অন্য নদীর গল্প

অফিস থেকে বাড়ি ফিরে আসবার সঙ্গে সঙ্গে মা বলল, ‘শৌভিকের একটা চিঠি এসেছে, রেজিস্ট্রি পোস্টে। পিওনটা মহা পাজি, আমাকে কিছুতেই দিতে চাইছিল না। অনেক করে বলবার পর দিল।’ রেজিস্ট্রি পোস্টের ব্যাপারটা শুনেই আমার একটু খটকা লাগল। এই তো দিন সাতেক আগে ওর সাথে ফোনে কথা হল। শুধু বলল, ‘বাড়িতে একটা ছোটো অনুষ্ঠান হবে, ইনভাইট করব।’ কিন্তু সেদিনও তো চিঠির ব্যাপারে কিছু বলেনি।

শৌভিক আমার কলেজের বন্ধু। আমরা দুজন কলেজ থেকে ইউনিভার্সিটি পর্যন্ত একসঙ্গে থেকেছি, খেয়েছি, পড়েছি। আমাদের দুজনের বাড়িও কাছাকাছি ছিল। আমি থাকতাম তেঘড়িয়া, আর ওরা কেষ্টপুরে। এখন অবশ্য ওরা এক নম্বর গেটের কাছে নতুন বাড়ি কিনেছে, আর আমাকে আসতে হয়েছে বীরভূম জেলার এক গ্রামে। শৌভিক চাকরির চেষ্টা করেনি। ইউনিভার্সিটি থেকে বেরিয়ে পারিবারিক ব্যাবসার খুঁটি ধরে বেশ জাঁকিয়ে বসেছে। ওর দাদার আবার পারিবারিক ব্যাবসা ছাড়াও আরও কী সব ব্যাবসা রয়েছে। তাদের বউরাও পারিবারিক ব্যাবসাতে সাহায্য করে। ওর দাদার এক মেয়ে, পড়াশোনার সূত্রে বাইরে থাকে। শৌভিকের এখনও পর্যন্ত সন্তান হয়নি। বাড়িতে একা থাকে শৌভিকের মা। কাকু বছর তিন আগে মারা যান।

কলেজ বা ইউনির্ভাসিটিতে পড়বার সময় প্রায় দিনই সময়ে অসময়ে ওর বাড়ি চলে যেতাম, কতদিন ওদের বাড়িতে থেকেছি, খেয়েছি তার হিসেব নেই। এখন অবশ্য আর সেরকম ভাবে ওদের বাড়িতে থাকা হয় না, সেরকম ভাবে কেন বলব, একরকম হয়ই না। ইউনিভার্সিটির পাঠ শেষ হওয়ার পরের কয়েক বছর বেকারত্বের জ্বালা রগড়াতে রগড়াতে সরকারি চাকরি পেলাম। তবে খুব ভালো চাকরি নয়, পঞ্চায়েত অফিসের সহায়কের চাকরি। প্রথম সপ্তাহে বাড়ি থেকে যাতায়াত করলাম। কিন্তু সপ্তাহের শেষে মনে হল, এই তেঘড়িয়া থেকে বাসে বাদুড় ঝুলে হাওড়া স্টেশন, সেখান থেকে ট্রেনে বোলপুর স্টেশন, তারপর বাস থেকে নেমে সাইকেল, এত সবের পর অফিস করে বাড়ি ফিরতাম প্রায় জাম্বি হয়ে। কোনওদিন আটটা বাজত, কোনওদিন নটা। তারপর কারওর ভালো কথাও খারাপ লাগত।

আমার বাবার কোনও ব্যাবসা ছিল না। বাবাও আমার মতো সরকারি কর্মচারি ছিল, তবে কেন্দ্রীয়। চাকরি জীবনে সংসার খরচ, আমাদের দুই ভাইয়ের পড়াশোনার খরচ বাদ দিয়ে যে-ক’টা টাকা বাবা জমাতে পেরেছিল, তা দিয়ে একতলার এই বাড়িটা ছাড়া আর কিছু হয়নি। তাও আবার চাকরি শেষ হবার ছয়মাস আগে কাউকে কিছু না বলে, বাবা চলে গেল। আমি, দাদা পিতৃহারা হলাম। দাদার পড়াটা সেই সময় শেষ হয়ে গেছিল। কিন্তু দাদা স্থানীয় একটি রাজনৈতিক সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েছিল। কম্পিউটার নিয়ে পড়াশোনা করবার সুবাদে দাদা বিভিন্ন কোম্পানিতে চাকরির জন্য ইন্টারভিউ দিচ্ছিল। সেই অবস্থাতেই বিশেষ প্রভাব খাটিয়ে একটি বড়ো কোম্পানির চেন্নাই অফিসে পোস্টিং নিয়ে দাদা চলে গেল। ফোন করত, চিঠি লিখত, কিন্তু মায়ের মন তো, চোখের আড়াল হলেই চোখের জল ফেলত। আমি আমার সাধ্যমতো চেষ্টা করলেও খুব বেশি বোঝাতে পারতাম না। এর মধ্যেই আমার বেকারত্বের জ্বালা আরম্ভ হল। একই বাড়িতে থেকেও কিছুটা অসামাজিক হয়ে পড়লাম। নিজের চাকরির পরীক্ষার প্রস্তুতির মধ্যে, কোথা দিয়ে যে সময় চলে গেল বুঝতেই পারলাম না। এই সময় মা আরও একা হয়ে গেলেও আমার কিছু করবার ছিল না। মাঝে মাঝে শৌভিকদের বাড়িতে কাকিমাকে দেখলেই নিজের মায়ের কথা মনে পড়ে যেত।

শৌভিকদের বড়ো বাড়ি, তবে সবাই ব্যস্ত, ব্যতিক্রম শুধু কাকিমা। বয়সে কাকিমা মায়ের থেকে কয়েক বছরের বড়ো। ওদের বাড়িতে গেলেই কাকিমাকে দোতলার ব্যালকনিতে বসে থাকতে দেখতাম। ‘কেমন আছো?’ জিজ্ঞেস করলেই, এক বুক হতাশা নিয়ে বলত, ‘এই বাড়িটার মতো।’

তারপরেই কাকু মারা যাওয়ার পরে কীভাবে শূন্যতা, একাকিত্ব, কাকিমাকে গ্রাস করেছিল, তার বর্ণনা দিতে আরম্ভ করত। আমার তখনই নিজের মায়ের কথা মনে পড়ে যেত।

বাড়ি ফিরে মায়ের পাশে বসে কিছুক্ষণ গল্প করতে ইচ্ছে করত, করতামও। সেই দিন থেকে পরের কয়েকটা দিন নিয়ম করে বসে গল্প করবার মাধ্যমে মায়ের সাথে সময় কাটাতাম।

কয়েক দিন পরেই অবশ্য মা বলে উঠত, ‘তুই তোর পড়াশোনা কর, আমি ঠিক আছি।’ আমি আবার বাধ্য ছেলের মতো পড়াশোনাতে মন দিতাম।

এমনি ভাবেই চলছিল। তারপরেই চাকরি পেলাম। অফিসের কাছে একটা বাসা দেখে মাকে বললাম, ‘কাজের খুব চাপ, এবার থেকে আমার বাড়ি ফিরতে রাত্রি বারোটা, একটা হতে পারে।’

ভীতু মনের মা সঙ্গে সঙ্গে জিজ্ঞেস করল, ‘ওখানে থাকবার কোনও ব্যবস্থা করতে পারবি না? না হলে তো তুই অসুস্থ হয়ে যাবি।’

আমি একটা বাড়ি নেওয়ার কথা জানাতেই মা বলে উঠল, ‘তাহলে তো আর অসুবিধা নেই। তুই ওখানেই চলে যা। আগে তো তোর শরীর।’

জিজ্ঞেস করলাম, ‘আর তুমি? তোমারও তো বয়স বাড়ছে।’

তুই আমার কথা ভাবিস না। আমি ঠিক থাকব। তাছাড়া চুয়ান্ন বছর বয়সটা কোনও বয়স নয়, তোর কাছে মাঝে মাঝে গিয়ে তো থাকব। বুকুর কাছেও চলে যাব।

তার থেকে তুমিও আমার সঙ্গে চলো। এই ঘরটা তালাবন্ধ থাক। শনি, রবি তো আমার ছুটি, চলে আসব। তাছাড়া আরও তো ছুটি আছে, ছুটি থাকলেই এখানে চলে আসব।

তা হয় না, এটা তোর বাবার তৈরি বাড়ি। এখানে আশেপাশের সবাই আমাকে চেনে। প্রয়োজনে বিপদে আপদে আমার পাশে দাঁড়াতে পারবে। তাছাড়া তোর বাড়িতে থাকলেও সারাটা দিন তো তুই অফিসে থাকবি। আমাকে ঘরের মধ্যে ভূতের মতো একাই থাকতে হবে। ওখানে একা থাকবার থেকে এখানে একা থাকাটাই ভালো।

এরপর আমি আর কোনও কথা না বলে, আমার নেওয়া বাড়িতে চলে গেলাম। প্রথম প্রথম একাই রান্না বা অন্য কাজকর্ম করতাম। মাস দেড় পরে একটা রান্না করবার ছেলে পেলাম। ছেলেটি প্রতিদিন সকাল সন্ধে রান্না করে দিয়ে যেত। আমি রবিবার রাত্রে বাড়ি থেকে অফিসের গ্রামে চলে এসে আবার শুক্রবার কোলকাতা ফিরে যেতাম। থাকল একা মা, আর বাবার তৈরি করা বাড়ি।

এমনিভাবেই পাঁচ মাস কাটল। এই পাঁচ মাসে চাকরির জায়গায় বেশ সুনাম অর্জন করলাম। প্রধান থেকে পার্টির স্থানীয় নেতাদের সাথে সখ্যতা বাড়ল। সেই সঙ্গে নতুন আরেক উপদ্রব আরম্ভ হল। অবশ্য এই উপদ্রবে শরীর মন, ভবিষ্যতের এক অলীক আনন্দের জন্য বেশ শিহরিত হয়ে উঠত। কিন্তু মা, দাদা জীবিত, তাই এই ব্যাপারে নিজেই কোনও সিদ্ধান্ত নিয়ে নিতে আমার মরালিটিতে বাধল। দাদা তখনও পর্যন্ত সংসার করেনি।

এই সব সাতপাঁচ ভেবেই মায়ের অনিচ্ছা সত্ত্বেও, আমার বাড়িতে কয়েকদিনের জন্যে মাকে নিয়ে এলাম। দুদিনের মাথায় শৌভিকের এই চিঠি।

হাত মুখ ধোয়ার আগেই খাম খুলে চিঠিটা বের করে পড়লাম। মা পাাশ থেকে জিজ্ঞেস করল, ‘কী লিখেছে?’

‘সামনের শনিবার ওদের বাড়িতে নিমন্ত্রণ করেছে। অবশ্যই যাওয়ার জন্য লিখেছে। তোমাকেও নিয়ে যেতে বলেছে।’

আমি জানি, মা শেষের কথাগুলো শোনেনি। এত তাড়াতাড়ি কলকাতাতে ফেরার কথা শুনে, মনে মনে বেশ খুশি হয়ে গেছে। বুঝলাম যে-কাজে মা এসেছিল সেটা এবারে খুব বেশি দূর এগোতে পারবে না। সেই শনিবার আমি একাই সন্ধেবেলা শৌভিকদের বাড়ি পৌঁছলাম। আগেই জানতাম, বাড়িতে কিছু একটা উৎসব হচ্ছে। এটা অবশ্য নতুন কিছু নয়। ওরা প্রায় দিন বিভিন্ন কারণে উৎসব করে, তা সে নিজেদের বিবাহবার্ষিকী হোক, বা ছেলে মেয়েদের জন্মদিন, ওদের বাড়ি আলোতে সেজে ওঠে, সেই সঙ্গে এলাহি খাওয়াদাওয়া। শৌভিকদের বাড়িতে কোনও অনুষ্ঠান মানেই, আমার নিমন্ত্রণ পাকা। মায়েরও থাকে, তবে মা, সব অনুষ্ঠানে যায় না।

শৌভিকদের বাড়ি পৌছনো মাত্রই বউদি এগিয়ে এসে আমাকে ঘরের ভিতর নিয়ে গেল। আমি বউদিকে বললাম, ‘আমাকে যে শৌভিক এমনি আসতে বলল। কিন্তু তোমাদের বাড়িতে তো দেখছি বড়ো কিছু অনুষ্ঠান হচ্ছে। আমি কিন্তু কী অনুষ্ঠান কিছুই জানি না, কোনও কিছু উপহার আনতে পারিনি।’

আমার কথা শেষ হওয়ার আগেই শৌভিকের বউদি বলে উঠল, ‘আমরা এই অনুষ্ঠানের বিষয়ে কাউকে বলিনি। সবাইকে অবাক করে দেওয়ার জন্যেই শুধু চিঠি দিয়ে নিমন্ত্রণ করলেও কী অনুষ্ঠান সে বিষয়ে কিছুই জানানো হয়নি। আর তুমি তো আমাদের ঘরের লোক, তুমি আবার উপহার কি আনবে?’ আমি আর কথা না বাড়িয়ে খাওয়াতে মন দিলাম।

নিমন্ত্রিতদের সংখ্যা খুব বেশি নয়। একশো দশ পনেরো হবে। আমার তো সবাইকে মনে হল আমারই মতো অবাক হওয়াদের দলে।

কিছু সময় পরে শৌভিকের সাথে দেখা হল। মা, না আসবার কারণ জিজ্ঞেস করতেই শৌভিক বলল, ‘আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করো ব্রাদার উত্তর পেয়ে যাবে।’

অন্য সব অনুষ্ঠানের মতো এবারেও ওদের বাড়িতে খাবারের অঢেল আয়োজন। সেইসব খাবার টুকটাক খেতে খেতে অন্য সবার সাথে কথা বলছি, এমন সময় শৌভিকের দাদা মাঝখানে দাঁড়িয়ে আমাদের সবাইকে অনুষ্ঠানে আসবার জন্য ধন্যবাদ জানাল।

আমাদের মধ্যে থেকে একজন বলে উঠল, ‘আরে, আমরা তো কেউই কোন অনুষ্ঠানে এসেছি, সে সব কিছুই জানি না, সেটা আগে বল।’

দাদা মুচকি হেসে আমাদের আরও কিছুসময় অপেক্ষা করতে বলে ভিতরে চলে গেল।

অবশ্য আমাদের খুব বেশি সময় অপেক্ষা করতে হল না, কিন্তু তারপর যা দেখলাম, প্রথমে আমার নিজের চোখ দুটোকেই বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। এরকম কিছু একটা দেখব, তা স্বপ্নেও ভাবিনি। আমার মতো যারা নিমন্ত্রত হয়ে এসেছিল, তারা প্রায় সকলেই কয়েকটা মুহূর্তের জন্য বাকরুদ্ধ হয়ে গেল। একটা চাপা গুঞ্জনও আরম্ভ হল।

আমি কারওর সাথে কোনও কথা আলোচনা না করলেও সব কিছু দেখে অবাক হয়ে গেলাম। চোখ বন্ধ করলেও ভেসে উঠল একটাই ছবি, কনের সাজে কাকিমা, পাশে ষাটোর্দ্ধ এক ভদ্রলোক, সঙ্গে শৌভিকদের বাকি সবাই।

মা একা থাকবে বলে, আমি বেশিক্ষণ থাকতে পারলাম না। অল্প একটু খেয়ে, মায়ের জন্যে খাবার পার্সেল করে তাড়াতাড়ি বাড়ির দিকে পা বাড়ানোর প্রস্তুতি নিলাম। শৌভিকের থেকে বিদায় নেওয়ার সময় জিজ্ঞেস করলাম, ‘কী করে সব হল?’

শৌভিক খুব স্বাভাবিক ভাবেই বলল, ‘তুই তো জানিস, আমরা সবাই ব্যাবসা নিয়ে ব্যস্ত থাকি। দাদার মেয়েটাও হস্টেলে। একা থাকতে থাকতে মা ডিপ্রেশনের পেশেন্ট হয়ে যাচ্ছিল। আর কয়েক দিন চললে অন্য রকম বিপদ হয়ে যেতে পারত। ডাক্তার দেখালাম। ডাক্তার বললেন, কম্পানির প্রয়োজন। কিন্তু আমাদের মধ্যে সেরকম কে কম্পানি দেবে বলতো? একটা আয়া ঠিক করলাম। মায়ের সাথে সবসময় থাকত, তার সাথেই মর্নিংওয়াকে বের হতো। এই মর্নিংওয়াকের সময় কাকুর সাথে আলাপ পরিচয়। মায়ের সাথে বন্ধুত্ব হল। বাড়িতে কাকু আসতে লাগলেন। দেখলাম কাকু বাড়িতে আসাতে মা বেশ হাশিখুশি থাকত, সাজগোজ করত। একদিন কাকুই প্রস্তাবটা মাকে দিলেন। মা প্রথমে আপত্তি করেছিল। কাকু তখন দাদার সাথে কথা বলেন। এরপর আমরা সবাই আলোচনা করতে বসি। আলোচনাতে অনেক কিছু কনফিউশন মিটিয়ে তারপর এই অনুষ্ঠান।’

শৌভিক সেদিন ব্যস্ত ছিল। আমাকে বলল, ‘পরে আরেকদিন আসবি, চুটিয়ে আড্ডা দেব।’ তারপরেই ওদের সবাইকে বিদায় জানিয়ে, মোবাইলে কাকিমা আর নতুন কাকুর একটা ছবি তুলে, বাসস্ট্যান্ডের দিকে পা বাড়াতেই, কানে এল নিমন্ত্রিতদের মধ্যে মাঝবয়সি এক মহিলা মোনোপজ সংক্রান্ত আলোচনা করতে করতে গাড়িতে উঠছে।

আমাদের হয়তো সব বয়সেই বিশেষ কারওর কম্পানির প্রয়োজন হয়। অনেক সময় এই কম্পানি ছেলে, মেয়ে, নাতি, নাতনি দিয়ে পূরণ করা যায় না। আমরা এত কিছু বুঝি না, বুঝতে চাইও না। ইনফ্যাক্ট আমার নিজের মায়ের ব্যাপারেও এতসব ভাবার প্রয়াজন আছে বলে, মনে করিনি। এমনকী মায়ের কাছে গেলে এরপরেও অন্য কিছু ভাবব।

বাড়ি ফিরতেই মা জিজ্ঞেস করল, ‘কিরে, শৌভিকদের বাড়িতে কী ছিল?’

আমি খুব স্বাভাবিক ভাবেই বললাম, ‘কাকিমার বিয়ে।’

‘কী বাজে বকছিস! বড়োদের নিয়ে কেউ এমনি কথা বলে?

মা রেগে গেল। আমি সঙ্গে সঙ্গে মাকে সবকিছু ভালো ভাবে বলে, কিছুক্ষণ আগে মোবাইলে নেওয়া কাকিমাদের ছবিটা দেখালাম। মা সব কিছু দেখে কোনও কথা না বলে নিজের ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়ল। আমি জামাকাপড় বদলে একটু ইতস্তত করে মায়ের ঘরে গিয়ে বললাম, ‘ঘুমোলে?’

মা শুয়ে শুয়েই উত্তর দিল, ‘না, কিছু বলবি?’

‘দাদাকে একটা ফোন করব?’

‘কেন?’

‘না, মানে তুমিও তো একা থাকো, তাই ভাবছিলাম…’

মা কিছু সময় চুপ করে শুয়ে থাকল। আমিও আর কোনও কথা না বলে আস্তে আস্তে মায়ের ঘর থেকে বের হওয়ার জন্যে পা বাড়াতেই মা বলল, ‘বুকু আজ ফোন করেছিল, পরের সপ্তাহে আসছে।’

 

আপসনামা

কুড়ি পাতা দীর্ঘ আট পরিচ্ছদের গল্পটার ফোটোকপির বদলে হাতে লেখা মূল পাণ্ডুলিপি চেয়ে নেওয়ায় মনটা একটু খুঁত খুঁত করছিল। তবে আনন্দও হচ্ছিল। লিটিল ম্যাগাজিন হলেও, এই প্রথম কেউ বাড়ি বয়ে এসে লেখা চেয়ে নিয়ে যাচ্ছে, তাও শারদ সংখ্যার জন্য। তখন কি ঘুণাক্ষরে আঁচ পেয়েছিল, এই অমল চক্রবর্তীই পুজোর পর শ্রীতমা ফোন করলে কিছুতেই নেটওয়ার্ক পাবে না এবং বিরাটাকার গল্পটা ‘পরিব্রাজক’-এর দফতরে না পৌঁছে নিরুদ্দেশ হয়ে যাবে। হতচ্ছাড়া নির্ঘাত অন্যত্র নিজের নামে ছাপিয়েছে।

আর একটা সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। বন্ধুপ্রেম। অমলের পরম বান্ধব মৃত্যুঞ্জয় ঘোষের সাথে শ্রীতমার একটা মনোমালিন্য হয়েছিল। এমন তস্করবৃত্তির প্রেরণা নিজের যশলোভ, না বন্ধুর প্রতিশোধস্পৃহা কে জানে। বন্ধুটি তো কবি, গল্পকার, ঔপন্যাসিক, সম্পাদক, সঞ্চালক, সংগঠক ইত্যাদি ইত্যাদি অনেক কিছু। সাড়ে ষাট হাজার শব্দের একটা স্বাস্থ্যকর সুপুষ্ট গল্প তার কাজে লাগবে বেশি। অবশ্য সবটাই অনুমান। হতেই পারে শ্রীতমাকে খানিকটা হয়রান করে মজা পাওয়াটাই একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল। তারপর থেকে কাউকে লেখা দিলে ভীষণ দুশ্চিন্তায় থাকতে হয়। কিন্তু লেখা চাইলে দেবে না এত হুপো দেখানোর জায়গায় পৗঁছোয়নি শ্রীতমা। তাছাড়া বড়ো পত্রিকায় লেখাগুলো পড়া হয় কিনা, তাই নিয়েও সংশয় থাকে। তাই বিশ্বাস করতেই হয় কাউকে না কাউকে। যেমন এখন করছে গৌরব পাত্র নামে এক মাঝবয়সি লেখককে এবং দেবপ্রিয় দামকে।

দেবপ্রিয় দামের প্রযোজনা সংস্থায় শ্রীতমা যোগাযোগ করেছিল কন্যা ও নিজের মডেলিং-এর জন্য। সে সব কিছু না হলেও শ্রীতমার একটি কবিতার বই কিনেছিল দেবপ্রিয়। সেখান থেকেই বইটা পড়ে অমল চক্রবর্তী, শ্রীতমার কবিতার প্রতি আগ্রহ দেখায়। সেই সূত্রেই অমলের পত্রিকা ‘পরিব্রাজক’এর সঙ্গে সম্পর্ক শুরু ছড়া ও কবিতা দিয়ে। অমলের বন্ধু হিসাবেই আলাপ মৃত্যুঞ্জয়ের সাথে। আলাপ থেকে প্রলাপ। প্রলাপের পর বিলাপ। এক সময় – শ্রীতমার তখন একুশ, কারও সাথে অ্যাফেয়ার আছে শুধু এই গুজবটুকুর জন্য ওর জীবনের শ্রেষ্ঠ অনুভূতিটা পূর্ণতা পায়নি। সঙ্কল্প সরে গিয়েছিল নীরবে। আজ চল্লিশ ছুঁই ছুঁই বয়সে সে বিবাহিতা এবং এক সন্তানের জননী – এগুলোও অধুনার প্রেমপ্রার্থীদের নিরস্ত করার পক্ষে যথেষ্ট নয়। এক নাছোড়বান্দা ছোকরাকে তো রুঢ়ভাবেই কাটাতে হয়েছে, কারণ ভালো ব্যবহার প্রশয় দেওয়ার সমার্থক হয়ে যাচ্ছিল। সমাজ এতটাই বদলেছে যে নিজেকে সেকেলে লাগে। অবশ্য তলিয়ে দেখলে আধুনিকতার বুলি আসলে আদিম রিপুর ছদ্মবেশ।

মৃত্যুঞ্জয় ঘোষ ওর চেয়ে বছর দুই তিন বড়োই, এখনকার প্রজন্মের মধ্যে পড়ে না। তবে আঁতেল সমাজে নাম লেখানো ব্যাটাছেলেদের ছোঁকছোঁকানির লাইসেন্স থাকে। প্রথম আলাপ অমল চক্রবর্তীর সাথে শ্রীতমার ফ্ল্যাটে ‘পরিব্রাজক’ সঙ্গে এনে। এক কাপ চা-ও স্পর্শ করেনি। দুর্দান্ত গরমে শরবত দিতে চাইলে বাধা দিয়ে বলেছিল, ‘ওসব মেয়েলি ড্রিংক’। পরে শ্রীতমাও বার কয়েক রহড়ায় ওর বাড়ির আড্ডায় গিয়েছিল। ক্রমশ ফোনে কথা হলে শ্রীতমাকে মদ্যপান ও চুম্বনের ওপর থিসিস শোনানো শুরু করে।

ধরা যাক মৃত্যুঞ্জয় শ্রীতমাদের বাড়ির কাছাকাছি এসেছে শুনে শ্রীতমা ভদ্রতার খাতিরে বলল, ‘তাহলে দেখা করে যান।’ প্রশ্ন এসেছে, ‘গেলে কী খাওয়াবেন?’

‘আগে খবর দিয়ে এলে আয়োজন রাখতাম। এখন না হয় চা পান করবেন টা সহযোগে। শরবত মেয়েলি পানীয় হতে পারে, কিন্তু চা তো দেখেছি আপনি ঘন ঘন খান।’

‘ধুর মশাই, আপনার কাছে গেলে চা খাব কেন? অন্য জিনিস চাই।’

বিব্রত করেই আনন্দ। সত্যি সত্যি এসে হানা দেয়নি কোনও দিন শ্রীতমাকে বাড়িতে একা পেতে।

শ্রীতমার কবিতার বই হাতে পেয়ে ক্যাটকেটে তির্যক মন্তব্য করলেও একটা দায়সারা প্রশংসাসূচক সমালোচনা লিখে দিয়েছিল। সেটা কোথাও ছাপেনি, শংসাপত্রের মতো নিজেরই সংগ্রহে রাখতে হয়েছে। শ্রীতমার একখানা কবিতাও চেয়ে নিয়ে মৃত্যুঞ্জয় একটি ক্ষুদ্র পত্রিকায় পাঠিয়েছিল। সেটা চটপট ছেপে বেরোনোর পর ফোন করে বলে, ‘আপনার বইয়ের রিভিউ লেখা হল, কবিতা ছাপা হল, আমার তো কিছু প্রাপ্য হয়।’

চড়াক করে মাথায় রক্ত উঠলেও ইঙ্গিতটা উপেক্ষা করতে হল, উদ্ভব অফিস থেকে ফিরেছে।

‘আপনার লেখা তো আমার পাঠানোর অপেক্ষা রাখে না। তবে আপনার বইয়ের রিভিউ আমাকে দিয়ে করাতে চাইলে করতে পারি।’

‘আপনার ভাষায় বলি, আমি হালুম করলাম। পাওনাটাও সেই মতো হয়।’

আর ন্যাকা সেজে থাকা সম্ভব নয়। পরের দিন দুপুরে একটা বার্তা পাঠায় মুঠোফোন থেকে, ‘আপনার সহযোগিতার দাম দিতে না পারায় আমি দুঃখিত।’

সঙ্গে সঙ্গে ফিরতি কল। ঝাড়া পঁয়ত্রিশ মিনিট ধরে বক্তৃতা উপদেশের বন্যা। মৃত্যুঞ্জয় ঘোষ যা করে, মনে ধান্দা নিয়ে নয়। সে যে রসিকতা করেছে সেগুলো আদি রসাত্মক হতে পারে কিন্তু তাতে নাকি যৗনতা নেই। কথাটার মাথা-মুণ্ড বোঝা গেল না। কিন্তু প্রশ্নও করল না শ্রীতমা। লোকটা দর্পিত ভাবে নিজের চরিত্রের সাফাই দিয়ে গেল– ‘সঙ্গ পেলাম না বলে অন্যদের মতো আপনার লেখা প্রকাশে ব্যাগড়াও দেব না। আপনার বাড়ি থেকে আমার বাড়ি কতই বা দূর? সেরকম মতলব থাকলে তো বাড়িতেই যেতে পারতাম। আপনাকে একা পাওয়া কি অসুবিধার ছিল?’… ইত্যাদি। শেষে যোগ করল, ‘কিন্তু ভেবে দেখুন আপনি যদি এটুকুও না নিতে পারেন, তা হলে লোকে আপনার জন্য করবে কেন?’

অতর্কিত আক্রমণের মুখে পড়ে সেদিন আমতা আমতা করে গিয়েছে শ্রীতমা। ঘণিষ্ঠতার স্পষ্ট ইঙ্গিত দিয়েও এমন কথা ঘোরাল যেন শ্রীতমার চিন্তাটাই অপরিচ্ছন্ন। জবাব খুঁজে না পাওয়ার পেছনে কি এই ভয়টাও কাজ করেছিল, প্রভাব খাটিয়ে যদি শ্রীতমার সদ্য তৈরি হওয়া লেখার জায়গাগুলো নষ্ট করে দেয়? ফোন রাখার পর জুতসই জবাবটা মনে মনে সাজানো গেল, ‘আপনার অশালীন রসিকতা বরদাস্ত করে আমায় এগোতে হবে না, নিজের কলমের জোরেই যত দূর পারি যাব।’ আগেও বলবে ভেবেছিল,বলেনি। এবারেও শুনেই গেল। একতরফা।

এর কদিন পরেই তার বন্ধুটি পুজো সংখ্যার জন্য কবিতা নয়, ঐ বড়োসড়ো গল্পটা যাকে নভেলেটও বলা যায়, নিয়ে গিয়েছিল। পুজোর আগে পর্যন্ত ফোন করলে বলেছে, ‘আপনার কপি আপনার বাড়ি গিয়ে দিয়ে আসব।’ কিন্তু পরে যখন অন্য সূত্রে শ্রীতমা পত্রিকাটির শারদ-সংখ্যা প্রকাশের খবর পেল, তখন অমল চক্রবর্তী ফোনের টাওয়ার পাওয়া ছেড়ে দিল।’ ‘হ্যালো, হ্যালো। শুনতে পাচ্ছি না’ পরিব্রাজকের প্রধান সম্পাদককে ফোন করে প্রশ্ন করায় সে তো আকাশ থেকে পড়ল। এমন কোনও লেখা তাদের দফতরে জমাই পড়েনি। বিশুদ্ধ হাপিশ! অন্য কোথাও অন্য কোনও শিরোনামে, স্থান-কাল-পাত্র বদলে, লেখকের নাম বদলে প্রকাশিত হয়েছে কিনা তদন্ত করে দেখা হয়নি। এর পেছনে তার চুম্বন রসিক বন্ধুর কোনও ইন্ধন ছিল কিনা সেটাও প্রমাণিত নয়।

তবে ব্যাপারটা শ্রীতমা, দেবপ্রিয়কে জানায়। মনে হয় দেবপ্রিয় একটু অস্বস্তিতে পড়েছিল। শ্রীতমাকে মডেল বা অভিনেত্রী হিসাবে না হলেও লেখিকা হিসাবে পথ খুলে দেওয়ার ব্যক্তিগত রাস্তাগুলো দেখছিল। অন্তত ব্যাপারটা শ্রীতমার কাছে এমনই। সেই সাথে শ্রীতমার প্রতি মানুষটার একটা আলগা ভালোলাগা যে কাজ করছে, সেটা টের পেলেও তেমন আপত্তিকর বলে মনে হয়নি। শ্রীতমাকে অপমান করেনি, ছুতোনাতায় গায়ে হাত দেবার চেষ্টা করেনি, রুঢ় ব্যবহারও করেনি। বস্তুত দেবপ্রিয় ফোন করলে শ্রীতমা খুশিই হয়। গলাটা বেশ আশ্বাস জাগানো।

‘হ্যালো। শ্রীতমা বলছি।’

‘আরে গুড মর্নিং। কী খবর বলুন?’

‘খবর নিতেই তো ফোন করা। ওই লেখাগুলোর কোনও গতি হয়েছে?’

‘সুখবরটা আমিই জানাতাম। তার আগেই আপনার ফোন এল। ‘পিঁপড়ের রানি’ গল্পটা বাল্যবন্ধুতে পাঠিয়েছিলাম। সুরেন্দ্র নস্কর নামে আমার এক বন্ধুরও লেখা পাঠিয়েছিলাম। ওরা সুরেন্দ্রর কবিতাটা নিয়ে খুঁতখুঁত করছে, কিন্তু আপনার গল্পটা পড়েই পছন্দ করেছে। তা দেখা কবে হচ্ছে?’

‘যবে অ্যাপয়েন্টমেন্ট পাব।’

‘আরে, সুন্দরী নায়িকার অ্যাপয়েন্টমেন্ট পাওয়াটাই তো সৌভাগ্যের। কাল, না কাল একটা কাজ আছে, পরশু আসুন। আছেন কেমন বলুন। কেমন ঘুরলেন?’

‘আমার যে শনি-রবি ছাড়া বেরোনোর উপায় নেই। তাও চূর্ণীর বাবা অফিস গেলে হয়ে গেল। জানেন তো মা বাবাকে নিয়ে বেড়াতে গিয়েছিলাম। মায়ের অ্যাক্সিডেন্টে হিপজয়েন্ট ভেঙে যায়। নড়াচড়া অসম্ভব। ট্রাভেল এজেন্টকে যা দেওয়া হয়েছে, তা তো ফেরত হলই না, কাশ্মীরের কোথাও কিছু না দেখে কাটরায় বাড়তি হোটেল ভাড়া গুণে ফেরার দিন পর্যন্ত বসে রইলাম। কী ভাবে যে একটা গাড়ি নিয়ে জম্মু এসে ফেরার ট্রেনে উঠেছি, তা ভাবলে এখনও অবাক লাগে…!’

‘কেন, বিকেলে কী অসুবিধা?’ লোকটা মায়ের অত বড়ো দুর্ঘটনার কথা শুনেও গ্রাহ্য করল না। শ্রীতমার কথা শেষ করতে না দিয়ে এত বিপর্যয়ের মধ্যেও বলছে দেখা করতে!

‘দুপুর সোয়া দুটো থেকে আড়াইটের মধ্যে চূর্ণী স্কুল থেকে ফেরে। ওকে নাইয়ে খাইয়ে সব সারতে বিকেল সোয়া তিনটে ছাড়িয়ে যায়। মেয়েকে কার জিম্মা করে যাব? যাঁর দায়িত্বে রেখে বেরোতাম, তিনি তো নিজে পাশও ফিরতে পারছেন না। যতক্ষণ আয়া আছে, আছে। তারপর বাকি সময়টা আয়া তো আমিই। খড়দা থেকে বেহালা শখের বাজার– একটুখানি রাস্তা তো নয়। চূর্ণীকে সঙ্গে নিয়ে বেরোতে পারি, কিন্তু ও টায়ার্ড থাকে। ওর কোনও কাজ হলে না হয় কষ্ট দেওয়া যেত। তিন চারটে ট্রান্সপোর্ট চেঞ্জ করে বেহালা যেতেই হয়তো ছ’টা বেজে যাবে। ফিরতে–’

‘আরে, বাচ্চা আনলে আপনার সাথে অভিসারটা হয় কী করে? আজ পর্যন্ত ঠিকমতো প্রেমালাপটাই তো হল না। চলে আসুন সময় করে।’

শ্রীতমা এবার হোঁচট খেল। ভদ্রলোক তাকে অনেকবার সুন্দরী বলেছে। চূর্ণী অর্থাৎ কাজু সম্পর্কেও প্রথম বার উচ্ছ্বাস দেখিয়েছিল। ইন্টারনেটে বিজ্ঞাপন দেখে যেহেতু কন্যার মডেলিং-এর উদ্দেশ্যেই যোগাযোগ, তাই রূপের প্রশংসাটা শংসাপত্র হিসাবেই নিয়েছে বরাবর। শ্রীতমাকে সংস্কার ত্যাগ করে তথাকথিত সাহসী হবার প্রস্তাব দিলেও ব্যবহারের মধ্যে এমন এক মার্জিত ভাব থাকে, যে অসভ্যতা মনে হয় না। আসলে মনে হলে চলবেও না। আলগোছে এড়িয়ে না চটিয়ে যদি সখ্যতা বজায় রাখা যায়। রূপের জন্য দরাজ সার্টিফিকেট দিলেও এবং একাধিক বিজ্ঞাপনের জন্য অফিসে ডেকে বিস্তর আলাপ আলোচনা করলেও আজ পর্যন্ত মা মেয়ে কাউকেই কাজ করায়নি। কেবল শ্রীতমার প্রথম কাব্যগ্রন্থ সাগ্রহে কিনে নিয়েছিল প্রথম সাক্ষাতেই। সেই সূত্রেই পরিব্রাজক এবং জোচ্চুরি কাণ্ড।

চমক সামলে হেসে উঠল শ্রীতমা, ‘দূর মশাই, আমার প্রেমে পড়লে কি অমল চক্রবর্তীর মতো তস্করের সঙ্গে সম্পর্ক রাখতেন? ভয়েস ওভার করার মতো মেল ভয়েস কি নেই বাজারে?’

‘অমলের সঙ্গে অনেকদিন পর কাল যোগাযোগ হল। ওই ফোন করেছিল।’

‘আমার গল্পটার খোঁজ নিয়েছেন?’

‘না, না। সেসব কথা হয়নি। সে এখন বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে নানান ডক্যুমেন্ট্রিতে কমেন্ট্রি করে।’

‘বাঃ! চুরির পুরস্কার? ভালো। ওই যে ডোর বেল বাজছে। মেয়ে চলে এসেছে। দেখছেন, আপনার সাথে কথা বলতে বলতে নীচেই নামা হয়নি। বেচারা ভারী ব্যাগ নিয়ে একাই উঠে এসেছে। ঠিক আছে…’

দরজা খুলে মেয়েকে ঢুকিয়ে নিল শ্রীতমা। ‘রাখছি এখন। চূর্ণীর জন্য কোনও অ্যাসাইনমেন্ট থাকলে দেখুন না। মেয়েটাকে যে দেখে অটো-অটো করে। কিন্তু কোনও কাজই মেটিরিয়ালাইজ করছে না।’

‘ওকেও লাগবে আর একটা অ্যাডে। আগে আপনাকে কাস্ট করি। নেচার কিওরের অ্যাডে আপনাকে লাগতে পারে।’

‘আচ্ছা। ওকে খাওয়াতে হবে। পরে কথা হবে।’

‘আমি কল ব্যাক করব? ধরুন এক ঘণ্টা পরে?’

‘করুন। রাখছি। বাই।’

‘কার ফোন?’ মায়ের গলা। শোবার ঘর থেকে। এসি চালাতে হয়েছে বলে দরজা বন্ধ থাকার কথা। এখন দেখছে খোলা। বোধ হয় বাবা খুলে এসেছে।

সুন্দর মুখের জয় নাকি সর্বত্র। কিন্তু শ্রীতমার ক্ষেত্রে তো বিড়ম্বনা। ওর লেখা যারা পছন্দ করে অথবা যারা করে না, প্রায় সব পুরুষ কবি লেখকই, শ্রীতমা সৌন্দর্যের খাতিরে সুবিধা পাচ্ছে এমন ইঙ্গিত করতে ছাড়ে না। শ্রীতমার কবিতার বইয়ের প্রথম সংস্করণ প্রায় নিঃশেষিত, সবটাই যদিও নিজে ফেরি করে। সেটা নাকি ওর মুখ দেখে, কবিতার গুণে নয়। এমন মন্তব্য কবি নির্মল সমাদ্দারের মতো বরিষ্ঠ মানুষেরও, যাঁর স্নেহ-ছত্রচ্ছায়ায় একাধিক স্তাবক প্রতিপালিত। নির্মলকাকু যথেষ্ট সম্মানিত ও প্রতিষ্ঠিত। তাঁর গাত্রদাহ কীসের? ওঁর পারিষদবর্গ কুড়ি বছর ধরে লিটল ম্যাগাজিনে ঘষ্টেও বেশি দূর এগোতে পারেনি বলে, নাকি শ্রীতমা কবিতার পাশাপাশি গদ্য লিখিয়ে হিসাবেও স্বীকৃতি পেয়ে যাচ্ছে বলে? কোনও নামি বাণিজ্যিক পত্রিকায় গল্প বার হওয়ার কথা জানলেই অভিনন্দন জানাতে গিয়েও বেশির ভাগ কেমন হিংস্র হয়ে ওঠে। স্বয়ং কবিতার বইয়ের প্রকাশকের মন্তব্য, ‘তোমার বই বি ডাবল ও কে – বুক দেখে বিক্রি হয়নি, হয়েছে বয় হ্রস্ব-উ ক – দেখে।’ মাথাটার ভেতরটা দাউ দাউ করে জ্বলে উঠলেও না বোঝার ভান করতে হয়।

শ্রীতমার হাবেভাবে মাঝেমাঝে একটু অপরিণত মনস্কতা ফুটে ওঠে। নিজেও বুঝতে পারে। কাউকে তোয়াজ করে না, বরং একটু অসহিষ্ণু, কিন্তু লেখার জন্য ব্যকুলতা গোপন থাকে না। এটাই কি অপমানের আমন্ত্রক? এ যাবৎ দেবপ্রিয় দামকে তো হিতৈষী বলেই মনে হয়েছে। হঠাৎ কথাবার্তায় এমন লাগাম ছাড়া ভাবগতিক? এর সাথেও সম্পর্ক টিঁকলে হয়। দেবপ্রিয় চেয়েছিল বলেই কয়েকটা লেখার ফোটোকপি দিয়ে এসেছিল, সেখান থেকেই একখানা ‘বাল্যবন্ধু’-তে প্রকাশিতব্য। গল্পটা সন্ধ্যাতারাতেও মনোনীত, কিন্তু কত বছর পরে ছাপবে কেউ জানে না। ‘বাল্যবন্ধু’ টাকা না দিলেও চটপট বার করে দেবে। এই অবস্থায় দেবপ্রিয়কে অসন্তুষ্ট না করাই মঙ্গল।

সারা দিন নানা কাজের ব্যস্ততা, রাতে আয়ার বদলে নাইট ডিউটি। ব্যস্ততার মধ্যেও খচ্খচানিটা বিঁধে রইল। রাত বারোটায় ফোন।

‘বলুন।’

‘বড্ড অসময়ে ফোন করলাম না? কথা বলা যাবে?’

‘এতক্ষণে আপনার এক ঘণ্টা হল? অসময় তো বটেই, বলুন।’

‘নাথিং স্পেসিফিক। ওই নেচার কিওরের অ্যাডটার ব্যাপারে আপনাকে একবার আসতে হবে। পেমেন্ট বেশি নয়। হাজার টাকা। ডাবিংও করতে হবে। ডায়ালগ আছে। ওরাই শিখিয়ে দেবে। এমন কিছু নয়। আপনার আবার উইক-ডে-তে প্রবলেম। একটু দুপুর করেও যদি আসতে পারতেন। ঠিক আছে শনিবারেই আসুন।’

‘বেশ কয়েকবার তো দেখলেন। কোনওটাই শেষ পর্যন্ত মেটিরিয়ালাইজ করল না। আবার বেকার দৌড়াদৗড়ি না হয়। তাছাড়া শনিবার কলেজ স্ট্রিটে গিয়ে কয়েকজনকে লেখা দিতে হবে।’

‘কখন যাবেন?’

‘বিকেল পাঁচটা সাড়ে পাঁচটা নাগাদ পৌঁছোতে হবে।’

‘তার আগেই আমার সাথে দেখা করে যান না। কাজটা ফেলে রাখতে চাই না। আর আপনাকেও অনেক দিন দেখিনি।’

শ্রীতমা নিরুত্তর।

‘কিছু বলছেন না যে।’

‘শনিবার আসুক, দেখব।’

‘শনিবার তো কাজের কথা হবে। একটু অকাজের কথাও তো হওয়া দরকার। আমার তো আপনাকে দেখতে ভীষণ ইচ্ছা করে। একটা ইনোসেন্স আর সেক্স অ্যাপিলের দারুণ কম্বিনেশন। আর এখন কাশ্মীর থেকে ফিরে কাশ্মীর কি কলি হয়েছেন কিনা দেখতে আরও ইচ্ছা করছে।’

‘আপনার কি মনে নেই যে আমার মায়ের অ্যাক্সিডেন্টের জন্য কাশ্মীর ঘোরাই হয়নি? তাছাড়া শর্মিলার তখন বয়স ছিল ষোলো সতেরো। আমি এখন চল্লিশ। এই ভুঁড়িদার চেহারা আপনার ফ্যান্টাসির সাথে মিলবে না।’

শ্রীতমা ওপাশে কোমরতলি ভাঙা মায়ের দিকে তাকাল। এখনও ঘুমোয়নি। মেয়েটাও দিদা আর মায়ের মাঝখানে শুয়ে উশখুশ করছে। ওর গ্রীষ্মের ছুটিতে বেড়াতে গিয়েই বিপত্তি। জানলাহীন বসার ঘরে উদ্ভব মশা তাড়ানো তরল জ্বালিয়ে শুয়ে আছে। এমনিতে মশারি ছাড়া শুতেই চায় না। ফ্ল্যাটের একমাত্র বাতানুকুল ঘরখানা শাশুড়ির জন্য ছেড়ে দিয়ে নিজে কষ্ট করছে। মাকে গাড়িতে তোলা নামানো ছাড়াও বাথরুম ইত্যাদির ব্যাপারেও যেভাবে শ্রীতমাকে সাহায্য করেছে, নিজের ছেলেও পারে না। কলকাতায় ফিরে অবধি তার বিশ্রাম নেই। গাড়ি অ্যাম্বুল্যান্স দৌড়াদৌড়ি তো আছেই, জটিল অপারেশনের অনেকটা খরচই আপাতত উদ্ভব দিয়েছে। মা-বাবা চিকিৎসা বিমার টাকা না পেলে ফেরত নেবে না পণ করে আছে। সারা দিন অফিস ডাক্তার ওষুধ-পত্র করে ফিরে এসে মেয়েকে নিয়ে বসে। তারপর বালিশে মাথা ঠেকাতেই ঘরের বাতাস ওর নাকের গর্জনে মন্দ্রিত হতে থাকে। মেয়ে বাবাকে পাশে না পেয়ে ঘুমোবে না বলে একদিন এই গরমের মধ্যেই বসার ঘরের সরু ডিভানে পাশে শুয়ে উদ্ভবকে সারা রাত এক কাতে রেখেছিল। আর শ্রীতমা!  অসুস্থ মাকে আর মেয়েকে পাশে নিয়ে ঠান্ডা হাওয়া খেতে খেতে মাঝরাতে পরপুরুষের সঙ্গে হেজাচ্ছে? কীসের জন্য? ক্যামেরার সামনে আসার তাগিদটা তো মরেই গেছে, তবু সুযোগ এলে না করতে পারে না বলে? নাকি তার লেখা কবিতা গল্পগুলো যাতে মাঝপথে হারিয়ে না যায়, সেই দুর্ভাবনায়? ওর তো এক্ষুনি ফোন কেটে দেওয়া উচিত। মায়ের নাক বিরতি দিয়ে ডাকছে। কাজু চুপচাপ শুয়ে। উদ্ভবের নাকের শব্দ মাঝে মাঝে ফুঁসে উঠে স্তিমিত হয়ে যাচ্ছে। বসার ঘর থেকে আসা সেই আওয়াজ শ্রীতমাকে কিছুটা আশ্বস্তর সাথে অনেকটা অপরাধবোধে বিক্ষত করছে।

‘কোথায় ভুঁড়ি? ওটুকু না থাকলে তো আইটেম গার্লদের বাজার পড়ে যেত। ওই পেটের নাভিতে চুমু খাওয়াতেই তো মজা।’

‘হোয়াট? আর ইউ ড্রাংক?’ গলাটা চড়ে গিয়েছিল। দাঁতে দাঁত ঘষে গলা নামিয়ে আনল শ্রীতমা। ‘এরকম সর্বনেশে ইচ্ছা হলে তো আপনার সাথে দেখা করাই চলবে না। রাখছি।’

‘এতেই সর্বনাশ বললে কী করে হয়? একটু ইনহিবিশন ত্যাগ করে দেখুন, আপনারও ভালো লাগবে। আর আমি ড্রিংক করি না। যা বলছি পরিষ্কার মাথাতেই বলছি।’

‘পরে কথা হবে গুড নাইট।’

‘গুড নাইট। শনিবার আসার আগে ফোন করে নেবেন। দেখি বাল্যবন্ধু যদি ছাপায় তাহলে জানাব।’

বালিশের ফাঁকে চলভাষ ঢোকানোর পর মায়ের প্রশ্ন, ‘কার ফোন তপা?’

‘আমার কয়েকটা লেখা আছে এর কাছে। আসলে প্রযোজক। আবার হোটেলও আছে শঙ্করপুরে। এখনও পর্যন্ত তোমার নাতনিকে বা আমাকে কোনও কাজ দেয়নি। তবে কয়েকটা পত্রিকায় যোগাযোগ আছে। সেই সূত্রে আমার একটা ছোটোদের গল্প বাল্যবন্ধুতে পাঠিয়েছিল। শুনছি এ মাসেই বেরোবে।’

‘এত রাতে ফোন করে কী এত বকছিল?’

‘আমার মতো বেকার তো নয়। সারা দিন ব্যাবসার কাজে ব্যস্ত। শুটিং-ফুটিংও থাকে। কখনও কখনও সারা রাতই হয়তো জেগে থাকতে হয়।’

মনটা আবার খচ্খচ্ করছে। লোকটা বলল শনিবার যাওয়ার আগে ফোন করতে। তাছাড়া আগে বলেছিল ‘বাল্যবন্ধু’-তে গল্প বেরোচ্ছেই। এখন ‘যদি’ যোগ করল কেন? এভাবে ‘গুড নাইট’ বলে ফোন কেটে দেওয়া কি ঠিক হল? মৃত্যুঞ্জয়ের উপদেশ মনে পড়ল। সামান্য রসিকতাও যদি না নিতে পারে তাহলে লোকে আনস্পোর্টিং ভেবে সাহায্যের হাত গুটিয়ে নেবে। দেবপ্রিয়র মতো একজন হিতৈষীর রসিকতায় বিরূপ প্রতিক্রিয়া জানানোটা কি ঠিক হল? নির্ঘাত রসিকতাই। লোকটার বউ আছে, ছেলে আছে। আর অমন ডাকসাইটে প্রযোজক চাইলেই অনেক অল্পবয়সি সুন্দরী মেয়ে পেতে পারে। হয়তো শ্রীতমার জন্য সত্যিই একটু কোমল জায়গা আছে, অমলের জোচ্চুরির জন্য একটা সংকোচবোধও আছে। কলকাতায় ফিরে এসে শ্রীতমাই তো ফোন করে জানল যে দেবপ্রিয় তার লেখা পাঠিয়েছে যেটা ছাপতেও চলেছে। লোকটা তো পাওনা গণ্ডার হিসাব বুঝে নিয়ে কাজটা করেনি। আজ সকালে শ্রীতমা ফোন না করলে এখন এতসব কথা হতোই না। প্রার্থী যদি তেজ দেখায়, তাহলে ‘নিশ্চিত’ প্রকাশিত হচ্ছেগুলো ‘যদি তবে’র গেরোয় পড়ে যাবে। মাথার বালিশের পাশ থেকে মোবাইল তুলে খানিকক্ষণ ভেবে নিয়ে একটা ‘স্পোর্টিং’ বার্তা পাঠাল, ‘সর্বনেশে কথা শুনতে মন্দ লাগে না, যদি সেগুলো কথার জায়গাতেই থাকে।’

মিনিট কয়েকের মধ্যে ফিরতি দুটো বার্তা। টুংটাং টুংটাং। ‘এ ব্যথা কী যে ব্যথা বোঝে কি আনজনে, আমার আঙুলের আর ঠোঁটের আদর রইল ওই বুকে আর নাভিতে। যদি এসএমএস করার থাকে এক্খুনি করুন। সকালে ফোন সুইচ অন করার পর আর কারও চোখে পড়লে অসুবিধা আছে।’

কান-মাথা গরম হয়ে গেল। শ্রীতমার চলভাষ সারা রাত জাগ্রত থাকে। যা কোনওদিন করে না, তাই করল আজ– সুইচ অফ।

‘কাকে মেসেজ করলে মা?’ কাজু জেগে আছে!

সত্যিই কি শ্রীতমার এই লোকটার সাহায্য দরকার? সে ‘সন্ধ্যাতারা’য় যেসব গল্প ও ছড়া দিয়ে এসেছিল, সেগুলোর মধ্যে দুটো মনোনীত হবার চিঠি পেয়েছে জমা দেওয়ার এগারো মাস পরে। তার পরেও সাত মাস পেরোল। পত্রিকা অফিসে খোঁজ নিয়ে জেনেছে আরও অন্তত বছরখানেক অপেক্ষা করতে হবে। এই গল্পটাও মনোনীত জানল তখন, যখন সেটা অন্যত্র প্রকাশ পেতে চলেছে। এখন সন্ধ্যাতারার ভরসায় বাল্যবন্ধু থেকে গল্পটা তুলেও নেওয়া যাচ্ছে না। কিন্তু শুধু এইটুকুর জন্য মাত্রা ছাড়ানো, মুখোশ খোলা পুরুষটাকে টুইয়ে চলা? ছিঃ!

কিন্তু কিছু প্রাপ্তির জন্য একটু উদার হওয়ার অভিনয় কি খুব দোষের? গত দু বছরে এইভাবে শ্রীতমা অনেককেই শত্রু করেছে। তাদের ক্ষেত্রে সরে আসা ছাড়া উপায় ছিল না। তারা আগেই নিজেদের পাওনাটা আদায়ের তালে থাকত। দেবপ্রিয় কি একটু ব্যতিক্রম নয়? এই লোকটাকে যে ভালো মানুষ বলে শ্রীতমা বিশ্বাস করতে শুরু করেছে। একটা নির্ভরতাও তৈরি হচ্ছে। এই সময় সব কিছু একদিনের ফোনের বাচালতায় নষ্ট করে ফেলতে হবে? নিশ্চই দেবপ্রিয় দাম নিজের কাঁচা আবেগ দেখিয়ে ফেলার জন্য লজ্জিত হবে। হয়তো দেখা হলে ঘুণাক্ষরেও এসব প্রসঙ্গ উল্লেখ করবে না। ভিড়ের মধ্যে সুযোগ খোঁজা পুরুষ যেমন আছে, ভিড় ঠেলে এগিয়ে যেতে সাহায্য করার মতো ভদ্রলোক কি ও দেখেনি ট্রেনে বাসে? কিন্তু….?

মা বোধহয় এখনই বেডপ্যান চাইবে। নড়ছে। মেয়ে কচি হাতে গলায় বেড় দিয়ে গায়ে পা চাপিয়ে বলল, ‘মা, তুমি শুধু গল্প লিখে যাও। আমায় বলো না।’

সকাল বেলা আয়া আসার আগে যথারীতি মাকে বেডপ্যান দিতে হল। শ্রীতমা দু জোড়া একবার ব্যবহারযোগ্য গ্লাভস্ বারবার ব্যবহারের জন্য রেখে দিয়েছে। একটা ও নিজে পরে আর একটা যে আয়া আসে তাকে দেয়। আয়া থাকলে রান্নার মেয়ের খুব একটা দরকার পড়ে না। একটু হাতে হাতে সাহায্য করলে নিজেই চালিয়ে নিতে পারে। তবু পুরোনো রান্নার মহিলা এসে টুকি দেওয়ায় হাতছাড়া করবে না বলে তাকেও বহাল করেছে এই বিপুল খরচের মধ্যে। উদ্ভবই বলেছে।

সকালে বর বেরিয়ে যেতে কম্পিউটারে বসেছে শ্রীতমা লেখা নিয়ে। মাঝে কয়েকদিন খুব উঠে পড়ে লেগেছিল মেয়ের মডেলিং কেরিয়ার গড়বে বলে। নিজেরও ছবি পাঠিয়েছে কয়েক জায়গায়। কেউ ঘরোয়া ছবি চায়, তো কেউ পোর্টফোলিও। বিশেষ সুবিধা না হওয়ায় এখন সে উৎসাহে ভাঁটা পড়েছে। এখন ও লেখালিখি নিয়েই ভাবতে চায়। কিন্তু সেখানেও প্রতি পদক্ষেপে আপোস। মাঝারি পত্রিকাও ভাব করে যেন বিশাল কিছু। তারা কেউ লেখার শিরোনাম বদলে দেয় তো কেউ কবিতার পিণ্ডি চটকে প্রকাশ করে। কেউকেটা নয় বলে অপছন্দসই সম্পাদনাও মাথা পেতে নেয়। আর শ্রীতমার গল্পের প্রতি উচ্ছ্বাস দেখিয়েও গৗরবদার যা মেজাজ। খোঁজ নিলেই বলেন, তাড়া থাকলে লেখা তুলে নাও।

শ্যামের বাঁশি। দেবপ্রিয় ল্যান্ডলাইন থেকে ফোন করছে।

‘তাহলে শনিবার আসছেন তো।’

মুখ ফসকে বেরিয়ে গেল, ‘ফোনটা ড্রিম শেয়ার করছে না দেবপ্রিয় করছে?’

‘দু জনেই। কাজ তো আছেই। প্রেমটাও আছে।’

‘….আসলে আমি একটা ট্রাভেলগ লিখছি। সিকিম ভ্রমণের ওপর। কাশ্মীর দর্শন তো রসাতলে গেল। লেখাটা রবিবারের মধ্যে শেষ করতে হবে, মানে শনিবার বেরোলে অসুবিধা–’

‘আচ্ছা, আপনি লেখার বাইরে কিছু ভাবতে পারেন না, না? আমায় দেখতে ইচ্ছা করে না? আর আপনি কমিট করাতেই কিন্তু অ্যাডটা নিয়ে এগিয়েছি।’

লোকটা নিজের টপিক থেকে সরছে না। একটু চুপ করে থেকে শ্রীতমা বলল, ‘যেতে পারি। কিন্তু বেশিক্ষণ বসব না। কলেজ স্ট্রিটে যেতেই হবে।’

লেখার প্রবাহ ঝিমিয়ে গেল। যেচে বিপদ ডেকে আনছে না তো। উদ্ভবকে জানাতে হবে। একটা ছোটো পত্রিকায় শ্রীতমার খাতিরে দেবপ্রিয় একটা বিজ্ঞাপন দেওয়ার পর উদ্ভব ঠাট্টা করেছিল, দেবপ্রিয় দামকে বিয়ে করলে তোমার বেশ সুবিধা হতো। কিন্তু ইদানীং রাত বিরেতে ফোন এলে বিরক্তি চাপা থাকে না। এতদিন পরস্পরের অনুরাগী বা অনুরাগিনীদের নিয়ে দুজনে খোঁচাহীন নির্দোষ রসিকতাই করে এসেছে। মাঝে মাঝে শ্রীতমাই কপট সন্দহের ভান করে। বারো বছরের দাম্পত্যে কোনও দিন তৃতীয় ব্যক্তি বা সন্দেহের মতো বিষয় দানা বাঁধেনি। এখন সাহিত্যিক পরিচিতি লিপ্সার অপরাধে কি সিনেমা সিরিয়ালে এই বহু ব্যবহূত ক্লিশে বিষয়টার অনুপ্রবেশ ঘটছে? শ্রীতমার একটাই জোরের জায়গা সে বরকে কিছুই গোপন করে না। নিজের পুরোনো কিছু একতরফা অন্ভুূতির কথা লুকোয়নি। কেউ বিরক্ত করলে তো নয়ই। কিন্তু কিছু পাবার আশায় এভাবে? ঠিক পাওয়ার আশাও নয়, যেহেতু একটু সহযোগিতা পেয়েছে তাই সম্পূর্ণ এড়িয়ে যেতেও ভদ্রতায় বাধছে। নাঃ! পানি না ছুঁয়ে মাছ ধরার খেলা ওর জন্য নয়।

মা কিচ্ছু খাচ্ছে না। শরীর ভয়ানক দুর্বল। অন্যের হাতের রান্না পছন্দ না হলেও উপায় নেই। এই অনশনে শরীর আরও বিগড়োলে কে দায়িত্ব নেবে? বাবা? থাক, তার কথা না বলাই ভালো। একেই সারাটা দিন অস্বস্তি আর উশখুশানির মধ্যে কাটছে। দুপুরে মেয়ে স্কুল থেকে ফিরলে তাকে খাইয়ে দাইয়ে স্নান করিয়ে বুকে জড়িয়ে শুয়ে থাকাটা শ্রীতমার ভীষণ প্রিয় ব্যাপার। অনেক অশান্তি অতৃপ্তির উপশম ঘটে বুকের ওপর ছোট্ট হাতের স্পর্শে, পেটে তুলে দেওয়া আলতো পায়ের চাপে। আজ যে এতেও স্বস্তি হচ্ছে না। খানিকক্ষণ আদর করল। ঘাড়ে মুখ গুঁজে ‘বুজকু-বুজকু, মাম্মাম্ মাম্মাম্’ গন্ধ নিল। তবুও না।

বাড়ির যা অবস্থা দুই শোবার ঘর বিশিষ্ট ফ্ল্যাটে বরের সঙ্গে দুটো কথা বলারও অবকাশ ঘটছে না। ডাক্তার, ওষুধ, টেস্ট-রিপোর্ট, মেডিক্লেম, আয়া, ঝি, রাঁধুনি এসবের ফাঁকে কাজুর পড়া, ইউনিট টেস্ট, উদ্ভবের অফিসে আবার ট্রান্সফারের গুঞ্জন। বেশ হয় কলকাতার বাইরে বদলি হলে। যে নগরটিকে নিজের কেরিয়ার, সন্তানের ভবিষ্যতের জন্য একদা গন্তব্য আর বর্তমানে আশ্রয় করেছে, সেখান থেকে পালিয়ে যেতে ইচ্ছা করছে। লেখালিখির জগতে সেরা রাজনীতিকরা বিরাজমান। পৃষ্ঠ দংশন, লেঙ্গি মারা, ঈর্ষা, হরেক কিসিমের নোংরামি। এসবের মধ্যে টিঁকে থাকার চামড়া বা কৗশল কোনওটাই শ্রীতমার নেই। আবার এমন বিরাট মাপের প্রতিভাও ও নয়, যে পর্বত সরিয়ে জায়গা করে নেবে। আর এত দৌড়েই বা কী হবে? পারবে সুনীল, শীর্ষেন্দু, সুচিত্রাদের মতো বছরে ডজন ডজন গল্প, সাত আটখানা করে উপন্যাস, ছোটোদের গোয়েন্দা কাহিনি লিখতে, যদি তেমন বরাত পায়ও? আসলে পারবে না ভাবলেই কান্না পায়।

উদ্ভব আজকাল শ্রীতমার দেহের ভাষা খেয়াল করে না। একটা ভালো মতো চটকাই মটকাই দিলেই পাগলি বউটা শান্ত হয়ে যায়, ভালো করেই জানে। তবু কেন যে না দেখার ভান করছে? আগে বউয়ের সামান্যতম ভাবান্তরও ওর নজর এড়াত না। কোনও দিন কোনও কথায় আহত হলে শ্রীতমা যতই স্বাভাবিক ব্যবহার করুক, ও যে রাগ করে আছে এটা ইঙ্গিতেও প্রকাশ করতে হতো না। এখন ওর চূড়ান্ত অস্থিরতা, বিরক্তি কোনওটাই যেন চোখে পড়ছে না। উদ্ভবের মতো মানুষ বছরের পর বছর পারে নিস্পৃহ থাকতে। শ্রীতমা এগিয়ে না গেলে এমনটাই চলতে থাকবে কোনও সুস্পষ্ট কারণ ছাড়াই। ঘুমের মধ্যে কখনও স্ত্রী-র ঘনিষ্ঠ হবার অনীহা প্রকাশ পেলে মাসের পর মাস আর কাছে আসে না। এখন তো বাড়ি ভর্তি মানুষ। পালানোর অনেক পরিসর। কিন্তু শ্রীতমার যে আদর ছাড়াও আশ্রয় দরকার এই সংকটে।

উদ্ভব অফিস থেকে ফিরেছে। মাকে আজকাল ডিভানে খানিকটা ঠেকের ব্যবস্থা করে দিলে সন্ধে বেলায় টিভি দেখতে পারে। বাবার দখলে রিমোট থাকে। তাই নিয়ে এক দিকে স্ত্রী আর এক দিকে নাতনিকে যুঝে চলে। গ্লোকোমা আক্রান্ত চোখ দিয়ে একটা মানুষ এত টিভিই বা দেখে কী করে, আর এত বই-ই বা পড়ে কী করে? শ্রীতমা বরকে ছোটো ঘরটায় ডাকল, ‘শোনো।’

‘কী?’

‘তুমি তো এখন আমার সাথে কথা বলার সময়ই পাও না। গলা ধরে এল।’

উদ্ভবের ভাবান্তর নেই।

‘ওই দেবপ্রিয় দাম। …এতদিন তো বেশ নিঃস্বার্থ হিতৈষীই মনে হচ্ছিল। এখন দুটো লেখা দুটো পত্রিকায় পাঠিয়েই গলার সুর বদলে গেছে। তাও তো রবিবারের ‘হট্টমেলা’ থেকে পরমার্থ সেনের কাছে ঠোক্বর খেয়ে তো ছড়াটা বাউন্সই করেছে। ‘বাল্যবন্ধু’-তে’ পাঠানো গল্পটাও এখন দেনা পাওনায় আটকে যেতে পারে। চোখ দিয়ে কয়েক ফোঁটা নেমে এল।

‘পৃথিবীতে একশো জনের মধ্যে নববইজন পুরুষ মেয়েদের একই রকম নজরে দেখে। তুমি যদি বোকা সেজে থাকো আমার কী করার আছে? তুমি কম্প্রোমাইজ করে লেখিকা হতে চাও না নিজের জোরে, সেটা নিজেই ঠিক করবে।’

‘একটা অ্যাডে কাস্ট করার কথাও বলছিল।’

‘তাহলে আর কী? যা ইচ্ছা করো। যে লোক রাত সাড়ে বারোটার সময় কোনও ভদ্রমহিলাকে ফোন করে গ্যাঁজায়, সে কী ধরনের মানুষ তা যদি তুমি এই চল্লিশ বছরেও না বোঝ, তাহলে কিছু বলার নেই।’

‘সারাদিন অন্য কাজে ব্যস্ত থাকে। তাছাড়া ফিল্ম লাইনের লোক। সারা রাত জেগে থাকাটাও স্বাভাবিক।’

‘তাহলে আমায় প্রশ্ন করছ কেন?’

‘আর কাকে করব?’

‘আমার উত্তর তো আমি দিয়েই দিয়েছি। জাস্ট যোগাযোগ রাখবে না। নম্বরটাই ডিলিট করে দাও। ফোন এলে রিসিভ কোরো না।’

‘বলছিল এই জুনেই বাল্যবন্ধু-তে বেরোবে। অন্য দিকে ‘সন্ধ্যাতারা’য় লেখা জমা দেওয়ার এক বছর পর চিঠিতে কনফার্ম করার পরেও সাত মাস পেরিয়ে গেল। শুনছি পুজো পর্যন্ত সব সংখ্যা তৈরি। তারপর ভূত-স্পেশাল। কবে আমার গল্প বেরোবে কোনও ঠিক নেই। লিটল ম্যাগগুলোতেও দলাদলি। ‘দিনকাল’-এ যে আমার গল্প ছাপল অজস্র ভুল করে, সেন্টেন্সগুলো পর্যন্ত এলোমেলো করে দিয়ে গল্পের বারোটা বাজিয়ে। বড়ো পত্রিকা বলে ওরা চাইলেই আমি আবার লেখা দিতে এক পায়ে খাড়া– এটা কম্প্রোমাইজ নয়? তাই এই লোকটাকে চটাতে পারছি না। লেখার কয়েকটা জায়গা বন্ধ হয়ে যেতে পারে। ইনফ্লুয়েন্শিয়াল…’

উদ্ভব উত্তর না দিয়ে স্নানঘরে চলে গেল।

শনিবার কলেজ স্ট্রিটের উদ্দেশে বাস ধরল। ট্রেন জার্নিটা ভিড়ের জন্য এড়াতেই চায়। তাছাড়া স্টেশনগুলোর চত্তরে বড়ো কটু গন্ধ। শহর ও শহরতলির সমস্ত রাস্তা ঘাটই অবশ্য পুরুষ মানুষের জল বিয়োগ ক্ষেত্র। এই গন্ধের জন্য হাঁটতে চলতে নাকে-মুখে কাপড় চাপা দিয়ে শ্বাস বন্ধ করে প্রাণায়াম করে যেতে হয়। সময় অনেক বেশি লাগলেও তাই বাসটাই ধরতে চায়। বেরোতে বেরোতে প্রায় তিনটে বেজে গেল। এখন বেহালা যাবার প্রশ্নই ওঠে না। ফোন।

‘আসছেন তো?’

‘দেরি হয়ে গেছে অনেক। সামনের সপ্তাহে না হয় উইক ডে দেখেই সময় করে যাব।’

‘নেচার কিওয়ের অ্যাডটাও তো ফাইনাল করা দরকার। পরের শনি নয়তো রবি শ্যুটিং। আজই ফাইনাল করে নিতাম।’

‘আ..চ্ছা। আমার কিন্তু দেরি হবে। আর যখন পৌঁছোব, তখন বসার সময় বেশি থাকবে না।’

‘হ্যাঁ হ্যাঁ। মিনিট পনেরো থেকে আধ ঘণ্টার ডিসকাশন।’

‘আপনার অ্যাড দেওয়া ‘ক্রমাগত’টাও অবশ্য সঙ্গে রয়েছে।’

‘ওটা এমন কিছু না। আপনি আসুন।’

দোনোমনো করে শ্যামবাজারে নেমে মেট্রো ধরল। কালীঘাটে নামতে হবে। সেখান থেকে অটো বদলে বা টানা বাস পেলে বেহালা শখের বাজার। আজ কফি হাউসে যাওয়া খুব জরুরি ছিল। একটা পত্রিকা হাতে পাওয়ার কথা, আর দুটোতে লেখা দেওয়ার। আর শনিবার গেলে অনেকের সাথে দেখা হয়। লেখার পরিসর বাড়তে পারে। নিছক আড্ডা মারতে যাওয়ার তাগিদ নেই। তাছাড়া ওই মাছের বাজারকে মাত দেওয়া শোরগোলে গলা তুলে কথা বলায় কোনও সুখ নেই। কেউ কেউ অবশ্য এজন্য শ্রীতমাকে ধান্দাবাজ ইঙ্গিত করে।

শখের বাজারে নেমে অনেকটা হাঁটতে হয়। জেমস্ লং সরণি পেরিয়ে বাঁদিকে কিছুটা গলির ভেতর হাঁটলে, তবে মহাশয়ের বাড়ি তথা দফতর। হাঁটতে হাঁটতে মোবাইলে বার্তা আসার শব্দ পেল। মোবাইল কোম্পানির বা অন্য কোনও প্রমোশনাল মেসেজ হতে পারে। দেখা হল না। জৈষ্ঠের আকাশে আলো ম্লান হয়নি তখনও। আধ ঘণ্টার মধ্যে হয়ে গেলে কলেজ স্ট্রিটটাও ছুঁয়ে আসার চেষ্টা করবে।

গেট দিয়ে ঢুকে লম্বা প্যাসেজ পেরিয়ে দারোয়ানকে বলে সিঁড়ি ভেঙে দোতলায় উঠতে হয়। অফিসের রিসেপশনের মতো জায়গাটা ফাঁকাই দেখেছে এযাবত। ভেতরের ঘরে বসে মালিক। দারোয়ান দোতলার অফিসের বাইরের ঘরে শ্রীতমাকে বসিয়ে তিনতলা গিয়ে ফিরে এসে বলল, ‘স্যার চান করছেন। এক ঘণ্টা বসতে হবে।’

পাঁচবার ফোন করে ডেকে এনে এ কী রসিকতা! ফোন বার করে দেখল রাস্তায় আসা মেসেজটা দেবপ্রিয়ই করেছে। সেটা না পড়ে অসহিষ্ণু ভাবে ফোন করল। দূর! বাথরুমে গেলে কি মোবাইল ধরতে পারবে? অবশ্য বাড়ির লোক ধরতে পারে। কাটতে যাচ্ছিল। ওপাশ থেকে পরিচিত গলা, ‘হ্যালো। কোথায়?’

‘আপনার অফিসে। কিন্তু আমাকে ডেকে আপনি এখন কী করছেন?’

‘স্নান করছি। মিনিট পনেরো কুড়ি বসুন।’

‘আমার তাড়া আছে। এমনিতেই দেরি হয়ে গেছে।’

লাইন কেটে মেসেজটা পড়ল। ‘আজ আমার আঙুল আর ঠোঁট– আদরে পাগল করে দেবে ঠিক তো?’

চড়াং! কাজের দোহাই দিয়ে ডেকে এনে বাথরুম থেকে পরনারীকে এই বার্তা? এরপর বসে থাকার একটাই অর্থ হয়। তরতর করে নীচে গিয়ে দারোয়ানকে বলল শ্রীতমা, ‘আমায় বেরিয়ে যেতে হবে। একটা বই আপনার স্যারের জন্য রেখে যাচ্ছি। এক টুকরো কাগজ দিতে পারবেন? চিঠি লিখে দিয়ে যাব।’

কাঁপা হাতে নোটপ্যাডের পাতায় লিখল, ‘দেবপ্রিয়বাবু, আজ আমার পক্ষে অপেক্ষা করা আর সম্ভব হল না। ‘ক্রমাগত’র কপি রেখে গেলাম। আপনার সহযোগিতার জন্য ধন্যবাদ। এসএমএসটা আমার সঙ্গে রইল।’

এর আগের বার্তাগুলো মুছে ফেলেছে। এটাকে না মুছে একটা ফোল্ডারে সেভ করে রাখবে। ভাগ্যিস লোকটা স্নানে ঢুকেছে। উর্দ্ধ্বশ্বাসে ছুটল ডায়মন্ড হারবার রোডের দিকে। বড়ো রাস্তায় পৗঁছেই একটা ডাবের খোলায় হোঁচট খেয়ে সপাটে আছাড়। সর্বনাশ! বাড়ির এই অবস্থায় ওরও কিছু হলে আর দেখতে হবে না। বাঁ হাতের কবজির ষন্ত্রণায় প্রথমটায় খেয়াল করেনি তালুটাও সামান্য ছড়ে গেছে।

সাড়ে ছটা। এখন আর কফিহাউস নয়। সোজা বাড়ি। সামনে যে বাস এল তাতেই চড়ে পড়ল। শিয়ালদা যাচ্ছে। ভালোই।

বাসে পরের স্টপেই জায়গা পেল মহিলা সিটে। তবে জানলার দিকে নয়। বসতে না বসতেই আবার চলভাষে সুরধবনি। কাঁপা হাতে ফোন ধরে যথাসম্ভব ঠান্ডা গলায় বলল, ‘বলুন।’

‘কী বলি বলুন তো। কীভাবে স্যরি বলব?’

‘বলতে হবে না। শুধু বুঝুন বেকারদের সময়ও দামি। আর স্যরি যদি বলতেই হয়, আপনার মেসেজটার জন্য বলুন।’

‘মেসেজ মানে? ওহ্! হো হো হো! এই ব্যাপার? হঠাৎ এত সিরিয়াস হয়ে গেলেন? এতদিন তো…’

‘এতদিন কী? আপনার রসিকতাকে রসিকতা হিসাবেই দেখেছি।…’

‘এভাবে পৃথিবীর সাথে মানাবেন কী করে? সুমনের একটা গান আছে, …। আমার নিজেরও একটা কবিতা আছে, শুনবেন…’

‘…নিজের ই-ইল্লিসিট ইচ্ছাকে …র-র্যাশনালাইজ করার জন্য হাজারটা উদ্ধৃতি দেওয়া যায়। আর নেচার কিওর অ্যাডটার জন্য বোধহয় আমাকে আর দরকার লাগবে না।’

‘ওটার জন্য তো আপনার সিলেকশন হয়েই আছে। আপনি এখন নিজে রাজি না থাকলে–’

‘প্রফেশনালি কাজ তো হবার নয়।’

‘আপনি চাইলেই হতে পারে।’

ছিছিঃ! শ্রীতমা এখনও লোকটার মুখের ওপর উচিত কথা না শুনিয়ে নিজেকে খেলো করে যাচ্ছে? নিজের লেখায় যে এত আপসহীন, এত সাহসী, এত অকপট, লেখাগুলোর প্রতি অপত্যস্নেহে সেই মানুষ এত দুর্বল? দেবপ্রিয় দামের কত বড়ো হাত?

‘চুপ করে আছেন যে?’

‘আপনার সঙ্গে এখনও কথা বলছি, ইজন্ট ইট স্ট্রেঞ্জ? সুরেন্দ্র নস্করের কাছেও কি একই এক্সপেক্টেশন রাখেন?’

কী জবাব এল বোঝা গেল না বাসের আওয়াজে। বোধহয় সুরেন্দ্র আর শ্রীতমা এক নয় সেটাই বোঝাতে চাইল।

‘ওই ভদ্রলোক আপনার বন্ধু। তিনি ভাগ্যবান। বিকজ ইউ আর নট আ গে আই থিংক। আমাকে বন্ধু ভাবতে পারলেন না। গিভ এ্যান্ড টেক চলে এল। আমি দেখতে ভালো, এটা কি আমার দোষ?’

‘ও হো হো হো। আচ্ছা, আপনি সুন্দর কে বলেছে? কতজন বলেছে?’

মনে হল সপাটে গালে চড় পড়ল। দাঁত চিপে বলল, ‘অনেকেই। আর একজন মিথ্যুক তো অনেকবার বলেছে।

আবার হাসি, উপদেশ। খেলো মেলোড্রামা ভরা স্থূল বার্তা পাঠিয়ে এখন এমন ভাবে হাসছে যেন শ্রীতমার মতো অপরিণত মেয়ে আর হয় না। এখনও কেন লোকটাকে বাজে বকার সুযোগ দিয়ে যাচ্ছে? কেন গল্প, উপন্যাসের নায়িকাদের মতো, সিদ্ধান্তহীনতায় না ভোগা ঋজু চরিত্রের মানুষের মতো কড়া কথা বলে ফোন কেটে দিতে পারছে না? অ্যাড ফিল্ম না বাল্যবন্ধু পত্রিকা? দুটোই তো গেল। নাকি নিজের বোকার মতো বিশ্বাসের মর্যাদা রাখার মরিয়া চেষ্টা, বন্ধুত্বের লোভ?

কথা যখন শেষ হল তখন খেয়াল করল, তার ডান কাঁধে ভর দিয়ে তার গোপন অঙ্গটিকে একরকম শ্রীতমার কাঁধে চেপে ধরে জুত করে একটা লোক দাঁড়িয়ে আছে। শ্রীতমা ফোন কেটে সচকিত হতেই জানোয়ারটা ঝট্ করে সরে গেল।

‘ইতর কোথাকার! কেটে ফেলতে হয়! বাসে কী এমন ভিড় যে ঠিকভাবে দাঁড়ানো যায় না?’

ঘেন্নায় অপমানে উদ্গত অশ্রু সামলাতে গিয়ে গলা কন্কন্ করে উঠল। শ্রীতমা সত্যিই অপরিণত। তার বয়সি মহিলাদের সাথে বাসে ট্রেনে এমন বজ্জাতি করার সাহস চট্ করে দেখানো যায় না। ও একাই চেঁচিয়ে গেল। বাসে কেউ কিছু বলল না। কন্ডাক্টর বোবা।

দেবপ্রিয়র প্রতি আর কোনও বিদ্বেষ নেই। বাসের এই নরকের কীটটা দেবপ্রিয়র মতো বুকে পেটে চুমু খাওয়ার আবেদন করেনি। সুযোগ বুঝে নিজের নোংরা প্রত্যঙ্গটা ওর কাঁধে ঠেকিয়ে দিয়েছে। পোশাকের আবরণ সত্ত্বেও ঘেন্না আর রাগে গা রিরি করছে।

যে মানুষটা দু বছরের পরিচয়ের ভিত্তিতে শ্রীতমাকে ছোঁয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিল, হয়তো মতলবই করেছিল, সে তো স্নান করে পরিষ্কার হয়ে তৈরি হচ্ছিল অভিসারের জন্য। নৈতিকতার খাতিরে তার কাছ থেকে সব সহযোগিতার রাস্তা বন্ধ করে দিয়ে এসে ভাগ্যের কাছে কী প্রতিদান পেল?

অন্ধকার হয়ে এসেছে। বাসের জানলা দিয়ে ভেসে আসা উন্মুক্ত পুরুষ ইউরিনালের গা গোলানো দূষিত গন্ধ নাকে মুখে ঝাপটা মারছে অনুমতির তোয়াক্বা না করে।

সময়ের স্রোতে

অভিকে গেটের ভিতর ঢুকিয়ে দিয়ে মানস গাড়িতে উঠতে যাবে, গেট খুলে দৌড়ে এসে অভি মানসের হাত জড়িয়ে ধরে, ‘তুমি যেও না বাবা, প্লিজ এখানেই থেকে যাও… তোমাকে ছাড়া আমার একদম ভালো লাগে না…।’

‘আসছে রবিবার তো আবার আসব অভি। প্রতিবারই তো আসি’, মানস অভির গালে আলতো টোকা দেয়।

‘না, তুমি অনেকদিন পর পর আসো। তোমার কথা খুব মনে হয় বাবা, বন্ধুরাও সব সময় তোমার কথা জিজ্ঞেস করে। তুমি আমার স্কুলেও কখনও আসো না। অন্য বন্ধুদের বাবারা তো সবাই আসে… তাহলে তুুমি কেন আস না বাবা?’

মানস ওর আট বছরের ছেলের অজস্র প্রশ্নের কী উত্তর দেবে ভেবে পাচ্ছিল না। যে প্রশ্নের উত্তরগুলো নিজেই ঠিকমতো জানে না মানস। ছেলেকে সেগুলোর উত্তর কীভাবে দেবে? মানস বুঝতে পারে না এইভাবে আর কতদিন ও ছেলের কাছে সব চেপে যেতে পারবে?

‘আমি আবার আসব অভি। তুমি তো খুব ভালো ছেলে সবকিছুই বোঝো। এরকম জেদ কোরো না। এখন লক্ষ্মী হয়ে উপরে যাও। আমি কয়েকদিনের ছুটি নিয়ে তোমাকে আমার কাছে নিয়ে গিয়ে রাখব। তখন আমরা খুব মজা করব।’

‘কিন্তু মজা কী করে হবে? মা তো ওখানে থাকবে না।’

‘অভি, এখন তুমি উপরে যাও। পরে আবার তোমার সঙ্গে কথা হবে। আমারও দেরি হয়ে যাচ্ছে। মানস গেট খুলে অভিকে লিফটে ঢুকিয়ে বাইরে বেরিয়ে এল। চাবি দিয়ে গাড়ির দরজা খুলে গাড়িতে উঠে বসল। একই শহরে থাকলেও দুটো বাড়ির দূরত্ব অনেকটাই। তা-সত্ত্বেও প্রতি রবিবার মানস অভিকে নিয়ে কোথাও না কোথাও ঘুরতে বেরোয়।

মানস একটা বড়ো কোম্পনিতে বড়ো পদে রয়েছে ওর উপরে বড়ো দায়িত্ব ফলে কাজের ব্যস্ততার সঙ্গে সঙ্গে ট্যুরও করতে হয় ওকে। দশ বছর আগে মধুমিতার সঙ্গে ওর বিয়ে হয়। বিয়েটা লাভ ম্যারেজই ছিল। একসঙ্গেই দুজনে এমবিএ পড়েছিল এবং প্রেমটা ওদের সেখান থেকেই। মিশুখে, সুন্দরী এবং ফ্যাশনেবল মধুমিতাকে দেখেই মানস ওর প্রেমে পড়ে। এমবিএ কমপ্লিট করার আগেই ক্যাম্পাস প্লেসমেন্টে দুজনেই ভালো চাকরি পেয়ে যায়। চাকরি পেয়েই দুজনে বাড়িতে পরস্পরের সম্পর্কে জানায়। দু’জনের বাড়ি থেকেই আনন্দের সঙ্গে বিয়েতে সম্মতি দিলে, কিছু দিনের মধ্যেই ওরা বিয়ে করে নেয়। দুজনেরই প্রথম পোস্টিং বেঙ্গালুরু। সুতরাং বিয়ের পর ওরা বেঙ্গালুরুতেই নতুন সংসার পাতে।

নতুন চাকরির ব্যস্ততা এবং নতুন বিয়ে, দিনগুলো যেন খুশির পাখায় ভর দিয়ে উড়তে থাকে। প্রথম বছরটা হইচই,আনন্দে কীভাবে কেটে যায় ওরা বুঝতেও পারে না। দ্বিতীয় বছরে না চাইতেও মধুমিতা সন্তানসম্ভবা হয়ে পড়ে যেটার জন্য ওরা স্বামী-স্ত্রী মানসিক ভাবে একেবারেই প্রস্তুত ছিল না। বাড়ির লোকেদের কাছে ব্যাপারটা জানাজানি হয়ে যেতে চাপে পড়ে ওরা পরিবার বাড়াতে রাজি হয়ে যায়।

মধুমিতাকে বাধ্য হয়ে চাকরি ছাড়তে হয় যেটার জন্য ও একেবারেই তৈরি ছিল না। মানস ওকে বোঝায় যে বাচ্চা একটু বড়ো হয়ে গেলেই ও আবার চাকরি জয়েন করতে পারে। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বাচ্চা এবং বাড়ির দায়িত্ব এতটাই বেড়ে গেল যে, মধুমিতা চাকরি করতে যাওয়ার কথা চিন্তাতেই আনতে পারল না। এদিকে বাড়ির দায়িত্ব বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মানসেরও কোম্পানিতে পদোন্নতি হতে থাকল। ফলে কর্মক্ষেত্রে কাজের দায়িত্বও অনেক বেড়ে গেল।

দায়িত্ব বাড়তেই মানসের শুরু  হল দেরি করে বাড়ি ফেরা। মধুমিতার ধৈর্য প্রথম থেকেই একটু কম ছিল। তার উপর চাকরি ছাড়তে হয়েছিল বলে মনে মনে মানসের উপর একটা রাগও তৈরি হয়েছিল। সুতরাং মানসের অত্যধিক ব্যস্ততা মধুমিতার সব ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে দিল। অসহিষ্ণু হয়ে পড়তে লাগল সে। কথায় কথায় মানসের সঙ্গে ঝগড়া, রাগারাগি –এটা ওদের দৈনন্দিন রুটিন হয়ে দাঁড়াল। রোজই প্রায় মানস রাত করে বাড়ি ফিরত।

‘এই ভাবে আর কতদিন চলবে? আমি, অভি কি তোমার কেউ হই না? সংসারে এতটুকু সময় তুমি দাও না। আমাদের প্রতি তোমার কি কোনও দায়িত্ব নেই?’ মধুমিতার এই প্রশ্নের উত্তরে মানসও রাগ না দেখিয়ে চুপ থাকতে পারে না, ‘আমি কি দায়িত্ব পালন করছি না? তোমাদের জন্য এবার কি তাহলে আমি চাকরি ছেড়ে দেব?’ ক্লান্তিতে মানস চেয়ারে বসে পড়ে। রেগে থাকাতে, ক্লান্ত মানসের চোখের অভিব্যক্তি মধুমিতার চোখ এড়িয়ে যায়। ঝাঁঝালো স্বরে বলে, ‘এমন কী চাকরি তুমি করো? কতদিন হয়ে গেলো অভির সঙ্গে খেলা তো দূরে থাক, ঠিকমতো কথাও বলোনি। রাত্রে যখন বাড়িতে আসো ও তখন ঘুমিয়ে থাকে। আর সকালে যখন ও স্কুলে যাচ্ছে তখন তুমি গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। ট্যুর-এ যাও। ফিরে একদিন দুদিন শহরে থাকো আবার অন্য ট্যুর-এ বেরিয়ে যাও। নিজের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের জীবনও তুমি নরক বানিয়ে দিয়েছ।’

‘মধুমিতা, তুমিও তো প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরি করতে…! সুতরাং প্রাইভেট কোম্পানির ব্যস্ততা তুমি ভালো মতোই বোঝো, তাহলে এরকম অবুঝের মতো কথা বলছ কেন? এমনি, এমনি তো এত উঁচু পদে পৌঁছোইনি… পরিশ্রম এবং দায়িত্ব নিয়ে কাজ করেছি বলেই কোম্পানি আমাকে ওই পদে বসিয়েছে। তোমাদের টাকাপয়সা, আরামের কোনও অভাব আমি রাখিনি… এই সবই তো আমার প্ররিশ্রমেরই ফল।’

‘এই আরাম, টাকাপয়সা আমরা চাই না মানস। আমারা তোমাকে চাই। তোমাকে আমাদের সময় দিতে হবে।’ মধুমিতার গলা ভেঙে আসে, ‘বাড়িতে এসেও তুমি ফোনে ব্যস্ত থাকো।ঞ্জআমার সঙ্গে কথা বলারও তোমার সময় হয় না।’

‘অফিসের কাজের জন্যই তো ফোন আসে। তোমার জন্য কি সেগুলোও অ্যাটেন্ড করা বন্ধ করে দেব?’

মানসের রাগের পারদ চড়তে থাকে।

‘কতদিন হয়ে গেছে, তোমার অফিসের ব্যস্ততার জন্য, আমরা কোনও বন্ধুবান্ধবের বাড়ি যেতে পারি না, কাউকে আমাদের এখানেও ডাকতে পারি না। কোথাও বাইরে যাই না ছুটির দিনে তুমি ক্লান্ত হয়ে থাকো।’

‘তাই বলে, আমি কি তোমাকে সোশ্যাল হতে বাধা দিয়েছি? তুমি নিজের মেলামেশা বাড়াও না, কে মানা করেছে? ব্যস্ত থাকলে আজেবাজে ব্যাপারগুলোয় মন দেবার সময় পাবে না’, এই বলে মানস চেয়ার থেকে উঠে পড়ে শোবার ঘরের দিকে পা বাড়ায়। আহত সিংহীর মতো মধুমিতা নিজের মধ্যেই গুমরাতে থাকে।

এই কথাকাটাকাটি, ঝগড়ার পরিবেশই ধীরে-ধীরে মধুমিতা আর মানসের দাম্পত্যে বড়ো একটা ফাটল ধরাতে শুরু করল। বরং টুর থাকলেই মানস, মধুমিতার অনুপস্থিতিতে বাড়ির ঘটনাক্রমকে লজিক্যালি দেখার এবং বোঝার চেষ্টা করত। মানস বুঝতে পারত, মধুমিতার তার প্রতি ক্ষোভ, নালিশ সম্পূর্ণ মিথ্যাও তো নয়। মনে মনে ঠিক করত, এবার বাড়ি ফিরে মধুমিতা আর অভিকে একটু বেশি সময় দেবে।

মানস শহরের বাইরে থাকলে মানসের অবস্থাটাও মধুমিতা বোঝার চেষ্টা করত। সত্যিই, লোকটা করবেটাই বা কী? কোম্পানির বড়ো পদ সামলাচ্ছে যখন, তখন সঙ্গে দায়িত্ব তো থাকবেই। সারাদিন কাজের পর ক্লান্ত হয়ে বাড়ি ফেরে মানস…। কোথায় ওর ক্লান্তি দূর করার চেষ্টা করবে, তা নয়, উলটে ঝগড়া করেই সময় নষ্ট করে সে।

অথচ এই একই মানুষ দুটো যখন সামনাসামনি হয় তখন মনের এই ভাবনাগুলো কোথায় হারিয়ে যায়। মানসের ব্যস্ততা স্বামী-স্ত্রীর শারীরিক সম্পর্কও প্রভাবিত ফেলতে শুরু করল। একে তো সময়ের অভাব, তার মধ্যে আবার ঝগড়া, কথাবন্ধ। মাস গড়িয়ে যেত, শারীরিক সম্পর্কটুকু রাখাও ওদের হয়ে উঠত না। দুজনেই মানসিক এবং শারীরিক ভাবে একাকিত্ব বোধ করতে শুরু করল।

এই সমস্যা শুধু মানস আর মধুমিতারই নয়, আজকের বহু দম্পতির এই একই সমস্যা। দুজনের চাকরির ব্যস্তস্তা সঙ্গে অফিস আর বাড়ির দূরত্ব এতটাই যে, রোজ যাতায়াত করার কষ্ট এবং ক্লান্তি দূর করতে করতেই ছুটি শেষ, সঙ্গে অন্যান্য জরুরি কাজগুলো তো আছেই। ফলে ছেলে বা মেয়ে কেউই এখন বিয়ের দায়িত্ব নিতে চাইছে না অথবা বিয়ের পর সন্তান নেওয়ার কথা ভাবছে না। কারণ তারা জানে বাচ্চা হয়ে যাওয়ার পর নিজের স্বাধীনতা এবং চাকরি ছাড়তে হতে পারে।

ধীরে ধীরে মানস আর মধুমিতার মৌখিক ঝগড়া ঠান্ডা লড়াইয়ে পরিণত হল। দুজনের মধ্যে কথা প্রায় হতো না বললেই হয়। হঠাৎ-ই একদিন মধুমিতা জানাল ও একটা চাকরি পেয়ে গেছে এবং অফিসের পাশেই একটা ফ্ল্যাট ভাড়াও নিয়ে নিয়েছে। সেখানেই ও অভিকে সঙ্গে নিয়ে উঠে যাবে।

মানসের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে মধুমিতার প্রস্তাবে। মধুমিতাকে কাছে টেনে নিয়ে ওর বলতে ইচ্ছে করছিল একলা চাকরি করে অভিকে ও কী করে মানুষ করবে, আর যদি একান্তই চাকরি করতে হয় তাহলে এখানে থেকেও তো অনায়াসেই সেটা করা যায়। কিন্তু মানসের আত্মাভিমান ওর গলা টিপে ধরল। যেখানে মধুমিতাকে নিয়ে ও এত চিন্তা করছে, সেখানে মানসকে ছেড়ে চলে যাওয়ার ডিসিশন নিতে মধুমিতার তো এতটুকুও বাধল না। পরের দিনই অভিকে নিয়ে মধুমিতা ঘর ছাড়ল। দিনটা আজও মানস ভুলতে পারে না। দু’বছর প্রায় হতে চলল। ছয় বছরের অভি আজ আট বছরের হয়ে গেল। মানসের জীবন, চাকরি এবং এই দুটো বাড়ির দূরত্ব মাপতে মাপতেই বেশ কেটে যাচ্ছিল।

লাল বাতিতে গাড়ি ব্রেক কষতেই মানসের চিন্তা ভগ্ন হল। আর কত দিন এভাবে চালানো সম্ভব? মানস সব সময় চেষ্টা করত ওদের স্বামী-স্ত্রীর দূরত্ব যেন অভির উপর কোনওরকম প্রভাব না ফেলে। দুজনেরই ভালোবাসায় ও যেন বড়ো হয়ে উঠতে পারে। কিন্তু চাইলেও এটা কিছুতেই সম্ভব হয়ে উঠছিল না।ঞ্জঅভির ব্যক্তিত্ব দুটো ভাগে ভাগ হয়ে যাচ্ছে এটা মানস খুব ভালো বুঝতে পারছিল। অভির জীবনে একটা শূন্যতাবোধ ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয়ে উঠছিল।

রাস্তার ভিড় অতিক্রম করে বাড়ি পৌঁছোতে মানসের অনেকটা সময় পার হয়ে গেল। মনটা ভারাক্রান্ত লাগছিল। অভির অগুনতি প্রশ্নের কোনও উত্তর ওর কাছে ছিল না। মনে হল, অভি নিশ্চয়ই এই প্রশ্নগুলো ওর মা-কেও করে, মধুমিতার কাছে কি এই প্রশ্নগুলোর কোনও উত্তর আছে…? আর কতদিন এসব সহ্য করতে হবে?

মানস এবং মধুমিতার পরিবারের সকলে দুজনকে বোঝাবার অনেক চেষ্টা করে যাতে নিজেদের মধ্যে দূরত্ব সরিয়ে দুজনে একসঙ্গে আবার জীবন শুরু করে। কিন্তু দুজনেই নিজের নিজের জেদে অটল, কেউ এক চুলও জেদ ছাড়তে রাজি নয়। বিরক্ত হয়েই মানসের মা-বাবা ছেলের কাছে প্রস্তাব রাখেন, ‘সঙ্গে যদি থাকতেই না চাস তাহলে ডিভোর্স নিয়ে নে। জীবন আবার নতুন করে শুরু করার চিন্তাভাবনা কর।’

মানসের শিরদাঁড়া বেয়ে ঠান্ডা একটা শিহরণ বয়ে যায়। সত্যিই কি জীবনের একটা অধ্যায় এত সহজে শেষ করে ফেলা যায়? নতুন শুরু করার কথা ভাবাই যায় না। আজ ও লাইফে ব্যস্ত কিন্তু কালও কি এতটাই ব্যস্ত থাকবে ও? আর অভি? ওর কী হবে? অভির করা প্রশ্নগুলো ওর মাথায় ভিড় করে আসে। কী করবে ও? অনেকবার মনে হয়েছে মধুমিতা যেমন নিজের ইচ্ছেয় ঘর ছেড়েছিল একদিন হঠাৎই আবার ফিরে আসবে কিন্তু অপেক্ষা করে করে দুই বছর কাটতে চলল। মধুমিতা নিজে থেকে কোনওদিন ওকে ডেকে পাঠাল না। আর এখন তো একা থাকারই অভ্যাস হয়ে গেছে।

অভি বাড়িতে ঢুকেই সোজা নিজের ঘরে চলে গেল। কিছু ভালো লাগছিল না ওর। এতটুকু বয়সেই মনটা ওর যেন ক্লান্তিতে ভেঙে আসছিল। অপেক্ষা আর অপেক্ষা। কবে থেকে মা আর বাবা একসঙ্গে ওর সাথে থাকবে, এই অপেক্ষায় ও রয়েছে। প্রতি সপ্তাহেই রবিবার আসে। বাবাও আসে আর এসেই ওকে বাইরে ঘুরতে নিয়ে চলে যায়। পছন্দের খাবার খাওয়ায়, জিনিসপত্রও কিনে দেয়। কিছু প্রয়োজন আছে কিনা জিজ্ঞেস করে এবং সন্ধেবেলায় আবার মা-র কাছে পৌঁছে দিয়ে, অন্য বাড়ি চলে যায়। সোমবার হলেই মায়ের অফিস আর ওর স্কুল। এইভাবেই সপ্তাহ কেটে গিয়ে আবার রবিবার আসে। এটাই অভির সারা সপ্তাহের রুটিন। ওর কিচ্ছু ভালো লাগে না। বাবার সঙ্গে থাকলে মায়ের জন্য মন খারাপ লাগে আর সারাটা সপ্তাহ বাবাকে অভি মিস করে খুব। সব সময়ই মনে হয় কেন মা-বাবা একসঙ্গে থাকতে পারে না?

মানসের সঙ্গে ঘুরে আসার পর এক ঝলক ছেলেকে দেখল মধুমিতা তারপর তার আর কোনও আওয়াজ না পেয়ে মধুমিতা রান্নাঘর থেকে ছেলের নাম ধরে হাঁক পাড়ল। না, কোনও শব্দ নেই! কী হল, চিন্তিত হল মধুমিতা। হাতটা মুছে নিয়ে অভির স্টাডিরুমে ঢুকল ও। ছেলেটা টেবিলে মাথা রেখে মুখটা ঢেকে রয়েছে। ঘরের আলোটা পর্যন্ত জ্বালায়নি।

ঘরের আলো জ্বালিয়ে মধুমিতা এসে অভির মাথায় হাত রাখল, ‘কী হল অভি? কেমন কাটল আজ সারাটা দিন?’

অভি উত্তর দিল না। টেবিল থেকে মাথা তুলে মায়ের দিকে তাকাল না পর্যন্ত।

‘কী হল? মন খারাপ।’ ছেলের চুলে আঙুল দিয়ে বিলি কাটতে কাটতে মধুমিতা জিজ্ঞেস করল।

‘কিছু হয়নি’, বলে অভি মায়ের হাতটা এক ঝটকায় সরিয়ে দিল।

‘চুপচাপ কেন বসে আছিস? কেউ কিছু বলেছে তোকে?’

‘না’, বলেই মধুমিতার হাত আঁকড়ে ধরে অভি, ‘মা, আমরা কেন বাবার সঙ্গে গিয়ে থাকতে পারি না? বলো না, কবে আমরা বাবার কাছে গিয়ে থাকব? চলো না আমরা বাবার কাছে গিয়ে থাকি।’

‘বাজে কথা শুনতে ভালো লাগে না অভি’, মধুমিতার কোমল কণ্ঠস্বর হঠাৎই রুক্ষ হয়ে ওঠে, ‘রাত হয়েছে, ডিনার খেয়ে শুয়ে পড়ো। কাল স্কুল রয়েছে।’

‘আমি খাব না। আগে তুমি আমার কথার উত্তর দাও,’ অভি জেদ করতে থাকে।

‘বললাম না, ফালতু কথা শোনার আমার সময় নেই। আমরা এখানেই থাকব, খেয়ে শুয়ে পড়ো’, হাত ছাড়িয়ে নিয়ে রান্নাঘরে চলে যায় মধুমিতা।

অভি বসেই থাকে। কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করলেই দুজনের কেউই জবাব দেয় না, বরং বকে ওকে থামিয়ে দেওয়ারই চেষ্টা করে। অভি কী করবে বুঝে পায় না।

কাজ শেষ করে মধুমিতা শোওয়ার ঘরে ঢুকে দেখল, অভি খেয়ে নিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। ওর কচি মুখটা দেখে মধুমিতার মনে হল কোলে টেনে নিয়ে অজস্র চুম্বনে ভরে দেবে ওর ছোট্ট মুখটা। নিজেকে সংযত করল ও। ঘুম ভেঙে যাবে ছেলেটার। বড্ড প্রশ্ন করে আজকাল অভি। সেই সব প্রশ্নের কোনও উত্তর ওর জানা নেই। অভির শৈশবটা সত্যিই হাজার সমস্যায় ভরা। মধুমিতা উদ্দেশ্যহীন ভাবে জীবনটা কাটিয়ে দিতে চাইছে, সিরিয়াসলি কখনও ও নিজেকে এবং অভিকে নিয়ে ভাবে না। জাস্ট এক একটা করে দিন কাটাচ্ছে? অভি ধীরে ধীরে বড়ো হচ্ছে। ওর শিশুসুলভ প্রশ্নগুলোই জেদের বশে কবে কঠোর হয়ে উঠবে কে বলতে পারে? একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে মধুমিতা।

মানসের সঙ্গে জীবন কাটানো অসহনীয় হয়ে উঠেছিল ওর কাছে, কিন্তু ওকে ছেড়ে এসেও কি ভালো আছে ও? মধুমিতা মনে মনে ভাবে। ছেড়ে আসার সময় মনে হয়েছিল মানসকে একটা শিক্ষা দেওয়া দরকার যাতে ওর জীবনে স্ত্রী-র গুরুত্ব ও উপলব্ধি করতে পারে। কিন্তু শেষপর্যন্ত চলে আসাটা অর্থহীন হয়ে দাঁড়াল। প্রথম প্রথম মধুমিতা মানসের আসার অপেক্ষা করে থেকেছে। ওর মনে হতো, মানস নিশ্চয়ই একদিন এসে ওর রাগ ভাঙিয়ে বাড়ি ফেরত নিয়ে যাবে। মধুমিতাও সব ভুলে গিয়ে মানসের সঙ্গে ফিরে যাবে। কিন্তু অপেক্ষা, অপেক্ষা হয়েই থেকে গেছে। মানসও আসেনি ওকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে আর মধুমিতাও ফিরে যেতে পারেনি মানসের কাছে।

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দূরত্বও বাড়তে থেকেছে। নিজের নিজের জীবন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে দুজনেই। মাঝেমধ্যে শুধু অভির প্রশ্নগুলো মধুমিতাকে বাস্তবের সম্মুখীন হতে বাধ্য করত।

গতকালই মায়ের ফোন এসেছিল। সেই-ই একই কথা। মানসের কাছে ফিরে না গেলে ভবিষ্যৎ নিয়ে কিছু তো একটা ভাবা দরকার। মধুমিতা খুব ভালো করেই জানে মা, ভবিষ্যৎ মানে কী বোঝাতে চাইছেন। মানসকে ডিভোর্স দিয়ে দ্বিতীয়বার বিয়ের পিঁড়িতে বসা। কিন্তু এটা বলা এবং করার মধ্যে বিস্তর ফারাক রয়েছে। এতই কি সোজা পুরো ব্যাপারটা? অভির কী হবে? ও আর মানস দুজনেই যদি আলাদা করে দ্বিতীয়বার বিয়ের কথা ভাবে তাহলে দুজনের কাছেই অভির প্রেজেন্সটা অবাঞ্ছিত হয়ে উঠবে না? চিন্তাটা আসাতেই মধুমিতা শিউরে উঠে অভিকে নিজের কোলের কাছে টেনে আনে।

মধুমিতা অভির ঘুমন্ত মুখটার দিকে তাকিয়ে থাকে খানিকক্ষণ। সত্যিই, ছোটো থেকেই ছেলেটার জীবনে সমস্যার শেষ নেই, মা-বাবার যৗথ ভালোবাসা ওর কপালে আজ পর্যন্ত জুটল না। এর উপর মধুমিতা নিজে আর ওর সমস্যা বাড়াতে একেবারে চায় না। অভির শরীরের ওম ধীরে ধীরে মধুমিতার চোখে তন্দ্রা এনে দিতে সাহায্য করে। আজ কেন জানি না মধুমিতার মনে হল ওর মনের ভিতর জমে থাকা বরফটা সামান্য হলেও গলতে শুরু করেছে। যেগুলো মেনে নিতে আগে কিছুতেই মন চাইত না আজ সেগুলো মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে না। সমস্যাগুলো রয়েই গেছে মধুমিতার জীবনে তবুও ওর মনে হল, সমস্যাগুলোকে দেখার দৃষ্টিভঙ্গি বদলে গেছে ওর। ও নিজের মন-কে বোঝার চেষ্টা করে। ভাবতে ভাবতেই কখন ঘুমিয়ে পড়ে, নিজেই টের পায় না মধুমিতা।

সকালে অভি আবার স্বাভাবিক। কিছু কিছু জিনিস যে ওর জীবনে বদলাবার নয় সেটা ও ভালোমতোই এতদিনে বুঝে গিয়েছিল।

স্কুলে যাওয়ার জন্য তৈরি হয়ে নিল অভি। অভিকে স্কুলে পাঠিয়ে মধুমিতাও নিজের অফিস এসে পৌঁছোল। রোজকার মতোই একটা দিন, কিন্তু মনের ভিতর সন্তুষ্টি অনুভব করছিল মধুমিতা। সারাটা সপ্তাহ ব্যস্ততার মধ্যেই ওদের কেটে গেল। আবার এসে গেল রবিবারের পালা।

মানস যথারীতি মধুমিতার ফ্ল্যাটের নীচে দাঁড়িয়ে ফোন করে নিয়ম মতো অভিকে ডেকে পাঠাল। কিন্তু প্রতি রবিবরের মতো অভি একা নামল না, মধুমিতাও এল ওর সঙ্গে যেটাতে শুধু মানস-ই নয় অভিও খুবই অশ্চর্য হল।

মানস লক্ষ করল, মধুমিতার চেহারায় লাবণ্য যেন অনেকটাই আবার ফিরে এসেছে। কঠোরতাটা অনেক কম। একলা লড়াই চালাতে চালাতে সৌন্দর্য কিছুটা মলিন হয়ে পড়েছে। তিনজন সামনাসামনি হলেও কারও মুখে কোনও শব্দ জোগাল না। মনের মধ্যে নানা কথা ভিড় করে আসছিল কিন্তু বলার ভাষা জোগাতে পারল না কেউই।

‘অভি চলো’, মানসই প্রথম নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করল। মধুমিতার সঙ্গে চোখাচোখি হতেই মধুমিতা চোখ নামিয়ে নিল। মানসের মনে হল মধুমিতা কিছু বলতে চায় কিন্তু ওর দিক থেকে কোনও কথা না আসায় মানস অভির হাত ধরে গাড়িতে ওঠার উপক্রম করতেই পিছন থেকে মধুমিতার কণ্ঠস্বর কানে এল, ‘মানস’। মানসের মনে হল একটা যুগ পার করে মধুমিতার গলায় নিজের নামটা ও শুনল। ‘কাল অভির স্কুলে পেরেন্ট-টিচার মিটিং আছে। তুমি যদি একটু সময় বার করে আসতে পার অভির খুব ভালো লাগবে।’

মানসের ‘হ্যাঁ’ বলে দিতে ইচ্ছে করছিল কিন্তু ও উত্তর দিল, ‘আমার সময় হবে না… কাল টুরে বেরিয়ে যাব আমি।’ উত্তর দিয়েই পালটা জবাবের জন্য প্রতীক্ষা না করে মানস ড্রাইভার সিটে উঠে বসল।

মধুমিতা নিজের জায়গায় পাথর  হয়ে দাঁড়িয়েই রইল। মন চাইছিল মানসের নাম ধরে আর একবার ডাকার কিন্তু গলা দিয়ে আওয়াজ বেরোল না। ততক্ষণে মানস গাড়ি স্টার্ট করে দিয়েছে। সম্পর্কের বরফ গলাবার চেষ্টা করাটা ব্যর্থ হয়ে গেল মধুমিতার। মানসের, মুখের উপর ‘না’ বলে দেওয়ার ভয়েই মধুমিতা সম্পর্কের এই বরফ গলাবার চেষ্টা করতেই বরাবর ভয় পেয়ে এসেছে। ক্লান্ত পায়ে মধুমিতা লিফটের দিকে পা বাড়ায়।

সন্ধেবেলায় অভি বাড়ি আসতে প্রত্যেকবারের মতো মধুমিতা এবারে ওকে কিছুই জিজ্ঞেস করল না। অভিও সারাদিন  কী করল– না করল কিছুই মধুমিতাকে বলল না, কারণ বলার মতো কিছুই ছিল না। পুরোটা দিন দুজনের মধ্যে কথা প্রায়ই হয়নি। নিজের নিজের চিন্তাতেই দুজনে বিভোর ছিল। অভি একবারও মানসকে স্কুলে পেরেন্টটিচার মিটিং-এ আসার জন্য বায়না করেনি।

অভিকে ছেড়ে বাড়িতে আসার পর মধুমিতার মুখটাই মানসের খালি মনে পড়ছিল। স্কুলের জন্য ‘না’ বলে দেওয়াতে মধুমিতার চোখে যে ব্যথার ঝলক মুহূর্তের মধ্যে দেখা দিয়ে মিলিয়ে গিয়েছিল, সেটা আর কেউ না হলেও মানসের চোখ এড়ায়নি। অভিও, একবার ওকে স্কুলে আসার জন্য বায়না করেনি। হয়তো অভিও ওর কাছ থেকে উত্তর আশা করাই ছেড়ে দিয়েছে। এইসব ভাবতে ভাবতেই বাইরের পোশাক ছেড়ে মানস বিছানায় গা এলিয়ে দিল। খাওয়ার ইচ্ছে হল না কিছুতেই।

পরের দিন মধুমিতা অভিকে সঙ্গে নিয়ে ঠিক সময়ে স্কুলে পৌঁছে গেল। ক্লাসরুমের দিকে যেতে গিয়ে দুজনেই থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। করিডরে মানস ওদেরই অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে। অভি ছুট্টে গিয়ে মানসকে জড়িয়ে ধরল।

অভির আনন্দ দেখে মানস আর মধুমিতা দুজনেরই চোখে জল এসে গেল। মধুমিতা ওদের দুজনের কাছে আর একটু ঘন হয়ে সরে এল। ওর মুখও প্রসন্ন হাসিতে ভরে যায়। ‘থ্যাংকস, মানস… তোমাকে দেখে অভি প্রচণ্ড খুশি হয়েছে। আমরা ভাবতেই পারিনি তুমি…’

পেরেন্ট-টিচার মিটিং শেষ হতেই বাইরে এসে অভি বন্ধুদের সঙ্গে মানসের আলাপ করাতে শুরু করল। ওর আনন্দ দেখে মানসেরও মনে হল ও স্কুলে এসে ঠিক কাজই করেছে।ঞ্জঅভিকে বন্ধুদের সঙ্গে গল্প করতে ছেড়ে দিয়ে মানস স্কুলের বাইরে এসে দাঁড়াল। মধুমিতাও ওর পিছন পিছন স্কুলের বাইরে বেরিয়ে আসে।

মধুমিতাই প্রথম কথা শুরু করে, ‘এত খুশি হতে অভিকে আমি অনেক দিন দেখিনি মানস।’

‘হ্যাঁ, অভি এখনও বাচ্চা… সুতরাং ছোটো ছোটো জিনিসেই ও খুশি হয়ে ওঠে’, বলে আবার মানস চুপ হয়ে যায়। মধুমিতাও কথা খুঁজে পায় না। ‘ঠিক আছে… এবার আমি যাব। অভিকে বলে দিও আমার দেরি হয়ে যাচ্ছিল… রবিবার ওকে নিতে আসব’, কথা শেষ করে মানস যাওয়ার জন্য পা বাড়ায়।

‘মানস’, অনুশোচনায় মধুমিতার গলা বুজে আসে, ‘একটা কথা জিজ্ঞেস করব।’

‘হ্যাঁ, করো।  কী জিজ্ঞেস করতে চাও?’

মানসের কণ্ঠস্বরে প্রশ্রয় অনুভব করে মধুমিতার ইচ্ছে হচ্ছিল দুই বছরের জমে থাকা চোখের জল বইয়ে দেয় মানসের কাঁধে মাথা রেখে। নিজেকে সংযত করল ও, ‘আচ্ছা মানস, এই দুই বছরে কখনও আমার অভাব বোধ করেছ? আমাদের ছাড়া তুমি জীবনে খুশি হতে পেরেছ? মধুমিতার স্বর খুব ক্লান্ত শোনাচ্ছিল, মনে হচ্ছিল কথাগুলো বলার জন্য ওর নিজের সঙ্গেই নিজেকে লড়তে হচ্ছে। অথচ বলে দেওয়ার পর ওর মনে হচ্ছিল বলাটা এতটাও কঠিন ছিল না। আগে কেন তাহলে কথাগুলো বলতে পারেনি ও? কথাগুলো বলে মধুমিতা, মানসের দিকে তাকাল, চেষ্টা করল ওর মুখের অভিব্যক্তিগুলো পড়ার।

‘আমার অভাব তুমি কখনও ফিল করেছ?’ কিছুক্ষণ চুপ থেকে মানস জিজ্ঞেস করল।

মধুমিতা উত্তর দিল না। উত্তর না পেয়ে মানস বলল, ‘ছাড়ো এসব কথা… এখন ও সব কথা বলে কী লাভ? অনেক দেরি করে ফেলেছি দুজনেই।’

‘এখন না হয় দেরি হয়ে গেছে, আগেও তো তুমি কখনও আমাকে একবারও ডাকোনি’, ভিজে স্বরে মধুমিতা বলে।

‘আমি তোমাকে ডাকিনি ঠিকই কিন্তু আমি তোমাকে বাড়ি থেকে চলে যেতেও বলিনি। তুমি নিজের ইচ্ছেয় বাড়ি ছেড়েছিলে, আবার নিজের ইচ্ছেয় বাড়ি ফিরেও আসতে পারতে, মানস বলে।

‘একবার তো ডাকতে পারতে। আমি ঠিক ফিরে আসতাম’, চোখের পাতা ভিজে আসে মধুমিতার।

‘তখন তোমাকে ডাকলেও তুমি ফিরতে না। ফেরারই যদি হতো তাহলে তুমি বাড়ি ছেড়ে যেতেই কেন? বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার সময় শুধু নিজের কথা না ভেবে একবারও যদি অভির কথা চিন্তা করতে, তাহলে কিছুতেই বাড়ি ছেড়ে যেতে পারতে না। আমাদের দুজনের জেদের বলি হতে চলেছে অভি। ওর শৈশব হারিয়ে যাচ্ছে বড়োদের ঝগড়ার মাঝে। আমরা ওকে কী দিতে পেরেছি? না নিজেরা আনন্দে আছি না সন্তানকে আনন্দে রাখতে পেরেছি’, বলে মানস নিজের চোখের জল লুকোতে গাড়ির দরজা খুলে উঠে বসে গাড়ি স্টার্ট করে।

মুহূর্তে মধুমিতার মনে হয়, গিয়ে মানসের রাস্তা আটকে দাঁড়ায়, ওকে জড়িয়ে ধরে বলে যে ওর কাছে ফিরে আসতে চায়। কিন্তু ভাবতে ভাবতেই মানস গাড়ি স্টার্ট করে ট্র্যাফিকের সঙ্গে মিশে যায়। নিজের মন ঠিক করে নেয় মধুমিতা। অনেক দেরি করে ফেলেছে ও আত্মসম্মান বজায় রাখার নাম করে। কিন্তু আর নয়, দোষ যখন নিজে করেছে, শুধরোতেও নিজেকেই হবে। অভিকে নিয়ে বাড়ি ফিরে আসে ও।

পরের দিন অফিস যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছে মানস, নীচের কলিংবেলটা বেজে উঠল। এত সকাল সকাল কে এল ভাবতে ভাবতে দরজা খুলতে নামল ও। দরজা খুলতেই দেখল, মধুমিতা আর অভি দাঁড়িয়ে আছে দরজায়।

‘তোমরা!’ নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারছিল না মানস।

‘ভেতরে আসতে বলবে না?’ মধুমিতা জিজ্ঞেস করে।

‘তুমি নিজের বাড়ি এসেছ মধুমিতা আমি তোমার রাস্তা আটকাবার কে?’ মানস দরজার পাশে সরে দাঁড়াল। মধুমিতা আর অভি ভিতরে ঢুকে এল। মানস দরজা বন্ধ করতে করতে নিজের মনেই একটা প্রতিজ্ঞা করল, এবার আর ও নিজের খুশিকে দরজা দিয়ে কখনও বাইরে বার হয়ে যেতে দেবে না।

রুমাল

মাথা নীচু করে ক্লাসে ঢুকতেই শুনতে পেলাম একজন ক্লাসমেট-এর মন্তব্য— শালা ভিখারির বাচ্চাটা এসে গেছে।

আর একজনের কটূক্তি শব্দভেদী বানের মতো অতর্কিতে ছুটে এল আমার দিকে– ব্যাটার হিরো হওয়ার শখ একেবারে ঘুচে গেছে।

আমি ওদের কথায় কান না দিয়ে পাস কাটিয়ে লাস্টবেঞ্চের এক কোণে বসলাম। এখন শুধু কটূক্তি শোনার পালা, র্যালা মারার দিন আমার শেষ। আমি শেকসপিয়রের জুলিয়াস সিজারের মতো পরাজিত রোমান সম্রাট। আমার চারপাশে ব্রুটাসের দল আমাকে হেনস্থা করার জন্য ওত পেতে আছে। আমার পরাজয়েই তাদের সুখ। তাদের আনন্দ।

রাগে আমার গা রি রি করছে। অথচ কিছু করার নেই। ক্লাসের সমস্ত সিলিং ফ্যানগুলো ফুল স্পিডে চলা সত্ত্বেও আমার গা দিয়ে দরদর করে ঘাম ঝরছে। অথচ এটা গ্রীষ্মকাল নয়, ভরা শ্রাবণ। শরৎ আসতে আর দেরি নেই। এর মধ্যেই একটু ঠান্ডা ভাব এসে গেছে। ভোরের দিকে শীত শীত মনে হয়। আকাশে বাতাসে পুজো পুজো গন্ধ। ভোরের দিকে শিউলির গন্ধ টের পাই।

কী শীত কী গ্রীষ্ম, সব সময়েই আমার গা দিয়ে ঘাম ঝরে। মনে হয় আমার শরীরে নুনের পরিমাণ একটু বেশি আছে। যাই হোক,

জিন্স-এর ট্রাউজারের পকেটে হাত ঢুকিয়ে ঘাম মোছার জন্য রুমালটা বার করতে যেতেই শূন্য হাতটা উঠে এল। অর্থাৎ আমার রুমাল হাওয়া। বেশ মনে আছে বাড়ি থেকে বেরোবার সময় সুগন্ধি লাল রুমালটা পাঞ্জাবির বাঁ পকেটে যত্ন করে রেখেছিলাম। পকেটে এখনও সেন্টের গন্ধ ম-ম করছে। এই, এই একটা জিনিস পকেটে রাখতে কখনও ভুল করি না। ও আমার নিত্য সহচর। একান্ত আপন।

একবার ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের গার্ডেনে কলেজ থেকে কাট মেরে আমি আর নন্দিতা বসে গল্প করছিলাম। একবার গল্প শুরু হলে বাড়ি ফেরার কথা আমাদের মনেই থাকত না। হঠাৎ অস্তমিত সূর্যের কিরণ চোখে এসে পড়তেই নন্দিতা তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়িয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল– এই রে দেরি হয়ে গেছে। তাড়াতাড়ি চল বাড়ি ফিরতে হবে। বাড়িতে বলেছি অনার্সের স্পেশাল ক্লাস আছে। দেরি হলেই মা চিন্তা করবে।

নন্দিতা সবুজ ঘাসের ওপর যে রুমালটা পেতে বসেছিল সেটা না নিয়েই উঠে পড়েছিল। আমি ওর অলক্ষ্যে সেই রুমালটা কুড়িয়ে পকেটে পুরেছিলাম। যেন সাত রাজার ধন এক মানিক কুড়িয়ে পেয়েছি। ট্রেনে জানলার ধারে বসে গরমে ঘাম মুছতে গিয়ে তার মনে পড়েছিল রুমালটার কথা। মনে পড়া মাত্রই সে তার নিজস্ব ভঙ্গিতে বলে উঠেছিল, ‘এইরে ভিক্টোরিয়ার মাঠে রুমালটা ফেলে এসেছি।’

আমি আমার রুমালটা ওর দিকে বাড়িয়ে দিয়ে চাপাস্বরে বলেছিলাম, ‘ওটা আমার পকেটে আছে।’

–তা হলে তোরটা কেন, আমার রুমালটা দে।

–ওটা আর তোকে দেব না। তুই যখন আমার পাশে থাকবি না তখন এই রুমালটার সুগন্ধ তোর কথা আমায় মনে করিয়ে দেবে। তোর ঘামে ভেজা শরীরের সুগন্ধ ওই রুমালটার মধ্যেই খুঁজে পাব।

আমার কথা শুনে নন্দিতা বলেছিল, ‘রুমাল নিলে কিন্তু প্রেম টেকে না। ছাড়াছাড়ি হয়।’

বলেছিলাম, ‘সেই জন্যই তো এখন থেকে তোর একটা স্মৃতি নিয়ে রাখলাম।’

আমার বেশ মনে আছে বাড়ি থেকে বেরোবার সময় রুমালটা পকেটে রেখেছিলাম। সেটা কোথায় হারিয়েছি কে জানে। আজ যে এরকম অঘটন হবে বুঝতেই পারিনি। সকালে কার মুখ দেখে উঠেছিলাম কে জানে।

আজ শনিবার। মনে হয় আজ আমার ওপর শনির কোপ পড়েছে। বাড়ি থেকে বেরোবার সময় যথারীতি মা তারার ফটোকে ভক্তি ভরে প্রণাম করেছি। তবে কোন পাপে আমার এই দশা হল। মনে করতে চেষ্টা করলাম আজ সকাল থেকে এ পর্যন্ত কী কী পাপ করেছি। যতদূর মনে পড়ে একটাও মিথ্যে কথা বলিনি। কাউকে কটু কথা বলিনি। এমনকী কারও বাড়া ভাতে ছাই দিইনি। বরং শেওড়াফুলি স্টেশনের বুকিং কাউন্টারের সামনে বসা ভিখারিকে আজ এক টাকার একটা কয়েন দিয়েছি। তাকে দেখলেই কেন জানি না আমার মৃত ঠাকুমার কথা মনে পড়ে। আমার ঠাকুমার মুখের সঙ্গে তার হুবহু মিল আছে।

হঠাৎ মনে পড়ে গেল আজ সকালে ঘুম থেকে উঠেই পাশের বাড়ির মাকুন্দ নিতাইয়ের মুখ দেখেছি। লোকে বলে ওর মুখ দেখলেই নাকি দিনটা খারাপ যায়। হলও তাই। একটা অপয়া লোকের মুখ দেখার জন্যই আমার রুমাল হারিয়ে গেছে। রুমাল হারানোর কথা ভাবতে গিয়ে হঠাৎ আমার মাথার বাঁদিকে মৃদু যন্ত্রণা শুরু হল। চোখে অন্ধকার দেখলাম। একটা অ্যানাসিন পেলে হতো। হাতের কাছে তা যখন নেই, তখন জলই খাওয়া ভালো। ফোলিও ব্যাগের চেনটা খুলে প্লাস্টিকের বোতল বার করে ঢকঢক করে খানিকটা জল খেয়ে নিলাম। তাতেও আমার যন্ত্রণা কমল না বরং বেড়ে গেল। যন্ত্রণাটা মাথার না মনের কিছুই বুঝে উঠতে পারলাম না।

আমার পাশে বসা সুনীতি ব্যানার্জী হঠাৎ বলে উঠল, ‘কিরে ভাস্কর তোর মুখটা অমন শুকনো লাগছে কেন? কি হয়েছে তোর? এনিথিং রঙ?’

ওর কথা কানে ভেসে আসতেই আমার তন্ময়তা কাটল। আমি এতক্ষণ একটা ঘোরের মধ্যে ছিলাম। বুঝতেই পারিনি কখন ইংরেজির প্রফেসর পড়ানো শেষ করে ক্লাস থেকে চলে গেছেন। কখন গুলতানি শুরু হয়েছে ক্লাসে।

বললাম, ‘জানিস আজ আমার রুমালটা হারিয়ে গেছে। ওটা আমার ভীষণ পয়া ছিল।’

ব্যস পাগলকে দিয়েছি সাঁকো নাড়া দিতে। সুনীতি আমার কথা শুনে ব্ল্যাক বোর্ডের কাছে গিয়ে গলা চড়িয়ে বক্তৃতার ঢঙে বলল, ‘লেডিজ এ্যান্ড জেন্টলম্যান, আজ আমাদের ভাস্কর স্যান্যালের রুমাল হারিয়ে গেছে। ওর মন খারাপ। তাই ওর শোকাচ্ছন্ন মনের শান্তির জন্য এসো আমরা এক মিনিট নীরবতা পালন করি।’

তার কথা শুনে ক্লাস শুদ্ধু সকলের সে কি হাসি। চন্দননগরের মেয়ে কস্তুরী সিন্হা হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ল। আমার এখন ইচ্ছে করছে এক ঘুসি মেরে ওর বত্রিশ পাটি দাঁত ফেলে দিতে। ও আগে বিধান কলেজে পড়ত। হঠাৎ কি খেয়াল হল ওখানে এক বছর পড়ে আমাদের কলেজে উড়ে এসে জুড়ে বসেছে। অনেকের মুখে শুনেছি রিষড়ার বিধান কলেজের অনেক ছেলের মাথা খেয়ে আমাদের কলেজে ঢুকেছে। এক নম্বর ছেলেবাজ।

কস্তুরী আমাদের কলেজে ভর্তি হওয়ার পর থেকেই অনেকেরই চিত্তচাঞ্চল্য বেড়ে গেছে। চারটে বাজলেই যারা পালাই পালাই করত, তারা পাঁচটা পর্যন্ত কলেজে থাকে। আসলে কস্তুরীর মেয়েদের চাইতে ছেলে বন্ধু বেশি। কস্তুরী যেখানে ছেলেরাও সেখানে। এ যেন সেই চিটে গুড়। যেখানে রাজ্যের মাছি ভন ভন করে। অথচ কস্তুরীকে দেখতে এমন কিছু আহামরি নয়। খুবই সাধারণ। গায়ের রং কালো, মুখটা লম্বা মতন, চোখ দুটো বড়ো বড়ো। দেহে মেদের পরিমাণ বেশি। দূর থেকে দেখলে মনে হবে একেবারে সাক্ষাৎ মা কালি। তবু কি আশ্চর্য সে আমাদের কলেজের অনেক ছেলের চোখে বিশ্ব সুন্দরী, মিস ইউনিভার্স। টিফিনের সময় ক্যান্টিনে গেলেই কলেজের ছেলেগুলো ওর সামনে মাছির মতো লেপটে থাকে।

ওদের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা লেগে যায় কস্তুরীর পাশের চেয়ারে কে বসবে। পাশে বসলে কস্তুরীর শরীরের অল্প বিস্তর স্পর্শ সুখ ফাউ পাওয়া যায়। আমি ওই প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ভুলেও অংশগ্রহণ করি না। ওরা যখন অফ পিরিয়ডে খোশ মেজাজে গল্প করে আমি তখন এক কোণে বসে বাংলা অনার্সের রেফারেন্স বইয়ের ভেতর ডুবে থাকি। ওদের আলোচনার বিষয় হল পরচর্চা আর রাজনীতি যা আমার একেবারেই ভালো লাগে না। আমি আসলে হই হট্টগোল পছন্দ করি না। তা ছাড়া যেখানে একজন মেয়ের সঙ্গ অনেকে কামনা করে, আমি তাদের থেকে সব সময় দূরে থাকি।

তবু চক্ষুলজ্জার মাথা খেয়ে কস্তুরী যখন ইংরেজি সাহিত্যের ইতিহাস সম্পর্কে আলোচনা করতে আসে, আমার তখন বুকের মধ্যে ধুক-পুকুনি শুরু হয়। আমি তখন ইষ্টনাম জপ করতে থাকি। ক্লাসের ছেলেগুলো বিষদৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। মনে হয় কস্তুরী ওদের যেন ব্যক্তিগত সম্পত্তি। ওদের জিনিসে ভাগ বসাব এমন ইচ্ছে আমার কখনও হয়নি। কস্তুরী যদি সেধে আমার সঙ্গে গল্প করতে আসে আমি কী করব?

একদিন লাইব্রেরি রুমে ও আমাকে বলেছিল, ‘তোমার গায়ে প্রেম প্রেম গন্ধ। তুমি অনেক মেয়ের সঙ্গে প্রেম করবে।’

বলেছিলাম, ‘প্রেমের আবার আলাদা গন্ধ আছে না কি?’

কস্তুরী বলেছিল, ‘তোমার কথাবার্তায়, চালচলনে তো অনুভব করা যায়। তা ছাড়া তুমি তো আমাদের পাত্তাই দাও না।’

বলেছিলাম, ‘ওটা তোমাদের ভুল ধারণা। তোমাদের সঙ্গে নিজেকে ঠিক খাপ খাওয়াতে পারি না। তা ছাড়া আমি একটু নির্জনতা পছন্দ করি।’

কস্তুরী তখন বলেছিল, ‘বলো কোন নির্জন জায়গায় তুমি যেতে চাও? জু গার্ডেন, মিলেনিয়াম পার্ক, ভিক্টোরিয়া, প্রিন্সেপ ঘাট। যেখানে শুধু আমি আর তুমি সারাদিন মজা করে কাটাব।’

বলেছিলাম, ‘ঠিক আছে। পরে ভেবে বলব।’

হঠাৎ রঙ্গমঞ্চে গদা হাতে ভীমের প্রবেশের মতো পলিটিক্যাল সায়েন্সের প্রফেসর এন দে, এসে হাজির। উনি সাধারণত ঘন্টা পড়ার সঙ্গে সঙ্গে আসেন না। আজ হঠাৎ এসে গেলেন। ওকে ঢুকতে দেখে ক্লাসের সব ছেলে মেয়েরা হাসি বন্ধ করে ক্লাস নোটের খাতা খুলে বসল। ভয়ে কস্তুরীর মুখ এতটুকু হয়ে গেল।

প্রফেসর এন দে তাঁর চেয়ারে বসে প্রথমেই বললেন, ‘আমি জানতে চাই তোমাদের হাসির কারণটা কি?’

শঙ্কর উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘স্যার আমাদের ভাস্কর স্যান্যাল

মা-আ-নে…’

প্রফেসর এন দে আমার দিকে ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন, ‘কি ব্যাপার ভাস্কর।’

আমি উঠে দাঁড়িয়ে মাথা নীচু করে বললাম, ‘স্যার আমার একটা রুমাল হারিয়ে গেছে। শুনে ওরা সবাই হাসছিল।’

আমার কথা শুনে ক্লাসের সকলকে উদ্দেশ্য করে এন দে বললেন, ‘মনে রেখো এটা কলেজ। ক্লাবঘর নয়। আর যেন কখনও এরকম না হয়। তোমাদের মনে রাখা উচিত পাশের ঘরে আর একটা ক্লাস চলছে। অসভ্যতা তোমাদের এখনও গেল না।’

কলেজ ছুটির পর মন খারাপ করে বাড়ি ফিরলাম। আজ কিছুই ভালো লাগছে না। না ভালো লাগছে টিফিন খেতে, না ভালো লাগছে পার্ট টু-এর পড়া করতে। মাকে শরীর খারাপের অজুহাত দেখিয়ে রাতে কিছু না খেয়েই বিছানায় শুয়ে পড়লাম। বারবার লাল রুমালটার কথা মনে পড়ল। নন্দিতার সব চিঠি পুড়িয়ে ফেললেও রুমালটা ফেলে দিতে পারিনি। লেডিস রুমালটা আমার রক্ত মাংস, মেদ মজ্জার সঙ্গে একাত্ম হয়েছিল। আজ সেটা হারিয়ে যেতে মনে হচ্ছে এত দিন নন্দিতার যে স্মৃতি উজবুকের মতো বয়ে বেড়িয়েছি, আজ তা থেকে মুক্তি পেলাম। স্বপ্নে দেখতে পেলাম নন্দিতার লাল রুমালটা রাজপথে অযত্নে পড়ে আছে। পথচারীরা রুমালটা মাড়িয়ে আমার প্রেমকে দুপায়ে থেঁতলে চলে যাচ্ছে।

হঠাৎ মাঝরাতে বাড়ির ফোনটা বেজে উঠতেই ঘুমটা ভেঙে গেল। মিউজিক থামার পর ফোনটা ধরতেই ক্লাসমেট সুনীতি ব্যানার্জীর গলা ভেসে এল, ‘হ্যালো ভাস্কর সুখবর আছে।’

–সুখবর?

–হ্যাঁ, নন্দিতার সঙ্গে বলাই-এর ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে।

–কেন ?

–বলাই এখন রীনার প্রেমে মেতেছে। বড়োলোকের প্রেম মানেই চায়ের ভাঁড়ে চুমুক দিয়ে ফেলে দেওয়া।

–খবরটা দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ। গুড নাইট, বলে আমি বিরক্ত হয়ে ফোনটা ছেড়ে দিয়ে শুয়ে পড়লাম।

সোমবার প্রফেসর প্রতাপরঞ্জন হাজরার ক্লাস ছিল এগারোটায় কিন্তু আমি চলে এলাম পৌনে দশটায়। এত আগে আমার কলেজে আসার কথা নয়। কিন্তু কেন জানি না আমি খানিকটা ঘোরের মধ্যে এক ঘন্টা আগে চলে এসেছি। ঘোরের মধ্যেই কখন জিন্স-এর ট্রাউজারের বদলে পাজামা পাঞ্জাবি পরেছি খেয়াল নেই। এই কেন-র উত্তর আমার জানা নেই। কে জানে কেন আজ সকাল হতেই একজনের মুখ আমার অবচেতন মনে ভেসে উঠেছিল। তাকে দেখার জন্যই কি আজ আমি সাত তাড়াতাড়ি কলেজে চলে এসেছি। কে জানে হয় তো তাই। কিন্তু যে আমাকে বিট্রে করেছে তার জন্য কেন এত ভেবে মরছি। ভালোবাসা কি এতই ঠুনকো।

যাইহোক সাত তাড়াতাড়ি যখন কলেজে এসেই পড়েছি তখন রেফারেন্স বই দেখে নোটটা লিখে ফেলা যাক। কারণ বইটা আর একদিন রাখলেই লাইব্রেরিতে আমাকে ফাইন দিতে হবে। এখনও কলেজে কোনও ছাত্র আসেনি। নিরিবিলিতে রেফারেন্স বই দেখে যতটা লেখা যায়। সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠে একেবারে কোণের ক্লাস রুমের ভেজানো দরজা ঠেলতেই চোখ পড়ল লাস্ট বেঞ্চে কে যেন আধশোয়া অবস্থায় রয়েছে। আধো আলো আধো অন্ধকারে দূর থেকে দেখা গেল বেঞ্চের নীচে গোলাপি ফলস্ পাড় ঝুলছে।

বুকটা আমার ছ্যাঁত করে উঠল। অশরীরী প্রেতাত্মা নয় তো? দু’বছর আগে পার্ট ওয়ানের একজন ছাত্রী ফাইনাল পরীক্ষায় রেজাল্ট খারাপ হয়েছিল বলে গলায় ওড়নার ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যা করেছিল। যে ঘরে সে আত্মহত্যা করেছিল আমি এখন সেই ঘরের দরজার সামনে একা দাঁড়িয়ে। মেয়েটার নাম সুমনা রায়। শ্রীরামপুরে বাড়ি। খুব হাসিখুশি মেয়ে ছিল। অনেকেই নাকি সন্ধের পর তাকে তিন তলার ছাদে ঘুরতে দেখেছে। কাঁধে শান্তিনিকেতনি চামড়ার ব্যাগ, চুলে বিনুনি। দু’বছর আগে মারা গেলেও সে এখনও কোন্নগর হীরালাল পাল কলেজের মায়া ছাড়তে পারেনি।

আমি যে এক ছুটে তাড়াতাড়ি নীচে নেমে যাব তার উপায় নেই। কে যেন আমার পায়ে পেরেক ঠুকে এখানে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। হঠাৎ নারী কণ্ঠের মৃদু গোঙানির শব্দ ভেসে আসতেই চমকে উঠলাম। আমি মনে মনে সাহস সঞ্চয় করে এগিয়ে দেখলাম নন্দিতা হাঁটু মুড়ে কপালে হাত রেখে শুয়ে আছে। মাথার নীচে বইয়ের ব্যাগ। জল ভরা প্ল্যাস্টিকের বোতল রয়েছে পাশের বেঞ্চিতে। মেহগনি গাছের ফাঁক দিয়ে একফালি রোদ্দুর জানলা দিয়ে টপকে তার মেক-আপ করা মুখে এসে পড়েছে।

আমি তার যন্ত্রণা কাতর মুখটা দেখে বললাম, ‘এই তোর কি হয়েছে?’

আমাকে দেখে তার কাজল টানা চোখ দিয়ে টসটস করে জল পড়তে লাগল। এর আগে নন্দিতাকে কলেজে অনর্গল কথা বলতে দেখেছি, হাসতে দেখেছি। কখনও এরকম কাঁদতে দেখিনি। কাঁদলেও যে তোকে কত মধুর লাগে তা এই প্রথম দেখলাম। সে চোখের জল মুছে বলল, আজ সকাল থেকে এ্যাপেন্ডিসাইটিসের ব্যথাটা হচ্ছে।

বললাম, ‘ডাক্তার দেখাসনি কেন?’

‘দেখিয়েছিলাম। পার্ট টু পরীক্ষা হলেই অপারেশন করতে হবে’, বলে নন্দিতা কপাল থেকে হাতটা সরাল।

হাতটা সরাতেই তার লাল কাচের চুড়ির শব্দে মল্লার রাগ বেজে উঠল। কোথা থেকে একটা পায়রা ডানা ঝাপটিয়ে ভেন্টিলেটারে গিয়ে বসল। মুখে মুখ লাগিয়ে তার প্রেমিকার সঙ্গে বকবকম শুরু করে দিল।

 

আমি তার পায়ের কাছে বসে বললাম, ‘তোর পেটে একটু হাত বুলিয়ে দিই। দেখবি ভালো লাগবে।’

 

সে কোনও কথা না বলে শুধু তার পেটের কাছ থেকে শাড়ির অাঁচলটা সরিয়ে দিল। যন্ত্রণা কমানোর উদ্দেশ্যে আমি তার মাখনের মতো নরম ফরসা পেটে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললাম, ‘জানিস তোর রুমালটা কাল হারিয়ে গেছে।’

সে কথা শুনে নন্দিতা উঠে বসে আমার গলা জড়িয়ে ধরে বলল, ‘রুমাল হারিয়েছে তো কী হয়েছে? আমাকে তো পেয়েছিস।’

আমি কিছু বলার আগেই সে তার উষ্ণ চুম্বনে আমার ঠোঁট দুটো পুড়িয়ে দিল। ভুলিয়ে দিল রুমাল হারানোর কষ্টটা।

চোরাবালি

গ্যাসে পাউরুটি সেঁকতে সেঁকতে স্ত্রী অনসূয়ার কথাই ভাবছিল দেবল। পনেরো দিন হল বাপের বাড়ি গিয়েছে অনু, আর এরই মধ্যে হাঁপিয়ে উঠেছে সে। কটা মাস কীভাবে কাটাবে জানা নেই দেবলের।

মা হতে চলেছে অনু। বিয়ের পর বাপের বাড়িতে মাত্র তিনবারই যেতে পেরেছে সে। দেবলকে একা রেখে যেতে কিছুতেই মন চায় না অনুর। এবার দেবলই একপ্রকার জোর করে অনুকে বাপের বাড়ি পাঠিয়েছে। ওখানে থাকলে অনুর ঠিকমতো দেখাশোনা হবে। অফিস থেকে দেবলের ফেরার কোনও ঠিক থাকে না। এতক্ষণ এই অবস্থায় অনুকে বাড়িতে একা রাখতে দেবলের মন সায় দেয়নি। তাছাড়া ডাক্তারের কথামতো এইসময় একটু বিশেষ যত্নেরও প্রয়োজন  অনুর।

যথারীতি রোজকার মতো ডিম-পাউরুটি দিয়ে ব্রেকফাস্ট সেরেই, দেবল অফিস পেঁছোল। লাঞ্চটা আজকাল বাইরেই সারে। অনু থাকতে টিফিন প্যাক করে ব্যাগে ভরে দিত। সারাদিন অফিসে কাটিয়ে বাড়ি যখন ফিরল দেবল, নিজেকে অসম্ভব ক্লান্ত মনে হচ্ছিল। জিরিয়ে নিতে সোফায় এসে বসল। ক্লান্তিতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছে খেয়াল নেই। ঘুম ভাঙল ফোনের একনাগাড়ে বেজে চলা ক্রিং ক্রিং শব্দে। অনুর ফোন। তাড়াতাড়ি উঠে বসল হ্যালো।

এত দেরি হল ফোন ধরতে? নিশ্চয়ই ঘুমিয়ে পড়েছিলে? এক কাজ করো বাইরে থেকে খাবার আনিয়ে নাও। বাড়িতে কিছু আর করতে হবে না, চিন্তিত লাগল অনুকে।

অনু ফোন ছেড়ে দিলে হাতমুখ ধুয়ে দেবল ফ্রেশ হয়ে নিল। সবে ফোনটা নিয়ে খাবারের অর্ডার দিতে যাবে, কলিংবেলটা বেজে উঠল। মনে মনে বিরক্ত হল, এই সময় কে আবার এল?

দরজা খুলতেই দেখল তিরিশ-বত্রিশ বছর বয়সি একটি তরুণী দরজায় দাঁড়িয়ে ফরসা, বেশ সুন্দরী। এক মুখ হাসি লেগে রয়েছে ঠোঁটের কোণায়।

আপনি?

আমি মিতা, আপনাদের ঠিক উপরের ফ্লোরেই থাকি।

কিন্তু আপনাকে তো আমি কোনও দিন…

দেবলের কথা শেষ হওয়ার আগেই মিতা বলে উঠল, হ্যাঁ, আপনি আমাকে চেনেন না। কিন্তু আমি আপনাকে চিনি। অনুর হাজব্যান্ড আপনি। অনু ডেলিভারির জন্য বাপের বাড়ি গেছে।

মিতার কথা শুনতে শুনতে একটা কথাই দেবলের মাথায় ঘুরপাক খেতে লাগল, ওদের সম্পর্কে মহিলা এত কথা কী করে জানলেন? এছাড়াও একই বিল্ডিং-এ থেকেও কী করে দেবল মহিলাকে চেনে না?

এত চিন্তা করতে হবে না। মাত্র একমাস আগেই এখানে শিফট হয়েছি আমি। কিছুই খবর রাখেন না দেখছি। আগে যারা থাকত তাদের জায়গায় এসেছি। অবশ্য আপনি সকালে অফিস বেরিয়ে যান, ফেরেন দেখি সেই সন্ধেবেলায়। আর আমাকে কী বাইরেই দাঁড় করিয়ে রাখবেন? ভিতরে আসতে বলবেন না?

ওহ! সরি, প্লিজ ভিতরে আসুন। দেবল মিতাকে বসার ঘরে সোফায় এনে বসায়।

সারাক্ষণ বাড়িতে দমবন্ধ হয়ে আসে না আপনার? বড়ো শহরের এই এক অসুবিধা। অন্যান্য সুবিধা তো প্রচুর আছে কিন্তু জায়গা অত্যন্ত সীমিত আর লোকগুলোও বড়ো স্বার্থপর। নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকে। অপরের জন্য কোনও সময় নেই।

মিতার কথা শুনে দেবল হেসে ফেলে।

আরে আমি আপনার খাবার নিয়ে এসেছি। কথায় কথায় সেটা দিতেই ভুলে গেছি, বলে মিতা হাতে রাখা কাপড় ঢাকা থালাটা সোফার সামনেই টেবিলে নামিয়ে রাখল।

খাবার দেখে অস্বস্তি বোধ করছিল দেবল। কিন্তু কিছু বলার আগেই মিতা বলে উঠল, আমি জানি আপনি বলবেন এসবের কী দরকার ছিল? আরে আমি নিজের জন্য খাবার বানাচ্ছিলাম ভাবলাম, আপনারটাও বানিয়ে নিই।

মিতাকে হাসতে দেখে দেবলও মুখে হাসি টেনে আনে।

কথায় কথায় দেবল জানতে পারে, মিতা লখনউ-এর মেয়ে ওর স্বামী দুবাইতে ব্যাবসা করেন। এতদিন ওখানেই ছিল মিতা কিন্তু নিজে কিছু করবে ভেবে দেশে ফিরে আসে। এখানে একটি এনজিও-র সঙ্গে যুক্ত সে।

ঠিক আছে আজ চলি। বাসনের চিন্তা করবেন না। সকালে এসে আমি নিয়ে যাব। মিতা চলে গেল। দেবল একদৃষ্টে মিতার চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে চিন্তায় ডুব দিল।

সকালে বাসন নেওয়ার অছিলায় গরম গরম আলুর পরোটা আর এক বাটি দই জোর করে ধরিয়ে দিয়ে গেল দেবলের হাতে। দেবল প্রতিবাদ করলে, মিতা বলল, দেবলকে দেখে ওর মৃত দাদা অক্ষয়ের কথা মনে পড়ে যায়। সুতরাং দেবল কিছুই আর বলে উঠতে পারে না।

 

এরপর থেকে রোজই কিছু না কিছু খাবার বানিয়ে দিয়ে যেতে আরম্ভ করে মিতা। অনু কিছু ভুল না ভেবে বসে, এই ভেবে বলব না বলব না করেও, শেষমেশ সবকিছু খুলে বলে দেবল।

সব শুনে অনু বলে, হ্যাঁ মনে পড়েছে, আমার এখানে চলে আসার আগেই ভদ্রমহিলা ওখানে শিফট করেন। অল্পবিস্তর আলাপ হয়েছিল। যাক বাড়ির তৈরি খাবার পাচ্ছ, আমি নিশ্চিন্ত। কিন্তু দেখো ওই খাওয়া অবধি, ওর থেকে বেশি কিন্তু এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা কোরো না। নিজের রসিকতায় অনু নিজেই হেসে ওঠে।

কখনও পোলাও-মাংস তো কখনও লুচি-তরকারি আবার কখনও সাদামাটা ঘরোয়া খাবার রোজই কিছু না কিছু দেবলের কাছে আনা আরম্ভ করল মিতা। কিছু বললেই বলে, আপনার জন্য আমারও তো খাওয়া হচ্ছে।

এত কিছু খেয়ে ফিট থাকেন কী করে বলুন তো? জিজ্ঞেস করেই বসে দেবল।

কেন, রোজ হাঁটা এবং জিম দুটোই করি নিয়ম করে।

বাঃ, তাহলে চলুন কাল থেকে আমিও আপনাকে সঙ্গ দেব, দেবল বলে।

উৎফুল্ল হয়ে ওঠে মিতা। এরপর রোজই সকালে দুজনে একসঙ্গে হাঁটতে বেরিয়ে যেত আর সন্ধেবেলায় জিম যাওয়াটা ওদের রুটিন হয়ে দাঁড়াল।

ধীরে ধীরে মিতা আর দেবলের বন্ধুত্ব গাঢ় হয়ে উঠতে লাগল। বিশ্বাস থেকে মিতার উপর একটা নির্ভরতা গড়ে উঠল। কথায় কথায় একদিন আগত সন্তানকে নিয়ে স্বপ্ন দেখার কথা শেয়ার করছিল দেবল, খেয়াল করল মিতা কিছুটা উদাস। কারণ জিজ্ঞেস করতে দেবল জানতে পারল, ডাক্তাররা নাকি জানিয়ে দিয়েছেন, মিতা কোনও দিনও মা হতে পারবে না। তবে ওদের স্বামী-স্ত্রীর ইচ্ছে কোনও অনাথ শিশুকে নিয়ে এসে মানুষ করা। এটা জানার পর মিতার প্রতি দেবলের মনে সম্মানের জায়গাটা আরও বেড়েছে।

সেদিন বিকেল থেকেই বৃষ্টি। আকাশ কালো করে শুধু মেঘের গর্জন। ছুটির দিন। অনুর কথা খুব মনে হচ্ছিল দেবলের। ও যদি বাড়িতে থাকত এই বৃষ্টির মরশুমে ছুটত গরম গরম পকোড়া ভাজতে। থালা ভরে দেবলের সামনে এনে রেখে দিত। নিজের হাত পুড়িয়ে পকোড়া ভাজতে মন চাইল না দেবলের। বিকেলে বারান্দায় দাঁড়িয়ে বৃষ্টিভেজা প্রকৃতির সৌন্দর্যে  বুঁদ হয়ে রইল।

ফোনটা বাজতেই চিন্তায় ছেদ পড়ল। মিতার ফোন, পকোড়া বানাচ্ছি। চলে আসুন আমার ফ্ল্যাটে।

যাক বাঁচা গেল। সত্যিই খুব পকোড়া খেতে ইচ্ছে করছিল। আমি এখনই আসছি, বলে দেবল ফোন ছেড়ে দিল।

মিতার ফ্ল্যাটে পৌঁছোতেই সঙ্গে সঙ্গে প্লেট ভর্তি করে পকোড়া হাজির। দেবলকে বসিয়ে মিতা পকোড়ার সঙ্গে গরম গরম চা বানিয়ে আনল। চা আর পকোড়ার সঙ্গে ওদের আড্ডাও বেশ জমে উঠল।

হঠাৎ-ই খেয়াল হল বাইরে বেশ অন্ধকার হয়ে গেছে।, আড্ডা মারতে মারতে খেয়ালই হয়নি। উঠব উঠব করেও কিছুতেই ওঠা হয়ে উঠছিল না। মাথাটাও কেমন জানি ঘুরছে বলেই মনে হল দেবলের। মিতা জোর করল, ডিনার খেয়ে যেতে হবে। বারণ করা সত্ত্বেও কথা কানে তুলল না মিতা। রান্নাঘরের দিকে চলে গেল।

হেঁটে একটু হাত-পাগুলো ছাড়িয়ে নিতে ইচ্ছে হচ্ছিল দেবলের। সেই কখন থেকে এক ভাবে সোফায় বসে আছে। উঠে দাঁড়াতেই মাথাটা জোরে ঘুরে গেল দেবলের। চারপাশটা অন্ধকার হয়ে এল। জ্ঞান হারিয়ে সোফায় লুটিয়ে পড়ল দেবল।

খানিক পরে মিতা এসে ঘরে ঢুকল। দেবলের ওই অবস্থা দেখে ঠোঁটের কোণায় হাসি ফুটে উঠল। কোনও ভাবে টানতে টানতে দেবলের বেহুঁশ শরীরটাকে শোবার ঘরে এনে বিছানায় শুইয়ে দিল। নিজেকে আয়নায় ভালো করে দেখল মিতা। যে-কোনও পুরুষমানুষের হুঁশ উড়ে যাওয়ার মতোই রূপ। ঘরের আলো নিভিয়ে দেবলের পাশে এসে শুয়ে পড়ল মিতা।

 

পরদিন সকালে ঘুম ভাঙতেই লক্ষ্য করল দেবল, মিতার নগ্ন শরীরটাকে ও বাহুবন্ধনে শক্ত করে জড়িয়ে রেখেছে। এ কী করে সম্ভব? চমকে উঠে বসল দেবল। ঘটনাস্রোত মনে করার চেষ্টা করল কিন্তু সব অন্ধকার।

ততক্ষণে মিতাও উঠে বসেছে। চাদর দিয়ে ঢেকে নিয়েছে নিজেকে। দেবলের বিস্ফারিত দুই চোখের দিকে তাকিয়ে অশ্রুসজল হয়ে উঠল ওর দুই চোখ। দেবলের দিকে তাকিয়ে বলল, কাল রাতে কী হয়েছিল তোমার? এর আগে কখনও এভাবে জবরদস্তি করোনি। আমি তোমাকে বিশ্বাস করেছিলাম। কাল রাতে তোমার শরীরের জোরের সঙ্গে আমি পেরে উঠিনি।

লজ্জায় চোখ তুলে তাকাতে পারল না দেবল। নিজের প্রতি নিজেরই ঘেন্না হল। যে ওকে দাদার আসনে বসিয়েছিল, তাকেই ও নিজের বাসনার শিকার করল। এই ভুল ও কী করে করল? যে কিনা কোনও দিন অন্য মহিলাদের দিকে চোখ তুলে তাকায়নি পর্যন্ত। ভুল করে ফেলেছে, কী করেই বা সেটা শুধরানো যায়?

দেবলের ইচ্ছে হচ্ছিল ফোন করে মিতার কাছে ক্ষমা চায় কিন্তু সাহসে কুলোল না। মিতা ফোন করা পুরোপুরি বন্ধ করে দিয়েছিল। দেবলের ভয় করতে লাগল, মিতা যদি ওর উপর ধর্ষণের অভিযোগ নিয়ে আসে তাহলে অনু আর সমাজের সামনে কী করে সে মুখ দেখাবে? ফোনে অনুর সঙ্গে রোজই কথা হতো দেবলের কিন্তু এই ঘটনার কথা দেবল কিছুতেই অনুকে বলতে পারল না।

 

একদিন হঠাৎ নিজে থেকেই মিতা এসে হাজির হল দেবলের কাছে। দেবল ওকে দেখেই আমতা আমতা করে বলে উঠল, মিতা আমিই তোমার কাছে আসতাম ক্ষমা চাইতে।

কীসের ক্ষমা দেবল? সেদিনের ঘটনায় না তোমার দোষ ছিল আর না আমার। ঘটনাটা হওয়ার ছিল হয়ে গেছে। দুর্ঘটনা ভুলে যেতে পারলেই ভালো। আমি মন থেকে ওটা মুছে ফেলেছি।

মিতার কথা শুনে দেবলের মধ্যে যেন প্রাণ এল। মনে হল, সত্যিই মিতার মতো মেয়ে হয় না!

দেবল, আমি একটা অন্য কাজে তোমার কাছে এসেছি। হঠাৎ আমার কিছু টাকার দরকার হয়ে পড়েছে। এই মুহূর্তে এত টাকা আমার কাছে নেই। আমি তাড়াতাড়িই তোমাকে টাকাটা ফিরিয়ে দেব, বলে সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে মিতা দেবলের দিকে তাকাল।

কত টাকা?

পঞ্চাশ হাজার। টাকা এসে গেলেই আমি তোমার টাকা ফিরিয়ে দেব, দেবলের চোখে চোখ রাখে মিতা।

দোষী দোষ ঢাকতে কী না করে? যখন-তখন প্রযোজনের জন্য বাড়িতে চল্লিশ হাজার মতো রেখেই দেয় দেবল। সেই টাকাটাই বার করে এনে মিতার হাতে তুলে দিয়ে বলল, এই মুহূর্তে আমার কাছে চল্লিশ হাজারই আছে মিতা। টাকাটা দিয়ে দেবলের মনে হল, কিছুটা হলেও ওর অপরাধের বোঝা হালকা হয়েছে।

 

সেই শুরু। এরপর থেকে মাঝেমাঝেই মিতা কখনও দশ-বিশ হাজার টাকা দেবলের কাছে চাইতে শুরু করল। দিয়ে দিত দেবল, কিন্তু কত দিন? কুবেরের ধন নেই ওর কাছে! সুতরাং একদিন দেবলকে না বলতেই হল মিতার মুখের উপর। মিতাও চুপ করে থাকল না।

না শোনার অভ্যাস নেই মিতার। ফোঁস করে উঠল। তুমি কী ভেবেছ দেবল? ওই রাতের ঘটনা আমি ভুলে গিয়েছি? সেদিন তুমি যা কিছু করেছ তার সব প্রমাণ আমার কাছে আছে। দেখতে চাও? বলে নিজের ফোনে রেকর্ড করা পুরো ভিডিও-টা তুলে ধরল দেবলের সামনে। ভিডিও-তে পরিষ্কারই দেখা যাচ্ছে দেবল মিতার সঙ্গে জবরদস্তি করার চেষ্টা করছে আর মিতা ওর হাত থেকে নিজেকে বাঁচাবার চেষ্টা করছে। সবকিছু দেখে ঘেমে উঠল দেবল।

কী বলো দেবল? ভিডিও-টা নিয়ে পুলিশের কাছে যাব, না সোশ্যাল প্ল্যাটফর্মে ভাইরাল করে দেব? ভালোই হবে, অনুও দেখবে তোমার আসল রূপ, বাঁকা হাসি হেসে বলে মিতা।

শিউরে ওঠে দেবল। যে ওকে দাদা বলে মেনেছিল তার কাছ থেকে এরকম ব্যবহার? ভাবতে পারেনি দেবল। সে মিতাকে কারণটা সরাসরি জিজ্ঞাসা করে। উত্তরও পায়।

একটা বড়ো বাড়ি দেখেছি। পঞ্চাশ লাখ দাম বলছে। তোমাকে দিতে হবে টাকাটা। একবারে নয়, কিছু কিছু করে দিলেই চলবে কিন্তু দিতে তো তোমাকে হবেই। নয়তো আমি কী করতে পারি এতক্ষণে নিশ্চয়ই বুঝে গেছ, শ্লেষের ভঙ্গিতে বলে মিতা।

খুব ভালো করেই বুঝেছে দেবল, ওর সঙ্গে আলাপ করাটা মিতার একটা কৌশল ছিল। অনুর কথাগুলো মনে পড়ল, কাউকে ভালো করে না জেনেশুনে ভরসা কোরো না। এটা যে কত বড়ো সত্যি আজ টের পাচ্ছে দেবল।

অনু ডেলিভেরির জন্য হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে শুনেই দেবল কয়েক দিনের ছুটি নিয়ে কানপুর রওনা হল। অনুর বাপের বাড়ি ওখানেই। কিন্তু দেবল পৌঁছনোর আগেই অনু ফুটফুটে পুত্রসন্তানের জন্ম দিয়েছে। সুতরাং হাসপাতালে পৌঁছে নিজের সন্তানকে দেখে গত কয়েক মাসের দুশ্চিন্তা ঝেড়ে ফেলে স্ত্রী আর নবজাত সন্তানকে নিয়ে মেতে উঠল দেবল। এদিকে ছুটিও ফুরিয়ে আসছিল। অনুর ইচ্ছে ছিল দেবলের সঙ্গেই ফিরে যায় কলকাতায়। কিন্তু ডাক্তারের কথামতো আরও একমাস কানপুরে মা-বাবার কাছে থেকে যেতে বাধ্য হল অনু। দেবল ফিরে এল একাই।

আবার সেই মিতার মুখোমুখি হওয়া। সেই টাকার জন্য চাপ। ভিডিও ভাইরাল হওয়ার ভয়। দমবন্ধ হয়ে আসতে লাগল দেবলের। পরিত্রাণ পাওয়ার কোনও রাস্তা দেখতে পেল না সে।

এক মাস বাদেই অনু ফিরে এল সন্তানকে নিয়ে এসে অবাক হল দেবলের ব্যবহারে। যে-সন্তানকে নিয়ে এতদিন এত স্বপ্ন দেখেছে দেবল, সেই সন্তানকে কোলে নেওয়া তো দূরে থাক, তার একটু কান্নায় বিরক্ত হয়ে উঠতে লাগল দেবল। নতুন খেলনা কিনে আনার কথা বললে রেগে উঠত বলত, বাজে খরচ করা বন্ধ করো অনু।

শুধু এটুকুই নয়, অনুর থেকেও দূরে দূরে থাকতে আরম্ভ করল দেবল। অনু কাছে আসার চেষ্টা করলে, অন্য ঘরে চলে যাওয়াটা রোজকার ঘটনা হয়ে দাঁড়াল।

 

সেদিন দেবলের ছুটি। রোজকার থেকে একটু ধীরে ধীরেই বাড়ির কাজ সারছিল অনু। দেবের মোবাইলটা অনেক্ষণ থেকে বাজছে। এত সকালে কোথায় গেল দেব? এদিক ওদিক চাইল অনু। নাঃ আশেপাশে কোথাও নেই। বাধ্য হয়ে হাত মুছে মোবাইলটা ধরল। হ্যালো বলার আগেই ওধার থেকে নারীকণ্ঠ ভেসে এল, দুদিন ধরে সমানে ফোন করছি, ফোন ধরছ না কেন? দ্যাখো আমাকে রাগিয়ে দিও না। তাহলে আমি বাধ্য হব ভিডিও-টা ভাইরাল করে দিতে। তখন তোমার অবস্থা কী হবে ভেবে দেখেছ একবার? আমার এখুনি পনেরো লাখ টাকা চাই। আর যখনই টাকার কথা বলব, এসে দিয়ে যেও। আর আজ রাত্রে একবার ফ্ল্যাটে এসো আমার শরীর জ্বলে যাচ্ছে, হঠাৎই ফোনটা কেটে গেল।

অনুর পায়ে তলার মাটি সরে গেল। মহিলা কে? দেবলের কাছে কেন টাকা চাইছে? কোন ভিডিও ভাইরাল করার ভয় দেখাচ্ছে? রাত্রিতে কেন দেবলকে ফ্ল্যাটে ডাকল? এরকম নানা প্রশ্ন এসে অনুর মাথায় ভিড় করতে শুরু করল। ইচ্ছে হল সঙ্গে সঙ্গে দেবলের মুখোমুখি হতে কিন্তু আটকাল নিজেকে। আগে ব্যাপারটা বুঝতে হবে, ঘটনার শুরুটা জানতে হবে, তবেই কোনও পদক্ষেপ করা সম্ভব।

দেবল বাইরে থেকে ফিরলে, আজ অনেক দিন পর ওর মুখের দিকে চেয়ে দেখল অনু। সত্যি কত রোগা হয়ে গেছে। চোখের তলায় কে যেন কালি ঢেলে দিয়েছে। অনু নিজেকেই দোষারোপ করল, কেন লোকটার দিকে এতদিন ভালো করে তাকায়নি? কী এমন দুঃখ বুকে চেপে বসে আছে, যেটা ওকেও বলতে পারেনি দেবল?

দেব? অনেকটা সাহস বুকের মধ্যে ভরে নিয়ে অনু তাকাল দেবলের দিকে। আমাকেও বলবে না, তোমার কী হয়েছে? আমরা তো কথা দিয়েছিলাম, কেউ কাউকে কোনও কথা লুকোব না। তাহলে এত বড়ো ঘটনা তুমি কী করে লুকিয়ে রাখলে?

ছ্যাঁত করে উঠল দেবলের বুকটা। অনু কি তাহলে সব জেনে গেল? সবকিছু অনুর কাছে খুলে বলার জন্য দেবলের মনটা উদ্বেল হয়ে উঠতে লাগল। কিন্তু মুখ ফুটে একটা শব্দও বেরোল না।

বলো না দেব, কে ওই মহিলা, যার সঙ্গে কথা বলার জন্য তোমাকে বাড়ির বাইরে যেতে হয়? আজ তুমি না থাকাতে আমি ফোন ধরেছিলাম। যতক্ষণ তুমি না বলবে আমাকে, আমি কী করে জানব কেন তোমাকে মহিলা বিরক্ত করছেন? প্লিজ আমাকে খুলে বলো, হয়তো তাহলে তোমাকে কিছু সাহায্য করতে পারব।

অনুর কথায় দেবের চোখ জলে ভরে এল। নিজেকে আর আটকে রাখতে পারল না দেবল। কী কী ঘটনা ওর সঙ্গে ঘটেছে সব খুলে বলল দেবল।

এত কিছু হয়ে গেছে, তুমি আমাকে জানাওনি? কীসের ভয় ছিল তোমার, যে আমি তোমাকে ভুল বুঝব? আমি তোমার স্ত্রী, এতদিনে তুমি আমাকে এটুকুই চিনেছ? তোমার সুখ-দুঃখের সঙ্গী আমি, একটু তো ভরসা করতে পারতে আমাকে। যাই হোক, যা হবার হয়েছে। আমি তোমাকে ঠিক এই চোরাবালি থেকে টেনে বার করবই।

সারাটা দিন ধরে ভাবল অনু। রাতে খেতে বসে মনে মনে ঠিক করে রাখা প্ল্যানটা জানাল দেবলকে।

সত্যিই অনু, তুমি যেটা করবে ভাবছ সেটা আদৌ কি হওয়া সম্ভব? তুমি জানো না ওই মহিলা কতখানি চালাক, শঙ্কিত চোখে প্রশ্নটা করে দেবল।

অবশ্যই হবে দেব তবে আমাদের একটু ধৈর্য ধরতে হবে, দেবলের হাতে হাত রেখে ওকে ভরসা দেয় অনু।

প্ল্যান অনুযায়ী অনু, মিতার সঙ্গে বেশি করে মিশতে আরম্ভ করল, যাতে বন্ধুত্বটা আরও গাঢ় হয়। যখন অনু বুঝল মিতা এখন ওকে বিশ্বাস করতে আরম্ভ করেছে তখন ও শেষ চালটা দিল।

আজ ছেলেকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাব। হয়তো দেরি হবে ফিরতে, দেবল ফিরলে তুমি বাড়ির চাবিটা দিয়ে দিও আর পারলে কিছু খাইয়ে দিও, নয়তো বেচারা খিদে পেটে নিয়ে বসে থাকবে। হাত জোড় করে বলে অনু। মিতার মনে হয় আকাশের চাঁদ আপনিই এসে ওর হাতে ধরা দিয়েছে।

আরে হাত জোড় কেন করছ অনু। চাবি দিয়ে দেব আর তোমার বরকে পেট ভরে খাইয়ে দেব। চিন্তা কোরো না।

মিতাকে হাসতে দেখে গা জ্বলে উঠল অনুর। মনে মনে বলল অনু, হেসে নাও এখন যত খুশি। তুমি আমার দেবকে কাঁদিয়েছ মিতা, আমি তোমাকে উচিত শিক্ষা দেব।

অফিস থেকে ফিরে নিজের বাড়িতে মিতাকে দেখে দেবল অবাক হবার ভান করল। মিতা তুমি আমার বাড়ির ভিতর, কী করছ?

তোমার অনু আমার হাতে তোমাকে সঁপে দিয়ে গেছে দেবল। রহস্যময় হাসিতে মুখ ভরে উঠল মিতার। চাবির গোছাটাকে আঙুলে ঘোরাতে ঘোরাতে দেবলের খুব কাছে ঘেঁষে এল মিতা।

প্লিজ বন্ধ করো তোমার ফালতু নাটক। কেন করছ তুমি এরকম আমার সঙ্গে? তুমিই বলেছিলে আমার মধ্যে তুমি তোমার দাদাকে দেখতে পাও। তাহলে আমার সঙ্গে এসব করতে তোমার লজ্জা করে না?

ইচ্ছে করেই দেবল আবার ওই একই প্রসঙ্গ টেনে আনল। সেদিন তোমার ফ্ল্যাটে আমাকে প্ল্যান করেই ডেকেছিলে, তাই না? চা-পকোড়ার নাম করে নেশার ওষুধ মিশিয়ে দিয়েছিলে চায়ের মধ্যে? ধর্ষণ আমি করিনি, তুমি করেছিলে আমাকে। বলো আমি মিথ্যা বলছি?

হ্যাঁ, তুমি ঠিকই বলছ। পুরোটাই আমার প্ল্যান ছিল। নেশার ওষুধ খাইয়ে শোবার ঘরে নিয়ে গিয়ে তোমার জামাকাপড় নিজের হাতে খুলে তোমাকে বিছানায় শুইয়ে দিয়েছিলাম। তুমি ঠিকই বলেছ, আমিই তোমাকে ধর্ষণ করি। কিন্তু একথা তুমি কী করে প্রমাণ করবে দেবলবাবু? ভিডিও-তে যা দেখা যাচ্ছে সেটাই সত্যি বলে সবাই ধরবে। যেদিন তোমাকে আমি বড়ো গাড়িটা করে যেতে দেখেছিলাম, সেদিনই ঠিক করে নিই, তোমাকে কোনও ভাবে ফাঁসাতে হবে। সত্যিই বলছি দেবল, এই দেশলাই বাক্সর মতো ফ্ল্যাটে দম আটকে আসছে। বড়ো বাড়ি, গাড়ি হবে। চাকরবাকর থাকবে আর পর্যাপ্ত শারীরিক সুখ, দেবে তো আমাকে দেবল?

আচ্ছা এইসব এইজন্যই তুমি করেছ যাতে আমাকে ব্ল্যাকমেল করতে পার?

হ্যাঁ দেবল। পঞ্চাশ লাখ টাকা আমাকে দিয়ে দাও, তারপর তুমি তোমার রাস্তায় আর আমি আমার রাস্তায়। তুমি তো টাকা দিতে ঝামেলা করছ।

আর আমি যদি টাকা না দিই?

তুমি আমার হাত থেকে রেহাই পাবে না। চেঁচিয়ে ওঠে মিতা। অনু যে বাইরে দাঁড়িয়ে সব শুনছে এবং ও পুলিশ নিয়ে এসেছে ভাবতেও পারেনি মিতা।

 

এবার তুই আমাদের হাত থেকে রেহাই পাবি না। অনেক ঘোল খাইয়েছিস। হঠাৎই মহিলা পুলিশ দেখে ঘাবড়ে যায় মিতা।

দেবল কিছু বলে ওঠার আগেই মিতা নকল অশ্রু ঝরাতে ঝরাতে বলে ওঠে, অফিসার এই লোকটা আমাকে ধর্ষণ করেছে আর এখন ব্ল্যাকমেল করার চেষ্টা করছে। বলছে ওর কথা না শুনলে ওর কাছে রেকর্ড করে রাখা ভিডিও ভাইরাল করে দেবে।

কোন ভিডিও-টা? যেটা উনি নন, তুই বানিয়েছিস? তোকে খুব ভালোমতন চিনি, বলে মহিলা পুলিশটি অনুদের দিকে তাকিয়ে বললেন, এই মহিলা এক নম্বরের ঠগ, জোচ্চোর। বহু লোককে এভাবে ঠকিয়েছে। অনেক দিন ধরেই পুলিশ একে খুঁজছিল। এর আসল নাম মিতা নয়, সোনম।

মিতার ফ্ল্যাট থেকে পুলিশ লাখ লাখ টাকা আর অনেকগুলো ভিডিও উদ্ধার করল। মিতাকে এবং ভিডিওগুলো পুলিশ নিজেদের হেফাজতে নিয়ে বেরিয়ে গেল। অনুদের বাড়ি ছেড়ে যাবার সময় মিতার চাহনি একটাই কথা দেবলকে বলে গেল, তোমাকে আমি ছাড়ব না।

থ্যাংকস অনু। তুমি যদি শেষ চালটা না চালতে তাহলে যে আমার কী হতো জানা নেই। হয়তো চোরাবালি-ই গ্রাস করত আমাকে। দেব অনুকে নিজের কাছে টেনে নিল। অনুও সম্পূর্ণ ভাবে নিজেকে দেবের হাতে সঁপে দিল।

 

দাগ

সকাল সকাল ঘরটার অবস্থা দেখে সুচিত্রার গলা ছেড়ে কাঁদতে ইচ্ছে করছিল। ছেলে তো সেই সকাল সাতটার আগেই স্কুলের জন্য রওনা হয়ে গেছে। প্রতিদিনই স্কুলবাস আসে বাড়ির দরজায়। আর অরুণাভও তো অফিসের জন্য বেরিয়ে গেল। কিন্তু বাড়ি খালি বলে, সুচিত্রার কিন্তু কোনও বিশ্রাম নেই। দু-কামরার ফ্ল্যাটটাকে বাপ-ব্যাটা মিলে আস্তাকুঁড় বানিয়ে রেখেছে যেন। চারিদিকে জামা কাপড় ছড়িয়ে রেখে গেছে। ছেলে রুমন পড়াশোনা যত না করেছে, তার থেকে বই-খাতা ছড়িয়েছে বেশি। সারা মেঝেতে দলাপাকানো কাগজ ছড়িয়েছে। এগুলো সব পরিষ্কার করে, ঘর-দোর গুছিয়ে তুলতে তুলতে সুচিত্রা জানে পাক্বা দু-তিন ঘন্টা লেগে যাবে। কোথা থেকে শুরু করবে ভেবে পাচ্ছিল না সুচিত্রা।

বাথরুমে ঢুকে ভেজা টাওয়েল এবং অরুণাভ-র ছাড়া শার্ট আর গেঞ্জিটা বার করে ওয়াশিং মেশিনে ফেলতেই যাচ্ছিল সুচিত্রা, খাটের পাশে রাখা মোবাইলটা বেজে উঠল। বিরক্ত হল ও। এই অসময়ে কার ফোন হতে পারে? সব রাগ গিয়ে পড়ল মোবাইল কোম্পানিগুলোর উপর। ওরা ছাড়া এই অসময়ে আর কে-বা হতে পারে! লেটেস্ট গানের কলার টিউন দিচ্ছে বলে ফোন করে করে জ্বালিয়ে যাবে। পুরো ব্যাপারটাই সুচিত্রার বুজরুকি কারবার ছাড়া কিছু মনে হয় না।

বিরক্ত হয়েই হাতটা নাইটিতে মুছে নিয়ে সুচিত্রা ফোনটা তুলে নিল। কলার আইডি দেখে সুচিত্রার রাগ মুহূর্তে জল হয়ে গেল। বিলাসপুর থেকে ননদের ফোন। একটু চিন্তিতও হল সুচিত্রা। দিদি সাধারণত দুপুরের দিকেই ফোন করে। আজ কী হল যে এত সকাল সকাল ফোন করছে?

‘হ্যালো দিদি, কেমন আছ? আজ এত সকাল সকাল ফোন করেছ সব ঠিক আছে তো?’

‘না সুচিত্রা, সব মনে হচ্ছে ঠিকঠাক নেই।’

‘কী হয়েছে’, খারাপ খবর শোনার আশঙ্কায় ঘাবড়ে গেল সুচিত্রা। যত খারাপ খবর সব কি এই সকালেই আসতে হয়?

‘তনুর শরীরটা মনে হয় ভালো নেই। সেদিন ফোন করেছিলাম ও ঘরে ছিল না। ওর রুমমেট বলল, সারারাত নাকি তনু ঘুমোয় না। জিজ্ঞেস করলে বলে ঘুম আসছে না। শরীরে অস্বস্তি হচ্ছে।’

‘কবে থেকে এটা হচ্ছে?’

‘দুই-তিন মাস ধরে চলছে’ , কেঁদে ফেলে দিদি।

‘দিদি, শুধু শুধু কাঁদছ কেন? আমাকে আগেই তো বলতে পারতে, আমি একবার গিয়ে খোঁজ করে আসতাম। ঠিক আছে আমি আজই একবার চলে যাব।’ঘড়ির দিকে তাকায় সুচিত্রা, ‘দিদি এখন নটা বাজে, একটু পরেই ওর কলেজ শুরু হয়ে যাবে। বিকেল ছাড়া ওর সঙ্গে দেখা হবে না। ওর সঙ্গে দেখা করে আমি তোমাকে রাতে ফোন করে দেব।  চা-জলখাবার খেয়েছ?’

‘না…’

‘সে কী? যাও, নিশ্চিন্তে খাওয়াদাওয়া করো। আমি বাড়ির কাজ সেরে রুমন আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করে বেরোব। তুমি এখন ফোন ছাড়ো। আমিও কাজ সেরে স্নান করে নিই।’ সুচিত্রা মোবাইল বন্ধ করে।

বাড়ির কাজ করতে করতে সুচিত্রার মাথায় ঘুরতে থাকে তনু মানে দিদির মেয়ে তানিয়ার কথা। শেষবার যখন দেখা হয়েছিল তখন তনুর শরীর তো ঠিকই মনে হয়েছিল। বাড়ির এবং আত্মীয়স্বজনের সবকটি ছেলেমেয়ের মধ্যে তনুই সবথেকে ভালো পড়াশোনায়। এছাড়াও প্রচণ্ড পরিশ্রমী এবং খেলাধূলাতেও খুবই ভালো। রুমনকে সবসময় পরামর্শ দেয় সুচিত্রা, ওর দিদির থেকে কিছু শেখার জন্য কিন্তু রুমনের পড়াশোনাতে মন আছে বলেই মনে হয় না সুচিত্রার। প্রতি মাসে পাঁচ-ছয় হাজার টাকা ওর টিউশনের পিছনেই খরচ করে সুচিত্রা আর অরুণাভ।

তাড়াতাড়ি বাড়ির কাজ আর রান্নাবান্না সেরে স্নান সেরে নিল সুচিত্রা। রুমনের বিকেলের জলখাবারের জন্য কড়াইশুঁটির কচুরি তৈরি করে ক্যাসারোলে তুলে রেখে দিল সুচিত্রা, যাতে ছেলেটা বিকেলে ‘খিদে খিদে’করে পঞ্চাশবার ফোন না করে। কয়েকটা তনুর জন্যেও প্যাক করে গুছিয়ে নিল। মেয়েটা বড়ো ভালোবাসে এইসব খেতে। হস্টেলে পাবেই বা কোথায়? দিদির এই মেয়েটাকে বড়ো ভালোবাসে সুচিত্রা। আজকালকার দিনে এমন মেয়ে খুব একটা চোখে পড়ে না। সুচিত্রা চাইছিল তনুকে সারপ্রাইজ দিতে তাই ওকে ইচ্ছে করেই ফোন করল না। একটার মধ্যে রুমন স্কুল থেকে বাড়ি ঢুকলে মা-ব্যাটায় দুপুরের খাবার খেয়ে রুমনকে সব বুঝিয়ে, সুচিত্রা তনুর হস্টেলে যাবার জন্য বেরোল। বাসস্ট্যান্ড অবধি পৌঁছোতে পৌঁছোতে অরুণাভকেও সবকিছু জানিয়ে রাখল সুচিত্রা।

তনুর হস্টেল, শহর থেকে একটু দূরে। দু’বার বাস বদলে যেতে হয়। ওর হস্টেলে যখন পৌঁছোলো সুচিত্রা, তখন চারটে বেজে গেছে। হস্টেল থেকে মেয়েরা বেরিয়ে কেউ কেউ টিউশন নিতে যাচ্ছে।

মুখেই দেখা হল তনুর রুমমেটের সঙ্গে। আগেই আলাপ হয়েছিল সুচিত্রার সঙ্গে, নাম সঞ্চিতা। সুচিত্রাকে দেখেই হাসিমুখে এগিয়ে এল, পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করল।

‘কেমন আছো?’ আশীর্বাদের ভঙ্গিতে সঞ্চিতার মাথায় হাত রাখল সুচিত্রা।

‘ভালো, মামিমা। আপনার আজকে আসার কথা ছিল? তনু জানে আপনি আসবেন?’

‘না, ওকে জানাইনি, সারপ্রাইজ দেব বলে। কিন্তু ও কোথায়?’ সুচিত্রা জিজ্ঞেস করে।

‘ও রুমে আছে,’ বলে সঞ্চিতা চলে গেল।

সুচিত্রা সিঁড়ি দিয়ে উঠে ওয়ার্ডেনের ঘরের দিকে পা বাড়াল। রেজিস্টারে সাইন করে তবেই তনুর ঘরে যাওয়ার পারমিশন পাবে।

সাইন করে তনুর রুমের সামনে গিয়ে অভ্যাসবশত দরজাটা হাত দিয়ে ঠেলতেই দরজাটা সামনের দিকে কিছুটা খুলে গেল। ঘরটা অন্ধকার। তনু সিলিঙের দিকে দৃষ্টি মেলে চুপচাপ শুয়ে আছে। বাইরের নিভু নিভু আলোয় ঘরের ভিতরের অবয়ব অস্পষ্ট, ধোঁয়াটে। সুচিত্রা পা টিপে রুমে ঢুকে দরজা ভেজিয়ে দিল। তনু কিছুই টের পেল না। ধীর পায়ে সুচিত্রা ওর মাথার পিছনে দাঁড়িয়ে দুই হাতে তনুর চোখ চেপে ধরল।

‘কে… কে?’ ভয় পেয়ে চেঁচিয়ে ওঠে তনু।

‘বল তো কে…’

‘ও… মামি, তুমি।’ গলার আওয়াজ চিনতে পেরে ওর সারা মুখে হাসি ছড়িয়ে যায়। বিছানা থেকে উঠে লাইট জ্বালায় তনু।

সুচিত্রা খাটের পাশে গিয়ে বসে। হাতটা ভিজে ভিজে ঠেকে, ‘কীরে কাঁদছিলি নাকি?’

‘না তো মামি’, তাড়াতাড়ি করে চোখের জল মোছবার চেষ্টা করে তনু।

ভালো করে তাকায় সুচিত্রা ওর দিকে। তনুর চোখ লাল হয়ে ফুলে উঠেছে। মুখটাও শুকনো, চোখের কোলে কালি পড়েছে। চুলগুলো অবিন্যস্ত, অগোছালো।

‘কী রে, কী হয়েছে তোর?’ চিন্তিত সুচিত্রা তনুর কাছে ঘেঁষে আসে। ‘সকালে তোর মা ফোন করেছিল, বলল, তুই নাকি খুব অসুস্থ। আমার কাছেও তো চলে আসতে পারতিস বা বাড়িতেও ক’দিন ঘুরে আসতে পারতিস। ডাক্তার দেখিয়ে ওষুধ খাচ্ছিস?’

‘আরে আরে দাঁড়াও মামি, একসঙ্গে কত প্রশ্ন করছ। আমি একদম ঠিক আছি, চিন্তা করার মতো কিচ্ছু হয়নি। তুমি বসো, আমি চা নিয়ে আসি , অগোছালো চুলটা হাতে পাকিয়ে খোপা করতে করতে তনু খাট থেকে নামার উপক্রম করে।

সুচিত্রা ওকে আটকে দেয়, ‘আমি চা খেয়েই এসেছি। তুই এখানে চুপচাপ বস, এখন কোথাও তোকে যেতে হবে না।’ হাতের ব্যাগটা থেকে বার করে টিফিন কৌটো-টা তনুর হাতে ধরিয়ে দেয় সুচিত্রা, ‘নে খেয়ে নে, কড়াইশুঁটির কচুরি আছে। আলুর দম আর মিষ্টি দিয়ে আজ খেয়ে নে। যেদিন প্ল্যান করে আসব তোর অর্ডারি রসোগোল্লার পায়েস নিশ্চয়ই নিয়ে আসব।’

অন্যদিন হলে সুচিত্রার হাত থেকে প্রায় কেড়েই কৌটো খুলে বসত তনু কিন্তু আজ সুচিত্রা আশ্চর্য হল, তনু কৌটোটা সরিয়ে রাখল, ‘এখন ইচ্ছে করছে না মামি, পরে খেয়ে নেব। কৌটো-টা টুলের উপর রাখতে গিয়ে হাত লেগে তনুর একটা পড়ার বই মাটিতে পড়তেই, বইয়ের ভিতর থেকে একটা ওষুধের পাতা ছিটকে কিছুটা দূরে গিয়ে পড়ল। সুচিত্রা চট্ করে ওষুধটা তুলে নিল। নামটা দেখে বুঝতে পারল ওটা ঘুমের ওষুধ। তনুর দিকে তাকিয়ে সুচিত্রা বলল, ‘কী রে তোর ঘুম হয় না? ঘুমের ওষুধ খাস কেন?’

তনু, সুচিত্রার চোখের দিকে তাকাতে পারে না। ‘না-না সেরকম কোনও ব্যাপার নয়। তুমি বসো, আমি দৌড়ে চা নিয়ে আসি।’

‘তুই খাবি?’ সুচিত্র প্রশ্ন করে।

‘না, আমি খাব না।’

‘তবে আমার কাছে বস। আমাকে তাড়াতাড়ি বেরোতেও হবে। পড়াশোনা কেমন চলছে তোর?’

‘তেমন কিছু নয়।’

সুচিত্রা লক্ষ্য করল, তনু কিছুতেই ওর চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলছে না। অথচ আগে সুচিত্রা এলেই ওর গলা জড়িয়ে ধরে রাজ্যের গল্প জুড়ে দিত তনু। বন্ধুরা কী করল, ক্লাসে কী হল, ওকে কে কী বলল, এ সব খুলে না বললে তনুর নাকি ঘুম আসত না। অথচ আজ এত চুপচাপ। প্রথম থেকেই সুচিত্রার সঙ্গে ওর বন্ধুর সম্পর্ক আর সুচিত্রারও মনে এই মেয়েটির প্রতি একটা ভালোবাসা সেই কবেই গড়ে উঠেছে।

কিন্তু আজ সুচিত্রার পরিবেশটা অন্যরকম মনে হল। যা প্রশ্ন করছে সেই উত্তরটুকুই খালি পাচ্ছে, আর বাকি সময়টা কিছু একটা চিন্তায় ডুবে যাচ্ছে তনু। সুচিত্রা ভেবে পেল না কীভাবে তনুর মনে কী চলছে সেটা জানবে কিন্তু কিছু যে একটা গোপনে ঘটে চলেছে সেটা বেশ ভালোই বুঝতে পারছিল সুচিত্রা। এরই মধ্যে তনুর রুমমেট সঞ্চিতাও রুমে ফিরে এল।

‘মামিমা, আপনি তনুকে সঙ্গে করে বাড়ি নিয়ে যান। সারা রাত ঘরের মধ্যে পায়চারি করে, জিজ্ঞেস করলে বলে ঘুম আসছে না। ওকে আমিই ঘুমের ওষুধ খেতে বলেছি। খাওয়া-দাওয়া ঠিকমতো করে না, পড়াশোনাও লাটে তুলে দিয়েছে। ওর রোগটা মনে হয় ‘প্রেমরোগ , বলে হাসতে থাকে সঞ্চিতা।

‘চুপ কর সঞ্চিতা। মামির সামনে মুখে যা আসছে বলে যাচ্ছিস , রেগে যায় তনু।

‘আরে আমাকে নামটা বলিসনি ঠিক আছে কিন্তু মামিকে তো ছেলেটার নাম বলে দে। হতে পারে মামি তোকে এবারের মতো প্রেমসমুদ্রে হাবুডুবু খাওয়ার থেকে বাঁচাতে সাহায্য করবে। নে… নে, মেলা নাটক না করে মামিকে সব বলে দে। আমি বরং বাইরে চলে যাচ্ছি , বলে সঞ্চিতা দুজনকে কথা বলার সুযোগ করে দিয়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল।

‘ইডিয়েট একটা , তনুর স্বগতোক্তি সুচিত্রারও কানে এসে পৌঁছোল।

সঞ্চিতার কথাগুলোই সুচিত্রার সত্যি মনে হল। ও তনুর দুটো হাত নিজের হাতে নিয়ে বলল, ‘কোনও ছেলেকে পছন্দ করিস তো বল, আমি দিদির সঙ্গে কথা বলব।’

‘না কেউ নেই , হাতটা সরিয়ে নিল তনু।

সুচিত্রা ওর থুতনিটা হাত দিয়ে তুলে ধরল, ‘সত্যি করে বল কী হয়েছে, আমি তোর মামি। কিছু তো একটা তোর মনের উপর চেপে বসেছে সেটা বেশ বুঝতে পারছি। আর সেই জন্যই তুই ঘুমের ওষুধ খাচ্ছিস। আমার উপর বিশ্বাস রাখ, তোর কোনও কথা কেউ জানবে না। তুই আমাকে বন্ধু ভাবিস তো… তাহলে বল, তুই কোনও ভুল কাজ করেছিস কি? কারও কাছে খুলে বললে মন হালকা হবে আর তাছাড়া হয়তো আমিও তোকে কিছু সাহায্য করতে পারব। প্রেম ট্রেমের চক্বরে পড়েছিস নাকি হস্টেলের কোনও প্রবলেম…?’ দশ পনেরো মিনিট ধরে বারবার একই কথা সুচিত্রা বলতে লাগল যাতে তনু আসল সত্যিটা ওর কাছে খুলে বলে।

অনেক চেষ্টা করেও সুচিত্রা তনুর পেট থেকে কথা বার করতে সফল হল না। একটু রাগও হল ওর, ‘ঠিক আছে, তনু, তোর যখন আমার উপর এতটুকু বিশ্বাস নেই আর ঠিকই যখন করেছিস আমাকে কিছুই বলবি না, তাহলে শুধু শুধু এখানে বসে থেকে কী লাভ আমার? এখন আমি তাহলে চললাম, ভালো থাকিস , বলে সুচিত্রা উঠে দাঁড়াবার উপক্রম করে।

‘মামি…’, তনু সুচিত্রার হাতটা আঁকড়ে ধরে। ওর চোখ দিয়ে অঝোরে জল পড়তে থাকে। সুচিত্রা তনুর চোখে জল দেখে ভিতরে ভিতরে ঘাবড়ে গেলেও কথা বার করার জন্য চিন্তাটা মুখের মধ্যে প্রকাশ হতে দেয় না, ‘কেন, আমি এখানে বসে আর কী করব , আমাকে বাড়িও তো ফিরতে হবে। নয়তো রুমনকে পড়ানোর সময় পেরিয়ে যাবে।’

কথা শেষ হওয়ার আগেই তনু সুচিত্রাকে জড়িয়ে ধরল। ওর কাঁধে মাথা রেখে হাউহাউ করে কেঁদে উঠল ও, ‘মামি, আমি একটা ভুল করে ফেলেছি।’

‘কী ভুল করেছিস?’ সস্নেহে সুচিত্রা প্রশ্নটা করে।

‘একজনের সঙ্গে আমি সম্পর্কে…’

আজকালকার মেয়ে প্রেমে পড়েছে হতেই পারে কিন্তু তনু, সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ার কথা বলাতে সুচিত্রার হাত-পা কাঁপতে শুরু করে। তনুর উপর প্রচন্ড রাগ হতে থাকে সুচিত্রার কিন্তু ও ভালো করেই জানে এখন বকাঝকা আরম্ভ করলে তনু সত্যি কিছুতেই ওর কাছে খুলে বলবে না।

তনুর হাত ধরে সুচিত্রা ওকে খাটে বসিয়ে নিজেও ওর সামনে এসে বসল। এই অবস্থায় রাগারাগি করলে সুচিত্রা জানে, এই মেয়ে কিছু একটা করে বসতে পারে, সুতরাং খুব সাবধানে সব কথা ওর পেট থেকে বার করতে হবে।

ধীরে ধীরে তনু শান্ত হলে সুচিত্রা ওকে পুরো ঘটনা খুলে বলতে বলে। তনুর মুখ থেকে সব ঘটনা শুনে মোটামুটি একটা ছবি পরিষ্কার হয়ে যায় সুচিত্রার, যে তনু পরিস্থিতির শিকার।

তনুর হস্টেলের ঠিক পাশেই ‘চন্দন স্টেশনারি শপ’ যেখান থেকে তনু প্রয়োজনীয় খাতা, পেন কেনার সঙ্গে সঙ্গে নোট্‌স, সার্টিফিকেট ইত্যাদি ফোটোকপি করাত। হস্টেলের সব মেয়েরাই ওই দোকানটা থেকেই এসব কেনাকাটা করে। এছাড়াও ওখানে কুরিয়ার, ফোনবুথ এবং ছবি তোলার জন্য একটা স্টুডিও-ও একসঙ্গে ছিল।

দোকানের মালিক চন্দনের বাড়িতেই নীচের তলাটা জুড়ে দোকানটা রমরমিয়ে চলত। দোকান দেখার জন্য একটা লোকও ছিল কিন্তু চন্দনের বউ রীতাও সকাল থেকেই দোকানে এসে বসত।

রোজ প্রায় আসা-যাওয়াতে, হস্টেলের অন্য মেয়েদের মতোই তনুর বন্ধুত্ব হয়ে যায় রীতা এবং চন্দনের সঙ্গে। কখনও দোকান খালি থাকলে রীতা তনুকে বসিয়ে স্ন্যাক্স, চা খাইয়ে তবে ছাড়ত। রীতার চার আর সাত বছরের দুটি ছেলে। ওদের জন্য রীতা ভালো একজন টিউটারের সন্ধানে ছিল।

রীতা সঞ্চিতার কাছে টিউটারের জন্য বলে রেখেছিল। সঞ্চিতার নিজের কোনও সময় ছিল না কারণ ওর বন্ধুবান্ধব, পার্টি ইত্যাদি নিয়ে ব্যস্ততার কারণে ও ঘুরে ঘুরে বেড়াত। ফলে ও তনুকে পড়াবার জন্য বলাতে তনু সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে গেল। বাচ্চাদের পড়ানোর কাজটা এমনিতেই তনুর খুব পছন্দের ছিল তার উপর হস্টেলের পাশে বলে ওর আরও সুবিধা হল। রীতার বাচ্চাদের পড়াবার দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিল।

দুই সন্তানের বাবা চন্দন, কিন্তু ওর চেহারা দেখে বয়স বোঝার কোনও উপায় ছিল না। সুপুরুষ চেহারা, দেখলে আঠাশ-তিরিশের বেশি বলে মনে হয় না। তনুর বয়সও কুড়ি-একুশের বেশি নয় এবং যথেষ্ট সুন্দরীও বলা চলে। বাচ্চাদের পড়াতে পড়াতে মাঝেমধ্যেই তনু লক্ষ্য করত যেতে-আসতে আড়চোখে চন্দন ওকে লক্ষ্য করছে। তনুও যে, যৌবনের আকর্ষণকে অগ্রাহ্য করতে পারত এমন নয়। চন্দনের স্ত্রী এবং সন্তান আছে সব জেনেও ওর প্রতি দুর্নিবার আকর্ষণ বোধ করত ও।

হঠাৎই একদিন মায়ের অসুস্থতার খবর পেয়ে রীতা ছোটো ছেলেকে নিয়ে বাপের বাড়ি চলে গেল তাড়াহুড়ো করে। এদিকে শহরে ধর্মীয় গন্ডগোলের কারণে দোকানপাট বন্ধ করিয়ে দিল মন্ত্রীর চ্যালাচামুণ্ডারা। অগত্যা দোকান বন্ধ রাখতে বাধ্য হল চন্দন। বাড়ির কাজে মন দিল। রীতা কিছুই গুছিয়ে যাওয়ার সময় পায়নি, চন্দন সেগুলো সবই গুছিয়ে তুলে রাখল।

এর দুদিন পর তনু নিয়মমতো পড়াতে গিয়ে দেখল চন্দনের দোকান বন্ধ রয়েছে। এতদিনে কখনও ও দোকান বন্ধ হতে দেখেনি, তাই অবাক হল। বাড়িতে ঢুকে চন্দনের কাছ থেকে রীতা আর দোকানের সব খবর শুনল তনু। ছোটো ভাই না থাকাতে চন্দনের বড়ো ছেলে কিছুতেই পড়তে রাজি হচ্ছিল না, তনু ওকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে পড়তে বসাল। এরই মধ্যে চন্দন তনুকে চা আর চানাচুর দিতে এল। চন্দনকে বাড়ির পোশাকে প্রথম দেখল তনু।

‘রীতাদি কবে ফিরবে?’ কাপ হাতে নিতে গিয়ে চন্দনের আঙুলের সঙ্গে তনুর আঙুল ছুঁয়ে গেল। তনুর শরীরে বিদ্যুৎ খেলে গেল।

‘কাল বা পরশু ফিরবে রীতা , নিজের চা-টা নিয়ে চন্দন ওখানেই একটা চেয়ার টেনে বসল।

‘চা-টা খুব ভালো হয়েছে , তনু হেসে বলল।

‘বাঃ বাঃ, আপনার মতো ম্যাডামের আমার বানানো চা যে ভালো লেগেছে সেটা জেনে ভালো লাগছে , চন্দন হাসল।

তনুর ছাত্র যেই দেখল বাবা আর দিদি গল্পে ব্যস্ত, ও ওমনি চেয়ার ছেড়ে বাইরে খেলতে বেরিয়ে গেল।

‘আরে রাতুল… কোথায় পালাচ্ছিস…’। তনু কাপ রেখে তাড়াহুড়ো করে রাতুলের পিছনে দৌড়োতে গিয়ে চেয়ারের পায়ে পা জড়িয়ে সামনে হুমড়ি খেয়ে পড়ার উপক্রম হতেই চন্দন চট্ করে ওকে ধরে ফেলল। ‘কী হল ম্যাডাম, শেষে আমার বাড়িতে হাত-পা ভেঙে আমাকে কেস দেওয়ার চেষ্টায় আছেন নাকি?’ বলে তনুকে খাটে বসাল চন্দন।

তনু কিছুতেই চন্দনের চোখের দিকে তাকাতে পারছিল না। ওর বুকের ভিতর যেন হাতুড়ির ঘা পড়ছিল। চন্দনের শরীরের এতটা কাছাকাছি এসে ওর সারা শরীরে শিহরণ উঠছিল। স্পষ্ট বুঝতে পারছিল তনু, ও যদি চন্দনের চোখে চোখ রাখে তাহলে চন্দনকে নিজের করে পাওয়ার আকুতি স্পষ্টই ওর চোখে ফুটে উঠবে। বুড়ো আঙুলে সামান্য চোট পেয়েছিল তাই সামনে থেকে চোখ সরিয়ে আঙুলের উপর সম্পূর্ণ মনোনিবেশ করল তনু।

‘আঙুলটা ব্যথা করছে?’ চন্দন জিজ্ঞেস করল।

‘হ্যাঁ।’

‘দাও আমি ঠিক করে দিচ্ছি , চন্দন তনুর বুড়ো আঙুলটা ধরে এক ঝকটায় জোরে টানল। তনুর গলা দিয়ে সামান্য চিৎকার বার হল, ব্যস ব্যথা একদম গায়েব।

‘নাও, ঠিক হয়ে গেছে। তোমার মুখের থেকে পা আরও বেশি সুন্দর, তুলোর মতো নরম এবং ফরসা ’, তনুর পায়ে হাত রেখে চন্দন সরাসরি তাকাল তনুর চোখে।

তনুর শরীরে নতুন করে শিহরণ খেলে গেল। নিজের অস্বস্তি ঢাকতে তনুর মনে হল কিছু বলা দরকার, ‘আপনাকেও তো সকলে হ্যান্ডসাম বলে। বাড়ির পোশাকেও আপনি সুপুরুষ আর জানেনই তো লোমশ চেহারার পুরুষ সব মেয়েদেরই পছন্দ।’

কথাগুলো বলার সঙ্গে সঙ্গেই তনু বুঝতে পারে ভুল বলে ফেলেছে। লজ্জায় লাল হয়ে ওঠে ও, ‘ও… ও… ভেরি সরি… আমি ঠিক এটা বলতে চাইনি।’

চন্দনের কাছে তনুর মুখের এই প্রশংসাটুকু প্রেম নিবেদন বলেই মনে হল। হঠাৎ-ই চন্দন নীচু হয়ে তনুর ঠোঁট স্পর্শ করল। চন্দনের তপ্ত নিঃশ্বাসের উত্তাপে তনুর প্রতিরোধ বাষ্প হয়ে উবে গেল। দু’জনেই বুঝতে পারছিল যেটা ঘটতে চলেছে সেটা অন্যায় কিন্তু এটাকে আটকাবার মানসিকতা দুজনের মধ্যে কারওরই ছিল না।

শারীরিক ক্ষুদা তৃপ্ত হতেই সম্বিৎ ফেরে দুজনেরই। নিজের আচরণে তনু লজ্জায় চন্দনের সঙ্গে চোখ মেলাতেও ইতস্তত করে। কোনও রকমে অবিন্যস্ত পোশাক ঠিক করে নিয়ে বেরিয়ে আসে তনু। রাতুলকে কোথাও দেখতে পায় না। হস্টেলে ফিরে এসে নিজের প্রতি ঘৃণা এবং সঙ্গে ভয় তনুকে ঘিরে ফেলে। নিজেকে শতবার দোষারোপ করতে থাকে যে পড়াশোনা শিখে এরকম নির্বুদ্ধিতার পরিচয় কীভাবে দিতে পারল ও।

বাচ্চাদের পড়ানো ছেড়ে দিল তনু। রীতা ফিরে এসে জিজ্ঞেস করলে তনু বলে দিল ওর শরীর ভালো নয় তাই পড়ানোর ধকল নিতে পারছে না।

চন্দনের মনেও শান্তি ছিল না। তনুর ক্ষতি করার জন্য নিজেকেই অপরাধী ভেবে নিল। কীভাবে মেয়েটার কাছে ক্ষমা চাইবে তার কোনও উপায় বার করতে পারল না চন্দন। তার উপর তনুর বাড়িতে আসা ছেড়ে দেওয়াতে এবং দোকানেও আসা যাওয়া বন্ধ করে দেওয়াতে তনুর সঙ্গে দেখাই হতো না ওর।

তনুর জীবনও দুর্বিষহ হয়ে উঠতে লাগল। যে ভুল একবার করে ফেলেছে তার পরিণাম যে কত ভয়ংকর হয়ে উঠতে পারে সেটা ভেবেই সারারাত ঘুমোতে পারত না তনু। মা-বাবার বিশ্বাস ভাঙার গ্লানি কুরে কুরে খেতে লাগল তনুকে। একবার যদি সমাজে বদনাম হয়ে যায় তাহলে আত্মহত্যা করা ছাড়া আর উপায়ই বা কী আছে, সেই চিন্তাতেই তনুর শরীর দিন দিন ভেঙে পড়তে লাগল।

‘মামি, প্লিজ, মা-বাবা যেন এই কথা জানতে না পারে , কাঁদতে কাঁদতে তনু সুচিত্রার দুহাত শক্ত করে জড়িয়ে ধরল।

‘বিশ্বাস রাখ তনু, কেউ জানবে না। শুধু একটা কথা বল কোনওরকম শারীরিক অসুবিধা কিছু মনে হচ্ছে কি?’ সুচিত্রার গলার স্বরে আশঙ্কা প্রকাশ পায়।

‘না।’

‘এখন এই পুরো ঘটনাটা মন থেকে মুছে ফেলার চেষ্টা কর। খুব বড়ো ভুল করেছিস সন্দেহ নেই। কিন্তু ভবিষ্যতেও যদি নিজেকে ঠিক না করিস তাহলে আমার থেকে খারাপ কেউ হবে না। চট্ করে দু-তিনটে জামাকাপড় গুছিয়ে ব্যাগে ভরে নে। আমার সঙ্গে আমার বাড়ি যাবি এখন।’

‘কিন্তু…’

‘কোনও কিন্তু নয়। আমি ওয়ার্ডেনের কাছ থেকে তোর এক সপ্তাহের ছুটি মঞ্জুর করিয়ে নিয়ে আসছি। কাল তোকে একটা জায়গায় নিয়ে যাব কারণ আজ অনেক রাত হয়ে গেছে , বলে সুচিত্রা ওয়ার্ডেনের ঘরের দিকে চলে গেল।

রাস্তায় যেতে যেতে সুচিত্রা বলল, ‘তনু এই পুরো ঘটনাটা কারও কাছে বলবি না এমনকী বন্ধুবান্ধবকে-ও না। আমি জানি, তোরা সব কথা শেয়ার করিস কিন্তু এটা কাউকে বলবি না।’

বাড়ি ঢুকতেই তনুকে দেখে রুমন খুশিতে লাফিয়ে উঠল। অরুণাভ তনুর চেহারা দেখে উদ্বিগ্ন হয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘কী রে চেহারা এত খারাপ হয়েছে কেন? হস্টেলে কিছু খাস না?’

তনুর সঙ্গে সুচিত্রার চোখাচোখি হল, তনু উত্তর দিল, ‘না, না খাবার ঠিক মতোই খাই। পড়াশোনোর চাপ একটু বেশি।’

সুচিত্রাও তনুর কথায় সায় দিল, ‘তাই জন্যই তো ওকে এক সপ্তাহের ছুটি করিয়ে নিয়ে এসেছি। শরীরটা একটু সারিয়ে তারপর হস্টেলে পাঠাব।’

‘ভালোই করেছ , বলে অরুণাভ অন্য ঘরে চলে গেল।

স্বামীকে মিথ্যা বলতে সুচিত্রার খারাপই লাগল কিন্তু তনুর সম্মান আর মর্যাদা বাঁচাতে হলে হাজারো মিথ্যা বলার জন্য সুচিত্রা মনকে আগে থেকেই প্রস্তুত করে রেখেছে সুতরাং বাড়ি থেকে শুরু করতে অসুবিধা হল না ওর।

ফোন করে দিদিকে জানিয়ে দিল সুচিত্রা, তনুর শরীর পড়াশোনার চাপে সামান্য খারাপ হয়েছে ঠিকই কিন্তু চিন্তা করার মতো কিছু হয়নি।

রাতের খাওয়া শেষ হতেই তনুকে রুমনের ঘরে শুইয়ে দিল সুচিত্রা আর ছেলেকে নিজের সঙ্গে নিয়ে নিল। সারা রাত সুচিত্রা চোখের পাতা এক করতে পারল না। তনুর কথাই বারবার মনে হতে লাগল। আজকাল ইয়ং জেনারেশনের এতটা চেঞ্জ সুচিত্রা কিছুতেই সমর্থন করতে পারল না। কোনও বুদ্ধি-বিবেচনা করে এই প্রজন্ম কাজ করে না যেটা সত্যিই বিরক্তিকর।

সুচিত্রা খুব ভালো করেই জানে, চন্দনের সঙ্গে সঙ্গে তনুও এই ঘটনার জন্য সমান দোষী। তবুও এই ব্যাপারটা দিদিরই জানার কথা ছিল কিন্তু সুচিত্রা জানে, মায়েদেরও একটা বিশাল দোষ যে, তারা সন্তানের সঙ্গে বন্ধুর মতো আলোচনা করে না, অথচ সমস্যা কিছু একটা হলে শাসন করতে ছাড়ে না। ফলে সন্তানও মায়ের সঙ্গে শেয়ার করতে চায় না।

সকালবেলায় রুমন বায়না ধরল স্কুল যাবে না, তনুদিদির সঙ্গে সারাদিন কাটাবে। সুচিত্রা অনেক বুঝিয়ে ওকে স্কুল পাঠাল। সবাই কাজে চলে গেল। সুচিত্রা তনুকে বলল, ‘তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নে। তোকে নিয়ে একটু বেরোব, ডাক্তারের কাছে যাব।’

‘ডাক্তার… কেন মামি…?’ মনে হল তনু ওখানেই বসে পড়বে।

‘আমি তোকে কালকেই বলেছিলাম, তোকে নিয়ে একটা জায়গায় যাব। তোর জীবনটা নিয়ে কোনওরম রিস্ক আমি নিতে চাই না , সুচিত্রা তনুর মনে সাহস জোগাবার চেষ্টা করল।

ডাক্তার তনুর সবরকম পরীক্ষা করলেন। উনি সুচিত্রাকে আলাদা ডেকে জানালেন, ‘ঘাবড়াবার কিছু নেই। অনেক কারণেই ইয়ং বয়সে পিরিয়ডের সমস্যা হয়ে থাকে। আমি ওষুধ লিখে দিচ্ছি, কয়েকদিন খেলেই আবার এনার্জি ফিরে পাবে। ও সামান্য দুর্বল সুতরাং ওর খাওয়া-দাওয়াটার একটু খেয়াল রাখা দরকার। এমনি আর কোনও ওর প্রবলেম নেই।’

আনন্দে সুচিত্রা ডাক্তারকে ধন্যবাদ জানিয়ে বাইরে বেরিয়ে এল। মন থেকে মেঘ সরে যেতেই সুচিত্রা আবার রোদ ঝলমলে দিনের অগ্রিম আভাস টের পেল।

রাস্তায় বেরিয়ে তনুর জন্য শপিং করল সুচিত্রা। রেস্তোরাঁয় বসে দুজনে তনুর পছন্দের খাবার আর আইসক্রিম খেয়ে বেরিয়ে এল। দুঃস্বপ্নের দিনগুলো থেকে তনুকে বাইরে বার করে আনার চেষ্টার কোনও ত্রুটি রাখল না সুচিত্রা।

বাড়ি ফিরতেই তনু সুচিত্রার গলা জড়িয়ে ধরল, ‘থ্যাংক্স মামি। কালকে তোমার সঙ্গে কথা বলার পর থেকে আজ পর্যন্ত যা যা হয়েছে তাতে আমার মন অনেক হালকা লাগছে। সত্যিই তুমি যদি আমাকে জোর না করতে আমি হয়তো তোমাকে খুলে বলতেই পারতাম না ঘটনাটা। মনের মধ্যেই পুরোটা থেকে যেত এবং কিছু হয়তো একটা করেও বসতাম। তুমি যেভাবে ব্যাপারটা হ্যান্ডল করেছ আমি সত্যিই টেনশন ফ্রি হয়ে গেছি।

শুধু একটাই কথা খালি মনে হচ্ছে, ‘আমি কী করে এমন অবিবেচকের মতো কাজ করলাম? ঘটনাটায় আমার নিজের সবথেকে বেশি দোষ এটা স্বীকার না করা ছাড়া উপায় নেই , বলতে বলতে তনুর চোখ দিয়ে জল পড়তে লাগল।

‘অবশ্যই তুই এমন একটা ভুল করেছিস যার কোনও ক্ষমা নেই। কিন্তু এই যে তুই নিজের ভুল বুঝতে পেরেছিস, প্রায়শ্চিত্ত করেছিস এটাই সবথেকে বড়ো কথা। সম্পর্ক সবসময় প্রথম মন থেকে হয়। স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক হোক অথবা প্রেমিকের সম্পর্কই হোক, প্রথম সম্পর্ক মনের গভীর থেকেই শুরু হয়। শরীর দিয়ে নয়।

চন্দনের সঙ্গে তোর মনের কোনও সম্পর্কই যেখানে ছিল না সেখানে ওকে নিয়ে এত চিন্তা করার দরকারটা কী? বরং ওকে মন থেকে সরিয়ে এবারে পড়াশোনায় মন দে আর আমার বিশ্বাস আর তুই এরকম ভুল করবি না’, বলে সুচিত্রা আলতো করে তনুর গালে সস্নেহে আদর করে। তনু যেন খানিকটা বিহ্বল হয়েই জড়িয়ে ধরে সুচিত্রাকে।

সেই মুহূর্তেই তনুর মোবাইল বেজে ওঠে, ‘মা আমি এখন একদম ভালো হয়ে গেছি। মামি আমার অসুখ সম্পূর্ণ সারিয়ে দিয়েছে…’ বলতে বলতে তনুর হাসির শব্দ সারা ঘরে প্রতিধবনিত হতে থাকে।

 

 

উচ্ছিষ্ট

বর্ধমানে পৌঁছে রমেনের বাড়ি খুঁজে পেতে সীমার বিশেষ অসুবিধা হল না। গাড়ি থেকে নেমে বাড়ির দরজার দিকে পা বাড়াল ও। বাইরে থেকে ওকে ধীরস্থির, শান্ত মনে হলেও ভিতরে ভিতরে ওর মন অধীর হয়ে উঠছিল।

দরজা খুলে যে-মহিলা এগিয়ে এলেন, তাকে কোনওমতে একটা নমস্কার জানিয়ে সীমা জিজ্ঞেস করল, ‘রমেন কি বাড়িতে আছে?’

‘আপনি সীমা না?’ ভদ্রমহিলার মুখ-চোখ দেখে মনে হচ্ছিল সীমা যেন ওনার বহু দিনের পরিচিত।

‘হ্যাঁ, কিন্তু আপনি আমাকে চিনলেন কী করে?’

‘একবার উনি, মানে রমেন অফিসের কোনও ফাংশনের ছবি আমাকে দেখিয়েছিলেন, তাই মনে থেকে গেছে। চলুন ভিতরে চলুন।’ সীমার হাত ধরে মহিলা ওকে বাড়ির ভিতরে নিয়ে গেল।

‘আমি কে, আপনি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন। আমি রমেনের স্ত্রী…।’

‘বন্দনা, তাই না?’ সীমা ওর কথার মাঝেই বলে উঠল, ‘আমিও আপনাকে চিনি। রমেনের ফ্ল্যাটে যে-ফ্যামিলি ফোটোগ্রাফটা লাগানো আছে, সেটাতে আপনাকে দেখেছি। ছবিটা এতবার দেখেছি যে মনের মধ্যে গেঁথে গেছে।’

সীমার কথায় কোনও প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে বন্দনা খুব সহজ ভাবে জিজ্ঞেস করল, ‘ওনার অসুস্থতার সম্পর্কে কী করে জানতে পারলেন?’

‘রমেন অফিসে আমার সিনিয়র। ওনার সঙ্গে ফোনে রোজ আমাকে কন্ট্যাক্ট রাখতে হয়। এখন ওনার শরীর কেমন আছে?’ সীমার উত্তরে কোনওরকম আড়ষ্টতা ছিল না।

‘আপনার এই প্রশ্নের উত্তর উনি নিজেই দেবেন। আমি ওনাকে ডেকে দিচ্ছি। আপনাকে কী দেব, চা না কফি? ঠান্ডাও খেতে পারেন।’

‘না-না। কফি হলেই চলবে।’

‘আপনি আমার সম্মানীয় অতিথি। ওনার অফিসের কারও সঙ্গে আমার কোনওদিন পরিচয় হওয়ার সুযোগ হয়নি, আপনিই প্রথম। সুতরাং অতিথি আপ্যায়নে আমি কোনও ত্রুটি রাখতে চাই না। আপনি বসুন, আমি ওনাকে পাঠিয়ে দিচ্ছি’, বলে বন্দনা হাসিমুখে ভিতরে চলে গেল।

সীমা এবার নিজের চারপাশে চোখ বুলোবার সুযোগ পেল। পরিপাটি ভাবে সজ্জিত ড্রয়িংরুম। চারপাশ গোছানো পরিষ্কার ঝকঝক করছে। ঘরের ডেকরেশনে গৃহিণীর সুরুচির ছাপ সর্বত্র।

বন্দনার ব্যক্তিত্বেরও তারিফ না করে পারল না সীমা। গায়ের রং শ্যামলা হলেও, যথেষ্ট সুন্দরী বলা চলে। দুই সন্তানের মা হয়ে যাওয়াতে চেহারাটা সামান্য ভারী হয়ে গেলেও, আকর্ষণ বিন্দুমাত্র কমেনি।

সীমা জানত, বন্দনার শিক্ষগত যোগ্যতা ক্লাস টেন পর্যন্ত। ও ধারণা করে নিয়েছিল স্বল্পশিক্ষিত অন্যান্য মহিলাদের মতোই বন্দনাও হয়তো ক্লান্ত শরীর নিয়ে সংসার সামলে গেঁয়োভূত হয়ে উঠেছে। অথচ সকাল সকাল বন্দনাকে যথেষ্ট আধুনিক সাজসজ্জায় এবং আত্মবিশ্বাসে ভরপুর দেখে সীমার মনে অনেক প্রশ্ন উঁকিঝুঁকি মারতে শুরু করল।

একটু পরেই রমেন এসে ঘরে ঢুকল। সীমাকে দেখে মুখে হাসি ফুটে উঠল তার। সীমার কাছে সরে এসে বলল, ‘তোমাকে আমার বাড়িতে দেখতে পাব কোনওদিন ভাবিনি। কালকে ফোনে কথা হল, বললে না কেন আজ এখানে আসবে তুমি?’

‘আমি বললে, তুমি আমাকে আসতে দিতে? কপট রাগ দেখিয়ে সীমা রমেনের হাতের উপর নিজের হাত রাখে।’

‘হয়তো না।’

‘সেই জন্যেই তো আগে থেকে তোমাকে কিছু জানাইনি, জাস্ট চলে এসেছি। এখন তোমার শরীর কেমন আছে?

‘গত দু’দিন জ্বরটা আর আসেনি, তবে অসম্ভব দুর্বল বোধ করছি।’

‘দেখতেও খুব দুর্বল লাগছে। আরও কদিন বরং ছুটি নিয়ে বিশ্রাম করো।’

‘না-না, আর নয়। সাতদিন হয়ে গেল কামাই করেছি, পরশু সোমবার জয়েন করব ঠিক করেছি। তোমার থেকেও দূরে আর থাকতে পারছি না।’

‘একটু আস্তে বলো’, রমেনের ঠোঁটে হাত রাখে সীমা, ‘তোমার বউ শুনতে পাবে। আচ্ছা একটা কথা জিজ্ঞেস করব?’

‘করো।’

‘আচ্ছা, বন্দনা কি আমাদের সম্পর্কের কথাটা জানে?’

‘জানে হয়তো তবে নিজের মুখে কখনও জিজ্ঞেস করেনি।’ কাঁধ ঝাঁকিয়ে অবহেলার ভঙ্গিতে বলে রমেন।

‘আমার সঙ্গে তো খুবই ভালো ব্যবহার করল। মনে তো হল না, আমার উপর ওর কোনও রাগ বা বিদ্বেষ আছে বলে। কী জানি হয়তো…’, চুপ করে গেল সীমা।

‘সীমা, তুমি আমার কলিগ এবং পরিচিত, আর সেই জন্যই ও তোমার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করবে না এবং করার সাহাসও ওর নেই। তুমি এখানে আমার বাড়িতে পুরো সেফ। বন্দনাকে নিয়ে কোনওরকম টেনশন করার দরকার নেই’, সীমার গালে আলতো করে একটা টোকা মেরে রমেন সামনের সোফাতে গিয়ে বসল।

অফিসের কাজকর্ম সম্পর্কে কথাবার্তা হতে হতে বন্দনা ট্রে নিয়ে ঘরে ঢুকল। কফি আর জলখাবারের ডিশ ট্রে থেকে তুলে টেবিলে রেখে ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে উদ্যত হল।

‘আপনিও আমাদের সঙ্গে বসে কফি খান’, সীমা বন্দনাকে ওদের সঙ্গে বসতে অনুরোধ জানাল কিন্তু বন্দনা সামান্য হেসে রান্নাঘরে কাজ আছে বলে ঘরের বাইরে চলে গেল।

কথা বলতে বলতে সীমা একপ্রকার বন্দনার কথা ভুলেই গেল। ভালোবাসার মানুষটাকে এতদিন পর সামনে পেয়ে সীমার মনের অপরাধবোধটাও এক মুহূর্তে মন থেকে মুছে গেল। বন্দনাও খালি কাপ প্লেটগুলো একবার এসে তুলে নিয়ে গেল কিন্তু তারপর ওই ঘরে ও আর পা মাড়াল না।

বছরখানেক আগে নতুন অফিসে জয়েন করার পর রমেনের সঙ্গে সীমার প্রথম পরিচয় হয়। রমেনের চেহারা এবং ব্যক্তিত্বের আকর্ষণে সীমা নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারে না। রমেন বিবাহিত জেনেও শরীর মন রমেনের কাছে সমর্পণ করে। সীমার এই সম্পর্কের কথা ওর মা-বাবার কানেও পৌঁছোয়। ওর বাবাই একদিন ওকে আলাদা করে ডেকে জিজ্ঞেস করেন, ‘রমেনের সঙ্গে তোমার সম্পর্কটা ঠিক কীরকম একটু জানতে পারি?’

‘বাবা আমার এখন ৩৫ বছর বয়স। রমেনকে আমি ভালোবাসি। ঠিক সময়ে তোমরা যখন আমার বিয়ে দিতে পারোনি তখন আমার চিন্তা করা ছেড়ে দাও। তোমরা যদি রমেনের সঙ্গে সম্পর্ক ত্যাগ দেওয়ার জন্য জোর করতে থাকো, আমি বাইরে কোথাও নিজের থাকার ব্যবস্থা করে নেব।’ সীমার পরিষ্কার জবাবের পর ওর মা-বাবাও বিষয়টি নিয়ে মেয়ের সঙ্গে আলোচনা করাই ছেড়ে দেন।

বহুদিন অবিবাহিত থাকার পর সীমাও ঠিক করে নিয়েছিল ও আর বিয়ে করবে না। কিন্তু একা জীবন অতিবাহিত করা অতটাও সহজ নয়। এদিকে রমেনও নিজের পরিবারের থেকে দূরে একলা শহরে থাকতে থাকতে নিজেকে নিঃসঙ্গ মনে করতে থাকে। ফলে উভয়ের প্রথম পরিচয় হতেই একে অপরের প্রতি আকর্ষিত হয়ে পড়ে।

রমেনের প্রতি তীব্র আকর্ষণ সীমার নীরস জীবনটাকেই পুরো বদলে দেয়। প্রেমটা অবৈধ জেনেও অজানা এক আকর্ষণে সীমা বাঁধা পড়তে থাকে। ধীরে ধীরে সীমার মনে আরও কিছু পাওয়ার স্বপ্ন জোরালো হতে শুরু করে।

একদিন অফিস শেষে দুজনে রমেনের ফ্ল্যাটে চলে আসে। সীমাকে চুপচাপ দেখে রমেনই জানতে চায়, ‘কী ব্যাপার, আজ এত চুপচাপ কেন?’

‘রমেন আমি তোমার সঙ্গে লিভ ইন করতেও রাজি আছি, যদি তুমি সেটাই চাও। কিন্তু বিয়ে করে জীবন কাটাবার আলাদা একটা আনন্দ যেমন আছে তেমনি সম্পর্কটাতে একটা সম্মানও আছে।’

‘তুমি রাজি থাকলে আজই আমি তোমাকে বিয়ে করে নিতে চাই’, সামান্য কৗতুকমিশ্রিত কণ্ঠে রমেন উত্তর দেয়। সীমা একটু গম্ভীর হয়, ‘এটা করা মানে তো নিজেকেই ঠকানো।’

‘তাহলে বিয়ের কথা তুলছ কেন?’

‘আমার মনের ইচ্ছা তোমার কাছে বলব না তো কাকে বলব?’ সীমা রমেনকে বোঝাবার চেষ্টা করে।

রমেনও একটু সিরিয়াস হয়, ‘সবই তো বুঝলাম কিন্তু আমাদের বিয়ে করাটা সম্ভব নয়, সেটাও তো তুমি ভালো করেই জানো।’

‘তুমি সত্যিই আমাকে মন থেকে ভালোবাসো তো?’ সন্দেহ উঁকিঝুঁকি দেয় সীমার মনে।

‘অবশ্যই’, সীমার মন থেকে সন্দেহ দূর করতে রমেন সীমার ঠোঁটে  চুম্বন এঁকে দেয়।

‘তুমিই সবসময় বলো, বন্দনা তোমার স্ত্রী হলেও, আমাকেই তুমি মন থেকে চাও। এটা তো সত্যি, তাই না?’

‘হ্যাঁ। বন্দনা আমার দুই সন্তানের মা। ও খুব সরল মনের মেয়ে কিন্তু নিজের স্ত্রী-র মধ্যে যে-ধরনের ব্যক্তিত্ব আমি দেখতে চাই, বন্দনার মধ্যে সেটার অভাব রয়েছে। মা-বাবার পছন্দ মতন আমার বিয়ে করা কখনওই উচিত হয়নি। কিন্তু বন্দনার দেখাশোনা করাটা এখন আমার একটা কর্তব্য ছাড়া আর কিছুই নয়’। মনের কথা খুলে বলতে পেরে রমেন অনেকটা সহজবোধ করে। অনেকদিন ধরেই সীমা চাইছিল ও যেন বন্দনাকে ডিভোর্স দিয়ে দেয়।

‘কিন্তু তাহলে আমার কী হবে? আমাদের খুশির জন্যেও তুমি বন্দনা-কে ডিভোর্স দেবে না?’ আহত বাঘিনির মতো সীমা রমেনের মুখোমুখি হয়।

‘না, দেব না। এই কথা নিয়ে তুমি এরপর আর কোনওদিন আমাকে প্রেশার দিও না। বন্দনা আমাকে ছেড়ে যেতে চাইলে আলাদা কথা, কিন্তু ওকে ডিভোর্সের প্রস্তাব দেওয়া মানে আমি নিজের চোখে নিজেই ছোটো হয়ে যাব। কারণ ও আমাকে ছাড়া আর কিছুই জানে না। ওর পৃথিবীটা আমাকে ঘিরেই ও তো তোমার মতো সাবলম্বি নয়। বিনা দোষে ওকে আমি এই শাস্তি কিছুতেই দিতে পারব না। সেটা অন্যায় হবে’।

রমেনের কঠোর স্পষ্ট উত্তর দেওয়ার ভঙ্গিতে সীমা আর কথা বাড়াবার সাহস পেল না। কিন্তু মনে মনে সীমা সেদিনই ঠিক করে নিয়েছিল, বন্দনার সঙ্গে তাকে একবার দেখা করতেই হবে। কারণটা অবশ্য সীমারও ঠিকমতো জানা ছিল না কিন্তু যাকে সে চোখে দেখেনি তার চরিত্র এবং ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে জানার এক অদম্য কৗতহূল সীমাকে সেদিন গ্রাস করেছিল। হয়তো মনে মনে সীমা চেয়েছিল বন্দনা নিজে থেকেই রমেনকে ছেড়ে চলে যাক এবং এই ইচ্ছাটাকে কার্যকরী করার লক্ষ্যেই রাস্তা খুঁজে বার করতে সীমা, রমেনের খোঁজ নেওয়ার বাহানা করে ওদের বর্ধমানের বাড়িতে গিয়ে উপস্থিত হয়েছিল।

বন্দনা-কে দেখে সীমারও মনে হল ও খুব সরল, শান্ত স্বভাবের মেয়ে। সীমার প্রতি কোনও রাগ বা বিদ্বেষ বন্দনার ব্যবহারে প্রকাশ না পাওয়ার ফলে, সীমাও মনে মনে ওর প্রতি বিরূপ মনোভাব কিছুতেই পোষণ করতে পারল না। বরং মেয়েটা-র প্রতি একটা মায়া অনুভব করল সীমা।

রমেনকে সীমা ভালোবাসে ঠিকই কিন্তু নিজের স্ত্রী-র সঙ্গে ওর ব্যবহার কেমন যেন অদ্ভুত মনে হল সীমার। সীমার জায়গায় অন্য কেউ হলে এই অদ্ভুত ব্যবহারের জন্য শুধুমাত্র রমেনকেই দোষারোপ করত, এটা সীমাও অস্বীকার করতে পারল না।

নিজের বাড়িতে রমেন খোলাখুলি ভাবেই সীমার সঙ্গে গল্পে মেতে উঠল। ওর ব্যবহারে কোনও আড়ষ্টতা প্রকাশ পেল না। বন্দনা বাড়িতে থাকা সত্ত্বেও রমেন সীমার হাতটা নিয়ে নিজের হাতে চেপে ধরে ওর সঙ্গে গল্পে মেতে উঠল।

বন্দনা হঠাৎ যদি এই অবস্থায় ওদের দেখে ফেলে, এই ভয় বোধহয় সীমারই খালি ছিল, রমেনের নয় কারণ রমেনের ব্যবহারে সেটাই বারবর প্রকট হয়ে উঠছিল। গল্পের মাঝে হঠাৎই রমেন, সীমাকে নিজের কাছে টেনে নিয়ে ওর ঠোঁটে নিজের ঠোঁট চেপে ধরতেই সীমা ঘাবড়ে গেল!

‘কী করছ রমেন? বন্দনা যদি এই অবস্থায় আমাদের দেখে ফেলে তাহলে অ্যাটলিস্ট আমি খুব লজ্জা পাব’, সীমাকে সত্যিই খুব নার্ভাস মনে হচ্ছিল।

‘রিল্যাক্স, সীমা’, রমেনকে খুব স্বাভাবিক মনে হল। ওকে এই ব্যাপারটা নিয়ে এতটুকু চিন্তা করতে সীমা দেখল না। ‘আমি তোমাকে মন থেকে ভালোবাসি সীমা। তুমি ভেবো না যে তোমাকে মাধ্যম করে আমি আমার কামনা-বাসনা মেটাচ্ছি। তোমার কাছ থেকে এতদিন যা পেয়েছি, বন্দনার কাছ থেকে সেটা কোনও দিন পাইনি, সেই আনন্দ একমাত্র তুমিই আমাকে দিয়েছ সীমা।’

‘কিন্তু তাও… এখানে, বন্দনার উপস্থিতিতে… ওর বাড়িতে আমাকে আদর করছ– এটা আমার কাছে অত্যন্ত অস্বস্তিকর। রমেন… প্লিজ ছারো’, আকুতি জানায় সীমা।

‘ঠিক আছে, আমি হাত সরিয়ে নিচ্ছি। কিন্তু একটা ব্যাপার তুমিও খেয়াল রেখো…।’

‘কী ব্যাপার রমেন?’

‘বন্দনাকে ভয় পাওয়ার কোনও কারণ নেই। ও যদি কোনওদিন আমাকে প্রেশার দেওয়ার চেষ্টা করে তাহলে আমি ওকে ছেড়ে তোমাকে বেছে নেব’। রমেনের কথার মধ্যেই ওর মনোভাব স্পষ্ট ভাবে সীমার কাছে ধরা দেয় যেটা সীমা অ্যাপ্রিশিয়েট করে ঠিকই কিন্তু মনের একটা কোণায় অস্বস্তির অনুভূতি সীমাকে মানসিক ভাবে চঞ্চল করে তোলে।

হঠাৎ-ই সীমার মনে হয় বন্দনার সঙ্গে কথা বলাটা খুব দরকার। বন্দনার ব্যক্তিত্ব, ওর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যগুলো জানার অদম্য ইচ্ছা সীমাকে পেয়ে বসে। বন্দনার সঙ্গে কথা না বলা পর্যন্ত রমেনকে ওর থেকে দূর করার কোনও রাস্তা সীমার খুঁজে পাওয়া সম্ভব নয়।

বন্দনাও আর একবারের জন্যেও বসার ঘরে ওদের সামনে আসেনি। রমেন-ই বলল রান্নাঘরে দুপুরের খাবার বানাতে ও ব্যস্ত রয়েছে। অথচ সীমার কেন জানি না মনে হল, বন্দনা ইচ্ছে করেই ওদের থেকে নিজের দূরত্ব বজায় রাখছে। ব্যস্ততার ব্যাপারটা শুধু একটা বাহানা মাত্র।

বন্দনা ওদের সঙ্গে একসঙ্গে খেতেও বসল না। সীমা ওকে অনেক জোর করল একসঙ্গে খাওয়ার জন্য কিন্তু ও কিছুতেই খেল না।

‘বন্দনা সব সময় আমার খাওয়া শেষ হলে তবেই খেতে বসে। তুমি শুরু করো, ও পরে খেয়ে নেবে’, বন্দনার তোয়াক্বা না করেই রমেন সীমার প্লেটে খাবার তুলে দিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।

সীমা খেয়াল করল, প্রত্যেকটা খাবার রমেনের পছন্দের বানিয়েছে বন্দনা এবং প্রত্যেকটি পদই অত্যন্ত সুস্বাদু।

‘রান্না কেমন হয়েছে সীমা?’ বন্দনার উপস্থিতিতেই রমেন সীমাকে প্রশ্ন করল।

‘দারুণ হয়েছে’, সীমার উত্তরে পরিষ্কার বোঝা গেল খাবার খেয়ে সীমা অত্যন্ত তৃপ্ত।

‘বন্দনা সত্যিই দারুণ রান্না করে। সেইজন্যই তো ওজন কিছুতেই কম করতে পারছি না।’

সীমা খেয়াল করল, রমেনের মুখে নিজের প্রশংসা শুনে বন্দনার মুখ রাঙা হয়ে উঠল। ওর দু’চোখে রমেনের জন্য অন্ধ ভালোবাসা ঝরে পড়ার সাক্ষী হয়ে থাকল সীমা।

বন্দনা যে রমেনকে প্রচন্ড ভালোবাসে এবং হয়তো রমেনকে ডিভোর্স দিতে ও কখনও রাজি হবে না, এই ভয়টা হঠাৎ-ই সীমাকে কেন জানি পেয়ে বসল। তার মন অশান্ত হয়ে উঠল।

খাওয়া-দাওয়া শেষ করে রমেন এসে ড্রয়িংরুমের ডিভানে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ল। খানিকক্ষণ পরেই ওর নাক ডাকার শব্দে সীমা মনে মনে না হেসে পারল না। কিছুক্ষণ অপলকে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে সীমা সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। ওর গন্তব্য রান্নাঘর।

বন্দনা-কে দুটো প্লেটে খাবার বাড়তে দেখে সীমা কৗতূহল চাপতে পারল না, ‘আপনি ছাড়াও আরও কেউ খাবার খেতে বাকি আছে নাকি?’

‘হ্যাঁ, এই অন্য প্লেট-টা আমার বান্ধবী রুনার’, বন্দনা জানলা দিয়ে পাশের বাড়ির দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করল, ‘ও পাশেই থাকে।’

‘আপনার বান্ধবী এখানে এসে খাবে না?’ আশ্চর্য হয়ে সীমা জিজ্ঞেস করল।

‘না, আমার বড়ো ছেলে বাবলু প্লেট-টা ওর বাড়ি দিয়ে আসবে।’

‘আপনার দুই ছেলেকে তো দেখলাম না, ওরা বুঝি বাড়িতে নেই?’ সীমা প্রশ্ন করে।

‘ছোটোটার জ্বর হয়েছে, ঘরে শুয়ে আছে। বাবলু-কে আমি ডাকছি। সকাল থেকে ও রুনার বাড়িতেই রয়েছে, একবারও বাড়ি আসেনি।’

পিছনের দরজা খুলে বন্দনা ছেলের নাম ধরে ডাকতেই, বাবলু ছুট্টে রুনার বাড়ি থেকে বেরিয়ে এল।

মায়ের আদেশ মতো সীমাকে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করল। খুব সাবধানে বন্দনা, রুনার জন্য বাড়া থালাটা বাবলুর হাতে ধরাতেই, ও সঙ্গে সঙ্গে আবার রুনার বাড়ির দিকে পা বাড়াল।

‘আপনার ছেলেটি তো খুব মিষ্টি এবং খুবই কাজের’, সীমাকে

প্রশংসা করতেই হল।

‘রুনা-ও ওকে প্রচণ্ড ভালোবাসে… মায়ের মতো। বাবলুই লাভবান, কারণ দু’জন মায়ের ভালোবাসা একসঙ্গে পাচ্ছে ও’, শান্তস্বরে সীমার চোখের দিকে তাকিয়ে বন্দনা কথাগুলো বলল।

খাবার ঘরের পাশেই, বারান্দায় তিন-চারটে চেয়ার পাতা ছিল, বন্দনা প্লেট নিয়ে ওখানেই বসল। সীমাকেও ইশারায় পাশে বসতে অনুরোধ করল। একটা নিঃস্তব্ধতা ওদের ঘিরে ধরল, কারও মুখেই কথা নেই। সীমাই প্রথম নিঃস্তব্ধতা ভঙ্গ করল।

‘রুনার বুঝি কোনও সন্তান নেই?’

‘ও-তো বিয়েই করেনি… আপনার মতোই বিয়ে করবে না বলে মনস্থির করেছে। প্রত্যেকটি মেয়েরই মনে মমতা ভরা থাকে এবং স্বাভাবিক ভাবেই মাতৃহূদয়ও থাকে। রুনা তো বাবলুকেই নিজের ছেলে মনে করে, ওর প্রতি রুনার ভালোবাসার অন্ত নেই’, হাসিমুখে জানায় বন্দনা।

কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থাকে সীমা। কী বলবে ভেবে পায় না। মনে মনে কিছুট সাহস সঞ্চয় করার চেষ্টা করে। হঠাৎ-ই নিঃস্তব্ধতা ভঙ্গ করে ও, ‘সত্যিই আমিও ভেবেছিলাম কোনওদিন আর বিয়ে করব না কিন্তু এখন আমি এমন মানুষকে খুঁজে পেয়েছি যার সঙ্গে আমি সারাটা জীবন কাটাতে চাই। এই ব্যাপারে আমি আপনার সঙ্গে কথা বলতে চাই।’

বন্দনার কানে সীমার কথাগুলো ঢুকেছে কিনা সীমা ঠিক বুঝতে পারে না কারণ বন্দনার পরের কথাগুলো ঠিক সীমাকে কেন্দ্র করে নয় বরং বাবলু আর রুনার সম্পর্কটা নিয়ে। আনমনা হয়েই বন্দনা বলতে থাকে, ‘রুনা-কে কতবার বলেছি একটা বিয়ে করতে কিন্তু ও কিছুতেই কথা শুনতে চায় না। সবসময় বলে, বিয়ে না করেই বাবলুর মতন একটা মিষ্টি ছেলেকে যখন সন্তান হিসেবে পেয়েছি, তখন মিছিমিছি একটা অজানা লোককে বিয়ে করে নিজের স্বাধীনতা কেন নষ্ট করব। আমার বাবলু যে ওর বার্ধক্যের অবলম্বন হতে চলেছে এই বিশ্বাস ওর মনে একেবারে গেঁথে গেছে।’

‘বন্দনা, রমেনের সঙ্গে এক বছরেরও বেশি আমার পরিচয়। ওর সঙ্গে দেখা হওয়ার পরেই আমার জীবনে খুশি ফিরে এসেছে, নয়তো এই একাকীত্ব আমায় আত্মহত্যাপ্রবণ করে তুলত। সীমা বন্দনার বলা কথাগুলোকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করেই যেন বলতে থাকে।

‘রুনার জীবনে আমার বাবলুই খুশির আলো নিয়ে এসেছে। রোজই প্রায় রুনা ওর জন্য গিফ্ট নিয়ে আসে।’

সীমাও নাছোড়বান্দা। ও গলার স্বর সামান্য বাড়িয়ে বলে, ‘রমেন আর আমার সম্পর্কটা বন্ধুত্ব দিয়ে শুরু হয়েছিল ঠিকই কিন্তু এখন অনেক গভীরে পৌঁছে গেছে এই সম্পর্ক। এখন আমরা একে অপরকে ভালোবাসি’। যেন কিছুটা অগ্রাহ্য করার ভঙ্গিতেই।

বন্দনা উদাস হয়ে যায়। দূর দিগন্তে নিজের দৃষ্টি প্রসারিত করে বলে, ‘জানেন, আমার ছেলের মন জেতার জন্য রুনা ওকে প্রচুর লোভ দেখায়। প্রচুর টাকা খরচ করে প্রায়শই রেস্তোরাঁর খাবার নিয়ে আসে বাবলুর জন্য। ছেলেটার বাইরের খাবারে এতটাই অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে যে বাড়ির খাবার এখন আর ওর মুখে রোচে না।’

‘বাবলুর কথা ছেড়ে রমেন সম্পর্কে কেন আপনি আমার সঙ্গে কথা বলছেন না?’ সীমা বিরক্ত হয়ে ওঠে।

আশ্চর্য, বন্দনা সীমার ব্যবহারে এতটুকু বিচলিত হয় না বরং সীমার কাঁধে হাত রাখে যেন সীমা ওর খুব ভরসার পাত্রী, ‘রুনা একদম রান্না করতে পারে না। ওর রান্নাঘর খালিই পড়ে থাকে। অথচ বাবলু যদি ওর নিজের ছেলে হতো তাহলে কি ও এই দায়িত্ব এড়িয়ে যেতে পারত? নিজের হাতে নিজের ছেলেকে রান্না করে খাওয়ানো-টা কি তখন ওর বোঝা মনে হতো?’

‘নিজের সন্তানের ইচ্ছে পূরণ করাটা কোনও মায়ের কাছেই বোঝা হতে পারে না।’

‘যাকে আমরা ভালোবাসি, তার খুশির জন্য কিছু করা কখনওই বোঝা হতে পারে না। রুনা-তো প্রায় রোজই আমাকে প্রেশার দিতে থাকে যে ও বাবলুকে অ্যাডপ্ট করতে চায়।’

‘এই বিষয়ে আপনার কি মতামত, বন্দনা?’ বন্দনা মুখে সামান্য হাসি টেনে এনে বলতে লাগল, ‘প্রসবযন্ত্রণা সহ্য না করেই কি কেউ যথার্থ অর্থে মা হতে পারে। সংসার সামলানোর ঝক্বি থেকে শুরু করে যে-কোনও পরীক্ষার সম্মুখীন হওয়ার শক্তি, নিজে কষ্ট সহ্য করে সন্তানের সুখ-সুবিধার খেয়াল রাখার ইচ্ছে একমাত্র মায়েরই থাকে –কোনও মাসিপিসি বা জেঠি, কাকিমার থাকে না এত কষ্ট করার ইচ্ছে।’

‘হ্যাঁ, আপনি ঠিকই বলেছেন। আমিও এখন নিজের একটা সংসার পাতার…’

বন্দনা সীমা-কে কথার মাঝেই থামিয়ে দিয়ে কিছুটা গম্ভীর হয়ে যায়। বলে, ‘আমার বাবলুকে রুনা যতই ভালোবাসুক, বাবলু কিন্তু আমার সন্তানই থাকবে… বিশ্ব-সংসার ওকে আমার ছেলে বলেই জানবে। রুনার, বাবলুর পিছনে এত টাকা খরচ করা, বাবলুর ওর বাড়িতে এত যাতায়াত করা ইত্যাদি কিন্তু একটা ‘সত্যি’ কখনও বদলাতে পারবে না যে, বাবলু আমার সন্তান। একটা কথা আপনাকে জিজ্ঞেস করতে পারি?’

‘হ্যাঁ, নিশ্চয়ই’, সীমা নিজেও একটু গম্ভীর হয়ে যায় কারণ প্রথমবার ওর মনে হয় বন্দনা, বাবলু আর রুনার সম্পর্কটার ব্যাপারে ওর কাছে কিছু জানতে চাইবে।

‘আমি যদি কোনও উপায় না পেয়ে আমার বাবলুকে রুনার হাতে তুলে দিই, তাহলেও কি সত্যি সত্যি রুনা ওর মা হয়ে যাবে? সন্তানকে জন্ম দেওয়ার আনন্দ ও কি করে বুঝবে? আমাকে কাঁদিয়ে ও কি জীবনে সুখী হতে পারবে?’ বন্দনার দুই চোখ হঠাৎই জলে ভরে ওঠে।

সীমা একটা গভীর নিঃশ্বাস ফেলে, ‘আপনাকে কষ্ট না দিয়ে কি রুনা আপনার বাবলুকে পেতে পারবে আর আপনার বান্ধবী হিসেবে রুনার বাবলুকে দত্তক নেওয়ার ইচ্ছে মন থেকে ত্যাগ করা উচিত। আমারও এখানে আসাটা উচিত হয়নি। আপনার ব্যক্তিত্বর সঙ্গে পরিচিত হওয়ার পর আমার মন আরও অশান্ত হয়ে উঠেছে।’

বন্দনা সীমার হাত নিজের হাতে তুলে নেয়। ভারী গলায় বলে, ‘সীমা, আপনি আমার ছোটো বোনের মতো তাই নিজের মনের কথা আপনার কাছে খুলে বলছি। আমার কাছে আমার সন্তান, স্বামী এবং

সংসার ছাড়া ভালোবাসার আর কেউ নেই। রমেনকে ছাড়ার কল্পনা করাটাও আমার কাছে অসহনীয়।

আমি জানি আমার থেকে আপনাকে বেশি চায় রমেন। এটা আমার জন্য ঠিক নয়। রমেনের সুখ-সুবিধা সবকিছুর খেয়াল অথচ আমিই রাখি। ও নিজের ছেলেদের প্রাণের থেকে বেশি ভালোবাসে। ওদের জন্যই বাড়ির সঙ্গে ওর যোগাযোগ রয়েছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে। আর এই সত্যিটা আমার মনকে গভীর নিরাপত্তা এবং একইসঙ্গে গভীর আনন্দও দেয়।’

‘আপনাকে দেখে যতটা সরল এবং সাদাসিধে মনে হয় আপনি মোটেও ততটা নন। আপনার সঙ্গে এক মিনিটও আর থাকা আমার পক্ষে সম্ভব নয়’, হঠাৎই চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় সীমা।

বন্দনা নির্লিপ্ত ভাবে জবাব দেয়, ‘আপনি যদি আমার মনের ভিতরে ঢুকতে পারতেন তাহলে আমার উপর রেগে না গিয়ে আমাকে সহানুভূতি দেখাতেন। আমার উপর দয়া হতো। স্বামীকে ভালোবেসেও, ভালোবাসা না পাওয়ার দুঃখ, হাজার চেষ্টা করেও আমি ভুলতে পারি না।

রমেন আর বাবলুর মধ্যে একটা মিল খেয়াল করেছেন কি? নিজেদের চাহিদা পূরণ করার জন্য আমার স্বামী আপনার সঙ্গে আর ছেলে রুনার সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করে নিয়েছে। কিন্তু এই বাড়ির সঙ্গে সম্পর্ক ত্যাগ করার জন্য কেউ ইচ্ছে প্রকাশ কখনও করেনি।

দোকানের খাবার বাবলুর স্বাস্থ্যের জন্য খারাপ জেনেও ছেলের খুশির জন্য আমি চুপ করে থাকি। রমেনের আপনাকে ভালো লাগে, এই নিয়ে আমিও কোনওদিন রমেনের কাছে নালিশ জানাতে যাব না। আমার মৃত্যু খালি পারবে ওদের সঙ্গে আমার সম্পর্ক ছিন্ন করতে।

যে-কোনও পরিস্থিতিতেই আমি রমেনের সঙ্গে ভালো ভাবে মনে আনন্দ বজায় রেখে থাকতে পারব কিন্তু রুনা বা আপনি এই সম্পর্কটা-কে টিকিয়ে রেখে কী আদৗ লাভবান হতে পারবেন? ওর সন্তান বা আপনার যদি একজন সঙ্গীর প্রয়োজন তাহলে আপনারা নতুন করে কেন শুরু করছেন না? অপরের উচ্ছিষ্ট যতই সুস্বাদু হোক না কেন, সেটা খাওয়ার কী খুব দরকার আছে?’

নিরুত্তর সীমা দাঁড়িয়ে বন্দনার অশ্রুসজল মুখের দিকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থাকে। ঠিক এই মুহূর্তে তার মনে হতে থাকে বন্দনার ওই ব্যক্তিত্বের জোরের কাছে, তার সমস্ত আধুনিকতা, বেপরোয়া ভাব, সবই কেমন যেন ফিকে হয়ে গেছে। বন্দনা একটা বিশেষ তারে ঘা দিয়েছে, যা তার মাথার কোশগুলোকে নাড়িয়ে দিয়েছে। সত্যি কি সে কোনওদিন সম্পূর্ণ ভাবে পাবে রমেনকে? উত্তরটা এই মুহূর্তে তার মতো করে কেউ জানে না। সীমা দরজার দিকে পা বাড়ায়। রমেন তখনও নিশ্চিন্তে সোফায় ঘুমোচ্ছে দেখে, ওকে না জাগিয়েই সীমা নিজের পার্সটা সোফা থেকে তুলে দরজা দিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসে।

মনে মনে, রমেনের সঙ্গে অবৈধ সম্পর্কটা থেকে বেরিয়ে আসার সিদ্ধান্তটা আরও দৃঢ় হতে থাকে সীমার মধ্যে।

কে দেখেছে

শেষ পর্যন্ত সোনাগাছিতেই যাবে অলকানন্দা। তার তাড়না এখন বিপদসীমা ছাপিয়ে ফুঁসে ওঠা নদীর মতো ভয়ংকর। সেই জলের তোড় এখন অলকানন্দাকে ভাসিয়ে নিয়ে গিয়ে আছড়ে ফেলতে চাইছে সোনাগাছিতে। তারপর অলকানন্দা সেরে নেবে তার আসল কাজ। চকার সঙ্গে হবে তার শেষ বোঝাপড়া। একটা তুমুল হেস্তনেস্ত করে ছাড়বে সে। জামার কলার ধরে হিড়হিড় করে টানতে টানতে নিয়ে যাবে থানায়। সবাই দেখুক গোবরডাঙার চ্যাটার্জিপাড়ার, লালবাড়ির ছোটোবউয়ের আসল মূর্তি।

অফিসে গিয়ে কদিনই সুস্থির মতো কাজে মন দিতে পারছে না অলকানন্দা। ভেতরে ভেতরে একটা ছটফটানি ভাব লেগেই আছে। সেটা খেয়াল করেছে কস্তুরী। কস্তুরীর পাশের টেবিল অলকানন্দার।

কী হল তোর?

কাল সারারাত দুচোখের পাতা এক করতে পারিনি।

ঘুমোতে পারিসনি? কীসের অস্বস্তি? কী ব্যাপার রে তোর? কদিন ধরে লক্ষ্য করছি, কী হয়েছে?

অলকানন্দা এড়িয়ে যেতে গিয়ে, গেল না। বলল, তোকে বলে তো কোনও সুরাহা হবে না। খুবই বিশ্রী একটা কাণ্ড ঘটে গেছে। আমি কিছুতেই ব্যাপারটা বরদাস্ত করতে পারছি না। আবার মন থেকে ঝেড়েও ফেলতে পারছি না।

সব শুনে কস্তুরী একটা বড়ো করে নিঃশ্বাস ছাড়ল। জলের গেলাস হাতে তুলে বলল, তোর মাথাটা সত্যিই গেছে। এসব তো খুবই বস্তাপচা ঘটনা। তুই এতে ফালতু মাথা গলাচ্ছিস। চিরকালই তো এসব হচ্ছে। তুই ভেবেও বা করবিটা কী?

আমি সোনাগাছিতে যাব।

জলের গেলাসে সবে ঠোঁট ছুঁইয়েছিল কস্তুরী। বেমক্কা বিষম খেয়ে কাশতে লাগল। ধরা গলায় বলল, তুই কোনও সাইকায়াট্রিস্ট-কে দেখা অলোকা। আমার ধারণা, তোর মাথাটা হ্যাং মোডে চলে গেছে। ডোন্ট বি সিলি অলোকা। মাটিতে পা রেখে চল। বাস্তবটা বোঝার চেষ্টা কর। ডোন্ট টেক এনি হুইমজিক্যাল ডিসিশন লাইক দিস। এই ধরনের ছেলেমানুষি জেদের কথা তোর মুখে মানায় না। কোনও ভদ্রঘরের মেয়ে ও-পাড়ায় পা দেয় নাকি? তোর বাড়িতে ক’বছর রান্না করেছে, তো কী হয়েছে? এসব কথা কেউ স্বীকার করে নাকি? লজ্জায় চেপে গেছে।

সেই লজ্জাটাই তো ওকে দিতে চাই আমি। আবার ঠাটের কথার বহর কী! চাকরি পেয়েছি।

তোকে কি এই যুদ্ধে জিততেই হবে? একটা নোংরা ব্যাপার ঘাঁটতে গিয়ে তোকেও যে নর্দমায় নামতে হবে, তা ভেবে দেখেছিস?

ওসব আমি বুঝি না। আমি সোনাগাছিতে যাবই আর তুইও আমার সঙ্গে যাবি।

আমি যাব! তুই আমাকে নিয়ে যাওয়ার আর জায়গা পেলি না? শেষ পর্যন্ত ওই নরকে? কোনও লোচ্ছা তোর বা আমার হাত ধরে টান দিলে, আই মিন টু সে দ্যাট, তুই বা আমি ফিজিক্যালি হ্যরাসড হলে মুখ দেখাতে পারব?

ওসব ভয়  দেখিয়ে আমাকে দমিয়ে রাখতে পারবি না। আমি যাবই। আর তুইও আমার সঙ্গে যাবি। আমাকে যেতেই হবে।

সে নয় গেলি। আমিও সঙ্গে গেলাম। কিন্তু তুই তোর হাবিকে বলতে পারবি? সাহসে কুলোবে তোর?

ও জানে কেসটা। ও-ই বলেছে আমাকে।

কী বলেছে? বলেছে, ওহ, শিয়োর। ইউ মাস্ট গো টু সোনাগাছি? তাই বলেছে?

না, তা নয়। সোমা যে সোনাগাছিতে ঘর নিয়েছে, খবরটা সুজয়ই আমাকে দিয়েছে। কে নাকি সোমাকে সোনাগাছিতে দেখেছে, এই তো গত বৃহস্পতিবারেই।

রাতে অলকানন্দা শুতে যাওয়ার তোড়জোড় করছিল। সুজয় ওর স্টাডিরুমে ল্যাপটপে ঘাড় গুঁজে বসেছিল। সুজয়ের জন্য জলের গেলাস নিয়ে গজগজ করতে করতে ঢুকল অলকানন্দা। বলল, বেশি রাত কোরো না। আমাকে সাতসকালে উঠতে হবে। সোমা আমার সব সুখ কেড়ে নিয়েছে। কথা নেই বার্তা নেই দুম করে কাজ ছেড়ে দিল।

সুজয় তখনই বলল কথাটা। প্রথমটা তেমন খেয়াল করেনি অলকানন্দা। বলল, কী বললে?

সুজয় ল্যাপটপেই ঘাড় গুঁজে রেখে ফের বলল, তোমার সোমার প্রামোশন হয়েছে। সে সোনাগাছিতে ঘর নিয়েছে।

কী বলছ তুমি?

ঠিকই বলছি। ইটস ট্রু অ্যাজ ডে লাইট। নাও সোমা ইজ আ পার্মানেন্ট রেসিডেন্ট অফ সোনাগাছি।

সোমা সোনাগাছিতে…!

ইয়েস, ঘর নিয়েছে। নাও সি ইজ আ কনফার্মড হোর। ওহ, আই অ্যাম সরি। দিজ ভোকাবুলারিজ আর আনকনস্টিটিউশনাল নাউ-এ-ডেজ। আজকাল ওদের ডেজিগনেশন হয়েছে। দে আর কলড সেক্স ওয়ার্কার্স। আই মিন যৌনকর্মী। ডোন্ট সে হোর, প্রস্টিটিউট অ্যান্ড সো অন…

কী নিষ্ঠুরের মতো বলছ এসব? একটুও মুখে বাধছে না তোমার?

লিসন মাই ডিয়ার, ইন দিস কেস, আম সিম্পলি হেল্পলেস। আই ডোন্ট ওয়ান্ট টু বি আ পেটি সিমপ্যাথাইজার লাইক ইউ, ইউ নো। আই হেট অল দিস ডার্টি থিংগস। যাও, শুতে যাও। আমাকে কাজ করতে দাও।

অলকানন্দা আর দাঁড়ায়নি। সুজযের স্টাডিরুম থেকে বেরিয়ে নিজের ঘরে এসে সোফার ওপর গা ছেড়ে দিয়ে বসে পড়ে। অলকানন্দা মনে মনে দুয়ে দুয়ে চার করে নেয়। নিজের সঙ্গেই কথা বলে ওঠে সে, ও তাই সোমা আমার রান্নার কাজটা ছেড়ে দিল!

দোলের পরের দিনই সোমা এসেছিল। বলল, বউদি, খুব খারাপ খবর। তোমার বাড়ির কাজ আমি আর করতে পারব না গো। শুনে অলকানন্দার মাথাটা বাঁই করে ঘুরে গেল। বলল, ইযার্কি করিস না সোমা। তুই ছাড়া আমি অচল, তুই জানিস। আমার অফিস মাথায় উঠবে, তুই না এলে।

সে তো জানি বউদি। কিন্তু, কলকাতায় আমি একটা বড়ো কাজ পেয়েছি। অনেক টাকা মাইনে!

তুই কি আমাকে মাইনে বাড়াতে বলছিস? তা অত ঘুরিয়ে নাক ধরার কী আছে? সোজা কথা বল না। দেব বাড়িয়ে জানি তোর বরের চিকিত্সার খরচ অনেক। আমি তো সবাইকে বলি, সোমা ওর বরকে নিয়ে কী লড়াইটাই না লড়ছে! এমনিতেই তোকে আমি অনেক বেশিই টাকা দিই। আরও বাড়িয়ে দেব। তবু তোকে ছাড়া আমার চলবে না সোমা।

না বউদি, চাকরিটা আমি হাতছাড়া করতে চাই না। ওর ওষুধের পেছনে কত খরচ, তা তো জানো। তিনবাড়ির রান্নার কাজে যা পাই ফুটকড়াই হয়ে যায়। সংসার চলে না। এবার মনে হয় একটু সুখের মুখ দেখব।

কী চাকরি তোর?

উঁ

উঁ না টুঁ। বলছি কাজটা কী?

ওই একটা কাজ। সে বলার মতো কিছু নয়। লেখাপড়া জানি না। অফিসের কাজ আর কে দেবে আমায়?

তবে কী? টিভি সিরিয়ালে অ্যাকটিং করবি? ওই চকা তোর মাথায় এসব ভূত চাপিয়েেছে না? আমি তোকে বলেছি না, ওসব লাইন তোর মতো মেয়ের জন্য নয়। তোর রূপের চটক আছে। কিন্তু, খুঁটির জোর আছে কি? চিল-শকুনে ছিঁড়ে খাবে তোকে, তখন কেঁদে কূল পাবি না। ওই চকার পাল্লায পড়িস না। ওটা একটা আস্ত ক্রিমিনাল। মওকা পেলে ও তোকে আরব-এ চালান করে দেবে।

সোমা বলল, না বউদি, চকাকে ওপর থেকে দেখে আম্মো তাই ভাবতাম। ও আমাকে দিদি ডেকেছে।

অলকানন্দার আন্দাজে ঢিল ছোড়াটা তাহলে লাগসই হয়েছে। রিভলভিং স্টেজ-ড্রামার মতো বাঁই করে এক চক্করে ঘুরে গেল যেন মঞ্চটা। একটা ঘাগু উকিল আর ঝানু গোয়েন্দার মতো দ্বৈত চরিত্রে ঢুকে পড়ে অলকানন্দা। অদ্ভুত ভঙ্গিতে মাথাটা দোলাতে দোলাতে বলে, তাহলে চকাই তোর মাথাটা খেয়েছে। দ্যাখ সোমা, দুনিয়াটার কিছুই দেখিসনি তুই। জানিসও না কিছুই। চকার মতো ক্রিমিনালদের কাছে মা-বোন বলে কিছু নেই রে। ওটা একটা আস্ত তোলাবাজ। ওরা শুধু চেনে টাকা আর চেনে মদ আর মেয়েমানুষ। তোকে দিদি বলল, আর তুই অমনি গলে গেলি?

চকা আজ পোজ্জন্ত আমার সঙ্গে কোনও খারাপ ব্যাভার করেনি।

করেনি তোকে বাগে পায়নি, তাই করেনি। এবার পাবে।

কেন? এবার পাবে কেন?

ওই যে কৃতজ্ঞতা। তুই তো আর অকৃতজ্ঞ হতে পারবি না। তোকে অনেক টাকার কাজ জোগাড় করে দিল। তার প্রতিদান যখন চাইবে, তখন বুঝবি। যাই হোক, চাকরিটা কী? মানে কী কাজ?

সোমা বলতে গিয়ে থেমে গেল। কে যেন ওর গলা টিপে ধরল। তার চোখ, চিবুক শক্ত দেখাল। বলল, ওই একটা ছোটোখাটো কাজ আর কী। বলার মতো তেমন কিছু না। চলি। আর দাঁড়ায়নি সোমা।

 

বাড়ি ফিরে ঘরে ঢুকেই অলকানন্দা হাতব্যাগটাকে ছুঁড়ে দিল সোফায়। বাথরুমে ঢুকে গেল সোজা। অনেকক্ষণ ধরে শাওয়ারের নীচে দাঁড়িয়ে শরীর ও মনকে স্থির করার অনুশীলন চালাল। সোমার এই পরিণতির কথা ভাবতে ভাবতে গা গুলিয়ে ওঠে তার। বেসিনের কাছে ছুটে গিয়ে ওয়াক তুলতে থাকে। খানিক ধাতস্থ হওয়ার পর চোখে মুখে জলের ঝাপটা দেয়। ঘাড়ে ও পিঠে জল দেয়। হ্যাঙার থেকে তোয়ালেটাকে একটানে নামিয়ে এনে, বিছানায় শরীর গড়িয়ে দিয়ে চোখ বুঁজে পড়ে থাকে। যেন চোখ খুলতেও ভয়। ছেলেবেলায় রাক্ষস-খোক্ষসের স্বপ্ন দেখার পর ভয়ে আতঙ্কে যেমন চোখ খুলতে পারত না ঠিক তেমন। ঠিক সেই আতঙ্ক গিলে রেখেছে অলকানন্দাকে। যেন জেগে শুয়ে চোখ বুজে থাকলে মনে হবে, সে সোমাকে নিয়ে দুঃস্বপ্ন দেখছিল। গোটাটাই স্বপ্ন। চোখ খুলে বাস্তবে ফিরতে চায় না সে।

ওভাবে শুয়ে থাকতে থাকতে অলকানন্দা টের পায়, ওর ভেতরে স্মৃতির জলভরা বোতলটা কখন কাত হয়ে শুয়ে পড়েছে। তাই নীচের অচেতন স্তরের খড়িমাটির গুঁড়োর মতো থিতিয়ে পড়া স্মৃতিগুলো গড়িয়ে অবচেতন স্তর টপকে এল। এল একেবারে অলকানন্দার চেতন স্তরে। নিজেকে নতুন করে আবিষ্কার করতে থাকে সে। তার মন বলে ওঠে, ও, তাই! তাই সোনাগাছির প্রতি তার এমন দুর্বার আকর্ষণ? এই সেই সোনাগাছি। ওহ! এ তো সেই প্রত্যভিজ্ঞা! সেই প্রত্যভিজ্ঞাই এতকাল পরে ঘুরে ফিরে অলকানন্দার সামনে এসে হাজির।

অলকানন্দা কলেজে সাইকোলজি পড়েছে। জেনেছে প্রত্যভিজ্ঞার কথা। আগের দেখা ও শোনার সঙ্গে মিল খুঁজে পাওয়া। এই যে-সোনাগাছি তাকে মাতিয়ে তুলেছে, তার মূলে তো শুধু সোমা নয়! রয়েছে আরও একজন। সে অলকানন্দার মাসতুতো দিদি মান্তুদি। অনেক বছর আগে মান্তুদি গেছিল সোনাগাছিতে। মান্তুদির বর প্রায় রাতেই বাড়ি ফিরত না। পাড়ার অভিজিত্দাই গোয়েন্দাগিরি করে, সুমনদার সুলুক সন্ধান এনে দিল মান্তুদিকে। অভিজিত্দার সঙ্গে সোনাগাছিতে গিয়ে হানা দিল মান্তুদি। এক রূপসী মহিলার ঘর থেকে মান্তুদি ওর বরকে, জামার কলার ধরে হিড় হিড় করে টেনে রাস্তায় এনে, মুখে থুতু ছিটিয়ে দিয়ে চলে এসেছিল। আর ফেরেনি।

সে আজ থেকে বছর কুড়ি আগের কথা। তখন অলকানন্দার বয়স বড়োজোর বারো-তোরো হবে। তাই বাড়ির বড়োরা ছোটোদের কানকে আড়াল করে ফিসফাস, কানাঘুষো চালাত। তখনই সোনাগাছি শব্দটা ছিটকে এসেছিল অলকানন্দার কানে। পরে সব ঘটনাই শুনেছে, জেনেছে। প্রায় এক যুগ আগের সেই পারিবারিক বিপর্যয়, মান্তুদির সেই সোনাগাছি অভিযানের কথা স্রেফ কর্পূরের মতো উবে গিয়েছিল। আজ এতকাল পরে সোমার কদর্য পরিণতিতে অলকানন্দার অন্তরিন্দ্রিয়ে অচেতন স্তরে, মজে যাওয়া সেই স্মৃতি উঠে এল চেতনায়। আখেরে মান্তুদিই হল তার অ্যাকচুয়াল ইন্সপিরেশন। এই মুহূর্তে মান্তুদিই তার মনের জোর একশোগুন বাড়িয়ে দিল যেন।

রাতে ভালো করে ঘুমোতে পারল না অলকানন্দা। যত রাত বেড়েছে, ততই রোখ বেড়েছে তার। কেবলই মনে হতে থাকে, ওই লোচ্ছা চকা যেন ওকে হারিয়ে দিল শেষটায়। চকাকে উচিত শিক্ষা না দিতে পারলে স্বস্তি নেই। এত দূর স্পর্ধা! একটা মেয়ে দারিদ্রের সুযোগ নিয়ে তাকে ওই নরকে টেনে নিয়ে যায় কী করে? আগে সোমার গালে চড় কষিয়ে ওর দেমাক ভেঙে গুঁড়িয়ে দিতে হবে। তারপর সে একটা হেস্তনেস্ত করে তবেই ছাড়বে।

পার্টি-পলিটিক্স যতদূর যেতে হয় যাবে অলকানন্দা।

 

পরের দিন অফিস থেকে ফেরার পথে অলকানন্দা গেল চকাদের ঠেকে। একদল ছেলেছোকরা বসে গুলতানি করছিল একটা চা দোকানে। চকা এসে দাঁড়াল অলকানন্দার সামনে। মোবাইল ফোনে তর্জনী চালাতে চালাতেই বলল, আপনি এখানে? কী ব্যাপার বলুন তো?

অলকানন্দা বলল, সোমাকে তুমি এই পথে নামালে কেন?

কে সোমা?

তুমি ভালোই জানো কোন সোমা। ও আমাদের বাড়িতে রান্নার কাজ করত।

অ… সোমাদি। তাকে সোনাগাছিতে নিয়ে গেছি কেন? তাই তো? তা সে কি কারও কোলের মেয়ে আমি কি তাকে কারও কোল থেকে কেড়ে নিয়ে গেছি? এমন গিলাবিলা বলেন না, শুনলে শালা সাত পেগের নেশা ছুটে যায়। নিজের পায়ে হেঁটে হেঁটে হাটে গেল ঘোষ, সবাই বলে, হাই রোডেরই দোষ। সোমা তো নিজের ইচ্ছেতেই গেছে। সব জেনে তাপ্পর কথা বলুন। মাস খানেক ধরে সোমা আমার পেছনে এঁটুলির মতো লেগে পড়েছিল। শুধু বলেছে, ছেলেকে ইশকুলে ভত্তি করাবে। ওর অনেক টাকা দরকার। বলল, ও কারও দয়া নেবে না। বলল, চকা আমি রোজগার করতে চাই। যেমন করেই হোক, নিজের রোজগার। ওর স্বামীর তো প্যারলিসিস। শুনে আমার মায়া হল। তাই আমি ওকে…

চকার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে অলকানন্দা বলল, তাই তুমি ওকে সোনাগাছিতে নিয়ে গেলে? বাঃ চমত্কার সোমা যে-ছেলেকে স্কুলে ভর্তি করাবে, দুদিন বাদে ছেলে বড়ো হয়ে যখন মায়ের আসল পরিচয়টা জানবে, তখন?

চকা আঙুলের টোকায় সিগারেটটাকে ঘরের এক কোণে ছুড়ে দিয়ে বলল, দেখুন বউদি, ছোটোমুখে একটা বড়ো কথা বলি, মায়ের পরিচয় শুধুই মা। আপনারা পিথিবির কটা মাকে দেখেছেন?

তোমার কাছে জ্ঞানের কথা শুনতে চাই না। তুমি আমাকে সোমার সোনাগাছির ঠিকানাটা একটু বলবে?

কেন? আপনি যাবেন নাকি সেখানে?

নিশ্চয়ই যাব।

বিন্দাস বলেছেন মাইরি। আপনার কলিজায় কুলোবে?

আমি ভয় পাই না।

তাওলে যান, আপনি গেলে সিনটা জমে যাবে। অবোসসো আপনি একা গেলে ওর ঠেক খুঁজে পাবেন না। সে অনেক গোলমেলে গলতা। কিন্তু, আপনি কেন যাবেন সেখানে সেটা বলবেন? মানে আপনার আসলি কাহানি?

কাহিনি আবার কী? ও আমায় বলেছে চাকরি পেয়েছে নাকি। আমি গিয়ে ওই মিথ্যেবাদীর গালে একটা ঠাস করে চড় মারব। তারপর তোমার সঙ্গে হবে আমার আসল বোঝাপড়া।

চমকাচ্ছেন? আমাকে? আপনি মেয়েছেলে, তাই চেপে গেলাম। ঠিক আছে, কবে যেতে চান, চলুন আমি নিয়ে যাব।

আমি কালই যেতে চাই। কিন্তু তুমি আগে থেকে সোমাকে কিছু জানাতে পারবে না।

সে ঠিক আছে। একটা সবুজ পাত্তি ছাড়তে হবে। মাগনা হবে না।

মানে! কত পাঁচশো?

চকা মাথা ঝাঁকিয়ে তার সম্মতি বুঝিয়ে দেয়।

অলকানন্দা বলে, ঠিক আছে দেব।

 

রাতে তুলকালাম ঝড় উঠল। অলকানন্দার প্রস্তাব শুনে সুজয়, সিংহের গর্জন তুলে গোটা বাড়ি কাঁপিয়ে দিল। এমন বিশ্রী একগুঁয়েমি, জেদের কথা শুনে সুজয় ঝাঁঝিয়ে উঠে ঠাস করে একটা চড় কষিয়ে দিল অলকানন্দার গালে। ব্যস, আর কোনও পরোয়া নেই। কোনও বাধা নেই আর। সুজয়ের চড় অলকানন্দার সোনাগাছির পাসপোর্ট পাকা করে দিল। তার সোনাগাছি অভিযানের আসন্ন সাফল্যের রোমাঞ্চ, সুজয়ের চড়ের গ্লানি মুহূর্তে মুছে দিল। আর কথা বাড়তে দেয়নি অলকানন্দা। বালিশে মুখ গুঁজে পড়ে থাকে। সুজয় বারবার অনুতাপ, অনুকম্পা জানাতে এলেও, মুখ তোলেনি সে।

সারারাত এক ভাবে বিছানায় পড়ে থাকে অলকানন্দা। অনেক রাত পর‌্যন্ত সুজয় আত্মপক্ষ সমর্থনে গজগজ করতে থাকে। একসময় অলকানন্দা টের পায়, তার সিংহমার্কা স্বামী নাকের গর্জন তুলছে। অলকানন্দা টুঁ শব্দেরও টুঁটি টিপে নেমে আসে বিছানা থেকে। ওদের তিনতলার ঝুলবারান্দায় একটু একটু করে রাতের আয়ু ফুরিয়ে আসতে থাকে।

খুব ভোরে আচমকা ঘুম থেকে জেগে উঠে সুজয় দেখল অলকানন্দা নেই। ওর বালিশের এক কোণে একটা ভাঁজ করা এ ফোর পেপার। তাতে লেখা, আজ অফিস ছুটির পর সোনাগাছি যাচ্ছি। তার পরের গন্তব্য আমার জানা নেই।

 

অফিস ছুটির পর অলকানন্দা ভূত দেখে চমকে ওঠে। অফিসের গেটের মুখে সুজয় দাঁড়িয়ে অলকানন্দাকে দেখে এগিয়ে এল। বলল, চলো আমিও যাব। পেছন থেকে কস্তুরী বলল, অলকা, তাহলে আমি আর যাচ্ছি না। অলকানন্দা মাথা নেড়ে হাত তুলে গুডবাই বোঝাল।

ভিক্টোরিয়া হাউসের সামনে চকার দাঁড়ানোর কথা। দূর থেকে চকাকে দেখা গেল। ফর্সা লম্বা মেয়ে পটানো চেহারা। নীল জিন্স-এর ওপর একটা ডার্ক টি-শার্ট। বলিউডের হিরোর স্টাইলে কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

অলকানন্দা বলল, ওই যে ওই ছেলেটা। চকার গা ঘেঁষেই ট্যাক্সি দাঁড়াল। অলকানন্দা মুখ বাড়িয়ে বলল, উঠে এসো চকা, সামনে বসো। ট্যাক্সি ছুটছে সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ ধরে। চকা ড্রাইভারের কপালের কাছে ঝোলানো আয়নায় কেঁপে কেঁপে যাওয়া লোকটাকে দেখার চেষ্টা করছিল।

ট্যাক্সি থেকে নেমে চকা বলল, আপনারা আসুন আমার সঙ্গে। চকাকে অনুসরণ করে চলল অলকানন্দা আর সুজয়। বুক কাঁপছিল অলকানন্দার। এটাই তাহলে সোনাগাছি! আসলে পৃথিবীর এই আদিম পেশার ওপর অনেকদিনের চাপা কৌতূহল তার। সোমাই যেন হাত ধরে নিয়ে এল অলকানন্দাকে। তার অজানা ও অদেখাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল সোমাই। রাস্তার দুধারের বাড়ির সামনে সব অসভ্য সাজগোজ করা রোজগেরে মেয়ে। এরাই বেশ্যা, বারবনিতা, বারাঙ্গনা আরও কত নাম এদের। এখন শুধুই যৌনকর্মী।

একটা বাড়ির সামনে এসে দাঁড়িয়ে পেছন ফেরে চকা। বলে, এই বাড়িটাই, চলে আসুন। বাড়িটার একবারে গর্ভস্থলে ঢুকে পড়ল ওরা তিনজন।

অলকানন্দা বলল, বাব্বা, কত ভেতরে গো চকা।

চকা বলল, আসুন না। আরও একটু ভেতরে। সুজয় নাকে-মুখে সাদা রুমাল চেপে হাঁটছিল। অলকানন্দার বুকে ভূমিকম্পের ধকল। গলা শুকিয়ে আসছিল। অনেক কষ্টে বলল, চকা তুমি সোমাকে কিছু জানাওনি তো।

না কিছু বলিনি। আপনাদের দেখে ও বমকে যাবে।

অলকানন্দা চাপা গলায় বলল, লজ্জাও পাবে। অবশ্য এখনও যদি ওর লজ্জা বলে কিছু অবশিষ্ট থাকে।

চকা বলল, এখানে ওসব লজ্জাফজ্জা চলে না। বলতে বলতে একটা ঘরে ঢুকে গেল চকা। পেছন ফিরে বলল, আসুন ভেতরে চলে আসুন। ঘরের ভেতরে ঝলমল করছে আলো। ঘরে ঢুকেই একেবারে সোমার মুখোমুখি অলকানন্দা।

সোমা ছুটে এসে অলকানন্দার হাত চেপে ধরল। বলল, দাদা-বউদি, তোমরা এখানে! চকা নিয়ে এল বুঝি? খুব ভালো করেছ এসেছ। আমি যেন স্বপ্ন দেখছি।

অলকানন্দার কথা বলার শক্তি নেই। চকা বলল, এটা এই বাড়ির কিচেন। দুবেলা পনেরো-পনেরো তিরিশটার মতো পাত পড়ে এখানে। দুজন জোগাড়েকে নিয়ে সোমা একাই সামলায় এই কিচেন। মাস মাইনে পনেরো হাজার।

সোমা বলল, তোমরা বসো বউদি, আমি তোমাদের চা করে দিই।

 

অলকানন্দার পায়ের নীচ থেকে মাটি সরে যাচ্ছিল। কিচেন থেকে বেরিয়ে বাইরের ছোট্ট প্যাসেজে একটা চেয়ারে স্থবিরের মতো বসে পড়ল অলকানন্দা। সুজয় পাশে নাকে রুমাল চাপা দিয়ে দাঁড়াল।

চকা এসে বলল, এবার বলুন বউদি, আমার সঙ্গে কী বোঝাপড়া করবেন।

অলকানন্দার চোখ ঝাপসা হয়ে এল। হাতের রুমাল দিয়ে চোখের কোণা মুছে নিয়ে বলল, আমাকে আর লজ্জা দিও না।

ঠিক তখনই চকার মধ্যে জেগে উঠল মাস্তান চকা। মাস্তানির ঢঙেই সে বলল, বউদি, সোমাকে এই সোনাগাছিতে কে দেখেছে বলুন তো? মানে সেই ডবল ভদ্দলোকটি কে?

সুজয় এবার তাড়া লাগাল। বলল, ওসব কথা পরে হবে। আমরা এখন ফিরব।

অলকানন্দার বুকের ভেতরে ভূমিকম্পে ধস নামছিল। সুজয় বলল, চলো, একটু হেঁটে এসো। ওই মোড় থেকে ট্যাক্সি নেব।

অলকানন্দা হাঁটছিল সুজয়ের পেছন পেছন। দূরত্ব সামান্য হলেও ব্যবধান ছিল। একটা লোক সুজয়কে দেখে সালাম সাব বলল। প্রায় মাঝবয়সি লোকটার পরনে চেক লুঙ্গি, কালো স্যান্ডো গেঞ্জি, গলায় চৌকো তাবিজ। অলকানন্দাকে পাশ কাটিয়ে চলে গেল লোকটা।

অলকানন্দা এবার পা চালিয়ে সুজয়ের পাশে পাশে হাঁটতে লাগল। বলল, লোকটাকে তুমি চেনো নাকি?

কথাটা সুজয়ের কানে গেল কিনা বোঝা গেল না। অদূরে দাঁড়ানো একটা ট্যাক্সি দেখে সুজয়, ট্যাক্সি বলে চেঁচিয়ে উঠল।

উড়ান

জুনি মোবাইলে সময়টা দেখে নিল। এখনও সময় আছে পার্লার পৌঁছোনোর। আগে থেকেই অ্যাপয়েন্টমেন্ট করা, সুতরাং সময়মতো ওকে পৌঁছোতে হবে। নতুন নতুন বিয়ের পর ওর এইসব সাজগোজ, পার্লারে বসে রূপচর্চা খুব ভালো লাগত। এখন পানিশমেন্ট মনে হয়! আগে এইসব করার জন্য একটা মন ছিল ওর, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে শরীর, মনে কেমন একটা শিথিলতা চলে এসেছে জুনির।

ওর বয়স এখন মাত্র সাতাশ। বড়ো বড়ো চোখ, পাতলা ঠোঁট, টিকালো নাক, কালো ঘন চুল যা কিনা স্টেপ করে কাটা, গায়ের রং একটু মাজা, যেটাকে আমরা শ্যামবর্ণ বলে থাকি। সব মিলিয়ে বেশ চোখে পড়ার মতো ব্যক্তিত্ব।

জুনি মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে। তিন বোন, জুনি মেজো। বড়ো আর ছোটো বোন অপরূপ সুন্দরী, গায়ের রং দুধে আলতা বলতে যা বোঝায়, সেখানে জুনির গায়ের রংটাই একটু চাপা। এর জন্য মনে মনে জুনি একটু বিব্রত হতো। অথচ ওর চোখের মধ্যে এমন একটা আকর্ষণ ছিল যে, সৌমেন একবার দেখেই জুনিকে বিয়ে করতে মনস্থ করে ফেলে।

বিয়ের পাঁচ বছর পরেও জুনি আজও বুঝতে পারেনি, ওদের বিয়েতে সৌমেনের মা-বাবা আদৌ খুশি হয়েছিলেন কিনা। ওর এই একই প্রশ্ন সৌমেনকে নিয়ে। জুনি কি আদৌ সৌমেনকে খুশি করতে পেরেছে?

পার্লারে মেয়েটির দক্ষ হাত জুনির সারা মুখে মাসাজ করছে। ছোট্ট গদিপাতা বেঞ্চটায় শুয়ে আরামে চোখ বুজল জুনি, অতীতের ঘটনাগুলো চোখের সামনে এসে ভিড় করছে। সৌমেনের সঙ্গে ওর বিয়ে আজও স্বপ্ন মনে হয় জুনির। বিয়ের দিন নিজের শাড়ি, গয়না দেখে জুনি বেশ বুঝতে পারছিল ওর বোনেদের, এমনকী বান্ধবীদেরও ওকে দেখে ঈর্ষাবোধ হচ্ছে। সৌমেনদের বাড়ি থেকে পাঠানো হয়েছিল বিয়ের পুরো সরঞ্জাম। লাল বেনারসিতে ঠাসা জরির বুনন, সোনার তারের কাজ। ওড়নাতেও শাড়ির সঙ্গে মানানসই কাজ করা।

গা ভর্তি গয়না, যার বেশিরভাগটাই শ্বশুরবাড়ি থেকেই আসা। বিয়ের দিন হিরের সেট দিয়ে শ্বশুরমশাই আশীর্বাদ করে গেলেন। সত্যি, কনেকে দেখে রাজকুমারীই মনে হচ্ছিল।

নতুন বউ হয়ে শ্বশুরবাড়িতে প্রবেশ করার সময় বুকের ভিতরটা কেমন যেন ভয়ে কাঁপছিল। এই বিশাল বাড়িতে সৌমেন থাকে। এ তো পুরো রাজপ্রাসাদ। জুনি ভয়ে সিঁটিয়ে ছিল। বউভাতের দিন রাতে বউভাতের ধড়াচুড়া ছাড়ার পর, এক ফাঁকে শাশুড়ি এসে ঘরে ঢুকেছিলেন। সৌমেন অতিথিদের ছাড়তে নীচে গিয়েছিল। একটা প্যাকেট ধরিয়ে শাশুড়ি বলেছিলেন, শাড়ি ছেড়ে এটা পরে নিও। আশা করি, আজ রাত্রে কী করতে হয় সেটা তুমি জানো? প্যাকেটের ভিতর সাদা ফাইন কাগজে মোড়া সুন্দর একটা নাইটি, যেটা বিদেশ থেকে কেনা বলেই মনে হয়েছিল জুনির। শাশুড়ির কথা শুনে জুনির গাল, কান সব লাল হয়ে উঠেছিল।

অবশ্য সৌমেন ভালোবাসার পাকদণ্ডি বেয়ে খুব যত্ন করে ধৈর্য্য সহকারে জুনিকে চলতে শিখিয়েছিল। সৌমেনের বাড়ির আদবকায়দা, রীতি-রেওয়াজ, পোশাক পরার ঢং একেবারেই জুনির বাপের বাড়ি থেকে আলাদা ছিল। ধীরে ধীরে জুনি নিজেকে শ্বশুরবাড়ির আদলেই ঢেলে সাজিয়ে তোলে।

একমাস পরে যখন ও বাপের বাড়ি কয়েকদিনের জন্য থাকতে এল, সকলে ওকে দেখে অবাক হয়ে গেল। নিজেদের বাড়ির মেয়েকেই যেন চেনা যাচ্ছে না। অতি সাধারণ থেকে রাজেন্দ্রানী। শুঁয়োপোকার খোলস ত্যাগ করে যেমন পূর্ণাঙ্গ প্রজাপতির আবির্ভাব ঘটে। কিন্তু এই নতুন ডানা নিয়ে কতদিন সে উড়তে পারবে, সেটা তখনও সকলের অজানাই ছিল।

শ্বশুরবাড়ি ফিরে আসতেই টিকিট কাটাই ছিল, সৌমেনের সঙ্গে সারা পৃথিবী ঘুরে বেড়াবার জন্য বেরিয়ে পড়ল জুনি। মোট দুই মাসের টুর। দেখতে দেখতে দিনগুলো যেন পার হয়ে গেল। জুনির কাছে এটা রূপকথার সফর ছাড়া আর কিছুই ছিল না। ও আর সৌমেন। প্রথম মদ্যপান বিদেশেই। তখন ও বুঝতেও পারেনি এই আসক্তি ধীরে ধীরে বাড়তে বাড়তে একদিন অভ্যাসে পরিণত হবে।

বাড়িতে ফিরে প্রথমেই খেয়াল করল, ওর বাড়ি থেকে আনা পুরোনো জামাকাপড় আর একটাও নেই। সবই আধুনিক পোশাকে বদলে ফেলা হয়েছে। শাশুড়ি একটা ফর্দ তৈরি করে জুনির হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন, এ বাড়ির বউ, মেয়েের এগুলো শিখে রাখাটা অত্যন্ত জরুরি। আমি ব্যবস্থা করে দিয়েছি, কাল থেকেই শুরু করো।

অগত্যা দুই-তিন মাস ধরে চলল ড্রাইভিং, সুইমিং, ঘোড়ায় চড়া সবকিছু শেখার পালা। জন্মদিনে উপহার হিসেবে গাড়ি কিনে দিল সৌমেন। নিজে ড্রাইভ করে বাপের বাড়ি পেঁছোলে, জুনির মা-বাবা মেয়ের ভাগ্য দেখে, আনন্দে কেঁদেই ফেললেন।

স্বাভাবিক ভাবেই ভগবানের আশীর্বাদ বলেই মেনে নিলেন জুনির কপালকে। এত ভালো শ্বশুরবাড়ি আজকালকার দিনে ক’টা মেয়ের ভাগ্যে জোটে? বাড়ির বউকে এতটা স্বাধীনতা কে দেয়? সৌমেনের মা-বাবা মেয়েবউয়ের মধ্যে তফাত করতেন না। কিন্তু জুনির মনে হতো স্বাধীনতার উপর সকলের মৌলিক অধিকার রয়েছে। স্বাধীনতা দেওয়ার কী আছে? এটা আবার কেউ কাউকে দেয় নাকি? আধুনিক জীবন কাটাবার জন্য জুনির সম্পূর্ণ স্বাধীনতা ছিল ঠিকই কিন্তু কিছু শর্ত এবং নিয়মের গণ্ডিও মেনে চলতে হতো। মনে মনে নিজেকে পুরো স্বাধীন বলে ভাবতে পারত না জুনি। বিয়ের পাঁচ বছর পরে আজও পারে না। পার্লারে বেঞ্চটাতে শুয়ে ব্যঙ্গের হাসি ফুটে ওঠে জুনির ঠোঁটের কোণায়।

পার্লার থেকে বেরিয়ে রাস্তায় রোল কিনে খেতে ইচ্ছে করল। কিন্তু মনে পড়ল ডায়েটিশিয়ান এইসব ফাস্টফুড খেতে একেবারে বারণ করে দিয়েছেন।

বাড়ি ফিরে বিস্বাদ সেদ্ধ খাবার কোনও মতে গলা দিয়ে নামিয়ে নিজের ঘরে চলে এল জুনি একটু আরাম করতে।

সন্ধেবেলায় একটা সোশ্যাল ফাংশনে যাওয়ার কথা শাশুড়ির সঙ্গে। শাশুড়ির জন্য একটা বক্তৃতাও তৈরি করার কথা। সেটা করতে করতেই পাঁচটা বেজে গেল। ইচ্ছে করছিল একটু কফি খাবার। রান্নাঘরের দিকে পা বাড়াতেই রান্নার ঠাকুর এসে এক গেলাস কিছু পানীয় ধরিয়ে দিল জুনির হাতে, এটা খেযে নাও দিদি। মা বলেছেন রাঙাআলু আর গাজরের রসটা বিকেলে চায়ের বদলে তোমাকে দিতে।

বাধ্য হয়ে ওষুধের মতো খেয়ে নিয়ে জুনি তৈরি হতে ঘরে চলে এল।

পেস্তা রঙের একটা জামদানি শাড়ির সঙ্গে ম্যাচ করে পান্নার একটা হালকা সেট বেছে নিল। কপালে বড়ো একটা টিপ পরে, আয়নায় নিজেকে দেখে সন্তুষ্ট হল।

গাড়িতে বসে রাস্তায় যেতে যেতে বক্তৃতা পুরো পড়ে শাশুড়িকে বুঝিয়ে দিল।

ফাংশনে কিছু ভালো লাগছিল না জুনির। সে কলমের জোরে বক্তৃতাটা তৈরি করেছিল ঠিকই কিন্তু মনে মনে জানত মনের কথা কলম দিয়ে শুধু নয়, হৃদয় দিয়ে লিখতে হয়। বক্তৃতার বিষয়টা ছিল, আমার অধিকারের প্রাধান্য বেশি, নাকি পরিবারের প্রতি দায়িত্বের…

হনিমুন থেকে ফেরার পর জুনির শরীরটা তেমন ভালো যাচ্ছিল না। সৌমেনের, প্রেমে তখনও হাবুডাবু খাবার অবস্থা। জুনিকে এক মুহূর্ত চোখের আড়াল হতে দেয় না। এক প্রকার জোর করেই সৌমেন জুনিকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেল। ফ্যামিলি ডাক্তার, জুনিকে পরীক্ষা করেই বললেন, সৌমেন মিষ্টির ব্যবস্থা করো, নতুন সদস্য আসতে চলেছে।

লজ্জায় জুনির গাল লাল হয়ে উঠল কিন্তু সৌমেন খুব খুশি হয়েে বলে মনে হল না। গাড়িতে বসতেই বলল, ওষুধ যেটা দিয়েিলাম ঠিকমতো খাওনি নাকি?

জুনি ভেবে উত্তর দিল, মনে হয় যে রাতে তোমার সঙ্গে বসে হুইস্কি খেয়েছিলাম… একটু জোরেই বলে ওঠে সৌমেন, হাউ ক্যান ইউ বি সো ইরেসপন্সিবল?

জুনি চুপ হয়ে গিয়েছিল। পুরো রাস্তা আসতে আসতে ভাবছিল হয়তো সৌমেন নতুন দায়িত্ব নিতে ঘাবড়াচ্ছে। জুনিও মাতত্বের স্বাদ পেতে পাগল হয়ে উঠেছিল এমনটাও নয়। কিন্তু যে আসতে চলেছে তাকে অস্বীকার করার ইচ্ছে জুনির ছিল না।

বাড়ি ফিরে চায়ে চুমুক দিতে দিতে সৌমেন মা-কে সব কিছু খুলে বলতেই, জুনির মনে হল শাশুড়ির মুখে বিদ্রুপের ভাব ফুটে উঠল। তিনি ব্যঙ্গ করেই বললেন, মধ্যবিত্ত বাড়ির মেয়েদের নিয়ে এই এক মুশকিল। অবশ্য এদের কাছ থেকে কী-ই বা আশা করা যায়। বিয়ে হয়ে যাওয়া মানেই ছেলেপুলের মা হয়ে বসা।

জুনির চোখে জল চলে এল। সৌমেন সেটা উপেক্ষা করেই বলল, বাচ্চা নেব কি নেব না, সেটা আমাদের দুজনেরই সম্মতিতে হওয়া উচিত। আমার অজান্তেই এতসব ঘটেছে এটা সত্যিই দুঃখের। কিন্তু এই দায়িত্ব নিতে আমি এখন তৈরি নই। এখন তো সবে জীবন শুরু করেছি।

অ্যাবর্শন-এর ঘটনাই প্রথম জুনির চোখ খুলে দিল। ও বুঝতে পারল ডানা তাকে দেওয়া হয়েে ঠিকই কিন্তু কতটা সে উড়বে সেটার রিমোট কন্ট্রোল তার শ্বশুরবাড়ির হাতে রয়েছে।

নার্সিংহোমে সবকিছুই ঠিক ভাবে হয়ে গেল। শরীরে কোনও ব্যথাই বোধ করল না জুনি। কিন্তু মনের ভিতরের ক্ষতটা দগদগে হয়ে উঠল। কেউ জানল না জুনির যন্ত্রণার কথা। ও কাকেই বা বলবে? এই ভাবে প্রথম ঘটনা, দ্বিতীয় ঘটনা, ঘটনাগুলো ভিড় করতে শুরু করল জুনির মনে। রোজই নতুন নতুন রং ঢেলে সাজানো হতো জুনির পাখা দুটোতে কিন্তু কেউই একবারের জন্যও জুনিকে জিজ্ঞেস করত না, রংগুলো আদৌ তার পছন্দ কিনা।

অথচ সবার চোখে জুনির মতো ভাগ্যবতী অন্য কোনও মেয়ে নজরে আসত না। সবার শ্বশুরবাড়িতেই নানা রকমের নিষেধ মানামানির ব্যাপার থাকে। অথচ জুনির কাছে আধুনিক পোশাক থেকে শুরু করে দেশবিদেশ ঘোরা, নিজের পছন্দ মতন কাজ করা, দামি পার্লারে গিয়ে রূপচর্চা করানো এত স্বাধীনতা কোন শ্বশুরবাড়ি থেকে দেয়? জুনির এই সুখ সকলের মনে ঈর্ষাই জাগাত।

বাপের বড়ি যাবে বলে তৈরি হচ্ছিল জুনি। হালকা নীল রঙের চিকন কাজের সুতির সালোয়ার কামিজ পরেছিল সে। গলায় পাতলা একটা সোনার চেন আর হাতে দুটো করে সোনার চুড়ি। তৈরি হয়ে ঘরের বাইরে আসতেই মুখোমুখি হতে হল সৌমেন আর শ্বশুরমশাইযে।

একী জুনি! এই পোশাকে মা-বাবার সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছ? ভালো শাড়ি কি নেই? হতভম্ব হয়ে জুনিকে প্রশ্নটা ছুড়ে দিলেন শ্বশুরমশাই।

সৌমেনও বাবার সঙ্গে গলা মেলাল, বাবা ঠিকই বলেছে। ভদ্র পোশাকে যাও, এটা পরার মতো পোশাক হল? বম্বের কলানিকেতন থেকে যে-শাড়িটা কিনে দিয়েিলাম সেই সিল্কটা পরে যাও। যাও চেঞ্জ করে এসো।

কলের পুতুলের মতো জুনি আবার নিজের ঘরে চলে এল। সৌমেনের দেওয়া প্রত্যেকটা শাড়ি যেমন দামি তেমনি সুন্দর। কিন্তু জুনি কাউকে এটা বোঝাতে পারে না, এত দামি শাড়ি আর দামি দামি গয়না ওর আর বাপের বাড়ির সকলের মধ্যে একটা দেয়াল তুলে দেয়। ওর এই দামি শাড়ি, গয়না দেখে তাদের মনে একটা হীনম্মন্যতা জন্ম নেয়। প্রাণখুলে কেউই তেমন আর কোনও কথা বলতে পারে না।

গলির মুখে গাড়ি দাঁড় করিয়ে জুনি পা টিপে টিপে বাড়ির ভেতর ঢোকে। জুনির মা ঠিকই টের পান মেয়ে আসা, কী রে জুনি, তুই এলি?

জুনি আবার সেই পুরোনো জুনি হয়ে ওঠে, উফ মা তুমি কী করে বুঝতে পারো বলো তো?

রান্নাঘরে এসে ঢোকে জুনি। মা রান্নায় ব্যস্ত। হাত ধুযে একটা প্লেট নিযে রান্না করে রাখা ছানার কোফতা তুলে খেতে শুরু করে দেয়।

জুনি, সাবধানে খা। এত দামি শাড়ি, একটু ঝোল পড়লেই শাড়িটা খারাপ হয়ে যাবে, মা সাবধান করলেন জুনিকে।

মা আর জুনির গলার আওয়াজ পেযে আরও দুই বোন এসে রান্নাঘরে ঢুকল। দিদি ফোড়ন কাটল, সেই ভালো জুনি, তুই ডাইনিং টেবিলে বসে কাঁটা-চামচ দিয়ে বরং খা। মা আমরা তো আছি বাসন ধুযে রান্নাঘর পরিষ্কার করার জন্য।

ছোটোবোন বলল, দি, তোকে কী দিই বলতো পা রাখার জন্য? তোর মাটিতে পা একেবারে মানায় না।

জুনি ওদের বক্রোক্তি গায়ে মাখল না। প্লেট-টা ধুযে বলল, চল, বাচ্চাগুলোর জন্য খেলনা নিযে এসেছি, দিয়ে দিই।

বিদেশ থেকে আনা খেলনাগুলো দুই বোনের ছেলেমেয়েের মধ্যে ভাগ করে দিল জুনি। ছোটো বোন হেসে বলল, দি, এত দামি দামি খেলনা প্লিজ আনিস না। খারাপ হয়ে গেলে আমরা ঠিকও তো করতে পারব না।

জুনি কী করে বলবে, সৌমেনের পছন্দ করা এসব খেলনা। জুনির কথা ওখানে কে শুনবে?

খেতে বসে মায়ের হাতের কচু শাক, লাউয়ে ঘন্ট, ছানার কোফতার ডালনা আর মাংস গোগ্রাসে জুনিকে খেতে দেখে মা হেসে ফেললেন। বললেন, কী রে শ্বশুরবাড়িতে খেতে দেয় না বুঝি? দেশবিদেশের কত রকমের খাবার খেযে বেড়াস। ওগুলো খেয়ে তোর মন ভরে না বুঝতে পারছি।

রাতটা মায়ের কাছে কাটাবারই কথা বলে এসেছিল জুনি। কিন্তু ঠিক সন্ধেবেলায় সৌমেনের ফোন এল, বড়ো পিসিমা হঠাত্ এসেছেন, তোমাকে বাড়ি চলে আসতে হবে। আমি ড্রাইভার পাঠিয়ে দিচ্ছি। ফোন রেখে দিল সৌমেন।

ড্রাইভার এসে বেল দিতেই জুনি দরজা খুলে দিল। ড্রাইভারের হাত দিয়ে শাশুড়ি সবার জন্য জামাকাপড় আর প্রচুর মিষ্টি পাঠিয়েছেন দেখল জুনি। বোনেদের হাতে উপহারগুলো তুলে দিতে দিতে জুনি স্পষ্ট বুঝতে পারল আনন্দে, লোভে ওদের চোখ চকচক করছে। জুনির ঠোঁটের মলিন একটুকরো হাসিটা সকলের চোখ এড়িয়ে গেল। মা কিছুটা ধরতে পারলেন ঠিকই, ইচ্ছে হল মেয়ে গলা জড়িয়ে ধরে জিজ্ঞেস করেন, হ্যাঁ রে তুই ভালো আছিস তো জুনি? কিন্তু পরক্ষণেই দামি শাড়ি, জামাকাপড়, মিষ্টির মোহ তাঁরও চোখকে পর্দার আস্তরণে ঢেকে দিল।

জুনি ভালো মতোই জানত সৌমেন আর ওর মা-বাবা কিছুতেই ওকে বাপের বাড়িতে রাত্রিবাস করতে দেবে না।

বাড়ি ঢুকতেই শাশুড়ি জড়িয়ে ধরলেন জুনিকে, সৌমেনের পিসিমা তোমাকে দেখবেন বলে একেবারে অস্থির হয়ে উঠেছেন। তাড়াতাড়ি শাড়ি বদলে বসবার ঘরে এসো।

জুনি আবার শাড়ি বদলে বসবার ঘরে ঢুকে পিসিমার পা ছুঁয়ে প্রণাম করল। জুনির মাথা থেকে পা অবধি পর‌্যবেক্ষণ করলেন পিসিমা, ভালো খবরটা কবে দিচ্ছ? খাওয়াদাওয়া করো ঠিকমতন?

সোফায় এসে বসল জুনি। এবার পিসিমা এসে পাশে বসে হাত দিয়ে জুনির মুখটা তুলে ধরলেন, বললেন, বাঃ শ্বশুরবাড়ির রং তো দেখছি ভালোই লেগেছে তোমার গায়ে এখানকার সুখসুবিধে পেয়ে কেমন লাগছে তোমার?

চুপচাপ বসে রইল। কী উত্তর দেবে বুঝে ঠিক করতে পারল না জুনি।

রাতে মদ্যপান করতে করতে সময়ে খেয়াল ছিল না জুনির। চোখ বুজে আসছিল। গেলাস ভর্তি এই পানীয়টাই একমাত্র ওকে শান্তি দিতে পারে। আলাদা জগতে বিচরণ করতে পারে, যেখানে সে ছাড়া আর কেউ থাকে না। নিজের ইচ্ছেমতন যা খুশি করতে পারে।

সকালে যখন ঘুম ভাঙল জুনির তখন বাইরে রোদ ঝলমল করছে। সৌমেন অফিসের জন্য তৈরি হচ্ছিল। জুনিকে দেখে বলল, এত কেন খাও যখন ওটা তোমার সহ্য হয় না?

মৃদু হাসল জুনি, তাহলে পান করার কী অর্থ নেশাই যদি না হল তো…

একাকিত্ব আর শূন্যতা ধীরে ধীরে জুনিকে গ্রাস করতে আরম্ভ করল। কিন্তু বাইরে থেকে কেউই সেটা বুঝতে পারল না। সে নিজের মতো করে জীবনটাকে বোঝার চেষ্টা করছিল কিন্তু সেটা কারওরই বোধগম্য হচ্ছিল না।

একদিন জুনি সৌমেনকে বলল, আমিও তোমার সঙ্গে অফিস যেতে চাই। সৌমেন খুশিই হল। ও রাজি হয়ে গেল। জুনি রোজ সৌমেনের সঙ্গে অফিস যেতে আরম্ভ করল। কিন্তু ওখানেও তার বিশেষ কিছুই করার ছিল না। দাবার ঘুঁটির মতো জুনির অবস্থা। এক কথায় বলতে গেলে সবকিছুই তার কিন্তু কোনও কিছুই যেন তার নিয়ন্ত্রণে নয়।

মরুভমির মতো হয়ে উঠল জুনির জীবনটা। জায়গায় জায়গায় মরীচিকা দেখা গেলেও জল কোথাও নেই সুতরাং তেষ্টা মিটবে কী করে? কয়েক মাস পরে নিজেই অফিস যাওয়া ছেড়ে দিল। অফিসে ওর পরিচিতি বলতে একটাই ছিল, সৌমেনের ওয়াইফ।

সৌমেনের কাকার ছেলের বিয়েতে বাড়িশুদ্ধু সবাই উপস্থিত ছিল। ককটেল পার্টি চলছিল। লাল রঙের অফ শোল্ডার গাউন আর রুবির গয়নার সেট-টায় অপরূপা হয়ে উঠেছিল জুনি। হালকা মিউজিকের সঙ্গে সকলেই ডান্স করছিল। কারও কারও হাতে গেলাস। দুটো পেগ আগেই খাওয়া হয়ে গিয়েিল জুনির। সৌমেনকে জড়িয়ে ধরল সে। কানের কাছে মুখ নিযে এসে বলল, সৌমেন আমি উড়তে চাই, আমাকে খাঁচায় বন্ধ করতে চেও না। আমি একটা সাধারণ মেয়ে আমাকে অসাধারণ করে তোলার জেদ ছেড়ে দাও।

কিছু উত্তর দেওয়ার আগেই সৌমেন খেয়াল করল ডান্স ফ্লোরে প্রায় সকলেরই চোখ ওদের উপর। জুনি কথাগুলো আস্তে বলতে চাইলেও আশেপাশে সকলের কানেই পেঁছেছে কথাগুলো। আরও কিছু না বলে বসে, এই ভয়ে সৌমেন ওর হাত ধরে একটু জোর করেই বাইরে এনে গাড়িতে তুলে দেয়। তারপর সোজা ড্রাইভ করে বাড়ি চলে আসে। সারারাত সৌমেনের ঘুম আসে না। কেন জুনি এরকম বলল? কী অভাব রেখেছে সৌমেন? কোথায় ভুল করে বসল সে? নিজেকেই নিজে প্রশ্ন করতে লাগল বারবার সৌমেন।

সকালে জুনি ঘুম থেকে উঠতেই সৌমেন জিজ্ঞাসা করল, তুমি সত্যি করে কী চাও জুনি? সবাই তোমার মতো জীবন পেতে চায় অথচ তোমার কাছে এরকম জীবনের কোনও কদরই নেই।

কী উত্তর দেবে জুনি? শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল জানলার বাইরে। মনের মধ্যে তোলপাড় হতে থাকল, সত্যিই কি বাস্তবে জুনি এমনটাই চেয়েছিল?

সোশ্যাল ফাংশন অ্যাটেন্ড করা, এলিট ক্লাবের মেম্বার হয়ে সৌমেনের সঙ্গে পার্টি অ্যাটেন্ড করতে যাওয়া, কোনও অনুষ্ঠানে অতিথির আসন অলংকৃত করতে শাশুড়ির সঙ্গে সেখানে গিয়ে বসে থাকা, পার্লার যাওয়া নয়তো শপিং আর নয়তো বাড়িতে চুপচাপ হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকা। এটাই জীবন হয়ে উঠেছিল জুনির। জীবনের সব রং হারিয়ে গিয়েছিল তার জীবন থেকে।

তখনই একদিন খবরের কাগজে বিজ্ঞাপনটা চোখে পড়ে। স্থানীয় কলেজে লেকচারারের পোস্ট। ইতিহাসের লেকচারার চাইছে। যে-বিষয়ে ও নিজে পড়াশোনা করেছে। কাউকে কিছু জিজ্ঞাসা না করেই আবেদন পাঠাল। সাক্ষাত্কারও চুপচাপ দিয়ে এল। জয়েনিং লেটার হাতে পেয়ে সৌমেনকে জানাল। সৌমেন বাড়ির সবাইকে।

রাতদিন হাজার প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হতো জুনিকে।

কী দরকার ছিল এরকম চাকরি নেওয়ার। পদে পদে, যেখানে ধাক্কা খেতে হবে?

যা রোজগার হবে তার থেকে বেশি টাকা পেট্রোলেই চলে যাবে?

রোদে বৃষ্টিতে সেই দৌড়ঝাঁপ করতে হবে, তখনই বুঝতে পারবে কত ধানে কত চাল। চাকরি করার যখন এতই শখ নিজেই যাওয়া আসা করবে আর নিজের খরচ নিজেই চালাবে।

এরকম হাজারো শব্দবাণ রোজ জুনির উপর বর্ষাতে আরম্ভ করল বাড়িতে। আর চুপচাপ মুখ বুঝে সব সহ্য করতে থাকল জুনি। ভুল তো করেছিল প্রথম থেকেই। ওড়বার জন্য দুটো ডানার রিমোট কন্ট্রোলটা স্বামী আর শ্বশুর-শাশুড়িকে দিয়ে রেখেছিল। কিন্তু আর নয়। নিজের উড়ান এবার সে নিজেই ঠিক করবে। মুখ থুবড়ে পড়লেও আবার উঠে দাঁড়াবে। জীবনের রামধনু রং-কে নিজের চোখে পরখ করতে উতলা হয়ে উঠেছিল জুনি।

পার্লার থেকে বেরোতে বেরোতে জুনি ভাবছিল, রাস্তা যখন আমার তখন সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকারও আমার। আমার ছোটো ছোটো স্বপ্নপূরণ করাটাই আমার মনের একান্ত ইচ্ছা। এটাই আজ থেকে সত্যি আমার জীবনে। নিজের মনের ভেঙে পড়া ডানা দুটোকে আবার জোড়া লাগাতে তত্পর হয়ে উঠল জুনি। এখনও অনেকটা পথ যাওয়া বাকি!

মেঘলা আকাশ

মেঘলা, আকাশ মেঘা বলে ডাকে। নামটা বেশ রোমান্টিক। সূর্য হাপুচুপু খায়। ভিজে যায় শরীর। আবার কখনও ফুঁপিয়ে কাঁদে মন। আকাশ যখন মেঘা বলে ডাকে,মেঘার শরীরজুড়ে শীতল বাতাস ছুঁয়ে যায়। আকাশের চোখে মুখে মনে হয় পৃথিবীর সব সুখ লেপটে রয়েছে।

দীর্ঘ শীতাবকাশের পর আজ ছিল কলেজ খোলার দিন। কলেজ ফেরত আকাশ রোজকার মতো ফিরছে তার মেসে। কিন্তু মেঘার সঙ্গে দেখা হয়নি! এই পাহাড়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে শীতের ছুটি পড়ে ডিসেম্বর মাস থেকে। মেঘা আসেনি কেন বুঝতে পারছে না আকাশ। অথচ, ওর তো আসার কথা ছিল। কিংবা একটা তো খবর দেবে। এমন তো করে না মেঘা!

কলেজের শেষ পিরিয়ডটা করে বেশ কিছুক্ষণ ক্যান্টিনে দু’কাপ চায়ের ধূমায়িত পেয়ালায় চুমুক দিতে দিতে ভাবতে থাকে সেসব কথা। খুব দেরি হয়ে গিয়েছে মেসে ফিরতে হবে তাড়াতাড়ি। কিছুটা আলো থাকলেও সন্ধ্যা নামতে দেরি নেই। এমন সময় আকাশের মুখ ভার। মেঘের গর্জন। মেঘলা আকাশের বুক চিরে অবিশ্রান্ত বৃষ্টি কিংবা বিদ্যুতের ঝিলিক। ঝোড়ো পরিবেশ। কারেন্ট নেই। বিদ্যুতের ঝলকানির আলোতে ঝাপসা পথটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।

বেশ কয়েকটা চড়াই-উতরাই পার করে আকাশের ছাত্রাবাস। সবুজ চা-বাগিচায় মোড়া সুখি উপত্যকার ঢালে মেস। স্থানীয় একজনের বাড়িতে প্রায় চার বছর ভাড়া রয়েছে। কাঠের সারি সারি ঘর, খুব পরিচ্ছন্ন আর লম্বা সরু এক ফালি বারান্দা। এই বারান্দা থেকে দূর পাহাড়ের বসতি ও উপত্যকায় চা-বাগিচার সবুজ যেন চুঁইয়ে পড়ে। কিছুক্ষণের জন্য চোখের আরাম হয় বইকি।

এই পাহাড়ি শহরে অনার্স কমপ্লিট করে মাস্টার ডিগ্রি করছে আকাশ-মেঘলা। বিষয় ভূগোল। ফাইনাল ইয়ার। আর প্রথম যেদিন ভর্তি হতে আসে সেদিন মেঘলার সঙ্গে পরিচয়। মেঘলার মাস্টারমশাই মনোময়বাবু সজ্জন মানুষ। প্রথম দিনই আলাপ জমে যায় আকাশের সঙ্গে। মেঘলাকে ভর্তির পর ক্যান্টিনে মোমো খেতে খেতে সব কিছু মনের কথা উজাড় করে দিয়েছেন মনোময় স্যার। আকাশের সহযোগিতায় মেঘলার জন্য একটা ঘরে পেয়িং গেস্ট থাকবার ব্যবস্থা করেন মনোময়বাবু। কিছুটা গার্জেনের ভূমিকা পালন করেন।

আজ দুর্যোগের দিন। মনখারাপ করা বিকালে হাঁটতে থাকে একাকী আকাশ। সাতপাঁচ ভাবতে থাকে। ঝিরঝিরে বৃষ্টি কিছুটা কমেছে। সবুজ কচিপাতায় ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি বিকালের রোদে মুক্তোর মতো ঝলমল করছে। পাহাড়ের সামনের ঢালে বৌদ্ধ মন্দিরে সান্ধ্য আরাধনার প্রস্তুতি চলছে। ঘন ধুপিগাছের সরলবর্গীয় কাণ্ডের ফাঁক দিয়ে অস্তগামী সূর্যের রশ্মি ঠিকরে পড়ছে চোখে মুখে। আরও কিছুটা পাহাড়ি রাস্তা পার হলেই হেয়ার পিন বেন্ড পথ। তামাটে বিকালের রং চোখে মুখে।

দুর্যোগ কিছুটা কমল মনে হচ্ছে। বাঁকটার কাছে আসতেই কিছুক্ষণ থমকে দাঁড়াল আকাশ। এই পথ যা স্মৃতির সরণি বেয়ে উঠে গিয়েছে শর্বরী পার্কে। বেশ কিছুটা ছায়া-সুনিবিড়, সমতল সবুজ ঘাসের মখমলে ঢাকা। দেখা যায় তুষারধবল কাঞ্চনজঙঘার মোহনীয় রূপ। কিছুটা পরিচ্ছন্ন আবহাওয়া। রামধনু আকাশ ছুঁয়ে পাহাড়ের উপত্যকায় যেন জিরিয়ে নিচ্ছে। আকশের নীচে সবুজ উপত্যকা যেন সাতরঙের পেখম মেলেছে।

যেদিন শীতের ছুটি পড়ল সেদিন চুটিয়ে আড্ডা দিয়েছিল আকাশ মেঘলা এইখানে। সেইসব স্মৃতি উসকে দিচ্ছে। প্রায় দিন কলেজ শেষে এই পার্কে বসত। একটা ভিউ পয়েন্ট। পরিচ্ছন্ন আবহাওয়ায় মেঘেদের লুটোপুটি উপত্যকার বুকজুড়ে। দেখতে দেখতে কত সময় কেটে গেছে তাদের।

কখনও মেঘের দল এসে আকাশ-মেঘলাকে ঢেকে দিয়েছে। কিছুক্ষণের জন্য হারিয়ে গিয়েও খুঁজে পেয়েছে। হারিয়ে খুঁজে পাওয়ার একটা আনন্দ আছে বইকি! গভীর খাদটা যখন ভরে যেত মেঘে মেঘে তখন মনে হতো মেঘের সাগর। বিকালের ফুরফুরে হওয়ায় একটা ফুরফুরে মেজাজ। মেঘার এলোচুল কপালে চোখে মুখে উড়তে থাকত। আর ছোটো সাদা ধবধবে হাত দুটো দিয়ে নিমেষে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করত মেঘলা। একটা দূরত্ব রেখে বসত দুজনেই।

লাল টুকটুকে ঠোঁটের ওঠানামায় আর চোখে কী দারুণ একটা মাদকতা ছিল মেঘলার। দূর থেকে দেখত কীভাবে মেঘেরা ঘনিষ্ঠ হয়ে বৃষ্টি হয়ে ঝরছে। আবার পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে আকাশ। দেশলাই-বাক্সের মতো পাহাড়ি গাঁয়ের বসতি দেখা যায়। আর যে-পাথরটায় রোজ বসে গল্প করত সেই পাথরটাও খুব আপন হয়ে গিয়েছিল। দিনের শেষে বাগিচার শ্রমিকরা পিঠের ওপর দুধের শিশু নিয়ে ঘরে ফিরত। একটা সর্পিল পথ এই পাহাড়ের বাঁকটা ছুঁয়ে বেশ কিছুটা নীচে অন্য উপত্যকায় নেমে গিয়েছে। এই পথের নিয়মিত পথচারীরাও তাদের চিনে ফেলেছিল।

লেখাপড়ার গল্প আর বিভিন্ন সামাজিক সমস্যা নিয়ে বেশি আলোচনা চলত। চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলতে পারত না কেউই। ভাসা ভাসা কথার ভাঁজে লুকিয়ে থাকত নির্ভেজাল মনের গল্প। রাতের বিছানায় স্মৃতি রোমন্থনে দুটো মন সময়ের বয়সে ঘনিষ্ঠ হয়ে গিয়েছে।

খুব দারিদ্রের মধ্যে বেড়ে ওঠা মেঘলার। মনোময় স্যার না থাকলে এই নামি কলেজটায় আসতেই পারত না। আকাশ প্রথম দিন কিছু কথা শুনেছিল মনোময়বাবুর কাছে।

এই সেই পাহাড়ি বাঁক, যেখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গল্প করতে করতে জীবনের প্রায় সব কথাই বলেছিল মেঘলা। আকশের মনে পড়ছে এখন সে সব কথাকাহিনি। মেঘলা সেদিন বলেছিল, ছোটো বোন চন্দ্রিমার কথা। বাবার কথা মনে করতে পারি না। মেঘলার মা সীমা জ্যোৎস্না রাতে ফুটফুটে আকাশের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে শুনিয়েছে হারিয়ে যাওয়া পিতার গল্প। সেসব কথাও বলেছে মেঘলা আকাশকে একটু একটু করে। মায়ের কাছে শুনেছে, বাবা সইফুদ্দিন আকাশে তারা হয়ে জ্বলছে। পরে তারা দেখতে দেখতে যখন বড়ো হয়েছে সব বুঝেছে।

মেঘালয় রাজ্যের ডাউকি নদী সীমান্তঘেঁষা বাংলাদেশের সিলেট লাগোয়া অঞ্চলে বিক্ষিপ্ত কিছু খাসি জনজাতির বাস। আর পাহাড়ের কোলে ছবির মতো ছোটো গাঁয়ে বসবাস করত মেঘলাদের আদি খাসি পরিবার। সইফুদ্দিন সিলেটের বাসিন্দা। পুরুষানুক্রম থেকে চলে আসা ওদের মৎস্যশিকার আর জমিতে কৃষিকাজ-ই ছিল জীবিকা। পরিবহণ ব্যাবসার সঙ্গে যুক্ত ছিল সইফুদ্দিন।

নৌকা নিয়ে প্রায় দিন ডাউকি নদীর জল ভেঙে মাছ ধরত! কখনও পর্যটকদের মনোরঞ্জন করতে নৗকাবিহার করাত। কিছুটা পর্যটনের সঙ্গেই যুক্ত ছিল। ভালোই আয় হতো। আসা যাওয়ার পথে এই পাহাড়ি বসতির মানুষজন তার মুখচেনা হয়ে যায়। প্রথমে পরিচয়, মন দেওয়া নেওয়া তারপর বৈবাহিক সম্পর্কে আবদ্ধ হয়! সীমা সফি বলে ডাকত। সফির বাবা মা পরিবার তা মেনে নেয়নি। ঘর থেকে পালিয়ে সীমার বন্ধনে আবদ্ধ হয় সফি।

খাসি পাহাড়ের পাদদেশে সুখের সংসার পেতেছিল সীমা-সফি। সইফুদ্দিন চোস্ত খাসি ভাষায় কথা বলতে পারত। বিয়ের পর দায়িত্ব বেড়ে যায় সফির। পরবর্তীতে পর্যটকদের সঙ্গী করে নৌকাবিহার পর্যটন ব্যবসায় যুক্ত হয়। তার নৗকাটাও বেশ সাজানো। নৌকার গায়ে আঁকা থাকত নদী, বিভিন্ন মাছের ছবি। ডাউকি বাজারলাগোয়া ডাউকি নদীর ঘাট পর্যটন মরশুমে পর্যটকদের ভিড়ে ঠাসা থাকত। নিশ্বাস ফেলার সময় হতো না সফির। নদীর স্বচ্ছ জলে নৌকা বিহার এখানে খুব জনপ্রিয়। আবার অফসিজনে কখনও মালবাহী ছোটো গাড়ি নিয়ে শিলং চেরাপুঞ্জি রওনা দিত। প্রায় দিন পাহাড়ি পথে সন্ধ্যা নামার আগেই ঘরে ফিরত।

সীমা ভুট্টা খেতে ভালোবাসত। সারাদিন স্টিয়ারিং ধরে ক্লান্ত অবসন্ন শ্রান্ত শরীর এলিয়ে দিত সীমার কোলে। সন্ধ্যায় ওরা দুজনে ডাউকির তীরে ভুট্টা খেতে খেতে গল্প করত। ডাউকি নদী যেন সীমা সফির কাছে ভালোবাসার পূণ্যতোয়া। রামধনু রঙে মাখামাখি জলে হরেক রকমের মাছের ছোটাছুটি দেখতে দেখতে বাসায় ফিরে যেত। এ ছিল তাদের রোজকার রুটিন।

মেঘলার মা সীমা সেই স্মৃতিচারণ করতে করতে প্রিয় সফিকে খুঁজে পেত। স্মৃতির চাতালে আজও দপদপ করে সেইসব দিনের কথা। মায়ের কাছে শুনেছে মেঘলা– তখনও সন্ধ্যা নামেনি, হঠাৎ একটা ঝাঁকুনি। নিমেষে থরথর করে কেঁপে ওঠে পাহাড়, যেন নৃত্য করছে। ডাউকির মাছরাঙা জল, উথলে উঠছে আকাশ ছোঁবে বলে। এমন একটা ধবংসলীলার চলচ্চিত্র সেদিন স্বচক্ষে দেখেছিল মা।

বাবা গাড়ি নিয়ে চেরাপুঞ্জির রাস্তায় ছিল সেদিন। শুনেছি বহু মানুষ সেই ভূমিকম্পে মারা গিয়েছিল। তারপর চোখ ছলছল হয়ে আসে মেঘলার। কিছুটা সামলে আবার বলতে থাকে– সেই সন্ধ্যায় আর ফেরা হয়নি সফির। আসলে সেই সময়টায় কে কোন দিকে গিয়েছে জানা যায়নি। আত্মীয়স্বজন অনেকেই খবর নিয়েছে কিন্তু খোঁজ মেলেনি বাবার। মেঘলা বলে, মায়ের কাছে শুনেছে বীভৎস সেই রাতের কথা।

সবুজ শৈলশিরাটা যেখানে শিকলের মতো নদীর স্রোত ছুঁয়েছে সেই ঢালে বিক্ষিপ্ত জনবসতি সেখানেই দু-কামরার সীমা-সফির সাধের ছোটো সাংসার। কুটির বলাই ভালো। নদীর কাছে কিছুটা সমতল জায়গায় কয়েকজন মিলে তাড়াহুড়ো করে বার হয়ে আসে তাই বেঁচে যায়। বহু ছবির মতো পাহাড়ি বসতি এলোমেলো হয়ে গিয়েছিল। তারপর সরকারি ব্যবস্থাপনায় ত্রাণশিবিরে আশ্রয়।

তখন মা সন্তানসম্ভবা। একটি ত্রাণশিবিরে প্রথম প্রসব! সেদিন ছিল মেঘলা আকাশ। ঝিরঝিরে বৃষ্টি। যদিও বৃষ্টি-মেঘের খেলা নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। সীমা যমজ কন্যাসন্তানের জন্ম দেয়। ত্রাণশিবিরের সকলে নাম রেখেছিল মেঘলা, চন্দ্রিমা।

এরপর ডাউকি নদী দিয়ে বহু জল গড়িয়ে গিয়েছে। সীমান্তঘেঁষা উত্তর-পূর্বের মেঘালয় রাজ্যের পশ্চিম জয়ন্তিয়া পাহাড়ে অবস্থিত ডাউকি নদীর সীমান্তঘেঁষে মেঘার পাহাড়ি গ্রাম। ঢিলছোড়া দূরত্বে বাংলাদেশের সিলেট শহর। খাসি ভাষা একটি অস্ট্রো-এশীয় ভাষা যা মূলত ভারতের মেঘালয় রাজ্যে প্রচলিত।

ত্রাণ শিবিরের পর কোনওরকম একটা তাঁবুর মতো ছেঁড়া প্লাস্টিকের ছাউনিতে ঠাঁই হয়। কিংবা বর্ষার দিন প্রাইমারি স্কুলের বারান্দায় ঠাঁই নিত। মেঘালয়ের ব্যবচ্ছিন্ন মালভূমির মতো বিচ্ছিন্ন ছিন্নমূল দরিদ্র পরিবার। খাসি রমণী সীমা পরিশ্রমী। দুই কন্যাসন্তানকে শিক্ষায় আচার-আচরণে উন্নত করেছে সে। মায়ের স্থানীয় হোটেলে রান্নার কাজ নেওয়া, কখনও-বা ডাউকি নদীর ঘাটের কাছে ছোটো দোকান দিয়ে রোজগারের ব্যবস্থা করা। এসব জীবনযন্ত্রণার কথা দিনের পর দিন বলেছে মেঘলা আকাশকে।

ডাউকি নদীর বর্ডার প্রসিদ্ধ প্রাকৃতিক পর্যটন। নদীর মনোলোভা সৗন্দর্য চুম্বকের মতো আকর্ষণ করে পর্যটকদের। এরকম মনোরম পরিবেশে বেড়ে ওঠা মেঘলার।

ছোট্ট বয়সে বিয়ে হয়ে যায় চন্দ্রিমার। ভীষণ জেদ ছিল মেঘলার। বড়ো হবার জেদ। দেশ-বিদেশের বিভিন্ন পর্যটকদের খুব কাছ থেকে দেখেছে নদীতে নৗকা বিহার করতে। মায়ের সঙ্গে ডাউকি নদীর ধারে দোকানদারি করেছে সে। স্কুল পড়াশোনা, পাহাড়ের ঢালে জ্বালানি সংগ্রহ এই ছিল রোজকার রুটিন। শুকনো কাঠের জ্বালানি সংগ্রহ করতে গিয়ে কতবার কাঁটাঝোপে দুই বোনের আপেলের মতো গাল চিরে রক্ত ঝরেছে। সেই রক্ত রোদে জলে ধুয়ে গিয়েছে। খেয়ালই নেই মেঘলা, চন্দ্রিমার। ডাউকি নদীর আয়নার মতো জলে যখন সূর্যাস্ত হতো সিঁদুর মেঘের প্রতিচ্ছবি দেখা যেত, তারপর ক্রমশ ঘন রাত আঁকড়ে ধরত ডাউকির এই পাহাড়ি গ্রামকে।

ডাউকির জনপথলাগোয়া ফুটপাথেই ছিল সীমা-মেঘলা-চন্দ্রিমার বাস। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াশোনা। তারপর হাইস্কুল উচ্চমাধ্যমিক স্তর পার করেছে চরম দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে বুঁদ হয়ে থাকত মেঘলা। দূর পাহাড়ের চূড়া থেকে সমতলে সিলেট শহরের রূপ দেখতে কখন সে আনমনা হয়ে পড়ত।

খাসি ভাষার কবি সো সো থামের কবিতা পড়তে ভালোবাসত মেঘলা। খাসি ও জয়ন্তিয়া পাহাড়ে এই প্রাচীনতম জনজাতির বাস। প্রকৃতি, প্রেম, কল্পনা, মননশীলতায় ভরপুর সো সো থামের খাসি কবিতার পুস্তকটি ইতিমধ্যে পড়ে ফেলেছে মেঘলা। এমন সুন্দরী সবুজ উপত্যকায় বসে দেখেছে পাহাড়ি ঝরনা আর সূর্যমেঘের লুকোচুরি। পিতৃহারা মেঘলা-চন্দ্রিমা দেখেছে তাদের মায়ের কঠোর শ্রম।

কল্পনা, প্রকৃতি আর বাস্তবতা এসব নিয়ে তাদের ছোটো সংসার।নংক্রেম নৃত্যও অতি প্রসিদ্ধ খাসি উৎসব। লোক নাচে বেশ দক্ষ ছিল মেঘলা চন্দ্রিমা। পুরোনা অ্যালবাম ঘেঁটে কয়েকটা স্কুলজীবনের নাচগানের ছবিও দেখিয়েছে। চন্দ্রিমা ভালো গান গাইত। জয়ন্তিয়া পাহাড়ের উপজাতীয়দের পার্বণ বেহদিয়েংখ্লাম পালিত হয় প্রতি বছর জুলাই মাসে। গারোরা পালন করেন ওয়াংগালা উৎসব যা আদতে সূর্যের উপাসনা। এসব কথা শুনতে শুনতে সন্ধ্যা নেমেছে পাহাড়ের পাকদণ্ডি পথে। এক নিঃশ্বাসে অনেক কথা বলত মেঘলা। দার্জিলিং পাহাড়ের সিঙ্গালিলা শৈলশিরায় বসে কলেজপড়ুয়া আকাশ জয়ন্তিয়া পাহাড়ের মেঘলার কথা শুনেছে।

‘প্রাইমারি স্কুল, হাইস্কুল, মাধ্যামিক, উচ্চমাধ্যমিক পাশ করে বেশ কিছুদিন বাড়িতেই বসেছিলাম। কয়েকজন প্রতিবেশীর বাচ্চাদের টিউশন পড়াতাম।’ আকাশকে তাদের পরিবারের অনেক কথাই বলেছে মেঘলা। ‘জানো, স্যার আসত প্রায় খোঁজখবর নিতে। বোনের খুব ছোটোতে বিয়ে হয়ে যায়। পরির মতো টুকটুকে সুন্দরী বোন। ঘটকের পাল্লায় পড়ে আমারও বিয়ের সম্বন্ধ এসেছিল বহুবার। কিন্তু রাজি হইনি। বাড়ির কোণে ফুঁপিয়ে কেঁদেছি। পরে একদিন স্যার কে সব কথা বললাম। আমি শুধু পড়তে চাই।

স্যার আমাদের ক্লাসে বলতেন, ‘মেয়েদের পড়তে হবে। নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে।’ সে অনেক কথা– বলতে বলতে চোখ ছলছল হয়ে আসে মেঘলার। মনোময় স্যার প্রবাসী বাঙালি। শিলং শহরে তাদের বাস। প্রাচীন বাঙালি পরিবার। অবিভক্ত দেশের এই পাহাড়ি স্কুলটা ডাউকি সীমান্তে অবস্থিত। মনোময় স্যার এই স্কুলের একজন শিক্ষক। তাঁর উদ্যোগে মেঘলার এতটা পথ আসা। মেঘলা বলেছিল, সে পড়তে চায়! বড়ো হতে চায়। এদিকে মনোময় স্যার অবসর নেন যে-বছর, সেই বছরই উচ্চ মাধ্যমিক পাস করে মেঘলা।

মাধ্যমিক পাস করবার পর থেকে অভাবী ঘরের মেধাবী ছাত্রী সকলের নজর কাড়ে। মনোময় মেঘলাকে স্নেহ করতেন। তিনি দুঃস্থ অসহায় পরিবারকে সব রকম সহযোগিতা করতেন। মনোময়বাবুর সহযোগিতা নিয়ে দার্জিলিঙে ভূগোল পড়তে আসা মেঘলার। সব কথাই আকাশকে বলেছিল মেঘলা দার্জিলিঙের শর্বরী পার্কের নির্জনতাকে সাক্ষী রেখে। কোনওদিন সন্ধ্যা গড়িয়ে গাঢ় অন্ধকার নামত পাহাড়ে।

ভোঁ ভোঁ শব্দে মেঘের চাদর ফুঁড়ে ফিরতি জিপগাড়িগুলো পাকদণ্ডি পথে হর্ন বাজিয়ে চলছে। সার্চলাইটের মতো গাড়ির হেডলাইট মেঘার কখনওবা আকাশের চোখে মুখে পড়ছে। প্রায় ঘণ্টাখানেক আড্ডা দিয়ে ফিরে যেত আপন আপন মেসে। একদিন তো ফিরতে বেশ দেরি হয়ে গিয়েছিল। এসব থরেথরে সাজানো স্মৃতি কথাগুলো মনে করতে করতে আজ মেসে ফিরল একলা আকাশ। সঙ্গে মেঘলা নেই । কিন্তু মেঘলার স্মৃতি রোমন্থন করতে করতে কখনও পথে থমকে দাঁড়িয়েছে। আবার হাঁটা শুরু।

মূল সড়ক থেকে কিছুটা এবড়োখেবড়ো পথ নেমে গিয়েছে হ্যাপিভ্যালি চা বাগানের দিকে। এখন বৃষ্টি নেই। পরিচ্ছন্ন মেঘমুক্ত আকাশ। কয়েকটা ধাপ পা ফেলে ফেলে উঠলেই বারান্দা তার পর গভীর খাদ। ভেজানো দরজা খুলে লাইটের সুইচে হাত দিতেই আলোকিত হল ঘর। লাইট জ্বালিয়ে লেপটা বিছানায় বিছিয়ে দেয়। কারণ রাতের দিকে সব কিছু হিমশীতল হয়ে যায়।

সেই সকালে নীচের ঝরনা থেকে সংগৃহীত পানীয় জল বালতিতে কতটুকু রয়েছে দেখে নেয়। এর পর রান্নার তোড়জোড়। ডিম আলু ডাল একসঙ্গে সেদ্ধ করে নেওয়া। খিদে পেটে সব কিছুর স্বাদ অমৃত। রাত আটটার পর সব নিঝুম। তারার মতো দূর পাহাড়ের গায়ে গায়ে জ্বলজ্বল করে আলো। টগবগ করে ফুটছে ভাতের হাঁড়ির জল। কাঠের ছোটো ঘরের ফাঁকে খবরের কাগজ সাঁটানো।

শীতের রাতে গুনগুন করে গাইতে থাকে নেপালি গান, হিজো রাতি কিনো? কিনো? নিদ্রা লাগিনো, কসতো মায়া… কসতো মায়া… গানের কলি। ডেকচি উপচে ভাতের ফ্যানা পড়ছে।

ডালে-চালে আর আলু সেদ্ধ পেঁয়াজ লংকার তরিবতের খানা রেডি। কিছুক্ষণ সব ভুলে কলেজের পড়াসংক্রান্ত কাজ।

আকাশ রাতের খাওয়া-দাওয়া সেরে এখন ব্যালকনিতে। নিঝুম রাতের নিস্তব্ধতা ভাঙে পাহাড়ি কুকুরের ঘেউ ঘেউ ডাকে। এই সময়টা সে তার পড়া আর ভাবনাগুলোকে এক সূত্রে গাঁথে। আরও কয়েকটা মাস কাটাতে হবে পাহাড়ি শহরে। মনের মানুষের সান্নিধ্য বঞ্চিত হয়ে থাকতে হবে।

পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন শেষ করে নদী বিষয়ে গবেষণার বড়ো ইচ্ছা আকাশের। সব ইচ্ছা তো আর পূরণ হয় না। এসব এলোমেলো ইচ্ছের কথাও বলে ছিল আকাশ মেঘলাকে। বলেছিল, ডুয়ার্সের ছবির মতো তার গ্রামের কথাও! কখন যে মেঘালায়ের ডাউকি আর আকাশের রায়ডাক মিলেমিশে একাকার হয়েছে মনের মোহনায়, হয়তো টের পায়নি কেউ। বন্ধুত্ব থেকে ভালোলাগা ভালোবসায় রূপান্তরিত হয়েছে সময়ে সময়ে। দিনের পর দিন ভালোবাসা ঘন হয়েছে।

আসলে এই তো সেদিন ডুয়ার্সের ভূটান সীমান্ত গাঁ থেকে আকাশ এই পাহাড়ি শহরে এসেছিল অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে। পাহাড়ে খরচ বেশি। কিন্তু ভূগোল বিষয়ে সব কলেজে তখন পড়ার সুযোগ ছিল না। জমি বিক্রি করে টাকা জোগাড়! মাসে মাসে আবার খরচ আছে। আকাশদের একান্নবর্তী পরিবার। বাবা বিমল রায় একজন কৃষিজীবী।

আকাশের বাবারা ছিল তিন ভাই। বাকিরা সকলেই ব্যাবসাবাণিজ্য সরকারি চাকরি নিয়ে থাকত। ডুয়ার্সের কুমারগ্রাম ব্লকের খোঁয়াড়ডাঙা এলাকার নারারথলি গ্রামের এটাই সব চেয়ে বড়ো পরিবার। আকাশের বাবা খেতি কাজের পাশাপাশি ভেষজ চিকিৎসার মাধ্যমে ভাঙা হাড় জোড়া লাগানোর কাজও বেশ সফলতার সঙ্গে করেন।

স্থানীয় জঙ্গলের বিভিন্ন লতাগুল্ম দিয়ে হাড়গোড় জোড়া লাগাতেন আকাশের বাবা। ভোর থেকে লেগে থাকত ঘরময় রোগীর ভিড়। আকাশকে বড়ো মানুষ করে গড়ে তোলবার ইচ্ছা। সাত-পাঁচ করেই দার্জিলিং পাহাড়ের কলেজে ভর্তির বন্দোবস্ত করেছেন। আসলে, আকাশের দাদু হাড়ভাঙা ডাক্তার নামে এই সীমান্ত লাগায়ো আসাম-ভূটান স্ললাকায় বেশ পরিচিত ছিলেন।

কলেজ ছুটির ফাঁকে পাহাড় থেকে নেমে পড়ত আকাশ। জীবনের গতি এখানে যেন ধীর। আলিপুরদুয়ার ছুঁয়ে জাতীয় সড়কটা অসমের দিকে গিয়েছে। আর তেলিপাড়া থেকেই বাঁ দিকে পিচ ঢালা এক ফালি রাস্তা ছুটছে খোঁয়াড়ডাঙা অভিমুখে! যা ভূটানের গা-ছমছম গভীর জঙ্গলে ঢুকেছে। রাস্তার দু-ধারে ছায়াসুনিবিড় গাছ গাছালি। চরম গ্রীষ্মে যখন হাঁসফাঁস করে মানুষ তখন রোদের তীব্রতাকে এই পথছায়া গোগ্রাসে গিলে খায়। আর শরীরে এক মনোরম শীতল অনুভূতি জেগে উঠে। এমন একটা রূপকথার গাঁয়ে যাওয়ার প্রবল ইচ্ছে মনে মনে দানা বাঁধত মেঘলার।

আকাশের গ্রামের ঢিলছোঁড়া দূরত্বে ভূটান। জমজমাট গ্রামীণ বাজার। হাটের দিনগুলোতে উপচে পড়ে মানুষের ভিড়। শনি ও মঙ্গলবার হাট বসে। আকাশ যখন ছোটো ছিল বাবার সঙ্গে ঘরের মুরগি ও মরশুমের সবজি নিয়ে হাটে বসত। স্থানীয় নদ-নদীর তাজা নদীয়ালি মাছ যেমন পাওয়া যায় তেমনি ঘরের পোষা মুরগি হাঁস নিয়েও হাটুরেরা হাজির হয়। বিভিন্ন জনজাতীর মনপছন্দ খাদ্যতালিকা অনুযায়ী রকমারি সব কিছু হাটে মিলবে।

এখানকার গ্রামীণ হাটগুলো মেলার রূপ নেয়। এলাকাটি যেন মিনি ভারতবর্ষ। বিভিন্ন জাতি উপজাতি ধর্মের আর সংস্কৃতির মিলনক্ষেত্র। সহজসরল জীবনযাপন আর অফুরন্ত প্রাণ প্রাচুর্যে ভরপুর মানুষজন। ভাষা পোশাক ধর্ম আচার ভিন্ন হলেও কোথায় যেন একটা ঐক্যের সুর বাঁধা আছে। কৃষিপ্রধান এলাকা। রয়েছে বন বস্তি। আধুনিকতার ছোঁয়ায় ঘরবাড়ি পোশাকেও ছাপ পড়েছে। সব কথা মেঘলাকে শুনিয়েছে আকাশ। সকলকে আপন করে নেওয়ার কি অসাধারণ জাদু আছে আকাশের!

কলেজ জীবন শেষ করে এবার ঘরে ফেরা। তাঁর প্রিয় অধ্যাপকের পরামর্শ মতো নদী বিষয়ে গবেষণা শুরু করবে। ছোটো থেকেই নদীকে সঙ্গী করে জীবন। খুব কাছ থেকে দেখেছে কীভাবে ভূটান থেকে নেমে আসছে বিভিন্ন নদনদী! সংকোষ, রায়ডাকের মতো আন্তর্জাতিক নদী যেমন রয়েছে, তেমনি ঘোড়ামারা, জোড়াই, কুলকুলি প্রভৃতি নদী শিরা উপশিরার মতো ছড়িয়ে রয়েছে। অতি বর্ষণে বন্যা এই এলাকার স্থায়ী সঙ্গী। ভূটান পাহাড়ের অবৈজ্ঞানিকভাবে ডোলোমাইট উত্তোলন একটা কারণ। এই অঞ্চলের ঢাল দক্ষিণ-পূর্ব দিকে।

আকাশ দেখেছে নদীগুলোর পূর্ব দিকের পাড় ভাঙার প্রবণতা। হঠাৎ করে পাহাড় থেকে সমতলে নেমে আসায় নদীর গতিবেগ কমে যায়। নদী পাথরনুড়িতে বোঝাই হয়ে থাকে। ফলত বন্যার কবলে পড়ে এলাকা। এখান থেকে যেদিকে চোখ যায় শুধু সবুজ আর সবুজ। নদীমাতৃক বাংলার রূপসী রুপ যেন এখানে উপচে পড়ছে। এলোকেশী-নারী যেন ভরা বর্ষায় ফুঁপিয়ে কাঁদে। ভীষণ গর্জন করে ভাসিয়ে দেয় গ্রাম। শীতের মরশুমে শুধু শোনা যায় নদীর কুলুকুলু শব্দ আর নিস্তব্ধতা ভাঙে কোকিলের কুহু কুহু ডাকে।

বনবস্তির চরে বেড়ানো গরু-ছাগলের গলায় ঝুলানো টিনের তৈরি ঘণ্টা জানান দিচ্ছে তাদের অস্তিত্ব। নদী যেন একা নীরবে শুয়ে থাকে। এমন এক অনাবিল প্রাকৃতিক পরিবেশে বেড়ে ওঠা আকাশের। নদী পাহাড় তাকে আজও চুম্বকের মতো টানে।

শীতের ছুটির পর আর ফেরা হয়নি মেঘলার। ফিরবে কি করে! ফেরার দিন ঘটে গেল অঘটন। প্রতিদিন শিলং-গৗহাটি মেল নামে দুধসাদা বাসটা সাতসকালে হর্ন বাজিয়ে ডাউকি বাজার থেকে ছাড়ে। আর তখনই মেঘলাদের পুরোনো ঘড়িটা পেন্ডুলাম দোলাতে দোলাতে পাখির কিচিরমিচির আওয়াজ করে ঘড়ির কাঁটা মিলে যায় সাতের ঘরে।

সকাল সাতটা বাজে। এই সাত-পুরোনো ঘড়িটার একটা ইতিহাস আছে। মেঘলার বাবা সইফুদ্দিন বাংলাদেশ থেকে যখন চলে আসে তখন সীমাকে উপহার দিয়েছিল। সীমা দেওয়াল ঘড়িটা আগলে থাকে।

আজ মেঘলার দর্জিলিং ফেরার দিন। কিন্তু মা সীমার ঘুম ভাঙেনি। চলে গিয়েছে ঘুমের দেশে। হার্টের পেশেন্ট। শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছে। শোকের ছায়া ঘরজুড়ে! মাস্টারমশায় মনোময়বাবুর কাছে খবর যায়। মেঘলার বুকে তখন একটা নোনা বঙ্গোপসাগর তৈরি হয়েছে। ঘড়িটার দিকে নিঃষ্পলক তাকিয়ে থাকে মেঘলা।

কিছুদিন মনোময়বাবুর ঘরে থাকে। পরে একটি বেসরকারি স্কুলে শিক্ষকতার সঙ্গে যুক্ত হয়। আকাশকে সেসব কথা জানিয়ে চিঠিও লিখে রেখেছিল। কিন্তু চিঠিটা ফেলা হয়নি ডাকবক্সে! কচিকাঁচা ছাত্র-ছাত্রীদের সঙ্গে কেটে যাচ্ছে দিনগুলো। প্রতিদিন সাতসকালে রাস্তায় পথ চলতি গাড়ি ধরে স্কুলে যায় মেঘলা। দুষ্টু-মিষ্টি শিক্ষার্থীরা তার বেঁচে থাকার রসদ। মনে মনে ভাবে জীবনটা যেন একটা অসম্পূর্ণ সনদ।

এদিকে দার্জিলিঙের পাট চুকিয়ে অব্যক্ত যন্ত্রণা বুকে নিয়ে ঘরে ফিরেছে আকাশ। ফিরেই সংবাদ পেল আকাশ গবেষণার জন্য নির্বাচিত হয়েছে। কৃষকের ছেলের এমন সাফল্যে গোটা গ্রামে উৎসবের মেজাজ। উত্তর-পূর্ব ভারতের এক বিশ্ববিদ্যালয়ে লেকচারারশিপ ও নদী বিষয়ে গবেষণার জন্য নির্বাচিত হয়েছে। গবেষণার কাজ শুরু করতে রওনা দিল আকাশ।

ডুয়ার্সের গা ঘেঁষেই অসম। গুয়াহাটি হয়ে সেদিন শিলং পৌঁছোল আকাশ। আবার একটা মেসের মতো কোয়ার্টারে থাকবার ব্যবস্থা। উত্তর-পূর্ব ভারতের নদনদী চরিত্র ও নদী অধ্যুষিত অঞ্চলের মানুষের জীবনযাত্রা সম্পর্কিত টাটকা তথ্য সংগ্রহ করতে পাহাড়ি রাজ্য চষে ফেলেছে আকাশ। যখন কাজ শেষে রুমে ফেরে মেঘার কথা মনে পড়ে।

যাইহোক যদি পথে দেখা হয় কোনওদিন কি বলবে মেঘলাকে! কখনও রাগ অভিমানে গাল ফুলে যায়। আবার গবেষণার কাজে ডুবে যায় আকাশ। ভোলার চেষ্টা করে সব কথা। এবার ডাউকি নদী সীমান্তে যাবে। মেঘালয় মালভূমি থেকে আগত একটি পাহাড়ি নদী। ডাউকি চ্যুতির নাম অনুসারে নদীটির নাম ডাউকি। জল স্বচ্ছ কাচের মতো নান্দনিক সৗন্দর্যের যেন লীলাভূমি।

আকাশের গা ছমছম করে। সবে ডাউকি ব্রিজটা পার হয়ে গাড়িটা থামল। হকারের কাছে পায়ে পায়ে এগিয়ে একটু কফি কাপে চুমুক। শিলং থেকে যখন গাড়িটা ছাড়ে তখনই বৃষ্টি শুরু। আজ সকাল থেকে খুব মেঘলা। ডাউকি ঢোকার মুখে ব্রিজ। মনে পড়ছে মেঘলার কথা। ডাউকি মেঘলা মেঘালয় যেন অজান্তেই তার নিজের হয়ে গিয়েছে। শরীরটা যেন হিমশীতল হয়ে আসে!

গাড়িটা স্টার্ট দিতে আবার ঝমঝম শিলা বৃষ্টি। বৃষ্টির ফোঁটায় নদীর জলে বুদবুদ উঠছে। হু হু করে পাহাড়ি ঝরনা মূল সড়কে ধুয়ে খাদে পড়ছে বীভৎস গর্জন করতে করতে। অগত্যা গাড়ি থামাল চালক! মেইন রোডের পাশে একটা বেসরকারি স্কুল। নাম রিভার পয়েন্ট নার্সারি। এখানে কিছুক্ষণ বিরতি। মেঘে ঢাকা আকাশ। দিনের বেলায় যেন অন্ধকার নেমে আসছে।

গাড়ির জানলার কাচটা খুলতেই আকাশ দেখে বেশ চমকে গেল, পরির মতো অপ্সরা একজন মহিলা মেঘেঢাকা পাহাড়ের সর্পিল পথ বেয়ে নেমে আসছে। লুকস লাইক আ ফাউন্টেন, হয়তো মূল সড়কে উঠবে! হাত নেড়ে গাড়িটাকে ইশারায় অপেক্ষা করতে বলছে। যদিও আকাশদের গাড়িটা এমনি অতিবৃষ্টির দরুন দাঁড়িয়ে আছে। আকাশ কিছুটা হতোভম্ব হয়ে গাড়ির গেটটা খুলে দিল। সটান গেটে ছোটো হাতটা চেপে গাড়িতে উঠে পড়ল মহিলা।

খুব চেনা খুব জানা। কিন্তু দুজনেই নির্বাক। তখন আবার মেঘেঢাকা আকাশের বুক চিরে বিদ্যুতের রক্তিম আভায় টুকটুকে গাল দুটো স্মৃতির আলোর ঝরনাধারা। চোখের তারায় তারায় আনন্দ অশ্রুর প্লাবন।

জীবনের গাড়িটা হয়তো ছুটল পাহাড়ের পাকদণ্ডি পথ পেরিয়ে আলোর ঠিকানায়।

পড়ার জন্য সীমাহীন গল্প-নিবন্ধসাবস্ক্রাইব