‘স্পিতি’ শব্দটির অনুবাদ করলে মোটামুটি দাঁড়ায় ‘মধ্যদেশ’। এ নামের কারণ খুঁজতে অবশ্য অসুবিধা হবার কথা নয়। স্পিতির অবস্থান ও ঐতিহ্য– ভারত ও তিব্বতের প্রেক্ষিতে বিচার করলে এ নামকরণ সমর্থন করতেই হয়। এই অঞ্চল জুড়ে বয়ে গেছে অনেকগুলি দ্রুত স্রোতস্বিনী ছোটো নদী, আর প্রধান নদী স্পিতি প্রায় সমগ্র অঞ্চলের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত হয়ে ‘খাব’ অঞ্চলে শতদ্রুর সঙ্গে মিলিত হয়েছে। স্পিতি হল এক শীতল মরুভূমি। বর্ষাকালে কখনও বৃষ্টি হয় না, ফলে এ অঞ্চলের রুক্ষ ভয়ংকর সৌন্দর্য উন্মোচিত হয় সুউচ্চ পর্বতশৃঙ্গ এবং সংকীর্ণ উপত্যকাগুলির মধ্যে।
রুডিয়ার্ড কিপলিং ‘স্পিতি’ সম্পর্কে বলেছিলেন ‘আ ওয়ার্ল্ড উইদিন আ ওয়ার্ল্ডড’ আর ‘আ প্লেস হোয়্যার গডস লিভ’ অর্থাৎ পৃথিবীর অন্দরে আর-এক নতুন পৃথিবী, যেখানে দেবতাদের আবাস। এখনও বোধহয় এই কথা ফেলে দেওয়া যাবে না। স্পিতি যেন চাঁদের পাহাড়, তার খাঁজে খাঁজে বৌদ্ধ গুম্ফাগুলির অবস্থিতি, মাঝে ছোটো ছোটো গ্রাম, অসাধারণ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের ব্যাপ্তি। ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে অনেকগুলি সরোবর। অনেকেই স্পিতির তাই নাম দিয়েছেন ‘ছোটো লাদাখ’। এবার আমরা চলেছি সেই আশ্চর্য দেশের সন্ধানে।
ঠিক হল চণ্ডীগড় পর্যন্ত আমরা বিমানেই যাব। এর ফলে লম্বা ট্রেন জার্নির ক্লান্তি অনেকটাই কমবে। কারণ এর পরে রয়েছে কষ্টসাধ্য সফর। কলকাতা থেকে বিমান দিল্লি হয়ে ঠিক সময়েই এসে নামল চণ্ডীগড় বিমানবন্দরে। তারপর পূর্বনির্ধারিত গাড়ি খুঁজে মালপত্র চাপিয়ে যাত্রা শুরু হল। প্রথম গন্তব্য মানালি। চণ্ডীগড় থেকে দূরত্ব ৩২০ কিমি। সময়টা জুলাই মাসের শেষ সপ্তাহ, লাহুল স্পিতি ভ্রমণের উপযুক্ত সময়। কারণ এসব অঞ্চলে বর্ষায় বৃষ্টি হয় না, বছরের মধ্যে পাঁচ-ছয় মাস থাকে বরফের নীচে, যানবাহন চলে না। বরফ গললে পাস খুললে, জুন থেকে অক্টোবর মাসে এসব অঞ্চলে কর্মচাঞ্চল্য।
‘কাজা হল স্পিতি উপত্যকার প্রধান শহর– মহকুমা সদর। স্পিতি মহকুমা লাহুল স্পিতি জেলার অন্তর্ভুক্ত। জেলা শহর হল কেলং, কাজা থেকে ১৮৮ কিমি দূরে আর মানালির থেকে কাজার দূরত্ব ২০১ কিমি। স্পিতি মানে শুধু পাহাড় আর পাহাড়– মধ্য ও বৃহত্তর হিমালয়ের অংশ যার শীর্ষ অনেক জায়গাতেই ৬০০০ মিটার অতিক্রম করেছে আর গড় উচ্চতা প্রায় সাড়ে চার হাজার মিটার। স্পিতির বসবাসকারীদের ভৌগোলিক অবস্থান অনুযায়ী চার অংশে ভাগ করা যায়– ‘সাম’ নীচের দিকের অংশ, ‘পিন’– পিন নদীর অববাহিকা অংশ ‘ভার’ মধ্যবর্তী অংশ আর ‘টুড’ বেশি উচ্চতার অংশ বলে পরিচিত। স্পিতি নদী এই অঞ্চলের প্রধান নদী, কুনঝুম পর্বতমালার বরফ গলা জল বয়ে নিয়ে প্রায় পুরো অঞ্চল ধরে প্রবাহিত। এই মূল নদীর সঙ্গে মিলিত হয়েছে অসংখ্য উপনদী– পিন, চিয়ামো, বাটাং, লাংজে, মানে, হানসে, কাজা, লিংটি, টাবো প্রভৃতি। অধিকাংশ নদীর উপত্যকাগুলি খুবই সংকীর্ণ। একমাত্র ব্যতিক্রম, স্পিতি নদীর অববাহিকার কিছু অংশের প্রায় ৩ কিমি পর্যন্ত বিস্তৃতি দেখা যায়। এ অঞ্চলে গাছপালা, চাষের জমি খুবই সীমিত। বড়ো গাছ বলতে সামান্য অংশে পপলার, উইলো গাছ দেখা যায়। আর চাষ বলতে সামান্য জমিতে আলু, কড়াইশুঁটির চাষ হয় আর বছরের মধ্যে ছ’মাসই তো বরফের নীচে থাকে এই স্পিতি অঞ্চল। কুনঝুম পাস হল লাহুল ও স্পিতির মধ্যে একমাত্র সংযোগ। এই পাস বছরের মধ্যে ছ’মাসের বেশি সময় তুষারপাতের জন্য বন্ধ থাকে। এছাড়া কিন্নর প্রদেশের মধ্যে দিয়ে স্পিতির সঙ্গে সিমলার যোগাযোগ আছে। বাস্তবিক পক্ষে ভৌগোলিক বিচ্ছিন্নতার কারণে স্পিতির ছিল অর্ন্তমুখী সংস্কৃতি যা সেখানকার মানুষকে টেনে এনেছিল শুধুমাত্র বৌদ্ধ গুম্ফাগুলির কর্মকাণ্ডের মধ্যে। ‘নোনো’ নামের উজির দ্বারা শাসিত হতো এ অঞ্চল। তবে প্রায়শ স্পিতিকে বহির্শত্রুর আক্রমণে বিব্রত হতে হয়েছে। কুলু ও লাদাখের রাজন্যবর্গের যুদ্ধবিগ্রহ ছাড়াও ১৮৪১ সালে জম্মু কাশ্মীরের সেনাপতি গুলাম খান ও রহিম খান স্পিতির নানা অংশ আক্রমণ করে বিপর্যস্ত করেছে। ১৮৪৬ সালে স্পিতির শাসনভার ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি গ্রহণ করলেও, সেই পুরোনো ঐতিহ্য অনুযায়ী ‘নোনো’ এই শাসনকার্য চালিয়ে গেছে। স্পিতির অধিবাসী