দুরন্ত ঘোড়া

এই সমাজে ছোটাটাই দস্তুর। কেউ কেউ পরিকল্পনা করেই ছোটে। মিশনটা ভোগ সাগরে ডুব দেওয়া। অনেকে শক্তি হারিয়ে সেই সাগরে অতল গর্ভে বিলীন হয়ে যায়। আবার কেউ সব হারিয়ে সর্বস্বান্ত হয়ে ফিরে আসে। জীবনের মূল্যবোধ, পরম্পরা দায়দায়িত্ব, কর্তব্যবোধ সব খুইয়ে সে রিক্ত। ভোগ সাম্রাজ্যের মাঝে বসে নিরেট ভোগ সামগ্রী তাকে গিলে খেতে চায়। প্রাগৈতিহাসিক ডাইনোসরেরা শিকারিকে নিয়ে প্রথমে খেলা করে, তারপর একটু একটু করে ছিঁড়ে খায়। সেই ছিন্নভিন্ন মনের যন্ত্রণায় প্রলেপ দিতে কেউ আসে না।

সে আজ বড়ো একা। মিঠু যন্ত্রমানবে পরিণত হতে চায় না। ছোটোবেলা থেকে অতি মেধাবী মিঠুর স্বপ্ন ছিল অন্যরকম। জীবনবিমার তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী আজীবন দারিদ্রের সঙ্গে লড়াই করতে করতে পর্যুদস্ত। নিম্নবিত্ত পরিবারে বেড়ে ওঠা মিঠু আলোর দিশারি। মিঠুর হাত ধরে আদিত্য আকাশ ছুঁতে চায়। অফিস কলিগরা ইন্ধন দেয়– আদিত্যবাবু, মিঠুর মতো অসাধারণ মেধাবী মেয়েকে স্টেট লেভেলের ইঞ্জিনিয়ারিং পড়িয়ে পাতি ইঞ্জিনিয়ার বানাবেন? ওর জন্য পড়ে রয়েছে তো গোটা জগৎ। ওকে তো আরও বড়ো জায়গায় পরীক্ষা দেওয়াতে পারতেন? ওর আসল জায়গা আইআইটি।

ভাগ্য খোলে তরুণ কর্মকারের লটারি ব্যাবসায়। ফুটপাথে চেয়ার টেবিল পেতে লটারি বিক্রিতে যা কমিশন হতো, সংসারের হাঁড়িতে তেমন একটা কালি পড়ে না। পড়ার কথাও নয়। মোড় ঘুরল এই কাউন্টার থেকে প্রথম পুরস্কার লেগে যাওয়ায়। প্রথম পুরস্কার পেয়ে ট্যারা গোবিন্দ কত নম্বর বিত্তশালীদের খাতায় নাম লিখিয়েছিল জানা যায়নি। তরুণ ফুলে ফেঁপে ঢোল। খদ্দেরের মন বুঝে মা কালীর ফটোতে প্রতিদিন তাজা জবার মালা, সিঁদুর পরিয়ে, ধুপকাঠি জ্বালিয়ে বসে। সামনে থাকে বড়ো প্লাইবোর্ডে কাগজ লাগানো বিজ্ঞাপন, আনন্দ সংবাদ, আনন্দ সংবাদ, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য লটারি প্রথম পুরস্কার এই কাউন্টার থেকে উঠেছে, ইত্যাদি। আওয়াজটা বহুদূর পেৌঁছে দেওয়ার তাগিদে রাখা আছে একটি সাউন্ড বক্স। চটুল হিন্দি গানের পাশে চলতে থাকে আনন্দ সংবাদ। খদ্দেররাও হঠাৎ বিত্তশালী হওয়ার বাসনায় পিল পিল করে টিকিট সংগ্রহ করে। প্রাচুর্য তরুণকে নিয়ে যায় নরক দর্শনে। অন্ধকার জগতে। সেই জগতে সে এখন মাফিয়া। জীবনের মূল্যবোধ দায়িত্ব কর্তব্যবোধ সব কিছুরই প্রয়োজন ফুরিয়েছে।

বাচ্চা হওয়ার সময়ই রূপাঞ্জনার মা সমস্ত দায়দায়িত্ব সন্তান বাৎসল্য সমস্ত কিছুই তরুণের হাতে সঁপে দিয়ে জগতের মায়া ছেড়ে কেটে পড়ে। এত দায়ভার বহনের ক্ষমতা হয়তো তরুণের ছিল না। ছোট্ট শিশুর মিষ্টি হাসি সন্তান বাৎসল্য উসকে দেয়। বিরক্ত হয় না। ক্লান্তি আসে না। তিল তিল করে হারিয়ে যাওয়া মায়ের সাহচর্য দিয়ে বড়ো করতে থাকে। দাম্পত্য জীবনের আশা আকাঙক্ষা স্বপ্ন সব কিছুরই মূর্ত প্রতীক রূপাঞ্জনা। সে আজ আকাশের বুকে লেপটে থাকা নক্ষত্র। কম্পিটিশনটা ছিল মিঠুর সাথে। মিঠু ফোন করে –– হ্যালো রূপাঞ্জনা পড়তে যাবি তো?

– না রে আজকে শরীরটা ভালো নেই।

– সে কি, আজ যে ফিজিক্সের ক্লাস।

– থাক আজ ভালো লাগছে না। মাথাটা কেমন ঘুরছে।

হঠাৎই মেয়ের এই পড়াশোনার উদাসীনতার উৎস বুঝতে পারে না। টিচাররাও মিঠু, রূপাঞ্জনার অগ্রগতিতে উৎসাহিত। শ্যামলবাবু তো প্রথমেই ডেকে বললেন– তোমরা আমার কাছে ফিজিক্স পড়বে। আর শোনো তোমাদের কোনও ফি দিতে হবে না। কোচিং দেওয়া নিয়ে শিক্ষকদের মধ্যে কম্পিটিশন ওঠে তুঙ্গে। ফোন ছাড়তেই তরুণ উদগ্রীব হয়ে প্রশ্ন করে– কিরে, পড়তে যাবি না কেন? শরীর খারাপ? কি হয়েছে?

– না তেমন কিছু না।

– তবে? শেষ সময়ে এসে এই ফাঁকি কতবড়ো সর্বনাশ ডেকে আনবে বুঝতে পারছিস না। তোকে যে বড়ো ইঞ্জিনিয়ার হতে হবে। তোর মা যে হাঁ করে বসে আছে। তাকে কি কৈফিয়ত দেব?

রূপাঞ্জনা চুপ করে থাকে। বাবার এই উৎকন্ঠা, আবেগ প্রলেপ দেওয়ার রসদ জমা নেই। শরীরের মধ্যে এক অজানা অস্থিরতা যন্ত্রণা। সমস্ত উৎসাহ উদ্দীপনা যেন ক্রমশ নিঃশেষিত হয়ে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে তরুণের মনে হয় মেয়েটা কোনও বয়ফ্রেন্ডের পাল্লায় পড়েনি তো? সেক্ষেত্রে এই উদাসীনতা স্বাভাবিক। তরুণ ভিন গ্রহে হ্যারিকেন নিয়ে বয়ফ্রেন্ডের তল্লাশি চালাতে থাকে।

বাড়ির সামনে লোকের ভিড় দেখে তরুণের বুকের ভিতরটা ধড়াস ধড়াস করতে থাকে। পা যেন আর চলতেই চায় না। সামনে এসে অতি কষ্টে জিজ্ঞাসা করে– কি হয়েছে? পুলকের মা একটু বকে বেশি। নাম কিনতে চায়। লোকজন ঠেলে মুখ বাড়িয়ে বলে– আর বলো কেন। তুমি সাত সকালেই বেরিয়ে যাও। মেয়েটা মনে হয়, না খেয়েই পড়তে গিয়েছিল। তাই বোধ হয় মাথা ঘুরে পড়ে গিয়েছে। জ্ঞান ছিল না। এখন এসেছে। তরুণ ঘরে ঢুকতেই বুলটির মাকে ঠেলা দিয়ে বলে– কি জানি বাবা। আজকাল ছেলে-মেয়েদের ব্যাপারে যা শুনি, কোথায় কি করে এসেছে কি জানি। বুলটির মা সায় দিয়ে বলে– মা মরা মেয়ে। শাসন নেই। হতেও পারে। উৎকন্ঠিত তরুণ জিজ্ঞাসা করে– কিরে মা, কি হয়েছে? রূপাঞ্জনা ধীরে ধীরে উত্তর দেয় – শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। বুকে একটা যন্ত্রণা।

তবে চল কাছাকাছি কোনও নার্সিং হোমে, বলেই তরুণ উর্দ্ধশ্বাসে বেরিয়ে যায় গাড়ির খোঁজে। অনেক পরীক্ষানিরীক্ষার পর ডাক্তার পাল জানিয়ে দেয়– পেশেন্ট ইজ ভেরি সিরিয়াস। হার্টের দুটো ভালভ্ই প্রায় ব্লক। একটি হান্ড্রেড অপরটি সিক্সটি পারসেন্ট। ইমিডিয়েট অপারেশন করতে হবে। ওয়ার্ড মাস্টারের কাছে যান। সব বলে দেবে।

তরুণ দিশেহারা। উদ্ভ্রান্ত, এসব ব্যাপারে মুরারীপুকুরের ক্লাবের ছেলেরা হাত গুটিয়ে বসে থাকে না। টাকার সংস্থান হল। সেই টাকা নিয়ে ছুটতে ছুটতে নার্সিংহোমে তরুণ যখন পৌঁছোয় সূর্য তখন পশ্চিম আকাশে ঢলে পড়েছে। অনেক আশা-আকাঙক্ষা স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করার চোখ দুটি স্থির। নিস্পন্দ নিথর দেহখানি। সার্জন জানিয়ে দিলেন– সরি, মেয়েটি কোনও সুযোগই দিল না। ওটি-তে নেওয়ার আগেই সব শেষ।

আদিত্য অফিস থেকে ফিরেই আইআইটি-র ফর্মটা মেয়েকে দিয়ে বলে– নে এটা ফিল আপ কর। মিঠু দেখেই বলে এটা কী?

পড়ে দেখ। ফর্মের পাতা ওলটাতে ওলটাতে মিঠু খানিকটা ভীত হয়ে প্রশ্ন করে– বাবা, এ কি আমি পারব? আদিত্য নিজেই মনোবল উসকে নিয়ে সাহস জোগায়– পারবি মানে, তোর টিউটররা কি তাহলে ভুল মূল্যায়ন করেছে। আর ছিল রূপাঞ্জনা। সে তো আজ অতীত। তোর টিচাররা তো তোদের দুজনের ব্যাপারে হাই অ্যামবিশনের এক্সপেক্ট করছে।

– কিন্তু বাবা আমি চেয়েছিলাম, স্টেট লেভেলে ইঞ্জিনিয়ারিংটা দিতে। লোকালই কোনও একটা চাকরি নিয়ে তোমাদের কাছে থাকতে। আমি তো তোমাদের একমাত্র সন্তান। এটাতে পড়াশোনা করলে চাকরি নিয়ে তোমাদের ছেড়ে চলে যেতে হবে।

– তা হোক। আমাদের কথা তোর ভাবতে হবে না। চোখ উপর দিকে রাখ, তোকে অনেক উঁচুতে উঠতে হবে। তুই আমাদের গর্ব। পাড়ার গর্ব। মিঠু তর্ক বাড়ায় না। চুপ করে যায়। যে কথাটা বলতে পারল না, এই যে বাবা উঁচুতে স্বপ্ন দেখছে, অর্থের প্রাচুর্য হয়তো একদিন গিলে খাবে। দায়িত্ব, কর্তব্য মূল্যবোধ সবই হয়তো একদিন পরিত্যাজ্য হবে।

তরুণ যাচ্ছিল আদিত্য মুখার্জীর বাড়ির পাশ দিয়ে। একটা চিৎকার চ্যাঁচামেচিতে বাড়িতে প্রবেশ করে। তার চাইতেও বড়ো, কারণে অকারণে মিঠুকে দেখার অভিলাষ। সে যে তার রূপাঞ্জনারই প্রতিরূপ। রাঘব আগরওয়ালার কর্মচারী সুজন অধিকারীর কঞ্চির আস্ফালনে আদিত্য কুঁকড়ে ঢোঁড়া সাপ। মুখে ভাষা নেই। প্রতিশ্রুতির বাক্যবাণী নেই। অবনত মস্তকে চেয়ারে মাথা নীচু করে বসে থাকে। সুজনের অশ্রাব্য ভাষায় দরজা নেই। অবিশ্রান্ত আস্ফালন করেই চলেছে– বুড়ো ভাম, ভাড়া চুকোতে অসুবিধা কোথায়? ছিপলিটা দিয়ে দিলেই তো সব চুকে যায়। বাইরে দাঁড়িয়ে তরুণ বেকায়দায় পড়ল। আশা ছিল মেয়েটার সাথে দু-দণ্ড কথা বলে মনটা জুড়োবে। মেজাজটা হিঁচড়ে দিল। পকেট থেকে কানপুরি ছুরিটা বের করে সুজনের পেটের সামনে ঠেকিয়ে বলে– আবে এ কাঞ্চা, কি বললি? আবার বল। একদম পেট কামিয়ে দেব। ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়া সুজন ছুরি দেখে নীচের কাপড় আর শুকনো রাখতে পারে না, দুর্বল পরিবারে তড়পানোর শক্তি হারিয়েছে। তরুণের পা দুটি জড়িয়ে ধরে হাউ হাউ করে কেঁদে বলে– দাদা আমার কি দোষ? মালিকের অর্ডার ছিল কড়া ভাষায় থ্রেট করতে।

– নে ওঠ শালা, তাই বলে আমার মাকে বেইজ্জত করবি। কত ভাড়া পাবি? সুজন করুন সুরে বলে– পাঁচশো টাকা করে ছয় মাস তিন হাজার টাকা।

পকেটের থেকে এক গোছা টাকা বের করে ছুড়ে দিয়ে বলে– নে এতে তোর তিনহাজার টাকার বেশি আছে। এর পরে যে টাকা বাকি পড়বে আমার মা চাকরি করে শুধবে। তার আগে যদি এ মহল্লায় পা দিয়েছিস তো, আসার সময় দত্তদের পুকুরটা দেখেছিস, একদম খাল্লাস করে ওখানে চালান করে দেব। চল হট শালা। মিঠুর দিকে তাকিয়ে বলে– মা-রে ও মালটার সাথে এভাবে কথা না বললে হল্লা করেই চলত। বারবার ঝামেলা করত। তোর সামনে লোকটার সঙ্গে এরকম ব্যবহার করায় আমারও সংকোচ হচ্ছে। এছাড়া আমার যে আর কোনও পথও খোলা ছিল না। সংকোচ মিঠু করে না। শ্রদ্ধার পরিমাণটা অন্তরস্থলে আরও একটু জায়গা করে নেয়। আমি উঠি রে, তোর পড়াশোনার অনেকটা ক্ষতি হয়ে গেল। বলে তরুণ দাঁড়ায় না।

পরিণতি তরুণকে নিয়ে যায় নরক দর্শনে। সে জাত বজ্জাত নয়। বেপরোয়া ঔদাসীন্যের সঙ্গে যারা পাপের পথে হাঁটে, কোয়ালিস হাঁকায়, সে ধাতুতে তরুণ গড়া নয়। পাপ তার পেশা নয়, নেশা। দারিদ্র্যকে বড়ো কাছের থেকে দেখেছে। সেই দারিদ্র্য নিয়ে স্ত্রী কন্যার সংসার সামলেছে। সব হারানোর যন্ত্রণা বিষাক্ত ভয়ানক নেশার মতোই তার মতো ইস্পাতে গড়া মানুষটাকে ধবংসের পথে নিয়ে যায়। বিদ্যার কারণেই হোক আর মস্তিষ্কের উর্বরা শক্তির প্রয়োগে বন্ধ কারখানায় মাল সরানোর কাজে সে এলাকার মাফিয়া ডন। তরুণের সমগোত্রীয় কেউ ধৃষ্টতা দেখানোর স্পর্ধা দেখায় না।

শ্রীজীবের আর এক দশা। বাপটা এক মেয়েছেলের খপ্পরে পড়ে তাকে নিয়ে ভেগেছে। দারিদ্র্য অনেক কিছু দেয়। দায়িত্ব কর্তব্য সুস্থ রুচিবোধের রসদ যোগায়। ক্ষিদের তাড়না মেটায় না। সেই তাড়নাতেই বাবুর বাড়িতে কাজ ধরে। শরীরে খাদ্য যোগানের বিনিময়ে পরিশ্রমের মাত্রা বেশি হলে শরীর তা সহ্য করে না। প্রতিদিন জ্বর হয়। বুকে কফের ভাব তৈরি হয়। সবসময় শুধু কাশে। শ্রীজীবটার কোনও কাজ জোটেনি। সব কারখানায় বড়ো বড়ো তালা ঝুলছে। তরুণের ফাইফরমাশ খাটে। তরুণ কিছু দেয়। শ্রীজীবটা কদিন তরুণের কাছে যায় না। মা টার শরীরটা বাড়াবাড়ি হয়েছে।

শ্রীজীব ধূর্ত নয়। সে পরিস্থিতির দাস। সেই দাসত্বের শৃঙ্খল মোচন করার শক্তি তার নেই। অকৃতজ্ঞতা, বিবেকদংশন মনকে কুরে কুরে খায়। যথাসম্ভব সেই যন্ত্রণাকে চাপা দিয়ে কৃত্রিম উত্তেজনা তৈরি করে হাঁপাতে হাঁপাতে তরুণকে গিয়ে বলে– তরুণদা, কোরা শিবুকে পুলিশ কৃষ্ণা রেপ কেসে সকালে তুলে নিয়ে গেছে। তরুণের মালের নেশাটা বেশ চড়েছে। চেয়ারে বসে দেয়ালে হেলান দিয়ে ব্যালেন্স রাখছে। শ্রীজীবের কথা শুনে চমকে ওঠে– কি, কোরা শিবুকে পুলিশ পেল কোথায়? ওকে তো ঘোড়াডাঙায় পাঠিয়েছি। আজ বিকেলে ফেরার কথা। ফোন করেছিল তো কাল রাত্রে।

– তা জানি না, হয়তো সকালেই এসেছিল। পুলিশ বাগে পেয়েই অ্যারেস্ট করেছে।

– ও কেসে শিবুকে ধরবে কেন। ওটা তো কাঁকুরগাছির কেস। ঘাপলা কেস নয়তো?

– কি জানি, একবার গিয়ে দেখলে হতো না?

– চল তবে দেখেই আসি। শীতের পড়ন্ত বেলায় হাঁটতে ভালোই লাগছে। হাঁটতে হাঁটতে মালের ধুনকিটা অনেকটা কেটে এসেছে। প্রশস্ত রাস্তার দুই পাশে অজস্র এঁদো গলি। নদীর শাখা নদী। স্রোত কম থাকায় এসব নদীতে পাঁক প্রজাতির মাছের উৎপাদন ঘটে। এই এঁদো গলিতে সন্ধ্যার আগেই সন্ধ্যার আঁধার ঘনিয়ে আসে। চাঁদ এ গলিতে উঁকি মারে না। এদের দৈন্যদশা খোঁজ নেওয়ার তাগিদ নেই। পাঁচ ফুট রাস্তার দুই পাশে সরু নর্দমার পাঁক চলকে চলকে সমস্ত রাস্তাটা পাঁকময় করে রেখেছে। হাবু ডাবু গলি থেকে বেরিয়েই তরুণের সাথে দেখা।

– আরে তরুণদা কোথায় চললে?

– আর বলিস না, আমাদের কোরা শিবুটাকে রেপ কেসে পুলিশ তুলে নিয়ে গেছে।

– হ্যাঁ তাই তো শুনলাম, তুমি এসেছ ভালোই হয়েছে। চলো তো যাই। কেসটা কি? তরুণ আপত্তি করে না। মনে মনে দু-একজন সঙ্গী তরুণ খুঁজছিল। শ্রীজীব অনেকক্ষণ ধরে কেটে পড়ার ধান্ধা করছিল। তরুণকে বলে– তরুণদা মা টার শরীরের অবস্থা ভালো না। আমি তবে চলে যাব? আয় তবে। প্রশস্ত রাস্তা ছেড়ে এঁদো গলিতে কিছুটা পথ যেতেই তরুণের নেশার ঘোরটা কাটতে স্বাভাবিক ছন্দে ফেরে– ইস, এ নোংরা গলিতে ঢুকলি কেন?

– আরে ইয়ার, এখান থেকে একটু তাড়াতাড়ি হবে।

– কেস দিয়ে দিলে সব লুচ্চা হয়ে যাবে না? মস্তিষ্কের উর্বরা শক্তি তরুণের কম নেই। সেই শক্তিতেই এক মুহূর্তে সিদ্ধান্ত নেয়।

এখান থেকে পালাবার আর কোনও রাস্তা নেই, মৃত্যুর বদ্ধভূমিতে ঢুকে পড়েছে।

– আরে ইয়ার থোড়া রুক, একটু খালাস করে নিই। হাবু ডাবু বাধা দেয় না। একটু এগিয়ে গিয়ে অপেক্ষা করে। পরস্পরের সঙ্গে শলা পর্ব সেরে নেয়। শালা এখান থেকে ভাগবে কোথায়? নে খালাস করে নে। একটু পরে তুই খালাস হবি। মতলবটা নরখাদক বাটপাড়েরা বুঝতে পারেনি। মিশকালো ঘন অন্ধকারে পকেট থেকে মেশিনটা বার করে। অত্যন্ত সন্তর্পণে লক্ষ্য স্থির রেখে পর পর শুট। আওয়াজটা বজ্রগর্ভ নয়। সাইলেন্সার লাগানো ছিল। হাবুটা ছিটকে এঁদো নর্দমায় পড়ে। বিষধর সাপ শেষবারের মতো ফণা তোলার চেষ্টা করে। পারে না। নর্দমার পাঁক মাথা ঠান্ডা করে। পাঁকেই সমস্ত শক্তি নিঃসৃত হতে হতে নিথর হয়ে যায়। ডাবু তলপেটে দানা খেয়ে বজ্রগর্ভে হুংকার দিতে দিতে বড়ো রাস্তায় মুখ থুবড়ে পড়ে। তরুণ পাঁকে দেহটাতে পাড়া দিয়ে বিজয়ের মুকুট চাপিয়ে দাম্ভিক শ্লেষাত্মক ভঙ্গিতে বলে– শালা মারনেওয়ালা মর গই। পথের কাঁটা তরুণ উপড়ে, দ্রুত গতিতে বেরিয়ে আসে। নির্মূল হয় না। পশ্চিম আকাশে লাল দিগন্তে মৃত্যুর বলিরেখা অঙ্কিত হয়ে রইল, তাতে তরুণের পরোয়া নেই। আত্মরক্ষার কোনও দায় নেই। সে আজ পালহীন, উদ্দেশ্যবিহীন উত্তলিত জোয়ারে বয়ে যাওয়া নৌকা। সে নৌকায় সওয়ারী সে নিজেই।

মিঠু প্রথম প্রথম বাবাকে ফোন করত। সুদূর কেনটনে বসে মায়ের যত্ন, বাবার সাহচর্যের অভাবে মনটা শূন্যতায় ভরে উঠত। ট্রেনিং পিরিয়ডে তখনও, বৃহৎ কর্ম জগতে প্রবেশ করেনি। মা-বাবার মায়া মমতার তুচ্ছ মোড়কটার অভাবে জীবনীশক্তি কেমন স্তিমিত হয়ে যায়। মেয়ের সাফল্যের চূড়ার মসনদে আসীন হওয়ার মোহে মেয়ের শূন্যতা আদিত্যকে ভারাক্রান্ত করে না। সেটা ক্ষণিকের মোহজাল। অবসর গ্রহণের পর আদিত্যের একমাত্র ঠিকানা রাধিকারঞ্জনের দাবার ঠেক। দাবার ঘুটিতে চাল দেওয়ায় আদিত্যের অপরূপ কৌশল। সেই কৌশলেই রাধিকারঞ্জন কুপোকাত। একটার পর একটা চালে কখন যে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা, সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত, কখন যে জগৎটাকে ঘন অন্ধকার গ্রাস করেছে আদিত্য বুঝতে পারে না। এবার বাড়ি ফেরার পালা। ফিরতে হয়। সেই যাওয়া আর আসা। এরমধ্যে সবসময় যে সদর্থ ব্যাখ্যা থাকে তা নয়। তবু যেতে হয়।

ঘরে ফিরেই আদিত্য মৃন্ময়ীকে সুধোয়– মেয়েটা ফোন করেছিল? মৃন্ময়ী উত্তর দেয় না। ফুঁসতে থাকে। মৃত আগ্নেয়গিরি বিস্ফোরণের রসদ সঞ্চয় করে। তারপর একসময় বজ্রনিনাদে বিস্ফোরিত হয়। দ্বিতীয়বার জিজ্ঞাসা করতেই অগ্নিস্ফুলিঙ্গের মতো বিচ্ছুরিত হতে থাকে– রোজ রোজ একই কথা বলো কেন। নিজে তো দাবার আড্ডায় সারা দিন কাটিয়ে, গভীর রাতে মেয়ের কথা মনে পড়ে। মা হয়ে আমার মন টেকে কি করে। ভেবে দেখেছ? টাকার লোভে মেয়েটাকে পরবাসী করে ছাড়লে। এখন লোক দেখানো হাপিত্যেস করে লাভ কি? লোভ আদিত্যের ছিল। লোভটা সহজাত নয়। দারিদ্রের অপমান লাঞ্ছনা তাকে লোভাতুর করে তোলে। মিঠুর নাম্বারটা ডায়াল করতেই অল লাইনস আর বিজি। কথাগুলো ফাটা কাঁসির মতো লাগে। আদিত্য ধীরে ধীরে ক্লান্ত হয়ে পড়ে। হতাশা অবসাদে ফোন আর ধরে না। অবসর সময়ে আকাশের দিকে শূন্য দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে।

ভয়, আতঙ্ক, সংকোচ এগুলি অপরাধী মনের সহজাত প্রবৃত্তি। সেই প্রবৃত্তিতে শ্রীজীব নিজেকে আত্মগোপন করে রাখে। তরুণদাকে জল্লাদের হাতে তুলে দিয়েছিল। মরেছে জল্লাদেরা। জল্লাদের হাতে দেবতাদের মৃত্যু হয় না। ইচ্ছা মৃত্যুতেই তাদের পরিণতি ঘটে। তরুণদার প্রতি শ্রদ্ধা ভক্তি শ্রীজীবের মনের দৃঢ়তা আনে। সেই দৃঢ়তায় মনের সমস্ত সংকোচ ঝেড়ে ফেলে তরুণের পায়ে মাথা নীচু করে বসে। তরুণদা আমাকে শাস্তি দাও। আমি মাফ চাই না। যে অপরাধ আমি করেছি তার ক্ষমা হয় না। তরুণের শান্ত স্নিগ্ধ মমতা যেন শ্রীজীবের উপর বর্ষিত হয়, বাইরে কৃত্রিম ক্ষিপ্রতায় ঝাঁঝিয়ে ওঠে– ওঠ শালা মাকড়া, ঘাপলা করে এসে ন্যাকামি মারাচ্ছে। কি এমন দরকার পড়ল, কত টাকা নিয়েছিস? ওদের তুই চিনিস? এবারে তো তোকে সরিয়ে দেওয়ার ছক করছে, সে খবর রাখিস?

– না না বস, টাকা নিইনি। মানে ওরা বলেছিল কাজ হলে টাকা দেবে।

– যাক, খাওয়াদাওয়া করেছিস? শ্রীজীবের মুখে ভাষা নেই। অপরাধীর মতো মাথা নত করে বসে থাকে।

– যা টেবিলের উপর পাউরুটি কলা আছে। খেয়ে নে। শ্রীজীব দুটো থালায় পাউরুটি কলা নিয়ে আসে। একটি তরুণদাকে দেয়, একটি নিজে নেয়।

– তোর মা কেমন আছে?

– ভালো না, সেই জন্যই ওরা বলল, তরুণকে আমাদের হাতে তুলে দে, তোর সব চিকিৎসার খরচ আমাদের।

– গর্ধব, সেটা তো আমাকে বলতে পারতিস।

– তোমার ঋণ আর কত বাড়াব। আমার যে আর মুখ ছিল না।

– তাই বলে আমাকে খরচা করে ঋণ শোধ করবি? এখন তোর বিপদটা ভেবে দেখছিস? তোকে যে ওরা খরচা করে দেবে। শোন, বিলাসপুরে আমার এক বন্ধু আছে। কাল দুপুরের মুম্বই মেলের টিকিট কেটে দিচ্ছি। মাকে নিয়ে ওখানে চলে যা। ওরা সব ব্যবস্থা করে দেবে। আমার সঙ্গে ঋত্বিকের কথা হয়ে আছে। ওখানকার চিরিমিরি কোলিয়ারিতে তোর একটা কাজেরও ব্যবস্থা করে দেবে। আর ড্রয়ারটা খোল, ওখানে লাখ খানেক টাকা আছে। ওই টাকা নিয়ে মায়ের চিকিৎসা করাবি। এটুকু সময় তোর বাড়ির চারদিকে আমার লোক থাকবে। এখানে তোকে রক্ষা করতে পারব না।

শ্রীজীব যে দেবতাকে জল্লাদের হাতে তুলে দিতে গিয়েছিল সেই তাকে মারন বিপদের হাত থেকে রক্ষা করতে এই মহান দায়ভার গ্রহণ করছে। বিপদ যে তার অন্তরস্থলের দেবতাকেও গ্রাস করতে চলেছে। দেবতার নাম সে শুনেছে। চোখে দেখেনি। শুখা নদীতে বান এসেছে। কৃতজ্ঞতার বানে উত্তলিত হয়ে তরুণের পা জড়িয়ে ধরে– তরুণদা, ঠাকুর আমি দেখিনি। তুমিই আমার ঠাকুর। তোমাকে এই বিপদের মধ্যে ফেলে আমি কোথাও যেতে পারব না। যা হবার হোক। আমি তোমার সাথেই থাকব।

– অনেক ভাট বকেছিস। এবার ওঠ। তোর যে সংসারে অনেক কাজ। আমার সংসারে প্রয়োজন ফুরিয়েছে।

– কি বলছ, তরুণদা? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।

– বুঝতে হবে না। অনেক মেগাসিরিয়াল হয়েছে। এবার কেটে পড়। বাড়িতে গিয়ে গোছগাছ কর।

কতদিন ধরে মৃন্ময়ীর শরীরটা ভালো যাচ্ছে না। পেটে একটা অব্যক্ত যন্ত্রণা সমস্ত শরীরটা নাড়া দিয়ে উঠেছে। সেই যন্ত্রণা প্রবল হলে আদিত্য কাছাকাছি এক হাসপাতালে মৃন্ময়ীকে নিয়ে যায়। পেশেন্টকে দেখেই ডা. রায়ের সন্দেহ হয়। বায়োপসির রিপোর্ট হাতে আসতেই ডা. রায়ের সন্দেহের অন্ধকার কেটে যায়। রিপোর্ট পজিটিভ। লিভারে ম্যালিগন্যান্ট ক্যান্সার। অন্ধকারটা নেমে আসে আদিত্যর জীবনে।

ব্যাংকে যে ক’টা টাকা ছিল প্রাথমিক চিকিৎসাতেই শেষ। মৃন্ময়ীর আয়ুষ্কাল আর কতদিন, সেটা বলবে ভবিষ্যৎ। চিকিৎসার পরবর্তী ব্যয়ভার মেটাবে কীভাবে। সেটা তো গন্ধমাদন পর্বত।

যাদুকরের কেরামতিতে পুতুল নাচে। অর্থের যাদুকর দুর্বল হলে পেশেন্টও অচল হতে থাকে। মৃন্ময়ী ক্রমশ ঝিমিয়ে পড়ে থাকে। দৃষ্টি আবছা হতে থাকে। গলাতে আওয়াজে আর সেই ঝাঁঝ নেই। থেকে থেকে আদিত্যকে প্রশ্ন করে– মেয়েটা ফোন করেছিল গো? আদিত্যের দীর্ঘনিঃশ্বাসের আঁচ মৃন্ময়ী করতে পারেনি। বাইরে কৃত্রিম স্বাচ্ছ্যন্দে উত্তর দেয়– হ্যাঁ করেছিল তো। নানান ঝামেলায় বলা হয়নি। এই তো রাধিকার বাড়ি থেকে আসার পথে হঠাৎই মিঠুর ফোন। তোমার কথা, আমার কথা। পাড়ার সবার কথা। বলছে অফিসে খুব কাজের চাপ। তবে পুজোর সময় আসবে বলেছে। মৃন্ময়ী বাধা দিয়ে বলে– আমার শরীর খারাপের কথা বলোনি তো?– না না ওসব বলিনি। মেয়েটা ওখানে বসে ছটফট করবে। এতগুলি মিথ্যা কথা বানিয়ে বলতে আদিত্যেরও মনটা হিঁচড়ে যাচ্ছিল। বাস্তবটা যে বড়ো নিষ্ঠুর। মৃত্যু পথযাত্রীর কাছে এই মিথ্যেটাই যে বাঁচার রসদ। কিছুটা হলেও শরীর, মন চাঙ্গা হয়।

বিকেল হলেই রাধিকারঞ্জনের মনটা ছুকছুক করে। চোখ পড়ে দাবার বোর্ডের দিকে। ঘুটি সাজিয়ে বসে থাকে আদিত্যের অপেক্ষায়। আজ কতদিন হল আদিত্য এমুখো হয় না। দাবার নেশা তাকে আদিত্যমুখী করে তোলে। সদর দরজা হাট করা খোলা। মধ্য খাটালে একটা বিড়াল উচ্ছিষ্ঠ যা কিছু ছিল সাবড়ে দিয়ে মৌতাত করছে স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে। ম্যাও করে নবাগত অতিথির আগমনি বার্তা জানান দিয়ে খাটের তলায় নিরাপদ আশ্রয় নিয়েছে। খাটের উপর গোটা তিনেক বালিশে হেলান দিয়ে অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে। যে চাউনিতে আলোর রেখা নেই। অন্ধকারের করাল গ্রাস একটু একটু করে গিলে খাচ্ছে। ভাঙা হাটে প্রেম ভালোবাসা স্নেহের খদ্দেররা এক এক করে সরে যাচ্ছে। এখন আদিত্য শুধুই একা। অকর্মণ্য স্বামী মৃত্যু পথযাত্রী স্ত্রীর শেষ চিকিৎসাটুকু করতে অপারগ। অসহায় মানুষের চিন্তাটাই একমাত্র অবলম্বন।

দরজা খোলা পেয়ে ভিতরে ঢুকে হাঁক পাড়ে রাধিকারঞ্জন – আদিত্য, ও আদিত্য ঘরে আছ নাকি? নিস্তব্ধ নিঃস্পন্দ একটা মাত্র অল্প পাওয়ারের ল্যাম্পের ক্ষীণ আলো জ্বলছে। প্রাণহীন ইটের পাঁজরে চারদেয়ালে আদিত্য যেন বন্দিদশা কাটাচ্ছে। মুখমণ্ডল মনের আরসি। কোটরাগত চোখ, অসংখ্য চিন্তার ভাঁজ জানান দিচ্ছে আদিত্য ভালো নেই। – কি ব্যাপার? কত দিন তোমার দেখা নেই। আদিত্যর সাড়া মেলে না। গায়ে হাত পড়তেই ধড়মড় করে ওঠে। স্বাভাবিক হতে চেষ্টা করে। সবটা পারে না। উদ্বিগ্ন অশান্ত মন স্বাভাবিক হতে দেয় না। বয়সের ভারে রাধিকারঞ্জনেরও চেতনার পরিপক্বতা এসেছে। সেই পরিপক্বতায় তার বুঝতে দেরি হয় না।

– কি ব্যাপার, মনে হচ্ছে কোনও গভীর সমস্যায় পড়েছ?– হ্যাঁ ভাই, ভালো নেই। মিঠুর মা হাসপাতালে ভর্তি। উদ্বিগ্ন রাধিকা প্রশ্ন করে– কেন কী হয়েছে? অকারণ গৌরচন্দ্রিকা বাড়ায় না। আর সে মানসিকতাও নেই। সরাসরি বলে– লিভার ক্যান্সার। রাধিকা হতবাক স্তম্ভিত। সে জানে অশান্ত, উদ্বিগ্ন মনকে শান্ত করা যায় না। রাধিকা সে পথে হাঁটেও না। পরিস্থিতিটা বোঝার চেষ্টা করে। তা চিকিৎসা ঠিকঠাক চলছে তো?

– চলছে, তবে প্রাথমিক পর্বটা মিটেছে। এখন দরকার পরের ধাপ। অপারেশন, কেমো এদিক সেদিক আরও খরচ। এ রাশ তো আমি আর টানতে পারছি না। এখন আমি সর্বশান্ত।

– তা এখনও খরচ কত কিছু জানতে পেরেছ?

– কি জানি, বোধহয় লাখখানেক হবে।

– মিঠুকে খবর দিয়েছ?

এক দীর্ঘনিশ্বাসে বলে– না, আসলে অতদূরে থাকে। তাছাড়া ওখানে ওর কাজের চাপও খুব বেশি। শুধু শুধু ব্যতিব্যস্ত করে লাভ কি বলো ভায়া।

এই দীর্ঘনিশ্বাসই রাধিকাকে জানান দেয় শেষোক্ত মনগড়া মন্তব্য অন্তরস্থলের হতাশার গভীরতা। বড়ো অজান্তে আদিত্যের দগদগে ঘায়ে খোঁচা দিয়ে বসেছে। রাধিকা কথা বাড়ায় না। আজ আসি– বলে রাধিকারঞ্জন রাস্তায় বেরিয়ে আসে।

বৃদ্ধ বয়সের দোসর বড়ো অবলম্বন। বয়েস বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ক্রমশ সঙ্গীহীন হতে থাকে মানুষ। সে হতে থাকে নিঃসঙ্গ, একা। এই দোসর তখন পরস্পর পরস্পরকে আঁকড়ে ধরতে চায়। এতগুলো টাকার দায়ভার সে বইবে কী ভাবে। ক্লাবের ছেলেদের বলবে? মন সায় দেয় না। আদিত্য তো তাকে দায়িত্ব দেয়ওনি। দিশাহীন, উদভ্রান্তের মতো চলতে চলতে হঠাৎই তরুণের সাথে দেখা হয়।

– পাশে এসো। একটা ভয়ংকর সমস্যায় পড়েছি।

সেটা তো দূর থেকে আসতে দেখেই বুঝতে পারছি। কি হয়েছে?

– আদিত্যের স্ত্রীর শরীর খুব খারাপ। হাসপাতালে ভর্তি। এখন ওর যা অবস্থা, তাতে চিকিৎসাটাও করতে পারছে না। ভাবছিলাম ক্লাবকে জানাব কিনা। মেয়েকে খবর দেওয়ার প্রসঙ্গ তুলতেই মনগড়া কতগুলো কথা বলে প্রসঙ্গ এড়িয়ে গেল।

– মিঠুর নাম্বারটা, আচ্ছা দেখি বাড়িতে যাই।

– কি মিঠুর নাম্বার। দাঁড়াও। বলে বুক পকেট থেকে একতাড়া চিরকুট বের করে খুঁজে খুঁজে নাম্বারটা দিয়ে বলে– দ্যাখো, নবাব নন্দিনীর নাগাল পাও কিনা।

নাম্বারটা পকেটে গুঁজেই বলে– আমাকে দুটো দিন সময় দিন। আমি হাসপাতালে যাচ্ছি রাধিকাবাবু, এ চিকিৎসার খরচ আমিই দিতে পারতাম। আপনি তো জানেন আমার রোজগার সবই পাপের টাকা। বউদি বাঁচবেন কিনা জানি না, পাঁক তাঁর গায়ে লাগাতে চাইছি না।

তরুণ সময় নষ্ট করে না। মিঠুকে ফোন লাগায়। সেই ফাটা ক্যাসেট– অল লাইনস আর বিজি। তরুণ নাছোড়। হতাশায় শ্রান্ত হওয়ার ধাতুতে সে গড়া নয়। অবিশ্রান্ত ডায়াল করতেই থাকে। আচমকাই রিং বাজতে থাকে। শুখা নদীতে যেন জলের সঞ্চার ঘটে। প্রাচুর্যের মসনদে আসীন হলে কণ্ঠস্বরে আলাদা গাম্ভীর্য আসে। রুচি, চালচলনে সর্বত্র লেগে থাকে পরিবর্তনের ছোঁয়া।

– হ্যালো, তরুণ ভীত নয়। মনের দৃঢ়তাই শক্তি যোগায়। অথচ স্নেহশীল বাপের মতোই আর্জি জানায়– হ্যালো মিঠু? আমাকে চিনতে পারছিস মা, আমি তোর তরুণ কাকা।

– ও হ্যাঁ, বলো, বাবা-মা কেমন আছে, তুমি কেমন আছ? পাড়ায় সবাই? দাঁড়া দাঁড়া একবারে এত প্রশ্ন করিস না, সব গুলিয়ে যাবে। ফোনটা ছাড়িস না। আমার কথা, পাড়ার কথা ছাড়, তোর বাপ মায়ের খবরটা নিস। তারা কেমন আছে?

– কাকু, এখন আর আপশোশ করে কি হবে বলো? বাবা যে আমায় এই জায়গায় আসতে বাধ্য করেছে। এটা তো আমি চাইনি। প্রচুর টাকার বিনিময়ে কোম্পানি আমার চব্বিশ ঘণ্টাই কিনে নিয়েছে। আমার পার্সোনাল লাইফ বলে যে কিছুই অবশিষ্ট নেই। যাক মা-বাবা এখন কেমন আছে?

– ভালো নেই। তোর মায়ের শরীর খুব খারাপ। লিভার ক্যান্সার। চিকিৎসার সামর্থ্যও তোর বাবার নেই। বলিস তো চাঁদা তুলে তোর মায়ের চিকিৎসা করাই।

– সে কি? বাবা একটু আমাকে জানাতে পারত।

– তোর বাবা ফোন করে করে হতাশ হয়ে অভিমানে ফোন করা ছেড়ে দিয়েছে।

– কাকু বাবার অ্যাকাউন্ট নাম্বার আমার জানা আছে। আজকেই আমি দশ লাখ টাকা ট্রান্সফার করে দিচ্ছি। তুমি একটু দাঁড়িয়ে থেকে চিকিৎসা করাও। লাগলে আরও পাঠাব। আমি যত তাড়াতাড়ি পারি দেশে ফিরব।

টাকা এল। চিকিৎসাও হল। পেল না অন্তরাত্মার পদধ্বনি। সেই অন্তরাত্মার অভাবে শেষ জীবনীশক্তি ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হতে লাগল। এ রোগের শেষ পরিণতি বড়ো মর্মান্তিক। সেই মর্মান্তিকতার চরম মুহূর্তের আগে পর্যন্ত ঝাপসা স্থির দৃষ্টিতে শুধু একটাই প্রলাপ

– মিঠুর ফোন পেলে গো? আমার শরীর খারাপের কথা বলোনি তো। ও যে বড়ো কষ্ট পাবে। মিথ্যে আশ্বাস পাথেয় করে মৃন্ময়ী ভোরবেলা চলে গেল।

আজ সতেরোই শ্রাবণ। ঘন কালো মেঘে আকাশটা নীচে নেমে এসেছে। প্রকৃতির অশ্রুধারা দু’কূল প্লাবিত করছে। সে অশ্রু মোছাবার কেউ নেই। এই কালান্তক দিনটি তরুণের বড়ো একার। একা কাঁদবার দিন। মালা, ফুল, চন্দনে অপরূপ সাজে সেজেছে। আজ যে মা-মেয়ের জন্ম মৃত্যু দিন। ভরপেট্টা মাল টেনেছে এই উৎসবে। বেসামাল তরুণ মা-মেয়ের সামনে দাঁড়িয়ে অবুঝ বালকের মতো প্রশ্ন করে– আমাকে এভাবে ঠকালি কেন বল তো? এখানে ফেলে রেখে তোরা সুখে আছিস তো? এবার তরুণ আর সামলাতে পারে না। দু-চোখ বেয়ে অবিরত ধারা বেয়ে আসে। একটু থেমে বায়না করে– আমাকে তোরা নিবি? এ শরীরের বোঝা আর যে টানতে পারছি না। রূপাঞ্জনার প্রতিকৃতি জীবন্ত মূর্ত প্রতীক হয়ে আর্জি মঞ্জুর করে– চলে এস বাবা। ওখানে যে তুমি পাঁকে তলিয়ে যাচ্ছ। তিনদিন পর বাড়িটার ভেতর থেকে পচা দুর্গন্ধ এলাকা ভারী করে তুলল।

মালতিটা কাজ করে ভালো। বাসন মাজা, রান্না করা, কাপড় কাচা, দাদুর স্নানের জল তোলা। এসব কাজে খুঁত রাখে না। তবে একটু টকেটিভ। চান্স পেলেই ডিভিডি চালাবে। আদিত্যর অসুবিধা হয় না। বোবা ঘরে তবু একটা কথা বলার লোক তো আছে। যতক্ষণ থাকে ঘরটা কথাময় করে রাখে। আদিত্য খাটে শুয়ে খবরের কাগজটা সামনে নিয়ে পুরু লেন্সের চশমাটা নাকের ডগায় রেখে রাজনীতির দুবৃত্তায়ন হজম করছিল। মালতি বাইরে থেকে ছুটতে ছুটতে এসে আদিত্যকে সংবাদটা দেয়– দাদু বাইরে বিশুর চায়ের দোকানে চ্যাঁচামেচি হচ্ছে, শুনতে পাচ্ছ না?

আদিত্য ভাবলেশহীন কৌতুক প্রকাশ করে বলে– কই না তো।

– সে কি, কত লোক জড়ো হয়েছে, তুমি শুনতে পাচ্ছ না?

– তাহলে চ্যাঁচামেচিটা বোধহয় আস্তে আস্তে হচ্ছে। একরকম জোর করে মালতি আদিত্যকে বাইরে টেনে আনে।

দিশেহারা ভীত সন্ত্রস্ত চান্দ্রেয়ী কোলের ছেলেটাকে বিশুর চায়ের দোকানে বসায়। বাচ্চাটা ক্ষিদের ক্লান্তিতে কেমন নেতিয়ে পড়ে। চান্দ্রেয়ী এ ব্যাগ সে ব্যাগ থেকে এক প্যাকেট দলা পাকানো বিস্কুট বের করে। বিশুর দিকে তাকিয়ে করুণ ভাবে বলে– দাদা এক গেলাস দুধ দেবেন? বিশু না করে না। দুধ বিস্কুট খেয়ে শক্তি ফিরে পায়। স্বভাবসিদ্ধ চরিত্রে এদিক ওদিক ছুটোছুটি করতে থাকে। উদ্দেশ্যবিহীন চান্দ্রেয়ীকে বাঁশের খুটিতে হেলান দিয়ে বসে থাকতে দেখে বিশুর কৌতুহলী মন জিজ্ঞাসা করে– এই মেয়ে তোমার নাম কি? চান্দ্রেয়ী নির্বাক। তুমি কোথায় থাকো? মনের বিভ্রান্তি তাকে আড়ষ্ট করে রাখে।

– আরে এ মেয়ে তো কোনও কথার উত্তর দেয় না। তোমার স্বামীর নাম কি? কোনও উত্তর না পেয়ে বিশুর মেজাজ এবার সপ্তমে।

– দুধ চাইবার বেলা তো বেশ কথা ফুটছিল। দাও তো বাপু, পয়সাটা দাও। লেডিস ব্যাগটা খুলে এদিক ওদিক ঝাঁকিয়ে করুণভাবে চান্দ্রেয়ী বলে,

– দাদা পয়সা যে নেই।

– সেটা তো আগে বলতে হয়। আগে বললে বাচ্চাটার জন্য বিশু দুধ দিত কি আদৌ দিত না সে প্রসঙ্গ অপ্রাসঙ্গিক। কিন্তু পাড়ার চায়ের দোকানে তার বচনে লোক সমাগমের সূত্রপাত এখানেই। আদিত্য কাছে এসে সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলে– বাপু তোমরা একটু সরো তো। মেয়েটা আসলে ঘাবড়ে গেছে। আদিত্যকে এ পাড়ার লোকজন কতকটা বয়সের কারণে কতকটা সজ্জন ব্যক্তিত্বের কারণে মান্য করে। তারা একে একে সরে যায়। বেশি দূর যায় না। দাঁড়িয়ে থাকে।

– এ-ই মেয়ে তোমার নাম কী? স্নেহমাখা এই প্রশ্নে পিতৃমাতৃহীন মেয়েটা বাপের অজস্র স্নেহ ধারা বইতে থাকে। মেয়েটার মুখে কথা ফোটে– চান্দ্রেয়ী মিত্র।

– বাড়ি কোথায়?

– রায়গঞ্জ, বকুলপুর।

– থানা পোস্টঅফিস জানা আছে?

– না তা তো জানি না।

– তোমার স্বামীর নাম কি?

রজতশুভ্র মিত্র।

– মোবাইল নাম্বার আছে

– না, আমার মোবাইলটাও তো ফেলে এসেছি।

– তাহলে এভাবে তো কারও হোয়্যার এবাউটস জানা যাবে না। তুমি চাইলে আমার বাড়িতে গিয়ে থাকতে পারো। আমার ঘরে আমি ছাড়া আর কেউ নেই। মেয়েমানুষ এখন কোথায় যাবে? তারপর দেখছি কী করা যায়। স্বামীর সাথে মান-অভিমানের পালা চলছে? পাগলি মেয়ে, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে মান-অভিমান মনোমালিন্য এসব হয়ই। তাই বলে এভাবে নিরুদ্দেশের পথে কেউ পা বাড়ায়? আর দেরি কোরো না, চলে এস। পালহীন নৌকো তীর খুঁজে পেয়েছে। দেবদূতের মতো সন্তানস্নেহে যে মানুষটা তাকে আশ্রয় দিতে চাইছে, সে যে তার বাবারই সমগোত্রীয়।

আদিত্য বুড়োর একাকিত্ব ঘুচেছে। চান্দ্রেয়ী, মালতির সেবাযত্নে নিভে যাওয়া প্রদীপের সলতে আবার তিরতির করে জ্বলে উঠেছে। আর ছোট্ট শিশুটির আধো আধো বুলিতে গোটা বাড়িটা বর্ণময় করে তুলছে। তাকে জিজ্ঞাসা করে

– দাদুভাই তোমার নাম কি?

– ছিচন মিত্ত।

চান্দ্রেয়ী শুধরে দেয়– বলো দাদুভাইকে সিঞ্চন মিত্র। ছোট্ট কথাকলির দস্যিপনায় বুড়ার হাড়গোড়ের মরচেগুলো ছাড়তে শুরু করেছে। কখন যে সকাল গড়িয়ে রাতের আঁধার নেমে আসছে, সে হিসেবের খাতা খোলার বুড়োর সময় নেই। হঠাৎই কাগজে নিরুদ্দেশের প্রতি, এক বিজ্ঞাপনে আদিতের নজর পড়ে। আদিত্যের বুঝতে অসুবিধা হয় না। পোস্টআফিসে চিঠিখানা ড্রপ করে দিন গুনতে থাকে। প্রদীপের তেল একটু একটু করে নিঃশেষিত হচ্ছে। জেগে ওঠা দীপ্তিময় জীবনে রাতের আঁধার নেমে আসছে।

সিঞ্চন বাইরের বারান্দায় খেলা করছিল। বলে ওঠে– বাবা বাবা। বাসন মাজতে মাজতে মালতি ঘরে ঢুকে বলে– দাদু, বাইরে কে একজন তোমার কাছে এসেছে।

– ও এসে গেছে। ঘরে আসতে বল। রজত ঘরে ঢুকেই আদিত্যকে প্রণাম করে। আদিত্যর অনুমতিতে বসে। এদিক-ওদিক তাকায়।

– তাহলে তুমিই রজতশুভ্র মিত্র।

– আজ্ঞে হ্যাঁ

– বেশ। মালতিকে উদ্দেশ্য করে বলে। – মালতি, চান্দ্রেয়ীকে ডেকে দে তো মা। রজতকে দেখে তার দুচোখ বেয়ে ঝর ঝর করে জল পড়তে থাকে। এ অশ্রুবর্ষণের গভীরতা বহুদূর বিস্তৃত। স্বামী দর্শনের ভিতর থেকে নির্দিষ্ট হয়ে যায়, যে সংসারের প্রদীপ সে তুচ্ছ অভিমানে নিভিয়ে এসেছিল, সেই প্রদীপ আবার জ্বেলে সংসারকে সে আলোকিত করবে। এক চোখে বইছে অনাবিল আনন্দের অশ্রুধারা, আর ওই যে অসহায় বৃদ্ধ মানুষটা সন্তান বাৎসল্যে, সস্নেহে এই কটাদিন লালিত করেছে, নাতিকে পেয়ে জীবনের দীপশিখা প্রজ্জ্বলিত হচ্ছিল, রজতের হাত ধরে বেরিয়ে যেতেই তার প্রদীপের শিখা যে ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হবে। সে চোখের জল সম্বরণ করা যায় না। আবেগ মানুষের চিরন্তন ধর্ম। সেই আবেগ হাসায়। সেই আবেগ চোখের জলে বুক ভাসায়। আবেগে ছেদ পড়ে আদিত্যের ডাকে– মা রজতকে খেতে দেওয়ার বন্দোবস্ত করো। ছেলেটা কতদূর থেকে এসেছে। রজতের দিকে তাকিয়ে বলে– তা বাবা আজ রাতটা থেকে কালকে না হয় সকালেই যেও, অতদূরের পথ। সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। রজত বাধা দেয় না।

সেই রাতে আদিত্য বুড়োর প্রবল জ্বর আসে। প্রলাপ বকতে থাকে– দাদু ভাই, আমার ঘোড়াটা দিয়ে যা। আমি যে হেরে যাচ্ছি। খবরটা মালতিই রাধিকারঞ্জনকে দেয়। রাধিকারঞ্জন দেরি করে না। হাসপাতালে ভর্তি করে বাইরে বেরিয়েই মিঠুকে ফোন লাগায়। রিং বাজতেই মিঠু ফোনটা ধরে– হ্যাঁ জেঠু বলো, বাবা, তোমরা কেমন আছ?

– হ্যাঁ মা, এখনও তোর আসার সময় হল না– এবার যে তোর বাবাও চলেছে রে। এক ভয়ংকর অজানা জ্বরে সঙ্গাহীন। জেঠু ফোনটা রাখ, আমি আসছি।

এয়ারপোর্ট থেকে ট্যাক্সি নিয়ে হাসপাতালে পৌঁছোয়। উদভ্রান্ত উন্মাদের মতো ছুটতে ছুটতে বাবাকে জড়িয়ে ধরে– বাবা আমি এসেছি। এই দেখো তোমার মিঠু। আর তোমাকে ফেলে যাব না। আদিত্য আবছা প্রলেপে তখনও প্রলাপ বকেই চলেছে– দাদুভাই এলি? ঘোড়াটা দিয়ে যা। আমি যে মাত হয়ে যাচ্ছি। আমাকে যে জিততেই হবে।

দুরন্ত ঘোড়া একসময় শান্ত হয়। প্রাচুর্যের ঢক্বানিনাদে বসে দায়িত্ব, কর্তব্য, মূল্যবোধ, জীবনের সার্থকতার তাৎপর্য সে বুঝতে পারে না। সে তখন ফিরতে চায়। অবহেলায় ফেলে যাওয়া সেই রত্নভাণ্ডারকে সংসারের ধ্বংসস্তূপের ভিতর খুঁজতে থাকে। পায় না। কোনওদিন পাবে কিনা, কে জানে।

প্রস্তাব

অফিসের মহিলা কলিগদের থেকে সৌহার্দ্য একটু ডিসটেন্স রেখেই চলে। অফিসিয়াল কথাবার্তা ছাড়া তেমনভাবে কারওর সাথে মেশে না। এর পিছনে যে কোনও কারণ রয়েছে, তেমনটা নয় বা তাকে দেখতে-শুনতে খারাপ তেমনও নয় বরং প্রয়োজনের তুলনায় অতিরিক্ত সুন্দর, হ্যান্ডসাম, মিষ্টি স্বভাবের। হাইটও তেমনি, প্রায় ছ ফুট। গায়ের রং শ্যামলা– মেয়েরা ঠিক যেমনটা চায় আর কি। তাকে দেখলে যে-কোনও মহিলার হূদয়ে কম্পন অনুভূত হবে, এমনটা হলফ করে বলা যায়। কিন্তু হয় না– অনেকেই নিজের মতো করে ভেবে নেয়, সৌহার্দ্যও অফিসের সঙ্গে ব্যক্তিগত জীবনকে এক করতে চায় না। তাই ছুটির পর এক মুহূর্তও ওয়েস্ট না করে সোজা বাইক ছুটিয়ে বাড়ির দিকে রওনা দেয় সে। তবে মাঝেমধ্যে কাজের জন্য আটকেও পড়তে হয়। এরকমই একদিন একটা প্রেজেন্টেশন বানানোর জন্য শ্রেয়া আর তাকে ছুটির পরেও থেকে যেতে হল। প্রেজেন্টেশন জমা করতে করতে রাত প্রায় সোয়া দশটা হয়ে গেল। যাবার সময় বসের ফরমায়েশ, ‘সৌহার্দ্য, শ্রেয়ার ফেরার ব্যাপারটা একটু দেখে নিও।’

‘ওকে স্যার। আপনি না বললেও এত রাতে ওনাকে…।’

‘আরে না না। আমাকে নিয়ে এত ভাববেন না। আমার সঙ্গে স্কুটি রয়েছে। আমি চলে যেতে পারব,’ কথার মাঝেই বলে বসে শ্রেয়া।

পার্কিং জোনে শ্রেয়ার স্কুটি স্টার্ট করার বিফল চেষ্টা দেখে, সৌহার্দ্য বলে– ‘স্টার্ট যখন নিচ্ছেই না, ওটা এখানে ছেড়ে যান। কাল মেকানিক ডেকে দেখিয়ে নেবেন। চেষ্টা করলে স্টার্ট হয়তো নিয়ে নেবে, কিন্তু মাঝপথে যদি আবার বিগড়োয় প্রবলেমে পড়বেন।’

‘ঠিক বলেছেন। বরং সৌরভকে বলি পিক করে নিতে।’ ব্যাগ থেকে ফোন বার করতে করতে কথাটা শেষ করে শ্রেয়া, ‘আশা করি মিনিট পনেরোর মধ্যে ও চলে আসবে।’

‘কিন্তু ততক্ষণ এখানে দাঁড়ানোটাও তো নিরাপদ নয়। তার চেয়ে বরং আমি ড্রপ করে দিচ্ছি।’

‘কিন্তু আমার বাড়ি তো আপনার বাড়ির ঠিক উলটো পথে, শুধু শুধু আবার অতটা পথ…’ বলতে বলতে থেমে যায় শ্রেয়া।

‘আপনাকে বিপদের মধ্যে একা ছেড়ে যাওয়ার মতো পাত্র তো আমি নই, আশা করি এতক্ষণে সেটা বুঝে গেছেন। তাছাড়া বসের হুকুম বলে কথা। না মানলে কী আর চলে বলুন? তাই বলছি দেরি না করে গাড়িতে বসে পড়ুন।’ ঈষৎ মজা করেই বলে সৌহার্দ্য।

শ্রেয়া আর কথা না বাড়িয়ে গাড়িতে চড়ে বসে। মিনিট দশেকের মধ্যে পৌঁছে যায় তারা।

‘চলুন, ভিতরে চলুন।’ বলতে বলতে কলিংবেলটা বাজায় শ্রেয়া।

‘অন্য আর এক দিন, শ্রেয়া।’ বলে গাড়িটা ঘোরাতে যাবে এমন সময় শ্রেয়ার মা উমাদেবী আর যমজ ভাই সৌরভ বেরিয়ে আসে। ভদ্রতার খাতিরে দাঁড়াতে হয় সৌহার্দ্যকে।

মা-ভাইয়ের সাথে আলাপ করিয়ে দেয় শ্রেয়া।

‘তা বাবা কষ্ট করে এতদূর যখন মেয়েটাকে ছাড়তে এলেই… অন্তত একটু চা যদি…’

‘শুধু চা কেন আন্টি অন্য একদিন পাত পেড়ে খেয়ে যাব’খন। আজ অনেক দেরি হয়ে গেছে। বাবা-মা না খেয়ে বসে থাকবেন।’

এমন সময় ভিতর থেকে কাঁপা গলায় শ্রেয়ার বাবা নীরেন্দ্রবাবুর আওয়াজ ভেসে আসে, ‘শ্রেয়া বাড়ি ফিরেছিস? সঙ্গে কে? ভিতরে আসতে বল।’

‘আসলে বাবার কাল থেকে আর্থ্রাইটিসের ব্যথাটা ভীষণ বেড়েছে। ঠিকমতো হাঁটতে-চলতেও পারছেন না। ভীষণ কষ্ট পাচ্ছেন। বাবা লোকজন খুব ভালোবাসেন। যদি একবার দেখা করে যেতেন।’

‘হ্যাঁ হ্যাঁ নিশ্চয়ই, চলুন ওনার সাথে আলাপ করে আসি।’ বলে গাড়ি থেকে নেমে পড়ে সকলের সঙ্গে সৌহার্দ্য ঘরে ঢুকে যায়।

ঘরে ঢুকেই নীরেন্দ্রবাবুর পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে সৌহার্দ্য। ‘আরে বোসো বোসো। এখন আর এসব কেউ মানে নাকি। তা বুঝেছ বাবা কাল থেকে বাতের ব্যথাটা খুব কষ্ট দিচ্ছে। পা বাড়াতে গেলেই একেবারে বাবা-মা সকলকে টেনে আনতে হচ্ছে।’ বলে খানিক থেমে যান, তারপর আবার বলতে শুরু করেন, ‘দেখেছ কাণ্ড, নিজের কথাই বলে যাচ্ছি। তোমার নামটাও তো জিজ্ঞেস করা হয়নি! তোমার নাম যেন কী?’

‘সৌহার্দ্য।’

‘মানে অন্তরঙ্গ। বাহ্ বেশ মিষ্টি নাম তো।’ বলেই উমাদেবীকে ডাকতে শুরু করেন। ‘উমা, উমা। বলি ছেলেটাকে কিছু খেতে তো দেবে নাকি। সারাদিন খেটে মুখটা একেবারে আমসি হয়ে গেছে।’ ভাবটা এমন যেন কতদিনের পরিচিত। অবশ্য মানুষটাই এইরকম। নীরেন্দ্রবাবুর ডাকাডাকিতে উমাদেবী ইতস্ততবোধ করতে থাকেন।

‘না না আঙ্কল, আন্টি বলেছিলেন। আমিই না বলেছি। রাত হয়েছে তো।’

‘বলি বিয়ে করেছ?’

‘আজ্ঞে!’

‘বিয়ে করেছ কি?’

‘না-না।’

‘ব্যাচেলার। তাহলে আবার দেরি কিসের হে। না খেয়ে তোমার যাওয়া হবে না।’

‘আসলে বাবা চিন্তা করবেন তো তাই।’

‘বাবা খুব ভালোবাসেন বুঝি?’

মুচকি হেসে সম্মতি জানায় সৌহার্দ্য।

‘জানিয়ে দাও। আজ তুমি খেয়েদেয়ে ফিরবে।’ বেগতিক দেখে বাড়িতে জানাতেই হয় সৌহার্দ্যকে।

খেতে বসে এদিক-ওদিকের নানারকম কথা চলতে থাকে। আড্ডা বেশ জমে ওঠে।

‘কাল ম্যাচটা দেখলেন?’ প্রশ্ন করে সৌরভ।

কোনও উত্তর দেওয়ার আগেই নীরেন্দ্রবাবু একেবারে ঝাঁপিয়ে পড়লেন, ‘ওই তোর এক দোষ বাবু, শুধু খেলা আর খেলা। তার চেয়ে বরং খবরটা শোন কাজে দেবে।’

‘সত্যি বাবা পারো বটে। খেলার নাম শুনলেই তোমার যে কী হয়!’ শুরু হয়ে যায় বাপ-ছেলের কথা কাটাকাটি।

‘তোমাদেরও বলিহারি যাই, ছেলেটা একদিন এসেছে কোথায় ওর সাথে চারটে কথা বলবে তা নয়, বাপ-ছেলে মিলে শুরু করে দিলে। ছাড়ো ওদের কথা। তুমি তোমার কথা বলো, বাবা।’ উমাদেবী পরিবেশ হালকা করার চেষ্টা করেন।

‘আমার কথা। আলাদা করে কী বলব! পরিবার বলতে বাবা-মা আর আমি। বাবা-মা দুজনেই ইউনিভার্সিটিতে অধ্যাপক ছিলেন। বেশ কয়েকদিন হল রিটায়ার করেছেন। এখন প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার কোচিং চালাচ্ছেন।’

‘তোমার সঙ্গে আলাপ হয়ে ভীষণ ভালো লাগল বাবা। সময় পেলেই চলে এসো।’

‘আরে আসবেই তো। কী হে, এই সেকেলে বুড়োটার সাথে মাঝেমধ্যে গল্প করতে আসবে তো?’

‘অবশ্যই আঙ্কল। তবে আজ উঠতে হবে। অনেক রাত হল। ওহ্… আঙ্কল আপনার বাতের ব্যথার জন্য একটা ওষুধ পাঠিয়ে দেব, ব্যবহার করে দেখবেন।’

দিন পাঁচেক পরেই শ্রেয়ার হাত দিয়ে একটা আয়ুর্বেদিক ওষুধের ফাইল পাঠিয়ে দিয়েছিল সৌহার্দ্য। সঙ্গে একটা কাগজে বড়ো বড়ো অক্ষরে ব্যবহারবিধি লিখে পাঠিয়েছিল সে।

তারপর আরও দিন দশেক কেটে গেছে। শ্রেয়ার সঙ্গে সম্পর্ক তেমন না এগোলেও নীরেন্দ্রবাবু আর উমাদেবীর প্রিয়পাত্র হয়ে উঠেছে সৌহার্দ্য। সময় পেলেই প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে একে-অপরকে ফোন করে খবর নেওয়া। কিছু স্পেশাল রান্না করলেই উমাদেবী নয় তো নীরেন্দ্রবাবুর ফোন। শ্রেয়ার হাত দিয়ে খাবারও পাঠিয়েছে বার দুয়েক। ওনাদের এই আন্তরিকতা সৌহার্দ্য-র মনকেও ছুঁয়ে গেছে। ব্যাপারটা সে বেশ এনজয়ই করে।

একদিন সৌহার্দ্য সবেমাত্র লাঞ্চবক্স নিয়ে বসেছে, ঠিক সেই সময়েই নীরেন্দ্রবাবুর ফোন, ‘বলি ব্যাপার কী হে! বুড়োটার খবর কী শুধু ফোন মার়ফত-ই নেবে নাকি দর্শনও দেবে?’

‘না না আঙ্কল, কী বলছেন, সময় পেলেই চলে যাব।’

‘না না ওসব সময়-টময় বুঝি না বাপু। তুমি বরং রবিবার দিনই চলে এসো। জমিয়ে আড্ডাও দেওয়া যাবে আর একসাথে খাওয়াদাওয়া করা যাবে। তোমার মাসিমা কী সব হায়দরাবাদি বিরিয়ানি বানাবে। তোমার খুব ভালো লাগবে।’

‘বিরিয়ানি, ওয়াও। বাবা – আমি দুজনেই ভীষণ ভালোবাসি। কিন্তু রবিবার তো হবে না আঙ্কল। ওই একটা দিনই তো বাড়ির সকলে একসঙ্গে লাঞ্চ করার সুযোগ হয়।’

‘তাহলে, বাবা-মাকেও সঙ্গে নিয়ে চলে এসো। ওনার ফোন নম্বর দাও। আমি নিজে ওনাদের আসার জন্য আমন্ত্রণ জানাব। ওই দ্যাখো তোমার মাসিমাও বলছে আসার জন্য।’

‘আরে না-না আঙ্কল, অত ফর্মালিটির প্রয়োজন নেই, বাবাকে আমি বললেই হবে। মা হয়তো আসতে পারবে না। ওই দিন মায়ের, মাসির বাড়ি যাবার কথা।’

‘ঠিক আছে তাহলে ওই কথাই রইল।’

কথামতো রবিবার সন্ধেবেলা সৌহার্দ্য তার বাবা অসীমবাবুকে নিয়ে শ্রেয়াদের বাড়িতে উপস্থিত হল। বাবা-ছেলের হূদ্যতা সত্যিই প্রভাবিত করার মতো। হাসিঠাট্টা, আলাপচারিতার পর, খাওয়ার টেবিলে উমাদেবীর রান্নার তারিফ না করে পারলেন না অসীমবাবুও।

‘বাহ্ দিদিভাই। লাজবাব। বিশ্বাস করুন বহু বড়ো বড়ো রেস্তোরাঁতে খেয়েছি। কিন্তু এই স্বাদ…জাস্ট অতুলনীয়! তবে হ্যাঁ আপনি যেমন বিরিয়ানিতে এক্সপার্ট, আমার গিন্নি তেমনি হিংয়ের কচুরি। না খেলে বুঝবেন না।’ তারিফের বহরে খানিক কুন্ঠাবোধ করেন উমাদেবী।

‘সামনের রবিবার আমাদের ওখানে চলে আসুন। গীতার সঙ্গে আলাপও হয়ে যাবে আর ছুটিটা উপভোগও করা যাবে। কী বলিস বাবা?’

‘আরে হ্যাঁ সে আর বলতে। চলে আসুন সামনের রবিবার। সৌরভ ওইদিন কোনও কাজ রাখিস না কিন্তু। শ্রেয়া, আঙ্কল-আন্টির সঙ্গে তুমিও আসছ কিন্তু।’ শ্রেয়ার দিকে তাকিয়ে বলে সৌহার্দ্য।

ঠোটের কোণায় ঈষৎ হাসি খেলে যায় শ্রেয়ার। মুখের দু-পাশ রাঙা হয়ে ওঠে। মাথা নীচু করে সম্মতি প্রকাশ করে সে।

পরের রবিবার শ্রেয়া, সৌরভ বাবা-মায়ের সঙ্গে টাইম মতোই পৌঁছে যায় সৌহার্দ্য-দের বাড়িতে। গীতাদেবীও বাপ-ছেলের মতোই মিশুকে। সহজ সরল। কাজেই দুই পরিবারের মধ্যে বন্ধুত্ব গড়ে উঠতে বেশি সময় লাগল না। গীতাদেবীর সঙ্গে উমাদেবীও কিচেনে ওনার হাতে হাতে খানিক সামলে নিলেন। খাওয়ার সময়তেও খাবার পরিবেশন করার ব্যাপারেও হেল্প করলেন। অসীমবাবুও খাতিরে কোনও ত্রুটি রাখেননি। যাবার সময় বরং সকলে মিলে বারবার অনুরোধ করেছে আবার আসার জন্য। ‘নিশ্চয়ই আসব। কিন্তু তার আগে গীতাদিকে আমাদের বাড়িতে আসতে হবে।’ প্রত্যুত্তরে উমাদেবী বললেন।

‘আপনি না বললেও আমি আমার মিসেসকে নিয়ে আসতাম আপনাদের বাড়িতে। কি বলো গিন্নি?’ গীতাদেবীর দিকে তাকিয়ে হেসে বলেন অসীমবাবু।

পরের দিন অফিসে শ্রেয়ার মোবাইলে একটা এসএমএস। প্রেরক সৌহার্দ্য। দু-চার কথায় লেখা রয়েছে– অফিসের পরে ওয়েট কোরো। কথা আছে।

শ্রেয়া বেশ অবাকই হয়েছিল। চোখের সামনেই তো রয়েছে মানুষটা, তাহলে কী এমন কথা যে এখানে বলা যাচ্ছে না। ব্যাপারটা বেশ ভাবিয়ে তুলেছিল শ্রেয়াকে। তারপর থেকে কাজে মন বসাতে পারেনি একটুও।

অফিসের পরে গেটের সামনে এগোতেই সৌহার্দ্য গাড়ি নিয়ে হাজির।

‘বোসো।’ সৌহার্দ্যের হঠাৎ করে আপনি থেকে তুমি বলাতে বোকার মতো তাকিয়ে থাকে শ্রেয়া। ভাবার শক্তি যেন কে ছিনিয়ে নিয়েছে। সম্বিত ফেরে সৌহার্দ্যের কন্ঠস্বরে, ‘কী হল বোসো।’

‘ও, হ্যাঁ হ্যাঁ বসছি। কোথায় যাব? আ…আপনি যে বললেন কথা…’ মাঝখানেই থামিয়ে দেয় সৌহার্দ্য, ‘কেন বিশ্বাস নেই আমার উপর?’

‘এবাবা আমি এভাবে বলতে চাইনি’, হঠাৎ এই পরিবর্তনে হকচকিয়ে যায় শ্রেয়া।

‘তাহলে?’ আর একটাও কথা বলে না শ্রেয়া। গাড়ি ছুটতে থাকে। মিনিট পনেরো পরে একটা রেস্তোরাঁর সামনে গাড়ি দাঁড় করায় সৌহার্দ্য। ভিতরে টেবিল আগে থেকেই বুক করা ছিল। সেখানে গিয়ে খাবারের অর্ডার দেয় সে।

‘দ্যাখো আমি ভীষণ স্ট্রেট ফরওয়ার্ড। ইনিয়েবিনিয়ে কথা বলতে পারি না। স্পষ্টই বলছি, বাবা-মা কাল তোমাদের বাড়িতে যাবেন আমাদের বিয়ের কথা বলতে।’ কথা সরে না শ্রেয়ার। কেবল শুনতে থাকে। এতটাও আশা করেনি শ্রেয়া। বলে যায় সৌহার্দ্য। ‘তুমিও খুব ভালো করে জানো যে তোমার বাবা-মা এই বিয়েতে অমত করবেন না। তবে তোমার হ্যাঁ বলার আগে, আমার মনে হয় তোমাকে কিছু কথা জানানো উচিত। অবশ্যই আমার পরিবারের কথা। আমার জীবনে আমার বাবার স্থান সবার উপরে। আমার জন্য ওনার অবদান ভোলার নয়। সত্যিই আমি ওনার প্রতি কৃতজ্ঞ। উনি আমার জন্মদাতা নন। আমার জন্মের কয়েকমাস পরেই আমার বাবা মারা যান।

মা যে-কলেজে পড়াতেন বাবাও সেই কলেজের অধ্যাপক ছিলেন, সঙ্গে মামার বন্ধুও। মামার সূত্রে মাঝেমধ্যেই বাড়িতে আসতেন আর আমার সঙ্গে আমার মতো করেই মিশতেন, খেলা করতেন। সেই সময় বাড়িতে মায়ের আবার বিয়ে দেওয়ার কথা চলছে। উনি আমাকে এতটাই ভালোবেসে ফেলেছিলেন যে শুনেই মামাকে প্রশ্ন করে বসেছিলেন, ‘তাহলে সৌহার্দ্যর কী হবে? নতুন মানুষটি সৌহার্দ্যকে মেনে নেবে এমন গ্যারান্টি কে দিতে পারে? এই সব সম্পর্কে সবসময়ই একটা রিস্ক থেকে যায়। সৌহার্দ্যর ব্যাপারে আমি কোনও রিস্ক নিতে চাই না। তোদের যদি অমত না থাকে আমি কথা দিচ্ছি সারাজীবন ওকে বুঝতেই দেব না যে, আমার সঙ্গে ওর রক্তের কোনও সম্পর্ক নেই।’ বলতে বলতে চোখে জল ভরে আসে সৌহার্দ্যর। বাবার প্রতি তার আবেগ একটু বেশিই।

সামলাতে সৌহার্দ্যের হাতটা চেপে ধরে শ্রেয়া। নিজেকে সামলে নেয় সৌহার্দ্য। অপলক দৃষ্টিতে শ্রেয়ার মুখের দিকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর আবার বলতে শুরু করে সে।

‘মামার বাড়ি থেকে মেনে নিলেও বাবার বাড়িতে মানে ঠাকুরদা ব্যাপারটা একেবারেই ভালো চোখে নেননি। শুধুমাত্র আমার জন্য সেদিন বাবা নিজের বাবা-মা, বিশাল সম্পত্তি সবকিছু ছেড়ে চলে এসেছিল। এখানেই শেষ নয়, সেইসময় বাবা আইএএস পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল। পরীক্ষার সময়তেই এমারজেন্সি পিরিয়ডে মায়ের ইউটেরাসের অপারেশন করাতে হল। মায়ের বেড রেস্ট। বাবা পরীক্ষা পর্যন্ত দেয়নি, কেরিয়ার ভুলে আমার আর মায়ের দেখাশোনা করে গেছে।’

সৌহার্দ্য আবেগতাড়িত হয়ে বলে যাচ্ছিল। বাবার প্রতি তার অসীম ভালোবাসা প্রতিটা কথায় ঝরে পড়ছিল।

‘এটা বললেও বোধহয় ভুল হবে না যে বাবা নিজের সর্বস্ব আমার উপর সমর্পিত করে দিয়েছিল। এখন বাবাকে বাকি জীবনটা সুখে রাখাই হল আমার একমাত্র কর্তব্য। আমার বউকেও এটা মেনে চলতে হবে। দায়িত্বটা আমার বউয়ের উপরও বর্তাবে। জানি শ্রেয়া, শুধুই পরিবারের লোকজনই নয়, আমরাও একে-অপরকে পছন্দ করতে শুরু করেছি। হয়তো বা ভালোও বেসে ফেলেছি। তবুও হ্যাঁ বলার আগে ভালো করে ভেবে নাও। সারাজীবন তোমাকে জয়েন্ট ফ্যামিলিতে মানে বাবা-মাকে নিয়েই থাকতে হবে।’ উত্তরের আশায় বসে থাকে সৌহার্দ্য।

সৌহার্দ্যর হাতটা আর একটু জোরে চেপে ধরে শ্রেয়া। বলে, ‘মেসোমশাই আর মাসিমার মতো সহূদয় মানুষের সঙ্গে থাকতে আমার কেন কারওরই কোনও প্রবলেম হওয়ার কথা নয়। ভবিষ্যতে কোনও সমস্যা হলেও কথা দিচ্ছি কোনওদিন কোনওরকম অভিযোগ করব না তোমাকে।’

শুনে খানিক আশ্বস্ত বোধ করে সৌহার্দ্য। একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। তারপর শ্রেয়ার হাতটা মুঠোর মধ্যে ভরে নেয়।

‘বিশ্বাস করো আমি জানতাম তুমি পারবে।’

মাস দেড়েক পরে চার-হাত এক হয়ে গেল। অফিসের নিয়ম অনুযায়ী এক অফিসে স্বামী-স্ত্রী চাকরি করতে পারে না। সেই কারণে চাকরি ছাড়তে দ্বিধাবোধ করেনি শ্রেয়া। মধুচন্দ্রিমা থেকে ফেরার পর শ্বশুর-শাশুড়ির কোচিং সেন্টারে যোগ দিয়েছিল সে। ধীরে ধীরে অসীমবাবুর বেশ কিছু গুরুদায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিল শ্রেয়া। কাজের সূত্রে দিনের বেশিরভাগ সময়টা একসঙ্গে কাটানোর জন্য শ্বশুর-বউমার সম্পর্কটা আরও দৃঢ় হয়ে উঠেছিল। অসীমবাবু স্নেহও করতেন তেমনভাবেই।

‘ভাগ্যিস অফিসের দায়িত্বটা নিয়েছিলে শ্রেয়া। সারাদিন কোচিং ক্লাস করানোর পর আর পেরে উঠছিলাম না।’ শ্রেয়া মমতা অনুভব করে শ্বশুরের প্রতি।

‘ঠিক আছে বাবা, নতুন অফিসে জয়েন করলেও তোমার এই অফিসের কাজগুলো ছুটির দিনে বসে আমিই করে দেব।’

‘খানিক স্বস্তি পেলাম। সত্যিই আর পারছি না, হাঁফিয়ে উঠছি। আর কতদিন পারব তাও জানি না। মনের সাথে যুদ্ধ করতে করতে ক্রমশ নিজের কাছেই নিজে হেরে যাচ্ছি।’ শ্বশুরের কথাগুলো কেমন আর্তনাদের মতো মনে হল শ্রেয়ার।

অবাক হয়ে শ্রেয়া বলে, ‘কী বলছ বাবা! মনের সাথে যুদ্ধ মানে!’

‘সৌহার্দ্য বা গীতাকে একথা বলা যায় না। তাছাড়া এই পরিস্থিতি থেকে ওরা আমাকে বার করতে পারবে না।’

‘তাহলে কে পারবে?’

‘তুমি, কেবলমাত্র তুমি।’ অসীমবাবুর চোখেমুখে তখন বিমর্ষতার স্পষ্ট ছাপ।

‘আমি! আমি কীভাবে?’ প্রহেলিকার থেকে কিছুতেই বেরোতে পারছিল না শ্রেয়া।

‘আমার করুণ কাহিনি শুনবে?’

‘অবশ্যই। আমায় বলে যদি একটু হালকা হতে পারো, তা বলো না বাবা।’

‘এখানে নয়, চলো একটু খোলা হাওয়ায় বেরোই।’

দারোয়ানকে সমস্ত কিছু বুঝিয়ে দুজনে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। প্রায় ঘন্টা দেড়েক পরে একটা বিশাল জমিদারবাড়ির সামনে থামল গাড়িটা।

‘এই বাড়িটা দেখছ। এটা আমাদের পূর্বপুরুষের ভিটে। গীতা আর আমার বিয়েটা বাবা কিছুতেই মেনে নিতে পারেননি। আমাদের বিয়ের পর বাবা একটাই শর্ত রেখেছিলেন, এই বিশাল সম্পত্তির মালিক শুধুমাত্র তার রক্তের সম্পর্কের নাতি বা নাতনি অর্থাৎ আমার নিজের সন্তানই পাবে। সৌহার্দ্য নয়। সৌহার্দ্যের জন্যই তো গীতাকে বিয়ে করা, আর বাবা বলে কিনা সে-ই…। রক্ত চড়ে গেল মাথায়, ডিসিশন নিয়ে ফেললাম। এমনিতেই গীতার গর্ভাশয়ে ফ্রাইব্রয়েডের সমস্যা ছিলই, হাতিয়ার করলাম সেটাকেই। ডাক্তারের সঙ্গে পরামর্শ করে গীতার জরায়ুটাই শরীর থেকে বাদ দিয়ে দেওয়া হল। তারপর আর কখনও এ-বাড়ির পথ মাড়াইনি।’ মিনিট খানেক স্থির হয়ে বসে রইলেন অসীমবাবু।

‘তারপর? তারপর কী হল?’

‘মাস আষ্টেক হল বাবা মারা গেছেন। মারা যাওয়ার আগে উনি ইচ্ছাপ্রকাশ করেছিলেন, ওনার দাহ-সংস্কার যেন আমার হাতেই হয়। সেইমতো ডেকে পাঠানো হয়েছিল আমাকে। অনিচ্ছা সত্ত্বেও সমস্ত সম্পত্তি আমার নামেই করে গেছেন, কারণ তিনি কখনও চাননি জায়গা-জমি-টাকাপয়সা বংশের বাইরে অন্য কারওর কাছে যাক। সঙ্গে রেখে গেছেন একটা চিঠিও। চিঠিটা পাওয়ার পর থেকেই আত্মগ্লানিতে তিল তিল করে মরছি।’

‘কেন, কী এমন লেখা ছিল সেই চিঠিতে?’

একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলেন অসীমবাবু। তারপর বলতে শুরু করেন ‘ওনার বংশ নিঃশেষ করার জন্য কেবলমাত্র আমিই দায়ী, এমন অভিযোগের পাশাপাশি একটা তীব্র আর্তি… ‘পারলে নিজের বংশজকে পৃথিবীতে নিয়ে এস। বংশরক্ষা কোরো নইলে আমার আত্মা শান্তি পাবে না। বেঁচে থাকতে তো বাবার ইচ্ছের দাম দিলে না, অন্তত মারা যাওয়ার পর যদি বাবাকে একটু সম্মান দাও।’

অসীমবাবুর সারা মুখে একটা ভেঙে পড়া বিষণ্ণতার ছাপ।

‘তারপর থেকেই অনুশোচনায় ভুগছি। কোথাও একটা মনে হচ্ছে, বাবার কথাটা বোধহয় কিছুটা হলেও সত্যি। যদি আমার আর একটা সন্তান এই পৃথিবীতে আসত তাতে তো সৌহার্দ্য-র প্রতি ভালোবাসা কমে যেত না। ছেলে বা মেয়ে যাই হতো দুজনে একসাথে বড়ো হতো। এতে আমার বাবাও শান্তি পেতেন আর বংশরক্ষাও হতো। এখন ভাবি সেদিন অতটা কঠিন সিদ্ধান্ত না নিলেই পারতাম। অন্তত একটা বাচ্চার পরেও তো গীতার অপারেশনটা করাতে পারতাম।’ বলতে বলতে কেঁদে ফেলেন অসীমবাবু।

‘আমি তোমার ফিলিংসটা বুঝতে পারছি বাবা। কিন্তু এখন সবই তো হাতের বাইরে।’

‘না, একটা রাস্তা এখনও আছে, তুমি, একমাত্র তুমি আমায় সাহায্য করলে এখনও সম্ভব শ্রেয়া। অবশ্যই যদি তুমি চাও।’

‘এক্ষেত্রে আমি তোমাকে কীভাবে সাহায্য করতে পারি?’ ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায় শ্রেয়া।

শ্রেয়ার হাতটা চেপে ধরে অসীমবাবু। ‘কেউ জানতে পারবে না শ্রেয়া। সবাই জানবে সৌহার্দ্য-র সন্তান। শুধু তুমি আর আমি…’ তড়িতাহত হয়ে এক ঝটকায় হাতটা ছাড়িয়ে নেয় শ্রেয়া। শ্বশুরের কথা শুনে আঁতকে ওঠে সে।

বউমার প্রতিক্রিয়া দেখে অসীমবাবু বোঝানোর চেষ্টা করে, ‘না-না শ্রেয়া তুমি ভুল বুঝছ। আমি কোনওরকম অশ্লীল বা অনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করতে বলছি না তোমাকে! স্পার্ম ট্রান্সপ্ল্যান্ট মানে আইভিএফ-এর কথা তো নিশ্চয়ই তুমি শুনে থাকবে। প্লিজ শ্রেয়া যদি একটু সাহায্যের হাত বাড়াও, তাহলে আমিও শান্তি পাই, আর বাবার আত্মাও খানিক স্বস্তি পায়।’

পরমপূজ্য শ্বশুরের আত্মতুষ্টির কথা শুনে বাক্যহারা হয়ে পড়ে শ্রেয়া। মনে মনে ভাবতে থাকে, এমন জঘন্য কথাটা বলল কীভাবে বাবা? একবারও বাধল না! ছিঃ ছিঃ ছেলের বউয়ের সম্পর্কে এমনটা ভাবতে পারে কোনও শ্বশুর? সৌহার্দ্য-র বিশ্বাস, ভালোবাসার এই দাম দিল মানুষটা! গলা ফাটিয়ে চিৎকার করলেও সৌহার্দ্যর কাছে কখনও এটা বিশ্বাসযোগ্য হবে না আর বিশ্বাস করলেও এই আঘাত সহ্য করতে পারবে না। পায়ের নীচ থেকে যেন অযাচিত ভাবে খানিকটা মাটি সরে গেছে। নিজেকে খানিক সামলে নিয়ে অভিশপ্ত সেই বাড়ি থেকে উদভ্রান্তের মতো বেরিয়ে আসে শ্রেয়া। কোথায় যাবে সে, কাকে বলবে, তার এই লজ্জাকর পরিস্থিতির কথা। সৌহার্দ্যও কী করে করতে পারবে তার এই দুঃস্বপ্নের অবসান?

 

আশ্বাস

বড়োজামাই বিজয়ের আচার-ব্যবহার সম্পর্কে আত্মীয়-পরিজন মোটামুটি সবাই ওয়াকিবহাল। প্রতিপত্তির পাশাপাশি বদমেজাজের কারণে সমাজে তার একটা নামডাক ছিলই। মানুষকে হেয় করা, ছোটো নজরে দেখা, সবসময় কেমন যেন একটা দাম্ভিক আচরণ। বিশেষত শ্বশুরবাড়ির লোকজনকে ছোটো করতে পারলে সে যেন একটু বেশিই মজা পায়। শ্বশুরবাড়ির যে-কোনও উৎসব অনুষ্ঠানে তার একটা গোল বাধানো চাই-ই-চাই।

সেসব এড়াতেই পিসিশাশুড়ি মুগ্ধা, ছেলের বিয়ের একমাস আগেই বিয়ের কার্ডের সঙ্গে একটি চিঠিও পাঠিয়েছিলেন। শুধুমাত্র তাই নয় বহুবার ফোনও করেছিলেন, কিন্তু সংযোগবশত জামাই বাড়িতে না থাকায় ভাইঝি স্নেহা আর নাতি-নাতনির সঙ্গেই কথা হয়েছে প্রত্যেকবার। ব্যক্তিগত ভাবে জামাই বিজয়ের সঙ্গে কথা বলা হয়ে ওঠেনি মুগ্ধার।

বিয়ের এক সপ্তাহ আগে আবারও ফোন করেন মুগ্ধা। এইবার ফোনটা বিজয় নিজেই ধরেছিল। কোনও কিছু শোনার আগেই পিসিশাশুড়ির গলা পেয়েই খোঁচা মারল, ‘এখন আপনি বিয়েতে যাওয়ার জন্য নিমন্ত্রণ করছেন, যখন বিয়ের আর মাত্র চার-পাঁচ দিন বাকি। কী ভেবেছেন, আমরা কি অনাহুত? ভাইঝিকে বললেই দায়িত্ব শেষ। ভাবলেন কী করে আপনাদের বাড়ির মেয়েকে বললেই আমরা হ্যাংলার মতো চলে যাব। জামাইয়ের কদর যারা করতে পারে না, তাদের সাথে আমরা সম্পর্কও রাখতে চাই না।’ বলেই ফোনটা রেখে দেয় বিজয়।

জামাইকে তোষামোদ করার নানানরকম চেষ্টা করেন মুগ্ধা। কিন্তু কেউ যদি বুঝতে না চায় তাকে বোঝানো খুব কঠিন। শেষ পর্যন্ত বিজয় তার স্বভাবসিদ্ধ আচরণের কারণে শালার বিয়েতে নিজেও অনুপস্থিত থেকেছে, স্নেহাকেও পাঠায়নি।

একমাত্র ভাইঝি, ভাইঝি-জামাই না আসায় বিয়েবাড়িতে বেশ চর্চা হয়েছে। সবকিছু শুনেও না শোনার ভান করতে হয়েছে মুগ্ধাকে। কখনও বা স্নেহার অসুস্থতার দোহাই দিয়ে কাটাতে হয়েছে। শুধু বা তাকেই বলা কেন, মুগ্ধার দাদা প্রতাপবাবুকেও জামাইয়ের এই ব্যবহারের জন্য কম লজ্জিত হতে হয়নি।

বাবার মৃত্যুর পর দু’হাজার টাকা নিয়ে ফল্স পাড়ের বিজনেসে নেমেছিল বিজয়। আর আজ সে-ই শহরের সব থেকে বড়ো কাপড়ের ব্যবসায়ী। দিনের পর দিন যত উপার্জন বেড়েছে, তেমনই বেড়েছে অভিমান আর টাকা কামানোর দম্ভ। আর সেই দম্ভে চাপা পড়েছে সম্পর্কের রসায়ন।

উপহার পেতে কে-না ভালোবাসে। তাই বলে সেই পাওনাটা তার অধিকার ধরে নেওয়াটাও একেবারে যুক্তি সঙ্গত নয়। ঐশ্বর্যশালী, প্রভাব-প্রতিপত্তি থাকার পরেও শ্বশুরবাড়ির থেকে পাওয়ার আশা বরাবরই বিজয়ের ছিলই। নিয়মমতো পূজাপার্বণ, উৎসব, ষষ্ঠীতে তত্ত্ব না পেলেই মুখ ব্যাজার। জামাইকে আমন্ত্রণ করে থালার চারপাশে বারো-চোদ্দো বাটি না সাজিয়ে দিলে কি জামাই আপ্যায়ন সম্ভব? অথচ কথাতেই আছে, কিছু পেতে গেলে কিছু দিতে হয়। ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্য পাত্র হয়ে উঠতে হয়। কিন্তু দম্ভের কারণে বিজয় বোধহয় সে-সব ভুলতে বসেছিল।

তার এই দুর্ব্যবহারের জন্য স্নেহার বাবা প্রতাপবাবুও একপ্রকার মেয়ের বাড়ি যাওয়াই ছেড়ে দিয়েছিলেন। প্রতাপবাবুর স্ত্রী রমাই নিয়ম মেনে, ফলটি, মুলোটি, মিষ্টিটি নিয়ে হাজির হতেন মেয়ের বাড়িতে। তাতেও কম গঞ্জনার মুখোমুখি হতে হতো না তাঁকে। তাঁর সামনেই প্যাকেট থেকে এক-একটা জিনিস বার করে প্রত্যেকটিতে কিছু না কিছু খুঁত বার করে অপমান করা। যার জন্য বিজয়ের মায়ের পেটের ভাইরাও আজ তার থেকে বিচ্ছিন্ন। তার উপর গোদের উপর বিষফোড়ার মতো নিত্যদিনের তার সুরাপান।

ছোটো থেকেই স্নেহা ভীষণ সহজ-সরল এবং শান্ত প্রকৃতির। কোনওদিন সাত চড়ে রা নেই তার। কাজেই স্বামীর বিরুদ্ধে মুখ খোলার সৎসাহসও তার ছিল না। অনিচ্ছা সত্ত্বেও মুখ বুজে কেবলই স্বামীর কঠোর অনুশাসন মেনে চলা। সেই কারণেই বিজয় আরও পেয়ে বসেছে। নিত্যদিন নেশা করে বাড়ি ফেরা। চ্যাঁচামেচি করা। কিছু বোঝাতে গেলে চিরাচরিত সেই এক ডায়লগ ‘নিজের পয়সায় খাই, তোমার বাবার টাকায় খাই না। তোমার বাবার তো ডেকে নিমন্ত্রণ করে খাওয়ানোরও ক্ষমতা নেই। নিজের পয়সায় খাচ্ছি তাও সহ্য হচ্ছে না তোমার।’

কোনও বিতর্কে যায় না স্নেহা। অভয়ের বিয়েতে যেতে না পারার জন্য স্নেহার মনটা ক’দিন ধরে ভালো নেই। অভয় স্নেহার থেকে বছর দশেকের ছোটো হলে কী হবে, ভাইবোনের দারুণ বন্ধুত্ব। কত সুখ-দুঃখের কথা হতো তাদের। বিয়ের পর সম্পর্কগুলো কেমন যেন এলোমেলো হয়ে গেছে।

কিছুদিন পরে এক বিয়েবাড়িতে হঠাৎই দেখা পিসির সঙ্গে। লজ্জায় অভয়ের বউয়ের কথা পর্যন্ত জিজ্ঞাসা করতে পারেনি স্নেহা। আর করবেটাই বা কী করে, বিয়ের মিষ্টি নিয়ে যা কান্ড ঘটল! মুগ্ধা, অভয়কে দিয়ে বাচ্চাদের জন্য বিয়ের মিষ্টি পাঠিয়েছিল, সে মিষ্টিও তো অভয়ের সামনেই ছুড়ে ফেলে দিয়েছিল বিজয়। মাথা নত করে ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল অভয়। তারপর দু-তরফ থেকেই ফোন বন্ধ।

এতকিছুর পরেও ভাইঝির উপর বিন্দুমাত্র রাগ নেই মুগ্ধার। স্নেহার সমস্যাটা সে বোঝে। বরং ভাইঝির জন্য চিন্তাই হয় তার। যে মেয়ে বলতে গেলে, একপ্রকার তার কাছে মানুষ, ভাগ্যের পরিহাসে সুখে-দুঃখে তার পাশে দাঁড়ানোরও অধিকার নেই তাদের। জোর করে কারও সংসারে নাকগলানোটাও ঠিক নয়। যদিও এর আগে স্নেহার বড়দা, বিজয়কে বোঝানোর নানারকম প্রচেষ্টা করেছেন। কিন্তু তার স্বভাব সব কিছুকে ছাপিয়ে গেছে।

মুগ্ধা মনোবিজ্ঞানের অধ্যাপিকা। মন নিয়েই তার যত কারবার। কাজেই পুরুষদের দম্ভ আর অহং সম্পর্কে তার ধারণাটা খুব স্পষ্ট। কিন্তু তার থেকে বেশি চিন্তার কারণ বিজয়ের নেশার প্রতি আসক্তি। যেটা মুগ্ধাকে ভীষণভাবে ভাবিয়ে তুলেছিল।

দুই পরিবারের মধ্যে যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেলেও এদিক-ওদিক থেকে কিছু খবর তো কানে আসেই। তারপর সেগুলোকেই বাড়িয়ে-চাড়িয়ে রং লাগিয়ে যা হয় আর কী! মুগ্ধা সেগুলো সহজভাবে নিলেও, বিজয় তো একেবারে বিপরীত। লোকের মুখে শোনামাত্রই নিরীহ স্নেহার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে, ‘তোমার পিসি নিজেকে কী মনে করেন? ওনাকে বলো আমাদের চিন্তা ছেড়ে দিতে। বেশি পড়াশোনা শিখে কি মাথা কিনে নিয়েছেন নাকি। শোনো ওসব পড়াশোনা-টড়াশোনা দিয়ে কিছু হয় না বুঝেছ, লোক টাকা চেনে, টাকা। আমার মতো উপায় করে দেখাক তো, তাহলে জানব।’ ব্যস তারপর ঝগড়ার বাহানায় আরও কয়েক পেগ চড়িয়ে নেয় বিজয়। দিন এভাবেই গড়িয়ে যায়।

অশান্তির কারণে আত্মীয়দের কারও সামনে ভাইঝির প্রসঙ্গে কিছু বলাও ছেড়ে দিয়েছিল মুগ্ধা। সারাটা দিন অধ্যাপনা নিয়েই ব্যস্ত থাকত। তার উপর মুম্বইতে অভয়ের ট্রান্সফার নিয়ে চলে যাওয়ার জন্য বাড়িতেও বেশ কিছুটা সময় দিতে হচ্ছিল তাকে। পরের মাসের মধ্যে আবার নতুন বউকে সেখানে পাঠানোর ব্যবস্থা করা।

বছর গড়াতে না গড়াতে হঠাৎ একদিন খবর এল বিজয়ের নাকি ওরাল ক্যানসার ডিটেক্টেড হয়েছে। ব্যস পরিবারের উপর একেবারে বজ্রাঘাত পড়ার মতো অবস্থা হল। যতই বদমেজাজি, দাম্ভিক হোক না কেন, বাড়ির একমাত্র জামাইয়ের এমন মারনরোগ, তাদের বেশ বিচলিত করে তুলেছিল। ক্যানসারের প্রথম স্টেজ।

ডাক্তাররাও যত তাড়াতাড়ি সম্ভব অপারেশন করার কথা বলেছেন। স্নেহার বাচ্চাগুলোও ছোটো ছোটো, আর স্নেহা এমনিই একটু দুর্বল প্রকৃতির। কোনওদিনই নিজের সিদ্ধান্তে চলেনি, বরাবরই অন্যের মুখাপেক্ষী। সুতরাং তার পক্ষে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়াও অসম্ভব। পাশে দাঁড়ানোর মতো কেউ নেই। টাকাপয়সার অভাব না থাকলেও কোথায় চিকিৎসা করাবে, কোথায় গেলে সমুচিত হবে কিছুই বোধগম্য হচ্ছিল না তার। বিজয়ের দুই ভাইও কর্তব্য পালন করতে শুধুমাত্র একদিন চোখের দেখা দেখে গেছে মাত্র, বাড়তি কোনও দায়িত্ব তারাও নিতে রাজি নয়। স্নেহার ননদও কোনওদিনই দাদার প্রতি যত্নশীল নয়। তার স্পষ্ট বক্তব্য, ‘যেটা ভালো মনে হয় করো। আমরা এ ব্যাপারে কোনও মতামত পোষণ করতে চাই না। দাদাকে তো চিনি, ভালো করতে গিয়ে যদি কিছু একটা… থাক ভাই আমাদের এর মধ্যে জড়িয়ো না।’

যত মত তত পথ। কেউ আয়ুর্বেদের উপর জোর দিতে বলে তো কেউ অ্যালোপ্যাথি বা হোমিওপ্যাথির। কেউ কেউ তো আবার এটা বলতেও ছাড়ে না যে, ‘এখনও পর্যন্ত তো এই রোগে আক্রান্ত কোনও ব্যক্তিকে বেঁচে ফিরতে দেখিনি’, তো কেউ বলে, ‘এরোগের কোনও চিকিৎসাই নেই। সুতরাং এখন সবই ভগবানের ইচ্ছা।’

সবাই গা-বাঁচিয়ে চললেও স্নেহার বাবা-মা দিক্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে ছুটে গিয়েছিলেন বোন মুগ্ধার কাছে। না মুগ্ধা ফেরায়নি বরং সেও মুখিয়ে ছিল। আদতে মুগ্ধা চাইছিল কেউ অন্তত একবার আসুক। তাই প্রতাপবাবু কোনও কিছু বলার আগেই মুগ্ধা বলে ওঠে, ‘দাদা তুমি তো জানোই অভয়ের মুম্বইতে ট্রান্সফার হয়েছে। মাস তিনেক হল টাটা মেমোরিয়ালে জয়েনও করেছে। যেভাবেই হোক বিজয়কে বুঝিয়ে সুঝিয়ে মুম্বই পাঠাও। বাকি, যা ব্যবস্থা করার অভয়ই করে নেবে।’

ডাক্তার ভাগনের জন্য মামার এমনিই গর্বের অন্ত ছিল না। ভাগনে ক্যানসার বিশেষজ্ঞ বলে কথা। কিন্তু তৎসত্ত্বেও ভাগনের কাছে জামাইকে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে একটা সংশয় থেকেই গেল। আসলে দুই পরিবারের মধ্যে ভীষণ মিষ্টিমধুর সম্পর্ক কিনা!

ক্যানসারের মতো মারণরোগের মৃত্যুভয়ও টলাতে পারেনি বিজয়কে। সেও হার মেনেছে তার দম্ভের কাছে। তাই বোধহয়, রিপোর্ট হাতে পাওয়া মাত্রই বিকৃত হেসে বউকে হুঁশিয়ারি দিয়েছিল, ‘খবরদার স্নেহা, আমার রোগের ব্যাপারে তোমার পিসি যেন কিচ্ছুটি জানতে না পারে। এমনিতেই ছেলে এখন বড়ো ডাক্তার হয়েছে। টাটা মেমোরিয়ালে চাকরি করছে। অহংকারে তেনাদের এখন মাটিতে পা পড়ে না। তার উপর তাদের অতিবড়ো শত্রু মরতে বসেছে শুনলে খুব খুশিই হবে।’

স্নেহা জবাব দিতে গিয়েও পরিস্থিতির কথা ভেবে চুপ করে যায়।

এভাবেই কেটে যায় আরও দুটো দিন। জামাইয়ের মানা-না মানার ব্যাপারে প্রতাপবাবুর একটা দ্বিধা ছিলই। বোঝাতে গেলে যদি উলটো ভাবে নেয়, তাহলেই তো বাড়ি মাথায় করে ফেলবে। এই অবস্থায় বেশি উত্তেজনাও শরীরের পক্ষে হানিকারক। ভাবতে থাকে প্রতাপবাবু।

ওদিকে দুদিন পরেও কোনও খবর না পেয়ে তৃতীয় দিনের দিন মুগ্ধা নিজেই প্রতাপবাবুকে ফোন করে জানতে চাইলেন, ‘দাদা কিছু ঠিক হল। বিজয় মুম্বই কবে যাচ্ছে?’

‘কী যে করি, বিজয়ের সঙ্গে কথা বলতেই ভয় করছে। এক বলব আর অন্য মানে করে বসবে। তুই তো ওর স্বভাব জানিস, পারলে হাওয়া বাতাসের সঙ্গেও যুদ্ধ করে।’ মেয়ের কথা ভেবে চোখে জল আসেঞ্জপ্রতাপবাবুর। অসহায়ের মতো বসে থাকেন বেশ কিছুক্ষণ। দাদার সঙ্গে কথা বলে মুগ্ধার মনটাও ভারাক্রান্ত হয়ে পড়ে। মনে মনে ভাবে, যে ভাবেই হোক, একটা উপায় বার করতেই হবে। দিন চারেকের জন্য বাড়ি ফিরেছিল অভয়। চিন্তামগ্ন মাকে দেখে, ‘কী হল মা চুপচাপ কেন? জামাইবাবু মুম্বই যেতে রাজি হয়নি তাই তো?’ মাথা নেড়ে সম্মতি প্রকাশ করেন মুগ্ধা।

‘মা, তুমি তো নিজেই মনোবিজ্ঞানের অধ্যাপিকা। তুমি তো জানোই কিছু মানুষ আছে যারা কোনও অবস্থাতেই মাথা নোয়াতে পছন্দ করেন না। জামাইবাবু সেল্ফমেড লোক। নিজের ক্ষমতায় এতো বড়ো একটা বিজনেস দাঁড় করিয়েছে। একটু অহংকারী এই যা। তুমি চিন্তা কোরো না, আমি দেখছি।’

‘কিন্তু তুই?’ প্রশ্ন করে মুগ্ধা।

‘আরে ধুর! তুমি আমার জন্য হেজিটেট কোরো না তো। আমাদের মতো ডাক্তারদের রোজ কত ভুরিভুরি কথা শুনতে হয় জানো? কোনও পেশেন্টকে বাঁচাতে না পারলেই গালিগালাজ হজম করতে হয়। আবার রুগি সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরলে কেউ কেউ মাথায় করে নাচে। আমাদের পেশাটাই এরকম! তার উপর উনি তো নিজের জামাইবাবু। স্নেহাদির বর। দিদির অসময়ে তার ছোটোভাই পাশে থাকবে না তো কে থাকবে?’ অভয়ের কথা শুনে আশ্বস্তবোধ করেন মুগ্ধা।

পরদিন দুপুরের মধ্যে দিদির বাড়িতে হাজির হয় অভয়। দিদিকে দেখে এমন হাবভাব করে যেন সবকিছু আগের মতোই নর্ম্যাল। ঘরে ঢুকে বসামাত্রই ডাক্তারসুলভ ভঙ্গিতে স্নেহাকে জামাইবাবুর সমস্ত রিপোর্ট আনার জন্য বলে। রিপোর্ট দেখার পর ফোনে সিনিয়র ডাক্তারের সঙ্গে বেশ কিছুক্ষণ চলল শলাপরামর্শ। তারপর সোজা জামাইবাবুর ঘরে ঢুকে প্রায় যুদ্ধের কম্যাণ্ডারের মতো করে বলে, ‘ব্যস অনেক হয়েছে। কাল সকালের ফ্লাইটে আপনি আমার সঙ্গে মুম্বই যাচ্ছেন। ডাক্তারের অ্যাপয়েন্টমেন্ট নেওয়া হয়ে গেছে। পরশুদিন আবশ্যক যা যা পরীক্ষানিরীক্ষা হওয়ার হবে, তারপরেই চিকিৎসা শুরু হয়ে যাবে।’

বিজয়ের ক্রোধ তখনও বিন্দুমাত্র প্রশমিত হয়নি। বরং যাদের সাথে এরকম তিক্ত সম্পর্ক, তাদের এত আদিখ্যেতায় রাগে তার গা জ্বালা করতে শুরু করেছিল। কিছুক্ষণ চুপ থেকে একটা সময়ে তো শালাবাবুর উদ্দেশ্যে বলেই ফেলল, ‘জানি, জানি, অনেক বড়ো ডাক্তার হয়ে গেছিস। আমার চিকিৎসাও করবি। কিন্তু তোর বিয়েতে পিসি যা ব্যবহার করেছে সেটা কোনওদিনও…’

জামাইবাবুকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই, ‘হ্যাঁ, জানি, আমার বিয়েতে মা আপনাকে ব্যক্তিগতভাবে নিমন্ত্রণ করতে আসতে পারেনি। বোঝেনই তো বাবা আর পেরে ওঠে না। আর মায়ের একার পক্ষে সব জায়গায় ছোটাছুটি করাটা প্রায় অসম্ভব। আর আমি নিমন্ত্রণ করতে এলেও তো হতো না বলুন। এসব আপনি বুঝবেন না তো কে বুঝবে বলুন তো। ঠিক আছে ছোটোর বিয়েতে আমি নিজে এসে আপনাকে নিয়ে যাব।’ কথার মারপ্যাঁচে অভয়, বিজয়ের মনের গ্লানি কিছুটা হলেও দূর করতে পারল। পরিস্থিতি আরও হালকা করতে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা দিদিকে দেখে, ‘কী রে চা-টাও দিবি না নাকি বলতো?’ ভাইয়ের এই সকল প্রচেষ্টায় স্নেহা কিছুটা হলেও সোয়াস্তি অনুভব করল।

পরদিন ভোররাতের ফ্লাইটে রওনা দিল তারা। প্রথমদিন ডাক্তারি পর্যবেক্ষণে পরীক্ষানিরীক্ষা সমস্ত কিছু চলল। দ্বিতীয় দিনে অপারেশন। ততক্ষণে প্রতাপবাবু আর মুগ্ধা দুই ভাইবোনেই, টাটা মেমোরিয়ালে পৌঁছে গেছে। সিনিয়র ডাক্তারের তত্ত্বাবধানে এবং অভয়ের সহযোগিতায় অপারেশন সাক্সেসফুল। চার-পাঁচ দিন পর থেকেই লিকুইড জাতীয় খাবার দেওয়া হল বিজয়কে। তারপর আর সাত দিন অবজার্ভ করার পর ছুটি দিয়ে দেওয়া হল তাকে।

ছুটির দিন বিজয়, পিসিকে সামনে পেয়ে পিসির হাত দুটো ধরে আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ে, ‘পিসিমা ওই দিন না-জানি কত বাজে কথা বলেছি আপনাকে। তারপরেও আপনারা। প্লিজ পিসিমা আমাকে ক্ষমা করে দেবেন।’

সঙ্গে সঙ্গে জামাইয়ের হাত দুটো ধরে নেয় মুগ্ধা। বলে, ‘এটা কী করছ বাবা! তুমি যে আমাদের কত আদরের, কত কাছের তা কী বলার অপেক্ষা রাখে। ভুলটা আমারই হয়েছিল বাবা, আমারই উচিত ছিল গিয়ে বলা।’

‘পিসিমা, আর লজ্জা দেবেন না। এখনও তো ও বাড়িতে একটা বিয়ে বাকি আছে। দেখবেন ছোটোর বিয়েতে নিমন্ত্রণের পরোয়া না করেই আমি চলে আসব। শালাবাবুর বিয়েতে সব দায়িত্ব আমার।’

অপারেশন করার পর বিজয়ের মুখটা সামান্য একটু বেঁকে গেছে। দাঁত তুলে দেওয়ার পর কথাগুলোও কিছুটা জড়িয়ে যাচ্ছে, তৎসত্ত্বেও বিজয়ের মন থেকে বলা জড়ানো কথাও বুঝতে অসুবিধা হয়নি মুগ্ধার।

ভরসা জোগাতে জামাইয়ের কাঁধে হাত রেখে মুগ্ধা শুধু এটুকুই বলতে পেরেছিল, ‘সম্পর্ক এত ঠুনকো নয় যে, দুটো কথাতে সেটা ভেঙ্গে যাবে। মন থেকে সমস্ত রাগ, দম্ভ মুছে ফেলো। দেখবে ভালো আছ। আমরা সবাই সবসময় তোমার সঙ্গেই আছি।

বিদায়

অনুভা কাগজ পড়তে পড়তে রিমার মুখের দিকে তাকালেন। একমাত্র মেয়ে। অরূপ এবং অনুভা বহু আদরে নিজেদের একমাত্র সন্তানকে বড়ো করে তুলেছেন। কোথাও কিছু ফাঁক রাখেননি। শহরের নামি স্কুলে পড়াশোনা শেষ করে এখন কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী সে। রিমার এখন বয়স মাত্র উনিশ বছর। অথচ অনুভা আশ্চর্য হয়ে যান রিমার সাহস এবং কথা বলার ভঙ্গি দেখে। বলেই ফেলেন, ‘এটা তুই কী বলছিস রিমা?’

‘হ্যাঁ মা, আমি অনেক ভেবেচিন্তেই ডিসিশন নিয়েছি। কলেজের ওই একঘেয়েমি ক্লাস আর পড়াশোনা আর ভালো লাগছে না। ঠিক করেছি অভিনেত্রী হব।’

অনুভার ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়া এক্সপ্রেশন রিমার চোখ এড়ায় না, ‘এতে এত আশ্চর্য হওয়ার কী আছে? অনেকদিন ধরেই খোঁজখবর নিচ্ছিলাম শুধু তোমাদের আগে জানাইনি। অনন্যাকে চেনো তো? আমার সঙ্গে কলেজে পড়ে। নামটা লেখানো মাত্র, ক্লাস করে না। টিভির পর্দায় এখন ও বেশ পরিচিত মুখ। ওই আমাকে মুম্বইয়ের এক এজেন্টের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে। ফোনে কয়েকবার ওই এজেন্টের সঙ্গে কথা হয়েছে। আমাকে মুম্বই গিয়ে থাকতে হবে, তবেই অডিশনের সুযোগ ও করিয়ে দেবে। তার আগে অবশ্য খানিকটা গ্রুমিংয়েরও দরকার আছে।’

অনুভা অবাক চোখে তাকিয়ে থাকেন মেয়ের মুখের দিকে। এই সেদিনের সেই ছোট্ট রিমা নিজের মধ্যে এত তেজ আনল কীভাবে, সেটা অনুভা ভেবে পেলেন না। তবুও মেয়েকে বোঝাবার চেষ্টা করতে ছাড়লেন না, ‘এতদূর একা গিয়ে থাকবি কিন্তু ওখানে কাউকেও তো তুই চিনিস না। আর ওই এজেন্টকেও তো সামনাসামনি কখনও দেখিসনি। ওর উপর আমরা ভরসা করব কী করে? এছাড়া তোর বাবাকেও তো সব খুলে বলতে হবে। উনি মত দেবেন বলে মনে হয় না।’

‘আমি মুম্বই যাব ঠিক করে নিয়েছি’, রিমার কণ্ঠস্বর কঠোর শোনায়, ‘তোমরা আমাকে ভরসা করবে কিনা সেটা সম্পূর্ণ তোমাদের ব্যাপার। যেমন করেই হোক অভিনয়ের জগতে আমাকে খ্যাতি পেতেই হবে, তবেই তো আমি টাকা রোজগার করতে পারব। টাকা এবং খ্যাতি, এই দুটোই আমার স্বপ্ন।’

অরূপ বাড়িতে আসতে অনুভা মেয়ের ইচ্ছের কথা স্বামীর কাছে জানান। অরূপ সব শুনে বুঝতে পারেন মেয়ে যখন জেদ ধরেছে ওকে আটকাবার আর কোনও উপায় নেই। অনুভাকে শান্ত করতে বলেন, ‘আমার মত যদি শোনো অনুভা, তাহলে মেয়েকে আটকাবার চেষ্টা কোরো না। রিমা বড়ো হয়েছে। আইনের চোখে ও এখন অ্যাডাল্ট। সুতরাং আমরা আটকাবার চেষ্টা করলে ও যদি বাড়ি থেকে পালিয়ে যায় তাহলে আমাদের আর কিছু করার থাকবে না। তার চেয়ে বরং ওর ইচ্ছেটাকে মেনে নিলে সম্পর্কটা টিকে থাকবে। আর ওর ভালোমন্দের দায়টা তো আমাদেরই। তবে একটা কথা, ওর কাছ থেকে এজেন্টের নম্বরটা নিয়ে রেখো, আমি একবার লোকটার সঙ্গে কথা বলে ওকে যাচাই করে নিতে চাই।’ অনুভা চুপ করে থেকেই সম্মতিসূচক মাথা নাড়েন।

খাওয়ার টেবিলে মুখোমুখি হতে মেয়েকে সরাসরি অরূপ ধরলেন, ‘হ্যাঁরে, তোর মায়ের কাছে শুনলাম তুই নাকি মুম্বই যেতে চাস অভিনয়ে সুযোগ পাওয়ার জন্য। ভালো কথা। আশা করি এই পেশার ভালোমন্দ সবকিছু জানার পরই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিস। এই পেশায় যেমন অর্থ, খ্যাতি আছে তেমনি একাকিত্ব, অবসাদও আছে। খ্যাতি ধরে রাখা কিন্তু কঠিন কাজ। তুই কি প্রস্তুত এই কঠিন পথে পা ফেলতে? ভেবে দ্যাখ কিন্তু।’

‘বাবা, আমি সবকিছু জেনেই অভিনেত্রী হতে যাচ্ছি। আমি জানি আমি সফল হবই।’

ট্রেন ছুটে চলেছে টিনসেল টাউনের দিকে। বাতানুকূল কামরার চারপাশটা একবার চোখ বুলিয়ে নেয় রিমা। মনে মনেই বলে, ‘চারপাশে শুধু মানুষের ভিড়। আজ আমি এই ভিড়েরই একটা

অংশমাত্র। এই লোকের ভিড়ে এদের সকলের মতো আজ আমি হারিয়ে গেছি, কেউ আমাকে চেনে না। আমার নামও কেউ জানে না। অথচ একটা এমন দিন আসবে যেদিন লোকের মুখে মুখে আমার নাম ঘুরবে। এক দেখায় লোকে আমাকে চিনে ফেলবে।’ চারপাশের ভিড় অগ্রাহ্য করেই রিমার মুখে ফুটে ওঠে তৃপ্তির হাসি।

রিমার চোখের সামনে মুম্বইয়া এজেন্টটার মুখ ভেসে ওঠে। আরব সাগরে খড়কুটোর মতো ওই এজেন্টটিই তো ভরসা। রিমার পোর্টফোলিও দেখে ও চার-পাঁচটা টিভি ধারাবাহিকের প্রোডাকশন হাউজের সঙ্গে কথা বলেছে। ওর জোরাজুরিতেই মুম্বইতে এসে থাকার সিদ্ধান্ত নেওয়া, কারণ এজেন্ট পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছে শহরে এসে না থাকলে অডিশনের সুবিধা ও করিয়ে দিতে পারবে না। তবে অডিশন দিলে নাকি কোথাও না কোথাও রিমার চান্স হয়েই যাবে এই আশ্বাস এজেন্ট দিয়েছে।

মুম্বইতে পা দিয়েই প্রথমে রিমা এজেন্টকে ফোন করে। ওরই পাঠানো গাড়িতে বান্দ্রার অফিসে গিয়ে এজেন্টের সঙ্গে দেখা করে। এজেন্টই রিমাকে নিয়ে যায় অফিসের কাছাকাছি একটি লোকালিটিতে যেখানে সস্তায় পিজি থাকার ব্যবস্থা রিমার জন্য করা হয়েছে। একটা ঘরে চারজন থাকার ব্যবস্থা রয়েছে। তিনটে অলরেডি দখল করেছে তিনটি অবাঙালি মেয়ে, চতুর্থজন হল রিমা।

ঘরের দশা দেখে রিমা খানিকটা দমে যায়। এজেন্টটা প্রবাসী বাঙালি তাই রিমার ধারণা ছিল বাঙালিদের সুবিধা অসুবিধাটা অন্তত লোকটা বুঝবে। এরকম একটা ঘর ঠিক করে রাখবে ও, রিমা ভাবতে পারেনি।

সংযত হয়ে রিমা প্রশ্ন করে, ‘আপনি তো অনেক বড়ো বড়ো কথা বলেছিলেন, এরকম একটা ঘর পছন্দ করলেন কীভাবে?’

‘ডোন্ট বি সিলি রিমা। এরকম ঘর না তো কি জুহুর বাংলোতে থাকবে! ভালো ঘর মানে ভালো টাকা। স্টার হতে পারলে তবেই তোমার হাতে টাকা আসবে আর এর জন্য তোমাকে প্রচুর পরিশ্রমও করতে হবে। এসব কথা এখন ছাড়ো। কাল তোমার জন্য একটা অডিশনের ব্যবস্থা করে রেখেছি। সকালে ঠিক দশটার সময় এই ঠিকানায় পৌঁছে যেও’, বলে রিমার হাতে একটা কাগজ গুঁজে দিল এজেন্ট।

সকাল সকাল তৈরি হয়ে রিমা সময়ের আগেই নির্দেশিত ঠিকানায় পৌঁছে গেল। নতুন জায়গা, অচেনা লোকজন রিমাকে ভিতরে ভিতরে অস্থির করে তুলছিল। অডিশনের জন্য লম্বা লাইন। অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই। অবশেষে ডাক এল। তখন প্রায় তিনটের ঘরে ঘড়ির কাঁটা। রিমার বেহাল অবস্থা। অপেক্ষা করতে করতে ক্লান্তিতে সারা শরীর ঝিম মেরে গেছে। তবুও নিজেকে কিছুটা ক্যামেরার সামনে দাঁড়াবার উপযুক্ত করে নিয়ে ভিতরে পৌঁছল রিমা। যে-লাইনগুলো ক্যামেরার সামনে বলার জন্য দেওয়া হয়েছিল সেগুলো মনে মনে ঝালিয়ে নিল। ভিতরে ঢুকে সামান্য কথাবার্তার পর সোজা ক্যামেরার সামনে ওকে দাঁড়াতে বলা হল। মুহূর্তে সব কিছু যেন গুলিয়ে গেল রিমার। যে লাইনগুলো ওকে বলার জন্যে দেওয়া হয়েছিল সেগুলো সব গুলিয়ে তাল পাকিয়ে গেল। কিছু বলতে পারল না। স্বাভাবিক ভাবেই অডিশন-এ পাশ করতে পারল না রিমা।

টানা তিনমাস একটাও অডিশন রিমা উতরোতে পারল না। ক্যামেরার সামনে দাঁড়ালেই কেমন জানি সব গোল পাকিয়ে যেত, চেহারায় এক্সপ্রেশন কিছুতেই ফোটাতে পারত না। সঙ্গের টাকাপয়সাও শেষ হবার জোগাড় হল। রিমার রুমমেটদেরও সেই একই অবস্থা। রুপোলি পর্দার মোহ সবাইকে এই মায়া নগরীতে টেনে এনেছিল ঠিকই কিন্তু বাস্তবে কাজ জোগাড় করা অতটাও সহজ ছিল না।

ক্যামেরার সামনে স্বাভাবিক না হতে পারাই যে তার ব্যর্থতার কারণ সেটা রিমা বুঝতে পারছিল। এজেন্টের অভিজ্ঞ চোখও সেটা বুঝতে পেরে রিমাকে প্রথমে মডেলিং-এ নিয়ে আসার সিদ্ধান্ত নিল।

এজেন্টের কথামতো রিমা ওয়াডালায় একটি মডেলিং এজেন্সিতে এসে উপস্থিত হল। সেখানেও মেয়েদের ভিড়। অপেক্ষা করতে করতে রিমা লক্ষ্য করছিল ওই এজেন্সিরই একটি ছেলে, মেয়েদের শরীরের বিভিন্ন জায়গার মাপ নিচ্ছে আর জোরে জোরে অন্য একটি ছেলেকে মেয়েদের নামের সঙ্গে সঙ্গে মাপগুলো বলছে। অন্যজন কাগজে সেগুলো লিখে নিচ্ছে। রিমার সামনে দাঁড়ানো মেয়েটির মাপ নেওয়ার সময় ছেলেটি অশালীন ভাবে মেয়েটির নিতম্বে চাপ দিয়ে প্রশ্ন করল, ‘আসলি হ্যায়?’ রিমার এসমস্তই অত্যন্ত কুরুচিকর মনে হলেও মনে মনে ভাবল আগুনে পুড়েই খাঁটি সোনা হওয়া যায়।

ধীরে ধীরে এই ধরনের কালচারে রিমা অভ্যস্ত হয়ে উঠল। ক্যামেরার সামনে জড়ত্ব কাটাতে শুরু করল। ছোটোখাটো বিজ্ঞাপনের কাজ আসতে লাগল সেইসঙ্গে টাকা পয়সার অভাবও মিটে গেল। মুম্বইতে থাকাটাই যেখানে অসম্ভব মনে হচ্ছিল, সেটাই রিমার কাছে এখন সম্ভব মনে হল।

রিমার চোখে এমন একটা জেদ ছিল এবং রিমার চেহারার বৈশিষ্ট্য দেখে রিমার এজেন্ট বুঝে গিয়েছিল, মেয়েটি এই ইন্ডাস্ট্রিতে হারার জন্য আসেনি। ইতিমধ্যে টিভি ধারাবাহিকের আর-একটি অডিশনের জন্য সে রিমাকে পাঠাল। এবার আর রিমাকে অসফল হতে হল না। ধারাবাহিকে একটি পার্শ্বচরিত্রে রিমা নির্বাচিত হল। পার্শ্বচরিত্র হলেও গল্পে চরিত্রটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রথম প্রথম রিমার মনে হতো, অফিসে কাজ করছে ও। পরিশ্রম, সময়ে পৌছনো সবই করতে হচ্ছে উলটে শনি-রবিবারেও কোনও ছুটি নেই। জ্বর, শরীর খারাপ হলেও ওষুধ খাও আর কাজে এসো। কিন্তু আস্তে আস্তে ধারাবাহিকের টিআরপি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে রিমার করা চরিত্রটাও দর্শকদের কাছে পর্দার পরিচিতি মুখ হয়ে দাঁড়াল। রিমার বাড়িওলাও ওর সঙ্গে আগের থেকে অনেক মার্জিত ভাবে কথা বলা শুরু করল। বাড়িওলার টিনএজার ছেলেটিও মাঝেমধ্যেই বন্ধুদের নিয়ে রিমার কাছে পৌঁছে যেত সেলফি তোলার অজুহাতে।

রিমাও ব্যাপারটা উপভোগ করতে আরম্ভ করল এবং ওর এজেন্টও ওকে সাবধান করল, ‘রিমা, এখন তুমি একজন সেলিব্রিটি। হুটহাট করে যে-কোনও পোশাকে দোকান-বাজার চলে যাওয়া তোমাকে এখন মানায় না। দরকার পড়লে অনলাইনে অর্ডার করো।’

ইতিমধ্যে অভিনয়ের ব্যস্ততা রিমাকে নিজের মা-বাবার থেকেও অনেকটাই দূরে সরিয়ে দিয়েছিল। ইচ্ছে থাকলেও কাজের প্রেশারে ফোনে কথাবার্তাও একরকম বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। মেয়েকে দেখতে ইচ্ছে করলে অনুভা স্বামীর সঙ্গে মুম্বই কিছুদিনের জন্য ঘুরে যেতেন। তাতেও বিশেষ লাভ হতো না কারণ বাড়িতে রিমাকে কতটুকুই বা তাঁরা পেতেন! কিন্তু মেয়ে সম্পর্কে কানাঘুষো কলকাতায় বসেও তাঁদের কানে আসতে থাকত। এবারে তাই অনুভা ঠিক করেই এসেছিলেন মেয়ের সঙ্গে সামনাসামনি কথা বলবেন।

‘হ্যাঁরে রিমা, খবরের কাগজগুলোতে তোর সঙ্গে ওই ছেলেটার নাম জড়িয়ে রোজই কিছু না কিছু ছাপা হচ্ছে। কী ব্যাপার বল তো! তোর এখন বয়স অল্প। এই ধরনের খবর যদি বেরোতে থাকে কাগজে তাহলে তো চিন্তার ব্যাপার। আমি জানি ওরা যা পারে কাগজে ছেপে দেয়। কারও বদনাম হলে ওদের কি?’

‘ওই নিয়ে তুমি চিন্তা কোরো না’, অল্প কথায় উত্তর সারলেও রিমা এই বিষয়টা নিয়ে খুবই সচেতন। অভিনয় জগতে প্রায় দুই বছর কাটাবার পর রিমা এখন অনেক বেশি পরিপক্ব। ওর সহঅভিনেতা সিদ্ধার্থকে রিমা প্রথম থেকেই খুব পছন্দ করে। কাজের খাতিরে দুজনকে প্রায়শই সঙ্গে সঙ্গে থাকতে হতো। রিমার চোখের ভালোলাগা, সংবাদমাধ্যমের ক্যামেরায় ধরা পড়ে যায় এবং গসিপ ছড়িয়ে পড়ে। সিদ্ধার্থও জেনে ফেলে রিমার হূদয়ের দুর্বলতা।

পঁয়ত্রিশ বছর উত্তীর্ণ সিদ্ধার্থ সময় নষ্ট না করেই রিমাকে ডিনারে নিয়ে যাওয়ার আমন্ত্রণ জানায়। সিদ্ধার্থর সঙ্গে একা থাকার এই সুযোগ রিমারও ছেড়ে দিতে মন চায় না। তারপর থেকেই কখনও কফি শপে, ডিস্কোয় অথবা কারও পার্টিতে শুটিং-এর পর দুজনে একসাথে যেতে শুরু করে। ধীরে ধীরে দুজনের এই মেলামেশা চর্চার বিষয় হয়ে দাঁড়ায় মিডিয়ার কাছে।

সেদিনটা, প্রাণ থাকতে রিমা কোনওদিন ভুলতে পারবে না। সিদ্ধার্থর সঙ্গে ডেটে বেরিয়েছিল রিমা। পাঁচতারা হোটেলে টেবিল বুক করে রেখেছিল সিদ্ধার্থ। ডিস্কোতে নাচতে নাচতে রিমা বুঝতে পারেনি কখন ভিড় থেকে সরে গিয়ে সামান্য আলোআঁধারইতে গিয়ে দাঁড়িয়েছে তারা। সিদ্ধার্থর শক্ত বাহু তার কোমর বেষ্টন করে তাকে নিজের শরীরের সঙ্গে এক করে নিয়েছে। কিছু বলা বা বোঝার আগেই সিদ্ধার্থের তপ্ত চুম্বন এসে পড়ে রিমার নরম ঠোঁটের উপর। একবার নয় বারবার। মিনিট, সেকেন্ড সময়ের জ্ঞান হারিয়ে ফেলে রিমা। ভালো খারাপ সব মুছে যায় মন থেকে। সেই রাতটা হোটেলেরই একটা রুমে এক শয্যায় কাটে রিমা আর সিদ্ধার্থর। নিজেকে উজাড় করে তুলে দেয় সিদ্ধার্থের চাহিদার আগুনে।

এরপর আর লুকোচুরি, রাখঢাক কিছুই রাখেনি রিমা। প্রকাশ্যে হাতে হাত দিয়ে দুজনে ঘুরে বেড়িয়েছে, ভিড়ের মধ্যেই সিদ্ধার্থর গলা জড়িয়ে ধরে উষ্ণ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছে। মিডিয়াও চুপ করে থাকেনি। ছবির পাশাপাশি ফলাও করে রিমা, সিদ্ধার্থর সম্পর্কের রঙিন বর্ণনা পাঠকদের কাছে পৌঁছে দিতে কার্পণ্য দেখায়নি। ফলে দুজনের সম্পর্কের কথা সাধারণ লোকের মুখে মুখে ফিরেছে এমনকী অভিনয় জগতের সহশিল্পীরা ওদের নিয়ে হাসিঠাট্টা করতেও ছাড়েনি।

আজ রিমা তাই মায়ের প্রশ্নের উত্তরও এড়িয়ে গেল যদিও ওর মনে হল মায়ের চিন্তাটা অমূলক নয়।

রাতে শুতে যাওয়ার আগে এজেন্টের ফোন দেখে রিমা একটু অবাকই হল। এত রাতে প্রয়োজন ছাড়া ও কথা বলে না তবুও ফোন তুলে নিল, ‘হ্যালো?’

‘রিমা, টিভিতে সন্ধে সাতটার স্লটে যে ধারাবাহিকটা চলছে তার লিড অ্যাক্ট্রেস প্রেগনেন্ট। আর কয়েকদিনই ও কাজ করবে। তুমি ওর জায়গায় কাজ করতে রাজি থাকলে আমি ডাইরেক্টরের সঙ্গে কথা বলব তোমার জন্য।’

‘হ্যাঁ, কথা বলুন আমি কাজ করব’, পরপর কাজের অফার আসাতে রিমা খুশি হয়, মনে মনে অহংকারও বোধ করে।

সকালে শুটিং-এর কাজ না থাকাতে একটু দেরিতেই ঘুম থেকে ওঠে রিমা। ফোনটা বাজতেই আলস্য ভরে ফোনটা কানে নেয়। ‘আজকের খবরের কাগজটা পড়েছো রিমা?’ ঈশানীর গলার আওয়াজ শুনে একটু অবাক হয়ে যায়। দুটো ধারাবাহিকে একসঙ্গে কাজ করেছে ঠিকই কিন্তু বন্ধুত্ব গড়ে ওঠেনি। সামনাসামনি দেখা হলে হাই…হ্যালো। ব্যস ওই পর্যন্তই দৌড়।

‘না, এখনও পড়া হয়নি। নতুন একটা কাজ নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম। সঙ্গে সাতটার স্লটে যে ধারাবাহিকটা চলছে তার লিড অ্যাক্ট্রেস হওয়ার একটা অফার পেয়েছি।’

‘সে কী! ওটাতেই তো যে লিড রোলে এখন করছে সে আসলে সিদ্ধার্থের গার্লফ্রেন্ড। ওর সন্তানেরই মেয়েটি মা হতে চলেছে। আসছে সপ্তাহেই ওরা দুজন বিয়ে করছে। আমি ভাবলাম তুমি আর সিদ্ধার্থ এত ভালো বন্ধু, তুমি নিশ্চই এই আনন্দের খবর আগেই পেয়ে থাকবে।’

ঈশানীর কথা শেষ হওয়ার আগেই রিমা ফোনটা নামিয়ে রাখে। সত্যিই কি সিদ্ধার্থ তার সঙ্গে এমনটা করতে পারে? ঈশানীরই বা কী স্বার্থ থাকতে পারে মিথ্যা কথা বলায়। এত বড়ো বিশ্বাসঘাতক সিদ্ধার্থ, মেনে নিতে রিমার কষ্ট হয়। বসে থাকতে পারে না রিমা। হাত-পা মনে হয় যেন অবশ হয়ে আসছে। শুয়ে পড়ে বিছানায়। অনুভা, অরূপ কেউই পারেন না ওকে তুলে খাওয়াতে।

সন্ধের সময় রিমার এজেন্ট, রিমার খোঁজে বাড়িতে এসে পৌঁছোয়। অনুভা ওকে রিমার ঘরের দোরগোড়ায় ছেড়ে দিয়ে অন্য ঘরে চলে যান। কারণ উনি ভালো করেই জানেন বাড়ির লোকের সামনে কাজের কথাবার্তা রিমা একেবারেই পছন্দ করে না।

‘কী ব্যাপার রিমা? সকাল থেকে তোমার ফোন ট্রাই করছি, ধরছ না কেন?’ বলতে বলতে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে এজেন্ট। রিমার বিশ্রস্ত অবস্থা দেখে মুহূর্তেই বুঝতে পারে সিদ্ধার্থর খবর আগেই এসে পৌঁছেছে রিমার কানে।

রিমাকে উঠিয়ে বসায়। রিমা সামলে নিতে একটু সময় নেয়। ওকে সহজ করার জন্য বলে, ‘এত আপসেট হওয়ার কী আছে? এই ইন্ডাস্ট্রিতে এরকম ঘটনা ঘটতেই থাকে।’

‘রিয়েলি? সত্যিই আপনার মনে হয় আমার আপসেট হওয়া উচিত নয়?’

‘দ্যাখো রিমা, যা হয়ে গেছে ভুলে যাও। চামড়া মোটা না করলে এই ইন্ডাস্ট্রিতে টিকতে পারবে না। টিভির জগৎটাই আলাদা। রাতারাতি খ্যাতি, প্রতিপত্তি… কাল পর্যন্ত তুমি সকলের অজানা ছিলে আর আজ ঘরে ঘরে তোমায় নিয়ে আলোচনা তুঙ্গে। তোমার কাছে অর্থ আছে, খ্যাতি আছে, জনপ্রিয়তার স্বাদ সবেই পেতে শুরু করেছ। আর তোমার বয়সটাই বা কী? এখনও বহুদিন তোমাকে কাজ করতে হবে। সুতরাং এবার নিজের একটু যত্ন নাও। যত তোমার নামডাক হবে ততই তুমি সাধারণ মানুষের ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যাবে এবং এটাই তোমার জন্য ভালো হবে। আবেগে ভেসে কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়া তোমার অনুচিত। নিজেকে শক্ত করো। প্রেমে বিহ্বল হয়ে পড়ার মতো ফালতু সময় তোমার এখন নেই।’ এজেন্ট রিমাকে বোঝাবার চেষ্টা করে।

কিন্তু ইন্ডাস্ট্রিতে সবাই একইরকম হয় না। রিমা স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি সিদ্ধার্থ তাকে এভাবে ধোঁকা দেবে। এজেন্টের হাজার বোঝানো সত্ত্বেও রিমা বুঝতে পারছিল কাজে ঠিকমতো মন বসাতে পারছে না। হাতের মুঠোয় আসা ধারাবাহিকের লিড রোলটাও এই করে রিমার হাতছাড়া হয়ে গেল। মেলামেশা করাও বন্ধ করে দিয়েছিল রিমা। যে-ধারাবাহিকটায় ও কাজ করছিল তার কাজও প্রায় শেষ হওয়ার মুখে ছিল। হাতে কাজ না থাকলেও টিভির অভিনেত্রী হিসেবে তাকে নিজের ঠাটবাট বজায় রেখেই চলতে হচ্ছিল। হাতের জমানো টাকাও প্রায় শেষ হয়ে যাওয়ায় রিমা নিজের এজেন্টকে গিয়ে ধরে। মনে মনে ঠিকই করে নিয়েছিল রিমা, হাতে যা কাজ পাবে তাতেই রাজি হয়ে যাবে। এজেন্টের চেষ্টায় একটা রিয়ালিটি শো-তে কাজ করার সুযোগ হয়ে যায়। কাজটা পেয়ে রিমা খুশিও হয় কারণ সেটার পুরো শুট্-টাই বিদেশে হওয়ার কথা ছিল ফলে এই বাহানায় বিদেশ যাওয়ারও সুযোগ হয়ে যায় রিমার।

শো-তে গিয়ে রিমার আলাপ হয় রঞ্জনের সঙ্গে। রঞ্জন মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে এসেছিল মুম্বইতে মডেলিং করার স্বপ্ন নিয়ে। কিন্তু আশা সফল হয়নি। কাজের জন্য যখন হয়রান হয়ে সব জায়গায় ঘুরে বেড়াচ্ছে তখনই হঠাৎ করে এই শো-টার কাজ হাতে পায় রঞ্জন। বিদেশে একা থাকার কষ্টটাও লাঘব হয়ে যায় রিমার সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠার পর।

রিমার অবস্থাটাও খানিকটা রঞ্জনের মতোই হয়। ভালোবাসায় একবার অসফল হওয়ার পর রঞ্জনকেই আঁকড়ে ধরে রিমা। কয়েক মাস বিদেশের মাটিতে কাটিয়ে দেশে ফেরার পথে বিমানেই রঞ্জন রিমাকে প্রোপোজ করে, ‘রিমা তোমাকে আমি আমার পাশে পেতে চাই সারা জীবন। তোমাকে ভালোবাসি।’

রিমাকে মুখে ‘হ্যাঁ’ বলতে হয় না, ওর চোখে-মুখে উপচে পড়া আনন্দই রঞ্জনকে তার প্রত্যাশিত উত্তর দিয়ে দেয়।

দুজনে ঠিক করে মুম্বই ফিরে তারা একসঙ্গে থাকবে ভাড়া বাড়ি ছেড়ে দিয়ে। কথামতোই শোতে পাওয়া পুরো টাকা দুজনে একত্রিত করে এবং রঞ্জনের নামে লোন অ্যাপ্লাই করা হয় নতুন ফ্ল্যাট কেনা হবে বলে। রঞ্জন পরিষ্কার রিমাকে লোন নিয়ে মাথা ঘামাতে বারণ করে দিল, ‘তোমাকে টাকার লোন নিয়ে ভাবতে হবে না। প্রতি মাসে মাসে আমি ঠিক শোধ করতে থাকব টাকা। কিন্তু ফ্ল্যাটটা সাজাবার দায়িত্ব তোমার। ওই ব্যাপারে আমি কোনও কথা বলব না।’ রঞ্জনের দায়িত্ববোধ রিমার সব চিন্তা দূর করে দেয়। মনে শান্তি অনুভব করে রিমা।

মুম্বইতে এসেই রিমা নিজের এজেন্টের সঙ্গে যোগাযোগ করে রঞ্জনের কাজের জন্য। এজেন্টের সাহায্যে পরপর কাজও আসতে থাকে রঞ্জনের কাছে। নতুন ফ্ল্যাটে এসে ওঠে দুজনে। কাজ থেকে কিছুদিনের বিরতি নিয়ে রিমা ব্যস্ত হয়ে যায় নতুন ফ্ল্যাট সাজাতে। আশেপাশের প্রতিবেশীদের কাছে স্বামী-স্ত্রী পরিচয়েই ওরা লিভ ইন শুরু করে। দিনগুলো কাটতে থাকে স্বপ্নের মতো আর রাতের আঁধারে দুজনে ভাসতে থাকে উষ্ণ ভালোবাসায়। নরম বিছানা ছুঁয়ে পড়ে থাকা দুটো তপ্ত শরীর তৃপ্ত হওয়ার বাসনায় ভুলে যায় সমাজ, বাস্তব জগতটার কথা। বিয়ে শব্দটা অনাহূত অতিথির মতোই ওদের মনের গভীরে প্রবেশ করার পথ পায় না।

হুঁশ ফেরে যখন রিমা নিজের শরীরে নতুন একটি প্রাণের স্পন্দন অনুভব করে। কী পরিচয়ে বড়ো করবে সন্তানকে? এতো তার ভালোবাসার সন্তান, তবুও রিমা চিন্তা করে, সমাজ কি রিমার মনের কথা বুঝবে?

রাতে রঞ্জন বাড়ি ফিরলে, বিছানায় শুয়ে রঞ্জনের হাতটা রিমা নিজের পেটের উপর টেনে আনে। মুহূর্তে রঞ্জন বুঝে যায় ইঙ্গিতটা। তার সন্তান রিমার গর্ভে। আনন্দে রিমার নরম শরীরটা নিজের শরীরের উপর টেনে নেয় রঞ্জন। চুম্বনে ভরিয়ে দেয় রিমাকে।

‘আমাদের বিয়েটা এবার করে নেওয়া উচিত রঞ্জন’, অতিকষ্টে রঞ্জনের বেষ্টনী থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে রিমা বলে।

‘হ্যাঁ, আমারও তাই মনে হয়। আমিও তাড়াতাড়ি সব অনুষ্ঠান করে নিতে চাই। সকালেই প্রয়োজনীয় কথাবার্তা বলে ব্যবস্থা করব। এই মাসের মধ্যেই শুভদিন দেখে…।’

দশ-বারো দিন স্বপ্নে ভেসে কাটার পর একদিন হঠাৎই বাড়ির ল্যান্ডলাইন নম্বরটা বেজে ওঠে। সাধারণত প্রয়োজনে সকলেই মোবাইল ব্যবহার করায় এই ফোনটার উপস্থিতি রিমা প্রায় ভুলতেই বসেছিল। বাজতেই চমকে ওঠে রিমা। উঠে এসে ফোনটা তুলে নেয় হাতে, ‘হ্যালো!’ মন দিয়ে শোনে ওপাশের মহিলা কণ্ঠস্বর কী বলতে চায়, তারপর আবার বলে, ‘কিন্তু রঞ্জন তো এখন বাড়ি নেই। আপনি কে বলছেন বলুন, ও এলে আমি ওকে বলে দেব।’

কণ্ঠস্বর ভেসে আসে, ‘আমি ওর পুরোনো বান্ধবী। ওর সঙ্গে দেখা করে সারপ্রাইজ দিতে চাই। যদি ঠিকানাটা দেন খুব ভালো হয়।’

রিমা ফ্ল্যাটের ঠিকানাটা দিয়ে দেয় সামান্য ইতস্তত করে।

সন্ধের অন্ধকার ঘনাতেই কলিং বেল বেজে ওঠে। রিমা দরজা খুলতেই অচেনা একটি মেয়ে ঘরে এসে ঢোকে রিমাকে একপ্রকার ঠেলে দিয়েই। রঞ্জনকে দেখেই মেয়েটি রঞ্জনের গালে সপাটে একটি চড় কষিয়ে দেয়, ‘তোমার সাহস কোথা থেকে হয় যে আমাকে বিট্রে করে অন্য একটি মেয়ের সঙ্গে ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখছ। ভুলো না তোমার বাবা আমার ড্যাডের আন্ডারে কাজ করে। ড্যাডের একটা কথায় যদি তোমার বাবার চাকরি যায় তাহলে তোমার অবস্থাটা কী হবে ভাবতে পারছ? একটা রাস্তার মেয়ের জন্য আমায় চিট করার স্বপ্ন যদি দেখে থাকো, তাহলে আমিও তোমার এবং তোমার এই গার্লফ্রেন্ডের কি দুর্দশা করব তুমি ভাবতেও পারবে না।’

এই ঘটনা রিমার জীবন থেকে সমস্ত আনন্দ ছিনিয়ে নিয়ে ওর জোড়া লাগা হূদয়টাকে আবার দুমড়ে মুচড়ে রক্তাক্ত করে তোলে। রঞ্জনকে জিজ্ঞেস করেও পরিষ্কার জবাব পায় না। দুজনে একসঙ্গে থেকেও সম্পূর্ণ আলাদা দুটো মানুষ। রঞ্জনের ব্যবহারে স্পষ্ট হতে থাকে রিমার প্রতি তার উদাসীনতা। রাগের মাথায় গায়ে হাত তুলতেও দ্বিধা করত না রঞ্জন।

গর্ভাবস্থায় এই মানসিক স্থিতি ধীরে ধীরে রিমাকে ডুবিয়ে দেয় অবসাদে। নিজেকে অসহায় মনে করা শুরু করে রিমা। তার মনে হতে থাকে, কী লাভ এই সৌন্দর্যের? সারা পৃথিবীতে কারও কাছ থেকেই তো এতটুকু ভালোবাসা সে পেল না। এত কিছু হয়ে যাওয়ার পর আর কী ভালোবাসা পাওয়া সম্ভব? অর্থ এবং খ্যাতির জন্য রিমা বাড়ি ছেড়েছিল, কিন্তু মানুষের চাহিদার কি কোনও শেষ আছে? এরপর জীবনে প্রেমকে আঁকড়ে ধরতে চেয়েছিল রিমা। সেটাও যখন পুরোপুরি পেয়ে গেছে মনে করতে শুরু করেছিল রিমা– রঞ্জনের সঙ্গে সংসার বাঁধার স্বপ্ন দেখেছিল– স্বপ্ন দেখার অপরাধ করেছিল, তখনই সব শেষ হয়ে গেল।

খবরের কাগজে বড়ো বড়ো করে ছাপা খবরটা অনুভার দৃষ্টি এড়াল না, ‘টিভির পর্দার বিখ্যাত অভিনেত্রী রিমার মৃতদেহ উদ্ধার তাঁর নিজের ফ্ল্যাট থেকে। সন্দেহ করা হচ্ছে তিনি আত্মহত্যা করেছেন। বিস্তারিত খবর তিন-এর পাতায়।’

 

লাইটহাউস

সানগ্লাসটা তাড়াতাড়ি চোখের উপর টেনে নিল কুমকুম। সে তার চোখের জল, এমনকী সমুদ্রকেও দেখাতে চায় না। ঢেউগুলো তার পায়ের পাতা ছুঁয়ে গুঁড়িয়ে যাচ্ছিল, পরমুহূর্তেই আবার একটা ঢেউ। তার মনে হল, অনুপম তাকে এইটাই দেখাতে এনেছে। একটা ঢেউয়ের ব্যর্থতা, পরবর্তী ঢেউয়ের নাছোড় উদ্যম। এভাবেই তাকে বাঁচতে শিখতে হবে।

এত ভেবেও সে ফোনটা না করে পারল না।

‘কি করছিস বেটা?’

ওপারে উত্তজিত গলায় মিষ্টি বলল, ‘মা, পায়েস করছি। জাস্ট ইমাজিন। লাইফে প্রথম। তোমার জামাইয়ের জন্মদিন তো। একটু পরে তোমায় সঙ্গে কথা বলছি। দুধটা নাকি ননস্টপ নেড়ে যেতে হবে, ও বলে গেল।’

কুমকুম দেখতে পেল তার মেয়ে হাতা দিয়ে সমানে দুধ নেড়ে যাচ্ছে। সে বলল, ‘রজত বেরিয়ে গেছে? কী বানিয়ে দিলি? তুই ব্রেকফাস্ট করেছিস বেটা?’

‘ওঃ মা, ছোলে চাউল, ছোলে চাউল। পরে তোমার সঙ্গে কথা বলছি।’ ব্যস্ত গলায় ফোন ছেড়ে দেয় মিষ্টি।

আবার সেই অবিশ্রান্ত ঢেউ। অবশ্য বেশিক্ষণ দেখতে হবে না। এখুনি পরের স্পটে যেতে হবে। তারপর আর একটা স্পট, তারপরও একটা। অনুপম আক্ষরিক অর্থেই নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরাচ্ছে তাদের। দাদাভাই, দিদিভাই তো অনেক স্পটে নামছেই না ভয়ে।

‘না রে, তোরা যা। আমরা এখানেই বসি। ওই তো চায়ের দোকান একটা। দেখি লাল চা পাওয়া যায় কিনা।’ এইসব বলে কাটিয়ে দিচ্ছে।

কুমকুম পারছে না ওরকম। সে কোথাও হাঁটু ব্যথা, বুক ধড়ফড়ের অজুহাতে নামতে না চাইলে অনুপম হই হই করে উঠছে, ‘আরে তোমার জন্যেই তো আসা। নইলে আমি তো অফিস টুরে তিন বছর আগেই…।’

সবাই ভাবছে কুমকুমকে ভোলানোর জন্যেই এই ভ্রমণের ললিপপ ধরিয়ে দিয়েছে অনুপম। অথচ ব্যাপারটা ঠিক সেরকম নয়।

দাদাভাই আর দিদিভাই যাচ্ছিল চোখ দেখাতে চেন্নাই। ফেরার পথে ওদের ইচ্ছে আরাকু ঘুরে আসে। দক্ষিণের এইটুকু বাকি আছে ওদের। ফেরার পথে দমদমে ওদের ফ্ল্যাটে কয়েকদিন থেকে শিলিগুড়ি ফিরবে। অনেক আগে থেকেই ঠিকঠাক এসব। টিকিটও কাটা। হঠাৎ এক রাতে দাদাভাইয়ের ফোন। ‘তোরাও চল ভাইজাগ, আমরা চেন্নাই থেকে চলে আসব। পাশাপাশি দুটো ডাবল রুম বুক করে ফেল।’

অনুপম ক্ষীণ আপত্তি তুলেছিল। টিকিট পাওয়া অসম্ভব, কুমকুম আজকাল কোথাও বেরোতেই চায় না, মিষ্টিদের আসার কথা সামনে। দাদাভাইয়ের জোরের কাছে কোনও আপত্তিই টেকেনি।

যাদের জোরাজুরিতে এখানে আসা, তারা অনেক জায়গা স্রেফ গাড়িতে বসেই দেখে নিচ্ছে। কুমকুমের মন ভালো করার পাশাপাশি অনুপম আর কুমকুমকে খানিকক্ষণ একলা ছেড়ে দেওয়ার এক কৌতুকও কি কাজ করছে না ওদের মধ্যে?

অথচ অনুপম এখন তার ধারেকাছেও নেই। খটখটে রোদ্দুরে, শুনসান ইরাডা বিচে সে একরকম একাই দাঁড়িয়ে, অনুপম সেই কোথায় পাহাড় ঘেঁষে বড়ো বড়ো পাথর টপকে টপকে চলেছে। ওখানে নাকি ঝাঁকে ঝাঁকে লাল কাঁকড়া আছে। থাক, কুমকুম যাবে না। ওই পাথর সে টপকাতে পারবে না। তাছাড়া কাঁকড়ার জ্বালা সে কি কম বুঝছে? বুকের মধ্যেটা সবসময় জ্বলে যাচ্ছে। মিষ্টিকে ছেড়ে থাকতে এত কষ্ট হবে আগে বুঝতে পারেনি তো।

সানগ্লাসটা খোলে কুমকুম। একেবারে ঝাপসা হয়ে গেছে। চোখ মোছে। এই এত বড়ো একটা তটে সে প্রায় একা– যেমন একা ওই আকাশ, দুপুরের পড়ন্ত রোদ। অনুপম দূরে যেতে যেতে একটা ছোট্ট বিন্দু হয়ে গেছে। এত ছোট্ট, যেন আঙুল দিয়ে মুছে ফেলা যায়।

কুমকুমের মনে পড়ল তার কাঁধের ব্যাগে একটা বায়নোকুলার আছে, বার করলেই হয়। এটা মিষ্টির খুব আদরের জিনিস। বাবার কাছে বায়না করে আদায় করেছিল। অনুপম তাই বলে বায়নোকুলার নয়, বায়নাকুলার। এত প্রিয়, তবু নিয়ে যায়নি মিষ্টি যাবার সময়। এখন আরও কত নতুন মডেল বেরিয়েছে। কত পাওয়ারফুল। অনেকদূর পর্যন্ত দেখা যায়। মিষ্টি কিন্তু এতেই সন্তুষ্ট ছিল। মেয়েটা কখনও সাধ্যাতীত জিনিসের বায়না করেনি। জানত, বাবার মাপা রোজগার। মা কত হিসেব করে চলে।

সেবার পুজোয় কত দ্বিধা করে একটা আনারকলি চুড়িদার চাইল। তাও অর্ধেক টাকা নিজের জমানো ফান্ড থেকে দিল। সেই সাধের চুড়িদারও নিয়ে যায়নি মেয়ে।

‘আরে এখানে থাক। আমি আসব তো মাঝে মাঝে। এসে থাকব। তখন কি সব বয়ে বয়ে আনব? নাকি ভাবছ একেবারে বিদায় করে দিচ্ছ?’

কত দূরে বিয়ে হল, তাও বায়না ধরেনি কাছে দাও বলে। হয়তো দিল্লি বলেই করেনি। বছর আটেক তো ওখানেই কেটেছে। এখানেই বরং ওর ভালো লাগত না। দমদমের ঘিঞ্জি রাস্তা, নোংরা, জ্যাম কোনওদিনই মানিয়ে নিতে পারেনি।

যতই চেনা জায়গা হোক, তবু কুমকুমের বুক কাঁপে। কী যে সব হচ্ছে। সেদিন বাসের মধ্যে ২০-২১ বছরের মেয়েটা, মিষ্টিরই বয়সি…! বায়নোকুলার চোখে লাগায় কুমকুম। অনুপমকে খোঁজে। কোথায় অনুপম? তার কোনও চিহ্ন নেই। সে খানিকটা আনমনে সমুদ্র, আকাশ, নারকেলের সারি দেখে যায়। হঠাৎ তার বায়নোকুলার থমকে যায় একটা বিন্দুতে। এই ইরাডা বিচে সে তাহলে একা নয়। ওই তো গোলাপি ফ্রক পরা দস্যি মেয়েটা দৌড়োচ্ছে, পেছন পেছন ছুটছে তার মা। মোটাসোটা চেহারার, সে দৌড়ে বিশেষ সুবিধে করতে পারছে না। কুমকুমের চোখে হাসি খেলে যায়।

ওই তো দশ-পনেরো বছর আগের কুমকুম। সে অমনিই মোটা চিরকাল, আর মিষ্টি বরাবরই রোগা-পাতলা। তার খুব কৌতুহল, বিয়ের জল মিষ্টির গায়ে লাগে কিনা। রজতরা প্রবাসী বাঙালি, ভিলাইয়ের। ওদের খাবার ধরনটাও অবাঙালিদের মতো হয়ে গেছে। ছোলে, রাজমা, কালি ডাল, পনির মশলা। গাদাগুচ্ছের ঘি আর প্যাকেটের মশলা ঢাললেই রান্না হয়ে গেল। মাছ প্রায় খেতেই পায় না মেয়েটা। রজত রুই ছাড়া মাছ চেনেও না কিছু। তাতেও মেয়ের কোনও অভিযোগ নেই। যখনই ফোন করে কুমকুম, তখনই মেয়ে ওইসব আগড়ম-বাগড়ম রাঁধছে। কী রেঁধেছে যেন বলল সকালে, ‘ছোলে চাউল!’ ইস্! পারশের ঝাল খেতে কি যে ভালোবাসত!

দাদাভাই আর দিদিভাই তাদের সঙ্গেই ফিরবে। কুমকুম ভালো করেই জানে, ফেরার পথে ট্যাক্সি থেকে বাজারমোড়েই নেমে যাবে অনুপম, একরাশ বাজার করে ফিরবে। এমন নয় যে এখানে এসে তারা দক্ষিণী তেঁতুলগোলা খাবার খেয়েছে। বাঙালি হোটেল, ভাত-মাছ চলেছে দুবেলাই। কিন্তু ওই যে– বাই। আর আনবেও সেই মিষ্টির প্রিয় মাছগুলোই, পারশে, পমফ্রেট, ভেটকি– সেগুলো ধুতে ধুতে, হলুদ মাখাতে মাখাতে, তেলে ছাড়তে ছাড়তে খানিকটা কেঁদে নেবে কুমকুম। দুপুরে একা ঘরে খেতে বসে সে মাছ কিছুতেই মুখে তুলতে পারবে না, শুধু নাড়াচাড়া করবে। দুপুরে তো একবার ফোন করবেই মিষ্টি। খেয়ে উঠতে উঠতে আসবেই ওর ফোন।

‘খেয়েছ তো? নাকি শুধু কেঁদেছ?’

‘খেয়েছি রে বেটা খেয়েছি। আজ সব তোর ফেভারিট ডিশ। কলমি শাক, পোস্ত আর পারশের ঝাল।’

‘পারশে! সরষে দিয়ে করেছ তো?’ প্রায় লাফিয়ে ওঠে মিষ্টি। এত কষ্ট হয় তখন। কিন্তু পরক্ষণেই মেয়ে অন্য প্রসঙ্গে চলে যায়।

‘জানো মা, আমি কী খেলাম?’ শোনার কোনও উৎসাহ থাকে না কুমকুমের। সেই তো ঘি জবজবে ডাল, নয় পনির, বড়ো জোর আন্ডা কারি। রাতে ধরাবাঁধা চিকেন। তবে মঙ্গলবার বাধ্যতামূলক নিরামিষ। ওখানে গিয়ে হনুমানের পুজো ধরেছে মিষ্টি, পাশের ফ্ল্যাটের একটা মেয়ের দেখাদেখি। হনুমানচালিশা না পড়ে মেয়ে জল খায় না। ভাবো! মাছ তো পনেরো দিনে একবার আসে, তাও রুই। কুমকুম তবু ক্ষীণ গলায় জিগ্যেস করে, ‘কী খেলি বেটা?’

‘ভাপা ইলিশ।’

‘ভাপা ইলিশ!’ চমকে ওঠে কুমকুম। কে আনল আর কেই বা রাঁধল!

‘তুমি ভাবছ রজত ইলিশ কিনেছে? চিনলে তো। ওই যে পাশের ফ্ল্যাটে শম্পা আছে না, ওরা খুব মাছ খায় মা। আর কি মুশকিল জানো, প্রায় দুপুরেই আমাকে দিয়ে যাবে। আমি ওকে একদিন ভালো করে খাওয়াব ভাবছি।’

‘খাওয়াস।’

‘জানো মা, ও আসা থেকে একদিনও বাপের বাড়ি যায়নি। তিন বছর! জাস্ট ভাবো। খুব কাঁদে জানো মা। মাকে ছেড়ে থাকেনি তো কখনও। একটা ভাই আছে। ক্লাস এইটে পড়ে।’

কুমকুম অস্ফুটে বলে ‘আমার যে তাও নেই বেটা। আমি কি নিয়ে থাকি বলত?’

রোজ দুপুরেই এভাবে ভাতে অনেকখানি অশ্রু মিশে যায়। ওখানে মিষ্টি কেমন থাকে, সত্যি কেমন আছে কে জানে। যা চাপা মেয়ে। সারাক্ষণই অন্যদের কথা বলে যায়। রজতের কথা, শম্পার কথা। আর কি উত্তেজিত গলা, যেন কি দারুণ একটা খবর দিচ্ছে মাকে।

কুমকুমের মুখে এক চিলতে হাসি ফুটে ওঠে। মিষ্টি আসলে এখনও ছেলেমানুষই থেকে গেছে। সাত তাড়াতাড়ি ওর বিয়েটা না দিলে যেন চলত না। অনুপমের যত বাড়াবাড়ি। কি, না ইন্টারনেটে ম্যাচিং, একেবারে রাজযোটক।

ইন্টারনেট কি ঠিকুজিকুষ্ঠি– এসব নিয়ে কোনও আগ্রহ নেই কুমকুমের। সে শুধু চেয়েছিল মেয়েটা কাছাকাছি থাক। একটাই তো সন্তান। একদম বাড়ির পাশে চায়নি। দু-তিন ঘন্টায় পৌঁছে গিয়ে মেয়ের মুখটা দেখে আবার ফিরে আসা যাবে– এমনটা হলে কি ক্ষতি হতো! তা নয়, একেবারে দিল্লি! কথায় বলে, ‘কোনওকালে নেই ষষ্টীপুজো, একেবারে দশভুজো!’

অবশ্য দিল্লি একেবারে অচেনা জায়গা নয় তাদের, বছর আষ্টেক ছিল তারা ওখানে, আর্মি কোয়ার্টারে। মিষ্টি তো ওখানেই বড়ো হল। স্কুলে পড়ল বছর চারেক। যদিও কুমকুম কলকাতায় ফেরার জন্যে ছটফট করত। অনুপমদের বাড়িটাকে কেন্দ্র করে পাঁচ কিলোমিটার ব্যাসার্ধের একটা বৃত্ত আঁকলে সেই বৃত্তের পরিসীমার মধ্যেই তার সব আত্মজন– বাপের বাড়ি, দিদি, বোন, দুই ননদ। অনুপমের অবশ্য সেরকম টান ছিল না ফেরার। ছোটোবেলায় বাবা-মাকে হারিয়েছে। হস্টেলে মানুষ। অল্প বয়সেই মিলিটারিতে ঢুকেছে। লোকটার যেন কোনও শেকড় নেই। নইলে একমাত্র মেয়েকে কেউ অতদূরে বিয়ে দেয়? রজতকে নাকি আবার কানাডায় পাঠাবে অফিস থেকে। মিষ্টিকে না নিয়ে কি ও যাবে? আর একবার ওখানে গেলে কেউ ফেরে না, জানে কুমকুম। এই তো তার মাসতুতো দাদা, বাবুলদা, তার ছেলে-বউ মন্ট্রিয়েল-এ চলে গেল। যাবার সময় বলল, দু’বছরের বন্ড, শেষ হলেই চলে আসবে। তারপর কত দু’বছর কেটে গেল। ফিরল না। এমনকী বাবুলদা যখন চলে গেল, তখনও আসতে পারল না। এল তিনমাস পরে শীতে। ওদের আর এ দেশের সামার সহ্য হয় না। তার মিষ্টিও যদি… বুকটা ধড়াস করে ওঠে কুমকুমের।

ধুৎ! কত বাড়িয়ে ভেবে ফেলছে সে। অনুপম বলে ফালতু চিন্তা মাথা থেকে বার করে দিতে। তার হার্ট একটু কমজোরি। ইদানীং একটা চিনচিনে ব্যথা হচ্ছে। গ্যাসের ব্যথা ভেবে এতদিন পাত্তা দেয়নি সে। এবার ভাবছে ফিরে গিয়ে কার্ডিওলজিস্ট দেখাবে। দিদিদের পাড়ায় বসে ডা. মনোজিৎ জানা। দেবতুল্য ডাক্তার।

বায়নোকুলারটা আবার চোখে লাগিয়ে চমকে ওঠে কুমকুম। একি! বাচ্চা মেয়েটা যে ক্রমশ জলে নেমে যাচ্ছে। সে চেঁচিয়ে ওঠে, ‘এই বেটা, বেটা, যায় না, ঢেউ টেনে নিয়ে যাবে।’

মা ছাড়া অন্য কারও স্বরে থমকে দাঁড়ায় মেয়েটা। দুটো বিনুনি, চুলে বার্বি ক্লিপ, গোলাপি রিবনে ওকে অবিকল প্রজাপতির মতো দেখায়। অনুপম এই প্রজাপতিটাকে না দেখে লাল কাঁকড়ার খোঁজে গেছে। পারেও বাবা!

সে আবার বলে ‘এসো বেটা, চকোলেট দেব, এসো।’ মিষ্টির জন্যে ব্যাগে চকোলেট রাখার অভ্যেস এখনও রয়ে গেছে কুমকুমের। এই সব জার্নিতে চকোলেট খুব কাজে দেয়। আরাকু ভ্যালির ওই লম্বা রাস্তায় চকোলেট খেয়ে খেয়েই তো সে খিদে সামলেছে। বুকের ব্যথাটার জন্যে সে বোরা কেভ-এ নামেনি। দাদাভাই, দিদিভাই তো নয়ই। অতগুলো সিঁড়ি ভাঙা ওদের পক্ষে অসম্ভব। ওরা দুজনে কফি খেল আর সে বসে বসে চকোলেট। দাদাভাই কিনে দিয়েছিলেন কফি চকোলেটের অনেকগুলো স্ল্যাব আরাকু থেকে। তারই একটা বার করে মেয়েটাকে দেখাল কুমকুম। চকোলেটের টানেই হোক কিংবা অচেনা মানুষের আকর্ষণে– মেয়েটা ছুটে ছুটে তীরের দিকে আসছিল। ওর মা-ও এসে পড়ল থপথপ করে। ‘দেখছেন তো? এই মেয়ে নিয়ে কোথাও যাওয়া যায় বলুন?’

কুমকুম হাসি-হাসি মুখে তাকিয়ে রইল মায়ের দিকে। মেয়েটা এসে ততক্ষণে ওর বুক ঘেঁষে দাঁড়িয়েছে।

‘তুমি ব্যাগে চকোলেট রাখো কার জন্যে?’ কুমকুমের আবার চোখে জল আসছিল। সেটা সামলে সে চকোলেটটা মেয়েটার হাতে দিয়ে বলল, ‘তোমার জন্যে বেটা।’

‘মা দ্যাখো, আন্টি আমাকে বেটা বলছে!’

‘আপনারা ওয়েস্ট বেঙ্গলের বাইরে থাকেন বুঝি?’

কুমকুম জবাব দেবার আগেই অনুপম ডাকল ‘চলে এসো, ড্রাইভার তাড়া দিচ্ছে।’

অনুপম কখন লাল কাঁকড়া ছেড়ে এদিকে চলে এসেছে খেয়াল করেনি কুমকুম। দেখতে পেয়ে সে বলল ‘এদিকে শোনো না। দ্যাখো এই নান্হি পরিটাকে। ছোটোবেলায় মিষ্টি ঠিক এইরকম ছিল না?’

অনুপম রুক্ষস্বরে বলল ‘চলে এসো, এরপর লাইটহাউস বন্ধ হয়ে যাবে।’

কুমকুম অপ্রস্তুত হেসে বলল ‘চলি ভাই, এই ড্রাইভারগুলো সব ঘোড়ায় জিন দিয়ে আসে। চলি রে বেটা।’ মেয়েটার গালে আলতো হাত ছুঁইয়ে আর এক মুহূর্তও দাঁড়াল না কুমকুম। বালির ওপর দিয়ে ওর দ্রুত হাঁটার চেষ্টা দেখে ফ্যাকাশে হাসল মা। মেয়ে তার হাত টেনে বলল ‘রান। আমাদেরও তো লাইটহাউস চড়তে হবে।’

কুমকুমের মুড অফ হয়ে গেছিল। অনুপমটা মাঝে মাঝে এত অভদ্র হয়ে যায়। তার ইচ্ছে করছিল দাদাভাই, দিদিভাইয়ের সঙ্গে বসে থাকতে। কিন্তু অনুপম তাকে বসতে দিলে তো? লাইটহাউস নাকি বন্ধ হয়ে যাবে।

কুমকুমের বুকে আবার ব্যথা করছিল। সে আর কিছু বলল না। লোহার ঘোরানো সিঁড়ি বেয়ে বেয়ে বহু কষ্টে ওপরে উঠে সে অবশ্য মুগ্ধ হয়ে গেল। সমুদ্রটা কি অপূর্ব লাগছে এখান থেকে! পড়ন্ত আলোর আভা জলের ওপর। কিন্তু কি হাওয়া, বাব্বা! তার মতো মোটা মানুষকেও উড়িয়ে নিয়ে যাবে মনে হয়। ভয়ে সে বসে পড়ল রেলিং ধরে। বসে বসে আরও ভালো লাগছিল সব কিছু। এই প্রথম বেড়ানোটা সে এনজয় করছিল। মিষ্টির কথা মনে পড়ে কোনও কষ্ট হচ্ছিল না তার। মনে হচ্ছিল, সব মানুষেরই মাঝে মাঝে এতটা উঁচু থেকে পৃথিবীটাকে দেখা দরকার। দু-তিনটে ছেলেমেয়ে ছিল ওপাশে। মেয়েটা তার সাদা ওড়না ধরে আছে। ওড়নাটা পতপত করে উড়ছে, ছেলেটা ছবি তুলছে। কুমকুম কৌতুকের সঙ্গে দেখছিল। এমন সময় একটা দুষ্টু-দুষ্টু মুখ লাইটহাউসের দরজা দিয়ে উঁকি দিল।

‘আন্টি!’

কুমকুমের বুক ধড়াস করে উঠল ‘বেটা! তুই একা এসেছিস?’

মেয়েটা দাঁড়িয়ে পড়ে লাফাতে লাফাতে বলল ‘মা উঠতেই পারছে না। যা মোটা! তোমার থেকেও মোটা!’

কুমকুম ভয় পেয়ে বলল ‘বসে পড় বেটা, তুই যা রোগা, হাওয়ায় উড়ে যাবি!’

মেয়েটা কোনও কথাই শোনার পাত্রী নয়। সে পুরোটা ঘুরে দেখবে। নীচ থেকে ওর মা’র কাতর গলা শোনা গেল।

‘একটু দেখবেন প্লিজ মেয়েটাকে। আমি হাফ উঠে আর উঠতে পারছি না।’

অনুপম এক মনে ছবি তুলছিল। হঠাৎ সে ঘুরে মেয়েটার হাত চেপে ধরল। কুমকুমের বুক ঢিপঢিপ করছিল। আবার না কড়া কড়া কথা বলে অনুপম। অনুপমের হাতে বন্দি মেয়েটা ছটফট করছিল যেন দৈত্যের হাতের মুঠোয় একটা পাখি। হঠাৎ অনুপম হাঁটু গেড়ে ওর সামনে বসে পড়ল। এখন ওর আর বাচ্চাটার মাথা সমান সমান। মেয়েটা অবাক হয়ে চেয়ে রইল ওর দিকে। কুমকুম শুনল অনুপম বলছে ‘লাইটহাউস কাকে বলে জানিস?’

‘ওই যে আলো দেখায়।’

‘কাদের?’

‘শিপগুলো যখন নাইটে কিছু দেখতে পায় না।’

‘দেখবি, লাইটহাউস কী করে কাজ করে?’

অমনি মেয়েটার চোখ চকচক করে উঠল। সে কুমকুমের দিকে চেয়ে হাসল। জয়ের হাসি। তারপর অনুপমের হাত ধরে দরজা গলে কলকব্জা বুঝতে গেল। কুমকুমের দু’পা টনটন করছিল। সে দু’পা ছড়িয়ে বসল। মেয়েটার ওড়না উড়ে গেছে। সেই নিয়ে কি ভীষণ হাসাহাসি ওদের। অচেনা ভাষা, তবু ওদের কথাগুলো ছুঁতে পারছিল কুমকুম। দূরে তখন সূর্য ডুবছে। তবু চারপাশে যথেষ্ট আলো।

 

সার্কাসের দুর্গা

লোহার জালের বেড়াটা আট-দশ ফুট মতো হবে। এইটুকু ডিঙোনো কোনও ব্যাপার নয়। এখনও হাত-পা নিশপিশ করে। ঝুলন্ত গাছের ডাল দেখলে এই আটষট্টি বছর বয়সেও ওরাংওটাং হ’তে ইচ্ছে করে কৃষ্ণলাল বোসের। রেললাইন দেখলে দুপাশে দুহাত পাখির ডানার মতো ছড়িয়ে দিয়ে একটা লাইনের উপর দিয়ে ব্যালান্সের খেলা দেখাতে দেখাতে ছুটে যেতে ইচ্ছে হয়। ইচ্ছে হলেও আজকাল উপায় থাকে না। প্রথমত রেললাইন পাওয়া যায় না, দ্বিতীয়ত পাবলিক এই স্পোর্টসম্যান স্পিরিটের মর্যাদা দেয় না।

কিছুদিন আগেই তো কলকাতার বাবুঘাটে চক্ররেলের লাইনের উপর দিয়ে ছুটতে গিয়ে একবার একটু পড়ে গেলেন, রেলের পাথরে হাত-পা ছড়েও গেল। পাঁচ পাবলিক এল, ধরে তুলল, আর বলল – এই বুড়ো বয়সে এমন কম্ম করতে গেলেন কেন মশাই? মাথাটা ঠিক আছে তো? কেউ বলল– পাগলদের দেখে বোঝা যায় না, পাগল নানারকম হয়। ভদ্র পোশাকেরও পাগল হতে পারে। কৃষ্ণলাল কী করে বোঝাবেন ওদের, ওর রক্তের মধ্যে সার্কাস মিশে আছে, সার্কাস। ট্রাপিজ, টানটান তার, এক চাকার সাইকেল। বয়ে যাওয়া রেল লাইন মানে দিগন্ত বিস্তারিত ব্যালান্সের খেলা।

এই লোকগুলোকে কি তখন বলা যেত– মাননীয়গণ, আমি উড়ন্ত মানুষের খেলা দেখাচ্ছি। এই সরু লোহার রেললাইন হ’ল একটা রানওয়ে। দু-হাত ছড়িয়ে দিলাম আমার দু-দিকে, ঈগলের মতো, ঈগল কেন, এরোপ্লেনের মতো। শো…শো…শো… মিউজিক, বিউগল, ট্রাম্পেট, ডানদিকে বাঁদিকে দু-টো জোকার, ওরাও ওড়ার চেষ্টা করতে গিয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে যাচ্ছে, আমি প্রফেসর কেএল বোস। এবারে শোঁ করে আকাশে উড়ব। মানে লাফ দিয়ে ধরে নেব ঝুলন্ত দোলনা। দিস ইজ গ্রেট প্যারাডাইস সার্কাস। পড়ে যাবার পর গায়ের ধুলো ঝাড়তে ঝাড়তে তো আর বলা যায় না, আমিই ছিলাম প্রোপ্রাইটার অফ গ্রেট প্যারাডাইস সার্কাস। বাংলা-বিহার-ওড়িশা দাপিয়ে শো করেছি এককালে। অসমে, ত্রিপুরায়। মানুষ অপেক্ষা করে বসে থাকত প্রফেসর বোসের সার্কাস কবে আসবে। উড়ন্ত চাকির খেলা অথবা কৃষ্ণের সুদর্শন চক্র, অভিমন্যুর যুদ্ধ অথবা তির আর ঢালের খেলা… চারিদিক থেকে তির মারা হচ্ছে আর সার্কাসম্যান ঢাল দিয়ে তির ঠেকাচ্ছে। মহিষাসুরমর্দিনীও ছিল। বিজয় মাহাতো ছিল অসুর। ও ছৌ নাচ জানত। পুরুলিয়ার রঘুনাথপুরে শো করতে গিয়ে ওকে পাওয়া গিয়েছিল। কী দারুণ ডিগবাজি খেত। দলের লোকেরা বলত মিস্টার তিড়িং। আর দেবী দুর্গা করত দুগ্গি। ওর ভালো নাম কিন্তু দুর্গা-ই। গোল মুখের মেয়ে। দুগ্গি ছিল তিড়িং-এর বউ।

বিজয় মাহাতোর ছৌ নাচ দেখে যখন সার্কাসে আসার প্রস্তাব দিয়েছিল কৃষ্ণলাল, বিজয় বলেছিল– আমার বিহা করা পরিবার আছে, আমি সার্কাসে গেলে উ মেয়াটা থাকবে কী করে? কৃষ্ণলাল বলেছিল বউকেও নিয়ে এসো। তাঁবুতে অনেক কাজ আছে। কাজ তো ছিলই। রান্না ঘরে কাজ ছিল, পাখিদের দানা খাওয়ানো, ঘোড়ার ঘাস কাটা, কত কী। পরে দেখা গেল দুগ্গি নাচতেও পারে। দুগ্গি ঝুমুর নাচত। ওর শরীরটা খুব আঁট ছিল। চিতাবাঘের খাঁচার সামনে দাঁড়িয়ে দুর্গার কথা মনে হয় কৃষ্ণলালের। লম্বা গড়ন, সরু কোমর, টানা চোখ, ভরাট বুক। দলের লোকেরা বলত কালোবাবু একটা ডাঁসা মেয়েছেলে আমদানি করেছে গো…।

কৃষ্ণলাল বোস মানে তো কেএলবি। তিনি কেলোবাবু বলেই খ্যাতিমান হলেন। রংটা কালোই, পাঁচ ফুট দশ ইঞ্চি লম্বা, চওড়া কাঁধ। ভদ্রঘরের ছেলে। বাবা ছিলেন সাহেবি অফিসের বড়োবাবু। শীতকালে ধুতির উপর কোট চড়াতেন। সে সময় মুড়ি চিঁড়ে দুধকলার যুগে মাখন পাউরুটি জ্যাম জেলিতে ব্রেকফাস্ট হতো। বউবাজারের বক্সিং ক্লাবে ভর্তি করিয়ে দিয়েছিলেন। কৃষ্ণলালের জিমনাস্টিক আর জাগলিং-এ উৎসাহ তৈরি হয়েছিল। নানা ধরনের জাগলিং-এ পারদর্শী হয়ে উঠলেন। বলের খেলা, বোতলের খেলা, আস্তে আস্তে ধারালো ছুরির খেলা, নানারকম ব্যালান্সের খেলা…। বিএ পাশটাও করে ফেললেন। ওর বাবা চেয়েছিল সাহেবকে বলে চাকরিতে ঢুকিয়ে দেবেন, কিন্তু কৃষ্ণলাল বলল চাকরি করব না, জাগলিং করব। গ্রেট এশিয়ান সার্কাসে ঢুকে পড়লেন। তারপর নিজেই সার্কাসের দল করে ফেললেন। সে অনেক কথা, অন্য ইতিহাস।

আসলে সার্কাস ছিল কৃষ্ণলালের রক্তে। ওর পিতামহ ছিলেন প্রিয়নাথ বোস। গ্রেট বেঙ্গল সার্কাসের প্রতিষ্ঠাতা। বাঙালির নিজস্ব সার্কাস। সাহেবদের মুখে ঝামা ঘষে দিয়ে ঝামাপুকুরের প্রিয়নাথ বোস কলকাতার ময়দানে হই হই করে সার্কাস দেখালেন ১৯১১ সালে, কিছু দিন আগেই বাঙালির বাচ্চারা খালি পায়ে ফুটবল খেলে সাহেবদের ইস্টইয়র্ক দলকে হারিয়ে আইএফএ শিল্ড জিতে নিয়েছিল। মোহনবাগান ক্লাব। আর প্রিয়নাথ বোসের বেঙ্গল সার্কাস বাঙালির ছেলেদের নিয়ে সার্কাস করিয়ে দেখিয়ে দিল বাঙালির ছেলেরা বাঘ নিয়েও খেলতে পারে। হ্যাঁ, সত্যেন দত্তর কবিতাটা ময়দানে প্রমাণ করে দিল, ‘বাঘের সঙ্গে যুদ্ধ করিয়া আমরা বাঁচিয়া আছি’। প্রিয়নাথ বোসের বেঙ্গল সার্কাসকে বলা হতো প্রফেসর বোসের সার্কাস।

প্রিয়নাথ বোস গোয়ালিয়রে খেলা দেখাতে গিয়ে গোয়ালিয়রের রাজার কাছ থেকে এক জোড়া বাঘ উপহার পেয়েছিলেন তার কিছুদিন আগেই। বাঘ দুটোর নাম রেখেছিলেন লক্ষ্মী আর নারায়ণ। লক্ষ্মী-নারায়ণকে কী করে ট্রেনিং দিয়েছিলেন প্রিয়নাথ সেটা কৃষ্ণলাল জানেন না, তবে বাবার কাছে শুনেছেন বাঘের গায়ে হাত বুলিয়ে বাঘকে ঘুম পাড়াতেন প্রিয়নাথ। বাঘদের গল্প শোনাতেন, গান শোনাতেন। কী গান? কৃষ্ণলাল কল্পনা করেছেন বাঘের সামনে মাথা দুলিয়ে ওর পিতামহ গাইছেন, ‘ছন্দে ছন্দে দুলি আনন্দে আমি বনফুল গো…’। নাকি ঝিঁঝিট আড়া তেতালাতে – ‘নয়নের মায়াজালে সই মজালে আমারে’। বাঘের পিঠে চেপে সার্কাসের এরিনায় আসতেন প্রফেসর বোস– দু-হাতে সাতখানা বল লোফালুফি করতে করতে। বাঘের মুখে হাত ঢুকিয়ে দিলে লকলকে জিভ দিয়ে হাত চেটে দিত বাঘ। এই সার্কাসেই যোগ দিয়েছিলেন ভীম ভবানী। ভীম ভবানী শুয়ে পড়লে, বুকের উপর তক্তা চাপিয়ে দেয়া হতো একটা, সেই তক্তার উপর দিয়ে হাতি চলে যেত। ভীম ভবানী উঠে দাঁড়িয়ে দর্শকদের উদ্দেশ্যে হাত জোড় করত। সেই হাততালি, বহুযুগ আগেকার মানুষের আনন্দ-বিস্ময় মাখানো হাততালির শব্দ এই কৃষ্ণলাল ওরফে কালোবাবুও শুনেছেন তার নিজের সার্কাসে।

প্রিয়নাথ বোস মারা গেলেন ১৯২০ সালে। সার্কাসের দলটাও ভেঙে গেল। প্রিয়নাথের পুত্র, মানে কৃষ্ণলালের বাবা তখন বালক মাত্র। কৃষ্ণলালের বাবা সার্কাসে ছিলেন না, আগেই বলেছি, সাহেবি অফিসে চাকরি করেছেন, কিন্তু গর্ব ছিল। বাঙালির সার্কাস ছিল বাঙালির মাথা তুলে দাঁড়ানো অহংকার। রক্তের গভীরে গোপনে বেঁচে থাকা সার্কাসকে জাগিয়ে তুলেছিলেন– এই কালোবাবু। রায়বেশে নাচের দল থেকে টেনে এনেছিলেন নকুল বাগদিকে, রণপায়ের খেলা দেখাত। ডুয়ার্সের চা বাগানে অবিরাম সাইকেল চালানোর আসর থেকে জোগাড় করেছিলেন বাচ্চু গুরুংকে, আর ওখানেই কৃষ্ণলাল পেয়ে গিয়েছিল একটি চিতাবাঘকে। হ্যাঁ, সারা গায়ে ছিট ছিট ছবি আঁকা চিতাবাঘ। চিতাবাঘটা ছিল কালোবাবুর প্যারাডাইস সার্কাসের সম্পদ। ওর পিতামহের মতো বাঘের পিঠে চেপে সার্কাসের এরিনায় প্রবেশ করতে পারেননি কালোবাবু কিন্তু চিতাবাঘের পিঠে চেপে ঢুকেছেন, যার অন্য নাম লেপার্ড।

কালোবাবু নারী শরীরের রহস্য কিছুটা জানেন, শরীরের কোন জায়গায় কী ধরনের স্পর্শ দিলে শরীর তার কী উত্তর দেবে কালোবাবু বোঝেন, কিন্তু আরও বেশি বোঝেন জানোয়ারের শরীর। কুকুরের মতো বাঘও লেজ নাড়ায়। জানতে হয় কী ধরনের স্পর্শে লেজ নড়ে উঠবে। কী ধরনের স্পর্শে বাঘ হুংকার দেবে, সেটাও জানেন। চিতাবাঘ তো বাঘই। এরিনায় নামছেন কালোবাবু, চিতার পিঠে চেপে। চিতা হুংকার দিল, আর বেজে উঠল ট্রাম্পেট, বিউগল…।

লোহার খাঁচাটার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন কৃষ্ণলাল। নতুন রং হয়েছে খাঁচার লোহায়। একটা গন্ধ আসছে। এখন রোদ্দুরটাও বেশ কড়া। দলের সবাই মূর্তিনদী দেখতে গেছে। কৃষ্ণলাল যাননি। উনি একাই এসেছেন এখানে। এক ঘন্টার উপর দাঁড়িয়ে আছেন। যদি মধুবালা আসে, একবারটি দেখা দেয়। এটা খয়েরবাড়ি বন্যপ্রাণী সুরক্ষা কেন্দ্র।

কৃষ্ণলালের প্যারাডাইস সার্কাসটাও ভেঙে গেছে বহুদিন হয়ে গেল। ওর বাবা দেখেশুনে বিয়ে দিয়েছিলেন, মিত্র বংশের মেয়ে। সে বিয়েও ভেঙে গেছে সার্কাসটা ভাঙার আগেই। ভাঙবেই তো। কে-না ভালোবাসা চায়। চিতাবাঘটাও চেয়েছিল। একটা মেয়ে বাঘকে যদি বউয়ের চেয়েও বেশি ভালোবাসে কোনও পুরুষ– সহ্য হয়? কেবল মধুবালা আর মধুবালা। চিতাবাঘিনির নাম রাখা হয়েছে মধুবালা– আদিখ্যেতা নয়? কৃষ্ণলালের বউ তো এমনই ভেবেছিল। তা ছাড়া বাড়িতে তো থাকতই না। প্যারাডাইস সার্কাস নিয়ে ঘুরে বেড়াত বাইরে বাইরে। নেশাও করত। সার্কাসের দলে মেয়েরাও তো ছিল। এক ঝুমুর নাচা মেয়ের সঙ্গে ফস্টিনস্টির গল্পও কানে এসেছিল কৃষ্ণলালের স্ত্রীর। কৃষ্ণলালের স্ত্রী অন্নপূর্ণা চেয়েছিল সার্কাস-টার্কাস অনেক হয়েছে। টাকাপয়সা যা আছে তা দিয়ে কিছু একটা ব্যাবসাপাতি করে এবার সংসারে থিতু হোন কৃষ্ণলাল। ছেলেটাও বড়ো হয়েছে। কৃষ্ণলাল স্ত্রী-র কথায় কান দেননি। অন্নপূর্ণা বলেছিলেন– হয় তোমার মধুবালা নয় আমি। কৃষ্ণলাল মধুবালাকেই বেছেছিলেন। অন্নপূর্ণা বলেছিলেন মধুবালা তোমার ভড়ং। তোমার আসল আঠা হ’ল দুর্গা নামের ওই নাচুনে মেয়েটা। সংসারটা ভাঙল। ভাঙা বউটাও পৃথিবীতে নেই আর। ছেলেটা লেখাপড়া শিখেছে। ভালো চাকরিবাকরি করে। বাপকে ফেলে দেয়নি ও। মনে রেখেছে। বিয়ে-থা করেছে। ওর মামার বাড়ির ন্যাওটা। কলেজের লেখাপড়া তো ওর মামার বাড়িতে থেকেই করেছে।

প্যারাডাইস সার্কাসটা তেমন কোনও বড়ো সার্কাস দল ছিল না। তত বড়ো করতে পারেনি। বিরাট তাঁবু ফেলে, কাগজে বড়ো বড়ো বিজ্ঞাপন দিয়ে কোনওদিনই শো করতে পারেনি কেএল বোস। জেলা শহরগুলিতেই শো করেছে। যেমন সিউড়ি, দুবরাজপুর, বসিরহাট, রায়গঞ্জ, বীরপাড়া, মালবাজার…। সবাই বলত কালোবাবুর সার্কাস। হ্যান্ডবিল বিলি হতো, জোকার রামদাস চোঙা ফুঁকে বলে বেড়াত– প্লাস্টিক গার্ল অঙ্গ বেঁকাবে যেখানে খুশি, বাঁদর সাইকেল চালাবে, দক্ষযজ্ঞ আর সীতার দেহত্যাগ, মহিষাসুরমর্দিনী…।

মহিষাসুরমর্দিনী খেলার অসুর তিড়িং মানে বিজয় মাহাতো, ছৌ নাচের অসুরের মুখোশ পরে কী ডিগবাজিটাই না দিত। আহা। দুগ্গি, মানে দুর্গা হাতে ত্রিশূল নিয়ে নাচত। ওর খ্যামটা নাচটাও ফ্যালনা নয়। সারা অঙ্গের কাজ আছে। নাচতে নাচতে, ত্রিশূল দোলাতে দোলাতে মুখ দিয়ে আগুন বের করত। মুখ দিয়ে আগুন বের করার খেলাটা শিখতে হয়েছিল মুখে কেরোসিন রেখে। শেষ কালে তিড়িং-এর কাঁধের উপর পা তুলে দিত দুগ্গি, ত্রিশূল বুকে বিঁধিয়ে দিত, উপর থেকে রঙিন কাগজের কুচি ঝরে পড়ত, যেন পুষ্পবৃষ্টি। তারপর তুমুল হাততালির মধ্যে দুগ্গি তিড়িং এর পা ছুঁয়ে প্রণাম করে বলত, ইনি আমার স্বামী। গায়ে পা দিয়েছি বলে পেন্নাম করে নিলাম। তারপর আর এক প্রস্থ হাততালি।

আবার দক্ষযজ্ঞ খেলায় মহাদেব সেজে ডিগবাজি খেত তিড়িং, লম্বা করে লাফ মারত, আর কৃষ্ণলাল নিজে পাগড়িতে ময়ূরের পালক গুঁজে চাকতির জাগলিং দেখাত, যেন সুদর্শন চক্র ছোড়া হচ্ছে। এই ভাবে সার্কাসের সাহেবিয়ানাকে দেশি, লৌকিক রূপ দিতে চেয়েছিলেন কৃষ্ণলাল। মহিষাসুরমর্দিনী খেলাটা একেবারে অন্য মাত্রা পেয়ে গেল যখন সার্কাসে বাঘটা এল। শ্রী শ্রী দুর্গা হলেন সিংহবাহনা। উত্তর ভারতের কোথাও কোথাও ব্যাঘ্রবাহনা দুর্গাও দেখা গেছে। পটচিত্রে আছে, মন্দিরেও। আমাদের দুগ্গি চিতাটার পিঠে করেই ঢুকত এরিনায়। চিতার গলায় পরানো থাকত পাটের ঝালর। সিংহের কেশর যেমন থাকে।

বেশ অদ্ভুত ভাবে চিতাটাকে পাওয়া গিয়েছিল। ডুয়ার্সের মালবাজারে সার্কাসের তাঁবু পড়েছিল। চা-বাগানের কুলি-কামিনরা সারা বছর কোনও আমোদ আহ্লাদ পায় না। ওরা দলে দলে ভিড় জমাত সার্কাসে। জঙ্গল থেকে মাঝে মাঝে হাতির পাল যেমন নেমে আসত, মাঝে মাঝে চলে আসত চিতাও। চিতাবাঘ এসে গোয়ালের গরুটা, বাছুরটা, ছাগলটা, হাঁস, মুরগি, ভেড়াকে মেরে টেনে নিয়ে যেত। গাঁয়ের লোকজন সার্কাস দেখতে এলে চিতাদের সুবিধে হতো। গাঁয়ে লোক কম থাকত বলে গেরস্ত ঘরের পালিত পশু শিকার করতে সুবিধে হতো। মানুষজন চিতাকে বাগে পেলে ছেড়ে দেবে কেন? চিতার দেখা পেলে তিরধনুক, কোদাল-কুড়ুল, শাবল নিয়ে বেরিয়ে পড়ত। কখনও মেরেই ফেলত। একবার হ’ল কি, সার্কাস চলার সময় খবর এল চিতা বেরিয়েছে। শুনে সার্কাস ছেড়ে অনেকে চলে গেল। বাইরে হইচই হট্টগোল। সার্কাস বন্ধ করেনি কৃষ্ণলাল। দশটা লোক থাকলেও শো চলবে। বাইরে পটকা বাজির শব্দ। শো শেষ হ’ল। শোনা গেল একটা চিতা একটা ছাগলছানাকে খেয়ে ফেলেছে। ওর গায়ে তির লেগেছে, হেঁসো-কোদালের কোপও পড়েছে। কিন্তু পালিয়েছে।

আরও রাত্তিরে জলত্যাগ করার জন্য তাঁবুর বাইরে বেরিয়ে কৃষ্ণলাল দেখতে পেলেন, আধা চাঁদের আলোছায়ায় তাঁবুর পিছনের জারুল গাছটার তলায় গুটিশুটি মেরে বসে আছে একটা জানোয়ার। টর্চের আলো পড়ল। চিতা…! রক্তমাখা। নিজের গায়ের রক্ত চেটে পরিষ্কার করছে ও। লেজের দিকে মুখ দিচ্ছে বার বার। লেজের শেষ দিকটা নেই। যেন কুড়ুলের ঘায়ে খাবলে নেওয়া। চিতার চোখে টর্চের আলো পড়লে কৃষ্ণলাল দেখেন ওর চোখে ভিক্ষা লেগে আছে। জীবন ভিক্ষা চাইছে চিতাবাঘটা। এক মগ জল সামনে রাখে। জলটা চেটে খায়। কৃষ্ণলালের দিকে তাকায়। দৃষ্টিতে কৃতজ্ঞতা। একটা চেন এনে গলায় পরায়। চিতা প্রতিবাদ করে না। জীবনের বিনিময়ে শিকল মেনে নেয়।

জীবন বড়ো না শিকল… এই প্রশ্নের উত্তর আজও কালোবাবুর কাছে পরিষ্কার নয়। জীবন বড়ো রহস্যময়, আর শিকলও। কে কখন কী ভাবে শিকল পরে তা বোঝা যায় না। আর শেকল প্রায়শই অদৃশ্যই থাকে।

কৃষ্ণলাল জানতেন গাঁয়ের মানুষ যদি খোঁজ পায়, সার্কাসের তাঁবুতে ঢুকে চিতাটাকে খুঁচিয়ে মারবে। তাই প্রথমেই চিতাটার মুখে একটা জাল পরিয়ে দিলেন, যাতে আওয়াজ করতে না পারে। গর্জন-ই হ’ল নির্দেশক। চিতাটার লেজের কিছুটা নেই। টাঙ্গি জাতীয় কিছুর আঘাতে লেজের শেষ অংশ খোয়া গেছে। রক্ত ঝরছে। ভালো করে পট্টি বেঁধে দেয় কৃষ্ণলাল। সারা গায়ে হাত বুলিয়ে দেয়… ঘাড়ের কাছটায়। ছিন্ন হয়ে যাওয়া লেজটা নড়ে ওঠে। সেদিন রাতের খাবারে ছিল মুরগি। দু-টুকরো নিয়ে আসে কৃষ্ণলাল। চিতার মুখের জালিটা খুলে ওর মুখের সামনে ধরে। দু-বার গন্ধ শোঁকে চিতা। তারপর মুখ ঘুরিয়ে নেয়। রান্না মাংস ওর অচেনা। হলুদ-লংকা-গরম মশলা দেওয়া মাংস কি কখনও খেয়েছে নাকি সে?

কিন্তু খিদে সব পারে। অনর্থ ঘটাতে পারে খিদে, আর এটা তো সামান্য খাওয়া।

ওদের সার্কাসে আগে শুধু ছাগল আর বাঁদর ছিল। চিতা ঢুকল। সে তো বহুদিন আগেকার কথা।

এই খাঁচাটার সামনে কৃষ্ণলাল। গতকাল দেখতে পেয়েছিলেন একটা মাংস ভক্ষণরত চিতা। খাবার সময় এই প্রজাতি লেজটা একটু বেঁকিয়ে রাখে। এই চিতাটার লেজের শেষদিকটা ছিল না। কিন্তু

মাংস দ্রুত শেষ করে ভিতরে চলে যায় সে। আর দেখেনি। তাই আজ আবার এখানে, অপেক্ষা। এখনও আসেনি সে…

বেশ কিছুক্ষণ খাঁচার বাইরে অপেক্ষার পর বাঘটির দেখা পেলেন কৃষ্ণলাল। কয়েকবার পায়চারি করার পর ঘাসের জঙ্গলে ঢুকে গেল। ঠিকই দেখেছিলেন গতকাল। লেজের শেষের দিকটা নেই। জোরে চিৎকার করলেন কৃষ্ণলাল– মধুবালা কাম হিয়ার। কই এল না তো…।

এই খয়েরবাড়ির বন্যপ্রাণী সুরক্ষা কেন্দ্রে সার্কাস থেকে ছিনিয়ে আনা বাঘ, চিতা, হাতিদের রেখে দেওয়া হয়। দীর্ঘদিন সার্কাসে থাকা বনের পশুদের ফের বনের ভিতরে ছেড়ে দিলে ওরা বেশিদিন বাঁচে না। কারণ বন্দিদশায় ওরা শিকার ভুলে যায়। খাবারের জোগান থাকে না, জোগাড়ও হয় না। তাই খাঁচাঘেরা বনে ছেড়ে রাখা হয়। এই খাঁচা, চিড়িয়াখানার খাঁচার মতো ছোটো নয়। প্রাকৃতিক বনের অনেকটা জায়গা লোহার জালে ঘিরে তার ভিতরে পশুদের ছেড়ে দেওয়া হয়। চিতাদের জন্য আলাদা অঞ্চল, বাঘেদের আলাদা, হাতিদের আলাদা। ঘেরা জায়গায় ঘাস জঙ্গল থাকে, ঝোপঝাড় থাকে, থাকে বড়ো গাছও। খরগোশ, শুয়োর-ও ছাড়া থাকে। যদি পারে বাঘেরা টুকটাক শিকার ধরে। নইলে সময়মতো খাবার তো আছেই। বেলা একটা নাগাদ একটা নির্দিষ্ট জায়গায় মাংস রেখে দেওয়া হয়। সেই যে একটা আইন হ’ল না, মানেকা গান্ধির সময়ে– সার্কাসে জন্তু-জানোয়ারের খেলা বেআইনি করে দিল, কেন? জন্তুদের কষ্ট হয়। তারপর থেকেই সার্কাসে জানোয়ারের খেলা দেখানো বন্ধ হতে লাগল। কালোবাবুর সার্কাসটা সেরকম বড়ো মাপের ছিল না, তাই বেশ কিছুদিন দেখাতে পেরেছিল। পানামা, অলিম্পিক, ইম্পিরিয়াল এসব সার্কাস থেকে আগেই হাতি-ঘোড়া-বাঘ-ভালুক ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছিল। ওর প্যারাডাইস সার্কাসের মধুবালাকে ওরা নিয়ে গেল আরও পরে। তা-ও আঠারো বছর হয়ে গেল। আর আঠারো বছর, মানে দেড় যুগ পরে মধুবালার সঙ্গে দেখা।

এই আঠারো বছরে কত কী হয়ে গেল। দু-তিন রকম সরকার হ’ল, মঙ্গল গ্রহে মানুষ গেল, ব্যাটাছেলেরা অপারেশন করে মেয়ে হল, প্যারাডাইস সার্কাস ভেঙে গেল, বিয়ে করা স্ত্রী মরে গেল, তার নিজের ক্যান্সার ধরা পড়ল।

হ্যাঁ। কালো রঙের বাহ্য হচ্ছিল, জ্বর, শেষ অবধি ধরা পড়ল ক্যান্সার। ছেলেকে জানিয়েছিল। ছেলে মুম্বই নিয়ে গিয়েছিল। অপারেশন হয়েছে, কেমো থেরাপি। মাত্র দু’বছর আগেকার কথা। এর আগে একা একাই থাকতেন কৃষ্ণলাল। হ্যারিসন রোডের একটা মেস-এ। সম্পদ বলতে একটা অ্যালবাম। ওখানে প্যারাডাইস সার্কাসের নানারকম ছবি। দক্ষযজ্ঞ, সীতার অগ্নিপরীক্ষা, মহিষাসুরমর্দিনী…। যে টাকাটা সার্কাসের কল্যাণে জমিয়েছিলেন, তা থেকে যা ব্যাংকের সুদ পেতেন, তাতেই কোনওরকমে চলে যাচ্ছিল। অসুখটাই বিপত্তি বাধাল। ছেলেকে জানাতে বাধ্য হলেন কৃষ্ণলাল। ছেলে চিকিৎসা করিয়ে দিল। খরচাপাতি কী লেগেছে কৃষ্ণলালের জানা নেই। হতে পারে চিকিৎসার খরচ অফিস থেকেই পেয়েছে। ওর সার্টিফিকেটে বাপের নাম তো কৃষ্ণলাল বোসই লেখা আছে। এরপর ছেলে বলেছে মেস-এ থেকে কোনও কাজ নেই। একটা বৃদ্ধাশ্রম ঠিক করে দিয়েছে। চন্দননগরে গঙ্গার ধারে। মাসিক খরচটা ওর সুদের টাকাতেই হয়ে যায়, তবে এককালীন একটা মোটা টাকা জমা রাখতে হয়েছিল। সেটা ছেলেই দিয়েছে। মরে গেলে ফেরত পেয়ে যাবে। মরে যাওয়াটা খুব বেশি দূরে নেই। ও জানে যখন-তখন ফিরে আসতে পারে রোগটা, শরীরের অন্য কোথাও, অন্য কোনও খানে। বৃদ্ধাশ্রম কর্তৃপক্ষও ব্যাপারটা জানে। ওরাও বলে দিয়েছে– এখন ভালো আছে, থাকা যাবে, কিন্তু রোগব্যাধি বাড়লে এখানে রাখা যাবে না। তবে লোকটাকে ফিরিয়ে দিলে জমা রাখা টাকাও ফিরিয়ে দেবে।

বৃদ্ধাশ্রমটা ভালোই। আলো হাওয়া খেলা করে। গঙ্গাটা দেখা যায়। বোর্ডাররা গল্প করে। সার্কাসের গল্প বলেন কৃষ্ণলাল। বৃদ্ধরা গল্প শোনে। মাঝে মাঝে বলে– আবার একটু সার্কাস হয়ে যাক-না প্রফেসর বোস।

এই বৃদ্ধাশ্রম মাঝেমধ্যে বেড়াতে যাওয়ার আয়োজন করে। একবার পুরী নিয়ে গিয়েছিল। এবার ডুয়ার্স। আশ্বিনের মাঝামাঝি। জঙ্গলে সদ্যস্নান সেরে আসা শ্যামলি। নদীজল কলকল, কাশফুল দুলছে। এই ডুয়ার্স পরিক্রমার মধ্যেই ছিল খয়েরবাড়ি বন্যপ্রাণী সংরক্ষণশালা দর্শন। গতকাল এসে এক ঝলক চিতাটিকে দেখে মনে হয়েছিল এই সেই মধুবালা। তাই আজ আবার। অন্যরা অন্যত্র বেড়াতে গেছে। গেস্টহাউসে ফিরে আসবে বিকেলে। শরীর খারাপের নাম করে গেস্টহাউসেই রয়ে গিয়েছিলেন, তারপর হাঁটি হাঁটি করে আবার এখানে। মধুবালার টানে।

সেই রাত্রের কথা মনে পড়ে। রক্তমাখা জবুথবু চিতাবাঘটি। সারা গায়ে কী সুন্দর ছোপছোপ। বড়ো কাঠের বাক্সে ঢোকানো হ’ল। উপরে চাপা দেওয়া। গোপনে রাখা। স্থানীয় মানুষদের চোখের আড়ালে রাখা। জানতে পারলে পিটিয়ে মেরে দিত। বাক্সের ভিতর থেকে মাঝে মাঝেই গাঁক-গাঁক করে উঠছিল। যন্ত্রণার কাতরানির শব্দের সঙ্গে ক্ষোভ মেশানো ছিল, ক্রোধও।

মালবাজারের পাট গুটিয়ে এরপর অসমের বড়পেটা। ওর জন্য খাঁচা বানানো হ’ল। খাঁচায় খাবার দেওয়া হল। খাঁচার ভিতরে আস্ফালন। কৃষ্ণলাল ওকে সোনামনি ডেকেছে, এমন দুষ্টুমি করে না সোনা বলেছে, খাঁচার বাইরে দাঁড়িয়ে ওর পিতামহের মতো গানও শুনিয়েছে, ‘এক পলকের একটু দেখা– আরও একটু বেশি হলে ক্ষতি কী?’ খাঁচার ভিতরে থেকে ও হালুম করেছে, গাঁক-গাঁক করেছে। মধুবালার জন্য একটুকরো লেজও গড়িয়ে দিয়েছিল। সার্কাসে যখন আসত, নকল লেজের টুকরোটা জোড়া দিয়ে দিত। কৃষ্ণলাল তো ট্রেনিং জানে না, অন্য সার্কাস থেকে একজন ট্রেনার আনিয়েছে। সেই ট্রেনার বলেছিল– এই চিতার বয়স একবছরও হয়নি। শিশু চিতা। কৃষ্ণলাল ওর নাম রেখেছিল মধুবালা।

ট্রেনার বলেছিল– এদের ঠিক মতো খাবার দিতে নেই। ক্ষুধার্ত রাখতে হয়। ক্ষুধার্তদেরই বশে রাখা যায়। হালুম করলেই চাবুক। এটাই পৃথিবীর নিয়ম। হুকুম পালন করলেই খাবার দেওয়া হবে। এটাই নিয়ম। এটাই ফর্মুলা।

এভাবেই পোষ মেনেছিল মধুবালা। বশ্য থাকার বিনিময়ে খাদ্য। তারপর ক্রমশ বনের চিতাবাঘ মানুষের নিয়মে অভ্যস্ত হয়ে উঠল। চাবুককে ভয় পেতে শিখল। নখ গুটিয়ে নিল থাবার ভিতর। নখ গোটানো থাবায় হ্যান্ডশেক শিখল। পিঠে চাপলেন প্রফেসর বোস। গলায় পাটের কেশর চাপল, সং সাজল বনের চিতা। সিংহের অভিনয় করল। প্যারাডাইস সার্কাসের নামযশ হল। মাইকে ফোঁকা হতে লাগল ‘চিতাবাঘের আশ্চর্য খেলা’।

খাঁচার লোহার বেড়ার সামনে দাঁড়িয়ে কৃষ্ণলাল, মানে প্রফেসর বোস হেঁকে চলেছেন মধুবালা… হ্যালো মধুবালা, মাই ডার্লিং… কাম হিয়ার… কাম হিয়ার।

এবং কী আশ্চর্য। মধুবালা আস্তে আস্তে এগিয়ে এল। ওর অবশিষ্ট লেজটুকু নড়ে উঠল। খাঁচার ওধারে মধুবালা। হ্যাঁ, মধুবালাই তো। চিতাও কি মনে রাখে? বেড়ার ওধারে মধুবালা। ও কি এখন প্রৌঢ়া? ওর চোখ চিকচিক করছে কেন? জল? চোখে জল?

এই পারে আমি আর ওই পারে তুমি।

মাঝে লোহার খাঁচা।

কেমন আছিস রে মধুবালা?

মধুবালা একবার তাকায়। প্রফেসর বোসের সঙ্গে চোখাচোখি হয়।

মধুবালা একটা আওয়াজ করে… গররর…।

প্রফেসর বোঝেন– তুমি ভালো আছো তো বোস?

প্রফেসর বলেন– কী করে ভালো থাকব বল। তোকেও ওরা টেনে হিঁচড়ে নিয়ে গেল, বাঁদর, কাকাতুয়াকেও নিয়ে গেল, তিড়িংটাও মরে গেল ঝপ করে, বড্ড মদ খেত। দলের আর রইল কী? মহিষাসুরমর্দিনীর আইটেমটাই বন্ধ হয়ে গেল। দলটাই উঠে গেল। দুর্গা, মানে দুগ্গি রে, ও বলল– এবার আমার কী হবে। কেউ তো আমার রইল না। আমার একটা উপায় করেন। ওকে কিছু টাকা দিয়ে বিদেয় দিলাম। অন্যরা কেউ কেউ অন্য সার্কাসে চলে গেল। আমিও এখন তোর মতোই একটা বৃদ্ধাশ্রমে। তুই নিশ্চই এখানে আমার সার্কাসের চাইতে ভালো আছিস। কত গাছ। মাথার উপর আকাশ। ছোটো খাঁচার ভিতরে তো থাকতে হয় না আর। তোর মুক্তি হয়েছে। আমারও মুক্তি হয়ে যাবে মধুবালা। ক্যান্সার। এখন ঠিকই আছি, তবে আবার চলে আসতে পারে। খুব ভালো হল, যাবার আগে তোর সঙ্গে দেখা হয়ে গেল আবার।

মধুবালা পিছন ফিরল। চলে যাচ্ছে কেন? ও কি চিনতে পারেনি তবে? আবার ডাকল, পুরোনো কায়দায়। হুকুম যেমন। কাম হিয়ার। কাম হিয়ার মধুবালা।

মধুবালা ফিরে এল। হুকুমের শব্দ মনে রেখেছে ও। দাঁড়িয়েছে।

প্রফেসর সত্যি সত্যি গান গায়। ‘আরও ভালো হতো। যদি তুমি আর আমি, পাশাপাশি বসে কাটিয়ে দিতাম যদি কিছুটা সময়…’।

এবার জঙ্গলের কেয়ারটেকার হাঁক দেয়। হাতে বস্তা। ও বেড়ার ওধারে। হু…উ..ই, হুক, হুক।

একটা পাথরের উপর মাংসখন্ড ফেলে দেয়।

গানের চেয়ে খাদ্য বেশি গুরুত্বপূর্ণ, এই জ্ঞানে মধুবালা খাদ্যের দিকেই মুখ ফেরায়।

কৃষ্ণলাল আরও কিছুক্ষণ দাঁড়ায়। দূর থেকে মধুবালার খাওয়া দেখে। খাওয়া শেষ হলে কৃষ্ণলাল আবার ডাকে। হুকুমের স্বরেই ডাকে। কেয়ারটেকারটি এগিয়ে আসে। বলে, চ্যাঁচামেচি করছেন কেন! কৃষ্ণলাল বলে এই বাঘটি আমার পুরোনো বন্ধু। বহুদিনের চেনা।

কেয়ারটেকার বলে, যত পাগলের কারবার। চলে যান এক্ষুনি। জঙ্গলে জোরে কথা বলা বারণ। ওই দেখুন বোর্ড।

বোর্ডে লেখা– জঙ্গলের শান্তি ও নীরবতা বজায় রাখুন।

কৃষ্ণলাল গুটিগুটি পায়ে চলে যায়। গেট পেরিয়ে, ছায়াছায়া পথে এবার পিচ রাস্তায়। এখানে কয়েকটা হোটেল। আর মিনিট পনেরো হেঁটে গেলেই গেস্টহাউস। কৃষ্ণলাল ভবেন এখানকার একটা হোটেলেই খেয়ে নেবেন। তৃপ্তি হোটেল। আজকের স্পেশাল বোরালি মাছ। ডুয়ার্সে শো করতে এলে এই মাছ খেয়েছেন কত।

ডুয়ার্সের নদীগুলোতেই এই মাছ পাওয়া যায়। হোটেলে ঢুকতেই বাঁদিকে একটা বাঁশের মাচা। সেই মাচায় শুয়ে আছে এক মহিলা। মাথার চুল ছোটো করে ছাঁটা। মুখটা চেনা-চেনা। থমকে দাঁড়িয়ে পড়েন কৃষ্ণলাল। বেজে ওঠে বেসুরো ট্রাম্পেট। দুর্গা? দুর্গাই তো। দুগ্গি। কৃষ্ণলাল চেঁচিয়ে ওঠেন। দুগ্গি, তুই?

দুর্গা চোখ খোলে। অপলক কিছুক্ষণ। ঠোঁট নড়ে ওঠে। হাল্কা শব্দে শোনে– পফেছর…।

পাশের কাশফুল ঝোপ নড়ে ওঠে। একটা নাম না জানা পাখির ডাক। কী আশ্চর্য। এখানে দুর্গা। এখানেই মধুবালা। কী করে হয়। পৃথিবী কী বিচিত্র। কোণায় কোণায় কত রহস্য কত সুখ পড়ে থাকে।

কৃষ্ণলাল বলেন– দুর্গা, তুই কি করে এখানে?

দুর্গা কিছু বলার চেষ্টা করে হয়তো, ঠোঁট নড়ে। কথা আসে না। তৃষ্ণা এগোয়, জল এগোয় না। হোটেল মালিক হাফপ্যান্ট আর জঙ্গলছাপ গেঞ্জি পরা। বলে– চেনেন এই মাসিকে?

কৃষ্ণলাল বলেন– খুব চিনি। এখানে কি করে ইনি?

হোটেল মালিক যা বলে তার সার কথা হল– এই মহিলা এই হোটেলে বাসন মাজা, তরকারি কোটা, ধোয়াধুয়ির কাজ করছে ওর বাবার আমল থেকে। টুকটাক রান্নাও। জঙ্গল থেকে ঢেঁকিশাক কুড়িয়ে আনতে গিয়ে পাথরে পা পিছলে পড়ে যায়। অজ্ঞান হয়ে পড়েছিল। সবাই ধরাধরি করে নিয়ে আসে। জ্ঞান আসে, কিন্তু অঙ্গ পড়ে গেছে। সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারে না। হাসপাতালে দেখিয়েছে। আলিপুরদুয়ারে। ওরা বলেছে শিরদাঁড়ায় চোট লেগেছে। অপারেশন দরকার। কলকাতায় নিয়ে যেতে হবে। কে নিয়ে যাবে কলকাতায়! এতদিনের পুরোনো মাসি। ফেলেও দেওয়া যায় না। শুয়েই থাকে।

কৃষ্ণলাল ওর পাশে বসে। নিজের কথা বলে।

এই দুগ্গিই দুঃখের কথা বলত প্রফেসরকে। বলত ওর স্বামী মদ খায়, মদটাই ওর আসল আনন্দ। বলত স্বামীর সোহাগ পায় না। বলত ও বাঁজা। বলত ও আদর চায়। কৃষ্ণলাল সেটাও দিয়েছিল।

কৃষ্ণলাল ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। মধুবালার কথা বলে। বলে কী আশ্চর্য, এত কাছে তোমরা দু’জনে থাকো, অথচ তোমাদের দেখা হয়নি। দুগ্গির মুখে হাসির রেখা আঁকা হয়ে যায়। ওর ঠোঁট নড়ে। প্রফেসর ঠিক বুঝতে পারছে ও বলছে, ওসব জায়গায় তো টুরিস্ট বাবুরা যায়। আমি কী করতে যাব?

প্রফেসর বলে– দেখবি দুগ্গি, দেখতে যাবি তোর মধুবালাকে? আবার চড়বি নাকি ওর পিঠে? ওর মুখে শিউলি ফোটে। কাশফুল নড়ে। আকাশে সাদা মেঘ ডানা মেলে।

দুগ্গিকে একটা ভ্যান রিকশায় শুইয়ে দেয়। পাশে প্রফেসর। মনে মনে বলে দুগ্গি, তোকে এই অবস্থায় ফেলে আমি চলে যেতে পারি? এখান থেকেও নয়, পৃথিবী থেকেও নয়। এখন আমার মরে যাওয়া চলবে না। ক্যান্সারের নিকুচি করেছে। তোকে কলকাতা নিয়ে যাব।

তার আগে ওই পুরোনো বন্ধুর কাছে।

সেই লোহার বেড়ার কাছে ভ্যান রিকশা থামে। কৃষ্ণলাল প্রফেসর বোস হয়ে হাঁকেন– মধুবালা… কাম, কাম হিয়ার। ইউ সি হু ইজ শি। কাম অন, কাম অন…। মধুবালা গুটি গুটি পায়ে বেড়ার কাছাকাছি চলে আসে। সূর্য পশ্চিমে হেলেছে। চিতার গায়ে বিকেলের সোনা রোদ। দুগ্গি পাশ ফেরে। মধুবালাকে চিনতে পারে যেন। ওর মুখে শিউলি-কাশফুল-সাদা মেঘ মেশানো শরৎ। মধুবালা শব্দ করে। বলে, চিনতে পারছ দিদি? বেজে উঠেছে আলোকমঞ্জীরা ধরনির বহিরাকাশে অন্তর্হিত মেঘমালা। আনন্দময়ী মহামায়ার পদধবনি। দুগ্গি কনুইয়ে ঠেস দিয়ে ওঠার চেষ্টা করে। প্রফেসর বাড়িয়ে দেয় হাত। দুগ্গি বসে। পিঠে হাত দিয়ে রাখে প্রফেসর। দুগ্গি ক্রমশ দুর্গা হয়ে যায়। লোহার খাঁচা আঁকড়ে ধরে দু’হাতের আঙুলে। প্রফেসর কোমর ধরে দাঁড় করিয়ে দেয়। দুর্গা বেড়া ধরে এক’পা – দু’পা। মধুবালা গররগরর করে বলে হ্যাঁ-হ্যাঁ, এভাবেই। সার্কাস দেখাচ্ছে দুর্গা। আবার। হয়। ভালোবাসায় হয়। বেজে উঠল ট্রাম্পেট, বিউগল। বাজল। ‘বাজল তোমার আলোর বেণু, মাতল রে ভুবন…’

 

আজ শালুকের জন্মদিন

সুবোধের যখন ঘুম ভাঙল পৃথিবীর গা থেকে কুয়াশার সর এতটুকু কাটেনি। যেন কয়েক লাখ টনের এসি ফুলদমে চলছে। পুরো কনকনে ঠান্ডা চারদিকে। পুরোনো সরষের তেলের গন্ধে ম-ম করা লেপটা গায়ে ভালো করে জড়িয়ে নিয়ে আর এক চোট ঘুমের ব্যবস্থা করতে যাবে হঠাৎই মনে হল কাল রাতে ছেলেটার গায়ে চাদর ঢাকা দেওয়া হয়েছিল? আধো ঘুম আধো জাগা অবস্থায় গতকাল রাতের কথা মনে করতে চেষ্টা করল। রাত্রে ছেলেকে খাওয়ানো তারপর এঁটো বাসন তুলে…। কম্বলটা কি শেষপর্যন্ত জড়িয়ে দিয়েছিল? …যতদিন যাচ্ছে মাথাটার বারোটা যেন বেজে যাচ্ছে। আগে কত মনে থাকত! বড়ো বড়ো হিসেব সব গড়গড় করে বলে ফেলতে পারত, এখন সব গেছে, এই এক বছরে মাথাটা যেন অন্য লোকের হয়ে গেছে!

দু’-একবার এপাশ-ওপাশ করে নরম গরম বিছানার মায়া ছেড়েছুড়ে উঠে পড়ল সুবোধ। লেপ ছাড়তেই ঘ্যাঁক করে কামড়ে ধরল শীত। ঘরের টিউব জ্বালল। পাশের চৌকিতে নীলিমা ঘুমোচ্ছে। আপাদমস্তক লেপে ঢাকা। ও কী করে যে মুখ ঢেকে ঘুমোয় সে এক বিস্ময়। তিপ্পান্ন বছরের সুবোধ কোনওকালেই চাদর বা লেপে মুখ ঢেকে ঘুমোতে পারে না। দম আটকে আসে। নীলিমা ঠিক উলটো স্বভাবের। ছেলেটার স্বভাবও ঠিক তাই। পুরো মুড়ি দিয়ে তারপরে ঘুমোয়।

ঘরের এককোণে লালুয়া চটের পাপোশের ওপর গুটিসুটি মেরে ঘুমোচ্ছিল, সুবোধকে উঠতে দেখে এখন পিটপিট করে দেখছে। তিন বছর বয়স হয়ে গেল মদ্দা কুকুরটার। শালুক, মানে সুবোধের ছেলেই নর্দমা থেকে তুলে নিয়ে এসেছিল কুকুরটাকে। লালচে হলুদ কুকুরটার তখন এই লিকলিকে চেহারা। নর্দমায় পড়ে ঠান্ডায় ঠকঠক করে কাঁপছে। বড়ো কুকুরের কামড়ে পিঠের অনেকটা ছালও উঠে গেছিল। সেই কুকুরবাচ্চাকে রীতিমতো সেবা শুশ্রূষা করে পুরো ফিট করে তুলেছিল শালুক। তারপর যা হয়, কুকুরটা আর গেল না এই বাড়ি ছেড়ে। নীলিমা মাঝে মাঝে ছেলের ওপর রাগ করে বলত বাড়িটা পুরো চিড়িয়াখানা করে ফেললি! কুকুর, খরগোশ, পায়রা, এরপর বন থেকে বাঘ ভাল্লুক নিয়েও পোষ, আমাদের মেরে খাক তবে তোর শান্তি হবে।

মায়ের কথা শুনে হাসত শালুক। খুব হাসত, আর হাসলে এত সুন্দর লাগে… সুবোধ তো নিজের ছেলের রূপ নিয়ে খুব ডাঁটে থাকে, এখনও। ওর বন্ধুদের গ্রুপে এমন সুন্দর রাজপুত্রের মতো চেহারা আর একজনেরও নেই। হোক না সুবোধ গরিব মানুষ, হোক না দুইবেলা ইস্তিরি ঘষে সুবোধের সংসার চলে কিন্তু এমন সুন্দর দেখতে ছেলে পাড়ায় কটা আছে? ছিলও না থাকবেও না।

ঘুমচোখে পা ঘষে ঘষে শালুকের কাছে এল সুবোধ। ছেলের দিকে তাকাল। ইসসস যা ভয় পেয়েছিল ঠিক তাই… আহা রে! পুরো রাতটা ঠান্ডার মধ্যে ছেলেটা… নিজের কপালটায় চটাস চটাস করে দুটো থাপ্পড় মারল সুবোধ। তারপর নিজের তোবড়ানো গালের ওপর বিজিবিজি পাকা দাড়িগুলোয় নিজের কেঠো আঙুলগুলো কয়েকবার বুলিয়ে নিল। নিজের পিছনেই লাথি মারতে ইচ্ছে করছে সুবোধের। শালা বাপ হয়েছে ও! নিজের ছেলের এইটুকু খোয়ালও রাখতে পারে না!

আলনা থেকে একটানে নীল রঙের শালটা নামাল। এটা শালুকের বড্ড প্রিয়। শালুক তাকিয়ে রয়েছে বাবার দিকে। সুবোধ নিজের ছেলের চোখের দিকে তাকাতে পারল না, বড়ো অপরাধী লাগছে নিজেকে। ক্ষমা কর বাবা, একেবারে ভুল হয়ে গেছে, জানিসই তো তোর বাপটা চিরকালের অপদার্থ! এই ঠান্ডায় আবার সর্দি হলে মাথা যন্ত্রণাটা বাড়বে তোর। সব জানি তাও যে কী করে ভুলে গেলাম। বিড়বিড় করে কথাগুলো বলতে বলতে শালটা দিয়ে ভালো করে নিজের উনিশ বছরের ছেলে শালুকের মাথা কান ভালো করে মাফলারের মতো পেঁচিয়ে দিল। চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে নামছিল সুবোধের। তারপর শালুকের নাকের ডগায় গালে হাত ঠেকাল। ইসস একেবারে ঠান্ডায় হিম হয়ে আছে ছেলেটা।

খুব ঠান্ডা লেগেছে না রে বাবা?

না বাবা আমার ঠান্ডা লাগেনি। বলল শালুক।

একবার তো ডাকবি আমাকে! আমার না হয় বয়স হচ্ছে আজকাল সবই কেমন যেন ভুলে যাই, আর তোর মা… তো ঘরে থেকেও নেই, কোনও কিছুতেই খেয়াল নেই শালীর। ছেলেটা সারা রাত এই যম ঠান্ডায়… একটা চাদর যে অন্তত গায়ে চাপিয়ে দেবে সেটাও মনে রাখে না। কতবার করে তোর মাকে বলেছিলাম, তোকে… কেউ শুনল না, তোর মাও না, তুইও না। এবার নে, ঠান্ডায় জমে বসে থাক। আমার কী! বলতে বলতেই বেশ ঝাঁঝিয়ে উঠে নিজের বিছানার দিকে যাচ্ছিল সুবোধ। আবার ফিরে এল। শালুকের গালে হাত রেখে বলল রাগ করিস না মনা। বকলাম তোকে।

না বাবা রাগ করিনি আমি, তুমি শুতে যাও। আমার শীত করছে না।

মাথায় ব্যথা করছে না তো?

না করছে না।

আচ্ছা। কাল বেলায় আমাকে একবার মনে করাস। একটু সরষের তেল গরম করে ভালো করে মালিশ করে তারপর চান করাব তোকে। ঠান্ডা যদি লেগেও থাকে সব পালাবে। আর কাল মনে আছে তো? কী দিন?

হ্যাঁ বাবা মনে আছে। বলে সামান্য হাসল শালুক।

এত সুন্দর করে কী করে যে হাসে ছেলেটা! দেখলে সব মন খারাপ হুশ হয়ে যায়। একটা দারুণ জিনিস এনেছি তোর জন্য। দেখবি খুব পছন্দ হবে তোর।

কী জিনিস বাবা?

উহুঁ আজ না কাল দেখিস। তোর মায়েরও বেশ পছন্দ হয়েছে। বলে নিজের বিছানায় শুয়ে পড়ল সুবোধ। আর শালুক তাকিয়ে থাকল কুয়াশার পাতলা পাতলা পর্দা ঢাকা ভোরের দিকে।

**

রবিবারটা সকলেরই ছুটি থাকে। প্রবুদ্ধ, সোনাল, অরিন্দম, নির্মাল্য একটু বেলা হলে চলে আসে সুবোধকাকুর দোকানে। ওরা সকলেই শালুকের বন্ধু। আগে যখন শালুক নিয়মিত দোকানে বসত তখনও আসত ওরা, এখন শালুক আর বসে না, তবু আসে। সুবোধের ইস্তিরি ঘরের ঠিক পাশেই শালুকের দোকান। পান, বিড়ি, সিগারেট, লজেন্স আরও টুকিটাকি জিনিস বিক্রির দোকান। সুবোধই দোকানটা করে দিয়েছিল ছেলেকে। টুয়েলভ পাশ করার পর আর পড়াশোনা করতে চাইছিল না শালুক। কোনওকালেই পড়াশোনায় তেমন মন ছিল না ওর। ছোটোবেলা থেকেই যার পায়রা ওড়ানোর শখ তার মনও আকাশেই ওড়ে। পড়ার বইয়ে আর বসতে চায় না। ক্লাস এইট পাশ সুবোধ ছেলেকে পণ্ডিত বানানোর কোনওদিনই স্বপ্ন দেখেনি। আর নীলিমাও তাই। আর শালুকের সেই মাথা যন্ত্রণার রোগটাও ছিল সাংঘাতিক। যখন তখন আসত। আর নিজেই ওষুধ খেত।

এইচএস পাশ করার পর বন্ধুরা যখন কলেজে ভর্তি হল তখন ছেলেকে নিজের ঘরেরই সামনে দোকান করে দিল সুবোধ। পাড়ার দোকান। মোটামুটি যেমন চলার তেমনই চলে। ছেলে ছোকরাদের ভিড়। ছেলের রূপের গর্বে গর্বিত সুবোধ শুধু শালুকের মুখের দিকে তাকাত আর ভাবত এমন রাজপুত্রের মতো চেহারা ছেলেটা পেল কী করে! এমন রং, ব্যাকব্রাশ করা এমন ঘন কালো চুল, সুন্দর নাক, ছুঁচলো চিবুক, পাতলা ঠোঁট, চোখের পাতাগুলো এত বড়োবড়ো। এমন চেহারা নিয়ে যেন কোনও বাজে মেয়ের খপ্পরে না পড়ে তাই নিয়েও অহরহ দুশ্চিন্তা সুবোধের। নীলিমা হাসত আর বলত, তোমার ওই পানবিড়িওলা ছেলেকে কোনও মেয়েই বিয়ে করবে না দেখো।

এহ্ বললেই হল! দেখো রাজকন্যাকে নিয়ে আসব বউমা করে।

কতযুগ আগের যেন সেইসব কথা। সুবোধ নিজের ইস্তিরি ঘরে দাঁড়িয়ে উনুনে লোহার ইস্তিরি গরম করে। তারওপর চাদর ঢাকা চওড়া টেবিলে খদ্দেরদের দিয়ে যাওয়া জামা, প্যান্ট, শাড়ি, সালোয়ার, ধুতি, পাঞ্জাবি একের পর এক ডলে যেতে থাকে। যত মনে পড়তে থাকে তত চাপ বাড়তে থাকে ইস্তিরির হাতলে।

সব ছুটির মতো আজও একটু বেলা হতেই প্রবুদ্ধ নির্মাল্যরা এসে পড়ল। আগে শালুক যখন দোকানে বসত তখন আড্ডাটা জমত দারুণ। কিন্তু ও যেদিন থেকে আর বসতে পারে না বন্ধুরা ভেবেছিল আর এই দোকানে কেউ অন্তত ছুটির দিনের সকালে আসবে না কিন্তু শেষ পর্যন্ত পারেনি সুবোধকাকুর জন্য। ওদের সকলের বাড়ি বাড়ি গিয়ে চিরকালের হাফ খ্যাপাটে লোকটা বলে এসেছিল হ্যাঁ রে তোরা কেমন বন্ধু। এতকাল একসঙ্গে রইলি আর যেই শালুক দোকানে বসতে পারবে না অমনি আসা ছেড়ে দিলি! তোরা না আসলে, ওর মনটা কেমন খারাপ লাগবে বল তো! আরে ওর হয়ে দোকান আমি খুলব। তোদের হাতজোড় করছি অন্তত ছুটির দিনগুলোয় ছেলেটার পাশে গিয়ে একটু বসে আগের মতো গল্পটল্প করিস।

প্রবুদ্ধরা বলতে চেয়েছিল কাকু বিশ্বাস করুন শালুককে ওইভাবে দেখতে আমাদের খুব কষ্ট লাগে… খুব! সেইজন্য ইচ্ছে হলেও ওর পাশে গিয়ে বসতে আর ইচ্ছে করে না। কিন্তু বলতে পারেনি কেউ। লোকটা আরও কষ্ট পাবে তাহলে। তাই ‘আচ্ছা কাকু আমরা আবার যাব ছুটির দিনে।’ কিন্তু কেউ যায়নি। যেতে পারেনি।

তার কিছুদিন পর নীলিমা গেছিল ওদের বাড়িতে। তোরা একটু ছুটির দিনগুলোয় পারলে যাস বাবা নইলে মানুষটাকে বাঁচাতে পারব না। জানিসই তো…

আচ্ছা কাকিমা যাব। আর না গিয়ে থাকতে পারেনি বন্ধুরা।

তারপর থেকে প্রতি ছুটির দিনে সেই আগের মতোই শালুককে ঘিরে সকাল সন্ধে গল্প করে ওরা। আর পাশের ঘরে ইস্তিরি চালাতে চালাতে সুবোধ কান খাড়া করে শুধু শোনে তার একমাত্র ছেলে শালুক, পাড়ার সবথেকে সুন্দর ছেলে শালুক কী গল্প করছে, কতটা হাসছে।

বেলা এগারোটা নাগাদ পৌঁছোল চার বন্ধু। গিয়ে দেখে তখন সুবোধকাকু হই হই করে শালুককে তেল মাখাচ্ছে। মাথায় মুখে কানে গলায় বুকে…

কী করছেন কাকু?

এই দেখ না তোদের বন্ধুর অবস্থা। ঠান্ডায় গালের চামড়া কেমন ফেটে গেছে। আজ এমন জম্পেশ করে তেল মাখাব সব ফাটাফুটি ভ্যানিশ হয়ে যাবে। আয় আয় দেখবি কেমন ফেটেছে দেখ বলে ওদেরকে কাছে ডাকল সুবোধ। চারজনেই এগিয়ে এসে মুখ ঝোঁকাল শালুকের মুখের সামনে। শালুক খুব হাসছে। কিছু বলছে না। বন্ধুরা দেখল শালুকের দুই গালে খুব সরু সরু ফাটা দাগ।

হ্যাঁ কাকু।

বল তো জন্মদিনের দিন এমন থাকলে মানায়? বোস তোরা, গল্প কর। আমি চানটা করিয়ে দিই ওকে।

গল্প আর কী করবে? প্রবুদ্ধ শালুকের দিকে তাকিয়ে বলল হ্যাপি বার্থ ডে শালুক। আজ সন্ধেবেলা সবাই আসছি। খুব আনন্দ হবে সবাই মিলে।

হ্যাঁ সন্ধের মধ্যে চলে আসিস সবাই। কাজ করতে করতে উত্তর দিল সুবোধ। তারপর বলল, তোরা এক কাজ কর তো। ঘরের ভেতর দেখ একটা হ্যালোজেন আছে আর সাউন্ড বক্স। কালকেই নিয়ে এসেছি। হ্যালোজেনটা বারান্দায় বেঁধে ফেল আর বক্সটা ফিট করে তোদের যা ইচ্ছে গান শোন, হই হই কর অমন চুপ করে বসে আছিস কেন বন্ধুর জন্মদিনে?

আচ্ছা কাকু করছি। উঠল চারজনে একরকম জোর করেই। শালুক সব দেখছে আর হাসছে। বন্ধুরা হ্যালোজেন লাইট বাঁধল, সাউন্ড বক্স ফিট করল আবার তার মাঝে শালুকের দোকানে যেসব খদ্দের টুকিটাকি জিনিস কিনতে এল তাদেরও জিনিস দিল। আর ওদিকে সুবোধ পুরো দুই বালতি জলে শালুককে স্নান করিয়ে নতুন গামছা দিয়ে ভালো করে মোছাল। তারপর শালুকের কপালে একটা চন্দনের ফোঁটা দিয়ে প্রবুদ্ধদের জিজ্ঞাসা করল বল এবার কেমন লাগছে তোদের বন্ধুকে।

খুব সুন্দর কাকু।

দেখবি রাত্রে তোদের বন্ধুর জন্য যা একখানা জিনিস এনেছি না। কাল রাতেও বলেছি তোদের বন্ধুকে। খুব দেখতে চাইছিল আমি দেখাইনি। একবারে রাতে দেখাব।

হ্যাঁ কাকু সেই ভালো।

তোরা বোস আমি পায়রাগুলোকে উড়িয়ে দিই একবার।

চার বন্ধু চুপ করে দেখল সুবোধকাকু ঘরের পিছনের মাচায় উঠে পায়রার খোপগুলো খুলছে। কত রকমের যে পায়রা রয়েছে শালুকের। গোলা, লককা, গিরিবাজ, চিলা। এইসব নাম শালুকের কাছ থেকেই জানা ওদের। একেক পায়রা একেক রকম স্পেশাল। কারও পেখম ময়ূরের মতো কেউ আকাশে উড়তে উড়তে দারুণ ভল্ট খায়। হাততালি আর বিশেষ রকমের সিটি দিয়ে পায়রা ওড়াত শালুক। খুব নেশা ছিল পায়রা ওড়ানোর। কম্পিটিশনে নামও দিত। ওর একজোড়া গিরিবাজ পায়রা রয়েছে সে দুটোর দারুণ ওড়ার দম। সকালে উড়িয়ে দিলে সন্ধে হয়ে গেলেও নামতে চায় না। শালুক যেখানেই খবর পেত কেউ ভালো জাতের পায়রা বেচতে চাইছে অমনি সাইকেল চালিয়ে ছুটত সেখানে, কিনে আনত সেটা। শালুকের কাছেই সোনালরা শুনেছিল অনেক সময় অন্য কোথাকার পায়রাকেও নিজের পায়রাদের দিয়ে ভুলিয়ে পোষ মানিয়ে ফেলা যায়। ঘণ্টার পর ঘণ্টা আকাশের দিকে তাকিয়ে পায়রা ওড়াতে এতটুকু ক্লান্তি ছিল না শালুকের। খুব আনন্দ পেলে বলেই ফেলত একেক সময়, এর পরের জন্মে মাইরি পায়রা হয়ে জন্মাব, আর শুধু উড়ব।

সেই ছেলেটাই এখন সারাদিন চুপচাপ হয়ে শুধু তাকিয়ে থাকে।

আজ পায়রাগুলোকেও খুব ভালো দানা খাওয়াব বুঝলি। আর শোন তোরা শুধু চারজনেই আসিস না। তোদের গ্রুপের যত বন্ধু আছে সকলকে তো আমি চিনি না, প্রত্যেককে নিয়ে আসিস কিন্তু। খাবারের কোনও অভাব হবে না। বুঝলি?

আচ্ছা কাকু।

গোটা বেলাটা শালুকের সামনে কাটিয়ে দুপুরে বাড়ি ফেরার সময় সোনাল বলল, আমার একটুও আসতে ইচ্ছে করছে না।

আমারও না। কিন্তু আসিস নইলে কাকু…

হ্যাঁ আসব।

আর কাকে বলবি?

অয়ন, মারুফ আর অর্পণকে বলা যেতে পারে।

দ্যাখ।

আচ্ছা ফোনে বলে নেব।

***

সন্ধেবেলা থেকে হ্যালোজেনের চড়া আলো সুবোধকাকুর বারান্দায় কিছুটা রাস্তায়। সঙ্গে বক্সে গান, শালুকের বন্ধুদের গল্প। যতটা না আনন্দ আসছিল তার থেকে একটু বেশিই দেখাতে হচ্ছিল ওদের। চুপ করে গেলেই সুবোধকাকু এসে বলছিল কী রে চুপ করে বসে আছিস কেন? গানবাজনা কর। ওই দেখ তোদের বন্ধু কেমন হাসছে আজ এতদিন পর তোদের সকলকে পেয়ে। আর ড্রেসটা কেমন পরিয়েছি বল?

হ্যাঁ কাকু খুব সুন্দর হয়েছে, প্রশংসাটা করতে গিয়ে গলা শুকিয়ে গেছিল শালুকের বন্ধুদের। আজ বন্ধুরা মিলে শালুককে উপহার দিয়েছে একটা ধপধপে সাদা খরগোশ ছানা।

সুবোধ বলেছে ঘরে তো একটা রয়েছে, আবার আর একটা আনলি কেন?

আর একটাও থাকুক কাকু।

আচ্ছা থাক।

নীলিমা শালুকের বন্ধুদের জন্য লুচি ছোলার ডাল, খাসির মাংস রান্না করছে। রান্না করতে করতে বার বার ভুল হয়ে যাচ্ছে তার। এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে সবকিছু।

কেমন ফিটিং হয়েছে বল জ্যাকেটটা? খুব অহংকারের হাসি নিয়ে ছেলের বন্ধুদের জিজ্ঞাসা করল সুবোধ। একটা নীল রঙের জ্যাকেট শালুককে আজ পরিয়েছে ওর বাবা। সুন্দর দেখতে।

খুব সুন্দর হয়েছে কাকু।

দ্যাখ দ্যাখ তোদের বন্ধুর কী হাসি দ্যাখ? বলে এমনভাবে শালুকের গাল টিপে দিল সুবোধ যেন এখনও ও ক্লাস টু-তে পড়ে। অবশ্য চিরকালই সুবোধের এমন স্বভাব। ছেলে যে বড়ো হয়েছে তা যেন খেয়ালই পড়ে না। এই বছর দেড়েক আগেও শালুক যখন এইচএস পরীক্ষা দিচ্ছে সুবোধ ওকে নিজের সাইকেলের হ্যান্ডেলে বসিয়ে স্কুল নিয়ে যাওয়া আসা করেছে, ওকে একা সাইকেল চালাতে দেয়নি। এত বেশি ছেলে ছেলে… আসলে নীলিমা বোঝে, বিয়ের ন’বছর পেরিয়ে যাওয়ার পরও যখন ওর পেটে কেউ আসছে না, ডাক্তার ওষুধ পির মন্দির সব করতে করতে হয়রান তখন আচমকাই একদিন ভগবান মুখ তুলে চাইলেন। শালুক এল। সে যে কী আনন্দ সুবোধের। বড্ড শখ ছিল একটা বাচ্চার। শালুককে পেয়ে যেন মানুষটা এক পৃথিবী আনন্দে ভরে উঠেছিল। সারাক্ষণ শুধু ছেলে আর ছেলে। নীলিমা মা হয়েও যা করে উঠতে পারত না সুবোধ যেন সেটুকুও করে ফেলত। গোটা জীবনটাই শুধু শালুকে ভরা হয়ে উঠেছিল সুবোধের।

পথচলতি মানুষরা যেতে যেতে একবার থমকে দাঁড়িয়ে দেখল ব্যাপারটা কী ঘটছে। যারা পাড়ার পরিচিত তারা বুঝল যারা অপরিচিত তারা কিছু না বুঝেই কয়েক মুহূর্ত হাঁ করে তাকিয়ে কিছুই না বুঝে আবার হাঁটা লাগাল।

আজ শালুক তোদের সঙ্গেই খাবে।

হ্যাঁ কাকু। আমরা আজ একসঙ্গে খাব।

শালুকের জন্য আজ নতুন থালা বাটি গ্লাস। তাতে লুচি মাংস ছোলার ডাল পায়েস। শালুক আজ যেন বেশি হাসছে। বন্ধুদের সঙ্গে কত খুশিতে খাচ্ছে শালুক। কতদিন পর আবার গুছিয়ে খাচ্ছে…। বারান্দার এককোণে দাঁড়িয়ে অবশ হয়ে দেখছিল সুবোধ। নীল রঙের জ্যাকেটটা পরে কী সুন্দর লাগছে! ওর বন্ধুদের মধ্যে সেরা।

অনেক রাত। পৃথিবীর সকলে ঘুমিয়ে পড়েছে। চোখ বুজে অনেকক্ষণ ভাবতে ভাবতে হঠাৎই চোখ মেলল নীলিমা। আজ তারও ঘুম আসছে না। একেক সময় মনে হয় বুক ফাটিয়ে কাঁদতে, কিন্তু তাহলে ওই মানুষটাকে আর বাঁচানো যাবে না। পাশ ফিরে নাইটল্যাম্পের আবছা আলোয় দেখল ঘরে সুবোধ নেই। নীলিমা জানে লোকটা কোথায় গেছে। লেপের ওম ছেড়ে উঠল। বারান্দার ভেজানো দরজাটা অল্প ফাঁক করে দেখল এক ভেঙেচুরে যাওয়া বাবা অন্ধকারে তার ছেলের সামনে বসে আছে। তার গায়ে মাথায় হাত বুলোচ্ছে আর বলছে তুই খুশি হয়েছিস তো বাবা? আমি কত করে মিস্তিরিকে বলেছিলাম শুধু বুক পর্যন্ত কেন বানাচ্ছ? পুরোটা চাই আমার ছেলে নইলে নড়াচড়া করতে পারবে না। কেউ শুনল না। জ্যাকেটটা তোকে বড়ো সুন্দর লাগছে… তোর হাতদুটো থাকলে আরও কত ভালো লাগত বল তো? কেউ শুনল না!…

উনিশ বছরের ছেলের শ্বেত পাথরের মূর্তির মাথায় গালে বুকে বার বার হাত বোলাচ্ছিল সুবোধ আর বলে চলেছিল তোর মাথায় ব্যথাটা আর নেই তো সোনা? ব্যথা হলে আমাকে এবার আগেই বলিস আর চুপ করে থাকিস না সোনা… আর নেই তো?

শালুক হাসছে। ওর বুকের পর থেকে যে চৌকো থামের মতো পাথরের পিলার তার অনেকটা পর্যন্ত ঝুলে রয়েছে জন্মদিনে বাবার পরানো জ্যাকেট। ওই কাপড়ের আড়ালে ঢাকা পড়ে আছে পাথরের ফলকে কালো রঙে লেখা একটা ছোটো লাইন। শালুক মজুমদার। জন্ম ১৮ অক্টোবর ১৯৯৭।

প্রেম-অপ্রেম

তারুণ্যে ভরপুর সেগুনগাছগুলো অল্প বাতাসেই বেশ মাথা নাড়ায়। মেন রোডের ধারে বাড়ি বলে দূষণের ছাপ বাড়ির গায়ে পড়েছে। সেগুনগাছগুলোর পাতার উপরেও। কর্পোরেশনের জল ইদানীং মানে কয়েক বছর হল চালু হয়েছে। সে জল নিতে হলে ছ’খানা গাছের মাঝবরাবর হেঁটে যেতে হয়। গাছগুলোর শিকড় এখনও পোক্ত নয়। মোটে পোক্ত নয়, বলতে গেলে কচি-ই। পাথুরে শক্তমাটি ভেদ করে মাটির গভীরে যেতে সময় চাই। অথচ কর্পোরেশনের জল এখন ঘরে ঘরে। দু’দিন পর পর রাস্তা ফুটো করে পাইপ বসে যায়। ঘরে পাইপ ঢোকা মানে আর রাস্তার কলে লাইন দিতে হয় না।

মনোজিৎ ভেবেছিল ওসব ঝামেলায় যাবে না। কুয়ো আছে। ভাবনা কী? গ্রুপ ডি-তে চাকরি করেও রিটায়ারের সময় দেদার টাকা এসেছে হাতে। তো, এত টাকা কি সব ভবিষ্যতের ভাঁড়ে জমা হবে। বর্তমান যদি হাঁপায়, ভবিষ্যৎ আসবে কী করে? সবকালেই টাকার খেলা চলে। ছেলে কুণাল বুদ্ধি দেয় বাপকে। মাধ্যমিক পাস কুণালের মাথায় বুদ্ধি গজগজ। কুয়ো এখন সমাজে অচল। পরিশ্রুত জল না খেলে সোসাইটিতে মান থাকে না। সোসাইটি এখানে পায়েল। কুণালের ধ্যান-জ্ঞান। সুতরাং বাড়িতে কর্পোরেশনের জল এল। দুটো সেগুনের মাঝবরাবর পাইপ ঢুকে গেল। মনোজিৎ স্নেহভরে সেগুনদের দ্যাখে। একদিন এরা মহীরুহ হবে। এত বড়ো বড়ো পাতা। চমৎকার বাতাস দেবে। জল এসেও স্বস্তি হয়েছে। ছেলেটা খুশি। মনোজিতের হাতে এখনও প্রচুর পয়সা।

শ্যালক বিবস্বান এসেছে জলপাইগুড়ির আদরপাড়া থেকে। এসেছে চকচকে অল্টো চেপে। গাড়ির হর্নে অ্যাম্বুলেন্সের ধামাকা। দেখেশুনে কুণালের মাথা খারাপ। মাতুলের প্রশ্রয় মিশে গেল এর সঙ্গে। জামাইবাবুকে আড়ালে ডেকে নিল বিবস্বান। সানগ্লাস খুলে পকেটে ঢোকাচ্ছে ও। দেখে খাপে ঢাকা ছুরি ভেবে চমকে উঠেছিল মনোজিৎ। দিনকাল ভালো নয়। স্বজনকেও ভয় হয়। হাতে পয়সা এসেছে কিনা!

‘বুদ্ধি খরচা করো মনোজিৎদা। সঙ্গে টাকাও। ভবিষ্যৎ তোমার ছেলে। ভয় কী?’ বিবস্বানের ধূর্ত চোখে বদবুদ্ধির পটাকা ফোটে। শ্যালককে খুব একটা বিশ্বাস করে না মনোজিৎ। নিজের লোককেই ভয় বেশি। কারণ, ঘরের খবর সে-ই জানে বেশি, দুর্বলতার সুযোগও সে-ই নেবে বেশি। ইদানীং কুণালের মন উড়ু উড়ু। পকেটে দামি মোবাইল। দামি বাইক। অ্যান্টি ড্যানড্রফ শ্যাম্পুর চুলে হাইলাইট। হাসি-কাশি সবই চেঞ্জ হয়ে গেছে ছেলের। মামার দেখাদেখি এখন আবার অল্টো না চায়।

জামাইকে আনমনা হতে দেখে সাবধান হল বিবস্বান। মেপে পা ফেলতে হবে। বিবস্বানের পরিচিত মানে সুপরিচিত সোমেশ দাসের মেয়েকে ছেলের বউ করে মনোজিতের ঘরে ঢোকাতে হবে। এ কাজটা পারলে সোমেশের কাউন্সিলার ভাই দীপেন দাসের নেকনজর পাবে বিবস্বান। নজরটা ঠিকঠাক পেলে ঠিকেদারির ব্যাবসা জমে ক্ষীর হয়ে যাবে। সেই ক্ষীরে কিশমিশ আর এলাচের গন্ধ। লোকবলঅলা সংসারে অর্থবল না থাকায় কাজু-টাজু অনেক দূরের বস্তু ছিল। ইদানীং অবস্থা পালটেছে। তাই মাঝেসাজে রূপশ্রী সিনেমা হলের পাশের মিষ্টান্ন ভান্ডার থেকে ছানা আনে ছেলেদের জন্য। আপেল আনে বিধান মার্কেট থেকে। তাও শালা দাম কম নাকি?

‘ছেলেকে কিছু তো করে দিতে হবে। মার্কেট প্লেসে একটা স্টেশনারি দোকান দিয়ে দিই?’ মনোজিৎ শ্যালকের চতুর পরামর্শ চায়। শ্যালকটাকে খুব বিশ্বাস করে না মনোজিৎ। বিবস্বান এত টাকা পায় কোথায়? জাল নোট-ফোটের কারবার করে না তো!

‘তুমি জানো মনোজিৎদা, মার্কেট প্লেসে অ্যাডভান্স কত দিতে হয়? বাড়ির সামনের সেগুন কেটে ফ্যালো। দোকান লাগিয়ে দাও। ফাইন।’

‘সেগুন?’ অবাক হয় মনোজিৎ, ‘ওতো সবে বাড়ছে। শিকড় নড়বড়ে। কেটে কী লাভ? তাছাড়া শেকড় মাটির ভেতরে যাবে, তবেই শক্ত হবে। পোক্ত হবে!’ মনোজিৎ বিড়বিড় করে।

‘ধুর! মাটি শক্ত হয়ে উঠেছে। শেকড় বেশি গভীরে যাবে কী করে? আর মাটি কোথায়? সবই পাথর।’ বিবস্বান শব্দ না করে হাসতে থাকে– ‘পড়াশোনা ছেড়ে না দিলে ও একদিন অফিসার হতে পারত। স্টেশনারি দোকান ওকে মানায় না! এসটিডি বুথ খুলে দাও। সঙ্গে ফিল্মের সিডি, মিউজিক সিডি, মোবাইলের হ্যান্ডসেট… খুব চলবে।’ বিবস্বান সন্তর্পণে মূল ঘটনার দিকে এগোয়– ‘এখন শিলিগুড়ি জমে উঠেছে। নানা ধরনের লোক ভিড় জমাচ্ছে এখানে। আরে জামাইবাবু, তুমি তো পারলে না! ছেলেকে টাকা ধরতে শেখাও। এরপর বিয়ে আছে, ভালো মেয়ে চাই, তাই না? কচি সেগুনই বেচে দাও। শেকড়বাকড় বেশি গভীরে না যাওয়াই ভালো, বুঝলে?’

শ্যালকের ইঙ্গিতমতো শোরুম খুলে দিয়েছে মনোজিৎ। ‘দোকান’ শব্দটা পছন্দ নয় কুণালের। আসলে ইদানীং, অনেক কিছুই ঠিকঠাক বোধগম্য হচ্ছে না। শিলিগুড়ির জল বাতাসে কীরকম একটা গন্ধ ভাসছে। শপিং মল, বিগবাজার, সিনেম্যাক্সে বিদেশি ছবি…। সানি আর বাসব সেদিন কোন হোটেলে নাকি ফ্যাশন শো দেখতে গেছিল। একটা মডেল নাকি দীপিকার মতো দেখতে। দীপিকা পাড়ুকোন। পায়েলও তো দীপিকার মতো দেখতে। ওরও খুব মডেলিং-এর শখ। লোকাল কেবল চ্যানেলে অ্যাংকারিং করে। পরিচিত মুখগুলো কী করে যেন ক্যামেরার মুখ হয়ে উঠেছে। মাথাটা পাগল পাগল ঠেকে কুণালের। অনেক টাকা চাই। ইদানীং পায়েল বড্ড উড়ু উড়ু করছে!

বিবস্বান জানতো এমনটাই হয়ে থাকে। সময়টা বড্ড উদ্ভ্রান্ত। বয়সটাও। কী করবে কেন করবে বুঝতে পারছে না এরা। হঠাৎ করে মোটা টাকা হাতে এসে যাওয়ায় টলমল করছে দিদির পরিবার। বর্ধমান রোডে বিরিয়ানি খাওয়াতে নিয়ে গেল ভাগ্নেকে। সেখানে বসে জীবনের মূল অর্থ, অর্থ বিনা অনর্থ সম্পর্কে বিশদ জ্ঞান দিল বিবস্বান মামা। বিরিয়ানির পাশাপাশি মামার কথা গিলছিল ভাগ্নে। শেষে তুরুপের তাস বের করল বিবস্বান– ‘বিয়ে কর। একটা বিয়ে তোকে করতে হবে।’

‘সে তো করব। আগে দাঁড়িয়ে নিই!’ কুণাল মৌরি চিবুচ্ছিল।

‘কবে? বুথ আর সিডির শোরুম তাড়াতাড়ি দাঁড়াতে দেবে? টাকা চটপট ধরতে চাইলে ডিসিশনও চটপট নিবি। দু’হাত ভরে পাবি, এমন একটা বিয়ে চাই। সঙ্গে পাওয়ারফুল শ্বশুর।’

কুণাল ভাবছিল পায়েলের কথা। পায়েল কোনওদিন কি মডেল হতে পারবে? ওর বাবা প্রাইমারি স্কুলের রিটায়ার্ড মাস্টারমশাই। কখনও তোবড়ানো স্কুটি চেপে নিউ সিনেমার পেছনে শেষবেলায় ঝড়তি পড়তির বাজার করে। লোকটা কুণালকে কতটা সাপোর্ট দেবে? কিন্তু পায়েল? দীপিকার মতো টোল ফেলে হাসে। পায়েলকে ছেড়ে দেবে? দিয়ে? টাকার বান্ডিল নিয়ে কে আর আসবে কুণালকে শাদি করতে?

‘আমার উপর ছেড়ে দে! তোর মত আছে মানে বাড়িতে সানাই বাজল বলে। রাজ ক্যাটারারকে রেডি থাকতে বলিস।’ হাসতে থাকে বিবস্বান। কুণাল কিন্তু কিন্তু করে– ‘আমার একটা রিলেশন আছে। এখন… পয়সা নেই তাদের। কী করা উচিত?’ কুণাল মোবাইল ফোনে পায়েলের হাসিমুখ দ্যাখে– দেখতে ফাইন। দারুণ নাচে। হিন্দি ডান্স। ‘ধুর! বলে দে শোরুম চলছে না! বাবার হাতে টাকা এসেছে সেকথা বলেছিস নাকি? খবরদার! শোন্, প্রেম করবি টাকার সঙ্গে। বাকি সব ফালতু। জীবনে টাকা থাকলে সব থাকে কুণাল, টাকা নেই মানে, তুমি ফালতু।’

‘বাবার হাতে টাকা কোথায়? আমার শোরুম, জলের লাইন, ফ্রিজ, কুলার, ডাইনিং টেবিল, মায়ের সোনার বালা, জামাইবাবুর জন্য সোনার চেন, দিদির ঝুমকো… মেঝেতে টাইলস…! কম লাগল?’ কুণাল হতাশ– ‘রিটায়ার করতে করতেই টাকা হাওয়া।’

‘শোন, তাহলে এখনই তোর টাকার দরকার। প্রথম কাজ হল প্রেমিকাকে ছেঁটে দে!’

প্রায় চমকেই উঠল কুণাল। কত সহজে বলে ফেলল মামা কথাটা। কী ভাববে পায়েল? সম্পর্কটা টেনে চলেছিল কুণালই। অথচ এখন ও-ই পিছিয়ে যাচ্ছে! অথচ কাজটা করতে হবে! মামা ভুল বলেনি কিছু! পায়েলও নাচতে চায়। বিখ্যাত হতে চায়। বিয়ে করতে চায় না। তবু… একটা প্রেম প্রেম ব্যাপার তো ছিল। কিন্তু মামা যা বলে, তা ঠিকই!

বিকেলে হুক্বাবারের পরের গলিতে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে শেখানো কথা উগরে দেয় কুণাল। অবাক চোখে ওকে দেখল পায়েল। অবশ্য খুশিই হল। কত রঙিন দুনিয়ার হাতছানি চারধারে। রিয়ালিটি শো-এ একটা সুযোগ করে দেবে সুরযদা। এখন কেউ কুণালের সঙ্গে প্রেম করে?

পায়েলকে ছেঁটে দিয়ে ফিরে আসতে আসতে শাহরুখের দেবদাসের ডায়লগ বলতে ইচ্ছে করছিল। কিন্তু মনেই করতে পারল না। সময়মতো কিচ্ছু মনে পড়ে না। অথচ মনটা খারাপ খারাপ লাগছে যেন। পাঁচদিন পরে কাউন্সিলারের ভাইয়ের মেয়েকে দেখতে গেল ও। মনোজিৎ চুপচাপ মুখবন্ধ করে চশমা পরে বসে আছে। বড়োলোকের উচ্চ মাধ্যমিক পাস মেয়ের জন্য কুণাল কেন? কুণাল কি কিছু আন্দাজও করতে পারে না! মেয়েটাই বা রাজি হল কেন কুণালকে বিয়ে করতে? বাবার প্রশ্নের জবাব দিতে পারে না কুণাল। পারে না বলেই সারা বিকেল সেভকে গিয়ে কাটাল একা একা। সন্ধে নাগাদ বাড়ি ফিরছিল স্পোর্টিং ক্লাবের পাশ দিয়ে। পাত্রীর বাবা সোমেশ দাসের মুখোমুখি হয়ে পড়ল। হাসিমুখে পথ আটকাল দাস– ‘কোতায় যাওয়া হচ্চে?’ কুণাল দেখল সোমেশ দাসের হাতে গাড়ির চাবি। আই-টেন গাড়ি। এইসব গাড়ির স্বপ্ন কতদিন ধরেই দেখছে কুণাল!

‘চলো। আজ অঙ্কিতার বার্থ ডে। তোমারই প্রেজেন্ট থাকার কথা আজ।’ ‘কিন্তু’ কুণাল তো তো করে। বার্থডে মানে গিফটের প্রশ্ন আসছে। সোমেশ দাস টিপটিপে হাসিমুখে সমাধানের রাস্তা বাতলায়– ‘জীবনে হাজারবার অঙ্কিতা মানে তোমার ওয়াইফের বার্থডে আসবে। অনেক সময় পাবে গিফট্ দেওয়ার। নাউ, লেটস্ গো!’

যাব কি যাব না ভেবে ভেবে কুল পায় না কুণাল। মামা বিবস্বান বিবেকের মতো পাশে থাকে ভাগ্নের– ‘টাকা না থাকলে কেউ পাত্তা দেয় না!’

মাথা থেকে সব দুশ্চিন্তা ঝেড়ে ফেলে কুণাল। আমি ঠাকুর হাবলা গোবলা। যা করাও তাই করি– ভাব নিয়ে সোমেশ দাসের গাড়ির পেছন ধরল ওর বাইক। হাজার বছর ধরে জন্মদিন উপভোগ করার মতো ভাগ্যবতী এক আয়ুষ্মতীর একটি জন্মদিনকে সমৃদ্ধ করতে ছুটছিল ও। এখন পায়েল অতীতমাত্র। সামনে অন্য নারী যার হাত ধরে কুণাল ছুটবে। চারধারে টাকা উড়বে। সব টাকা ধরবে কুণাল। হাত ভরে টাকা তুলবে ঘরে। পাঁচজনের সামনে বুক ফুলিয়ে দাঁড়াবে। খাওয়াদাওয়ার জম্পেশ ব্যবস্থা ছিল। সোমেশের মেল মারফত আমন্ত্রণ জুটেছে বিবস্বান আর মনোজিতের। তেতলার ব্যালকনিতে অঙ্কিতার সঙ্গে বসে প্রাক-অনুরাগপর্ব সেরে নিচ্ছিল কুণাল। ওদিকে বিবস্বান ব্যাবসায়িক কথাবার্তা পাকা করে নিচ্ছিল। ‘দাদাকে বলে মোটা ঠিকেদারি দিতে হবে। নির্ভেজাল জামাই দিচ্ছি! সোনার চাকা। গড়গড় ছুটবে। ঝলক দেখবেন কেবল!’

সোমেশ টিপটিপ হাসে, ‘আমিও কম দিচ্ছি না। জামাইকে তুলব। সঙ্গে তার মামাকেও!’

তেরিয়া মেজাজ সামলেও অস্ত্র দেখাতে বাধ্য হল বিবস্বান, ‘তুলব মানে? তুলছি তো আমি! তোমার মেয়ের দুটো কেচ্ছা হজম করেছি! থার্ড হ্যান্ড মাল! নার্সিংহোমে গেছিল যেন কবে?’ নীচু স্বর বিবস্বানের। ব্যাবসার কথা! চ্যাঁচাতে নেই।

সুশৃঙ্খল ভাবে আলোচনাচক্র শেষ হল একসময়। জামাইবাবুকে নিয়ে অল্টোতে উঠে বসে বিবস্বান।

‘সব ঠিক আছে তো মনোজিৎদা? পাত্রী… বাবা… মা… বাড়িঘর…’

‘হ্যাঁ! লোক ভালো!’ মনোজিৎ বিজ্ঞের ভান করে। এছাড়া উপায় কি! দিনকাল হুড়মুড় করে পালটাচ্ছে। তার জীবনের সঙ্গে তার ছেলের জীবনের কত পার্থক্য। পাত্রী দেখা নিয়ে কত রোমাঞ্চ ছিল সেই সময়ে। সেই রোমাঞ্চ বিবাহিত জীবনেও শাল-সেগুনের শেকড়ের মতো গেড়ে বসত। এখনও ইচ্ছে করলে বউ-এর লাজুক মুখটা মনে করতে পারে। প্রথমদিন দেখা হওয়ার সেই লাজুক মুখ। অথচ কুণালের কোনও মানসিক বৈকল্য নেই। তবে ছেলের পেছনে ভারীসারি শ্বশুর থাকলে ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবনা নেই। কিন্তু ভরসাই বা কি? মেয়েটা কেমন হবে…! তাছাড়া, সারা বাড়ি জুড়ে বড্ড বদ টাকার গল্প!

একটু আগে হবু শ্বশুরের গাড়ির পেছনে চলছিল, এবার মামার গাড়ির পেছনে চলছে কুণালের বাইক। অল্প অল্প বাতাস দিচ্ছে। আরাম হওয়ার কথা। কুণালের শীত করছিল। নিজেকে গরম রাখতে ছোটে ও। দেখে মনে হচ্ছে বাইকটা গাড়িটাকে ছুঁতে চাইছে। খুব শিগগির ওরও গাড়ি হবে। বাকি সব ক্রমান্বয়ে আসবে। প্রাপ্তির হাজার সম্ভাবনার মধ্যেও এমন শূন্যতা কেন চারধারে! বোধহয় থমকে গেছিল কুণাল। বিবস্বানের মুখ গাড়ির জানলায়– ‘কী হল? তাড়াতাড়ি আয়! কাল আবার কীসের বনধ্! অনেক কাজ! আয়।’

সেই অমোঘ আহ্বানকে উপেক্ষা করতে পারে না কুণাল। কার্গোর ছ’টা পকেটের একটা থেকে মোবাইল ফোনটা বের করে। সামনে নতুন জীবন। গতস্য শোচনা নাস্তি। পায়েলের ছবিটা ডিলিট করতে করতে বিড়বিড় করে কুণাল, ‘ধুর! প্রেম করে কী লাভ? বেকার সময় নষ্ট। শ্বশুর বড়লোক হলে তবু কথা ছিল। না হলে কী লাভ?’

এলওভিই লাভ এখন হিসেবের দাঁড়িপাল্লায়। কিস্যু করার নেই কুণালদের। এখন শাল-সেগুনের শেকড় পোক্ত হওয়ার সময় পায় না। রোমাঞ্চ টোমাঞ্চ সেইরকম। পালটে যাচ্ছে পরিবেশ। পালটে যাচ্ছে মানুষ। চারধারে জাল জুয়াচুরি। কোথায় পৌঁছোতে চায় মানুষ, তারা নিজেও জানে না! সময়টা বড্ড উদ্ভ্রান্ত। ঠিকই ধরেছে বিবস্বান। মাটি শক্ত হয়ে উঠেছে। শেকড় এখন আর বেশি গভীরে যায় না। অল্পেই শুকিয়ে যায়।

প্রতীক্ষাপ্রান্তর

অসীম টুরে গেছে পাঁচ দিনের জন্য, তিতির কলেজে। কারেন্টও নেই। একা বাড়িতে লম্বা দুপুরটা কাটতে চাইছিল না। আজকের কাগজটা নিয়ে বিছানায় গড়াচ্ছিল নন্দিনী। এ পাতা থেকে ও পাতায় এলোমেলো উদ্দেশ্যহীন ঘুরতে ঘুরতে আচমকাই চোখটা পার্সোনাল কলামে আটকে গেল। ডান দিকের কোণে একদম তলার দিকে ছোটো ছোটো কয়েকটা অক্ষর। আলাদা করে সেইভাবে চোখে পড়ার কথাই নয়। তবু পড়ল। হয়তো পড়ার ছিল বলেই। ‘জেনিফার ক্যাথারিন ম্যাকলেন অফ হ্যাপি নুক, জোরহাট– পাসড অ্যাওয়ে পিসফুলি, অ্যাট হার রেসিডেন্স। ফিউনারেল মাস অন’…

জেনিফার ম্যাকলেন? জোরহাটের জেনিফার ম্যাকলেন? এই নামে অনেকদিন আগে একজনকে চিনত না নন্দিনী? হ্যাপি নুকের জেনিফার ম্যাকলেন বলতে তো একজনের কথাই মনে পড়ে। মিস ম্যাকলেন তাহলে এতদিনে মারা গেলেন। কে দিল নোটিসটি? চার্চ থেকেই হবে নিশ্চয়ই। নন্দিনী অন্যমনস্কভাবে হাতের কাগজটা ভাঁজ করে। আশ্চর্য, একেবারে ভুলেই গিয়েছিল মহিলার কথা।

অসীমের পোস্টিং তখন ছিল অসমের জোরহাটে। জোরহাট টাউন থেকে একটু দূরে কিছুটা ভেতরের দিকে ছিল ওদের বাড়িটা। বেশ নির্জনই ছিল পাড়াটা সেই সময়। প্রচুর জায়গা, বাগান, ফলের গাছ-টাছ নিয়ে এক একটা বাড়ি। এরকমই একটা বাড়ির একতলাটা অসীমের অফিস থেকে তাদের জন্য ভাড়া নেওয়া হয়েছিল।

কলকাতায় ও রকম বাড়ি স্বপ্নের অতীত। বিরাট বড়ো বড়ো চারখানা ঘর, আলো ভরা বাথরুম, বাদশাহি রান্নাঘর, সঙ্গে আলাদা প্যান্ট্রি, চারদিক ঘুরিয়ে কাঠের জাফরি ঝোলানো টানা বারান্দা, মানে এককথায় এলাহি ব্যাপার। কিন্তু এত বড়ো বাড়িতে সারাদিন একা একা কাটাতে নন্দিনীর দম বন্ধ হয়ে আসত। তাদের মানিকতলার বাড়িও যথেষ্ট বড়ো। কিন্তু সেখানে ছিল কাকা-কাকি, জ্যেঠা-জেঠি তুতো ভাইবোন সবাইকে নিয়ে বিশাল যৌথ পরিবার। চেষ্টা করলেও ওবাড়িতে একা থাকা যেত না।

সেই হট্টমালার দেশ থেকে বিয়ে হয়ে এসে পড়ল এই ভূতবাংলোয়। ঘর মোছা, বাসন মাজার জন্য একজন আর কাপড়চোপড় কাচার জন্য একজন, এই দু’জন স্থানীয় আদিবাসী কাজের মেয়ে ছিল, কিন্তু সারাদিনের জন্য নয়। সকাল সকাল এসে দশটার মধ্যে সব কাজ সেরে তারা চলে যেত। কতটুকুই বা কাজ থাকত দুজনের সংসারে। তাদের ওদিককার ভাষাও নন্দিনী সবটা ঠিকঠাক বুঝে উঠতে পারত না। ফলে সঙ্গী হিসেবে তারা খুব একটা অন্তরঙ্গ হয়ে উঠতে পারেনি।

তিতির হয়নি তখনও। অসীম অফিসে বেরিয়ে গেলে এত বড়ো বাড়িতে একলা নন্দিনী। শূন্যতা যেন বিশাল হাঁ করে তাকে গিলে খেতে এগিয়ে আসত। উপরতলায় কোনও ভাড়াটেও ছিল না যে গল্প করে সময় কাটাবে। পাড়াটাও এত চুপচাপ। লোকজন বাস করে বলে বোঝাই মুশকিল। কলকাতার শোরগোলের একেবারে বিপরীত। কী করে যে দিনগুলো কাটত এখন ভাবলেও অবাক লাগে। তখনই কোনও এক সময় মিস ম্যাকলেনের সঙ্গে নন্দিনীর পরিচয়।

নন্দিনীদের বাড়িটার ঠিক পাশেই একটা একতলা বাংলো প্যাটার্নের ছোটো বাড়ি ছিল। রংচটা, ধুলোটে। চওড়া কাঠের গেটের রং এককালে হয়তো সাদাই ছিল, বা অন্য কিছুও হতে পারে, বলা মুশকিল, কারণ বহুদিনের অযত্নে অবহেলায় সেটা একটা অবর্ণনীয় শেড ধরে নিয়েছিল। কার্নিশে যেখানে সেখানে বেয়াড়া বট অশ্বত্থের চারার যথেচ্ছ জবরদখল অভিযান। দেয়ালে জায়গায় জায়গায় বৃষ্টি গড়ানো শ্যাওলাটে সবুজ দাগ। গেটের পাশে বহু বছরের ময়লায় কালচে হয়ে যাওয়া ফলকে কষ্ট করে পড়া যায় ‘হ্যাপি নুক’। বাগান হয়তো কোনওকালে একটা ছিল, নন্দিনীর চোখে যেটা পড়েছিল তাকে বাগানের অপভ্রংশও বলা চলে না।

এই বাড়িতেই থাকতেন জেনিফার ম্যাকলেন। একাই। কাজের লোকটোকও কেউ ছিল না। অন্তত নন্দিনী তো কোনওদিন কাউকে থাকতেও দেখেনি, আসতে যেতেও দেখেনি। সঙ্গী বলতে একটি বৃদ্ধ পমেরিয়ান কুকুর। এত দিন পরে হঠাৎ তার নামটাও আজ নন্দিনীর মনে পড়ে গেল। পিক্সি। তাকে নিয়ে রোজ সকাল-বিকেল হাঁটতে বেরোতেন। চুপচাপ মাথা নীচু করে কোনও দিকে না তাকিয়ে একটু ঝুঁকে হেঁটে যেতেন, আবার ওই ভাবেই বাড়ি ফিরে আসতেন। যতদিন নন্দিনী ছিল ওখানে শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষা ওই রুটিনে কোনওদিন ছেদ পড়তে দেখেনি।

মিস ম্যাকলেনের মতো নিরুত্তাপ মানুষ নন্দিনী আজ পর্যন্ত আর দ্বিতীয় একজন দেখল না। কোনও মানুষ যে তার চারপাশের জগৎ সম্বন্ধে এতটাই নিরাসক্ত হতে পারে ভাবা যায় না। কারমেল কনভেন্টে ইংরেজি পড়াতেন। শোনা কথা, ছাত্রীরা নাকি আড়ালে বলত ‘আইসবার্গ’। স্বভাবের জন্য না চেহারার জন্য সেটা জানা যায়নি। তবে দুদিক থেকেই নামটা মানানসই।

রোগাপাতলা ছোটোখাটো চেহারা। গায়ের রং পুরোনো খবরের কাগজের মতো। সম্পূর্ণ ভাবলেশহীন মুখ। পাতলা ফ্যাকাশে ঠোঁট। ফ্যাকাশে সবজেটে চোখের মণি। ফ্যাকাশে বাদামি চুল। চিরটাকাল পরনে হালকা রঙের ছাঁটকাটহীন ঢোল্লা হাঁটুর নীচ পর্যন্ত ঝুলের ফ্রক। সব মিলিয়ে একজন ফ্যাকাশে মানুষ। কেউ ডেকে কথা বললে উত্তরে বাধ্য হয়ে ভদ্রতাসূচক দু-চারটে কথা যা বলার বলতেন, নইলে চুপচাপ। গলার আওয়াজও চেহারার মতোই নিষ্প্রভ, নিরুত্তেজ। কোনও ওঠাপড়া নেই। স্কুল, বাড়ি আর পিক্সির মধ্যেই ওঁর জগৎ সীমাবদ্ধ ছিল। প্রতি রবিবার অবশ্য নিয়ম করে চার্চে যেতেন। আর প্রতি মাসে দিন দুয়েক বাড়ি তালা বন্ধ রেখে সম্ভবত গৃহস্থালির টুকটাক কেনাকাটার জন্য টাউনেও যেতেন। কারণ এবং গন্তব্যস্থলটা লোকের ধরে নেওয়া। কোনওটাই কারও সঠিক জানা ছিল না, কারণ উনিও কোনওদিন কাউকে ডেকে বলেননি, আর ওঁর কাছে কোনওদিন কেউ জানতেও চায়নি। কাকেই বা বলবেন, কেই বা জানতে চাইবে। কুকুরটি ছাড়া তো তিন কুলে কোথাও কেউ ছিলও না। অন্তত আছে বলে কেউ জানত না। উনি যে দিনগুলো বাড়ির বাইরে থাকতেন সেই কটা দিনের জন্য পিক্সি চার্চের ফাদার অ্যান্টনির কাছে থাকতে যেত।

নন্দিনী বলতে গেলে সেধেই আলাপ করেছিল। ওঁর বাড়িতেও গিয়েছিল কয়েকবার। উনি অবশ্য বিশেষ আসতেন না। দেখা হলে বেড়ার পাশে বা গেটের ওধারে দাঁড়িয়েই সামান্য দুচারটে সৌজন্যমূলক কথা বলে চলে যেতেন। বাড়ির ভেতরে ঢুকতে স্পষ্টই অনীহা ছিল। তবে পরের দিকে মাঝেমধ্যে কেক বা বিস্কিট গোছের কিছু ভালোমন্দ বানালে ডাক দিতেন। নন্দিনী খেয়েও আসত, নিয়েও আসত। জিজ্ঞাসা করে করে শিখেও নিয়েছিল ওঁর কাছ থেকে নানারকম।

একদিন, শুধু একদিনই মিস জেনিফার ক্যাথারিন ম্যাকলেনকে অন্যরকম দেখেছিল নন্দিনী। একটা পুরো দিন।

সেদিন সকালে একটু বেলার দিকে মিস ম্যাকলেনের গেটের লেটারবক্সে পিওন চিঠি ফেলে গিয়েছিল একটা। নন্দিনী নিজের শোবার ঘরে কী যেন করছিল। জানালা দিয়ে ব্যাপারটা দেখতে পেয়ে মনে মনে একটু অবাকই হয়েছিল। এতদিনের মধ্যে কোনও দিনও ওবাড়িতে কোনও চিঠিপত্র আসতে দেখেনি সে। পিক্সির ডাকাডাকির আওয়াজ পেয়েই আসলে তার চোখ বাইরের দিকে গিয়েছিল। সে বেচারাও পিওন নামক খাকি পোশাকধারী অপরিচিত জীবটিকে দেখে ঘাবড়ে গিয়ে পাহারাদারির সহজাত সারমেয় প্রবৃত্তি পালনের তাগিদে পরিত্রাহি চেঁচিয়ে যাচ্ছিল। একটু পরে মিস ম্যাকলেনের ভাবভঙ্গি দেখে নন্দিনীর অবাক হওয়ার মাত্রাটা আরও বেড়ে গিয়েছিল যেন। পিক্সির চিৎকারে উনিও বেরিয়ে এসেছিলেন। পিওন চলে যেতে যেতে হাতের ইশারা করে বুঝিয়ে দিল চিঠি দিয়ে গেছে। উনি খানিকক্ষণ যেন কিছু না বুঝে পিওনের চলে যাওয়ার দিকে চেয়ে ছিলেন। তারপরে পায়ে পায়ে গেটের দিকে এগোলেন।

নন্দিনী ঘটনাটা কী ঘটছে দেখার জন্য জানালার পাশ থেকে সরেনি, ওখান থেকেই তাকিয়ে ছিল। মিস ম্যাকলেন লেটারবক্স থেকে চিঠিটা বার করে একটু হতবুদ্ধি ভাবে প্রথমটা ওখানেই দাঁড়িয়ে ছিলেন। বাদামি কাগজের খামটা হাতে নিয়ে ভুরু কুঁচকে উলটেপালটে দেখছিলেন, বোঝার চেষ্টাই করছিলেন হয়তো তাঁকে কে চিঠি লিখতে পারে। তারপরে ওখানে দাঁড়িয়েই খামটা ছিঁড়ে চিঠিটা বার করলেন। নন্দিনী আশ্চর্য হয়ে দেখল চিঠিটা পড়তে পড়তেই ওঁর হাবভাব কেমন যেন পালটে গেল। দূর থেকেও সে বুঝতে পারছিল মহিলা থরথর করে কাঁপছেন। হাত বাড়িয়ে একবার গেটটা ধরারও চেষ্টা করলেন। নন্দিনীর ভয় হচ্ছিল উনি পড়ে-টড়ে না যান। হয়তো কোনও খারাপ খবর আছে চিঠিতে। তারপরে আরও অবাক হয়ে গেল যখন দেখল উনি ওদের বাড়ির দিকেই আসছেন।

মিস ম্যাকলেন বেল বাজানোর আগেই নন্দিনী বারান্দায় বেরিয়ে এসেছিল। জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছিলেন উনি। মুখচোখ যেন কেমন কেমন। নাকের তলায় ফোঁটা ফোঁটা ঘাম জমেছে। কিছু না বলে অকস্মাৎ নন্দিনীর দিকে চিঠিটা বাড়িয়ে ধরলেন। নন্দিনীও কিছু না বুঝেই ওঁর হাত থেকে ওটা নিয়ে নিল। পড়তে ইশারা করছিলেন মিস ম্যাকলেন। তখনও কথা বলতে পারছিলেন না। নন্দিনী আগে ওঁকে ধরে ধরে নিয়ে গিয়ে ঘরে বসাল। তাড়াতাড়ি এক গ্লাস খাবার জল এনে দিল। উনি এক নিঃশ্বাসে জলটা শেষ করে গ্লাসটা ফিরিয়ে দিলেন। তারপরে কেমন যেন গা ছেড়ে দিয়ে সোফার পিছনে মাথা হেলিয়ে চোখ বন্ধ করলেন। নন্দিনী নজর ফেরাল হাতে ধরা চিঠিটার দিকে।

চিঠিটা লিখেছেন কোনও এক ডাক্তার এসপি বড়ুয়া। ইংরেজিতে লেখা চিঠির বাংলা করলে এরকম দাঁড়ায়–

‘ডিয়ার জেনিফার,

আশা করি ভালোই আছ। তোমার জন্য সুখবর আছে একটা। তুমি হয়তো জেনে খুশি হবে যে ফ্র্যাংকলিনের মধ্যে আজকাল আগের থেকে অনেক বেশি উন্নতি দেখা যাচ্ছে। গত সপ্তাহে ওর ঘরে রাখা তোমার ছবিটা দেখে তোমাকে চিনতে পেরেছিল। কাল নিজে থেকেই বলল, জেনি খুব ভালো চকোলেট কেক বানায়। আমার মনে হচ্ছে নতুন ওষুধটায় বোধহয় কাজ হচ্ছে।

যে জন্য তোমাকে চিঠিটা লেখা। আমি ভাবছিলাম এ মাসে তুমি না এসে যদি আমিই ফ্র্যাংকলিনকে নিয়ে তোমার কাছে যাই তাহলে কেমন হয়? একটা চেঞ্জও হবে ওর। তাই এই বৃহস্পতিবার বিকেলে তোমার বাড়ি আসছি আমরা। তৈরি থেকো।’ তারপরে আবার পুনশ্চ দিয়ে লিখেছেন– ‘খুব বেশি কিছু আশা কোরো না। এই রিঅ্যাকশনগুলো প্রায়ই খুব একটা পার্মানেন্ট হয় না। তবুও লেট আস হোপ ফর দ্য বেস্ট।’

বৃহস্পতিবার? বৃহস্পতিবার তো আজকেই। কিন্তু কে এই ডাক্তার বড়ুয়া? যে ফ্র্যাংকলিনের কথা চিঠিতে আছে সে-ই বা কে? আর এই চিঠি পেয়ে মিস ম্যাকলেনেরই বা অমন অবস্থা কেন হল? নন্দিনী সত্যি কিছুই বুঝতে পারে না। এ প্রহেলিকার উত্তর একমাত্র মিস ম্যাকলেনই জানেন। ধাঁধায় পড়ে সে মিস ম্যাকলেনের দিকে তাকায়। আর অবাক হয়ে দেখে মিস ম্যাকলেন কেমন অদ্ভুত চোখে ওর দিকেই চেয়ে আছেন। চেয়ে আছেনও, আবার নেইও। ওঁর ওই ফ্যাকাশে সবুজ চোখের দৃষ্টি যেন নন্দিনীকে ভেদ করে, এ ঘর ছাড়িয়ে কোথায় কতদূরে উধাও হয়ে গেছে।

আস্তে আস্তে একটি দুটি করে কথা বলতে আরম্ভ করেন জেনিফার ম্যাকলেন। তারপরে বাঁধভাঙা বন্যার মতো বেরিয়ে আসতে থাকে অনেক দিনের অনেক জমে থাকা কথা। গলার আওয়াজ থরথর করে কাঁপে। আর নন্দিনী স্তব্ধ হয়ে শুনতে থাকে এক আশ্চর্য কাহিনি। যাকে কাহিনি না বলে রূপকথা বলাই বোধহয় উচিত।

আসাম চা বাগিচার দেশ। আর চা বাগিচা মানেই প্ল্যান্টার। প্রথম দিকে খাঁটি সাহেবরাই বাগান চালাত। পরে আস্তে আস্তে তাদের সংখ্যা কমতে থাকে। সে জায়গায় আসতে শুরু করে দেশি সাহেবরা। এ কাহিনির যখন শুরু তখন সবে এদেশ স্বাধীন হয়েছে। কিছু কিছু বাগানে দু-একজন সাদাচামড়া সাহেব তখনও ছিল। তাদেরই একজন রঙালি টি এস্টেটের ছোটো সাহেব প্যাট্রিক ম্যাকলেন। প্যাডি সাহেব। প্যাডি সাহেবকে সবাই চিনত দুটো কারণে। এক নম্বর কারণ তার দিলদরিয়া স্বভাব। গায়ের রংটা তাকে আলাদা করে চিনিয়ে দিত ঠিকই, তা নইলে এদেশের লোকেদের সঙ্গে মেলামেশায় সে, সাহেব আর নেটিভের কোনও ফারাকই রাখত না। কত প্ল্যান্টারদের কত অত্যাচারের কাহিনি সে সময় বাগানের কুলি কামিনদের মুখে মুখে ফিরত, কিন্তু প্যাডি সাহেব সম্বন্ধে কেউ কোনওদিনও অমন কথা ভাবতেও পারত না।

আর দু-নম্বর কারণ তার মা-মরা একমাত্র মেয়ে জেনি মেমসাহেব। জেনিফার ক্যাথারিন ম্যাকলেন। বলতে গেলে সেটাই তখন সাহেবকে চেনার প্রধান কারণ। বিশেষ করে উঠতি যুবকদের মধ্যে। পাহাড়ি ঝরনার মতো চঞ্চল, পরিদের মতো সুন্দর উনিশ বছরের জেনি মেমসাহেবকে দেখলে অতি বড়ো গোমড়ামুখোদেরও মন ভালো হয়ে যায়। সেই সময় আশপাশের ছোটোবড়ো যত গার্ডেনের সব ইয়ং ম্যানদের জীবনের একটাই লক্ষ্য, কে জেনিকে একটু খুশি করতে পারে। পিকনিক, টি-পার্টি, ক্রিসমাস ড্যান্স– সবের মধ্যমণি জেনি ম্যাকলেন। মিস স্টুয়ার্ট, মিস ব্রাউনদের দিকে কেউ ফিরেও তাকায় না। জেনির সঙ্গে একটা ড্যান্স মানে জীবন সার্থক। জেনি কারও দিকে চেয়ে একটু হাসলে সে নিজেকে পৃথিবীর সবথেকে সৌভাগ্যবান ব্যক্তি ভাবতে একটুও দ্বিধা করে না।

জেনি কাউকে নিরাশ করে না। কিন্তু কাউকে আশাও দেয় না। আজ ব্রিজ পার্টিতে ডিকি রবার্টসনকে পার্টনার করলে পরের দিন নাচের ফ্লোরে তার সঙ্গী হয় জেরি উইলিয়ামস। কেউ তার কাছে বিশেষ নয়। সবাই তার ভালো বন্ধু, ব্যাস।

বিশেষ তার একজনই। সেই ছেলেবেলা থেকেই। ফ্র্যাংকি। তখন ছিল শুধুই ফ্র্যাংকি। বড়ো হয়ে হল টগবগে তরুণ আর্মি অফিসার ক্যাপ্টেন ফ্র্যাংকলিন। প্যাডি সাহেবের বন্ধু ফ্রেডি ক্লিফটনের একমাত্র ছেলে। খাঁটি সাহেব ছিল না অবশ্য সে।

ফ্রেডি ক্লিফটন এদেশে আসার আগে ছিল বার্মায়। আজকাল যে দেশের নাম হয়েছে মায়ানমার। ইঞ্জিনিয়ার ফ্রেডি ক্লিফটন ভালোবেসে বিয়ে করেছিল সেই বার্মারই এক সুন্দরী মেয়েকে। ফ্র্যাংকি ছিল তাদের ভালোবাসার ফসল। মিশ্র রক্তের সন্তান।

তাতে অবশ্য বাগানের কারও কিছু আসত যেত না। ওখানে অনেকেরই জন্মের ইতিহাস ফ্র্যাংকির মতোই। তাও তো তার মা, পাতা তোলা কামিন ছিল না। যথেষ্ট শিক্ষিত, ধনী ঘরের মেয়ে ছিল তার মা। কেবল বিজাতীয়, বিধর্মীকে বিয়ে করার অপরাধে সে মেয়ের পরিবার তাকে ত্যাগ করে।

ফ্র্যাংকির যখন বারো বছর বয়স তখন তার মা বাবা দুজনেই এক সাংঘাতিক কার অ্যাক্সিডেন্টে মারা যায়। এ-দেশে তার আর কেউ ছিল না। বহু দূর আয়ারল্যান্ডে, কখনও-না-দেখা তার এক কাকা ছিল বটে, সে ভাইপোকে নিয়ে যেতে চাইছিল না। ঝুটঝামেলায় না গিয়ে প্যাডি সাহেব ফিউনারেল হয়ে যাবার পর সটান ফ্র্যাংকিকে নিজের কাছে রঙালিতে নিয়ে চলে এসেছিল। জেনির বয়স তখন আট। সেই থেকে জেনি আর ফ্র্যাংকি একসঙ্গেই বড়ো হয়েছে।

দশ বছর বয়স থেকেই জেনি জানত সে ফ্র্যাংকির। কী করে জানত জানে না। কিন্তু জানত। ফ্র্যাংকিও যেমন জানত জেনি তার। একমাত্র তার। তারা দুজন একে-অপরের জন্যই তৈরি। আর কেউ কখনও তাদের মধ্যে আসবে না, আসতে পারে না। এই ধ্রুব সত্যিটা মনের মধ্যে গেঁথে রেখেই জেনি দশ থেকে উনিশ হয়েছে, ফ্র্যাংকি হয়েছে তেইশ।

‘হি ওয়াজ সাচ আ হ্যান্ডসাম ডেভিল য়ু নো। অ্যান্ড ডেয়ারিং। আর্মি জয়েন করল। ইউনিফর্ম পরে আমার সামনে দাঁড়াত। নানডিনি, বিলিভ মি, আমি মেল্ট করে যেতাম। আমাকে পেছনে বসিয়ে স্পিডে মোটরবাইক চালাত, ভাবতে পারবে না। আই থট মাইসেল্ফ দ্য লাকিয়েস্ট গার্ল অ্যালাইভ।’

নন্দিনী রূপকথা শুনছে। এই মিস ম্যাকলেনকে সে দেখেনি কোনওদিন। মিস ম্যাকলেনের গলায় উনিশের জেনি কথা বলে চলে। গলার আওয়াজ আর কাঁপছে না এখন। সেই কণ্ঠস্বরের সম্মোহনী ওঠাপড়া নন্দিনীকে আবিষ্ট করে ফেলে। রূপকথার নায়িকা স্মৃতিমগ্ন হয়ে নিজের কাহিনি শোনাতে থাকে।

‘সেদিন সানডে ছিল, জানো। আমাদের ফর্মাল এনগেজমেন্ট হয়ে গেল। ফ্র্যাংকি আমাকে আংটি পরাল। আমি পরালাম ফ্র্যাংকিকে। চার্চে বিয়ের নোটিস পড়ল। তিন মাস পরে আমাদের বিয়ে। উই ওয়্যার সো হ্যাপি দ্যাট ডে।’ হালকা হাসির রেখা জেনিফার ম্যাকলেনের ঠোঁট ছুঁয়ে ছুঁয়ে যায়।

নন্দিনী অবাক বিস্ময়ে মিস ম্যাকলেনের দিকে চেয়ে দেখতে থাকে। তার চোখের সামনে মধ্য চল্লিশের বর্ণহীন মিস ম্যাকলেন আস্তে আস্তে খোলস ঝরিয়ে আদ্যন্ত জেনি হয়ে ওঠে। পুরোনো কাগজের মতো গালে গোলাপি রক্তোচ্ছ্বাস, চোখে পান্নার দ্যুতি।

গুনগুন করে কত দিনের কথা বলে যান মিস ম্যাকলেন। আর নন্দিনীর চোখের সামনে আস্তে আস্তে জীবন্ত হয়ে উঠতে থাকে রঙালি টি এস্টেট, জেনি মেমসাহেব আর সুদর্শন, ডাকাবুকো

ফ্র্যাংকলিন ক্লিফটন।

আর তার পরে সেই রাতের কথা। জেনি আর প্যাডি সাহেবের সঙ্গে ডিনার সেরে ইউনিটে ফিরছিল ক্যাপ্টেন ক্লিফটন। ঠিক কী যে সে রাতে হয়েছিল কেউই জানে না, কিন্তু পরের দিন সকালে রাস্তার পাশে দোমড়ানো মোচড়ানো মোটরবাইকটা ও তার থেকে অনেকটা দূরে ন্যাকড়ার পুতুলের মতো তালগোল পাকিয়ে পড়ে থাকা ফ্র্যাংকলিন ক্লিফটনের রক্তাক্ত অচৈতন্য শরীরটা দেখেছিল ভোরের পথচলতি বাগানশ্রমিকরা। খুব সম্ভবত কোনও মাতাল লরির ধাক্বায় বাইক শুদ্ধু রাস্তা থেকে ছিটকে গিয়েছিল ফ্র্যাংকলিন ক্লিফটন।

‘ওরাই ওকে তুলে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিল। পকেটে ডায়ারি ছিল, তাতে আমার ছবি, ঠিকানা ছিল। হাসপাতাল থেকে আমাদের খবর দেয়।’

মাথায় সাংঘাতিক আঘাত লেগেছিল ফ্র্যাংকির। বাঁচার আশাই ছিল না। দীর্ঘ সাঁইত্রিশ দিন কোমায় অচেতন ছিল সে। তারপরে জ্ঞান যখন ফিরল তখন ক্যাপ্টেন ফ্র্যাংকলিন ক্লিফটন নিজের নামটুকুও মনে করতে পারে না আর। হাসপাতালের বিছানায় ফ্র্যাংকি তখন শুধুই স্মৃতিহীন, ভাষাহীন এক মানবশরীর মাত্র।

প্যাডি সাহেব অনেক করেছে তখন। মিলিটারির ডাক্তার ছাড়াও আরও বড়ো বড়ো ডাক্তার দেখিয়েছে। সবারই এক কথা। আশা ছাড়লে চলবে না। সময়, সময়ই করতে পারে যা করবার। ফ্র্যাংকির খুব ভালো বন্ধু ছিল ডাক্তার বড়ুয়া। সে-ও তাই বলে গেছে অহর্নিশ। ধৈর্য ধরো, ধৈর্য ধরো।

ধৈর্য ধরেছে জেনি। প্যাডি সাহেবের ধৈর্যের বাঁধও ভেঙে গেছে একদিন, কিন্তু জেনির ভরসা ভাঙেনি। প্যাডি সাহেব অনেক বুঝিয়েছে মেয়েকে, মন পালটাবার অনেক চেষ্টা করেছে, তারপরে একদিন বোধহয় মনের দুঃখেই ফট করে মাথার শিরা ছিঁড়ে ওপরে চলে গেছে।

এই হ্যাপি নুক বাড়িটা অনেকদিন আগে কিনেছিল প্যাডি সাহেব। কখনও কোনও দরকারে বাগান থেকে টাউনে এসে রাত হয়ে গেলে এখানেই থেকে যেত। সাহেব মারা যাবার পর জেনিরও বাগানের পাট চুকে গিয়েছিল। সেই তখন থেকেই জেনি এখানে। সেও আজ প্রায় ছাব্বিশ বছর হয়ে গেল। এখান থেকে মাসে মাসে হাসপাতাল যেতেও সুবিধে। ধৈর্য ধরে থাকতে থাকতে ফ্র্যাংকির মুখে ধীরে ধীরে একটা দুটো কথা ফুটল। আর দিনে দিনে কখন যেন রঙালির চুলবুলি জেনি মেমসাহেব আস্তে আস্তে সব রং ঝরিয়ে ফ্যাকাশে মিস ম্যাকলেন হয়ে গেল।

সেই ফ্র্যাংকি আজ ডাক্তার বড়ুয়ার সঙ্গে আসছে, জেনির বাড়িতে।

‘তুমি বিকেলে একটু থাকবে আমার সঙ্গে, নানডিনি, প্লিজ? আয়্যাম ফিলিং সো নার্ভাস। ফ্র্যাংকি এতদিন পরে আসছে আমায় মিট করতে।’ নন্দিনী খুব অবাক হয়ে দেখে মিস ম্যাকলেন সদ্য প্রেমে পড়া কিশোরীর মতো টুকটুকে গোলাপি হয়ে যাচ্ছেন।

বিকেলে মিস ম্যাকলেনকে চেনা যাচ্ছিল না। ঘন সবুজ সিল্কের একটা অপূর্ব ফ্রক পরেছেন। পুরোনো কাটের জামা, কিন্তু কী যে সুন্দর মানিয়েছে ওঁকে। ঝলমল করছেন যেন। নন্দিনী কখনও লক্ষ্যই করেনি, মিস ম্যাকলেনের হাত পায়ের পাতা কী অদ্ভুত সুন্দর। ঝিনুকের মতো পাতলা, শাঁখের মতো মসৃণ। লম্বা আঙুলের ডগায় বাদাম শেপের হালকা গোলাপি নখ। চোখ মুখ চেপে রাখা উত্তেজনার আঁচে গনগন করছে। এই অপরূপা মিস ম্যাকলেন কোথায় ছিলেন এতদিন? নন্দিনী নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিল না।

অস্থির ভাবে ঘরের মধ্যে ছটফট করে বেড়াচ্ছিলেন জেনিফার। বারবার দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছিলেন। লজ্জাও পাচ্ছিলেন, নন্দিনী তাঁর অস্থিরতা বুঝতে পারছে বলে। টেবিলে একটা ট্রে আগে থেকেই সাজিয়ে রেখেছেন। চায়ের যাবতীয় সরঞ্জাম, আর একটা বড়ো প্লেটে নিজের হাতে তৈরি চকোলেট কেক। এত উত্তেজনার মধ্যেও কখন যেন ঠিক সময় করে বানিয়ে ফেলেছেন।

গাড়ির শব্দটা একই সঙ্গে দুজনের কানেই আসে। নন্দিনী মিস ম্যাকলেনের দিকে তাকায় একঝলক। যেখানে ছিলেন সেখানেই একদম স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছেন উনি। মুখ থেকে সব রক্ত নেমে গিয়ে বরফের মতো সাদা দেখাচ্ছে। এক হাত দিয়ে অন্য হাতটা এত জোরে আঁকড়ে ধরেছেন যে আঙুলের গাঁটগুলো চামড়ার নীচে স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠেছে। বন্ধ দরজাটার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে ছিলেন জেনিফার। নন্দিনীই এগিয়ে গিয়ে দরজাটা খোলে।

দুজন মানুষ। একজনকে স্পষ্টই বোঝা যায় এদিককার অধিবাসী বলে। খুব সম্ভব ইনিই ডাক্তার এসপি বড়ুয়া। এক হাত দিয়ে আরেকটি মানুষের কাঁধ জড়িয়ে রেখেছেন। সে মানুষটি এক বিশাল বৃক্ষের বাজ পড়া শুকনো কাণ্ড। ঝুঁকে পড়া লম্বা শরীর, পোড়া তামাটে গায়ের রং। নীল হাওয়াই শার্ট তার গায়ে ঢলঢল করছে। গাল ভাঙা, চোখের কোলে গভীর ক্লান্তি। কানের দু-পাশে কিছু পিঙ্গলে সাদায় মেশানো চুল। বাকি মাথা ফাঁকা। বয়স আন্দাজ করা অসম্ভব। পঞ্চাশও হতে পারে, পঁচাত্তরও হতে পারে। পিঠে ডাক্তার বড়ুয়ার হাতের চাপ অনুসরণ করে পা ঘষে ঘষে সে এগিয়ে আসতে থাকে নন্দিনীর দিকে।

‘হ্যালো জেনি।’ নন্দিনী ডাক্তার বড়ুয়ার কথায় সচেতন হয়ে পিছনে তাকায়। কখন যেন মিস ম্যাকলেন বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছেন। ‘আমরা এসে গেছি।’

কথার জবাব দেন না জেনিফার। তাঁর দৃষ্টি শুধু দ্বিতীয় মানুষটির দিকে। ডাক্তার বড়ুয়া তার পিঠে চাপ দেন। ‘চিনতে পারছ ফ্র্যাংক? তোমার জেনিকে?’

ফ্র্যাংক নীরব থাকে। চোখে কোনও ভাষাই ফোটে না। মিস ম্যাকলেন নিজের হাতদুটো শক্ত করে মুঠি করেন। মুখ একবার লাল একবার সাদা হয়। নন্দিনীর ভেতরে কী একটা ভাঙতে থাকে, ভেঙে ভেঙে যায়।

ডাক্তার বড়ুয়া আস্তে আস্তে ফ্র্যাংককে ভেতরে নিয়ে গিয়ে সোফায় বসান। সামনে টেবিলে মিস ম্যাকলেনের সাজানো ট্রে।

‘দেখছ ফ্র্যাংক, চকোলেট কেক। তুমি তো ভালোবাসো। দ্যাখো, জেনি নিজে বানিয়েছে, তোমার জন্য।’

ফ্র্যাংকি দুহাতে দুটো কেকের টুকরো তুলে নেয়। বাচ্চাদের মতো একবার এ-হাত একবার ও-হাত থেকে কামড়ায়। থুতনিতে গুঁড়ো গুঁড়ো ঝরে পড়া কেক মাখামাখি হয়ে যায়। শব্দ করে চিবোয় ফ্র্যাংকি। অথচ কী আশ্চর্য, মুখে কোনও অভিব্যক্তি ফোটে না।

‘আর এক পিস কেক নেবে ফ্র্যাংকি?’ জেনিফার খুব নরম গলায় বলে।

ফ্রাংকি কোনও উত্তর দেয় না। শুনতে পেল কী না তাও বোঝা যায় না। তাকিয়ে থাকে সোজা নির্বিকার। ফাঁকা দৃষ্টি জেনিফারকে ভেদ করে চলে যায়। তার হাতে মুখে আইসিঙের ক্রিম আর কেকের গুঁড়ো লেগে থাকে। সে বুঝতেও পারে না, বসে থাকে স্থির। জেনিফার ফ্রাংকির সোফার সামনে মেঝেতে হাঁটু গেড়ে বসে। অসীম মমতায় পরিষ্কার নরম ন্যাপকিন দিয়ে তার মুখ মুছিয়ে দেয়, হাত মুছিয়ে দেয়।

গোধূলির রং আস্তে আস্তে সন্ধ্যায় পালটে যেতে থাকে। আগে থেকে সাজিয়ে রাখা ট্রে-র কাপ ভর্তি চায়ে সর পড়ে যায়। ঘরের কোণায় কোণায় অন্ধকার গাঢ় হয়ে আসে। টেবিলবাতিটা জ্বেলে দেয় নন্দিনী।

জেনিফার ফ্র্যাংকির দুটি হাত মুঠিতে নিয়ে হাঁটু গেড়ে বসেই থাকে। হাতদুটি অল্প অল্প কাঁপে, পাতলা দুটি ঠোঁট কত কিছু বলতে চেয়ে থিরথির করে। কিন্তু কোনও কথাই বেরোয় না। বোধহীন, ভাষাহীন ফ্রাংকির মুখের দিকে চেয়ে চেয়ে চোখের পলকও বুঝি পড়ে না তার।

ঘরের মধ্যে ক্রমশ ভারী হয়ে জমতে থাকা একরাশ নৈঃশব্দ্য নন্দিনীকে চেয়ারে গেঁথে রাখে। নড়াচড়া করলেই যেন কী একটা ঘটে যাবে। সে শুধু দুচোখ মেলে এই ট্র্যাজিক মূকাভিনয় দেখতেই থাকে। গলার কাছে কী যে ভীষণ কষ্ট শক্ত হয়ে ডেলা পাকায়, সে জোর করে করে গিলে গিলে সেই ডেলাকে নীচে পাঠায়। কতক্ষণ যেন কেটে যায় এমনি করেই।

ডাক্তার বড়ুয়াই শেষে উঠে দাঁড়ান। শব্দ করে গলা পরিষ্কার করেন। ‘সরি জেনিফার।’ নিস্তব্ধ ঘরের মধ্যে অনেকক্ষণ পরে ওঁর কথাটা যেন ভীষণই জোরে বেজে ওঠে মনে হয়। চোখ তুলে তাকাতে পারছিলেন না ভদ্রলোক। গলা নামিয়ে আবার বলেন, ‘এবার যেতে হবে আমাদের।’

ডাক্তারের গলার আওয়াজে ঘোর ভাঙে জেনিফারের। ‘ফ্র্যাংকি আমার কাছে থাকতে পারে না? প্লিজ ডাক্তার? ও তো অনেক ভালো আছে আগের থেকে। ওকে তো এখন তোমরা এখানেই রাখতে পারো।’ জেনিফারের কণ্ঠস্বরে একরাশ আকুল আর্তি। অসহায় আশা ভরা দুটি চোখ ডাক্তার বড়ুয়ার দিকে চেয়ে থাকে।

জ্বলন্ত টেবিলবাতিটার চারপাশে একটা মথ অবিশ্রাম পাক খাচ্ছিল। ডাক্তার বড়ুয়া সেইদিকে একদৃষ্টে চেয়ে ছিলেন। অনেকক্ষণ এমন ভাবে চুপ করে থাকেন যেন কানেই যায়নি। তারপর চোখ না সরিয়েই খুব নরম গলায় বলেন, ‘এইরকম সোবার কোয়ায়েট মোমেন্টগুলো ফ্র্যাংকির লাইফে খুবই রেয়ার, জেনিফার। তুমি পারবে না। পারবে না ম্যানেজ করতে তুমি। মাঝে মাঝে এমন অবস্থা হবে…’ জেনিফারের দিকে তাকিয়ে কথা শেষ না করেই থেমে যান ডাক্তার।

এতক্ষণে বাঁধ ভাঙে। কী অসহ্য এক আক্ষেপে জেনির মুখ দুমড়ে দুমড়ে যায়। শব্দহীন কান্নায় বিকৃত মুখ দু-হাতে ঢেকে ফেলে সে। কেঁপে কেঁপে উঠতে থাকে শরীরটা। ডাক্তার বড়ুয়া আর নন্দিনী দুজনেই অপরাধীর মতো দাঁড়িয়ে থাকে শুধু। গতে বাঁধা সান্ত্বনাবাক্য এখানে এত অর্থহীন।

অস্বস্তি কাটানোর জন্য নন্দিনী চায়ের সরঞ্জামগুলো সরাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। ডাক্তার বড়ুয়া ফ্র্যাংকির দিকে তাকান। এ ঘরের চারজন মানুষের মধ্যে একমাত্র ফ্র্যাংকিরই কোনও বিকার নেই।

গেটের বাইরে অনেকক্ষণ ধরে দাঁড়ানো গাড়িটা এই সময়ে একবার জোরে হর্ন বাজায়। চমকে তাকিয়ে নন্দিনী এতক্ষণে দেখতে পায় গাড়িটার গায়ে বড়ো বড়ো সাদা অক্ষরে লেখা ‘সেন্ট জর্জেস অ্যাসাইলাম’।

পরের দিন সকালেও মিস ম্যাকলেনকে দেখেছিল নন্দিনী। রোজকার মতোই হালকা রঙের হাঁটুর নীচ পর্যন্ত ঝুলের ঢোল্লা ফ্রক পরে পিক্সিকে নিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন। মাথা নীচু, চোখ রাস্তার দিকে। বর্ণহীন, নিষ্প্রাণ, ফ্যাকাশে এক প্রৌঢ়া।

টিউব লাইটটা হঠাৎ দপদপ করে জ্বলে উঠে নন্দিনীর চোখটা ধাঁধিয়ে দিল। যাক, এতক্ষণে কারেন্ট এল তাহলে। বাবা, পাঁচটা বাজে। তিতিরের কলেজ থেকে ফেরার সময় হয়ে এল। সবিতা বিকেলের কাজ করতে এসে যাবে আর একটু পরেই। নন্দিনী দ্রুত হাতে খোলা চুল গোছাতে গোছাতে বিছানা থেকে নামে। আলস্যমন্থর স্মৃতিমেদুর দুপুরের ভার তাকে ছেড়ে চলে গেছে, এবার আবার সংসারের অভ্যস্ত ছন্দ তার আপাদমস্তক অধিকার করে নিতে শুরু করে।

মিস ম্যাকলেনের মতো ফ্যাকাশে হয়ে যাওয়া কাগজটা দলামোচড়া হয়ে খাটের উপরেই পড়ে থাকে।

 

ভিতরের লোকটা

অফিস থেকে বাড়ি ফিরেই পাঁচ মিনিটের মধ্যে সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়েছেন প্রণববাবু। মেয়ে বলেছিল, চা-টা অন্তত খেয়ে যাও।

–এসে খাচ্ছি। বলে বাইরের ঘেমো পোশাক না ছেড়েই শুধু জুতোটা খুলে চটি গলিয়ে বেরিয়ে এসেছেন। নিজের অক্ষমতা ঢাকতেই এত তাড়াহুড়ো। অফিসে বসে ফোন পেয়েছিলেন মেয়ের। বলেছিল, বাবা, মায়ের জ্বরটা বেড়েছে। একশো চার। মাথা তুলতে পারছে না। কী করব?

প্রণববাবু বলেন, তোর দাদাকে বল ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে। তাকে যদি না পাস, তুই-ই নিয়ে যা।

–ঠিক আছে। বলার পর মেয়ে জুড়ে দিল, আজ একটু তাড়াতাড়ি ফিরো।

ফেরা হয়নি। মেয়েও জানে প্রাইভেট কোম্পানির কেরানি বাবা, ইচ্ছে থাকলেও তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরতে পারবে না। মায়ের শরীর খারাপটা বাড়াবাড়ি হয়ে যাওয়াতে ঘাবড়ে গিয়ে আকুতিটা জানিয়েছিল।

প্রণববাবু বাড়ি ফিরে শুনলেন ছেলে তার মাকে নিয়ে গিয়েছিল ডাক্তারের কাছে। খুব সংকটজনক অবস্থা ছাড়া ডাক্তারকে কল দেওয়া হয় না। প্রণববাবুর সামর্থ্য কম। মেয়ে পিউ দাদাকে ফোন করে ডেকে রিকশাভাড়া, ডাক্তারের ফিজ আর অল্প কিছু টাকা ওষুধের জন্য দিয়েছিল। ছেলে সমু বেকার। পার্টিঅফিস অথবা পাড়ার ক্লাবই তার আস্তানা। খেতে শুতে আসে বাড়িতে। বাবাকে যতটা সম্ভব এড়িয়ে চলে সমু। প্রণববাবু কাছাকাছি এসে পড়লে ওর চেহারায় কেমন একটা যেন অসন্তোষ ভাব ফুটে ওঠে। বাবার প্রতি সমুর কীসের এত বিরাগ, প্রণববাবু বুঝে উঠতে পারেন না। ছেলেকে লেখাপড়ার ব্যাপারে কখনও চাপ দেননি। যা দেওয়ার দিয়েছে ওর মা। গ্র্যাজুয়েট হওয়ার পর ছেলে দিনের পর দিন বেকার বসে আছে। কোনও গঞ্জনা করেননি প্রণববাবু। বলেননি, সংসারের হালটা এবার ধর। বোনের বিয়ে দিতে হবে। অনেক খরচা আছে সামনে…। প্রণববাবু জানেন এই কথাগুলো ছেলেকে বলার কোনও দরকার নেই। এ-টুকু দায়িত্ববোধ সমুর আছে। সে নিশ্চয়ই সাধ্যমতো চেষ্টা করে যাচ্ছে স্থায়ী কোনও রোজগারের। তাই তো পার্টিটা করে। ক্লাবে পড়ে থাকে যদি পাড়ার কোনও ব্যাবসাদার ওকে কোনও কাজ-টাজ দেয়। স্বাধীনভাবে ব্যাবসা করার জন্য সমু বাবার থেকে মূলধন চাইতে পারে না। সামান্য মাইনেতে বাবা যে কী ভাবে টেনেটুনে সংসার চালায়, সে ভালো মতোই জানে। ছেলের মা, মানে মিত্রা বারকয়েক প্রণববাবুকে বলেছেন, তোমার অফিসেই সমুর জন্য একটু চেষ্টা করে দেখো না। এতদিন ধরে কাজ করছ! একে তাকে ধরে যদি কোনও ভাবে ওকে ঢুকিয়ে দেওয়া যায়।

রক্ত জল করে খাটা নিজের ওঁচা কোম্পানিতেই ছেলের চাকরির জন্য ইউনিয়ন, ছোটো-মেজো কর্তাদের ধরেছিলেন প্রণববাবু, সুবিধে করতে পারেননি। কয়েকজন সহকর্মী কিন্তু পেরেছে, নিজের ছেলে, এমনকী নিকট আত্মীয়কে ঢুকিয়ে দিতে। প্রণববাবুর দ্বারা কেন হল না, কে জানে! ধরা-করায় কোথাও একটা খামতি থেকে গিয়েছিল নিশ্চয়ই। খামতিটা কী, জানতে চেয়েছিলেন স্ত্রীর কাছে। মিত্রা বলেছে, তুমি তো তেমন চালাক-চতুর নও। ঠিকঠাক তেল মারতে পারো না কাউকে। বড্ড গোবেচারা, মিনমিনে টাইপের।

সমু গোবেচারার সন্তান হওয়া মেনে নিতে পারে না, তাই বাবার প্রতি এত অসন্তোষ। কিন্তু জন্ম তো একটা অ্যাক্সিডেন্ট, কিছুই করার নেই মানুষের। তবে সমু যে আজ মা-কে নিয়ে ডাক্তারের কাছে গিয়েছিল, এই ব্যাপারটাতে খুশি হয়েছেন প্রণববাবু। ছেলে বাড়ির প্রতি উদাসীন হয়ে পড়েনি। সমস্যা হয়েছে একটাই, এত দামি ওষুধ লিখেছে ডাক্তার, সমু দু’ডোজের বেশি কিনতে পারেনি। বোন গোনাগুনতি টাকা দিয়েছে তাকে। এর জন্য প্রণববাবুই দায়ী। বাড়ির ওষুধপত্র তিনিই কেনেন। সেবা মেডিকেল স্টোর থেকে টোয়েন্টি পার্সেন্ট ডিসকাউন্ট পান। এখানে সব দোকানে এখন টেন চলছে। সেবা-র মালিক বিদ্যুৎকে প্রণববাবু এককালে টিউশন পড়াতেন। সেই সম্মান এবং কৃতজ্ঞতা থেকে বিদ্যুৎ প্রণববাবুকে এক্সট্রা টেন পার্সেন্ট দেয়। তার সঙ্গে এটাও জানিয়ে রেখেছে, স্যার, টোয়েন্টি নিতে হলে আপনাকেই আসতে হবে। অন্য কাউকে দিয়ে পাঠালে দিতে পারব না। বাড়ির লোকের হাতেও না। ছাড়টা জানাজানি হলে বাকি কাস্টমারও ডিমান্ড করবে।

সেই কারণে বেশি টাকার ওষুধ কেনার হলে প্রণববাবুকেই আসতে হয় বিদ্যুতের দোকানে। বাড়ির লোক ব্যাপারটা জানে বলেই পিউ তার দাদাকে ওষুধ কেনার জন্য বেশি টাকা দেয়নি। আন্দাজ করে একদিন চলার মতো দিয়েছিল। ওষুধ দামি হওয়ার কারণে দু’প্রকার ট্যাবলেট দুটো করে হয়েছে। এক জোড়া খাওয়া হয়ে গেছে, সন্ধের দিকে খেতে হবে এক ডোজ। রাত থেকে ওষুধ নেই। এ-ছাড়া জ্বর বাড়লে যে ট্যাবলেটটা দিতে বলেছে ডাক্তার, সেটাও কিনতে পারেনি সমু। …বাড়ি ফিরে সমস্ত ব্যাপারটা বুঝে নেওয়ার পর প্রণববাবু চা খেয়ে সময় নষ্ট করেননি। সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়েছেন। জ্বর আয়ত্ত্বে আনার ওষুধটা হাতের কাছে থাকা খুবই জরুরি।

জিটি রোড ধরে এতক্ষণ সাইকেল চালাচ্ছিলেন প্রণববাবু। শোভনা বস্ত্রালয়ের পাশের গলিটা এবার ধরতে হবে। রাত হতে চলল, গলিতে আলো কম। বয়সের কারণে অন্ধকারে সাইকেল চালাতে একটু সমস্যা হয়। তার জন্য এই শর্টকাটের রাস্তাটিকে এড়ানোর কোনও মানেই হয় না।

গলিতে ঢুকে কিছুটা যেতে না যেতেই বাধা। বিচ্ছিরি কাণ্ড ঘটছে, একটা ছেলেকে পাঁচ-ছ’জন মিলে বেদম মারছে। মার খাওয়া ছেলেটা মনে হচ্ছে বিদ্যুতের দোকান থেকেই ওষুধ কিনে ফিরছিল। প্ল্যাস্টিকের ছোটো ক্যারিব্যাগটা এখন রাস্তায়, ছড়িয়ে পড়েছে ট্যাবলেটের ফয়েল। এসব ঝুট-ঝামেলা একদম সহ্য করতে পারেন না প্রণববাবু। বুক ধড়ফড় করে। গলি সরু, তবু ব্রেক কষে সাইকেলের গতি কমাননি প্রণববাবু, মারধরের জটলার পাশ কাটিয়ে চলে যাওয়ার চেষ্টা করছেন, এমন সময় শুনতে পেলেন আর্তস্বর, কাকু বাঁচান! বাঁচান আমাকে!

গলি শুনশান। প্রণববাবু বুঝতেই পারলেন আর্তিটা তাঁর উদ্দেশ্যে। আবছা আলোতে ছেলেটাকে যতটুকু দেখেছেন, অচেনাই ঠেকেছে। গলাটাও কোনওদিন শুনেছেন বলে মনে করতে পারলেন না। প্রণববাবুর বয়সি যে কেউ এখন এই রাস্তা দিয়ে গেলে, ছেলেটা একই ভাবে বাঁচাতে বলত। যারা মারছে, তারাও যেন প্রণববাবুকে চিনে না রাখে। প্যাডেলে বাড়তি চাপ দিয়ে প্রণববাবু এগোতে লাগলেন। ছেলেটা চেনা হলেও মার আটকাতে যেতেন না। পাঁচ-ছ’জন মারমুখি জোয়ান ছেলে, যাদের হাতে লাঠিসোঁটাও আছে, তাদের বিরুদ্ধে এই বয়সে খালি হাতে দাঁড়ানোটা মূর্খামি হতো। তবে প্রণববাবুর মনটা বেশ খারাপ হয়ে গেল। তাঁদের এই মফস্সল শহরটা বছর দশেক আগেও কত নির্ঝঞ্ঝাট, শান্ত-শিষ্ট ছিল। যত দিন যাচ্ছে দুর্গানগরে অশান্তি বাড়ছে। লেগেই আছে মারপিট, চুরি-ছিনতাই। যে-ছেলেটা মার খাচ্ছে, তার কেনা ওষুধগুলো রোগীর কাছে পৌঁছোবে না। ছেলেটারই চিকিৎসার দরকার পড়বে। হয়তো ওর বাড়ির কেউ অসুস্থ, মা অথবা বাবা, নিকট আত্মীয়ও হতে পারে। ছেলেটার অপেক্ষায় বসে থাকবে তারা।

গলি শেষ হতে চলল। মোড়ের মুখে আলো ঝলমলে ‘সেবা মেডিকেল’, কাস্টমারের ভালোই ভিড়। মন খারাপটা ঝেড়ে ফেলে এগিয়ে গেলেন প্রণববাবু। দোকানের সামনে রাখা বেশকটা সাইকেলের পাশে নিজের সাইকেলটা স্ট্যান্ড করে চাতালে উঠে পড়লেন। তাঁর বাড়িতেও একজন অসুস্থ, ওষুধ নিয়ে ফিরতে হবে তাড়াতাড়ি।

ভিড়ের কারণে একটু সময় লাগল ওষুধগুলো পেতে। এক সপ্তাহের প্রেসক্রিপশন করেছিল ডাক্তার, প্রণববাবু চারদিনের মতো নিলেন। মিত্রার একটা বদভ্যাস, শরীর একটু সামলে গেলেই ওষুধ খাওয়া বন্ধ করে দেয়। মিছিমিছি টাকা নষ্ট। দু’দিন ওষুধ খেয়ে রিপোর্ট করতে বলেছে ডাক্তার, তখন আবার কোনও ট্যাবলেট বদলে দিতে পারে। আগে থেকে বেশি নেওয়ার কোনও প্রয়োজন নেই।… ফেরার পথে গলির দিকে গেলেন না প্রণববাবু। ব্যানার্জিপাড়ার চওড়া রাস্তাটা ধরে মেন রাস্তার উদ্দেশ্যে এগোচ্ছেন। স্পিডে চালাতে চাইছেন সাইকেল, ঠিক মতো চলছে না। একটু টাইট আর টাল লাগছে সাইকেলটা। যখন ওষুধ কিনতে ঢুকেছিলেন দোকানে, কারওর অসতর্ক ধাক্বায় সাইকেলটা কি পড়ে গিয়েছিল? সেই কারণেই কি হ্যান্ডেল, প্যাডেল টাল খেয়ে গেল? এখন চেক করার সময় নেই, বাড়ি গিয়ে দেখবেন।

মেন রাস্তায় খানিকক্ষণ চালানোর পর প্রণববাবু টের পেলেন অস্বাচ্ছন্দ্যটা হ্যান্ডেল, প্যাডেলের নয়, গোটা সাইকেলের চলনটাই আলাদা ধরনের। বসার সিটটারও অনুভূতি অচেনা। তা হলে কি ওষুধের দোকান থেকে বেরোনোর পর ভুল করে অন্য কারওর সাইকেলে চেপে বসেছেন?

রাস্তার ধারে চলে গেলেন প্রণববাবু। সাইকেল থেকে নেমে দেখলেন, যা ভেবেছিলেন তাই! এটা তাঁর সাইকেল নয়। কোম্পানি আলাদা, সিটকভার কালো রঙের। তাঁরটা ছিল নীল। এত বড় ভুল হল! এইটা তাঁর সাইকেলের চেয়ে খানিকটা নতুন। কী করবেন এখন? বিদ্যুতের দোকানে গিয়ে দেখবেন, তাঁরটা আছে কিনা? যদি না থাকে? বিদ্যুৎ তাঁকে দেখতে পেয়ে জিজ্ঞেস করবে, কী ব্যাপার মাস্টারমশাই, ফিরে এলেন!

সত্যিটা বলতেই হবে এবং রেখে আসতে হবে সাইকেলটা। বিদ্যুৎ হয়তো বলবে, নিয়ে যান। বোঝাই যাচ্ছে বদলাবদলি হয়েছে। আপনার সাইকেলটা কেউ ফেরত নিতে এলে আপনাদের বাড়ির ঠিকানা দিয়ে দেব।

এতটা দূর অবধি তবু ঠিক আছে। কিন্তু বদলাবদলির বদলে প্রণববাবুর সাইকেল যদি চুরি হয়ে থাকে, ফেরত পাওয়ার চান্স নেই। ভদ্রতাবশত এই সাইকেলটা রেখে আসতে হবে। এমনটা হওয়াও অসম্ভব নয়, এর মালিক সাইকেল হাপিশ হওয়া নিয়ে দোকানের সামনে এখন হই-চই করছে। প্রণববাবু পৌঁছোনোর সঙ্গে সঙ্গে নিজের সাইকেল ছিনিয়ে নেবে। হেঁটে বাড়ি ফিরতে হবে প্রণববাবুকে। শুধু তাই নয়, কাল অফিস যাওয়ার সময় সাইকেল ছাড়াই পৌঁছোতে হবে স্টেশনে। নতুন সাইকেল কেনার বিলাসিতা করা যাবে না এখন। সাইকেল সারাইয়ের দোকানগুলোয় পুরোনো সাইকেল বিক্রি আছে কিনা খোঁজ নিতে হবে। তার মানে ততদিন পা দু’টোর উপর ভরসা। অফিস, দোকান-বাজার সব জায়গাতেই সময় লাগবে বেশি।

এর চেয়ে ভালো ক’টা দিন অপেক্ষা করা যাক। বদলাবদলির সম্ভাবনাই বেশি। এই সাইকেলের মালিক প্রণববাবুরটা দোকানে নিয়ে আসবে, বিদ্যুৎ চিনতেও পারবে। প্রণববাবুর সাইকেলের স্ট্যান্ডটা গোলমেলে, দাঁড় করাতে সমস্যা হয়। সেটা দেখে বিদ্যুৎ এক-দুবার বলেছে, স্যার, সাইকেলটা এবার পালটান। অনেকদিন তো হল। …আর একদিন বলল, স্ট্যান্ডটা অন্তত নতুন লাগিয়ে নিন।… সাইকেল ফেরত এলে বিদ্যুৎ লোকটাকে পাঠাবে প্রণববাবুর বাড়ি। তখনই যে যার নিজেরটা পেয়ে যাবে। এটা ঘটার হলে কালকের মধ্যেই ঘটবে। যদি চুরির ঘটনা হয়, ঘটনাটা ঘটবে না। যত দ্রুত সম্ভব একটা সেকেন্ড হ্যান্ড সাইকেল কিনে, এটা বিদ্যুতের দোকানে দিয়ে আসবেন প্রণববাবু। ফেরত দিতে দেরির কারণ হিসেবে বলবেন, কাজে আটকে পড়েছিলাম। আসতে পারিনি।

ফের সাইকেলে উঠে পড়েছেন প্রণববাবু। অচেনা সাইকেল দেখে বাড়ির লোকের মনে প্রশ্ন জাগবে। কিছু জিজ্ঞেস করলে প্রণববাবু বলবেন, আমারটা একজন ভুল করে নিয়ে গেছে, আমি তারটা চেপে চলে এসেছি।

পরের দিন অফিস বেরোনোর আগে খেতে বসেছেন প্রণববাবু। মেয়ে পিউ খাবার দিচ্ছে টেবিলে। মিত্রার জ্বর নেমে গেলেও, শরীর খুবই দুর্বল। চেয়ারে বসে স্বামীর খাওয়া দেখছে। বলে উঠল, কাল তো বাজারের গলিতে একটা খুন হয়েছে, শুনেছ?

বুকটা ধড়াস করে উঠল প্রণববাবুর। সেই ছেলেটাই কি? মার খাচ্ছিল যে? ভিতরের উত্তেজনা সামলে স্বাভাবিক গলায় জানতে চাইলেন, কখন হল খুন?

– রাত আটটা নাগাদ। তুমি যখন ওষুধ আনতে বেরোলে। বাজারের দিকেই তো গিয়েছিলে, কোনও গোলমাল টের পাওনি? জানতে চাইল মিত্রা।

খাবার গলা দিয়ে নামতে চাইছে না, প্রণববাবু বুঝতেই পারছেন সেই ছেলেটাই। স্ত্রীকে বললেন, না, আমি তো কোনও গণ্ডগোলের আঁচ পাইনি। খবরটা কে দিল তোমাকে?

– সকালে সমু বলল। কাল রাতেই ঘটনাটা ওর কানে এসেছে। আজ কাগজে বেরিয়েছে খবরটা।

এবাড়িতে খবরের কাগজ নেওয়া হয় না। সমু পড়ে পাড়ার কোনও দোকানে বা ক্লাবে। প্রণববাবু চোখ বোলান অফিসে, কোনও সহকর্মীর থেকে নিয়ে।

দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফের মিত্রা বলতে থাকল, কী যে হচ্ছে আজকাল! কোন মায়ের কোল খালি হল, কে জানে! সমুরই বয়সি ছেলেটা। খুব নাকি পরোপকারী।

–সমুর চেনা, মানে আলাপ ছিল? খাওয়া থামিয়ে জানতে চাইলেন প্রণববাবু। আসলে জানার ইচ্ছে সমুর বন্ধু ছিল কিনা, তাহলে প্রণববাবুকে চিনতে পেরেই বাঁচাতে বলেছিল।

এবার পিউ উত্তর দিল, দাদা সেরকম তো কিছু বলল না। বন্ধু হলে নিশ্চয়ই কাল রাত থেকে হাসপাতাল-বাড়ি করত।

একটু হলেও আশ্বস্ত হলেন প্রণববাবু, অপরাধবোধের ভারটা বাড়ল না।

বাড়ি থেকে স্টেশনের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়েছেন প্রণববাবু। অন্যের সাইকেলটাই চালাচ্ছেন। যা হোক তা হোক করে খাওয়া শেষ করেছেন আজ। কেন জানি তাঁর মনে হচ্ছে এই সাইকেলটা খুন হয়ে যাওয়া ছেলেটারই। ওর হাতে ওষুধের ক্যারিব্যাগ ছিল। সেবা মেডিকেলে গিয়েছিল নিশ্চয়ই। গলির কাছে বলতে ওই দোকানটাই। ওখান থেকে বেরিয়ে সাইকেলে ওঠার আগেই দুষ্কৃতীরা ওকে ধরে, কোনও না কোনও অছিলায় গলিতে এনে শুরু করে মার। গলি নির্জন, লোক জড়ো হয়ে বাধা দেওয়ার সুযোগ নেই। এই সব কেসে পুলিশ বসে থাকবে না, এতক্ষণে খুনের তদন্ত শুরু করে দিয়েছে। ছেলেটার সাইকেলের খোঁজ পড়বেই। প্রণববাবুর সাইকেল ছেলেটা নেয়নি, পাওয়া যাবে দোকানের সামনে। সেই সূত্র ধরে পুলিশ আসবে প্রণববাবুর কাছে। …ভাবনাটা মাথায় খেলতেই পা-দুটোর জোর যেন ঝপ করে কমে গেল। প্যাডেলে সে ভাবে আর চাপ দিতে পারছেন না প্রণববাবু। পুলিশের জেরা ভয়ানক জিনিস। এসে বলতেই পারে, খুনের চক্রান্তে আপনিও জড়িত। মার্ডারটা যাতে নির্বিঘ্নে হয়, সেই পরিকল্পনার অংশীদার হয়ে আপনি ছেলেটার সাইকেল নিয়ে সরে পড়েছিলেন। বেচারির পালানোর ন্যুনতম সুযোগটুকু ছিল না।… প্রণববাবু তখন যদি বলেন, ওরা মারধর শুরু করার পর আমি দোকানে গেছি।… পুলিশ বলবে, আপনি তার মানে দেখেছেন ছেলেটাকে মারা হচ্ছে। বাধা তো দেনইনি, পুলিশকেও জানাননি ফোনে। অপরাধ ঘটতে দেখে পুলিশকে না জানানোটাও অপরাধ।… কথাগুলো ভাবতে ভাবতে প্রণববাবুর মনে হচ্ছে সাইকেলটা কোথাও ফেলে হেঁটে স্টেশনে যাওয়া উচিত। কিন্তু কোথায় ফেলবেন? তাঁদের মফস্সলে কোনও ঝোপঝাড় আর অবশিষ্ট নেই। ঘেঁষাঘেষি বাড়ি, ফ্ল্যাট, দোকান। অফিস টাইমে রাস্তায় এখন প্রচুর লোকজন। কোনও গলিতে গিয়ে যদি রেখে আসেন, কেউ না কেউ ঠিক দেখে নেবে, সাইকেলটা কে রাখল। তদন্তের সাক্ষী হয়ে যাবে সে। কী যে করা উচিত, বুঝে উঠতে পারছেন না প্রণববাবু। তবে এত দুশ্চিন্তার মধ্যেও কিছু আশাব্যাঞ্জক পয়েন্ট মাথায় আসছে। প্রথমত, তাঁর সাইকেল যদি পড়ে থাকত সেবা মেডিকেলের সামনে, এতক্ষণে নিশ্চয়ই পুলিশ চলে আসত বাড়িতে। মাঝে একটা গোটা রাত গেছে। তদন্তপর্বের এই সময়টা ভীষণ মূল্যবান। সাইকেলটা নিয়ে গেছে অন্য কেউ, ফেলে গেছে এটা। প্রণববাবুর সাইকেল পড়ে থাকলে বিদ্যুৎ দোকান বন্ধ করার আগে লক্ষ্য করত এবং জানাত তাঁকে। অতএব সাইকেলটা খুন হয়ে যাওয়া ছেলেটার নয়। আর একটা আশার কথা, বাড়ির লোকও খেয়াল করেনি প্রণববাবু অন্য কারওর সাইকেল নিয়ে এসেছেন। তাঁর সাইকেল থাকে সিঁড়ির তলায়, সমুরটা ঢাকা বারান্দায়। বাড়ির কারওরই তেমন নজর যায় না সাইকেল দুটোর দিকে। ‘এই সাইকেলটা কার? তোমার সাইকেল কোথায়?’ এসব প্রশ্ন বাড়ির লোক আপাতত করছে না। যদি করে, সত্যি ঘটনা বললে ওদেরও মনে হবে সাইকেলটা বুঝি খুন হয়ে যাওয়া ছেলেটার। তার চেয়ে ক’টা দিন চুপচাপ থাকা যাক। যে ভুলোমনের লোকটা প্রণববাবুর সাইকেলটা নিয়ে গেছে, যদি ফেরত দিতে আসে, প্রণববাবু এটা দিয়ে দেবেন। ব্যস, ঝামেলা মিটে গেল।

পাঁচদিন কেটে গেল। অন্যের সাইকেল চালিয়ে যাচ্ছেন প্রণববাবু। তাঁরটা এখনও ফেরত পাননি। বাড়ির লোকেরও চোখে পড়েনি এই সাইকেল আগেরটা নয়। এমনকী রেলস্টেশনে, যেখানে সাইকেল জমা দিয়ে অফিসের ট্রেন ধরেন, স্ট্যান্ডের ছেলেরাও অন্য সাইকেল দেখে কোনও মন্তব্য করেনি। আসলে সকলেই যে যার কাজে ব্যস্ত। প্রণববাবুও খুব একটা লক্ষ্য করার মতো ব্যক্তি নন, একেবারেই

ছা-পোষা। কেউ তেমন ধর্তব্যের মধ্যে আনে না। অতি সাধারণ হওয়ার এটা একটা সুবিধে। সেকেন্ডহ্যান্ড সাইকেল কেনাটাও এখন মুলতুবি রেখেছেন প্রণববাবু। গতকাল মিত্রার ওষুধ ফুরিয়েছে, এখনও জ্বরটা ঘুরে ঘুরে আসছে, কোর্সের বাকি ওষুধগুলো প্রণববাবু আনতে গিয়েছিলেন সেবা মেডিকেলে, এই সাইকেলটা চেপেই গিয়েছিলেন। বিদ্যুৎ সাইকেল সংক্রান্ত কোনও কথাই তুলল না। ক’দিন আগে দোকান থেকে চার হাত দূরে ওই দোকানেরই এক কাস্টমার খুন হয়ে গেছে, সে সব নিয়েও কোনও আলোচনা নেই। যতদিন যাচ্ছে মানুষ কেমন যেন নিরাসক্ত হয়ে পড়ছে। প্রণববাবু কিন্তু খবরটায় চোখ রেখেছেন। অফিসে গিয়েই সহকর্মীর থেকে কাগজটা নিয়ে চোখ বোলান একটা খবরেই। এখন ভেতর পাতায় এবং ছোটো হয়ে এসেছে খবরটা। ছেলেটা পরোপকারী তো ছিলই। কিছু সেবামূলক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গেও যুক্ত ছিল। একটি প্রতিষ্ঠানের বাড়ি দখলে নিতে চাইছিল কিছু সমাজবিরোধী, ছেলেটা বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। খুন হতে হল অবশেষে। পুলিশ কয়েকজন আততায়ীকে চিহ্নিত করেছে। তারা সকলেই ফেরার। এই ধরনের ঘটনা নতুন কিছু নয়, আকছার ঘটছে। প্রথমবার প্রণববাবুর সামনে ঘটল। প্রণববাবু যে দেখেছেন ঘটনাটা, আততায়ীরা ছাড়া আর কোনও সাক্ষী নেই। যদি মুখ না খোলেন, প্রণববাবু নিরাপদ, খুনিরাও।

ভুলো লোকটা এখনও প্রণববাবুর সাইকেল নিয়ে ফেরত আসেনি। বোধহয় ব্যস্ত মানুষ, টাইম পায়নি আসার। সাইকেলের মতো তুচ্ছ ব্যাপার নিয়ে মাথা ঘামানোর মতো লোকও হয়তো সে নয়। ভাবছে, কাজ চলে যাচ্ছে, যাক। কোথায় বদলাবদলি হয়েছে, সেটাও মনে হয় খেয়াল করতে পারছে না। প্রণববাবুও ঠিক করছেন যে ভাবে চলছে, চলুক। সেকেন্ডহ্যান্ড সাইকেল কিনতে গিয়ে অযথা টাকা খরচ করার কোনও মানেই হয় না। অসুবিধে শুধু একটাই, সাইকেলটাতে এখনও তিনি স্বাচ্ছন্দ্য হতে পারেননি। বেশ সমস্যা হয় চালাতে গেলে। এখনও মনে হয় সাইকেলটা প্রণববাবুর মালিকানা পছন্দ করছে না। সে নিজের মতো চলতে চায়। হ্যান্ডেল ঘোরাতে হয় জোর করে। প্যাডেলে চাপ মারতে হয় স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি। যান্ত্রিক কোনও জটিল গোলযোগ আছে সাইকেলটায়। সমস্যাটা ঠিক মতো বোঝানো যাবে না সারাইয়ের দোকানে। ত্রুটিটা নিজে অনুমান করতে চেয়ে গত পরশু অফিস ফেরত ট্রেন থেকে নেমে সাইকেল যেমন চলতে চেয়েছে, তেমনই চলতে দিয়েছিলেন প্রণববাবু। দেখা গেল সাইকেল বাড়ির উলটো পথে বেশ সাবলীলভাবে চলছে। প্রণববাবুদের দুর্গানগর পার হয়ে গেল, এরপর চণ্ডীতলা গ্রাম। অনিচ্ছুক ঘোড়ার লাগাম টানার মতো সাইকেল ঘুরিয়েছিলেন প্রণববাবু। বাড়ি ফিরতে যদি দেরি হয়ে যেত। চিন্তা করত মিত্রা, পিউ।

বাড়ির বিপরীত পথে সাইকেলের স্বাভাবিক চলনে প্রণববাবু বেশ বিস্মিত হয়েছেন। বড়ো খটকা লেগেছে মনে। আজ টিফিনের পর কেবল ফল্ট হয়ে কারেন্ট গেল অফিসে। ঘন্টা খানেক গরমে পচিয়ে ছুটি দিল কোম্পানি। অপ্রত্যাশিত ভাবে বেশ কিছুটা সময় পাওয়া গেল হাতে। সাইকেলটাকে ভালো করে পরখ করার এই সুযোগ। নিজেদের স্টেশনে নেমে, স্ট্যান্ড থেকে সাইকেল নিয়ে চেপে বসেছেন প্রণববাবু। বলা যেতে পারে নিজেকে সাইকেলটায় সঁপে দিয়েছেন। সাইকেল চলছে তার মর্জি মতো। আগের দিনের রাস্তাই ধরেছে। চণ্ডীতলায় এসে পড়েছেন প্রণববাবু। খালের দিকে যে মেঠো রাস্তাটা গেছে সাইকেল নিজের থেকেই সেই দিকে বাঁক নিল। সন্ধে নামছে। এখন কি এই নির্জন পথে যাওয়া ঠিক হচ্ছে?

রাস্তাটা মাঠ ধরে গেলেও মাটির নয়। পুরোটাই মোরাম পাতা এবং লরি যাওয়ার মতো চওড়া। কারণ, এই রাস্তার শেষে আছে একটা ইটখোলা, তারপরই গঙ্গার খাল। ইটখোলার জন্যই রাস্তার এত যত্ন। এখানে একবারই মাত্র এসেছিলেন প্রণববাবু, ইটের দর করতে। দোতলা তোলার ইচ্ছে ছিল। বাজেট করার পর পিছিয়ে গেছেন। সাধ্যে কুলোয়নি। কিন্তু সাইকেলটা তাঁকে আবার এখানে নিয়ে এল কেন?… ভাবনা এগোল না। কারণ, সাইকেলও এগোচ্ছে না। যেন গোঁ ধরে দাঁড়িয়ে গেছে। কাজ-কারবার কিছুই বুঝতে পারছেন না প্রণববাবু, নেমে পড়লেন সাইকেল থেকে। গড়িয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছেন। তাও এগোচ্ছে না। স্ট্যান্ড নামিয়ে দিলেন প্রণববাবু। দু’পা পিছিয়ে গিয়ে সাইকেলটার দিকে তাকালেন, সন্ধের আবছায়াতে সাইকেলটাকে কেমন যেন জীবন্ত মনে হচ্ছে। নির্দিষ্ট গন্তব্যে নিয়ে এসেছে আরোহীকে, এখন চাইছে তিনি আশপাশটা পায়ে হেঁটে দেখুন। কিছু একটা তাকে দেখাতে নিয়ে এসেছে সাইকেলটা। দেখার মতো কী আছে এখানে? অদূরে ইতস্তত সার সার ইটের পাঁজা। মাঝে ঢিবির মতো ভাটি, এখন নিভন্ত। ঢিবিটা সন্ধের অন্ধকার মাখা। আকাশ ছোঁয়া চিমনির মাথায় দিনশেষের চিলতে আলো। নিয়ে যখন এসেছে, কিছু তো একটা দেখার আছে নিশ্চয়ই।

দৌড়ে সব থেকে কাছের ইট সাজানো পাঁজার কাছে গেলেন প্রণববাবু। আড়াল ধরে সন্তর্পণে এগিয়ে যাচ্ছেন! স্ফূর্তির আড্ডা চলছে। পরের লাটের ওপার থেকে আসছে আওয়াজ। আলোও জ্বলছে ওখানে। বিড়াল পায়ে এগিয়ে গেলেন প্রণববাবু। পাঁজাটার ধারে গিয়ে বাড়ালেন মুখ, তাস-মদের আড্ডা চলছে। ইটখোলার অফিস থেকে তার টেনে জ্বালানো হয়েছে মাথা ঢাকা দেওয়া বাল্ব। দলটাকে খুঁটিয়ে দেখতে গিয়ে চমকে উঠলেন প্রণববাবু, সাতজনের চারজনই তাঁর চেনা! এই চারজন শোভানা বস্ত্রালয়ের গলিতে ছেলেটিকে মারছিল। পরে যে মারা যায়। আক্রমণকারী চারজনের বেশি ছিল। এক ঝলক দেখে এদেরকেই মনে রাখতে পেরেছেন প্রণববাবু। চারজনের দুজনকে ইট দর করতে এসে দেখেছিলেন এই খোলায়, সেটা এইমাত্র মনে পড়ল। ঘটনার সময় খেয়াল হয়নি। …পা কাঁপছে প্রণববাবুর, স্পষ্ট টের পাচ্ছেন সাইকেলটা মৃত ছেলেটারই। ওর আত্মা হত্যাকারীদের চেনানোর জন্য এখানে এনেছে। এদের হন্যে হয়ে খুঁজছে পুলিশ। কিন্তু প্রণববাবু তো পুলিশের কাছে যাবেন না। বিস্তর ঝামেলা। যখন তখন ডেকে পাঠাবে থানা, আদালত। ধরিয়ে দেওয়ার জন্য এরাও লোক দিয়ে শোধ তুলবে প্রণববাবুর উপর। অনেক কষ্টে টিকিয়ে রাখা তাঁর সাংসারিক জীবন ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে। …ইটের পাঁজা থেকে সরে প্রায় দৌড়ে এসে সাইকেলে উঠে পড়লেন প্রণববাবু। সজোরে প্যাডেল মারতে লাগলেন। তিনি আর সাইকেলটার মর্জি মতো চলবেন না, সোজা বাড়ি ফিরবেন।

তা কিন্তু হল না। কী ভাবে জানি থানার সামনেই এসে পড়লেন প্রণববাবু। সাইকেলটাই নিয়ে এল আর কি! প্রণববাবু বুঝলেন নিস্তার নেই। অদৃশ্য একজন তাঁকে নিয়ন্ত্রণ করছে। থানার বাইরে স্ট্যান্ড করলেন সাইকেল। নিরুপায় মুখ নিয়ে ঢুকলেন ভিতরে।

একঘন্টার উপর কেটে গেল থানায়। টেবিলের এপারে বড়োবাবুর মুখোমুখি বসে আছেন প্রণববাবু। নিহত ছেলেটির বিষয়ে যতটুকু যা দেখেছেন। তারপর যা যা ঘটেছে সবিস্তারে বলেছেন ওসিকে। আততায়ীর হদিশ পেয়েই ওসি ফোর্স পাঠালেন ইটখোলায়। মনে হচ্ছে গোটা দলটা ধরা পড়েছে। এই মুহূর্তে কানে ফোন রেখে ফোর্সের কারুর সঙ্গে কথা বলছেন ওসি। চোখেমুখে উৎফুল্ল ভাব। কান থেকে ফোন নামিয়ে বড়োবাবু হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, ইউ ডিড আ গ্রেট জব। সবকটা ধরা পড়েছে। সমাজের সবাই যদি আপনার মতো এগিয়ে আসত!

হ্যান্ডশেক সারা হল। প্রণববাবু বলতে যাচ্ছিলেন, আমি কিছু করিনি স্যার। যা করার ওই সাইকেলটাই… বললেন না। কথা বাড়িয়ে কী লাভ! বদলে বললেন, আমি তা হলে এখন বাড়ি যাই স্যার।

–সে কী, ওরা আসুক। আপনাকে তো আইডেন্টিফাই করতে হবে ওদের। ওসির কথায় মুখ আরও শুকিয়ে গেল প্রণববাবুর। বললেন, আমার খুব শরীর খারাপ লাগছে স্যার। সেই কোন সকালে অফিসে বেরিয়েছি। তারপর এতক্ষণ সাইকেলিং! তা ছাড়া আপনারা যে-দলটাকে খুঁজছিলেন, তাদেরই তো পেয়ে গেলেন। আমার সাক্ষীর আর কী দরকার?

–এখন অত দরকার না পড়লেও, কোর্টে আপনাকে সাক্ষী দিতে যেতে হবেই। আপনি একমাত্র আই উইটনেস। আপনি না চেনালে ওরা শাস্তিই পাবে না।

এসব ঝামেলা আসবে, জানেন প্রণববাবু। সেই কারণেই থানায় আসতে চাননি। বাঁচার ক্ষীণ চেষ্টায় প্রণববাবু বললেন, আমার স্যার প্রাইভেট কোম্পানি। কোর্টে যাওয়ার ছুটি কি পাব? সাক্ষী দিতে গিয়ে চাকরি না চলে যায়।

–ছুটি পাবেন না মানে! কোর্ট ডাকলে মালিক ছুটি দিতে বাধ্য। দাপটের সঙ্গে বললেন ওসি। প্রণববাবু কল্পনায় দেখে নিলেন এই দাপটের আঁচ লাগল তাঁর সদাগম্ভীর বসের মুখে। মুহূর্তে মিইয়ে গেল সেই অভিব্যক্তি। মনের চোখে প্রণববাবু দেখছেন, বস এসে তাঁকে বলছেন, আপনি ভাই তাড়াতাড়ি কোর্টে যান। পুলিশ অফিসার এই মাত্র ফোন করল। কোর্ট থেকেই বাড়ি চলে যাবেন, আজ আর অফিসে আসতে হবে না। কাল যেমন আসার আসবেন।

–চলুন, এবার আপনার সাইকেলটা দেখা যাক। যে-ছেলেটা খুন হয়েছে, সে ওষুধের দোকানে সাইকেল নিয়ে গিয়েছিল, এমন কোনও খবর নেই আমাদের কাছে।

ওসির কথায় বাস্তবে ফিরেছেন প্রণববাবু। বললেন, চলুন, দেখুন কার সাইকেল। আপনাদের কাছে সঠিক খবর নাও থাকতে পারে।

থানার বাইরে বেরিয়ে সাইকেলের সামনে যেতেই থমকে দাঁড়ালেন প্রণববাবু। নিজের চোখকে বিশ্বাস হচ্ছে না। ভ্যাবাচাকা মুখ নিয়ে তাকালেন বড়োবাবুর দিকে। বড়োবাবু জিজ্ঞেস করলেন, কী হল?

বিস্ময়ের গলায় প্রণববাবু বললেন, এ তো আমারই সাইকেলটা স্যার। যখন ভিতরে ছিলাম, কেউ কি বদলে দিল?

ওসির ঠোঁটে প্রবোধ দেওয়ার হাসি। বললেন, আপনার ধারণা মতো সাইকেলটা মৃত ছেলেটার। সে তো আর এসে সাইকেল পালটে দিয়ে যাবে না। কোথাও ভুল হচ্ছে আপনার। টেনশনে আছেন, বাড়ি গিয়ে রেস্ট নিন।

প্রণববাবুর দেরি দেখে মিত্রা, পিউ বেশ টেনশনে পড়ে গিয়েছিল। ওরা নাকি ফোনও করেছিল, প্রণববাবু ধরেননি। ‘অফিসে কাজের চাপ ছিল, বেরোতে দেরি হয়েছে’, বলে প্রণববাবু হাতমুখ ধুতে বাথরুমে গেলেন। ফিরে এসে চা নিয়ে বসেছেন টিভির ঘরের সোফাটায়। স্ত্রী এবং মেয়ে রয়েছেন এই ঘরেই। ওদের উদ্দেশ্যে শান্ত গলায় বললেন, তোমরা খেয়াল করেছ, এই কদিন আমি অন্যের সাইকেল নিয়ে বাড়ি ঢুকছিলাম?

–কই, না তো। সিঁড়ির তলাটা ধুতে গিয়ে গত দু’দিন তোমার সাইকেলটাই তো দেখেছি। বলার পর মিত্রা সামান্য উৎকণ্ঠার গলায় জানতে চায়, কেন, কী হয়েছে?

–পরে বলছি। বলে চায়ের কাপে চুমুক দিলেন প্রণববাবু। চলন্ত টিভির দিকে তাকিয়ে ডুব দিলেন মনের গভীরে। থানার বড়োবাবু বলছেন কোথাও একটা ভুল হচ্ছে তাঁর। একটা ব্যাপার একটু গোলমাল লাগছে বটে, দু’জন দুষ্কৃতীকে তিনি আগে থেকে চিনতেন ইট দর করতে গিয়ে দেখেছিলেন খোলায়। তা হলে কি ওদের ডেরায় অন্য কেউ নিয়ে যায়নি? তিনি নিজেই… বাকিটা আর ভাবতে পারছেন না। ভয়ে কপালে ঘাম এসে গেছে প্রণববাবুর।

পড়ার জন্য সীমাহীন গল্প-নিবন্ধসাবস্ক্রাইব