আজ ক’দিন ধরেই মেজাজ বিগড়ে রয়েছে আত্রেয়ীর। ছেলেটার জন্য বড়ো দুশ্চিন্তায় পড়েছে। কী যে করবে ছেলেটাকে নিয়ে। ছেলের দিকে নজর দেবে নাকি সংসারের দিকে। সংসারে সাহায্য করার মতো তো আর দ্বিতীয় লোক নেই। বছর চরেক আগেও আত্রেয়ীদের জয়েন্ট ফ্যামিলি ছিল। ভাসুর, দেওর, জা নিয়ে একেবারে ভরাভর্তি ফ্যামিলি। তারাও তো এখন যে-যার কর্মসূত্রের কারণে শহরের বাইরে থাকে। এখন আত্রেয়ীর সংসার বলতে তারা স্বামী-স্ত্রী, বছর দশ এগারোর এক ছেলে আর শাশুড়ি। শাশুড়িও বয়সের ভারে ন্যুব্জ হয়ে পড়েছে। তবে নাতি অন্ত প্রাণ। তার সামনে নাতিকে কিছু বলা যাবে না। সেটা নিয়েই আত্রেয়ীর যত আপত্তি। সারাদিন সংসারে সব ঝক্বি-ঝামেলা মুখ বুঝে সামলাবে কিন্তু ছেলে শাসন করার সময় কেউ কিছু বললেই মাথা গরম হয়ে যায় তার। এই নিয়ে মাঝেমধ্যে লেগেও যায় শাশুড়ির সঙ্গে। একে মনসা তায় আবার ধুনোর গন্ধ। দিনচারেক হল আবার আত্রেয়ীর বড়ো ননদ সহেলী এসেছে এবাড়িতে। ব্যস পিসি আর ঠাম্মার প্রশ্রয়ে আরও মাথায় উঠেছে ছেলেটা। শুধু জেদ আর জেদ। সকাল থেকে মায়ের পিছন পিছন ঘুরছে অমূলক বায়না নিয়ে।
‘মা আমায় সিডি প্লেয়ারটা দাও না। কখন থেকে চাইছি। দাও না।’ মায়ের আঁচল ধরে টানতে থাকে বিট্টু।
‘দেব না যখন বলেছি, তখন কোনওমতেই তোকে আমি ওটা দেব না। মাথা খারাপ করিস না। যা এখান থেকে।’
‘কেন দেবে না, তুমিই তো বলেছিলে দেবে। তাহলে এখন কেন না বলছ। আমি কিছু জানি না, আমার ওটা চাই।’ জেদ বেড়ে যায় বিট্টুর।
ছেলের কথায় ঝাঁঝিয়ে ওঠে আত্রেয়ী। হ্যাঁচকা মেরে আঁচলটা ছাড়িয়ে নেয়। ‘খুব সাহস হয়েছে নারেতোর। আমি বলে দিচ্ছি এক্ষুনি এখান থেকে চলে যা, নইলে চ্যালাকাঠ ভাঙব তোর পিঠে।’ আরও জেদ চেপে যায় বিট্টুর। হাত-পা ছুড়তে ছুড়তে সামনে বসে থাকা বড়োপিসিকে অনুনয়ের সুরে বলে, ‘বড়োপিসি তুমি বলো না সিডি প্লেয়ারটা দিতে, তুমি বললে মা শুনবে।’ ছোট্ট ভাইপোর অনুরোধ উপেক্ষা করতে পারে না সহেলী। এতক্ষণ বউদিকে হাতে হাতে সাহায্য করতে গিয়ে সবই তার চোখে পড়েছে।
‘দিয়ে দাও না আত্রেয়ী, সামান্য একটা জিনিসই তো চাইছে। দ্যাখো তো কেঁদে কেঁদে ছেলেটার চোখমুখ একেবারে ফুলে গেছে।’
‘প্লিজ দিদি, এই নিয়ে তুমি আর কিছু বলতে এসো না। প্রশ্রয় পেয়ে পেয়েই ছেলেটা আরও বিগড়ে যাচ্ছে। এইটুুকু ছেলের জেদ দেখেছ, যেটা চাই বলবে সেটা চাই-ই। দিন দিন একেবারে বাঁদর তৈরি হচ্ছে।’
‘মানলাম আমরা একটু বেশিই আদর-আহ্লাদ দিই। কিন্তু তুমিই তো ওকে প্রমিস করেছিলে। প্রমিস করে কথার খেলাপ করাও তো ঠিক নয়।’ বলেই বিট্টুর মাথায় স্নেহের হাত বুলিয়ে দেয় সহেলী। ‘কাঁদিস না বাবু, বিকেলে আমি তোকে একটা আইপড কিনে দেব।’
বড়ো ননদের কথার ভঙ্গি দেখে মাথা আগুন হয়ে যায় আত্রেয়ীর। কোনওমতে রাগ সংবরণ করে নিয়ে বলে, ‘যদি বা দিতাম, এখন তো আর দেবই না।’ রাগে গজগজ করতে করতে ঘর থেকে বেরিয়ে যায় আত্রেয়ী। বিট্টুও বড়োপিসির কথায় খানিক আশ্বস্ত বোধ করে অন্য খেলনা নিয়ে মেতে ওঠে।
দুপুরে লাঞ্চ সেরে ননদ, ভাজ মিলে বিছানায় গড়িয়ে নিতে নিতে সংসারের নানারকম আলোচনা হতে থাকে। বিট্টুর প্রসঙ্গ উঠতেই আত্রেয়ীর চোখেমুখে চিন্তার ছাপ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। উঠে বসে পড়ে সে। ‘এই ছেলেটা আমাকে পাগল করে দেবে দিদি। কারওর কথা শোনে না। পড়াশোনার কথা তো ছেড়েই দাও। সারাক্ষণ শুধু দুষ্টুবুদ্ধি মাথায় পাক খেতে থাকে।’
‘কী যা-তা বলছ আত্রেয়ী। বিট্টু কত বিনয়ী, পড়াশোনায় ভালো, আর কী চাই তোমার? তাছাড়া ও এখন ছোটো, তুমি যেভাবে গড়েপিঠে মানুষ করবে, ও ঠিক তেমনটাই তৈরি হবে।’ আত্রেয়ীকে বোঝানোর চেষ্টা করে সহেলী।
‘আমার হাতে কী আছে বলো? সংসারটা কি শুধু আমার একার?’ বলে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আত্রেয়ী। তারপর আবার বলতে শুরু করে, ‘যখনই ওকে বোঝাতে যাই, কেউ না কেউ মাঝখানে এসে কথা কাটবেই। যেভাবেই হোক আমাকে ভুল প্রমাণ তাদের করতেই হবে। এরকম চললে বাচ্চারাও তো কনফিউজড্ হয়ে যায় বলো। তারাও তো ঠিক করতে পারবে না কোনটা ঠিক কোনটা ভুল। এই পরশুদিনের কথাই ধরো না, তোমার ভাইয়ের বস আর তার দুই ছেলেমেয়ে এসেছিল বাড়িতে। ওদের জন্য রসগোল্লা আর কিছু স্ন্যাকস্ আনা হয়েছিল। সকলের প্লেটেই দু’টো রসগোল্লা আর স্ন্যাকস্ সাজিয়ে দেওয়া হয়েছিল। বিট্টুকেও তাই। সকলের জন্য ম্যাঙ্গো শেক আনতে রান্নাঘরে ঢুকেছি, সেইসময় সেখানে গিয়ে বিট্টুর বায়না, ‘মা আমাকে আরও দুটো রসগোল্লা দাও।’
আমি বললাম, ‘ঠিক আছে ওরা যাক, তারপর খেয়ে নিস। সত্যি বলতে কী, সকলকে আর দু’টো দেওয়ার মতো অত আনেনি সেদিন তোমার ভাই। ওকে বোঝাতে ও মেনেও গিয়েছিল, কিন্তু মাঝখানে মা এসে বলতে লাগলেন, ‘দু’টো রসগোল্লাই তো খেতে চেয়েছে’ বলে ওকে দিয়ে চলে গেলেন। সে-ও প্লেট হাতে সোজা গেস্টদের সামনে। সম্মানটা থাকে তুমি বলো? ঠিক সেই কারণেই আমি পরে দেব বলেছিলাম। এখন তুমিই বলো ওকে আমি সঠিক শিক্ষা দেব কেমন করে? পড়ানোর সময়ও ঠিক এমনটাই ঘটে। পড়া না পারলে একটু বকলে মা চলে আসবেন, ব্যস ইনিও পড়াশোনার পাট তুলে দিয়ে ঠাম্মার অাঁচলের তলায় গিয়ে লুকোবে। এভাবে ছেলে মানুষ করা যায়! এখন পড়ার নাম শুনলেই তার গায়ে জ্বর চলে আসে।’
‘হাফ-ইয়ারলির রেজাল্ট আউট হয়েছে না? কেমন নাম্বার পেয়েছে?’ প্রশ্ন করে সহেলী।
‘রেজাল্ট নিয়ে আর কিছু জিজ্ঞাসা কোরো না। এখন তো মিথ্যে বলতেও শিখে গেছে।’ ভারি মনমরা দেখায় আত্রেয়ীকে।
‘কেন, কী এমন করেছে যে এরকম করে বলছ?’
‘কয়েকদিন ধরেই ওকে জিজ্ঞাসা করছি, কীরে পরীক্ষার খাতা দেখায়নি। সমানে মিথ্যে বলে গেল। দিন সাতেক পর ওর ক্লাসেরই এক বন্ধুর বাড়িতে গিয়ে জানতে পারি খাতা বেশ কয়েকদিন আগেই দেখানো হয়ে গেছে।’ চোখ চিকচিক করে ওঠে আত্রেয়ীর। সান্ত্বনা দিতে আত্রেয়ীর হাতটা চেপে ধরে সহেলী।
‘জানো দিদি ওর বন্ধু সৃঞ্জয় বলল, ‘কেন আন্টি বিট্টু তোমাকে কপি দেখায়নি? ও-তো এবারে চারটে সাবজেক্টে পাশ মার্ক তুলতে পারেনি।’ লজ্জায়, অপমানে মুখটা কোথায় লুকোব ঠিক করতে পারিনি। সৃঞ্জয়ের মায়ের ওই তীর্যক হাসি যেন আমাকে দুমড়ে-মুষড়ে এক করে দিচ্ছিল। কোনওরকমে পালিয়ে আসি ওদের বাড়ি থেকে।’ নিজেকে সামলাতে পারে না আত্রেয়ী। গাল বেয়ে জল নেমে আসে তার।
সব শুনে সহেলীও অবাক হয়ে যায়, ‘কী বলছিস রে, আমাদের বিট্টু!’ কথা শেষ করতে পারে না সহেলী। তার আগেই আত্রেয়ী ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বলে ওঠে, ‘তাহলে আর বলছি কী! প্রথমে কী বলে, মারধোর করতে তবে গিয়ে স্বীকার করল সব। এখন তুমিই বলো আমি কী করব? এখানেই শেষ নয় রিপোর্ট কার্ডটা পর্যন্ত আমাদের হাতে দেয়নি জানো। বেশ কয়েক সপ্তাহ পরে ওয়াশিং মেশিনের নীচ থেকে ওটা পেয়েছি। আর কী বলব তোমাকে, মাসিক রিপোর্ট কার্ডে পর্যন্ত তোমার ভাইয়ের সইটা নকল করে জমা দিয়েছে। আমি ফেড-আপ হয়ে গেছি।’ মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ে আত্রেয়ী।
‘বিশ্বাসই হচ্ছে না, যে-ছেলেটা গতবছর পর্যন্ত র্যাঙ্ক করে এসেছে, তার এই অবনতি কীভাবে? জাস্ট ভাবতে পারছি না।’ বিস্ময় ঘিরে ধরে সহেলীকে।
‘তোমার ভাই তো জীবনেও ওকে পড়ার জন্য বলে না, কোনওদিন বসেও না ছেলেকে নিয়ে। সবসময় আমিই পড়াশোনা নিয়ে টিকটিক করি, সেইজন্য এখন আমি ওর চোখের বিষ। মা হয়ে কী করে আমি ছেলের ভবিষ্যৎ নষ্ট হতে দেখব বলো দিদি?’
‘কিন্তু আত্রেয়ী, বাচ্চাদের ভালোবাসা দিয়ে বোঝাতে হবে। কাছে টানতে হবে। সবসময় মারলে, বকলেও আরও হাতের বাইরে চলে যাবে। পড়াশোনাতেও ওই জন্য ওর মন নেই। পড়াতে বসলে তুমি পড়াও কম, মারো বেশি। বাচ্চাদের সাথে এমন করলে চলবে কেন. যেমন কালকেই তুমি ওকে বলছিলে, আরে ওই ছেলে মানুষ হবে নাকি। জীবনে কিছু করতে পারবে না, জুতো সেলাই করে পেট চালাতে হবে। বাচ্চাদের সামনে তুমি যদি এরকম কথাবার্তা বলো, তাহলে ওদের মনে কেমন প্রভাব পড়বে বুঝতে পারছ আত্রেয়ী। জীবনে কোনওদিন মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে না, সারাক্ষণ হীনন্মন্যতায় ভুগবে। নতুন কিছু করার সাহসই জোগাতে পারবে না।’
ডাইনিং রুমের মেঝেতে বসে বিট্টু কীসব আঁকিবুকি করছিল মন দিয়ে। হঠাৎই সেসব ছেড়ে দিয়ে পিসির হাতটা ধরে বলতে শুরু করল, ‘পিসি, পিসি দাবা খেলবে আমার সাথে?’
‘কিন্তু বাবু আমি যে দাবা খেলতে পারি না। তাহলে তোমার সাথে খেলব কেমন করে?’
‘খুব সোজা। আমি শিখিয়ে দেব।’ ঝটপট উত্তর দেয় বিট্টু।
‘তারচেয়ে বরং লুডো খেলি। কী বলিস?’
‘ঠিক আছে।’ বলে লুডো আনতে দৌড়ে যায় ঠাম্মির ঘরে। মিনিট দুয়েকের মধ্যে ফিরে এসে ঘুঁটি সাজাতে শুরু করে দেয় বিট্টু।
‘সাপ-লুডো খেলি, কী বলো পিসি। তোমার সাথে দারুণ জমে যাবে। ঠাম্মি তো ঠিক করে দান-ই চালতে পারে না।’
‘লুডো ছাড়া আর কী কী খেলা জানিস রে বাবু?’ জানতে চায় সহেলী।
‘দাবা, স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড, কার রেস, বিজনেস গেম, কবাডি।’ গড়গড় করে একটার পর একটা নাম বলতে থাকে বিট্টু।
‘আরে আরে থাম থাম। বাপরে বাপ, কার সাথে খেলিস এসব?’ হাসতে হাসতে প্রশ্ন করে সহেলী।
‘কারওর সাথেই নয়।’
‘কিন্তু এসব খেলা তো একা একা খেলা যায় না বাবু। একাই যদি খেলবে কিনেছ কেন এই সমস্ত গেম?’ অবাক হয়ে যায় সহেলী।
‘কিছু মাসি কিনে দিয়েছিল। জেঠু এসেও কয়েকটা কিনে দিয়ে গেছে, আর গতবারের জন্মদিনে আরও অনেকগুলো পেয়েছি। একা একা খেলব না-তো কী করব বলো। মা যে সঞ্জুদের বাড়িতে ওগুলো নিয়ে যেতে দেয় না। বলে দামি জিনিস নষ্ট হয়ে যাবে। সঞ্জু বাড়িতে এলেও খেলতে বসলে মা রাগ করে। বলে সবসময় বাড়িতে হইহল্লা লেগেই রয়েছে, বন্ধ করো এসব। খেলা বন্ধ করে মা ওকে বাড়ি পাঠিয়ে দিয়ে আমাকে জোর করে পড়তে বসিয়ে দেয়। ঠাম্মিও তো এসব খেলতে পারে না। কত চেষ্টা করেছি শেখানোর।’ বিট্টুর কথাগুলো মনের মধ্যে বিঁধতে থাকে সহেলীর।
‘ঠাম্মি পারে না তো কী হয়েছে, মাঝেমধ্যে বাবা-মা-র সঙ্গেও তো খেলা যেতে পারে। কী বলো বিট্টু সোনা?’ বড়োপিসির কথা শুনে মাথা নীচু করে নেয় বিট্টু। চোখের কোনা চিকচিক করে ওঠে। তীর্যক দৃষ্টিতে একবার মায়ের দিকে দেখে পিসির কথার উত্তর না দিয়েই ঘর থেকে বেরিয়ে যায় সে।
সহেলী বুঝতে পারে তার কথায় বিট্টু কতটা আঘাত পেয়েছে। পরিবারের সকলে থাকা সত্ত্বেও সে যে কত একা, তা বুঝতে বাকি থাকে না বিট্টুর বড়োপিসির। এতটুকু ছেলের একটা খেলার সঙ্গী নেই। তার উপর সারাক্ষণ মায়ের কড়া শাসন। শাসনের চোটে ভালোবাসাগুলো ম্লান হয়ে গেছে, আর তাই দিন দিন রগচটা হয়ে যাচ্ছে। সবথেকে বেশি রাগ মা-র উপর। সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে স্থির করে নেয় আত্রেয়ীকে যেভাবেই হোক বোঝাতে হবে। এখনও সময় আছে। ভাজের উপর খানিক রাগই হয় সহেলীর। পরক্ষণেই আবার নিজেকে বোঝানোর চেষ্টা করে, ভাবে আসলে ছেলেটাকে নিয়েই আত্রেয়ীর পৃথিবী। তাকে ঘিরেই তার যত স্বপ্ন। যার কারণে একটু এদিক-ওদিক দেখলেই কেমন যেন অস্থির হয়ে ওঠে আত্রেয়ী। সবসময় চোখে চোখে রাখার চেষ্টা করে ছেলেকে। চতুর্দিকের ঘটনা দেখে ভয়ে ছেলেটাকে দূরে স্কুলে পর্যন্ত ভর্তি করেনি। কী-যে ভয় ওর। বিট্টু তো তাদেরও মনের খুব কাছাকাছি। বিয়ের প্রায় বছর আটেক পর বিট্টু জন্মায়। তার আগে দু’দুটো বাচ্চা…। কিন্তু সেসব অতীত আঁকড়ে ধরে থাকলে চলবে? বর্তমানকে নিয়ে বাঁচতে হবে।
তারপর নিজের মনেই বিড়বিড় করতে থাকে, আর ভাইটাও হয়েছে তেমনি। ব্যাবসা ছাড়া কিছুই বুঝল না। শুধু টাকা আর টাকা। বলি এত টাকা নিয়ে কী করবি, যদি ছেলেটাকেই না মানুষ করতে পারলি। দু’দণ্ড ছেলেটার পাশে বসে একটু সময় দিলে কী হয়। এদিকে মুখে বলছে আমি যা রেখে যাব আমার ছেলেকে আর খেটে খেটে হবে না। এদিকে সেই ছেলের জন্যই সময় নেই। একজন চিন্তায় অস্থির, আর একজন উদাসীন! না আত্রেয়ীর সঙ্গে খোলাখুলি কথা বলতেই হবে। এভাবে বিট্টুর ছেলেবেলাটা নষ্ট হতে দেওয়া যাবে না।
সহেলী ভাইবোনেদের মধ্যে সবথেকে বড়ো। কাজেই সবাই সমীহ করেই চলে। অবশ্য সমীহ করার মতোই তার ব্যক্তিত্ব। ছেলে বিদেশে থাকে আর মেয়ের বছর খানেক হল বিয়ে হয়ে গিয়েছে। স্বামী রিটায়ার্ড কর্নেল। বেড়াতে ভীষণ ভালোবাসেন। বছরে অন্তত বারচারেক তল্পিতল্পা নিয়ে বেরিয়ে পড়েন বেশ কয়েকদিনের জন্য। এবারের মিশন মিশর। সেই কারণেই কয়েকদিনের ছুটিতে এবাড়িতে এসেছে সহেলী। আত্রেয়ীও বড়ো ননদকে খুব ভালোবাসে। সে অন্তত তাকে বোঝে। তাই সমস্ত কিছু শেয়ার করে বড়ো ননদের সঙ্গে। মনের কথা বলে খানিক শান্তি পায়।
সেইদিনই সন্ধ্যাবেলায় ননদের বোঝানোতে সিডি প্লেয়ারটা আলমারি খুলে ছেলেকে বের করে দেয় আত্রেয়ী। সেটা হাতে পেয়েই লাফাতে লাফাতে বিট্টু সোজা পৌঁছে যায় বড়োপিসির ঘরে। বড়োপিসিকে জড়িয়ে ধরে আনন্দে আটখানা হয়ে। ‘থ্যাঙ্ক ইউ পিসি, আমি জানি তোমার কথাতেই মা সিডি প্লেয়ারটা ফেরত দিয়েছে আমাকে।’
‘তাই! তুমি কেমন করে জানলে?’ বিট্টুকে খোলা মনে হাসতে দেখে সহেলীর মনটা ভালো হয়ে যায়।
‘আমি জানি। আচ্ছা শুনবে এতে কী আছে?’ বলেই যন্ত্রটার বাটন-টা প্রেস করে দেয় বিট্টু। শুরু হয় খুব মিষ্টি একটা গান।
‘আরে এটা তো বিট্টু সোনার গলা। বাবা আমার বিট্টু সোনা গানও গাইতে পারে। তা-ও আবার এত সুরে!’ অবাক হয়ে যায় সহেলী।
পিসির কাছ থেকে নিজের প্রশংসা শুনে লজ্জায় মুখটা রাঙা হয়ে ওঠে বিট্টুর। অদ্ভুত এক ঝলক খেলে যায় বিট্টুর চোখেমুখে। প্রশান্তির সেই ছাপ চোখ এড়ায় না সহেলীরও।
সহেলীর বুঝতে বাকি থাকে না বিট্টুর সিডি প্লেয়ার চাওয়ার ওই অদম্য জেদ কেন চেপেছিল। আসলে সে চেয়েছিল তার স্কুলের প্রোগ্রামে গাওয়া গানটা পিসিকে শোনাতে। নিজের খুশি জাহির করতে বাচ্চারা তাদের ভালোবাসার মানুষকে খোঁজে। ইস্ আত্রেয়ী যদি একটু বুঝত ছেলেটা কেন ওভাবে জেদ ধরেছিল। মা হয়ে ছেলেটার ইচ্ছে-অনিচ্ছেগুলো বুঝল না।
পরদিন সকালেও বিট্টুর মনটা বেশ ভালো ছিল। সকালে উঠে নিজেই লাফাতে লাফাতে তৈরি হয়ে স্কুল গেল। পিসির কাছে আবদার করে গেছে ফিরলে তাকে ভূতের গল্প শোনাতে হবে। সেইমতো স্কুল থেকে ফিরে সোজা পিসির ঘরে হানা দেয় বিট্টু। তখন ননদ ভাজের আড্ডা বেশ জমে উঠেছে। কোনও কিছু নিয়ে ইয়ার্কি-ঠাট্টা হচ্ছিল বোধ করি। বিট্টুর মাঝে ঢুকে পড়াতে আত্রেয়ীর হাসি মুহূর্তে বিরক্তিতে পরিণত হয়।
‘কতবার তোমাকে বলেছি না বড়োরা কথা বললে এভাবে বিরক্ত করবে না। যাও ঠাম্মিকে বলো খেতে দিতে।’
‘আমার পেট ভর্তি আমি খাব না।’
‘পেট ভর্তি মানেটা কী? সেই কোন সকালে একটু হরলিক্স আর দুটো বিস্কুট খেয়ে বেরিয়েছ। যাও খেয়ে নাও।’ চোখ রাঙায় আত্রেয়ী।
মায়ের চোখ রাঙানিকে উপেক্ষা করেই জবাব দেয় বিট্টু, ‘বলছি তো খিদে নেই।’ বলে সহেলীর পাশে গিয়ে বসে পড়ে।
‘ও পিসি, তারপর কী হল? তারপর? ভূতটা কী করল?’
‘দেখেছ দিদি, দেখেছ, এই ছেলে আমাকে কোনওদিন শান্তি দেবে? দু’দণ্ড যে কারওর সাথে কথা বলব তা এই ছেলের সহ্য হয় না। আমার বোন এলেও এমনটাই করে। বাপের বাড়িতে গিয়েও বন্ধুবান্ধবদের সাথে একটু গল্প করতে, মনের কথা খুলে বলতে পারি না জানো। সেখানেও মুখের সামনে বসে সব গিলবে, আর বাড়ি ফিরে বাবা-ঠাম্মিকে সব লাগাবে। সত্যি বলছি দিদি আর পেরে উঠছি না।’ গর্জে ওঠে আত্রেয়ী।
‘ঠিক আছে, ঠিক আছে, অতো বিরক্তির কী আছে। আর তো ক’দিন পর বড়ো জেঠুর কাছে চলেই যাব। বাবা তো কথাও বলে নিয়েছে। তখন চাইলেও তোমার কাছে আর ফিরে আসব না।’
‘আচ্ছা আচ্ছা, আর অতো রাগ করতে হবে না। মার কথা শোনো, একটু খেয়ে এসো। তারপর তো বাকি গল্পটা বলবই। যাও যাও ছুটে যাও, ঠাম্মির থেকে খেয়ে এস।’ বিট্টুকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে ঠাম্মির কাছে পাঠিয়ে দেয় সহেলী। তারপর আত্রেয়ীর দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়,’ হঠাৎ বড়ো জ্যেঠুর কাছে, ব্যাপারটা ঠিক বুঝলাম না।’
‘ছেলেটা যেভাবে বিগড়ে যাচ্ছে, তাই আমরা ঠিক করেছি ওকে বড়দার কাছে পাঠিয়ে দেব। ওখানেই থাকবে, পড়াশোনা করবে। আমাদের তো ধর্তব্যের মধ্যেই ধরে না, কম সে কম ওনাকে তো একটু ভয় পায়।’
কথাটা শোনামাত্রই মাথায় বিদ্যুৎ খেলে যায় সহেলীর। ‘মানে, নিজের দায় অন্যের উপর চাপিয়ে দিয়ে দায় মুক্ত হতে চাইছ। কিছু মনে কোরো না আত্রেয়ী এভাবে ছেলে মানুষ হয় না। একটা মানুষের পিছনে দিনরাত্রি খিটখিট করলে, সে তো বিরক্ত হবেই। ছেলে মানুষের নামে দিনরাত কড়া অনুশাসন, স্কুলের পর দুটো টিউটর, হাঁফ ফেলতে পারে না ছেলেটা ঠিক করে। মিশতে দেবে না কারওর সঙ্গে, ছেলে নাকি এতে খারাপ হয়ে যাবে। ভাবলেই অবাক লাগে এই বয়সের একটা ছেলের খেলার সঙ্গী নেই। ছেলে বিগড়োনোর জন্য কিন্তু দায়ী তোমরাই। এভাবে কোনওদিন ছেলে মানুষ করতে পারবে না।’
ননদের কথার কোনও প্রতিবাদ করতে পারে না আত্রেয়ী। যৗক্তিকতার চাপে গলা রূদ্ধ হয়ে আসে তার। চোখ ভিজে যায়। একটা ক্ষীণ স্বর সহেলীর কানে পৌঁছোয় ‘তুমি শুধু আমার দোষটাই দেখছ দিদি। কষ্টটা বুঝতে পারছ না। একজন মা কতটা প্যাঁচে পড়লে তবে তার বাচ্চাকে নিজের কাছছাড়া করার কথা ভাবে বলো তো?’
‘শোনো আত্রেয়ী, মাঝে মাঝে কাছের মানুষগুলোর কাছে ভালোবাসা প্রকাশ করতে হয় বুঝেছ। রাগের বশবর্তী হয়ে এমন কিছু ডিসিশন নিও না, যাতে ছেলেটা তোমার থেকে আরও দূরে সরে যায়। একটু আমার কথামতো চলেই দ্যাখো না, দেখবে তোমার ছেলে সত্যিই ভালো।’ আবেগের বশে কখন যে ভাজকে জড়িয়ে ধরে চোখে জল এসে গেছে বুঝতেও পারে না সহেলী।
দেখতে দেখতে কেটে যায় আরও একটা সপ্তাহ। এই কয়েক দিন সহেলী, ভাইপো বিট্টুকে নিয়েই বেশি সময় কাটিয়েছে।
পিসির কথা শুনে খাওয়াদাওয়া, পড়াশোনা সবই করেছে বিট্টু। এক মুহূর্তেও কথার অবাধ্য হয়নি বিট্টু। আত্রেয়ীর অভিযোগের সঙ্গে বিন্দুমাত্র মেলাতে পারেনি ছেলেটাকে। একটু ভালোবাসা একটু প্রশংসা পাওয়ার জন্য কী না করতে পারে ছেলেটা। আত্রেয়ীকে ভুল প্রমাণ করার জন্য তাকে দিয়েই কোয়েশ্চেন সেট বানিয়ে পরীক্ষা নিয়েছে বিট্টুর। একেবারে পঞ্চাশে পঞ্চাশ। ফুল মার্কস পেয়ে ছেলের কী লাফানো।
‘দেখেছ আত্রেয়ী, একটু ভালোবাসা পেলে ছেলেটা কী করতে পারে। আমার কী আছে বলো, আমি তো আর সারাজীবন থাকতে যাব না এখানে। তোমার জামাইবাবুরা দুর্যোগের জন্য সময়ের আগেই ফিরে আসছে বর্ডার থেকে। পরশুই আমাকে চলে যেতে হবে।
নিজের মনে খেলতে খেলতেই, পিসির কথাটা কানে যায় বিট্টুর। খেলা ছেড়ে দিয়ে একলাফে দৌড়ে আসে সহেলীর কাছে। বরাবরই বড়োপিসিকে সে একটু বেশিই ভালোবাসে। এই কদিনে সহেলীর আরও কোলঘেঁষা হয়েছে সে। ‘পিসি তুমি চলে যাবে? তুমি যে বলেছিলে এখন থাকবে তাহলে কেন? আমার সাথে কে খেলবে?’ বিট্টুর কথাগুলো সহেলীর কানে গিয়ে ধাক্বা মারে।
‘কী করব বলো, পিসেমশাই ফিরে আসছে। আমি বাড়ি না গেলে উনি খাবেন কী? ওনাকে কে দেখবে? তবে আমি কথা দিতে পারি, তুমি যদি আমার কথা শোনো, তাহলে আমি প্রতিমাসে দু’দিন করে এসে তোমার সাথে দেখা করে যাব। আর তোমার গরমের ছুটির সময় তোমাকে আমার ওখানে নিয়ে যাব।’
‘কী কথা বলো?’ উৎসাহের সঙ্গে জিজ্ঞাসা করে বিট্টু।
‘বলব, তবে আগে প্রমিস করতে হবে, আমি যা বলব তুমি তাই শুনবে।’ শর্ত রাখে সহেলী।
‘তোমায় কথা দিতে হবে ভালো ছেলের মতো মা-র সব কথা শুনবে। মন দিয়ে পড়াশোনা করবে। ভালো রেজাল্ট করে প্রমাণ করতে হবে তুমি ভালো ছেলে।’ সহেলীর কথা মন দিয়ে শোনে বিট্টু। কোনও সাড়া করে না।
‘কি আমার কথা রাখবে তো?’ বিট্টুর দিকে প্রশ্ন ছুড়ে দেয় সহেলী।
‘প্রমিস পিসি, তোমার কথা মতোই আমি চলব, কিন্তু তুমি প্রমিস ভাঙবে না তো? সপ্রতিভ চোখে পিসির দিকে তাকিয়ে থাকে বিট্টু।
‘পিসি কোনওদিন কথার খেলাপ করেছে?’ ঘাড় নেড়ে সম্মতি প্রকাশ করে বিট্টু। বিট্টুকে কাছে টেনে নিয়ে আদর করে সহেলী। চোখ ভিজে যায় তার। একদিনে ছেলেটার প্রতি যেন আরও মায়া পড়ে গেছে। ছেড়ে যাওয়ার কথা ভাবতেই চোখে জল চলে এসেছে।
দেখতে দেখতে কেটে যায় আরও দু’টো দিন। আজ মা-বাবার সঙ্গে স্টেশনে এসেছে সহেলীকে ছাড়তে। সকাল থেকে বায়না ধরেছিল স্টেশনে আসার জন্য। বাড়ি থেকে স্টেশন পর্যন্ত একটি বারও পিসির কাছছাড়া হয়নি।
‘বাবু ভালো থাকিস। মা-র কথা শুনবি।’ বলে বিট্টুকে জড়িয়ে ধরে একটা চুমু খায় সহেলী। ঠিক সেই সময়তেই ট্রেনের হুইসল বেজে ওঠে। ট্রেনে উঠে পড়ে সহেলী। ধীর গতিতে ট্রেন চলতে শুরু করে। বিট্টু আর নিজেকে ধরে রাখতে পারে না। ডুকরে কেঁদে ওঠে।
‘প্লিজ পিসি, যেও না আমাকে ছেড়ে।’
‘কাঁদে না বাবু, আমি বলেছি না আমি ঠিক আসব।’ ট্রেন তখন প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে দ্রুত গতিতে ছুটতে শুরু করেছে। বিট্টুও করুণ মুখ করে দেখছে সেই ট্রেনের চলে যাওয়া। ‘আমার কথা রেখো কিন্তু,’ সহেলীর ক্ষীণ আওয়াজ ভেসে আসে বিট্টুর কানে।
হাত নাড়তে নাড়তে বলতে থাকে ‘শুনব পিসি, শুনব।’
বিট্টুর কষ্টটা অনুভব করতে পারে সহেলী। চোখ ভিজে যায় জলে, কিন্তু বিট্টুর উজ্জ্বল ভবিষ্যতের কথা ভেবে মনটা আনন্দে ভরে ওঠে।