চ্যাঁচানি পিসি

দালাল যেদিন আমায় ঘর দেখাতে নিয়ে যায়, সেই দিনই আমি চ্যাঁচানি পিসিকে দেখি। টাইমকল থেকে ছ্যারছ্যার করে জল পড়ছে। পাশে উবু হয়ে বসে তিনি বাসন মাজছেন। চটা উঠে যাওয়া সিমেন্টের চাতাল। একদিকে ডাঁই করা কাঠের ভাঙা তক্তা, প্লাস্টিকের বস্তা, মরচে ধরা আধখানা টিন, বইয়ের একগোছা ছেঁড়া পাতা, আরও কত কী। চাতালটার এখানে সেখানে ছিটিয়ে ছেতরে পড়ে রয়েছে পায়রার গু। দেখেই মন খারাপ হয়ে গিয়েছিল।

বাড়িটার বয়েস একশো বছর তো হবেই। যেখানে সেখানে পুলটিস মারা। দরজা দিয়ে ঢুকেই চোখেমুখে অন্ধকার জড়িয়ে যায়। সরু গলি। খানিকটা গিয়ে ডানহাতে সিঁড়ি। তার মুখে একটা বইয়ের দোকান। সেখানে আলো জ্বলছে। বাঁদিকের দোকানেও আলো। কিন্তু অন্ধকার এত বেশি যে মনে হয় যেন দোকানের ভেতরে মশারি খাটানো আছে। সেখানে আলো একেবারে জবুথবু অবস্থায় পড়ে আর বেরোনোর পথ পায়নি।

বাঁহাতি মোড় নিয়ে ডানদিকে ঘুরলেই ওই চাতাল। তার তিন কোণে তিনটে দোকান। বাসন মাজতে মাজতে পিসি চোখ তুলে আমাদের দিকে তাকিয়েছিলেন। ট্যারা চোখ। তার চেয়েও ধাক্বা লেগেছিল যেটা তা হল ওর পরনে একটা শুধু ফ্যাকাশে কামিজ। নীচে কিছু নেই। উবু হয়ে বসার ফলে কামিজের অনেকটা খসে গিয়ে রোগা পা দাবনা অব্দি দেখা যাচ্ছে। চোখ সরিয়ে নিতে নিতে খেয়াল হল একদম কিছু নেই তা নয়। একটা লাল রঙের ইজেরের খানিকটা উঁকি মারছে।

চাতালের পাশে সরু হাঁটাচলার জায়গাটা একটা খোলা কোলাপসিবল গেট টপকে আর একটা গলির রূপ ধারণ করেছে। আবার অন্ধকার। আরও একটা সিঁড়ি। কাঠের রেলিং ঘুরে ওপরে উঠেছে। এই ছোট গলিটা পেরিয়ে একফালি ফাঁকা জায়গা। সেখানে পাশাপাশি দুটো দোকানঘর। তার মধ্যে যেটা বন্ধ তার সামনে আমাকে ফেলে দালাল বলেছিল, দাঁড়ান, তালাটা খুলি।’

আমি বললাম, ‘এ কোথায় নিয়ে এলেন বলুন তো!’

সে ঘটাং ঘটাং করে ঠুকে তালা খুলে হড়হড় করে শাটার তুলতে তুলতে বলল, ‘বইপাড়ায় ঘর নিয়ে ব্যাবসা করতে গেলে ওসব ভাবলে চলবে? আপনার যা বাজেট তাতে এ যা দিচ্ছি, রাজা জিনিস বুঝলেন। যদি টিকে যেতে পারেন তাহলে এখান থেকেই মা লক্ষ্মী হাত ঝেড়ে দেবে। একটুকরো জায়গার জন্যে লোকে মাথা খুঁড়ছে। একবার নোঙর ফেলতে পারলেই হল। দোকানের ভেতরটা ভালো করে দেখুন। আশি স্কোয়ার ফুট। ফলস সিলিং করা আছে, ওপরে বই রাখতে পারবেন। সলিড একেবারে। ভাড়া কম, সেলামি কম, আর কী চাই?’

‘না আসলে এত ভেতরে তো, তাই।’

‘সামনে নিতে গেলে তো আপনার পড়তায় আসবে না দাদা। ফুটপাতের ধারের গুমটিগুলো দেখেছেন? পঞ্চাশ-ষাট স্কোয়ার ফুট– স্টাটিংই আছে সাত-আট লাখ থেকে। এখান থেকে লাগান না। কত এঁদো গলি থেকে বেরিয়ে রাজা-উজির হয়ে গেল সব। পঁচিশ বচ্ছর ধরে কলেজ স্ট্রিটে ব্রোকারি করছি। কম তো দেখলাম না।’

এদিকেও একটা সিঁড়ি আছে লাল সিমেন্টের। উঁচুতে তাকালাম। দোতলায় কতগুলো সাইনবোর্ড দেখা যাচ্ছে। তার মানে ওখানেও দোকান বা গোডাউন আছে। তিনতলার এদিকটায় জাল দিয়ে ঘেরা। বারান্দা হতে পারে। তার ওপরে আশি স্কোয়ার ফুটেরও কম মাপের আকাশ। দমচাপা লাগছিল সব মিলিয়ে। বললাম, ‘এখানে কি কোনও কাস্টমার আসবে? জায়গাটা যেন কেমন। ঢোকার মুখে আলো নেই, একজন কলতলায় বসে বাসন ধুচ্ছে–।’

দালাল এমন হাসল যেন আমি ছেলেমানুষি কথা বলছি। ‘ওঃ, চ্যাঁচানি পিসি? ওকে নিয়ে ভাববেন না। স্ক্রু ঢিলে আছে। ওই কলটা ওর। কলের পাশে যে-তিনটে দোকান– ওগুলো ওর ভাগে। যা ভাড়া পায় তাই দিয়ে চলে। বেশি পায় না যদিও। কবেকার ভাড়াটে সব। পিসি থাকে গলির ভেতরের দোতলায়। এ বাড়ির তিন শরিক। কারও সাথে কারও সম্পক্ব নেই। সামনের দিকেরগুলো যাদের তারা ওদিকেই তিনতলায় থাকে। এই বাড়িওলা থাকে এদিকের ওপরে। ঘর পছন্দ হলে বলুন, ডাইরেক্ট কথা বলিয়ে দিচ্ছি।’

ঘরটা নিয়ে নিয়েছিলাম। বাবার একটা বইয়ের দোকান ছিল। বইয়ের সঙ্গে লেখাপড়ার কাজে আসে এমন সব জিনিসও বিক্রি হতো। যেমন হয় আর কী। বয়েস হয়ে গিয়েছে, আর বসতে ভালো লাগছে না, এসব বলে বাবা আমাকে সেখানে ভিড়িয়ে দিল। সাত বছর ধরে আমি সেটাই চালিয়েছি। তবে এত ছোট ব্যাপারে মনটা আটকে থাকতে চাইছিল না। বই ঘাঁটতে আমার ভালো লাগে। ভাবলাম বই বানালে কেমন হয়। বছর দেড়েক হল নিজে একটা পাবলিকেশন খুলেছি। গল্প, উপন্যাস, ভ্রমণকাহিনি ছেপেছি, প্রবন্ধের বইও। কয়েকটা বইয়ের, কাগজে রিভিউ বেরোল। প্রকাশনার নাম জানল লোকে। কলেজ স্ট্রিট থেকে ফোনে অর্ডার হলে বই পৌঁছে দিতাম। ছোটদের বইয়ের কাটতি ভালো জেনে সেদিকেও যাব ভাবছিলাম। বাবাকে অনেক বলেকয়ে, বুঝিয়ে দোকানটা বিক্রি করে দিলাম। বাবার হাতে খানিকটা রেখে আমার হাতে কিছুটা পুঁজি এল। বিয়ে করেছি। ছেলে-বউ আছে। বউ একটা মন্টেসরি স্কুলে পড়ায়। আমার বেলায় পঁয়ত্রিশ পেরিয়ে পাল্লাটা ঝুঁকির দিকেই চলে গেল বেশি, কিন্তু তখনই ঠিক করেছিলাম এই ব্যাবসাটা কলেজ স্ট্রিটে বসেই করতে হবে। দালালের পিছন পিছন ঘুরে শেষে এই বাড়ি।

এখানে চ্যাঁচানি পিসির সঙ্গে আমার কথা হওয়ার কোনও দরকার ছিল না। দালাল বলেছিল ওকে নিয়ে ভাববেন না। কিন্তু না ভেবে রেহাই নেই। সত্যি বলতে কী ওকে দেখলেই হাত-পা চিড়বিড় করে। বারোটায় যখন দোকানে আসি তখন তিনি খাওয়াদাওয়া শেষ করে বাসন ধুচ্ছেন কলতলায়। বিকেল চারটেয় আবার জল আসে। পিসি থালা বাটি গেলাস হাঁড়ি কড়াই নিয়ে সেখানে হাজির। বাসন ধুচ্ছেন কলতলায়। শুধু বাসন নয়, নিজেকেও রগড়ে ধোবেন। একজন পঞ্চাশ-পঞ্চান্নর হাড়সর্বস্ব মহিলা সর্ব অঙ্গ ভিজিয়ে বইয়ের দোকানের মাঝখানের চাতালে বসে চান করছেন এ দৃশ্য যে কী শুকনো হতে পারে, তা টের পাই। যাওয়া আসার পথে দেখে মনে হয় আড়াল করে দাঁড়াই। কোনও খদ্দের যদি আসে এখন? কিংবা লেখক কেউ? লজ্জার একশেষ হবে। তখন ওরই ভাড়াটে এক দোকানদারের স্টাফ পাশ দিয়ে যেতে যেতে বলে যায়– ‘আহা মন্দাকিনী। রাজ কাপুর দেখে যেতে পেল না রে। রাম তেরি গঙ্গা মইলি হো গয়ি…।’

চ্যাঁচানি তো কারও নাম হতে পারে না। পিসির আসল নাম যে কী সেটা ওরই ভাড়াটে ডিএম পাবলিশার্সের মালিকের সঙ্গে একবার কথা বলতে গিয়ে জানলাম। বললেন, ‘ওর নাম লাবণি, লাবণি দত্ত। ভাড়ার রসিদে ওই নামেই সই করে। এখানকার ছেলেছোকরারা বলে চ্যাঁচানি পিসি। বলবে নাই বা কেন। অষ্টপ্রহর কিছু না কিছু নিয়ে চ্যাঁচাচ্ছে।’

সাবধানে বললাম, ‘উনি তো আপনাদের বাড়িওয়ালি। কিছু বলেন না কেন?’

‘কী আর বলব। যবে থেকে এসেছি তবে থেকে তো এই দেখছি।’

আমি চুপ করে গেলাম। এখানে আরও যারা আছে তারাও পুরোনো। পিসিকে কেউ সামনাসামনি কিছু বলে না। বলতে গেলেই চিৎকার। কেউ গলির ভেতরে ধপাস করে বইয়ের বস্তা নামাল। পিসি সঙ্গে সঙ্গে চেঁচিয়ে উঠবে– ‘অ্যাই কে? কে রে? গায়ের জোরে বস্তা ফেলেছিস! আস্তে আস্তে নামানো যায় না? এটা তোর বাবার বাড়ি নয় বুঝলি! একেই ওখানকার মেঝেটা ফেটে রয়েছে, তার মধ্যে ইচ্ছে করে বদমাইশি। সারাতে গেলে তুই পয়সা দিবি?’

আমি সব শুনি। তবে খেয়াল করে দেখেছি গলির মেঝের একটা জায়গা সত্যিই অনেকটা বসে গিয়েছে। পুরোনো বাড়ি। ধেড়ে ধেড়ে ইঁদুর ঘুরঘুর করে। ওরাই ফাঁকফোকর থেকে মাটি তুলে আলগা করে দিয়েছে। গলিটায় কোনও আলো নেই। অন্ধকারে কেউ কোনওদিনও পড়ে পা মচকাবে।

ডিএমের মালিক বলেছিলেন, ‘আপনার বাড়িওয়ালা প্রভাত দত্ত হল ওর দাদা, জ্যাঠার বড়ো ছেলে। বাড়ি ভাগাভাগি হয়েছে অনেকদিন। শুনেছি আগে থেকেই ঝামেলা চলছিল। যে যার অংশ বুঝে নেওয়ার পর থেকে তিন শরিকের মধ্যে কথাবার্তা বন্ধ। কেউ কারও খোঁজও নেয় না। এই চ্যাঁচানি পিসির বাপ-মা তো কবেই স্বর্গে রওনা দিয়েছে। থাকার মধ্যে আছে এক দিদি-জামাইবাবু। বছরে বারদুয়েক আসে ব্যারাকপুর থেকে। আসবেই বা কী করতে। সেখানে তারা সুখেই রয়েছে। দয়া যেটুকু করে, এর ভাগের দোকানগুলোর ভাড়ায় হাত দেয় না। বয়েসকালে বিয়ে-থা হয়নি। বিয়ে হওয়ার কথাও নয়। ওই তো চেহারার ছিরি। আগেও ভালো কিছু ছিল বলে মনে হয় না। একাই রাঁধেবাড়ে, খায়। একা থেকে থেকে মাথাটা গেছে আর কী। কথা বলার লোক পায় না। চ্যাঁচায়!’

আমি ভাবছিলাম ভাগ্যিস এই মহিলা আমার বাড়িওয়ালি নয়।

আমার দোকানে কোনও কর্মচারী নেই এখনও। এই কোম্পানিতে আমিই মালিক, আমিই শ্রমিক। বিক্রিবাটা তেমন জমেনি। তবু রিটেল কোনও কাউন্টার থেকে বইয়ের নাম লেখা স্লিপ এলে বই দিই। ফোনে বললে দৌড়ে গিয়ে বই পৌঁছে দিয়ে আসি। চালান লিখি, বিল কাটি, টাকা তুলে আনি। বিজ্ঞাপন দেখে, খুঁজেপেতে কাস্টমার আসে খুব কম। ওই কালো ঝুল গলি পেরিয়ে যারা এসে পৌঁছোয়, দেবতাজ্ঞানে তাদের সামলাই। যাদের বই রয়েছে সেই লেখকদের মধ্যে কেউ কেউ এসে পড়েন কখনও। আর টাকা নিয়ে বই ছাপিয়ে দেব কিনা জানতে বা কথা বলতেও আসেন দু-একজন। হ্যাঁ বলে দিয়েছি কয়েকজনকে। নইলে তো প্রেসে ধার ধারালো হয়ে উঠবে। আমি ধরে নিই যারা টাকা দেবে তারা আমার টেম্পোরারি পার্টনার। বাইরে চায়ের দোকান আছে। লোকজন এলে সেখানে গিয়ে বললে চা দিয়ে যায়, কিন্তু কেউ জল চাইলেই আমি সিঁটিয়ে যাই।

পাশের দোকানটা বর্ণলিপি পাবলিকেশন। মাঝবয়েসি কর্মচারী বসে থাকেন একজন। তিনিই বলেছিলেন, ‘খাওয়ার জল ওই কল থেকেই আপনাকে ভরতে হবে তমালবাবু। তবে খবরদার। পিসি যতক্ষণ কলতলায় থাকবে ততক্ষণ ওদিকের ধারও মাড়াবেন না। খালি দেখলেই বোতল নিয়ে দৌড়ুবেন। আমরাও তাই করি। নাহলে ও চিল্লিয়ে মাত করে দেবে একেবারে।’

তাও টের পেয়েছি অনেক দিন আগেই। বিকেলে কেউ জলের বোতল কলের মুখে বসালেই হল। সঙ্গে সঙ্গে চিৎকার– ‘অ্যাই, জল ভরছে কে? কার এত আস্পদ্দা! আমার এখনও বাসন ধোয়া বাকি।’

আসলে বাসন মাজা হয়ে গেছে। শুচিবাই থাকার ফলে উনি একই বাসন বারবার ধুতে থাকেন। এই সময় পিসিকে দেখা যায় না। শুধু তার কন্ঠস্বরটি দোতলার সিঁড়ি থেকে এমন করে নামতে থাকে যে ঝনঝনিয়ে বাসন গড়ালে তার চেয়ে মধুর শোনাত। কোনও কোনও দিন কলের সামনেই ওই চিৎকারে পায়রারা ভয় পেয়ে উড়ে যায় ঘুলঘুলি কী কার্নিশ থেকে। ঝগড়ার রেওয়াজি গলা ছাড়া এ সম্ভব নয়।

আমার দোকানঘরের সামনে দাঁড়িয়ে একজন একদিন আঁতকে উঠলেন। চুঁচড়ো থেকে বই নিতে এসেছেন। কখনওসখনও মফসসলের দোকানিরা বা তাদের লোক আসে আমার এখানে। পিসিকে তাদের চেনার কথা নয়। তিনি বললেন, ‘কোথাও কি গোলমাল হচ্ছে কিছু? দেখে আসবেন একবার?’

আমি বললাম, ‘তেমন কিছু নয়। ওই জল ভরা নিয়ে–।’

‘সে কী! কাজের জায়গায় এরকম চ্যাঁচামেচি হলে তো মুশকিল। বিজনেস করবেন কী করে? একে তো বাড়ির বাইরে আপনাদের কোনও সাইনবোর্ড নেই, খুঁজে খুঁজে টাইম কাবার। তার ওপর–। আর জায়গা পেলেন না!’

চুপ করে থাকি। হাসি দিয়ে বিজনেস সামলাবার চেষ্টা করি। তবে এও দেখেছি, পিসি যখন কলতলায় গিয়ে বসে, সেই সময়টি বেছে নিয়ে এখানকার দোকানের কয়েকজন আধ ডজন বোতল হাতে হাজির হয়। তারা পিসির ওই গলাবাজির চোটপাট চেটে চেটে খেতে চায়। হ্যা হ্যা করে হাসে। বোতল বসানোর ছুতোয় বাসন ছুঁয়ে দিতে চায়, বোতলের তলানি জল ছুড়ে দিতে চায় পিসির গায়ে। তিনিও চ্যাঁচাতে থাকেন– ‘যাও, যাও বলছি, দূর হয়ে যাও এখান থেকে। জেনেশুনে পেছনে লাগা, না! আবার দাঁত ক্যালানো হচ্ছে? শয়তান বদমাইশের দল, মেরে হাত ভেঙে দোব একদম বলে দিচ্ছি।’

আমার বাড়িওলা পীযূষ দত্তকে দেখেছি কখনও এরকম ঘটনার মধ্যে পড়ে গেলেও তিনি পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছেন। বোনের হয়ে দুটো কথা বললে হয়তো থামত। থামে না।

একদিন জল ভরতে গিয়ে দেখলাম কলে লাল বালতি, বাসনের পাঁজা। না বলে জল নেওয়া যাবে না। পিসি দোতলায় তার ঘরে আছে ভেবে ওপরে উঠলাম।

একটা পাঁচিল গেঁথে আমাদের ওদিকটা থেকে এদিকটা আলাদা করা আছে। লালচে ইটের দাঁতকপাটি বেরিয়ে পড়েছে সে পাঁচিলের। পাশে সিমেন্টের একটা খিলানের অর্ধেক। বৃষ্টির জল পড়ে শ্যাওলায় আঁকা নকশা ফুটেছে তার শরীরে। কত কাণ্ড করে যে বাড়িটা ভেঙে ভাগ করেছে এরা। সিঁড়ির যেখানে আমি দাঁড়িয়ে তাতে আমার নাকের প্রায় ডগায় শোয়ানো একটা মেঝে। লোহার শিক লাগানো কাঠের রেলিং। অর্থাৎ এটা দোতলার ভেতরের বারান্দা। একটা বেড়াল থাবায় মুখ নামিয়ে বসে আছে। এককোণে একটা স্টোভ, কেরোসিন তেলের জার, কাঠের ডাঁটির একটা বড়ো ছাতা দেয়ালে হেলান দিয়ে, সিলিঙের কড়িবরগা থেকে দড়ি বাঁধা একটা হ্যারিকেন ঝুলছে, রেলিঙের খুঁটি থেকে দেয়ালের পেরেকে টাঙানো আর একটা দড়িতে এলিয়ে রয়েছে কয়েকটা ময়লা কাপড়, সেই দেয়ালেই লোহার ব্র্যাকেটে বাল্ব, দরজার পাশের দেয়ালে বাঁধানো ছবিতে উলটে আঁচড়ানো চুলে এক পুরুষ। চৌকো চোয়াল। সাদা-কালো ছবি হলদেটে হয়ে গেছে। মনে হচ্ছিল সব মিলিয়ে মৃণাল সেনের সিনেমার কোনও স্টিল ফ্রেম দেখছি। এমন সময় সেই ফ্রেমের ভেতর থেকে বেড়ালটা মুখ তুলে ডেকে উঠল– মিঁউ।

‘কী ব্যাপার? এখানে এসেছেন কেন?’

দরজায় আধময়লা কামিজ উঁকি দিয়েছে। বললাম, ‘আমার ওখানে একদম জল নেই। একটা বোতল যদি ভরে নেওয়া যেত।’

‘আপনি কি আমার পারমিশন নিতে এসছেন?’

‘হ্যাঁ।’

খোলা ঠোঁটদুটো টপ করে নেমে এসে কেমন গুম ধরে গেল মুখে। উনি কামিজের দু’পাশের চেরা জায়গা দু’হাতে চেপে ধরলেন। তারপর বললেন, ‘যান, নিয়ে নিন জল।’

‘আপনার জিনিসপত্র সব ওখানে রয়েছে। সরাতে গেলে হাত ছোঁয়াতে হবে।’

‘বললাম তো ভরে নিন। সরিয়ে দিন ওগুলো।’

কী মনে হল, সেই ছবিটার দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘ওটা কি আপনার বাবার ছবি?’

‘হ্যাঁ, কেন?’

‘না এমনি। তাই মনে হচ্ছিল। ঘরের ভেতরে রাখলে পারতেন।’

‘ঘরে অন্ধকার।’

অদ্ভুত যুক্তি। আমি আর কিছু না বলে ফিরে আসছিলাম। তখন উনি বললেন, ‘জল নেওয়ার জন্য আমাকে বলতে আসতে হবে না। আপনার যখন দরকার নিয়ে নেবেন।’

আমি নেমে জল ভরে নিয়ে এসে কাউন্টারে বসি। বাইরে কত লোক, বই বোঝাই রিকশা ভ্যান, দোকান উপচে রাস্তায় বই, হাঁকাহাঁকি, হাত ধরে টানাটানি– কী বই লাগবে বলুন। আর এই জায়গাটা ঘুমন্ত পুরী। এরকম রোজই। বৃষ্টিতে, রোদ্দুরে, শীতে ভিজে ভিজে।

এক একদিন বসে বসে ঝিম ধরে যায়, চোখের পাতা নেমে আসে। তখন ওই রাজকন্যের চিৎকারে চটকা ভাঙে। সিগারেট ধরাই। ভাবি আরও কয়েকটা কাউন্টারে বই বিক্রির ব্যবস্থা করতে হবে, লাইব্রেরিতে ক্যাটালগ পাঠাতে হবে, বাংলাদেশের অর্ডার পেতে হবে। পারব কি আমি? দোকানের ভাড়া, সেই সাউথ থেকে মেট্রোয় যাওয়া-আসার খরচ, ইলেকট্রিকের বিল। মাত্র তেরোটা বই নিয়ে এখানে জায়গা হাঁকিয়ে বসাটা বোধহয় ঠিক হয়নি। এই বাড়িটায় সব টেক্সট বইয়ের দোকান। সেখানে আমার পাবলিকেশনের বই মেলানো যাবে না। যাদের সঙ্গে মেলানো যায় তারা তো রথী-মহারথী। কম্পিটিশন তো দূরের কথা, টিকে থাকতে পারব কিনা সেই সন্দেহই চোঁয়া ঢেকুর হয়ে উঠে আসছে এই কয়েক মাসে। বড়ো লেখকদের বই পেতে গেলে অনেক টাকা দিতে হয়। বই ভালো করে ছাপতে গেলেও খরচ বেশি। বেশি ছাপলে খরচ কমে কিন্তু আমার দৌড় তিনশো কী পাঁচশো। লাইব্রেরি নামি প্রকাশকদের বই কেনে, বাংলাদেশের অর্ডারও তাই, কলকাতার বাইরে থেকে কদাচিৎ কেউ কিনতে আসে। এত কিছু আগে বুঝিনি। এখানে এসে মালুম হচ্ছে। আমার বউয়ের স্কুলে পড়ানোর ভরসায় তো এখানে আসিনি আমি। নিজেই নিজের দোকানের ছোট্ট সাইনবোর্ডটার দিকে তাকিয়ে থাকি। কায়দা করে পাবলিকেশনের নাম দিয়েছি ‘সোনার তরী’। শেষে ডুববে না তো?

এসব ভাবতে ভাবতে কোনও দিন ঘটাং করে আওয়াজ শুনে পিছন ফিরে দেখি পাশের গোডাউন থেকে বই বের করতে এসেছে কেউ। দুটো ছেলে। এরা যে– দোকানে কাজ করে সেটা রাস্তার ওপরে। ওরা নিজেদের মধ্যে কথা বলছে। বলছে মানে প্রত্যেক কথার আগে পরে একটা করে খিস্তি। বাংলা ভাষাকে উদার প্রমাণ করতে এসব আমরা আপন করে নিয়েছি। কোনও শ্রেণিবৈষম্য নেই। বলার স্বাধীনতা আছে, না শোনার স্বাধীনতা নেই। তাই খিস্তি হজম করছিলাম। ঠিক তখন ওপর থেকে চেঁচিয়ে উঠলেন পিসি। ‘অ্যাই কে রে? তপন, না? এখানে দাঁড়িয়ে আবার নোংরা কথা বলছিস! ওসব এখানে চলবে না।’

তপন ছেলেটি মুখ তুলে বারান্দায় তাকাল। ‘তোমার ওখানে তো নেই পিসি আমি। এ তো আমাদের বাড়িওলার এরিয়া। আমি এপারে রয়েছি।’

এবার আরও জোরে চিৎকার ধেয়ে এল। ‘খারাপ কথার আবার এপার-ওপার কী অ্যাঁ! বেশি ওস্তাদ হয়েছ, না। বই বিক্রি করিস, সে তো বিদ্যের জিনিস রে, গালাগাল দিতে লজ্জা করে না!’

তপন পাশের ছেলেটার দিকে তাকিয়ে চোখ মটকে হাসল। গলা নামিয়ে বলল, ‘বহুত ঢেমনি এই বুড়িটা, দেখবি একটা মজা?’

মোবাইলে খুটখাট করছে তপন। একবার আড়চোখে আমাকে দেখল। তারপর গান বেজে উঠল ফোনে। ও মধু… ও মধু… আই লাভ ইউ… আই লাভ ইউ…। সঙ্গে তপনের খিক খিক হাসি।

আমি ভাবছিলাম, পিসির তো এতদিনে জেনে যাওয়া উচিত ছিল যে বই বিক্রি হয় বলেই বইপাড়ায় সকলে সাধুভাষায় কথা বলবে না। হতে পারে একদিন বিদ্যাসাগর সংস্কৃত কলেজের প্রিন্সিপালের চাকরি ছেড়ে দিয়ে কলেজ স্ট্রিটেই বইয়ের দোকান খুলে বসেছিলেন। কিন্তু এখন বই এখানে একটা প্রোডাক্ট। বাংলা ভাষায় যাকে বলে মাল।

হঠাৎ চমকে উঠলাম আমি। তপন ও অন্য ছেলেটিও অবাক হয়ে গেছে। দোতলায় অন্ধকার বারান্দা থেকে আর চিৎকার নয়, গান ভেসে আসছে। ‘দূরদেশি সেই রাখাল ছেলে… আমারে বাটের বটের ছায়ায়… সারাটা দিন গেল খেলে…।’ গলা খ্যানখ্যানে, সুর কিছু এলোমেলো কিন্তু ওটা গানই।

তপন কাঁধ ঝাঁকাল। ‘কী গো পিসি, এ আবার কী শুরু করলে?’

গান থামল। ‘কেন, তুই গান বাজাচ্ছিস, আমি গান গাইছি। কী অসুবিধে?’

‘আরে আমারটা শোনো, শরীর চাঙ্গা হয়ে যাবে।’

‘আরে তুই আমারটা শোন, তোর মন ভাল হয়ে যাবে। দূরদেশি সেই রাখাল ছেলে…।’

অন্য ছেলেটি এবার তপনকে বলল, ‘চল চল মাল ওঠা। সব পাগলের কারবার এখানে।’

লাবণি দত্ত থামেননি। পুরোটাই গাইলেন।

অনেক দিন পর গানটা শুনতে পেলাম। মাঠে ফুটবল পিটিয়ে বাড়ি ফেরার পথে সন্ধেবেলা কাদের বাড়িতে যেন হারমোনিয়ামে বাজত এই গান। আজ এই পুরনো ভাঙা ছায়াময় বাড়িটাতে যেন ঘুরে ঘুরে ভেসে ভেসে একটা কোনও ঝরা পাতা হয়ে গানটা নেমে আসে।

পরের মাসে বাড়িওলার কাছে ভাড়া দিতে গিয়ে বললাম, ‘আমাদের দোকানের আগে যে– প্যাসেজটা, সেটা বড্ড অন্ধকার। অনেকে ওটা দেখে ওখান থেকেই ফিরে যায়, একটা আলো লাগানো গেলে…।’

পীযূষ দত্ত টাকা গুনতে গুনতে বললেন, ‘ও বাবা, ও ব্যাপারে আমি কিছু করতে পারব না। আপনি লাবুকে, মানে আমার বোনকে বলে দেখতে পারেন। ওটা তো ওর অংশ। যদি রাজি হয়–। তবে আপনার পাশের বর্ণলিপি আগে বলেছিল শুনেছি, হয়নি।’

আমি নেমে এলাম। আলোটা লাগানো খুবই দরকার। ন’মাস হয়ে গেল এখানে এসেছি। কাউকে বলে দিলেও জায়গাটা চিনে আসতে পারে না। সন্ধে নেমে এলে তো কথাই নেই, দিনের বেলাতেও এরকম ঘটে। এ তল্লাটের অনেক বাড়ির ভেতরেই খুপরি দোকানঘর আর অফিস রয়েছে। তারা কী করে ম্যানেজ করে জানি না। আমাকে আমার ব্যাবসার কথা ভাবতে হবে।

খাওয়া শেষে, বাসন ধোওয়ার পর, দুপুর একটা নাগাদ পিসি বাড়ির একেবারে বাইরের দরজার মুখে রোয়াকটায় গিয়ে বসে থাকেন। রোজকার ব্যাপার। ভাবলাম তখনই গিয়ে আলোর কথাটা বলব। গিয়েছিলাম, কিন্তু বলা হল না। দেখি পিসি ডান হাতে চড় তোলার ভঙ্গিতে খালি পায়ে রাস্তায় নেমে ছুটছেন। সামনে দু-তিনটে দামড়া লোকও খ্যাক খ্যাক করে হাসতে হাসতে এঁকেবেঁকে ছুটে পালাচ্ছে। তাদের কেউই এ বাড়ির কোনও দোকানের লোক নয়। বাইরের। হয়তো কাস্টমার নেই কোনও, কাজ নেই অন্য, তাই সময় কাটাতে পিসিকে বেছে নিয়েছে ওরা। পিসি চেঁচাচ্ছেন– ‘এক চড়ে মাথা ভেঙে দোব। অসভ্য কোথাকার। বাড়িতে মা-বোন নেই তোমাদের?’

টানা রিকশাওলা, অন্য দোকানদার, রাস্তার লোক, ভ্যানওলারা রগড় দেখছে। আমি পা চালিয়ে পিসির সামনে গিয়ে রাস্তা আটকালাম। খানিকটা ধমকেই বলে ফেললাম, ‘এটা কী করছেন আপনি? কেন দৌড়াচ্ছেন এভাবে?’

পিসি থতমত হয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছেন। হাতটা নামিয়ে নিয়ে বললেন, ‘কী বাজে বাজে কথা বলছে ওরা, জানেন না আপনি। কাউকে কিছু বলি না, চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকি, তাও ইচ্ছে করে আমায় খোঁচাবে। পিছনে লাগবে।’

বললাম, ‘ওরা তো চায় আপনিও রেগে গিয়ে ওদের বাজে কথা বলুন। তাতেই মজা। আপনিও সব ভুলে ওদের পিছনে ছুটবেন! চলুন, এক্ষুনি ফিরে চলুন। আসুন আমার সঙ্গে। আপনিই না সেদিন গান গাইছিলেন!’

ট্যারা চোখ রাস্তার দিকে রেখে, কামিজটা সেই দু’হাতে চেপে ধরে আমার সামনে সামনে হেঁটে বাড়ির ভেতরে ঢুকে পড়লেন তিনি। আরও কিছুটা ধমক দিয়ে বললাম, ‘এটা কী পরে থাকেন আপনি! আর কিছু নেই আপনার?’

বোধহয় চ্যাঁচাতে গিয়ে কষ জমেছিল। সিঁড়ি বেয়ে ওঠার মুখে পিসি হাত দিয়ে ঠোঁট মুছলেন। আমি দোকানে বসতে যাচ্ছিলাম। উনি বললেন, ‘আপনি ওখানে কেন গেছিলেন?’

মাথা নাড়ালাম। ‘আমি আপনার কাছেই যাচ্ছিলাম। আর সেকথা বলে কী হবে।’

‘কী কথা? বলুন।’

‘এই প্যাসেজটায় যদি একটা আলো লাগাতে দিতেন। লোকজন আসা-যাওয়ায় সুবিধে হতো একটু। আপনার ভাড়াটেদের তো এই সমস্যা ভোগ করতে হয় না।’

গলার স্বর হালকা হয়ে উঠে যাচ্ছে ওপরে। শুনতে পেলাম উনি বলছেন, ‘লাইট কিনে নিয়ে আসুন। লাগাবে কে? মিস্ত্রিকে ডাকুন। জানেন কোথায় পাবেন? বেরিয়ে দেখুন ভারবি পাবলিশার্স কোথায়। ওই বাড়ির একদম শেষমাথায় বাপ-ছেলে থাকে, ইলেকট্রিকের কাজ করে। বলবেন চ্যাঁচানি পিসির বাড়ি। ঠিক চলে আসবে।’

আলো লাগানো হল। গলির অন্ধকারটা ছিঁড়ে গেল। যদিও তাতে আমার কতদূর কী সুবিধে হবে বোঝা যাচ্ছিল না। বাড়িতে বউয়ের সঙ্গে কথা বললাম কয়েকদিন পর। শ্রাবন্তী বলল, ‘বাবার বইয়ের দোকানটা তবু ছিল, সেটাও বিক্রি করলে। কী যে তোমার মাথায় চাপল! বাবা-মাও এই নিয়ে বলতে ছাড়ছে না। বলারই কথা। এখন যদি ব্যাবসাটা না দাঁড়ায় তাহলে কী হবে?’

বললাম, ‘সেই তো ভাবছি। আমি তো খারাপ বই করিনি। কিন্তু বিক্রি তেমন হচ্ছে না। এ ব্যাবসায় ইনভেস্টমেন্ট বেশি, রিটার্ন এত স্লো! আরও যে বই করব, ফান্ডই তো জমছে না। কলেজ স্ট্রিটে গিয়ে না পড়ে তো বুঝতে পারিনি। তাছাড়া বাজারও খুব খারাপ। দেখি। তেমন বুঝলে সব বিক্রি করে চলে আসতে হবে।’

শ্রাবন্তী আবার বলল, ‘মাস গেলে টাকা তো লাগে সংসারে। সেটা যদি না আসে, চলবে কী করে?’

দোকানে বসে শ্রাবন্তীর কথাগুলোই ভাবছিলাম। তিন-চারজন এসে দাঁড়াল কাউন্টারের সামনে। ‘এটা নতুন হয়েছে, না? মালিক কোথায়?’

চিনি না এদের, তবে কাস্টমার যে নয় তা বোঝাই যাচ্ছে। বললাম, ‘বলুন কী ব্যাপার?’

‘ব্যাপার কিছু না, দুর্গা পুজোর ডোনেশান। এই পাশের গলি। পাশশো টাকা।’

‘পাঁচশো!’ চমকে উঠি। ‘এত তো আমি পারব না দাদা।’

‘না বলবেন না। নতুন বলেই দিতে হবে, পুরানো হলে দেখবেন অ্যামাউন্টটা কমে ফিক্স হয়ে গেছে।’

‘অ্যাই কে রে? চাঁদা চাইতে এসেছে কারা? কোন পুজো?’

একজন মুখ তুলে জায়গামতোই তাকাল। ‘আমরা পিসি। মুখটা বাড়াও। চিনতে পারবে।’

পিসি তরতর করে নেমে এলেন। ‘ওনার কাছে বেশি নিতে পারবে না তোমরা। একশো টাকা নিয়ে বিদেয় হও।’

‘কী বলছ পিসি! একশো টাকায় কী হয়?’

‘যা বলছি শোনো। ওতে যা হয় তাই হওয়াও।’ বলে তিনি চোখ দুটো আমার দিকে রাখার চেষ্টা করছিলেন। ‘আপনি এর বেশি দেবেন না কিন্তু।’

‘আঃ পিসি, এমন কেলোর কীত্তি করো না মাঝে মাঝে। কিছু বলতে গেলেই তো আবার চ্যাঁচাবে।’ বলতে বলতে ওরা বিলের পাতা ছিঁড়ল। ‘আর কী হবে, দিন ওই একশো। সিনিয়র সিটিজেনের কথা রাখলাম।’

ওরা চলে যাওয়া অবধি পিসি দাঁড়িয়েই রইলেন। তারপর আমায় বললেন, ‘কলেজ স্ট্রিটে ব্যাবসা করতে এসেছেন তো। অনেক কিছু দেখতে হবে।’

চেয়ারে বসে পড়েছি। ভালো লাগছিল না এসব। তবু বললাম, ‘ব্যাবসাটা যদি ঠিকঠাক হতো, তাও না হয় দেখতাম। এখন তো ভাবছি কেন এলাম।’

পিসি মুখটা গলির দিকে ফিরিয়ে নিলেন। ‘এই বই ছাপার ব্যাবসা তো আপনার বাপ-ঠাকুদ্দার নয়।’

‘না, কেন বলুন তো?’

‘আমি সেই জ্ঞান হওয়া থেকে এসব দেখছি বুঝলেন। কত পাবলিশার এ বাড়িতে এল আর গেল। আমার বাবাও প্রকাশক ছিল, জানেন? পড়ার বই নয়, গল্প-উপন্যাস-কবিতা এসব ছাপত। কত লেখক এসেছেন তখন। পয়লা বৈশাখে বই বেরোত। কিন্তু বাবা শেষ অবধি পেরে ওঠেনি। এখন যেটা যূথিকা প্রকাশনীর ঘর, ওটাই আমাদের কাউন্টার ছিল। পরে তিনটে ঘরই এক এক করে ভাড়া দিয়ে দিল। বাবা বলত ছোটো প্রকাশকের ব্যাবসা করা খুব কঠিন। পাট তুলে দিল। বইগুলো উইয়ে খেল। আপনি পারবেন তো?’

আমি বললাম, ‘এত ভেতরে বসে বসে কী করতে পারব তাই ভাবছি। বাইরে একটা বোর্ড অবধি নেই যে কেউ নাম দেখে ঢুকবে?’

পিসি বললেন, ‘আপনার খুব চিন্তা হচ্ছে, না? থাকতে থাকতে লোকে জেনে যাবে ঠিক। খুঁজে খুঁজে আসবে দেখবেন। এই তো গলিতে আলো লাগালেন, সামনের দিকে আমাদের যে শরিক থাকে ওরা আপনাকে বোর্ড দিতে দেবে না। আমি তো দুপুরবেলা আর সন্ধেবেলা বাইরে দাঁড়িয়ে থাকি, কেউ জিজ্ঞেস করলে দেখিয়ে দেব– এই দিকে সোনার তরী। আপনি ভালো ভালো বই করুন। বিক্রি বাড়ানোর বুদ্ধি বের করুন। আমার বাবার মতো হবেন না। পালিয়ে গেলে কিছু করতে পারবেন না। আর শুনুন, আমার আর এবেলা কলে কাজ নেই। যান জল ভরে নিন।’

আমি অবাক হওয়াটা ঝেড়ে ফেলতে পারছিলাম না। তার মধ্যেই পিসি চলে গেলেন। একটু পরেই শুনতে পেলাম দোতলার সেই বারান্দা থেকে ভাঙা গলার গান ভেসে আসছে। ‘এই আকাশে… আমার মুক্তি আলোয় আলোয়…।’

আমি কাউন্টার ছেড়ে দোকানের সামনের ছোট্ট জায়গাটায় দাঁড়াই। ওপরে তাকিয়ে ফালি আকাশটা দেখি। একঝলক চোখে পড়ে, একটা পায়রা পাকসাট দিচ্ছে। ওখান থেকে কোনও পক্ষীরাজ ঘোড়া উড়ে এসে নামবে না আমার জন্য। কিন্তু আমি যতটুকু দেখতে পাচ্ছি আকাশ তো ততটুকু নয়। খামোখা পালাতে যাব কেন?

 

দেব ও কার্তিক

একটু আগেই রংচটা ক্ষয়াটে মোবাইলটায় কেসের খবর এল। শেষ টানটা দিয়ে ভসভস করে নাকমুখ দিয়ে ধোঁয়া ছাড়ল কার্তিক। চোখ বুজে কয়েক মিনিট বসে রইল। ধুনকিটা মাথায় ঠেলছে। বেশ আরাম। এবার ওঠা যেতে পারে। কলকেটা উপুড় করে ছাইটুকু মাটিতে ফেলল, তারপর পেল্লায় একটা হাই তুলে রয়েসয়ে নিজের সাইকেল ভ্যানটার কাছে গেল। ভ্যানের চেহারাও কার্তিকের মতোই। একেবারে খ্যাঁচাখোঁচা। মাঝরাস্তায় ফেলে দিয়ে আসলে চোরেও ছুঁয়ে দেখবে না, উলটে সারানোর পয়সা রেখে যেতে পারে। মাডগার্ড নেই, ঢিলে চেন বারবার পড়ে যায়। চাকার টায়ারে কার্তিকের বয়েসের থেকে বেশি গ্যাটিস মারা। তিনটে রিঙেই টাল রয়েছে। লগবগ করতে থাকে চালানোর সময়। মনে হয় বুঝি চাকাগুলো খসে গেল। ব্রেক নামকা ওয়াস্তে। ইচ্ছে হলে ধরে, কখনও ধরে না। হর্নের আওয়াজ ডিম ফুটে বেরোনো চড়ুইয়ের মতো। ভ্যানের তক্তাগুলো সব ঢিলে হওয়ার কারণে হর্ন দিতে লাগে না। গাড়ি চললে তার বিচিত্র আওয়াজে লোকে এমনিই বুঝতে পারে পিছন থেকে কিছু একটা আসছে। তার সঙ্গে কার্তিক মাঝেমধ্যেই মুখে হুই হুইইইইই করে শব্দ করে হর্নের বদলে। কিন্তু এই ভ্যানটা আছে বলেই না কার্তিকের গাঁজার পয়সা ছাড়াও পেটে কিছুটা চাল, ডাল, তেল পড়ার পয়সা জোটে।

আসলে কার্তিকের বুদ্ধি কম। আর যাদের বুদ্ধি কম, তাদের অনুভূতিও কম। সুতরাং কার্তিকের অনুভূতিটুতি সেই ছোটোবেলা থেকেই একটু ফিকে। বাবা-মা, ভাই-বোন, বেয়াই, মুনাই, জগাই-মাধাই সব হারিয়ে বত্রিশ বছর বয়েসের কার্তিক একেবারেই একা। হদিশপুরের ফরালপট্টি নামের একটা আধা গ্রাম মার্কা মফসসল পাড়ার একেবারে শেষপ্রান্তে, বাঁশবাগান শুরুর মুখে ও থাকে। ওর সঙ্গে থাকে শুধু এই ভ্যানটা আর একচিলতে জমির ওপর টালির ছাউনি দেওয়া ছিটেবেড়ার এক ঘুপচি ঘর। ঘরের এককোণে একটা নড়বড়ে পায়ার খাটিয়া, খাটিয়ার তেলচিটে বালিশের তলায় রগরগে ল্যাংটো মেয়ের ছবিওলা খাস্তা হয়ে যাওয়া দুটো ছবির বই। নারকোলের দড়িতে ঝোলানো কয়েকটা জামা প্যান্ট, লুঙ্গি। অন্য কোণে জনতা স্টোভ, কুচকুচে কালো হাঁড়ি, কড়াই, বাটি, খুন্তি আর থালা। ব্যস কার্তিকের সংসার কমপ্লিট।

উঠোন থেকে ভ্যানটা বাইরে এনে সিটে চেপে বসে লগবগ করতে করতে চলল কার্তিক। ওর গন্তব্য এখন হদিশপুর রেলস্টেশন। আজ আবার একটা কেস ঘটেছে। কেস শব্দটা কার্তিক শিখেছে জিআরপি-র কাছ থেকে। এখন শব্দটা ওর মনেও সেঁটে গেছে। কারণ কেস মানেই পয়সা। বেশ ভালো পয়সা।

আসলে হদিশপুর, মোল্লাবাজার আর ভাঙনহাটি এই তিনটে রেলস্টেশনের মধ্যে যদি কেউ লাইনে কাটা পড়ে কিংবা গলা দেয় তাহলে সেই বডি হদিশপুর মর্গে পৌঁছানোর দায়িত্ব কার্তিকের। জিআরপি-র লোক বডি কাপড়, প্লাস্টিক দিয়ে মুড়ে দেয়। তারপর সেটাকে ভ্যানে চাপিয়ে মর্গে জমা দেওয়া পর্যন্ত কার্তিকের কাজ। সাত বচ্ছর হয়ে গেল এই কাজে। তার আগে ওই ভ্যানে করেই পাড়ার বাড়িতে বাড়িতে কাঁচাসবজি বেচত। কিন্তু বুদ্ধি কম থাকলে আর যাই হোক ব্যাবসা হয় না। কার্তিকেরও হল না। খদ্দেররা প্রায় সবাই ঠকাত কিংবা পরে দাম দেব বলে আর কেউ দিত না। ব্যাবসা লাটে। তারপর কিছুদিন স্টেশনের সামনে নাড়ুর মুরগির দোকানে মুরগি ছাড়ানোর কাজ করল। সেটাও হল না, একদিন তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে মুরগির গলার সঙ্গে নিজের ডানহাতের আঙুলটাও নামিয়ে ফেলল বটিতে। ছেড়ে দিল কাজ। শেষে পাড়ার বন্ধু শ্যামল বাঁচাল। বলল, ‘দেখ ভাই, ভগবান তোর ঘটে ছাগলের নাদির সাইজেরও ঘি দেয়নি। সুতরাং ওসব ব্যাবসা ফ্যাবসা তোর দ্বারা হবে না। বরং আমার খোঁজে একটা কাজ আছে করবি?’

এই কাজ প্রথম দিকে করতে জান বেরিয়ে যেত, ঘেন্নায়, ভয়ে। ভেবেছিল ছেড়ে দেবে। কিন্তু শালা খিদের ভয় এত মারাত্মক যে…। শ্যামল বলল, ‘খবরদার কাজটা ছাড়িস না। এটা কিন্তু হাফ সরকারি চাকরি। তোকে কেউ কোনওদিনও ছাড়াবে না। আর ঠাকুরের আশীর্বাদে কাটা পড়া, গলা দেওয়ার কেস তো দিনে দিনে বাড়ছে বৈ কমছে না। তুই না খেয়ে থাকলে কেউ দুবেলা ভাত দেবে না। প্রথমদিকে এট্টু চাপ যাবে, তারপর সয়ে যাবে দেখবি। আরেকটা জিনিস শিখিয়ে দিচ্ছি। সেটা করে বেরোবি, একটুও পবলেম হবে না আর। সেই জিনিসটা হল মহাদেবের প্রসাদ। মাথায় ঠেকিয়ে টানতে হয়।’

কার্তিক শিখে নিল কীভাবে কলকে ধরতে হয়, মশলা ঠুসতে হয়, ছিলিম টানতে হয়। বুকের খাঁচায় আপ্রাণ ধোঁয়া নিয়ে বমকে চেপে রেখে তারপর ভুসভুস করে ছাড়তে হয়। সত্যি সত্যি,

চার-পাঁচ টান দিয়ে কাজে নামলে আর কোনও ঘেন্না, ভয় লাগত না। তবে নেশাটা বেড়ে গেল অনেকটাই। ফলে শরীরটা দড়ি পাকিয়ে দু-টাকা প্যাকেটের কালো আমলকির মতো হয়ে গেল। সে হোক গে। যে ক’দিন বাঁচতে হবে দুবেলা খেতে পেলেই হল, শরীর দিয়ে কী হবে? বিয়ে থা তো আর এজন্মে হবে না।

টিপিকাল গেঁয়ো মফসসলের ঘেয়ো রাস্তার ওপর দিয়ে লটবহর নিয়ে ভ্যান চালাতে চালাতে আকাশের দিকে দেখল কার্তিক। ভাদ্র মাসের বিকেল চারটে। আজ সারাদিন খুব গুমোট। দরদরিয়ে ঘাম হচ্ছে। বৃষ্টি হলে ভালো হয়। হবে কি?

আরও খানিকটা এগোনোর পর মেন রাস্তাতেই চলচিত্রম সিনেমা হলের সামনে ভ্যান সমেত থমকে গেল ও। হেব্বি চমকে গেল। উরেশশাললাহ– গুরুর বই চলছে! প্রায় মাসখানেক হল ভাঙনহাটিতে কোনও কেস হয়নি বলে আসা হয়নি। তাই জানাও ছিল না যে গুরুর বই দিয়েছে এখন। দেবকে মনে মনে গুরু মানে কার্তিক। শালা যেমন ফিগার আর তেমনি ঝাড়পিট করতে পারে। মিঠুনের পর এমন ঝাড়পিট আর কেউ পেরেছে? সিনেমা হলের দেয়ালে বিশাল বড়ো দেবের পোস্টার। রক্তমাখা দেব একটা মেয়েছেলের বডি কোলে নিয়ে চিৎকার মারছে। মেয়েছেলেটা কি নায়িকা? মরে গেছে? হেব্বি অ্যাকশন হবে নিশ্চয়ই। ইশশ কতদিন গুরুর বই দেখা হয়নি। কাউন্টারের সামনে তেমন ভিড় নেই। তার মানে হপ্তাখানেক নিশ্চয়ই পেরিয়ে গেছে বইটা।

দেবের প্রচুর বই দেখেছে কার্তিক। আর যেদিনই দেখেছে সেদিনই ওর গাঁজার ধোঁয়ামাখানো ঘিলুতে রাত্তিরে ভর করেছে দেব। ঘরের এককোণে বাঁশের খুঁটিতে ঝোলানো এই টুকুন একটা ঘষা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে লম্পর আলোয় একা একা দেব সেজে কম ঝাড়পিট করেছে গুন্ডাদের সঙ্গে? কচুকাটা করেছে সবক’টাকে। কখনও দুহাতে বন্দুক ঘুরিয়ে কখনও তলোয়ার ঘুরিয়ে। তারপর কোয়েল, শ্রাবন্তী, মুমতাজ, নুসরতের সঙ্গে নেচেছে। নাচতে নাচতে কিংবা অ্যাকশন করতে করতে কখন যে মাটিতে ঘুমিয়ে পড়েছে নিজেরও খেয়াল থাকেনি। বাংলার একনম্বর হিরো হল দেব। ওর ঘরের ছিটেবেড়ার দেয়ালে একটা দেবের পোস্টারও রয়েছে।

খুব খুঁটিয়ে পোস্টারের এদিক-ওদিক দেখে নেহাৎ অনিচ্ছায় প্যাডেলে আবার চাপ দিল কার্তিক। বইটা দেখা হল না। খুব আপশোশ লাগছে। মন পড়ে রইল চলচিত্রম হলের দেয়ালে আর মিনিট পনেরোর মধ্যে কার্তিক পৌঁছে গেল হদিশপুর জিআরপি অফিসে। ঢোকামাত্র বড়োবাবুর পেল্লায় ধমক। ‘শুয়োরের বাচ্চা, আসতে ইচ্ছে করে না নাকি রে তোর? এইটুকু রাস্তা আসতে কতক্ষণ লাগে? সেই বিকেল থেকে বডি পড়ে রয়েছে।’

এই খিস্তিটুকুতে জলখাবারও হয় না কার্তিকের। পেটভরা তো দূরের কথা। সামান্য বিগলিত হাসল।

‘তোকে তো বলেও কিছু লাভ নেই। সবসময় ধুনকিতে রয়েছিস।’ বড়োবাবুর কথায় আশপাশের কনস্টেবলগুলো হেসে উঠল।

‘দে বডিটা তুলে দে।’ বড়োবাবুর আদেশমাত্র অফিসের বাইরের ঘরটা থেকে প্লাস্টিক মোড়া বডিটা দুজন জমাদার ধরাধরি করে তুলে দিল কার্তিকের ভ্যানে।

‘তাড়াতাড়ি পৌঁছে দিস। আবার রাস্তায় বডি সমেত লাট খেয়ে পড়ে থাকিস না। আজ বৃষ্টি হতে পারে,’ বলে একটা একশো টাকার নোট আর একটা কাগজ ধরিয়ে দিল ছোটোবাবু। টাকাটা কার্তিকের ভ্যানভাড়া আর কাগজটা মর্গে বডির সঙ্গে জমা করতে হবে। এসব মুখস্ত হয়ে গেছে কব্বে…। মেয়েছেলের বডি, জেনে নিয়েছে কার্তিক।

ফেরার পথে আবার ঠিক সেইখানেই থেমে পড়ল কার্তিক। চলচিত্রমের সামনে। সেই পোস্টারটার গায়ে এখন দুটো বাম্পার চোখ ঝলসানো লাইট ফেলা রয়েছে। আরও ফাটাফাটি লাগছে গুরুকে। বইটা সত্যিই দেখা হবে না! কথাটা মনে আসতেই মেজাজটা খিঁচড়ে গেল। শালা কপালটাই খারাপ।

দু-তিনবার মেঘ ডাকল চাপা স্বরে। সন্ধে নেমে গেছে। এখনও ভাঙনহাটি মর্গ মেন রাস্তা ধরে অনেকটা। প্রায় ঘন্টাখানেক তো বটেই। ভাবতে ভাবতে গায়ে দুফোঁটা জল পড়ল আকাশ থেকে। আর বৃষ্টির সঙ্গে কয়েকফোঁটা বুদ্ধিও এসে টুপ করে পড়ল কার্তিকের মাথায়। ভ্যান থেকে নেমে শোয়ানো বডিটার সামনে এল ও। আগাপাশতলা প্লাস্টিক দিয়ে মোড়া। তার ওপর আবার একটা প্লাস্টিক টানটান করে তার কোণাগুলো দড়ি দিয়ে এমন করে বাঁধা রয়েছে যে, বাইরে থেকে কারও বোঝার উপায় নেই ভেতরে কী রয়েছে। এইভাবেই বরাবর বডি নিয়ে যায় কার্তিক, নইলে রাস্তায় লোকে ডিস্টার্ব করে। দুনিয়ার প্রশ্ন লোকের।

খুব ধীরেসুস্থে সাবধানে ভ্যানটাকে হাতে ঠেলে সিনেমা হলের চত্বরে ঢুকিয়ে নিল কার্তিক। চত্বরটা ফাঁকা। হলের সামনেও লোকজন কেউ প্রায় নেই। বই শুরু হয়ে গেছে বোধহয়। নাকি শেষ? ভ্যানটাকে এককোণে রেখে গুটিগুটি পায়ে টিকিট কাউন্টারের কাছে গেল। মুখ নামিয়ে বলল, ‘দাদা বই শুরু হয়ে গেছে?’

‘এই একটু আগে হল। কটা চাই?’

‘একটা দিন।’ লুঙ্গির গেঁজ থেকে একশো-র ভাঁজ দেওয়া নোটটা আরও ভাঁজ করে শেষ পর্যন্ত গলিয়েই দিল কার্তিক। সত্তর টাকা আর একটা লাল রঙের টিকিট ফেরত এল হাতে। টিকিট হাতে নিয়ে ভেতরে ঢোকার আগে আরেকবার পিছন ফিরে ভ্যানটাকে দেখল কার্তিক। চুপ করে দাঁড়িয়ে রয়েছে ওটা, আর সামনে একটা নেড়িকুকুর ওটার দিকে তাকিয়ে লেজ নাড়ছে।

আবার মেঘ ডাকল। প্ল্যান মনে মনে ছকা হয়ে গেছে। বই দেখে তারপর বডি নিয়ে মর্গে যাবে। দেরি হওয়ার কারণ জিজ্ঞেস করলে বলতে হবে বৃষ্টিতে রাস্তায় আটকে গেছিলাম। ব্যস। জয়গুরু বলে অন্ধকার হলে ঢুকে পড়ল কার্তিক। এই হলে আগেও অনেকবার বই দেখেছে ও। সিট নাম্বার বলে কিছু নেই। যে আগে ঢুকবে তার নিজের পছন্দের মতো সিটে বসে পড়বে। ঘষা ধোঁয়াটে স্ক্রিন। সামনের দিকের বেশ কিছু চেয়ার ভেঙে মুখ থুবড়ে পড়ে রয়েছে। বোঝাই যায় এই অবদান দর্শকদের। আসলে এই হলটায় কিছুদিন আগেও তেড়ে পানু চলত। বাইরে পোস্টার থাকত আশির দশকের কিছু সস্তার হিন্দি ছবির। সেই ছবি শুরুও হতো, কিন্তু চলার কিছুক্ষণ পরেই চালু হয়ে যেত সাউথ ইন্ডিয়ান ব্লু। মাঝেমধ্যেই সেই ছবি অদ্ভুত ভাবে উলটে যেত কিংবা পুরোটা অন্ধকার হয়ে যেত। তখনই দর্শকের অশ্রাব্য খিস্তি। চেয়ারে লাথি। অনেক সময়ে দর্শকের হুকুমে একই সিন দুবার করেও চালাতে হতো প্রজেক্টরদের। এইসব ছবির দর্শক ছিল সব ভ্যানওলা, রিকশাওলা কিংবা সবজিওলা, মিস্তিরি আর স্কুলকলেজে পড়া কিছু উঠতি বয়েসের ছেলে। পুলিশকে প্রতি সপ্তাহে নমস্কারি দিয়ে আসতে হতো হল কর্তৃপক্ষকে।

তবু মাঝেমধ্যে রেড পড়ত আচমকা। যেসব দর্শকরা পিছনের দরজা দিয়ে পালাতে পারত না, ধরা পড়ত। হলের লোকের সঙ্গে পুলিশ ভ্যানে উঠতে হতো তাদেরও। বেশ কয়েকদিন বন্ধ থাকত হলটা। তারপর আবার যেই কে সেই। কিছুদিন আগে একটা বড়োসড়ো কেস খাওয়ার পর হলটা এখন পানু ছেড়ে বাংলা বই চালাচ্ছে। হল ভরতি নয়। সিটে বসে পড়ল কার্তিক। ওই তো গুরু… উহ্ কী দেখাচ্ছে দেবকে। পাশে একজন লুঙ্গি আর গেঞ্জি পরে সিটের ওপর পা তুলে বিড়ি টানছিল, তাকে জিজ্ঞেস করল কার্তিক। ‘কখন শুরু হল?’

‘এই তো এট্টু আগে।’

‘যাক তার মানে বেশি লস হয়নি।’ খানিকক্ষণের মধ্যেই ডুবে গেল ছবিতে।  মারকাটারি বই। উহহ না দেখলে যে কী লস হতো…। হেব্বি অ্যাকশন। দেবের নায়িকাটাকে অনেকগুলো গুন্ডা মিলে ছিঁড়েখুঁড়ে খাওয়ার জন্য তুলে নিয়ে পালাচ্ছিল। পাহাড়ের ধারে একটা জায়গায় শুইয়ে দিয়ে সবে জামাকাপড় ছিঁড়তে শুরু করেছে তখনই বাইকে করে গুরু এসে গেল। হাতে একটা লোহার রড। তারপর পনেরো-ষোলোটা গুন্ডার সঙ্গে একা ঝাড়পিট করল গুরু। রডের বাড়িতে, লাথিতে, ঘুসিতে সবকটাকে শুইয়ে দিল। কিন্তু লাস্টে তবু পারল না হিরোয়িনকে বাঁচাতে। আসলে ভিলেন দেবকে লক্ষ্য করে গুলি ছুড়েছিল। নায়িকাটা সামনে চলে আসায় দেব বেঁচে গেল কিন্তু মেয়েছেলেটার বুকে গুলি লাগল। মরে গেল মেয়েটা।

নায়িকাকে বুকে জড়িয়ে দেব এমন চিৎকার করে কাঁদছিল যে কার্তিকের চোখেও জল চলে এসেছিল। ইচ্ছে করছিল ভিলেনটাকে নিজের হাতে ক্যালাতে। তারপর দেব স্রেফ মুঠো পাকিয়ে একটা ঘুসি মারল ভিলেনটাকে। মালটা সেই ঘুসিতেই পাহাড় থেকে পুরো খাদে। সব্বাই হাততালি দিল। কার্তিকও। কিন্তু মনের ভেতর থেকে কষ্টের দলাটা নামল না। এত সুন্দর মেয়েটা মরেই গেল শালা। নায়িকাটার নাম জানে না কার্তিক। কিন্তু দেবের মতোই কাঁদতে ইচ্ছে করছিল ওর। খুব কাঁদতে ইচ্ছে করছিল। খুব কষ্ট নিয়ে হলের বাইরে আসতেই তুমুল চমক।

ওর ভ্যানটার সামনে ভিড়ে ভিড়। কয়েকটা কুকুর বিটকেল চিল্লাচ্ছে। আর ওর ভ্যানে শুইয়ে রাখা বডিটাকে টেনে নামানোর জন্য প্লাস্টিকটাকে সবকটা মিলে এমনভাবে টানাটানি করছে যে, প্রায় ছিঁড়ে ফালাফালা হয়ে গেছে ওটা। বডির বেশ খানিকটা দেখা যাচ্ছে এখন। সামনে দাঁড়ানো সবকটা লোকও বেজায় চিৎকার করছে। চুপ করে কিছুক্ষণ দাঁড়াল কার্তিক। এবার কী করা উচিত ভাবার চেষ্টা করল। ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি হচ্ছে। ‘কোন শুয়োরের বাচ্চা রেখে গেছে আমরা কী করে জানব?’ একজন চিল্লাল।

‘আরে কেউ বুঝতে পারত নাকি? কুকুরগুলো টানাটানি করে প্লাস্টিকটা ছিঁড়ল বলেই তো বোঝা গেল ভেতরে বডি রয়েছে। কী ঝামেলা বলুন তো এখন পুলিশের ঠেলা…।’

কার্তিক একবার ভাবল বডি ছেড়ে কেটে পড়বে। কিন্তু কুকুরগুলো এমনভাবে বডিটার পা ধরে কামড়ে নামাতে চাইল যে আর নিজের মাথার ঠিক রাখতে পারল না কার্তিক। আর দেরি করলে মেয়েছেলেটাকে সবার সামনে খুবলে খাবে ওগুলো।

আই সা..ল..লা..হ বলে দুহাত ছড়িয়ে দিগ্বিদিগ্ জ্ঞান হারিয়ে কুকুরগুলোর দিকে ছুটে গেল কার্তিক। কুকুরগুলো কার্তিকের এমন মারমুখী চেহারা দেখে একটু থমকাল, তারপর আবার বডিটার এদিক-ওদিক কামড়ে ভ্যান থেকে নামানোর চেষ্টা করল। সামনে দাঁড়ানো লোকগুলো যেন তামাশা দেখছে। সামনে পড়ে থাকা একটা কাঠের টুকরো তুলে এলোপাতাড়ি ঘোরাতে শুরু করল, দমাদ্দম পেটাতে শুরু করল যেটাকে সামনে পেল, অবিকল…

মিনিট কয়েকের মধ্যে রণে ভঙ্গ দিয়ে একটু দূরে দাঁড়িয়ে চেল্লাতে থাকল কুকুরগুলো। আর কার্তিক বড়ো বড়ো নিঃশ্বাস ফেলতে ফেলতে ভ্যানে শোয়ানো শরীরটাকে আবার গুছিয়ে নিয়ে ভ্যান টেনে চুপচাপ চলে যেতে গেল, ঠিক তখনই ওকে আটকাল ভিড়ের কয়েকটা লোক।

‘এই ভাই এই, এটা কোথায় নিয়ে যাচ্ছিস?’

‘মর্গে।’ মেজাজ নিয়ে উত্তর দিল কার্তিক। কুকুরগুলোর হাত থেকে মেয়েছেলেটাকে বাঁচাতে পেরে মনটা ফুলে উঠেছে। ভাগ্যিস ঠিক সময়ে এসে পড়েছিল। নইলে…

‘মানে?’ সবাই তাকাল ওর দিকে।

‘বই দেখতে ঢুকেছিলাম। এই বডি আর ভ্যান আমার। এই যে আমার কাছে জিআরপি-র কাগজ রয়েছে। বডিটা মর্গে…’

আর কথা শেষ হল না। কারও একটা সলিড থাপ্পড় এসে পড়ল কার্তিকের গালে। টাল সামলাতে না পেরে মাটিতে মুখ থুবড়ে পড়ে গেল কার্তিক।

শুরু হল অবিরাম লাথি, ঘুসি… আর খিস্তি। ‘শালা বাইরে লাশ রেখে সিনেমা মারাতে এসেছ… পাতাখোর…তোর রস বার করছি…’ মার খেতে খেতে বারবার দেবের কথা মনে পড়ছিল কার্তিকের। হেব্বি ইচ্ছে করছিল গুরুর মতো ইয়াআআ করে দুহাত ছড়িয়ে উঠে দাঁড়িয়ে সবকটাকে ক্যালাতে। একটু আগে যেভাবে কুকুরগুলোকে…। পারল না। মাটিতে কুঁকড়ে বসে একবার চোখ মেলল কার্তিক। তাকাতেই দেখল ওর পাশে বসা সেই লুঙ্গি পরা লোকটাও পা তুলছে ওকে লাথি মারবে বলে… আবার চোখ বন্ধ করে ফেলল।

অনেক রাত্তির। বৃষ্টি পড়ছে অঝোরে। বারবার বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। হু হু ফাঁকা রাস্তার এক ধারে থুবড়ে শুয়ে ছিল কার্তিক। জবজবে ভিজে। নড়াচড়া করতেও কষ্ট হচ্ছে। গোটা গায়ে অসহ্য ব্যথা।

বাঁ-চোখে কিছুই প্রায় দেখতে পাচ্ছে না। চোখটা পাবলিকের মারের চোটে গেছে বোধ হয়। অনেক উঁচুতে ল্যাম্পপোস্টের হলদেটে আলোটা বৃষ্টির ধোঁয়ায় ঝাপসা। হামাগুড়ি দিয়ে ভ্যানের চাকা ধরে কোনও মতে উঠে দাঁড়াল। এমন ক্যালানি বাপের জন্মে খায়নি ও। উহহ্…। মুখ ফুলে ঢোল। ঠোঁটের কষে রক্ত জমাট বেঁধে রয়েছে। একেবারে গুরুর মতো অবস্থা। বিদ্যুতের আলোয় ওর মুখটা অদ্ভুত লাগছে। হঠাৎ দাঁত কিড়মিড় করে বাঁহাতের তর্জনী তুলে কাউকে তীব্র শাসাল কার্তিক। তারপর রাস্তার মাঝখানে এসে দাঁড়াল। তুমুল বৃষ্টি পড়ছে। ছেঁড়াখোঁড়া প্লাস্টিকটা দিয়েই কোনওমতে ঢাকা দেওয়া ভ্যানের ওপর শোওয়ানো বডিটা। আজ আর মর্গে পৌঁছোতে পারেনি ও। শরীরে কুলোয়নি। তুমুল ক্যালানি খাওয়ার পর ভ্যান চালিয়ে খানিকটা যাওয়ার পরেই রাস্তার একধারে কেতরে পড়েছিল। মোবাইলটাও হারিয়েছে বলে কাউকে খবর দিতে পারেনি। কাল কপালে অশেষ দুঃখ আছে। কাজটা আর থাকবে না নিশ্চয়ই। কিন্তু কিছু করার ছিল না। শরীরে দিচ্ছিল না অত দূর ভ্যান টেনে যাওয়ার।

ভ্যানটার দিকে কিছুক্ষণ অপলক তাকিয়ে থাকল কার্তিক। মাথার ভেতর অনেক ভাবনা আসছে। ঝিমঝিম করছে মাথাটা। বারবার ক্যালানি খাওয়ার দৃশ্যটা মনে পড়ছে আর ভেতরটা রাগে জ্বলেপুড়ে যাচ্ছে। রাগটা বাড়তে বাড়তে একসময় প্রায় ঘোর লাগিয়ে দিল কার্তিকের সরষের দানার সাইজের ঘিলুতে। আস্তে আস্তে ভ্যানের চারদিকটায় পাক দিল। তারপর বেঘোরেই ভ্যানের সামনে এসে দড়িগুলো খুলে একটানে প্লাস্টিকটা সরিয়ে দিল ও। বডিতে জড়ানো কাপড়টা খুলতে এই জীবনে প্রথমবার খানিকটা যেন চমকালো কার্তিক। মুখ ঝুঁকিয়ে মেয়েটার মুখ খুব সামনে থেকে দেখল। চোখদুটো খোলা। মুখের কোথাও আঘাতের চিহ্ন নেই। কী সুন্দর মুখটা! হয়তো সুইসাইড নয়, ট্রেনে ধাক্বা খেয়ে দূরে ছিটকে পড়েছিল। আবার বিদ্যুৎ চমকানোয় মুখটা একঝলক দেখতে পেল। খুব চেনা মুখ… কোথায় যেন… দেবের নায়িকাটার মতো…?

হঠাৎ যেন মাথাটা পুরো এলোমেলো হয়ে গেল কার্তিকের। একদৃষ্টে অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইল মেয়েটার শরীরের দিকে। বুকের খাঁচা বেলুনের মতো ফুলছে নামছে উত্তেজনায়। শুয়োরের বাচ্চা… ইয়ায়ায়ায়ায়া… করে

দু-হাত ছড়িয়ে উঠে দাঁড়াল একবার, অবিকল দেবের স্টাইলে। তারপরেই মেয়েটার সামনে হাঁটু গেড়ে দুমড়ে নেতিয়ে বসে পড়ল। আকাশের দিকে মুখ তুলে করুণ কুকুরের মতো সুর করে বিকৃত কান্নার আওয়াজ তুলল। দু-হাত ছড়িয়ে কান্নার অভিনয় করতে করতে হঠাৎ সত্যি সত্যিই একটা মোচড় দেওয়া দুঃখ হল সামনে শুয়ে থাকা অচেনা মেয়েটার জন্য। নিজের বেখেয়ালেই কয়েক ফোঁটা জল বেরিয়ে এল ওর চোখ থেকে, অকারণে। কিন্তু নায়কদের সত্যি সত্যি কাঁদতে নেই বলেই বোধ হয় বৃষ্টির জল সঙ্গে সঙ্গে ধুইয়ে দিল সেই কান্না। বারবার বিদ্যুৎ চমকাচ্ছিল। কার্তিক চোখ বুজে বসে রইল সেই বৃষ্টিতে। আর মৃত মেয়েটার অবাক খোলা চোখের ভেতর বৃষ্টির জল গড়িয়ে পড়তে থাকল অবিরাম।

 

জ্যামিতিক

‘একটা চতুষ্কোণ মাটি দরকার, বুঝলেন?’ নীলাভ মাংকি-ক্যাপটাকে কপালের নীচে আকর্ষণ করল। অসম্ভব ঠান্ডা পড়েছে। বাতাস ভারী হয়ে আছে। শ্বাস নিতে কষ্ট হয়। তাছাড়া, মর্নিংওয়াক শব্দটায় যতটা আরাম এবং স্বাস্থ্যচর্চা মিশে আছে, বাস্তব অবশ্য অন্য কথা বলে। এই হাত, পা, এই শরীর এতটাই জড় যে, সামান্য নড়াচড়াও ভীতিকর। মানস হাতের রুপো বাঁধানো লাঠিটা জোরে ঠুকল মাটিতে, ‘কী হল? দাঁড়িয়ে পড়লেন যে।’

‘আসলে, ভাবছি। ক’দিন যাবৎ একটা কথাই ভাবছি’ নীলাভ মানসের চোখের দিকে তাকায় ‘একটা বাড়ি করতে পারিনি এখনও! আমার একটু মাটি চাই। দেড়-দুকাঠা হলেও হবে। খোঁজ আছে নাকি?’

‘বাড়ি? সাতকুলে কেউ নেই আপনার, বাড়ি করবেন কার জন্য?’

মানস থমকে গেল।‘আমার জন্যই। একটা বাড়ির স্বপ্ন দেখছি। খুব লোভ হচ্ছে জানেন! ভাবতেও ভালো লাগে! নিজের বাড়ি!’ নীলাভ অপ্রস্তুত হাসি লুকিয়ে ফেলার চেষ্টা করে।

মানস হেসে ফেলে। ‘এটা আবার ব্যাপার নাকি? হয়ে যাবে। ঠিক আছে। জানা রইল।’ মানস ভিজে ঘাসের উপর ফের লাঠি ঠুকল। শব্দ হল না। ভেজা মাটি কোনও শব্দ করে না। লাঠিটা দেখতে দেখতে বাস্তবের মাটিতে পা রাখছিল নীলাভ– ‘আচ্ছা! আজ দেখছি লেঠেল হয়ে বেরিয়েছেন! শখ?নাকি প্রয়োজন?’‘আরে, প্রয়োজন ছাড়া কি আর…! বুড়ো হতে কার ভালো লাগে বলুন? ক’দিন ধরেই যন্ত্রণা হচ্ছে পায়ে। তো, গিন্নি লাঠিটা এগিয়ে দিলেন, সঙ্গে রাখো। আরাম হবে। দেখছি কথাটা মিথ্যে নয়। আসলে, ভারটা অন্যের উপর রাখলে স্বস্তি মেলে।’ মানসের হাসি দেখতে দেখতে নীলাভর ঠোঁটও প্রসারিত হতে থাকে। স্থির লক্ষ্যে পৌঁছোনোর আগেই অবশ্য থেমে যায় নীলাভ। সত্যিই কি বার্ধক্য এসে গেছে? তাই কি চট করে ঠান্ডা লেগে যায়?

‘সব কিছু পালটে গেল কীরকম। এই শহরে তেত্রিশ বছর কাটিয়ে দিলাম। যখন এসেছিলাম চব্বিশ পঁচিশের টগবগে ঘোড়া!’ নীলাভ কুয়াশার ভেতর দৃষ্টি নিক্ষেপ করার চেষ্টা করে।

‘আমি যে পাঁচবছর ধরে আছি, আমারই তাই মনে হয়। পড়শি পর্যন্ত পালটে যায় মশাই। শহর একেই বলে।’ হা-হা শব্দে হাসে মানস। নীলাভ মনে মনে হাসে। মানস ভাড়াটের কথা বলছে। পাঁচ বছরের মধ্যে বাড়ি বানিয়েছে। ভাড়াটে বসিয়েছে। সারাদিন খ্যাঁচম্যাচ্! ধুর! নিজের বাড়িতে নিজের সঙ্গে বাস করার আনন্দ বুঝবে না মানস। বাড়ির সঙ্গে গৃহস্থের যা সম্পর্ক, ভাষার সঙ্গে বর্ণমালার সেই সম্পর্ক।

মানসের হাসির শব্দে জগিং-এ ব্যস্ত তরুণী চমকে তাকাল। দু-একজন স্বাস্থ্য অন্বেষণকারী ওঁদের দেখছে বুঝে লজ্জিত হয় নীলাভ– ‘আস্তে! আস্তে!’

‘ওঃ! ভাষার সঙ্গে বর্ণমালা আর গৃহস্থের সঙ্গে বাড়ি? দারুণ!’

‘কথাটা চুরি করেছি। গণিতশাস্ত্রবিদ ইউক্লিডের কথা এটা। অবশ্য একটু অন্যভাবে বলা।

‘তো, কী বলছিলেন? গৃহস্থ আর বর্ণমালা…?’

নীলাভ হাসল। ‘দেখুন, এসব তত্ত্বের জন্য যুক্তিতর্ক দরকার হয় না। একে স্বতঃসিদ্ধ মেনে নিতে পারেন। সত্য বলে ভাববেন।’

‘না না! তা বলছি না। তবে, কথাটা বেশ।’ মানস লাঠিখানা মাটির উপর থেকে তুলে নেয়। নীলাভ একটু দাঁড়াল। ইদানীং হাঁপ ধরে যাচ্ছে সহজেই। দুপাক হাঁটতেই মাঠটাকে বিশাল এবং ভয়ংকর বলে মনে হচ্ছে। যেন বিরাট শূন্যতা গিলে খেতে আসছে। যেন হারিয়ে যাবে নীলাভ এই মহাশূন্যতায়। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে শারীরিক ও মানসিক অবস্থার পরিবর্তন হচ্ছে। কেন পালটে যাচ্ছে শরীর, বা কেন মানসিক অবস্থা পরিবর্তিত হয়ে যায় তার কোনও যুক্তিতর্ক নেই। প্রশ্ন নেই। এসব হল স্বতঃসিদ্ধ।। এলিমেন্টস নামক বইতে ইউক্লিড একথা বলেছেন।

মানস গিন্নির দেওয়া লাঠিখানাকে ফের ভেজা মাটির উপর বসিয়ে দিয়ে হাঁটতে শুরু করেছে। একটা লাঠি তো নীলাভরও দরকার ছিল। কিন্তু কে এগিয়ে দেবে সেই স্বস্তি-দণ্ড? মানস জানে সাতকুলে কেউ নেই নীলাভর। যদি থাকত, তবে এই কুয়াশাভরা মাঠে রুপোর লাঠি আজ নীলাভর হাতেও থাকত।

এখনও কুয়াশা ছড়িয়ে আছে মাঠ জুড়ে। দূরে দূরে দু-একটা ধোঁয়ামূর্তি নজরে আসে। শুদ্ধ বাতাস শহরে নেই। চারপাশে কি কুয়াশা? নাকি ধোঁয়াশা?

‘আজ মেয়ে-জামাই আসছে গোরখপুর থেকে। ওখান থেকে নেপালে গেছিল। মায়ের জন্য নানাবিধ গিফ্ট আসছে। ওর মা-তো গত কাল থেকেই টেনশনে… কী আনবে ওরা…!’ মানসের সুখী মুখে লালচে গোলাপ ফুটেছে। এই তো জীবন! সুখ নিয়ে বেঁচে থাকা। মানস হাসিহাসি মুখ করে, ‘গিন্নি বায়না ধরেছেন জামাইকে মালাই চিংড়ি খাওয়াবেন। নারগিসি কোফতা বানাবেন! হই হই কান্ড। বুঝেছেন?’

বুঝল নীলাভ। মানস এখন ফিরতে চাইছে। কাজ আছে বাড়িতে। ফিরে আসতে গিয়ে শর্টকাট করতে চাচ্ছিল মানস। নীলাভ কথাবার্তায় ভুলিয়ে সোজাপথে নিয়ে এল মানসকে। শর্টকাট অপছন্দ নয়। তবে, ওই পথটা বড়ো কঠিন পথ। একটা অস্বস্তিকর অবস্থা তৈরি হয়। মাস ছয়েক আগে একদিন অবশ্য গেছিল। আজ আর গেল না। একদিন গেলে কদিন যাবৎ অস্বস্তিটা জাপটে থাকে শরীর-মনে। বড্ড কষ্ট হয়। ভয় হয়। যেন স্বপ্নে দেখা নিঃসঙ্গ পথ। আলো নেই। আশ্রয় নেই। শূন্যতা কেবল। ভালো লাগে না। আবার, ভুলেও থাকা যায় না।

বাজারের রাস্তা ধরল মানস। বাজার ছাড়িয়ে ডানদিকের সরু গলিতে ঢুকে পড়ল নীলাভ। এবার শর্টকাট। তার আস্তানাটা আবার কাছে নয়। সোজাপথে সময় লাগবে।

বাসার কাছাকাছি আসতেই সীমন্তর সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। মেসবাড়ির মেস-ম্যানেজার সে-ই। বাজার সেরে ফিরছে। নীলাভকে দেখে দাঁড়াল। ‘নীলাভদা যে! আজ বিফোর টাইমে!’

হাসে নীলাভ। ‘কী আনলে। কী মাছ?’

‘মাছ নয়। মাংস। সবাই ধরে বসল।’

‘কেন? কোনও ব্যাপার আছে বুঝি?’

‘না, মানে ওই আর কী…!’ সীমন্ত এদিক-ওদিক তাকায়।

ছেলেটা স্পষ্ট হল না। অথচ ভেতরে একটা কথা আছে ঠিক। বেশ। খেতে বসে জানা যাবে।

বারান্দায় টিনের চেয়ার টেনে বসল নীলাভ। কাগজফুল গাছে অনেক ফুল ফুটেছে। আসলে বোগেনভিলিয়া। তারা ছেলেবেলায় কাগজফুল বলেই জানত। এমন প্রাণময় গাছটার এমন একটা জড় নাম কেন ছিল? লিপ্তা বলেছিল, এই ফুলে পুজো হয় না। কেন হয় না? লিপ্তা জবাব দিতে পারেনি। অবশ্য অনেক কথারই জবাব দিতে পারেনি লিপ্তা। কখনও পারেনি। ভরাট ঠোঁট টিপে দাঁড়িয়েছিল মাত্র। যুগলপ্রসাদ রোদে দাঁড়িয়ে খবরের কাগজ পড়ছিল। ছেলেটা চমৎকার বাংলা বলে। মাঝে মধ্যে তৎসম শব্দও ব্যবহার করে। ডাকল নীলাভ ‘এই যে যুগল!

ঠান্ডা কীরকম?’

‘ঠান্ডা?’ যুগল পেছন ফিরে তাকাল ‘উত্তরোত্তর বেড়ে চলেছে। আর কদিন পর শৈত্যপ্রবাহ শুরু হবে।’

কিছু বলতে মুখ খুলেছে নীলাভ, দীপংকর চ্যাঁচাল– ‘খাবার রেডি। ফটাফট এসে পড়ুন সবাই।’

খেতে বসে আসল কথাটা জানা গেল। সীমন্তর ছেলে হয়েছে। আজই। সকালে ফোন এসেছে। আগামিকাল সীমন্ত যাচ্ছে বালুরঘাটে শ্বশুরবাড়িতে। ছেলেকে দেখতে।

খুশি হওয়ারই কথা। খুশিই হল নীলাভ। সীমন্তর চনমনে মুখের দিকে তাকিয়ে অন্যমনস্ক হয়ে পড়ল ও। বারান্দায় কে জল ফেলে রেখেছে। পড়তে পড়তে বেঁচে গেল। যে-যার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়বে। একমাত্র ওর কোনও কাজ নেই। ধীরেসুস্থে স্নান সেরে খবরের কাগজ নিয়ে বসবে। কাগজফুল গাছটা বাতাসে ফুলপাতা দুলিয়ে চলেছে খসখস শব্দে। যেন বই-এর পৃষ্ঠা উলটে যাচ্ছে নিজে থেকে। কত ঘটনা কত মিলন-বিচ্ছেদের কাহিনি লেখা আছে সেইসব পৃষ্ঠায়।

আজ সবাই খুশি। সীমন্তর ছেলে এল। মানসের মেয়ে-জামাই এল। চিংড়ি রেঁধেছে মানসের বউ। স্বাভাবিক। খুশি হওয়ারই কথা। একটা জ্যামিতিক কোণ পুরো হল।

বাইকের শব্দে চটকা ভেঙে গেল। যুগলপ্রসাদ অফিসে গেল। দিবাকর সাইকেল বের করে আনছে বারান্দায়। ভূদেবের অফিস কাছেই। জিৎ, দেবনাথ ব্যাগ ঝুলিয়ে মেট্রো ধরতে দৌড়োচ্ছে। এই লোকটা কখনও হাসে না। ঠিক এইরকম একটা স্কুটার ছিল নীলাভর। এটা কার? সজীবের। সজীব স্কুটার ঠেলে নামাচ্ছে। নীলাভ হাটবাজার, অফিস… সর্বত্র স্কুটার নিয়ে চলত। অবশ্য লিপ্তা ছিল। পিছনে বসে জাপটে ধরে থাকত। জীবনটা বেহিসেবি হয়ে গেল নীলাভর! হিসেব করে চলতে শেখা হল না!’

অন্যদিন সন্ধে রাতে শুয়ে পড়ে। আজ ইচ্ছে হল না। নানা ভাবনায় মাথাটা গরম। প্রেশারটা চেকআপ করাতে হবে। একটু শুয়ে থাকলে হয়তো ভালো লাগবে। নাঃ! বসে থাকাই ভালো। অস্থির নীলাভ ফের শুয়ে পড়ে। কে ডাকে? অর্ণব স্যার? চার পাঁচজন ছেলেকে ডেকে ব্ল্যাকবোর্ডের সামনে দাঁড়িয়ে কী বোঝাচ্ছে?

‘দ্যাখ, একটা সরলরেখা অন্য দুটো সরলরেখাকে ছেদ করলে, একপাশের দুই কোণের সমষ্টি যদি একশো আশি ডিগ্রির কম হয়, তাহলে সরলরেখা দুটোকে দুই পাশে বাড়ালে কোথাও না কোথাও মিলবেই।’ চক দিয়ে খসখস শব্দে সরলরেখা টানে অর্ণব স্যার! সেই শব্দে চোখ মেলে তাকায় নীলাভ। স্বপ্ন দেখছিল! আর ঘুম হবে না। উঠে জল খেল নীলাভ। কনকনে ঠান্ডাজল গলা কেটে ফেলল ধারালো অস্ত্রের মতো। মধুমিতা ঠান্ডা জল খেতে দিত না। ফ্লাস্ক রাখত টেবিলে। গরম জলের ফ্লাস্ক। কিন্তু এতদিন পর ছেলেবেলার স্যার কেন এল স্বপ্নের ভেতর? কী শেখাল এতক্ষণ ধরে? কেন বলল না নীলাভর জীবনের খামতির কথাটা? কেন নীলাভর জীবনের দুটো কোণের সমষ্টি একশো আশি ডিগ্রি হয়নি? একটা চতুষ্কোণ মাটি পাওয়া হল না। তার ভিতরে ঘর। তার ভিতরে সংসার। মধুমিতাও কি এভাবেই ভাবে? হয়তো ভাবে, হয়তো ভাবে না। সে তো সাহিত্যের ছাত্রী! একটু নরম, একটু লাজুক। স্কুটারের পেছনে বসতে ভয় পেত। মুকুন্দপুরে বন্ধুর বাড়িতে যাচ্ছিল। সিল্কের শাড়ি পিছলে মধুমিতা…! লজ্জায় কেঁদে ফেলেছিল। বন্ধুর বউ বকুনি দিয়েছিল। ‘বউ পড়ে গেল, আপনি হাসছেন?’

বাড়িতে ফিরেও রাগ পড়েনি মধুমিতার। অনেক কষ্টে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে হয়েছে। অঝোর বৃষ্টি পড়ছিল সে রাতে। মধুমিতা বিরহের গান গেয়েছিল। ভালো গাইত ও। নীলাভ চেয়েছিল মধু গানের চর্চা রাখুক। ভালো গাইত।

দু-চারজন ছাত্রীও জুটে গেল। সে সময়ই এল লিপ্তা।

গাঢ় অন্ধকারের দিকে জোনাকি খুঁজল নীলাভ। টর্চটা কোথায়? এত অন্ধকার কেন? আজ কি অমাবস্যা? এই যে টর্চ…! লিপ্তার চটক ছিল। স্মার্টনেসও। গুছিয়ে শাড়ি পরত লং কোটের সঙ্গে। মনে মনে কি এমনই একটা অন্বেষণ ছিল? নিজের মনকে বুঝতে পারেনি নীলাভ!

চোখ বুজে ফেলল। ভালো লাগছে না। বরং বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালে ভালো লাগবে। …নাঃ! খুব ঠান্ডা বাইরে। অসুখ হলে কে দেখবে? অথচ প্রবল ঠান্ডা বলে কিস্যু ছিল না। আগুন জ্বলত শরীর-মনে। দাউদাউ আগুন। লিপ্তার হাজব্যান্ড তখন চণ্ডীগড়ে। কোয়ার্টার পায়নি। টু বিএইচকে ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে চার বন্ধু থাকত। লিপ্তাকে সেখানে নেওয়ার সুবিধে ছিল না। এদিকে লিপ্তার তখন অখন্ড অবসর। গান শিখতে আসত মধুমিতার কাছে। আর নীলাভ? কী করে যেন সব ভুলে যেতে থাকল। এমনকী গোল্ডিকেও!

মধুমিতা যখন সব বুঝল, তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। ততদিনে মুক্তির সন্ধান করছে নীলাভ। মধুমিতার হাত থেকে মুক্তি। প্রথম প্রথম ঝগড়াঝাঁটি। তারপর স্পষ্টভাষায় মুক্তি চাইল নীলাভ। লিপ্তাকে ছাড়া ওর আর পৃথিবী বলতে কিছুই কি ছিল?

উঃ! কী মশা বাইরে! নীলাভ ফের মশারির ভেতরে ঢুকে পড়ে। কখন ভোর হবে।… স্তব্ধ হয়ে গেছিল মধুমিতা। তারপর জড়তা ভেঙেছিল। ‘মুক্তি চাইছ যখন, যাও। একদিন বুঝবে কত কঠিন কাজ করলে আজ। কিন্তু আরও কঠিন কাজ রয়ে গেল। আর কখনও ফিরে আসতে পারবে না।’

ইচ্ছেও ছিল না ফিরে আসার। বাড়িটা তো মধুমিতার। উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া। সে বাড়ি কখনও নীলাভর ছিল না। খোলামেজাজে বেরিয়ে এসেছিল। মুক্তি! আবার বাঁধা পড়ার জন্য মুক্ত!

মাত্র সাতদিন আগেই শ্যামবাজার পাঁচমাথার মোড় থেকে লিপ্তার পছন্দমতো জাংক জুয়েলারি সেট কিনে দিয়েছিল নীলাভ। ফেডেড জিন্সের সঙ্গে দারুণ মানিয়েছিল লিপ্তাকে।

‘একি? ঘুমোননি এখনও?’ দিবাকর বাথরুমে যাচ্ছে।

‘ক’টা বাজল দিবাকর?’

‘মর্নিং ওয়াক? দেরি আছে। সবে আড়াইটে। ঘুমোন।’

বাথরুমে জলের শব্দ। ছলছল শব্দে বয়ে যাচ্ছে জল। এভাবে বয়ে গেল একটা জীবন। মধুমিতা কখনও কিছু দাবি করেনি। ওর এতটা আত্মসম্মানজ্ঞানের সন্ধান আগে পায়নি নীলাভ। বুঝতেই পারেনি। এখনও কি মধু আগের মতই আছে? আর লিপ্তা? ভয় পেয়ে গেছিল নীলাভর পাগলামিতে। অথচ বুঝতে দেয়নি। বর চণ্ডীগড়ে নাকি ফ্ল্যাট কিনেছে। লিপ্তা চলে গেল সংসারের খোঁজে। সেই চতুষ্কোণ মাটির গল্প। নাকি নীলাভকে বিশ্বাস করতে পারেনি? যে লোক অতি সহজে চতুষ্কোণ মাটি ভেঙে ফেলে বেরিয়ে আসতে পারে তাকে বিশ্বাস করেনি লিপ্তা। মানস কী যেন বলছিল? সাতকুলে কেউ নেই, মাটি দিয়ে কী করবে? সত্যি! কী করবে তুমি? কে থাকবে তোমার মাটিতে? বৃত্তাকার ঘেরাটোপে তুমি এক স্বতন্ত্র নিঃসঙ্গ সত্তা নীলাভ!

ওফ্! এত মশা! মশারির গায়ে আটকে গুনগুন করে চলেছে। ওর দিকে আঙুল তুলছে মশারা। অভিযোগের বাণ ছুড়ছে! মাথা ধরে যায়!

শেষ রাতে ঘুমিয়ে পড়ল নীলাভ। মানস ডাকতে এসেছে। উঠে গরম পোশাক চাপিয়ে কুয়াশার ভেতরে নেমে গেল ওরা। বকবক করছিল মানস।

‘নাতনিটি বুঝলেন, পাকা দি গ্রেট। পটপট কথা বলে। খুদে ঠাকুমা। বলে, একা একা বের হবে না কিন্তু। পড়ে গেলে কে ধরবে? ভাবুন!’ হাঃ হাঃ শব্দে হাসে মানস। সেই হাসিতে সুখের গন্ধ ওড়ে।

মানস জোরে হাঁটতে পছন্দ করে। পায়ের যন্ত্রণাটা হয়তো নেই। আজ তো লাঠিও আনেনি। নীলাভ তাল রাখতে পারছিল না। শরীর বশে নেই। হাঁটু যেন ভেঙে পড়ছে।

‘শরীর ভালো নয় নাকি? চলুন, ফিরে যাই। আমার বাড়ি চলুন। গরম চা হয়ে যাবে এক রাউন্ড।’

না। আর কেন। লোভ হয় ঠিকই। কিন্তু সামলাতে জানতে হয়। সেটা জানা ছিল না বলেই হয়তো জ্যামিতিটা সম্পূর্ণ হল না। মানস বার তিনেক কথা চালাতে চেষ্টা করল। কিন্তু নীলাভর তরফ থেকে প্রত্যুত্তর না পেয়ে নীরব হয়ে গেল। ধীর পায়ে হাঁটছিল নীলাভ। মানস অবাক হল। নীলাভ আজ সোজা পথ ধরছে না। শর্টকাট করবে নাকি? গতকালও যেতে চায়নি। আজ নিজে থেকে….? কিছু বলছিল মানস। নীলাভ শুনতে পায়নি। বিষম উত্তেজনায় ধড়ফড় করছিল বুক। কেন যাচ্ছে এপথে? অদৃশ্য এক সুতো যেন প্রবল আকর্ষণে নিয়ে যাচ্ছে ওকে। ছ-মাস আগে একবার এই রাস্তায় ঢুকেছিল। তাকাতে পারেনি। আজ তাকাবে। পূর্ণ দৃষ্টি মেলে দেখবে।

বাড়ির চেহারাটা অন্যরকম হয়ে গেছে! দোতলাই আছে অবশ্য। গোল্ডিকে দেখেছে একদিন। সঙ্গে গোল্ডির বউ ছিল। কেনাকাটা করছিল। মধু এখন শাশুড়ি। ছেলে, ছেলের বউ নিয়ে মধুমিতা সুখী? সবটাই হল মানিয়ে নেওয়া। সুখ তো সোজা পথেই আসে। শর্টকাটে তাকে পাওয়া যায় না।

‘কী ভাবছেন?’

‘কিছু বললেন?’

‘বলছি, এসব জায়গায় কত বাড়ি উঠেছে। ক’মাস আগেও ফাঁকা ছিল। প্রোমোটর-রাজ শুরু হয়ে গেছে।’

ঠিক। ফাঁকা ছিল এদিকটা। বারান্দায় দাঁড়ালে অনেকটা দেখা যেত। পাড়ার দোকানি, পাশের বাড়ির বকুল, পলাশ… চিনে ফেলবে কি নীলাভকে? কেন চিনবে না? নিশ্চয়ই ওরা দেখেছে ওকে। একই জায়গায় যখন বসবাস!

‘মশাই, প্রোমোটররা যা সব হয়েছে…’ মানস বকবক চালিয়ে যাচ্ছে।

এক ঝলকের জন্য তাকাল নীলাভ! বাড়িটার সামনে দিয়ে চলে যেতে যেতে একবার চোখ তুলল ও। কেউ কি ছিল জানলায়? পর্দাটা নড়ছে না? না। কেউ নেই! কাকে আশা করেছিল নীলাভ!

‘ওই বাড়িটা’ আঙুল তুলে দেখাল নীলাভ ‘ওই যে হলদে… দোতলা বাড়িটা… ওই বাড়িতে… আমার…!’

‘রিলেটিভ? চেনা লোক?’

রিলেটিভ? কি জানি! রিলেশন না থাকলে রিলেটিভ হয়? বলা যায়? নীলাভ আঙুলটা নামাতে ভুলে যায়।

‘আগে সাদা রং ছিল। হাতির দাঁতের মতো রং। দোতলার বারান্দায় জাফরি ছিল।’

‘ও।’

‘ছেলেটা খুব ছোটো তখন। বছর পাঁচেক। খুব হাসত। একটা দাঁত পড়েছিল। ফোকলা। বললে বিশ্বাস করবেন না কোলে নিলে কাঁধের কাছটা লালা ফেলে ফেলে ভিজিয়ে দিত।’ হাঃ হাঃ শব্দে হাসতে থাকে নীলাভ। এই ঘটনার মধ্যে অবিশ্বাস্য ব্যাপারের অন্বেষণ করতে নীলাভর মুখের দিকে অবাক হয়ে তাকায় মানস।

‘এত পরিচিত যখন, গেলেই পারেন, সময়ও কাটে।’ গলায় মাফলার জড়াতে জড়াতে পরামর্শ দেয় মানস।

‘যাব? যাওয়া যায়?’ ভীষণ বিস্ময়ে মানসকে দেখে নীলাভ। মধুমিতা বলেছিল এ কাজটা আরও কঠিন। সত্যি কথা। গেট খুলে ডোরবেলে আঙুল রাখা যাবে? কে খুলবে দরজা? কে দাঁড়াবে দরজা খুলে? গোল্ডি? গোল্ডির বউ? নাকি…

কে যেন বলেছিল শূণ্যস্থানে কোনও বস্তু থাকলে তা তার চারপাশের জায়গাটাকে দুমড়ে মুচড়ে দেয়। বাঁকিয়ে দেয়। কোথায় যাবে নীলাভ? ওর জন্য কোনও সহজ পথ নেই। কোনও সরলরেখা নেই। সবটাই বক্ররেখা! কতদিন শূণ্যস্থানে থাকবে নীলাভ? চারপাশ যে দুমড়ে মুচড়ে গেল! কেন এত দেরি হল সবকিছু বুঝতে? অর্ণব স্যার তো কবেই বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। বুঝেও ছিল। কিন্তু বুঝেছিল কি সত্যি? তাহলে প্রয়োগ করতে পারেনি কেন? কেন লিপ্তার দিকে অমন প্রবলবেগে ভেসে যাচ্ছিল ও?

হঠাৎই শীত করে ওঠে নীলাভর। এতক্ষণে যেন টের পেল শীতকাল এসে গেছে! জল বরফ হয়ে যাচ্ছে! প্রবল শৈত্যপ্রবাহের মধ্যে দুঃসহ ভীতি এসে হাত পা নখ বের করে তাড়া করে। বিশাল ফাঁকা মাঠ হুহু শূণ্যতার মধ্যে টেনে নিতে থাকে নীলাভকে।

মানস কিছু বলছিল। শুনতে পেল না নীলাভ।

মানসের পাশে পাশে হেঁটে যায় এক উদ্বাস্তু। একা নিঃসঙ্গ!

 

জন্মভিটে

প্রণয় বহু বছর গ্রামের বাড়ি থেকে বাইরে। প্রণয়ের বদলির চাকরি। ষ্টেট ব্যাংক-এর ম্যানেজার। দুবছর বিহারে তো দুবছর আন্দামানে। বদলির চাকরির জন্য ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে ঘুরে বেড়িয়েছে। পুজোর সময় ও শীতের সময় এক সপ্তাহের ছুটি নিয়ে বাড়ি আসে। এছাড়া সুযোগ সুবিধা পেলে অফিসের কাজ নিয়ে কলকাতায় আসলেই দুদিন গ্রামের বাড়িতে থেকে যেত। গ্রামের বাড়িটা ছিল প্রণয়ের জন্মভিটে ও ভালোবাসার বাড়ি। এই গ্রামের বাড়িতেই তার জন্ম, ফলে যেখানেই থাকুক সুযোগ পেলেই বাড়ি আসার জন্য মুখিয়ে থাকটা

প্রণয় ভারতের সমস্ত রাজ্য ঘুরে ঘুরে যখন কলকাতায় এসে পাকাপাকি ভাবে চাকরিতে থেকে গেল, তখন কলকাতায় একটা ফ্ল্যাট কিনে নিল। আর এদিকে প্রণয়ের বাবা স্কুলের শিক্ষকতা থেকে রিটায়ার করেছেন। দেখাশোনার সুবিধার্থে বয়স্ক বাবা-মাকে কলকাতায় নিজের ফ্ল্যাটে রাখতে চেয়েছিল। প্রণয়ের বাবা ও মায়ের অতি প্রিয় ছিল এই গ্রামের বাড়ি ও গ্রামের মানুষজন। আর এই গ্রাম ছেড়ে কোথাও গিয়ে থাকার কথা মনেও করতেন না।

প্রণয়রা তিন ভাইবোন। প্রণয়ের দাদা বিদেশে থাকে এবং বছর পাঁচেক পর একবার গ্রামের বাড়িতে আসে। বোনেরও বিয়ে হয়ে গেছে। প্রণয়ের বাবা যতদিন বেঁচে ছিলেন ততদিন পাকাপাকি ভাবে প্রণয়ের কাছে গিয়ে থাকেননি। মাঝেমধ্যে গিয়ে কিছুদিনের জন্য প্রণয়ের কাছে থেকে আসতেন।

গ্রামের বাড়িতে ফুলের বাগান, সবজির বাগান আছে। এছাড়া নারকেল, সুপুরি গাছ দিয়ে ঘেরা। একটি ছোটো পুকুরও আছে। পুকুরে অনেক মাছ আছে। ফাল্গুন, চৈত্র ও বৈশাখ মাসে পুকুর থেকে মাছ তুলে গ্রামের সবাইকে দিত এবং নিজেরা সবাই খেত। গ্রামের পাকাবাড়ি বলতে প্রণয়দের বাড়ি আর কয়েকটা পাকাবাড়ি ছিল ছড়িয়ে ছিটিয়ে এছাড়া বেশির ভাগ বাড়ি বেড়া দিয়ে ঘেরা ও টালির চাল।

গ্রামের লোকেরা প্রণয়ের বাবাকে খুব সম্মান করত। প্রণয়দের গ্রামের প্রত্যেক মানুষের মধ্যে ছিল প্রচুর আন্তরিকতা। পুজোর সময় প্রণয়দের গ্রামে একটিমাত্র দুর্গাপূজা হতো, আর সেখানে গ্রামের সবাই একসাথে মিলে কাজ করা, খাওয়া, হইচই করে খুব আনন্দ হতো। তবে গ্রামের রাস্তা মাটির ছিল বলে বর্ষাকালে জল জমে রাস্তায় কাদা হয়ে যেত।

একসময় গ্রামের সবাই মিলে ঠিক করা হয়েছিল রাস্তায় ইট ফেলে পাকা রাস্তা তৈরি করা হবে। পাকা রাস্তা তৈরির ব্যাপারে প্রণয়ের বাবা অজয় মাস্টারমশাইয়ের সাথে গ্রামের বড়োরা সবাই আলোচনা করেছিল। মাস্টারমশাইকে এতটাই সম্মান করত যে, গ্রামের কোনও কাজই মাস্টারমশাইয়ের মতামত ছাড়া করা হতো না।

বেশ কয়েক বছর বাদে গ্রামের রাস্তা পাকা হল ঠিকই কিন্তু অজয় মাস্টারমশাইয়ের আর দেখে যাওয়া হয়নি। কেন-না তার আগেই মাস্টারমশাই নার্ভের অসুখ হয়ে এক বছর কষ্ট পেয়ে সবাইকে ছেড়ে স্বর্গে চলে গেলেন।

দাদা ও বোন দূরে থাকে আর বাবা মারা যাওয়ার পর মা একা হয়ে গেল, ফলে মা-র অনিচ্ছা সত্ত্বেও প্রণয় মাকে কলকাতার ফ্ল্যাটে নিয়ে যেতে বাধ্য হল। বাড়ি, বাগান, পুকুর ফেলে এমনকী গ্রামের মানুষজনকে ছেড়ে যেতে খুব কষ্ট হয়েছিল প্রণয়ের মা-র। তবে প্রণয় অফিসের ছুটি দেখে মাসে একবার করে মাকে নিয়ে গ্রামের বাড়িতে এসে দুদিন থেকে যেত। আর তখন বাগানের সবজি ও পুকুরের মাছ তুলে গ্রামের সবাইকে দিয়ে নিজেরা কিছু নিয়ে যেত কলকাতায়। ক্রমশ অফিসের কাজের চাপে এছাড়া ছুটির দিনে অন্যান্য কাজের ব্যস্ততায় গ্রামের বাড়িতে প্রণয়ের মাকে নিয়ে আসা হয়ে ওঠে না।

পাশের বাড়ির লাল্টু-কে বাড়িটা দেখশোনার জন্য বলা হয়েছিল। লাল্টু ভালোই দেখেশুনে রাখছিল। মাঝেমধ্যে গ্রামের বাড়ি থেকে ফসল ও মাছ নিয়ে কলকাতার ফ্ল্যাট বাড়িতে দিয়ে আসত। আর প্রণয়ের মা নারকেল, সুপুরি, লিচু ও আমগাছগুলি এবং গেটের সামনে মাধবীলতা ও শিউলি গাছ কেমন আছে সবকিছুর খবর নিতেন লাল্টুর কাছ থেকে। এইভাবে দশবছর পার হয়ে গেল। একসময় লাল্টু জানাল ও নিজের কাজের চাপে বাড়িটা ভালো করে দেখাশোনা করতে পারছে না। ফলে বাড়িটা জঙ্গলে ভরে গেছে, পুকুরটা আগাছায় ভরে গেছে। অনেকটা জীর্ণ পোড়ো বাড়িতে পরিণত হয়েছে। লাল্টু বাড়িটাকে হয় বিক্রি করতে, নাহলে প্রমোটারের কাছে ফ্ল্যাট তৈরির জন্য দিতে বলল।

লাল্টুর কথা শুনে প্রণয় গ্রামের বাড়িতে যাওয়ার কথা ভাবল। মা-র সাথে কথা বলে গ্রামের বাড়িতে যাওয়ার জন্য রওনাও হল প্রণয়। প্রায় দশ বছর বাদে প্রণয় গ্রামের বাড়িতে ফিরছে। গ্রামে ঢুকতে ঢুকতে চারিদিক দেখছে আর প্রণয়ের মনে হচ্ছে অন্য কোনও নতুন গ্রামে ঢুকছে। গ্রামের এখন পিচের রাস্তা হয়েছে, বেড়া ও টালির চালের বাড়িগুলোর জায়গায় ইটের দালান বাড়ি উঠেছে। রাস্তার পাশে যে-পুকুরগুলি ছিল সেই পুকুরগুলি মাটি দিয়ে বুজিয়ে মাঠ তৈরি করে তাতে চার পাঁচতলা ফ্ল্যাটবাড়ি উঠেছে। গ্রামের দুর্গামন্দির ও শিবমন্দির পাকা হয়েছে। খেলার মাঠগুলো সুন্দর পাঁচিল দিয়ে ঘিরে দেওয়া হয়েছে। একপাশে বাচ্চাদের জন্য পার্ক তৈরি করা হয়েছে।

 

গ্রামে ঢুকতে ঢুকতে প্রণয় তার ছোটোবেলার পাড়াটাকে চিনতে পারছিল না। পথের দুধারের গাছগুলিকে কেটে রাস্তাটাকে চওড়া করা হয়েছে। প্রণয়দের বাড়িতে নানারকমের ফুল ও ফলের গাছ আছে আর সেই গাছগুলোতে সকাল হতেই কত রঙের ও কত রকমের পাখি এসে বসত। আর সেইসব পাখিদের ডাক শুনতে খুব ভালো লাগত। প্রণয়দের বাড়ির পুকুরটায় দুপুরবেলা পাড়ার অনেকে স্নান করতে আসত আর পুকুরের চারপাশে পেয়ারা ও কুল গাছ থেকে ফল পেড়ে খেত। অনেকে মিলে পুকুরে সাঁতার কাটা, বঁড়শি দিয়ে পুকুর থেকে মাছ ধরা, কী যে আনন্দ হতো। তারপর পাড়ার বন্ধুরা একসাথে ঘুড়ি ওড়ানো, ফুটবল খেলা, জলকাদা মেখে বাড়ি ফেরা সে যে কী মজা ভাবা যায় না। এখন সেই খেলার মাঠগুলোতে পার্ক হয়েছে, তাতে দোলনা, ঢেঁকি ও স্লিপার বসেছে।

প্রণয়দের সামনের বাড়িটা প্রদীপদের বাড়ি। প্রদীপ প্রণয়ের বন্ধু। প্রদীপদের ছোটো টিনের চালের বাড়িটার জায়গায় সুন্দর পাকাবাড়ি উঠেছে। রাস্তায় ভ্যানগাড়ি, রিকশা খুব কম চলে তার পরিবর্তে বাইক, ট্যাক্সি ও টোটো গাড়ির শব্দ দিনরাত কান ঝালাপালা করে দিচ্ছে। পাশে মহামায়াদের বাড়ির আম বাগানটার কথা খুব মনে পড়ছে। ঝড়বৃষ্টি হলে প্রচুর আম পড়ত আর গ্রামের বাচ্চারা বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে ঝড়ের মধ্যে আম কুড়াত। সেই আমবাগান আর নেই। আম গাছ কেটে পরিষ্কার করে ক্লাবঘর বানিয়েছে। সেখানে নানারকমের পুজো ও অনুষ্ঠান হয়।

গ্রামের পথে আসতে আসতে যাদের সাথে দেখা হচ্ছিল তারা সবাই প্রণয়ের বাবার কথা জিজ্ঞাসা করছিল। মাস্টারমশাই নেই শুনে সবাই দুঃখ প্রকাশ করছিল। আর সবাই একই কথা বলছে, কী ভালো মনের মানুষ ছিলেন। গ্রামের কত ছেলেমেয়েকে এমনিই পড়িয়ে দিতেন। তারা সবাই এখন ভালো চাকরি করছে, কেউ বা ব্যাবসা করছে। প্রণয় ওদের বাড়িটার সামনে এসে দাঁড়িয়ে দেখছে, নিজেদের বাড়ি নিজেই চিনতে পারছে না। সমস্ত বাড়ি জঙ্গলে ভরে গেছে, দরজা জানলায় কোথাও কোথাও উইপোকা উঠেছে। ঘরের চারপাশ ধুলো বালি ময়লায় ভরে গেছে। ফুলগাছগুলি ও সবজি গাছগুলি অযত্নে মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে আছে।

প্রণয় আসার সময় লাল্টু-কে খবর দিয়ে এসেছিল। প্রণয় বাড়িতে আসার পর পরই লাল্টু এসে হাজির হল আর বলল নিজের কাজের চাপে দেখভাল করতে পারেনি। বাড়িটার খুব খারাপ অবস্থা।

প্রণয় বলল, হ্যাঁ তা তো দেখতেই পাচ্ছি গ্রামের খুব উন্নতি হয়েছে কিন্তু আমাদের বাড়িটার অবস্থা জীর্ণ হয়ে এসেছে।

লাল্টু বলল, গ্রামের উন্নতি হয়েছে তো মলয়ের জন্য। মলয় ভোটে জিতে পার্টির নেতা হয়েছে। ও-ই গ্রামের রাস্তা মেরামত করেছে। এছাড়া গ্রামের যত উন্নতি দেখছ সব মলয়ের জন্য হয়েছে। মলয় তোমাদের বাড়িটার কথা বলছিল। যদি তুমি বাড়িটা বিক্রি করতে চাও বা ফ্ল্যাট তুলতে চাও তাহলে মলয় বলেছে তোমার সাথে দেখা করবে। কিন্তু এখন তোমাদের বাড়িটা থাকার অবস্থায় নেই। তুমি আমাদের বাড়িতে দুদিন থেকে সব ঠিকঠাক করে যাও।

প্রণয় বলল, একটা লোক দেখে দাও আমাদের বাড়ির একটা ঘর পরিষ্কার করে দেবে। তাহলে আমি আমাদের বাড়িতেই থাকব ভাবছি। আর আমি মা-র সাথে কথা বলে নেব। মা যা বলবে সেইমতো বাড়িটাকে নিয়ে ভাবব।

ঠিক আছে আমি লোক এনে তোমার জন্য একটা ঘর পরিষ্কার করে দিচ্ছি কিন্তু খাবার আমাদের বাড়ি থেকে দিয়ে যাব কেমন? প্রণয় বলল, তাই হবে। মাকে ফোনে সব কথা বলে মা-র মতামত জানতে চাইল প্রণয়।

মাস্টারমশাই মারা যাওয়ার পর প্রণয়ের মা ছেলের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিলেন। তাই উনি ছেলেকে বলেই দিলেন তুই যা করবি তাতেই আমার মত আছে। মায়ের কথা শুনে একটু নিশ্চিন্ত হল প্রণয়। তারপর ঘরে ঢুকে দেখল আলো জ্বলছে না। লাল্টুকে ডাকল। লাল্টু এসে বললে ইলেকট্রিকের লোক এসে লাইন কেটে দিয়েছে। আমি তোমাকে মোমবাতি ও দেশলাই দিয়ে যাচ্ছি।

কিছুক্ষণ পরে লাল্টুর পাঠানো লোক এসে ঘর পরিষ্কার করে দিয়ে গেল। ঘরে তেমন কিছু ছিল না। একটি খাট ও আলমারি ছিল তাতে ধুলো পড়ে আছে। চারদিকে উইপোকা বাসা করে আছে। তবে বাড়ির চাপাকলটা ভালো আছে। কেন-না পাড়ার সবাই এই কল থেকেই খাবার জল নেয়। একটু বাদে লাল্টু এসে মোমবাতি, দেশলাই, জল, খাবার, একটি বালিশ ও একটি চাদর দিয়ে গেল।

সন্ধে হতেই প্রণয় মোমবাতি জ্বেলে দিল। ঘরে বসে প্রণয়ের ছোটোবেলা থেকে বাইরে যাওয়ার আগে পর্যন্ত সব কথা একে একে মনে পড়ছে। ছোটোবেলায় বাবার হাত ধরে স্কুলে যাওয়া, কত মজা হতো, মা তার পছন্দের টিফিন বানিয়ে দিত। আর স্কুলের বন্ধুদের সাথে সেই টিফিন ভাগ করে খাওয়া। স্কুল ছুটির দিনে পাড়ার বন্ধুদের সাথে মাঠে গিয়ে ফুটবল খেলা, বন্ধুরা মিলে সবার গাছ থেকে ফল পেড়ে খাওয়া, সেসব ছিল খুব মজার দিন।

প্রণয়দের বাড়ির সামনে প্রদীপদের বাড়ির সকলের সাথে খুব ভালো সম্পর্ক ছিল। মাসিমা মা-র অনেক কাজে সাহায্য করে দিত। এখন মাসিমা ও মেসোমশাই কেউ বেঁচে নেই। প্রদীপ ও পরিতোষ দুই ভাই একসাথে ভালোই আছে। নানা স্মৃতির কথা ভাবতে ভাবতে রাত আটটা বেজে গেল। প্রণয় খাবার ও জল খেয়ে খাটের উপর চাদর বিছিয়ে শুয়ে পড়ল। কিন্তু সারারাত প্রণয়ের ভালো ঘুম হল না। যখনই চোখে ঘুম আসছে তখনই মা বাবা ও তিন ভাইবোনের একসাথে থাকার কথা মনে আসছে।

সবাই মিলে পুজোর জন্য জামাকাপড় কেনা, ভাইফোঁটার দিন কত আয়োজন হতো বাড়িতে। বোন কত আদরের ছিল। এখন বিয়ে পর বোন অনেক দূরে থাকে। দাদাও বিদেশে থাকে। সবাই মিলে আগের মতো একসাথে আর আনন্দ করা হয় না। এরকম নানাকথা ভাবতে ভাবতে শেষ রাতে চোখে যেই না ঘুম জড়িয়ে আসছে, স্বপ্নের মধ্যে দেখতে পেল বাবা এসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলছে, কী রে ভালো আছিস খোকা? বাড়িতে এসে পুরোনো সব কথা মনে পড়ছে জানি। জানিস তো এই বাড়িটা আমার আর তোর মায়ের খুব সখের এবং ভালোবাসার বাড়ি। আর এটা যে তোদের জন্মভিটে। খোকা বাড়িটা বিক্রি করিস না। বাড়িটা মেরামত করে মাকে নিয়ে এসে মাঝেমধ্যে থাকবি। দেখবি তোর মায়ের খুব ভালো লাগবে আর আমিও খুব শান্তি পাব।

প্রণয়ের ঘুম ভেঙে গেল আর খাটের উপর বসে স্বপ্নে দেখা বাবার কথাগুলো ভাবতে লাগল। কিছুক্ষণ পরেই সকাল হলে ফ্রেশ হয়ে ড্রেস পরে নিল। লাল্টু চা বিস্কুট দিয়ে গেল। আর জঙ্গল পরিষ্কার করার জন্য লোক আসবে বলে গেল। বেলা ১১টার সময় জঙ্গল পরিষ্কারের লোক এলে, প্রণয় বলে দিল কোনও গাছ না কেটে শুধু বাড়ি পরিষ্কার করে দিলেই হবে।

প্রণয়ের মাথার মধ্যে স্বপ্নে দেখা বাবার কথাগুলো ঘুরপাক খেতে লাগল। আর এদিকে বাড়ি পরিষ্কার হচ্ছে দেখে পাড়ার অনেকে এসে বলতে লাগল, প্রণয় শুনলাম তোমাদের বাড়িটা নাকি বিক্রি করে দেবে?

না ঠিক সেরকম কিছু ভাবিনি, তবে কী করব সেই নিয়ে চিন্তা ভাবনা করছি।

আমরা বলছি কি বাড়িটা তোমার বাবা অনেক কষ্ট করে বানিয়েছিলেন এবং তোমার মা-বাবার খুব সখের বাড়ি। বাড়িটা বিক্রি না করে যদি মেরামত করে মাকে নিয়ে এসে মাঝেমাঝে থেকে যাও, তাহলে আমাদের খুব ভালো লাগবে।

ঠিক আছে, মা-র সাথে কথা বলে দেখি কী করা যায়।

 

প্রণয় মনে মনে ভাবতে লাগল যে গ্রামের মানুষজন এখনও ওদের এত ভালোবাসে। সত্যি প্রমোটারের কাছে বাড়িটা দিলে বাগানের গাছপালা কিছুই আস্ত থাকবে না আর এত সুন্দর বাড়িটাকে ভেঙে ফ্ল্যাট বাড়ি তৈরি করবে। অবশ্য মা, দাদা ও বোন সবাই একই কথা বলেছে যে, আমি যা করব তাই হবে। এরকম নানা কথা ভাবতে ভাবতে দুপুরের খাবার খেয়ে একটু বিশ্রাম নিয়ে বিকেলে বাড়ির বাগানটা ঘুরে দেখতে লাগল প্রণয়।

মা-র হাতে লাগানো স্থলপদ্ম গাছটায় কত ফুল ফুটে আছে, আর বাবার হাতে লাগানো বাতাবি লেবু গাছটায় কত বাতাবি লেবু হয়ে আছে দেখে প্রণয়ের খুব ভালো লাগছে। কিন্তু বাগানের ভিতর ঢুকতেই প্রণয়ের মনে হতে লাগল গাছগুলি ওকে দেখে যেন খুশিতে ডালপালা নাড়তে লাগল আর গাছের ফুলগুলো যেন হাসতে হাসতে বলছে, আমরা খুব আনন্দ পেয়েছি তুমি এসেছ বলে। আমাদের কেটে নষ্ট করে দিও না। বেলা পড়তেই সন্ধে হয়ে এল। প্রণয় হাত পা ধুয়ে ঘরে এসে মোমবাতি জ্বেলে খাটের উপর বসল। কিছুক্ষণ পরেই লাল্টু রাতের খাবার ও জল দিয়ে গেল। কিছুক্ষণ মা-র সাথে ফোনে কথা বলে ৯টার সময় খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ল।

পরদিন সকাল হতেই প্রণয় দেখল লাল্টু চা আর সঙ্গে করে দুজনকে নিয়ে এসেছে। প্রণয় জিজ্ঞাসা করল, কাদের নিয়ে এসেছ?

গ্রামের দুটো ছেলেকে নিয়ে এসেছি, তোমাদের বাগানের গাছগুলোকে কাটার জন্য। বড়ো গাছগুলোকে বেচলে ভালো টাকা পাওয়া যাবে, ফলে তোমারও লাভ হবে আর আমরাও কিছু পাব।

প্রণয় একটু মুচকি হেসে বলল, সব বুঝতে পারছি তবে এখনই কোনও গাছ কাটার দরকার নেই কেমন?

ঠিক আছে দাদা তুমি যা বলবে তাই হবে। তাহলে আমরা আসছি, দুপুরবেলা এসে খাবার দিয়ে যাব।

প্রণয় ভাবছে পাড়াপ্রতিবেশীরা এখনও তাদের বাড়িটাকে ও তাদেরকে এত ভালোবাসে। না এলে বুঝতে পারত না। তাই বাড়িটাকে বিক্রি করা বা প্রোমোটারের হাতে দেওয়া কোনওটাই প্রণয়ের পছন্দ হচ্ছে না। রাতে ঘুমোতে গিয়ে প্রণয় ভেবে নিল বাড়িটা সে বিক্রি করবে না। বাড়িটাকে মেরামত করে মাকে নিয়ে মাঝে মাঝে এসে থেকে যাবে। মা, বাবা ও ভাই-বোনেদের প্রচুর স্মৃতি আছে বাড়িটাতে। আর মা গ্রামের বাড়িতে এসে আবার থাকতে পারবেন জানলে খুব খুশি হবেন। এইসব ভাবতে ভাবতে প্রণয় ঘুমিয়ে পড়ল।

পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে প্রণয় সব গুছিয়ে নিল কেন না অফিসের ছুটি শেষ। কলকাতায় ফিরেই অফিসে যেতে হবে। হঠাৎ দেখল লক্ষ্মী এসে হাজির। লক্ষ্মী প্রণয়দের বাড়িতে অনেক বছর কাজ করেছে। প্রণয়ের মা ও বাবাকে মা-বাবা বলে ডাকত আর সবাইকে নিজের মনে করে ভালোবাসত। বাবা নেই শুনে লক্ষ্মীর চোখে জল চলে এসেছে। প্রণয়কে বলল, দাদা শুনলাম বাড়িটা নাকি বিক্রি করে দেবে তোমরা।

না রে লক্ষ্মী এখনও কিছু কথা হয়নি।

তোমাদের বাড়ির সাথে অনেক দিনের সম্পর্ক। এই বাড়ি ও তোমাদের ওপর খুব মায়া আমার। তাই বলছি বাড়িটা বিক্রি না করে ঠিকঠাক করে মাকে নিয়ে মাঝেমধ্যে এসে থেকে যেও। দেখবে আমি এসে মা-র সব কাজ করে দেব।

ঠিক আছে লক্ষ্মী তোর কথা রাখার চেষ্টা করব। আজ আমি কলকাতায় ফিরে যাচ্ছি। আমি মাকে নিয়ে এলে তোকে জানাব।

লক্ষ্মী চলে যাবার পর লাল্টু খাবার নিয়ে এল আর বলল, বিকেলে মলয় আসবে তোমার সাথে বাড়ি বিক্রি নিয়ে কথা বলার জন্য।

প্রণয় বলল, আজ আমি কলকাতায় ফিরে য়াচ্ছি। মলয়কে বলে দিস বাড়ি বিক্রি করব না। বাড়িটা মেরামত করে ও রং করে নিয়ে মাঝেমধ্যে এসে থাকব। তুই বাড়িটা একটু দেখে রাখিস। কেউ যেন গাছগুলোকে না কাটে।

লাল্টু অবাক হয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল, কলকাতায় থাকার পর তোমরা গ্রামে এসে থাকতে পারবে? তোমাদের অসুবিধে হবে না?

নিশ্চয় এসে থাকব। এটা যে আমাদের ভাই-বোনের জন্মভিটে। আর আমাদের ছোটোবেলার সব স্মৃতি যে এই বাড়িতে। আমার মা ও বাবার প্রাণের বাড়ি। এমনকী এই গ্রামের বাতাস ও মানুষের ভালোবাসা আমাদের অনেকদিন বাঁচতে সাহায্য করবে।

 

জন্মের গল্প

বছর তিনেক ধরে আমার স্বভাবে একটা উল্লেখযোগ্য বদল এসেছে, অন্যমনস্কতা বেড়েছে ভীষণ ভাবে। বিশেষ করে অফিস ছুটির পর। কখন যে বাস, ট্রেন ধরে আমাদের স্টেশনের কাছাকাছি চলে আসি, হুঁশ থাকে না। সম্বিৎ ফেরে লোকাল ট্রেনটা যখন ব্রিজের ওপর এসে পড়ে। গমগম আওয়াজ শুনে এগিয়ে যাই গেটের দিকে। ব্রিজ পার হলেই দেবনগর স্টেশন, জন্মাবধি এই অঞ্চলেই আমার বসবাস।

আজ আমাকে অন্যমনস্কতা সেভাবে গ্রাস করতে পারেনি। ডাউন লোকাল প্ল্যাটফর্মে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে লাফিয়ে উঠে পড়েছি, এটাই আপ-এ যাবে। কামরায় তাড়াতাড়ি ওঠার সুবাদে পেয়েছি জানলার পাশের সিট। অন্যমনস্ক হওয়ার জন্য আদর্শ বসার জায়গা। কিন্তু হতে পারছি কই! মনের মধ্যে একটা অস্থিরতা কাজ করছে, চাপা টেনশন। উদ্বেগটা গল্পের প্লট খুঁজে পাওয়া নিয়ে। গত তিনবছর ধরে আমার একটা বিশেষ পরিচয় তৈরি হয়েছে, আমি একজন লেখক। নামি বাণিজ্যিক পত্রপত্রিকায় আমার লেখা নিয়মিত ছাপা হয়। এখন অবধি গল্পকার। উপন্যাসে হাত দিইনি। কবিতা আমার ঠিক আসে না। প্রবন্ধ লেখার মতো পাণ্ডিত্য আমার নেই। গল্প লেখা শুরু করেছিলাম কলেজবেলায়, কয়েকজন সাহিত্যপ্রেমী বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে। দু’তিনটের বেশি লিখিনি। বন্ধুরা ভালো বলেছিল। তবে চর্চাটা আর এগিয়ে নিয়ে যাইনি। কারণ আমাদের নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবার। বাবা বড়োবাজারের এক ওষুধের হোলসেলারের খাতা লেখে। দাদার লেখাপড়ায় আগ্রহ ছিল না। হায়ার সেকেন্ডারি-র পর বিভিন্ন বিজনেস ট্রাই করে যাচ্ছিল। পুঁজির জোর নেই, ফেল করছিল বিজনেসগুলো। বাড়িতে মা, শ্বশুরবাড়ি ফেরত পিসি আর বোন, তখন স্কুলে পড়ে সে। একার রোজগারে ছ’জনের খাওয়াপরা চালাতে হিমসিম খেয়ে যাচ্ছিল বাবা। এরপর বোনের কলেজে পড়া, বিয়ে দেওয়া এসব আছে।

গল্প লেখার শৌখিনতা সরিয়ে রেখে পড়াশোনায় মন দিয়েছিলাম। কেমিস্ট্রিতে অনার্স নিয়ে বেরিয়েই ঢুকে গিয়েছিলাম এখনকার চাকরিতে। একটা কেমিক্যাল ফ্যাক্টরির ল্যাব অ্যাসিস্ট্যান্ট আমি। আমার চাকরির টাকায় একটু স্বস্তির বাতাস বইতে শুরু করেছিল সংসারে। এদিকে দাদাও ফুড প্রোডাক্ট সাপ্লাইয়ের বিজনেসে মোটামুটি দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। তার সুফল অবশ্য সংসারের গায়ে তেমন লাগেনি, দাদা দ্রুত বিয়ে করে নিয়েছিল বহুদিন অপেক্ষায় থাকা প্রেমিকাকে। তবু বলব দুই ভাই দাঁড়িয়ে যাওয়াতে আমাদের পরিবার নিত্যদিনের আর্থিক অনটন থেকে অনেকটাই মুক্ত হতে পেরেছিল।

ছুটির দিনগুলো সত্যিকারের অবসরের দিন মনে হতো। তখনই আমার মাথায় আবার গল্প লেখার পোকাটা নড়ে উঠেছিল। ভাবলাম, ছুটির সময়টা পাড়ায় আড্ডা না মেরে ভালো কাজে লাগাই। লিখে ফেললাম একটা গল্প। কাকে পড়াই? কেমন হয়েছে জানতে হবে তো। কলেজের সেই সব সাহিত্য অনুরাগী বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। কাউকে খুঁজে নিয়ে পড়ানোর চেয়ে একটা সহজ কাজ করে ফেলা যাক, গল্পটা পাঠিয়ে দিলাম সবচেয়ে নামি পত্রিকা ‘প্রিয়ভাষা’-র ঠিকানায়। আমি যে পাঠিয়েছি, কেউ তো জানতে যাচ্ছে না। মনোনীত না হলে লজ্জার কিছু নেই।

আমাকে অবাক করে গল্পটা ছাপা হয়ে গেল। লেখাটা পাঠানোর পর থেকেই প্রিয়ভাষার প্রতিটি সংখ্যার ওপর নজর রাখতাম।

যে-সংখ্যায় বেরোল আমার গল্প, দু’কপি কিনে ফিরলাম বাড়ি। এক কপি বাবার হাতে দিয়ে বলেছিলাম, এতে আমার লেখা একটা গল্প বেরিয়েছে।

সূচিপত্র ঘেঁটে গল্পের প্রথম পাতাটা বার করে ফেলল বাবা। তারপর আমার দিকে এমন ভাবে তাকিয়ে ছিল, যেন অচেনা কেউ! মুখে কিছু বলল না, পত্রিকাটা হাতে নিয়ে উঠে গিয়েছিল রান্নাঘরের দিকে। মায়ের উদ্দেশ্যে বলেছিল, মাধবী, তোমার ছেলে কী কান্ড ঘটিয়েছে দ্যাখো!

আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে গলাটা সামান্য কেঁপে গিয়েছিল বাবার। আসলে আমাদের বংশে এতবড়ো কান্ড কেউই ঘটায়নি। একেবারেই সাদামাটা গৌরবহীন বংশ।

বাবাকে যে-কপিটা দিয়েছিলাম, কদিনের মধ্যেই দুমড়ে-মুচড়ে একসা করে ফেলল। চেনাপরিচিতদের ধরে ধরে দেখাচ্ছে, পড়াচ্ছে ছেলের গল্প। এমনটা হবে আন্দাজ করেই আমি দু’কপি পত্রিকা কিনেছিলাম। প্রিয়ভাষার মতো বড়ো পত্রিকায় গল্পটা বেরোনোর ফলে চেনা, অচেনা মানুষের থেকে প্রচুর ফিডব্যাক পেলাম। কলেজের সেইসব সাহিত্য অনুরাগী বন্ধুরাও আমার ফোন নাম্বার জোগাড় করে নিজেদের উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছিল। উৎসাহিত হয়ে শুরু করে দিলাম একের পর এক গল্প লেখা। ছোটো, বড়ো, মাঝারি সব ধরনের কমার্শিয়াল পত্রপত্রিকায় ছাপা হতে লাগল। আমাদের এলাকার শিক্ষিত, বিদগ্ধ মহলে যথেষ্ট গুরুত্ব পেতে লাগলাম।

গত তিনবছর ধরে জাগ্রত অবস্থায় আমি গল্প নিয়ে ভেবে যাই। কখনও গভীর ভাবে, অফিসে কাজের সময় আলতো ভাবে। অফিস ছুটির পর ভাবনাটা সবচেয়ে বেশি জমাট বাঁধে। টানা আটঘণ্টার ডিউটি শেষ হওয়ার ফলে মনটা থাকে উৎফুল্ল, আইডিয়াগুলো দৌড়ে দৌড়ে এসে ঢুকে পড়ে মাথায়।

আমি যেহেতু কোম্পানির ল্যাবে আছি, তাই শিফটিং ডিউটি। ছ’টা দু’টো, দু’টো দশটা। সপ্তাহন্তর ডিউটির শিফট বদলে যায়। জেনারেল ডিউটি নয় বলে বাস, ট্রেন মোটামুটি ফাঁকা পাই। ভাবনায় বিশেষ বিঘ্ন ঘটে না। কিন্তু আজ এখন অবধি গল্প নিয়ে ভাবা শুরু করতে পারিনি। ইতিমধ্যে দু’টো স্টেশন পার করেছে ট্রেন। ক’দিন ধরেই এমনটা হচ্ছে। আসলে হয়েছে কি, এ বছরই প্রথমবার আমি পুজোসংখ্যায় গল্প লেখার আমন্ত্রণ পেয়েছি। ‘প্রিয়ভাষা’ থেকে নয়, প্রায় ওরকমই নামি একটি ম্যাগাজিনের সম্পাদক চিঠি দিয়ে লেখা চেয়ে পাঠিয়েছেন। গল্পটা কত তারিখের মধ্যে দিতে হবে লেখা আছে তাতে। চিঠি দিয়ে লেখা চাওয়াটাও আমার জীবনে প্রথমবার। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আমি যেচে পাঠিয়েছি, কয়েকবার মৌখিক আবেদনে দু’একজন সম্পাদক লেখা চেয়েছেন। ‘চিঠি’ মানে তো রীতিমতো অফিশিয়াল ব্যাপার! আর তাতেই বিরাট চাপে পড়ে গেছি আমি। কেমন যেন নার্ভাস লাগছে, সময় মতো যদি না দিতে পারি গল্পটা! আর তো কোনওদিন লিখতে বলবেন না সম্পাদক। পুজোসংখ্যায় লেখার সুযোগ হারানোর মানে, এক লাফে অনেকটা বিখ্যাত হওয়ার চান্স মিস করা। এমনটা কিছুতেই হতে দেওয়া যায় না।

কোনও গল্প লেখার প্রাথমিক পর্যায়টা আমার কাছে এই রকম, চার পাঁচটা প্লট মনের চারপাশে ঘুরঘুর করে। সবই অপূর্ণ, অস্পষ্ট। বলতে পারা যায় প্রায় বিষয়ের আকার। শুধুমাত্র গল্প হয়ে ওঠার ইঙ্গিতটুকু আছে সেখানে। যে-কোনও একটাকে বেছে নিয়ে মনে মনে পূর্ণতা দেওয়ার চেষ্টা করি। গল্পটা কোথা থেকে শুরু করব, এগোবে কেমন ভাবে, শেষ করব কোথায়… ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ভাবতে থাকি। যদি দেখি বেছে নেওয়া প্লটটাকে গল্প হিসেবে ঠিকঠাক দাঁড় করাতে পারছি না, সেটাকে তখনকার মতো সরিয়ে রেখে অন্য একটা প্লটকে নিয়ে আসি সামনে। ভাবনার এই প্রক্রিয়ায় হঠাৎই, বলতে গেলে আমার অজান্তে একটা প্লট পূর্ণতা পেয়ে যায়। লিখতে বসে যাই গল্পটা। কিন্তু এই প্রসেস কাজ করছে না পুজোসংখ্যার গল্পটা লিখতে গিয়ে। বাড়তি উত্তেজনা আর লিখিত আকারে দেওয়া সম্পাদকের ডেডলাইন আমার ভাবনার ধরনটাকে এলোমেলো করে দিচ্ছে। মনে মনে প্রণাম জানাচ্ছি সেই সব লেখকদের, যাঁরা বহুবছর ধরে ডেডলাইন মেনটেইন করে লিখে চলেছেন। আমার বোধহয় বড়ো লেখক হওয়া হল না।

ব্রিজের ওপর উঠে পড়ল ট্রেন। ছোটো খালব্রিজ। রোজকার সেই গমগম শব্দ আজ যেন আরও বেশি গম্ভীর শোনাচ্ছে। যেন ব্রিজটা বলছে, সময় পেরিয়ে যাচ্ছে তরুণ লেখক। নিজেকে প্রমাণ করার জন্য হাতে মাত্র পাঁচটা দিন।

প্ল্যাটফর্মে নেমে খেয়াল করি বেশ মেঘ করেছে আকাশে! ট্রেন হাওড়া ছাড়ার সময় এত মেঘ ছিল না। বিকেল চারটেতেই দেবনগরে সকাল সন্ধে। গা-ছাড়া ভাব নিয়ে প্ল্যাটফর্ম পার হচ্ছি, তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে কী হবে! লিখতে বসা হবে না। সাদা পাতার সামনে বসে ভাবতে হবে। ইদানীং আবার না লিখে চুপচাপ বসে থাকতে দেখলে বউদি তাড়া দেয়। বলে, কী এত ভাবছ বলো তো! তোমার বড্ড খুঁতখুঁতানি বাই। আরে বাবা, তোমার লেখাটাই এত সুন্দর, যা লিখবে লোকে গোগ্রাসে পড়বে। …বলার পর বউদি আমার জন্য চা বানানোর উদ্যোগ নেবে। মানা করলে বলবে, তুমি খেলে আমারও একটু খাওয়া হয় আর কি। আমার লেখা নিয়ে বউদির এই যে এত উৎসাহ, এর একটা কিঞ্চিৎ বাস্তব দিকও আছে। লিখে টুকটাক রোজগার হয় আমার। সেই টাকাটা বোন, বউদি কিছুতেই আমার মূল রোজগারের সঙ্গে মেশাতে দেবে না। লেখা ছাপা হয়েছে দেখলেই, দু’জনেই নানান বায়না করতে থাকে। শৌখিনতার বায়না। লিপস্টিক, পারফিউম, ঝুটোগয়না ইত্যাদি। মা, বাবা, দাদার জন্যেও কিছু কিনে আনে, আমার জন্যেও। এই খাতে খরচ করতে আমারও ভালো লাগে। পুজোসংখ্যায় গল্পটা লিখতে পারলে টাকা অনেক বেশি পাব। শুনেছি পুজোর লেখায় বেশি দেয়। সম্পাদকের চিঠিতে অবশ্য অ্যামাউন্টের উল্লেখ নেই।

প্ল্যাটফর্মের শেড পেরোতে চলেছি, চোখ গেল সিমেন্টের বেঞ্চের নীচে, একটা বাচ্চাকে শুইয়ে রাখা আছে। ছ’সাত মাসের বাচ্চাদের আলাদা করে চেনা যায় না, তা সত্ত্বেও এই বাচ্চাটা কার, বুঝতে আমার কোনও অসুবিধে হচ্ছে না। জবার পুত্রসন্তান। বাচ্চাটার পিঠের কাঁথা, গায়ের জামা আমি চিনি। কারণ, জবা এঁটুলির মতো করে কোলে নিয়ে ঘোরে। কখনওই কাছছাড়া করে না। বাচ্চাটা এখানে এইভাবে পড়ে আছে কেন? জবা গেল কোথায়? প্ল্যাটফর্ম প্রায় ফাঁকা। দূরে দূরে এক দু’জন প্ল্যাটফর্মবাসীকে দেখা যাচ্ছে। প্যাসেঞ্জার বলতে আমি এখন একাই। লোকাল ট্রেনটা থেকে আরও যারা নেমেছিল, পা চালিয়ে বাড়ির পথ ধরেছে। গল্প মাথায় না আসার হতাশায় আমি শ্লথ হয়ে পড়েছিলাম। এখন বাচ্চাটাকে এই অবস্থায় দেখে চলে যেতে মন চাইছে না। একটা আশঙ্কা ঘিরে ধরেছে আমাকে, বাচ্চাটাকে কেউ যদি চুরি করে পালিয়ে যায়! প্ল্যাটফর্ম থেকে কিছু তুলে নিয়ে চম্পট দেওয়া খুবই সহজ। লোকাল ট্রেন এসে দাঁড়াবে, ছাড়ার মুখে বাচ্চাটাকে কোলে তুলে কেউ যদি উঠে পড়ে কামরায়, চট করে চলে যাবে নাগালের বাইরে। জবাপাগলি ফিরে এসে বাচ্চাটাকে না দেখতে পেয়ে যে কী মূর্তি ধারণ করবে, কল্পনা করতেই ভয় পাচ্ছি আমি।

আপাতত বাড়ি যাওয়া স্থগিত রেখে বেঞ্চটায় গিয়ে বসলাম। জবার বাচ্চার পাহারায় বহাল হলাম আর কি! পায়ের খানিক দূরেই কাঁথার ওপর শান্ত হয়ে শুয়ে আছে বাচ্চাটা। হাত-পা একটু আধটু নাড়ছে। মুখটায় হাসিহাসি ভাব। পরিস্থিতি মোটামুটি স্থিতিশীল। হঠাৎ যদি কান্নাকাটি শুরু করে দেয়, কী করব জানি না। বাচ্চাটাকে কোলে তুলে ভোলানোর প্রবৃত্তি আমার নেই। জবাপাগলি স্নানটান করে বলে তো মনে হয় না। শুধুমাত্র বৃষ্টিতে ভিজলে অথবা মাছ চুরি করতে পুকুরে নামলে স্নান করা হয় ওর। এই যার স্বভাব সে তার বাচ্চাকে তেলটেল মাখিয়ে স্নান করাবে, আশা করাই বৃথা। বাচ্চাটার গায়ের কাঁথা, জামা ছ’মাস ধরে এই একটাই দেখে আসছি। কাঁথা, জামা, বাচ্চাটা মিলিয়ে সাক্ষাৎ একটা উৎকট গন্ধের মণ্ড। যতই কাঁদুক ওকে আমি হাতে নিতে পারব না।

জবার এই অপরিষ্কার থাকার কারণেই লোকে ওকে পাগলি বলে। মাথায় অল্পবিস্তর ছিট থাকলেও, পুরো পাগলি সে নয়। যথেষ্ট সেয়ানা। বিশেষ করে পাওনাগণ্ডা বুঝে নেওয়ার ক্ষেত্রে। জবাকে নিয়ে একটা গল্প লিখেছি। তখন বাচ্চাটা হয়নি। বাচ্চা সমেত জবাকে নিয়ে আরও একটা দারুণ গল্প হতে পারে। তবে সে ঝুঁকি আমি নিচ্ছি না। আগের গল্পটা লিখে বিরাট ফেঁসে গেছি। সন্তানের প্রতি জবার নিরেট অবসেশন, এটাই আমার জবাকে নিয়ে পরের গল্পের মেন থিম হওয়ার কথা। ওকে খুঁটিয়ে খেয়াল করেই বিষয়টা আমার মাথায় এসেছে। সেই অবজার্ভেশন থেকেই আমি আন্দাজ করতে পারছি, খুব বেশি সময় বাচ্চাটাকে পাহারা দিতে হবে না, জবা এল বলে।

আমার এখন অদ্ভুত দশা! কয়েকহাত দূরে পড়ে রয়েছে গল্পের প্লট, পাহারা দিচ্ছি, কিন্তু এক লাইনও লেখা যাবে না। জবাকে নিয়ে লেখা আগের গল্পের আফটার শক এখনও কাটিয়ে উঠতে পারিনি। এরকম হেনস্থা আগেও আর একজনের বেলায় হয়েছে, তার নাম সাধন। আসলে আমাদের এই মফসসলে সাধন, জবার মতো বিচিত্র চরিত্ররাই আমার লেখার রসদ। পুরোটা বানিয়ে লিখতে পারি না। এই বিচিত্রদের মধ্যে যারা শিক্ষিত, তাদের নিয়ে সমস্যা কম। আমাকে খুব একটা বিব্রত করে না। মুখোমুখি দেখা হয়ে গেলে অর্থপূর্ণ হেসে হয়তো বলল, অমুক পত্রিকায় তোমার গল্পটা পড়লাম (মানে যে গল্পটা তাকে নিয়ে লেখা)। আমার চোখে পড়েনি লেখাটা, দু’চারজন পড়ে আমাকে পড়তে বলল। কেউ হয়তো আর একটু এগিয়ে বলল, সবই তো বোঝা যাচ্ছে, আমার নাম পালটে দিয়েও তুমি কিছু আড়াল করতে পারোনি। তবে ভালোই হয়েছে গল্পটা।

যে সব শিক্ষিত চরিত্রদের অবলম্বনে গল্প লিখি আমি, তারা জানে গল্পে সত্যির মিশেল না থাকলে লেখা প্রাণ পায় না। তাছাড়া চরিত্রের নাম, ঘটনাস্থল সবই তো পালটে দিই, সরাসরি অভিযোগ করারও সুযোগ থাকে না তাদের। কিন্তু সে দলে তো সাধন, জবারা পড়ে না। বই বা সাহিত্য থেকে যোজন দূরত্ব দু’জনের। সাধন তবু খানিকটা স্কুলবেলা কাটিয়েছে। জবা স্কুলের চৌকাঠ ডিঙোয়নি। সাধনের মা হসপিটালের আয়া। ছেলের লেখাপড়া হল না বলে একটা চায়ের দোকান করে দিয়েছে। দোকানে নিয়ম করে বসে না সাধন। তার নেশা নাচ। পাতি হিন্দি সিনেমার নাচ। কলোনি এলাকার জলসায়, বিয়ের অনুষ্ঠানে লাউড স্পিকারে মিউজিক সহযোগে নাচে। সাধনের বিয়ে দিয়েও ঘরমুখী করতে পারল না মা। বউটির স্বভাবগুণ ভালো, বরকেও ভীষণ ভালোবাসে।

সাধন একদিন স্টেজে নাচতে উঠেছে, খবর এল অন্তঃসত্ত্বা বউ ভীষণ অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি। নাচ বন্ধ করল না সাধন। পারফর্মেন্স শেষ করে ছুটল হাসপাতালে। বউ চোখ বুজে শুয়ে আছে, যেন মরেই গেছে! আকুল আশায় সাধন কান রাখে বউয়ের বুকে। হার্টবিট শুনতে পায়। খুশি ছড়িয়ে পড়ে সাধনের মুখে। নিজের অজান্তেই বউয়ের হার্টবিটের সঙ্গে আলতো করে তাল দিতে থাকে পায়ে। …মোটামুটি এই রকম ছিল গল্পটা। নামি পত্রিকায় বেরিয়েছিল। আমাদের এলাকার পাঠকদের সাধনকে আইডেন্টিফাই করতে অসুবিধে হয়নি। সাধনের মতো অখ্যাতর জীবনের গল্প বেরিয়েছে বিখ্যাত কাগজে! এই আবেগের উত্তেজনা কন্ট্রোল করতে না পেরে জনৈক পাঠক খবরটা তুলে দিল সাধনের কানে, লেখক পরিচয়সহ।

একদিন সাধনের দোকানের সামনে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি, ছিটকে বেরিয়ে এসেছিল সে। আমার হাত আঁকড়ে ধরে বলেছিল, গুরু, তুমি শুনলাম আমাকে নিয়ে একটা স্টোরি লিখেছ বইয়ে! চট করে ব্যাপারটা স্বীকার করিনি। গম্ভীর মুখে জানতে চেয়েছিলাম, তুমি কি গল্পটা পড়েছ? এমনটা জিজ্ঞেস করার কারণ, সাধন যদি অভিযোগ তোলে গল্পে ওকে ছোটো করা হয়েছে, তখন বলতে হবে, ও গল্প তোমাকে নিয়ে নয়। দেখছ না, ছেলেটার নাম আলাদা, থাকেও অন্য জায়গায়। ওই রাস্তায় গেল না সাধন। সে তখন আনন্দে আত্মহারা। বলেছিল, না, আমি পড়িনি। একজন দিদিমণি আমাকে বলল। স্কুলে পড়ায়, সে তো আর ঢপ দেবে না। তুমি মাইরি ‘সাজন’ সিনেমার সঞ্জয় দত্তর মতো। আমার সঙ্গে আড্ডা মারতে আসতে, কত গল্প করেছি, ধরতেই পারিনি তুমি রাইটার। চলো চলো, চা খাবে চলো।

সেই যে আমাকে খাতির করা শুরু করল সাধন, আজও উৎসাহে ভাটা পড়েনি। রাস্তাঘাটে আমাকে দেখতে পেলেই হাঁকডাক করে এগিয়ে আসে। চকরাবকরা ড্রেস, ভাবভঙ্গি, কথাবার্তায় ফিল্মি স্টাইল। আশপাশের মানুষজন বেশ অবাক হয়। বিশেষ করে যারা আমার লেখক পরিচয় জানে। ভাবে, লুচ্চা টাইপের ছেলেটার কী করে এই সাহস হয়, এরকম একজন মানী ব্যক্তির সঙ্গে এভাবে কথা বলতে? সাধনের অবশ্য সে সবের কোনও ভ্রূক্ষেপ নেই। যেখানেই দেখা হোক, গল্প জুড়ে দেয়। নিজের জীবনের গল্প। জোরজার করে চা, সিগারেট খাওয়ায়। আমি টের পাই ওর মনোবাসনা, সাধন চায় ওকে নিয়ে আরও একটা গল্প লিখি আমি। ওর তুচ্ছ জীবন নিয়ে অসাধারণ কোনও গল্প। একজন দিদিমণি এসে সেই গল্পের খোঁজ দেবে ওকে। বেচারি জানে না ওর জীবনের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য অংশটা আগের গল্পে লেখা হয়ে গেছে আমার। বাকি যা পড়ে আছে, সমস্তটাই বোরিং। পরিচিত। পাঠক ওই গল্প জানে। সাধনকে ইদানীং এড়িয়ে চলি। দূর থেকে যদি দেখতে পাই, ধরে নিই অন্য রাস্তা।

জবাকে নিয়ে আমার সমস্যা আরও মারত্মক। মেয়েটা তিনবার সরকারি হোম থেকে পালিয়ে এসেছে। কোনও এক অদ্ভুত কারণে আমাদের দেবনগর জায়গাটাই জবার পছন্দ। শেষবার হোমের কর্মচারীরা ওকে নিতে আসেনি। ভীষণ বিরক্ত হয়েছিল জবার ওপর। প্রথমদিকে এই প্ল্যাটফর্মই ছিল জবার স্থায়ী ঠিকানা। ট্রেন থেকে নেমে প্যাসেঞ্জার হয়তো কুলি খুঁজে পাচ্ছে না, জবা লাগেজ তুলে নিয়ে রিকশা স্ট্যান্ডে দিয়ে আসে। বিনিময়ে টাকা নেয়। কখনও এর বাগানের ফল, ওর পুকুরের মাছ, খেত থেকে চুরি করে আনা সবজি ঘুরে ঘুরে বিক্রি করে স্টেশন লাগোয়া বাজারে। কখনও আবার কেটারিং-এর কাজে যায়। দোকান পরিষ্কার কিংবা রং করাতেও ওকে হাত লাগাতে দেখা গেছে। এভাবেই নিজের পেট চালায়। তবে যেটাকে ‘চুরি’ বললাম, সেটা ‘ডাকাতি’ বলাই বোধহয় ভালো। চুরিতে বাধা দিতে এলে এমন খিস্তি খেউড় করে, ইট-পাটকেল ছোড়ে, মালিক ভয়ে চুপ করে যায়।

ওকে নিয়ে যে-গল্পটা লিখেছিলাম, তাতে একটা ভয়ংকর ঘটনার কথা ছিল। সত্যিই ঘটেছিল জবার জীবনে। লাস্ট লোকাল থেকে কিছু ছেলে নেমে প্ল্যাটফর্মে ঘুমন্ত জবাকে রেপ করতে গিয়েছিল। ছেলেগুলো জানত না জবা রেললাইনের পাথর থলেতে পুরে তার ওপর কাপড় জড়িয়ে মাথার বালিশ করে শোয়। পাথর ভরা থলে দিয়ে এইসান মার মেরেছিল ছেলেগুলোকে, একজন হসপিটালে, বাকিরা প্রাণ হাতে করে পালিয়েছিল। এই ঘটনা সম্বলিত গল্পটা পড়ে সাধনের দিদিমণির মতো কোনও এক পাঠক জবাকে জানায়, চিনিয়ে দেয় লেখককে। এক সকালে বাজার করছি, সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল জবা। কোমরে গিঁট বেঁধে উঁচু করা পরা রংজ্বলা ম্যাক্সি, গামছাও বাঁধা কোমরে, চুলে চিরুনির চলাচল নেই বহুদিন। এটাই রোজকারের ড্রেস। সেদিন একমুখ হেসে বলেছিল, তুই নাকি কাগজে আমার নামে খবর লিখেছিস!

আমি ‘হ্যাঁ, মানে, না, ইয়ে, আসলে’ বলে পাশ কাটিয়ে তাড়াতাড়ি পা চালিয়েছিলাম। জবা গল্প, উপন্যাস, কবিতা, কাকে বলে জানে না। ছাপার অক্ষরে যা কিছু বেরোয়, ‘খবর’ বলেই মনে করে। আরও একটা বড়ো সমস্যা, জবার ভোকাবুলারিতে ‘তুমি’ সম্বোধন প্রয়োগ হয় না। যেসব রাশভারী কাস্টমারকে চুরি করে আনা মাছ, সবজি বিক্রি করে, তাদের আর মালিকশ্রেণির লোককে ‘আপনি’ ডাকে। বাকি সবাইকে তুই। যেহেতু ওকে নিয়ে লিখেছি, জবা ধরেই নিয়েছে আমি আপনজন। ‘তুই’ বলে তো ডাকবেই।

আপনজন হওয়ার যে কত ঝক্বি, বুঝতে পারলাম তারপর থেকে। দু’টো দশটার ডিউটি থাকলে সকালের বাজারটা আমি করি। একবার যদি জবার চোখে পড়ে যাই, সঙ্গে সঙ্গে এগিয়ে আসে। মুঠোতে বা গামছার কোঁচড়ে যা থাকে, মাছ, পেয়ারা, লেবু, ধনেপাতা, কলমি শাক… যেদিন যেমন চুরি করতে পারে, আমাকে অন্যদের তুলনায় সস্তায় দিতে চায়। বলে, নে না বাবু, পুরোটাই নে। কুড়িটাকা দিবি। তুই আমার চেনা লোক বলেই এত কমে দিচ্ছি।

‘বাবু’ সম্বোধনটা সম্মান জানানোর জন্য করছে, নাকি আমার নতুন নামকরণ করেছে জবা, বলার ধরন দেখে বুঝতে পারি না। জবার জিনিস না নেওয়ার থাকলেও, অনেক সময় নিতে হয়। একগাদা অদরকারি সবজিপাতি নিয়ে এলে মা রাগ করে। নিজের অসহায়তার কথা বলতে পারি না। বললেও বুঝবে না মা। কখনও দেখা যায় নিজের জিনিসপত্র সব বেচে ফেলে বাজারে এমনিই ঘুরঘুর করছে জবা, অথবা কোনও মাছওলা, সবজিওলাকে হেল্প করছে কাজে। আমাকে দেখতে পেলে মাঝে মাঝে উঠে আসে। পাশে হাঁটতে থাকে ডিঙি মেরে মেরে। এটাই ওর হাঁটার স্টাইল। নানা রাজ্যের গল্প বলে। সাধনের মতো ওকে নিয়ে আর একটা গল্প লিখিয়ে নেওয়ার প্রত্যাশায় বলে না। জবার সেই বোধ নেই। নিজের জীবনটাকে তুচ্ছও মনে করে না। আমাকে নিজের লোক মনে করে গল্পগুলো বলে। বেশিরভাগ চুরির গল্প। মালিক বাধা দেওয়াতে কী কী খিস্তি করেছে সেগুলো শোনায়। আমি আতঙ্কে মরি, এই বুঝি পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়া লোকটা ওর কথাগুলো শুনে ফেলল! আমাদের একসঙ্গে হেঁটে যেতে দেখলে লোকজন ঘুরে ঘুরে তাকায়। সাধনের সঙ্গে হাঁটতে দেখলে যতটা অবাক হয়, জবার বেলায় তার চেয়ে অনেক বেশি। কারণ, জবার পোশাক-আশাক পাগলির মতো তো বটেই, ডিঙি মেরে হাঁটাটাও পিকিউলিয়ার, রাস্তায় যারা হাঁটছে, সবার থেকে আলাদা। পায়ে আবার চটি পরে না।

ওর চুরির বিবরণের মধ্যেই আমাকে একদিন জানিয়েছিল, প্ল্যাটফর্মে আর থাকছে না। ঘর ভাড়া নিয়েছে স্টেশন ধারে। আমি বলেছিলাম, এবার একটা বিয়ে করে ফেল। লজ্জা পেয়ে হেসেছিল জবা, ভঙ্গিটা আর-পাঁচটা স্বাভাবিক মেয়ের মতোই। পাগলামির ছিঁটেফোটা নেই তাতে। মাঝে কিছুদিন যাবৎ খেয়াল করি বাজারে, রেলের প্ল্যাটফর্মে, আশপাশের কোনও এলাকাতেই জবাকে দেখা যাচ্ছে না। গেল কোথায় মেয়েটা? প্রশ্নটা বাজারের কাউকে করিনি। এখান থেকে বিদেয় হলে বাঁচা যায়। বেশ কয়েক মাস বাদে দেখি জবা কোলে বাচ্চা নিয়ে ঘুরছে। চেহারায় বিয়ের কোনও সাক্ষর নেই, মানে সিঁদুর, শাঁখা, পলা… আমি সামনে দিয়ে হেঁটে গেলাম, খেয়ালই করল না। বাচ্চাটার দিকেই সমস্ত মনোযোগ!

মাছওলা রবিনের কাছে মাছ কেনার সময় জিজ্ঞেস করলাম, জবা কার বাচ্চা কোলে নিয়ে ঘুরছে? কেন, ওর নিজের? বলেছিল রবিন।

জানতে চেয়েছিলাম, বিয়ে করল কবে? বাচ্চার জন্য ওদের আবার বিয়ে করতে লাগে নাকি! তাচ্ছিল্যের গলায় বলেছিল রবিন। ব্যাপারটা কিন্তু তুচ্ছ মনে হয়নি আমার। হাইফাই সোসাইটিতে আজকাল ‘সিঙ্গল মাদার’ প্রায়ই শোনা যায়। সেলিব্রিটিরা ‘সিঙ্গল মাদার’ হলে লেখালিখি হয় কত! সাহসিনীর সম্মান পায় নারীটি। এর উলটো দিকে, সমাজের প্রান্তসীমায় থাকা জবা একই রকম কাজ করে ফেলল, কোনও শাবাশি নেই! শুধুই তাচ্ছিল্য আর অবজ্ঞা! রবিনের থেকে মাছ নিয়ে রাস্তায় এসে দেখি, জবা বসে আছে রেলের ইলেকট্রিক পোস্টের বেদিতে। ওর সামনে গিয়ে বলি, কী রে, তোর বাচ্চা? ছেলে না মেয়ে?

একগাল হেসে জবা বলেছিল, ছেলে।

ওর বাবা কোথায়? একটু ঝুঁকি নিয়ে কথাটা জিজ্ঞেস করেছিলাম। খেঁচিয়ে উঠতেই পারত। কেন-না, এই প্রশ্ন নিশ্চয়ই অনেকেই ওকে করেছে। ক্ষেপে যায়নি। শান্ত গলায় বলেছিল, ওর বাবা নেই। বাবার কী দরকার!

দরকার নেই কেন বলছিস? আমার প্রশ্নের কোনও উত্তর দেয়নি জবা। মুখে নানারকম আওয়াজ করে বাচ্চাটাকে আদর করতে লেগেছিল।

দিন যায়। জবাকে আর আগের মতো বাজারের এপ্রান্ত-ওপ্রান্ত করতে দেখা যায় না। হঠাৎ হঠাৎ চোখে পড়ে, কোলে সবসময় বাচ্চা। একদিন একদম সামনে থেকে দেখলাম, জবার চেহারা খুব খারাপ হয়ে গেছে। শরীরে ঝিমানো ভাব। হাঁটাচলায় আগের সেই চনমনে ব্যাপারটা নেই। কোলে বাচ্চাটা ঠিক আছে। একটু বড়োও লাগছে। মা কিন্তু অতীব শীর্ণ।

ফের রবিনকেই জিজ্ঞেস করলাম, জবার কোনও রোগভোগ হল নাকি? চেহারা তো বেশ ভেঙে গেছে দেখছি। আর বোলো না, অতিরিক্ত আদরে পাগলিটা বোধহয় বাচ্চাটাকে মেরেই ফেলবে। ছেলেটা হওয়ার পর থেকে সারাক্ষণ কোলে নিয়ে ঘুরছে। এক মুহূর্ত কাছছাড়া করে না। নিজের কাজ কারবারও বন্ধ করে দিয়েছে। আর ওকে দেখতে পাও বাজারে কিছু বিক্রি করতে?

মাথা নেড়ে ‘না’ বুঝিয়ে ছিলাম আমি। রবিন ফের বলেছিল, নিজে কী খায়, কতটুকু খেতে পায়, কে জানে? ও না খেলে বুকের দুধও তো হবে না। বাচ্চাটা খাবে কী? এ নিয়ে তুমি যদি কিছু বলতে যাও, টাকা দিয়ে সাহায্য করতে চাও, তক্ষুনি তেড়ে আসবে। টাকাপয়সার জন্য কোনওদিনই কারুর কাছে হাত পাতে না জবা, বিরাট প্রেস্টিজ জ্ঞান! বাচ্চাটার ভালোর জন্য কিছু বলতে গেলে গালাগাল শুনতে হবে। ইতিমধ্যেই শুনেছে অনেকে। ও বোঝে উলটো। মনে করে বাচ্চার ওপর নজর দেওয়া হচ্ছে। নজর কাটাতে নানান ঠাকুরের থানে ঘুরে বেড়াচ্ছে। মাদুলি, তাবিজ পরিয়ে যাচ্ছে বাচ্চাটাকে। …রবিন আরও অনেক কিছু বলে যাচ্ছিল। মন খারাপ হয়ে গিয়েছিল আমার। মাছবাজার থেকে উঠে এসে ফের রেলের পোস্টের নীচে বাচ্চা কোলে বসে থাকতে দেখেছিলাম উশকোখুশকো চুলের জবাকে। একেবারে প্রেতিনীর চেহারা! মুখের ‘মা মা’ হাসিতে অবশ্য কোনও অন্ধকার লেগে নেই। বাচ্চাটার সঙ্গে আদরের খুনশুটি করে যাচ্ছে। সেদিন আর ওকে কিছু বলতে ইচ্ছে করেনি। সরে গিয়েছিলাম সামনে থেকে।

দিন দুয়েক বাদে ছ’টা দু’টোর ডিউটি সেরে বাড়ি ফিরছি, স্টেশনরাস্তায় দেখি আমার সামনে হাঁটছে জবা। মন্থর হাঁটা। বাচ্চাটা তো কোলে আছেই। পা চালিয়ে ওর পাশে চলে গিয়েছিলাম। জবাকে বলেছিলাম, কী রে, কেমন আছিস? বাচ্চা মানুষ করতে গিয়ে চেহারাটা তো একেবারেই গেছে দেখছি! ওর বাবা খোঁজটোজ নেয়?

কেন নেবে? সে তো বাবা হতে চায়নি। আমি মা হতে চেয়েছিলাম। বলেছিল জবা।

আমি বললাম, তবু সে লোকটা তো বাবা। তার কোনও দায়দায়িত্ব নেই? গায়ে হাওয়া লাগিয়ে ঘুরে বেড়াবে, তুই বাচ্চাটাকে মানুষ করতে গিয়ে হাড্ডিসার হয়ে যাবি! নিজেকে দেখেছিস আয়নায়?

ও সব ঠিক হয়ে যাবে। বাচ্চাটা একটু বড়ো হয়ে গেলেই কাজে নেমে পড়ব। এখন তো কোথাও রেখে যেতে পারি না। কারুর কাছে দিতেও পারি না, সবাই নজর দেয়।

বাচ্চার প্রতি জবার যা অন্ধ বাৎসল্য, ওকে বোঝালেও বুঝবে না, বাচ্চাটা বড়ো হওয়ার আগেই জবা মরে যেতে পারে। ও কথায় না গিয়ে জবাকে বলেছিলাম, মা হওয়ার যখন ইচ্ছেই হয়েছিল তোর, বিয়েটা করে নিতে পারতিস। তাহলে লোকটা এইভাবে পালিয়ে বেড়াতে পারত না। বাচ্চা মানুষ করতে মা-বাবা দু’জনকেই লাগে। উত্তরে জবা বলেছিল, বিয়ে ফিয়ে বহুত ঝামেলার ব্যাপার, আমার মা হওয়ার ইচ্ছে হয়েছিল, হয়ে গেছি ব্যস। মা হওয়ার ইচ্ছেটা কখন, কীভাবে এল তোর মনে? জিজ্ঞেস করেছিলাম জবাকে। আসলে অশিক্ষিত মেয়েটা মাতৃত্বের আকাঙক্ষাটা কীভাবে প্রকাশ করে, সেটাই দেখতে চাইছিলাম। শিক্ষিতরা তো অনেক গুরুগম্ভীর ব্যাখ্যা দেয়। কিন্তু জবা যা বলল, বোধবুদ্ধি গুলিয়ে গিয়েছিল আমার।

একটা ঘটনার কথা বলেছিল জবা, মহাদেবের কেটারিং-এর হয়ে কাজে গিয়েছিল চাপাডাঙায়। বিয়ের কাজ। রাত হয়ে গিয়েছিল ফিরতে, পেটে ভালোমন্দ খাবার, ম্যাটাডোরে বাসনপত্রের মাঝে বসে ঢুলছিল জবা। মাকালতলায় এসে বিগড়ে গেল গাড়ি। ড্রাইভার চেষ্টা করছিল সারানোর। জবা ম্যাটাডোর থেকে নেমে মাঠের ধারে শিরীষগাছের নীচে গিয়ে বসেছিল। সেখানেই ঘুমিয়ে পড়ে। রাতে স্বপ্ন দেখে, গাছটা তাকে যেন বলছে জবা রে, এবার মা হ। মা হয়ে যা জবা। মেয়েমানুষ যখন হয়েছিস, মা হবি না কেন? মা হওয়ায় দারুণ সুখ, খুব আনন্দ… ঘুম ভাঙতে জবা দেখেছিল ভোর হয়ে গেছে। তাকে ফেলে চলে গেছে কেটারিং কোম্পানির গাড়ি। তাতে রাগ হয়নি জবার, মা হওয়ার ইচ্ছেতে মন তখন টইটুম্বুর। গাছটাকে প্রণাম করে পায়ে হেঁটে মাকালতলা থেকে ফিরেছিল দেবনগরে।

জবার ভাষায়, কিছু হারামি সবসময় ওঁত পেতে বসে থাকে ওকে পাওয়ার জন্য, তাদেরই একটাকে ঘরে তুলেছিল জবা। কিছুদিন পর যখন বুঝল বাচ্চা এসে গেছে পেটে, হারামিটাকে তাড়িয়ে দিয়েছে। …ঘটনাটা অবান্তর, কিন্তু চিত্তাকর্ষক। বিষয়টাকে নিয়ে গল্প লেখাই যায়। দ্রুত বাসনাটাকে আমি ত্যাগ করেছিলাম। সাধন, জবা এদের নিয়ে দ্বিতীয় গল্প লিখে ঝামেলা বাড়াতে চাই না। একটা করে লেখাতেই রাস্তাঘাটে বিরক্ত করে মারে। দু’টো লিখলে আমাকে এতটাই আপনজন ভাববে, চলে আসতে পারে বাড়িতে।

নাঃ, এবার কিন্তু বেশ চিন্তাই হচ্ছে। এখনও কেন ফিরছে না জবা? আকাশে যা মেঘ করেছে, বৃষ্টি নামল বলে। তবু ভালো, বাচ্চাটা এখনও কেঁদে ওঠেনি। যতবারই চোখ যাচ্ছে ওর দিকে, দেখছি, মুখে নানারকম আওয়াজ তুলে নিজের মনে হাত-পা নেড়ে যাচ্ছে। …বৃষ্টি এসেই গেল। জোর কদমে শুরু হয়েছে। শেডের শেষের দিকে আছি বলে প্ল্যাটফর্মে বৃষ্টি পড়ে ছিটকে আসছে জল। একটু বাদে প্ল্যাটফর্মও ভাসবে। শেডে অনেক ফুটোফাটা আছে, ওপর থেকে জল নামার পাইপও ভাঙা। বাচ্চাটাকে এবার তুলে আনতেই হবে, নয়তো ভিজে যাবে পুরোপুরি। বেঞ্চ থেকে নেমে বাচ্চাটাকে দু’হাতে তুলে ধরি, উৎকট গন্ধটা আছে ঠিকই, তবে শিশুর গায়ের সেই অদ্ভুত ঘোরলাগা গন্ধটা পুরোপুরি চাপা পড়ে যায়নি।

আমাকে চমকে দিয়ে সামনে এসে দাঁড়াল জবা। ভিজে একেবারে সপসপে হয়ে গেছে। খুব হাসছে, নুয়ে পড়ে হাসছে। আমাকে দেখেই ওর হাসি। বলে ওঠে, তোকেই তো ওর বাপের মতো লাগছে! জবা যেন একদলা কাদা ছুড়ে মারল আমার গায়ে। রাগ হচ্ছে ভীষণ। ওকে কিছু বলেও তো লাভ নেই। কাকে কী বলতে হয় জানে না। বাচ্চাটাকে এগিয়ে দিয়ে বললাম, কোথায় থাকিস? বাচ্চাটা তো এক্ষুনি ভিজে যেত।

বাচ্চাকে কোলে নিল জবা। বলতে থাকল, আর বলিস না মাইরি, বাচ্চাটাকে রেখে একটা প্যাসেঞ্জারের মাল তুলে দিতে গেছি রিকশায়, পুলিশ আটকে রেখে দিল। বাজারে হারানদার সোনার দোকানে চুরি হয়েছে, আমার কাছে এটা ওটা জানতে চাইছে পুলিশ। বলছি, বাচ্চাকে রেখে এসেছি স্টেশনে, কথা কানেই নিচ্ছে না!

অঝোরে বৃষ্টি সত্ত্বেও শেড থেকে বেরিয়ে বাড়ির উদ্দেশে হাঁটা দিলাম। খেয়াল করলাম জবার ছোড়া কাদাটা আলকাতরার মতোন নাছোড়! এত বৃষ্টিতেও ধুয়ে যাচ্ছে না।

পরের দিন ঘুম ভাঙল একদম ভোরে। অদ্ভুত একটা স্বপ্ন দেখলাম। মাকালতলার যে শিরীষ গাছটার কথা বলেছিল জবা, গাছটা আমি চিনি। পিছনে মাঠ। অল্প বয়সে ম্যাচ খেলতে গেছি। স্বপ্নে দেখছি, সেই গাছতলায় শুয়ে আছি আমি। গাছটা বলছে, বাচ্চাটাকে নিয়ে গল্প লেখ। গল্পটা তো এসে গেছে মাথায়। কেন দেরি করছিস? গল্পটা যে মাথাতেই মরে যাবে…

ধড়মড় করে উঠে বসলাম বিছানায়। হাতে মাত্র চারটে দিন। পুজোসংখ্যায় গল্পটা দিতে হবে। বাথরুম ঘুরে এসে বসে পড়েছি লেখার টেবিলে। প্রথম লাইনটা লিখলাম, বছর তিনেক ধরে আমার স্বভাবে একটা উল্লেখযোগ্য বদল এসেছে…

 

হস্তান্তর

সাতডিহি গ্রাম থেকে নাইট শো সেরে ফিরছিল কমলা। ট্রেকারে গাদাগাদি যাত্রীর মধ্যে গা ঘেঁষাঘেষি করে কমলার পাশে বসে রসিক ধনঞ্জয় আর পেছনে সঙ্গতের বাজনদাররা। হারমোনিয়াম গলায় কানাই নেমে গেছে পথে। সেখান থেকে আদ্রা যাবে একটা যাত্রা দলের সাথে মহড়ায় বসতে। আদ্রার কাছেই এক গ্রামে তার বাড়ি। কমলার ঘর বলো, সংসার বলো, সবই রসিক ধনঞ্জয়ের দান। ঝুমুরের মরশুম ছাড়াও বাজনদাররা খেপ কাজের সুযোগ পায়। কিন্তু প্রধান শিল্পী ‘নাচনি’র নাচের বায়না না থাকলে, নাচ নিয়ে পড়ে থাকার উপায় নেই। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত ধান ভানা,ধান-চাল সেদ্ধ করা, খড় কুচোনো, গরুর জাবনা তৈরি করা, উঠোন নিকোনো, ঘুঁটে দেওয়া– কাজের অভাব? ধনঞ্জয়ের বউ কমলাকে ডাকে ‘ঢেমনি’ বলে। খাবার দেয় ছুড়ে। তার নিড়ানো বা ভানা চাল অচ্ছুত নয়, বাগানের সবজি অচ্ছুত নয়, শুধু কমলা অস্পৃশ্য। হাড়ভাঙা খাটনির পর রাতে দু-চোখের পাতা এক হয়ে এলে, রসিক ধনার স্পর্শে জেগে উঠতে হয় প্রায় দিন। রক্ষিতা নাচনির দিনের বেলা ছায়া মাড়ানোও চলে না, কথা বলাও পাপ। কেবল অনুষ্ঠান থাকলে ছাড় থাকে। কিন্তু রাত্রিটা আর পাপের থাকে না। তখন রসিককে খুশি করাই তার একমাত্র কাজ। শরীর খারাপের ওজরটাও ধোপে টেকে না।

কমলার এবছরের মতো নাচের আসর শেষ। এখন ধান সেদ্ধ করার সময়। আরও হাজারটা কাজ। ধনার বউ অতসী ওকে দেখলে এক ঘটি জলও গড়িয়ে খায় না। ভুল হল। জল ছোঁয়া তো বারণ। হেঁসেলে ঢোকাও। কমলার কাজ উঠোন থেকে শুরু হয়ে সারা গাঁয়ে ছড়িয়ে আছে। অন্যের বাড়িও খেটে আসতে হয়। মজুরিটা ধনার সংসারের প্রাপ্য।

ট্রেকারে চাপাচাপি করে আসতে আসতে নিজের বারোমাস্যার কথাই ভাবছিল কমলা। এই যে ওর গায়ে গা লাগিয়ে যাত্রীরা বসে আছে, তারা বাড়ি ফিরেই স্নান করবে নিশ্চয়ই। গাড়িটা হঠাৎ জুরিডির হাটে থেমে গেল। সামনে রাস্তা আটকে অনেক লোক। তা হাটবারে ভিড় তো হবেই। কিন্তু এ তো জটলা বেধেছে। কিছু একটা হয়েছে। চড়নদাররা একে একে নামল। কমলাও। ওর ছোঁয়া বাঁচাতে জটলাটা একটু ফাঁক হয়ে গেল। হাটের প্রকাণ্ড অর্জুন গাছটার নীচে বসে আছে এক অশীতিপর বৃদ্ধা। সামনে ভিক্ষাপাত্র। নড়ার ক্ষমতা নেই। শরীর থরথর করে কাঁপছে। ‘ভিক্ষা দাও মাগো বাবারা’ নয়, মুখ থেকে অস্ফুটে বেরিয়ে আসছিল ‘জল জল…।’

কেউ কাছে যাচ্ছে না। সামনে চায়ের দোকানে জগে জগে পানীয় জল রাখা। কিন্তু কারও গ্রাহ্য নেই। কমলা জনতার জাত চেনে। সে বলল, ‘দাঁড়াও বিজলি মাসি, আমি জল লিয়ে আইসছি।’ ট্রেকারে নিজেদের নিজেদের সামগ্রী ঠাসা থলেতে একাধিক বোতল। শালারা কোনটায় জল, আর কোনটায় মাল রেখেছে বোঝা দায়। ভাগ্যিস নিজের ব্যাগে একটা জলের বোতল রাস্তার কল থেকে ভরে ঢুকিয়েছিল। বোতল হাতে ফিরে এসে দেখে ভিড় পাতলা হচ্ছে। নানারকম মন্তব্য– ‘পাপের জীবন’, ‘এমনটাই হবার ছিল’। বিজলিবালা গাছের তলায় নেতিয়ে পড়ে আছে। লিকলিকে শরীরটাকে তার নোংরা পুঁটলি থেকে একনজরে আলাদা করে চেনা যাচ্ছে না।

শেষ সময়টা তৃষ্ণা নিয়ে গেল মানুষটা? কমলার বোতলের জল খরচ হল না। চোখ জলে ভরে উঠল। ধনঞ্জয় এসে তাড়া  লাগাল, ‘কী দেখছিস কী? চল। মেলা বেলা হইল।’

‘বিজলিমাসি কত সোন্দর দেইখতে ছিল। কত বড়ো  মাইনষে তার নাচ দেইখে শাড়িতে টাকা লাগায়েন দিত। মরার আগে একফোঁটা জলও পেইলেক লাই? আমি তো জল জল শুনেই দৌড় লাগায়েনছি। কিন্তুক হাটের লোকে তো আগে থাইকতে শুইনছে। উয়ারা কেউ জলটুকু দিলেক না?’

‘খানকির এমনই গতি হয়। ইবার ডোম আইসবেক, খবর করা হঁইছে। আমরা ভালে কী কইরব? চল।’

‘খানকি বইলছ কাকে? উ নাচনি ছিলেক। গুণী শিল্পী, আমার পারা। গরমেন্ট চাদর দিলেক, সাট্টিফিকেট দিলেক, পেরাইজে টাকাও দিলেক, দেখো নাই?’

 

‘গুণী শিল্পী।’ ভেংচি কাটল ধনঞ্জয়। ‘চল।’

‘মাসির কাছে কত কিছু শিখছি। শেষ সময়টা টুকদু থাইকতে দাও।’

‘গাড়িটো কি তুর বাপের? সবাই কি তুর পারা কামকাজ ফেইলে টাইম কাবার কইরবে? কী কইরবি দেইখে? ওই দেখ মাতলা ডোম চলে এইসছে।’

মাতলা বিজলিবালার পায়ে আলগোছে দড়ির ফাঁস দিল। তারপর টেনেহিঁচড়ে নিয়ে চলল শ্মশানের কাছে ভাগাড়ে। বিজলির ছেঁড়া বসন রাস্তায় আটকে আটকে লুটিয়ে চলল। মাথার চুল ধুলো ঝাঁটাল। পুঁটলির চাল ছড়িয়ে পড়ল পথে। আহা! অমন করে খরখরে মোরামের রাস্তায় টানতে আছে? অবশ্য বিজলিমাসি আর ব্যথা পাচ্ছে না। কিন্তু নিজের ভবিতব্য দেখে শিউরে উঠল কমলা। নাঃ, আর কিছু দেখার নেই। এরপর শ্মশান ভাগাড়ের শেয়াল, কুকুর, শকুন…!

বাড়ির দরজায় জোরে জোরে শেকলের বাড়ি মারল ধনঞ্জয়। মেয়ে টুসু এসে দরজা খুলে সরে দাঁড়াল। অতসী উঠোনে কাপড় মেলছিল। স্বামীকে আহ্বানের সঙ্গে সঙ্গে সাবধানও করে দিল, ‘দেইখো। কাচা কাপড়গুলান ছুয়াৎ না যায়। আগে গোবর ছুঁয়ে ডুব দিয়ে ঘরে ঢুইকবে।’

কমলাকে যেন দেখতেই পেল না। সে নিজের ঘুপচি ঘরে ঢুকে একটা বালতি মগ নিয়ে এসে অপেক্ষা করতে লাগল। সবাই চলে গেলে টিউব কলের জল নিয়ে স্নান করবে। জল নিয়ে কলটা ধুয়ে দিতে হবে। তার স্নানের জায়গাও আলাদা। কানা গরুর ভিনু বাথান। এদিকে পেটটা টিস্টিস্ করছে। এ বাড়িতে সেপটিক ট্যাংক আছে। গত বছর খাটা পায়খানার পরিবর্তে বসেছে। কিন্তু সেখানে কমলার ঢোকা মানা। তাকে সেই আগের মতোই এই দিনেদুপুরেও মাঠ থেকে কাজ সেরে ফিরতে হবে। সেসব না চুকিয়ে স্নান করা বৃথা। দু-দুবার কাপড় কাচতে হবে। আচারবিচার সব মেনে স্নান করলেও তার অস্পৃশ্যতা দূর হবে না। অতসীবউদির কাছে কলাই করা থালা নিয়ে দাঁড়ালে সেই ছুড়েই খাবার দেবে। শুধু অতসী নয়, গ্রামের বিয়ে-শাদিতে যখন চেয়ার টেবিল পেতে পংক্তিভোজন হয়, তখনও কমলাদের মাটিতে বসিয়ে ছুড়ে ছুড়েই খাবার দেওয়া হয়। মেয়ে বিউটি তো নাচনি নয়, তবু তাকেও মায়ের পাশে অচ্ছুৎ হয়ে বসে থাকতে হয়। মানে লাগার জো নেই। নেমন্তন্ন থাকলে বাড়িতে মা মেয়ের নিজেদের ভাত ফুটিয়ে খরচ করা চলবে না।

ঝুমুর সেরে ‘বাড়ি’ ফিরে যেন চোর হয়ে থাকতে হয়। অতসী এমনিতেই তাকে নিজের ছেলেমেয়ের সামনেও ‘খানকি, ছেনাল’ ইত্যাদি বলতে ছাড়ে না। নাচের আসর থেকে ফিরলে তার মেজাজ যেন আরও চড়ে থাকে। কদিনের জন্য স্বামী এই ঢেমনির সঙ্গে ঢলাঢলি করেছে না? যতক্ষণ আসর ততক্ষণ হৈচৈ। তারপর ‘সোহাগ চাঁদ’ থেকে ঘুঁটে কুড়ুনি।

বাড়ি ফিরে মেয়ের খোঁজ করলেও রাগ রসিক দম্পতির। তার মেয়েকে কি অতসী না খাইয়ে রেখেছে, না বেচে দিয়েছে? বরং নাচনির আবদার রেখে তাকে গ্রামের প্রাইমারি স্কুলে ভর্তি করা হয়েছে। দুপুরের মিড ডে মিল ছাড়া শিক্ষা কী পায় বলা মুশকিল, তবে শাসন পায় পর্যাপ্ত। মেয়েটাকে গর্ভে মেরে ফেলার চেষ্টা কম করেনি ধনা। কিন্তু সব বিষ হজম করে কেমন নির্লজ্জের মতো জন্ম নিল। আর যাতে না হয়, সে ব্যবস্থা পাকা করে দিয়েছে রসিক মেয়েটা জন্মানোর পরই। কিন্তু ওই এক মেয়ের জন্যই ঘুঙুরজোড়া পায়ের বেড়ি হয়ে গেছে। অবশ্য যেসব নাচনির সন্তান নেই, তাদেরই বা মুক্তি পেতে দেখল কোথায়? পঞ্চমীর কথা কে না জানে?

স্নানের পর থেকেই চোখে ঢুল আসছিল। পেটে ভাত পড়ার পর আর বসে থাকা যাচ্ছে না। মায়ের এঁটো মেঝে গোবরজলে বিউটিই নিকিয়ে দিল। ‘শুতে চল মা। দুপুরটো টুকদু জিরায়েঁ লাও।’

অতসীর হুংকারে তন্দ্রা ছুটে গেল। ‘রাতভর ঢলানি কইরে আসছিস। কামকাজ কুছু তো করার নাম লাই। মুড়ির চাল সিজাগে।’

কমলা চাল সেদ্ধ করে শুকিয়ে তৈরি করে রাখলে অতসী ভাজবে। সেই মুড়ি সংসারে উদ্বৃত্ত হলে পাড়ায় বিকোয় না, প্যাকেটবন্দি হয়ে চলে যায় শহরে। আয় মন্দ না। ‘বর্ধমানের মিষ্টি মুড়ি’ শুধু বর্ধমানেই তৈরি হয় না। ঘুম চোখে দুপুরের কড়া রোদ পিঠে নিয়ে গনগনে অাঁচের সামনে বসল কমলা। বিউটি মায়ের সঙ্গে থাকলেও এসব কাজ ওকে করতে দিতে চায় না কমলা।

মুকুন্দ ঘোষের ঘর ছাইবার কাজ করতে গিয়ে সরকারি ‘সয়ম্ভর’ যোজনা, একশো দিনের কাজ এসব তথ্য কানে এল। ধনাদের লুকিয়ে সেই কাজের এক ফাঁকে ‘স্বয়ম্ভর’ যোজনায় কাজ খুঁজতে গেল। কমলার ভোটার কার্ড, বিপিএল কার্ড সবই আছে। এক মাতব্বর বলল, ‘তুই নাচনি বটিস না? ধনা সর্দারের? ইখানে ক্যানে? যা ঢলানি কইরে রোজগার করগে যা। ইটো গেরামের গরিব বউ বিটিদের জইন্য।’ সরকারি নির্দেশের ব্যাখ্যা ও রূপায়ন সরকারি কর্মীদের জিম্মায়। সুতরাং মুখ চুন করে ফিরে আসতে হল।

মাঝখান থেকে ধনঞ্জয়ের কানে গেল কথাটা। দরজা ঠেলে স্বামী উঠোনে পা রাখা মাত্র অতসী আবার সাতকাহন শোনাল। কমলার চুলের মুঠি ধরে উঠোনে ফেলে কিল, চড়, লাথি কোনওটাই বাদ রাখল না। বিউটি ভাগ্যিস এখনও স্কুল থেকে ফেরেনি। ‘খানকির শখ কত। আমি কি তুকে পুষছি লাই?’

কে কাকে পোষে? নাচনির রোজগারেই রসিকের সংসার, বউ-বাচ্চার ভাতকাপড় থেকে রসিকের নেশার চোলাই। ঝুমুর নাচের জলসা থেকেই রসিকপত্নীর নাকে সোনার নথ। আর নাচনি গায়ে নকল গয়না ও মুখে সস্তার মেক-আপ মেখে ঘুরে ঘুরে নাচে। নাগরের প্রেম বিরহের আখ্যান শোনায় গানে গানে। কমলার বাঁধা গানগুলিও নিজের নামে চালায় ধনঞ্জয়। কমলা মুখ্যু মেয়েমানুষ। সে কি গান বাঁধতে পারে? সে শুধু নাচবে আর গাইবে। আর রাতে ‘প্রতিপালক’ রসিকের দেহের তলায় পিষ্ট হবে।

‘অবেলায় ছুয়াৎ কইরলে? কাপড় ছেইড়ে ঘরে ঢুইকবে।’

অবেলা। তাই তো। এখনও ধনার কমলার ঘরে ঢোকার সময় হয়নি। ধনা টিউব কলের তলায় বসে বলল, ‘ফের যদি বেচাল দেখি, তো জ্যান্ত কুত্তা দিয়ে খাওয়াব, মরা তক অপেক্ষা কইরব না। আর তুর বিটিটোকে…’

বিজলিমাসির শক্ত হয়ে যাওয়া মরদেহ শেয়াল, কুকুরে ছিঁড়ে খাচ্ছে কল্পনা করেই এ কদিন রাতে ঘুম হয়নি কমলার। আর তাকে জ্যান্ত…? আর তার মেয়েকে নিয়ে কী করবে ভগবানও জানে না। ইয়ারা সব পারে।

মারের ক্ষতিপূরণ হিসাবে সন্ধেবেলায় কোনও কাজ করতে হল না। তবে রাতের আহারটাও বাজেয়াপ্ত হল। বিউটিও অতসীমামির ভয়ে মাকে খাবার দিতে পারল না। কমলা একবার কোনওরকমে ছেঁচড়ে ছেঁচড়ে ঘরের বাইরে নালিতে গিয়ে ছোটো বাইরে সেরে ফিরল। খাটে ওঠারও ক্ষমতা নেই। মেঝেতেই শুয়ে পড়ল। মুখের কষে রক্ত মোছার জন্য বিউটি মাকে জল দিয়েছে, ওই জলই সামান্য পান করেছে। হাত পাও ধুয়েছে। মেয়েটা দুপুরে মায়ের কাছে থাকলেও রাতে দালানে শোয়।

এ রাতে তাড়াতাড়ি ঢুকল ধনা। ‘খুব বেদনা কইরছে?’

উত্তর দিল না কমলা।

‘আমার কি তুর গায়ে হাত তুইলতে মন চায় রে? তুই আমার সোহাগি চাঁদ। দিকে দিকে তুর কত নামডাক ছড়াইনছে। ইয়াতে তুই খুশি লোস? বিডিও অফিস কিসকে গেঁইছিলিস। পালি কুছু? উয়ারা অপমান কইরে তাড়ায়েন দিলেক না? তুকে ভালাবুরা বইললে আমাকেও বাজে ইটো বুঝিস লা? তুকে কি আমি খারাপ রেইখেছি? তুর বিটিও পড়ালিখা শিখছে আমার ছিলাগুলার সাথে।’ কমলাকে টেনে বিছানায় তোলে ধনা।

‘আমার বিটি তুমার বিটি লয়?’ বলতে সাহস হল না। বলল, ‘সারা শরীল চিড়বিড়াইনছে। আজ রেইতে খেমা দাও। মারার সময় খেয়াল থাকে লা। আমি তো অচ্ছুত বটি। মইরলে আগুনটুকু পাব লাই।’

‘আয় তুর গায়ে হাত বুলায়েন দিই। বোরোলিন লাগায়েন দুবো? টুসুর মাকে বইলব কাল চুন-হলুদ কইরে দিতে।

বেদনা কুথায়?’

‘আর সোহাগ কাড়াতে হবেক লাই। সারাদিন তুমার সংসারের লেইগে জিউকে জামিন দিয়ে খাটি। সন্ঝায় মার খাই। রেইতে ঘুমাতে তো দিবে।’

‘শালি ভালো কথার বিটিছিলা লয়।’ ধনা কমলার বুকের কাপড়-ব্লাউজ সরিয়ে কামড় বসাল। ভয়ে জোরে কাতরোক্তি করার সাহস হল না কমলার।

বিয়ালা বউ না হয়েও ঘরগেরস্থালির কাজ, ঝুমুর নাচ আর সহবাস মিলে রসিককে ভালোবাসে কিনা কমলা নাচনি ঠিক ঠাওর করতে পারে না। কিন্তু অতসীর কাছে দিবারাত্রি দুর্ব্যবহার পেয়ে এমন এক অলিখিত প্রতিদ্বন্দ্বিতা জন্মেছে, যে ধনা বউয়ের বদলে কমলার ঘরে রাত্রিবাস করলে এক রকম আনন্দ হয়। শরীরের আনন্দ নয়, হিংসুটেকে জ্বালাতে পারার আনন্দ। যেসব রাতে শরীর সুস্থ থাকলেও রসিক ওর ঘরে না আসে, সেসব রাতগুলো ফাঁকাও লাগে। তাছাড়া বাপ হলেও রসিকের নজরটা ভালো নয়। দালানে মেয়েটা একা শোয়। ধনা কমলার কাছে না এলেই ভয় ভয় করে।

বহুবার মেয়েকে নিয়ে পালানোর কথা ভেবেছে। কিন্তু পঞ্চমীর দশা শুনে সে সাহস হয় না। পঞ্চমী পালিয়ে গিয়ে স্টেশনে এক মহিলার মিষ্টি কথায় ভুলে তার অনুগামী হয়েছিল। মহিলা নিজের বাড়িতে কাজ করাবে বলে কলকাতা নিয়ে যায় তাকে। পঞ্চমী এখন সোনাগাছি, হাড়কাটা গলি থেকে হাতবদল হয়ে শোনা যায় মুম্বইতে। কেউ বলে দুবাইয়ে চালান হয়ে গেছে। ধনঞ্জয় মারধোর করলেও কমলার দেহে একাই প্রবেশ করে। আদর করে বুকে টেনে নিলে বহুব্যবহূত শরীরেও মাঝেমধ্যে শিহরণ জাগে। পঞ্চমীর মতো নিত্যনতুন জানোয়ারদের থুতু চাটতে হয় না।

নিজের চেয়েও বেশি ভয় মেয়ে বিউটির জন্য। হারামজাদি কেন যে জন্মাতে গেল? নাচনির ছেলেকেই স্কুলে ভর্তি নিতে চায় না, সেখানে এক দিদিমণির দয়ায় বিউটিকে যে ভর্তি নিয়েছে এই ঢের। শুধু মায়ের পরিচয়েও যে সন্তান শিক্ষার সুযোগ পেতে পারে, তা নিয়ে অনেক তর্ক করতে হয়েছে দিদিমণিকে। অবশ্য এর জন্য ধনা আর অতসীর পায়ে পড়তেও কসুর করেনি কমলা। বিউটিকে কিছুতেই নাচনি হতে দেবে না। এত করেও কি শেষ রক্ষা হবে? চতুর্থ শ্রেণি পাস করলেও কি উচ্চ বিদ্যালয়ে ঢোকার সুযোগ পাবে? টুসু ফেল করে তার ছোটো ভাই তপনের সাথে তৃতীয় শ্রেণিতে। বিউটি ক্লাস ফোর। স্কুল যাওয়ার সময় অচ্ছুত নাচনিকন্যা, মণিবের পুত্র-কন্যার ব্যাগ বইতে বইতে পিছু পিছু হাঁটে, কারণে অকারণে শাস্তি পায়। তবু টুসুর চেয়ে ভালো ফল করে বলে পরীক্ষার রেজাল্ট বেরোলেই অতসী ঝাঁটা হাতে কথা বলে। ওদিকে ওই দিদিমণি ছাড়া বেশিরভাগ মাস্টারদের হাতে তো বেত মজুতই থাকে। তবে পরীক্ষার খাতাতে সম্ভবত কারচুপি করে না।

একবার কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি ফিরে মায়ের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল মেয়েটা। ‘মা আমি আর হুস্কুলে যাব না। উয়ারা বলে তুর মা নাংটি বটে। নাচনি আর নাংটি কি একঅই কথা মা? পড়া না পাইরলে মাস্টার মারে, সাজা দেয়। বুইঝতে চাইলে বুঝায় লা। বলে তুঁ কী কইরবি পড়ালিখা শিখে?’ তারপরেও মেয়েটা কী করে পাস দিচ্ছে কে জানে?

‘এই মাগি, চার বেলা গিলে উনুনধারে বসে ঘুমাচ্ছিস? ভাগ্যে উনোনটো নিভে গেঁইছে, নইলে সব চাল লষ্ট হইত।’ অতসীর ধমকে ধড়মড় করে উঠে বসে কমলা। দুপুরের সূর্য গড়িয়ে পশ্চিমের চালের ওপাশে চলে গেছে। এখন ছায়া ছায়া বিকেল। কখন ঘুমিয়ে পড়েছিল খেয়াল নেই।

‘কুছু হবেক লাই। চালটো ঠিকঠাক সিজাইনছে। দালানে

তুলে রাখি?’

‘কুছু হবেক লাই– সব জেইনে বইসে আছে। যা আর মড়া আগুলতে হবেক লাই। রেইখে দে? আর শুন, আজ যদি টুসুর বাপ রেইতে তুর ঘরকে গেইছে তো সকালে তুর একদিন কি আমার একদিন। কদিন আগে লাইচতে গিয়ে খুব তো ফুর্তি মেইরে এলি। তারপরেও মাগির আশ মিটে লা।’

‘আমি কি তাকে ডাকি? উয়ার যখন ইচ্ছা আমাকে মারে, আর যখন ইচ্ছা ঘুম ভাঙায়। আমার আজ শরীল-গতিক ভাল লয়। তুমার সোয়ামিকে তুমি সামাল দাও।’

‘আমি কী কইরব তুর কাছে শিখব লাকি।’

চুপচাপ আধসেদ্ধ চাল ভরা প্রকাণ্ড মাটির মালসা দালানে তুলে ঢাকা দিয়ে রাখল। এই লাল চাল ভেজেই মুড়ি হবে। ভাজার আগে নুন সোডা দিয়ে ভেজা চাল মাটির মালসায় নাড়াচাড়া করে নিতে হয়। তারপর রোদে শুকোতে হয়। সেই চাল শুকোলে মাটির খোলায় বালি গরম করে ছেড়ে নারকেল কাঠি দিয়ে নাড়লেই চড়বড়িয়ে মুড়ি। বাড়ির জন্য মুড়িটা অতসী নিজে ভাজে। কিন্তু ব্যাবসার মুড়ি ভাজতে হয় কমলাকেই। যারা কিনবে তারা কি জানছে সেটা কে ভেজেছে– সতীলক্ষ্মী না ছেনাল? কমলার ভেতরটা ঢিপঢিপ করছে। কাল বাচ্চাগুলোর রেজাল্ট।

যা আশা আর আশঙ্কা ছিল, তাই ঘটল। বিউটি উতরে গেছে, তপন টেনেটুনে পাস, টুসু কেলাস থিরি ফেল। আর কথায় গায়ের জ্বালা মেটার নয়। বিউটিকে বেড়াল ঠেঙানো লাঠি দিয়ে পেটাল টুসুর মা। ‘বারো ভাতারির বিটি, আমাদের খাবি আমাদের পরবি, আর আমার ব্যাটাবিটিকে গুণতুক কইরে ফেল করাবি?

আজই তুকে দিয়ে দিব দাসু সর্দারের হাতে। মায়ের পারা রোজগার কইরবি।’

‘কার টাকা কে খায়?’ বলতে গিয়েও কথাটা গিলে ফেলল। অতসীর পায়ের কাছে মাটিতে পড়ে বলল, ‘বউদিদি গো, তুমার ফাইফরমাস খেইটে, তুমার ছিলামিয়ার বইপত্তর বয়ে মিয়াটো আমার পেরাইমারি পাস দিছে। উয়াকে ছাড়ান দাও না কেনে। তুমারই মরদের কইন্যা। তুমারও বিটির পারা। আজ মাইরছ, মেইরে লাও। কিন্তু উয়াকে আর পাঁকে নামাও না। আমি তো তুমাদের সংসার টাইনছি। যতদিন গতর চইলবে ততদিন জিউকে জামিন দিয়ে কইরব। আমি পাপী বটি। আমাকে শাস্তি দাও। আমার বিউটিকে টুকদু লিখাপড়া শিখতে দাও। উয়ার খরচ আমি যোগাব।’

‘কী? তুই আমাদের সংসার টাইনছিস? যা না, বিরা আমার বাড়ি থিক্যা। দেইখব কোন ভাতারে তুকে লেয়। আমার সোয়ামি আসরা না দিলে, নাচগান না শিখালে তুকে কে পুঁঁইছত।’

‘আমি ও কথা বলি নাই। আমি তুমাদের দাসী-বাঁদী হঁইয়ে থাইকব। আমার বিটিটোকে হাই হুস্কুলে অ্যাডমিট হইতে দাও।’

‘এ যে বইসতে পেইলে শুতি চায়। হাইস কুলে অ্যাডমিট? ধনঞ্জয় সর্দারের বিটি ফেল মাইরবে, আর নাচনির বিটি উয়াকে টপকায়েঁ বড়ো হুস্কুলে যাবে?’

অনেক কান্নাকাটি করে রসিকপত্নীর না হলেও, বাপ রসিকের অনুমতি ও প্রতিশ্রুতি আদায় করা গেছে। হাইস্কুল তিন কিলোমিটার দূরে উরমা হাট ছাড়িয়ে। মেয়েকে উচ্চতর শিক্ষালাভের সুযোগ দেওয়া হবে বলে কমলা উৎসাহে দ্বিগুণ খাটে, অতসীকে চারগুণ তোয়াজ করে। ধনঞ্জয় যে আদৌ রাজি হবে, তা দরবার করার সময় আশা করেনি। ধনাকে মুকুন্দ ঘোষের চেয়েও বড়ো বাড়ি করিয়ে দেবে কমলা।

রাস্তায় দেখা মঙ্গলার সাথে। সেও নাচনি– তবে বংশ পরম্পরায়। তার মায়ের গর্ভ নষ্ট করা হয়নি। তার দুই ভাইও আছে। তবে তাদের ভদ্র পথে রোজগারের সুযোগ নেই। রানিগঞ্জে গিয়ে কয়লার কারবার করে। কেমন কারবার সেটা স্পষ্ট নয়। মঙ্গলার মা পাঁচকড়ি তার মা গিরিবালার কাছ থেকে সামান্য কত্থকের তালিম পেয়েছিল। কারণ গিরিবালা রীতিমতো ধ্রূপদী শিখতে শুরু করেছিল ছোটোবেলায়। তার মা শৈলবালা ছিল রাজা কৃষ্ণ বর্মনের খাস নর্তকী। তিনি নাচলে রাজামশাই নিজে পাখোয়াজ বাজাতেন। রক্ষিতা হলেও রাজবাড়ির প্রাচুর্য ও আদবকায়দার মধ্যে থেকেছেন। বারবাড়ি আর অন্দরমহল আলাদা বলে স্ত্রী ও রক্ষিতার মধ্যে সংঘাত বাধার অবকাশ ঘটত খুব কম। রানিরা নর্তকীর সঙ্গে কথাই বলতেন না। মাঝে মাঝে নাচ দেখতেন শুধু। শৈলবালাকে বাড়ি বাড়ি দাসীগিরিও করতে হতো না। রাজার দেওয়া বালুচরির ঔজ্জ্বল্য ম্লান হয়ে গেলেও, এখনও মঙ্গলার কাছে সযত্নে রাখা আছে।

‘যাস কুথা? বিটি শুনছি পেরাইমারি পাস দিলেক।’

‘ঘরামির সাথে ঘর ছাওয়ার কাজে। রবীন গোপের গোয়ালের কাজ। আর আমার মেইয়ে ফোর পাস দিছে না, টুসুর মায়ের কী জ্বলন কী জ্বলন! টুসু ফেল মেইরেছে লয়? তবে উয়ার বাপকে হাতেপায়ে ধইরে বড়ো হুস্কুলে ভর্তি করাইতে রাজি করাইনছি। উ বইলেছে বিউটিকে নিজে ভর্তি করাইবেক।’

‘করাইবেক মানে? অখনও অ্যাডমিট হয় লাই? কেলাস ফাইভের নতুন কেলাস তো কবে শুরু হঁইন গেছে।’

‘যাঃ! ধনা সর্দার যে বইললেক অখনও মাসখানেক দেরি আছে অ্যাডমিটে?’

‘তবে তাখেই শুধাগে যা। আমি বসন্ত মল্লিকের লেগে ওই হুস্কুলের পাঁচিলে ঘুঁটে দিয়ে আসি হপ্তায় তিন দিন। যা দেখছি নিজের চোখে, তাই বইলাম। বিশ্বাস না যায় শুধা কেনে দিদিমণিদের।’

কমলার মাথা ঝিমঝিম করতে লাগল। ক্ষীণভাবে নিজের বিশ্বাসে অটল থাকতে তর্ক করল।

‘ধনা তুকে মিছা বইলছে। পেরাইমারিতে ভর্তির সময় লিজের নাম দিঁইছিল উ, যে হাইস্-কুলের বেলা দিবেক? তুর নামে বিউটি হুস্কুলে দাখিল হয় লাই? ইবারও ধনার ভরসা না কইরে লিজে গেলি লাই কেনে?’

রবীন গোপের বাড়ি না গিয়ে সোজা নিজের বাড়ি ফিরে এল কমলা। ধনঞ্জয় তখন সদ্য ঘুম থেকে উঠে তেল-মুড়ি আর চা দিয়ে জলখাবার খাচ্ছিল। কমলা ঝাঁপিয়ে পড়ল। ‘বিউটিকে কবে অ্যাডমিট করাবে?’

‘মানে? তার তো দেরি আছে। বইলেছি তো উটো ইবার আমার ভাবনা। তুঁই ইটো জানতে কাজ ফেইলে ঘরকে আলি?’

‘কেলাস ফাইভের কেলাস পেরায় এক মাস আগে থাইকতে শুরু হঁইন গেছে। উয়াদের ভর্তি লিবার সময় শেষ। গরিবের বিটি বইলে একটা জলপানির ব্যবস্থা হঁইনছিল। সিটো আর পাবেক লাই বিউটি। লিজের বিটির সাথে ইমন বেইমানি কইরতে পাইরলে?’

‘কে বইলেক ইসব? যা কইরেছি বেশ কইরেছি। জলপানির টাকায় সব হইত? খরচ যুগাবেক কে?’

‘রোজগার তো আমি করি। নিজের মিয়ার জইন্যে এইটুকুন করার অধিকার লাই আমার? আমি বলে ডবল খাইটছি, আর তুমি…’

‘রোজগার, অধিকার? এত স্পর্ধা!’ চা শুদ্ধু এঁটো গ্লাস ছুড়ে দিল কমলার দিকে। ‘আবার উত্তম-মধ্যম খাওয়ার শখ হয়েছে মাগির। নাহলে যে থালে খায়, সেই থালে ছ্যাঁদা করে?’

ধনার বউ কুটনো কাটতে কাটতে তারিয়ে তারিয়ে মজা দেখতে লাগল। ‘মর কসবি’। না, না, মরে গেলে সংসারের আয় কমবে, অতসীর কাজ বাড়বে। স্বামীর হাতে মার সেও যে খায়নি তা নয়। গায়ের জ্বালা একটু জুড়োলে বরের হাত চেপে ধরে বলল, ‘ওগো, ইবার ছাড়ান দাও। আমি কথা দিছি, আর হুস্কুলের নাম কইরবে না। কমলিকে ছাড়ো। বিউটিকেও নাচ-গানের তালিম দাও।’

অত মার খেয়েও ঝাঁঝিয়ে উঠল কমলা। ‘উয়ার পড়ার খরচ তো আমি বাড়তি খেইটে যুগায়েনছি, যুগাবও। তুমাদের গায়ে লাগে কেনে?’

‘এই হারামজাদি। আমি তুকে বাঁচাতে চাইছি, তুঁই আমার উপর কথা বলিস? টুসুর বাপ তোকে মেইরে ফেইললে বিটিটোর কী হবে ভেইবে দেখছিস?’

‘উটো তুমরা ভেইবে রেইখেছ? নাচনি কইরবে। দাসুর হাতে তুলে দিবে।’

যাকে নিয়ে এত অশান্তি সে দাওয়া ঝাঁট দেওয়া বন্ধ রেখে অঝোরে কাঁদছিল। ধনা থামলে মাকে জল দিয়ে পরিষ্কার করল। দশ বছরের বালিকা মাকে ঘর পর্যন্ত নিয়ে যেতে জোর পায় না। অবাক হয়ে দেখল, অতসীমামি মাকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে মুখে জল দিচ্ছে। বিউটিকে বলল, ‘আজ রেতে মায়ের পাশে শুস। সেবা করিস।’

রাতে মায়ের পাশে? বিউটির চোখে জল এল অভাবনীয় সৌভাগ্যে। এ তো স্কুলে যাওয়ার চেয়েও বেশি আনন্দের। নাহলে দালানে শুয়ে মশার কামড় খেতে খেতে সারারাত শুনতে হয় মায়ের চাপা কাতোরক্তি আর ‘বাপের’ চাপা গর্জন। মাকে দিয়ে কী করায়, আর মাকে কী করে ওই বয়সেও আবছা আন্দাজ করতে পারে, আর অসহায় আক্রোশে কাঁদে।

দিনদুয়েক উঠতে পারল না কমলা। গায়ে জ্বর। পাকা পায়খানায় বসার অনুমতি পেল মা-মেয়ে। ধনা অতসী নিজেদের মধ্যে গুজগুজ করে, ওদের কিছু বলে না। তৃতীয় দিন সকালে কমলা উঠোন ঝাঁটাতে এলে ধনা নরম গলায় বলল, ‘আজ শরীল ঠিক আছে?’ এর দু-রকম মানে হয়।

‘টুকদু। পুরা লয়।’

‘পরাণ গরাইয়ের নাম শুনছিস? উ সরকারি জলসায় ঝুুমুর দিবেক। তুঁই যাবি উয়ার সাথে? যা না। দুদিন মনটো ভালো থাইকবেক।’

‘পরানের সাথে। তালে বিউটিকেও লিয়ে যেইতে মন কইরছে। উ যাবেক আমার সাথে?’

‘বিউটি গিয়্যা কী কইরবেক? তুঁই তো উয়াকে নাচনি কইরতে চাস না।’

‘উ তো সবার কাছে শুনে উয়ার মা নাংটি বটে, একবার শিল্পী মাকে দেখুক কেনে।’

‘উয়াকে আমি উরমা বালিকা বিদ্যালয়ে দাখিল করাব। তুঁই

যা চাস।’

সত্যি বলছে ধনা? হবেও বা। বাপ তো যতই হোক। চোখের জল সামলে ধরা গলায় বলল, ‘তুমি সাথে যেইতে লাইরবে?’

‘আমার অনেক কাজ। বিউটির লেগেও তো থাইকতে হবেক।’

আজ কার মুখ দেখে উঠেছে কমলা? ওই হতভাগি মেয়েটারই তো! তবু মনটা কেন কু গায়?

দোনোমোনো করে পরাণের দলে ভিড়েই গেল কমলা। দুদিন বই তো নয়।

ভালোই কাটল দুটো দিন। সরকারি অনুষ্ঠান কিনা বোঝা গেল না। ফেরার সময় পরাণ ওকে অন্য গাঁয়ে নামাল। তার বাড়িতে নিয়ে যেতে চায়। পরাণের আন্তরিক ডাকে সাড়া দিতে হলেও, মেয়েটার কী হল জানতে এক্ষুনি নিজের বাড়ি ফিরতে ইচ্ছা করছে। সে উশখুশ করতে থাকে। ‘পরাণদাদা তুমার বাড়ি তো দেইখলম। ইবার আমাকে জুরিডি পোঁহুছানোর ব্যবস্থা কর।’

‘এবার থেইকে ইটোই তুর আস্তানা। ধনার কাছে নগদ সাত হাজার টাকা দিয়্যা কিনছি তুকে।’

‘তার মানে? উ আমাকে বেইচে দিঁইছে? আর আমার মিয়া বিউটি?’

পরাণ কুৎসিৎ মুখভঙ্গি করে হাসল। ‘তুর বিটিকে লিয়ে ধনা রসিক রেইতে ঘরে দোর দিছে, দেইখতে পাইরবি?’

কষ্ট নীড়

ফ্ল্যাটের কোনও নাম রাখা যায় না? যেমন বাড়ির নাম হয়, কী সুন্দর সুন্দর সব নাম– ছায়াপথ, সুরলোক, সুখনীড়, মানসী– শান্তিনিকেতনে দেখেছি…। ফ্ল্যাটে ঢুকবার সময় দরজার গায়ে একটা নম্বর দেখে সবাই ৭সি-৩৬, কেন? একটা নাম রাখলে কী হয়? মহাভারত অশুদ্ধ হয়?– দুলাল বলল।

রাই বলল– কী নাম রাখতে চাও?

দুলাল সেটা ভাবেনি যদিও। মনে এল, তাই বলে ফেলল। রাইয়ের সঙ্গে গল্প করছিল কিনা, ব্যালকনিতে। পাশাপাশি বসে। সাততলা থেকে অনেকটা আকাশ দেখা যায়। কাশিপুর গান-শেল কারখানার চিমনিও দেখা যায়। আবার রাস্তার গাড়িগুলোকে খেলনা গাড়ির মতো লাগে। ওসব দেখছিল আর গল্প করছিল। সকালে আলুর পরোটাটা বেশ ভালো হয়েছিল দিয়ে শুরু। রাই বলল, পরোটা নয়, পরাঠা। নর্থ ইন্ডিয়ানরা এটাকে পরাঠাই বলে। দুলাল বলে, ধুর, পরাঠা কেন? ছোটোবেলা থেকে পরোটাই তো শুনে এসেছি। অফিস ক্যানটিনেও তো পরোটাই বলে।

বলুকগে। ভুল বলে। তর্ক কোরো না। বড়ো হোটেলে পরাঠাই বলে।

 

দুলাল চুপ করে।

ওর নাম কিন্তু দুলাল নয়। ওর নাম কংসারি। কংসারি মন্ডল। রাই ওকে দুলাল ডাকে। কংসারি ডাকা যায় নাকি?

বলো, একটা নাম বলো, সাজেস্ট করো তুমি, ফ্ল্যাটের কেউ নাম দেয় না তো কি হয়েছে, আমরা দিতেই পারি, খুব সুন্দর করে, কাঠে এনগ্রেভ করে একটা নাম দরজার গায়ে লাগিয়ে রাখব।

দুলাল নাম খুঁজে পায় না। মাথা চুলকে বলে কষ্ট নীড় রাখলে কেমন হয়, কত কষ্ট করে ফ্ল্যাটটা করলাম, ইএমআই দিতে দিতে টাট্টি জ্যাম হয়ে যাচ্ছে।

টাট্টি জ্যাম ধরনের শব্দ আগে খুব একটা বলত না, ইদানীং স্মার্ট হবার জন্য এসব শব্দ বলছে। বলে লাভ হয়। এই তো রাই খুশি হয়ে ওর থুতনিটা নাড়িয়ে দিল।

আজ রোববার। আলুর পরোটা বা পরাঠা দিয়ে ব্রেকফাস্ট সারা হল। তারপর হাতে খবরের কাগজ নিয়ে ব্যালকনিতে। রান্নাঘর থেকে টুংটাং ঠকঠক শব্দ। এগুলো গৃহস্থালির শব্দ। এই শব্দ সংসারের শব্দ। এই শব্দ খুব ভালো লাগে দুলালের।

বাসন মেজে, ঘর মুছে তরকারি কাটবে দীপা। একটা তরকারিও করে দেবে। রোববারের রান্নাটা রাই নিজে হাতে করে। আজ ছোটো চিংড়ি দিয়ে ওলের ডালনা, আর পাঁঠার মাংস।

কংসারি, তথা দুলারের এই শহরজীবন বেশি দিনের নয়। ও থাকত বাতকুল্লা নামে একটা জায়গায়। ছোটোবেলায় বাবা মারা গেছে। মা আর ছেলে। খুব টাকাপয়সার টানাটানি ছিল ছোটোবেলায়। ওর বাবার ছিল একটা মুদি দোকান। বাবা গত হলে ওর মা বসতেন। মা কি আর দোকান চালাতে পারে? মাল আনাই তো বড়ো সমস্যা। কখনও কৃষ্ণনগর, কখনও চাকদহ থেকে মাল আনতে হতো। কংসারির মায়ের ছিল এক ফুল পাতানো সই। সেই সই বাজার থেকে ব্যাগে করে মশলাপাতি, বিস্কুট, চায়ের প্যাকেট এনে দিত। মাঝেমধ্যে কংসারিকেও দোকানে বসতে হতো। মুসুর ডালের কিলো বাইশ টাকা হলে দেড়শো গ্রাম কত, দু’টাকায় কতটা কালোজিরে দেয়া যাবে, তেরো টাকার প্যাকেটে তিরিশটা বিস্কুট থাকলে খুচরো একটা বিস্কুট কত করে বেচলে প্যাকেটে টাকা লাভঞ্জথাকে– এসব জটিল অঙ্ক মুখে মুখে করতে হতো বলেই পাটিগণিতে ভালো হয়ে গিয়েছিল। মাধ্যমিক ফাস্ট ডিভিশন। সায়েন্স পড়লে নাকি খরচ বেশি, তাছাড়া মাস্টার রাখতে হয়, তাই কমার্স। বিকম পাশ করেই চাকরির জন্য নানা রকম পরীক্ষায় বসা। দু’বছরের মাথায় প্রথম চাকরিটা হয়ে গেল স্টেট ইলেকট্রিসিটি বোর্ড-এ। রানাঘাট এ পোস্টিং। পরের বছরই ব্যাংকের প্রবেশনারি অফিসার। কলকাতার একটি ব্র্যাঞ্চে পোস্টিং।

সেই প্রথম কলকাতায় থাকা। আগে কলকাতা এসেছে পরীক্ষা দিতে কিংবা বইপত্র কিনতে, দু’একবার বড়োবাজারে দোকানের মাল কিনতে। কলকাতার সঙ্গে সম্পর্ক বলতে এটুকুই ছিল। ও সাউথ সিটি চিনত না, নিক্বো পার্ক জানত না, পিৎজা চোখে দেখেনি আগে, পার্ক স্ট্রিটের কোনও বার-এ ঢোকা দূরে থাক, ওই রাস্তাটা দিয়েও আগে হাঁটেনি কখনও। সেই পার্ক স্ট্রিট ব্র্যাঞ্চ-এ পোস্টিং হল।

একটা মেস-এ থাকত দমদমের কাছে। দু’বেলা পেট ভরে খাওয়া আর একটা ছোট্ট ঘরে নিজের একটা তক্তাপোশে– সেই তো অনেক। অফিস কলিগরা বলল, তুমি একটা বুদ্ধু। এভাবে থাকে কোনও ব্যাংক অফিসার? ব্যাংক তোমায় বাড়িভাড়া দেবে। একটা ফ্ল্যাট ভাড়া করে নাও।

একটা পুরো ফ্ল্যাট? ওরেব্বাবা। পুরোটা নিজের? ভাবাই যায় না।

চাকরি পাওয়ার পর টাকা যা পেত, সে তো অনেক। দোকানটা ঠিকঠাক করল। শো কেস, সুন্দর তাক, মা খুব খুশি। কংসারি ভাবল ফ্ল্যাট নিলে মাকে নিয়ে আসবে, আর দোকানটার দায়িত্ব দিয়ে দেবে ওর ছেলেবেলার বন্ধু হারুকে। সে আবার ওর মায়ের ফুল পাতানো সখীর ছেলেও। হারু বেকার। পড়াশোনাতে ও ভালো ছিল না তেমন। হায়ার সেকেন্ডারি দুবারে পাশ। কলেজে ভর্তি হয়নি। একটা লন্ড্রিতে জামাকাপড় ইস্তিরি করত।

ওর দাদা ছিল দুটো, বউদিরা গঞ্জনা দিত, দামড়া ছেলে ভাত গিলছে বসে বসে– এইসব বলত। হারুর মা, মায়ের সই, ফুলমাসি

কংসারিকে বলেছিল, ছেলেটাকে কিছু জুটিয়ে দাও বাবা।

ফুলমাসির জন্যই দোকানটা চালাতে পেরেছিল মা। আর, দোকানের সামান্য আয়েই তো কংসারির পড়াশোনা, এই চাকরি।

ফুলমাসির তিন ছেলে। হারু ছোটো। বড়ো দু’জন যে খুব ভালো রোজগারপাতি করত এমন নয়। হারু তো কিছু করত না। ফুলমাসি সন্ধের দিকে দোকানে বসত, হারুও বসত মাঝে মাঝে। কংসারির মা ওদের কিছু ধরে দিত। সুতরাং মাকে কলকাতায় নিয়ে এলে দোকানটা চালানোর দায়িত্ব হারুকেই দেয়া যায়। বিক্রি করতে চাইলে হারু কিনতে পারবে না, তা ছাড়া হারুর সঙ্গে কংসারির যা সম্পর্ক, তাতে দোকানের দরদাম নিয়ে দরাদরি চলে না। হারুর টাকাপয়সা হলে না হয় কিছু দিয়ে দেবে।

হারু ওর গুরু। অনেক কিছুর গুরু। ডাংগুলি গুরু, মাছধরা গুরু, অসভ্য খেলারও গুরু। কৈশোরের গুপ্ত পাঠক্রম হারুই দিয়েছিল। প্রথম বিড়ির টান, কাশি, ও কিছু নয়– পরে সব ঠিক হয়ে যাবে, হারুই তো বলেছিল।

মাকে ফ্ল্যাটে নিয়ে এল কংসারি। মা তো গ্যাসের উনুন দেখে হেসেই বাঁচে না। ওমা! আঁচ দিতে হয় না? হিহিহি। ওমা, ধুয়াঁ নাই? কীরে! হিহিহি। কিন্তু ছাই হয় না বলে দুঃখ, বাসন মাজা হবে কী করে? ফ্রিজ আগে দেখেছে, কিন্তু ব্যবহার করেনি কখনও। কী আজব আলমারি। সব ঠান্ডা করে রাখে। ঠান্ডা করার দরকার কী? সব তো গরম করতেই হয় আবার। ঠান্ডা তরকারি কি খাওয়া যায় না কি?

কংসারি বলে– একদিন রান্না করে তিনদিন খাওয়া যাবে মা, খাটুনি কমবে। উনি বলেন– সে কী রে? বাসি খাবি কেন? এই আলমারিটা ভালো না। রোজ রোজ টাটকা রান্না করে দেব। নীচেই তো বাজার বসে, তোর সময় না হলে আমিই বাজার করে আনব। আমার আর কাজ কী! ঠান্ডা করার আলমারিটা ফিরত দিয়ে আয়। কংসারি বলে– না মা, ভালো চাকরি করলে ঠান্ডাই খেতে হয়, ফ্রিজ রাখতে হয় ঘরে, বন্ধুরা আসবে, ফ্রিজ না হলে খারাপ ভাববে, গাঁইয়া ভাববে মা, ঠান্ডা জলে শরবত করে দিও।

কংসারির মা বলত– কত রকম খাবার খাওয়াস তুই, রোজ দুধ খাই, সন্দেশ, ইচ্ছামতো শাকসবজি। কিন্তু এখানে দমবন্ধ লাগে। খুপরি বাড়ি। উঠান নাই। একটা নিমগাছ নাই। নিমবেগুন করব বলে নিমপাতাও কিনতে হয়। সরুসরু চারগাছি দুটাকা। তুলসিগাছও নেই। তুই বিয়ে কর, শহরের মেয়ে যে সব জানে, ওকে তোর কাছে রেখে আবার দেশের ঘরে ফিরে যাই।

সেটা আর হল না। ওর মা আগুনে পুড়ে মারা গেল। সভ্যতার আগুনে। মানে গ্যাসের আগুনে।

গ্যাস কি করে খুলতে হয়, বন্ধ করতে হয় ভালো করেই তো শিখিয়ে দিয়েছিল কংসারি। তবু কিছু ভুল করেছিল ওর মা। অফিসে ফোন পেল– শিগগির চলে আসুন, আপনার ঘরে আগুন লেগেছে।

ততক্ষণে ঘরের দরজা ভাঙ্গা হয়ে গেছে। রান্নাঘরের দেয়ালের তেলরঙে কালচে ছোপ, কাঠের ক্যাবিনেট থেকে হালকা ধোঁয়া বেরুচ্ছে। মাকে ওরাই হাসপাতালে পৌঁছে দিয়েছে।

করেছেন কি মশাই, গ্রাম থেকে যাকে এনেছেন, সে যদি গ্যাসের ইউজ না জানে তো গ্যাস ওভেন হ্যান্ডেল করাচ্ছেন কেন? সারা বাড়িতে আগুন ধরে যেত, সবাই পুড়ে মরতাম, ভাগ্যিস সিলিন্ডারে বেশি গ্যাস ছিল না, যা ছিল বেরিয়ে গেছে, নইলে সিলিন্ডার বার্স্ট করত।

মা তখনও জীবিত ছিল, জ্ঞানও ছিল, চোখের তারা নড়েছিল, ঠোঁট কেঁপে উঠেছিল, মুখের চামড়া ঝলসানো। পরদিন মারা গেল। বাড়িওলা ক্ষতিপূরণ চাইল। দিতে হ’ল। আবার নতুন করে রং করানো হল। বাড়িওলা বলল ছেড়ে দিন। আবার মেসজীবন। সেটাই ভালো। মেস থেকে হেঁটে দমদম মেট্রোরেল, পার্ক স্ট্রিট। অফিস, অফিসে যত বেশি সময় থাকা যায় থাকত, তারপর ফের মেসের গহ্বর। একটা কষ্ট কেবল ঘুনপোকার মতো ওকে কুরে খাচ্ছিল– ওর মায়ের মৃত্যুর জন্য ও দায়ী। সভ্যতা দিতে গিয়েছিল, আধুনিকতা দিতে চেয়েছিল মাকে। বাতকুল্লার নিম-তুলসী-উঠোন থেকে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে এসে গ্যাস চেম্বারে মেরে ফেলল নিজের মাকে।

একদিন পার্ক স্ট্রিট স্টেশন ছেড়ে পরের স্টেশনের দিকে ছুটল ট্রেনটা। কংসারি দাঁড়িয়ে, ওসব ভাবছে। সিটে বসা একটি মেয়ে ওকে বলল– এক্সকিউজ মি, পার্ক স্ট্রিট নামলেন না? ওর হুঁশ হল। বলল– থ্যাংকিউ। ভুল হয়ে গিয়েছিল। মেয়েটা বলল– রোজই তো নামেন, আপনি আনমাইন্ডফুল, বুঝতে পারছিলাম।

এই মেয়েটাই রাই। ট্রেনে দমদম থেকে পিছনের দিকেই ওঠে।

কংসারিও তাই। কংসারি খেয়াল করেনি আগে। এরপর থেকে মাঝে মাঝে দেখা হওয়া, গুডমর্নিং বলা, সিইউ বলা…। সিট পেলে মেয়েটা ব্যাগটা চেয়ে নিত, কংসারি সিট পেলে নিজে না বসে ওকেই বসতে দিত। মেয়েটা ওয়েব ডিজাইন করে। ওর অফিস এলগিন রোডে। নেতাজি ভবন স্টেশনে নামে। একদিন ফেরার সময় দেখা, ট্রেনেই। মেট্রোরেল গিরীশ পার্কে থেমে গেল, সামনের কোথাও আত্মহত্যার ঘটনা। মেয়েটা বলল– চলুন, ট্যাক্সি পাই কিনা দেখি। শীতকাল। ওরা হাঁটছিল, হাঁটতে হাঁটতে কথা। এভাবেই ক্রমশ।

মেয়েটা বলেছিল– আপনাকে কংসারি ডাকতে পারব না আমি। খুব বাজে নাম। আপনার কোনও ডাকনাম নেই?

কংসারি বলেছিল– ডাকনামটা তো আরও ইয়ে। ভুতো।

– ইশ্, ভুতো, ভুতো কেন?

– তা জানি না। পাড়ায় তো এটাই আমার নাম।

– ভুতো ডাকা যায় নাকি? কংসারি নামটাকে যে ছোটো করে ডাকব, তারও উপায় নেই। কংসারি ছোটো করলে কংস হয়। হুঃ, কী বাজে। এরকম নাম কে রেখেছিল?

– আসলে এটা শ্রীকৃষ্ণের একটা নাম। কংস বধ করেছিলেন কিনা, কংসের অরি।

তা কেষ্টঠাকুরের তো আরও নাম ছিল, সে সব রাখলেই তো হতো। বলুন তো কেষ্টঠাকুরের আর কী কী নাম আছে?

শ্রীকৃষ্ণের শতনাম তো মুখস্থই ছিল, মা রোজ সকালবেলা একবার বলতেন কিনা… যশোদা রাখিল নাম যদু বাছাধনযশ্রীনন্দ রাখিল নাম নন্দের নন্দন। ননীচোরা নাম রাখে যতেক গোপিনি কালসোনা নাম রাখে রাধা বিনোদিনী। দেবকী রাখিল নাম আদরে গোপালযচন্দ্রাবলী রাখে নাম নন্দের দুলাল…

– হ্যাঁ, নন্দের দুলাল নামটা মন্দ নয়, তবে নন্দটা বাদ। দুলাল বেশ মিষ্টি নাম। আমি দুলাল বলেই ডাকব।

কংসারি ঘাড় নেড়েছিল।

সেই থেকে রাই, দুলাল বলেই ডাকে।

– দুলাল বলেছিল– রাই মানে জানো তো?

রাই মানে সখী, গার্লফ্রেন্ড…।

– গার্লফ্রেন্ড ঠিক কথা, তবে কৃষ্ণের গার্লফ্রেন্ড। রাই হল রাধিকা। কীর্তনে আছে না– ললিতা বলছে, শুন বলি রাই, ডাকিছে কানাই…।

রাই বলে– তাই বুঝি? রাই মানে রাধিকা? আই মিন রাধা? আর তুমি কংসারি মিন্স কৃষ্ণ? তা হলে তো উই আর মেড ফর ইচ আদার।

রাইরা শহুরে। ওর বাবা মাঝারি মাপের সরকারি আমলা। বোঝাই যাচ্ছে বেশ স্মার্ট, আধুনিক। রাই প্রচুর স্মার্ট ছেলে দেখেছে জীবনে, হামবড়াই, চতুর, মিথ্যুক এবং শরীর লোভী দেখে ফেলেছে ওর ছাব্বিশ বছরের জীবনে। দুলালের সরলতা, আনস্মার্টনেস এবং যা অনেকের কাছে বোকামি মনে হবে– সেটাই ভালো লেগেছিল রাইয়ের। যে দিন ফ্লুরিস্ এ গিয়ে কোল্ড কফি অর্ডার দিয়েছিল রাই, দুলাল বলেছিল– কফি কেউ ঠান্ডা খায় নাকি? রাই বলেছিল– তোমার ভুতো নামটাই ভালো ছিল।

বিয়ে হল। রাইয়ের বাবার অমত ছিল না। অভিভাবকহীন সাধাসিধে অথচ সুচাকুরে জামাইকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখা যাবে এটাই সবচেয়ে বড়ো প্লাস পয়েন্ট। এবং তাই হল। দুলাল রাইয়ের বাধ্য হল, যা নাকি রাইয়ের ভাষায় লক্ষ্মী ছেলে, আদরে সেটা ‘নো-ও-ক্ষ্মি’ হয়ে যায়।

যে ফ্ল্যাটটা ভাড়া করেছিল দুলাল, সেটা পছন্দ নয়। ব্যাংক অফিসার যখন, লোন নিয়ে নিজে কিনবে না কেন? লোন নিল। কাছাকাছির মধ্যেই একটা রেডি ফ্ল্যাট। থ্রিবিএইচকে। মানে তিনটে বেডরুম। ওয়ান ব্যালকনি, টু টয়লেট, প্লাস লিভিং-ডাইনিং। বারোশো আশি স্কোয়ার ফিট, উইথ লিফ্ট।

গত এক বছরের বিবাহিত জীবনে ভুতো দুলালকে অনেকটাই সভ্য করে নিতে পেরেছে বলে রাইয়ের ধারণা। অফিস যাবার সময় ডিও স্প্রে করে দুলাল, চুলে কন্ডিশনার দিতে শিখেছে, লিফ্টে কারুর সঙ্গে দেখা হলে হ্যালো গুডমর্নিং ইত্যাদি বলতে শিখেছে, এমনকী রাইয়ের কোনও বান্ধবী বাড়িতে এলে বলতে শিখেছে– আপনাকে দেখে তো ফিদা হয়ে যাচ্ছি। এমনকী যে চিজ-এর গন্ধটা সহ্য করতে পারত না, এখন চিজ স্যান্ডউইচ খাচ্ছে। কিন্তু ছাড়তে পারছে না হারুকে। একটা ইরিটেটিং, ডিসগাসটিং লোক।

হারুর কথা ভাবতে ভাবতেই হারু এসে হাজির। কলিংবেল বাজার কায়দাই বুঝিয়ে দেয় ও হারু। পরপর তিনবার। একটু গ্যাপ দিয়ে আবার একবার। ভদ্রলোকরা একবারই বাজায়। বড়োজোর দুবার।

রাই ব্যালকনিতেই। চেয়ার ছেড়ে উঠল না। দুলাল ছিটকিনি খুলে দিল। হারুর হাতে একটা ব্যাগ। যখনই আসে ব্যাগ থাকে। কিছু না কিছু নিয়ে আসে। কুমড়ো, কিংবা লাউ, কিংবা এঁচোড়– কিছু না হলে পুঁইশাক। হারু বলল– দুটো নারকোল আছে, আমাদের গাছের, আর ক’টা পেঁপে আছে, তোদের উঠোনের গাছের।

রাই ভ্রু কুঁচকে তাকায়। এক্ষুনি ওকে জলখাবার দিতে হবে। আলুপরাঠার দুটো পুর ভরা গোলা রাখা ছিল কাল টিফিন নিয়ে যাওয়ার জন্য, ওগুলো এখন দীপাকে দিয়ে লেচি করিয়ে নিতে হবে।

সাধারণত সকালের দিকে আসে না এই হারুবাবু। রবিবার সন্ধের দিকে আসে। রাত্তিরে থেকে যায়, সোমবার সকালে বৈঠকখানায় মালপত্র কিনে বাড়ি ফেরে। বাতকুল্লা এমন কিছু দূরে নয়, সকালে বেরিয়ে বাজার সেরে বিকেলের মধ্যেই ফিরে যাওয়া যায়। কিন্তু ও মাঝেমাঝেই রোববার সন্ধের সময় হাজির হয়ে যায়। প্রশ্রয় আছে।

দুলালই ওকে আসতে বলে। যদি ওরা বাড়ি না থাকে, ব্যাগটা কেয়ারটেকারের জিম্মায় রেখে ঘুরে বেড়ায়, রাত্রে চলে আসে। দুলাল জানে রাই ওকে পছন্দ করে না, দুলাল বলে– সংসারের সবই তো তোমার কথা মতোই চলে, শুধু এই একটা ব্যাপার তুমি মেনে নাও। ওর উপর আমার দুর্বলতা আছে, বাবা মারা যাবার পর হারুর মা যদি  আমাদের হেল্প না করত, আমার লেখাপড়াই হতো না। তা ছাড়া হারু যত অনেস্ট। দোকানটা থেকে যা লাভ হয়, তার কিছুটা আমাকে দিয়ে যায়, জোর করে। ও আমার একমাত্র বন্ধু। অফিসে যারা আছে, ওরা তো কলিগ।

– আমি বুঝি বন্ধু না? রাই বলে,

দুলাল বলে– সরি সরি, তুমি সব চেয়ে বড়ো বন্ধু। বন্ধু, গার্জিয়ান, এভরিথিং। তোমার পরেই হারু।

চটিটা নোংরা। কখনও পালিশ দূরে থাক, ব্রাশও করে না। ওর জামা থেকে বাজে গন্ধ ছাড়ে। ভাগ্যিস থ্রি রুম ফ্ল্যাট, একটা ঘরে একটা সিংগল খাট পাতা থাকে, ছোটো আলনাও। ও চলে গেলে দীপাকে দিয়ে চাদরটা কাচিয়ে নেয়। বাইরের বাথরুমটা ইউজ করে ও। প্রথম যেবার এল, লোকটা নির্লজ্জের মতো গামছা পরে খালিগায়ে বাথরুম থেকে বেরিয়ে ব্যালকনিতে মেলে দেয়া গৌহাটি থেকে আনা রাইয়ের সাদা গামছাটায় বগল মুছে নিল। রাই ওই দৃশ্য দেখেই বলল– দাঁড়ান, দাঁড়ান, তোয়ালে দিচ্ছি– বলে আলমারি খুলে একটা সাদা তোয়ালে ছুড়ে দিল ওর দিকে। ও বলল– আর তোয়ালে কী হবে, এতেই তো হয়ে গেছে। ভুতো, তোর একটা লুঙ্গি দে পরি।

বিয়ের পর দুলাল হয়ে গিয়ে লুঙ্গি পরা বন্ধ হয়ে গেছে ভুতোর। একটা পা-জামা দিয়েছিল দুলাল।

সেই পা-জামাটায় কালো সুতো দিয়ে একটা মার্ক করে রেখেছে রাই। ও এলে ওই পা-জামাটাই বের করে দেয়, পরে দীপাকে দিয়ে কাচায়। ওর জন্য একটা আলাদা সাবানও রাখতে হয়েছে। ও চলে গেলে পলিথিনে জড়িয়ে এক জায়গায় রেখে দেয়, আবার এলে বাথরুমের সাবানটা বের করে ওটা ঢুকিয়ে দেয়। ওর এদিক নেই, ওদিক আছে। একদিন বলল– কী ব্যাপার বলতো ভুতো, তোদের সাবান দেখি ফুরোয় না… সেই একই সাদা লাক্স, কতদিন চলে?

দুলাল তো ভুতোই, কী বলতো কে জানে? রাই ম্যানেজ করেছিল। বলেছিল– সবার আলাদা সাবান ব্যবহার করতে হয়। ডাক্তাররা তাই বলে। আপনারটাও তোলা থাকে। এবাড়িতে ওরা মাস ছয়েক হ’ল এসেছে। এবাড়িতে আসার পর মাসে দুবার করে ওর আসাটা প্রায় বাঁধা হয়ে গিয়েছিল। ওরা দুজনে একই গল্প করে। সেই ডাংগুলি খেলা, ভূগোল স্যার, বেঁটে স্যার, কুঁজো পিসি, কেঁচো দিয়ে মাছ ধরা, খ্যাপলা জাল না কি একটা জালে কচ্ছপ উঠেছিল, সেই কচ্ছপের মাথায় সিঁদুরের দাগ… সব মুখস্থ হয়ে গেছে। ওরা গল্প করতে থাকলে টিভির সিরিয়াল চালিয়ে দেয় রাই, বলে– তোমরা একটু চুপ করো। শুনতে পাচ্ছি না। ওরা ওই ছোটো ঘরটায় চলে যায়। একবার বিকেলে ওদের সিনেমায় যাবার কথা, বেরোবে, সেই সময় হাজির। ওকে নিয়েই সিনেমায় যেতে হল। পিভিআর-এ। তারপর পপকর্ন। আশি টাকা করে প্যাকেট। এমন করে খাচ্ছিল যেন দু’টাকার ঠোঙার মুড়ি খাচ্ছে।

লাস্ট যেবার এল, ওরা দুজন একটু ঘুরে আসছি বলে বেরিয়ে গেল, ফিরল দশটার পর। বোঝাই যাচ্ছিল ওরা মদ খেয়েছে। মদ-টদ আগে তো খেত না, বিয়ের পরই একটু-আধটু, দু’জনে মিলে। কখনওই দুপেগের বেশি নয়। বেশিই খেয়েছিল সেদিন, বিশেষত ওই লোকটা। হারু। জুলজুল করে তাকাচ্ছিল, চোখটা লাল। বলছিল– বউদি, বউদি, তুমি আমার বন্ধুকে হরণ করেছ। রাত্রে খেল না। বলল বাইরে থেকে খেয়ে এসেছে। রাত্রে ওরা দুজনে একসঙ্গে শুল। সিঙ্গল খাটে। সেদিন থেকেই লোকটাকে অসহ্য লাগে। রাই জিজ্ঞাসা করেছিল দুলালকে– ওর সঙ্গে শুলে কেন? ও বলেছিল– যাতে তোমার কোনও অসুবিধে না হয়। মুখে একটু গন্ধ ছিল কিনা। খেয়ে ফেলেছিলাম।

– ও? ক’টা খেয়েছিলে?

– দুটোর পর একটুখানি, হাফ।

– ও ক’টা খেয়েছিল?

– তিনটের পর একটুখানি, হাফ। দুজনে মোট ছ’টা। ওর কি এসব অভ্যেস আছে নাকি? ভালো হুইস্কি খাবার পয়সা আছে নাকি ওর, যদি এক-আধবার খায় তো দেশিই খায়।

– দেশি? মানে বাংলা? বিচ্ছিরি লোক তো ও। ক্রিমিনালরা

বাংলা খায়। আঁৎকে উঠেছিল রাই। দুলাল বলেছিল– পয়সার অভাবে তো। ক্রিমিনাল হবে কেন? কত কবি সাহিত্যিক দেশি খেতেন জানো? পড়োনি অমৃতধারা ম্যাগাজিনটার লাস্ট ইস্যুতে?

হারুবাবু এসে সোফাতে বসেছে। বসেই চ্যাঁচাল– বউদি, চা খাব।

বউদি বলে কেন কে জানে? ও তো দুলালের চেয়ে বড়ো। দুতিন বছরের বড়ো। অবশ্য কীই বা ডাকবে? নাম ধরে ডাকলে তো আরও খারাপ হতো।

রাই ম্যাক্সিটার উপরে হাউসকোট চাপিয়ে নেয়। এসে না বসেই বলে– কী ব্যাপার, আজ যে সকালে?

হারু হাহা করে হাসে– আপনার হাতের কচিপাঁঠার ঝোল খাব। রবিবার দুপুরে পাঁঠার মাংস হয়, রাতের বেলায় আর থাকে না।

–ও। রাই তির্যক তাকিয়ে বলেছিল। হারু এবার বলল– আর একটা কারণও আছে। আজ একটা মিটিং আছে না, ধর্মতলায়, দুপুরের পর থেকে ট্রেনে ওঠা যাবে না। ওরা সব ফ্ল্যাগ, লাঠিসোঁটা নিয়ে ওঠে। ওরা খুব দজ্জালি করে। তাই ভাবলাম সকালেই আসি।

– ও।

খুব নির্লিপ্তভঙ্গিতে বলল রাই।

দুলাল বলল– বেশ করেছিস, বেশ করেছিস।

– চা খা। দুজনে বাজার যাব।

রাই বলল– দীপা, পরোটা বেলে দে।

বিকেলে দুজনে মিলে রাইয়ের এক কলিগের বাড়িতে যাওয়ার কথা। রাইয়ের কোম্পানিটা ভালো চলছে না। কাজটাজ বেশিরভাগই মুম্বই-ব্যাঙ্গালোর-গুরগাঁও থেকে হচ্ছে। গত দু’ বছর কোনও ইনক্রিমেন্ট হয়নি। শোনা যাচ্ছে লোক কমাবে। মানে ছাঁটাই। নিজেরা একটা বিজনেস করার কথা ভেবেছে। এখন বুটিকের ব্যবসায় লাভ ভালো। বিভিন্ন জায়গা থেকে কিনে আনলেই হল। সাজানোটাই আসল, আর লোকেশন। ঠিক জায়গায় বুটিক খোলা। খরচ প্রচুর।

ব্যাংক লোন নিয়ে কথা বলার ছিল। ওকে তো ওখানে নিয়ে যাওয়া যায় না। থাকুক, বাড়িতেই। রাই, হারুর সঙ্গে বিশেষ কথাবার্তা বলল না। ওয়াশিং মেশিনটা বের করে রাজ্যের জামাকাপড় চাদর কাচতে লাগল। একবার স্বগতোক্তি করল– রোদ উঠেছে বেশ। মাড় দিল। ব্যালকনিতে মেলে দিল। হারু আর ভুতো গল্পগাছা করছিল, সেই এক গল্প। মাঝেসাজে একবার বলল– সাইড বিজনেস শুরু করেছি। জমির দালালি। এবং এটা যে মিথ্যে নয়– বোঝা গেল, মাঝে মাঝে ওর মোবাইলে ফোন আসছিল, হ্যাঁ-হ্যাঁ-ডাঙ্গা জমি, জল জমে না, হ্যাঁ, হ্যাঁ, ভ্যান রিকশা ঢুকে যাবে– এইসব কথাবার্তা শোনা যাচ্ছিল। কাচাকুচির পর মাংস রান্না। বেলা হয়ে গেল।

বিচ্ছিরি করে খায় লোকটা। কড়মড় করে হাড় চিবিয়ে টেবিলে রাখে। হাতের আঙুলগুলো বিচ্ছিরি ভাবে চাটে। রাই ওর সঙ্গে কথা বলছে না, পাত্তা দিচ্ছে না, সেটা বুঝতে পারলে এর পর আসতে গেলে চিন্তা করবে। ওকে মাংসের বাটিটা দেবার সময় টেবিলে ঠক করে শব্দ হয়েছে, আরও ভাত দেব? হাঁড়ির অর্ধেকটা দিয়ে দিই? এভাবেই বলেছে রাই। লোকটা তাও বোঝে না?ঞ্জবলেছে অর্ধেক কেন, তার চেয়ে কম।

বিকেলে বেরোল ওরা। আলমারির চাবি সঙ্গে করে নিয়ে গেল রাই। হারুকে বলল সাবধানে থাকতে। কেউ এলে দরজা না খুলতে। হারু বলল– কোনও চিন্তা নেই। চুপচাপ বসে বসে টিভি দেখব। কেয়ারটেকারকেও বলে গেল রাই, বাড়িতে বাইরের লোক আছে, লক্ষ্য রাখতে।

রাতে ফিরল, বাইরে থেকে খাবার কিনে। বেশি করেই আনতে হল, ছাতার-মাথা গেস্ট আছেন। বাড়ি ফিরে দুঃসংবাদ– হারু আরও একদিন থাকবে। আজকের মিটিং-এ আসা নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় ঝামেলা হয়েছে। বাতকুল্লার ভিতরের দিকে কোনও জায়গা থেকে ম্যাটাডোর বোঝাই কিছু মিটিংগামী লোক বাতকুল্লা স্টেশনে আসছিল, সেই ম্যাটাডোরে বোমা ফেলা হয়েছে। দু’জন মারা গিয়েছে। এর প্রতিবাদে আগামীকাল বাতকুল্লা বন্ধ। রেল অবরোধ। কৃষ্ণনগরেও বন্ধ পালিত হবে।ঞ্জওরা দেখল টিভিতেও এই খবর দেখাচ্ছে, হাসপাতালে ব্যান্ডেজবাঁধা আহত সকাশে নেতাগণ। অন্য চ্যানেলে বলছে সবরকম ভাবে প্রতিবাদের কর্মসূচি নেওয়া হবে।

হারু বলল– মালপত্র কিনে কাল বিপদে পড়ব। পরশু বরং যাব। একটা দিন বেশ রেস্ট হোক। ঘুমিয়ে কাটিয়ে দেব। রাই ভ্রূ কুঁচকে তাকাল হারুর দিকে, আর কটমট করে দুলালের দিকে। দুলাল অপরাধবোধে মাথা নীচু করে।

– আপনার আর কোথাও যাবার জায়গা নেই? রাই বলেই ফেলল।

কোথায় আবার যাব? ভুতো ছাড়া আমার কে আছে? হারু মাথা চুলকোয়। বুঝতে পেরেছে এতক্ষণে। নইলে বলবে কেন– তোমাদের খুব ডিসটার্ব করছি, না?

দুলাল বলে– না-না, ডিসটার্ব কেন? ভালোই তো লাগে।

রাই দুলালকে ডেকে বলল– একদম ওর সঙ্গে গুজুর গুজুর করবে না। ও একা থাকুক। কোম্পানি দিতে হবে না। এইখানে বসে থাকো। বেডরুমের রকিং চেয়ারটাকে দেখায় রাই, হাতে নেতানো খবরের কাগজটা ধরিয়ে দেয়।

রকিং চেয়ারে ও দোদুল্যমান।

রাইকে চটানো উচিত হবে? হারুর কাছে একবার যাওয়াটা কি উচিত নয়? রান্নাঘর থেকে খুটখাট শব্দ আসছে। রাই কিচেন গুছোচ্ছে। জলের শব্দ। এবার হারুর কথা শুনল দুলাল। – বউদি, ও বউদি, কাল তো সারা দিন আমি ঘরে। একটু আটা জাল দিয়ে রাখলে সারাদিন ধরে ঠোঙা বানাতে পারি, খবরের কাগজ আর একটা কাঁচি যদি…

ওর কথা শেষ হবার আগেই রাই বলে– খবরের কাগজ নেই, সব বেচে দেয়া হয়েছে।

ও, ঠিক আছে। তা হলে এক কাজ করেন। একটা ইস্তিরি রেখে যান। সারাদিন তো অনেক কাচাকুচি করেছেন, রোদটাও বেশ খরখরে ছিল, অঘ্রানের রোদ, সব শুকিয়ে গেছে, ইস্তিরি করে দিতাম…।

রাই বলল– ইস্তিরি আপনার করতে হবে না, ইস্তিরি করার লোক এসে নিয়ে যায়।

হারু বলল– আমি খারাপ ইস্তিরি করব না। এই কাজই তো করতাম আগে। খুব ভালো পারি।

ভালো পারতে হবে না।– রাইয়ের গলা বেশ কর্কশ। রাই ঘরে আসে। দরজায় ছিটকিনি দেয়। হাউস কোট খোলে, নাইট ড্রেস পরে। মুখে নাইট ক্রিম মাখে। তারপর নাইট ল্যাম্প জ্বালায়। বলে– শুয়ে পড়ো। দুলালকে জড়িয়ে ধরে রাই। বলে– ওই লোকটার জন্য তোমার আমার চেয়েও বেশি দরদ, তাই না? নিজেকে দ্রুত অনাবৃত করে রাই। দুলালকেও। তারপর ক্রিয়াশীলা হয়। উথালপাথাল করে। বলে– তুমি এত প্যাসিভ কেন, অ্যাঁ? রাই সেই রাতে ভীষণ উদ্যমী, সেইরাতে ভীষণ রমন পটিয়সী হয়। তারপর রতিক্লান্ত রাই বেডসুইচে নীল আলো নেভায়।

ভোরের দিকে এখনও পাখি ডাকে। পাখির ডাকে আধো জাগরণে রাই পাশ ফিরে হাতটান করে দিলে ফাঁকা ফাঁকা লাগে। চোখ মেলে দেখল সত্যিই ফাঁকা। দুলাল নেই। আলো জ্বালে। দরজা ভেজানো, কিন্তু ছিটকিনি খোলা। ছোটো ঘরটায় গিয়ে দেখে লাল কম্বলের উপরে দুটো মুন্ডু। ছিঃ।

ঘড়িতে দেখল পাঁচটা কুড়ি। সাধারণত সাতটা অবধি বিছানায় থাকে রাই। দীপা আসে সোয়া সাতটা নাগাদ। আজ আর ঘুম আসছে না রাইয়ের। যা-তা ভাবছে। একটু পরই ধীরে দুলাল এল। বিছানায় সন্তর্পণে উঠতে যাচ্ছিল, সে সময় রাই বলল– তুমি কি হোমো? দুলাল পর্দা চোঁয়ানো ভোরবেলার আলোয় রাইয়ের মুখের রক্তিমতা লক্ষ্য করল।

রাই আবার বলল– ওর সঙ্গে শুতে গিয়েছিলে কেন?

দুলাল গলা উঁচু করে না। ভোর বেলাটায় প্রকৃতি শান্ত থাকে। দুলাল শুধু বলে– ওকে বলতে গিয়েছিলাম ডোন্ট মাইন্ড।

রাই বলল– আই হেট ইউ।

তারপর কোনও কথা নেই। নিঃশব্দে চা। স্নান। দীপা যা বেড়ে দিল, খেয়ে নিল রাই।

দুলালের জামা-প্যান্ট, পার্স, মোবাইল বাইরের ডিভানে রেখে বেডরুমে তালা দিল। ডিভানে স্তূপ করে রাখা শুকনো জামাকাপড়, চাদর। পাশের ঘরটাও তালা– যেটা আসলে সত্যিকারের গেস্ট রুম। রাইয়ের বাপের বাড়ির লোক এলে যে-ঘরটায় থাকে। রাই বেরিয়ে গেল অন্যদিনের তুলনায় অন্তত পনেরো মিনিট আগে।

দীপাও কাজ সেরে বেরিয়ে গেছে। দুলাল আবার ভাত বসাল রাইস কুকারে। ভাতে আলু আর ডিম দিল। মাছের তরকারির কিছুটা হারুর জন্য রেখে দিল। টিভি খুলল, একটা সিনেমার চ্যানেল। হারুকে বলল– দুপুরে খেয়ে নিস। বসে বসে টিভি দ্যাখ, এটা টিপে চ্যানেল পালটাস, খেয়েদেয়ে ঘুম দিস, আমি যতটা পারি আগে চলে আসব। হারু বলে– বউদির খুব রাগ না? আমি বরং চলে যাই। দুলাল বলে– না-না, যাবি কেন? তোর বউদির তো আমার উপর রাগ। অন্য কারণে, তোর জন্য নয়।

সাতটা নাগাদ ফিরল দুলাল। কলিংবেল বাজাচ্ছে, বেজে যাচ্ছে, বারবার। দরজা ধাক্বা দিতে থাকল, পাশের ঘর থেকে লোকজন, ক্রমাগত শব্দ, চাবির ফাঁক দিয়ে কেউ কেউ দেখে কিছু বোঝার চেষ্টা করছে। মায়ের কথা মনে পড়ল দুলালের, চাবির ফুটোয় নাক রেখে বাতাস টেনে দুর্বিপাকের গন্ধ নিতে চেষ্টা করল।

কে ছিল? কে ছিল ভিতরে– এই প্রশ্নের উত্তরে দুলাল শুধু বলতে পেরেছিল, বন্ধু।

দুলাল ফোন করল রাইকে।– রাই, কিছু অঘটন ঘটেছে। তাড়াতাড়ি এসো। কেউ বলল পুলিশ। এক্ষুনি পুুলিশ।

দরজা ভাঙতেই হল। কোনও পোড়া গন্ধ নেই। সুইচ টিপলে আলো জ্বলল না। কাচের সার্সি চুইয়ে বাইরের রাস্তার আলোর কিছুটা ভিতরে। দুটো ঘরে তালা। ছোটো ঘরটায় উপুড় হয়ে পড়ে আছে একটা দেহ। পাশে এক মগ জল, একটা শতরঞ্জি পাতা, জামাকাপড় কুণ্ডলী করা, একটা ইস্তিরি, প্লাগে লাগানো।

কারুর মোবাইলের টর্চে দেখা গেল প্লাগ পয়েন্টে কালো রং। ফিউজ উড়ে গেছে– কেউ বলল। ফিউজ লাগানো হল। উদ্ভাসিত আলোয় উপুড় হয়ে আছে হারু, ওর হাতের থেকে দু’ইঞ্চি দূরে একটা ইলেকট্রিক ইস্তিরি, যেটা খারাপ, অব্যবহার্য, যার তারের থেকে তামা বেরিয়ে গিয়েছিল, যেটা চৌকির তলায় ফেলে রাখা হয়েছিল।

দেহটাকে উলটে দিল পুলিশের লোক। হারুর ঠোঁটের কোনায় রক্ত জমাট বেধেছে।

– কে এই লোকটা।

দুলাল বলল– বন্ধু। তারপর হুহু করে কেঁদে ফেলল।

ঝক্বিঝামেলা কম হ’ল না। পোস্টমর্টেম, পুলিশ কেস, দেশের বাড়ি যাওয়া… হারুর মায়ের আকুল ক্রন্দন…। কী করা যাবে? অ্যাক্সিডেন্ট ইজ অ্যাক্সিডেন্ট। আমরা তো ইস্তিরি করতে বলিনি, ওতো নিজে থেকেই…।

কিছুদিন পর হারুর দুই দাদা বাড়িতে এল। সেদিনও রবিবার। বলল হারু একটা লাইফ ইনস্যুরেন্স করিয়ে ছিল, বছর দেড়েক আগে। পাঁচ লাখ টাকার। নমিনি করে গেছে কংসারিকে।

কাগজ দেখাল– নমিনিঃ কংসারি মন্ডল। রিলেশনশিপঃ ফ্রেন্ড।

টাকার খুব দরকার ওদের। ওই হারুর ঝমেলায় লাখ খানেক টাকা বেরিয়ে গেছে। থানাপুলিশ, মর্গ, তাছাড়া ওর শ্রাদ্ধের পুরো খরচ, রাইয়ের কোনও ইনক্রিমেন্ট নেই, একটা গাড়িও কিনতে পারেনি ওরা এখনও…

হারুর দুই দাদাই হাত জোড় করে বসে আছে। বড়ো দাদা বলল –  ভুতো, তুমি ছাড়া তো এই টাকাটা উদ্ধার হবে না। তোমার সই লাগবে। তোমার নামেই তো চেক হবে। কিন্তু আমাদের অবস্থা তো…

কথা শেষ হবার আগেই রাই বলল– ও টাকাটা পেয়ে গেলে পুরো টাকাটাই আপনাদের মায়ের হাতে তুলে দেবে। আমি জানি, ও দেবে।

রাই আগে কাঁদেনি। এবার কাঁদছে।

রাজবাড়ির রহস্য

গিয়ার একটু উপরে তুলে প্রবীর বলল, আসল মজা আসত মামার বাড়িতে। পাশেই ছিল সীতা কুণ্ড, সবাই মিলে হুল্লোড় করে ঝাঁপ দিতাম তার স্নিগ্ধ শীতল জলে। সারাদিন সাঁতার কেটেও জ্বর-সর্দি কিচ্ছু হতো না।

পাশেই অরিন্দম বসেছিল, সে হই হই করে উঠল। থাম তো তোর সীতা কুণ্ড। আমার গ্রামে চল। পাশেই দ্বারকেশ্বর নদী আর বিশাল ধানের খেত। গেলে বুঝবি পাড়াগ্রামে কত আনন্দ।

দুজনে বেশ তুমুল বিতর্ক শুরু করেছে দেখে অতনু চুপ থাকে কেন? সেও যোগ দিল, তোরা নদী আর কুণ্ড নিয়ে রইলি আর আমার মাসির বাড়িতে পাঁচ কিলোমিটার-এর মধ্যে পাহাড়, নদী, রাজবাড়ি, খেত, পুকুর সবকিছুই পাবি।

রাজবাড়ির নাম শুনে অনন্ত আর প্রবীরের মুখ হাঁ হয়ে গেল। অরিন্দম বলল, চল তাহলে পুজোর ছুটিতে তোদের মাসি বাড়ি ঘুরে আসা যাক। সবাই রাজি হয়ে গেল।

পুজোর ছুটিটা বেশ জমিয়ে উপভোগ করতে চায় সবাই। তাই শহরের পুজো নয়, এবার গ্রামে গিয়ে একটু অন্য ভাবে পুজো উপভোগ করার জন্যে সবাই অনন্তর কথামতো হাজির হল গিয়ে ওর মাসির বাড়ি। দারুণ জায়গা, মন প্রাণ খুলে ঘুরে বেড়ানো যায়। বাধা দেওয়ার কেউ নেই। আর মাসিমণির বরাতে বেশ জম্পেস খাওয়াদাওয়া চলছে।

সারাদিন পাহাড় নদী ঘুরে এসে ভীষণ ক্লান্ত চারমূর্তি। এসেই বিছানায় গা এলিয়ে দেয় আর নিজেদের মধ্যে নিয়মমাফিক তর্কে লিপ্ত হয়ে পড়েছে সকলেই। ইতিমধ্যে মাসিমা মুড়ি আর তেলেভাজা দিয়ে গেছেন, ওটাকেই চটকানো হচ্ছে। কথা প্রসঙ্গে অতনু বলে উঠল, তোরা রাজবাড়ি কবে যাবি? আমি বাপু পাহাড় নদী দেখতে আসিনি। আমার মামারবাড়িতে এইসব ঢের দেখেছি।

প্রবীর বললে, চুপ কর তো। শুধু ঘ্যান ঘ্যান করতে হবে না। অতনু বেশ উত্তেজিত হয়ে উঠেছে। সে প্রায় সাড়ে তিন হাত লাফিয়ে উঠে বললে, জানিস রাজবাড়ি মানে অনেক কিছু থাকতে পারে, এই ধর গুপ্তধন!

অরিন্দম বললে, হ্যাঁ তোর জন্য গেড়ে রেখে গেছে। তুই যাবি আর তুলে নিয়ে আসবি।

গল্প শেষ পর্যন্ত গড়িয়ে গেল রাজবংশের কেউ এখনও আছে কি না। ওদের সাথে দেখা করে সব জানতে হবে।

অতনুর যেন এখানে আসার একটাই কারণ। রাজবাড়ি গিয়ে লুকোনো গুপ্তধন আবিষ্কার করা। ওর কথা শুনে সবাই হো হো করে হেসে উঠল। পাশের ঘরে মাসিমা ছিলেন, তিনিও চারমূর্তির কথা শুনতে পেয়েছেন। তিনি এসে বললেন, একবার ঘুরেই এসো। তবে সন্ধে কোরো না। জায়গাটা ভালো নয়।

সকালে উঠেই সবাই তৈরি রাজবাড়ি দর্শন করতে যাবার জন্যে। মাইল খানেকের পথ। একটা টোটো করে সবাই উঠে বসল। মনের মধ্যে অনেক কথা লুকোচুরি খেলছে, অতনুর মুখ দেখলেই বোঝা যায়। সেই সবার আগে বসেছে। আর ক্রমাগত টোটো চালককে একটু তাড়াতাড়ি চালানোর জন্যে খোঁচাতে শুরু করেছে। টোটোওয়ালা ভীষণ বিরক্ত হয়ে শেষমেশ বলেই ফেলল, দাদাবাবু আপনি এরোপ্লেন ভাড়া করে নিন। আমার টোটো এই স্পিড-এর বেশি চলে না।

কিছুক্ষণের মধ্যেই ওরা রাজবাড়ির সামনে এসে উপস্থিত। টোটো থেকে নেমে অবাক চোখে সবাই তাকিয়ে দেখতে লাগল, প্রায় ভগ্নদশা তবু মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে প্রাচীন রাজবাড়ি। হুট করে ভেতরে ঢুকতে গিয়ে দেখল দুজন প্রহরী। রাজবাড়ি এখন সরকার অধিগ্রহণ করেছে, তাই ভেতরে প্রবেশ নিষেধ। বাইরে থেকে ঘুরে দেখতে পাওয়া যাবে। ভেতরে যেতে গেলে সরকারি অনুমতি লাগবে।

একটু নিরাশ হলেও সেই দিনের মতো ওরা আশেপাশেই ঘুরে দেখে নিতে লাগল। কোথায় হাতিশাল, কোথায় সিপাহিদের থাকার জন্য ঘর ছিল। সামনেই একটা বড়ো পুকুর আছে। টোটোচালক সব ঘুরিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছিল। ওরা ঘুরতে ঘুরতে রাজবাড়ির পশ্চিম দিকে এসে দেখতে পেল কিছু ভগ্ন মন্দিরের স্তূপ। সেখানে অনেকক্ষণ নিরীক্ষণ করে যখন ফিরে এল তখন বেশ খিদে পেয়েছে।

অরিন্দম বলল, চল রে আগে পেটে কিছু দিয়ে আসি, তার পর দেখা যাবে। এই কথা শুনে সবাই এসে হাজির হল একটা হোটেলে। হোটেলের বেয়ারা বেশ মিশুকে ছেলে। ওদের দেখেই বলল, বাবুরা নতুন নাকি? গ্রাম দেখতে এসেছেন। একটুর মধ্যেই বেশ ভাব জমে উঠল তার সাথে।

প্রবীর বললে, তোমাদের গ্রামে কী আছে দেখার জন্য।

ছেলেটি সব কিছুই বলতে লাগল। শেষে এল রাজবাড়ির কথা। অতনুর এই সময়টার অপেক্ষায় ছিল। সে জিজ্ঞেস করে বসল, এখানে গুপ্তধন নেই?

ছেলেটি হো হো করে হেসে উঠল। তা তো জানিনে বাবু, তবে লোকে বলে রাজবাড়ির ভেতরে ভূতের উপদ্রব আছে। তাই রাতে পুলিশেও পাহারায় থাকে না।

নতুন খবর পেয়ে চারমূর্তি নড়ে চড়ে বসল। আরও কিছু কথা হল কিন্তু খাওয়া হয়ে গেছে আর বেলা বেড়ে চলেছে তাই ওরা বেরিয়ে এল হোটেল থেকে। সবাই বেশ উত্তেজিত! একটা ভালো তথ্য মিলল রাজবাড়ি নিয়ে, এই সময় সুযোগ রয়েছে ভূতের দর্শন পাওয়ার। যদিও ভূত বলে কিছু আছে সেটা কেউ বিশ্বাস না করলেও, নাম শুনলেই একটা শিহরণ জাগে বুকের ভিতর।

মনের ভিতর অনেক প্রশ্ন খেলা করতে লাগল। পুজোর বাজার। একটা সাজো সাজো রব চারিদিকে। কলকাতার মতো এখানে সারারাত জেগে ঠাকুর দেখা হয় না। এই সুযোগটাকেই কাজে লাগাতে হবে। বাড়িতে জানিয়ে গেলে মাসিমা বাধা দেবে। তাই বাড়িতে না জানিয়ে চারমূর্তি রাজবাড়িতে রাত কাটাবে প্ল্যান করল। এখন শুধু অপেক্ষা নির্দিষ্ট দিনের।

 

এক সময় সেই দিন এসেও গেল। সবাই প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে হাজির হল রাজবাড়ির পেছনে। ওখানে একটা প্রাচীর ভেঙে আছে আগেই দেখে এসেছিল তারা। ভীষণ উত্তেজিত চারমূর্তি। এই কয়েকদিন শুধু এই নিয়ে আলোচনা চলেছে। অতনু গুপ্তধন-এর নেশা কবেই ভুলে গেছে। যদিও অরিন্দম বলেছে, ভাগ্যে থাকলে গুপ্তধন পেয়ে যেতে পারিস।

একটা রোমহর্ষক ঘটনার সাক্ষী হতে যাচ্ছে ভাবলেই শিউরে উঠছে অতনু। যাই হোক, পিছনের রাস্তা দিয়ে ওরা রাজবাড়ির ভেতরে ঢুকে দেখল চারিদিকে অন্ধকার। একটাও আলোর ব্যবস্থা নেই। পকেট থেকে মোবাইল-এর আলো জ্বালিয়ে চারপাশ ভালো করে দেখে নিয়ে একটা ফাঁকা মতো জায়গা দেখে ওরা বসে পড়ল। চারদিকে শুধু অন্ধকার ছাড়া কিছুই চোখে পড়ছে না।

হঠাৎ পাশে সড়সড় করে একটা শব্দ আসতেই প্রবীর মোবাইল-এর আলো জ্বেলে দেখতে গিয়ে চমকে উঠল। একটা সাপ নিশব্দে এগিয়ে চলেছে। সবাই বেশ ভয় পেয়ে গেল। অনেক রাত অবধি যখন কিছুই হল না, বেশ বিরক্ত হয়ে উঠল চারজনেই। এভাবে ভূতের দেখা না মিললেও সাপ আর বিছের দেখা প্রতি মুহূর্তে মিলতে পারে। আর ভুল করে যদি কেউ পা দিয়ে ফেলে একবার কামড় খায়, তাহলে আর কথাই নেই!

প্রবীর বলল, চল একবার রাজবাড়ির ভেতর থেকে ঘুরে আসি তারপর ফিরে যাব। এই ভাবে রাত জেগে কোনও লাভ নেই। ভূতের দেখা মিলবে না। শুধু শুধু মশার দাপটে অতিষ্ঠ হয়ে উঠছি। সবাই রাজি হয়ে গেল। আসলে কৌতূহলী হয়ে সবাই এলেও এখন অনুভব করছে, কী ভুলই না করেছে! এ ভাবে বাড়িতে না জানিয়ে এখানে এসে। যে-কোনও মুহূর্তে কিছু একটা হয়ে যেতে পারে। ধরা পড়লে পুলিশও চোর বলে লক-আপ-এ ঢুকিয়ে দেবে। তাই মোবাইলের আলো জ্বেলে এবড়ো খেবড়ো ভাঙা রাজবাড়ির ভেতরে কিছুক্ষণ ঘুরে এবার ফিরে আসবে ভেবেই পিছনের দরজার কাছে উপস্থিত হয়েছে। এমন সময় অতনু সামনের দিকে হাত বাড়িয়ে আঁতকে উঠল! ওই দ্যাখ…

সবাই চমকে উঠল। অরিন্দম সেখানেই হুঁশ হারিয়ে পড়ে যাচ্ছিল। প্রবীর ওকে ধরে ফেলল। অতনুর মুখে রা নেই। সবাই এক দৃষ্টে তাকিয়ে আছে দোতলার একটা ভাঙা ঘরের ভেতর লাল রঙের আলো জ্বলছে। ভাবতেও গা শিউরে ওঠে। অরিন্দম নিজেকে কিছুটা সামলে নিয়েছিল। হঠাৎ প্রবীরের হাত ঝাঁকিয়ে একটা দৌড় লাগাল। অতনুও দেখাদেখি দৌড়োতে গেল।

প্রবীর বলল, দাঁড়া আগে ব্যাপারখানা দেখতে হচ্ছে। অতনু বেশ উত্তেজিত হয়ে বলল, বলিস কী এত রাতে লাল আলো জ্বেলে দোতলায় কী হচ্ছে! নির্ঘাত ভুতুড়ে কাণ্ড। চল পালাই। প্রবীর ওকে শান্ত করে বলল, এত দূর ভূত দেখতে এসে এখন এভাবে পালিয়ে গেলে চলবে না। আগে পুরো ব্যাপারটা দেখতে হবে। একপ্রকার জোর করেই অতনুকে টেনে নিয়ে রাজবাড়ির ভেতরে ঢুকে পড়ল প্রবীর।

ভাঙা সিঁড়ি বেয়ে কোনও ভাবে দোতলায় উঠে দেখল, সে রকম কিছুই নেই। বেশ কয়েকটা ধংসস্তূপ আর ছাদহীন ঘর। ঘরের শ্রী দেখলে ভয় লাগে, কখন হুড়মুড় করে নীচে ধসে পড়বে। খুব সন্তর্পণে ওরা ঘরের ভেতরে ঢুকে পড়েছে।

হঠাৎ করে মুখের উপর জোরালো আলো এসে পড়ল দুজনের উপর। কে তোমরা? এত রাতে এখানে কেন মরতে এসেছ? বেশ রাশভারী গলায় কেউ প্রশ্ন করেছে। এই রকম অবস্থায় যে কেউ হলে ভয় পেয়ে যেত। কিন্তু প্রবীর বেশ মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল, সব কিছুর উত্তর পেয়ে যাবে একটু সবুর করো, তারপর একটা অদ্ভুত কাণ্ড করে বসল। হঠাৎ লাফিয়ে সামনে যে-আলো ধরেছিল তার বুকে একটা জম্পেস লাথি মেরে বসল প্রবীর। আলোটা কোথায় পড়ে নিভে গেল আর মুহূর্তের মধ্যে আবার অন্ধকার।

অতনু কী করবে ভেবে পাচ্ছে না। হঠাৎ কারও দুমদাম করে নীচে নেমে যাওয়ার শব্দ হতে লাগল। প্রবীর বলল, অতনু চল ওদের তাড়া কর। পালিয়ে যেন না যায়। অন্ধকারে থাকতে থাকতে চোখ সয়ে গেছে। আবার বাইরে হালকা চাঁদের আলোও আছে, তাই বেশ দেখা যাচ্ছে। দুতিন জন পালিয়ে পিছনের ভাঙা প্রাচীরের কাছে এসে গেছে।

প্রবীর আর অতনুও নীচে নেমে এসেছে। এমন সময় একটা কাণ্ড হল, ওপাশ দিয়ে পুলিশের একটা দল ভেতরে ঢুকছে। যারা পালাচ্ছিল তারা ধরা পড়ে গেল। বড়োবাবু প্রবীর আর অতনুর হাত ঝাঁকিয়ে বললেন, বেশ বাহাদুর ছোকরা তো তোমরা। এই দলটাকে আমরা বেশ কয়েক মাস ধরে খুঁজছিলাম। লোকাল চুরি ডাকাতির অনেক কেস আছে এদের নামে।

অতনু অবাক হয়ে সব কিছুই দেখছিল। সব কিছু যেন একটা স্বপ্ন। এতক্ষণে বলল, কিন্তু স্যার আপনি ঠিক সময় এখানে কী করে হাজির হলেন? একটু দেরি হলেই তো ওরা পালিয়ে যেত।

পুলিশকর্তা এবার হাসতে হাসতে বললেন, এর জন্যে তোমার এই বন্ধুটি দাযী। আমরা নিয়মমাফিক পেট্রলিং-এ বেরিয়েছিলাম। এমন সময় তোমার এই বন্ধুটি আমাদের দেখতে পেয়ে সব ঘটনা খুলে বলে। এখানে এসে দেখি এই কাণ্ড।

প্রবীর বলল, আমাদের বন্ধুটিকে দেখতে পাচ্ছি না?

সবার পিছন থেকে শুকনো গলায় অরিন্দমের আওয়াজ ভেসে এল, আমি আছি!

 

 

নাটক

সবিতা একটা বড়ো থলে কাঁধে করে ঘরে ঢুকতেই আঁতকে উঠলাম। ‘হ্যাঁরে, তোর কাঁধে ওটা কী? ওটার মধ্যে কী আছে?’

‘আজ্ঞে, দিদি আমার বাপের বাড়ির দেশের আম। তুমি তো খেতে ভালোবাসো তাই।’

সবিতার ঠোঁট উলটে কথা বলার কায়দা দেখে খুব হাসি পেল। কিন্তু সবিতা সেদিকে বিন্দুমাত্র ভ্রূক্ষেপ করল না। বরং স্বমহিমায় তার নিজের ছন্দেই গড়গড় করে বলে চলল, ‘দেশ থেকে ছোটো ভাই আর ভাইপো এসেছে কিনা। মা ওদের হাত দিয়ে অনেক কিছু পাঠিয়ে দিয়েছে। তুমি আর তনুদিদি আম পছন্দ করো তো, তাই খানিক নিয়ে এলুম।’

‘হ্যাঁরে এটা খানিক?’ মনে মনে হাসি পেলেও, থলে ভর্তি আম নিয়ে আসার ব্যাপারটা কিছুতেই হজম করতে পারছিলাম না। আসলে খুব কাছের লোক ছাড়া এইভাবে কারওর থেকে কিছু নেওয়ার অভ্যাস কোনওদিনই আমার ছিল না।

‘খানিক নয় তো কি গো দিদি! দু-তিন বস্তা ভর্তি করে নিয়ে এসেছে যে। তোমাদের খাওয়া শেষ হলে আমকে বোলো, আবার আনব।’ গর্বের সঙ্গে সবিতা এমন ভাবে কথাগুলো বলল যে, আমি আর সেগুলো ফিরিয়ে দেওয়ার সাহস দেখাতে পারলাম না।

‘না না এটাই অনেক। আর আনিস না বাবা।’ ঠিক সেই সময় ডোরবেলটা বেজে উঠল। ‘সবিতা দ্যাখ তো বাবা কে এসেছে।’

দরজা খুলতেই দুজন অপরিচিত ব্যক্তি ফলের ঝুড়ি আর ড্রাই ফ্রুটের কয়েকটা প্যাকেট হাতে নিয়ে ঘরের ভিতর ঢুকে পড়ে সেগুলো টেবিলের উপর সাজিয়ে রেখে দিল। তাদের আচরণ দেখে বেশ বিরক্তই হলাম।

‘এসব কী? আর আপনারাই বা কে?’

আমার কথা সম্পূর্ণ হওয়ার আগেই আগন্তুক জবাব দিল, ‘আজ্ঞে, ম্যাডাম, ব্যস একটু খাবার জিনিস আর কী। প্লিজ এটাকে অন্যভাবে নেবেন না। বলেই ছেলের দিকে তাকিয়ে, ‘রাজ দাঁড়িয়ে  আছিস কেন? তোর ডকুমেন্টস-টা ম্যাডাম-কে দে।’

ছেলেটি আমার অনুমতি ছাড়াই সামনের চেয়ারটাতে ধপাস করে বসে পড়ল।

‘এক মিনিট, আগে আমার কথা শুনুন। কলেজের কাজ আমি বাড়িতে করি না। আপনারা কলেজে দেখা করুন, আর হ্যাঁ এইসমস্ত জিনিসপত্র নিয়ে যান।’

‘প্লিজ, ম্যাডাম দু-মিনিট সময় দিন।’ বলেই ছেলের হাত থেকে মার্কশিট-টা নিয়ে ‘এই দেখুন মাত্র ১ নম্বরের জন্য ছেলেটার অ্যাডমিশন আটকে গেছে। এখন আপনি যদি একটু চেষ্টা করেন, তাহলে ছেলেটার ভবিষ্যৎ…।’

ওদের স্পর্ধা দেখে মাথাটা ভীষণ ভাবে গরম হয়ে উঠল। কিন্তু বাড়ির মধ্যে কোনওরকম সিনক্রিয়েট হোক, এটা চাইছিলাম না, তাই তৎক্ষণাৎ নিজেকে সামলে নিয়ে বলি, ‘দেখুন আমি আগেই বলেছি কলেজের ব্যাপার আমি কলেজেই মেটাই। আর একটা কথা, এক নম্বরের জন্য অ্যাডমিশন হয়নি এমন ছেলেমেয়ের সংখ্যাটাও নেহাত কম নয়। আমি যদি সুপারিশ করে আপনার ছেলেকে অ্যাডমিশন দিই, তাহলে কি অন্যদের সঙ্গে অন্যায় করা হবে না? আপনার ছেলের ভালোর জন্যই বলছি, যে কলেজে চান্স পেয়েছে, সেখানেই অ্যাডমিশন করিয়ে নিন।’

‘এরকম করার হলে তো কবেই করিয়ে নিতাম ম্যাডাম। তাহলে আর আপনার কাছে আসা কেন? আসলে আপনার কলেজের একটা সুনাম রয়েছে, সঙ্গে প্রিন্সিপাল হিসাবে আপনারও। সেইজন্যই আমি চাই, আমার ছেলেটা আপনার ছত্রছায়ায় থেকে সঠিক পথে পরিচালিত হোক। তাহলে ওর ভবিষ্যৎ নিয়েও আমার কোনও চিন্তা থাকবে না।’

‘প্লিজ, এভাবে প্রেশার ক্রিয়েট করার চেষ্টা করবেন না। আমার কলেজের দেরি হয়ে যাচ্ছে। সবিতা, আমি তৈরি হতে যাচ্ছি। দরজাটা বন্ধ করে দিস।’

ওদের যেতে বলার স্পষ্ট ইঙ্গিত দিয়ে সোজা বাথরুমে ঢুকে গেলাম। ঢুকতে ঢুকতে দু-তিনবার ম্যাডাম, ম্যাডাম ডাকও কানে এল শেষে একটা হুমকিও শুনতে পেলাম। ‘এর ফল কিন্তু ভালো হবে না ম্যাডাম।’ ইচ্ছা করেই সেটা না শোনার ভান করলাম।

বাবা ছোটোবেলায় কবিতাটা শিখিয়েছিলেন, ‘চিত্ত যেথা ভয়শূন্য, উচ্চ যেথা শির আজও ভুলিনি, মাথা উঁচু করে বাঁচার মন্ত্র সেই কবেই ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন অন্তরে। স্নান করে বেরোনোর পর মুডটা ঠিক হয়ে গিয়েছিল। সবিতা তখন ঘর ঝাড়পোঁছে ব্যস্ত। কিন্তু ওর মুখটা কেমন যেন একটা…। হঠাৎ করে আকাশে মেঘ জমার কারণটা ঠিক বুঝতে পারলাম না।

‘কী হল? ওরা চলে গেছে?’

‘হ্যাঁ গেছে। একটু যদি সাহায্যই করতে দিদি, তাহলে কী আর এমন হতো শুনি? বেচারা! অসন্তুষ্ট হয়ে ফিরে গেল। সঙ্গে যেসব জিনিসপত্র এনেছিল, সেগুলোও দিয়ে দিতে হল।’

সবিতার কথা শুনে না হেসে পারলাম না। সবিতাকে আমি কোনওদিনই কাজের লোক হিসাবে দেখিনি। বরং ছোটোবোনের মতোই দেখে এসেছি। তাই ওর জোরটাও আমার উপর একটু বেশিই।

‘ওহ তাই বল! সব জিনিসপত্র ফিরিয়ে নিয়ে গেছে বলে তোর গোঁসা হচ্ছে।’

‘তামাশা কোরো না তো দিদি। সত্যিই তুমি যদি ওই বেচারাদের মুখটা দেখতে।’

শোন, বেচারা-টেচারা কেউ নয়। জাস্ট নিজের কাজ হাসিল করার জন্য ঘুষ দিতে এসেছিল বুঝেছিস। তুই খুব বোকা, এসব বুঝবি না। জানিস ওই উপহারগুলোর বদলে আমাকে দিয়ে কী করিয়ে নিতে চাইছিল। দ্যাখ, তুইও তো আমার জন্য ফল এনেছিস। কিন্তু তোর আনার মধ্যে কোথাও কি…’

আমার কথা শেষ হওয়ার আগেই ডোরবেলটা আবার বেজে উঠল। সবিতা দরজা খুলতে গেল বটে, কিন্তু আমার সন্দিগ্ধ নজরও দরজার দিকে আটকে রইল। দরজা খুলতেই সামনে দুজন অজ্ঞাত পরিচয় লোক। একজনকে অবশ্য লোক বললে ভুল হবে। তাকে দেখে মনে হল বছর উনিশ-কুড়ির বেশি হবে না। কিন্তু দুজনেরই পোশাকআশাক কেমন যেন একটু প্রত্যন্ত গাঁ ঘেঁষা। ভাবলাম এরা আবার কারা রে বাবা!

‘সাবু দি, এটাই ম্যাডাম না?’

‘ম…ম… ম্যাডাম’ দূর থেকে দাঁড়িয়েই হাতজোড় করে প্রণাম সারল তারা।

এ পর্যন্ত এইটুকুই বোধগম্য হল যে সবিতার ডাক নাম সাবু আর এরা তারই পরিচিত কেউ।

‘ওহ্ দিদি আমার ভাই আর ভাইপো, তোমাকে বলেছিলাম না দেশ থেকে এসেছে।’

‘ওহ্ হ্যাঁ হ্যাঁ বলেছিলি বটে’ বলে সম্মতি জানাতে ঘাড় নাড়ালাম। কিন্তু একটা জিনিস কিছুতেই বুঝতে পারছিলাম না যে, এদের এখানে আসার কারণটা কী!

ততক্ষণে সবিতার ভাই ঘরের ভিতর ঢুকে এসেছে, ‘আম খেয়েছেন ম্যাডাম? আমাদেরই বাগানের।’

ঠিক সেই সময় চোখে পড়ল সবিতা আমার সাইডে দাঁড়িয়ে ইশারা করে ওদের কিছু বোঝানোর চেষ্টা করছে। না তারা কিছু বুঝতে পারছে, না আমি। উত্তরে আমের বেশ তারিফ করে, বেশিমাত্রায় পাঠানোর কথাও জানালাম।

‘আরে না না ম্যাডাম, চাষেরই তো জিনিস। সিজনে জাম আর পেয়ারার ফলনও বেশ ভালো। পরের বার ১-২ ঝুড়ি পাঠিয়ে দেব’খন। চাইলে বাড়িতে বানানো খাঁটি ঘিও পাঠাতে পারি।’

‘না না। ধন্যবাদ। এই যথেষ্ট।’ ঘড়ি দেখতে দেখতে আলগোছে বলি, ‘সবিতার সঙ্গে কিছু দরকার আছে তাই তো? ঠিক আছে, বসে ওর সঙ্গে কথা বলে নিন। আমি আসছি।’

বাইরে বেরোনোর জন্য পা বাড়াব এমন সময় সবিতার ভাই হাতজোড় করে রাস্তা আটকে দাঁড়াল। ‘দরকারটা আপনার সঙ্গেই ছিল ম্যাডাম। আপনি কৃপা করলে মা-মরা এই বাচ্চাটার ভবিষ্যৎ তৈরি হয়ে যেত। দয়া করে যদি এই গরিবের উপর একটু কৃপাদৃষ্টি করেন। ছেলেটা আমার পড়াশোনায় একটু কমজোর বটে, কিন্তু খুব ভালো মনের।’ বলে একটু থামে। নিঃশ্বাস নিয়ে আবার বলতে শুরু করে, ‘দিদি বলেছিল আপনি নাকি কলেজের প্রিন্সিপাল।’

‘আপনারা কলেজে গিয়েছিলেন? ওনারা কী বললেন?’

‘বললেন লিস্টে নাম নেই।’

‘রিজার্ভেশন কোটায় দেখেছিলেন।’

‘হ্যাঁ ম্যাডাম। একদম শেষের দিকে। আপনি সব পারেন ম্যাডাম। শুধু বাচ্চার মাথায় একটু হাত রেখে দিন। তাহলেই…’ কথাগুলো বলতে বলতেই আমার হাতদুটো জোর করে চেপে ধরে ছেলের মাথায় রাখার চেষ্টা করে। মাথায় রক্ত চড়ে যায় আমার।

‘এটা কী ধরনের অসভ্যতা?’

‘ভুল হয়ে গেছে ম্যাডাম, ক্ষমা করে দিন। গাঁয়ের লোক তো, তাই শহুরে আদবকায়দা ঠিক জানি না। সাবুদি কিছু বলো না। সাবুদি আপনার খুব সুনাম করে, বলে দিদি খুব দয়ালু, উপকারী। কিগো দিদি বলো।’ বলতে বলতে চোখভরা আশা নিয়ে সবিতার দিকে তাকাতেই, সবিতা কিন্তু কিন্তু করতে করতে আমার সামনে এসে দাঁড়াল।

‘দিদি তোমার কলেজে ওর একটা ব্যবস্থা করে দাও না দিদি। সারাজীবন আমরা তোমার খেদমত খাটব দিদি। দাও না দিদি।’ বলতে বলতেই ভাইপোকে একেবারে আমার পায়ে ঝুঁকিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করল।

পরিস্থিতি দেখে একপ্রকার লাফিয়েই দু-পা পিছিয়ে এলাম। ‘কী করছিসটা কী সবিতা? তুই তো জানিস আমি এসব পছন্দ করি না।’ এরকম অকোয়ার্ড সিচুয়েশনে এর আগে কোনওদিন পড়িনি।

‘রাস্তা ছাড়। আগে কলেজে যাই। পৌঁছে লিস্টটা চেয়ে একবার চেক করে দেখব। তবে আমার মনে হয় না, এই ব্যাপারে খুব একটা কিছু হবে বলে। হয় ভাইপোকে অন্যত্র ভর্তি করিয়ে দে, নয়তো ভালো করে পড়াশোনা করে আবার পরীক্ষায় বসতে বল। এক্ষেত্রে সত্যিই আমার কিছু করণীয় নেই।

বেশ রূঢ় ভাবেই কথাগুলো বলে কোনওদিকে না তাকিয়ে হন্তদন্ত হয়ে কলেজের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। আজ বলে নয়, বরাবরই আমি একটু আদর্শবাদী। নিয়মনীতি মেনেই চলি। সেসবের বিরুদ্ধে গিয়ে কোনও কাজ করা আমার পক্ষে সত্যিই বোধহয় অসম্ভব। তাই মাঝেমধ্যেই লোকের কাছে ভীষণ ভাবে অপ্রিয় হয়ে উঠি।

বিশ্বাস করুন, ঘুনাক্ষরেও টের পাইনি যে, পরের দিনই তার থেকে অনেক বেশি চমক অপেক্ষা করছে আমার জন্য। ভেবেছিলাম সবিতা হয়তো আর কাজেই আসবে না। কিন্তু উলটোটাই হল। অন্যান্য দিনের মতো সকাল সাতটাতেই হাজির হল সে। ব্যাতিক্রম বলতে শুধু মুখ হাঁড়ি করে চুপচাপ কাজ করে যাওয়া। যেটা সবিতার একেবারেই স্বভাববিরুদ্ধ। ওর চুপ থাকাটা একসময় বেশ অসহ্য হয়ে উঠছিল। বুঝতে হয়তো পারছিলাম ওর মনের মধ্যে কী উথালপাথাল চলছে। আমারও মনের অবস্থা খানিকটা সেইরকমই।

সত্যি কথা বলতে কি, প্রশান্ত মারা যাওয়ার পর থেকেই প্রাকৃতিক নিয়মে কী জানি না, আমি অনেক শান্ত, চুপচাপ হয়ে গেছি। বলতে পারেন নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছি। তনু তখন খুব ছোটো। মনের মধ্যে কষ্ট থাকলেও তা চেপে রেখে সর্বদা ওর সামনে হাসিখুশি থাকার চেষ্টা করেছি। আমিই যদি ভেঙে পড়ি, তাহলে ওকে দেখবে কে, এই ভাবনাই তাড়িয়ে বেড়িয়েছে চিরটাকাল।

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ও বড়ো হয়েছে, বড়ো হয়েছে ওর পরিধিও। তখন থেকে আজ পর্যন্ত আমার পৃথিবী কেবলমাত্র ওকে ঘিরেই। কিন্তু ওর দিন-প্রতিদিনের বিস্তৃত হওয়া পৃথিবীতে, আমার জায়গাটা যে কোথায়, তা অনুমান করা খুব কঠিন।

বন্ধু হিসাবে কারওর কাছে যে নিজের দুটো মনের কথা বলব, জীবনে তেমন সঙ্গী আর পাইনি। সেই কারণেই হয়তো নিজেকে এভাবে খোলসের মধ্যে গুটিয়ে রাখা। তবে শুধু আমার চেনা-পরিচিতরা কেন, আমার মেয়েটাই যে আমাকে কতটা জানে, বোঝে, বলা মুশকিল।

পরের দিন সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে সবেমাত্র খবরের কাগজটা নিয়ে বসেছি, ঠিক সেই সময় তনু ফোনে কথা বলতে বলতে নীচে নেমে এল। আমাকে দেখামাত্রই ফোনটা কেটে এগিয়ে এল, ‘ও মাম্মা, পরশুদিন আমার উৎকল ইউনিভার্সিটিতে চাকরির ইন্টারভিউ আছে। বটানিতে লেকচারারশিপে ভ্যাকেন্সি ছিল। রিয়া, পূজা, মুন সবাই অ্যাপ্লাই করেছে বলে, আমিও করলাম। যদিও টিচিং ব্যাপারটাতে আমার খুব একটা ইন্টারেস্ট নেই, তবুও যতদিন না মনের মতো একটা কিছু হচ্ছে, ততদিন অন্তত। প্লিজ, তুমি একটু বিসি আঙ্কলকে ব্যাপারটা জানিয়ে রেখো।’

‘আবার বিসি সাহেব কেন তনু? এই পদটির জন্য তুমি যথেষ্ট যোগ্য। কনফিডেন্স লেভেল হারিয়ে ফেলছ কেন? আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে ইন্টারভিউ দাও। তুমি এমনিই সিলেক্ট হয়ে যাবে।’

‘আমার উপর আমার যথেষ্ট আস্থা আছে মাম্মা। কিন্তু তুমি জানো না, এখন ছোটো ছোটো চাকরির জন্যও বিশাল কম্পিটিশন। তার উপর এদের পে-প্যাকেজটাও তো বেশ ভালো। সুতরাং কম্পিটিটরও অনেক থাকবে। একটু এদিক-ওদিক হলেই চাকরিটা হাতছাড়া হয়ে যাবে মাম্মা। আমি কোনও রিস্ক নিতে চাই না। তুমি শুধু আঙ্কলকে একটু বলে রেখো। আমি যাচ্ছি। বাই মাম্মা।’ বলেই তাড়াতাড়ি করে চলে গেল তনু। আজ ওদের পিকনিক না কি যেন একটা আছে।

‘তনু শোন তো… আমি…’ বাকি কথাগুলো গলার মধ্যেই কাঁটা হয়ে বিঁধে রইল। এক তো কিছু শোনার আগেই তনু বেরিয়ে গেল, দ্বিতীয়ত রান্নাঘর থেকে দুটো জাজ্জ্বল্যমান সন্দিগ্ধ চোখ আমাকে যেন বিঁধতে থাকল। মনের মধ্যে ঢেউয়ের মতো উথালপাতাল চলল। দু-ঠোঁট আর এক করতে পারলাম না। কোনও অপরাধ না করেই, অপরাধীর মতো কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে থাকার মতো অবস্থা হল আমার।

কী করব ভেবে পাচ্ছিলাম না। একদিকে একমাত্র মেয়ে, অন্যদিকে আমার আদর্শবাদী নিয়মনীতি। যদি মেয়ের পক্ষে যাই, তাহলে বাকি জীবনটা আদর্শচ্যুত হওয়ার অপরাধবোধে ভুগতে হবে, আর যদি মনের কথা শুনি তাহলে, বাড়িতে অশান্তির পারদ চড়তেই থাকবে। যা হবে হবে। স্থির করলাম, নিজের সিদ্ধান্ত থেকে একপাও নড়ব না।

এইভাবেই কেটে গেল আরও তিন-চার দিন। এই ক’দিনের আত্মসংঘর্ষই আমাকে বয়েসের তুলনায় আরও বৃদ্ধা বানিয়ে তুলেছিল। বাড়িতে একটা অদ্ভুত ধরনের শান্ত পরিবেশ তৈরি হয়েছিল। হয়তো সুনামির আগের পরিস্থিতির মতোই। পাঁচদিনের দিন কলেজ থেকে ফিরে টিভিটা খুলে বসতেই, সবিতাও চা দেওয়ার বাহানায় মাটিতে বসে পড়ল। ঠিক সেই সময় তনু ছুটে এসে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরল। ও যে কখন দরজা খুলে ঘরে এসেছে কিছুই টের পাইনি।

‘ওহ্ মাম্মা, আমি সিলেক্ট হয়ে গেছি, কালই জয়েন করতে হবে। আমার ফ্রেন্ডসার্কেলে কারওরই হয়নি। আমি তোমাকে বলে ছিলাম না যে জবরদস্ত কম্পিটিশন হবে। তুমি হেল্প না করলে চাকরিটা আমি পেতাম না। লভ ইউ মাম্মা।’

আনন্দে আটখানা হয়ে গলা জড়িয়ে আমাকে আদর করতে থাকে তনু। ঠিক সেই সময় পাশে দাঁড়ানো সবিতার তির্যক চোখের দিকে চোখ পড়তেই আঁতকে উঠলাম। এমন তাচ্ছিল্যপূর্ণ দৃষ্টি সত্যিই অসহ্যকর। মুহূর্তেই যেন আকাশ থেকে মাটিতে কেউ ফেলে দিয়ে গেল আমাকে।

‘কী হল চুপ করে আছ কেন মা, কিছু বলো। তুমি না থাকলে তো…।’

‘তুই চাকরি পেয়েছিস তার জন্য আমি ভীষণ খুশি। কিন্তু একটা কথা তোকে না বলে পারছি না তনু। তোর চাকরির জন্য আমি কোনও তদবির করিনি। তুই তোর নিজের যোগ্যতাতেই চাকরিটা পেয়েছিস।’

কথাটা শুনেই তনু গলাটা ছেড়ে দিয়ে এক ঝটকায় একেবারে একহাত দূরে গিয়ে দাঁড়াল। ‘কী, তার মানে তুমি আঙ্কেলের সঙ্গে কথাই বলোনি।’ তনু নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে পারছিল না। ‘কিন্তু, কেন মাম্মা? তুমি তোমার মেয়ের জন্য এইটুকুও করতে পারলে না। আজ আমার চাকরিটা হয়েছে তাই, নাহলে! তোমার কাছে তোমার মেয়ের খুশি, ভবিষ্যৎ কিছু নয়? আমি ছাড়া এই পৃথিবীতে তোমার আছেটাই বা কে?’

‘শোন্ তনু’

‘কী শুনব?’

‘আমি বরাবরই চেয়ে এসেছি আমার মেয়েও আমার মতো আত্মসম্মান নিয়ে বাঁচুক। সারাজীবন আমাকে যেমন কারও কাছে মাথা নত করতে হয়নি, তেমনি আমার মেয়েও যেন জীবনে কারওর দ্বারস্থ না হয়। তাছাড়া, আমি যেখানে জানি, আমার মেয়ে যথেষ্ট মেধাবী। তার কারও সাহায্যের প্রয়োজন পড়বে না, তখন কেন?’

‘মেধা? সেটা তো পরের কথা মাম্মা। এখানে তো নিজের সবথেকে কাছের মানুষের উপর থেকে বিশ্বাসটাই উঠতে বসেছে। সত্যিটা স্বীকার করো না, যে তুমি তোমার আদর্শবাদী নীতির জন্য তোমার মেয়ের ভবিষ্যৎ নিয়েও ছিনিমিনি খেলতে রাজি। ছিঃ মাম্মা! তুমি এত স্বার্থপর? নিজের সন্তুষ্টির জন্য…’

‘আমি স্বার্থপর?’

‘এটা স্বার্থপরতা ছাড়া আর কী বলতে পারো? আমি এতদিন ভাবতাম পাপা নেই তো কী হয়েছে, আমার মা-ই আমার সব। কিন্তু আজ তোমার আদর্শের এই নাটুকেপনায় আমার সেই ভুল ভেঙে গেছে।’ রেগেমেগে নিজের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দেয়। মুহূর্তের মধ্যে চোখের সামনে সব অন্ধকার হয়ে গেল। মাথাটাও যেন বনবন করে ঘুরছে। কোনওরকমে সোফাটা ধরে বসে পড়লাম।

মিনিট পাঁচেক পরে একটু ধাতস্থ হলাম। চোখ খুলেই দেখি সবিতা কোমর বেঁধে একেবারে রেডি। আমি কিছু বলার আগেই সে বেশ দাপটের সঙ্গে বলতে থাকে, ‘আমি অশিক্ষিত, গাঁয়ের লোক আছি বটে, কিন্তু তোমাদের মা-মেয়ের এই নাটক খুব বুঝতে পারছি। আমরা ছোটো জাতের গরিব লোক বলে, সবাই আমাদের সঙ্গে এমনই ব্যবহার করে। আমারই বোঝা উচিত ছিল! মেয়ের জন্য সুপারিশ করতে একটুও বাধল না তোমার? রক্তের সম্পর্ক যে! যত আদর্শ, সিদ্ধান্ত সবই আমাদের মতো গরিব লোকেদের জন্য। বেচারা ভাই আমার, কোন মুখে যে গাঁয়ে ফিরবে! এসব তোমাকেই বা বলছি কেন, এসবে তোমার কী-ই বা যায় আসে। তোমরা তো আনন্দেই আছ না।’

এই অতর্কিত ঘটনায় উঠে দাঁড়ানোর ক্ষমতা প্রায় হারাতে বসেছি। বুঝতেই পারলাম না কীভাবে এক কল্পিত নাটকের চরিত্র হয়ে গেলাম আমি। আমার আত্মজ থেকে পরিচারিকা, সবার কাছেই অবিশ্বাসের পাত্রী হয়ে উঠেছি। ‘ঘুষ নেওয়া, তদবির করা অর্থাৎ যা কিছু-কে চরম অসম্মানের বলে যেনে এসেছি এতকাল, তা-ই আজ আমার জীবনের চূড়ান্ত ব্যর্থতার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বুকের বাঁদিকটা চিনচিন করছে। চোখ কেমন ঝাপসা হয়ে আসছে। তনু, সবিতা, ওই অচেনা লোকগুলো আঙুল তুলে কী যেন চিৎকার করে বলতে চাইছে। কোনও কিছু কানে ঢুকছে না আমার। বাবার উদাত্ত গলায় ফিরে ফিরে আসছে কবিতার লাইনগুলো… চিত্ত যেথা ভয়শূন্য উচ্চ যেথা শির/জ্ঞান যেথা মুক্ত সেথা গৃহের প্রাচীর…’।

 

কাঠগোলাপের গন্ধ

‘আমি সাইকেলে চেপে রাষ্ট্রপতির কাছে যাব, বুঝলে।’

উদয়কাকার মুখোমুখি সোফায় বসে আছি। তিনি আমার দিকে তাকিয়ে আছেন কিনা বুঝতে পারছি না। চোখে কড়া পাওয়ারের চশমা। তার পুরু কাচে মণিদুটো ভেসে রয়েছে। শার্টের নীচে ধুতি জড়িয়েছেন লুঙ্গির মতো করে। এক পা মেঝেয়, অন্য পা তার ওপরে পেঁচিয়ে রেখেছেন। ফোকলা মুখের দু’পাশে গাল বসে গিয়েছে। সেই গালে কয়েক দিনের সাদা কুচো দাড়ি।

আমার চোখ চলে গেল তার কাঁধ পেরিয়ে দরজার দিকে। সেখানে সাগ্নিক এসে দাঁড়িয়েছে। কাকা আমার দিকে ফিরে বসে আছেন বলে ছেলেকে দেখতে পেলেন না। সাগ্নিকও কথাটা শুনেছে। কেন-না আমার দিকে তাকিয়ে চোখ মটকে হাসল। ভাবখানা এমন– শুনলেন তো বাবার কথা!

আমি বললাম, ‘বয়স কত হল আপনার? সত্তর তো পেরিয়ে গেছেন। এখনও সাইকেল চালাতে পারেন আপনি?’

‘সেভেন্টি সিক্স। এখনও পারি তো। কিন্তু ওরা চালাতে দেয় না।’

বুঝলাম ওরা বলতে বাড়ির লোক। বলতেই হল, ‘সে আপনার কথা চিন্তা করে বলেই বলে, বারণ করে। এই বয়সে আর সাইকেল না-ই বা চালালেন। রাস্তাঘাটের যা অবস্থা।’

উদয়কাকা বললেন, ‘হ্যাঁ, রোজই তো কত লোক মারা যাচ্ছে অ্যাক্সিডেন্টে। খবরের কাগজে পড়ি। আমারও তো কতকাল বেঁচে থাকা হয়ে গেল। এখন থাকলেই বা কী, গেলেই বা কী। কিন্তু রাষ্ট্রপতির কাছে যাওয়াটা খুব দরকার।’

‘কী দরকার আমাদের বলা যাবে কি?’ বলতে বলতে সাগ্নিক এবার ঘরে ঢুকে এল।

উদয়কাকা ঘাড় ঘুরিয়েছিলেন। ছেলে এসে সোফার পাশের চেয়ারে বসল। তিনি বললেন, ‘বলে তোদের বোঝানো যাবে না।’

‘কেন? যাবে না কেন? আমরা কি মূর্খ?’

ছেলে ও বউমাকে নিয়ে উদয়কাকার কাছ থেকে বেশ কিছু কথা আমি আগেই শুনেছি। প্রশংসার কথা নয় সেসব। গোলমাল আঁচ করে তাড়াতাড়ি বললাম, ‘আপনার চোখের অবস্থা তো ভালো নয়। সাইকেল চালাবেন কী করে?’

এবার বুঝলাম কাকার চোখের মণিদুটো ছেলের দিক থেকে আমার দিকে ঘুরল। ‘হ্যাঁ, দুটো চোখেই গ্লুকোমা। দুটোতেই অপারেশন হয়েছে। কিছু তো হল না। ওষুধ দিয়ে দিয়ে ঠিক রাখতে হয়। তবে সাইকেল তো চালাব দিনেরবেলায়। রাতে তো চালাব না।’

‘চোখ সারিয়ে নিন না। তারপর না হয় দেখা যাবে।’

‘নাঃ, আর কত দিন বসে থাকব? আর সময় পাব কিনা তা তো জানি না।’

আমি হেসে ফেললাম। ‘তা রাষ্ট্রপতির কাছে যাবেন, সাইকেলেই যেতে হবে কেন? ট্রেনে যাবেন। রাজধানীতে উঠে সোজা রাজধানী।’

মাথা নাড়তে থাকলেন উদয়কাকা। ‘না, তা হবে না। আমি যা বলতে চাই, সাইকেলে গেলে তার গুরুত্বটা বোঝানো যাবে। কথাগুলো বলা দরকার। তুমি আমায় উৎসাহ দাও অত্রি। এবার বেরিয়ে পড়তে হবে।’

এ তো আচ্ছা লোক। আমাকেও জড়িয়ে নিচ্ছে। এ কি কোনও সাইকেল চালানোর কম্পিটিশন যে উৎসাহ দেব!

আমার এখন পঁয়তাল্লিশ। উদয়কাকার ছেলে আমার চেয়ে দু-তিন বছরের ছোটোই হবে। বছর পঁচিশ-তিরিশ কি তারও আগে দেখতাম পাড়ার মাঠে একজন সাইকেল নিয়ে এসেছে। ক্লাবের সঙ্গে কথা বলে সে একটা ব্যানার টাঙিয়ে দিত। সেখানে লেখা থাকত– কাহারও কোনওরূপ সাহায্য না লইয়া বাহাত্তর ঘণ্টা অবিরাম সাইকিলিং। দিনরাত সেই লোক সাইকেল চালিয়ে যেত। তার বুকে-পিঠে সেফটিপিন দিয়ে সাঁটা থাকত কয়েকখানা সার্টিফিকেট। আর সেসবের ফাঁকে ফাঁকে দশ টাকা, পাঁচ টাকার নোট। সে সাইকেলেই খেত, তার ওপর বসেই নীচে থেকে কায়দা করে বালতি তুলে মাথায় জল ঢেলে স্নান সারত। পেচ্ছাপ করার সময় মাঠের ধারে কাপড় ঘেরা একটা জায়গায় চলে যেত। সাইকেলে বসেই ঘুমোত কিনা জানি না। কারণ সেটা দেখার জন্য অনেক রাত অবধি অপেক্ষা করে আমরা বন্ধুবান্ধবরা বাড়ি চলে আসতে বাধ্য হতাম। শুধু পাড়ায় নয়। বেপাড়ার মাঠে কিংবা রাস্তার ধারেও এ জিনিস দেখেছি। একবার সাইকেল না চালানোও দেখেছিলাম। মানে একজন সাইকেল নিয়ে একজায়গাতেই দাঁড়িয়ে ছিল সারাক্ষণ। মাঝে মাঝে সামান্য প্যাডেল করত। বোধহয় তার মেয়াদ কম ছিল। চব্বিশ ঘণ্টা হবে। সবই তখন বিস্ময়। আমরা গিয়ে দাঁড়ানোয় ওরা নিশ্চয়ই উৎসাহ পেত। কিন্তু ছিয়াত্তর বছরের এক বুড়ো মানুষকে সাইকেল চালিয়ে দিল্লি যাওয়ার ব্যাপারে এই রবিবারের সকালবেলায় আমি কী বলব! উঠে পড়লাম।

উদয়ভানু পালের সঙ্গে আমার মোলাকাত হয়েছিল বছর তিনেক আগে এলাহাবাদের কুম্ভমেলায়। আমি থাকি বেহালা থানার পিছনে বারিকপাড়ায়। আর উনি ঠাকুরপুকুরের কাছে গৌরনগরে। যদিও দেখা হল কুম্ভে। এরকম তো হয়। বেহালার কত লোক হয়তো ওই কুম্ভেই গিয়েছিল। কারও সঙ্গে কারও দেখা হয়নি।

বাবা-মাকে নিয়ে যাব। মেয়ের পরীক্ষা বলে বউয়েরও যাওয়ার উপায় ছিল না। যাব কিন্তু কোথাও থাকার জায়গা পাচ্ছি না। এক সাংবাদিক বন্ধুকে ধরলাম। সে এক আশ্রমের কথা বলে হাতে একটা চিরকুট ধরিয়ে দিল। সেখানে ওই উদয়ভানু পালের নাম লেখা। বন্ধু বলল, ‘আমি আশ্রমে কথা বলে নিয়েছি। তোরা এর সঙ্গে গিয়ে দেখা করলেই ব্যবস্থা হয়ে যাবে।’

ব্যবস্থা হয়েছিল। আমি আর বাবা এক তাঁবুতে। মা মেয়েদের জায়গায়। উদয়কাকা বাবার চেয়ে দু’বছরের ছোটো। দেখলাম দু’দিনেই দুজনের বেশ জমে গিয়েছে। আমার সঙ্গেও গল্প করতেন। রান্নার ঠাকুর থেকে বাজার করার লোক অবধি সকলকে ডেকে ডেকে আলাপ করিয়ে দিয়েছিলেন। একদিন দেখলাম কয়লা কিনতে যাচ্ছেন। আর একদিন দেখলাম টেম্পোরারি পায়খানার দরজা খুলে গিয়েছে বলে নিজে হাতে সারাচ্ছেন। খাওয়ার সময় মাটিতে পাত পড়ত। তার আগেই উদয়কাকা এসে আমাদের বলে যেতেন। বিকেলের চা আর বিস্কুট নিয়ে আসতেন নিজের হাতে করে। তখনও দেখেছি সময় সময় চোখের ড্রপ নিতে। পরে জেনে অবাক হলাম উনি ওই আশ্রমের কেউ নন। এক মাস জমাদার আর অন্য কাজের লোকদের কাজকম্ম দেখাশোনার জন্য এসেছেন। ফ্রি সার্ভিস। নিজে নিজে তো আসতে পারতেন না তাই আশ্রমের মারফত হয়ে আসা। হেলথে চাকরি করতেন। জিবি রায়-তে ছিলেন, আরজি কর-এও।

তখনই জানতে চেয়েছিলাম, ‘এসব করতে কুম্ভে এলেন আপনি!’

উনি বললেন, ‘কেন, কী হয়েছে। সবাই তীর্থ করতে আসে, আমি কাজ করতে এসেছি। ভালো লাগলে এই আশ্রমেরই দীক্ষিত হয়ে যাব। যেখানে খুশি যাওয়া যাবে। রিটায়ারের পর থেকে তো আমি বেকার।’

ফিরে আসার পর উদয়কাকার যাতায়াত শুরু হয়েছিল আমাদের বাড়ি। একলাই আসতেন বেশিরভাগ। বারদুয়েক কাকি এসেছিলেন। বাবা-মাও গিয়েছে কয়েকবার। আমিও। দেড় বছর হল বাবা মারা গিয়েছে। উদয়কাকার আসাও কমেছে। আমারও অফিস আছে। সংসার আছে। জ্বর-পেটখারাপ আছে। মেয়ের টিউশনি আছে। মায়ের ডাক্তার আছে। পুজোর বাজার আছে। এরমধ্যেই একদিন সাগ্নিকের ফোন। ‘বাবার মনে হয় মাথাখারাপ হয়ে গেছে। আপনি একদিন আসতে পারবেন অত্রিদা?’

মাথাখারাপের ব্যাপারটা বিশ্বাস করিনি। ভেবেছিলাম সাংসারিক কোনও গোলমাল হয়েছে। এসে দেখি সাইকেল ও রাষ্ট্রপতি।

সপ্তাহ তিনেক পরেই উদয়কাকা আমাদের বাড়িতে এসে হাজির। শুধু এসেছেন বললে ভুল হবে। সাইকেলে সওয়ার হয়ে এসেছেন। আমার বউ নবীনা দরজা খুলতেই তিনি বললেন, ‘অত্রিকে একবার বাইরে আসতে বলবে বউমা?’

বেরোতেই তিনি সাইকেলের সিটে এমনভাবে চাপড় মারলেন যেন ঘোড়ার পিঠ থাবড়াচ্ছেন। ‘কেমন দেখছ? হারকিউলিস। এ জিনিস আর এখন পাবে না। তুমি চালিয়েও দেখতে পারো। এখনও যথেষ্ট মজবুত।’

জিনিসটা কতটা শক্তপোক্ত রয়েছে তার সাক্ষাৎ প্রমাণ দিতে উনি সাইকেল চালিয়ে এতটা চলে এলেন! বললাম, ‘ভেতরে আসুন। সাইকেলটা সিঁড়ির নীচে রাখুন।’

উদয়কাকা ঢুকতে ঢুকতে বলে যাচ্ছিলেন, ‘আমাদের দেশ ছিল ময়মনসিংহ। কিশোরগঞ্জ সাব ডিভিশন। গ্রাম জঙ্গলবাড়ি। তোমার বাবা জানতেন। বলেছিলাম।’

আমিও জানি। এখন আবার সে কথা তুললেন কেন কে জানে। নবীনাকে চা করতে বললাম। মা দোতলায়। অস্টিও আর্থ্রাইটিসে কাবু। উদয়কাকা ডাইনিং রুমের চেয়ারেই বসে পড়লেন। হাঁফাচ্ছেন। চিবুকের তলা দিয়ে নেমে যাওয়া শিরাদুটো কাঁপছে।

বললাম, ‘আপনার সাইকেলটা সত্যি ভালো আছে দেখলাম। অত পুরোনো বলে মনেই হয় না।’

উদয়কাকা ছেলেমানুষের মতো খুশি হলেন। ‘আছেই তো। সিক্সটি থ্রি-তে কেনা। তখন আমরা মানকুন্ডুতে থাকি। বাবা ওখানেই তখন প্র্যাকটিস করতেন তো। আমি সবে চাকরি পেয়েছি আরজি কর-এ। ডেলি প্যাসেঞ্জারি করি। বাবা মারা যাওয়ার পরে যখন কলকাতায় চলে এলাম তখন অনেকদিন সাইকেলটা বস্তাবন্দি ছিল। তারপর ঝেড়েমুছে, তেলটেল দিয়ে দাঁড় করালাম। পিছনের চাকার টায়ারটিউব নষ্ট হয়ে গেছিল। সারালাম। ছেলেকে এই সাইকেলেই চালানো শিখিয়েছিলাম।’

এইসময় আমার মেয়ে দোতলা থেকে নেমে এল। তাকে দেখেই উদয়কাকা কাছে ডাকলেন। ‘এসো দিদিভাই, কেমন আছ তুমি? লেখাপড়া কেমন চলছে?’

সঞ্জনা মাথা নেড়ে হেসে বলল, ‘ভালো।’

‘কোন ক্লাস হল তোমার?’

‘এইট।’

‘বেশ বেশ। তা তুমি তো দেখছি মাথায় অনেকখানি লম্বা হয়ে গেছ। বাবাকে ধরে ফেলো এবার।’

মেয়ে আমার দিকে তাকাল। ‘ধরে ফেলতাম তো। বললাম আমাকে একটা সাইকেল কিনে দাও। দিচ্ছে না।’

‘অ্যাঁ, সে কী! এ তো ভারি অন্যায়। কেন দিচ্ছে না?’

নবীনা বলল, ‘দেব যে, চালাবে কোথায়? রাস্তায় ছাড়া জায়গা তো নেই। যেভাবে গাড়ি চলে, ভয় করে। তাছাড়া ও এখন বড়ো হচ্ছে কাকা। একা একা এই বয়েসের মেয়েকে ছাড়া যায়, বলুন? দেখছেন তো চারদিকে কী অবস্থা!’

উদয়কাকার মুখ ভারী হয়ে এল। ‘শুধু এই বয়েসের কেন? কোন বয়েসের মেয়েই বা নিরাপদে থাকতে পারছে বউমা? আমাদের সব দাঁত নখ বেরিয়ে পড়েছে।’

সঞ্জনা এখন সবই বুঝতে পারে। সে কোনও কথা না বলে সরে যেতে চাইছিল। উদয়কাকা বললেন, ‘তোকে একটা মজার কথা বলি শুনে যা মা। এই একটু আগে তোর বাবাকে বলছিলাম। আমাদের দেশের বাড়ি ছিল ময়মনসিংহ। তোর ঠাকুমারও কিন্তু তাই।’

‘জানি তো। বাংলাদেশে।’

‘ঠিক বলেছিস। তা বুঝলি, আমার বাবা ইংরাজি শেখাতেন– আমার মানুষরা গান গায়। মাই মেন সিং। মানে কী হল? ময়মনসিং।’ হা হা করে নিজেই হেসে উঠলেন উদয়কাকা। তারপর থেমে বললেন, ‘জগদীশচন্দ্র বসু, আলাউদ্দিন খাঁ, উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী, নীহাররঞ্জন রায়, ফণিভূষণ চক্রবর্তী, শৈলজারঞ্জন মুখোপাধ্যায়, জয়নাল আবেদিন– সব ময়মনসিংহ। আরও কতজন আছেন। গর্ব হয় না, বল? কী সব মানুষ!’

সঞ্জনা চলে যেতে আমি বললাম, ‘আপনার বাবা তো ফুটবল প্লেয়ার ছিলেন, না কাকা?’

চা শেষ করে কাপ নামিয়ে উত্তেজিত গলায় তিনি বললেন, ‘অ্যাই, তখন যে তোমায় বলছিলাম না দেশের কথা, কেন জানো? সাইকেল চালিয়ে আসতে আসতে, এই তোমাদের বাড়ির কাছেই, হঠাৎ কাঠগোলাপের গন্ধ পেলাম। দেখি এক বাড়ির পাঁচিলের ওপাশে গাছটা মাথা তুলেছে। মোটা মোটা পাতা হাওয়ায় দুলছে। এর আগে যে তোমাদের বাড়ি এসেছি, তখন বোধহয় ফুল ফোটেনি গাছটায়। আমাদের গ্রামের বাড়িতে একটা কাঠগোলাপের গাছ ছিল। হলুদ-সাদা, গোলাপি-সাদা ফুল। তার গন্ধ এত সুন্দর। হঠাৎ কোথাও কাঠগোলাপের গন্ধ পেলে ছেলেবেলা মনে পড়ে যায়। বাবার কথাও মনে পড়ে গেল। ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল থেকে পাশ করে বাবা এখানে এসে সুরেন্দ্রনাথে ভর্তি হন। এসেই খেলা। ইউনিভার্সিটি চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর হরপ্রসাদ শাস্ত্রী প্লেয়ারদের সঙ্গে ছবি তুলেছিলেন। তাতে আমার বাবাও আছেন। বাবার নাম ছিল দেবেন্দ্র পাল। সবাই বলত ডি পাল। গ্রিয়ার স্পোর্টিংয়ে খেলতেন। গ্রিয়ার স্পোর্টিং ছিল মিত্তিরদের। পুরো নামটা মনে পড়ছে না। ওই যাদের লক্ষ্মীবিলাস তেল গো–।’

লক্ষ্মীবিলাস বলতে এবার আমার নাকে কবেকার একটা গন্ধ ভেসে এল। মাকে মাখতে দেখেছি ছোটোবেলায়। ঘন, খয়েরি রং। কবিরাজি দোকানের ভেতরে গেলে ওই গন্ধটা পাওয়া যায়। সেসব দোকান আর নেই বললেই চলে। লক্ষ্মীবিলাসও ধুয়ে গিয়েছে।

উদয়কাকা তখনও বলে যাচ্ছিলেন, ‘খেলতে খেলতে বাবা পরে যান ইস্টবেঙ্গলে। সেন্টার ফরোয়ার্ড পজিশনে খেলতেন। নাইন্টিন টোয়েন্টি থ্রি কী ফোর হবে, মোহনবাগানকে হারান এক গোলে। বাবাই গোল করেছিলেন। পরে যদিও ব্ল্যাকওয়াচ টিমের কাছে হেরে যান।

সে যাই হোক। বাবা পরে ডাক্তারিও পড়েছিলেন। জাহাজের ডাক্তার ছিলেন। সারা পৃথিবী ঘুরেছেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বর্মায়। যশোরে যখন ছিলেন তখন বিধানচন্দ্র রায় গেছিলেন সেই হাসপাতালে। বাবা রোজ ব্যায়াম করতেন। ভালো স্বাস্থ্য ছিল। বলতেন, দ্যাখ, আমি খেলেওছি, আবার ডাক্তারিও করেছি। মনের জোর থাকলে মানুষ কী না করতে পারে। এক জায়গায় নিজেকে বদ্ধ রাখলেই মুশকিল। কোনও কাজ করার ইচ্ছে থাকলে সেটা করে ফেলার দিকেই যেতে হবে তোমায়। আর আমায় দ্যাখো অত্রি, জীবনের বেশিটাই চাকরিতে চলে গেল। এক এই সাইকেল চালানো ছাড়া আর কোনও যোগ্যতা আছে আমার, বলো?’

কাকাকে এগিয়ে দেওয়ার জন্য বাড়ি থেকে বেরিয়ে হাঁটছিলাম। উনি সাইকেল নিয়ে পাশে পাশে। বললাম, ‘এই যে আপনি বেরিয়ে পড়তে চাইছেন, আপনার বাড়ির লোকেদের তাতে দুশ্চিন্তা হবে না? তারা কখনও আপনাকে এভাবে ছেড়ে দিতে পারে?’

উদয়কাকা বললেন, ‘ছেলে-বউমা দুজনেই চাকরি করে। তাদের সন্তান হয়নি, তাতে নিশ্চয়ই দুঃখ আছে। তা নিয়ে আমি বা তোমার কাকিমা কোনও কথা বলি না। কিন্তু বউমা রান্নাবান্না, বাজারহাট, ঘর সাজানো গোছানো– সব নিয়ে তার শাশুড়ির সঙ্গে খিটখিট করে। মশারি টাঙানো নিয়ে পর্যন্ত ছেলে তার মায়ের সঙ্গে ঝগড়া করে। একদিন বলল, তোমাদের জঙ্গলে রেখে আসা উচিত।’

আমি বললাম, ‘সব সংসারেই এরকম কিছু না কিছু হয় উদয়কাকা।’

উনি মানলেন না। বললেন, ‘একসঙ্গে থাকতে গেলে ভাব ভালোবাসা রেখে থাকতে হবে তো। সে কি তারা বোঝে? ছেলে দারুণ সেতার বাজাত। আমি সেতার বয়ে নিয়ে নিয়ে যেতাম তাকে শেখাতে। ভেবেছিলাম সে বড়ো শিল্পী হবে। হয়নি। বাজনা ছেড়েই দিয়েছে। ডালহৌসিতে একটা চাটার্ড ফার্মে কাজ করে। এই চাকরির কী মানে? ওই অর্থের মানে কী? ছেড়ে দিলেই বা কী আসে যায়? আবার শুরু করতে পারে না নতুন করে? বেঁচে থাকার কারণটা কী? আমি বেরিয়ে পড়লে প্রভা হয়তো চিন্তা করবে। কিন্তু ওরা সত্যি সত্যি চিন্তা করবে আমার জন্য? বিশ্বাস হয় না। ওই যে আশ্রমের হয়ে আমি কাজ করতাম– কত জায়গায় তো গেছি– গয়ায়, হরিদ্বারে, উজ্জ্বয়িনীতে, নৈমিষ্যারণ্যে– কখনও খোঁজ নিয়েছে আমার? জানতে চেয়েছে বাবা কেমন আছ? গয়ার রাস্তায় দেখেছিলাম একটা ছেলে চিরুনি বাজাচ্ছে মুখ দিয়ে, আর একজন মাটির হাঁড়ি। রাগ যোগিয়া বাজাচ্ছে বুঝলে! যে যা পয়সা দেয়। ভেবেছিলাম ওদের বাড়ি নিয়ে আসব তুলে। তা তো হওয়ার নয়। কিন্তু ওরা রাস্তার ধারে বসেও পারছে তো! একবার বালামৌ স্টেশনে আটকে পড়েছিলাম। পরদিন সকালের ট্রেনে নৈমিষ্যারণ্যে যাব। সেখানে যিনি স্টেশনমাস্টার ছিলেন তিনি রিটায়ারের পরও পাশেই থাকেন। জমি কিনেছেন। নিজে হাতে ধান চাষ করেন। আমাদের সেই চালের ভাত রেঁধে খাওয়ালেন। ইচ্ছে থাকলে পারে না লোকে?’

জানতে চাইলাম, ‘সাগ্নিক বলছিল আপনি এখন আর আশ্রমের কাজেও যান না, সত্যি?’

‘নাঃ, যাই না আর। রিটায়ারমেন্ট-এর পর অনেকগুলো বছর শুধু শুধুই কেটে গেছে। তারপর ওই আশ্রমে গেলাম। কাজ করতে চেয়েছিলাম। বলে বটে মানুষের মধ্যে ঈশ্বরের বাস কিন্তু মানুষকেও দ্যাখে না, ঈশ্বরকেও দ্যাখে না। শুধুই আড়ম্বর। ঈশ্বরে বিশ্বাস রাখাও খুব শক্ত। যে কৃষ্ণ ভজনা করে সে চতুর। যে জানে সে ভজনা করে তার আবার ভজনা কীসের?’

কাকার কথা শুনে বুঝলাম ওখানেও কোথাও একটা কাঁটা আছে। আমি আর খোঁচালাম না। কথা ঘুরিয়ে দেওয়ার জন্য বললাম, ‘আপনি যে সাইকেল চালিয়ে দিল্লি যাবেন ভাবছেন, কতটা রাস্তা জানেন?’

‘জানি তো। বাই রোড এক হাজার চারশো ঊনআশি কিলোমিটার। নিরামিষ খাই। হাতে-পায়ে যা জোর আছে তাতে করে দিনে কুড়ি কিলোমিটার চালাতে পারব মনে হয়। আমি মিস্ত্রির সাথে কথাও বলেছি। একটা ছাতা লাগাতে হবে সিটের সঙ্গে। কিছু জিনিসপত্র রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। এক্সট্রা ক্যারিয়ার লাগবে।’

সেরেছে। ইনি তো দেখছি অনেক এগিয়ে গিয়েছেন। বললাম, ‘আপনি রাষ্ট্রপতির কাছে যেতে চাইছেন কেন? কারণটা কী?’

উদয়কাকা দাঁড়িয়ে পড়লেন। ‘শোনো, আমার এক বন্ধু ছিল– সত্য গুপ্ত। একসঙ্গেই চাকরি করতাম জিবি রায়-তে। সে ব্যাচেলার লোক। ছবি কেনার নেশা ছিল শুধু। তাই দিয়ে ঘর সাজাত। ভীষণ মুখ খারাপ করত, সোজা কথা সোজা বলে দিত। মানে কোনও সত্যই তার মুখে গুপ্ত থাকত না। একবার ইনজেকশনের স্টকে একটা গরমিল ধরা পড়ল। সত্য তো যা তা বলতে শুরু করল। কয়েকজন ধরা পড়ে পড়ে। তাকে বদলি করে দিল দূরে। সে যাবে না। মাইনে বন্ধ। কাউকে ধরাকরাও করবে না। ওর হয়ে আমি রাইটার্সে ধরনা দিলাম। তখন হেল্থ মিনিস্টার ননী ভট্টাচার্য। রাইটার্স থেকে আমায় বলল, উদয়বাবু আপনার বন্ধুকে ঠোঁট সেলাই করতে বলুন। আপনি এত হাঁটাহাঁটি করেছেন বলে দূরের বদলি ক্যানসেল করে ওকে মেডিকেলে দেওয়া হল।’

একটু থামলেন উদয়কাকা। তারপর আবার বললেন, ‘কত তো দেখলাম। সবাই চায় অন্যের ঠোঁট যেন বন্ধ থাকে। কিন্তু আর তো পারা যাচ্ছে না অত্রি। এই আমাদের দেশ! রোজ কাগজে, টিভিতে দেখছি আর শিউরে উঠছি। রোজ ধর্ষণ আর খুন, দাঙ্গাও হচ্ছে– সে খবর লুকিয়ে যাচ্ছে– কিন্তু হচ্ছে তো। চারপাশ একেবারে দুর্নীতিতে ছয়লাপ হয়ে গেছে। ঘুষ ছাড়া কেউ নড়ে না। যে যাকে পারছে ঠকাচ্ছে। টাকার লোভে মানুষ পাতালে তলিয়ে যাচ্ছে। টেকনোলজির যে এত উন্নতি, তা দিয়ে গরিব মানুষের কিছু হচ্ছে কি? কারা ফল পাচ্ছে তার?’

আমার কেমন রাগ হয়ে গেল। বললাম, ‘এসব তো অনেকদিন ধরেই ঘটছে। আপনাদের সময় সবাই কি সাধুপুরুষ ছিল?’

‘না, মোটেও নয়। কিন্তু এত নোংরামি ছিল না। তুমি হিসেব নিয়ে দ্যাখো। এত পাবে না। যত দিন যাচ্ছে, সব দিকেই মানুষের বিকৃতি বেড়েই চলেছে। ঈশ্বরে বিশ্বাস নেই কারও। ধর্মেও নয়। এখন পাপ করেঞ্জভাবে ভগবানের সামনে গিয়ে দাঁড়ালেই সব মাফ। কাল আবার নতুন পাপ করা যাবে। আর ঠোঁট সেলাই করে রাখা যাচ্ছে না অত্রি।’

‘আপনি কি এসব কথা বলতে যাবেন রাষ্ট্রপতিকে?’

‘হ্যাঁ। বলব– কী হচ্ছে এসব?’

‘কী লাভ হবে বলে? উনি তো হাত ধরে সকলকে আইনের পথে, সততার পথে, ন্যায়ের পথে নিয়ে আসতে পারবেন না।’

‘জানি পারবেন না। কিন্তু আমার উদ্বেগ আমি জানাতে পারব না?’

আমি মানুষটাকে ভালো করে দেখলাম। ওর কি সত্যিই মাথায় গোলমাল দেখা দিচ্ছে? না কি নিজের বিশ্বাসের এতটাই জোর যে অনায়াসে এসব কথা বলে যাচ্ছেন?

তখন উনি বললেন, ‘শোনো অত্রি, আমি এখনকার ছেলেমেয়েদের জীবনের উদ্দেশ্য বুঝি না। গরিব-বড়োলোক, শিক্ষিত-অশিক্ষিত– সবার রুচি একইরকম লাগে। তারা ভবিষ্যতে কী করবে আমি জানি না। কিন্তু আমি এখনই এসব কথা বলতে চাই। আর বললে রাষ্ট্রপতিকেই বলব।’

‘রাষ্ট্রপতি আপনার সঙ্গে দেখা করবেন কেন?’

উদয়কাকা যেন খুব অবাক হওয়ার মতো একটা কথা শুনছেন, এভাবে তাকিয়ে রইলেন আমার দিকে। তারপর বললেন, ‘কেন দেখা করবেন না? একজন সিনিয়র সিটিজেন আরেকজন সিনিয়র সিটিজেনের সঙ্গে দেখা করবেন না?’

আমার কথা এবার বন্ধই হয়ে গেল। এই লোককে আর কী বলা যেতে পারে! ফিরে যাব ভাবছি, তখন উদয়কাকা নাক টেনে বলে উঠলেন, ‘আহা! আবার সেই গন্ধ। পাচ্ছ তুমি? কাঠগোলাপের গন্ধ। ওই যে গাছটা। এখন আর এ গাছ দেখাই যায় না। রেয়ার হয়ে গেছে। এক একটা শব্দ, গান, গন্ধ– কী যে করে দেয়।’

আমি কোনও গন্ধ পাইনি। সে কথা ওকে বলা গেল না। উদয়কাকা চলে যাওয়ার পর আমি তার কথাই ভাবতে ভাবতে বাড়ি ফিরে এলাম। উনি যা নিয়ে বলছেন তা তো আমরাও জানি। কিন্তু কিছু বলতে পারি কই? আর সাইকেল ও রাষ্ট্রপতির ব্যাপারটাকে তো লোকে খ্যাপামিই বলবে।

মাস খানেক পর একদিন সকাল ন’টায় সাগ্নিকের ফোন। ‘অত্রিদা, বাবাকে পাওয়া যাচ্ছে না। সাইকেলটাও নেই। আসবেন প্লিজ?’

স্কুটার বের করে পৌঁছলাম উদয়কাকার বাড়ি। সাগ্নিক বলল, ওরা ভেবেছিল কাছেই কোথাও গেছে। সাইকেলটা নেই দেখে সন্দেহ বেড়েছে।

আমি বললাম, ‘এত আগ বাড়িয়ে ভাবছ কেন? হয়তো এদিক-ওদিকেই গেছেন সত্যি। এর আগে তো একদিন আমার বাড়িতেই গেছিলেন সাইকেলে।’

সাগ্নিক তখন বলল, ‘না, এবার তা নয়। একটা ব্যাগে জামাকাপড় ভরে নিয়ে গেছেন। চোখের ড্রপটাও।’

চুপ করে রইলাম। উদয়কাকা এভাবে সবাইকে বিপদে ফেলল? সাগ্নিককে বললাম, ‘স্কুটার তো রয়েইছে, একবার বেরিয়ে দেখি চলো।’

বেরিয়ে পড়লাম। কিন্তু তখনই মনে হতে লাগল– কোথায় খুঁজব? বিশেষ করে যদি কেউ ইচ্ছে করেই হারায়। কোন রাস্তায় গিয়েছেন তা কি বোঝা যাবে? সাগ্নিক মাঝে মাঝে মোবাইল থেকে বাড়িতে ফোন করছিল। ওদিক থেকেও কোনও খবর নেই। আশপাশের তল্লাট হাঁটকেও উদয়কাকার দেখা মিলল না। ঘুরতে ঘুরতে ডায়মন্ডহারবার রোডের অনেকখানি চলে গেলাম। আচমকা সাগ্নিক চেঁচিয়ে উঠল– ওই বাঁদিকে চলুন তো। ওই যে, ওই সাইকেলটা।’

স্পিড বাড়িয়ে কাছাকছি পৌঁছে দুজনেই হতাশ। নাঃ, দূর থেকে দেখে ভুল হয়েছিল। চুলটা ওইরকমই খোঁচা খোঁচা, গড়নটাও লম্বাটে ধাঁচের, বয়েসও কাছাকাছিই হবে, কিন্তু ইনি উদয়ভানু পাল নন।

সাগ্নিক বলল, ‘ঘুরিয়ে নিন। আপনাকে আর কষ্ট দেব না। দেখি অপেক্ষা করে। না হলে সেই থানাপুলিশ করতে হবে।’

ফিরে আসছিলাম। কেন জানি মনে হল, ওই বুড়ো লোকটা না হয় উদয়কাকা নন, কিন্তু উনিই বা সাইকেল নিয়ে যাচ্ছেন কোথায়? কোনও কাজে বেরিয়েছেন? না কি উনিও দিল্লি যাচ্ছেন? এরা কি এক এক করে বেরিয়ে পড়ছে না কি? এই রাস্তায়? তা হলে কি অন্য কোথাও? অন্য কারও সঙ্গে দেখা করতে?

থানায় খবর দিতেই হয়েছিল সাগ্নিককে। আত্মীয়স্বজনের বাড়ি। হাসপাতাল। মর্গ। সেই আশ্রমেও গিয়েছিল। তাদের শাখাপ্রশাখাকেও জানানো হয়েছিল। উদয়কাকার খোঁজ পাওয়া যায়নি। এমনকী চার-পাঁচ মাস পেরিয়ে যাওয়ার পরেও কোনও খবর পাওয়া গেল না।

এ সময়ের মধ্যে কোথাও কিছু বদলায়নি। দিন ও রাত নিজেদের নিয়মেই আসাযাওয়া চালু রেখেছে। কত অয়েলক্লথ কেনা হয়েছে, কত শবযাত্রা গিয়েছে। সরু গলি ও বড়োরাস্তায় কত উৎসব হয়েছে। এখন শুধু আমি মাঝে মাঝেই কাগজ পড়ার সময় রাষ্ট্রপতির ছবি দেখলেই বাড়তি ঝুঁকে পড়ি। কোনওদিন হয়তো দেখব ছবি ছাপা হয়েছে– হাস্যমুখ রাষ্ট্রপতির সঙ্গে হাত মিলিয়ে ফোকলা গালে হাসছেন উদয়কাকা। সাইকেল বুড়োর গালে সাদা কুচো কুচো দাড়ি। চোখে পুরু কাচের চশমা।

তেমন কিছু দেখতে পাই না। কে জানে। এত বড়ো দেশ। হয়তো উদয়কাকা ঘুরতে ঘুরতে যাচ্ছেন সাইকেল নিয়ে। আরও অনেকের সঙ্গে দেখা করবেন। কথা বলবেন। একদম শেষে পৌঁছবেন রাইসিনা হিলে। বলেছেন যখন, তখন যাবেন নিশ্চয়ই। অপেক্ষায় থাকি।

 

পড়ার জন্য সীমাহীন গল্প-নিবন্ধসাবস্ক্রাইব