ভাঙা বনেদ

সুমির সঙ্গে অতনুর পরিচয় হয় একটি আর্ট গ্যালারিতে। পাঁচ মিনিটের আলাপেই দু’জনের মধ্যে বিজনেস কার্ড-এর আদানপ্রদানও সারা হয়ে যায়।

অতনুকে নিজের বিজনেস কার্ড-টা ধরাতে ধরাতে সুমি বলল, ‘এটা আমার কার্ড। এখানে আমার স্টুডিওর নামটা আর ঠিকানাটা দেওয়া আছে। আমার নিজস্ব ওয়েবসাইটও রয়েছে। ওখানেই আমার সব পেইন্টিং-এর ছবি রয়েছে এবং দামও দেওয়া আছে।’ কার্ডে দেওয়া লিংক-টাতে আঙুল রেখে সুমি অতনুর দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করল।

‘হ্যাঁ, ভালোই হল। আমি আপনার সব পেইন্টিংগুলো দেখতে চাই। দেখা হলে টেক্সট ম্যাসেজ করে আপনাকে ফিডব্যাকটা জানিয়ে দেব। এমনিতে প্রায় শহরের কোনও আর্ট এগ্জিবিশন আমি দেখতে বাদ রাখি না, কিন্তু আপনার মতো শিল্পীর সঙ্গে আলাপ হওয়ার সুযোগ কখনও হয়নি। আপনার প্রত্যেকটা ছবির যেন কোনও না কোনও বক্তব্য আছে। স্টাইলাইজড্ ফর্ম হলেও তা ভীষণভাবে মৌলিক। কার্ডটাতে চোখ বোলাতে বোলাতে অতনু সুমিকে নিজের বক্তব্য জানাল।

‘আপনার সঙ্গে আলাপ হয়ে খুব ভালো লাগল। স্টে ইন টাচ।’ সুমি হেসে উত্তর দিল। এই ছোট্ট আলাপে সুমির মনে হল, অতনুর মতো তার শিল্পের এত বড়ো অনুরাগী সারা পৃথিবীতে আর নেই।

পাঁচ মিনিটের বেশি অতনুর সঙ্গে কথা হয়নি কিন্তু গ্যালারিতে সুমির চোখ সর্বক্ষণ অতনুর দিকেই নিবদ্ধ রইল। অতনুর আকর্ষণ সুমি কিছুতেই উপেক্ষা করতে পারছিল না। যতক্ষণ অতনু গ্যালারিতে রইল সুমির প্রত্যেকটা ছবি সময় নিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখল এবং ছোট্ট একটা নোটবুকে অতনুকে কিছু লিখে রাখতেও দেখল। ছেলেটি শিল্পের কদর করতে জানে, এই একটা কথাই অতনুর হাবভাবে সুমির মনে হল।

এই ঘটনার পর প্রায় ছয় মাস কেটে গেছে। এর মধ্যে অতনু সুমিকে কন্ট্যাক্ট করার যেমন চেষ্টা করেনি সুমিও অতনুর সঙ্গে কোনও যোগাযোগ রাখেনি।

এই ক’মাসের মধ্যে ওয়েবসাইট থেকে সুমির মাত্র দুটো তিনটে ছবিই বিক্রি হয়েছে। সুমি নানা ভাবে নিজের ছবির প্রচার চালাবার চেষ্টা করেছে কিন্তু কোনও লাভ হয়নি। চেনা-অচেনা সুমি পরোয়া করেনি। নিজের ওয়েবসাইটের লিংক সবাইকে পাঠিয়ে দিয়েছে। সুমির একটাই লক্ষ্য– পেইন্টিংয়ের জগতে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করা, নিজের জন্য একটা জায়গা বানানো। মানসিক এই চাহিদা পূর্ণ করার লক্ষ্যে সুমি অতনুকেও একটা মেসেজ করে, ‘আপনি যদি আজকে ফ্রি থাকেন তাহলে একসঙ্গে কফি খাওয়া যেতে পারে।’

পাঁচ মিনিটের মধ্যে অতনুর ‘ফ্রি আছি’ শব্দটা সুমিকে দ্বিধার মধ্যেই ফেলে দেয়। পাঁচ মিনিটের আলাপের পর দীর্ঘ ছ’মাসের বিরতি। আর আজ এতদিন পর সুমি নিজের দরকারে একটা মেসেজ পাঠাতেই সঙ্গে সঙ্গে কফি খাওয়ার জন্য আসতে রাজি! একটু অস্বাভাবিক নয় কি? সুমি, অতনুর হ্যাঁ-এর উত্তরে আর কিছু লিখল না মেসেজে।

‘পৃথিবী-টাই বড়ো অদ্ভুত’, মনে মনে বলল সুমি। ঘটনাটা মনের এক কোণায় সরিয়ে রেখে নিজের আসন্ন আর্ট এগ্জিবিশন নিয়ে সুমি মেতে উঠল।

হঠাৎই কাজের মধ্যে একদিন সুমির কাছে অতনুর ফোন এল, ‘হ্যালো সুমি, সেদিন আপনি কফি খাওয়ার জন্য ডাকলেও যে-কোনও কারণেই হোক প্ল্যান-টা ম্যাচিওর করেনি। চলুন একটা দিন ঠিক করে কফি শপ্-এ দু’জনে বসা যাক।’

‘কিন্তু আপনি আমাকে চেনেন না আর আমাদের পরিচয় মাত্র পাঁচ মিনিটের। দু’জন একে অপরের সম্পর্কে কিছুই জানি না প্রায়। সুতরাং একসঙ্গে বসে কফি খাওয়ার কোনও মানে নেই। আমি আমার কাজের জন্যই আপনাকে আগে মেসেজ করেছিলাম। এর অর্থ এটা ধরে নেবেন না যে, আমি আপনার সঙ্গে বে-ফালতু টাইম পাস করতে আগ্রহী,’ সুমির নিজেরই নিজেকে বড্ড রুড মনে হয়।

‘সুমি, আপনার আর্ট, আপনার শিল্পকলা আমাকে আকর্ষণ করে। আপনার শিল্পের গভীরতায় আমি মুগ্ধ। আপনার ছবিকে মাধ্যম করে আপনাকে চিনতে আমার কষ্ট হয়নি। এতে আপনার প্রতি আমার সম্মান দিনে দিনে বেড়েছে। একদিন দেখবেন আপনার সৃষ্টি আপনাকে তুমুল জনপ্রিয়তা দেবে। প্রতিটি খবরের কাগজে আপনাকে নিয়ে লেখা বেরোবে। এই জার্নিটায় আমি কি আপনার একজন নির্ভরযোগ্য বন্ধু হতে পারি না?’

নিজের প্রশংসা কার না ভালো লাগে? অতনুর কথাগুলোর প্রভাব পড়তে শুরু করে সুমির উপরে। অতনুর প্রশংসা বাক্যের সম্মোহনী শক্তি সুমিকে আকর্ষণ করতে থাকে অতনুর দিকে। এরপর ঘণ্টার পর ঘণ্টা সুমি অতনুর সঙ্গে কথা বলতে থাকে। মনের সুপ্ত বাসনাগুলো শিকড় মেলতে শুরু করে।

‘সুমি, তোমার সঙ্গে যত মিশছি, কথা বলছি, তোমার প্রতি সম্মান আমার ততো বাড়ছে। সারা পৃথিবীর মানুষ একত্র হলেও তোমার প্রতি আমার এই মনোভাব কখনও ভাঙতে পারবে না। কতদিন হয়ে গেল, তোমার সঙ্গে ফোনে কথা বলছি, অথচ এখনও একসঙ্গে বসে আমাদের কফি খাওয়া হল না,..’ প্রথম আড়ষ্টতা কাটিয়ে, অতনু এবার অনেকটা স্পষ্টবাক।

সুমির সব প্রতিরোধের দেয়াল মুহূর্তে ভেঙে চৌচির হয়ে যায়। এরপর থেকে প্রায় দিনই অতনুর সঙ্গে সুমির দেখা হতে থাকে। সামান্য পরিচয় গভীর বন্ধুত্বে পরিণত হয়। সুমি জানতে পারে অতনু বিবাহিত। ওর তিন বছরের একটি মেয়ে আছে। ওর স্ত্রী মীনাক্ষী কলেজে ইতিহাসের প্রফেসর। অতনু নিজে কোনও কাজ করে না।

‘আমার কাজ করার দরকারটা কী? আমার বাবা বিধায়ক ছিলেন, সারাজীবনে প্রচুর অর্থ উপার্জন করেছেন। আমিও বিধায়কের টিকিটের জন্য দরখাস্ত দিয়ে রেখেছি। আশা করছি এবার টিকিট পেয়েই যাব। হাজার-দু’হাজার টাকার চাকরি আমার জন্য নয়,’ গর্বের সঙ্গে অতনু সুমিকে বলে।

‘চাকরিতে যখন তোমার এতই ঘেন্না তাহলে মীনাক্ষীর মতো চাকুরিরতাকে কেন বিয়ে করেছ?’ সুমি জিজ্ঞাসা না করে পারে না।

‘মীনাক্ষীকে অনেক বুঝিয়েছি কিন্তু ওর ওই এক জেদ, চাকরি কিছুতেই ছাড়বে না। অথচ বিয়ের আগে ও আর ওর পরিবারের লোকেরা প্রমিস করেছিল বিয়ের পর চাকরি ছেড়ে দেবে। কিন্তু বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর মীনাক্ষী এতটা বদলে যাবে বুঝতে পারিনি। চাকরি ছাড়তে কিছুতেই রাজি হল না। আসলে ওর কোনও ধারণাই নেই বিধায়কের বাড়ির বউয়ের চাল-চলন কীরকম হওয়া উচিত।’ আত্মগর্বে এবং অহংকারে অতনুর চোখদুটো জ্বলজ্বল করে ওঠে।

অতনুর উত্তর শুনে সুমির মাথায় শঙ্কার ঘন মেঘ ঘনিয়ে আসে। সুমির কাছে সংকেত আসে, ভুল মানুষের সঙ্গে সে জড়িয়ে পড়ছে। কিন্তু অতনুর প্রশংসা আর ওর বিধায়ক বাবার পরিচিতির বিশাল পরিধির মাঝে থাকতে পারলে সুমির লাভ বই ক্ষতি নেই– এই বোধটাই সুমিকে নিজের মনের বিপদের ঘণ্টাটাকে উপেক্ষা করেই অতনুকে আঁকড়ে ধরতে চায়।

একদিন কফি শপে কফি খেতে খেতে অতনু সুমিকে বলে, ‘মন্দিরের মূর্তির মতো আমি মনে মনে তোমাকে পুজো করি। আমি তোমাকে যা-যা বলি শুধু শুনে যেও তুমি, মনের মধ্যে রেখো না তাহলে কষ্ট পাবে। তবে এটাও ঠিক, আমি বিবাহিত, তোমার হাত ধরে লম্বা পথ পাড়ি দেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়।’

‘আমি জানি তুমি বিবাহিত। আমাদের সম্পর্ক নিয়ে আমি কোনও আশা রাখি না। কিন্তু এটা কিছুতেই বুঝতে পারছি না যখন আমরা দু’জনেই জানি আমরা এই পথে বেশিদূর এগোতে পারব না, তখন মিছিমিছি এই ভাবে দেখা করার কী লাভ?’ সুমি জিজ্ঞেস করে।

‘তোমার প্রতিভা-কে সম্মান করি। তোমাকে সাফল্যের চূড়ায় দেখতে চাই। আমি তোমার কাছ থেকে কিছুই আশা করি না। শুধু ভালো বন্ধু হিসেবে তোমাকে সাফল্য পেতে সাহায্য করতে চাই। আসছে বছর থাইল্যান্ডে ফাইন আর্টস-এর একটা বড়ো প্রদর্শনী আছে। সেখানে যোগদান করার সব ব্যবস্থা করে দেব। তোমাকে ললিত কলা অ্যাকাদেমি স্কলারশিপও পাইয়ে দেব। আমার বাবার বড়োবড়ো কনট্যাক্টস আছে। সুতরাং তোমার জন্য এইটুকু করতে আমার কোনও অসুবিধে হবে না। তোমার দুটো-চারটে ইন্টারন্যাশনাল প্রদর্শনী হয়ে গেলেই দেখবে তুমি বিখ্যাত হয়ে উঠেছ।’

অতনুর কথা শুনে সুমি উৎফুল্ল হয়ে উঠল। সুমির মনে হল ও বিখ্যাত হতে পারুক চাই না পারুক, অতনুর মতো মানুষ তার প্রশংসা করছে, এর চেয়ে বড়ো পাওয়া আর কী হতে পারে?

রোজই নানা ছুতোয় অতনু আর সুমির দেখা হওয়া শুরু হল। সুমি বুঝতে পারল তার প্রতি অতনুর ব্যবহারটা শুধু বন্ধুত্বে আটকে নেই। অতনু আরও কিছু চাইছে ওর কাছে। আগে দেখা হলেই পেইন্টিং সম্পর্কে আলোচনা হতো কিন্তু ধীরে ধীরে অতনুর কথার ধরন বদলাচ্ছে লক্ষ্য করল সুমি –

‘একটা জিনিস চাইব তোমার কাছে?’

‘কী?’

‘আমি তোমাকে পুরোপুরি পেতে চাই।’

‘একদমই না। এরকম ভুলভাল ইচ্ছা না হওয়াই ভালো।’

‘প্লিজ, শুধু একবার। জানো আমার কী মনে হয়?’

‘কি?’

‘মনে হয় তোমাকে বুকের মধ্যে চেপে ধরে সময়কে বরাবরের মতো থামিয়ে দিই। সময় নেই, অসময় নেই, চোখ খুলে বন্ধ করে সবসময় তুমিই আমার সমস্ত মন জুড়ে থাকো।’

সুমি আর নিজেকে ধরে রাখতে পারে না। মুখে সে যতই বলুক, তার মন-ও তো এটাই চাইছিল। তার শুভবুদ্ধি তাকে সাবধান করা সত্ত্বেও সুমি তাকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করেই অতনুর বুকে নিজেকে সঁপে দেয়।

সর্প কুণ্ডলীর মতো অতনুর দুটো বাহু সুমিকে জড়িয়ে ধরে। সুমির মনে হয় কোনও গভীর অতল থেকে ভেসে আসছে অতনুর গলার স্বর, ‘সুমি আমি তোমাকে উচ্চতার শিখরে দেখতে চাই…’

সম্বিত ফেরে সুমির। নিজেকে অতনুর বাহুবন্ধন থেকে ছাড়াতে ছাড়াতে অতনুকে অনুরোধ করে, ‘প্লিজ এবার আমাকে বাড়ি যেতে দাও। কাল সন্ধের মধ্যে আমাকে আরও দুটো পেইন্টিং শেষ করতে হবে।’

‘ঠিক আছে, যাও ছেড়ে দিলাম… কিন্তু প্রমিস করো কাল-পরশুর মধ্যে আবার দেখা করবে। এই সপ্তাহের শেষে তোমার সম্পর্কে বাবার সঙ্গে কথা বলব। ললিত কলা অ্যাকাডেমির স্কলারশিপটা নিয়ে তাড়াতাড়ি এগোনো দরকার।’

দু’দিন বাদেই অতনু আর সুমি ওদের পছন্দের কফি শপে মুখোমুখি হল। আগের দিনের প্রচণ্ড বৃষ্টির পর সকালের নরম রোদ্দুরে গা ভাসাতে ইচ্ছে করছিল সুমির। অতনুর ফোনটাও এসেছিল সময় বুঝে। রেস্তোরাঁর নিমন্ত্রণটা সুমি তখনই পেয়েছিল। ভাবার জন্যে এক মুহূর্তও নষ্ট করেনি। কফি খেতে খেতে অতনু বলল, ‘চলো পাশের পার্কটাতে কিছুক্ষণ সময় কাটাই। আজ দিনটা বেশ ভালো। কাল বৃষ্টি হওয়াতে গরম নেই বললেই চলে।’

পার্কের বেঞ্চিতে পিঠ এলিয়ে দিয়ে অতনু সহজ হবার চেষ্টা করে। ‘সুমি আমরা পরস্পরকে ভালোবাসি। একথা আমরা দুজনেই আর অস্বীকার করতে পারি না। মনের বন্ধন যেখানে আছে, সেখানে শরীরকে শাসন করতে চাইছ কেন?’

সুমি চুপ থাকতে পারল না। উত্তর দিল, ‘তুমি ঠিক কী বলতে বা বোঝাতে চাইছ অতনু?’ যদিও অতনুর ইচ্ছা দিনের মতোই পরিষ্কার ছিল সুমির কাছে তবুও না বোঝারই ভান করল সুমি।

আমার এই ইচ্ছে নতুন তো কিছু নয় সুমি। তুমি জানোই যে আমি বিবাহিত এবং শহরে বাবার একটা সম্মান আছে সুতরাং এই সম্পর্কটাকে কোনও পরিণতি দেওয়া হয়তো আমার পক্ষে সম্ভব নয়। কিন্তু তোমার সঙ্গে যে গভীর সম্পর্ক গড়ে উঠেছে তাতে আরও কিছু পাওয়ার অধিকার কি আমার নেই?’

কোনওরকম প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করার আগেই অতনু সুমিকে টেনে নিয়ে একটা মোটা গাছের গুঁড়ির আড়ালে চলে গেল। কিছু বলার জন্য মুখ খুলতেই সুমি টের পেল অতনুর তপ্ত নিঃশ্বাস ওর মুখের উপর এসে পড়ছে। তার নিজের ঠোঁটের উপর অতনুর ঠোঁট এসে প্রতিরোধের সব ক্ষমতা সুমির লুপ্ত করে দিল। সমস্ত শরীরময় অতনুকে অনুভব করছিল সুমি অথচ কোনও প্রতিরোধ কাজ করছিল না।

নিজের ফ্ল্যাটে ফিরে এসে সুমি ব্যস্ত হয়ে পড়ল। কিছুদিন ধরে নিজের আঁকা আর অতনুকে নিয়ে এতটাই ব্যস্ত হয়ে উঠেছে যে ফ্ল্যাটটা অগোছালো হয়েই পড়ে আছে। আজ পরিষ্কার না করলেই নয়। সুমির মা-বাবা নিজেদের পৈত্রিক বাড়িতেই থাকেন শহরের উত্তর অংশে নিজের অন্য ভাইদের সঙ্গে। মেয়ের কাজের সুবিধার জন্য ছোট্ট ফ্ল্যাটটা সুমির বাবাই সুমিকে কিনে দিয়েছেন।

ফ্ল্যাটটা গোছগাছ করে সুমি বিছানায় এসে বসল। আজ অনেক দিন বাদে নিজের বিবেকের সম্মুখীন হওয়ার সুযোগ ঘটল সুমির। পার্কে সময় কাটিয়ে অতনুই নিজের গাড়িতে সুমিকে ফ্ল্যাটে নামিয়ে দিয়ে এসেছিল। অবধারিত ভাবে দুটো প্রাপ্ত বয়স্ক শরীর ডুবে গিয়েছিল, ভেসে গিয়েছিল, পূর্ণতার লক্ষ্যে। অতনুর সঙ্গে তার এই সম্পর্কটার কী নাম দেওয়া যেতে পারে? সুমি ভালো করেই জানে অতনুর সঙ্গে যে রাস্তায় সে পা বাড়িয়েছে তাতে কিছু পাবার আশা নেই বরং চারিদিকে ধূ ধূ করছে প্রান্তর। মুখ লুকোবার কোনও জায়গা নেই। কী করবে সুমি ভেবে স্থির করতে পারে না। সব জেনেশুনে অতনুকে বেছে নেওয়াটা কি সুমির নিয়তি না দুর্বলতা– মনে হতে থাকে সুমির।

অনেক প্রশ্ন, অনেক কথা সুমির মস্তিষ্কে ভিড় করে আসে। প্রায় দুই বছর হতে চলল সুমি আর অতনুর বন্ধুত্বের। সত্যিই কি অতনু ওকে একজন বড়ো শিল্পী ভাবে? আদৌ কি ওর জন্য অতনুর মনে কোনও সম্মান আছে? অতনু কি সত্যিই কোনওদিন একজন সত্যিকারের বন্ধুর মতো ওকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসবে? মুখে যা-ই বলুক, কাজে সেটা সফল হতে এখনও দেখেনি সুমি। এই দুই বছরে সুমির জন্য ও কী চেষ্টা করেছে? কিছুই তো না।

প্রশ্নের বোঝা মাথায় নিয়েই সুমি ঘুমে অচেতন হয়ে পড়ে। পরের দিনও সুমির, ফ্ল্যাটের বাইরে পা রাখতে ইচ্ছে করে না। রাত্রের প্রশ্নগুলোই ঘুরেফিরে সুমির মাথায় ঘুরপাক খেতে থাকে। এমন নয়তো উচ্চাশাকাঙক্ষী হতে গিয়ে অতনুর কামনার একটা মাধ্যম হয়ে উঠছে সে? উত্তর জোগায় না। এই দু’বছরে সুমি অতনুকে নিয়ে এতটাই মেতে ছিল যে সুমির অন্য বন্ধুরা ওর থেকে দূরে সরে গেছে। ফ্ল্যাটে একা বসে বসে সুমির পুরোনো স্মৃতি, ফেলে আসা দিনগুলোর কথা মনে পড়তে থাকে। শেষমেশ সব গ্লানি, অপরাধের বোঝা ঝেড়ে ফেলে সুমি, বান্ধবী শ্রেয়ার বাড়ি যাওয়ার মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে নেয়।

‘অনেক দিন পর সুমি, কী ব্যাপার? কোথায় ছিলি এতদিন? তোর কোনও খবরই কারও কাছে ছিল না? শ্রেয়ার বাড়ির দরজাতেই সুমিকে দেখে শ্রেয়ার মা এক নিঃশ্বাসে প্রশ্নগুলি করে গেলেন। সামান্য হাসি টেনে ঘরের ভিতরে ঢুকতেই সুমিকে উনি জড়িয়ে ধরলেন। ওনার আন্তরিকতা সুমির চোখের পাতা ভিজিয়ে তুলল।

‘মাসিমা, কয়েকটা বড়ো পেইন্টিং প্রোজেক্ট নিয়ে খুব ব্যস্ত ছিলাম, তাই সময় করে উঠতে পারিনি। তবে একটা দিনও এমন যায়নি, যখন আপনাদের কথা আমার মনে পড়েনি,’ রুমাল দিয়ে চোখের কোণটা মুছে নেয় সুমি।

‘চল, ভালোই হল সুমি। এতদিন পরে হলেও তো এসেছিস। কী খাবি? শরবত নাকি গরম কিছু? হাত ধরে সুমিকে সোফায় বসাতে বসাতে শ্রেয়ার মা জিজ্ঞাসা করলেন।

‘কিছু খাব না মাসিমা, শুধু বলুন শ্রেয়া কোথায়… ওকে তো কোথাও দেখছি না।

‘এতদিন পর এসেছিস, কিছু তো খেতেই হবে। আর ততক্ষণে শ্রেয়াও চলে আসবে। ওর আজকে একটা বড়ো অনুষ্ঠানে সেতার বাজাবার প্রোগ্রাম আছে। প্রোগ্রামটা নিয়ে ও খুব আশাবাদী। কয়েক মাস ধরে এটা নিয়েই লেগে ছিল,’ মেয়ের প্রতিভার উপর গভীর আস্থা ফুটে ওঠে শ্রেয়ার মা-র স্বরে।

‘আমার বেস্ট ফ্রেন্ড এত বড়ো একটা সুযোগ পেয়েছে আর আমি কিছুই জানি না,’ ভাবতে ভাবতে গ্লানিতে সুমির মন ভরে ওঠে।

গল্প করতে করতে কখন এক ঘণ্টা কেটে গেছে সুমি টের পায়নি। কলিংবেলের আওয়াজে দু’জনের ঘোর ভাঙে। শ্রেয়ার মা দরজা খুলতেই ঝড়ের গতিতে শ্রেয়া ঘরে ঢুকে মা-কে জড়িয়ে ধরে। শ্রেয়ার চোখমুখ উৎসাহ, উদ্দীপনায় জ্বলজ্বল করছে।

‘মা, মা… আজ আমার প্রোগ্রাম দারুণ হয়েছে। জানো অনুষ্ঠান চলাকালীন কী হয়েছে?’ খুশি উপচে ওঠে ওর চোখে-মুখে। মা-কে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই বলে ওঠে, ‘মা, আজকে প্রোগ্রামে এখানকার একজন এমএলএ, পরিবারের সঙ্গে এসেছিলেন প্রধান অতিথি হিসেবে। জানো ওদের আমার বাজনার হাত এত ভালো লেগেছে যে ওনার ছেলে অনুষ্ঠানের শেষে আলাদা করে আমার সঙ্গে দেখা করতে আসে। ছেলেটি আমাকে বলে যে, আমার বাজনার হাত নাকি এতটাই ভালো যে একদিন আমি রবিশঙ্করের মতোই নিজের নাম প্রতিষ্ঠিত করতে পারব। ছেলেটি ওর বাবার সঙ্গেও কথা বলবে, যদি কোনও স্কলারশিপের ব্যবস্থা আমার জন্য করা যায়।

কথা শেষ করতেই শ্রেয়ার দৃষ্টি পড়ল সুমির উপর। আনন্দে লাফিয়ে উঠে, সুমিকে জড়িয়ে ধরল শ্রেয়া। অনেক কষ্টে সুমি মনের ভাবটা মুখে প্রকাশ হতে দিল না। কিন্তু তার বিশ্বাসের বনেদটা ক্রমশ ভেঙে চৌচির হতে থাকল, অতনুর স্বরূপটা জানতে পেরে। শ্রেয়া কিছু বলার আগেই সুমি সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। কথা বলতে ইচ্ছে করছিল না, খালি মনে হচ্ছিল কতক্ষণে নিজের ফ্ল্যাটে ফিরবে। শুধু সুমির মনে তোলপাড় হচ্ছিল, অতনুর সঙ্গে ওর দুই বছরের সম্পর্কে এটাই কি তার প্রাপ্য?

‘শ্রেয়া, প্লিজ আজকে আমাকে বাড়ি যেতে দে। শরীরটা খুব খারাপ লাগছে। একটু বিশ্রাম করলে মনে হচ্ছে ঠিক হয়ে যাবে। আর এক দিন আসব তোর কাছে। জমিয়ে গল্প করব সেদিন দু’জনে,’ কোনওমতে সুমি বলে।

‘ঠিক আছে, তোর মুখটা কেমন যেন রক্তশূন্য হয়ে গেছে। বিশ্রাম নিলেই মনে হয় ঠিক হয়ে যাবে। তোকে আমি আটকাব না, সাবধানে যেতে পারবি তো?’ শ্রেয়ার চোখে-মুখে সুমির জন্য চিন্তা ফুটে ওঠে।

রাতের শহরে স্ট্রিট লাইটগুলোর আলো আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। বাসের বদলে ট্যাক্সি নিয়েছে সুমি। পিঠটা ট্যাক্সির সিটে এলিয়ে দিয়েছে, তবু যেন স্বস্তি পাচ্ছে না। উঠেই ড্রাইভারকে গন্তব্য জানিয়ে গুছিয়ে বসেছে ও। চিন্তাগুলো গুছিয়ে নিতে ব্যস্ত হয়ে ওঠে। দুই বছরের ছায়া ছায়া অন্ধকার হারিয়ে গেছে। অতনুর ব্যক্তিত্বের মধ্যে লুকিয়ে থাকা কামুক পুরুষটাই ক্রমশ সুমির চোখে স্পষ্ট হয়ে ধরা পড়ছে। যে নিজের বিবাহিত স্ত্রীকে, কলেজের প্রফেসর হওয়া সত্ত্বেও নিকৃষ্ট মনে করতে পারে, তার কাছ থেকে অন্য নারীরা সম্মানের আশা রাখবে কী করে? এই ধরনের লোক কারও প্রতিভার কদর করতেই পারে না। সুমির মনে হল যেটুকু নামডাক ওর হয়েছে সেটা সম্পূর্ণ নিজের চেষ্টাতেই। অতনুর কোনও অবদান সেখানে নেই।

সুমি আর অতনুর পরিচয়ের শুরুটাই ভুল ছিল। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে যতগুলি অধ্যায় ওর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে, ভ্রান্তি আরও বেড়েছে, সম্পর্কের ধাপগুলিতে মলিনতা আশ্রয় পেয়েছে। মনের আয়না কুয়াশাচ্ছন্ন থাকায় সুমি, অতনুকে চিনতে ভুল করেছিল, কিন্তু কুয়াশা সরতেই চেহারা স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হচ্ছে তার কাছে। অতনু এসেইছিল সুমিকে টেনে অন্ধকারের অতলে নিয়ে যেতে, উচ্চতার শিখরে নয়। এরপরেও যদি সম্পর্ক এগোতে থাকে তাহলে তা আরও ঘৃণ্যতর হয়ে উঠবে। সুতরাং এখানেই তা শেষ করা দরকার। সুমির পাড়া কাছাকাছি এসে পড়েছে। খুব ঠান্ডা মাথায় ড্রাইভারকে নির্দেশ দিয়ে সুমি ব্যাগ থেকে মোবাইলটা বার করল। মনে মনে অতনুর সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক ত্যাগ করার বিষয়ে এখন সে নিশ্চিত। মোবাইল অন করে অতনুর ফোন নম্বরটা ব্লক করে দিল সুমি। জীবনটা এবার নতুন করে গুছিয়ে নিতে হবে।

 

বডিগার্ড

উন কুরলা এক্সপ্রেসের সেকেন্ড ক্লাসে চড়ে টাটানগর থেকে হাওড়া ফিরছিল প্রকাশ। তার এমআর-এর চাকরি। আগের দু-দিনে সব ডক্টর্স চেম্বার ভিজিট করা হয়নি। শনি-রবিতে প্রায় সব চেম্বারে রোগীর এত লাইন থাকে যে,পাঁচ মিনিট ডেমনস্ট্রেশন দেওয়ার জন্য এক দেড় ঘন্টা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়। তাই আজ সকালেও তাড়াতাড়ি ব্রেকফাস্ট সেরে ঘন্টা চারেক টাটানগরে টো টো করে ঘুরতে হল। অভ্যাস অনুযায়ী সকালবেলায় খবরের কাগজ পড়ারও সময় মেলেনি। ট্রেনে চেপে ব্যাগটা কোনও মতে বাংকে তুলে প্রকাশ দৈনিকটা খুলে বসেছে। তারপর দু’ঘন্টা ধরে আর তার হুঁশ ছিল না। কাগজের ষোলো-সতেরো পাতা যখন প্রায় মুড়ো ল্যাজা করে পুরোপুরি পড়া হল, তখন ট্রেন ঝাড়গ্রামে ঢোকার আগে লেভেল ক্রসিং পার হচ্ছে।

ঘড়ি দেখে বিরক্ত হল প্রকাশ, কুরলা এক্সপ্রেস টানা দুঘন্টা টাটায় লেট ছিল, আর এখন তিন ছুঁই ছুঁই। কত রাত করে যে হাওড়া ঢুকবে, ভগবানেরও অজানা। ওঠার পরে এতটা সময় পার করে দিয়ে, এই প্রথম কামরার অভ্যন্তরে চোখ বুলোবার ফুরসত পায় প্রকাশ। লম্বা সিটে তাকে নিয়ে চার চার আটজন, ওপাশে জানালার ধারে সিঙ্গল সিটে আরও দু’জন। সকলেই দেহাতি, মলিন পোশাক। এদের কেউ খড়গপুরের এপারে যাবে বলে মনে হয় না। তাতে অবশ্য প্রকাশের কিছুই হেলদোল নেই। যেন আগুনের পরশমণি প্রাণে জাগিয়ে বসে আছে।

প্রায় দু’বছর ধরে মাসে দু’তিনবার ট্রেনে জার্নি করা খাওয়া-শোয়ার মতো অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গিয়েছে। কথা বলার মতো সঙ্গীর দরকার হয় না। অনেকে বলে খালি ট্রেনে চোর-ডাকাতের উৎপাত হয়, প্রকাশ আমল দেয় না। সেই কবিতার লাইনটা মনে পড়ে, ‘হঠাৎ আলো দেখবে যখন, ভাববে কী বিষম এই কান্ডখানা।’ হঠাৎ আলো মানে আরপিএফ জওয়ানদের লাঠির গুঁতো আর গুলির খোঁচা। তবে কুরলা নিয়ম করে লেট করে ঠিকই, কিন্তু ভিড় কমে গেলে কামরায় চুরি ছিনতাই হয়, এই গাড়ির বেলায় এমন বদনাম শোনেনি। নিজেও তো এল গেল এবার নিয়ে সাত-আটবার।

ফালতু কথা আর না ভেবে প্রকাশ ঝাড়গ্রাম প্ল্যাটফর্মে চোখ বোলাতে থাকে। সকালে ইস্পাত এক্সপ্রেসে আসার সময় দেখেছে, স্টেশন লোকের ভিড়ে জমজমাট আছে। এখন শুনশান। ঝাঁকড়া গাছগুলোয় কিচিরমিচির করে পাখিরা আসর জমিয়ে রেখেছে। তিন নম্বর, মানে লুপ লাইনে গাড়ি থেমেছে। হয়তো, এখানেও খানিক লেট করানো হবে। বিরক্ত মুখ কামরার ভেতরে ফেরাতে গিয়েই চোখ পড়ল ভদ্রমহিলার দিকে। এখান থেকেই উঠলেন। হাতে ঢাউস ভ্যানিটি ব্যাগ, জলের বোতল। উলটোদিকের সিটে বসতে চাইতেই দুই দেহাতি বুড়ো নিজেদের মধ্যে ছ’ইঞ্চি জায়গা খালি করে দিল। ভদ্রমহিলা বেশ দ্বিধায় পড়েছেন, প্রকাশ দেখেই বুঝতে পারে। উঠে দাঁড়িয়ে বলে, আপনি বরং এই জানলার ধারে এসে বসুন, আমি ওপাশে চলে যাচ্ছি।

– থাক না, একটু বাদে খড়গপুরে অনেকে নেমে যাবে মনে হয়। তখন ভালো করে বসব।

– আরে বসুন। আমি টাটা থেকে জানালার ধারে এলাম।

ভদ্রমহিলা আর কথা বাড়ালেন না। বসতে গিয়ে প্রকাশকে একটা অনুরোধ করলেন– আমার এই ব্যাগটা যদি বাঙ্কের একটু ভিতর দিকে তুলে দেন। বেঁটে চেহারার মানুষকে এই সাহায্যটা প্রতিবারই কারও না কারও কাছে চাইতে হয়।

প্রকাশ হেসে ফেলল। ‘বেঁটে’ শুনে ভদ্রমহিলাকে প্রথম ভালো করে দেখল। তখনই মনে হল, আগে কোথাও দেখেছে।

এইমাত্র জানালা ছেড়েছে, এইবার গায়ে পড়ে ‘মনে হচ্ছে আগে কোথাও যেন দেখেছি আপনাকে’ বলাটা নাটকের মতো হয়ে যাবে। মহিলা সুন্দরী হলেও বিবাহিতা, বয়সে ওর সমান কিংবা খানিক বড়োও হতে পারেন। বাড়তি মনোযোগ দেবার তেমন কোনও কারণ নেই। তাই প্রশ্নটা ঢোঁক গিলে মনোযোগ দিয়ে বাঙ্কে ব্যাগ ওঠাল প্রকাশ। দুই বুড়োর মাঝখানে আলগোছে বসতেই ট্রেন নড়ে উঠল।

বাঁশতলা এবং সারদিয়া স্টেশন পার হয়ে খেমাশুলিতে গাড়ি আবার ঘটাং করে থেমে গেল। তখনই কাচ্চাবাচ্চা নিয়ে পিলপিল করে উঠতে থাকে আদিবাসী মহিলারা। মিনিট দুই তিনেকের মধ্যে লোকাল ট্রেনের চেহারা নিল কুরলা এক্সপ্রেসের সেকেন্ড ক্লাস। দুই সিটের মধ্যে এত লোক ঢুকেছে যে, নড়াচড়া করাই দায় হল। কুরলা এক্সপ্রেসে এতবার ফিরেছে প্রকাশ, এরকম ঘটনা আগে কখনও চোখে পড়েনি। মনে করে দেখল, স্টপেজই নেই লো-লেভেল স্টেশন খেমাশুলিতে। হাওয়ায় ভাসিয়ে দিল চমকে মোড়া বিস্ময়– এত লোক এই জঙ্গল দেশে কোথা থেকে এল?

– কপালে সিঁদুর লেপা দেখে বুঝতে পারছেন না, এরা গুপ্তমণির পুজো দিতে গিয়েছিল। আজ হয়তো কোনও বিশেষ উৎসব আছে। হাইওয়েতে বাস বন্ধও হতে পারে। জানলার ধারে ভদ্রমহিলা বললেন।

অনেকক্ষণ পরে তাঁর দিকে ফিরে তাকাল প্রকাশ। ভিড়ের মধ্যে মুখটুকুই শুধু দেখতে পাচ্ছে। জিজ্ঞাসা করল, সবার কপালে টিপ তো দেখতে পাচ্ছি, কিন্তু গুপ্তমণি আবার কে?

– তিনি আমাদের দুর্গা বা কালীর মতো এই এলাকার আদিবাসীদের প্রিয় এক দেবী। সবাই বলে খুব জাগ্রত। হাইওয়ে দিয়ে বাসে গেলে দেখতেন, যাত্রী থেকে ড্রাইভার কন্ডাক্টর, সকলে মন্দির পার হওয়ার সময় নমস্কার করে পয়সা ছুড়ে দেয়। সেই পয়সা কুড়োতে মন্দিরের পনেরো কুড়ি জন লোক সবসময় ছুটে বেড়ায়।

প্রকাশ এমন বিচিত্র দেবীস্থানের মাহাত্ম্যের কথা শুনে মজা পায়। উপরন্তু অবাক ভাব চাপতে না পেরে ভদ্রমহিলাকে জিজ্ঞাসা করে– আপনি এখানকার অনেক কিছুই জানেন দেখছি!

– এটা জানার মতো কোনও বিষয় নয়। ঝাড়গ্রামে আমার প্রায় আঠারো উনিশ মাস মানে দেড় বছরেরও বেশি চাকরি হয়ে গেল। উইকেন্ডে ফিরে যাই। এই ট্রেন প্রায় দিনই লেট করে। তখন বাস ধরে খড়গপুর বা গিরি ময়দান যেতে হয় লোকাল ট্রেন ধরার জন্য। সেই বাসেই দেখেছি গুপ্তমণির মন্দির।

প্রকাশ কথা ঘোরায়– আপনার চাকরি ঝাড়গ্রামে, রাজ কলেজে নাকি?

– বাঃ, আপনিও তো দেখছি অনেক কিছু জানেন। রাজ কলেজের নাম বলে দিলেন। তবে, আমি স্কুলে পড়াই, রানি বিনোদ মঞ্জরী।

– এ নামটাও শুনেছি মনে হচ্ছে। মেয়েদের স্কুল। বোধহয় সরকারি।

– ঝাড়গ্রাম তো দেখছি, আপনার নখদর্পনে। অথচ গুপ্তমণির নাম শোনেননি?

– আসলে, আমার এক মেসোমশাই বেশ কয়েক বছর আগে রাজ কলেজে পড়াতেন। সরকারি কলেজ তো, হুগলি মহসিন থেকে দু-বছরের জন্য ট্রান্সফার হয়ে এসেছিলেন। তখন আমি উচ্চমাধ্যমিক দিয়ে কয়েকটা দিন কাটিয়ে গেছি। বলে রাখি, আমার সেই মেসোমশাইয়ের নাম জগৎ লাহা।

– তাই বলুন।

– এখনও রাজবাড়ি, জঙ্গলমহল, চিলকিগড় আর ডুলুং নদীর কথা ভালোই মনে আছে। মেসোমশাই যে জায়গাটায় বাড়ি ভাড়া নিয়ে থাকতেন সেখানকার নাম রঘুনাথপুর না রঘুনাথগঞ্জ কী যেন।

এবার ভদ্রমহিলার অবাক হওয়ার পালা। বললেন– আপনার স্মৃতি দেখছি একেবারে টাটকা রয়েছে। আমিও রঘুনাথপুরে থাকি, স্টেশনের কাছেই।

ভিড়ের চাপে, বাচ্চাদের তারস্বরে কান্না আর বায়নায় একসময় কথা চালাচালি বন্ধ হয়ে গেল। আধঘন্টা বাদে শেষ বিকেলের সোনা হলুদ আলো মেখে খড়গপুর স্টেশনে ঢুকল ডাউন কুরলা এক্সপ্রেস।

কামরা খালি করে প্রায় সবাই নেমে গেল। প্রকাশদের খোপে সে এবং ভদ্রমহিলা ছাড়া উলটোদিকের জানালার ধারের লোকদুটো শুধু বসে রইল। ভদ্রমহিলার মুখোমুখি জানালায় সরে গেল প্রকাশ। দেখতে চেষ্টা করল, প্ল্যাটফর্মে কোনও কফিওয়ালা দেখা যাচ্ছে কি না। তখনই এদের খোপে ফাঁকা সিটের দখল নিল জনা পাঁচেক লোক। হাবভাব দেখে ডেলিপ্যাসেঞ্জার বলে মনে হচ্ছে। ধুপধাপ বসেই কোনও কথা না বলে সিগারেট ধরাল। মুহূর্তে ধোঁয়ায় খোপটা নরক গুলজার করে তুলল। প্রকাশ দেখল, উলটোদিকে ভদ্রমহিলা নাকে রুমাল চাপা দিয়ে বসে আছে। প্রাণপণে কাশি চাপতে চেষ্টা করছেন। বিরক্ত মুখে ও লোকগুলোর দিকে ফিরল। বলল– কম্পার্টমেন্টের ভিতরে এভাবে স্মোক করছেন কেন? জানেন না, এটা নিষিদ্ধ? দরজায় দাঁড়িয়ে শেষ করে আসুন।

লোকগুলো উঠে যাওয়ার কোনও গরজ দেখায় না। যেন কথা শুনতেই পায়নি। প্রকাশ আবার তাই গলার জোর আরেকটু বাড়িয়ে বলে– আপনাদের বলছি, সিগারেটগুলো দরজায় গিয়ে ফিনিশ করে আসুন। আমাদের খুব অসুবিধা হচ্ছে।

এইবার দলের একজন ঝাঁঝিয়ে উঠল– বেশি বকবেন না তো। রোজই আমরা এই ট্রেনে যাই।

এইবার প্রকাশের রাগ বেড়ে যায়। উঁচু গলায় বলে কী বলতে চান আপনারা, রোজ এক ট্রেনে গেলে কি আইন ভাঙার অধিকার জন্মায়?

– আইন আপনার বাড়িতে গিয়ে দেখাবেন। জানালায় বসেছেন, খানিকক্ষণ এখন নাকে রুমাল চাপা দিয়ে প্রকৃতির শোভা দেখুন। সিগারেট একসময় নিজেই ফুরিয়ে যাবে।

রাগে লাল হয়ে উঠল প্রকাশ। কোনওরকম সিভিক সেন্স নেই এদের। একবার ভাবে, টিটিই-র কাছে কমপ্লেন করা যেতে পারে। কিন্তু এটা ভেস্টিবিউল কম্পার্টমেন্ট নয়, টিটিই-কে কোথায় খুঁজে পাওয়া যাবে, তার ঠিক নেই। কমপ্লেন করেও কোনও ফল হবে কি না, তা নিয়েও সংশয় আছে প্রকাশের। যাতায়াতের পথে এমন কাণ্ডজ্ঞানহীন লোকজন তো কম দেখল না। তাই প্রকাশ একবার ভাবল, তর্ক চালিয়ে যাবে। তাতে পরের রাউন্ডে সিগারেট ধরানোর আগে লোকগুলো অন্তত দ্বিতীয়বার ভাববে। শেষ পর্যন্ত উলটোদিকে বসা সদ্য পরিচিতার অস্বস্তিতে ঘেমে ওঠা মুখের দিকে তাকিয়ে সামলে নিল নিজেকে। ভদ্রমহিলাকে পূর্ণ দৃষ্টিতে দেখতেই তার আবার মনে হল, খুব চেনা। স্মৃতি হাতড়ে বিরক্তি আর সময় কাটাতে থাকল প্রকাশ। সংবিৎ ফিরল মেচেদা পৌঁছে, জানালার কাছে ‘গরম চপ-সিঙাড়া’ ওয়ালার বাজ পড়ার মতো হাঁক শুনে। কামরার ভেতরে তখন টিমটিমে আলো জ্বলে উঠেছে। পাশের লোকগুলো যথারীতি ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে হাঁটুতে হাঁটুতে তোয়ালে পেতে তাস খেলার আসরে মেতে উঠেছে। অকারণে তর্ক জুড়ে কামরা ফাটাচ্ছে। সামনে ভদ্রমহিলা যথারীতি নাকে রুমাল চাপা দিয়ে বসে রয়েছেন, দৃষ্টি প্রকাশের দিকে। এক পলকে দেখল ও, তার চোখেও কেমন অবাক করা ভাব। এ চোখের ভুল, ভেবে প্রকাশ দৃষ্টি ফেরাল মেচেদার ভিড়ের দিকে।

ট্রেন স্টেশন ছাড়তেই বাইরের ঝুপসি অন্ধকার ধেয়ে এল। ভিতরে পরিবেশ এতই বিরক্তিকর যে, বাইরের সে অন্ধকার রাজ্যে চোখ সওয়াবার চেষ্টা করতে থাকে প্রকাশ। গাড়ি এবারে বেশ গতি নিয়েছে। কোলাঘাটে রূপনারায়ণের সেতু পার হওয়ার পর ও আবার ভাবতে শুরু করে, সামনে বসা ভদ্রমহিলাকে ও কোথায় দেখতে পেয়েছে আগে। এমন সময় সিট ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন ভদ্রমহিলা। হয়তো টয়লেটে যাবেন। তাসখেলা লোকগুলোর দিকে এগিয়ে গিয়ে বললেন– তোয়ালেটা একটু সরিয়ে নিন, আমি বাইরে যাব। খেলা থেকে চোখ না সরিয়ে একজন কড়া গলায় জবাব দেয়– এখন গোটানো যাবে না। সিটে গিয়ে বসুন। সাঁতরাগাছি ঢুকলে খেলা শেষ হবে।

– তা কেন? আমাকে যেতে দিন।

তাসুড়ের গলা এবার আরও চড়ল– বাইরে যাওয়ার এত তাড়া থাকলে জানালার ধারে বসেন কেন? নিজের বাড়ির সব সুবিধা তো ট্রেনে মেলে না।

একে ভদ্রমহিলা, তায় তার ওপর মানসিক জবরদস্তি। মনে হচ্ছিল প্রকাশের, ভদ্রমহিলার বাথরুমে যাওয়ার কথা শুনে তাঁর মন এবং শরীরকে মানসিক ভাবে ভিসুয়ালাইজ করছিল তারা।

আরেকজন চোখ নাচিয়ে বলল– আমি ঘোড়াঘাটা যাচ্ছি। এই তো ঘোড়াঘাটা চলে এল বলে। আর বড়োজোর ঘন্টা খানেকের মামলা। মেয়েরা তো ঘন্টার পর ঘন্টা বাথরুম চেপে রাখতে পারে।

সংকোচে বাক্রুদ্ধ হয়ে ভদ্রমহিলা বসে পড়লেন। এতক্ষণ প্রকাশ চুপচাপই ছিল। মন বসাতে চেষ্টা করছিল বাইরের অন্ধকারে। এবারে তার ধৈর্যের বাঁধ ভাঙল। উঠে দাঁড়িয়ে আদেশের সুরে বলল– খেলা বন্ধ করুন এবার।

লোকগুলো কথা শোনার পাত্র নয়। ওর চেয়েও এক কাঠি বেশি রাগ দেখিয়ে একজন বলল– আপনি তখন থেকে ফালতু বকে চলেছেন কেন বলুন তো। সব প্রসঙ্গের মধ্যে ঢুকছেন! যার বাথরুম যাওয়ার দরকার ছিল তিনি তো চুপচাপ বসে রয়েছেন।

– নোংরা কথা বলবেন না। মহিলাদের সঙ্গে শালীনতা বজায় রেখে কথা বলতে জানেন না আপনারা?

– আমরা জানি না, আর আপনি দরকারের চেয়ে বেশি কথা বলেন। এই তো শোধবোধ হয়ে গেল। এবারে তবে থামুন।

নিজেকে প্রকাশ আর সামলে রাখতে পারল না। কলার চেপে ধরল সবচেয়ে উঁচু গলার লোকটার। তখন বাকিরা ঝাঁপিয়ে পড়ল প্রকাশের উপর– ছাড় শালা। রাজার চালে যাবি তো এসিতে চাপতে পারতিস। মেয়েরা সেখানে সারাদিন বার্থ আর বাথরুম করে কাটালেও কেউ কিছু বলবে না।

সিঙ্গল সিটে বসা লোকদুটোর দিকে ফিরে মরিয়া ভাবে প্রকাশ বলে– শুনুন আপনারা। আবার নোংরা কথা বলছে। এরা মহিলাদের সম্মান করে না। আপনারা চুপ করে থাকবেন?

প্রকাশের আশা বৃথা। গ্রাম্য লোকদুটো এদিকেই তাকিয়ে বসেছিল, কথা শুনে নিজেদের মধ্যে মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে জানালার দিকে ঘুরে বসল। পাশের খুপরি থেকে কয়েকটা উৎসুক মুখ উঁকি দিল। তাদের একজন তাসপার্টির নেতাকে জিজ্ঞাসা করে– কীসের ঝামেলা, মজুমদারবাবু? হাত লাগাতে হবে নাকি?

– আরে না দাদা, একজন অসভ্য লোক সেই ট্রেনে ওঠা থেকে ভাট বকেই যাচ্ছে। আমরা চেপে বসিয়ে দিয়েছি। সঙ্গে মহিলা থাকলে সবাই তো একটু বীরত্ব দেখাতে চায়। প্রকাশ এরকম পরিস্থিতিতে হতোদ্যম হয়ে গেল নিজের অসহায়তা অনুভব করে। নোংরা লোকগুলো দলে ভারী। এদেশে সেটা হওয়াই স্বাভাবিক। অন্যায়ের প্রতিবাদ করার লোক ক্রমেই কমে আসছে। বিষিয়ে যাওয়া মন নিয়ে নিজের সিটে বসে পড়ল প্রকাশ। ও এবং সামনের মহিলা, দু’জনের দৃষ্টি মাটির দিকে। তাসুড়েরা কিন্তু নির্বিকার, তাসের চাল নিয়ে আবার তুমুল তর্কে ফিরে গেল। একটু বাদে খুপরির ভিতরের অস্বাভাবিক গুমোট ভাবটা কাটানোর জন্য ভদ্রমহিলার সঙ্গে কথা শুরু করে প্রকাশ– আপনি যাবেন কোথায়?

– চন্দননগর।

– আজ অনেক রাত্রি হয়ে যাবে হাওড়া ঢুকতে। ন’টা আটান্নোর মেন লাইন বর্ধমানটা পাওয়া যাবে কি না কে জানে।

– আপনি কি ওদিকেই?

– হ্যাঁ, কিন্তু আপনার অনেক আগে নামব, কোন্নগর।

মৌড়িগ্রামে কুরলা ঢুকছে। আউটার সিগনাল লাল হয়ে থাকায় থেমে গিয়ে ঘন ঘন হুটার বাজাচ্ছে। এইবার তাসপার্টির আসর গোটানোর তাড়া লাগল। তোয়ালে ভাঁজ করতে করতে লোকগুলো নিজেদের মধ্যে বলাবলি করল– আমি ভাবলাম লোকটা নিজের লোকের জন্য গলা ফাটাচ্ছে, এখন দেখছি অচেনা।

আরেকজন হেসে গড়িয়ে গিয়ে বলল– মজুমদার, মেয়েদের মতো ন্যাকামি কোরো না। তুমিও বয়সকালে পরিচিত মহিলার কাছে এমনই হিরো সাজতে চাইতে।

– তা হতে পারে, কিন্তু মালটাকে কোন্নগরে আগে দেখেছি বলে তো মনে হয় না।

– ফি হপ্তায় আটটা দশটা করে ফ্ল্যাটবাড়ি গজিয়ে উঠছে আর কত উটকো লোক রোজ থাকতে আসছে। কোন্নগরের বনেদি লোক বলে কি সবাই তোমার চেনা হবে?

– তা একরকম ঠিকই বলছ। আমরাই এখন কোন্নগরে কোণঠাসা।

ওরা ভাব এমন করছিল যেন নিজেদের মধ্যে কথা বলছে। কিন্তু প্রকাশ ও ভদ্রমহিলা দুজনের কানেই যাতে পৌঁছোয়, ততটাই জোরে বলছিল।

মহিলা আবার সংকুচিত হলেন। তাসের আসর গোটানো হতেই টয়লেটের দিকে চলে গেলেন। প্রকাশ একটুক্ষণ আগে যে লোকটার জামার কলার চেপে ধরেছিল, সে এই সুযোগে ওর দিকে ফিরল। গলায় দারুণ ঘৃণা ঝরিয়ে বলল– ঝামেলা পাকানো ধাতে নেই বলে আজ ছাড় পেয়ে গেলে। অন্য কারও গায়ে হাত দিলে মেরে শুইয়ে দিত। আমিও কোন্নগরে থাকি, তিনপুরুষের বাস। মুখটা ভালো করে চিনে রাখো।

বিরক্ত প্রকাশ উঠে দাঁড়াল। ভদ্রমহিলা যে-দিকে গিয়েছেন তার উলটোদিকের টয়লেটের পথে পা বাড়াল।

শেষবার প্রতিদিনের নিয়মমতো ট্রেনটা মার খেল টিকিয়াপাড়া ইয়ার্ডে। হাওড়া ঢুকল দশটা বাজার পর। তাসপার্টি শেষবার প্রকাশের দিকে আগুনের মতো দৃষ্টি হেনে তাড়াহুড়ো করে নেমে গেল। বাংক থেকে নিজের ও ভদ্রমহিলার ব্যাগ নামাতে নামাতে বলল প্রকাশ– চলুন, একটু তাড়াতাড়ি হাঁটলে দশটা সতেরোর ব্যান্ডেল লোকালটা মনে হয় পেয়ে যাব। কোন্নগর পর্যন্ত একসঙ্গেই যাওয়া যাবে। তারপরেও ট্রেনে ভালো ভিড় থাকে। ভয় পাবেন না।

ভাগ্যক্রমে ব্যান্ডেল লোকালে পাশাপাশি দুটো সিট পাওয়া গেল। ট্রেন ছাড়ল। মাত্রই কয়েকটা স্টেশন পার হয়ে কোন্নগর। প্রকাশ ‘এবার আসি’ বলে বিদায় জানিয়ে উঠে পড়ল ভিড় ঠেলে দরজার দিকে এগিয়ে যাবে বলে। কোন্নগরে ট্রেন ঢোকার মুখে ভদ্রমহিলা গলা তুলে জানতে চাইলেন– এতক্ষণ জিজ্ঞাসা করা উচিত ছিল, আপনার নাম কী ভাই?

পিছনে প্রবল ঠেলা খেতে খেতে প্রকাশ কোনওমতে জবাব দিল– প্রকাশ সেনগুপ্ত, আপনার?

উত্তর শোনার আগেই এক ধাক্বায় প্লাটফর্মে। প্রকাশ ট্রেনের জানালায় হাত নাড়তে যেতেই ভদ্রমহিলা উত্তেজিত হয়ে এগিয়ে এলেন জানালার সামনে। বললেন– প্রকাশ আমি তোমার পারমিতা দিদি। ঝাড়গ্রাম থেকে মনে হচ্ছিল, কোথায় যেন দেখেছি। এইমাত্র চিনতে পারলাম। আর কোনও কথা হওয়ার আগেই দ্রুত বেরিয়ে গেল ব্যান্ডেল লোকাল। প্লাটফর্মে হতবাক প্রকাশ। সেও এইমাত্র চিনতে পেরেছে পারমিতা দিদিকে। চেনার সঙ্গে সঙ্গেই আবার হারিয়ে যাওয়া।

দুঃখিত প্রকাশ মনে মনে ফিরে গেল চব্বিশ পচিঁশ বছর আগে। স্কুলে পড়ার দিনগুলোতে। তখন ওরা ভাড়াবাড়িতে ঢাকুরিয়ায়। স্কুল বাসে গড়িয়াহাট মোড়ের কাছে স্কুলে যাতায়াত করত ও। বড়ো ছেলেরা বাসের জানালা আর প্যাসেজের দিকের সিট সবসময় আগলে রাখত, ওকে কিছুতেই মাঝখানে ছাড়া বসতে দিত না। দুজনের মাঝখানে চিঁড়ে চ্যাপ্টা হয়ে স্কুলে যাওয়া যেন অলিখিত নিত্যনৈমিত্তিক নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ওঠা নামার সময় তাড়াহুড়ো করলেও দাদারা টেনে ধরে আটকে, অকারণে চড়চাপড় লাগাত। বাসের কাকুদের কাছে দু-একবার কাঁদো কাঁদো হয়ে অভিযোগ জানিয়েও কোনও ফল হয়নি। বাসযাত্রার ভয়ে ‘কাল স্কুলে যাব না’ একসময় নিত্যনৈমিত্তিক বোল হয়ে দাঁড়িয়েছিল প্রকাশের। রোজ শুতে যাওয়ার আগে একপ্রস্থ আর সকালে ঘুম থেকে চোখ ছাড়ানোর পর একপ্রস্থ।

সমস্যাটা কী, তা জানতে বাবা-মা বারদুয়েক স্কুলের আন্টির সঙ্গে দেখাও করে এলেন। স্কুল থেকে কোনও গ্রহণযোগ্য কারণ না পেয়ে তারাও দিশাহারা হয়ে পড়লেন। ঠিক সেই সময় একদিন স্কুলবাসে যেতে পাদানিতে উঠতে আরম্ভ করে ডাকাবুকো পারমিতা দিদি। প্রকাশ যখন ক্লাস ওয়ান, পারমিতা তখন সিক্স। ওদের স্টপ থেকে দুটো কালো সাপের মতো লম্বা বিনুনি ঝুলিয়ে উঠত। ছোট্ট প্রকাশের ওপর বড়োদের অত্যাচারের কথা শুনে দু-তিনদিন পরেই কাছে ডেকে নিল। জানালার সিট ছেড়ে সেখানে বসতে দিল। বড়ো ছেলেদের শুনিয়ে শুনিয়ে বলে দিল– আজ থেকে রোজ তুই আমার পাশের সিটেই বসবি। কেউ মেরে তুলে দিতে এলে আমাকে বলবি, তাকে উচিত সাজা দেব। এরপর থেকে অনেকদিন ধরে প্রকাশকে আগলে আগলে রাখত পারমিতা দিদি। এর জন্য দাদাদের সঙ্গে ঝগড়াও করত। একসময় তাই বাসের সকলে পারমিতা দিদিকে ‘প্রকাশের বডিগার্ড’ বলে ডাকতে শুরু করে।

অভিভাবক মহলেও নামটা ছড়িয়েছিল। প্রকাশের বাবা-মা ছেলের বডিগার্ডকে খুব ভালোবাসতেন। প্রকাশ স্কুল বদল করার আগে পর্যন্ত তার প্রত্যেক জন্মদিনে বডিগার্ড-এর নিমন্ত্রণ বাঁধা ছিল। প্রকাশরা কোন্নগরে নিজেদের বাড়িতে উঠে আসতে সব যোগাযোগ ছিন্ন হয়ে যায়। আজকের ঘটনার কথা ভেবে অসহায় প্রকাশের নিজের প্রতি চরম বিরক্তি জাগল, অসভ্য লোকগুলো দিদিকে অপমান করে গেল আর উচিত জবাবটুকুও একজন পুরুষ হয়ে সে দিতে পারল না। নিজের দু’গালে চড় কষালেও বোধহয় খারাপ লাগা দূর হবে না।

কোন্নগরে তখন রাত প্রায় এগারোটা। প্ল্যাটফর্ম ফাঁকা হয়ে গিয়েছে। পুরোনো কথা ভাবতে ভাবতে দাঁড়িয়ে পড়েছিল প্রকাশ। কুরলা এক্সপ্রেসের সেই তাসুড়েদের মধ্যে কোন্নগরের বাসিন্দা দু’জন প্লাটফর্ম থেকে নামার পথে আবিষ্কার করল তাকে। শুনিয়ে শুনিয়ে একজন আরেকজনকে বলল– দ্যাখ, ভ্যাবলাটা দাঁড়িয়ে আছে। বউদির বডিগার্ড।

কক্ষচ্যুত

ঘরের দেয়ালময় দাদার পছন্দের ক্রিকেটারদের পাশাপাশি ইন্দ্রজিতের নায়করা– ব্রুস লি, জ্যাকি চ্যান, অক্ষয় কুমার। এই তিনজন তারকার চটকদার অনাচ্ছাদিত সিক্সপ্যাক সমৃদ্ধ পোস্টারের পাশে, এখন জুড়েছে আরও কয়েক জনের মলিন ছবি– মাসুতাৎসু ওয়্যামা, হিদেয়েৎসু আশিয়ারা। পত্রিকার পাতা কাটা কাগজের ঝাপসা ছবিতে মুখ চেনার উপায় নেই, শুধু পোশাক জানান দিচ্ছে তারা মার্শাল আর্টিস্ট। জ্যাকি চ্যান-এর মতো কমেডি বা ব্রুসলির মতো তাক লাগানো হলিউডি অ্যাকশন হিরো নয়, অক্ষয় কুমারের মতো নাচিয়ে ঝাড়পিট করা বলিউড তারকাও নয়। এরা ক্যারাটের এক একটি ঘরানার নির্মাতা। অবশ্য জিৎকোন্ডোর মতো ক্যারাটে আর তাইকোন্ডোর মিশেল দেওয়া লড়াকু শিল্পের জনক হিসাবে ব্রুস লিরও একটা বাড়তি সমীহ প্রাপ্য। ইন্দ্রজিৎ অতশত না বুঝে অক্ষয়, ব্রুসলিদের দেখেই ক্যারাটেতে ঝুঁকেছিল। মার্শাল আর্ট কথাটার সঙ্গেও তখন পরিচয় ঘটেনি। দত্তপুকুরে তাদের বাড়ির কাছে যে – সম্মিলনি ক্লাব, সেখানে সাদা ঢোলা পোশাক আর কোমরে বাঁধা বেল্ট নিয়ে ছেলেদের ‘ইয়া ইয়া’ করে হাত পা ছুড়তে দেখে তারও শখ তীব্র হয়। মা-বাবার কাছে আবদার করে ঢুকেও পড়ে।

একদিন এক বেঁটে গাঁট্টাগোট্টা মাঝ বয়সি এক পুরুষকে তাদের অনুশীলন দেখে বিদ্রূপের হাসি হাসতে দেখে। মন্তব্য কানে আসে, ‘বেসিক স্টান্সগুলো না শিখেই কিক, আপার ব্লক, লোয়ার ব্লক? বেশ বেশ। এসবই তো চলছে এখন। কারই বা জ্ঞান আছে আসল জিনিস শেখাবার আর কজনেরই বা ধৈর্য আছে শেখবার? কয়েক বছরের মধ্যেই তো সব ব্রাউন বেল্ট, ব্ল্যাক বেল্ট পেয়ে যাবে সিলেবাস কমপ্লিট করে।’

ইন্দ্রজিৎ সেদিন থেকে পিছু নিয়েছিল ব্রহ্মদেশ থেকে আসা এই একটেরে লোকটার। আসল জিনিস শিখবে। ভদ্রলোকের ছাত্র পেটানোর মোহ নেই। খেদিয়েই দিয়েছিলেন ইন্দ্রজিৎকে আজকালকার নিষ্ঠাহীন ফাঁকিবাজ ওপর চালাক ছোকরার দলে ফেলে। ইন্দ্রজিৎও একদিন বলেই ফেলল, ‘শেখানোর মুরোদ নেই যখন, অন্যের তালিমকে হ্যাটা দেওয়া কেন? শুভ্রাংশু স্যাররা তো কিছু দিচ্ছে আমাদের মতো ফালতু ছেলে ছোকরাদের। আপনি ক’জনকে তৈরি করেছেন?’

ভদ্রলোক খানিকক্ষণ স্থির দৃষ্টিতে ইন্দ্রজিতের চোখের দিকে তাকিয়ে থেকে বলেছিলেন, ‘বেশ কাল ভোর পাঁচটায় এসো। স্কুল কটা থেকে? দেখি তোমার কত এলেম, কত নিষ্ঠা।’ ওঁর কাছ থেকেই শোনা মাসুতাৎসু হলেন কায়োকুশিন ধারার প্রবর্তক। অত্যন্ত আক্রমণাত্মক এই শৈলীটি ক্রীড়ামঞ্চে গ্রহণযোগ্য নয়। বিশ্বজুড়ে শোটোকান ও গোজুকান-এরই রমরমা। হিদেয়ুকো আশিয়ারা কায়োকুশিনকে একটু নরম ধাঁচে ফেলে নিজস্ব ঘরানা তৈরি করেন, কায়োকুশিন আশিয়ারা। বিনোদ শেঠ ব্রহ্মদেশে থাকা কালে এই শৈলীটিই ‘সামান্য একটু’ শিখেছিলেন।

পরের দিন ইন্দ্রজিতের নবলব্ধ জেনারেল নলেজের ভাণ্ডার দেখে আকৃষ্ট হয়ে সম্মিলনি ক্লাবের আরও কিছু ছেলে বিনোদদার বাড়িতে হানা দেয়। বিনোদদার উঠোনে অতজনের জায়গা হবে না। তিনি বাধ্য হয়ে বাড়ির পাশের মাঠে প্রশিক্ষণ শুরু করলেন। দক্ষিণার কথা জানতে চাইলে হাসতেন, ‘আগে মাসখানেক দেখি।’

বস্তুত এক মাসের আগেই ইন্দ্রজিৎ আর সুজয় ছাড়া বাকিরা কেটে পড়েছিল। তারা আবার নাকে খত দিয়ে সম্মিলনিতে। অনেক ত্যারছা মন্তব্য হজম করতে হয়েছিল তাদের, ‘দেখি আসল জিনিস কোথায় লুকিয়ে রেখেছিস তোরা? শার্টের পকেটে না প্যান্টের পকেটে, নাকি জাঙিয়ার বুক পকেটে?’

বিনোদদা শুরু করেছিলেন দাচি বা স্টান্স দিয়ে। কিবাদাচি বা ঘোড়সওয়ারের ভঙ্গি, জাঙ্গুৎসুদাচি বা সামনে ঝোঁকার কায়দা, কোকুৎসুদাচি বা পেছনে ঝুঁকে দাঁড়ানোর কৗশল, সানচিংদাচি বা থ্রি পয়েন্ট স্টান্স, কুমিতেদাচি বা রণপ্রস্তুতি– এইসব। দুই পায়ের নানারকম অস্বাচ্ছন্দ্যকর ভঙ্গি ও হাতকে বিশেষ অবস্থানে রেখে দাঁড়িয়ে থাকা। শুরুর কিবাদাচি অনেকটা ভরতনাট্যমের ভঙ্গিতে দাঁড়ানো। প্রথমটায় উৎকটাসনের মতো সহজ মনে হলেও যখন ওই স্টান্সে পনেরো মিনিট দাঁড়াতে বলা হতো, বেশিরভাগই ‘উঃ আঃ’ করে সাত আট মিনিটের মাথায় উঠে দাঁড়াত।

সময়টা বাড়তে থাকলে ছাত্র সংখ্যা কমতে থাকল। কেউই জাঙ্গুৎসুদাচির পর টিকে থাকেনি। ইন্দ্রজিৎ আর সুজয়কে যখন কোনও স্টান্সে এক ঘণ্টা পর্যন্ত দাঁড় করিয়ে রেখে দিতেন বিনোদদা, প্রবল যন্ত্রণাবোধটা যখন ক্রমশ অস্তিত্ব অসাড় করে দিত, তখন ইন্দ্রজিতের সংশয় হতো, লোকটা সত্যিই কিছু শেখাতে চায় তো। কিন্তু কষ্ট সহ্য করার অলৗকিক ক্ষমতা অর্জনের সাথে সাথে মাসখানেক পর স্নানের সময় নিজের উরু আর গুলির পেশির দিকে তাকিয়ে নিজেই মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিল। নার্সিসাসের মতো নিজেকে আয়নায় দেখে যেত। মুখখানা তো তার মারকাটারি ছিলই। কিন্তু শরীর ডিগডিগে, হাত-পা টিংটিঙে। ওই সুগঠিত পা’দুটো ইন্দ্রজিৎ পুরকায়স্থেরই তো? শুধু দাঁড়াতে শিখেই এই? তাহলে হাত পা ছুড়ে অক্ষয় মার্কা চেহারা পেতে কত দিন?

সুজয়ের চেহারা বরাবরই দোহারা। তার গায়ের জোর, ঘুসির পরিধি অনেক বেশি। তবু ইন্দ্রজিৎ ওর সঙ্গে সমানে টক্বর দিয়ে যেত। ওর সম্পদ ছিল নমনীয়তা, গতি আর অ্যাকিউরেসি যাকে বাংলা করে ত্রুটিহীনতা বললে বাড়াবাড়ি শোনাতে পারে। সম্পূর্ণ ত্রুটিহীন কেই বা হতে পারে? বছর তিনেক পর সুজয় গেল অন্য গুরুর কাছে। বিনোদদার শিক্ষানবিশি যত উচ্চাঙ্গেরই হোক, তিন বছরেও একটা ন্যূনতম ‘ইয়েলো বেল্ট’-ও দিতে পারল না। কোনও স্বীকৃত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নয় যে। ওদিকে, গৗরাঙ্গরা লম্ফঝম্প করে ব্রাউন বেল্ট থেকে এখন ব্ল্যাক বেল্টের দাবিদার। সম্মিলনি নয়, সুজয় গেল কলকাতার এক নাম করা প্রতিষ্ঠানে। তারা সোটোকান শৈলী শেখায়। তা হোক। সুজয়ের অসুবিধা হল না। বছর দুয়েকের মধ্যে সে-ই নতুন বাচ্চাদের তালিম দেওয়ার কাজ পেয়ে গেল। ক্যারাটেকেই ধ্যান জ্ঞান করেছে সে। মাধ্যমিকে ভালো ফলের অভিলাষ নেই, উচ্চমাধ্যমিকে বিজ্ঞান নিয়ে পড়তে চায় না, তার পরে না পড়লেও চলে।

সুজয় বন্ধুকে লুকিয়ে চলে যায়নি। সঙ্গে নিতেই চেয়েছিল। কিন্তু ইন্দ্রজিতের পড়াশুনোয় ভালো হিসাবে মাধ্যমিকে স্টার পাওয়ার লক্ষ্যমাত্রা ছিল, উচ্চমাধ্যমিকের পর জয়েন্ট ইত্যাদির পরিকল্পনা ছিল। স্কুল টিউটোরিয়াল করে বাড়ির কাছে বিনোদদার আখড়াটা চালানো যায়, কলকাতায় দৗড়ে সময় নষ্ট করা সম্ভব নয়। তাছাড়া বিনোদদাকে ভালোও বেসে ফেলেছিল। ইন্দ্রজিতের বাবা এসে মাস তিনেক বিনে পয়সায় শিক্ষার পর খামে ভরে টাকা দিয়ে গিয়েছিলেন। সেই থেকে ছেলের হাতেও মাসের শুরুতে খাম পাঠিয়ে দিতেন। সুজয়কেও লজ্জায় পড়ে গুরুদক্ষিণা চালু করতে হয়েছিল। কিন্তু এমন নির্লোভ আপনভোলা গুরু আজকের যুগে কেন, ত্রেতা যুগেও কেউ ছিল কিনা কে জানে? অন্তত দাপরে যে ছিল না, তার প্রমাণ দ্রোণাচার্য, পরশুরামরা রেখে গেছেন। গুরুগৃহে শ্লোক মুখস্থ ও পেট ভাতার বিনিময়ে বৈদিক যুগের ছাত্রদের গুরুর গরু চরানো, ক্ষেত চষা, বাড়ির কাজ সবই করতে হতো। সে অন্যত্র গেল না।

কিন্তু বিনোদদা বিনা নোটিসে বেমক্বা হার্টফেল করে চলে গেলেন। অমন সুস্বাস্থ্যের অধিকারী, কোনও মন্দ দোষ বা নেশা অন্তত ছিল না। হিসাব মিলছিল না। অনাত্মীয় মানুষটা কেন বার্মা ছেড়ে এই দত্তপুকুরে জমি কিনে বসবাস শুরু করেছিলেন, সেটাও অজানা থেকে গেল। উনি মারা যাওয়ার পর কোনও এক দূর সম্পর্কের ভাইপো নিজেকে একমাত্র বৈধ উত্তরাধিকারী প্রমাণ করে ওই বাড়িতে সপরিবারে প্রতিষ্ঠিত। বাড়ির উঠোনে এখন দড়িতে শাড়ি, জামা, কাঁথা ঝোলে এক গাদা। সম্মিলনিতে ফিরে যাওয়ার মুখ নেই। ক্যারাটে তার এই পর্যন্তই ভাগ্যে ছিল।

আজকাল জয়েন্টের সিট অনেক বাড়ানো হয়েছে। নব্বই দশকের গোড়াতেও মেডিকেলের আসন ছিল হাজারের কম, ইঞ্জিনিয়ারিং-এ বারোশোর মতো। এখন নাকি বসলেই পাওয়া যায় প্রাইভেট শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর রমরমায়। বাবার ইচ্ছে কারিগরি, নিজের আয়ত্বে জীবনবিজ্ঞান। দুটোতেই বসেছিল। মেদিনীপুরের একটা কলেজে অ্যাডমিশন হয়েও যেত। কিন্তু বাবা শিবপুর, যাদবপুর বা বড়ো জোর উত্তরবঙ্গের সরকারি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ ছাড়া প্রাইভেট কলেজগুলোতে পড়ে কিছু শেখা যায় বলে মানতেই নারাজ। হয়তো খরচায় কুলোলে মত বদলাতেন। মা বলেছিলেন, ‘পলিটেকনিক দে’। বাবা নাক সিঁটকে বলেন, ‘কোথায় বিই, আর কোথায় পলিটেকনিক ইঞ্জিনিয়ার? যে ডাক্তার হওয়ার যোগ্য, তাকে বলছ আয়া হয়ে থাক। অশিক্ষিত মেয়েমানুষের বুদ্ধি আর কাকে বলে? দরকার হলে ফিজিক্স নিয়ে জেনারেল পড়বে।’

‘কেন তোমার বন্ধু তিমিরবাবু পলিটেকনিক পাস করেই তো কোম্পানির অ্যাডিশনাল চিফ ইঞ্জিনিয়ার হয়ে রিটায়ার করবে। আমি যেটা সহজে হবে আর ও পারবে সেটা বলেছি। মুখ্যু মানুষের খোঁটা তো নতুন নয়। তুমি ফিজিক্সে অনার্স নিয়ে টেকনিক্যাল অফিসার…’

‘যা বোঝো না, তাই নিয়ে কথা বোলো না। অফিসে আমার কাছে এখনও সবাই আসে যে-কোনও টেকনিক্যাল সমস্যা নিয়ে, এমনকী যে-কোনও ক্রিটিক্যাল চিঠি ড্রাফট্ করাতে হলেও অবিনাশ পুরকায়েত। এত বছর কাজ দেখিয়ে…। আমার দুর্বল জায়গায় একদম ঘা দেবে না। আদর্শ স্ত্রী হওয়ার শিক্ষাই পাওনি, আর ছেলের পড়াশুনো নিয়ে ফোড়ন কাটতে এসেছে…’

দাদা বাবাকে কিছু বলতে সাহস পায় না। মায়ের ওপরই বিরক্তি প্রকাশ করে। সে নিজের জেদে এমকম করে আধা সরকারি প্রতিষ্ঠানে ভালো চাকরি করে। ইন্দ্রজিতের এখনও পড়াশুনোই শেষ হয়নি। তবু দাদা অরবিন্দের ভাষায় সে বেকার। ছোটো ভাইয়ের কেরিয়ার নিয়ে আলোচনা হতে একদিন মন্তব্য করল, ‘মা, বাবার কিন্তু বেশিদিন চাকরি নেই। ভস্মে ঘি ঢালার পর নিজেদের খাওয়া পরার ব্যবস্থাটা যাতে থাকে সেটা দেখো।’

সারা জীবন সবার জন্য এত করে নিজের ছেলেকে কি কোনও নৈতিকতা শেখাতে পারেননি অবিনাশ? বুড়ো মানে অরবিন্দ নিজের বাবাকে দেখেনি কীভাবে ঠাকুমা দাদু তিন কাকা, তিন পিসির অত বড়ো সংসার টেনেছেন? বাড়িতে এসোজন বোসোজন লেগেই থাকত। মা অভূক্ত থাকলেও কোনওদিন অভিযোগ করেননি। এখনও দুপুরে এলে কেউ না খেয়ে যেতে পারে না। সেই বাপ মার ছেলে হয়ে নিজের মায়ের পেটের ভাইয়ের দায়িত্ব এড়িয়ে হিংসা? ছোটনের তো এখনও দায়িত্ব নেওয়ার সময় শুরুই হয়নি। এখনও এই সংসার বাপের টাকায় চলে। রোজগেরে ছেলে খেয়াল খুশি মতো এটা সেটা শখের জিনিস কিনে নিজের ঘর সাজায়। সংসারে দেওয়ার মধ্যে পুরোনো ফ্রিজ বদলে একটা দুই দরজার ফ্রিজ কিনেছে। সেটাতেও সদা সতর্ক। যেন সে ছাড়া আর কেউ রেফ্রিজারেটর ব্যবহার করতে জানে না, নষ্ট করে ফেলবে। ছোটনের মতো শান্ত ও বাধ্য ভাই, যে বাবা দাদার ফরমাসে দিনে শতবার দোকান হাট ইলেকট্রিক অফিস, গ্যাসের দোকান দৌড়োচ্ছে, এমনকী পরীক্ষার আগেও মুখে কোনও ভাবান্তর ঘটায় না, তার প্রতি কেন এত বিদ্বেষ? ছোটো ছেলেটার মুখচোখ মায়ের আদলে বেশ চোখা চোখা, বাবার মতো মাঠো মাঠো গায়ের রং। বড়োর মাথা আর গায়ের রং দুটোই টকটকে পরিষ্কার, শুধু মনটাই সাফ হয়নি। …কাঁধে ব্যথা নিয়ে ইন্দ্রজিৎ দাদার ঝাঁজের কারণ খানিকটা অনুমান করতে পারে।

কস্তুরী সল্টলেকের একটা কল সেন্টারে চাকরি করে। শিফ্ট ডিউটি। কখনও ভোরে উঠে দৗড়োতে হয়, কখনও দুপুরে আবার কখনও সময় রাত্রি আটটায় অফিসের বাস ধরার জন্য এই মোড়ের মাথায় এসে দাঁড়ায়। অফিস ফেরতা তাকে প্রায় রোজই দেখত অরবিন্দ। একবার রবিবারে বাজারে দেখা হওয়াতে দুজনেই দুজনকে দেখে হেসেছিল, ‘বাজার করতে?’

কস্তুরীর নাইট শিফ্ট না থাকলে নিয়মিত দেখা হওয়ার সম্ভাবনা নেই। তাই ছোটো ভাই নিয়ম করে বাজার করলেও রবিবার অরবিন্দ একবার বাজারে চক্বর দিয়ে যায়। রবিবার সকাল আটটা নাগাদ যেতে পারলে দেখা হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। সবজিপাতি, মাছ মাংস কী লাগবে জানা না থাকায় খান দশেক মিষ্টি কিনে বাড়ি ফেরে। কস্তুরীকে দেখতে পেলে খানিক গল্পগুজব আর প্রশ্ন, ‘নাইট শিফট কবে থেকে?’

আমেরিকান শিফট থাকলে কস্তুরী আজকাল একটু আগে আগেই অফিসের বাসের জন্য মোড়ের মাথায় অপেক্ষা করতে থাকে। আর অরবিন্দ স্টেশনে নেমে একটু দেরিতে বাড়ি ঢোকে।

‘রবিবার দিন বাজার ছাড়া আর কোথাও দেখা করা যায় না?’

‘এই তো দেখা হচ্ছে।’ হেসেছিল কস্তুরী।

অতঃপর দুজনেরই বাজারের ঘটা বেড়ে যায়। রোজগেরে ছেলে শুধু মিষ্টি কিনে বাড়ি ফিরলে ভালো দেখায় না বলে মাছ, মাংস, পনির, গোলদারি যেসব দোকানে কস্তুরী লাইন দেয়, অরবিন্দকেও সেখানে সেখানে হাজিরা দিতে গিয়ে এটা সেটা কিনতেও হয় মাঝেমধ্যে। যদিও জানিয়ে দেয়, সংসার খরচ বাবদ মা আর বাজার বাবদ ছোটো ভাইকে টাকা দেওয়াই আছে। কস্তুরীর একটাই উত্তর, মৃদু হাসি।

ফেরার পথে একটা চায়ের দোকানে খানিকক্ষণ বসা। দুজনেই বাড়ি গিয়ে মায়ের হাতে বানানো চা খেতেই পছন্দ করে। তবু। চায়ের দোকানে বসার প্রস্তাব অরবিন্দের হলেও তার খুচরোর অভাবে দাম বেশির ভাগ কস্তুরীই মেটায়। সঙ্গের হাসিটা ফাউ।

সেদিনও চা খেতেই ঢুকেছিল। দোকানটায় বড্ড বেশি ভিড় ছিল ওইদিন। একদল টি-শার্ট পরা ছোকরা উচ্চকণ্ঠে গুলতানি করছিল। কস্তুরী বলল, ‘আজ থাক। এত ভিড়ের মধ্যে…। চেয়ারও তো ফাঁকা দেখছি না’।

‘কেন, এই তো জায়গা ফাঁকা ওদিকে। সব সময় কি অধৈর্য হলে চলে? ফাইভস্টার হোটেলেও অনেক সময় ক্যাফেটেরিয়ায় টেবিল পেতে লাইন দিতে হয়। হাবু দা চারটে বেগুনি আর দুটো চা দাও।’

‘না না। আজ এই ক্যালর-ব্যালোরের মধ্যে বসতে ইচ্ছা করছে না। আমার বাড়িতে এসো বরং, চা খেয়ে যাও।’

একটা তালঢ্যাঙা লোক কস্তুরীর দিকে মন্তব্য ছুড়ে দিল, ‘ভিড়ে পোষাচ্ছে না? নিরিবিলি চাও? সকালবেলাতেই ফুর্তির ফোয়ারা বসাবে নাকি মান্তু? সন্ধেটা ফ্রি থাকলে আমাদের কাছে এসো না, সব পুষিয়ে দেব।’

‘একদম বাজে কথা বলবেন না। মিনিমাম ভদ্রতাটুকু নেই। এদের জন্যই আমি এখানে বসতে চাইছিলাম না। এখন বুঝেছ তো? শুধু শুধু এইসব নোংরা কথা শুনতে হল।’ কস্তুরী বেশ শান্ত মিষ্টি মেয়ে। এভাবে রেগে গলা চড়িয়ে কথা বলতে দেখেনি অরবিন্দ।

‘ঠিক আছে, ঠিক আছে। আজ থাক। চলো যাই।’ অরবিন্দ কস্তুরীর বাহু ধরে টান দিল।

ওই দলের আর একজন উঠে এসে বলল, ‘মেয়েছেলের হাত ধরে টানাটানি করছিস। তার বেলা কিছু নয়। আর আমার ফ্রেন্ড দুটো রসিকতা করল তো ইজ্জত খসে গেল?’ ছেলেটা সোজা কস্তুরীর অন্য হাত ধরে টান লাগাল।

‘একী? একী অসভ্যতা! ছাড়ুন বলছি হাত। আমি কোথায় বসব, কার সাথে চা খাব আমার ব্যাপার। আপনারা মাথা গলানোর কে? হাবুদা কিছু বলুন। দেখছেন তো কী করছে।’

হাবুদা মন্তব্য করল, ‘শালা, মেয়েছেলে থাকা মানেই ঝঞ্ঝাট!’

বাকিরা কেউ কিছুই বলছে না। গুনগুন করে যে আওয়াজটা হল তাতে মনে হল হাবুর কথাটা একাধিক সমর্থন পেল। অরবিন্দও চুপ। সে কস্তুরীর হাত ছেড়ে দিয়েছে।

কস্তুরী স্তম্ভিত হয়ে অরবিন্দের দিকে তাকাল, ‘তুমিও কিছু বলবে না? আমাকে এখানে নিয়ে এসে এখন বিপদে ফেলে ল্যাজ গুটিয়ে পালাবে?’

‘তুমি চুপচাপ ওই কোণার টেবিলে ওয়েট করলে এত কথা হতো না। তা নয়, ঘটা করে নিজের চলে যাওয়া অ্যানাউন্স করে ওদের প্রভোক করলে।’

‘আমি প্রভোক করেছি? তোমাকে দোকানে ঢোকার আগেই বললাম এখান থেকে চলো যাই। ছেলেগুলোর হাবভাব দেখেই সুবিধের নয় মনে হয়েছিল। আমরা ভেতরে ঢুকলে কি ওরা টিজ করত না? এত স্পর্ধা আমার গায়ে হাত দিচ্ছে!’ কস্তুরী উত্তেজনায় কাঁপছিল।

‘গায়ে তো হাতই দিয়েছি সোনা। অন্য কিছু তো নয়। খিক্খিক্।’ ঢ্যাঙার মন্তব্যে দলের সবকটা মিলে বিকট হাসতে শুরু করল। দোকানের ভেতরে খদ্দেরের ভিড় কমে গেল, বাইরে দর্শকের ভিড় বাড়তে লাগল।

হাবুদা গজগজ করল, ‘মেয়েছেলে রোজগার করলে ধরাকে সরা জ্ঞান করে।’ কী আশ্চর্য! লোকটা সব দেখেও ছেলেগুলোকে কিছু বলছে না। কস্তুরীর ওপর ঝাল ঝাড়ছে, যে নিয়মিত আসে। আরও আশ্চর্য– অরবিন্দের প্রতিবাদের সাহস না থাকুক, কস্তুরীকে দোষ দিয়ে পালানোর পথ খুঁজছে?

‘এবারের মতো ছেড়ে দিন। ওকে বাড়ি পৌঁছে দিই।’ বাপরে, অরবিন্দ অনেক সাহস দেখিয়ে ফেলল তো।

‘আমরা কি খুকিকে বাড়ি পৌঁছে দিতে পারি না?’

অকস্মাৎ জনতার জটলা ভেদ করে এক সুদেহী যুবক বেরিয়ে এল। আততায়ীর কবজি চেপে ধরে কস্তুরীর হাত ছাড়িয়ে নিল ওদের হাত থেকে। ‘দাদা তুই কস্তুরীদিকে নিয়ে চলে যা, আমি এদের দেখছি– কত বড়ো মস্তান। চিন্টু সুজয়কে খবর দে তো।’

সুজয় আসার আগেই তিনটে ছেলেকে দোকান থেকে টেনে বের করে মেরে পাট করে দিল ইন্দ্রজিৎ। বাকিরা আক্রোশে কাপ-প্লেট ভেঙে, চেয়ার হাতে নিয়ে আক্রমণ করতে এল ইন্দ্রজিৎকে। অরবিন্দ সেদিন কার মুখ দেখে উঠেছিল কে জানে? কিন্তু ভাইকে সাবধান করার মতো গলার জোরটাও নেই। কস্তুরীর উদ্দেশ্যে দাঁত কিড়মিড়িয়ে বলল, ‘তোমার জন্য এই ঝামেলার উৎপত্তি। ছেলেগুলোকে গালাগাল না দিয়ে ভদ্র ভাষায় বলা যেত না? বোলতার চাকে ঢিল ছুড়েছ। এবার দেখো, কদ্দুর গড়ায়। চলে এসো।’ হাত ধরে টানল অরবিন্দ।

কস্তুরী এক ঝট্কায় হাত ছাড়িয়ে নিল। ‘আর যার সাথে যাই, তোমার সঙ্গে তো নয়ই। আর কাউকে আমার জন্য বিপদে পড়তে দেখে তোমার মতো পালিয়ে যেতে আমি পারব না। ছোটন, তোমায় চেয়ার তুলে মারতে আসছে!’ কস্তুরী চেয়ার মাথায় ছেলেটাকে ঠেলার চেষ্টা করল। বাকিরা ওকে যাচ্ছেতাই ভাবে জড়িয়ে ধরল।

সুজয় আর সম্মিলনি কতগুলো ছেলে চলে এসেছে। অত বড়ো হাট্টাকাট্টা চেহারা নিয়ে সুজয় এক পাশে দাঁড়িয়ে রইল। অতনু তার প্যানপ্যাঁকাটি চেহারা নিয়ে চিতার মতো অতর্কিতে ঝাঁপিয়ে পড়ল। তার দেখাদেখি তনয়। সুজয় সামান্য খাঁকারি দিল দল ভারি হতে, কিন্তু ষোলো ইঞ্চির বাইসেপস্ওয়ালা হাত গুটিয়ে দাঁড়িয়ে রইল একপাশে। মাথা বাঁচলেও চেয়ার কাঁধে লেগে ইন্দ্রজিতের মুখ যন্ত্রণায় বিকৃত হয়ে গেল।

‘তোমার পরিচয় পেয়ে গেছি। আমার সঙ্গ পাবে বলে এখানে নিয়ে এসে কতগুলো ইতর হুলিগানের হাতে তুলে দিয়ে পালিয়ে যাচ্ছ? নিজের ভাইকে দ্যাখো’।

‘ওর মাস্তানি দেখানো বেরিয়ে যাবে। গুন্ডা বদমাশদের সঙ্গে যেচে কেউ লাগে? ওদের কাছে ছুরি-ছোরা, আর্মস থাকে। ক্যারাটে শিখে হিরোগিরি দেখাচ্ছে।’

‘ছিঃ! প্রতিবাদ করার সাহস সবার থাকে না। যা ঘটছে চারদিকে, সেটা করা নিরাপদও নয়। কিন্তু নিজের অক্ষমতা ঢাকতে কখনও আমাকে দোষারোপ করছ, কখনও নিজের ভাইকে। আমি কিন্তু ছোটনের সঙ্গে নয়, তোমার সঙ্গে এখানে এসেছিলাম। ও মাগো! ছোটন সাবধান!’

সুজয় এসে আক্রমণকারীকে অনুনয়ের ভঙ্গিতে পেছন থেকে জাপটে ধরল। ‘ভাই কী হচ্ছে কী? শান্ত হও। শুধু শুধু…।’

সুজয়ের দুই বাহুর আলিঙ্গনে একসাথে দুজন চ্যাঙড়া চলৎশক্তিহীন হয়ে গেল। অথচ ওই বিশাল দেহ আর বল নিয়ে সে এতক্ষণ চুপচাপ দেখছিল। ও আগে এগিয়ে এলে ইন্দ্রজিতের আঘাত লাগত না, অতনুর মুখ মাথা ফেটে কনুই কেটে রক্তারক্তি হতো না। সুজয় ছাড়া অল্প-বিস্তর চোট লেগেছে, এ পাড়ার যে ছেলেগুলো এগিয়ে এসেছিল তাদের সবারই।

অরবিন্দের সঙ্গে এক মুহূর্ত থাকতে রাজি নয় দেখে, কস্তুরীকে বাড়ি পৌঁছে দেওয়ার জন্য সুজয় রিকশা ডেকে চড়ে বসল। কস্তুরী ঠান্ডা গলায় বলল, ‘আমি একাই যেতে পারব। তার আগে আমার জন্য যারা ইনজিওরড্ হল তাদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করব।’

কস্তুরীর সঙ্গে বাড়ি ফিরতে অরবিন্দর কী ঝাঁজ! ‘ক্যারাটে ব্ল্যাক বেল্ট, বীরত্ব দেখানোর হাতে গরম পুরস্কার পাওয়া হয়ে গেল তো? ইস্! এমন দয়াময়ী সাহসিনী আর দুচার পিস থাকলে ওই ইভটিজিং-এর প্রোটেস্ট করা ছোকরাগুলোকে বেঘোরে মরতে হতো না।’

কস্তুরী মুখ খুলল, ‘নিজের ভাইয়ের ওই ছেলেগুলোর মতো পরিণতি হোক চাইছিলে মনে হচ্ছে!’

‘আমাকে ভদ্রলোকের মতো খেটে খেতে হয়। বাপের হোটেলে থেকে আর ভাইয়ের অন্ন ধবংস করে মারামারি শেখার সৌভাগ্য তো সবার হয় না। আর লম্বা চওড়া মাসল্ বাগানো বডি নিয়ে হিরোইজম দেখাতে কার না সাধ যায়?’

‘দাদা, অন্যায়ের প্রোটেস্ট করতে সবার আগে যেটা দরকার হয় সেটা হল মেরুদণ্ড। স্ট্রিট-ফাইটিং-এর জন্য মাসলস-এর চেয়ে আগে দরকার কলজে। অতনুকে দেখলি না? ওই নিঙলে চেহারা নিয়ে কীভাবে ফুঁসে উঠল? তনয়, বাপি এরাও কেউ ব্রুস লি বা হলিফিল্ড নয়। ওদিকে সুজয় আমার দেড়া চেহারা নিয়ে চুপচাপ আমাদের মার খেতে দেখে গেল। ওরা কোণঠাসা হওয়ার পর শালা মিটমাট করতে ময়দানে নামল। না হলে সবকটাকে পেঁদিয়ে বৃন্দাবন দেখাতাম আমরা। কস্তুরীদি তো আগে অতনুকে হাসপাতালে অ্যাডমিট করার ব্যবস্থা করল। বাকিদেরও হসপিটালে ফার্স্টএইড দেওয়া হয়েছে।’

অরবিন্দ ভেতর ঘরে যাওয়ার আগে হিসহিসিয়ে স্বগতোক্তির ভঙ্গিতে কথা ছুড়ে দিয়ে গেল, ‘সবচেয়ে উপাদেয় পদটা শেষপাতের জন্য তোলা থাকে।’

কস্তুরী চোয়াল শক্ত করে তারপর চোখ বুজিয়ে রাগের সঙ্গে বোধহয় খানিকটা কান্নার দলাও গিলে ফেলল। তারপর ধরা গলায় বলল, ‘মাসিমা, এলাম। ডাক্তার কিন্তু গরম জল নয়, আইস কম্প্রেস করতে বলেছেন। হট ওয়াটার ব্যাগ থাকলে তার মধ্যেও বরফ ভরে নিতে পারেন। ডাক্তারবাবু এক্স-রে প্লেট দেখে নিয়েছেন, কিন্তু ক্লিনিক থেকে রিপোর্টটা আজ সন্ধেবেলায় কালেক্ট করতে হবে। ওষুধগুলো মনে করে খেও ছোটন। আর পরের কথা– ভগবান দুটো কান দিয়েছেন কেন জানো তো?’ তারপর নিজেকেই বলল, ‘আমি ভেবে পাই না, মেয়েরাই যেখানে টার্গেট হয় সেখানে তাদের নিদেন পক্ষে সেলফ্ ডিফেন্সটুকু শেখারও ব্যবস্থা থাকে না বেশিরভাগ জায়গায়। অ্যাটাক করে ভয় না দেখালে রেসকিউ করে ছেলেরা কথা শোনাবে কী করে?’

বাকিদের কাটা ছড়া, হাড়ে ফাটল ধীরে ধীরে সেরে গেলেও ইন্দ্রজিতের কাঁধের ব্যথাটা ছ মাস পরেও পুরোপুরি গেল না। এখনও বাজার দোকান করে, মানে করতে হয়। কিন্তু ডান হাতে বা কাঁধে ভারি ব্যাগ নিলেই পুরো হাতটাই খচকা লেগে অবশ হয়ে আসে। কস্তুরী জোর করে কিছুদিন ওর চিকিৎসার খরচ চালিয়েছিল। বাড়ি এসে খোঁজ করে যেত মাঝে মাঝে। অরবিন্দের উপস্থিতি বা প্রতিক্রিয়া যেন দেখতেই পেত না। রিকশায় বসিয়ে সঙ্গে করে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেত।

অতনুরা ওদের একসাথে দেখে একবার দুই আঙুলে ‘দারুণ’ মুদ্রা ফুটিয়ে মন্তব্য ছোড়ে, ‘বস, সচীনের চেয়ে অঞ্জলি সাত বছরের বড়ো, অভিষেকের চেয়ে ঐশ্বর্যও দু-তিন বছরের বড়ো।’ বুকের ভেতরটা যে একটু শিরশির করেনি তা নয়। দাদার বান্ধবী বলে কস্তুরীকে দিদি ডাকে, না হলে বয়সের ফারাক তেমন কিছু নয়। কিন্তু বন্ধুদের রসিকতায় কস্তুরীর সাহস ও সহানুভূতি দুটোর প্রবাহই বন্ধ হয়ে গেল। এখন রাস্তাঘাটে চোখাচোখি হলে, ‘ভালো?’– এর বেশি কথা হয় না।

কাঁধের ব্যথাটা এমনিতে নিয়ন্ত্রণেই থাকে। কিন্তু ডাক্তার ও ফিজিওথেরাপিস্টের দেখানো ব্যায়াম ছাড়া আর কোনও কসরত করতে গেলেই হাত নড়ানো, ঘাড় ঘোরানোর উপায় থাকে না বেশ কিছু দিন। ওয়েট ট্রেনিং তো নৈব নৈব।

বিনোদদা চলে গেছেন চার বছরের ওপর। সুজয় এখন সম্মিলনি ক্লাবের সুজয় স্যর। কস্তুরী কর্মসূত্রে ব্যাঙ্গালোরে। কথা তো দূর, দেখাই হয় না আর। নতুন নম্বরও নেওয়া হয়নি। চাকরির পরীক্ষা সাক্ষাৎকারের ছোটাছুটির মধ্যে দেহটাকে যোগাসন করে সচল রেখে চলেছে। কাঁধে মাঝেমধ্যে চিড়িক মারা চিনচিনে ব্যথার মতো দাদার এখনও অবদি চালিয়ে যাওয়া তির্যক মন্তব্যগুলোও যেন জিইয়ে রেখেছে কিছু গোপন পর্বের স্মৃতি– চার বছরের তদগত মার্শাল আর্ট সাধনা অথবা কাঁধে কস্তুরী…দির হাতের স্পর্শ, ‘ছোটন পেইনকিলার বেশি খেয়ো না, সেঁক নিও। তুমি আবার প্রাকটিস শুরু করতে না পারলে নিজেকে বড়ো অপরাধী মনে হবে।’

অসত্য

সুচন্দ্রা এই পাড়ায় নতুন নয়। সেই নয় বছর বয়সে মা-বাবার হাত ধরে এই পাড়াটায় প্রথম পা রেখেছিল সে। প্রথম প্রথম বন্ধু বলতে কেউ ছিল না। খুব খারাপ লাগত সুচন্দ্রার। স্কুল থেকে ফিরে খেলার সঙ্গী বলতে কেউ ছিল না।

ধীরে ধীরে একই পাড়ার ঘোষ পরিবারের সঙ্গে সুচন্দ্রার মা-বাবার আলাপ-পরিচয় গড়ে ওঠে। সেই সূত্রে সুচন্দ্রাও ওদের বাড়িতে যাতায়াত আরম্ভ করে। ওর প্রধান আকর্ষণ ছিল ঘোষদের ছোট্ট ছেলেটা। কীরকম ফুটফুটে পুতুলের মতো। ওর থেকে বয়সে চার বছরের ছোটো। সবে সবে সুচন্দ্রার স্কুলেই ভর্তি হয়েছিল। নাম অনির্বাণ। বড়োদের সবার দেখাদেখি সুচন্দ্রাও ওকে ‘অনি’ বলেই ডাকত।

মা শিখিয়ে দিয়েছিল সুচন্দ্রাকে যে, অনি-ই সুচন্দ্রার ছোটো ভাই, তাই অত কম বয়সেই সুচন্দ্রা অনি-র অনেকটা দায়িত্বই নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিল।

স্কুলে অনি যতক্ষণ থাকত সুচন্দ্রা ওকে চোখে চোখে রাখত। একটা ক্লাস শেষ করেই দৌড়ে এসে ভাইকে দেখে যেত। ভাইয়ের ছুটি আগেই হয়ে যেত। স্কুল থেকে ফিরেই সুচন্দ্রা চলে যেত ঘোষদের বাড়ি। সারাটা বিকেল ভাইয়ের সঙ্গে খেলতে খেলতে সময় কেটে যেত সুচন্দ্রার। সূর্য পশ্চিমে ঢলে পড়লে সুচন্দ্রা বাড়ি ফিরে আসত।

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দু’জনে একসাথে বড়ো হতে থাকে। কিন্তু একে অপরের প্রতি স্নেহ ওদের এতটুকুও কম হয় না। অনির্বাণ ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে বেঙ্গালুরু চলে যায়। আর সুচন্দ্রা কলকাতাতেই থেকে যায়। ও কলকাতার মেডিকেল কলেজ থেকে পাস করে নিজেরই এক সহপাঠীকে বিয়ে করে নেয়। সরকারি হাসপাতালে চাকরিও হয়ে যায় ওর।

এরই মধ্যে অনির্বাণের বাবা অন্য শহরে বদলি হয়ে যান। পরিবার নিয়ে ওরা নাগপুর চলে যায়। দূরত্ব তৈরি হলেও অনির্বাণ ছুটিছাটায় সুচন্দ্রার সঙ্গে এসে দেখা করে যেত। ফোনে যোগাযোগ সুচন্দ্রা কোনওদিনই বন্ধ করেনি।

সউদি আরবে চাকরি পাওয়ার খবর অনির্বাণ ফোনেই জানিয়েছিল। অনির্বাণের সঙ্গে ফোন ছাড়াও, মেলেও সুচন্দ্রা খবরা-খবর রাখত। এরই মধ্যে তিন বছরের জন্য সুচন্দ্রা স্বামীর সঙ্গে আয়ারল্যান্ড চলে যায় পড়াশোনা করতে। ওখানে থাকতেই খবর পায় যে অনির্বাণ দেশে ফিরে এসে একটি বিদেশি সংস্থায় চাকরি নিয়েছে। কলকাতাতেই ওর পোস্টিং।

কলকাতায় ফিরতেই সুচন্দ্রা, অনির্বাণের সঙ্গে যোগাযোগ করে। সেই সন্ধেতেই অনির্বাণ এসে হাজির হয় সুচন্দ্রার বাড়িতে।

‘আয় ভাই, ভিতরে আয়। বাব্বা কতদিন পর তোর সঙ্গে দেখা,’ সহাস্যে সুচন্দ্রা বলে।

‘এত দেরি করে ফিরলে তোমরা, আমার আর সময় কাটছিল না। বাবারা তো নাগপুরেই সেটেল করলেন। আমি এখানে একটা ফ্ল্যাট ভাড়া করে রয়েছি। সারাটা দিন অফিসে কাজেই কেটে যায় কিন্তু সন্ধে থেকে কিছুই আর করার থাকে না…’ বলতে বলতে অনির্বাণ বসার ঘরের সোফায় গা এলিয়ে দেয়।

অনির্বাণের সাড়া পেয়ে ততক্ষণে সুচন্দ্রার স্বামী অর্ক-ও বাইরের ঘরে বেরিয়ে এসেছে। বাড়িতেই চেম্বার অর্ক-র কিন্তু অনির্বাণ আসবে জেনে রুগি দেখা বন্ধ রেখেছে আজ ও।

‘কী ব্যাপার শালাবাবু? একাকিত্বে বড়োই কাহিল হয়ে পড়েছ, বোধ হচ্ছে। তা জানো তো, এর একমাত্র চিকিৎসা হয় কিন্তু ছাদনাতলায়,’ হাসতে হাসতে অর্ক বলে।

‘অর্ক ঠিকই বলেছে অনি, তুই এখনও কেন বিয়ে করিসনি?’ সুচন্দ্রা জিজ্ঞেস করে।

‘প্রথম সউদি আরব আর এখন কলকাতা, একা একা থাকা। বিয়েটা হবে কী করে? তারপর মা আর বাবার শরীরের অবস্থা তো জানোই তুমি। ওঁদের পক্ষে মেয়ে খোঁজা অসম্ভব আর মেয়ে দেখতে সারা ভারতবর্ষ ঘুরে বেড়ানো আমার পক্ষে সম্ভব নয়। যাই হোক, এখন তোমরা এসে গেছ, সুতরাং মনে হচ্ছে দিদি এবার আমার বিয়েটা হয়েই যাবে।’

‘অনি, হয়েই যাবে মনে হচ্ছে… এই কথাটার মানে কী? আর একলা থাকলে কি বাইরে বিয়ে করে এসে এখানে একটা রিসেপশন দেওয়া যেত না?’ কপট রাগের সঙ্গে সুচন্দ্রা অনি-কে বাগে আনার চেষ্টা করে।

‘দিদি, নাগপুরে কোনও বাবা-মা তাঁদের মেয়ের সঙ্গে আমার বিয়ে দেবে না কারণ বয়সটা আমার কম হল না। আর আমার পছন্দ মায়ের পছন্দ নয়। এই করে বিয়েটাই আর করা হচ্ছে না। দিদি, তুমি এক কাজ করো, হয় মা-বাবাকে বোঝাও যে আমি নিজের পছন্দ করা মেয়েকে বিয়ে করব আর নয়তো তুমি নিজেই এই পাত্রী ঠিক করার দায়িত্বটা নাও।’

‘কিন্তু কাকু-কাকিমা, তোর পছন্দের মেয়েকে কেন মেনে নিচ্ছেন না? অন্য কাস্ট ও, নাকি ডিভোর্সি?’ সুচন্দ্রা জানতে চায়।

‘ওই সব কিছুই না দিদি। মেয়েটি অবিবাহিত এবং আমাদেরই কাস্টের। কিন্তু ওর একটাই শর্ত যে ভবিষ্যতে আমাদের যেন কোনও সন্তান না হয়। আর এটাতেই মায়ের আপত্তি।’

‘কিন্তু মেয়েটি কেন সন্তান চায় না আর এখনও কেন মেয়েটি বিয়ে করেনি? এটা একটু অদ্ভুতই মনে হচ্ছে,’ সুচন্দ্রার গলায় স্পষ্ট শঙ্কা ফুটে ওঠে।

‘দিদি, রুমন মা-বাবার একমাত্র সন্তান। আমার সঙ্গে একসঙ্গে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ত। ওখানে পড়তে পড়তেই ওর বাবার ক্যান্সার ধরা পড়ে এবং তার কিছুদিনের মধ্যেই ওর মা-ও, ওই একই রোগে আক্রান্ত হন। অনেক চিকিৎসা করিয়েও ওদের বাঁচানো সম্ভব হয়নি। এখন ও চাকরি করে। আমাকে বিয়ে করতে চায় কিন্তু ওর একটাই শর্ত– মা হতে চায় না,’ অনির্বাণের কণ্ঠে হতাশা ফুটে ওঠে।

‘কিন্তু কেন ওর এরকম জেদ?’

‘এটা আমি জিজ্ঞেস করিনি বা করবও না। ও আমাকে কারণটা বলতে চেয়েছিল কিন্তু ওর অতীত জানার আমার কোনও আগ্রহ নেই। আমি ওকে একটা সুন্দর ভবিষ্যৎ দিতে চাই।’

‘কিন্তু এরকম একটা ডিসিশন নেওয়ার কোনও তো কারণ হবে,’ সুচন্দ্রা বলতে বাধ্য হয়।

‘রুমন আমাকে বলেছিল যে মা-বাবার চিকিৎসায় প্রচুর টাকার দরকার ছিল যার জন্য ওকে রাতদিন পরিশ্রম করতে হয়েছিল। কিন্তু এমন কাজ ও কোনওদিন করেনি যাতে ওকে পরে লজ্জায় পড়তে হয়। আর ওর মা না হওয়ার ডিসিশনও সম্পূর্ণ ওর নিজের ইচ্ছেয়, এর পিছনেও কোনও অনৈতিক কারণ নেই। দিদি, আমার মনে হয় কাউকে ভালোবাসলে তাকে তার প্রয়োজনীয় প্রাইভেসিটুকু দেওয়া উচিত। আমার সন্তান হোক আর নাই হোক, তাতে মা-বাবার সমস্যা কোথায়? বাড়িতে বংশ এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য তো ভাই রয়েছে।’ একটু চুপ করে থেকে অনির্বাণ বলে, ‘তাছাড়া বাচ্চা দত্তক নেওয়ার অথবা সারোগেসির বিকল্প তো রয়েইছে।’

‘এই ব্যাপারটা নিয়ে রুমনের সঙ্গে কথা বলেছ?’ অর্ক এতক্ষণ চুপ করে থেকে জিজ্ঞেস করে।

‘হ্যাঁ, অর্কদা। ও-ই আমাকে বলেছিল যে আমার বাড়ির লোক যদি আমার মা হওয়া নিয়ে খুব বেশি চাপ দেয়, তাহলে সারোগেসির মাধ্যমে আমি যেন ওদের ইচ্ছে পূরণ করি। ওর কোনও আপত্তি নেই। এত কিছুর পরেও মা-বাবা রাজি হয়নি। এখন তোমরা যদি কোনও ভাবে সাহায্য করো।’ অনির্বাণের কথা শুনে অর্ক চিন্তিত হয়ে পড়ে। সুচন্দ্রার দিকে তাকায় অনির্বাণ, ‘দিদি জানোই তো ভালোবাসা অন্ধ। আর রুমনের প্রতি ভালোবাসাই আমার প্রথম এবং শেষ বলতে পারো।’

‘আর রুমনের ক্ষেত্রেও কি তুই-ই ওর প্রথম এবং শেষ প্রেম?’ সুচন্দ্রা জিজ্ঞেস করে।

অনির্বাণ সম্মতিসূচক ঘাড় হেলায়। সুচন্দ্রার প্রশ্নের উত্তরে ও বলে, ‘হ্যাঁ দিদি। প্রথম থেকেই আমরা দু’জনে একে অপরকে পছন্দ করতাম। ভেবেছিলাম পড়া শেষ করে সকলকে আমাদের সম্পর্কটার বিষয়ে জানাব। কিন্তু তার আগেই রুমনের বাবা অসুস্থ হয়ে পড়লেন, আর রুমনও আমার সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে চাইল না। কিন্তু একই শহরে থেকে সেটা কিছুতেই সম্ভব হচ্ছিল না। সেইসময় আমিও সউদি আরবে চাকরিটা পেয়ে চলে যাই।’

‘তাই জন্যেই কি তুই হঠাৎ বাইরে চলে গিয়েছিলি?’ সুচন্দ্রা, অনিকে কথার মাঝেই থামিয়ে দেয়।

‘হ্যাঁ দিদি, তুমি ঠিকই ধরেছ। রুমনের জীবন থেকে আমি সরেই যেতে চেয়েছিলাম।’

‘কিন্তু তাহলে ফিরে এলি কেন?’

‘আমাদের দু’জনের কমন ফ্রেন্ড শান্তা। ওর সঙ্গে বরাবরই আমার যোগাযোগ ছিল। ওই আমাকে রুমনের বাবা-মায়ের মৃত্যুসংবাদ দেয়। এই খবর পাওয়ার পরেই আমি এখানে চাকরি খুঁজতে আরম্ভ করি। চাকরি পেয়েই কলকাতায় ফিরে আসি। রুমন আর আমি এখন একই অফিসে চাকরি করি।’ অকপটে সবকিছু সুচন্দ্রার কাছে খুলে বলে অনির্বাণ।

‘নাঃ, শালাবাবু! তোমার কেসটা দেখতেই হচ্ছে। সুচন্দ্রা, তোমাকে অনির সাহায্য করতেই হবে। হাসপাতালে কাজের মাঝে মাঝে কীভাবে অনিকে সাহায্য করবে ভাবো,’ অর্ক এবার মুখ খোলে।

‘অনি, আজ অনেক দেরি হয়ে গেছে, আজ আর কিছু করা যাবে না। কাল দেখি কোথা থেকে শুরু করা যায়,’ সুচন্দ্রা বলে।

‘তাহলে দিদি, আজ আসি। কাল তোমাকে একবার রুমনের বাড়ি নিয়ে যাব কিন্তু তার আগে পারলে মায়ের সঙ্গে একবার ফোনে কথা বলে নিও। দ্যাখো, মা তোমাকে কী বলেন!’ অনির্বাণ বাড়ি চলে যায়।

পরের দিন সকালে সুচন্দ্রা নাগপুরে অনির্বাণের বাড়িতে ফোন করে অনির্বাণের মা-র সঙ্গে পুরো ব্যাপারটা নিয়ে কথা বলে এবং নিজের দৃষ্টিভঙ্গিও কাকিমাকে জানায়।

‘আমার আশ্চর্য লাগছে সুচন্দ্রা, তুই ডাক্তার হয়েও এই সম্পর্কটা মেনে নিতে চাইছিস? তোর মনে হচ্ছে না যে, ওই মেয়েটি কোনওরকম মানসিক অথবা শারীরিক অসুস্থতার শিকার নয়তো অনির সামনে এই ধরনের শর্ত রাখে?’ অনির্বাণের মা সুচন্দ্রার কাছে প্রশ্নটা রাখেন।

‘হ্যাঁ, হতেই পারে কাকিমা… আজ আমি মেয়েটির বাড়ি যাব ওর সাথে কথা বলতে। দেখি কিছু বুঝতে পারি কিনা। কথাবার্তা যাই হোক তোমাকে এসে ফোন করব’, এই বলে সুচন্দ্রা ফোনটা কেটে দেয়।

অর্ক, সুচন্দ্রার কথাগুলো বসে শুনছিল। ও বলে ওঠে, ‘সুচন্দ্রা, এই দিকটা তো আমার মাথাতেই আসেনি। কাকিমা এর মধ্যে অনেক কিছুই ভেবে ফেলেছেন।’

‘যদি এরকম কিছু হয় তাহলে আমরা ওর চিকিৎসা করাতেই পারি। সব রোগেরই চিকিৎসা আছে। কিন্তু এখনই অনিকে ওদের কথা কিছু বোলো না তাহলে ওর মন আরও ভেঙে যাবে,’ সুচন্দ্রা ভেবে বলে।

‘ওনাদের আপত্তি হওয়াটাও স্বাভাবিক সুচন্দ্রা। কোনও রোগগ্রস্ত মেয়ের সঙ্গে কি কোনও মা-বাবা নিজের ছেলের বিয়ে দিতে চাইবেন? অনি আর রুমনকে না জানিয়েই বুদ্ধি খাটিয়ে আসল কাহিনিটা জানতে হবে তোমাকে।’ অর্কর কথাগুলো সুচন্দ্রা মেনে নেয়।

অর্ক আরও বলে, ‘তুমি এক কাজ করো। রুমনের বাড়ি যাওয়ার থেকে অন্য কোথাও ওর সঙ্গে দেখা করো। তুমি বরং আজ না গিয়ে কাল লাঞ্চ ব্রেকে অনির অফিসে চলে যাও। রুমনও তো একই অফিসে চাকরি করে। গিয়ে বোলো, হঠাৎ কাজের জন্য তোমাকে ওদিকে আসতে হয়েছে, একসঙ্গে লাঞ্চ করতে চাও। ও নিজেই হয়তো তোমাকে রুমনকে ডেকে পরিচয় করিয়ে দেবে। কিন্তু যদি না-ও ডাকে তুমিই ওকে ডেকে নিতে পারো।’

সুচন্দ্রা কাজের দোহাই দিয়ে সেদিন রুমনের বাড়ি যাওয়া ক্যানসেল করে দিল। পরের দিন না জানিয়েই অনির অফিসে পৌঁছে গেল। দরজায় ঢুকে লিফটের সামনে দাঁড়াতেই, লিফটের দরজা খুলে দেখল অনি বেরিয়ে আসছে সঙ্গে লম্বা, শ্যামলা একটি মেয়ে, বেশ সুন্দরী।

সুচন্দ্রাকে দেখেই অনির্বাণ বলে ওঠে, ‘আরে দিদি। তুমি এখানে? সব ঠিক তো?’

‘হ্যাঁ, হ্যাঁ… সব ঠিক আছে। ঘাবড়াস না। এদিকে একটু কাজে এসেছিলাম, ভাবলাম তোর সঙ্গে দেখা করে যাই। কেন, কোথাও বেরোচ্ছিস নাকি?’ সুচন্দ্রা বলে।

‘রুমনকে লাঞ্চে নিয়ে যাচ্ছিলাম। বিকেলের প্রোগ্রাম ফিক্স করার ছিল… তুমিও চলো আমাদের সঙ্গে,’ অনির্বাণের অনুরোধে সুচন্দ্রা ওদের সঙ্গে যেতে রাজি হয়ে যায়।

‘ঠিক আছে, চল। ভালো কোথাও একটু বসি যেখানে শান্তিতে কথা বলা যাবে।’

‘তাহলে একটু এগিয়ে ‘আঙ্গিঠি’ রেস্তোরাঁর ফ্যামিলিরুমে গিয়ে বসা যেতে পারে। ওটা বেশ ভালো আর দুপুরে ওখানে ভিড়টা কম,’ রুমন বলে ওঠে।

পাঁচ মিনিটেই ওরা রেস্তোরাঁয় এসে পৌঁছে যায়।

‘খুব ভালো আইডিয়া দিয়েছ রুমন। নয়তো পার্কিং পেতে আর ব্যস্ত রাস্তায় যাতায়াত করতেই অনেকটা সময় নষ্ট হয়ে যেত,’ সুচন্দ্রা বলে।

অনির্বাণ বলে, ‘রুমনের আইডিয়া কিন্তু সবসময়ই খুব কাজে লাগে দিদি। এটা ওর একটা বড়ো গুণ।’

‘তাহলে তো ওকে খুব শিগগিরই, পরিবারের একজন সদস্য করে নিতে হবে।’

অনির্বাণ হেসে রুমনের দিকে তাকায়। সুচন্দ্রার মনে হয়, রুমনের ঠোঁটে হাসি লেগে থাকলেও চোখ দুটো বিষাদ মাখানো। এই বিষাদটাকে লুকোবার জন্যেই যেন রুমন আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

রেস্তোরাঁয় বসে রুমন সুচন্দ্রার কাছে ওর বিদেশে থাকাকালীন দিনগুলো সম্পর্কে জানার আগ্রহ প্রকাশ করে। এই নিয়েই খানিকটা সময় কেটে যায় ওদের। খাবার খেতে খেতে সুচন্দ্রা বলে, ‘আমার বিদেশের এক্সপিরিয়েন্স সবই তো শুনলে, এখন তোমার কথা বলো রুমন।’

‘আমার সম্পর্কে বলার মতো সবকিছুই হয়তো শুনে থাকবেন অনির্বাণের কাছে। বলার মতো কিছুই নেই। অনির্বাণের সঙ্গে কলেজে পড়তাম, এখন এক অফিসে চাকরি করি আর আমি থাকি যাদবপুরে।’

‘যাদবপুরে রুমনের বাবা খুব শখ করে বাড়ি বানিয়েছিলেন। হাজার অসুবিধে হওয়া সত্ত্বেও ও ওই বাড়ি বিক্রি করেনি,’ অনি এরই সঙ্গে জুড়ে দেয়, ‘ওখানে ও একাই থাকে।’

‘ভয় লাগে না?’

‘না, দিদি। ভয় পাওয়া অনেক আগেই ছেড়ে দিয়েছি,’ রুমন হাসে।

‘বাঃ, খুব ভালো। কিন্তু অনিকে ছোটোবেলায় ভীতু বলে ডাকতাম, সেটা জানো কি?’

রুমনা হেসে গড়িয়ে পড়ে, ‘কই না-তো দিদি। ও তো কখনও বলেনি যে ছোটোবেলায় ওকে ভীতু বলে ডাকা হতো। কীসে ভয় পেত দিদি?’

‘বলার দরকার নেই। যখন ওর সাথে থাকবে তখন নিজে থেকেই সব জানতে পারবে,’ হেসে উত্তর দেয় সুচন্দ্রা।

‘ওর সাথে থাকার সম্ভাবনা খুব কম। অনির মা-কে কষ্ট দিয়ে আমি অনিকে বিয়ে করতে পারব না।’ রুমনের চোখে বিষাদের ছায়া উঁকি মারলেও কণ্ঠস্বরের দৃঢ়তা সুচন্দ্রাকে অবাক করল।

সুচন্দ্রা হাতঘড়ির দিকে তাকায়, ‘এই কথা আলোচনা করার সময় বা জায়গা এটা নয়। আমাকে একবার হাসপাতালে ঢুঁ মারতে হবে। হাতে সময় রয়েছে। তোমার সময় হলে বোলো, আরাম করে বসে এটা নিয়ে আলোচনা করা যাবে। হয়তো সমাধানের একটা রাস্তাও পাওয়া যেতে পারে।’

‘আজ সন্ধেবেলা তুমি আর অর্কদা যাবে রুমনের বাড়ি?’ অনির্বাণ জিজ্ঞেস করে।

‘এখন কাজ শেষ করে বাড়ি যাব। একবার বাড়ি গেলে দ্বিতীয়বার আর বেরোবার ইচ্ছে হবে বলে মনে হয় না। আর আজ তো তোদের সঙ্গে দেখা হয়েই গেল।’

‘তোমার সঙ্গে দেখা হয়েছে কিন্তু অর্কদার সঙ্গেও তো ওর আলাপ করাতে হবে।’ অনির্বাণ বলে, ‘তুমি বাড়ি গিয়ে আরাম করো, আমি রুমনকে নিয়ে বরং তোমাদের বাড়ি চলে আসব।’

‘সেটা তো খুব ভালো হয়। চলে আয় রুমনকে নিয়ে। রাত্রে আমার বাড়িতেই খাওয়াদাওয়া করে বাড়ি ফিরিস।’

সন্ধে হতেই অনির্বাণ, রুমনকে সঙ্গে করে সুচন্দ্রাদের বাড়ি পৌঁছে গেল। একসাথে বসে হাসি, আড্ডায় চারজনেই জমে উঠল। গল্পের মাঝে একপ্রস্থ চা আর স্ন্যাক্স সার্ভ করল সুচন্দ্রা। গল্প চলতে চলতেই অর্ক বলল, ‘সুচন্দ্রা আর একবার চা হলে আড্ডাটা কিন্তু আরও জমে যেত।’

‘চা খাওয়ার তোমার একটা এক্সকিউজ চাই।’

‘প্লিজ, লক্ষ্মীটি…।’

অর্কর মুখের ভঙ্গি দেখে সকলে হেসে ফেলল। অগত্যা সুচন্দ্রাকে উঠতেই হল। রান্নাঘরের দিকে ও পা বাড়াল। চায়ের জলটা গরম করতে করতেই অনির্বাণ এসে রান্নাঘরের দরজায় দাঁড়াল, ‘দিদি তুমি কি মাকে ফোন করেছিলে?’

‘হ্যাঁ, ফোন করেছিলাম। কাকিমারা কেমন আছেন সেটা নিয়েই কিছুক্ষণ কথা হল।’

‘ব্যস, আর কিছু বললে না? আমাদের কথা কিছু বলোনি? তোমাকে বলেছিলাম না, মায়ের সঙ্গে আমাদের ব্যাপারটা নিয়ে একটু কথা বলতে,’ অনির্বাণের স্বরে সামান্য হতাশা প্রকাশ পেল।

‘সুযোগ হয়নি। আর সব কথা আলোচনা করার একটা সঠিক সময় থাকে। রুমন কোথাও পালিয়ে যাচ্ছে না, বিয়ে করলে তো তোকেই করবে। যখন এতদিন অপেক্ষা করলি তখন না হয় আরও কটা দিন কর।’

‘এছাড়া আর করারই বা কী আছে?’ অনির দীর্ঘশ্বাস সুচন্দ্রার কানে এসে বাজল।

রুমনের সঙ্গে সুচন্দ্রার বন্ধুত্ব ধীরে ধীরে আরও গভীর হয়ে উঠল। সবদিক দিয়ে সুচন্দ্রা রুমনের বিশ্বাস অর্জন করে নিল। একদিন সুচন্দ্রার সঙ্গে কথা না হলে রুমনের মনে হতো তার জীবন থেকে একটা কিছু বাদ পড়ে গেছে। কিছু একটা অমূল্য জিনিস যেন ও হারিয়ে ফেলেছে।

সুচন্দ্রাও রুমনের প্রতি একটা স্নেহের আকর্ষণ অনুভব করত। মেয়েটার মধ্যে সত্যিই একটা চুম্বকীয় আকর্ষণ ছিল। রুমনের কাছেই সুচন্দ্রা জানতে পারল, অনি অফিসের কাজে কয়েকদিনের জন্য মুম্বই যাচ্ছে। মুম্বই চলে গেলে অনির অনুপস্থিতিতে সুচন্দ্রা একদিন ফোন করে রুমনের বাড়ি এসে উপস্থিত হল। রুমনের বাড়িটা সত্যিই দেখার মতো। বোঝাই যাচ্ছিল যিনি বানিয়েছেন তার পছন্দটা বেশ উঁচুমানের।

‘খুব ভালো করেছ বাড়িটা বিক্রি না করে রুমন। বিয়ের পরেও নিশ্চয়ই তুমি এখানেই থাকতে চাও? অনির্বাণ রাজি তোমার প্রস্তাবে?’ সুচন্দ্রা আস্তে করে রুমনকে জিজ্ঞেস করল।

‘অনি তো কোনও শর্ত ছাড়াই আমার সব প্রস্তাব মানতে রাজি। কিন্তু আমি ওর মা-বাবার আশীর্বাদ না নিয়ে অনিকে কিছুতেই বিয়ে করতে পারব না। মা-বাবার স্নেহ থেকে তাদের সন্তানকে দূরে সরিয়ে দেওয়া কখনও উচিত নয়। স্বার্থপর ভালোবাসায় আমি বিশ্বাস করি না। আমার জন্য অনি সবার সঙ্গে সম্পর্ক ত্যাগ করুক, এ আমি কিছুতেই চাই না।’

‘এটা তো খুবই ভালো কথা রুমন। কাকু, কাকিমা মানে অনির বাবা-মা খুবই ভালোমানুষ। ওদের যদি ঠিকমতো বোঝানো যায় মানে তুমি বিয়ের যে শর্ত রেখেছ, তার কারণ বলা যায়, তাহলে ওনারাও বিনা দ্বিধায় হাসতে হাসতে এই বিয়েতে মত দেবেন। কিন্তু অনি ওদের কোনও কারণও বলেনি।’

‘ও নিজে জানলে তবে তো ও, অন্য কাউকে বলবে। আমি ওকে অনেকবার বলার চেষ্টা করেছি কিন্তু ও কিছুতেই শুনতে চায় না। অনির কথা হল ভবিষ্যতকে সুন্দর করে তোলার চেষ্টা করো, অতীতকে মনে রেখে কী লাভ।

আমিও অতীতকে মনে করতে চাই না দিদি। কিন্তু অতীত অথবা জীবনের সঙ্গে জুড়ে থাকা কিছু ঘটনা এমনও হয় যেটাকে কিছুতেই এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব হয় না। সারা জীবন সেটাকে নিয়েই বাঁচতে হয় দিদি,’ রুমনের চোখের কোণ চিকচিক করে ওঠে।

‘তুমি চাইলে তোমার জীবনের এই অধ্যায়টা আমার সঙ্গে শেয়ার করতে পারো,’ সুচন্দ্রা দুই হাত দিয়ে নত হয়ে আসা রুমনার মুখটা পরম স্নেহে তুলে ধরে।

‘কয়েকদিন ধরে আমি এটাই ভাবছিলাম দিদি।’ গভীর নিঃশ্বাস নেয় রুমন। একটু নিজেকে গুছিয়ে নিতে সময় নেয়। বলতে শুরু করে, ‘কলেজের পরেই চাকরি পেয়ে যাই। ততদিনে বাবা আর মা দু’জনেরই ক্যান্সার ধরা পড়েছে। চাকরি থেকে দেরি করে ফেরা আর বারবার ছুটি নেওয়ার জন্য চাকরিটাও ঠিকমতো করতে পারছিলাম না। আর মা-বাবার দেখাশোনাও ঠিকমতো হচ্ছিল না। অতএব চাকরিটা আমি ছেড়ে দিই। মুম্বই চলে যাই মা-বাবাকে নিয়ে। আত্মীয়ের একটা ফ্ল্যাট খালি ছিল, ওখানে গিয়েই উঠি। বাবার টাকা ছিল। কিন্তু বিপুল পরিমাণ চিকিৎসার খরচ জোগানোর জন্য আমিও কাজ করতে শুরু করি। ভ্যাকিউম ক্লিনার বেচা থেকে শুরু করে, কী না করেছি। হাসপাতালে ক্যান্টিনে কাজ করেছি, বেবি সিটিং করেছি। মা-বাবার আপত্তি সত্ত্বেও বেশি পরিমাণ অর্থ জোগাড় করতে দু’বার স্যারোগেট মাদার হতেও লজ্জা পাইনি।

সেইসময় মেশিনের মতো বাচ্চার জন্ম দিয়েছি আর টাকার বিনিময়ে যারা টাকা দিয়েছে তাদের হাতে তুলে দিয়েছি বাচ্চাকে। কিন্তু এখন মনে হয় বিয়ের পর যখন নিজের সন্তান হবে তখন তাকে মানুষ করতে গিয়ে আগের দু’টো বাচ্চার কথাও মনে পড়তে পারে। তাদের তো আমি অচেনা লোকেদের হাতে তুলে দিয়ে এসেছি। ওদের কথা মনে পড়লে আমি যদি বিচলিত হয়ে উঠি, তাহলে সেটা অনি বা অনির সন্তানের প্রতি অন্যায় করা হবে। সুতরাং বিয়ের পর নিজের সন্তান যাতে না হয় তারই জন্য অনির কাছে ওই প্রস্তাব রেখেছিলাম। দিদি তুমি, অনি এবং ওর মা-বাবাকে পুরো সত্যিটা খুলে বলো। ওনারা যা সিদ্ধান্ত নেবেন সেটা আমি মাথা পেতে নেব।’

‘ঠিক আছে রুমন, সুযোগ বুঝে আমি ওনাদের সঙ্গে কথা বলব,’ সুচন্দ্রা রুমনকে আশ্বাস দেয়।

সুচন্দ্রা বেরিয়ে আসে রুমনের বাড়ি থেকে। রুমনের স্বীকারোক্তি সুচন্দ্রার মাথায় ঘুরপাক খেতে থাকে। রুমনের ভাবনাটা সত্যি। অনির সঙ্গে হয়তো ওর কোনও সমস্যা হবে না কারণ অনির রুমনের প্রতি ভালোবাসাটা নিঃস্বার্থ। রুমনের সবকিছুই ও মেনে নেবে কিন্তু অনির মা-বাবা? তারা কী করে এমন মেয়েকে পুত্রবধূ হিসেবে স্বীকার করবেন যে কিনা দু’বার স্যারোগেট মাদার হয়েছে? কাজটা সহজ নয়।

সুচন্দ্রা ভাবতে থাকে। কাকু, কাকিমাকে রুমনের বয়সের দোহাই দেওয়াটা কি খুব অন্যায় হবে? রুমনের যা বয়স তাতে সন্তানের জন্ম দেওয়াটা বিপজ্জনক, এমনটা বোঝানো অসুবিধার নয়। কথাটা খুব একটা মিথ্যাও না। সুচন্দ্রার মনে হয় অনি আর রুমনের ভালোবাসা টিকিয়ে রাখতে এতটুকু ছলনার আশ্রয় তো নেওয়াই যেতে পারে।

 

ছায়াবৃতা

ট্রেনের সফর বরাবরই আমার খুব প্রিয়। জানালা থেকে মুখ ফেরাতে ইচ্ছে করে না আমার। ভালোবাসি প্রকৃতি দেখতে। ট্রেনের জানলায় বসে দেখতে থাকি কীভাবে প্রকৃতি বদলে যায়, বদলায় মাটির রং, মাটির গঠন। কুলটি ছাড়াতেই এরকমই বদলটা চোখে পড়ছে। কুমারডুবি ছেড়ে ট্রেন এগোতেই বুঝি, রাজ্য বদল হতে যাচ্ছে। ঝাড়খন্ডে প্রবেশ করব এবার।

বহুবছর পরে আবার প্রান্তিক মালভূমি অঞ্চলের ধূ-ধূ আবহে ফিরে এলাম। কুড়ি বছর আগে, আমি ছিলাম এই এলাকার এসডিও। যাকে সোজা ভাষায়, জেলার সর্বেসর্বা বলা চলে। তখন আমার বয়সও কম। গোটা এলাকাটাও ছিল একেবারে অন্যরকম। অনুন্নত কিছু মানুষ, আর ততধিক অনুন্নত পরিকাঠামো। রাস্তা বলতে, দীর্ঘকাল চলতে চলতে পায়ে পায়ে যে-রাস্তা তৈরি হয়ে যায়, সেটাই। বাকিটা কেবলই জঙ্গল। জঙ্গলে বেশিরভাগই পলাশ গাছ।এ অঞ্চলে প্রচুর পরিমাণে পলাশফুল ফোটে। রাঙা পলাশ রক্তিম করে রাখে গাছের শীর্ষ আর শাখা।

এসডিও-র অফিস অর্থাৎ জেলার প্রধান কার্যালয় থেকে এই গভীর জঙ্গলের কাছাকাছি আসতে হলে, একাধিক নদীনালা পার হতে হতো। বর্ষায় এখানে পৌঁছনো তো বলতে গেলে অসম্ভব হয়ে পড়ত, কেন-না তখন নদীনালাগুলিও জল পেয়ে ফুলে উঠেছে। ভীষণ স্রোত। সহায় বলতে ভুটভুটি। নদী এপার-ওপার করার কোনও সেতু ছিল না।

এবার এসে দেখলাম, রাস্তাঘাট পাকা হয়েছে বটে, কিন্তু বড়ো নদীর উপর কোনও সেতু এখনও তৈরি হয়নি। ক্রমাগত কেটে ফেলায় জঙ্গলের ঘনত্বও যথেষ্ট কমে এসেছে। কোথাও কোথাও তো এতটাই কমে গেছে গাছের সংখ্যা যে, সেখানে জঙ্গল নামমাত্র। দেখে অবাক হয়ে গেলাম। মানুষের কি নিজের ভবিষ্যতের জন্যও কোনও আশঙ্কা হয় না! নজরদারি থাকা সত্ত্বেও এমন নির্বিবাদে গাছ কেটে নেওয়ার পিছনে বড়ো ষড়যন্ত্র আছে। যে-কটি পুরোনো পলাশগাছ এখনও মাথা তুলে দাঁড়িয়ে রয়েছে, তাদের মাথায় লাল আগুন দেখে মন ভরে গেল নিমেষে।

জঙ্গলের মধ্যে কিংবা আশেপাশে যারা থাকে, তারা সকলেই আদিবাসী। কুড়ি বছর আগে তাদেরকে নিজেদের রীতি-রেওয়াজের রক্ষণশীল চেতনাতেই আবদ্ধ দেখেছি। প্রকৃতির সঙ্গে যেন মিশে ছিল এরা। যেমনভাবে জঙ্গলের আর-পাঁচটা প্রাণী থাকে। মনে হতো, এই জঙ্গলটিই ওদের পৃথিবী। এই পৃথিবীর বাইরেও যে-একটা পৃথিবী আছে, সে সম্পর্কে তারা ছিল উদাসীন। নিজেদের পৃথিবীতে বাইরের কারও আগমন তারা ভালো চোখে দেখত না। বিরক্ত হতো। লুকিয়ে পড়ত ঘন জঙ্গলের মধ্যে।

জঙ্গল ওদের রক্ষা করত। বাঁচিয়ে রাখত ওদের গোপনীয়তাকেও। এ অঞ্চলের আদিবাসী নারীদের ঊধর্বাঙ্গে বস্ত্র বিশেষ দেখিনি। তাতে তাদেরকে লজ্জা পেতেও দেখিনি কখনও। এইবার এসে দেখলাম, আদিবাসী মহিলারাও অনেক বদলে গেছে। ঊধর্বাঙ্গ আর অনাবৃত নয়। পরিবর্তন আরও অনেক জায়গায় ঘটেছে। যেমন, বিভিন্ন জায়গায় জঙ্গল সাফ করে চাষাবাদ করার চিহ্ন দেখা যাচ্ছে। আগে এরা বনজ সম্পদের উপরই বেশি নির্ভরশীল ছিল। এখন যেন মনে হচ্ছে, এলাকাটির অর্থনীতি কৃষিপ্রধান হয়ে পড়ছে।

বিশেষ দায়িত্ব নিয়ে, সরকারের পক্ষ থেকে, এই এলাকার উন্নয়নের পরিকাঠামো আর সম্ভাবনা সরেজমিনে দেখতে এসেছি। সঙ্গে, জেলার কালেক্টর, পুলিশ প্রধান এবং অন্যান্য অফিসাররাও রয়েছেন। ঠিক হল, সকলে মিলে জলখাবার খেয়েই একটি বড়ো গ্রাম দেখতে বেরিয়ে পড়ব। কুড়ি বছর আগে এই গ্রামটিকে আমার প্রভূত সম্ভাবনার আকর মনে হয়েছিল। নানা কারণে সে সময় কাজ আর এগোয়নি। এবার সুযোগ পেয়ে প্রথমেই এই গ্রামটিতে যাব বলে মনস্থ করলাম।

গাড়ি চলাচলের রাস্তা নেই বলে, অনেকটা ঘুরে যেতে হল। ফলে, পৌঁছতে যথেষ্ট বেলা হয়ে গেল। প্রয়োজনীয় কাজকর্ম সেরে নিতে গিয়ে টেরই পাইনি, কখন ঝুপ করে সন্ধে নেমে পড়েছে, বাদুড়ের বেশে বিস্তৃত পাখা ছড়িয়ে দিয়ে!

এই গ্রামে এখনও বিদ্যুৎ আসেনি। খুব সম্পন্ন পরিবারে সৌরবিদ্যুতের দুটো-একটা আলো জ্বলে। না হলে, অন্ধকার ঘোচাতে লন্ঠনই ভরসা। সরকারি বাবুরা এসেছেন বলে, আজ অবশ্য একটা হ্যাজাক জোগাড় করে আনা হয়েছে। সেটা জ্বালাতে অন্ধকারটা যেন আর একটু গাঢ় হল।কাজকর্ম মিটতে, কালেক্টর কানের কাছে মুখ নিয়ে এসে বললেন, ‘স্থানীয় ক্লাবের ছেলেরা সামান্য বিনোদনের ব্যবস্থা করেছে।এখানকার ছেলেমেয়েরা নাচে খুব ভালো!’  কবজি উলটে হাতঘড়ি দেখে বললাম, ‘নাচ দেখতে গেলে তো অনেক দেরি হয়ে যাবে মশাই। আর-একদিন এলে হতো না?’

কালেক্টর নিজেই যথেষ্ট উৎসাহী। স্বাভাবিক। বউ-ছেলেমেয়ে-টিভি সিরিয়াল ছেড়ে, এই নির্বান্ধব পৃথিবীতে দিনের পর দিন কাটানো, খুব সহজ কথা নয়। ভদ্রলোক আশ্বস্ত করে বললেন, ‘খুব জরুরি কাজ না থাকলে, আমি বলি কী, একটু দেখেই যান। সঙ্গে তো গাড়ি আছে। পৌছনোর চিন্তা তো নেই। তা ছাড়া এখন পুলিশের যা কড়া নজরদারি শুরু হয়েছে, তাতে ডাকাতেরাও আর ট্যাঁ-ফোঁ করতে পারছে না!’

আদিবাসীদের নাচের এক নিজস্ব মাদকতা আছে। দু’দশক আগে এখানে যখন ছিলাম, সুযোগ হয়েছিল দেখার। কিন্তু, সেসব তো প্রায় গতজন্মের কথা বলে মনে হয়! বাকি সবকিছুর মতো সেই নৃত্যশিল্পীদের মোহিনী বিভঙ্গেও পরিবর্তন এল কিনা, সেটা লক্ষ্য করার লোভ আমারও কিছু কম ছিল না। আটচালায় পাতা মাদুরের উপর পা মুড়ে বসে পড়ে কালেক্টরকে বললুম, ‘বেশ, আপনি যখন অভয় দিচ্ছেন, থাকাই যাক তাহলে কিছুক্ষণ!’

ক্লাবের সদস্যদের আনন্দ তখন আর দেখে কে! সরকারি বাবুর খামখেয়ালে এত বড়ো আয়োজনটা বানচাল হয়ে যাচ্ছিল দেখে, তারা একটু ঝিমিয়ে পড়েছিল। এখন তেড়েফুঁড়ে উঠে, আর্জি নিয়ে আসা স্থানীয় লোকের ভিড়টা নিমেষে ফাঁকা করে, তারা নাচের জায়গা তৈরি করে নিল।

মূল অনুষ্ঠান শুরুর আগে গান। ক্লাবেরই দুই যুবক, তাদের নিজস্ব ভাষায় গান ধরল। ভাষাটা খানিকটা চেনা ঠেকছে, খানিকটা অচেনা। বোঝা, না-বোঝার আলো-আঁধারিতে গান শেষ হলে, কালেক্টর ফিসফিস করে বললেন, ‘আপনি বোধহয় ভাষাটা বুঝতে পারেননি, তাই না?’

মাথা নেড়ে লজ্জিত গলায় বললাম, ‘বাস্তবিক ভুলেছি। অনেক দিনের ব্যাপার তো!’

কালেক্টর বললেন, ‘আপনাকে স্বাগত জানাল। গাইল, ‘শহর থেকে গাঁয়ে আসা সরকারি বাবু, তোমায় নমস্কার’।’

খানিকক্ষণের বিরতির পর তিনজন আদিবাসী মহিলা মঞ্চে এল। দুজন তরুণী, অন্যজন মধ্যবয়সিনি। বয়স্কার শরীরও একটু ভারী। কিন্তু আশ্চর্যরকম টানা টানা চোখ আর ভারী কালো শরীরকে পেঁচিয়ে রাখা শাড়ি ভেদ করে, উন্নত স্তনদ্বয়ের আভাসে তার রূপ, ভারতীয় সনাতন সৌন্দর্যের কথা মনে করিয়ে দেয়। তিন মহিলা হাত ধরাধরি করে দাঁড়াল। তিনজনের মধ্যে সবচেয়ে কমবয়সি যে, তার বয়স খুব বেশি হলে কুড়ি বছর। ছিপছিপে চেহারার ছটফটে মেয়েটির চোখ-মুখ আদিবাসীদের মতো নয়, বরং বেশ চোখা। নাচের লয় যত দ্রুত হল, ততই মেয়েটির শরীরে দেখা দিল তীব্র ঘূর্ণি। কী অনায়াস দক্ষতায় যে নাচতে থাকল সে!

তিনজন নারী ঘুরে ঘুরে নাচছে আর তাদের পিছনে একটু দূরে দাঁড়িয়ে আর-এক দল গান গাইছে বনজ সুরে। যন্ত্রানুষঙ্গ বলতে নেই কিছুই। কেবল একটি স্টিলের থালা আর চামচ। একজন গায়িকা চামচ দিয়ে থালায় আঘাত করে তাল রাখছে। নাচের মুদ্রা এই আদিবাসীদের নিজস্ব। কয়েকটি একেবারে নতুন লাগল। হয়তো শহুরে প্রভাবেই কয়েকটি মুদ্রা নতুনভাবে যোগ হয়েছে নাচে। শহুরে দর্শক সামনের সারিতে বসে থাকায় নর্তকী ও গায়িকারা যেন নিজেদের উজাড় করে দিচ্ছে।

আমি মগ্ন হয়ে আছি। কিন্তু মগ্ন হয়ে যে নাচটাই দেখছি, এমন নয়। আসলে, আমার মন চলে গেছে কুড়ি বছর আগের অন্য একটি ঝাপসা হয়ে আসা দৃশ্যে। সেদিনও এমনই নাচের অনুষ্ঠান হচ্ছিল। রাতের বেলা, তবে হ্যাজাক বা লন্ঠন জ্বালতে হয়নি। আকাশ ভরা ছিল জ্যোৎস্না। জায়গাও অবশ্য এটা ছিল না। জঙ্গলের মধ্যে, চারদিকে আদিবাসীদের ঝুপড়ি দিয়ে ঘেরা একটা ফাঁকা গোল জায়গায় ঘুরে ঘুরে নাচছিল নর্তকীরা। আজ যেন অলৌকিক মনে হয়। যেন, এমন কোনও ঘটনাই ঘটেনি, যেন এমন কোনও দৃশ্যের প্রত্যক্ষদর্শীই আমি ছিলাম না!

আনমনা মনটাকে টেনে বর্তমানে ফিরিয়ে নিয়ে আসি। নর্তকীরা এখনও নাচছে। হঠাৎই মনে হল, ওদের মধ্যে বয়স্কা নারীটি আমার দিকে তাকিয়ে রয়েছে যেন। দর্শকদের প্রতিক্রিয়া জানতে নর্তকীরা যেভাবে তাকায়, এই তাকানোর ধরনটা সেরকম নয়। একটু অন্যরকম। যেন খুব ঔৎসুক্য নিয়ে তাকিয়ে আছে। বুক কেঁপে উঠল আমার।

আমিও সেই নারীকে ভালো করে দেখলাম। ততক্ষণে নর্তকীদের ঘূর্ণনের গতি বেড়ে গেছে। কিন্তু, তা সত্ত্বেও আমার যেন মনে হল, এই মহিলাকে আগেও কোথাও আমি দেখেছি। এই দৃষ্টি আমার খুব পরিচিত।

পৃথিবীতে কত মানুষের সঙ্গেই না পরিচয় ঘটে! হূদয় খুঁড়ে অনুরূপ একটি অবয়বকে তুলে আনতে চাইলাম। ততক্ষণে নাচের অনুষ্ঠান শেষ। শিল্পীরাও আটচালার বাইরে গিয়ে ভিড় আর অন্ধকারের মধ্যে মিলিয়ে গেল।

আটচালা থেকে বেরিয়ে অন্ধকারের গহ্বরের দিকে একটু এগোলাম। সঙ্গী অফিসারদের মধ্যে দু-একজন পিছু পিছু আসছিলেন। হাত নেড়ে তাদের অনুসরণ করতে বারণ করে বললাম, ‘দূরে কোথাও যাচ্ছি না। এক্ষুনি আসছি।’

শুনলাম, এই আটচালায় পঞ্চায়েত মিটিংয়ে বসে। সন্ধে হয়ে যাওয়ায় চারপাশটা ইতিমধ্যেই বেশ শুনশান। একটু দূরে বেশ খানিকটা খোলা জায়গায় কয়েকটি বড়ো গাছ। ধীর পায়ে আনমনে হেঁটে যাচ্ছিলাম সেদিকে। হঠাৎই পিছনে কারও পায়ের শব্দ শুনে ঘোর ভেঙে গেল। চমকে ফিরে তাকিয়ে দেখি, আদিবাসী এক মহিলা এদিকেই হেঁটে আসছে। মনে ভাবলাম, সম্ভবত কোনও ব্যক্তিগত কারণেই, এদিকটা নিরালা বলে, এদিকেই আসছে। তাকে শুনিয়ে গলাখাঁকারি দিলাম। কিন্তু, তাতে না থমকে, মহিলা দ্রুত পায়ে হেঁটে কাছে এগিয়ে এল।

এবার রাগত গলায় বলে উঠলাম, ‘কে? কী চাই?’ আসলে ভিতরে ভিতরে একটু ভয়ও হচ্ছিল। সেটাই রাগের মধ্য দিয়ে প্রকাশ পেল।

কয়েক হাত দূরে দাঁড়িয়ে পড়ল সেই মহিলা। তারপর নীচু গলাতে বলল, ‘আমায় চিনতে লারছেন, সাহেব?’

এবার একটু সাহস পেয়ে দু-পা এগোতেই মুখটা স্পষ্ট দেখতে পেলাম। এ তো সেই নাচের মেয়েদের দলের মধ্যবয়সিনি মহিলা! নাচতে নাচতে বারবার অদ্ভুত চোখে যে আমায় দেখছিল!

আমি এবার সত্যিই অবাক হয়ে বললাম, ‘কে তুমি? ঠিক চিনতে পারলাম না তো–!’

মহিলার মুখের হাসি মিলিয়ে গেল। সন্দিগ্ধ গলায় জিজ্ঞেস করল, ‘মিথিলাকে তুমার সত্যি মনে লাই?’

এক পলকে মন চলে গেল কুড়ি-কুড়ি বছরের পার। সেই জ্যোৎস্নালোকিত, ঝুপড়ি পরিবেষ্টিত গোল নৃত্যাঙ্গন। তাতে জনাকয়েক আদিবাসী তরুণী নাচছে। তাদের কোমরে দুলকি তরঙ্গ উঠেছে। পায়ের গোছে রুপোলি চাঁদের গলিত মায়া। নর্তকীদের মধ্যে মিথিলাও ছিল, এবার মনে পড়েছে। ওর বয়স তখন কুড়ির আশেপাশে। কিন্তু তখনই যথেষ্ট বন্য শরীর। সুডৌল কায়ায় ভয়ংকর পুরুষঘাতী বাঁক। সমুদ্রের তলদেশ থেকে ফুঁসে ওঠা পাহাড়ের মতো উত্তুঙ্গ দুই বুক, নাচের ঘূর্ণিতে দুলছে। অলৌকিক ছিল সেই রাত। অবিশ্বাস্য! তখন আমিও অবিবাহিত। বান্ধবী হয়নি। এমন এক জায়গায় চাকরি সূত্রে এসে পড়েছি, যা তথাকথিত সভ্য জগৎ থেকে সবদিক দিয়ে পৃথক। টেলিফোন নেই, ডাকবিভাগের অস্তিত্বও না থাকার মতো, ইলেকট্রিক আলোর তো কোনও প্রশ্নই ওঠে না!

ফলে, নাচ হচ্ছিল খুঁটিতে বাঁধা মশালের আলোয়। কখনও কখনও মাদলের শব্দকে ছাপিয়ে, দূরের কোনও জঙ্গল থেকে ভয়াবহ বন্যপ্রাণীর চিৎকার ভেসে আসছিল।

একসময় থেমে গেল নাচ-গান। আদিবাসীরা আপ্যায়ন করতে জানে। প্রত্যেকেই দিনএনে দিন খাওয়া মানুষ, হাড় জিরজিরে, অভাবে অর্ধনগ্ন–কিন্তু আন্তরিকতায় কোনও খামতি নেই। এসডিও-বাবু তাদের মহল্লায় এসেছেন, এতেই যেন তাদের মোক্ষলাভ হয়ে গেছে।

এমনিতে সারাটা দিন কেটেছে ভীষণ ব্যস্ততায়। গ্রামের মুখিয়ার সঙ্গে একটার পর একটা স্থানীয় সমস্যার সমাধান করে, একটু ফুরসত পেয়ে দেখি, সূর্য পশ্চিমে ঢলে পড়েছে। সমস্যার সমাধানে এলাকার বাসিন্দারা খুশি হল। বোধহয়, সেইজন্যই নাচ-গানের এই আয়োজন! এরপর আবার ঢালাও খাওয়াদাওয়ারও ব্যবস্থা রেখেছে। শোওয়ার বন্দোবস্ত ফাঁকা একটি ঝুপড়িতে। খেয়েদেয়ে নিজের ক্লান্ত শরীরটাকে কোনওমতে টেনে নিয়ে গিয়ে, বিছানায় ফেলে দিলাম। গরমকাল। তাই শখ করে আনা নাইটসুটের উপরাংশটা খুলে ভাঁজ করে রেখে দিলাম পাশে।

কখন দুচোখ ঘুমে জড়িয়ে এসেছে, নিজেই জানি না। মৃদুমন্দ হাওয়া বয়ে আনছে মহুয়া-পলাশের মিষ্টি গন্ধ। ক্লান্তি ভুলিয়ে দিচ্ছে। কিন্তু এমন নিশ্চিন্ত অবকাশ বেশিক্ষণ রইল না। তন্দ্রাচ্ছন্ন অবস্থাতেই হঠাৎ মনে হল, এ ঘরে আমি একা নই, আরও কেউ আছে। আশেপাশের নিস্তব্ধতায় তার নিশ্বাসের শব্দটিও তীব্রতর হয়ে প্রবেশ করছে কানে।

বুকের ভিতরটা ছ্যাঁৎ করে উঠল। উঠে বসে চিৎকার করে বললাম, ‘কে? কে ওখানে?’ ঘরের মধ্যে থিকথিকে অন্ধকার। তার মধ্যেই একটি ছায়া নড়েচড়ে উঠে, বিছানার দিকে এগিয়ে এল ধীর পায়ে। করউজ তেলের তীব্র গন্ধ নাকে এসে ঠেকল আমার। ছায়া বলে উঠল, ‘বাবু, আমি মিথিলা!’

‘মিথিলা’, আমি সতর্ক গলায় বলে উঠি, ‘তুমি এত রাতে কী করছ এখানে? কী… ক্বী…?’

মিথিলা এগিয়ে এসে আমার পায়ের কাছে বসল। তারপর একটু থেমে থেকে বলল, ‘একজন মেয়ে রাতের বেলা একলা একজন পুরুষলোকের কাছে কেন আসে, তুমি বুঝো লাই বাবু? তুমি আমাদের গাঁয়ের অতিথ্। আমাদের মালিক। তাই, মুখিয়া আমায় বললে, মিথিলা, তুই যখন লাচ করছিলি, তখন সাহেব সবচেয়ে বেশি তুর দিকেই চোখ ঠারছিল। তুকেই সাহেবের বেশি মনে ধরেছে। সত্যি?’

অন্ধকারেও বুঝতে পারি, ঠোঁটে রহস্যময় হাসি ধরে, মিথিলা এদিকেই তাকিয়ে আছে। মেঝের উপর দাঁড়িয়ে পড়ে চিৎকার করে বলে উঠি, ‘মুখিয়ার এত সাহস? ডাকো তো তাকে–!’

মিথিলা উঠে দাঁড়িয়ে, হঠাৎ-ই আমার কাঁধে হাত রাখল। সারা শরীরে শিহরণ খেলে গেল আমার। ফিক করে হেসে, সে বলল, ‘আবার মুখিয়াকে কেন ডাকছ গো বাবু? আমি কি এতই খারাপ? এদিকে তাকাও, দ্যাখো না বাবু, কত সোন্দর আমি!’

মিথিলার আহ্বান প্রত্যাখ্যান করতে পারে, এমন মহাপুরুষ আমি নই। ওই তীব্রতার কাছে হার মানলাম। সে আমায় ঠেলে বিছানার উপর ফেলে দিল। অনুভব করলাম, তার চওড়া ভিজে ঠোঁটজোড়া আমার গলার কাছে উন্মত্ত হয়ে উঠেছে। আমি তাকে ঠেলে উঠতে চাইলাম, কিন্তু সে যেন, এখানকার জঙ্গলের কুখ্যাত মানুষখেকো লতার মতোই আমায় জড়িয়ে ধরেছে।

এভাবে কতক্ষণ ভেসেছি জানি না। তলিয়ে যেতে যেতে, কাঁধের উপর হঠাৎ-ই দুফোঁটা গরম জল এসে পড়ায়, যেন চেতনা ফিরে পেলাম। কানের কাছে অত্যন্ত নীচু গলায় কথা বলে উঠল মিথিলা।

‘বাবু, আমাকে তাড়িয়ে দিয়ো না। তাইলে, মুখিয়া আর তার লোকজন মনে করবে, আমারই কোনও খামতি আছে। আমি পুরা মেয়েমানুষ লই। কারও বউ কি রাখিতো হওয়ারও যোগ্য লই!’

ভোরে ঘুম ভাঙতে পুরো ঘটনাটা স্বপ্ন মনে হল। বেড়ার ফাঁক দিয়ে সকালের সোনালি রোদ্দুর গলে ভিতরে ঢুকে আসছে। ঘরের দরজায় এসে দাঁড়ালাম। চারদিক এখনও বেশ নিরিবিলি। তবে জঙ্গলের উপর থেকে রাতের রহস্যময়তার পর্দা সরে গেছে।

সেদিন সকালেই সদরে ফিরে এলাম। তারপর মাসখানেকের মধ্যে আমার বদলি হয়ে গেল অন্য জেলায়। সেই রাতটা বিস্মৃতির ধুলোর নীচে চাপা পড়ে রইল।

তারপর আজ।

সেই রাত আর কুড়ি বছর পরের এই রাত। জায়গাটা একই। মিথিলাও সেই মিথিলা, মাত্র কয়েক হাত দূরে সংকোচ নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। হাত বাড়ালেই আমি ওকে ছুঁতে পারি, ও এতটাই কাছে। স্তিমিত গলায় বললাম, ‘হ্যাঁ মিথিলা, আমার সব কথা মনে পড়ে গেছে। কেমন আছ? কী করছ আজকাল?’

মিথিলা ম্লান হেসে বলল, ‘আমি ভালো আছি, বাবু। আদিবাসীরা যেভাবে ভালো থাকে! বুড়ি হয়ে গেছি, লয়? এখন আর কেউ কোনও কাজকম্ম দেয় না।’

তারপরই কী মনে পড়ে যেতে, সরাসরি মুখের দিকে তাকিয়ে, আন্তরিক গলায় প্রশ্ন করল, ‘তুমি কেমন আছ বাবু? কত্ত বছর বাদে দেখা হল! আমি তো তুমায় একবার দেখেই চিনে ফেলেছি। মু-কে তুমি ভুলে গেছিলে, লয়?’

তার চোখদুটো অন্ধকারেও জ্বলছে। সে যেন আমার অন্তরের তলদেশ পর্যন্ত দেখে নিচ্ছে।

বললাম, ‘মিথিলা, আমি অনেক দূরে চলে গেছিলাম। এর মধ্যে আমার বিয়ে হয়েছে। দু-দুটো সন্তান হয়েছে। এতদিন পর তোমাকে দেখেও খুব ভালো লাগছে মিথিলা–!’

মিথিলা চোখ নামিয়ে মাটির দিকে দেখছিল। চারদিক নিরালা। হঠাৎ মনে হল, আমাকে খুঁজতে খুঁজতে অফিসাররা যদি এদিকেই আসে, তাহলে ভুল বুঝতে পারে। মিথিলাকে তাই বললাম, ‘চলো, ফিরে যাই। সকলে আমার জন্য অপেক্ষা করছে।’

আমি আটচালার দিকে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই, সে আমার হাত চেপে ধরল। চোখে বিরক্তি নিয়ে তাকালাম। মিথিলা নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে। আমি ঘুরে দাঁড়াতে, ও খুব বিব্রত মুখে বলল, ‘একটা কুথা বলার ছিল বাবু। বুঝতে লারছি, কী করে বলি সে কথাটো তুমায়!’

প্রশ্নভরা চোখে ওর মুখের দিকে স্থিরদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম। টাকাপয়সা চাইবে নাকি? অন্ধকারে ওর মুখের ভাবও স্পষ্ট অনুভব করা যাচ্ছে না। মিথিলা বলল, ‘বাবু, আমার আর তুমার মেয়ে, পুতলি, আটচালাতেই ছিল। দেখেছ কি তাকে?’

বলে কী? আমার গলা থেকে সহসা যেন কোনও আওয়াজ বের হল না। পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যাচ্ছে, মনে হল। কপালে ঘাম দেখা দিল। সেই সূচীভেদ্য অন্ধকারে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। মেয়েটা চায় কী? কী অভিসন্ধি? দুর্বল হলে চলবে না। গলায় যতদূর সম্ভব তীব্রতা এনে বললাম, ‘তোমার আর আমার মেয়ে? বাজে কথা বলার জায়গা পাওনি? কীভাবে হবে? কীভাবে, কীভাবে? আমাকে ঠকানোর চেষ্টা করো না, বুঝলে! আমাকে খাটো করার চেষ্টা করে লাভ হবে না–!’

নিজের কথা নিজের কানেই অসংলগ্ন শোনাল। কপাল থেকে ঘামের বিন্দুগুলি মুছে নিলাম।

মিথিলার গলার স্বর আগের মতোই শান্ত। বলল, ‘চিল্লিয়ো না। সবাই তো জেনে লিবে তাইলে।… বাবু, ওই রাতের পর আমি তো তুমারই হয়ে গেছিলাম। মন থেকে আজও আমি তুমারই। আমারও শাদি-বেহা হয়ে গেছে। আরও সন্তান হয়্যেছে। ওই পুতলি কিন্তু তুমারই বাবু। তুমার এবং আমার!’

আমি সন্দিগ্ধ গলায় শেষ অস্ত্রটা ছুড়লাম, ‘যখন তোমার বিয়ে হয়ে গেছে বলছ, তখন এ ব্যাপারে এতখানি নিশ্চিতই বা হচ্ছ কী করে?’

‘সেই রাতের সাত মাস পরে আমার বেহা হয়ে যায়। ওই সময়ের মধ্যে আর-কোনও মরদ আমায় ছোঁয়নি। ওই রাতের ঘটনার পরে যেদিন বুঝতে পারলাম, পেটে শত্তুর এসেচে, আমাদের রীতি অনুযায়ী মুখিয়া আমার বেহা ঠিক করল। আর তার ঠিক দু-মাসের মাথায় পুতলি জন্মাল। এবার তাইলে বলো?’ সে হেসে আমার দিকে তাকায়।

‘তাহলে, এতদিন এ কথা আমায় জানাওনি কেন মিথিলা? বুঝতে পারার পরপরই যদি জানাতে আমায়…’, আমি অসহায়ের মতো আমতা-আমতা করি, ‘আর, যদি তখন না জানিয়ে থাকো, তাহলে আজ জানানোর কী দরকার ছিল?’

মিথিলা বলল, ‘পুতলি আদিবাসীদের মধ্যেই মানুষ হয়েছে। আমার মরদ ওকে নিজের বাচ্চার মতোই দেখে। তুমি কুথায় থাকো, সে আমি কী করে জানব, বাবু? হাঁ, মুখিয়া বলতে পারত। কিন্তু, উহাকে আমি কিছু বলি লাই। তুমাকে এত বছর পরে দেখ্যে কথাটো মনে পড়্যে গেল। পুতলিকে চিনতে লারছ বাবু? উই যে, যে আমার সঙ্গে লাচছিল!’

আমার মনে পড়ে গেল। কমবয়েসি মেয়েটিকে দেখে অবাক হয়েছিলাম বটে! আদিবাসীদের মধ্যে অমন চোখা নাক-চোখ তো দেখা যায় না! আমার তখনই বোঝা উচিত ছিল!

কিন্তু আমার কুশলী শহুরে মনটা কথা বলে উঠল, ‘ও? ওকে তো পুরো আদিবাসী মনে হয়! দূর–!’

এবার যেন একটু রেগে যায় মিথিলা। বলে, ‘ও আমার বুকের দুধ খেয়েছে বাবু। আদিবাসী মায়ের বুকের দুধ গো! আদিবাসীদের মধ্যে ও বড়ো হয়্যেছে। তুমি উকে আদিবাসী বললে, এতে আমি খুব খুশি হয়্যেছি, বাবু!’

আমার মনের মধ্যে ঝড় বইছে। শহরে আমার বউ, ছেলেমেয়ে যদি এ কথা জানতে পারে কী হবে? যদি অফিসাররা জেনে যায়, তাহলেই বা কী হবে? যদি সরকারের কাছে খবর যায়? আমি আর ভাবতে পারছিলাম না। একটা বড়ো গাছের গুঁড়িতে ঠেস দিয়ে বসে পড়ে ক্লান্ত গলায় বললাম, ‘তোমার এ কথা যদিও কেউ মানতে চাইবে না, তবু তর্কের খাতিরে যদি বিশ্বাস করিও, তাহলে একটা প্রশ্নের উত্তর দাও। কী চাও তুমি?’

‘কী চাই?’ মিথিলা ব্যঙ্গ করে হাসে, ‘তুমাকে দেখ্যে পুরোনো কুথাটো মনে পড়্যে গেল। পুতলির বাবা কে, এ কথাটো কেউ জানে না! এক রাত তোমায় ভালোবেসেছিলাম, সাহেব। সেই ভালোবাসার উপহার পুতলি। ও তুমার উপহার। মনে হল, এ কুথাটো জানা তোমার অধিকার বটে!’

মুখে হাত চাপা দিয়ে আমি ডুকরে উঠি, ‘কত বড়ো ভুল! আমাকে সকলে সম্মান করে। আমি বিবাহিত। সন্তানের বাবা। বড়ো চাকরি করি। আমি কোথাও মুখ দেখাতে পারব না–!’

মিথিলা আমার পাশে সরে এসে বলল, ‘ছি বাবু, তুমি আমাকে এতটা খারাপ ভাবলে?’

আমি হঠাৎ আবেগে, মিথিলার হাতদুটো চেপে ধরে বললাম, ‘না, না, কথাটা এখানেই কি শেষ হয়ে যায় মিথিলা? পুতলি যখন আমারই মেয়ে, ওর প্রতি কিছু কর্তব্য তো আমারও আছে! সব জেনে আমিই বা কী করে চুপ করে থাকি? ওকে এখানেই বা ফেলে রেখে চলে যাই কোন প্রাণে!’

‘তুমি কিছু করব্যে বলে তো এ কুথা আমি জানাইনি, বাবু,’ মিথিলা শান্ত গলায় বলে, ‘বিশ বছর ধরে, উকে আমি এই শিমূল-পলাশের জঙ্গলে পালছি। উ গিয়ে তুমার চকচকে বাংলোয় কেমনে রইবে গো? উ তো পাগল হয়্যে যাবে। উ আদিবাসী। উর মা আদিবাসী। উ তাই এখানেই থাকবে। মায়ের কাছে। এই সমাজেই উর বেহা হবে। তুমি উকে লিয়ে যেতে পারবে লাই।’

মিথিলার গলায় হঠাৎ কাঠিন্য ভর করে। আটচালার দিকে যাওয়ার জন্য পা বাড়ায়। কয়েক পা এগিয়ে হঠাৎ-ই ঘুরে দাঁড়িয়ে বলে, ‘তুমাকে কিছু না জানানোই ভালো ছিল, বাবু!’

ছুটে গিয়ে আমি মিথিলার হাত ধরলাম। অনুনয়ের সুরে বললাম, ‘রাগ কোরো না। তোমার মেয়ে তোমারই থাকবে। কোনওদিন ওর ‘বাবা’ পরিচয়ে ওর কাছে যাব না। আমি জানি, তাহলেই তোমাদের জীবনে ঝড় উঠবে। শুধু মাঝেমধ্যে এসে পুতলিকে একবার দেখে যাব। তুমি অনুমতি দেবে তো?’

মিথিলা আশ্বস্ত হয়ে মাথা নাড়ে।

‘আর-একটা কথা। পুতলি আমার মেয়ে। আমার ইচ্ছে ও স্কুলে পড়বে। বড়ো মানুষ হবে। তোমাদের গ্রামে মাস্টারমশাই তো আসেন! তুমি ওকে নিয়ম করে তাঁর কাছে নিয়ে যেয়ো– আমি খরচা…!’

আমায় থামিয়ে দিতেই যেন মিথিলা আকর্ণ হাসল। তারপর বলল, ‘তুমি সোজা পথে চলে যাও বাবু। জঙ্গলের ভিতর দিয়ে আর একটা চোরা রাস্তা আছে। আমি সেইটো দিয়ে আসছি।’

 

স্বপ্ন ছোঁয়ার গল্প

বাথরুম থেকে মাঝেমাঝেই স্মিতার চুড়ির টুং টাং শব্দ আসছে। আর নাকে এসে লাগছে সুন্দর একটা সাবানের গন্ধ। অস্বচ্ছলতার মধ্যেও, এই একটা বিলাস স্মিতা ত্যাগ করতে পারেনি। স্নানের জন্য একটা সুগন্ধী সাবান সে ব্যবহার করে। আজ আর সকালে বেরোয়নি স্মিতা। নিশ্চয়ই অন্য কোনও কাজ আছে। তাই হয়তো একটু সময় নিয়ে স্নান করছে। ভিজে চুল পিঠের ওপর ছড়িয়ে একটা সুন্দর সুগন্ধের ঢেউ তুলে বাথরুম থেকে ঘরের দিকে গেল স্মিতা। একটুক্ষণ মুগ্ধ চোখে তাকিয়েই অনিকেতের মনে হল, খাবারটা বেড়ে দেওয়া দরকার। হয়তো খেয়েই বেরোবে স্মিতা। দুবেলা পরিশ্রম করে মুখ বুজে। এক এক সময় নিজেকে বড়ো অপরাধী মনে হয় অনিকেতের।

খাবার বলতে কেবল ভাত, আর আলুভাতে। দুপুরের খাবারের তালিকায় কোনও সবজি নেই। মাসের শেষ। সংসারখরচেও তাই টান পড়েছে। অনিকেত একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে খেতে বসল। ‘তুমিও এসো, একসঙ্গে খাই’– খুব আন্তরিকভাবেই সে ডাকল স্মিতাকে। স্মিতা তার স্ত্রী। তার সন্তানের মা। একটা স্কুলে পড়ায়।

বাইরে থেকে দেখলে অনিকেতকে খুব সংসারী বলে মনে না হলেও দু’জন প্রাপ্তবয়স্ক নারী-পুরুষের যথাযথভাবে পেট ভরানোর মতো খাবারের অভাব প্রতিদিনই সে টের পায়। স্মিতা সংসারের এই বেহাল দশা লুকোনোর চেষ্টা করে। কিন্তু অনিকেত তো লেখক, তার অতিসংবেদি মনের আয়নায় ধরা পড়ে যায় সব কিছুই। সে খাবার তুলতে পারছিল না মুখে। কেন এমন হয় যে, সম্ভাবনাময় লেখকেরা কখনওই কেবল লিখে জীবনধারণ করতে পারেন না? অনিকেত খুব জনপ্রিয় লেখক নয়। তার লেখার আবেদন এক বিশেষ শ্রেণির পাঠককুলের কাছে। সাধারণ পাঠক পাঠিকাদের কাছে সে ‘সিরিয়াস’ লেখক। বারো বছরেরও বেশি সময়ের লেখকজীবনে বিভিন্ন পত্রিকায় তার কমবেশি ৫০টি গল্প প্রকাশিত হয়েছে। যদিও না-ছাপা লেখার সংখ্যা অনেক বেশি।

এ যাবৎ মাত্র একটি গল্পসংগ্রহ প্রকাশিত হয়েছে অনিকেতের। প্রকাশক খুব নামি নয়। প্রত্যেকটি গল্পে অনিকেত ডুব দিয়েছে চরিত্রের মানসিকতার গভীরে। প্রত্যেকটি গল্পের শেষভাগে থাকে টানটান উত্তেজনা। যখনই কোনও পত্রিকায় তার লেখা ছাপা হয়, অনিকেতের মানসিক জোর সেই সময়ের জন্য অনেকখানি বেড়ে যায়। পাশাপাশি যে সাম্মানিক পাওয়া যায়, তা যত সামান্যই হোক, তা দিয়ে সংসারের কিছু সুরাহা হয়। কিন্তু এরকম তো সবসময় হয় না!

‘বই ভালো বিক্রি হচ্ছে না দাদা’, প্রকাশকের মুখোমুখি হলেই তার এক কথা। কয়েকশোবার সে অনিকেতকে একথাটা বলেছে। অতএব, সে বেচারা আর কী করে রয়্যালটি দেয়। পত্রপত্রিকাগুলোও আজকাল ভালোর কদর না করে সাধারণ মানুষ যা চায় তাই ছাপতে উৎসাহী। ফলে সার্বিকভাবে সাহিত্যের গুণগত মানও কমে যাচ্ছে। ফলে প্রত্যেক মাসেই মূল পান্ডুলিপিসমেত ‘দুঃখিত, আপনার লেখাটি মনোনীত করা গেল না’ লেখা চিরকুট পাওয়ার পরও কোনও মনোজ্ঞ পাঠকের প্রশংসা অনিকেতকে নতুন লেখার উৎসাহ যুগিয়ে দেয়।

এই লেখালেখির প্রবণতাই আগের তিনটি চাকরি খোয়ানোর মূল কারণ। শেষ চাকরিটা যাওয়া ইস্তক অনিকেত খুবই বিমর্ষ হয়ে পড়েছে। সে একজন বিবাহিত পুরুষ। বাড়িতে তার যুবতি স্ত্রী রয়েছে। রয়েছে ছোট্টো একটি শিশুসন্তান। কী করে এই সংসার চালাবে সে?

অনিকেতের মনে হয়, গৃহস্থ মানুষের স্বপ্ন দেখাই উচিত নয়। সে মাঝেমধ্যেই ভাবে, শেষ চাকরিটির মালিকের কাছে গিয়ে আবার হারানো চাকরিটি ফিরে পাওয়ার জন্য তদ্বির করে আসবে। যে-কোনও উপায়ে তাকে একটি চাকরি পেতেই হবে।

স্মিতা কিন্তু কোনওমতেই মানতে রাজি হল না সে কথা। সে স্পষ্ট বলল, ‘না অনিকেত। তুমি একজন সৃষ্টিশীল মানুষ । কেরানি নও। আমার তো একটা চাকরি আছে। কোনওরকমে দুমুঠো ডালভাত আমার টাকায় জুটে যাবে। তুমি চিন্তা কোরো না। আমি জানি, তুমি একজন সর্বসময়ের লেখক হতে চাও। তাই হও। আমি তোমার পাশে আছি। দেখবে একদিন তোমার লেখার জন্য অনেক সম্মান পাবে তুমি। আর, তা যদি না-ও পাও, একথাটা তো ঠিক, এই কাজেই তুমি সবচেয়ে সুখী। সেটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।’

অনিকেতের দু’চোখ জলে ভিজে এল। কোনও কথা না বলে নীরবে সে শুধু তার দু’হাত স্মিতার দু’কাঁধে রাখল। আর কীভাবেই বা সে তার কৃতজ্ঞতা জানাতে পারে? স্মিতার স্যাক্রিফাইস ছাড়া তার যাবতীয় প্রচেষ্টা জলে যেত। তার প্রতিভার উপর স্মিতার আস্থা তাকে সাফল্যের জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ করে তুলল।

অনিকেতের লেখার ঘর বাড়ির সামনের দিকের ছোটো ঘরটা। সে লেখার টেবিলে বসতে গিয়ে দেখল দরজার কাছে মেঝের উপর ডাকবিভাগের দুটো খাম পড়ে আছে। ডাকপিওন এসে সম্ভবত জানলা দিয়ে ফেলে গেছে। অনিকেত খামদুটি হাতে নিল। সে আগে লম্বা খামটি নিয়েই পড়ল। খুব নামি পত্রিকা থেকে এসেছে।  এক মাস আগে এই ছোটোগল্পটা লিখে পাঠিয়েছিল অনিকেত। সেটাই ফেরত এসেছে, সঙ্গে ‘দুঃখিত, মনোনীত হল না’ লেখা চিরকুট। আলগোছে খামসহ পাণ্ডুলিপিটাকে টেবিলের উপর ফেলে দিল অনিকেত। দ্বিতীয় খামটা দেখে সে খুব খুশি হয়ে উঠল। খামের উপরে বাঁদিকে পত্রিকার নাম লেখা। মাস দুই আগে এই পত্রিকায় একটা অণু-উপন্যাস পাঠিয়েছিল সে। সাধারণ আকৃতির হালকা খামে সব সময় ভালো খবরই আসে।

তবু একটু উৎকণ্ঠা নিয়ে সে খামের মুখটা ছিঁড়ল। এবং দেখল, তার ভাবনাটাই ঠিক। লেখাটা মনোনীত হয়েছে। সম্পাদক অণু-উপন্যাসটি সম্পর্কে চিরকুটে লিখেছেন, লেখাটি ‘সুন্দর আর

সংবেদনশীল’ হয়েছে। সম্পাদকের মন্তব্য উদ্বেল করে তুলল তাকে। সাহিত্যের পাঠক-সমালোচক মহলে পত্রিকাটির গুরুত্ব রয়েছে। খুবই শিল্পমনস্ক ত্রৈমাসিক সাহিত্য-পত্রিকা হিসাবে যথেষ্ট নাম রয়েছে। আর সেই পত্রিকাই কিনা তার লেখাকে বলছে সুন্দর আর সংবেদনশীল!

পত্রিকাটির সাম্প্রতিকতম সংখ্যাটি দশদিনও হয়নি প্রকাশিত হয়েছে। এর একটি কপি সে কিনেওছে। যদি ধরেও নেওয়া হয় তার অণু-উপন্যাসটি আগামী সংখ্যাতেই প্রকাশিত হবে, তা হলেও এখনও তিন মাস দেরি। একটু দমে গেল অনিকেত। সাফল্যের স্বাদ পেতে তিন মাস সময়টা এমন কিছু বেশি নয়। কিছুক্ষণের জন্য চোখ বুজে বসে রইল সে। সাফল্যের স্বাদটা উপভোগ করতে চাইল। এরকম নামি পত্রিকায় আর কয়েকটা লেখা ছাপা হলেই আধুনিক বাংলা সাহিত্যে তার একটা স্থায়ী জায়গা তৈরি হতে পারে। লেখাটি ছাপা হবে তিন মাস পরে। সাম্মানিক পাওয়া যাবে লেখা প্রকাশিত হওয়ার পর। সে কি একবার সম্পাদকের সঙ্গে দেখা করে কিছু অগ্রিম চাইবে? পেয়ে গেলে আজই পরিবারসমেত রাতে ভালোমন্দ কিছু খাওয়া যেতে পারে। পেটভরে খেয়ে একবার তৃপ্তির চোখে তাকাবে স্মিতা, এই তার সুখ। এই সুখের প্রতি যে খুব লোভ অনিকেতের!

পরমুহূর্তেই তার মনে হল, অগ্রিম চাওয়াটা কি উচিত কাজ হবে? একজন লেখকের কাছে আত্মমর্যাদা অনেক মূল্যবান। কী করে অনিকেত সেই আত্মসম্মানকে বিসর্জন দেবে? একজন লেখক, যিনি ‘সুন্দর এবং সংবেদনশীল’ লেখালেখি করেন, তার কি এরকম ব্যবহার করা সংগত? স্মিতাই বা কী ভাববে?

‘অনিকেত,’ স্মিতা ডাকল। পরিপাটি সুতির শাড়ি পরে আছে। সুন্দর করে চুল আঁচড়ে ক্লিপে আটকেছে চুলের ঢাল। ডান কাঁধে হ্যান্ডব্যাগ। অন্য হাতে অনিকেত-স্মিতার সন্তান। ‘বেরোচ্ছি, বুঝলে? আজ একবার ডিআই অফিসে যেতে হচ্ছে। বাবানকে খাইয়ে দিয়েছি। দুপুরে ঘুম পাড়িয়ে দিয়ো। রান্নাঘরে দুধ গরম করা আছে। বিকেলে ওকে খাইয়ে দিয়ো। কেমন? আমি তাড়াতাড়িই ফেরার চেষ্টা করব।’

‘আমি সব করে রাখব। তুমি কোনও চিন্তা কোরো না।’

মঞ্জুরি-চিঠিটাকে খামে ঢুকিয়ে রেখে অনিকেতও লিখতে বসল। সাড়ে চারটে নাগাদ হঠাৎ-ই তার পুরোনো সহকর্মী হরি এসে হাজির। অনিকেতের শেষ চাকরির জায়গায় গৌরহরি ছিল স্টেনোগ্রাফার।

‘কেমন আছো অনিকেত? আশা করি ভীষণ সৃষ্টিশীল হয়ে আছো।’ হাসতে হাসতে বলল হরি।

‘আরে, সেরকম কিছু না। ভেতরে এসো।’ ততোধিক আন্তরিকতা নিয়ে হরিকে আমন্ত্রণ জানাল সে।

‘কিন্তু, একটা কথা মানতেই হবে ভাই, তুমি দুর্দান্ত লেখো। সেদিন তোমার একটা বই পড়ছিলাম। প্রত্যেকটা গল্পই এত উচ্চমানের যে ভাবা যায় না!’

প্রশংসায় অনিকেতের মুখচোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। সে জানত, হরি মন-রাখা কথা বলার লোক নয়। সে সলজ্জ হয়ে বলল ‘থ্যাংক ইউ হরি। আগে তুমি বসো।’

অনিকেত খানিকক্ষণ কথা বলার পর উঠে চা করল। হরি অনেকদিন পরে এসেছে। ইচ্ছে হচ্ছিল ওকে কফি খাওয়ানোর। কিন্তু কফির চেয়ে চায়ে কম দুধ দিতে হয়। সুতরাং সে চা-ই করল । ইতিমধ্যে ছেলেও উঠে পড়েছে। কিছুক্ষণ ছেলের সঙ্গে খেলল সে। খানিকক্ষণ পরে হরি আবার বলল, ‘এবার আর একটা বই প্রকাশ করো অনিকেত।’

‘ইচ্ছে হয়। যতই বিভিন্ন ম্যাগাজিনে একটা-দুটো করে লেখা বের হোক, বই হচ্ছে এমন একটা জিনিস যা আসলে একজন লেখকের আস্ত পরিচয় বহন করে। কিন্তু, আমার বই বের করবে কে, হরি? আমি সেই অর্থে জনপ্রিয় লেখক নই। আমার পাঠক সীমিত। আমার পাবলিশার তো বলে থাকে, আমার বই নাকি বিক্রিই হয় না।’

‘তাই নাকি? তোমাকে এই কথা বলেছে? বিক্রিই যদি না হবে তাহলে তোমার বই-এর দ্বিতীয় সংস্করণ বের হল কীভাবে?’

‘কী বলছ?’ অনিকেত উত্তেজনায় ঢোঁক গিলে বলল, ‘দ্বিতীয় সংস্করণ?’

‘আসলে আমি যে-বইটা পড়েছিলাম সেটা দ্বিতীয় সংস্করণ।’

‘বলছ কী? তুমি ঠিক দেখেছিলে?’

‘আলবাত।’

‘লোকটা তো পাকা জালিয়াত দেখছি! প্রত্যেকবার যখন রয়্যালটির জন্য গেছি, লোকটা মুখের উপর বলেছে, ‘আপনার বই বিক্রি হয় না’। একবার মাত্র রয়্যালটি দিয়েছে। প্রথম যখন বইটা বের হল, অগ্রিম হিসাবে দু’হাজার টাকা দিয়েছিল। সেও তিন বছর আগে। বলেছিল, বই বিক্রি হলে আস্তে আস্তে বাকি টাকা পাওয়া যাবে।’

‘ভালোমানুষকে কীভাবে ঠকতে হয় দেখেছ? একটা পুরো সংস্করণের জন্য কত পাওনা হয় তোমার?’

‘পনেরো হাজারের মতো।’

‘আর, এই সামান্য টাকার জন্য লোকটা তোমায় ঠকাল! তোমার বই-এর ভালো কাটতি হওয়া সত্ত্বেও!’

সন্ধে নাগাদ চলে গেল হরি। তার মুখ থেকে দ্বিতীয় সংস্করণ বের হওয়ার কথাটা জানা ইস্তক খুবই অশান্ত হয়ে ছিল অনিকেতের মনটা। স্মিতা ফিরতেই সে পুরো ঘটনাটা বিবৃত করল। বলল, ‘কাল বদমাশ লোকটার কলার চেপে ধরে আমি পুরো পাওনা বুঝে নেব।’

কলেজ স্ট্রিটের এক সরু অন্ধকার গলির মধ্যে তার বই-এর দোকানে নিশ্চিন্তে বসে ছিল বিপ্লব দত্ত। দোকানে কোনও দ্বিতীয় ব্যক্তি নেই। দূর থেকে অনিকেতকে আসতে দেখেই জোড়হাত করে উঠে দাঁড়াল সে। চোখেমুখে শ্রদ্ধা, আন্তরিকতা, উৎসাহের ভঙ্গি মিশিয়ে বলল, ‘আসুন, আসুন অনিকেতবাবু। ভীষণ খুশি হয়েছি, আপনি এসেছেন। বসুন। বলুন, চা না কফি।’ তেতো গলায় বলল অনিকেত, ‘বিপ্লব, আমি তোমার আতিথেয়তা পেতে আসিনি। আমি কাজে এসেছি।’

‘ওঃ কাজ! আপনিও স্যার এমন বলেন–।’ দেঁতো হাসি হেসে বলল বিপ্লব। অনিকেত তার আপাদমস্তক ভালো করে দেখে নিল। চল্লিশের এপাশেই বয়স হবে। উজ্জ্বল সাদা পাজামা আর পাঞ্জাবিতে খুবই স্মার্ট দেখাচ্ছে। নিষ্পাপ মুখচোখ বজায় রেখে একটা লম্বা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বিপ্লব বলল, ‘আপনি একজন এরকম উঁচুমানের লেখক, আপনিও কিনা সাধারণ লেখকদের মতো বিজনেসের কথা বলেন? মনে বড়ো ব্যথা দিলেন–।’

‘রয়্যালটি চাইছেন? কীসের রয়্যালটি স্যার? কতবার আমি আপনাকে বলব, আপনার বই একেবারেই…’

‘বিক্রি হয় না, তাই তো? বেশ, সেইজন্যে বুঝি বইটার দ্বিতীয় সংস্করণ ছাপাতে হল?’

‘দ্বি-দ্বিতীয় সংস্করণ?’ হাসার চেষ্টা করে বিপ্লব বলল, ‘এইসব গল্প কে শুনিয়েছে আপনাকে বলুন তো?’ কোনও কথা না বলে অনিকেত উঠে দেয়ালের এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্ত পর্যন্ত টানা বই-এর র‍্যাকগুলির দিকে এগোল। র‍্যাকের একধারে তার বইটির অসংখ্য কপি রাখা রয়েছে। সুন্দর সোনালি হরফে বইটির শিরোনাম ও তার নাম সে দেখতে পেল বাঁধাই-এর ধার বরাবর। প্রত্যেকবার যখন এই অফিসে বিপ্লবকে সে রয়্যালটির কথা বলতে এসেছে, এই তাকগুলিকে দেখিয়েই বিপ্লব বলেছে, ‘দেখেছেন তো, বইগুলি যেমন ছিল তেমনভাবেই রয়েছে। বিক্রিই হয় না। যদি বিক্রিই হতো, তাহলে কি আপনাকে রয়্যালটি দিতাম না, বলুন! অনিকেত কোনওদিনও তার কথায় অবিশ্বাস করে বইগুলো হাতে তুলে দেখেনি। নতমুখে বের হয়ে এসেছে। কী ভুলই যে করেছে! আজ আর সেই এক ভুলের পুনরাবৃত্তি ঘটাবে না সে। সে দ্রুত পায়ে র‍্যাকের সামনে এসে দাঁড়াল। একটি কপি তুলে প্রচ্ছদ উলটে দ্বিতীয় পাতায় আসতেই মুদ্রণ সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য চোখে পড়ল। হরি ঠিকই বলেছিল, অনিকেতও দেখল, লেখা আছে, ‘দ্বিতীয় সংস্করণ। ফেব্রুয়ারি ২০১৫’। বিপ্লবের টেবিলের উপর সশব্দে বইটির ওই পাতাটি খোলা অবস্থায় রাখল অনিকেত।

‘এর মানে কী বিপ্লব?’ বলতে গিয়ে গলা কেঁপে গেল তার।

‘স্যার, আমায় ভুল বুঝবেন না…আপনি জানেন না, কী ভীষণ আর্থিক দুরবস্থার মধ্যে দিয়ে যেতে হচ্ছে আমাকে।’ বিপ্লবের মুখ ভয়ে বিবর্ণ হয়ে গিয়েছিল। তা সত্ত্বেও ক্রমাগত কাহিনির জাল বুনে যাচ্ছিল সে। অনিকেত সেদিকে দৃষ্টি না দিয়ে সাফ বলল, ‘তোমাকে দেখে তা মনে হয় না। এই জায়গাটারও তো যথেষ্ট উন্নতি হয়েছে। শেষবার যখন এখানে এসেছিলাম, এটা ছিল একটা বই-এর দোকান। এখন তো দিব্যি প্রকাশনা সংস্থার মতো মনে হয়।’

বিপ্লব বলল, ‘না স্যার। সেসব কিছু হয়নি। বিশ্বাস করুন। আমার সত্যি অনেক আর্থিক দায়দায়িত্ব রয়েছে।’

‘আরে সে তো জানি! আমাকে আমার পাওনাটুকু মিটিয়ে দেওয়ার দায়িত্বই শুধু তোমার নেই। প্রথম সংস্করণের সবক’টি কপি বিক্রি হয়ে যাওয়ার দরুন আমার পাওনা হয় পনেরো হাজার টাকা। তুমি আমাকে দু’হাজার টাকা অগ্রিম দিয়েছিলে। সুতরাং এখন তোমায় দিতে হবে পনেরো হাজার মাইনাস দু’হাজার… এক্ষুনি আমার টাকাটা আমি চাই।’

‘স্যার, আমি ধারের টাকায় ব্যাবসা চালাচ্ছি। শুধুমাত্র এই আশায় যে, আমার বইগুলো ভালো ব্যাবসা করবে। সব লেখকরাই তো নামকরা। আর আপনি সকলের মধ্যে সেরা…’

‘আমি ওসব অনেক শুনেছি বিপ্লব। আমার টাকা…।’

‘স্যার, একটা কথা বোঝার চেষ্টা করুন। বই বাজারে কাটুক বা না কাটুক, কম্পোজিটর, প্রুফ রিডার, শিল্পী, ছাপাখানা, বাঁধাইওলা, পরিবেশক—ওদের সকলকে আমায় টাকা দিতে হয়।’

‘ওদের কেউ বিনা টাকায় কাজ করবে না, তাই না?’

‘ঠিক। ওরা কি ছেড়ে দেবে বলুন?’

‘অর্থাৎ, সবার সব পাওনা তোমায় মিটিয়ে দিতে হয়, শুধু লেখকদেরই না দিলেও চলে।’

‘স্যার, আমায় শুধু একটু সময় দিন। আমার সময়টা ফিরুক। এই মুহূর্তে আমার কাঁধে পরিবারের অনেক দায়দায়িত্ব রয়েছে। আমার বোনের স্বামী হঠাৎ মারা গেল…।’

‘তোমার অর্নগল মিথ্যে বলা আমায় ক্লান্ত করে বিপ্লব।’ অনিকেত দেখল, মিথ্যে ধরা পড়ে যাওয়ায় সারা শরীর ঘামে ভিজে গেছে বিপ্লবের। সে বলল, ‘আমি তো আপনার শত্রু নই। আমরা তো বন্ধু। এখন একটু টানাটানির মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি। দেখি, এই মুহূর্তে কতটা দেওয়া যায়…। আমি আপনাকে ইতিমধ্যে দু’হাজার দিয়েছি। এখন আরও হাজার দিচ্ছি। তাহলেই তিন হাজার হয়ে গেল। কী…?’ উৎসুক চোখে সে তাকাল অনিকেতের দিকে।

‘আমি দান-খয়রাত চাইছি না বিপ্লব। আমার পাওনা বুঝে নিতে এসেছি। চলি–।’ অনিকেত উঠে দাঁড়ায় ও চলে যাওয়ার জন্য উদ্যত হয়।

‘আরে, না না, যাবেন না। আমি না হয় আরও এক হাজার টাকা দিচ্ছি। বাকিটা, সত্যি বলছি, আস্তে আস্তে দিয়ে দেব।’

অনিকেত চলে যেতে গিয়েও দাঁড়াল। এখন হাতে দু’হাজার টাকা মোটেও কম টাকা নয়। বিশেষ করে এই সময়ে। পেলে সংসার নিয়ে ব্যাতিব্যস্ত স্মিতা অন্তত কয়েকদিনের জন্য হাঁফ ছাড়বে। কিন্তু বিপ্লব বাকি টাকাটা দেবে তো?

‘ঠিক আছে দাও দু’হাজার টাকা। এক মাসের মধ্যে বাকি টাকাটা কিন্তু দিতে হবে।’

‘নিশ্চয়ই স্যার, নিশ্চয়ই। তবে আমার অবস্থা…’

‘আমি আপনাকে শ্রদ্ধা করি স্যার। আপনি একজন আপাদমস্তক ভদ্রলোক। আপনার লেখারও আমি একজন ভক্ত। আসলে,’ চশমার উপর দিয়ে অনিকেতকে দেখে নিয়ে সে বলল, ‘আপনি যদি রাজি থাকেন, তাহলে আপনার আর একটা বই আমায় দিন। আর একটা গল্পসংগ্রহ।’

অনিকেত একদৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, ‘মানে?’

‘মানে, বলতে চাইছি, পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে এমন গল্প কি আছে আপনার কাছে। অপ্রকাশিত গল্প হলেও চলবে।’

‘বই বের করার টাকা কোথায় পাবে?’

‘ধার করব স্যার। এভাবেই তো করি। ঝুঁকি হলেও এবার আমি অনেকটা নিশ্চিত কারণ, আপনি খুব ভালো লেখেন। লোকেও আপনার লেখা নিতে শুরু করেছে। আপনার বই ভালো কাটলে আমার অন্য বইগুলোও পাঠকরা নেবে। আমি একটু সুখের মুখ দেখব স্যার। তখন আপনার সব পাওনাগণ্ডা মিটিয়ে দেব। যতটা ভাবছেন, ততটা অসৎ লোক আমি নই।’

অনিকেতের হূৎপিণ্ডের গতি বেড়ে গেল। এক আশ্চর্য কিশোরসুলভ উত্তেজনায় বড়ো বড়ো হয়ে গেল তার চোখদুটো। আর একটি বই! সে যেন বিশ্বাস করতে পারছিল না। ‘কতগুলো গল্প চাই তোমার বিপ্লব?’ বলতে গিয়ে গলা কেঁপে গেল তার।

বিপ্লব মৃদু হাসল। ‘কুড়িটার মতো গল্প দিতে পারবেন?’

‘কুড়িটার বেশি দিতে পারব। প্রকাশিত হয়েছে এমন গল্প, অথচ প্রথম বইতে নেই কিন্তু এবার আর পনেরো নয়, তোমাকে দিতে হবে পঁচিশ।’

অনিকেতের মনে হল, কেউ যেন তার ফুসফুসে বাড়তি কিছু তাজা অক্সিজেন ভরে দিয়েছে। পাবলিশারের অফিসের বাইরে এসে সে লাফিয়ে যখন বাসে উঠল, তার মনে হল, সে যেন নিজের মধ্যে নেই। যেন মাটিতে তার পা নেই। যেন সুখের সমুদ্রে সে ভেসে বেড়াচ্ছে। বসতে জায়গা পেল না সে, তবু একটুও অস্বস্তি হল না তার। বদলে সে ভাবতে লাগল কোন গল্পগুলো যথাযথ হবে। অনিকেতের মনের পটে ভেসে উঠতে লাগল তার প্রিয় সৃষ্টিগুলি। কোনওরকমে বাড়ি পৌঁছে স্মিতার হাতে রয়্যালটির টাকাগুলো তুলে দিতে সে খুব খুশি হয়ে উঠল।

স্মিতা বলল ‘বাঃ। তোমার প্রকাশক তাহলে তোমাকে কিছুটা রয়্যালটি দিল শেষ পর্যন্ত। বাকিটা কবে দেবে গো?’

‘জানি না… কিন্তু আমি আর ওকে এর জন্য চাপ দিতেও চাইছি না। বেচারা। ও নানারকম ব্যাপারে ফেঁসে আছে। তাছাড়া…, ‘এবার নরম আর নীচু হয়ে এল অনিকেতের গলা,’ ও আমার আর একটা বই প্রকাশ করতে চাইছে।’

‘তাই?’ রীতিমতো লাফিয়ে উঠে বলল স্মিতা।

‘আজ দিনটা বড্ডো সুন্দর। চলো স্মিতা, সেলিব্রেট করি। বাইরে কোথাও যাই। রাতের খাবারটা বাইরেই সেরে আসি। অনেকদিন পেটভরে কিছু ভালোমন্দ খাওয়া হয়নি। ছেলের জন্য আইসক্রিমও কিনে আনব।’

পরের সন্ধেয় অনিকেত গেল হরির কাছে। হরি বাড়িতেই ছিল। অনিকেত বলল, ‘হরি, কাল আমি তোমার অফিসে আসছি। ম্যানেজারবাবুকে একবার রিকোয়েস্ট করবে আবার একটা কাজের যাতে ব্যবস্থা করে দেয়? আমি ওকে বলব, আর কোনওদিন অফিসে বসে গল্প লিখব না। আমি একটু আর্থিক অনটনে আছি হরি, তুমি জানো। আমার হয়ে একটু বলবে ম্যানেজারবাবুকে?’

ঝলমলে গড়িয়াহাট, দুপাশে পশরা সাজিয়েছে দোকানদাররা। ট্রামটা এসে থামতেই এক লাফে উঠে পড়ল অনিকেত। বুকের বাঁদিকটা অনেকটা হালকা লাগছে আজ। একটা কিছু সুরাহা যেন হয়ে যাবে। যাবেই। হঠাৎই এই কৃতঘ্ন শহরটাকে যেন, অনেক বেশি উজ্জ্বল মনে হল অনিকেতের।

 

টান

আজ ক’দিন ধরেই মেজাজ বিগড়ে রয়েছে আত্রেয়ীর। ছেলেটার জন্য বড়ো দুশ্চিন্তায় পড়েছে। কী যে করবে ছেলেটাকে নিয়ে। ছেলের দিকে নজর দেবে নাকি সংসারের দিকে। সংসারে সাহায্য করার মতো তো আর দ্বিতীয় লোক নেই। বছর চরেক আগেও আত্রেয়ীদের জয়েন্ট ফ্যামিলি ছিল। ভাসুর, দেওর, জা নিয়ে একেবারে ভরাভর্তি ফ্যামিলি। তারাও তো এখন যে-যার কর্মসূত্রের কারণে শহরের বাইরে থাকে। এখন আত্রেয়ীর সংসার বলতে তারা স্বামী-স্ত্রী, বছর দশ এগারোর এক ছেলে আর শাশুড়ি। শাশুড়িও বয়সের ভারে ন্যুব্জ হয়ে পড়েছে। তবে নাতি অন্ত প্রাণ। তার সামনে নাতিকে কিছু বলা যাবে না। সেটা নিয়েই আত্রেয়ীর যত আপত্তি। সারাদিন সংসারে সব ঝক্বি-ঝামেলা মুখ বুঝে সামলাবে কিন্তু ছেলে শাসন করার সময় কেউ কিছু বললেই মাথা গরম হয়ে যায় তার। এই নিয়ে মাঝেমধ্যে লেগেও যায় শাশুড়ির সঙ্গে। একে মনসা তায় আবার ধুনোর গন্ধ। দিনচারেক হল আবার আত্রেয়ীর বড়ো ননদ সহেলী এসেছে এবাড়িতে। ব্যস পিসি আর ঠাম্মার প্রশ্রয়ে আরও মাথায় উঠেছে ছেলেটা। শুধু জেদ আর জেদ। সকাল থেকে মায়ের পিছন পিছন ঘুরছে অমূলক বায়না নিয়ে।

‘মা আমায় সিডি প্লেয়ারটা দাও না। কখন থেকে চাইছি। দাও না।’ মায়ের আঁচল ধরে টানতে থাকে বিট্টু।

‘দেব না যখন বলেছি, তখন কোনওমতেই তোকে আমি ওটা দেব না। মাথা খারাপ করিস না। যা এখান থেকে।’

‘কেন দেবে না, তুমিই তো বলেছিলে দেবে। তাহলে এখন কেন না বলছ। আমি কিছু জানি না, আমার ওটা চাই।’ জেদ বেড়ে যায় বিট্টুর।

ছেলের কথায় ঝাঁঝিয়ে ওঠে আত্রেয়ী। হ্যাঁচকা মেরে আঁচলটা ছাড়িয়ে নেয়। ‘খুব সাহস হয়েছে নারেতোর। আমি বলে দিচ্ছি এক্ষুনি এখান থেকে চলে যা, নইলে চ্যালাকাঠ ভাঙব তোর পিঠে।’ আরও জেদ চেপে যায় বিট্টুর। হাত-পা ছুড়তে ছুড়তে সামনে বসে থাকা বড়োপিসিকে অনুনয়ের সুরে বলে, ‘বড়োপিসি তুমি বলো না সিডি প্লেয়ারটা দিতে, তুমি বললে মা শুনবে।’ ছোট্ট ভাইপোর অনুরোধ উপেক্ষা করতে পারে না সহেলী। এতক্ষণ বউদিকে হাতে হাতে সাহায্য করতে গিয়ে সবই তার চোখে পড়েছে।

‘দিয়ে দাও না আত্রেয়ী, সামান্য একটা জিনিসই তো চাইছে। দ্যাখো তো কেঁদে কেঁদে ছেলেটার চোখমুখ একেবারে ফুলে গেছে।’

‘প্লিজ দিদি, এই নিয়ে তুমি আর কিছু বলতে এসো না। প্রশ্রয় পেয়ে পেয়েই ছেলেটা আরও বিগড়ে যাচ্ছে। এইটুুকু ছেলের জেদ দেখেছ, যেটা চাই বলবে সেটা চাই-ই। দিন দিন একেবারে বাঁদর তৈরি হচ্ছে।’

‘মানলাম আমরা একটু বেশিই আদর-আহ্লাদ দিই। কিন্তু তুমিই তো ওকে প্রমিস করেছিলে। প্রমিস করে কথার খেলাপ করাও তো ঠিক নয়।’ বলেই বিট্টুর মাথায় স্নেহের হাত বুলিয়ে দেয় সহেলী। ‘কাঁদিস না বাবু, বিকেলে আমি তোকে একটা আইপড কিনে দেব।’

বড়ো ননদের কথার ভঙ্গি দেখে মাথা আগুন হয়ে যায় আত্রেয়ীর। কোনওমতে রাগ সংবরণ করে নিয়ে বলে, ‘যদি বা দিতাম, এখন তো আর দেবই না।’ রাগে গজগজ করতে করতে ঘর থেকে বেরিয়ে যায় আত্রেয়ী। বিট্টুও বড়োপিসির কথায় খানিক আশ্বস্ত বোধ করে অন্য খেলনা নিয়ে মেতে ওঠে।

দুপুরে লাঞ্চ সেরে ননদ, ভাজ মিলে বিছানায় গড়িয়ে নিতে নিতে সংসারের নানারকম আলোচনা হতে থাকে। বিট্টুর প্রসঙ্গ উঠতেই আত্রেয়ীর চোখেমুখে চিন্তার ছাপ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। উঠে বসে পড়ে সে। ‘এই ছেলেটা আমাকে পাগল করে দেবে দিদি। কারওর কথা শোনে না। পড়াশোনার কথা তো ছেড়েই দাও। সারাক্ষণ শুধু দুষ্টুবুদ্ধি মাথায় পাক খেতে থাকে।’

‘কী যা-তা বলছ আত্রেয়ী। বিট্টু কত বিনয়ী, পড়াশোনায় ভালো, আর কী চাই তোমার? তাছাড়া ও এখন ছোটো, তুমি যেভাবে গড়েপিঠে মানুষ করবে, ও ঠিক তেমনটাই তৈরি হবে।’ আত্রেয়ীকে বোঝানোর চেষ্টা করে সহেলী।

‘আমার হাতে কী আছে বলো? সংসারটা কি শুধু আমার একার?’ বলে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আত্রেয়ী। তারপর আবার বলতে শুরু করে, ‘যখনই ওকে বোঝাতে যাই, কেউ না কেউ মাঝখানে এসে কথা কাটবেই। যেভাবেই হোক আমাকে ভুল প্রমাণ তাদের করতেই হবে। এরকম চললে বাচ্চারাও তো কনফিউজড্ হয়ে যায় বলো। তারাও তো ঠিক করতে পারবে না কোনটা ঠিক কোনটা ভুল। এই পরশুদিনের কথাই ধরো না, তোমার ভাইয়ের বস আর তার দুই ছেলেমেয়ে এসেছিল বাড়িতে। ওদের জন্য রসগোল্লা আর কিছু স্ন্যাকস্ আনা হয়েছিল। সকলের প্লেটেই দু’টো রসগোল্লা আর স্ন্যাকস্ সাজিয়ে দেওয়া হয়েছিল। বিট্টুকেও তাই। সকলের জন্য ম্যাঙ্গো শেক আনতে রান্নাঘরে ঢুকেছি, সেইসময় সেখানে গিয়ে বিট্টুর বায়না, ‘মা আমাকে আরও দুটো রসগোল্লা দাও।’

আমি বললাম, ‘ঠিক আছে ওরা যাক, তারপর খেয়ে নিস। সত্যি বলতে কী, সকলকে আর দু’টো দেওয়ার মতো অত আনেনি সেদিন তোমার ভাই। ওকে বোঝাতে ও মেনেও গিয়েছিল, কিন্তু মাঝখানে মা এসে বলতে লাগলেন, ‘দু’টো রসগোল্লাই তো খেতে চেয়েছে’ বলে ওকে দিয়ে চলে গেলেন। সে-ও প্লেট হাতে সোজা গেস্টদের সামনে। সম্মানটা থাকে তুমি বলো? ঠিক সেই কারণেই আমি পরে দেব বলেছিলাম। এখন তুমিই বলো ওকে আমি সঠিক শিক্ষা দেব কেমন করে? পড়ানোর সময়ও ঠিক এমনটাই ঘটে। পড়া না পারলে একটু বকলে মা চলে আসবেন, ব্যস ইনিও পড়াশোনার পাট তুলে দিয়ে ঠাম্মার অাঁচলের তলায় গিয়ে লুকোবে। এভাবে ছেলে মানুষ করা যায়! এখন পড়ার নাম শুনলেই তার গায়ে জ্বর চলে আসে।’

‘হাফ-ইয়ারলির রেজাল্ট আউট হয়েছে না? কেমন নাম্বার পেয়েছে?’ প্রশ্ন করে সহেলী।

‘রেজাল্ট নিয়ে আর কিছু জিজ্ঞাসা কোরো না। এখন তো মিথ্যে বলতেও শিখে গেছে।’ ভারি মনমরা দেখায় আত্রেয়ীকে।

‘কেন, কী এমন করেছে যে এরকম করে বলছ?’

‘কয়েকদিন ধরেই ওকে জিজ্ঞাসা করছি, কীরে পরীক্ষার খাতা দেখায়নি। সমানে মিথ্যে বলে গেল। দিন সাতেক পর ওর ক্লাসেরই এক বন্ধুর বাড়িতে গিয়ে জানতে পারি খাতা বেশ কয়েকদিন আগেই দেখানো হয়ে গেছে।’ চোখ চিকচিক করে ওঠে আত্রেয়ীর। সান্ত্বনা দিতে আত্রেয়ীর হাতটা চেপে ধরে সহেলী।

‘জানো দিদি ওর বন্ধু সৃঞ্জয় বলল, ‘কেন আন্টি বিট্টু তোমাকে কপি দেখায়নি? ও-তো এবারে চারটে সাবজেক্টে পাশ মার্ক তুলতে পারেনি।’ লজ্জায়, অপমানে মুখটা কোথায় লুকোব ঠিক করতে পারিনি। সৃঞ্জয়ের মায়ের ওই তীর্যক হাসি যেন আমাকে দুমড়ে-মুষড়ে এক করে দিচ্ছিল। কোনওরকমে পালিয়ে আসি ওদের বাড়ি থেকে।’ নিজেকে সামলাতে পারে না আত্রেয়ী। গাল বেয়ে জল নেমে আসে তার।

সব শুনে সহেলীও অবাক হয়ে যায়, ‘কী বলছিস রে, আমাদের বিট্টু!’ কথা শেষ করতে পারে না সহেলী। তার আগেই আত্রেয়ী ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বলে ওঠে, ‘তাহলে আর বলছি কী! প্রথমে কী বলে, মারধোর করতে তবে গিয়ে স্বীকার করল সব। এখন তুমিই বলো আমি কী করব? এখানেই শেষ নয় রিপোর্ট কার্ডটা পর্যন্ত আমাদের হাতে দেয়নি জানো। বেশ কয়েক সপ্তাহ পরে ওয়াশিং মেশিনের নীচ থেকে ওটা পেয়েছি। আর কী বলব তোমাকে, মাসিক রিপোর্ট কার্ডে পর্যন্ত তোমার ভাইয়ের সইটা নকল করে জমা দিয়েছে। আমি ফেড-আপ হয়ে গেছি।’ মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ে আত্রেয়ী।

‘বিশ্বাসই হচ্ছে না, যে-ছেলেটা গতবছর পর্যন্ত র‍্যাঙ্ক করে এসেছে, তার এই অবনতি কীভাবে? জাস্ট ভাবতে পারছি না।’ বিস্ময় ঘিরে ধরে সহেলীকে।

‘তোমার ভাই তো জীবনেও ওকে পড়ার জন্য বলে না, কোনওদিন বসেও না ছেলেকে নিয়ে। সবসময় আমিই পড়াশোনা নিয়ে টিকটিক করি, সেইজন্য এখন আমি ওর চোখের বিষ। মা হয়ে কী করে আমি ছেলের ভবিষ্যৎ নষ্ট হতে দেখব বলো দিদি?’

‘কিন্তু আত্রেয়ী, বাচ্চাদের ভালোবাসা দিয়ে বোঝাতে হবে। কাছে টানতে হবে। সবসময় মারলে, বকলেও আরও হাতের বাইরে চলে যাবে। পড়াশোনাতেও ওই জন্য ওর মন নেই। পড়াতে বসলে তুমি পড়াও কম, মারো বেশি। বাচ্চাদের সাথে এমন করলে চলবে কেন. যেমন কালকেই তুমি ওকে বলছিলে, আরে ওই ছেলে মানুষ হবে নাকি। জীবনে কিছু করতে পারবে না, জুতো সেলাই করে পেট চালাতে হবে। বাচ্চাদের সামনে তুমি যদি এরকম কথাবার্তা বলো, তাহলে ওদের মনে কেমন প্রভাব পড়বে বুঝতে পারছ আত্রেয়ী। জীবনে কোনওদিন মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে না, সারাক্ষণ হীনন্মন্যতায় ভুগবে। নতুন কিছু করার সাহসই জোগাতে পারবে না।’

ডাইনিং রুমের মেঝেতে বসে বিট্টু কীসব আঁকিবুকি করছিল মন দিয়ে। হঠাৎই সেসব ছেড়ে দিয়ে পিসির হাতটা ধরে বলতে শুরু করল, ‘পিসি, পিসি দাবা খেলবে আমার সাথে?’

‘কিন্তু বাবু আমি যে দাবা খেলতে পারি না। তাহলে তোমার সাথে খেলব কেমন করে?’

‘খুব সোজা। আমি শিখিয়ে দেব।’ ঝটপট উত্তর দেয় বিট্টু।

‘তারচেয়ে বরং লুডো খেলি। কী বলিস?’

‘ঠিক আছে।’ বলে লুডো আনতে দৌড়ে যায় ঠাম্মির ঘরে। মিনিট দুয়েকের মধ্যে ফিরে এসে ঘুঁটি সাজাতে শুরু করে দেয় বিট্টু।

‘সাপ-লুডো খেলি, কী বলো পিসি। তোমার সাথে দারুণ জমে যাবে। ঠাম্মি তো ঠিক করে দান-ই চালতে পারে না।’

‘লুডো ছাড়া আর কী কী খেলা জানিস রে বাবু?’ জানতে চায় সহেলী।

‘দাবা, স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড, কার রেস, বিজনেস গেম, কবাডি।’ গড়গড় করে একটার পর একটা নাম বলতে থাকে বিট্টু।

‘আরে আরে থাম থাম। বাপরে বাপ, কার সাথে খেলিস এসব?’ হাসতে হাসতে প্রশ্ন করে সহেলী।

‘কারওর সাথেই নয়।’

‘কিন্তু এসব খেলা তো একা একা খেলা যায় না বাবু। একাই যদি খেলবে কিনেছ কেন এই সমস্ত গেম?’ অবাক হয়ে যায় সহেলী।

‘কিছু মাসি কিনে দিয়েছিল। জেঠু এসেও কয়েকটা কিনে দিয়ে গেছে, আর গতবারের জন্মদিনে আরও অনেকগুলো পেয়েছি। একা একা খেলব না-তো কী করব বলো। মা যে সঞ্জুদের  বাড়িতে ওগুলো নিয়ে যেতে দেয় না। বলে দামি জিনিস নষ্ট হয়ে যাবে। সঞ্জু বাড়িতে এলেও খেলতে বসলে মা রাগ করে। বলে সবসময় বাড়িতে হইহল্লা লেগেই রয়েছে, বন্ধ করো এসব। খেলা বন্ধ করে মা ওকে বাড়ি পাঠিয়ে দিয়ে আমাকে জোর করে পড়তে বসিয়ে দেয়। ঠাম্মিও তো এসব খেলতে পারে না। কত চেষ্টা করেছি শেখানোর।’ বিট্টুর কথাগুলো মনের মধ্যে বিঁধতে থাকে সহেলীর।

‘ঠাম্মি পারে না তো কী হয়েছে, মাঝেমধ্যে বাবা-মা-র সঙ্গেও তো খেলা যেতে পারে। কী বলো বিট্টু সোনা?’ বড়োপিসির কথা শুনে মাথা নীচু করে নেয় বিট্টু। চোখের কোনা চিকচিক করে ওঠে। তীর্যক দৃষ্টিতে একবার মায়ের দিকে দেখে পিসির কথার উত্তর না দিয়েই ঘর থেকে বেরিয়ে যায় সে।

সহেলী বুঝতে পারে তার কথায় বিট্টু কতটা আঘাত পেয়েছে। পরিবারের সকলে থাকা সত্ত্বেও সে যে কত একা, তা বুঝতে বাকি থাকে না বিট্টুর বড়োপিসির। এতটুকু ছেলের একটা খেলার সঙ্গী নেই। তার উপর সারাক্ষণ মায়ের কড়া শাসন। শাসনের চোটে ভালোবাসাগুলো ম্লান হয়ে গেছে, আর তাই দিন দিন রগচটা হয়ে যাচ্ছে। সবথেকে বেশি রাগ মা-র উপর। সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে স্থির করে নেয় আত্রেয়ীকে যেভাবেই হোক বোঝাতে হবে। এখনও সময় আছে। ভাজের উপর খানিক রাগই হয় সহেলীর। পরক্ষণেই আবার নিজেকে বোঝানোর চেষ্টা করে, ভাবে আসলে ছেলেটাকে নিয়েই আত্রেয়ীর পৃথিবী। তাকে ঘিরেই তার যত স্বপ্ন। যার কারণে একটু এদিক-ওদিক দেখলেই কেমন যেন অস্থির হয়ে ওঠে আত্রেয়ী। সবসময় চোখে চোখে রাখার চেষ্টা করে ছেলেকে। চতুর্দিকের ঘটনা দেখে ভয়ে ছেলেটাকে দূরে স্কুলে পর্যন্ত ভর্তি করেনি। কী-যে ভয় ওর। বিট্টু তো তাদেরও মনের খুব কাছাকাছি। বিয়ের প্রায় বছর আটেক পর বিট্টু জন্মায়। তার আগে দু’দুটো বাচ্চা…। কিন্তু সেসব অতীত আঁকড়ে ধরে থাকলে চলবে? বর্তমানকে নিয়ে বাঁচতে হবে।

তারপর নিজের মনেই বিড়বিড় করতে থাকে, আর ভাইটাও হয়েছে তেমনি। ব্যাবসা ছাড়া কিছুই বুঝল না। শুধু টাকা আর টাকা। বলি এত টাকা নিয়ে কী করবি, যদি ছেলেটাকেই না মানুষ করতে পারলি। দু’দণ্ড ছেলেটার পাশে বসে একটু সময় দিলে কী হয়। এদিকে মুখে বলছে আমি যা রেখে যাব আমার ছেলেকে আর খেটে খেটে হবে না। এদিকে সেই ছেলের জন্যই সময় নেই। একজন চিন্তায় অস্থির, আর একজন উদাসীন! না আত্রেয়ীর সঙ্গে খোলাখুলি কথা বলতেই হবে। এভাবে বিট্টুর ছেলেবেলাটা নষ্ট হতে দেওয়া যাবে না।

সহেলী ভাইবোনেদের মধ্যে সবথেকে বড়ো। কাজেই সবাই সমীহ করেই চলে। অবশ্য সমীহ করার মতোই তার ব্যক্তিত্ব। ছেলে বিদেশে থাকে আর মেয়ের বছর খানেক হল বিয়ে হয়ে গিয়েছে। স্বামী রিটায়ার্ড কর্নেল। বেড়াতে ভীষণ ভালোবাসেন। বছরে অন্তত বারচারেক তল্পিতল্পা নিয়ে বেরিয়ে পড়েন বেশ কয়েকদিনের জন্য। এবারের মিশন মিশর। সেই কারণেই কয়েকদিনের ছুটিতে এবাড়িতে এসেছে সহেলী। আত্রেয়ীও বড়ো ননদকে খুব ভালোবাসে। সে অন্তত তাকে বোঝে। তাই সমস্ত কিছু শেয়ার করে বড়ো ননদের সঙ্গে। মনের কথা বলে খানিক শান্তি পায়।

সেইদিনই সন্ধ্যাবেলায় ননদের বোঝানোতে সিডি প্লেয়ারটা আলমারি খুলে ছেলেকে বের করে দেয় আত্রেয়ী। সেটা হাতে পেয়েই লাফাতে লাফাতে বিট্টু সোজা পৌঁছে যায় বড়োপিসির ঘরে। বড়োপিসিকে জড়িয়ে ধরে আনন্দে আটখানা হয়ে। ‘থ্যাঙ্ক ইউ পিসি, আমি জানি তোমার কথাতেই মা সিডি প্লেয়ারটা  ফেরত দিয়েছে আমাকে।’

‘তাই! তুমি কেমন করে জানলে?’ বিট্টুকে খোলা মনে হাসতে দেখে সহেলীর মনটা ভালো হয়ে যায়।

‘আমি জানি। আচ্ছা শুনবে এতে কী আছে?’ বলেই যন্ত্রটার বাটন-টা প্রেস করে দেয় বিট্টু। শুরু হয় খুব মিষ্টি একটা গান।

‘আরে এটা তো বিট্টু সোনার গলা। বাবা আমার বিট্টু সোনা গানও গাইতে পারে। তা-ও আবার এত সুরে!’ অবাক হয়ে যায় সহেলী।

পিসির কাছ থেকে নিজের প্রশংসা শুনে লজ্জায় মুখটা রাঙা হয়ে ওঠে বিট্টুর। অদ্ভুত এক ঝলক খেলে যায় বিট্টুর চোখেমুখে। প্রশান্তির সেই ছাপ চোখ এড়ায় না সহেলীরও।

সহেলীর বুঝতে বাকি থাকে না বিট্টুর সিডি প্লেয়ার চাওয়ার ওই অদম্য জেদ কেন চেপেছিল। আসলে সে চেয়েছিল তার স্কুলের প্রোগ্রামে গাওয়া গানটা পিসিকে শোনাতে। নিজের খুশি জাহির করতে বাচ্চারা তাদের ভালোবাসার মানুষকে খোঁজে। ইস্ আত্রেয়ী যদি একটু বুঝত ছেলেটা কেন ওভাবে জেদ ধরেছিল। মা হয়ে ছেলেটার ইচ্ছে-অনিচ্ছেগুলো বুঝল না।

পরদিন সকালেও বিট্টুর মনটা বেশ ভালো ছিল। সকালে উঠে নিজেই লাফাতে লাফাতে তৈরি হয়ে স্কুল গেল। পিসির কাছে আবদার করে গেছে ফিরলে তাকে ভূতের গল্প শোনাতে হবে। সেইমতো স্কুল থেকে ফিরে সোজা পিসির ঘরে হানা দেয় বিট্টু। তখন ননদ ভাজের আড্ডা বেশ জমে উঠেছে। কোনও কিছু নিয়ে ইয়ার্কি-ঠাট্টা হচ্ছিল বোধ করি। বিট্টুর মাঝে ঢুকে পড়াতে আত্রেয়ীর হাসি মুহূর্তে বিরক্তিতে পরিণত হয়।

‘কতবার তোমাকে বলেছি না বড়োরা কথা বললে এভাবে বিরক্ত করবে না। যাও ঠাম্মিকে বলো খেতে দিতে।’

‘আমার পেট ভর্তি আমি খাব না।’

‘পেট ভর্তি মানেটা কী? সেই কোন সকালে একটু হরলিক্স আর দুটো বিস্কুট খেয়ে বেরিয়েছ। যাও খেয়ে নাও।’ চোখ রাঙায় আত্রেয়ী।

মায়ের চোখ রাঙানিকে উপেক্ষা করেই জবাব দেয় বিট্টু, ‘বলছি তো খিদে নেই।’ বলে সহেলীর পাশে গিয়ে বসে পড়ে।

‘ও পিসি, তারপর কী হল? তারপর? ভূতটা কী করল?’

‘দেখেছ দিদি, দেখেছ, এই ছেলে আমাকে কোনওদিন শান্তি দেবে? দু’দণ্ড যে কারওর সাথে কথা বলব তা এই ছেলের সহ্য হয় না। আমার বোন এলেও এমনটাই করে। বাপের বাড়িতে গিয়েও বন্ধুবান্ধবদের সাথে একটু গল্প করতে, মনের কথা খুলে বলতে পারি না জানো। সেখানেও মুখের সামনে বসে সব গিলবে, আর বাড়ি ফিরে বাবা-ঠাম্মিকে সব লাগাবে। সত্যি বলছি দিদি আর পেরে উঠছি না।’ গর্জে ওঠে আত্রেয়ী।

‘ঠিক আছে, ঠিক আছে, অতো বিরক্তির কী আছে। আর তো ক’দিন পর বড়ো জেঠুর কাছে চলেই যাব। বাবা তো কথাও বলে নিয়েছে। তখন চাইলেও তোমার কাছে আর ফিরে আসব না।’

‘আচ্ছা আচ্ছা, আর অতো রাগ করতে হবে না। মার কথা শোনো, একটু খেয়ে এসো। তারপর তো বাকি গল্পটা বলবই। যাও যাও ছুটে যাও, ঠাম্মির থেকে খেয়ে এস।’ বিট্টুকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে ঠাম্মির কাছে পাঠিয়ে দেয় সহেলী। তারপর আত্রেয়ীর দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়,’ হঠাৎ বড়ো জ্যেঠুর কাছে, ব্যাপারটা ঠিক বুঝলাম না।’

‘ছেলেটা যেভাবে বিগড়ে যাচ্ছে, তাই আমরা ঠিক করেছি ওকে বড়দার কাছে পাঠিয়ে দেব। ওখানেই থাকবে, পড়াশোনা করবে। আমাদের তো ধর্তব্যের মধ্যেই ধরে না, কম সে কম ওনাকে তো একটু ভয় পায়।’

কথাটা শোনামাত্রই মাথায় বিদ্যুৎ খেলে যায় সহেলীর। ‘মানে, নিজের দায় অন্যের উপর চাপিয়ে দিয়ে দায় মুক্ত হতে চাইছ। কিছু মনে কোরো না আত্রেয়ী এভাবে ছেলে মানুষ হয় না। একটা মানুষের পিছনে দিনরাত্রি খিটখিট করলে, সে তো বিরক্ত হবেই। ছেলে মানুষের নামে দিনরাত কড়া অনুশাসন, স্কুলের পর দুটো টিউটর, হাঁফ ফেলতে পারে না ছেলেটা ঠিক করে। মিশতে দেবে না কারওর সঙ্গে, ছেলে নাকি এতে খারাপ হয়ে যাবে। ভাবলেই অবাক লাগে এই বয়সের একটা ছেলের খেলার সঙ্গী নেই। ছেলে বিগড়োনোর জন্য কিন্তু দায়ী তোমরাই। এভাবে কোনওদিন ছেলে মানুষ করতে পারবে না।’

ননদের কথার কোনও প্রতিবাদ করতে পারে না আত্রেয়ী। যৗক্তিকতার চাপে গলা রূদ্ধ হয়ে আসে তার। চোখ ভিজে যায়। একটা ক্ষীণ স্বর সহেলীর কানে পৌঁছোয় ‘তুমি শুধু আমার দোষটাই দেখছ দিদি। কষ্টটা বুঝতে পারছ না। একজন মা কতটা প্যাঁচে পড়লে তবে তার বাচ্চাকে নিজের কাছছাড়া করার কথা ভাবে বলো তো?’

‘শোনো আত্রেয়ী, মাঝে মাঝে কাছের মানুষগুলোর কাছে ভালোবাসা প্রকাশ করতে হয় বুঝেছ। রাগের বশবর্তী হয়ে এমন কিছু ডিসিশন নিও না, যাতে ছেলেটা তোমার থেকে আরও দূরে সরে যায়। একটু আমার কথামতো চলেই দ্যাখো না, দেখবে তোমার ছেলে সত্যিই ভালো।’ আবেগের বশে কখন যে ভাজকে জড়িয়ে ধরে চোখে জল এসে গেছে বুঝতেও পারে না সহেলী।

দেখতে দেখতে কেটে যায় আরও একটা সপ্তাহ। এই কয়েক দিন সহেলী, ভাইপো বিট্টুকে নিয়েই বেশি সময় কাটিয়েছে।

পিসির কথা শুনে খাওয়াদাওয়া, পড়াশোনা সবই করেছে বিট্টু। এক মুহূর্তেও কথার অবাধ্য হয়নি বিট্টু। আত্রেয়ীর অভিযোগের সঙ্গে বিন্দুমাত্র মেলাতে পারেনি ছেলেটাকে। একটু ভালোবাসা একটু প্রশংসা পাওয়ার জন্য কী না করতে পারে ছেলেটা। আত্রেয়ীকে ভুল প্রমাণ করার জন্য তাকে দিয়েই কোয়েশ্চেন সেট বানিয়ে পরীক্ষা নিয়েছে বিট্টুর। একেবারে পঞ্চাশে পঞ্চাশ। ফুল মার্কস পেয়ে ছেলের কী লাফানো।

‘দেখেছ আত্রেয়ী, একটু ভালোবাসা পেলে ছেলেটা কী করতে পারে। আমার কী আছে বলো, আমি তো আর সারাজীবন থাকতে যাব না এখানে। তোমার জামাইবাবুরা দুর্যোগের জন্য সময়ের আগেই ফিরে আসছে বর্ডার থেকে। পরশুই আমাকে চলে যেতে হবে।

নিজের মনে খেলতে খেলতেই, পিসির কথাটা কানে যায় বিট্টুর। খেলা ছেড়ে দিয়ে একলাফে দৌড়ে আসে সহেলীর কাছে। বরাবরই বড়োপিসিকে সে একটু বেশিই ভালোবাসে। এই কদিনে সহেলীর আরও কোলঘেঁষা হয়েছে সে। ‘পিসি তুমি চলে যাবে? তুমি যে বলেছিলে এখন থাকবে তাহলে কেন? আমার সাথে কে খেলবে?’ বিট্টুর কথাগুলো সহেলীর কানে গিয়ে ধাক্বা মারে।

‘কী করব বলো, পিসেমশাই ফিরে আসছে। আমি বাড়ি না গেলে উনি খাবেন কী? ওনাকে কে দেখবে? তবে আমি কথা দিতে পারি, তুমি যদি আমার কথা শোনো, তাহলে আমি প্রতিমাসে দু’দিন করে এসে তোমার সাথে দেখা করে যাব। আর তোমার গরমের ছুটির সময় তোমাকে আমার ওখানে নিয়ে যাব।’

‘কী কথা বলো?’ উৎসাহের সঙ্গে জিজ্ঞাসা করে বিট্টু।

‘বলব, তবে আগে প্রমিস করতে হবে, আমি যা বলব তুমি তাই শুনবে।’ শর্ত রাখে সহেলী।

‘তোমায় কথা দিতে হবে ভালো ছেলের মতো মা-র সব কথা শুনবে। মন দিয়ে পড়াশোনা করবে। ভালো রেজাল্ট করে প্রমাণ করতে হবে তুমি ভালো ছেলে।’ সহেলীর কথা মন দিয়ে শোনে বিট্টু। কোনও সাড়া করে না।

‘কি আমার কথা রাখবে তো?’ বিট্টুর দিকে প্রশ্ন ছুড়ে দেয় সহেলী।

‘প্রমিস পিসি, তোমার কথা মতোই আমি চলব, কিন্তু তুমি প্রমিস ভাঙবে না তো? সপ্রতিভ চোখে পিসির দিকে তাকিয়ে থাকে বিট্টু।

‘পিসি কোনওদিন কথার খেলাপ করেছে?’ ঘাড় নেড়ে সম্মতি প্রকাশ করে বিট্টু। বিট্টুকে কাছে টেনে নিয়ে আদর করে সহেলী। চোখ ভিজে যায় তার। একদিনে ছেলেটার প্রতি যেন আরও মায়া পড়ে গেছে। ছেড়ে যাওয়ার কথা ভাবতেই চোখে জল চলে এসেছে।

দেখতে দেখতে কেটে যায় আরও দু’টো দিন। আজ মা-বাবার সঙ্গে স্টেশনে এসেছে সহেলীকে ছাড়তে। সকাল থেকে বায়না ধরেছিল স্টেশনে আসার জন্য। বাড়ি থেকে স্টেশন পর্যন্ত একটি বারও পিসির কাছছাড়া হয়নি।

‘বাবু ভালো থাকিস। মা-র কথা শুনবি।’ বলে বিট্টুকে জড়িয়ে ধরে একটা চুমু খায় সহেলী। ঠিক সেই সময়তেই ট্রেনের হুইসল বেজে ওঠে। ট্রেনে উঠে পড়ে সহেলী। ধীর গতিতে ট্রেন চলতে শুরু করে। বিট্টু আর নিজেকে ধরে রাখতে পারে না। ডুকরে কেঁদে ওঠে।

‘প্লিজ পিসি, যেও না আমাকে ছেড়ে।’

‘কাঁদে না বাবু, আমি বলেছি না আমি ঠিক আসব।’ ট্রেন তখন প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে দ্রুত গতিতে ছুটতে শুরু করেছে। বিট্টুও করুণ মুখ করে দেখছে সেই ট্রেনের চলে যাওয়া। ‘আমার কথা রেখো কিন্তু,’ সহেলীর ক্ষীণ আওয়াজ ভেসে আসে বিট্টুর কানে।

হাত নাড়তে নাড়তে বলতে থাকে ‘শুনব পিসি, শুনব।’

বিট্টুর কষ্টটা অনুভব করতে পারে সহেলী। চোখ ভিজে যায় জলে, কিন্তু বিট্টুর উজ্জ্বল ভবিষ্যতের কথা ভেবে মনটা আনন্দে ভরে ওঠে।

পাকদণ্ডি

কেউ ঝুঁকে পড়ে পায়ে হাত রাখতেই চমকে উঠল বন্দনা। ‘না-না, বলে সংকুচিত হয়ে উঠলেও যে প্রণাম করতে এসেছিল, সে কোনও ওজর-আপত্তি শুনতে আগ্রহী নয়। লোকটি চলে যাওয়ার পরই বন্দনা চোখ বন্ধ করে নিয়েছিল। এই সময়ে তার মন অতীত স্মৃতির নানা গলিপথে ঘুরে বেড়াতে শুরু করে। একের পর এক মুখ ভেসে উঠতে শুরু করল স্মৃতিপটে। অনেকগুলি মুখ ধোঁয়াশায় আবছা হয়ে এসেছে। মুখ মনে আসছে, অথচ মুখের মালিকের নাম মনে পড়ছে না। এখন কারওর উপরেই সে আর ভরসা করতে পারে না। তা সত্ত্বেও শৈশবের এক স্বভাব সে কখনওই ছাড়তে পারেনি। মানুষের সুখ-দুঃখ, হাসিকান্নার পাশে থাকার অভ্যাসেই সে স্কুলের চাকরির পাশাপাশি সমাজসেবাকেও ব্রত হিসাবে নিয়েছে।

সন্ধে সাতটার সময় সুদর্শন পান্ডের বাড়িতে তার ছোটোছেলের জন্মদিনের অনুষ্ঠান ছিল। বিশেষ ইচ্ছে ছিল না যাওয়ার। কিন্তু সুদর্শন তার সমাজসেবী সংস্থা ‘অর্চনা’র সদস্য। বন্দনা স্নান করল, আলমারি থেকে নামিয়ে একটা ময়ূরকণ্ঠী রঙের উজ্জ্বল শাড়ি পরল, সামান্য সাজল, বেরিয়ে পড়ল তারপর।

সুদর্শনের বাড়িতে আজ উৎসবের মেজাজ। ইতিমধ্যে অন্য অতিথিরাও দলে দলে আসতে শুরু করে দিয়েছেন। সকলের সঙ্গে বন্দনার পরিচয় করিয়ে দিয়ে সুদর্শন বলতে লাগল, ‘ইনি বন্দনা দত্ত, ‘অর্চনা’ স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার প্রধান।’কয়েকটি কৌতূহলী চোখ চমকে তাকাল বন্দনার দিকে। বন্দনা এ ধরনের দৃষ্টিপাতে অভ্যস্ত। আগে অস্বস্তি হতো তার। এখন আর হয় না। পঁয়তাল্লিশে পড়ল সে গতমাসে। হয়তো এখনও তার ধারালো চোখমুখ আর টানটান শরীর বাইরে লোকের কাছে আকর্ষক মনে হয়। কিন্তু, এরই পাশাপাশি তাদের চোখে অন্য একটা প্রশ্ন ফুটে উঠতে দেখে বন্দনা ভেবে কুল পায় না। সেই চোখগুলি প্রশ্ন করে, ‘এত সুন্দরী হওয়া সত্ত্বেও কেন আপনি বিয়ে করেননি বন্দনা?’

এককালে এইসব প্রশ্ন তাকে বিরক্ত করত, এখন আর করে না। এরই মধ্যে কোনও কোনও কৌতূহলী সাহসী পুরুষ তার কাছাকাছি আসার চেষ্টা করে। কারওর বাচ্চার অ্যাডমিশন নিয়ে সমস্যা, কারওর বা সংসারে পণ দেওয়া নিয়ে ঝামেলা। এসব কিছু না থাকলে সমাজসেবা করার ঝুটো ইচ্ছের ছুতোয় কাছে আসার প্রক্রিয়া জারি থাকে। অনেকক্ষেত্রে বন্দনা এমনও টের পেয়েছে, হয়তো কোনও সমস্যাই নেই, তবু, কোনও কোনও পুরুষ শুধু তার সঙ্গ পাবে এই আশায় তার সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছে।

চিরকালই বন্দনার মধ্যে তার সামাজিক প্রতিষ্ঠা সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা এবং আত্মমর্যাদাবোধ খুবই বেশি। অভিজ্ঞতা থেকে সে শিখেছে, কার সঙ্গে কতটা কথা বলতে হবে, কার সঙ্গে কতটা দূরত্ব বজায় রাখা সংগত। সুদর্শনের ঘরোয়া পার্টি খুব জমে উঠেছিল। খাওয়াদাওয়ার ভালো বন্দোবস্ত, বন্দনা দেরি করল না। এমনিতেই তার শরীরটা খুব একটা ভালো নেই। সামান্য কিছু খেয়ে সে তাড়াতাড়ি বাড়ি পৌঁছোতে চাইছিল। প্লেটে খাবার নিয়ে দু-এক চামচও খায়নি, এমন সময় পাশে এসে দাঁড়াল বিজন। নিজের প্লেট হাতে নিয়ে সে বন্দনার পাশে দাঁড়িয়ে কথায় কথায় বলল  ‘আপনার কাছে আমি কৃতজ্ঞ।’

বন্দনা একটু অবাক চোখে তাকাতেই সে ফের বলল, ‘আপনিই তো মৃদুলাকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে ঠিক রাস্তায় ফিরিয়ে এনেছেন।’

মৃদুলা বিজনের একমাত্র মেয়ে। যে-স্কুলে বন্দনা অধ্যক্ষ, সেখানেই পড়ে মৃদুলা। অনেকদিন ধরেই তার নামে নানা অভিযোগ আসছিল। ক্লাসরুমে অনুপস্থিত থাকে। ছেলেবন্ধুদের সঙ্গে এখানে-ওখানে ঘুরে বেড়ায়, অভিযোগের কোনও অন্ত নেই। উপায়ান্তর না দেখে বিজন তখন বন্দনার দ্বারস্থ হয়। সেই ওদের প্রথম দেখা। তারপর বেশ কয়েকবার বিজন এসেছে তার কাছে। অনেক কষ্টের কথা বলেছে। বন্দনা এখনও বোঝে না, কোনওরকম আকর্ষণ থেকেই কি সে তার কাছে আসত? নাকি, সত্যিই সে ব্যতিব্যস্ত ছিল তার মেয়ের ব্যাপারে?

সে সময় বন্দনা মৃদুলাকে ডেকে অনেক বুঝিয়েছিল। বুঝিয়েছিল, নদীর জল আর সময় কারু জন্য অপেক্ষা করে না। সময় থাকতে থাকতে তার যথাযথ উপযোগিতাটাও জরুরি। তাতে ভবিষ্যৎ জীবন সুন্দর ও সুখের হবে। তার কথায় কী যে জাদু থাকে, যে-শোনে সে মন্ত্রমুগ্ধের মতো শোনে। এসব ঘটনার পর একদিন হঠাৎ-ই বিজন এসে হাজির। তার নিশ্চিন্ত মুখচোখ দেখে খানিকটা স্বস্তি পেল বন্দনা। বিজন বললছ ‘মৃদুলা খুব প্রশংসা করে আপনার। এখন তো দেখছি বাড়িতেও খুব মন দিয়ে পড়াশোনা করছে।’উপকারের কথা অধিকাংশ ক্ষেত্রে মানুষ ভুলে যায়। কিন্তু, বিজন সেই বিরল প্রকৃতির মানুষ, যে, কৃতজ্ঞ থাকতে ভালোবাসে আর বারবার সেই কথার পুনরাবৃত্তি করে বন্দনাকেও কিছু ভুলতে দেয় না।

‘আচ্ছা ম্যাডাম, রাজনীতির জগতের মানুষজনও তো সকলেই আপনাকে চেনে। আপনার এক কথায় কত লোকের কত কাজ হয়ে যায়!’

একটু হকচকিয়ে গেল বন্দনা। তার ব্যাপারে বিজন এত খবর রাখে কেন? মনের দোলাচল তার কথাতেও বের হয়ে এল,  ‘আপনি তো দেখছি, আমার সম্পর্কে প্রচুর খবর রাখেন।’

‘সত্যি বলতে কি ম্যাডাম,’ বিজন বলল, ‘ব্যাপারটাকে কাকতালীয় বলতে পারেন, কিন্তু, আপনার অতীত ও বর্তমানের অনেক কথাই আমার জানা।’

বন্দনা হেসে ফেলল, ‘আমার সম্পর্কে এত কিছু যখন জানেন, তখন নিশ্চয়ই আমার ভবিষ্যৎটাও জানেন আপনি!’

একথা শুনে একটু চুপ করে রইল বিজন। তারপর নীচু গলায় কেটে-কেটে বলল, ‘ভবিষ্যৎ তো আপনার নিজেকেই স্থির করতে হবে।’ তারপর হঠাৎ-ই সে খুব গম্ভীর হয়ে গেল।

সেদিন পার্টি শেষ করে বাড়ি চলে আসার পর থেকে বেশ কিছুদিন বন্দনা বিজনের কথাগুলি ভাবছিল। ভাবছিল, কী বিচিত্র মানুষ এই বিজন! বলে কিনা তার অতীত-বর্তমান, সবকিছু সে জানে! বন্দনার অতীত… কোন অতীত?

বন্দনার বাবা ছিলেন বামপন্থী রাজনীতির সক্রিয় কর্মী। একসময় অনেক লড়াই দেখেছে বন্দনা, ঘরে-বাইরে। পার্টি গড়ে ওঠার সময়ে বহু মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে এমন স্যাক্রিফাইস করেছেন। অত্যধিক পরিশ্রমে বন্দনার বাবার শরীর ভেঙে গিয়েছিল শেষদিকে। সেই টালমাটাল সময়ে বন্দনা দেখেছে কী প্রচণ্ড কষ্টে সংসার সামলেছেন মা! বিএ পাশ করেই তাই বন্দনাকে চাকরির খোঁজে বের হতে হল। অন্য আর পাঁচটা সমবয়সি মেয়ের কাছে সেই সময়টা ছিল চোখে রঙিন স্বপ্নের জাল বোনার। আর তখনই স্বপ্ন দেখার সঙ্গে বন্দনার ছিল আড়ি। কাঁধের উপর যে বিরাট সংসারের দায়! সুজয়, আরাধনা দুই ভাইবোন, আর মা। পুরো সংসারকে টানতে স্কুলের চাকরির পরেও বাড়িতে কোচিংক্লাস খুলতে হল বন্দনাকে। তারপর হঠাৎ-ই একদিন মা’ও মারা গেলেন। মাথার উপর আর রইল না কেউ। ওই সময় বড়ো অসহায় হয়ে পড়েছিল বন্দনা। সময় সব ক্ষত মুছিয়ে দেয়। জীবনের স্বভাবই হল গড়িয়ে যাওয়া। কিন্তু সুজয় আর আরাধনার সংসার সাজিয়ে দিয়ে যখন সে একটু নিজের দিকে তাকানোর সময় পেল, দেখল, চুলে ততদিনে পাক ধরেছে।

অতীতের ইতিহাসের পাতা উলটালে তার চোখ জলে ভিজে আসে। মনে হয়, এক পলকে সে পৌঁছে গেছে সেই গাঁ-এ, যেখানে দাদু-দিদা’র সঙ্গে কয়েকদিন খুব আনন্দে কেটেছিল। সারাদিন গ্রামের সমবয়সি ছেলেমেয়েদের সঙ্গে ছুটোছুটি করে প্রজাপতি ধরে বেড়ানোর সুখ ভোলা যায় না। ভোলা যায় না, তারপর পাকদণ্ডি পথ বেয়ে অনেক বেশি রাস্তা ঘুরে দেরি করে বাড়ি ফেরা …।

ওই কয়েকটা বছর সংসারের উপর দিয়ে খুবই ঝড়ঝাপটা গেছে। রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়া বাবা কোনওভাবেই কোনও চাকরির ব্যবস্থা করে উঠতে পারছিলেন না। বাধ্য হয়েই দাদু-দিদা, মা আর ভাইবোনদের নিয়ে গিয়েছিলেন গ্রামের বাড়িতে। আস্তে আস্তে ভাইবোনরাও বড়ো হচ্ছিল। বাবা বাধ্য হয়ে শহরে নিয়ে এলেন সকলকে। এখন এই নিশ্চিন্ত জীবনের অবসরে চোখ বুজলেই গ্রামের সেই পাকদণ্ডি পথ চোখে ভাসে। পাকদণ্ডি হচ্ছে সেই পথ, যেটি মানুষের চলাচলের মাধ্যমে আপনা-আপনিই তৈরি হয়ে যায়।

বন্দনা নিজেও জানে, সারাজীবন ধরে সে পাকদণ্ডিই হয়ে রইল। চেনাপরিচিত মানুষজনের কাছে, এমনকী ভাইবোনদের কাছেও। একমাত্র বিজন অন্যরকম। যখনই দেখা হয়, অত্যন্ত আন্তরিক হাসিতে সে অভিবাদন জানায়। বিজনের ভাবনাচিন্তার ধরন ভালো লাগে বন্দনার। কিন্তু, সে তার অতীত বিষয়ে কী জানে, সেটা জানার আগ্রহ থাকলেও সংকোচবশত কোনও কথা জিজ্ঞেস করতে পারে না বন্দনা। অতীত… কোন অতীত? এ প্রশ্ন কতবার তার ঠোঁটের ডগায় চলে এসেছে। শেষ মুহূর্তে সামলে নিয়েছে বন্দনা। অনেকদিন হল, বিজন আসেনি। স্কুলে মৃদুলার সঙ্গে দেখা হতে বন্দনা তার কাছে বিজনের কথা জানতে চাইল। মৃদুলা জানাল, তার বাবা খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছে। বিজনের ব্যক্তিত্ব আর শালীনতাবোধ সেই প্রথমদিন থেকেই বন্দনাকে মুগ্ধ করে। হয়তো এইজন্যই সে ঠিক করল, এক সন্ধেয় বিজনকে সে দেখে আসবে।

বিজন শুয়ে ছিল, বন্দনাকে ঘরে ঢুকতে দেখে তাড়াতাড়ি উঠে বসল সে। ‘আরে, ম্যাডাম…। আপনি…,’ তার মুখে যেন প্রথমে কোনও কথাই জোগাল না। বিছানা থেকে উঠে বসার চেষ্টা করতে যেতেই বাধা দিল বন্দনা, বলল ‘আপনি উঠবেন না, শুয়ে থাকুন। মৃদুলা বলল আপনি অসুস্থ, তাই, দেখতে চলে এলাম।‘ যেন কোনও ঘোরের মধ্যে থেকে বন্দনার প্রশ্নের জবাব দিতে থাকল বিজন। তারপর হঠাৎ-ই বিছানার উপরে সোজা হয়ে বসে বলল, ‘বন্দনা, এখনও কি তোমার প্রজাপতি ধরার শখ আছে?’

বন্দনা চমকে উঠল। দুটো কারণে। বিজন ‘আপনি’র সম্পর্ক ভেঙে দিল। সচেতনভাবে ভেঙে দিল নাকি? পাশাপাশি, প্রজাপতির পিছনে ছোটার প্রসঙ্গও তাকে খুব আশ্চর্য করে দিল। ‘তুমি… আপনি…,’ কোন সম্বোধনে কীভাবে যে কথা শুরু করবে তাই বুঝে উঠতে পারছিল না বন্দনা।

‘তুমি-ই চলুক না বন্দনা…। তোমার মনে আছে, তোমার প্রজাপতি ধরার অভিযানে একজন থাকত, বিজু নামে?’ বন্দনার দিকে সরাসরি না তাকিয়েই বলল বিজন।

‘আরে…?’ বলতে গিয়ে খুশি উছলে পড়ল বন্দনার গলায়। মনে হল, সত্যি সত্যি আর একবার সে প্রজাপতি ধরার সেই বয়সে পৌঁছে গেছে। ‘ছোটোবেলাটা কী আশ্চর্য, তাই না? ছেড়ে গিয়েও যেন আজীবন জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে থাকে। আরে… সেইজন্যেই তুমি বারবার বলতে আমার অতীতের কথা জানো?’  বালিকাসুলভ খুশি ঝিলিক দিয়ে উঠল বন্দনার চোখে। সে ঘরের চারদিকে চোখ বুলিয়ে জানতে চাইল, ‘মৃদুলাকে দেখছি না, সে কোথায়?’

‘মৃদুলা বন্ধুর বাড়ি গেছে।’

‘আর ওর মা?’, জিজ্ঞেস করল বন্দনা। একটা কৌতূহলও ছিল। বিজনের সঙ্গে বিভিন্ন জায়গায় যতবার দেখা হয়েছে, ওকে একাই দেখেছে। ‘সে নেই বন্দনা,’ গভীর একটা শ্বাস নিয়ে বিজন বলল, ‘মৃদুলার যখন দশ বছর বয়স, তখনই ওর মা…।’

সেদিনের পর থেকে বন্দনার সঙ্গে প্রায়ই বিজনের দেখা হতে থাকল। বন্দনা তার চাকরি ও সমাজসেবা নিয়ে ব্যস্ত থাকলেও কেন কে জানে, বিজনের ফোন এলে সে খুশি হয়ে উঠত, আর বিজনের সঙ্গে দেখা করা আর কথা বলার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠল তার মন। সরষেখেতের পিছনে প্রজাপতি ধরতে যাওয়ার দিনগুলির স্মৃতি তাকে যেন তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াত।

বন্দনার জীবনে কখনও প্রেম আসেনি। মাঝেমধ্যে একা থাকলে বন্দনা ভাবতে বসত, এই যে বিজনের জন্য একটা আকুলতা সে টের পায় মনের মধ্যে, একেই কি প্রেম বলে? ভিতরে ভিতরে এক ভীষণ যন্ত্রণা অথচ উপর-উপর সব শান্ত। যে-যার নিজস্ব সামাজিক মর্যাদার জালে বন্দি, যে-যার নিজস্ব খোলসে আবদ্ধ।

সমস্যাটা হল অন্য জায়গায়। বন্দনা যদিও টিচার্স রুম-এ বসে না, তবু, কানে এল, বন্দনা এবং বিজনের একসঙ্গে ঘোরাফেরার বিষয়টিকে অনেকেই রীতিমতো চর্চার বিষয় করে তুলেছে। বন্দনা খুব চিন্তায় পড়ে গেল। সারাজীবনে অন্য লোকে কী ভাবল তা নিয়ে আদৌ ভাবেনি সে। কিন্তু, এখন তার একটা সামাজিক মর্যাদা রয়েছে। নিজেকে কি তাহলে সে গুটিয়ে নেবে? কিন্তু, মন কেন চাইছে অন্য কিছু? কেন বালিকার মতো অবুঝ হয়ে উঠছে? আবেগে ভেসে নিজের সব প্রতিষ্ঠা ও মর্যাদাকে কি সে বিসর্জনের চতুর্দোলায় তুলে দেবে? অনেক ভেবে বন্দনা স্থির করল, মনে লাগাম পরানো দরকার। বিজন এরপর থেকে ফোন করে দেখা করতে চাইলে সে ঘুরিয়ে অসম্মতি জানাতে শুরু করে দিল। বেশ কিছুদিন ‘না’  শোনার পর বিজনও ফোন করা বন্ধ করে দিল।

জীবন দৌড়ে চলছিল। প্রথম-প্রথম একটু অস্বস্তি হলেও বন্দনা কাজকর্মের মধ্যে ভুলে থাকার চেষ্টা করছিল রুদ্ধ আবেগ। কিন্তু হঠাৎই একদিন মৃদুলার এক কাণ্ড বন্দনা আর বিজন দুজনকেই চমকে দিল।

তার সমাজসেবী সংস্থার দফতরে বসে ফাইলপত্র ঘাঁটছিল বন্দনা। দেখা করতে আসা মানুষজন খানিকক্ষণ আগেই বিদায় নিয়েছে। সন্ধে হয়ে এসেছে। হঠাৎ-ই ফোন। বন্দনা ‘হ্যালো’ বলতেই, ওপার থেকে মৃদুলা বলে উঠল, ‘ম্যাডাম, বাবা হঠাৎ খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছে। আপনি এক্ষুনি একবার আসতে পারবেন? আমি কী করব, কিছুই বুঝতে পারছি না।‘ মৃদুলার উদ্বেগ-মাখা কণ্ঠস্বর খুবই বিচলিত করে দিল বন্দনাকে। ফোন রেখে কোনওমতে রাস্তায় নেমেই সে ট্যাক্সি ধরল।

বিজনের বাড়ির দরজায় ট্যাক্সি থামতে নেমে পড়ল বন্দনা। ট্যাক্সিওলাকে ভাড়া মিটিয়ে খুচরোও ফেরত নিল না। কিন্তু বিজনের ঘরে ঢুকে সে সত্যিই চমকে উঠল। বসার ঘরের হেলানো চেয়ারে দিব্যি পা তুলে বসে খবরের কাগজ পড়ছিল বিজন। শরীরে অসুস্থতার কোনও লক্ষণ পর্যন্ত নেই। সে বলে উঠল ‘আরে, তুমি তো দেখছি দিব্যি সুস্থ আছ। মৃদুলা যে বলল তোমার ভীষণ শরীর খারাপ?’

‘তাই নাকি,’ অবাক হওয়া গলায় বিজনও বলে ওঠে, ‘মৃদুলা এরকম বলবে কেন?’ তাদের কথাবার্তার মাঝখানেই পাশের ঘর থেকে বের হয়ে এল মৃদুলা। বলল, ‘আমি বলছি বাবা, কেন ফোন করেছিলাম।’

মৃদুলার কথায় বিজন ও বন্দনা দুজনেই বিব্রত হয়ে পড়ল। দুজনের অর্থবহ দৃষ্টিবিনিময় হল। দুজনের মনেই সম্ভবত একই ভাবনা খেলা করতে থাকল, তাদের ঘনিষ্ঠতার বিষয়ে কোনও গুরুতর অভিযোগ করতে চায় নাকি মৃদুলা! বন্দনার মনে একটা গ্লানি এল। নিজের বয়স ও সম্মান ভুলে তার কখনওই এরকম আচরণ করা ঠিক হয়নি। কেন এত বড়ো ভুলের পথে পা বাড়াল সে! এখন তো এর মাশুল গুনতেই হবে। নিজের হূদস্পন্দনও তার কানে আসছিল।

ঘরের মধ্যের দমবন্ধ ভাবটা কাটিয়ে তখনই মৃদুলা হেসে বিজনের গলা জড়িয়ে ধরে বলে উঠল, ‘বাবা, আগে আমার একটা প্রশ্নের উত্তর দাও।‘ বিজন খুব বিব্রত চোখে দেখল মৃদুলাকে। মৃদুলা হাসি ধরে রেখে বলল, ‘আজকাল তোমরা দুজন আর একসঙ্গে কোথাও বের হও না কেন?’

দুজনের কেউ-ই এই প্রশ্ন আশা করেনি। চমকে উঠে দুজনেই দুজনকে দেখল। খানিকক্ষণ ঘরে যেন হাওয়াবাতাস বন্ধ হয়ে রইল। তারপর বিজনই নিজেকে খানিকটা সামলে নিয়ে বলল, ‘সময় কোথায় পাই মৃদু?’ মৃদুলা হাসল না, বলল ‘কথাটা আন্টি বললে মানা যায়। নিজের চাকরি ছাড়াও তার অনেক কাজ। তা সত্ত্বেও তো উনি সময় বের করতেন।’

মৃদুলার এমন স্পষ্ট কথায় লজ্জা পেল বন্দনা। চোখ তুলে একবার মৃদুলার দিকে তাকাতেই তার চোখে দুষ্টুমির রং দেখতে পেল সে। ‘আচ্ছা, সে না হয় ঠিক আছে! কিন্তু, আগে বলো, আমাদের দুজনের একসঙ্গে ঘোরাফেরা করাটা কি তোমার অপছন্দ?’ জিজ্ঞেস করল বন্দনা।

‘একদম নয়,’ মৃদুলা বলল।

মৃদুলা নয়, বরং মা-হারা এক মেয়ের গলায় ভালোবাসা আর স্নেহের চাহিদা ঝরে পড়তে দেখল বন্দনা। তার চোখদু’টিও আবেগে ভিজে এল।

‘বাবা, তুমি নিজেই জানো না, তুমি কতটা অসুস্থ!’ একথা বলেই মৃদুলা বন্দনার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আন্টি ওই দিনগুলোতে বাবার চেহারায় কত জৌলুস ছিল! যেন নতুন জীবন পেয়েছে বলে মনে হতো! অথচ, এখন…।’ মৃদুলার কথায় বিজনের দিকে তাকাল বন্দনা। মৃদুলা ঠিকই বলেছে, একই অনুভবের সাগরে সে ও বিজন দুজনেই সাঁতার কেটেছে এতদিন।

‘আর এখন…।’মৃদুলা তার বক্তব্য জারি রাখে, ‘বাবা বিকেল থেকে মনমরা হয়ে বসে থাকে। হয় টিভি দেখে, নয়তো বাসি খবরের কাগজটাই দু’বার, তিনবার করে পড়ে। বাবার মনমরা ভাবটা তুমিই দূর করতে পারো আন্টি।’

বন্দনার মনে হল, মৃদুলাকে যতটা বালিকা ভাবত সে ও বিজন, সে ততটা ছোটো আর নেই। বন্দনাকে, তার এই পরিণত বয়সেও একরাশ লজ্জা যেন ঢেকে ফেলল। তার বিব্রত ভাব কাটাতে এবার বিজনই বলে উঠল, ‘মৃদু, বাকি জীবন একসঙ্গে চলার ফয়সালা তো আমরা করেই ফেলেছি! আমাদের সিদ্ধান্তকে তুমি কীভাবে নিলে সেটাও একবার আমরা যাচাই করে নিতে চেয়েছিলাম।’

‘বাবা…,’ মৃদুলা খুশিতে উদ্বেল হয়ে উঠে এক হাতে বিজন, অন্য হাতে বন্দনার হাত ধরে বলে উঠল  ‘আমি একলা থাকতে থাকতে হাঁফিয়ে উঠেছি বাবা। আমারও মায়ের হাতের ছোঁয়া পেতে ইচ্ছে করে…।’ মৃদুলার চোখের কোনে টলটল করা জল বন্দনার মাতৃহূদয়কে উদ্বেল করে তুলল। হঠাৎ-ই মনে হল, এই ভালোবাসার জন্য এতকাল মরুভূমি হয়ে ছিল তার মনের ভিতরটা।

মৃদুলা পাশের ঘরে চলে যেতেই বিজন বলল, ‘বন্দনা, তোমার কোনও আপত্তি নেই তো?’

‘কীসে আপত্তি?’ খুব অবাক চোখে বিজনের দিকে তাকিয়ে বলল বন্দনা। আবার একটা পাকদণ্ডির সামনে এসে দাঁড়িয়েছে বন্দনা। কিন্তু এই পথটা যেন তার আর অচেনা ঠেকছে না।

‘না, মানে…।’ কোনওমতে বলল বিজন।

‘আর না-মানে, না-মানে করতে হবে না। অনেক হয়েছে, এবার ওঠো। মৃদুলাকে নিয়ে আজ রাতের খাবারটা বাইরেই সারব। দেখলে না মেয়েটা কত দুঃখী!’

 

অবস্থান

দরজাটা বন্ধ করে দাও রাজু…। অঙ্কিতা অফিস বেরোল। সিল্কির সঙ্গে পাজল গেম খেলছিল রাজু বারান্দায় বসে। শুনল কি শুনল না, রাতে রান্না বসাতে গিয়ে চোখ কপালে উঠল অনুর––কুকারটা গেল কোথায়! দরজার পাশে এঁটো বাসনের সঙ্গে ছিল যে!

টুলুর মেজে ধুয়ে রেখে যাওয়া বাসনের বাস্কেট, আরও যথা যথাস্থানে হাতড়ে না পেয়ে হতাশ অনু রাজুর সামনে চড়াও হল, দরজাটা তখন বন্ধ করেছিলে রাজু?

দিনভর বন্দিদশা কাটিয়ে গায়ে শার্ট চড়াচ্ছে রাজু। বেরোবে। কুকারের কথায় ভ্রূ কুঁচকে তাকাল,

–মানে… তখন সিল্কি এমন…।

– বাহ্। অনু স্পষ্টত বিরক্ত।

– তাই বলে দরজা বন্ধ হবে না! নতুন জায়গা অচেনা পাড়া, পাশের ফাঁকা মাঠ দিয়ে ময়লা কুড়োতে এসে উঁকিঝুঁকি মারে। একদিন তো ঢুকেই পড়েছিল, এসব তো জানোই…।

রাজু একটু ইতস্তত করে বলল,

– কিন্তু চোর কি শুধু কুকারটাই নেবে! খুঁজলে সব?

অনুর মুখ গনগনে। মিল্কি তার মা আসামাত্র গা লেপ্টেছে। রাজু নিজেও খুঁজতে শুরু করে। বিরক্ত অনু থামা দেয়-– হয়েছে। আর খুঁজে কী হবে! দরজার পাশেই ছিল, খোলা পেয়ে সহজেই নিয়ে সটকান মেরেছে।

ফলত এক অপরাধবোধ এখন। মোড়ের গুমটি থেকে সিগারেট কিনে খাওয়া, কি পাড়ার ছোট্ট ক্লাবঘরে এক চক্বর দিয়ে আসবে, সেই ফুরসতও তার নিজস্ব নয়। কখন কোন দিক থেকে হুকুম আসবে। কোনটা জরুরি হয়ে উঠবে তার ঠিক নেই। আপাতত মশার ধূপ জ্বেলে দিল রাজু। ঘরে পাখা চলছিল। অফ করল। সামান্য একটু অপেক্ষা করল কোনও ফরমায়েশের। পরে বাজারের থলিটা টেনে নিয়ে হাতে মুড়ল। চাল কেনার বাকি টাকাটা সকালে ফেরত

– যায় নি, যাহোক বাজার আনবে ওই থেকে।

নজর করে অনু বলল, ড্যাডিকে চা খেয়ে যেতে বলো মিল্কি।

চটি পরা স্থগিত থাকল। এমনটাই যেন চাইছিল রাজু। এইভাবে ডেকে  চা বা আড়াইশো গ্রাম পেঁয়াজ এনো, বলার ভেতর দিয়ে অনুরও যেন কোথাও খানিক মেরামতির ছুতো থেকে যায়।

কাপ হাতে চেয়ারে বসেছে রাজু। সামান্য তফাতে অন্যমনস্ক অনু। অফিস ফেরত শাড়ি পালটে নাইটি পরেছে। কিন্তু চুলে চিরুনি পড়েনি। ঝুরো ক’গাছি চুল লেপটে আছে বাঁ-গালে। চিবুকের ডৗলটুকু বেশ আধখানা ডাঁসা পেয়ারার মতো। প্লাক্ড ভ্রূর নীচে টানা টানা চোখ দু’টো যেন গাত্রবর্ণকে অনেকটাই ছাড় দিতে পেরেছে। চেহারা কিছুটা ভারীর দিকে হলেও টান টান শাড়ির প্যাঁচে তন্বির চেষ্টা আছে। তবু নজর করলে ফরসা ঢ্যাঙ্গা রাজু ওর ছোটো না বড়ো ভাবতে হবে…।

কাপ নামিয়ে গলা ঝাড়ল রাজু

– অনু, দরজাটা বন্ধ করে দাও…।

সাড়ে ছ’শো স্কোয়ার ফিটের ছোট্ট বাড়িটা শান্তনু শুরু করলেও শেষ করে যেতে পারেনি। বাকি যা ছিল, শোক সন্তাপ কাটিয়ে অঞ্চিতা তাতে হাত দেয়। ভাড়া বাড়ির বসবাস মার মৃত্যুর সঙ্গেই চুকিয়ে, বছরখানেক হল তাদের এখানে আসা।

জায়গাটা এখনও নিরিবিলি। বাইপাস সন্নিকটে না হলেও, জমি ডোবার দ্রুত ভরাটে দোকান, বাড়ি, বাজার যা এগোচ্ছে, বাইপাস সংলগ্ন হতে বেশিদিন লাগবে না।

নতুন কালভার্টের কাজ চলছে, সেটা পেরিয়ে রাজু যেখানে এসে দাঁড়াল, ঝাঁ-চকচকে সুপার মার্কেট-এর এক মিনি মডেল। চতুর্দিকের আলো ঠিকরে ঝলমল করছে দোকানের সম্ভার। এখান থেকে একটি কুকার কিনে অনুর পাশে দাঁড়াতে পারলে পরিস্থিতিটা হয়তো পালটাত। কিন্তু তার পার্সে দু’শোরও কিছু কম পড়ে আছে।

– রাজুদা, তুমি কোথায়?

কানে মোবাইল তুলে নিয়েছে রাজু।  নাম্বারটা দেখেও, কেটে না দিয়ে বলল, বল!

– এই আর কী! মানে বলছিলাম যে…।

শুনতে গরজ নেই রাজুর। চণ্ডীতলার বঙ্কা যে কি বলবে তার জানা। কেনা-বেচার কোনও চক্বরে সে আর নেই। অনেক হয়েছে। শেষে মূলধনেরই পুঁজি থাকে না, তো লাভ। পরে মহাজনের দ্বারস্থ হওয়া, সে এক শনির কোপ। পিছল সেই খানাখন্দে হাঁটার কথা ভাবলে এখনও গায়ে কাঁটা দেয় রাজুর। বস্তুত হিংস্রতার উগ্র আদি বীজ কি রক্তে ওর আদৗ ছিল!

বাপ যার নিরীহ ছা-পোষা রং মিস্ত্রি! তিনতলা বাঁশের ভাড়া থেকে পিছলে পড়ে থেঁতো হল! নেহাত পেটের দায়ে পথের বিচার সম্ভব হয়নি, তাই রাজু কোন পথে না হেঁটেছে। সম্মুখ যখন ধূধূ, দল-দ্বন্দ্বের হাতিয়ার হতেও পিছপা হয়নি। হাত পাকাতে ছোটোখাটো হাতাহাতি চলছিলই। বড়ো সংঘর্ষের সূচনায়, মানে, এলাকা দখলের ছুরি শান দেবার পর্বে পিছোতে হল রাজুকে। লাশ ফেলে দেওয়া যেখানে মুহূর্তের ডিসিশন মাত্র। নিমরাজি ইচ্ছাটা শেষতক সেখানেই ফনা গুটিয়ে নিয়েছিল ওর। বেরিয়ে আসা সহজ ছিল না। যদি না গাড়োল ভেবে নিয়ে তারা লাথি ঝাড়ত।

সেই টানাপোড়েন, সেই মরিবাঁচি সময়ের কতককাল পরে আজকের অধ্যায়টির সূচনা…। মা ভাই নিয়ে একত্র বসবাসের পাট চুকিয়ে তবেই না…। বঙ্কাকে জানিয়ে দিল, আমার সময় হবে না রে বঙ্কা… আমার মেয়ের কাল পোলিও আছে।

– তোমার মেয়ে। বলছ কী, সে আবার কবে হল? খুক খুক হাসছে বঙ্কা। নাকি রাজুরই মনের ভুল, কেটে দিয়ে বাজার ঢুকে পড়ল সে।

জাঁকিয়ে বসেছে সবজির সান্ধ্যহাট। বিট গাজর আলু কাঁকরোল, শেষে কিনল আড়াইশো পেঁয়াজ। মোচা কেনার ইচ্ছা থাকলেও সেটা তাকেই ছাড়াতে হবে ভেবে নিল না। ক’টা মুসম্বি রাখল সিল্কির জন্য। এই ফলের রসটুকু আর অফিস ফিরে মেয়ের পড়া, খাওয়া ছাড়া বাদবাকি যত হ্যাপা রাজুর। স্কুল ইউনিফর্ম পরিয়ে সাইকেলে স্কুলে ছেড়ে আসা, ঘড়ি ধরে ঘরে আনা থেকে খাওয়ানো, ঘুম পাড়ানো– সব। মেয়ে না ঘুমিয়ে বলল, কার্টুন চালাও। রাস্তার ডুগডুগি শুনে বাঁদর-নাচ দেখতে চাইল। বলল, মিউ ধরে আনো। কেক খাব। চাউ বানিয়ে দাও। বলল, আমার বন্ধু জিজা তো মার কাছে ঘুমোয়। ওর কোনও ড্যাডি নেই, বাপী আছে… হাজারো প্রশ্ন আর বায়না।

এসময় অদ্ভুত একটা তুলনা মনে এল রাজুর। মঙ্গলা হাট থেকে কিনে ট্রেনে রিকশায় কাপড়ের গাঁটরি বয়ে এনে দোকানে ধরানো, কি সাইকেল চাপিয়ে ফিরি করা, অন্যদিকে সর্বক্ষণ এক মেয়েলি ঘরকন্নার ঊনকোটি দায় সামাল দেওয়া, দুটো কাজের শ্রমগত লাভটা কোনদিকের বেশি।

চট করে একটা সিগারেট ধরিয়ে ফেলল সে। ভাবল, শ্রমের পাল্লা যেদিকেই ঝুঁকুক, এখানে তার আসা– বিপদে বিপথে বিপর্যস্ত এক যুবকের অবস্থার বিপাকে মাথা বিকানো হিসেবে। অন্যদিকে স্বনির্ভর, সসন্তান এক বিধবার সঙ্গহীন স্বেচ্ছাসমর্পণ। সেদিক দিয়ে দেখলে, প্রয়োজনের পাল্লাটি কোন দিকে কতটা ভারী, নাকি ভারসাম্যতা রাখছে, সেটা খতিয়ে ভাববার।

রাজু হিসাব গুলিয়ে বাড়ির পথ ধরল। ক্লাবে যাবার ইচ্ছা থাকলেও বুধবারে সেখানে তালা ঝোলে। মনটা গুমোট। বাড়ি ঢুকে ততোধিক গুমোট ঠেকল পরিপাশ। সাড়াশব্দহীন ঘর। টিভি। সিল্কিও। এমন উত্তুরে হাওয়া সতর্ক করল রাজুকে। মেয়েকে নিয়ে শুয়ে পড়েছিল অনু। দরজা খুলে দিয়ে আবার ঢুকে গেছে, আর এলই না। চুপচাপ বাজারের থলি চুবড়িতে উপুড় করল রাজু। প্যাসেজে আলো জ্বালাতেই চোখে পড়ল টেবিলে খাবার ঢাকা। ক্লাব থেকে ফিরতে দেরি হলেও তো এটা হয় না। আজ তো ক্লাবই নেই। ন’টাও বাজেনি এখনও। প্লাস্টিকের ঢাকা তুলে দেখল রুটি ডাল ডিমের কারি সাজানো একটাই প্লেট। অনুরটা কোথায়! আগে তো খায় না। না খেয়েই শুয়ে পড়ল নাকি!

খাবার দেখলে খিদে চাগাড় দেয় রাজুর। ক্ষুধা লজ্জাহীন। জীবনভর এই তাড়নাটা তাকে নানা ঘাটের জল খাইয়েছে। কত যে কঠিন সময় তাকে পেষাইকলের দাঁতের মতো চিবিয়েছে! প্রত্যয় হয়েছে, সব মানুষই ক্ষুন্নিবৃত্তির শর্তে বাঁধা।

ঝপ্ করে ঢাকনাটা নামিয়ে দিল প্লেটের। অনুকে বাদ দিয়ে খাওয়া ঠিক হবে না। মান-অভিমানের একটা বড়ো ভূমিকা আছে এই খাওয়ায়। সাধাসাধিতে সেটা ভাঙতে পারলে লাভ ছাড়া ক্ষতি নেই। কিন্তু কীভাবে এগোবে!

– তুমি খাবেনা অনু! শরীর খারাপ? শুয়ে পড়লে যে!

অনু হয়তো কথাই বলল না। বললেও দায়সারা গোছের, – তুমি খেয়ে নাওগে না। আমার ইচ্ছে নেই।

শুনেই হামলে পড়ে একা খাওয়া ভালো দেখায় না। হয়তো বলা উচিত, তোমাকে ছাড়া আমি একা কোনওদিন খেয়েছি, অনু! প্লিজ… ওঠো…! নিজের মনেই হাসল রাজু। কথাগুলো সাজিয়ে গুছিয়ে অনুর কাছে গিয়ে দাঁড়াল আদত বুঝি খিদের টানেই।

বাক্যব্যয়হীন দিন দুই পর ছুটির দুপুরে অনুকে সহজ হতে দেখা গেল।

ঘরের আসবাব ঝাড়পোঁছ করছিল রাজু। দেয়াল থেকে ল্যামিনেট করা দাম্পত্যের ছবিখানা নামিয়ে, সেখান থেকে ভোঁতা নাক, খুদি চোখ, পুরু ঠোঁটের পুরুষটিকে কি বাদ দিয়ে ধুলো মুছবে রাজু!

পাশের কনেবউ যেখানে আজকের অঙ্কিতা !

দুর্ঘটনার দু’মাস পর সিল্কির জন্ম না হলে আরও একখানি ছবি ঝুলত দেয়ালে। একইভাবে সে ছবি মুছত সে। এই ভবিতব্যের প্রথম দৃশ্য তাই মনে রয়ে গিয়েছে তার।

হসপিটাল থেকে ফিরছে প্রসূতি, ন্যাপিতে মোড়া শিশু। দুধেল গন্ধ মাখা প্রথম বিষণ্ণ মাতৃত্ব। সঙ্গে বৃদ্ধা মা, গলায় গুনগুনে কান্নার বিলাপ। রাজু ছিল ওই অটোর সহযাত্রি। গাড়ির চালক দীপক তার বন্ধু। উচ্চকিত মনটা রাজুর পড়ে ছিল অনিশ্চিত ফায়দার দিকে। বয়ে আনা জামাকাপড়ের গাঁটরির বিক্রি ব্যবস্থা করার আছে। দোকান মালিকের কিস্তিমাফিক টাকায় তেমন লাভ হয় না। নিজস্ব ফিরিতে থেকে যায় উশুলের একটা দুর্নিবার লোভ। দরদামের কচকচি। যেটায় রাজু তেমন পোক্ত নয়।

চিন্তাগুলো ঘোঁট পাকালেও চোখকান পিছলে যাচ্ছিল পাশ্ববর্তিনীর দিকেও। পুতুলের মতো লালচে বাচ্চাটা নজর কাড়ছিল। সেই শুরু…। আর কে না জানে, কোনও সূত্রপাতেরই গড়িয়ে যাওয়ার কোনো নির্দিষ্ট নিয়ম নেই। যাতায়াতে, সাহায্যে – সহযোগিতায়…। পাড়াটি যখন সংলগ্ন আর অটোড্রাইভার দীপক যার বন্ধু…।

ছবি মুছতে মুছতে দেখল রাজু, সামনে দাঁড়িয়েছে দেড়খানা মানুষ।

ভ্রূ নাচাল সে। সিল্কি না মা-কে? সিল্কি ছিল মার কোলে। মাঝেমধ্যে মেয়েকে সাধ করে কোলে নিয়ে ঘুরে বেড়ায় অনু। দিনভর সঙ্গহীনতার চাপা ভরতুকি!

রাজু বলল, কুকারের শোকপালন শেষ হল?

উত্তর এল না।

– তার মানে ওটা পাওয়া গেছে?

– অত সোজা। চোর যেন ফিরিয়ে দেবার জন্য নিয়েছে। সিল্কিকে নামিয়ে অনু মোড়া টেনে বসল। ঝাড় পোঁছে অনুর সঙ্গে শান্তনুকেও সমান মনোযোগ পেতে দেখেই কি এই প্রসন্নতা! মাথা ঝুঁকিয়ে রাজু যখন শান্তনুর চওড়া কপাল থেকে ধুলোর আস্তরণ তুলছিল, অনু ছিল পিছনে, নিঃশব্দ। এখন মুখোমুখি বসে বলল, রাজু, তুমি অনেক কিছুই বোঝো, আবার কিছু জিনিস বোঝার চেষ্টাই করো না।

চশমা ফোঁড় চেয়ে থাকল রাজু সেই বোঝার চেষ্টায়। অনু চোখ সরিয়ে নিয়ে বলল, দিনটা ছিল সেভেন্থ মার্চ…।

–তো! বলেই হঠাৎ মনেপড়ার উদ্ভাসে বলল সে, তাই তো! অনু চোখের জল সামলে বলল, কুকারটা শান্তনু আমাকে সেকেন্ড অ্যানিভার্সারিতে প্রেজেন্ট করেছিল। আমি মাংস রেঁধে খাইয়েছিলাম। অতীত স্মৃতির কাতরতা সামলে বলে, আসলে, যে সময় থেকে স্বামীরা বউকে শুধু বিছানাতেই নয়, রান্নাঘরেও দেখতে চায়, সেই সময়ের কেনা আর কি।

অধোবদন রাজু অনুর একটা দীর্ঘশ্বাস পড়তে শুনল। হাতটি বাড়িয়ে অনুকে ছুঁয়ে বলল, সরি অনু!

উঠে পড়ে দেয়ালে ছবিটা সেট করে রাজু হাত ঝাড়ল। এইভাবে যদি ঝেড়ে ফেলা যেত চোরা ক্ষোভ দ্বন্দ্বের মালিন্য, ধুলোবালির মতোই। তা কী আর হয়! গভীর কারও দুঃখ প্রকাশের সামনে বিমুখতা কী শোভন! জীবন যেখানে সহভাগে মিশেছে। যেজন্য নিজেকে জুড়েছে অনু। তারই পাশাপাশি নিবিড় মিলমিশের এই যে আয়োজন! উন্মুখতা যেখানে একই তৃষ্ণার তাগিদে একাকার! অনু কি তা জানে! নাকি সহজলভ্য দাম্পত্যে তার সেই খেয়াল দরকার পড়ে না! রাজু তার মুখের ভাব লুকোতে ঊধর্বমুখ উত্তর খোঁজে। হাতে তার ঝুলদন্ড।

ছুটির দিন সিল্কির স্নানখাওয়া মার হাতে। কিছুটা পাশ কাটাতে অন্য কাজে ব্যস্ত থাকে সে। কিন্তু মায়ের গল্পবিহীন ধমকভরা ভাতে সিল্কির গরজ নেই। শুরু হয়েছে ড্যাডির বায়না। এদিকে আলমারির পিছনে মস্ত এক মারড়সা রাজুর নজরবন্দি, ঝুলকাঠিতে জাল সমেত টেনে আনতে যাবে, অনু তার হাত থাবড়ে বলল, ওসব ছাড়ো তো এখন! আগে তোমার মেয়ে সামলাও…।

…সপ্তাহ শেষের দুপুরটা আজ অনুর পাশে গড়ানো গেল না। কাজের মেয়ে টুলু এসে গেল বিকেলের কাজ দুপুরে চুকোতে। রাজু ঠায় চেয়ারে তার পাহারাদার, যতক্ষণ না সে কাজ সেরে বেরিয়ে যাচ্ছে। ফলত ভাতঘুম-ছুট মাথাটার দখল নিল এমন কিছু চিন্তা, যা তার দিনগত আচরণে মিলবে না। অলস মস্তিষ্কের ধর্ম! হবে বা। রাজুর তো মনে হয় শর্তমাফিক রাজুতেই আছে সে। কালি মিশেল হু হু ধুম্র তবে কেন। কোন রন্ধ্র দিয়ে মাথায় ঢুকে তছনছ করে দেয় নিভৃত কুলুঙ্গিটি! যা হয়তো সময়ের অপেক্ষায় তুমুল হতে পারত– কিন্তু রাজুর সতর্কতায় তা হয়নি।

ল্যান্ডফোন বাজল…। কেটেও গেল। উঠতে গিয়ে ওঠা হল না। সদ্য কুকার খোয়া গেছে। ভাবল সে, টুলু গেলে দরজা বন্ধ করল কী! ঘুম থেকে উঠে এই নিয়েই হয়তো ধুন্ধুমার হবে অনু। যাকে যা মানায়। ওর লাইফ স্টাইলে এটাই স্বাভাবিক। শান্তনুর মৃত্যুবাবদ চাকরিটি ওর বেঁচে থাকা কায়েম করেছে। দ্রুত বৈধব্য ঘুচিয়ে রসে বসে রেখেছে আর একটি পুরুষ। রীতিমতো রেজিস্টার্ড স্বামী রাজেন্দ্র দাস। দাসানুদাস। দাসত্ব এমন যে, ছাড়তে হয়েছে রক্তবন্ধনও। মা ভাইয়ের ফোন এলে রাজু ফাঁপরে পড়ে যায়। অনুর ভ্রূ এলোমেলো হয়। মুখ তৗল করে বলে, কে এত ফোন করে বলো তো! তোমার কী ঘরসংসার বউবাচ্চা নেই? কথা বাড়বার আগেই ফোন কেটে দেয় সে।

সময়ের দখলদারিতে অনুর অধিকার, কি আদ্যন্ত নির্ভরশীল এক যুবকের এই অবনমন, রাজুর অস্বাভাবিক মনে হয় না। ক্ষুণ্ণতা তার অন্য জায়গায়। একটি পূর্ণবয়স্ক পুরুষশরীরে অদম্য হয়ে ওঠে যে প্রদানক্ষমতা, যার তাড়না একসময় তাকে প্রজন্মকামী করে তুলতেই পারে– এখানে তা নস্যাৎ করেছে অনু সিল্কিকে একক মনস্থ রেখে। রাজু সিল্কির ড্যাডি। বিনা বিস্তারে রাজুর বংশ? তা হলে…।

এই সময় সেই চারাগাছটির কথা মনে পড়ে রাজুর। কোনও একসময় সবজি চালানের ব্যাবসায় নেমেছিল যখন, মহিষবাথান থেকে জোগান আনতে বাসস্ট্যান্ডে নেমে মেঠোপথে খানিক হাঁটতে হতো খেতের দিকে। রাস্তার পাশে বুনো ঝোপঝাড়ে মিশে থাকা একটি ছোট্ট গাছ, যাকে সে জলধারায় ভিজিয়ে তখন প্যান্টের বোতাম আঁটছে, চকিত চেনায় মাথাজোড়াহীন সেই চারাগাছের দশা দেখে কে বলবে সেটি লংকাগাছ। বিশেষ ঝাঁজ ঝাল যার প্রকৃতিগত। কিন্তু ঘন সন্নিবেশিত কাঁটা ঝোপ তাকে বাড়বার পরিসর দেয়নি। বস্তুত অঙ্গ থেকেও অঙ্গহানি যার, মরণ কি শুধু মরণেই! মাথা নাড়ায় রাজু। পিছনের উত্তপ্ত দিনগুলোর কথা ভেঙে হৃৎপিণ্ড উত্তাল হয়ে ওঠে।

লোডশেডিং। সিল্কি কান্না জুড়েছে।

– একটা পাখা দাও তো…।

গ্রিল বারান্দা থেকে রাস্তার চলাচল দেখছে রাজু। হেলদোল নেই। সদ্য তৈরি ঝকঝকে রাস্তায় আড়াআড়ি একটা বেড়াল পেরোল। কিন্তু কালো নয়। তবু ব্রেক কষে থেমে পড়েছে হাই স্পিডের স্করপিওটি। নিজের মনেই হেসে ফেলল রাজু। …হায় জীবন…।

– কি গো একটা পাখা চাইছি যে…।

অনুর মেজাজ চড়ছে। কটু কথায় তিক্ত হচ্ছে রাজুরও জিভ, চাপা স্বরে বিড়বিড় করল, –দিচ্ছি রে বাবা দিচ্চি… আচ্ছা বে-শরম মেয়েছেল বটে, উঠে পাখাটাও আনতে পারে না! পাখা হাতড়ায় রাজু। কিন্তু কোথায় পাখা! কারেন্ট এলেই যার প্রয়োজন শেষ। খাদানের কুলির মতো খেটে খেটে আর ফুসফুস নিঙড়ে এদের হাওয়া দিয়ে রাজু হবে ডাঙার মাছ। খাবি খাবে।

এইভাবেই অভ্যস্ত আপোসনামা ছিঁড়ে মানুষেরও কখনও কখনও এনার্জিক কারেন্ট চলে যায়। ঘনঘোর অন্ধবোধ বড়ো দুর্বহ তখন, ঠিক এই মুহূর্তটির মতো।

আবার ল্যান্ডফোন…। বাজছে তো বাজছেই।

অনুর তিরিক্ষি নির্দেশ আসবার আগেই দৌড়োল রাজু, – হ্যা..লো..ও..। মুহূর্তেই তার স্বর নেমে এল একপরত – ধরুন, ম্যাডামকে দিচ্ছি…।

খাটের পাশে এসে দাঁড়াল সে প্রকৃত নফরের মতো, বলল, তোমার ফোন। গলার খন্দে আটকে থাকল বাকি কথা।

– কার? অনু চোখ কুঁচকে মাথা তুলেছে।

– ব্যাংকলোনের। চোখ সরিয়ে মাথা নামাল রাজু। রাজুর বিগত ধারদেনার জন্য ব্যাংকলোন নেওয়া আছে অনুর। কিন্তু সিল্কির এককালীন স্ল্যাডমিশন ফি জোগাতে আপাতত সেটা বাদ পড়েছে দু-মাস। অনুর এই অপারগতায় তার যথেষ্ট দুঃখবোধ হলেও, এখান থেকেই যে সুরক্ষাটি তাকে বর্তমান অবস্থানে এনেছে, সেই স্বস্তিসুখও এড়াতে পারে না। একের দায় অন্যে বহন করার মূল রসায়ন সম্বন্ধে আর একটু সচেতন হল কী সে! হয়তো বা। বিছানায় অনুর অনিচ্ছ উঠে বসা দেখতে দেখতে কেনই বা ভেসে উঠবে সেই রসায়নের ছবি। রাজুর পায়ে হোঁচট খেয়ে কবে একদিন পা ছুঁয়ে হাতটি মাথায় ঠেকিয়েছিল অনু। কাছে টানতেই মনোরম হয়ে উঠেছিল সেই সমর্পণ। রাজু বলেছিল, আরে, আরে, প্রণাম কেন। এসব আর চলে না অনু। উচ্ছ্বসিত হয়ে অনু বলেছিল, সময়টা দু’হাজার প্লাস বলেই তুমি এটা বলতে পারলে রাজু। আমাদের দিদিমণি বলতেন, রামায়ণের যুগে মেয়েদের তো পুরুষমানুষের নীচে রাখতে ঊনমানুষ বলা হতো।

দু’জনেই হেসেছিল খুব। সময়মতো সুখস্মৃতির উদ্ভাস যেন বিবেকের পালাগানের মতো সচেতন করে রাজুকে।

অন্তরঙ্গ এমন ঘেরাটোপের পিছনেই তার হিম স্থির এক অতীত, সে জানে। কত যে খণ্ডদৃশ্য। ফিরে ফিরে আসে জিতু রতন গিরিধারীরা…। ঘনশ্যাম দল পালটালেও মদের ঠেক ওকে ছাড়তে হয়েছিল পাবলিকের মারের চোটে। রতন ওয়াগন ব্রেকিং-এ পুলিশের তাড়া খেয়ে ট্রেনে কাটা পড়ল। পড়ে থাকল লাইনের ধারে। খবরটা রাজুকেই দিতে হয়েছিল ওর মাকে।

আর ছিল গিরিধারী। জ্যাংরা এলাকায় নির্মিয়মান ফ্ল্যাটে বিশিষ্ট একজনের জন্য মধুচক্রের ব্যবস্থা করে দিতে গিয়ে, মূল মেহমান ও অন্যান্যরা সটকালেও ধরা পড়ল শুধু গিরিধারী। পুলিশের মারে সে কী ফালাফালা পিঠ। রাজু গা-ঢাকা দিতে পেরেছিল– ক’দিন মাসির বাড়ি বাগনান পালিয়ে।

…সেইসব সহযাত্রীরা …দিকশূন্য বাজপাখিগুলি…। তাদের মুখ থুবড়ে পড়া থেঁতো রক্তাক্ত মুখ, রাতের ঘুম কেড়ে নেয় রাজুর আজও। অস্থির উত্তাল সেই দুর্বহ বোধই কী স্তিমিত হয়ে ফিরিয়ে আনে তাকে আপাত অবস্থানে! তাই যদি, তাহলে খেদ অসন্তোষের দিকগুলি বাদ দিয়ে বাকিটা রাজুর কেমন? কতটা ভাল?

না, প্রাপ্তির তলদেশ ঘাঁটতে আর ইচ্ছা হয় না। বরঞ্চ ভেবে নেওয়া যাক জল বাদ দিয়ে দুধ যেমন একা উথলোয় না, সংসারে দুঃখ সুখের অবস্থানও অনেকটা সেইরকম…। এটাই বোধহয় নিয়ম।

এরপর তার দীর্ঘসময়ের গুমোট নিশ্বাস মোচন, আর পরবর্তী সুখটানের মতো টেনে নেওয়া তাজা বাতাস, দু’টোই তাকে এমন আশ্চর্য সহায়তা দেয় যে, হঠাৎ খেয়াল হয় হাতপাখাটা খুঁজে পেয়ে হাতে নিয়েই তো দাঁড়িয়ে আছে সে। অনু খাট থেকে নামতেই ছিট্কে পড়া তার চপ্পলজোড়া পা দিয়ে টেনে এগিয়ে দেয় অনুর পায়ের নীচে। অবিন্যস্ত নাইটি সামলে, পায়ে চটি গলিয়ে উদভ্রান্তের মতো ফোন ধরতে যাচ্ছে অনু। অপলক রাজু সেই মুখ দেখতে দেখতে সিল্কিকে বাতাস দেয়। ভেবে রাখে, অনু এলে তাকেও দেবে…।

মায়ানদী

‘এই ছেঁড়া মাতলা!’

শান্তনুর এত বিস্ময়ের কারণ খুঁজে পেল না মারুনা। মাতলার একটা ছোটো শাখা নিশ্চয়ই, তাই ছেঁড়া মাতলা। কিন্তু শান্তনুর কথায় মনে হচ্ছে এই নদীর অনুষঙ্গে কোনও স্মৃতি মনে পড়ে গেছে ওর! যাকে বলে অ্যাসোসিয়েশন মেমরি। চোখটা জ্বালা-জ্বালা করে উঠল তার। তাদের সব জার্নিতেই কি পিয়ালীর ব্যাগেজ বয়ে বেড়াতে হবে?

গতকাল থেকেই লক্ষ্য করেছে যে-কোনও স্পটে পৌঁছেই শান্তনু বলছে ‘এখানে আমরা এসেছিলাম।’ এমনকী ছবি তুলতে তুলতে বলল ‘ঠিক এই সিঁড়িটার সামনে পিয়ালীর একটা ছবি আছে। স্মাইল!’ মারুনার হাসিটা বেঁকে গিয়েছিল ধেবড়ে যাওয়া কাজলের মতো। শান্তনুর এই হৃদয়হীন ব্যবহারের কোনও অর্থই খুঁজে পায়নি মারুনা। মারুনা তো সেধে ওর জীবনে আসেনি, পিয়ালীকেও তাড়ায়নি।

মানুষের জীবনের প্রথম আতান্তরটি বোধহয় ‘ওই যাঃ, পাখি উড়ে গেল, দুশ যাঃ!’ উড়ে গেল, না উড়িয়ে দিল কেউ, মারুনা বুঝতে পারেনি। শান্তনুর সঙ্গে এই দেড়বছরের একত্রযাপনে কখনও এসেছে এমন সঙ্কট? আসেনি। সে বরাবরই অজস্র মনোযোগ পেয়েছে, অজস্র আদর, তার মনে হতে শুরু করেছিল সে একেশ্বরী। কিন্তু সুন্দরবনে না এলে সে যে এত দীন– তা তো বুঝতেই পারত না।

আপনজন হোটেল, পাখিরালয়, ঘাটে নেমে জায়গাটার কোনও বিশেষত্ব খুঁঝে পায়নি। ঘাটের কাছে, যেমন হয় আর পাঁচটা পর্যটন কেন্দ্রে, হরেক জিনিসের দোকান, ডাব খাবার ভিড়, সেগুলো ফেলে বাঁদিকে গিয়ে একটা ছোট্ট কাঠের সাঁকো পেরিয়ে ওদের হোটেল। বিশাল বড়ো, আর ছিরিছাঁদহীন, বাথরুম-টাথরুম খুব খারাপ নয়, কিন্তু পুরোটাই জেনারেটর নির্ভর। বাপরে! এই মার্চ মাসে দোলের সময় এখানে আসে কেউ? মারুনার মনে হল ওরাই এ মরশুমের শেষ পর্যটক।

আসলে এবার ওদের অন্য কোথাও যাবার কথা ছিল। কখনওই সুন্দরবন নয়। কিন্তু মারুনার একটা ইন্টারন্যাশনাল সেমিনার হবার কথা ছিল জানুয়ারিতে, সেই জন্য লম্বা কোনও টুর আগে থেকে বুক করা হয়নি। অথচ সেই সেমিনার জানুয়ারিতে হল না, পেছিয়ে গেল, মাঝখান থেকে লম্বা টুরও হল না। মারুনা প্রস্তাব দিয়েছিল, ‘চলো গাড়ি নিয়ে লং-ড্রাইভে বেরিয়ে পড়ি’ শান্তনু অন্যমনস্ক গলায় বলেছিল, ‘তুমি তো গান জানো না!’

কথাটা ঠক করে লেগেছিল মারুনার বুকে। ও জানে, এরপর অবধারিতভাবে পিয়ালীর গানের প্রসঙ্গ আসবে। পিয়ালী দারুন গান গাইত, রবীন্দ্রসংগীত থেকে সেমি ক্লাসিক্যাল সবই। মারুনা চুপ করে শুনবে, কোনও কথা বলতে পারবে না, কারণ কথাটা তো সত্যি। পিয়ালী তো সত্যিই দারুণ গান গাইত। ওর গান শুনে মারুনাও তো মুগ্ধ হয়েছে, এখনও হয়। ওর একটা গান এখন এফএম, টিভি, পুজো প্যান্ডেল সর্বত্র বাজছে, বলিউডে বড়ো ব্রেক পেয়েছে যে-গানটা গেয়ে ‘নাজুক কলহাইয়া মোরি’।

মারুনার তবু চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করেছে, ‘আমি গান জানি না বলেই তো আমাকে বিয়ে করেছ তুমি। এখন তা হলে আমাকে নিয়ে লং-ড্রাইভে যেতে অসুবিধে কোথায়?’

বড়ো টুর হল না, লং-ড্রাইভ হল না, ফেব্রুয়ারিতে মারুনার মা অসুস্থ হলেন হঠাৎ, তাঁকে নিয়ে নার্সিংহোম, ঘর ছোটাছুটি– শান্তনুই করল বেশি। মার্চ আসতে দুজনের মনের অবস্থাই সাংঘাতিক, কোথাও একটা যেতেই হবে। শহরের সব ট্র্যাভেল এজেন্সিতে খোঁজ নিয়ে দেখা গেল বেদুইন ট্রাভেলসেরই, দোলে সুন্দরবন প্যাকেজে দুটো সিট পড়ে আছে। ঝটপট সেটাই বুক করে ফেলল শান্তনু।

সত্যি বলতে কি, বিয়ের পর এই তাদের প্রথম বাইরে যাওয়া। পিয়ালী শান্তনুকে ছেড়ে মুম্বই গিয়েছিল অনেকদিন, সেখানে কে এক মিউজিক ডিরেক্টর পবন চতুর্বেদীর সঙ্গে লিভ-ইন করছিল, এটাও জানা ছিল। এসব সত্ত্বেও সে শান্তনুকে ডিভোর্স দিতে রাজি ছিল না। মুম্বইয়ে সুবিধে করতে না পারলে কলকাতায় ফিরে আসবে, তাই শান্তনুকে কুশন হিসেবে রাখতে তার ইচ্ছে হয়তো অস্বাভাবিক কিছু নয়। কিন্তু শান্তনু তা মেনে নেবে কেন? শুরু হল টানাপোড়েন। শান্তনু না চাইলেও অ্যাডাল্টরির অভিযোগ আনতে হল। যেহেতু ওটাই স্ট্রং গ্রাউন্ড। অভিযোগ সম্পূর্ণ সত্যি হলেও শান্তনু যে কেন পিয়ালীকে সর্বসমক্ষে ব্যভিচারিণী বলতে চায়নি, তা মারুনার কাছে স্পষ্ট নয়, যেমন স্পষ্ট নয়, পিয়ালী ফেরত নিতে এলেও জরুরি ডকুমেন্টস ছাড়া, তার ব্যবহূত জিনিসপত্র, কসমেটিক্স, ব্যাগ, শাড়ি, অন্য পোশাক, টুকটাক গয়না কিছুই কেন শান্তনু ফেরত দেয়নি, এমনকী পিয়ালীর লঁজারি পর্যন্ত।

ছোট্ট ফ্ল্যাট নয়, বেশ বড়ো বাড়ি শান্তনুর, মাস্টারদা সূর্য সেন মেট্রো স্টেশনে নেমে সামান্য হাঁটলেই বাড়িটা। বাড়ি ঘিরে বিশাল বাগান, এমনকী একটা পুকুর পর্যন্ত আছে। সেই বিশাল বাড়ির একটি ঘরে ঠাসা শুধু পিয়ালীর জিনিস। ওটা আগে ওদের বেডরুম ছিল। এখন শান্তনু তার আর মারুনার জন্য অন্য একটি ঘর সাজিয়ে নিয়েছে। মারুনার প্রতি তার যত্ন ও আদরের কোনও ত্রুটি নেই। মারুনার প্রতিটি সুবিধে অসুবিধের দিকে তার সদাসতর্ক দৃষ্টি। কিন্তু ওই যে তালাবন্ধ ঘরটা, ঘরে ঠাসা পিয়ালীর জিনিস। সারাক্ষণ মারুনার মনের সবটুকু জুড়ে আছে ওই স্মৃতির ঘর। এখানেও যেন সেই ঘরটা সঙ্গে বয়ে এনেছে ওরা। শান্তনু সেটা সারাক্ষণ পিঠে বয়ে বেড়াচ্ছে, আর মারুনা একটুও স্বস্তি পাচ্ছে না, একটুও আনন্দ পাচ্ছে না তাদের বিবাহিত জীবনের প্রথম যৗথ ভ্রমণে। তার খালি মনে হচ্ছে বেড়াতে না এলেই ভালো হতো। বাড়িই ভালো।

নদী এখানে অনেকটা চওড়া হয়ে গেছে, বিকেলের হলুদ আলো গাছগুলোর মাথা আলগোছে ছুঁয়ে আছে। সূর্য ডুবতে বেশি দেরি যে নেই, তা বোঝা যাচ্ছে সবার চোখেমুখে চাপা টেনশন দেখে। সূর্যাস্তের ছবি তুলতেই হবে। বন্দুকের ট্রিগারে হাত রাখার মতো সবাই ক্যামেরা নিয়ে তৈরি। বেশিরভাগই আলাদা ক্যামেরা আনে না আজকাল, মোবাইলেই তোলে। মারুনাও তার মোবাইল বার করে ফেলল। সূর্য, নদী, অরণ্য– নৈর্ব্যক্তিক এই ছবিগুলো অন্তত পিয়ালীর কথা বলবে না।

‘দ্যাখো, দ্যাখো, আমি জাস্ট ভাবতে পারছি না!’

শান্তনু আচমকা এত প্রাবল্যের সঙ্গে তার পিঠে হাত রাখল যে আর একটু হলেই তার মোবাইলটা হাত ফসকে জলে পড়ে যাচ্ছিল। খুব বিরক্ত হয়ে সে পেছন ফিরে বলল ‘যাচ্ছিল মোবাইলটা। এত এক্সাইটমেন্টের হয়েছেটা কী? ঘন্টার পর ঘন্টা ধরে সেই তো জল আর জল দেখে যাচ্ছি।’

শান্তনু নাটকীয় গলায় বলল,

‘জল শুধু জল, দেখে দেখে চিত্ত তোর হয়েছে বিকল– তাই না রে? ওরে অবোধ বালিকা, এক্সাইটেড হব না! ওই যে গাইডটা দেখছ, সকাল থেকে আমাদের পেছনে ফেউয়ের মতো লেগে আছে, ওই যে, কলকেতার বাবুরা হাঁ করে যার জ্ঞানবাণী গিলে যাচ্ছে, ওই লোকটা কে জানো?’

‘কে? ডোনাল্ড ট্র্যাম্প? না রয়েল বেঙ্গল টাইগার?’

‘তার চেয়ে বেশি। সকাল থেকে তাই ওকে এত চেনা-চেনা লাগছিল। আরে সেবার যখন পিয়ালীকে নিয়ে এখানে এসেছিলাম, এই লোকটাই গাইড ছিল। ওর নাম হচ্ছে আশুতোষ খাঁড়া। পিয়ালী ওর কাছ থেকে একটা রুটম্যাপ লিখে নিয়েছিল। লোকটার হাতের লেখা মুক্তোর মতো। পিয়ালী ওকে দুশো টাকা দিয়েছিল আলাদা করে।’

পিয়ালী, পিয়ালী, পিয়ালী! উঃ! মারুনার মুখ নিমেষে ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। তবু সে যথাসাধ্য নিজেকে সামলে নিয়ে বলল ‘কাগজটা কোথায়?’

‘মানে?’

‘ওই যে বললে কাগজে রুটম্যাপ লিখে দিয়েছিল’,

শান্তনুর মুখ হাজার দীপশিখায় জ্বলে ওঠে। ‘আছে। আমি দিইনি তো কিছু ফেরত। আমার সঙ্গে থাকার প্রতিটি মুহূর্ত, আমার সূত্রে যা যা অর্জন করেছে পিয়ালী, সব, সব  রেখে দিয়েছি। ওই তালা বন্ধ ঘরে আছে। ওয়াল ক্যাবিনেটের বাঁদিকের তিন নম্বর খোপে পেয়ে যাবে।’

মারুনা যেন এতক্ষণে একটা আঁকড়ে ধরার মতো কিছু পায়। ওয়াল ক্যাবিনেটের তিন নম্বর খোপে যেন ওর সুখের ঘরের চাবি আছে। সে বেশ গুছিয়ে মোবাইল ক্যামেরা তাক করে পশ্চিম আকাশের দিকে, মুরুবি৩ চালে বলে ‘একি! সূর্যাস্তের ছবি তুলবে না?’

সকাল থেকে যতটা খারাপ গেছে, সন্ধেটা তার তুলনায় অনেক অনেক ভালো কাটল। হোটেলটা খুব খারাপ না। অনেকখানি জায়গা জুড়ে। যদিও কোনও ছিরিছাঁদ নেই, এল শেপের স্কুলবাড়ির মতো। তার ওপর লোডশেডিং-এর দৗরাত্ম্য। বাথরুমে একরাশ অজানা পোকা, গা ধুতে গিয়ে চোখে নাকে ঢুকে গেল। তিনতলার ঘর, ছাদ রোদে তেতে আগুন হয়ে আছে। গা ধুয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়াতে বেশ আরাম হল। সারা হোটেলে নাকি দুটো মাত্র এসি ঘর, যারা আগে বুক করে এসেছে তারা পাবে। নীচে এ নিয়ে চ্যাঁচামেচি শোনা গেল খুব। ম্যানেজারকে যাচ্ছেতাই করে কথা শুনিয়ে এল কয়েকজন। ‘আগে জানালে আমরাও এসি বুক করে আসতে পারতাম। কেন সেই অপশনটাও দেওয়া হল না!’

কিছুক্ষণ চলল এরকম, তারপর সব শান্ত হয়ে এল। আসন্ন সন্ধের মায়া ছড়িয়ে পড়ল আকাশে। বারান্দা থেকে দেখল সন্ধেলাগা নদীর ওপর চাঁদ উঠল, সোনার থালার মতো চাঁদ। মারুনার আচমকা মনে পড়ল আজ পূর্ণিমা। যে সে পূর্ণিমা নয়, দোলপূর্ণিমা। দোল আর পরের শনি-রবি এই মিলিয়েই তো ট্রিপটা সম্ভব হয়েছে তাদের। আজ দোল, অথচ এক ফোঁটা আবিরও কেউ কারও কপালে ছোঁয়ায়নি। ফোনে কয়েকটা মেসেজ এসেছে, ‘হ্যাপি হোলি’। এছাড়া সারাদিনে মনেই পড়েনি আজ দোল। প্রতিবার দোলে তাদের বাড়িতে উৎসবের মেজাজ, মা পূর্ণিমার শিন্নি দেয় একদিকে, অন্যদিকে মামাতো, মাসতুতো, পিসতুতো ভাইবোনেরা মিলে রং মেখে হুল্লোড় করে। এখানে না এলে এবারও সেখানেই থাকত। বুকে একটা চিনচিনে ব্যথা উঠেই মিলিয়ে গেল। মহাসমারোহে দোল পালন করতে না পারা, শান্তনুর লাগাতার পিয়ালী – পিয়ালী– সব মুছে গেল মুহূর্তে। নদী আর তার বুকে মস্ত চাঁদ, মারুনার সমস্ত না-পাওয়াকে তুচ্ছ করে দিল। বারান্দায় আরও অনেকে চেয়ার পেতে বসে গজল্লা করছিল। তাদের কথাও মারুনার কানে গেল না। কতক্ষণ যে সে ওইভাবে বসেছিল কে জানে। হঠাৎ ট্রাভেলসের একটা ছেলে এসে প্লেটে প্লেটে চাউমিন দিয়ে গেল, আর সেটা দেখেই নিশ্চয়ই শান্তনু বেরিয়ে এল ঘর থেকে, ছেলেটাকে বলল, ‘চা দেবে না?’

‘এটা খেয়ে নিন, চা আসছে।’ বাব্বা! ছেলেটার গলা কী গম্ভীর! খেতে খেতে সেই গম্ভীর গলা চড়িয়ে ছেলেটা বলে গেল, ‘চা খেয়ে নীচের লনে আসবেন। যাত্রা হবে।’

‘কী যাত্রা ভাই?’

‘বনবিবির পালা।’

শান্তনুর সামনে বসে খেতে রীতিমতো অস্বস্তি হচ্ছিল মারুনার। হয়তো বলে বসবে, সেবার পিয়ালীর সঙ্গে যখন এসেছিল, বিকেলে ঠিক এই টিফিনই খেয়েছিল। তাকে আশ্বস্ত করে শান্তনু কিছু বলল না, চাউমিনটা চেটেপুটে খেয়ে নিল, তারপর বারান্দা থেকে নীচের লনে উঁকি মেরে বলল, ‘দেখেছ, স্টেজ বাঁধা হয়ে গেছে।’

মারুনাও উঁকি মারল নীচে। খুব নীচু মঞ্চ, স্টেজের পেছনে কয়েকজন বসে মেক-আপ করছে। যারা স্টেজ বাঁধছিল, তারাও মেক-আপ নিতে বসে গেল একটু পরে। একজন ব্যানার টাঙিয়ে দিল একটা, তাতে লেখা ‘মা নৃত্যাঞ্জলি অপেরা’। দেখে মজা লাগল মারুনার।

‘যাবে না নীচে? ওঃ তোমার তো আবার গান-টানে ইন্টারেস্ট নেই।’

মারুনার বুক ধক্ করে উঠল। গান থেকে পিয়ালীতে যেতে এক সেকেন্ডও লাগবে না শান্তনুর। বিয়ের পর এই তাদের প্রথম যৗথ ভ্রমণ, যাকে মধুচন্দ্রিমা বলাই দস্তুর, একেবারে পলিটিক্যালি কারেক্ট, চাঁদও উঠেছে সঙ্গতি রেখে– তবু সারাক্ষণ পিয়ালী-পিয়ালী জপে কেন যে কানের পোকা বার করে দিচ্ছে লোকটা? হয় ও অতিবোকা, নয় অতি হূদয়হীন, নয় যে কী ভেবে পেল না মারুনা। সে শান্তনুকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে নেমে এল নীচে।

স্নান সেরে লংস্কার্ট আর কুর্তি পরেছিল। চুল খোলা, চোখে কোহল, ঠোঁটে লিপবাম, বডি পারফিউমের গন্ধটা তাকে ঘিরে রেখেছে। লনে সারি সারি পাতা চেয়ারে চাঁদের নীচে বসে তার নিজেকে খুব ভালোবাসতে ইচ্ছে করছিল। যেন শান্তনুর সঙ্গে নয়, সে একাই এসেছে। একটু পরে যাত্রা শুরু হল। গরিব বিধবা মায়ের সন্তান দুখে, সে কীভাবে বনবিবির কৃপায় বাঘের হাত থেকে রক্ষা পেল– এই প্রচলিত লোকগল্প নিয়েই পালা। যাত্রা ফর্মটা তার কোনওদিন দেখা না থাকায় প্রথম প্রথম হাসি পাচ্ছিল। কিন্তু কিছুক্ষণ পর সে লোকশিল্পের শক্তি টের পেল। গানে, অভিনয়ে গোটা সুন্দরবনের লোকজীবন, নদী, অরণ্য, নোনামাটি তার মধ্যে ঢুকে যাচ্ছিল। শেষে যখন দুখে গান ধরল ‘এই মায়ানদী ক্যামনে হব পার’– অকারণেই তার চোখে জল চলে এল। হঠাৎ সে চমকে উঠে দেখল শান্তনু কখন এসে মন দিয়ে তার ছবি তুলছে।

পালার শেষে দুখে সকলের কাছে গিয়ে টাকা সংগ্রহ করছিল। মারুনা দেখল দুখে আসলে একটি ছোটো মেয়ে। ভারি সুন্দর দেখতে আর গানের গলার তো তুলনা হয় না। সে একবার ভাবল শান্তনুকে বলবে মেয়েটার ছবি তুলতে। ভয়ে বলল না। শান্তনু যদি বলে বসে পিয়ালীও সেবার এমন আবদার করেছিল।

রাতের খাওয়াটা ভালোই হল। যদিও মেনু নিয়ে অনেকেই নাক সিঁটকেছে। ফ্রায়েড রাইস, চিলি চিকেনের সঙ্গে বেগুনি! ছোঃ! ফিশফ্রাই করতে পারল না! আর ওটা চিলি চিকেন হয়েছে? মারুনা আদৗ রাঁধতে জানে না, তাই খাওয়া নিয়ে সে কোনও সমালোচনায় যায় না। তার তো ভালোই লেগেছে। একটু বেশিই খাওয়া হয়ে গেছে। সে শান্তনুকে বলে ফেলল ‘চলো না, একটু হেঁটে আসি।’

শান্তনু কী যেন বলতে গিয়ে থেমে গেল। তারপর বলল, ‘চলো যাই।’

হাঁটতে হাঁটতে তারা বাজার ছাড়িয়ে অনেকটা চলে এল। বাজার এলাকাটুকু ছাড়া পাখিরালয় একটা সাধারণ গ্রাম, রাত দশটা বাজতে না বাজতেই নিঝুম হয়ে গেছে। ওরা দুজন, নদী আর চাঁদ ছাড়া কেউ নেই চরাচরে। মারুনার ভয় করছিল একটু। সে শান্তনুর পাঞ্জাবি টেনে বলল ‘চলো ফিরি।’

শান্তনু তখনি আঙুল দেখিয়ে বলল ‘ওই জেটিটা’।

মারুনা ওর আঙুল অনুসরণ করে দেখল একটা পরিত্যক্ত জেটি, এই দ্বীপ থেকে কেমন বিচ্ছিন্ন হয়ে নদীর বুকে প্রসারিত হয়ে আছে। যেন পৃথিবীর মাটির নয়, জেটিটা নদীর আর চাঁদের। মারুনার খুব ইচ্ছে হল ওখানে গিয়ে দাঁড়াতে। ও শান্তনুর হাত ধরে টানল, ‘চলো না, ওই জেটিটায় গিয়ে একটু দাঁড়াই।’

শান্তনু এর উত্তরে কী একটা বলতে গিয়ে থেমে যায় আবার। মারুনা বুঝতে পারে আবার পিয়ালীকে নিয়ে কিছু একটা মনে পড়ে গেছে ওর। কিন্তু হঠাৎ খেয়াল হয়েছে, এধরনের কথায় মারুনা হার্ট হচ্ছে, তাই হয়তো বলতে পারছে না। হঠাৎ মাথাটা গরম হয়ে যায়। চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে ও জেটির দিকে ছুটে যায়। শান্তনু আঁতকে ওঠে ‘মারুনা শোনো, ওটা ভাঙা জেটি, যে-কোনও মুহূর্তে ভেঙে পড়তে পারে।’

মারুনা ছুটতে ছুটতেই বলে ‘ভাঙুক, তোমার সঙ্গে আমার সম্পর্কটাও তো তাই, ভেঙে পড়বে যে-কোনও মুহূর্তে।’

শান্তনু ছুটে এসে ওকে জড়িয়ে ধরে নিবিড় করে। ‘না ভাঙবে না। তুমি আমায় ছেড়ে যাবে না, জানি আমি।’

কান্না থেমে যায় মারুনার। কি নির্লজ্জ লোক রে বাবা! মারুনা কি কুকুর নাকি এত অপমান সয়ে পড়ে থাকবে? ‘আমি যাব, চলে যাব, বারবার এভাবে পিয়ালীর কথা বললে।‘

‘আর বলব না মারুনা, ক্ষমা, ক্ষমা, শুধু একটা কথা, শেষবারের মতো।’

জেটিটা প্রবল টানে মারুনাকে। তবু সে থমকে যায় শান্তনুর কথা শোনার জন্যে।

‘এই জেটিতে দাঁড়িয়েই পিয়ালী ওই বাস্টার্ডটার কথা আমাকে বলেছিল, যেটার সঙ্গে ও থাকে মুম্বইতে। আমি চাই না মারুনা, তুমি ওই জেটিতে যাও।’

কান্নায় জড়িয়ে আসে শান্তনুর গলা। চাঁদের আলো পড়ে সেই চোখের জলে। মারুনা অবাক হয়ে দেখে শান্তনুর চোখে নদী, তার এপার-ওপার দেখতে পায় না সে।

পড়ার জন্য সীমাহীন গল্প-নিবন্ধসাবস্ক্রাইব