চল ফুলি, তোর নামে ব্যাংক-এ একটা অ্যাকাউন্ট খুলে দিই। তোর ভালো নামটা কীরে?

মেয়েটা লজ্জা লজ্জা মুখ করে বলেছিল ফুলেশ্বরী।

– ফুলেশ্বরী? কী সুন্দর নামটা রে তোর। তোকে নিয়েই তাহলে সিনেমাটা হয়েছিল। সন্ধ্যা রায় ছিল না? স্ত্রীকে জিজ্ঞাসা করলেন রজতকান্তি।

রজতকান্তির স্ত্রীর নাম চন্দ্রিমা। সায় দিলেন।

রজতকান্তি বললেন– মেয়েটা এতদিন আছে, ভালো নামটাই জানি না। ফুলি নামে ডাকি।

ফুলি বলে, না, আমার নামে ব্যাংক-এ বই খুলতে হবে না। আপনার কাছে টাকা আছে, ওটাই ঠিক আছে।

রজতকান্তি বলে, মোটেই ঠিক নেই। আমি মরে গেলে?

ধুর, খালি বাজে কথা।

মানুষ চিরকাল বাঁচে নাকি? একবার তো হার্ট অ্যাটাক হয়েই গেল। তোর সব টাকা তোর অ্যাকাউন্ট-এ রেখে দেব।

কিন্তু অ্যাড্রেস প্রুফ? আইডেনটিটি প্রুফ? ওর তো ভোটার কার্ডই নেই। গত ভোটের আগে একবার ভোটার কার্ড করার চেষ্টা করেছিলেন রজতকান্তি, হয়নি। ওরা চেয়েছিল ব্যাংক অ্যাকাউন্ট, পাসপোর্ট, প্যান কার্ড এসব কত কিছু।

তোর রেশন কার্ড আছে না একটা?

জানি না।

জানি না মানে? ছিল তো নিশ্চয়ই।

ঠোঁট উলটে ফুলি মাথা নাড়ায়। মানে জানে না।

তার মানে ফুলির ভারতের নাগরিকত্বের কোনও প্রমাণ নেই।

ফুলি কবে থেকে এখানে? মামণি যখন মাধ্যমিক দিল। ফুলির মা বলেছিল, মেয়েটাকে আপনারা রাখুন। বারো বছর বয়স হ’ল ওর। ওর উপর কুনজর পড়েছে। সকালে চলে আসি, ঘরে একা থাকে মেয়ে। ওকে খাওয়া পরায় রেখে দিন। তার মানে বারো বছর হয়ে গেল এ বাড়িতে।

আগেকার সময় হলে চেষ্টা চরিত্র করে একটা রেশন কার্ড করে নেওয়া যেত। এখন শহুরে মধ্যবিত্তরা রেশন-এর চাল খায় না। রেশন দোকান থেকে গম নিয়ে চাকিতে দিয়ে আটা ভাঙানোর দিনও আর নেই। এখন সবাই আটাই কেনে। রেশন-এর দোকানে আজকাল মুদি দোকানের মতোই মশলা, সাবান, এমনকি প্রসাধন সামগ্রীও বিক্রি হয়। রজতদেরও রেশন কার্ড আছে। মাসে একবার গিয়ে যা হোক কিছু নিয়ে আসা হয়। রেশন কার্ড করাতে গেলে বলবে আগের কার্ডখানা নিয়ে আসুন, যদি বলা হয় আগে কার্ড ছিল না– তখন বলবে এত বছর বয়সেও কার্ড নেই? ঠিকানার প্রমাণ, বয়সের প্রমাণ, ভোটার কার্ড…। ফুলির তো কিচ্ছু নেই। এই যে চব্বিশটা বছর ধরে পৃথিবীতে রয়েছে, তার কোনও প্রমাণ নেই। ফুলিকে কেউ চিঠিও দেয় না।

দেশের বাড়িতে ফুলি ক্লাস ফাইভ অবধি পড়েছিল। এ বাড়িতে আসার পর চন্দ্রিমা মাঝেমধ্যে পড়াতে বসত। দোকানের নাম পড়তে পারে, মুদির হিসেব পড়তে পারে, টিভির সিরিয়ালগুলোর নাম পড়তেও অসুবিধে হয় না তার– এমনকী যুক্তাক্ষর দিয়ে লেখা কঠিন কঠিন নাম যেমন স্বয়ংসিদ্ধা, অগ্নিপরীক্ষা এসবও পড়তে পারে। ওকে কেউ চিঠি দিলে, ও পড়তে পারবে। উত্তরও দিতে পারবে। একদিন বলেছিল দিদিকে। দিদি মানে এ বাড়ির মেয়ে। রজত-চন্দ্রিমা ওকে মামণি ডাকে, ওর আসল নামটা খুব কঠিন, মন্দাক্রান্তা। মামণি তো আদরের ডাক। ফুলি তো সেটা বলতে পারে না, আবার মন্দাক্রান্তাকে ছোটো করে মন্দ দিদি বলা যায় নাকি? জেঠিমা-ই বলে দিয়েছে মিষ্টি দিদি ডাকতে। ফুলি একদিন বলেছিল ও মিষ্টি দিদি, আমাকে একটা চিঠি দেবে?

কী চিঠি?

এমনি চিঠি। আমার নামে আসবে বেশ…

কী লিখব?

যা খুশি…।

তার চে বরং তোকে একটা মেল আইডি বানিয়ে দিচ্ছি, চ্যাট করবি বেশ।

আসলে পাত্তাই দেয়নি।

ঝন্টুদাকে ও বলেছিল একটা চিঠি দেবেন আমাকে? এমনি চিঠি।

ঝন্টুদা দিয়েছিল।

রজতকান্তি বলেছিল ফুলি, তোর নামে আলাদা পাসবই বোধহয় হবে না, আমি তোর টাকাটা আমার নামেই রাখছি, তোকে নমিনি করে দিচ্ছি, আমার কিছু হয়ে গেলে তুই সেটা পাবি। আমার নামে হলেও ওটা তোরই টাকা। তোর মা বলেছিল খাওয়া-পরায় রাখতে। আমি কিন্তু তোকে মাইনেও দিচ্ছি। হিসেব করে দেখলাম তোর তিরিশ হাজার টাকার উপর পাওনা হয়ে গেছে। বলে রাখলাম এগুলো তোর টাকা। তুই এখন তিরিশ হাজার টাকার মালিক। এই টাকায় আমি হাত দেব না। তোর যা খুশি, যেভাবে ইচ্ছে খরচ করবি। তোর বিয়েতেও এই টাকা খরচ করব না ফুলি। তোর বিয়ের খরচ আমাদের। মামণির বিয়েটা মিটে যাক, তারপর তোর জন্য পাত্র দেখা শুরু করব। তোকে বিয়ে দিয়ে আমরা দুজন কোনও বৃদ্ধাশ্রমে চলে যাব।

মিষ্টি দিদির বিয়েটা ঠিক হয়ে গেছে। ঠিক হয়ে গেছে মানে দিনটা। বিয়েটা তো আগেই ঠিক ছিল। মিষ্টি দিদির বরকে তো ফুলি কবে থেকেই চেনে। পার্থদা। এ বাড়িতে আসে। মিষ্টিদির ঘরে বসে গল্প করে। তখন ওঘরে কেউ যায় না। ঘরের বাইরে থেকে জিজ্ঞাসা করে, এবার চা দিয়ে যাব? কখনও মিষ্টি দিদি নিজে এসে চা আর জলখাবার নিয়ে যায়। খুব বড়ো চাকরি করে পার্থদা। মিষ্টিদিও তো চাকরি করে। কম্পুটারি চাকরি। পরশু দিন বিয়ে। বাড়ি রং করা হয়েছে। ইলেকট্রিকের কাজ করা হয়েছে, বাড়িতে অনেক লাইট লাগানো হয়েছে। ছাদেও লাইটের ব্যবস্থা হয়েছে। বিয়েটা এবাড়িতে হবে না। বিয়েবাড়ি ঠিক করা হয়েছে। কাল থেকেই লোকজন আসবে। মামা-মামি আসবে। দু’জন কাকু আসবে। ওরা সবাই মিষ্টি দিদির মামা-মামি। মিষ্টি দিদির কাকা-কাকু। ফুলিরও। ফুলির কে আছে? কেউ নেই। মা মরে গেছে, ব্যস, হয়ে গেল। কেউ নেই। শুধু ঝন্টুদা আছে।

ঝন্টুদা এবাড়ির সব ইলেকট্রিক-এর কাজকর্ম করে। ফ্যান খটখট, টিউব লাইটে ভোঁ ভোঁ, গিজার খারাপ– সব ঝন্টুদা করে। ফোন করে দিলেই চলে আসে। ঝন্টুদাকে চা করে দেয় ফুলি। চায়ে চুমুক দিতে দিতে মিটিমিটি তাকায় ফুলির দিকে।

ঝন্টুদা প্রথম আদর করেছিল ছাদে। সরস্বতী পুজোর প্যান্ডেল করার সময়। পুজোর আগের দিন। বাড়িতে সরস্বতী পুজো হয়। ছাদে ছোটো করে প্যান্ডেল হয়। খিচুড়ি হয়। দিদিমণির বইপত্তর আর ল্যাপটপ না কি যেন বলে, সেটা রাখে। ওখানে ফুল চন্দন পড়ে। পাড়ার অনেকে আসে। আদরের সময় ফুলি বলেছিল– এমা, এখানে না, ঠাকুর দেখে ফেলছে। ঝুন্টদা বলেছিল ঠাকুরের এখন চোখ ঢাকা। কেউ ছিল না ছাদে। বাড়ির পাম্পের কাজ করতেও ছাদে যেতে হয়। চৌবাচ্চায় ওঠার মই ধরতে হয় ফুলিকে। পাম্পটা তো প্রায়ই খারাপ হয়। ঝন্টুদা বলে পাম্পটা কি ভালো বল, তোকে আর আমায় ছাদে এনে দেয়।

ঝন্টু ফুলির কাছ থেকে জেনে নিয়েছিল-এ বাড়ির কে কোথায় শোয়। দোতলায় তিনটে ঘর। একটা ঘরে মিষ্টি দিদি। একটা ঘরে জ্যাঠা-জেঠি আর একটা ঠাকুরঘর।

একতলায় রান্না খাওয়া। একটা ড্রইংরুম। কেন যে ড্রইংরুম বলে কে জানে। ওখানে কোনও ড্রইং হয় না। ওখানে গদিওলা চেয়ার আছে। একটা টিভিও আছে। আর একটা ঘরে ফুলি থাকে। ফুলির ভয় করে না। ওর নীচে থাকতেই ভালোলাগে। বারবার দরজা খোলা-বন্ধ করা ফুলিকেই তো করতে হয়।

ঝন্টুদা বলেছিল ফুলি, তুই দারুণ। খুব মিষ্টি। তোকে ছুঁলে আমার গায়ে ইলকট্রিক শট্ লাগে। তোর লাগে? ফুলি মাথা নীচু করে বলেছিল দুষ্টু কোথাকার। এটা কিন্তু ওর নয়, হাসিরাশি সিরিয়ালের হাসির ডায়লগ। ঝন্টুদা বলেছিল তোকে আমি একদিন অনেকটা পেতে চাই। অনেকক্ষণ ধরে।

ওমা! সেকি কথা। নানা… এটা কোনও সিরিয়ালের নয়, ফুলির নিজের।

ঝন্টুদা বলেছিল– না করিস না ফুলি। তোকে আমি স্বপ্ন দেখি। স্বপ্নে আদর করি। আমার বোনটাকে বিয়ে দিয়ে তোকে আমি বিয়ে করে তোর সঙ্গে সংসার করব। তোর কেউ নেই, আমারও কেউ নেই। একদিন ফুলি, আমি রাতে তোর ঘরের জানালায় টোকা দেব…।

না– এমন কথা বলে না, বলে পালিয়ে গিয়েছিল ফুলি সেদিন।

তারপর ঝন্টুর ওই কথাগুলো তোলপাড় করেছে ফুলিকে। স্বপ্ন। স্বপ্নে স্ক্রু, নাটবল্টু আর তারের মালা জড়ানো ঝন্টুদা বলছে সংসার! সংসার।

পার্থদা আর মিষ্টি দিদি যে একসঙ্গে থেকেছে! পর্দা ফেলা, কখনও দরজা বন্ধ। তার বেলা?

এখন না হয় বিয়ে হবে। কিন্তু এর আগেও তো কতদিন…

রাস্তায় দেখা হতে ঝন্টুদা বলল, কিরে ফুলি। কতদিন দেখি না। তোদের বাড়ির কিছু খারাপও হচ্ছে না দেখছি। তোকে না দেখে আমার তো মেনসুইচ খারাপ হয়ে গেল। ফুলি, মাইরি বলছি, তোকে যেদিন ফার্স্ট দেখেছিলাম না, আমার ফিউজ উড়ে গিয়েছিল। প্লিজ মাইরি, একদিন ব্যবস্থা কর। আমি তোর ঘরে আজ রাতে টোকা দেব।

ফুলি বলেছিল– না-না, টোকা নয়, টোকা নয়, কেউ শুনে ফেলবে।

ঝন্টু বলেছিল– তুই তো বলেছিলি তোর জ্যাঠা-জেঠি দশটার সময় শুয়ে পড়ে। দিদি মনে কানে ছিপি গুঁজে কম্পুটারি করে। কে শুনবে?

ফুলি বলেছিল– না না, টোকা দেওয়া খুব খারাপ। শুনে ফেলবে।

ঝন্টু বলেছিল তাহলে সাইকেলের বেল বাজাব। টিরিং। রাস্তায় তো সাইকেল চলতেই পারে। আজ ঠিক রাত সাড়ে এগারোটায় টিরিং, কেমন!

রাত্রে টিরিং। ঝন্টুদার হাতে একটা সাইকেল বেল। খুব আস্তে দরজা খুলে গেল। ফুলির ঘরে ঝন্টু। ঝন্টু বলেছিল কোনও ভয় নেই ডার্লিং, সব ব্যবস্থা নিয়ে এসেছি।

ঝন্টুদা এক ঘণ্টা বাদে চলে গিয়েছিল। রাস্তার আলোয় তখন শ্যামাপোকা, কার্তিকের কুয়াশা। নিমগাছের পাতায় পাতায় – না যেও না… রজনীর তখনও বাকি।

এরকম টিরিং হয়ে গেছে আট দশ বার। প্রতিবারই ফুলি ঝন্টুর কানে ফিসফিস করে বলেছে আর নয় কেমন, বিয়ের পরে আবার।

একমাসের উপর কোনও টিরিং হয়নি। আজ হ’ল। হ’তে পারে এটা সত্যিসত্যি সাইকেলের টিরিং। কান খাড়া করে শুনল। চলমান সাইকেলের একটা আলাদা টিরিং ধবনি থাকে। রাত্রির অন্ধকারে আবার ছোট্ট একটা টিরিং।

দু’দিন পর বিয়ে। মেয়ে চলে যাবে। বড়িতে এখন এসব ঠিক নয়। তাছাড়া বাড়িতে এ সময়ে ঘুম কমে যায়। কাল সকালেও এসেছিল ঝন্টুদা। ছাদে লাইট লাগাতে। কোনও কথা হয়নি। কিচ্ছু বলেনি ঝন্টুদা। যাবার সময় শুধু বলে গেল ছাদের দরজাটা বড্ড পলকা জ্যাঠামশাই, ঠিক করিয়ে নেবেন। জ্যাঠামশাই বলেছিলেন মিস্তিরিগুলোর বড্ড ডাঁট বেড়েছে। বললে আসে না। একটা মিস্তিরি পাঠিয়ে দিও কাল। দেখছি, বলে চলে গেল। একটি বারের জন্যও ফুলির দিকে তাকাল না। অভিমান হয়েছিল। একমাস হয়ে গেল বলে ঝন্টুদার খুব কষ্ট হচ্ছে।

আস্তে আস্তে দরজার ছিটকিনিটা খুলল ফুলি।

ছিটকিনি খুলতেই একজন লোক ফুলির মুখ চেপে ধরল। অন্য একজন ফুলির দুটো হাত পিছনে নিয়ে বেঁধে দিল। মুখের উপর আঠালো কী একটা জিনিস চেপে দিল। তারপর একটা কাপড় দিয়ে মুখ বেঁধে দিল। একজন ফুলির মুখটা খামছে ধরল। গলাটাও। বুকের কাছেও হাত দিয়ে খামচে দিল। বলল চুপ করে এখানে দাঁড়িয়ে থাক।

ফুলি উপরে উঠে যাবার পায়ের শব্দ শুনল।

ফুলির তো পা বাঁধা ছিল না। ফুলি উপরে উঠতে গেল ওদের পেছন পেছন। একজন ওকে ধাক্বা দিয়ে ফেলে দিল। ফুলি দেখল ওরা চারজন। না। ওদের মধ্যে ঝন্টুদা ছিল না।

ফুলি উপরে গেল না। নীচে দাঁড়িয়ে রইল। একটু পরই দরজা ধাক্বানোর শব্দ শুনল। একটা প্রচন্ড আওয়াজ যেন কিছু ভেঙে পড়ল। জেঠিমার গলার আওয়াজ শুনল– কী? কী হয়েছে রে ফুলি?

ফুলি শুনল– একটা পুরুষ কণ্ঠ– কোনও আওয়াজ করবেন না। একদম চুপচাপ। চ্যাঁচামিচি করলে আপনার মেয়েকে রেপ করব সবাই মিলে। চাবিটা দিন।

পাঁচ মিনিটও নয়। ওরা চলে গেল। একজন বলে গেল– আমরা ছাদের পলকা দরজাটা ভেঙে ফেলেছি। পুলিশ এলে বলবি ছাদের দরজা ভেঙে ঢুকেছিলাম আমরা। তুই দরজা খুলেছিস বললে ফেঁসে যাবি। ওদের হাতে একটা লাল ব্যাগ আর একটা কালো ব্যাগ। আর কিচ্ছু নেই।

ওরা চারজন চলে গেল। ওদের মধ্যে ঝন্টুদা ছিল না।

ফুলি উপরে উঠল। ঘরে আলো জ্বলছে। আলমারির দরজা হাট করে খোলা। আলমারির ভিতরে লকারের খোপটাও খোলা। খাটের উপর বসে আছে জ্যাঠামশাই, মুখের উপর সাদা রঙের কী একটা আটকানো, মুখ থেকে অদ্ভুত কিছু আওয়াজ বের হচ্ছে। ফুলিও চিৎকার করছে, কোনও আওয়াজ পাচ্ছে না। জ্যাঠামশাইয়ের হাত পিছনে বাঁধা। জেঠিমাকে দেখতে পাচ্ছে না। বাথরুম থেকে দরজা ধাক্বা দেবার শব্দ। পাশের ঘর থেকেও দরজা ধাক্বানোর শব্দ। ফুলি দেখল দিদিমণির ঘর এবং বাথরুমের বাইরের ছিটকিনি বন্ধ। ফুলি ওর বাঁধা হাত দিয়ে পিছন ফিরে বাথরুমের দরজাটা খুলে দিতে পারে। জেঠিমা বাথরুম থেকে বেরিয়ে এসে প্রথমেই বলল মামণি কোথায়, মামণির কিছু হয়নি তো? জেঠিমা দিদিমণির ঘর থেকে দরজা ধাক্বানোর শব্দ পায়। বাইরে থেকে লাগানো দরজাটার ছিটকিনি খুলে দেয়। দিদিমণিও বেরিয়ে আসে। ওর বাবার মুখের আঠা লাগানো সাদা জিনিস খুলে দেয়। জ্যাঠামশাই এতক্ষণ ধরে কিছু বলার চেষ্টা করছিল। ওটা খুলে দেবার পর শব্দহীন ফুলির মুখটাও খোলা হল। কান্না এল দলা দলা।

পিছনে বাঁধা হাতটা কাটা পাঁঠার মতো ছটফট করছে।

কী হয়েছিল বল?

ফুলিকে জিজ্ঞাসা করল মন্দাক্রান্তা।

আমি জানি না, আমি জানি না…। ও নিজের মুখটা ঢাকতে চায়, কিন্তু হাত বাঁধা।

পুলিশ বলল যে-মেয়েটা আপনাদের কাছে থাকে, ওর ভোটার কার্ড আছে?

রজতকান্তি মাথা নাড়ায়।

এনি অ্যাড্রেস প্রুফ?

মাথা নাড়ায় রজতকান্তি।

মেয়েটা কে তবে?

মেয়েটা ভালো। এর মা এখানে কাজ করত। মা মরা মেয়ে…

ফুলি শুনছে ঘরের পাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে।

পুলিশ বলছে– লকার থেকে গয়না তুলে এনেছেন এটা আর কে জানত?

আমি, আমার স্ত্রী আর মেয়ে।

ওই মেয়েটা?

ও কী করে জানবে?

যারা চুরি করেছে ওরা তো জানত। চিন্তা করে দেখুন কখনও মেয়েটাকে বলেছেন কিনা।

না। বলিনি।

ক’জন ছিল?

চারজন। নাকি আরও বেশি…

কীভাবে এল?

ছাদের দরজা ভেঙে।

দরজা ভাঙার শব্দ পেয়েছিলেন?

পেয়েছিলাম।

মেয়েটা কোথায় ছিল তখন?

মেয়েটা বাধা দেবার চেষ্টা করেছিল। ওর গলায় ঘাড়ে নখের আঁচড়। ভাগ্যিস আর কিছু করেনি।

আপনার মেয়েকে কিছু করেনি তো? গায়ে-টায়ে…

না-না-না, আমার মেয়ের গায়ে ওরা হাত দেয়নি। একদম হাত দেয়নি। আমার মেয়ে যে-ঘরে শোয় সেই ঘরের দরজাটা প্রথমেই ওরা বাইরে থেকে বন্ধ করে দিয়েছিল। আমার মেয়ে আনটাচড, আমার মেয়ে আনটাচড।

মেয়েটাকে ডাকুন। পুলিশ অফিসার বলে।

ফুলির বুকের ভিতরে কীরকম বিচ্ছিরি টিরিং টিরিং টিরিং। ওর বুকের ভিতরের শিরাগুলো কেঁপে কেঁপে উঠছে। ছলাৎ ছলাৎ রক্ত ছিলিক দিচ্ছে প্রতিটি টিরিং, তার চেয়ে আমাকে রেপ করে মেরে ফেললেই তো পারত ঝন্টুদা। আমাকে বলতে হবে পৃথিবীতে কোনও টিরিং নেই। কোনও টিরিং হয়নি কখনও। কোনও টিরিং শুনিনি জীবনে। আমাকে দেখাতে হবে আমার গলার, আমার ঘাড়ের, বুকে লেগে থাকা নখের আঁচড়। বাধা দেওয়ার প্রমাণ। প্রমাণ রেখে গেছ, ঝন্টুদা কত দয়া তোমার। ভুল ভাবছি, ভুল। ঝন্টুদা ছিল না। উপরে কাঠের দরজাটাও ভেঙে দিয়ে গেছে। তোমরা তো উপর থেকেই এসেছিলে। দরজা ভেঙে। দরজাটা তো পলকাই ছিল। ছিটকিনিও পুরোনো। ঝন্টুদা, তুমি তো আগেই বলে দিয়েছিলে– দরজাটা ভালো নেই।

ফুলি… কোথায় রে তুই… পুলিশ সাহেব ডাকছেন। যা দেখেছিস বলবি…।

পুলিশের গলা শোনা যায়– এখন এই মেয়েটা নয়। আপনার মেয়েকে ডাকুন। এক এক করে সবাইকে জিজ্ঞাসা করব। আপনারা বাইরে যান। একদম বাইরে। যখন বেল বাজাব এক জন করে আসবেন, দরজা বন্ধ থাকবে।

বন্ধ দরজার এপারে খাবার টেবিলে বসে আছে ওরা। ড্রইংরুমে পুলিশের দুজন লোক। দিদিমণি ভিতরে গেল। দরজা বন্ধ। বাইরের টেবিলে এক বৃদ্ধ, এক বৃদ্ধা এবং মেয়েটা।

ফুলি দেখল ওরা দুজন ফুলির দিকে তাকিয়ে আছে।

ফুলি বলল কী হবে জ্যেঠু?

রজতকান্তি বলল, কী আর হবে? আরও কত খারাপ হতে পারত। ভগবানের দয়ায় আমাদের মেয়ে দুটো বেঁচে গেছে। গয়না না হয় গেছে। গয়না ছাড়াই বিয়ে দেব…।

ফুলি বলল আপনি যে বলেছিলেন, আমার টাকা আছে আপনার কাছে, ওই টাকা দিয়ে মিষ্টি দিদির গয়না কিনে নিন।

ওতে আর কী গয়না হবে? সেসব তোকে ভাবতে হবে না।

জেঠিমা বলল– পুলিশের ঝামেলা এখন না করলেই হতো। এখনই তো লোকজন আসবে।

তারপর আর কোনও কথা নেই ঘরে।

এতক্ষণ কী জিজ্ঞাসা করছে পুলিশ? রজতকান্তি স্বগতোক্তি করে। তারপর আবার নিশ্চুপ সবাই। চেনালোকই এর পিছনে আছে। যারা সব জানে। ছাদের দরজাটা যে পলকা সেটাও তো জানে। কে হতে পারে ফুলি? ঝন্টু?

জোরে মাথা নাড়ায় ফুলি।

ঝন্টুদা, তোমার চিঠিটা সকালবেলায় বাথরুমে নিয়ে গিয়েছিলাম। যেসব ভালোবাসার কথা লিখেছিলে, সব কুচি কুচি করে ছিঁড়েছি, তারপর পায়খানার প্যানে ফেলে দিয়ে জল ঢেলে দিয়েছি। আমি তো জানি, তুমি ছাড়া আর কেউ টিরিং শব্দ জানে না। তুমি আর আমি। সেই টিরিং তুমি অন্যদের বলেছ। আর আমি, এই শব্দের গোলোক আমি কোথাও ভাঙবনা। এই কৌটোবন্দি শব্দের ঢাকনা কোথাও খুলব না। পুলিশ যদি মারে, তবুও না। যদি জেলে ভরে দেয়, তবুও না।

তুমি কি সত্যি সত্যি তোমার বোনের বিয়ে দেবে? বিয়েতে টাকার দরকার। জানি তো। ওর বিয়ে হয়ে গেলে যদি তুমি আমাকে চাও? আমার সঙ্গে সংসার চাও? তাহলে কী করব? কী বলব? তোমায় আমি?

দিদিমণি চলে এল।

পুলিশের কঠিন স্বর– এবার কাজের মেয়েটাকে পাঠান।

ওঘর থেকে শব্দ আসছে টিরিং… টিরিং… টিরিং…।

 

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...