দুর্গা (পর্ব-৩)

পর্ব – ৩

আজও বেশ মনে আছে দুর্গার লালকালিতে লেখা প্রথম প্রেমপত্রটি দলমঘাটা বাস রাস্তায় এসে লাইট পোস্টের নীচে দাঁড়িয়ে শুভায়ু প্রায় তিরিশবার পড়েছিল। ইচ্ছে করেছিল, তার সেই পবিত্র নিষ্পাপ ভালোবাসার কথা পৃথিবীর সবাইকে জানাতে। সে কারণে সে সন্ধেবেলা প্রেমপত্রটি দেখাতে শোভনের বাড়ি ছুটে গিয়েছিল। কিন্তু শত চেষ্টা করেও দুর্গার লেখা প্রেমপত্র শোভনকে সে দেখাতে পারেনি। একটা অপরাধবোধ তার মনকে সতর্ক করে দিয়েছিল।

সে এক পা এগিয়ে আবার দু’পা পিছিয়ে এসেছিল। তার কারণ হল দুর্গা শোভনের দাদার শালি। শোভনের দৌলতেই শুভায়ু দুর্গাদের বাড়িতে যাওয়ার ছাড়পত্র পেয়েছে। শোভনকে চিঠিটা দেখালে যদি সে রাগ করে, যদি তাকে ঘেন্না করে, তা হলে তো শুভায়ুর সব আনন্দটাই মাটি হয়ে যাবে। তাই সে দিন শোভনকে চিঠিটার কথা বলতে পারেনি।

ইতিমধ্যে জল অনেক দূর গড়িয়েছে। দুর্গার সঙ্গে শুভায়ুর প্রেম যখন তুঙ্গে, ঠিক তখনই হায়ার সেকেন্ডারি পরীক্ষার ফল বেরোতে দেখা গেল, শুভায়ু ভালো ভাবেই পাস করেছে। কিন্তু শোভন কম্পার্টমেন্টাল পেয়েছে। শোভনের কম্পার্টমেন্টাল পাওয়ার কারণ হল লেখাপড়ায় তার যতটা না মন ছিল, তার চেয়ে বেশি মনোযোগ ছিল ছাত্র রাজনীতিতে। রাজনীতি করতে গিয়েই তার লেখাপড়ার এই হাল হয়েছিল।

যাই হোক, পরীক্ষায় খারাপ রেজাল্ট করে শোভন যখন মনে প্রাণে ক্ষতবিক্ষত, তখনই সে ঠিক করল যে-দিকে দু’- চোখ যায় চলে যাবে। এ পোড়া মুখ নিয়ে বারড্রোন গ্রামে সে আর থাকতে রাজি নয়। একটা কিছু কাজ জোগাড় করে তবেই সে গ্রামে ফিরবে, নচেৎ নয়। শোভনের মনের কথা জানতে পেরে শুভায়ু তখন তাকে বলেছিল, ‘আমিও তোর সঙ্গে যাব।’

সে কথা শুনে শোভন বাধা দিয়ে বলেছিল, ‘তুই ভালো ভাবে পাস করেছিস। তুই আমার সঙ্গে জাহান্নামের পথে কেন যাবি? তা ছাড়া তোকে কলেজে ভর্তি হতে হবে। তোর এখানে থাকা দরকার।’

শুভায়ু বলেছিল, ‘তোকে জাহান্নামের পথে একা ঠেলে দিতে পারব না। তা ছাড়া তোকে ছেড়ে আমি থাকতে পারব না। আমি তোর সঙ্গে যাবই।’

শুভায়ু জেদ ধরে থাকায় শোভন আর বারণ করতে পারেনি। তার পর একদিন কাউকে কিছু না বলে হাওড়া স্টেশনে এসে পাটনার টিকিট কেটে গয়া প্যাসেঞ্জারে দু’জনে উঠে বসল। ট্রেনটা যখন ধানবাদ স্টেশনে এসে পৌঁছোল, তখন শুভায়ুর বাড়ির জন্য মন কেমন করে উঠেছিল।

শুভায়ু বলেছিল, ‘বাড়ির লোকেরা যদি তোর খোঁজ না পেয়ে পুলিশে খবর দেয়, তাহলে কী হবে?’

—যা হওয়ার তাই হবে। তবে আমি শুধু পাটনায় যাওয়ার খবর দুর্গাকে জানিয়ে এসেছি। বলে শোভন একটা সিগারেট ধরিয়েছিল।

শুভায়ু আবার প্রশ্ন করেছিল, ‘ও কিছু বলেনি।’

—তখন সে কিছু বলেনি। তবে চলে আসার আগে দুর্গা আমার হাতে একটা চিঠি ধরিয়ে দিয়েছে। এই নে পড়ে দেখ। বলে শোভন ট্রাউজারের পকেট থেকে দুর্গার লেখা চিঠিটা বাড়িয়ে দিয়েছিল।

শোভনের হাত থেকে চিঠিটা নিতে গিয়ে শুভায়ুর বুকের ভেতর ক্যানেস্তারা পেটানোর মতো দ্রিমদ্রিম শব্দ হচ্ছিল। তার জন্য তখন হয়তো কোনও অশুভ সংকেত অপেক্ষা করছিল। দুর্গার হাতে লালকালিতে লেখা চিঠিটা চোখের সামনে মেলে ধরতেই দেখা গেল তাতে লেখা রয়েছে- -দোহাই শোভনদা, তুমি ফিরে এসো। তুমি ফিরে না এলে বুঝব আমাকে তুমি একটুও ভালোবাসো না।

—ইতি দুর্গা

চিঠিটা শোভনকে ফিরিয়ে দিয়ে শুভায়ু ট্রেনের জানলার ধারে বসে দূর আকাশের দিকে তাকিয়েছিল। অব্যক্ত যন্ত্রণায় পুড়ে যাচ্ছিল তার দেহ-মন। সেই প্রথম সে বুঝতে পেরেছিল নারী কী বিষম বস্তু। নারী যেমন ভালোবাসা দিয়ে পুরুষ মানুষকে রাজা বানাতে পারে, তেমনি আবার চূড়ান্ত ছলনা করে পথেও বসাতে পারে। দুর্গা শোভনকে ভালোবাসে বলে তার একটুও দুঃখ হয়নি। দুঃখ হয়েছে শোভনকে ভালোবাসার কথা দুর্গা কেন গোপন করল। নারী যে ছলনাময়ী, এ কথা দুর্গা সেদিন চোখে আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছিল।

ক্রমশ…

 

সিলেবাসের বাইরে (পর্ব- ১)

অভীকের একমাত্র আশ্রয় মা, কিডনির সমস্যায় এখন শয্যাশায়ী। গবেষণার কাজ প্রায় থেমে। স্যারের “বিগ পুশ”-এও কোনও কাজ হচ্ছে না। মায়ের ডায়ালিসিস চলছে মাসে দুটো করে। অনেক টাকার ধাক্কা। একটা চাকরির নিতান্ত প্রয়োজন। তাই স্কুল সার্ভিস কমিশনের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে অর্থনীতির সহকারী শিক্ষক পদে যোগদান গ্রামেরই স্কুল আরামবাগ বিদ্যানিকেতনে। মেধা তালিকার ক্রমসংখ্যা একদম প্রথম দিকে থাকার ফল।

শনিবার বিকেল ও রবিবার গবেষণার কাজে বের হতে হয়। ও স্বনির্ভর গোষ্ঠী নিয়ে সামাজিক ও অর্থনৈতিক পালা বদলের যে-ইতিহাস তৈরি হতে শুরু করেছে তা সমাজ পরিবর্তনের হাওয়া মোরগ হয় কিনা তার ওপর চলছে ওর গবেষণা। স্বনির্ভর গোষ্ঠী গ্রামের প্রত্যন্ত পরিবারে একটা উন্নয়নের দিশা দেখাচ্ছে। কিছু মহিলা দল তৈরি করে কাজ করছে।

ব্যাংক থেকে ঋণ নিচ্ছে যৌথ ভাবে। তাতে দায়বদ্ধতা থাকছে সকলের। সেই ঋণের টাকা আয় উপার্জনকারী কোনও কাজে লাগিয়ে আয় করছে এবং ব্যাংকের ঋণ শোধ করছে। বাংলাদেশের অধ্যাপক মহম্মদ ইউনুসের দেখানো পথে চলছে এই ‘সেল্ফ হেল্প গ্রুপ’-এর কর্মধারা। উন্নয়নের একটা উদ্দীপনা সারা বিশ্বেই দেখা যাচ্ছে।

শিক্ষকতার কাজে অভীকের আগ্রহ নতুন নয়। সংসার চালাতে এর আগে ও প্রাইভেট টিউশনিও করেছে অনেক। বাবার মৃত্যুর পর জমানো টাকায় আর ক’দিন চলবে! ভালো ছাত্র হিসেবে নামডাক ওর টিউশনির পসার বাড়িয়ে ছিল খুব। চাকরিটা পেয়ে ও সব টিউশন ছেড়ে দিয়েছে। ওর বন্ধু প্রবালকে দিয়ে দিয়েছে। এখন শুধু মা, স্কুল, গবেষণা নিয়েই চলছে।

মায়ের কাছে সবসময় থাকার জন্য চম্পা মাসিকে রেখেছে। অসহায় বিধবা চম্পা মাসি ওদের বাড়িতেই থাকে। মায়ের দেখাশোনার সাথে বাড়ির সব কাজই করে। শনিবার স্কুল ছুটির পর, রবিবার ও ছুটির দিনগুলোয় গবেষণার কাজ জোর কদমে করে অভীক।

স্কুলের পরিবেশ বেশ ভালোই। সহকর্মীরা খুব তাড়াতাড়ি ওকে নিজেদেরই একজন করে নিয়েছে। স্কুলের শৃঙ্খলা বেশ ভালো। লেখাপড়ায় ছাত্রছাত্রীদের গুণগত মানও বেশ উঁচুতে। ভালোই চলছে ওর শিক্ষকতার দিনগুলো। বেশ মন দিয়ে কাজ করে ও। মা বলেন – যে অন্ন দেয় তাকে কখনও ঠকাবি না। অভীক স্কুলে ওর সেরাটা দেবার চেষ্টাই করে। সহকর্মীরা ও প্রধানশিক্ষকও খুশি ওর কাজে।

নীচু শ্রেণির ক্লাসে ও গ্রামারটা পড়ায়। ভিত শক্ত না হলে ইংরাজিটা শিখবে কী করে! সিক্স-এর ক্লাসে সেদিন ও সবে ক্রিয়ার কাল শুরু করেছে। হঠাৎ দেখে পিছনের বেঞ্চে একটি ছেলে মুখ নীচু করে বসে। মাঝে মাঝে ওর সারা দেহ কেঁপে কেঁপে উঠছে। ফুঁপিয়ে কাঁদছে যেন! কৌতূহলী হয়ে বিষয়টা জানার চেষ্টা করতেই ওর পাশের ছেলে যা বলল তা শুনে খুব কষ্ট হল অভীকের।

যে-ছেলেটি কাঁদছে তার নাম অয়ন। ক্লাশের মনোযোগী ছাত্র। ক্লাসে মাঝেমাঝে অভীকের প্রশ্নের উত্তরও দেয়। অন্য শিক্ষকদের কাছ থেকে খবর নিয়ে জেনেছে, অন্য বিষয়েও বেশ ভালো। ছেলেটির রোল পনেরো। পাশের ছেলে রমেন বলল, ওর কান্নার কারণটা।

অয়নরা খুব গরিব। ওর মা লোকের বাড়ি কাজ করে সংসার চালায়। ওর মা ক্লাসের চতুর্থ রোল নম্বর, আলোকদের বাড়িতে কাজ করে। আলোক ক্লাসের মনিটর। অয়নের মা লোকের বাড়ি কাজ করে বলে অয়নকে আলোক ‘ছোটোলোক’ বলে গালাগাল করে। ভীতু চেহারার অয়ন কিছু বলতে পারে না। শুধু কাঁদে। ক্লাসের অন্য ছেলেরা অয়নের হয়ে বলতে গেলে আলোক মনিটর বলে উলটোপালটা নাম তুলে স্যারেদের কাছে বকুনি খাওয়ায়।

অয়ন আজ আগে এসে প্রথম বেঞ্চে বসেছিল। আলোক পরে এসে ওর ব্যাগ শেষ বেঞ্চে রেখে ওর জায়গায় বসে। শুধু তাই নয়, আলোক অয়নকে সকলের সামনে বলে – ছোটোলোকের ছেলে সামনের বেঞ্চে বসবি কী! তুই রোজ শেষ বেঞ্চে বসবি। নাহলে তোর নামে উলটোপালটা নালিশ করব স্যারেদের কাছে। রীতিমতো হুমকি! চমকে উঠল অভীক। এইটুকু ছোটো ছেলেটার বুকে এতো ঘৃণা! অয়নের জন্য একটা কান্না যেন বুক ফেটে বেরিয়ে আসতে চাইছে। কোথায় যেন মিলে যাচ্ছে অভীকের ছেলেবেলা অয়নের সাথে।

অভীকের বাবার মৃত্যুর পর আশপাশের পরিচিত আত্মীয়দের ব্যবহার, ও ভোলেনি। কথায় কথায় গরিব বলে একটা ঘেন্না ছুড়ে দিত ওদের দিকে। মাকে জড়িয়ে ধরে শুধু কাঁদত সেই সময়। আগুন চোখে মা শুধু বলত, সুদিন আসবেই। মুখ বুজে অভীক সেই সুদিনের প্রতীক্ষা করে গেছে। ঈশ্বরের দূতের মতো কিছু শ্রদ্ধেয় শিক্ষককে তখন ও পাশে পেয়েছে। স্যারেরা অভীকের লেখাপড়ায় সব সমস্যা মিটিয়েছেন। তাঁদের, শুধু তাঁদেরই জন্যে অভীক অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেছে এবং আজ গবেষণায়। অয়নের কান্নাভেজা দু’চোখ ওর বুকে ঝড় তুলেছে আজ!

স্টাফরুমে ফিরে ও সহকর্মীদের বলল সব। প্রধানশিক্ষকও শুনলেন সব। পরের দিন আলোকের অভিভাবক-কে ডাকার ব্যবস্থা করলেন। অভীক বুঝল, অয়নের মাকে কালই অপমান করে কাজ থেকে ছাড়িয়ে দেবে ওরা। তাই যা করার আজই করতে হবে। স্কুল ছুটির পর অভীক ছাত্রদের জিজ্ঞেস করে করে অয়নের বাড়িতে গিয়ে পৌঁছোল। দেখল মাটির বারান্দায় অয়নের বাবা শুয়ে।

ক্রমশ…

 

 

কালো রাস্তার মানুষ (শেষ পর্ব)

শেষ পর্ব  

বিয়ের পর বছর চার কেটে গেলেও হারু ও ফুলমণির কোনও সন্তান জন্মায় না। ফুলমণির মাসের রক্তপাত বন্ধ হয়, পেটে সন্তানের উপস্থিতি বুঝতে পারে। কয়েকমাসের মধ্যে একদিন হঠাৎ রক্তপাত হতে শুরু করে। পরনের কাপড় ছেড়ে রক্ত গড়িয়ে আসে পায়ের দিকেও। এই রক্তপাত বড়োবাবুদের কাছে এটা খুব ভালো খবর হলেও ফুলমণির জন্যে খুবই দুঃখের।

হারু ফুলমণিকেই দোষ দেয়। ঝগড়া করে, খাবার উলটে দেয়, মদ খাবার পরিমাণ বাড়ায়। এমন ভাবেই চার বছর কেটে যায়। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে এই তিন মাস হল একটা মেয়ে জন্মালেও হারু কিন্তু তার আগের জায়গায় ফিরে আসেনি, বরং একটা গা’ছাড়া ভাব তাকে জাপটে ধরেছে। মুখে কিছু না বললেও ফুলমণি বেশ বুঝতে পারে।

পরের দিন খুব তাড়াতাড়িই ঘুম ভেঙে যায়। ফুলমণি ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে তাঁবুতে হারু নেই। মেয়েটা রাতে বেশ কয়েকবার কেঁদে উঠেছিল, কেমন যেন দম বন্ধ করা কান্না, গা পুড়ে যাচ্ছে জ্বরে। কাল সকালেও না কমলে বড়োবাবুর হাতে পায়ে ধরে একটা ডাক্তার দেখাতেই হবে। এদিকে সারা রাত বৃষ্টিও পড়েছে। রাতভর সে নিজেও ঘুমোতে পারেনি। ভোরের দিকে চোখদুটো বুজে আসে। ফুলমণি বাইরে বেরিয়ে দেখে বাকি সবাই উঠে গেলেও কাজের কোনও তোড়জোড় নাই।

বৃষ্টি থামলেও আকাশের মুখ ভার, এইরকম থাকলে আজ আর কাজ হবে না। চোখে মুখে জল দিয়ে হাঁড়ি থেকে পান্তা বের করে নিজে নেয়, হারুর জন্যেও ঢাকা দিয়ে রেখে দেয়। কিছু সময় পরেই দেখে দূরের চা-দোকানের ওই লোকটা তার দোকান ছেড়ে আরেকটু উপরের দিকে উঠে গেছে। জিনিসগুলো একটা একটা করে সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।

মেয়েটার শরীরের কথা ভেবে ফুলমণি ছেলেদের তাঁবুর কাছে এসে বাইরে থেকেই জিজ্ঞেস করে, “আমার লোকটা কোথায় গো?’

—পকুরের পানে গেইচে, উ আর সুবলা।

—আজ কাজ হবেক?

—দেখি বাবু যা বলবেক, ম্যাঘ করিছে, জল পড়লে আর কী করে কাজ বাগাব? রাজুয়ার গলা।

ফুলমণি একপা একপা করে দোকানের কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করে, ‘কি গো আজ রুটি দিবে না?’ দোকানি প্রথমে কোনও উত্তর দেয় না। ফুলমণি আবার জিজ্ঞেস করে। এবার দোকানি বিরক্ত হয়!

—দেখছ না, আজ কী অবস্থা, এক্ষুনি গাড়ি এসে সব ভেঙে দেবে, পিছিয়ে গেলাম। বৃষ্টি আরম্ভ হলে এই মানুষটাকে কোথায় রাখব কে’জানে?’

ফুলমণি তাকিয়ে দেখে দোকানির বউটা সেই একই ভাবে শুয়ে আছে। মাথার উপর খোলা আকাশ, ঝোড়ো হাওয়া বয়ে যাচ্ছে। ফুলমণি মাথা নীচু করে নিজের তাঁবুতে ফিরে মেয়েদের তাঁবুর কাছে এসে দাঁড়ায়, ‘কাঁদেনি তো?”

—না, শুনি নাই। রুবি উত্তর দেয়।

—আজ তো কাজ হবেক নাই, চল চানট করে আসি গা। একটু ভালো করে রান্না চাপাইতে হবেক।

–তুই উদিকে কুথাকে গিছিলি?

—উই যে, আজ উয়াদের দুকানটা ভেঙি দিবেক বলিছে, সেই…।

টিপ টিপ বৃষ্টি আরম্ভ হয়, ফুলমণি নিজের তাঁবুর ভেতর আসে। মেয়েটা এখনও উঠে নাই। ‘ভালো হল!’

পাশের তাঁবুতে গিয়ে মেয়েটাকে দেখবার জন্যে বলে ফুলমণি আরও কয়েকজনের সাথে স্নান করতে যায়। ফেরবার সময় একটু দেরি হয়ে যায়। বৃষ্টির জন্যে বেশ কয়েকবার দাঁড়াতে হয়েছিল। মাথায় গামছা ঢাকা দিয়ে তাঁবুতে ফিরতেই ভয় পেয়ে যায়। তাঁবুর ভেতর এক পাশে হারু কেমন ভাবে বসে আছে, তার মুখে কোনও কথা নেই।

ফুলমণি তার দিকে তাকিয়ে একরকম আঁৎকে উঠেই জিজ্ঞেস করে, ‘কী হল?’

হারু কাঁপা গলায় উত্তর দেয়, ‘গা-ট ঠান্ডা হয়ে… ‘

ফুলমণি তাড়াতাড়ি মেয়েটার পাশে বসে তার গায়ে হাত দিয়ে দ্যাখে, সেই তো এক্কেবারে বরফের মতো ঠান্ডা, নাকের নীচে হাত দেয়, না কোনও শ্বাস পড়ছে না।

ফুলমণি চিৎকার করে ওঠে। তার চিৎকার শুনে পাশের দুটো তাঁবু থেকে সবাই বেরিয়ে আসে। একজন ফুলমণিদের তাঁবুর ভেতর গিয়ে বাচ্চাটার শরীরে হাত দেয়।

—না আর প্রাণ নাই।

বেশ কয়েক ঘন্টা পেরিয়ে যায়। বাইরে তখন মুষল ধারায় বৃষ্টি পড়ছে। নিজেদের তাঁবুতে ফুলমণি কোলে মরা বাচ্চাটাকে নিয়ে বসে বৃষ্টি থামবার অপেক্ষা করে। কবর দেবে? কোথায় দেবে? বড়োবাবুকে একবার জানাবে?

ফুলমণির চোখ দুটো কেমন যেন শুকিয়ে গেছে। পাশে ছেলেদের তাঁবু, ওখান থেকেও কোনও গান বা হাসি-মজার আওয়াজ নেই. ওখানেই হারু বসে আছে। হঠাৎ ফুলমণির দূরের ওই চায়ের দোকানটার দিকে চোখ যায়। পাঁচরকমে খেয়াল করেনি, দোকানটা এক্কেবারে ভেঙে দিয়ে গেছে। ফুলমণির চোখ দুটো বন্ধ হয়ে যায়।

ভাঙা দোকানের পিছনে একটা খোলা ছাতা দেখতে পায়। ভিতরে দু’জন মানুষ খোলা আকাশের মাঝে একটা ছাতার নীচে বসে আছে। ফুলমণি এক ভাবে দেখে যায়, শুধু দেখে যায়। কোলে মরা মেয়ে, একটু দূরে একটা ছাতার নীচে বসে আছে সেই দোকানি আর তার অসুস্থ বউ। একদিকে তৈরি হওয়া রাস্তার উপর তখন শুধু মুষল ধারার বৃষ্টি পড়ছে।

 

কালো রাস্তার মানুষ (পর্ব-২)

পর্ব ২

বড়োবাবু বুঝতে পারলেই চিৎকার করে, ‘দূর হ, এখন আর কাজ হবে না, হয় সব খসিয়ে আয়, না হলে ভাগ।’ ফুলমণিদের সবেই জ্বালা। এমনিতেই মাসে মাসে আরেকটা জ্বালা আসে, কয়েকটা দিন পেটে ব্যথা হয়, মাথা ঘোরে, সারাটা শরীরে একটা দম বন্ধ করা পরিস্থিতি তৈরি হয়, সেই ম্যাদা মেরে যায়। তখন কাজ করতে হাঁপ ধরে, মাঝে মাঝেই আড়াল খুঁজতে হয়।

কথাগুলো তাঁবুতে প্রথম দিকে টুনটুনির মা বলেছিল, সেই সঙ্গে বড়োবাবুর থেকে সাবধানে থাকতে বলে। ফুলমণি নিজেও বড়োবাবুর চোখে সব সময়ের খিদে দেখছে। ফুলমণিরা শাড়ি বা সালোয়ার যাই পরুক তার উপর একটা জামাও পরে। তাও কাজ করবার ফাঁকে জামা সরে যায়, পোশাকের বাঁধন আলগা হয়, বড়োবাবু তখনই শকুন হয়ে ওঠে।

ফুলমণি নিজেও দেখেছে, গোবরার বউ কয়েকদিন আগে তার কোলের বাচ্চাটাকে দুধ খাওয়াচ্ছিল। বড়োবাবু মুখে একটা বিড়ি ভরে চোখ দিয়ে গিলে নিচ্ছিল মায়ের আদর, ভালোবাসা। গোবরার বউয়ের সেদিন কোনও উপায় ছিল না।

টুনটুনিও কাজ করত। কাজ করবার সময়েই বিয়ে হল, এখন কোনও নজর নাই। একবার টুনটুনি আর ফুলমণির একই সময়ে রক্তপাত আরম্ভ হল। টুনটুনি বয়সে অনেক ছোটো ছিল, তাও মেয়ে তো। কাজ করবার মাঝে বারবার আড়াল খুঁজতে গেলে বড়োবাবু ঝাঁঝি মেরে ওঠেন, ‘তুরা গেদে কামচোর, একটু ঝাঁট দিচ্ছিস আর পালাচ্ছিস।’

—উয়ারা এমনি পালাচ্ছে নাকি গো। তোমার ঘরে বিটিছিলা নাই! জানো না, কি বটে?

সেদিন অবশ্য বড়োবাবু সবার মাঝে হেসে উঠেছিল, ‘তুদের আবার লজ্জা?’

খেপে উঠেছিল টুনটুনির মা, ‘কেন গো বাবু, তুমার ঘরের মেয়েদের শরীর-ট শরীর, লাজলজ্জা সব তুমাদের, আমাদের নাই।’

—তুর কিন্তু খুব কথা হয়েছে। লাথ মেরে তাড়িয়ে দিলে বুঝবি।

আর কোনও কথা বলেনি টুনটুনির মা। সেদিনই রাতে রান্না করবার সময় ফুলমণিদের মাঝে বসে কথাগুলো বলে। ফুলমণি কোনও দিন তার মাকে কাঁদতে দেখেনি। চরম কষ্টের দিনেও শুকনো চোখে খেটে গেছে। গোবর কুড়িয়েছে, ঘুঁটে দিয়েছে, সেই ঘুঁটে মাথায় করে বিক্রি করেছে, রাতে বরের হাতে মার খেয়েছে, মারামারি করেছে, চিল্লিয়েছে। টুনটুনির মাকে কাঁদতে না দেখলেও চোখমুখে একটা চাপা ভয় দেখতে পেয়েছে।

ফুলমণি লম্ফের আলোটা একটু বাড়ায়। ভাতের মধ্যে কয়েকটা আলু আর দুটো ডিম ফেলে দেয়। আর বেশি কিছু করতে ভালো লাগছে না। লোকটার মুখে আবার খারাপ কিছু রোচে না, খিস্তি করে, মারতে যায়। আগে লোকটা এমন ছিল না। যে-রাতে বড়ো তাঁবুতে ফুলমণির পাশে মোটা বউয়ের বরটা ফুলমণির শরীর ছুঁয়ে নিজের আমিত্ব ফলাতে গেছিল তারপরের দিন সকালে উঠেই হারু লোকাটাকে খুব পেটায়। বড়োবাবুর কাছে খবর চলে যায়।

মোটাবউ ও তার বর দু’জনেই বড়োবাবুর পেয়ারের লোক ছিল। সবাই জানত নিজের শরীরের গন্ধ শুঁকিয়ে মোটা বউ বড়োবাবুর হকের মেয়েমানুষ হয়ে উঠেছে। সারাদিন কোনও কাজ না করে বসে থাকলেও তাকে কিছু বলে না, বরং ফুরসত পেলেই দু’জনে গল্প করে। বড়োবাবু একটা ক্লাব ভাড়া নিয়ে সেখানে থাকে। মোটাবউ সকালে রাতে সেখানে রান্না করতে যায়।

—রান্না করে হাতি, ও যায় ধান্দা করতে। কথাগুলো হাবুলের বউ একদিন বলে।

ফুলমণি তখন এই কাজে নতুন এসেছে। কথা বললেও খুব বেশি মাখামাখি করে না। পরের দিনের ঝামেলার জন্যে দু’জনেরই কাজ চলে যেত, পোঁটলা গুটিয়ে চলে যেতে হতো। কিন্তু বড়োবাবুর হাত পা ধরে সে যাত্রায় কোনওরকমে কাজটা বাঁচলেও অন্য জায়গায় পাঠিয়ে দেয়, বড়োবাবুও সেখানে যাবে। হারু ও ফুলমণিকে আবার নিজেদের খরচে পোঁটলা-পুঁটলি নিয়ে নতুন জায়গায় যেতে হয়।

হারুর বাবাও রাস্তা তৈরি করবার কাজ করত। ছোটো বয়সে মা মারা যাবার পর হারুও বাবার সাথে ছোটো থেকেই এই রাস্তা তৈরি করবার কাজে ঢুকে যায়। দু’জনের রোজগারে ভালোই চলছিল। বাবা ফুলমণির সাথে বিয়ের দেখাশোনাটাও করে গেছিল, তারপর হারুর বিয়ের আগেই একদিন রাস্তা তৈরি করবার সময় রোলার গাড়ির নীচে পড়ে এক্কেবারে মাটির সাথে মিশে যায়। কয়েক বছর সব চুপচাপ থাকবার পরেই ফুলমণির বাড়ি থেকে আবার হারুর সাথে যোগাযোগ করে, তাদের বিয়ে হয়। কন্ট্রাকটর কিছু টাকা দিয়েছিল, সেই টাকাতেই বিয়ের খরচ মেটে।

বিয়ে হলেও সমস্যা হয় অন্য জায়গায়। হারুর তো বিভিন্ন শহরে ঘুরে ঘুরে কাজ। গ্রামে বাবার একটা ঘর থাকলেও সেখানে আর কেউ থাকে না। হারুর জীবনও এই তাঁবুর ভেতরেই কাটতে আরম্ভ হয়ে গেছে। নতুন বিয়ে করা বউ তো আর সেভাবে থাকবে না। কথাগুলো তার তাঁবুর বাকি লোকদের সাথে আলোচনা করলে তারা বেশ মজা করেই বলে, “আরে বাবা, তুই বিয়ে করবি এটা তো ভালো কথা। এখানে অনেকেই বউ নিয়েই থাকে। তোরা যখন থাকবি আমরা না হয় চোখদুটো বন্ধ করে রাখব।”

হারু হেসে ওঠে। তাদের বিয়ে হয়, কন্ট্রাকটর কয়েকদিন ছুটিও দেয়, ফুলমণির বাড়িতেই তাদের ফুলশয্যা হয়। কয়েকদিন এদিক ওদিক ঘুরে বেড়ালেও বসে বসে কেউ আজীবন মুখে ভাত দেবে না। হারু ফুলমণি দু’জনই কাজে ঢুকে যায়। কাজ বলে কাজ— পিচ গরম, রাস্তা খোঁড়া, ধুলো বালি পরিষ্কার করা, পাথর বিছিয়ে সমান করা, দু’পায়ে চিকচিকি বেঁধে পিচ ফেলা, বালি দেওয়া, কাজের আর শেষ নাই।

ফুলমণির প্রথম প্রথম অসুবিধা হতো। বিয়ের কয়েকদিন পর হারু কোনও পিচের রাস্তার উপর দিয়ে যাবার সময় বলে উঠত, “এই দ্যাখ এই রাস্তাটা আমরা করেছি।’ তারপরেই রাস্তা তৈরি করবার গল্প করত। তখন ফুলমণি অবাক হয়ে শুনলেও কাজ করতে এসে বোঝে, সব গল্প গল্প হয় না!

ক্রমশ…

কালো রাস্তার মানুষ (পর্ব-১)

তাঁবুর বাইরে বেরিয়ে ফুলমণি আকাশের দিকে চোখ রেখে কিছু সময় দাঁড়িয়ে থাকে। এই দিকটাতে আলো নেই, চারদিকের অন্ধকার মেঘের জন্যে আরও গুমোট, তাঁবুর ভিতরেও হ্যারিকেন জ্বালিয়ে কাজ করতে হচ্ছে। পাশে মেয়েদের তাঁবুটাতেও রান্না চেপেছে, কারওর মোবাইলে গান বাজছে। ছেলেদের তাঁবুতে এই সময় এক-দু’জন বাদে কেউ থাকে না, ওরা রান্না করে না, মেয়েদের তাঁবুতেই রান্না করা হয় — সবাই তো বউ-বর বা মা-ছেলে।

মেয়েদের একটা তাঁবু, আর ছেলেদের আলাদা একটা। শুধু ফুলমণিরাই আলাদা থাকে। তাঁবুটা ওদের টাকাতেই তৈরি করা। ফুলমণি দেখে একটু দূরের চায়ের দোকানটা এখনও খোলা আছে। বেশ কয়েকবার ওই দোকানে পাউরুটি কিনতে গেছে। ঘরের মানুষটার মতিগতি সব সময় ভালো থাকে না। মাঝে মাঝে ফুলমণির মনে হয় সকাল আর রাতে দু’জন আলাদা লোকের সাথে ঘর করে! পেটে জল পড়লেই হয়ে গেল, কতদিন ভাতের হাঁড়ি উলটে দিয়েছে, তখনই দোকানে খাবার কিনতে যেতে হয়।

চায়ের দোকানটাতে গিয়ে অনেকবার কথাও বলেছে। দেখে খুব মায়া হয়! লোকটার বয়স হয়েছে, ছেলে মেয়ে কেউ দ্যাখে না। বউটাও অসুস্থ। দোকানের পিছনেই একটা ছোটো জায়গায় ওরা দু’জন থাকে। বউটা ওখানেই শুয়ে থাকে। ফুলমণি একবার দোকানের লোকটাকে, ‘কী হয়েছে?’ জিজ্ঞেস করেছিল।

লোকটা কেমন ভাবে বলে উঠেছিল, ‘আর কী হয়েছে! বেঁচে আছে এই…’

বউটা চোখ ঘুরিয়ে ফুলমণিকে দেখেছিল। তারপর থেকে ফুলমণি দোকানে গেলেই বউটাকে দেখে। বুঝতে পারে ভালো ঘরের মেয়ে, রোগে ভুগলেও গায়ের রং এখনও বেশ চকচকে। কয়েকদিন আগে দোকানিটা অন্য আরেকজন খদ্দেরকে বলছিল, “আর ক’দিন থাকতে দেবে কে জানে? শুনলাম সেন গুমটির কাছে সব দোকান ভেঙে দিয়েছে, আমাদের এদিকটাও ভাঙবে।” ফুলমণি কথাগুলো শুনে নিজের থেকেই জিজ্ঞেস করে, ‘তোমাদের দোকান ভেঙে দেবে, কেন?’

লোকটা ফুলমণির মুখের দিকে তাকিয়ে উত্তর দেয়, ‘এই যে তোমরা রাস্তা তৈরি করছ।’

মনটা খারাপ হয়ে যায়, কথাগুলো কাউকে বলতে পারে না! হারুকে বললেই এক্ষুনি খেঁকিয়ে উঠবে। সে নিজে এই কয়েক বছরে অনেক জায়গায় রাস্তা তৈরি করতে গেছে। দেখেওছে কীভাবে রাস্তা তৈরি করবার আগে কত জায়গার দু’দিকের ঘরবাড়ি দোকানঘর ভেঙে দেয়। এখানেও প্রথম দিকে কয়েকটা দোকানঘর ভেঙেছিল।

ফুলমণির এসব দেখে কষ্ট হয়, একবার ঝড়ে ওদের নিজেদের গোয়ালঘর ভেঙে গেছিল। দু’টো গরু সারাটা রাত ভিজেছিল। এদিকেও রাস্তা একদিকে তৈরি হয়, আরেক দিকে গাড়ি চলে। রাস্তা হয়ে গেলে এখন আবার পাথর বসায়, একটা কী যেন নাম আছে। ফুলমণিদের অবশ্য তখন ডাকে না।

একটু আগেই ও পুকুরে স্নান করে এসেছে। পুকুরটা একটু দূরে, তাও সন্ধেবেলাতেও সবাই মিলে স্নান করতে গেলে খুব একটা অসুবিধা হয় না। প্রতিদিন দু’বার করে স্নান করবার জন্যে প্রথম দিকে ঠান্ডা লাগত। এখন সবকিছু কেমন যেন সয়ে গেছে।

—কি রে ফুলু, আজ কী করবি, আটা খাবি, নাকি ভাত চাপাবি?

—আটা খেতে লারি, গলা দিয়ে নামতেই খুঁজে না, গেল হপ্তাতে কয়েকদিন আটা খেয়িছিলম, হাগা আর বাগাতে লারি, ক’টা ভাতই ভালো, তুমি কী করছ?

—আমার তো একার কথাতে কিছু হবেক নাই, সবাই রুটি সেঁকছে। ভাত কালকের লগে, পান্তা করবেক।

কথাগুলো বলে লোকটি এগিয়ে গেলেও পিছন থেকে ফুলমণি ডাকে, ‘ও, খুড়ো, বড়োবাবুর কী খবর, এখনও টাকা দিলেক নাই।’ খুড়ো একটা শ্বাস ছাড়ে। হাওয়ার শব্দ ফুলমণির কান দিয়ে মাথার ভেতরে পৌঁছে যায়।

—সেই তো, গেল হপ্তা থেকে পাঁয়তারা কষছে। হারু কই?

—সাঁঝের ব্যালা কুথাকে থাকে?

খুড়ো আর কথা না বলে একপা একপা করে নিজের তাঁবুর দিকে যায়। খুড়োর বয়স হয়েছে, এখন একটু বেশি কাজ করলেই হাঁপায়। কয়েকদিন আগেও মাটি কুপাত, মাথায় করে গরম পিচ মেশাত, পাথর ফেলত। এখন শুধু রোলার গাড়িটার সামনে ভিজে বস্তা ধরে আর বাকি টুকটাক কিছু কাজ করে।

ফুলমণি খুড়োর সাথে কথা শেষ করেই নিজের তাঁবুতে ঢোকে। মেয়েটা ঘুমোচ্ছে। এইবেলা ভাতটা করে নিলে অনেকটাই ফের কাটে। ফুলমণিরা আগে একটা তাঁবুতেই থাকত, তখন এই ব্যাটাছেলে মেয়েছেলে ছিল না। মরদগুলো সারাটা দিন জানোয়ারের মতো খাটত। কাজ শেষ হলে কয়েকজন পিচ গলানোর কাজ করলেও বাকিরা চলে যেত। রাত বাড়লে টলতে টলতে তাঁবুতে ফিরত। যারা পিচ গলাত তারাও যে গিলত না সেটা নয়, তাও ওদের সব কিছু বাঁচিয়ে করতে হতো।

এই দলে কম বয়সি মেয়েছেলেগুলোও মদ মারে। না হলে ওদের শরীর কেমন যেন ম্যাদামারা হয়ে যায়, তারা কেউ বাইরে যায় না। ফুলমণি প্রথম প্রথম অবাক হয়ে দেখত। টানা পাঁচদিন কাজের পর একদিন ছুটি থাকত, সেদিনের জন্যে তারা টাকা না পেলেও সবাই সন্ধেবেলা তাঁবুর ভেতরে বসে যেত, সামনের কোনও দোকানে ঝাল ঝাল করে চপ বা অন্যকিছু ভাজাত তারপর…

ফুলমণির লোকটার অবশ্য এইসব পোষাত না। দোকানে না গেলে তার নেশা জমত না। ফুলমণিরও খুব সাধ হতো, ছুটির বেলায় সবার সাথে বসে একটু মজা করবে। কিন্তু সেই সময় পেটে শত্রু চলে আসত। এটাই ফুলমণির সব থেকে অসুবিধার। শত্রু আসত, কয়েকটা মাস পেটেই বড়ো হতো, তারপর পেটের ভেতরেই মরে যেত। ফুলমণির সেই সময় খুব রক্তপাত হতো। কয়েকদিন তাঁবুর ভেতরেই শুয়ে থাকতে হতো। কাজ করতে পারত না। এটাই ঝামেলার, শত্রু এলে আর ভালো কাজ হয় না।

ক্রমশ…

 

 

চান (পর্ব ২)

পর্ব ২

“শিল্‌দা শিল্‌দা আইছে। নামবে আস।’ বাসের হেল্পার কাম্ কন্ডাক্‌টর চেঁচিয়ে উঠল। হুড়মুড় করে একগাদা মানুষ হাঁড়িকুড়ি ছানাপোনা, পোঁটলা পুঁটলি নিয়ে নেমে যায়। আর একদল ওঠে। বাস ছেড়ে দেয়। বাঁদিকে বাঁক নিয়ে বীণপুরের উদ্দ্যেশে চলে ঝাড়গ্রামগামী বাস। বীণপুরে অনেকটা সময় দাঁড়ায় বাস। চা-জলখাবার খায় ড্রাইভার, যাত্রীরা।

সূর্য উঠে পড়েছে আলসেমি ছেড়ে। কাঁচারাস্তায় বাস হুহু করে এগিয়ে চলেছে। দুপাশে মহুয়া, শাল, বহেড়া গাছ রোদ মাখছে। শীত আর নেই। বেশ ভালো লাগে কুড়ানির। অন্যদিনের মতো সকালে পান্তা খায়নি। আজ উপোস। কিন্তু খিদের কথা মনেই আসছে না আজ। এমনিতে খিদে সইতে পারে না। ভারী শরীর। কাজও যেমন করে, খায়ও গবর গবর। শরীরও তাই বাঁধানো ঘাটের মতো। দিবা বাগ যখন তখন বাঘ হয়ে উঠেও কিছু জৌলুস কমাতে পারেনি। বরং কুড়ানিই শরীর পেতে আশ্রয় দেয়, যথেচ্ছ ব্যবহারের আনন্দ দেয় শান্তভাবে। দিবা উঠে গেলে পালদের পুকুরে একটা ডুব মেরে শরীর ঠান্ডা করে এসে ঘুমিয়ে পড়ে।

বাসের দুলুনিতে ঝিমুনি এসেছিল। দুটো গরু রাস্তার উপর হঠাৎ উঠে আসায় ড্রাইভার হাওয়া-ব্রেক মারে। বাসশুদ্ধ লোক হুড়মুড় করে এ ওর গায়ে। কুড়ানি পড়ে যাবার আগেই ডানহাত ইঞ্জিনের উপর উঁচু জায়গায় আটকে যায়। হাওয়াই চটি ছিটকে যায়। কুড়ানি লজ্জা পায়। মুখে লাজুক হাসি। এদিক ওদিক তাকায়। পা দিয়ে চটিটা টেনে নিয়ে কোনওক্রমে পায়ে গলিয়ে ফেলে। আসলে এত সকালে ঘুম থেকে ওঠার অভ্যাস নেই অনেকদিন। আর রাতেও ভালো ঘুম হয়নি। সকালে উঠতে হবে, ভোরের প্রথম বাস ধরতে হবে এই ভেবে।

ছেলেবেলায় মার সাথে খুব ভোরে উঠত। উঠে জলা-জায়গায় যেতে হতো খড়িকাঠি চুপিচুপি আনতে। মা-র মুখে শুনেছে বাবা পানু ঘোড়ই খুব বড়ো খড়িয়াল ছিল। বাবারা এখানে থাকত না। সবং-এ থাকত। সেখানে নদী ছিল, চণ্ডী নদী। কেলেঘাই-এর শাখানদী ওটা। বাবাদের গ্রামের নাম ছিল শ্যামসুন্দরপুর। মজা- নদীর চরে খুব সরু সরু খড়িগাছ হতো। গাছ কেটে শুকিয়ে ঝোড়া বুনত ওরা। দেখতে বেতের কাঠির মতো। খুব সুন্দর বুনোট। ঝোড়ার কানার দিকে অনেকটা মোটা বেষ্টনী থাকত, ধরার সুবিধার জন্য। স্থানীয় বাজারে শুধু নয়, বাইরেও চালান যেত সে সব। খুব কদর ছিল। বাবার খুব নামডাক ছিল একাজে। মা গেঁওখালির পাল্টি ঘর। কাজ জানত। বাবা মরে গেলে কেন যে সে কাজ উঠে গেল, কেনইবা এখানে এল ওরা, তা এক রহস্য।

বাসের গতি কমে এসেছে। বীণপুর এসে গেল বোধ হয়। ছেদো অনেকক্ষণ থেকে লটপটে মাথা নামিয়ে একটা আধুলি খুঁজছে। পায়নি। রুক্ষ গলায় আধবসা অবস্থায় চ্যাঁচাতে লাগল— ‘বীণপুর, বীণপুর।’

এখানে একটা বাস এলেই ভ্যানরিকশার তোড়জোড় শুরু হয়ে যায়। নানা সুরে ভেঁপু বাজতে থাকে। গম্ভব্য সবই কাসাইঘাট পর্যন্ত।

যত্ন-পায়ে নেমে এদিক ওদিক একবার দেখে কুড়ানি। তারপর কাছের ভ্যানরিকশার সামনের দিকে উঠে পড়ে। আরও অনেকটা পথ। তাছাড়া শুধু যাওয়া তো নয়, ফিরতেও হবে বেলায় বেলায়। ভেতরে ভেতরে একটা অস্থিরতা। শুধু মজুমদার মশাই-র কাজ নয়। একজোড়া কাপড় আর আলতা-সিঁদুর পাওয়া নয়। তার নিজেরও একটা কাজ আছে। একটু বাঁকা হাসে। ঠোঁট বাঁকে।

বড়ো জাগ্রত এই দেবী। রক্তমুখী, রক্তবর্ণা দেবীকে তুষ্ট করে বর চাইলে অভীষ্ট পূর্ণ হয়। কুড়ানিও চাইবে। আজ পুজোর পরম লগ্নে দেবীর থানে মাথা কুটে বলবে, ‘মহুল বৃক্ষের মতো একটা খোকা দাও ঠাকুর হে।’ ওতো জানেই সন্ধ্যা গায়েন, নন্দীগ্রাম থেকে বিয়ে হয়ে এল, দশ-বারো বছর পার করেও সন্তান নেই। শেষে রঙ্কিণীর থানে মানত করেইতো বছর ঘুরতে ছেলে। এখন নিত্যপুজোয় সে সাহায্য করে।

ভটভটি নৌকোয় ওঠার আগে হাতে জল তুলে কপালে ছোঁয়ায়, মাথায় নেয়, বিড়বিড় করে কুড়ানি। পুরুলিয়ার কপিলা পাহাড়ের বুক চিরে নেমেছে এ নদী। অঞ্চলের মানুষেরা ভক্তি করে খুব। গঙ্গার মতো।

নৌকোয় উঠতে যেয়েই বাধা। দুটো ছোকরা সাইকেল নিয়ে একেবারে মুখেই দাঁড়িয়ে। ওঠবার জায়গা নেই। কুড়ানি বিরক্তিতে ভ্রু কুঁচকে মুখ তুলতেই কিছুটা ভয়ে দুই কিশোর সাইকেলের হ্যান্ডেল ঘুরিয়ে ওঠার জায়গা করে দেয়। ভটভটি আড়া কাসাইয়ের বুকে ঢুকে পড়ে। পাশ থেকে হলেও কুড়ানি বুঝতে পারে দুই ছোকরাই তার দিকে ড্যাবডেবে চেয়ে আছে। তাকাবে না! কেন! আজ ব্লাউজের নীচে আরও একটা টাইট, ছোটো জামা পরেছে। এ নিয়ে দুবার পরল। বিয়ের পর দিবার সাথে রেলগাড়ি চড়ে দূরের কুটুমবাড়ি যাবার সময় একবার। আজ নিজেরই লজ্জা লাগছিল। কিছুটা গর্বও। মোষের সিং-এর মতো ফুঁসে আছে, বুক যেন বাঁধ দেয়া বর্ষার কাসাই।

ক্রমশ …

চান (পর্ব ১)

কুড়ানি প্রায় ঘুম চোখেই স্নানে যায় আজ। ভোরের উঠোন স্পষ্ট দেখতে পায় না, চেনা পায়েই পালদের পুকুরের দিকে ইটিতে থাকে। ঝুপ করে তিন চারটে ডুব মেরে দিতে হবে। পৌষ মাস। এ বছর ঝেপে ঠান্ডা পড়েছে। ভোরের কুয়াশাও আছে। বেশ কয়েক পা পথ। কুড়ানি শাড়ি চাপা দিয়ে কান ঢেকে কিছুটা উষ্ণতা পেতে চায়। বেশ বড়োসড়ো চেহারা তার। ফলে দশহাতি শাড়িতে টান ধরে। পিঠে পেটে ঠান্ডা বাতাস এসে ঝাঁ করে কামড় বসায়। কটা বাজে? আকাশে চোখ রাখে। ঠাহর করতে পারে না। সাদা তারারা তখনও ভাঁট ফুলের মতো ফুটে আছে। ফসল ওঠা মাটির গন্ধ নাকে। শব্দহীন এক আনন্দ শিরশির করে। ভক্তাদের বাছুর পায়ের শব্দে জেগে ওঠে, হাম্বা করে। বুকটা ছ্যাৎ করে ওঠে। একটু ভয় পায়। হঠাৎ মনে হয় সকাল হয়নি। মুখের কাঠকয়লার মাজন শব্দ করে ফেলে। ভয় কমে। মনে মনে মা রঙ্কিণীকে ডাকে।

দিবা এই সকালে ওঠার কথা ভাবতেই পারে না। তা শীত-গ্রীষ্ম যাই হোক। ওর আলসেমিটা যেন সকালেই পেয়ে বসে। খুব রাত করে জেগে থাকতে পারে। মজুমদারের ভাঁটিতে কাজ করে। অনেক রাতে ফিরতে হয়। শীতকালটাই কাজের সময়। টালির কাজ খুব বেশি। আজকাল খড়, শণের চাল আর কেউ রাখতে চায় না এখানে। দু-তিনটে বর্ষা যেতে না যেতেই জল পড়ে। সবাই তাই চেষ্টা চরিত্র করে টালির চালের জন্য। দিবাকে অবশ্য এখন আর পোণে আগুন দেয়া বা কাদা ছেনার কাজ করতে হয় না। মজুমদার মশাই ওকে বেশ ভালো চোখে দেখেন। তদারকি করেন। বছর চারেক হল বিয়ে করেছে কুড়ানিকে। শ্যামলা শরীর হলে কী হবে, একটা আলগা শ্রী আছে তার। দ্রুত চলনের মেয়েটিকে দেখলেই লাগসই একটা মন-পসন্দ চলে আসে। তো বাপ-মা মরা তিন কুলে কেউ নেই এমন নির্বান্ধব দিবার মনও যে মহুয়া ফুলের গন্ধে উড়ু- উড়ু করবে, তা বিচিত্র কি! কুড়ানিরও তিন কুলে কেউ ছিল না এক বিধবা মা ছাড়া। তা সে মা-ও বিয়ের ছ’মাসের মধ্যেই মরে গেল। এখন হাত-পা ঝাড়া দুটি প্রাণীর একান্ত বসবাস।

জলে পা রাখতেই ছ্যাঁৎ করে উঠল। কুড়ানি আস্তে আস্তে জল হাতে নিয়ে মুখে তুলল। একমুখ জল নিয়ে কুলকুচি করল। অনেকক্ষণ। চোখের কোনে জমা পিচুটি ধুলো। এভাবে জল সয়ে আসতে হাঁটুর ওপর কাপড় তুলে নেমে পড়ল। তারপর দুকানে আঙুল দিয়ে ঝুপ ঝুপ করে তিন চারটে ডুব মারল। হি হি করে কাঁপুনি আসছে। মোটা কাপড়ের আঁচল ঘুরিয়েই গলা মুখ বুক একবার ভালো করে মেজে নিয়ে একটা ডুব দিয়েই উঠে এল। পুব দিকের আকাশটা লাল লাল লাগছে। বুঝতে পারল ভোর হচ্ছে। ভেজা শাড়ি পরেই দ্রুত পা চালায় ঘরের দিকে। ভোরের প্রথম বাস ধরতে হবে।

বাঁকুড়া-ঝাড়গ্রামের প্রথম বাস ওড়গোঁদা আসে সকাল সাড়ে ছ’টায়। শিলদা হয়ে বীণপুর যেতে নিদেন দশটা বাজিয়ে দেবে। সেখান থেকে ভ্যান-রিকশায় চেপে যেতে হবে কাঁসাই-এর ঘাট। তারপর নদী পার হয়ে ডাইনটিকরি। এক বেলার হ্যাপা। কিন্তু কুড়ানির কাছে এসব আজ নেশার মতো, মিষ্টি স্বপ্নের মতো। বাপের কথা মনে নেই। সেই এটুবেলা থেকে এই পরব সে দেখে আসছে। মা-র কোলে উঠে এসেছে সে রঙ্কিণী থানে। মকরতিথিতে দেবী আসেন এখানে। তারপর তিন দিন ধরে পাতাবেদার মেলা। দূর থেকে ভয়ে বিস্ময়ে সে তাকিয়ে থাকত কতদিন, মেলা শেষ হবার পরও। ভৈরব চাতালের দিকে, রঙ্কিণী চাতালের দিকে। আজ সে এই পুজোয় সরাসরি অংশগ্রহণ করতে পারছে, একেবারে ছুঁয়ে দিতে পারবে দেবীকে, ভেবেই ভয়ে, আনন্দে একটা ঘোরের মধ্যে আছে।

কুয়াশামোড়া ভোরের একটা অন্য আমেজ আছে। সংসার এখনও ব্যক্ত হয়ে ওঠেনি। সূর্য সবে উকিঝুঁকি মারছে। ঠান্ডার সাথে একটা আবেগ জড়ো হয়ে কুড়ানিকে কাঁপাচ্ছিল। এখান থেকে তেমন কেউ ওঠার নেই, শুধু নামল কয়েকজন।

মজুমদার মশাই-এর দুটো বাস এই রুটে চলে। কথামতো ড্রাইভারের কেবিনে অহংকারী মুখে গ্যাট হয়ে বসল কুড়ানি। লালপাড়ের সাদা শাড়ি। চন্দ্রকোণা থেকে এসেছে। সাদা ব্লাউজ। মন্দিরের দেবীর পা ছুঁয়ে আবার ফিরে আসবে ভৈরবভূমিতে। হাতে রঙ্কিণীমা-র ফুল একটা সুন্দর পিতলের পাত্রে রাখা। রঙ্কিণী কুড়ানি আড়চোখে দেখছিল বাসের যাত্রীরা শুধু না, রাশভারী বিড়িও ফুঁকছে না। ড্রাইভার বলাই সামন্তও কেমন সম্ভ্রমের চোখে তাকাচ্ছে আজ, অন্যদিনের মতো নয় আজ। বীণপুর বাজারে এটা ওটা নিয়ে যাতায়াতের যত্ন আর কষ্টমাখা ব্যস্ততা নেই। পরিবর্তে অন্য এক ভালোলাগায় পেয়ে বসেছে। বাসের উইন্ডস্ক্রিন থেকে হু হু হাওয়া আসছে। গোছা গোছা ভারীচুল এলোমেলো করে দিচ্ছে। সে দিক। কপালে আজ বেশ বড়োসড়ো মেটে সিঁদুরের গোল সূর্য এঁকেছে। কুড়ানি আজ অন্যমূর্তি। কী মূর্তি? নিজেকে কি রঙ্কিণী মা মনে হচ্ছে। ইস! অমন ভাবাও পাপ। নিজের অজান্তেই একটা হাত মাথায় উঠে এল।

ক্রমশ…

 

মা (পর্ব-২)

তুষার সম্মতি জানিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। পরিমল তাকান অসীমার দিকে। ফ্যাকাশে মুখ, রক্তশূন্য চেহারা। পরিমল উঠে আসেন চেয়ার ছেড়ে। যদিও স্বভাবসিদ্ধভাবে তিনি খুব প্র্যাকটিকাল তবু সেই মুহূর্তে স্ত্রীয়ের পাশে এসে বসেন। ‘মা’য়ের ব্যথাটাকে হৃদয় দিয়ে অনুভব করার চেষ্টা করেন। ‘অসীমা এভাবে ভেঙে পোড়ো না। আমাদের পছন্দ করা মেয়ে তুষারের পছন্দ না-ও হতে পারত। এটাই বরং ভালো হল। ও যা করতে চাইছে, করতে দাও। ও সুখী হলে আমাদের সঙ্গে সম্পর্কটাও অটুট থাকবে। এক ছেলে তো আগেই আমাদের ছেড়ে চলে গেছে। এখন ওর কথা মেনে নিলে এটুকুই আমাদের লাভ যে, ও আমাদের চোখের সামনে থাকবে।’

স্বামীর কথায় অসীমাদেবী খানিকটা আশ্বস্ত বোধ করেন। সত্যিই তো, ছেলেটাকে তো চোখের সামনেই রোজ দেখতে পাবেন। শুধু বউমাকে আপন করে নিতে পারলেই সংসারে শান্তি বজায় থাকবে। তবে রঞ্জনা যে-বাড়ির মেয়ে, তাতে যথেষ্ট আধুনিকা হওয়াটাই স্বাভাবিক। পোশাকে-আশাকে, মানসিকতায় তাদের মতো মধ্যবিত্ত পরিবারের সঙ্গে রঞ্জনা মানিয়ে উঠতে পারবে কিনা এমন সন্দেহও উঁকি মেরে যায় অসীমাদেবীর মনে।

বিয়ের কথা বলতে গিয়ে প্রথম দর্শনে দু’জনেরই রঞ্জনাকে পছন্দ হয়। বেশ স্মার্ট অথচ মিষ্টি স্বভাব মেয়েটির। তুষারের পছন্দ আছে। বেশ গর্ব অনুভব করেন তাঁরা। বিয়ের দিন স্থির করে বাড়ি ফেরেন।

এরপরেই অপেক্ষা করেছিল আসল ধাক্কাটা, যার আঁচ আগে একেবারেই পাননি পরিমলবাবুরা। একদিন হঠাৎই তুষার অসীমাদেবীকে এসে জিজ্ঞেস করল, ‘মা, তোমরা কি বিয়ের কেনাকাটা আরম্ভ করে দিয়েছ?’

‘না, কেন রে?’

আমি চাই না আমার বিয়েতে তোমরা আজেবাজে কিছু খরচ করো অথবা গয়নাগাটি কিছু কেনো। তোমরা আমার বিয়েতে যা টাকা খরচা করবে ভেবেছ সেটা আমার হাতে দিয়ে দাও। রঞ্জনাও একই কথা নিজের মা-বাবাকে জানিয়েছে। আমরা রাজারহাটে ছোটো একটা ফ্ল্যাট দেখেছি। তোমরা আমাদের জন্য যে-টাকা রেখেছ সেই টাকার সঙ্গে আরও কিছু টাকা দিয়ে আমরা ওই ফ্ল্যাটটা কিনব।’

ছেলের কথায় অসীমাদেবী পাথর হয়ে যান। কোথাও যেন একটা ভুল হয়ে যাচ্ছে তাঁর মনে হয়। ছেলেকে ঠিকমতো শিক্ষা দিতে পারেননি, নাকি যুগের পক্ষে তারাই বেমানান, ঠিক বুঝে উঠতে পারেন না অসীমা। ছেলের মুখের দিকে তাকান, চোখে শূন্যতা।

“তার মানে তুই আর আমাদের সঙ্গে থাকবি না?”

“তোমাদের ছেড়ে চলে যাওয়ার প্রশ্ন উঠছে কেন? তোমার আর বাবার সুবিধার জন্যেই আমরা এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমাদের এমনই চাকরি যে বাড়িতে আসা-যাওয়ার কোনও সঠিক সময় নেই। যখন- তখন আমরা তোমাদের বিরক্ত করতে চাই না।’

তুষারের সব কথাই ধীরে ধীরে অসীমার কাছে কাচের মতো পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছিল। মনে হচ্ছিল সব দিক দিয়ে এটাই বোধহয় ঠিক হল। চোখেও কিছু দেখতে হবে না তাই নতুন করে ব্যথা পাওয়ারও প্রশ্ন ওঠে না। আধুনিকা বউমা জিন্‌স, কুর্তি পরে তুষারের কোমর জড়িয়ে তাদের ‘বাই মম’ বলে অফিস বেরিয়ে যাবে। এমনটা হওয়ার থেকে এটাই ভালো, ওরা দূরে থাক। তুষারের ইচ্ছে, অসীমাদেবী পরিমলকে জানালেন। পরিমলবাবু মনে ব্যথা পেলেও স্ত্রীয়ের সামনে সেটা প্রকাশ করলেন না।

বিয়ের পর তুষার আর রঞ্জনা নিজেদের রাজারহাটের ফ্ল্যাটে আলাদা করে সংসার পাতল। নবদম্পতি হিসেবে সকালটাই একটু একসঙ্গে কাটাবার সময় পেত ওরা। একসঙ্গে জলখাবারের টেবিলে বসে দুজনে প্রয়োজনীয় কথাবার্তা সেরে ফেলত। এরপর তো দু’জন আলাদা আলাদা। দু’জনের আলাদা চাকরি। তুষার ইংরেজি দৈনিকে কাজ করত আর রঞ্জনার চাকরিটা ছিল বাংলা কাগজে। তুষারের কাজের সময়টা নির্ধারিত ছিল, সকাল এগারোটা থেকে সাতটা। আর রঞ্জনা বেরোত দুপুরে। ফিরতে প্রায়দিনই মধ্যরাত। সুতরাং সকালের পর থেকে দু’জনের যোগাযোগের মাধ্যমটা ছিল টেলিফোন।

রবিবার অথবা ছুটির দিনগুলোতে, তুষার আর রঞ্জনার ঘুম ভাঙতে দুপুর হয়ে যেত। সন্ধেবেলাটা দু’জনে কাটাত সিনেমা দেখে অথবা কারও একজনের মা-বাবার সঙ্গে দেখা করতে যেত। মুশকিল হতো রঞ্জনার যেদিন তুষারের বাড়ি যাওয়ার থাকত কারণ তুষারের মুখ থেকেই শুনেছিল শাশুড়িমা ওয়েস্টার্ন ড্রেস একেবারেই পছন্দ করেন না। তুষারের মা-বাবা দু’জনেই নাকি একটু পুরোনো ভাবধারায় বিশ্বাসী। অগত্যা শাড়ি পরেই রঞ্জনাকে শ্বশুরবাড়ি যেতে হতো।

তবে শ্বশুর, শাশুড়ির বিরুদ্ধে রঞ্জনার কোনও নালিশ ছিল না। ভয় তো একটা ছিলই কারণ শ্বশুরবাড়ির অত্যাচার নিয়ে রঞ্জনা অনেকবারই নিজের কাগজে স্টোরি করেছে। তাই নিজে যখন বউ হয়ে এল, মনের মধ্যে ভয়, সংশয় মিশ্রিত একটা দোনামনার মানসিকতা তৈরি হয়েছিল। কিন্তু অসীমাদেবীর এবং পরিমলবাবুর সৌম্য উপস্থিতি এবং অন্তরঙ্গ ব্যবহারে সেই ভয়টা রঞ্জনা কাটিয়ে উঠেছিল। একটাই অসুবিধে হতো রঞ্জনার। অসীমার অনুরোধে ও শাঁখা-পলা পরতে বাধ্য হয়েছিল।

যেদিন তুষার আর রঞ্জনার বাড়িতে আসার কথা থাকত, অসীমাদেবী স্বামীকে দিয়ে প্রচুর বাজার করিয়ে নিজের হাতে বিভিন্ন পদ রান্না করতেন। টেবিল ভর্তি এত রকমের খাবার দেখে রঞ্জনার খালি মনে হতো যে একটা মানুষ কীভাবে এত রান্না করে উঠতে পারে। অসীমাদেবী দু’জনকে বসিয়ে যত্ন করে খাওয়াতেন। শাশুড়ির সঙ্গে যদিও বা কথা হতো, শ্বশুরের সঙ্গে গল্প করার সুযোগ হতো না রঞ্জনার। উনি ছেলের সঙ্গে বসেই কথা বলে যেতেন, যতক্ষণ ওরা ওখানে থাকত। এতে রাগও হতো রঞ্জনার। ফেরার সময় তুষারের সঙ্গে ঝগড়া লেগে যেত, ‘দেখলে তো তুষার, তোমার ব্যাপারে ওনারা একটু বেশিই পজেসিভ। আমার সঙ্গে একটা-দুটো দায়সারা কথার পরেই ওনারা তোমার সঙ্গেই কথা বলতে থাকেন। আমি মধ্যিখানে বোকার মতো বসে থাকি। অথচ ওনাদের ভালো লাগবে বলে আমাকে পুতুলের মতো সাজিয়ে গুজিয়ে তুমি এখানে আমাকে নিয়ে আসো। আমার এখানে আসার কী মানে হয়?’ তুষার, রঞ্জনাকে বোঝাবার চেষ্টা করে, “তুমি এভাবে কেন ভাবছ? মা-বাবা আমাদের দু’জনকেই সমান ভালোবাসেন। কিন্তু ওনারা একটু সরল মানসিকতার, তোমাদের ভাষার সফিস্টিকেশনের অভাব রয়েছে ওনাদের মধ্যে। লোক দেখিয়ে ভালোবাসা জাহির করা ওনাদের আসে না।’

অন্যদিকে বউমারা চলে যাওয়ার পর অসীমাদেবী ক্ষোভ উগরে দিতেন স্বামীর কাছে। ‘দেখলে তো, এতক্ষণ ওরা রইল অথচ বউমা আমাদের সঙ্গে কথাই বলল না। তুষারই নিশ্চই ওকে জোর করে এখানে নিয়ে এসেছে। মুখ দেখে বোঝাই যায় না ও আমাদের সম্পর্কে কী ভাবছে। এত রকমের রান্না করে খাওয়ালাম অথচ মুখে একটা কথাও বলল না। কোন বাড়িতে শাশুড়ি, বউমার জন্যে এতটা করবে?”

পরিমলবাবু স্ত্রীকে চিনতেন। জানতেন অসীমার এই ক্ষোভ মুহূর্তের তাই চুপ করে থাকাটাই শ্রেয় মনে করতেন।

ক্রমশ…

গর্ব ( শেষ পর্ব )

দেখতে দেখতে ক”টাদিন পার হয়ে গেল। এখানে আসার আগে রমেন্দু মনে মনে ধরেই নিয়েছিলেন তিনি এই শহরের একজন বিস্মৃত মানুষ। হয়তো সবাই তাঁকে ভুলেই গিয়েছে। কিন্তু এখানে আসার পর সেই ধারণা সম্পূর্ণ পালটে গেল। আশ্চর্য! এখনও বহু মানুষ তাঁকে মনে রেখেছে। এমনকী তাঁর ছেলেদের কৃতিত্বের কাহিনি পরবর্তী প্রজন্মের কচিকাঁচাদের উদাহরণ হিসেবে শোনানো হয়।

কথায় কথায় শিবতোষ বললেন, ‘তুই হলি গিয়ে গর্বিত পিতা। তোর দু’ছেলে যাকে বলে জুয়েল। ওরা দুইভাই যেসময় বোর্ডের পরীক্ষায় স্ট্যান্ড করে দেখিয়েছিল, সেটা নিঃসন্দেহে বিরল নজির। তোদের কথা এই ছোটো শহরের মানুষ কী করে ভুলবে বল? ওদের জন্য কত সন্মান এসেছিল এখানে। তোরা ভুলে গেলেও, তোদের কথা আমরা ভুলতে পারব না।’

শিবতোষের শেষটা মর্মে বিধল রমেন্দুর। এই পথ দিয়েই একদিন গন্তব্যের দিকে গিয়েছিলেন, সেই পথটাকে আজ ভুলে বসে আছেন! মাথা নত করে রইলেন বেশ কিছুটা সময়।

শিবতোষের ছোটো বউমা রিনিকেই সঙ্গী হিসেবে বেছে নিলেন রমেন্দু। রিনি বেশ উচ্ছ্বল, টুকির চেয়ে চালাকচতুরও বটে। বুনিয়াদপুর তার স্মৃতির কায়া পালটেছে, অঙ্গসজ্জা বেড়েছে অনেক। এখন মিউনিসিপ্যালিটি। বড়ো বড়ো দোকান গজিয়েছে। বিশ্বায়নের ধাক্কায় শপিং মল তৈরি হয়েছে দু’দুটো। তিনি যখন ছেড়ে যান তখন ‘মা কালী বস্ত্রালয়’ ছাড়া আর কোনও কাপড়ের দোকান ছিল না। ভালো কিছু কিনতে হলে যেতে হতো সদরে।

নতুন শপিং মল ‘ড্রেসিং বাজার’-এ ঢুকলেন রমেন্দু। সঙ্গে রিনি। শপিং জিনিসটা কোনও দিনই পছন্দের ছিল না রমেন্দুর। ওসব লতাই সামলেছে। মেয়েদের একটা সহজাত দক্ষতা থাকে ওই বিষয়ে৷ শপিং করতে পছন্দ করে না এমন মেয়ের সংখ্যা খুব কম। তবে রিনি বেশ পটু। রমেন্দু শুধু সাজেশন দিলেন, রিনি বেছে বেছে কিনে ফেলল সেসব। সব শেষে টাকার অঙ্কটা দেখে রিনি বলল— “আমাদের জন্য এত দামি দামি জিনিস কেনার কী দরকার ছিল কাকাবাবু?”

কার্ডে পেমেন্ট করে রমেন্দু বললেন, ‘টাকা আসবে যাবে আমি আর আসতে পারব কিনা কোনও গ্যারান্টি আছে? তোমাদের এটুকু দিতে পারলে আমার খুব ভালো লাগবে। ওসব কথা ছাড়ো, তোমার জন্য যে-শাড়িটা নিয়েছি সেটা একবার পরে দেখিও কিন্তু। আমি ছবি তুলে রাখব।’

রিনির চোখ দুটো আনন্দে ঝকঝক করে উঠল, “আমি আজকেই পরে দেখাব।”

সবার জন্যেই কিছু না কিছু নিয়েছেন রমেন্দু। ভাইয়েরা এটাকে লোক দেখানো প্রদর্শন মনে করলেও কিছু মনে করেননি। ওরা এখনও ভাবে, সাফল্যটা দাদার যেন বাঁধা লক্ষ্মী। এখনও সেই ভয়ংকর ঈর্ষা বয়ে চলেছে! ঈর্ষার জায়গায় যদি একটু অন্য ভাবে দেখত? একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল। আপন মনেই স্বগতোক্তি করেন রমেন্দু — সাফল্য আর জয় এক জিনিস নয়। অথচ এরা সেটাকেই অমোঘ সত্য ধরে জীবনটাকে…।

আজ রাতে শিবতোষের বাড়িতে নেমন্তন্ন। এই নিয়ে দু’তিন দিন তো হয়েই গেল। আজকেরটা স্পেশাল কারণ কাল সকালের ট্রেনে কলকাতা ফিরে যাচ্ছেন রমেন্দু। মেয়েরা ভেতরে রান্নায় ব্যস্ত। বাইরের বারান্দায় ছেলেরা মাদুর বিছিয়ে গোল হয়ে বসেছে। চা আর মুড়ি সহযোগে আড্ডা জমে উঠেছে।

শিবতোষ বললেন, “একবার সময় করে ওদের সবাইকে নিয়ে আয়। খুব ভালো লাগবে।’

শিবতোষের বড়ো ছেলে শেখর বলল, ‘হ্যাঁ কাকাবাবু। রিটায়ার করেছেন আর তো কোনও টান নেই।”

রমেন্দু বললেন, “ওদের কথা বলতে পারি না, তবে আমি আসব। লতাকেও আনার চেষ্টা করব। আসলে, না আসতে আসতে এমন একটা দূরত্ব তৈরি হয়ে গিয়েছিল। এই আসা তো কিছুটা জোর করেই। কী মনে হল ভাবলাম জীবনের শেষ প্রান্তে এসে একবার জন্মভিটেটা দেখেই আসি। তাছাড়া এখন আমার হাতে অফুরন্ত সময়। ছেলেরা বিদেশে, শেষ কবে সবাই একসঙ্গে হয়েছি বলা মুশকিল। বাড়িতে তো দুটো প্রাণী, আমি আর লতা। লতা ওর ভাইয়ের বাড়ি গেল ধানবাদ, আমি ভাবলাম এই সুযোগে…

শিবতোষ বললেন— আমি যে কী খুশি হয়েছি বলে বোঝাতে পারব না। তোর ছেলেরাও এখানেই জন্মেছে, তবুও ওদের ফিলিংস একটু অন্যরকম হবেই। তাছাড়া পড়ুয়া ছেলেদের মাঠঘাট, বনবাদাড়ের স্মৃতি কম থাকে। ওদের লক্ষ্য সব সময় উঁচুতে ছিল। ক’জন আর ওরকম হতে পারে? কিন্তু তুই তো বনেবাদাড়ে ঘোরা ছেলে, তোর আমাদের সেইসব দিনের স্মৃতি মনে পড়ত না? অবশ্য ওদের পিছনে তোকে তো কম সময় দিতে হয়নি। সেদিক থেকে তুই সফল।

ভেতর থেকে বেরিয়ে এল রিনি। ডানহাতে জলের গেলাস বাঁ হাতে ওষুধ। শিবতোষের দিকে এগিয়ে ধরে বলল, “বাবা তোমার প্রেশারের ওষুধ। দিদি পাঠিয়ে দিল। ঝটপট খেয়ে নাও।’

বাধ্য ছেলের মতো খেয়ে নিল শিবতোষ। রিনি এবার রমেন্দুর দিকে তাকিয়ে বলল— দিদি বলল, আর একবার চা দেব কাকাবাবু? রান্না কমপ্লিট হতে কিছুটা সময় লাগবে।

—দেবে, তবে দাও। চা-তে আমার আপত্তি থাকে না, জেনে ফেলেছ দেখছি!

রিনি মিষ্টি হেসে চলে যাচ্ছিল, পিছু ডাকল শেখর— বাবার প্রেশারের ওষুধ আর ক’টা আছে টুকিকে একটু দেখে রাখতে বোলো তো রিনি, কাল সকালে এনে রাখব তাহলে।

রিনি মাথা নেড়ে চলে যেতেই শেখর রাজার দিকে তাকিয়ে বলল- মায়ের চশমাটা ঠিক করতে দিয়েছিলি, ওটা এনেছিস রাজা ?

রাজা বলল— গিয়েছিলাম। কিন্তু বিল্টুদা বলল, মায়ের পাওয়ার সম্ভবত বেড়েছে। কলকাতার ডাক্তার আসবে পরশু, তাকে একবার দেখিয়ে নিতে বলল। আমিও ভাবলাম সেটাই ভালো হবে। নাম লিখিয়ে দিয়েছি, পরশু রিনি দেখিয়ে আনুক মাকে। তারপরেই না হয় চশমা বানানো যাবে।

কবজি ডুবিয়ে খেলেন রমেন্দু। তারপর অনেক রাত পর্যন্ত চলল গল্প গুজব আর আড্ডা। জমাটি আড্ডা ছেড়ে কিছুতেই উঠতে ইচ্ছে করছিল না রমেন্দুর। কলকাতায় ফিরে আবার তো সেই একঘেয়ে জীবন। অবসরপ্রাপ্ত বুড়ো বুড়ির উপাখ্যান। প্রতিদিনের ছাঁচে ঢালা রুটিন। মর্নিং ওয়াক, বাজার, খবরের কাগজ, টিভি, মোবাইল – একটা যান্ত্রিক বৃত্ত!

শিবতোষই স্মরণ করিয়ে দিলেন- অনেক রাত হল রে, এবার শুয়ে পড়গে যা। তোকে আবার ভোরের ট্রেন ধরতে হবে।

হঠাৎ রমেন্দুর চোখ ছলছল করে উঠল। শিবতোষ অবাক হয়ে বললেন— কী হল রে?

রমেন্দুর গলা ভার। ‘আমার সব গর্ব চুরমার হয়ে গেছে রে শিবু! বহুকাল একটা অহংকার মনে বাসা বেঁধে ছিল। মনে মনে ভাবতাম, আমি সত্যি সত্যি এক গর্বিত পিতা। আমার সমকক্ষ হতে পারা সহজ কাজ নয়। এখন মনে হয় ওটা আমার পরাজয় ছাড়া আর কিছুই নয়। আমার বড়ো হওয়া সন্তানেরা হয়তো অনেক বড়ো বড়ো কাজ করবে কিন্তু কোনও দিন এসে মাকে বলবে না, চলো মা তোমাকে ডাক্তার দেখিয়ে আনি। পুত্রবধূরা কোনও দিন বলবে না, বাবা এই নিন আপনার প্রেশারের ওষুধ। এ বড়ো যে অনেক বড়ো রে শিবু, ধরাছোঁয়ার বাইরে।’

শিবতোষ অবাক হয়ে দেখলেন, রমেন্দুর মুখে চোখে সেই ঝলমলে দীপ্তি আর নেই। সেই জায়গায় শেষ বিকেলের অসীম শূন্যতা। কোনও উত্তর দেওয়ার মতো ভাষা খুঁজে পেলেন না শিবতোষ ।

 

পাথর-প্রতিমা (শেষ পর্ব)

শেষ পর্ব

একপ্রকার আমার জোরাজুরিতেই আমি আর সিদ্ধার্থ বড়োদিনের সন্ধেবেলা হাজির হলাম আদিবাসীদের গ্রামে। দূর থেকে দেখেই বিরজু ছুটে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরল। আরও অনেকে রয়েছে। আয়োজন ভালোই। মহুয়া আর মেঠো ইঁদুরের মাংস ধনেপাতা দিয়ে। সিদ্ধার্থ আমাকে চোখ দিয়ে ইশারা করল, না খাওয়ার জন্য। কিন্তু বয়ঃসন্ধিতে যে-নেশার বীজ শরীরের অলিতে গলিতে ছড়িয়েছে তাকে এড়ানো বড়ো মুশকিল। তার ওপর আবার যদি ছোটোবেলার স্যাঙাতদের অনুরোধ থাকে। বেশ কয়েক ভাঁড় মহুয়া মেরে দিলাম ইঁদুরের মাংস দিয়ে। আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখছি অনেকগুলো আধখাওয়া চাঁদ। তার মানে ভালোই নেশা হয়েছে।

সিদ্ধার্থ বলল, ‘চল এবার উঠি।’

আমার তখন ওঠার শক্তি নেই। হাতের ইশারায় আর একটু অপেক্ষা করতে বললাম। সিদ্ধার্থ তাড়া দিল। বিরজু ভরসা জোগাল, ‘সিধু তুই যা, আমি একটু পরে শুভকে এগিয়ে দেব।’ সিদ্ধার্থ আমার পিঠে হাত বুলিয়ে ভরসা দিয়ে চলে গেল।

আমি আর বিরজু আবার শুরু করলাম। উল্লাস! কিছুক্ষণ পর খেয়াল করলাম, বিরজুর-ই ওঠার ক্ষমতা নেই। ও আমাকে কীভাবে এগিয়ে দেবে! আমার শরীর ছেড়ে দিয়েছে। মনের জোরে উঠে দাঁড়ালাম। ভাবলাম, নদীর ধার দিয়ে কোয়ার্টারে ফিরতে অনেক সময় লাগবে। তার চেয়ে বরং পাহাড়ি জঙ্গলের মেঠো পথ দিয়ে শর্টকাট মারি।

ধীরে পাহাড়ের ঢাল ধরলাম। চারদিকে শুধু ঝিঁঝিঁপোকার শব্দ। থকথকে অন্ধকার। চারপাশের কালো পাহাড়গুলো যেন আমার বুকের ওপর চেপে বসছে। পা ক্রমশ ভারী হয়ে আসছে। আর চলতে চাইছে না। হঠাৎই পিঠে একটা শক্ত কিছু দিয়ে ধাক্কা মারা অনুভব করলাম। মুখ থুবড়ে সামনে পড়ে গেলাম। তারপরেই সেই গল্পের শুরুর ঘটনাটা।

আমার যখন হালকা জ্ঞান ফিরল, তখন দেখি আমি একটা পাহাড়ের গুহায় হাত বাঁধা অবস্থায় পড়ে আছি। দূরে আবছা দেখতে পেলাম একটা আগুন জ্বলছে। চারদিকে গোল হয়ে জলপাই রঙের পোশাক পরা কয়েকটি ছেলেমেয়ে। বসে খাওয়াদাওয়া করছে। একজনকে পিছন থেকে দেখে, যেন মনে হল বুধিয়া। আমার আর বুঝতে অসুবিধে হল না যে, আমি একটি জঙ্গি সংগঠন দ্বারা অপহৃত হয়েছি। কিন্তু এখন মুক্তির উপায় কী? আপাতত চুপ করে বসে থাকা ছাড়া আমার এই মুহূর্তে আর অন্য কোনও পথ নেই।

রাত ক্রমশ গড়াচ্ছে। আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখলাম চাঁদ দিক বদল করছে। ক্লান্তিতে আমার আবার চোখ জুড়ে আসতে লাগল। কখন ঘুমিয়ে পড়েছি জানি না। হঠাৎ ঘুম ভাঙল একটা উষ্ণ হাতের কোমল স্পর্শে। ভারী চোখের পাতা খুলে চমকে উঠলাম। চাঁদের আলোয় দেখি বিজলি। পরনে জংলা রঙের পোশাক। পিঠে একটা স্বয়ংক্রিয় রাইফেল। দূরে আগুনটা নিভু নিভু। ছড়িয়ে ছিটিয়ে কয়েকজন শুয়ে আছে।

পায়ের জুতোর ফাঁক থেকে ছোটো ছুরিটা বার করে বিজলি আমার হাতের বাঁধনটা কেটে দিল। তারপর ঠোঁটের ওপর আঙুল দিয়ে শব্দ করতে বারণ করল। হাতটা বাড়িয়ে দিল আমার দিকে। আমি বিজলির হাত ধরে উঠে দাঁড়ালাম। মাথা নীচু করে বেরিয়ে এলাম গুহা থেকে। অন্ধের মতো ওর হাত ধরে পাহাড়ি পথে জঙ্গল চিরে হাঁটতে লাগলাম। কোথায় যাচ্ছি, কেন যাচ্ছি জানি না।

কিছুক্ষণ পরে পিছনে শুনি শুকনো পাতার খসখস আওয়াজ। মনে হয় কেউ বা কারা যেন আমাদের অনুসরণ করছে। আমরা হাঁটার গতি বাড়ালাম। কতক্ষণ হাঁটছি খেয়াল নেই। শুধু মনে হচ্ছে মৃত্যুর মুখ থেকে জীবনের দিকে হাঁটছি। হঠাৎ আমরা একটা উঁচু টিলার ওপর এসে দাঁড়ালাম। দূরে দেখা যাচ্ছে নীচে আমাদের রাজগাঙপুর। টিপটিপ করে জ্বলছে কোয়ার্টারের কয়েকটা আলো। মুহূর্তের মধ্যে বিজলি আমাকে জড়িয়ে ধরল। আমার সারা শরীর অবশ হয়ে গেল। আমি পাহাড়ের বুকে আবার হারিয়ে যেতে লাগলাম। একটা আদিম চুম্বন আমার সংবিৎ ফেরাল। মনে হল খুব কাছেই কোনও মানুষের উপস্থিতি। ভারী বুটের আওয়াজ। বিজলি আমাকে ধাক্কা দিয়ে বলল, “পালা…ও। যত তাড়াতাড়ি পারো।’

আমি রুদ্ধশ্বাসে দৌড় শুরু করলাম। আচমকা পিছনে একটা গুলির আওয়াজ। একটা মেয়েলি গলার বিকট চিৎকার। চারদিকের পাহাড়ে প্রতিধ্বনিত হতে লাগল সেই গগনভেদী শব্দ। সে শব্দ কীসের! সে কি কোনও নারীর মৃত্যুর আর্তনাদ? নাকি তার দলের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতার বিচারহীন ভবিতব্য শাস্তির প্রতিবাদ? বা জাতপাতের অন্ধবিশ্বাসে এক নিষ্পাপ ভালোবাসার মৃত্যুর বিরুদ্ধে জেহাদ! জানি না৷

এক দৌড়ে এসে থামলাম একেবারে সিদ্ধার্থদের বাড়ির সামনে। দরজা খুলে আমার অবস্থা দেখে সিদ্ধার্থ অবাক। আমি নিশ্চুপ। আমার এক চোখে তখন বাঁচার আনন্দ, অন্য চোখে ভালোবাসার মরণের অশ্রু।

পরদিন কলকাতা ফেরার ট্রেন ধরলাম। সিদ্ধার্থ স্টেশনে ছাড়তে এল। ট্রেন ছাড়ার পর, আমি হাত নাড়তে থাকলাম। আমার পিছনে পড়ে রইল পাহাড়ঘেরা আমার জন্মস্থান, আমার ছোটোবেলার বেড়ে ওঠার স্মৃতিবিজড়িত পাহাড়ের পাদদেশের এক আদিবাসী গ্রাম আর আমার পবিত্র ভালোবাসার মৃত্যু উপত্যকা।

 

 

পড়ার জন্য সীমাহীন গল্প-নিবন্ধসাবস্ক্রাইব