হস্তান্তর

সাতডিহি গ্রাম থেকে নাইট শো সেরে ফিরছিল কমলা। ট্রেকারে গাদাগাদি যাত্রীর মধ্যে গা ঘেঁষাঘেষি করে কমলার পাশে বসে রসিক ধনঞ্জয় আর পেছনে সঙ্গতের বাজনদাররা। হারমোনিয়াম গলায় কানাই নেমে গেছে পথে। সেখান থেকে আদ্রা যাবে একটা যাত্রা দলের সাথে মহড়ায় বসতে। আদ্রার কাছেই এক গ্রামে তার বাড়ি। কমলার ঘর বলো, সংসার বলো, সবই রসিক ধনঞ্জয়ের দান। ঝুমুরের মরশুম ছাড়াও বাজনদাররা খেপ কাজের সুযোগ পায়। কিন্তু প্রধান শিল্পী ‘নাচনি’র নাচের বায়না না থাকলে, নাচ নিয়ে পড়ে থাকার উপায় নেই। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত ধান ভানা,ধান-চাল সেদ্ধ করা, খড় কুচোনো, গরুর জাবনা তৈরি করা, উঠোন নিকোনো, ঘুঁটে দেওয়া– কাজের অভাব? ধনঞ্জয়ের বউ কমলাকে ডাকে ‘ঢেমনি’ বলে। খাবার দেয় ছুড়ে। তার নিড়ানো বা ভানা চাল অচ্ছুত নয়, বাগানের সবজি অচ্ছুত নয়, শুধু কমলা অস্পৃশ্য। হাড়ভাঙা খাটনির পর রাতে দু-চোখের পাতা এক হয়ে এলে, রসিক ধনার স্পর্শে জেগে উঠতে হয় প্রায় দিন। রক্ষিতা নাচনির দিনের বেলা ছায়া মাড়ানোও চলে না, কথা বলাও পাপ। কেবল অনুষ্ঠান থাকলে ছাড় থাকে। কিন্তু রাত্রিটা আর পাপের থাকে না। তখন রসিককে খুশি করাই তার একমাত্র কাজ। শরীর খারাপের ওজরটাও ধোপে টেকে না।

কমলার এবছরের মতো নাচের আসর শেষ। এখন ধান সেদ্ধ করার সময়। আরও হাজারটা কাজ। ধনার বউ অতসী ওকে দেখলে এক ঘটি জলও গড়িয়ে খায় না। ভুল হল। জল ছোঁয়া তো বারণ। হেঁসেলে ঢোকাও। কমলার কাজ উঠোন থেকে শুরু হয়ে সারা গাঁয়ে ছড়িয়ে আছে। অন্যের বাড়িও খেটে আসতে হয়। মজুরিটা ধনার সংসারের প্রাপ্য।

ট্রেকারে চাপাচাপি করে আসতে আসতে নিজের বারোমাস্যার কথাই ভাবছিল কমলা। এই যে ওর গায়ে গা লাগিয়ে যাত্রীরা বসে আছে, তারা বাড়ি ফিরেই স্নান করবে নিশ্চয়ই। গাড়িটা হঠাৎ জুরিডির হাটে থেমে গেল। সামনে রাস্তা আটকে অনেক লোক। তা হাটবারে ভিড় তো হবেই। কিন্তু এ তো জটলা বেধেছে। কিছু একটা হয়েছে। চড়নদাররা একে একে নামল। কমলাও। ওর ছোঁয়া বাঁচাতে জটলাটা একটু ফাঁক হয়ে গেল। হাটের প্রকাণ্ড অর্জুন গাছটার নীচে বসে আছে এক অশীতিপর বৃদ্ধা। সামনে ভিক্ষাপাত্র। নড়ার ক্ষমতা নেই। শরীর থরথর করে কাঁপছে। ‘ভিক্ষা দাও মাগো বাবারা’ নয়, মুখ থেকে অস্ফুটে বেরিয়ে আসছিল ‘জল জল…।’

কেউ কাছে যাচ্ছে না। সামনে চায়ের দোকানে জগে জগে পানীয় জল রাখা। কিন্তু কারও গ্রাহ্য নেই। কমলা জনতার জাত চেনে। সে বলল, ‘দাঁড়াও বিজলি মাসি, আমি জল লিয়ে আইসছি।’ ট্রেকারে নিজেদের নিজেদের সামগ্রী ঠাসা থলেতে একাধিক বোতল। শালারা কোনটায় জল, আর কোনটায় মাল রেখেছে বোঝা দায়। ভাগ্যিস নিজের ব্যাগে একটা জলের বোতল রাস্তার কল থেকে ভরে ঢুকিয়েছিল। বোতল হাতে ফিরে এসে দেখে ভিড় পাতলা হচ্ছে। নানারকম মন্তব্য– ‘পাপের জীবন’, ‘এমনটাই হবার ছিল’। বিজলিবালা গাছের তলায় নেতিয়ে পড়ে আছে। লিকলিকে শরীরটাকে তার নোংরা পুঁটলি থেকে একনজরে আলাদা করে চেনা যাচ্ছে না।

শেষ সময়টা তৃষ্ণা নিয়ে গেল মানুষটা? কমলার বোতলের জল খরচ হল না। চোখ জলে ভরে উঠল। ধনঞ্জয় এসে তাড়া  লাগাল, ‘কী দেখছিস কী? চল। মেলা বেলা হইল।’

‘বিজলিমাসি কত সোন্দর দেইখতে ছিল। কত বড়ো  মাইনষে তার নাচ দেইখে শাড়িতে টাকা লাগায়েন দিত। মরার আগে একফোঁটা জলও পেইলেক লাই? আমি তো জল জল শুনেই দৌড় লাগায়েনছি। কিন্তুক হাটের লোকে তো আগে থাইকতে শুইনছে। উয়ারা কেউ জলটুকু দিলেক না?’

‘খানকির এমনই গতি হয়। ইবার ডোম আইসবেক, খবর করা হঁইছে। আমরা ভালে কী কইরব? চল।’

‘খানকি বইলছ কাকে? উ নাচনি ছিলেক। গুণী শিল্পী, আমার পারা। গরমেন্ট চাদর দিলেক, সাট্টিফিকেট দিলেক, পেরাইজে টাকাও দিলেক, দেখো নাই?’

 

‘গুণী শিল্পী।’ ভেংচি কাটল ধনঞ্জয়। ‘চল।’

‘মাসির কাছে কত কিছু শিখছি। শেষ সময়টা টুকদু থাইকতে দাও।’

‘গাড়িটো কি তুর বাপের? সবাই কি তুর পারা কামকাজ ফেইলে টাইম কাবার কইরবে? কী কইরবি দেইখে? ওই দেখ মাতলা ডোম চলে এইসছে।’

মাতলা বিজলিবালার পায়ে আলগোছে দড়ির ফাঁস দিল। তারপর টেনেহিঁচড়ে নিয়ে চলল শ্মশানের কাছে ভাগাড়ে। বিজলির ছেঁড়া বসন রাস্তায় আটকে আটকে লুটিয়ে চলল। মাথার চুল ধুলো ঝাঁটাল। পুঁটলির চাল ছড়িয়ে পড়ল পথে। আহা! অমন করে খরখরে মোরামের রাস্তায় টানতে আছে? অবশ্য বিজলিমাসি আর ব্যথা পাচ্ছে না। কিন্তু নিজের ভবিতব্য দেখে শিউরে উঠল কমলা। নাঃ, আর কিছু দেখার নেই। এরপর শ্মশান ভাগাড়ের শেয়াল, কুকুর, শকুন…!

বাড়ির দরজায় জোরে জোরে শেকলের বাড়ি মারল ধনঞ্জয়। মেয়ে টুসু এসে দরজা খুলে সরে দাঁড়াল। অতসী উঠোনে কাপড় মেলছিল। স্বামীকে আহ্বানের সঙ্গে সঙ্গে সাবধানও করে দিল, ‘দেইখো। কাচা কাপড়গুলান ছুয়াৎ না যায়। আগে গোবর ছুঁয়ে ডুব দিয়ে ঘরে ঢুইকবে।’

কমলাকে যেন দেখতেই পেল না। সে নিজের ঘুপচি ঘরে ঢুকে একটা বালতি মগ নিয়ে এসে অপেক্ষা করতে লাগল। সবাই চলে গেলে টিউব কলের জল নিয়ে স্নান করবে। জল নিয়ে কলটা ধুয়ে দিতে হবে। তার স্নানের জায়গাও আলাদা। কানা গরুর ভিনু বাথান। এদিকে পেটটা টিস্টিস্ করছে। এ বাড়িতে সেপটিক ট্যাংক আছে। গত বছর খাটা পায়খানার পরিবর্তে বসেছে। কিন্তু সেখানে কমলার ঢোকা মানা। তাকে সেই আগের মতোই এই দিনেদুপুরেও মাঠ থেকে কাজ সেরে ফিরতে হবে। সেসব না চুকিয়ে স্নান করা বৃথা। দু-দুবার কাপড় কাচতে হবে। আচারবিচার সব মেনে স্নান করলেও তার অস্পৃশ্যতা দূর হবে না। অতসীবউদির কাছে কলাই করা থালা নিয়ে দাঁড়ালে সেই ছুড়েই খাবার দেবে। শুধু অতসী নয়, গ্রামের বিয়ে-শাদিতে যখন চেয়ার টেবিল পেতে পংক্তিভোজন হয়, তখনও কমলাদের মাটিতে বসিয়ে ছুড়ে ছুড়েই খাবার দেওয়া হয়। মেয়ে বিউটি তো নাচনি নয়, তবু তাকেও মায়ের পাশে অচ্ছুৎ হয়ে বসে থাকতে হয়। মানে লাগার জো নেই। নেমন্তন্ন থাকলে বাড়িতে মা মেয়ের নিজেদের ভাত ফুটিয়ে খরচ করা চলবে না।

ঝুমুর সেরে ‘বাড়ি’ ফিরে যেন চোর হয়ে থাকতে হয়। অতসী এমনিতেই তাকে নিজের ছেলেমেয়ের সামনেও ‘খানকি, ছেনাল’ ইত্যাদি বলতে ছাড়ে না। নাচের আসর থেকে ফিরলে তার মেজাজ যেন আরও চড়ে থাকে। কদিনের জন্য স্বামী এই ঢেমনির সঙ্গে ঢলাঢলি করেছে না? যতক্ষণ আসর ততক্ষণ হৈচৈ। তারপর ‘সোহাগ চাঁদ’ থেকে ঘুঁটে কুড়ুনি।

বাড়ি ফিরে মেয়ের খোঁজ করলেও রাগ রসিক দম্পতির। তার মেয়েকে কি অতসী না খাইয়ে রেখেছে, না বেচে দিয়েছে? বরং নাচনির আবদার রেখে তাকে গ্রামের প্রাইমারি স্কুলে ভর্তি করা হয়েছে। দুপুরের মিড ডে মিল ছাড়া শিক্ষা কী পায় বলা মুশকিল, তবে শাসন পায় পর্যাপ্ত। মেয়েটাকে গর্ভে মেরে ফেলার চেষ্টা কম করেনি ধনা। কিন্তু সব বিষ হজম করে কেমন নির্লজ্জের মতো জন্ম নিল। আর যাতে না হয়, সে ব্যবস্থা পাকা করে দিয়েছে রসিক মেয়েটা জন্মানোর পরই। কিন্তু ওই এক মেয়ের জন্যই ঘুঙুরজোড়া পায়ের বেড়ি হয়ে গেছে। অবশ্য যেসব নাচনির সন্তান নেই, তাদেরই বা মুক্তি পেতে দেখল কোথায়? পঞ্চমীর কথা কে না জানে?

স্নানের পর থেকেই চোখে ঢুল আসছিল। পেটে ভাত পড়ার পর আর বসে থাকা যাচ্ছে না। মায়ের এঁটো মেঝে গোবরজলে বিউটিই নিকিয়ে দিল। ‘শুতে চল মা। দুপুরটো টুকদু জিরায়েঁ লাও।’

অতসীর হুংকারে তন্দ্রা ছুটে গেল। ‘রাতভর ঢলানি কইরে আসছিস। কামকাজ কুছু তো করার নাম লাই। মুড়ির চাল সিজাগে।’

কমলা চাল সেদ্ধ করে শুকিয়ে তৈরি করে রাখলে অতসী ভাজবে। সেই মুড়ি সংসারে উদ্বৃত্ত হলে পাড়ায় বিকোয় না, প্যাকেটবন্দি হয়ে চলে যায় শহরে। আয় মন্দ না। ‘বর্ধমানের মিষ্টি মুড়ি’ শুধু বর্ধমানেই তৈরি হয় না। ঘুম চোখে দুপুরের কড়া রোদ পিঠে নিয়ে গনগনে অাঁচের সামনে বসল কমলা। বিউটি মায়ের সঙ্গে থাকলেও এসব কাজ ওকে করতে দিতে চায় না কমলা।

মুকুন্দ ঘোষের ঘর ছাইবার কাজ করতে গিয়ে সরকারি ‘সয়ম্ভর’ যোজনা, একশো দিনের কাজ এসব তথ্য কানে এল। ধনাদের লুকিয়ে সেই কাজের এক ফাঁকে ‘স্বয়ম্ভর’ যোজনায় কাজ খুঁজতে গেল। কমলার ভোটার কার্ড, বিপিএল কার্ড সবই আছে। এক মাতব্বর বলল, ‘তুই নাচনি বটিস না? ধনা সর্দারের? ইখানে ক্যানে? যা ঢলানি কইরে রোজগার করগে যা। ইটো গেরামের গরিব বউ বিটিদের জইন্য।’ সরকারি নির্দেশের ব্যাখ্যা ও রূপায়ন সরকারি কর্মীদের জিম্মায়। সুতরাং মুখ চুন করে ফিরে আসতে হল।

মাঝখান থেকে ধনঞ্জয়ের কানে গেল কথাটা। দরজা ঠেলে স্বামী উঠোনে পা রাখা মাত্র অতসী আবার সাতকাহন শোনাল। কমলার চুলের মুঠি ধরে উঠোনে ফেলে কিল, চড়, লাথি কোনওটাই বাদ রাখল না। বিউটি ভাগ্যিস এখনও স্কুল থেকে ফেরেনি। ‘খানকির শখ কত। আমি কি তুকে পুষছি লাই?’

কে কাকে পোষে? নাচনির রোজগারেই রসিকের সংসার, বউ-বাচ্চার ভাতকাপড় থেকে রসিকের নেশার চোলাই। ঝুমুর নাচের জলসা থেকেই রসিকপত্নীর নাকে সোনার নথ। আর নাচনি গায়ে নকল গয়না ও মুখে সস্তার মেক-আপ মেখে ঘুরে ঘুরে নাচে। নাগরের প্রেম বিরহের আখ্যান শোনায় গানে গানে। কমলার বাঁধা গানগুলিও নিজের নামে চালায় ধনঞ্জয়। কমলা মুখ্যু মেয়েমানুষ। সে কি গান বাঁধতে পারে? সে শুধু নাচবে আর গাইবে। আর রাতে ‘প্রতিপালক’ রসিকের দেহের তলায় পিষ্ট হবে।

‘অবেলায় ছুয়াৎ কইরলে? কাপড় ছেইড়ে ঘরে ঢুইকবে।’

অবেলা। তাই তো। এখনও ধনার কমলার ঘরে ঢোকার সময় হয়নি। ধনা টিউব কলের তলায় বসে বলল, ‘ফের যদি বেচাল দেখি, তো জ্যান্ত কুত্তা দিয়ে খাওয়াব, মরা তক অপেক্ষা কইরব না। আর তুর বিটিটোকে…’

বিজলিমাসির শক্ত হয়ে যাওয়া মরদেহ শেয়াল, কুকুরে ছিঁড়ে খাচ্ছে কল্পনা করেই এ কদিন রাতে ঘুম হয়নি কমলার। আর তাকে জ্যান্ত…? আর তার মেয়েকে নিয়ে কী করবে ভগবানও জানে না। ইয়ারা সব পারে।

মারের ক্ষতিপূরণ হিসাবে সন্ধেবেলায় কোনও কাজ করতে হল না। তবে রাতের আহারটাও বাজেয়াপ্ত হল। বিউটিও অতসীমামির ভয়ে মাকে খাবার দিতে পারল না। কমলা একবার কোনওরকমে ছেঁচড়ে ছেঁচড়ে ঘরের বাইরে নালিতে গিয়ে ছোটো বাইরে সেরে ফিরল। খাটে ওঠারও ক্ষমতা নেই। মেঝেতেই শুয়ে পড়ল। মুখের কষে রক্ত মোছার জন্য বিউটি মাকে জল দিয়েছে, ওই জলই সামান্য পান করেছে। হাত পাও ধুয়েছে। মেয়েটা দুপুরে মায়ের কাছে থাকলেও রাতে দালানে শোয়।

এ রাতে তাড়াতাড়ি ঢুকল ধনা। ‘খুব বেদনা কইরছে?’

উত্তর দিল না কমলা।

‘আমার কি তুর গায়ে হাত তুইলতে মন চায় রে? তুই আমার সোহাগি চাঁদ। দিকে দিকে তুর কত নামডাক ছড়াইনছে। ইয়াতে তুই খুশি লোস? বিডিও অফিস কিসকে গেঁইছিলিস। পালি কুছু? উয়ারা অপমান কইরে তাড়ায়েন দিলেক না? তুকে ভালাবুরা বইললে আমাকেও বাজে ইটো বুঝিস লা? তুকে কি আমি খারাপ রেইখেছি? তুর বিটিও পড়ালিখা শিখছে আমার ছিলাগুলার সাথে।’ কমলাকে টেনে বিছানায় তোলে ধনা।

‘আমার বিটি তুমার বিটি লয়?’ বলতে সাহস হল না। বলল, ‘সারা শরীল চিড়বিড়াইনছে। আজ রেইতে খেমা দাও। মারার সময় খেয়াল থাকে লা। আমি তো অচ্ছুত বটি। মইরলে আগুনটুকু পাব লাই।’

‘আয় তুর গায়ে হাত বুলায়েন দিই। বোরোলিন লাগায়েন দুবো? টুসুর মাকে বইলব কাল চুন-হলুদ কইরে দিতে।

বেদনা কুথায়?’

‘আর সোহাগ কাড়াতে হবেক লাই। সারাদিন তুমার সংসারের লেইগে জিউকে জামিন দিয়ে খাটি। সন্ঝায় মার খাই। রেইতে ঘুমাতে তো দিবে।’

‘শালি ভালো কথার বিটিছিলা লয়।’ ধনা কমলার বুকের কাপড়-ব্লাউজ সরিয়ে কামড় বসাল। ভয়ে জোরে কাতরোক্তি করার সাহস হল না কমলার।

বিয়ালা বউ না হয়েও ঘরগেরস্থালির কাজ, ঝুমুর নাচ আর সহবাস মিলে রসিককে ভালোবাসে কিনা কমলা নাচনি ঠিক ঠাওর করতে পারে না। কিন্তু অতসীর কাছে দিবারাত্রি দুর্ব্যবহার পেয়ে এমন এক অলিখিত প্রতিদ্বন্দ্বিতা জন্মেছে, যে ধনা বউয়ের বদলে কমলার ঘরে রাত্রিবাস করলে এক রকম আনন্দ হয়। শরীরের আনন্দ নয়, হিংসুটেকে জ্বালাতে পারার আনন্দ। যেসব রাতে শরীর সুস্থ থাকলেও রসিক ওর ঘরে না আসে, সেসব রাতগুলো ফাঁকাও লাগে। তাছাড়া বাপ হলেও রসিকের নজরটা ভালো নয়। দালানে মেয়েটা একা শোয়। ধনা কমলার কাছে না এলেই ভয় ভয় করে।

বহুবার মেয়েকে নিয়ে পালানোর কথা ভেবেছে। কিন্তু পঞ্চমীর দশা শুনে সে সাহস হয় না। পঞ্চমী পালিয়ে গিয়ে স্টেশনে এক মহিলার মিষ্টি কথায় ভুলে তার অনুগামী হয়েছিল। মহিলা নিজের বাড়িতে কাজ করাবে বলে কলকাতা নিয়ে যায় তাকে। পঞ্চমী এখন সোনাগাছি, হাড়কাটা গলি থেকে হাতবদল হয়ে শোনা যায় মুম্বইতে। কেউ বলে দুবাইয়ে চালান হয়ে গেছে। ধনঞ্জয় মারধোর করলেও কমলার দেহে একাই প্রবেশ করে। আদর করে বুকে টেনে নিলে বহুব্যবহূত শরীরেও মাঝেমধ্যে শিহরণ জাগে। পঞ্চমীর মতো নিত্যনতুন জানোয়ারদের থুতু চাটতে হয় না।

নিজের চেয়েও বেশি ভয় মেয়ে বিউটির জন্য। হারামজাদি কেন যে জন্মাতে গেল? নাচনির ছেলেকেই স্কুলে ভর্তি নিতে চায় না, সেখানে এক দিদিমণির দয়ায় বিউটিকে যে ভর্তি নিয়েছে এই ঢের। শুধু মায়ের পরিচয়েও যে সন্তান শিক্ষার সুযোগ পেতে পারে, তা নিয়ে অনেক তর্ক করতে হয়েছে দিদিমণিকে। অবশ্য এর জন্য ধনা আর অতসীর পায়ে পড়তেও কসুর করেনি কমলা। বিউটিকে কিছুতেই নাচনি হতে দেবে না। এত করেও কি শেষ রক্ষা হবে? চতুর্থ শ্রেণি পাস করলেও কি উচ্চ বিদ্যালয়ে ঢোকার সুযোগ পাবে? টুসু ফেল করে তার ছোটো ভাই তপনের সাথে তৃতীয় শ্রেণিতে। বিউটি ক্লাস ফোর। স্কুল যাওয়ার সময় অচ্ছুত নাচনিকন্যা, মণিবের পুত্র-কন্যার ব্যাগ বইতে বইতে পিছু পিছু হাঁটে, কারণে অকারণে শাস্তি পায়। তবু টুসুর চেয়ে ভালো ফল করে বলে পরীক্ষার রেজাল্ট বেরোলেই অতসী ঝাঁটা হাতে কথা বলে। ওদিকে ওই দিদিমণি ছাড়া বেশিরভাগ মাস্টারদের হাতে তো বেত মজুতই থাকে। তবে পরীক্ষার খাতাতে সম্ভবত কারচুপি করে না।

একবার কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি ফিরে মায়ের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল মেয়েটা। ‘মা আমি আর হুস্কুলে যাব না। উয়ারা বলে তুর মা নাংটি বটে। নাচনি আর নাংটি কি একঅই কথা মা? পড়া না পাইরলে মাস্টার মারে, সাজা দেয়। বুইঝতে চাইলে বুঝায় লা। বলে তুঁ কী কইরবি পড়ালিখা শিখে?’ তারপরেও মেয়েটা কী করে পাস দিচ্ছে কে জানে?

‘এই মাগি, চার বেলা গিলে উনুনধারে বসে ঘুমাচ্ছিস? ভাগ্যে উনোনটো নিভে গেঁইছে, নইলে সব চাল লষ্ট হইত।’ অতসীর ধমকে ধড়মড় করে উঠে বসে কমলা। দুপুরের সূর্য গড়িয়ে পশ্চিমের চালের ওপাশে চলে গেছে। এখন ছায়া ছায়া বিকেল। কখন ঘুমিয়ে পড়েছিল খেয়াল নেই।

‘কুছু হবেক লাই। চালটো ঠিকঠাক সিজাইনছে। দালানে

তুলে রাখি?’

‘কুছু হবেক লাই– সব জেইনে বইসে আছে। যা আর মড়া আগুলতে হবেক লাই। রেইখে দে? আর শুন, আজ যদি টুসুর বাপ রেইতে তুর ঘরকে গেইছে তো সকালে তুর একদিন কি আমার একদিন। কদিন আগে লাইচতে গিয়ে খুব তো ফুর্তি মেইরে এলি। তারপরেও মাগির আশ মিটে লা।’

‘আমি কি তাকে ডাকি? উয়ার যখন ইচ্ছা আমাকে মারে, আর যখন ইচ্ছা ঘুম ভাঙায়। আমার আজ শরীল-গতিক ভাল লয়। তুমার সোয়ামিকে তুমি সামাল দাও।’

‘আমি কী কইরব তুর কাছে শিখব লাকি।’

চুপচাপ আধসেদ্ধ চাল ভরা প্রকাণ্ড মাটির মালসা দালানে তুলে ঢাকা দিয়ে রাখল। এই লাল চাল ভেজেই মুড়ি হবে। ভাজার আগে নুন সোডা দিয়ে ভেজা চাল মাটির মালসায় নাড়াচাড়া করে নিতে হয়। তারপর রোদে শুকোতে হয়। সেই চাল শুকোলে মাটির খোলায় বালি গরম করে ছেড়ে নারকেল কাঠি দিয়ে নাড়লেই চড়বড়িয়ে মুড়ি। বাড়ির জন্য মুড়িটা অতসী নিজে ভাজে। কিন্তু ব্যাবসার মুড়ি ভাজতে হয় কমলাকেই। যারা কিনবে তারা কি জানছে সেটা কে ভেজেছে– সতীলক্ষ্মী না ছেনাল? কমলার ভেতরটা ঢিপঢিপ করছে। কাল বাচ্চাগুলোর রেজাল্ট।

যা আশা আর আশঙ্কা ছিল, তাই ঘটল। বিউটি উতরে গেছে, তপন টেনেটুনে পাস, টুসু কেলাস থিরি ফেল। আর কথায় গায়ের জ্বালা মেটার নয়। বিউটিকে বেড়াল ঠেঙানো লাঠি দিয়ে পেটাল টুসুর মা। ‘বারো ভাতারির বিটি, আমাদের খাবি আমাদের পরবি, আর আমার ব্যাটাবিটিকে গুণতুক কইরে ফেল করাবি?

আজই তুকে দিয়ে দিব দাসু সর্দারের হাতে। মায়ের পারা রোজগার কইরবি।’

‘কার টাকা কে খায়?’ বলতে গিয়েও কথাটা গিলে ফেলল। অতসীর পায়ের কাছে মাটিতে পড়ে বলল, ‘বউদিদি গো, তুমার ফাইফরমাস খেইটে, তুমার ছিলামিয়ার বইপত্তর বয়ে মিয়াটো আমার পেরাইমারি পাস দিছে। উয়াকে ছাড়ান দাও না কেনে। তুমারই মরদের কইন্যা। তুমারও বিটির পারা। আজ মাইরছ, মেইরে লাও। কিন্তু উয়াকে আর পাঁকে নামাও না। আমি তো তুমাদের সংসার টাইনছি। যতদিন গতর চইলবে ততদিন জিউকে জামিন দিয়ে কইরব। আমি পাপী বটি। আমাকে শাস্তি দাও। আমার বিউটিকে টুকদু লিখাপড়া শিখতে দাও। উয়ার খরচ আমি যোগাব।’

‘কী? তুই আমাদের সংসার টাইনছিস? যা না, বিরা আমার বাড়ি থিক্যা। দেইখব কোন ভাতারে তুকে লেয়। আমার সোয়ামি আসরা না দিলে, নাচগান না শিখালে তুকে কে পুঁঁইছত।’

‘আমি ও কথা বলি নাই। আমি তুমাদের দাসী-বাঁদী হঁইয়ে থাইকব। আমার বিটিটোকে হাই হুস্কুলে অ্যাডমিট হইতে দাও।’

‘এ যে বইসতে পেইলে শুতি চায়। হাইস কুলে অ্যাডমিট? ধনঞ্জয় সর্দারের বিটি ফেল মাইরবে, আর নাচনির বিটি উয়াকে টপকায়েঁ বড়ো হুস্কুলে যাবে?’

অনেক কান্নাকাটি করে রসিকপত্নীর না হলেও, বাপ রসিকের অনুমতি ও প্রতিশ্রুতি আদায় করা গেছে। হাইস্কুল তিন কিলোমিটার দূরে উরমা হাট ছাড়িয়ে। মেয়েকে উচ্চতর শিক্ষালাভের সুযোগ দেওয়া হবে বলে কমলা উৎসাহে দ্বিগুণ খাটে, অতসীকে চারগুণ তোয়াজ করে। ধনঞ্জয় যে আদৌ রাজি হবে, তা দরবার করার সময় আশা করেনি। ধনাকে মুকুন্দ ঘোষের চেয়েও বড়ো বাড়ি করিয়ে দেবে কমলা।

রাস্তায় দেখা মঙ্গলার সাথে। সেও নাচনি– তবে বংশ পরম্পরায়। তার মায়ের গর্ভ নষ্ট করা হয়নি। তার দুই ভাইও আছে। তবে তাদের ভদ্র পথে রোজগারের সুযোগ নেই। রানিগঞ্জে গিয়ে কয়লার কারবার করে। কেমন কারবার সেটা স্পষ্ট নয়। মঙ্গলার মা পাঁচকড়ি তার মা গিরিবালার কাছ থেকে সামান্য কত্থকের তালিম পেয়েছিল। কারণ গিরিবালা রীতিমতো ধ্রূপদী শিখতে শুরু করেছিল ছোটোবেলায়। তার মা শৈলবালা ছিল রাজা কৃষ্ণ বর্মনের খাস নর্তকী। তিনি নাচলে রাজামশাই নিজে পাখোয়াজ বাজাতেন। রক্ষিতা হলেও রাজবাড়ির প্রাচুর্য ও আদবকায়দার মধ্যে থেকেছেন। বারবাড়ি আর অন্দরমহল আলাদা বলে স্ত্রী ও রক্ষিতার মধ্যে সংঘাত বাধার অবকাশ ঘটত খুব কম। রানিরা নর্তকীর সঙ্গে কথাই বলতেন না। মাঝে মাঝে নাচ দেখতেন শুধু। শৈলবালাকে বাড়ি বাড়ি দাসীগিরিও করতে হতো না। রাজার দেওয়া বালুচরির ঔজ্জ্বল্য ম্লান হয়ে গেলেও, এখনও মঙ্গলার কাছে সযত্নে রাখা আছে।

‘যাস কুথা? বিটি শুনছি পেরাইমারি পাস দিলেক।’

‘ঘরামির সাথে ঘর ছাওয়ার কাজে। রবীন গোপের গোয়ালের কাজ। আর আমার মেইয়ে ফোর পাস দিছে না, টুসুর মায়ের কী জ্বলন কী জ্বলন! টুসু ফেল মেইরেছে লয়? তবে উয়ার বাপকে হাতেপায়ে ধইরে বড়ো হুস্কুলে ভর্তি করাইতে রাজি করাইনছি। উ বইলেছে বিউটিকে নিজে ভর্তি করাইবেক।’

‘করাইবেক মানে? অখনও অ্যাডমিট হয় লাই? কেলাস ফাইভের নতুন কেলাস তো কবে শুরু হঁইন গেছে।’

‘যাঃ! ধনা সর্দার যে বইললেক অখনও মাসখানেক দেরি আছে অ্যাডমিটে?’

‘তবে তাখেই শুধাগে যা। আমি বসন্ত মল্লিকের লেগে ওই হুস্কুলের পাঁচিলে ঘুঁটে দিয়ে আসি হপ্তায় তিন দিন। যা দেখছি নিজের চোখে, তাই বইলাম। বিশ্বাস না যায় শুধা কেনে দিদিমণিদের।’

কমলার মাথা ঝিমঝিম করতে লাগল। ক্ষীণভাবে নিজের বিশ্বাসে অটল থাকতে তর্ক করল।

‘ধনা তুকে মিছা বইলছে। পেরাইমারিতে ভর্তির সময় লিজের নাম দিঁইছিল উ, যে হাইস্-কুলের বেলা দিবেক? তুর নামে বিউটি হুস্কুলে দাখিল হয় লাই? ইবারও ধনার ভরসা না কইরে লিজে গেলি লাই কেনে?’

রবীন গোপের বাড়ি না গিয়ে সোজা নিজের বাড়ি ফিরে এল কমলা। ধনঞ্জয় তখন সদ্য ঘুম থেকে উঠে তেল-মুড়ি আর চা দিয়ে জলখাবার খাচ্ছিল। কমলা ঝাঁপিয়ে পড়ল। ‘বিউটিকে কবে অ্যাডমিট করাবে?’

‘মানে? তার তো দেরি আছে। বইলেছি তো উটো ইবার আমার ভাবনা। তুঁই ইটো জানতে কাজ ফেইলে ঘরকে আলি?’

‘কেলাস ফাইভের কেলাস পেরায় এক মাস আগে থাইকতে শুরু হঁইন গেছে। উয়াদের ভর্তি লিবার সময় শেষ। গরিবের বিটি বইলে একটা জলপানির ব্যবস্থা হঁইনছিল। সিটো আর পাবেক লাই বিউটি। লিজের বিটির সাথে ইমন বেইমানি কইরতে পাইরলে?’

‘কে বইলেক ইসব? যা কইরেছি বেশ কইরেছি। জলপানির টাকায় সব হইত? খরচ যুগাবেক কে?’

‘রোজগার তো আমি করি। নিজের মিয়ার জইন্যে এইটুকুন করার অধিকার লাই আমার? আমি বলে ডবল খাইটছি, আর তুমি…’

‘রোজগার, অধিকার? এত স্পর্ধা!’ চা শুদ্ধু এঁটো গ্লাস ছুড়ে দিল কমলার দিকে। ‘আবার উত্তম-মধ্যম খাওয়ার শখ হয়েছে মাগির। নাহলে যে থালে খায়, সেই থালে ছ্যাঁদা করে?’

ধনার বউ কুটনো কাটতে কাটতে তারিয়ে তারিয়ে মজা দেখতে লাগল। ‘মর কসবি’। না, না, মরে গেলে সংসারের আয় কমবে, অতসীর কাজ বাড়বে। স্বামীর হাতে মার সেও যে খায়নি তা নয়। গায়ের জ্বালা একটু জুড়োলে বরের হাত চেপে ধরে বলল, ‘ওগো, ইবার ছাড়ান দাও। আমি কথা দিছি, আর হুস্কুলের নাম কইরবে না। কমলিকে ছাড়ো। বিউটিকেও নাচ-গানের তালিম দাও।’

অত মার খেয়েও ঝাঁঝিয়ে উঠল কমলা। ‘উয়ার পড়ার খরচ তো আমি বাড়তি খেইটে যুগায়েনছি, যুগাবও। তুমাদের গায়ে লাগে কেনে?’

‘এই হারামজাদি। আমি তুকে বাঁচাতে চাইছি, তুঁই আমার উপর কথা বলিস? টুসুর বাপ তোকে মেইরে ফেইললে বিটিটোর কী হবে ভেইবে দেখছিস?’

‘উটো তুমরা ভেইবে রেইখেছ? নাচনি কইরবে। দাসুর হাতে তুলে দিবে।’

যাকে নিয়ে এত অশান্তি সে দাওয়া ঝাঁট দেওয়া বন্ধ রেখে অঝোরে কাঁদছিল। ধনা থামলে মাকে জল দিয়ে পরিষ্কার করল। দশ বছরের বালিকা মাকে ঘর পর্যন্ত নিয়ে যেতে জোর পায় না। অবাক হয়ে দেখল, অতসীমামি মাকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে মুখে জল দিচ্ছে। বিউটিকে বলল, ‘আজ রেতে মায়ের পাশে শুস। সেবা করিস।’

রাতে মায়ের পাশে? বিউটির চোখে জল এল অভাবনীয় সৌভাগ্যে। এ তো স্কুলে যাওয়ার চেয়েও বেশি আনন্দের। নাহলে দালানে শুয়ে মশার কামড় খেতে খেতে সারারাত শুনতে হয় মায়ের চাপা কাতোরক্তি আর ‘বাপের’ চাপা গর্জন। মাকে দিয়ে কী করায়, আর মাকে কী করে ওই বয়সেও আবছা আন্দাজ করতে পারে, আর অসহায় আক্রোশে কাঁদে।

দিনদুয়েক উঠতে পারল না কমলা। গায়ে জ্বর। পাকা পায়খানায় বসার অনুমতি পেল মা-মেয়ে। ধনা অতসী নিজেদের মধ্যে গুজগুজ করে, ওদের কিছু বলে না। তৃতীয় দিন সকালে কমলা উঠোন ঝাঁটাতে এলে ধনা নরম গলায় বলল, ‘আজ শরীল ঠিক আছে?’ এর দু-রকম মানে হয়।

‘টুকদু। পুরা লয়।’

‘পরাণ গরাইয়ের নাম শুনছিস? উ সরকারি জলসায় ঝুুমুর দিবেক। তুঁই যাবি উয়ার সাথে? যা না। দুদিন মনটো ভালো থাইকবেক।’

‘পরানের সাথে। তালে বিউটিকেও লিয়ে যেইতে মন কইরছে। উ যাবেক আমার সাথে?’

‘বিউটি গিয়্যা কী কইরবেক? তুঁই তো উয়াকে নাচনি কইরতে চাস না।’

‘উ তো সবার কাছে শুনে উয়ার মা নাংটি বটে, একবার শিল্পী মাকে দেখুক কেনে।’

‘উয়াকে আমি উরমা বালিকা বিদ্যালয়ে দাখিল করাব। তুঁই

যা চাস।’

সত্যি বলছে ধনা? হবেও বা। বাপ তো যতই হোক। চোখের জল সামলে ধরা গলায় বলল, ‘তুমি সাথে যেইতে লাইরবে?’

‘আমার অনেক কাজ। বিউটির লেগেও তো থাইকতে হবেক।’

আজ কার মুখ দেখে উঠেছে কমলা? ওই হতভাগি মেয়েটারই তো! তবু মনটা কেন কু গায়?

দোনোমোনো করে পরাণের দলে ভিড়েই গেল কমলা। দুদিন বই তো নয়।

ভালোই কাটল দুটো দিন। সরকারি অনুষ্ঠান কিনা বোঝা গেল না। ফেরার সময় পরাণ ওকে অন্য গাঁয়ে নামাল। তার বাড়িতে নিয়ে যেতে চায়। পরাণের আন্তরিক ডাকে সাড়া দিতে হলেও, মেয়েটার কী হল জানতে এক্ষুনি নিজের বাড়ি ফিরতে ইচ্ছা করছে। সে উশখুশ করতে থাকে। ‘পরাণদাদা তুমার বাড়ি তো দেইখলম। ইবার আমাকে জুরিডি পোঁহুছানোর ব্যবস্থা কর।’

‘এবার থেইকে ইটোই তুর আস্তানা। ধনার কাছে নগদ সাত হাজার টাকা দিয়্যা কিনছি তুকে।’

‘তার মানে? উ আমাকে বেইচে দিঁইছে? আর আমার মিয়া বিউটি?’

পরাণ কুৎসিৎ মুখভঙ্গি করে হাসল। ‘তুর বিটিকে লিয়ে ধনা রসিক রেইতে ঘরে দোর দিছে, দেইখতে পাইরবি?’

কষ্ট নীড়

ফ্ল্যাটের কোনও নাম রাখা যায় না? যেমন বাড়ির নাম হয়, কী সুন্দর সুন্দর সব নাম– ছায়াপথ, সুরলোক, সুখনীড়, মানসী– শান্তিনিকেতনে দেখেছি…। ফ্ল্যাটে ঢুকবার সময় দরজার গায়ে একটা নম্বর দেখে সবাই ৭সি-৩৬, কেন? একটা নাম রাখলে কী হয়? মহাভারত অশুদ্ধ হয়?– দুলাল বলল।

রাই বলল– কী নাম রাখতে চাও?

দুলাল সেটা ভাবেনি যদিও। মনে এল, তাই বলে ফেলল। রাইয়ের সঙ্গে গল্প করছিল কিনা, ব্যালকনিতে। পাশাপাশি বসে। সাততলা থেকে অনেকটা আকাশ দেখা যায়। কাশিপুর গান-শেল কারখানার চিমনিও দেখা যায়। আবার রাস্তার গাড়িগুলোকে খেলনা গাড়ির মতো লাগে। ওসব দেখছিল আর গল্প করছিল। সকালে আলুর পরোটাটা বেশ ভালো হয়েছিল দিয়ে শুরু। রাই বলল, পরোটা নয়, পরাঠা। নর্থ ইন্ডিয়ানরা এটাকে পরাঠাই বলে। দুলাল বলে, ধুর, পরাঠা কেন? ছোটোবেলা থেকে পরোটাই তো শুনে এসেছি। অফিস ক্যানটিনেও তো পরোটাই বলে।

বলুকগে। ভুল বলে। তর্ক কোরো না। বড়ো হোটেলে পরাঠাই বলে।

 

দুলাল চুপ করে।

ওর নাম কিন্তু দুলাল নয়। ওর নাম কংসারি। কংসারি মন্ডল। রাই ওকে দুলাল ডাকে। কংসারি ডাকা যায় নাকি?

বলো, একটা নাম বলো, সাজেস্ট করো তুমি, ফ্ল্যাটের কেউ নাম দেয় না তো কি হয়েছে, আমরা দিতেই পারি, খুব সুন্দর করে, কাঠে এনগ্রেভ করে একটা নাম দরজার গায়ে লাগিয়ে রাখব।

দুলাল নাম খুঁজে পায় না। মাথা চুলকে বলে কষ্ট নীড় রাখলে কেমন হয়, কত কষ্ট করে ফ্ল্যাটটা করলাম, ইএমআই দিতে দিতে টাট্টি জ্যাম হয়ে যাচ্ছে।

টাট্টি জ্যাম ধরনের শব্দ আগে খুব একটা বলত না, ইদানীং স্মার্ট হবার জন্য এসব শব্দ বলছে। বলে লাভ হয়। এই তো রাই খুশি হয়ে ওর থুতনিটা নাড়িয়ে দিল।

আজ রোববার। আলুর পরোটা বা পরাঠা দিয়ে ব্রেকফাস্ট সারা হল। তারপর হাতে খবরের কাগজ নিয়ে ব্যালকনিতে। রান্নাঘর থেকে টুংটাং ঠকঠক শব্দ। এগুলো গৃহস্থালির শব্দ। এই শব্দ সংসারের শব্দ। এই শব্দ খুব ভালো লাগে দুলালের।

বাসন মেজে, ঘর মুছে তরকারি কাটবে দীপা। একটা তরকারিও করে দেবে। রোববারের রান্নাটা রাই নিজে হাতে করে। আজ ছোটো চিংড়ি দিয়ে ওলের ডালনা, আর পাঁঠার মাংস।

কংসারি, তথা দুলারের এই শহরজীবন বেশি দিনের নয়। ও থাকত বাতকুল্লা নামে একটা জায়গায়। ছোটোবেলায় বাবা মারা গেছে। মা আর ছেলে। খুব টাকাপয়সার টানাটানি ছিল ছোটোবেলায়। ওর বাবার ছিল একটা মুদি দোকান। বাবা গত হলে ওর মা বসতেন। মা কি আর দোকান চালাতে পারে? মাল আনাই তো বড়ো সমস্যা। কখনও কৃষ্ণনগর, কখনও চাকদহ থেকে মাল আনতে হতো। কংসারির মায়ের ছিল এক ফুল পাতানো সই। সেই সই বাজার থেকে ব্যাগে করে মশলাপাতি, বিস্কুট, চায়ের প্যাকেট এনে দিত। মাঝেমধ্যে কংসারিকেও দোকানে বসতে হতো। মুসুর ডালের কিলো বাইশ টাকা হলে দেড়শো গ্রাম কত, দু’টাকায় কতটা কালোজিরে দেয়া যাবে, তেরো টাকার প্যাকেটে তিরিশটা বিস্কুট থাকলে খুচরো একটা বিস্কুট কত করে বেচলে প্যাকেটে টাকা লাভঞ্জথাকে– এসব জটিল অঙ্ক মুখে মুখে করতে হতো বলেই পাটিগণিতে ভালো হয়ে গিয়েছিল। মাধ্যমিক ফাস্ট ডিভিশন। সায়েন্স পড়লে নাকি খরচ বেশি, তাছাড়া মাস্টার রাখতে হয়, তাই কমার্স। বিকম পাশ করেই চাকরির জন্য নানা রকম পরীক্ষায় বসা। দু’বছরের মাথায় প্রথম চাকরিটা হয়ে গেল স্টেট ইলেকট্রিসিটি বোর্ড-এ। রানাঘাট এ পোস্টিং। পরের বছরই ব্যাংকের প্রবেশনারি অফিসার। কলকাতার একটি ব্র্যাঞ্চে পোস্টিং।

সেই প্রথম কলকাতায় থাকা। আগে কলকাতা এসেছে পরীক্ষা দিতে কিংবা বইপত্র কিনতে, দু’একবার বড়োবাজারে দোকানের মাল কিনতে। কলকাতার সঙ্গে সম্পর্ক বলতে এটুকুই ছিল। ও সাউথ সিটি চিনত না, নিক্বো পার্ক জানত না, পিৎজা চোখে দেখেনি আগে, পার্ক স্ট্রিটের কোনও বার-এ ঢোকা দূরে থাক, ওই রাস্তাটা দিয়েও আগে হাঁটেনি কখনও। সেই পার্ক স্ট্রিট ব্র্যাঞ্চ-এ পোস্টিং হল।

একটা মেস-এ থাকত দমদমের কাছে। দু’বেলা পেট ভরে খাওয়া আর একটা ছোট্ট ঘরে নিজের একটা তক্তাপোশে– সেই তো অনেক। অফিস কলিগরা বলল, তুমি একটা বুদ্ধু। এভাবে থাকে কোনও ব্যাংক অফিসার? ব্যাংক তোমায় বাড়িভাড়া দেবে। একটা ফ্ল্যাট ভাড়া করে নাও।

একটা পুরো ফ্ল্যাট? ওরেব্বাবা। পুরোটা নিজের? ভাবাই যায় না।

চাকরি পাওয়ার পর টাকা যা পেত, সে তো অনেক। দোকানটা ঠিকঠাক করল। শো কেস, সুন্দর তাক, মা খুব খুশি। কংসারি ভাবল ফ্ল্যাট নিলে মাকে নিয়ে আসবে, আর দোকানটার দায়িত্ব দিয়ে দেবে ওর ছেলেবেলার বন্ধু হারুকে। সে আবার ওর মায়ের ফুল পাতানো সখীর ছেলেও। হারু বেকার। পড়াশোনাতে ও ভালো ছিল না তেমন। হায়ার সেকেন্ডারি দুবারে পাশ। কলেজে ভর্তি হয়নি। একটা লন্ড্রিতে জামাকাপড় ইস্তিরি করত।

ওর দাদা ছিল দুটো, বউদিরা গঞ্জনা দিত, দামড়া ছেলে ভাত গিলছে বসে বসে– এইসব বলত। হারুর মা, মায়ের সই, ফুলমাসি

কংসারিকে বলেছিল, ছেলেটাকে কিছু জুটিয়ে দাও বাবা।

ফুলমাসির জন্যই দোকানটা চালাতে পেরেছিল মা। আর, দোকানের সামান্য আয়েই তো কংসারির পড়াশোনা, এই চাকরি।

ফুলমাসির তিন ছেলে। হারু ছোটো। বড়ো দু’জন যে খুব ভালো রোজগারপাতি করত এমন নয়। হারু তো কিছু করত না। ফুলমাসি সন্ধের দিকে দোকানে বসত, হারুও বসত মাঝে মাঝে। কংসারির মা ওদের কিছু ধরে দিত। সুতরাং মাকে কলকাতায় নিয়ে এলে দোকানটা চালানোর দায়িত্ব হারুকেই দেয়া যায়। বিক্রি করতে চাইলে হারু কিনতে পারবে না, তা ছাড়া হারুর সঙ্গে কংসারির যা সম্পর্ক, তাতে দোকানের দরদাম নিয়ে দরাদরি চলে না। হারুর টাকাপয়সা হলে না হয় কিছু দিয়ে দেবে।

হারু ওর গুরু। অনেক কিছুর গুরু। ডাংগুলি গুরু, মাছধরা গুরু, অসভ্য খেলারও গুরু। কৈশোরের গুপ্ত পাঠক্রম হারুই দিয়েছিল। প্রথম বিড়ির টান, কাশি, ও কিছু নয়– পরে সব ঠিক হয়ে যাবে, হারুই তো বলেছিল।

মাকে ফ্ল্যাটে নিয়ে এল কংসারি। মা তো গ্যাসের উনুন দেখে হেসেই বাঁচে না। ওমা! আঁচ দিতে হয় না? হিহিহি। ওমা, ধুয়াঁ নাই? কীরে! হিহিহি। কিন্তু ছাই হয় না বলে দুঃখ, বাসন মাজা হবে কী করে? ফ্রিজ আগে দেখেছে, কিন্তু ব্যবহার করেনি কখনও। কী আজব আলমারি। সব ঠান্ডা করে রাখে। ঠান্ডা করার দরকার কী? সব তো গরম করতেই হয় আবার। ঠান্ডা তরকারি কি খাওয়া যায় না কি?

কংসারি বলে– একদিন রান্না করে তিনদিন খাওয়া যাবে মা, খাটুনি কমবে। উনি বলেন– সে কী রে? বাসি খাবি কেন? এই আলমারিটা ভালো না। রোজ রোজ টাটকা রান্না করে দেব। নীচেই তো বাজার বসে, তোর সময় না হলে আমিই বাজার করে আনব। আমার আর কাজ কী! ঠান্ডা করার আলমারিটা ফিরত দিয়ে আয়। কংসারি বলে– না মা, ভালো চাকরি করলে ঠান্ডাই খেতে হয়, ফ্রিজ রাখতে হয় ঘরে, বন্ধুরা আসবে, ফ্রিজ না হলে খারাপ ভাববে, গাঁইয়া ভাববে মা, ঠান্ডা জলে শরবত করে দিও।

কংসারির মা বলত– কত রকম খাবার খাওয়াস তুই, রোজ দুধ খাই, সন্দেশ, ইচ্ছামতো শাকসবজি। কিন্তু এখানে দমবন্ধ লাগে। খুপরি বাড়ি। উঠান নাই। একটা নিমগাছ নাই। নিমবেগুন করব বলে নিমপাতাও কিনতে হয়। সরুসরু চারগাছি দুটাকা। তুলসিগাছও নেই। তুই বিয়ে কর, শহরের মেয়ে যে সব জানে, ওকে তোর কাছে রেখে আবার দেশের ঘরে ফিরে যাই।

সেটা আর হল না। ওর মা আগুনে পুড়ে মারা গেল। সভ্যতার আগুনে। মানে গ্যাসের আগুনে।

গ্যাস কি করে খুলতে হয়, বন্ধ করতে হয় ভালো করেই তো শিখিয়ে দিয়েছিল কংসারি। তবু কিছু ভুল করেছিল ওর মা। অফিসে ফোন পেল– শিগগির চলে আসুন, আপনার ঘরে আগুন লেগেছে।

ততক্ষণে ঘরের দরজা ভাঙ্গা হয়ে গেছে। রান্নাঘরের দেয়ালের তেলরঙে কালচে ছোপ, কাঠের ক্যাবিনেট থেকে হালকা ধোঁয়া বেরুচ্ছে। মাকে ওরাই হাসপাতালে পৌঁছে দিয়েছে।

করেছেন কি মশাই, গ্রাম থেকে যাকে এনেছেন, সে যদি গ্যাসের ইউজ না জানে তো গ্যাস ওভেন হ্যান্ডেল করাচ্ছেন কেন? সারা বাড়িতে আগুন ধরে যেত, সবাই পুড়ে মরতাম, ভাগ্যিস সিলিন্ডারে বেশি গ্যাস ছিল না, যা ছিল বেরিয়ে গেছে, নইলে সিলিন্ডার বার্স্ট করত।

মা তখনও জীবিত ছিল, জ্ঞানও ছিল, চোখের তারা নড়েছিল, ঠোঁট কেঁপে উঠেছিল, মুখের চামড়া ঝলসানো। পরদিন মারা গেল। বাড়িওলা ক্ষতিপূরণ চাইল। দিতে হ’ল। আবার নতুন করে রং করানো হল। বাড়িওলা বলল ছেড়ে দিন। আবার মেসজীবন। সেটাই ভালো। মেস থেকে হেঁটে দমদম মেট্রোরেল, পার্ক স্ট্রিট। অফিস, অফিসে যত বেশি সময় থাকা যায় থাকত, তারপর ফের মেসের গহ্বর। একটা কষ্ট কেবল ঘুনপোকার মতো ওকে কুরে খাচ্ছিল– ওর মায়ের মৃত্যুর জন্য ও দায়ী। সভ্যতা দিতে গিয়েছিল, আধুনিকতা দিতে চেয়েছিল মাকে। বাতকুল্লার নিম-তুলসী-উঠোন থেকে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে এসে গ্যাস চেম্বারে মেরে ফেলল নিজের মাকে।

একদিন পার্ক স্ট্রিট স্টেশন ছেড়ে পরের স্টেশনের দিকে ছুটল ট্রেনটা। কংসারি দাঁড়িয়ে, ওসব ভাবছে। সিটে বসা একটি মেয়ে ওকে বলল– এক্সকিউজ মি, পার্ক স্ট্রিট নামলেন না? ওর হুঁশ হল। বলল– থ্যাংকিউ। ভুল হয়ে গিয়েছিল। মেয়েটা বলল– রোজই তো নামেন, আপনি আনমাইন্ডফুল, বুঝতে পারছিলাম।

এই মেয়েটাই রাই। ট্রেনে দমদম থেকে পিছনের দিকেই ওঠে।

কংসারিও তাই। কংসারি খেয়াল করেনি আগে। এরপর থেকে মাঝে মাঝে দেখা হওয়া, গুডমর্নিং বলা, সিইউ বলা…। সিট পেলে মেয়েটা ব্যাগটা চেয়ে নিত, কংসারি সিট পেলে নিজে না বসে ওকেই বসতে দিত। মেয়েটা ওয়েব ডিজাইন করে। ওর অফিস এলগিন রোডে। নেতাজি ভবন স্টেশনে নামে। একদিন ফেরার সময় দেখা, ট্রেনেই। মেট্রোরেল গিরীশ পার্কে থেমে গেল, সামনের কোথাও আত্মহত্যার ঘটনা। মেয়েটা বলল– চলুন, ট্যাক্সি পাই কিনা দেখি। শীতকাল। ওরা হাঁটছিল, হাঁটতে হাঁটতে কথা। এভাবেই ক্রমশ।

মেয়েটা বলেছিল– আপনাকে কংসারি ডাকতে পারব না আমি। খুব বাজে নাম। আপনার কোনও ডাকনাম নেই?

কংসারি বলেছিল– ডাকনামটা তো আরও ইয়ে। ভুতো।

– ইশ্, ভুতো, ভুতো কেন?

– তা জানি না। পাড়ায় তো এটাই আমার নাম।

– ভুতো ডাকা যায় নাকি? কংসারি নামটাকে যে ছোটো করে ডাকব, তারও উপায় নেই। কংসারি ছোটো করলে কংস হয়। হুঃ, কী বাজে। এরকম নাম কে রেখেছিল?

– আসলে এটা শ্রীকৃষ্ণের একটা নাম। কংস বধ করেছিলেন কিনা, কংসের অরি।

তা কেষ্টঠাকুরের তো আরও নাম ছিল, সে সব রাখলেই তো হতো। বলুন তো কেষ্টঠাকুরের আর কী কী নাম আছে?

শ্রীকৃষ্ণের শতনাম তো মুখস্থই ছিল, মা রোজ সকালবেলা একবার বলতেন কিনা… যশোদা রাখিল নাম যদু বাছাধনযশ্রীনন্দ রাখিল নাম নন্দের নন্দন। ননীচোরা নাম রাখে যতেক গোপিনি কালসোনা নাম রাখে রাধা বিনোদিনী। দেবকী রাখিল নাম আদরে গোপালযচন্দ্রাবলী রাখে নাম নন্দের দুলাল…

– হ্যাঁ, নন্দের দুলাল নামটা মন্দ নয়, তবে নন্দটা বাদ। দুলাল বেশ মিষ্টি নাম। আমি দুলাল বলেই ডাকব।

কংসারি ঘাড় নেড়েছিল।

সেই থেকে রাই, দুলাল বলেই ডাকে।

– দুলাল বলেছিল– রাই মানে জানো তো?

রাই মানে সখী, গার্লফ্রেন্ড…।

– গার্লফ্রেন্ড ঠিক কথা, তবে কৃষ্ণের গার্লফ্রেন্ড। রাই হল রাধিকা। কীর্তনে আছে না– ললিতা বলছে, শুন বলি রাই, ডাকিছে কানাই…।

রাই বলে– তাই বুঝি? রাই মানে রাধিকা? আই মিন রাধা? আর তুমি কংসারি মিন্স কৃষ্ণ? তা হলে তো উই আর মেড ফর ইচ আদার।

রাইরা শহুরে। ওর বাবা মাঝারি মাপের সরকারি আমলা। বোঝাই যাচ্ছে বেশ স্মার্ট, আধুনিক। রাই প্রচুর স্মার্ট ছেলে দেখেছে জীবনে, হামবড়াই, চতুর, মিথ্যুক এবং শরীর লোভী দেখে ফেলেছে ওর ছাব্বিশ বছরের জীবনে। দুলালের সরলতা, আনস্মার্টনেস এবং যা অনেকের কাছে বোকামি মনে হবে– সেটাই ভালো লেগেছিল রাইয়ের। যে দিন ফ্লুরিস্ এ গিয়ে কোল্ড কফি অর্ডার দিয়েছিল রাই, দুলাল বলেছিল– কফি কেউ ঠান্ডা খায় নাকি? রাই বলেছিল– তোমার ভুতো নামটাই ভালো ছিল।

বিয়ে হল। রাইয়ের বাবার অমত ছিল না। অভিভাবকহীন সাধাসিধে অথচ সুচাকুরে জামাইকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখা যাবে এটাই সবচেয়ে বড়ো প্লাস পয়েন্ট। এবং তাই হল। দুলাল রাইয়ের বাধ্য হল, যা নাকি রাইয়ের ভাষায় লক্ষ্মী ছেলে, আদরে সেটা ‘নো-ও-ক্ষ্মি’ হয়ে যায়।

যে ফ্ল্যাটটা ভাড়া করেছিল দুলাল, সেটা পছন্দ নয়। ব্যাংক অফিসার যখন, লোন নিয়ে নিজে কিনবে না কেন? লোন নিল। কাছাকাছির মধ্যেই একটা রেডি ফ্ল্যাট। থ্রিবিএইচকে। মানে তিনটে বেডরুম। ওয়ান ব্যালকনি, টু টয়লেট, প্লাস লিভিং-ডাইনিং। বারোশো আশি স্কোয়ার ফিট, উইথ লিফ্ট।

গত এক বছরের বিবাহিত জীবনে ভুতো দুলালকে অনেকটাই সভ্য করে নিতে পেরেছে বলে রাইয়ের ধারণা। অফিস যাবার সময় ডিও স্প্রে করে দুলাল, চুলে কন্ডিশনার দিতে শিখেছে, লিফ্টে কারুর সঙ্গে দেখা হলে হ্যালো গুডমর্নিং ইত্যাদি বলতে শিখেছে, এমনকী রাইয়ের কোনও বান্ধবী বাড়িতে এলে বলতে শিখেছে– আপনাকে দেখে তো ফিদা হয়ে যাচ্ছি। এমনকী যে চিজ-এর গন্ধটা সহ্য করতে পারত না, এখন চিজ স্যান্ডউইচ খাচ্ছে। কিন্তু ছাড়তে পারছে না হারুকে। একটা ইরিটেটিং, ডিসগাসটিং লোক।

হারুর কথা ভাবতে ভাবতেই হারু এসে হাজির। কলিংবেল বাজার কায়দাই বুঝিয়ে দেয় ও হারু। পরপর তিনবার। একটু গ্যাপ দিয়ে আবার একবার। ভদ্রলোকরা একবারই বাজায়। বড়োজোর দুবার।

রাই ব্যালকনিতেই। চেয়ার ছেড়ে উঠল না। দুলাল ছিটকিনি খুলে দিল। হারুর হাতে একটা ব্যাগ। যখনই আসে ব্যাগ থাকে। কিছু না কিছু নিয়ে আসে। কুমড়ো, কিংবা লাউ, কিংবা এঁচোড়– কিছু না হলে পুঁইশাক। হারু বলল– দুটো নারকোল আছে, আমাদের গাছের, আর ক’টা পেঁপে আছে, তোদের উঠোনের গাছের।

রাই ভ্রু কুঁচকে তাকায়। এক্ষুনি ওকে জলখাবার দিতে হবে। আলুপরাঠার দুটো পুর ভরা গোলা রাখা ছিল কাল টিফিন নিয়ে যাওয়ার জন্য, ওগুলো এখন দীপাকে দিয়ে লেচি করিয়ে নিতে হবে।

সাধারণত সকালের দিকে আসে না এই হারুবাবু। রবিবার সন্ধের দিকে আসে। রাত্তিরে থেকে যায়, সোমবার সকালে বৈঠকখানায় মালপত্র কিনে বাড়ি ফেরে। বাতকুল্লা এমন কিছু দূরে নয়, সকালে বেরিয়ে বাজার সেরে বিকেলের মধ্যেই ফিরে যাওয়া যায়। কিন্তু ও মাঝেমাঝেই রোববার সন্ধের সময় হাজির হয়ে যায়। প্রশ্রয় আছে।

দুলালই ওকে আসতে বলে। যদি ওরা বাড়ি না থাকে, ব্যাগটা কেয়ারটেকারের জিম্মায় রেখে ঘুরে বেড়ায়, রাত্রে চলে আসে। দুলাল জানে রাই ওকে পছন্দ করে না, দুলাল বলে– সংসারের সবই তো তোমার কথা মতোই চলে, শুধু এই একটা ব্যাপার তুমি মেনে নাও। ওর উপর আমার দুর্বলতা আছে, বাবা মারা যাবার পর হারুর মা যদি  আমাদের হেল্প না করত, আমার লেখাপড়াই হতো না। তা ছাড়া হারু যত অনেস্ট। দোকানটা থেকে যা লাভ হয়, তার কিছুটা আমাকে দিয়ে যায়, জোর করে। ও আমার একমাত্র বন্ধু। অফিসে যারা আছে, ওরা তো কলিগ।

– আমি বুঝি বন্ধু না? রাই বলে,

দুলাল বলে– সরি সরি, তুমি সব চেয়ে বড়ো বন্ধু। বন্ধু, গার্জিয়ান, এভরিথিং। তোমার পরেই হারু।

চটিটা নোংরা। কখনও পালিশ দূরে থাক, ব্রাশও করে না। ওর জামা থেকে বাজে গন্ধ ছাড়ে। ভাগ্যিস থ্রি রুম ফ্ল্যাট, একটা ঘরে একটা সিংগল খাট পাতা থাকে, ছোটো আলনাও। ও চলে গেলে দীপাকে দিয়ে চাদরটা কাচিয়ে নেয়। বাইরের বাথরুমটা ইউজ করে ও। প্রথম যেবার এল, লোকটা নির্লজ্জের মতো গামছা পরে খালিগায়ে বাথরুম থেকে বেরিয়ে ব্যালকনিতে মেলে দেয়া গৌহাটি থেকে আনা রাইয়ের সাদা গামছাটায় বগল মুছে নিল। রাই ওই দৃশ্য দেখেই বলল– দাঁড়ান, দাঁড়ান, তোয়ালে দিচ্ছি– বলে আলমারি খুলে একটা সাদা তোয়ালে ছুড়ে দিল ওর দিকে। ও বলল– আর তোয়ালে কী হবে, এতেই তো হয়ে গেছে। ভুতো, তোর একটা লুঙ্গি দে পরি।

বিয়ের পর দুলাল হয়ে গিয়ে লুঙ্গি পরা বন্ধ হয়ে গেছে ভুতোর। একটা পা-জামা দিয়েছিল দুলাল।

সেই পা-জামাটায় কালো সুতো দিয়ে একটা মার্ক করে রেখেছে রাই। ও এলে ওই পা-জামাটাই বের করে দেয়, পরে দীপাকে দিয়ে কাচায়। ওর জন্য একটা আলাদা সাবানও রাখতে হয়েছে। ও চলে গেলে পলিথিনে জড়িয়ে এক জায়গায় রেখে দেয়, আবার এলে বাথরুমের সাবানটা বের করে ওটা ঢুকিয়ে দেয়। ওর এদিক নেই, ওদিক আছে। একদিন বলল– কী ব্যাপার বলতো ভুতো, তোদের সাবান দেখি ফুরোয় না… সেই একই সাদা লাক্স, কতদিন চলে?

দুলাল তো ভুতোই, কী বলতো কে জানে? রাই ম্যানেজ করেছিল। বলেছিল– সবার আলাদা সাবান ব্যবহার করতে হয়। ডাক্তাররা তাই বলে। আপনারটাও তোলা থাকে। এবাড়িতে ওরা মাস ছয়েক হ’ল এসেছে। এবাড়িতে আসার পর মাসে দুবার করে ওর আসাটা প্রায় বাঁধা হয়ে গিয়েছিল। ওরা দুজনে একই গল্প করে। সেই ডাংগুলি খেলা, ভূগোল স্যার, বেঁটে স্যার, কুঁজো পিসি, কেঁচো দিয়ে মাছ ধরা, খ্যাপলা জাল না কি একটা জালে কচ্ছপ উঠেছিল, সেই কচ্ছপের মাথায় সিঁদুরের দাগ… সব মুখস্থ হয়ে গেছে। ওরা গল্প করতে থাকলে টিভির সিরিয়াল চালিয়ে দেয় রাই, বলে– তোমরা একটু চুপ করো। শুনতে পাচ্ছি না। ওরা ওই ছোটো ঘরটায় চলে যায়। একবার বিকেলে ওদের সিনেমায় যাবার কথা, বেরোবে, সেই সময় হাজির। ওকে নিয়েই সিনেমায় যেতে হল। পিভিআর-এ। তারপর পপকর্ন। আশি টাকা করে প্যাকেট। এমন করে খাচ্ছিল যেন দু’টাকার ঠোঙার মুড়ি খাচ্ছে।

লাস্ট যেবার এল, ওরা দুজন একটু ঘুরে আসছি বলে বেরিয়ে গেল, ফিরল দশটার পর। বোঝাই যাচ্ছিল ওরা মদ খেয়েছে। মদ-টদ আগে তো খেত না, বিয়ের পরই একটু-আধটু, দু’জনে মিলে। কখনওই দুপেগের বেশি নয়। বেশিই খেয়েছিল সেদিন, বিশেষত ওই লোকটা। হারু। জুলজুল করে তাকাচ্ছিল, চোখটা লাল। বলছিল– বউদি, বউদি, তুমি আমার বন্ধুকে হরণ করেছ। রাত্রে খেল না। বলল বাইরে থেকে খেয়ে এসেছে। রাত্রে ওরা দুজনে একসঙ্গে শুল। সিঙ্গল খাটে। সেদিন থেকেই লোকটাকে অসহ্য লাগে। রাই জিজ্ঞাসা করেছিল দুলালকে– ওর সঙ্গে শুলে কেন? ও বলেছিল– যাতে তোমার কোনও অসুবিধে না হয়। মুখে একটু গন্ধ ছিল কিনা। খেয়ে ফেলেছিলাম।

– ও? ক’টা খেয়েছিলে?

– দুটোর পর একটুখানি, হাফ।

– ও ক’টা খেয়েছিল?

– তিনটের পর একটুখানি, হাফ। দুজনে মোট ছ’টা। ওর কি এসব অভ্যেস আছে নাকি? ভালো হুইস্কি খাবার পয়সা আছে নাকি ওর, যদি এক-আধবার খায় তো দেশিই খায়।

– দেশি? মানে বাংলা? বিচ্ছিরি লোক তো ও। ক্রিমিনালরা

বাংলা খায়। আঁৎকে উঠেছিল রাই। দুলাল বলেছিল– পয়সার অভাবে তো। ক্রিমিনাল হবে কেন? কত কবি সাহিত্যিক দেশি খেতেন জানো? পড়োনি অমৃতধারা ম্যাগাজিনটার লাস্ট ইস্যুতে?

হারুবাবু এসে সোফাতে বসেছে। বসেই চ্যাঁচাল– বউদি, চা খাব।

বউদি বলে কেন কে জানে? ও তো দুলালের চেয়ে বড়ো। দুতিন বছরের বড়ো। অবশ্য কীই বা ডাকবে? নাম ধরে ডাকলে তো আরও খারাপ হতো।

রাই ম্যাক্সিটার উপরে হাউসকোট চাপিয়ে নেয়। এসে না বসেই বলে– কী ব্যাপার, আজ যে সকালে?

হারু হাহা করে হাসে– আপনার হাতের কচিপাঁঠার ঝোল খাব। রবিবার দুপুরে পাঁঠার মাংস হয়, রাতের বেলায় আর থাকে না।

–ও। রাই তির্যক তাকিয়ে বলেছিল। হারু এবার বলল– আর একটা কারণও আছে। আজ একটা মিটিং আছে না, ধর্মতলায়, দুপুরের পর থেকে ট্রেনে ওঠা যাবে না। ওরা সব ফ্ল্যাগ, লাঠিসোঁটা নিয়ে ওঠে। ওরা খুব দজ্জালি করে। তাই ভাবলাম সকালেই আসি।

– ও।

খুব নির্লিপ্তভঙ্গিতে বলল রাই।

দুলাল বলল– বেশ করেছিস, বেশ করেছিস।

– চা খা। দুজনে বাজার যাব।

রাই বলল– দীপা, পরোটা বেলে দে।

বিকেলে দুজনে মিলে রাইয়ের এক কলিগের বাড়িতে যাওয়ার কথা। রাইয়ের কোম্পানিটা ভালো চলছে না। কাজটাজ বেশিরভাগই মুম্বই-ব্যাঙ্গালোর-গুরগাঁও থেকে হচ্ছে। গত দু’ বছর কোনও ইনক্রিমেন্ট হয়নি। শোনা যাচ্ছে লোক কমাবে। মানে ছাঁটাই। নিজেরা একটা বিজনেস করার কথা ভেবেছে। এখন বুটিকের ব্যবসায় লাভ ভালো। বিভিন্ন জায়গা থেকে কিনে আনলেই হল। সাজানোটাই আসল, আর লোকেশন। ঠিক জায়গায় বুটিক খোলা। খরচ প্রচুর।

ব্যাংক লোন নিয়ে কথা বলার ছিল। ওকে তো ওখানে নিয়ে যাওয়া যায় না। থাকুক, বাড়িতেই। রাই, হারুর সঙ্গে বিশেষ কথাবার্তা বলল না। ওয়াশিং মেশিনটা বের করে রাজ্যের জামাকাপড় চাদর কাচতে লাগল। একবার স্বগতোক্তি করল– রোদ উঠেছে বেশ। মাড় দিল। ব্যালকনিতে মেলে দিল। হারু আর ভুতো গল্পগাছা করছিল, সেই এক গল্প। মাঝেসাজে একবার বলল– সাইড বিজনেস শুরু করেছি। জমির দালালি। এবং এটা যে মিথ্যে নয়– বোঝা গেল, মাঝে মাঝে ওর মোবাইলে ফোন আসছিল, হ্যাঁ-হ্যাঁ-ডাঙ্গা জমি, জল জমে না, হ্যাঁ, হ্যাঁ, ভ্যান রিকশা ঢুকে যাবে– এইসব কথাবার্তা শোনা যাচ্ছিল। কাচাকুচির পর মাংস রান্না। বেলা হয়ে গেল।

বিচ্ছিরি করে খায় লোকটা। কড়মড় করে হাড় চিবিয়ে টেবিলে রাখে। হাতের আঙুলগুলো বিচ্ছিরি ভাবে চাটে। রাই ওর সঙ্গে কথা বলছে না, পাত্তা দিচ্ছে না, সেটা বুঝতে পারলে এর পর আসতে গেলে চিন্তা করবে। ওকে মাংসের বাটিটা দেবার সময় টেবিলে ঠক করে শব্দ হয়েছে, আরও ভাত দেব? হাঁড়ির অর্ধেকটা দিয়ে দিই? এভাবেই বলেছে রাই। লোকটা তাও বোঝে না?ঞ্জবলেছে অর্ধেক কেন, তার চেয়ে কম।

বিকেলে বেরোল ওরা। আলমারির চাবি সঙ্গে করে নিয়ে গেল রাই। হারুকে বলল সাবধানে থাকতে। কেউ এলে দরজা না খুলতে। হারু বলল– কোনও চিন্তা নেই। চুপচাপ বসে বসে টিভি দেখব। কেয়ারটেকারকেও বলে গেল রাই, বাড়িতে বাইরের লোক আছে, লক্ষ্য রাখতে।

রাতে ফিরল, বাইরে থেকে খাবার কিনে। বেশি করেই আনতে হল, ছাতার-মাথা গেস্ট আছেন। বাড়ি ফিরে দুঃসংবাদ– হারু আরও একদিন থাকবে। আজকের মিটিং-এ আসা নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় ঝামেলা হয়েছে। বাতকুল্লার ভিতরের দিকে কোনও জায়গা থেকে ম্যাটাডোর বোঝাই কিছু মিটিংগামী লোক বাতকুল্লা স্টেশনে আসছিল, সেই ম্যাটাডোরে বোমা ফেলা হয়েছে। দু’জন মারা গিয়েছে। এর প্রতিবাদে আগামীকাল বাতকুল্লা বন্ধ। রেল অবরোধ। কৃষ্ণনগরেও বন্ধ পালিত হবে।ঞ্জওরা দেখল টিভিতেও এই খবর দেখাচ্ছে, হাসপাতালে ব্যান্ডেজবাঁধা আহত সকাশে নেতাগণ। অন্য চ্যানেলে বলছে সবরকম ভাবে প্রতিবাদের কর্মসূচি নেওয়া হবে।

হারু বলল– মালপত্র কিনে কাল বিপদে পড়ব। পরশু বরং যাব। একটা দিন বেশ রেস্ট হোক। ঘুমিয়ে কাটিয়ে দেব। রাই ভ্রূ কুঁচকে তাকাল হারুর দিকে, আর কটমট করে দুলালের দিকে। দুলাল অপরাধবোধে মাথা নীচু করে।

– আপনার আর কোথাও যাবার জায়গা নেই? রাই বলেই ফেলল।

কোথায় আবার যাব? ভুতো ছাড়া আমার কে আছে? হারু মাথা চুলকোয়। বুঝতে পেরেছে এতক্ষণে। নইলে বলবে কেন– তোমাদের খুব ডিসটার্ব করছি, না?

দুলাল বলে– না-না, ডিসটার্ব কেন? ভালোই তো লাগে।

রাই দুলালকে ডেকে বলল– একদম ওর সঙ্গে গুজুর গুজুর করবে না। ও একা থাকুক। কোম্পানি দিতে হবে না। এইখানে বসে থাকো। বেডরুমের রকিং চেয়ারটাকে দেখায় রাই, হাতে নেতানো খবরের কাগজটা ধরিয়ে দেয়।

রকিং চেয়ারে ও দোদুল্যমান।

রাইকে চটানো উচিত হবে? হারুর কাছে একবার যাওয়াটা কি উচিত নয়? রান্নাঘর থেকে খুটখাট শব্দ আসছে। রাই কিচেন গুছোচ্ছে। জলের শব্দ। এবার হারুর কথা শুনল দুলাল। – বউদি, ও বউদি, কাল তো সারা দিন আমি ঘরে। একটু আটা জাল দিয়ে রাখলে সারাদিন ধরে ঠোঙা বানাতে পারি, খবরের কাগজ আর একটা কাঁচি যদি…

ওর কথা শেষ হবার আগেই রাই বলে– খবরের কাগজ নেই, সব বেচে দেয়া হয়েছে।

ও, ঠিক আছে। তা হলে এক কাজ করেন। একটা ইস্তিরি রেখে যান। সারাদিন তো অনেক কাচাকুচি করেছেন, রোদটাও বেশ খরখরে ছিল, অঘ্রানের রোদ, সব শুকিয়ে গেছে, ইস্তিরি করে দিতাম…।

রাই বলল– ইস্তিরি আপনার করতে হবে না, ইস্তিরি করার লোক এসে নিয়ে যায়।

হারু বলল– আমি খারাপ ইস্তিরি করব না। এই কাজই তো করতাম আগে। খুব ভালো পারি।

ভালো পারতে হবে না।– রাইয়ের গলা বেশ কর্কশ। রাই ঘরে আসে। দরজায় ছিটকিনি দেয়। হাউস কোট খোলে, নাইট ড্রেস পরে। মুখে নাইট ক্রিম মাখে। তারপর নাইট ল্যাম্প জ্বালায়। বলে– শুয়ে পড়ো। দুলালকে জড়িয়ে ধরে রাই। বলে– ওই লোকটার জন্য তোমার আমার চেয়েও বেশি দরদ, তাই না? নিজেকে দ্রুত অনাবৃত করে রাই। দুলালকেও। তারপর ক্রিয়াশীলা হয়। উথালপাথাল করে। বলে– তুমি এত প্যাসিভ কেন, অ্যাঁ? রাই সেই রাতে ভীষণ উদ্যমী, সেইরাতে ভীষণ রমন পটিয়সী হয়। তারপর রতিক্লান্ত রাই বেডসুইচে নীল আলো নেভায়।

ভোরের দিকে এখনও পাখি ডাকে। পাখির ডাকে আধো জাগরণে রাই পাশ ফিরে হাতটান করে দিলে ফাঁকা ফাঁকা লাগে। চোখ মেলে দেখল সত্যিই ফাঁকা। দুলাল নেই। আলো জ্বালে। দরজা ভেজানো, কিন্তু ছিটকিনি খোলা। ছোটো ঘরটায় গিয়ে দেখে লাল কম্বলের উপরে দুটো মুন্ডু। ছিঃ।

ঘড়িতে দেখল পাঁচটা কুড়ি। সাধারণত সাতটা অবধি বিছানায় থাকে রাই। দীপা আসে সোয়া সাতটা নাগাদ। আজ আর ঘুম আসছে না রাইয়ের। যা-তা ভাবছে। একটু পরই ধীরে দুলাল এল। বিছানায় সন্তর্পণে উঠতে যাচ্ছিল, সে সময় রাই বলল– তুমি কি হোমো? দুলাল পর্দা চোঁয়ানো ভোরবেলার আলোয় রাইয়ের মুখের রক্তিমতা লক্ষ্য করল।

রাই আবার বলল– ওর সঙ্গে শুতে গিয়েছিলে কেন?

দুলাল গলা উঁচু করে না। ভোর বেলাটায় প্রকৃতি শান্ত থাকে। দুলাল শুধু বলে– ওকে বলতে গিয়েছিলাম ডোন্ট মাইন্ড।

রাই বলল– আই হেট ইউ।

তারপর কোনও কথা নেই। নিঃশব্দে চা। স্নান। দীপা যা বেড়ে দিল, খেয়ে নিল রাই।

দুলালের জামা-প্যান্ট, পার্স, মোবাইল বাইরের ডিভানে রেখে বেডরুমে তালা দিল। ডিভানে স্তূপ করে রাখা শুকনো জামাকাপড়, চাদর। পাশের ঘরটাও তালা– যেটা আসলে সত্যিকারের গেস্ট রুম। রাইয়ের বাপের বাড়ির লোক এলে যে-ঘরটায় থাকে। রাই বেরিয়ে গেল অন্যদিনের তুলনায় অন্তত পনেরো মিনিট আগে।

দীপাও কাজ সেরে বেরিয়ে গেছে। দুলাল আবার ভাত বসাল রাইস কুকারে। ভাতে আলু আর ডিম দিল। মাছের তরকারির কিছুটা হারুর জন্য রেখে দিল। টিভি খুলল, একটা সিনেমার চ্যানেল। হারুকে বলল– দুপুরে খেয়ে নিস। বসে বসে টিভি দ্যাখ, এটা টিপে চ্যানেল পালটাস, খেয়েদেয়ে ঘুম দিস, আমি যতটা পারি আগে চলে আসব। হারু বলে– বউদির খুব রাগ না? আমি বরং চলে যাই। দুলাল বলে– না-না, যাবি কেন? তোর বউদির তো আমার উপর রাগ। অন্য কারণে, তোর জন্য নয়।

সাতটা নাগাদ ফিরল দুলাল। কলিংবেল বাজাচ্ছে, বেজে যাচ্ছে, বারবার। দরজা ধাক্বা দিতে থাকল, পাশের ঘর থেকে লোকজন, ক্রমাগত শব্দ, চাবির ফাঁক দিয়ে কেউ কেউ দেখে কিছু বোঝার চেষ্টা করছে। মায়ের কথা মনে পড়ল দুলালের, চাবির ফুটোয় নাক রেখে বাতাস টেনে দুর্বিপাকের গন্ধ নিতে চেষ্টা করল।

কে ছিল? কে ছিল ভিতরে– এই প্রশ্নের উত্তরে দুলাল শুধু বলতে পেরেছিল, বন্ধু।

দুলাল ফোন করল রাইকে।– রাই, কিছু অঘটন ঘটেছে। তাড়াতাড়ি এসো। কেউ বলল পুলিশ। এক্ষুনি পুুলিশ।

দরজা ভাঙতেই হল। কোনও পোড়া গন্ধ নেই। সুইচ টিপলে আলো জ্বলল না। কাচের সার্সি চুইয়ে বাইরের রাস্তার আলোর কিছুটা ভিতরে। দুটো ঘরে তালা। ছোটো ঘরটায় উপুড় হয়ে পড়ে আছে একটা দেহ। পাশে এক মগ জল, একটা শতরঞ্জি পাতা, জামাকাপড় কুণ্ডলী করা, একটা ইস্তিরি, প্লাগে লাগানো।

কারুর মোবাইলের টর্চে দেখা গেল প্লাগ পয়েন্টে কালো রং। ফিউজ উড়ে গেছে– কেউ বলল। ফিউজ লাগানো হল। উদ্ভাসিত আলোয় উপুড় হয়ে আছে হারু, ওর হাতের থেকে দু’ইঞ্চি দূরে একটা ইলেকট্রিক ইস্তিরি, যেটা খারাপ, অব্যবহার্য, যার তারের থেকে তামা বেরিয়ে গিয়েছিল, যেটা চৌকির তলায় ফেলে রাখা হয়েছিল।

দেহটাকে উলটে দিল পুলিশের লোক। হারুর ঠোঁটের কোনায় রক্ত জমাট বেধেছে।

– কে এই লোকটা।

দুলাল বলল– বন্ধু। তারপর হুহু করে কেঁদে ফেলল।

ঝক্বিঝামেলা কম হ’ল না। পোস্টমর্টেম, পুলিশ কেস, দেশের বাড়ি যাওয়া… হারুর মায়ের আকুল ক্রন্দন…। কী করা যাবে? অ্যাক্সিডেন্ট ইজ অ্যাক্সিডেন্ট। আমরা তো ইস্তিরি করতে বলিনি, ওতো নিজে থেকেই…।

কিছুদিন পর হারুর দুই দাদা বাড়িতে এল। সেদিনও রবিবার। বলল হারু একটা লাইফ ইনস্যুরেন্স করিয়ে ছিল, বছর দেড়েক আগে। পাঁচ লাখ টাকার। নমিনি করে গেছে কংসারিকে।

কাগজ দেখাল– নমিনিঃ কংসারি মন্ডল। রিলেশনশিপঃ ফ্রেন্ড।

টাকার খুব দরকার ওদের। ওই হারুর ঝমেলায় লাখ খানেক টাকা বেরিয়ে গেছে। থানাপুলিশ, মর্গ, তাছাড়া ওর শ্রাদ্ধের পুরো খরচ, রাইয়ের কোনও ইনক্রিমেন্ট নেই, একটা গাড়িও কিনতে পারেনি ওরা এখনও…

হারুর দুই দাদাই হাত জোড় করে বসে আছে। বড়ো দাদা বলল –  ভুতো, তুমি ছাড়া তো এই টাকাটা উদ্ধার হবে না। তোমার সই লাগবে। তোমার নামেই তো চেক হবে। কিন্তু আমাদের অবস্থা তো…

কথা শেষ হবার আগেই রাই বলল– ও টাকাটা পেয়ে গেলে পুরো টাকাটাই আপনাদের মায়ের হাতে তুলে দেবে। আমি জানি, ও দেবে।

রাই আগে কাঁদেনি। এবার কাঁদছে।

রাজবাড়ির রহস্য

গিয়ার একটু উপরে তুলে প্রবীর বলল, আসল মজা আসত মামার বাড়িতে। পাশেই ছিল সীতা কুণ্ড, সবাই মিলে হুল্লোড় করে ঝাঁপ দিতাম তার স্নিগ্ধ শীতল জলে। সারাদিন সাঁতার কেটেও জ্বর-সর্দি কিচ্ছু হতো না।

পাশেই অরিন্দম বসেছিল, সে হই হই করে উঠল। থাম তো তোর সীতা কুণ্ড। আমার গ্রামে চল। পাশেই দ্বারকেশ্বর নদী আর বিশাল ধানের খেত। গেলে বুঝবি পাড়াগ্রামে কত আনন্দ।

দুজনে বেশ তুমুল বিতর্ক শুরু করেছে দেখে অতনু চুপ থাকে কেন? সেও যোগ দিল, তোরা নদী আর কুণ্ড নিয়ে রইলি আর আমার মাসির বাড়িতে পাঁচ কিলোমিটার-এর মধ্যে পাহাড়, নদী, রাজবাড়ি, খেত, পুকুর সবকিছুই পাবি।

রাজবাড়ির নাম শুনে অনন্ত আর প্রবীরের মুখ হাঁ হয়ে গেল। অরিন্দম বলল, চল তাহলে পুজোর ছুটিতে তোদের মাসি বাড়ি ঘুরে আসা যাক। সবাই রাজি হয়ে গেল।

পুজোর ছুটিটা বেশ জমিয়ে উপভোগ করতে চায় সবাই। তাই শহরের পুজো নয়, এবার গ্রামে গিয়ে একটু অন্য ভাবে পুজো উপভোগ করার জন্যে সবাই অনন্তর কথামতো হাজির হল গিয়ে ওর মাসির বাড়ি। দারুণ জায়গা, মন প্রাণ খুলে ঘুরে বেড়ানো যায়। বাধা দেওয়ার কেউ নেই। আর মাসিমণির বরাতে বেশ জম্পেস খাওয়াদাওয়া চলছে।

সারাদিন পাহাড় নদী ঘুরে এসে ভীষণ ক্লান্ত চারমূর্তি। এসেই বিছানায় গা এলিয়ে দেয় আর নিজেদের মধ্যে নিয়মমাফিক তর্কে লিপ্ত হয়ে পড়েছে সকলেই। ইতিমধ্যে মাসিমা মুড়ি আর তেলেভাজা দিয়ে গেছেন, ওটাকেই চটকানো হচ্ছে। কথা প্রসঙ্গে অতনু বলে উঠল, তোরা রাজবাড়ি কবে যাবি? আমি বাপু পাহাড় নদী দেখতে আসিনি। আমার মামারবাড়িতে এইসব ঢের দেখেছি।

প্রবীর বললে, চুপ কর তো। শুধু ঘ্যান ঘ্যান করতে হবে না। অতনু বেশ উত্তেজিত হয়ে উঠেছে। সে প্রায় সাড়ে তিন হাত লাফিয়ে উঠে বললে, জানিস রাজবাড়ি মানে অনেক কিছু থাকতে পারে, এই ধর গুপ্তধন!

অরিন্দম বললে, হ্যাঁ তোর জন্য গেড়ে রেখে গেছে। তুই যাবি আর তুলে নিয়ে আসবি।

গল্প শেষ পর্যন্ত গড়িয়ে গেল রাজবংশের কেউ এখনও আছে কি না। ওদের সাথে দেখা করে সব জানতে হবে।

অতনুর যেন এখানে আসার একটাই কারণ। রাজবাড়ি গিয়ে লুকোনো গুপ্তধন আবিষ্কার করা। ওর কথা শুনে সবাই হো হো করে হেসে উঠল। পাশের ঘরে মাসিমা ছিলেন, তিনিও চারমূর্তির কথা শুনতে পেয়েছেন। তিনি এসে বললেন, একবার ঘুরেই এসো। তবে সন্ধে কোরো না। জায়গাটা ভালো নয়।

সকালে উঠেই সবাই তৈরি রাজবাড়ি দর্শন করতে যাবার জন্যে। মাইল খানেকের পথ। একটা টোটো করে সবাই উঠে বসল। মনের মধ্যে অনেক কথা লুকোচুরি খেলছে, অতনুর মুখ দেখলেই বোঝা যায়। সেই সবার আগে বসেছে। আর ক্রমাগত টোটো চালককে একটু তাড়াতাড়ি চালানোর জন্যে খোঁচাতে শুরু করেছে। টোটোওয়ালা ভীষণ বিরক্ত হয়ে শেষমেশ বলেই ফেলল, দাদাবাবু আপনি এরোপ্লেন ভাড়া করে নিন। আমার টোটো এই স্পিড-এর বেশি চলে না।

কিছুক্ষণের মধ্যেই ওরা রাজবাড়ির সামনে এসে উপস্থিত। টোটো থেকে নেমে অবাক চোখে সবাই তাকিয়ে দেখতে লাগল, প্রায় ভগ্নদশা তবু মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে প্রাচীন রাজবাড়ি। হুট করে ভেতরে ঢুকতে গিয়ে দেখল দুজন প্রহরী। রাজবাড়ি এখন সরকার অধিগ্রহণ করেছে, তাই ভেতরে প্রবেশ নিষেধ। বাইরে থেকে ঘুরে দেখতে পাওয়া যাবে। ভেতরে যেতে গেলে সরকারি অনুমতি লাগবে।

একটু নিরাশ হলেও সেই দিনের মতো ওরা আশেপাশেই ঘুরে দেখে নিতে লাগল। কোথায় হাতিশাল, কোথায় সিপাহিদের থাকার জন্য ঘর ছিল। সামনেই একটা বড়ো পুকুর আছে। টোটোচালক সব ঘুরিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছিল। ওরা ঘুরতে ঘুরতে রাজবাড়ির পশ্চিম দিকে এসে দেখতে পেল কিছু ভগ্ন মন্দিরের স্তূপ। সেখানে অনেকক্ষণ নিরীক্ষণ করে যখন ফিরে এল তখন বেশ খিদে পেয়েছে।

অরিন্দম বলল, চল রে আগে পেটে কিছু দিয়ে আসি, তার পর দেখা যাবে। এই কথা শুনে সবাই এসে হাজির হল একটা হোটেলে। হোটেলের বেয়ারা বেশ মিশুকে ছেলে। ওদের দেখেই বলল, বাবুরা নতুন নাকি? গ্রাম দেখতে এসেছেন। একটুর মধ্যেই বেশ ভাব জমে উঠল তার সাথে।

প্রবীর বললে, তোমাদের গ্রামে কী আছে দেখার জন্য।

ছেলেটি সব কিছুই বলতে লাগল। শেষে এল রাজবাড়ির কথা। অতনুর এই সময়টার অপেক্ষায় ছিল। সে জিজ্ঞেস করে বসল, এখানে গুপ্তধন নেই?

ছেলেটি হো হো করে হেসে উঠল। তা তো জানিনে বাবু, তবে লোকে বলে রাজবাড়ির ভেতরে ভূতের উপদ্রব আছে। তাই রাতে পুলিশেও পাহারায় থাকে না।

নতুন খবর পেয়ে চারমূর্তি নড়ে চড়ে বসল। আরও কিছু কথা হল কিন্তু খাওয়া হয়ে গেছে আর বেলা বেড়ে চলেছে তাই ওরা বেরিয়ে এল হোটেল থেকে। সবাই বেশ উত্তেজিত! একটা ভালো তথ্য মিলল রাজবাড়ি নিয়ে, এই সময় সুযোগ রয়েছে ভূতের দর্শন পাওয়ার। যদিও ভূত বলে কিছু আছে সেটা কেউ বিশ্বাস না করলেও, নাম শুনলেই একটা শিহরণ জাগে বুকের ভিতর।

মনের ভিতর অনেক প্রশ্ন খেলা করতে লাগল। পুজোর বাজার। একটা সাজো সাজো রব চারিদিকে। কলকাতার মতো এখানে সারারাত জেগে ঠাকুর দেখা হয় না। এই সুযোগটাকেই কাজে লাগাতে হবে। বাড়িতে জানিয়ে গেলে মাসিমা বাধা দেবে। তাই বাড়িতে না জানিয়ে চারমূর্তি রাজবাড়িতে রাত কাটাবে প্ল্যান করল। এখন শুধু অপেক্ষা নির্দিষ্ট দিনের।

 

এক সময় সেই দিন এসেও গেল। সবাই প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে হাজির হল রাজবাড়ির পেছনে। ওখানে একটা প্রাচীর ভেঙে আছে আগেই দেখে এসেছিল তারা। ভীষণ উত্তেজিত চারমূর্তি। এই কয়েকদিন শুধু এই নিয়ে আলোচনা চলেছে। অতনু গুপ্তধন-এর নেশা কবেই ভুলে গেছে। যদিও অরিন্দম বলেছে, ভাগ্যে থাকলে গুপ্তধন পেয়ে যেতে পারিস।

একটা রোমহর্ষক ঘটনার সাক্ষী হতে যাচ্ছে ভাবলেই শিউরে উঠছে অতনু। যাই হোক, পিছনের রাস্তা দিয়ে ওরা রাজবাড়ির ভেতরে ঢুকে দেখল চারিদিকে অন্ধকার। একটাও আলোর ব্যবস্থা নেই। পকেট থেকে মোবাইল-এর আলো জ্বালিয়ে চারপাশ ভালো করে দেখে নিয়ে একটা ফাঁকা মতো জায়গা দেখে ওরা বসে পড়ল। চারদিকে শুধু অন্ধকার ছাড়া কিছুই চোখে পড়ছে না।

হঠাৎ পাশে সড়সড় করে একটা শব্দ আসতেই প্রবীর মোবাইল-এর আলো জ্বেলে দেখতে গিয়ে চমকে উঠল। একটা সাপ নিশব্দে এগিয়ে চলেছে। সবাই বেশ ভয় পেয়ে গেল। অনেক রাত অবধি যখন কিছুই হল না, বেশ বিরক্ত হয়ে উঠল চারজনেই। এভাবে ভূতের দেখা না মিললেও সাপ আর বিছের দেখা প্রতি মুহূর্তে মিলতে পারে। আর ভুল করে যদি কেউ পা দিয়ে ফেলে একবার কামড় খায়, তাহলে আর কথাই নেই!

প্রবীর বলল, চল একবার রাজবাড়ির ভেতর থেকে ঘুরে আসি তারপর ফিরে যাব। এই ভাবে রাত জেগে কোনও লাভ নেই। ভূতের দেখা মিলবে না। শুধু শুধু মশার দাপটে অতিষ্ঠ হয়ে উঠছি। সবাই রাজি হয়ে গেল। আসলে কৌতূহলী হয়ে সবাই এলেও এখন অনুভব করছে, কী ভুলই না করেছে! এ ভাবে বাড়িতে না জানিয়ে এখানে এসে। যে-কোনও মুহূর্তে কিছু একটা হয়ে যেতে পারে। ধরা পড়লে পুলিশও চোর বলে লক-আপ-এ ঢুকিয়ে দেবে। তাই মোবাইলের আলো জ্বেলে এবড়ো খেবড়ো ভাঙা রাজবাড়ির ভেতরে কিছুক্ষণ ঘুরে এবার ফিরে আসবে ভেবেই পিছনের দরজার কাছে উপস্থিত হয়েছে। এমন সময় অতনু সামনের দিকে হাত বাড়িয়ে আঁতকে উঠল! ওই দ্যাখ…

সবাই চমকে উঠল। অরিন্দম সেখানেই হুঁশ হারিয়ে পড়ে যাচ্ছিল। প্রবীর ওকে ধরে ফেলল। অতনুর মুখে রা নেই। সবাই এক দৃষ্টে তাকিয়ে আছে দোতলার একটা ভাঙা ঘরের ভেতর লাল রঙের আলো জ্বলছে। ভাবতেও গা শিউরে ওঠে। অরিন্দম নিজেকে কিছুটা সামলে নিয়েছিল। হঠাৎ প্রবীরের হাত ঝাঁকিয়ে একটা দৌড় লাগাল। অতনুও দেখাদেখি দৌড়োতে গেল।

প্রবীর বলল, দাঁড়া আগে ব্যাপারখানা দেখতে হচ্ছে। অতনু বেশ উত্তেজিত হয়ে বলল, বলিস কী এত রাতে লাল আলো জ্বেলে দোতলায় কী হচ্ছে! নির্ঘাত ভুতুড়ে কাণ্ড। চল পালাই। প্রবীর ওকে শান্ত করে বলল, এত দূর ভূত দেখতে এসে এখন এভাবে পালিয়ে গেলে চলবে না। আগে পুরো ব্যাপারটা দেখতে হবে। একপ্রকার জোর করেই অতনুকে টেনে নিয়ে রাজবাড়ির ভেতরে ঢুকে পড়ল প্রবীর।

ভাঙা সিঁড়ি বেয়ে কোনও ভাবে দোতলায় উঠে দেখল, সে রকম কিছুই নেই। বেশ কয়েকটা ধংসস্তূপ আর ছাদহীন ঘর। ঘরের শ্রী দেখলে ভয় লাগে, কখন হুড়মুড় করে নীচে ধসে পড়বে। খুব সন্তর্পণে ওরা ঘরের ভেতরে ঢুকে পড়েছে।

হঠাৎ করে মুখের উপর জোরালো আলো এসে পড়ল দুজনের উপর। কে তোমরা? এত রাতে এখানে কেন মরতে এসেছ? বেশ রাশভারী গলায় কেউ প্রশ্ন করেছে। এই রকম অবস্থায় যে কেউ হলে ভয় পেয়ে যেত। কিন্তু প্রবীর বেশ মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল, সব কিছুর উত্তর পেয়ে যাবে একটু সবুর করো, তারপর একটা অদ্ভুত কাণ্ড করে বসল। হঠাৎ লাফিয়ে সামনে যে-আলো ধরেছিল তার বুকে একটা জম্পেস লাথি মেরে বসল প্রবীর। আলোটা কোথায় পড়ে নিভে গেল আর মুহূর্তের মধ্যে আবার অন্ধকার।

অতনু কী করবে ভেবে পাচ্ছে না। হঠাৎ কারও দুমদাম করে নীচে নেমে যাওয়ার শব্দ হতে লাগল। প্রবীর বলল, অতনু চল ওদের তাড়া কর। পালিয়ে যেন না যায়। অন্ধকারে থাকতে থাকতে চোখ সয়ে গেছে। আবার বাইরে হালকা চাঁদের আলোও আছে, তাই বেশ দেখা যাচ্ছে। দুতিন জন পালিয়ে পিছনের ভাঙা প্রাচীরের কাছে এসে গেছে।

প্রবীর আর অতনুও নীচে নেমে এসেছে। এমন সময় একটা কাণ্ড হল, ওপাশ দিয়ে পুলিশের একটা দল ভেতরে ঢুকছে। যারা পালাচ্ছিল তারা ধরা পড়ে গেল। বড়োবাবু প্রবীর আর অতনুর হাত ঝাঁকিয়ে বললেন, বেশ বাহাদুর ছোকরা তো তোমরা। এই দলটাকে আমরা বেশ কয়েক মাস ধরে খুঁজছিলাম। লোকাল চুরি ডাকাতির অনেক কেস আছে এদের নামে।

অতনু অবাক হয়ে সব কিছুই দেখছিল। সব কিছু যেন একটা স্বপ্ন। এতক্ষণে বলল, কিন্তু স্যার আপনি ঠিক সময় এখানে কী করে হাজির হলেন? একটু দেরি হলেই তো ওরা পালিয়ে যেত।

পুলিশকর্তা এবার হাসতে হাসতে বললেন, এর জন্যে তোমার এই বন্ধুটি দাযী। আমরা নিয়মমাফিক পেট্রলিং-এ বেরিয়েছিলাম। এমন সময় তোমার এই বন্ধুটি আমাদের দেখতে পেয়ে সব ঘটনা খুলে বলে। এখানে এসে দেখি এই কাণ্ড।

প্রবীর বলল, আমাদের বন্ধুটিকে দেখতে পাচ্ছি না?

সবার পিছন থেকে শুকনো গলায় অরিন্দমের আওয়াজ ভেসে এল, আমি আছি!

 

 

নাটক

সবিতা একটা বড়ো থলে কাঁধে করে ঘরে ঢুকতেই আঁতকে উঠলাম। ‘হ্যাঁরে, তোর কাঁধে ওটা কী? ওটার মধ্যে কী আছে?’

‘আজ্ঞে, দিদি আমার বাপের বাড়ির দেশের আম। তুমি তো খেতে ভালোবাসো তাই।’

সবিতার ঠোঁট উলটে কথা বলার কায়দা দেখে খুব হাসি পেল। কিন্তু সবিতা সেদিকে বিন্দুমাত্র ভ্রূক্ষেপ করল না। বরং স্বমহিমায় তার নিজের ছন্দেই গড়গড় করে বলে চলল, ‘দেশ থেকে ছোটো ভাই আর ভাইপো এসেছে কিনা। মা ওদের হাত দিয়ে অনেক কিছু পাঠিয়ে দিয়েছে। তুমি আর তনুদিদি আম পছন্দ করো তো, তাই খানিক নিয়ে এলুম।’

‘হ্যাঁরে এটা খানিক?’ মনে মনে হাসি পেলেও, থলে ভর্তি আম নিয়ে আসার ব্যাপারটা কিছুতেই হজম করতে পারছিলাম না। আসলে খুব কাছের লোক ছাড়া এইভাবে কারওর থেকে কিছু নেওয়ার অভ্যাস কোনওদিনই আমার ছিল না।

‘খানিক নয় তো কি গো দিদি! দু-তিন বস্তা ভর্তি করে নিয়ে এসেছে যে। তোমাদের খাওয়া শেষ হলে আমকে বোলো, আবার আনব।’ গর্বের সঙ্গে সবিতা এমন ভাবে কথাগুলো বলল যে, আমি আর সেগুলো ফিরিয়ে দেওয়ার সাহস দেখাতে পারলাম না।

‘না না এটাই অনেক। আর আনিস না বাবা।’ ঠিক সেই সময় ডোরবেলটা বেজে উঠল। ‘সবিতা দ্যাখ তো বাবা কে এসেছে।’

দরজা খুলতেই দুজন অপরিচিত ব্যক্তি ফলের ঝুড়ি আর ড্রাই ফ্রুটের কয়েকটা প্যাকেট হাতে নিয়ে ঘরের ভিতর ঢুকে পড়ে সেগুলো টেবিলের উপর সাজিয়ে রেখে দিল। তাদের আচরণ দেখে বেশ বিরক্তই হলাম।

‘এসব কী? আর আপনারাই বা কে?’

আমার কথা সম্পূর্ণ হওয়ার আগেই আগন্তুক জবাব দিল, ‘আজ্ঞে, ম্যাডাম, ব্যস একটু খাবার জিনিস আর কী। প্লিজ এটাকে অন্যভাবে নেবেন না। বলেই ছেলের দিকে তাকিয়ে, ‘রাজ দাঁড়িয়ে  আছিস কেন? তোর ডকুমেন্টস-টা ম্যাডাম-কে দে।’

ছেলেটি আমার অনুমতি ছাড়াই সামনের চেয়ারটাতে ধপাস করে বসে পড়ল।

‘এক মিনিট, আগে আমার কথা শুনুন। কলেজের কাজ আমি বাড়িতে করি না। আপনারা কলেজে দেখা করুন, আর হ্যাঁ এইসমস্ত জিনিসপত্র নিয়ে যান।’

‘প্লিজ, ম্যাডাম দু-মিনিট সময় দিন।’ বলেই ছেলের হাত থেকে মার্কশিট-টা নিয়ে ‘এই দেখুন মাত্র ১ নম্বরের জন্য ছেলেটার অ্যাডমিশন আটকে গেছে। এখন আপনি যদি একটু চেষ্টা করেন, তাহলে ছেলেটার ভবিষ্যৎ…।’

ওদের স্পর্ধা দেখে মাথাটা ভীষণ ভাবে গরম হয়ে উঠল। কিন্তু বাড়ির মধ্যে কোনওরকম সিনক্রিয়েট হোক, এটা চাইছিলাম না, তাই তৎক্ষণাৎ নিজেকে সামলে নিয়ে বলি, ‘দেখুন আমি আগেই বলেছি কলেজের ব্যাপার আমি কলেজেই মেটাই। আর একটা কথা, এক নম্বরের জন্য অ্যাডমিশন হয়নি এমন ছেলেমেয়ের সংখ্যাটাও নেহাত কম নয়। আমি যদি সুপারিশ করে আপনার ছেলেকে অ্যাডমিশন দিই, তাহলে কি অন্যদের সঙ্গে অন্যায় করা হবে না? আপনার ছেলের ভালোর জন্যই বলছি, যে কলেজে চান্স পেয়েছে, সেখানেই অ্যাডমিশন করিয়ে নিন।’

‘এরকম করার হলে তো কবেই করিয়ে নিতাম ম্যাডাম। তাহলে আর আপনার কাছে আসা কেন? আসলে আপনার কলেজের একটা সুনাম রয়েছে, সঙ্গে প্রিন্সিপাল হিসাবে আপনারও। সেইজন্যই আমি চাই, আমার ছেলেটা আপনার ছত্রছায়ায় থেকে সঠিক পথে পরিচালিত হোক। তাহলে ওর ভবিষ্যৎ নিয়েও আমার কোনও চিন্তা থাকবে না।’

‘প্লিজ, এভাবে প্রেশার ক্রিয়েট করার চেষ্টা করবেন না। আমার কলেজের দেরি হয়ে যাচ্ছে। সবিতা, আমি তৈরি হতে যাচ্ছি। দরজাটা বন্ধ করে দিস।’

ওদের যেতে বলার স্পষ্ট ইঙ্গিত দিয়ে সোজা বাথরুমে ঢুকে গেলাম। ঢুকতে ঢুকতে দু-তিনবার ম্যাডাম, ম্যাডাম ডাকও কানে এল শেষে একটা হুমকিও শুনতে পেলাম। ‘এর ফল কিন্তু ভালো হবে না ম্যাডাম।’ ইচ্ছা করেই সেটা না শোনার ভান করলাম।

বাবা ছোটোবেলায় কবিতাটা শিখিয়েছিলেন, ‘চিত্ত যেথা ভয়শূন্য, উচ্চ যেথা শির আজও ভুলিনি, মাথা উঁচু করে বাঁচার মন্ত্র সেই কবেই ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন অন্তরে। স্নান করে বেরোনোর পর মুডটা ঠিক হয়ে গিয়েছিল। সবিতা তখন ঘর ঝাড়পোঁছে ব্যস্ত। কিন্তু ওর মুখটা কেমন যেন একটা…। হঠাৎ করে আকাশে মেঘ জমার কারণটা ঠিক বুঝতে পারলাম না।

‘কী হল? ওরা চলে গেছে?’

‘হ্যাঁ গেছে। একটু যদি সাহায্যই করতে দিদি, তাহলে কী আর এমন হতো শুনি? বেচারা! অসন্তুষ্ট হয়ে ফিরে গেল। সঙ্গে যেসব জিনিসপত্র এনেছিল, সেগুলোও দিয়ে দিতে হল।’

সবিতার কথা শুনে না হেসে পারলাম না। সবিতাকে আমি কোনওদিনই কাজের লোক হিসাবে দেখিনি। বরং ছোটোবোনের মতোই দেখে এসেছি। তাই ওর জোরটাও আমার উপর একটু বেশিই।

‘ওহ তাই বল! সব জিনিসপত্র ফিরিয়ে নিয়ে গেছে বলে তোর গোঁসা হচ্ছে।’

‘তামাশা কোরো না তো দিদি। সত্যিই তুমি যদি ওই বেচারাদের মুখটা দেখতে।’

শোন, বেচারা-টেচারা কেউ নয়। জাস্ট নিজের কাজ হাসিল করার জন্য ঘুষ দিতে এসেছিল বুঝেছিস। তুই খুব বোকা, এসব বুঝবি না। জানিস ওই উপহারগুলোর বদলে আমাকে দিয়ে কী করিয়ে নিতে চাইছিল। দ্যাখ, তুইও তো আমার জন্য ফল এনেছিস। কিন্তু তোর আনার মধ্যে কোথাও কি…’

আমার কথা শেষ হওয়ার আগেই ডোরবেলটা আবার বেজে উঠল। সবিতা দরজা খুলতে গেল বটে, কিন্তু আমার সন্দিগ্ধ নজরও দরজার দিকে আটকে রইল। দরজা খুলতেই সামনে দুজন অজ্ঞাত পরিচয় লোক। একজনকে অবশ্য লোক বললে ভুল হবে। তাকে দেখে মনে হল বছর উনিশ-কুড়ির বেশি হবে না। কিন্তু দুজনেরই পোশাকআশাক কেমন যেন একটু প্রত্যন্ত গাঁ ঘেঁষা। ভাবলাম এরা আবার কারা রে বাবা!

‘সাবু দি, এটাই ম্যাডাম না?’

‘ম…ম… ম্যাডাম’ দূর থেকে দাঁড়িয়েই হাতজোড় করে প্রণাম সারল তারা।

এ পর্যন্ত এইটুকুই বোধগম্য হল যে সবিতার ডাক নাম সাবু আর এরা তারই পরিচিত কেউ।

‘ওহ্ দিদি আমার ভাই আর ভাইপো, তোমাকে বলেছিলাম না দেশ থেকে এসেছে।’

‘ওহ্ হ্যাঁ হ্যাঁ বলেছিলি বটে’ বলে সম্মতি জানাতে ঘাড় নাড়ালাম। কিন্তু একটা জিনিস কিছুতেই বুঝতে পারছিলাম না যে, এদের এখানে আসার কারণটা কী!

ততক্ষণে সবিতার ভাই ঘরের ভিতর ঢুকে এসেছে, ‘আম খেয়েছেন ম্যাডাম? আমাদেরই বাগানের।’

ঠিক সেই সময় চোখে পড়ল সবিতা আমার সাইডে দাঁড়িয়ে ইশারা করে ওদের কিছু বোঝানোর চেষ্টা করছে। না তারা কিছু বুঝতে পারছে, না আমি। উত্তরে আমের বেশ তারিফ করে, বেশিমাত্রায় পাঠানোর কথাও জানালাম।

‘আরে না না ম্যাডাম, চাষেরই তো জিনিস। সিজনে জাম আর পেয়ারার ফলনও বেশ ভালো। পরের বার ১-২ ঝুড়ি পাঠিয়ে দেব’খন। চাইলে বাড়িতে বানানো খাঁটি ঘিও পাঠাতে পারি।’

‘না না। ধন্যবাদ। এই যথেষ্ট।’ ঘড়ি দেখতে দেখতে আলগোছে বলি, ‘সবিতার সঙ্গে কিছু দরকার আছে তাই তো? ঠিক আছে, বসে ওর সঙ্গে কথা বলে নিন। আমি আসছি।’

বাইরে বেরোনোর জন্য পা বাড়াব এমন সময় সবিতার ভাই হাতজোড় করে রাস্তা আটকে দাঁড়াল। ‘দরকারটা আপনার সঙ্গেই ছিল ম্যাডাম। আপনি কৃপা করলে মা-মরা এই বাচ্চাটার ভবিষ্যৎ তৈরি হয়ে যেত। দয়া করে যদি এই গরিবের উপর একটু কৃপাদৃষ্টি করেন। ছেলেটা আমার পড়াশোনায় একটু কমজোর বটে, কিন্তু খুব ভালো মনের।’ বলে একটু থামে। নিঃশ্বাস নিয়ে আবার বলতে শুরু করে, ‘দিদি বলেছিল আপনি নাকি কলেজের প্রিন্সিপাল।’

‘আপনারা কলেজে গিয়েছিলেন? ওনারা কী বললেন?’

‘বললেন লিস্টে নাম নেই।’

‘রিজার্ভেশন কোটায় দেখেছিলেন।’

‘হ্যাঁ ম্যাডাম। একদম শেষের দিকে। আপনি সব পারেন ম্যাডাম। শুধু বাচ্চার মাথায় একটু হাত রেখে দিন। তাহলেই…’ কথাগুলো বলতে বলতেই আমার হাতদুটো জোর করে চেপে ধরে ছেলের মাথায় রাখার চেষ্টা করে। মাথায় রক্ত চড়ে যায় আমার।

‘এটা কী ধরনের অসভ্যতা?’

‘ভুল হয়ে গেছে ম্যাডাম, ক্ষমা করে দিন। গাঁয়ের লোক তো, তাই শহুরে আদবকায়দা ঠিক জানি না। সাবুদি কিছু বলো না। সাবুদি আপনার খুব সুনাম করে, বলে দিদি খুব দয়ালু, উপকারী। কিগো দিদি বলো।’ বলতে বলতে চোখভরা আশা নিয়ে সবিতার দিকে তাকাতেই, সবিতা কিন্তু কিন্তু করতে করতে আমার সামনে এসে দাঁড়াল।

‘দিদি তোমার কলেজে ওর একটা ব্যবস্থা করে দাও না দিদি। সারাজীবন আমরা তোমার খেদমত খাটব দিদি। দাও না দিদি।’ বলতে বলতেই ভাইপোকে একেবারে আমার পায়ে ঝুঁকিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করল।

পরিস্থিতি দেখে একপ্রকার লাফিয়েই দু-পা পিছিয়ে এলাম। ‘কী করছিসটা কী সবিতা? তুই তো জানিস আমি এসব পছন্দ করি না।’ এরকম অকোয়ার্ড সিচুয়েশনে এর আগে কোনওদিন পড়িনি।

‘রাস্তা ছাড়। আগে কলেজে যাই। পৌঁছে লিস্টটা চেয়ে একবার চেক করে দেখব। তবে আমার মনে হয় না, এই ব্যাপারে খুব একটা কিছু হবে বলে। হয় ভাইপোকে অন্যত্র ভর্তি করিয়ে দে, নয়তো ভালো করে পড়াশোনা করে আবার পরীক্ষায় বসতে বল। এক্ষেত্রে সত্যিই আমার কিছু করণীয় নেই।

বেশ রূঢ় ভাবেই কথাগুলো বলে কোনওদিকে না তাকিয়ে হন্তদন্ত হয়ে কলেজের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। আজ বলে নয়, বরাবরই আমি একটু আদর্শবাদী। নিয়মনীতি মেনেই চলি। সেসবের বিরুদ্ধে গিয়ে কোনও কাজ করা আমার পক্ষে সত্যিই বোধহয় অসম্ভব। তাই মাঝেমধ্যেই লোকের কাছে ভীষণ ভাবে অপ্রিয় হয়ে উঠি।

বিশ্বাস করুন, ঘুনাক্ষরেও টের পাইনি যে, পরের দিনই তার থেকে অনেক বেশি চমক অপেক্ষা করছে আমার জন্য। ভেবেছিলাম সবিতা হয়তো আর কাজেই আসবে না। কিন্তু উলটোটাই হল। অন্যান্য দিনের মতো সকাল সাতটাতেই হাজির হল সে। ব্যাতিক্রম বলতে শুধু মুখ হাঁড়ি করে চুপচাপ কাজ করে যাওয়া। যেটা সবিতার একেবারেই স্বভাববিরুদ্ধ। ওর চুপ থাকাটা একসময় বেশ অসহ্য হয়ে উঠছিল। বুঝতে হয়তো পারছিলাম ওর মনের মধ্যে কী উথালপাথাল চলছে। আমারও মনের অবস্থা খানিকটা সেইরকমই।

সত্যি কথা বলতে কি, প্রশান্ত মারা যাওয়ার পর থেকেই প্রাকৃতিক নিয়মে কী জানি না, আমি অনেক শান্ত, চুপচাপ হয়ে গেছি। বলতে পারেন নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছি। তনু তখন খুব ছোটো। মনের মধ্যে কষ্ট থাকলেও তা চেপে রেখে সর্বদা ওর সামনে হাসিখুশি থাকার চেষ্টা করেছি। আমিই যদি ভেঙে পড়ি, তাহলে ওকে দেখবে কে, এই ভাবনাই তাড়িয়ে বেড়িয়েছে চিরটাকাল।

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ও বড়ো হয়েছে, বড়ো হয়েছে ওর পরিধিও। তখন থেকে আজ পর্যন্ত আমার পৃথিবী কেবলমাত্র ওকে ঘিরেই। কিন্তু ওর দিন-প্রতিদিনের বিস্তৃত হওয়া পৃথিবীতে, আমার জায়গাটা যে কোথায়, তা অনুমান করা খুব কঠিন।

বন্ধু হিসাবে কারওর কাছে যে নিজের দুটো মনের কথা বলব, জীবনে তেমন সঙ্গী আর পাইনি। সেই কারণেই হয়তো নিজেকে এভাবে খোলসের মধ্যে গুটিয়ে রাখা। তবে শুধু আমার চেনা-পরিচিতরা কেন, আমার মেয়েটাই যে আমাকে কতটা জানে, বোঝে, বলা মুশকিল।

পরের দিন সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে সবেমাত্র খবরের কাগজটা নিয়ে বসেছি, ঠিক সেই সময় তনু ফোনে কথা বলতে বলতে নীচে নেমে এল। আমাকে দেখামাত্রই ফোনটা কেটে এগিয়ে এল, ‘ও মাম্মা, পরশুদিন আমার উৎকল ইউনিভার্সিটিতে চাকরির ইন্টারভিউ আছে। বটানিতে লেকচারারশিপে ভ্যাকেন্সি ছিল। রিয়া, পূজা, মুন সবাই অ্যাপ্লাই করেছে বলে, আমিও করলাম। যদিও টিচিং ব্যাপারটাতে আমার খুব একটা ইন্টারেস্ট নেই, তবুও যতদিন না মনের মতো একটা কিছু হচ্ছে, ততদিন অন্তত। প্লিজ, তুমি একটু বিসি আঙ্কলকে ব্যাপারটা জানিয়ে রেখো।’

‘আবার বিসি সাহেব কেন তনু? এই পদটির জন্য তুমি যথেষ্ট যোগ্য। কনফিডেন্স লেভেল হারিয়ে ফেলছ কেন? আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে ইন্টারভিউ দাও। তুমি এমনিই সিলেক্ট হয়ে যাবে।’

‘আমার উপর আমার যথেষ্ট আস্থা আছে মাম্মা। কিন্তু তুমি জানো না, এখন ছোটো ছোটো চাকরির জন্যও বিশাল কম্পিটিশন। তার উপর এদের পে-প্যাকেজটাও তো বেশ ভালো। সুতরাং কম্পিটিটরও অনেক থাকবে। একটু এদিক-ওদিক হলেই চাকরিটা হাতছাড়া হয়ে যাবে মাম্মা। আমি কোনও রিস্ক নিতে চাই না। তুমি শুধু আঙ্কলকে একটু বলে রেখো। আমি যাচ্ছি। বাই মাম্মা।’ বলেই তাড়াতাড়ি করে চলে গেল তনু। আজ ওদের পিকনিক না কি যেন একটা আছে।

‘তনু শোন তো… আমি…’ বাকি কথাগুলো গলার মধ্যেই কাঁটা হয়ে বিঁধে রইল। এক তো কিছু শোনার আগেই তনু বেরিয়ে গেল, দ্বিতীয়ত রান্নাঘর থেকে দুটো জাজ্জ্বল্যমান সন্দিগ্ধ চোখ আমাকে যেন বিঁধতে থাকল। মনের মধ্যে ঢেউয়ের মতো উথালপাতাল চলল। দু-ঠোঁট আর এক করতে পারলাম না। কোনও অপরাধ না করেই, অপরাধীর মতো কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে থাকার মতো অবস্থা হল আমার।

কী করব ভেবে পাচ্ছিলাম না। একদিকে একমাত্র মেয়ে, অন্যদিকে আমার আদর্শবাদী নিয়মনীতি। যদি মেয়ের পক্ষে যাই, তাহলে বাকি জীবনটা আদর্শচ্যুত হওয়ার অপরাধবোধে ভুগতে হবে, আর যদি মনের কথা শুনি তাহলে, বাড়িতে অশান্তির পারদ চড়তেই থাকবে। যা হবে হবে। স্থির করলাম, নিজের সিদ্ধান্ত থেকে একপাও নড়ব না।

এইভাবেই কেটে গেল আরও তিন-চার দিন। এই ক’দিনের আত্মসংঘর্ষই আমাকে বয়েসের তুলনায় আরও বৃদ্ধা বানিয়ে তুলেছিল। বাড়িতে একটা অদ্ভুত ধরনের শান্ত পরিবেশ তৈরি হয়েছিল। হয়তো সুনামির আগের পরিস্থিতির মতোই। পাঁচদিনের দিন কলেজ থেকে ফিরে টিভিটা খুলে বসতেই, সবিতাও চা দেওয়ার বাহানায় মাটিতে বসে পড়ল। ঠিক সেই সময় তনু ছুটে এসে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরল। ও যে কখন দরজা খুলে ঘরে এসেছে কিছুই টের পাইনি।

‘ওহ্ মাম্মা, আমি সিলেক্ট হয়ে গেছি, কালই জয়েন করতে হবে। আমার ফ্রেন্ডসার্কেলে কারওরই হয়নি। আমি তোমাকে বলে ছিলাম না যে জবরদস্ত কম্পিটিশন হবে। তুমি হেল্প না করলে চাকরিটা আমি পেতাম না। লভ ইউ মাম্মা।’

আনন্দে আটখানা হয়ে গলা জড়িয়ে আমাকে আদর করতে থাকে তনু। ঠিক সেই সময় পাশে দাঁড়ানো সবিতার তির্যক চোখের দিকে চোখ পড়তেই আঁতকে উঠলাম। এমন তাচ্ছিল্যপূর্ণ দৃষ্টি সত্যিই অসহ্যকর। মুহূর্তেই যেন আকাশ থেকে মাটিতে কেউ ফেলে দিয়ে গেল আমাকে।

‘কী হল চুপ করে আছ কেন মা, কিছু বলো। তুমি না থাকলে তো…।’

‘তুই চাকরি পেয়েছিস তার জন্য আমি ভীষণ খুশি। কিন্তু একটা কথা তোকে না বলে পারছি না তনু। তোর চাকরির জন্য আমি কোনও তদবির করিনি। তুই তোর নিজের যোগ্যতাতেই চাকরিটা পেয়েছিস।’

কথাটা শুনেই তনু গলাটা ছেড়ে দিয়ে এক ঝটকায় একেবারে একহাত দূরে গিয়ে দাঁড়াল। ‘কী, তার মানে তুমি আঙ্কেলের সঙ্গে কথাই বলোনি।’ তনু নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে পারছিল না। ‘কিন্তু, কেন মাম্মা? তুমি তোমার মেয়ের জন্য এইটুকুও করতে পারলে না। আজ আমার চাকরিটা হয়েছে তাই, নাহলে! তোমার কাছে তোমার মেয়ের খুশি, ভবিষ্যৎ কিছু নয়? আমি ছাড়া এই পৃথিবীতে তোমার আছেটাই বা কে?’

‘শোন্ তনু’

‘কী শুনব?’

‘আমি বরাবরই চেয়ে এসেছি আমার মেয়েও আমার মতো আত্মসম্মান নিয়ে বাঁচুক। সারাজীবন আমাকে যেমন কারও কাছে মাথা নত করতে হয়নি, তেমনি আমার মেয়েও যেন জীবনে কারওর দ্বারস্থ না হয়। তাছাড়া, আমি যেখানে জানি, আমার মেয়ে যথেষ্ট মেধাবী। তার কারও সাহায্যের প্রয়োজন পড়বে না, তখন কেন?’

‘মেধা? সেটা তো পরের কথা মাম্মা। এখানে তো নিজের সবথেকে কাছের মানুষের উপর থেকে বিশ্বাসটাই উঠতে বসেছে। সত্যিটা স্বীকার করো না, যে তুমি তোমার আদর্শবাদী নীতির জন্য তোমার মেয়ের ভবিষ্যৎ নিয়েও ছিনিমিনি খেলতে রাজি। ছিঃ মাম্মা! তুমি এত স্বার্থপর? নিজের সন্তুষ্টির জন্য…’

‘আমি স্বার্থপর?’

‘এটা স্বার্থপরতা ছাড়া আর কী বলতে পারো? আমি এতদিন ভাবতাম পাপা নেই তো কী হয়েছে, আমার মা-ই আমার সব। কিন্তু আজ তোমার আদর্শের এই নাটুকেপনায় আমার সেই ভুল ভেঙে গেছে।’ রেগেমেগে নিজের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দেয়। মুহূর্তের মধ্যে চোখের সামনে সব অন্ধকার হয়ে গেল। মাথাটাও যেন বনবন করে ঘুরছে। কোনওরকমে সোফাটা ধরে বসে পড়লাম।

মিনিট পাঁচেক পরে একটু ধাতস্থ হলাম। চোখ খুলেই দেখি সবিতা কোমর বেঁধে একেবারে রেডি। আমি কিছু বলার আগেই সে বেশ দাপটের সঙ্গে বলতে থাকে, ‘আমি অশিক্ষিত, গাঁয়ের লোক আছি বটে, কিন্তু তোমাদের মা-মেয়ের এই নাটক খুব বুঝতে পারছি। আমরা ছোটো জাতের গরিব লোক বলে, সবাই আমাদের সঙ্গে এমনই ব্যবহার করে। আমারই বোঝা উচিত ছিল! মেয়ের জন্য সুপারিশ করতে একটুও বাধল না তোমার? রক্তের সম্পর্ক যে! যত আদর্শ, সিদ্ধান্ত সবই আমাদের মতো গরিব লোকেদের জন্য। বেচারা ভাই আমার, কোন মুখে যে গাঁয়ে ফিরবে! এসব তোমাকেই বা বলছি কেন, এসবে তোমার কী-ই বা যায় আসে। তোমরা তো আনন্দেই আছ না।’

এই অতর্কিত ঘটনায় উঠে দাঁড়ানোর ক্ষমতা প্রায় হারাতে বসেছি। বুঝতেই পারলাম না কীভাবে এক কল্পিত নাটকের চরিত্র হয়ে গেলাম আমি। আমার আত্মজ থেকে পরিচারিকা, সবার কাছেই অবিশ্বাসের পাত্রী হয়ে উঠেছি। ‘ঘুষ নেওয়া, তদবির করা অর্থাৎ যা কিছু-কে চরম অসম্মানের বলে যেনে এসেছি এতকাল, তা-ই আজ আমার জীবনের চূড়ান্ত ব্যর্থতার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বুকের বাঁদিকটা চিনচিন করছে। চোখ কেমন ঝাপসা হয়ে আসছে। তনু, সবিতা, ওই অচেনা লোকগুলো আঙুল তুলে কী যেন চিৎকার করে বলতে চাইছে। কোনও কিছু কানে ঢুকছে না আমার। বাবার উদাত্ত গলায় ফিরে ফিরে আসছে কবিতার লাইনগুলো… চিত্ত যেথা ভয়শূন্য উচ্চ যেথা শির/জ্ঞান যেথা মুক্ত সেথা গৃহের প্রাচীর…’।

 

কাঠগোলাপের গন্ধ

‘আমি সাইকেলে চেপে রাষ্ট্রপতির কাছে যাব, বুঝলে।’

উদয়কাকার মুখোমুখি সোফায় বসে আছি। তিনি আমার দিকে তাকিয়ে আছেন কিনা বুঝতে পারছি না। চোখে কড়া পাওয়ারের চশমা। তার পুরু কাচে মণিদুটো ভেসে রয়েছে। শার্টের নীচে ধুতি জড়িয়েছেন লুঙ্গির মতো করে। এক পা মেঝেয়, অন্য পা তার ওপরে পেঁচিয়ে রেখেছেন। ফোকলা মুখের দু’পাশে গাল বসে গিয়েছে। সেই গালে কয়েক দিনের সাদা কুচো দাড়ি।

আমার চোখ চলে গেল তার কাঁধ পেরিয়ে দরজার দিকে। সেখানে সাগ্নিক এসে দাঁড়িয়েছে। কাকা আমার দিকে ফিরে বসে আছেন বলে ছেলেকে দেখতে পেলেন না। সাগ্নিকও কথাটা শুনেছে। কেন-না আমার দিকে তাকিয়ে চোখ মটকে হাসল। ভাবখানা এমন– শুনলেন তো বাবার কথা!

আমি বললাম, ‘বয়স কত হল আপনার? সত্তর তো পেরিয়ে গেছেন। এখনও সাইকেল চালাতে পারেন আপনি?’

‘সেভেন্টি সিক্স। এখনও পারি তো। কিন্তু ওরা চালাতে দেয় না।’

বুঝলাম ওরা বলতে বাড়ির লোক। বলতেই হল, ‘সে আপনার কথা চিন্তা করে বলেই বলে, বারণ করে। এই বয়সে আর সাইকেল না-ই বা চালালেন। রাস্তাঘাটের যা অবস্থা।’

উদয়কাকা বললেন, ‘হ্যাঁ, রোজই তো কত লোক মারা যাচ্ছে অ্যাক্সিডেন্টে। খবরের কাগজে পড়ি। আমারও তো কতকাল বেঁচে থাকা হয়ে গেল। এখন থাকলেই বা কী, গেলেই বা কী। কিন্তু রাষ্ট্রপতির কাছে যাওয়াটা খুব দরকার।’

‘কী দরকার আমাদের বলা যাবে কি?’ বলতে বলতে সাগ্নিক এবার ঘরে ঢুকে এল।

উদয়কাকা ঘাড় ঘুরিয়েছিলেন। ছেলে এসে সোফার পাশের চেয়ারে বসল। তিনি বললেন, ‘বলে তোদের বোঝানো যাবে না।’

‘কেন? যাবে না কেন? আমরা কি মূর্খ?’

ছেলে ও বউমাকে নিয়ে উদয়কাকার কাছ থেকে বেশ কিছু কথা আমি আগেই শুনেছি। প্রশংসার কথা নয় সেসব। গোলমাল আঁচ করে তাড়াতাড়ি বললাম, ‘আপনার চোখের অবস্থা তো ভালো নয়। সাইকেল চালাবেন কী করে?’

এবার বুঝলাম কাকার চোখের মণিদুটো ছেলের দিক থেকে আমার দিকে ঘুরল। ‘হ্যাঁ, দুটো চোখেই গ্লুকোমা। দুটোতেই অপারেশন হয়েছে। কিছু তো হল না। ওষুধ দিয়ে দিয়ে ঠিক রাখতে হয়। তবে সাইকেল তো চালাব দিনেরবেলায়। রাতে তো চালাব না।’

‘চোখ সারিয়ে নিন না। তারপর না হয় দেখা যাবে।’

‘নাঃ, আর কত দিন বসে থাকব? আর সময় পাব কিনা তা তো জানি না।’

আমি হেসে ফেললাম। ‘তা রাষ্ট্রপতির কাছে যাবেন, সাইকেলেই যেতে হবে কেন? ট্রেনে যাবেন। রাজধানীতে উঠে সোজা রাজধানী।’

মাথা নাড়তে থাকলেন উদয়কাকা। ‘না, তা হবে না। আমি যা বলতে চাই, সাইকেলে গেলে তার গুরুত্বটা বোঝানো যাবে। কথাগুলো বলা দরকার। তুমি আমায় উৎসাহ দাও অত্রি। এবার বেরিয়ে পড়তে হবে।’

এ তো আচ্ছা লোক। আমাকেও জড়িয়ে নিচ্ছে। এ কি কোনও সাইকেল চালানোর কম্পিটিশন যে উৎসাহ দেব!

আমার এখন পঁয়তাল্লিশ। উদয়কাকার ছেলে আমার চেয়ে দু-তিন বছরের ছোটোই হবে। বছর পঁচিশ-তিরিশ কি তারও আগে দেখতাম পাড়ার মাঠে একজন সাইকেল নিয়ে এসেছে। ক্লাবের সঙ্গে কথা বলে সে একটা ব্যানার টাঙিয়ে দিত। সেখানে লেখা থাকত– কাহারও কোনওরূপ সাহায্য না লইয়া বাহাত্তর ঘণ্টা অবিরাম সাইকিলিং। দিনরাত সেই লোক সাইকেল চালিয়ে যেত। তার বুকে-পিঠে সেফটিপিন দিয়ে সাঁটা থাকত কয়েকখানা সার্টিফিকেট। আর সেসবের ফাঁকে ফাঁকে দশ টাকা, পাঁচ টাকার নোট। সে সাইকেলেই খেত, তার ওপর বসেই নীচে থেকে কায়দা করে বালতি তুলে মাথায় জল ঢেলে স্নান সারত। পেচ্ছাপ করার সময় মাঠের ধারে কাপড় ঘেরা একটা জায়গায় চলে যেত। সাইকেলে বসেই ঘুমোত কিনা জানি না। কারণ সেটা দেখার জন্য অনেক রাত অবধি অপেক্ষা করে আমরা বন্ধুবান্ধবরা বাড়ি চলে আসতে বাধ্য হতাম। শুধু পাড়ায় নয়। বেপাড়ার মাঠে কিংবা রাস্তার ধারেও এ জিনিস দেখেছি। একবার সাইকেল না চালানোও দেখেছিলাম। মানে একজন সাইকেল নিয়ে একজায়গাতেই দাঁড়িয়ে ছিল সারাক্ষণ। মাঝে মাঝে সামান্য প্যাডেল করত। বোধহয় তার মেয়াদ কম ছিল। চব্বিশ ঘণ্টা হবে। সবই তখন বিস্ময়। আমরা গিয়ে দাঁড়ানোয় ওরা নিশ্চয়ই উৎসাহ পেত। কিন্তু ছিয়াত্তর বছরের এক বুড়ো মানুষকে সাইকেল চালিয়ে দিল্লি যাওয়ার ব্যাপারে এই রবিবারের সকালবেলায় আমি কী বলব! উঠে পড়লাম।

উদয়ভানু পালের সঙ্গে আমার মোলাকাত হয়েছিল বছর তিনেক আগে এলাহাবাদের কুম্ভমেলায়। আমি থাকি বেহালা থানার পিছনে বারিকপাড়ায়। আর উনি ঠাকুরপুকুরের কাছে গৌরনগরে। যদিও দেখা হল কুম্ভে। এরকম তো হয়। বেহালার কত লোক হয়তো ওই কুম্ভেই গিয়েছিল। কারও সঙ্গে কারও দেখা হয়নি।

বাবা-মাকে নিয়ে যাব। মেয়ের পরীক্ষা বলে বউয়েরও যাওয়ার উপায় ছিল না। যাব কিন্তু কোথাও থাকার জায়গা পাচ্ছি না। এক সাংবাদিক বন্ধুকে ধরলাম। সে এক আশ্রমের কথা বলে হাতে একটা চিরকুট ধরিয়ে দিল। সেখানে ওই উদয়ভানু পালের নাম লেখা। বন্ধু বলল, ‘আমি আশ্রমে কথা বলে নিয়েছি। তোরা এর সঙ্গে গিয়ে দেখা করলেই ব্যবস্থা হয়ে যাবে।’

ব্যবস্থা হয়েছিল। আমি আর বাবা এক তাঁবুতে। মা মেয়েদের জায়গায়। উদয়কাকা বাবার চেয়ে দু’বছরের ছোটো। দেখলাম দু’দিনেই দুজনের বেশ জমে গিয়েছে। আমার সঙ্গেও গল্প করতেন। রান্নার ঠাকুর থেকে বাজার করার লোক অবধি সকলকে ডেকে ডেকে আলাপ করিয়ে দিয়েছিলেন। একদিন দেখলাম কয়লা কিনতে যাচ্ছেন। আর একদিন দেখলাম টেম্পোরারি পায়খানার দরজা খুলে গিয়েছে বলে নিজে হাতে সারাচ্ছেন। খাওয়ার সময় মাটিতে পাত পড়ত। তার আগেই উদয়কাকা এসে আমাদের বলে যেতেন। বিকেলের চা আর বিস্কুট নিয়ে আসতেন নিজের হাতে করে। তখনও দেখেছি সময় সময় চোখের ড্রপ নিতে। পরে জেনে অবাক হলাম উনি ওই আশ্রমের কেউ নন। এক মাস জমাদার আর অন্য কাজের লোকদের কাজকম্ম দেখাশোনার জন্য এসেছেন। ফ্রি সার্ভিস। নিজে নিজে তো আসতে পারতেন না তাই আশ্রমের মারফত হয়ে আসা। হেলথে চাকরি করতেন। জিবি রায়-তে ছিলেন, আরজি কর-এও।

তখনই জানতে চেয়েছিলাম, ‘এসব করতে কুম্ভে এলেন আপনি!’

উনি বললেন, ‘কেন, কী হয়েছে। সবাই তীর্থ করতে আসে, আমি কাজ করতে এসেছি। ভালো লাগলে এই আশ্রমেরই দীক্ষিত হয়ে যাব। যেখানে খুশি যাওয়া যাবে। রিটায়ারের পর থেকে তো আমি বেকার।’

ফিরে আসার পর উদয়কাকার যাতায়াত শুরু হয়েছিল আমাদের বাড়ি। একলাই আসতেন বেশিরভাগ। বারদুয়েক কাকি এসেছিলেন। বাবা-মাও গিয়েছে কয়েকবার। আমিও। দেড় বছর হল বাবা মারা গিয়েছে। উদয়কাকার আসাও কমেছে। আমারও অফিস আছে। সংসার আছে। জ্বর-পেটখারাপ আছে। মেয়ের টিউশনি আছে। মায়ের ডাক্তার আছে। পুজোর বাজার আছে। এরমধ্যেই একদিন সাগ্নিকের ফোন। ‘বাবার মনে হয় মাথাখারাপ হয়ে গেছে। আপনি একদিন আসতে পারবেন অত্রিদা?’

মাথাখারাপের ব্যাপারটা বিশ্বাস করিনি। ভেবেছিলাম সাংসারিক কোনও গোলমাল হয়েছে। এসে দেখি সাইকেল ও রাষ্ট্রপতি।

সপ্তাহ তিনেক পরেই উদয়কাকা আমাদের বাড়িতে এসে হাজির। শুধু এসেছেন বললে ভুল হবে। সাইকেলে সওয়ার হয়ে এসেছেন। আমার বউ নবীনা দরজা খুলতেই তিনি বললেন, ‘অত্রিকে একবার বাইরে আসতে বলবে বউমা?’

বেরোতেই তিনি সাইকেলের সিটে এমনভাবে চাপড় মারলেন যেন ঘোড়ার পিঠ থাবড়াচ্ছেন। ‘কেমন দেখছ? হারকিউলিস। এ জিনিস আর এখন পাবে না। তুমি চালিয়েও দেখতে পারো। এখনও যথেষ্ট মজবুত।’

জিনিসটা কতটা শক্তপোক্ত রয়েছে তার সাক্ষাৎ প্রমাণ দিতে উনি সাইকেল চালিয়ে এতটা চলে এলেন! বললাম, ‘ভেতরে আসুন। সাইকেলটা সিঁড়ির নীচে রাখুন।’

উদয়কাকা ঢুকতে ঢুকতে বলে যাচ্ছিলেন, ‘আমাদের দেশ ছিল ময়মনসিংহ। কিশোরগঞ্জ সাব ডিভিশন। গ্রাম জঙ্গলবাড়ি। তোমার বাবা জানতেন। বলেছিলাম।’

আমিও জানি। এখন আবার সে কথা তুললেন কেন কে জানে। নবীনাকে চা করতে বললাম। মা দোতলায়। অস্টিও আর্থ্রাইটিসে কাবু। উদয়কাকা ডাইনিং রুমের চেয়ারেই বসে পড়লেন। হাঁফাচ্ছেন। চিবুকের তলা দিয়ে নেমে যাওয়া শিরাদুটো কাঁপছে।

বললাম, ‘আপনার সাইকেলটা সত্যি ভালো আছে দেখলাম। অত পুরোনো বলে মনেই হয় না।’

উদয়কাকা ছেলেমানুষের মতো খুশি হলেন। ‘আছেই তো। সিক্সটি থ্রি-তে কেনা। তখন আমরা মানকুন্ডুতে থাকি। বাবা ওখানেই তখন প্র্যাকটিস করতেন তো। আমি সবে চাকরি পেয়েছি আরজি কর-এ। ডেলি প্যাসেঞ্জারি করি। বাবা মারা যাওয়ার পরে যখন কলকাতায় চলে এলাম তখন অনেকদিন সাইকেলটা বস্তাবন্দি ছিল। তারপর ঝেড়েমুছে, তেলটেল দিয়ে দাঁড় করালাম। পিছনের চাকার টায়ারটিউব নষ্ট হয়ে গেছিল। সারালাম। ছেলেকে এই সাইকেলেই চালানো শিখিয়েছিলাম।’

এইসময় আমার মেয়ে দোতলা থেকে নেমে এল। তাকে দেখেই উদয়কাকা কাছে ডাকলেন। ‘এসো দিদিভাই, কেমন আছ তুমি? লেখাপড়া কেমন চলছে?’

সঞ্জনা মাথা নেড়ে হেসে বলল, ‘ভালো।’

‘কোন ক্লাস হল তোমার?’

‘এইট।’

‘বেশ বেশ। তা তুমি তো দেখছি মাথায় অনেকখানি লম্বা হয়ে গেছ। বাবাকে ধরে ফেলো এবার।’

মেয়ে আমার দিকে তাকাল। ‘ধরে ফেলতাম তো। বললাম আমাকে একটা সাইকেল কিনে দাও। দিচ্ছে না।’

‘অ্যাঁ, সে কী! এ তো ভারি অন্যায়। কেন দিচ্ছে না?’

নবীনা বলল, ‘দেব যে, চালাবে কোথায়? রাস্তায় ছাড়া জায়গা তো নেই। যেভাবে গাড়ি চলে, ভয় করে। তাছাড়া ও এখন বড়ো হচ্ছে কাকা। একা একা এই বয়েসের মেয়েকে ছাড়া যায়, বলুন? দেখছেন তো চারদিকে কী অবস্থা!’

উদয়কাকার মুখ ভারী হয়ে এল। ‘শুধু এই বয়েসের কেন? কোন বয়েসের মেয়েই বা নিরাপদে থাকতে পারছে বউমা? আমাদের সব দাঁত নখ বেরিয়ে পড়েছে।’

সঞ্জনা এখন সবই বুঝতে পারে। সে কোনও কথা না বলে সরে যেতে চাইছিল। উদয়কাকা বললেন, ‘তোকে একটা মজার কথা বলি শুনে যা মা। এই একটু আগে তোর বাবাকে বলছিলাম। আমাদের দেশের বাড়ি ছিল ময়মনসিংহ। তোর ঠাকুমারও কিন্তু তাই।’

‘জানি তো। বাংলাদেশে।’

‘ঠিক বলেছিস। তা বুঝলি, আমার বাবা ইংরাজি শেখাতেন– আমার মানুষরা গান গায়। মাই মেন সিং। মানে কী হল? ময়মনসিং।’ হা হা করে নিজেই হেসে উঠলেন উদয়কাকা। তারপর থেমে বললেন, ‘জগদীশচন্দ্র বসু, আলাউদ্দিন খাঁ, উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী, নীহাররঞ্জন রায়, ফণিভূষণ চক্রবর্তী, শৈলজারঞ্জন মুখোপাধ্যায়, জয়নাল আবেদিন– সব ময়মনসিংহ। আরও কতজন আছেন। গর্ব হয় না, বল? কী সব মানুষ!’

সঞ্জনা চলে যেতে আমি বললাম, ‘আপনার বাবা তো ফুটবল প্লেয়ার ছিলেন, না কাকা?’

চা শেষ করে কাপ নামিয়ে উত্তেজিত গলায় তিনি বললেন, ‘অ্যাই, তখন যে তোমায় বলছিলাম না দেশের কথা, কেন জানো? সাইকেল চালিয়ে আসতে আসতে, এই তোমাদের বাড়ির কাছেই, হঠাৎ কাঠগোলাপের গন্ধ পেলাম। দেখি এক বাড়ির পাঁচিলের ওপাশে গাছটা মাথা তুলেছে। মোটা মোটা পাতা হাওয়ায় দুলছে। এর আগে যে তোমাদের বাড়ি এসেছি, তখন বোধহয় ফুল ফোটেনি গাছটায়। আমাদের গ্রামের বাড়িতে একটা কাঠগোলাপের গাছ ছিল। হলুদ-সাদা, গোলাপি-সাদা ফুল। তার গন্ধ এত সুন্দর। হঠাৎ কোথাও কাঠগোলাপের গন্ধ পেলে ছেলেবেলা মনে পড়ে যায়। বাবার কথাও মনে পড়ে গেল। ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল থেকে পাশ করে বাবা এখানে এসে সুরেন্দ্রনাথে ভর্তি হন। এসেই খেলা। ইউনিভার্সিটি চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর হরপ্রসাদ শাস্ত্রী প্লেয়ারদের সঙ্গে ছবি তুলেছিলেন। তাতে আমার বাবাও আছেন। বাবার নাম ছিল দেবেন্দ্র পাল। সবাই বলত ডি পাল। গ্রিয়ার স্পোর্টিংয়ে খেলতেন। গ্রিয়ার স্পোর্টিং ছিল মিত্তিরদের। পুরো নামটা মনে পড়ছে না। ওই যাদের লক্ষ্মীবিলাস তেল গো–।’

লক্ষ্মীবিলাস বলতে এবার আমার নাকে কবেকার একটা গন্ধ ভেসে এল। মাকে মাখতে দেখেছি ছোটোবেলায়। ঘন, খয়েরি রং। কবিরাজি দোকানের ভেতরে গেলে ওই গন্ধটা পাওয়া যায়। সেসব দোকান আর নেই বললেই চলে। লক্ষ্মীবিলাসও ধুয়ে গিয়েছে।

উদয়কাকা তখনও বলে যাচ্ছিলেন, ‘খেলতে খেলতে বাবা পরে যান ইস্টবেঙ্গলে। সেন্টার ফরোয়ার্ড পজিশনে খেলতেন। নাইন্টিন টোয়েন্টি থ্রি কী ফোর হবে, মোহনবাগানকে হারান এক গোলে। বাবাই গোল করেছিলেন। পরে যদিও ব্ল্যাকওয়াচ টিমের কাছে হেরে যান।

সে যাই হোক। বাবা পরে ডাক্তারিও পড়েছিলেন। জাহাজের ডাক্তার ছিলেন। সারা পৃথিবী ঘুরেছেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বর্মায়। যশোরে যখন ছিলেন তখন বিধানচন্দ্র রায় গেছিলেন সেই হাসপাতালে। বাবা রোজ ব্যায়াম করতেন। ভালো স্বাস্থ্য ছিল। বলতেন, দ্যাখ, আমি খেলেওছি, আবার ডাক্তারিও করেছি। মনের জোর থাকলে মানুষ কী না করতে পারে। এক জায়গায় নিজেকে বদ্ধ রাখলেই মুশকিল। কোনও কাজ করার ইচ্ছে থাকলে সেটা করে ফেলার দিকেই যেতে হবে তোমায়। আর আমায় দ্যাখো অত্রি, জীবনের বেশিটাই চাকরিতে চলে গেল। এক এই সাইকেল চালানো ছাড়া আর কোনও যোগ্যতা আছে আমার, বলো?’

কাকাকে এগিয়ে দেওয়ার জন্য বাড়ি থেকে বেরিয়ে হাঁটছিলাম। উনি সাইকেল নিয়ে পাশে পাশে। বললাম, ‘এই যে আপনি বেরিয়ে পড়তে চাইছেন, আপনার বাড়ির লোকেদের তাতে দুশ্চিন্তা হবে না? তারা কখনও আপনাকে এভাবে ছেড়ে দিতে পারে?’

উদয়কাকা বললেন, ‘ছেলে-বউমা দুজনেই চাকরি করে। তাদের সন্তান হয়নি, তাতে নিশ্চয়ই দুঃখ আছে। তা নিয়ে আমি বা তোমার কাকিমা কোনও কথা বলি না। কিন্তু বউমা রান্নাবান্না, বাজারহাট, ঘর সাজানো গোছানো– সব নিয়ে তার শাশুড়ির সঙ্গে খিটখিট করে। মশারি টাঙানো নিয়ে পর্যন্ত ছেলে তার মায়ের সঙ্গে ঝগড়া করে। একদিন বলল, তোমাদের জঙ্গলে রেখে আসা উচিত।’

আমি বললাম, ‘সব সংসারেই এরকম কিছু না কিছু হয় উদয়কাকা।’

উনি মানলেন না। বললেন, ‘একসঙ্গে থাকতে গেলে ভাব ভালোবাসা রেখে থাকতে হবে তো। সে কি তারা বোঝে? ছেলে দারুণ সেতার বাজাত। আমি সেতার বয়ে নিয়ে নিয়ে যেতাম তাকে শেখাতে। ভেবেছিলাম সে বড়ো শিল্পী হবে। হয়নি। বাজনা ছেড়েই দিয়েছে। ডালহৌসিতে একটা চাটার্ড ফার্মে কাজ করে। এই চাকরির কী মানে? ওই অর্থের মানে কী? ছেড়ে দিলেই বা কী আসে যায়? আবার শুরু করতে পারে না নতুন করে? বেঁচে থাকার কারণটা কী? আমি বেরিয়ে পড়লে প্রভা হয়তো চিন্তা করবে। কিন্তু ওরা সত্যি সত্যি চিন্তা করবে আমার জন্য? বিশ্বাস হয় না। ওই যে আশ্রমের হয়ে আমি কাজ করতাম– কত জায়গায় তো গেছি– গয়ায়, হরিদ্বারে, উজ্জ্বয়িনীতে, নৈমিষ্যারণ্যে– কখনও খোঁজ নিয়েছে আমার? জানতে চেয়েছে বাবা কেমন আছ? গয়ার রাস্তায় দেখেছিলাম একটা ছেলে চিরুনি বাজাচ্ছে মুখ দিয়ে, আর একজন মাটির হাঁড়ি। রাগ যোগিয়া বাজাচ্ছে বুঝলে! যে যা পয়সা দেয়। ভেবেছিলাম ওদের বাড়ি নিয়ে আসব তুলে। তা তো হওয়ার নয়। কিন্তু ওরা রাস্তার ধারে বসেও পারছে তো! একবার বালামৌ স্টেশনে আটকে পড়েছিলাম। পরদিন সকালের ট্রেনে নৈমিষ্যারণ্যে যাব। সেখানে যিনি স্টেশনমাস্টার ছিলেন তিনি রিটায়ারের পরও পাশেই থাকেন। জমি কিনেছেন। নিজে হাতে ধান চাষ করেন। আমাদের সেই চালের ভাত রেঁধে খাওয়ালেন। ইচ্ছে থাকলে পারে না লোকে?’

জানতে চাইলাম, ‘সাগ্নিক বলছিল আপনি এখন আর আশ্রমের কাজেও যান না, সত্যি?’

‘নাঃ, যাই না আর। রিটায়ারমেন্ট-এর পর অনেকগুলো বছর শুধু শুধুই কেটে গেছে। তারপর ওই আশ্রমে গেলাম। কাজ করতে চেয়েছিলাম। বলে বটে মানুষের মধ্যে ঈশ্বরের বাস কিন্তু মানুষকেও দ্যাখে না, ঈশ্বরকেও দ্যাখে না। শুধুই আড়ম্বর। ঈশ্বরে বিশ্বাস রাখাও খুব শক্ত। যে কৃষ্ণ ভজনা করে সে চতুর। যে জানে সে ভজনা করে তার আবার ভজনা কীসের?’

কাকার কথা শুনে বুঝলাম ওখানেও কোথাও একটা কাঁটা আছে। আমি আর খোঁচালাম না। কথা ঘুরিয়ে দেওয়ার জন্য বললাম, ‘আপনি যে সাইকেল চালিয়ে দিল্লি যাবেন ভাবছেন, কতটা রাস্তা জানেন?’

‘জানি তো। বাই রোড এক হাজার চারশো ঊনআশি কিলোমিটার। নিরামিষ খাই। হাতে-পায়ে যা জোর আছে তাতে করে দিনে কুড়ি কিলোমিটার চালাতে পারব মনে হয়। আমি মিস্ত্রির সাথে কথাও বলেছি। একটা ছাতা লাগাতে হবে সিটের সঙ্গে। কিছু জিনিসপত্র রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। এক্সট্রা ক্যারিয়ার লাগবে।’

সেরেছে। ইনি তো দেখছি অনেক এগিয়ে গিয়েছেন। বললাম, ‘আপনি রাষ্ট্রপতির কাছে যেতে চাইছেন কেন? কারণটা কী?’

উদয়কাকা দাঁড়িয়ে পড়লেন। ‘শোনো, আমার এক বন্ধু ছিল– সত্য গুপ্ত। একসঙ্গেই চাকরি করতাম জিবি রায়-তে। সে ব্যাচেলার লোক। ছবি কেনার নেশা ছিল শুধু। তাই দিয়ে ঘর সাজাত। ভীষণ মুখ খারাপ করত, সোজা কথা সোজা বলে দিত। মানে কোনও সত্যই তার মুখে গুপ্ত থাকত না। একবার ইনজেকশনের স্টকে একটা গরমিল ধরা পড়ল। সত্য তো যা তা বলতে শুরু করল। কয়েকজন ধরা পড়ে পড়ে। তাকে বদলি করে দিল দূরে। সে যাবে না। মাইনে বন্ধ। কাউকে ধরাকরাও করবে না। ওর হয়ে আমি রাইটার্সে ধরনা দিলাম। তখন হেল্থ মিনিস্টার ননী ভট্টাচার্য। রাইটার্স থেকে আমায় বলল, উদয়বাবু আপনার বন্ধুকে ঠোঁট সেলাই করতে বলুন। আপনি এত হাঁটাহাঁটি করেছেন বলে দূরের বদলি ক্যানসেল করে ওকে মেডিকেলে দেওয়া হল।’

একটু থামলেন উদয়কাকা। তারপর আবার বললেন, ‘কত তো দেখলাম। সবাই চায় অন্যের ঠোঁট যেন বন্ধ থাকে। কিন্তু আর তো পারা যাচ্ছে না অত্রি। এই আমাদের দেশ! রোজ কাগজে, টিভিতে দেখছি আর শিউরে উঠছি। রোজ ধর্ষণ আর খুন, দাঙ্গাও হচ্ছে– সে খবর লুকিয়ে যাচ্ছে– কিন্তু হচ্ছে তো। চারপাশ একেবারে দুর্নীতিতে ছয়লাপ হয়ে গেছে। ঘুষ ছাড়া কেউ নড়ে না। যে যাকে পারছে ঠকাচ্ছে। টাকার লোভে মানুষ পাতালে তলিয়ে যাচ্ছে। টেকনোলজির যে এত উন্নতি, তা দিয়ে গরিব মানুষের কিছু হচ্ছে কি? কারা ফল পাচ্ছে তার?’

আমার কেমন রাগ হয়ে গেল। বললাম, ‘এসব তো অনেকদিন ধরেই ঘটছে। আপনাদের সময় সবাই কি সাধুপুরুষ ছিল?’

‘না, মোটেও নয়। কিন্তু এত নোংরামি ছিল না। তুমি হিসেব নিয়ে দ্যাখো। এত পাবে না। যত দিন যাচ্ছে, সব দিকেই মানুষের বিকৃতি বেড়েই চলেছে। ঈশ্বরে বিশ্বাস নেই কারও। ধর্মেও নয়। এখন পাপ করেঞ্জভাবে ভগবানের সামনে গিয়ে দাঁড়ালেই সব মাফ। কাল আবার নতুন পাপ করা যাবে। আর ঠোঁট সেলাই করে রাখা যাচ্ছে না অত্রি।’

‘আপনি কি এসব কথা বলতে যাবেন রাষ্ট্রপতিকে?’

‘হ্যাঁ। বলব– কী হচ্ছে এসব?’

‘কী লাভ হবে বলে? উনি তো হাত ধরে সকলকে আইনের পথে, সততার পথে, ন্যায়ের পথে নিয়ে আসতে পারবেন না।’

‘জানি পারবেন না। কিন্তু আমার উদ্বেগ আমি জানাতে পারব না?’

আমি মানুষটাকে ভালো করে দেখলাম। ওর কি সত্যিই মাথায় গোলমাল দেখা দিচ্ছে? না কি নিজের বিশ্বাসের এতটাই জোর যে অনায়াসে এসব কথা বলে যাচ্ছেন?

তখন উনি বললেন, ‘শোনো অত্রি, আমি এখনকার ছেলেমেয়েদের জীবনের উদ্দেশ্য বুঝি না। গরিব-বড়োলোক, শিক্ষিত-অশিক্ষিত– সবার রুচি একইরকম লাগে। তারা ভবিষ্যতে কী করবে আমি জানি না। কিন্তু আমি এখনই এসব কথা বলতে চাই। আর বললে রাষ্ট্রপতিকেই বলব।’

‘রাষ্ট্রপতি আপনার সঙ্গে দেখা করবেন কেন?’

উদয়কাকা যেন খুব অবাক হওয়ার মতো একটা কথা শুনছেন, এভাবে তাকিয়ে রইলেন আমার দিকে। তারপর বললেন, ‘কেন দেখা করবেন না? একজন সিনিয়র সিটিজেন আরেকজন সিনিয়র সিটিজেনের সঙ্গে দেখা করবেন না?’

আমার কথা এবার বন্ধই হয়ে গেল। এই লোককে আর কী বলা যেতে পারে! ফিরে যাব ভাবছি, তখন উদয়কাকা নাক টেনে বলে উঠলেন, ‘আহা! আবার সেই গন্ধ। পাচ্ছ তুমি? কাঠগোলাপের গন্ধ। ওই যে গাছটা। এখন আর এ গাছ দেখাই যায় না। রেয়ার হয়ে গেছে। এক একটা শব্দ, গান, গন্ধ– কী যে করে দেয়।’

আমি কোনও গন্ধ পাইনি। সে কথা ওকে বলা গেল না। উদয়কাকা চলে যাওয়ার পর আমি তার কথাই ভাবতে ভাবতে বাড়ি ফিরে এলাম। উনি যা নিয়ে বলছেন তা তো আমরাও জানি। কিন্তু কিছু বলতে পারি কই? আর সাইকেল ও রাষ্ট্রপতির ব্যাপারটাকে তো লোকে খ্যাপামিই বলবে।

মাস খানেক পর একদিন সকাল ন’টায় সাগ্নিকের ফোন। ‘অত্রিদা, বাবাকে পাওয়া যাচ্ছে না। সাইকেলটাও নেই। আসবেন প্লিজ?’

স্কুটার বের করে পৌঁছলাম উদয়কাকার বাড়ি। সাগ্নিক বলল, ওরা ভেবেছিল কাছেই কোথাও গেছে। সাইকেলটা নেই দেখে সন্দেহ বেড়েছে।

আমি বললাম, ‘এত আগ বাড়িয়ে ভাবছ কেন? হয়তো এদিক-ওদিকেই গেছেন সত্যি। এর আগে তো একদিন আমার বাড়িতেই গেছিলেন সাইকেলে।’

সাগ্নিক তখন বলল, ‘না, এবার তা নয়। একটা ব্যাগে জামাকাপড় ভরে নিয়ে গেছেন। চোখের ড্রপটাও।’

চুপ করে রইলাম। উদয়কাকা এভাবে সবাইকে বিপদে ফেলল? সাগ্নিককে বললাম, ‘স্কুটার তো রয়েইছে, একবার বেরিয়ে দেখি চলো।’

বেরিয়ে পড়লাম। কিন্তু তখনই মনে হতে লাগল– কোথায় খুঁজব? বিশেষ করে যদি কেউ ইচ্ছে করেই হারায়। কোন রাস্তায় গিয়েছেন তা কি বোঝা যাবে? সাগ্নিক মাঝে মাঝে মোবাইল থেকে বাড়িতে ফোন করছিল। ওদিক থেকেও কোনও খবর নেই। আশপাশের তল্লাট হাঁটকেও উদয়কাকার দেখা মিলল না। ঘুরতে ঘুরতে ডায়মন্ডহারবার রোডের অনেকখানি চলে গেলাম। আচমকা সাগ্নিক চেঁচিয়ে উঠল– ওই বাঁদিকে চলুন তো। ওই যে, ওই সাইকেলটা।’

স্পিড বাড়িয়ে কাছাকছি পৌঁছে দুজনেই হতাশ। নাঃ, দূর থেকে দেখে ভুল হয়েছিল। চুলটা ওইরকমই খোঁচা খোঁচা, গড়নটাও লম্বাটে ধাঁচের, বয়েসও কাছাকাছিই হবে, কিন্তু ইনি উদয়ভানু পাল নন।

সাগ্নিক বলল, ‘ঘুরিয়ে নিন। আপনাকে আর কষ্ট দেব না। দেখি অপেক্ষা করে। না হলে সেই থানাপুলিশ করতে হবে।’

ফিরে আসছিলাম। কেন জানি মনে হল, ওই বুড়ো লোকটা না হয় উদয়কাকা নন, কিন্তু উনিই বা সাইকেল নিয়ে যাচ্ছেন কোথায়? কোনও কাজে বেরিয়েছেন? না কি উনিও দিল্লি যাচ্ছেন? এরা কি এক এক করে বেরিয়ে পড়ছে না কি? এই রাস্তায়? তা হলে কি অন্য কোথাও? অন্য কারও সঙ্গে দেখা করতে?

থানায় খবর দিতেই হয়েছিল সাগ্নিককে। আত্মীয়স্বজনের বাড়ি। হাসপাতাল। মর্গ। সেই আশ্রমেও গিয়েছিল। তাদের শাখাপ্রশাখাকেও জানানো হয়েছিল। উদয়কাকার খোঁজ পাওয়া যায়নি। এমনকী চার-পাঁচ মাস পেরিয়ে যাওয়ার পরেও কোনও খবর পাওয়া গেল না।

এ সময়ের মধ্যে কোথাও কিছু বদলায়নি। দিন ও রাত নিজেদের নিয়মেই আসাযাওয়া চালু রেখেছে। কত অয়েলক্লথ কেনা হয়েছে, কত শবযাত্রা গিয়েছে। সরু গলি ও বড়োরাস্তায় কত উৎসব হয়েছে। এখন শুধু আমি মাঝে মাঝেই কাগজ পড়ার সময় রাষ্ট্রপতির ছবি দেখলেই বাড়তি ঝুঁকে পড়ি। কোনওদিন হয়তো দেখব ছবি ছাপা হয়েছে– হাস্যমুখ রাষ্ট্রপতির সঙ্গে হাত মিলিয়ে ফোকলা গালে হাসছেন উদয়কাকা। সাইকেল বুড়োর গালে সাদা কুচো কুচো দাড়ি। চোখে পুরু কাচের চশমা।

তেমন কিছু দেখতে পাই না। কে জানে। এত বড়ো দেশ। হয়তো উদয়কাকা ঘুরতে ঘুরতে যাচ্ছেন সাইকেল নিয়ে। আরও অনেকের সঙ্গে দেখা করবেন। কথা বলবেন। একদম শেষে পৌঁছবেন রাইসিনা হিলে। বলেছেন যখন, তখন যাবেন নিশ্চয়ই। অপেক্ষায় থাকি।

 

মাঝেমধ্যে হয়

প্রায় ফাঁকা লেডিস কম্পার্টমেন্টটার দিকে তীব্র ঈর্ষার দৃষ্টিতে তাকিয়ে পার হতে গিয়েই বিপদটা ঘটল। আসলে… আটটা পঁচিশের কাটোয়া লোকাল ভায়া ব্যান্ডেল, এক নম্বর প্ল্যাটফর্ম থেকে ছাড়বে। কৃপয়া ধ্যায়ান দে… শোনা মাত্র হাওড়া স্টেশনের কয়েক হাজার লোক মুহূর্তে তাদের নখ দাঁত বার করে হুড়মুড় করে ছুটতে শুরু করল এক নম্বর প্ল্যাটফর্মের দিকে। যেন এটাই পৃথিবীর শেষ ট্রেন। চুয়ান্ন বছরের সুতনু চক্রবর্তীও সেই ভিড়ে ডুবেছিলেন মিনিটকয়েক আগে। আজ কপালটাই খারাপ। মনে মনে নিজের কপাল এবং অফিসের মালিক দিনেশ পরশরামপুরিয়াকে দুটো মোক্ষম গালাগাল দিয়ে একগলা ভিড়ে ভাসতে ভাসতে এগোচ্ছিলেন প্ল্যাটফর্ম বেয়ে। এত দেরি রোজ হয় না। সাতটা চল্লিশ কিংবা সাতটা পঞ্চান্নর ট্রেনটা ধরেন উনি। আজ অফিস থেকে বেরোনোর শেষ মুহূর্তে মালিক ডাকলেন। কেজরিওয়ালের ফাইলটা আপডেট করে দিতে বললেন। ব্যস, করতে গিয়ে দেরি হয়ে গেল। যার ফল পেটে গুঁতো, পায়ে বুটের মাড়ানো, পিঠে ক্রমাগত ধাক্বা। শালা আর সয় না। কুত্তার জাত সব।

ওই ভাবেই এগোতে এগোতে আচমকা পিছনের কোনও সহমর্মী সহযাত্রীর ধাক্বায় দুটো কম্পার্টমেন্টের মাঝখানের ফাঁকায় মুখ থুবড়ে পড়ে যাচ্ছিলেন তিনি। প্রচণ্ড ভয়ে চোখ বুজেও ফেলেছিলেন সঙ্গে সঙ্গে। তারপর চোখ খুলে বুঝলেন যে এযাত্রায় বেঁচে গেছেন। উনি লাইনের ওপর নয় একটা কম্পার্টমেন্টের দরজা গলে ফুটবোর্ডের ওপর পড়েছেন। তার ওপরেই থেবড়ে কয়েক মুহূর্ত বসে রইলেন। তারপর উঠলেন। মাথাটা পুরো ঘেঁটে গেছে। আর একটু হলে কী বিপদটাই না হচ্ছিল! এ কামরাটা পুরো ফাঁকা। কেন? তার মানে লেডিসে ঢুকে পড়েছেন। জিআরপি দেখতে পেলে অপমানের একশেষ। দরজা দিয়ে বাইরে উঁকি দিলেন। না ওই তো ঠিক পিছনের কামরাটাতেই ধাক্বাধাক্বি করে সব মহিলারা উঠছেন। তার মানে ওটা লেডিস বগি। তাহলে এটা?

চোখের সামনে দিয়ে লক্ষ লক্ষ লোক বন্যার তোড়ে খড়কুটোর মতো ভেসে যাচ্ছে কিন্তু এদিকে কেউ তাকাচ্ছেও না। আশ্চর্য তো। তাহলে ডেফিনিট… হয় বমি না হয় পায়খানায় ছড়াছড়ি হয়ে রয়েছে বগিটা। চারদিক দেখলেন। নাহ তাও নেই।

ভুতুড়ে ব্যাপার ভেবে নেমে যেতে গেলেন ঠিক তক্ষুনি আবার একটা ছেলে হুড়মুড়িয়ে এসে পড়ল কামরাটাতে, একদম সুতনুর স্টাইলেই। পড়েই আবার চট করে উঠে দাঁড়াল। সুতনুর মতোই গোটা কামরাটাকে এদিক-ওদিক ভালো করে দেখল অবাক হয়ে। সুতনুও বেশ মনোযোগ দিয়ে দেখলেন ছেলেটাকে। বড়ো জোর আঠেরো থেকে কুড়ি বছর বয়স হবে। রোগাপ্যাংলা চেহারা। কালো রঙের একটা টি-শার্ট আর জিন্স-এর প্যান্ট। সরু থুতনিতে খানিকটা দাড়ি। আর পিঠে একটা ইয়া লম্বা কালো ব্যাগ। দেখেই বোঝা যায় ওটার ভেতর গিটার জাতীয় কিছু একটা আছে। ছেলেটা সুতনুকে জিজ্ঞেস করল, কাকু ডিসপুট কেস নাকি?

অ্যাঁ!

মানে পটি-টটি পড়ে রয়েছে কি?

জানি না। দেখলাম তো নেই।

ছেলেটা শ্রাগ করল, তারপর জানলার ধারের একটা সিটে বসে উলটো দিকের সিটের ওপর সটান নিজের পা-দুটো তুলে দিল। এখানেই শেষ নয়, টুক করে পকেট থেকে একটা মোবাইল বার করে তার গুঁজে গান চালিয়ে দিল। উফ্ এই এক অসহ্য হয়েছে। এখনকার জেনারেশন যেন গান ছাড়া থাকতেই পারে না। গানের তালে তালে মাথা ঝাঁকাচ্ছে ছেলেটা। সুতনু ভুরু কুঁচকে কয়েক মুহূর্ত দেখলেন তারপর অন্যদিকে তাকালেন। ভেতরে একটা চাপা টেনশন হচ্ছে। একটা লোকও কেন উঠছে না কম্পার্টমেন্টটায়! ঘড়ি দেখলেন। আটটা পঁচিশই বাজে। একবার ভাবলেন নেমে যাবেন, দরকার নেই বাবা এমন কিম্ভূত কামরায় বসে। তার থেকে ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে যাওয়াও ভালো।

ভাবা মাত্রই উঠে দাঁড়ালেন উনি, আর সঙ্গে সঙ্গে ট্রেন ছাড়ার হুইসেল দিল। বাধ্য ছেলের মতো আবার সিটে বসে পড়লেন সুতনু।

ট্রেনটা অলস্টপ তো কাকু? জিজ্ঞেস করল ছেলেটা।

হুঁ।

ওক্বে। আবার গান শুনতে মগ্ন হয়ে গেল। এমন যে একটা আশ্চর্য বিষয় ঘটছে সে বিষয়ে কোনও ভ্রূক্ষেপই নেই ওর। আশ্চর্য জেনারেশন! অবাক হতেই ভুলে যাচ্ছে এই নতুন প্রজন্মটা।

ট্রেনটা ছাড়ল। বাইরের লোকের আরও ঠেলাঠেলি দৌড়াদৌড়ি। যেভাবে হোক এই ট্রেনে উঠতেই হবে। সুতনু মনেপ্রাণে চাইছিলেন কামরাটা আর পাঁচটা কামরার মতোই ভিড়ে ভিড় হয়ে যাক। দরকার হলে নিজের সিটটা কাউকে ছেড়ে দিয়ে দাঁড়িয়ে যেতেও রাজি উনি। কিন্তু কেউই উঠল না।

আর ঠিক তখনই আবার একজন মহিলা হুমড়ি খেয়ে পড়লেন ফুটবোর্ডে। কাঁধের ব্যাগটাও পড়ল ছিটকে। বেকায়দায় পড়ার জন্য উঠে দাঁড়াতে পারছিলেন না। ট্রেন স্পিড নিয়ে নিয়েছে এবার। প্ল্যাটফর্ম পেরিয়ে গেল। মহিলাকে উঠতে সাহায্য করার জন্য সুতনু সবে উঠে দাঁড়াতে যাবে, তার আগেই ওই ছেলেটা ঝট করে গিয়ে ওঁকে তুলে ধরল। মনে মনে বেশ খানিকটা খুশি হলেন সুতনু। যাক ছেলেটার মধ্যে এই ফিলিংসটা অন্তত রয়েছে এখনও। ভদ্রমহিলার বয়স সুতনুর কাছাকাছি হবে। ছোটোখাটো, ভারী চেহারা। একমাথা কোঁকড়া চুলের বেশ কয়েকগাছির রং রুপোলি। খুব সাধারণ একটা শাড়ি। কপালে, সিঁথিতে সিঁদুর নেই। ছেলেটার হাতে হাত রেখে সামান্য খুঁড়িয়ে এসে সিটে বসল। সুতনুর সঙ্গে চোখাচুখি হতেই সুতনু জিজ্ঞেস করলেন, লেগেছে?

নাহ্, তেমন কিছু না। এই গোড়ালিটায় শুধু…।

জল দেবেন? রয়েছে আমার কাছে।

না না থাক।

কারশেড পেরিয়ে গেল ট্রেন। চারদিকে অন্ধকারের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকা উঁচু উঁচু ল্যাম্পপোস্টের নিয়ন আলোগুলো আপ্রাণ হলদে আলো স্প্রে করছে চারিদিকে।

এই বগিটায় আর কেউ উঠল না?

মহিলার প্রশ্নে সামান্য হাসলেন সুতনু। সে প্রশ্ন তো আমাদেরও। কেন ওঠেনি কে জানে। তবে নোংরা-টোংরা কিছু পড়ে নেই সেটা দেখে নিয়েছি।

শুনে মহিলা যে খুব আশ্বস্ত হলেন তা নয়। বেশ কিছুক্ষণ তিনজনেই চুপ। ট্রেনটা দুরন্ত গতিতে ছুটছে। রোজের তুলনায় অনেকটা বেশিই স্পিড। বাইরের কিছুই দেখা যাচ্ছে না। লিলুয়া স্টেশন আসতে আর কতদূর? ভাবতে ভাবতেই আচমকা আবার সুতনুর চোখের সামনে একটা কাগজ ভেসে উঠল। বিবর্ণ হলুদ হয়ে যাওয়া একটা কাগজ। তার মধ্যে নীল রঙের পেনসিলে আঁকা প্রায় ক্ষয়ে আসা একটা ছবি। একটা বাড়ির ছবি। উফ্ফ আবার। মাথা ঝাঁকিয়ে দৃশ্যটাকে ভুলতে চাইলেন। হারামজাদা যখন তখন এসে মনের ভেতরটাকে মুহূর্তে পুড়িয়ে দিয়ে যায়। বিড়বিড় করে বলে উঠলেন, দূর হ দূর হ।

কিছু বললেন?

মহিলার কথায় হুঁশ ফিরল সুতনুর। না না কিছু না।

আজ বড়ো দেরি হয়ে গেল আমার। নইলে রোজ সাতটা পঁচিশের কাটোয়াটা ধরি। বললেন মহিলা।

ও আচ্ছা।

আপনি কোথায় নামবেন দাদা?

শ্রীরামপুর।

অ, আমি নামব ভদ্রেশ্বর। এ্যাই ছেলে তুই কোথায় নামবি।

কানের থেকে হেডফোনটা নামিয়ে ছেলেটা জিজ্ঞেস করল, কিছু বললেন?

উফ্ তোদের এই সারাক্ষণ এক কেতা হয়েছে কানের মধ্যে তার গুঁজে রাখা। আমার ছোটো ছেলেটাও দিন-রাত এই কানে মোবাইল ঠুসে বসে থাকে। কাজকম্ম নেই খালি…।

ছেলেটা কিছু উত্তর দিল না, শুধু হাসল।

তুই নামবি কোথায়?

রিষড়া।

গান করিস নাকি?

না, আমি গিটার বাজাই, আমাদের একটা ব্যান্ড আছে।

অ। তা বেশ, গানবাজনা নিয়ে আছিস। আমার ছেলেটা যে কী করে কে জানে। জিজ্ঞেস করলে বলে ব্যাবসা করছে। এমন ব্যাবসা যে মাস গেলে একটা টাকারও মুখ দেখি না। আর পারি না। তেইশ বছর ধরে এই যাতায়াত। কবে যে শেষ হবে? নিজের মনেই বিড়বিড় করলেন উনি।

কোথাও গেছিলেন?

হ্যাঁ, এত বছর ধরে যেখানে যাই, সেখানেই।

ও, অফিস?

ধুস অফিস! ওসব তো আপনারা করেন। আমি পগেয়াপট্টিতে একটা শাড়ির দোকানে কাজ করি। কত্তা ওখানেই কাজ করতেন। দুম করে চলে গেলেন একদিন। দুটো ছেলেকে নিয়ে আমি তখন অথই জলে। পেট চালাতে ওই দোকানে ঢুকে পড়েছিলাম। সেই চলছে। বলে বড়োসড়ো একটা নিশ্বাস ফেললেন উনি। সুতনু শুনছিলেন আর খানিকটা কষ্টের সঙ্গে সঙ্গে অবাকও হচ্ছিলেন। মহিলা ওদের চেনেন না, ওরা কেউই কাউকে চেনে না, সম্পূর্ণ অপরিচিত পরস্পরের, অথচ কী নির্দ্বিধায় অনায়াসে নিজের দুঃখের কথা বলে গেলেন। হয়তো এই কথা জীবনে বহু মানুষকে বহুবার শুনিয়েছেন, তাই বলাটা অভ্যাস হয়ে গেছে, কিংবা হয়তো কেউ নেই ওর কথা শোনার জন্য। তাই অপরিচিত দুজনকে এইটুকু সময়ের মধ্যেই যতটা সম্ভব মনের কষ্ট উগরে দিয়ে খানিকটা হালকা হতে চাইলেন। আর ক’টাইবা স্টেশন। যে যার মতো নেমে যাবে। আর কোনওদিন দেখাই হবে না হয়তো পরস্পরের সঙ্গে। কিন্তু লিলুয়া এখনও এল না কেন? জানলা দিয়ে বাইরে তাকালেন সুতনু। এখন বাইরের অন্ধকারটা আরও গভীর। অবিশ্বাস্য গতিতে ছুটছে ট্রেনটা। হাওয়ার ঝাপটা লাগছে চোখে মুখে। এত অন্ধকার কেন? আর ট্রেনটা…

কাকু, আমার কিন্তু কেস একটু লোচা লাগছে। বলেই সিট ছেড়ে উঠে গিয়ে দরজার সামনে গেল ছেলেটা। ঝুঁকে বাইরে দেখতে গেল। অমনই হাঁ হাঁ করে উঠলেন মহিলা। আরে রে ওই ছেলে করিস কী? এত ওস্তাদি কীসের তোর? ওইভাবে চলন্ত ট্রেন থেকে কেউ বাইরে ঝোঁকে? চুপ করে এসে বোস বলছি। যখন স্টেশন আসার ঠিক আসবে।

ছেলেটা আবার এসে বসল।

নাম না জেনেই বকা দিয়ে দিলাম, কী নাম তোর?

শীর্ষ বন্দ্যোপাধ্যায়।

বাহ সুন্দর নাম। আমার বডো় ছেলে দুবাইতে থাকে, সোনার কাজ করে। ওর নাম দেবাশিস। অনেকদিন আসে না বাড়িতে। ভুলেই গেছে মাকে। বিয়েও করেছে, একটা ছোটো ছেলেও হয়েছে। ফোন করে জানিয়েছিল আর ওদের একটা ফটো পাঠিয়েছিল একবার। ব্যস ওইটুকুই। আজ পর্যন্ত সামনাসামনি বউমা-নাতির মুখ দেখিনি। আর ছোটো ছেলেটার নাম শুভাশিস। শুভ বলে ডাকি। এক নম্বরের বিচ্ছু। তোরই বয়সি। বাড়িতে কে কে আছে তোর? প্রশ্নটা করার সঙ্গে সঙ্গে সেকেন্ডের মধ্যে চোখ-মুখ শক্ত হয়ে গেল ছেলেটার। খুব সংক্ষেপে স্পষ্ট করে বলল, কেউ নেই।

মানে! মুখ ফসকে প্রশ্নটা বেরিয়ে গেল সুতনুর।

মানে আমি যে-বাড়িতে থাকি সেখানে আমার কেউ নেই।

ও। তোর বাড়ি এখানে নয় তাহলে? ভাড়া থাকিস বুঝি একা? বাবা এইটুকু বয়সে…।

শীর্ষ মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, না বাড়িতে সকলেই আছে, বাট আমি একা।

সে আবার কী কথা!

আমার বাবা-মা নোবডি লাইক মি। বাট আই ডোন্ট কেয়ার।

ধ্যাত তাই আবার হয় নাকি। বলে ফেললেন সুতনু।

হ্যাঁ হয়। অন্তত আমার ক্ষেত্রে তাই হয়েছে।

তুই কী করিস বাবা?

ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ি।

বাহ্ খুব ভালো, মন দিয়ে পড়াশোনা কর, অনেক বড়ো মানুষ হ।

করি তো। কিন্তু আমার বাবা-মা কেউ চান না আমি গানবাজনা করি। আমার বাড়িতে কোনও বন্ধুদের আসা বারণ। তাদের মতে আমার ফ্রেন্ডসরা সব স্পয়েল্ড। ডিসগাসটিং…।

ওহ ওটা কোনও ইস্যু না। সব বাবা-মায়েরাই তাদের সন্তানদের নিয়ে একটু আধটু চিন্তায় থাকেন। ঠিক হয়ে যাবে।

কিচ্ছু ঠিক হবে না কাকু। আমি ওদের চিনি। আমার বাড়ি ঢুকতে ইচ্ছে করে না। তবু শালা রোজ… সরি। বলে চুপ করে গেল শীর্ষ। বাইরের দিকে তাকাল।

সুতনু হাঁ করে তাকিয়ে রইলেন। এইটুকু ছেলে, ওর ওই বয়সেই এত দুঃখ! এখনই বলে বাড়ি ঢুকতে ইচ্ছে করে না! আর গত কুড়ি বছর ধরে সকালবিকেল, সারা রাত ধরে মনের মধ্যে যে স্বপ্ন-বাড়ির প্ল্যানটাকে বয়ে বেড়াচ্ছেন, তার কথা কেউ জানে? জীবনের পঞ্চান্নটা বছর পার হয়ে গেল দেড়খানা রুমের ঘুপচি ভাড়া বাড়িতে। খুব সখ ছিল নিজের মনের মতো একটা বাড়ি বানানোর। দেড় কাঠা জমিও কিনেছিলেন অনেক কষ্ট করে, তাও আজ থেকে বছর দশেক হল। বাড়ির প্ল্যান তৈরি হল। সবে বাড়ির কাজে হাত দেবেন ভাবছেন ঠিক তখনই স্ত্রী তনুশ্রী পড়ল কঠিন অসুখে। ব্রেস্ট ক্যানসার। বছর দুই ধরে যমে মানুষে টানাটানির পর তনু সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরল ঠিকই কিন্তু ততদিনে সুতনুর জমানো সমস্ত পুঁজি হাসপাতাল-ডাক্তার আর ওষুধের দোকানে। আর জমল না। নিজেকে বহু বুঝিয়েছেন সুতনু, টাকা গেছে যাক, বাড়ি নাই বা হল, মানুষটা তো ফিরে এসেছে। তবু এমন একটা দিনও যায়নি, যেদিন ইঞ্জিনিয়ারের বানিয়ে দেওয়া সেই বাড়ির প্ল্যানটা চোখের সামনে ভেসে ওঠে না। পৃথিবীর কেউ জানে না, মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেলে তনুকে লুকিয়ে, সেই প্ল্যানের পুরোনো হয়ে যাওয়া বিবর্ণ কাগজটা আলমারির থেকে বার করে লাইট জ্বালিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা তাকিয়ে থাকেন নিঃসন্তান সুতনু, আজও।

মন খারাপ করিস না রে, এই নে বিস্কুট খা, বলে নিজের জীর্ণ ঘসা ব্যাগটার ভেতর থেকে একটা ছোটো বিস্কুটের প্যাকেট বার করে সেখান থেকে দুটো বিস্কুট বাড়িয়ে দিলেন মহিলা।

না না আমি কিছু খাব না।

পাকামো করিস না তো। যা দিচ্ছি খা।

শীর্ষ সামান্য হেসে বিস্কুট দুটো নিল। নীচু স্বরে বলল,থ্যাংক ইউ।

খুব হয়েছে। খেয়ে ফেল। জল রয়েছে আমার কাছে। এই নিন আপনিও খান দুটো।

আরে না না। বলে উঠলেন সুতনু।

কেন বড়োদের বিস্কুট খেতে নেই নাকি? আমি তো সবসময় সঙ্গে রাখি। ডাক্তার বলেছেন একদম খালি পেটে না থাকতে। খুব গ্যাস-অম্বলের রোগ আমার।

সে আমারও। বলে বিস্কুট নিলেন সুতনু। কামড় দিলেন।

এই বাড়ি গিয়েই আবার রান্নাবান্না। ছেলে কখন ফিরবে কিছুই জানি না। আর ভাল্লাগে না। একটা কেউ নেই যে আমাকে একটু হেল্প করবে। ভেবেছিলাম দুই ছেলের বিয়ে দিয়ে বউমা-নাতি-নাতনি নিয়ে বাকি জীবনটা কাটিয়ে দেব… সবই কপাল আমার।

লিলুয়া কি পেরিয়ে গেল? জিজ্ঞেস করলেন সুতনু।

না না আর লিলুয়া আসবে বলে মনে হচ্ছে না। এটা শিওর ঘোস্ট কম্পার্টমেন্টে উঠেছি আমরা।

মানে? জিজ্ঞেস করলেন মহিলা।

ভূতের কামরা।

চুপ। রাত্তিরে এসব হাবিজাবি কথা কেউ বলে? আমার কিন্তু বাপু বেশ ভয় করছে এবার।

ভাগ্যিস আমি একা নই।

বাইরের লাইটগুলোও কিচ্ছু দেখা যাচ্ছে না এবার। বলল শীর্ষ।

তাই? বলে জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে উঁকি দিলেন সুতনু। সত্যিই তো, নিকষ অন্ধকার ছাড়া আর কিচ্ছু নেই। ট্রেনটা যেন আলোর গতিতে ছুটছে। এবার সত্যি সত্যিই ভয় লাগতে শুরু করল। ঘড়ির দিকে তাকালেন। যাব্বাবা ঘড়িটাও কখন যেন বন্ধ হয়ে গেছে। সেই আটটা পঁচিশই বেজে রয়েছে এখনও।

কী করা যায় কাকু? চেন টানব?

উঁ… চেন? টানো। অন্যমনস্কভাবেই উত্তর দিলেন সুতনু।

শীর্ষ উঠে দাঁড়িয়ে জানলার একটু ওপরে ঝুলতে থাকা চেনটা প্রাণপণে টানল। কোনও লাভ হল না। ট্রেনের একই গতি।

কী হবে গো তাহলে? আর ফিরতে পারব না বাড়ি? হাউমাউ করে উঠলেন মহিলা।

তাই আবার হয় নাকি। আমার মনে হচ্ছে আমরা ভুল করে কোনও দূরপাল্লার ট্রেনে চেপে বসেছি।

তিনজনেই একই ভুল করলাম? আর এক নম্বর প্ল্যাটফর্মে এত আগে কোনওদিন মেল ট্রেন দেয়? বললেন সুতনু।

হুম। কোনও উত্তর দিল না শীর্ষ। মোবাইলটা হাতে নিয়ে বলে উঠল যাব্বাবা, টাওয়ারও নেই।

এ সত্যিই ভূতের বগিতে উঠলাম নাকি? হে রামঠাকুর, হে লোকনাথবাবা রক্ষা করো বাবা…। কাঁদো কাঁদো স্বরে বলে উঠলেন মহিলা।

কেউ উত্তর দিল না। মনে হচ্ছিল যেন একটার পর একটা ছায়াপথ হুশ হুশ করে পেরিয়ে যাচ্ছে কামরাটা।

চুপ করে পরস্পরের গা ঘেঁসে বসেছিল তিনজন অসমবয়সি মানুষ।

তারপর হঠাৎ একটা সময় গতিটা যেন কমতে শুরু করল।

থামছে থামছে বলে চিৎকার করে উঠল শীর্ষ।

সত্যি সত্যিই থামল ট্রেনটা। না কোনও প্ল্যাটফর্মে না, বাইরেটা একই রকম অন্ধকার। সুতনু আর শীর্ষ ভুরু কুঁচকে তাকাল বাইরের দিকে। এটা আবার কোন স্টেশন। ওরা কেউ কিছু বলার আগেই আবার হাউমাউ করে উঠলেন সে মহিলা, আরে আরে একি একি, এটা আমার বাড়ি যে… ওই তো আমার দুই ছেলে! ও মা, বড়োছেলেটা কখন এল দুবাই থেকে? ওই দেখুন দাদা, আমার বউমা আর নাতি। হি..হি..হি… আমার ছোটোটার সঙ্গে কেমন খেলায় মেতেছে দেখুন, আমি চললাম। বলেই প্রায় একঝাঁপে কামরা থেকে নেমে গেলেন মহিলা। আর দেখা গেল না ওকে। মুহূর্তে অন্ধকারে মিশে গেলেন। সুতনু কিছু একটা বলতে গেলেন, গলা দিয়ে আওয়াজ বেরোল না। ট্রেন আবার ছেড়ে দিল।

দুজনেই চুপ করে বসে। সুতনুর কান-মাথার ভেতর থেকে গরম হাওয়া বের হচ্ছে টেনশনে। এসব কী হচ্ছে। এ কোন মৃত্যুকূপ! চোখ বুজে ইষ্টনাম জপ করতে শুরু করলেন উনি। চোখ বুজে গুরুদেবকে ডাকতে ডাকতে কখন যেন চোখ লেগে এসেছিল। আবার চটকা ভাঙল। ট্রেনটা আবার থেমেছে।

কাকু কি আশ্চর্য দেখুন! কান্ট বিলিভ!

কী হল আবার? জিজ্ঞেস করলেন সুতনু।

আমার বাড়ি।

তোমার বাড়ি? মানে… তোমারও কি মাথাটা..

না না আয়্যাম ফাইন। ওই দেখুন বাড়ির সামনে, বলে জানলা দিয়ে হাত গলিয়ে ঘুটঘুটে অন্ধকারে হাত বাড়াল শীর্ষ।

ওই দেখুন আমার বাড়ির সামনের লনটায় আমার সব বন্ধুরা রিহার্স করছে, আমার মা-বাবা শুনছে, কথা বলছে ওদের সঙ্গে! হোয়াট ইজ দিস! উত্তেজনায় প্রাণপণ চিল্লে উঠল শীর্ষ।

এটা বিভ্রম শীর্ষ।

না না ইট ইজ নট হ্যাল। ওই দেখুন রাতুল, অঙ্কন, শ্রীজা, দীপ সব্বাই রয়েছে, ওই দেখুন আমাকে দেখতে পেয়েছে ওরা… হেই দীপ, অর্ক… ওই দেখুন ওরা আমাকে ডাকছে। বাই কাকু, সি ইউ…  বলেই ট্রেন থেকে এক লাফ দিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল।

অসহায়ভাবে সেদিকে তাকিয়ে রইলেন সুতনু। ট্রেন ছেড়ে দিল। গোটা কামরাটায় সুতনু একা কিন্তু আশ্চর্য একটুও ভয় করছে না আর। বরং বড়ো অদ্ভুত ভালোলাগায় ভর্তি হয়ে উঠছে ভেতরটা। একটা ঝিম ঝিম ঘোর তৈরি হচ্ছে। আর কিছুক্ষণ পরেই…

হ্যাঁ আর কিছুক্ষণ পরেই সুতনু সিট ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। দরজার সামনে এসে দাঁড়ালেন। চারদিকে নরম আলো আর আলো। ট্রেনটা থেমেছে সুতনুর বাড়ির একেবারে সামনে। কয়েক পলক মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলেন সুতনু। চোখের সামনে তার সেই স্বপ্ন-বাড়ি, এতদিন পর কাগজের পৃষ্ঠা থেকে প্রাণ পেয়ে উঠে দাঁড়িয়েছে। সুতনু দেখতে পাচ্ছেন সেই ছোট্ট সুন্দর দোতলা বাড়ির ড্রয়িংরুম থেকে শোয়ার ঘর, ডাইনিং রুম থেকে কিচেন, টয়লেটের দুধসাদা টাইলস। বাড়ির সামনে ছোট্ট একটা বাগান। কিচেনে তনু কী যেন একটা রান্না করছে মন দিয়ে। মিষ্টি গন্ধ আসছে তার। আমার… শুধু এই শব্দটুকু বলে ট্রেনের বাইরে পা রাখলেন সুতনু।

এর ঠিক তিনদিন পরে দু-একটি খবরের কাগজের ভেতরের পাতায় খুব ছোট্ট করে একটা খবর প্রকাশ হয়েছিল…

গতপরশু রাত আটটা কুড়ি নাগাদ হাওড়া স্টেশনের এক নম্বর প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে থাকা আপ কাটোয়া লোকালের দ্বিতীয় মহিলা কামরা ও তার আগের কামরার মাঝামাঝি এক যুবক, এক মাঝবয়সি ব্যক্তি এবং একজন মহিলাকে সন্দেহজনকভাবে ঘুরঘুর করতে দেখা যায়। প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, ওই তিনজন প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে বেশ কিছুক্ষণ ধরেই দুই কামরার মাঝখানে আপ্রাণ কী যেন খোঁজার চেষ্টা করছিলেন। কিছুক্ষণ পর জিআরপি এসে তাদের তিনজনকে আটক করে। কোনও নাশকতামূলক চক্রান্তের ছক কষছিলেন কি না তাই নিয়ে তাদের পৃথকভাবে দীর্ঘক্ষণ জিজ্ঞাসাবাদ করার পর উক্ত তিনজনই এক উদ্ভট কল্পকাহিনির গল্প শোনান। পুলিশের অনুমান উক্ত তিনজনই মানসিক অবসাদগ্রস্ত। তিন ব্যক্তিকেই পরে ছেড়ে দেওয়া হয়। সবথেকে আশ্চর্যের ঘটনা, গতকাল হাওড়া স্টেশনে ঠিক ওই ট্রেনের ওই জায়গাতেই উক্ত তিনজনকে আবার দেখতে পাওয়া যায়, সঙ্গে আরও কয়েকজন বিভিন্ন বয়সের পুরুষ ও মহিলা, যারা একইভাবে ওই দুই কামরার মাঝখানে কিছু খুঁজছিলেন।

শীতল পরশ

সকাল থেকেই কেমন যেন গুমোট আবহাওয়া। আকাশে মেঘের ঘনঘটা। গাছের পাতা একেবারে স্তব্ধ। হাওয়ার লেশমাত্র নেই। সবমিলিয়ে বেশ একটা দমচাপা পরিবেশ।

এমনিতেই ক’দিন ধরে বাপ-ছেলের গন্ডগোলের জেরে মালার প্রাণ একেবারে ওষ্ঠাগত। বেচারা সবসময় ভয়ে-ভয়েই থাকে এই বুঝি আবার যুদ্ধ লাগল। তার উপর এরকম একটা ঝিমোনো পরিবেশে দমবন্ধ হয়ে আসছিল মালার। আজ মনটা কেমন যেন কু গাইছে তার। বোধহয় বড়ো কিছু হওয়ার একটা অশনি সংকেত পাচ্ছিল সে। যতই হোক মায়ের মন তো।

যা ভাবা ঠিক তাই। অতনু অফিস বেরোবার সময় রমাকান্তের মুখোমুখি। তিনি তখন প্রাতর্ভ্রমণ সেরে অন্যান্য দিনের মতোই বাজার করে ঘরে ঢুকছেন।

ছেলেকে দেখামাত্রই ভ্রূকুঞ্চিত করে, ‘কিছু ভাবলে?’

রমাকান্তের এই অ্যাটিটিউড-টাই পছন্দ নয় অতনুর। সবসময় একটা বসিং বসিং ব্যাপার। নিজের সিদ্ধান্ত অন্যের উপর জোর করে চাপিয়ে দেওয়া। কথা বলার ভঙ্গিও এতটাই খারাপ যে, যে-কোনও মানুষেরই মাথা গরম হওয়ার জন্য যথেষ্ট।

‘ভাবার কী আছে। তোমাকে তো আগেই বলেছি। বিয়ে আমি স্টেলাকেই করব।’ রাগত স্বরে জবাব দেওয়া মাত্রই গর্জে ওঠে রমাকান্ত। ‘রাসকেল! দুটো পয়সা উপায় করছ বলে কি ধরাকে সরা জ্ঞান করছ নাকি? শুনে নাও, ও মেয়ে কখনওই আমার বাড়ির বউ হয়ে আসবে না। এটাই আমার শেষ কথা।’

‘আনব না! তোমার গোঁড়ামো নিয়ে তুমিই থাকো। এই একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে শুধুমাত্র জাতপাতের দোহাই দিয়ে একটা মেয়েকে চিট করা, আমার পক্ষে সম্ভব নয়। সরি, যাকে এতদিন ভালোবেসে এসেছি, শুধুমাত্র তোমার অনর্থক জেদের কারণে তাকে আমি ছাড়তে পারব না’, বলেই পাশ কাটিয়ে অফিসের উদ্দেশ্যে রওনা দেয় অতনু।

অতনু আর রমাকান্তকে মুখোমুখি দেখেই বুকটা ছ্যাঁৎ করে উঠেছিল মালার। কেবল নির্বাক শ্রোতার মতো বাপ-ছেলের এই প্রহসন শুনতে শুনতে সে রীতিমতো ক্লান্ত। কাকে বোঝাবে? কে বুঝবে তার কথা। কেবলমাত্র ওই দীপ্তি ছাড়া। দীপ্তি, অতনুর ছোটো বোন। ওর থেকে বছর পাঁচেকের ছোটো। সেও তো বাবার ভয়ে তটস্থ। এই কোরো না সেই কোরো না। সন্ধে হলে মেয়েরা বাইরে বেরোবে কেন? কোনও ছেলের সাথে বন্ধুত্ব করবে না। ছেলেদের সঙ্গে মেয়েদের কখনওই বন্ধুত্ব হয় না।

অতনু যাওয়ার পর মাথা ধরে সোফার উপর বসে পড়ে মালা। মাইগ্রেন-এর ব্যথাটাও বেড়েছে বেশ কয়েকদিন হল। তার উপর এ-এক চিন্তা। এর যে শেষ কোথায় কে জানে! যত বয়স বাড়ছে লোকটা যেন আরও খিটখিটে হয়ে উঠছে। রিটায়ারমেন্ট-এরও আর মাত্র বছর চারেক বাকি। এখনই মাঝেমধ্যে শরীর বিগড়োচ্ছে, নতুন বিজনেসের কারণে অফিসে ইরেগুলার। রিটায়ার হওয়ার পর তাহলে কী হবে? তখন তো সারাদিন বাড়িতেই থাকবে। ভেবেই আতঙ্কে শিউরে ওঠে মালা। কী করবে এই লোকটাকে নিয়ে। এতদিন না হয় সে সবকিছু মুখ বুজে সহ্য করেছে। কিন্তু ছেলেমেয়েরা? আর কেনই বা তারা মুখ বুজে এইসব অন্যায় সহ্য করবে। না, আজ যেভাবেই হোক, অতনুর বাবার সঙ্গে কথা বলতেই হবে, যদি কিছু বোঝানো যায়। আজ তো অফিস যাবে না ঠিক করেছে, যে-কোনও সময় একবার…।

দুপুরবেলা রমাকান্তকে খেতে দিয়ে পাশে বসে মালা বলেই ফেলে কথাটা, ‘বলছি মেয়েটাকে একবার দেখতে দোষ কী? লেখাপড়া জানা মেয়ে। বাবুর অফিসে ভালো পদে আছে। শুনেছি দেখতেও ভালো। ব্যবহারটাও। অন্য জাতের হওয়াটা তো দোষের নয় বলো?’

চুপচাপ মাথা গুঁজে খেয়ে যাচ্ছিল রমাকান্ত। জাতপাতের কথা শোনামাত্রই ভাতের থালা ঠেলে সরিয়ে দিয়ে ফুঁসে ওঠে, ‘ছেলের হয়ে ওকালতি করতে এসেছ? তোমার জন্যই আজ বাবুর এই বাড়বাড়ন্ত। আমিও দেখছি ও কী করে ওই বেজাতের মেয়েকে বিয়ে করে!’

খেয়ে নেওয়ার জন্য মালার বারংবার অনুরোধ একপ্রকার উপেক্ষা করেই কলতলার দিকে চলে যায় রমাকান্ত। সে কোনও কিছুর বিনিময়েই স্টেলাকে মেনে নেবে না। তাই বোধহয় সবকিছু জেনেশুনে আজও ছেলের জন্য মেয়ে দেখে চলেছে।

সন্ধে সাতটা নাগাদ থমথমে মুখে ঘরে ফেরে অতনু। ছেলের চোখমুখ দেখেই হাত থেকে ব্যাগটা নিয়ে নেয় মালা। বলে, ‘তুই আগে বোস। জল দিই একটু জল খা। শরীরটা খারাপ লাগছে নাকি রে বাবু? সারাদিন ঠিকঠাক খেয়েছিস তো?’

‘শোনো মা, শোনো। আমার কিছু হয়নি। শরীর ঠিক আছে। তুমি আমার কাছে বসো, তোমার সাথে কথা আছে।’

‘কথা! কী কথা রে? পরে বলিস। আগে ঘরে যা, হাত-মুখ ধুয়ে একটু রেস্ট নে। তারপর না হয়…।’

‘না মা ঘরে যাব না। বলছি আমি একটা ফ্ল্যাট দেখেছি।’

‘কী দেখেছিস!’

‘ফ্ল্যাট।’

‘কী বলছিস বাবু। তুই কি পাগল হলি। তোর বাবার জন্য তুই আমাদের থেকেও…’ চোখে জল চলে আসে মালার।

‘না মা। শোনো আগে। এভাবে বোলো না। তুমি তো চাও, আমি একটু ভালো থাকি। শান্তিতে থাকি। রোজ বাবার এই গঞ্জনা, অশান্তি আমি আর সহ্য করতে পারছি না। একদিকে বাবার জেদ, অহংকার, অন্যদিকে ‘ওর’ ওই এক গোঁয়ারতুমি, বাবা আর্শীবাদ না করলে বিয়ের পিঁড়িতে বসবে না। দুজনের জেদাজেদিতে আমি হাঁপিয়ে উঠছি মা। অন্য জায়গায় গেলে অন্তত একটা দিক থেকে তো রেহাই মিলবে। এই বাড়িতে তো প্রাণখুলে শ্বাসও নেওয়া যায় না।

‘সবই তো বুঝলাম বাবু, কিন্তু তোকে ছেড়ে…’ কথা শেষ করতে পারে না মালা। দু-চোখ বেয়ে জল নেমে আসে।

‘আরে কাঁদছ কেন? আগে কথাটা শোনো। আমি কাছাকাছিই ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়েছি। যখনই মনে হবে তুমি আর ছুটকি চলে আসবে।’

ছেলের কথা ভেবে নিজেকে খানিক ধাতস্ত করে মালা, ‘যাবি কবে?’

মায়ের হাতদুটো ধরে অতনু জবাব দেয়, ‘আজই মা।’

‘আজই’, কাঁপা গলায় বলে ওঠে মালা।

একপ্রকার বুকের ওপর পাথর চাপা দিয়েই ছেলেকে বিদায় জানায় মালা। যাওয়ার সময় কয়েকটা প্রয়োজনীয় জিনিস এবং নিজের পোশাকআশাক ছাড়া কিছু সঙ্গে নেয়নি অতনু। রমাকান্ত বাড়ি ফিরলে ছেলের বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়া নিয়ে চলে আর এক প্রস্থ। আর সেটাই বোধহয় স্বাভাবিক– যার সম্বল কেবলমাত্র অহং আর জেদ, সেই অহংকারে আঘাত হানা– পারতপক্ষে ব্যাপারটা তার পক্ষে মেনে নেওয়া বেশ কঠিন।

ওদিকে রমাকান্ত অফিসে বেরোলেই সংসারের সমস্ত কাজকর্ম গুছিয়ে মালা সোজা ছেলের বাড়িতে। ঘরগোছানো, ছেলের জন্য রান্না করা। কখনও বা রান্না করে তার জন্য নিয়ে যাওয়া। কখনও দীপ্তির হাতে পাঠানো। তাছাড়া ফোন তো রয়েইছে। দেখতে দেখতে এইভাবেই বেশ কয়েকটা দিন কেটে গেল। এরই মধ্যে স্টেলার সঙ্গে পরিচয়ও হয়েছে। মা-মেয়ের বেশ ভালোই লেগেছে তাকে।

মাসখানেক হয়ে গেল বাবা-ছেলের দেখাসাক্ষাৎ নেই।

তার আড়াল-আবডালে যে কী চলছে, কিছুই জানতে বাকি রইল না রমাকান্তের। তবুও সবকিছু জেনেশুনে একপ্রকার না জানার ভান করা আর কী! হয়তো কিছুটা মন ও বয়সের ভারে, আবার কিছুটা কাজের চাপে। কথা ছিল অতনু আর রমাকান্ত দুজনে মিলে ব্যাবসাটা দাঁড় করাবে। কিন্তু নিজের জেদের কারণে সব জায়গায় একা একা দৌড়োনো, এই বয়সে বেশ সমস্যাই হচ্ছিল।

তাই অনেক ভেবেচিন্তে রমাকান্তই মালাকে বলে, ‘মালা অনেকদিন তো হল, তোমার সুপুত্তুরকে বলো বাড়ি ফিরতে।’

কথাটা শুনেই অবাক হয়ে রমাকান্তের দিকে তাকায় মালা।

‘আরে কী হল! তোমাকেই বলছি। এরকম অবাক হলে কেন? বলছি তোমার সপুত্তুরকে বলো এবার বাড়ি ফিরতে।’

‘আমাকে বললে?’

‘তবে কাকে বলছি, এখানে তুমি ছাড়া আর কেউ আছে নাকি?’

নিজেকে খানিক সামলে নেয় মালা, ‘যেতে যখন তুমি বলেছ, আসতেও তুমিই বোলো। তোমারই তো ছেলে। তুমি না বললে কী আর সে…।’

কোনও জবাব না দিয়েই রমাকান্ত উপরে ঘরের দিকে চলে যায়। সন্ধে সাতটা নাগাদ কাউকে কিছু না জানিয়ে সোজা অতনুর ভাড়া নেওয়া ফ্ল্যাটে হাজির রমাকান্ত। অতনু তখন সবেমাত্র অফিস থেকে ফিরেছে। উইদাউট এনি ইনফরমেশন বাবার হঠাৎ আগমনে, বেশ আশ্চর্য হয় অতনু।

‘চলো অনেক হয়েছে। জিনিসপত্র গোছাও আর বাড়ি চলো।’

‘না বাবা। আমি এখানেই ঠিক আছি। জাতপাত, বৈষম্য এসবের থেকে অনেক দূরে। এখানে আমি নিজের মতো ভাবতে পারি, সিদ্ধান্ত নিতে পারি। জোর করে কেউ কিছু চাপিয়ে দেয় না আমার উপর। আজ তোমার মনে হয়েছে তাই আনতে এসেছ, কাল মনে হলেই আবার লাথি মারবে। তোমার আমার মত কোনওদিনই মিলবে না। ভবিষ্যতে স্টেলাকে নিয়েও প্রবলেম হবে। আজ আমাকে অপমান করছ। বিয়ের পর স্টেলাকে করবে। সেটা আমি কখনওই মেনে নিতে পারব না। আমি যেমন আছি, ভালো আছি। প্লিজ আমাকে আমার মতো থাকতে দাও।’

‘এটা কী ধরনের অসভ্যতা। ইগো দেখাচ্ছ আমাকে। ইগো! একটা বেজাতের মেয়ের জন্য আমাকে অপমান করছ। রমাকান্ত সান্যালকে। এত বড়ো স্পর্ধা তোমার। দ্যাখো এবার আমি কী করতে পারি’, বলেই রাগে গটগট করতে করতে উলটো পায়ে ফিরে গেল রমাকান্ত।

বাড়ি ফেরার পর থেকেই মুখ গম্ভীর করে বসে থাকে রমাকান্ত। মালার বহুবার জিজ্ঞাসা করাতেও কোনও সদুত্তর মেলে না। কেবলই কী যেন ভাবতে থাকে।

দিন সাতেক পর একটি নামকরা দৈনিক পত্রিকাতে বড়ো বড়ো হরফে লেখা বেরোয়, ‘আমি শ্রী রমাকান্ত সান্যাল, মন্দিরতলা ফার্স্ট লেন, কামরাবাদ, সোনারপুর এলাকার বাসিন্দা, সজ্ঞানে আইন মারফত আমার পুত্র অতনু সান্যালকে (২৯) কে ত্যাজ্য করলাম। আমার স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি, কোনও কিছুতেই তার অধিকার রইল না।’

শ্রী রমাকান্ত সান্যাল

সকালেই সুশীলার ফোন। ‘কীরে দিদি, জামাইবাবু এটা কী করল?’ কিছু বোধগম্য হওয়ার আগেই রমাকান্তের চায়ের জন্য হাঁকডাকে ফোনটা কেটে দিতে হয়েছিল মালাকে। তারপর চা করার সময় উলটো দিকের বাড়ির গীতাও তার রান্নাঘর থেকে কী যেন একটা বলার চেষ্টা করছিল। প্রথমে বুঝতে পারেনি মালা। তারপর দুই নম্বর পাতায় আজকের খবরের কাগজটা দেখাল। চা দেওয়া হয়ে গেলে কৌতূহলবশত পাতাটা ওলটাতেই চক্ষু ছানাবড়া মালার। ‘এটা কী করল অতনুর বাবা। রাগ মেটাতে শেষপর্যন্ত এই পদক্ষেপ নিল লোকটা। কাগজটা হাতে করে জড়বতের মতো বসে রইল মালা। পাড়াপড়শি থেকে শুরু করে আত্মীয়স্বজন, সকলের প্রশ্নের জবাব দিতে দিতে সারাদিন পরিশ্রান্ত হয়ে গেল মালা। এখন ফোন ধরাও প্রায় ছেড়ে দিয়েছে সে। রিং হতেই থাকে। দীপ্তি থাকলে কখনওসখনও ধরে নয়তো কেটেই যায়।

দু-একজন শুভাকাঙক্ষীর পরামর্শে মালা আবারও স্বামীকে বোঝানোর চেষ্টা করে। ‘অনেক হয়েছে। এই বয়সে ছেলের বিরুদ্ধে কোর্টকাছারি করছ, সেটা কি ভালো দেখাচ্ছে। লোকে যে ছি ছি করছে।’

‘যা করছি ঠিক করছি। আমার ঘরের মান-সম্মান, সংস্কৃতি কোনও কিছুই আমি ক্ষুণ্ণ হতে দেব না। না পোষালে তুমিও যেতে পারো।’

এই ঘটনার পর থেকে মালা প্রায় নিজেকে ঘরবন্দি করে ফেলেছে। ওদিকে পাড়াপড়শি, আত্মীয়স্বজন ব্যাপারটা বেশ তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করছে। ঘরের শান্তির জন্য নিজের আত্মসম্মান শিকেয় তুলে দিয়ে সর্বদা স্বামী নামক জীবের হ্যাঁ তে হ্যাঁ মেলানো এ যেন তার জীবনের এক এবং একমাত্র কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অথচ দুটো মানুষ একেবারে দুই মেরুর। পছন্দ, চিন্তাভাবনা কোনও কিছুই মেলে না তাদের। তৎসত্ত্বেও জীবনের তিরিশটা বছর কাটিয়েছে একে-অপরের সঙ্গে। বিয়ের পর থেকেই লক্ষ্যহীনভাবে কেবলই পতিদেবতার কথা মতো কাজ করেছে।

সংসারে কোনওদিনই তার ইচ্ছে বা মতামত প্রাধান্য পায়নি। প্রথমদিকে রমাকান্তকে বদলানোর বহু চেষ্টা করেছে মালা। কিন্তু লাভের লাভ কিছুই হয়নি। সারাজীবন স্বামীর মিথ্যে অহংকারের তুষ্টির জন্য নিজের ইচ্ছের বলিদান দিয়ে এসেছে সে।

ভাগ্যের পরিহাসে এখনও তার জন্য অনেক কিছু অপেক্ষা করছে এই ধারণা মালার বদ্ধমূল ছিলই। এরই মধ্যে দীপ্তির পড়াশোনা কমপ্লিট হয়েছে। জোরকদমে মেয়ের বিয়ের জন্য দেখাশোনা শুরু করেছে রমাকান্ত। ব্যাবসার চাপ, পাত্র খোঁজা, অফিস– সব নিয়ে রমাকান্ত বেশ ব্যস্ত হয়ে পড়ে।

অঙ্কুশকে মনে ধরে রমাকান্তের। এক অফিস কলিগের ছেলের বিয়েতে তার সঙ্গে আলাপ। তারপর বন্ধু কেশবের থেকে জানতে পারে, অঙ্কুশ বেশ বড়োমাপের বিজনেসম্যান। শহরে বেশ নামডাকও আছে তার। ছেলে হিসেবেও নাকি ভীষণ ভালো, ভদ্র নম্র। যদি দীপ্তির এখানে বিয়ে হয়ে যায় তাহলে দীপ্তির ভাগ্য ফিরে যাবে।

বন্ধু কেশবকে সঙ্গে করে একদিন সোজা অঙ্কুশের বাড়িতে হাজির হয় রমাকান্ত। কেশবের সাহায্য নিয়ে যদি তার বাবার সাথে কথা বলে পাকাপাকি একটা ব্যবস্থা করা যায়।

সেইমতো প্রথমে সৌজন্যমূলক কথাবার্তার পর সম্বন্ধর কথা উঠতেই, অঙ্কুশের বাবা একেবারে সরাসরিই প্রশ্ন করে বসলেন, ‘কাগজে আপনিই নোটিশ ছাপিয়েছিলেন না? ছেলের সাথে কী এমন ঝগড়া?’

রমাকান্ত কী বলবে ভেবে পাচ্ছিল না। কোনওমতে কিছুটা থেমে জবাব দিল, ‘তেমন কিছু নয়। ব্যস ছেলের আর আমার মতের মিল একদমই হতো না। তারপর কথা বাড়তে বাড়তে…।’

‘ক্ষমা করবেন রমাকান্তবাবু। যে বাড়িতে বাপ-ছেলের সম্পর্ক আদালত পর্যন্ত গড়ায়, সে বাড়ির মেয়েকে আমি ছেলের বউ করে আনতে পারব না।’

অগত্যা মুখ চুন করে ফিরে আসে রমাকান্ত। তারপর থেকে যত সম্বন্ধ হয়েছে, ছেলের প্রসঙ্গ উঠতেই সে সম্পর্ক ভেঙ্গে গেছে।

মহা ফাঁপড়ে পড়েছে রমাকান্ত। কায়িক এবং মানসিক পরিশ্রমে কয়েকদিনেই আরও বুড়িয়ে গেছে সে। স্বাস্থ্যও ক্রমশ খারাপের দিকে যাচ্ছে।

বাল্যবন্ধু উমাচরণবাবু রমাকান্তের এই অবস্থা দেখে ঘর বয়ে এসে তাকে বুঝিয়ে গেলেন। ‘রমাকান্ত যুগ বদলেছে। তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মানুষের চিন্তাভাবনাও বদলাচ্ছে। এখনও সেই সেকেলে চিন্তাভাবনা নিয়ে বসে থাকলে চলবে কেন ভাই? দুনিয়াটা কত এগিয়ে গেছে বলোতো। মানুষের থেকে কি জাতপাত বড়ো হতে পারে? মনের এই সংকীর্ণতা থেকে বেরিয়ে এসে দ্যাখো, দুনিয়াটা তোমাকে স্বাগত জানাবে।’

‘কিন্তু বছরের পর বছর চলে আসা পরম্পরা, সামাজিক নিয়মে বাঁধা মন, এত সহজে কি শিকল কেটে বেরিয়ে আসতে পারবে?’ বিষাদময় কণ্ঠে জবাব দেয় রমাকান্ত।

‘জীবনের পঞ্চাশ-ষাটটা বছর তো এটা ভেবেই কাটিয়ে দিলে যে, লোকে কী বলবে? সংসারের কথা না ভেবে লোকের কথা ভাবলে বেঁচে থাকা মুশকিল হয়ে দাঁড়াবে, তা তো হাতেনাতে টের পেয়েছ। নতুন প্রজন্ম যদি পুরোনো নিয়মের বাইরে বেরিয়ে ভালো কিছু করতে চায়, তাতে বাধা দেওয়া কেন বাপু। লাইফটা যখন তোমার ছেলের, সে কার সাথে সংসার করবে না করবে সিদ্ধান্তটা তারই হওয়া উচিত। চেষ্টা তো করো। একবার মেয়েটার সঙ্গে দেখা করো। দ্যাখো তো ছেলের পছন্দটা কেমন।’

‘ঠিক আছে। চেষ্টা করব’, পাশের ঘরে বসে থাকা মালা ও দীপ্তি রমাকান্তের এই কথা শোনা মাত্রই আনন্দে আত্মহারা হয়ে উঠল। মালার চোখ ভরে এল জলে। দীপ্তি তো লাফিয়ে লাফিয়ে দাদাকেও ফোনে সব জানিয়ে দিল।

পরের দিন সন্ধেবেলা অতনুর রুমের ডোরবেলটা বেজে উঠল। সামনেই বড়োদিন। ভিতরে কয়েকজন বন্ধুবান্ধব মিলে তারই আয়োজন চলছে। ঠিক সেই সময় ডোরবেল বেজে ওঠাতে বেশ বিরক্তই হল তারা। ডোরবেলটা আবারও বেজে উঠল। দরজা খুলে বোকার মতো দাঁড়িয়ে রইল অতুন। সামনে বাবা। সে জানত বাবা আসবে, তবে এত তাড়াতাড়ি আশা করেনি। কোনও কথা সরছিল না তার মুখে। মিনিট দুয়েক-তিনেক এভাবে কেটে গেল। অতনুর কোনও সাড়াশব্দ না পেয়ে ভিতর থেকে কে যেন বলে উঠল, ‘কে এল রে অতনু?’

বন্ধুর আওয়াজে সম্বিৎ ফিরে পেল অতনু।

‘ওহ! বাবা তুমি, ভিতরে এসো।’

ভিতরে ঢুকেই রমাকান্তের চোখে পড়ল ড্রইংরুমে আট-দশজন অতনুর বন্ধুর মধ্যে তিনটি মেয়েও রয়েছে। নিজেদের মধ্যে হাসি-ঠাট্টা চলছিল। তাকে দেখামাত্রই যেন আনন্দে ভাটা পড়ে গেল। প্রথমেই সামনে বসা তিনটি মেয়ের দিকে নজর পড়ল রমাকান্তের। বোধহয় প্রবীণ চোখ বিশেষ কাউকে খোঁজার চেষ্টা করছিল।

‘বাবা ভিতরের ঘরে চলো।’

রমাকান্ত ভিতরের ঘরে গিয়ে চেয়ারে বসল।

‘এরা এক্ষুনি চলে যাবে। তুমি বসো, আমি আসছি।’

‘ঠিক আছে। আমি কিছুক্ষণ বসছি। তাড়াহুড়ো করার দরকার নেই। ওরা যাক, তারপর এসো।’ নিজের বিনম্র ব্যবহারে রমাকান্ত নিজেই অবাক হয়ে যায়। তার স্বভাব তো এমন নয়! বরং উলটোটাই। কোনওদিন তো তলিয়ে দেখেনি। উমাচরণ বোঝানোর পর কাল থেকে যত পিছন ফিরে তাকিয়েছে তত যেন নিজেকে দোষী বলে মনে হয়েছে। বারবার বাড়ির সকলের করুণ মুখগুলো ভেসে উঠেছে চোখের সামনে।

পাখার হাওয়ায় পর্দাটা উড়ছে। ফাঁক দিয়ে ড্রইংরুমের কিছুটা অংশ দেখা যাচ্ছে। তিনটি মেয়ের মধ্যে দুটিতে মিলে একটি মেয়েকে সমানে ক্ষ্যাপাচ্ছে। ওদের হাবভাবে, রমাকান্তের আর বুঝতে বাকি থাকল না ওই মেয়েটিই স্টেলা। বেশ সুন্দর, স্মার্টও। বাচ্চাদের নিজেদের মধ্যে খুনসুটি ভালোই লাগছিল তার। কোথাও একটা মনে হচ্ছিল এরা কত সুন্দর, প্রাণবন্ত। কত সহজ করে নিয়েছে এরা জীবনটাকে। সুন্দরভাবে একে অপরের সুখ-দুঃখ শেয়ার করতে পারে। নিজের কথা সবার সামনে বলার ক্ষমতা রাখে এরা। মনে পড়ে যায় স্ত্রী মালা এবং মেয়ে দীপ্তির কথা।

নতুন প্রজন্মে জাতিধর্মকে ছাপিয়ে গিয়ে মানব সম্বন্ধকে প্রাধান্য দেওয়া, মহিলা পুরুষদের সমতুল্য ভাবা– জাতিধর্মের বন্ধন থেকে বেরিয়ে এই ধরনের নতুন নতুন বিচার ঘুরতে থাকে রমাকান্তের মনে। পুরোনো ধ্যানধারণার উপর নতুন ধ্যানধারণা ভারী হয়ে দাঁড়ায়। এমন সময়, স্টেলা ঘরে ঢুকে পায়ে হাত দিয়ে নমস্কার করতেই চমকে ওঠে রমাকান্ত। আশীর্বাদ করার জন্য হাতটা বাড়াতে গিয়েও…।

‘কেমন আছ বাবা?’ প্রশ্নটা শোনামাত্রই স্টেলার দিকে অবাক নয়নে তাকিয়ে থাকে রমাকান্ত। কত আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে মেয়েটি বাবা বলে ডাকছে। আবার মিষ্টি স্বরে, ‘বাবা তোমাকে খুব ক্লান্ত লাগছে। একটু শরবত বানিয়ে দিই?’

‘না না কিছু লাগবে না।’

‘না, তা বললে তো হবে না। জানি তুমি লেবু দেওয়া চা খেতে ভালোবাসো, কিন্তু এই গরমে চা খেলে শরীর খারাপ করবে যে। আমি বরং শরবত বানিয়ে নিয়ে আসি।’

রমাকান্তর বিস্ময়ের শেষ থাকল না। এত সহজে কেউ আপন হয়ে উঠতে পারে! এইটুকু একটা পুঁচকে মেয়ে, শরীরে ভয়ের লেশমাত্র নেই। কোথায় তার নামে বাঘে-গরুতে একঘাটে জল খায়, বাড়ির লোক দু-ঠোঁট এক করতে পারে না, আর এই মেয়েটি কিনা দিব্যি শাসন করে চলে গেল। বলে কিনা, গরমে চা খেতে হবে না, শরবত খাও!

খানিক পরে স্টেলা এসে শরবত দিয়ে গেল। যাবার সময় বলে গেল, ‘আমরা সবাই যাচ্ছি বাবা।’ বলে আবার একটা প্রণামও করে গেল। মনে হল কোনও ঠান্ডা হাওয়া বয়ে গেল।

মেয়েটিকে দেখে রমাকান্তের মনে প্রশ্ন ঘুরতে থাকল, সত্যিই কি মানুষের থেকে বংশের মানমর্যাদা, জাতপাত বড়ো হতে পারে? প্রত্যেকবারই এক জবাব পেয়েছে সে।‘না’। ‘কখনওই নয়’। বন্ধুদের ছেড়ে অতনু যতক্ষণে ঘরে ঢুকল, ততক্ষণে তার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়ে গেছে। লোকের কথা ভেবে সিদ্ধান্ত না নিয়ে মনের কথা শুনে চলাই শ্রেয়। তাতে সকলে মিলে ভালো থাকা যায়। সুতরাং তার বাড়ির বউ হওয়ার যোগ্য পাত্রী স্টেলা ছাড়া আর কেউ হতেই পারে না।

 

হঠাৎ দেখা

সকাল সাড়ে চারটেয় ফ্লাইট। বিমান বন্দরে ট্যাক্সি নামিয়ে দিয়ে গেল রাত বারোটা নাগাদ।

চেক-ইন সেরে ইমিগ্রেশন পার হয়ে ভেতরে ঢুকে নিরালা একটা জায়গা দেখে বসে পড়লাম জানলার ধারে। কাচের জানলা দিয়ে দূরে শহরে যাওয়ার হাইওয়ে দেখা যাচ্ছে। শেষ ডিসেম্বরের রাত। হালকা কুয়াশার মধ্যে রাস্তার বাতিগুলো যে-আলো ছড়াচ্ছে, সেটাও আবছা লাগছে।

হঠাৎ মনে হল আমাদের জীবনটাই কেমন যেন আবছা। আলো ছায়া অন্ধকার মেশানো। সঙ্গে সবসময়ই একটা বই থাকে পড়ার জন্যে। কিন্তু পড়তে ইচ্ছে করছিল না। গভীর রাতে যাত্রী সংখ্যাও বেশ কম। দূরে দূরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে আছেন তাঁরা।

হঠাৎ একটু অস্বস্তি লাগল। ঘরের মধ্যে দৃষ্টি ফিরিয়ে এনে দেখতে চেষ্টা করলাম, কোনও এমন কিছু চোখে পড়ল না, যাতে এরকম লাগতে পারে। কিন্তু কেবলই মনে হচ্ছে কারও নজরের মধ্যে আছি যেন।

কায়রোর এই বিমান বন্দরটি যাত্রীদের জন্যে অত্যাধুনিক সব রকম আরাম আয়েসের ব্যবস্থা করে রেখেছে। উঠে একটু পায়চারি করে অন্য একটা চেয়ারে গিয়ে বসলাম। এ দিকটায় অনেকগুলো ইজিচেয়ার রয়েছে। সবগুলোতে দূরপাল্লার যাত্রীরা চাদরমুড়ি দিয়ে আধশোয়া হয়ে ঘুমোচ্ছেন। আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে এমন দৃশ্য হামেশাই দেখা যায়। নতুন কিছু নয়। বিসদৃশও নয়। আমার এখনও প্রায় ঘন্টা তিনেক বাকি ফ্লাইটে ওঠার। খালি একটা এরকম চেয়ার পেলে পিঠটাকে টান করে নেওয়া যেত।

ভাবছি। হঠাৎ এক ভদ্রলোক সামনে এসে দাঁড়ালেন। জিজ্ঞেস করলেন, মাফ করবেন আপনি বাঙালি? উত্তরে কিছু বলার আগেই আবার তাঁর প্রশ্ন, আপনি কি খুলনার? মানে বাংলাদেশের খুলনার কথা বলছি।

কেন বলুন তো? খুলনার কাউকে আপনি খুঁজছেন?

না, ঠিক তা নয়। কিন্তু আপনাকে আমার খুব চেনা লাগছে।

আমাকে আপনি চিনবেন কেমন করে! আমি বাঙালি অবশ্যই। তবে প্রবাসী বাঙালি। বহুকাল ধরে, বলতে গেলে সারা জীবনই আমি প্রবাসে আছি।

ভদ্রলোক একটু আনমনা হলেন। খুব আস্তে করে বললেন, আমি চিনি আপনাকে।

আমি হাসলাম। হয়তো আপনার পরিচিত কারও মতো মনে হয়েছে আমাকে দেখে। আমি আপনাকে চিনি না। আমি পেছন ফিরে উলটো দিকে হাঁটতে শুরু করলাম। সত্যিই ভদ্রলোককে আমার পরিচিত বলে মনে হচ্ছে না। সরে এসে একটু দূরে বসে এবার সঙ্গের বইটি খুলে চোখ রাখলাম।

বাংলাদেশ বিমানের এই ফ্লাইট-এর যাত্রীদের উদ্দেশ্যে অ্যানাউন্স করা হচ্ছে। প্যাসেঞ্জার্স হু আর ট্রাভেলিং বিমান বাংলাদেশ, ফ্লাইট নাম্বার ০২২১, প্লিজ গো টু গেইট নাম্বার বি ২৫। আশেপাশের থেকে অনেকেই সঙ্গের হাতব্যাগ, ট্রলি নিয়ে উঠে রওয়ানা হচ্ছেন নির্ধারিত গেটের দিকে। সামনে দিয়ে যাচ্ছেন কয়েজন একসঙ্গে।

আরে রওশন আরা খানম, নয়? এখানে আপনি? মুখ তুলে তাকাবার সঙ্গে সঙ্গে তার শ্লেষ মিশ্রিত বাক্য, কী-ইই ম্যাডাম, চিনতে পারছেন?

হাতের বইটা বন্ধ করে উত্তর দিতেই হল, না চেনবার কারণ নেই, রায়হান সাবেহান।

বেশ বেশ। বিখ্যাত আন্তর্জাতিক সাংবাদিক ম্যাডাম, কেমন আছেন? এখানে কেন? বাংলাদেশে যাচ্ছেন?

যাচ্ছি তো কোথাও নিঃসন্দেহে। তবে সেটা বাংলাদেশে না-ও হতে পারে।

তা বটে, তা বটে। সৌভাগ্য আপনি আমাকে মনে রেখেছেন।

হ্যাঁ, এই যে সেজো ভাই, আসেন পরিচয় করিয়ে দেই। ইনি মার্কিন মুলুকে বিদেশি সংবাদ মাধ্যমে বাঙালি নারী সাংবাদিক। বিখ্যাত। আমাদের মতো ছাপোষা অখ্যাত বাংলা কাগজের সাংবাদিক নন। এনার বিচরণ অন্য লোকে। তাকিয়ে দেখি আমি খুলনার কিনা জিজ্ঞেস করেছিলেন যিনি, সেই ভদ্রলোক!

এবার একটু থমকাবার পালা আমার। এমনিতেই রায়হান সাবেহানের মতো এঁটেল ব্যক্তির সঙ্গে হিসেব করে কথাবার্তা বলা অতীব জরুরি। তীব্র ব্যঙ্গ দিয়ে কথাবার্তা বলে, সে তার গুরুত্ব বোঝাতে খুব পারঙ্গম। তার ওপর বোঝা গেল এরা আত্মীয়। হাত তুলে সালাম দেওয়ার আগেই রায়হান সাবেহান বলল, এর আর একটা পরিচয় দেই সেজো ভাই। ইনি আমাদের শহরেরই মেয়ে।

ভদ্রলোক মৃদু হেসে বললেন, অনেকক্ষণ আগে আমি দূর থেকে দেখেই ওঁকে চিনতে পেরেছি। আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, আপনি অবশ্য খুলনার কিনা সেটা বলতে চাইছিলেন না। অনেক দিন হয়ে গেল। প্রায় পঞ্চান্ন বছর! রায়হান সাবেহানের মতো ঘাঘু লোকও এবার বাক্যহারা বলে মনে হল। আমি নিজেও।

আপনি কি আমার বড়ো ভাই, কি মামাদের সঙ্গে পড়তেন? মানে আমি ঠিক আপনাকে চিনতে পারছি না।

আমাকে আপনার চেনবার কথাও নয়। তবে আমি আপনাকে চিনি। আমার ডাক নাম তরু। নামটা আপনি শুনেছেন কিনা জানি না অবশ্য। হয়তো শুনে থাকতে পারেন। খুলনায় যান না আপনি কখনও?

হ্যাঁ যাই তো। তবে কম। মানে দেশেই তো আসা হয় না তেমন। তার ওপর এখন আর আমার পরিবারের প্রায় কেউ সেখানে নেই।

হ্যাঁ জানি আমি। আপনাদের সেই বড়ো বাড়িটাও বিক্রি হয়ে গেছে। আমি সবই জানি। আসবেন। খুলনা এলে নিশ্চয়ই যোগাযোগ করবেন।

মুহুর্মুহু তাড়া আসছে মাইক্রোফোনে তখন নির্ধারিত গেটে যাওয়ার জন্যে। বিমানে যাত্রীদের তোলা শুরু হয়েছে।

হ্যাঁ, নিশ্চয়ই। যদি খুলনা যাওয়া হয় কোনও সময়। আপনাদের ফ্লাইটে লাস্ট কল দিচ্ছে।

রায়হান সাবেহান একেবারে চুপ। ও একবার আমার দিকে তাকাচ্ছে একবার ওই ভদ্রলোকের দিকে। ভদ্রলোক নিঃশব্দে হাত তুললেন। প্রত্যুত্তরে আমিও। ওরা এগিয়ে যাচ্ছে গেটের দিকে।

শুনতে পেলাম রায়হান সাবেহানের প্রশ্ন, সেজো ভাই এই তাহলে সেই, যার জন্যে আপনি… বাকি কথাগুলো অস্পষ্ট হয়ে গেল। ভদ্রলোক কিছু বললেন সেটা আর শোনা গেল না। আমিও চুপ করে বসে রইলাম। মনে হল এই তাহলে সেই তরু!

পাত্রী দেখতে এসেছে দুই বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে শুনেই বললাম, যাব না সামনে। শেষ পর্যন্ত বড়ো ভাই, মা-এর চাপে যেতেই হল। বড়ো ভাই বললেন, যা শুধু গিয়ে দাঁড়াবি, আর চলে আসবি। আমি ঠিক তাই করেছিলাম। গিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম নীচের দিকে চোখ রেখে। তিন জোড়া পায়ে জুতো দেখেছিলাম।

ওরা বসেছিল। কে কোন জন তাও আমি দেখিনি। আমাকে বসতে বলা হল, বসলাম। একবারও মুখ তুলে তাকাইনি। কয়েক মিনিট পর ওরা বললেন ঠিক আছে, তুমি ভেতরে যাও। আমি চলে এলাম।

তখন বিয়ে সম্বন্ধ আসছে। বাবা নেই। মা অস্থির হয়ে গেলেন মেয়ের বিয়ে দেওয়ার জন্যে। বাড়িতে একজনকে পছন্দ করা হল। ওরা ঢাকার। খুলনার এই পাত্রটির বাড়ি থেকে বেশ কয়েকবার এদের বাড়ির বড়ো বউ, মা খালারা এলেন। তাদের ছেলের খুব পছন্দ হয়েছে মেয়েকে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বিয়ে হয়ে গেল ঢাকাতেই।

আমার বুক ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়ে আপনারা ওকে অন্যত্র বিয়ে দিলেন, এমন একটা কথা বলেছিল এই ছেলে আমাদের বাড়ির কাউকে। আর সেটা নিয়ে বেশ হাসি তামাশাও হয়েছিল আমাদের বাড়িতে।

নুরুল আমিনের সঙ্গে আমার বিয়ে টিকল না। বছর দশেক টানাটানি করে সম্পর্কটা বহাল থাকল বটে কিন্তু সে বছরগুলো ছিল আমার জন্যে এবং আমার পরিবারের জন্যেও এক দুঃসহ সময়। তখন এই তরু নামটি অনেকবার উচ্চারিত হতে শুনেছি বাড়িতে।

বড়ো মামি খুব বলতেন, ছেলেটি ওকে এত পছন্দ করেছিল, ঠিক ওর দীর্ঘনিশ্বাস লেগেছে! কেন ওর সঙ্গে তোমরা বিয়েতে রাজি হলে না গো? এর ঠিক কোনও সদুত্তর ছিল না। মা তখন নিঃশ্বাস ফেলে বলতেন, ভাগ্য। নাহলে ওরা এত অনুরোধ করেছিল।

একটি এনজিওতে কাজ করার সুবাদে ইউরোপে যাওয়া। তারপর জীবন গড়িয়ে গেছে। দু’-দু’বার সংসার পাতার চেষ্টা, কোনওটাই সফল হয়নি। আমিও ভাবি, ভাগ্য। আজ পড়ন্তবেলায় এভাবে এক বিমান বন্দরে দেখা হয়ে যাবে কে জানত! নামটা শুনেছিলাম বহুবার। আজ সে নামের সঙ্গে একটা চেহারা যুক্ত হল। আমার ফ্লাইটের এখনও ঘন্টা দুয়েক বাকি। কাজেই ঢাকা বিমান বন্দরে দেখা হওয়ার কোনও সম্ভাবনা নেই। সেটাই স্বস্তির।

তৃতীয় অঙ্ক

আকাশ মেঘলা থাকায় সামনের সবুজ ঢেউয়ের মতো পাহাড়, পাহাড়ের গায়ে লেপটে থাকা ছোটো ছোটো জনপদ, আঁকাবাঁকা পথরেখা, ইউক্যালিপটাস, সাইপ্রাস আর পাইন বনের শোভা উপভোগ করা যাচ্ছিল না। আচমকা পাহাড়ের ওপর থম মেরে দাঁড়ানো মেঘেরা সরে গেল। নাটকের মঞ্চের মতো কোনও এক অদৃশ্য আলোক পরিকল্পকের অমোঘ ইশারায় মেহগনি ছোপ পড়তে শুরু করল পালানি হিলসের গায়ে। গাঢ় ছায়া সরে গিয়ে ঝলমল করে উঠল কোদাইকানালের পাহাড়।

ঝেড়েঝুড়ে একটা বেঞ্চে বসলাম। পাশের বেঞ্চে মিলিটারি গোঁফওলা এক প্রবীণ খবরের কাগজ পড়ছেন। পাখির দল এসে বসছে গাছে। একটা গাঢ় নিস্তব্ধতার ছায়া চারদিকে। পাহাড়ি অর্কিড আর পাইন গাছের পাতায় লেগে আছে ভেজা শিশির আর মেঘবাষ্প। এখানে গাড়ির মিছিল নেই, মর্নিংওয়াকারের কলরব নেই, হকারের উৎপাত নেই, বাচ্চাদের প্র্যামগাড়ির অত্যাচার নেই– এই পার্ক যেন কোলাহলবিহীন প্রকৃতির এক স্বর্গরাজ্য।

রুনুদার হার্টের আর্টারিতে একটা ব্লকেজ ধরা পড়ায় তড়িঘড়ি চলে আসা হয়েছিল বেঙ্গালুরুতে। রিন্টির এখন উঁচু ক্লাস, প্রাইভেট টিউশন থাকে সপ্তাহ জুড়ে। রিন্টি আসেনি ওর বাবা মায়ের সঙ্গে। তবে অসুবিধে কিছু হয়নি, মা রুনুদাদের ফ্ল্যাটে এসে রিন্টির সঙ্গে আপাতত থাকছে। বেঙ্গালুরুতে ডক্টর আয়েঙ্গার অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টি করলেন দু’দিন পর। যতটা সময় লাগবে ভাবা হয়েছিল তার আগেই সব মসৃণভাবে হয়ে গেল। ডাক্তারবাবু ওষুধপত্র দিয়ে ছেড়ে দিলেন রুনুদাকে। বলে দিলেন ফ্যাট-ফ্রি ডায়েট চলবে এক বছর আর সামনের বছর চেক-আপের জন্য একবার আসতে হবে তাঁর কাছে।

রুনুদা বেড়াতে ভালোবাসে। ওর ইচ্ছেতে সায় দিয়ে আমরা এসেছি কোদাইকানালে। হোটেলের পাশেই কোদাই লেক। গতকাল একটা গাড়ি ভাড়া করে সিলভার ক্যাসকেড, পিলার রকস আর গ্রিন ভ্যালি ভিউ দেখে বিকেলে আমরা এলাম বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন মানমন্দির সোলার অবজারভেটরিতে। ফেরার পথে ড্রাইভার জানাল সিজন টাইমে কোদাই নাকি টুরিস্টে গিজগিজ করে। নেহাত বর্ষাকাল বলে এখন লোকজন একটু কম।

সাইট সিইং করে রুনুদা একটু টায়ার্ড। মেঘলা মেঘলা দিন, দিদিও বলল হোটেল থেকে বেরোবে না। মশালা ধোসা আর মোটা করে চা খেয়ে সকালে আমি একাই বেরিয়েছিলাম। কিছুক্ষণ হেঁটে যে জায়গাটায় এসেছি এর নাম কোয়েকার্স ওয়াক। সিমেন্টের ফলক দেখে জানা গেল কোয়েকার নামে এক সাহেব দেড়শো বছর আগে কোদাই শহরের মানচিত্র তৈরি করতে এসে এই জায়গাটা দেখে অভিভূত হন। এক কিলোমিটার লম্বা পায়ে চলা পথ বাঁধিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। সেটাই কোয়েকার্স ওয়াক।

তলপেটে চাপ অনুভব করছি কিছুক্ষণ থেকে। গলা খাঁকারি দিয়ে মিলিটারি গোঁফওলা ভদ্রলোকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে কড়ে আঙুল উঁচিয়ে দেখালাম। তাতে কাজ হল। ভদ্রলোক চশমাটা নাকের ডগায় এনে আমাকে একবার জরিপ করে আঙুল দিয়ে সামনের দিকে ইশারা করে আবার কাগজে মন দিলেন। দেখি রাস্তার ওপাশে একটা একতলা পাকা বাড়ি। ওপরে অবোধ্য তামিল ভাষায় লেখা আছে কিছু। নীচে ইংরেজিতে ‘ইউজ মি’।

ভেতরে এসে দেখি এক দক্ষিণী তরুণী হলদে সিল্কের শাড়ি আর গোলাপি স্টোল গায়ে বসে রয়েছে একটা চেয়ারে। মাথায় সাদা ফুলের গজরা। সামনে একটা কাঠের টেবিল। ওপরে টিনের বাক্স। তামিল আর ইংরেজি দুটো ভাষাতেই লেখা আছে বড় বাইরে করলে খরচ দশ টাকা, ছোটো বাইরে দু’টাকা। পাশাপাশি দুটো ইউরিনাল। একটায় ছবি পাগড়ি পরা গোঁফওলা একজন পুরুষের। পাশেরটায় শাড়ি পরা হাসিখুশি এক মহিলার।

মাঝারি সাইজের কমন চত্বর। দু’দিকে দুটো দরজা। ঠেললে খোলে, আপনা আপনি বন্ধ হয়ে যায়। টয়লেটে ঢুকতেই চমক। সরকারি প্রস্রাবাগার এমন হতে পারে সেটা ভাবিনি। মার্বেলের মতো টাইলের মেঝে। দাগ নেই কোথাও। ঘরের তিন দিকের দেয়াল ঝকঝকে সাদা। ভেন্টিলেটরের মতো একজস্ট ফ্যান ঘুরছে। দেয়ালের সঙ্গে লাগানো গোটা দশেক বেসিন। ওপরে ফিট করা আয়না। সাবানদানিতে শোভা পাচ্ছে সাবান। ইউরিনাল থেকে বেসিন সব জায়গায় দেওয়া আছে দুধসাদা ন্যাপথলিন। সব কিছুই পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন।

দু’টাকা দিতে গিয়ে বিপত্তি। আমার পার্সে পাঁচ টাকা তো দূরস্থান একটা দশ টাকা অবধি নেই। একটা একশো টাকার নোট এগিয়ে দিতে মেয়েটি তামিলে কিছু বলল। মুখে বিড়ম্বনার একটা ভাব ফুটিয়ে জানালাম খুচরো নেই। মেয়েটি মনে হল যেন ভাবনায় পড়ল। আটানব্বই টাকা সে এখন কী করে ফেরত দেয়! অন্য কেউ হলে নির্ঘাত আমার গুষ্টির তুষ্টি করত। কিন্তু এই মেয়ে রাগ দেখাতে জানে না বোধ হয়। এদিকে আমাকে ফ্রি-তে  ছেড়ে দিতে তার নীতিবোধে বাধছে কোথাও। একটু ইতস্তত করে দক্ষিণী তরুণীর নাম জিজ্ঞেস করলাম।

মেয়েটির চোখেমুখে কিশোরীসুলভ সারল্য, নাম বলল, রাধিকা পিল্লাই।

রাধিকাকে বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করলাম, একশো টাকা একদিনের জন্য তার কাছে জমা থাক। কাল সকালে কোয়েকার্স পার্কে এসে দু’টাকা খুচরো দিয়ে একশো টাকা ফেরত নিয়ে যাব। নিরুপায় রাধিকা কী ভাবল খানিক। তারপর নিমরাজি হল আমার কথায়।

হোটেলে ফিরে আসার পর কোয়েকার্স পার্কের ঘটনাটা সবিস্তারে বললাম দিদি আর রুনুদাকে। রাধিকার কাছে আমার একশো টাকা জমা রেখে আসার গল্প শুনে দুজনেই খুব হাসল। দিদি বলল, কাল সকালে তাহলে কী করবি? যাবি টাকাটা ফেরত নিতে?

–আলবাত যাব। একশো টাকা কি সস্তা নাকি?

রুনুদা মুচকি মুচকি হাসছে, মেয়েটা কি সুন্দরী নাকি? আমাদের ফেরার টিকিট কিন্তু তিনজনের। একস্ট্রা কাউকে নিয়ে যেতে হলে কোলে বসিয়ে নিয়ে যেতে হবে সেটা মনে রেখো।

পরদিন সকাল সকাল ব্রেকফাস্ট সেরেই চলে এসেছি কোয়েকার্স পার্কে। রাধিকা বসে আছে মাথায় গজরা ঝুলিয়ে। পরনে কালকের সেই হলদে শাড়ি আর গোলাপি স্টোল। দু’টাকার একটা কয়েন এগিয়ে দিলাম রাধিকার দিকে। হাসল রাধিকা, নিজের বটুয়া থেকে একশো টাকার একটা নোট বার করে আমার দিকে এগিয়ে দিল। কয়েনটা ফেলে দিল টিনের বাক্সে।

টাকাটা পকেটে রেখে জিজ্ঞেস করলাম, এই সরকারি ইউরিনাল পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখার দায়িত্ব কি তোমার ওপর?

রাধিকা বলল, সারাদিন নয়। প্রতিদিন ভোর পাঁচটা থেকে সকাল এগারোটা অবধি আমার ডিউটি।

আমি জিজ্ঞাসু, তাহলে তো রাত ফুরোবার আগেই উঠে পড়তে হয় তোমাকে?

রাধিকা ভাঙা ভাঙা হিন্দিতে বলল, অন্ধকার ঘুমন্ত নৈঃশব্দ্যের পাহাড়ি পথে হেঁটে হেঁটে ডিউটিতে চলে আসে সে। ওয়াচম্যান তখন বসে বসেই ঘুমে অচৈতন্য। তাকে না জাগিয়েই দরজা ঠেলে টয়লেটে ঢুকে পড়ে রাধিকা। সমস্ত দেয়াল, মেঝে, আয়না, সাবান আর ফিনাইল দিয়ে ঝেড়েমুছে তকতকে করে রাখে। সব ক’টা বেসিনে লিকুইড সোপ আর ওডোনিল রাখে ঠিক করে। তারপর স্নানঘরে ঢুকে স্নান সেরে পরিষ্কার হয়ে সারাদিনের জন্য সে তৈরি।

–তোমার ভাইবোন নেই?

রাধিকা দু’-চার সেকেন্ড চুপ করে থাকল। হয়তো মনে মনে ভেবে নিল আমার মতো একজন অপরিচিত লোকের কাছে কথাটা বলা যায় কিনা। তারপর বলল, আমার এক দাদা আছে, তার নাম কার্তিক। সে-ই এই টয়লেটের দেখাশোনার দায়িত্ব পেয়েছিল। কিন্তু একটা অ্যাক্সিডেন্টে তার একটা পা হাঁটু থেকে কাটা যায়। অন্য পায়েও বড়ো জখম। ও এখন বিছানা ছেড়ে উঠতে পারে না। ফলে আমাকেই এই দায়িত্ব নিতে হয়েছে। আমাদের এক বোন আছে। ওর নাম পদ্মাক্ষী, কলেজে পড়ে।

–তোমার বাবা কী করেন?

মনে হল রাধিকা একটা শ্বাস বুঝি গোপন করল, আমার বাবা ছিল ড্রাইভার, সরকারি বাস চালাত। লেভেল-ক্রসিং না থাকা রেললাইন পার হতে গিয়ে ট্রেনের সঙ্গে ধাক্বা লেগেছিল বাবার বাসের। হাসপাতালে নিতে নিতেই সব শেষ। আমার বয়স তখন দু’বছর। তখন আমরা চেন্নাইতে থাকতাম।

আনম্যানড লেভেল-ক্রসিং পার হতে গিয়ে কত অ্যাক্সিডেন্ট হয় কাগজে দেখি। একটুক্ষণের জন্য মনটা ভার হয়। এক সেকেন্ড পরেই নিস্পৃহমুখে পাতা উলটে অন্য খবরে চলে যাই। এই মুহূর্তে রেল আর বাসের সংঘর্ষে মৃত বাস ড্রাইভারের একজন মেয়ে আমার চোখের সামনে বসা। সেই কালান্তক সময়ে কী দুঃসহ ঝড় রাধিকাদের ওপর দিয়ে গিয়েছে কে জানে! জিজ্ঞেস করলাম, সরকার ফ্যামিলি পেনশনের ব্যবস্থা করেনি?

–হ্যাঁ করেছিল। দাদার বয়স তখন পাঁচের মতো। পদ্মাক্ষী সবে হয়েছে। ওই অল্প টাকায় আমাদের তিন ভাইবোন নিয়ে মা সংসার চালাতে পারছিল না। তবে ইউনিয়নের লোকেরা সে সময় হেল্প করেছিল। ওদের সাহায্যেই ছ’মাসের মধ্যে মা বাস চালাতে শিখে নিয়েছিল। বিশ্বাস করবেন কিনা জানি না এক বছরের মধ্যেই মা সিটি-বাস চালাবার চাকরি পেয়ে গেল। চেন্নাইয়ের হাতে গোনা মহিলা বাস ড্রাইভারদের মধ্যে একজন ছিল আমার মা।

অচেনা অদেখা এক মহিলার জীবনযুদ্ধে ঘুরে দাঁড়াবার দুর্জয় সাহস আমাকে নাড়িয়ে দিয়ে গেল ভেতর থেকে। আন্তরিক স্বরে বললাম, তোমার মা-র মনের জোরের কথা শুনে খুব ভালো লাগল। ওঁকে আমার প্রণাম জানিও।

রাধিকা আমার দিক থেকে চোখ সরিয়ে নিল। ঠোঁট টিপে বলল, সে উপায় নেই। আমার মা মারা গেছে এগারো বছর আগে।

আমি হতভম্ব হয়ে বললাম, মানে?

রাধিকা বলল, বাবার মারা যাবার পর বারো বছর ধরে মা আমাদের তিন ভাইবোনকে বড়ো করল। তারপর ঘটল সেই ঘটনা। একদিন মা ডিউটি করে সন্ধেবেলা বাড়ি এল। সেদিন মায়ের চেহারাটা একটু যেন কেমন কেমন। সকাল থেকেই নাকি বুকে ব্যথা। কার্তিক গিয়ে দোকান থেকে গ্যাসের বড়ি কিনে নিয়ে এল। সে ওষুধ খেয়ে কিছু হল না। একটু পরে ব্যথা আরও বাড়ল। যন্ত্রণায় ছটফট করা শুরু করল মা। ডাক্তারকে খবর দিতে দিতেই সব শেষ।

রাধিকার কথায় কী যেন ছিল মনটা দ্রব হয়ে গেল। সেই ভয়ংকর সন্ধের প্রত্যেকটা দৃশ্য চোখের সামনে অভিনীত হতে দেখলাম যেন। এই বিরাট স্বার্থপর পৃথিবীতে তিন কপর্দকহীন নাবালক সন্তানের বেঁচে থাকা যে কতটা কঠিন সেটা অনুমান করাটা শক্ত নয়। আর্দ্র স্বরে বললাম, ইস্ তোমরা তো তখন অথই জলে পড়লে।

রাধিকা বলল, সে তো পড়লাম ঠিকই। চেন্নাই ছেড়ে আমরা চলে এলাম কোদাইতে। মামার ব্যাবসা আছে এখানে। টুরিস্টদের রেলের টিকিট, প্লেনের টিকিট, বাসের টিকিট কেটে দেয়। অনেক লোকের সঙ্গে খাতির আছে। এক পরিচিত অফিসারকে ধরে মামা কার্তিককে ঢুকিয়ে দিয়েছিল এই সরকারি ইউরিনালে। কিন্তু সেটাও আমাদের কপালে সইল না। একদিন ডিউটি করে কার্তিক বাড়ি ফিরছিল। একটা গাড়ি পেছন থেকে এসে ধাক্বা দেয়। খাদে পড়ে যায় কার্তিক। মারাত্মক চোট লাগে তার। একটা পা হাঁটু থেকে কেটে বাদ দিতে হয়েছিল। ওর জায়গায় আমি ঢুকেছি কয়েক মাস আগে।

আমাদের কথার মধ্যেই টুকটাক লোকজন দেখি টয়লেটে আসছে যাচ্ছে। টিনের বাক্সে কয়েন ফেলে দিয়ে যাচ্ছে প্রত্যেকে। রাধিকা জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে আপনার জামাইবাবুর?

জানালাম, হার্টের সমস্যা ছিল। বেঙ্গালুরুর এক হসপিটালে অপারেশন করা হয়েছে। এখন ভালো আছে। ডাক্তার বলে দিয়েছেন সামনের বছর চেক-আপের জন্য আর একবার আসতে হবে।

রাধিকা স্মিতমুখে বলল, তাহলে তো ভালোই হল। সামনের বছর আপনারা সকলে বেঙ্গালুরু থেকে কোদাইতে চলে আসবেন। বারো বছর পর পর পালানি পাহাড়ে ফোটে করৌঞ্জি ফুল। সামনের বছর আবার সেই ফুল ফুটবে। সে এক অসাধারণ দৃশ্য।

আমি হেসে বললাম, কাল আমরা মুরুগানের মন্দির গিয়েছিলাম। সেখানেও তো প্রচুর করৌঞ্জি গাছ রয়েছে দেখলাম। তবে ফুল ফোটেনি সে গাছে।

রাধিকা বলল, বললাম যে ফুল ফুটবে সামনের বছর। আসলে করৌঞ্জি ফুল দেবতা মুরুগানের খুব প্রিয়। দেবতা মুরুগানের ছয় অধিষ্ঠানের একটা আমাদের এই পালানি পাহাড়ে। আপনারা মুরুগানকে চেনেন কার্তিক হিসেবে। দক্ষিণ ভারতে তিনি ইন্দিবর নামে পরিচিত। ইন্দিবর মানে হল পাহাড়ের অধীশ্বর।

আমি হাসলাম, আমাদের গাড়ির ড্রাইভারের মুখে শুনেছি করৌঞ্জি ফুল কোদাইয়ের সৌভাগ্যের প্রতীক।

রাধিকা ঘাড় নাড়ল, আমাদের ফ্যামিলিতে ব্যাপারটা উলটো। আমার বাবা যখন মারা যায় সেবার করৌঞ্জি ফুল ফুটেছিল পালানি পাহাড়ে। ঠিক বারো বছর পর আমার মা মারা যায়। পরের বছর আবার করৌঞ্জি ফুল ফুটবে। আমাদের আবার কী ক্ষতি হবে কে জানে!

রাধিকার কথায় ঝাঁকি খেয়েছি একটু। মনে মনে অঙ্ক কষে ফেললাম। হ্যাঁ ঠিকই তো। ওর বাবা মারা যাবার ঠিক বারো বছর পর ওর মা-র মৃত্যু হয়েছিল। তারপর এগারো বছর কেটে গেছে। সামনের বছর আবার করৌঞ্জি ফুল ফুটবে পালানি পাহাড়ে। তাহলে কি সামনের বছর কার্তিকের জন্য একটা বড়ো ফাঁড়া অপেক্ষা করে আছে? মুখে সেই উদ্বিগ্ন ভাবটা ফুটতে দিলাম না। ঘাড় ঝাঁকিয়ে বললাম, ধুস এটা নেহাতই কাকতালীয় ব্যাপার। ওসব নিয়ে উলটোপালটা ভেবে দুশ্চিন্তা কোরো না।

–আপনি আমাদের পরিবারের লোক হলে টেনশনটা বুঝতেন। কী হাসিখুশি ছেলে ছিল কার্তিক। প্রচুর পরিশ্রম করতে পারত। দারুণ ফুটবল খেলত। সেই ছেলে এখন শুয়ে থাকে বিছানায়। কার্তিকের ট্রিটমেন্ট চালাতে গিয়ে মামার জমানো টাকা শেষ হয়ে যাচ্ছে জলের মতো। তাছাড়া… রাধিকা কথাটা বলবে কি বলবে না ভেবে শেষে বলেই ফেলল, তাছাড়া আমার বিয়েতেও তো অনেক টাকা লাগবে। মামা যে কী করে সবকিছু সামাল দেবে কে জানে!

আমি হাসলাম, কবে তোমার বিয়ে?

– সামনের বছর মাঝামাঝি হতে পারে। রাধিকা একটু লজ্জা পেল, তবে ডেট এখনও ঠিক হয়নি।

আমার কৌতূহল একটু বাড়ল, ডোন্ট মাইন্ড প্লিজ, কী করে তোমার উড বি?

– ওর নাম মুরলিধর আইয়ার। তামিল ব্রাহ্মণ। কর্পোরেশন অফিসে চাকরি করে। ওর বাবা সরকারি চাকরি করত। কোদাইতে ওদের নিজেদের বাড়ি আছে।

–কনগ্র্যাচুলেশনস রাধিকা। আমি বললাম, কিন্তু একটা কথা তোমাকে না বলে পারছি না। তোমাদের মুরুগান কিন্তু বেশ রসিক দেবতা। তিনি রাধিকার জন্য খুঁজে খুজে ঠিক একজন মুরলিধর জোগাড় করে দিয়েছেন।

রাধিকার মুখে আবির ছিটিয়ে দিল কেউ। লজ্জা পেয়ে বলল, আমার বন্ধুরা তো এই বলেই আমার পেছনে লাগছে সারাক্ষণ।

আমি হাসছি। রাধিকা কেজো গলায় বলল, আপনার ঠিকানাটা লিখে দিয়ে যান এই কাগজটায়। আপনার বাড়িতে বিয়ের কার্ড পোস্ট করে দেব।

–ঠিকানা আর ফোন নম্বর দুটোই লিখে দিয়ে যাচ্ছি। সামনের বছর যখন কোদাই আসব তখনই যদি তোমার বিয়ের তারিখটাও পড়ে যায় তাহলে কথা দিচ্ছি পুরো কবজি ডুবিয়ে ভোজ খেয়ে যাব!

রাধিকা বলল, আমাদের আমিষ চলে না। আপনার ভেজ থালিতে আপত্তি নেই তো?

আমি বললাম, একেবারেই আপত্তি নেই। সত্যি বলতে নিরামিষই আমি ভালো খাই। তাছাড়া সাউথ ইন্ডিয়ান ডিশ তো আমার ভীষণ পছন্দের।

রাধিকা হেসে ফেলল আমার কথায়।

রাধিকার বিয়ের কার্ড পাইনি। খুব যে প্রত্যাশা ছিল তা অবশ্য নয়। কোথাও বেড়াতে গিয়ে কত লোকের সঙ্গেই তো আলাপ হয়। ফোন নম্বরও বদলাবদলি হয়। কিন্তু ব্যস্ত নাগরিক জীবনে যত একটার পর একটা দিন চেপে বসে তত সেসব আপাতসখ্যের জোড় আলগা হয়ে যায়। ফোন আর করা হয়ে ওঠে না কাউকেই। এক্ষেত্রেও তাই হল। স্বস্থানে ফিরে আসার পর রাধিকার কথা একরকম ভুলেই গিয়েছিলাম। ফের মনে পড়ল বেঙ্গালুরু থেকে কোদাইকানাল যাবার বাসের সিটে বসে। এখন কেমন আছে রাধিকা? বিয়ের পর চাকরিটা কি করছে এখনও? কোদাই গিয়ে ওর দেখা মিলবে তো? মনটা হঠাৎ উচাটন হল রাধিকার কথা ভেবে।

বেঙ্গালুরুতে রুণুদাকে নিয়ে চেক-আপে আসা হয়েছিল। ডক্টর আয়েঙ্গার পরীক্ষানিরীক্ষা করিয়ে সার্টিফিকেট দিলেন সবকিছুই নর্মাল। রুনুদা এখন যাকে বলে ফাইটিং ফিট। সেদিন সন্ধেবেলা হোটেলের ঘরে বসেই ঠিক হল আমরা আবার কোদাইকানালেই যাব। দীর্ঘ এক যুগ পর আবার করৌঞ্জি ফুল ফুটবে কোদাই পাহাড়ের উপত্যকা জুড়ে। সেটা মিস করা যাবে না কিছুতেই।

কাল পৌঁছেছি কোদাইতে। আজ সকাল থেকে আকাশ মেঘে ঢাকা। সঙ্গে গুঁড়ো গুঁড়ো বৃষ্টি। তার মধ্যেই আমরা বেরিয়েছি গতবার যে জায়গাগুলো দেখা হয়নি সেগুলো দেখতে। প্রথমে শোলা ফরেস্টে গিয়েছিলাম। এখানেই আছে পাম্বার ফল্স। সেখান থেকে এলাম বেরিজাম লেকে, যে হ্রদ থেকে পানীয় জল সরবরাহ করা হয় কোদাই শহরে। সারাদিন ধরে আকাশ গোমড়া থাকার পর বিকেলের দিকে আকাশ পরিষ্কার হল। আমাদের ড্রাইভার নিয়ে এল এদিকের বিখ্যাত লা সালেথ চার্চে।

ফিরে আসছিলাম যখন তখন বিকেল। একটা জায়গায় ঘ্যাস্স করে গাড়ি দাঁড় করাল ড্রাইভার। গাড়ির জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আমাদের তিনজনের চোখ স্থির হয়ে গেল। পাহাড়ের চুড়োতে পাইন গাছগুলোর মাথায় উঁকি মারছে নীল আকাশ। বর্ষার ধূসর মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে সেই আকাশে। সূর্য উঁকি দিচ্ছে মেঘের ফাঁক দিয়ে। সোনালি রোদ এসে পড়েছে উপত্যকায়। সৃষ্টি হয়েছে এক অভূতপূর্ব দৃশ্য। মায়াবী নীলচে বেগুনি আলো বিছিয়ে আছে গোটা উপত্যকা জুড়ে।

আগে পিছে আরও অনেকগুলো গাড়ি দাঁড়িয়ে গেছে। খাদের একেবারে ধারে হাঁটু গেড়ে বসে এসএলআর ক্যামেরা তাক করে আছে এক বিদেশিনি। ওদিকে একটা জটলা। এক গাইডকে ঘিরে রেখেছে কিছু মঙ্গোলয়েড মুখের পর্যটক। সেই দক্ষিণ ভারতীয় গাইড টিপিকাল সাউথ ইন্ডিয়ান অ্যাকসেন্টের ইংরেজিতে বলছে, দীর্ঘ এক যুগের প্রতীক্ষার অবসান হয়েছে। দেবতা মুরুগান তাঁর করুণা বর্ষণ করেছেন পালানি পাহাড়ের উপত্যকায়।

প্রকৃতি বোধ হয় সেই আয়না যার মধ্যে দিয়ে ঈশ্বরের অবয়ব ধরা পড়ে। দিদি কেঁদে ফেলল এই অলৌকিক দৃশ্য দেখে। প্র্যাক্টিক্যাল ম্যান রুণুদা প্রকৃতির রূপ দেখে বিহ্বল। আমাদের ড্রাইভার, যে কিনা স্থানীয় মানুষ, সে পর্যন্ত হাঁ।

রাশি রাশি করৌঞ্জি ফুলের দল যেন নীলচে বেগুনি রং দিয়ে হোলি খেলছে এখানে। এমন অপার্থিব দৃশ্য দেখার জন্য একশো মাইল হেঁটে আসা যায়। বড়ো একটা শ্বাস ফেললাম। এই অপার্থিব সৌন্দর্যের এক আনাও যদি ক্যামেরাবন্দি করা যেত!

এবার আমরা কোয়েকার্স পার্কের দিকে এগোচ্ছি। সেখানে কিছুক্ষণ কাটিয়ে সোজা হোটেলে ফিরব। পার্ক লাগোয়া সেই সরকারি টয়লেটে রাধিকার ডিউটি ছিল ভোররাত থেকে দুপুর পর্যন্ত। এই পড়ন্ত বিকেলে কি ওর দেখা পাব? তাছাড়া বিয়ের পর চাকরি ছেড়ে দিয়েছে কিনা সেটাও তো জানা নেই।

ড্রাইভার গাড়ি পার্ক করল। দিদি আর রুণুদা টিকিট কেটে কোয়েকার্স পার্কের ভেতরে ঢুকল। আমি গেটের উলটোদিকের সরকারি টয়লেটের দিকে তাকালাম। বছরখানেক বাদে এলাম কিন্তু একদম একই আছে সেই ছোট্ট পাকা বাড়িটা।

রাধিকা নয়, নীল সিল্কের শাড়ি পরা এক কিশোরী বসে রয়েছে চেয়ারে। চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা। ভাবলেশহীন মুখে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, টু রুপিজ ফর ইউরিনাল। টেন ফর টয়লেট।

বিনা ভূমিকায় সরাসরি প্রশ্ন করলাম, রাধিকা পিল্লাই নামে একজন সকালের শিফটে ডিউটি করত এখানে। তার সঙ্গে একটু দেখা করতে চাই। ওর ডিউটি কি সকালবেলাতেই আছে এখনও?

মেয়েটি ভুরু কুঁচকে আমাকে দেখল একটুক্ষণ। বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করল, হাও ডু ইউ নো রাধিকা?

রাধিকার সঙ্গে আমার এই সরকারি ইউরিনালে কীভাবে আলাপ হয়েছিল সেটা ভেঙে বললাম। নীল শাড়ি কিশোরী বলল, আমার নাম পদ্মাক্ষী। আমি রাধিকার ছোটো বোন। মর্নিং কলেজ করে এখানে চলে আসি। দুপুর থেকে সন্ধে পর্যন্ত আমিই এখানে ডিউটি করি।

প্রশ্নের বাণ ছুড়লাম পদ্মাক্ষীর দিকে, রাধিকা বিয়ের পর কাজ ছেড়ে দিয়েছে? নাকি সকালের শিফটে আছে এখনও? কার্তিক কেমন আছে এখন?

লক্ষ্য করলাম পদ্মাক্ষীর মুখে কেমন একটা ভাঙচুর হচ্ছে। চোখ ভিজে উঠছে জলে। আঙুল ইশারা করে পাশের দেয়ালে দিক নির্দেশ করল পদ্মাক্ষী।

সাদা ফুলের মালা দেওয়া রাধিকার একটা ফটো টাঙানো রয়েছে দেয়ালে। চোখ যে দৃশ্য দেখল তার ছবি পাঠাল মস্তিষ্কে। কিন্তু মস্তিষ্কের ধূসর অংশ সেই সিগনালের মানে করতে পারল না। বিমূঢ় গলায় বললাম, এটা কেন টাঙিয়ে রেখেছ এখানে?

পদ্মাক্ষী নিজেকে সংযত করল চোয়াল শক্ত করে। তারপর যা শোনাল তার জন্য একেবারেই প্রস্তুত ছিলাম না।

কয়েক মাস আগে এক ফরেনার কোয়েকার্স পার্কে ফটো তুলছিল। চারজন মাতাল ক্রমাগত বিরক্ত করে যাচ্ছিল সেই বিদেশিনিকে। মহিলা তার প্রতিবাদ করায় দু-তরফে কথা কাটাকাটি শুরু হয়। ঝামেলা বাড়ে একটু একটু করে। এক সময় মদ্যপের দল সেই মহিলাকে টেনে নিয়ে যায় পার্কের ভেতর। পার্কে যে দু-একজন ছিল তারা চুপচাপ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছিল ঘটনাটা। শুধু একজন ছাড়া। শান্তশিষ্ট মেয়ে বলে যাকে সকলে চিনে এসেছে এতদিন, সেই রাধিকা দৌড়ে গিয়েছিল পার্কের ভিতর। ততক্ষণে সেই বিদেশিনিকে বিবস্ত্র করে ফেলেছে লোকগুলো।

আমি রুদ্ধশ্বাসে বললাম, তারপর?

–একটা ইট কুড়িয়ে নিয়ে রাধিকা ছুড়েছিল ওদের দিকে। একজনের মাথায় গিয়ে লাগে সেটা। ইটটা কুড়িয়ে নিয়ে এগিয়ে আসে লোকটা। কাছে এসে ঠান্ডা মাথায় থেঁতলে দেয় রাধিকার মাথা। কানের নীচে আঘাত লাগায় সঙ্গে সঙ্গে জ্ঞান হারায় রাধিকা। লোকগুলো পার্ক ছেড়ে বেরিয়ে যায়। কেউ তাদের আটকাবার সাহস দেখায়নি। রাধিকাকে নিয়ে যাওয়া হয় কোদাই হসপিটালে। পরদিন বিকেলেই তার লড়াই শেষ হয়ে যায়।

মাথাটা শূন্য হয়ে গেল কিছুক্ষণের জন্য। পদ্মাক্ষীর মুখোমুখি ধপ করে একটা চেয়ারে বসে পড়লাম। নিভে যাওয়া গলায় বললাম, ওই ছেলেগুলির কী হল? অ্যারেস্ট হয়নি ওরা?

–পুলিশ ধরেছে চারজনকে। সেই মহিলা ফ্রান্সের হিউম্যান রাইটস সংক্রান্ত একটা এনজিও-র সঙ্গে যুক্ত। পুলিশ থেকে টিআই প্যারেডের ব্যবস্থা করেছিল। সেখানে সেই মহিলা আইডেনটিফাই করেছে প্রত্যেককে। স্থানীয় আদালতে সাক্ষ্যও দিয়েছে। সেই মহিলা বলেছে এর শেষ দেখে ছাড়বে। লোয়ার কোর্টে অপরাধীরা ছাড়া পেয়ে গেলে হাইকোর্টে যাবে।

ফটোটার দিকে বিহ্বল হয়ে তাকালাম। চব্বিশ বছর আগে রাধিকা হারিয়েছিল তার বাবাকে। বারো বছর আগে মারা যায় তার মা। এ বছর আর সকলের মতো রাধিকা নিজেও কার্তিকের জন্য উদ্বিগ্ন ছিল। কিন্তু নাটকের তৃতীয় অঙ্কে কী ঘটতে চলেছে তা কি আঁচ করেছিল ওদের পরিবারের কেউ? তার নিজের জীবন যে এভাবে শেষ হয়ে যাবে সেটা কি ঘুণাক্ষরেও টের পেয়েছিল রাধিকা? পারেনি। আসলে এই পুতুলনাচের সব সুতো হয়তো দেবতা মুরুগানের হাতে। যেমন টানেন তেমন নাচে মর্ত্যলোকের পুতুলের দল। নইলে সেদিন শান্তশিষ্ট রাধিকা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কেন ছুটে গিয়েছিল পার্কের ভেতর? তাও আবার এমন একজনকে ধর্ষকদের হাত থেকে বাঁচাতে, যাকে সে জন্মে দেখেনি!

ধীর পায়ে বাইরে এসেছি। অন্যমনস্ক হয়ে কোয়েকার্স পার্কে ঢুকেছি। খানিকটা হাঁটার পর এক জায়গায় এসে দাঁড়ালাম। এই ভিউপয়েন্ট থেকে উপত্যকার অনেকটা দূর পর্যন্ত দেখা যায়। এখন যতদূর দৃষ্টি যায় সামনে নীল মেশানো বেগুনি রঙের এক অপরূপ প্রপাত। মেঘের ফাঁক দিয়ে গুনে গুনে ঠিক তিনটে আলোর রেখা এসে পড়েছে পাহাড়ি উপত্যকায়। ভারি অদ্ভুত লাগছে ভ্যালিটাকে। প্রগাঢ় আঁধার আর হিরণ্যবর্ণ রোদের জাফরিকাটা আলোছায়াতে গোটা পাহাড়ি উপত্যকাটাকে মনে হচ্ছে যেন নাটকের মঞ্চ।

নাটকের মঞ্চই তো। তবে এই নাটকের নিয়মটা একটু অন্যরকম। এখানে একবার যবনিকা পড়লে আবার পর্দা ওঠে ঠিক একযুগ পরে।

মৃত তারার আলো

অনেকদিন থেকেই ঘ্যানঘ্যান করছিল শৌনক। এতদিন এটা ওটা বলে দেওরকে পাশ কাটিয়ে এসেছে নিবেদিতা। সৌমেনেরও ইচ্ছে ছিল না এতদূরে স্রেফ বেড়াতে আসার। এমনিতেই সে উদ্ভিদ গোত্রের মানুষ। একবার যেখানে শিকড় চালিয়ে বসল সাধ্য কার তাকে সেখান থেকে নড়ায়। কলেজ থেকে ফিরে চা জলখাবার খেয়ে ল্যাপিতে ফেসবুক খুলে সেই যে একবার বিছানায় আধশোওয়া হল, তারপর বোধহয় ঘরে আগুন দিলেও তার হুঁশ ফেরানো যাবে না। বন্ধুরা টিটকিরি দেয় ক্রিকেট খেললে সে নাকি অনায়াসেই রাহুল দ্রাবিড় হতে পারত। বেডিং বেঁধে বসে যেত ক্রিজে। আচ্ছা আচ্ছা ফাস্ট বোলারের কালঘাম ছুটে যেত তাকে টলাতে।

সৌমেনকে নিয়ে এক একবার নিজেরও বিরক্তি ধরে নিবেদিতার। মনে পড়ে যায় কলেজ লাইফের এক্সারশনের দিনগুলোর কথা। শুধু নতুন নতুন জুলজিক্যাল স্পিসিসই নয় বলতে গেলে সেই ক’টা দিনই যেন তাকে এক নতুন পৃথিবীরও খোঁজ দিয়েছিল। দুটো বছর দেদারে ঘুরেছে তারপর। দীঘা, জুনপুট বা হাজারদুয়ারির সেই দিনগুলোর কথা মনে পড়লে একান্তে আজও আনমনা হয়ে যায় সে। জুনপুটের সেই রাত। হাজার বছর অতীতের মৃত তারাদের আলোতে মাখামাখি চিকচিকে বালির বিছানায় শুয়ে গ্রহান্তরের গল্প শোনা…

এইরকম সময় কতবার মনে হয়েছে নিবেদিতার, যদি তারা ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ত বা প্রফেশনাল কোনও কোর্স তাহলে বাড়িতে বলে কয়ে হয়তো আটকে রাখা যেত আরও দু’ একটা বছর। ছুটির দিনে সৌমেন যখন অনেক রাত অবধি হুইস্কি নিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে হুল্লোড় করে তখন আরওই ফাঁকা ফাঁকা লাগে। প্রায় মাঝরাতে সৌমেনের বেঁহুশ বেসামাল শরীরটা টলতে টলতে এসে ধপ করে পড়ে যায় বিছানায়। প্রাণপণে নাক মুখ কুঁচকে শুয়ে থাকে নিবেদিতা। সেই মুহূর্তেই মনে পড়ে যায়– ছ’বছরেরও বেশি হয়ে গেল বিয়ে হয়েছে তাদের।

শৌনককে দেখে তাই আরওই ভাবে নিবেদিতা– সৌমেনেরই তো আপন ভাই। কিন্তু একেবারে অন্য মেরু। ইলেকট্রিক্যালে বি.টেক করার পর প্রায় বছরখানেক বসেছিল বাড়িতে। ক্যাম্পাসিংয়ে চাকরি পায়নি। পাগলের মতো পরীক্ষা দিয়ে যাচ্ছিল সরকারি চাকরির। একদিন হুট করেই ডিভিসির চিঠি এল। এখন এক্সিকিউটিভ ইঞ্জিনিয়ারের পদে রয়েছে শৌনক। দু’ বছর চাকরি করার পর এই সবে গেল বছর বিয়েও করেছে। কলেজের ইয়ারমেট অঙ্গনাকেই।

সেম এজে বিয়ে করলে শৌনক, অঙ্গনাকে চোখ টিপে বলেছিল নিবেদিতা, অঙ্গনা তোমায় মানে তো? নাকি বউয়ের কথায় উঠছ বসছ আজকাল?

এসব আবার কী কথা বউদি, শৌনকের কথার সুরে বিস্ময়, ফ্র্যাংকলি স্পিকিং, তোমার কাছে এমনটা এক্সপেক্ট করিনি আমি…

অঙ্গনা অবশ্য বুঝেছে। শৌনককে রাগাচ্ছে নিবেদিতা। সেও হাসছে বড়ো জায়ের কথায়। কিন্তু শৌনক হঠাৎ সিরিয়াস, দ্যাখো, হোল ওয়ার্ল্ড খুঁজলেও কখনও এমন কাউকে পাওয়া যাবে না, যার সঙ্গে আমার একেবারে হুবহু মেলে। যে দশটা জিনিস আমার চয়েসে একদম এক্সেলেন্ট তার দশটাই কখনওই অঙ্গনার পছন্দ হতে পারে না। ওরও সব ডিসিশন আমার ঠিক মনে হবে এমন নয়। দেখতে হবে ফ্রিকোয়েন্সি ম্যাচ করছে কিনা। ওটা হলেই কাফি। তারপরে একটা লিবারাল স্পেস রাখতে হবে। আমাকে তুমি চেঞ্জ করতে আসবে না কখনও। আমিও যাব না তোমার যেসব ব্যাপার আমার অপছন্দ তাতে ইন্টারফেয়ার করতে…

আমরা কেউ কাউকে ডমিনেট করতে যাই না দিদি, এবারে মুখ খোলে অঙ্গনা, ওর এই মেন্টালিটিটাই আমার ভালো লেগেছিল কলেজে প্রথম মিশতে গিয়ে। ইনফ্যাক্ট আমিই শৌনকের চাইতে মাস তিনেকের বড়ো। বাড়িতে অ্যাজ ইট ইজ একটা হালকা আপত্তিও ছিল তাই। কিন্তু আমি কেয়ার করিনি। বলেই দিয়েছিলাম বিয়ে করতে হলে শৌনককেই করব। আর ওকে যদি ভুলে যেতে হয় আমায়, দেন ইউ অলসো ফরগেট অ্যাবাউট মাই ম্যারেজ ফর এভার…

অঙ্গনার কথা শুনতে শুনতে ভাবছিল নিবেদিতা– সবাই তো আর অঙ্গনা হতে পারে না।

তা বলে লিবারাল স্পেসের মানে এই নয় যে অঙ্গনা কারুর সঙ্গে শুতে চলে গেলে আমি টলারেট করব, বেশি সিরিয়াস হয়ে গেলে শৌনক যে আর আলগা ভদ্রতার ধার ধারে না অনেকবারই টের পেয়েছে নিবেদিতা। চশমাটা চোখ থেকে নামিয়ে বলে যায় সে, তেমন আমিও যদি প্রায়দিনই ড্রিংক করে রাস্তায় গড়াগড়ি দিই ও অফকোর্স সেটা হজম করবে না।

অঙ্গনার কাছে শুনেছে নিবেদিতা। শৌনকও মদ খায়। মাঝেমধ্যে অনেকটাই। কিন্তু অদ্ভুত সীমা রেখে।

বিয়ের এক বছরের মাথায় দিনকয়েকের ছুটিতে কলকাতার বাড়িতে এসে উঠেছিল শৌনক আর অঙ্গনা। তখনই হয়েছিল এত কথা। নিবেদিতা হঠাৎ অকারণেই বলে উঠেছিল, না আসলে সেম এজে বিয়ে তো বেশি হয় না। এখন অবশ্য হচ্ছে কিছু। আর তোমরা যেমন একজন আরেকজনের জন্যে ওয়েট করে বসেছিলে তেমনও হয় না ম্যাক্সিমাম কেসে। মেয়েদের বিয়ে হয়ে যায় আগেই। কলেজ লাইফের প্রেম টেকে খুব রেয়ার…

আরও কিছু হয়তো বলে ফেলতে যাচ্ছিল নিবেদিতা। কিন্তু সামলে নিল শেষ মুহূর্তে।

আমার কিন্তু তা মনে হয় না। আমাদের ক্লাসে ইনক্লুডিং আমি আর অঙ্গনা মোট সাতটা পেয়ার ছিল। পাঁচটা পেয়ারেরই বিয়ে হয়েছে। ফেলিওর মাত্র দুটো… বউদির কথার জবাবে বলে উঠেছিল শৌনক।

শৌনক, একটা কথা বলি এখানে, দিদির কথাটা আমি একেবারে কনডেম করব না, শৌনককে থামিয়ে দিয়ে এবারে বলেছিল অঙ্গনা, দেখ, ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ছেলেমেয়েদের সঙ্গে বাকিদের কমপেয়ার করলে চলবে না। দিদি যেটা বলছেন সেটাও ঠিক। জেনারেল গ্র্যাজুয়েশনের পর পরই একটা ছেলে চাকরি পেয়ে যায় খুব কমই। ক’ বছর লাগবে তার এস্টাব্লিশড হতে কোনও শিওরিটি নেই। আর মেয়েদের মোটামুটি গ্র্যাজুয়েশন হয়ে গেলেই বাড়ি থেকে বিয়ের কথা ভাবতে শুরু করে। তাই সিরিয়াস থাকলেও অনেক মেয়ে বাড়ির প্রেশারে অ্যাট লাস্ট ভেঙে পড়ে। একটা ইঞ্জিনিয়ার ছেলের জন্য বরং মেয়ের বাড়ি তাও বছরখানেক ওয়েট করতে রাজি থাকে…

হ্যাঁ এটা অবশ্য ঠিক। আমি ভাবিনি এ দিকটা, স্বীকার করেছিল শৌনক।

অঙ্গনার কথা শুনতে শুনতে অস্বস্তি হচ্ছিল নিবেদিতার। মেয়েটা যথেষ্ট স্মার্ট। কলেজ ক্যম্পাসিংয়ে শৌনকের আগেই চাকরি পেয়ে গিয়েছিল। সেক্টর ফাইভের একটা সফটওয়্যার কোম্পানিতে। বিয়ের পর চাকরি ছেড়ে না দিলে এতদিনে আরও উঁচুতে উঠতে পারত। হাঁ করলে হাই ধরতে পারে এসব মেয়েরা। নিবেদিতার কথায় কি কিছু আন্দাজ করে ফেলল মেয়েটা? এই প্রসঙ্গটা এখন তুলতে না গেলেই হয়তো ভালো হতো।

ছুটি শেষে অফিসে ফেরার আগে বরাবরের মতোই দাদা বউদিকে কয়েকদিনের জন্য ডিভিসি ঘুরে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করেছিল শৌনক। এবারে আর সে একা নয় খুব ধরেছিল অঙ্গনাও, একদিনের জন্যে মাইথন খুব ভালো আউটিং হবে দাদা। ডিভিসির ব্যারেজ, ডিয়ার পার্ক, দামোদরে বোটিং। খুব ভালো লাগবে…

হ্যাঁ, টানা দিন তিন চারেকের লিভ পেলেই যাব। শৌনকও বলছে অনেকদিন থেকেই। যাব এবারে অফকোর্স, চেলো রাইসের প্লেট থেকে এক টুকরো মাটন কাঁটায় গেঁথে নিতে নিতে বলেছিল সৌমেন।

পিটার ক্যাটের সোফায় বসে বসে ভাবছিল নিবেদিতা। শৌনকরা চলে গেলেই মাইথনের কথাও বেমালুম ভুলে যাবে সৌমেন। আর অন্তত এই একটা কথা কখনও তাকে মনে করিয়ে দিতে চায় না নিবেদিতাও।

কিন্তু মানুষ ভেবে রাখে এক আর হয় আর এক। কলকাতার হেড অফিস যে আচমকা সৌমেনকে দুর্গাপুর এনএসএইচএম-এর ম্যানেজমেন্ট বিভাগের হেড করে সেখানে বদলি করতে চলেছে সে কথা সৌমেন নিজেও জানতে পারেনি সপ্তাখানেক আগেও। দুর্গাপুরের কলেজে এতদিন যিনি ওই বিভাগের দায়িত্ব সামলাচ্ছিলেন সেই প্রফেসরের আকস্মিক মৃত্যুতেই সংস্থা বিপাকে পড়ে। আর যেসব ম্যানেজমেন্টের ফ্যাকাল্টি রয়েছে ওখানকার কলেজে বয়স বা অভিজ্ঞতা কোনওটার ভিত্তিতেই তাদের কাউকেই এই দায়িত্ব দিতে চাইছিল না হেড অফিস। অগত্যা কলকাতার কলেজ থেকে অন্তত কোনও অ্যাসোসিয়েট প্রফসরকেও বদলি করতেই হতো। দায়িত্বটা স্বভাবতই এসে পড়ল সৌমেন সর্বাধিকারীর ঘাড়ে। তবে আশ্বাস মিলল, বছর দুয়েক বাদে তাকে আবার কলকাতাতেই ফিরিয়ে আনা হবে। মুরারীপুকুরের বাড়ি কেয়ারটেকারের জিম্মায় রেখে অগত্যা সৌমেন আর নিবেদিতাকে চলে আসতে হল দুর্গাপুর। ভিরিঙি মোড়ের কাছাকাছি নাচন রোডে একটা ভালো বাড়ি ভাড়া পাওয়া গেল।

দুর্গাপুরে আসার সপ্তাখানেকের মধ্যেই একদিন ডিনারে বসে সৌমেন নিজেই বলল, বুঝলে নিবু, অনেকদিন থেকেই শৌনক বলছে তাছাড়া সেবার আমাদের ওখানে গিয়ে অঙ্গনাও খুব রিকোয়েস্ট করছিল, তা ভাবছি এত কাছে যখন এসেই পড়তে হল একবার ওদের ওখান থেকে ঘুরেই আসি। তুমি কী বলো? তাছাড়া এমনিও আমরা সেই হনিমুনের পরে আর বাইরে কোথাও যাইনি। শৌনককে জানিয়ে দিই যে আমরা একটা শনিবার দেখে যাচ্ছি…

ভাতের দলা মুখে তুলতে গিয়ে সহসা নিথর হয়ে গেল নিবেদিতা। দুর্গাপুরে এসে এখনও কলিগদের সঙ্গে সেভাবে সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি সৌমেনের। শনি-রোববারের সন্ধেগুলোয় তাই আর হুইস্কির আসর বসেনি এখনও অবধি। অথবা এমনও হতে পারে– সৌমেনের মনে হয়েছে এতদিন সে ছিল এক সাধারণ ফ্যাকাল্টি। কিন্তু আজ সে ডিপার্টমেন্টাল হেড। জুনিয়র ফ্যাকাল্টিদের আগের মতোই বাড়িতে ডেকে আনাটা শোভন না-ও দেখাতে পারে। তাছাড়া এসব দিক বাদ দিলেও নতুন জায়গায় এসে সৌমেন হঠাৎ সংসারের খুঁটিনাটি বিষয়ে অত্যন্ত সচেতন হয়ে উঠেছে। নতুন বাসা কিভাবে সাজিয়ে গুছিয়ে নেবে সেই ব্যাপারে আজকাল মাথাও ঘামাচ্ছে বেশ। সন্ধেগুলো আর ফেসবুক নিয়ে কাটায় না সেইভাবে। এতদিনে যদি সে স্ত্রীর একাকিত্বজনিত একঘেয়েমিকে একটুও উপলব্ধি করে থাকে, তবে সে তো খুবই আনন্দের বিষয়। কিন্তু নিবেদিতা আচমকা কোনও জবাব দিতে পারল না সৌমেনের কথায়। মাথা নীচু করে আবার মাছের কাঁটা বাছতে লাগল।

একটুক্ষণ চুপ করে থেকে অপরাধীর মতো গলায় সৌমেন আবার বলতে থাকে, আমি বুঝেছি তোমার ব্যাপারটা। আসলে কি জানো, কলকাতায় অনেক বন্ধুবান্ধব ছিল। বাড়িতে ছিল চব্বিশ ঘণ্টার কাজের লোক। আর বাড়ির যা কিছু টুকিটাকি সব মা-বাবাই গুছিয়ে দিয়ে দিয়েছিলেন। সংসারের কোনও দিকে যে মাথা ঘামানোর দরকার আছে আমার সেই কথাটাই তাই এতকাল খেয়াল হয়নি সেভাবে। কিন্তু এখানে এসে নতুন বাড়িতে ঢুকে ফিল করলাম অনেক কিছু গোছগাছ করতে হবে নিজের মতো করে। আর আমার নিজেকেই এবার অনেক দায়িত্ব নিতে হবে। তখনই ফিল করতে পারলাম তোমার কেসটাও। আমি তো সকালে উঠে এতদিন কলেজে চলে গেছি। সারাটা দিন কলেজে কাটিয়ে বাড়ি ফিরে আবার নিজের জগতে ঢুকে গেছি। কিন্তু সারাদিন তুমি…

সৌমেনের কথা শুনতে পাচ্ছে না নিবেদিতা। তার চোখের সামনে ক্রমশ ভেসে উঠছে একটা মৃত তারার মিটমিটে আলো। যে আলোটা আকাশের বুক থেকে হয়তো নিভে গেছে সাড়ে সাতশো বছর আগেই। কিন্তু হাজার আলোকবর্ষ দূরের তারাটা থেকে সেই আলোটুকু এইমাত্র এসে পৌঁছল পৃথিবীতে, যে আলোর যাত্রা শুরু হয়েছিল তারার জীবনকালে।

মরে যাওয়া তারার গল্প শুনিয়েছিল জয়দীপ। জুনপুটের সেই রাতে। তারপর কেটে গেল আজ আটটা বছর। আট বছর আগের একটি দিন। জীবনানন্দের নাম জানা ছিল কিন্তু সম্যক পরিচয় হয়েছিল জয়দীপের সূত্রেই।

বালিয়াড়ির বুকে পাশাপাশি শুয়েছিল নিবেদিতা আর জয়দীপ। সমুদ্রের ছলাৎ ছলাৎ শব্দ ভেসে আসছিল যেন কোন অনাদির বুক চিরে।

তোর আর আমার যদি বিয়ে না-ও হয় কোনওদিন, দীর্ঘক্ষণের নিস্তব্ধতা ভেঙে বলেছিল জয়দীপ, তবু এই অনন্ত নক্ষত্রলোকের কাছে অমর হয়ে রয়ে যাবে আমাদের এই সহবাস…

জয়দীপের মুখে হাত চেপে ধরেছিল নিবেদিতা। মৃত তারার আলোয় তার সিঁথিতে তখনও জ্বলজ্বল করছে জয়দীপের দেওয়া কালীঘাটের সিঁদুর। স্বামী-স্ত্রীর পরিচয়ে রেজিস্ট্রির কাগজপত্তর নিয়েই তারা এসেছে জুনপুটে। জুনপুটের এই রাত তাদের মধুচন্দ্রিমার প্রথম রাত। এমন রাতে এসব কী অনাসৃষ্টির কথা বলছে জয়দীপ!

নিবেদিতার হাত নিজের মুখের উপর থেকে সরিয়ে দিয়েছিল জয়দীপ। সমুদ্রের কোলাহলের সঙ্গে মিশে যেন বহুদূর থেকে ভেসে আসছিল তার উদাস কণ্ঠস্বর, পৃথিবী ছাড়া এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের আর কোথাও কি প্রাণ থাকতে পারে না নিবেদিতা?

আমার তো মনে হয় না আছে বলে। থাকলে কি আর এতদিনে খোঁজ পাওয়া যেত না? সহজ সুরেই উত্তর দিয়েছিল নিবেদিতা। ততদিনে এমন অদ্ভুত সব কথার সঙ্গে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে সে।

এই বিরাট আকাশের কতটুকুই বা আমরা জানি! ওই যে তারাটা জ্বলছে আকাশের ওই কোণায়, একদিকে আঙুল দিয়ে দিক নির্দেশ করেছিল জয়দীপ, ওই তারাটা আর সত্যি সত্যিই ওখানে আছে কিনা কে বলতে পারে?

এবারে সত্যিই অবাক হয়েছিল নিবেদিতা, মানে! তারাটাকে দিব্যি দেখতে পাচ্ছি। আর তুই বলছিস ওটা নাও থাকতে পারে ওখানে?

হ্যাঁ, ঠিক তাই, একটু থেমে আবার শুরু করেছিল জয়দীপ, হয়তো ওই তারাটা থেকে পৃথিবীতে আলো এসে পৌঁছোতে সময় লেগে যায় একহাজার বছর। তাই এইমাত্র যে আলোটা দেখছি আমরা আসলে সেটা সেই হাজার বছরের পুরোনো আলো। হয়তো সাড়ে সাতশো বছর আগেই নিভে গেছে তারাটা। কিন্তু আরও আড়াইশো বছর আলোটাকে অমনি দেখা যাবে…

শুনতে শুনতে ঘোর লেগে আসছিল।

জয়দীপ বলে যাচ্ছিল, আমাদের এই ছায়াপথেই আছে সূর্যের মতো কত নক্ষত্র। সূর্যেরই মতো তাদেরও কত গ্রহ উপগ্রহ। আবার এই ছায়াপথ আকাশের কতটুকুই বা। তারও বাইরে আরও কত দূর দূরান্তে এমন আরও কত অজস্র ছায়াপথ। আরও কত লক্ষ কোটি নক্ষত্র। তাদের গ্রহ উপগ্রহ। আমরা হয়তো জানি না কিন্তু এই বিশালতার আর কোথাও প্রাণ থাকা কি সত্যিই অসম্ভব?

জয়দীপের এই প্রশ্নের কোনও উত্তর ছিল না তার কাছে। সে শুধু মুগ্ধ বিস্ময়ে তাকিয়েছিল ছেলেটার মুখের দিকে। আবছা অন্ধকারে জয়দীপকে বহু আলোকবর্ষ দূরের মানুষ মনে হচ্ছিল। তার সেই অনন্ত অনুসন্ধিৎসাও যেন গ্রহান্তরের বিস্ময়। মৃত তারার পাণ্ডুর আলো মেখে জয়দীপের গালের চাপদাড়ি যেন পৌরাণিক দেবতার দাড়ির মতো সবুজ হয়ে গেছে। সেই সবুজ দাড়িতে হাত বোলাতে বোলাতে জয়দীপ বলেছিল, আড়াইশো বছর পরে ওই তারাটা পৃথিবীর মানুষের কাছেও মরে যাবে। কিন্তু তখনও হয়তো ওর জন্ম মুহূর্তের আলোটাও আকাশের সব কোণায় কোণায় পৌঁছবে না। হয়তো আরও দূরে অন্য কোনও এক ছায়াপথের এমন এক ছোট্ট গ্রহের উন্নত প্রাণী সেদিনও দেখতে পাবে তারাটাকে। মরে যাওয়ার পরেও তাই অনন্তকাল আকাশের দূর দূরান্তে বেঁচেই থাকবে তারাটা…

কি অপূর্ব এক মাদকতায় ভেসে যাচ্ছিল নিবেদিতা। জয়দীপের কথাগুলোর খানিক খানিক তাকে স্পর্শ করছিল আবার খানিক খানিক হারিয়ে যাচ্ছিল সামুদ্রিক ঝিমেল বাতাসে। জয়দীপ বলে চলেছিল, সেই গ্রহের বাসিন্দাদের হয়তো আছে আরও হাজারগুন উন্নত যন্ত্রপাতি। এই পৃথিবী থেকে আলো যেতে সেখানে সময় লাগে দশ হাজার বছর। ঠিক এই মুহূর্তে তুই আর আমি এই যে শুয়ে আছি জুনপুটের বালিতে এই ছবিটা সেই গ্রহের প্রাণীরা দেখতে পাবে আরও দশ হাজার বছর বাদে। ততদিনে আমরা আর কেউই বেঁচে নেই। হয়তো পৃথিবীটাই ধবংস হয়ে গেছে পারমাণবিক বোমায়। কিন্তু আমাদের এই সহবাসের ছবিটা অনন্তকাল আকাশের বিভিন্ন দূর দূরান্তের গ্রহ থেকে দেখাই যাবে। তাই বলছিলাম যদি তোর আর আমার কখনও ছাড়াছাড়ি হয়েও যায় আমাদের এই মুহূর্তের ভালোবাসাটুক…

হাত দিয়ে আবার জয়দীপের মুখ চেপে ধরেছিল নিবেদিতা।

আজ মনে হয় জুনপুটের সেই রাতে মৃত তারার আলো মেখে সবুজ হয়ে ওঠা দাড়িগোঁফের জয়দীপ যেন সত্যি সত্যিই স্বর্গের দেবতাদের মতো দিব্যদৃষ্টি লাভ করেছিল। নাহলে সে কেমন করে জানতে পারল সত্যিই একদিন ছাড়াছাড়ি হয়ে যাবে তাদের। বাড়ির চাপের মুখে ভেঙে পড়তে হবে নিবেদিতাকে। বিয়ে করতে হবে বয়সে প্রায় বছর সাতেকের বড়ো কর্মজীবনে সুপ্রতিষ্ঠিত সৌমেনকে।

বিয়ের পর বছরখানেক ফোনে যোগাযোগ ছিল কলেজের বান্ধবী সায়ন্তনীর সঙ্গে। তার মুখেই খবর পেত নিবেদিতা– জয়দীপ কেমন বিবাগি ধরনের হয়ে গেছে। কবিতা লেখার হাত ছিল কলেজে থাকতেই। আর ততদিনে নাকি একেবারে কবি বনে গেছে জয়দীপ। চাকরি বাকরির হাল হদিশ না করে শুধু নাকি লিখে যাচ্ছে ছোটো বড়ো সব লিটল ম্যাগাজিনে।

নাম বলতে পারিস? কোথায় কোথায় লেখে জয়দীপ? কলেজ স্ট্রিটে গিয়ে তাহলে একদিন… বলেছিল নিবেদিতা।

জানি না রে। লিটল ম্যাগাজিনের খোঁজ আর কে রাখে বল? নিউজ পেপার বা রেপুটেড ম্যাগাজিনে লিখলে তাও হয়তো চোখে পড়ত, নির্লিপ্ত গলায় বলেছিল সায়ন্তনী, কী আর হবে এসব করে? পয়সা আসবে? অথচ কত ব্রাইট ছেলে ছিল। আর কীভাবে নিজেকে স্পয়েল করছে আজকাল…

ফোনের এপাশে তখন নীরবতা।

ওপাশ থেকে তারপরেই মুখ ঝামটা দিয়েছিল সাযন্তনী, তোর কী রে এসব ভেবে? মাসিমা মেসোমশাই দেখেশুনে ভালোই বিয়ে দিয়েছেন। জাস্ট ভুলে যা। ফরগেট। আমারই ভুল হয়েছে। তোকে ওর কথা বলে। শোন, আর যদি কখনও তুই জয়দীপ শব্দটা উচ্চারণ করিস আমি দেন অ্যান্ড দেয়ার ফোনটা কেটে দেব। আর কখনও ধরবও না তোর ফোন। সে নিজের জীবনটাকে নষ্ট করছে, করতে দে। নইলে তোর ম্যারেড লাইফটা শেষ হয়ে যাবে। সৌমেনদা জানতে পারলে…

শেষ খবরটা অবশ্য সেই সায়ন্তনীই দিয়েছিল। বেড়াতে গিয়ে পাথরের খাঁজে খাঁজে অনেক নীচে নেমে গিয়েছিল জয়দীপ। উঠে আসতে আর কেউই দেখেনি…

সায়ন্তনীর গলাও ধরে এসেছিল সেদিন, যতই বল, একসঙ্গে কাটিয়েছি তো তিনটে বছর। শেষের দিকে যেমনই বাউন্ডুলে ছন্নছাড়া হয়ে যাক না কেন সত্যিকারের ভালো ছেলে তো ছিল এককালে…

শৌনক, তোমার ক্যামেরার অপটিক্যাল জুমটা আর একটু বাড়াও তো। যতটা বাড়ানো যায়, প্রাণপণে স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করে নিবেদিতা। কণ্ঠস্বরে যেন এতটুকুও উত্তেজনা প্রকাশ না পেয়ে যায়। প্রায় খাড়া একটা পাথরের ওপর দাঁড়িয়ে আছে সে। শৌনক রয়েছে পাশেই। সৌমেন আর অঙ্গনা দিব্যি বোল্ডারের মতো পাথর বেয়ে নেমে গেছে জলের একদম কাছে। এখান থেকে প্রায় পুতুলের মতো ছোটো দেখায় তাদের। নিবেদিতা শুরুতে নামতে চায়নি অত নীচে।

তোমরা ঘুরে এস না। আমি ততক্ষণ এখানে বসেই ওয়েট করছি না হয়। বলেছিল সে।

কিন্তু সবাই জোরাজুরি করল।অঙ্গনা বলল, আমাকে খেয়াল রাখবেন দিদি। কীভাবে নামব আমি। আপনি জাস্ট ফলো করে যান।

নিবেদিতা এড়ানোর চেষ্টা করছিল যদিও, শাড়ি পরে কি আর পারব? তুমি সালোয়ার-কামিজ পরে যতটা এফিশিয়েন্টলি পারবে নামতে…

তখন সৌমেন বলল, ভয়ের কিছু নেই। ধাপ ধাপ আছে বেশ পাথরগুলো। সিঁড়ির মতো নেমে যাবে। কোনওটা একটু খাড়া মনে হলে জাস্ট অ্যাভয়েড করে পাশের পাথর বেয়ে নামবে।

শেষে শৌনক বলল, ঠিক আছে। অঙ্গনা আর দাদা আগে নেমে যাক। আমি তোমার সঙ্গে থাকছি। কোনও প্রবলেম হলে আমি থাকছি পাশে।

অগত্যা নামতেই হল। আর এখানে এসে প্রথমে যেমন আড়ষ্ট লাগছিল, অঙ্গনাদের সঙ্গে কথায়বার্তায় ঠাট্টাইয়ার্কিতে সেই ভাবটা আপনা থেকেই কেটেও গিয়েছিল একসময়। শৌনকের কোয়ার্টারটা পড়ে ঝাড়খণ্ডে। আবার কাজের জায়গাটা বেঙ্গলেই। অফিস ঘুরিয়ে দেখাল শৌনক। আন্ডারগ্রাউন্ডে যেখানে টারবাইন রয়েছে সেখানে দাদা-বউদিকে নিয়ে যাওয়ার জন্য বিশেষ পাসও করিয়ে রেখেছিল। অফিস দেখার পর লাঞ্চ সারতে গাড়ি চেপে যাওয়া হল আবার ঝাড়খন্ড। মাইথন হোটেলের খাওয়াদাওয়া একটু কস্টলি হলেও কোয়ালিটি বেশ ভালো। দুপুরে সাদা ভাত খেতেই ভালোবাসে নিবেদিতা। পাতলা করে মাছের ঝোল সঙ্গে থাকলে বেশ হয়। সেসব আর এখানে কোথায়! ডাল ফ্রাই আর চিকেন নিল সে। শৌনক খেল হায়দ্রাবাদি মাটন বিরিয়ানি। অঙ্গনা আর সৌমেন ফ্রায়েড রাইস আর চিকেন বাটার মসালা নিয়েছিল। ভরদুপুরে এরা যে কী করে এত রিচ খেতে পারে!

খাওয়াদাওয়ার পর ড্যাম দেখতে আসা হয়েছে। পাথরের ধাপে নামতে গোড়ায় যতটা ভয় লাগছিল দু’ কদম চলার পর নিবেদিতা দেখল ব্যাপারটা অত মাথাব্যথার কিছুই নয়। বরং বেশ মজারই। ঠাট্টা করে বললও শৌনককে, এডমন্ড হিলারি পাহাড়ে উঠে বিশ্বজয় করেছিলেন আর আমরা খাদে নেমে মাইথন জয় করছি।

যা বলেছ, হাসল শৌনক। ক্যামেরাটা নিবেদিতার হাতে দিয়ে বলল, ফটো তুলতে পারো এখানে। দূরের পাহাড়ের বা ড্যামের। সিনিক বিউটি পাবে এনাফ…

ছবি তুলতে বরাবরই খুব ভালোবাসে নিবেদিতা। তাও দোনামোনা করছিল ক্যামেরাখানা হাতে নিতে, দ্যাখো, আমার হাতে দিচ্ছ। ক্যালাস ভাবে নামতে গিয়ে যদি পা হড়কায় তোমার এত কস্টলি ক্যামেরাখানাই কিন্তু যাবে তখন।

কিচ্ছু হবে না। তুমি ক্যামেরার ফিতেটা গলায় ঝুলিয়ে নাও বরং।

দূরের খাদের পাথরের দিকে ক্যামেরা তাক করল নিবেদিতা। কিছুটা গাছপালা নিয়ে ভালো ছবি আসতে পারে। ক্যামেরা চোখে লাগানোর আগেই মনে হচ্ছিল একটা লোক ঘুরে বেড়াচ্ছে পাথরের ধাপে ধাপে। আঙুল তোলে সে, একটা লোককে ওইখানে ঘুরতে দেখছ শৌনক। বাপ রে, শখ বলিহারি। কোথায় চলে গেছে।

তার নির্দেশ করা দিকে তাকিয়ে শৌনক বলল, কই আমি তো কাউকেই দেখতে পাচ্ছি না। না না একদম ফাঁকা। কোথায় লোক। আর ওদিকে যাবেই বা কেন। জল নেই শুধুই পাথর। অবশ্য অ্যাডভেঞ্চারের জন্যে যেতেও পারে। কিন্তু কেউ নেই তো…

সে কি তুমি দেখতে পাচ্ছ না! ওই তো হেঁটে যাচ্ছে। এবার দাঁড়াল। এই আমাদের দিকে মুখ ঘুরিয়ে তাকিয়ে আছে এখন, নিবেদিতা স্পষ্ট দেখতে পায় একটা মানুষের মতো অবয়ব।

শৌনক বলে, তুমি দেখতে পাচ্ছ? আমি দেখতে পাচ্ছি না কেন? কেস খেয়েছে। পাওয়ার বেড়েছে বোধহয়…

ক্যামেরাখানা শৌনকের দিকে এগিয়ে দিয়ে নিবেদিতা বলে, জুমটা একটু বাড়িয়ে দাও। আমি লোকটার ছবি নিয়ে তোমায় দেখাচ্ছি।

শৌনক অপটিক্যাল জুম বাড়িয়ে দেয় খানিকটা।

কিন্তু লেন্সে চোখ রেখেই ভয়ানক চমকে উঠল নিবেদিতা। সঙ্গে সঙ্গে চোখ থেকে ক্যামেরা নামিয়ে আবার শৌনকের দিকে বাড়িয়ে দিল সে। উত্তেজনায় তার সারা শরীর কাঁপছে। আকাশির উপর নেভি ব্লু স্ট্রাইপ দেওয়া ওই শার্টটা তার অনেক কাল আগের চেনা। তাছাড়া চোখমুখও…

কণ্ঠস্বরকে যথাসম্ভব সংযত রেখে বলে ওঠে নিবেদিতা, শৌনক, তোমার ক্যামেরায় অপটিক্যাল জুমটা আর একটু বাড়াও তো। যতটা বাড়ানো যায়…

শৌনক এবারে আশ্চর্য হয়, তুমি কি লোকটার ফুল সাইজ ফটো নেবে নাকি? একটা অচেনা লোকের ফটো নিয়ে কি হবে বেকার!

শৌনক। শৌনক, তোমায় যা বলছি তাই করো, নিবেদিতার গলায় এবার সুস্পষ্ট আদেশের সুর।

বউদির গলায় এমন জোর কখনও শোনেনি শৌনক। সে আশ্চর্য হয়। কিছুই বুঝতে পারে না। তবু অপটিক্যাল জুমটা যথাসম্ভব বাড়িয়ে বউদির হাতে দেয় ক্যামেরাখানা।

লেন্সে চোখ রেখে এবার নিবেদিতার সারা শরীর কাঁপতে থাকে। উত্তেজনায়, নাকি ভয়ে সে নিজেও জানে না। স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে সে মানুষটাকে। চোখ মুখ নাকের প্রত্যেকটা রেখা এখন পরিষ্কার। আর সারা গালে সবুজ রঙের দাড়ি। কোনও মানুষের দাড়ি এত সবুজ হতে দেখেনি নিবেদিতা। দূরের পাহাড়ের ঢাল থেকে জয়দীপ হাসছে তার দিকে তাকিয়ে। বিকেলের মরা রোদ জয়দীপের মুখে চোখে। সেই রোদে সবুজ দাড়ি আর তপ্ত কাঞ্চন শরীরের জয়দীপকে পুরাণের গল্পে বর্ণিত দেবরাজ ইন্দ্রের মতোই অপরূপ সুন্দর দেখাচ্ছে। তার শরীরও পৃথিবীর মানুষের মতো নয়। যেন অপার্থিব এক জ্যোতি নির্গত হচ্ছে তার অবয়ব থেকে। আরও আশ্চর্য এত বছর পরেও তার চেহারা সেই পুরোনো দিনের মতোই রয়ে গেছে। এই আট বছরে অনেক মেদ জমেছে নিবেদিতার শরীরে। কিন্তু জয়দীপ সেই জুনপুটের দিনগুলোর মতোই নির্মেদ বলিষ্ঠ। আট বছর আগেকার হাফস্লিভ শার্টটাও অত উজ্জ্বল থাকতে পারে না এতদিন ধরে। আকাশির ওপর সেই নেভি ব্লু স্ট্রাইপের দাগগুলো ঠিক তেমনি আছে।

কতক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পেরেছিল নিবেদিতা মনে ছিল তা তার। হয়তো দু’ এক মুহূর্তই।

শৌনক জড়িয়ে না ধরলে টলে পড়ে যেত সে। শৌনকের চিৎকারে অঙ্গনা আর সৌমেন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব উঠে এসেছে পাথরের ধাপে ধাপে দৌড়ে।

শৌনক বলে, পড়ে যাওয়ার আগে ক্যামেরার শাটার টিপেছিল বউদি। আমার স্পষ্ট মনে আছে।

অঙ্গনা বলল, দেখ তো ফটোটা একবার…

কিন্তু ফটোয় শুধু একটা বড়ো পাথর। জুম করার কারণেই পাথরের প্রত্যেকটা দাগ স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে।

শৌনক বলে, আমি ঠিকই দেখেছিলাম। কেউ ছিল না ওখানে।

শুধু নিবেদিতা দেখতে পেয়েছিল জয়দীপকে।

অনেক আলোকবর্ষ দূরের মানুষ হয়ে গেছে আজ জয়দীপ। সেই দূরত্ব থেকে আলো পৃথিবীতে এসে পৌঁছোতে লেগে যায় অনেক বছর। যতদিন বাঁচবে নিবেদিতা, এমন করেই মাঝে মাঝে দেখতে পাবে বহু আলোকবর্ষ দূরান্তের সেই মানুষটাকে।

মৃত তারার আলো যেমনি করে অনন্তকাল পরিক্রমা করে চলে অনন্ত আকাশে।

 

পড়ার জন্য সীমাহীন গল্প-নিবন্ধসাবস্ক্রাইব