দীর্ঘ পনেরো বছর দাম্পত্য জীবন কাটালেও ধ্রুবর সঙ্গে নম্রতার মনের সখ্যতা কোনওদিনই গড়ে ওঠেনি। এতগুলো বছরে গড়ে ওঠার সম্ভবনাও তেমন ছিল না। ধ্রুব এবং নম্রতার অবস্থান দুই বিপরীত মেরুতে। একটা প্রচলিত কথা আছে বিপরীত মেরু পরস্পরকে আকর্ষণ করে। এখানে আকর্ষণের সব রাস্তাই বিয়ে দিন থেকেই নম্রতা রুদ্ধ করে রেখেছিল। দুটো ভিন্ন মানুষের মধ্যে ক্রমাগত দূরত্ব বিকর্ষণের পথকে প্রশস্ত করে তোলে। এক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি।

বিয়ে তিন বছর পর নম্রতার কোল আলো করে এক ফুটফুটে কন্যাসন্তানের জন্ম হয়। ধ্রুবর স্নেহকাতর পিতৃহৃদয় কন্যার মুখ দেখে, স্ত্রী নম্রতার প্রতি অনেকখানি কোমল হয়েছিল। অনেক আশা করে ধ্রুব কন্যার নাম রেখেছিল আশা। তার আশা ছিল মেয়ে আশাই পারবে তাদের স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ককে স্বাভাবিক করতে। কিন্তু নম্রতা সে আশা পূরণের চেষ্টাটুকু করেনি। তবে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে যতই মনোমালিন্য এবং অমিল থাকুক, মেয়ে আশাকে দুজনেই প্রাণাধিক ভালোবাসত। আশা এই বছর এগারোয় পা দিল।

ধ্রুবর সঙ্গে নম্রতার স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক মধুর না হওয়ার কারণে বিয়ে পর দুজনের কোথাও ঘুরে বেড়ানো বা সময় কাটানোর সুযোগ হয়নি। এমনকী দুজনের তরফ থেকে আত্মীয়স্বজনের বাড়ি নিমন্ত্রণ থাকলেও কৌশলে তারা এড়িয়ে গেছে। ধ্রুব অবশ্য বিয়ে কয়েক সপ্তাহ পর নম্রতাকে নিয়ে অরুণাচল প্রদেশে হনিমুনে যাবে বলে স্থির করে। সে ঠিক করে যে, নম্রতাকে না জানিয়ে সারপ্রাইজ দেবে। ফ্লাইটের টিকিট বুক থেকে হোটেল বুক সব হয়ে যাবার পর নম্রতার দৃঢ় অনিচ্ছায় তার কোনও আশাই পূরণ হয়নি। স্ত্রীর এই আচরণে ধ্রুব কষ্ট পায়। ফলে পরবর্তীকালে নম্রতার কাছে ভুলেও কোথাও বেড়াতে যাবার ইচ্ছা প্রকাশ করেনি।

ধ্রুব থেমে গেলেও এগারো বছরের মেয়ে আশা থামার পাত্রী নয়। আশা ক্লাস সিক্স-এ পড়ে। স্কুলের বড়োদিনের ছুটিতে তার বায়না স্কুলের অন্যসব বন্ধুদের মতো সেও বাবা মা-র সঙ্গে বেড়াতে যাবে। ধ্রুব বেড়াতে যাবার জন্য এক পায়ে খাড়া। ব্যক্তিগত ভাবে বেড়াতে যেতে তার খুব ভালো লাগে। নম্রতার জন্য তার সেই ভালোলাগাকে সরিয়ে রাখতে হয়েছে। স্ত্রী তাকে ভালোবাসে না জেনেও সে আপ্রাণ চেষ্টা করতে থাকে নম্রতার ভালোবাসা পাওয়ার। বুকের সুপ্ত কোণে ধ্রুব নম্রতার প্রতি ভালোবাসাকে জিইয়ে রেখে দুহাত বাড়িয়ে অপেক্ষা করতে থাকে। স্ত্রীর সঙ্গে এত মনোমালিন্য, এত অমিল, এত ঔদাসীন্য তবুও দিনের শেষে নম্রতার স্বামীর পরিচয়ে ধ্রুব বাঁচতে চায়। এই পরিচয়টুকুতেই সে খুব খুশি। তার মনের গভীরে জোরালো বিশ্বাস যে, নম্রতা তার ভালোবাসা একদিন ঠিকই বুঝবে। ধ্রুব ভাবে, আজ এতগুলো দিন পর মেয়ে আশা একটা সুযোগ এনে দিয়েছে নম্রতাকে কাছে পাবার। এই সুযোগ হাতছাড়া করা যাবে না। আশা তো হাজার হোক নম্রতার মেয়ে সে তার মায়ের মতোই জেদী। যেটা সে একবার মুখে বলে সেটা না করে তার শান্তি নেই।

ধ্রুব তাই মেয়ে বেড়াতে যাবার প্রস্তাবে পূর্ণ সমর্থন জানায়। বাবার মত পেয়ে আশাও বেশ খুশি। কিন্তু সে জানে বাবা রাজি হলেও মাকে রাজি করানো তার পক্ষে বেশ কঠিন। তবু ভালোবাসা মানুষের জীবনে একটা দুর্বল জায়গা। সেই ভালোবাসার জোরেই আশা সন্ধেবেলায় নম্রতার কোল ঘেঁষে বসে হঠাৎ বলে বসল, মাম্মা, আমি তোমার সবকিছু! তুমি আমার জন্য সব করতে পারবে?

নম্রতা মেয়ে অন্য সুরে কথা শুনে বলল, কী ব্যাপার! এসব কথা বলছ হঠাৎ! যতটুকু আমার পক্ষে তোমার জন্য করা সম্ভব নিশ্চয়ই করব।

আশা একটু ঢোক গিলে আবদারের গলায় নম্রতাকে বলল, মাম্মা, আমার স্কুলে বড়োদিনের ছুটি পড়েছে। স্কুলের প্রায় সব বন্ধুরা ঘুরতে যাচ্ছে। আমিও বেড়াতে যাব। তোমরা দুজন কখনও কোথাও আমাকে নিয়ে যাওনি। প্লিজ মাম্মা, কোথাও চলো না। আমরা কদিনের জন্য ঘুরে আসি। পাপা রাজি।

নম্রতা শান্তস্বরে বলল, তোমাকে যেমন কোথাও ঘুরতে নিয়ে যাইনি, তেমনি আমরাও তো কোথাও ঘুরতে যাইনি। পাপা যখন রাজি তখন পাপার সঙ্গেই ঘুরে এসো। তুমি জানো যে আমার বেড়াতে ভালোলাগে না।

নম্রতার কথা শুনে আশা হতাশ হয়ে বলল, ঠিক আছে। তুমি না গেলে আমিও যাব না। সে মায়ের কোল ছেড়ে মলিন মুখে বলল, মাম্মা, আসি। আমার কার্টুন শো টম অ্যান্ড জেরি শুরু হয়ে যাবে। আশার অভিমানী মুখ দেখে সুর নরম করে স্মিত হেসে নম্রতা বলল, রাগ হল বুঝি আমার কথায়! আমি তো জাস্ট মজা করছিলাম। দেখছিলাম যে আমার মেয়ে আমাকে ফেলে কোথাও চলে যায় কিনা। আমি যাব ঘুরতে তোমাকে নিয়ে এবার খুশি তো!

নম্রতার কথা শুনে খুশিতে আত্মহারা হয়ে আশা তার কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ল। আশাকে জড়িয়ে ধরে নম্রতা তার কপালে মাথায় চুমু খেল। একটু ধরা গলায় সে বলল, তুমি আমার সন্তান। সন্তানের জন্য মায়েরা অনেক কিছু পারে। অনেক কিছু পারতে হয়।

ধ্রুব দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে নম্রতার দিকে গভীর বিস্ময়ে তাকিয়ে ছিল। ভিতরে মা-মেয়ে সব কথাই তার কানে এসেছিল। এই চিরন্তন দৃশ্য দেখে সে ভিতরে না এসে পারল না। নম্রতার উদ্দেশ্যে বলল, নম্রতা, তোমার এই সিদ্ধান্তের জন্য থ্যাংক ইউ। আমি সিকিম যাওয়ার সব ব্যবস্থা করছি। পরশু আমরা বেরোব। ধ্রুবর কথায় নম্রতার কোনও প্রতিক্রিয়া দেখা গেল না।

আশা মায়ের কোল ছেড়ে বাবার কোলে উঠে বলল, পাপা, আমরাও একসঙ্গে বেড়াতে যাব। কী মজা হবে।

নম্রতাও বিছানা ছেড়ে ঘরের বাইরে যাবার জন্য পা বাড়াতেই ধ্রুব তার হাতটা টেনে ধরল। হ্যাঁচকা টানে নম্রতা ধ্রুবর বুকের কাছাকাছি চলে এল। ফ্যানের হাওয়ায় নম্রতার ঠোঁটের কাছে আসা চুলগুলো আলতো হাতে সরিয়ে ধ্রুব বলল, তুমি আমাকে যতই এড়িয়ে যাও ততই আমি তোমাকে বেশি করে ভালোবেসে ফেলি। নম্রতা তুমি আমার স্ত্রী। তুমি কি বোঝো না, আমি তোমাকে কতটা ভালোবাসি? আমার জন্য না হোক আমার মেয়ে জন্য যে তুমি কিছু সময় আমার সঙ্গে কাটাবে এতেই আমার বুকের ভিতর কী হচ্ছে তোমাকে কী করে বলব।

ধ্রুবর স্পর্শ নম্রতার কাছে এক অচেনা মানুষের মতো। তার স্পর্শে নম্রতার শরীর মন সব সংকুচিত হয়ে আসে। আশা হবার পর ধ্রুব এই প্রথম তাকে স্পর্শ করল। নম্রতা নিরুত্তাপ গলায় বলল, আমার হাতটা ছাড়ো। আশার জন্য বেড়াতে যেতে রাজি হয়েছি ঠিকই। তুমি আমার এই বেড়াতে যাওয়াতে খুব খুশি। কিন্তু আমাকে ঘিরে তোমার বাড়াবাড়ি না দেখলে আমি বেশি খুশি হব।

নম্রতা ধ্রুবর হাত থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে বাইরে বেরিয়ে গেল। ধ্রুব মনে মনে একটু হেসে শূন্য ঘরে দাঁড়িয়ে বলল, তুমি আর কতদিন আমার থেকে দূরে থাকবে! একদিন আমার ভালোবাসাই তোমাকে ভালোবাসতে বাধ্য করবে।

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...