শেষ পর্ব

একপ্রকার আমার জোরাজুরিতেই আমি আর সিদ্ধার্থ বড়োদিনের সন্ধেবেলা হাজির হলাম আদিবাসীদের গ্রামে। দূর থেকে দেখেই বিরজু ছুটে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরল। আরও অনেকে রয়েছে। আয়োজন ভালোই। মহুয়া আর মেঠো ইঁদুরের মাংস ধনেপাতা দিয়ে। সিদ্ধার্থ আমাকে চোখ দিয়ে ইশারা করল, না খাওয়ার জন্য। কিন্তু বয়ঃসন্ধিতে যে-নেশার বীজ শরীরের অলিতে গলিতে ছড়িয়েছে তাকে এড়ানো বড়ো মুশকিল। তার ওপর আবার যদি ছোটোবেলার স্যাঙাতদের অনুরোধ থাকে। বেশ কয়েক ভাঁড় মহুয়া মেরে দিলাম ইঁদুরের মাংস দিয়ে। আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখছি অনেকগুলো আধখাওয়া চাঁদ। তার মানে ভালোই নেশা হয়েছে।

সিদ্ধার্থ বলল, ‘চল এবার উঠি।’

আমার তখন ওঠার শক্তি নেই। হাতের ইশারায় আর একটু অপেক্ষা করতে বললাম। সিদ্ধার্থ তাড়া দিল। বিরজু ভরসা জোগাল, ‘সিধু তুই যা, আমি একটু পরে শুভকে এগিয়ে দেব।’ সিদ্ধার্থ আমার পিঠে হাত বুলিয়ে ভরসা দিয়ে চলে গেল।

আমি আর বিরজু আবার শুরু করলাম। উল্লাস! কিছুক্ষণ পর খেয়াল করলাম, বিরজুর-ই ওঠার ক্ষমতা নেই। ও আমাকে কীভাবে এগিয়ে দেবে! আমার শরীর ছেড়ে দিয়েছে। মনের জোরে উঠে দাঁড়ালাম। ভাবলাম, নদীর ধার দিয়ে কোয়ার্টারে ফিরতে অনেক সময় লাগবে। তার চেয়ে বরং পাহাড়ি জঙ্গলের মেঠো পথ দিয়ে শর্টকাট মারি।

ধীরে পাহাড়ের ঢাল ধরলাম। চারদিকে শুধু ঝিঁঝিঁপোকার শব্দ। থকথকে অন্ধকার। চারপাশের কালো পাহাড়গুলো যেন আমার বুকের ওপর চেপে বসছে। পা ক্রমশ ভারী হয়ে আসছে। আর চলতে চাইছে না। হঠাৎই পিঠে একটা শক্ত কিছু দিয়ে ধাক্কা মারা অনুভব করলাম। মুখ থুবড়ে সামনে পড়ে গেলাম। তারপরেই সেই গল্পের শুরুর ঘটনাটা।

আমার যখন হালকা জ্ঞান ফিরল, তখন দেখি আমি একটা পাহাড়ের গুহায় হাত বাঁধা অবস্থায় পড়ে আছি। দূরে আবছা দেখতে পেলাম একটা আগুন জ্বলছে। চারদিকে গোল হয়ে জলপাই রঙের পোশাক পরা কয়েকটি ছেলেমেয়ে। বসে খাওয়াদাওয়া করছে। একজনকে পিছন থেকে দেখে, যেন মনে হল বুধিয়া। আমার আর বুঝতে অসুবিধে হল না যে, আমি একটি জঙ্গি সংগঠন দ্বারা অপহৃত হয়েছি। কিন্তু এখন মুক্তির উপায় কী? আপাতত চুপ করে বসে থাকা ছাড়া আমার এই মুহূর্তে আর অন্য কোনও পথ নেই।

রাত ক্রমশ গড়াচ্ছে। আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখলাম চাঁদ দিক বদল করছে। ক্লান্তিতে আমার আবার চোখ জুড়ে আসতে লাগল। কখন ঘুমিয়ে পড়েছি জানি না। হঠাৎ ঘুম ভাঙল একটা উষ্ণ হাতের কোমল স্পর্শে। ভারী চোখের পাতা খুলে চমকে উঠলাম। চাঁদের আলোয় দেখি বিজলি। পরনে জংলা রঙের পোশাক। পিঠে একটা স্বয়ংক্রিয় রাইফেল। দূরে আগুনটা নিভু নিভু। ছড়িয়ে ছিটিয়ে কয়েকজন শুয়ে আছে।

পায়ের জুতোর ফাঁক থেকে ছোটো ছুরিটা বার করে বিজলি আমার হাতের বাঁধনটা কেটে দিল। তারপর ঠোঁটের ওপর আঙুল দিয়ে শব্দ করতে বারণ করল। হাতটা বাড়িয়ে দিল আমার দিকে। আমি বিজলির হাত ধরে উঠে দাঁড়ালাম। মাথা নীচু করে বেরিয়ে এলাম গুহা থেকে। অন্ধের মতো ওর হাত ধরে পাহাড়ি পথে জঙ্গল চিরে হাঁটতে লাগলাম। কোথায় যাচ্ছি, কেন যাচ্ছি জানি না।

কিছুক্ষণ পরে পিছনে শুনি শুকনো পাতার খসখস আওয়াজ। মনে হয় কেউ বা কারা যেন আমাদের অনুসরণ করছে। আমরা হাঁটার গতি বাড়ালাম। কতক্ষণ হাঁটছি খেয়াল নেই। শুধু মনে হচ্ছে মৃত্যুর মুখ থেকে জীবনের দিকে হাঁটছি। হঠাৎ আমরা একটা উঁচু টিলার ওপর এসে দাঁড়ালাম। দূরে দেখা যাচ্ছে নীচে আমাদের রাজগাঙপুর। টিপটিপ করে জ্বলছে কোয়ার্টারের কয়েকটা আলো। মুহূর্তের মধ্যে বিজলি আমাকে জড়িয়ে ধরল। আমার সারা শরীর অবশ হয়ে গেল। আমি পাহাড়ের বুকে আবার হারিয়ে যেতে লাগলাম। একটা আদিম চুম্বন আমার সংবিৎ ফেরাল। মনে হল খুব কাছেই কোনও মানুষের উপস্থিতি। ভারী বুটের আওয়াজ। বিজলি আমাকে ধাক্কা দিয়ে বলল, “পালা…ও। যত তাড়াতাড়ি পারো।’

আমি রুদ্ধশ্বাসে দৌড় শুরু করলাম। আচমকা পিছনে একটা গুলির আওয়াজ। একটা মেয়েলি গলার বিকট চিৎকার। চারদিকের পাহাড়ে প্রতিধ্বনিত হতে লাগল সেই গগনভেদী শব্দ। সে শব্দ কীসের! সে কি কোনও নারীর মৃত্যুর আর্তনাদ? নাকি তার দলের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতার বিচারহীন ভবিতব্য শাস্তির প্রতিবাদ? বা জাতপাতের অন্ধবিশ্বাসে এক নিষ্পাপ ভালোবাসার মৃত্যুর বিরুদ্ধে জেহাদ! জানি না৷

এক দৌড়ে এসে থামলাম একেবারে সিদ্ধার্থদের বাড়ির সামনে। দরজা খুলে আমার অবস্থা দেখে সিদ্ধার্থ অবাক। আমি নিশ্চুপ। আমার এক চোখে তখন বাঁচার আনন্দ, অন্য চোখে ভালোবাসার মরণের অশ্রু।

পরদিন কলকাতা ফেরার ট্রেন ধরলাম। সিদ্ধার্থ স্টেশনে ছাড়তে এল। ট্রেন ছাড়ার পর, আমি হাত নাড়তে থাকলাম। আমার পিছনে পড়ে রইল পাহাড়ঘেরা আমার জন্মস্থান, আমার ছোটোবেলার বেড়ে ওঠার স্মৃতিবিজড়িত পাহাড়ের পাদদেশের এক আদিবাসী গ্রাম আর আমার পবিত্র ভালোবাসার মৃত্যু উপত্যকা।

 

 

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...