তেলমশলা যুক্ত ভারী খাবার গ্রহণের ফলে অনেক সময় বদহজম এবং পাচনজনিত রোগ হওয়ার দিকে একধাপ এগিয়ে যাওয়া হয়। আসলে এই সব সমস্যা হয় নানা কারণে। যেমন— বাইরে খাওয়া, বেশি তৈলাক্ত এবং মশলাদার খাবার খাওয়া, জাংক ফুড খাওয়া, অতিরিক্ত খাওয়া, অসময়ে খাওয়া প্রভৃতি। অনেক সময় পেট ফুলে যাওয়া, বমি বমি ভাব, বমি, পেট খারাপ, কোষ্ঠকাঠিন্য, পেটে ব্যথা এবং জ্বালাপোড়ার লক্ষণ দেখা যায়। শুধু তাই নয়, মলের সঙ্গে রক্ত বের হওয়া এবং উপরের পেটে তীব্র ব্যথাও হতে পারে। এগুলি মূলত গ্যাস্ট্রো ইসোফেজিয়াল রিফ্লাক্স, পেপিক অ্যাসিড ক্ষরণ, অন্ত্রের রোগ কিংবা গ্যাস্ট্রোএন্টেরাইটিসের কারণে ঘটে বলে জানিয়েছেন কনসালট্যান্ট গ্যাস্ট্রোইনটেস্টাইনাল সার্জন ডা. সঞ্জয় মন্ডল।

আসলে প্রচুর পরিমাণে মাংসভিত্তিক খাবার খাওয়ার প্রবণতা থাকে মানুষের মধ্যে। এর ফলে কোষ্ঠকাঠিন্য এবং মলের সঙ্গে রক্তপাত প্রভৃতি হতে পারে। যাদের পিত্তথলিতে পাথর রয়েছে, তারা যদি তৈলাক্ত এবং চর্বিযুক্ত খাবার খান বেশি পরিমাণে, তাহলে পেটে তীব্র ব্যথা হতে পারে। গলব্লাডারে পাথর এবং অ্যালকোহল গ্রহণের ফলেও প্যানক্রিয়াটাইটিস-এর সমস্যা হয় অনেক সময়। অপর একটি গুরুতর সমস্যা যা খাবার খাওয়ার ফলে হতে পারে, তা হল— অস্বাস্থ্যকর উপায়ে তৈরি করা বা সঠিক ভাবে সংরক্ষণ করা হয়নি এমন খাবার।

গ্যাস্ট্রোএন্টেরাইটিস একটি স্বল্পমেয়াদী অসুস্থতা, যা পাচনতন্ত্রের সংক্রমণ এবং প্রদাহের কারণে তৈরি হয়। উপসর্গগুলির মধ্যে পেটে ব্যথা, ডায়রিয়া এবং বমিবমি ভাব হতে পারে। গ্যাস্ট্রোএন্টেরাইটিসের কারণগুলির মধ্যে রয়েছে— ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া, ব্যাকটেরিয়াল টক্সিন, পরজীবী, বিশেষ রাসায়নিক এবং কিছু ওষুধ। গ্যাস্ট্রোএন্টেরাইটিস-কে ‘স্টমাক বা পাকস্থলীর ফ্লু’-ও বলা হয়।

ডায়রিয়া এবং বমি হলে আপনি বুঝতে পারবেন আপনার ‘পেটের ফ্লু’ হয়েছে। এই লক্ষণগুলি প্রায়শই গ্যাস্ট্রোএন্টেরাইটিস নামক অবস্থার কারণে হয়।

গ্যাস্ট্রোএন্টেরাইটিসের কারণে আপনার পাকস্থলি স্ফীত হয়ে উঠতে পারে। এটি আসলে ভাইরাল বা ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণ।

গ্যাস্ট্রোএন্টেরাইটিসের লক্ষণ

প্রধান লক্ষণগুলি হল— জলযুক্ত মল এবং বমি। এছাড়া পেটে ব্যথা, জ্বর, বমি বমি ভাব এবং মাথাব্যথাও হতে পারে।

ডায়রিয়া এবং বমির কারণে আপনি জলশূন্যও হতে পারেন। ডিহাইড্রেশনের লক্ষণগুলির জন্য শুষ্ক ত্বক এবং শুষ্ক মুখ, হালকা মাথা ব্যথাও হতে পারে। এক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে, শিশুরা দ্রুত ডিহাইড্রেটেড হতে পারে। তাই যদি আপনার সন্তানের গ্যাস্ট্রোএন্টেরাইটিসের লক্ষণ দেখা দেয়, তাহলে সময় নষ্ট না করে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে চিকিৎসার ব্যবস্থা করুন।

গ্যাস্ট্রোএন্টেরাইটিসে আক্রান্ত শিশু সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত তাকে ডে-কেয়ার বা স্কুলে পাঠাবেন না। আপনার সন্তানকে কোনও ওষুধ দেওয়ার আগে চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করুন। ডায়রিয়া এবং বমি নিয়ন্ত্রণে ব্যবহৃত ওষুধগুলি সাধারণত ৫ বছর বয়সের কম বয়সি শিশুদের দেওয়া হয় না।

পাকস্থলীর ফ্লু-র জন্য দায়ী যে-ভাইরাস, সেই ভাইরাস প্রতিরোধ করার জন্য শিশুদের দুটি টিকা দেওয়া যেতে পারে। ভ্যাকসিন সম্পর্কে আপনার চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলুন।

গ্যাস্ট্রোএন্টেরাইটিসের কারণ কী?

◌ নোরো ভাইরাস আছে এমন কারওর সংস্পর্শে এলে

◌ দূষিত খাবার খেলে

◌ বিশুদ্ধ জল পান না করলে

◌ বাথরুমে যাওয়ার পর বা ডায়াপার পরিবর্তন করার পর হাত না ধুলে

◌ গ্যাস্ট্রোএন্টেরাইটিসের সবচেয়ে সাধারণ কারণ একটি ভাইরাস। প্রধান প্রকারগুলি হল রোটা ভাইরাস এবং নোরো ভাইরাস।

রোটা ভাইরাস শিশুদের মধ্যে ডায়রিয়ার বিশ্বের সবচেয়ে সাধারণ কারণ এবং নোরো ভাইরাস হল গুরুতর গ্যাস্ট্রোএন্টেরাইটিস রোগের প্রাদুর্ভাবের সবচেয়ে সাধারণ কারণ।

যদিও তেমন সাধারণ নয়, ই-কোলাই এবং সালমোনেলার মতো ব্যাকটেরিয়াও পেটের ফ্লু-কে ট্রিগার করতে পারে। সালমোনেলা এবং ক্যাম্পাইলোব্যাক্টর ব্যাকটেরিয়া হল গ্যাস্ট্রোএন্টেরাইটিসের সবচেয়ে সাধারণ ব্যাকটেরিয়াজনিত কারণ। সাধারণত কম আঁচে রান্না করা মুরগি, ডিম দ্বারা ছড়িয়ে পড়তে পারে। পোষা সরীসৃপ বা জীবন্ত হাঁস-মুরগির মাধ্যমেও সালমোনেলা ছড়াতে পারে।

আরও একটি ব্যাকটেরিয়া হল শিগেলা, যা প্রায়শই অস্বাস্থ্যকর ডে-কেয়ার সেন্টারে ছড়িয়ে পড়ে। এটি সাধারণত ব্যক্তি থেকে ব্যক্তিতে ছড়িয়ে পড়ে এবং সংক্রমণের সাধারণ উৎস হল দূষিত খাবার এবং পানীয় জল।

আপনি যদি দূষিত সুইমিং পুলে স্নান করেন কিংবা দূষিত জল পান করেন, তাহলে জিয়ার্ডিয়া এবং ক্রিপ্টোম্পোরিডিয়ামের মতো জীবাণু দ্বারা আক্রান্ত হতে পারেন।

এছাড়াও গ্যাস্ট্রোএন্টেরাইটিস হওয়ার অন্যান্য কারণগুলির মধ্যে রয়েছে— পানীয় জলে ভারী ধাতু (আর্সেনিক, ক্যাডমিয়াম, সিসা বা পারদ), প্রচুর অ্যাসিডিক খাবার খাওয়া, যেমন সাইট্রাস ফল এবং বিষাক্ত পদার্থ যা নির্দিষ্ট সামুদ্রিক খাবারে থাকে। এছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক, অ্যান্টাসিড, জোলাপ এবং কেমোথেরাপির ওষুধ।

গ্যাস্ট্রোএন্টেরাইটিস-এ সতর্কতা এবং চিকিৎসা

আক্রান্ত শিশুকে ওরাল রিহাইড্রেশন সলিউশন দিন। বয়স-উপযুক্ত ডোজ স্পেসিফিকেশনের জন্য আপনার চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। প্রতিদিন অন্তত ৩ থেকে ৪ লিটার জল পান করুন প্রাপ্তবয়স্করা। মসৃণ, সহজে হজমযোগ্য খাবার যেমন ক্র্যাকার, কলা, টোস্ট, ভাত এবং চিকেন দিয়ে শুরু করুন। দুগ্ধজাত খাবার, ক্যাফিন এবং অ্যালকোহল এড়িয়ে চলুন গ্যাস্ট্রোএন্টেরাইটিস-এ আক্রান্ত হলে।

যতটা সম্ভব বাইরের খাবার এড়িয়ে চলার চেষ্টা করুন। আর তা যদি সম্ভব না হয়, তাহলে অন্তত এমন খাবার খান, যা স্বাস্থ্যকর উপায়ে প্রস্তুত করা হয়েছে। সেইসঙ্গে বিশুদ্ধ জল পান করুন। এর জন্য বাইরে বেরোলেই বাড়ি থেকে জল নিয়ে যান। আর জল রাখার পাত্র যেন প্লাস্টিকের না হয়। জল পান করার জন্য স্টিল কিংবা কাচের পাত্র ব্যবহার করুন।

তৈলাক্ত এবং মশলাযুক্ত খাবারগুলি এড়িয়ে চলুন। জাংক ফুড থেকে দূরে থাকুন। অসময়ে খাবেন না। যতটা সম্ভব নিয়মিত সঠিক সময়ে খাবার খান। খাদ্য গ্রহণের পরে যদি আপনার কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যা থাকে, তাহলে মাংস খাওয়া বন্ধ করুন। ঘুমানোর ঠিক আগে ভারী খাবার এড়িয়ে চলুন। বেশি রাত করে খাবেন না এবং সকালে সাতটার মধ্যে ব্রেকফাস্ট সারুন। খুব বেশি মিষ্টি খাবেন না। শুধুমাত্র ডায়াবেটিস রোগীদের ক্ষেত্রেই নয়, মিষ্টি সবারই কম খাওয়া উচিত। কারণ, মিষ্টি ওজন বাড়িয়ে দেয়। স্বল্পমেয়াদে বদহজম এবং দীর্ঘমেয়াদে স্থূলতার সমস্যার কারণও হতে পারে। অ্যালকোহল এবং ধূমপান এড়িয়ে চলুন।

পিত্তথলিতে পাথর আছে এমন রোগীদের সেদ্ধ খাবার খাওয়া উচিত উপযুক্ত পরিমাণে। যাদের পাইলস রয়েছে, তারা মাংস খাবেন না এবং জল পান করবেন সঠিক পরিমাণে। অতএব মনে রাখতে হবে,  সুস্থ থাকার চেষ্টা করতে হবে। কারণ, সুস্বাস্থ্যই প্রকৃত সুখ বয়ে আনে।

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...