আপনার সন্তান কি ঠিক বয়ঃসন্ধির মুখে দাঁড়িয়ে ?

বয়ঃসন্ধির সময়টা হল কৈশোর পেরিয়ে যৌবনের সূত্রপাত। এই সময় ছেলে, মেয়ে উভয়েই মধ্যে আসে মানসিক এবং শারীরিক পরিবর্তন। কৈশোর থেকে প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের শরীরে রূপান্তরিত হওয়ার এই প্রক্রিয়ার Puberty ফলে শরীর প্রজনন সক্ষমতাও লাভ করে।

সাধারণত মেয়েদের বয়ঃসন্ধির প্রক্রিয়া ছেলেদের থেকে এক-দুই বছর আগেই শুরু হয়ে যায়। ৯ থেকে ১৪ বছরের মধ্যে মেয়েদের এবং ছেলেদের ক্ষেত্রে ১০ থেকে ১৭ বছরের মধ্যে এই প্রক্রিয়া সম্পূর্ণতাপ্রাপ্ত হয়। এই সময়ে হরমোনাল পরিবর্তনের কারণে কিশোর-কিশোরীদের চিন্তাভাবনারও দ্রুত পরিবর্তন ঘটতে দেখা যায়। তারা আত্মনির্ভর হয়ে উঠতে চায় কিন্তু পারিপার্শ্বিক পরিবেশের সঙ্গে সহজে খাপ খাওয়াতে পারে না। নিজেকে নিয়ে অনেকে বিব্রত বোধ করে। স্বাধীনতা প্রিয় হয় এবং বাবা-মা পরিবারের সান্নিধ্যের থেকে বন্ধু-বান্ধবের সাহচর্য বেশি পছন্দ করে। গোপনীয়তা বজায় রাখতে নিজের একটা আলাদা জগত্ তৈরি করে নিতে চায়। এছাড়াও দেখা যায় এই সময়কালে অত্যধিক আত্মসচেতন হয়ে ওঠার ফলে নতুন, ফ্যাশনেবল পোশাকের উপর ঝোঁক বাড়ে। প্রেম, ভালোবাসার জন্য সবকিছু ত্যাগ করতেও দ্বিধাবোধ করে না।

অভিভাবকদের উচিত সন্তানের এই মানসিক পরিবর্তনকালে বন্ধুর মতো পাশে পাশে থাকা। এই সময় ছেলে-মেয়েরা খুব অল্পতেই রেগে যায়। কোনও কারণে আশানুরূপ কাজ বা কথার অন্যথা হলে তারা রেগে ওঠে। এই ক্ষেত্রে তাদের সঙ্গে রাগের বিষয়টি নিয়ে পরিষ্কার আলোচনা করে তাদের ধারণায় স্বচ্ছতা আনা দরকার। রাগের প্রকাশ যেন সীমা অতিক্রম না করে, তার জন্য রাগের পরিস্থিতি থেকে সামযিক ভাবে কিছুক্ষণের জন্য সরিয়ে দেওয়া উচিত তাদের এবং শান্ত হতে তাদের সময় দিতে হবে। বিষয়ে পরিবর্তন করাটাও খুব জরুরি এইক্ষেত্রে। সুসম্পর্ক বজায় রাখতে রাগ মিটিয়ে ফেলা এবং ভুলে যাওয়া খুব দরকার।

তাই যতটা সম্ভব খেয়াল রাখতে হবে, Puberty-র সময়কালটায় সন্তানের রাগের প্রকাশ এমন হওয়া বাঞ্ছনীয় নয় যাতে অপর কেউ মানসিক বা শারীরিক আঘাতপ্রাপ্ত হয় বা অপরের সঙ্গে সম্পর্ক নষ্ট হয়। রাগের কারণ এবং সেই সময়ের মনোভাব সন্তানকে ডায়ারি বা কাগজে লিখে রাখতে বলতে পারেন যাতে পরবর্তীকালে সে সেটা সংশোধন করতে পারে।

অনেক সময় দেখা যায় সমবয়সিদের অন্যায় দাবি আপনার সন্তান মেনে নিতে পারছে না অথবা তাদের দ্বারা প্রত্যাখাত হওয়ার কারণে, সে মুষড়ে পড়ছে, নিজের আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলছে। মূল্যবোধের সঙ্গে সন্তানকে কখনও আপোস করতে দেবেন না। যুক্তি দিয়ে ওর বন্ধুদের বোঝাতে সাহায্য করুন। সন্তানকে বলুন ইতিবাচক চিন্তাভাবনা রাখে এমন মানুষের সঙ্গে মেলামেশা করতে এবং মনের মিল যার সঙ্গে হবে তাকেই বন্ধু বানাতে।

 

 

শাশুড়ি যদি হন ‘ওয়ার্কিং লেডি’

তিন চার দশক আগেও যখন বাড়ির বউটি কাজে বেরোনোর কথা জানাত, তখন শুধু তার পরিবারের মানুষদেরই নয়– এমনকী পাড়ার লোকেরও চোখ কপালে উঠত। গৃহলক্ষ্মী, পুরুষদের মতো আবার চাকরি করবে কী! ‘মহানগর’ ছবির আরতি-কে মনে পড়ে? সে তো এই মহানগরেরই কতশত আরতির প্রতিভূ, যে কিনা সামাজিক বেড়া লঙঘন করে তার একক সত্ত্বা আর আত্মমর্যাদা প্রতিষ্ঠার লড়াই চালিয়েছিল। ষাটের দশকের সেই-সব আত্মবিশ্বাসী বউমা-রা সন্তান পালন আর কর্মক্ষেত্র সামলানো, দুই-ই করেছেন ভরপুর আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে। তাঁরা অনেকেই এখন শাশুড়ি-মা। সেই সময়ের ‘ওয়ার্কিং মাদার’ হওয়ার গৌরবের কথা যাঁরা শেয়ার করেন, তাঁদের বউমাদের সঙ্গে।

আরও-একদল ‘শাশুড়ি-মা’ আছেন, যাঁরা হালফিল সমাজের চটপটে বউমাদের দেখে অনুপ্রাণিত। বউমাদের স্বয়ম্ভরিতা তাঁদের মনে সাহস জোগায় নতুন করে জীবনটাকে নিয়েঞ্জভাবার। আজ্ঞে হ্যাঁ, একটু চোখ-কান খোলা রাখলেই বুঝবেন এই সময়টা হল ‘ওয়ার্কিং’ শাশুড়িদের।

কথা হচ্ছিল রুপালি শাহ’র সাথে। শহরের আই-টি ফার্ম-এ চাকরি করা রুপালি, ভীষণ খুশি শাশুড়ির এই বলিষ্ঠ সিদ্ধান্তে। তিনি বলেন, ‘আই গেট অ্যালং পার্ফেক্টলি উইথ মাই মাদার-ইন-ল। আমার শাশুড়ি-মা সংসারের চাপে চাকরি ছেড়ে দেননি, তাঁর এই সিন্ধান্তটাকে আমি খুব শ্রদ্ধা করি। উনি একটি ব্যাংক-এ চাকরি করেন, ওঁর কাজের ফিক্সড আওয়ার্স থাকার জন্য উনি সংসারের রান্নাবান্নাও করেন। আমার ওয়ার্কিং আওয়ার্স একটু অড। আমি তেমন কিছু করতে পারি না সংসারের জন্য। তবু সেটা নিয়ে উনি কিছু মনে করেন না। আবার ছুটির দিনে আমি সংসারের সমস্ত দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিই। ওঁকে রিল্যাক্স করার সুযোগ করে দিই। উনি টিভি দেখে বা বন্ধু-আত্মীয়দের বাড়িতে গিয়ে গল্পগুজব করে সময় কাটান। আর যদি দুজনেই টায়ার্ড থাকি, তাহলে বাইরে থেকে খাবার আনিয়ে নিই। এভাবেই চলে আমাদের ঘরকন্না।’

এ তো গেল বউমার কথা। এবার দেখা যাক তাঁর শাশুড়ি কী বলছেন। গায়ত্রীদেবী, রুপালির শাশুড়ি। তাঁকে প্রশ্ন করা হলে বলেন, ‘আমি রুপালি-কে ভালো ভাবে চিনি। ও মোটেই অলস প্রকৃতির মেয়ে নয় যে সংসারের কাজে ফাঁকি দেবে। সপ্তাহের অন্যান্য দিন ও সত্যিই সময় পায় না, তাই সংসারের কাজ করে উঠতে পারে না। কিন্তু ওর মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা, আর কেয়ারিং নেচার আমায় মুগ্ধ করে। তাই ওর অফিস থেকে আসতে দেরি হলে, বা অফিস থেকে কোথাও সোশ্যালাইজ করতে যাওয়ার থাকলে, আমি রাগ করি না। একাই সামলে নিই সংসারের কাজ।’

অনেকেই হয়তো অবাক হয়ে ভাববেন, এও কি সম্ভব? হ্যাঁ সম্ভব। যদি অ্যাডজাস্টমেন্টের মানসিকতা থাকে।

‘আসলে অফিসের পাশাপাশি বাড়িতে রান্না করা, ঘর গোছানো এসব আমার প্রকৃতিগত হয়ে গেছে। খানিকটা অভ্যেসেই হয়তো রুপালির থেকে অনেক দ্রুত গতিতে আমি এসব কাজ সম্পন্ন করতে পারি। রুপালি এত গুছিয়ে সংসার সামলাতে পারে না, কারণ ওর চাকরিতে অবসর কম,’ সংযোজন গায়ত্রীদেবীর।

শাশুড়ি-বউমা রাজযোটক

 শাশুড়ি এবং বউমা আর নিজেদের প্রতিপক্ষ না-ভেবে, বন্ধু হয়ে উঠছেন, এই চিত্রটা খুবই আশাব্যঞ্জক। শাশুড়ি-মা যদি নিজে ওয়ার্কিং লেডি হন, তাহলে কর্মরতা বউমা-কে বোঝা তাঁর পক্ষে সহজ হয়। এটা অবশ্য উভয়ের দিক থেকেই সত্যি। কর্মস্থলের টেনশন, কাজের শেডিউল ইত্যাদি সম্পর্কে শাশুড়িরও হাতেকলমে অভিজ্ঞতা থাকার ফলে, তিনি বউমার সমস্যা ভালো ভাবে বুঝতে পারেন। এর ফলে বউমার সংসারে সময় না-দিতে পারাটা তিনি উদার মনে মেনে নেন।

আবার উলটোটাও ঘটে। বউমা অযথা শাশুড়িকে পরিশ্রম করানোর এবং নিজে আরামে থাকার মানসিকতা থেকে বেরিয়ে, শাশুড়ির সঙ্গে সহযোগিতা করে। শাশুড়ি বোঝেন, সংসারের কত প্রতিবন্ধকতা, বাধা ও অশান্তির বেড়াজাল টপকে তবে তাঁকে বাইরের দুনিয়ায় পা রাখতে হয়েছিল। আর এও বোঝেন যে বউমা, মনে মনে সমীহও করে তাঁর সেই লড়াই। একাধারে ভালো বউ, পারফেক্ট মাদার আর সুযোগ্য ‘অফিস গোয়ার’ হওয়ার মন্ত্রটি তিনি যেভাবে রপ্ত করেছিলেন, তা শেয়ারও করেন বউমার সঙ্গে। এভাবেই তিনি বউমাকেও একই চ্যালেঞ্জ নিতে উদ্বুদ্ধ করেন এই আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে, যে বউমাও নিশ্চয়ই পারবে তাঁর দেখানো পথে সফল হতে।

সীমা বিশ্বাস একটি মিডিয়া সংস্থায় কর্মরতা। তাকে শিফ্ট ডিউটি-তে কাজ করতে হয়। নানা অসুবিধার মধ্যে একটাই শুধু সুবিধা, সেটা হল সীমা অগ্রিম জানতে পারেন তাঁর সাপ্তাহিক শেডিউল। সেই মতো সামলে নেন সংসারের বাজারহাট বা অতিথি আপ্যায়ন। শাশুড়ি একটি বাণিজ্যিক সংস্থায় সিনিয়র অ্যাডমিনিস্ট্রেটর হিসাবে কর্মরতা। তাঁর অফিস যাওয়া-আসার সময় নির্দিষ্ট। সীমা তাঁর রুটিন অনুযায়ী বাচ্চাদের দেখাশোনা করেন, অন্যান্যদিন এই কাজের ভার নেন তাঁর শাশুড়ি।

সবচেয়ে আনন্দের কথা হল সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পুরুষরাও যথেষ্ট সহযোগিতার মানসিকতা তৈরি করে ফেলেছেন। বাড়ির দুই মহিলা সদস্য, মা এবং স্ত্রী কর্মস্থলে যাবেন বলে একধরনের মানসিক প্রস্তুতি যেন  তৈরি হয়ে গেছে এখনকার পুরুষদের মধ্যে। ফলে অনেক সময় শিশুদের দেখভাল বা সংসারের কাজকর্মে তারাও সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে। দক্ষ হাতে বাচ্চার ডায়পার বদলানো কিংবা দুধ গুলে ফিডিং বট্ল-এ করে বাচ্চাকে খাওয়ানো– এখন অনেক পুরুষের কাছেই খুব সহজ কাজ হয়ে গেছে।

শাশুড়ি-বউমার অ্যাডজাস্টমেন্ট বহু পরিবারেই আনন্দ নিয়ে এসেছে। ঈর্ষা বা রেশারেশির প্রশ্নই ওঠে না, উপরন্তু দু’জনে নিজের উপার্জনে পরস্পরকে উপহার দেওয়া ছাড়াও, শাশুড়ি-বউমা পরস্পরের ব্যাংক-এর কাজকর্ম বা অতিথি আপ্যায়নের কাজটা সামলে দিচ্ছেন অক্লেশে। এমনটা হয়তো একদশক আগেও ভাবা যেত না!

আধুনিক মনস্ক শাশুড়ি-মা

 এখনকার ওয়ার্কিং শাশুড়ি-মা’রা সংসারের দায়িত্ব নিতে সর্বদা প্রস্তুত। প্রীতিলতা মিত্র এমনই একজন শাশুড়ি, যিনি একটি বাচ্চাদের স্কুল চালান। কিন্তু এই কাজের অবসরে তিনি তাঁর একমাত্র নাতি রোহনের দেখাশোনা করতে ভোলেন না। তাঁর বউমা রাইমা, মাতৃত্বের ছুটির মেয়াদ পেরোতেই পুনরায় কাজে যোগ দিয়েছে। কিন্তু রাইমা নিশ্চিন্ত যে, তার সদ্যজাত শিশুটি তার শাশুড়ি-মা’র তত্ত্বাবধানে ভালোই থাকবে। প্রীতিলতা স্কুলের প্রধানা হওয়া সত্ত্বেও, কাজের ফাঁকে ফাঁকে তার স্কুল-সংলগ্ন বাড়িতে গিয়ে নাতির দেখাশোনা করে আসেন। রাইমা জানে, শাশুড়ির ব্যস্ততা তার চেয়ে হয়তো অনেকগুন বেশি, তবু প্রীতির মধ্যে এমন একটি সহজাত স্নেহশীলতা আছে, যা দায়িত্ববোধ পালনে প্রতিনিয়ত তাঁকে উদ্বুদ্ধ করে।

এ যুগের শাশুড়িরা অবশ্য সেকেলে শাশুড়িদের মতো রক্ষণশীল বা ডমিনেটিং নন। কর্মজগতের নানা চ্যালেঞ্জ নিতে নিতে হয়তো তাদের মধ্যে উদারতার মনোভাব তৈরি হয়ে গেছে। কর্মক্ষেত্রে অ্যাডজাস্ট করার প্রবণতা হয়তো পারিবারিক জীবন যাত্রাকেও প্রভাবিত করেছে। ফলে বউমাদের আজকাল শাশুড়িকে কিছু শেয়ার করতে অসুবিধা হয় না। আর্থিক স্বয়ম্ভরিতা দুজনের মধ্যের পাঁচিল ভেঙে, সম্পর্কটাকে সহজ-স্বাভাবিক করে তুলেছে। দুজনেই প্রতিদ্বন্দ্বিতার মানসিকতা থেকে বেরিয়ে হয়ে উঠছেন পরস্পরের প্রিয় সখী।

আইকিউ বাড়ানোর ম্যাজিক মেথড

শিশুর বুদ্ধিমত্তা বিচার :

–    আপনার ছোট্ট বাচ্চাটির সঙ্গে খেলার সময়ে, কয়েকটা কাজ বাছাই করে বের করে নিন। তাদেরও কিছু করতে দিন। যেমন– পাজল সলভ্ করান, একটা গান গেয়ে শোনাতে বলুন, একটা ছবি আঁকান বা একটা গল্প বলান। প্রত্যেকবারই একই কাজের পুনরাবৃত্তি প্রয়োজন নেই। কিন্তু প্রতিবারই নতুন কিছু করতে দিন এবং দুটি বা তিনটির পুনরাবৃত্তি করুন।

–    অতি দ্রুত, আপনার ছেলে বা মেয়ে কীসে ইচ্ছুক, তা আপনার সামনে চলে আসবে। তার এই ইচ্ছের Talent মধ্য দিয়েই শিক্ষার প্রণালী খুঁজে পাবেন। এর ফলে আপনি এই কাজগুলির সঙ্গে আপনার শিশুর আইকিউ-এর সংমিশ্রণ খুঁজে পাবেন।

নানা কাজের মধ্যে নিজের সন্তানকে নিয়োজিত করুন। অবশ্যই এই কাজগুলি যেন তাদের পছন্দমতো হয় এবং তারা করতে আগ্রহী হয়। একাধিক অ্যাক্টিভিটির সাহায্যে তার প্রতিভার Talent স্ফূরণ ঘটতে পারে, তাতে তাকে সাহায্য করুন। এর ফলে কিছু কিছু ক্ষেত্রে আপনার সন্তানের অবিরাম সাফল্য, উৎসাহ ও আনন্দ টের পাবেন। নির্দিষ্ট উচ্চ আইকিউ-এর এটি একটি ইঙ্গিত।

অভিভাবকদের জন্য:

বুঝতে চেষ্টা করুন যে আইকিউ সবসময় স্থির নয়। লেখাপড়ায় সাধারণ বা নিম্নমানের হলেও তাদের সামনে অসংখ্য পছন্দসই পথ খোলা রয়েছে। আমরা প্রত্যেকেই আট প্রকার আইকিউ আশীর্বাদ স্বরূপ স্বতঃস্ফূর্তভাবে পেয়েছি। এগুলি হল– ভাষাগত, আঙ্কিক, দৃশ্যগত, শারীরিক, গতিশীল, সাঙ্গীতিক, পারস্পরিক, স্বাভাবিক এবং ব্যক্তিগত বুদ্ধি বা আইকিউ।

আপনার সন্তানকে, আত্মমর্যাদা গঠন করে তা বাড়িয়ে তুলতে সাহায্য করুন। প্রশংসা ও স্নেহশীলতার মাধ্যমে যে-কোনও সদর্থক পরিবর্তন আসতে পারে।

–    খারাপ ফল করার সঠিক কারণ খুঁজে বের করুন এবং এভাবেই তাকে ভালো ফল করতে শেখান।

–    আপনার সন্তান সবচেয়ে ভালো কী করতে পারে, সে বিষয়ে তাদের সাহস যোগান। সাধারণমাত্রায় তারা কী করতে পারে সেদিকে বেশি গুরুত্ব দেবেন না।

–    ছেলে বা মেয়েকে সাবলম্বি করে তুলতে, যত সহজে বিষয়টি তাদেরকে শেখানো যায়, সেই সহজ শিক্ষা পদ্ধতি অবলম্বন করুন। এর ফলে সে সহজেই এই শিক্ষাপদ্ধতি ব্যবহারিক জীবনে প্রয়োগও করতে পারবে।

ছেলেমেয়ের মেধা Talent বাড়ানো এখন আর কোনও কঠিন কাজ নয়। তাদের সঙ্গে থাকুন, এগিয়ে চলতে সাহায্য করুন।

 

সন্তানের আইকিউ লেভেল নির্ধারণ করুন

আপনি কি আপনার সন্তানের বিষয়ে চিন্তিত? তাকে অলরাউন্ডার বানাতে চান? শুধু আপনিই নন, আপনার মতো অনেক অভিভাবকই, পড়াশোনা ছাড়াও খেলাধূলা, গান-বাজনা, ছবি-আঁকা সবেতেই নিজেদের ছেলে বা মেয়েকে সেরা করে আপনি তুলতে চান। উদ্দেশ্য– সমস্ত প্রতিযোগিতায় নিজ সন্তান যেন প্রথম হয়। ইনটেলিজেন্ট কোশেন্ট বা আইকিউ আমাদের সবারই সম্বল। কিন্তু অধিকাংশ মানুষই যে-বিষয়টি ভেবে দেখেন না তা হল, আইকিউ-এর ভিন্নতায় প্রতিটি শিশু মেধা ও বুদ্ধিবৃত্তিতে Talent and wisdom পৃথক হয়ে যায়। কম-বেশি মেধা অনুযায়ী নির্ভর করে শিশুর সামগ্রিক পারফরমেন্স। সুতরাং কোনও কোনও শিশু এই প্রতিযোগিতায় পয়লা সারিতে স্থান না-ও পেতে পারে। তা নিয়ে হতাশ হবার কিছু নেই। কারণ… আইকিউ বা বুদ্ধিমত্তা এমনই এক স্থিতিস্থাপক, যা বাড়ানো যায়। এটি স্থির নয়। আমরা প্রত্যেকেই জন্মগতভাবে কিছু পরিমাণ বুদ্ধিমত্তা দ্বারা আশীর্বাদধন্য। কোনও একটি বিশেষ ক্রিয়াকলাপে কারও বুদ্ধির হার বেশি বা কম হয়।

শিশুর খেয়ালখুশি

অঙ্কের ফরমুলা নিজের মনে গুনগুন করে কোয়েল। ছন্দের তালে কবিতা, পেনসিল ঘুরিয়ে বানান শেখে। অঙ্কিতা আগে ছবি আঁকে তারপর আঁকা ছবির ব্যাখ্যা করে। এসব শিশু আমার আপনার ঘরেই রয়েছে। এরা তাদের স্কুলের কাজে পারদর্শী হতে নিজস্ব বুদ্ধিমত্তা বা আইকিউ প্রয়োগ করতে পছন্দ করে।

প্রথাগত পড়াশোনা ও আইকিউ

আমাদের সমাজে একটি শিশুর ইনটেলিজেন্স কোশেন্ট নির্ণয় করা হয় তার রিপোর্ট-কার্ড দেখে। প্রত্যেকেই এক অনিশ্চিত ইঁদুর দৌড়ের শিকার। তারই অংশস্বরূপ প্রত্যেক দুজনের একজন শিক্ষার্থী ইঞ্জিনিয়ারিং, মেডিসিন, সিএ, সিএস, বিবিএ পড়ে।

এই ছবিটা ‘কমন’ হলেও ব্যতিক্রম সব ক্ষেত্রেই থাকে। অনেক ছাত্র এমনও আছে যারা জীবনে ভালো কিছু করতে পারছে না। অথচ তাদের মধ্যে কোনও না কোনও বিষয়ে আইকিউ লেভেল যথেষ্ট ভালো।

আমাদের সবারই ব্যক্তিত্ব, পছন্দ, বিশেষ পারদর্শীতার বিভিন্নতা রয়েছে। রামধনুর সাতরঙের মতোই আমাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যগুলি পৃথক ও স্পষ্ট। আমাদের শিক্ষাপদ্ধতিও ভিন্ন। অভিভাবক ও শিক্ষক-শিক্ষিকাদের প্রথম থেকেই উচিত তাদের সন্তানদের এবং শিক্ষার্থীদের মধ্যে এই পার্থক্য পর্যবেক্ষণ ও মূল্যায়ন করা। একবার যদি আমরা সবাই আমাদের ছেলেমেয়েদের সমর্থ সম্পর্কে অবহিত হই, এবং জানতে পারি তারা কী ধরনের পড়ুয়া-তাহলে নানা কাজের মাধ্যমে তাদের সক্ষমতার একটা আভাস পাব এবং এর ফলে তাদের প্রতিভা বিকাশের সুযোগ ও সাফল্য বৃদ্ধি করতে পারব।

এই প্রসঙ্গে শহরের এক কাউন্সেলর বললেন যে, ‘আমাদের ছেলেমেয়েদের প্রত্যেকের মধ্যেই বিশেষ কিছু গুণাবলি আছে, যা প্রকাশের জন্য প্রয়োজন সঠিক সাহসিকতা, উপযুক্ত অভিভাবকত্ব ও নির্দেশনা।’

আইকিউ-এর সমীক্ষা

বাবা-মায়েরাই শিশুর প্রবণতার পরিমাপ সবচেয়ে ভালো করতে পারেন। আপনাদের বাচ্চারা যেসব প্রশ্ন বা যেসব কাজ করে তার প্রতি সতর্ক থাকুন, সজাগ দৃষ্টি দিন। যেমন – আপনার ছেলে বা মেয়ে কি গৃহস্থালির জিনিসপত্র তছনছ করে? তারা তাদের ভঙ্গিমা প্রকাশে ভালো বা মন্দ, গান শুনলে দুলে ওঠে কি না, বা দেয়ালে হিজিবিজি আঁকিবুঁকি কাটে কি না। লক্ষ্য করুন যে আপনার সন্তান খেলায় ক্যাপ্টেন হতে চায় কি না। একবার যদি আপনি আপনার সন্তানের মনের ঝোঁক বুঝতে পারেন, তার ক্রিয়েটিভ ট্যালেন্টের সন্ধান পান, লেখাপড়া শেখা তার কাছে বোঝা হয়ে দাঁড়াবে না। শিশুদের যদি শেখানো যায় কী তাদের স্ট্রং পয়েন্ট এবং তারা বুদ্ধিমান, এই মোটিভেশন-ই তাদের সঠিক পথে চালিত হতে সাহায্য করবে। নিজেদের আইকিউ Talent and wisdom আবিষ্কার করতে শিশুদের সাহস যোগানো প্রয়োজন। স্বাস্থ্যবান, প্রাণোচ্ছল ও মেধাবী শিশুদের নির্ভরতার আধার হল বই, খেলনা আর খেলাধূলা। যেসব শিশু ছোটো থেকেই এমন অভ্যাস তৈরি করে, তারা যে-কোনও বিষয়ে শেখার নানা রাস্তা উদ্ভাবন করে।

 

 

সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং এবং সম্পর্কে এর প্রভাব

অজানাকে জানা আর দূরকে নিকট করার অন্যতম সেরা মাধ্যম হল Social Networking সাইটস বা এসএনএস। আজকের বৈদ্যুতিক ও বৈদ্যুতিন যুগে ব্যক্তিমানুষ বড়ো একা। এই একাকিত্ব দূর করতে স্ত্রী-পুরুষ উভয়েই এসএনএস নির্ভর। সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং কী সত্যিই মানুষকে আনে মানুষের কাছে, নাকি একের সঙ্গে অপরের বন্ধন করে শিথিল? এই প্রশ্ন উত্থাপিত হচ্ছে সময়েরই দাবিতে।

আজকের ইন্টারনেটের যুগে একটি অতি পরিচিত সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইট হল ‘লিংকড ইন’। এটি এমনই একটি সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইট যা আজকের প্রোফেশনালদের পক্ষে এড়ানো কঠিন। কারণ এটি শুধু চাকরি খুঁজতেই সহায়তা করে না, উপরন্তু নানা শাখায় যুক্ত থাকা মানুষজনের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনেও অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করে। অন্ততপক্ষে ২০০ দেশের ১৫০ কোটি মানুষ বর্তমানে এই সাইটের সদস্য।

জীবন থেকে অর্কুট-ফেসবুক-ট্যুইটার-স্কাইপ বাদ দিলে, সাধারণ মানুষ থেকে সেলিব্রিটি, সকলেই যেন এক নিঃসঙ্গতার অসহায়ত্ব অনুভব করে। টিন-এজ ছেলেমেয়েরা অর্কুট-ফেসবুক-এ এতটাই আসক্ত যে, এছাড়া তারা বন্ধুত্ব পাতাতেই পারে না। আর ট্যুইটার?  মনে আছে ক্রিকেটার যুবরাজ সিং-এর যখন ক্যানসার ট্রিটমেন্ট হচ্ছিল মার্কিন দেশে, আমরা ঘরে বসেই তার বিস্তারিত বিবরণ পেয়ে যাচ্ছিলাম। কীভাবে সম্ভব হল? হ্যাঁ, ট্যুইটারে তিনি তাঁর অবস্থার ধারাবাহিক বিবরণ করতেন। ট্যুইটার ব্যবহারে অভিনেতা অমিতাভ বচ্চন বেশ এগিয়ে। ঐশ্বর্য রাইও রয়েছেন সেইসঙ্গে, ফলে ঘরে বসেই আমরা পেরেছিলাম অমিতাভের দাদু হওয়ার যাবতীয় সুখানুভূতির শরিক হতে।

দীর্ঘদিনের না-দেখা মুখ হঠাৎই জীবন্ত হয়ে ওঠে স্কাইপ-এর ম্যাজিক স্পর্শে। এর সাহায্যে মেলে ভিডিও কনফারেন্সিং-এর সুবিধা। বিশ্বের যে-কোনও প্রান্তের মানুষের সঙ্গে অফিস মিটিং-ও খুব অনায়াসেই সম্পন্ন হয়। মেটে, ‘বন্ধু কী খবর বল, কতদিন দেখা হয়নি’ বলার আক্ষেপ। সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটগুলি এভাবেই যোগাযোগের সক্রিয় মাধ্যম হয়ে উঠছে।

বিশেষজ্ঞদের মতে অবশ্য, এই সব সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটগুলো ইমোশনাল ডিসপ্লের সর্বোত্তম মাধ্যম নয়, যার ফলে পারস্পরিক সম্পর্ক স্থাপিত হতে পারে। উপরন্তু, পারস্পরিক সম্পর্কের বিবিধ দিক বিকশিত হয় না এই যান্ত্রিক মাধ্যমে। আজকের দিনের যুবসম্প্রদায়, ক্বচিৎ ব্যক্তিগত আলোচনা করে বলে, তাদের ইমোশনাল ইনটেলেক্ট এমনিতেই প্রকাশ বিমুখ। তাই বন্ধুবান্ধব-বান্ধবীদের বিচ্ছেদও এই মাধ্যম মারফতই হয় অতি দ্রুততার সঙ্গে।

একমাত্র স্থায়ী বিষয়টি হল, পরিবর্তন। অর্থাৎ চিরায়ত সংযোগের নীতিগুলি পরিবর্তিত হচ্ছে ক্রমাগত। ফলত মানুষের পারস্পরিক সম্পর্কও পরিবর্তিত হয় নিরন্তর। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যে, একটি চোদ্দো বছরের ছেলেকে শিক্ষিকা বকলে, ছাত্রটি শিক্ষিকার বিরুদ্ধে ফেসবুকে কিছু কুরুচিকর এবং জঘন্য কথা লেখে। ফলে শিক্ষিকার আত্মমর্যাদা ক্ষুণ্ণ হয়। এই সাইটগুলো যেন ক্রমশই আমাদের হতাশা প্রকাশ করার মাধ্যম হয়ে উঠছে। কিন্তু ছাত্রছাত্রীরা যেটা করে তা হল অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তারা শেষমেশ অন্যকে আঘাত করে। অভিভাবকেরাও জানেন না, এইসব পরিস্থিতি কীভাবে সামলাতে হয়, কারণ ট্যুইটার-ফেসবুকের মতো এগুলোও নতুন।

ছাত্ররা যেসব সমস্যার সম্মুখীন হয়

স্কুলে সামান্য কলহ হলেও এইসব সাইটে প্রতিশোধ তোলা যায়, এমনটাই ধরে নিচ্ছে এ যুগের পড়ুয়ারা। অনেক সময়ে ফেক অ্যাকাউন্ট থেকে এমন সব উদ্ভট খবর রটিয়ে দেওয়া হয়, যার ফলে যে-কোনও ব্যক্তি মানুষের সামাজিক পরিচয়ও কলুষিত হয়। এবং কে যে কার ক্ষতি চায় সেটিও সঠিকভাবে অনুসন্ধান করা যায় না।

অর্পিতা, ্বঙ্ম, একজন বিপিও প্রফেশনাল এবং তার ডাক্তার বয়ফ্রেন্ড মৃত্যুঞ্জয় সাইক্রিয়াটিস্ট এক কমিটেড অবিবাহিত কাপল। জীবনে তাদের ঝঞ্ঝা এসেছিল। তাদের সম্বন্ধের ভিতেই একদিন অবিশ্বাস্যভাবে ফাটল ধরল, অর্পিতা তার পাঁচ বছরব্যাপী বয়ফ্রেন্ডকে যখন বলল, সে ব্রেকআপের কথা ভাবছে, মৃত্যুঞ্জয় তার ভাবনা প্রকাশ করার মাধ্যম করল এসএনএস-কে এবং তার ফেসবুক অ্যাকাউন্ট-এ একটি কমেন্ট পোস্ট করল, যাতে সকলেই জানল যে তাদের সম্পর্ক শেষ হবার মুখে। এতে তার ব্যক্তিগত আঘাত আর ব্যক্তিগত রইল না, সম্পর্কের গোপনীয়তা হরণ করল ওই নেটওয়ার্ক সাইট।

অবশ্য, Social Networking–এর দুনিয়ার কিছু প্লাস পয়েন্টও রয়েছে। অর্পিতা-মৃত্যুঞ্জয় এখনও সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটে রয়েছে এবং মৃত্যুঞ্জয় বলে যে, সে তার বন্ধুদের কাছে কৃতজ্ঞ এই ভেবে যে সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটে কী বলা উচিত আর কী বলা উচিত নয়, তা বন্ধুরা তাকে বলেছে। এই বন্ধুরাই তাকে মেন্টালি সাপোর্ট-ও দিয়েছে। ভেঙে পড়ার সময়টাতে মৃত্যঞ্জয় যখন  তাদের মিঠে-কড়া সম্পর্কের সমাপ্তি ঘোষণা করল ফেসবুকে, তার কিছুদিন পরে তাদের কমন ফ্রেন্ডসদের কেউ কেউ তাদের প্যাচ-আপ-এরও চেষ্টা করল। তারা পরামর্শ ও কমেন্টস পাঠাতে লাগল এই বলে যে, অযাচিত ভাবাবেগের উপর লাগাম দিয়ে তারা যেন আর-একবার সম্পর্কটা গড়ার কথা ভাবে। তারা বিচ্ছিন্ন প্রেমিকযুগলকে বলল, যাবতীয় বিদ্বেষ ভুলে, ফেসবুক-ট্যুইটারের ওপেন ফোরামের পরিবর্তে পরস্পরের সঙ্গে কিছুটা ব্যক্তিগত সময় অতিবাহিত করতে। এপন্থায় তাদের পারস্পরিক সম্পর্ক আরও দৃঢ় হল এবং তারা জোড় বাধার জন্য নতুন করে তৈরি হল।

বিশেষজ্ঞদের মতে, ‘সংযোগের সাবেকি প্রথায় পরিবর্তন আসছে। চিরন্তন সংযোগ আজ মৃতপ্রায়। অতএব, একটি নতুন ব্যবস্থার প্রয়োজন। একটি নভেল প্রোটোকল মেনে চলা উচিত যাতে নষ্টপ্রায় সম্পর্ককে শুধরোনো যায়।

সমাজবিজ্ঞানী শিব বিশ্বনাথন-এর মতে, ‘সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং-এর ভাবনা এই সময়ের অনুষঙ্গ বহন করে।’ কোনওরকম দ্বন্দ্ব বা তিক্ত সম্পর্ক এড়ানোর জন্য এধরনের সংলাপ বা যোগাযোগ মাধ্যম সযত্নে ব্যবহার করা উচিত বলে মনে করেন বিশ্বনাথন। সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইট বা এসএনএস-কে বলা যায় সংঘ-ভিত্তিক ওয়েবসাইট, ডিসকাশন ফোরাম, চ্যাটরুম এবং অনলাইনের ইউনিক স্পেস।

 

পরিণয়ের আগে পরস্পরকে চিনুন পর্ব-১

জীবনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় অবশ্যই বিয়ে। কারণ, জন্ম থেকে মৃত্যু এই সফরপথে সবচেয়ে বেশি সময় জুড়ে থাকে দাম্পত্য জীবনযাপন। সাধারণত, শিক্ষাপর্বের পরে কর্মজীবনের নিশ্চয়তা তৈরি হওয়ার পর, বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নেন এই প্রজন্মের বেশিরভাগ তরুণ-তরুণী। আর যেহেতু পারস্পরিক বোঝাপড়ার একটা সরু সুতোর উপর অবস্থান করে দাম্পত্য, তাই ভারসাম্য থাকা অত্যন্ত জরুরি। কিন্তু ভারসাম্য কতটা বজায় থাকবে কিংবা আদৌ থাকবে কিনা তা স্বামী-স্ত্রীর স্বভাব চরিত্র, মনন-মানসিকতা এবং আরও অনেক বিষয়ে উপর নির্ভর করবে। কোনও মানুষই হয়তো ১০০ শতাংশ পারফেক্ট হন না এটাই বাস্তব। কিন্তু ভালোর থেকে খারাপের পাল্লা ভারী হলেই বিপত্তি ঘটার প্রবল সম্ভাবনা থাকবে।

মনে রাখবেন, কোনও দাম্পত্য সম্পর্ক ভেঙে যাওয়া মোটেই সুখকর নয়। কারণ, যারা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন, তাদের সঙ্গে নানা ভাবে জড়িয়ে থাকেন পরিবারের সদস্য এবং আত্মীয়রা। আর যদি সন্তান জন্মলাভের পরে বিবাহবিচ্ছেদ ঘটে, তাহলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় নির্দোষ সন্তান। কাজেই, বিচ্ছেদে শুধু মন ভাঙে না, নানা ভাবে অপূরণীয় ক্ষতি হয়, এমনকী অনেকসময় জীবনহানিও ঘটে যায়।

একটা সময় ছিল যখন সন্তানের জীবনসঙ্গী নির্বাচনের ক্ষেত্রে মা-বাবার সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত ছিল। কিন্তু সময় বদলেছে। গ্রাম থেকে শহর সর্বত্র তরুণ-তরুণীরা এখন বেশিরভাগই মা-বাবার সিদ্ধান্তকে মেনে নিতে বাধ্য নন সবসময়। বরং, সিংহভাগ তরুণ-তরুণী বিয়ের ব্যাপারে নিজেরাই সিদ্ধান্ত নেন এখন। কিন্তু যৌবনের উন্মাদনা, অতিরিক্ত আবেগ, বোধবুদ্ধির অপূর্ণতা, ভালোমন্দের তফাত ঠিক মতো বুঝতে না পারা, অদূরদর্শিতা কিংবা হঠকারিতা প্রভৃতি কারণে জীবনসঙ্গী নির্বাচনে ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন অনেকেই। আর জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ের ক্ষেত্রে যদি একবার কেউ ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে নেন, তাহলে সেই ভুলের জন্য আজীবন মাশুল গুনতে হয় তাকে।

অনেকে ভেবে নেন, প্রেমের বিয়েতে পরস্পরের সম্পর্কে ভালো ভাবে জানা হয়ে যায়, তাই বিয়ের পরে বিপত্তি ঘটার সম্ভাবনা কম। না, সবসময় এই ভাবনা সঠিক হয় না। কারণ, প্রেমের বিয়েতে অতিরিক্ত আবেগ থাকে। আর অতিরিক্ত আবেগ বাস্তব থেকে দূরে সরিয়ে দেয়। এর ফলে, জেগে ঘুমোন অনেকে। অর্থাৎ, হবু জীবনসঙ্গীর দোষত্রুটি থাকা সত্ত্বেও, তা চোখে পড়ে না। এ অনেকটা ওই জলে পোঁতা বাঁকা কাঠিকে সোজা দেখতে লাগার মতো বিষয়। অনেকে তো আবার শুধু বাহ্যিক সৌন্দর্য  কিংবা ফিগার দেখে আকৃষ্ট হয়ে প্রেমে পড়েন এবং বিয়ে করে নেন। কিন্তু আপাতসুন্দর বাঘসিংহ যখন দাঁতনখ বসিয়ে দেয় শরীরে, তখন সেই হিংস্র রূপ দেখে ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছি বলে অনুশোচনা করে কোনও সুফল পাওয়া যায় না। অতএব, সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়া জরুরি। আর বিয়ের আগে অর্থাৎ কোর্টশিপ পর্বে জীবনসঙ্গীর সম্পর্কে কীভাবে এবং কোন কোন বিষয়ে জানলে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে সুবিধে হবে, জেনে নিন সেই বিষয়ে—

সাক্ষাৎপর্ব 

প্রাথমিক পছন্দ এবং বিয়ের কথা এগোনোর পর, দুজনের একান্ত সাক্ষাতের প্রযোজনীয়তার কথা জানান হবু সঙ্গীকে। তিনি রাজি থাকলে কোনও উদ্যান কিংবা রেস্তোরাঁয় দেখা করুন। আর এখান থেকেই শুরু করুন অবজার্ভেশন। যেমন সঠিক সময়ে তিনি আপনার সঙ্গে দেখা করার জন্য পৌঁছোচ্ছেন কিনা, অর্থাৎ তিনি পাংচুয়াল কিনা কিংবা কথা রাখার ক্ষেত্রে কতটা তিনি সিরিয়াস ইত্যাদি।

এরপর নজর রাখুন দেখা করার পর তার প্রতিক্রিয়া কেমন। তিনি আপনার জন্য কোনও উপহার এনেছেন কিনা প্রথম একান্ত সাক্ষাতে এটা দেখা যেমন জরুরি, ঠিক তেমনই আপনি যদি তাকে কোনও উপহার দেন তাহলে সেক্ষেত্রে তিনি কী ভমিকা নিচ্ছেন, এটা দেখাও জরুরি। তিনি কেমন পোশাক পরেছেন কিংবা আপনার পরা পোশাকের বিষয়ে কোনও তারিফ বা মন্তব্য করছেন কিনা তাও দেখা উচিত। অর্থাৎ, এর থেকে কিছুটা আন্দাজ করা যাবে, তিনি কতটা সিনসিয়ার আপনার বিষয়ে এরপর কথা বলা কিংবা আচার আচরণে তিনি বিনম্রভাব দেখাচ্ছেন কিনা, সেটাও পরখ করুন। এমনকী, রেস্তোরাঁয় খাবার অর্ডার করার আগে খাবারের বিষয়ে তিনি আপনার পছন্দ অপছন্দকে গুরুত্ব দিচ্ছেন কিনা কিংবা লক্ষ্য রাখুন খাবারের দাম মেটানোর সময় তিনি কতটা আন্তরিক।

আসলে এইসব ছোটো ছোটো বিষয় থেকে একজনের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য অনেকটা আন্দাজ করা যায়। তবে একবার মুখোমুখি হওয়ার পরই সবকিছু জেনেবুঝে গেছেন এমন ভেবে নেবেন না। কাউকে ঠিকমতো বুঝতে হলে অন্তত পাঁচ থেকে সাতবার একসঙ্গে কিছুটা সময় ব্যয় করা অত্যন্ত জরুরি বিয়ের আগে। কারণ অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আছে, যা বিয়ের আগে জানতে বুঝতে হলে পাঁচ-সাতবার দেখা করে কথা বলা প্রযোজন। কেন-না, এক অপরিচিত মানুষকে প্রথম একান্ত সাক্ষাতে সবকিছু জিজ্ঞেস করা যায় না কিংবা শোভনীয়ও নয়। যাইহোক, এবার জেনে নিন বিয়ের সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে কোন কোন বিষয়ে জেনে নেবেন হবু সঙ্গীর থেকে কিংবা খোঁজখবর নেবেন তার সম্পর্কে।

দাম্পত্যে ‘তোমার-আমার’

একটি মেয়ে বিয়ের Married Life পরে প্রবেশ করে নতুন এক পরিবারে। এই পরিবারের একটি মাত্র সদস্যই তার একান্ত আপন। কিন্তু কোনও স্ত্রী, স্বামীর সব কথা শুনে চলার পর তার শ্বশুর-শাশুড়ির সব কথা ভালো মনে মেনে নিতে না-ও পারে। ঠিক তখনই দেখা দেয় দ্বন্দ্ব। কীভাবে? গৃহবধূরা আজকাল প্রায়শই শ্বশুর-শাশুড়ির সংসার থেকে ভিন্ন হয়ে বেরিয়ে আসতে চায়। কেন এমন হয়, আপাতদৃষ্টিতে আমরা তা বুঝি না। এখন ঘরে ঘরে একটাই পুত্রসন্তান – তবুও এমন হচ্ছে। অ্যাডজাস্টমেন্টের কি কোনও পথ নেই? হয়তো আছে, কিন্তু সে পথে কেউ হাঁটতে চায় না।

শ্বশুর-শাশুড়ি বদমেজাজি, এমন অভিযোগ বউমাদের তরফ থেকেই আসে। স্বামীটি ভেবে পায় না বাবা-মা’র কত আদর-যত্ন-ভালোবাসায় সে বড়ো হয়েছে, আর তাদেরকেই তার স্ত্রী বলছে বদমেজাজি স্বভাবের? অন্যদিকে শ্বশুর-শ্বাশুড়ির প্রশ্ন, বউ-মা-তো নিজের মুখ সামলেই কথা বলতে শেখেনি, শ্বশুর-শাশুড়িকে কীভাবে সামলাবে? এদিকে বউমা ভাবে অফিস-সংসার সব সামলে সংসারে যদি একটু উষ্ণতার ছোঁয়া পাওয়া না যায়, তাহলেই বা কীভাবে চলে? স্বামী কিন্তু সবসময়ই একথাই বোঝাতে চায় যে, তার বাবা-মা বদমেজাজি নয় বরং স্পষ্টবাদী। স্ত্রীও ছাড়বে কেন, সে ভাবে স্পষ্টবাদী হওয়া আজকাল শোভনীয় নয়। আবার সে নিজেই সব কথা স্পষ্টভাবে জানায় তার স্বামীকে।

এমন ঘটনাই ঘটল বৃন্দা আর সুফলের জীবনে, বৃন্দার স্বামী সুফল কিছুতেই বুঝতে চায় না, ত্রুটি-টা বৃন্দার তরফে নয়, বরং সুফলের বাবা-মা’র মধ্যেই অ্যাডজাস্টমেন্টের অভাব। চোখে জল আসে বৃন্দার। কথা না বলে চুপ করে যায়। কান্না পায় এই ভেবে যে, স্বামী যদি একবারও তার দুঃখটা বুঝত। যদি বলত ‘আমি তোমার কষ্টটা বুঝতে পারছি, তুমি এভাবে চলো।’ কিন্তু সেই পথে সুফল হাঁটল না।

এখন শ্বশুর-শাশুড়ির সঙ্গে স্বামীর প্রতিও একধরনের উষ্মা দেখা দিয়েছে বৃন্দার মনে। সুফল আর সে যে, শপথ করেছিল দুটি মন একটি প্রাণের! কিন্তু স্বামীই সে কথা ভুলে গেল? একদিন স্বামীকে যখন বৃন্দা সে কথা জানাল, সে নির্বিবাদে বলল, ‘তুমিও তো বলছ আলাদা হবে, আমার বাবা-মা বদমেজাজি।’ সুফল আরও বলল, ‘সেদিন তোমার পিসিমা এসেছিলেন বারেবারে বললেন আমার বাবার মতো মানুষ হয় না, আমি কোনওদিনই আমার বাবার মতো হতে পারব না। এসব কথার মানে আমি বুঝি না? এতে বাবার আর আমার সম্পর্কের চিড় ধরানো হয়, বুঝি না?’

প্রত্যুত্তরে বলে ওঠে বৃন্দা, ‘দ্যাখো আমি তোমাকে অনেকদিনই বলেছি যে, আমার পিসিমা অপ্রাসঙ্গিক কথা বলেন। আমি মানছি।’

‘মানছ তো কুটুম্বিতা করতে তাকেই কেন পাঠান তোমার বাবা-মা?’

‘বাঃ, এখন তুমি ‘আমার পিসিমা’, ‘আমার বাবা-মা’ বলছ?’

হ্যাঁ, আমরা জানি অনেক সংসারেই তোমার-আমার থেকে ‘তোমরা-আমরা’ অনুভূতি অর্থাৎ ‘উই ফিলিং’, ‘দে ফিলিং’ তৈরি হয় যা কখনওই কাম্য নয়।

এই ‘দে ফিলিং’ মনোভাব তখনই ‘উই ফিলিং’-এ পর্যবসিত হয়, যদি আমরা একবার নিজেদের একটু শুধরে নিয়ে সহযোগিতা, সহমর্মিতার আশ্রয় নিই।

যেমন, সব স্ত্রীকেই বুঝতে হবে, বিয়ের আগে তার বাবা-মা-ও তাকে শাসনে আদরে রেখেছিলেন। প্রায়শই বন্ধু নির্বাচন নিয়ে মা’র কাছে বকুনি শুনতে হয়েছে। অনেক কাজে মা বাধা দিয়েছেন, মা’র কথা শুনে চলতে হয়েছে। বিয়ের পরেও আর-একটা পরিবারে, আর-একটা সংসারের চরিত্র একই রকম। সেখানে স্বামীর ভালোবাসা-আদরই শেষ কথা নয়, শাসন-বারণও থাকবে।

আবার স্বামীর ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। স্ত্রী-এর দোষগুণ যেমন সে মেনে নিয়েছে, ঠিক একই রকমভাবে তাকে মেনে নিতে হবে স্ত্রীর আত্মীয়স্বজনের দোষত্রুটি বা তার বাবা-মার ব্যবহার। তবেই ‘এটা তোমার, এটা আমার’ ধারণার অবসান হবে।

স্ত্রী ভাবতে শিখবে বৃহত্তর পরিবারে সে আর-এক যুগল অভিভাবক পেয়েছে, স্বামীও ভাবতে শিখবে, একটি মেয়েকে তার পরিবার-সহ গ্রহণ করতে হবে। আমাদের দেশ ভারতবর্ষ, পারস্পরিক সম্প্রীতির ভিত্তিতেই বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যকে তুলে ধরে। আমরাও আশা করব, আমাদের পরিবারগুলির পারস্পরিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে দেশের এই আদর্শই প্রতিফলিত হবে।

বিবাহ-সমস্যা

সাধারণভাবে ‘বিবাহ সমস্যা’ বিষয়ে বলা যায় যে, মুদ্রার মতোই বিয়েরও Married Life দু-পিঠ। একদিকে এটি যেমন নির্ভরতার আশ্বাস ও সামাজিক সুরক্ষাবোধ বহন করে, অন্যদিকে বিয়ে অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং ও সমস্যাদীর্ণও হয়ে উঠতে পারে। বিয়ের ‘তেমন ভালো দিক নয়’-এর প্রসঙ্গে বলা যায় যে, শ্বশুর-শাশুড়ির সঙ্গে দ্বন্দ্ব হল মুখ্য সমস্যা, একটি দম্পতিকে যার সম্মুখীন হতে হয়। শ্বশুর-শাশুড়িরা হয় দারুণ সহযোগী হবে নয়তো এর পুরো বিপরীত হবে। পরবর্তী পরিস্থিতিতে বিষয় একটু জটিল ও বুদ্ধির পরীক্ষা হয়ে দাঁড়ায়। উভয়তরফে মানিয়ে চলতে না পারা থেকেই সমস্যার সৃষ্টি হয়। আমরা জানি যে জীবন চ্যালেঞ্জপূর্ণ, সেটা আমাদের কাটিয়ে উঠতে হয়। অতএব আপনি কখনওই ইনলজ-দের জন্য নিজের বিয়ে ভাঙতে দেবেন না। কে জানে হয়তো সমস্যার সমাধান হলে বধূটি একজোড়া বুঝদার অভিভাবক পাবে।

বিবাহ সমস্যার সমাধান

–    বিয়ের পর বিয়ের বন্ধন অটুট রাখাই হোক মুখ্য প্রাধান্যের বিষয়। বাকি যা কিছু সরিয়ে রেখে, সেইসব উপায়ের কথা ভাবা উচিত যে, কীভাবে সম্পর্ক সুদৃঢ় করা যায়। শ্বশুরবাড়ি এবং স্বামীই হল বিবাহোত্তর জীবনের মুখ্য বিষয়।

–    শ্বশুরবাড়ির আত্মীয়স্বজনের প্রতি সম্মান, সুস্থ সম্পর্ক গড়ে তুলতে সাহায্য করে। একবার যদি শ্বশুরবাড়ির মানুষজনের প্রতি সম্ভ্রম তৈরি হয়, সম্পর্ক অনেক মসৃণ হবে। অভিভাবকদের দাবি অধিকাংশ ক্ষেত্রে অত্যন্ত কম থাকে বা থাকেই না। তারা যা চান, তা হল শ্রদ্ধা আর সম্মান। যদি আপনার মনে হয়েও থাকে যে, ইনলজ-রা প্রকৃত অর্থেই এসবের উপযুক্ত নন, তবু তাদের উদ্দেশে প্রশংসা বর্ষণ করাই শ্রেয়।

–    শ্বশুর-শাশুড়ি আপনার স্বামীর বাবা-মা একথা মনে রাখবেন। তারা আপনার থেকে আনুগত্য দাবি করেন। সুতরাং আপনারও কিছুটা অনুগত হওয়া জরুরি। তাহলেই সব সমস্যার সমাধান হবে।

–    ইনলজ-দের সমালোচনা করবেন না। তাদের সব স্বভাব বা চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য আপনার পছন্দ না-ও হতে পারে। যদি স্বামীও তাদের বিরুদ্ধে কোনও মন্তব্য করেন, শুধু শুনে যাওয়াই ভালো, কোনও মন্তব্য না করে। আপনার মন্তব্য বিদ্যমান সমস্যাকে বাড়াবে। পরিষ্কার প্রশ্নও বিরাট সমস্যা তৈরি করতে পারে।

–    ইনলজ-রা আপনার বিষয়ে কী ভাবেন সেটাও জানা দরকার। কে জানে হয়তো শুধুমাত্র শুনেই আপনি সমস্যার মূল কারণ চিনতে পারবেন এবং সমাধানও পাবেন।

–    অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নিরাপত্তার অভাব সমস্যার মূল কারণ হয়। অধিকাংশ শ্বশুর-শাশুড়িই, তাঁদের ছেলের বিয়ের পরে নিজেদের অবাঞ্ছিত বা হেয় বোধ করেন এটি খুবই স্বাভাবিক। কারণ, অন্য কেউ একজন তার সন্তানের জীবনে গুরুত্বপূর্ণ বা অত্যন্ত প্রিয় হয়ে ওঠেন। এই নিরপত্তাহীনতা অত্যন্ত কঠিন সমস্যা। কিন্তু আপনারই তাঁদের নিশ্চিন্ত করা উচিত যে, তাঁরা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং একটি বিশেষ স্থান অধিকার করেন।

–    ইনলজ-দের সঙ্গে সমস্যা হলে স্বামীর সঙ্গে কথা বলুন– তিনিও আপনাকে সঠিক পরামর্শ দিতে পারেন। যার ফলে সমস্যার সম্পূর্ণ সমাধান হবে।

–    অনেক সময় ছুটি কাটানো নিয়েও ভিন্ন মত থাকে শ্বশুর-শাশুড়ি আর বউমার। ভালো পরামর্শ হল আগে থেকেই অনুভূতি, আকাঙ্খা আর চিন্তায় সীমারেখা টেনে দেওয়া।

–    মনে রাখা জরুরি আপনি এবং আপনার ইনলজ-দের মধ্যে সামাজিক, সাংস্কৃতিক পার্থক্য থাকবে। এই পরিস্থিতিতে, যদি উভয়পক্ষে বিবাদ হয়, তাহলে মধ্যপন্থা খুঁজে নিয়ে সমস্যার সমাধান করাই ভালো।

 

জীবনের প্রান্তে কেমন আছেন ওঁরা?

পৃথিবী বদলাচ্ছে। উষ্ণায়নের প্রভাবে অস্তিত্ব সঙ্কট। সঙ্কটে পরিবারতান্ত্রিক ভারতীয় সমাজও। উষ্ণায়ন নয়, সম্পর্কের বন্ধনে কিন্তু শীতলতার ছোঁয়া। আবেগের পরিবর্তে, হূদয়ে জায়গা নিয়েছে পশ্চিমি হিসেব কষা লাইফস্টাইল। আমি, আমার পরিবার ও সন্তানের গণ্ডিতে ক্ষয়িষ্ণু সম্পর্কগুলি। ভেঙে যাচ্ছে ভারতীয় সমাজব্যবস্থার মেরুদণ্ড, যৌথ পরিবারের প্রাচীন ভিতটাই।

কাকা-জ্যাঠা, দাদা-ভাইদের নিয়ে ভরা পরিবারের চিত্রটা কার্যত উধাও। পরিবর্তে নিউক্লিয়ার ফ্যামিলির নতুন ট্রেন্ড। যুগের সঙ্গে তাল মেলাতে, সন্তানদের আরও উজ্জ্বল ভবিষ্যতের তীব্র আকাঙ্খার চাপে হারিয়ে যাচ্ছে যৌথ পরিবার, সবার সঙ্গে সুখ-দুঃখ, আনন্দ ভাগ করে নেওয়ার মানসিকতা।

পরিবর্তনের এই পালাবদলে সবথেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শিশুমন ও বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা। সবার মাঝে বেড়ে ওঠার সুযোগ হারিয়ে চার দেয়ালে বন্দি হচ্ছে শৈশব। সবচেয়ে করুণ অবস্থা বয়স্ক পিতা-মাতার। সারাজীবন যৌথ পরিবারে কাটিয়ে দেওয়ার পর, শেষ বয়সে Old age সন্তানদের নিউক্লিয়ার ফ্যামিলিতে মানিয়ে নেওয়া বড়ো কঠিন। দাদা-ভাই, কাকা-জ্যাঠার ভরাট সংসার থেকে চার দেয়ালে আটকে পড়া, হঠাৎই যেন পৃথিবীটা বদলে দেয়।

সন্তানদের হয়তো পুরোপুরি দোষ দেওয়া যায় না। আর্থিক সুরক্ষা, স্ট্যাটাস বজায়ের ইঁদুরদৌড়ে সামিল সন্তানেরা সারাদিন দৌড়োচ্ছে। হাতে সময় নেই বৃদ্ধ পিতা-মাতার জন্য। সকাল-সন্ধ্যা কর্মব্যস্ততার মাঝে গুড-মর্নিং, গুড-নাইটেই সম্পর্কের বাঁধন ঝুলে থাকে। ফলে ফিকে হচ্ছে হূদয়ের যোগ। প্রাধান্য পাচ্ছে মস্তিষ্ক। হিসেব কষে পা ফেলার মানসিকতার সামনে আবেগ, ভালোবাসাগুলি যেন পরিযায়ী পাখি।

সুকল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথাই ধরুন। কর্মজীবনে আইনজীবী হিসেবে সুখ্যাতি ছিল। বন্ধুবান্ধব, মক্বেলদের নিয়ে দিব্যি সময় কেটে যেত। কিন্তু বয়সের ভারে এখন অনেকটা ন্যুব্জ। মফসসল ছেড়ে শহরে প্রতিষ্ঠিত ছেলের কাছে চলে এসেছেন শেষ জীবনটা কাটাতে। নতুন শহর, নতুন পরিবেশ। শুরুর কয়েকটা দিন বেশ ভালো কাটছিল। কিন্তু তারপর ঘিরে ধরল একাকিত্ব। অনেকে পরামর্শ দেন প্রাইভেট প্র্যাকটিস শুরু করার। যদিও বাড়িওয়ালার নিয়মের জাঁতাকলে সে উপায় নেই। ভাড়া বাড়িতে ব্যাবসা ফেঁদে বসা মানা।

মধ্য সত্তরের পরেশবাবুর হালও একইরকম। মহকুমা শহরে জীবনের বেশিরভাগ সময়টাই কাটিয়েছেন। একডাকে সবাই চিনত। শরীর খারাপ হলে ডাক্তার বন্ধু বাড়িতে এসে দেখে যেতেন। কাঁধে হাত রেখে ভরসা জোগাতেন। সময়ে সময়ে সমবয়সি পড়শিরা বসে যেতেন চায়ের আড্ডায়। কিন্তু শহরে একদম উলটো। চাকুরিজীবী মেয়ে সারাদিনই ব্যস্ত কাজ নিয়ে। সপ্তাহে একটা দিন ছুটি। মেয়েকে বলতে অস্বস্তি হয়। অথচ, কারওর সাহায্য ছাড়া অচেনা রাস্তায় বেরোতে সাহস পান না। অগত্যা বন্দিজীবন। নিউক্লিয়ার ফ্যামিলির সাইড এফেক্ট।

বৃদ্ধ বাবা-মার প্রতি যত্নশীল হওয়া ভারতীয় সংস্কৃতির অঙ্গ। সামাজিক পরিকাঠামোর পটপরিবর্তনে বৃদ্ধ Old age পিতা-মাতারা বোঝা হয়ে দাঁড়াচ্ছে সন্তানদের কাছে। ললিতা-মনোহর এখন দুঃখ করেন গ্রাম ছেড়ে শহরে থাকা ছেলের কাছে চলে আসার জন্য। ছেলে মোহিত সারাদিন অফিসে ব্যস্ত। রাতে ফিরেও ফুরসত নেই। রয়েছে বিভিন্ন প্রোজেক্টের কাজ। এমনকী সময়ে-অসময়ে কর্মসূত্রে দীর্ঘদিনের জন্য বাইরে থাকতে হয় তাকে। তখন বাড়িতে শুধু দুই বৃদ্ধ-বৃদ্ধা। জরুরি কোনও সমস্যা হলে দেখার মতো কেউ নেই। চিকিৎসা থেকে দোকানবাজার, অচেনা শহরে সব নিজেদেরই সামলাতে হয়। ললিতার মতে, গ্রামে কিছু প্রয়োজন পড়লে আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব, প্রতিবেশীরা দৌড়ে আসতেন। এখানে ঠিক তার উলটো। অনেকটা নিজভূমে পরবাসী। কারওর সময় নেই তাকিয়ে দেখার।

শহুরে লাইফস্টাইলও গ্রাম্য বৃদ্ধ পিতামাতার পক্ষে বেমানান। এরজন্য শুধুমাত্র সন্তানদের দোষ দেওয়া যায় না। বর্তমান জীবনযাত্রা অনেকবেশি জটিল ও সমস্যাসঙ্কুল। যার সঙ্গে তাল মেলাতে গিয়ে ছোটো ছোটো অনুভূতিগুলি হারিয়ে যাচ্ছে। সময় কমছে নিজের এবং পরিবারের জন্য।

একাকিত্ব, নিঃসঙ্গ এই জীবন থেকে বেরিয়ে আসার রাস্তা খুঁজে নিতে হবে নিজেদেরই। নিজের হবিগুলিতে নতুন করে ডুব দিন। কী করতে ভালোবাসেন, কী নয়, তা নিয়ে একটা পরিকল্পনা ছকে নিন। ভালোলাগার বিষয়গুলিতে বেশি করে সময় দিন। নতুন বন্ধু তৈরি করুন। পুরোনো বন্ধুদের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ রাখুন। দেখবেন, একঘেয়ে জীবনে অনেকটা প্রাণ ফিরে এসেছে।

বৃদ্ধ পিতা-মাতার একাকিত্ব নিয়ে বেশ কিছু সংগঠনও তৈরি হয়েছে বিদেশে। সংগঠনের সদস্যরা নিয়মিত যোগাযোগ রাখেন, জানতে চান তাদের সমস্যার কথা। বেঙ্গালুরুর মতো শহরগুলিতে পুলিশ বিশেষ গ্রুপ তৈরি করেছে, বৃদ্ধ পিতা-মাতাদের প্রতি নজরদারির জন্য। বৃহত্তর ভাবে এই উদ্যোগকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হলে নব্য যুবাদেরও যুক্ত করতে হবে। পুরোটাই হতে পারে পেশাদারিত্বের মোড়কে। নিঃসঙ্গ প্রবীণদের মেডিকেল চেক-আপ, ট্রিটমেন্ট থেকে তাদের সময় দেওয়া –পারিশ্রমিকের বিনিময়ে এই কাজে যুক্ত হতেই পারেন বেকার যুবকেরা। অসহায় বয়স্করা সাহায্য পাবেন, নিশ্চিন্ত হবেন বাইরে থাকা সন্তানরা, একই সঙ্গে আরও একটা আয়ের রাস্তা খুলে যাবে বেকারদেরও। অনেকটা কেয়ারটেকারের একটু অন্যরকম রূপ। কলকাতা পুলিশের উদ্যোগে প্রবীণদের নিঃসঙ্গতা দূরীকরণের উদ্দেশ্যে গড়ে উঠেছে ‘প্রণাম’। নানা পরিষেবা দান করে থাকে এই সংস্থা।

সন্তানদের করণীয় –

 রোহিত বিশ্বাস, এব্যাপারে দারুণ পদক্ষেপ নিয়েছেন। তুতোভাই, বন্ধুদের সঙ্গী করে এলাকার বয়স্কদের নিয়ে একটা গ্রুপ নেটওয়ার্ক তৈরি করেছেন। গ্রুপের যুব সদস্যদের কাজই হল সময় সুযোগ মতো বয়স্কদের খোঁজখবর রাখা। ফলে ওই গ্রুপের কে কেমন আছেন, কার কী প্রয়োজন, তা সবসময় কেউ না কেউ খোঁজ নিতে পারছেন।

এছাড়াও প্রবীণদের নিরাপত্তার জন্য বেশ কিছু পদক্ষেপও নেওয়া উচিত। পুরোনো আমলের বাড়ির বাইরের টয়লেটের কনসেপ্ট বদলে ঘরের মধ্যে পশ্চিমি ঘরানার টয়লেট দরকার। পর্যাপ্ত আলো এবং জলের ব্যবস্থাও রাখতে হবে। নিরাপত্তার জন্য দরকার সঠিক গেট ও গ্রিলের ব্যবস্থা। মোবাইল ফোন হাতের সামনে থাকাটা জরুরি। একাকিত্বময় জীবনে ফোন হল বহির্জগতের সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যম। আপৎকালীন প্রয়োজনে সাহায্য চাইতে পারবেন ফোনের মাধ্যমে। রয়েছে ইন্টারনেটও। বৃদ্ধ পিতা-মাতাকে আধুনিক এই লাইফস্টাইলের সঙ্গে পরিচিত করে তুলুন।

বাবা-মায়ের মূল্যবোধকে সম্মান জানান –

 অনেকেরই ধারণা বয়স্কদের Old age-এ কোনও গোপনীয়তা বা নিজস্বতা থাকতে পারে না। ধারণাটা একদম ভুল। প্রতিটি মানুষেরই নিজস্বতা রয়েছে। এ নিয়ে শ্রদ্ধাশীল হওয়া দরকার। এছাড়া পুরোনো বাড়ি থেকে আনা বাবা-মায়ের জিনিসপত্রের স্থান যেন কখনওই বাড়ির গোডাউনে না হয়। খেয়াল রাখা দরকার বাড়ির দামি আসবাবপত্রের ভিড়ে তা যেন হারিয়ে না যায়।

বয়স্করাও আশা করেন সন্তানদের থেকে একটু যত্ন। মাঝেমধ্যে দু-চার দিনের জন্য বাবা-মাকে নিয়ে বেড়িয়ে পড়ুন আউটিং-এ। ব্যস্ততার মাঝে তাদের একটু সময় দিলে তাদেরও খুব ভালো লাগবে।

সবকিছু ছাপিয়ে পারিবারিক শিক্ষা। সন্তানদের প্রাথমিক পাঠ দেওয়ার ভারটা বাবা-মায়েদেরই। বড়োদের শ্রদ্ধা এবং তাদের নিজস্বতার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়ার শিক্ষাটা দিতে হবে বাবা-মায়েদের। নাহলে বৃদ্ধ বয়সে অবহেলা, অশ্রদ্ধা এবং একাকিত্ব ছাড়া কিছুই জুটবে না।

চার দেয়ালের ঘেরাটোপে আটকে না থেকে, বিভিন্ন সামাজিক কাজে নিজেদের যুক্ত করতে হবে। বার্ধক্যজনিত অসুস্থতা স্বাভাবিক ব্যাপার। সেক্ষেত্রে মেডিকেল ইনসিওরেন্স আবশ্যিক। নিজের সাধ ও প্রয়োজন অনুসারে কাছাকাছি কোনও ভালো হাসপাতালের সঙ্গে যোগাযোগ থাকা জরুরি।

বাচ্চাদের সামনে ঝগড়ায় সম্পর্কেরই ক্ষতি

‘বিয়ের পর ১০ বছর কেটে গেল, কিন্তু এখনও রান্নায় পরিমাণমতো মশলা দিতে শিখল না তোমার মা। আরও কতদিন যে এই অখাদ্য খাবার খেতে হবে জানি না!’ স্ত্রীর বিরুদ্ধে ছেলের কাছে দীনেশ এমন নালিশ করতেই ছেলে খিলখিলিয়ে হেসে উঠল, কিন্তু যার বিরুদ্ধে এই অভিযোগ, সেই রেনু তো খেপে লাল! সঙ্গেসঙ্গেই দীনেশের বিরুদ্ধে তার পালটা অভিযোগ, ‘আমার প্রতি কোনও সহানুভূতিই নেই তোমার বাবার। আমার শরীর ভালো নেই জেনেও, বন্ধুর বাড়িতে গিয়ে বসে রইল, বাড়িতে তাড়াতাড়ি ফিরে একটু সাহায্য করতে পারত না কি? আমি শুধু একাই খেটে মরছি, কী সুখ পেলাম জীবনে? আরে দু’বেলা দু’মুঠো খাবার তো জন্তু-জানোয়ারও জুটিয়ে নেয়।’ একরাশ বিরক্তি নিয়ে মেয়ে নেহার দিকে তাকিয়ে দীনেশের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ করতেই, ছোট্ট নেহা গম্ভীর হয়ে গেল। বাবাকে নিয়ে নেহার যে গর্ববোধ ছিল এতদিন, মায়ের অভিযোগের পর তাতে যে একটু পলি পড়ল, তা মুহূর্তের মধ্যেই নেহার চোখেমুখে ফুটে উঠল।

অনেক পরিবারেই এমন ঘটনা আকছার ঘটে চলেছে। ঝগড়া-অশান্তির সময় রাগের মাথায় স্বামী বা স্ত্রী কেউ একবারও ভাবেন না যে, এর কতটা কুপ্রভাব পড়বে বাচ্চাদের উপর! অথচ বাচ্চারা ‘পারফেক্ট পেরেন্টস’ হিসাবে দেখতে চায় বাবা-মা-কে।

ঝগড়ার কুপ্রভাব

দিনের পর দিন বাবা-মায়ের মধ্যে মনোমালিন্য বা ঝগড়া Relationship দেখতে দেখতে বাচ্চাদের মন খারাপ হয়। ওরা যত বড়ো হতে থাকে, ততই নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে। ওদের মনে হতে থাকে, ওরা যেন ক্রমশ স্নেহ-ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। শুধু তাই নয়, ওদের বদ্ধমূল ধারণা হয়, বাবা অথবা মা কেউই ভালো নয়। এতে ওদের ক্ষোভ বাড়তে থাকে। জেদি স্বভাবের হয়ে যায়। শৈশবের সুকুমার বৃত্তিগুলি হারিয়ে যায়। মনোবিজ্ঞানীদের মতে, তরুণ প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের নেশা করা বা কুপথে চলে যাওয়ার অন্যতম কারণ অবশ্যই পারিবারিক অশান্তি। বাবা-মায়ের দৈনন্দিন ঝগড়া-ঝামেলার ফলে বাড়িতে যে-অশান্তির পরিবেশ তৈরি হয়, তার থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার জন্য উদগ্রীব হয়ে থাকে ছেলেমেয়েরা। আর তাই ওরা নিজেদের অজান্তেই ভুল পথে পা বাড়ায়। মা-বাবারা নিজেদের মান-অভিমান কিংবা ঝুটঝামেলায় এতটাই ব্যস্ত থাকেন যে, ছেলেমেয়েরা কোথায় যাচ্ছে, কী করছে এসব খবর প্রায় রাখেনই না। ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃত যাইহোক না কেন, বাচ্চাদের প্রতি বাবা-মায়ের এই অবহেলার জন্য পারিবারিক ক্ষতি তো হয়ই, পরোক্ষভাবে সমাজেরও ক্ষতি হয়। অনেকসময় ছেলেমেয়েরা অপরাধপ্রবণ হয়ে ওঠে এবং জড়িয়ে পড়ে অসামাজিক কাজে।

ভুলের মাশুল

ছেলেমেয়ের সামনে প্রতিদিন ঝগড়া করার মাশুল একসময় দিতেই হবে বাবা-মাকে। কারণ, ছেলেমেয়েরা প্রতিদিন বাবা-মায়ের বিশ্রী ঝগড়া দেখতে দেখতে ভাবতেই পারে, ‘বিয়ে করা মানেই বোধহয় পরস্পরের মধ্যে শুধু ঝগড়া আর ঝামেলা! এরথেকে বোধহয় বিয়ে না করাই মঙ্গলজনক।’ যে সব ছেলেমেয়েরা বাবা-মায়ের ঝগড়ার মধ্যে দিয়ে বড়ো হয়েছে, তাদের সিংহভাগেরই এমন ধারণা হতে পারে এবং বাস্তবে হয়ও। ওরা যখন বিয়ে না করার সিদ্ধান্ত নেয়, তখন মা-বাবা রাজি করাতে চাইলে অপমানিত হন ছেলেমেয়ের কাছ থেকে। ‘বিয়ে করে তোমরা কী সুখ পেয়েছ?’ এই ধরনের প্রশ্ন করে বসে ছেলেমেয়েরা এবং এর কোনও সদুত্তর দিতে পারেন না মা-বাবারা। আর সত্যি বলতে কী, বাবা, মা ছেলেমেয়েদের বুঝিয়ে শুনিয়ে যদি বিয়ে দেনও, বিবাহপরবর্তী সময়ে ছেলেমেয়েরা একে অন্যকে ঠিকমতো সম্মান করতে পারে না। কারণ মনোবিজ্ঞানীদের মতে, ভালো কিছুর তুলনায় খারাপ দিকগুলিই আমাদের মস্তিষ্ক গ্রহণ করে আগে।

সমাধানের উপায়

মনে রাখতে হবে, স্বামী-স্ত্রীর ঝগড়ার কারণে যেন বাচ্চাদের কোনও ক্ষতি না হয়। অনেক ধৈর্য, সহানুভূতি, ত্যাগ এবং সুক্ষ্ম বিচারবিশ্লেষণের মাধ্যমে শান্ত মাথায় সিদ্ধান্ত নিলে, তবেই সংসারে সুখশান্তি আসে। তাছাড়া, পুরুষ বা মহিলা উভয়ের একশোভাগ মতের মিল না হওয়ারই সম্ভাবনা বেশি থাকে। কারণ এক একজন এক একরকম পরিবেশে বড়ো হয়েছেন। প্রত্যেকেরই কিছু নিজস্বতা থাকে। অতএব বাচ্চার ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে, সুখেশান্তিতে বসবাস করতে গেলে, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে আলাপ আলোচনা জরুরি। অন্যকে দোষারোপ করার আগে, নিজের দোষ আছে কিনা তা আত্মবিশ্লেষণ করে দেখতে হবে। সেইসঙ্গে, জীবনসঙ্গী বা সঙ্গিনী যদি কোনও দোষ কিংবা অন্যায় করে থাকেন, তাহলে তা তাকে শান্ত ও সহজভাবে একান্তে বোঝাতে হবে। আর ত্রুটি শুধরে নেওয়ার জন্য কিছুটা সময়ও দিতে হবে অন্যকে। এ প্রসঙ্গে আরও যে বিষয়টি উল্লেখ করা প্রয়োজন তা হল, অনেকে খুব দ্রুত মাথাগরম করে ফেলেন বা রাগ করেন। এটা যে শুধু তার স্বভাবদোষ এমনটা না-ও হতে পারে। উচ্চ রক্তচাপ, থাইরয়েড প্রভৃতি নানা শারীরিক অসুস্থতার কারণেও মুহূর্তের মধ্যে রেগে যান অনেকে। তাই প্রয়োজনে মেডিকেল চেক-আপ এবং চিকিৎসার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করতে হবে। এছাড়া এমনকিছু সমস্যা থাকে, যা স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা উচিত। কারণ স্বামী-স্ত্রীর ওই সমস্যা বাচ্চাদের সামনে এলে, খুব খারাপ ফল হতে পারে। অতএব স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে যদি মন কষাকষি Relationship বা রাগ অভিমান হয়ও, তা যেন ছেলেমেয়েরা বুঝতে না পারে। ওদের সামনে সবসময় হাসিখুশি থাকার চেষ্টা করবেন। কারণ ছেলেমেয়েদের ভালোভাবে মানুষ করা এবং ভবিষ্যৎ গড়ার দায়দায়িত্ব পুরোটাই যে বাবা-মায়ের উপর বর্তায়।

 

 

 

বউমার সঙ্গে আপনার রসায়ন ঠিক কেমন

দুনিয়াটা বদলে যাচ্ছে। আমরাও পালটে যাচ্ছি খুব দ্রুত। পুরোনো মূল্যবোধগুলো ভেঙেচুরে গড়ে নিচ্ছি নতুন করে। সামাজিক, অর্থনৈতিক গঠনের পরিবর্তন হচ্ছে। একান্নবর্তী পরিবারের জায়গা দখল করে নিচ্ছে নিউক্লিয়ার ফ্যামিলি। তবু, এদেশে এখনও, ‘পিতা স্বর্গ, পিতা ধর্ম, পিতাহি পরমন্তপঃ’ আর ‘জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরীয়সি।’ তাই পুত্র-সন্তান, বিয়ের পরেও বৃদ্ধ মা-বাবার সঙ্গে এক বাড়িতে বাস করতে পারে, তাতে চোখ কপালে ওঠে না। শ্বশুর-শাশুড়ির সঙ্গে ছেলের বউটিও মিলেমিশে সংসার করে। তবু রান্নাঘরে একসঙ্গে রাখা বাসনের মধ্যে যেমন ঠোকাঠুকি লেগেই থাকে, তেমনই শাশুড়ি-বউমা’র সম্পর্কেও মনোমালিন্য অত্যন্ত সাধারণ একটি ব্যাপার। তাই একসঙ্গে থাকতে হলে, সাংসারিক জীবনে সহজতার ছোঁয়া বজায় রাখতে হলে মেনে চলতে হবে কিছু জরুরি বিষয়। শাশুড়ি-বউমার টক-ঝাল Relationship যদি থাকে তবেই আসবে ভালোবাসার রোমাঞ্চ।

নতুন বউমাকে স্বাগত জানান প্রাণখুলে

ছেলের বিয়ে প্রেমঘটিত হোক অথবা সম্বন্ধ করে, পুত্রবধূকে প্রাণখুলে স্বাগত জানান। যদি কোনও কারণে বউমাটিকে আপনার পছন্দ না-ও হয়, সে’কথা নিজের মধ্যে রাখাই ভালো। প্রকাশ্যে আনবেন না। মনে রাখবেন, ভালোবাসা দিলে তবেই ভালোবাসা পাওয়ার প্রত্যাশা রাখতে পারেন। শ্রদ্ধা আর সম্মানও অর্জন করতে হয়, বাজারে বিক্রি হয় না।

বউমাকে মানিয়ে নিতে সময় দিন

আপনার বউমাটি অন্য একটি পরিবার থেকে আপনাদের পরিবারে এসেছে, তাই চেষ্টা করুন সে যেন স্বাচ্ছন্দ্য অনুভব করে। স্বামীর সঙ্গে নতুন জীবন শুরু করার এই মুহূর্তটিতে তার যেন নিজস্ব একটি ঘর থাকে, যেখানে সে আর তার স্বামী একটু একা হয়ে পরস্পরের সান্নিধ্য উপভোগ করতে পারবে। সাজানো ঘর, দেয়ালে নতুন রং, জানলা-দরজায় নতুন পর্দা, জামাকাপড় ও জুতো রাখার কাবার্ড, এই সবই বউমাকে পরিবারের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ মনে করাতে সাহায্য করবে। সে নিজেকে অপাঙক্তেয় ভাববে না।

শ্বশুর-শাশুড়ি যেন ছেলে-বউকে একটু নিভৃতে সময় কাটানোর সুযোগ করে দেয়। যৌথ পরিবারের ক্ষেত্রে প্রাইভেসি একটি বড়ো সমস্যা। সমস্যা মেটাতে, ওদের একসঙ্গে সময় কাটানোর মুহূর্ত তৈরি করে দিন। খেয়াল রাখুন, ওদের হানিমুনের ছুটিটা যেন বেশ লম্বা হয়।

বউমাকে ঘরে আটকে রাখবেন না

সিঁথির মোড়ের মুনমুনের শ্বশুরবাড়ির লোকেরা ওকে বাইরে কাজ করতে দেয় না। ওরা চায় যে, মুনমুন যেন বাড়ির খেয়াল রাখে আর চুটিয়ে সংসার করে, বাইরের কাজ নয়। অথচ, মুনমুন ফাইন্যান্সে মাস্টার্স করেছে। বিয়ের আগে একটি এমএনসি-তে চাকরিও করত। ফলে শ্বশুরবাড়ির লোকেদের সঙ্গে মুনমুনের মতবিরোধ হয় এবং স্বামীকে নিয়ে ও আলাদা থাকতে শুরু করে।

এমন ঘটনা শুধু মুনমুনের ক্ষেত্রেই নয়, আরও অনেকের ক্ষেত্রেই ঘটে। তাই সংসার বাঁচাতে শ্বশুর-শাশুড়িরা আগের থেকেই সাবধান হোন। ছেলের বউ-কে বাড়ির ‘কাজের লোক’ বানিয়ে তুলবেন না। তাকে মুক্ত হাওয়ায় বাঁচতে দিন। চাকরি করা বা না-করার সিদ্ধান্ত তার নিজের সিদ্ধান্ত, আপনাদের মতামত চাপিয়ে দেবেন না।

সন্তান-ধারণের জন্য বউমাকে চাপ দেবেন না

যে-কোনও দায়িত্বশীল দম্পতিই খুব ভেবেচিন্তে সন্তান ধারণের সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে। এর জন্য অর্থনৈতিক, মানসিক এবং ভবিষ্যত সম্পর্কে নিশ্চিন্ত হওয়া অত্যন্ত প্রয়োজন। এমনকি এমন অনেক দম্পতি আছেন যারা সন্তান চান না। তাই শুধুমাত্র ঠাকুরদা-ঠাকুমা হবার স্পেশাল আনন্দকে উপভোগ করার মনস্কামনায় ছেলের বউকে সন্তান ধারণের জন্য চাপ দেবেন না। কন্সিভ করার সিদ্ধান্ত ছেলে-ছেলের বউ-কেই নিতে দিন।

বউমার প্রশংসা করুন

শাশুড়ি-মায়েরা ছেলের বিয়ের পরে বোধহয় নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেন। তবে কারণ যাই হোক না কেন, আত্মীয়স্বজন, প্রতিবেশী বা বন্ধুবান্ধবদের কাছে কখনওই বউমার নিন্দা করবেন না। এর ফলে সংসারে শুধু তিক্ততাই বাড়বে।

এক-এর অধিক পুত্রবধূ

যদি পুত্রবধূর সংখ্যা একাধিক হয়, তবে কখনওই পুত্রবধূদের মধ্যে তুলনা টেনে বা অন্য উপায়ে তাদের একে অপরের প্রতিপক্ষ বানিয়ে তুলবেন না। এর সুদূরপ্রসারী ফলাফল আপনার জন্য ক্ষতিকারক হতে পারে। সংসারে অশান্তির সম্ভাবনা এবং সংসার ভেঙ্গেও যেতে পারে।

সমস্যা শেয়ার করুন

পুত্রবধূকে আপনার পরিবারের একজন সদস্য করে তুলুন। সে যেন নিজেকে বাইরের লোক না ভাবে। পরিবারের যে-কোনও সমস্যা তার সঙ্গে শেয়ার করুন। যৌথ পারিবারিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে তার মতামতকে গুরুত্ব দিন।

বউমাকে নিজের সন্তানের মতোই ভালোবাসুন। গল্পে, আড্ডায় দু’জনে সুন্দর সময় কাটান। ওকে স্বাধীনভাবে বাঁচতে দিন। কথায় আছে ‘শাসন করা তারই সাজে সোহাগ করে যে।’ তাই শাসনের অধিকার পেতে, বউমাকে ভালোবাসায় ভরে দিন।

সন্তান হবার পর

গর্ভধারণের পর দীর্ঘ সময় এবং সন্তান ভূমিষ্ট হবার পরেও, বউমাকে আদর-যত্নে ভরিয়ে রাখুন। বাচ্চা সামলাতে তাকে সাহায্য করুন। অনেকসময় সদ্যজাত সারারাত জেগে থাকে, ঘুমোতে চায় না, মা-কেও জাগিয়ে রাখে। এই অবস্থায় বউমার ওপরে অতিরিক্ত কাজের দায়িত্ব না চাপানোই ভালো। শুধুই শিশুটির নয়, বউমার শরীরেরও যত্নের প্রয়োজন। শাশুড়ি মায়েরা কিছুক্ষণের জন্য হলেও বাচ্চাটির খেয়াল রাখুন। আপনার বউমা হাঁফ ছেড়ে বাঁচবে।

এমনই সব ছোটো ছোটো সহজ উপায়, সুস্থ Relationship-এর চাবিকাঠি। একটু খেয়াল রাখলেই, পারিবারিক বন্ধন দৃঢ় হবে, সংসার থাকবে অটুট।

 

পড়ার জন্য সীমাহীন গল্প-নিবন্ধসাবস্ক্রাইব