সাপ লুডো খেলা

ম্যাডাম, ও ম্যাডাম, ঘুমিয়ে গেছেন যে, কোথায় নামবেন?

সামনে বসে থাকা ভদ্রলোকটির কথাগুলো শুনে ম্যাডাম চোখ দুটো তাড়াতাড়ি খুলে চারদিকটা একবার দেখে নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, এটা কোন স্টপেজ?

চোপান, আপনি কোথায় নামবেন?

সরাইগ্রাম, দেরি আছে?

অনেক। সেই সকাল ৯টার আগে ঢুকছে না, লেটে রান করছে।

‘ও’ বলে ভদ্রমহিলা আবার কিছু সময় চুপ করে শুয়ে হঠাৎ উঠে বসে পড়লেন। তারপর হঠাৎই নিজের মনে দরজার কাছে এসে দাঁড়ালেন। রাত দুটো, কামরার আলো নেভানো থাকলেও মেয়েটির উলটো দিকে বসে থাকা ভদ্রলোক এতক্ষণ শুয়ে শুয়ে ভদ্রমহিলাকে দেখছিলেন। বেশ কিছুটা অস্বাভাবিক মনে হচ্ছিল। একবার উঠে বসছেন, একবার শুচ্ছেন, শুয়ে শুয়ে কেঁদে উঠছেন।

উলটো দিকে বসে থাকা ভদ্রলোকের কেমন যেন সন্দেহ হল। তারপর দরজার কাছে ভদ্রমহিলা এসে দাঁড়াতেই পিছন থেকে তাকে চেপে ধরে ভিতরে ঢুকিয়ে দরজা লাগিয়ে দিলেন। ভদ্রমহিলা ছটফট করলেও আর কোনও উপায় নেই। এমনিতেই ধস্তাধস্তির আওয়াজ শুনে কয়েকজন ঘুমন্ত প্যাসেঞ্জার ঘুম থেকে উঠেও পড়েছেন। ভদ্রলোক সব কিছু বলবার পরে সবাই শুনে অনেক কিছু জানবার চেষ্টা করে গেলেও, কোনও লাভ হল না।

কলকাতার আপ ট্রেন, বাঙালি যাত্রীর সংখ্যাও নেহাৎ কম নয়। কিন্তু ভদ্রমহিলা সমানে চিৎকার করে যেতে লাগলেন, আমাকে ছেড়ে দাও, আমার বেঁচে থাকবার কোনও অধিকার নেই। ভদ্রলোক অনেক বুঝিয়ে শেষে হার মেনে পরের স্টেশনে এক রকম জোর করেই তার সাথে নামালেন।

আজকাল দীক্ষাকে অপর্ণার কেমন যেন অচেনা মনে হয়। যত বয়স বাড়ছে মেয়ের আদিখ্যেতা বেড়ে যাচ্ছে। কয়েকদিন আগেই মেয়েকে একবার বলে, দ্যাখ বড়ো হচ্ছিস এখন এমন ভাবে হাফ-প্যান্ট, গেঞ্জি পরে থাকিস না। কে কার কথা শোনে! কথাগুলো এক্কেবারে ফুত্কারে উড়িয়ে দিয়ে মেয়ে বলে ওঠে, তুমি সেই গাঁইয়াই রইলে, আমার বন্ধুগুলোকে দ্যাখো, সুইম করে, হাফ-প্যান্ট পরে পড়তেও আসে।

সেদিন কথাগুলো শুনেই মাথা ঘুরছিল অপর্ণার। ওদের মাদেরকেও বলিহারি, হাফ-প্যান্ট পরে কেউ বাইরে ছেড়ে দেয়। এই জন্যেই চারদিকে এত সব ঘটনা ঘটছে। আরে বাবা তুমি যদি তৈরি করা খাবার কারও-র মুখের সামনে তুলে দাও, কে আর না খেয়ে থাকতে পারে? আমরাও তো পড়াশোনা করেছি নাকি! ছেলেদের সাথে মিশেওছি।

সুপ্রকাশ নামের একটা ছেলে তো প্রায়ই বাড়ি আসত। ঘন্টার পর ঘন্টা গল্প করত, কই কোনও দিন তো নির্লজ্জ হতে পারেনি। বরং মা যেদিন সুপ্রকাশের সাথে নিজের পিরিওডস নিয়ে আলোচনা করে, সেদিন খারাপ লেগেছিল। সুপ্রকাশ চলে যেতেই মায়ের ওপর রেগে গিয়ে বলেছিল, এসব কথা কেউ ওর সাথে আলোচনা করে? মা অবাক হয়ে উত্তর দিয়েছিল, কেন ও তো আমার ছেলের মতো, ওর কাছে আবার কীসের লজ্জা? দীক্ষারা অবশ্য খোলাখুলি এসব নিয়ে আলোচনা করে।

একদিন অপর্ণার কানেও কিছু কথা আসে। তবে তন্ময় বাড়ি ফিরে আসার পরেই দীক্ষার সাহস একটু বেড়ে যায়। আগে ওর যখন বাইরে পোস্টিং ছিল, অপর্ণাকেই সব কিছু করতে হতো। সে টিউশনের স্যারের সাথে যোগাযোগই হোক অথবা স্কুলের কোনও সমস্যা। ক্লাস এইটে পড়তে তো একটা ছেলে কয়েকদিন খুব পিছনে লেগেছিল। অপর্ণা একাই ছেলেটার বাড়ি খুঁজে সেখানে গিয়ে তার বাবা মায়ের সাথে কথা বলে এবং ছেলেটির সঙ্গেও কথা বলে আসে। তার জন্য অবশ্য দীক্ষা খুব একটা খুশি হয়নি। বরং অপর্ণার ওপর রেগেই যায়।

ক্লাস নাইনে আবার দীক্ষার সাথে একটি ছেলের একটা সম্পর্কও তৈরি হয়। সেখানেও অপর্ণাকে বলতে হয়। তখন তন্ময় শুধু মাসে মাসে টাকা পাঠিয়ে দাযিত্ব পালন করে। এমনকী ফোনে এই প্রেম-টেম কথাগুলো শুনে খুব সাধারণ ভাবেই উত্তর দেয়, এই বয়সে এরকম একটু আধটু হয়, অ্যাডোলেসেন্ট পিরিয়ড, অপোজিট সেক্সের প্রতি একটু ভাব ভালোবাসা জন্মাবেই, তোমারও জন্মেছিল, এখন তুমি অস্বীকার করতেই পারো।

এরপর আর কী-ই বা বলা যায়, শুধু রেগে উঠে বলেছিল, বেশ, কিছু সমস্যা হলে আমাকে কিছু বলতে এসো না।

সমস্যা আর কী-ই বা হতে পারে, একটু প্রেম করবে, ফুর্তি করবে, এটাই তো বয়স।

বেশ, তুমিও তাহলে যেখানে আছো সেখানকার মেয়েের সাথে ফুর্তি করোগে। এখানে আমি সন্ন্যাসিনীর মতো থাকি।

আগে দীক্ষাকে বকে মেরেও কিছু কাজ হতো, কিন্তু তন্ময়ের আসার পরেই কী রকম সব যেন গণ্ডগোল হয়ে যেতে আরম্ভ করল। এমনি তো ফোর্সের কাজ, রিটায়ারমেন্ট নিয়ে বাড়ি এসে মাস ছয়েকের মধ্যেই আবার একটা সরকারি চাকরিও জুটিয়ে নেয়। এই কয়েক মাস রিটায়ারমেন্টের কিছু কাগজপত্র তৈরির জন্য এদিক ওদিক ঘোরে। সেসময় মেয়ে সাথে আগের মতোই যোগাযোগ ছিল। কিন্তু অপর্ণা কয়েকদিন বাড়িতে না থাকবার জন্য তন্ময়ে, মেয়ে সাথে একটা অন্য রকমের বন্ডিং তৈরি হল।

পাকাপাকি ভাবে এখানে আসার পরে প্রতিদিন সকালে উঠেই মেয়ে সাথে মাঠে ছুটতে বের হতো। দুজনেই হাফ-প্যান্ট আর গেঞ্জি পরত। প্রথম কয়েকদিন কোনও কিছু মনে না হলেও কয়েকদিন পরেই সামনের দোকানে একটা জিনিস কিনতে গিয়ে পাড়ার এক বউদির সাথে দেখা হয়। কয়েকটা কথা জিজ্ঞেস করবার পরেই বলে, দীক্ষাকে সকালে দেখি, হাফ-প্যান্ট পরে দৌড়ায়। সঙ্গে কে কর্তা? দেখে মনে হয় ওরাই যেন স্বামী স্ত্রী! কে বলবে তুমি মা! এখন তো তোমাকে কর্তার থেকেও বড়ো লাগে।

কথাগুলো অপর্ণার খুব কানে লেগেছিল। বাড়ি ফিরেই বাথরুমের দরজা বন্ধ করে নিজেকে আয়নার সামনে নগ্ন করে দেখার চেষ্টা করেছিল। শরীরে সত্যি সত্যিই অযাচিত বার্ধক্য বাসা বাঁধতে আরম্ভ করেছে কিনা। অনেকক্ষণ ধরে পরীক্ষা করে। শরীর ঝুলছে? সেদিনই দীক্ষার ওপর রাগ দেখিয়ে বলে ওঠে, সকাল সকাল এমন ভাবে হাফ-প্যান্ট পরে বাইরে যাস না, পাড়ায় কথা উঠছে।

কথা! হাউ স্যাভেজ ইউ আর অপর্ণা! ভেরি ব্যাড, আমি দীক্ষাকে মর্ডান করে মানুষ করবার চেষ্টা করছি, আর তুমি ওকে সেই পুরোনো মানসিকতার করে তুলতে চাইছ! কে কী বলছে তাতে মাই ফুট। তুমিও সব শোনো, যদি তোমার ভালো না লাগে বলবে। আমি দীক্ষাকে অন্য জায়গায় নিয়ে চলে যাব, অন্য কোথাও ভর্তি করে দেব। তুমি একা থাকো।

মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে অপর্ণার। এত বড়ো কথা, মেয়েে নিয়ে আলাদা থাকবে! শরীরটা কেঁপে ওঠে। এভাবেও কেউ বলতে পারে, এই ভাবনাটা মাথায় আসছে না অপর্ণার। খুব বাজে অবস্থা। তারপর থেকে দীক্ষাকে কথায় কথায় বকা বন্ধ করে। কিছুটা উদাসীন থাকবার চেষ্টাও করে। কিন্তু কতক্ষণ এভাবে উদাসীন থাকা যায়? সতেরো বছরের মেয়ে কথায় কথায় বাবাকে জাপটে ধরছে। বাবার সামনে একটা ভেস্ট পরে বেরিয়ে যাচ্ছে, এটা তো মেনে নেওয়া যায় না।

অপর্ণার নিজের ছোটোবেলার কথা মনে পড়ে। যেদিন থেকে বুকের দুদিকে দুটো মাংসপিণ্ড বড়ো হয়, সেদিনই মা বলে দেয়,মাম্পি, এবার থেকে পোশাকে একটু যত্ন নিবি। আর খালি গায়ে বাইরে বেরোবি না। বাবা কাকাদের সামনেও দুমদাম করে চলে যাবি না। জামার নীচে এবার থেকে একটা টেপ বা গেঞ্জি পরবি।

অপর্ণা কিন্তু কোনও দিন মাকে কী, কেন প্রশ্ন করেনি। বরং মা সময়ে সাথে একটু পরিবর্তিত হলেও, অপর্ণা নিজেকে পরিবর্তন করতে পারেনি। কিছু কিছু বিষয়ে মায়ের ওপর রেগেও যেত। এখন অবশ্য মেয়ে ওপর রাগতে পারছে না। কয়েকদিন পরে তন্ময় অফিস থেকে ফিরেই অপর্ণাকে বলে, কাল থেকে একটু ছোলা, বাদাম, পেস্তা ভেজাবে। আজ কিনে এনেছি, দীক্ষাকে জিমে ভর্তি করছি, শরীরে ফিটনেস আসবে। তারপর দেখি টেনিসে ভর্তি করবার ইচ্ছেও আছে।

কিন্তু এখন তো পড়ার খুব চাপ, আর এক বছর অপেক্ষা করলে হতো না?

জানতাম তুমি বাধা দেবে।

কথাগুলো শেষ করবার সময়ে দীক্ষা ঘরে আসতেই, তন্ময় দীক্ষাকে জাপটে ধরে নিজের কোলে তুলে নেয়। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা অপর্ণার শরীরে কারেন্ট লাগে। এমন ভাবে তো কেউ কোনও দিন ওকে কোলে তোলেনি। দীক্ষা আবার তন্ময়ে কোলে উঠেই তন্ময়ে গালে কপালে চুমু খেতে আরম্ভ করে। মুখে বলে, ও সুইট ড্যাডি আই লাভ ইউ।

অপর্ণা আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না, কে জানে চুমুটা কখন ঠোঁটে পড়ে যায়।

রান্নাঘরে সবজি কাটার সময় আঙুল কেটে ফেলে, হাতে ভাতের ফ্যান পড়ে যায়। ভগবান এ তুমি কোন পাপের শাস্তি দিচ্ছ। শেষ কালে কিনা মেয়ে তার বাবার সাথে এমন সম্পর্কে জড়িয়ে যাচ্ছে, আর মা হয়ে সেটা ড্যাব ড্যাব করে দেখতে হচ্ছে!

এক রাতে অপর্ণার হঠাৎ ঘুম ভেঙে যায়। বিছানায় পাশে তন্ময়কে না পেয়ে এক পা এক পা করে বারান্দায় বেরিয়ে আসতেই, দীক্ষার ঘরের ভেতর থেকে একটা চাপা গলার আওয়াজ শুনতে পায়। কোনও কিছু না বলে তাড়াতাড়ি দরজাটা খুলতেই নিজের চোখ দুটো লজ্জায় বন্ধ হয়ে আসে।

তন্ময় বিছানার ওপর একটা ছোটো প্যান্ট পরে শুয়ে আছে। আর তার শরীরে শরীর লাগিয়ে একটা ভেস্ট পরে শুয়ে আছে দীক্ষা। নীচে প্যান্টিটাও নেই। অপর্ণা আর চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না, চিত্কার করে ওঠে, এসব কী হচ্ছে, তুমি তো বাবা, ও তো তোমার মেয়ে তোমার লজ্জা করছে না?

তন্ময় প্রথম দিকটাতে ভ্যাবাচ্যাকা মেরে গেলেও পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিয়ে চিত্কার করতে আরম্ভ করে, তুমি পারভার্টেড হয়ে গেছ, ও আমার মেয়ে ওর সাথে কোনও সর্ম্পকই খারাপ সম্পর্ক নয়! সেটা না দেখে তুমি এইসব ভাবছ, তোমার লজ্জা করছে না, যাও নিজের ঘরে যাও।

পারভার্টেড! তাহলে কি সত্যি সত্যিই দীক্ষা আর তন্ময়কে অকারণ সন্দেহ করছে? বাবা-মেয়ে অপত্যস্নেহ! তার মধ্যে কি সত্যিই শরীর এলেও আসে না? ছোটোবেলাতে অপর্ণা একবার বাবার সাথে ডাক্তার দেখাতে গেছিল। মায়ে কি একটা কাজ ছিল। কিন্তু সেই ডাক্তার তো কিছুতেই দেখবেন না।

বাবাকে কড়া করে শুনিয়ে দিয়েছিলেন, মায়ে সাথে পাঠাবেন, আপনার সামনে ওর সব সমস্যা আলোচনা করা ঠিক নয়। মেয়ে বড়ো হলে প্রত্যেক বাবার উচিত তাকে স্নেহের সাথেও একজন মেয়ে হিসাবে মর‌্যাদা দেওয়া। যেমন ধরুন এই যে আপনার মেয়ে আপনার সাথে এসেছে, এখন মেয়ে যদি কিছু প্রাইভেট দেখার প্রয়োজন হয় আপনার সামনে মেয়ে কি সাবলীল হতে পারবে?

সেদিন ডাক্তারের চেম্বার থেকে বাবা বাইরে বেরিয়ে আসে। তারপর থেকে আর কোনও দিন অপর্ণাকে নিয়ে ডাক্তার দেখাতে যায়নি, সমস্যা হলেই তার মাকে পাঠিয়েছে। এটাই তো স্বাভাবিক, বাবা কাকা যতই নিজের হোক তারাও তো পুরুষ।

এক বিখ্যাত উপন্যাসে ঘরের মামাতো পিসতুতো দাদাদের জোর করে তার সাথে যৌন সর্ম্পক করার বর্ণনা পড়ে চমকে উঠেছিল অপর্ণা। এমনটা কি সত্যি সত্যিই হতে পারে? তবে ওটা তো তুতো দাদা। কিন্তু তা বলে বাবা!

পরের দিন সকালেই কাজের মেয়ে টুম্পা ময়লার বালতিটা একটা প্লাস্টিকের প্যাকেটে ফেলবার সময় মুচকি হেসে ওঠে। অপর্ণা ওর হাসি দেখে একটু জোর করেই বলে, কী হল রে? জিজ্ঞেস করতেই টুম্পা বলে, বউদি তোমাদের মেয়ে তো বয়স হয়ে গেছে। এখন আরেকটা ছেলে-মেয়ে কিছু নিতেই পারো।

অপর্ণার মাথাতে আবার বিদু্যৎ খেলে যায়, রেগে ওঠে। এরকম বলবার কারণ জিজ্ঞেস করতেই টুম্পা প্যাকেটটা একটু ফাঁক করে আঙুল দিয়ে দেখায়। চমকে ওঠে অপর্ণা, দুচোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ে। কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকা ছাড়া এই কেন-র কোনও উত্তর নেই। তন্ময় এখানে ফিরে আসার পর এখনও পর্যন্ত তাদের মধ্যে কোনও শারীরিক সম্পর্ক হয়নি। কনডোমের কোনও প্রশ্নই ওঠে না। তার ওপর আবার ডাস্টবিনে ফেলা। ওরা শেষকালে এতটা নীচে নেমে গেল? হায় ভগবান এর থেকে মরে যাওয়াটাই ভালো।

কয়েকদিন তন্ময়দের সাথে কথা বলা এক্কেবারে বন্ধ করে দিল সে। একই ঘর, এক ছাদের নীচ, শুধু কথা বলা বন্ধ। এমনি ভাবেও তো বেশিদিন থাকা যায় না। বাপের বাড়িতে গিয়ে যে-কয়েক দিন থাকবে তারও কোনও উপায় নেই। এদিকে যে কী হবে তা বলা মুশকিল। তাছাড়া বাপের বাড়িতে মা ছাড়া এখন কেউ নেইও। মাকে তো এই সব অনাসৃষ্টির কথা বলা যায় না। কিন্তু বলবার জন্যেও একজন বন্ধুর প্রয়োজন।

একদিন সকালের দিকে পেপার পড়তে পড়তে এক মনোবিদের ফোন নম্বরে ফোন করে অ্যাপযে্টমেন্ট নেয়। ওখানে গিয়ে সব কিছু বলতে ডাক্তার ম্যাডাম ক্লাইটেমনেস্ট্রা, এজিস্টাস, ইলেকট্রা, ওরিস্ট্রেস সব নাম একের পর এক বলে বিভিন্ন ধরনের যৌন বিকৃতির কথা বলতে আরম্ভ করেন।

উলটো দিকে বসে থাকা অপর্ণা অপেক্ষা করে বসে থাকে, এই বুঝি কোনও উপায় বলবেন। বললেনও তবে অনেক শেষে। নিজেকে হাজব্যান্ডের কাছে আরও প্রেজেন্টবল করে তোলার সাথে মেয়েকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার কথা বলেন।

বাড়ি ফিরে মাথাটা আবার গরম হয়ে যায়। দরজা খোলার সঙ্গে সঙ্গে দেখে তন্ময় দীক্ষার ঘরের বিছানাতে শুয়ে আছে। দুজনের শরীরে কোনও সুতো নেই।

জীবনে এক ভাবা ছিল, এক হল। কয়েক বছর ধরে আয়নার থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছে, অথচ এই আয়নাটাই এখন নিত্য সঙ্গী হয়ে গেল। মাসে একবার করে মাকে দেখতে যাওয়াটাই কাল হল, অবশ্য এর আগেও বহুবার মাকে দেখতে গেছে কিন্তু কোনও বার এমনি ভাবে কোনও মহিলার সাথে দেখা হয়নি। তাও যদি শুধু দেখা হতো তাহলে না হয় ঠিক হতো, কিন্তু এমনি ভাবে একটা সম্পর্ক তৈরি হয়ে যাবে কে জানত? ভদ্রমহিলা অবশ্য বেশ ভালো, কোনও রকম ঝামেলা নেই। বহুবার জিজ্ঞেস করবার পরেও নিজের সম্পর্কে কিছুই বলেনি। প্রথম দিন শুধু নিজের পরিচয় দিয়ে বলেছিল, আমার নাম অপর্ণা, আপনার।

কুশল।

এরপর থেকে আর কিছু না বললেও কুশল প্রতিদিন অফিস বের হবার সময় ভাবে, নিশ্চয়ই ফিরে দেখব উনি নেই। কিন্তু উনি থাকেন। বাড়িতে ফিরে প্রতিদিন কুশল, অপর্ণার হাতে তৈরি নতুন নতুন খাবার খায়। তখনই চোখের সামনে অ্যাসাইলামের ভিতর থেকে মা উঠে আসে, পাশে বাবা।

বাবা ডাকে, কুশল ছুটে পালায়। পাড়ার লোক বাবাকে অপমান করে। মা-বাবা পাড়া ছাড়ে, বাবা চাকরি ছেড়ে নতুন ঠিকানার উদ্দেশ্যে যাত্রা করে। তারপরেও অবশ্য নিস্তার নেই। কুশলের বড়ো হবার সঙ্গে সঙ্গে বাবা মায়ে ঝগড়া আরম্ভ হয়। বাবা, মায়ে গায়ে হাত তুলতে আরম্ভ করে। তারপর একদিন রেললাইনে মাথা দেয়।

কুশল কিছুই জানতে পারে না। একা মা তাকে বড়ো করতে থাকে। একদিন একটা ফাইলের ভিতরে একটা কাগজ দেখে চমকে ওঠে কুশল। মাকে জিজ্ঞেস করে, ঝগড়া হয়, মাকে অপমান করে, মা আর সহ্য করতে পারে না।

একটা কথা জিজ্ঞেস করব?

নিশ্চয়ই।

এই যে আমি আপনার বাড়িতে আছি আপনাকে কেউ কিছু জিজ্ঞেস করেনি? মানে আপনার অফিসে, পাড়ায়?

কুশল একটা শ্বাস টানে, এক্কেবারে যে করেনি এটা বলব না, তবে বলেছি আমার দিদি। জামাইবাবু মারা যাওয়াতে আমার কাছে থাকছে।

অপর্ণা কিছুক্ষণ চুপ থেকে উত্তর দেয়, এটা কিন্তু আপনি ঠিকই বলেছেন, আমার স্বামী সত্যি সত্যিই মারা গেছেন। তারপরেই ব্যাগ থেকে একটা খবরের কাগজ বের করে একটা খবর দেখিয়ে বলে, আত্মহত্যা, আমার মেয়ে ও উনি, দুজন একসঙ্গে।

কুশল অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে, হঠাৎ!

হঠাৎ না।

মানে? আপনার মেয়ে আর স্বামী দুজন একসাথে সুইসাইড করেছে, আপনি কিছু করতে পারেননি।

আমি ঘটনার দুমাস আগেই ঘর ছেড়ে বেরিয়ে একটা হোমে থাকতে আরম্ভ করেছিলাম। চাকরির চেষ্টা করছিলাম।

কী এমন ঝামেলা করলেন?

আমার মেয়ে প্রেগন্যান্ট হয়ে গেছিল, অ্যান্ড বাই হার ফাদার।

কুশল শেষের কথাগুলো শুনে চমকে উঠল। এক-পা এক-পা করে একটা জানলার ধারে অন্ধকারের দিকে চোখ রেখে দাঁড়িয়ে থাকে সে। রাত্রি অন্ধকার হলেও দিনের আলোর মতো জটিল নয়। শহরটাতে মানুষ খুব তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়ে, না হলে কুশলের দুচোখ থেকে গড়িয়ে পড়া জল দেখতে পেত। নাহলে পড়তে পারত দুটো বার্থ সার্টিফিকেট। অনেক চেষ্টা করেও যেদুটো থেকে বাবার নামটা মোছা যায়নি। পাশাপাশি রাখলে পড়া যায় কুশলের দাদুই তার বাবা।

প্রায়শ্চিত্ত

ক্রিং ক্রিং…। ফোনটা অনবরত বেজে চলেছে। ঘড়িটার দিকে তাকালাম। বিরক্তি চেপে রেখে ফোনটা তুললাম। ওপাশ থেকে গলা ভেসে এল। প্রথমটা বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। অজয়ের গলা। এক যুগ কেটে গেছে। কবে শেষবারের মতো ওর সঙ্গে কথা হয়েছিল মনে পড়ল না। সেই কবেই ওর সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে গেছে আর তার প্রধান কারণ ছিল ওর অহংকার। অহংকারে এতটাই ও অন্ধ হয়ে গিয়েছিল যে বিবেক বলে ওর আর কিছুই ছিল না। ওর ব্যবহারে আমি এতটাই ব্যথা পেয়েছিলাম, যে ওর সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক ত্যাগ করে দিয়েছিলাম। ও-ও যোগাযোগ রাখার কোনও চেষ্টা করেনি। বন্ধুত্ব আছে বলেই যে ওর হ্যাঁ তে হ্যাঁ মেলাব এমন কোনও মানে নেই। যেটা অন্যায় সেটা স্পষ্ট করে বলে দেওয়াটাই আমার অভ্যাস। অজয়েরও সেটা খারাপ লাগতেই পারে তাই বলে এতটাও নয় যে ও খুব খারাপ ভাষায় আমাকে ওর বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে বলবে। এত বছরের বন্ধুত্ব, একজন মহিলার জন্যে এভাবে যে ওর কাছে মূল্যহীন হয়ে যেতে পারে, সেটা দেখে আমি প্রচন্ড ব্যথা পেয়েছিলাম। সেদিনই ঠিক করে নিয়েছিলাম অজয়ের সঙ্গে কোনওরকম সম্পর্কই আর রাখব না।

আমি আর অজয় একই পাড়ায় থাকতাম। স্কুল, কলেজ সব একসঙ্গে। তারপর আলাদা চাকরির জগৎ। সুখ-দুঃখ আমরা সবসময় একসঙ্গে ভাগ করে নিয়েছি। অজয় প্রথম বিয়ে করে নিজে দেখে। স্বাতিকে। স্বাতি যথেষ্ট সুন্দরী, বুদ্ধিমতী এবং ধনী পরিবারের মেয়ে। মা-বাবার একমাত্র সন্তান ও সম্পত্তির একমাত্র উত্তরাধিকারী। অজয়ের মা-বাবাও স্বাতিকে খুবই ভালোবাসতেন। ওর স্বভাবটাই এতটা মিষ্টি ছিল যে সকলেই ওকে পছন্দ করত। ওর সঙ্গে দাদা-বোনের সম্পর্ক পাতিয়েছিলাম। আমি ওর বাড়িতে গেলেই খাতিরদারীর কোনও সুযোগ ও হাতছাড়া করত না। আমিও ওকে নিজের বোন ছাড়া বন্ধুর স্ত্রী হিসেবে কোনওদিন ভাবতে পারিনি।

এরই মধ্যে স্বাতি দুই সন্তানের মা হল। অজয় সরকারি চাকরি করত। প্রোমোশন পেয়ে পেয়ে এমন জায়গায় পেৌঁছে গিয়েছিল যেখানে উপরি-কামাইয়ের কোনও অন্ত ছিল না। মধ্যবিত্ত একটা পরিবারকে কালো টাকার আবর্তে ধীরে ধীরে ঠেলে দিচ্ছিল। কিন্তু ভগবান বাধ সাধলেন। অজয়ের কপালে সুখ সহ্য হল না। স্বাতি আক্রান্ত হল ক্যানসারে। তিন বছর ধরে জলের মতো টাকা খরচ করেও স্বাতিকে বাঁচানো গেল না। স্বাতির মৃত্যুতে অজয় প্রচন্ড ভাবে ভেঙে পড়ল। বাচ্চা দুটো অসময়ে তাদের মা-কে হারাল।

কথায় আছে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সব আঘাতের চিহ্নই ধীরে ধীরে মুছে যায় তা সে যত বড়ো আঘাতই হোক না কেন। কয়েকমাস পার হয়ে যাওয়ার পর অজয়ের ডিভোর্সি ছোটো বোন কানপুর থেকে চাকরি নিয়ে কলকাতায় দাদার কাছে এসে উঠল। পৈতৃক বাড়ি, আজয়ও বোনকে মানা করল না। অন্বেষার নিজের কোনও সন্তান না থাকায় দাদার বাচ্চাদের দেখাশোনা করার দায়িত্ব নিজের কাঁধে নিয়ে নিল। অজয়ও স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বাঁচল।

স্বাতির মৃত্যুর দুই বছর তখনও হয়নি। অন্বেষা এবং অন্যান্য আত্মীয়স্বজনেরা অজয়কে দ্বিতীয়বার বিয়ে করার জন্যে চাপ দিতে আরম্ভ করল। অজয়ের বয়স তখন বিয়াল্লিশ ছুঁই ছুঁই। বাচ্চারা মায়ের আদর ফিরে পাবে এই ভেবে আমিও অজয়কে বিয়ে করার পরামর্শ দিই। অজয়ের মনে সংশয় ছিল যে সৎমা আসলে বাচ্চাদের সঙ্গে কীরকম ব্যবহার করবে? অনেক বোঝাবার পরে অজয় রাজি হল কিন্তু চোখের জল ধরে রাখতে পারল না। লুকোবার চেষ্টা করলেও আমার কাছে ধরা পড়ে গেল। আমার কাঁধে হাত রেখে বলে, ‘কী দোষে বল তো আমাকে মাঝ সমুদ্রে ফেলে রেখে দিয়ে স্বাতি আমাদের সকলকে ছেড়ে চলে গেল? আমি কি কখনও বাচ্চাদের মায়ের জায়গা নিতে পারি? রাত্তিরে আমি ওদের নিয়ে শুই। মাঝরাতে মায়ের জন্যে কেঁদে উঠলে আমি ওদের চুপ করাতে পারি না। অফিসে গেলে বাড়ি ফেরার জন্যে উতলা হয়ে উঠি, কত বেশি বাচ্চাদের সঙ্গে থাকতে পারব এই ভেবে। আমি সবসময় চাই যাতে ওরা মায়ের অভাব বুঝতে না পারে।’

অজয়ের কথায় আমিও ভাষা হারিয়ে ফেলি। মুহূর্তের মধ্যে নিজেকে সংযত করে বেশ জোরের সঙ্গে বলি, ‘যা হবার ছিল হয়েছে। অতীতে পড়ে না থেকে বর্তমান ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাব।’

‘কী ভাবব? বাচ্চারা বড়ো হচ্ছে কিন্তু মায়ের স্মৃতি আজও ওরা অাঁকড়ে ধরে রেখেছে। আজও চোখে ওদের জল আসে মায়ের কথা উঠলেই। ওদের জন্যেই আমার বেশি চিন্তা হয়।’

‘দ্যাখ, স্বাতির অভাব আমরা সকলেই ফিল করি আর বাচ্চারা তো করবেই। তুই দ্বিতীয় বিয়ে করলে হয়তো মায়ের এই অভাব কিছুটা হলেও দূর হবে।’

‘হতে পারে কিন্তু এর গ্যারান্টি কোথায়? যদি আমার বিয়ে করার বিচার ভুল প্রতিপন্ন হয়, তাহলে আমি নিজেকে কোনওদিন ক্ষমা করতে পারব না। বাচ্চাদের চোখেও আমি সারা জীবনের মতো অপরাধী হয়ে থাকব।’

অজয়ের ভয় অমূলক নয় জানি কিন্তু আশঙ্কার উপর নির্ভর করে পথচলা তো আর বন্ধ করা যায় না। ভবিষ্যতে কী হবে আর কী হবে না, সেটা কে জানে? এমনও তো হতে পারে অজয়-ই পুরোপুরি বদলে গেল?

অজয়ের জন্যে বহু পাত্রীর সম্বন্ধ এল। অন্বেষা অনেক সম্বন্ধ প্রথমেই নাকচ করে দিল সুন্দরী মেয়ে চাই বলে। নিন্দুকেরা এই নিয়ে মশকরা করতে ছাড়ল না যে এই বয়সেও সুন্দরী ভার্যার প্রয়োজন পড়ল। শেষে একটা সম্বন্ধ অজয়ের মনে ধরল। ফরসা, সুন্দরী, ডিভোর্সি, এক সন্তানের মা। নাম সুনন্দা। কানে এসেছিল মহিলার স্বামী কোনও কোম্পানিতে মার্কেটিং বিভাগে কাজ করতেন এবং পথ দুর্ঘটনায় তার একটা পা চলে যায়।

অজয় আর অন্বেষা দুজনেই যে সুনন্দাকে পছন্দ করেছিল তার প্রধান কারণ ছিল সুনন্দা সুন্দরী। ওর একটি মেয়ে, বয়স আট বছর। কেন জানি না সুনন্দার সঙ্গে অজয়ের বিয়েটা আমি মন থেকে মেনে নিতে পারিনি।

আমার সুনন্দাকে দেখে মনে হয়েছিল, অজয়ের জন্যে সুনন্দা উপযুক্ত নয়। অজয়ের দরকার ছিল ঘরোয়া একজন সাধারণ মেয়ের। কিন্তু সুনন্দা খুবই ব্যক্তিত্বময়ী এবং অজয়ের সঙ্গে ওর ব্যক্তিত্বের জমিন-আসমান ফারাক।

অজয় আমার বন্ধু ঠিকই কিন্তু মানবিকতার দৃষ্টি দিয়ে দেখলে মনে হয় ভগবান বোধহয় অন্যায়ই করেছেন সুনন্দার সঙ্গে। সুনন্দার মেয়ে শ্রেয়াও যথেষ্ট স্মার্ট এবং সুন্দরী সেই তুলনায় অজয়ের ছেলেমেয়ে অতটা অসাধারণ নয়। একলা কোনও নারীর পক্ষে একাকী সারাজীবন কাটানো সহজ নয় এবং সেই কারণেই হয়তো সুনন্দার মা-বাবা সামাজিক সুরক্ষার কথা মাথায় রেখে অজয়ের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে দেওয়াই উচিত মনে করেছেন।

সুনন্দার সঙ্গে বিয়ের পর থেকেই অজয় প্রচণ্ড বদলে যেতে থাকে। স্ত্রীয়ের সৌন্দর্য ওকে কীরকম যেন একটা পাগল করে তুলতে থাকে। আত্মীয়স্বজন, বন্ধু এমনকী বাচ্চারাও ওর কাছে গুরুত্ব হারিয়ে ফেলতে শুরু করে। চোখের সামনে থেকে সরে গেলেই সুনন্দা অপর কারও হয়ে যেতে পারে এই ভয় অজয়কে কুরে কুরে খেতে আরম্ভ করে ফলে অফিস না যাওয়ারও নানা বাহানা ধীরে ধীরে অজয় তৈরি করা আরম্ভ করে।

আমার আসা-যাওয়াও অজয়ের বাড়িতে অনেক কমে গেল। অজয় আমাকেও সুনন্দার সঙ্গে সময় কাটাতে দিতে পছন্দ করত না। সর্বক্ষণ সুনন্দার সঙ্গে ছায়ার মতো লেগে থাকত। সুনন্দাও স্বামীর দুর্বলতা বুঝতে পেরে নিজের মতো অজয়কে চালাবার চেষ্টা করতে লাগল। নিজে যেটা ভালো বুঝত, অজয়কে দিয়ে সেটাই করাত। অজয়ের চারিত্রিক পরিবর্তন ওর দুই সন্তানকে ভীষণ ভাবে প্রভাবিত করল। ওরা বাবার থেকে ক্রমশ দূরে সরে যেতে থাকল। অফিস থেকে ফিরে বাচ্চাদের ঘরে না ঢুকে অজয় সোজা সুনন্দার ঘরে চলে যেত।

সেদিন সুনন্দার কোনও আত্মীয়ের বিয়ে ছিল। অজয়, সুনন্দা মেয়েকে নিয়ে বিয়েতে যাবার জন্যে তৈরি হচ্ছিল। অজয়ের ছেলে অয়নও যাওয়ার জন্যে বাবার কাছে আগ্রহ প্রকাশ করে। কিন্তু অজয় ওকে বকা দিয়ে চুপ করিয়ে দেয়, ‘গিয়ে পড়াশোনা করো, কোথাও যাওয়ার দরকার নেই।’

বাবার কথা শুনে ছেলে ঘরে এসে মায়ের ছবির সামনে দাঁড়ায়, চোখে জল ভর্তি। অন্বেষা ভাইপোর মনের অবস্থা বুঝতে পেরে ঘরে এসে ঢোকে। অয়নকে ছোট্ট থেকে দেখছে অন্বেষা, খুবই মুখচোরা ছেলে। বাপের মুখের উপর কথা বলবে এমন অভ্যাস ওদের দুই ভাই-বোনের কারওরই নেই। অজয় আজকাল সুনন্দার কথায় ওঠে বসে। সুনন্দার মেয়ের খেয়াল রাখাটা অজয়ের কাছে বেশি জরুরি। অন্বেষা প্রতিবাদ করাতে অজয় জানিয়েছিল, পিতৃহীন মেয়েকে সময় দেওয়াটা অনেক বেশি দরকার। অথচ অজয়ের একবারও মনে হয়নি মা-মরা তার নিজের দুটি সন্তানের কষ্ট। বাচ্চাদের স্কুলের মাইনে, জরুরি কিছু জিনিসপত্র কিনে দেওয়াকেই অজয় ভেবে নিত বাচ্চাদের প্রতি তার কর্তব্য শেষ। অয়ন আর রিয়া বুঝে গিয়েছিল তারা বাবার স্নেহ থেকে বঞ্চিত হতে চলেছে। বাড়িতে যেটুকু ভালোবাসা পাচ্ছে সেটা পিসির কাছ থেকেই। বাড়ির পরিবেশে নিজেদের মানিয়ে নিতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল দুই ভাই-বোন।

হঠাৎই অজয় একদিন নিজের বাড়ি ছেড়ে সুনন্দা আর তিন ছেলেমেয়েকে নিয়ে স্বাতির পৈতৃক বাড়িতে এসে ওঠে। স্বাতির মা মৃত্যুর আগে নাতির নামে বাড়িটা লিখে দিয়ে গিয়েছিলেন। অজয়ের নিজের বাস্তুভিটে ত্যাগ করার প্রধান কারণ ছিল ওখানে বাড়ির অন্যান্যদের মধ্যে ওর স্বাধীনতা খর্ব হচ্ছিল। অন্বেষাই একমাত্র মাঝেমধ্যে বাচ্চাদের দেখতে অজয়ের নতুন আস্তানায় যেত।

আমি অয়নের থেকেই অজয়ের খবরাখবর পেতাম। অজয়ের ব্যবহারে আমিও খুশি ছিলাম না। অনেকবার মনে হয়েছে ওকে বোঝাই কিন্তু অপমানিত হওয়ার ভয়ে সবসময় পিছিয়ে এসেছি। এরই মধ্যে অয়নের কাছ থেকে জানতে পারলাম সুনন্দা মা হতে চলেছে। অজয়ের যা বয়স সেটা ভেবে অবাক হলাম। পঁয়তাল্লিশ ছুঁই ছুঁই, নিজের দুটি সন্তান প্রথম স্ত্রী থেকে। তাছাড়াও সুনন্দারও মেয়ে তখন এগারোয় পড়বে। সন্তানের সত্যিই কি কোনও দরকার ছিল ওদের জীবনে? হঠাৎই অজয় আর সুনন্দাকে প্রচন্ড স্বার্থপর বলে মনে হল আমার।

দ্বিতীয়বার অজয় যখন বিয়ে করতে সম্মতি দিয়েছিল তখনই ওর সঙ্গে কথা হয়েছিল। ও বলেছিল একে অপরের সঙ্গী হতে পারবে বলেই এই বিয়ে করা। আর সন্তানরাও নতুন করে মা-বাবার স্নেহ ভালোবাসা পাবে। তাহলে হঠাৎ কী ভেবে সুনন্দা মা হবার জন্যে রাজি হয়ে গেল?

অজয়, সুনন্দার ছেলে হল। শহরের বড়ো হোটেলে পার্টিও দিল ওরা। আমন্ত্রিতদের লিস্টে আমারও নাম ছিল। অতিথিরা প্রায় সকলেই উপস্থিত ছিলেন ঠিকই কিন্তু আড়ালে আবডালে তাদের মুখে অজয়দের সম্পর্কে খারাপ মন্তব্য ছাড়া কিছু শুনলাম না। অবশ্য অজয়কে দেখলাম এব্যাপারে বেশ নির্লিপ্ত। ওর জগতে সুনন্দা এবং ওদের ছোট্ট শিশুসন্তান ছাড়া আর কেউই নজরে পড়ল না।

পার্টিতেই দেখা হয়ে গেল অয়ন আর রিয়ার সঙ্গে। এতটা উদাস ওদের আগে কখনও দেখিনি। জানি কারণটা অজয়। ওদের প্রতি অজয়ের উদাসীনতাই এর জন্যে দায়ী। টাকা-পয়সা দিয়ে বাচ্চাদের মন হয়তো ভোলানো যায় কিন্তু মন জয় করা সম্ভব নয়। অয়ন আর রিয়ার দরকার ছিল মায়ের স্নেহ মমতার কিন্তু মা না থাকায় কর্তব্যটা বর্তায় বাবার উপর। অথচ দ্বিতীয়বার বিয়ে করবার সময় বাচ্চারাই বাবাকে সবথেকে বেশি জোর দিয়েছিল নিজের জীবনসঙ্গিনী খুঁজে নেওয়ার জন্যে। সেই বাবাই যদি সন্তানদেরথেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় তাহলে সন্তানদের মনের অবস্থা কী হতে পারে এটা কারওরই অজানা নয়।

একটা ব্যাপার আমাকে কুরে কুরে খাচ্ছিল যে এই বয়সে অজয়ের কী দরকার ছিল তৃতীয় সন্তানের। তৃতীয় বলাও ভুল কারণ সুনন্দার মেয়েকে ধরলে অজয়ের মোট চারটি সন্তান। অয়নের সঙ্গে রাস্তায় একদিন দেখা হয়ে গেল। জোর করে বাড়িতে ধরে নিয়ে এলাম। স্বাভাবিক ভাবেই অজয়ের কথা উঠে এল। ‘আচ্ছা কাকু বলোতো, এই বয়সে বাবার আবার কেন ‘বাবা’ হওয়ার সাধ জাগল? বাড়ির বাইরে গেলেই বন্ধুরা, আত্মীয়স্বজনেরা এই নিয়ে হাসি তামাশা করতে ছাড়ে না। কোথাও মুখ দেখাতে পারি না। মনে হয় চুরির দায়ে আমিই চোর সাব্যস্ত হয়েছি। এইসব কারও ভালো লাগে বলো?’ অয়নের কথাগুলো এসে বুকে বিঁধল। কী উত্তর দেব বুঝে পেলাম না। অজয়কে নিয়ে আলোচনা করতে ইচ্ছে হল না। স্বাতির মুখটা মনে পড়ল। ও থাকলে কি অজয় পারত সন্তানদের এভাবে অবহেলা করতে, নিজের স্নেহ থেকে ওদের দূরে রাখতে? স্বাতিকে তো অজয় ভালোবেসে বিয়ে করেছিল। তাহলে তার আমানতকে কী করে অজয় দূরে সরিয়ে রাখতে পারল শুধুমাত্র সুনন্দার জন্যে? অয়নের মুখেই শুনলাম সুনন্দার মা-বাবা ওদের বাড়িতে এসেছিল। ও সুনন্দার মা-কে, অজয়ের কাছে বলতে শুনেছে, ‘যাক বাবা এখন তোমার আর সুনন্দার পরিবার সম্পূর্ণ হল। এক ছেলে এক মেয়ের বাবা-মা তোমরা।’

আশ্চর্য হয়ে গেলাম, রাগও হল। তার মানে অয়ন আর রিয়া অজয়ের পরিবারের সদস্যদের মধ্যে আর পড়ে না? সুনন্দাই তাহলে চতুর্থ সন্তানের জন্যে অজয়ের ব্রেন ওয়াশ করেছিল! হয়তো সুনন্দার মনে হয়েছিল অজয়ের সন্তান যদি সুনন্দা ধারণ না করে তাহলে সম্পত্তির পুরো অধিকার চলে যাবে অয়ন আর রিয়ার হাতে। মনে মনে সুনন্দাকেই দোষী ঠিক করে নিলাম।

কথা বলার জন্যে একদিন অজয়কে ফোন করে ওর বাড়ি গেলাম। অয়ন আর রিয়ার পক্ষ টেনে অজয়কে বোঝাবারও চেষ্টা করলাম, ‘দ্যাখ অজয় তুই অয়ন এবং রিয়ার সঙ্গে অন্যায় করছিস। ওদের মা মারা যাওয়ার পর তোর উপরেই ওদের ভরসা ছিল। কিন্তু সুনন্দাকে বিয়ে করার পর ওদের উপর থেকে স্নেহের হাতটা কেন তুলে নিলি তুই?’

‘কে বলেছে? জানিস অয়নের ইঞ্জিনিয়ারিং কোর্সের জন্য দশ লাখ টাকা খরচ করেছি। রিয়াকে প্রচুর টাকা দিয়ে এমবিএ কোর্সে ভর্তি করিয়েছি। আর তুই বলছিস আমি ওদের জন্য কিচ্ছু করিনি।’

‘টাকা দিয়ে স্নেহের অভাব পূরণ করা যায় না। তুই শুধু বাবার কর্তব্যটুকুই করেছিস।’

‘তোকে কি অয়ন আর রিয়া আমার কাছে পাঠিয়েছে? ওদের বলে দিস আমার পক্ষে যেটুকু করা সম্ভব ছিল আমি করেছি। এর বেশি কিছু আমার পক্ষে করা সম্ভব নয়। আর তুই-ও আসতে পারিস এবার কারণ আমি চাই না এধরনের কথাবার্তা সুনন্দার কানে পৌঁছোক।’

এখানেই আমার আর অজয়ের সম্পর্কের ইতি। অপমানিত হয়ে বাড়ি ফিরে এসেছিলাম সেদিন। অয়ন বিটেক পাশ করে চাকরি নিয়েছে খবর পেয়েছি। একদিন এল আমার কাছে বিয়ে করছে জানাতে।

‘বাবাকে জানিয়েছিস?’

‘না। আমাদের নিয়ে বাবা যখন কিছু ভাবে না তখন আমরা কী করছি না করছি জানাতে যাব কেন? কোনওদিন ভালোবেসে আমাদের সঙ্গে দুটো কথা বলে?’

‘তোদের পড়াশোনা তো করিয়েছে?’

‘পড়িয়েছে ঠিকই, কিন্তু সেটা শুধুই দায়িত্ব মনে করে। আমাদের সঙ্গে বাবার মনের সংযোগ সেই কবেই কেটে গেছে। টাকাপয়সা নিয়ে আমার বা বোনের কোনও চিন্তা নেই কারণ দিদা, মায়ের নামে যা টাকা রেখে গিয়েছিলেন তা এখন আমাদের দুই ভাইবোনের নামেই। তাছাড়া বাবারা এখন যে বাড়িতে রয়েছে সেটাও আমার নামেই।’

‘তোরা আজকালকার ছেলে, যা ভালো বুঝিস।’

অয়নের বিয়েতে আমি গিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম। শুনেছি অজয় রিয়ার বিয়ে দিয়ে দিয়েছে কিন্তু আমাকে জানায়নি। তবে এটুকু জানতাম অয়নের সঙ্গে অজয় কোনওরকম সম্পর্ক রাখেনি।

সময় কারও জন্যে থেমে থাকে না। সম্পর্ক না থাকলেও অজয়ের সব খরবই আমার কানে আসত। সুনন্দার নামে একটা ফ্ল্যাট কিনে অজয়রা সেখানেই উঠে গিয়েছিল। অয়নও এসে বাবার হাত থেকে দিদার ফ্ল্যাটের চাবি হস্তগত করে। চাবি দেওয়ার সময় অজয়ও অয়নকে জানিয়ে দেয় পৈতৃক সম্পত্তি থেকে কানাকড়িও অয়ন পাবে না।

সুনন্দার মেয়েও ধীরে ধীরে বিবাহযোগ্য বয়সে এসে পৌঁছোয়। সুনন্দা পাত্রও পছন্দ করে কিন্তু পণের বড়োসড়ো টাকার অঙ্ক দিতে অজয় অস্বীকার করে। সুনন্দা আর অজয়ের মধ্যে সেই প্রথম ঝগড়ার সূত্রপাত। সুনন্দাই প্রথম অশান্তি শুরু করে অজয় পণের টাকা দিতে না চাইলে।

‘অয়নকে দশ লাখ টাকা খরচ করে পড়াতে পারো আর আমার মেয়ের বিয়ের জন্যে তোমার কাছে টাকা নেই?’

‘এভাবে কেন ভাবছ? ফ্ল্যাট কেনার পর আমার হাতে আর বেশি টাকা নেই। আর পণ দিয়ে মেয়ের বিয়ে দেওয়াটা কি একান্ত দরকার? আর একটু দ্যাখো, ভালো ছেলে নিশ্চই পাবে যারা কিনা পণ চাইবে না।’

‘অয়নের থেকে কিছু টাকা চাও না। ওর তো উচিত বাবাকে কিছু টাকা দেওয়া।’

‘তোমার জন্যে ওর সঙ্গে কোনও সম্পর্ক রাখিনি। আজ কোন মুখে ওর কাছে টাকা চাইব?’

‘আমার জন্যে? বরং বলো ইঞ্জিনিয়ার হয়ে দুটো পয়সা কামাচ্ছে বলে ও চালবাজ হয়ে গেছে।’

‘যাই বলো আমি ওর কাছে টাকা চাইতে পারব না।’

‘তাহলে এক কাজ করো। পৈতৃক বাড়িটা বিক্রি করে দাও।’ সুনন্দার এই প্রস্তাবটা অজয়ের খারাপ লাগল না কারণ ওই বাড়িতে শুধু অন্বেষাই থাকত। সেও প্রায় তিন বছর আগে নিজে ফ্ল্যাট কিনে চলে গেছে। বাড়ি বিক্রির খবরটা চারিদিকে চাউর হয়ে গেল। অয়নের কানেও খবরটা পৌঁছোল। সঙ্গে সঙ্গে সে অজয়ের কাছে গেল।

‘বাড়ি বিক্রি করলে সকলকে সমান ভাগ দিতে হবে,’ অয়ন বলল আজয়কে।

‘সকলকে মানে?’

‘রিয়াকেও ভাগ দিতে হবে।’

‘রিয়ার বিয়েতে আমি যা খরচ করেছি, তাতেই সব বরাবর হয়ে গেছে।’

‘তোমার লজ্জা করে না বাবা? বোনের বিয়ের হিসেব করছ?’

‘তোমাদের কাছে ফ্ল্যাট রয়েছে।’

‘সেটা দিদার ফ্ল্যাট। এটা আমার ঠাকুরদার বাড়ি। আইনত এটার উপর আমাদেরও অধিকার রয়েছে। সুতরাং বিক্রির সময়ই হোক অথবা টাকা ভাগ করার সময়, আমি সামনে থাকব।’ অয়নের সামনে সুনন্দা মুখ না খুললেও পরে অজয়কে একলা পেয়ে সুনন্দা এক মুহূর্তও দেরি করে না নিজের রাগ প্রকাশ করতে।

‘খুব তো ছেলে ছেলে করতে, এখন কীরকম মুখে ঝামাটা ঘষল। আমার ছেলে-মেয়েকে বঞ্চিত করে ওকে কেউকেটা বানিয়েছ। আজ তার ভালো প্রতিদান পেলে।’

‘আমি কারও অধিকার ছিনিয়ে নিইনি। তাছাড়া অয়নও আমারই সন্তান।’

‘সেটাই তো বলতে চাইছি। ছেলে হয়ে তাই এরকম দায়িত্বের কাজ করেছে।’

‘শ্রেয়া তোমার মেয়ে, আমার মেয়ে নয়’, অজয়ের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গিয়েছিল।

অজয়ের কথায় সুনন্দাও আর রাগ সামলাতে পারে না, ‘তোমার মতো নির্লজ্জ আমি জীবনে দেখিনি। বিয়ের সময় তুমিই বলেছিলে আমার মেয়েকে বাবার পরিচয় দেবে। তোমার পরিচয়েই ও বড়ো হবে। এত সহজে আমি তোমাকে ছাড়ছি না।’

‘তোমারও আসল রূপ বেরিয়ে পড়েছে।’ ঘৃণা ঝরে পড়ে অজয়ের গলায়। ‘তোমার মেয়ের জন্যে আমার কাছে এক টাকাও নেই। ওকে ওর নিজের বাবার কাছে পাঠিয়ে দাও। আমি ওর বাবা নই।’

অজয়ের কথায় সুনন্দার আত্মসম্মানে আঘাত লাগে। চোখে জল এনে সুনন্দা বলে, ‘তাহলে এই ছেলেও তোমার নয়? একেও কি তুমি অস্বীকার করবে?’ ইশারাটা নিজের ছেলের দিকে।

ছেলেকে দেখে অজয় কিছুটা শান্ত হয়। সুনন্দারও ঠোঁটে ছুঁয়ে যায় আত্মতৃপ্তির তীর্যক হাসি।

শেষমেশ অয়নের শর্ত অনুযায়ীই অজয়ের পৈতৃক সম্পত্তির বিক্রি স্থির হল এবং বিক্রি করে যে টাকা পাওয়া গেল তা সমান ভাবে সকলের মধ্যে অজয়কে ভাগ করে দিতে হল। অবশ্য এই ঘটনার পর অজয় ছেলের মুখ না দেখার প্রতিজ্ঞা করল।

রিটায়ার করার পর অজয় ভীষণ একলা হয়ে গেল। অয়ন, রিয়ার সঙ্গে তো আগেই সম্পর্ক শেষ হয়ে গিয়েছিল। সুনন্দার মেয়ের বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর বাড়িতে সুনন্দা আর ছোটো ছেলে। সেও দেখতে দেখতে কৈশোরে পা দিয়েছে। বাবার থেকে মায়ের সঙ্গেই তার বেশি ওঠাবসা। নামেই শুধু বাবা হয়ে থেকে গেছে অজয়, সুনন্দার ছেলে মেয়ের কাছে। সেই শুরু অজয়ের আত্মদহনের। অয়ন, রিয়ার কাছে সে প্রতিজ্ঞা করেছিল, সেই বাবার দায়িত্বটাও সে পুরোপুরি পালন করতে পারেনি। মনে মনে নিজেকেই ঘৃণা করতে শুরু করে অজয়। মানসিক এই পরিস্থিতির মধ্যেই পুরোনো সম্পর্কগুলো ঝালিয়ে নিতেই অজয় আমাকে ফোন করে।

এত বছর পর ওর গলা শুনে সত্যিই আশ্চর্য হয়েছিলাম কিন্তু বন্ধুত্বের টানে না গিয়েও পারলাম না। দেখলাম অনেক বদলে গেছে অজয়। নিজের ভুল শোধরাতে চায়। অয়ন, রিয়ার সঙ্গে দেখা করতে চায় আমার সাহায্য নিয়ে। কথা দিতে পারলাম না শুধু আশ্বাস দিলাম যে চেষ্টা নিশ্চই করব। কয়েকদিন পরই সুনন্দা ফোন করে জানাল অজয় হাসপাতালে ভর্তি। দুদিন আগে রাতে শরীর খারাপ হওয়াতে পাড়ার সকলে মিলে ওকে হাসপাতালে ভর্তি করেছে। সমস্যা হার্ট স্ট্রোক।

দৌড়োলাম হাসপাতালে। আরও চব্বিশ ঘণ্টা না কাটলে নাকি ডাক্তাররা আশ্বাস দিতে পারছেন না। অয়ন, রিয়াকেও জানালাম। খবর পেয়েই পরের দিন রিয়া বাবাকে দেখতে এল। আশা করেছিলাম সঙ্গে অয়নও আসবে। ও এল না। অয়নের বাড়ি গেলাম। অজয়ের সঙ্গে আমার যা কথা হয়েছে সবই ওকে জানালাম। সব শুনে ও বলল, ‘কাকু, কোনও সন্তানই চায় না তার মায়ের জায়গা সৎমা নিক। কিন্তু বাবার মুখ চেয়ে বাবার বিয়েতে বাধা দিইনি। বাবাও কথা দিয়েছিলেন ভালোবাসার কোনও অভাব আমাদের হবে না। কিন্তু নতুন মা আসার পর থেকে বাড়ির পরিবেশটাই বদলে গেল। মাকে আমি দোষ দেব না। আমার অভিযোগ বাবার বিরুদ্ধে যিনি আমাদের নিজের স্নেহ থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছেন। বোনের বিয়ে বাবা যেমন তেমন করে সেরেছেন অথচ নতুন মায়ের মেয়ের জন্যে পৈতৃক বাড়ি পর্যন্ত বিক্রি করেছেন। আমার টাকার উপর কোনও মোহ নেই কিন্তু নতুন মা-কে বাবা ফ্ল্যাট কিনে দিয়েছেন, তাহলে আমরা পৈতৃক সম্পত্তির ভাগ কেন পাব না? বাবার পিএফ, বিমা, পেনশন সবকিছুর ওপর অধিকার রয়েছে নতুন মায়ের তাহলে আমরা আমাদের অধিকার ছাড়ব কেন?’

‘কিন্তু টাকার কি দরকার আছে তোর?’

‘আমাদের শুধু দরকার ছিল মা-বাবার ভালোবাসার যা ওঁরা আমাদের দেননি। মায়ের জায়গা হয়তো নেওয়া সম্ভব নয় কিন্তু রাত্রে ঘুমন্ত সন্তানের মাথায় হাত বুলিয়ে আদর তো করতে পারতেন।’

‘তোদের বাবা আজ অনুশোচনার আগুনে জ্বলছেন।’

‘অনুশোচনা তো করতেই হবে। নতুন মায়ের প্রতি মোহ, আকর্ষণ কমেছে বয়সের সঙ্গে তাই ছেলে মেয়ের কথা এখন মনে পড়েছে।’

‘তোদের বাবা যে ভুল করেছেন, তুইও কি একই ভুল করতে চাস? প্রতিশোধ নিতে চাস?’

‘আমি আর কী করব? যা অন্যায় করেছেন তার ফল আজ উনি ভোগ করছেন।’

‘তাও উনি তোর বাবা। উনি তোর কাছে কিছু চাইছেন না শুধু নিজের কৃতকর্মের জন্যে লজ্জিত। তার প্রায়শ্চিত্ত করতে চান। একবার ওনার কাছে যা। তোর কাছে ক্ষমা চাইতে পারলে ওনার মনের বোঝা খানিকটা হালকা হবে।’

অয়ন আমার কথা শুনল। পরের দিন আমার সঙ্গে হাসপাতালে বাবাকে দেখতে এল। ওকে দেখে অজয়ের চোখের জল বাঁধ মানল না। অয়নের হাত চেপে ধরে রাখল, মুখ থেকে একটা কথাও বেরোল না। সুনন্দাও স্বামীর স্বাস্থ্যের কথা ভেবে অভদ্রতা না করে অয়নের কুশল জিজ্ঞেস করে চুপ করে থাকল।

অজয় যতদিন হাসপাতালে থাকল অয়ন নিয়ম করে বাবাকে দেখে যেত। হাসপাতাল থেকে ছাড়ার দিন অয়ন এসে সব বিল মিটিয়ে বাবাকে বাড়ি পেৌঁছে দিল। অজয় ছাড়ল না অয়নকে, ‘তোদের কাছে আমি অপরাধী। নিজের প্রতিজ্ঞা আমি রাখতে পারিনি। এতটাই স্বার্থপর হয়ে উঠেছিলাম যে ভুল করেও ভুলটাকে স্বীকার করিনি। আমাকে ক্ষমা করিস।’

‘মানুষের এতটা স্বার্থপর হওয়া উচিত নয় বাবা।’ অয়ন উত্তর করলে সুনন্দা কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল। অজয় ওকে থামিয়ে দিল। আমিও পুরোনো রাগ পুষে রেখেছিলাম। উপযুক্ত সময় দেখে মুখ থেকে বেরিয়েই গেল, ‘বউদি, তোমাদের দুজনের উচিত ছিল সংসারটাকে ধরে রাখার। ছেলে মেয়েদের মধ্যে ভেদাভেদ করা কখনওই উচিত হয়নি। সৎ বোন, সৎ ভাই এই চিন্তাটাই বাচ্চাদের মনে কেন আসবে যদি মা-বাবা সঠিক শিক্ষায় বাচ্চাদের মানুষ করে? তুমি আসতেই কেন অজয়ের ছেলে মেয়েকে নিজের সন্তান ভেবে মাতৃস্নেহে ভরিয়ে তুলতে পারোনি? অজয়কে বিয়ে করে তুমি যে সামাজিক সুরক্ষা পেয়েছ সেটা কীভাবে অস্বীকার করবে? অজয় তো তোমার সঙ্গে এমনটা করেনি। ও তোমার মেয়েকে বাবার পরিচয়ে বড়ো করেছে। ওর বিয়েতে, পৈতৃক বাড়ি বিক্রি করতেও ও পিছপা হয়নি।’ বহুদিনের জমে থাকা কথাগুলো বলতে পেরে অনেক হালকা মনে হচ্ছিল নিজেকে। ফুরফুরে মেজাজ নিয়ে আমি আর অয়ন অজয়ের বাড়ি থেকে বেরিয়ে নিজেদের গন্তব্যে রওনা হলাম।

খবর পেলাম অয়নের দিল্লিতে বদলি হয়েছে। বউকে নিয়ে একদিন দেখা করতে এল। জানাল পরের মাসে অজয়, সুনন্দাও ওর সঙ্গে দিল্লি যাচ্ছে। দুই তিন মাস ওখানে থেকে অয়নের সংসারটা গুছিয়ে দিয়ে কলকাতা ফিরবে। খুশি হলাম। দেরি করে হলেও সুনন্দা বউদি যে নিজেকে বদলাতে পেরেছে সেটা ভেবে আনন্দ পেলাম।

পিঙ্গলার প্রেম

বুনো বিড়ালটা এক মোক্ষম শিকার ধরেছে। ঠিক ধরেনি। হদিশ পেয়েছে। পাহাড়ের গর্তে মুখ ঢোকাচ্ছে আবার পিছিয়ে আসছে। দু’পা এগোচ্ছে আবার পিছিয়ে আসছে। শিকার যে একটা জবরদস্ত পেয়েছে সেটা বোঝা যায়, লেজ নাড়ানোর বহর দেখে। তিড়িক তিড়িক করে লেজ নাড়িয়েই চলেছে। এটা তার শিকার ধরার আক্রমনাত্বক শানিত অস্ত্র। শিকার রেঞ্জে এলে তবেই সিওর শট। শিকার পিঙ্গলাও পেয়েছে। তিনটে ছোটো ছোটো পাথরের টুকরো বসিয়ে আগুন জ্বালিয়েছে। একটা ভাঙা কড়াইয়ের ভিতরে উই পোকার ডিম ফ্রাই হচ্ছে। পিঙ্গলার দৃষ্টি এড়ায়নি। ঘরের থেকে বর্শাটা এনে উনুনে লাল করতে থাকে। ঘর বলতে পাহাড়ের গুহা। গুহাটা বেশি বড়ো নয়। একটু বড়ো সাইজের ফোকর। তারই মধ্যে জঙ্গলের কাঠ দিয়ে তক্তপোশ বানানো। বুড়া বাপটার জন্য। বুড়া বাপটা একটানা কেশেই চলেছে। সূর্যের উদয় অস্ত আছে। বুড়ার কাশিতে উদয় আছে, অস্তটা নেই। থেকে থেকে চ্যাঁচায়– এ বিটিয়া ভুখ লাইগছে রে।

গর্তের মধ্যে মুরগিটা ঘাপটি মেরে বসেছিল। বেচারা মুরগি! পালাবার বিকল্প পথও নেই। দেহটা মুরগির মতো। মুখটা মুরগির মতো নয়। মুখটা থ্যাবড়ানো। প্যাঁচার মতো। বনবিড়ালটা তাক করেছে মুরগিটাকে। পিঙ্গলা ভাবছে, আর বিড়ালটার গতিবিধি নজর করছে। পাহাড়টা সবার জন্য খাবারের বন্দোবস্ত করেছে। যত উন্নাসিকতা মানুষ নামক জীবগুলোর খাদ্যের বেলায়। বিড়ালটা এক কিম্ভূত কিমাকার আওয়াজ করে লেজটা সটান বীর বিক্রমে খাড়া করে মুরগির মাথাটা কামড়ে ধরে। হতভাগা মুরগি। মরণ যন্ত্রণার আর্তনাদটুকু করার পর্যন্ত সময়ও পেল না। ততক্ষণে পুরো মাথাটাই বিড়ালের মুখের ভিতর। পিঙ্গলার মনে এক অদ্ভুত রকমের জিঘাংসার অগ্নিস্ফুলিঙ্গ যেন ছিটকে বেরোতে চায়। দু’দুটো দিন অনাহারে থাকতে থাকতে তারই সামনে বনবিড়ালটা খাবারটা চিবোচ্চে। পিঙ্গলা ঠিক থাকতে পারে না। আগুনের ভেতর থেকে তপ্ত বর্ষাটা বার করে হিংস্র বাঘিনীর মতো বিড়ালটার পুচ্ছদেশে সেদিয়ে দেয়। হত্যার উন্মত্ত আনন্দে পিঙ্গলার চোখ দুটো জ্বলজ্বল করে।

দেবার মেজাজ আজ বেশ রিলাক্সড মুডে। গতকাল ত্রিদেবের মেয়ের বিয়ের ভূরিভোজনে শরীর মন দু’টোই বেশ চাঙ্গা। ভুরিভোজনের চাইতেও বড়ো, খাবারের পুঁটুলি লাঠির ডগায় নিয়ে পরমানন্দে পাহাড়ের বেষ্টনী ডিঙিয়ে চলেছে কুঠুরির দিকে। উদরস্থ খাদ্যবস্তুর পঁচাত্তর শতাংশ পথেই খরচ করেছে। বাকিটা এখনও পেটে গজগজ করছে। এসব অনায়াসে হয়নি। আমদানি করা খাসি কেটে মাংস থেকে জ্বালানি জোগাড় করা ছাড়াও নানা রকম ফাইফরমাসের বিনিময়ে হয়েছে।

পিঙ্গলা বসেছে বর্শার ফলা দিয়ে মৃত বিড়ালটার চামড়া ছাড়াতে। থেকে থেকে গুহার ভিতর থেকে বুড়ার সেই ফাটা কাশির আওয়াজ– পিংলা, ভুক্ষ লাইগছে রে। পিঙ্গলা সাড়া দেয় না। আপন মনে কাজ করে আর গজগজ করে। বুড়ার অভিভাবক পিঙ্গলা। অভিভাবকের ক্ষুদা তৃষ্ণা থাকতে নেই। পেছন দিক থেকে দেবা লম্বা লাঠির মাথায় পুটুলি নিয়ে পিঙ্গলার পিছনে দাঁড়ায়।

– এ পিংলা, এ-তু কি করছিস বটেক? পিঙ্গলা ঘাড় ঘুরিয়ে এক নজর দেখে নিয়ে বলে– কেনে, দিখতে লাইরছিস? জ্বলন, পেডের জ্বলন। ঘরকে দ্যাখ, বুড়ার মরণ ভুক্ষ লাইগছে। আবার সেই আওয়াজ– কুছ খেতে দে নারে। দেবা এক পলক দেখে নিয়ে বলে– তুয়ার ভুক্ষ লাগে নাই?

– হুঃ, মুয়ের ভুক্ষ লাইগতে নাই রে, দেবা। দেবা লাঠির মাথায় বাঁধা পুটুলিটা খুলে নিয়ে বলে– পিংলা, এ কামডা মু করছি। তু ঘরকে যা। এ খাবারডা তু খা, আর বুড়াকে দে।

– তু খাবেক নাই কেনে? মু তো খাইছি বটেক।

তিলাবনী পাহাড়। ছোটো নাগপুরের মালভূমি অঞ্চলের এক মিনি সদস্য। দৈত্যাকার নয়। শান্তস্নিগ্ধ। শীতের কুয়াশায় অলসতায় আকাশের বুকে মাথা এলিয়ে ঘুমিয়ে আছে। ভৌগোলিক অক্ষরেখায় নামটা আছে। বাহ্যিক দাম্ভিকতা নেই। অন্তরে আছে। কোলে কোলে অজস্র গ্রাম। শ্রাবণের ধারা কৃষি জমিকে উর্বর করে। তিলাবনী বুক চিরে লোকালয়ের সঙ্গে রাস্তা তৈরি করেছে। জীবনযাত্রা বর্ণময় না হলেও দুর্বিষহ নয়। তারই অপর প্রান্তে বেজম্মার মতো জন্ম নিয়েছে জিয়ারা গ্রাম। বঞ্চিত। অবহেলিত। পদদলিত। শ্রাবণের রক্তরস নিংড়ে ছিবড়ে করে সমৃদ্ধ করেছে পাশেই পিচুলা গ্রাম। কোল দিয়ে অবারিত জলধারা সমতলে নদীর চেহারা নিয়েছে। পোশাকি নাম দ্বারকেশ্বর। জিয়ারা তার অবাঞ্ছিত বেয়ারা জারজ সন্তান। জিয়ারা অপভ্রংশ নাম।

রুক্ষ শুষ্ক। বছরের পর বছর ধরণে (খরা) বাঁজা মরুভূমিতে পরিণত। আর্তনাদ নেই। কলরব নেই। শক্তি নেই বলে। তিলাবনীর রুক্ষ পাথরের দেয়ালে সেঁদিয়ে থাকা মৃতদেহের দুর্গন্ধ চিল-শকুনের নাকে বিরিয়ানির স্বাদ এনে দিচ্ছে। নীল আকাশ কবে দেখা গেছিল কে জানে। গোটা আকাশ চিল-শকুন দখল করে নিয়েছে। ভাবলেশহীন তিলাবনী নীরব দর্শক। নীরব দর্শক সরকারি ত্রাণ দফতরও। ত্রাণ নিয়ে এ গ্রামে কেউ পা মাড়ায় না। ভোটও নেই। রাস্তাও নেই। বেজম্মা গ্রামে কারও মমত্ববোধ কাজ করে না।

শীতে হাড় কাঁপানো ঠান্ডা। গ্রীষ্মে সূর্যের অগ্নিবৃষ্টি। এসবে তিলাবনী ভাগ বসায়নি। কেড়ে নিয়েছে শুধু শ্রাবণের ধারা। দেবা বসেছে উনুনের পাশে আড়ষ্ট হয়ে যাওয়া দেহটাকে সেঁকে নিতে। ঠিক সেঁকে নিতে নয়। বিড়ালের ঠ্যাংটাকে আগুনে ঝলসে নিতে। আলকাতরার পোঁচ লাগানো মুখে কোটরগত চোখ দুটো জ্বলজ্বল করছে। অনাহারে শীর্ণ হয়ে যাওয়া হাত দুটো দিয়ে বিরানির মাংস খেতে খেতে পিঙ্গলা বলে– বেসাম খাবারডা ভালাই আনছিস বটেক। ইতে হরদিন কুছু খিতে লাইরবেক। দেবা, ই খাবার তু কুথা থেকে আনছিস? কেনে, পিচলার তিদেব বাবুয়ার মিয়ার বিয়া লাইগছে যে।

– ওহঃ, তা তু চোরি করিছ নাই ত?

– কেনে? বাবুয়ার ডেড়াতে কাম করলাম যে। উস লাইগা খাবারডা দিল ত। দেবা আগুনে লাকড়িটা খানিক ঠেলে দিয়ে বলে– বুড়া খাবারডা খাইছে? পিঙ্গলা ক্ষিপ্রতা নয়, অনুযোগের সুরে বলে– মুর বাপকে বুড়া বলবিক নাই। দেবা অনুযোগের জন্য প্রস্তুত ছিল না। তারপর রান্নার রসদ যুগিয়ে বলে– গুস্সা করছিস কেনে পিংলা। তুয়ার বাপ ত মুয়ার বাপ আইনছে বটেক।

পেটে মা লক্ষ্মী গিয়ে পিঙ্গলার খিটখিটে মেজাজ এখন শান্ত। বুড়া বাপটা ফাটা কাশি বন্ধ করে শীতের আড়ষ্টতায় দুই হাঁটু মাথা এক করে তিন মাথার বুড়া। মন বুঝে দেবা সুপ্ত ইচ্ছাটা বলেই বসে।

– পিংলা মিলায় যাবি কেনে?

– মিলা! কোন মিলা?

– শবর মিলা

– কুথা সে?

– রাজনা গাড়ে।

– আরে বা প! সে তো বহত দূর আছে বটেক। টঙ্কা লাগবেক তো।

– মুয়ের আছে। চলনা কেনে?

– ডাকাইতি করলি না-কি রে?

– কেনে কাম জুটাইছি যে। উ বাবুয়ার ডেড়ায়। হপ্তায় শ-টংকা দিবে। একশো টাকার একটা নোট বের করে বলে– ই দেখ না কেনে।

ত্রিশংকর হালদার এখানকার আদিবাসী নয়। বহুদিন আগে পূর্ববঙ্গের ছিন্নমূল ছেলেটা জীবিকার সন্ধানে ভাসতে ভাসতে তিলাবনীর পাহাড়ে আশ্রয় নেয়। পেশায় কোয়াক ডাক্তার। কুমিরের সাথে সখ্যতা না করলে জলে বাস করা যায় না। শ্রম দিয়ে চিকিৎসায়, সেবায়, ধীরে ধীরে অপরাধপ্রবণ শবর জাতিদের সঙ্গে সখ্যতা গড়ে ওঠে। হয়ে ওঠে শবর জাতির দেবতা। কতকটা বেঁচে থাকার তাগিদ কতকটা মানবিকতা, মূল্যবোধের তাগিদে সমাজের মূল স্রোতে ফেরাবার মরিয়া চেষ্টা। ত্রিশংকর এখন দেবতা ত্রিদেব। তিলাবনীর কোলে মাথা গুঁজেই ত্রিশংকর জীবনের ধারাটা বদলে ফেলেছে। এরা বড়ো অসহায়। অশিক্ষা অজ্ঞতা যাদের একমাত্র অবলম্বন, হিংস্রতা ছাড়া বেঁচে থাকার পথ থাকে না। কাজটা যে সহজ, অনায়াসলভ্য তাও নয়। অনেক অত্যাচার, লাঞ্ছনা সহ্য করেও একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে জীবনের মধ্যগগনে বসে ভাবছে– সভ্যতার বিকাশ, উন্নত প্রযুক্তির ছোঁয়া স্পর্শ করাতে পারলাম কই? অশিক্ষা, নির্বুদ্ধিতাকে কাজে লাগিয়ে সম্পদ লুঠেরা অতি বিপ্লবীর দল বারে বারে কাজে লাগাচ্ছে। একদম বিফলে গেছে ঠিক তাও নয়। একজনকে অন্তত পেরেছে। দেবা। কাক কাকের মাংস খাওয়ার অনাবিল আনন্দে নয়। ধবংস নয়। দেবা আজ সৃষ্টি সুখের উল্লাসে মত্ত।

দীর্ঘ অনাহারে গুরু ভোজনের গুরু ভার বুড়া বহন করতে পারেনি। চিল শকুনের দল পজিসন নিচ্ছে। একটু একটু করে রাতের আঁধার নেমে আসছে। চিল-শকুনদের ধৈর্যচ্যুতি ঘটেছে। গুটি গুটি পায়ে সরে যাচ্ছে। জায়গা নিল তিলাবনীর ফোকরে। হিমেল হাওয়ায় উনুনের পাশে বসে পিঙ্গলা আর দেবা উষ্ণতার নির্যাস নিচ্ছে। দেবা বলছে

– ভোর রাইতে এক স্বপন দিখলাম বটেক। পিঙ্গলার তর সয় না।

– কি স্বপন দিখলি? দিখলাম, জিয়ারা থিকা রাস্তা বানায়ছি পিচলাতক। কোতো গাড়ি আইছে। কোতো গাড়ি যাইছে। তিলাবনীর বুক ফাটায়ে জলের তোড় আনছি। মাঠ ডোবা জলে টইটম্বুর হইছে। মাঠ সবুজ। সগগলে কাম লইছে। পিঙ্গলা উদাস মনে দেবার স্বপ্নের বাসনা গিলছিল। এ বাসনা পিঙ্গলারও ছিল। সুপ্ত রেখেছে। প্রতিদিন যাদের মৃত্যুর সাথে লড়াই করতে হয়, এ স্বপ্ন পাহাড়ের চূড়ায় বসে ভৈরবী রেওয়াজের মতো। বাস্তবে ফিরেছে পিঙ্গলা।

– তিলাবনীর বুক ফাটায়ে রাস্তা বানায়ছিস?

– হ।

– জল আনছিস?

– হ।

– কোতো দিন সিনান করিস না বল না কেনে? তুয়ার মাথাডা গরম হইছে।

– কেনে?

– তু পাগল হইছিস বটেক।

– পাগল হই নাইরে পিংলা। উ রাস্তা হামি বানাবই। দিখে লিবি। উ চিল-শকুনের দল মু তাড়াবই। সগ্গলে জমিনে কাম করবেক। বাবুয়া কইছে– তু-ই পারবিক দেবা। আরও কইছে– হামাদের ভদ্দর হইতে হবেক। ভদ্দর সমাজ তৈয়ার কইরতে হবেক।

– তু থাম দেবা। উ বাবুয়া তোর মাথাডা খাইছে। উয়ারা ভদ্দরলোক বাবুয়া আছে। পেটে দানা পানি আইনছে। তাই উসব কতা কইছে। মু-দের পেটে দানা পানি নাই।

– উ সব কুথা মুদের মানাইছে না।

– চুপ যা পিংলা। উ বাবুয়া দেব্তা আইনছে রে। পাশে রাখা পুঁটুলিটার ভিতর থেকে একটা নাইটি বার করে বলে– ই দেখ্ না কেনে। ইটাকে মিয়াদের ডেরেস বলে।

– পর। পর না কেনে। দাঁড়া মু পড়ায় দিছি। দেখ্, দেখ্ মুকেও দিছে। প্রথম। এই প্রথম পিংলাকে নতুন রূপে, নতুন ভাবে দেখল। চোখ ফেরায় না। শরীরে, মনে এক অদ্ভুত শিহরণ। কি অপরূপ শোভা! গুছিয়ে ভাবতে পারে না। সদ্য উত্থিত যৌবনের চিহ্নগুলো শুকিয়ে ফলন্ত লাউগাছ। একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে। ভাবছে মিয়াটা পেট পুরে দুটো খিতে পাইরত! উঠে দাঁড়ায়– নাঃ ঘরকে যাই।

ত্রিশংকর হালদারের বাজার আজ বড়ো খারাপ। সকাল থেকে টেবিল চেয়ার পরিষ্কার করে চুপচাপ বসে। কোনও পেশেন্ট নেই। মেয়েটার বিয়ের পর ঘরটা একেবারে শুন্সান। বউ মরেছে মেয়েটাকে জন্ম দিতে গিয়েই। বয়েস বাড়ার সাথে সাথে সে স্মৃতি আজ ঝাপসা হয়ে আসছে। পেশেন্ট যে একেবারে হয়নি ঠিক তাও নয়। বউনি খদ্দের। একটি কচি মেয়ে গণশাকে ধরতে ধরতে চেম্বারের বেঞ্চে শুইয়ে দেয়। কচি বউটা রাগে গরগর করতে করতে বলে– দ্যাখ্ কেনে বাবুয়া, ডেড়ায় চাউল নাই। বাচ্চা দুটো খিতে লাইরছে। আর উ কাম করবেক নাই। শুধু হাড়িয়া গিলবে। হর রাইত ঘরকে যায় নাই। সক্বালবেলা দিখি জমিনে শুইয়া ঘ্যোৎ ঘ্যোৎ কইরছে। সারা শরীল থিকে খুন ঝইরছে। উ মুয়ার শরীলে জ্বলন ধরায় দিল। ত্রিশংকর ডেটল জল দিয়ে ধুয়ে, বেটাডিন তুলায় লাগাতেই গণশার আর্ত চিৎকার।

জ্বলন ধইরচে রে ডাক্তার বাবুয়া। ত্রিশংকর ওর চিৎকারে কান দেয় না। ব্যান্ডেজটা ভালো করে বেঁধে দেয়। তারপর টক্সাইড ইঞ্জেকশান প্রস্তুত করতেই আবার চিৎকার– বাবুয়া জ্বলন ধইরছে। তু আবার সূঁচ লাগাইছিস? মরে যাবেক বাবুয়া। উটা তু দিস না বাবুয়া। ত্রিশংকর ডাক্তার মিচকি মিচকি হাসছে। ডাক্তার আদিবাসীদের ভাষা বোঝে। বলতে পারে না। এরাও ডাক্তারের ভাষা বোঝে। ভাব বিনিময়ের বোঝাপড়াটা এরকমই। ডাক্তার বলছে– জ্বলন ধরছে? মরে যাবি? জখমটা তো বেশি হয়নি। তা সারারাত জমিনে পড়েছিলি যখন জ্বলনটা কোথায় ছিল? ছাইপাঁশ গিলবার সময় জ্বলনের কথাটা মাথায় ছিল না? এভাবে বেঘোরে প্রাণটা দিচ্ছ কেন বাপু? এসব ছাড়। বেঘোরে মরবি। মন দিয়ে কাজ কর।

সংসারে অভাব থাকবে। কষ্ট থাকবে। বউ বাচ্চা নিয়ে দুঃখ কষ্টে সংসারটা চালা। এর মধ্যেই শান্তির ঠিকানা খুঁজে পাবি। বুঝলি তো। বাধ্য ছাত্রের মতো গণশা ঘাড় নাড়ে। পকেট থেকে ত্রিশংকর পঞ্চাশ টাকার একটা নোট বার করে বউটাকে দিয়ে বলে– নাও, আজকের মতো বাচ্চাগুলোকে কিছু খাওয়াও। বউটা কোঁচড়ে টাকাটা গুঁজে নিয়ে পা দুটো ধরে প্রণাম করে বলে– বাবুয়া, তু দেবতা আছিস বটেক। গণশা কিছু বলল না।

বউ-এর ঘাড়ে হাত রেখে খোঁড়াতে খোঁড়াতে চলে গেল। শুধু ঘাড় ঘুরিয়ে ছলছল দৃষ্টিতে এক ঝলক দেখে নিল। মনের অভিব্যক্তি। হে মহামানব, তুমি আছ বলেই শবর জাতি আছে। অবহেলিত, ঘৃণিত মানুষগুলো এখনও অতল তিমিরে চলে যায়নি। সকালবেলা বউনি দক্ষিণাটা এভাবেই হ’ল ত্রিশংকর হালদারের।

নিকম্মা দিন। কাজ না থাকলে ত্রিশংকর ভাবে। টেবিলের উপর বাঁ কনুইটা রেখে গালে হাত রেখে অনাবিল ভাবনার নদীতে ডুব দেয়। কতটুকু সামর্থ্য আমার। ভাবে জিয়ারা গ্রামের কথা। সেখানে শবর আদিবাসীদের কথা। বছরের পর বছর খরা। পাহাড়ের ঝরনা ধারা নামে না। অনাহার অপুষ্টিতে ক্রমশ ক্ষিপ্র হয়ে ওঠে গ্রামের মানুষ। শিক্ষিত সমাজ গায়ে অপরাধপ্রবণ গোষ্ঠীর লেবেল সেঁটে দেয়। কালেভদ্রে ছিটেফোঁটা বৃষ্টিতে যা ফসল হয়, সেখানেও সম্পদ লুঠেরা অতি বিপ্লবীর মুখোশ পরে চালায় নিরীহ মানুষের উপর তাণ্ডব। কাজে লাগায় এই অশিক্ষিত অজ্ঞ বুভুক্ষু শবর জাতিদের। ভাবনার শ্বাস সীমিত। সেই ভাবনার শ্বাসরুদ্ধ হয়ে আসলে আর এগোতে পারে না।

দেবার ঘরটা বেশ মজবুত। এখানটা তিলাবনীর ঢালটা নেমে এসে লম্বা একটা ছাদের আকার নিয়েছে। দেবা বেশ খানিকটা জায়গা বুনো জঙ্গলের ডালপালা দিয়ে বেড়া দিয়ে নিয়েছে। ঝড় বৃষ্টি রোদের তাপ নেই। বেশ নিরাপদ। দেবা বসেছে ছেনি ঘষে ঘষে ধার দিতে। মনে দিগন্ত বিস্তৃত স্বপ্ন। তিলাবনী যে দুর্ভেদ্য প্রাচীর দিয়ে পিচুলা আর জিয়ারা গ্রামকে বিভক্ত করে রেখেছে। পাহাড়ের বুক চিরে রাস্তা তৈরি করবে। দুটি গ্রাম থাকবে একই মায়ের সহোদরের মতো। দেবা অশিক্ষিত। তথাকথিত মূর্খ। প্রযুক্তিটা জানে। মনে মনে রাস্তার ব্লু প্রিন্ট ছকে নিয়েছে। তিলাবনী দেবার কাছে মায়ের মতো। শুধু দেবা কেন সমস্ত শবর, কুর্মী আদিবাসীদের কাছেই মাতৃতুল্য। তবু কেন জানি কোন এক অজ্ঞাত কারণে জিয়ারা গ্রামের উপর তার এই বৈমাত্রেয় আচরণ। অভিমানে, ক্ষোভে চোখ দুটো ছল ছল করে ওঠে। তবু মা-তো! ধরিত্রীর উপর সুবিস্তৃত এলাকা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, তার ভারসাম্য বজায় রাখার দায়ভার তো সন্তানকেই নিতে হয়। দেবা মনে মনে ভাবছে কীভাবে রাস্তাটা সেপ্টিপিনের মতো ঘুরে ঘুরে পিচুলা গ্রামে মিশবে। দু’টো গ্রাম মিলেমিশে একাকার হয়ে যাবে। পরিকল্পিত সৃষ্টির আনন্দে আরও একবার চোখ দুটো চিক্ চিক্ করে ওঠে।

কার্তিকে চলেছে দুর্ভেদ্য পাহাড় ডিঙিয়ে এঁকেবেঁকে এবড়োখেবড়ো পাথরের খাঁজে খাঁজে পা চালিয়ে। কাঁধে দু’হাত দিয়ে ধরা একটা ছাগল। দেবা দেখেছে। ছেনিতে শান দিতে দিতে হাঁক পাড়ে– এ কার্তিকে, এ কার্তিকে। সাড়া দেয় না, আরও তরতর করে পা চালায়। ছেনিটা রেখে পিছু নেয় দেবা। কার্তিকে দাঁড়ায় না। আরও তাড়াতাড়ি পা চালায়। দেবা এবার দৌড়। হাঁপাতে হাঁপাতে সামনে এসে দাঁড়ায়।

– ছাগলটা তু কুথা থিকা আনছিস বটেক? কার্তিকে নিরুত্তর। তাড়াতাড়ি পা চালাতে গিয়ে গল্পটা তৈরি করতে পারেনি। সত্যিটা বলতেও মনের সাহস জোগায় না। দেবার কাছে গোটা গ্রাম ঋণী। বিপদে আপদে সবসময় পাশে দাঁড়ায়। শরীরের রক্তরস নিঃশেষিত করে অপরাধপ্রবণ লেবেলটা মোছার চেষ্টা করছে। ভদ্র সমাজ গড়ার স্বপ্ন দেখিয়েছে। এ শিক্ষাটা পেয়েছে ত্রিদেব বাবুয়ার কাছ থেকে।

– তু চোরি করলি বটেক?

ছাগলটা ছেড়ে দিয়ে মাথা নীচু করে থাকে। তারপর বলে

– ছিনায়ে আনছি বটেক।

– ছিনায়ে আনছিস? ভদ্দর হবিক নাই? ভদ্দর সমাজ মুদের ঘৃণা কইরছে। উ দাগ মুছতে দিবিক নাই?

– হ হ ভদ্দর সমাজ! পেডের জ্বলন ভদ্দর সমাজ মুছে নাই রে, দেবা। বলে হাউ হাউ করে কাঁদতে থাকে।

– তুয়ার খাওন হয় নাই তো মুকে জানালি না কেনে? চল্, চাড়ে চাড়ে চল।

– কুথা?

– কেনে মুয়ার ঘরকে। মুয়ার খাবারডা যা আছে ভাগ করে লিবেক। যেতে যেতে দেবা বলে– মুয়ের স্বপনডা মুই একা পূরণ কইরতে লারবেক। এ গিরামের সগ্গলে কাম কইরতে হবেক। স্মরণে রাইখবি, তুয়ের খতরা তো মুয়ের খত্রা। সগ্গলের খত্রা।

বুদ্ধিটা ত্রিশংকরই দিয়েছিল। বলেছিল

– শোন দেবা, রাস্তাটা প্রথমে বেশি চওড়া করবি না। একজন যাতায়াত করার মতো। মনে রাখবি তিলাবনী তোদের মা-বাপ। পাহাড়ের আড় দেখে দেখে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে রাস্তাটা হবে? জনপ্রতি দু’টাকা করে নিবি। তারপর বড়ো রাস্তা। পেটে লক্ষ্মী-নারায়ণ ঢুকে গেলে কার্তিকের ভোঁতা বুদ্ধির খোলসটা থেকে খানিকটা সতেজ হয়েছে। তা ইখন পেড চালাইছি কি করে? ঘরে ইকটা বাচ্চা। বউ-ডার আবার পেড হইছে। হব হব কইরছে। চইলতে লাইরছে।

– তু এক কাম কর। মুয়ের লগে বাবুয়ার ডেড়াই যাবেক। উ দেবতা একটা কাম জুটাই দিবেক। ই নে, পিরানডা পর। ছাগল ডা লিয়ে যা, কাল মালকিনকে ফিরায়ে দিবেক। একটা পুঁটুলিতে কিছু চাল দিয়ে বলে– ইটা লিয়ে যা। বউ-ডা, বাচ্চা খাবেক কি? মনের ক্ষিপ্ততার, ঝাঁঝ কেটে গিয়ে এখন লাউডগা সাপ। শুধু মনে মনে ভাবে। বয়সে দেবা আমারই মতো। অথচ আমাদের মতো এই জংলা মানুষটার মধ্যে মহামানবের মহা-প্রাণ প্রতিষ্ঠা করল কে? শান্ত, অবনত মস্তকে বলে– ইকটা কুথা বলবেক দেবা? বল্ না কেনে? কার্তিকে ছাগলটার মাথায় হাত বুলিয়ে বলে– ইটা তুয়ার কাছে রাইখ রাইতডা। কাল দু’য়ে দু’য়ে ফিরায়ে দিবে।

মহাপ্রাণটা প্রতিষ্ঠা করেছিল ত্রিশংকর। প্রতিষ্ঠা করেনি। দেবার মধ্যে উন্নত সভ্যতার চেতনা জাগিয়েছিল। দিয়েছিল বেঁচে থাকার লড়াইয়ের মন্ত্রণা। সেই মন্ত্রণার বীজ দেবা একটু একটু করে শবরদের মধ্যে রোপন করেছে। সবটা পারেনি। কিছুটা পেরেছে। সেই বীজ অঙ্কুরিত হয়ে কার্তিকে, পিঙ্গলার মধ্যে শাখাপ্রশাখা বিস্তার করেছে। ত্রিশংকর শবরদের দিয়েছে অনেক কিছুই। ত্রিশংকর পরামর্শ দিয়েছে। হেমন্ত চলে গিয়ে শীত আসব আসব করছে।

– দেখ দেবা, ধানপাকার সময় হয়েছে। পিচুলার গ্রামে এখন অনেক কাজ। প্রতিষ্ঠিত পরিবারে পুরোনো লেপ কম্বল কিছুটা মজুরির বিনিময়ে চেয়ে নে। আর একটা কথা মনে রাখবি। যেখানেই সম্পদ, সেখানেই লুঠেরা। যত সম্পদ। তত লুঠেরা। সেই সম্পদ লুঠ করার চেষ্টা চলে অবিরত। স্বনামে। বেনামে। কখনও অতি বিপ্লবী মুখোশ পরে তাণ্ডব চালায়। ভণ্ড সাধুর দল আড়াল থেকে সাহায্য করে। হিংস্র পশু গেরস্থের সংসারে এসে পোষ মেনেছে। সব কথার তাৎপর্য বুঝতে পারেনি। এটুকু বুঝতে পেরেছে, মনের ভিতর ঘুমন্ত সৈনিকটা জাগিয়ে তুলতে হবে। আসন্ন শীতে রাতের আকাশটা মেঘমুক্ত। খোলামেলা জায়গায় তারাগুলো কিত কিত খেলছে। দেবা সেই আকাশে চোখ রেখে একান্তে ভেবে চলেছে। দেবা ডেরায় বসে জংলি কাঠ বিছানো শুকনো জঙ্গলে একসময় শ্রান্ত দেহটাকে নিদ্রার কোলে ছেড়ে দেয়।

মানবিক মূল্যবোধ, চেতনা কম দামে পাওয়া যায় না। মূল্য দিতে হয়। অনেক মূল্য। হয়তো বা জীবন দিয়েও। মনের দিক থেকে ত্রিশংকর প্রস্তুতই ছিল। জীবনের সুখ, দুঃখ, বাঁচা মরা সব কিছুই ঈশ্বরের ঘাড়ে চাপিয়ে যারা নির্লিপ্ত থাকে, ত্রিশংকর সে ধাতুতে গড়া নয়। রাতের আকাশ। এক দৃষ্টে চেয়ে থাকে। ওই এক মুঠো আকাশটার ভাগীদার তো সবাই। অথচ তারাগুলো অনাবিল আনন্দে যখন খেলে বেড়াচ্ছে, পিছন থেকে লম্পট মার্কা মেঘগুলো চুপিচুপি গুঁড়ি মেরে এগিয়ে আসছে। মেঘ না মেছো চিল! জীবনটা আসলে সবলের জন্য। কৌশলবাজদের জন্য। সবলেরা গিলতে চায় দুর্বলকে। কৌশলবাজ ক্যারাটে প্যাঁচ মারে সরল নির্ভেজাল মানুষগুলোকে। এটা আদি অকৃত্রিম।

ত্রিশংকর এখন অনেক বস্তুনিষ্ঠ। জীবনদর্শনটা খুব কাছ থেকে দেখেছে। ত্রিশংকর ঘরে ঢুকে দরজার খিলটা এঁটে দেয়। শুয়ে শুয়ে ভাবছে। সময় বেশি নেই। আক্রমণটা আসবে। প্রথম আঘাতটা তার উপরই। অনেক ঘুরপথে অস্ত্রটা দেবার হাতে তুলে দিলাম। আগ্নেয়াস্ত্রের ভারটা বইতে পারবে তো? এলোমেলো ভাবনা। সেই ভাবনাগুলি মনে ক্লান্তি এনে দেয়। সেই ক্লান্তিতেই ত্রিশংকর ঘুমিয়ে পড়ে। পাতলা ঘুম। হঠাৎই ঘুম ভেঙে যায়। একঝাঁক বুটের আওয়াজ। এগিয়ে আসছে। ঝরে পড়া শুকনো পাতাগুলির ভুষ্টিনাশ করে বাড়ির চারপাশ ঘিরে ফেলছে। পালাবার পথ নেই। দরজায় ভারী কিছু দিয়ে আঘাত করে হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ে গোটাকতক হায়েনা। চোখগুলো জ্বলজ্বল করছে। সারা মাথা মুখ কালো কাপড়ে ঢাকা। শুধু হায়েনার দাঁতগুলো চিক্ চিক্ করছে। মত্ত উল্লাসে বলছে। ই বাবুয়া, তু ডাইকলি না। মুয়েরা আইছি। তুয়ার ব্যামো সারাইতে। পাশ থেকে আর এক হায়েনা বলছে– তু কে সূঁচ ফুটাইছিল না? তুয়ার ব্যামো সারাইবার লিগা। তু এক কাম কর। উয়ার ব্যামো সারাই দে বটেক। সূঁচ ফুটাই দে না কেনে? উয়ার ব্যামো সারবেক। অনেকক্ষণ থেকে গলার আওয়াজটা পরিচিত মনে হচ্ছিল। ‘ব্যামো’র কথাতে ত্রিশংকরের চিনতে অসুবিধা হয় না।

– তুই গণশা না? তু-ই আমাকে মারতে এসেছিস? গণশা মুখে কথা নেই। শুধু মনে মনে বলে

– তুমি দেবতা। যদি পারো ক্ষমা করে দাও প্রভু। তুমিই তো পারো অধমকে ক্ষমা করতে। যে জালে আমি জড়িয়েছি। এছাড়া আমার যে আর পথ খোলা ছিল না। হায়েনার দল সাংকেতিক নামে কথা বলছে। ‘র’ ‘গ’ ‘শ’ নামে। পাশ থেকে বলছে

– ‘গ’ মশিনডা চলা কেনে?

‘গ’ বলছে,

– মশিনডা কাম কইরতে লাইরছে। সময় নষ্ট করে না। দুম দুম করে দুটো আওয়াজ। বার্ধক্যে শক্তি বেশি ধরে না। ত্রিশংকরও মৃত্যু যন্ত্রণায় বেশি সময় নষ্ট করেনি। অল্প ক্ষণেই ঘরের কড়িকাঠে চোখ দুটো স্থির করে শান্ত হয়ে যায়। প্রস্তাবটা গণশাই দিল। বলে – ইকটা কাম করি। ডেড়ায় আগ লাগাই দি কেনে?

– লগই দে। গণশা সাইকেলের টায়ারগুলি সারা ঘরে ছড়িয়ে দেয়। সদর থেকে বাতিল টায়ার কাঁধে করে নিয়ে আসে। আগুন লাগাতে এগুলি উপাদেয় পদার্থ। আগুন লাগায়। মনে মনে বলে– দেওতার সৎকারডা ত হউক বুটেক।

অমাবস্যার রাত। বাইরে মিশকালো ঘন অন্ধকার তিলাবনীকে গ্রাস করেছে। আবার দুম দুম করে আওয়াজ। ‘র’ ‘শ’ ইত্যাদি পিছন ফিরে তাকায়। টর্চ মারে। গণশা পড়ে আছে। তখনও ঠোঁটটা থর থর করে কাঁপছে। কিছু বলতে চাইছে। নব আগন্তুকেরা সে ভাষা বোঝে না। তিলাবনী বুঝেছে। সেই একই কথার পুনরাবৃত্তি। দেব্তা তুয়ার মরণ হয় নাই। মরণ হইছে মুয়ের। মরণ হইছে শবরদের। সেই অন্ধকারে হিংস্র দানবের দল মিলিয়ে গেল।

বসন্ত আসতে ঢের দেরি। হোলি খেলাও শুরু হয়নি। শুরু হয়েছে রক্তের হোলি খেলা। ত্রিশংকরের রক্ত দিয়ে। গল্পটা এখানেই শেষ হলে হয়তো ভালো হতো। সব গল্প তো শেষ হয়েও হয় না। কারণ ত্রিশংকরের রক্তের বীজ দিয়ে জন্ম নিয়েছে আগামীদিনের লড়াইয়ের বুনিয়াদ। শবরদের লড়াই। বেঁচে থাকার লড়াই।

শীতকাল না এলেও শীত এসে পড়েছে। গ্রীষ্মেও অনাহুতে দল আগে ভাগে ঢুকে পড়ে। তিলাবনী শত সহস্র হাত প্রসারিত করে চারিদিক বেষ্টন করে রেখেছে। তিলাবনীর অবাঞ্ছিত জিয়ারা গ্রামের জলবায়ুর বন্দোবস্তটা এরকমই। দেবার কাঁধে লম্বা লাঠির মাথায় এক পুঁটুলি। পুঁটুলি ঠিক নয়। একটা বস্তা। গা দিয়ে তখনও গলগল করে ঘাম ঝরছে। বস্তাটা পিঙ্গলার ডেরার সামনে ধপাস্ করে ফেলে। একটা বিরাট কম্বল বার করে ললিত মোহনের বুকে চাপিয়ে দেয়। মনের ভিতর এক আনন্দের ঝিলিক মারে।

– ই বাপ, শরীলডা গরম হইছে না বটেক? জারে বহুত কষ্ট পাইছিস বটেক। আর কইরতে লাইরবেক। আর একটা কম্বল পিঙ্গলার ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে বলে– পিঙ্গলা কিমন লাইগছে বটেক।

ভিন্ গাঁয়ে ভিন্ মজুরিতে দেবার পকেট ভারী। আচমকাই পিঙ্গলার পিঠে হাত পড়ে যায়। মুহূর্তে পিঙ্গলার সমস্ত শরীরটা চনমন করে ওঠে। চোখে চোখ রেখে দুটি হৃদয় ভালোবাসাময় হয়ে ওঠে। পিঙ্গলা মনে মনে বলে– মু ত তুয়ার পরানে হারায়ে গিছি বুটেক। যৌবনের বুকে ফুটে ওঠে নব পত্রিকার জৌলুস। দেবার বুকে তখন দহনীয় বৈশাখ। মনের কোণে কোণে ছড়িয়ে পড়ছে রং মশালের আলো। দু’টি হূদয় ভালোবাসার গাঙে হারিয়ে, সময়কে বয়ে যেতে দেয়। বাধা দেয় না। ডেরার বাইরে আগাছার মতো বেড়ে ওঠে পাহাড়ি ফুলের ঝাড়। দেবা এক গোছা ফুল নিয়ে বলে– চুলডা জড়ায়ে নে না কেনে? বসন্ত আসতে ঢের দেরি। এলেও এ গাঁয়ে উঁকি মারে না। না এলেও পিঙ্গলার মনে এসেছে। সেই বসন্ত পিঙ্গলাকে করেছে লজ্জাবতী ফুল। লাজুক চোখে তাকিয়ে বলে– কেনে?

– জড়াই দেনা কেনে। পিঙ্গলা অবাধ্য হয় না। জড়িয়ে দেয়। দেবা সেই চুলে পাহাড়ি ফুল গুঁজে দিয়ে বলে,

– বড়ো বাহারি লাইগছে বুটেক। শীতের হিমেল বাতাস চুপিসারে বলছে দেখেছি, দেখেছি। সব দেখেছি। সাক্ষী আছে হিমেল বাতাস। সাক্ষী আছে তিলাবনী। সমাজে ফিরেছে দেবা। বলছে– পিংলা, একটা কথা বইলবার মন চাইছে বুটেক। পিঙ্গলার কালো গাল দুটো লজ্জায় রাঙা হয়ে গেছে। লাজুক গলায় বলে

– বল্ না কেনে।

শরম লাইগছে বুটেক। দু’টো চোখ পরস্পরের দিকে তাকিয়ে স্বপ্নের জাল বোনে। দেবার মুখ থেকে শোনার অপেক্ষা। সময়ের দণ্ড পলের তর সয় না। অবশেষে অমৃত স্বাদের গন্ধ ঝরে পড়ে।

গুসসা করবিক নাইন ত বুটেক? মু তুকে বিহ করবারে মন চাইছে। দুয়ে দুয়ে ঘর করবেক। বাপটা থাইকবে মুদের মালিক। তু নারাজ নাইন ত বটেক?

সরম পিঙ্গলারও লাগছে। এক ছুটে ডেড়ার বাইরে গিয়ে মাথা নীচু করে নখ খুটতে থাকে। কিছু ত বল্ না বুটেক? পিঙ্গলা ফিস্ফিস করে বলে– পিরিতডা ত করি বুটেক।

– তা হইলে শুন্ না কেনে।

– ই অগ্রানে টুসু পরবে ঠাকুর মশাইকে স্মরণ দিবে। উ ঠাকুর মুদের বিহডা করাই দিবেক।

– উ কানুনডা মুদের ত নাইন বটে।

– নাইন থাক। ছাড়ান দে জংলি কানুন। ভদ্দর সমাজের কানুডাই বিহ করবেক।

ভালোবাসার রংমশালের আলোটা আচমকাই দপ করে নিভে গেল। ললিত মোহনের বুক থেকে অদ্ভুত একটা ঘড়ঘড়ানি শব্দ। দেবা এক লাফে বুড়ার সামনে এসে দাঁড়ায়। চোখ দু’টো যেন ঠিকরে বেরোচ্ছে। এক ভয়ংকর শ্বাস টান উঠছে। দেবা উদ্ভ্রান্ত, বিভ্রান্ত। চিৎকার করে বলে– পিংলা, চাড়ে চাড়ে আয় কেনে। দ্যাখ বাপ কিমন কইরছে বটে। তবু অশক্ত কম্পিত হাতটা দিয়ে দেবার হাতটা খপ্ করে ধরে। দেবা মরিয়া চেষ্টা করে। বলে– পিংলা, বাপকে মু লিয়ে যাব।

– কুথা?

– সদরে।

– আর সময় লাইরে দেবা। বাপটাকে থিরে যাইত দে। শেষবারের মতো পিংগলার হাতটা টেনে নিয়ে দেবার হাতে মেলাবার চেষ্টা করে। পারে না। শুধু অপূর্ণ স্বপ্নের বার্তাটা থরথর করে কেঁপে ঠোঁটটা স্তব্ধ হয়ে যায়।

চঞ্চলতা, অস্থিরতা, ব্যস্ততা কাঠবেড়ালির আছে। সে ব্যস্ততার যুক্তিগ্রাহ্য কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না। উদভ্রান্ত, অস্থিরতা ব্যস্ততার কারণ কার্তিকের আছে। কার্তিকে ছুটছে। পাগলের মতো। হোঁচট খাচ্ছে। পড়ছে। আবার ছুটছে। তিলাবনীর পাঁজরে আঘাত লেগে সমস্ত শরীর ক্ষতবিক্ষত। রক্ত ঝরছে। ভ্রূক্ষেপ নেই। মুখে শুধু আকাশ ফাটা আর্তনাদ। এই মুহূর্তে দেবাই সর্বনাশের আসান। পিঙ্গলার মনটা বিষাদগ্রস্ত। অসহায়ের মতো গালে হাত দিয়ে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছে। বাপটা চলে গেল। এইমাত্র দাহ করে ফিরেছে। মাথার উপর থেকে অশক্ত ছাদটুকু চলে গেল। সমস্ত অভিভাবকত্ব, অনুশাসন, শাসনের অবসান ঘটিয়ে ঘরে ফিরেছে। দেবা স্ত্বান্না দেয় না। ভাষা নেই যে। বসে আছে হাঁটু মুড়ে মাথা নীচু করে। পিঙ্গলার দৃষ্টিতে ধরা পড়েছে কার্তিকে। বয়ে আনছে আরও এক ভয়ংকর বিপর্যয়ের ঝোড়ো হাওয়া। মনটা আরও উতলা হয়ে ওঠে।

– দেবা, উ আইছে কার্তিকে না? দেখ্ না কেনে উ আঙ্গাস ফাটা চেচাইছে। মাথা নীচু করে দেবা চলে গেছে ভিন জগতে। পিঙ্গলার উত্তেজনায় সম্বিত ফিরেছে।

– হ, লাইগছে বটে। কার্তিকে আরও কিছুটা সামনে এলে দেবা উঠে দাঁড়ায়।

– কার্তিকে, চেঁচাইছিস কেনে? কী হইছে বল্ না বটে? তিলাবনীর পাজরে আরও একবার আছাড় খেয়ে দেবার সামনে ছিটকে পড়ে। উত্তেজিত দেবা সস্নেহে বসিয়ে বলে

– চাড়ে চাড়ে বল্। কি হইছে বটেক?

– দেব্তা নাইরে দেবা। উ শয়তানরা দেব্তাকে মারি দিলা। উয়ার ঘর জ্বালাইন দিছে। গণশাও ছিল বটেক। আকস্মিক বজ্রপাতে দেবা দিশেহারা। উন্মাদ। শুধু আর্তনাদে একটা কথাই শোনা গেল। দেব্তা মু আইছি বটেক। সব শয়তান মু নিধন করবেক। পিতৃহীন, অভিভাবকবিহীন পিঙ্গলা এখন বড়ো অসহায়। পাশে আছে দেবা। বলিষ্ঠ অবলম্বন। ভালোবাসার রঙিন স্বপ্ন। সেই স্বপ্ন ছুটে চলেছে ভয়ংকর দুর্যোগের অকুস্থলে। অসহায় পিঙ্গলা স্বপ্নকে ধরে রাখতে ছুটতে থাকে। মুখে শুধু আকুল আর্তি – দেবা, মুয়ার ডর লাগিছে বটেক। ইখন তু নাইন যাইছ। দুপহর গড়াইছে। রাইত নাইমছে। পথের বিপদ আইনছে। তু নাইন যাইছ। পিঙ্গলার সেই আকুল আর্তি তিলাবনীর পাঁজরে প্রতিধবনিত হতে থাকে। দেবার কানে সেই আর্তি পৌঁছোল কি না, কে জানে! দূর থেকে একটাই প্রতিশ্রুতি ভেসে আসল।

– ডরাইস না পিংলা। মু আসবেই। মু চাড়ে চাড়ে যাব আর আসব। পাথরের চড়াই উৎরাই পার করে মুহূর্তে অন্ধকারে মিলিয়ে গেল। আর দেখা গেল না।

ত্রিদেবের চিতা নিভে গেছে অনেক আগেই। শুধু ধোঁয়ার কুণ্ডলীটা পাকিয়ে পাকিয়ে উঠে যাচ্ছে তিলাবনীর চূড়া ছুঁয়ে উঁচুতে। আরও উঁচুতে। ত্রিদেবের চিতার পাশে বসে দেবা নিস্পলক দৃষ্টিতে কুণ্ডলী পাকানো ধোঁয়ার দিকে চেয়ে আছে। দেবা শুধু ভাবছে। পিঙ্গলাকে নিয়ে ঘর করার স্বপ্ন, রাস্তা তৈরির পরিকল্পনা, সুস্থ সামাজিক মানুষ গড়ার কারিগর সব কিছুই দলা পাকিয়ে তিলাবনীর চূড়া ছাড়িয়ে মিলিয়ে যাচ্ছে নীল নীলিমায়। ঘোর দুঃস্বপ্নের মধ্যেই ভেসে আসে অমোঘ বার্তা। ভয় পাস না দেবা। আমার দেহটা নেই। আছি তোদের মাথার উপর। লড়াইটা চালিয়ে যা। ভয় কি? তোর সঙ্গে আছে পিঙ্গলা, কার্তিকে। জিয়ারা গ্রামের সবাইকে নিয়ে এগিয়ে যা। দেবা উঠে দাঁড়ায়। জীবন যুদ্ধের নির্ভীক সৈনিক। জিয়ারাকে কোমর সোজা করে দাঁড়াতে হবে। জিয়ারা হবে সভ্য সমাজের মডেল গ্রাম। সে যুদ্ধ হবে পিঙ্গলাকে সঙ্গে নিয়েই।

তিলাবনী রাস্তা দেয়নি। দেয়নি জল। কিন্তু সব কেড়ে নেয়নি। দিয়েছে অসংখ্য গাছ। সেই গাছের অসংখ্য প্রসারিত ডালের ঝুরি নামিয়ে দিয়েছে। ত্রিশংকরের আশীর্বাদপুষ্ট দেবার বুক ভরা আর্তনাদ। আর একদিকে আন্দোলিত হচ্ছে অপরাজিত সংকল্প। এগিয়ে চলেছে দেবা। সামনে বিশাল রাক্ষুসে খাদ। পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে তিলাবনীর বুক চিরে বিশাল জলধারা দড়ির মতো পাক দিয়ে। এ প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত অসংখ্য গাছের ডাল। অগণিত ঝুরি নেমে গেছে খাদের দিকে। দেবার মনোবল এখন অনেক মজবুত। মজবুত মনের শক্তি যুগিয়ে গেছে ত্রিশংকর। সেই মনোবলেই ঝাঁপিয়ে পড়ে গাছের ঝুরি ধরে। একটার পর একটা। রাতের জমাট বাঁধা অন্ধকার।

তিলাবনীর বুকে রাতের আঁধার বড়ো তাড়াতাড়ি নামে। পায়ের নীচে মরণখাদ। শ্রান্তিহীন, ক্লান্তি বিহীন অকুতোভয় ছেলেটা এখন মৃত্যুঞ্জয়ী। হাত ফসকালেই চলে যেতে হবে মৃত্যুর কোলে। প্রান্তিক ঝুরি। তারপরই সেই দুর্ভেদ্য প্রাচীর। জিয়ারা আর পিচুলা গ্রামকে বিভাজন করে রেখেছে। আচমকাই দুর্ঘটনা। চড়চড় করে একটা শব্দ। নিভে গেল দেবার মনের সব আলো। গড়িয়ে চলে গেল দেবার নিথর দেহটা গহিন খাদে। সেই ঘন অন্ধকারে আর দেখা গেল না। জিয়ারার স্বপ্ন, পিঙ্গলার চোখে রংমশালের আলো, রাস্তা তৈরির কারিগর, সব কিছুই চলে গেল অনন্ত তিমির লোকে।

দেবার চিতা দাউ দাউ করে জ্বলছে। সমস্ত গ্রাম আজ শোকের হাট। সুখ চায়নি। বাঁচতে চেয়েছিল। সভ্য সমাজে মাথা উঁচু করে। তিলাবনী কেড়ে নিয়েছে তাদের ন্যূনতম স্বপ্ন। দেবা যে তাদের লড়াইয়ের সেনাপতি। সামনে দেবার চিতা। পিঙ্গলার চোখে মুখে আগুনের ঝলকানি। চোখ দুটো হিংস্র বাঘের মতো জ্বলছে। রোদের ঝাঁঝ কমে আসছে। তবু সেই আলোয় পরিষ্কার বোঝা যায়, তিলাবনী ভয় পেয়েছে। কোনও দাম্ভিকতা নেই। নেই কোনও বিদ্বেষ। ঈশান কোণে জমে ওঠা জমাট বাঁধা মেঘটা ঘনীভূত হচ্ছে। ধেয়ে আসছে এক প্রবল ঝড়। সে ঝড়ে তিলাবনী তার অস্তিত্ব কতটুকু ধরে রাখতে পারবে? কে জানে।

এই বিয়োগান্তক গল্পের পরিসমাপ্তিটা এখানেই হলে হয়তো ভালো হতো। আসলে লড়াইয়ের পাটিগণিত কোনও সূত্র ধরে চলে না। আসলে লড়াইটা যে এখান থেকেই শুরু। পিঙ্গলা এক দৌড়ে দেবার আস্তানা থেকে ছেনি হাতুড়িটা নিয়ে আসে। ঘৃণা, ক্ষোভে সমস্ত শরীর থর থর করে কাঁপছে। চিতার লেলিহান অগ্নিশিখা পিঙ্গলার মনেও আগুন ধরিয়েছে। এক বজ্র হুংকারে তিলাবনীর পাথরে প্রতিধবনিত হতে থাকে।

– এ তিলাবনী, তুয়ার বহুত দিমাক হইছে না রে? মুয়াদের রাস্তা নাইন দিলি। কোল গড়ায়ে জল দিছিস নাই। কষ্ট করছি। কুছু বলি নাইন। মুয়াদের ভুক্ষা মারবি? ইখন মুয়ার ভাবী মরদকে ছিনায় নিলি? তুয়ার ইত জ্বলন কেনে রে? ত দেখ কেনে, মু কি কইরতে লাইরছি? কোনও ভূমিকা নেই। কোনও গৌরচন্দ্রিকা নেই। ছেনির উপর হাতুড়ির এক একটা আঘাত আগুনের ফুলকি হয়ে ক্ষোভের বর্হিপ্রকাশ ঘটতে থাকে। রাস্তার নক্সাটা পেয়েছিল দেবার কাছ থেকেই। অবিরত ছেনির উপর হাতুড়ির আঘাত। ঠন্ ঠন্ ঠন্।

সতেরোটা বছর ধরে

– ছেনি হাতুড়ির আঘাতে পাথরের এক একটা চাঙ্গড় ধসে পড়ছে। অনিদ্রা অনাহারে শরীরটা ক্লান্ত। মনের জোরটা অটুট। সেই জোরেই সেফটিপিনের মতো রাস্তাটা ঘুরে ঘুরে প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। হঠাৎই কানে আসে একটা অজানা সোঁ সোঁ শব্দ। বুঝতে পারে না। উৎসে যাওয়ার চেষ্টা করে। বুঝতে পারে না। পাথরের গায়ে মাথা ঠেকায়। একটা বিশাল জলের গর্জন। পিঙ্গলা সময় নষ্ট করে না। শুরু হয় ছেনি হাতুড়ির আঘাত। আঘাতের পর আঘাত। তারপরই কুল কুল শব্দে জলের ধারা। আসন্ন বিপদ বুঝতে দেরি হয় না। পিঙ্গলা ছুটে বেরিয়ে আসে। মুহূর্তে বিশাল আওয়াজ। বিরাট পাথরের চাঙড় খসে পড়ে। তারপরই ভয়ংকর গর্জনে আছড়ে পড়ে জলের ধারা জিয়ারা গ্রামে। অনাহারক্লিষ্ট শীর্ণ মাঠ, পুকুর, ডোবা হয়ে ওঠে কল্লোলিনী গর্ভবতী। শরীরের দুর্বলতা ঝেড়ে ফেলে মনের অনাবিল আনন্দে পিঙ্গলা নাচতে থাকে। আত্মহারা জিয়ারা শবরবাসী।

রাস্তা ফিনিশিং-এর কাজ চলছে। কাশিটা ধরেছে অনেকদিন ধরেই। পালা করে জ্বরও আসছে প্রতিদিন। তবু তিলাবনীর পাঁজরে সেই আওয়াজ। ঠন্ ঠন্ ঠন্। কার্তিকে বুঝতে পারছে, পিঙ্গলার শরীরের অবস্থা ভালো না। বলছে– পিংলা, রাইত হইছে বুটেক। ঘরকে চল। তুয়ার শরীলডা অর দিছে নাই। ছলকে যাবি বুটেক। কাশির সঙ্গে গলগল করে খানিক রক্ত। হাঁপাচ্ছে। শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। হাত দিয়ে রক্ত মুছে পিঙ্গলা বলে

– তু ঘরকে যা। তুয়ার গরে বহু, বাল-বাচ্ছা আইনছে। তুয়ার অনেক দায় আইনছে। ই রাস্তাডা মুয়ার পরান। ইটাই মুয়ার দেবা আইনছে রে, কার্তিকে। তু ঘরকে যা।

সদর থেকে মাল বোঝাই ট্রাকগুলো ধুলো উড়িয়ে পিচুলা ছুঁয়ে জিয়ারা দিয়ে বেরিয়ে যায়। জিয়ারাবাসী আজ অপরাধপ্রবণ অসভ্য লেবেলটা মুছে ফেলেছে। সে শিক্ষাটা দিয়ে গেছে দেবা পিঙ্গলা। কালের নিয়মে, সময়ের মলিনতায় নব প্রজন্মের স্মৃতির অতলে তারা তলিয়ে গেছে। সাক্ষী আছে তিলাবনী। জিয়ারা পিচুলা যে একই মায়ের গর্ভজাত। তবু তিলাবনীর পাঁজরে কান পাতলে আজও শোনা যায় পিঙ্গলার ছেনি-হাতুড়ির শব্দ। ঠন্ ঠন্ ঠন্।

বিকৃতি

আজ বেশ কিছুদিন ধরেই বারবার রজত ওই অচেনা নম্বর থেকে আসা ম্যাসেজের চ্যাট বক্সটা খুলছে, ডিপিটা দেখছে, আবার রেখে দিচ্ছে।

ভদ্রমহিলার মুখটা একেবারেই বোঝা যাচ্ছে না। শুধু মাথা ভর্তি কোঁকড়া চুল ঘাড় বেয়ে কোমর অবধি নেমে এসেছে। সুঠাম দেহের গঠন, চুলের পাশ থেকে প্রসারিত হয়েছে ফরসা দুটো হাত যেন কোনও চিত্রকরের অঙ্কিত দুটি বঙ্কিমরেখা। বয়স বড়োজোর ত্রিশ-পঁয়ত্রিশের বেশি হবে না। প্রথম মেসেজটা ওপার থেকেই এসেছিল, ছোট্ট একটা, হাই!

রজত প্রথমে ভেবেছিল, হয়তো কোনও উড়ো মেসেজ। তাই অফিসিয়ালি রিপ্লাই দিয়েছিল, হাউ ক্যান আই হেল্প ইউ?

একসাথে অনেকগুলো স্মাইলি এসেছিল। রজত একটু অবাক হয়। এত রাতে সচরাচর এরকম রিপ্লাই কে দেবে?

কৌতূহলী হয়ে প্রশ্ন করেছিল,

কে আপনি?

ধরুন, আপনার কোনও বান্ধবী।

মানে?

কেন আপত্তি আছে? ছবি না দেখে বুঝি বন্ধুত্ব করা যায় না?

রজতের আকর্ষণটা বেড়ে গেছিল। এরকম প্রত্যুত্তর সে অনেক দিন পায়নি।

আপনার পরিচয়টা জানতে পারি?

এই মহাবিশ্বের কোনও একটি ক্ষুদ্র শহরের বাসিন্দা।

হেঁয়ালি করছেন?

সরকারি আধিকারিকের সাথে হেঁয়ালি? না, অত সাহস নেই।

ভদ্রমহিলার চমকপ্রদ জবাবগুলো রজতের আকর্ষণ বাড়িয়ে তুলেছিল। এখন প্রায় সারাদিনই ও ফোন কাছে কাছে রাখে। কিন্তু সেই রহস্যময়ী সারাদিনে একবারও অনলাইন আসে না। শুধুমাত্র একবার। রাত বারোটার পর।

অতএব, রজতও সেই সময়টাই বেছে নিয়েছে। মনে মনে একবার কল্পনা করে অবয়বটাকে। আজ সে ঠিক করেছে, ভদ্রমহিলার নাম জানতে চাইবে।

তাই প্রথমেই বলে, এতদিন কথা বলছি, আপনার নামটা জানতে পারি কি?

লোকে মধুরিমা বলে!

বেশ, আমিও ওই নামেই ডাকব।

যা ইচ্ছা!

একবার দেখা করা যায় কি?

এই প্রশ্নের পর টানা কুড়ি মিনিট কোনও রিপ্লাই আসেনি। ইতিবাচক কোনও কিছুর আশা নিয়ে রজত ফোনের দিকে তাকিয়েছিল। চার্জটা ক্রমশ কমে আসছে। প্লাগে চার্জারটা কানেক্ট করে ফোনটা হাতে নিয়ে বসেছিল। অবশেষে রিপ্লাই এল, সেই কাঙ্ক্ষিত নম্বর থেকেই

অবশ্যই, আগে চিনি, জানি..

রজত নিরাশ হয়নি। বরং আশার একটা ক্ষীণ আলেয়া জ্বলে উঠেছিল। ওর পুরো মনটা আলোকিত করে তুলেছিল। মুখভঙ্গি না দেখেও শুধু কয়েটা রিপ্লাই যে, কোনও মানুষকে এতটা সম্মোহিত করতে পারে সেটা জানা ছিল না রজতের।

আজকাল আর তার কাজে মন নেই। সে এখন শুধু বারবার ওই নম্বরটাতে কল করে।

সুইচ অফ! ট্রু কলারে দেখেও কোনও লাভ হয়নি।

তাই শুধু রাতের গহিন অপেক্ষা। এখন রাত হলেই কেমন নেশায় বুঁদ হয়ে যায় সে। অমোঘ জালে জড়িয়ে পড়েছে, নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। বলেই ফেলে, মধুরিমা, মধুরিমা, আমি তোমায় ভালো…

কী?

ভালোবেসে ফেলেছি!

তাই বুঝি! এত তাড়াতাড়ি?

দেরির কী আছে শুনি? তোমার কি আমাকে পছন্দ না?

তুমি যে বিবাহিত!

হ্যাঁ, রজত তো বিবাহিত। দীর্ঘ সংসারজীবন অতিক্রম করে এসেছে। এখনও করে যাচ্ছে। কিন্তু পৃথক ভাবে। একই বাড়িতে থাকলেও রজতের স্ত্রী মল্লিকা থাকে নীচের তলায়, রজত উপরতলায়। এখনও মল্লিকা সিঁদুর পরে, শাঁখায় সিঁদুর ছোঁয়ায়।

 

রজতের আজকের চাকরির পদটা একদা মল্লিকার বাবারই দেওয়া। বিয়ে পর বেকার জামাইকে কর্মসংস্থান করে দেওয়া শ্বশুরের দাযিত্ব! সেই দাযিত্ব যথাযথ ভাবে পালন করেছিলেন মল্লিকার বাবা পরিমলবাবু। নিজের সর্বস্ব বিক্রি করে দিয়ে জামাইকে সরকারি অফিসে পার্মানেন্ট পদ বানিয়ে দিয়েছিলেন। কলকাতা শহরের বুকে জমি কিনে ঝাঁ চকচকে একটা বাড়ি বানিয়ে দিয়েছিলেন। বদলে চেয়েছিলেন, মেয়ে কাছে বাকি জীবনটা কাটাতে। সেটাই কাল হয়েছিল। মরতে হয়েছিল জামাইয়ে হাতে। তাও সুখ। মরেও সুখ। মেয়ে তো ভালো আছে। কিন্তু সত্যিই কি ভালো ছিল মল্লিকা?

রজতের এনে দেওয়া ওষুধগুলো খেতে খেতে দিন দিন কেমন যেন ঝিমিয়ে যাচ্ছিল মল্লিকা। শুধু ঘুম পেত, অনিচ্ছাকৃত কোনও ঘটনায় প্রতিক্রিয়া জানাতে পারত না। ক্রমে নীরবে পরিস্থিতির কাছে আত্মসমর্পণ করাই ওর ভবিতব্য হয়ে দাঁড়ায়। রজত বলত, ওগুলো নাকি বাতের ব্য়থার ওষুধ, খেলে বার্ধক্য আসবে না কোনও দিন।

মল্লিকাও সরল বিশ্বাসে দিনের পর দিন নিঃশব্দে জলের তোড়ে গিলত সেগুলো। কখনও কোনও প্রশ্ন করত না। আসলে বাঙালি মেযো কখনওই স্বামীর সামনে একটা বিরাট প্রশ্নচিহ্ন এঁকে দিতে পারে না। দৃঢ় গলায় কোনও কিছুর সদর্থক কারণ জিজ্ঞাসা করতে পারে না। এই চিরকালীন ব্যর্থতাই হয়তো কালের নিষ্ঠুর নিয়মে পর্যবসিত হয়েছে।

এই অনাড়ম্বর জীবন থেকে নতুন করে আর কিছু পাওয়ার নেই রজতের। তাই সে আবারও প্রেমে পড়েছে। এবারের প্রেক্ষাপটটা অন্যবারের থেকে একটু অন্যরকম। কথা বলতে বলতে সেই সুতোর জটে সে এমন ভাবে জড়িয়ে পড়েছে যে, তার থেকে বেরোনোর উপায় পাচ্ছে না। সে বেরোতে চায়ও না। বরং আরও প্রবল ভাবে নিজেকে সেই জটের মধ্যে বেঁধে ফেলতে চায়। সংসার সুতোয় গিঁট দিতে চায়। অতঃপর, মধুরিমার সম্মতি চাই। তাই আবারও মুষ্টিভিক্ষা করে, তুমি কি আমার হবে মধুরিমা?

সম্ভব?

জীবনটা বড়ো বিষাদ হয়ে গেছে। তোমাকে নিয়ে শেষ জীবনটা কাটাতে চাই। ব্যস।

বেশ, তবে দেখা কোরো।

বলো। কোথায় আসতে হবে?

কাল, পার্ক হোটেলে। বাকি ডিটেলস কাল সকালে আমি তোমাকে সেন্ড করে দেব।

ওকে!

মনের মধ্যে অদ্ভুত একটা ভালো লাগা তৈরি হয়েছে। সবকিছুই যেন নিমেষে রঙিন হয়ে গেছে রজতের কাছে। পাথুরে মাটিতে আবার জলীয় স্পর্শে ঘাস গজিয়েছে। কাল সে অনেকগুলো গোলাপ নিয়ে যাবে মধুরিমার জন্য। ভালো করে দেখতে পাবে ওর মুখটা। না জানি, সে কতই না সুন্দর হবে! এইসব ভাবতে ভাবতে চোখটা বুজে আসে রজতের।

পরদিন সকালে অনেক দেরিতে ঘুম ভাঙে। উঠে দেখে, প্রায় দশটা বাজতে যায়। চটপট করে ব্রেকফাস্ট সেরে মোবাইল খুলে দেখে, মধুরিমা অ্যাড্রেস সেন্ড করেছে। দেরি না করে রেডি হয়ে বেরিয়ে যায় গন্তব্যের উদ্দেশে।

আজ রজত অনেকটা পারফিউম দিয়েছে। তার এক বন্ধু বিদেশ থেকে এনে দিয়েছিল। কোনও দিনও খুলে দেখা হয়নি। কিন্তু আজ প্রয়োজন পড়ল।

এক ঘন্টার মধ্যে পৌঁছে গেল পার্ক হোটেলে। তারপর রিসেপশনে ফরম্যালিটিস কমপ্লিট করে সিঁড়ি দিয়ে উঠে গেল দোতলায়। দুশো বাহাত্তর নম্বর রুম। সেখানেই অপেক্ষা করছে তার বহু কাঙ্ক্ষিত সুন্দরী।

ঘরের সামনে এসে আলতো করে নক করে রজত। আপাদমস্তক কালো ওড়নাতে ঢাকা একজন মহিলা দরজা খুলে দেয়। সম্মোহিতের মতো কোনও অজানা স্নায়বিক নির্দেশনায় ঘরে ঢুকে আসে রজত। বসে পড়ে সোফার উপর। প্রশ্ন করে, তুমিই মধুরিমা?

ইঙ্গিতে উত্তর আসে, হ্যাঁ!

এখনও কি নিজেকে এভাবে আড়াল করে রাখবে?

ভদ্রমহিলা কোনও কথা না বলে একটা মদের গেলাস বাড়িয়ে দেয় রজতের দিকে। বশীভূতের মতো সেটা হাতে নিয়ে একচুমুকে শেষ করে ফেলে সে। এভাবে পরপর তিনবার। রজতের মাথাটা ঝিমঝিম করে ওঠে। সোফার উপর ধীরে ধীরে এলিয়ে পড়ে সমস্ত শরীরটা। ঝাপসা দৃষ্টিতে দেখতে পায়, কালো ওড়নাটা সরিয়ে ওর সামনে দাঁড়িয়ে আছে মল্লিকা। বিস্ফারিত দৃষ্টি, যেন আগুন ঝরছে সমস্ত দেহটা থেকে!

চিত্কার করে বলে ওঠে, কেন এরকম করলে তুমি বলো? আমাকে ঠকিয়ে দিনের পর দিন একের পর এক মেয়েদের সাথে সম্পর্ক করে গেলে? একবারও আমার মুখটা মনে পড়ল না? কত সম্মান করেছিলাম তোমাকে। আমার ভগবান ভাবতাম।

সেদিন যখন তুমি ফোনটা ভুল করে আমার ঘরে রেখে চলে গেছিলে, আমার কাছে সবটা স্পষ্ট হয়ে গেছিল। তুমি আমায় এতদিন যে-ওষুধগুলো খাইয়ে, ওগুলো কোনও সুস্থ মানুষের সেবনযোগ্য নয়। ওই ড্রাগসগুলো নিলে যে-কোনও সুস্থ মানুষও পাগল হয়ে যেতে পারে।

অ্যাকচুয়ালি, তুমি আমাকে বদ্ধ পাগল বানিয়ে রাখতেই চেয়েছিলে! যাতে বাইরের দুনিয়ার সামনে কখনও আমাকে না নিয়ে যেতে হয়, আর তুমি নিজের মতো করে স্বেচ্ছাধীন জীবনযাপন করতে পারো, ইচ্ছামতো নারীসঙ্গে বুঁদ হতে পারো! কিন্তু আমি আর তা হতে দেব না মি. রজত সান্যাল! কারণ আসল মনের অসুখ তো তোমার, অসুস্থ তুমি! উন্মাদ তুমি, নাহলে এভাবে একের পর এক নারীসঙ্গে জড়িয়ে পড়তে পারো না। বিকৃত মানসিকতাও একপ্রকার ভয়ংকর অসুখ, যার একমাত্র ওষুধ মৃত্যু!

রজত মল্লিকার হাত দুটো আটকাতে যায়। কিন্তু পারে না। শরীর ইতিমধ্যেই অবশ হয়ে গেছে। মল্লিকা হিংস্র বাঘিনীর মতো ছুরিটা হাতে নিয়ে এগিয়ে আসে। সেই শেষের মুহূর্তটা আসতে আর কিছুক্ষণ মাত্র বাকি!

দীনানাথের শেষ উইল

কাকভোরে রাজপালের ঘুমটা ভেঙে গেল। কী কারণে সেটা প্রথমে ঠাউর করতে করতে কিছুটা সময় গেল। তারপরেই খেয়াল হল তাকের উপর সযত্নে তুলে রাখা মোবাইল ফোনটা বেজে উঠতেই ঘুম ভেঙেছে। মালিকের ফোন। মালিক হচ্ছেন বড়ো হাভেলির দেওয়ান সাহেব। আজ তো শনিবার ওর ছুটির দিন। তাহলে সকাল সকাল ফোন, কী ব্যাপার!

চিন্তার ভাঁজ পড়ল রাজপালের কপালে। আজকের দিনে ওকে দেওয়ান সাহেবের জঙ্গলের দেখাশোনা করতে যেতে হয়। জঙ্গলের পুরো দাযিত্বই রাজপালের ওপর ছেড়ে রেখেছেন মালিক। অত বড়ো হাভেলিতে দেওয়ান সাহেব একাই থাকেন। দু’-দু’বার বিয়ে করেছেন। কোনওটাই স্থায়ী হয়নি।

প্রথম স্ত্রী ছেলের সঙ্গে বিদেশে থাকেন। মালিকের এক ছেলে এক মেয়ে দ্বিতীয় স্ত্রীও আলাদাই থাকেন, তবে যাওয়ার আগে দেওয়ানজির অনেক টাকা সঙ্গে নিয়ে গেছেন। মালিকের বিরাট ব্যাবসা।

হ্যালো, রাজপাল ফোনটা হাতে নিল। দেওয়ানজির কণ্ঠস্বর ভেসে এল, রাজপাল, কাল ঠিক এগারোটার সময় হাভেলি আসতে হবে।

মনে মনে আশ্চর্য হল রাজপাল। মালিক ভালো করেই জানেন, শনি আর রবিবারটা জঙ্গলে কাটিয়ে সোমবার রাজপাল ফেরে। কী আর করা? মালিকের আদেশ অমান্য করা চলবে না। হয়তো মালিকের শরীরটা একটু বেশি খারাপ হয়েছে। বেশ কয়েদিন ধরে ওনার শরীর ভালো যাচ্ছিল না। একা একা থাকা। শুধুমাত্র একজন গুজ্জর মহিলা নুরা মালিকের দেখাশোনা করে।

প্রথম প্রথম নুরা হাভেলির দোতলাটার পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার দাযিত্বে ছিল। কিন্তু ওর কাজ দেখে খুশি হয়ে দীনানাথ পুরো বাড়ির দায়িত্ব ওকে সঁপে দিয়েছিলেন। অত বড়ো হাভেলির পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কাজে বাবলু, নুরাকে সাহায্য করত আর রাত্রে দীনানাথের কাছে শুত।

দীনানাথের মেয়ে মুম্বইয়ে থাকত। তার দুটি সন্তান। এক ছেলে এক মেয়ে স্বামীর জুতোর ব্যাবসা ছিল যার অবস্থা তখন প্রায় পড়ন্ত। অবশ্য মেয়ে উপাসনার স্বামীর সঙ্গে তখন বনিবনাও ছিল না। উপাসনার মদ্যপানে আসক্তির অভ্যাস স্বামী আনন্দকে আরও দূরে সরিয়ে দিয়েছিল। শুধুমাত্র স্ত্রীকে বরদাস্ত করত এই আশায় যে, শ্বশুরের মৃত্যুর পর অর্ধেক সম্পত্তির মালকিন হবে উপাসনা। যেনতেন প্রকারেণ ওই সম্পত্তি স্ত্রীকে ঠকিয়ে কী করে নিজের করা যায়, তারই নানা ফন্দিফিকির মাথায় আনাগোনা করত সবসময়। উপাসনার সঙ্গে ভালোবাসার বিয়ে ছিল ঠিকই কিন্তু সম্পর্কটা তিক্ততার দিকে মোড় নিয়েছিল। আনন্দ দেনায় আকণ্ঠ ডুবে ছিল।

দীনানাথের ছেলে অতুল একেবারে নিষ্কর্মা বলতে যা বোঝায় তাই। আজ পর্যন্ত কোনও কাজই ঠিক ভাবে করে উঠতে পারেনি। অতুলেরও এক ছেলে। সবাই বিদেশেই থাকত। অতুলের যত ফুটানি সবই মায়ের টাকায়। কিন্তু মায়ের প্রতি কোনও দায়িত্বই ও পালন করত না। এই নিয়ে নিত্যদিন বাড়িতে অশান্তি লেগে থাকত।

দুই ছেলে-মেয়ের সঙ্গেই দীনানাথের বনিবনা একেবারেই হতো না। মাঝেমধ্যে কখনও কখনও দেখাসাক্ষাৎ হতো। মা-কে ডিভোর্স করার জন্য উপাসনা বাবাকে কোনও দিন ক্ষমা করতে পারেনি। যদিও সে জানত তার মা খুবই ঝগড়ুটে, স্বার্থপর একজন মহিলা। দুই-তিন বছরে একবার ভাইবোন বাবার সঙ্গে দেখা করতে আসত, তাও কিছু টাকা আদায় করার ধান্দায়।

নাতি-নাতনিদেরও কোনও খবর দীনানাথের কাছেও ছিল না। উনি কোনও দিন তাদের চোখেই দেখেননি। এই হল দীনানাথের পুরো পরিবারের চিত্র যা আজকের পটভূমিকাতেও অদ্ভুত বলেই সকলে গণ্য করবে।

ঠিক এগারোটায় হাভেলি পৌঁছোতেই রাজপাল দেখল সদরে বহু মানুষ ভিড় করেছে। ঘাবড়ে গেল সে। গাড়ি রাস্তাতেই দাঁড় করিয়ে ভিতরে ঢুকে এল। দেখল পুলিশের কিছু লোক রয়েছে। একটা চৌকির উপর দীনানাথের নিষ্প্রাণ শরীরটা শোয়ানো আছে। অদূরেই দাঁড়িয়ে নুরা, মুখটা ফ্যাকাশে দেখাচ্ছে। চোখদুটো লাল হয়ে ফুলে গেছে। বোঝা যাচ্ছে কান্নাকাটি করেই এমন অবস্থা হয়েছে।

রাজপালকে দেখেই ইন্সপেক্টর রমন এগিয়ে এলেন ওর দিকে, আপনি কি দেওয়ানজি মারা যাওয়ার খবরটা আগেই পেয়েছিলেন?

রাজপাল সংযত হয়ে উত্তর দিল না, ইন্সপেক্টর। আমার জন্য এটা একটা বিরাট শক্। আমাকে তো স্যার নিজেই ফোন করে বলেছিলেন, আজ ঠিক এগারোটায় হাভেলি পেঁছে যেতে।

নুরা আর রাজপালকে অনেক জিজ্ঞাসাবাদের পর ইন্সপেক্টর রমন মোটামুটি নিশ্চিত হলেন যে, এটা আত্মহত্যার কেস। শুধুমাত্র এই দুজনই জানত মালিক ফুসফুসের ক্যান্সারে আক্রান্ত। দুই ছেলে-মেয়ে সম্প্রতি জানতে পেরেছিল, বাবার শরীর ভালো যাচ্ছে না। তবে তারা নিজেদের নিয়ে এতটাই ব্যস্ত ছিল যে, বাবার কাছে আসার কারওরই সময় হয়নি।

ইন্সপেক্টর রমন পকেট থেকে একটা বাদামি রঙের খাম বার করে রাজপালকে জিজ্ঞেস করলেন, এই খামটা অ্যাডভোকেট লোকেশ বক্সির নামে। আপনি একে চেনেন নাকি?

হ্যাঁ, উনি, দেওয়ানজির খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু। এই হাভেলির চার-পাঁচটা বাড়ি পরেই উনি থাকেন।

আপনি কি দেওয়ান সাহেবের ছেলেমেয়ে আর আত্মীয়স্বজনদের খবর পাঠিয়েছেন? রমন রাজপালকে উদ্দেশ্য করেই প্রশ্নটা করলেন।

দুজনের কথার মাঝেই হঠাৎই অ্যাডভোকেট বক্সি উদভ্রান্তের মতো ভিতরে প্রবেশ করলেন। একনজর দেখেই ওনার তীক্ষ্ম দৃষ্টি বুঝে ফেলেছিল, বন্ধু আর নেই। ওনার হাতেও একটা বাদামি রঙের খোলা খাম ধরা। ইন্সপেক্টর, মিস্টার বক্সিকে আগে থেকেই চিনতেন। নানা কেসের সুবাদে আদালতে দেখাসাক্ষাৎ হতেই থাকত। দীনানাথ, বক্সি আর রমন তিনজনেই জম্মুর পুরোনো বাসিন্দা।

চিঠি আগেই পড়া হয়ে গিয়েছিল, বক্সি সাহেব খামটা ইন্সপেক্টরের হাতে ধরাল। দুটো খামেই চিঠির বর্ণনা হুবহু একই। রমন লক্ষ্য করলেন একই ব্যক্তির লেখা। পরিষ্কার তাতে লেখা আছে, আমি দীনানাথ, সম্পূর্ণ সজ্ঞানে নিজের জীবন শেষ করছি। আজ চার-পাঁচ বছর হল ক্যান্সারের মতো দুরারোগ্য অসুখে ভুগছি। হয়তো আর বেশীদিন বাঁচব না। এই কষ্ট আর সহ্য করতে পারছি না। আমার কাছে যারা কাজ করে তারা অত্যন্ত প্রভুভক্ত। সুতরাং তাদেরও আমি আর কষ্ট দিতে চাই না। অনেক ভেবেচিন্তে আমি এই সিদ্ধান্তে পেঁছেছি।

আমার মৃত্যুর পর আমার গোটা সম্পত্তির অর্ধেক ভাগ অর্থাৎ এই বাড়ি, আমার গ্রামের আমবাগান আর নগদ ধনরাশিরও অর্ধেক ভাগ নুরা পাবে। রাজপাল যে-কিনা কুড়ি বছর ধরে আমার সঙ্গে আছে, সে আমার কুদ-এর জমি বাড়ি সব পাবে। এছাড়া আমার নগদ অর্থের কুড়ি শতাংশ ওকে যেন দেওয়া হয়।

বাকি যা অর্থ পরে থাকবে তা আমি আমার বাড়ির পাশের মন্দিরের ট্রাস্ট-কে দিয়ে যাচ্ছি। বাকি যারা নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য আমাকে খালি ব্যবহার করে গেছে, তাদের জন্য আমার কাছে দেওয়ার কিছুই নেই। বেঁচে থাকতে আমি যা কষ্ট পেয়েছি, আমি চাই ওরাও এই কষ্ট ভোগ করুক। যদি এর থেকে ওরা কোনও শিক্ষা নিতে পারে।

আমার কাজ ধুমধাম করে করার কোনও দরকার নেই। যে-মন্দিরে আমি প্রতি মঙ্গল আর রবিবার যেতাম সেখানেই যেন আমার শ্রাদ্ধশান্তি সম্পন্ন করা হয়। আর লোকেশ, তোমার দাযিত্ব হচ্ছে আমার শেষ ইচ্ছা পূরণ করা। আর নুরা আর রাজপাল যেন তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত না হয় সেটা দেখা। নয়তো মৃত্যুর পরেও আমি শান্তি পাব না।

রমনের চোখে প্রশ্ন ফুটে উঠতেই বক্সি বললেন, হাতে লেখা উইল কোনও কোর্ট অস্বীকার করতে পারবে না। কিন্তু সবথেকে আশ্চর‌্যের বিষয় হল দীনানাথ নিজের সন্তানদের জন্য কিছুই রেখে গেলেন না।

ইন্সপেক্টর রমন বললেন, বাচ্চারা তো এই উইল-টাকে চ্যালেঞ্জও করতে পারে।

হ্যাঁ পারে, কিন্তু সেটা খুবই দীর্ঘ প্রসেস। কত বছর যে লাগবে কিছুই বলা যায় না, তার উপর আলাদা করে খরচও আছে।

আপনি তো দীনানাথের খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু, আপনি নিশ্চই সব জানেন? প্রশ্ন করেন রমন।

হ্যাঁ, জানি তো সব। রোজ সন্ধেবেলায় দেখা করতে যেতাম। রবিবারও বাদ যেত না। তবে দুই বছরের বেশি হল, ওর শরীর আরও খারাপ হয়ে পড়ে। খুব চুপচাপ হয়ে গিয়েছিল। আমাকেও মনের কথা বলা অনেক কমিয়ে দিয়েছিল, উত্তর দেন বক্সি।

আপনি নুরা সম্পর্কে কী জানেন?

বক্সি আর রমন কথা বলতে বলতে বারান্দায় চলে এসেছিলেন। বাড়িতে লোকজন আসতে আরম্ভ করছিল। সন্ধের মধ্যে

দাহ-সংস্কার করার কথা ঠিক করা হয়েছিল কারণ ছেলে-মেয়ে দূর থেকে আসতে সময় লাগবে।

নুরা প্রায় দশ বছর ধরে দীনানাথের কাছে কাজ করছে। নুরার বাবা ও তার গোটা পরিবারকে দীনানাথ চিনতেন। প্রথম প্রথম নুরা ঘরদোর পরিষ্কার করে বাড়ি চলে যেত। কিন্তু যখন থেকে দীনানাথ অসুস্থ হলেন, নুরা সারা বাড়ির দাযিত্ব নিজের হাতে তুলে নিয়েছিল। শেষ দুবছর তো ও-ই প্রায় সব কাজ করত। ওদের বাড়ির অবস্থা বেশ খারাপ। মদ খেয়ে খেয়ে স্বামীটা মরে গেছে, ছেলে বাড়ি থেকে পালিয়েছে। তবে মেযো ভালো। মেযো নার্সিং পড়া সবে শেষ করেছে, বক্সিবাবু জানালেন রমনকে।

নুরার মেয়ে এখন কোথায়? রমন আগ্রহ প্রকাশ করল।

লুধিয়ানায় চাকরি করছে। নুরার বুড়ি মা নাতনির সঙ্গে থাকে।

দাহ-সংস্কার হয়ে যাওয়ার পর উইলের দুটো কপি বানানো হল। একটা রমন নিজে রাখল, অন্য অরিজিনাল কপিটা বক্সির কাছে থাকল। ঠিক করা হল, দীনানাথের সন্তানরা এলে ওনার পারিবারিক উকিল হিসেবে বক্সিবাবু ছেলে-মেয়েে উইল-এর বিষয়ে জানাবে।

মৃত্যুর খবর পেয়ে উপাসনা ও তার স্বামী আনন্দ রাতেই পেঁছে গিয়েছিল। অপেক্ষা ছিল দাদা অতুলের পৌঁছোনোর। সে-ও দুদিন বাদেই বিদেশ থেকে এসে পৌঁছোল।

বাবার মৃত্যুর খবর পেয়ে উপাসনা অনুশোচনার আগুনে জ্বলে খাক হয়ে যাচ্ছিল। সারা জীবন মায়ের কথা শুনে এসেছে। বাবার বিরুদ্ধে হাজারো অভিযোগ শুনতে শুনতে বাবার প্রতি ঘৃণার মনোভাব তৈরি হয়ে গিয়েছিল উপসনার। কিন্তু আজ বাবা না থাকাতে মনের মধ্যে একটা শূন্যস্থান তৈরি হয়েছে।

আনন্দর এই পরিবেশে দমবন্ধ হয়ে আসার উপক্রম হচ্ছিল। ওর একটাই উদ্দেশ্য ছিল, টাকা আত্মসাৎ করার। ওল্ড ম্যান-এর মৃত্যুতে ওর কোনওরকম আপশোশ ছিল না।

বাবার মৃত্যুতে অতুলের মন কিছুটা খারাপ হয়েছিল। বারবার শেষবারের আসার কথা মনে পড়ছিল। সেই প্রথমবার দীনানাথ ওর সন্তানদের পড়াশোনার বিষয়ে জিজ্ঞেস করেছিলেন। কিন্তু বাবা-ছেলের মধ্যে মতের মিল ছিল কোথায়, যে দুজনে কোনও বিষয় নিয়ে বসে আলোচনা করবে এবং একটা সিদ্ধান্তে উপনীত হবে!

অত দূর কানাডা থেকে এসে মাত্র পাঁচদিন থেকেই অতুল ফিরে গিয়েছিল। বাবার মৃতু্য়র পর বারবার এটাই মনে হচ্ছিল, চলো একটা অধ্যায় তো শেষ হল। এখন বাবা তার জন্য যে-সম্পত্তি, টাকাপয়সা রেখে গেছেন তাই দিয়ে সে নতুন করে নিজের ব্যাবসাটা দাঁড় করাবে।

নুরা অতিথিদের দেখাশোনার দায়িত্বে ছিল। হাভেলির প্রত্যেকটা ঘর পরিষ্কার করে সকলের থাকার ভালো ভাবে বন্দোবস্ত করে দিয়েছিল।

দীনানাথের শ্রাদ্ধশান্তির কাজ শেষ হলে অতুল আর উপাসনা মিলে ঠিক করল, এবার নুরা আর রাজপালকে ওদের দায়িত্ব থেকে ছুটি দেওয়ার সময় হয়েছে। এদের বদলে নতুন লোক রাখা হবে বাড়ির কাজের আর রান্নাবান্না করার জন্য। রাজপালের জায়গায় একজন স্মার্ট অ্যাকাউন্ট্যান্ট রাখা দরকার, যে-কিনা ব্যাবসা থেকে শুরু করে জঙ্গলের সব কাজকর্ম একাই সামলাতে পারবে। অতুল জানাল, এখন থেকে সে মাঝেমাঝেই দেশে আসবে সবকিছু দেখাশোনা করার জন্য।

ভাইবোনের আলোচনার মাঝেই ইন্সপেক্টর রমন এবং বক্সি সাহেব হাভেলি এসে পৌঁছোলেন। ওনাদের সাদর অভ্যর্থনা জানাল অতুল আর উপাসনা। কারণ তারা জানত আজ বাবার উইল পড়া হবে। নুরাকে অতিথিদের জন্য চা আনতে বলে দুজনে এসে বসল।

অতুল, অ্যাডভোকেট বক্সিকে লক্ষ্য করে বলল, আংকেল, আমি ভাবছি এবার বাড়ির হাল নিজের হাতে ধরব। বাবার পর আমারই দাযিত্ব সবকিছু দেখাশোনা করার। আমরা ঠিক করেছি নুরা আর রাজপালকে আর রাখব না। এমনিতেও ওদের দু’জনকে আমরা কেউ পছন্দ করি না। নুরাকে দেখলে তো মনে হয়, ওই এ বাড়ির মালকিন।

রমন আর বক্সির চোখাচোখি হল, যেন ওরা বলতে চাইছে, এরা বেচারারা কী করে জানবে, যে কী হতে চলেছে ওদের সঙ্গে।

আংকেল আপনি কিছু বলবেন না এই ব্যাপারে? উপাসনা জিজ্ঞেস করল।

উত্তর দিল রমন, তোমাদের যা বলা হচ্ছে মন দিয়ে শোনো। তোমার বাবার লেখা চিঠি যেটা ওনার কাছ থেকে পাওয়া গেছে, সেটা পড়ে তোমাদের শোনানো হচ্ছে এখন।

বাবার এত বড়ো সম্পত্তি পেতে চলেছে এই ভেবে উপাসনা আর অতুল মনে মনে খুশি হয়ে উঠলেও, চোখেমুখে দুঃখের ভাব ফুটিয়ে রেখে দু’জনেই সাগ্রহে রমনের দিকে তাকাল।

রমন প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত দীনানাথের পত্রটা পড়ে দুই ভাইবোনের দিকে তাকাল।

কারও মুখে কোনও কথা ফুটল না। ওদের দুজনের মুখচোখ দেখে বোঝা যাচ্ছিল, ওরা রীতিমতো শকড। এমনটা কেউ আশা করেনি।

এ কী করে সম্ভব? উপাসনাই প্রথম নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করল।

আমরা দুজন ওনার সন্তান। নুরা, রাজপাল ওনার কে? কোথা থেকে ওরা এসেছে কেউ জানে না। আমার তো প্রথম থেকেই মনে হচ্ছিল কোথাও একটা রহস্য আছে…। নুরাটা এক নম্বরের চরিত্রহীন, বাবাকে ফাঁসিয়ে সবকিছু নিজের নামে করে নিয়েছে।

সেই মুহূর্তে উপাসনার স্বামী আনন্দ ঘরে ঢুকে ওদের কথাবার্তায় যোগ দিল। উপসনার কথা শেষ হতেই বলে উঠল, আমার তো প্রথম থেকেই সন্দেহ ছিল, বাড়িতে যেভাবে গৃহকত্রী হয়ে ঘুরে বেড়াত, তাতে যে কেউই ভাবতে পারে বাড়িটা ওরই।

অতুল কোনও কথাই বলতে পারল না। রাগে ওর মাথা গরম হয়ে উঠেছিল। দীনানাথ কোনও দিন বাবা হিসেবে কোনও কর্তব্য পালন করেননি। শুধু খরচ দিয়ে গেছেন। কখনও ওর স্কুলে যাননি। স্পোর্টস-এ এত ভালো ছিল অতুল কিন্তু বাবার কাছ থেকে কোনও দিন একটা বাহবাও ওর কপালে জোটেনি। মায়ে সঙ্গেও দীনানাথ মানিয়ে নিতে পারেননি এবং বহু অর্থ নিয়ে তবেই দীনানাথের থেকে আলাদা হয়েছিলেন মা ঠিকই কিন্তু তাতে অতুলের দোষটা কোথায় ছিল! অতুল তো দীনানাথের নিজের সন্তান। তাহলে বাবা হয়ে সন্তানের এত বড়ো সর্বনাশ কী করে করতে পারলেন, অতুল কিছুতেই সেটা ভেবে পেল না।

নুরা নুরা উপাসনা গলার জোর বাড়াল।

জি বিবিজি, নুরা মুহূর্তে সামনে এসে হাজির হল।

নুরা, এসব কী শুনছি! তুই জানতিস বাবা এত সম্পত্তি তোর নামে করে গেছেন? জানতিস তো নিশ্চয়ই নয়তো কোনও সম্পর্ক ছাড়াই দিনরাত কেন এখানে পড়ে থাকতিস? তিক্ততা ফুটে ওঠে উপাসনার গলায়।

না বিবিজি, আমি কিছুই জানতাম না, চোখে জল ভরে যায় নুরার।

আপনি এসব কী বলছেন? আমি তো এখনই আপনার মুখ থেকে শুনছি। আমি তো স্বপ্নেও এসব ভাবতে পারি না।

নুরা, তুমি যাও নিজের কাজ করো, অ্যাডভোকেট বক্সি এতক্ষণে মুখ খুললেন।

এটা কী করে সম্ভব আংকেল। আমি তো রাজপাল আর নুরাকে ছাড়ব না। এটা এদের বাপের সম্পত্তি নয় যে, এগুলো নিয়ে নেবে। প্রযোজনে আদালতে যাব, ওখানেই মীমাংসা হবে। রাগের মাথায় বলে ওঠে আনন্দ। শুনে সকলের কী প্রতিক্রিয়া হয় তার জন্য অপেক্ষা করতে থাকে।

বক্সি উত্তরে বলেন, হাতে লেখা উইলকে চ্যালেঞ্জ করাটা খুবই ঝুঁকির কাজ। বছর গড়িয়ে যাবে। খুব বেশি হলে আর কী হবে হয়তো কোনও জজ সাহেব হাতের লেখার পরীক্ষা করাতে পাঠাবেন। কিন্তু আমি নিশ্চিত দুটো চিঠিই দীনানাথ নিজের হাতেই লিখেছেন।

কিন্তু এদের কেন? আমরা কেন নই? এতক্ষণে অতুল কথা বলে।

ইন্সপেক্টর রমন এবার বলেন, এটা তো নিজের নিজের ইচ্ছের উপর নির্ভর করে। ওনার একাকিত্বটা একটু ভাবার চেষ্টা করো যেটার মধ্যে দিয়ে ওনাকে একাই যেতে হয়েছে। তার উপর ক্যান্সারের মতো রোগ, তোমরা তো কেউ খোঁজও রাখোনি। এই দুজনই তোমাদের বাবার সেবা করেছে।

শেষের এক দেড় বছর তো অসম্ভব মেজাজ তিরিক্ষি হয়ে থাকত। কখনও খুশি তো কখনও ডিপ্রেশনের শিকার হত। আমি ওর এই মুড সুইং দেখেছি আর এও দেখেছি নুরার কি অসীম ধৈর‌্য আর সহনশীলতা। নিজের কাজ নিয়ে থাকত ও। অত্যন্ত প্রভুভক্ত এবং বিশ্বাসী। শেষের বেশ কিছুদিন দীনানাথ এতটাই দুর্বল হয়ে পড়েছিল যে কাপড়চোপড় বদলানো, পায়ে জুতো পরিয়ে দেওয়া সব নুরাই সামলাত। অ্যাডভোকেট বক্সি বললেন।

ইন্সপেক্টর রমনের আর কিছু করার ছিল না। উনি সকলের কাছ থেকে বিদায় নিলেন। মনে মনে জানতেনই নতুন কিছু ঘটলে, সেটা বক্সি সাহেবের কাছেই জানতে পেরে যাবেন।

রমন চলে যেতেই বক্সি বললেন, তোমরা জানতে চাও, এরকম কেন করেছে দীনানাথ। আমি জানি এটার সম্পর্ক তোমাদের পরিবারের সঙ্গে। সেজন্য রমনের সামনে আমি কিছু বলতে চাইছিলাম না।

শ্লেষ মিশ্রিত হাসির রেখা ফুটে উঠল আনন্দের ঠোঁটে, কী এমন কথা আছে যে বাড়ির লোকেরা কিছু জানে না অথচ আপনি জানেন? আবার নুরার সাপোর্টে নতুন গল্প নয় তো?

ভদ্র ভাবে কথা বলো। তুমি এ বাড়ির জামাই। তাই তোমাকে বেশি কিছু বলতে চাই না। আমার মাথার সাদা চুলের সম্মানটুকু করো। বক্সি রাগত স্বরে আনন্দকে বললেন।

অতুল বলে উঠল, আংকেল আপনি কিছু বলতে যাচ্ছিলেন।

বক্সি বলতে আরম্ভ করলেন, তোমরা সকলেই আশ্চর‌্য হয়ে গেছ, দীনানাথ কেন এরকম করল এই ভেবে! ১৯৪৬-৪৭ সালের কথা হবে। তোমাদের ঠাকুরদা নতুন নতুন ব্যাবসা আরম্ভ করেছেন। ব্যাবসা বাড়াবার জন্য তিনি কুদ-এ বেশ কিছু জমি নিয়ে রেখেছিলেন। ওখানে ওনার ছোটো একটা বাড়ি ছিল। সেখানে পাশেই এক গুজ্জর পরিবার থাকত। ওদের অনেক জমিজমা ছিল।

অশিক্ষিত গুজ্জরের কাছে অত জমি দেখে তোমাদের ঠাকুরদার মনে লোভ জন্ম নেয়। উনি সেগুলো হাতিয়ে নেওয়ার সুযোগ খুঁজতে থাকেন। যখন কিছুতেই কিছু করে উঠতে পারেন না, তখন একদিন রাতের অন্ধকারে ওদেরকে মেরে ফেলা হয়, সেটা তোমাদের বাবা দেখে ফেলে। ওর বয়স তখন মাত্র সাত। গুজ্জরের বউ একমাত্র মেয়ে নুরাকে নিয়ে কোনওমতে পালিয়ে জম্মু চলে আসে। নুরা তখন খুব ছোটো।

কিন্তু বাবা ওদেরকে কী করে খুঁজে পেল? উপাসনা জানতে চাইল।

আমি এটুকুই জানি, দীনানাথ ওদেরকে অনেক খুঁজেছিল, হয়তো পরিচিত কাউকে একাজে বহাল করেছিল। নুরা যখন এই বাড়িতে কাজে লেগেছে তখন হয়তো দীনানাথ ওদের ঠিকানাও খুঁজে বার করে ফেলেছে। হ্যাঁ, তবে নুরাকে ও কখনও কিছু বলেনি এ ব্যাপারে। মনের মধ্যে একটা অপরাধবোধ সবসময় কাজ করত ওর। হয়তো সেই থেকেই এরকম একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছে দীনানাথ।

তোমাদের নিজেদের মধ্যে বনিবনা

না-হওয়া, দীনানাথের দুরারোগ্য ব্যাধি এই সবই হয়তো ওকে নতুন করে চিন্তা করতে প্ররোচিত করেছে। রক্তের সম্পর্ক নয়, সম্পর্ক গড়ে ওঠে ভালোবাসা দিয়ে যখন দীনানাথ ভয়ানক যন্ত্রণায় ছটফট করত, তখন নুরাই ওর দেখাশোনা করত, ওষুধ এগিয়ে দিত।

আনন্দ বলে ওঠে, তবুও নিজের সন্তানের জায়গা কেউ নিতে পারে না। সে কাছেই থাকুক বা দূরেই থাকুক।

উপাসনা আর অতুল একসঙ্গে বলে ওঠে, আমরা এর বিরুদ্ধে কোর্টে অ্যাপিল করব।

বক্সি সাহেব মৃদু হেসে বললেন, অতুল তোমাকে কানাডা থেকে বারবার আসা-যাওয়া করতে হবে। উপাসনা তুমিও ভেবে দেখ এটা কিন্তু সহজ নয়. বেশ কিছু বছর হয়তো লেগে যেতে পারে। কিন্তু হাতে লেখা উইল কেউ অস্বীকার করতে পারবে না।

দূরত্ব

পরিতোষের ধৈর্য এত কমে যাচ্ছে! পূর্ণিমা বেশ বিরক্তই হচ্ছেন মাঝেমধ্যে। সকালবেলা এত কীসের হাঁকডাক? বেশ তো চায়ের কাপ, খবরের কাগজ নিয়ে বসেছে, তবু ‘পূর্ণিমা, পূর্ণিমা’। রান্নাঘর থেকে হাত মুছে বেরোতে না বেরোতেই মুখোমুখি পরিতোষের। পূর্ণিমা একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেলেও চুপ করে তাকিয়ে রইলেন স্বামীর মুখের দিকে। ‘দ্যাখো দ্যাখো কী লিখেছে! সম্পত্তির জন্য ভাড়াটে গুন্ডা দিয়ে বুড়ো বাবা-মাকে খুন করিয়েও শেষ রক্ষা হয়নি। কুপুত্তুর পুলিশের হাতে ধরা পড়ে সব কবুল করেছে। বুঝেছ, ধর্মের কল বাতাসে নড়ে।’ পূর্ণিমাকে পড়ে শোনানোর পরই পরিতোষ কেমন যেন উদাস হয়ে গেলেন। তাঁর নিজেরও তিন ছেলেমেয়ে।

‘আরে বাবা এত ভাবাভাবির কী আছে। কোন কালচারের লোকজন এমন করেছে সেটা তো দেখবে। শিক্ষিত না অশিক্ষিত সেটাও তো ভাবা উচিত।’ পরিতোষ ঝাঁঝিয়ে উঠলেন ‘থামো তো, বলছি বাড়ি সম্পত্তি অর্থাৎ নিশ্চিত ভাবে বড়োলোক! তাছাড়া এমবিএ করেছে ছেলে, বিদেশ থেকে।’ বলতে বলতে যেন হাঁফিয়ে উঠলেন। পূর্ণিমা তাই দেখে তাড়াতাড়ি এক গ্লাস জল মুখের সামনে এগিয়ে ধরে বললেন ‘কাগজে কি পড়ার আর কিছুই থাকে না? খেলা, সিনেমা, রাজনীতি, তা না যত্তসব আজে বাজে খবরে আগে দৃষ্টি যায়! আর ক’দিন বাদেই তোমার রিটায়ারমেন্ট। নিজের বাড়ি-বউ-ছেলেমেয়ে, পেনশনের মোটা টাকা– তোমার ভাবনা বা দুশ্চিন্তা কেন হয়? কী চাও তুমি?’

পরিতোষ আবার এক ঢোঁক জল খেয়ে বললেন ‘এক পয়সাও আর কাউকে দেব না। ছেলেমেয়েদের যথেষ্ট পড়াশোনা করিয়েছি, এবার নিজেরা বুঝে নিক।’ পূর্ণিমা চমকে উঠলেন ‘কী বলছ। পাপুর বিয়ে হয়ে গেছে। ঘরে বউ আছে। দু’দিন পরে মেয়ে অর্থাৎ পাপিয়ার বিয়ে। আর কয়েকদিন আগেই তো পিকলু বলছিল আরও পড়বে।’ ‘ব্যস– চুপ। যথেষ্ট পড়িয়েছি, ইঞ্জিনিয়ার হয়েছে, এবার যা করার নিজের টাকায় করো। আমার পেনশনের এক নয়া পয়সাও কাউকে দেব না।’ পরিতোষ উঠে বাইরে হাঁটা দিলেন।

short story
Bengali story Durotwo

আজ সকাল থেকে পরিতোষের মন ভালো নেই। সকালে মর্নিংওয়াকে গিয়ে দেখেন রতন চুপচাপ বসে আছে। খুঁচিয়ে জিজ্ঞাসা করায় হাঁউমাঁউ করে কেঁদে উঠল। হঠাৎ স্থির হয়ে গিয়ে কঠিন গলায় বলে উঠল, ছেলে বলেছে, তারা চাকরির জায়গায় চলে যাচ্ছে। বউ-বাচ্চা নিয়ে দু’কামরার ছোটো অফিস-ফ্ল্যাটে খুবই অসুবিধা হয় বেশি লোক হলে। ছেলের এটুকু কথাতেই রতন বুঝে নিয়েছে ছেলে-বউ কী বলতে চাইছে। জমানো টাকা যেটুকু ছিল স্ত্রী-র অসুখে বেরিয়ে গেছে, চাকরির কোনও পেনশন নেই। নিজের বাড়ি ছিল। বন্ধক রেখে ছেলেকে বিদেশ পাঠিয়েছিল, মানুষ হবে বলে। হায়রে!

রতনের মুখে ওই ঘটনা শুনে ঞ্জবং বাড়ি গিয়ে খবরের কাগজ পড়ে পরিতোষের মনমেজাজ সবই তিরিক্ষে হয়ে গেল। সেই যে বাসের পিছনে একবার লেখা দেখেছিলেন ‘টাকা আপন, সবই পর টাকার টুঁটি চেপে ধর’, সেদিন বিড়বিড় করে বলেছিলেন দেশটা উচ্ছন্নে গেল! আজ চকিতে মনে পড়ে গেল সে কথা। ওই কথাগুলোই ঠিক। পূর্ণিমা জানতেন পরিতোষ একবার যা ভেবে নিয়েছেন তা-ই করবেন। গত রাতে পিকলু আবদার করেই বলেছিল, ‘বাবা, স্পনসরশিপের টাকাতেই বিদেশ যাব। কিন্তু আরও অন্যান্য খরচার জন্য প্রায় ২ লাখ টাকা লাগবে। মাত্র চার-পাঁচ বছরের ব্যাপার। তারপর সব টাকা সুদে-আসলে আমাদের ঘরেই আসবে। পিকলু থামল, বাবার নিশ্চুপ মুখের দিকে তাকাল। তারপর মা’র দিকে। মায়ের চাহনি দ্বিধাবিভক্ত। পিকলু বুদ্ধিমান ছেলে। যা বোঝার সে বুঝে নিল।

রাতের সব কাজ সেরে পরিতোষের পাশে বসে পূর্ণিমা বেশ অভিমান করে বললেন ‘কী হয়েছে তোমার? যদি ছেলেদের সাথে এমন ব্যবহার করো, তাহলে সংসার টিকবে কী করে? রাতে টেবিলেও এলে না। ছেলেরা তোমার জন্য অপেক্ষা করে ছিল। দিন রাত কী ভাবছ?’ পরিতোষ ধীর-ঠান্ডা গলায় বলে উঠলেন ‘আমার জন্য কেউ অপেক্ষা করেনি, অপেক্ষায় ছিল আমি টাকা দেব কিনা সেটা জানার জন্য।’ অবাক পূর্ণিমা তাকালেন স্বামীর দিকে। এই মানুষটাকে তিনি চেনেন না! এ কোন পরিতোষ! কি হলটা কী!

পরের দিন সকালে খাবার টেবিলে বসেই পাপু জিজ্ঞাসা করল পিকলুর কথা– টাকার কথা। পূর্ণিমা চুপ। আবার প্রশ্ন করতে পিকলুই ঝাঁঝিয়ে উঠল ‘দাদা চুপ কর।’

‘চুপ করব কেন? তোর বিদেশ যাওয়া হবে না? টাকার জন্য আটকে যাবি?’

পরিতোষ বেশ জোর গলায় বলে উঠলেন ‘ইঞ্জিনিয়ার করে দিয়েছি। তোমাদের দুজনের জন্য লাখ লাখ টাকা খরচ করেছি। আর নয়। এবার যা করবে, তা নিজেরাই করো।’ পিকলু মাথা হেঁট করে পাউরুটি চিবোতে থাকল। পাপু বেশ থতমত খেয়ে গেল বাবার এই আচরণে। নীচু স্বরে বলল সে, ‘আমার ভাইয়ের বিদেশ যাওয়া টাকার জন্য আটকে যাবে? এ হতে পারে না। আমি দেখছি কী ব্যবস্থা করা যায়।’ পরিতোষ তাড়াতাড়ি করে খাওয়া শেষ করে উঠে গেলেন। নিজের মনেই, অথচ সবাই যেন শুনতে পায়, এমন স্বরে বলে চলে গেলেন, ‘আমি কারুর কাছ থেকে কিছু আশা করি না, কেউ যেন আমার কাছ থেকে কিছু প্রত্যাশা না করে। সবাইকে বড়ো করে দিয়েছি, মানুষ করেছি, আর নয়।’

‘মা, বাবার আজকাল কী হয়েছে?’ পিকলুর প্রশ্ন শুনে পূর্ণিমা ঘুরে তাকালেন, চোখ ভর্তি জল নিয়ে। ‘জানি না, কী যে হয়েছে, বুঝি না। কাল রাতে শোবার সময় বললেন ‘পূর্ণিমা, আর টাকাপয়সা কাউকে নয়। সব নিজেদের নিজেদের,’ বলে শুয়ে পড়লেন।

‘কি! আমরা বাবার টাকা নেব? ভাই-বোন, ছোটো থেকে এক সঙ্গে বড়ো হওয়া, নিজের পায়ে দাঁড়ানো, সব কিছুতেই যে তোমরা মা। বাবা কি বোঝে না! আমি তো এই বাবাকে চিনতেই পারছি না’, পাপু উঠে চলে গেল। পিকলু মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘বাবার দোষ কোথায়? দিনরাত কাগজে-টিভিতে খবর– সম্পত্তির লোভে বাবা-মাকে হেনস্তা, কখনও খুন। আকছার এমন খবর পড়া-শোনা-দেখার পর বৃদ্ধ, পেনশনভোগি মানুষটা নিজেকে কতটা ঠিক রাখতে পারে? চোখের সামনে রতন জ্যাঠার ছেলেটাকে দ্যাখো। কত ভালো মানুষ রতন জ্যাঠা, তার ছেলের এই ব্যবহার! বাবা তো ভয় পাবেই, এমন ঘটনা শুনে।’

পরের মাসেই পিকলু চলে গেল বিদেশে। বোন পাপিয়াও ক্যাম্পাস-ইন্টারভিউ দিয়ে চাকরি পেয়ে খুশি। নিজেকে নিয়ে সে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। সেই সকালে বেরিয়ে বাড়ি আসতে আসতে প্রায়দিনই আটটা বেজে যায়। এ নিয়ে পূর্ণিমার সঙ্গে মাঝেমধ্যে মন কষাকষি হয়। পাপিয়া মাকে বুঝিয়েও হাল ছেড়ে দেয়, এখন অফিসে সকাল ন’টা থেকে বিকেল সাড়ে পাঁচটা পর্যন্ত থাকতেই হয়। তারপর ওভারটাইম থাকলে তো কথাই নেই। পূর্ণিমা হাল ছেড়ে দিয়েছেন। সারাদিন একা একা থাকতে হয় তাঁকে। একদিন রাতে পরিতোষের কাছে পূর্ণিমা কথাটা পাড়লেন, ‘মেয়ের বিয়ের ব্যাপারে কি চিন্তাভাবনা করছ? বয়স বাড়ছে। চাকরি করছে, এবার খোঁজখবর শুরু করো।’ পরিতোষ শুনলেন চুপচাপ।

দিনকয়েক পরে এক রাতে খাবার টেবিলে পরিতোষ সবাইকে জানালেন, ‘কাল পাপিয়াকে দেখতে আসবে,’ পাপিয়া বেশ অবাক হয়ে গেলেও বাবাকে কিছু বলল না। পরে মাকে বলল, ‘বেশি আয়োজন কোরো না। প্রথমবার দেখতে আসছে, চা, বিস্কুট দিলেই হবে।’ মা হেসে কিছুই বললেন না। মেয়ে অফিস গেলে নিজেই বসে গেলেন মিষ্টি তৈরি করতে। গোলাপজাম, নারকেল বরফি, নিমকি, সিঙাড়া, কাটলেট আর পনির মানচুরিয়ান। এছাড়া ঘরে জলজিরার শরবত তো আছেই।

সন্ধ্যায় যথা সময়ে পাত্রপক্ষ হাজির হলেন পরিতোষের বাড়িতে। পাত্র প্রমোদ বেশ সম্ভ্রান্ত পরিবারের ছেলে। সঙ্গে এসেছেন মা সৌদামিনী। বসামাত্রই সৌদামিনী শুরু করে দিলেন তাঁর ছেলের প্রশংসা। ছেলেকে সিএ তৈরি করতে কত খরচ হয়েছে, তার হিসেবও তিনি দিতে ভুললেন না। পরিতোষ আর থাকতে না পেরে বলে উঠলেন ‘এগুলো তো সব মা-বাবারই কর্তব্য, সন্তানকে মানুষ করার জন্য যতটা প্রয়োজন তাদের দিকে হাত বাড়িয়ে দেওয়ার। আপনি টাকা-পয়সার কথা কী যেন বলছিলেন?’ প্রমোদের মা বেশ হকচকিয়ে গেলেন পরিতোষের কথা এবং গলার গম্ভীর স্বর শুনে। পরিতোষ না থেমেই বলে উঠলেন ‘আমার মেয়ের বিয়ের জন্য যদি কোনও পণ, মানে টাকা পয়সার লেনদেনের কথা আপনারা বলেন, তাহলে এখানে আমার মেয়ের বিয়ে দেব না।’ ব্যস কথাবার্তার এখানেই ইতি। পূর্ণিমা স্বামীকে একা পেয়ে ক্ষোভে ফেটে পড়লেন ‘কী ভেবেছ তুমি, এ ভাবে পাত্রপক্ষকে বললে কেউ কি আর বিয়ের কথা এগোবে!’

পরিতোষ শান্ত গলায় পূর্ণিমাকে জবাব দিলেন ‘মেয়ের বিয়ে দেব, বেচব না।’ পূর্ণিমা মুখে আঁচল চাপা দিয়ে কাঁদতে লাগলেন, ‘মেয়ের বিয়েতে কোন বাবা না খরচ করে? তুমি কী রকম মানুষ!’ পরিতোষ উঠে চলে গেলেও পূর্ণিমা একা বসে কাঁদতেই থাকলেন। হঠাৎ কাঁধে মৃদু চাপ পড়তেই ঘুরে দেখলেন পাপিয়া-কে। মায়ের হাত ধরে নরম গলায় সে বলল, ‘মা বাবা তো ঠিকই করেছে, তুমি কাঁদছ কেন? আমার শিক্ষাদীক্ষার কি কোনও দাম নেই? তুমি চিন্তা কোরো না, আমার জীবনসঙ্গী আমি নিজেই খুঁজে নেব। তুমি একটু ধৈর্য ধরো।’ মেয়ের আশ্বাসবাণীতেও মা শান্ত হলেন না, নিজের মনেই কেঁদে চললেন।

এরপর ছ’মাস কেটে গেছে। একদিন বিকেলে পাপিয়া তাড়াতাড়ি বাড়ি এল, মা-বাবা দুজনেই সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে মেয়ের দিকে তাকালেন। পাপিয়া হেসে বলল ‘আজ তোমাদের সঙ্গে একজনের আলাপ করিয়ে দেব, তাই তাডাতাড়ি বাড়ি চলে এলাম। এসো অমৃত, ভেতরে এসো।’

পূর্ণিমা-পরিতোষ দুজনেই দরজার দিকে তাকালেন। দরজায় দাঁড়িয়ে ঞ্জকজন সুগঠিত চেহারার মানুষ। বয়সটা পাপিয়ার তুলনায় কিঞ্চিত বেশি। পরিচয় পর্বের পর জানা গেল লোকটি পাপিয়ার থেকে অন্তত বারো তেরো বছরের বড়ো এবং সে দক্ষিণ ভারতীয়। অপ্রস্তুত অবস্থাটা কাটিয়ে পূর্ণিমা পাপিয়াকে টানতে টানতে ভেতরে নিয়ে গিয়ে বকুনির স্বরে বলে উঠলেন, ‘এ কি করছিস তুই! ছেলেটি আমাদের স্বজাতি নয়, তোর থেকে এত বড়ো এমন একজনকে তুই ভালোবাসিস!’

‘মা!’ পূর্ণিমার হাতটা চেপে ধরল পাপিয়া। ‘কী আসে যায়, অমৃত খুবই মেধাবী ছেলে, ও বিজ্ঞানী। আজকাল নর্থ-ইন্ডিয়ান, সাউথ-ইন্ডিয়ানে কিছু এসে যায় না। আমরা কি ইডলি-ধোসা খাই না, হোটেলে গিয়ে রসম-ভাত খাই না? অমৃত তো রাজমা-অড়হড় ডাল-ভাত বেশ পছন্দ করে। আলুর পরোটা ওরও খুব প্রিয়, তোমারও প্রিয়, মা। আমরা দুজনে দুজনকে বুঝি, ভালোবাসি। আমি সারা জীবন ওর সঙ্গে সুখে থাকব। তুমি বাধা দিও না।’ বলতে বলতে পাপিয়ার দু’চোখে জল ভরে উঠল।

‘তোর সুখই আমার কাছে সব থেকে বড়ো পাওয়া, তুই যা ভালো বুঝিস কর মা, আমার কিছুই বলার নেই।’ পাপিয়া চোখের জল মুছে হাসতে হাসতে মাকে নিয়ে বাইরের ঘরে এসে দেখল, বাবা আর অমৃত দুজনে খোসগল্পে মেতেছে। সেদিন রাতে অমৃত ওদের বাড়িতে খেয়ে গেল, বেশ তৃপ্তি করে। পূর্ণিমা-পরিতোষ বেশ খুশি হল অমৃতর ব্যবহারে।

এই ঘটনার তিন মাসের মধ্যেই পাপিয়া-অমৃতর রেজিস্ট্রি হয়ে গেল! ছোট্ট এক পারিবারিক অনুষ্ঠানের মধ্যে দিয়ে। পিকলু আসতে পারেনি। এজন্য সে দারুণ আপসোস করে দিদিকে ‘মেল’ পাঠিয়েছে। বলেছে সে ফিরে এলে আবার অনুষ্ঠান হবে। পূর্ণিমা একটু নিমরাজি ছিলেন বিয়ের তেমন ঘটা না হওয়ার জন্য কিন্তু অমৃতই বুঝিয়েছিল ‘শুধু শুধু খরচা করার কোনও মানে হয় না।’ পরিতোষ কিন্তু বেশ নিশ্চিন্ত এমন জামাই পেয়ে। সময় পেলেই অমৃতকে নিয়ে আড্ডা দিতে বসে যান। পাপুও তাই।

আস্তে আস্তে অমৃত-পাপিয়ার যাওয়া আসা এ বাড়িতে কমে গেল। কাজের চাপ বেড়ে যাচ্ছে সকলের। এক বছরের মধ্যে পাপুও অন্য চাকরি নিয়ে পিকলুর কাছে চলে গেল সপরিবারে। চার বছরের কনট্রাক্ট। বাড়িটা একদম ফাঁকা। পরিতোষ চুপচাপ থাকেন, পূর্ণিমারও একইরকম অবস্থা। বাড়িটা যেন খাঁ-খাঁ করছে। একসময় বাড়িটা ভরে থাকত। তিন ভাইবোনের হাসি ঝগড়া কান্নায়। বিশেষ করে পিকলুর। সবার ছোটো, অল্পেতেই বায়না। পাপু সব সময় পিকলুর পক্ষ নিত। দু’ভাই একদিকে, তো পাপিয়া একা। বেশ ছিল দিনগুলো। পরিতোষ না বুঝেই মেয়ের পক্ষ নিতো। কি হইচই আনন্দের দিন ছিল সেগুলো। একবার বেশ মনে আছে পূর্ণিমার, দুই ভাইয়ে কোথা থেকে ক’টা পেয়ারা নিয়ে এসেছে, বোধহয় রতনদাদের বাগান থেকে, এনে বাপ-ব্যাটারা মিলে সব খেয়ে নিয়েছিল হঠাৎ পাপিয়া হাজির। দেখেই চিৎকার, ‘আমার ভাগ কই?’ সবাই মুখ মুছে চুপচাপ। পাপিয়া ছুটে রান্নাঘরে গিয়ে নালিশ জানাতেই, পূর্ণিমা খুন্তি হাতে দুই ছেলের দিকে ছুটে গেলেন। পিকলু ছুটে পালাতে পালাতে জানাল ‘বাবা দুটো পেয়ারা খেয়েছে।’ রেগে পরিতোষের দিকে তাকাতে গিয়ে হেসে ফেলেছিলেন পূর্ণিমা। বেচারা মাথা হেঁট করে বলির পাঁঠার মতো বসে আছে। সেবার পাপিয়া অভিমানে দু-তিন দিন বোধহয় বাবার সাথে কথা বলেনি। সেদিন রাতেই অবশ্য পরিতোষ মেয়ের মান ভাঙাতে একটা নতুন গল্পের বই কিনে এনেছিলেন। পাপিয়া ছুঁয়েও দেখেনি। সে রাত কাটলেও পরের দিনও পাপিয়া যখন কারুর সাথে কথা বলেনি, তখন দু’ভাই বেশ ভড়কে গিয়েছিল। চুপচাপ দুজনে দুটো পেয়ারা এনে দিয়েছিল। বাপরে কি জেদ ছিল মেয়ের। দেখতে বেশ শান্ত কিন্তু দারুণ একরোখা। কত সুখ-স্মৃতি।

আচমকা একদিন, পরিতোষ-পূর্ণিমা রাতের খাওয়া সেরে শুয়ে গল্প করতে করতে ঘুমিয়ে পড়লেন। পরের দিন পূর্ণিমা সকালে উঠে অবাক! পরিতোষ রোজ ভোরবেলায় মর্নিংওয়াক করতে যান, আজ কী হল! এত ঘুমোচ্ছেন কেন?

‘তোমার হলো কী! শরীর খারাপ নাকি?’ সাড়া না পেয়ে এবার একটু ধাক্বা দিতেই মানুষটার মাথাটা এক পাশে হেলে পড়ল।

পাপিয়া-অমৃত এল। ছেলেরা কেউ আসতে পারল না বাবার শেষকৃত্যে। পাপিয়ারা কয়েকদিন মায়ের কাছে থেকে গেল। দিন-দিন বাড়িটা যেন পূর্ণিমাকে গ্রাস করে নিচ্ছে। পরিতোষের মৃত্যুর মাস চারেক পর পূর্ণিমা ছেলেদের আইএসডি করে খবর পাঠালেন একবার অন্তত তারা যেন আসে। এই বাড়ির কোনও ব্যবস্থা করতে হবে। যে যার সম্পত্তির ভাগ যেন বুঝে নেয়। পাপু-পিকলু সোজাসাপটা বলল, ‘মা আমরা দু’ভাই কিছু চাই না। শুধু তোমায় চাই। তুমি তোমার ইচ্ছামতো বাড়ি কোনও অনাথালয় বা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানকে দান করো। তুমি চলে এসো। বাবার আত্মা শান্তি পাবে।’

পূর্ণিমার দু’চোখে জল। পরিতোষের ছবির সামনে দাঁড়িয়ে

নিজেই বলে উঠলেন, ‘দ্যাখো, যে-সম্পত্তির জন্য তুমি ছেলেদের দূরে পাঠালে, যে টাকাপয়সা তুমি কাউকে দিলে না, নিজের ভবিষ্যতের জন্য ভয় পেলে, সেই পয়সা আজ কারুর কাজে লাগল না। ছেলেরা শুধু মাকেই চায়। সময় বড়ো কম। আমি চলে যাব, আমি ওদের কাছেই থাকব। সব দিয়ে দেব গরিবদের। আমার সন্তানরা আমারই।’

বেহায়া

অফিসের জন্য তৈরি হয়ে অনন্যা বাইরের ঘরে এসে দেখল, শাশুড়ি-মা বসে শ্বশুরের সঙ্গে গল্প করছেন। অনন্যা এসেই সুগন্ধার গলা জড়িয়ে ধরে অফিস যাওয়ার অনুমতি চেয়ে নিল। শ্বশুরের দিকে তাকিয়ে আস্তে করে বাই বলে অফিসের ব্যাগটা কাঁধে তুলে নিল। অজয়ের বাবা অনিরুদ্ধবাবু খুবই ভালোবাসেন অনন্যাকে।

সুগন্ধা বললেন, অনন্যা, আজ কিন্তু একটু তাড়াতাড়ি ফিরো। অজয়ের পিসিমা আসবেন সন্ধেবেলা।

মা, তাড়াতাড়ি আসা তো মুশকিল। অফিস থেকে পাঁচটায় বেরোলেও বাড়ি ফিরতে ফিরতে সন্ধে সাতটা তো বাজবেই। এসে দেখা হয়ে যাবে। তুমি চিন্তা কোরো না। বলে নিজেই জোর করে হাসি টেনে আনে মুখে। আর তাছাড়া পিসিমা তো আর আমার সঙ্গে দেখা করতে আসছেন না। নিজের গুরুদেবের সঙ্গে দেখা করতে আসছেন।

খানিক আগেই স্বামী অজয় ঘরে ঢুকেছে, অনন্যা খেয়াল করেনি। অজয়ে গলার আওয়াজে ওর দিকে দৃষ্টি পড়ল অনন্যার। ওর দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি করে হাসতে হাসতেই অজয় বলল, বাজে কথা বোলো না অনন্যা। ঠিক সময় চলে এসো।

হাসতে হাসতেই অনন্যা বেরিয়ে গেল।

মায়ে গম্ভীর মুখ দেখে অজয় সুগন্ধাকে জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে মা? মুড খারাপ?

না, সংক্ষিপ্ত উত্তর পেয়ে অজয় বাবার দিকে তাকাল। অনিরুদ্ধবাবু ইশারায় ছেলেকে চুপ থাকতে বললেন। ইশারায় কথা বলে বাবা ছেলে দুজনের মুখেই চাপা হাসি ফুটে উঠল।

অজয় অফিস চলে গেলে অনিরুদ্ধবাবু নিজের স্ত্রীকে বললেন, আমি আজ অফিস থেকে তাড়াতাড়ি ফিরে আসতে চেষ্টা করব, দিদি আসার আগেই পৌঁছে যাব। কিন্তু তুমি এত কেন চুপচাপ?

স্বামী প্রশ্ন করতেই রাগে ফেটে পড়লেন সুগন্ধা। চুপ করে থাকব না তো আর কী করব? আর কত অ্যাডজাস্ট করব? সকাল থেকে ওইরকম বেহায়া ছেলের বউকে দেখে এমনিতেই আমার মাথাব্যথা শুরু হয়ে যায়।

বেহায়া? অনন্যা? একথা কেন বলছ?

হাবভাব দেখছ তো, একে দেখে এ বাড়ির বউ বলে মনে হয়? সবসময় ঠাট্টা, ইয়ার্কি, সাজগোজ তারপর এই প্রাইভেট চাকরি! আর কথাবার্তার তো কোনও ছিরিছাঁদ নেই। কত ভেবেছিলাম বাড়ির বউ নম্র, ভদ্র হবে, মা-বাবার দেওয়া শিক্ষা-দীক্ষা থাকবে। কিন্তু না, যাই বলি না কেন এমন উত্তর দেবে যে, তারপর আর কিছু বলা চলে না। সব কথা হেসে উড়িয়ে দেয়। অথচ আমাদের মেয়ে অপর্ণাকে দেখো, শ্বশুরবাড়ির সকলে ওর প্রশংসায় পঞ্চমুখ। শাশুড়ি যা বলছেন তাই মাথা নীচু করে মেনে নিচ্ছে। আর আমাদের অজয় এমন একটা বেহায়া মেয়েে এনে আমাদের ঘাড়ে ফেলে দিয়েছে।

অনিরুদ্ধবাবু স্ত্রীকে সান্ত্বনা দিতে তার কাঁধে হাত রাখলেন, এখনই এত অধৈর্য্য হয়ে পড়ছ কেন? মাত্র চারমাস হয়েছে অনন্যা এই বাড়ির বউ হয়ে এসেছে। এত তাড়াতাড়ি ওর কোনও রকম ছবি মনের মধ্যে এঁকে ফেলো না। তুমিও তো পড়াশোনা করেছ, তুমিও যথেষ্ট মডার্ন। এই কদিন অনন্যাকে দেখেই তুমি ওর নামকরণ করে ফেলেছ বেহায়া! এটা ঠিক নয় সুগন্ধা। অজয় যথেষ্ট দাযিত্ববান ছেলে। ও অনন্যাকে যখন নিজের বউ হিসেবে স্বীকার করেছে, তখন নিশ্চই সে অনন্যার গুণ দেখেই ঘরে এনেছে।

হ্যাঁ, গুণ তো আছে বটেই। সেই জন্যই তো অজয়কে ক্রীতদাস বানিয়ে রেখেছে। অনন্যা যা বলে তাতেই সায় দেয় অজয়। ও সাজগোজ আর বউয়ে রূপ দেখে এমন মজেছে যে, অনন্যা যাই করুন না কেন তাতে তার সাত খুন মাপ হয়ে যায়। আমিই শুধু ওর কোনও গুণ দেখতে পাই না কেন কে জানে!

অনিরুদ্ধবাবু স্ত্রীয়ের রাগ দেখে হেসে ফেলেন। একটু রসিকতা করার ইচ্ছা সামলাতে পারেন না। সুগন্ধা কখনও কোনও শাশুড়িকে দেখেছ ছেলের বউয়ে গুণ এত সহজে মেনে নিতে? তোমার তো কত গুণ ছিল কিন্তু তোমার শাশুড়ি কোনও দিন সেটা স্বীকার করেছেন?

এত রাগের মধ্যেও স্বামীর কথা শুনে সুগন্ধা হেসে ফেলেন।

অনিরুদ্ধবাবু বলেন, ঠিক আছে, আমি এখন বেরোচ্ছি। রাগ কোরো না, বিশ্রাম নাও। দিদি এলে তুমিও ব্যস্ত হয়ে পড়বে, এই বলে অনিরুদ্ধবাবু বেরিয়ে যান।

সুগন্ধা বাড়ির কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। কাজের লোককে দিয়ে বাড়ি পরিষ্কার করিয়ে দুপুরে একটু ফ্রি হয়ে সবে শুতে যাবেন, ফোনটা বেজে উঠল। বড়ো ননদের ফোন যিনি সন্ধেবেলায় ওঁদের বাড়ি আসছেন থাকতে।

সুগন্ধা, আমি ছটা সাড়ে ছটা নাগাদ তোমাদের বাড়ি পৌঁছে যাব। ততক্ষণে আমাদের বউমাও নিশ্চয় বাড়ি এসে যাবে? বিয়ের সময়ে ওর সঙ্গে বেশি কথা বলতে পারিনি।

হ্যাঁ দিদি, অনন্যা বলেছে ও চেষ্টা করবে তাড়াতাড়ি ফিরতে, বলে ফোন নামিয়ে রাখেন সুগন্ধা। নিজের অজান্তেই একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলেন।

সুগন্ধা এসে বিছানায় গা এলিয়ে দেন। বিশ্রাম নেওয়া জরুরি। সন্ধেবেলায় অনেক কাজ আছে। কিন্তু শুয়ে দুচোখের পাতা এক করতে পারেন না। নানা চিন্তা এসে মাথায় ভিড় করে। তিন বছর আলাপের পর মাত্র চারমাস আগে অজয় আর অনন্যার বিয়ে হয়েছে। অনন্যার মা-বাবা দুজনেই প্রফেসর। বেঙ্গালুরুতে অনন্যা বড়ো হয়েছে। সুন্দরী, মডার্ন, সুশিক্ষিতা, ভালো পরিবারের মেয়ে

অজয় অনন্যাকে পছন্দ করে, এটাই সুগন্ধার কাছে সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছিল। সন্তনের খুশিতে, সংসারের আনন্দেই সুগন্ধা পরিপূর্ণ ছিলেন। সবসময় হাসিখুশিতে থাকতেই পছন্দ করতেন। কিন্তু অনন্যার সঙ্গে কিছুদিন কাটাবার পরেই একটাই শব্দ দিনরাত ওনার মাথায় ঘুরতে আরম্ভ করল, বেহায়া।

সুগন্ধা ভালোমতোই জানেন, অনন্যা অজয়কে চোখে হারায়। অনন্যার অফিস বাড়ি থেকে অনেকটাই দূরে। যার ফলে অজয়ে আগে ওকে বাড়ি থেকে বেরোতে হয় আর ফেরেও অজয় ফেরার অনেকটা পরে।

কলকাতায় অফিস যাতায়াত করাটা একটা সমস্যা কিন্তু অনন্যা বাড়ি এসেই চটপট জামাকাপড় বদলে, ফ্রেশ হয়ে সকলের সঙ্গে বসে গল্প করতে শুরু করে দেয়। কোথাও ক্লান্তির ছিটেফোঁটাও থাকে না ওর চেহারায়। সুগন্ধা অবাক হয়ে যান যত ওকে দেখেন। বাড়িতে এমন ভাবে থাকে, দেখে যে কেউ ভাববে ও বাড়ির মেয়ে নতুন বিয়ে হয়ে আসা বউ নয়।

রান্নাবান্নার কোনও শখ নেই অনন্যার। একদিন সুগন্ধা খুব আদর করেই অনন্যাকে বলেছিলেন, অনন্যা, ছুটির দিনগুলোতে একটু একটু করে রান্নাটা শিখে নাও।

কেন মা? ঝট করে অনন্যা বলে ফেলে।

রান্নার জন্য লোক আছে ঠিকই কিন্তু একটু আধটু রান্না তো সকলেরই শিখে নেওয়া উচিত।

সে কাজ চালাবার মতো রান্না আমি করে নিতে পারব। ওটাতেই এখন কাজ চলবে। পরে কখনও শিখে নেব, বলেই অনন্যা শাশুড়ির গলা জড়িয়ে ধরে।

মা রান্নাঘরে ঢুকতে আমার একদম ভালো লাগে না। তুমি একবার হ্ঁযা বলো, এখুনি একজন ফুল টাইম রান্নার লোকের ব্যবস্থা করছি। তোমারও একটু বিশ্রাম হবে। আমি তো বলি তুমি সবসময়ে জন্য একটা লোক রেখেই নাও।

বাড়ির ভিতর সবসময় কাজের লোক ঘোরাফেরা করবে ভেবেই সুগন্ধা মনে মনে বিরক্ত হয়ে ওঠেন। তখনকার মতো অনন্যাকে চুপ করানোর জন্য বলেন, ঠিক আছে, যখন ইচ্ছে হবে শিখে নিও। এখন লোকের আমার কোনও প্রযোজন নেই। প্রমিলা সব কাজই তো করে দিচ্ছে।

অনন্যা আর সুগন্ধার কথোপকথন যখন হচ্ছিল তখন অনিরুদ্ধবাবু এবং অজয় দুজনেই সেখানে উপস্থিত ছিলেন। বাবা আর ছেলে, দুজনের কথা শুনে শুধু মুচকি মুচকি হেসেছিলেন।

আজ সুগন্ধা অনিরুদ্ধবাবুকে একা পেয়ে অনন্যার বিরুদ্ধে জমে থাকা রাগ উগরে দিলেন, নিজের চোখেই দেখছ বাড়ির কোনও কাজ করতে চায় না। যখনই কিছু শেখার কথা বলি অমনি গলা এমন ভাবে জড়িয়ে ধরে যে, রাগও করতে পারি না।

স্ত্রীয়ে নালিশ শুনে হেসে ফেলেন অনিরুদ্ধবাবু, তুমি কতটা শাশুড়ি হিসেবে রাগ দেখাতে পারো আমার খুব জানা আছে।

সন্ধেবেলায় উমাদিদি আসার আগেই অনিরুদ্ধবাবু অফিস থেকে বাড়ি ফিরে এলেন, যাতে সুগন্ধার মনে ক্ষোভ না তৈরি হয়।

চা-জলখাবার খেতে খেতে উমা অনন্যা সম্পর্কে নানা প্রশ্নের ঝাঁপি খুলে বসলেন। কেমন বউ হয়েছে? শ্বশুর-শাশুড়ির সেবা করে কিনা? অফিসে এতটা সময় কাটায়, তাহলে বাড়ির কাজ করে কখন? ইত্যাদি ইত্যাদি।

উত্তরটা অনিরুদ্ধবাবুই দিলেন, আমাদের সেবার কীসের দরকার! আমরা কি কেউ অসুস্থ? অনন্যা খুব ভালো মেয়ে দিদি। দাযিত্ব নিয়ে সব কাজ করে।

অনন্যার কথা ওঠাতে সুগন্ধার মুখের উপর কালো ছায়া ঘনিয়ে এল। উমার তীক্ষ্ণদৃষ্টি সবই নজর করল। মনে মনে আন্দাজ করে নিলেন উমা। অনিরুদ্ধর থেকে বেশ অনেকটাই বড়ো উমা। মা-বাবার মৃতু্যর পর ভাই-বোনের সম্পর্ক আরও অনেক বেশি মজবুত হয়েছে। সম্পর্কের মান দুজনেই রক্ষা করে চলেছেন।

বরাবরই খুব ধার্মিক প্রকৃতির ছিলেন উমা। এখন বয়ে হওয়ায় আরও বেশি পূজাপাঠ নিয়ে সারাদিন ব্যস্ত থাকেন। সেকেলে

আচার-বিচার মেনে চলেন। কোনও এক মহারাজ-এর কাছে দীক্ষিত। কাশীধামে থাকেন মহারাজ। দেশের যেখানেই মহারাজের প্রবচন থাকে, উমা ঠিক কিছু একটা করে

চার-পাঁচদিনের জন্য সেখানে পৌঁছে যান।

কলকাতার রাজারহাটে এবার মহারাজের শিবির অনুষ্ঠিত হয়। সেটার জন্যই উমার রাঁচি থেকে কলকাতায় আসা। ওঁরা বসে গল্প করতে করতেই অজয় আর অনন্যাও অফিস থেকে চলে এল। পিসিমার পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে অনন্যা নিজের ঘরে চলে এল ফ্রেশ হবে বলে। ডিনার টেবিলে একসঙ্গে বসে ডিনার করতে করতে সকলে আড্ডায় মেতে উঠল। অন্যান্য সময়ে মতো অনন্যাও ঠাট্টা-ইয়ার্কি করে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে লাগল। অনন্যার এই ব্যবহার উমার চোখে অতিরিক্ত স্পর্ধার বলেই মনে হতে লাগল।

এরপর শুরু হল নাগরিকতা বিল নিয়ে আলোচনা। অনন্যা তো সোজাসুজি জানিয়ে দিল এই বিল সে সমর্থন করে না। অথচ উমা নিজের বাড়িতে স্বামীকে এই বিলের সমর্থনে সবসময় কথা বলে আসতে শুনেছেন। অনন্যার কথাবার্তায় উমার খালি মনে হতে লাগল, অনন্যা একপ্রকার তার স্বামীকেই অপমান করছে। প্রচণ্ড রাগ হতে লাগল উমার। কিন্তু এ বিষয়ে তাঁর জ্ঞান স্বল্প হওয়াতে চুপ করে থাকাই শ্রেয় মনে করলেন।

অনন্যা অনিরুদ্ধবাবুর দিকে তাকিয়ে বলে চলছিল, বাবা আমাদের অফিসে আমার কিছু সহকর্মী এই বিলের বিরোধিতা করে একটা মিছিল বার করার প্ল্যান করছে। আমার এতে পুরো সমর্থন রয়েছে।

উমা আর সহ্য করতে পারছিলেন না। ইচ্ছে করে অনন্যাকে থামাবার জন্য বলে উঠলেন, আমি ভাবছিলাম এবার মহারাজের শিবিরে যাওয়ার সময় সুগন্ধাকে সঙ্গে করে নিয়ে যাব। ওখানে দুটো দিন থেকেও নেবে আর মহারাজের সঙ্গেও দেখা হয়ে যাবে। কী বউমা, তোমার শাশুড়ির অনুপস্থিতিতে ওই দুটো দিন সংসার সামলে নিতে পারবে তো?

কিন্তু পিসিমা, মা তো শিবিরে যাবেন না।

সুগন্ধা হতচকিত হয়ে পড়েন। এই বেহায়া মেয়েটা বলে কী? আমি কোথায় যাব আর কোথায় যাব না, সেটা ও ঠিক করবে? উমাও অনন্যার কথা শুনে যেন শক খেলেন। দুদিন হল বাড়িতে এসেছে, এর মধ্যেই ওনার মুখের উপর কথা বলার সাহস পাচ্ছে মেযো? একটু গম্ভীর হয়ে উমা বললেন, মহারাজের কাছে দু’দণ্ড বসে ওনার কথা যে-শোনে, তার জীবনে কোনও দুঃখ-কষ্ট থাকে না।

পিসিমার কথায় রসিকতা করার ইচ্ছেটাকে কিছুতেই দমাতে পারল না অনন্যা। মুখ ফসকে বেরিয়ে এল, সে কী পিসিমা, তাহলে আপনার মহারাজের জন্য দেখছি, ডাক্তারদের ক্লিনিকগুলো সব বন্ধ হয়ে যাবে! সাবধান হতে বলবেন মহারাজকে, নাসা থেকে ওনাকে তুলে নিয়ে না চলে যায়, হা হা হা বলে হাসিতে ফেটে পড়ে অনন্যা।

খুব গম্ভীর দেখায় উমাকে। বলেন, বউমা, আমার মনে হয় আধ্যাত্মিক বিষয়ে তোমার জ্ঞান খুবই সীমিত। সেজেগুজে অফিসে যাওয়া এক ব্যাপার আর আধ্যাত্মিক চেতনা অন্য জিনিস।

পিসিমার কঠোর স্বর শুনে অনন্যা ভিতরে ভিতরে একটু মুষড়ে পড়লেও, স্বভাবসুলভ কৌতুকের বশেই বলে ফেলল, পিসিমা সত্যিই আধ্যাত্মিক আলাপ-আলোচনায় আমার বিন্দুমাত্র ইন্টারেস্ট নেই।

অনন্যার থেকে দৃষ্টি সরিয়ে এবার উমা সুগন্ধাকে সরাসরি প্রশ্ন করলেন, তাহলে তুমি যাবে তো সুগন্ধা?

সুগন্ধার কাছে বাড়ির শান্তি সবচাইতে প্রিয়। কিন্তু ননদের মুখের উপর কিছু বলার সাহস কোনও দিনই তাঁর হয়নি। আমতা আমতা করে উত্তর দিলেন, আমি মনে হয় যেতে পারব না দিদি। বেশিক্ষণ বসে থাকতে খুব কষ্ট হয় আজকাল। পায়ে ব্যথাটা খুব বেড়েছে।

উমার মুখের উপর অসন্তোষের ছায়া এসে মিলিয়ে গেল। অজয়ও বলে উঠল, হ্যাঁ মা, তোমার তো ওখানে একেবারেই যাওয়া উচিত নয়। পিসি, তুমি বরং একাই ঘুরে এসো।

রাতে সবাই ঘরে শুতে চলে গেলে উমা, সুগন্ধার সঙ্গে সোফায় এসে বসলেন, সুগন্ধা তোমার ছেলের বউ তো দেখছি খুব স্মার্ট। ফটফট করে মুখের উপর কথা বলে।

সুগন্ধা কী বলবেন ভেবে পান না। চুপ করে থাকেন।

তোমাকে সাবধান করছি সুগন্ধা, ওকে এত বেশি বাড়তে দিও না। লাগাম নিজের হাতে রাখো।

হেসে ফেলেন সুগন্ধা। দিদি ও বাড়ির বউ। ঘোড়া হলে না হয় লাগাম কষে ধরতাম। সুগন্ধা বরাবরই শান্তিপ্রিয়। অশান্তি কোনও দিনই ওনার পছন্দ নয়।

সুগন্ধাকে চুপ থাকতে দেখে উমাই আবার মুখ খুললেন, এ যেরকম মেয়ে দেখলাম বাড়ির কাউকে ও পরোযা করে না বলেই মনে হয়। সবসময় সেজেগুজে, মেক-আপ করে রয়েছে। বড়োদের সামনে মুখ বন্ধ করে থাকার সভ্যতাটুকুও ওর জানা নেই। এইসব মেযো স্বামীকে ভালো মতন আঁচলে বেঁধে রাখতে জানে। দেখো তোমার সংসারে ভাঙন না ধরায়।

ছেলের বউকে কীভাবে রাখা উচিত, এ বিষয়ে জ্ঞানের ভাণ্ডার সুগন্ধার কাছে উজাড় করে দিয়ে উমা পরের দিন সকালে মহারাজের শিবিরে চলে গেলেন। ওখান থেকেই উমা নিজের বাড়ি চলে যাবেন এটাই প্রথম থেকে স্থির ছিল।

পিসিমা চলে যেতে অজয় অনন্যাকে বলল, তুমি তো পিসির সামনে প্রচুর কথা বলছিলে দেখলাম। এত কথা মা কোনও দিন বলতে সাহস করেননি।

মা যত ভালোমানুষ না অজয়, সেরকম ভালোমানুষ হয়ে আজকের দুনিয়ায় কোনও কাজ করা যায় না। মাঝেমধ্যে বলতেও হয়। শান্ত এবং গম্ভীর স্বরে কথাগুলো অনন্যা বলতেই, সুগন্ধা কিছুক্ষণ স্থির হয়ে দেখলেন অনন্যাকে। অফিসে যাওয়ার জন্য তৈরি অনন্যা। ওর চেহারায় সবসময় একটা তরতাজা ভাব, মুখে প্রশান্তি এবং যথেষ্ট সুন্দরী সে।

অপর্ণা, অজয়ে থেকে চার বছরের বড়ো। শ্বশুরবাড়ি বরোদায়। বছরে একবার আসে

মা-বাবার সঙ্গে দেখা করতে। সঙ্গে ছেলেকে আনে।

স্বামী সুজয় সবসময় আসতে পারে না। ভাই অজয়ে বিয়ে সময় মাত্র পাঁচদিনের জন্য আসতে পেরেছিল। তাই ছেলের স্কুলের ছুটি পড়তেই, এবার কুড়ি দিনের জন্য ছেলেকে নিয়ে অপর্ণা হাজির হল বাপের বাড়িতে। বাড়তি আগ্রহ, অনন্যার সঙ্গে জমিয়ে আলাপ করার। সুজয় আসতে পারেনি অফিসে জরুরি কাজ থাকার জন্য। এমনিতে অপর্ণা খুবই স্বামীর অনুগামী। কিন্তু একলা বাপের বাড়ি আসায় বেশ একটা মুক্তির আনন্দ উপভোগ করে।

অনন্যার সঙ্গে জমেও গেল খুব অপর্ণার। সুগন্ধা দেখে অবাক হয়ে গেলেন অপর্ণার সঙ্গে বেশি করে, সময় কাটাবার জন্য অনন্যা অফিস থেকে ছুটি নিয়ে নিল।

দুদিন যেতে না যেতেই অনন্যা একদিন অপর্ণাকে বলল, এ কী দিদি, আজকাল ম্যাচিং গয়না পরে সাজগোজ করে থাকার যুগ। আর তোমার গলায়, হাতে লাল-কালো সুতোয় খালি মাদুলি পরা! এসব কোথা থেকে জোগাড় করেছ?

অপর্ণা আমতা আমতা করে উত্তর দিল, আমার শাশুড়ি-মা সারাদিন মন্দির, দেবতা, বাবাজি, পুরোহিতদের নিয়ে থাকেন। বাড়িতে কিছু একটা হলেই, একটা মাদুলি নিয়ে পরের দিনই উপস্থিত হন। আমাকে এরকম দেখছ, তাহলে সুজয়কে দেখে কী বলবে? সারা শরীরে এই মাদুলি। এভাবেই ওকে অফিস করতে হয়। ওর অফিসে নিশ্চই ওকে নিয়ে ওর কলিগরা হাসাহাসি করে।

অনন্যা এবার জোরে হেসে উঠল, দিদি, সুজয়দার অফিসে যদি আমার মতো মেয়ে থাকে, তাহলে তো নিশ্চই সুজয়দাকে নিয়ে হাসবেই।

অনন্যার কথা বলার ভঙ্গিতে অপর্ণাও হেসে উঠল। অনন্যা এটা কিন্তু খুব খারাপ। নন্দাইকে নিয়ে এরকম রসিকতা তাও আবার ননদেরই সামনে!

সন্ধেবেলা শপিং-এ যাওয়ার কথা ছিল। অনন্যা জিজ্ঞেস করল, দিদি তুমি শাড়ি আর সু্য়ট ছাড়া আর কিছু পরো না? যেমন ধরো ওযে্টার্ন ড্রেস?

না, অনন্যা। আমার শাশুড়ির শাড়িই পছন্দ।

তুমি তো তোমার পছন্দের কথাও ওনাকে জানাতে পারো। এখন তো সবাই সবরকমের পোশাক পরছে।

অপর্ণাকে রাজি করানোর চেষ্টা করে অনন্যা।

বাইরের ঘরে বসে অপর্ণা এবং অনন্যার সব কথাই সুগন্ধা শুনতে পাচ্ছিলেন। মনে হচ্ছিল বেহায়া মেযোর এতদূর স্পর্ধা যে, নিজের নন্দাইকে নিয়ে হাসিঠাট্টা করতে একটুও আটকায় না। আবার ভিতরে ভিতরে খুশিও হচ্ছিলেন নিজের মেয়ে অপর্ণার প্রতি অনন্যার ভালোবাসা দেখে। মেয়ে আগেও যতবার এসেছে এতটা আনন্দে ওকে কখনও থাকতে দেখেননি সুগন্ধা।

অপর্ণা আসার চার-পাঁচদিন পরেই হঠাৎ সুগন্ধার ভাই ফোন করে জানাল, ওনার ছেলে রাতুল তার ফ্যামিলির সঙ্গে কলকাতা বেড়াতে আসছে। ফোন আসার পর থেকে সুগন্ধা কেমন জানি গম্ভীর হয়ে গেলেন। অনিরুদ্ধবাবু এবং অজয় যখন খবরটা শুনলেন তখন ওদের ভাবভঙ্গি স্বাভাবিক মনে হলেও অনন্যা, শাশুড়ি এবং ননদের মুখের উপর লক্ষ্য করে কালো মেঘের ঘনঘটা।

সারাদিনই অপর্ণা কারও সঙ্গেই বিশেষ কথাবার্তা না বলে নিজের ঘরেই বন্ধ থাকল। হাসিখুশি মেযো হঠাৎ করে কেমন চুপ হয়ে গেল। অপর্ণার ছেলে খুবই শান্ত, ও নিজের মতো অাঁকা, বই পড়া নিয়ে ব্যস্ত থাকে। মাকে বিরক্ত করার কথা ওর মনেও হয় না।

পরের দিন অনিরুদ্ধবাবু আর অজয় অফিস চলে গেলে, অনন্যা খেয়াল করল সুগন্ধার ঘরে অপর্ণা। নীচু স্বরে দুজনে কিছু কথা বলছে। অপর্ণার ছেলে বসে টিভি দেখছে। অনন্যা, শাশুড়ির ঘরের বন্ধ দরজার সামনে এসে দাঁড়াল। এতদিনে এই বাড়িটা, বাড়ির লোকজনগুলো বড়ো আপন হয়ে উঠেছে তার। ও জানতে চাইছিল, কেন ওদের দুজনের মুখে অমাবস্যার ছায়া পড়েছে, মামার ছেলে রাতুলের নাম শুনে।

অপর্ণার গলা শুনতে পেল, মা, আমি কালই বরোদায় ফিরে যাচ্ছি। টিকিটের ব্যবস্থা এখুনি অজয়কে বললেই করে দেবে।

না অপু, এত কষ্ট করে এই তো এলি, এরই মধ্যে…

মা আমি রাতুলের মুখও দেখতে চাই না।

কিন্তু রাতুল তো ফ্যামিলির সঙ্গে আসছে, তুই চিন্তা করিস না। ইগনোর করিস।

মা, তুমি সবসময় এই একই কথা বলো, ইগনোর কর। আমি কিছুতেই ওর মুখ দেখতে পারব না।

বাইরে দাঁড়িয়ে অনন্যা বুঝে ফেলে, কিছু একটা রহস্য আছে। সে দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকে আসে। অপর্ণাকে বলে, দিদি তুমি কেন এখান থেকে যাবে? এটা তোমার বাপের বাড়ি, মানে তোমারও নিজের বাড়ি। তোমরা আমার আপন। তোমার কষ্ট মানে আমারও কষ্ট। আমাকে আপন ভেবে নিজের কষ্টের কথা আমার সঙ্গে শেয়ার করতে পারবে না?

অপর্ণা জড়িয়ে ধরে অনন্যাকে, নিশ্চই শেয়ার করব। এতদিনে তুইও আমার বড়ো আপন হয়ে উঠেছিস। রাতুল আমার মামার ছেলে। অত্যন্ত অভদ্র, রুঢ় এবং চরিত্রহীন। আমার বিয়ে কিছুদিন আগে এখানে এসেছিল এবং আমাকে একদিন একা পেয়ে আমার শ্লীলতাহানি করার চেষ্টা করে। আমি চ্ঁযাচাতে এবং থাপ্পড় মারাতে আমাকে ছেড়ে দেয়। অথচ ওকে কিছু বলার বদলে মা আমাকেই চুপ থাকতে বলে, ইগনোর করতে বলে। আমার বিয়েে আসেনি। এতদিন পর যখন আসছে, আমি ওর মুখও দেখতে চাই না।

অনন্যা ননদের হাত চেপে ধরে, তোমাকে ওর মুখ দেখতে হবে না দিদি।

কিন্তু ও তো আসছে!

সুগন্ধা চুপ করে ছিলেন। অনন্যা বলে, মা তুমি শুধু নও, অনেক মা-ই এমন করেন। মেয়েেই চুপ করিয়ে দেন। কিন্তু বাড়ির সাপোর্ট না পেলে এই ক্ষত আরও গভীর হয়ে ওঠে মেয়েের মনে। সেদিন দিদির কাছে শোনার পর, রাতুলের গালে চারটে থাপ্পড় মেরে ওকে বাড়ি থেকে বার করে দেওয়া উচিত ছিল তোমার। তাহলে দিদিকে আজ চলে যাওয়ার কথা বলতে হতো না। যাই হোক, যা হওয়ার ছিল হয়েছে। দিদি তুমি একদম চিন্তা কোরো না। এছাড়াও দেখছি, যে যখন খুশি কলকাতায় মানে এখানে চলে আসছে। ফলে মা-কে একগাদা কাজ করতে হয়। মা মুখে কিছু বলেন না কিন্তু খুব ক্লান্ত হয়ে পড়েন। আমিও অফিসে থাকি। ইচ্ছে করলেও কোনও সাহায্য করতে পারি না। দিদিকে তো আমি কোনও ভাবেই কষ্টে থাকতে দেব না। বলেই অনন্যা তত্ক্ষণাৎ অজয়কে ফোন করল।

অজয়, প্লিজ একটা কাজ করতে হবে। মামাকে ফোন করে বলো, যে-হঠাৎই আমরা বাইরে বেড়াতে যাচ্ছি। মা কিছু জানত না। তুমি সারপ্রাইজ দেবে বলে আগে থেকে টিকিট কেটে, কাউকে জানাওনি।

অজয়ে উত্তর কেউ শুনতে না পেলেও অনন্যার মুখ হাসিতে ভরে গেল। কপট রাগ দেখিয়ে বলল, আচ্ছা ঠিক আছে, এখুনি ফোনটা করো। বলে ফোন কেটে দিল।

অপর্ণার মুখের উপর থেকে চিন্তার ছায়া কেটে গিয়ে হাসিতে মুখ ঝলমল করে উঠল। সুগন্ধার মুখে হাসি ফুটতেই অনন্যা সুগন্ধার কোলে মাথা রেখে বিছানায় গা এলিয়ে দিল। হাসতে হাসতেই বলল, মা, এইসব করতে হয়। ভালোমানুষ হয়ে কাজ চলবে না। আমার মতো স্পষ্টবক্তা এখনকার দিনে দরকার। অজয় তোমার ভালোমানুষির অনেক গল্প শুনিয়েছে। কিন্তু আর তোমাকে চিন্তা করতে হবে না। এখন আমি এসে গেছি।

এমন ভাবে কথাগুলো বলল অনন্যা, সুগন্ধা আর অপর্ণা জোরে হেসে উঠলেন।

সুগন্ধা অনন্যার চুলে বিলি কাটতেই ঝট করে অনন্যা উঠে বসল, আমার চুলে এখন হাত দেওয়া যাবে না মা, সবে স্ট্রেটনিং করিয়েছি।

সুগন্ধা হেসে হাত সরিয়ে নিলেন। সঙ্গে সঙ্গে সুগন্ধার ফোনটা বেজে উঠল। তাকিয়ে দেখলেন উমার ফোন। ফোনটা নিয়ে ঘরের বাইরে বেরিয়ে এলেন।

উমা মহারাজের সম্পর্কে দু-চার কথা বলেই অনন্যার প্রসঙ্গে চলে এলেন, কী সুগন্ধা তোমার বেহায়া বউটার কী খবর?

দিদি, ওই বেহায়া বউটাই আমার মনের পুরো জায়গাটা জুড়ে বসে গেছে। আরও অন্য কিছু কথা বলে সুগন্ধা ফোন রেখে আবার ঘরে এসে ঢুকলেন। বুঝতে পারলেন তাঁর কথায় উমাদি যথেষ্ট আশ্চর‌্য হয়েছেন।

ঘরে আসতেই অনন্যা জিজ্ঞেস করল, পিসি কী বললেন?

কিছু না। ওই আমরা সবাই কেমন আছি।

কেন মা, জিজ্ঞেস করলেন না, বেহায়া মেযো নতুন কী খেল দেখাচ্ছে?

সুগন্ধা শক খেলেন, মুখ ফ্যাকাশে হয়ে উঠল। আমতা আমতা করে জিজ্ঞেস করলেন, হঠাৎ একথা বলছ কেন?

হেসে গড়িয়ে পড়ল অনন্যা। মা চিন্তা কোরো না। আমার খুব ভালো লেগেছে এই নামটা। আজকে দিদি আর তোমার কথা যেমন কানে এসেছিল, সেরকমই ওইদিনও পিসিমা আর তোমার কথাগুলো কানে গিয়েছিল। তোমাকে বললাম না, ভালোমানুষির যুগ শেষ। এখন চোখ-কান খোলা রেখে চলতে হয়। কিন্তু এটা সত্যি আমি তোমাদের সবাইকে খুব ভালোবাসি। বলে সুগন্ধার গলা জড়িয়ে ধরল অনন্যা।

অপর্ণা লক্ষ্য করছিল। হেসে বলল, মা, এটা কী হচ্ছে?

সরি সরি রে বাবা, বলে সুগন্ধা নাটকীয় ভঙ্গিতে নিজের কান ধরতেই তিনজনে একসঙ্গে হেসে উঠল। অনন্যা মিছিমিছি কলার তোলার ভান করে বলল, দেখলে তো, এই বেহায়া মেযে শাশুড়িকেও কান ধরিয়ে ছাড়ল।

তিনজনেরই মিষ্টি হাসিতে ঘরের ভিতরটা আনন্দে ভরে উঠল।

সংঘাত

সুখে থাকতে গেলে একজন মানুষের কোন কোন জিনিসের প্রয়োজন হয়? মানুষের উপর বিশ্বাসের? সম্পর্কের উপর আস্থার? সহানুভূতির? নাকি, অনেক অর্থ উপার্জনের ক্ষমতার উপরই নির্ভর করে সুখ, যেরকম বলে থাকেন অনেকে। জীবনের নিরাপত্তা, স্বাধীনভাবে বাঁচার রসদ, গলা ফাটিয়ে নিজের অধিকার ঘোষণা করার অধিকার– সুখে থাকার জন্য এইরকম কত বিষয়েরই না দরকার পড়ে!

কিন্তু সবসময় কি এই সবকিছু খুব সহজে মেলে? সহজে পাওয়ার রাস্তায় কত না বাধা। মানুষের রিপু বড়ো পরশ্রীকাতর। সে বড়ো হিংসুক। বড়ো লালসা তার! চুরি, ডাকাতি, রাহাজানি, প্রতারণা, দাঙ্গা, বিশ্বাসঘাতকতা, ছল– ইত্যাকার হাজাররকম প্রকাশ সেই লালসার। এই কি তবে মানুষের নসিব? মানুষ একটু সুখে থাকবে, তাতে আর একজন মানুষের খুব কি কিছু আসে-যায়, যদি না সেই সুখ অন্য কারও বঞ্চনার মাধ্যমে এসে না থাকে? যুক্তি বলে, যায় না। বুদ্ধি বলে, অবশ্যই যায়।

তাড়াহুড়ো করে স্টেশনের দিকে যেতে গিয়ে এই সব কথাই মনে মনে ভাবছিল সুজাতা। রোজ সকালে ঠিক এভাবেই অত্যন্ত ব্যস্ত পা ফেলে তাকে স্টেশনে আসতে হয়। অফিসযাত্রীদের ভিড়টা এসময়েই সবচেয়ে বেশি থাকে। পা মাড়িয়ে, কনুই দিয়ে সহযাত্রীকে ঠেলে ফেলে দিয়ে মানুষের চলমান শরীরগুলো উন্মত্তের মতো প্ল্যাটফর্মের দিকে ছুটে যাচ্ছে। কারওর অন্য কোনও দিকে হুঁশ নেই। মানুষ কি ধীরে ধীরে উন্মাদ বা পাশবিক হয়ে যাচ্ছে? কে জানে!

পিছন থেকে এসে একটা লোক সুজাতার পা মাড়িয়ে চলে যেতেই সে চাপা গুঙিয়ে উঠল। লোকটি বোধহয় একটু ভদ্রগোছের। সুজাতার গোঙানি শুনে অন্তত পিছন ফিরে তাকিয়ে বলে গেল, ‘দুঃখিত’! হায়, দুঃখ প্রকাশে যদি শরীরের ব্যথা কিছুমাত্রাতেও কমত! যদিও ব্যথার দিকে পিছু ফিরে তাকানোর সময় সুজাতারও নেই। ভোরে বাড়িতে একটা ব্যাচ পড়তে আসে। তাদের পড়িয়ে উঠতে বেলা চড়ে যায়। অন্যান্য দিন যদিও সে কিছুটা সমবেদনামূলক ছাড় পায়, কিন্তু সেটি হওয়ার জো নেই আজ। স্কুলপরিদর্শনে সরকারের অফিসারেরা আসছেন। ছাত্রছাত্রীদের কালকেই সে পইপই করে বলে দিয়েছিল যাতে আজ কেউ কামাই না করে। সরকারি বাবুরা যদি দেখেন স্কুলে পড়াশুনা ভালো হচ্ছে, ছেলেমেয়েদর মধ্যে পড়ার এবং বাবা-মায়েদের মধ্যে তাদের স্কুলে পাঠানোর ইচ্ছা রয়েছে, তাহলে স্কুলের জন্য বাড়তি কিছু অনুদান চাইবার মুখটা থাকে।

কিন্তু এত সহজে সে নিশ্চিন্ত হতে পারছে না কিছুতেই। শেষমুহূর্তে ছেলেমেয়েগুলো যেন না ডোবায়।

মালতীপুর উচ্চ বিদ্যালয়ে ভূগোলের দিদিমণি সুজাতা। মালতীপুর জায়গাটা খুব বড়ো হয়তো নয়, তবে বেশ বর্ধিষ্ণু গ্রাম। এ অঞ্চলে ধান খুব ভালো হয়। ট্রেন থেকে নেমে ভ্যান রিকশায় চেপে সুজাতা যখন স্কুলের দিকে যায়, রাস্তার দুধারে হলুদ হয়ে যাওয়া ধানগাছগুলি হাওয়ায় মাথা দোলাতে থাকে। মাটিতে বীজ পোঁতা থেকে, কচি সবুজ ধানগাছগুলির বেড়ে ওঠা, তারপরে সেগুলির সোনালি হতে থাকার প্রতিটি দৃশ্য এখন তার চেনা। কিন্তু ওই পর্যন্তই! এত বর্ধিষ্ণু গ্রামেও বিকাশের লক্ষণগুলি তেমন স্পষ্ট নয়। টিউবওয়েলে ঠিকমতো জল ওঠে না, মানুষের মধ্যে স্বাস্থ্য এবং শিক্ষা সম্পর্কে সচেতনতা নামমাত্র। কে বলবে, এখানেও বছর-বছর ভোটের হাওয়া বয়। নেতাদের গরম বক্তৃতায় তেতে ওঠে সমাজজীবন। ভোট হয়ে যায়। উন্নয়নও ঝিমিয়ে পড়ে। জীবন চলতে থাকে সেই একইরকম শম্বুকগতিতে। তাই এখানে চাকরি করতে আসার ইচ্ছে থাকে না সরকারি কর্মচারীদের মধ্যেও। সুজাতাই কি পোস্টিংটা পেয়ে খুব খুশি হতে পেরেছিল?

তার অবশ্য অন্য সমস্যাও কিছু ছিল। তবে সবকিছুর উপরে, এখানে বদলি হয়ে আসতেও তার মন চায়নি। শহর থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে, কোনওরকম সামাজিক সুযোগসুবিধাহীন জায়গায় পঙ্গু হয়ে থাকার চেয়ে কষ্টকর আর কী হতে পারে?

তার উপর রাতুল এখনও যথেষ্ট ছোটো। শ্বশুর-শাশুড়িও বৃদ্ধ হয়েছেন। তবু যদি মনোময় কলকাতায় চাকরি করত, একটা কথা ছিল। তাকেও তো বর্ধমানের এক প্রত্যন্ত গ্রামে বদলি করে দিয়েছে।

সুজাতা তাই বাস্তবিক খুবই আতান্তরে পড়ছিল। অনুরোধে যদি কিছু হয়, সেই ভেবে সত্যপ্রিয় মজুমদারের কাছে পৗঁছেও গিয়েছিল একদিন। টাকমাথা, মধ্যবয়সি ভদ্রলোক। সারাদিন পান চিবোচ্ছেন। দেখলেই মনে হয় ধুরন্ধর, ভোগী মানুষ। সব শুনে বাঁকা হেসে বললেন, ‘মিসেস মিত্র, আপনি কি মনে করেন অসুবিধা আপনার একার? কিন্তু তাই বলে, লোকে শহর ছেড়ে নড়বে না, এরকম হলে গ্রামাঞ্চলের শিক্ষাদীক্ষার হালটা কী দাঁড়াবে ভাবতে পারছেন?’

সুজাতা এরপরও তার নাচার অবস্থাটা আর একটু বিস্তারিত ভাবে ব্যাখ্যা করতে গেছিল। সত্যপ্রিয়বাবু থামিয়ে দিয়ে বলে উঠলেন, ‘কত্তা তো ভালো পোস্টেই আছেন, তাই তো? তা আপনার আর টাকাপয়সার কী দরকার? অসুবিধা হলে ছেড়ে দিন না। আমরাও তো সেটাই চাই। আপনার পুরোনো লোকেরা সব বাস্তুঘুঘু হয়ে গেছেন। চাকরির বাজারের যা অবস্থা তাতে নতুন টিচার অনেক কম মাইনেয় পাওয়া যাবে।’

জিভটা মুহূর্তে তেতো হয়ে গিয়েছিল লোকটার চাঁচাছোলা বক্তব্য শুনে। কথা না বাড়িয়ে নিঃশব্দে সত্যপ্রিয়র চেম্বারের বাইরে বেরিয়ে এল সুজাতা। সত্যিই তো, প্যানেলে এখনও শতসহস্র যুবক-যুবতি অপেক্ষা করছে চাকরি পাওয়ার জন্য। একটা জায়গা খালি হওয়ার খবর পেলেই তদ্বিরের ধুম পড়ে যায় বলে শোনা যায়। যার যেখানে যত প্রভাবশালী খুঁটি আছে, তাদের ব্যবহার করার মরিয়া প্রচেষ্টা শুরু হয়ে যায়। কপালের শিকে তো এক-আধজনেরই ছেঁড়ে। আর সত্যপ্রিয় মজুমদারের মতো লোকেরা দিব্যি মাতব্বরি করার সুযোগ পেয়ে যান।

তাকে ম্লানমুখে চেম্বারের বাইরে বের হতে দেখে রামকুমার দাঁড়িয়ে পড়ে। বগলে একগাদা ফাইলপত্র নিয়ে সে কোথাও যাচ্ছিল। সুজাতাকে দেখে গলায় খানিকটা শ্লেষ এনে কথা শুরু করে।

‘কী? হল না বুঝি?’– মুখে একফালি হাসি ঝুলিয়ে রাখল রামকুমার, যেন কিছুই হয়নি, এমনভাবে।

ম্লান হাসল সুজাতা, যার মানে, না।

রামকুমার বলল, ‘আপনাদের কিছু হবেও না। কেন হবে? এত বছর ধরে চাকরি করছেন, এখনও সরকারি কর্তারা কীসে তুষ্ট সেটা ধরতে পারলেন না?’

রামকুমার খুব অর্থবহ দৃষ্টিতে সুজাতার দিকে চেয়ে রইল। তার মনে পড়ে গেল সহকর্মী তপতীর কথা। সাধারণ গ্রামীণ পরিবারের মেয়ে তপতী। কিন্তু মেয়েটির বাস্তববোধ দেখার মতো। সুজাতাদের বয়সি হলেও তপতী তাদের থেকে বেশ খানিকটা পরিণত। বছরকয়েক শহরের জল পেটে পড়তেই, তপতী গ্রাম ছেড়ে এসে এখানেই একটা ছোটোখাটো ফ্ল্যাট কিনে জমিয়ে বসল। বিয়ে-থা করেনি। গ্রাম থেকে বাবা-মাকে নিয়ে এল।

সেই তপতীর আবার গ্রামে পোস্টিং হতে সে বেঁকে বসল। সুজাতাদের কাছে বলল, ‘এই অর্ডার আমি পালটে তবে ছাড়ব।’ বাস্তবে ঘটলও তাই। তপতীর বদলে অন্য কোন শিক্ষকের ঘাড়ে বদলির কোপটা পড়ল, তা অবশ্য সুজাতা জনে না। তপতী হাসতে হাসতে বলেছিল, ‘জানতে হবে, কোন পুরুষের কী চাহিদা! লোকটা বোকা ছিল বুঝলি! খুব বেশি আপস করতে হল না। বাঁ হাতের মুঠোয় আদর করে কিছু ছাপানো কাগজ গুঁজে দিতেই গলে গেল!’

আড়ালে ডেকে নিয়ে গিয়ে তপতী বলল, ‘তুই চাইলে লোকটার সঙ্গে আমি একবার কথা বলে দেখতে পারি। খুব বেশি কম্প্রোমাইজ না করে যদি হয়ে যায় ক্ষতি কী? আর একটু-আধটু কম্প্রোমাইজ করলেই বা কী এমন মহাভারত অশুদ্ধ হয় বল তো? পৃথিবীর প্রত্যেককে আপস করেই বেঁচে থাকতে হচ্ছে. কেউ কম করছে, কেউ বেশি। এত সতীপনা করলে নিজেকেই ভুগতে হবে আজীবন!’

তপতীর চাপা গলায় বলা কথাগুলো কানে যেন গরম সিসের মতেই ঢুকল সুজাতার। সে মরে গেলেও পারবে না তপতীর মতো করে ভাবতে। কঠিন গলায় বলল, ‘না, তার দরকার হবে না!’ তক্ষুনি তার চোখের সামনে মনোময়ের সহজ ঋজু চাহনিটা ভেসে উঠেছিল।

আজকাল পনেরো দিনে একবার বাড়িতে আসার সুযোগ পায় মনোময়। আর তাই নিয়ে তার খেদের অন্ত নেই। যে দু-একদিন বাড়িতে থাকে মনোময়, সুজাতার ইচ্ছে করে না তাকে ছেড়ে দূরে যেতে। এটা শুধু প্রেমের জন্য নয়। নির্ভরতার জন্য, বলা যেতে পারে। মনোময় একটা ভাড়াবাড়িতে থাকে। সকাল-সন্ধে কাজের মাসি এসে তার জন্য রান্না করে চাপাঢাকা দিয়ে রেখে চলে যায়। অধিকাংশ দিন সেই ঠান্ডা খাবারই গিলতে হয় তাকে। সুজাতার বুকটা ভেঙে যায় এসব কথা শুনে। মনোময় বোঝে। তাই আজকাল ক্লিষ্ট হাসি ঠোঁটে টেনে এনে বলে, সে ভালো আছে।

সুজাতা এখন দিব্যি বোঝে, সেই ভালো থাকার মানে কী! সকালের ভিড়ে ঠাসা লোকাল ট্রেনে ঘণ্টাদেড়েক যাত্রার পর, কম করে দু-কিলোমিটার হাঁটা। তবে পৌঁছোনো যায় স্কুলে। সেদিন অংকের বিনোদবাবু বলছিলেন, ‘আপনি একটা সাইকেল কিনে নিন মিসেস মিত্র। এখানে একটু খোঁজখবর নিলে পুরোনোও পেয়ে যেতে পারেন। স্টেশন থেকে স্কুলে আসবেন, আবার ফেরার সময় স্টেশনে রেখে বাড়ি চলে যাবেন।’

সুজাতাও দেখেছে, গ্রামের রাস্তায় মেয়েরা এখানে সাইকেলে যাতায়াত করে। কিন্তু সুজাতার বড়ো সংকোচ হয়।

ইংরেজির বিনতা মিস বলেছিলেন, ‘একটা কথা তোকে বলে রাখি সুজাতা। আমাদের গ্রামটা আর আগের মতো নেই বুঝলি? পাশের গ্রামে পলিটিক্যাল মারামারি নিত্যদিনের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রায়ই খুনজখম হয় বলে শুনি। তার ছোঁয়াচ এ গ্রামেও লাগছে। কাজেই সাবধানে রাস্তা চলবি । তুই নতুন লোক। কখনও রাত করে ফিরবি না।’

বিনোদবাবু বললেন, ‘শুধু পলিটিক্যাল বলছেন কেন? আমাদের স্কুলের কতগুলো মেয়ে গত দু-তিন বছরে উধাও হয়ে গেছে কেউ খোঁজ রেখেছে? সব নারীপাচারের ব্যাপার, বুঝলেন মিসেস মিত্র! কেউ দেখার নেই!’

বিনোদবাবু খেদের সঙ্গে জিভে শব্দ করলেন। ভয়ে শিউরে উঠছিল সুজাতা। সব শুনে মনোময়ও কম উদ্বিগ্ন হল না। বলল, ‘তোমার ছুটিছাটা জমা নেই? কোনওমতে ওসব নিয়ে এ বছরটা কাটিয়ে দাও সুজাতা। সামনের বছর দেখি, কাউকে ধরেকরে কিছু করা যায় কিনা!’

বিছানায় শুয়ে থাকা মনোময়ের শরীরের উপর নিজেকে হিঁচড়ে তুলে এনে সুজাতা বলল, ‘আর ততদিনে আমার যদি একটা কিছু হয়ে যায়? তুমি এত দূরে থাকো, তুমি তো খবরও পাবে না! আমার খুব ভয় করে।’

মনোময় বলল, ‘ভয়ের কী? তুমি একা অত দূরে চাকরি করতে যাও? আরও অনেকে ওই স্টেশনে বা কাছাকাছি স্টেশনে নামে। তাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করে নেবে। তোমরা দল বেঁধে যাওয়া-আসা কোরো। দেখবে কোনও বিপদ থাকবে না।’

মুখে এ কথা বলে সুজাতার মনে সাহস জোগাবার চেষ্টা করলেও মনোময়ের গলায় যেন জোর নেই। সুজাতাও হয়তো সেটা বুঝতে পারল। কিন্তু কিছুই করার নেই, মনে করে চুপ করে রইল দুজনেই।

দুপাশে বিস্তীর্ণ ধানখেতকে সাক্ষী রেখে ট্রেনটা ছুটছে। সুজাতাদের স্কুলের হেডমাস্টার অভ্রনীল দত্ত, বিপ্লবী মানুষ। একসময় নাকি প্রত্যক্ষভাবে রাজনীতি করতেন। কিন্তু রাজনীতির ক্লেদটা নিজের চোখের সামনে দেখার পরেই এক মুহূর্ত আর থাকেননি তার মধ্যে। ইদানীং বেশ হালছাড়া হতাশ গলাতেই কথাবার্তা বলে থাকেন। একদিন স্টাফরুমে সুজাতাকে ঝুঁকির কথা বলতে শুনে, নিজেই এগিয়ে এসে বললেন, ‘খুব বেশি ভেবো না এসব নিয়ে সুজাতা। পৃথিবীটা এরকম-ই। এভাবেই চলবে। তুমি আর আমি কিছু ভাবলেই যে সেটা হয়ে যাবে, এমন নয়। আমি জীবন দিয়ে বুঝেছি, আমার কিংবা তোমার মতে কিছুই হওয়ার নয়।’

তারপর থেকে প্রবীণ এই শিক্ষকের সঙ্গে বেশ বন্ধুত্বই হয়ে গেল সুজাতার।

মানুষের সত্ত্বা সবসময়ই দ্বৈত। যে-অভ্রনীল অন্য সময় সুজাতাকে স্ত্বান্না দেন, সেই তিনিই কোনও কোনওদিন চরম বিরক্তিতে বলে ওঠেন, ‘ভেবে দ্যাখো একবার, সরকারি যোজনাগুলিকে গ্রামীণ জনতার কাছে পৗঁছে দেবে কে? না আমরা। পোলিয়ো ড্রপস খাওয়ানোর প্রচার কে করবে? আমরাই। ছেলেমেয়েদের স্কুলে পাঠানোর জন্য অভিভাবকদের বোঝাবে, গ্রামীণ মানুষের মনে গণতান্ত্রিক চেতনার জাগরণ ঘটাবে, সাক্ষরতা অভিযান চালাবে, বিনে পয়সার বই বন্টন করবে, বাচ্চারা স্কুলে না এলে বাড়ি থেকে টেনে আনবে, সরকারি কর্তারা এলে জলপানির ব্যবস্থা করবে কে? কেন, আমরা!’

হেডমাস্টারমশাইয়ের কথাটা যে কত দূর সত্যি, তা আজ হাড়ে-হাড়ে টের পেল সুজাতা। দশটা বাজতে না বাজতে স্কুলের সামনে এসে হাজির হয়েছে ধুলোমাখা দুটো গাড়ি। ঝটপট দরজা খুলে চার-পাঁচজন মানুষ নেমে এলেন। ততক্ষণে তাদের দেখতে গ্রামের কৗতূহলী মানুষজন ভিড় করেছে। আজ স্কুলে অ্যাটেনডেন্স একশো শতাংশ। এর পুরো কৃতিত্বটাই অবশ্য স্কুলের অশিক্ষক কর্মীদের। অভ্রনীলের একটা বড়ো চিন্তা তাতে দূর হয়েছে। হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছে সুজাতারাও।

সরকারি প্রতিনিধি দলের নেতার নাম জয়ন্ত গুহ। ক্লাসগুলো খুব কম সময়ে পরিদর্শন করে ফিরে এলেন স্টাফরুমে। সমস্ত শিক্ষক-শিক্ষিকা এবং হেডমাস্টারমশাইয়ের সঙ্গে খোলামেলা আলোচনায় বসলেন সরকারি প্রতিনিধিরা। তাদের ফেরার তাড়া আছে। ফলে একটা মুহূর্তও নষ্ট করতে তারা রাজি নন।

জয়ন্ত গুহ গম্ভীর চোখে হেডমাস্টারমশাইয়ের দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, ‘বলুন, আপনাদের কথাও শুনি–!’

খুকখুক করে একটু কেশে নিলেন অভ্রনীল। তারপর বললেন, ‘আমাদের স্কুলবাড়িটার অবস্থাটা তো নিজের চোখেই দেখলেন স্যার। আমাদের এ গ্রামের পঞ্চায়েত প্রধানকে অনেকবার বলেছি। কাজ হয়নি। আরও অনেক সমস্যা রয়ে গেছে। যেমন ধরুন, স্কুলে যে-টিউবওয়েলটা আছে, তাতে জল ওঠে না ঠিকমতো। বাচ্চারা জল খেতে পারছে না। স্কুলের মূল দরজাটা চুরি হয়ে গেছে। সকালবেলা এসে আমরা দেখতে পাই অবলা জীবের বিষ্ঠায় ভরে আছে ক্লাসঘর। পরিষ্কার না করলে ভদ্রভাবে বসা পর্যন্ত যাবে না। কে পরিষ্কার করবে? এখানে তো  কোনও সাফাইকর্মীও নেই!’

অভ্রনীল হাঁফিয়ে উঠলেন সমস্যার ফিরিস্তি দিতে গিয়ে। জয়ন্ত গুহরা নিশ্চয়ই সব জায়গাতে গিয়েই এমন ফিরিস্তি শুনতে অভ্যস্ত। তাই, তার মুখেচোখে কোনও ভাবান্তর ধরা পড়ল না। কেবল বললেন, ‘সমস্যা কোথায় নেই অভ্রনীলবাবু? এই তো, আমরা শহর থেকে আসছিলাম। আসার পথে গাড়ির টায়ার গেল ফেটে। এটা সমস্যা নয়?’

জয়ন্ত গুহের রসিকতায় তার সাঙ্গোপাঙ্গোরা হেসে উঠলেন।

জয়ন্ত তাদের থামিয়ে বললেন, ‘যাক সে কথা। ঘটনা হচ্ছে, অভ্রনীলবাবু, আমি আপনাদের কোনও মিথ্যে প্রতিশ্রুতি দিতে আসিনি। স্কুলের ডেভেলপমেন্টের জন্য পঞ্চায়েতের কাছে সরকারি টাকাপয়সা আছে। এত দূর থেকে আমরা তো আর সবটা দেখে উঠতে পারি না! আপনাকেই প্রধানের সঙ্গে বসে সমস্যাগুলো মিটিয়ে নিতে হবে। তবে একটা কথা, মিড-ডে মিলের ব্যাপারে সরকার কিন্তু এখন খুবই কড়া। এ বিষয়ে কোনও অভিযোগ পেলে সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। কাজেই ওই প্রকল্পটা যাতে ঠিকভাবে চলে সেটা দেখবেন।

‘মিড-ডে-মিল?’ অভ্রনীল আঁতকে ওঠেন, ‘সত্যি বলতে কী জয়ন্তবাবু, সপ্তাহে তিনদিনের বেশি স্কুলের ছেলেমেয়েদের জন্য রান্না হয় না। বাসনপত্র নেই। জ্বালানি কেনার টাকা পাওয়া যায় না। আপনারা কেবল আমাদেরই দোষ দেখেন!’

অভ্রনীল রেগে উঠতে গিয়েও উলটোদিকে বসে থাকা সুজাতার ভয়ার্ত মুখচোখ দেখে চুপ করে যান। সরকারি লোকেদের কাছে কোন বিষয়গুলি তুলে ধরা হবে, এ নিয়ে শিক্ষকদের মিটিংয়ে মিড-ডে মিলের বিষয়ে প্রবলভাবে সরব হয়েছিলেন অভ্রনীল। তার বক্তব্য ছিল, একটা এসপার-ওসপার হয়ে যাক এইবার। রাজনৈতিক টানাপোড়েনে বাচ্চারা মিড-ডে মিলের মতো সরকারি প্রকল্প থেক বঞ্চিত হবে, আর সব দোষটা এসে পড়বে শিক্ষকদের উপর– এটা চলতে পারে না।

তখনই অজানা আতঙ্কে শিরদাঁড়া বেয়ে শীতল স্রোত নেমে গিয়েছিল সুজাতার। মরিয়া প্রতিবাদ জানিয়ে বলেছিল, ‘এমন চরম মনোভাব নেওয়া ঠিক হবে না স্যার। আপনি মোটরসাইকেলে গ্রামের মধ্য দিয়ে স্কুলে আসা-যাওয়া করেন। কেউ যদি আপনাকে একা পেয়ে অপহরণ করে, তাহলে? আপনি আছেন বলেই আমরা জোর পাই।’

‘তা বলে কি চুপ করে থাকব দিনের পর দিন?’ অভ্রনীল রেগে গিয়েছিলেন সেদিনও। তারপর নিজেকে সামলে, শান্ত গলায় বললেন, ‘মনে রেখো, এটা আমার গ্রাম। আমার মাতৃভূমি। আমার কিছু অধিকার আছে। পাঁচটা মানুষ আমায় সম্মান করে। সবকিছু এত সহজ হবে না।’

ভূগোলের দিদিমণি চিত্রা সমর্থন করেছিল সুজাতাকে। বলল, ‘আমার মনে হয় সুজাতা ঠিক কথাই বলেছে স্যার। আপনি না হয় এখানকার ভূমিপুত্র। আমরা তো তা নই। সকালবেলা সংসার গুছিয়ে রেখে শহর থেকে এখানে আসি চাকরি করতে। কাজেই, আমার মনে হয় কৗশল নিয়ে চলাই সমীচীন হবে।’

অভ্রনীল খানিকটা থমকে গেলেন শিক্ষিকাদের প্রত্যুত্তরে। শেষে নীরবতা ভেঙে বলে উঠলেন, ‘কৗশল কাকে বলে, আপনারাই বলে দিন আমায়। প্রধানের কাছে মিড-ডে মিলের টাকাপয়সা ও অন্যান্য সামগ্রী আসে। সেগুলো ঠিকমতো দেওয়া হয় না। আংশিক দেওয়া হয়। হেডমাস্টারের আলাদা ঘর আছে। কিন্তু প্রথমত সেটি জরাজীর্ণ, বসার অযোগ্য, উপরন্তু পঞ্চায়েত মেম্বারের বাড়ির পশুখাদ্য সব ওখানেই থাকে, আপনারা জানেন। স্কুলবাড়িটা ভেঙে পড়ছে, কারওর নজর আছে সেদিকে? সরকারি লোকজন তো দেখেশুনে আমাদেরই দোষ দেবেন। বলবেন, আপনারাই ঠিকভাবে যত্ন নেননি। শাস্তিও দিতে পারেন তারা। তখন কোন কৌশলটা কাজে লাগবে বলুন তো!’

সুজাতা আর কোনও কথা বলেনি। চিত্রাও চুপ করেই ছিল। কারণ ওরা সকলেই জানত, অভ্রনীল যতই গলা ফাটান, সে কেবল অরণ্যেরোদন ছাড়া অন্য কিছু হবে না। এই গ্রামে প্রধানের প্রতিপত্তি সীমাহীন। সামনে অবশ্যই একটা ভদ্রতার আড়াল আছে। কিন্তু বাস্তবে যে তার ভয়ংকর লোকলস্করের সঙ্গে ওঠাবসা, এ কথাও গ্রামে সকলে জানে। তাই কেউ মুখ খোলে না। কে জানে, কোন কথায় আবার কোন সংঘাতের আগুন জ্বলে ওঠে!

অভ্রনীলের অভিযোগ লোকটি নতমস্তকে শুনে প্রতিশ্রুতি দিয়ে চলে যাবে– এটাই তো ঘটেছে বারবার।

সরকারি প্রতিনিধিরা আসার আগেরদিন অভ্রনীল নিজেই স্কুল বসার আগে একজন মজুরকে ডেকে এনে গোটা স্কুল সাফ করালেন নিজের গ্যাঁটের কড়ি খরচ করে। সুজাতা অবশ্য বলছিল, সে-ও অর্ধেক খরচ দেবে। স্কুল সাফ করা কি একা হেডমাস্টারের দায়িত্ব?

অভ্রনীল রাজি হননি। গলা নামিয়ে বলেছিলেন, ‘গতকাল রাতে নিজেকে অনেক বোঝালাম সুজাতা। কিন্তু মন সায় দিল না আপসে। বাস্তব পরিস্থিতি যা, তাকেই সামনে না এনে উপায় নেই সুজাতা। কাউকে আড়াল করে গা বাঁচানোর চেষ্টা করে লাভ নেই।’

সুজাতা চুপ করে রইল। এক অদ্ভুত মানসিক দোলাচল তাকে ক্রমাগত পীড়িত করছে।

অভ্রনীল ফের বললেন, ‘ভয় পাচ্ছ?’

সুজাতা ক্লিষ্ট হেসে জবাব দিল, ‘একটু।’

অভ্রনীল বললেন, ‘আমি ভয় করব না ভয় করব না, দুবেলা মরার আগে মরব না ভাই, মরব না’– শুনেছ তো এই রবীন্দ্রসংগীতটা? তাহলে? সমস্যার প্রতিকার তো একদিন কাউকে না কাউকে করতেই হবে। তাহলে আমরাই বা নই কেন? এখনই বা নয় কেন?’

জয়ন্ত গুহ পোড়খাওয়া আমলা। ফুঁসে উঠলেন, ‘দোষের ভাগি তো আপনাকেও হতে হবে অভ্রনীলবাবু। এই স্কুল দেখাশোনার দায়িত্ব সরকার আপনার উপর সঁপেছে। ইস, কী অবস্থা করেছেন স্কুলটার! চোখে দেখা যায় না!’

অভ্রনীল ম্লান হেসে বললেন, ‘কেন কিছু হয়নি, সবই আপনাকে বলেছি স্যার। তারপরও…!’

জয়ন্ত গুহর পাশে বসে থাকা অন্য অফিসারটি এবার মুখ খুললেন, ‘ঞ্জসব বাহানা না হয় না-ই শোনালেন! আমরা সবকিছুই জানি। গ্রামের বেশিরভাগ বাইরে থেকে আসা শিক্ষক স্কুলেই আসেন না। কেবল মাইনে নেন। আমরা এও জানি, সেই মাইনে থেকে সামান্য টাকা গ্রামেরই কোনও বেকার যুবককে দিয়ে, তাকে দিয়ে শিক্ষকতার কাজটা করিয়ে নেন।’

জয়ন্ত গুহ হাসেন, ‘যা হোক, এটুকু দায়িত্ববোধ তো তাদের আছে, কী বলো সরকার! এটুকু অন্তত বোঝে যে, স্কুলটা খুলতে হবে।’

সরকার বলে যেতে থাকেন, ‘আমরা জানি, এ স্কুলেও সেই ঘটনা ঘটে। প্রধানসাহেব আমাদের সবই জানিয়েছেন। লুকোনোর চেষ্টা করে লাভ হবে না অভ্রনীলবাবু।’

অভ্রনীল স্তম্ভিত হয়ে গেলেন শুনে। বলতে গেলেন, তার স্কুলে এমন ঘটনা কখনও ঘটেনি। তিনি গ্রামবাসীদের জিজ্ঞেস করে দেখতে পারেন। এইসময় বিনোদবাবু এসে তার কানে কিছু যেন বললেন। মিটিং ছেড়ে বাইরে এলেন অভ্রনীল। গ্রামের প্রধান অরূপ মাইতি এসেছেন। মুখে বিগলিত হাসি। দেখেই মনটা বিষিয়ে উঠল অভ্রনীলের। ভ্রূদুটো কুঁচকে গেল।

প্রধান বললেন, ‘মাস্টারমশাই, একটা ঘটনা ঘটে গেছে।’

অভ্রনীল প্রমাদ গুনলেন।

প্রধান বললেন, ‘শহর থেকে বাবুদের যে-দলটা এসেছে, তারা আজ এখানেই থাকবেন। কাল এখান থেকেই অন্য জায়গায় স্কুল পরিদর্শনে যাবেন। ওদের থাকা-খাওয়ার বন্দোবস্ত করতে হয়।’

অভ্রনীল বললেন, ‘পঞ্চায়েত করুক। আমায় বলছেন কেন?’

প্রধান বললেন, ‘সে তো করবই। কিন্তু, আপনার স্কুলের দুই দিদিমণিরও বাড়ি যাওয়া চলবে না। বাবুদের একটু যত্নআত্যি…!’

প্রধানের কথা শেষ করতে দিলেন না অভ্রনীল। বলে উঠলেন, ‘ওরা অনেক দূর থেকে আসেন। সংসার, ছোটো বাচ্চা আছে। ওদেরকে তো ছাড়তেই হবে ভাই!’

‘ছাড়তেই হবে, মানে?’ প্রধানের গলা চড়ে যায়, ‘ঞ্জই স্কুলে চাকরি করতে হলে ওদের যে এটুকু করতেই হবে মাস্টারমশাই!’

অভ্রনীলের যে কী হয়ে গেল, হঠাৎই হাওয়ায় হাত ঘুরিয়ে সজোরে এক থাপ্পড় কষিয়ে দিলেন প্রধানের গালে। অরূপ মাইতির টকটকে গায়ের রং ক্রমশ রক্তাভা ধারণ করল। তাকে কিছু বলতেও হল না। তার সাঙ্গোপাঙ্গোরা ঝাঁপিয়ে পড়ল অভ্রনীলের উপর।

তার পরের দৃশ্যটা দেখার জন্য অবশ্য প্রস্তত ছিল না সুজাতা। সমস্ত ক্লাসঘর থেকে পিলপিল করে বেরিয়ে আসছে ছোটো ছেলেমেয়েদের দল। তারা ঝাঁপিয়ে পড়ছে দুষ্কৃতীদের উপর। আর অভ্রনীল দূর থেকে চ্যাচাঁচ্ছেন, ‘ওরে ছেড়ে দে। মারের পালটা মার নয়।…’ কিন্তু তার দুচোখ বেয়ে পড়ছে অশ্রু।

টান

আজ ক’দিন ধরেই মেজাজ বিগড়ে রয়েছে আত্রেয়ীর। ছেলেটার জন্য বড়ো দুশ্চিন্তায় পড়েছে। কী যে করবে ছেলেটাকে নিয়ে। ছেলের দিকে নজর দেবে নাকি সংসারের দিকে। সংসারে সাহায্য করার মতো তো আর দ্বিতীয় লোক নেই। বছর চরেক আগেও আত্রেয়ীদের জয়েন্ট ফ্যামিলি ছিল। ভাসুর, দেওর, জা নিয়ে একেবারে ভরাভর্তি ফ্যামিলি। তারাও তো এখন যে-যার কর্মসূত্রের কারণে শহরের বাইরে থাকে। এখন আত্রেয়ীর সংসার বলতে তারা স্বামী-স্ত্রী, বছর দশ এগারোর এক ছেলে আর শাশুড়ি। শাশুড়িও বয়সের ভারে ন্যুব্জ হয়ে পড়েছে। তবে নাতি অন্ত প্রাণ। তার সামনে নাতিকে কিছু বলা যাবে না। সেটা নিয়েই আত্রেয়ীর যত আপত্তি। সারাদিন সংসারে সব ঝক্বি-ঝামেলা মুখ বুঝে সামলাবে কিন্তু ছেলে শাসন করার সময় কেউ কিছু বললেই মাথা গরম হয়ে যায় তার। এই নিয়ে মাঝেমধ্যে লেগেও যায় শাশুড়ির সঙ্গে। একে মনসা তায় আবার ধুনোর গন্ধ। দিনচারেক হল আবার আত্রেয়ীর বড়ো ননদ সহেলী এসেছে এবাড়িতে। ব্যস পিসি আর ঠাম্মার প্রশ্রয়ে আরও মাথায় উঠেছে ছেলেটা। শুধু জেদ আর জেদ। সকাল থেকে মায়ের পিছন পিছন ঘুরছে অমূলক বায়না নিয়ে।

‘মা আমায় সিডি প্লেয়ারটা দাও না। কখন থেকে চাইছি। দাও না।’ মায়ের আঁচল ধরে টানতে থাকে বিট্টু।

‘দেব না যখন বলেছি, তখন কোনওমতেই তোকে আমি ওটা দেব না। মাথা খারাপ করিস না। যা এখান থেকে।’

‘কেন দেবে না, তুমিই তো বলেছিলে দেবে। তাহলে এখন কেন না বলছ। আমি কিছু জানি না, আমার ওটা চাই।’ জেদ বেড়ে যায় বিট্টুর।

ছেলের কথায় ঝাঁঝিয়ে ওঠে আত্রেয়ী। হ্যাঁচকা মেরে আঁচলটা ছাড়িয়ে নেয়। ‘খুব সাহস হয়েছে নারেতোর। আমি বলে দিচ্ছি এক্ষুনি এখান থেকে চলে যা, নইলে চ্যালাকাঠ ভাঙব তোর পিঠে।’ আরও জেদ চেপে যায় বিট্টুর। হাত-পা ছুড়তে ছুড়তে সামনে বসে থাকা বড়োপিসিকে অনুনয়ের সুরে বলে, ‘বড়োপিসি তুমি বলো না সিডি প্লেয়ারটা দিতে, তুমি বললে মা শুনবে।’ ছোট্ট ভাইপোর অনুরোধ উপেক্ষা করতে পারে না সহেলী। এতক্ষণ বউদিকে হাতে হাতে সাহায্য করতে গিয়ে সবই তার চোখে পড়েছে।

‘দিয়ে দাও না আত্রেয়ী, সামান্য একটা জিনিসই তো চাইছে। দ্যাখো তো কেঁদে কেঁদে ছেলেটার চোখমুখ একেবারে ফুলে গেছে।’

‘প্লিজ দিদি, এই নিয়ে তুমি আর কিছু বলতে এসো না। প্রশ্রয় পেয়ে পেয়েই ছেলেটা আরও বিগড়ে যাচ্ছে। এইটুুকু ছেলের জেদ দেখেছ, যেটা চাই বলবে সেটা চাই-ই। দিন দিন একেবারে বাঁদর তৈরি হচ্ছে।’

‘মানলাম আমরা একটু বেশিই আদর-আহ্লাদ দিই। কিন্তু তুমিই তো ওকে প্রমিস করেছিলে। প্রমিস করে কথার খেলাপ করাও তো ঠিক নয়।’ বলেই বিট্টুর মাথায় স্নেহের হাত বুলিয়ে দেয় সহেলী। ‘কাঁদিস না বাবু, বিকেলে আমি তোকে একটা আইপড কিনে দেব।’

বড়ো ননদের কথার ভঙ্গি দেখে মাথা আগুন হয়ে যায় আত্রেয়ীর। কোনওমতে রাগ সংবরণ করে নিয়ে বলে, ‘যদি বা দিতাম, এখন তো আর দেবই না।’ রাগে গজগজ করতে করতে ঘর থেকে বেরিয়ে যায় আত্রেয়ী। বিট্টুও বড়োপিসির কথায় খানিক আশ্বস্ত বোধ করে অন্য খেলনা নিয়ে মেতে ওঠে।

দুপুরে লাঞ্চ সেরে ননদ, ভাজ মিলে বিছানায় গড়িয়ে নিতে নিতে সংসারের নানারকম আলোচনা হতে থাকে। বিট্টুর প্রসঙ্গ উঠতেই আত্রেয়ীর চোখেমুখে চিন্তার ছাপ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। উঠে বসে পড়ে সে। ‘এই ছেলেটা আমাকে পাগল করে দেবে দিদি। কারওর কথা শোনে না। পড়াশোনার কথা তো ছেড়েই দাও। সারাক্ষণ শুধু দুষ্টুবুদ্ধি মাথায় পাক খেতে থাকে।’

‘কী যা-তা বলছ আত্রেয়ী। বিট্টু কত বিনয়ী, পড়াশোনায় ভালো, আর কী চাই তোমার? তাছাড়া ও এখন ছোটো, তুমি যেভাবে গড়েপিঠে মানুষ করবে, ও ঠিক তেমনটাই তৈরি হবে।’ আত্রেয়ীকে বোঝানোর চেষ্টা করে সহেলী।

‘আমার হাতে কী আছে বলো? সংসারটা কি শুধু আমার একার?’ বলে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আত্রেয়ী। তারপর আবার বলতে শুরু করে, ‘যখনই ওকে বোঝাতে যাই, কেউ না কেউ মাঝখানে এসে কথা কাটবেই। যেভাবেই হোক আমাকে ভুল প্রমাণ তাদের করতেই হবে। এরকম চললে বাচ্চারাও তো কনফিউজড্ হয়ে যায় বলো। তারাও তো ঠিক করতে পারবে না কোনটা ঠিক কোনটা ভুল। এই পরশুদিনের কথাই ধরো না, তোমার ভাইয়ের বস আর তার দুই ছেলেমেয়ে এসেছিল বাড়িতে। ওদের জন্য রসগোল্লা আর কিছু স্ন্যাকস্ আনা হয়েছিল। সকলের প্লেটেই দু’টো রসগোল্লা আর স্ন্যাকস্ সাজিয়ে দেওয়া হয়েছিল। বিট্টুকেও তাই। সকলের জন্য ম্যাঙ্গো শেক আনতে রান্নাঘরে ঢুকেছি, সেইসময় সেখানে গিয়ে বিট্টুর বায়না, ‘মা আমাকে আরও দুটো রসগোল্লা দাও।’

আমি বললাম, ‘ঠিক আছে ওরা যাক, তারপর খেয়ে নিস। সত্যি বলতে কী, সকলকে আর দু’টো দেওয়ার মতো অত আনেনি সেদিন তোমার ভাই। ওকে বোঝাতে ও মেনেও গিয়েছিল, কিন্তু মাঝখানে মা এসে বলতে লাগলেন, ‘দু’টো রসগোল্লাই তো খেতে চেয়েছে’ বলে ওকে দিয়ে চলে গেলেন। সে-ও প্লেট হাতে সোজা গেস্টদের সামনে। সম্মানটা থাকে তুমি বলো? ঠিক সেই কারণেই আমি পরে দেব বলেছিলাম। এখন তুমিই বলো ওকে আমি সঠিক শিক্ষা দেব কেমন করে? পড়ানোর সময়ও ঠিক এমনটাই ঘটে। পড়া না পারলে একটু বকলে মা চলে আসবেন, ব্যস ইনিও পড়াশোনার পাট তুলে দিয়ে ঠাম্মার অাঁচলের তলায় গিয়ে লুকোবে। এভাবে ছেলে মানুষ করা যায়! এখন পড়ার নাম শুনলেই তার গায়ে জ্বর চলে আসে।’

‘হাফ-ইয়ারলির রেজাল্ট আউট হয়েছে না? কেমন নাম্বার পেয়েছে?’ প্রশ্ন করে সহেলী।

‘রেজাল্ট নিয়ে আর কিছু জিজ্ঞাসা কোরো না। এখন তো মিথ্যে বলতেও শিখে গেছে।’ ভারি মনমরা দেখায় আত্রেয়ীকে।

‘কেন, কী এমন করেছে যে এরকম করে বলছ?’

‘কয়েকদিন ধরেই ওকে জিজ্ঞাসা করছি, কীরে পরীক্ষার খাতা দেখায়নি। সমানে মিথ্যে বলে গেল। দিন সাতেক পর ওর ক্লাসেরই এক বন্ধুর বাড়িতে গিয়ে জানতে পারি খাতা বেশ কয়েকদিন আগেই দেখানো হয়ে গেছে।’ চোখ চিকচিক করে ওঠে আত্রেয়ীর। সান্ত্বনা দিতে আত্রেয়ীর হাতটা চেপে ধরে সহেলী।

‘জানো দিদি ওর বন্ধু সৃঞ্জয় বলল, ‘কেন আন্টি বিট্টু তোমাকে কপি দেখায়নি? ও-তো এবারে চারটে সাবজেক্টে পাশ মার্ক তুলতে পারেনি।’ লজ্জায়, অপমানে মুখটা কোথায় লুকোব ঠিক করতে পারিনি। সৃঞ্জয়ের মায়ের ওই তীর্যক হাসি যেন আমাকে দুমড়ে-মুষড়ে এক করে দিচ্ছিল। কোনওরকমে পালিয়ে আসি ওদের বাড়ি থেকে।’ নিজেকে সামলাতে পারে না আত্রেয়ী। গাল বেয়ে জল নেমে আসে তার।

সব শুনে সহেলীও অবাক হয়ে যায়, ‘কী বলছিস রে, আমাদের বিট্টু!’ কথা শেষ করতে পারে না সহেলী। তার আগেই আত্রেয়ী ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বলে ওঠে, ‘তাহলে আর বলছি কী! প্রথমে কী বলে, মারধোর করতে তবে গিয়ে স্বীকার করল সব। এখন তুমিই বলো আমি কী করব? এখানেই শেষ নয় রিপোর্ট কার্ডটা পর্যন্ত আমাদের হাতে দেয়নি জানো। বেশ কয়েক সপ্তাহ পরে ওয়াশিং মেশিনের নীচ থেকে ওটা পেয়েছি। আর কী বলব তোমাকে, মাসিক রিপোর্ট কার্ডে পর্যন্ত তোমার ভাইয়ের সইটা নকল করে জমা দিয়েছে। আমি ফেড-আপ হয়ে গেছি।’ মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ে আত্রেয়ী।

‘বিশ্বাসই হচ্ছে না, যে-ছেলেটা গতবছর পর্যন্ত র‍্যাঙ্ক করে এসেছে, তার এই অবনতি কীভাবে? জাস্ট ভাবতে পারছি না।’ বিস্ময় ঘিরে ধরে সহেলীকে।

‘তোমার ভাই তো জীবনেও ওকে পড়ার জন্য বলে না, কোনওদিন বসেও না ছেলেকে নিয়ে। সবসময় আমিই পড়াশোনা নিয়ে টিকটিক করি, সেইজন্য এখন আমি ওর চোখের বিষ। মা হয়ে কী করে আমি ছেলের ভবিষ্যৎ নষ্ট হতে দেখব বলো দিদি?’

‘কিন্তু আত্রেয়ী, বাচ্চাদের ভালোবাসা দিয়ে বোঝাতে হবে। কাছে টানতে হবে। সবসময় মারলে, বকলেও আরও হাতের বাইরে চলে যাবে। পড়াশোনাতেও ওই জন্য ওর মন নেই। পড়াতে বসলে তুমি পড়াও কম, মারো বেশি। বাচ্চাদের সাথে এমন করলে চলবে কেন. যেমন কালকেই তুমি ওকে বলছিলে, আরে ওই ছেলে মানুষ হবে নাকি। জীবনে কিছু করতে পারবে না, জুতো সেলাই করে পেট চালাতে হবে। বাচ্চাদের সামনে তুমি যদি এরকম কথাবার্তা বলো, তাহলে ওদের মনে কেমন প্রভাব পড়বে বুঝতে পারছ আত্রেয়ী। জীবনে কোনওদিন মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে না, সারাক্ষণ হীনন্মন্যতায় ভুগবে। নতুন কিছু করার সাহসই জোগাতে পারবে না।’

ডাইনিং রুমের মেঝেতে বসে বিট্টু কীসব আঁকিবুকি করছিল মন দিয়ে। হঠাৎই সেসব ছেড়ে দিয়ে পিসির হাতটা ধরে বলতে শুরু করল, ‘পিসি, পিসি দাবা খেলবে আমার সাথে?’

‘কিন্তু বাবু আমি যে দাবা খেলতে পারি না। তাহলে তোমার সাথে খেলব কেমন করে?’

‘খুব সোজা। আমি শিখিয়ে দেব।’ ঝটপট উত্তর দেয় বিট্টু।

‘তারচেয়ে বরং লুডো খেলি। কী বলিস?’

‘ঠিক আছে।’ বলে লুডো আনতে দৌড়ে যায় ঠাম্মির ঘরে। মিনিট দুয়েকের মধ্যে ফিরে এসে ঘুঁটি সাজাতে শুরু করে দেয় বিট্টু।

‘সাপ-লুডো খেলি, কী বলো পিসি। তোমার সাথে দারুণ জমে যাবে। ঠাম্মি তো ঠিক করে দান-ই চালতে পারে না।’

‘লুডো ছাড়া আর কী কী খেলা জানিস রে বাবু?’ জানতে চায় সহেলী।

‘দাবা, স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড, কার রেস, বিজনেস গেম, কবাডি।’ গড়গড় করে একটার পর একটা নাম বলতে থাকে বিট্টু।

‘আরে আরে থাম থাম। বাপরে বাপ, কার সাথে খেলিস এসব?’ হাসতে হাসতে প্রশ্ন করে সহেলী।

‘কারওর সাথেই নয়।’

‘কিন্তু এসব খেলা তো একা একা খেলা যায় না বাবু। একাই যদি খেলবে কিনেছ কেন এই সমস্ত গেম?’ অবাক হয়ে যায় সহেলী।

‘কিছু মাসি কিনে দিয়েছিল। জেঠু এসেও কয়েকটা কিনে দিয়ে গেছে, আর গতবারের জন্মদিনে আরও অনেকগুলো পেয়েছি। একা একা খেলব না-তো কী করব বলো। মা যে সঞ্জুদের  বাড়িতে ওগুলো নিয়ে যেতে দেয় না। বলে দামি জিনিস নষ্ট হয়ে যাবে। সঞ্জু বাড়িতে এলেও খেলতে বসলে মা রাগ করে। বলে সবসময় বাড়িতে হইহল্লা লেগেই রয়েছে, বন্ধ করো এসব। খেলা বন্ধ করে মা ওকে বাড়ি পাঠিয়ে দিয়ে আমাকে জোর করে পড়তে বসিয়ে দেয়। ঠাম্মিও তো এসব খেলতে পারে না। কত চেষ্টা করেছি শেখানোর।’ বিট্টুর কথাগুলো মনের মধ্যে বিঁধতে থাকে সহেলীর।

‘ঠাম্মি পারে না তো কী হয়েছে, মাঝেমধ্যে বাবা-মা-র সঙ্গেও তো খেলা যেতে পারে। কী বলো বিট্টু সোনা?’ বড়োপিসির কথা শুনে মাথা নীচু করে নেয় বিট্টু। চোখের কোনা চিকচিক করে ওঠে। তীর্যক দৃষ্টিতে একবার মায়ের দিকে দেখে পিসির কথার উত্তর না দিয়েই ঘর থেকে বেরিয়ে যায় সে।

সহেলী বুঝতে পারে তার কথায় বিট্টু কতটা আঘাত পেয়েছে। পরিবারের সকলে থাকা সত্ত্বেও সে যে কত একা, তা বুঝতে বাকি থাকে না বিট্টুর বড়োপিসির। এতটুকু ছেলের একটা খেলার সঙ্গী নেই। তার উপর সারাক্ষণ মায়ের কড়া শাসন। শাসনের চোটে ভালোবাসাগুলো ম্লান হয়ে গেছে, আর তাই দিন দিন রগচটা হয়ে যাচ্ছে। সবথেকে বেশি রাগ মা-র উপর। সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে স্থির করে নেয় আত্রেয়ীকে যেভাবেই হোক বোঝাতে হবে। এখনও সময় আছে। ভাজের উপর খানিক রাগই হয় সহেলীর। পরক্ষণেই আবার নিজেকে বোঝানোর চেষ্টা করে, ভাবে আসলে ছেলেটাকে নিয়েই আত্রেয়ীর পৃথিবী। তাকে ঘিরেই তার যত স্বপ্ন। যার কারণে একটু এদিক-ওদিক দেখলেই কেমন যেন অস্থির হয়ে ওঠে আত্রেয়ী। সবসময় চোখে চোখে রাখার চেষ্টা করে ছেলেকে। চতুর্দিকের ঘটনা দেখে ভয়ে ছেলেটাকে দূরে স্কুলে পর্যন্ত ভর্তি করেনি। কী-যে ভয় ওর। বিট্টু তো তাদেরও মনের খুব কাছাকাছি। বিয়ের প্রায় বছর আটেক পর বিট্টু জন্মায়। তার আগে দু’দুটো বাচ্চা…। কিন্তু সেসব অতীত আঁকড়ে ধরে থাকলে চলবে? বর্তমানকে নিয়ে বাঁচতে হবে।

তারপর নিজের মনেই বিড়বিড় করতে থাকে, আর ভাইটাও হয়েছে তেমনি। ব্যাবসা ছাড়া কিছুই বুঝল না। শুধু টাকা আর টাকা। বলি এত টাকা নিয়ে কী করবি, যদি ছেলেটাকেই না মানুষ করতে পারলি। দু’দণ্ড ছেলেটার পাশে বসে একটু সময় দিলে কী হয়। এদিকে মুখে বলছে আমি যা রেখে যাব আমার ছেলেকে আর খেটে খেটে হবে না। এদিকে সেই ছেলের জন্যই সময় নেই। একজন চিন্তায় অস্থির, আর একজন উদাসীন! না আত্রেয়ীর সঙ্গে খোলাখুলি কথা বলতেই হবে। এভাবে বিট্টুর ছেলেবেলাটা নষ্ট হতে দেওয়া যাবে না।

সহেলী ভাইবোনেদের মধ্যে সবথেকে বড়ো। কাজেই সবাই সমীহ করেই চলে। অবশ্য সমীহ করার মতোই তার ব্যক্তিত্ব। ছেলে বিদেশে থাকে আর মেয়ের বছর খানেক হল বিয়ে হয়ে গিয়েছে। স্বামী রিটায়ার্ড কর্নেল। বেড়াতে ভীষণ ভালোবাসেন। বছরে অন্তত বারচারেক তল্পিতল্পা নিয়ে বেরিয়ে পড়েন বেশ কয়েকদিনের জন্য। এবারের মিশন মিশর। সেই কারণেই কয়েকদিনের ছুটিতে এবাড়িতে এসেছে সহেলী। আত্রেয়ীও বড়ো ননদকে খুব ভালোবাসে। সে অন্তত তাকে বোঝে। তাই সমস্ত কিছু শেয়ার করে বড়ো ননদের সঙ্গে। মনের কথা বলে খানিক শান্তি পায়।

সেইদিনই সন্ধ্যাবেলায় ননদের বোঝানোতে সিডি প্লেয়ারটা আলমারি খুলে ছেলেকে বের করে দেয় আত্রেয়ী। সেটা হাতে পেয়েই লাফাতে লাফাতে বিট্টু সোজা পৌঁছে যায় বড়োপিসির ঘরে। বড়োপিসিকে জড়িয়ে ধরে আনন্দে আটখানা হয়ে। ‘থ্যাঙ্ক ইউ পিসি, আমি জানি তোমার কথাতেই মা সিডি প্লেয়ারটা  ফেরত দিয়েছে আমাকে।’

‘তাই! তুমি কেমন করে জানলে?’ বিট্টুকে খোলা মনে হাসতে দেখে সহেলীর মনটা ভালো হয়ে যায়।

‘আমি জানি। আচ্ছা শুনবে এতে কী আছে?’ বলেই যন্ত্রটার বাটন-টা প্রেস করে দেয় বিট্টু। শুরু হয় খুব মিষ্টি একটা গান।

‘আরে এটা তো বিট্টু সোনার গলা। বাবা আমার বিট্টু সোনা গানও গাইতে পারে। তা-ও আবার এত সুরে!’ অবাক হয়ে যায় সহেলী।

পিসির কাছ থেকে নিজের প্রশংসা শুনে লজ্জায় মুখটা রাঙা হয়ে ওঠে বিট্টুর। অদ্ভুত এক ঝলক খেলে যায় বিট্টুর চোখেমুখে। প্রশান্তির সেই ছাপ চোখ এড়ায় না সহেলীরও।

সহেলীর বুঝতে বাকি থাকে না বিট্টুর সিডি প্লেয়ার চাওয়ার ওই অদম্য জেদ কেন চেপেছিল। আসলে সে চেয়েছিল তার স্কুলের প্রোগ্রামে গাওয়া গানটা পিসিকে শোনাতে। নিজের খুশি জাহির করতে বাচ্চারা তাদের ভালোবাসার মানুষকে খোঁজে। ইস্ আত্রেয়ী যদি একটু বুঝত ছেলেটা কেন ওভাবে জেদ ধরেছিল। মা হয়ে ছেলেটার ইচ্ছে-অনিচ্ছেগুলো বুঝল না।

পরদিন সকালেও বিট্টুর মনটা বেশ ভালো ছিল। সকালে উঠে নিজেই লাফাতে লাফাতে তৈরি হয়ে স্কুল গেল। পিসির কাছে আবদার করে গেছে ফিরলে তাকে ভূতের গল্প শোনাতে হবে। সেইমতো স্কুল থেকে ফিরে সোজা পিসির ঘরে হানা দেয় বিট্টু। তখন ননদ ভাজের আড্ডা বেশ জমে উঠেছে। কোনও কিছু নিয়ে ইয়ার্কি-ঠাট্টা হচ্ছিল বোধ করি। বিট্টুর মাঝে ঢুকে পড়াতে আত্রেয়ীর হাসি মুহূর্তে বিরক্তিতে পরিণত হয়।

‘কতবার তোমাকে বলেছি না বড়োরা কথা বললে এভাবে বিরক্ত করবে না। যাও ঠাম্মিকে বলো খেতে দিতে।’

‘আমার পেট ভর্তি আমি খাব না।’

‘পেট ভর্তি মানেটা কী? সেই কোন সকালে একটু হরলিক্স আর দুটো বিস্কুট খেয়ে বেরিয়েছ। যাও খেয়ে নাও।’ চোখ রাঙায় আত্রেয়ী।

মায়ের চোখ রাঙানিকে উপেক্ষা করেই জবাব দেয় বিট্টু, ‘বলছি তো খিদে নেই।’ বলে সহেলীর পাশে গিয়ে বসে পড়ে।

‘ও পিসি, তারপর কী হল? তারপর? ভূতটা কী করল?’

‘দেখেছ দিদি, দেখেছ, এই ছেলে আমাকে কোনওদিন শান্তি দেবে? দু’দণ্ড যে কারওর সাথে কথা বলব তা এই ছেলের সহ্য হয় না। আমার বোন এলেও এমনটাই করে। বাপের বাড়িতে গিয়েও বন্ধুবান্ধবদের সাথে একটু গল্প করতে, মনের কথা খুলে বলতে পারি না জানো। সেখানেও মুখের সামনে বসে সব গিলবে, আর বাড়ি ফিরে বাবা-ঠাম্মিকে সব লাগাবে। সত্যি বলছি দিদি আর পেরে উঠছি না।’ গর্জে ওঠে আত্রেয়ী।

‘ঠিক আছে, ঠিক আছে, অতো বিরক্তির কী আছে। আর তো ক’দিন পর বড়ো জেঠুর কাছে চলেই যাব। বাবা তো কথাও বলে নিয়েছে। তখন চাইলেও তোমার কাছে আর ফিরে আসব না।’

‘আচ্ছা আচ্ছা, আর অতো রাগ করতে হবে না। মার কথা শোনো, একটু খেয়ে এসো। তারপর তো বাকি গল্পটা বলবই। যাও যাও ছুটে যাও, ঠাম্মির থেকে খেয়ে এস।’ বিট্টুকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে ঠাম্মির কাছে পাঠিয়ে দেয় সহেলী। তারপর আত্রেয়ীর দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়,’ হঠাৎ বড়ো জ্যেঠুর কাছে, ব্যাপারটা ঠিক বুঝলাম না।’

‘ছেলেটা যেভাবে বিগড়ে যাচ্ছে, তাই আমরা ঠিক করেছি ওকে বড়দার কাছে পাঠিয়ে দেব। ওখানেই থাকবে, পড়াশোনা করবে। আমাদের তো ধর্তব্যের মধ্যেই ধরে না, কম সে কম ওনাকে তো একটু ভয় পায়।’

কথাটা শোনামাত্রই মাথায় বিদ্যুৎ খেলে যায় সহেলীর। ‘মানে, নিজের দায় অন্যের উপর চাপিয়ে দিয়ে দায় মুক্ত হতে চাইছ। কিছু মনে কোরো না আত্রেয়ী এভাবে ছেলে মানুষ হয় না। একটা মানুষের পিছনে দিনরাত্রি খিটখিট করলে, সে তো বিরক্ত হবেই। ছেলে মানুষের নামে দিনরাত কড়া অনুশাসন, স্কুলের পর দুটো টিউটর, হাঁফ ফেলতে পারে না ছেলেটা ঠিক করে। মিশতে দেবে না কারওর সঙ্গে, ছেলে নাকি এতে খারাপ হয়ে যাবে। ভাবলেই অবাক লাগে এই বয়সের একটা ছেলের খেলার সঙ্গী নেই। ছেলে বিগড়োনোর জন্য কিন্তু দায়ী তোমরাই। এভাবে কোনওদিন ছেলে মানুষ করতে পারবে না।’

ননদের কথার কোনও প্রতিবাদ করতে পারে না আত্রেয়ী। যৗক্তিকতার চাপে গলা রূদ্ধ হয়ে আসে তার। চোখ ভিজে যায়। একটা ক্ষীণ স্বর সহেলীর কানে পৌঁছোয় ‘তুমি শুধু আমার দোষটাই দেখছ দিদি। কষ্টটা বুঝতে পারছ না। একজন মা কতটা প্যাঁচে পড়লে তবে তার বাচ্চাকে নিজের কাছছাড়া করার কথা ভাবে বলো তো?’

‘শোনো আত্রেয়ী, মাঝে মাঝে কাছের মানুষগুলোর কাছে ভালোবাসা প্রকাশ করতে হয় বুঝেছ। রাগের বশবর্তী হয়ে এমন কিছু ডিসিশন নিও না, যাতে ছেলেটা তোমার থেকে আরও দূরে সরে যায়। একটু আমার কথামতো চলেই দ্যাখো না, দেখবে তোমার ছেলে সত্যিই ভালো।’ আবেগের বশে কখন যে ভাজকে জড়িয়ে ধরে চোখে জল এসে গেছে বুঝতেও পারে না সহেলী।

দেখতে দেখতে কেটে যায় আরও একটা সপ্তাহ। এই কয়েক দিন সহেলী, ভাইপো বিট্টুকে নিয়েই বেশি সময় কাটিয়েছে।

পিসির কথা শুনে খাওয়াদাওয়া, পড়াশোনা সবই করেছে বিট্টু। এক মুহূর্তেও কথার অবাধ্য হয়নি বিট্টু। আত্রেয়ীর অভিযোগের সঙ্গে বিন্দুমাত্র মেলাতে পারেনি ছেলেটাকে। একটু ভালোবাসা একটু প্রশংসা পাওয়ার জন্য কী না করতে পারে ছেলেটা। আত্রেয়ীকে ভুল প্রমাণ করার জন্য তাকে দিয়েই কোয়েশ্চেন সেট বানিয়ে পরীক্ষা নিয়েছে বিট্টুর। একেবারে পঞ্চাশে পঞ্চাশ। ফুল মার্কস পেয়ে ছেলের কী লাফানো।

‘দেখেছ আত্রেয়ী, একটু ভালোবাসা পেলে ছেলেটা কী করতে পারে। আমার কী আছে বলো, আমি তো আর সারাজীবন থাকতে যাব না এখানে। তোমার জামাইবাবুরা দুর্যোগের জন্য সময়ের আগেই ফিরে আসছে বর্ডার থেকে। পরশুই আমাকে চলে যেতে হবে।

নিজের মনে খেলতে খেলতেই, পিসির কথাটা কানে যায় বিট্টুর। খেলা ছেড়ে দিয়ে একলাফে দৌড়ে আসে সহেলীর কাছে। বরাবরই বড়োপিসিকে সে একটু বেশিই ভালোবাসে। এই কদিনে সহেলীর আরও কোলঘেঁষা হয়েছে সে। ‘পিসি তুমি চলে যাবে? তুমি যে বলেছিলে এখন থাকবে তাহলে কেন? আমার সাথে কে খেলবে?’ বিট্টুর কথাগুলো সহেলীর কানে গিয়ে ধাক্বা মারে।

‘কী করব বলো, পিসেমশাই ফিরে আসছে। আমি বাড়ি না গেলে উনি খাবেন কী? ওনাকে কে দেখবে? তবে আমি কথা দিতে পারি, তুমি যদি আমার কথা শোনো, তাহলে আমি প্রতিমাসে দু’দিন করে এসে তোমার সাথে দেখা করে যাব। আর তোমার গরমের ছুটির সময় তোমাকে আমার ওখানে নিয়ে যাব।’

‘কী কথা বলো?’ উৎসাহের সঙ্গে জিজ্ঞাসা করে বিট্টু।

‘বলব, তবে আগে প্রমিস করতে হবে, আমি যা বলব তুমি তাই শুনবে।’ শর্ত রাখে সহেলী।

‘তোমায় কথা দিতে হবে ভালো ছেলের মতো মা-র সব কথা শুনবে। মন দিয়ে পড়াশোনা করবে। ভালো রেজাল্ট করে প্রমাণ করতে হবে তুমি ভালো ছেলে।’ সহেলীর কথা মন দিয়ে শোনে বিট্টু। কোনও সাড়া করে না।

‘কি আমার কথা রাখবে তো?’ বিট্টুর দিকে প্রশ্ন ছুড়ে দেয় সহেলী।

‘প্রমিস পিসি, তোমার কথা মতোই আমি চলব, কিন্তু তুমি প্রমিস ভাঙবে না তো? সপ্রতিভ চোখে পিসির দিকে তাকিয়ে থাকে বিট্টু।

‘পিসি কোনওদিন কথার খেলাপ করেছে?’ ঘাড় নেড়ে সম্মতি প্রকাশ করে বিট্টু। বিট্টুকে কাছে টেনে নিয়ে আদর করে সহেলী। চোখ ভিজে যায় তার। একদিনে ছেলেটার প্রতি যেন আরও মায়া পড়ে গেছে। ছেড়ে যাওয়ার কথা ভাবতেই চোখে জল চলে এসেছে।

দেখতে দেখতে কেটে যায় আরও দু’টো দিন। আজ মা-বাবার সঙ্গে স্টেশনে এসেছে সহেলীকে ছাড়তে। সকাল থেকে বায়না ধরেছিল স্টেশনে আসার জন্য। বাড়ি থেকে স্টেশন পর্যন্ত একটি বারও পিসির কাছছাড়া হয়নি।

‘বাবু ভালো থাকিস। মা-র কথা শুনবি।’ বলে বিট্টুকে জড়িয়ে ধরে একটা চুমু খায় সহেলী। ঠিক সেই সময়তেই ট্রেনের হুইসল বেজে ওঠে। ট্রেনে উঠে পড়ে সহেলী। ধীর গতিতে ট্রেন চলতে শুরু করে। বিট্টু আর নিজেকে ধরে রাখতে পারে না। ডুকরে কেঁদে ওঠে।

‘প্লিজ পিসি, যেও না আমাকে ছেড়ে।’

‘কাঁদে না বাবু, আমি বলেছি না আমি ঠিক আসব।’ ট্রেন তখন প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে দ্রুত গতিতে ছুটতে শুরু করেছে। বিট্টুও করুণ মুখ করে দেখছে সেই ট্রেনের চলে যাওয়া। ‘আমার কথা রেখো কিন্তু,’ সহেলীর ক্ষীণ আওয়াজ ভেসে আসে বিট্টুর কানে।

হাত নাড়তে নাড়তে বলতে থাকে ‘শুনব পিসি, শুনব।’

বিট্টুর কষ্টটা অনুভব করতে পারে সহেলী। চোখ ভিজে যায় জলে, কিন্তু বিট্টুর উজ্জ্বল ভবিষ্যতের কথা ভেবে মনটা আনন্দে ভরে ওঠে।

মায়ানদী

‘এই ছেঁড়া মাতলা!’

শান্তনুর এত বিস্ময়ের কারণ খুঁজে পেল না মারুনা। মাতলার একটা ছোটো শাখা নিশ্চয়ই, তাই ছেঁড়া মাতলা। কিন্তু শান্তনুর কথায় মনে হচ্ছে এই নদীর অনুষঙ্গে কোনও স্মৃতি মনে পড়ে গেছে ওর! যাকে বলে অ্যাসোসিয়েশন মেমরি। চোখটা জ্বালা-জ্বালা করে উঠল তার। তাদের সব জার্নিতেই কি পিয়ালীর ব্যাগেজ বয়ে বেড়াতে হবে?

গতকাল থেকেই লক্ষ্য করেছে যে-কোনও স্পটে পৌঁছেই শান্তনু বলছে ‘এখানে আমরা এসেছিলাম।’ এমনকী ছবি তুলতে তুলতে বলল ‘ঠিক এই সিঁড়িটার সামনে পিয়ালীর একটা ছবি আছে। স্মাইল!’ মারুনার হাসিটা বেঁকে গিয়েছিল ধেবড়ে যাওয়া কাজলের মতো। শান্তনুর এই হৃদয়হীন ব্যবহারের কোনও অর্থই খুঁজে পায়নি মারুনা। মারুনা তো সেধে ওর জীবনে আসেনি, পিয়ালীকেও তাড়ায়নি।

মানুষের জীবনের প্রথম আতান্তরটি বোধহয় ‘ওই যাঃ, পাখি উড়ে গেল, দুশ যাঃ!’ উড়ে গেল, না উড়িয়ে দিল কেউ, মারুনা বুঝতে পারেনি। শান্তনুর সঙ্গে এই দেড়বছরের একত্রযাপনে কখনও এসেছে এমন সঙ্কট? আসেনি। সে বরাবরই অজস্র মনোযোগ পেয়েছে, অজস্র আদর, তার মনে হতে শুরু করেছিল সে একেশ্বরী। কিন্তু সুন্দরবনে না এলে সে যে এত দীন– তা তো বুঝতেই পারত না।

আপনজন হোটেল, পাখিরালয়, ঘাটে নেমে জায়গাটার কোনও বিশেষত্ব খুঁঝে পায়নি। ঘাটের কাছে, যেমন হয় আর পাঁচটা পর্যটন কেন্দ্রে, হরেক জিনিসের দোকান, ডাব খাবার ভিড়, সেগুলো ফেলে বাঁদিকে গিয়ে একটা ছোট্ট কাঠের সাঁকো পেরিয়ে ওদের হোটেল। বিশাল বড়ো, আর ছিরিছাঁদহীন, বাথরুম-টাথরুম খুব খারাপ নয়, কিন্তু পুরোটাই জেনারেটর নির্ভর। বাপরে! এই মার্চ মাসে দোলের সময় এখানে আসে কেউ? মারুনার মনে হল ওরাই এ মরশুমের শেষ পর্যটক।

আসলে এবার ওদের অন্য কোথাও যাবার কথা ছিল। কখনওই সুন্দরবন নয়। কিন্তু মারুনার একটা ইন্টারন্যাশনাল সেমিনার হবার কথা ছিল জানুয়ারিতে, সেই জন্য লম্বা কোনও টুর আগে থেকে বুক করা হয়নি। অথচ সেই সেমিনার জানুয়ারিতে হল না, পেছিয়ে গেল, মাঝখান থেকে লম্বা টুরও হল না। মারুনা প্রস্তাব দিয়েছিল, ‘চলো গাড়ি নিয়ে লং-ড্রাইভে বেরিয়ে পড়ি’ শান্তনু অন্যমনস্ক গলায় বলেছিল, ‘তুমি তো গান জানো না!’

কথাটা ঠক করে লেগেছিল মারুনার বুকে। ও জানে, এরপর অবধারিতভাবে পিয়ালীর গানের প্রসঙ্গ আসবে। পিয়ালী দারুন গান গাইত, রবীন্দ্রসংগীত থেকে সেমি ক্লাসিক্যাল সবই। মারুনা চুপ করে শুনবে, কোনও কথা বলতে পারবে না, কারণ কথাটা তো সত্যি। পিয়ালী তো সত্যিই দারুণ গান গাইত। ওর গান শুনে মারুনাও তো মুগ্ধ হয়েছে, এখনও হয়। ওর একটা গান এখন এফএম, টিভি, পুজো প্যান্ডেল সর্বত্র বাজছে, বলিউডে বড়ো ব্রেক পেয়েছে যে-গানটা গেয়ে ‘নাজুক কলহাইয়া মোরি’।

মারুনার তবু চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করেছে, ‘আমি গান জানি না বলেই তো আমাকে বিয়ে করেছ তুমি। এখন তা হলে আমাকে নিয়ে লং-ড্রাইভে যেতে অসুবিধে কোথায়?’

বড়ো টুর হল না, লং-ড্রাইভ হল না, ফেব্রুয়ারিতে মারুনার মা অসুস্থ হলেন হঠাৎ, তাঁকে নিয়ে নার্সিংহোম, ঘর ছোটাছুটি– শান্তনুই করল বেশি। মার্চ আসতে দুজনের মনের অবস্থাই সাংঘাতিক, কোথাও একটা যেতেই হবে। শহরের সব ট্র্যাভেল এজেন্সিতে খোঁজ নিয়ে দেখা গেল বেদুইন ট্রাভেলসেরই, দোলে সুন্দরবন প্যাকেজে দুটো সিট পড়ে আছে। ঝটপট সেটাই বুক করে ফেলল শান্তনু।

সত্যি বলতে কি, বিয়ের পর এই তাদের প্রথম বাইরে যাওয়া। পিয়ালী শান্তনুকে ছেড়ে মুম্বই গিয়েছিল অনেকদিন, সেখানে কে এক মিউজিক ডিরেক্টর পবন চতুর্বেদীর সঙ্গে লিভ-ইন করছিল, এটাও জানা ছিল। এসব সত্ত্বেও সে শান্তনুকে ডিভোর্স দিতে রাজি ছিল না। মুম্বইয়ে সুবিধে করতে না পারলে কলকাতায় ফিরে আসবে, তাই শান্তনুকে কুশন হিসেবে রাখতে তার ইচ্ছে হয়তো অস্বাভাবিক কিছু নয়। কিন্তু শান্তনু তা মেনে নেবে কেন? শুরু হল টানাপোড়েন। শান্তনু না চাইলেও অ্যাডাল্টরির অভিযোগ আনতে হল। যেহেতু ওটাই স্ট্রং গ্রাউন্ড। অভিযোগ সম্পূর্ণ সত্যি হলেও শান্তনু যে কেন পিয়ালীকে সর্বসমক্ষে ব্যভিচারিণী বলতে চায়নি, তা মারুনার কাছে স্পষ্ট নয়, যেমন স্পষ্ট নয়, পিয়ালী ফেরত নিতে এলেও জরুরি ডকুমেন্টস ছাড়া, তার ব্যবহূত জিনিসপত্র, কসমেটিক্স, ব্যাগ, শাড়ি, অন্য পোশাক, টুকটাক গয়না কিছুই কেন শান্তনু ফেরত দেয়নি, এমনকী পিয়ালীর লঁজারি পর্যন্ত।

ছোট্ট ফ্ল্যাট নয়, বেশ বড়ো বাড়ি শান্তনুর, মাস্টারদা সূর্য সেন মেট্রো স্টেশনে নেমে সামান্য হাঁটলেই বাড়িটা। বাড়ি ঘিরে বিশাল বাগান, এমনকী একটা পুকুর পর্যন্ত আছে। সেই বিশাল বাড়ির একটি ঘরে ঠাসা শুধু পিয়ালীর জিনিস। ওটা আগে ওদের বেডরুম ছিল। এখন শান্তনু তার আর মারুনার জন্য অন্য একটি ঘর সাজিয়ে নিয়েছে। মারুনার প্রতি তার যত্ন ও আদরের কোনও ত্রুটি নেই। মারুনার প্রতিটি সুবিধে অসুবিধের দিকে তার সদাসতর্ক দৃষ্টি। কিন্তু ওই যে তালাবন্ধ ঘরটা, ঘরে ঠাসা পিয়ালীর জিনিস। সারাক্ষণ মারুনার মনের সবটুকু জুড়ে আছে ওই স্মৃতির ঘর। এখানেও যেন সেই ঘরটা সঙ্গে বয়ে এনেছে ওরা। শান্তনু সেটা সারাক্ষণ পিঠে বয়ে বেড়াচ্ছে, আর মারুনা একটুও স্বস্তি পাচ্ছে না, একটুও আনন্দ পাচ্ছে না তাদের বিবাহিত জীবনের প্রথম যৗথ ভ্রমণে। তার খালি মনে হচ্ছে বেড়াতে না এলেই ভালো হতো। বাড়িই ভালো।

নদী এখানে অনেকটা চওড়া হয়ে গেছে, বিকেলের হলুদ আলো গাছগুলোর মাথা আলগোছে ছুঁয়ে আছে। সূর্য ডুবতে বেশি দেরি যে নেই, তা বোঝা যাচ্ছে সবার চোখেমুখে চাপা টেনশন দেখে। সূর্যাস্তের ছবি তুলতেই হবে। বন্দুকের ট্রিগারে হাত রাখার মতো সবাই ক্যামেরা নিয়ে তৈরি। বেশিরভাগই আলাদা ক্যামেরা আনে না আজকাল, মোবাইলেই তোলে। মারুনাও তার মোবাইল বার করে ফেলল। সূর্য, নদী, অরণ্য– নৈর্ব্যক্তিক এই ছবিগুলো অন্তত পিয়ালীর কথা বলবে না।

‘দ্যাখো, দ্যাখো, আমি জাস্ট ভাবতে পারছি না!’

শান্তনু আচমকা এত প্রাবল্যের সঙ্গে তার পিঠে হাত রাখল যে আর একটু হলেই তার মোবাইলটা হাত ফসকে জলে পড়ে যাচ্ছিল। খুব বিরক্ত হয়ে সে পেছন ফিরে বলল ‘যাচ্ছিল মোবাইলটা। এত এক্সাইটমেন্টের হয়েছেটা কী? ঘন্টার পর ঘন্টা ধরে সেই তো জল আর জল দেখে যাচ্ছি।’

শান্তনু নাটকীয় গলায় বলল,

‘জল শুধু জল, দেখে দেখে চিত্ত তোর হয়েছে বিকল– তাই না রে? ওরে অবোধ বালিকা, এক্সাইটেড হব না! ওই যে গাইডটা দেখছ, সকাল থেকে আমাদের পেছনে ফেউয়ের মতো লেগে আছে, ওই যে, কলকেতার বাবুরা হাঁ করে যার জ্ঞানবাণী গিলে যাচ্ছে, ওই লোকটা কে জানো?’

‘কে? ডোনাল্ড ট্র্যাম্প? না রয়েল বেঙ্গল টাইগার?’

‘তার চেয়ে বেশি। সকাল থেকে তাই ওকে এত চেনা-চেনা লাগছিল। আরে সেবার যখন পিয়ালীকে নিয়ে এখানে এসেছিলাম, এই লোকটাই গাইড ছিল। ওর নাম হচ্ছে আশুতোষ খাঁড়া। পিয়ালী ওর কাছ থেকে একটা রুটম্যাপ লিখে নিয়েছিল। লোকটার হাতের লেখা মুক্তোর মতো। পিয়ালী ওকে দুশো টাকা দিয়েছিল আলাদা করে।’

পিয়ালী, পিয়ালী, পিয়ালী! উঃ! মারুনার মুখ নিমেষে ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। তবু সে যথাসাধ্য নিজেকে সামলে নিয়ে বলল ‘কাগজটা কোথায়?’

‘মানে?’

‘ওই যে বললে কাগজে রুটম্যাপ লিখে দিয়েছিল’,

শান্তনুর মুখ হাজার দীপশিখায় জ্বলে ওঠে। ‘আছে। আমি দিইনি তো কিছু ফেরত। আমার সঙ্গে থাকার প্রতিটি মুহূর্ত, আমার সূত্রে যা যা অর্জন করেছে পিয়ালী, সব, সব  রেখে দিয়েছি। ওই তালা বন্ধ ঘরে আছে। ওয়াল ক্যাবিনেটের বাঁদিকের তিন নম্বর খোপে পেয়ে যাবে।’

মারুনা যেন এতক্ষণে একটা আঁকড়ে ধরার মতো কিছু পায়। ওয়াল ক্যাবিনেটের তিন নম্বর খোপে যেন ওর সুখের ঘরের চাবি আছে। সে বেশ গুছিয়ে মোবাইল ক্যামেরা তাক করে পশ্চিম আকাশের দিকে, মুরুবি৩ চালে বলে ‘একি! সূর্যাস্তের ছবি তুলবে না?’

সকাল থেকে যতটা খারাপ গেছে, সন্ধেটা তার তুলনায় অনেক অনেক ভালো কাটল। হোটেলটা খুব খারাপ না। অনেকখানি জায়গা জুড়ে। যদিও কোনও ছিরিছাঁদ নেই, এল শেপের স্কুলবাড়ির মতো। তার ওপর লোডশেডিং-এর দৗরাত্ম্য। বাথরুমে একরাশ অজানা পোকা, গা ধুতে গিয়ে চোখে নাকে ঢুকে গেল। তিনতলার ঘর, ছাদ রোদে তেতে আগুন হয়ে আছে। গা ধুয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়াতে বেশ আরাম হল। সারা হোটেলে নাকি দুটো মাত্র এসি ঘর, যারা আগে বুক করে এসেছে তারা পাবে। নীচে এ নিয়ে চ্যাঁচামেচি শোনা গেল খুব। ম্যানেজারকে যাচ্ছেতাই করে কথা শুনিয়ে এল কয়েকজন। ‘আগে জানালে আমরাও এসি বুক করে আসতে পারতাম। কেন সেই অপশনটাও দেওয়া হল না!’

কিছুক্ষণ চলল এরকম, তারপর সব শান্ত হয়ে এল। আসন্ন সন্ধের মায়া ছড়িয়ে পড়ল আকাশে। বারান্দা থেকে দেখল সন্ধেলাগা নদীর ওপর চাঁদ উঠল, সোনার থালার মতো চাঁদ। মারুনার আচমকা মনে পড়ল আজ পূর্ণিমা। যে সে পূর্ণিমা নয়, দোলপূর্ণিমা। দোল আর পরের শনি-রবি এই মিলিয়েই তো ট্রিপটা সম্ভব হয়েছে তাদের। আজ দোল, অথচ এক ফোঁটা আবিরও কেউ কারও কপালে ছোঁয়ায়নি। ফোনে কয়েকটা মেসেজ এসেছে, ‘হ্যাপি হোলি’। এছাড়া সারাদিনে মনেই পড়েনি আজ দোল। প্রতিবার দোলে তাদের বাড়িতে উৎসবের মেজাজ, মা পূর্ণিমার শিন্নি দেয় একদিকে, অন্যদিকে মামাতো, মাসতুতো, পিসতুতো ভাইবোনেরা মিলে রং মেখে হুল্লোড় করে। এখানে না এলে এবারও সেখানেই থাকত। বুকে একটা চিনচিনে ব্যথা উঠেই মিলিয়ে গেল। মহাসমারোহে দোল পালন করতে না পারা, শান্তনুর লাগাতার পিয়ালী – পিয়ালী– সব মুছে গেল মুহূর্তে। নদী আর তার বুকে মস্ত চাঁদ, মারুনার সমস্ত না-পাওয়াকে তুচ্ছ করে দিল। বারান্দায় আরও অনেকে চেয়ার পেতে বসে গজল্লা করছিল। তাদের কথাও মারুনার কানে গেল না। কতক্ষণ যে সে ওইভাবে বসেছিল কে জানে। হঠাৎ ট্রাভেলসের একটা ছেলে এসে প্লেটে প্লেটে চাউমিন দিয়ে গেল, আর সেটা দেখেই নিশ্চয়ই শান্তনু বেরিয়ে এল ঘর থেকে, ছেলেটাকে বলল, ‘চা দেবে না?’

‘এটা খেয়ে নিন, চা আসছে।’ বাব্বা! ছেলেটার গলা কী গম্ভীর! খেতে খেতে সেই গম্ভীর গলা চড়িয়ে ছেলেটা বলে গেল, ‘চা খেয়ে নীচের লনে আসবেন। যাত্রা হবে।’

‘কী যাত্রা ভাই?’

‘বনবিবির পালা।’

শান্তনুর সামনে বসে খেতে রীতিমতো অস্বস্তি হচ্ছিল মারুনার। হয়তো বলে বসবে, সেবার পিয়ালীর সঙ্গে যখন এসেছিল, বিকেলে ঠিক এই টিফিনই খেয়েছিল। তাকে আশ্বস্ত করে শান্তনু কিছু বলল না, চাউমিনটা চেটেপুটে খেয়ে নিল, তারপর বারান্দা থেকে নীচের লনে উঁকি মেরে বলল, ‘দেখেছ, স্টেজ বাঁধা হয়ে গেছে।’

মারুনাও উঁকি মারল নীচে। খুব নীচু মঞ্চ, স্টেজের পেছনে কয়েকজন বসে মেক-আপ করছে। যারা স্টেজ বাঁধছিল, তারাও মেক-আপ নিতে বসে গেল একটু পরে। একজন ব্যানার টাঙিয়ে দিল একটা, তাতে লেখা ‘মা নৃত্যাঞ্জলি অপেরা’। দেখে মজা লাগল মারুনার।

‘যাবে না নীচে? ওঃ তোমার তো আবার গান-টানে ইন্টারেস্ট নেই।’

মারুনার বুক ধক্ করে উঠল। গান থেকে পিয়ালীতে যেতে এক সেকেন্ডও লাগবে না শান্তনুর। বিয়ের পর এই তাদের প্রথম যৗথ ভ্রমণ, যাকে মধুচন্দ্রিমা বলাই দস্তুর, একেবারে পলিটিক্যালি কারেক্ট, চাঁদও উঠেছে সঙ্গতি রেখে– তবু সারাক্ষণ পিয়ালী-পিয়ালী জপে কেন যে কানের পোকা বার করে দিচ্ছে লোকটা? হয় ও অতিবোকা, নয় অতি হূদয়হীন, নয় যে কী ভেবে পেল না মারুনা। সে শান্তনুকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে নেমে এল নীচে।

স্নান সেরে লংস্কার্ট আর কুর্তি পরেছিল। চুল খোলা, চোখে কোহল, ঠোঁটে লিপবাম, বডি পারফিউমের গন্ধটা তাকে ঘিরে রেখেছে। লনে সারি সারি পাতা চেয়ারে চাঁদের নীচে বসে তার নিজেকে খুব ভালোবাসতে ইচ্ছে করছিল। যেন শান্তনুর সঙ্গে নয়, সে একাই এসেছে। একটু পরে যাত্রা শুরু হল। গরিব বিধবা মায়ের সন্তান দুখে, সে কীভাবে বনবিবির কৃপায় বাঘের হাত থেকে রক্ষা পেল– এই প্রচলিত লোকগল্প নিয়েই পালা। যাত্রা ফর্মটা তার কোনওদিন দেখা না থাকায় প্রথম প্রথম হাসি পাচ্ছিল। কিন্তু কিছুক্ষণ পর সে লোকশিল্পের শক্তি টের পেল। গানে, অভিনয়ে গোটা সুন্দরবনের লোকজীবন, নদী, অরণ্য, নোনামাটি তার মধ্যে ঢুকে যাচ্ছিল। শেষে যখন দুখে গান ধরল ‘এই মায়ানদী ক্যামনে হব পার’– অকারণেই তার চোখে জল চলে এল। হঠাৎ সে চমকে উঠে দেখল শান্তনু কখন এসে মন দিয়ে তার ছবি তুলছে।

পালার শেষে দুখে সকলের কাছে গিয়ে টাকা সংগ্রহ করছিল। মারুনা দেখল দুখে আসলে একটি ছোটো মেয়ে। ভারি সুন্দর দেখতে আর গানের গলার তো তুলনা হয় না। সে একবার ভাবল শান্তনুকে বলবে মেয়েটার ছবি তুলতে। ভয়ে বলল না। শান্তনু যদি বলে বসে পিয়ালীও সেবার এমন আবদার করেছিল।

রাতের খাওয়াটা ভালোই হল। যদিও মেনু নিয়ে অনেকেই নাক সিঁটকেছে। ফ্রায়েড রাইস, চিলি চিকেনের সঙ্গে বেগুনি! ছোঃ! ফিশফ্রাই করতে পারল না! আর ওটা চিলি চিকেন হয়েছে? মারুনা আদৗ রাঁধতে জানে না, তাই খাওয়া নিয়ে সে কোনও সমালোচনায় যায় না। তার তো ভালোই লেগেছে। একটু বেশিই খাওয়া হয়ে গেছে। সে শান্তনুকে বলে ফেলল ‘চলো না, একটু হেঁটে আসি।’

শান্তনু কী যেন বলতে গিয়ে থেমে গেল। তারপর বলল, ‘চলো যাই।’

হাঁটতে হাঁটতে তারা বাজার ছাড়িয়ে অনেকটা চলে এল। বাজার এলাকাটুকু ছাড়া পাখিরালয় একটা সাধারণ গ্রাম, রাত দশটা বাজতে না বাজতেই নিঝুম হয়ে গেছে। ওরা দুজন, নদী আর চাঁদ ছাড়া কেউ নেই চরাচরে। মারুনার ভয় করছিল একটু। সে শান্তনুর পাঞ্জাবি টেনে বলল ‘চলো ফিরি।’

শান্তনু তখনি আঙুল দেখিয়ে বলল ‘ওই জেটিটা’।

মারুনা ওর আঙুল অনুসরণ করে দেখল একটা পরিত্যক্ত জেটি, এই দ্বীপ থেকে কেমন বিচ্ছিন্ন হয়ে নদীর বুকে প্রসারিত হয়ে আছে। যেন পৃথিবীর মাটির নয়, জেটিটা নদীর আর চাঁদের। মারুনার খুব ইচ্ছে হল ওখানে গিয়ে দাঁড়াতে। ও শান্তনুর হাত ধরে টানল, ‘চলো না, ওই জেটিটায় গিয়ে একটু দাঁড়াই।’

শান্তনু এর উত্তরে কী একটা বলতে গিয়ে থেমে যায় আবার। মারুনা বুঝতে পারে আবার পিয়ালীকে নিয়ে কিছু একটা মনে পড়ে গেছে ওর। কিন্তু হঠাৎ খেয়াল হয়েছে, এধরনের কথায় মারুনা হার্ট হচ্ছে, তাই হয়তো বলতে পারছে না। হঠাৎ মাথাটা গরম হয়ে যায়। চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে ও জেটির দিকে ছুটে যায়। শান্তনু আঁতকে ওঠে ‘মারুনা শোনো, ওটা ভাঙা জেটি, যে-কোনও মুহূর্তে ভেঙে পড়তে পারে।’

মারুনা ছুটতে ছুটতেই বলে ‘ভাঙুক, তোমার সঙ্গে আমার সম্পর্কটাও তো তাই, ভেঙে পড়বে যে-কোনও মুহূর্তে।’

শান্তনু ছুটে এসে ওকে জড়িয়ে ধরে নিবিড় করে। ‘না ভাঙবে না। তুমি আমায় ছেড়ে যাবে না, জানি আমি।’

কান্না থেমে যায় মারুনার। কি নির্লজ্জ লোক রে বাবা! মারুনা কি কুকুর নাকি এত অপমান সয়ে পড়ে থাকবে? ‘আমি যাব, চলে যাব, বারবার এভাবে পিয়ালীর কথা বললে।‘

‘আর বলব না মারুনা, ক্ষমা, ক্ষমা, শুধু একটা কথা, শেষবারের মতো।’

জেটিটা প্রবল টানে মারুনাকে। তবু সে থমকে যায় শান্তনুর কথা শোনার জন্যে।

‘এই জেটিতে দাঁড়িয়েই পিয়ালী ওই বাস্টার্ডটার কথা আমাকে বলেছিল, যেটার সঙ্গে ও থাকে মুম্বইতে। আমি চাই না মারুনা, তুমি ওই জেটিতে যাও।’

কান্নায় জড়িয়ে আসে শান্তনুর গলা। চাঁদের আলো পড়ে সেই চোখের জলে। মারুনা অবাক হয়ে দেখে শান্তনুর চোখে নদী, তার এপার-ওপার দেখতে পায় না সে।

পড়ার জন্য সীমাহীন গল্প-নিবন্ধসাবস্ক্রাইব