের নির্দিষ্ট সময়ে কয়েক ঘণ্টার জন্য এই পাম্প খোলা থাকে। তেল আবার পাওয়া যাবে কেলং-এর আগে তান্ডিতে।

কাজাতে সেরকম দর্শনীয় বিশেষ দ্রষ্টব্য নেই বললেই চলে। আমাদের হোটেলের পাশেই বিশাল বর্ণময় কাজা মনাস্ট্রি ও রাস্তার ওপারে কয়েকটি সুদৃশ্য চোর্তেন। ২০০৯ সালে এই নতুন মনাস্ট্রির উদ্বোধন হয়েছে। অন্দর খুবই সুসজ্জিত, বুদ্ধমূর্তি প্রাণময়, মোমবাতি ও প্রদীপের আলোয় এক স্নিগ্ধ পরিবেশ। নতুন মনাস্ট্রির পিছনে অনেক সিঁড়ি ডিঙিয়ে পৌঁছোতে হবে ভগ্ন পুরোনো মনাস্ট্রিতে। এখানে টুরিস্টের সংখ্যা খুবই কম। সামান্য কয়েকজন বিদেশি টুরিস্ট। কয়েকজন দেখলাম মোটর সাইকেলের পিছনে মালপত্র চাপিয়ে হিমালয় দর্শনে বেরিয়েছে। মনাস্ট্রি দর্শনের পর হাতে তখনও অনেক সময়, দিনের আলোও রয়েছে যথেষ্ট। বাজার ও গ্রামে এক চক্বর ঘোরা। সবই পাথরের বাড়ি, বাড়ির ছাদে গাছের গুঁড়ি, ডালপালা কেটে কেটে এখনই জমা করা হচ্ছে। সবই শীতের রসদ। যখন বরফে ঢেকে যাবে চারদিক, আগুন জ্বালিয়ে জল গরম, ঘর গরম, রান্না সবই করতে হবে এই কাঠের সাহায্যে।

স্পিতি এলাকায় ভূপ্রকৃতি ও জনজীবন দুদিক থেকেই বৈশিষ্টপূর্ণ। হিমাচলের অন্যান্য এলাকা থেকে তা অনেকটাই স্বতন্ত্র। পরের দিন সকালে আবার যাত্রা শুরু– ‘কী’ গুম্ফা আর কিব্বের গ্রামের উদ্দেশে। স্পিতি উপত্যকার প্রধান বৈশিষ্ট্য শুধু তুষারশিখর নয়, তার সঙ্গে শুষ্ক কঠিন ভূমিরূপ। স্পিতি নদী এখানে খুব চওড়া না হলেও স্রোত খুব আর নদীর খাতে শুকনো পাথরে ভর্তি। গাড়ির পথে ‘কী’ গুম্ফা কাজা থেকে মাত্র ১২ কিমি দূরে। পথের সৌন্দর্য একইরকম– পাহাড়ের গায়ে পাথরের প্রাকৃতিক ভাস্কর্য, আকাশ নীল, রোদ ঝকমকে প্রকৃতি, আকাশে তুষারশৃঙ্গের উঁকিঝুঁকি।

গ্রামের মধ্যে টিলার মাথায় ‘কী’ গুম্ফার অবস্থিতি। কিছুটা দূর থেকে মনে হয় ‘কী’ গুম্ফা যেন পাহাড়ের গায়ে খাঁজে খাঁজে আঠা দিয়ে কেউ আটকে দিয়েছে উই ঢিবির আকারে। কাজা থেকে ‘কী’ হয়ে কিব্বের গ্রামের দিকে দিনে একটা বাস যায়, তবে এই বাসের অপেক্ষায় বসে থাকলে যাওয়া-আসা সবই অনিশ্চিত হয়ে পড়বে। পাথরের নানা রং এ পথেও প্রত্যক্ষ করা গেল। বাঁকে বাঁকে এগিয়ে গুম্ফার দরজায় গাড়ি পৌঁছে দিল। বাসে এলে শেষ ৩ কিমি চড়াই ভেঙ্গে উঠতে হবে। ঢোকার মুখে এক গ্রামীণ কিউরিও দোকান– মেয়েদের কিছুটা সময় সেখানে কাটে কেনাকাটায়।

প্রাচীন এই ‘কী’ গুম্ফা এক কেল্লার মতো ধাপে ধাপে উঠে গেছে ওপরে। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন অংশের নির্মাণের ফলে নির্মাণ স্থাপত্যে কিছুটা অসঙ্গতি চোখে পড়ে। বিরাট একটি ঘরের একপ্রান্তে সুবিশাল এক বুদ্ধমূর্তি। এছাড়া রয়েছে দুষ্প্রাপ্য থাঙ্কাচিত্র এবং প্রাচীন বাদ্যযন্ত্রের এক অনন্য সংগ্রহ। প্রাচীন পুঁথি, পাণ্ডুলিপি ইত্যাদির সংগ্রহও রয়েছে এখানে। এই গুম্ফা নানা সময়ে বহিঃশত্রুর আক্রমণে ও প্রাকৃতিক কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল আর তার পুনর্নির্মাণ হয়েছে। ‘কী’ গুম্ফার নির্মাণকাল নিয়ে মতভেদ রয়েছে। কারও মতে এটি অন্তত এক হাজার বছরের প্রাচীন আবার অন্যের মতে এটি পঞ্চদশ শতকে নির্মিত। যাইহোক ১৪,৪০০ ফুট উচ্চতায় নির্মিত এই গুম্ফা এক অনন্য স্থাপত্য এবং এটির সাংস্কৃতিক ও ধার্মিক গুরুত্বও স্বীকার করে নিতে হবে। এই গুম্ফায় বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের বাসকক্ষ যেমন রয়েছে তেমনি রয়েছে সাধারণের অতিথিশালা। সন্ন্যাসীদের ব্যবহার বেশ মধুর।

আমাদের প্রথমে নিয়ে যাওয়া হল প্রার্থনাকক্ষে যার বিবরণ আগেই দিয়েছি। সেখানে গুরুগম্ভীর পরিবেশে পূজাপাঠ চলছে, বিশাল মোমবাতি জ্বলছে, ধূপের এক অচেনা গন্ধে ভরে গেছে কক্ষর অন্দর। কক্ষের বাইরে কিছু চিত্রাবলী। দুই সন্ন্যাসী আমাদের নিয়ে গেলেন অন্দরের এক কক্ষে সেখানে এক অনন্য স্বাদের চা খাওয়ালেন। সেই চায়ের উপকরণ– হার্বাল চা পাতা ছাড়া রয়েছে পুদিনা, আদা, দারচিনি, এলাচ, তুলসী ও চিনি। এরপর প্রসাদ হিসেবে খেলাম ছাতু, বার্লি, চিনি ও ঘিয়ের মিশ্রণে তৈরি এক মণ্ড। খেতেই পেট ভরে গেল। ধন্যবাদ জানিয়ে গেলাম এবার গুম্ফার ওপরতলায় ছাদে। ছাদে দাঁড়িয়ে পাখির চোখে দেখা গেল কাজা উপত্যকা– স্পিতি নদীর অববাহিকার এক অপূর্ব দৃশ্য। নদীর ধারে ‘কী’ গ্রামের বাড়িঘরও দেখা যায় খেলনা বাড়ির মতো। এবার ‘কী’ গুম্ফা থেকে বিদায় নিয়ে যাত্রা করি কিব্বের গ্রামের পথে। দূরত্ব ৭ কিমি।

পৃথিবীর উচ্চতম গ্রাম বলে পরিচিত কিব্বের, যেখানে স্থায়ীভাবে মানুষ বসবাস করে। উচ্চতা ১৪,৭১০ ফুট (৪২০৫ মিটার) তবে বর্তমানে উচ্চতম গ্রামের শিরোপা পেয়েছে গেট্টে (৪২৭০ মিটার) তবে সে গ্রামে নাকি মাত্র পাঁচ ঘরের মানুষের বসবাস। ‘কী’ থেকে পথ ঊধর্বমুখী। রাস্তার অবস্থা খুব একটা ভালো নয়। ন্যাড়া পাহাড়গুলির পিছনে তুষারশৃঙ্গের উঁকিঝুঁকি। আকাশ হঠাৎই মেঘে ঢেকে গেছে, বৃষ্টি পড়ার উপক্রম যা এই অঞ্চলে খুবই ব্যতিক্রমী ঘটনা। কিব্বের কিন্তু সবুজে ভরা– গ্রামে ঢোকার মুখে এক ছোট্ট টিলা, সেখান থেকে একদিকে সবুজ চাষের ক্ষেত্র আর একদিকে রুক্ষ পাহাড়ি গ্রামের দিকে চলে গেছে। খেতে কড়াইশুঁটি, আলুর চাষ হচ্ছে তার সঙ্গে গমের খেতও চোখে পড়ে। ফুলে ভর্তি গাছও স্পিতি ভ্রমণে প্রথম দেখা হল। গ্রামের মধ্যে দিয়ে হাঁটতে থাকি, বেশ কয়েকটা হোটেল, হোম-স্টে, গেস্টহাউস, স্কুল, পোস্ট অফিস, এসটিডি বুথ, বাজার-দোকানও রয়েছে ছড়িয়ে ছিটিয়ে। তবে রাস্তায় গ্রামের মানুষদের যাতায়াত খুব একটা চোখে পড়ে না, মূলত বিদেশি টুরিস্ট– ট্রেকারদেরই ঘোরাফেরা।

গ্রামের বাড়িগুলি বেশ রংচঙে, পাথর ও মাটি দিয়ে তৈরি। চড়াই পথ উঠে গেছে গ্রামের শেষে এক গুম্ফায়। বাতাসে অক্সিজেনের অভাব, দ্রুত হাঁটলে দমের কষ্ট হচ্ছে। এক রেস্তোরাঁয় বসে মেমো খেলাম। দু এক ফোঁটা বৃষ্টি পড়ছে। এখানে বৃষ্টি একেবারেই স্বাভাবিক নয়। রেস্তোরার কর্মী জানাল এখানে অধিকাংশ মাটির বাড়ি তাই বৃষ্টি হলে ক্ষতি হবে অনেক। এখানে বছরের পর বছর বৃষ্টি হয় না। কিব্বের-এর বসতি বেশ প্রাচীন। এই বসতি গড়ে উঠেছিল তিব্বতের সঙ্গে বাণিজ্যের কেন্দ্র হিসেবে। বাড়ির মাথায় জমা করা কাঠের স্তূপ, আর লাল শুকনো ঘাস– আসন্ন শীতকালের মানুষ ও পশুর সংস্থান আর কি!

এবার কাজা ফেরার পালা। দুপুরে মধ্যাহ্নভোজ সেরে আবার পথে। বৃষ্টি আর হয়নি তবে আকাশ মেঘে ঢাকা। এবার চলেছি কোমিক গ্রামের পথে, লাংজা, হিক্বিম হয়ে তবে কোমিক গ্রাম। কাজা থেকে লাংজা ১৮ কিমি, লাংজা থেকে হিক্বিম ১০ কিমি আর হিক্বিম থেকে কোমিক আরও ৩ কিমি পথ। পাহাড় টপকে টপকে এগিয়ে চলা, পাহাড়ের গায়ে অতুলনীয় প্রাকৃতিক ভাস্কর্য তবে সেই শুষ্ক, রুক্ষ রূপই এখানেও প্রধান। স্পিতি নদী পেরিয়ে আবার পাহাড় চড়া তবে আকাশে এখনও মেঘের ঘনঘটা। পথ গেছে কালো রঙের পাহাড়ের মধ্যে দিয়ে।

যতই লাংজা গ্রামের দিকে এগিয়ে চলেছি ততই প্রকৃতিতে সবুজের সমারোহ বাড়ছে। প্রায় ৪৫ মিনিটের মধ্যে পৌঁছে গেলাম লাংজা গ্রামে। চারদিক পাহাড় দিয়ে ঘেরা, তার মধ্যে অনেকগুলিরই শীর্ষ বরফে মোড়া। তবে আকাশে মেঘের জন্য নীল আকাশে বরফ-চূড়ার কাঙ্খিত রূপ পাওয়া গেল না। গ্রামটি তারের বেড়া দিয়ে ঘেরা, তাই যে-কোনও দিক দিয়ে ঢোকা যাবে না, ঘুরে আসতে হবে প্রবেশপথের কাছে। দূর থেকেই দেখা যায় গ্রামের মধ্যে বিশাল এক বুদ্ধমূর্তি। গ্রাম কিন্তু সবুজে ভরা। সরকারের বিশেষ যোজনায় এই গ্রামে সবুজের সমারোহ।

অবশেষে গ্রামে প্রবেশের পথ পাওয়া গেল। আলু, ধনে, কড়াইশুঁটি, সরষে, গমের চাষ হচ্ছে। সুন্দর সাজানো গোছানো গ্রাম। এইরকম শুষ্ক পরিবেশে এই সবুজের সমারোহ অভূতপূর্ব। চোদ্দো হাজার ফুট উচ্চতায় আইবেক্স দেখা পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ড্রাইভার অনিল জানাল শীতের সময় এ অঞ্চলে দলে দলে আইবেক্স ঘুরে বেড়ায়। গ্রামের সর্বোচ্চ অংশে গুম্ফা। এখন রং করা হচ্ছে। তবে ভেতরে প্রবেশের কোনও বাধা নেই। গুম্ফা দর্শন করে বেরোতেই গ্রামের বাচ্চা ছেলেমেয়েরা ঘিরে ধরল– ‘ফসিল’ কেনার জন্য অনুরোধ– ৫০ টাকা/১০০ টাকা দর। জানা গেল এই অঞ্চলে পাথরের মধ্যে ফুলের ও নানা ধরনের পোকামাকড়ের ফসিল (জীবাস্ম) পাওয়া যায়। গ্রামের পথে পথে একটু ঘোরা– ঘুরতে ঘুরতে সেই বিশাল বুদ্ধমূর্তির পায়ের কাছে পৌঁছে গেলাম। এবার ফেরার পালা। সময়াভাবে আর হিক্বিম আর কোমিক গ্রামে যাওয়া হল না। ফিরে আসি কাজায়।

পরদিন আমরা যাব কাজা থেকে টাবোর উদ্দেশে। পথে পড়বে আর-এক বিখ্যাত গুম্ফা ধানকড়। ঘুরে নেব পিনভ্যালির পথে প্রান্তরে। তবে সে অভিজ্ঞতার কথা তো অন্য এক গল্প, তা আর একদিন হবে!

প্রয়োজনীয় তথ্য

(১) হাওড়া থেকে দু-রাত কালকা মেলে কাটিয়ে খুব ভোরে চন্ডীগড়। চন্ডীগড় থেকে বাসে বা গাড়িতে মানালি (৩২০ কিমি)। বিমানে চন্ডীগড় চলে এলে সময় অনেকটাই কমে।

(২) মানালি থেকে গাড়ি ভাড়া করে সরাসরি চলে আসা যায় কাজা। সময় ১২/১৩ ঘণ্টা লাগবে। যাঁরা চন্দ্রতাল দেখে আসতে চান (মানালি থেকে ১৪০ কিমি) তাঁরা চন্দ্রতালের ধারে টেন্ট অথবা লোসারের গেস্ট হাউসে থাকতে পারেন। টেন্টে থাকা খাওয়া জনপ্রতি ১৫০০/২০০০ টাকা বুকিং ৯৮৭৪৩৭৩৩৮০/ ৯৪৩৩৮১৩৬৭৮

সিমলা থেকে কিন্নর হয়েও কাজা পেৌঁছোনো যায়।

(৩) স্পিতি অঞ্চলের প্যাকেজের জন্য যোগাযোগ করতে পারেন হিমাচল প্রদেশ হেল্পলাইন টুরিজমের সঙ্গে। কলকাতার ঠিকানা ৬ সি আর অ্যাভিনিউ (ম্যাগনেট হাউস) রুম নং ১০৪, ফোন ৬৪৫৯৭০৫২

(৪) কাজায় থাকার জন্য রয়েছে এইচপিটিডিসির টুরিস্ট লজ, পিডব্লুডি’র রেস্ট হাউস ছাড়াও কয়েকটি প্রাইভেট হোটেল।

(৫) সেরা সময় জুন–অক্টোবর তবে কুনঝুম-রোটাং পাস কখন খোলা থাকছে জেনে পথে নামা উচিত

(৬) বিশদ বিবরণের জন্য

হিমাচল প্রদেশ পর্যটন উন্নয়ন নিগম

২ এইচ, ইলেকট্রনিক্স সেন্টার (২ তল)

১/১এ বিপ্লবী অনুকূল চন্দ্র স্ট্রিট

কলকাতা – ৭০০০১২

ফোন – ২১১২-৬৩৬১/৯০৭২

 

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...