একটা ঘরে ফেরার গল্প (২-পর্ব)

২ পর্ব

পড়শিদের চিৎকার আর আলোচনা শুনে শ্রাবণী জানতে পেরেছিল, ওর জ্ঞাতিরা তার মা-বাবাকে মেরে ওদের জায়গা জমি হাতিয়ে নেওয়ার উদ্দেশ্যেই তাদের ঘরে আগুন লাগিয়ে দিয়েছিল। দিন দু’য়েক বাদে গাঁয়েরই এক পিসে ওকে বুঝিয়েছিল, এভাবে পথে পথে কেঁদে বেড়ালে, না আর বাপ-মাকে খুঁজে পাবি; না জোটাতে পারবি পেটের ভাত। তার চেয়ে আমার সাথে চল, কলকাতার একটা অনাথ আশ্রমে ভর্তি করিয়ে দেব’খন। সেখানে মাথা গোঁজার ঠাঁই যেমন একটা পাবি; দু’বেলা দু’মুঠো ভাতের সঙ্গে দু’অক্ষর লেখাপড়াও শিখতে পারবি। পথে পথে ভিক্ষে করে আর বেড়াতে হবে না তোকে।

কিন্তু হাওড়া স্টেশনে ট্রেন থেকে নামার পরে, সেই পিসেকে আর খুঁজে পায়নি শ্রাবণী। পরে জিআরপি’র এক পুলিশ অফিসার কাকুর কাছ থেকে শ্রাবণী জেনেছিল, ওটা তোর পিসে না ছাই! ওটা শিশু পাচার চক্রের একটা দালাল। তোকে বেচে দেওয়ার উদ্দেশ্যে কলকাতায় নিয়ে যাচ্ছিল। পুলিশ দেখে ভয় পেয়ে গিয়ে, তোকে ফেলে রেখে এখান থেকে পিঠটান দিয়েছে।

হাওড়া স্টেশন থেকে বেরিয়ে, পূর্বপ্রান্তের রাস্তার ওপারে একটা ভাতের হোটেলে নিয়ে গিয়ে, সেইদিন দুপুরে মাছ-ভাত খাইয়ে, রেল-পুলিশের অফিসার শ্রাবণীকে ওই ভাতের হোটেলে রেখে দিয়ে, চলে যাওয়ার আগে বলে গিয়েছিল, আপাতত তুই এখানেই থাক, টুকটাক ফাই-ফরমায়েশ খেটে দিবি। দু’বেলা দু’মুঠো ভাত যেমন পেয়ে যাবি, তেমনই মাথা গোঁজার একটা ঠাঁইও হয়ে গেল তোর। কিন্তু হোটেল মালিক কথায় কথায় যেমন ধমক-ধামক আর তার সাথে চুলের মুঠি ধরে ঝাঁকুনি দিত, তা মোটেও পছন্দ হতো না শ্রাবণীর।

একদিন ভোর হওয়ার আগে হোটেল থেকে পালিয়ে, প্রথম মেদিনীপুর লোকাল ধরে, সোজা খড়গপুর স্টেশনে গিয়ে নেমে পড়েছিল সে। সেখানে কিছুদিন ট্রেনে ট্রেনে ভিক্ষে করে বেশ ভালোই দিন কেটে যাচ্ছিল তার। হঠাৎ করে একদিন রেল পুলিশের তাড়া খেয়ে, বছর দুয়েক বাদে আবার হাওড়া স্টেশনে ফিরে আসে সে। তারপর থেকে রোজ সারাদিন ধরে এ ট্রেন ও ট্রেন ভিক্ষে করে বেড়ানোর শেষে, রাতে ফিরে আসত এই তেইশ নম্বর প্ল্যাটফর্মে। প্ল্যাটফর্মের বেঞ্চে শুয়ে, নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়ত শ্রাবণী।

আর রোজ সন্ধ্যায় অর্জুনের পাশে বসে, কোলে চেপে, সবচেয়ে ছোটো যে মেয়েটা স্লেট-পেন্সিল নিয়ে, সবে অক্ষরজ্ঞান অর্জনে ব্যস্ত; তার নাম শান্তা। শান্তার জন্ম এই তেইশ নম্বর প্ল্যাটফর্মেই। সেও এক প্রচণ্ড ঝড়বৃষ্টির রাতে। জন্ম দেওয়ার পরে, ওকে ফেলে রেখে ওর মা-টা যে কোথায় চলে গিয়েছিল, তা কে জানে! মা-কে ছাড়া অতটুকু শিশু এতটুকু টু-শব্দটি পর্যন্ত করেনি কোনওদিন। ছোটো থেকেই সে এতই শান্ত ছিল যে, অর্জুনই ওর নাম দিয়েছিল— শান্তা!

এদের সঙ্গে অর্জুন দীর্ঘদিন ধরে পরিচিত হলেও, এদেরকে সঙ্ঘবদ্ধ করে, এই তেইশ নম্বর প্ল্যাটফর্মের বাসিন্দা বানাতে সক্ষম হয়েছে সে; তাও প্রায় বছর তিনেক হয়ে গেল। এদের বেশির ভাগই আগে প্ল্যাটফর্মে বসে, ট্রেনে ট্রেনে ঘুরে ভিক্ষে করে বেড়াত। সুযোগ পেলে যাত্রীদের মালপত্র থেকে হাতসাফাই করে, দু’-চার টাকা কামিয়ে নিতেও সিদ্ধহস্ত ছিল এরা।

অর্জুন বুঝেছিল, এদের সকাল থেকে রাত পর্যন্ত পেট চালানোর একটা বন্দোবস্ত করে দিতে পারলে আর নিয়মিত ভাবে পড়াশোনার জগতে ব্যস্ত করে রাখতে পারলে, তবেই এদের এই অসৎ উপার্জনের থেকে বিরত রেখে, একটা সুস্থ জীবনের আলো দেখানো সম্ভব। তাই সকাল হতেই কোনওদিন লুচি-তরকারি, কোনওদিন কেক, কোনওদিন কলা-পাউরুটি ধরিয়ে দিয়ে, সকলকে আজকাল টিকিয়াপাড়ার রেল লাইনের ধারের স্কুলে পাঠিয়ে দেয় অর্জুন। সেখানে প্রাপ্ত মিড-ডে মিলের সুবাদে দুপুরের খাওয়াটাও জুটে যায় রোজ। রাতে তেইশ নম্বর প্ল্যাটফর্ম সংলগ্ন গোডাউনের পাঁচিলের ধারে বসে ঘন্টা দুয়েকের পড়াশোনার পরে, একুশজনের এই দলটা চলে যায় হাওড়া স্টেশনের বাইরে নদীর ধারের ভাতের হোটেলে নৈশভোজ সারতে। তারপর সেখান থেকে ফিরে এসে, ওই গোডাউনের পাঁচিলের ধারেই সবাইকে শুইয়ে দেওয়ার পরে, রাতের এই ক’ঘন্টার জন্য অর্জুনের সারাদিনের সব ব্যস্ততার অবসান।

ক্রমশ…

 

একটা ঘরে ফেরার গল্প (১-পর্ব)

সকালে ঘুম থেকে উঠে টয়লেটে যেতে, আজ বেশ দেরি হয়ে গেছে অর্জুনের। ঘুম থেকে উঠে চোখ মেলে, কবজিতে বাঁধা ঘড়ির দিকে তাকাতেই মেজাজটা খারাপ হয়ে গেল। সকাল সাতটা বাজে। এইসময় টয়লেটে ঢুকতে গেলে, লম্বা লাইনের পিছনে গিয়ে দাঁড়াতে হবে। রোজ সাধারণত ভোর পাঁচটা-সাড়ে পাঁচটার মধ্যে টয়লেটে ঢুকে, একেবারে প্রাতঃকৃত্য-স্নানাদি সেরে নেয় অর্জুন। এর থেকে বেশি দেরি হয়ে গেলেই, হাওড়া স্টেশনের তেরো নম্বর প্ল্যাটফর্ম সংলগ্ন এই টয়লেটে সহজে ঢোকার সুযোগ পাওয়াটা বেশ দুরূহ হয়ে পড়ে।

দূরপাল্লার ট্রেনগুলো ভোরবেলায় ঠিক এই সময় থেকেই একের পর এক ঢুকতে শুরু করে হাওড়া স্টেশনে। যেসব প্যাসেঞ্জারদের ট্রেন থেকে নেমে, ট্রেন পালটাতে হয়, তারা এইসময় টয়লেটে ঢুকে একটু ফ্রেশ হয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে সবাই। এদের পিছনে লাইন দিতে হলে, সেদিনকার মতো সব কাজ যে মাথায় উঠবে, তা খুব ভালো করে জানে অর্জুন।

অর্জুন মনে মনে ভাবে, আজকের এই গণ্ডগোলের মূলে হচ্ছে গতকাল রাতের কালবৈশাখীর ঝড়। গতকাল রাত আটটা নাগাদ শুরু হয়ে, কয়েক দফায় যে ভীষণ বেগে এবছরের প্রথম কালবৈশাখীর ঝড় আছড়ে পড়েছিল, তাতেই তো সমস্ত রেল-যোগাযোগ ব্যবস্থা একেবারে লন্ডভন্ড হয়ে গিয়েছিল। ওই ঝোড়ো হাওয়ার সঙ্গী ছিল অবিশ্রান্ত ধারায় বৃষ্টি। সেই ঝড়বৃষ্টির তাণ্ডব যখন থামল, তখন ঘড়ির কাঁটা রাত বারোটা পার হয়ে গিয়েছে।

হাজার হাজার প্যাসেঞ্জার অসহায় ভাবে এদিক ওদিক ছোটাছুটি করছে। তারা কেউ লোকাল ট্রেন ধরে বাড়ি ফিরবে, কেউ আবার বাক্সপ্যাঁটরা নিয়ে দূরপাল্লার ট্রেন ধরবে বলে হাজির হয়েছে হাওড়া স্টেশনে। বাচ্চা, বুড়ো, মহিলা, সবার সে এক নিদারুণ অসহায় অবস্থা! সেই ঝড়-বৃষ্টির পর থেকে সারারাত, না আর কোনও ট্রেন হাওড়া স্টেশনে ঢুকেছে; না কোনও ট্রেন হাওড়া স্টেশন থেকে ছেড়ে বেরোতে পেরেছে।

গতকাল রাতে ঝড় যখন উঠল, অর্জুন তখন ওর দলবল নিয়ে হাওড়া স্টেশনের তেইশ নম্বর প্ল্যাটফর্ম সংলগ্ন গোডাউনের পাঁচিলের কোল ঘেঁষে বসেছিল। ওর দলবল বলতে এক পাঁচ বছর বয়সি থেকে শুরু করে, আঠারো-ঊনিশ বছর বয়স পর্যন্ত কয়েক জন কিশোর-কিশোরী মিলিয়ে জনা বিশেকের একটা দল। এদের সবাইকে এককথায় ‘অনাথ’ বলা চলে। কিন্তু অর্জুন তা মানতে রাজি নয়। অর্জুন বলে, ‘এরা সবাই আমার পরিবারের!” রোজ সন্ধ্যায়, মাঝখানে একটা হ্যাজাক জ্বেলে বসে অর্জুন। তাকে ঘিরে গোল করে বসে থাকে বাকি সকলে। অর্জুন ওদের গুরু। গুরুর কাছে পাঠ নিতে, সন্ধ্যা সাতটা বাজতে না বাজতেই যে যেখানে থাকুক না কেন, সকলেই এসে হাজির হয় হাওড়া স্টেশনের তেইশ নম্বর প্ল্যাটফর্মের এই গোডাউন লাগোয়া পাঁচিলের গোড়ায়।

ওদের প্রত্যেককে একটা করে পিঠব্যাগ কিনে দিয়েছে অর্জুন। সঙ্গে দিয়েছে বই, খাতা, কলম, পোশাক; যার যেমন প্রয়োজন। পড়াশোনার স্তরও একেক জনের একেকরকম। সবচেয়ে বড়ো যে ছেলেটি, তার নাম বিল্টু; বয়স সতেরো আঠারো হবে। ওর ব্যাগে রয়েছে ক্লাস সিক্সের বইপত্র। বিল্টু কীভাবে এই হাওড়া স্টেশনে এসে পৌঁছোল, তা অর্জুন অনেকবার বিল্টুর কাছে জানতে চেয়েছে। কিন্তু বিল্টু কিছুতেই তার জবাব দিতে পারে না। শুধু ওর কথাবার্তা থেকে অর্জুন বুঝতে পারে— ও কোনও সাঁওতাল মা-বাবার সন্তান। বিল্টুর পড়াশোনায় আগ্রহ থাকলেও, ভিতটা খুব দুর্বল হওয়ায়, অর্জুন ওকে গত দু’বছর আগে ক্লাস ফোরের স্তর থেকে সব বইপত্র কিনে দিয়ে, তালিম দিতে শুরু করেছিল। বয়স অনুপাতে অনেকটা পিছন থেকে শুরু করলেও, বিল্টুর অধ্যাবসায় যথার্থভাবেই ওকে ক্লাস সিক্স স্তর পর্যন্ত টেনে নিয়ে এসেছে।

আর বিল্টুর সমবয়সি যে-মেয়েটি, সে হল শ্রাবণী। আগামী বছর মাধ্যমিক পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে ও। শ্রাবণীর মা-বাবা যখন বেঁচে ছিল, তখন ও ক্লাস ফাইভে পড়ত। ওর কতই বা আর বয়স হবে তখন; বছর এগারো হবে। মেদিনীপুর জেলার শ্যামচকে ওদের বাড়ি ছিল। একরাতে ঘুমের মধ্যেই শ্রাবণী টের পায়, ওদের গ্রামের সেই খড়ের চালের ঘরটা দাউদাউ করে জ্বলছে। ভয়ে আতঙ্কে কাঁদতে কাঁদতে শ্রাবণী একরাশ ধোঁয়া আর অন্ধকারের মধ্যে ঘর থেকে বাইরে বেরিয়ে এসেছিল। মালপত্র বের করতে গিয়ে, চালচাপা পড়ে ঘরের মধ্যেই অগ্নিদগ্ধ হয়ে ওর মা-বাবা মারা গিয়েছিল সেদিন।

ক্রমশ…

 

ভুলের মাশুল (শেষ পর্ব)

শেষ পর্ব

নেগেটিভিটিতে ভরপুর জীবন তারক সিং-এর। ভালো চিন্তা কিছু নেই, সর্বক্ষণ দুঃখী ভাব। তার শরীরের কলকবজা বিকলের কাহিনি, প্রায় প্রত্যহ এদের শুনতে হয়। কেষ্ট দাস ঠিক তার উলটো। সর্বসময় প্রাণচঞ্চল তেজি ঘোড়া। একেবারে টগবগ করে ফুটছে। তবে মুখে কোনও লাগাম নেই। ‘অমিতসাব, পাক্কা দো’দিন মেরা টয়লেট নেহি হুয়া।’ বললেন তারক সিং। অমিতবাবু কিছু বললেন না, তিনি নিজেই বেশ ক’দিন ধরে নড়বড়ে। মুখ খুললেন কেষ্ট দাস।

—কোনটা বন্ধ, হিসি না হাগু?

—নেহি, ও তো কর রাহা, লেকিন হা…

—পিছনে বাতি দিন, সেরেফ বাতি।

—দূর মশাই, কী যে বলেন! হেসে ফেলেছেন অমিত সেন।

—কেন, লজ্জার কী আছে দাদা! ছেলেবেলায় আমরা সবাই তো…, হো হো করে হাসছেন দু’জনে। তারক সিং-ও গাঁদাল পাতা গেলা মুখ করে হাসতে বাধ্য হলেন। এইসব করে যখন অমিতবাবু ফ্ল্যাটে ফিরলেন নীচের পাম্পের ঘরের সামনে বেশ কয়েকজন আবাসিকের জটলা। আষাঢ়ে মেঘের ইঙ্গিত পেলেন অমিতবাবু। চারতলার গঙ্গাগোবিন্দবাবু, তিনতলার ভিনেশ জোশি, দোতালার অটল সাঁপুই, ডাঃ নিতিশ মিত্র— সবাই আছেন। কেমন যেন ভিলেন ভিলেন গন্ধ খুঁজছে সবাই তাঁর শরীর থেকে।

অটল সাঁপুই কিছুদিন আগে ছানি কাটিয়ে এসেছেন। চোখের দৃষ্টি বেড়ে গেছে, তিনি কাছে এসে খুব একেবারে গোয়েন্দা কায়দায় মাপতে লাগলেন অমিতবাবুকে। অমিতবাবু বুঝতে পারলেন না, কী খুঁজছেন রিভলবার না রক্তমাখা ছোরা! আসরে প্রথম এগিয়ে এলেন ভিনেশজি।

—আপনি কী করলেন মিঃ সেন? ওয়াটার পাম্প একদম খারাপ করিয়ে দিলেন। অমিতবাবু কিছু বুঝতে পারলেন না, শুধু সকলের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন।

গঙ্গাগোবিন্দ মণ্ডল সংক্ষেপে যা বললেন তার সারমর্ম হল, ‘সকালে অমিতবাবু পাম্প চালিয়ে চলে গেসলেন। আবাসিকরা কেউ তা জানতেন না। দীর্ঘক্ষণ চলায় পাম্পের মোটর পুড়ে গেছে। সারাই করতে অনেক টাকার ধাক্কা।’

নিতিশ মিত্র প্রকাশ্যে ঘোষণা করলেন, “তিনি এই বাবাদ এক কানাকড়িও দেবেন না।’ অমিতবাবুর মনে হল অন্য সকলে নির্বাক থেকে নিতিশবাবুর মতেই মত দিলেন। আর এখানে দাঁড়ালেন না তিনি। তিনতলায় তাঁর নিজের ফ্ল্যাটের বেল বাজালেন। কাজের লোক বুলি দরজা খুলল। এখানেও সন্দেহের স্যাঁতসেঁতে গন্ধ। এক গেলাস জল খেয়ে খবরের কাগজটা হাতে নিলেন। হঠাৎ হাত থেকে কে যেন টেনে নিল কাগজটা। স্ত্রী, বিমলা পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। হাতে চেক বই।

স্ত্রীর দিকে মুখ তুলে তাকালেন তিনি। চোখ দুটো জবা ফুলের মতো লাল। থমথমে মুখ। ভয় পেলেন অমিতবাবু, কিছু না বলাই শ্রেয় মনে করলেন। মুখ খুললেন বিমলা। পাম্পটা ঠিক করতে প্রায় বারো হাজার টাকা লাগবে। আমি কল মিস্ত্রী রাজু-কে খবর দিয়েছি। ও একটু বাদে এসে চেক নিয়ে যাবে। কোনওরকম ভূমিকা না করে চেকবইটা সামনে রেখে চলে গেল বিমলা।

আমিতবাবু বুঝতে পারলেন এই বাড়ির বারোটা ফ্ল্যাটেই তিনি এখন খলনায়ক! শুধু জানতে পারলেন না, খবরটা চেন্নাই-তে ছেলে অত্রি অবধি পৌঁছেছে কিনা! যাই হোক, নিজের ভুলের মাশুল চোকাতে বারো হাজার টাকার একটা চেক লিখে টেবিলের উপর কলম চাপা দিয়ে বেরিয়ে পড়লেন তিনি। বিমলাদেবী দেখলেন কিন্তু বাধা দিলেন না। লোকটার মনেপ্রাণে আজ একটু মুক্ত হাওয়ার দরকার।

 

ভুলের মাশুল (২-পর্ব)

(পর্ব-২)

টেকো ওসি রামদাস টুথপিক দিয়ে দাঁত খোঁচাতে খোঁচাতে কথোপকথন শুরু করলেন।

—কী মশাই একেবারে রসের ভাণ্ডার হয়ে বসে রয়েছেন যে!

—হে, হে, তা যা বলেছেন, রস ছাড়া তো জীবন অচল। পৃথিবী তো রসেরই ভাণ্ডার। ফলের রস, তালের রস, আখের রস, খেজুর রস, রসগোল্লার রস…।

—থামুন, এইবার আমি আপনার দুটো রসগোল্লার রস বার করব!

ঘাড় নাড়লেন মোহিত দাস। অমিত সেন এবং আশেপাশের বাড়ির দু-চারজন মুখ চাওয়া চাওয়ি করল।

—মনিকা কে? একেবারে বাজখাঁই গলায় খেঁকিয়ে উঠলেন পাঁচতলা থানার ওসি। নামটা শোনার পর মোহিত দাসের চেহারায় কোনও ভাবগতিক লক্ষ্য করা গেল না। সেটা দেখে আরও সুর চড়ালেন ওসি।

—স্পিক আউট, স্পিক আউট, টেল মি হু ইজ মনিকা। কিন্তু যাঁকে উদ্দেশ্য করে কথাগুলো বলা, সে ফ্যালফ্যাল করে শুধু সবার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। এইবার রামদাসবাবু পুলিশি বিক্রম দেখাতে তার হাতের লাঠিটা মোহিতবাবুর চিবুকে ঠেকিয়ে বললেন, ‘মনিকা, মাই ডার্লিং, শালা আপনার পিছনে এই লাঠি …!’ মুহূর্তের মধ্যে নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন, “স্যরি, ভেরি স্যরি, আসলে…।’ অন্য ছন্দে ফিরলেন তিনি।

মোহিতবাবুর আয়াকে আলাদা করে কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করে, অয়ন দাসের বাড়ির পজিশন ইত্যাদি দেখে ফিরে গেলেন ওসি রামদাস মণ্ডল। যাওয়ার সময় তার সনাক্তকরণ রিপোর্টও প্রকাশ করে গেলেন। এটা বয়সজনিত মানসিক দুর্বলতা। জীবনের চলার পথে এসব এড়িয়ে চলাই শ্রেয়।

অমিতবাবু কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলেন, তাকে থামিয়ে দিয়ে হেসে উত্তর করলেন ওসি, ‘ভুল তো মানুষ মাত্রই করে, মিঃ সেন, না কি?’ বাদী পক্ষের অয়ন দাস নীচে দাঁড়িয়েছিলেন, তাকে এ ব্যাপারে আর বাড়াবাড়ি না করার নির্দেশ দিয়ে আসল নাটকের মঞ্চ ছেড়ে জিপে উঠলেন ওসি।

মোহিতবাবুর সেই ঘটনা অনেক রজনী অতিক্রান্ত করেছে। কিন্তু আমিতবাবুর এইরকম ভুল মাঝে মাঝেই কেন হয়, তা তিনি নিজেই বুঝতে পারেন না। ওসি রামদাসের কথা মতো মোহিতবাবুর সঙ্গে তুলনা করতে থকেন তিনি। কিন্তু অমিতবাবুর তো করোনা হয়নি। তাহলে? অমিতবাবুর স্ত্রী বিমলাও স্বামীর নানাবিধ অস্বাভাবিক ব্যবহারে নাজেহাল হয়ে যান। কিন্তু তার কিছুই করার নেই। তিনি নিরুপায়।

আজকের ঘটনাটাই ধরা যাক। বাড়ি থেকে মিনিট দশেক হাঁটাপথে ভগবানদাস পার্কে প্রত্যেকদিন সকালে একেবারে নিয়ম করে প্রাতভ্রমণে বেরোন অমিত সেন। সকালে টয়লেটে গিয়ে দেখেন জল নেই। তার মানে, মিউনিসিপালিটির কলের জল গতকাল রাতে আসেনি। এখন একমাত্র ভরসা ভূগর্ভস্থ জল। অমিতবাবু চাবি নিয়ে একতলায় পাম্প ঘরে সুইচটা অন করে হাঁটতে বেরিয়ে গেলেন। তাঁদের পেল্লাই ট্যাঙ্ক ভরতে প্রায় এক ঘন্টারও বেশি সময় লাগে। ততক্ষণে তিনি বাড়ি ফিরে আসবেন। কিন্তু ঘটনাটা যে এরকম ঘেঁটে বর্ণপরিচয়ের সব অক্ষর ধারণ করবে তা তিনি বুঝতে পারেননি। তাহলে কি তার মস্তিষ্ক ও স্নায়ুর কার্যক্ষমতা দিন দিন লোপ পাচ্ছে। তিনি কি অ্যালজাইমার রোগের শিকার! আজকাল কিছুই বুঝতে পারেন না অমিতবাবু। সেদিন মোহিবাবুর বাড়িতে এসে কেমন যেন একটা উপলব্ধি হল।

ভগবানদাস পার্কে দু-পাক চক্কর মেরে নিত্যদিনের মতো পার্কের বাঁধানো পাথরের বেঞ্চে বসে কপালভাতি প্রাণায়ম করছিলেন অমিত। কেষ্ট দাস আর তারক সিং এসে পাশে বসে পড়ল। কপালভাতি চটকে গেল। বিহারের ছাপরা থেকে কলকাতায় এসে একটা ওষুধের দোকানে কাজ করে তারক সিং।

ক্রমশ…

ভুলের মাশুল (১-পর্ব)

এখন সকাল। রোদ্দুরের তেজটা সেরকম বোধ হচ্ছে না। প্রিন্সেপ ঘাটের উন্মুক্ত আকাশের নীচে বসে আছেন অমিত সেন। ফোর্ট উইলিয়ামে কাজ করার সুবাদে আগে এখানে কতবার এসেছেন। এখন আর সেরকম ভাবে আসা হয় না। ঘাটের চারপাশজুড়ে আকাশ কমলা হওয়ার দৃশ্যটা কতদিন দেখেননি তিনি! চার দিকের ভিড় কমে যাচ্ছে দেখতে দেখতে। এটাই স্বাভাবিক। বাড়ি গিয়ে রেডি হয়ে প্রায় সবাইকে নিজের কাজে বেরুতে হবে। সে তাড়া অমিত সেনের নেই। আজ তাঁর একটু নিজের সঙ্গে বোঝাপড়া করবার দরকার ছিল। তাই সটান চক্র রেলে চেপে এখানে এসেছেন।

আজ আবার ঘটনাটা ঘটল। এই নিয়ে কতবার যে হল আর মনে করতে পারছেন না অমিত সেন। কিছুদিন আগে বাসে উঠে মনে পড়ল দরজাটা লক করা হয়নি। মাঝরাস্তায় বাস থেকে নেমে রিকশা করে বাড়ির সামনে এসে দেখেন তার ধারণা ভুল। দরজা বন্ধ। ব্যাংক-এ পাশবই আপ ডেট করতে গিয়ে দেখেন পাশবইটা সঙ্গে আনা হয়নি। এসব তো ঠিক আছে। কিন্তু আজকেরটা একেবারে সাংঘাতিক ভুল। কথায় বলে ভুলের মাশুল। কড়ায় গণ্ডায় একেবারে বারো হাজার টাকা বেরিয়ে গেল। এরপর চলবে জলকষ্ট। তাঁদের চার-পাঁচটা বাড়ির পরে থাকেন মোহিত দাস। তিনি কিছুদিন করোনা রোগের শিকার হয়েছিলেন। যমে-মানুষে টানাটানি করে বাড়ি এলেন কিন্তু ব্রেন-এর অবস্থা খুব খারাপ। কিছুই মনে রাখতে পারেন না। উলটোপালটা বকেন। মোহিতবাবু-র একমাত্র মেয়ে বিদেশে। আয়া-নির্ভর জীবন। আয়ার চড়-চাপট খেয়ে জীবন কাটে। সেই মোহিত দাসের বাড়িতে কিছুদিন আগে পুলিশ এল। দীর্ঘদিন একই পাড়ায় থাকার সুবাদে মোহিত দাসের সঙ্গে অমিত সেনের ভালোই সখ্যতা আছে। আজকাল অবশ্য দেখা সাক্ষাৎ হয় না বললেই চলে। অভিযোগ মারাত্মক। মহিলার শ্লীলতাহানি।

আশেপাশের বাড়ি থেকে গুঞ্জন উঠল, তাহলে কি আয়ার সঙ্গে! এই বয়েসে! ছিঃ ছিঃ ইত্যাদি। পরের ঘরের কুৎসা পেয়ে যে যত পারে বেলুন ফোলাতে শুরু করল। কেউ কেউ আবার এইসব ঘটনাকে মোহিতবাবুর সাময়িক যৌন উত্তেজনা ছাড়া আর কিছুই নয় বলে আখ্যায়িত করল। অমিতবাবুর এইসব ন্যাস্টি কথাবার্তা মোটেই ভালো লাগল না। তিনি নিজে মোহিতবাবুর বাড়ি উপস্থিত হলেন। কিন্তু সেখানে গিয়ে দেখলেন ব্যাপারটা অন্য। এক্কেবারে রোমান্টিক।

অয়ন দাস তাঁর স্ত্রী মনিকাকে নিয়ে মোহিতবাবুর পাশের বাড়িতেই থাকেন। উত্তর কলকাতার বাড়িগুলো সব গায়ে গায়ে লাগানো। এক ছাদ থেকে অন্য ছাদে ঝপাং ঝপাং করে লাফিয়ে চুরি করতে চোরেদের এখানে খুব মজা। এখন অবশ্য এসব ঘটনা শোনা যায় না। তবে উঁকি ঝুঁকি মারলে প্রতিবেশীর বেডরুমে চোখ পৌঁছে যায়। সেই চোখই হয়েছে ভিলেন।

মোহিতবাবু নাকি প্রায়শই অয়নবাবুর বাড়িতে উকিঝুঁকি মারেন। মনিকাকে নাম ধরে ডাকেন। বয়সে বড়ো, তাছাড়া ভুলো মনের মানুষ এইসব ভেবে অয়ন বা মনিকা খুব একটা পাত্তা দেননি। কিন্তু শেষ কয়দিন মোহিবাবুর মাথার ব্যামো একেবারে এভারেস্টের চূড়ায় পৌঁছে গেছে। প্রায়ই কলতলায় যাওয়ার সময় জানলার ফাঁক দিয়ে ‘মনিকা, মনিকা’ বলে হাঁক পেড়ে চলে যান। এতেও ঠিক ছিল। তিন দিন আগে দু’তিনবার, ‘মনিকা, ও মাই ডার্লিং’ সুর ভেঁজেছেন। ব্যস আর যায় কোথায়! রাহুল দেব বর্মনের এই কীর্তিকে একেবারে খাটো করে দেখতে রাজি নন তারা। একটা এসপার ওসপার করে ছাড়বেন। তাই সহ্য করতে না পেরে অবশেষে অয়ন-রা পুলিশের দারস্থ হয়েছেন। পুলিশ যদি বুড়োকে একটু আচ্ছা করে কড়কে দেয়।

পাঁচতলা থানার ওসি রামদাস মণ্ডল একজন রসিক এবং সমপরিমাণ বদমেজাজি ব্যক্তি। নিজে মাঝেমধ্যে পাড়ার গজিয়ে ওঠা শখের থিয়েটারে ছোটোখাটো পার্ট করে প্রচুর হাততালি কুড়িয়েছেন। খুব সহজেই সমস্যার সমাধান করেন বলে পুলিশমহলে বেশ ওজনদার। রামদাস ওসি যখন মোহিত বাবুর কাঁটাপুকুরের বাড়িতে এলেন, তখন অমিতবাবু একটু অবাকই হলেন। সিনেমার শুটিং-এর মতো ক্যামেরার পরিবর্তে হাতের আঙুলগুলো ভাঁজ করে চোখের সামনে এনে বিভিন্নরকম অঙ্গভঙ্গি করে মোহিত বাবুকে মাপতে লাগলেন। হি ইজ পারফেক্টলি অল রাইট। তার কথা শুনে মোহিতবাবু দেঁতো হাসি হাসলেন। অমিতবাবু হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন।

ক্রমশ…

 

 

জোড়া শালিক (শেষ পর্ব)

শেষ পর্ব

একবার সুশীলা এবং সুনীল ব্যাংক থেকে বেরিয়ে বাড়ি ফিরছে। সুনীলের বাইকের পিছনে সুশীলা বসল। হঠাৎ করে ব্যাংকের দরজার বাইরে পেয়ারা গাছেতে জোড়া শালিকের একটি ডেকে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে অন্য শালিকটাও কাঁই কাঁই করে উঠল। সুনীল তখন সবে বাইক স্টার্ট দিয়েছে। গাছটা ওদের ঠিক ডান পাশে। ভালো করে দেখার জন্য সুশীলা ‘রুকিয়ে জি’ বলে লাফিয়ে নেমে পড়ল বাইক থেকে। কান হেলমেটে ঢাকা থাকাতে সুনীল কিছুই শুনতে পায়নি। বাইক ব্যাংকের পরিসর থেকে বেরিয়ে বাড়ির রাস্তা ধরল।

জোড়া শালিকে মাথা ঠোকা শেষ হলে সুশীলা সংবিৎ ফিরে পেয়ে দেখল সুনীল ও বাইক দুটোই ধারে কাছে নেই। এদিকে অনেকটা যাওয়ার পর সুনীল অনুভব করল পিছনটা বেশ হালকা লাগছে। পিছনে তাকিয়ে দেখে বউ নেই। দুশ্চিন্তায় বাইক ঘোরাল ব্যাংকের দিকে। ব্যাংকে পৌঁছে অবাক, সুশীলা সেখানে নেই! সুনীলের সঙ্গে আসবে বলে সুশীলা ফোনটাও আনেনি। কী করবে ভাবছে, এমন সময়, গেটের বাইরে বসে থাকা মুচিটা বলল, ‘সাব কিসিকো ঢুঁঢ রহা হ্যায় ক্যায়া?’

সুনীল বলল, ‘মেরি পত্নি কুছ দের পহলে এহি থি, কহা চল দি পতা নহি, ফোন ভি নহি হ্যায় উনকি পাস।’

—এক মেডামজি থোড়া পরিশান দিখ রহি থি। ও তো পয়দল চল দিয়ে।

সুনীল আর্তস্বরে বলল, “কিধার চল দিয়ে, দেখা আপনে?’

—জি সাহাব বাঁয়ে তরফ গয়ি, জবাব দিল মুচি।

এবার প্রমাদ গুনল সুনীল, উলটো দিকে হাঁটা দিয়েছে সুশীলা। বাইক ঘোরাল ডান দিকে। কিছুটা এগোতেই দেখা পেল সুশীলার। ও হেঁটেই বাড়ি যাবে, কিছুতেই সুনীলের বাইকে চড়বে না। অনেকবার সরি বলার পরেও মানতে নারাজ। অগত্যা সুনীল বলল, ‘মগর হামারা ঘর দুসরা তরফ হ্যায়, রাস্তাপে খো যাওগি।’ এবার ভয় পেয়ে গেল সুশীলা, ফিরে এসে বাইকে বসল।

এহেন সুশীলাদেবীর ঝোলা বারান্দার সামনে কবিতাদেবীর বারান্দা। কবিতাদেবী এবং ওনার স্বামী দুবেজি ধার্মিক প্রকৃতির। দুবেজি সকালবেলায় স্নান করে সূর্য প্রণাম করেন। এরকম একদিন, দুবেজি যখন সূর্য প্রণাম সারছেন, সেই সময় এক জোড়া শালিক কচর কচর করতে করতে দুবেজির বারান্দার মাথার উপর কার্নিশে এসে বসল। জোড়া শালিকের কচকচানি শুনে সুশীলা দৌড়ে এসে দরজা খুলে জোড়া শালিক সকাল সকাল দেখে আনন্দে আত্মহারা। ভাবাবেগে পরের পর ফ্লাইং কিস ছুড়ে দিল।

ভগবান বন্দনায় মত্ত দুবেজি পরপর চুমু ছুড়ে দেওয়ার আওয়াজ শুনে চোখ খুলে দেখেন, সুশীলা দেবী চোখ বুজে ক্রমাগত চুমু ছুড়ে দিচ্ছেন তার দিকে। বয়সে অনেকটা ছোটো সুশীলা ওনার থেকে। দুবেজির স্ত্রী রীতিমতো দাপুটে। ভগবানবন্দনা অসম্পূর্ণ রেখে বেশ অসন্তুষ্ট হয়ে ভিতরে চলে গেলেন দুবেজি! সংবিৎ ফিরে এল সুশীলার, এবার খেয়াল হল তির ভুল জায়গায় বিঁধেছে!

চুমুর আওতায় শালিক ছাড়া দুবেজিও ছিলেন। শালিক-চুম্মা দুবেজি-চুম্মাতে পরিণত হয়েছে। লজ্জায় মাটিতে মিশে যাওয়ার উপক্রম। দুবেজিও চাচা নিজের প্রাণ বাঁচা, ঝুল বারান্দায় আসাই বন্ধ করে দিলেন। সুশীলা অনুশোচনায় দগ্ধ। এ কি কাণ্ড হল! ছেলে বড়ো হয়ে গেছে, পাঁচকান হলে আর রক্ষে নেই। বাধ্য হয়ে স্বামী সুনীলকে বলল কিছু একটা করতে।

সুনীল সাফ জানাল, ‘হামসে কুঁছো না হতোই। ই তোহার লাফরা, হম না পরবু।’

এমত অবস্থায় একদিন নীচে মন্দিরে যেতে গিয়ে সামনে পেলেন দুবেজি পত্নি কবিতাজিকে। হিম্মত করে বলেই ফেললেন সমস্ত ঘটনা। সব শুনে কবিতাজি বললেন, ‘ছোড়িয়ে আপ ময়না কো দিয়ে, ক্যায়া দুবেজি কো দিয়ে — ম্যায় ক্যায়া জানু। ঔরতকো সমাহালকে রহনা চাহিয়ে। হমলোগ হ্যায় সজ্জন ব্রাহ্মণ।’ বলে গটগট করে চলে গেলেন কবিতা।

সুশীলার মাথায় হাত— এবার বোধহয় পাড়ায় ঢিঢি পড়তে আর খুব বেশি দেরি হবে না!

 

জোড়া শালিক (পর্ব-২)

পর্ব ২

সুশীলা দেখতে সুন্দরী, তার উপর মাঞ্জা দিয়ে গেছিল। বাড়ি ফিরে সুনীল, শালাকে ফোন করে বলল, ‘অব সে ডগডর কে পাস অপনি পাগলেট দিদিকো তুমহি লেকে জানা, আজ বহুৎ বেইজ্জত হুয়া মেরা।’

বলা বাহুল্য ডাক্তারের ওষুধ বেশিদিন চলল না এবং চরিত্রের পরিবর্তনও এল না। এই অসুবিধার জন্য সুনীল কোনও লম্বা দূরত্বের ট্রেনজার্নি সুশীলাকে নিয়ে করে না। কারণ সুশীলা ট্রেনের টয়লেটে কিছুতেই যাবে না। একবার ভাগ্নির বিয়েতে গুয়াহাটি নিয়ে গেছিল। গুয়াহাটি পৌঁছোতে বিকেল হয়ে গেল। সমস্যা দেখে, সুনীল ফিরতি পথে ফ্লাইটে এল।

সুশীলার এই আচরণে সবচেয়ে দুঃখী সুশীলার শ্বাশুড়ি মা। ভদ্রমহিলা যৌথ পরিবারে সংসার করেছেন, ভাসুর, দেওর ও জায়েদের সঙ্গে মিলেমিশে থাকতেন। ওনারা এখন বাড়ির কাছাকাছি সবাই থাকেন। এছাড়া সুশীলার তিন ননদ। তারাও কাছাকাছি থাকেন। এরা সবাই সুশীলার ছোঁয়াছুঁয়ির ও সেই নিয়ে ঘ্যানঘ্যানানিতে বিরক্ত হয়ে সহজে এই বাড়িতে পা রাখেন না। এই নিয়ে বাড়িতে কম অশান্তি হয়নি। কিন্তু সুশীলা নিজেকে একটুও বদলায়নি।

নিজের এই চারিত্রিক অবস্থা নিয়ে সুশীলা কখনও মনে মনে নিজেই বিব্রত বোধ করে। বুঝে পায় না কী করবে! একেক সময় মনে করে কিছুতেই এসব নিয়ে ভাববে না। কিন্তু সেরকম কিছু দেখলে মনের মধ্যে খচখচ হতেই থাকে। নিজের এই বিব্রত বোধ কাউকে বললে একমাত্র রেখা ছাড়া সবাই বিস্তর জ্ঞান দেয়।

কাজের মেয়ে রেখা সুশীলাকে খুব তেলিয়ে চলে। রেখাই একমাত্র সুশীলাকে বোঝে, এরকমটাই সুশীলা মনে করে। তার জন্য মাঝে মাঝে দুশো চারশো টাকা রেখাকে ধারও দেয়। সেগুলো পরে ধার থেকে দান-এ পরিবর্তিত হয়ে যায়। টাকা ফেরত কখনওই বেচারি রেখা দিতে পারে না। তবুও টাকা নেওয়ার সময় ধার বলেই সুশীলার থেকে নেয়।

একদিন সুশীলা যখন ওর মনের দুঃখের কথা রেখাকে বলে, রেখা ওকে আশ্বস্ত করে, বলে ও এক গুনিনকে জানে যার অব্যর্থ ঝাড়ফুঁকে এসব নিমেষে ঠিক হয়ে যায়। সেইমতো বাড়ির লোককে লুকিয়ে সুশীলা রেখার সঙ্গে গুনিনের ডেরায় পৌঁছোয়। গুনিন গঙ্গার পাড়ে এক পোড়ো বাড়িতে ভেড়া বানিয়েছে। বাড়ির ভিতর ঢুকেই সুশীলার গা ছমছম করতে থাকে। নিজেকেই নিজে দোষ দেয় এই ভেবে যে, এরকম জায়গায় কাজের লোকের কথায় এই ভাবে আসাটা ঠিক হয়নি।

সুশীলার অবস্থা দেখে রেখা ওকে অভয় দেয়। সুশীলাকে নিয়ে ভিতরে ঢোকে। গুনিন তখন এরকমই আরেক রোগীর রোগ সারাতে ব্যস্ত। সমানে একটা ময়ূরপঙ্খি ঝাড়ু দিয়ে সপাং সপাং করে পিঠে মারছে, আর চলছে উটপটাং মন্ত্র উচ্চারণ। মার খাওয়া রোগী ঘাড় দুলিয়ে দুলিয়ে গোঙিয়ে চলেছে। সব মিলিয়ে এক ভয়ংকর ভয়াবহ পরিবেশ।

সুশীলা এক ঝটকায় রেখার হাত ছাড়িয়ে পিছন ফিরে দৌড় লাগাল। থামল এসে গলি থেকে বেরিয়ে মেন রোডে। পিছনে পিছনে ‘এ ভাবি, এ ভাবি’ বলে চীৎকার করতে করতে রেখাও দৌড়োতে দৌড়োতে এসে পৌঁছেছে। একটা খালি অটো থামিয়ে তাতে চেপে বসল সুশীলা। রেখা তখনও পিছনে ডেকে চলেছে। অ্যাপার্টমেন্টের ভিতরে ঢুকে শান্তি পেল সুশীলা। এরপর রেখার চাকরিটা ওই বাড়িতে আর একদিনের জন্যও টেকেনি।

জোড়া শালিকে খুব আস্থা সুশীলার। জোড়া শালিক দেখলে দিন ওর খুব ভালো যায়। এক শালিক দেখলে নাকি খুব খারাপ যায়। নিদেনপক্ষে শাশুড়ির বকা তো খেতেই হয়। এর একটা নিদানও বের করেছে সে। যেদিন এক শালিক দেখে আর জোড়া শালিক দেখা হয় না, সেদিন কপালে তর্জনি দিয়ে ‘জ’ আঁকে। তাতে নাকি কিছুটা রেহাই হয়। তবে সকাল সকাল ভুল করে একটা শালিক দেখলে ছাদে গিয়ে দ্বিতীয়টার দর্শন না করে খান্ত হয় না সে।

ক্রমশ…

 

জোড়া শালিক (পর্ব-১)

আমাদের পাটনার আবাসনের ফ্ল্যাটগুলোর বেশ কিছু ব্যালকনির অবস্থান এরকম, একটা ব্যালকনিতে দাঁড়ালে অন্য ব্লকের ব্যালকনির ঠিক মুখোমুখি দাঁড়ানো যায়। এর সুফল অনেক, যেমন আমার স্ত্রী-কে এঘর ওঘর ঘুরে না পেলে আমি সোজা ব্যালকনিতে পৌঁছে যাই। দেখি সামনের ফ্ল্যাটের পল্লবীর মায়ের সঙ্গে গল্পে মশগুল। পল্লবীর বাবা চাকরিসূত্রে পাটনার বাইরে কর্মরত। সামনাসামনি ব্যালকনি হওয়ার কুফলও আছে! আজকের গল্প সেই কুফল কে নিয়ে।

আমার পাশের ফ্ল্যাটের গৃহিণী হলেন সুশীলা শর্মা। তিনি ভালোরকম খুঁতখুঁতে ও বাতিকগ্রস্ত ভদ্রমহিলা। বিড়াল রাস্তা কেটে বেরিয়ে গেলে, বরকে ধমকে বাইক থামিয়ে দেন। বেরনোর সময় হাঁচি পড়লে, তখনকার মতো যাত্রা বন্ধ। সৌন্দর্য নিয়ে প্রশংসা করলে বলেন – নজর মত লাগাইয়ে জি। রাস্তায় ভুলবশত স্বামীর বাইক কোনও বিষ্ঠার ওপর দিয়ে গেলে বাইক, স্বামী ও নিজেকে স্নান না করিয়ে ছাড়েন না।

একবার ব্যালকনিতে গিয়ে দেখেন পিঁপড়ের সারি রেলিং-এ শুকোতে দেওয়া বালিশের উপর দিয়ে চলে যাচ্ছে, আর তারা আসছে পাশের একটা নির্দিষ্ট পাইপ বেয়ে। ব্যালকনির পাশেই বাথরুম, পাইপগুলো বাথরুম থেকেই বেরিয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে বালিশগুলো পত্রপাঠ বিদায়। ওনার এই অদ্ভুত আচরণে স্বামী সুনীল বেচারা বিরক্ত এবং পরিশ্রান্ত। কোনও ভাবে সুনীলকে কোনও পাইপের তলা দিয়ে আসতে দেখলে ধুন্দুমার লেগে যায় শর্মা পরিবারে। বেচারিকে বাড়িতে ঢুকে সোজা বাথরুমে স্নান করতে হয়। শাস্তির বহর এখানেই শেষ নয়, এর থেকেও বড়ো শাস্তি পেতে হয়।

শীতের দিনে মাঝ রাত্তিরে আদিম খেলার ইচ্ছা জাগলে, সম্ভোগের পর বেচারা সুনীলকে ৫ ডিগ্রি টেম্পেরেচারেও পুরোদস্তুর স্নান করতে হতো। এহেন অত্যাচারের ফলে প্রায় বারো মাসই পাশের ফ্ল্যাটে সুনীলের ‘হ্যাঁচ্চো” “হ্যাঁচ্চো’ লেগেই থাকত। সেই হাঁচিও আবার আমার জন্য বিশেষ বিশেষ সময়েতেই বরাদ্দ থাকত। আমি বাড়ির থেকে বেরোতে গেলে, ঘুম থেকে উঠে মাটিতে পা দেওয়ার আগে, ভাতের থালায় প্রথম গ্রাসটা মুখে দেওয়ার প্রাক্ মুহূর্তে ইত্যাদি ইত্যাদি।

সুশীলার এই পাইপ নিয়ে শুচিবাই অনেকেই জেনে গেছেন। কেউ কেউ ভালোবেসে নাম দিয়েছেন পাইপওয়ালি ভৌজাই। এক অদ্ভুত যুক্তিতে বলির পাঁঠা হয়েছিল বাড়ির দ্বিতীয় বাথরুমের ওয়েস্টার্ন স্টাইলের কমোডটা। সেটিকে সমূলে উৎপাটিত করে সিমেন্ট বালি দিয়ে একটা স্মৃতি সৌধ করে রাখা হয়েছে। যুক্তিটা ছিল কমোড মানে ছোঁয়াছুঁয়িতে পুরো শরীর অশুচি। বাড়ির অন্য লোকরাও তিতিবিরক্ত হয়ে ওটাকে সাবেকি দেশি প্যানেতে বদলাননি। সুনীল তো বিরক্ত হয়ে যৌবনেই আলাদা বিছানায় শোওয়ার ব্যবস্থা করে নিল।

ছেলে ঈশান মায়ের এই ব্যবহারে ভীষণ ক্ষিপ্ত। কোনও বন্ধুকে বাড়িতে আনে না। আসলেই প্রশ্ন— “ঈশানওয়া তোরা দোস্তলোগ নীচলকা পাইপ নহি না ছুল হ্যায়?’ কী অপমান! কী অপমান! আমরাও কোনও দরকারে দরজায় দাঁড়িয়েই কথা সেরে নিতাম, নিতান্তই নিরুপায় না হলে ঘরে ঢুকতাম না।

একবার হোলিতে ধুন্দুমার। ফ্ল্যাটের ছাদে বিকেলবেলায় সবাই সবাইকে আবির লাগাচ্ছে। আমরা সবাই সুশীলা ভাবিকে এড়িয়েই যাই। সেবার নতুন ভাড়াটে এসেছেন মনোজজি। সুশীলা ভাবি দেখতে মন্দ ছিলেন না। বেচারা মনোজজি একমুঠো আবির নিয়ে সুশীলা ভাবির গায়ে দিয়ে বললেন— ‘মেরি ইতনি সুন্দর ভাবিকো কোই ধ্যান হি নহি দে রহা হ্যায়।’

আবির লাগানোর পর সুশীলা ভাবির মনোজজির স্ত্রীকে সোজা সাপটা প্রশ্ন— ‘বহনজি, মনোজজি উধার ওয়ালা পাইপ নহি না ছুঁয়া।’ লেগে গেল ধুন্দুমার। ছোঁয়াছুঁয়ির রোগ সুশীলার কিছুতেই যায় না। রোজ বাড়িতে অশান্তি, ভাইয়েরা এসে বোঝায়, মা এসে বকা দিলেন— কোনও পরিবর্তন নেই। অগত্যা সবাই মিলে অনেক কষ্টে রাজি করাল মনোবৈজ্ঞানিক ডাক্তার দেখানোর, নিয়ে যাবে সুনীল। বউয়ের নির্যাতনে দিশাহারা সুনীল বেচারা সাদামাটা থাকে। বউ, সংসার এবং অফিস সামলাতে গিয়ে অনেক সময় দাড়ি কাটার সময় পায় না।

কর্তা-গিন্নি পৌঁছোলেন ডাক্তারের চেম্বারে। ডাক্তারের পসার ভালো, লাইনে অপেক্ষা করতে হল। পেশেন্টদের নম্বর দেওয়া হয়েছে। সময় আসলে নম্বর ধরে ডাকা হচ্ছে। ওদের নম্বর আসতেই ওরা ডাক্তারের ঘরে ঢুকতেই সুশীলাকে আটকে দিয়ে সুনীলের হাত ধরে টেনে নিয়ে বলল— ‘রুকিয়ে মেডাম, পেশেন্টকো পহলে জানে দিজিয়ে।’

ক্রমশ…

দুর্গা (শেষ পর্ব)

শেষ পর্ব

গিরিডি স্টেশন আসতেই শুভায়ুর মন থেকে দুর্গার কথা কর্পূরের মতোই উবে গেছিল। তার কারণ পাটনার মতো অজানা অচেনা জায়গায় গিয়ে কোথায় উঠবে, কোথায় থাকবে সেটাই ছিল তখন চিন্তার বিষয়। কথায় বলে জীব দিয়েছেন যিনি, আহার দেবেন তিনি। তা না হলে সেদিন ট্রেনের কামরায় গেরুয়াবসন পরা এক সন্ন্যাসীর সঙ্গে তাদের দেখা হবে কেন? কেন সেই সন্ন্যাসী দুই বন্ধুর ভাবগতিক দেখে সন্দেহের বশে বলে উঠলেন, ‘তোমরা কি বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছে?’

শোভন বলেছিল, ‘হ্যাঁ। আপনি ঠিকই ধরেছেন।’

—কিন্তু কেন? সন্ন্যাসী আবার তাকে প্রশ্ন করেছিলেন।

শোভনের মুখ থেকে সব শুনে তিনি বলেছিলেন, ‘আমাদের রাঁচিতে একটা আশ্রম আছে। সেখানে মিশনের সেবামূলক কাজ যদি করতে চাও তাহলে আমার সঙ্গে যেতে পারো। ওখানে তোমাদের থাকা-খাওয়ার কোনও অসুবিধা হবে না। আর যদি সেখানে ভালো না লাগে, তাহলে আমি তোমাদের আটকাব না।’

এমন সুবর্ণ সুযোগ হাতছাড়া করে কে? আশ্রমে তিনমাস অজ্ঞাতবাসে থাকার পর শোভনের আর মন টিকল না। কলকাতার ছাত্র রাজনীতির হাতছানি তাকে অস্থির করে তুলল। শুভায়ুরও বাড়িতে ফেরার জন্য মন টানছিল। শেষে দুই বন্ধু রাঁচির পাট তুলে চলে এল গ্রামের বাড়িতে।

শুভায়ু ফিরে এসে ভর্তি হল কলকাতার সুরেন্দ্রনাথ কলেজে, আর শোভন মেতে রইল রাজনীতির আখড়ায়। রাঁচি থেকে ফিরে আসার পর শুভায়ু দুর্গার সঙ্গে আর দেখা করেনি। কারণ শোভন যাকে ভালোবাসে, সেখানে ভাগ বসাতে তার মন ওঠেনি। তার কাছে তখন প্রেমের চেয়েও বড়ো ছিল শোভনের বন্ধুত্ব। যদিও দুর্গার সঙ্গে নিভৃতে একটু কথা বলার জন্য, তার গায়ের সুগন্ধটুকু পাওয়ার জন্য শুভায়ুর মনপ্রাণ উতলা হয়ে উঠত। কিন্তু শোভনের কথা ভেবে সে নিজেকে দুর্গার কাছ থেকে সরিয়ে নিয়েছিল। দুর্গা পথে ঘাটে যতবার কথা বলার চেষ্টা করেছে, সে এড়িয়ে গেছে। একবার জয়নগরের চড়কের মেলায় হঠাৎ তার সঙ্গে দুর্গার দেখা হয়ে গিয়েছিল।

দুর্গা তার পথরোধ করে দাঁড়িয়ে কান্নার স্বরে বেজে উঠেছিল, ‘তুমি এ ভাবে আমাকে এড়িয়ে যাচ্ছ কেন? আমি কী দোষ করেছি?”

শুভায়ু তার অশ্রুসজল চোখের দিকে তাকিয়ে নির্লিপ্ত ভাবে বলেছিল, “দোষ তুমি করোনি। তোমাকে ভালোবাসাটাই আমার অন্যায় হয়েছে।’

—কিন্তু কেন? দুর্গার অশ্রুভেজা চাপা স্বর শোনা গিয়েছিল।

দুর্গাকে সে আঘাত দিতে চায়নি। তবু সেদিন শুভায়ু তার ক্ষোভ উজাড় করে দিয়ে দুর্গার উদ্দেশে বলেছিল, “দু’-নৌকায় পা দিয়ে চলা যায় না। শোভনকে তুমি ভালোবাসো, এ কথা জানলে আমি কিছুতেই তোমাকে মন দিতাম না!”

সে কথা শুনে দুর্গা অশ্রুসজল চোখে বলেছিল, ‘তোমার ধারণা সম্পূর্ণ ভুল। আমি শোভনদাকে দাদার মতো সম্মান করি!” দুর্গা তখন হাত নেড়ে আরও কী যেন বলতে চেয়েছিল। কিন্তু শুভায়ু তাকে আর কোনও কথা বলার সুযোগ না দিয়ে দ্রুত বাড়ির উদ্দেশে পা বাড়িয়েছিল।

এর পর গঙ্গা দিয়ে অনেক জল গড়িয়ে গেছে। কলকাতায় থেকে কলেজে পড়ার জন্য শুভায়ু বারড্রোন গ্রাম থেকে পাততাড়ি গুটিয়ে শিয়ালদার একটি মেসবাড়িতে এসে উঠেছিল। লেখাপড়ায় ব্যস্ত থাকার জন্য দুর্গার কথা তার মনেই ছিল না। তার তখন একটাই চিন্তা, লেখাপড়া শিখে নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে।

একদিন রাতে মেসবাড়িতে বসে শুভায়ু এক মনে পার্ট টু পরীক্ষার পড়া মুখস্থ করছে— হঠাৎ শোভন ঝড়ের গতিতে এসে বলল, ‘দুর্গার বিয়ে হয়ে গেছে জানিস?’

সে কথা শুনে শুভায়ু হকচকিয়ে গিয়ে বলেছিল, ‘সে কি কার সঙ্গে!’

—বাসুলডাঙা গ্রামের বাড়ুজ্যেবাড়ির ছোটো ছেলের সঙ্গে।

—কিন্তু আমি যে জানতাম দুর্গা তোকে ভালোবাসে।

—ভুল শুনেছিস, ও আমাকে দাদার মতো ভালোবাসে। আসলে দুর্গা তোকে মন প্রাণ দিয়ে ভালোবাসত।

—তুই জানলি কী করে?

—বিয়ের পর ওর সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল। দুর্গা আমাকে সব কথা বলেছে। তুই যদি আমাকে একবার বলতিস তা হলে বউদিকে বলে তোর সঙ্গেই দুর্গার বিয়ে দিতাম।

আজ মাকে পুড়িয়ে আসার পর দাওয়ায় বসে দুর্গার দিকে তাকিয়ে শুভায়ুর মনে হল জীবনে একটা মস্ত বড়ো ভুল হয়ে গেছে। মাকে দাহ করে শ্মশান থেকে ফিরে শুভায়ুর মনে যে শোকের আগুনটা ছাইচাপা আগুনের মতো ধিকিধিকি জ্বলছিল, বহুদিন বাদে দুর্গাকে দেখার পর তা যেন ভালোবাসার আগুন হয়ে শতগুন বেড়ে গেল।

সমাপ্ত

 

দুর্গা (পর্ব-৩)

পর্ব – ৩

আজও বেশ মনে আছে দুর্গার লালকালিতে লেখা প্রথম প্রেমপত্রটি দলমঘাটা বাস রাস্তায় এসে লাইট পোস্টের নীচে দাঁড়িয়ে শুভায়ু প্রায় তিরিশবার পড়েছিল। ইচ্ছে করেছিল, তার সেই পবিত্র নিষ্পাপ ভালোবাসার কথা পৃথিবীর সবাইকে জানাতে। সে কারণে সে সন্ধেবেলা প্রেমপত্রটি দেখাতে শোভনের বাড়ি ছুটে গিয়েছিল। কিন্তু শত চেষ্টা করেও দুর্গার লেখা প্রেমপত্র শোভনকে সে দেখাতে পারেনি। একটা অপরাধবোধ তার মনকে সতর্ক করে দিয়েছিল।

সে এক পা এগিয়ে আবার দু’পা পিছিয়ে এসেছিল। তার কারণ হল দুর্গা শোভনের দাদার শালি। শোভনের দৌলতেই শুভায়ু দুর্গাদের বাড়িতে যাওয়ার ছাড়পত্র পেয়েছে। শোভনকে চিঠিটা দেখালে যদি সে রাগ করে, যদি তাকে ঘেন্না করে, তা হলে তো শুভায়ুর সব আনন্দটাই মাটি হয়ে যাবে। তাই সে দিন শোভনকে চিঠিটার কথা বলতে পারেনি।

ইতিমধ্যে জল অনেক দূর গড়িয়েছে। দুর্গার সঙ্গে শুভায়ুর প্রেম যখন তুঙ্গে, ঠিক তখনই হায়ার সেকেন্ডারি পরীক্ষার ফল বেরোতে দেখা গেল, শুভায়ু ভালো ভাবেই পাস করেছে। কিন্তু শোভন কম্পার্টমেন্টাল পেয়েছে। শোভনের কম্পার্টমেন্টাল পাওয়ার কারণ হল লেখাপড়ায় তার যতটা না মন ছিল, তার চেয়ে বেশি মনোযোগ ছিল ছাত্র রাজনীতিতে। রাজনীতি করতে গিয়েই তার লেখাপড়ার এই হাল হয়েছিল।

যাই হোক, পরীক্ষায় খারাপ রেজাল্ট করে শোভন যখন মনে প্রাণে ক্ষতবিক্ষত, তখনই সে ঠিক করল যে-দিকে দু’- চোখ যায় চলে যাবে। এ পোড়া মুখ নিয়ে বারড্রোন গ্রামে সে আর থাকতে রাজি নয়। একটা কিছু কাজ জোগাড় করে তবেই সে গ্রামে ফিরবে, নচেৎ নয়। শোভনের মনের কথা জানতে পেরে শুভায়ু তখন তাকে বলেছিল, ‘আমিও তোর সঙ্গে যাব।’

সে কথা শুনে শোভন বাধা দিয়ে বলেছিল, ‘তুই ভালো ভাবে পাস করেছিস। তুই আমার সঙ্গে জাহান্নামের পথে কেন যাবি? তা ছাড়া তোকে কলেজে ভর্তি হতে হবে। তোর এখানে থাকা দরকার।’

শুভায়ু বলেছিল, ‘তোকে জাহান্নামের পথে একা ঠেলে দিতে পারব না। তা ছাড়া তোকে ছেড়ে আমি থাকতে পারব না। আমি তোর সঙ্গে যাবই।’

শুভায়ু জেদ ধরে থাকায় শোভন আর বারণ করতে পারেনি। তার পর একদিন কাউকে কিছু না বলে হাওড়া স্টেশনে এসে পাটনার টিকিট কেটে গয়া প্যাসেঞ্জারে দু’জনে উঠে বসল। ট্রেনটা যখন ধানবাদ স্টেশনে এসে পৌঁছোল, তখন শুভায়ুর বাড়ির জন্য মন কেমন করে উঠেছিল।

শুভায়ু বলেছিল, ‘বাড়ির লোকেরা যদি তোর খোঁজ না পেয়ে পুলিশে খবর দেয়, তাহলে কী হবে?’

—যা হওয়ার তাই হবে। তবে আমি শুধু পাটনায় যাওয়ার খবর দুর্গাকে জানিয়ে এসেছি। বলে শোভন একটা সিগারেট ধরিয়েছিল।

শুভায়ু আবার প্রশ্ন করেছিল, ‘ও কিছু বলেনি।’

—তখন সে কিছু বলেনি। তবে চলে আসার আগে দুর্গা আমার হাতে একটা চিঠি ধরিয়ে দিয়েছে। এই নে পড়ে দেখ। বলে শোভন ট্রাউজারের পকেট থেকে দুর্গার লেখা চিঠিটা বাড়িয়ে দিয়েছিল।

শোভনের হাত থেকে চিঠিটা নিতে গিয়ে শুভায়ুর বুকের ভেতর ক্যানেস্তারা পেটানোর মতো দ্রিমদ্রিম শব্দ হচ্ছিল। তার জন্য তখন হয়তো কোনও অশুভ সংকেত অপেক্ষা করছিল। দুর্গার হাতে লালকালিতে লেখা চিঠিটা চোখের সামনে মেলে ধরতেই দেখা গেল তাতে লেখা রয়েছে- -দোহাই শোভনদা, তুমি ফিরে এসো। তুমি ফিরে না এলে বুঝব আমাকে তুমি একটুও ভালোবাসো না।

—ইতি দুর্গা

চিঠিটা শোভনকে ফিরিয়ে দিয়ে শুভায়ু ট্রেনের জানলার ধারে বসে দূর আকাশের দিকে তাকিয়েছিল। অব্যক্ত যন্ত্রণায় পুড়ে যাচ্ছিল তার দেহ-মন। সেই প্রথম সে বুঝতে পেরেছিল নারী কী বিষম বস্তু। নারী যেমন ভালোবাসা দিয়ে পুরুষ মানুষকে রাজা বানাতে পারে, তেমনি আবার চূড়ান্ত ছলনা করে পথেও বসাতে পারে। দুর্গা শোভনকে ভালোবাসে বলে তার একটুও দুঃখ হয়নি। দুঃখ হয়েছে শোভনকে ভালোবাসার কথা দুর্গা কেন গোপন করল। নারী যে ছলনাময়ী, এ কথা দুর্গা সেদিন চোখে আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছিল।

ক্রমশ…

 

পড়ার জন্য সীমাহীন গল্প-নিবন্ধসাবস্ক্রাইব