অ-সমকাম

বিয়ের সাত বছর পর রনিতা বুঝতে পেরেছিল অসম্ভব! যদিও বিয়ে ফুলশয্যা, মধুচন্দ্রিমার আবেশ কাটতেই অনুভব করেছিল অন্যরকম কিছু একটা। তবু আশায় বুক বেঁধে ছিল। হয়তো সব ঠিক হয়ে যাবে। সংসারের কঠোর বন্ধনে বেঁধে ফেলতে চেয়েছিল কর্পোরেট সেক্টরের অফিসার স্বামী অনিন্দ্যকে। আশা করেছিল, একবার বেঁধে ফেলতে পারলেই হয়তো সব ঠিক হয়ে যাবে। সাত তাড়াতাড়ি সন্তানের জন্য বায়না ধরেছিল রনিতা।

–এখনই সন্তানের প্রয়োজন কী!

অনেকেই অনিন্দ্যকে সমর্থন করেছিল।

–সত্যিই তো! সবে বিয়ে হয়েছে। কয়েকটা দিন যাক। এনজয় করুক জীবনটাকে। বাচ্চাকাচ্চা হলেই তো সব শেষ!

অনিন্দ্যর যুক্তি ছিল অবশ্য অন্যরকম। তার যেটুকু উপার্জন, সন্তান এলে তাতে তাদের ঠিকমতো চলবে না।

প্রথম প্রথম রনিতা রাতে শুতে গিয়ে তাকে বুকের কাছে টেনে নিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করেছিল। সন্তান হচ্ছে দাম্পত্যে ভালোবাসার সেতু। কিন্তু অনিন্দ্য কিছুতেই সে কথা মানতে নারাজ। একটু একটু করে রনিতাও বুঝতে পারছিল, অনিন্দ্যকে বোঝানো তার সাধ্যের অতীত। তবু হাল ছেড়ে দিয়েছিল, এমন নয়। সুযোগ পেলেই অনিন্দ্যর দুর্বলতম অনুভূতিগুলোর গায়ে নক করত রনিতা।

কিন্তু সেদিন ঘরে ঢুকেই রনিতা বুঝতে পেরেছিল, অন্যরকম কিছু একটা। অনেক দিনই রাত করে বাড়ি ফেরে অনিন্দ্য। কোনও দিন হয়তো ফেরেও না। তাই নিয়ে অনেকবার অভিযোগও করেছে অনিন্দ্যর কাছে। অনিন্দ্যর একটাই জবাব, রুটিনে বাঁধা জীবন তার ভালো লাগে না। তাও মেনে নিয়েছিল রনিতা।

আজ রাতের খাওয়াদাওয়া সেরে অন্য দিনের মতোই ঘরে ঢুকতেই, খটকা লাগল রনিতার। তাকে দেখেই তড়িঘড়ি সেলফোনে কলটা কেটে দিল অনিন্দ্য। উন্মত্ত বাঘিনির মতোই রনিতা ঝাঁপিয়ে পড়ল অনিন্দ্যর উপর। হ্যাঁচকা টানে কেড়ে নিল মুঠোবন্দি সেলফোনটি। লক খুলতেই চোখের উপর ভেসে উঠল একের পর এক আপত্তিকর ছবি আর মেসেজ।

সেলফোনের স্ক্রিনের তীব্র আলোয় রনিতার মুখ তখন ঝলসে যাচ্ছে। অথচ কেমন নিস্পৃহ দেখাচ্ছে অনিন্দ্যকে। ভাবলেশহীন, যেন অত্যন্ত স্বাভাবিক সে। কোনও কিছুরই হিসাব মেলাতে পারছে না রনিতা। যেন এক অথৈ সমুদ্রে একটু একটু করে তলিয়ে যাচ্ছে সে।

–এসব কী অনিন্দ্য! আমি কি সত্যি দেখছি! বাইরে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে স্পষ্ট অনুভব করল রনিতা। তার তীব্র নীল আলো এসে পড়ছে জানলার কাছে। পাথরের মতো দাঁড়িয়ে রনিতা। নিস্পৃহ অনিন্দ্য।

–সত্যি! আমি শুধু পুরুষের প্রতি দুর্নিবার আকর্ষণ অনুভব করি। কোনও নারী আমাকে তা দিতে পারে না!

দূরে কোথাও কর্কশ শব্দে বাজ পড়ল। রনিতা নিজের অজান্তেই কেঁপে উঠল একবার। তারপর অনুভব করল বাইরে অঝোর ধারায় শুরু হয়েছে বৃষ্টি। ইচ্ছে করেই খুলে দিল জানলার কাচের শার্শিগুলো।

বিন্দু বিন্দু বৃষ্টি কণা জমে উঠছে এখন রনিতার কপালে, চিবুকে, চোখের পাতায়। একা এবং একা নিথর বসে রইল ভোরের প্রতীক্ষায়।

 

 

শান্তি

আরও চাই, আরও, আরও। টাকাপয়সা, সম্মান, ক্ষমতা, জনপ্রিয়তা সব কিছুই হিসেবে কম পড়ছে। তাই আরও বেশি বেশি করে চাই। এই সুখে হবে না, আরও সুখ চাই। এই পরিমাণ শান্তিতে চলবে না, নিরবচ্ছিন্ন শান্তি চাই। যেটুকু আয়ত্তের বাইরে আছে সেটুকুকে পেতে আয়ত্তের মধ্যে থাকা জিনিসকেও বাজী ধরতে রাজি আছি।

গোপালের বিয়ে দেবার জন্য ওর মা-বোন-দিদি সব উঠে পড়ে লেগেছে। বিয়ের জন্য গোপাল নিজে যত না আগ্রহী, উদ্যোগী ওর বাড়ির লোকজন তার হাজারগুণ। গোপালের মা বলেন, ‘মেয়েগুলোর বিয়ে হয়ে যাবার পর বাড়িটা কীরকম যেন খাঁখাঁ করে। একটা চুড়ির রিনিঝিনি নেই, একটা নূপুরের নিক্বণ নেই। যেন ভূতের বাড়ি। নাতি-নাতনির মুখ বোধহয় আর দেখে যেতে পারব না।’

গোপাল বলে, ‘দাঁড়াও না মা, আর একটু সবুর করো না, আমার আর একটা পদোন্নতি হোক তারপর না হয়…’

গোপালের মা ওর মুখের কথা ছোঁ মেরে কেড়়ে নিয়ে বলে, ‘পদ বাড়ানোর প্রস্তুতি আর বিয়ের প্রস্তুতি একই সঙ্গে চলুক না, ক্ষতি কি? তোর পদোন্নতি হতে হতে আমাদেরও মেয়ে রেডি হয়ে যাবে। আরও দেরি করে মেয়ে দেখতে বেরোলে, তোর বিয়ের বয়স পার হয়ে যাবে।’

সুতরাং প্রায় প্রত্যেকটা ছুটির দিনেই মা-দিদি-বোনেরা একজোট হয়ে একটা না একটা মেয়ে দেখতে যাওয়া চাই-ই। এটা যেন ওদের কাছে একটা সাপ্তাহিক উৎসবে পরিণত হয়েছে। সকাল থেকেই সাজোসাজো রব। ইতিমধ্যে নয় নয় করে তেরোটা মেয়ে দেখা হয়ে গেছে। কিন্তু পছন্দ যেন আর হয় না। এদেরই মধ্যে একজনকে গোপালের মনেও ধরেছিল কিন্তু মা-দিদি-বোনের যুক্তফ্রন্ট সেটাকে পত্রপাঠ নাকচ করে দিয়েছে।

দেখতে দেখতে গোপালের বিয়ে হয়ে গেল। এলাহি আয়োজন হল, প্রচুর লোক খেল। বাড়িতে এখন দিনরাত হইচই লেগেই আছে। দিদি, বোন প্রায়ই আসে। নতুন বউকে নিয়ে হোটেল, রেস্টুরেন্ট, বাজার কিংবা সিনেমা হলে যায়। গোপালও যায় মাঝে মাঝে। শাশুড়ি-বউমার যুগলমূর্তি প্রায়ই চোখে পড়ে এখানেওখানে। বাড়িতে হাসাহাসি, দাপাদাপি, হুটোপাটি, লুটোপুটি লেগেই আছে। নতুন বউমা নতুন মাকে পেয়ে সেকি উচ্ছ্বসিত। তার চেয়েও বেশি উচ্ছ্বসিত নতুন মা তার নতুন মেয়েকে খুঁজে পেয়ে। যেন আক্ষরিক অর্থেই জন্মজন্মান্তরের পর আকস্মিক ভাবেই কোনও এক অজানা গ্রহের ফেরে মা-মেয়ের দেখা। বউমা ‘মা’ ‘মা’ বলতে অজ্ঞান। শাশুড়িও একই রকম বউমা ভক্ত। দুজনে যেন একে-অপরকে কিছুতেই চোখের আড়াল করতে পারে না। গোপালের বাড়ি এখন সুখের হাট। লোকে দেখে হিংসে করে।

সস্তার জিনিস যেমন প্রথম দর্শনে চেনা যায় না, দুদিন ব্যবহারেই তার আসল রূপ প্রকাশ পায়, তার চাকচিক্যের অবসান ঘটে, তেমনি শাশুড়ি-বউমার চিরন্তন স্বাভাবিক সম্পর্ক ধরা পড়ল মাসখানেক বাদে।

এখন কাক, চিল, আদি পক্ষীকুল গোপালের বাড়ির ছাদ, পাঁচিল এড়িয়ে চলে। মফসসলের এই মধ্যবিত্ত পাড়াটার আপাত শান্ত চেহারাটা হঠাৎই বড়ো অশান্ত হয়ে ওঠে শাশুড়ি-বউয়ের নিত্য কলহে। অশান্তি, চিৎকার, চ্যাঁচামেচি লেগেই আছে। কান পাতা দায়। কী নিয়ে যে অশান্তি তা বোধগম্য নয়। কোনও ইস্যু নেই। শাশুড়ি-বউয়ের ঝগড়া না, দুই সতিনের ঝগড়া তাও চট করে বোঝার উপায় নেই। সেই একমেবদ্বিতীয়ম ছেলে-স্বামীর ওপর আধিপত্য বিস্তারের গল্প, যা প্রতিদিন হাজার হাজার ঘর ভেঙে টুকরো টুকরো করে দিচ্ছে। শাশুড়ি ভাবে, যে-ছেলেকে, যে-গোপালকে এই সেদিন জন্ম দিলাম বত্রিশটা নাড়ি ছিঁড়ে, মাসের পর মাস বুকের দুধ খাইয়ে মানুষ করলাম, আধপেটা খেয়ে না খেয়ে পুজোয় নিজের জামাকাপড় না কিনে লেখাপড়া শেখালাম, সেই গোপাল আমার শেষ পর্যন্ত কিনা পর হয়ে গেল! হতচ্ছাড়া অলক্ষুনে মাগিটা আমার অমন মাতৃভক্ত, গোবেচারা গোপালটাকে ছিনতাই করে নিল! দিনরাত অত গুজুর গুজুর, ফুসুর ফুসুর কীসের? আমার ভোলাভালা ছেলেটার মাথা খাচ্ছে! দিনরাত কুযুক্তি দিচ্ছে, আমার বিরুদ্ধে সব সময় নালিশ করছে! ছেলের বিয়ের আগে বাড়িতে আমার কত শান্তি ছিল! ওই মাগিটা আসার পর থেকে ছেলেও আমার বিগড়ে গেল, বাড়ি থেকেও শান্তি উধাও!

চেহারা কিংবা শিক্ষার পালিশ গোপালের মায়ের কোনওদিনই ছিল না। তাই চিন্তার ও ভাষাদৈন্য অচিরেই প্রকট হয়ে ওঠে। বউমা সম্পর্কে তার তিক্ত ভাবনাটাই মুখের কদর্য ভাষায় বেরিয়ে পড়ে মাঝেমধ্যেই। ‘বাড়ি থেকে বেরিয়ে যা হতচ্ছাড়ি মাগি! গোপালের আবার বিয়ে দেব আমি। খাল কেটে আমিই ঘরে কুমির এনেছি! বলি সংসারটা কি শুধু স্বামীটাকে নিয়ে? আরে মূর্খ, স্বামীটাকে পেলি কোত্থেকে? তুই জন্ম দিয়েছিস? আমি কি বাইরের লোক? তোর বাপ-মায়ের সঙ্গে কি তুই এইরকম আচরণ করতিস? পাঠাবার সময় বাপ-মা শিখিয়ে দেয়নি শ্বশুরবাড়িতে কীরকম ভাবে থাকতে হয়, শ্বশুর-শাশুড়ির সঙ্গে কীরকম ব্যবহার করতে হয়? আমরা তো জীবনে শ্বশুর-শাশুড়ির মুখের ওপর কোনওদিন কথা বলিনি, কোনও কথার প্রতিবাদ করিনি, চিরটাকাল তাদের দাসী হয়ে থেকেছি। আমারই ভিটেয় থেকে আমাকেই অপমান? ছেলে মানুষ করলাম শেষ বয়সে এসে বউয়ের লাথিঝাঁটা খাবার জন্য! এর চেয়ে তো মরণও ভালো ছিল আমার!’

মায়ের সঙ্গে উপযুক্ত সঙ্গত করে ননদেরা, ‘মা, একি চেহারা হয়েছে তোমার? সেই কাঁচা সোনার বরন কোথায় গেল? ওই ডাইনি বউটার কীর্তি নিশ্চয়ই! তাড়াও হতচ্ছাড়িকে।’

ভাইয়ের বউয়ের দিকে আঙুল তুলে বলে, ‘তুই এই বাড়ির নখের যুগ্যি নস, দূর হয়ে যা এখনই, নইলে গলা ধাক্বা দিয়ে বের করে দেব, এই বলে দিলাম। চিরকালের জন্য এবাড়ির ভাত খাওয়া ঘুচিয়ে দেব।’

ছেলে-বউ একসঙ্গে বেশিক্ষণ কাটালে, গল্প করলে বা হাসাহাসি করলে শাশুড়ি সহ্য করতে পারেন না। কোনও না কোনও ছুতোয় ছেলেকে অন্য কোনও কাজে ব্যস্ত করে তোলেন অথবা নিজেই দুজনের মাঝে বসে পড়ে অপ্রয়োজনীয় গল্প জুড়ে দেন। রসভঙ্গ করেন। ছেলে-বউ সব বুঝেও কিছু বলতে পারে না।

ছেলে-বউ কোথাও বেড়াতে যাবে শুনলেই শাশুড়ির গাত্রদাহ ও রক্তচাপ হাজারগুন বেড়ে যায়। শরীর খারাপ বা অন্য কোনও ছুতোয় তিনি তা বানচাল করার চেষ্টা করেন। এই করেই সেবারে ওদের দীঘা যাওয়া ক্যানসেল হয়ে গেল। বাড়ি থেকে বেরোবার ঘণ্টাখানেক আগে শাশুড়িমা বুকে হাত দিয়ে শুয়ে পড়লেন। ছোটাছুটি, ডাক্তার ডাকাডাকি সবই করতে হল বেচারা গোপালকে। দীঘা যাওয়া মাথায় উঠে গেল। ডাক্তার এসে বললেন আশ্বাসের কথা, ‘তেমন কিছুই হয়নি… একটু বিশ্রাম।’

ততক্ষণে দীঘার বাস ডায়মন্ডহারবার পৌঁছে গেছে। গোপালের মধুচন্দ্রিমা উচ্ছেচন্দ্রিমায় রূপান্তরিত হয়েছে।

গোপালের মা, বউয়ের দিক থেকে ছেলের মন একশো আশি ডিগ্রি ঘোরানোর আপ্রাণ চেষ্টা করেন। গোপাল চা করতে গেলে, জামাকাপড় কাচতে গেলে বা এঁটো বাসনপত্র তুলতে গেলে অর্থাৎযে-কাজগুলোকে সচরাচর অন্যায়ভাবে শুধুমাত্র মেয়েলি কাজ বলে মনে করা হয়, সেগুলো করতে গেলে মা বাধা দেন। বলেন, ‘তুই এসব কাজ করছিস কেন? এগুলো তো মেয়েদের কাজ, তোর বউয়ের কাজ! এতে তো তোর বউ আরও প্রশ্রয় পেয়ে যাবে, মেয়েদের কাজ ছেলেদের করতে নেই। তুই বোকাসোকা ভালোমানুষ বলে তোকে দিয়ে হাবিজাবি কাজগুলো করিয়ে নিচ্ছে। একদিন ওর কাজ করে দিলে দ্বিতীয় দিন আর ও সেই কাজ করতে চাইবে না। সারাজীবন ধরেই তোকে বউয়ের গোলামি করে যেতে হবে।’

গোপাল মায়ের কথা ঠিক বুঝে উঠতে পারে না। মায়ের কথা মেনে নিতে ওর বড়ো কষ্ট হয়। অথচ তীব্র প্রতিবাদও করতে পারে না। ছোটোবেলা থেকেই ও জেনে এসেছে বড়োরা বিশেষ করে মা-বাবা কখনও সন্তানের অমঙ্গল চান না। তাঁরা যা বলেন বা করেন সবই সন্তানের ভালোর জন্যই। তাঁদের মুখের ওপর কথা বলতে নেই। অথচ ও বেশ বুঝতে পারে স্ত্রীর ক্ষেত্রে মা যা যা বলেন তা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বেঠিক, চরম বিদ্বেষপূর্ণ, শত্রুতাপূর্ণ। সে কী করবে, তার কী করা উচিত কিছুতেই ঠিক করতে পারে না। এক চরম নিষ্ঠুর তীব্র অন্তর্দ্বন্দ্বে ভোগে সে। সে দেখেছে বিয়ের আগে পর্যন্ত মা যা যা বলে এসেছে বা করে এসেছে সবই তার স্বার্থের অনুকূলে। তাই রাতারাতি মায়ের এই ভোলবদল সে কিছুতেই নিজের কাছে ব্যাখ্যা করতে পারে না। যদিও শাশুড়ি-বউ-এর সম্পর্কের চিরকালীন কূটনৈতিক জটিলতা ও পরিপক্ব সাংসারিক বুদ্ধির অভাবই তিক্ততার জন্য দায়ী।

ভালো কথায় কাজ হচ্ছে না দেখে মা এবার অন্য রাস্তা ধরেন। গোপালকে দিনরাত কথায় কথায় তুচ্ছতাচ্ছিল্য, অপমান করেন। বলেন, ‘বউকে প্রশ্রয় দিচ্ছিস। তোর প্রশ্রয়েই বউ এত বাড় বেড়েছে। বউকে শাসন করার ক্ষমতা নেই, স্ত্রৈণ কোথাকার! বউয়ের কথায় ওঠবোস করিস। মনে রাখিস, বউ গেলে বউ আসবে, মা গেলে মা আসবে না। যে মা তোকে জন্ম দিল, এই এতটুকু থেকে মানুষ করল, দুদিনের বউকে পেয়ে সেই মাকে ভুলে গেলি? নেমকহারাম কোথাকার! একেই বলে কলিকাল। এমন ছেলে থাকার চেয়ে বাঁজা হওয়াও ভালো ছিল। জন্মের পরই যে কেন তোকে গলায় নুন দিয়ে মেরে ফেলিনিরে হতভাগা!’

গোপালের ওপর মায়ের এই মানসিক অত্যাচারের কারণ হল যে, তিনি চান এসব অপমানের মাধ্যমে গোপালকে এমন মানসিক অশান্তির মধ্যে ফেলা যে, সে যেন ভাবে এসবের জন্য বউ-ই দায়ী, কারণ, বিয়ের আগে মা তার সঙ্গে ভালো ব্যবহারই করত কিন্তু বিয়ের পর মায়ের আচরণ পালটে গেল। এই কথা ভেবে গোপাল যাতে মায়ের অত্যাচারের হাত থেকে বাঁচতে বউয়ের ওপর অত্যাচার করে, মায়ের মনে এমনই আশা। কিন্তু গোপাল মায়ের এই কৌশল বুঝে ফেলে। তাই সে মায়ের কৌশলের ফাঁদে পা দেয় না।

কম যায় না গোপালের বউ-ও। শাশুড়িমাকে সে সতিন জ্ঞান করে। তাকে মন্দ ভাষা বলতেও বউয়ের বুক কাঁপে না। তিরিশ বছরের বড়ো এক মহিলার সঙ্গে সমানে টক্বর দেবার বা তাকে ওই ভাষায় গালাগাল করার সাহস কোত্থেকে আসে তা ভেবে গোপাল অবাক হয়ে যায়। গোপাল মাঝে মাঝে ভাবে, ‘এ নিজের মায়ের সঙ্গেও কেমন আচরণ করে!’

গোপালকেও বউ ছেড়ে কথা বলে না। শাশুড়ি-ননদের হাতে হেনস্তার জন্য সে সর্বদা গোপালকেই দায়ী করে।

‘তুমিই তো যত নষ্টের গোড়া! বিয়ে করে এনেছিলে কি মাকে দিয়ে পদে পদে অপমান করাবে বলে? বউয়ের সম্মান রাখতে পার না, কী ধরনের স্বামী তুমি? অমন স্বামী থাকার থেকে না থাকা ঢের ভালো ছিল। এর চেয়ে আইবুড়ি হয়ে সারাজীবন কাটানো অনেক সুখের হতো। ব্যক্তিত্বহীন নপুংসক কোথাকার! মায়ের ন্যাওটা হয়েই তো সারাজীবন থাকতে পারতে। বিয়ে করার শখ হল কেন? অতই যদি মাকে ছেড়ে থাকতে কষ্ট, তাহলে রাতটাও তো মায়ের সঙ্গেই কাটাতে পারতে!’

বউ আরও বলে, ‘এখানে তোমার মায়ের সঙ্গে আমি থাকতে পারব না। অন্য কোথাও চলো, বাড়ি ভাড়া করো, ফ্ল্যাট কেনো, নইলে বাপের বাড়ি চলে যাব, পুলিশের কাছে তোমার নামে বধূ নির্যাতনের অভিযোগ করব। মহিলা সমিতিতে অভিযোগ করব, কোর্টে নারী নির্যাতনের মামলা করব। জেলের খাবার খাওয়াব তোমায়, এই বলে দিলাম!’

ইতিমধ্যে বউয়ের বাপ আর তিন দাদা এসে চমকে দিয়ে গেছে গোপালকে। তিন দাদা তিনটে আলাদা আলাদা রাজনৈতিক দলের ঘাটে নোঙর বেঁধেছে। সে কী তড়পানি! ‘অনেক খরচা করে বোনের বিয়ে দিয়েছি পড়ে পড়ে লাথিঝাঁটা খাবার জন্য নয়। অমন মা থাকার চেয়ে না থাকা ভালো। দরকার হলে বুড়িটাকে লাথি মেরে বাড়ি থেকে বের করে দাও। আমাদের আদরের একমাত্র বোনের ওপর কোনওরকম অত্যাচার সহ্য করব না। মাকে যদি শায়েস্তা করতে না পারো তাহলে তোমাকে কীভাবে শায়েস্তা করতে হয় তা আমরা বুঝে নেব!’

মা, বউ দুজনেই দিনরাত আত্মহত্যা করার ভয় দেখায়। বউ যদি সকালে আত্মহত্যা করার ভয় দেখায় তাহলে মা দেখায় বিকেলে, মা যদি দিনের বেলায় তো বউ রাতে। এ যেন একদলের মিছিল বা বন্ধের ডাকের বদলে অন্য দলের পালটা ডাক। আত্মহত্যা করার ভয় দেখিয়ে দুজনেই এক ঢিলে দুই পাখি মারতে চায়– গোপালকে চাপের মধ্যে রেখে নিজ নিজ স্বার্থসিদ্ধি করা এবং অপর পক্ষের আত্মহত্যার হুমকিকে নস্যাৎ করে দেওয়া। কিন্তু মনস্তত্ত্বের এই সূক্ষ্ম ও জটিল উপধারাগুলো উপলব্ধি করার মতো সূক্ষ্মতর বুদ্ধি উচ্চশিক্ষিত গোপালের থাকলেও তা এখন কাজ করে না।

ইতিমধ্যে মা একদিন ঘরের দরজা বন্ধ করে বউয়ের শাড়ি গলায় পেঁচিয়ে সিলিং ফ্যান থেকে ঝুলতে আপ্রাণ চেষ্টা করেও চরম ব্যর্থ হয়েছেন। বাইরে থেকে গোপাল দরজায় দমাদ্দম লাথি মারতে থাকে আর চিৎকার করতে থাকে, ‘বাঁচাও বাঁচাও’। পাড়ার ক্লাবের ছেলেরা দৌড়ে আসে, আশেপাশের বাড়ির লোকেরা হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসে। সকলের ঠেলাঠেলি, লাথালাথিতে দরজা ভেঙে যায়। দেখা যায় গোপালের মা গলায় গোপালের বউয়ের শাড়ি বেঁধে ‘অজ্ঞান’ অবস্থায় মাটিতে পড়ে আছে। ‘মা মা’ বলে ককিয়ে চিৎকার করে ওঠে গোপাল। সকলে মিলে কেউ ফ্রিজ থেকে, কেউ বাথরুম থেকে জল এনে মায়ের চোখে মুখে ঝাপটা মারতে থাকে। আস্তে আস্তে জ্ঞান ফেরে মায়ের।

পালটা হিসেবে পরের দিনই বউ কেরোসিন তেলের জ্যারিকেন খুলে সারা গায়ে ঢেলে আগুন লাগাবার আপ্রাণ চেষ্টা করেও চরম ব্যর্থ হয়। পরপর চারচারটে দেশলাই কাঠি জ্বেলেও শাড়িতে ঠেকাবার আগেই নিভে যায়। এই বিশাল পরিমাণ সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে গোপাল ছাড়ে না। দৌড়ে গিয়ে ছোঁ মেরে দেশলাই কেড়ে নিয়ে সে যাত্রা বউ ও নিজেকে বাঁচাতে সক্ষম হয়। বলাবাহুল্য এ দুটো ঘটনাই বাড়িতে গোপালের উপস্থিতিতে ঘটেছিল। মন্দজনে বলাবলি করে দুটোই নাকি চিৎপুরের কোনও এক হিট যাত্রা পালার অংশ থেকে ধার নেওয়া।

গোপাল দিনরাত আতঙ্কে থাকে, এই বুঝি কিছু একটা হয়ে গেল। এই বুঝি মা আবার ঝুলে পড়ল, এই বুঝি বউ নিজের গায়ে আগুন লাগিয়ে দিল। অফিসে কাজে মন দিতে পারে না, ক্লাবে আড্ডা দিতে যেতে পারে না, না জানি বাড়ি গিয়ে কী দেখবে! ঘনঘন মোবাইল চেক করে, কোনও দুঃসংবাদ এল কিনা। মনে শান্তি নেই, চোখে ঘুম নেই, কাজে মন নেই। চব্বিশ ঘণ্টা তাকে একটাই আতঙ্ক তাড়া করে বেড়ায়– এই বুঝি, এই বুঝি… মনে মনে সে দুজনের যে-কোনও একজনের মৃত্যু কামনা করে– মা অথবা বউ, বউ অথবা মা, যে-কোনও একজনকে যেতেই হবে, তা না-হলে সে নিজে বাঁচবে না। অথচ দুজনের কেউ একজন আত্মহত্যা করেছে ভাবলেই সে শিউরে ওঠে, কী অস্বাভাবিক অন্তর্দ্বন্দ্ব! এক এক সময় ভাবে, দরকার নেই দুজনের কাউকেই, দুজনেই চরম স্বার্থপর, যে যার নিজেরটাই শুধু বোঝে, তার কথা কেউ ভাবে না, ভাবলে এই রকম আচরণ করত না। কেউ তাকে ভালোবাসে না।

গোপাল ঠিক বুঝতে পারে না কার দোষ। মায়ের কথা শুনলে মনে হয় সব দোষ বউয়ের। আবার বউয়ের সব কথা শুনলে মনে হয় যত নষ্টের গোড়া ওই মা। মা না বউ, বউ না মা, মা না বউ, বউ না মা। ওঃ, গোপাল আর পারে না, ও কি পাগল হয়ে যাবে? এখন ও সবসময় ভাবে, কেন যে মরতে বিয়ে করতে গেলাম!

বন্ধুরা অনেকেই বলে, ‘গোপাল, শাশুড়ি-বউয়ের ঝগড়া নিত্যসত্য, জীবনের অঙ্গ, আমাদের জীবনেও আছে বা ছিল, সব ঠিক হয়ে যাবে।’ কেউবা বলে, ‘যদি সত্যিই বাঁচতে চাস তবে বউকে নিয়ে আলাদা হয়ে যা। কিন্তু বউকে নিয়ে আলাদা হয়ে গেলে বৃদ্ধা মাকে দেখবে কে? বাবা মারা গেছেন মায়ের কোলে আড়াই বছরের গোপালকে রেখে। তারপর থেকে মা-ই বাবা, মা-ই মা।

জ্ঞানবয়সে বাবার স্বাদ পায়নি গোপাল। বাবা কি জিনিস সে জানে না। স্কুলে বন্ধুবান্ধবদের কাছে যখন তাদের বাবাদের গল্প শুনত, তখন ওর খুব দুঃখ হতো। ওদের বাবারা অফিস থেকে ফেরবার সময় টফি, চকোলেট, ক্যাডবেরি, আইসক্রিম, নতুন নতুন খেলনা নিয়ে আসে। অফিস থেকে ফিরে কত আদর করে বাবারা। ছুটির দিনে ওদের সঙ্গে ফুটবল, ক্রিকেট খেলে। কার বাবা কাকে কত ভালোবাসে এই নিয়ে ওর বন্ধুবান্ধবদের মধ্যে প্রায়ই ঝগড়া হতো। গোপাল ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকত সেই দিকে। ওর শিশুমন কল্পনা করার চেষ্টা করত ফোটোর বাবা অফিস থেকে ফিরে জামাকাপড় না ছেড়েই ওকে কোলে তুলে নিল। চুমোয় চুমোয় ভরিয়ে দিল ওর মুখচোখ। তারপর পকেট থেকে বার করল মুঠো মুঠো চকোলেট, লজেন্স, ক্যাডবেরি।

ছোটোবেলায় গোপাল প্রায়ই স্বপ্ন দেখত বাবা ওকে পার্কে বেড়াতে নিয়ে গেছে। নাগরদোলা চড়াচ্ছে, ওকে ওপরে ছুড়ে দিয়ে লুফছে, ওর সঙ্গে ফুটবল, ক্রিকেট, লুকোচুরি খেলছে, ওকে বকছে, শাসন করছে, পড়াচ্ছে। সকালে ঘুম ভাঙার পর বাবার ওপর ওর খুব রাগ, অভিমান হতো। বাবা কেন ওকে ফেলে, মাকে ফেলে ‘তারা’ হয়ে গেল, বাবা খুব দুষ্টু!

বাবার অকাল মৃত্যুর পর মা-ই ওদের তিন ভাইবোনকে অতিকষ্টে মানুষ করেছে, লেখাপড়া শিখিয়েছে। সমাজে পরিচয় দেবার মতো করে তৈরি করেছে। বাবা বেসরকারি অফিসে চাকরি করতেন। তাই বাবার অফিসে অনেক চেষ্টা করেও মায়ের কোনও চাকরি হয়নি। তবে অফিসেরই কেউ কেউ বাঁকা পথে চাকরি পেতে সাহায্য করার বদলে টাকাপয়সা এবং আরও অনেক কিছুই চেয়েছিল। শেষ পর্যন্ত কয়েকটা টিউশনি আর রান্নার কাজ ধরে মা নড়বড়ে সংসারটাকে কোনওরকমে দাঁড় করায়।

মা যে লোকের বাড়ি রান্নার কাজ করত তা মা কাউকে কোনওদিন বলত না। বাড়িতেও কেউ জানত না, গোপালও না। ‘পড়াতে যাচ্ছি’ বলে গোপালের মা বাড়ি থেকে বেরোত। একদিন গোপালের মামা হঠাৎ অফিস থেকে গোপালদের বাড়িতে এসে হাজির। মামার বাড়ির দাদুর খুব শরীর খারাপ, দাদুর ইচ্ছা এখনই মাকে নিয়ে যেতে হবে। তাই মামা নিজেই এসে হাজির। গোপালকে পাঠানো হল মায়ের ছাত্রীর বাড়ি। সেখানে গিয়ে গোপাল শুনল, ‘তোর মা রান্না করে চলে গেছে’। গোপাল ব্যাপারটা বুঝতে পারেনি। ভেবেছিল মা ভালো রান্না করতে পারে বলে হয়তো আবদার করে মাকে দিয়ে কিছু রান্না করিয়ে নিয়েছে। পরে একদিন মাকে জিজ্ঞেস করাতে মা ওর মুখে হাত দিয়ে চেপে ধরেছিল। বলেছিল, ‘আর কাউকে ওসব কথা কোনওদিন বলিসনি’। নাঃ, গোপাল আর কোনওদিন ও কথা মুখেও আনেনি। বাড়িতেও কাউকে বলেনি। যদিও কথাটার অন্তর্নিহিত অর্থের মাথামুন্ডু সে তখন কিছুই বোঝেনি।

সেই মাকে একা অসহায় ভাবে ফেলে রেখে সে কেমন করে শুধুমাত্র ব্যক্তিগত সুখের সন্ধানে ফ্ল্যাট কিনে চলে যাবে?

ঘাড়টা সামনের দিকে ঝুঁকে পড়েছে। জিভটা মাকালীর মতো আধফুটের মতো বেরিয়ে এসেছে। চোখদুটো কোটর ঠেলে প্রায় বাইরে বেরিয়ে এসেছে। যেন ড্যাবডেবিয়ে গোপালের দিকেই তাকিয়ে আছে, বলছে, তুমিই, হ্যাঁ হ্যাঁ তুমিই দায়ী। বাড়িতে লোকে লোকারণ্য। এটা মফসসল এলাকা। এখানে কেউ খুন হলে বা আত্মহত্যা করলে এখনও জমাট ভিড় হয়। সবাই ফিসফিসিয়ে গোপালের বউ সীমার আত্মহত্যার সম্ভাব্য কারণ নিয়ে আলোচনা করছে। এরকম একটা পরিণতির ধারণা যে অনেকের মধ্যেই ছিল তার ইঙ্গিত দিচ্ছে। এরই মধ্যে হুড়মুড়িয়ে পুলিশ এসে হাজির।

আচমকাই গোপালের ঘুমটা ভেঙে যায়। এই শীতেও তার সারা শরীরে ঘামের স্রোত বয়ে যায়। ও ভাবে, ওঃ সীমা তাহলে আত্মহত্যা করেনি। বিছানায় শুয়ে শুয়েই ও ভাবতে চেষ্টা করে, এটা সত্যিই স্বপ্ন তো!

এর আগেও একদিন গোপাল স্বপ্ন দেখেছে ওর মা বিষ খেয়ে হ্যাঁচোড়প্যাচোড় করছে আর পাড়া মাথায় করে চ্যাঁচাচ্ছে, ‘গোপাল আমি বিষ খেয়েছি, আমি চললাম, তুই বউকে নিয়ে সুখে থাকিস।’

গোপাল, ‘আর হবে না মা, আর কখনও হবে না, এবারের মতো ক্ষমা করে দাও’ বলে কান্নাকাটি করছে। হঠাৎ মা দুম করে মাটিতে পড়ে গেল আর চমকে উঠে গোপালেরও ঘুম ভেঙে গেল।

গোপাল নিখোঁজ। আগের দিন রাতে মা-বউতে তুলকালাম হয়েছে। মুখের সীমান্ত পেরিয়ে গতকাল যুযুধান দুইপক্ষে তুমুল হাতাহাতি হল। শেষ পর্যন্ত তা রক্তারক্তিতে গড়াল। শাশুড়ি গ্যাস আভেনে রুটি সেঁকতে সেঁকতে গরম খুন্তি দিয়ে বউকে ঘা কতক দিতেই বউ মড়াকান্না জুড়ে দিয়ে শাশুড়ির মাথায় সাঁড়াশির বাড়ি দমাদ্দম লাগিয়ে দিল। দুপক্ষই রক্তারক্তি। প্রবল চিৎকার চ্যাঁচামেচিতেও পাড়ার কেউ এল না। কারণ এটা এ বাড়ির নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। দুর্গাপুজোয় ভিড় হয়, ট্রাফিক জ্যাম হয়, নিত্যপুজোয় ওসব কিছু হয় না। রাতবিরেতে ডাক্তার, হাসপাতাল সবই হল। হাতে, মাথায় ব্যান্ডেজ বেঁধে দুপক্ষ মাঝরাতে বাড়ি ফিরল।

স্বভাবতই পরের দিন শাশুড়ি, বউ উভয়েরই ঘুম ভাঙল বেশ দেরিতে। উঠে দেখল, গোপাল নেই। ভাবল, হয়তো দোকান বাজার গেছে, এখনই ফিরবে। কিন্তু বেলা গড়ায়, গোপালের দেখা নেই। ভাবল, রাগ করে বেরিয়ে গেছে, রাগ পড়লেই ফিরে আসবে। সকাল গড়িয়ে বিকেল, বিকেল গড়িয়ে সন্ধে, সন্ধে গড়িয়ে রাত হল, কিন্তু গোপালের দেখা নেই। খবরটা সারা পাড়া ছড়িয়ে পড়েছে। গোপালের শ্বশুরবাড়ি পর্যন্ত খবর পৌঁছে গেছে। বন্ধুবান্ধব, পাড়াপড়শি, আত্মীয়স্বজন সবাই মিলে তন্নতন্ন করে খোঁজ করে গোপালের। কিন্তু না, কোনও হদিশই নেই।

– গোপাল কি মা-বউয়ের ওপর রাগ করে বিবাগি হয়ে গেল?

– গোপাল কি বাড়িতে দিনরাত অশান্তির জেরে দু-চার দিনের জন্য কোথাও আত্মগোপন করল?

গোপালের অন্তর্ধানে কিন্তু বাড়ির অশান্তি থেমে থাকল না, বরং তা অন্য মাত্রা নিল। মা-বউকে বলল, ‘তুই আমার ছেলেকে খেয়েছিস!’ আর বউ মাকে বলল, ‘তোর জন্যই ও বাড়ি ছেড়ে চলে গেল।’

তিন দিনের দিন– আশেপাশের এলাকা দুর্গন্ধে ভরে যায়। মানুষজন নাকে রুমাল দিয়ে হাঁটতে থাকে, ভাবে বেড়াল বা রাস্তার কুকুর মরেছে। কিন্তু বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ে দুর্গন্ধের তীব্রতা। পুলিশ আসে। গোপালের বাড়ির উলটোদিকে একটা পরিত্যক্ত কারখানা থেকে উদ্ধার হয় গোপালের পচাগলা ঝুলন্ত দেহ।

‘বউকে দুলাখ টাকা দিয়ে গেলাম। টাকাটা কো-অপারেটিভ ব্যাংকে আছে। বউ যেন টাকাটা পায়। মা, তুমি আমাকে ক্ষমা কোরো। তোমাকে খুব ভালোবাসি। দিদিকে, বোনকেও খুব ভালোবাসি। সবাইকে নিয়ে সুখে শান্তিতে বাঁচার চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু পারলাম না, হেরে গেলাম। পুলিশ যেন কাউকে না ধরে। আমার মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী নয়।’ পরের দিন বালিশের ওয়াড়ের ভেতর থেকে উদ্ধার হল গোপালের সুইসাইড নোট।

গোপালের বাড়িতে এখন চরম ‘শান্তি’ বিরাজ করছে। গোপাল তো এটাই চেয়েছিল! তাই না?

 

টিরিং

চল ফুলি, তোর নামে ব্যাংক-এ একটা অ্যাকাউন্ট খুলে দিই। তোর ভালো নামটা কীরে?

মেয়েটা লজ্জা লজ্জা মুখ করে বলেছিল ফুলেশ্বরী।

– ফুলেশ্বরী? কী সুন্দর নামটা রে তোর। তোকে নিয়েই তাহলে সিনেমাটা হয়েছিল। সন্ধ্যা রায় ছিল না? স্ত্রীকে জিজ্ঞাসা করলেন রজতকান্তি।

রজতকান্তির স্ত্রীর নাম চন্দ্রিমা। সায় দিলেন।

রজতকান্তি বললেন– মেয়েটা এতদিন আছে, ভালো নামটাই জানি না। ফুলি নামে ডাকি।

ফুলি বলে, না, আমার নামে ব্যাংক-এ বই খুলতে হবে না। আপনার কাছে টাকা আছে, ওটাই ঠিক আছে।

রজতকান্তি বলে, মোটেই ঠিক নেই। আমি মরে গেলে?

ধুর, খালি বাজে কথা।

মানুষ চিরকাল বাঁচে নাকি? একবার তো হার্ট অ্যাটাক হয়েই গেল। তোর সব টাকা তোর অ্যাকাউন্ট-এ রেখে দেব।

কিন্তু অ্যাড্রেস প্রুফ? আইডেনটিটি প্রুফ? ওর তো ভোটার কার্ডই নেই। গত ভোটের আগে একবার ভোটার কার্ড করার চেষ্টা করেছিলেন রজতকান্তি, হয়নি। ওরা চেয়েছিল ব্যাংক অ্যাকাউন্ট, পাসপোর্ট, প্যান কার্ড এসব কত কিছু।

তোর রেশন কার্ড আছে না একটা?

জানি না।

জানি না মানে? ছিল তো নিশ্চয়ই।

ঠোঁট উলটে ফুলি মাথা নাড়ায়। মানে জানে না।

তার মানে ফুলির ভারতের নাগরিকত্বের কোনও প্রমাণ নেই।

ফুলি কবে থেকে এখানে? মামণি যখন মাধ্যমিক দিল। ফুলির মা বলেছিল, মেয়েটাকে আপনারা রাখুন। বারো বছর বয়স হ’ল ওর। ওর উপর কুনজর পড়েছে। সকালে চলে আসি, ঘরে একা থাকে মেয়ে। ওকে খাওয়া পরায় রেখে দিন। তার মানে বারো বছর হয়ে গেল এ বাড়িতে।

আগেকার সময় হলে চেষ্টা চরিত্র করে একটা রেশন কার্ড করে নেওয়া যেত। এখন শহুরে মধ্যবিত্তরা রেশন-এর চাল খায় না। রেশন দোকান থেকে গম নিয়ে চাকিতে দিয়ে আটা ভাঙানোর দিনও আর নেই। এখন সবাই আটাই কেনে। রেশন-এর দোকানে আজকাল মুদি দোকানের মতোই মশলা, সাবান, এমনকি প্রসাধন সামগ্রীও বিক্রি হয়। রজতদেরও রেশন কার্ড আছে। মাসে একবার গিয়ে যা হোক কিছু নিয়ে আসা হয়। রেশন কার্ড করাতে গেলে বলবে আগের কার্ডখানা নিয়ে আসুন, যদি বলা হয় আগে কার্ড ছিল না– তখন বলবে এত বছর বয়সেও কার্ড নেই? ঠিকানার প্রমাণ, বয়সের প্রমাণ, ভোটার কার্ড…। ফুলির তো কিচ্ছু নেই। এই যে চব্বিশটা বছর ধরে পৃথিবীতে রয়েছে, তার কোনও প্রমাণ নেই। ফুলিকে কেউ চিঠিও দেয় না।

দেশের বাড়িতে ফুলি ক্লাস ফাইভ অবধি পড়েছিল। এ বাড়িতে আসার পর চন্দ্রিমা মাঝেমধ্যে পড়াতে বসত। দোকানের নাম পড়তে পারে, মুদির হিসেব পড়তে পারে, টিভির সিরিয়ালগুলোর নাম পড়তেও অসুবিধে হয় না তার– এমনকী যুক্তাক্ষর দিয়ে লেখা কঠিন কঠিন নাম যেমন স্বয়ংসিদ্ধা, অগ্নিপরীক্ষা এসবও পড়তে পারে। ওকে কেউ চিঠি দিলে, ও পড়তে পারবে। উত্তরও দিতে পারবে। একদিন বলেছিল দিদিকে। দিদি মানে এ বাড়ির মেয়ে। রজত-চন্দ্রিমা ওকে মামণি ডাকে, ওর আসল নামটা খুব কঠিন, মন্দাক্রান্তা। মামণি তো আদরের ডাক। ফুলি তো সেটা বলতে পারে না, আবার মন্দাক্রান্তাকে ছোটো করে মন্দ দিদি বলা যায় নাকি? জেঠিমা-ই বলে দিয়েছে মিষ্টি দিদি ডাকতে। ফুলি একদিন বলেছিল ও মিষ্টি দিদি, আমাকে একটা চিঠি দেবে?

কী চিঠি?

এমনি চিঠি। আমার নামে আসবে বেশ…

কী লিখব?

যা খুশি…।

তার চে বরং তোকে একটা মেল আইডি বানিয়ে দিচ্ছি, চ্যাট করবি বেশ।

আসলে পাত্তাই দেয়নি।

ঝন্টুদাকে ও বলেছিল একটা চিঠি দেবেন আমাকে? এমনি চিঠি।

ঝন্টুদা দিয়েছিল।

রজতকান্তি বলেছিল ফুলি, তোর নামে আলাদা পাসবই বোধহয় হবে না, আমি তোর টাকাটা আমার নামেই রাখছি, তোকে নমিনি করে দিচ্ছি, আমার কিছু হয়ে গেলে তুই সেটা পাবি। আমার নামে হলেও ওটা তোরই টাকা। তোর মা বলেছিল খাওয়া-পরায় রাখতে। আমি কিন্তু তোকে মাইনেও দিচ্ছি। হিসেব করে দেখলাম তোর তিরিশ হাজার টাকার উপর পাওনা হয়ে গেছে। বলে রাখলাম এগুলো তোর টাকা। তুই এখন তিরিশ হাজার টাকার মালিক। এই টাকায় আমি হাত দেব না। তোর যা খুশি, যেভাবে ইচ্ছে খরচ করবি। তোর বিয়েতেও এই টাকা খরচ করব না ফুলি। তোর বিয়ের খরচ আমাদের। মামণির বিয়েটা মিটে যাক, তারপর তোর জন্য পাত্র দেখা শুরু করব। তোকে বিয়ে দিয়ে আমরা দুজন কোনও বৃদ্ধাশ্রমে চলে যাব।

মিষ্টি দিদির বিয়েটা ঠিক হয়ে গেছে। ঠিক হয়ে গেছে মানে দিনটা। বিয়েটা তো আগেই ঠিক ছিল। মিষ্টি দিদির বরকে তো ফুলি কবে থেকেই চেনে। পার্থদা। এ বাড়িতে আসে। মিষ্টিদির ঘরে বসে গল্প করে। তখন ওঘরে কেউ যায় না। ঘরের বাইরে থেকে জিজ্ঞাসা করে, এবার চা দিয়ে যাব? কখনও মিষ্টি দিদি নিজে এসে চা আর জলখাবার নিয়ে যায়। খুব বড়ো চাকরি করে পার্থদা। মিষ্টিদিও তো চাকরি করে। কম্পুটারি চাকরি। পরশু দিন বিয়ে। বাড়ি রং করা হয়েছে। ইলেকট্রিকের কাজ করা হয়েছে, বাড়িতে অনেক লাইট লাগানো হয়েছে। ছাদেও লাইটের ব্যবস্থা হয়েছে। বিয়েটা এবাড়িতে হবে না। বিয়েবাড়ি ঠিক করা হয়েছে। কাল থেকেই লোকজন আসবে। মামা-মামি আসবে। দু’জন কাকু আসবে। ওরা সবাই মিষ্টি দিদির মামা-মামি। মিষ্টি দিদির কাকা-কাকু। ফুলিরও। ফুলির কে আছে? কেউ নেই। মা মরে গেছে, ব্যস, হয়ে গেল। কেউ নেই। শুধু ঝন্টুদা আছে।

ঝন্টুদা এবাড়ির সব ইলেকট্রিক-এর কাজকর্ম করে। ফ্যান খটখট, টিউব লাইটে ভোঁ ভোঁ, গিজার খারাপ– সব ঝন্টুদা করে। ফোন করে দিলেই চলে আসে। ঝন্টুদাকে চা করে দেয় ফুলি। চায়ে চুমুক দিতে দিতে মিটিমিটি তাকায় ফুলির দিকে।

ঝন্টুদা প্রথম আদর করেছিল ছাদে। সরস্বতী পুজোর প্যান্ডেল করার সময়। পুজোর আগের দিন। বাড়িতে সরস্বতী পুজো হয়। ছাদে ছোটো করে প্যান্ডেল হয়। খিচুড়ি হয়। দিদিমণির বইপত্তর আর ল্যাপটপ না কি যেন বলে, সেটা রাখে। ওখানে ফুল চন্দন পড়ে। পাড়ার অনেকে আসে। আদরের সময় ফুলি বলেছিল– এমা, এখানে না, ঠাকুর দেখে ফেলছে। ঝুন্টদা বলেছিল ঠাকুরের এখন চোখ ঢাকা। কেউ ছিল না ছাদে। বাড়ির পাম্পের কাজ করতেও ছাদে যেতে হয়। চৌবাচ্চায় ওঠার মই ধরতে হয় ফুলিকে। পাম্পটা তো প্রায়ই খারাপ হয়। ঝন্টুদা বলে পাম্পটা কি ভালো বল, তোকে আর আমায় ছাদে এনে দেয়।

ঝন্টু ফুলির কাছ থেকে জেনে নিয়েছিল-এ বাড়ির কে কোথায় শোয়। দোতলায় তিনটে ঘর। একটা ঘরে মিষ্টি দিদি। একটা ঘরে জ্যাঠা-জেঠি আর একটা ঠাকুরঘর।

একতলায় রান্না খাওয়া। একটা ড্রইংরুম। কেন যে ড্রইংরুম বলে কে জানে। ওখানে কোনও ড্রইং হয় না। ওখানে গদিওলা চেয়ার আছে। একটা টিভিও আছে। আর একটা ঘরে ফুলি থাকে। ফুলির ভয় করে না। ওর নীচে থাকতেই ভালোলাগে। বারবার দরজা খোলা-বন্ধ করা ফুলিকেই তো করতে হয়।

ঝন্টুদা বলেছিল ফুলি, তুই দারুণ। খুব মিষ্টি। তোকে ছুঁলে আমার গায়ে ইলকট্রিক শট্ লাগে। তোর লাগে? ফুলি মাথা নীচু করে বলেছিল দুষ্টু কোথাকার। এটা কিন্তু ওর নয়, হাসিরাশি সিরিয়ালের হাসির ডায়লগ। ঝন্টুদা বলেছিল তোকে আমি একদিন অনেকটা পেতে চাই। অনেকক্ষণ ধরে।

ওমা! সেকি কথা। নানা… এটা কোনও সিরিয়ালের নয়, ফুলির নিজের।

ঝন্টুদা বলেছিল– না করিস না ফুলি। তোকে আমি স্বপ্ন দেখি। স্বপ্নে আদর করি। আমার বোনটাকে বিয়ে দিয়ে তোকে আমি বিয়ে করে তোর সঙ্গে সংসার করব। তোর কেউ নেই, আমারও কেউ নেই। একদিন ফুলি, আমি রাতে তোর ঘরের জানালায় টোকা দেব…।

না– এমন কথা বলে না, বলে পালিয়ে গিয়েছিল ফুলি সেদিন।

তারপর ঝন্টুর ওই কথাগুলো তোলপাড় করেছে ফুলিকে। স্বপ্ন। স্বপ্নে স্ক্রু, নাটবল্টু আর তারের মালা জড়ানো ঝন্টুদা বলছে সংসার! সংসার।

পার্থদা আর মিষ্টি দিদি যে একসঙ্গে থেকেছে! পর্দা ফেলা, কখনও দরজা বন্ধ। তার বেলা?

এখন না হয় বিয়ে হবে। কিন্তু এর আগেও তো কতদিন…

রাস্তায় দেখা হতে ঝন্টুদা বলল, কিরে ফুলি। কতদিন দেখি না। তোদের বাড়ির কিছু খারাপও হচ্ছে না দেখছি। তোকে না দেখে আমার তো মেনসুইচ খারাপ হয়ে গেল। ফুলি, মাইরি বলছি, তোকে যেদিন ফার্স্ট দেখেছিলাম না, আমার ফিউজ উড়ে গিয়েছিল। প্লিজ মাইরি, একদিন ব্যবস্থা কর। আমি তোর ঘরে আজ রাতে টোকা দেব।

ফুলি বলেছিল– না-না, টোকা নয়, টোকা নয়, কেউ শুনে ফেলবে।

ঝন্টু বলেছিল– তুই তো বলেছিলি তোর জ্যাঠা-জেঠি দশটার সময় শুয়ে পড়ে। দিদি মনে কানে ছিপি গুঁজে কম্পুটারি করে। কে শুনবে?

ফুলি বলেছিল– না না, টোকা দেওয়া খুব খারাপ। শুনে ফেলবে।

ঝন্টু বলেছিল তাহলে সাইকেলের বেল বাজাব। টিরিং। রাস্তায় তো সাইকেল চলতেই পারে। আজ ঠিক রাত সাড়ে এগারোটায় টিরিং, কেমন!

রাত্রে টিরিং। ঝন্টুদার হাতে একটা সাইকেল বেল। খুব আস্তে দরজা খুলে গেল। ফুলির ঘরে ঝন্টু। ঝন্টু বলেছিল কোনও ভয় নেই ডার্লিং, সব ব্যবস্থা নিয়ে এসেছি।

ঝন্টুদা এক ঘণ্টা বাদে চলে গিয়েছিল। রাস্তার আলোয় তখন শ্যামাপোকা, কার্তিকের কুয়াশা। নিমগাছের পাতায় পাতায় – না যেও না… রজনীর তখনও বাকি।

এরকম টিরিং হয়ে গেছে আট দশ বার। প্রতিবারই ফুলি ঝন্টুর কানে ফিসফিস করে বলেছে আর নয় কেমন, বিয়ের পরে আবার।

একমাসের উপর কোনও টিরিং হয়নি। আজ হ’ল। হ’তে পারে এটা সত্যিসত্যি সাইকেলের টিরিং। কান খাড়া করে শুনল। চলমান সাইকেলের একটা আলাদা টিরিং ধবনি থাকে। রাত্রির অন্ধকারে আবার ছোট্ট একটা টিরিং।

দু’দিন পর বিয়ে। মেয়ে চলে যাবে। বড়িতে এখন এসব ঠিক নয়। তাছাড়া বাড়িতে এ সময়ে ঘুম কমে যায়। কাল সকালেও এসেছিল ঝন্টুদা। ছাদে লাইট লাগাতে। কোনও কথা হয়নি। কিচ্ছু বলেনি ঝন্টুদা। যাবার সময় শুধু বলে গেল ছাদের দরজাটা বড্ড পলকা জ্যাঠামশাই, ঠিক করিয়ে নেবেন। জ্যাঠামশাই বলেছিলেন মিস্তিরিগুলোর বড্ড ডাঁট বেড়েছে। বললে আসে না। একটা মিস্তিরি পাঠিয়ে দিও কাল। দেখছি, বলে চলে গেল। একটি বারের জন্যও ফুলির দিকে তাকাল না। অভিমান হয়েছিল। একমাস হয়ে গেল বলে ঝন্টুদার খুব কষ্ট হচ্ছে।

আস্তে আস্তে দরজার ছিটকিনিটা খুলল ফুলি।

ছিটকিনি খুলতেই একজন লোক ফুলির মুখ চেপে ধরল। অন্য একজন ফুলির দুটো হাত পিছনে নিয়ে বেঁধে দিল। মুখের উপর আঠালো কী একটা জিনিস চেপে দিল। তারপর একটা কাপড় দিয়ে মুখ বেঁধে দিল। একজন ফুলির মুখটা খামছে ধরল। গলাটাও। বুকের কাছেও হাত দিয়ে খামচে দিল। বলল চুপ করে এখানে দাঁড়িয়ে থাক।

ফুলি উপরে উঠে যাবার পায়ের শব্দ শুনল।

ফুলির তো পা বাঁধা ছিল না। ফুলি উপরে উঠতে গেল ওদের পেছন পেছন। একজন ওকে ধাক্বা দিয়ে ফেলে দিল। ফুলি দেখল ওরা চারজন। না। ওদের মধ্যে ঝন্টুদা ছিল না।

ফুলি উপরে গেল না। নীচে দাঁড়িয়ে রইল। একটু পরই দরজা ধাক্বানোর শব্দ শুনল। একটা প্রচন্ড আওয়াজ যেন কিছু ভেঙে পড়ল। জেঠিমার গলার আওয়াজ শুনল– কী? কী হয়েছে রে ফুলি?

ফুলি শুনল– একটা পুরুষ কণ্ঠ– কোনও আওয়াজ করবেন না। একদম চুপচাপ। চ্যাঁচামিচি করলে আপনার মেয়েকে রেপ করব সবাই মিলে। চাবিটা দিন।

পাঁচ মিনিটও নয়। ওরা চলে গেল। একজন বলে গেল– আমরা ছাদের পলকা দরজাটা ভেঙে ফেলেছি। পুলিশ এলে বলবি ছাদের দরজা ভেঙে ঢুকেছিলাম আমরা। তুই দরজা খুলেছিস বললে ফেঁসে যাবি। ওদের হাতে একটা লাল ব্যাগ আর একটা কালো ব্যাগ। আর কিচ্ছু নেই।

ওরা চারজন চলে গেল। ওদের মধ্যে ঝন্টুদা ছিল না।

ফুলি উপরে উঠল। ঘরে আলো জ্বলছে। আলমারির দরজা হাট করে খোলা। আলমারির ভিতরে লকারের খোপটাও খোলা। খাটের উপর বসে আছে জ্যাঠামশাই, মুখের উপর সাদা রঙের কী একটা আটকানো, মুখ থেকে অদ্ভুত কিছু আওয়াজ বের হচ্ছে। ফুলিও চিৎকার করছে, কোনও আওয়াজ পাচ্ছে না। জ্যাঠামশাইয়ের হাত পিছনে বাঁধা। জেঠিমাকে দেখতে পাচ্ছে না। বাথরুম থেকে দরজা ধাক্বা দেবার শব্দ। পাশের ঘর থেকেও দরজা ধাক্বানোর শব্দ। ফুলি দেখল দিদিমণির ঘর এবং বাথরুমের বাইরের ছিটকিনি বন্ধ। ফুলি ওর বাঁধা হাত দিয়ে পিছন ফিরে বাথরুমের দরজাটা খুলে দিতে পারে। জেঠিমা বাথরুম থেকে বেরিয়ে এসে প্রথমেই বলল মামণি কোথায়, মামণির কিছু হয়নি তো? জেঠিমা দিদিমণির ঘর থেকে দরজা ধাক্বানোর শব্দ পায়। বাইরে থেকে লাগানো দরজাটার ছিটকিনি খুলে দেয়। দিদিমণিও বেরিয়ে আসে। ওর বাবার মুখের আঠা লাগানো সাদা জিনিস খুলে দেয়। জ্যাঠামশাই এতক্ষণ ধরে কিছু বলার চেষ্টা করছিল। ওটা খুলে দেবার পর শব্দহীন ফুলির মুখটাও খোলা হল। কান্না এল দলা দলা।

পিছনে বাঁধা হাতটা কাটা পাঁঠার মতো ছটফট করছে।

কী হয়েছিল বল?

ফুলিকে জিজ্ঞাসা করল মন্দাক্রান্তা।

আমি জানি না, আমি জানি না…। ও নিজের মুখটা ঢাকতে চায়, কিন্তু হাত বাঁধা।

পুলিশ বলল যে-মেয়েটা আপনাদের কাছে থাকে, ওর ভোটার কার্ড আছে?

রজতকান্তি মাথা নাড়ায়।

এনি অ্যাড্রেস প্রুফ?

মাথা নাড়ায় রজতকান্তি।

মেয়েটা কে তবে?

মেয়েটা ভালো। এর মা এখানে কাজ করত। মা মরা মেয়ে…

ফুলি শুনছে ঘরের পাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে।

পুলিশ বলছে– লকার থেকে গয়না তুলে এনেছেন এটা আর কে জানত?

আমি, আমার স্ত্রী আর মেয়ে।

ওই মেয়েটা?

ও কী করে জানবে?

যারা চুরি করেছে ওরা তো জানত। চিন্তা করে দেখুন কখনও মেয়েটাকে বলেছেন কিনা।

না। বলিনি।

ক’জন ছিল?

চারজন। নাকি আরও বেশি…

কীভাবে এল?

ছাদের দরজা ভেঙে।

দরজা ভাঙার শব্দ পেয়েছিলেন?

পেয়েছিলাম।

মেয়েটা কোথায় ছিল তখন?

মেয়েটা বাধা দেবার চেষ্টা করেছিল। ওর গলায় ঘাড়ে নখের আঁচড়। ভাগ্যিস আর কিছু করেনি।

আপনার মেয়েকে কিছু করেনি তো? গায়ে-টায়ে…

না-না-না, আমার মেয়ের গায়ে ওরা হাত দেয়নি। একদম হাত দেয়নি। আমার মেয়ে যে-ঘরে শোয় সেই ঘরের দরজাটা প্রথমেই ওরা বাইরে থেকে বন্ধ করে দিয়েছিল। আমার মেয়ে আনটাচড, আমার মেয়ে আনটাচড।

মেয়েটাকে ডাকুন। পুলিশ অফিসার বলে।

ফুলির বুকের ভিতরে কীরকম বিচ্ছিরি টিরিং টিরিং টিরিং। ওর বুকের ভিতরের শিরাগুলো কেঁপে কেঁপে উঠছে। ছলাৎ ছলাৎ রক্ত ছিলিক দিচ্ছে প্রতিটি টিরিং, তার চেয়ে আমাকে রেপ করে মেরে ফেললেই তো পারত ঝন্টুদা। আমাকে বলতে হবে পৃথিবীতে কোনও টিরিং নেই। কোনও টিরিং হয়নি কখনও। কোনও টিরিং শুনিনি জীবনে। আমাকে দেখাতে হবে আমার গলার, আমার ঘাড়ের, বুকে লেগে থাকা নখের আঁচড়। বাধা দেওয়ার প্রমাণ। প্রমাণ রেখে গেছ, ঝন্টুদা কত দয়া তোমার। ভুল ভাবছি, ভুল। ঝন্টুদা ছিল না। উপরে কাঠের দরজাটাও ভেঙে দিয়ে গেছে। তোমরা তো উপর থেকেই এসেছিলে। দরজা ভেঙে। দরজাটা তো পলকাই ছিল। ছিটকিনিও পুরোনো। ঝন্টুদা, তুমি তো আগেই বলে দিয়েছিলে– দরজাটা ভালো নেই।

ফুলি… কোথায় রে তুই… পুলিশ সাহেব ডাকছেন। যা দেখেছিস বলবি…।

পুলিশের গলা শোনা যায়– এখন এই মেয়েটা নয়। আপনার মেয়েকে ডাকুন। এক এক করে সবাইকে জিজ্ঞাসা করব। আপনারা বাইরে যান। একদম বাইরে। যখন বেল বাজাব এক জন করে আসবেন, দরজা বন্ধ থাকবে।

বন্ধ দরজার এপারে খাবার টেবিলে বসে আছে ওরা। ড্রইংরুমে পুলিশের দুজন লোক। দিদিমণি ভিতরে গেল। দরজা বন্ধ। বাইরের টেবিলে এক বৃদ্ধ, এক বৃদ্ধা এবং মেয়েটা।

ফুলি দেখল ওরা দুজন ফুলির দিকে তাকিয়ে আছে।

ফুলি বলল কী হবে জ্যেঠু?

রজতকান্তি বলল, কী আর হবে? আরও কত খারাপ হতে পারত। ভগবানের দয়ায় আমাদের মেয়ে দুটো বেঁচে গেছে। গয়না না হয় গেছে। গয়না ছাড়াই বিয়ে দেব…।

ফুলি বলল আপনি যে বলেছিলেন, আমার টাকা আছে আপনার কাছে, ওই টাকা দিয়ে মিষ্টি দিদির গয়না কিনে নিন।

ওতে আর কী গয়না হবে? সেসব তোকে ভাবতে হবে না।

জেঠিমা বলল– পুলিশের ঝামেলা এখন না করলেই হতো। এখনই তো লোকজন আসবে।

তারপর আর কোনও কথা নেই ঘরে।

এতক্ষণ কী জিজ্ঞাসা করছে পুলিশ? রজতকান্তি স্বগতোক্তি করে। তারপর আবার নিশ্চুপ সবাই। চেনালোকই এর পিছনে আছে। যারা সব জানে। ছাদের দরজাটা যে পলকা সেটাও তো জানে। কে হতে পারে ফুলি? ঝন্টু?

জোরে মাথা নাড়ায় ফুলি।

ঝন্টুদা, তোমার চিঠিটা সকালবেলায় বাথরুমে নিয়ে গিয়েছিলাম। যেসব ভালোবাসার কথা লিখেছিলে, সব কুচি কুচি করে ছিঁড়েছি, তারপর পায়খানার প্যানে ফেলে দিয়ে জল ঢেলে দিয়েছি। আমি তো জানি, তুমি ছাড়া আর কেউ টিরিং শব্দ জানে না। তুমি আর আমি। সেই টিরিং তুমি অন্যদের বলেছ। আর আমি, এই শব্দের গোলোক আমি কোথাও ভাঙবনা। এই কৌটোবন্দি শব্দের ঢাকনা কোথাও খুলব না। পুলিশ যদি মারে, তবুও না। যদি জেলে ভরে দেয়, তবুও না।

তুমি কি সত্যি সত্যি তোমার বোনের বিয়ে দেবে? বিয়েতে টাকার দরকার। জানি তো। ওর বিয়ে হয়ে গেলে যদি তুমি আমাকে চাও? আমার সঙ্গে সংসার চাও? তাহলে কী করব? কী বলব? তোমায় আমি?

দিদিমণি চলে এল।

পুলিশের কঠিন স্বর– এবার কাজের মেয়েটাকে পাঠান।

ওঘর থেকে শব্দ আসছে টিরিং… টিরিং… টিরিং…।

 

সিদ্ধান্ত

‘তুমি কি তবে সম্বন্ধটা ভেঙে দেওয়ার কথা বলছ? জয়ের কথাটাতো একবার ভাবো। আর এটা যে সত্যি, তার প্রমাণই বা কী আছে?’ অনামিকাদেবী বেশ আশ্চর্য হয়েই জিজ্ঞাসা করলেন।

‘যা কিছু বলছি, তার সবটাই সত্যি। সমস্ত খোঁজখবর নিয়ে তবেই বলছি। যে-মেয়েটিকে তোমরা মা-ছেলে মিলে এবাড়ির পুত্রবধূ করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছ, তার মায়ামাখা মুখের পেছনে রয়েছে এক কালিমাময় অতীত।’

এবার যেন ধাঁধায় পড়ে গেলেন অনামিকাদেবী। স্বামীকে প্রায় ধমকের সুরে বলে উঠলেন, ‘কী বলছ কি তুমি?’

একটু থেমে সুপ্রকাশ উত্তর দিলেন, ‘কথাগুলো শুনে আমিও আশ্চর্য হয়ে গিয়েছিলাম। কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছিলাম না কিন্তু বাস্তবটা বাস্তবই। ওই মেয়েটি মুর্শিদাবাদের গগনেন্দ্র চৌধুরির ভাগনি ঠিকই কিন্তু ও যে বলেছিল ওর বাবা-মা দুজনেই মৃত, এটা একেবারে ডাহা মিথ্যে। ওর বাবার কথা বলতে পারব না, তবে ওর মা কোনও নামজাদা ব্যক্তির রক্ষিতা।’

‘কোথাও কোনও ভুল হচ্ছে না তো?’

‘কেন বিশ্বাস করছ না… মুর্শিদাবাদে ওর মামার সঙ্গে কথা বলে বিয়ের সমস্ত কথাবার্তা ফাইনাল করে ফেরার পথেই ট্রেনে সুবিমলের সঙ্গে দেখা। ওর-ও তো মুর্শিদাবাদেই বাড়ি। জুঁইদের আশেপাশেই কোথায় যেন একটা! ওখানে যাওয়ার কারণ বলতে গিয়েই জানতে পারি, জুঁইয়ের মায়ের এই কুকীর্তির কথা। উনিই ওনার কুপথে অর্জিত টাকায় মেয়ের ভরণ-পোষণের সব দায়িত্ব সামলান। তাই প্রতি মাসেই বেশ মোটা অঙ্কের টাকা পাঠান মেয়েকে। গগনেন্দ্র চৌধুরী তো শুধু শিখন্ডী মাত্র।’

‘কী বলছ কী তুমি, আমি তো ভাবতেই পারছি না,’ বিস্মিত স্বরে বলে ওঠেন অনামিকাদেবী।

কিছুক্ষণের জন্য চুপ থেকে জয়ের বাবা সুপ্রকাশ আবার অনামিকাদেবীকে বলতে শুরু করেছিলেন। ‘কী জানি কেন, তবু সত্যিটা ঠিক মানতে পারছিলাম না। কেমন যেন একটা খটকা লাগছিল।  আর সেই কারণেই সেদিন বাড়ি ফিরে তোমাদের কিছু জানাইনি। মনে মনে ঠিক করেছিলাম, সঠিক জেনে তবেই তোমাদের বলব। সুবিমলের থেকে জানতে পেরেছিলাম যে, জুঁইয়ের মা এখন দেরাদুনে থাকেন। ঠিক করেছিলাম সেখানেই যাব। সেইমতো অফিসের টুর-এর নাম করে তিনদিন পরেই তৎকাল টিকিটে চলে গিয়েছিলাম দেরাদুন। ওখানে গিয়ে একটু খোঁজখবর করতেই জানতে পারি দেরাদুনে একটা প্রাইভেট সংস্থাতে টাইপিস্টের কাজ করতেন জুঁইয়ের মা বন্দনাদেবী। বর্তমানে তিনি ওই কোম্পানির মালিক রঞ্জন বাসুর রক্ষিতা।’

অনামিকাদেবী দিকবিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে কেবল বোকার মতো তাকিয়ে থাকলেন সুপ্রকাশের মুখের দিকে। ‘এবার কী হবে? জয় যে ওকে খুব ভালোবাসে। আমার সুখের সংসারে এ কার নজর পড়ল? ও যে জুঁইকে নিয়ে কত স্বপ্ন সাজিয়ে রেখেছে। ওর এই স্বপ্ন বুনতে আমি যে নিজেই ওকে সাহায্য করেছি, আনন্দের সঙ্গে ওদের সম্পর্কের স্বীকৃতি দিয়েছি। এসব জানতে পারলে জয় যে একেবারে ভেঙে পড়বে।’

এমনিতে জয় আর জুঁইয়ের ভালোবাসার ব্যাপারে আলাদা করে বাড়িতে কিছুই জানাতে হয়নি জয়কে। কারণ কোনও কিছু বলার আগেই সবকিছু বুঝে গিয়েছিলেন অনামিকাদেবী। বছর চারেক আগে ছেলের জন্মদিনের পার্টি-তে হাজির ছিল ছেলের কলেজের বেশ কয়েকজন বন্ধুবান্ধব। তাদের মধ্যে জুঁইও ছিল। সকলের থেকে আলাদাভাবেই নজর কাড়ছিল প্রাণোচ্ছল, ফুটফুটে মেয়েটি। তার উপর অন্যান্যদের তুলনায় ছেলের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতাই প্রমাণ করছিল তাদের সম্পর্কের অন্তরঙ্গতা।

জুঁইকে অপছন্দের কোনও জায়গাই ছিল না অনামিকাদেবীর। সুন্দরী তো বটেই, তার ব্যবহারটিও ছিল ফুলের মতো মিষ্টি। তার উপর আবার তার পিতৃমাতৃহীন হওয়াটা তাকে আরও অনামিকাদেবীর স্নেহের পাত্রী করে তুলেছিল।

কলকাতার নামিদামি স্কুল-কলেজে পড়ার কারণে ছোটো থেকেই সে হস্টেলে থেকেছে। শুধুমাত্র ছুটির দিনগুলোতে মুর্শিদাবাদে মামার বাড়ি ফিরত। ওই মামাই নাকি ভাগনিকে আদর-আহ্লাদে বড়ো করে তুলেছে। জুঁইয়ের অতীতের এইটুকু সংক্ষিপ্ত ইতিহাসই জানা ছিল তাদের।

অফিস থেকে ফিরে বাবাকে গম্ভীর দেখে কিছু বলার সাহস পেল না জয়। সোজা মায়ের কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করল, ‘মা, বাবার কী হয়েছে? ঝগড়া করেছ নাকি? কেমন একটা গুরুগম্ভীর মুখ করে যেন বসে আছে। ভয়ে কিছু বলারই সাহস পেলাম না। কিছু বললেই তো বলবে, তুই সবসময় আমারই দোষ দেখিস, তোর মা তো কোনও অন্যায়ই করতে পারে না। কেন ঝগড়া করো বাবা, মিটিয়ে নাও না।’

‘না রে, তুই যেটা ভাবছিস ব্যাপারটা তা নয়।’

‘তাহলে কী? বাবার অফিসের কিছু প্রবলেম?’

‘না রে। তোকে যে কীভাবে বলি?’

‘কী হয়েছে এত হেজিটেট করছ কেন? সকালে যখন অফিস গেলাম তখনও তো সব ঠিক ছিল। বাবাও তো বোধহয় অফিস টুর থেকে সন্ধেবেলাই ফিরেছে। তাহলে এইটুকু সময়ের মধ্যে কী এমন ঘটে গেল, যে আমাকে বলতে পারছ না। কী হয়েছে মা? প্লিজ, আমাকে বলো।’

‘কী বলব বলতো। আমি কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছি না যে, জুঁই তোর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। এমনও তো হতে পারে ও হয়তো ওর অতীত সম্পর্কে নিজেই কিছু জানে না। ব্যাপারটা ঠিক বুঝতেও পারছি না আর মানতেও পারছি না। কিন্তু তোর বাবা যে নিজে সমস্ত খোঁজখবর নিয়ে তবেই বলছে। সে যে নিজেও কষ্ট পাচ্ছে।’

‘কী যা তা বলছ! স্পষ্ট করে বলো। হেঁয়ালি কোরো না। আমি আর নিতে পারছি না।’

অনামিকাদেবী সমস্ত কিছু খুলে বললেন ছেলে জয়কে। কথাগুলো শোনার পরে বিস্ময়বিমূঢ়তা যেন তাকে একেবারে ঘিরে ধরল। কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করে শান্তস্বরে মাকে বলল, ‘জুঁই জ্ঞানত ইচ্ছা করে আমার থেকে কিছু লুকিয়েছে, এটা একেবারেই বিশ্বাসযোগ্য নয় মা। অন্তত আমি এটা বিশ্বাস করতে পারছি না। চার-চারটে বছর ধরে আমাদের সম্পর্ক, ও আজ পর্যন্ত কোনও কিছু বলেনি বা লুকিয়েছে এরকম কোনওদিন হয়নি।’

‘ঠিক তোর মতো আমি ওকে জানি বলেই তো ব্যাপারটা মানতে পারছি না বাবু। কিন্তু তোর বাবা…।’

‘সব বুঝছি কিন্তু তুমি তো জানো মা ও কতটা ইনোসেন্ট, সহজ, সরল প্রকৃতির মেয়ে। আজ পর্যন্ত কারওর সঙ্গে উঁচু গলায় কথা বলেছে বলেও মনে হয় না। যে জীবনের কোনও জট-জটিলতা বোঝেই না, সে এত বড়ো একটা মিথ্যে– কিছু মনে কোরো না মা আমার মানতে কষ্ট হচ্ছে। বাবার বোধহয় কোথাও একটা ভুল হচ্ছে। আর ওর মায়ের ব্যাপারটা যদি সত্যি হয়েও থাকে, তাহলেও আমার কিছু এসে যায় না। তবু বলছি, তারপরেও যদি তোমার মনে হয় জুঁই আমাদের বাড়ির অনুপযুক্ত, ওর সঙ্গে আমার সম্পর্ক রাখাটা ঠিক নয়– তাহলে তোমার কথা ভেবে আমি ওর সঙ্গে সম্পর্ক ভেঙে দিতে রাজি। কিন্তু আমি জানি, আমার দৃঢ় বিশ্বাস আমার মা কখনও নিরপরাধ কাউকে শাস্তি দিতে পারে না। এখন সবকিছুই তোমার হাতে,’ বলেই উদ্ভ্রান্তের মতো ঘর থেকে বেরিয়ে গেল সুপ্রকাশ ও অনামিকাদেবীর একমাত্র আদরের সন্তান জয়।

জয় বেরিয়ে গেলেও অনামিকাদেবী বেশ কিছুক্ষণ সেই জায়গাতেই বসে রইলেন। অহরহ শুধু ছেলের মুখটা তার চোখের সামনে ভাসতে থাকল। কথাগুলো বলার সময় কীভাবে বুকে পাথর চেপেছিল সে, তার সমস্তটাই ধরা পড়ছিল মায়ের চোখে। ছেলে কতটা কষ্ট পাচ্ছে, তা ভালোভাবেই অনুভব করতে পারছিলেন। ছেলে বলে হয়তো কাঁদতে পারেনি, মেয়ে হলে…।

সেদিন রাত্রে একটুও ঘুমোতে পারেননি অনামিকাদেবী। শুধু ছটফট করেছেন আর ভেবেছেন, কীভাবে এই রহস্যের শিকড়ে পৌঁছোনো যায়। সারারাত চিন্তা করে একটা সিদ্ধান্তও নিয়েছেন। সেইমতো পরদিন সকালে সুপ্রকাশবাবুকে জানান নিজের দেরাদুন যাওয়ার কথা।

প্রত্যুত্তরে সুপ্রকাশবাবু বলেন, ‘অনামিকা তুমি যাবে যখন ভেবেছ যাও। কিন্তু গিয়ে কোনও লাভ হবে বলে মনে হয় না।’

‘তবু যদি কিছু আশার আলো দেখা যায়।’

‘ঠিক আছে দু-তিন দিন বাদে যেও। আমি আজই দত্ত-দা-কে বলে টিকিটের ব্যবস্থা করছি। তবে তৎকালে গেলে খুব কষ্ট হবে তোমার।’

‘হোক কষ্ট। এই কষ্ট আমার ছেলের কষ্টের থেকে বেশি নয়। ওর জন্য আমাকে সবকিছু জানতেই হবে।’

পাশেই ডাইনিং টেবিলে বসে চা খাচ্ছিল জয়। মার কথা শুনে ধীরে ধীরে মাকে বলল, ‘মা তুমি দেরাদুন যাচ্ছ, আমি যাব তোমার সঙ্গে?’

‘না, আমি একাই যাব। আর হ্যাঁ, জুঁইকে এখনই এসব ব্যাপারে কিছু জানাবার দরকার নেই। আগে আমি ফিরি। তারপর…।’

নির্ধারিত দিন অনুযায়ী রওনা দেন অনামিকাদেবী। দীর্ঘ সফর শেষ করে যখন স্বামীর দেওয়া ঠিকানায় পৌঁছোলেন, তখন তাঁর বিধ্বস্ত অবস্থা।

সামনে ছোট্ট সুন্দর একটা বাংলো, যার সামনের দিকটায় সুন্দর সুন্দর বিভিন্ন ধরনের বাহারি ফুলগাছের বাগান। গেট খুলে বাগান পেরিয়ে বাংলোর কলিংবেল বাজাতেই, একজন অল্পবয়সি যুবতি দরজা খুলে দিয়ে জিজ্ঞাসা করল, ‘কাকে চাই?’

‘বন্দনাদেবী আছেন?’

‘হ্যাঁ আছেন। আপনি ভিতরে বসুন, আমি ডেকে দিচ্ছি’, বলে চলে যাচ্ছিল সে, কী ভেবে আবার ফিরে এসে বলল, ‘কিন্তু দিদিমণি যদি জিজ্ঞাসা করে কে, কোথা থেকে এসেছেন, তাহলে কী বলব?’

‘দিদিমণিকে বলো কলকাতা থেকে অনামিকা চ্যাটার্জী এসেছে দেখা করতে, বিশেষ কিছু প্রয়োজনে।’

‘ঠিক আছে আপনি বসুন। আমি এক্ষুনি ডেকে দিচ্ছি।’

মিনিট দুয়েকের মধ্যে উপর থেকে নেমে এলেন বছর পঁয়তাল্লিশের একজন মহিলা। দেখতেও বেশ সুন্দর, এমনকী তার দেহের বাঁধন-টাঁধনও এই বয়সে অটুট।

‘হ্যাঁ বলুন। কিন্তু আপনাকে তো ঠিক…।’

‘আমি কলকাতা থেকে আসছি। আমার পরিচয় দিলে হয়তো চিনলেও চিনতে পারেন। জয় আমার ছেলে…’ বাকি কথা বলার আর অবকাশই পেলেন না অনামিকাদেবী। তার কথা শেষ হওয়ার আগেই বন্দনাদেবী বলে উঠলেন, ‘জানি, আমার মেয়ে জুঁই আপনার ছেলেকে ভালোবাসে, শুধু তাই নয় বর্তমানে ওদের বিবাহও স্থির হয়ে গেছে, তাইতো?

কথার মাঝেই থামিয়ে দেওয়ার জন্য মাফ করবেন। কিন্তু এখন আপনারা কোনওভাবে জানতে পেরেছেন জুঁইয়ের অতীতের কথা, আর তাই ছুটে এসেছেন আমার কাছে। কী জানি কেন আমার মনটা ক’দিন ধরেই বলছিল, এরকম কিছু একটা ঘটতে পারে। গত সপ্তাহেই আমার দাদার ফোনে জানতে পারি কলকাতাতে জুঁইয়ের বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। বাদ দিন এসব, এখন বলুন কী জানতে চাইছেন?’

জুঁইয়ের মায়ের কথাগুলো কেমন কেমন শুনতে লাগলেও অনামিকার কিছু করার ছিল না। তাকে সমস্ত কিছু জানতেই হবে। এটা তার ছেলের জীবনের ব্যাপার বলে কথা।

‘জুঁই শুধু আমার ছেলেরই নয় আমার এবং আমার স্বামীরও পছন্দের পাত্রী। ও আমাদের বলেছিল ছোটোবেলাতেই ওর মা-বাবা মারা গেছে। মামার কাছেই মানুষ। আমার স্বামী মুর্শিদাবাদ গিয়ে বিয়ের দিন পর্যন্ত ঠিক করে ফেলেছিলেন কিন্তু তার পরেই জানা গেল…।’

‘ওর মা বেঁচে আছে তাইতো? আপনি যা কিছু শুনেছেন সব সত্যি। আপনাকে শুধু এইটুকু বলতে পারি জুঁই এ সম্পর্কে সত্যিই কিছু জানে না। সুতরাং এর সঙ্গে ওকে জড়াবেন না। ও নিরপরাধ। জানি ও হয়তো আর আপনার ঘরের পুত্রবধূ হতে পারবে না। মা-বাবার কৃতকর্মের ফল সন্তানদেরই ভোগ করতে হয়। এর থেকে আর বেশি কী বলব!’

‘আমরা জুঁইকে কখনও দোষী ভাবিনি, কিন্তু আপনি এইরকম কাজ কেন করলেন? ক্ষমা করবেন, এটা আমার ছেলের জীবনের প্রশ্ন, তাই আপনাকে জিজ্ঞাসা করতে বাধ্য হলাম।’

‘আমি তো আপনাকে নিঃসংকোচে সমস্ত কিছু বলতেই পারি, কিন্তু তাতে কি কোনও লাভ হবে? আমার জীবনের সেই ভয়ংকর সত্যিটা শুনলেও, আপনার মন থেকে আমার প্রতি জন্মানো ঘৃণা-বিতৃষ্ণা বদলাবে না। তাহলে আর শুধুশুধু অতীতের এই বিষাদ ঘেঁটে লাভ কী বলুন। আমার মেয়েটা তো আর…’ করুণভাবে বলে ওঠেন বন্দনাদেবী।

‘লাভ হোক আর না হোক, এই সম্পর্ক ভাঙার পিছনে একটা সঠিক কারণ তো জয়কে জানাতে হবে। শুধু তাই নয় নিজের মনকে স্ত্বান্না দেওয়ারও একটা ব্যাপার আছে। ছেলের দৃঢ় বিশ্বাস তার মা কোনও অন্যায় করতে পারে না, কোনও নিরপরাধীকে শাস্তি দিতে পারে না, তাই তার এই বিশ্বাস আমি ভাঙতে চাই না। প্লিজ বন্দনাদেবী চুপ করে থাকবেন না। দয়া করে সত্যিটা বলুন। আপনাকে কথা দিচ্ছি, জুঁই, এর বিন্দুবিসর্গও জানবে না,’ বেশ উত্তেজিত হয়েই বলেন অনামিকাদেবী।

‘তাহলে শুনুন, আজ থেকে অনেক বছর আগেকার কথা। একদিন আমি আর আমার স্বামী দুজনেই ভাইপোর জন্মদিন সেরে মুর্শিদাবাদ থেকে শ্বশুরবাড়ি কলডোঙায় ফিরছিলাম। সেই সময় জুঁই ছোটো ছিল। আমার দাদার তিন ছেলে জবরদস্তি করে জুঁইকে রেখে দিল কয়েকদিনের জন্য। দাদাও ভাগনিকে খুব ভালোবাসত। তাই বাধ্য হলাম জুঁইকে কয়েকদিনের জন্য রেখে আসতে।

ফেরার পথে মাঝরাস্তাতেই যত বিপত্তি। হঠাৎই বেশ কয়েকজন দুষ্কৃতীর অতর্কিত আক্রমণে, বাসের সমস্ত যাত্রীই শিউরে উঠি। বাসের সিটে বসে থরথর করে কাঁপতে থাকি আমরা। সেই বিভীষিকাময় দিনটার কথা কোনওদিন বোধহয় ভোলা সম্ভব নয়। বাসের মধ্যে সর্বসাকুল্যে আট-দশ জন মহিলা ছিলাম। প্রথমেই মাথায় বন্দুক ঠেকিয়ে চলল লুঠতরাজ।’ বলতে বলতে হঠাৎই থেমে গিয়েছিলেন বন্দনাদেবী। অনামিকাদেবী লক্ষ্য করছিলেন কথাগুলো বলতে বলতে বন্দনাদেবীর চোখ-মুখ একেবারে ভয়ে লাল হয়ে উঠছিল।

‘তারপর? তারপর কী হল?’ বলে ওঠেন অনামিকাদেবী।

‘তারপর? তারপর শুরু হল মহিলাদের উপর নির্মম অত্যাচার। পুরুষদের চোখের সামনেই এক এক করে সব ক’টি মহিলাকে ধর্ষণ করতে থাকল ওই দুষ্কৃতীরা। আর পুরুষরা, অবশ্য পুরুষ কি কাপুরুষ জানি না, তারা তাদের প্রাণের ভয়ে চুপচাপ বসে বসে দেখল তাদের মা, বোন, স্ত্রীর সতীত্ব হরণ হতে। অবশ্য যে-দুজন এর প্রতিবাদ করতে গিয়েছিলেন, তাদের একেবারে সেইখানেই সারাজীবনের মতো মুখ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। তার মধ্যে একজন ছিলেন আমার স্বামী। এরকম লজ্জাজনক ঘটনার পরেও সেদিন যে কেন পৃথিবী ফাঁক হয়ে ধরাতলে মিশে যাইনি, সেটাই আশ্চর্যের।

একের পর এক দুষ্কৃতীদের পাশবিক অত্যাচারে কখন যে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলাম নিজেও জানি না। যখন জ্ঞান ফিরল তখন চারিদিকে কান্নার রোল। মনে পড়ে গেল পরিমল মানে আমার স্বামীর কথা। কোনওরকমে উঠে বসলাম। তারপর স্বামীর খোঁজ করতে জানতে পারলাম, যে-দু’জন ব্যক্তি দুষ্কৃতীদের হাতে মারা গিয়েছিল, দুষ্কৃতীরা যাবার আগে তাদের ভাগীরথীর জলে ভাসিয়ে দিয়ে গেছে। অসহায়ের মতো হাউহাউ করে কাঁদতে থাকলাম। মনে হতে থাকল ভোগ-লালসার শিকার হওয়া ঘৃণ্য এই দেহ শেষ করে দেব। নিজেও ভেসে যাব ওই ভাগীরথীর জলে। কিন্তু পরক্ষণেই মনে পড়ে গেল জুঁইয়ের কথা। বাবা তো গেলই, যদি আমিও চলে যাই তাহলে ওকে দেখবে কে?’ বলতে বলতে ডুকরে ডুকরে কাঁদতে থাকে জুঁইয়ের মা।

লজ্জায় মাথা হেঁট করে নেন অনামিকাদেবী। নিজের মনে বলে ওঠেন, ‘বাসের সমস্ত পুরুষরা যদি সকলেই একসঙ্গে প্রতিবাদ করত তাহলে হয়তো এধরনের ঘটনা ঘটত না। যারা চোখের সামনে নিজের মা, বোন, স্ত্রীর সম্মানহানি চুপচাপ মেনে নিতে পারে, তাদের এ পৃথিবীতে থাকাটাই গর্হিত অপরাধ। আদতে তারাই এ পৃথিবীর বোঝা।

এই ধরনের ঘটনার পর সমস্ত মানুষ প্রশাসনের নিন্দায় মুখর হয়ে ওঠে। কিন্তু প্রশাসনের পক্ষে কি দেশের সমস্ত মানুষকে নিরাপত্তা দেওয়া সম্ভব? তাহলে তো প্রত্যেক নাগরিকের সুরক্ষার্থে একটি করে বন্দুকধারী নিরাপত্তারক্ষী দিতে হয়, যাতে তারা বিপদের সময় তাদের উপর নির্ভর করে হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকতে পারে। নিজেকে বন্দনার জায়গায় কল্পনা করে নিয়ে ওই বিপর্যয়ের কথা ভাবতে চেষ্টা করলেন অনামিকদেবী।

মিনিট পাঁচেক পরে বন্দনাদেবী একটু শান্ত হতে অনামিকাদেবী আবার জিজ্ঞাসা করেন, ‘তারপরে কী করলেন?’

‘কোনওমতে পৌঁছোই দাদার কাছে। ভেবেছিলাম সবাই ফেলে দিলেও দাদা ফেলবে না। দাদার আশ্রয়েই বাকি জীবনটা কাটিয়ে দেব। কিন্তু হায়। যে-দাদা বোন বলতে অজ্ঞান ছিল, সেই দাদাই সমস্ত কিছু শুনে, স্ত্বান্না দেওয়ার বদলে, আমাকে তক্ষুনি সেখান থেকে চলে যেতে বলল।

দাদার এই পরিবর্তন দেখে ভীষণ ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। প্রশ্ন শুধুমাত্র আমার একার নয়, আমার ফুলের মতো ছোট্ট মেয়েটারও ভবিষ্যৎও জুড়ে ছিল এর সঙ্গে।

যে-ভাগনিকে আদরের ঠেলায় অস্থির হতো তার মামা, সেদিন সেই ভাগনিই কাঁটা হয়ে গলায় বিঁধছিল তার। বহু অনুনয়-বিনয় করে কিছুতেই রাখতে চাইছিল না তাকে। অবশেষে কতকগুলো প্রতিজ্ঞা করিয়ে তবেই জুঁইকে আশ্রয় দিয়েছিল।

এক, আমার এই মুখ কখনও যেন তাকে আর দেখতে না হয়।

দুই, প্রতিমাসে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে জুঁইয়ের যাবতীয় খরচ যেন তার অ্যাকাউন্টে জমা করে দেওয়া হয়।

আর তিন, সেদিন থেকেই সবাই জানবে যে ওই দুর্ঘটনায় আমি এবং আমার স্বামী দুজনেই মৃত। এমনকী আমার মেয়েও কোনওদিন জানবে না যে আমি জীবিত।

আমার মেয়ের ভবিষ্যতের কথা ভেবে সবকিছু মেনে নিয়ে মাথা নত করে বেরিয়ে এলাম। মেয়ের জন্য কষ্ট হলেও, উপায়ও তো আর কিছু ছিল না।’

‘এবার কিছুটা হলেও অাঁচ করতে পারছি, একজন একা সমর্থ মেয়ের সঙ্গে কী কী ঘটতে পারে। তবু আপনার মুখ থেকেই শুনি, দাদার বাড়ি থেকে বেরিয়ে কী করলেন? কোথায় গেলেন?’ বেশ কুণ্ঠিতভাবেই বলেন অনামিকাদেবী।

প্রত্যুত্তরে বন্দনাদেবী বলতে থাকেন, ‘কী আর করব ভাই, দাদার শর্ত মতো তখন আমি মৃত। তাই আমাকে শহর ছেড়ে চলে যেতে হবে। সেই ফরমান অনুযায়ী হাতে হাজার তিনেক টাকা গুঁজে দিয়ে চিরতরে বিদায় দিয়েছিল আমাকে। সঙ্গে এও বলেছিল হাওড়া থেকে দূরপাল্লার কোনও ট্রেন ধরে নিতে। সেইমতো স্টেশনে পৌঁছে দেরাদুনগামী ট্রেনে চড়ে বসলাম। চলে এলাম এই শহরে। কত যে ঠোক্বর খেয়েছি তার ইয়ত্তা নেই। পদে পদে অপমান, অভাব, অনটন কতই না সয়েছি। তার উপর মার রূপই আমার কাছে অভিশাপ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। অপরদিকে জুঁইয়ের খরচ পাঠানোরও ব্যাপার ছিল। তখন ওকে মানুষ করাটাই ছিল আমার প্রধান লক্ষ্য। আর সেই জন্য আমি যে-কোনও কাজ করতেই রাজি ছিলাম।

একজন সুন্দরী মহিলার থেকে সমাজ কাজের বদলে টাকা নয়, পরিবর্তে অন্য কিছু চাইত। কীভাবে যে ওই হিংস্র জন্তুগুলোর থেকে নিজেকে বাঁচিয়েছি, তা বলার নয়। এভাবেই কেটে গেল একটা বছর। ধীরে ধীরে জুঁইও বড়ো হতে থাকল। ওর পড়ার খরচও বাড়তে থাকল। সেই সময়েই রঞ্জনবাবুর সঙ্গে পরিচয়।

আমার প্রয়োজনের কথা শুনে ওনার অফিসে টাইপিস্ট-এর পদে নিয়োগ করেন আমাকে। বোঝেনই তো সুরূপা একটি মহিলা, তার উপর আবার বাবুর নিয়োগ করা লোক হওয়ার কারণে সবসময়েই অফিসের অন্যান্য স্টাফদের থেকে নানা ধরনের নোংরা নোংরা কথা শুনতে হতো আমাকে। এক-এক সময় মনে হতো রঞ্জনবাবুকে সব জানাব, কিন্তু পরক্ষণেই জুঁইয়ের মুখটা ভেসে উঠত মুখের সামনে। জানাতে গিয়ে যদি উলটো ফল হয়, যদি কোনও কারণে চাকরিটা চলে যায়, তাই মুখ বুজে সব সহ্য করতাম।

একদিন কেবিনে বসে বসে রঞ্জনবাবু সবকিছু শুনে আমাকে ডেকে পাঠালেন। বিগত এক বছরে আমি কামাতুর পুরুষ ছাড়া কিছুই দেখিনি। হঠাৎই ওই মানুষটির সহানুভূতি পেয়ে ওনাকে আমার পূর্বের সব ইতিহাস খুলে বলি। তখন থেকেই উনি আমাকে বিশেষ স্নেহের চোখেই দেখেন।

একদিন উনি আমাকে ওনার বাড়িতে নিয়ে গেলেন, সেখানে পক্ষাঘাতে আক্রান্ত ওনার স্ত্রী বহুদিন ধরেই শয্যাশায়ী। আর কোনও দিন সুস্থ হবেন না জেনেই স্বামীর দ্বিতীয় বিবাহের জন্য অস্থির হয়ে উঠেছিলেন তিনি। তখনই আমি একটা কঠোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। বললে হয়তো বিশ্বাস করবেন না, এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার পেছনে আমার অন্য কোনও খারাপ উদ্দেশ্য ছিল না। শুধুমাত্র নিজেকে এই সমাজের মুখোশধারী ব্যক্তিদের থেকে বাঁচানো আর মেয়ের উচ্চশিক্ষার অভিপ্রায়েই থেকে গেলাম ওনার বাড়িতে। মনে মনে এই ভেবে খুশি হয়েছিলাম যে, এতে অন্তত জুঁইকে তো ভালোভাবে মানুষ করতে পারব।

রঞ্জনবাবুর স্ত্রীর স্বীকৃতিতেই সম্মানের সঙ্গে থেকে গিয়েছিলাম ওখানে। যতদিন তিনি বেঁচেছিলেন ততদিন ওনাকে বড়োদিদির মতোই সেবা শুশ্রূষা করেছি। সুরক্ষা বলুন আর ভালোবাসাই বলুন তা তো কেবল ওনাদের থেকেই পেয়েছি। না হলে লোকে তো বেশ্যা বা রক্ষিতা কোনওটাই বলতে বাকি রাখে না। আপনিও একজন মহিলা, আপনি বলুন তো লোকে যে-যে ভাষায় আমাকে গালিগালাজ করে, আমি কি সত্যিই তার অধিকারী?’

‘মাফ করবেন বন্দনাদেবী। আমি কিছু না জেনেই আপনাকে ভুল ভেবেছি।’ ‘আবেগাপ্লুত হয়ে বন্দনাদেবীর হাত দুটো ধরে বলেন অনামিকাদেবী, ‘এবার আমি উঠব, দেখছি কত দূর কী করতে পারি!’

‘সব কিছু শোনার পরেও কি…’ কোথায় যেন আশার আলো দেখতে পায় জুঁইয়ের মা।

‘হ্যাঁ এখনই তো কিছু করার সময়। আচ্ছা খুব তাড়াতাড়ি দেখা হচ্ছে,’ এই বলে অনামিকাদেবী যে-গাড়িতে এসেছিলেন, তাতে করেই স্টেশনে ফিরে গেলেন।

কলকাতায় ফিরে সমস্ত কিছু জানান স্বামীকে অনামিকাদেবী। সঙ্গে সিদ্ধান্তও নেন যে জুঁই-ই তাদের বাড়ির পুত্রবধূ হবার যোগ্য, অন্য কেউ নয়।

‘তুমি যেটা বলছ মানছি। কিন্তু লোকে কী বলবে?’ বলে ওঠে সুপ্রকাশ।

‘লোকের কথা বাদ দাও তো। মানুষের কাজই তো শুধু অন্যের বদনাম করে বেড়ানো। জুঁই নিরপরাধ। ওর কোনও দোষ নেই। শুধু ওই কেন ওর মা-ও নির্দোষ। রঞ্জনবাবু যদি ওনাকে নিজের করে নিতে পারেন, নিজের স্ত্রীর মর্যাদায় রাখতে পারেন, তাহলে আমরা জুঁইকে ঠেলে সরিয়ে রাখব কেন? কোন অপরাধের সাজা মা-মেয়েকে দেব বলতে পার?’ উত্তেজিত হয়েই কথাগুলো বলেন উঠল জয়ের মা।

‘আমি কখন বলছি যে ওরা দোষী? কিন্তু…’

‘কিন্তু কীসের? প্রবল বর্ষণে বড়ো বড়ো কংক্রিটের অট্টালিকা পর্যন্ত বয়ে চলে যাচ্ছে, নদীর গতিপথ বদলে যাচ্ছে, সেখানে তো উনি একজন অসহায় নারী, ভাগ্যের পরিহাসে যাকে জীবনে নানা বিপর্যয়ের সম্মুখীন হতে হয়েছে। তিনি নির্দোষ হওয়া সত্ত্বেও ভগবান তাকে চরম দণ্ডে দণ্ডিত করেছেন। তার নিরপরাধ সন্তান কেন সেই সাজা ভোগ করবে?’

অনামিকাদেবীর গম্ভীর স্বর বাবা-ছেলের হৃদয়ে প্রতিধ্বনিত হতে থাকল। বাবার কাছ থেকে উঠে গিয়ে মার কাঁধে মাথা রাখে জয়। তার মা শুধু তার বিশ্বাসই বজায় রাখেনি, তাকে তার প্রাণাধিক প্রিয় ভালোবাসাও ফিরিয়ে দিয়েছে।

পাপ

বোতলের অনেকটা তরল একসঙ্গে গলায় ঢালে বাচ্চু। আজ আর কিছুই ভালো লাগছে না। দুদিন ভালো করে খাওয়া হয়নি। সিগারেট খেলে বুকের ভেতরটা জ্বালা করে আজকাল। চলতে গেলে পা কাঁপে। অথচ বাচ্চুর চেহারা বেশ ভালোই ছিল। আগে নিয়মিত ব্যায়াম করত। পঞ্চাশ ইঞ্চি বুক ছিল। এখন সেসব স্বপ্ন মনে হয়। বাবা মারা যাওয়ার পর অভাব আর দারিদ্র্য যেন ওর জীবনের সঙ্গী হয়ে গেছে। পড়াশোনাটা ভালো করে করলে হয়তো একটা চাকরি পাওয়া যেত। একসময়ে স্বাস্থ্যের গৌরবে সে অচিরেই হয়ে উঠেছিল পাড়ার হিরো। কিন্তু এই হিরোই একসময় হয়ে উঠল এক চলমান ত্রাস। একজন অ্যান্টি সোশ্যাল। বাচ্চা থেকে বুড়ো সবাই বাচ্চুকে ভয় পেত। আর পাড়ার মেয়েদের তো নিশ্চিন্তে ঘোরাফেরা করার উপায়ই ছিল না। অথচ জীবনটা কীরকম বদলে গেল। মা সেই কোন ছোটোবেলায় মারা গেছে। তারপর বাবাও চলে গেল। একটা ছোটো বোনকে রেখে গেল বাচ্চুর জিম্মায়। রোজগারের কোনও নিশ্চয়তা নেই। কোনওমতে দিন চলে। কখনও রাজনৈতিক দলের হয়ে কাজ করে। আবার কখনও হয় বড়ো ব্যবসাদারের ভাড়া করা গুণ্ডা। দুবার জেলও খেটেছে বাচ্চু। বোনটা পাড়ার এক বুড়ি পিসিমার কাছেই মানুষ। এখন শরীরটাও চলে না। ক্ষমতায় এখন অন্য রাজনৈতিক দল। স্বাভাবিক কারণেই এখন বাচ্চুর রোজগারও কম হয়। বোনটা তো অসুখে ভুগে ভুগে কঙ্কালের রূপ নিয়েছে।

নেশার পাত্রটা শেষ করে চোখদুটো খুলল সে। রোখ চেপে যাওয়া গলায় বলল ‘ওঠ’। পাশে বসা মনু বলল, ‘গুরু বোতলটা শেষ করে গেলে হতো না?’

ক্লান্তস্বরে বাচ্চু বলল, ‘না ওটা ফেলে দে। আজ একবার শেঠ বাজোরিয়ার কাছে যেতে হবে। কিছু টাকার দরকার বুঝলি? বোনটাকে ওষুধপত্র না দিলে ও মরে যাবে।’

‘কাজ ছাড়া কি শেঠ টাকা দেবে?’

‘ওর বাপ দেবে। ওর জন্য আমি কম খুন, জখম করেছি?’

‘ওর তো এখন পেয়ারের লোক বিল্লে, যাকে তুমি হাতে ধরে বানিয়েছ।’ প্যান্টের পকেটে রাখা রামপুরী চাকুটা একবার অনুভব করল বাচ্চু। চোখদুটো লাল। দাঁতে দাঁত চেপে রাগে গর্জন করে উঠল। তারপর বলল, ‘আমি যদি টাকা না পাই তবে দুটোকে সাফ করে দেব।’

‘গুরু তার চেয়ে চামেলির ওখানে চলো। ও যদি কিছু টাকা দিতে পারে।’

‘ওই ভোগলালসার টাকা আমি ছুঁই না। তার থেকে কাঁচড়াপাড়ায় চল দেখি আমার ছোটো মামার থেকে কিছু পাই কিনা।’

স্বপনলালের চায়ের দোকানের পিছনে ওরা এতক্ষণ বসে ছিল। দোকান থেকে বেরোতে বেরোতে কী যেন একটু ভেবে নিয়ে মনুকে বলল, ‘তুই এখন যা, আমাকে একটু একা থাকতে দে।’

নানা জায়গায় ঘুরতে ঘুরতে চামেলির বস্তির সামনে এসে দাঁড়াল বাচ্চু। রাস্তার কলের জলে দু’চার জন মেয়েমানুষ বুকে গামছা জড়িয়ে স্নান করছিল। ফুটপাথের ওপর দু’চারটে বাচ্চা খেলা করছে। অদ্ভুত এদের জীবন। দুঃখটা কেমন সহজ করে মেনে নিয়েছে। কোনও আশা নেই প্রত্যাশা নেই শুধু কোনও রকমে বেঁচে থাকা। চামেলির ঘরের বাইরে টুলের ওপর ওর স্বামী বসে চা খাচ্ছিল। একটু হেসে বলল, ‘কি খবর বাচ্চুদা?’

বাচ্চু সে কথার জবাব না দিয়ে বলল, ‘চামেলি কোথায়?’

‘ঘরেই আছে। একটু ব্যস্ত আছে।’

চামেলির এই দেহদান বাচ্চুর একটুও ভালো লাগে না। পয়সার জোর থাকলে বড়ো বড়ো উপদেশ দেওয়া যায়। চামেলির চারটে বাচ্চা, তার ওপর ওর স্বামীর কোনও রোজগার নেই। মাঝে মাঝে ভাবে বাচ্চু, জীবনটা কি এতই সুন্দর যা কোনওভাবে বাঁচিয়ে রাখতেই হয়।

একটা সিগারেট ধরাল বাচ্চু। মাথাটা খুব ধরেছে। কী করবে সে। তারপর বলল, ‘আমি ঘুরে আসছি।’

চামেলির স্বামী বলল, ‘সেই ভালো, জানি না তো কতক্ষণ লাগবে।’

রাত বারোটার পর যখন চামেলির ঘরে ঢুকল বাচ্চু, চামেলি তখন ক্লান্ত। বড়ো বড়ো হাই উঠছে। বাচ্চাগুলো জড়াজড়ি করে ঘুমিয়ে আছে তেলচিটে বিছানাটাতে। চামেলি বলল, ‘হঠাৎ পথ ভুল করে এখানে?’

চৌকির ওপর বসতে বসতে বাচ্চু বলল, ‘বোনটার খুব অসুখ। তাই বেরিয়েছিলাম টাকার সন্ধানে।’

‘কী হয়েছে নীতার?’ অনেক জানার আগ্রহ চামেলির মুখে।

‘জানি না। তবে আজ ক’দিন ধরে কিছু খাচ্ছে না।’

‘ডাক্তার দেখিয়েছ?’

‘হ্যাঁ, ছোটোখাটো ডাক্তার দেখিয়েছি, কিছুই ধরতে পারছে না।’

‘কোনও বড়ো ডাক্তার দেখাও।’

একটু হাসল বাচ্চু, বলল, ‘খাবার পয়সা নেই ডাক্তার দেখাব!’

‘আমি পয়সা দেব, তুমি নীতাকে বাঁচাও।’

‘সে হয় না চামেলি। তোমার রোজগারের লজ্জা আমাকে দিনরাত কুরে কুরে খাবে।’

‘তবুও তুমি না কোরো না। আমি যদি আমার সমস্ত লজ্জা, ঘৃণা ত্যাগ করে আমার বাচ্চাদের বাঁচিয়ে রাখতে পারি, তবে নীতাকেও বাঁচাতে পারব। আমি বড়ো বড়ো শেঠের কাছে যাব। অনেক টাকা আনব।’

বাচ্চু হঠাৎ চামেলির মুখ চেপে ধরে, রাগে ওর শরীর জ্বলছে। বলে, ‘না। ওই পয়সাওয়ালা লোকদের ভোগের সামগ্রী হতে দেব না তোকে। এবার, যদি না পাই তবে ছিনিয়ে নেব। ওইসব বাড়ির মেয়েদের লাজলজ্জা আছে, আমাদের মা-বোনেদের নেই?’ চামেলির ঘর ছেড়ে রাস্তায় নেমে পড়ল বাচ্চু। মাথাটা কেমন ঘুরছে, কান গরম।

দুদিন পর বাড়ি ফিরল বাচ্চু। নীতার অবস্থার আরও অবনতি হয়েছে। ঘরের এককোণে নেতিয়ে পড়ে আছে মেয়েটা। জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে। চারদিন কিছু খায়নি। পাড়ার ডাক্তার জীবেনবাবু কোনও বড়ো ডাক্তারকে দেখাতে বলেছেন।

‘এখন কী করবে করো।’ পিসিমা রাগে গজগজ করতে করতে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল। বাচ্চু নীতার মাথায় হাত দিল। জ্বরটা এখনও আছে। চোখের দু’ধারে শুকনো জলের দাগ। অচৈতন্যের মতো পড়ে আছে। কষ্টের ছাপ ওর মুখে।

বাচ্চু ডাকল, ‘নীতা’।

নীতা চোখ খুলে চেয়ে রইল।

‘খুব কষ্ট হচ্ছে না রে?’

নীতা কিছু বলল না।

‘একটু ফলের রস খাবি?’

নীতা মাথা নাড়ল।

‘একটু কিছু খেয়ে নে,’ মাথায় হাত বোলাল বাচ্চু।

‘ভীষণ কষ্ট হচ্ছে দাদা।’

‘কোথায় কষ্ট হচ্ছে বল।’

নীতা নিজের পেটের ওপর দৃষ্টি নামাল।

আবার বাচ্চু বলল, ‘খুব ব্যথা হচ্ছে নীতা?’

‘হ্যাঁ দাদা, ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। আচ্ছা দাদা তুই বাড়ি আসিস না কেন? আমার কথা তোর একটুও মনে পড়ে না?’

বাচ্চুর চোখ ফেটে জল এল। ওর পেটে হাত বোলাতে বোলাতে বলল, ‘তোর জন্য বড়ো ডাক্তারের কাছে যেতে হবে। অনেক টাকার দরকার তাই কাজ করি।’

‘তুই কত রোগা হয়ে গেছিস দাদা। আমার জন্য তোর কত পরিশ্রম।’

‘কথা বলিস না নীতা, ব্যথা বাড়বে।’

‘আমার একটুও ভালো লাগছে না দাদা, ব্যথাটা বাড়ছে। আমি মা-বাবার কাছে যাব। মা আমাকে কত ভালোবাসবে, আদর করবে। কত সুন্দর বই কিনে দেবে। আমি বাবার সঙ্গে বেড়াতে যাব। কত মজা হবে।’

জ্বরের ঘোরে ভুল বকতে থাকে নীতা। পিসিমা ঘরে ঢুকে বলল, ‘ব্যথাটা বাড়ল বুঝি? কী যে হল। আমি একটু গরম তেল মালিশ করে দেখি।’

বাচ্চু হঠাৎ উঠে দাঁড়াল। নীতার অসহ্য কষ্ট আর দেখতে পারছে না। সমস্ত শরীরের ভেতর ওর অক্ষমতার জন্য একটা যন্ত্রণা বয়ে গেল। নীতাকে বাঁচতেই হবে। ওকে এরকম ভাবে মরতে দেবে না বাচ্চু। যে করেই হোক টাকা চাই।

শেঠ বাজোরিয়ার বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াল বাচ্চু। গেটের দারোয়ান বাধা দিতেই বলল, ‘সাহেব ডেকেছে।’

আরও কয়েকবার বাচ্চু এবাড়িতে এসেছে। বাড়ির ভেতরে ঢুকেই চাকরকে বলল, ‘শেঠ সাহেবকে বল আমি এসেছি।’

চাকর ফিরে এসে জানাল, ‘সাহেব এখন বাইরে যাবে এখন দেখা হবে না।’ বাচ্চুর মাথায় তখন খুন চেপে গেছে। চাকরকে হাত দিয়ে সরিয়ে জোরে জোরে পা ফেলে সোজা বাজোরিয়ার বেডরুম-এ ঢুকল। শেঠ বাজোরিয়া তখন পোশাক বদলাচ্ছিল। ওকে দেখেই বলল, ‘তুই বেডরুম-এ কেন এলি?’

সারা শরীরে এক প্রচণ্ড হিংস্রতা ঘিরে আছে বাচ্চুর। বলল, ‘শেঠ আমার কিছু টাকার দরকার।’

‘রুপিয়া কি এমনিই আসে যে বললেই দিয়ে দেব!’

‘আমার বোনের খুব অসুখ শেঠ, কিছু টাকা দাও। হাতজোড় করছি।’

‘বোনের অসুখ তো আমি কী করব? যা না সরকারি হাসপাতালে।’

‘তোমার অনেক কাজ করেছি শেঠ, আমি আবার কাজ করে শোধ করে দেব।’

‘না তোকে আমার দরকার নেই। আমি তোর মতো কুত্তাকে আর ডাকব না। বেরিয়ে যা আমার ঘর থেকে।’

বাচ্চু আর থাকতে পারল না। মাথায় খুন চেপে গেছে। পকেট থেকে রামপুরী চাকুটা বার করল। তারপর চিৎকার করে উঠল, ‘টাকা আমার চাই।’

‘আচ্ছা ঠিক আছে। তুই বস আমি আসছি।’ বাজোরিয়া বারান্দায় রাখা টেলিফোন তুলে বলল, ‘হ্যালো লালবাজার আমি…’ আর বলা হল না। প্রচণ্ড শক্তিতে বাচ্চু তখন ওর গলা টিপে ধরেছে। একটা গোঙানি ভেসে এল বাজোরিয়ার মুখ দিয়ে। তারপর বাচ্চুর হাতের রামপুরী চাকুর আঘাতে লুটিয়ে পড়ল বাজোরিয়ার দেহ। বাজোরিয়ার দেহটা নিথর হয়ে যেতেই বাচ্চুর হুঁশ এল। এটা সে কি করল! লোকটাকে সে মেলে ফেলল! এতটা যে খুন চেপে যাবে ও আগেও ভাবেনি। কিন্তু আর এখন কিছু ভাবার নেই। দুদ্দাড় করে সিঁড়ি দিয়ে নেমে রুদ্ধশ্বাসে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল বাচ্চু।

রাত অনেক হয়ে গেছে চারিদিক নিঃস্তব্ধ, রাস্তার কুকুরগুলো ঘেউ ঘেউ করছে। শীতের রাত্রি লোক চলাচলও কম। বাচ্চু চামেলির ঘরের দরজার কড়া নাড়ল। চামেলি জেগেই ছিল। খুব সেজেছে আজ চামেলি। ভালো নাইলন শাড়ি, কপালে লাল টিপ। চামেলির স্বামী ঘরে নেই। মাল টেনে কোথাও পড়ে আছে বোধহয়, বাচ্চাগুলো এককোণে শুয়ে ঘুমুচ্ছে।

দরজা খুলেই চামেলি জিজ্ঞেস করল, ‘এত রাতে কী ব্যাপার?’

বাচ্চু বলল, ‘আমাকে একটু জল দাও চামেলি। অনেকটা পথ হেঁটে এসেছি।’ বাচ্চু তখনও হাঁপাচ্ছে।

চামেলি বলল, ‘বসো আমি জল আনছি।’

জল খেয়ে বাচ্চু বলল, ‘আজকে একটা খারাপ কাজ করে ফেলেছি।’

‘আবার মারামারি করেছ? না তোমাকে নিয়ে আর পারা গেল না। তুমি না থাকলে নীতার কি হবে ভেবে দেখেছ একবার?’

চিৎকার করে উঠল বাচ্চু– ‘ওকথা বোলো না চামেলি। ওকথা বোলো না।’

তারপর চামেলির হাতদুটো জড়িয়ে ধরে বলল, ‘তুমি না একদিন বলেছিলে– নীতাকে বাঁচাবে।’

‘হ্যাঁ বলেছিলাম।’

‘তবে তুমি ওকে বাঁচাও চামেলি। আমার একান্ত অনুরোধ, বলো তুমি রাখবে?’

‘হ্যাঁ, সেই ভেবেই তো…। এখুনি বাজোরিয়া শেঠের গাড়ি আসবে, আমাকে নিয়ে যাবে ওর বাগান বাড়িতে দিন সাতেক থাকতে হবে, কিন্তু অনেক টাকা দেবে, জানো!’

বাচ্চুর শিরা দুটো দবদব করছে। মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে। এখন সে কী করবে? কোথায় পালাবে। কিছু কূলকিনারা পাচ্ছে না।

বাজোরিয়ার নামটা যেন তার বুকের ভেতর হাতুড়ি পিটছে। ওকেই তো কিছুক্ষণ আগে নিজের হাতে খুন করে এসেছে সে। ওতো আর কোনওদিন আসবে না চামেলিকে নিতে।

চামেলি পান খেতে খেতে বলল, ‘ও এখনও এল না লোকটা। টাকাটা পেয়ে নিই, তারপর দেখো আমি নীতাকে বাঁচাবই।’

বাচ্চুর মাথা ঘুরছে। এ কী করল সে! ওই টাকাও আর পাওয়া যাবে না। শুধু বাজোরিয়ার নয়, সে যে নীতারও প্রাণ নিয়ে ফেলেছে। সমস্ত পৃথিবী কাঁপছে। হাত মুঠি করে নিজের ভেতরের সমস্ত শক্তি সঞ্চয় করে সে বলল, ‘ওই শেঠ আর আসবে না চামেলি। আমি বাজোরিয়াকে খুন করে এসেছি নিজের হাতে।’ কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে বাচ্চু।

‘এ তুমি কি করলে বাচ্চুদা। আমি যে অনেক কষ্টে এ টাকার বন্দোবস্ত করেছিলাম।’

‘আর বোলো না চামেলি। আমি নিজের হাতে দুটো প্রাণ নষ্ট করে দিলাম, আমাকে তুমি ক্ষমা করো।’

রাত্রির মধ্যম যাম। অনেকক্ষণ দুজনে চুপ করে বসে থাকে। তারপর উদভ্রান্তের মতো ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যায় বাচ্চু। বড়ো রাস্তা পেরোলে ওপারেই সরকারি হাসপাতাল। আরও একটু এগোলেই মোড়ের মাথায় থানা।

 

বেলাশেষের বাসনা

সত্যি, পাণ্ডুলিপিটা যে কোথায় গেল!

শুভায়ু বারবার চিন্তা করে। ওর চেন-আঁটা শান্তিনিকেতন ব্যাগটা তন্নতন্ন করে খোঁজে। সবমিলে পনেরোটা গল্পের পাণ্ডুলিপি ছিল একসঙ্গে।

সবগুলোই জেরক্স কপি। শুধুমাত্র একটাই হাতে লেখা… আর সেটাই হারিয়ে গেছে।

আসলে একটা ফাইল নেওয়া হয়নি সেটাই ভুল হয়ে গেছে। বড়ো একটা বাদামি রঙের প্যাকেট বা বড়ো খাম, তাতে ঠাসাঠাসি করে কাগজগুলি ছিল। প্যাকেটের মুখ একটা জেমস্ ক্লিপ দিয়ে আঁটা ছিল।

অথচ কী করে যে পড়ে গেল— আশ্চর্য!

শুভায়ুর একটা ইচ্ছা ছিল। বেশ পুরোনো ইচ্ছা। সেটা হল একটা গল্প সংকলন প্রকাশ করা। এটা ও অনেকদিন থেকে ভেবে আসছে।

শুভায়ু যে একজন নামকরা সাহিত্যিক, তা নয়। লেখক হিসেবে মফসসল শহরে দু-চারটে পত্রপত্রিকায় গল্প ছাপিয়ে আর আসরে এক-আধটা গল্প পাঠ করে যে বিরাট কিছু হওয়া যায় না— তা সে জানে।

তবে যাচ্ছ কেন বই ছাপাতে? নিজেকেই যেন প্রশ্ন করে বসে শুভায়ু। আর উত্তরগুলো একইসঙ্গে আউড়ে যায়। আসলে ছড়ানো ছিটানো গল্পগুলোকে একত্রিত করে পাঁচজনের হাতে দেওয়া। আর এই লেখালেখির মধ্যে দিয়ে জীবনটাকে একটু কর্পূর সুবাসিত করা।

এছাড়া গতানুগতিক আটপৌরে জীবনে আর কী-ই বা করার আছে?

আরে— আসল কথাটাই বলতে ভুলেছে ও। সেটা হল ও’র অবসরপ্রাপ্ত জীবনে— জীবনবিমার সামান্য কিছু টাকা ম্যাচিওর করেছে। যেটাকে ও সংগোপনে বাড়ির খরচা থেকে খুব কৌশলে সরিয়ে রেখেছে। টাকার অঙ্কটাও সামান্য। ওই সংকলন বের করার মতোই— হাজার ষোলো টাকা। সেটাকেই ও ইদানীং ব্যাঙের আধুলির মতো সম্বল করে প্রকাশনার ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে পড়েছে।

এতক্ষণে শুভায়ুর মনে পড়ল – কাল ভোরে ও যখন সবকিছু গোছাচ্ছিল কলকাতা যাওয়ার প্রস্ততি হিসেবে, তখনই তৃষা মন্তব্য করেছিল, ‘দ্যাখো বাপু, সব ঠিকঠাক গোছগাছ করে নিলে তো? তোমার আবার রাস্তাঘাটে মাথার ঠিক থাকে না।’

কথাটা অবশ্য মিথ্যে বলেনি। সেদিন গোছগাছ করে ও হাওড়া লোকাল ধরেছিল… উদ্দেশ্য কলেজ স্ট্রিট-এ কোনও প্রকাশকের দ্বারস্থ হওয়া।

নতুন লেখকদের বেশিরভাগ বই-ই গ্যাঁটের পয়সা দিয়ে ছাপাতে হয়। এটাই প্রায় দস্তুর হয়ে গেছে। তবু কত রকমের বাহানা – ‘লেখাগুলোর জেরক্স কপি দিয়ে যান— পড়াব, এক্সপার্ট-দের দেখাব।’

শুভায়ু বলেছিল ‘টাকাটা তো আমার। তবে আপনাদের অতশত বাহানা বা খুঁতখুঁতানি কেন?’ প্রকাশকের গদিতে বসে ওর ছোটো ছেলে — যে সবেমাত্র গ্র্যাজুয়েশন করেছে, সে বিজ্ঞের মতো উত্তর করে, ‘খুঁতখুঁত করি কি সাধে? মালটা তো আমাদের ব্যানার-এ বেরোচ্ছে। আমাদের গুডউইল ওর সঙ্গে জড়িত থাকছে যে। তাই আমাদের একটু মাথা ঘামাতে হয় বই-কি!’

শুভায়ু মনে মনে বলে তোমাদের আবার গুডউইল বলে কিছু আছে নাকি? পয়সা— আসলে পয়সা হলেই হল। বড়ো বড়ো প্রকাশকরা পর্যন্ত নামিদামি লেখকদের সঙ্গে দু’চারটে অনামি লেখককেও এক আসনে বসাচ্ছে।

যাকগে ওসব কথা। ওর সব লেখাগুলোই রয়েছে কেবল শেষেরটা নেই— তার কোনও কপিও নেই— । বেশ ঝঞ্ঝাট হল বই-কি!

কী ব্যাপার তবে কি ফেরার পথে ট্রেনেই মিস করল? ওই ‘বাসনা বিসর্পিল নদী’ গল্পটাই হারিয়ে গেছে…

বড়ো টেন্সড ফিল করে শুভায়ু। গুনে গুনে লেখাগুলো নিয়ে গেল অথচ…

আচ্ছা প্রকাশককে ফোন করে জানলে হয় না? যদি সেখানে পড়ে থেকে থাকে—।

ব্যাপারটা প্রায় সপ্তাহখানেক হয়ে গেল আর নিশ্চয়ই ফেরত পাওয়া যাবে না। ওটা তাহলে গেল? ওই বিষয়বস্তু নিয়ে লেখা যেতে পারে কিন্তু তেমনটি হবে কি?

এরই মাঝে তৃষা মন্তব্য করে, ‘অত মনমরা হলে চলবে! আবার নতুন করে লিখতে কি তোমার গায়ে জ্বর আসছে নাকি?’

শুভায়ু বলে, ‘থামো তো তুমি! হাজার হোক লেখা তো আমার সৃষ্টি। লেখা খোয়া গেলে শোক হতেই পারে। লেখা হচ্ছে আত্মজ। সন্তানের মতো… ও সব তুমি বুঝবে না!’

তৃষা উত্তর করে, ‘কী জানি ওসব বাতিক আমার নেই—তাই বুঝি না।’

এবার শুভায়ু রেগে যায়— ‘যা বোঝো না তা নিয়ে তক্বো কোরো না চুপ থাকো!’

পরের শনিবার আবার কলেজ স্ট্রিট যেতে হয়েছিল। প্রকাশক বললেন— ‘নাহ এখানে কোনও পাণ্ডুলিপি ফেলে যাননি। কী আশ্চর্য কোথায় গেল!’

ফেরার পথে বাস থেকে তাড়াতাড়ি নেমে— সাবওয়ের মুখে পৌঁছল। কিন্তু হঠাৎ একি দেখছে ও! সামনের মেয়েটি অমন করে তাকাচ্ছে কেন? একদম কাছাকাছি এসেই মেয়েটি থমকে যায়।

‘স্যার একটু দাঁড়াবেন…’ শুভায়ু থমকে যায়।

‘মনে করতে পারেন স্যার? চিনতে পারেন…’ তারপর পা ছুঁয়ে প্রণাম করে।

শুভায়ু হকচকিয়ে যায়। প্রশ্ন করে, ‘কে তুমি?’

‘স্যার আমি শ্রাবণী। আপনার ছাত্রী ছিলাম দেউলগ্রাম হাইস্কুলে। আর আপনার সঙ্গে ছিটেফোঁটা আত্মীয়তাও ছিল। আপনার মা বীণাপানি দেবী আমার দূর সম্পর্কের মাসি… আপনি কেমন আছেন?’

শুভায়ু লেন্স-এর ফাঁকে ওকে ভালো করে দেখে।

‘ভালো আছি… ওহ্ সেই শ্রাবণী!… কোথায় চলেছ? আমি কিন্তু বর্ধমান যাব।’

‘হ্যাঁ… দাদা। মানে স্যার…’

‘অত ইতস্তত করছ কেন? আমাকে দাদা বলেই ডেকো… তুমি তো বেশ বড়ো হয়ে গেছ। দেউলগ্রাম স্কুলের মাধ্যমিক পরীক্ষার্থিনী হিসাবে শেষ দেখেছিলাম কিন্তু তোমার সেই চেহারা একদম ভেঙে গেছে… আমি তো চিনিয়ে না দিলে ধরতেই পারতাম না। তারপর সব কেমন আছ? কী করছ? তোমার সেই ভাই সুপ্রকাশ কী করে?’

শ্রাবণী মাথা চুলকোয়।

‘বাব্বা! আপনার সব মনে আছে দেখছি— খবর ভালোই… আমি তো বড়ো… আমার পরে সুপ্রকাশ। আমি অনার্স পাশ করে ট্রেনিং নিয়ে বসে আছি… এমএসসি দিচ্ছি। ভাইও বেকার, ইন্টারভিউ দিচ্ছে। বাবার সেই প্রাইভেট ফিন্যান্স কোম্পানি উঠে গেছে। স্টাফ-দের কিছু কিছু পয়সা দিয়ে ছেড়ে দিয়েছে।’

একটু থেমে আবার শুরু করে…

‘কিন্তু দাদা সত্যি বলতে কী, বেশ দুর্দিন যাচ্ছে আমাদের। সে কথা আপনাকে লুকিয়ে লাভ নেই… বরং চলুন না কর্ড লাইনে এই সামনেই বেলানগরে নেমে শিউলিবাগান কলোনি। যাবেন দাদা? বাবা আপনাকে দেখলে খুশি হবেন। আর দেউলগ্রামের লোকজন তো আসে না। তার কারণও আছে, গেলে সবকিছু জানবেন।’

একটু যেন বিমনা হয়ে যায় শুভায়ু।

‘চলুন না দাদা— অসুবিধে হবে না।’ অনুরোধটা বারবার আসতে থাকাতে একটু দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়ে ও—

‘কিন্তু আমার তো রিটার্ন কাটা আছে।’

শ্রাবণী বেশ গুছিয়ে বলতে থাকে। ‘টিকিটটা সামান্য, তবে যদি বাড়িতে অসুবিধে থাকে, বউদি চিন্তাভাবনা করে— সে কথা আলাদা।’

হঠাৎই শুভায়ু মনস্থির করে ফেলে।

‘চলো তাই যাই… তোমাদের আস্তানাটা চিনে আসি, কলকাতা আসা যাওয়ার পথে কাজে লাগবে। বুথ থেকে বাড়িতে জানিয়ে দিলেই চলবে।’

‘ভালোই হল কাল তো রবিবার, সকালেই ফেরার তাড়া নেই।’

ট্রেনে চড়ে সামান্য রাস্তা। যাত্রাপথে নানান চিন্তা… এসে পড়ে।

লেখাটা হারিয়ে যাওয়ার পর থেকে কেমন খচখচ করে মনটা। গল্পটার নায়িকা ছিল অতসী… ভ্যান চালাত সুবলসখা। তার সঙ্গে অতসীর ঘনিষ্ঠতা… শেষে বাড়ির অমতে রেজিস্ট্রি করে বিয়ে হয়। মা-বাবা ক্ষুণ্ণ হয়, সুবল-রা অন্য জাত। অতসীদের তুলনায় ওদের বাড়ির অবস্থা তেমন ভালো নয়।

এরমধ্যে অতসীর মা মারা যেতে বাড়ির একটা ছন্নছাড়া হাল হয়ে যায়। মাত্র পঁয়তাল্লিশ বছর বয়সে স্ত্রীহারা হয়ে বাবা বেশ ভেঙে পড়ে। অতসী তার স্বামীকে বারবার কাছে এসে থাকতে বলে। ওরা একদিন এসেও যায়। কিন্তু পরস্থিতি ভিন্ন খাতে বইতে শুরু করে। এক প্রত্যুষে ওদের খামারবাড়ি থেকে সাদা পোশাকে এক নারী মূর্তিকে ওরা বের হতে দেখে… তবে কি ওটা ওর মার অশরীরী আত্মা?

শেষ পর্যন্ত রহস্যের কিনারা হয়। আত্মা আর অশরীরী থাকে না, তার শরীরী রূপ ধরা পড়ে। সে অতসীর ছোটো মাসি… অল্প বয়সে বিধবা হয়ে পাশের গ্রামে বাপের বাড়িতে থাকত। সে ছুটে আসে কীসের টানে। সেও এক বাসনার শিকার। বাসনার এক বিসর্পিল নদী ওকে টানে।

যাক এটা শুধুমাত্র কাঠামোটা…।

রক্তমাংসের গল্পটা তো নেই। শুভায়ু কী করে শুধু মুখের কথায় বাসনার বিসর্পিল রূপটা বিশ্বাস্য করে তুলবে…!

স্টেশন থেকে শিউলিবাগান কলোনি সামান্যই রাস্তা। সেখানে শ্রাবণীদের একতলা ঘর— মাত্র দুটো কুঠরি। ছাদের সিঁড়ি, চিলেকোঠা। সুপ্রকাশ কম্পিউটার ট্রেনিং নিচ্ছে, রাতে বিকম পড়ে।

ওদের বাবা সরকারবাবু কথা শুরু করেন।

‘তাহলে শুভবাবু আমাকে চিনতে পারছেন তো… দেউল গ্রামে থাকতে মাত্র একবারই গিয়েছিলেন আমাদের বাড়ি… সে তো আটবছর আগে।’

শুভায়ু তাকিয়ে দেখে সরকারবাবুর দোহারা চেহারা সামনের দিকে কিছু পাকা চুল, কেমন যেন পোড়খাওয়া।

‘আরে দেখুন না শ্রাবণী ধরে নিয়ে এল। আর আমাকে নতুন জায়গা দেখার নেশায় কেমন যেন পেয়ে বসল।’

সরকারবাবু বলেন, ‘আরে মশাই এসে অন্যায় কিছু করেননি।’

‘অন্যায় আর কী, এসেছি এই বোনটির টানে। সত্যি শ্রাবণী মেয়েটি বড়োই ভালো। আর মেশোমশাই আমাকে আর ‘আপনি’ সম্বোধনে লজ্জা দেবেন না। আমি তো আর এখন দেউল গ্রামের প্রধান শিক্ষক পদে নেই… তাছাড়া আপনি বয়সে বড়োই হবেন।’

‘তাই হবে বাবা! শ্রাবণী মাঝেমধ্যে এখনও তোমার কথা বলে। ওই তো সবকিছু দেখাশোনা করে, ঘরের কাজ বাইরের কাজ সামলায়। ওরাই তো ভাই-বোনে ঠেলা গোঁজা দিয়ে চালাচ্ছে সংসারটাকে। নিজেরা পড়ছে, ছাত্র-ছাত্রীদের পড়াচ্ছে। আমি তো যেটুকু ছাঁটাইয়ের আগে পেলাম সেটা— সেই সঙ্গে কিছু দেনা করে মাথা গোঁজার জায়গাটুকু করতে পেরেছি।’

সুবর্ণা মাসি মানে শ্রাবণীর মা’র প্রসঙ্গ উঠতে সবাই মুখে তালা এঁটে দিল। কেউ কোনও কথা বলে না।

একটা থমথমে গুমোট ভাব হঠাৎ যবনিকাপতনের মতো ঝুলে রইল…

শেষে শ্রাবণী নীরবতা ভঙ্গ করল। ‘দাদা খাওয়াদাওয়া হোক, তারপর রাতে ধীরেসুস্থে সব কথা বলব। না বললে আমাদের চলবে না। আর আপনিও ঠিক বুঝবেন না। এই বলে আশ্বস্ত করল শুভায়ুকে।

সুবর্ণা মাসির সঙ্গে শুভায়ু’র মা’র একটা দূর সম্পর্কের আত্মীয়তা ছিল। খানিকটা লতায়-পাতায় গোছের। শুভায়ু সেটা সঠিক বুঝত না। থাক সে কথা।

রাতে শ্রাবণীর কথা শুরু হল।

‘দাদা! আপনাকে সবকথা খুলে বলতে আমার লজ্জা ছাড়াও— কেমন একটা তিক্ত বিস্বাদ ভাব এসে যাচ্ছে। কথা বলতে যাচ্ছি, না আকাশে থুতু ছুড়তে যাচ্ছি, সেটাই ভাববার বিষয়। মাকে নিয়ে কথা বলা বা মা’র কেচ্ছা আলোচনা করা সন্তানের পক্ষে কতখানি নির্লজ্জতার নজির তা নিশ্চয়ই উল্লেখের দরকার নেই। একজনের ভুলের মাশুল গুনছে গোটা সংসার…। সমস্ত সংসারটাতে যেন অলক্ষ্মীর ছায়া। বাবা এখন আমাদের অভিভাবক, আমাদের ভরসা স্থল। তাঁর মুখের দিকে তাকানো যায় না। কে যেন কালি লেপে দিয়েছে। তবু ভালো শিউলিবাগান কলোনির লোকজন সব কিছু স্পষ্ট করে জানে না। কারণ ঘটনাটা এখানে ঘটেনি।’

একটু থেমে আবার বলতে থাকে শ্রাবণী, আমরা তখন ডানলপের দিকে ভাড়া ছিলাম। নতুন বাড়িতে শিফট করার পর মা’র সম্পর্কে সবরকম কৌতূহল মেটাতে তৎপর হলাম। মা’র একটা পুরোনো নেগেটিভ-কে কায়দা করে এনলার্জ করা হল— সেটাকেই বাঁধিয়ে ফুলের মালা দিয়ে দেয়ালে টাঙানো হল। বলা হল— সুদূর দেশের বাড়িতে মা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন আর সেখানেই মারা যান। এখানকার লোক আমাদের সম্পর্কে তত উৎসাহী নয় যে বাঁকুড়ার দেউল গ্রামের খবর নিতে যাবে। সবচেয়ে বড়ো কথা হল কলকাতার শহরতলিতে ছাপোষা এক সরকারবাবুর স্ত্রী আদৌ মারা গেছেন কিনা, সে নিয়ে গবেষণা করতে কারও বয়ে গেছে। তাদের ভাববার জন্য বহু গুরুত্বপূর্ণ জিনিস আছে।’

শুভায়ু মাঝখানে শ্রাবণীকে থামিয়ে দেয়।

‘শ্রাবণী, আমার কাছে ব্যাপারটা ধোঁয়াশা হয়ে রইল। আচ্ছা বলো তো, সুবর্ণা মাসি কোথায় চলে গেলেন? সঙ্গে কে ছিলেন?’

শ্রাবণী দীর্ঘশ্বাস ফেলে কিছু বিরতির পর কথা বলতে থাকে।

‘শুভদাদা! কিছু মনে করবেন না… আমি এতখানি বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছি যে কথাসূত্রর ঠিকঠিক সঙ্গতি রাখতে পারছি না। তাই কোথায় এ কাহিনি শুরু করতে হবে তাই ভুলে বসে আছি। আমাদের দুঃখকষ্ট, মনের জ্বালাযন্ত্রণা আজ পর্যন্ত কাউকে স্পষ্টভাবে বলতেই পারলাম না। আসলে সেরকম পারিবারিক বন্ধুই পেলাম না – যার কাছে নিজেদের কথা বলে হালকা হতে পারি। আপনাকে টেনে এনেছি মনের কথা শোনাব বলে। এবার শুনুন –

মা’র বাপের বাড়ির অবস্থা যাইহোক, ওঁর মধ্যে একটা বিলাসী সুখস্বপ্নে বিভোর সত্তা ছিল। আমার জন্মের পর থেকেই নানানভাবে আঘাত পেতে থাকেন। বাবা সামান্য চাকরি করতেন প্রাইভেট ফিন্যান্স কোম্পানি-তে। তাও সেটা বড়ো প্রতিষ্ঠান ছিল না। মায়ের মতো সুন্দরী একটা মেয়ের এমন একটা দৈন্যপীড়িত সংসারে কেন যে বিয়ে হল – সেটাই বিরাট রহস্য। যাক ওসব প্রসঙ্গ। তবু মাকে সুখস্বাচ্ছন্দ্য দেওয়ার জন্য বাবার নিরন্তর চেষ্টার অন্ত ছিল না। কিন্তু মা’র কাছে, এই সংসার… ভাড়া বাড়ি… বাবার আর্থিক টানাটানিগুলো বড়োই ঘৃণা ও বিরক্তির বিষয় ছিল…।

‘আমরা কত কষ্ট করেছি পড়াশোনা করতে গিয়ে। অন্যের বাড়ি থেকে নোটবই চেয়ে এনেছি, রাত জেগে নোটকপি কিংবা ছুটোছুটি করে অথবা জেরক্স সংগ্রহ করে বহু কষ্ট স্বীকার করে লেখাপড়া করেছি। মা’র কাছে এসব মূল্যহীন ছিল! মা-কে বলতে শুনেছি, জানো বইপত্র কিনতে হয়, ওরকম চেয়েমেগে বিরাট কিছু হওয়ার স্বপ্ন দেখে লাভ নেই।

সে তো অনেক পয়সার দরকার— আমার উত্তর। মা ভ্রূকুটি করে হেসেছে – হ্যাঁ টাকাপয়সার দরকার বই-কি! আর বেশি দাম দিয়ে সেই বই কেনার মতো স্বচ্ছলতা বা সামর্থ্য আমাদের নেই। স্বচ্ছলতা আনতে যে যোগ্যতা দরকার তা তোমার বাবার নেই।

ছলেবলে কৌশলে যেভাবেই হোক বাবার আর্থিক দৈন্যকে ব্যঙ্গ করাই মার লক্ষ্য ছিল।

– কী বলছ তুমি! তুমি তো সবই জানো বাবার অবস্থা।

– জানি বই-কি। আর এও জানি তোমার বাবা নানা অজুহাত যাই দেখান, তিনি আর্থিক সাফল্যের পরীক্ষায় অকৃতকার্য বলেই প্রতিপন্ন।

শ্রাবণী বড়োই দ্বিধাদ্বন্দ্বের মধ্যে দিয়ে এ ক’টি কথা বলতে পারল।

আমার মা’র কথাবার্তা শুনলে মনে হতো, মার ভাগ্যে এক সচ্ছল সুন্দর গোছালো সংসার অপেক্ষা করছিল, আমার বাবা হঠাৎ তাঁর জীবনে এসে পড়ে সবকিছু তছনছ করে দিয়েছে।

আমি মাঝে মাঝে অনুমান করতে চেষ্টা করতাম – মায়ের সেই ঈপ্সিত পুরুষ কি সুরঞ্জন মামা? কে জানে!

তবে সুরঞ্জন সান্যালকে দু’একবার এ বাড়িতে আসতে দেখেছি। ছোটোবেলায় তাঁর দেওয়া মুঠোমুঠো টফি আমরা ভাইবোনে ভাগ করে খেয়েছি। শুনেছি মা’র মামার বাড়ির দেশে ওঁর বাড়ি ছিল। মানুষ হয়েছিলেন উত্তরবঙ্গের কোথায় যেন! প্রথম যখন আমাদের বাড়ি আসেন তখন উনি বেকার। বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ ধাপ পার হয়ে স্কুল-কলেজে চাকরির ধান্দায় ঘুরছেন। বিষ্ণুপুরের কাছে একটা কলেজে সাক্ষাৎকারে এসে হঠাৎই মা’র সঙ্গে দেখা করতে আসেন। আমার বাবা শিবতোষ সরকারকে বলেন, শিব জামাইবাবু, এদিকে একটা চাকরি পেলে দিব্যি থেকে যাব। সুবর্ণার সঙ্গে যোগাযোগ রাখা যাবে…

চাকরি পাওয়ার পর ছুটিছাটায় দেউল গ্রামের বাড়িতে এসেছেন সুরঞ্জন মামা। দু’চারদিন বেশ হইচই করেছেন। আমাদের সঙ্গে হালকা হাসিমস্করা হুটোপাটি করেছেন, এসব বেশ মনে পড়ে। আমাকে খুবই আদর করতেন। মা-কে বলতেন সুবর্ণা! তোমার এই মেয়েটাকে ভালোভাবে লেখাপড়া শিখিও, বেশ বুদ্ধিমতী হবে। ওর দৌড়ঝাঁপ দেখে মনে হয় স্পোর্টস-এ বেশ ভালো করবে। ওর কোন নামটা ফাইনাল করলে, শ্রাবণী?

শুনে মা’র মুখে হাসির ছ’টা। মা বলেই ফেলল, আর সব নাম তো চাপা পড়ে গেল। তোমার দেওয়া ওই নামটাই রীতিমতো চালু হয়ে গেল দেখছি। কার দেওয়া নাম দেখতে হবে তো?

মা’র মুখে সুরঞ্জন মামার নাম তখন সব সময় শোনা যেত, প্রশংসায় পঞ্চমুখ।

এমনিতর একটা প্রতিভাসম্পন্ন ব্যক্তি। বাঁকুড়া জেলার একটা সামান্য কলেজে চাকরি করছে। সেটাই মা’র আপশোশের কারণ। অবশ্য তখন সোনামুখি কলেজ ছোট্ট কলেজই ছিল…

দেউল গ্রামের দিনগুলি এমনিভাবেই পার হচ্ছিল। মাসে অন্তত একবার সুরঞ্জন মামা এসে যেতেন। জুলজি বোটানি-র লোক যে কবি-শিল্পী মনের হতে পারে, আমার ধারণা ছিল না।

একবার দ্বারকেশ্বর নদীর পাড়ে শীতের সময় আমরা ‘পৌষলা’ করেছিলাম। তখন আমি সবে মাধ্যমিক পাশ করেছি। তখন সুরঞ্জন মামার ভরাট গলায় শুনেছি রবীন্দ্রসংগীত – ‘যেন পেরিয়ে এলেম অন্তবিহীন পথ… আসিতে তোমার দ্বারে…’

মা-ও ভালো গাইত, একটু চাপা গলায় গেয়েছিল—‘যখন প্রথম ধরেছে কলি আমার মল্লিকা বনে…’

তখন ভালো বুঝতাম না। মনে হতো কেমন একটা কুয়াশা ঘেরা অন্ধকার, তারই মধ্য দিয়ে আমাদের সংসারটা চলেছে।

এইচএস পড়ার সময় থেকে আমার মনে হল— কোথায় যেন একটা অন্য স্রোত বইছে। চোরাস্রোত ফল্গুধারার মতো। সে ছুটে চলেছে হয়তো বা কোনও অজানা সর্বনাশা পথে। সুপ্রকাশ-এর চোখ ছেলেদের চোখ আর তরুণের চোখ। ওর তখন বয়স অল্প। ও ঠিক ধরতে পারেনি। ধোঁয়াটে হলেও আমি অনেকটা বুঝতাম। দেখতাম, সুরঞ্জন মামা এলে মা’র চোখে একটা খুশি চিকচিক করে উঠত।

ওদিকে বাবা, সুরঞ্জন মামা সম্পর্কে কোনও না কোনও মন্তব্য করলেই মা রেগে যেত।

একদিন বাবা বললেন, সে কি সুবর্ণা তুমি ওঁর সঙ্গে সোনামুখি যাবে?

– কেন তোমার আপত্তি আছে?

– না মানে সুরঞ্জনবাবু মেসে থাকেন তাই বলছিলাম।

মা ব্যঙ্গ হাসি হেসেছে, তুমি তো অমনি বলবে জানতাম। ওদের অধ্যক্ষ ফ্যামিলি নিয়ে থাকেন। আমি সেখানে থাকব। এখন সুরঞ্জনদা ওখানকার ভাইস প্রিন্সিপাল জানো তো!

বাবা চুপ করে যেতেন বাধ্য হয়ে। মা বলেছিল, দুটো দিন রান্নাবান্না শ্রাবণীই সামলে নিতে পারবে।

কলেজে সুরঞ্জন মামার নামডাক ছিল। ওঁর দু’চারটে বই ডিগ্রি কোর্স-এ চালু ছিল। এরপর বেশ কিছুদিন সুরঞ্জন মামা আর আসছিলেন না। দেউল গ্রামে যে ঢিঢি পড়ে গেছিল শিবতোষ সরকারের স্ত্রীকে কেন্দ্র করে, তা কিছুটা স্থিমিত হয়ে গিয়েছিল।

ইতিমধ্যে বাবাকে সঞ্চয়ন ফিন্যান্স বদলি করল হাওড়ার দিকে। বাবা সবকিছু গুটিয়ে ডানলপের দিকে চলে গেলেন। সেখানে নানান টানাটানির মধ্যে দিয়ে সুপ্রকাশ আর আমার পড়াশোনা চলতে থাকে।

শেষের ঘটনাটা ঘটল বছর দুই আগে। ইতিমধ্যে মা’র নামে চিঠিপত্র আসত, কিন্তু সুরঞ্জন মামা আর আসেননি। মাঝ্যেমধে মা’র মুখটা দেখতাম বেশ থমথমে। মাঝে মাঝে ভীষণ রেগে যেত বেশি প্রশ্ন করলে।

– চালাও তোমাদের সংসার, আমি আর পারছি না। শুধু নাই নাই রব। এত অভাব আর দেখতে পারছি না। আমারই কপাল দোষে জুটেছে ক’টা দুষ্টগ্রহ।

শুভদা। এরপর গল্প শেষ হয়ে আসছে। আমরা ঘটনায় যাচ্ছি। একদিন ভোরে বাবা উঠেছেন। অনেক খোঁজাখুজি করে মাকে কোথাও দেখা গেল না। আমি, ভাই অনেক খুঁজলাম। লাজলজ্জার মাথা খেয়ে বাবা একদিন সুপ্রকাশকে সোনামুখি পাঠালেন। পরের দিন সুপ্রকাশ খবর আনল, সুরঞ্জন সান্যাল প্রায় ছ’মাস আগে সোনামুখি ছেড়ে অসমের দিকে কোনও কলেজে অধ্যক্ষ পদে যোগ দিয়েছেন।

এরপর থেকে আমরা তিনজন সমানে লড়াই করে যাচ্ছি। ভাঙা হাল ছেঁড়া পাল তবুও…’

শুভায়ু শ্রাবণীর পিঠে হাত দিয়ে বলে ‘সোজা হয়ে হাঁটবে— এতটুকু ভেঙে পড়বে না। ভয় কী? তোমরা তো কিছু অন্যায় করোনি। শুধু ফটোতে নয় বাস্তবে সুবর্ণা মাসি মৃত বই-কি! অন্তত তোমাদের কাছে। শক্ত হও, তোমার কাছ থেকেই তো সুপ্রকাশ জীবন সংগ্রামের ভাষা আয়ত্ব করবে।’

অনেক দেরিতে শুভায়ু কিছুক্ষণের জন্য বিছানায় গড়াতে যায়। আর মনে মনে ভাবে ‘বাসনা বিসর্পিল নদী’র পাণ্ডুলিপিটা হারিয়েছে বটে কিন্তু গল্পটা তো হারিয়ে যায়নি।

 

চ্যাঁচানি পিসি

দালাল যেদিন আমায় ঘর দেখাতে নিয়ে যায়, সেই দিনই আমি চ্যাঁচানি পিসিকে দেখি। টাইমকল থেকে ছ্যারছ্যার করে জল পড়ছে। পাশে উবু হয়ে বসে তিনি বাসন মাজছেন। চটা উঠে যাওয়া সিমেন্টের চাতাল। একদিকে ডাঁই করা কাঠের ভাঙা তক্তা, প্লাস্টিকের বস্তা, মরচে ধরা আধখানা টিন, বইয়ের একগোছা ছেঁড়া পাতা, আরও কত কী। চাতালটার এখানে সেখানে ছিটিয়ে ছেতরে পড়ে রয়েছে পায়রার গু। দেখেই মন খারাপ হয়ে গিয়েছিল।

বাড়িটার বয়েস একশো বছর তো হবেই। যেখানে সেখানে পুলটিস মারা। দরজা দিয়ে ঢুকেই চোখেমুখে অন্ধকার জড়িয়ে যায়। সরু গলি। খানিকটা গিয়ে ডানহাতে সিঁড়ি। তার মুখে একটা বইয়ের দোকান। সেখানে আলো জ্বলছে। বাঁদিকের দোকানেও আলো। কিন্তু অন্ধকার এত বেশি যে মনে হয় যেন দোকানের ভেতরে মশারি খাটানো আছে। সেখানে আলো একেবারে জবুথবু অবস্থায় পড়ে আর বেরোনোর পথ পায়নি।

বাঁহাতি মোড় নিয়ে ডানদিকে ঘুরলেই ওই চাতাল। তার তিন কোণে তিনটে দোকান। বাসন মাজতে মাজতে পিসি চোখ তুলে আমাদের দিকে তাকিয়েছিলেন। ট্যারা চোখ। তার চেয়েও ধাক্বা লেগেছিল যেটা তা হল ওর পরনে একটা শুধু ফ্যাকাশে কামিজ। নীচে কিছু নেই। উবু হয়ে বসার ফলে কামিজের অনেকটা খসে গিয়ে রোগা পা দাবনা অব্দি দেখা যাচ্ছে। চোখ সরিয়ে নিতে নিতে খেয়াল হল একদম কিছু নেই তা নয়। একটা লাল রঙের ইজেরের খানিকটা উঁকি মারছে।

চাতালের পাশে সরু হাঁটাচলার জায়গাটা একটা খোলা কোলাপসিবল গেট টপকে আর একটা গলির রূপ ধারণ করেছে। আবার অন্ধকার। আরও একটা সিঁড়ি। কাঠের রেলিং ঘুরে ওপরে উঠেছে। এই ছোট গলিটা পেরিয়ে একফালি ফাঁকা জায়গা। সেখানে পাশাপাশি দুটো দোকানঘর। তার মধ্যে যেটা বন্ধ তার সামনে আমাকে ফেলে দালাল বলেছিল, দাঁড়ান, তালাটা খুলি।’

আমি বললাম, ‘এ কোথায় নিয়ে এলেন বলুন তো!’

সে ঘটাং ঘটাং করে ঠুকে তালা খুলে হড়হড় করে শাটার তুলতে তুলতে বলল, ‘বইপাড়ায় ঘর নিয়ে ব্যাবসা করতে গেলে ওসব ভাবলে চলবে? আপনার যা বাজেট তাতে এ যা দিচ্ছি, রাজা জিনিস বুঝলেন। যদি টিকে যেতে পারেন তাহলে এখান থেকেই মা লক্ষ্মী হাত ঝেড়ে দেবে। একটুকরো জায়গার জন্যে লোকে মাথা খুঁড়ছে। একবার নোঙর ফেলতে পারলেই হল। দোকানের ভেতরটা ভালো করে দেখুন। আশি স্কোয়ার ফুট। ফলস সিলিং করা আছে, ওপরে বই রাখতে পারবেন। সলিড একেবারে। ভাড়া কম, সেলামি কম, আর কী চাই?’

‘না আসলে এত ভেতরে তো, তাই।’

‘সামনে নিতে গেলে তো আপনার পড়তায় আসবে না দাদা। ফুটপাতের ধারের গুমটিগুলো দেখেছেন? পঞ্চাশ-ষাট স্কোয়ার ফুট– স্টাটিংই আছে সাত-আট লাখ থেকে। এখান থেকে লাগান না। কত এঁদো গলি থেকে বেরিয়ে রাজা-উজির হয়ে গেল সব। পঁচিশ বচ্ছর ধরে কলেজ স্ট্রিটে ব্রোকারি করছি। কম তো দেখলাম না।’

এদিকেও একটা সিঁড়ি আছে লাল সিমেন্টের। উঁচুতে তাকালাম। দোতলায় কতগুলো সাইনবোর্ড দেখা যাচ্ছে। তার মানে ওখানেও দোকান বা গোডাউন আছে। তিনতলার এদিকটায় জাল দিয়ে ঘেরা। বারান্দা হতে পারে। তার ওপরে আশি স্কোয়ার ফুটেরও কম মাপের আকাশ। দমচাপা লাগছিল সব মিলিয়ে। বললাম, ‘এখানে কি কোনও কাস্টমার আসবে? জায়গাটা যেন কেমন। ঢোকার মুখে আলো নেই, একজন কলতলায় বসে বাসন ধুচ্ছে–।’

দালাল এমন হাসল যেন আমি ছেলেমানুষি কথা বলছি। ‘ওঃ, চ্যাঁচানি পিসি? ওকে নিয়ে ভাববেন না। স্ক্রু ঢিলে আছে। ওই কলটা ওর। কলের পাশে যে-তিনটে দোকান– ওগুলো ওর ভাগে। যা ভাড়া পায় তাই দিয়ে চলে। বেশি পায় না যদিও। কবেকার ভাড়াটে সব। পিসি থাকে গলির ভেতরের দোতলায়। এ বাড়ির তিন শরিক। কারও সাথে কারও সম্পক্ব নেই। সামনের দিকেরগুলো যাদের তারা ওদিকেই তিনতলায় থাকে। এই বাড়িওলা থাকে এদিকের ওপরে। ঘর পছন্দ হলে বলুন, ডাইরেক্ট কথা বলিয়ে দিচ্ছি।’

ঘরটা নিয়ে নিয়েছিলাম। বাবার একটা বইয়ের দোকান ছিল। বইয়ের সঙ্গে লেখাপড়ার কাজে আসে এমন সব জিনিসও বিক্রি হতো। যেমন হয় আর কী। বয়েস হয়ে গিয়েছে, আর বসতে ভালো লাগছে না, এসব বলে বাবা আমাকে সেখানে ভিড়িয়ে দিল। সাত বছর ধরে আমি সেটাই চালিয়েছি। তবে এত ছোট ব্যাপারে মনটা আটকে থাকতে চাইছিল না। বই ঘাঁটতে আমার ভালো লাগে। ভাবলাম বই বানালে কেমন হয়। বছর দেড়েক হল নিজে একটা পাবলিকেশন খুলেছি। গল্প, উপন্যাস, ভ্রমণকাহিনি ছেপেছি, প্রবন্ধের বইও। কয়েকটা বইয়ের, কাগজে রিভিউ বেরোল। প্রকাশনার নাম জানল লোকে। কলেজ স্ট্রিট থেকে ফোনে অর্ডার হলে বই পৌঁছে দিতাম। ছোটদের বইয়ের কাটতি ভালো জেনে সেদিকেও যাব ভাবছিলাম। বাবাকে অনেক বলেকয়ে, বুঝিয়ে দোকানটা বিক্রি করে দিলাম। বাবার হাতে খানিকটা রেখে আমার হাতে কিছুটা পুঁজি এল। বিয়ে করেছি। ছেলে-বউ আছে। বউ একটা মন্টেসরি স্কুলে পড়ায়। আমার বেলায় পঁয়ত্রিশ পেরিয়ে পাল্লাটা ঝুঁকির দিকেই চলে গেল বেশি, কিন্তু তখনই ঠিক করেছিলাম এই ব্যাবসাটা কলেজ স্ট্রিটে বসেই করতে হবে। দালালের পিছন পিছন ঘুরে শেষে এই বাড়ি।

এখানে চ্যাঁচানি পিসির সঙ্গে আমার কথা হওয়ার কোনও দরকার ছিল না। দালাল বলেছিল ওকে নিয়ে ভাববেন না। কিন্তু না ভেবে রেহাই নেই। সত্যি বলতে কী ওকে দেখলেই হাত-পা চিড়বিড় করে। বারোটায় যখন দোকানে আসি তখন তিনি খাওয়াদাওয়া শেষ করে বাসন ধুচ্ছেন কলতলায়। বিকেল চারটেয় আবার জল আসে। পিসি থালা বাটি গেলাস হাঁড়ি কড়াই নিয়ে সেখানে হাজির। বাসন ধুচ্ছেন কলতলায়। শুধু বাসন নয়, নিজেকেও রগড়ে ধোবেন। একজন পঞ্চাশ-পঞ্চান্নর হাড়সর্বস্ব মহিলা সর্ব অঙ্গ ভিজিয়ে বইয়ের দোকানের মাঝখানের চাতালে বসে চান করছেন এ দৃশ্য যে কী শুকনো হতে পারে, তা টের পাই। যাওয়া আসার পথে দেখে মনে হয় আড়াল করে দাঁড়াই। কোনও খদ্দের যদি আসে এখন? কিংবা লেখক কেউ? লজ্জার একশেষ হবে। তখন ওরই ভাড়াটে এক দোকানদারের স্টাফ পাশ দিয়ে যেতে যেতে বলে যায়– ‘আহা মন্দাকিনী। রাজ কাপুর দেখে যেতে পেল না রে। রাম তেরি গঙ্গা মইলি হো গয়ি…।’

চ্যাঁচানি তো কারও নাম হতে পারে না। পিসির আসল নাম যে কী সেটা ওরই ভাড়াটে ডিএম পাবলিশার্সের মালিকের সঙ্গে একবার কথা বলতে গিয়ে জানলাম। বললেন, ‘ওর নাম লাবণি, লাবণি দত্ত। ভাড়ার রসিদে ওই নামেই সই করে। এখানকার ছেলেছোকরারা বলে চ্যাঁচানি পিসি। বলবে নাই বা কেন। অষ্টপ্রহর কিছু না কিছু নিয়ে চ্যাঁচাচ্ছে।’

সাবধানে বললাম, ‘উনি তো আপনাদের বাড়িওয়ালি। কিছু বলেন না কেন?’

‘কী আর বলব। যবে থেকে এসেছি তবে থেকে তো এই দেখছি।’

আমি চুপ করে গেলাম। এখানে আরও যারা আছে তারাও পুরোনো। পিসিকে কেউ সামনাসামনি কিছু বলে না। বলতে গেলেই চিৎকার। কেউ গলির ভেতরে ধপাস করে বইয়ের বস্তা নামাল। পিসি সঙ্গে সঙ্গে চেঁচিয়ে উঠবে– ‘অ্যাই কে? কে রে? গায়ের জোরে বস্তা ফেলেছিস! আস্তে আস্তে নামানো যায় না? এটা তোর বাবার বাড়ি নয় বুঝলি! একেই ওখানকার মেঝেটা ফেটে রয়েছে, তার মধ্যে ইচ্ছে করে বদমাইশি। সারাতে গেলে তুই পয়সা দিবি?’

আমি সব শুনি। তবে খেয়াল করে দেখেছি গলির মেঝের একটা জায়গা সত্যিই অনেকটা বসে গিয়েছে। পুরোনো বাড়ি। ধেড়ে ধেড়ে ইঁদুর ঘুরঘুর করে। ওরাই ফাঁকফোকর থেকে মাটি তুলে আলগা করে দিয়েছে। গলিটায় কোনও আলো নেই। অন্ধকারে কেউ কোনওদিনও পড়ে পা মচকাবে।

ডিএমের মালিক বলেছিলেন, ‘আপনার বাড়িওয়ালা প্রভাত দত্ত হল ওর দাদা, জ্যাঠার বড়ো ছেলে। বাড়ি ভাগাভাগি হয়েছে অনেকদিন। শুনেছি আগে থেকেই ঝামেলা চলছিল। যে যার অংশ বুঝে নেওয়ার পর থেকে তিন শরিকের মধ্যে কথাবার্তা বন্ধ। কেউ কারও খোঁজও নেয় না। এই চ্যাঁচানি পিসির বাপ-মা তো কবেই স্বর্গে রওনা দিয়েছে। থাকার মধ্যে আছে এক দিদি-জামাইবাবু। বছরে বারদুয়েক আসে ব্যারাকপুর থেকে। আসবেই বা কী করতে। সেখানে তারা সুখেই রয়েছে। দয়া যেটুকু করে, এর ভাগের দোকানগুলোর ভাড়ায় হাত দেয় না। বয়েসকালে বিয়ে-থা হয়নি। বিয়ে হওয়ার কথাও নয়। ওই তো চেহারার ছিরি। আগেও ভালো কিছু ছিল বলে মনে হয় না। একাই রাঁধেবাড়ে, খায়। একা থেকে থেকে মাথাটা গেছে আর কী। কথা বলার লোক পায় না। চ্যাঁচায়!’

আমি ভাবছিলাম ভাগ্যিস এই মহিলা আমার বাড়িওয়ালি নয়।

আমার দোকানে কোনও কর্মচারী নেই এখনও। এই কোম্পানিতে আমিই মালিক, আমিই শ্রমিক। বিক্রিবাটা তেমন জমেনি। তবু রিটেল কোনও কাউন্টার থেকে বইয়ের নাম লেখা স্লিপ এলে বই দিই। ফোনে বললে দৌড়ে গিয়ে বই পৌঁছে দিয়ে আসি। চালান লিখি, বিল কাটি, টাকা তুলে আনি। বিজ্ঞাপন দেখে, খুঁজেপেতে কাস্টমার আসে খুব কম। ওই কালো ঝুল গলি পেরিয়ে যারা এসে পৌঁছোয়, দেবতাজ্ঞানে তাদের সামলাই। যাদের বই রয়েছে সেই লেখকদের মধ্যে কেউ কেউ এসে পড়েন কখনও। আর টাকা নিয়ে বই ছাপিয়ে দেব কিনা জানতে বা কথা বলতেও আসেন দু-একজন। হ্যাঁ বলে দিয়েছি কয়েকজনকে। নইলে তো প্রেসে ধার ধারালো হয়ে উঠবে। আমি ধরে নিই যারা টাকা দেবে তারা আমার টেম্পোরারি পার্টনার। বাইরে চায়ের দোকান আছে। লোকজন এলে সেখানে গিয়ে বললে চা দিয়ে যায়, কিন্তু কেউ জল চাইলেই আমি সিঁটিয়ে যাই।

পাশের দোকানটা বর্ণলিপি পাবলিকেশন। মাঝবয়েসি কর্মচারী বসে থাকেন একজন। তিনিই বলেছিলেন, ‘খাওয়ার জল ওই কল থেকেই আপনাকে ভরতে হবে তমালবাবু। তবে খবরদার। পিসি যতক্ষণ কলতলায় থাকবে ততক্ষণ ওদিকের ধারও মাড়াবেন না। খালি দেখলেই বোতল নিয়ে দৌড়ুবেন। আমরাও তাই করি। নাহলে ও চিল্লিয়ে মাত করে দেবে একেবারে।’

তাও টের পেয়েছি অনেক দিন আগেই। বিকেলে কেউ জলের বোতল কলের মুখে বসালেই হল। সঙ্গে সঙ্গে চিৎকার– ‘অ্যাই, জল ভরছে কে? কার এত আস্পদ্দা! আমার এখনও বাসন ধোয়া বাকি।’

আসলে বাসন মাজা হয়ে গেছে। শুচিবাই থাকার ফলে উনি একই বাসন বারবার ধুতে থাকেন। এই সময় পিসিকে দেখা যায় না। শুধু তার কন্ঠস্বরটি দোতলার সিঁড়ি থেকে এমন করে নামতে থাকে যে ঝনঝনিয়ে বাসন গড়ালে তার চেয়ে মধুর শোনাত। কোনও কোনও দিন কলের সামনেই ওই চিৎকারে পায়রারা ভয় পেয়ে উড়ে যায় ঘুলঘুলি কী কার্নিশ থেকে। ঝগড়ার রেওয়াজি গলা ছাড়া এ সম্ভব নয়।

আমার দোকানঘরের সামনে দাঁড়িয়ে একজন একদিন আঁতকে উঠলেন। চুঁচড়ো থেকে বই নিতে এসেছেন। কখনওসখনও মফসসলের দোকানিরা বা তাদের লোক আসে আমার এখানে। পিসিকে তাদের চেনার কথা নয়। তিনি বললেন, ‘কোথাও কি গোলমাল হচ্ছে কিছু? দেখে আসবেন একবার?’

আমি বললাম, ‘তেমন কিছু নয়। ওই জল ভরা নিয়ে–।’

‘সে কী! কাজের জায়গায় এরকম চ্যাঁচামেচি হলে তো মুশকিল। বিজনেস করবেন কী করে? একে তো বাড়ির বাইরে আপনাদের কোনও সাইনবোর্ড নেই, খুঁজে খুঁজে টাইম কাবার। তার ওপর–। আর জায়গা পেলেন না!’

চুপ করে থাকি। হাসি দিয়ে বিজনেস সামলাবার চেষ্টা করি। তবে এও দেখেছি, পিসি যখন কলতলায় গিয়ে বসে, সেই সময়টি বেছে নিয়ে এখানকার দোকানের কয়েকজন আধ ডজন বোতল হাতে হাজির হয়। তারা পিসির ওই গলাবাজির চোটপাট চেটে চেটে খেতে চায়। হ্যা হ্যা করে হাসে। বোতল বসানোর ছুতোয় বাসন ছুঁয়ে দিতে চায়, বোতলের তলানি জল ছুড়ে দিতে চায় পিসির গায়ে। তিনিও চ্যাঁচাতে থাকেন– ‘যাও, যাও বলছি, দূর হয়ে যাও এখান থেকে। জেনেশুনে পেছনে লাগা, না! আবার দাঁত ক্যালানো হচ্ছে? শয়তান বদমাইশের দল, মেরে হাত ভেঙে দোব একদম বলে দিচ্ছি।’

আমার বাড়িওলা পীযূষ দত্তকে দেখেছি কখনও এরকম ঘটনার মধ্যে পড়ে গেলেও তিনি পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছেন। বোনের হয়ে দুটো কথা বললে হয়তো থামত। থামে না।

একদিন জল ভরতে গিয়ে দেখলাম কলে লাল বালতি, বাসনের পাঁজা। না বলে জল নেওয়া যাবে না। পিসি দোতলায় তার ঘরে আছে ভেবে ওপরে উঠলাম।

একটা পাঁচিল গেঁথে আমাদের ওদিকটা থেকে এদিকটা আলাদা করা আছে। লালচে ইটের দাঁতকপাটি বেরিয়ে পড়েছে সে পাঁচিলের। পাশে সিমেন্টের একটা খিলানের অর্ধেক। বৃষ্টির জল পড়ে শ্যাওলায় আঁকা নকশা ফুটেছে তার শরীরে। কত কাণ্ড করে যে বাড়িটা ভেঙে ভাগ করেছে এরা। সিঁড়ির যেখানে আমি দাঁড়িয়ে তাতে আমার নাকের প্রায় ডগায় শোয়ানো একটা মেঝে। লোহার শিক লাগানো কাঠের রেলিং। অর্থাৎ এটা দোতলার ভেতরের বারান্দা। একটা বেড়াল থাবায় মুখ নামিয়ে বসে আছে। এককোণে একটা স্টোভ, কেরোসিন তেলের জার, কাঠের ডাঁটির একটা বড়ো ছাতা দেয়ালে হেলান দিয়ে, সিলিঙের কড়িবরগা থেকে দড়ি বাঁধা একটা হ্যারিকেন ঝুলছে, রেলিঙের খুঁটি থেকে দেয়ালের পেরেকে টাঙানো আর একটা দড়িতে এলিয়ে রয়েছে কয়েকটা ময়লা কাপড়, সেই দেয়ালেই লোহার ব্র্যাকেটে বাল্ব, দরজার পাশের দেয়ালে বাঁধানো ছবিতে উলটে আঁচড়ানো চুলে এক পুরুষ। চৌকো চোয়াল। সাদা-কালো ছবি হলদেটে হয়ে গেছে। মনে হচ্ছিল সব মিলিয়ে মৃণাল সেনের সিনেমার কোনও স্টিল ফ্রেম দেখছি। এমন সময় সেই ফ্রেমের ভেতর থেকে বেড়ালটা মুখ তুলে ডেকে উঠল– মিঁউ।

‘কী ব্যাপার? এখানে এসেছেন কেন?’

দরজায় আধময়লা কামিজ উঁকি দিয়েছে। বললাম, ‘আমার ওখানে একদম জল নেই। একটা বোতল যদি ভরে নেওয়া যেত।’

‘আপনি কি আমার পারমিশন নিতে এসছেন?’

‘হ্যাঁ।’

খোলা ঠোঁটদুটো টপ করে নেমে এসে কেমন গুম ধরে গেল মুখে। উনি কামিজের দু’পাশের চেরা জায়গা দু’হাতে চেপে ধরলেন। তারপর বললেন, ‘যান, নিয়ে নিন জল।’

‘আপনার জিনিসপত্র সব ওখানে রয়েছে। সরাতে গেলে হাত ছোঁয়াতে হবে।’

‘বললাম তো ভরে নিন। সরিয়ে দিন ওগুলো।’

কী মনে হল, সেই ছবিটার দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘ওটা কি আপনার বাবার ছবি?’

‘হ্যাঁ, কেন?’

‘না এমনি। তাই মনে হচ্ছিল। ঘরের ভেতরে রাখলে পারতেন।’

‘ঘরে অন্ধকার।’

অদ্ভুত যুক্তি। আমি আর কিছু না বলে ফিরে আসছিলাম। তখন উনি বললেন, ‘জল নেওয়ার জন্য আমাকে বলতে আসতে হবে না। আপনার যখন দরকার নিয়ে নেবেন।’

আমি নেমে জল ভরে নিয়ে এসে কাউন্টারে বসি। বাইরে কত লোক, বই বোঝাই রিকশা ভ্যান, দোকান উপচে রাস্তায় বই, হাঁকাহাঁকি, হাত ধরে টানাটানি– কী বই লাগবে বলুন। আর এই জায়গাটা ঘুমন্ত পুরী। এরকম রোজই। বৃষ্টিতে, রোদ্দুরে, শীতে ভিজে ভিজে।

এক একদিন বসে বসে ঝিম ধরে যায়, চোখের পাতা নেমে আসে। তখন ওই রাজকন্যের চিৎকারে চটকা ভাঙে। সিগারেট ধরাই। ভাবি আরও কয়েকটা কাউন্টারে বই বিক্রির ব্যবস্থা করতে হবে, লাইব্রেরিতে ক্যাটালগ পাঠাতে হবে, বাংলাদেশের অর্ডার পেতে হবে। পারব কি আমি? দোকানের ভাড়া, সেই সাউথ থেকে মেট্রোয় যাওয়া-আসার খরচ, ইলেকট্রিকের বিল। মাত্র তেরোটা বই নিয়ে এখানে জায়গা হাঁকিয়ে বসাটা বোধহয় ঠিক হয়নি। এই বাড়িটায় সব টেক্সট বইয়ের দোকান। সেখানে আমার পাবলিকেশনের বই মেলানো যাবে না। যাদের সঙ্গে মেলানো যায় তারা তো রথী-মহারথী। কম্পিটিশন তো দূরের কথা, টিকে থাকতে পারব কিনা সেই সন্দেহই চোঁয়া ঢেকুর হয়ে উঠে আসছে এই কয়েক মাসে। বড়ো লেখকদের বই পেতে গেলে অনেক টাকা দিতে হয়। বই ভালো করে ছাপতে গেলেও খরচ বেশি। বেশি ছাপলে খরচ কমে কিন্তু আমার দৌড় তিনশো কী পাঁচশো। লাইব্রেরি নামি প্রকাশকদের বই কেনে, বাংলাদেশের অর্ডারও তাই, কলকাতার বাইরে থেকে কদাচিৎ কেউ কিনতে আসে। এত কিছু আগে বুঝিনি। এখানে এসে মালুম হচ্ছে। আমার বউয়ের স্কুলে পড়ানোর ভরসায় তো এখানে আসিনি আমি। নিজেই নিজের দোকানের ছোট্ট সাইনবোর্ডটার দিকে তাকিয়ে থাকি। কায়দা করে পাবলিকেশনের নাম দিয়েছি ‘সোনার তরী’। শেষে ডুববে না তো?

এসব ভাবতে ভাবতে কোনও দিন ঘটাং করে আওয়াজ শুনে পিছন ফিরে দেখি পাশের গোডাউন থেকে বই বের করতে এসেছে কেউ। দুটো ছেলে। এরা যে– দোকানে কাজ করে সেটা রাস্তার ওপরে। ওরা নিজেদের মধ্যে কথা বলছে। বলছে মানে প্রত্যেক কথার আগে পরে একটা করে খিস্তি। বাংলা ভাষাকে উদার প্রমাণ করতে এসব আমরা আপন করে নিয়েছি। কোনও শ্রেণিবৈষম্য নেই। বলার স্বাধীনতা আছে, না শোনার স্বাধীনতা নেই। তাই খিস্তি হজম করছিলাম। ঠিক তখন ওপর থেকে চেঁচিয়ে উঠলেন পিসি। ‘অ্যাই কে রে? তপন, না? এখানে দাঁড়িয়ে আবার নোংরা কথা বলছিস! ওসব এখানে চলবে না।’

তপন ছেলেটি মুখ তুলে বারান্দায় তাকাল। ‘তোমার ওখানে তো নেই পিসি আমি। এ তো আমাদের বাড়িওলার এরিয়া। আমি এপারে রয়েছি।’

এবার আরও জোরে চিৎকার ধেয়ে এল। ‘খারাপ কথার আবার এপার-ওপার কী অ্যাঁ! বেশি ওস্তাদ হয়েছ, না। বই বিক্রি করিস, সে তো বিদ্যের জিনিস রে, গালাগাল দিতে লজ্জা করে না!’

তপন পাশের ছেলেটার দিকে তাকিয়ে চোখ মটকে হাসল। গলা নামিয়ে বলল, ‘বহুত ঢেমনি এই বুড়িটা, দেখবি একটা মজা?’

মোবাইলে খুটখাট করছে তপন। একবার আড়চোখে আমাকে দেখল। তারপর গান বেজে উঠল ফোনে। ও মধু… ও মধু… আই লাভ ইউ… আই লাভ ইউ…। সঙ্গে তপনের খিক খিক হাসি।

আমি ভাবছিলাম, পিসির তো এতদিনে জেনে যাওয়া উচিত ছিল যে বই বিক্রি হয় বলেই বইপাড়ায় সকলে সাধুভাষায় কথা বলবে না। হতে পারে একদিন বিদ্যাসাগর সংস্কৃত কলেজের প্রিন্সিপালের চাকরি ছেড়ে দিয়ে কলেজ স্ট্রিটেই বইয়ের দোকান খুলে বসেছিলেন। কিন্তু এখন বই এখানে একটা প্রোডাক্ট। বাংলা ভাষায় যাকে বলে মাল।

হঠাৎ চমকে উঠলাম আমি। তপন ও অন্য ছেলেটিও অবাক হয়ে গেছে। দোতলায় অন্ধকার বারান্দা থেকে আর চিৎকার নয়, গান ভেসে আসছে। ‘দূরদেশি সেই রাখাল ছেলে… আমারে বাটের বটের ছায়ায়… সারাটা দিন গেল খেলে…।’ গলা খ্যানখ্যানে, সুর কিছু এলোমেলো কিন্তু ওটা গানই।

তপন কাঁধ ঝাঁকাল। ‘কী গো পিসি, এ আবার কী শুরু করলে?’

গান থামল। ‘কেন, তুই গান বাজাচ্ছিস, আমি গান গাইছি। কী অসুবিধে?’

‘আরে আমারটা শোনো, শরীর চাঙ্গা হয়ে যাবে।’

‘আরে তুই আমারটা শোন, তোর মন ভাল হয়ে যাবে। দূরদেশি সেই রাখাল ছেলে…।’

অন্য ছেলেটি এবার তপনকে বলল, ‘চল চল মাল ওঠা। সব পাগলের কারবার এখানে।’

লাবণি দত্ত থামেননি। পুরোটাই গাইলেন।

অনেক দিন পর গানটা শুনতে পেলাম। মাঠে ফুটবল পিটিয়ে বাড়ি ফেরার পথে সন্ধেবেলা কাদের বাড়িতে যেন হারমোনিয়ামে বাজত এই গান। আজ এই পুরনো ভাঙা ছায়াময় বাড়িটাতে যেন ঘুরে ঘুরে ভেসে ভেসে একটা কোনও ঝরা পাতা হয়ে গানটা নেমে আসে।

পরের মাসে বাড়িওলার কাছে ভাড়া দিতে গিয়ে বললাম, ‘আমাদের দোকানের আগে যে– প্যাসেজটা, সেটা বড্ড অন্ধকার। অনেকে ওটা দেখে ওখান থেকেই ফিরে যায়, একটা আলো লাগানো গেলে…।’

পীযূষ দত্ত টাকা গুনতে গুনতে বললেন, ‘ও বাবা, ও ব্যাপারে আমি কিছু করতে পারব না। আপনি লাবুকে, মানে আমার বোনকে বলে দেখতে পারেন। ওটা তো ওর অংশ। যদি রাজি হয়–। তবে আপনার পাশের বর্ণলিপি আগে বলেছিল শুনেছি, হয়নি।’

আমি নেমে এলাম। আলোটা লাগানো খুবই দরকার। ন’মাস হয়ে গেল এখানে এসেছি। কাউকে বলে দিলেও জায়গাটা চিনে আসতে পারে না। সন্ধে নেমে এলে তো কথাই নেই, দিনের বেলাতেও এরকম ঘটে। এ তল্লাটের অনেক বাড়ির ভেতরেই খুপরি দোকানঘর আর অফিস রয়েছে। তারা কী করে ম্যানেজ করে জানি না। আমাকে আমার ব্যাবসার কথা ভাবতে হবে।

খাওয়া শেষে, বাসন ধোওয়ার পর, দুপুর একটা নাগাদ পিসি বাড়ির একেবারে বাইরের দরজার মুখে রোয়াকটায় গিয়ে বসে থাকেন। রোজকার ব্যাপার। ভাবলাম তখনই গিয়ে আলোর কথাটা বলব। গিয়েছিলাম, কিন্তু বলা হল না। দেখি পিসি ডান হাতে চড় তোলার ভঙ্গিতে খালি পায়ে রাস্তায় নেমে ছুটছেন। সামনে দু-তিনটে দামড়া লোকও খ্যাক খ্যাক করে হাসতে হাসতে এঁকেবেঁকে ছুটে পালাচ্ছে। তাদের কেউই এ বাড়ির কোনও দোকানের লোক নয়। বাইরের। হয়তো কাস্টমার নেই কোনও, কাজ নেই অন্য, তাই সময় কাটাতে পিসিকে বেছে নিয়েছে ওরা। পিসি চেঁচাচ্ছেন– ‘এক চড়ে মাথা ভেঙে দোব। অসভ্য কোথাকার। বাড়িতে মা-বোন নেই তোমাদের?’

টানা রিকশাওলা, অন্য দোকানদার, রাস্তার লোক, ভ্যানওলারা রগড় দেখছে। আমি পা চালিয়ে পিসির সামনে গিয়ে রাস্তা আটকালাম। খানিকটা ধমকেই বলে ফেললাম, ‘এটা কী করছেন আপনি? কেন দৌড়াচ্ছেন এভাবে?’

পিসি থতমত হয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছেন। হাতটা নামিয়ে নিয়ে বললেন, ‘কী বাজে বাজে কথা বলছে ওরা, জানেন না আপনি। কাউকে কিছু বলি না, চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকি, তাও ইচ্ছে করে আমায় খোঁচাবে। পিছনে লাগবে।’

বললাম, ‘ওরা তো চায় আপনিও রেগে গিয়ে ওদের বাজে কথা বলুন। তাতেই মজা। আপনিও সব ভুলে ওদের পিছনে ছুটবেন! চলুন, এক্ষুনি ফিরে চলুন। আসুন আমার সঙ্গে। আপনিই না সেদিন গান গাইছিলেন!’

ট্যারা চোখ রাস্তার দিকে রেখে, কামিজটা সেই দু’হাতে চেপে ধরে আমার সামনে সামনে হেঁটে বাড়ির ভেতরে ঢুকে পড়লেন তিনি। আরও কিছুটা ধমক দিয়ে বললাম, ‘এটা কী পরে থাকেন আপনি! আর কিছু নেই আপনার?’

বোধহয় চ্যাঁচাতে গিয়ে কষ জমেছিল। সিঁড়ি বেয়ে ওঠার মুখে পিসি হাত দিয়ে ঠোঁট মুছলেন। আমি দোকানে বসতে যাচ্ছিলাম। উনি বললেন, ‘আপনি ওখানে কেন গেছিলেন?’

মাথা নাড়ালাম। ‘আমি আপনার কাছেই যাচ্ছিলাম। আর সেকথা বলে কী হবে।’

‘কী কথা? বলুন।’

‘এই প্যাসেজটায় যদি একটা আলো লাগাতে দিতেন। লোকজন আসা-যাওয়ায় সুবিধে হতো একটু। আপনার ভাড়াটেদের তো এই সমস্যা ভোগ করতে হয় না।’

গলার স্বর হালকা হয়ে উঠে যাচ্ছে ওপরে। শুনতে পেলাম উনি বলছেন, ‘লাইট কিনে নিয়ে আসুন। লাগাবে কে? মিস্ত্রিকে ডাকুন। জানেন কোথায় পাবেন? বেরিয়ে দেখুন ভারবি পাবলিশার্স কোথায়। ওই বাড়ির একদম শেষমাথায় বাপ-ছেলে থাকে, ইলেকট্রিকের কাজ করে। বলবেন চ্যাঁচানি পিসির বাড়ি। ঠিক চলে আসবে।’

আলো লাগানো হল। গলির অন্ধকারটা ছিঁড়ে গেল। যদিও তাতে আমার কতদূর কী সুবিধে হবে বোঝা যাচ্ছিল না। বাড়িতে বউয়ের সঙ্গে কথা বললাম কয়েকদিন পর। শ্রাবন্তী বলল, ‘বাবার বইয়ের দোকানটা তবু ছিল, সেটাও বিক্রি করলে। কী যে তোমার মাথায় চাপল! বাবা-মাও এই নিয়ে বলতে ছাড়ছে না। বলারই কথা। এখন যদি ব্যাবসাটা না দাঁড়ায় তাহলে কী হবে?’

বললাম, ‘সেই তো ভাবছি। আমি তো খারাপ বই করিনি। কিন্তু বিক্রি তেমন হচ্ছে না। এ ব্যাবসায় ইনভেস্টমেন্ট বেশি, রিটার্ন এত স্লো! আরও যে বই করব, ফান্ডই তো জমছে না। কলেজ স্ট্রিটে গিয়ে না পড়ে তো বুঝতে পারিনি। তাছাড়া বাজারও খুব খারাপ। দেখি। তেমন বুঝলে সব বিক্রি করে চলে আসতে হবে।’

শ্রাবন্তী আবার বলল, ‘মাস গেলে টাকা তো লাগে সংসারে। সেটা যদি না আসে, চলবে কী করে?’

দোকানে বসে শ্রাবন্তীর কথাগুলোই ভাবছিলাম। তিন-চারজন এসে দাঁড়াল কাউন্টারের সামনে। ‘এটা নতুন হয়েছে, না? মালিক কোথায়?’

চিনি না এদের, তবে কাস্টমার যে নয় তা বোঝাই যাচ্ছে। বললাম, ‘বলুন কী ব্যাপার?’

‘ব্যাপার কিছু না, দুর্গা পুজোর ডোনেশান। এই পাশের গলি। পাশশো টাকা।’

‘পাঁচশো!’ চমকে উঠি। ‘এত তো আমি পারব না দাদা।’

‘না বলবেন না। নতুন বলেই দিতে হবে, পুরানো হলে দেখবেন অ্যামাউন্টটা কমে ফিক্স হয়ে গেছে।’

‘অ্যাই কে রে? চাঁদা চাইতে এসেছে কারা? কোন পুজো?’

একজন মুখ তুলে জায়গামতোই তাকাল। ‘আমরা পিসি। মুখটা বাড়াও। চিনতে পারবে।’

পিসি তরতর করে নেমে এলেন। ‘ওনার কাছে বেশি নিতে পারবে না তোমরা। একশো টাকা নিয়ে বিদেয় হও।’

‘কী বলছ পিসি! একশো টাকায় কী হয়?’

‘যা বলছি শোনো। ওতে যা হয় তাই হওয়াও।’ বলে তিনি চোখ দুটো আমার দিকে রাখার চেষ্টা করছিলেন। ‘আপনি এর বেশি দেবেন না কিন্তু।’

‘আঃ পিসি, এমন কেলোর কীত্তি করো না মাঝে মাঝে। কিছু বলতে গেলেই তো আবার চ্যাঁচাবে।’ বলতে বলতে ওরা বিলের পাতা ছিঁড়ল। ‘আর কী হবে, দিন ওই একশো। সিনিয়র সিটিজেনের কথা রাখলাম।’

ওরা চলে যাওয়া অবধি পিসি দাঁড়িয়েই রইলেন। তারপর আমায় বললেন, ‘কলেজ স্ট্রিটে ব্যাবসা করতে এসেছেন তো। অনেক কিছু দেখতে হবে।’

চেয়ারে বসে পড়েছি। ভালো লাগছিল না এসব। তবু বললাম, ‘ব্যাবসাটা যদি ঠিকঠাক হতো, তাও না হয় দেখতাম। এখন তো ভাবছি কেন এলাম।’

পিসি মুখটা গলির দিকে ফিরিয়ে নিলেন। ‘এই বই ছাপার ব্যাবসা তো আপনার বাপ-ঠাকুদ্দার নয়।’

‘না, কেন বলুন তো?’

‘আমি সেই জ্ঞান হওয়া থেকে এসব দেখছি বুঝলেন। কত পাবলিশার এ বাড়িতে এল আর গেল। আমার বাবাও প্রকাশক ছিল, জানেন? পড়ার বই নয়, গল্প-উপন্যাস-কবিতা এসব ছাপত। কত লেখক এসেছেন তখন। পয়লা বৈশাখে বই বেরোত। কিন্তু বাবা শেষ অবধি পেরে ওঠেনি। এখন যেটা যূথিকা প্রকাশনীর ঘর, ওটাই আমাদের কাউন্টার ছিল। পরে তিনটে ঘরই এক এক করে ভাড়া দিয়ে দিল। বাবা বলত ছোটো প্রকাশকের ব্যাবসা করা খুব কঠিন। পাট তুলে দিল। বইগুলো উইয়ে খেল। আপনি পারবেন তো?’

আমি বললাম, ‘এত ভেতরে বসে বসে কী করতে পারব তাই ভাবছি। বাইরে একটা বোর্ড অবধি নেই যে কেউ নাম দেখে ঢুকবে?’

পিসি বললেন, ‘আপনার খুব চিন্তা হচ্ছে, না? থাকতে থাকতে লোকে জেনে যাবে ঠিক। খুঁজে খুঁজে আসবে দেখবেন। এই তো গলিতে আলো লাগালেন, সামনের দিকে আমাদের যে শরিক থাকে ওরা আপনাকে বোর্ড দিতে দেবে না। আমি তো দুপুরবেলা আর সন্ধেবেলা বাইরে দাঁড়িয়ে থাকি, কেউ জিজ্ঞেস করলে দেখিয়ে দেব– এই দিকে সোনার তরী। আপনি ভালো ভালো বই করুন। বিক্রি বাড়ানোর বুদ্ধি বের করুন। আমার বাবার মতো হবেন না। পালিয়ে গেলে কিছু করতে পারবেন না। আর শুনুন, আমার আর এবেলা কলে কাজ নেই। যান জল ভরে নিন।’

আমি অবাক হওয়াটা ঝেড়ে ফেলতে পারছিলাম না। তার মধ্যেই পিসি চলে গেলেন। একটু পরেই শুনতে পেলাম দোতলার সেই বারান্দা থেকে ভাঙা গলার গান ভেসে আসছে। ‘এই আকাশে… আমার মুক্তি আলোয় আলোয়…।’

আমি কাউন্টার ছেড়ে দোকানের সামনের ছোট্ট জায়গাটায় দাঁড়াই। ওপরে তাকিয়ে ফালি আকাশটা দেখি। একঝলক চোখে পড়ে, একটা পায়রা পাকসাট দিচ্ছে। ওখান থেকে কোনও পক্ষীরাজ ঘোড়া উড়ে এসে নামবে না আমার জন্য। কিন্তু আমি যতটুকু দেখতে পাচ্ছি আকাশ তো ততটুকু নয়। খামোখা পালাতে যাব কেন?

 

দেব ও কার্তিক

একটু আগেই রংচটা ক্ষয়াটে মোবাইলটায় কেসের খবর এল। শেষ টানটা দিয়ে ভসভস করে নাকমুখ দিয়ে ধোঁয়া ছাড়ল কার্তিক। চোখ বুজে কয়েক মিনিট বসে রইল। ধুনকিটা মাথায় ঠেলছে। বেশ আরাম। এবার ওঠা যেতে পারে। কলকেটা উপুড় করে ছাইটুকু মাটিতে ফেলল, তারপর পেল্লায় একটা হাই তুলে রয়েসয়ে নিজের সাইকেল ভ্যানটার কাছে গেল। ভ্যানের চেহারাও কার্তিকের মতোই। একেবারে খ্যাঁচাখোঁচা। মাঝরাস্তায় ফেলে দিয়ে আসলে চোরেও ছুঁয়ে দেখবে না, উলটে সারানোর পয়সা রেখে যেতে পারে। মাডগার্ড নেই, ঢিলে চেন বারবার পড়ে যায়। চাকার টায়ারে কার্তিকের বয়েসের থেকে বেশি গ্যাটিস মারা। তিনটে রিঙেই টাল রয়েছে। লগবগ করতে থাকে চালানোর সময়। মনে হয় বুঝি চাকাগুলো খসে গেল। ব্রেক নামকা ওয়াস্তে। ইচ্ছে হলে ধরে, কখনও ধরে না। হর্নের আওয়াজ ডিম ফুটে বেরোনো চড়ুইয়ের মতো। ভ্যানের তক্তাগুলো সব ঢিলে হওয়ার কারণে হর্ন দিতে লাগে না। গাড়ি চললে তার বিচিত্র আওয়াজে লোকে এমনিই বুঝতে পারে পিছন থেকে কিছু একটা আসছে। তার সঙ্গে কার্তিক মাঝেমধ্যেই মুখে হুই হুইইইইই করে শব্দ করে হর্নের বদলে। কিন্তু এই ভ্যানটা আছে বলেই না কার্তিকের গাঁজার পয়সা ছাড়াও পেটে কিছুটা চাল, ডাল, তেল পড়ার পয়সা জোটে।

আসলে কার্তিকের বুদ্ধি কম। আর যাদের বুদ্ধি কম, তাদের অনুভূতিও কম। সুতরাং কার্তিকের অনুভূতিটুতি সেই ছোটোবেলা থেকেই একটু ফিকে। বাবা-মা, ভাই-বোন, বেয়াই, মুনাই, জগাই-মাধাই সব হারিয়ে বত্রিশ বছর বয়েসের কার্তিক একেবারেই একা। হদিশপুরের ফরালপট্টি নামের একটা আধা গ্রাম মার্কা মফসসল পাড়ার একেবারে শেষপ্রান্তে, বাঁশবাগান শুরুর মুখে ও থাকে। ওর সঙ্গে থাকে শুধু এই ভ্যানটা আর একচিলতে জমির ওপর টালির ছাউনি দেওয়া ছিটেবেড়ার এক ঘুপচি ঘর। ঘরের এককোণে একটা নড়বড়ে পায়ার খাটিয়া, খাটিয়ার তেলচিটে বালিশের তলায় রগরগে ল্যাংটো মেয়ের ছবিওলা খাস্তা হয়ে যাওয়া দুটো ছবির বই। নারকোলের দড়িতে ঝোলানো কয়েকটা জামা প্যান্ট, লুঙ্গি। অন্য কোণে জনতা স্টোভ, কুচকুচে কালো হাঁড়ি, কড়াই, বাটি, খুন্তি আর থালা। ব্যস কার্তিকের সংসার কমপ্লিট।

উঠোন থেকে ভ্যানটা বাইরে এনে সিটে চেপে বসে লগবগ করতে করতে চলল কার্তিক। ওর গন্তব্য এখন হদিশপুর রেলস্টেশন। আজ আবার একটা কেস ঘটেছে। কেস শব্দটা কার্তিক শিখেছে জিআরপি-র কাছ থেকে। এখন শব্দটা ওর মনেও সেঁটে গেছে। কারণ কেস মানেই পয়সা। বেশ ভালো পয়সা।

আসলে হদিশপুর, মোল্লাবাজার আর ভাঙনহাটি এই তিনটে রেলস্টেশনের মধ্যে যদি কেউ লাইনে কাটা পড়ে কিংবা গলা দেয় তাহলে সেই বডি হদিশপুর মর্গে পৌঁছানোর দায়িত্ব কার্তিকের। জিআরপি-র লোক বডি কাপড়, প্লাস্টিক দিয়ে মুড়ে দেয়। তারপর সেটাকে ভ্যানে চাপিয়ে মর্গে জমা দেওয়া পর্যন্ত কার্তিকের কাজ। সাত বচ্ছর হয়ে গেল এই কাজে। তার আগে ওই ভ্যানে করেই পাড়ার বাড়িতে বাড়িতে কাঁচাসবজি বেচত। কিন্তু বুদ্ধি কম থাকলে আর যাই হোক ব্যাবসা হয় না। কার্তিকেরও হল না। খদ্দেররা প্রায় সবাই ঠকাত কিংবা পরে দাম দেব বলে আর কেউ দিত না। ব্যাবসা লাটে। তারপর কিছুদিন স্টেশনের সামনে নাড়ুর মুরগির দোকানে মুরগি ছাড়ানোর কাজ করল। সেটাও হল না, একদিন তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে মুরগির গলার সঙ্গে নিজের ডানহাতের আঙুলটাও নামিয়ে ফেলল বটিতে। ছেড়ে দিল কাজ। শেষে পাড়ার বন্ধু শ্যামল বাঁচাল। বলল, ‘দেখ ভাই, ভগবান তোর ঘটে ছাগলের নাদির সাইজেরও ঘি দেয়নি। সুতরাং ওসব ব্যাবসা ফ্যাবসা তোর দ্বারা হবে না। বরং আমার খোঁজে একটা কাজ আছে করবি?’

এই কাজ প্রথম দিকে করতে জান বেরিয়ে যেত, ঘেন্নায়, ভয়ে। ভেবেছিল ছেড়ে দেবে। কিন্তু শালা খিদের ভয় এত মারাত্মক যে…। শ্যামল বলল, ‘খবরদার কাজটা ছাড়িস না। এটা কিন্তু হাফ সরকারি চাকরি। তোকে কেউ কোনওদিনও ছাড়াবে না। আর ঠাকুরের আশীর্বাদে কাটা পড়া, গলা দেওয়ার কেস তো দিনে দিনে বাড়ছে বৈ কমছে না। তুই না খেয়ে থাকলে কেউ দুবেলা ভাত দেবে না। প্রথমদিকে এট্টু চাপ যাবে, তারপর সয়ে যাবে দেখবি। আরেকটা জিনিস শিখিয়ে দিচ্ছি। সেটা করে বেরোবি, একটুও পবলেম হবে না আর। সেই জিনিসটা হল মহাদেবের প্রসাদ। মাথায় ঠেকিয়ে টানতে হয়।’

কার্তিক শিখে নিল কীভাবে কলকে ধরতে হয়, মশলা ঠুসতে হয়, ছিলিম টানতে হয়। বুকের খাঁচায় আপ্রাণ ধোঁয়া নিয়ে বমকে চেপে রেখে তারপর ভুসভুস করে ছাড়তে হয়। সত্যি সত্যি,

চার-পাঁচ টান দিয়ে কাজে নামলে আর কোনও ঘেন্না, ভয় লাগত না। তবে নেশাটা বেড়ে গেল অনেকটাই। ফলে শরীরটা দড়ি পাকিয়ে দু-টাকা প্যাকেটের কালো আমলকির মতো হয়ে গেল। সে হোক গে। যে ক’দিন বাঁচতে হবে দুবেলা খেতে পেলেই হল, শরীর দিয়ে কী হবে? বিয়ে থা তো আর এজন্মে হবে না।

টিপিকাল গেঁয়ো মফসসলের ঘেয়ো রাস্তার ওপর দিয়ে লটবহর নিয়ে ভ্যান চালাতে চালাতে আকাশের দিকে দেখল কার্তিক। ভাদ্র মাসের বিকেল চারটে। আজ সারাদিন খুব গুমোট। দরদরিয়ে ঘাম হচ্ছে। বৃষ্টি হলে ভালো হয়। হবে কি?

আরও খানিকটা এগোনোর পর মেন রাস্তাতেই চলচিত্রম সিনেমা হলের সামনে ভ্যান সমেত থমকে গেল ও। হেব্বি চমকে গেল। উরেশশাললাহ– গুরুর বই চলছে! প্রায় মাসখানেক হল ভাঙনহাটিতে কোনও কেস হয়নি বলে আসা হয়নি। তাই জানাও ছিল না যে গুরুর বই দিয়েছে এখন। দেবকে মনে মনে গুরু মানে কার্তিক। শালা যেমন ফিগার আর তেমনি ঝাড়পিট করতে পারে। মিঠুনের পর এমন ঝাড়পিট আর কেউ পেরেছে? সিনেমা হলের দেয়ালে বিশাল বড়ো দেবের পোস্টার। রক্তমাখা দেব একটা মেয়েছেলের বডি কোলে নিয়ে চিৎকার মারছে। মেয়েছেলেটা কি নায়িকা? মরে গেছে? হেব্বি অ্যাকশন হবে নিশ্চয়ই। ইশশ কতদিন গুরুর বই দেখা হয়নি। কাউন্টারের সামনে তেমন ভিড় নেই। তার মানে হপ্তাখানেক নিশ্চয়ই পেরিয়ে গেছে বইটা।

দেবের প্রচুর বই দেখেছে কার্তিক। আর যেদিনই দেখেছে সেদিনই ওর গাঁজার ধোঁয়ামাখানো ঘিলুতে রাত্তিরে ভর করেছে দেব। ঘরের এককোণে বাঁশের খুঁটিতে ঝোলানো এই টুকুন একটা ঘষা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে লম্পর আলোয় একা একা দেব সেজে কম ঝাড়পিট করেছে গুন্ডাদের সঙ্গে? কচুকাটা করেছে সবক’টাকে। কখনও দুহাতে বন্দুক ঘুরিয়ে কখনও তলোয়ার ঘুরিয়ে। তারপর কোয়েল, শ্রাবন্তী, মুমতাজ, নুসরতের সঙ্গে নেচেছে। নাচতে নাচতে কিংবা অ্যাকশন করতে করতে কখন যে মাটিতে ঘুমিয়ে পড়েছে নিজেরও খেয়াল থাকেনি। বাংলার একনম্বর হিরো হল দেব। ওর ঘরের ছিটেবেড়ার দেয়ালে একটা দেবের পোস্টারও রয়েছে।

খুব খুঁটিয়ে পোস্টারের এদিক-ওদিক দেখে নেহাৎ অনিচ্ছায় প্যাডেলে আবার চাপ দিল কার্তিক। বইটা দেখা হল না। খুব আপশোশ লাগছে। মন পড়ে রইল চলচিত্রম হলের দেয়ালে আর মিনিট পনেরোর মধ্যে কার্তিক পৌঁছে গেল হদিশপুর জিআরপি অফিসে। ঢোকামাত্র বড়োবাবুর পেল্লায় ধমক। ‘শুয়োরের বাচ্চা, আসতে ইচ্ছে করে না নাকি রে তোর? এইটুকু রাস্তা আসতে কতক্ষণ লাগে? সেই বিকেল থেকে বডি পড়ে রয়েছে।’

এই খিস্তিটুকুতে জলখাবারও হয় না কার্তিকের। পেটভরা তো দূরের কথা। সামান্য বিগলিত হাসল।

‘তোকে তো বলেও কিছু লাভ নেই। সবসময় ধুনকিতে রয়েছিস।’ বড়োবাবুর কথায় আশপাশের কনস্টেবলগুলো হেসে উঠল।

‘দে বডিটা তুলে দে।’ বড়োবাবুর আদেশমাত্র অফিসের বাইরের ঘরটা থেকে প্লাস্টিক মোড়া বডিটা দুজন জমাদার ধরাধরি করে তুলে দিল কার্তিকের ভ্যানে।

‘তাড়াতাড়ি পৌঁছে দিস। আবার রাস্তায় বডি সমেত লাট খেয়ে পড়ে থাকিস না। আজ বৃষ্টি হতে পারে,’ বলে একটা একশো টাকার নোট আর একটা কাগজ ধরিয়ে দিল ছোটোবাবু। টাকাটা কার্তিকের ভ্যানভাড়া আর কাগজটা মর্গে বডির সঙ্গে জমা করতে হবে। এসব মুখস্ত হয়ে গেছে কব্বে…। মেয়েছেলের বডি, জেনে নিয়েছে কার্তিক।

ফেরার পথে আবার ঠিক সেইখানেই থেমে পড়ল কার্তিক। চলচিত্রমের সামনে। সেই পোস্টারটার গায়ে এখন দুটো বাম্পার চোখ ঝলসানো লাইট ফেলা রয়েছে। আরও ফাটাফাটি লাগছে গুরুকে। বইটা সত্যিই দেখা হবে না! কথাটা মনে আসতেই মেজাজটা খিঁচড়ে গেল। শালা কপালটাই খারাপ।

দু-তিনবার মেঘ ডাকল চাপা স্বরে। সন্ধে নেমে গেছে। এখনও ভাঙনহাটি মর্গ মেন রাস্তা ধরে অনেকটা। প্রায় ঘন্টাখানেক তো বটেই। ভাবতে ভাবতে গায়ে দুফোঁটা জল পড়ল আকাশ থেকে। আর বৃষ্টির সঙ্গে কয়েকফোঁটা বুদ্ধিও এসে টুপ করে পড়ল কার্তিকের মাথায়। ভ্যান থেকে নেমে শোয়ানো বডিটার সামনে এল ও। আগাপাশতলা প্লাস্টিক দিয়ে মোড়া। তার ওপর আবার একটা প্লাস্টিক টানটান করে তার কোণাগুলো দড়ি দিয়ে এমন করে বাঁধা রয়েছে যে, বাইরে থেকে কারও বোঝার উপায় নেই ভেতরে কী রয়েছে। এইভাবেই বরাবর বডি নিয়ে যায় কার্তিক, নইলে রাস্তায় লোকে ডিস্টার্ব করে। দুনিয়ার প্রশ্ন লোকের।

খুব ধীরেসুস্থে সাবধানে ভ্যানটাকে হাতে ঠেলে সিনেমা হলের চত্বরে ঢুকিয়ে নিল কার্তিক। চত্বরটা ফাঁকা। হলের সামনেও লোকজন কেউ প্রায় নেই। বই শুরু হয়ে গেছে বোধহয়। নাকি শেষ? ভ্যানটাকে এককোণে রেখে গুটিগুটি পায়ে টিকিট কাউন্টারের কাছে গেল। মুখ নামিয়ে বলল, ‘দাদা বই শুরু হয়ে গেছে?’

‘এই একটু আগে হল। কটা চাই?’

‘একটা দিন।’ লুঙ্গির গেঁজ থেকে একশো-র ভাঁজ দেওয়া নোটটা আরও ভাঁজ করে শেষ পর্যন্ত গলিয়েই দিল কার্তিক। সত্তর টাকা আর একটা লাল রঙের টিকিট ফেরত এল হাতে। টিকিট হাতে নিয়ে ভেতরে ঢোকার আগে আরেকবার পিছন ফিরে ভ্যানটাকে দেখল কার্তিক। চুপ করে দাঁড়িয়ে রয়েছে ওটা, আর সামনে একটা নেড়িকুকুর ওটার দিকে তাকিয়ে লেজ নাড়ছে।

আবার মেঘ ডাকল। প্ল্যান মনে মনে ছকা হয়ে গেছে। বই দেখে তারপর বডি নিয়ে মর্গে যাবে। দেরি হওয়ার কারণ জিজ্ঞেস করলে বলতে হবে বৃষ্টিতে রাস্তায় আটকে গেছিলাম। ব্যস। জয়গুরু বলে অন্ধকার হলে ঢুকে পড়ল কার্তিক। এই হলে আগেও অনেকবার বই দেখেছে ও। সিট নাম্বার বলে কিছু নেই। যে আগে ঢুকবে তার নিজের পছন্দের মতো সিটে বসে পড়বে। ঘষা ধোঁয়াটে স্ক্রিন। সামনের দিকের বেশ কিছু চেয়ার ভেঙে মুখ থুবড়ে পড়ে রয়েছে। বোঝাই যায় এই অবদান দর্শকদের। আসলে এই হলটায় কিছুদিন আগেও তেড়ে পানু চলত। বাইরে পোস্টার থাকত আশির দশকের কিছু সস্তার হিন্দি ছবির। সেই ছবি শুরুও হতো, কিন্তু চলার কিছুক্ষণ পরেই চালু হয়ে যেত সাউথ ইন্ডিয়ান ব্লু। মাঝেমধ্যেই সেই ছবি অদ্ভুত ভাবে উলটে যেত কিংবা পুরোটা অন্ধকার হয়ে যেত। তখনই দর্শকের অশ্রাব্য খিস্তি। চেয়ারে লাথি। অনেক সময়ে দর্শকের হুকুমে একই সিন দুবার করেও চালাতে হতো প্রজেক্টরদের। এইসব ছবির দর্শক ছিল সব ভ্যানওলা, রিকশাওলা কিংবা সবজিওলা, মিস্তিরি আর স্কুলকলেজে পড়া কিছু উঠতি বয়েসের ছেলে। পুলিশকে প্রতি সপ্তাহে নমস্কারি দিয়ে আসতে হতো হল কর্তৃপক্ষকে।

তবু মাঝেমধ্যে রেড পড়ত আচমকা। যেসব দর্শকরা পিছনের দরজা দিয়ে পালাতে পারত না, ধরা পড়ত। হলের লোকের সঙ্গে পুলিশ ভ্যানে উঠতে হতো তাদেরও। বেশ কয়েকদিন বন্ধ থাকত হলটা। তারপর আবার যেই কে সেই। কিছুদিন আগে একটা বড়োসড়ো কেস খাওয়ার পর হলটা এখন পানু ছেড়ে বাংলা বই চালাচ্ছে। হল ভরতি নয়। সিটে বসে পড়ল কার্তিক। ওই তো গুরু… উহ্ কী দেখাচ্ছে দেবকে। পাশে একজন লুঙ্গি আর গেঞ্জি পরে সিটের ওপর পা তুলে বিড়ি টানছিল, তাকে জিজ্ঞেস করল কার্তিক। ‘কখন শুরু হল?’

‘এই তো এট্টু আগে।’

‘যাক তার মানে বেশি লস হয়নি।’ খানিকক্ষণের মধ্যেই ডুবে গেল ছবিতে।  মারকাটারি বই। উহহ না দেখলে যে কী লস হতো…। হেব্বি অ্যাকশন। দেবের নায়িকাটাকে অনেকগুলো গুন্ডা মিলে ছিঁড়েখুঁড়ে খাওয়ার জন্য তুলে নিয়ে পালাচ্ছিল। পাহাড়ের ধারে একটা জায়গায় শুইয়ে দিয়ে সবে জামাকাপড় ছিঁড়তে শুরু করেছে তখনই বাইকে করে গুরু এসে গেল। হাতে একটা লোহার রড। তারপর পনেরো-ষোলোটা গুন্ডার সঙ্গে একা ঝাড়পিট করল গুরু। রডের বাড়িতে, লাথিতে, ঘুসিতে সবকটাকে শুইয়ে দিল। কিন্তু লাস্টে তবু পারল না হিরোয়িনকে বাঁচাতে। আসলে ভিলেন দেবকে লক্ষ্য করে গুলি ছুড়েছিল। নায়িকাটা সামনে চলে আসায় দেব বেঁচে গেল কিন্তু মেয়েছেলেটার বুকে গুলি লাগল। মরে গেল মেয়েটা।

নায়িকাকে বুকে জড়িয়ে দেব এমন চিৎকার করে কাঁদছিল যে কার্তিকের চোখেও জল চলে এসেছিল। ইচ্ছে করছিল ভিলেনটাকে নিজের হাতে ক্যালাতে। তারপর দেব স্রেফ মুঠো পাকিয়ে একটা ঘুসি মারল ভিলেনটাকে। মালটা সেই ঘুসিতেই পাহাড় থেকে পুরো খাদে। সব্বাই হাততালি দিল। কার্তিকও। কিন্তু মনের ভেতর থেকে কষ্টের দলাটা নামল না। এত সুন্দর মেয়েটা মরেই গেল শালা। নায়িকাটার নাম জানে না কার্তিক। কিন্তু দেবের মতোই কাঁদতে ইচ্ছে করছিল ওর। খুব কাঁদতে ইচ্ছে করছিল। খুব কষ্ট নিয়ে হলের বাইরে আসতেই তুমুল চমক।

ওর ভ্যানটার সামনে ভিড়ে ভিড়। কয়েকটা কুকুর বিটকেল চিল্লাচ্ছে। আর ওর ভ্যানে শুইয়ে রাখা বডিটাকে টেনে নামানোর জন্য প্লাস্টিকটাকে সবকটা মিলে এমনভাবে টানাটানি করছে যে, প্রায় ছিঁড়ে ফালাফালা হয়ে গেছে ওটা। বডির বেশ খানিকটা দেখা যাচ্ছে এখন। সামনে দাঁড়ানো সবকটা লোকও বেজায় চিৎকার করছে। চুপ করে কিছুক্ষণ দাঁড়াল কার্তিক। এবার কী করা উচিত ভাবার চেষ্টা করল। ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি হচ্ছে। ‘কোন শুয়োরের বাচ্চা রেখে গেছে আমরা কী করে জানব?’ একজন চিল্লাল।

‘আরে কেউ বুঝতে পারত নাকি? কুকুরগুলো টানাটানি করে প্লাস্টিকটা ছিঁড়ল বলেই তো বোঝা গেল ভেতরে বডি রয়েছে। কী ঝামেলা বলুন তো এখন পুলিশের ঠেলা…।’

কার্তিক একবার ভাবল বডি ছেড়ে কেটে পড়বে। কিন্তু কুকুরগুলো এমনভাবে বডিটার পা ধরে কামড়ে নামাতে চাইল যে আর নিজের মাথার ঠিক রাখতে পারল না কার্তিক। আর দেরি করলে মেয়েছেলেটাকে সবার সামনে খুবলে খাবে ওগুলো।

আই সা..ল..লা..হ বলে দুহাত ছড়িয়ে দিগ্বিদিগ্ জ্ঞান হারিয়ে কুকুরগুলোর দিকে ছুটে গেল কার্তিক। কুকুরগুলো কার্তিকের এমন মারমুখী চেহারা দেখে একটু থমকাল, তারপর আবার বডিটার এদিক-ওদিক কামড়ে ভ্যান থেকে নামানোর চেষ্টা করল। সামনে দাঁড়ানো লোকগুলো যেন তামাশা দেখছে। সামনে পড়ে থাকা একটা কাঠের টুকরো তুলে এলোপাতাড়ি ঘোরাতে শুরু করল, দমাদ্দম পেটাতে শুরু করল যেটাকে সামনে পেল, অবিকল…

মিনিট কয়েকের মধ্যে রণে ভঙ্গ দিয়ে একটু দূরে দাঁড়িয়ে চেল্লাতে থাকল কুকুরগুলো। আর কার্তিক বড়ো বড়ো নিঃশ্বাস ফেলতে ফেলতে ভ্যানে শোয়ানো শরীরটাকে আবার গুছিয়ে নিয়ে ভ্যান টেনে চুপচাপ চলে যেতে গেল, ঠিক তখনই ওকে আটকাল ভিড়ের কয়েকটা লোক।

‘এই ভাই এই, এটা কোথায় নিয়ে যাচ্ছিস?’

‘মর্গে।’ মেজাজ নিয়ে উত্তর দিল কার্তিক। কুকুরগুলোর হাত থেকে মেয়েছেলেটাকে বাঁচাতে পেরে মনটা ফুলে উঠেছে। ভাগ্যিস ঠিক সময়ে এসে পড়েছিল। নইলে…

‘মানে?’ সবাই তাকাল ওর দিকে।

‘বই দেখতে ঢুকেছিলাম। এই বডি আর ভ্যান আমার। এই যে আমার কাছে জিআরপি-র কাগজ রয়েছে। বডিটা মর্গে…’

আর কথা শেষ হল না। কারও একটা সলিড থাপ্পড় এসে পড়ল কার্তিকের গালে। টাল সামলাতে না পেরে মাটিতে মুখ থুবড়ে পড়ে গেল কার্তিক।

শুরু হল অবিরাম লাথি, ঘুসি… আর খিস্তি। ‘শালা বাইরে লাশ রেখে সিনেমা মারাতে এসেছ… পাতাখোর…তোর রস বার করছি…’ মার খেতে খেতে বারবার দেবের কথা মনে পড়ছিল কার্তিকের। হেব্বি ইচ্ছে করছিল গুরুর মতো ইয়াআআ করে দুহাত ছড়িয়ে উঠে দাঁড়িয়ে সবকটাকে ক্যালাতে। একটু আগে যেভাবে কুকুরগুলোকে…। পারল না। মাটিতে কুঁকড়ে বসে একবার চোখ মেলল কার্তিক। তাকাতেই দেখল ওর পাশে বসা সেই লুঙ্গি পরা লোকটাও পা তুলছে ওকে লাথি মারবে বলে… আবার চোখ বন্ধ করে ফেলল।

অনেক রাত্তির। বৃষ্টি পড়ছে অঝোরে। বারবার বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। হু হু ফাঁকা রাস্তার এক ধারে থুবড়ে শুয়ে ছিল কার্তিক। জবজবে ভিজে। নড়াচড়া করতেও কষ্ট হচ্ছে। গোটা গায়ে অসহ্য ব্যথা।

বাঁ-চোখে কিছুই প্রায় দেখতে পাচ্ছে না। চোখটা পাবলিকের মারের চোটে গেছে বোধ হয়। অনেক উঁচুতে ল্যাম্পপোস্টের হলদেটে আলোটা বৃষ্টির ধোঁয়ায় ঝাপসা। হামাগুড়ি দিয়ে ভ্যানের চাকা ধরে কোনও মতে উঠে দাঁড়াল। এমন ক্যালানি বাপের জন্মে খায়নি ও। উহহ্…। মুখ ফুলে ঢোল। ঠোঁটের কষে রক্ত জমাট বেঁধে রয়েছে। একেবারে গুরুর মতো অবস্থা। বিদ্যুতের আলোয় ওর মুখটা অদ্ভুত লাগছে। হঠাৎ দাঁত কিড়মিড় করে বাঁহাতের তর্জনী তুলে কাউকে তীব্র শাসাল কার্তিক। তারপর রাস্তার মাঝখানে এসে দাঁড়াল। তুমুল বৃষ্টি পড়ছে। ছেঁড়াখোঁড়া প্লাস্টিকটা দিয়েই কোনওমতে ঢাকা দেওয়া ভ্যানের ওপর শোওয়ানো বডিটা। আজ আর মর্গে পৌঁছোতে পারেনি ও। শরীরে কুলোয়নি। তুমুল ক্যালানি খাওয়ার পর ভ্যান চালিয়ে খানিকটা যাওয়ার পরেই রাস্তার একধারে কেতরে পড়েছিল। মোবাইলটাও হারিয়েছে বলে কাউকে খবর দিতে পারেনি। কাল কপালে অশেষ দুঃখ আছে। কাজটা আর থাকবে না নিশ্চয়ই। কিন্তু কিছু করার ছিল না। শরীরে দিচ্ছিল না অত দূর ভ্যান টেনে যাওয়ার।

ভ্যানটার দিকে কিছুক্ষণ অপলক তাকিয়ে থাকল কার্তিক। মাথার ভেতর অনেক ভাবনা আসছে। ঝিমঝিম করছে মাথাটা। বারবার ক্যালানি খাওয়ার দৃশ্যটা মনে পড়ছে আর ভেতরটা রাগে জ্বলেপুড়ে যাচ্ছে। রাগটা বাড়তে বাড়তে একসময় প্রায় ঘোর লাগিয়ে দিল কার্তিকের সরষের দানার সাইজের ঘিলুতে। আস্তে আস্তে ভ্যানের চারদিকটায় পাক দিল। তারপর বেঘোরেই ভ্যানের সামনে এসে দড়িগুলো খুলে একটানে প্লাস্টিকটা সরিয়ে দিল ও। বডিতে জড়ানো কাপড়টা খুলতে এই জীবনে প্রথমবার খানিকটা যেন চমকালো কার্তিক। মুখ ঝুঁকিয়ে মেয়েটার মুখ খুব সামনে থেকে দেখল। চোখদুটো খোলা। মুখের কোথাও আঘাতের চিহ্ন নেই। কী সুন্দর মুখটা! হয়তো সুইসাইড নয়, ট্রেনে ধাক্বা খেয়ে দূরে ছিটকে পড়েছিল। আবার বিদ্যুৎ চমকানোয় মুখটা একঝলক দেখতে পেল। খুব চেনা মুখ… কোথায় যেন… দেবের নায়িকাটার মতো…?

হঠাৎ যেন মাথাটা পুরো এলোমেলো হয়ে গেল কার্তিকের। একদৃষ্টে অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইল মেয়েটার শরীরের দিকে। বুকের খাঁচা বেলুনের মতো ফুলছে নামছে উত্তেজনায়। শুয়োরের বাচ্চা… ইয়ায়ায়ায়ায়া… করে

দু-হাত ছড়িয়ে উঠে দাঁড়াল একবার, অবিকল দেবের স্টাইলে। তারপরেই মেয়েটার সামনে হাঁটু গেড়ে দুমড়ে নেতিয়ে বসে পড়ল। আকাশের দিকে মুখ তুলে করুণ কুকুরের মতো সুর করে বিকৃত কান্নার আওয়াজ তুলল। দু-হাত ছড়িয়ে কান্নার অভিনয় করতে করতে হঠাৎ সত্যি সত্যিই একটা মোচড় দেওয়া দুঃখ হল সামনে শুয়ে থাকা অচেনা মেয়েটার জন্য। নিজের বেখেয়ালেই কয়েক ফোঁটা জল বেরিয়ে এল ওর চোখ থেকে, অকারণে। কিন্তু নায়কদের সত্যি সত্যি কাঁদতে নেই বলেই বোধ হয় বৃষ্টির জল সঙ্গে সঙ্গে ধুইয়ে দিল সেই কান্না। বারবার বিদ্যুৎ চমকাচ্ছিল। কার্তিক চোখ বুজে বসে রইল সেই বৃষ্টিতে। আর মৃত মেয়েটার অবাক খোলা চোখের ভেতর বৃষ্টির জল গড়িয়ে পড়তে থাকল অবিরাম।

 

জ্যামিতিক

‘একটা চতুষ্কোণ মাটি দরকার, বুঝলেন?’ নীলাভ মাংকি-ক্যাপটাকে কপালের নীচে আকর্ষণ করল। অসম্ভব ঠান্ডা পড়েছে। বাতাস ভারী হয়ে আছে। শ্বাস নিতে কষ্ট হয়। তাছাড়া, মর্নিংওয়াক শব্দটায় যতটা আরাম এবং স্বাস্থ্যচর্চা মিশে আছে, বাস্তব অবশ্য অন্য কথা বলে। এই হাত, পা, এই শরীর এতটাই জড় যে, সামান্য নড়াচড়াও ভীতিকর। মানস হাতের রুপো বাঁধানো লাঠিটা জোরে ঠুকল মাটিতে, ‘কী হল? দাঁড়িয়ে পড়লেন যে।’

‘আসলে, ভাবছি। ক’দিন যাবৎ একটা কথাই ভাবছি’ নীলাভ মানসের চোখের দিকে তাকায় ‘একটা বাড়ি করতে পারিনি এখনও! আমার একটু মাটি চাই। দেড়-দুকাঠা হলেও হবে। খোঁজ আছে নাকি?’

‘বাড়ি? সাতকুলে কেউ নেই আপনার, বাড়ি করবেন কার জন্য?’

মানস থমকে গেল।‘আমার জন্যই। একটা বাড়ির স্বপ্ন দেখছি। খুব লোভ হচ্ছে জানেন! ভাবতেও ভালো লাগে! নিজের বাড়ি!’ নীলাভ অপ্রস্তুত হাসি লুকিয়ে ফেলার চেষ্টা করে।

মানস হেসে ফেলে। ‘এটা আবার ব্যাপার নাকি? হয়ে যাবে। ঠিক আছে। জানা রইল।’ মানস ভিজে ঘাসের উপর ফের লাঠি ঠুকল। শব্দ হল না। ভেজা মাটি কোনও শব্দ করে না। লাঠিটা দেখতে দেখতে বাস্তবের মাটিতে পা রাখছিল নীলাভ– ‘আচ্ছা! আজ দেখছি লেঠেল হয়ে বেরিয়েছেন! শখ?নাকি প্রয়োজন?’‘আরে, প্রয়োজন ছাড়া কি আর…! বুড়ো হতে কার ভালো লাগে বলুন? ক’দিন ধরেই যন্ত্রণা হচ্ছে পায়ে। তো, গিন্নি লাঠিটা এগিয়ে দিলেন, সঙ্গে রাখো। আরাম হবে। দেখছি কথাটা মিথ্যে নয়। আসলে, ভারটা অন্যের উপর রাখলে স্বস্তি মেলে।’ মানসের হাসি দেখতে দেখতে নীলাভর ঠোঁটও প্রসারিত হতে থাকে। স্থির লক্ষ্যে পৌঁছোনোর আগেই অবশ্য থেমে যায় নীলাভ। সত্যিই কি বার্ধক্য এসে গেছে? তাই কি চট করে ঠান্ডা লেগে যায়?

‘সব কিছু পালটে গেল কীরকম। এই শহরে তেত্রিশ বছর কাটিয়ে দিলাম। যখন এসেছিলাম চব্বিশ পঁচিশের টগবগে ঘোড়া!’ নীলাভ কুয়াশার ভেতর দৃষ্টি নিক্ষেপ করার চেষ্টা করে।

‘আমি যে পাঁচবছর ধরে আছি, আমারই তাই মনে হয়। পড়শি পর্যন্ত পালটে যায় মশাই। শহর একেই বলে।’ হা-হা শব্দে হাসে মানস। নীলাভ মনে মনে হাসে। মানস ভাড়াটের কথা বলছে। পাঁচ বছরের মধ্যে বাড়ি বানিয়েছে। ভাড়াটে বসিয়েছে। সারাদিন খ্যাঁচম্যাচ্! ধুর! নিজের বাড়িতে নিজের সঙ্গে বাস করার আনন্দ বুঝবে না মানস। বাড়ির সঙ্গে গৃহস্থের যা সম্পর্ক, ভাষার সঙ্গে বর্ণমালার সেই সম্পর্ক।

মানসের হাসির শব্দে জগিং-এ ব্যস্ত তরুণী চমকে তাকাল। দু-একজন স্বাস্থ্য অন্বেষণকারী ওঁদের দেখছে বুঝে লজ্জিত হয় নীলাভ– ‘আস্তে! আস্তে!’

‘ওঃ! ভাষার সঙ্গে বর্ণমালা আর গৃহস্থের সঙ্গে বাড়ি? দারুণ!’

‘কথাটা চুরি করেছি। গণিতশাস্ত্রবিদ ইউক্লিডের কথা এটা। অবশ্য একটু অন্যভাবে বলা।

‘তো, কী বলছিলেন? গৃহস্থ আর বর্ণমালা…?’

নীলাভ হাসল। ‘দেখুন, এসব তত্ত্বের জন্য যুক্তিতর্ক দরকার হয় না। একে স্বতঃসিদ্ধ মেনে নিতে পারেন। সত্য বলে ভাববেন।’

‘না না! তা বলছি না। তবে, কথাটা বেশ।’ মানস লাঠিখানা মাটির উপর থেকে তুলে নেয়। নীলাভ একটু দাঁড়াল। ইদানীং হাঁপ ধরে যাচ্ছে সহজেই। দুপাক হাঁটতেই মাঠটাকে বিশাল এবং ভয়ংকর বলে মনে হচ্ছে। যেন বিরাট শূন্যতা গিলে খেতে আসছে। যেন হারিয়ে যাবে নীলাভ এই মহাশূন্যতায়। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে শারীরিক ও মানসিক অবস্থার পরিবর্তন হচ্ছে। কেন পালটে যাচ্ছে শরীর, বা কেন মানসিক অবস্থা পরিবর্তিত হয়ে যায় তার কোনও যুক্তিতর্ক নেই। প্রশ্ন নেই। এসব হল স্বতঃসিদ্ধ।। এলিমেন্টস নামক বইতে ইউক্লিড একথা বলেছেন।

মানস গিন্নির দেওয়া লাঠিখানাকে ফের ভেজা মাটির উপর বসিয়ে দিয়ে হাঁটতে শুরু করেছে। একটা লাঠি তো নীলাভরও দরকার ছিল। কিন্তু কে এগিয়ে দেবে সেই স্বস্তি-দণ্ড? মানস জানে সাতকুলে কেউ নেই নীলাভর। যদি থাকত, তবে এই কুয়াশাভরা মাঠে রুপোর লাঠি আজ নীলাভর হাতেও থাকত।

এখনও কুয়াশা ছড়িয়ে আছে মাঠ জুড়ে। দূরে দূরে দু-একটা ধোঁয়ামূর্তি নজরে আসে। শুদ্ধ বাতাস শহরে নেই। চারপাশে কি কুয়াশা? নাকি ধোঁয়াশা?

‘আজ মেয়ে-জামাই আসছে গোরখপুর থেকে। ওখান থেকে নেপালে গেছিল। মায়ের জন্য নানাবিধ গিফ্ট আসছে। ওর মা-তো গত কাল থেকেই টেনশনে… কী আনবে ওরা…!’ মানসের সুখী মুখে লালচে গোলাপ ফুটেছে। এই তো জীবন! সুখ নিয়ে বেঁচে থাকা। মানস হাসিহাসি মুখ করে, ‘গিন্নি বায়না ধরেছেন জামাইকে মালাই চিংড়ি খাওয়াবেন। নারগিসি কোফতা বানাবেন! হই হই কান্ড। বুঝেছেন?’

বুঝল নীলাভ। মানস এখন ফিরতে চাইছে। কাজ আছে বাড়িতে। ফিরে আসতে গিয়ে শর্টকাট করতে চাচ্ছিল মানস। নীলাভ কথাবার্তায় ভুলিয়ে সোজাপথে নিয়ে এল মানসকে। শর্টকাট অপছন্দ নয়। তবে, ওই পথটা বড়ো কঠিন পথ। একটা অস্বস্তিকর অবস্থা তৈরি হয়। মাস ছয়েক আগে একদিন অবশ্য গেছিল। আজ আর গেল না। একদিন গেলে কদিন যাবৎ অস্বস্তিটা জাপটে থাকে শরীর-মনে। বড্ড কষ্ট হয়। ভয় হয়। যেন স্বপ্নে দেখা নিঃসঙ্গ পথ। আলো নেই। আশ্রয় নেই। শূন্যতা কেবল। ভালো লাগে না। আবার, ভুলেও থাকা যায় না।

বাজারের রাস্তা ধরল মানস। বাজার ছাড়িয়ে ডানদিকের সরু গলিতে ঢুকে পড়ল নীলাভ। এবার শর্টকাট। তার আস্তানাটা আবার কাছে নয়। সোজাপথে সময় লাগবে।

বাসার কাছাকাছি আসতেই সীমন্তর সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। মেসবাড়ির মেস-ম্যানেজার সে-ই। বাজার সেরে ফিরছে। নীলাভকে দেখে দাঁড়াল। ‘নীলাভদা যে! আজ বিফোর টাইমে!’

হাসে নীলাভ। ‘কী আনলে। কী মাছ?’

‘মাছ নয়। মাংস। সবাই ধরে বসল।’

‘কেন? কোনও ব্যাপার আছে বুঝি?’

‘না, মানে ওই আর কী…!’ সীমন্ত এদিক-ওদিক তাকায়।

ছেলেটা স্পষ্ট হল না। অথচ ভেতরে একটা কথা আছে ঠিক। বেশ। খেতে বসে জানা যাবে।

বারান্দায় টিনের চেয়ার টেনে বসল নীলাভ। কাগজফুল গাছে অনেক ফুল ফুটেছে। আসলে বোগেনভিলিয়া। তারা ছেলেবেলায় কাগজফুল বলেই জানত। এমন প্রাণময় গাছটার এমন একটা জড় নাম কেন ছিল? লিপ্তা বলেছিল, এই ফুলে পুজো হয় না। কেন হয় না? লিপ্তা জবাব দিতে পারেনি। অবশ্য অনেক কথারই জবাব দিতে পারেনি লিপ্তা। কখনও পারেনি। ভরাট ঠোঁট টিপে দাঁড়িয়েছিল মাত্র। যুগলপ্রসাদ রোদে দাঁড়িয়ে খবরের কাগজ পড়ছিল। ছেলেটা চমৎকার বাংলা বলে। মাঝে মধ্যে তৎসম শব্দও ব্যবহার করে। ডাকল নীলাভ ‘এই যে যুগল!

ঠান্ডা কীরকম?’

‘ঠান্ডা?’ যুগল পেছন ফিরে তাকাল ‘উত্তরোত্তর বেড়ে চলেছে। আর কদিন পর শৈত্যপ্রবাহ শুরু হবে।’

কিছু বলতে মুখ খুলেছে নীলাভ, দীপংকর চ্যাঁচাল– ‘খাবার রেডি। ফটাফট এসে পড়ুন সবাই।’

খেতে বসে আসল কথাটা জানা গেল। সীমন্তর ছেলে হয়েছে। আজই। সকালে ফোন এসেছে। আগামিকাল সীমন্ত যাচ্ছে বালুরঘাটে শ্বশুরবাড়িতে। ছেলেকে দেখতে।

খুশি হওয়ারই কথা। খুশিই হল নীলাভ। সীমন্তর চনমনে মুখের দিকে তাকিয়ে অন্যমনস্ক হয়ে পড়ল ও। বারান্দায় কে জল ফেলে রেখেছে। পড়তে পড়তে বেঁচে গেল। যে-যার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়বে। একমাত্র ওর কোনও কাজ নেই। ধীরেসুস্থে স্নান সেরে খবরের কাগজ নিয়ে বসবে। কাগজফুল গাছটা বাতাসে ফুলপাতা দুলিয়ে চলেছে খসখস শব্দে। যেন বই-এর পৃষ্ঠা উলটে যাচ্ছে নিজে থেকে। কত ঘটনা কত মিলন-বিচ্ছেদের কাহিনি লেখা আছে সেইসব পৃষ্ঠায়।

আজ সবাই খুশি। সীমন্তর ছেলে এল। মানসের মেয়ে-জামাই এল। চিংড়ি রেঁধেছে মানসের বউ। স্বাভাবিক। খুশি হওয়ারই কথা। একটা জ্যামিতিক কোণ পুরো হল।

বাইকের শব্দে চটকা ভেঙে গেল। যুগলপ্রসাদ অফিসে গেল। দিবাকর সাইকেল বের করে আনছে বারান্দায়। ভূদেবের অফিস কাছেই। জিৎ, দেবনাথ ব্যাগ ঝুলিয়ে মেট্রো ধরতে দৌড়োচ্ছে। এই লোকটা কখনও হাসে না। ঠিক এইরকম একটা স্কুটার ছিল নীলাভর। এটা কার? সজীবের। সজীব স্কুটার ঠেলে নামাচ্ছে। নীলাভ হাটবাজার, অফিস… সর্বত্র স্কুটার নিয়ে চলত। অবশ্য লিপ্তা ছিল। পিছনে বসে জাপটে ধরে থাকত। জীবনটা বেহিসেবি হয়ে গেল নীলাভর! হিসেব করে চলতে শেখা হল না!’

অন্যদিন সন্ধে রাতে শুয়ে পড়ে। আজ ইচ্ছে হল না। নানা ভাবনায় মাথাটা গরম। প্রেশারটা চেকআপ করাতে হবে। একটু শুয়ে থাকলে হয়তো ভালো লাগবে। নাঃ! বসে থাকাই ভালো। অস্থির নীলাভ ফের শুয়ে পড়ে। কে ডাকে? অর্ণব স্যার? চার পাঁচজন ছেলেকে ডেকে ব্ল্যাকবোর্ডের সামনে দাঁড়িয়ে কী বোঝাচ্ছে?

‘দ্যাখ, একটা সরলরেখা অন্য দুটো সরলরেখাকে ছেদ করলে, একপাশের দুই কোণের সমষ্টি যদি একশো আশি ডিগ্রির কম হয়, তাহলে সরলরেখা দুটোকে দুই পাশে বাড়ালে কোথাও না কোথাও মিলবেই।’ চক দিয়ে খসখস শব্দে সরলরেখা টানে অর্ণব স্যার! সেই শব্দে চোখ মেলে তাকায় নীলাভ। স্বপ্ন দেখছিল! আর ঘুম হবে না। উঠে জল খেল নীলাভ। কনকনে ঠান্ডাজল গলা কেটে ফেলল ধারালো অস্ত্রের মতো। মধুমিতা ঠান্ডা জল খেতে দিত না। ফ্লাস্ক রাখত টেবিলে। গরম জলের ফ্লাস্ক। কিন্তু এতদিন পর ছেলেবেলার স্যার কেন এল স্বপ্নের ভেতর? কী শেখাল এতক্ষণ ধরে? কেন বলল না নীলাভর জীবনের খামতির কথাটা? কেন নীলাভর জীবনের দুটো কোণের সমষ্টি একশো আশি ডিগ্রি হয়নি? একটা চতুষ্কোণ মাটি পাওয়া হল না। তার ভিতরে ঘর। তার ভিতরে সংসার। মধুমিতাও কি এভাবেই ভাবে? হয়তো ভাবে, হয়তো ভাবে না। সে তো সাহিত্যের ছাত্রী! একটু নরম, একটু লাজুক। স্কুটারের পেছনে বসতে ভয় পেত। মুকুন্দপুরে বন্ধুর বাড়িতে যাচ্ছিল। সিল্কের শাড়ি পিছলে মধুমিতা…! লজ্জায় কেঁদে ফেলেছিল। বন্ধুর বউ বকুনি দিয়েছিল। ‘বউ পড়ে গেল, আপনি হাসছেন?’

বাড়িতে ফিরেও রাগ পড়েনি মধুমিতার। অনেক কষ্টে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে হয়েছে। অঝোর বৃষ্টি পড়ছিল সে রাতে। মধুমিতা বিরহের গান গেয়েছিল। ভালো গাইত ও। নীলাভ চেয়েছিল মধু গানের চর্চা রাখুক। ভালো গাইত।

দু-চারজন ছাত্রীও জুটে গেল। সে সময়ই এল লিপ্তা।

গাঢ় অন্ধকারের দিকে জোনাকি খুঁজল নীলাভ। টর্চটা কোথায়? এত অন্ধকার কেন? আজ কি অমাবস্যা? এই যে টর্চ…! লিপ্তার চটক ছিল। স্মার্টনেসও। গুছিয়ে শাড়ি পরত লং কোটের সঙ্গে। মনে মনে কি এমনই একটা অন্বেষণ ছিল? নিজের মনকে বুঝতে পারেনি নীলাভ!

চোখ বুজে ফেলল। ভালো লাগছে না। বরং বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালে ভালো লাগবে। …নাঃ! খুব ঠান্ডা বাইরে। অসুখ হলে কে দেখবে? অথচ প্রবল ঠান্ডা বলে কিস্যু ছিল না। আগুন জ্বলত শরীর-মনে। দাউদাউ আগুন। লিপ্তার হাজব্যান্ড তখন চণ্ডীগড়ে। কোয়ার্টার পায়নি। টু বিএইচকে ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে চার বন্ধু থাকত। লিপ্তাকে সেখানে নেওয়ার সুবিধে ছিল না। এদিকে লিপ্তার তখন অখন্ড অবসর। গান শিখতে আসত মধুমিতার কাছে। আর নীলাভ? কী করে যেন সব ভুলে যেতে থাকল। এমনকী গোল্ডিকেও!

মধুমিতা যখন সব বুঝল, তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। ততদিনে মুক্তির সন্ধান করছে নীলাভ। মধুমিতার হাত থেকে মুক্তি। প্রথম প্রথম ঝগড়াঝাঁটি। তারপর স্পষ্টভাষায় মুক্তি চাইল নীলাভ। লিপ্তাকে ছাড়া ওর আর পৃথিবী বলতে কিছুই কি ছিল?

উঃ! কী মশা বাইরে! নীলাভ ফের মশারির ভেতরে ঢুকে পড়ে। কখন ভোর হবে।… স্তব্ধ হয়ে গেছিল মধুমিতা। তারপর জড়তা ভেঙেছিল। ‘মুক্তি চাইছ যখন, যাও। একদিন বুঝবে কত কঠিন কাজ করলে আজ। কিন্তু আরও কঠিন কাজ রয়ে গেল। আর কখনও ফিরে আসতে পারবে না।’

ইচ্ছেও ছিল না ফিরে আসার। বাড়িটা তো মধুমিতার। উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া। সে বাড়ি কখনও নীলাভর ছিল না। খোলামেজাজে বেরিয়ে এসেছিল। মুক্তি! আবার বাঁধা পড়ার জন্য মুক্ত!

মাত্র সাতদিন আগেই শ্যামবাজার পাঁচমাথার মোড় থেকে লিপ্তার পছন্দমতো জাংক জুয়েলারি সেট কিনে দিয়েছিল নীলাভ। ফেডেড জিন্সের সঙ্গে দারুণ মানিয়েছিল লিপ্তাকে।

‘একি? ঘুমোননি এখনও?’ দিবাকর বাথরুমে যাচ্ছে।

‘ক’টা বাজল দিবাকর?’

‘মর্নিং ওয়াক? দেরি আছে। সবে আড়াইটে। ঘুমোন।’

বাথরুমে জলের শব্দ। ছলছল শব্দে বয়ে যাচ্ছে জল। এভাবে বয়ে গেল একটা জীবন। মধুমিতা কখনও কিছু দাবি করেনি। ওর এতটা আত্মসম্মানজ্ঞানের সন্ধান আগে পায়নি নীলাভ। বুঝতেই পারেনি। এখনও কি মধু আগের মতই আছে? আর লিপ্তা? ভয় পেয়ে গেছিল নীলাভর পাগলামিতে। অথচ বুঝতে দেয়নি। বর চণ্ডীগড়ে নাকি ফ্ল্যাট কিনেছে। লিপ্তা চলে গেল সংসারের খোঁজে। সেই চতুষ্কোণ মাটির গল্প। নাকি নীলাভকে বিশ্বাস করতে পারেনি? যে লোক অতি সহজে চতুষ্কোণ মাটি ভেঙে ফেলে বেরিয়ে আসতে পারে তাকে বিশ্বাস করেনি লিপ্তা। মানস কী যেন বলছিল? সাতকুলে কেউ নেই, মাটি দিয়ে কী করবে? সত্যি! কী করবে তুমি? কে থাকবে তোমার মাটিতে? বৃত্তাকার ঘেরাটোপে তুমি এক স্বতন্ত্র নিঃসঙ্গ সত্তা নীলাভ!

ওফ্! এত মশা! মশারির গায়ে আটকে গুনগুন করে চলেছে। ওর দিকে আঙুল তুলছে মশারা। অভিযোগের বাণ ছুড়ছে! মাথা ধরে যায়!

শেষ রাতে ঘুমিয়ে পড়ল নীলাভ। মানস ডাকতে এসেছে। উঠে গরম পোশাক চাপিয়ে কুয়াশার ভেতরে নেমে গেল ওরা। বকবক করছিল মানস।

‘নাতনিটি বুঝলেন, পাকা দি গ্রেট। পটপট কথা বলে। খুদে ঠাকুমা। বলে, একা একা বের হবে না কিন্তু। পড়ে গেলে কে ধরবে? ভাবুন!’ হাঃ হাঃ শব্দে হাসে মানস। সেই হাসিতে সুখের গন্ধ ওড়ে।

মানস জোরে হাঁটতে পছন্দ করে। পায়ের যন্ত্রণাটা হয়তো নেই। আজ তো লাঠিও আনেনি। নীলাভ তাল রাখতে পারছিল না। শরীর বশে নেই। হাঁটু যেন ভেঙে পড়ছে।

‘শরীর ভালো নয় নাকি? চলুন, ফিরে যাই। আমার বাড়ি চলুন। গরম চা হয়ে যাবে এক রাউন্ড।’

না। আর কেন। লোভ হয় ঠিকই। কিন্তু সামলাতে জানতে হয়। সেটা জানা ছিল না বলেই হয়তো জ্যামিতিটা সম্পূর্ণ হল না। মানস বার তিনেক কথা চালাতে চেষ্টা করল। কিন্তু নীলাভর তরফ থেকে প্রত্যুত্তর না পেয়ে নীরব হয়ে গেল। ধীর পায়ে হাঁটছিল নীলাভ। মানস অবাক হল। নীলাভ আজ সোজা পথ ধরছে না। শর্টকাট করবে নাকি? গতকালও যেতে চায়নি। আজ নিজে থেকে….? কিছু বলছিল মানস। নীলাভ শুনতে পায়নি। বিষম উত্তেজনায় ধড়ফড় করছিল বুক। কেন যাচ্ছে এপথে? অদৃশ্য এক সুতো যেন প্রবল আকর্ষণে নিয়ে যাচ্ছে ওকে। ছ-মাস আগে একবার এই রাস্তায় ঢুকেছিল। তাকাতে পারেনি। আজ তাকাবে। পূর্ণ দৃষ্টি মেলে দেখবে।

বাড়ির চেহারাটা অন্যরকম হয়ে গেছে! দোতলাই আছে অবশ্য। গোল্ডিকে দেখেছে একদিন। সঙ্গে গোল্ডির বউ ছিল। কেনাকাটা করছিল। মধু এখন শাশুড়ি। ছেলে, ছেলের বউ নিয়ে মধুমিতা সুখী? সবটাই হল মানিয়ে নেওয়া। সুখ তো সোজা পথেই আসে। শর্টকাটে তাকে পাওয়া যায় না।

‘কী ভাবছেন?’

‘কিছু বললেন?’

‘বলছি, এসব জায়গায় কত বাড়ি উঠেছে। ক’মাস আগেও ফাঁকা ছিল। প্রোমোটর-রাজ শুরু হয়ে গেছে।’

ঠিক। ফাঁকা ছিল এদিকটা। বারান্দায় দাঁড়ালে অনেকটা দেখা যেত। পাড়ার দোকানি, পাশের বাড়ির বকুল, পলাশ… চিনে ফেলবে কি নীলাভকে? কেন চিনবে না? নিশ্চয়ই ওরা দেখেছে ওকে। একই জায়গায় যখন বসবাস!

‘মশাই, প্রোমোটররা যা সব হয়েছে…’ মানস বকবক চালিয়ে যাচ্ছে।

এক ঝলকের জন্য তাকাল নীলাভ! বাড়িটার সামনে দিয়ে চলে যেতে যেতে একবার চোখ তুলল ও। কেউ কি ছিল জানলায়? পর্দাটা নড়ছে না? না। কেউ নেই! কাকে আশা করেছিল নীলাভ!

‘ওই বাড়িটা’ আঙুল তুলে দেখাল নীলাভ ‘ওই যে হলদে… দোতলা বাড়িটা… ওই বাড়িতে… আমার…!’

‘রিলেটিভ? চেনা লোক?’

রিলেটিভ? কি জানি! রিলেশন না থাকলে রিলেটিভ হয়? বলা যায়? নীলাভ আঙুলটা নামাতে ভুলে যায়।

‘আগে সাদা রং ছিল। হাতির দাঁতের মতো রং। দোতলার বারান্দায় জাফরি ছিল।’

‘ও।’

‘ছেলেটা খুব ছোটো তখন। বছর পাঁচেক। খুব হাসত। একটা দাঁত পড়েছিল। ফোকলা। বললে বিশ্বাস করবেন না কোলে নিলে কাঁধের কাছটা লালা ফেলে ফেলে ভিজিয়ে দিত।’ হাঃ হাঃ শব্দে হাসতে থাকে নীলাভ। এই ঘটনার মধ্যে অবিশ্বাস্য ব্যাপারের অন্বেষণ করতে নীলাভর মুখের দিকে অবাক হয়ে তাকায় মানস।

‘এত পরিচিত যখন, গেলেই পারেন, সময়ও কাটে।’ গলায় মাফলার জড়াতে জড়াতে পরামর্শ দেয় মানস।

‘যাব? যাওয়া যায়?’ ভীষণ বিস্ময়ে মানসকে দেখে নীলাভ। মধুমিতা বলেছিল এ কাজটা আরও কঠিন। সত্যি কথা। গেট খুলে ডোরবেলে আঙুল রাখা যাবে? কে খুলবে দরজা? কে দাঁড়াবে দরজা খুলে? গোল্ডি? গোল্ডির বউ? নাকি…

কে যেন বলেছিল শূণ্যস্থানে কোনও বস্তু থাকলে তা তার চারপাশের জায়গাটাকে দুমড়ে মুচড়ে দেয়। বাঁকিয়ে দেয়। কোথায় যাবে নীলাভ? ওর জন্য কোনও সহজ পথ নেই। কোনও সরলরেখা নেই। সবটাই বক্ররেখা! কতদিন শূণ্যস্থানে থাকবে নীলাভ? চারপাশ যে দুমড়ে মুচড়ে গেল! কেন এত দেরি হল সবকিছু বুঝতে? অর্ণব স্যার তো কবেই বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। বুঝেও ছিল। কিন্তু বুঝেছিল কি সত্যি? তাহলে প্রয়োগ করতে পারেনি কেন? কেন লিপ্তার দিকে অমন প্রবলবেগে ভেসে যাচ্ছিল ও?

হঠাৎই শীত করে ওঠে নীলাভর। এতক্ষণে যেন টের পেল শীতকাল এসে গেছে! জল বরফ হয়ে যাচ্ছে! প্রবল শৈত্যপ্রবাহের মধ্যে দুঃসহ ভীতি এসে হাত পা নখ বের করে তাড়া করে। বিশাল ফাঁকা মাঠ হুহু শূণ্যতার মধ্যে টেনে নিতে থাকে নীলাভকে।

মানস কিছু বলছিল। শুনতে পেল না নীলাভ।

মানসের পাশে পাশে হেঁটে যায় এক উদ্বাস্তু। একা নিঃসঙ্গ!

 

জন্মভিটে

প্রণয় বহু বছর গ্রামের বাড়ি থেকে বাইরে। প্রণয়ের বদলির চাকরি। ষ্টেট ব্যাংক-এর ম্যানেজার। দুবছর বিহারে তো দুবছর আন্দামানে। বদলির চাকরির জন্য ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে ঘুরে বেড়িয়েছে। পুজোর সময় ও শীতের সময় এক সপ্তাহের ছুটি নিয়ে বাড়ি আসে। এছাড়া সুযোগ সুবিধা পেলে অফিসের কাজ নিয়ে কলকাতায় আসলেই দুদিন গ্রামের বাড়িতে থেকে যেত। গ্রামের বাড়িটা ছিল প্রণয়ের জন্মভিটে ও ভালোবাসার বাড়ি। এই গ্রামের বাড়িতেই তার জন্ম, ফলে যেখানেই থাকুক সুযোগ পেলেই বাড়ি আসার জন্য মুখিয়ে থাকটা

প্রণয় ভারতের সমস্ত রাজ্য ঘুরে ঘুরে যখন কলকাতায় এসে পাকাপাকি ভাবে চাকরিতে থেকে গেল, তখন কলকাতায় একটা ফ্ল্যাট কিনে নিল। আর এদিকে প্রণয়ের বাবা স্কুলের শিক্ষকতা থেকে রিটায়ার করেছেন। দেখাশোনার সুবিধার্থে বয়স্ক বাবা-মাকে কলকাতায় নিজের ফ্ল্যাটে রাখতে চেয়েছিল। প্রণয়ের বাবা ও মায়ের অতি প্রিয় ছিল এই গ্রামের বাড়ি ও গ্রামের মানুষজন। আর এই গ্রাম ছেড়ে কোথাও গিয়ে থাকার কথা মনেও করতেন না।

প্রণয়রা তিন ভাইবোন। প্রণয়ের দাদা বিদেশে থাকে এবং বছর পাঁচেক পর একবার গ্রামের বাড়িতে আসে। বোনেরও বিয়ে হয়ে গেছে। প্রণয়ের বাবা যতদিন বেঁচে ছিলেন ততদিন পাকাপাকি ভাবে প্রণয়ের কাছে গিয়ে থাকেননি। মাঝেমধ্যে গিয়ে কিছুদিনের জন্য প্রণয়ের কাছে থেকে আসতেন।

গ্রামের বাড়িতে ফুলের বাগান, সবজির বাগান আছে। এছাড়া নারকেল, সুপুরি গাছ দিয়ে ঘেরা। একটি ছোটো পুকুরও আছে। পুকুরে অনেক মাছ আছে। ফাল্গুন, চৈত্র ও বৈশাখ মাসে পুকুর থেকে মাছ তুলে গ্রামের সবাইকে দিত এবং নিজেরা সবাই খেত। গ্রামের পাকাবাড়ি বলতে প্রণয়দের বাড়ি আর কয়েকটা পাকাবাড়ি ছিল ছড়িয়ে ছিটিয়ে এছাড়া বেশির ভাগ বাড়ি বেড়া দিয়ে ঘেরা ও টালির চাল।

গ্রামের লোকেরা প্রণয়ের বাবাকে খুব সম্মান করত। প্রণয়দের গ্রামের প্রত্যেক মানুষের মধ্যে ছিল প্রচুর আন্তরিকতা। পুজোর সময় প্রণয়দের গ্রামে একটিমাত্র দুর্গাপূজা হতো, আর সেখানে গ্রামের সবাই একসাথে মিলে কাজ করা, খাওয়া, হইচই করে খুব আনন্দ হতো। তবে গ্রামের রাস্তা মাটির ছিল বলে বর্ষাকালে জল জমে রাস্তায় কাদা হয়ে যেত।

একসময় গ্রামের সবাই মিলে ঠিক করা হয়েছিল রাস্তায় ইট ফেলে পাকা রাস্তা তৈরি করা হবে। পাকা রাস্তা তৈরির ব্যাপারে প্রণয়ের বাবা অজয় মাস্টারমশাইয়ের সাথে গ্রামের বড়োরা সবাই আলোচনা করেছিল। মাস্টারমশাইকে এতটাই সম্মান করত যে, গ্রামের কোনও কাজই মাস্টারমশাইয়ের মতামত ছাড়া করা হতো না।

বেশ কয়েক বছর বাদে গ্রামের রাস্তা পাকা হল ঠিকই কিন্তু অজয় মাস্টারমশাইয়ের আর দেখে যাওয়া হয়নি। কেন-না তার আগেই মাস্টারমশাই নার্ভের অসুখ হয়ে এক বছর কষ্ট পেয়ে সবাইকে ছেড়ে স্বর্গে চলে গেলেন।

দাদা ও বোন দূরে থাকে আর বাবা মারা যাওয়ার পর মা একা হয়ে গেল, ফলে মা-র অনিচ্ছা সত্ত্বেও প্রণয় মাকে কলকাতার ফ্ল্যাটে নিয়ে যেতে বাধ্য হল। বাড়ি, বাগান, পুকুর ফেলে এমনকী গ্রামের মানুষজনকে ছেড়ে যেতে খুব কষ্ট হয়েছিল প্রণয়ের মা-র। তবে প্রণয় অফিসের ছুটি দেখে মাসে একবার করে মাকে নিয়ে গ্রামের বাড়িতে এসে দুদিন থেকে যেত। আর তখন বাগানের সবজি ও পুকুরের মাছ তুলে গ্রামের সবাইকে দিয়ে নিজেরা কিছু নিয়ে যেত কলকাতায়। ক্রমশ অফিসের কাজের চাপে এছাড়া ছুটির দিনে অন্যান্য কাজের ব্যস্ততায় গ্রামের বাড়িতে প্রণয়ের মাকে নিয়ে আসা হয়ে ওঠে না।

পাশের বাড়ির লাল্টু-কে বাড়িটা দেখশোনার জন্য বলা হয়েছিল। লাল্টু ভালোই দেখেশুনে রাখছিল। মাঝেমধ্যে গ্রামের বাড়ি থেকে ফসল ও মাছ নিয়ে কলকাতার ফ্ল্যাট বাড়িতে দিয়ে আসত। আর প্রণয়ের মা নারকেল, সুপুরি, লিচু ও আমগাছগুলি এবং গেটের সামনে মাধবীলতা ও শিউলি গাছ কেমন আছে সবকিছুর খবর নিতেন লাল্টুর কাছ থেকে। এইভাবে দশবছর পার হয়ে গেল। একসময় লাল্টু জানাল ও নিজের কাজের চাপে বাড়িটা ভালো করে দেখাশোনা করতে পারছে না। ফলে বাড়িটা জঙ্গলে ভরে গেছে, পুকুরটা আগাছায় ভরে গেছে। অনেকটা জীর্ণ পোড়ো বাড়িতে পরিণত হয়েছে। লাল্টু বাড়িটাকে হয় বিক্রি করতে, নাহলে প্রমোটারের কাছে ফ্ল্যাট তৈরির জন্য দিতে বলল।

লাল্টুর কথা শুনে প্রণয় গ্রামের বাড়িতে যাওয়ার কথা ভাবল। মা-র সাথে কথা বলে গ্রামের বাড়িতে যাওয়ার জন্য রওনাও হল প্রণয়। প্রায় দশ বছর বাদে প্রণয় গ্রামের বাড়িতে ফিরছে। গ্রামে ঢুকতে ঢুকতে চারিদিক দেখছে আর প্রণয়ের মনে হচ্ছে অন্য কোনও নতুন গ্রামে ঢুকছে। গ্রামের এখন পিচের রাস্তা হয়েছে, বেড়া ও টালির চালের বাড়িগুলোর জায়গায় ইটের দালান বাড়ি উঠেছে। রাস্তার পাশে যে-পুকুরগুলি ছিল সেই পুকুরগুলি মাটি দিয়ে বুজিয়ে মাঠ তৈরি করে তাতে চার পাঁচতলা ফ্ল্যাটবাড়ি উঠেছে। গ্রামের দুর্গামন্দির ও শিবমন্দির পাকা হয়েছে। খেলার মাঠগুলো সুন্দর পাঁচিল দিয়ে ঘিরে দেওয়া হয়েছে। একপাশে বাচ্চাদের জন্য পার্ক তৈরি করা হয়েছে।

 

গ্রামে ঢুকতে ঢুকতে প্রণয় তার ছোটোবেলার পাড়াটাকে চিনতে পারছিল না। পথের দুধারের গাছগুলিকে কেটে রাস্তাটাকে চওড়া করা হয়েছে। প্রণয়দের বাড়িতে নানারকমের ফুল ও ফলের গাছ আছে আর সেই গাছগুলোতে সকাল হতেই কত রঙের ও কত রকমের পাখি এসে বসত। আর সেইসব পাখিদের ডাক শুনতে খুব ভালো লাগত। প্রণয়দের বাড়ির পুকুরটায় দুপুরবেলা পাড়ার অনেকে স্নান করতে আসত আর পুকুরের চারপাশে পেয়ারা ও কুল গাছ থেকে ফল পেড়ে খেত। অনেকে মিলে পুকুরে সাঁতার কাটা, বঁড়শি দিয়ে পুকুর থেকে মাছ ধরা, কী যে আনন্দ হতো। তারপর পাড়ার বন্ধুরা একসাথে ঘুড়ি ওড়ানো, ফুটবল খেলা, জলকাদা মেখে বাড়ি ফেরা সে যে কী মজা ভাবা যায় না। এখন সেই খেলার মাঠগুলোতে পার্ক হয়েছে, তাতে দোলনা, ঢেঁকি ও স্লিপার বসেছে।

প্রণয়দের সামনের বাড়িটা প্রদীপদের বাড়ি। প্রদীপ প্রণয়ের বন্ধু। প্রদীপদের ছোটো টিনের চালের বাড়িটার জায়গায় সুন্দর পাকাবাড়ি উঠেছে। রাস্তায় ভ্যানগাড়ি, রিকশা খুব কম চলে তার পরিবর্তে বাইক, ট্যাক্সি ও টোটো গাড়ির শব্দ দিনরাত কান ঝালাপালা করে দিচ্ছে। পাশে মহামায়াদের বাড়ির আম বাগানটার কথা খুব মনে পড়ছে। ঝড়বৃষ্টি হলে প্রচুর আম পড়ত আর গ্রামের বাচ্চারা বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে ঝড়ের মধ্যে আম কুড়াত। সেই আমবাগান আর নেই। আম গাছ কেটে পরিষ্কার করে ক্লাবঘর বানিয়েছে। সেখানে নানারকমের পুজো ও অনুষ্ঠান হয়।

গ্রামের পথে আসতে আসতে যাদের সাথে দেখা হচ্ছিল তারা সবাই প্রণয়ের বাবার কথা জিজ্ঞাসা করছিল। মাস্টারমশাই নেই শুনে সবাই দুঃখ প্রকাশ করছিল। আর সবাই একই কথা বলছে, কী ভালো মনের মানুষ ছিলেন। গ্রামের কত ছেলেমেয়েকে এমনিই পড়িয়ে দিতেন। তারা সবাই এখন ভালো চাকরি করছে, কেউ বা ব্যাবসা করছে। প্রণয় ওদের বাড়িটার সামনে এসে দাঁড়িয়ে দেখছে, নিজেদের বাড়ি নিজেই চিনতে পারছে না। সমস্ত বাড়ি জঙ্গলে ভরে গেছে, দরজা জানলায় কোথাও কোথাও উইপোকা উঠেছে। ঘরের চারপাশ ধুলো বালি ময়লায় ভরে গেছে। ফুলগাছগুলি ও সবজি গাছগুলি অযত্নে মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে আছে।

প্রণয় আসার সময় লাল্টু-কে খবর দিয়ে এসেছিল। প্রণয় বাড়িতে আসার পর পরই লাল্টু এসে হাজির হল আর বলল নিজের কাজের চাপে দেখভাল করতে পারেনি। বাড়িটার খুব খারাপ অবস্থা।

প্রণয় বলল, হ্যাঁ তা তো দেখতেই পাচ্ছি গ্রামের খুব উন্নতি হয়েছে কিন্তু আমাদের বাড়িটার অবস্থা জীর্ণ হয়ে এসেছে।

লাল্টু বলল, গ্রামের উন্নতি হয়েছে তো মলয়ের জন্য। মলয় ভোটে জিতে পার্টির নেতা হয়েছে। ও-ই গ্রামের রাস্তা মেরামত করেছে। এছাড়া গ্রামের যত উন্নতি দেখছ সব মলয়ের জন্য হয়েছে। মলয় তোমাদের বাড়িটার কথা বলছিল। যদি তুমি বাড়িটা বিক্রি করতে চাও বা ফ্ল্যাট তুলতে চাও তাহলে মলয় বলেছে তোমার সাথে দেখা করবে। কিন্তু এখন তোমাদের বাড়িটা থাকার অবস্থায় নেই। তুমি আমাদের বাড়িতে দুদিন থেকে সব ঠিকঠাক করে যাও।

প্রণয় বলল, একটা লোক দেখে দাও আমাদের বাড়ির একটা ঘর পরিষ্কার করে দেবে। তাহলে আমি আমাদের বাড়িতেই থাকব ভাবছি। আর আমি মা-র সাথে কথা বলে নেব। মা যা বলবে সেইমতো বাড়িটাকে নিয়ে ভাবব।

ঠিক আছে আমি লোক এনে তোমার জন্য একটা ঘর পরিষ্কার করে দিচ্ছি কিন্তু খাবার আমাদের বাড়ি থেকে দিয়ে যাব কেমন? প্রণয় বলল, তাই হবে। মাকে ফোনে সব কথা বলে মা-র মতামত জানতে চাইল প্রণয়।

মাস্টারমশাই মারা যাওয়ার পর প্রণয়ের মা ছেলের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিলেন। তাই উনি ছেলেকে বলেই দিলেন তুই যা করবি তাতেই আমার মত আছে। মায়ের কথা শুনে একটু নিশ্চিন্ত হল প্রণয়। তারপর ঘরে ঢুকে দেখল আলো জ্বলছে না। লাল্টুকে ডাকল। লাল্টু এসে বললে ইলেকট্রিকের লোক এসে লাইন কেটে দিয়েছে। আমি তোমাকে মোমবাতি ও দেশলাই দিয়ে যাচ্ছি।

কিছুক্ষণ পরে লাল্টুর পাঠানো লোক এসে ঘর পরিষ্কার করে দিয়ে গেল। ঘরে তেমন কিছু ছিল না। একটি খাট ও আলমারি ছিল তাতে ধুলো পড়ে আছে। চারদিকে উইপোকা বাসা করে আছে। তবে বাড়ির চাপাকলটা ভালো আছে। কেন-না পাড়ার সবাই এই কল থেকেই খাবার জল নেয়। একটু বাদে লাল্টু এসে মোমবাতি, দেশলাই, জল, খাবার, একটি বালিশ ও একটি চাদর দিয়ে গেল।

সন্ধে হতেই প্রণয় মোমবাতি জ্বেলে দিল। ঘরে বসে প্রণয়ের ছোটোবেলা থেকে বাইরে যাওয়ার আগে পর্যন্ত সব কথা একে একে মনে পড়ছে। ছোটোবেলায় বাবার হাত ধরে স্কুলে যাওয়া, কত মজা হতো, মা তার পছন্দের টিফিন বানিয়ে দিত। আর স্কুলের বন্ধুদের সাথে সেই টিফিন ভাগ করে খাওয়া। স্কুল ছুটির দিনে পাড়ার বন্ধুদের সাথে মাঠে গিয়ে ফুটবল খেলা, বন্ধুরা মিলে সবার গাছ থেকে ফল পেড়ে খাওয়া, সেসব ছিল খুব মজার দিন।

প্রণয়দের বাড়ির সামনে প্রদীপদের বাড়ির সকলের সাথে খুব ভালো সম্পর্ক ছিল। মাসিমা মা-র অনেক কাজে সাহায্য করে দিত। এখন মাসিমা ও মেসোমশাই কেউ বেঁচে নেই। প্রদীপ ও পরিতোষ দুই ভাই একসাথে ভালোই আছে। নানা স্মৃতির কথা ভাবতে ভাবতে রাত আটটা বেজে গেল। প্রণয় খাবার ও জল খেয়ে খাটের উপর চাদর বিছিয়ে শুয়ে পড়ল। কিন্তু সারারাত প্রণয়ের ভালো ঘুম হল না। যখনই চোখে ঘুম আসছে তখনই মা বাবা ও তিন ভাইবোনের একসাথে থাকার কথা মনে আসছে।

সবাই মিলে পুজোর জন্য জামাকাপড় কেনা, ভাইফোঁটার দিন কত আয়োজন হতো বাড়িতে। বোন কত আদরের ছিল। এখন বিয়ে পর বোন অনেক দূরে থাকে। দাদাও বিদেশে থাকে। সবাই মিলে আগের মতো একসাথে আর আনন্দ করা হয় না। এরকম নানাকথা ভাবতে ভাবতে শেষ রাতে চোখে যেই না ঘুম জড়িয়ে আসছে, স্বপ্নের মধ্যে দেখতে পেল বাবা এসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলছে, কী রে ভালো আছিস খোকা? বাড়িতে এসে পুরোনো সব কথা মনে পড়ছে জানি। জানিস তো এই বাড়িটা আমার আর তোর মায়ের খুব সখের এবং ভালোবাসার বাড়ি। আর এটা যে তোদের জন্মভিটে। খোকা বাড়িটা বিক্রি করিস না। বাড়িটা মেরামত করে মাকে নিয়ে এসে মাঝেমধ্যে থাকবি। দেখবি তোর মায়ের খুব ভালো লাগবে আর আমিও খুব শান্তি পাব।

প্রণয়ের ঘুম ভেঙে গেল আর খাটের উপর বসে স্বপ্নে দেখা বাবার কথাগুলো ভাবতে লাগল। কিছুক্ষণ পরেই সকাল হলে ফ্রেশ হয়ে ড্রেস পরে নিল। লাল্টু চা বিস্কুট দিয়ে গেল। আর জঙ্গল পরিষ্কার করার জন্য লোক আসবে বলে গেল। বেলা ১১টার সময় জঙ্গল পরিষ্কারের লোক এলে, প্রণয় বলে দিল কোনও গাছ না কেটে শুধু বাড়ি পরিষ্কার করে দিলেই হবে।

প্রণয়ের মাথার মধ্যে স্বপ্নে দেখা বাবার কথাগুলো ঘুরপাক খেতে লাগল। আর এদিকে বাড়ি পরিষ্কার হচ্ছে দেখে পাড়ার অনেকে এসে বলতে লাগল, প্রণয় শুনলাম তোমাদের বাড়িটা নাকি বিক্রি করে দেবে?

না ঠিক সেরকম কিছু ভাবিনি, তবে কী করব সেই নিয়ে চিন্তা ভাবনা করছি।

আমরা বলছি কি বাড়িটা তোমার বাবা অনেক কষ্ট করে বানিয়েছিলেন এবং তোমার মা-বাবার খুব সখের বাড়ি। বাড়িটা বিক্রি না করে যদি মেরামত করে মাকে নিয়ে এসে মাঝেমাঝে থেকে যাও, তাহলে আমাদের খুব ভালো লাগবে।

ঠিক আছে, মা-র সাথে কথা বলে দেখি কী করা যায়।

 

প্রণয় মনে মনে ভাবতে লাগল যে গ্রামের মানুষজন এখনও ওদের এত ভালোবাসে। সত্যি প্রমোটারের কাছে বাড়িটা দিলে বাগানের গাছপালা কিছুই আস্ত থাকবে না আর এত সুন্দর বাড়িটাকে ভেঙে ফ্ল্যাট বাড়ি তৈরি করবে। অবশ্য মা, দাদা ও বোন সবাই একই কথা বলেছে যে, আমি যা করব তাই হবে। এরকম নানা কথা ভাবতে ভাবতে দুপুরের খাবার খেয়ে একটু বিশ্রাম নিয়ে বিকেলে বাড়ির বাগানটা ঘুরে দেখতে লাগল প্রণয়।

মা-র হাতে লাগানো স্থলপদ্ম গাছটায় কত ফুল ফুটে আছে, আর বাবার হাতে লাগানো বাতাবি লেবু গাছটায় কত বাতাবি লেবু হয়ে আছে দেখে প্রণয়ের খুব ভালো লাগছে। কিন্তু বাগানের ভিতর ঢুকতেই প্রণয়ের মনে হতে লাগল গাছগুলি ওকে দেখে যেন খুশিতে ডালপালা নাড়তে লাগল আর গাছের ফুলগুলো যেন হাসতে হাসতে বলছে, আমরা খুব আনন্দ পেয়েছি তুমি এসেছ বলে। আমাদের কেটে নষ্ট করে দিও না। বেলা পড়তেই সন্ধে হয়ে এল। প্রণয় হাত পা ধুয়ে ঘরে এসে মোমবাতি জ্বেলে খাটের উপর বসল। কিছুক্ষণ পরেই লাল্টু রাতের খাবার ও জল দিয়ে গেল। কিছুক্ষণ মা-র সাথে ফোনে কথা বলে ৯টার সময় খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ল।

পরদিন সকাল হতেই প্রণয় দেখল লাল্টু চা আর সঙ্গে করে দুজনকে নিয়ে এসেছে। প্রণয় জিজ্ঞাসা করল, কাদের নিয়ে এসেছ?

গ্রামের দুটো ছেলেকে নিয়ে এসেছি, তোমাদের বাগানের গাছগুলোকে কাটার জন্য। বড়ো গাছগুলোকে বেচলে ভালো টাকা পাওয়া যাবে, ফলে তোমারও লাভ হবে আর আমরাও কিছু পাব।

প্রণয় একটু মুচকি হেসে বলল, সব বুঝতে পারছি তবে এখনই কোনও গাছ কাটার দরকার নেই কেমন?

ঠিক আছে দাদা তুমি যা বলবে তাই হবে। তাহলে আমরা আসছি, দুপুরবেলা এসে খাবার দিয়ে যাব।

প্রণয় ভাবছে পাড়াপ্রতিবেশীরা এখনও তাদের বাড়িটাকে ও তাদেরকে এত ভালোবাসে। না এলে বুঝতে পারত না। তাই বাড়িটাকে বিক্রি করা বা প্রোমোটারের হাতে দেওয়া কোনওটাই প্রণয়ের পছন্দ হচ্ছে না। রাতে ঘুমোতে গিয়ে প্রণয় ভেবে নিল বাড়িটা সে বিক্রি করবে না। বাড়িটাকে মেরামত করে মাকে নিয়ে মাঝে মাঝে এসে থেকে যাবে। মা, বাবা ও ভাই-বোনেদের প্রচুর স্মৃতি আছে বাড়িটাতে। আর মা গ্রামের বাড়িতে এসে আবার থাকতে পারবেন জানলে খুব খুশি হবেন। এইসব ভাবতে ভাবতে প্রণয় ঘুমিয়ে পড়ল।

পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে প্রণয় সব গুছিয়ে নিল কেন না অফিসের ছুটি শেষ। কলকাতায় ফিরেই অফিসে যেতে হবে। হঠাৎ দেখল লক্ষ্মী এসে হাজির। লক্ষ্মী প্রণয়দের বাড়িতে অনেক বছর কাজ করেছে। প্রণয়ের মা ও বাবাকে মা-বাবা বলে ডাকত আর সবাইকে নিজের মনে করে ভালোবাসত। বাবা নেই শুনে লক্ষ্মীর চোখে জল চলে এসেছে। প্রণয়কে বলল, দাদা শুনলাম বাড়িটা নাকি বিক্রি করে দেবে তোমরা।

না রে লক্ষ্মী এখনও কিছু কথা হয়নি।

তোমাদের বাড়ির সাথে অনেক দিনের সম্পর্ক। এই বাড়ি ও তোমাদের ওপর খুব মায়া আমার। তাই বলছি বাড়িটা বিক্রি না করে ঠিকঠাক করে মাকে নিয়ে মাঝেমধ্যে এসে থেকে যেও। দেখবে আমি এসে মা-র সব কাজ করে দেব।

ঠিক আছে লক্ষ্মী তোর কথা রাখার চেষ্টা করব। আজ আমি কলকাতায় ফিরে যাচ্ছি। আমি মাকে নিয়ে এলে তোকে জানাব।

লক্ষ্মী চলে যাবার পর লাল্টু খাবার নিয়ে এল আর বলল, বিকেলে মলয় আসবে তোমার সাথে বাড়ি বিক্রি নিয়ে কথা বলার জন্য।

প্রণয় বলল, আজ আমি কলকাতায় ফিরে য়াচ্ছি। মলয়কে বলে দিস বাড়ি বিক্রি করব না। বাড়িটা মেরামত করে ও রং করে নিয়ে মাঝেমধ্যে এসে থাকব। তুই বাড়িটা একটু দেখে রাখিস। কেউ যেন গাছগুলোকে না কাটে।

লাল্টু অবাক হয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল, কলকাতায় থাকার পর তোমরা গ্রামে এসে থাকতে পারবে? তোমাদের অসুবিধে হবে না?

নিশ্চয় এসে থাকব। এটা যে আমাদের ভাই-বোনের জন্মভিটে। আর আমাদের ছোটোবেলার সব স্মৃতি যে এই বাড়িতে। আমার মা ও বাবার প্রাণের বাড়ি। এমনকী এই গ্রামের বাতাস ও মানুষের ভালোবাসা আমাদের অনেকদিন বাঁচতে সাহায্য করবে।

 

পড়ার জন্য সীমাহীন গল্প-নিবন্ধসাবস্ক্রাইব