কুড়িয়ে পাওয়া স্বপ্ন (পর্ব ১)

রাস্তার পাশে জমে থাকা জলে চাকাটা পড়তেই ছপাৎ করে শব্দ হল একটা। মাঝবয়সি রিকশাচালক বলল, ‘ইয়ে লিজিয়ে ভাইয়াজি আগয়ি আপকি শান্তিকুঞ্জ।’

রিকশায় বসেই অবাক চোখে স্যমন্তক তাকাল বাড়িটার দিকে। ছোটোখাটো চেহারার একতলা বাড়ি। সামনে একফালি সবুজ ঘাসে ঢাকা জমি। দু’চারটে ফুল আর গোটা কয়েক সুপুরি গাছ নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে। রিকশার ভাড়া মিটিয়ে ছোটো লোহার গেটটা খুলল স্যমন্তক। ক্যাঁচ করে শব্দ হল একটা। বাড়ির হাতা পেরিয়ে এসে দাঁড়াল সদর দরজার সামনে। পুরোনো আমলের ডোরবেলটা বাজাতেই ভেতর থেকে শোনা গেল নারী কণ্ঠ, ‘কে?’

—আমি স্যমন্তক, স্যমন্তক সরকার। ম্যাডামের সঙ্গে আমার অ্যাপয়েন্টমেন্ট নেওয়া ছিল।

খুট করে একটা শব্দ হল দরজায় আর সঙ্গে সঙ্গে বন্ধ পাল্লা খুলে বেরিয়ে এল ফরসা, ছিপছিপে চেহারার একটা মেয়ে। বয়স পঁচিশ-ছাব্বিশের বেশি হবে না। জিন্‌স, টি-শার্ট পরা, পিঠব্যাগ কাঁধে স্যমন্তককে মাথা থেকে পা পর্যন্ত দেখে সে বলল, ‘ও, আপনি? আপনার তো সকালের দিকে আসার কথা ছিল, তাই না?”

—হ্যাঁ কথা তো তেমনই ছিল। কিন্তু রাস্তায় একটু ফেঁসে গিয়েছিলাম। হাইওয়েতে সকালে একটা বড়োসড়ো অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে। তাই পথ অবরোধ ছিল অনেকক্ষণ। তার উপর জ্যাম, প্রায় ঘণ্টা তিনেক আটকে থাকতে হল ওখানে। ঝড়ের গতিতে কথাগুলো বলে থামল স্যমন্তক। তারপর জিজ্ঞেস করল, আজ কি তাহলে দেখা হবে না ম্যাডামের সঙ্গে? আসলে আমার দেখা করাটা খুব দরকার। অনেকটা দূর থেকে এসেছি।

ঘিয়ে রঙের সালোয়ার কুর্তি পরা মেয়েটি মাথা নেড়ে বলল, “আপনি ভেতরে এসে বসুন। আমি মাসিমণিকে খবর দিচ্ছি। যদি উনি দেখা করতে চান তবে নিশ্চয়ই দেখা হবে।’

স্যমন্তককে বৈঠকখানায় বসিয়ে সে চলে গেল বাড়ির ভেতরে। ধবধবে সাদা দেয়াল। জানলা-দরজার পর্দা, সোফার কভার এমনকী ছোট্ট ডিভানের ঢাকাটা পর্যন্ত সাদা! একটা হালকা লাল আলো জ্বলছে ঘরে। চন্দনের সুবাসে ভরে আছে চারপাশ। ঘরটাতে ঢুকেই একটা অদ্ভুত প্রশান্তিতে ভরে গেল স্যমন্তকের মন। একটু ইতস্তত করে স্যমন্তক বসল দুধ সাদা সোফার ধার ঘেঁষে। চারদিকটা ভালো করে দেখছিল সে।

ঘরের মেঝে থেকে টি-টেবিলের ঢাকনা, সবেতেই যত্নের ছাপ স্পষ্ট। ডানদিকের বড়ো দেয়াল জুড়ে রয়েছে একজন শুভ্র কেশ প্রৌঢ়ের ছবি। নীচে বড়ো বড়ো করে ইংরেজি হরফে লেখা ওম শান্তি। ধুপকাঠি জ্বলছে দু’খানা। কুণ্ডলী পাকানো ধোঁয়া বেরিয়ে আসছে সেখান থেকে। বোধহয় গুরুদেব-টেব হবেন। ছোটো একটা ট্রেতে এক গেলাস জল আর দুটো সন্দেশ নিয়ে ঘরে ঢুকল মেয়েটি। বলল, ‘মাসিমণি আপনাকে একটু অপেক্ষা করতে বললেন। একটু পরে আসছেন উনি।’

সে ভেতরে যাবার জন্যে পা বাড়াতেই স্যমন্তক পেছন থেকে আচমকা বলে উঠল, ‘ছোটোমা, মানে মধুরিমা ম্যাডাম কি আপনার আপন মাসি?’

প্রশ্ন শুনে ঘুরে তাকাল মেয়েটি। একটা সৌজন্যমূলক হাসি হেসে বলল, ‘না ঠিক আপন নয়। একটু দূর সম্পর্কের। খুব ছোটো বয়সে আমার মা-বাবা মারা গিয়েছিলেন। তাই মাসিমণি নিজের কাছে রেখে মানুষ করেছেন আমাকে।’

—আমিও সেরকমই কিছু আন্দাজ করছিলাম, কারণ মিসেস মধুরিমা সরকারের কোনও ভাই বা বোন ছিল না বলেই জানতাম। কথাটা বলে ঠান্ডা জলের গেলাসে চুমুক দিল স্যমন্তক।

মেয়েটি খানিকক্ষণ ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে থাকল স্যমন্তকের দিকে। ভর দুপুরে আসা এই আগন্তুকের প্রতি যে তার অসীম কৌতূহল সে বিষয়ে স্যমন্তক নিশ্চিত। মধুরিমাদেবী মেয়েটিকে স্যমন্তকের বিষয়ে একেবারে অন্ধকারে রেখেছেন, বোঝা যাচ্ছে। মেয়েটিকে একটু খেলাতে ইচ্ছে করল।

এমনিতে তার সুপুরুষ চেহারা, তুখোড় বুদ্ধিদীপ্ত কথাবার্তা যে-কোনও নারীর মনকেই টেনে নেয় চুম্বকের মতো। রমণীমোহন হিসেবে তার ভালোরকম খ্যাতি আছে বন্ধুমহলে। বান্ধবীর সংখ্যাও নেহাত কম নয়।

জলের গেলাসটা টেবিলে রেখে বলল, উফ, প্রাণটা জুড়োল। এই রোদে ভিড় বাসে ট্র্যাভেল করা যে কী হ্যাপা, সেটা যারা করে তারাই জানে। তার উপর এই বিরক্তিকর জ্যাম! একবার ভাবলাম বাড়ি ফিরে যাই। পরক্ষণেই মনে হল মধুরিমাদেবী হয়তো অপেক্ষা করে বসে থাকবেন। কথার খেলাপ করাটা ঠিক হবে না। তাই তেতে পুড়ে হলেও চলে এলাম। বড্ড তেষ্টা পেয়েছিল, জানেন? জলটা দিয়ে আপনি আমাকে বাঁচালেন মিস…?

—তন্দ্ৰা৷

—বাহ, বেশ সুন্দর নাম তো আপনার!

—আপনি বিশ্রাম নিন, আমি দেখি ওদিকে মাসিমণির হল কিনা। লাজুক হেসে তন্দ্রা আবার চলে গেল ভেতরে।

 

(চলবে)

বুদি

অনেকক্ষণ ধরে স্কুলের বড়ো গেটটার বাইরে, ভাই ও ঝুপড়ির কতগুলো ছোটো ছোটো ছেলেমেয়ের সাথে দাঁড়িয়েছিল চোদ্দ বছরের বুদি। বছর চোদ্দো হলেও বুদিকে যুবতি বলে ভুল হয়। অনেক ‘শিক্ষিত’, ‘সভ্য’ বাবুরাও মশকরা করে বলে— ‘ঝুপড়ি ঘরে এত সুন্দর একটা ‘মাল’ কীভাবে পয়দা হল মাইরি। মা-টা বোধহয় কোনও বাবুর ঘরে…’

এই সুবাদে স্কুলে মাঝেমধ্যেই কাজের সুযোগ পায় বুদি। মাস্টার, ক্লার্কদের চা-টা এনে দিয়ে দু’চার পয়সা বকশিস পায়। মাস্টারদের লোভাতুর চোখ বুদির উপর থাকলেও, পেশাগত অবস্থান চিন্তা করে তেমন কিছু একটা করে উঠতে পারে না তারা। তবে অশিক্ষক কর্মীরা মশকরা করতে ছাড়ে না। এইটুকু জীবনেই বুদি বুঝে গেছে, এইটুকু মশকরা মেনে না নিলে আয় বন্ধ, পিতৃহীন সংসার চলবে না। রুগ্ন মা ও ছোটো ভাইয়ের একমাত্র অবলম্বন সে।

আজ ২৬ জানুয়ারি। এই স্কুলের একটা আভিজাত্য আছে। স্কুলেরই প্রাক্তন মস্তান ছাত্র বর্তমানে এমএলএ হয়েছেন। তিনি নিজের স্কুলে পতাকা তুলে স্কুলকে গৌরবান্বিত করবেন। অন্যান্য বার পতাকা তোলার আগে একপ্রস্থ চা দিয়ে দু’একটা মিষ্টির প্যাকেট পায় বুদি। এবার এমএলএ আসবেন। ‘দেশপ্রাণ জননেতা’র সিকিউরিটির জন্য বুদিদের গেটের বাইরে আটকে দেওয়া হয়েছে। বুদি এতসব বোঝে না, প্যাকেটের লোভে দাঁড়িয়ে থাকে। ছোটো ছোটো ছেলেমেয়েগুলোও চকোলেটের আশায় থাকে।

যথা সময়ের দু’ঘণ্টা পরে এমএলএ এসে পতাকা উত্তোলন করেন। শিশুদের মঙ্গল কামনায় দুর্দান্ত মানবতার ভাষণ দিয়ে অনুষ্ঠানের সমাপ্তি হয় ৷

শিক্ষকরা চলে গেছেন। টুকিটাকি কাজের জন্য অশিক্ষক কর্মী, ডেকোরেটাররা মাঠে ঘোরাফেরা করে। অশিক্ষক কর্মীরা বুদিকে ডাকে। বলা হয় মাঠ থেকে চায়ের কাপ, মিষ্টির প্যাকেটগুলো তুলে বাইরে ফেলে দিতে।

বুদি ক’টা টাকার লোভে চায়ের কাপ, প্যাকেট জড়ো করতে থাকে। কোনও যুবতির দেওয়া ঢিলেঢালা, মাপে বড়ো নাইটির ভেতর থেকে উঁকি দেয় বুদির প্রাকযৌবনের বিকশিত স্তন। লোলুপ দৃষ্টিতে দেখতে থাকে স্কুলের কর্মীরা। ‘সস্নেহে’ আদর করার অছিলায় বুদিকে কাছে টানে।

শীতের রৌদ্রোজ্জ্বল আকাশে উত্তুরে হাওয়ায় পতপত করে উড়ছে জাতীয় পতাকা। হঠাৎই জাতীয় পতাকাটি উড়ে এসে পড়ে বুদির গায়ে। জড়িয়ে যায় ওড়নার মতো। কেউ বুঝতে পারে না কীভাবে খুলে গেল জাতীয় পতাকা, উড়ে রক্ষা করল সরল বুদির সম্ভ্রম। শিক্ষিত অশিক্ষক কর্মীরা অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে, দাঁড়িয়েই থাকে….।

চোখ টেপা মেয়ে (পর্ব ২)

শনিবার বিকেলে ওদের শর্ট লিস্টের শেষ মেয়েটিকে দেখতে ক্যাবে করে ওঁরা এসে হাজির হলেন সিরিটিতে প্রফুল্ল সেন কলোনির দেড়তলা একটা বাড়িতে। যারা ওঁদের অভ্যর্থনা করে বাইরের ছোটো ঘরটিতে বসালেন, তাঁরা সম্পর্কে মেয়ের দাদা বউদি। মেয়ের বাবা মারা গিয়েছেন বছর খানেক আগে। মা একটু মোটার দিকে, জর্দা দিয়ে পান খাবার অভ্যেস। কেতকীকে উনি সাদর আমন্ত্রণ জানালেন পান সেবন করার জন্য কিন্তু কেতকী হাত জোড় করে জানালেন ও রসে তিনি বঞ্চিত।

প্রথম নজরেই কাকলিকে অপছন্দ করে বসলেন কেতকী। মুখটা একটু চ্যাপটা ধরনের, রং শ্যামলা বলা চলে আর চোখদুটো ছোটো। শাড়ি না পরে চিকনের কাজ করা সালোয়ার কুর্তা পরে ও কি নিজেকে স্মার্ট বলে জাহির করতে চায় ওর ভাবি শ্বশুড়- শাশুড়ি আর বরের সামনে? থার্ড ডিভিশানে যে-মেয়ে পাস কোর্সে বিএ পাশ করেছে তার চাকরি জুটবে কী করে? তাই ছাতের ঘরে দুই ব্যাচে গোটা দশেক পাড়ার বাচ্চাকে পড়িয়ে নিজের হাত খরচাটা উঠিয়ে নেয় কাকলি।

মেয়ের দাদা বিকাশ কুঁদঘাটার একটা শাড়ির দোকানে সেল্সম্যান। এই পরিবারের মাসিক আয় যে পনেরো হাজার টাকার উপরে হবে না— সেটা বুঝতে অবিনাশ এবং কেতকীর কোনও অসুবিধে হল না। এই পরিবারের যা আর্থিক অবস্থা তাতে এ ঘরে বিয়ে হলে মেয়ের হাতে, গলায়, কানে পরাবার মতো গয়নার ব্যবস্থা ওরা করতে পারবে কিনা তাতে সন্দেহ জাগতেই পারে কেতকীর মনে!

কাকলিকে শর্ট লিস্টে রাখার পেছনে অরিত্র আর আবিনাশবাবুর একটাই যুক্তি ছিল— চোখে মুখে বুদ্ধির ছাপ আছে মেয়েটার। শুধু ওদের দু’জনের সন্মান রক্ষা করতেই চায়ের কাপটা হাতে তুলে নিয়ে কেতকী জানতে চাইলেন ও রান্নাবান্না জানে কিনা৷ কাকলি সরাসরি কেতকীর মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, বিয়ের পর ও কাজটা তো সব মেয়েকেই করতে হয় মাসিমা। কিন্তু আমরা তো বাঙাল, আমার রান্না কি আপনাদের পছন্দ হবে?

কাকলির বউদি শম্পা আগ বাড়িয়ে বললেন, ‘কেন তুই তো ঘটিদের রান্নাও জানিস। বিউলির ডাল আর আলুপোস্ত করে খাওয়ালি সেদিন, খুব ভালো হয়েছিল।’

—সে আমাদের রান্না না হয় শিখিয়ে নেওয়া যাবে, বললেন কেতকী। আর বেশি সময় দিতে রাজি নন উনি এ দারিদ্র্যক্লিষ্ট পরিবারের সঙ্গে। ছেলের দিকে তাকিয়ে বললেন, “তোর কিছু জিজ্ঞেস করার থাকলে এই বেলা জিজ্ঞেস করে নে খোকা। আমাদের আবার শপিং করতে যেতে হবে তো।’

অরিত্র মাথা তুলে ওর দিকে তাকাতেই ওকে চোখ মারল কাকলি। অরিত্র প্রথমে ভাবল মেয়েটা হয়তো একটু ট্যারা তাই… কিন্তু মেয়েটা যেভাবে ওর দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসল তাতে বুঝল, ও ভুল দেখেনি। আশ্চর্যের ব্যাপার ওর বাবা-মা কেউই লক্ষ্য করেননি মেয়েটার এই শরারতি।

গেস্টহাউসে ফিরে খাওয়াদাওয়া সেরে মা-বাবা টিভির সামনে বসে গেলেন আর অরিত্র চলে গেল ব্যালকনিতে। পথে আসতে আসতেই মা জানিয়ে দিয়েছিলেন বেলেঘাটার মেয়ে শুভমিতাকেই ওঁর পছন্দ আর বিয়ের ব্যাপারে বাবার নয়, মার পছন্দটাই যে শেষ কথা, সেটা অরিত্রও ভালো ভাবেই জানে।

শুভমিতাকে অরিত্র-র খারাপ লাগেনি, খারাপ লাগেনি বাগুইআটির বর্ণালিকেও। ওদের দু’জনেরই কিছু গুণ এবং ক্ষমতা আছে যা হয়তো তার নেই। অরিত্রর মনে হয় বিয়ের জন্য মেয়ে দেখা ব্যাপারটাই একটা মধ্যযুগীয়, কুৎসিত সামাজিকপ্রথা কিন্তু একটি মেয়েকে ভালোবেসে বিয়ে করার জন্য যে সাহস, সময় এবং উদ্যোগের প্রয়োজন তা কোনওদিনই খুঁজে পায়নি অরিত্র। আর সেই জন্যই এই নোংরা প্রথাটাকে মেনে চলতে হচ্ছে ওকে।

কিন্তু কাকলি নামের মেয়েটি তাকে চোখ মেরে বসল কেন? ও কি তাকে ঠাট্টা করল মা বাবার সঙ্গে মেয়ে দেখতে এসেছে বলে? নাকি ওর অন্য কোনও মতলব আছে? অনেক রাত পর্যন্ত কাকলির চোখ টেপার পিছনে কী হেঁয়ালি আছে বুঝবার চেষ্টা করে ঘুমিয়ে পড়ল অরিত্র।

পরের দিন সকাল ন’টা নাগাদ ফোনটা এল অবিনাশবাবুর কাছে। কেতকী তখন বাথরুমে৷ ‘ও হ্যাঁ, ও কাছেই আছে, দিচ্ছি ওকে।” অবিনাশবাবু মুচকি হেসে মোবাইলটা এগিয়ে দিলেন অরিত্রর দিকে। ‘নাও কথা বলো কাকলির সঙ্গে’, অবিনাশবাবু বললেন গলা খাটো করে। ‘হ্যাঁ বা না বলার দরকার নেই এখন।’

অরিত্র ভাবতে পারেনি কাকলি ওকে সরাসরি ফোন করবে। ‘হ্যালো’ বলতেই কাকলি বলল, ‘অবাক হয়েছেন নিশ্চয়ই, বুঝতে পারছি। আপনার সঙ্গে আমি একটু কথা বলতে চাই— ফোনে নয়, সাক্ষাতে। কখন কোথায় আমার সঙ্গে দেখা করতে পারবেন যদি বলেন।’

—বিকেলে আমাদের ফ্লাইট, কাজেই দেখা করতে হলে এখনই দেখা করতে হয়, অরিত্র বলল। কিন্তু আপনি তো সিরিটিতে থাকেন আর আমি এখন সল্টলেকে।

—নো প্রবলেম। মাঝামাঝি কোনও জায়গায় দেখা করতে পারি আমরা। আমি যদি মেট্রোতে পার্ক স্ট্রিট এসে যাই?

—তাই করুন। পার্ক হোটেলের সামনেই দাঁড়াবেন। সাড়ে দশটা, ঠিক আছে?

—একদম। অনেক ধন্যবাদ।

                                                                                                                                        চলবে…

বলিদান (পর্ব ২)

অনেকদিন পর অনন্যা যখন সার্থকের এরকম আচরণের কারণটা জানতে পারল, ও মনে মনে খুব দুঃখিত বোধ করল। সার্থকের জন্য মনের কোণায় সহানুভূতি জন্ম নিল। দু’বছর আগে ক্যান্সারের মতো মারণ রোগে সার্থক স্ত্রীকে হারিয়েছে। পাঁচ বছরের ওদের একটি সন্তান আছে। দ্বিতীয়বার সার্থক আর বিয়ে করেনি কারণ সৎমা সম্পর্কে খুব একটা ভালো ধারণা সার্থকের নেই। ছেলের ভবিষ্যৎ নিয়েই সবসময় দুশ্চিন্তায় থাকে সার্থক।

এতটা শারীরিক এবং মানসিক সমস্যা থাকতেও সার্থক যে নিজের সন্তানের ভবিষ্যৎকে অগ্রাধিকার দেয়, এটা ভেবেও ভালো লাগল অনন্যার।

একদিন লাঞ্চ টাইমে অনন্যাকে ক্যান্টিনে বসে খেতে দেখে সার্থক মনের মধ্যে ওঠা একটা প্রশ্ন না করে পারল না, “আচ্ছা অনন্যা, নিজের বাড়ি-ঘর ছেড়ে পুণার মতো একেবারে অচেনা একটা শহরে বদলি নিলে কেন?”

—কারণ, ওটা শুধু চারটে দেয়ালযুক্ত একটা বাড়িই, আর হ্যাঁ মাথায় একটা ছাদ আছে এইপর্যন্ত! আনমনা হয়ে উত্তর দিল অনন্যা।

—মানে? সার্থক অনন্যার উত্তরের মানেটা ঠিক বোধগম্য করতে পারল না।

—বাড়িতে ভাই বোনেদের মধ্যে আমি সবথেকে বড়ো। বাবার হঠাৎ মৃত্যুর পর বাড়িতে রোজগার করার মতো কেউ ছিল না। ভাই বোনেরা পড়াশোনা করছিল। বাবার জায়গায় আমাকে কোম্পানি বহাল করে কারণ বাবার বস বাবাকে খুব শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসতেন। সংসারে অবশ্য আর্থিক অনটন কিছু ছিল না।

আমার মাইনেতে ভালো ভাবেই সংসারটা চলছিল। ভাই বোনের পড়াশুনোও বন্ধ হয়নি। কিন্তু বিয়ে করা সম্ভব ছিল না। বিয়ে করে নিলে বাড়ির অর্থনৈতিক অবস্থা খারাপ হয়ে যেত আর ভাই বোনের কেরিয়ারটাও নষ্ট হয়ে যেত। উলটে অন্য আর একটা বিপদের সম্মুখীন হতে হতো।

একবার একটা ভালো সম্বন্ধ এসেছিল। পাত্রপক্ষকে খুব সাহস করে একটা শর্ত দিয়েছিলাম — বিয়ের পর আমার মাসমাইনের অর্ধেক আমি নিজের বাড়িতে দেব। ব্যস, ওদের আগ্রহ ওখানেই শেষ। এরপর আর ওই শর্ত কারও সামনে রাখার সাহস হয়নি। আমার কাছে আমার ভাই বোন বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল। আমিই ওদের আশা-ভরসা ছিলাম। নিজের জীবন নিয়ে আমি খুব খুশি ছিলাম। ওদের পড়াশোনা শেষ হলে, নিজেদের কেরিয়ারে ওরা প্রতিষ্ঠিত হলে যতটা সম্ভব ধূমধাম করে ওদের বিয়ে দিই। মা-ও বোধহয় ওটার জন্যই বেঁচে ছিলেন। এরপর মা-ও মারা যান।

ভাইয়ের বিয়ের পরেই সমস্যা শুরু হয়। ভাইয়ের বউয়ের আমার মোটা মাইনের অঙ্কটা খুব পছন্দ ছিল কিন্তু আমি ওই একই বাড়িতে থাকি ওটা ওর পছন্দ ছিল না। আমাকে নিয়ে আমার ভাইয়ের সঙ্গেও কথা কাটাকাটি করত। ফলে ভাই-ভাইয়ের বউয়ের মধ্যে যেমন দূরত্ব বাড়ছিল, আমার আর ভাইয়ের মধ্যেও একটা দুর্ভেদ্য দেয়াল উঠতে আরম্ভ করল। বেশ বুঝতে পারছিলাম ওদের জীবনে আমার প্রয়োজন ফুরিয়েছে। এবার সম্মানের সঙ্গে সরে আসাটাই সবার জন্য মঙ্গল। অফিসেও বদলির জন্য দরখাস্ত করি এবং কারণটাও ওদের খুলে বলি। প্রথম বদলি হয় হায়দরাবাদে। এখন কোন শহরে আমার বদলি হল তাতে আমার কিছু যায় আসে না। সব শহরই আমার কাছে সমান।

এখানে পুণাতে এসে আমি মানসিক শান্তিতে রয়েছি। তারপর তোমার সঙ্গে দেখা হয়ে এখন তো আরও ভালো লাগছে। সার্থক, আমি যেন আবার সেই কলেজের দিনগুলোতে ফিরে গেছি।

—অনন্যা, তোমার আত্মত্যাগের কোনও তুলনা হয় না। নিজের পরিবারের ভালোর জন্য এভাবে নিজের সুখ স্যাক্রিফাইস করা খুব সহজ কাজ নয়। তাও প্রথমবার নয়। পরিবারের জন্য নিজে বিয়ে করলে না আবার দ্বিতীয়বার সকলের ভালো চেয়ে নিজের বাড়ি ছেড়েই চলে এলে, যেটা কিনা মেয়েদের কাছে সবথেকে প্রিয় জায়গা। বলতে বলতে সার্থকের গলা অবরুদ্ধ হয়ে এল।

সার্থক অনন্যার জন্য গর্ববোধ করল। ওর মনের মধ্যে অনন্যার প্রতি শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসা অনেকটাই বেড়ে গেল।

—তুমি কখনও কাউকে ভালোবেসেছ? ইতস্তত করে জিজ্ঞেস করল সার্থক।

—জানি না, আমার কাছে দায়িত্ববোধ-টাই এত প্রবল ছিল, ভালোবাসাটা কোনওদিন উপলব্ধিই করতে পারিনি। অনন্যার উত্তর শুনে সার্থকের মনে হল আজও অনন্যা সত্যিকারের ভালোবাসার অপেক্ষায় রয়েছে।

—এখন আর তো কোনও দায়িত্ব নেই, তাহলে কেন বিয়ে করছ না? আপন মনে করেই সার্থক অনন্যাকে প্রশ্নটা করল।

—সত্যি বলব, এক তো বয়স হয়ে গেছে আর দ্বিতীয়ত খোঁজার মতোও তো কাউকে দরকার। হতাশা ভরা ফ্যাকাশে হাসি হাসল অনন্যা!

—৩৪-৩৫ বছর এখনকার দিনে কোনও বয়স নয়।

—দেখি, আমার ভাগ্য আমাকে কোথায় নিয়ে যায়। অনন্যা এই আলোচনা বন্ধ করতে চাইছিল।

—তুমিও তো আমার থেকে মাত্র দু’বছরের সিনিয়র ছিলে, তাহলে তুমিই বা বিয়ে করছ না কেন? অনন্যা পালটা প্রশ্ন করল।

—শুধু ছেলের জন্য। মায়ের ভালোবাসা থেকে ও বঞ্চিত হয়েছে বলে বাবা হয়ে আমি ওকে ভালোবাসা দেব না? বাড়িতে ওর সৎমা নিয়ে এলে সে কেমন মা হবে কে জানে? তার উপর তার নিজের সন্তান হলে, আমার ছেলের খেয়াল সে কি রাখবে? এই প্রশ্নগুলোই আমার মনে ভয়ের উদ্রেক করে, স্পষ্ট উত্তর সার্থকের।

—ছেলে যেদিন কলেজ যাবে তখন না হয় দ্বিতীয় বিয়েটা করা যাবে, বলে সার্থক হেসে ফেলল। দেখাদেখি অনন্যাও হেসে ফেলল।

দেখতে দেখতে অনন্যা দু’টো বছর পুণায় কাটিয়ে ফেলল। সার্থক আর ও এখন খুব ভালো বন্ধু। একসঙ্গে দু’জনে বাইরে ঘুরতে যায় এমনকী সার্থকের সাত বছরের ছেলে কুশলও বেশিরভাগ সময় ওদের সঙ্গে থাকে। অনন্যাকে কুশলও খুব পছন্দ করে। ওকে অ্যান্টি সম্বোধন করে কুশল।

ক্রমশঃ

উদয়ের অস্তাচল (পর্ব ২)

এবার হারান মণ্ডল প্রায় মেঝেতে শুয়ে প্রণাম জানাল অমিয়বাবুকে। বৈদ্যনাথবাবুও সসম্ভ্রমে আরও একবার হাতজোড় করে নমস্কার জানাল। অমিয় আর একটা সিগারেট জ্বালিয়ে ধোঁয়া ছাড়লেন।

—বাবা চেয়েছিলেন আমিও বাবা-ঠাকুরদার মতো প্রজাপালন আর তথাকথিত জমিদারির কাজকর্ম দেখে জীবনটা কাটিয়ে দিই। কিন্তু আমার লক্ষ্য ছিল অন্য। আমি চেয়েছিলাম বলরামপুরের গণ্ডি পেরিয়ে অনেক অনেক দূরের পৃথিবী দেখতে! নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে। সেই কুড়ি বছর বয়সে আমাকে পেয়ে বসেছিল বিশ্বজয়ের নেশা। এই নেশা আমাকে টেনে নিয়ে গেল অনেক অনেক দূরে। একটা স্কলারশিপ পেয়েছিলাম। এক লাফে আরব সাগর পেরিয়ে পৌঁছে গেলাম ইংল্যান্ড! সেই সময় আমাদের যুগের যুবকদের স্বপ্ন ছিল শিক্ষা-দীক্ষা আর উন্নতির শেষ সীমানা— ইংল্যান্ড-লন্ডন।

অমিয় থামলেন। অদ্ভুত একটা হাসিতে মুখ ছেয়ে গেল! বৈদ্যনাথবাবুর মনে হল— অমিয়বাবু বুঝি নিজেকেই ব্যঙ্গ করছেন। কিন্তু মুখ তুলে অমিয়বাবুর গল্প শোনার জন্য চেয়ে রইল। হারানও গাঙ্গুলিবাড়ির বড়ো কর্তার গল্প শুনছিল অবাক হয়ে। একবার শুধু রান্নাঘরে গিয়ে মাছের ঝোলটা নামিয়ে ভাত বসিয়ে এল।

রাতের হাওয়ার স্বরে আবার শুরু করলেন অমিয়নাথ — কুড়ি বছরের বিশ্বজয়ের নেশা আফিমের নেশার চেয়েও জোরালো। ওদেশে পৌঁছে মনে হয়েছিল আমার যোগ্য স্থানে পৌঁছে গেছি। ওই যে ইংরাজিতে বলে না ‘আই হ্যাভ অ্যারাইভড’, অনেকটা সেই রকম। আবার একবার সেই অদ্ভুত হাসিতে অনিন্দ্যসুন্দর মুখখানি ছেয়ে গেল।

অমিয়নাথ চেয়ার ছেড়ে জানলার দিকে এগিয়ে গেলেন। ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি হয়ে চলেছিল তখনও। মাঝে মাঝে দূরে নিঃশব্দ বিদ্যুৎ চমকের আলোয় ওর মুখটা কেমন যেন রহস্যময় দেখাচ্ছিল। মনে হল স্টেশনের কোয়ার্টারের জানালায় দাঁড়িয়ে বৃষ্টিভেজা আকাশ পানে চেয়ে যেন নিজের পুরোনো দিনের স্মৃতির গবাক্ষ উন্মুক্ত করে নিজেকেই দেখছেন অমিয়।

ফিরে এল হারানের ডাকে— ‘মাস্টারবাবু, ভাত হয়ে গেছে, আসুন।’ খাবার ডাকে সম্বিত ফিরে পেলেন বৈদ্যনাথবাবুও অনুভব করলেন চিনচিনে খিদে। ‘আসুন, গরম গরম ভাত আর তাজা রুই মাছের ঝোল’, বলে উঠে পড়লেন।

খেতে বসে বিশেষ কথা হল না। ঠাট্টার ছলেই বৈদ্যনাথবাবু বললেন, ‘আসলে আজ খিচুড়ি আর ইলিশ মাছ ভাজার রাত।”

—ইলিশ মাছ পাওয়া যায় এখন? খেতে খেতে প্রশ্ন করলেন আমিয়।

—পাওয়া যায়, তবে আগের মতো স্বাদ আর নেই। উত্তর দিলেন বৈদ্যনাথবাবু।

খাবার থালা থেকে মুখ তুলে অমিয় বললেন, “ওদেশে, মানে ইংল্যান্ড-এ কিন্তু আসল পদ্মার ইলিশ পাওয়া যায়। সে জিনিস বোধহয় আপনারাও এখানে পান না।’

বৈদ্যনাথবাবু মাথা নাড়লেন, ‘না অত দামি জিনিস খাবার সামর্থ্য কোথায় এখানের লোকের? তাই আসেও না, এখানে পাওয়া যায় কোলাঘাটের ইলিশ। আজকাল তো শুনি পুকুরেও ইলিশের চাষ হচ্ছে।’

—পুকুরে! অবাক হয়ে হাসলেন অমিয়।

ধীরে ধীরে মাথা নাড়লেন বৈদ্যনাথবাবু।

খাবার পরে দু’জনেই তক্তাপোষের উপর পা’তুলে আরাম করে বসলেন। অমিয় পা ছড়িয়ে দেয়ালে হেলান দিয়ে জানলার ধারে বসে একটা সিগারেট ধরালেন। হারান একটা ছোটো বাটি এগিয়ে দিল ছাইদানি হিসাবে।

বাইরে বৃষ্টিঝরা অন্ধকার রাত্রির স্তব্ধতা ভেঙে ভরাট গলায় বলে উঠলেন অমিয়, ‘বৈদ্যনাথবাবু, বলুন তো মানুষের অ্যাচিভমেন্ট কী?’

কী উত্তর দেবেন বৈদ্যনাথবাবু?

উত্তরের অপেক্ষা না করে অমিয়-ই বলে চলল, ‘মানুষের উচ্চাশা মানুষকে কোথা থেকে কোথায় নিয়ে যায়। মানুষকে চাঁদে নামিয়েও তো ফেরত এনেছে। তবুও তার উচ্চাশা থেমে আছে?”

বৈদ্যনাথবাবু সম্মতিসূচক ভাবে ঘাড় নাড়লেন না। উচ্চাশা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। এবার বলছে মঙ্গলে যাবে।

সম্মতিসূচক ঘাড় নেড়ে অমিয় বলল— এ এক অদ্ভুত মরীচিকা। আমি এর পিছনে ঘুরে বেড়িয়েছি ঘণ্টা, দিন, মাস, বছর। ডাক্তার হয়েছিলাম লন্ডনে গিয়ে। বিরাট সার্জেন-মানুষের অসুস্থ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ছুরি দিয়ে কেটে নতুন প্রত্যঙ্গ জুড়ে দিয়েছি। মৃত্যুপথযাত্রীকে মৃত্যু দেবতার হাত থেকে ছিনিয়ে এনে যমকে কাঁচকলা দেখিয়েছি। ইউরোপ, আমেরিকার বড়ো বড়ো হাসপাতালে কাজ করে প্রচুর

নাম-যশ আর অর্থ উপার্জন করেছি। একজন মানুষ পার্থিব সম্পদ বা সুনাম যা কিছু কামনা করতে পারে তার সবকিছু পেয়েছিলাম। এমনকী আমাদের দুনিয়ার সেরা পুরস্কারের জন্যও ‘নমিনেশন’ গেছে শুনে এসেছি।

বৈদ্যনাথবাবু সপ্রশংস দৃষ্টিতে আর একবার অমিয়নাথকে পা-থেকে মাথা পর্যন্ত জরিপ করে নিলেন।

—কিন্তু, এসবের কিছুই থাকে না বৈদ্যনাথবাবু! এমনকী, মনে হয়, কোনও দরকারও ছিল না। এ সত্যটা বুঝলাম অনেক দেরিতে! অমিয়র কণ্ঠে আন্তরিক আক্ষেপ প্রকাশ পেল। আমাদের একমাত্র মেয়ে ফুটফুটে ছোট্ট পরির মতো, পলিন। আমি তাই ওকে এঞ্জেল বলে ডাকতাম। মাত্র তিন দিনের জ্বরে সে আমাদের ছেড়ে চলে গেল!

নরদেহ পর্ব-৩

তাপসকে কড়া ভাষায় কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলেন সিদ্ধার্থ, হঠাৎ তখনই মনের মধ্যে একটা প্রশ্ন জেগে উঠল। আচ্ছা, হরিশ কি তাপসের নাম দিয়ে নিজের কোনও প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে চাইল তাঁর কাছে? পর্যবেক্ষণ করে দেখল সিদ্ধার্থের প্রতিক্রিয়া? কী মারাত্মক! সেজন্যই কি বারবার বলত ফিরে এলে এটা করবে, সেটা করবে। সেসব কি এই সম্পর্কিত অনুসন্ধান? মৃত্যুর কাছাকাছি পৌঁছে অনুসন্ধান করার সময় না থাকাতে তাপসকে সামনে রেখে প্রশ্নটা করে বসেছিল? কাপুরুষ! এতই যখন সন্দেহ তখন নিজে সরাসরি প্রশ্ন করে জেনে নিতে পারতিস। এই ভনিতার কী দরকার ছিল?

শ্রাদ্ধ হয়ে গেল হরিশের। কঠোর নিয়মে বাঁধা লকডাউন-শ্রাদ্ধ৷ গোনা গুনতি লোক নিয়ে কোনওরকমে পারলৌকিক ক্রিয়া সম্পন্ন করা, আড়ম্বরহীন, আতিশয্যহীন। সিদ্ধার্থের মনে হল, এটাই যথার্থ। আত্মার মুক্তি কামনায় করণীয় বিধি এমনই তো হওয়া উচিত। সবকিছুতেই আড়ম্বর যুক্ত করে দেওয়ার প্রক্রিয়া বড়ো অদ্ভুত। কিছু কিছু জিনিস অন্তরের অন্তঃস্থলে বসে সমাধা করতে হয়, প্রকৃতির সংযোগে হয় না। মুশকিল হল, অন্তরের ঘরটাকে দেখেই বা ক’জন, চেনেই বা ক’জন! চর্মচক্ষু যা দেখে তার বাইরে যেন আর কিছুই নেই।

হরিশ আর নেই। ওঁর অনুরোধ রক্ষা করার দায়ও আর নেই। এখন ওঁর নির্দেশ পালন করাই বেশি যুক্তিযুক্ত। সিদ্ধার্থ মনে মনে ঠিক করলেন, এবার বন্ধ করবেন আসা যাওয়ার অভ্যাস। কী কারণে আর যাবেন? এমনও তো হতে পারে, হরিশের কথাই ঠিক। তাপস মনে মনে সত্যি সত্যি এমন একটা নোংরা ধারণা পোষণ করে। এতদিন বলেনি সামনাসামনি কিন্তু এবার বলবে। কারণ হরিশের ঢাল আর নেই।

চারদিনের মাথায় ডাক পড়ল সিদ্ধার্থের। অপমান করার নিমন্ত্রণ? না গিয়েও উপায় নেই। ডাকার পর না গেলে অন্যভাবে নিতে পারে। হরিশ ওদের মনে এমন ভাবে গেঁথে দিয়ে গিয়েছে তাঁকে, এখন সিদ্ধার্থের মাঝে হরিশকে দেখবে ওরা। অন্তত যাদের মনে নোংরা কিছু নেই।

তাপস আলাদা করে ডেকে বলল, ‘আপনি তো আমাদের পরিবারের সবই জানেন। আসল কথাটা একবারেই বলি। তপন, নীপা ওরা সবাই বলছে, বাবা যখন নেই তখন সম্পত্তির একটা বন্দোবস্ত করে ফেলাই ভালো। আমি বড়ো ভাই হিসাবে ভেবে দেখলাম, সেটাই ভালো, ওদের প্রাপ্য বুঝিয়ে দিলে আমারও শাস্তি। তাই ডেকেছি আপনাকে।”

“আমি কেন? আমি কে? না না তোদের পৈতৃক সম্পত্তি ভাগবাটোয়ারা করবি, সেখানে আমার থাকাটা শোভন দেখায় না। তোরা ঠিক করে নে। তাছাড়া তোর মা তো এখনও বেঁচে আছেন।’

“ওখানেই তো সমস্যা। আমি একচোট আলোচনা করেছি ওদের সঙ্গে। সম্পত্তির ভাগ নেবে সবাই অথচ মায়ের কী হবে, সে বিষয়ে এড়িয়ে যাচ্ছে। আমি প্রস্তাব দিয়েছিলাম, আমরা সবাই মিলে রোটেশন করে মাকে রাখব। চার মাস বা এক মাস করে করে। কিন্তু তাতেও রাজি নয়। এ বলে ব্যাবসার সমস্যা, ও বলে কাজের লোকের সমস্যা নানা অজুহাত। আমি তো ওদের চিনি, একবার ভাগবাটোয়ারা হয়ে গেলে আর টিকিও খুঁজে পাওয়া যাবে না ওদের।’

খানিক চুপ করে থেকে সিদ্ধার্থ বললেন, ‘মায়ের একটা সঠিক বন্দোবস্ত না করে ভাগ বাটোয়ারা করার প্রশ্ন আসে না। তাঁর মতামত নিয়েছিস কিছু, নাকি তিনি সরল মানুষ বলে নিজেরাই সব ডিসিশন নিচ্ছিস? তাঁর ইচ্ছে অনিচ্ছেটাও তো জানা দরকার। তোরা এমন করছিস যেন সে অনাথ শিশু, তাঁকে নিয়ে যা খুশি তাই করা যায়।”

“মায়ের কোনও মতামত নেই। তাঁর বক্তব্য, তোরা যেটা ভালো বুঝিস তাই করবি। ওরা আমার ওপর দায় চাপাতে চায় কাকু। সেটা কি সম্ভব, নাকি নায্য, আপনিই বলুন? অপর্ণা বলছিল আপনিই পারেন এর সমাধান করতে। আমিও জানি মায়ের প্রতি আপনার একটা দায়িত্ব বোধ আছে, যেটা আপনি কোনওদিনই এড়িয়ে যেতে পারবেন না।’

হঠাৎ কথা হারিয়ে ফেললেন সিদ্ধার্থ। তবে কি হরিশের কথাই ঠিক? সেই সত্যেরই ইঙ্গিত দিল তাপস?

ইচ্ছে না থাকলেও বসতে হল সিদ্ধার্থকে। হরিশের সবচেয়ে বড়ো গুণ ভীষণ গোছানো টাইপের মানুষ ছিলেন। জীবনে রোজগারও করেছেন অনেক। কে কী পাবে না পাবে তার একটা ইঙ্গিতও দিয়ে গিয়েছেন। সম্পত্তি নিয়ে বিবাদ সেরকম না হলেও সমস্যা হল মায়ের প্রশ্নেই।

প্রতিধ্বনি ফেরে (পর্ব ১ )

দীর্ঘ পনেরো বছর দাম্পত্য জীবন কাটালেও ধ্রুবর সঙ্গে নম্রতার মনের সখ্যতা কোনওদিনই গড়ে ওঠেনি। এতগুলো বছরে গড়ে ওঠার সম্ভবনাও তেমন ছিল না। ধ্রুব এবং নম্রতার অবস্থান দুই বিপরীত মেরুতে। একটা প্রচলিত কথা আছে বিপরীত মেরু পরস্পরকে আকর্ষণ করে। এখানে আকর্ষণের সব রাস্তাই বিয়ে দিন থেকেই নম্রতা রুদ্ধ করে রেখেছিল। দুটো ভিন্ন মানুষের মধ্যে ক্রমাগত দূরত্ব বিকর্ষণের পথকে প্রশস্ত করে তোলে। এক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি।

বিয়ে তিন বছর পর নম্রতার কোল আলো করে এক ফুটফুটে কন্যাসন্তানের জন্ম হয়। ধ্রুবর স্নেহকাতর পিতৃহৃদয় কন্যার মুখ দেখে, স্ত্রী নম্রতার প্রতি অনেকখানি কোমল হয়েছিল। অনেক আশা করে ধ্রুব কন্যার নাম রেখেছিল আশা। তার আশা ছিল মেয়ে আশাই পারবে তাদের স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ককে স্বাভাবিক করতে। কিন্তু নম্রতা সে আশা পূরণের চেষ্টাটুকু করেনি। তবে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে যতই মনোমালিন্য এবং অমিল থাকুক, মেয়ে আশাকে দুজনেই প্রাণাধিক ভালোবাসত। আশা এই বছর এগারোয় পা দিল।

ধ্রুবর সঙ্গে নম্রতার স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক মধুর না হওয়ার কারণে বিয়ে পর দুজনের কোথাও ঘুরে বেড়ানো বা সময় কাটানোর সুযোগ হয়নি। এমনকী দুজনের তরফ থেকে আত্মীয়স্বজনের বাড়ি নিমন্ত্রণ থাকলেও কৌশলে তারা এড়িয়ে গেছে। ধ্রুব অবশ্য বিয়ে কয়েক সপ্তাহ পর নম্রতাকে নিয়ে অরুণাচল প্রদেশে হনিমুনে যাবে বলে স্থির করে। সে ঠিক করে যে, নম্রতাকে না জানিয়ে সারপ্রাইজ দেবে। ফ্লাইটের টিকিট বুক থেকে হোটেল বুক সব হয়ে যাবার পর নম্রতার দৃঢ় অনিচ্ছায় তার কোনও আশাই পূরণ হয়নি। স্ত্রীর এই আচরণে ধ্রুব কষ্ট পায়। ফলে পরবর্তীকালে নম্রতার কাছে ভুলেও কোথাও বেড়াতে যাবার ইচ্ছা প্রকাশ করেনি।

ধ্রুব থেমে গেলেও এগারো বছরের মেয়ে আশা থামার পাত্রী নয়। আশা ক্লাস সিক্স-এ পড়ে। স্কুলের বড়োদিনের ছুটিতে তার বায়না স্কুলের অন্যসব বন্ধুদের মতো সেও বাবা মা-র সঙ্গে বেড়াতে যাবে। ধ্রুব বেড়াতে যাবার জন্য এক পায়ে খাড়া। ব্যক্তিগত ভাবে বেড়াতে যেতে তার খুব ভালো লাগে। নম্রতার জন্য তার সেই ভালোলাগাকে সরিয়ে রাখতে হয়েছে। স্ত্রী তাকে ভালোবাসে না জেনেও সে আপ্রাণ চেষ্টা করতে থাকে নম্রতার ভালোবাসা পাওয়ার। বুকের সুপ্ত কোণে ধ্রুব নম্রতার প্রতি ভালোবাসাকে জিইয়ে রেখে দুহাত বাড়িয়ে অপেক্ষা করতে থাকে। স্ত্রীর সঙ্গে এত মনোমালিন্য, এত অমিল, এত ঔদাসীন্য তবুও দিনের শেষে নম্রতার স্বামীর পরিচয়ে ধ্রুব বাঁচতে চায়। এই পরিচয়টুকুতেই সে খুব খুশি। তার মনের গভীরে জোরালো বিশ্বাস যে, নম্রতা তার ভালোবাসা একদিন ঠিকই বুঝবে। ধ্রুব ভাবে, আজ এতগুলো দিন পর মেয়ে আশা একটা সুযোগ এনে দিয়েছে নম্রতাকে কাছে পাবার। এই সুযোগ হাতছাড়া করা যাবে না। আশা তো হাজার হোক নম্রতার মেয়ে সে তার মায়ের মতোই জেদী। যেটা সে একবার মুখে বলে সেটা না করে তার শান্তি নেই।

ধ্রুব তাই মেয়ে বেড়াতে যাবার প্রস্তাবে পূর্ণ সমর্থন জানায়। বাবার মত পেয়ে আশাও বেশ খুশি। কিন্তু সে জানে বাবা রাজি হলেও মাকে রাজি করানো তার পক্ষে বেশ কঠিন। তবু ভালোবাসা মানুষের জীবনে একটা দুর্বল জায়গা। সেই ভালোবাসার জোরেই আশা সন্ধেবেলায় নম্রতার কোল ঘেঁষে বসে হঠাৎ বলে বসল, মাম্মা, আমি তোমার সবকিছু! তুমি আমার জন্য সব করতে পারবে?

নম্রতা মেয়ে অন্য সুরে কথা শুনে বলল, কী ব্যাপার! এসব কথা বলছ হঠাৎ! যতটুকু আমার পক্ষে তোমার জন্য করা সম্ভব নিশ্চয়ই করব।

আশা একটু ঢোক গিলে আবদারের গলায় নম্রতাকে বলল, মাম্মা, আমার স্কুলে বড়োদিনের ছুটি পড়েছে। স্কুলের প্রায় সব বন্ধুরা ঘুরতে যাচ্ছে। আমিও বেড়াতে যাব। তোমরা দুজন কখনও কোথাও আমাকে নিয়ে যাওনি। প্লিজ মাম্মা, কোথাও চলো না। আমরা কদিনের জন্য ঘুরে আসি। পাপা রাজি।

নম্রতা শান্তস্বরে বলল, তোমাকে যেমন কোথাও ঘুরতে নিয়ে যাইনি, তেমনি আমরাও তো কোথাও ঘুরতে যাইনি। পাপা যখন রাজি তখন পাপার সঙ্গেই ঘুরে এসো। তুমি জানো যে আমার বেড়াতে ভালোলাগে না।

নম্রতার কথা শুনে আশা হতাশ হয়ে বলল, ঠিক আছে। তুমি না গেলে আমিও যাব না। সে মায়ের কোল ছেড়ে মলিন মুখে বলল, মাম্মা, আসি। আমার কার্টুন শো টম অ্যান্ড জেরি শুরু হয়ে যাবে। আশার অভিমানী মুখ দেখে সুর নরম করে স্মিত হেসে নম্রতা বলল, রাগ হল বুঝি আমার কথায়! আমি তো জাস্ট মজা করছিলাম। দেখছিলাম যে আমার মেয়ে আমাকে ফেলে কোথাও চলে যায় কিনা। আমি যাব ঘুরতে তোমাকে নিয়ে এবার খুশি তো!

নম্রতার কথা শুনে খুশিতে আত্মহারা হয়ে আশা তার কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ল। আশাকে জড়িয়ে ধরে নম্রতা তার কপালে মাথায় চুমু খেল। একটু ধরা গলায় সে বলল, তুমি আমার সন্তান। সন্তানের জন্য মায়েরা অনেক কিছু পারে। অনেক কিছু পারতে হয়।

ধ্রুব দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে নম্রতার দিকে গভীর বিস্ময়ে তাকিয়ে ছিল। ভিতরে মা-মেয়ে সব কথাই তার কানে এসেছিল। এই চিরন্তন দৃশ্য দেখে সে ভিতরে না এসে পারল না। নম্রতার উদ্দেশ্যে বলল, নম্রতা, তোমার এই সিদ্ধান্তের জন্য থ্যাংক ইউ। আমি সিকিম যাওয়ার সব ব্যবস্থা করছি। পরশু আমরা বেরোব। ধ্রুবর কথায় নম্রতার কোনও প্রতিক্রিয়া দেখা গেল না।

আশা মায়ের কোল ছেড়ে বাবার কোলে উঠে বলল, পাপা, আমরাও একসঙ্গে বেড়াতে যাব। কী মজা হবে।

নম্রতাও বিছানা ছেড়ে ঘরের বাইরে যাবার জন্য পা বাড়াতেই ধ্রুব তার হাতটা টেনে ধরল। হ্যাঁচকা টানে নম্রতা ধ্রুবর বুকের কাছাকাছি চলে এল। ফ্যানের হাওয়ায় নম্রতার ঠোঁটের কাছে আসা চুলগুলো আলতো হাতে সরিয়ে ধ্রুব বলল, তুমি আমাকে যতই এড়িয়ে যাও ততই আমি তোমাকে বেশি করে ভালোবেসে ফেলি। নম্রতা তুমি আমার স্ত্রী। তুমি কি বোঝো না, আমি তোমাকে কতটা ভালোবাসি? আমার জন্য না হোক আমার মেয়ে জন্য যে তুমি কিছু সময় আমার সঙ্গে কাটাবে এতেই আমার বুকের ভিতর কী হচ্ছে তোমাকে কী করে বলব।

ধ্রুবর স্পর্শ নম্রতার কাছে এক অচেনা মানুষের মতো। তার স্পর্শে নম্রতার শরীর মন সব সংকুচিত হয়ে আসে। আশা হবার পর ধ্রুব এই প্রথম তাকে স্পর্শ করল। নম্রতা নিরুত্তাপ গলায় বলল, আমার হাতটা ছাড়ো। আশার জন্য বেড়াতে যেতে রাজি হয়েছি ঠিকই। তুমি আমার এই বেড়াতে যাওয়াতে খুব খুশি। কিন্তু আমাকে ঘিরে তোমার বাড়াবাড়ি না দেখলে আমি বেশি খুশি হব।

নম্রতা ধ্রুবর হাত থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে বাইরে বেরিয়ে গেল। ধ্রুব মনে মনে একটু হেসে শূন্য ঘরে দাঁড়িয়ে বলল, তুমি আর কতদিন আমার থেকে দূরে থাকবে! একদিন আমার ভালোবাসাই তোমাকে ভালোবাসতে বাধ্য করবে।

মুখোশ (দ্বিতীয় পর্ব)

কয়েক ঘন্টা পর সমর এসে ওকে বাড়ি নিয়ে গেল। বাড়ি পৌঁছোবার পর সন্ধেবেলায় সমর সঞ্চিতাকে শুধু এটুকুই বলল যে, ও এখন বাচ্চার দায়িত্ব নিতে মানসিক ভাবে প্রস্তুত নয়। ওর এখন অনেক কাজ বাকি রয়েছে। ও যদি সঞ্চিতাকে গর্ভপাত করাবার কথা বলত, তাহলে হয়তো ও রাজি হতো না। তাই বাধ্য হয়ে সমরকে এই ব্যবস্থা নিতে হয়েছে।

সবকিছু শোনার পর নিজের মনে গুমরে মরা ছাড়া অন্য কোনও রাস্তা ওর কাছে খোলা নেই— সেটা খুব ভালো করেই বুঝে নিয়েছিল সঞ্চিতা। সমরের সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করে দিল। এতদিন সমরের প্রতি যে-সম্মান, ভালোবাসা সঞ্চিতার হৃদয়কে ঘিরে রেখেছিল— সেখানে জায়গা হল ঘৃণা, তিরস্কারের। কিন্তু বিদেশ-বিভুঁইয়ে থেকে সমরের বিরুদ্ধতা করা উচিত মনে করল না সঞ্চিতা। কারণ এখানে ও কাউকেই চেনে না, যে ওর পক্ষ নেবে। এখানে না কোনও বন্ধু, আত্মীয়স্বজন বা চেনা-পরিচিত— কার সঙ্গে ও মনের দুঃখ শেয়ার করবে?

একদিন দুপুরে বনানী পিসির ফোন এল সঞ্চিতার কাছে। পিসির কাছ থেকেই সঞ্চিতা জানতে পারল— গত পনেরো দিনে সমর বনানী পিসিকে তিনবার ফোন করেছে। প্রতিবারই নাকি পঁচিশ লক্ষ টাকা বনানীকে পাঠাতে বলেছে সমর ওর আমেরিকার অ্যাকাউন্টে। ও পিসিকে বলেছে, ও চাকরি ছেড়ে দিয়েছে এবং এই টাকা দিয়ে নিজের ব্যাবসা শুরু করবে। তাই টাকাটা ওর খুব প্রয়োজন।

সমরের হাবভাবে বনানীর সন্দেহ হওয়াতে সঞ্চিতাকে ফোন করে তিনি নিশ্চিত হতে চাইছিলেন। কিন্তু এ ব্যাপারে সঞ্চিতা কিছু জানতই না বরং মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে সঞ্চিতার গর্ভপাত ঘটানোর কথা সঞ্চিতা পিসিকে জানালে— বনানী সমরের ব্যবহারে মানসিক ভাবে খুবই মুষড়ে পড়লেন।

সঞ্চিতা সমরকে ভয় পেতে আরম্ভ করল। সমর সম্পর্কে সমস্ত সত্যটা ধীরে ধীরে সঞ্চিতার সামনে আসতে আরম্ভ করল। বিদেশে সমরের শত্রুতা করার সাহস ছিল না সঞ্চিতার— আর দেশে মা-বাবাকে জানিয়ে তাদের চিন্তিত করে তুলতে কিছুতেই মন চাইছিল না তার।

বাড়িতেও আর সময় কাটছিল না সঞ্চিতার। ভাগ্যের কাছে পরাজিত সঞ্চিতা একদিন বসে খবরের কাগজের পাতা ওলটাচ্ছিল। পত্রিকাটি আমেরিকার হলেও আমেরিকায় বসবাসকারী ভারতীয়দের জন্যই মূলতঃ পত্রিকাটি বার হতো। একটা খবরের দিকে দৃষ্টি পড়তে সঞ্চিতার চোখ সেখানে আটকে গেল।

প্রণতি নামের একজন ক্রাইম রিপোর্টার কীভাবে নিজের সাহস এবং বুদ্ধির জোরে একটি বড়ো সেক্স র‌্যাকেটের পর্দা ফাঁস করেছে। ভারত ও পাকিস্তানের বেশ কিছু প্রতিপত্তিশালী ব্যক্তি, যারা এর সঙ্গে জড়িত ছিল, প্রমাণ-সহ আইনের চোখে তাদের সে দোষী সাব্যস্ত করে ছেড়েছে— তার সম্পূর্ণ বিস্তারিত খবর ‘দ্য ট্রুথ’ পত্রিকায় ছাপা হয়েছে।

খবরটা তিন-চারবার পড়ল সঞ্চিতা। আশার একটা আলো দেখতে পেল সে। সঙ্গে সঙ্গে পত্রিকাটির দফতরে ফোন করে প্রণতির ঠিকানা এবং ফোন নম্বর সংগ্রহ করল সে। প্রণতিকে ফোন করে একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিল সঞ্চিতা। কথায় কথায় জানতে পারল প্রণতি ওর স্কুলেরই মেয়ে ওর থেকে দুবছরের সিনিয়র ছিল। তার বাবা চাকরি নিয়ে আমেরিকা চলে আসাতে ওদের পরিবার আমেরিকায় পাকাপাকি ভাবে থেকে গেছে।

প্রণতি নিজের বাড়িতেই আসতে বলল সঞ্চিতাকে। আমেরিকাতেও সঞ্চিতার নিজের বলতে কেউ আছে, এটা ভেবেই সঞ্চিতার মন অনেকটা হালকা বোধ হল। প্রণতির সঙ্গে দেখা করে ওর সঙ্গে যা যা ঘটেছে সব খুলে বলল। এমনকী পিসির কাছে পঁচিশ লক্ষ টাকা সমর চেয়েছে, এটা জানাতেও ভুলল না।

প্রণতিও মন দিয়ে সব শুনল। প্রায় দুঘন্টা ধরে ওদের কথাবার্তা চলল। প্রণতি কথা দিল, ও সমর সম্পর্কে সবকিছু অনুসন্ধান করে সঞ্চিতার সঙ্গে যোগাযোগ করবে। নিশ্চিন্ত মনে সঞ্চিতা বাড়ি ফিরে এল।

সেদিন সারারাত সমর বাড়ি ফিরল না। ওর জন্য অপেক্ষা করতে করতে, সঞ্চিতার কখন তন্দ্রা এসে গিয়েছিল ও নিজেই বুঝতে পারেনি। বহুবার ফোন করার পরেও কোনও রিপ্লাই না আসাতে, সঞ্চিতাও খোঁজ করা বৃথা চেষ্টা, ভেবে হাল ছেড়ে দিল। পরের দিন দুপুরে সমর বাড়ি ফিরল। ও কোথায় ছিল জিজ্ঞেস করাতে উত্তর দিল না। এক সপ্তাহর বেশি সময় পেরিয়ে গেল। রাতে বাড়ি না ফেরাটা প্রায়শই হতে লাগল সমরের। ফেরার কোনও ঠিক থাকত না। একবার টানা দুই রাত বাড়ি ফিরল না। জিজ্ঞেস করাও ছেড়ে দিল সঞ্চিতা।

পরের সপ্তাহের শেষের দিকে প্রণতির ফোন এল দেখা করার জন্য। তার আগের রাতেও সমর বাড়ি ফিরল না। সকালে উঠে চা খেয়ে সঞ্চিতা তৈরি হয়ে নিল। ওর অনুপস্থিতিতে সমর বাড়ি ফিরতে পারে, এই ভেবে একটা কাগজে মার্কেট যাচ্ছে লিখে খাবার টেবিলে চাপা দিয়ে রাখল।

প্রণতির বাড়ি পৌঁছোতেই প্রণতি ওকে বসার ঘরে আসার জন্য বলল। সঞ্চিতা সোফায় এসে বসলে প্রণতি বলতে শুরু করল, সঞ্চিতা তুমি আমাকে সমরের অফিস এবং ওর সম্পর্কে যা যা প্রয়োজনীয় তথ্য জানিয়েছিলে, সেই মতন আমি খোঁজখবর নেওয়া শুরু করে দিয়েছিলাম। ও একটা খুনের কেসে জড়িয়ে গেছে। গতকাল পুলিশ ওর ডেরায় পৌঁছে ওকে অ্যারেস্ট করেছে। এই কয়েকদিন ও পালিয়ে বেড়াচ্ছিল, তাই রাতে বাড়ি ফিরত না। ও এখন পুলিশের লক-আপে রয়েছে।

দ্বিতীয়ত ও চাকরি ছাড়েনি বরং কোম্পানি ওকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করেছে। ও অফিসে ভারতীয় মুদ্রায় পঁচিশ লক্ষ টাকা তছরুপ করেছে। বনানী পিসিকেও মিথ্যা বলেছিল। উনি সমরের অ্যাকাউন্টে টাকা পাঠাতেই ওই টাকা তুলে ও কোম্পানিকে দিয়ে আইনি সাজা পাওয়ার হাত থেকে রেহাই পেয়েছে।

 

পিরামিড (শেষপর্ব)

মাস তিন আরও পেরিয়ে গেল। রূপার মায়ের গর্ভের সেই অপত্যস্নেহের প্রাণ এই তিনমাসে আরও তিনমাস বড়ো হয়ে গেছে। রূপার মাকে এখন দেখলে বোঝা যায়। সেদিনের ঘটনার পর রূপার ব্যবহার জটিল থেকে যৌগিক হয়ে উঠল।

রূপার বাবা-মা ডাক্তারের কাছে গিয়ে ওয়াশের ব্যাপারে আলোচনা করেছিল। রূপার কথাও বলেছিল। কিন্তু ডাক্তারবাবু সবকিছু পরীক্ষা করে বললেন, আপনাদের এইরকম পরিকল্পনা থাকলে আরও আগে ভাবতে হতো। এখন ব্যাপারটা রিস্কি হয়ে যাবে। এমনকী ম্যাডামের কিছু ভালো-মন্দ হয়ে যেতে পারে। তার থেকে মেয়ের সঙ্গে আবার কথা বলুন, বোঝান।

বাড়ি ফিরে রূপাকে কিছু বোঝানোর চেষ্টা করেও লাভ হয়নি। বরং দিন দিন রূপা তার নিজস্ব পৃথিবীর মধ্যে নিজেকে আরও বেশি করে পেঁচিয়ে রাখতে আরম্ভ করে। প্রযোজন ছাড়া বাবা মায়ের সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করে দেয়। লাঞ্চ তো একা খেতই, ডিনার নিয়ে নিজের ঘরে চলে যেতে আরম্ভ করল। বাবা-মায়ের প্রশ্নের কোনও উত্তর দিত না। স্কুল বা টিউশন থেকে দেরি করে বাড়ি ফিরতে আরম্ভ করল। কিছু জিজ্ঞেস করলেই বেশির ভাগ সময়ে এড়িয়ে চলে যেত, অথবা চিল্লিয়ে বলত, তোমাদের কী?

একটা ছেলের সঙ্গে ঘোরাঘুরির কথাও কানে এল। কিন্তু রূপাকে কিছু বলতে সাহস হয় না। একদিন রাত্রি নটার সময় বাবা বাড়ির সামনে একটা ছেলের বাইক থেকে রূপাকে নামতে দেখে। বাড়ি ফিরলে ছেলেটার ব্যাপারে প্রশ্ন করতে খুব বাজে ভাবে উত্তর দেয়, ইজ ইট ইযোর বিজনেস?

মা শুয়ে শুয়ে চেল্লাতে আরম্ভ করে, এর মানে! আমরা জিজ্ঞেস করব না তো কে করবে?

বাবা শান্ত করে বলে, ডাক্তার তোমায় উত্তেজিত হতে বারণ করেছে, শান্ত থাকো। আমি ওর সঙ্গে কথা বলছি। তারপর খুব শান্ত ভাবেই ছেলেটার কথা আবার জিজ্ঞেস করতে রূপা জবাব দেয়, ও চাঙ্কি, আমার টাইম পার্টনার, এনি প্রবলেম?

তবে ব্যাঙ্কের ব্যালান্স শূন্যের দিকে গেলে বাবার কাছে এসে গম্ভীর গলায় বলে, বাবা আমাকে কিছু ফান্ড ট্রান্সফার করে দেবে তো।

বাড়িতে টুকটাক কাজ করবার জন্যে আলপনা মাসি ছাড়াও রান্নার জন্যে আরকজন এসেছে। খিদে পেলে তাদের কাউকে বলে টিফিন থেকে আরম্ভ করে বাকি সব নিয়ে নেয়।

মা কিন্তু এখন এক্কেবারে শয্যাশাযী। ডাক্তার বলেছেন, বেশি বয়সের তো, বেশ কমপ্লিকেটেড প্রেগন্যান্সি। রেস্ট না নিলে রিস্ক হতে পারে।

রূপা কিন্তু কোনওদিন মায়ের ঘরে ঢুকে জিজ্ঞেস করে না, কেমন আছো? সাধের দিন পিসি আর দূর সম্পর্কের মাসি মামিরা এলেও রূপা স্কুল চলে যায়। এমনকী আগের রাতে মাকে শুনিয়ে শুনিয়ে ফোনে বলে, তাহলে কাল টিউশন থেকে ফেরার সময় পার্টি হবে।

আরও মাস দেড় পরে একরাতে দরজাতে বাবার জোরে জোরে ধাক্কা মারবার আওয়াজে রূপার ঘুম ভেঙে যায়। বাইরে বাবার গলার আওয়াজ পায়, মাম্পি তোর মায়ের শরীর খারাপ, তুই দরজা খোল।

একবার দুবার তিনবার। রূপা কিন্তু দরজা খোলে না। শুধু ভিতর থেকেই জোরে বলে ওঠে, শরীর খারাপ তো আমি কী করব? তোমাদের ব্যাপার, তোমরা বোঝো।

মিনিট পনেরো পরে একটা গাড়ির আওয়াজ পাওয়া যায়। ঘরের ভিতরে আরও কয়েকজন মানুষের উপস্থিতিও বোঝা যায়। আস্তে, একটু নামাও। এইসব কয়েকটা কথাও কানে আসে। আরও কিছু সময় পরে আবার বাবার গলা পায়।

—মাম্পি, তোর মাকে নিয়ে হাসপাতাল যাচ্ছি। আলপনা থাকল, পারলে সকালে আসবি।

রূপা কিন্তু তার পরের দিন হাসপাতালে যায়নি। সকালে উঠেই টিউশন চলে গেল। বাড়ি ফিরে তাকে আরও গুম হয়ে থাকতে হল। ঘরভর্তি লোকজন। ঢুকতেই প্রশ্ন, তোর মা কেমন আছে জানিস? সে কী রে?

তারপরেও হাজারটা অপ্রাসঙ্গিক কথাবার্তা। রূপা কোনওরকমে সবাইকে এড়িয়ে নিজের ঘরে ঢুকেই দরজা বন্ধ করে দেয়। কিছুসময় পরে দরজাতে টোকা দেওয়ার আওয়াজ শুনে দরজা খুললে, পিসি ঘরের ভিতরে এসেই বলে উঠল, পড়তে গেছিলি?

—হ্যাঁ।

—তোদের রান্নার মেয়েটা বলল সাড়ে আটটার মধ্যে চলে আসবে। তোর জন্যেই অপেক্ষা করছিলাম।

—কেন?

—তোর মাকে দেখতে যাবি না?

—তোমরা যাচ্ছ তো।

—তোর মায়ের এখনও জ্ঞান ফেরেনি।

—ও।

—ও মানে! ডাক্তার বলেছে ক্রিটিক্যাল স্টেজ।

কিছু সময় চুপ থেকে রূপার কাঁধে হাত রেখে বলল, কাল ওটিতে ঢোকানোর সময়ে ওই ব্যথার মধ্যেও তোর নাম ধরে ডাকছিল। দাদাকে বলে, তুমি বাড়ি যাও, মাম্পি একা আছে। কথাগুলো বলে বেরিয়ে যাবার সময় দরজাতে হাত রেখে বলে উঠল, তোর বোনটাও বাঁচেনি।

নিজের ঘরে এই প্রথম রূপা নিজে খুব একা হয়ে উঠল। খোলা জানলা দিয়ে বাইরের হাওয়া ঢুকলেও তার গরম লাগছিল। ব্যাগটা কিছুসময় আগেই বিছানাতে রেখেছিল। এবার নিজের শরীরটাকেও বিছানাতে জড় পদার্থের মতো ফেলে রাখল। মায়ের যদি কিছু হয়ে যায়…

মোবাইলে হিন্দি গান বেজে উঠল। একবার, দুইবার তিনবারের বার মোবাইলে চোখ রাখল। স্ক্রিনে চাঙ্কির ছবি দেখা যাচ্ছে।

—বল।

—বাড়িতে কেউ নেই তো, স্কুলে আসবি?

—কেন?

—আমারও বাড়ি ফাঁকা।

—একটু ব্যস্ত, পরে কল করব।

ফোনটা কেটে বিছানাতে মুখ নীচু করে কিছুসময় শুয়ে থাকল রূপা। পিসির কথাগুলো কানে বাজছে। কিছুসময় পরেই বিছানাতে উঠে বসল। বাইরে একটা আওয়াজ আসছে। সবাই বেরোচ্ছে। রূপা ফোনটা সাইলেন্ট করে জোরে বলে উঠল, পিসি… তোমরা কখন যাবে? আমি রেডি।

 

 

পিছুটান

দেখতে দেখতে বেশ কিছুদিন হয়ে গেল এখানে। চুপচাপ নিস্তরঙ্গ এই ছোট্ট জনপদটা বেশ লাগছে আমার। সবুজে ঘেরা চারপাশ। আকাশ এখানে দিনে নীল, রাতে ঘন কালো। আর যখন সেই ঘন কালো আকাশ জুড়ে সলমাজরির ফুলকারি কাজের মতো ঝিকিমিকি তারা দেখি, আমার ছেলেবেলার কথা মনে পড়ে যায়। ছেলেবেলায় ছোটোকাকু মাঝেমাঝে আমায় এমন রাতে ছাদে নিয়ে যেত তারা চেনাতে। সপ্তর্ষিমণ্ডল, শুকতারা, ধ্রুবতারা…

এখানে এসে আবার আমার তারাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব হচ্ছে। আকাশ, গাছ, পাখি, কাঠবিড়ালি— সবার সঙ্গে চেনাজানা বাড়ছে। শহরে তো শুধু ইট-কাঠ-কংক্রিট আর ব্যস্ত দৌড়ে বেড়ানো মানুষের ভিড়।

আমি খুবই সাধারণ মধ্যমেধার একজন মানুষ। কী পড়শোনা, কী অন্যকিছু, কোনও কিছুতেই তেমন ছাপ ফেলার মতো কিছু করতে পারিনি আজ অবধি। আমি যাকে বলে একটা এলেবেলে, ভিড়ে মিশে থাকা মনিষ্যি. যার ওই একটা নামই আছে শুধু।

বাবা-মা গত হয়েছেন, বোন তার সংসার নিয়ে নাজেহাল। চারপাশে সবাই কমবেশি ব্যস্ত, শুধু আমারই অখণ্ড অবসর। পৈত্রিক বাড়ির একটা অংশের ভাড়া আর বাবার রেখে যাওয়া কিছু টাকায় আমার চলেই যেত ঠিকঠাক। আসলে কোনও কাজই খুব বেশিদিন আমার ভালো লাগত না, একঘেয়ে লাগত। তাই কখনও কাজ আমায় ছাড়ত কখনও আমি কাজকে।

বন্ধুবান্ধব সবাই যে যার মতো নিজের জীবনে শিকড় গেড়ে বসেছে। তাদের কত গল্প! বউয়ে টকঝাল খুনসুটি, সন্তানের স্কুল, পরীক্ষা, ভবিষ্যৎ। নিজেদের পরকীয়া, অবদমিত যৌনতা, সুগার, প্রেশার, আমাশা, ফ্ল্যাটের ইএমআই, গাড়ির মাইলেজ, বসের শয়তানি, বকেয়া ডিএ। ওদের কত্ত বিষয় আলোচনার, যেগুলো আমার কিচ্ছু নেই। তাই ধীরে ধীরে একসময় ওদের থেকে আলাদা হয়ে গেলাম। ওরা ওদের মতো আর আমি আমার মতো, একা।

তবে কি, একা থাকতে থাকতে একটা সময় বেশ ক্লান্ত লাগত। মাঝেমাঝেই মনে হতো একটা সংসার থাকলে বেশ হতো। একটা মিষ্টি মতো বউ। যার পরনে ঢাকাই শাড়ি কপালে সিঁদুর, দু-একটা ছেলেপিলে, কিছু দায়িত্ব, একটু ঝগড়াঝাঁটি, মান-অভিমান আর এসব জড়ানো অনেকটা ভালোবাসা মাখানো রাশি রাশি স্বপ্ন। তারপরই হাসি পেত। আমার মতো লোকের নাকি আবার বউ, ছেলে-মেয়ে সংসার… ঠিক এমন সময়ে এই চাকরির সুযোগটা এসেছিল।

আমার ভাড়াটে ছেলেটি বেশ চৌকশ। কোথায় একটা চাকরি করে, শখের ফটোগ্রাফার আর কী সব এনজিও-র সঙ্গে যুক্ত। ছটফটে মজারু ছেলে। ও একদিন হঠাৎ বলল, দাদা আজকাল কী করছেন?

এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া ভারি মুশকিল। যদি বলি কাজ করছি, তো কী কাজ? কোথায় অফিস? কত দেয়? হাজার প্রশ্ন! আর যদি বলি কিছু করছি না, তবে কেন করছেন না? না করলে চলছে কী করে? আরও একঝুড়ি কথা। আমার বেশি কথা বলতে ভালো লাগে না। তাই হুঁ হা করে এড়িয়ে যাব ভেবেছিলাম। কিন্তু সে ছেলে ছাড়লে তো?

—একটা কাজ আছে, করবেন? আপনার ভালো লাগবে।

—এই রে, আমার মতো লোকের জন্যও কাজ?

—কেন? মানে আমাকেই বলছ কেন? কাজের লোকের তো অভাব নেই।

—না মানে, ওরা একজন পিছুটানহীন লোক চাইছেন, তাই…

সত্যিই তো। এভাবে তো ভাবিনি। আমার এই জীবনটা নিয়ে আমি যা খুশি করতে পারি। আমার পথ চেয়ে কেউ বসে থাকার নেই। আমারও কারও কাছে কোনও দায় নেই। আমার না আছে শিকড় না নিজস্ব পরিসর। আমি সত্যিই পিছুটানহীন। তা এহেন আত্মপোলব্ধিতে অন্যের কী হতো জানি না, আমার বেশ মজাই লেগেছিল।

রাজি হবার সময় সত্যি ভাবতে পারিনি এরকম একটা জায়গায় থেকে কাজ করতে হবে আমায়। শহর থেকে অনেক দূরে, শাল মহুলে ঘেরা এই ছোট্ট জনপদে একটা আবাসিক স্কুলের কেরানি এখন আমি। ছাত্ররা সবাই স্থানীয় গ্রামের। বেশির ভাগই বোর্ডিং-এ থাকে। আমার কাজ বোর্ডিং-এর খাতাপত্র লেখা, ছেলেপুলেগুলোর ওপর নজর রাখা, খাবারদাবার এর তদারকি করা এইসব। থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা বোর্ডিং-এই।

আমার জন্য বরাদ্দ ছাদের ঘরটা চমৎকার। জানলা খুললেই স্কুলের চৌহদ্দি ছাড়িয়ে সবুজ মাঠ পেরিয়ে দূরের গহিন জঙ্গলটা দেখা যায়, যার একটু ভিতরে একটা আদিগন্ত বিস্তৃত জলাশয় আছে। রাতে ছেলের দল খেয়েদেয়ে যখন শুয়ে পড়ে, আমি ঘর ছেড়ে ছাদে চলে আসি। দূর জঙ্গলটা থেকে তখন কতরকম শব্দ মিঠে হাওয়ায় ভেসে আসে। শনশনে হাওয়ায় ডালপালার আড়মোড়া ভাঙা, রাতচরা পাখির তীক্ষ্ন ডাক, অজানা জন্তুর গরগরানি আর সেসব ছাপিয়ে অদ্ভুত একটা ছলছলে জলের আওয়াজ ভেসে আসে। প্রশান্ত, গম্ভীর, বাঙ্ময়। যেন একটা গভীর ডাক, একটা আকুল আহ্বান। আমি একদিন যাব। আমায় যেতেই হবে ওইখানে।

আজ অকারণেই আমার মনটা খারাপ। দুপুর শেষ হতেই কিছুই যেন ভালো লাগছিল না। কাজে মন বসছিল না। কাউকে কিছু না জানিয়ে স্কুল চৌহদ্দির পিছন দিকটার ঢালু জমিটায় এসে বসেছি। এখান থেকে বড়ো বড়ো গাছগুলোর ফাঁক দিয়ে সেই জলাটা আবছা দেখা যায়।

আমার ভিতরে আজ কদিন একটা ইচ্ছে পাক খাচ্ছে। যাই চলে এই ঘাস জমি পেরিয়ে জঙ্গলের ভিতর দিয়ে ওই জলাশয়ে কাছে। দুদণ্ড বসি ওর পাড়ে। স্কুলের মাস্টারমশাইরা পই পই করে বারণ করেছেন জঙ্গলে যেতে। সাপ-খোপ, বুনো জন্তু কী না আছে ওখানে! বোর্ডিং-এর রান্নার মাসি একদিন বলছিল, ওই জলার নাকি মায়াটান আছে। মানুষকে ভুলিয়ে ভালিয়ে টেনে নিয়ে যেতে চায়। যতসব গ্রাম্য রটনা।

এখন দুপুর গড়িয়ে পড়ছে বিকেলের কোলে। কয়েজন গ্রাম্য নারীপুরুষ গরু ছাগলের খুঁট ধরে বেরিয়ে আসছে জঙ্গল থেকে। কারও মাথায় ঝরা শালপাতার বোঝা, কারও হাতে কাঠকুটো, ডালপালা। আপন মনে কলকল করতে করতে ওরা চলে যাচ্ছে দূর গাঁয়ে দিকে। ওদের কথা, হাসি, ছাগলগুলোর গলার ঘন্টার টুংটাং আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি। মানুষ আর গরু ছাগলের পায়ে অভিঘাতে মেঠো পথে ধুলোর ঘুর্ণি উঠছে। ওদিকের বিশাল প্রাচীন গাছগুলোর মাথায় সূর‌্য আগুনরাঙা থালার মতো ধীরে নেমে আসছে। আর সেসবের মধ্যে দিয়ে আমার কানে আসছে পাড়ে মৃদু মৃদু ধাক্কা খাওয়া জলের শব্দ। ছলাৎ… ছলাৎ…। আমায় বিবশ করে ফেলছে সেই শব্দ।

হঠাৎ যেন ঘোর ভেঙে দেখি একটা ছোট্ট ছেলে, এই দশ কি বারো বছর বয়ে হবে, ঢলঢলে হাফ প্যান্ট আর গেঞ্জি পরা, হাতে একটা মাছ ধরার ছিপ নিয়ে হনহন করে জঙ্গলের দিকে যাচ্ছে। আমি তো অবাক। এই সময়ে একা একটা বাচ্চা ছেলে ওদিকে যাচ্ছে কেন?

—এই ছেলে, তুই কোথায় যাচ্ছিস রে?

ভয়ানক চমকে ছেলেটা দাঁড়িয়ে পড়ল। আমি উঠে ওর কাছে গেলাম। ছেলেটা আমাকে দেখছে আমিও ওকে। একমাথা রুখুশুখু চুল, শ্যামলা মুখটায় টানা টানা দুটো চোখ। কী ভীষণ মায়া জড়ানো তাতে।

—তুমি কে?

—আমি? আমি ওই স্কুলে থাকি। শহরের লোক।

—ও, তা তুমিও জলা দেখতে যাচ্ছ?

ভারি আশ্চর্য তো! আমার জলা দেখার ইচ্ছের কথা ও জানল কী করে?

—বললি না তো তোর নাম কী?

—ছোটু।

—আরে বাঃ ভারি সুন্দর নাম তো। তা তোর প্যান্টুটা কি কোমরে ঢলঢল করছে? হাত দিয়ে ধরে আছিস যে?

—হঁ।

—আচ্ছা দাঁড়া।

আমি ওর সামনে হাঁটু মুড়ে বসলাম। তারপর প্যান্টুটা ধরে ওর কোমরের ঘুনসির মধ্যে দিয়ে গলিয়ে ওপর দিকে তুলে আবার একটু নামিয়ে দিলাম। প্যান্টটা টাইট করে আটকে রইল ওর ঘুনসিতে। একগাল হাসি উপহার দিল ছোটু।

—চলো তোমায় জলা দেখিয়ে নিয়ে আসি। আমি দুটো মাছ ধরব ওখান থেকে। মা আর আমি খাব।

—ও তা বেশ। চল…

ছেলেটা ভারি সরল আর মিশুকে তো। আমি ভাবছিলাম আমাদের শহরের বাচ্চারা অচেনা লোকের সাথে এত কথা বলত না।

—ঘরে তোরা কে কে থাকিস রে?

—আমি আর মা।

—তোর বাবা?

—বাবা নেই। চলে গেছে। আর আসে না।

আমার বুকটা হু হু করে উঠল। আহা রে, এতটুকু ছেলের বাবা নেই। কেন জানি না কীরকম একটা জ্বালা করে উঠল চোখ দুটো। ছোটু মহা উৎসাহে হাত পা নেড়ে আপনমনে বকবকম করতে করতে তরতরিয়ে হাঁটছে। আমি ওর সাথে তাল রাখতে গিয়ে হাঁফিয়ে যাচ্ছি।

—তা মাছ যে ধরবি তোর চার কোথায়?

—এই তো।

বলে পকেট থেকে ছেঁড়া কাগজে মোড়া একদলা মোটা লালচে ভাত বার করল ও।

—ও আচ্ছা।

আমরা এখন জঙ্গলে ঢুকে পড়েছি। খুব চুপচাপ চারদিক। দূরে অস্পষ্ট পাখির ডাক আর বড়ো গাছগুলোর নীচে পড়ে থাকা শুকনো পাতার ওপর দিয়ে আমাদের চলার শব্দ ছাড়া আর কোনও আওয়াজ নেই।

শুধু একটা গন্ধ। ভেজা, গহন, গভীর, প্রাচীন একটা গন্ধ ধীরে ধীরে আমার ইন্দ্রিয়কে বশ করে আনছে। কী মাদকতা এই গন্ধে। আমি অস্থির হয়ে উঠছিলাম। আরও কাছে যেতে হবে এ গন্ধের

—উই দ্যাখো গো জলা। আমরা এসে গেছি গো।

হঠাৎ যেন উঁচু গাছগুলোর মাথা থেকে ঝুপ করে দলা দলা নরম অন্ধকার নেমে এল নীচে। কুয়াশার মতো ছড়িয়ে পড়তে লাগল আমাদের ঘিরে। আমরা এখন জলের একদম কাছে এসে দাঁড়িয়েছি।

দ্রুত সন্ধে নেমে আসছে। ছোটু দেখলাম পাড়ের কাদা মাড়িয়ে পায়ে পাতা ডুবিয়ে ভাত বেঁধানো বড়শিটা জলে ছুড়ে দিল। কিছুক্ষণ সব চুপচাপ। তারপর জলে একটা আলোড়ন উঠল। আমি ছোটুর পাশে দাঁড়িয়ে দেখলাম তোলপাড় হচ্ছে জল। ছোটুর ছিপে টান পড়েছে। ও প্রাণপণে ছিপটা টেনে ধরে পাড়ের দিকে আনতে গেল কিন্তু উলটে নিজেই জলের মধ্যে নেমে যেতে লাগল।

আমি খুব উৎসাহ পেয়ে গেলাম। বড়ো কোনও রাঘব বোয়াল গেঁথেছে নির্ঘাত। ছোটুর হাতের পাশ দিয়ে চেপে ধরলাম বঁড়শিটাকে। টানতে লাগলাম পাড়ের দিকে।

পারছি না। পারছি না দুজনে। উলটে নেমে যাচ্ছি জলের গভীরে। ওটা আমাদের টেনে নিচ্ছে ভিতর পানে। আঁধার আরও গভীর হচ্ছে চারপাশে। আমার পায়ে জড়িয়ে যাচ্ছে শ্যাওলা। ছোটুর হাতটা ছেড়ে গেল বোধহয়। আমি শরীরের সর্বশক্তি দিয়ে ছিপটায় টান দিলাম আর তখনই এক অপার্থিব দৃশ্য দেখলাম।

আমার মাথার ওপরে, চারপাশে চরাচর জোড়া মিশকালো আকাশ। সারা আকাশ জুড়ে সলমাজরির ফুলকারি কাজের মতো তারাদের ঝিকিমিকি। আমি কোমর অবধি ডুবে আছি সেই তরল কালো আকাশে! আমার চারপাশে সেই আকাশ ছাওয়া অমোঘ মায়া আমায় পিছু টানছে। চারপাশে কী যেন ভেসে বেড়াচ্ছে মাছের মতো। সরে যাচ্ছে দূরে, আবার কাছে আসছে।

আমায় হাতছানি দিয়ে ডাকছে। ফিশফিশ করে বলছে আয় আয়। ডুব দে আরও গভীরে। পাড়ে কেউ নেই তোর জন্য অপেক্ষায়। আর ফিরে যাওয়ার কী দরকার? এখানে আয়। এখানে নির্জন অন্ধকার বড়ো গভীর আর শীতল। সব তাপ তোর জুড়িয়ে যাবে। আয়… আয়…

আমি অনুভব করলাম এই অমোঘ ডাক— এই টান, অস্বীকার করার ক্ষমতা আমার নেই। আমি বিবশ। আমি সিদ্ধান্ত নিলাম আমি পাড়ে যাব না।

সেই গন্ধটায় চারপাশ ম’ ম’ করছে। আমি ডুবে যাচ্ছি সেই আদিম গন্ধে। হঠাৎ মনে হল ছোটুর কথা। ও কোথায়? আমি থমকে গেলাম, জোর করে নিজের মনকে সংযত করার চেষ্টা করলাম।

—ছোটু, ছোটু, কোথায় তুই?

—এই তো আমি, মাছ পেয়েছি গো।

আমি পিছু ফিরলাম। ছোটু পাড়ে দাঁড়িয়ে ওর হাতে একটা রুপোলি মাছ ছটপট করছে। ছোটুর মুখে হাসি। এমন হাসি, এত মধুর, অমলিন, স্বর্গীয় যে, আমার বুকটা হু হু করে উঠল।

আমি দেখতে পেলাম তকতকে নিকানো মাটির উনুনে, কাঠকুটো আর শুকনো ডালপালার আগুনে লোহার কড়াইয়ে মাছ ভাজা হচ্ছে। টাটকা মাছের গন্ধে ম’ ম’ করছে চারপাশ। ছোটু বসে আছে ধোঁয়া ওঠা মোটা লালচে ভাত রাখা থালার সামনে। একগোছা রেশমি চুড়ি পরা হাতে ভাজা মাছের দুটো টুকরো তুলে দিচ্ছে ওর পাতে, মাথায় ঘোমটা টানা কেউ একজন। তারপর সে আমার দিকে ফিরল।

—আসুন, এবার আপনিও বসুন।

আমি দেখলাম তার মুখে সলজ্জ হাসি। গর্জন তেল মাখানো প্রতিমার মুখের মতো চকচকে মুখ তার, কপালে সিঁদুর। সেই সিঁদুরের কমলা গুঁড়ো তার নাকের ওপর পড়েছে। তার হাতে ধরা গরম ধোঁয়া ওঠা ভাতের থালা। আমার জন্য।

আর কিছু ঠিক ঠাওর করতে পারলাম না। আমার দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে এসেছে, গলার কাছে দলা পাকানো কী একটা ঠেকছে।

আমি আর কিচ্ছু না ভেবে শরীরের সব শক্তি দিয়ে পিছু ফিরলাম। আমায় ফিরতে হবে। পাড়ে যেতে হবে। এক উলটো টান আমায় পাড়ের দিকে টানছে। সে টান অগ্রাহ্য করার শক্তি নেই আমার।

এখন আমার হাতে ধরা ছোটুর হাত। ওর গা মাথা আমি মুছিয়ে দিয়েছি আমার জামা দিয়ে।

ছোটু বকবক করছে। ওর গাঁয়ের গল্প, বন্ধুদের কথা, মায়ের কথা বলছে।

আমার মনে এখন অদ্ভুত এক প্রশান্তি। অথই জল ছেড়ে শুকনো ডাঙায় ওঠার নিশ্চিন্তি। ছোটুর হাতের উত্তাপ আমার সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ছে। আমি ভিতরে ভিতরে ছটফট করছি। দেখতে পাচ্ছি কেউ একজন আমার জন্য অপেক্ষা করছে গরম ধোঁয়া ওঠা ভাতের থালা নিয়ে যার পরনে ঢাকাই শাড়ি কপালে সিঁদুর।

আকাশের নিকষ কালো অন্ধকার কেটে যাচ্ছে। ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘের ফাঁক দিয়ে উঁকি দিচ্ছে ফুটফুটে একফালি চাঁদ। আমার শরীর মন জুড়ে এখন ভীষণ খিদে।

পড়ার জন্য সীমাহীন গল্প-নিবন্ধসাবস্ক্রাইব