মাঙ্কি ক্যাপ (২য় পর্ব)

(৩)

সাতসকালেই ঝিলমিলের এসএমএস— আই নিড এ মাঙ্কি ক্যাপ ইমিডিয়েটলি। ইমন মেসেজ পড়ে বিস্মিত হয়। ঝিলমিলের হনুমান টুপির আবার কি দরকার? ক’দিন আগেও দেখা হয়েছে। সকালবেলায় আরকেটি-র বাড়িতে লাইফ সায়েন্স পড়তে গিয়ে। কিছু তো বলেনি। মাফলার দিয়ে মাথা গলা ঢেকে ছিল। তেমন অস্বাভাবিক কিছু মনে হয়নি। অবশ্য ওপর থেকে বোঝা যায় না ভিতরে কী হয়েছে? কী ধরনের অসুবিধা? তবে এবারের হাড় হিম করা কনকনে শীত সত্যিই অসহনীয়। ঝিলমিলের কি তাহলে এক্সট্রা লার্জ প্রোটেকশনের দরকার এখন?

ইমনও এসএমএস পাঠাল— এক্সকিউজ মি। আই হ্যাভ ওনলি ওয়ান।

ঝিলমিলের চট্‌জলদি মেসেজ— ইফ ইউ লাভ মি, শেয়ার ইট। এতো ভারি বিপদ! নো ডাউট ঝিলমিলকে ইমন ভালোবাসে। কিন্তু তাদের বংশপরম্পরাগত মাঙ্কি ক্যাপ ভালোবাসার নামে উৎসর্গ করলে বাড়িতে তাণ্ডব থেকে শুরু করে গৃহযুদ্ধ বেধে যেতে পারে। টুপিদাদু জানতে পারলে ইমনকে আর আস্ত রাখবে না। তার বাবাও কি তাকে মার্সি করবে? যে টুপি পরিয়ে ইমনের বাবা তার মা-কে হাসিল করেছে ইমনও কি পারবে এই সুযোগে ঝিলমিলকে টুপি পরাতে?

ঝিলমিলের তবু বেপরোয়া আবদার— টুপি আমায় দিতেই হবে।

—টুপি ছাড়া আমি তোমায় সব দিতে পারি। প্লিজ মাইরি টুপি চেয়ো না।

—আমার টুপিই চাই।

—কী করে সম্ভব? টুপি আমাদের বাড়িতে একটাই। দাদু থেকে বাবা, বাবা থেকে আমি গসাগু-র মতো ব্যবহার করছি।

—গসাগু মানে?

—গরিষ্ঠ সাধারণ গুননীয়ক অর্থাৎ বড়ো থেকে ছোটো। এক্কেবারে কেসি নাগের ফর্মুলা।

—ওসব গ.সা.গু. ল.সা.গু. ছেড়ে ঝেড়ে কাশো তো চাঁদু। টুপি দেবে কি না?

—একি মামার বাড়ির আবদার নাকি?

—সামান্য টুপি দিতে পারো না, তুমি বাসবে ভালো?

—কি বলছ ঝিলমিল? ভালোবাসার জন্য আমার প্রাণ দিতেও প্রস্তুত। কিন্তু টুপি দিতে পারব না। তুমি অন্য কিছু চাও, আমার আই ফোন, ল্যাপটপ, মানিব্যাগ…..

—আমার টুপিই চাই।

—বাজার থেকে কিনে নিলেই তো ল্যাটা চুকে যায়।

—তুমি হয়তো জানো না এবারের কনকনে শীতে আলু পেঁয়াজের মতো বাজার থেকে মাঙ্কি ক্যাপও ভ্যানিশ। হাতে-গোনা দু-একটা যাও পাওয়া যাচ্ছে, তার দামও আকাশছোঁয়া। পঞ্চাশের হনু ব্ল্যাকে পাঁচশো হাঁকছে।

—কি বলছ?

—যা বলছি মার্কেট স্টাডি করেই বলছি। ভাবলাম তুমি আমাকে ভালোবাসো। টুপি ছাড়া আমি বাঁচব না। আমার মান- সম্মান লাজ-লজ্জা সব ওই হনুমান টুপির সঙ্গে জড়িয়ে আছে। ইমন বোকার মতো জানতে চায়— এসব তুমি কী বলছ? আমি তোমার মাথামুণ্ডু কিছুই ছাই বুঝতে পারছি না।

—তোমায় অতশত বুঝতে হবে না। যা বলছি সেটা করতে পারবে কিনা বলো?

—আমি চেষ্টা করব ঝিলমিল। কিন্তু যদি না পারি? ঝিলমিলের সটান জবাব— আমাদের ভালোবাসার —দি এন্ড।

(8)

ইমনের দাদু স্বদেশ হালদার বিদ্যুৎ চমকানোর মতো বাজখাঁই গলায় চিৎকার করে বলেন— চোর শেষপর্যন্ত আর কিছু না নিয়ে মাঙ্কি ক্যাপ নিয়ে চম্পট দিল?

ইমনের বাবা লেপের ভিতর থেকেই জবাব দেয়— আপদ গেছে। এখন ক’দিন শান্তিমতো ঘুমোতে পারব। বাব্বা কয়েক রাত্তির যা ধকল গেল।

—মহিম তুই একথা বলতে পারলি?

—আগের গান্ধিটা ট্রাই করছ না কেন?

—হনুমানটা বেশ সেট হয়ে গিয়েছিল। দারুণ গরম হতো। শরীরে মনে বেশ চাঙ্গা বোধ করতাম। গান্ধি বড্ড সেকেলে হয়ে গেছে। আধুনিক ছেলেছোকরার দল যেন মানতেই চায় না। আমাকে টুপি দাদু বলে খেপাত— তোর মনে নেই?

—না পাওয়া গেলে কী করবে? ক’দিন পুরোনোটা দিয়ে চালাও। তারপর সময়মতো পেলে কিনে দেব। অন্তত মাথাটা তো বাঁচবে। সঙ্গে মাফলার, শাল জড়িয়ে নিলে দিব্যি ক’দিন কেটে যাবে। বরং বলি কি তুমি ক’দিন রেস্ট নাও। মর্নিং ওয়াকে না গেলেই নয়?

—আমায় জ্ঞান দিস না মহিম। আমি বিপ্লবী, চুটিয়ে স্বদেশি করেছি। আমাদের অভিধানে রেস্ট বলে কোনও শব্দ লেখা নেই। কিন্তু আমি ভাবছি এত সাধের মাঙ্কি ক্যাপটা মিসিং হল কী করে? চোর, সোনাদানা-টিভি-ফ্রিজ-ল্যাপটপ চুরি না করে শেষপর্যন্ত হনুমান টুপি? ভেরি স্ট্রেঞ্জ!

—এই প্রচণ্ড শীতে মনে হয় চোরের কাছে ওটাই মস্ত জরুরি, মহা মূল্যবান। আরে বাবা চোরও তো মানুষ নাকি? চোরেরও ঠান্ডা লাগে।

—ডোন্ট টক ননসেন্স, মহিম। এমন একটা সিরিয়াস ব্যাপারকে লঘু করে দেখা উচিত না।

—তুমিও পারো বাবা। সামান্য একটা টুপি নিয়ে কি কাণ্ডটাই না তুমি করছ।

—এটা সামান্য নয়। আমার কাছে বেশ রহস্যময় বলে মনে হচ্ছে। প্রেস্টিজ ইস্যুও বলতে পারিস।

ক’দিন বাদে দাদুই আবিষ্কার করলেন ইমনদের পারিবারিক ঐতিহ্যশালী মিসিং লিংক মাঙ্কি ক্যাপটি। দাদু ইমনকে জরুরি তলব করলেন, পার্ক থেকে মর্নিং ওয়াক সেরে ফিরে আসার পর। দাদু কি শেষ পর্যন্ত ইমনকে সন্দেহ করছেন? ইমন কি ধরা পড়ে গেল? ইমনের বুকের ভিতর হাজারটা অশ্বখুর দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। ঝিলমিলকে ইমনই যে টুপিটা দিয়েছিল, দাদু জানল কী করে?

তার দাদু গলার মাফলার আলগা করে চাদরটা গা থেকে খুলে মায়ের দেওয়া এক কাপ গরম চায়ে তৃপ্তির চুমুক দিয়ে বললেন— জানিস দাদুভাই হনুমানটাকে খুঁজে পেয়েছি।

ইমন অবাক বিস্ময়ে জানতে চাইল— কোথায়?

—পার্কে রংগন গাছের ঝোপের আড়ালে। আমি ঠিক চিনতে পেরেছি। হালকা হলুদ রঙের, মাথায় কালো উলের বল।

ইমন আত্মপক্ষ সমর্থনের ভঙ্গিতে বলে– ধ্যাৎ দাদু কী যে বলো না। তোমার চোখে নির্ঘাত ছানি পড়েছে। এরকম কালার কম্বিনেশন অনেক টুপির হতে পারে।

—আমার চোখকে ফাঁকি দিতে পারবে না। আমার বিপ্লবীর চোখ। দূর থেকে দেখেই কত ইংরেজের দুরভিসন্ধি ফাঁস করে দিয়েছি। ঝোপের আড়ালে টুপিতে মুখ ঢেকে মেয়েটা এমনভাবে বসেছিল যাতে কেউ চিনতে না পারে আর তার গা ঘেঁষে ছেলেটি অশোভন অবস্থায়…। পার্কটা ক্রমশ দূষিত হয়ে যাচ্ছে রে দাদুভাই। আর বোধহয় মর্নিং ওয়াকে যাওয়া যাবে না।

ইমন দারুণ বিস্ময়ে হতবাক। তার চোখের সামনে সবকিছু এখন জলের মতো পরিষ্কার। আসলে ঝিলমিল তাকে ঠকিয়েছে। তাকেই মস্ত টুপি পরিয়েছে।

 

আজি ঝড়ের রাতে…

আঠারো বছর বয়সের সময় যখন আমি কলকাতায় পালিয়ে যাই, তখন নন্দিনীর বয়স ছিল পনেরো। আজ তিন বছর পর আমি বাড়ি ফিরলাম। এখন আমার বয়স একুশ আর নন্দিনীর আঠারো। মা বললেন, দুজনের বিয়ের বয়স হয়ে গেছে এবার চারহাত এক করতে হবে।

ওই যে কথায় আছে না, জন্ম-মৃত্যু-বিয়ে তিন বিধাতা নিয়ে। কেউ জানে না কার ভাগ্য কার সঙ্গে লেখা হয়ে আছে। কিন্তু শুরুটা তো এমন ভাবে হয়নি, হয়েছিল এক প্রাণবন্ত ছন্দে। নন্দিনী যে কখনও অন্য কারও হয়ে যাবে সে কথা তো কোনওদিন ভেবেই দেখিনি।

নন্দিনীর সঙ্গে ছোটোবেলায় স্কুলে গেছি। পুতুল খেলেছি। পুতুলের বাবা মা সাজার সময় আমি বাবা হয়েছি ও মা হয়েছে। কখনও আবার বর-বউ খেলেছি। ওদের বাড়িতে গেলে নন্দিনীর মা আমাকে খুব আদর যত্ন করতেন। স্কুল ছুটি থাকলে দুপুরবেলা প্রায়ই ডেকে নিয়ে খাওয়াতেন এবং দস্তুর মতো দুজনকে পাশে বসিয়ে হাত দিয়ে ভাত মেখে খাইয়ে দিতেন। আবার আমাদের দুজনকে একসাথে দাঁড় করিয়ে আপনা-আপনি বলাবলি করতেন, আহা, বেশ মানিয়েছে দুটিকে।

তখন ক্লাস টু-তে পড়ি। অনেক ছোটো ছিলাম তাই হয়তো কথাটার মানে বুঝতে পারতাম না। শুধু এটুকু বুঝতাম আমাদের দুজনকে ওনারা খুব পছন্দ করতেন। নন্দিনীর প্রতি আমার একটু বেশিই দাবি ছিল অন্যান্য বন্ধুবান্ধব বা ওর আত্মীয়স্বজনের থেকে এবং সেই ধারণা ক্রমশই বদ্ধমূল হয়ে যাচ্ছিল আমার মনের মধ্যে। সেই অধিকারে আমি কখনও তাকে শাসন করতাম এবং সেও আমার সব শাসন মাথা পেতে নিত সহিষ্ণু ভাবে।

মাঝে মাঝে তাকে উপদ্রব করতাম, শাস্তি দিতাম কিন্তু কোনওদিন টুঁ-শব্দটি করেনি। নির্দ্বিধায় সব মাথা পেতে নিত। খুব সুন্দরী বলব না তবে বেশ ভালোই দেখতে ছিল। পাড়ার বখাটে ছেলেদের কাছে সে সৌন্দর্যের কোনও দাবি ছিল না। তবে আমি জানতাম আমার আদেশ পালন করার জন্যেই তার জন্ম এবং হয়তো সেই কারণে আমি অনেকটাই তাকে অবহেলা করতাম।

বাবাকে হারিয়েছি বছর দুই আগে। শুনেছি বাবা বলতেন, বাড়ুজ্জ্যে মশাই ওর হাত দেখে বলেছেন আমার রাজা একদিন সত্যি-সত্যিই দেশের রাজা হবে। বাবার ইচ্ছা আমি পড়াশোনা করে অনেক বড়ো হই। তাঁর মতো কলমপেশার চাকরি যেন না করি। ছোটোবেলায় আমি কিন্তু মনে মনে তা, কোনওদিন চাইতাম না। আমি চাইতাম সারাদিন ধরে শুধু খেলাধুলা করব। তাই জীবনে আমি হয়তো কোনও খেলাই বাদ দিইনি।

মার্বেলগুলি, ডাংগুলি, সিগারেট-এর প্যাকেট কেটে তাস, পিট্টু ছাড়াও মেয়েদের সঙ্গে গোল্লাছুট, আরও কত বলব। ফুটবল, ক্রিকেট তো একটা ইতিহাস। দুপুর রোদে ঘর থেকে পালিয়ে যেতাম ক্রিকেট ম্যাচ খেলার জন্যে। মা আবার আমাকে খোঁজ করে ঘরে এনে বেঁধে রাখতেন। কখনও মার সবে একটু তন্দ্রা এসেছে, সেই ফাঁকে বাঁধন খুলে, দরজার খিল খুলে আবার পালিয়ে গিয়েছি। পরে দাদাদের হাতে মার খেয়েছি কিন্তু খেলা থেকে কখনও পিছপা হইনি।

প্রতিদিন বিকালে স্কুল থেকে ফিরে এসে কোনওমতে নাকেমুখে গুঁজে সোজা অরবিন্দ স্কুলের মাঠে। আর বৃষ্টি হলে তো কথাই নেই। এদিকে মা ছাতা নিয়ে যখন আমাকে মাঠে খুঁজতে গেছে তখন আমি স্ট্রাইকার রোলে সররা খাচ্ছি।

যাইহোক ধীরে ধীরে খেলাধুলার জগৎ থেকে ইতি টানলাম। শৈশব থেকে কৈশোরে পা বাড়াতেই দেখলাম আমার বন্ধু রঞ্জন ডাক্তার হওয়ার বাসনায় তেড়েফুঁড়ে লেগেছে। হঠাৎ একদিন এও শুনলাম যে, সে কলকাতায় পালিয়ে গেছে। উঠেছে কোনও এক আত্মীয়ের বাড়িতে। সেখানে থেকে সে ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন সফল করবে।

আমার জীবনেও সেরকম অনেক উচ্চাশা ছিল। ওর মতো ডাক্তার না হতে পারি (যদিও মনে ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার বাসনা ছিল) নিদেনপক্ষে একটা সরকারি চাকুরে অর্থাৎ সরকারি অফিসের বড়োবাবু হওয়ার জন্য মনে মনে ঠিক করে রেখেছিলাম।

ছোটোবেলার কথা আবছা মনে পড়ে। বাবাকে দেখতাম হাওড়া ব্রিজের নির্মাণ পদ্ধতি কত সুন্দর করে বুঝিয়ে বলতেন। তাছাড়া বাবার আত্মীয়দের মধ্যে অনেকেই উঁচু পোস্টের ইঞ্জিনিয়ার। বাড়িতে তাঁরা এলে বাবা তাঁদের অনেক সম্মান করতেন। সেদিন যেন বাড়িতে উৎসব আনন্দের ঢেউ উঠত। কত পদ যে-মাকে রান্না করতে হতো তার হিসাব নেই।

আমিও শিশুকাল থেকে সেই ইঞ্জিনিয়ার আত্মীয়দের হৃদয়ের অন্তস্থল থেকে সম্ভ্রমের আসন দিয়েছিলাম। যেন আমার ভারতবর্ষের পূজ্য দেবতা। তেত্রিশ কোটি দেবতার ছোটো ছোটো সংস্করণ। যেন বাবা বিশ্বকর্মার সন্তান, নাতি, পুতি এঁরা। বাবা বিশ্বকর্মা কী কী খেতে ভালোবাসতেন জানি না, তবে এদের খাতির আরও বেশি ছিল।

আমিও রঞ্জনের মতো একবার বাড়ি থেকে পালিয়ে গেলাম কলকাতায়। যাই হোক বালিগঞ্জে একটা চেনা লোক পেয়ে গেলাম। তার বাড়িতেই উঠলাম। ভদ্রলোকের নাম বীরেন দাস। তাঁর আবার তিন মেয়ে, বড়োজন ভালো গান গাইতে পারে অনেক মেডেলও পেয়েছে। সে আমার চেয়ে বছর দু-তিনেক বড়ো। আবার প্রেমও করে। ছেলে সাধারণ কারখানায় কাজ করে।

বীরেনবাবুর আপত্তি ওই ছেলের সঙ্গে বড়ো মেয়ের বিয়ে দিতে। সেই দুঃখে বড়ো মেয়ে কন্টিনিউয়াস সাতদিন অনশনে। বীরেনবাবু অনেক কষ্টে বিয়েতে রাজি হলেন এবং তারপর বড়ো মেয়ে অনশন ভঙ্গ হল। মেজটার বিয়ে হবে হবে করছে। ছেলে আর্মিতে চাকরি করে। ছোটোটা স্কুলে পড়ে। আমার উপর দায়িত্ব পড়ল ছোটোটাকে পড়ানোর।

মাথায় গোবর আছে বললেও বেশি বলা হবে। আমি পড়াব কী, সে উলটে আমায় পড়িয়ে দেয়। জানি না ওনারা কী ভেবেছিলেন বা আমার ছাত্রীর মনে কী মনোভাব ছিল। তবে ওদের পাড়ায় কানাঘুষো চলত আমি ওই বাড়ির ছোটো জামাই। যাই হোক মা কেঁদেকেটে যখন খবর পেলেন যে, আমি কোথায় আছি তখন দাদাদের হাত দিয়ে পড়াশোনার জন্য কিছু কিছু দক্ষিণা পাঠাতে লাগলেন।

পড়াশোনাও ধীরে ধীরে এগিয়ে চলল। আর টিউশানির পয়সা আমি নিতাম না, ওটা বীরেনবাবুর কাছে জমা থাকত। ওনার রেফারেন্সে গ্রাজুয়েশনের পরে ম্যানেজমেন্ট পড়তে গেলাম। কারণ উনি বলেছিলেন সাধারণ গ্রাজুয়েট হয়ে কিচ্ছু হবে না। দেশে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যাই শুধু বাড়বে। খরচা ম্যানেজ করেছিলাম ওই জমা টিউশানির পয়সা আর ওনার সামান্য কিছু সাহায্য দিয়ে। বীরেনবাবুকে কোনওদিন ভুলব না!

মাঝে মাঝে কলকাতার মিছিল-মিটিং-এ যোগ দিতাম। সেই সময় দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ভযংকর ছিল। দেশে শান্তি ফিরিয়ে আনা অবিলম্বে প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল এবং সে সম্বন্ধে আমার বিন্দুমাত্র সন্দেহ ছিল না। সেই দুঃসাধ্য কাজটা কীভাবে করব, লোকে উপদেশ দিত কিন্তু দৃষ্টান্ত কেউ দেখাত না।

সেই শহরে তখন নীলুদা, রূপকদার পাল্লায় পড়ে দেশের কাজে লেগে পড়লাম। বদমাস ছিলাম ঠিকই, তবে সেই কাজে উৎসাহের কোনও ঘাটতি ছিল না। আমরা পাড়াগাঁয়ের ছেলে হতে পারি, কলকাতার ওই ইঁচড়ে-পাকা ছেলেদের মতো সব জিনিস নিয়ে পরিহাস করতে শিখিনি। সুতরাং আমাদের নিষ্ঠা অত্যন্ত দৃঢ় ছিল।

আমাদের সভায় নেতা-নেত্রীরা বক্তৃতা দিতেন, আর আমরা চাঁদার বই হাতে নিয়ে না-খেয়ে দুপুর-রৌদ্রে টো-টো করে বাড়ি বাড়ি ভিক্ষা করে বেড়াতাম। রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে লিফলেট-পত্রিকা বিলি করতাম। সভার জন্য চেয়ার-বেঞ্চি সাজাতাম। আমাদের নেতার নামে কেউ একটা খারাপ মন্তব্য করলে মারামারি পর্যন্ত করতে এগিয়ে যেতাম। শহরের ছেলেরা এসব দেখে আমাদের নিয়ে মজা করত।

আসলে পার্টির লোকেরা যে আমার ব্রেন ওয়াশ করে রেখেছে। দেশের এখন দুরবস্থা, তাই দেশের জন্য লড়তে হবে। মনে মনে আমি প্রতিজ্ঞাও করেছিলাম, আজীবন বিয়ে না করে দেশের জন্য লড়ে যাব। মাকেও তাই বললাম, পড়াশোনা শেষ না করে আমি বিয়ে করব না।

এসব ভাবনা যখন চলছিল, তার ঠিক ছমাস পরেই খবর পেলাম, এলআইসি-তে কর্মরত অবিনাশবাবুর সাথে নন্দিনীর বিয়ে হয়ে গেছে। রাজনৈতিক ডামাডোলে অসহায় ভারতের চাঁদা-আদায়ের কাজে ব্যস্ত ছিলাম, নন্দিনীর বিয়ের খবর তখন অত্যন্ত তুচ্ছ বলে মনে হয়েছিল। পরে শুনেছিলাম দুজনের বয়সের অনেকটাই পার্থক্য, বছর পনেরো তো হবেই।

বন্ধুরা বলেছিল বিয়ের দিন নন্দিনী নাকি খুব কান্নাকাটি করেছিল। বারবার বলছিল রাজা আমাকে ভীষণ ঠকাল। সেই ছোটোবেলা থেকে ওকে আমি ভালোবাসি। সে কথা শুনে আমার চোখের কোণাটা একটু ভিজেছিল ঠিকই আর ঠিক সেই সময়ে রবিঠাকুরের কবিতাটা কোথা থেকে যেন উড়ে এসে আমার দিকে বুকের মধ্যে তার তির নিক্ষেপ করে বলতে চাইল, যে আছে অপেক্ষা করে তার পরনে ঢাকাই শাড়ি কপালে সিঁদুর।

ম্যানেজমেন্ট পড়া সবে শুরু করেছি এমন সময় দাদা বিয়ে করে বউ নিয়ে আলাদা হয়ে গেল। সংসারে আমি আর মা। কলেজ থেকে ফিরে রাত্রে দুটো টিউশানি ধরলাম। এর ফাঁকে চাকরির সন্ধানও চলতে লাগল। ম্যানেজমেন্ট পড়ার পাঠ অনেক লড়াই ও কষ্টে শেষ হল। রেজাল্ট ভালোই করলাম। অনেক ইন্টারভিউ দেওয়ার পর একটা বিদেশি কোম্পানিতে ট্রেনিং অফিসার-এর কাজ পেলাম। মনে মনে ভাবলাম মাঠে-ঘাটে পার্টির জন্য লেকচার দেওয়াটা এখন বেশ কাজে লাগবে। কাজও যেমন শেখাতে পারব, উপদেশ আর উৎসাহ দিয়ে এক একটা ছাত্রকে আগামী ভারতবর্ষের সৈনিক করে গড়ে তুলতে পারব।

ট্রেনিং শুরু হয়ে গেল। দেখলাম আগামী ভারতবর্ষের চেয়ে প্রোজেক্ট-এর কাজের ধারণা ও প্রোগ্রেস নিয়ে তাদের তাড়া বেশি। প্রোজেক্ট-এর সিলেবাসের বাইরে কোনও বিষয় নিয়ে আলোচনা হলে ম্যানেজারবাবু রাগ করেন। ধীরে ধীরে আমারও উৎসাহ নিস্তেজ হতে লাগল।

আমাদের বেশির ভাগ লোকেদেরই বোকা বুদ্ধি বেশি, আর কাজের বুদ্ধি কম। তাছাড়া বেশির ভাগই প্রতিভাহীন। ঘরে বসে নানান কল্পনা করতেই ব্যস্ত। কার্যক্ষেত্রে নেমে ঘাড়ে লাঙল নিয়ে পশ্চাত্দেশে ল্যাজমলা খেয়ে নতশিরে সহিষ্ণু ভাবে প্রত্যেকদিন মাটি-ভাঙার কাজ করে, সন্ধ্যাবেলায় একপেট জাবনা খেতে পারলেই সন্তুষ্ট থাকে। লম্ফেঝম্ফে আর উৎসাহ থাকে না।

যাই হোক প্রোজেক্ট শেষ হওয়ার সাথে সাথেই ট্রান্সফার হয়ে গেলাম ভুবনেশ্বর। যে-গ্রামের মধ্যে আমাদের প্রোজেক্ট শুরু হবে তার প্রায় কাছাকাছিই সমুদ্র। ওখানেই একটা গ্রামে মেস ভাড়া করে থাকলাম। চারিদিকে সুপুরি, নারকেল এবং মাদারের গাছ। মেস-বাড়িটার প্রায় গায়ে দুটো প্রকাণ্ড বৃদ্ধ নিমগাছ গায়ে গায়ে সংলগ্ন হয়ে ছায়া দান করছে।

অনেকদিন ধরে একটা কথা বলব বলব করে আর বলা হয়ে ওঠেনি। আসলে আমি নিজেই সেই কথাটাকে বেশি প্রাধান্য দিতে রাজি ছিলাম না। সেই যে অবিনাশবাবু, এলআইসি-তে চাকরি করেন, যার সঙ্গে আমার ছোটোবেলার বান্ধবী নন্দিনীর বিয়ে হয়েছিল তিনিও এই সুদূরে ভুবনেশ্বরে আমাদের পাশের বাড়িতে ভাড়া থাকেন।

অবিনাশবাবুর সঙ্গে দেখা হল, আলাপ হল। আসলে আমরা দুই বাঙালি কলকাতা থেকে এসেছি। আশেপাশের বাড়িতে উড়িষ্যাবাসীরাই বেশি থাকেন। ভাষার অজ্ঞানতায় তাই কথা বলতে একটু অসুবিধা হয়। নন্দিনীর সাথে ছোটোবেলায় আমার যে জানাশোনা ছিল সেটা অবিনাশবাবু জানতেন কি না জানি না, তবে আমিও নতুন পরিচয়ে সে সম্বন্ধে কোনও কথা বলা উচিত হবে বলে মনে করলাম না। এবং নন্দিনী যে কোনওদিন আমার জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িত ছিল, সে কথাগুলোও আমি ভাবতে চাইছিলাম না। যাই হোক উনি সস্ত্রীক এখানে আছেন আমাকে বললেন, নিমন্ত্রণও জানালেন ওনার বাড়িতে যাওয়ার জন্য।

এক রবিবার প্রোজেক্টে না গিয়ে অবিনাশবাবুর বাড়ি গিয়ে হাজির হলাম। অনেকরকম বিষয় নিয়ে আলোচনা হওয়ার পর ভারতবর্ষের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হল। আলোচনার ইতি টানা হল বর্তমান ভারতবর্ষের দুরবস্থা প্রসঙ্গে। তিনি যে সেজন্য বিশেষ চিন্তিত এবং ম্রিয়মান সেটা কিন্তু নয়। কিন্তু বিষয়টা এমন যে সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে এ সম্বন্ধে ঘন্টাখানেক অনর্গল শখের দুঃখ করা যেতেই পারে।

আলোচনার ফাঁকে ফাঁকে শুনতে পাই পাশের ঘরে অত্যন্ত হালকা বাসন পড়ার আওয়াজ, দরজা খোলা-বন্ধের শব্দ, আর হাওয়াই চটির খসখস। বুঝতে দেরি হল না, জানলার ফাঁক দিয়ে কোনও কৌতূহলী চোখ আমার দিকে ইশারা করছে।

সেই মুহুর্তে চোখে চোখ পড়তেই আমার মনে পড়ে গেল সেই সরলতা, সেই নিবেদিত প্রাণ এবং শৈশবের প্রেমের ঢলঢল দুটো বড়ো বড়ো চোখ, কালো কালো তারা, ঘনকৃষ্ণ পল্লব, স্থিরস্নিগ্ধ দৃষ্টি। হঠাৎ আমার হৃদপিণ্ডটাকে কে যেন তার ডান হাত দিয়ে শক্ত করে চেপে ধরল আর অব্যক্ত বেদনায় বুকের ভিতরটা টন টন করে উঠল।

সেই বুকের ব্যথা সঙ্গে নিয়ে অবশেষে মেসে ফিরলাম। রাত্রে যখন লিখতে বসি কিংবা কোনও ম্যাগাজিন পড়তে বসি সেই চিন চিন ব্যথাটা শরীরটাকে কেমন যেন অবসন্ন করে রাখে। মনের মধ্যে একটা ভারী বোঝার সঙ্গে শিরা-উপশিরার রক্তগুলো দ্রুতলয়ে ছুটতে থাকে। গভীর রাতে একটু স্থির হয়ে বসে ভাবতে লাগলাম এমনটা কেন হল? বিবেক যেন জিজ্ঞেস করল, তোমার নন্দিনী কোথায় গেল?

বিবেকের প্রশ্নে আমার মনের ভেতর থেকে উত্তর এল, কই তাকে তো আমি ভালোবাসিনি। কবেই তো তাকে মন থেকে মুছে দিয়েছি। সে আমার জন্য অপেক্ষা করবে কেন? বিবেক আবার প্রত্যুত্তরে বলল, নন্দিনীকে তুমি ইচ্ছা করলেই পেতে পারতে। আজ শত চেষ্টা করলেও, মাথা খুঁড়ে মরলেও তাকে আর দেখতে পাবে না।

সেই ছোটোবেলার নন্দিনী যতই তোমার চারপাশে ঘুরে বেড়াক, আজ হয়তো তুমি দূর থেকে তার পায়ের নুপূরের ধ্বনি শুনতে পাবে, দূর থেকে তার শরীর থেকে মিষ্টি সুগন্ধ অনুভব করতে পারবে কিন্তু মাঝখানে চিনের প্রাচীরের মতো একটা দেয়াল থাকবে বরাবর।

মনের অব্যক্ত বেদনাকে চেপে রেখে বিবেককে উত্তর দিলাম, তা থাক না, নন্দিনী আমার কে? প্রত্যুত্তরে বিবেক বলল, নন্দিনী আজ হয়তো তোমার কেউ নয়, কিন্তু এই নন্দিনী তোমার মনের অনেক কিছু হতে পারত।

কথাটা হয়তো সে সত্যি বলেছে। নন্দিনী আমার জীবনে, মননে অনেক কিছুই হতে পারত। আমার সবচেয়ে অন্তরঙ্গ, আমার সবচেয়ে নিকটবর্তী, আমার সমস্ত জীবনের সুখদুঃখের অংশীদার ছিল সে। আজ অনেক দূরে, কত আপন ছিল, আজ পর হয়ে গেছে, আজ তাকে দেখার অবকাশ নেই। একটু দেখার চেষ্টা করলে লোকে পরকীয়ার বদনাম দেবে। সেটা হয়তো নন্দিনীর শান্তির জীবনে অশান্তি ডেকে আনবে। আর আমিও সেটা চাই না। তার সঙ্গে কথা বলা তো দূর অস্ত, তাকে নিয়ে চিন্তা করাও পাপ। আর ওই ভদ্রলোক, কোথা থেকে যে উড়ে এসে জুড়ে বসল, শুধু কটা মন্ত্র উচ্চারণ করে নন্দিনীকে আমার কাছ থেকে চিলের মতো ছোঁ মেরে নিয়ে পালিয়ে গেল।

তবু স্বামীর সুখের সংসারে যে-নন্দিনী বিরাজ করছিল সে যে ওই মানুষটার চেয়ে বেশি করে আমার, এ কথা আমি কিছুতেই মন থেকে উড়িয়ে দিতে পারছিলাম না। জানি এরকম চিন্তা করা নিতান্ত অন্যায় এবং সেটা আমি স্বীকার করি। তবে নিজের মনের কাছে সেটা খুব একটা অস্বাভাবিক নয়। তারপর থেকে আর কোনও কাজে মনঃসংযোগ করতে পারছিলাম না। লাঞ্চের পরে যখন সুপারভাইজাররা ট্রেনিং-এর ক্লাসে বসে সোরগোল করতে থাকত, বাইরে প্রখর রোদ ঝাঁ ঝাঁ করত, গরম বাতাস নিমগাছের ফুলের গন্ধ বহন করে আনত, তখন ইচ্ছা করত… জানি না কী ইচ্ছা করত! এই পর্যন্ত বলতে পারি, ভারতবর্ষের শিল্পের এই সমস্ত ভাবী অফিসারদের প্রযুক্তিগত উপদেশ দিয়ে এই ইট-কাঠ-বালির জীবনযাপন করতে ইচ্ছা করত না।

অফিসের ছুটি হয়ে গেলে আমার ছোট্ট ওই মেসবাড়িতে একলা থাকতে মন টিকত না, অথচ কোনও অফিসের স্টাফ দেখা করতে এলেও অসহ্য লাগত। রাত্রে যখন পাশের একটা পুকুর ধার দিয়ে হাঁটতাম, তখন সুপারি-নারকেলের হেলেদুলে ওঠা অর্থহীন মর্মরধ্বনি শুনতে শুনতে ভাবতাম, মানুষ জাতটা মাকড়সার জালের মতো ভুলগুলিকে বুনতে থাকে। আবার ঘুরে ঘুরে ফিরে এসে কবে যে তাকে শোধরাবে সে নিজেই জানে না। ঠিক সময়ে ঠিক কাজ করতে মনে পড়ে না, তার পরে প্রয়োজনে মনের বাসনা চরিতার্থ করতে টেনশন নিয়ে মরে।

অবচেতন মনে বিবেকের খোঁচা মারা ভাষণ শুনতে পাই, তুমি নন্দিনীর স্বামী হয়ে বুড়ো বয়স পর্যন্ত বেশ সুখে থাকতে পারতে, আর তুমি কিনা প্রথমে হতে গেলে দেশপ্রেমী এবং শেষে ইট-বালি-চুন-সুরকি কোম্পানির ট্রেনিং অফিসার। আর, অবিনাশবাবু একজন অফিসার, আর তার কি বিশেষ করে নন্দিনীর স্বামী হবার কোনও জরুরি আবশ্যকতা ছিল? বিয়ের আগে পর্যন্ত তার কাছে নন্দিনীও যেমন, রানী লক্ষ্মীবাঈও তেমন। সে কিনা কিছু না ভেবে না চিন্তা করে বিয়ে করে বসলেন আর সরকারি কর্মচারী হয়ে হাজার হাজার টাকা কামিয়ে যাচ্ছেন। যেদিন তরকারিতে বেশি নুন পড়ে যায় সেদিন তিনি নন্দিনীকে গালিগালাজ করেন, আর যেদিন মন প্রসন্ন থাকে সেদিন নন্দিনীর জন্য উপহার কিনে আনেন। গোলগাল শরীর, সু্ট-টাই পরেন, মনের মধ্যে কোনও টেনশন নেই। যাকে পুকুরের ধার দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে আকাশের তারা গুনতে গুনতে রাতে ঘুমোতে যাওয়ার আগে অবসর সময় কাটাতে হয় না।

যাই হোক, ভদ্রলোক অফিসের কাজে কয়েকদিনের জন্য কলকাতায় গেছেন। অবশ্য যাওয়ার আগে আমাকে বলে গেছেন। আমি হাঁটছি আর ভাবছি, এই মেসবাড়িতে আজ আমি যেরকম একা আছি নন্দিনীও সেরকম বোধহয় তার ঘরে একাই আছে।

মনে পড়ে, সেদিনটা ছিল মঙ্গলবার। সকাল থেকেই আকাশটা কালো মেঘে ঢেকে আছে। সকাল আটটা থেকেই টুপটুপ করে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। টিভির খবরে বলছে ভযংকর এক ঘুর্ণিঝড় ফণী, উড়িষ্যার উপর দিয়ে বয়ে যেতে পারে। আকাশের ভাবগতিক দেখে আশেপাশের সব স্কুল ছুটি ঘোষণা করে দিয়েছে। প্রোজেক্টের কাজও বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। খণ্ড খণ্ড কালো কালো মেঘগুলো যেন আকাশের বুকে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। বিকালের দিকে মুষলধারে বৃষ্টি এবং সঙ্গে সঙ্গে ঝড় আরম্ভ হল। যত রাত বাড়ছে বৃষ্টি আর ঝড়ের বেগ ভযংকর ভাবে বাড়তে লাগল। প্রথমে পূর্ব দিক থেকে বাতাস বইছিল, ক্রমে উত্তর এবং উত্তর-পূর্ব দিক থেকে বইতে লাগল।

ওই দুর্যোগের রাতে ঘুমোবার চেষ্টা করা বৃথা। মনে পড়ল, এই দুর্যোগে নন্দিনীও ঘরে একলা আছে। আমাদের মেসবাড়ি তাদের একতলা ঘরের থেকে অনেক মজবুত। কতবার মনে করলাম, তাকে মেসবাড়িতে বসিয়ে রেখে আমি না হয় পুকুর পাড়ে গ্রামের কোনও চালাঘরের নীচে দাঁড়িয়ে বিধ্বংসী ঝড়ের রূপ উপভোগ করব। কিন্তু কিছুতেই মন স্থির করে উঠতে পারলাম না। অনেকটা মনের দ্বিধা-দ্বন্দ্বে আটকে গেলাম।

রাত যখন একটা-দেড়টা হবে হঠাৎ আরও প্রবল বেগে ঝড়ের সোঁ সোঁ ডাক শোনা গেল। সমুদ্র যেন উথাল পাতাল হয়ে ছুটে আসছে। ঘর থেকে ছাতা হাতে বাইরে বেরোলাম। দেখি একটা রক্তকরবী গাছ ঝড়ের দাপটে একদম শিকড় থেকে উপড়ে পড়েছে। আমার খুব পছন্দের ফুল। মনে পড়ে কতদিন নন্দিনী তার ওড়নায় বেঁধে আমার জন্য নিয়ে এসেছে। সে কথা মনে পড়তেই কটা ফুল কুড়িয়ে নিলাম। নন্দিনীর বাড়ির দিকে পা বাড়ালাম। পথে যে-পুকুরের পাড়, সে পর্যন্ত যেতে না যেতেই দেখি হাঁটুজল হয়ে গেছে। পুকুরের পাড়ের উপর যখন উঠে দাঁড়ালাম তখন দ্বিতীয় আর একটা জলের স্রোত এসে আছড়ে পড়ল।

পুকুর পাড়ের একটা অংশ প্রায় দশ-এগারো হাত উঁচু। পাড়ের উপর আমি যখন উঠে দাঁড়ালাম, বিপরীত দিক থেকে আরেকজন লোকও উঠে দাঁড়াল। লোকটা যে কে সেটা আমার সমস্ত অন্তরাত্মা, মাথা থেকে পা পর্যন্ত আমার সমস্ত শরীর অনুভব করতে পারল। এবং সেও যে আমাকে চিনতে পারল সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। শুধু একটা কন্ঠস্বর শুনতে পেলাম রাজা, তুমিও এখানে?

সমস্ত জলমগ্ন হয়ে গেছে কেবল হাত-পাঁচ-ছয় দূরত্বে দ্বীপের উপর আমরা দুটি প্রাণী এসে দাঁড়ালাম। তখন প্রলয় চলছে, আকাশে তারার আলো ছিল না এবং পৃথিবীর সমস্ত প্রদীপ যেন নিভে গেছে। তখন একটা কথা বললেও বলতে পারতাম। হাতে ধরা সিক্ত রক্তকরবী ওর পায়ের কাছে পড়ে গেল কিন্তু একটা কথাও বলা গেল না। কেউ কাউকেও একটা কুশল প্রশ্নও করল না। শুধু দুজনে অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে রইলাম। মনে মনে রবিঠাকুরের গান গেয়ে উঠলাম, আজি ঝড়ের রাতে তোমার অভিসার।

আজ সমস্ত বিশ্বসংসার ছেড়ে নন্দিনী আমার কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। আজ এই বিপদের দিনে আমি ছাড়া নন্দিনীর পাশে কেউ নেই। সেই কবে শৈশবে, কোন এক জন্মান্তর, কোন এক পুরোনো রহস্য অন্ধকার থেকে ভেসে, এই সূর্য‌্য আর চন্দ্রের আলোকে আলোকিত হয়ে এই পৃথিবীর কোলে আমারই পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল; আর, আজ বহুদিন পরে সেই আলোকিত পৃথিবী ছেড়ে এই ভযংকর জনশূন্য প্রলয় অন্ধকারের মধ্যে নন্দিনী একাকিনী আমারই পাশে এসে দাঁড়িয়ে আছে। জন্মের পরে সেই ফুলের কলিকে যেমন বিধাতা আমার হাতে সমর্পণ করেছিল, আজও প্রকৃতির তাণ্ডবে জীবনমৃত্যুর মাঝখানে সেই বিকশিত পুষ্পকে আমারই কাছে এনে দাঁড় করিয়েছে। সমুদ্রের উত্তাল তরঙ্গে আর একটা ঢেউ আসলেই পৃথিবীর এই সীমানা থেকে বিচ্ছেদের শেষ বৃন্তটুকু ছিঁড়ে, আবার আমরা দুজনে এক হয়ে যেতে পারি।

ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করি সে ঢেউ যেন আর না আসে। স্বামী সংসার নিয়ে নন্দিনী যেন বাকি জীবন সুখে থাকে। ওই রাতে ফণীর তাণ্ডবে হয়তো অনেক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তবু এই মহাপ্রলয়ের তীরে দাঁড়িয়ে নন্দিনীকে ফিরে পেয়ে এক অনন্ত আনন্দের আস্বাদ পেয়েছি।

রাত প্রায় শেষ হয়ে এল। ঝড় থামল, জলও নেমে গেল। নন্দিনী কোনও কথা না বলে বাড়ির পথে পা বাড়াল। তার পায়ের সামনে পড়ে থাকা রক্তকরবী ফুলগুলো কি বলল জানি না, তবে আমিও কোনও কথা না বলে মেসবাড়ির দিকে রওনা হলাম। কোনওদিন কবিতা লিখিনি, কিন্তু আজ বিবেকের দংশন খেয়ে হৃদয়ের গভীর থেকে কয়েকটা লাইন লিখে ফেললাম,

আজ এই প্রলয়ে দিনে,

মেঘে মেঘে গুরু গর্জনে

ধেয়ে আসে ঘুর্ণিঝড় ফণী,

তুমি এসে দাঁড়ালে নন্দিনী।

নূপুর ছিল না ওই পায়,

এভাবে কেউ অভিসারে যায়?

পায়ে পায়ে বাজে না কিঙ্কিণী,

কেন এসে দাঁড়ালে নন্দিনী?

এলে যদি কেন গেলে একা?

আর কি হবে না তবে দেখা?

শৈশবের কৈশোরের রানি

সব ভুলে গেলে নন্দিনী?

ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে। মেসে ফিরতে ফিরতে ভাবছিলাম, আমি একজন সাচ্চা দেশপ্রেমীও হতে পারলাম না, ইঞ্জিনিয়ারও হতে পারলাম না, আমি সামান্য এক ইট-বালি-চুন-সুরকি কোম্পানির ট্রেনিং অফিসার। সাধারণ মেস বাড়িতে থাকি। শুধু ক্ষণিকের অবকাশে এক প্রলয়রাত্রির উদয় হয়েছিল আমার এই ক্ষুদ্র জীবনে। সমস্ত দিনরাত্রির মধ্যে, একমাত্র সেই প্রলয়রাত্রিতে আমার তুচ্ছ জীবনে নন্দিনীকে ফিরে পাওয়াই আমার জীবনের চরম সার্থকতা।

 

জীবন-নদী

অদিতি এভাবে চলে যাবে ভাবিনি। অদিতি এভাবে ফিরিয়ে দিয়ে যাবে তাও অকল্পনীয়। জীবনের বাঁকে বাঁকে এত রূপ রস, সব আমার জন্য!

‘আমি তোমার সাথে দেখা করব।’ অচেনা স্বর, কিন্তু আওয়াজে বোঝা যায় কিশোরী কণ্ঠ। দ্বিধাহীন ভাবে ‘তুমি’ সম্বোধনে সে কথা বলল।

‘কে কথা বলছ?’

‘নয়না।’

ভেবে পেলাম না এমন নামে আমি কাউকে চিনি কি না। গম্ভীর হয়ে তাই জবাব দিলাম, ‘আমার কোনও আগ্রহ নেই তোমার সাথে দেখা করায়।’ ওধার থেকে ধীরে জবাব এল, ‘আপনি আমায় মানে নয়নাকে চেনেন না কিন্তু আমার মাকে চেনেন।’ মেয়েটা হঠাৎ ‘তুমি’ থেকে ‘আপনি’তে উঠে এল। বোধহয় আমার বলাটা একটু বেশিই রুক্ষ হয়ে গিয়েছিল।

সকালবেলা একটা উটকো ফোন। চা খাওয়া হয়নি এখনও। বাসি মুখেই এমন ঝামেলা। দিনটা কেমন যাবে কে জানে। ‘আমি তোমার সঙ্গে দেখা করতে চাই না,’ বলেই রিসিভারটা নামিয়ে রাখলাম। চুপচাপ বসে অনেকক্ষণ ভাবলাম। কোনও দিশা খুঁজে পেলাম না। কার মেয়ে! আমার কাছে কী চায়? ‘মেয়ে’ শব্দটাই আমার কাছে অতীত মাত্র। সেই স্মৃতি– যা আমায় রুক্ষ, একা করে দিয়েছে। জীবনবোধে বিতৃষ্ণা এলেও জীবনকে ছাড়তে পারিনি। মেয়েটা কে? অদিতির চলে যাওয়া, আমার মাথার উপর ছাদ উড়ে যাওয়ার সমান। আমি ফিরে গেলাম চল্লিশ বছর আগের স্মৃতির পাতায়।

মফসসলের ছেলে আমি। উচ্চমাধ্যমিকে ভালো রেজাল্ট করায় বাবা পাঠিয়ে দিল কলকাতায়, কাকার বাড়ি। ভর্তি হলাম আশুতোষ কলেজে। কাকার বাড়ি থেকে কলেজ হাঁটা পথ। একদিন এমনই একা একা হেঁটে ফিরছি রবীন্দ্রসরোবর লেকের ভিতর দিয়ে হঠাৎ কেউ ডাকল ‘হাই অলোক।’ তাকিয়ে দেখি আমাদেরই সাইকোলজি ক্লাসের একটি মেয়ে। অনেকবার চোখাচোখি হয়েছে কিন্তু কথা হয়নি। বেশ ভালো লাগল কিন্তু ও আমার নাম জানল কী করে? ওই বয়েসে বেশ গর্ব-ও হল ক্লাসমেট আমার নাম জানে বলে। আমি হেসে দাঁড়িয়ে বললাম, ‘আমার নাম অলক, অলোক নয়।’ ও পরিচয় দিল, ‘আমি অদিতি। তুমি কোথায় থাকো? আমি কি তোমার সাথে একটু হাঁটতে পারি? আমার বাড়ি কাঁকুলিয়া রোড। বাড়িতে…।’ বেশ অনেকক্ষণ একা একাই বকবক করে গেল। হঠাৎ কী মনে হতে নিজেই চুপ করে হেসে জিজ্ঞাসা করল, ‘কই কথার জবাব দিলে না তো?’ আমি ওর দিকে সোজাসুজি তাকিয়ে বললাম– ‘সময় দিলে কোথায় কথা বলার?’ এইভাবেই আমাদের বন্ধুত্ব। অদিতি কবে যে আমার কাছে ‘দিতি’ হয়ে গেল তা নিজেই জানি না। এই আমার দিতি। অদিতি।

সামাজিকতার ধার আমি কোনওদিন ধারিনি। নিজের ইচ্ছেতেই চলেছি।

আমি এই বয়েসে নিজের কাজকর্ম নিয়ে বেশ আনন্দে আছি। জীবনে তেমন উচ্চাশা নেই, কেউকেটা হতেও চাইনি। তাই কলেজ জীবনে যখন, কলেজের মধ্যে সবথেকে সুন্দরী, মেধাবী মেয়েটি আমার দিকে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে ছিল, আমার সহপাঠীরা বেশ ঈর্ষান্বিতই হয়েছিল। আমার কিন্তু কোনও হেলদোল নেই, আমি স্বাভাবিক ভাবেই নিয়েছিলাম ব্যাপারটা। অদিতিও বেশ স্বাভাবিক। আমাদের মেলামেশা দিনের আলোর মতো সহজই ছিল কিন্তু অদিতি ধীরে ধীরে সেই সীমা ছাড়িয়ে অনেক এগিয়ে এল। আমি বারণ করেছিলাম, বুঝিয়েছিলাম ‘দিতি তোমার সমাজ আর আমার সমাজে অনেক তফাত। প্লিজ, তুমি এমন কোরো না, পরে কষ্ট পাবে।’ কিন্তু কাকস্য পরিবেদনা। অদিতি আমার কোনও কথাই শুনল না। ও দুর্দম, আমিও ভেসে গেলাম ওর সাথে। জানতাম অদিতির জীবনে আমি প্রথম পুরুষ নয়, তবু নিজের মধ্যে একটু দোটানা থাকলেও আমি নিজেকে আটকাতে পারিনি। আমরা স্বপ্নে ভেসে গেলাম– ছোট্ট সংসার, টলোমলো পা।

সত্যি আমরা ভেসে গেলাম। যেদিন দিতি জানাল তার শরীরের নতুন অনুভবের, সেদিন আমি আনন্দের পরিবর্তে বেশ ভীত হয়ে উঠলাম। মুখে হাসলেও দিতি ঠিক বুঝতে পারল, আমি ভয় পেয়েছি। দুজনের বাড়িতে কে কী বলবে? কীভাবে সামলাব? আমার শুকনো মুখ দেখে অদিতি কি বুঝল, কে জানে! বারবার একই কথা জোরের সঙ্গে পুনরাবৃত্তি করতে থাকল, ‘আমাদের ভালোবাসার ফসল, নতুন মানুষ আসবেই। আমাদের উত্তাপ ওর মধ্যেই। আমি পারবই।’ আমি অবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে রইলাম। খটকা লাগল ওর কথায় ‘আমি পারবই,’ তবে কী ‘আমরা’ নয়? হঠাৎ অনুভব করলাম আমি ঘেমে উঠেছি। এমনই হয়েছিল যেদিন প্রথম অদিতিকে আমি চুমু খেয়েছিলাম, ফাঁকা কলেজ করিডোর-এ। ভুল বললাম, আমি নয়, ও এগিয়ে এসে সপাটে জাপটে ধরে…। আমি ছটফট করে ওকে ঠেলে দিতেই ওর বাঁধভাঙা হাসি। ভয়, ভালোলাগা মিলেমিশে… এমনটাই হয়। হয়তো বা সকলের জীবন-সন্ধিক্ষণে। সেই শুরু। এতদিন পরে অদিতির সন্তানসম্ভাবনার কথা শুনে আবার তেমন ভয় আমায় চেপে ধরল।

সময় এগিয়ে চলে। অদিতির আড়ষ্টতাহীন চলাফেরা আমায় আবার স্বাভাবিক করে তুলল। আমি প্রায় ভুলেই গেলাম ওর শরীরের নতুন অঙ্কুরোগদ্মের কথা। আমি মেতে উঠলাম ওকে নিয়ে। ছুটির দিনে বেড়াতে যাওয়া, আইসক্রিম খাওয়া, হইচই করা, ঘুরে বেড়ানো সব আগের মতোই। ধীরে ধীরে আমি ধাতস্থ হয়ে গেলাম। দুজনের আনন্দের জীবনে শুধু নিস্তরঙ্গ জোয়ারের খেলা। অদিতি কিছু বুঝতে দেয়নি।

জোয়ারের পর ভাটা অনিবার্য। তা এল, কিন্তু এমনভাবে যা আমার কল্পনার অতীত। দিতি একদিন এসে খুব স্বাভাবিক ভাবে বলল, ‘আজ আমার লাঞ্চ আছে, স্পেশাল ব্যাপার।’ আমি শান্ত চোখ তুলে তাকালাম। কোনও প্রশ্ন নেই মুখে। শুধুই তাকিয়ে থাকলাম। ও আশা করেছিল আমি কিছু জিজ্ঞাসা করব। দিতিই নীরবতা ভাঙল, ‘আমার পুরোনো প্রেমিক। লন্ডন থেকে এসেই যোগাযোগ করেছে। সোহম সেন।’ আমি জানতাম, অদিতি বলেছিল, দুম করে সোহমের লন্ডন স্কুল অব ইকনমিক্স-এ চান্স পেয়ে যাওয়ার কথা। অদিতির খুব মন খারাপ হয়েছিল। তবে ওর মতন হুল্লোড়বাজ মেয়ের সব কিছু ভুলে যেতে সময় লাগেনি। মাঝে মধ্যে মনে হয় অদিতি খুবই ক্যাজুয়াল। জামাকাপড় বদলানোর মতো বয়ফ্রেন্ড বদল করে। ভাবতেও ভালো লাগে না এভাবে। আসলে ও তো ধনী পরিবারের দুলালি। আমারও কখনও কখনও সংশয় হয়। সত্যি ভালোবাসে তো মেয়েটা আমায়! আচ্ছা ও কি সত্যিই প্রেগন্যান্ট! তাই ওর সাথে দেখা করা। আমার মনের মধ্যে যাই-ই হোক, আমি ‘না’ বলতে পারিনি ওর মুখ দেখে।

সেদিন দিতি কলেজে এলেও ক্লাস করল না, তারপর দিনও এল না। পরপর চারদিন এল না। ওর ক্লাসমেটদের জিজ্ঞাসা করলাম, কেউ সদুত্তর দিতে পারল না। যেখানে যেখানে খোঁজ নেওয়া যায় নিলাম, কিন্তু কোথাও দিতির খোঁজ পেলাম না। হতাশা কেমন যেন আমায় গ্রাস করে নিল। আমি কলেজে আসতাম, শুধু আমার শরীরটাকেই বয়ে নিয়ে। মনটা সারাক্ষণ অদিতি-অদিতি করে ওকেই খুঁজে চলত।

গাছতলায় মাথা হেঁট করে বসে আনমনে ঘাস ছিঁড়ছি, মাটি খুঁটছি এমন সময় লক্ষ্য করলাম সামনে একটা ছায়া। মুখ তুলে দেখি অদিতি। অপূর্ব সুন্দর দেখাচ্ছে, ঝলমল করছে ও। আমি বুঝলাম না, কারণটা কী? আমি রাগে-দুঃখে ওকে দেখে চিৎকার করে উঠলাম ‘কী ব্যাপার তোমার? তুমি বোঝো না, তোমার সাথে একদিন দেখা না হলে আমি প্রায় পাগল হয়ে যাই। কোথায় ছিলে? এত দায়িত্বজ্ঞানের অভাব কেন?’ অন্য সময় আমি চিৎকার করলেই দিতিও সমানতালে ঝগড়া করত। সব সময় আমিই পরাজিত হতাম এবং হেসে সারেন্ডার করতাম। আজ এ কোন দিতি, আমার সামনে? আমি চিৎকার করছি, ও মাথা নিচু করে দাঁড়িয়েই থাকল। আমি হতভম্ব। দিতি চুপ করেই থাকল, তারপর যেন বহু কষ্টে নীরবতা ভেঙে অস্ফূটে বলল, ‘সরি অলক, এই ক’দিনের মধ্যেই বাড়ি থেকে আমার বিয়ের কথা পাকা হয়ে গেছে। আমার মতামত নিয়ে, সোহমের সাথে।’ অর্থাৎ অদিতির প্রাক্তন প্রেমিক, লন্ডন ফেরত, ভবিষ্যৎ সম্ভাবনাময় পূর্ণ সেই সোহম সেনই দিতির মনোনীত পাত্র। দিতির কথা শুনে আমি প্রায় হিংস্র বাঘের মতন হয়ে উঠেছিলাম। আমি হিস হিস করে বলে উঠলাম, ‘অসম্ভব, আমার দিতি অন্যের হতে পারে না। আমি তোমার বাড়িতে যাব, মা-বাবার সাথে কথা বলব, তুমি এভাবে আমায় ছেড়ে…।’

‘চুপ অলক’, আমার কথা শেষ হওয়ার আগেই দিতির শানিত স্বর আমায় থামিয়ে দিল। ‘কত উপার্জন তোমার? তোমার স্ট্যাটাস কী? কী খাওয়াবে? সবার আগে বলো, আজ বিয়ে করলে কোথায় রাখবে আমায়?’ আমি ঝড়ে ধাক্বা খাওয়া পাখির মতন যেন কিছুটা টাল খেয়ে গেলাম ওর কথায়, একটু সামলে নিজেকে প্রবোধ দিলাম। সত্যিই তো, অদিতির কথাগুলো বাস্তব-যুক্তিপূর্ণ। আমার কী আছে?

অদিতি সত্যিই চলে গেল আমায় ছেড়ে। আমার অনেক কিছু বলার ছিল, করার ছিল। কিন্তু আমি পারলাম না। নিজেকে গুটিয়ে নিলাম শামুকের মতন। দিতির শেষ কথাগুলো ‘তোমার স্ট্যাটাস কী? কোথায় রাখবে?…’ আমায় যেন এক নতুন আমি-তে রূপান্তরিত করল। আমি নিজেকে নিয়ে একটা ব্যূহ রচনা করে ফেললাম। নিজেরই অজান্তে। দিতি-সোহম, চলে গেল গোয়ায়। ও বিয়েতে নিমন্ত্রণও করে গিয়েছিল। কলেজ সহপাঠীরা জোরজবরদস্তি করে আমায় নিয়ে গিয়েছিল। ওরা সব কিছু জানত, তবুও। পরে শুনেছি অদিতি ওদের বারবার বলেছিল আমায় নিয়ে যাওয়ার জন্য। ওদের বাড়ি গিয়েও আমি অদিতির সামনে দাঁড়াতে চাইনি। ঢুকেই কোল্ড-ড্রিংকস নিয়ে অন্যদিকে চলে গিয়েছিলাম। অদিতি খুঁজে পেতে ঠিক আমার সামনে হাজির। অদিতি– না স্বর্গ থেকে নেমে আসা পরি! আমার চোখের পলক পড়ে না। আমি মূর্তির মতো নিথর। নিজের না পাওয়া আকাঙ্খাগুলো, ক্ষোভ-যন্ত্রণা আবার যেন সামনে এসে প্রাচীর হয়ে দাঁড়াল। অদিতি আমার। কেন অন্যের বিছানায় ও শোবে! কেন? কেন? একটা কথাও অদিতিকে বলতে পারলাম না। অথবা ওই অবস্থাতেও সে আমার হাতে মৃদু চাপ দিয়ে হাসতে হাসতে বলেছিল, ‘অলক আমি তোমারই থাকব।’

মেয়েদের প্রতি আমার এক অদ্ভুত বিতৃষ্ণা সেই থেকে। আমি নিজের লেখাপড়ার মধ্যেই পুরোপুরি ডুবে গেলাম। নিজের শরীর, খাওয়াদাওয়া, কোনও দিকে দৃষ্টি নেই। বাবা-মা এসেছিলেন, আমায় বাড়ি নিয়ে যাবার জন্য। কিন্তু আমি নারাজ। এভাবে মাস গড়াল, ফুরোল বছর।

স্মৃতির জালে যেন খাবি খাচ্ছিলাম, হঠাৎ দরজায় কলিংবেল শুনে আমার চমক ভাঙল। আমি স্খলিত পায়ে উঠে দাঁড়ালাম। আবার বেল, ভাবার চেষ্টা করলাম কে হতে পারে? মাথা কাজ করল না। প্রায় অবশ হাতে দরজা খুলতেই চমকে উঠলাম। একটা ঠান্ডা স্রোত শিরদাঁড়া বেয়ে নেমে গেল। এ কে! প্রায় কুড়ি বছর আগের দিতি এতটুকুও বদলায়নি! এ কী করে সম্ভব! আমি স্থাণুবৎ দাঁড়িয়েই রইলাম। দিতি না, দিতির প্রতিচ্ছবি আমার দিকে তাকিয়ে একটু হেসে আমারই ঘরে বিনা অনুমতিতে গিয়ে বসে পড়ল চেয়ারে। বিছানায় ছড়ানো আমার পুজো সংখ্যার উপন্যাসের খসড়া। দিতি নয়, নয়না মেয়েটি আমার কোনও পরোয়া না করেই ঘরের মধ্যে এটা ওটা ঘুরে দেখতে শুরু করল। বইয়ের তাক, টেবিলে ছড়ানো বই, ঢাকনা না লাগানো পেন, পেনসিল, ফাইল-ক্লিপ সব এলোমেলো। ও শুধু দেখেই গেল। যেমন দিতিকে আমি কখনও বারণ করতে পারতাম না, নয়নাকেও আমি কিছুই বলতে পারলাম না। আমার চোখজোড়া ওকে অনুসরণ করে গেল। একসময় ও থামল, আবার চেয়ারে এসে বসল, ‘আপনার লেখা আমি পড়েছি।’ প্রসঙ্গে না গিয়ে আমি ওকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কেন এসেছ?’ নয়না তক্ষুণি কোনও প্রত্যুত্তর করল না। কয়েক সেকেন্ড সময় নিল, তারপর দৃঢ় স্বরে বলে উঠল, ‘আমি জানি, আপনি আর মা মেড ফর ইচ আদার ছিলেন। সমাজ, পরিবার আপনাদের এক হতে দেয়নি। আমার মা পারেনি নিজের পরিবারের বিরুদ্ধে যেতে। তাই আপনাদের দুজনের ভালোবাসার চিহ্ন নিয়ে সে চলে যেতে বাধ্য হয়েছিল। যে-বীজ বপন হয়েছিল তার শরীরে, তাকে সে বিনষ্ট হতে দেয়নি। ডালপালা মেলে তাকে পৃথিবীর আলো দেখতে সাহায্য করেছে। সোহম সেন সামাজিক দায়িত্ববোধে অবশ্যই আমার বাবা। কিন্তু আমার মা, মানে আপনার অদিতি, দিতি আমায় সব বলেছে অকপটে। আমার স্কুল-গণ্ডি পার হয়ে যাবার পরেই। আমি দিনটার অপেক্ষায় ছিলাম, কবে আপনার সাথে দেখা হবে।’

আমি স্থবির, নিশ্চল হয়ে বসে রইলাম। একি শুনছি। দিতি এখানেও তুমি আমায় হারিয়ে দিলে! তোমার প্রতি আমার যে ধারণা তা চুরচুর করে ভেঙে তুমি সোহমের সঙ্গে চলে গিয়েছিলে। সেটা যে তোমার অভিনয় ছিল তা বিন্দুমাত্র আমাকে বুঝতে দাওনি। আমার ভালোবাসাকে তুমি অপমানিত হতে দাওনি, দিতি। মেয়েদের প্রতি আমার যত বিষ সব আমি উগরে দিয়েছি, ঘৃণা, জ্বালা সব মিলিয়ে মেয়েরা যে বিশ্বাসঘাতকতার নজির তৈরি করেছিল আমার জীবনে, তা একমুহূর্তের জন্য ভুলিনি। আজ নয়না আমায় সম্পূর্ণরূপে এলোমেলো করে দিল। দিতি আমায় তুমি ক্ষমা করো। নিজেকে অবহেলা অযত্নে শেষ করে দিয়েছি। তুমি চলে যাওয়ার পর নেশা ধরলাম। কিছুদিন বাদে বুঝলাম আমি নেশা না করতে চাইলেও মদ আমার পিছু ছাড়ে না। আমার শরীর পুরোপুরি ভেঙে গেছে। এই মধ্যচল্লিশে আমায় দেখতে লাগে ষাট বছরের বুড়োর মতো। আজ আমার সামনে আমার আত্মজ– নয়না। আমি কি স্বপ্ন দেখছি!

মা জানত, বাড়িতে জানাজানি হলে দাদু আপনাকে খুন করিয়ে দিতেও দ্বিধা করবেন না। আপনিও জানেন আমার মামার বাড়ির অর্থনৈতিক ক্ষমতা-প্রতিপত্তির কথা। তাই মা নিজের ভালোবাসাকে বাঁচিয়ে রাখতে মুখ বুজে সব মেনে নিয়েছিল। মায়ের জেদ ছিল আমায় পৃথিবীতে আনার। সোহম সেনের প্রতি তার কর্তব্যে কোনও ত্রুটি ছিল না। শুধু এতগুলো বছর মা অপেক্ষায় ছিল, আপনাকে দেখানোর জন্য মা ও আপনার ভালোবাসায় ফাঁকি ছিল না।’

এ কোনও স্বপ্ন নয়, বড়ো নির্দয় কঠিন বাস্তব, নয়না, নয়নমণি।

 

গুড সামারিটান

প্রকাশ ওর ঠোঁটে চুমু খেয়ে চলে যাবার পর প্রায় দুমিনিট মোহাচ্ছন্নের মতো দরজা ধরে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল বাসবী।

দুপুর দেড়টা নাগাদ খিচুড়ি খেতে বসেছিল বাসবী আর ঠিক সে সময়ই প্রকাশ এসে হাজির হল। পাঁচদিন আগে লক্ষীনগরের মোড়ের কাছে রাস্তা পার হবার সময় অটোর ধাক্কায় ছিটকে রাস্তায় পড়ে গিয়ে বাসবী যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছিল। চারপাশে জমে যাওয়া ভিড়ের মধ্য থেকে যখন কেউ এগিয়ে আসছিল না ওকে সাহায্য করতে তখন প্রকাশই বাসবীকে রাস্তা থেকে তুলে ওলা ডেকে, নিয়ে গিয়েছিল আকাশ নার্সিংহোমে।

ডান পায়ে পাতায় হেয়ার-লাইন ফ্র‌্যাকচার জুড়তে প্লাস্টার আর ফেটে যাওয়া মাথায় পাঁচটা স্টিচিং লাগিয়ে প্রকাশ ওকে ঘরে পৌঁছে দিয়েছিল সন্ধের দিকে। যাবার সময় ও বলেছিল দেখা করতে আসবে কোনও একদিন। কিন্তু এভাবে দুপুরের দিকে আগে না জানিয়ে ও এসে হঠাৎ হাজির হবে ভাবতে পারেনি বাসবী।

—চমকে গেছেন আমাকে দেখে, তাই না? প্রকাশ বলেছিল হেসে। অসময়ে এসে আপনাকে বিরক্ত করলাম।

বাসবী মাথা ঝাঁকিয়ে বলেছিল, না না, বিরক্ত হব কেন? আসুন ভেতরে।

—আপনি ওয়াকার ইউজ করছেন না কেন? ভাঙা পা তাড়াতাড়ি সারাতে হলে আপনাকে ওয়াকারের সাহায্য নিতে হবে।

—আমার মেয়ে রিয়াও আমাকে ওয়াকার নিতে বলেছে, বাসবী দরজা বন্ধ করতে করতে বলেছিল।

—আপাতত আমার হাতে ভর দিয়ে ভেতরে চলুন আপনি, প্রকাশ বলল হাত বাড়িয়ে দিয়ে দীর্ঘকায়, সুদর্শন যুবকটি বয়সে অন্তত দশ বছরের ছোটো হবে ওর থেকে কাজেই বাসবী বিনা দ্বিধায়, অসংকোচে প্রকাশের হাতে ভর দিয়ে পা টেনে টেনে এসে বসল সোফায়।

—সেদিন আপনি খুব বাঁচা বাঁচিয়ে দিয়েছেন আমাকে মিস্টার প্রকাশ।

—যখন বয়সে আপনার থেকে ছোটোই, তখন আমাকে নাম ধরে তুমি বলে সম্বোধন করলে খুশি হব।

বাসবী হেসে বলল, আচ্ছা তাই করব আমি। সেদিন তুমি এসে আমাকে রাস্তা থেকে না তুললে পেছন থেকে কোনও গাড়ি বা ভ্যান এসে যদি…

—আরে না না, অতটা ভয় পাবার মতো কিছু হয়নি। লোকজন তো জমেই গিয়েছিল আপনার চারপাশে, কেউ না কেউ ঠিক এগিয়ে আসত আপনাকে তুলে নিতে।

বাসবী ভ্রূ কুঁচকে বলল, বুঝতে পাচ্ছি তুমি দিল্লির ছেলে নও। এখানকার লোকজন কারও আপদ-বিপদে সহজে এগোতে চায় না। পকেটমার, ছিনতাইবাজ কাজ করে চলে যায় কিন্তু চ্যাঁচামেচি করলেও সাহায্য করতে কেউ এগিয়ে আসে না। তা কোথাকার ছেলে তুমি বলো তো?

—আমার বাড়ি বেনারস। পড়াশোনা করেছি এলাহাবাদ আর বেঙ্গালুরুতে। চাকরি নিয়ে গুরুগ্রামে এসেছি ছমাস হল।

—খুব ভালো। বসো প্রকাশ, তোমার জন্য চা করে আনছি আমি।

—মাফ করবেন, এই ভরদুপুরে চা খাব না। আপনার দুপুরের খাওয়া হয়ে গিয়েছে?

বাসবী ভাবল হ্যাঁ বলবে, কিন্তু তারপর ওর মনে হল যে-লোকটা ওর প্রাণ বাঁচিয়েছে তাকে মিথ্যে বলবে না। আমার ঝি উমা খিচুড়ি রেঁধে রেখে গেছে আমার জন্য। তোমার যদি আপত্তি না থাকে একটু খিচুড়ি খেয়ে নাও আমার সঙ্গে।

প্রকাশ প্রথমে না না করলেও শেষ পর্যন্ত বাসবীর অনুরোধে খিচুড়ি খেতে বসে গেল ওর সঙ্গে।

—আগে থেকে জানিয়ে এলে তোমাকে এর থেকে ভালো কিছু রান্না করে খাওয়াতে পারতাম, বাসবী বলল খেতে খেতে। রাজমা-চাওল কিংবা পুরি-সবজি। তা এদিকে কোথায় এসেছিলে তুমি?

প্রকাশ একটু অপ্রস্তুত হয়ে বলল, কেন আপনাকে দেখতে আসতে পারি না আমি? আজ তো শনিবার, আমার অফিস ছুটি।

—কী কাজ করো তুমি, প্রকাশ?

—আমি ইঞ্জিনিয়র, একটা আইটি কোম্পানিতে কাজ করি।

—খুব ভালো। আমার মেয়ে রিয়ার সঙ্গে তোমার কখনও আলাপ করিয়ে দেব। ও দুসপ্তাহ আগে পুণেতে গেছে কম্পিউটার সাযে্সে বিটেক কোর্স করতে। আমার মেয়ে পড়াশোনায় খুব ভালো। বারো ক্লাসের পরীক্ষায় সাতানব্বুই পারসেন্ট পেয়েছে সাযে্সে। জযে্ট এন্ট্রান্সেও ভালো রেজাল্ট করেছে। বাসবী সস্নেহে তাকাল দেয়ালে টাঙানো, ফ্রেমে বাঁধানো, মা-মেয়ে যুগল ছবির দিকে। গালে গাল লাগিয়ে ওরা যেভাবে হাসছে তাতে ওদের মা মেয়ে নয়, দুই বোন বা ঘনিষ্ঠ বান্ধবী মনে হওয়াই স্বাভাবিক।

—আপনার সঙ্গে আপনার মেয়ে বয়সের তফাত খুব কম মনে হচ্ছে এই ছবিতে, প্রকাশ বলল ছবির দিকে চোখ রেখেই।

—ঠিকই বলেছ তুমি, ও আমার থেকে ঠিক সতেরো বছরের ছোটো। আমরা এখন বন্ধুর মতোই হয়ে গেছি।

খাওয়া হয়ে গেলে বাথরুমে গিয়ে হাতমুখ ধুয়ে ওরা এসে বসল সোফায়। একটু পরে প্রকাশ বলল, এখন আপনি বিশ্রাম করুন, আমি উঠি। সামনের বার এসে আপনাকে যেন ওয়াকার নিয়ে হাঁটছেন দেখতে পাই।

—নিশ্চয়ই দেখবে, কিন্তু তোমার সামনের বার কতদিন পরে আসবে সেটা তো বললে না?

প্রকাশ হেসে বলল, শনি-রোববার ছাড়া তো আমার আসা হবে না।

—এবার দয়া করে একটা ফোন করে এসো, যাতে তোমাকে আবার খিচুড়ি খেতে না হয়। আমার ফোন নাম্বারটা সেভ করে নাও তোমার মোবাইলে।

একটু পরে প্রকাশের হাতে ভর দিয়ে বাসবী দরজায় পৌঁছেছিল ওকে বিদায় জানাতে। কিন্তু দরজার ছিটকিনি না খুলে বাসবীর মুখটা দুহাতের মধ্যে নিয়ে ওকে স্তম্ভিত করে দিয়ে প্রকাশ চুমু খেল! বাসবী প্রথম ভেবেছিল প্রকাশ ওর সঙ্গে বেয়াড়া ঠাট্টা করছে, কিন্তু প্রকাশের উত্তপ্ত ঠোঁট ওর ঠোঁটের উপর চেপে রইল পুরো এক মিনিট কিংবা তারও বেশি সময়। তারপর মুখ তুলে বাসবীর দুই গালে চুমু খেয়ে নরম গলায় ও বলেছিল, আমি তোমাকে ভালোবাসি, বাসবী।

দরজা খুলে বেরিয়ে সিঁড়ি দিয়ে ও নীচে চলে গেল আর হতভম্ব বাসবী পাথরের মূর্তির মতো দরজা ধরে দাঁড়িয়ে রইল।

দুই

দুর্ঘটনার পর কীভাবে প্রকাশ ওকে রাস্তা থেকে তুলে নার্সিংহোমে নিয়ে গিয়ে প্রাথমিক চিকিত্সা করিয়ে বাড়ি পৌঁছে দিয়েছিল তার বিস্তারিত বিবরণ রিয়াকে পরের দিনই জানিয়েছিল বাসবী। সেদিন সন্ধ্যার দিকে মায়ের শরীর কেমন আছে ফোনে জানতে চাইলে বাসবী মেয়েকে জানাল, প্রকাশ আজ ওকে দেখতে এসেছিল। খুব ভালো ছেলেটা, বলল বাসবী হালকা ভাবেই।

—হি ইজ আ গুড সামারিটান, মম। তোমার কথা শুনে মনে হচ্ছে তুমি খুব আনন্দে রয়ে আজ, রিয়া বলল। প্রকাশ কি খুব হ্যান্ডসাম মম?

—তা বলতে পারিস। বেনারসের ছেলে, একটু বাউন্ডুলে টাইপের নইলে এভাবে না জানিয়ে ভরদুপুরে এসে হাজির হয়? আমি ভাবলাম খেয়েটেয়ে এসেছে, তাই চা অফার করলাম। চা না খেয়ে ছেলেটা শেষে আমার সঙ্গে বসে খিচুড়ি খেল।

—ভালোই তো, হ্যান্ডসাম গুড সামারিটানের সঙ্গে বসে খিচুড়ি খাওয়ার ভাগ্য কজনার হয় বলো?

—ধ্যাৎ, কী যে বলিস তুই। পাগলাটে টাইপের ছেলে ও, কখন কী করে বসে তার ঠিক নেই। প্রকাশ যে ওকে চুমু খেয়েছে সে খবরটা মেয়েকে জানাবার সাহস হল না বাসবীর। প্রকাশ যদি সত্যিই খেয়ালের বশে ওকে চুমু খেয়ে থাকে আর দুএকবার ওর খবরাখবর নিয়ে এখানে আসা বন্ধ করে দেয়? রিয়া জানতে পারলে মাকে ত্রিশোর্ধ মহিলাদের নতুন সম্পর্ক স্থাপনের ব্যাপারে কী ধরনের সাবধানতা অবলম্বন করা উচিত, সে ব্যাপারে জ্ঞান দিতে শুরু করবে।

—পা কেমন আছে তোমার? রিয়া জিজ্ঞেস করল।

—ব্যথাটা চলে গেছে। ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন মতো ক্যালসিয়াম খেয়ে যাচ্ছি। ওয়াকার নিয়ে চলাফেরা করছি না বলে প্রকাশ খুব বকাবকি করে গেল।

—ঠিকই করেছে, আমি তো প্রথম দিনই বলেছিলাম তোমাকে। তা আমার কথা শুনলে তো! ওয়াকার না ইউজ করলে পায়ে পাতার উপর জোর পড়বে, হাড় জোড়া লাগতে সময় লাগবে।

—ঠিক আছে, ওয়াকার কিনে নেব আমি। কাল পাশের বাড়ির সুনীতাকে নিয়ে নার্সিংহোমে যাব কপালের স্টিচ কাটতে। এবার তোর খবর বল। কলেজ, হস্টেল সব ঠিক আছে তো?

রিয়া জানাল, ওর কলেজের ফ্যাকাল্টি খুব ভালো, প্রশ্ন করলে বিরক্ত হয় না। হস্টেলে ওর রুমমেট অঙ্কিতা খুব শান্ত, পড়ুয়া মেয়ে একটু ধার্মিক টাইপের, সকালে উঠে হনুমান চল্লিশা পড়ে, বৃহস্পতিবার সাঁইবাবার মন্দিরে যায়। ওর বাড়ি লখ্নউ-এ। হস্টেলের খাবারদাবার এ ক্লাস না হলেও মোটামুটি ভালো, টলারেব্ল বলা চলে। গতকাল ফ্রেশারদের জন্য যে-পার্টি দিয়েছিল কলেজ কর্তৃপক্ষ, তাতে রিয়া রং দে বাসন্তী গেয়ে খুব তালি পেয়েছে। পুণেতে গিয়ে রিয়া ওর কলেজ লাইফ ভালোভাবে উপভোগ করছে শুনে বাসবী নিশ্চিন্ত হল।

মেয়ে সঙ্গে কথা শেষ করে বাসবী এসে ওর শোবার ঘরে আয়নার সামনে দাঁড়াল। ছত্রিশ বছর বয়সে বাসবী এখনও সুন্দরী, এমনকী রিয়ার ভাষায় ওকে সেক্সিও বলা চলে। গায়ে রং একটু চাপা আর মাঝারি উচ্চতার হলেও ওর বড়ো বড়ো প্রতিমার মতো টানা চোখ, ডিম্বাকৃতি মুখের গড়ন, পুরু ঠোঁট (রিয়ার ভাষায় বি স্টাংগ লিপ্স) আর লম্বা, ঘন, কালো চুল এখনও আকৃষ্ট করতে পারে প্রকাশের মতো অনেক কম বয়সি ছেলেকে। রসগোল্লা খেয়ে রবীন্দ্রসংগীত শুনে দিল্লির বাঙালি কলোনি চিত্তরঞ্জন পার্কে বড়ো হওয়া বাসবী এখন দীর্ঘদিন ধরে পূর্ব দিল্লির পাণ্ডব নগরের বাসিন্দা।

মুখের উপর এসে পড়া চুল সরিয়ে দিয়ে আয়নায় হাসল বাসবী। কী দেখল প্রকাশ ওর মধ্যে যে দ্বিতীয়বার দেখা হতেই ওর এই অসুস্থ অবস্থায় চুমু খেয়ে বসল ওকে? পুরুষ মানুষকে সব সময় চেনা যায় না, বোঝা যায় না। লম্বা একটা শ্বাস নিল বাসবী। প্রকাশ এক আচেনা, আগন্তুক, আমাকে সাবধানে থাকতে হবে, বাসবী নিজেকে বোঝাল। কে জানে বেনারসের এই সুদর্শন ছেলেটি ওর সঙ্গে ভাব করে হয়তো শুধু উপভোগ করতে চায় তার শরীর, ওর সেবার বিনিময়ে যদি সেটাই সত্যি হয়ে দাঁড়ায় তবে ওকে স্পষ্ট ভাবে না করে দিতে হবে।

মনস্থির করে খোঁড়াতে খোঁড়াতে বাসবী চলে গেল রান্নাঘরে এক কাপ চা করতে। না, কাল সুনীতার সঙ্গে বেরিয়ে নার্সিংহোম থেকে ফেরার পথে একটা ওয়াকার কিনতে হবে। না হলে হুট করে প্রকাশ যদি আবার এসে পড়ে কোনওদিন তাহলে, গালমন্দ শুনতে হবে তাকে।

তিন

পরের শনিবার সন্ধের দিকে প্রকাশ আবার এসে হাজির হল ফোন না করেই। বাসবী ওয়াকার ব্যবহার করছে দেখে ও খুশি হল, আরও খুশি হল ওর মাথার স্টিচ খুলে ফেলা হয়েছে দেখে।

—আজ তোমার কপাল ভালো প্রকাশ, বাসবী বলল সোফায় বসে। আমার ঝি ঊমা বিকেলে এসে সুজির হালুয়া করে দিয়ে গেছে, চায়ের সঙ্গে ওটাই দেব তোমাকে।

—কিন্তু ভাঙা পায়ে ভর দিয়ে তোমাকে আমার জন্য চা করতে হবে না, প্রকাশ বলল। প্রকাশ যে ওকে তুমি সম্বোধন করেছে তাতে আর আশ্চর্য হল না বাসবী।

—চা করতে কোনও অসুবিধা হবে না আমার, বলল বাসবী। ওয়াকার নিয়ে এখন আমি দিব্বি চলাফেরা করতে পারি।

—চলো রান্নাঘরে গিয়ে তোমায় সাহায্য করি আমি।

প্রস্তাবটা সরাসরি নাকচ করে দিতে চাইল না বাসবী। তাই বলল, সবতো হাতের কাছেই আছে, কী দরকার তোমার?

কিন্তু প্রকাশ ততক্ষণে রান্নাঘরে চলে গেছে, কাজেই ও যখন কেটলিতে জল ভরে, উপরের তাক থেকে চায়ের কাপ, ছাঁকনি ইত্যাদি এগিয়ে দিল, বাসবী কোনও বাধা দিল না। চায়ের জল যখন ফুটতে আরম্ভ করেছে ঠিক তখনই প্রকাশ ওকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে ঘাড়ে চুমু খেল আর কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল সেই যাদু মাখানো, হৃদয় দ্রবিভত করা তিনটে শব্দ— আমি তোমাকে ভালোবাসি।

প্রকাশ যখন ওর সঙ্গে রান্নাঘরে ঢুকল বাসবী তো তখনই জানত, প্রকাশ ওকে চুমু খাবে! তবু ওর হাত কাঁপল, নিশ্বাস ঘন হয়ে এল। আমাকে চা-টা করতে দাও প্রকাশ, ও কাঁপা গলায় বলল।

উত্তরে নব ঘুরিয়ে গ্যাসের উনুন বন্ধ করে দিয়ে প্রকাশ বলল, চা পরে খাওয়া যাবে।

ওরা দুজন যখন গভীর আবেগে একে অপরকে জড়িয়ে ধরে চুমু খাচ্ছিল ঠিক তখনই বেল বাজল দরজায়। পাশের বাড়ির সুনীতা এসেছে, আঁচল দিয়ে ঠোঁট মুছে ফিসফিস করে বলল বাসবী। তুমি আমার মেয়ে শোবার ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে চুপচাপ বসে থাকো যতক্ষণ না ও চলে যায়।

কিন্তু সে রাতে সুনীতা গল্পগাছা সেরে যখন উঠল তখন রাত সোয়া আটটা। ততক্ষণে রিয়ার বিছানায় শুয়ে প্রকাশ ম্যাগাজিনের পুরোনো একটা সংখ্যা নাড়াচাড়া করতে করতে ঘুমিয়ে পড়েছে। বাসবী এসে যখন ওকে জাগিয়ে তুলে সুনীতার দেওয়া পুরির সঙ্গে হালুয়া খেতে দিল তখন নতুন করে প্রেমপর্ব শুরু করার উত্সাহ হারিয়ে ফেলেছে ওরা দুজনেই।

সে রাতে বিছানায় শুয়ে বাসবীর মনে হল, প্রকাশকে ওর পরিষ্কার ভাবে জানিয়ে দেওয়া উচিত ছিল নতুন করে প্রেমে পড়ার বয়স ও পেরিয়ে এসেছে। শরীরের একটা নিজস্ব দাবি আছে যেটা অস্বীকার করার ক্ষমতা নেই বাসবীর কিন্তু সেটা মেটাতে গিয়ে নতুন ভাবে কোনও সম্পর্কে জড়িয়ে পড়তে চায় না ও। নতুন সম্পর্ক মানেই নতুন আবেগ আর আবেগ মানুষকে কোথায় ভাসিয়ে নিয়ে যায় তার কোনও ঠিকানা নেই। নাহলে মাত্র ষোলো বছর বয়সে মাধ্যমিক পরীক্ষায় বসবার আগেই বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়ে ওর বাবার অফিসের লোয়ার ডিভিশন ক্লার্ক, পাঞ্জাবি ছেলে রোহিত খন্নার সঙ্গে কালকাজি মন্দিরে গিয়ে মালা বদল করতে পারত না বাসবী।

বিয়েটা ওদের টিকেছিল ঠিক দেড় বছর কারণ ওই সময়ে মধ্যেই মেধাবী এবং পরিশ্রমী ছেলে রোহিত সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ভালো সরকারি চাকরি পেয়ে গিয়েছিল। পরিবারের গুঁতোয় আর পাঁচ কোটি টাকা পণের লোভে রোহিত লুধিয়ানার এক ধনী পরিবারের মেয়ে নেহাকে বিয়ে করে ফেলল। আর আঠারো বছর বয়সে ছমাসের মেয়ে কোলে নিয়ে পাণ্ডব নগরের দুকামরার ভাড়া বাড়িতে এসে উঠতে হয়েছিল বাসবীকে।

বাসবীর বাবা রণেন বোস কোর্টে কেস ঠুকে দিলে রোহন শেষ পর্যন্ত পাণ্ডব নগরের এই পাঁচশ পঞ্চাশ স্কোয়ার ফিটের ছোট্ট, দুকামরার ফ্ল্যাট আর মেয়ে ভরণপোষণ এবং শিক্ষার জন্য কুড়ি লাখ টাকা বাসবীর অ্যাকাউন্টে জমা করে ডিভোর্সের পেপারে সই করায় ওকে দিয়ে।

মেয়ে দশ বছরে পড়লে বাসবী ওকে সব কথা জানিয়ে দিয়েছিল কেন না একটু বড়ো হবার পর থেকেই রিয়া ওকে নানা প্রশ্ন করতে শুরু করেছিল। সব শুনে ওই বয়সেই বুদ্ধিমতী রিয়া মাকে বলেছিল, তোমার বয়স কম, দেখতেও তুমি খারাপ নও। তুমি আবার বিয়ে করো, মম।

বাসবী হেসে বলেছিল, না রে, আমি বিয়ে টিয়ে করব না। আমি তোকে নিয়ে খুব ভালো আছি।

কয়েক বছর পর আরেকটু বড়ো হলে বাসবী মেয়েকে বলেছিল, সাবধান রিয়া, আমার মতো অল্প বয়সে প্রেমে পড়ে জীবনটা নষ্ট করবি না তুই। নিজের পায়ে ভালো ভাবে দাঁড়িয়ে তবেই বিয়ে কথা ভাববি।

তা রিয়া তো মার উপদেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করে চলেছে। উনিশ বছরের মেয়ে এখনও পর্যন্ত কোনও ছেলেকে কাছে ঘেঁষতে দেয়নি। কিন্তু মা হয়ে বাসবী কি সেই ভুলটাই করতে বসল দ্বিতীয় বার?

পরের দিন সকাল দশটা নাগাদ রিয়া ফোন করলে বাসবী বলল, তোকে একটা কথা বলার ছিল রিয়া।

আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে মোবাইলের স্পিকার অন করে রিয়া বলল, ভালো না খারাপ কথা সেটা আগে বলে দাও মম।

—সেটা নির্ভর করছে তুই কীভাবে নিবি আমার কথাটা তার উপর। আমার মনে হচ্ছে আমি প্রেমে পড়ে গেছি।

রিয়া চট করে ওর প্রতিক্রিয়া জানাল না। সম্ভবত খবরটা ভালো ভাবে হজম করতে একটু সময় নিল ও, তারপর বলল, তুমি ঠাট্টা করছ না তো মম? তা কার প্রেমে পড়লে তুমি? প্রকাশ?

—হ্যাঁ। বয়সে আমার থেকে বছর দশেকের ছোটো হবে ও।

—সেটা কোনও ফ্যাক্টর নয়। কিন্তু ও যে তোমাকে সত্যি ভালোবাসে সেটা তোমার জানা দরকার।

—বার বার বাড়ি আসছে আর…

—তোমাকে চুমু খেয়েছে, তাই না?

—কী করব বল? রান্নাঘরে এসে পেছন থেকে জাপটে ধরে…

—ঘুরে দাঁড়িয়ে কষে একটা থাপ্পড় মারলে না কেন?

—কী করে থাপ্পড় মারব ওকে? ও যে আমার জীবন বাঁচিয়েছে, আমাকে রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে নার্সিংহোমে চিকিত্সা করিয়ে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে গেছে।

—সত্যিকার গুড সামারিটানরা কিন্তু সাহায্যপ্রার্থীকে প্রেম নিবেদন করে না, মম। ওর যে আর কোনও প্রেমিকা নেই বা ও যে বিবাহিত নয় সেটা জানার প্রযোজন বোধ করলে না তুমি? কী আশ্চর্য! ও যে তোমার সঙ্গে দুদিন ফুর্তি করে কেটে পড়বে না তার নিশ্চয়তা কী?

—ওকে এসব কথা জিজ্ঞেস করা ঠিক হবে না। এখন কী করব তুই বল আমাকে।

—ও তোমাকে বিছানায় নিয়ে যায়নি তো?

—না, আর চাইলেও আমি রাজি হব না।

—গুড। সিচুযেন এখনও তোমার কন্ট্রোলেই আছে। ও আবার এসে চুমু খেতে চাইলে বা প্রেম নিবেদন করলে ওকে স্পষ্ট বলে দিও তুমি ওর আন্টির বয়সি, কাজেই তোমাকে ও যেন আন্টি বলেই ডাকে আর আন্টির সন্মান দেয়। ওকে সোজাসুজি বলবে ও যেন ওর নিজের বয়সি কোনও মেয়ে খুঁজে নেয় প্রেম ভালোবাসার জন্য।

—ঠিক আছে, তুই যেরকম বললি সে রকমটাই করব আমি।

—গুড গার্ল। যা বললাম তাই করবে। কলেজের সময় হয়ে গেছে, আমাকে এখন ছুটতে হবে। বাই মম।

চার

সাতদিন পর রোববার সকালে প্রকাশ এসে বলল, আমাকে কিছুদিনের জন্য বাইরে যেতে হচ্ছে, বাসবী।

রিয়ার উপদেশ মনে ছিল বাসবীর, তবু কেন ওর বুকের মধ্যে আলোড়ন শুরু হয়ে গেল ও বুঝতে পারল না।

—কোথায় যাচ্ছ তুমি?

—সিয়াটেল, ইউএসএ। ছমাসের ট্রেনিং হবে ওখানে।

—খুব ভালো। মুখে হাসি ফোটাবার চেষ্টা করল বাসবী। নতুন দেশ দেখবে, চাকরিতে আরও উন্নতি হবে।

—কিন্তু তোমাকে তো ওখানে দেখতে পাব না।

—আমি তো তোমার আন্টির বয়সি প্রকাশ। আমার বয়স কত জান তুমি? চল্লিশে পা রেখেছি আমি। নিজের বয়সটা চার বছর বাড়িয়ে প্রকাশকে ওর থেকে দূরে সরে যাবার স্পষ্ট ইঙ্গিত দিল বাসবী। তারপর বলল, আমাকে তুমি আন্টি বলে ডাকলেই খুশি হব আমি।

—নেভার! আমি তোমাকে ভালোবাসি, বাসবী।

—কিন্তু আমি তোমাকে ভালোবাসি না, বলতে গিয়ে বলতে পারল না বাসবী। নিজের বয়সি কোনও মেয়েকে তুমি খুঁজে নাও প্রকাশ, বাসবী বলল রিয়ার উপদেশ মনে রেখে।

আর ঠিক তখনই প্রকাশ এসে ওকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেল প্রবল আবেগে, বাসবীর শ্বাস রোধ করে। দুমিনিট পর ওর ঠোঁট থেকে মুখ তুলে নিয়ে প্রকাশ বলল, আমার ভালোবাসার কী প্রমাণ চাও তুমি আমার কাছ থেকে, বলো?

—ছ’মাস পর আমেরিকা থেকে ফিরে এলে এ ব্যাপারে তোমার সঙ্গে কথা বলব আমি, বাসবী বলল ওর চোখে চোখ রেখে। বাসবী জানে ছ মাসের মধ্যে অনেক কিছু ঘটে যেতে পারে দুজনের জীবনে। বিদেশে গিয়ে প্রকাশ কোনও অল্প বয়সি, সুন্দরী মেয়ে সংস্পর্শে এসে ওকে ভুলে যেতে পারে।

—ঠিক আছে, তাই হবে। কিন্তু ছমাস পর ফিরে এলে আমাকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারবে না তুমি। তুমি হয়তো জানো না তোমাকে রাস্তা থেকে কোলে তুলে নেবার সময়-ই তোমার প্রেমে পড়ে গেছি আমি। আমি জানি তুমিও আমাকে ভালোবেসে ফেলেছ।

বাসবী মুখ ফিরিয়ে নিল কেন না ওর চোখে জল এসে গিয়েছিল। ভাগ্যের এ কী বিড়াম্বনা? প্রকাশ যদি দশ বছর আগে আসত ওর জীবনে তাহলে ওকে বিয়ে করতে কোনওই অসুবিধা ছিল না বাসবীর। এমনকী রিয়াও কোনও বাধা দিত না ওদের বিয়েতে।

বাসবীর অনুরোধ সত্ত্বেও প্রকাশ চা খেতে রাজি হল না সেদিন। ও বলল বাইরে যাবার জন্য ওকে কিছু কেনাকাটি করতে হবে আর দেখা করতে হবে কয়েকজন কলিগের সঙ্গে। যাবার আগে শুধু এটুকুই জানিয়ে গেল প্রকাশ যে আমেরিকায় গিয়ে বাসবীর সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ রাখবে ও।

সন্ধ্যার দিকে রিয়া ফোন করলে বাসবী জানাল প্রকাশ অধ্যায়ে যবনিকা টেনে দিয়েছে ও কোনওরকম ঝগড়াঝাঁটি না করেই। প্রকাশ যে ট্রেনিং নিতে আমেরিকার সিয়াটেলে চলে যাচ্ছে তাও জানাল রিয়াকে।

—ভেরি গুড মম। ইউ হ্যাভ ডান দ্য রাইট থিং। ছমাসের মধ্যে ও ওর পার্টনার ঠিক পেয়ে যাবে, হয়তো সুযোগ পেলে আমেরিকায় ও সেটল করে যাবে। ওখানের কোনও মেয়েকে বিয়ে করলে গ্রিন কার্ড পেতেও সুবিধা হবে ওর।

—ওখানে গিয়ে ও আমাকে ফোন করবে বলে বলেছে। ভাবছি ওর ফোন এলে আমি তুলব না, কী বলিস তুই?

—নো মম, ডোন্ট বি সিলি। আফটার অল হি ইজ আ গুড সামারিটান। ফোন করলে কথা বলবে জাস্ট অ্যাজ আ ওয়ে উইশিং আন্টি।

—কিন্তু আন্টি বললে ও যে খুব রেগে যায়।

—ওকে, ওকে, দেন ট্রিট হিম অ্যাজ আ ফ্রেন্ড, অ্যাজ আ গুড সামারিটান। গুড সামারিটানদের ডিসকারেজ করতে নেই কারণ ওদের সংখ্যা কমে আসছে পৃথিবীতে।

রিয়ার সঙ্গে কথা বলে মন হালকা হয়ে গেল বাসবীর। ঈশ্বরের ইচ্ছায়-ই প্রকাশ দূরে সরে যাচ্ছে যাতে ওর সঙ্গে সম্পর্কটা দানা বাঁধতে না পারে, ভাবল বাসবী স্বস্তির নিশ্বাস নিয়ে

পাঁচ

প্রথম সপ্তাহটা ভয়ে ভয়ে কাটল বাসবীর প্রকাশের ফোন আসবে ভেবে। রিয়া যতই বলুক একটা জোয়ান, শক্ত-সমর্থ ছেলে যে ওকে কোলে তুলেছে, ওর ঠোঁটে চুমু খেয়েছে বেশ কয়েকবার, তাকে প্রেমিকের সিংহাসন থেকে নামিয়ে বন্ধুত্বের নড়বড়ে চেয়ারে বসানো সহজ কাজ নয়। কিন্তু তিনমাস পরেও প্রকাশের ফোন না আসায় বাসবীর সেই সমস্যাটা মিটে গেল।

রিয়া শুনে বলল, মম, আমি তো তোমাকে আগেই বলেছিলাম ও ওর পার্টনার জোগাড় করে নেবে। সিয়াটেল তো আইটি হাব, বেশ কয়েক হাজার ইন্ডিয়ান থাকে ওখানে। আচ্ছা শোনো, ক্রিসমাস ভ্যাকেশনে আসছি আমি পাঁচদিনের জন্য। তোমাকে দেখতে ইচ্ছে করছে খুব।

—আমারও তোকে দেখতে খুব ইচ্ছে করছে। কথা বলতে বলতে চোখে জল এসে গেল বাসবীর। প্রায় ছমাস মেয়েকে দেখেনি ও।

ক্রিসমাসের ছুটিতে রিয়া এলে পাঁচটা দিন মা আর মেয়ে খুব আনন্দে কাটাল। ওরা দুজন তো বন্ধুর মতোই ছিল আগে থেকে। এখন ছমাস দূরে থাকার পর সেই বন্ধুত্বটা আরও গাঢ় হয়েছে। একসঙ্গে মলে যাওয়া, সিনেমা দেখা, রেস্তোরাঁয় খাওয়া… দেখতে দেখতে পাঁচটা দিন কীভাবে উড়ে চলে গেল টেরও পেল না ওরা।

বাসবী বাঙালি রান্নাবান্না শেখবার তেমন সুযোগ পায়নি, তবু বাংলা চ্যানেলে রান্নার রেসিপি দেখে নিয়ে রিয়ার পুণে ফিরে যাবার আগের দিন শুক্তোনি আর মোচার ঘন্ট করে খাওয়াল মেয়েকে।

রিয়া চলে যাবার দুসপ্তাহ পর বাসবী যখন ধীরে ধীরে ওর একক জীবনে আবার অভ্যস্ত হয়ে উঠছে তখনই ফোন এল প্রকাশের। সকাল দশটার দিকে এল ফোনটা, আমেরিকায় তখন প্রায় রাত বারোটা। ফোন ধরে হ্যালো বললে ওপাশ থেকে প্রকাশ জিজ্ঞেস করল, কেমন আছেন আপনি আন্টি?

প্রকাশের মুখে এই প্রথম আন্টি ডাক শুনে বাসবী হাসবে না কাঁদবে বুঝতে পারল না। ঢোক গিলে কোনওমতে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, আমি ভালো আছি, তুমি কেমন আছো প্রকাশ?

—আমিও খুব ভালো আছি আন্টি। অনেকদিন আপনাকে ফোন করব ভেবেছি, কিন্তু ঠিক সাহস করে উঠতে পারিনি। তা আপনার পা ঠিক আছে এখন?

—হ্যাঁ, চলতে ফিরতে কোনও অসুবিধে হচ্ছে না।

—খুব ভালো। আপনার মেয়ে রিয়া কেমন আছে?

রিয়ার নাম শুনে খুশি হয়ে বাসবী বলল, ক্রিসমাসের ছুটিতে ও এখানে এসেছিল। দুজনে মিলে খুব ঘোরাঘুরি করেছি, সিনেমা দেখেছি, রেস্তোরাঁয় খেয়েছি। ও তো এখন আমার বন্ধুই!

—তা তো বুঝতেই পারছি। আমার দুঃখটা কী জানেন আন্টি, বয়সে অনেক ছোটো মেয়েকে বন্ধু করতে আপনার কোনও বাধা নেই কিন্তু কম বয়সি কাউকে নিজের প্রেমিক হিসেবে মেনে নিতে আপনার ঘোর আপত্তি আছে। এই ডাব্ল স্ট্যান্ডার্ড নিয়ে জীবন কাটাতে আপনার যে-কোনও অসুবিধা হচ্ছে না সেটাই খুব আশ্চর্য লাগছে আমার!

বাসবী বুঝল প্রকাশ ঝোপ বুঝে কোপ মেরে বসেছে। অপ্রস্তুত হয়ে ও বলল, এসব কথা এখন থাক না প্রকাশ। তোমার ওখানে কেমন সময় কাটছে বলো।

—দিনটা কীভাবে কেটে যায় টের পাই না কারণ ট্রেনিং-এ বেশ ব্যস্ত থাকতে হয়। রাত কাটানোই একটু কষ্টকর।

—ওখানে কোনও বন্ধুবান্ধব নেই তোমার?

—আছে বইকি তবে বন্ধু তো বন্ধুর-ই কাজ করতে পারে। কিন্তু তার বাইরেও তো একটা জীবন আছে।

প্রকাশের ইঙ্গিত বুঝতে পেরে বাসবী বলল, তা বান্ধবী জুটিয়ে নাও না কেন? রিয়া বলল তোমার ওখানে হাজার হাজার ভারতীয় আছে।

—তা আছে কিন্তু আমার তো বান্ধবীর প্রযোজন নেই, আমার আপনার মতো একজন সুন্দরী আন্টির প্রযোজন। নিজের অজান্তেই বাসবী খিল খিল করে হেসে উঠল।

—তুমি তো গুড সামারিটান, পরোপকারী। বাইরে বেরোলে রাস্তাঘাটের দিকে নজর রেখো। কখনও কোন সুন্দরী ভারতীয় বা আমেরিকান আন্টি দুর্ঘটনাগ্রস্ত দেখলে এগিয়ে যাবে।

—কিন্তু এখানে তো অটো নেই আন্টি আর যে স্পিডে গাড়ি চলে এখানে, তাতে অ্যাক্সিডেন্ট হলে গুড সামারিটানরা অ্যামবুলেন্স ডেকে আন্টিকে সোজা হাসপাতালে পাঠিয়ে দেয়। যাক জেনে খুশি হলাম আন্টি আপনি বহাল তবিয়তেই আছেন আর আপনার মেয়েকাম-বন্ধু…

বাসবী আর সহ্য করতে পারল না। বার বার আন্টি ডাকটা একটা বিশ্রী ঠাট্টার মতো কানে বিঁধছিল ওর। প্লিজ প্রকাশ আমাকে আর আন্টি ডাকতে হবে না তোমাকে।

—তাহলে কী ডাকব আপনাকে, ম্যাডাম?

—আগে যা ডাকতে তাই ডেকো।

—বাসবী ডার্লিং!

—প্রথমটাই যথেষ্ট নয় কি?

—অলরাইট। থ্যাংক ইউ সো-ও-ও মাচ, বেবি।

বাসবী আরেকবার খিল খিল করে হাসল। সত্যিই তো, সতেরো বছরের ছোটো মেয়ে যদি বন্ধু হতে পারে, তবে দশ বছরের ছোটো প্রকাশ প্রেমিক হতে বাধা কোথায়?

রিয়ার সঙ্গে এই নিয়ে তর্ক করবে বাসবী আর ও জানে এবার ওর স্মার্ট, বিদুষী মেয়ে ওর কাছে হেরে যাবে।

ইঁদুরের গর্ত

আমি করব। মা বাবার কনসেন্ট জোগাড় করাটা আমার ব্যাপার।

র-এর চাকরির সাক্ষাৎকারে বলেছিল কস্তুরী, যদিও ব্যাপারটা ওর হাতে ছিল না, পারিবারিক বিষয় হয়ে গিয়েছিল। র-এর প্রাথমিক মনোনয়নপত্র বা অফার লেটার আসতেই বাড়িতে কান্নাকাটি পড়ে গেল। কারণ ভিন দেশে গুপ্ত মিশনে মারা গেলে শরীরটা ভারত সরকার ফেরত নেওয়া তো দূর, নিজের নাগরিক হিসাবে স্বীকার নাও করতে পারে। এই জাতীয় শর্ত দেখার পর মা তো নাওয়া-খাওয়া ও সেইসঙ্গে রান্না করা ছাড়লেন।

ট্রেকিং-এর স্বপ্ন কোন ছোটোবেলায় দুচোখে ও মস্তিষ্কে আঁকা হয়ে গেছে পাকাপাকি। কিন্তু শখ থাকলেই সাধ্য থাকতে হবে, এই আপ্তবাক্য বা প্রবাদ সবার জীবনে মেলে না। কস্তুরীরও জেদ, কিছুতেই আর-পাঁচজন বিজ্ঞানের ছাত্রীর মতো ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার বা আর্কিটেক্ট হওয়ার ইঁদুর দৌড়ে শামিল হবে না। সে বিশেষ কিছু করবে, মানে ভেতো বাঙালি মার্কা নয়, রোমাঞ্চকর কিছু।

তবে রক্তে অ্যাডভেঞ্চারের নেশা থাকলে আর প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার প্রস্তুতি নিলে তেমন কিছু একটা চাকরি লাগিয়ে ফেলা যায়। সবাই যখন আইএএস দেয়, কিছু ছেলেমেয়ে শুধু একটা লাইসেন্সড আগ্নেয়াস্ত্র পেয়ে বস হবে বলে আইপিএস পেতে চায়। অন্যরা যখন ব্যাংক প্রবেশনারি অফিসার হওয়ার জন্য হন্যে হয়ে পড়াশোনা করে, তখন খুশিমনে কস্তুরী দাশগুপ্ত সিবিআই, র, ফরেনসিক বা নিদেনপক্ষে কাস্টমস ও সেন্ট্রাল এক্সাইজ় তথা আইবি-র পরীক্ষা দিয়ে গেছে।

বাড়ির সবার চাপে জয়েন্ট দিয়ে ডাক্তারি পড়ার সুযোগ পেয়ে মন নেই। ভর্তি হয়েছে মায়ের মন রাখতে। যদি ফরেন্সিকে যেতে পারে, তো এই লাইনে থাকবে, নয়তো শুধু শুধু মরা-পচা কাটার কোনও বাসনা নেই। যে-কাজে চ্যালেঞ্জ নেই, সেই গতানুগতিকতার মধ্যে ঢুকতে ইচ্ছা করে না।

এই সময় কাস্টমস ও সেন্ট্রাল এক্সাইজ-এর ইন্টারভিউ কল পেল। চাকরিটা যে তিন বছর করে কাস্টমস আর তিন বছর করে সেন্ট্রাল এক্সাইজ় পোস্টিং আগে জানা ছিল না। অস্ত্র প্রশিক্ষণ থেকে দুরূহ অবস্থার মোকাবিলা, আত্মগোপন করা, ছদ্মবেশ ধারণ করার শিক্ষানবিশি সব নিতে হবে। শুনেই কস্তুরীর গায়ে কাঁটা দিচ্ছিল রোমাঞ্চে, আর মা-বাবার কাঁটা দিচ্ছিল উদ্বেগে। উড়িয়ে দিচ্ছিলেন, পাগলির কথা শোনো। ডাক্তারির সুযোগ ছেড়ে কেউ চোর ডাকাত স্মাগলারদের পিছু ঘোরে?

মনে মনে মরিয়া হয়ে সাক্ষাৎকার দিল এবং পেয়ে গেল কস্তুরী। প্রশিক্ষণের জন্য প্রথম পোস্টিং মেঘালয়ে জয়ন্তিয়া পাহাড়ের অসম সীমান্ত লাগোয়া একটি গ্রামে। নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন নিয়ে যা অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে গোটা উত্তর-পূর্ব ভারতেই, মা-বাবা তাতেও খুঁতখুঁত করছিলেন। ওখানে বাঙালিরা মোটেই নিরাপদ নয়।

বাংলাদেশ থেকে যেহেতু অবাধে হিন্দু মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ে পরিয়াযী মানুষ অসম ও মেঘালয়ে প্রাণ বাঁচাতে বা জীবিকার সন্ধানে আসে, তাই সাত প্রজন্ম ধরে বসবাসকারী বাঙালির প্রতিও যেন শরণার্থী জবরদখলকারীর মনোভাব স্থানীয়দের। অথচ পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিদের হ্যাংলার মতো শিলং, বড়া পানি, চেরাপুঞ্জি, মৌসিনরাম দেখতে ছোটা চাই। স্বজাতির কী হল না হল সেসব ভেবে নিজেদের সীমিত পরিসরের আনন্দ মাটি করতে চায় না কেউ। কিন্তু এখন যে, নিজের কন্যার প্রশ্ন। মাথা ঘামাতেই হচ্ছে।

কিন্তু আজকের দিনে সরকারি চাকরি বলে কথা, কোটার পাত্রী নয়, কটাকে হেলাফেলা করবে? ডাক্তারি পড়তে লাগবে কম পক্ষে পাঁচ বছর। তারপর হাউস স্টাফ থাকতে হবে। স্বাধীন রোজগেরে হতে গেলে অন্তত ছয় সাত বছরের ধাক্কা। আর এটা শুরুতেই মোটা মাইনে, দুবছর পর পাকা চাকরি। সবরকম সরকারি সুযোগসুবিধা-সহ নিয়মিত ইনক্রিমেন্ট, মহার্ঘ্য ভাতা, এলটিসি সব। অগত্যা মা কালী মা দুর্গার আশীর্বাদ নিয়ে শেষে লোকনাথ বাবার কাছে নিরাপত্তার জিম্মা দিয়ে মেয়েকে এয়ারপোর্টে এসে মেঘালয়ের উদ্দেশে রওনা করতেই হল।

বিমানে ওঠার আগে খুশির হাসি হেসে খুশিমনে কস্তুরী বলল, মা দুই বাংলার বাইরে লোকনাথ বাবাকে কেউ চেনে না, যদিও বলা হয় উনি সুমেরু পর্যন্ত নাকি ঘুরে এসেছেন, তবে নর্থ-ইস্টে যাননি। উনি না মানচিত্র গোলমাল করে ফেলেন। ঠাকুরের আসনে সেভেন সিস্টার সমেত ভারতের ম্যাপটাও রেখে দিও।

উত্তর-পূর্ব ভারতে সেনার বিশেষ অধিকার, তার অপব্যবহার, ক্রমাগত অনুপ্রবেশ ও বিচ্ছিন্নবাদী কার্যকলাপ সব মিলিয়ে জটিল গোলকধাঁধা। তার মধ্যে কস্তুরীর কাজ পড়েছে কয়লা চোরাচালান আটকানোর বিভাগে। যদিও প্রশিক্ষণ পর্যায়, তবু এমন বিপজ্জনক কাজের ট্রেনিং-ও বিপন্মুক্ত হওয়া সহজ নয়।

ওদিকে দক্ষিণ মিজ়োরামে ইতিমধ্যে বহু সংখ্যক চাকমা উদ্বাস্তু বাংলাদেশ থেকে এসে বসবাস করছে যাদের কর্ণফুলি নদীতে কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের বাঁধ তৈরির জন্য ১৯৬২ সালেই উচ্ছেদ করেছিল পাকিস্তান সরকার, কোনও পুনর্বাসন বা ক্ষতিপূরণের আযোজন না করে। তারপরে ১৯৭১-এ বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের সময়ই চাকমাদের বাংলাদেশে স্থান দেওয়া নিয়ে আপত্তি উঠেছিল। ভাষা, সংস্কৃতি ও সর্বোপরি ধর্ম সবকিছু নিয়ে ঝামেলা। কোনওটাই বাংলাদেশের সংখ্যাগুরুর সঙ্গে মেলে না।

ষাটের দশক থেকে লাগাতার উচ্ছেদের অসন্তোষ থেকেই কালক্রমে ১৯৭২ সালে জন্ম নেয় পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি। নিজেদের জুমিয়া জাতি বলে বাংলাদেশ তৎকালীন সরকারের কাছ থেকে স্বীকৃতিও দাবি করে। তাতে ব্যর্থ হয়ে স্বায়ত্ব শাসনের চার দফা দাবি পেশ করে। তখন থেকেই পার্বত্য চট্টগ্রামবাসী এই জনগোষ্ঠীকে বিচ্ছিন্নতাবাদী বলে চেনে ও কড়া হাতে দমন করে আসছে। ফলত ১৯৭৩-এর গোড়ায় সত্যিই চাকমা সশস্ত্র প্রতিরোধ বাহিনী বা চাকমা আর্মড ফোর্স তৈরি করে নাম দেওয়া হয় শান্তি বাহিনী। তাই নিয়ে অশান্তির শেষ নেই। আবার উচ্ছেদ, আবার ভারতের অরুণাচল, মিজ়োরাম ও ত্রিপুরায় আশ্রয় নেওয়া। কেউ কেউ পরিব্রাজন করে লাগোয়া অসম মেঘালয়ে চলে আসে। তাদের পুনরায় আগমণ নিয়ে মিজ়োরাম তো বটেই, মেঘালয়ে এই বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী অংশও উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। তার ওপর বসতভিটে ত্যাগ করে ভারতে আশ্রয় নেওয়া বাঙালি হিন্দুদের উৎপাত তো আছেই।

নাক ও চোখের গড়নের সাদৃশ্যের খাতিরে স্থানীয়দের চোখে চাকমারা যদিও ওদের মধ্যে কিছুটা আত্মগোপন করতে পারে, কিন্তু বাঙালি মানেই বাংলাদেশী আর বাঙালি দেখলেই সবার দ্যাখো মার ভঙ্গি। মেয়ও তবু একটু দয়া দাক্ষিণ্য করে, কিন্তু মেঘালয়ে গারো খাসি জয়ন্তিয়া জনজাতিরা এবং মিজ়ো ছেলেরা বাঙালি পুরুষ নারী বাচ্চা কাউকেই রেহাই দিতে চায় না।

বাঙালি ও চাকমা খেদানো নিয়ে সেখানে প্রজাতন্ত্র দিবস বয়কট পর্যন্ত হয়ে গেছে। জনজাতিদের জন্য সংরক্ষিত এলাকায় পুনর্বাসন ও অভিবাসন হবে না কথা দিয়ে শান্তি নেই। বাঙালি মানেই মেরে ফ্যাল শালা, রিফিউজির জাত। নামেই মাতৃপ্রধান সমাজ। কোনও মহিলাকে মুখ্যমন্ত্রী তো দূর, কোনও বড়ো পদে দেখাও বিরল ব্যাপার। অথচ ঘর-সংসার থেকে ব্যাবসাপত্র, সম্পত্তি সবকিছুর দেখভাল মেয়েরাই করে।

আরেক পক্ষের দাবি, অভিবাসন দিলে সবাইকে দিতে হবে। জাতি ধর্মের বিভেদ করলে চলবে না। যারা আসছে অর্থনৈতিক নিরাপত্তা পেতে আসছে, সুতরাং কে মারছে আর কে মার খাচ্ছে সেই ভেদাভেদ করা চলবে না। রাজনীতি থেকে সাম্প্রদায়িক, প্রাদেশিক পরিস্থিতি সব সময় উত্তপ্ত, যে-আগুনে পুড়তে হয় মূলত সব হারানো বাঙালি পরিবারগুলোকেই।

নাগরিকত্ব নিয়ে কেন্দ্র সরকার একটু আংশিক উদারতা দেখাতেই মেঘালয়ে বাঙালি খেদানোর ও মারার নতুন হিড়িক পড়ে যায়। রীতিমতো হুমকি দেওয়া হয়, বাঙালি মেঘালয় পাহাড় না ছাড়লে রক্তের স্রোত বইবে। ভারতের দেশজ হোক বা বাংলাদেশ থেকে আগত শরণার্থী বাঙালির জন্য ক্রমশ আরেক বধ্যভূমি হয়ে উঠেছে মিজ়োরাম ও মেঘালয়। বাঙালিরা যেখানেই যায়, নিজেদের বুদ্ধির জোরে বড়ো বড়ো চাকরি, শিক্ষকতা, ডাক্তারি ইত্যাদি সম্মানজনক পেশাগুলো হাতিয়ে নেয়। কিন্তু তাদের থিতু হয়ে বসতে না দিলে জীবনরক্ষায় দিনানিপাতেই কেটে যাবে কাল।

আরও একটা ভয়, এই পুরো অঞ্চল জুড়ে নানা খনিজ সম্পদ। বিশেষ করে কয়লা ও প্রাকৃতিক গ্যাস। সেগুলোর মালিকানা স্থানীয় জনজাতি ছাড়া আর কারও হাতে যাওয়া পছন্দ নয় মিজো, খাসি, গারোদের। কিছু সরকারি, কিছু বেসরকারি ও অনেক বেআইনি কোলিয়ারি আছে। বেশ কয়েকটির মালিক মাড়োয়ারিরা। স্থানীয়দের ভাষায় ইন্ডিয়ান। তাদের বেসরকারি কোলিয়ারি আইনানুগ নথিভুক্ত। কিন্তু তাতেও বেআইনি কাজ করতে বাধা নেই। চুক্তিমতো ন্যুনতম পারিশ্রমিক না দেওয়া, দৈনিক রোজ বাকি রাখা, বিমা ছাড়া কন্দরে প্রবেশ করানো কত আর বলা যায়?

কোথাও কোথাও খনির মুখ এত সরু, যে বড়ো মানুষ ঢুকতে পারে না। তাই বাচ্চা ছেলেমেয়েদেরও বেআইনি ভাবে নামানো হয় সেই সব গভীর ইঁদুর গর্তে। বাস্তবিকই ওগুলোর নামকরণ সার্থক র‌্যাট হোল মাইন। সেখানে অস্ত্র হাতে গুঁড়ি মেরে কয়লা কেটে আনতে হয়। দুর্ঘটনা নিত্যসঙ্গী। সেই ভ্যান গখের জীবনীতে পড়েছিল কস্তুরী এই অবিশ্বাস্য শোষণের কাহিনি। এ যেন তাকেও ছাপিয়ে যায়। এখানে তো গরিব মানুষের নগণ্য পারিশ্রমিকও বাকি রেখে তা পুরোটা চোকানোর টোপ দিয়ে তাদের আবার নামতে বাধ্য করা হয় ওই মরণ গহ্বরে। এই কাজের জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত সব হারানো বাঙালির বাচ্চারাই। দুটো খেতে পাওয়ার জন্য মানুষ কী না পারে? বাংলাদেশ থেকে খেদানি খেয়ে এখন অসম থেকেও খাচ্ছে, আর কোলিয়ারি মালিকদের সহজ শিকারে পরিণত হচ্ছে।

মা আমি নাই যাব ঐহানে। ডর লাগে। হাত পা ছিলা যায়। বাবা গো! আমারে পাঠায়ও না।

আজ কাম করে নে, টাকাটা পেলে পরদিন আর যাবি না উহেনে।

কিন্তু সেই পরদিন আর আসে না। পেট চালাতে মহাজনের কাছে দেনা। শুধতে গেলে আবার কাজ, আর কাজ মানে ইঁদুরের গর্তের অতলে তলিয়ে কয়লা তুলে আনা। পারিশ্রমিক যা পায়, গালাগাল পায় তার বেশি। তবু এই চক্র থেকে রেহাই নেই। ২০১৮-র ডিসেম্বরে একসাথে পনেরো জন শ্রমিক আটকে পড়ায় খবর হয়েছিল। তাদের উদ্ধারে বাযুসেনা পর্যন্ত নেমেছিল, নেমেছিল ডুবুরি বাহিনী। তবু শেষটায় ছয় জনকে বাঁচানো যায়নি। আরও কত খুচরো সংখ্যক প্রাণ যে অবর্ণনীয় কষ্ট ভোগ করে চলে যায়, তার গোনা-গুনতি নেই!

আবার শোনা যাচ্ছে লিটন নদীর জল ইঁদুর গর্তে ঢুকে পঞ্চাশজন শ্রমিক আবদ্ধ। ৩৬০ ফুট গভীরে তাদের জীবনের আশা ছেড়ে দিয়ে স্থানীয় প্রশাসন কীভাবে খবরটা ধামাচাপা দেওয়া যায়, তাতে সচেষ্ট। মুখ্যমন্ত্রী অবশ্য নিজের উদ্ধার বাহিনী নামিয়েছেন। কিন্তু সেনা ডাকা মানে সর্বভারতীয় খবর হওয়া। একই ব্যক্তির রাজত্বে দু-দুবার এমন দুর্ঘটনা ভালো প্রশাসনের পরিচয় নয়। গতবারেই কোল ইন্ডিয়া স্বীকার করেছিল, এই তল্লাটে প্রচুর চোরা খাদান আছে। পাহাড় গাত্র ফুঁড়ে চলা এই র‌্যাট হোল, শুধু শ্রমিক কেন, সাধারণ মেঘালয়বাসীর পক্ষেও ধস নেমে বিপজ্জনক হতে পারে। তারা মেনেছিল আইন অমান্য করে খনিতে নাবালক নাবালিকাদের নামানো হচ্ছে। কিছুদিন কাগজে হইচই হল, দু-একজন গ্রেফতার হয়ে জামিনে খালাস। তারপর আবার যেই কে সেই। এবারেও মনে হচ্ছে আধা সেনা ও সেনা ডাকতে হবে, নতুবা পরে জানাজানি হলে আরও হাঙ্গামা, যদিও মন্ত্রীদের পদ তাতে টলে না।

র‌্যাট হোল খনি শুনলেই গা ছমছম করে কস্তুরীর মতো ডাকাবুকো মেয়েও। তার মধ্যে স্থানীয়রা সবাই এটাকে সবচেয়ে ভয় করে। ওখানে মানুষ ঢুকলে আর বেরোতে পারে না। যাদের জীবন নরকের চেয়ে দুর্বিষহ, তাদেরও বাঁচার এত সাধ, আর অজানা অন্ধকারকে এত ভয়?

কস্তুরী সীমান্তে চোরাচালান ধরার দাযিত্বে। যদিও তার ট্রেনিং চলছে, কিন্তু নির্ভীক স্বভাবের জন্য ওকে মাঝে মাঝে ভয়াল জায়গাতেও ঠেলে দেওয়া হয়। এবার রেস্কিউ টিমে ওকেও রাখা হয়েছে। খনি মালিকের বিরুদ্ধে প্রমাণ ও চার্জশিট গঠনে সহায়তা করলেই তার দায় মেটে। আটকা পড়া মানুষগুলোকে জীবন্ত উদ্ধার করা গেলে একরকম, আর মারা গেলে আরও কড়া প্রকৃতির। তাদের বাঁচানোর দায় মোটেই তার নয়। তবু বাঁচাতে পারলে নাকি চোর ধরতে কাজে লাগবে।

এটা কাস্টমস্-এর কাজ নয়। কিন্তু ওই যে কথায় আছে ঢেঁকি স্বর্গে গিয়ে ধান ভাঙে। আসলে কাজটা কস্তুরীর ছেলেমানুষি আবেগে নিজের শখের ডুবুরি ট্রেনিং নেওয়ার কথা ফাঁস করে দেওয়ার ফলশ্রুতি। নাও এখন মরণ গহ্বরে ডুবে মানুষ উদ্ধার করো। এক সময় ডাক্তারি ইঞ্জিনিয়ারিং-এর ইঁদুর দৌড়ে শামিল হতে চায়নি কিন্তু এখন আক্ষরিক অর্থেই ইঁদুরের গর্তের মুখোমুখি।

ঘটনাচক্রে শ্রমিক ছেলেমেয়ে ও বয়স্করাও জলের শব্দ পেয়ে ১৬০ ফুট গভীরে একটা চাতালে উঠে এসেছে। ওখানকার ছাত বা সিলিং-এ একটা সিসি টিভি ক্যামেরা আছে। ভাগ্যক্রমে তার লাইনে এখনও গোলযোগ হয়নি বলে দেখা যাচ্ছে। বস্তুত এর গভীরে নামা নিয়মও নয়। একজন মাত্র নিখোঁজ। ওই একজন কে, ওপরে কেউ জানে না, নীচ থেকেও স্পষ্ট খবর আসছে না। সম্ভবত কোনও মহিলা। কিন্তু মানুষজনের হাভভাব দেখে মনে হচ্ছে পঞ্চাশের মধ্যে একটি প্রাণ যেন কিছুই না।

চাতালের সঙ্গে সোজাসুজি কিন্তু পর্বতগাত্রের সঙ্গে ত্যারছাভাবে একটা সুড়ঙ্গ সাবধানে খোঁড়া হচ্ছে সমান্তরাল উদ্ধারকার‌্যের জন্য, ঠিক যেমন রানিগঞ্জের মহাবীর কোলিয়ারিতে করা হয়েছিল। সেবারেও ছয় সাতজনের খোঁজ পাওয়া যায়নি। মাটির গভীরে অন্ধকারে জলের তলায় তারা জলে ইঁদুর চোবা হয়ে মারা গিয়েছিল। তারপর থেকে ওইসব অঞ্চলে ওপেন কাস্ট খনির সংখ্যা বাড়ানো হলেও চোরা খাদানকে আটকানো যায়নি। আটকানো যাচ্ছে না ধস, অগ্নুৎপাতকেও।

বৃষ্টি শুরু হল। সর্বনাশ! বৃষ্টি পড়লেই বিপত্তি। তখন আর কোনও আশা থাকবে বা। বড়ো বড়ো ত্রিপলে খনিমুখ ঢাকার ব্যবস্থা হল। আধা সেনাবাহিনীর ট্রুপ এখনও এসে পৌঁছোয়নি। তবে শোনা মাত্র স্থানীয় মানুষরা কয়েকটা ত্রিপল ও প্লাস্টিক জোগাড় করেছে। কারণ তাদেরই আপনজনেরা কেউ কেউ যে নীচে আটকে আছে।

প্রথমেই জলে ডুবতে হয়নি, কৃত্রিম সুড়ঙ্গ পথে উদ্ধারকারী দলের সাহায্যে ত্রিশজন চেন বাঁধা ডুলিতে চেপে উঠে এসেছে। এবার শ্রমিকদের আশ্রয় নেওয়া শুকনো চাতাল পর্যন্ত জল উঠে এসেছে। শুকনো বললেও ভেতরটা অসম্ভব গুমোট ও ভ্যাপসা। ওই একজন তরুণী ছাড়া মনে হচ্ছে সবাইকে তোলা যাবে।

একজনের পা ফেঁসে গেছে পাথরের বা কয়লার খাঁজে। জল উঠে এসেছে তার বুক পর্যন্ত। নিজের পা-টা ছাড়ানোর জন্য যত টানাটানি করে তত যন্ত্রণায় মুখ বেঁকে যায়, কিন্তু পা যে আরও ফেঁসে যায়।

কস্তুরী বলল, ওর পা কেটে বার করে আনা হোক। পা যাবে কিন্তু প্রাণটা বাঁচবে।

মাথা খারাপ? জলের মধ্যে পা কাটলে ব্লিডিং বন্ধ করা যাবে? ও দমবন্ধ হয়ে না মরলেও রক্তপাতেই শেষ হয়ে যাবে…

ডাক্তারির সেকেন্ড ইয়ার পড়তে পড়তে ছেড়ে এসেছি। স্কুলে এনসিসি করেছি। সবরকম স্মল আর্মস চালাতে পারি। এ ছাড়া উপায় নেই। কোনও সার্জেন থাকলে প্লিজ় দেখুন। তেমন কেউ দাযিত্ব নিলে আমি নামব না।

বাধা ব্যাগড়া দেওয়ার জন্য যত লোক তৎপর হয়, আসল কাজে তার এক শতাংশকেও দেখা যায় না। কেউ রাজি নয় দেখে কস্তুরী নিজের পিঠে অক্সিজেন সিলিন্ডার আর নাকে নল গুঁজে বলল, আমি যাব। যদি ওর পা কাটতে হয়, আইনত কোলিয়ারি তার দাযিত্ব নেবে। কিন্তু যদি মারা যায়, আমি সব দায় মাথায় করে নেব। শাস্তি ভোগ করতে রাজি। দেখুন জল ওর গলা, টাচ করেছে। আর সময় নেই। আর এক ফুট জল উঠলেই সিসি টিভি অকেজো হয়ে যাবে। এখনও হয়নি সেটাই পরম বিস্ময়। কিন্তু অন্ধকার হয়ে গেলে আর কিচ্ছু করা যাবে না।…

কাউকে কিছু ভাবার সময় না দিয়ে মাথায় টর্চ হেডলাইট নিয়ে আর হাতে ধারালো চপার নিয়ে কস্তুরী নেমে পড়ল গহ্বরে। সবাই হতবাক। তারপর মিনিট পনেরো যেতে না যেতেই তুমুল হইহল্লা শুরু হল। যদিও উত্তর-পূর্বের পাহাড়ি অঞ্চলে নাকি মেয়েদের সম্মান আছে। পরিবার প্রধান হয়, পদবি ও সম্পত্তির উত্তরাধিকার তাদের মাধ্যমে প্রবাহিত হয়। কিন্তু সব গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক পদেই প্রায় পুরুষ। আর বৃহত্তর ভারতীয় সংস্কৃতির প্রভাবে মন্তব্য ভেসে এল মেয়ে মানুষের বেশি বাড়। ট্রেনিং পিরিয়ডে এত সাহস পায় কী করে? কাস্টমস অফিসাররা কি হাতে চুড়ি পরে আছে? আর্মি তো আসছেই। আটচল্লিশজনকে উদ্ধার করা গেছে, একজন নিখোঁজ, আরেকজন মরলে কী ক্ষতি ছিল?… ইত্যাদি।

আধ ঘণ্টা পরে মাইন শ্যাফট এলিভেটরে টান পড়ায় টেনে তোলা হল। ডুবুরির সরঞ্জাম না থাকলে কস্তুরীকে চেনা যেত না। সারা গায়ে কয়লা ও কাদার আস্তরণ। ও ডুলিতে চেপে ধরে আছে এক তরুণকে। তার গায়ে জল কাদা কালি। তার মধ্যেও রক্ত চোঁয়াচ্ছে। কাটা পায়ে যন্ত্রণায় চিৎকার করছে সে। সেখানে তার নিজের শার্টখানাই বাঁধা রক্তক্ষরণ যতটুকু কম করা যায়।

তবে আরও আশ্চর্য, কস্তুরীর দু পায়ের মাঝখানে কিছু একটা কাদাকালি মাখা জিনিস ধরা। সেটা মাথার ওপর তুলে ধরে ও চ্যাঁচাল, সেই কাটা পাটা নিয়ে এসেছি। শিগগির হাসপাতালে ভর্তি করলে ছেলেটাকে আর তার পা, দুটোই বাঁচানো যাবে। কুইক।

দুজনকেই হাসপাতালে ভর্তি করা হল। সিংগ্রাম নামের ছেলেটার প্রাণ বাঁচলেও তার থ্যাঁতলানো এলোমেলো করে কাটা পাখানা জোড়া লাগানো যায়নি। তবু কস্তুরী তার ও তার পরিবারের কাছে সাক্ষাৎ দেবী।

হাসপাতালে শুয়ে কস্তুরী খবর পেল, খনি মালিককে পুলিশ ধরেছে। তিনি আপাতত পুলিশ হেফাজতে হাজতে। সেটাও ওদের কাস্টমস দলের দলবদ্ধ সাফল্য। মনটা হালকা হয়ে এল।

অন্যমনস্ক হয়ে একজনের মোবাইল চেয়ে বাড়িতে ফোন করল কস্তুরী, মা, খুশি বলছি। কেমন আছো?

আর কেমন আছো? যেখানে গেছিস সব সময় চিন্তায় থাকি। তুই কেমন আছিস?

ভালো। ইয়ে মা… একটু খোঁজ নিতে পারবে, মেডিকেলটা আবার শুরু করা যায় কিনা? জানি জেনারেল ক্যান্ডিডেটের সিট ফাঁকা থাকে না, তবু যদি আমার স্কোর কনসিডার করে…। ডিপার্টমেন্ট যদি পারমিশন দেয়, তাহলে ভাবছি মা, এমবিবিএস-টা কমপ্লিট করে সার্জারিতে মাস্টার্স করব। দেখলাম চোর ডাকাত ধরার চাইতেও কারও প্রাণ বাঁচাতে পারাটা আরও বেশি স্যাটিসফ্যাকশন দেয়।

 

 

মুক্তি

॥ ১ ॥

ভোরের কুয়াশা সরিয়ে স্পষ্ট হয়ে উঠছে নম্রতার পুরোনো শহর। বাসটা ক্রমশ পাহাড়পুরের দিকে এগিয়ে আসছে। চারপাশটা অনেক বদলে গেছে। এমনি বৃষ্টি ছিল সেদিন ভোরেও, যেদিন বিধ্বস্ত অবস্থায় তিন বছরের রাইকে নিয়ে বেরিয়ে এসেছিল নম্রতা। একরত্তি মেয়েটা কোল আঁকড়ে চুপ করে বসেছিল। এতটুকু কাঁদেনি। বরং যেন আগলে রেখেছিল নম্রতাকে। দেখতে দেখতে সতেরোটা বছর কেটে গেল।

এই তো দেবী চৌধুরানির মন্দির! যেদিন প্রথম টকটকে লাল সিঁদুর আর লাল বেনারসি পরে প্রথম পা রেখেছিল এই শহরটায়, সেদিনই এসেছিল এখানে প্রণাম করে নতুন জীবনের আশীর্বাদ নিতে। ভেজা ভেজা মায়া চোখে লেপটে যাওয়া কাজল আর একরাশ স্বপ্ন ছিল সেদিন। তারপর তো কত হেরে যাওয়া বিকেলে সে এসেছে!

সেই পাকুড় গাছটা! চার বছরে যতবার এদিকে এসেছে, ততবার খুঁজেছে গাছটাকে। রঙিন থেকে ফ্যাকাশে হয়ে যাওয়া জীবনের নীরব সাক্ষী তো এই গাছটাই!

বাসের হর্ন আর স্মৃতির মেদুরতায় কখন যে ব্যাগে মোবাইলটা বাজছে খেয়ালই করেনি নম্রতা। ফোনটা রিসিভ করে বলল, হ্যাঁ রে রাই এক্ষুনি ও বাড়ি পৌঁছোব। সন্ধের আগে ব্যাক করব কোচবিহারে দিদির কাছে। দিদান কে দে তো একটু…

—মা চিন্তা কোরো না যেটা আমার রাইয়ের প্রাপ্য সেটা আমি নেবই। কেউ বাধা দিতে পারবে না।

নেতাজি বাস টার্মিনাস থেকে কয়েক পা এগোলেই চৌমাথার মোড়টা। ডান পাশে সরু কানাগলিতে ঢুকতেই ওই তো দোতলা হলদে বাড়িটা। সামনের বেগনভেলিয়া গাছটা নেই বলে কেমন যেন ন্যাড়ান্যাড়া লাগছে। আশপাশের ছাদ থেকে দু-একটা উৎসুক, পরিচিত মুখ চোখে পড়ল নম্রতার। এই তো আর কপা এগোলেই বিশাল ফটক। কিন্তু পাগুলো কেন অসাড় হয়ে আসছে নম্রতার? অবশেষে সব দ্বিধা কাটিয়ে কলিংবেল বাজাতেই বেরিয়ে এল এ বাড়ির জামাই দেবেশ। কেস চলাকালীন দেখেছিল নম্রতা দুএকবার।

—আরে আসুন! একা কেন, রাই কোথায়?

—ওর ক্যাম্পাসিং আছে।

—তা বাপের ভিটে, ঠাকুমা এদের প্রতি অবশ্য আজকালকার ছেলেমেয়েদের তেমন সেন্টিমেন্ট নেই। কী বলে যে ডাকি! বউদিই বলি, কি বলেন? আপনি তো এখন কলকাতার ফ্ল্যাটে থাকেন। ইস্কুলটা কোথায়? আর পেপারে ফিচার টিচার তো লিখছেন খুব।

—ওই একটু আধটু!

—স্কুল ব্যান্ডেলের কাছে। থাকি উত্তরপাড়া, প্রপার কলকাতা নয়। ফ্ল্যাট না, দিদির ননদের বাড়ির নীচতলায় ভাড়া আছি।

—একাই তো থাকা হয় নাকি? বলেই ফিচেল হাসি হাসে দেবেশ।

—একা কেন? রাই আর মা থাকে। দৃঢ় ভাবে বলে নম্রতা।

ইতিমধ্যেই দোতলায় এসে পৌঁছেছে নম্রতা। বড়ো বৈঠকখানাটা এখন রোগিণীর শয্যা। বিছানার একপাশে পড়ে আছে এককালের দাপুটে বিভা দত্ত। চারদিকে চোখ বোলাতেই নজরে এল দেয়ালে ঝুল আর ধুলোর আস্তরণের মাঝে ঝুলছে শুকনো ফুলের মালা জড়ানো দীপকের ছবি।

ত্রস্তব্যস্ত হয়ে ছুটে এল সোনা। এখন বেশ গিন্নিবান্নি।

—ও তুমি? এসেছ? মা তো ঘুমোচ্ছে। একটু বসো, বলেই ইশারায় স্বামীকে ডেকে নিয়ে গেল। আয়া মাসি বলে চলে, তুমি বুঝি বাবুদার প্রথম বউ! বুড়ি খুব তোমার নাম করছে গো!

তার নাম করছে? আশ্চর্য! কয়েক মুহূর্তের জন্য নম্রতা পিছিয়ে গেল একুশ বছর আগে। তখন সে পাঁচ মাসের গর্ভবতী। রাত প্রায় বারোটা। সব কাজ সেরে ঘুমোনোর প্রস্তুতি নিচ্ছে। দীপক অফিসের কাগজপত্র নিয়ে একটু বিচলিত। ক্ষুদ্রাতি ক্ষুদ্র বিষয়ে বিচলিত আর উত্তেজিত হওয়াটাই প্রকৃতি ছিল দীপকের। নম্রতা বেশি ঘাঁটাত না। হঠাৎই রণংদেহী হয়ে ছেলের ঘরে কড়া নেড়ে উত্তেজিত হয়ে উপস্থিত হলেন বিভাদেবী।

—ও বাবু দেখ দেখ তোর বউ আজও হলুদের বয়মের মুখ আলগা রেখে এসেছে। আগে একদিন এভাবে চিনি নষ্ট করেছিল, আমি না দেখলে এখনি সব ছিটিয়ে চিত্তির হতো! বলি বিয়ে বাড়িতে দেখে কী মেয়ে পছন্দ করে আনলি? আমার সংসারটা তো গোল্লায় গেল!

—নম্রতা কী শুনছি এসব?

—আসলে মা বললেন শেষ পাতে সোনা বেগুন ভাজা খাবে, তাই তাড়াহুড়োয় খেয়াল করিনি।

—হলুদ কি তোমার বাবা জোগায় নাকি?

—বাবার নাম একদম তুলবে না। উনি নেই।

—একদম চুপ! মুখে মুখে কথা বললে জিভ টেনে ছিঁড়ে দেব।

—আহ লাগছে! চুলটা ছাড়ো!

—চল হারামজাদি! মা আর সোনার কাছে ক্ষমা চেয়ে বল, তোর মাস্টারবাবা তোকে শিক্ষা দেয়নি! বল!

—আহ লাগছে! ক্ষমা কেন চাইব? ভুল করে হয়ে গেছে। ইচ্ছে করে তো…

—একদম চুপ! আই! সোনা নিয়ে আয় ওর খাতাগুলো! দেখাচ্ছি মজা! লুকিয়ে লুকিয়ে কাগজে ফিচার পাঠানো? মন সবসময় উড়ু উড়ু! এক্ষুনি সব ছিঁড়ে দেব।

—হায় হায় গো! কী মেয়ে মানুষ! ক্ষ্যাপা ছেলেটাকে অসুস্থ করা! যা বাবা চোখে মুখে জল দে আমাদের ভদ্দর লোকের বাড়িতে চ্যাঁচামেচি! পাঁচজনে শুনলে বলবে কী?

॥ ২ ॥

—ও বউদি চা খাবে গো! ও বউদি! চারু মাসির ডাকে সম্বিত ফেরে নম্রতার। ধীরে ধীরে চশমাটা খুলে ব্যাগে রাখে। একবার শীর্ণ বিভাদেবীর দিকে তাকায়। এই মৃত্যুপথযাত্রীনির শেষইচ্ছে পূরণ করতেই তো আসা!

পাশের লাল সিমেন্টের ঘরটা ছিটকিনি দেওয়া। চারুর অনুমতি নিয়ে ঢুকল নম্রতা। এখানেই তার খাট, আলমারি ছিল এককালে! পরে হয়তো রুম্পাও এখানে থাকত! এখন বাতিল জিনিসের আখড়া হয়েছে। হয়তো বাতিল হওয়া সম্পর্কও? ঘর? না সেভাবে নম্রতা কোনও বরাদ্দ ঘর পায়নি এ বাড়িতে।

বিয়ের পরপরই উঠেছিল নীচতলার আলো, বাতাসহীন স্যাঁতসেঁতে ঘরে। বছর ঘুরতে না ঘুরতেই রাই এল। বাচ্চার ঠান্ডার ধাত থাকায় উপরের লাল সিমেন্টের ঘর বরাদ্দ হল। কিন্তু সোনার পড়ার সমস্যা হওয়ায় শেষমেশ রাই আর নম্রতার ঠাঁই হল একদম ডাইনিং ঘরের এককোণে কাঠের চৌকিতে।

দরজাগুলোর একটাতেও কোনও পাল্লা ছিল না। শ্বশুরমশাই নগেন দত্ত তখন জীবিত ছিলেন। একে অ্যালজাইমার তার ওপর ডায়াবেটিস। যতবার তিনি ঘরের ওপর দিয়ে টয়লেটে যেতেন ততবার ছোট্ট রাইকে ফিডিং করাতে নম্রতাকে অস্বস্তিতে পড়তে হতো। হাজার বুঝিয়ে সুরাহা হয়নি। আসলে বিভাদেবী চাননি দীপক আর নম্রতার কোনও ব্যক্তিগত পরিসর থাকুক। জিনিসপত্র অবশ্যি নীচতলার ঘরেই থাকত।

একদিন এটাই তার সংসার ছিল! কই এতটুকু টান আসছে না তো? নম্রতার ঠাকুমা বলতেন দিনহাটার বাড়িটা ঠাকুমার স্বামীর ভিটে। পরপারে যাবার আগে তিনি ভিটে ছাড়বেন না! সেই ঠাকুমার সংস্কারেই তো বড়ো হয়েছে সে! স্বামীর ঘর, সিঁদুর, শাখা, পলা, নোয়া— এসব ভাবলেই ছোটোবেলায় প্রতিটা রোমকূপে যে-শিহরণ জাগত সেসব যে কোথায় উবে গেল কবে?

ধীরে ধীরে জানলার শিকগুলোতে হাত বোলায় নম্রতা। কত বুক ফাটা কান্নায় এই শিকগুলোর ফাঁক দিয়ে একফালি আকাশ খোঁজার চেষ্টা করেছে! কতদিন! ডানদিকের সরু দরজাটা খুলতেই চোখে পড়ে বাঁকানো সিঁড়িটা। ধীরে ধীরে খানিকটা ঘোরের মধ্যেই ছাদে চলে আসে নম্রতা। এই ছাদটার মধ্যেই মরূদ্যান খুঁজে পেত এক সময় সে! গাছগুলো সব শুকিয়ে মরে আছে। চারদিকে পরিত্যক্ত টব। ওই তো নম্রতার ফেব্রিক দিয়ে রং করা ছোট্ট টবটা রং চটে পড়ে আছে।

আজও মনে পড়ছে তখন সবে দুদিন বিয়ে হয়েছে, একদিন আপন মনে গাছে জল দিতে দিতেই পাশের বাড়ির ক্যাসেট থেকে ভেসে আসা শ্রাবণী সেনের আমার প্রাণের মাঝে সুধা আছে চাও কী-র সুরে গুনগুন করছিল হঠাৎ পেছন থেকে দীপকের ধুপধাপ চটির শব্দ এগিয়ে আসছিল। কাঁধে দীপকের স্পর্শে চোখ বুজে রোমান্টিকতার কাব্য লিখছিল নম্রতা। না কোনও আবেশেই আবিষ্ট হতে পারেনি সেদিন।

দীপক জানিয়ে দিল তাদের সবার বাটি, চামচ, থালা, গেলাস আলাদা। দেখে বুঝে নিতে হবে। গুলিয়ে যেন না যায়। আর সোনার ঘরে বিছানায় ভুলেও নম্রতা যেন না বসে। সোনার এসব পছন্দ নয়। মুহূর্তেই শ্রাবণী সেন এর গানটা কলেজের পি ডি স্যারের হ্যাকের থিওরির মতো লাগতে শুরু করেছিল!

আজও চোখে জল এসে গেল নম্রতার? এখনও জল বেরোয় চোখ দিয়ে দীপকের জন্য? ভালোবাসা না পাওয়ার জন্য? নাকি স্বামী নামক অদেখা ব্যক্তিটির জন্য আশৈশব তিল তিল করে জমানো এক বুক ভালোবাসার এক কণাও দিতে না পারার জন্য? সত্যি কোথায় গেল ভালোবাসাগুলো যার এক কণাও এই পরিবারের একটি মানুষকেও সে দিতে পারল না।

॥ ৩ ॥

—ও বউদি নীচে চলো গো সবাই ডাকছে!

—তুমি চারু? কতদিন আছ?

—আমি অনেকদিন বউদি। আগে ঠিকা কাজ করতাম। এখন বুড়ির ডিউটি। তোমার কথা শুনছি অনেকের মুখেই।

—কী? আমি খুব খারাপ?

—ধুর! মানুষ দেইখে চুল পাকল! রুম্পা বউদিও খারাপ না গো! একটু ইসস্টরং! বাবুন দাদা যে কী করল! বেরেনশর্টের অতগুলা ওষুধ! তুমি আসো শিগগির, আমি যাই। নাহলে ভাববে চুকলি কাটতেছি।

ধীরে ধীরে পা বাড়ায় নম্রতা। চিলেকোঠার কাছে এসে পুরোনো কাচের বই রাখার আলমারিটা চোখে পড়ে। এটা আগে তার ঘরেই ছিল। এখানেই হয়তো ছড়িয়ে আছে পুরোনো যাপনের কোনও চিহ্ন। ওই তো সেই ফটো স্ট্যান্ডটা! ধুলোয় ধূসরিত। ওর মধ্যেই অযত্নে অস্পষ্ট হয়ে গেছে ছোট্ট রাই আর দীপকের ছবি! ধীরে ধীরে ছবিটা বের করে নেয়। পুরো নষ্ট হয়নি এখনও। সেই লাল কভার ফাইলটা না? তাতে কোচবিহার থেকে নম্রতার লেখা প্রথম আর শেষ বোকা বোকা ইনল্যান্ড লেটারে চিঠি। ফাইলটা হাতে নিতেই আঠেরো বছর আগের সব স্মৃতি হুড়মুড় করে বেরিয়ে এল।

সেদিন দীপকের বন্ধুর বিয়ে ছিল। দীপক অবশ্য কোথাও তেমন যেত না। কথা ছিল নম্রতা সন্ধের আগেই রাইকে নিয়ে যাবে। হরিদার রিকশা বলে রেখেছিল। খুব একটা বেরোনোর ভাগ্য ছিল না বলেই ছোটো ছোটো জিনিসে সুখ খুঁজে নিত। দীপক অফিসে বেরিয়ে গেছে। আলমারি থেকে লাল সিল্কটা বের করে আয়রন করতে গিয়ে দেখে দীপকের কভার ফাইলটা ছিটিয়ে আছে। ধীরে ধীরে সব গুছিয়ে আলমারিতে তুলে রাখে নম্রতা। এমনিতে দীপকের সব জিনিস কখনওই ঘাঁটার অভ্যাস তার ছিল না।

বিকেলে সব কাজ এগিয়ে তৈরি হতে গিয়ে দেখে আলমারি থেকে সব বের করে স্তূপ হয়ে আছে। নম্রতার ভালো শাড়িগুলো সিগারেট দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া। দীপকের চোখগুলো টকটকে লাল আর ফর্সা গালগুলো লাল হয়ে আছে। নিজেকে সংযত রেখে কি ঘটেছে জানতে চাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঝাঁপিয়ে এসে চুলের মুঠি ধরে শুরু হয়ে গেল এলোপাতাড়ি কিল, চড়, লাথি। এক ধাক্কায় আছড়ে পড়ল লোহার রেলিংটায়।

অভ্যাসবশত চেষ্টা করেছিল শান্ত ভাবে অপরাধ জানতে আর পাঁচ কান না করে চার দেয়ালে মিটিয়ে নিতে! কিন্তু সেই সময় পাশবিকবলে বলীয়ান হয়ে দীপক এমন ধাক্কা দিল যে, সে আছড়ে পড়ল লোহার রেলিংয়ে ওপর! তারপর কতক্ষণ যে পড়েছিল নম্রতা সিঁড়ির নীচে আজ আর মনে করতে পারে না।

হাতটা ফ্র‌্যাকচার হয়েছিল। ওই অবস্থায় মেয়েটাকে খাইয়ে হাতব্যাগে বাবার দেওয়া গয়নাগুলো, ৫০০ টাকা আর রাই-এর দু একটা জিনিস ভরে, ভোর হবার আগেই উঠে বসেছিল কোচবিহারের বাসে। তারপর তো জামাইবাবু সব সামলাল। পুলিশ কেসের ভয়ে মিউচুয়াল ডিভোর্সটা হয়ে গেল।

এরাও ততদিনে ছেলের মানসিক সমস্যা দেখিয়ে গা বাঁচাল। তখনও দীপক দ্বিতীয় বিয়ে করেনি। ফোনে, চিঠিতে মেরে ফেলার হুমকি দিত। সেই জন্যই দিদি পাঠিয়ে দিল উত্তরপাড়া। সেখানে চাকরির পরীক্ষার প্রস্তুতি, টিউশনি, আর একের পর এক লড়াই।

আজও ভাবে সেদিন ফাইল থেকে একটা কাগজ খাটের নীচে পড়ে যাওয়ার মাশুল তাকে কীভাবে যে দিতে হয়েছে? সেটা কতটা দরকারি ছিল সেটাই তো আর জানা হল না।

॥ ৪ ॥

ইতিমধ্যে অনেকেই হাজির। বিভাদেবী বালিশে হেলান দিয়ে বসে। ছোটো কাকিমণি বললেন, কত দিন পর দেখলাম নম্রতা! জেল্লা বেড়েছে তো? একদম কোনও খোঁজখবর নেই। বাবুন চলে যাবার পরও এলে না? এলেম আছে তোমার, বর ছেড়ে, কলকাতায় গিয়ে চাকরি নিলে, ফিচার লেখালেখি! বলি এ বাড়ির ছেলেদের মেজাজ তো বরাবরই তিরিক্ষি। আমরা আর পারলাম কই?

—আপনারাও তো কাকিমা রাইয়ের বাবার খবর যতদিনে জানালেন তখন আসা না আসা এক। কী হয়েছিল সেটা স্পষ্ট করে বলেননি।

—কি আর জানাব বাছা! তুমি মাথা বিগড়িয়ে দিয়ে গেলে, ওষুধ ধরল। পরের বউ এসে কোথায় বুঝিয়ে ওষুধ খাওয়াবে তা না, আরও বাড়িয়ে দিল, শেষমেশ সেই ওষুধগুলো একবারে খেয়ে..

—ও সোনা কাঁদিস না মা!

—কী করব বলো কাকিমা! দাদাটা এত সৎ ছিল না! আমার মায়ের মতো। অন্যায় বরদাস্ত করত না। বউগুলো এমন জুটল…

নম্রতার হাসি পাচ্ছিল তবু সংযত হয়ে বলল, এতটাই সৎ যে না জানিয়ে মানসিক ভাবে অসুস্থ ছেলের দুবার বিয়ে দিলে!

হঠাৎই বিভাদেবী বলে ওঠেন, বউমা তুমি রাই দিদিকে আনলে না? ক্যান্সার রোগীটা ফোন করেছিল তাও রাখলে না কথাটা।

—পরে আসবে। এখন ক্যাম্পাসিং।

—আর পরে কি আমি থাকব?

—এই বালাটা রাখো। রাইদিদুর বিয়েতে দিও। আর এই শিবলিঙ্গটা রাখো মা। সে মেয়েকে আমি বলতে পারব না আর সোনা তো এসব পারবে না… তাই তুমি এর দায়িত্ব নাও। গভীর একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে নম্রতা।

দেবেশ ইতিমধ্যে দলিল আর জমি-বাড়ির ম্যাপ নিয়ে হাজির। উকিলি কেতায় বলে চলে,

—বউদি পুরো বাড়ি আর ফাঁকা জায়গা নিয়ে ৫ কাঠা ৩ ছটাক। শ্বশুরমশাই নগেন দত্তের নামে বাড়ি। ওয়ারিশ হচ্ছে, বিভা দত্ত, সোনালি রায়, রুম্পা দত্ত, ছেলে রাতুল দত্ত, আর আপনার মেয়ে রাই দত্ত। আপনি তো ডিভোর্সি। এবার আমি রুম্পা বউদিকে বুঝিয়েছি সরকারি রেটে আমাকে বিক্রি করতে, রাজি হচ্ছেন না। আমি অবশ্য এমন কেস ঠুকে দিয়েছি ও কাউকে বেচতেও পারবে না। এবার থাকে আপনার মেয়ে। আমরা ভদ্র ফ্যামিলি। রাইকে বঞ্চিত করব না। আপনি দানপত্রে কোনও দাবি নেই বলে সই করে দিন। রাই-এর বিয়েতে আমরা থোক অ্যামাউন্ট কিছু দেব। এখন হাতটা খালি!

মাঝখান থেকে সোনা বলে, তোমার ভাগ্য ভালো যে আমাদের ফ্যামিলিতে এসেছিলে!

আপন মনেই হেসে ওঠে নম্রতা। দেবেশের দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে, এখন ডিভোর্সি মহিলারও প্রপার্টিতে লিগ্যালি অনেক দাবি আছে। আপনি বোধহয় আপ টু ডেট নন।

—মানে আপনি সহজে মেটাবেন না তাই তো? অত দুর থেকে সব পারবেন?

—থামুন! আমার কথা শেষ হয়নি। বিভাদেবীর দিকে তাকিয়ে বলেন, রাই এখন বড়ো হয়েছে। কিছু না কিছু করবেই। ওর বিয়ে নিয়ে আমার কোনও তাড়া নেই। আপনি বালাটা রাখুন। আর শিবঠাকুর আমায় দিচ্ছেন? ভরসা পাচ্ছেন? একদিন তো ঠাকুরঘরে ঢুকতে দিতেন না। যাইহোক ওটা দিতে চাইলে আমি নেব। এই চেকটা রাখুন সই করা। আপনার ছেলের একটা মাত্র পিএলআই-এর নমিনি ছিলাম আমি। বাদ বাকি তো আপনি আর সোনা। যখন সব বন্ধন ছেড়ে গেছি তখন এটার জন্য ঋণী থাকতে চাই না, আপনার কাছে রাখুন। ৫০ হাজার আছে।

সবাই একটু মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে দেখে নম্রতা বলে চলে, আশা করি বুঝেছেন সম্পত্তির প্রতি আমার আর রাই-এর কোনও আগ্রহ নেই। সম্পর্ক যখন ছিঁড়ে গেছে প্রপার্টি দিয়ে কি হবে? এ বাড়িতে চারবছরে একটাই সম্পদ পেয়েছি সেটা আমার রাই। যা যা সই সাবুদ একটু গিয়ে করিয়ে আনবেন আবার কবে আসব জানি না, ভালো থাকবেন।

অনেকদিন ধরেই ওই চেকটা গলার কাঁটার মতো বিঁধে ছিল। আজ ফেরত দিতে পেরে নিজেকে উদাত্ত আকাশের মতো মুক্ত মনে হচ্ছে। ভেবেছে রাইয়ের কথা। তার অধিকারের কথা। কিন্তু না, সে রাইকে যোগ্য করে গড়তে পেরেছে। সে নিজেই নিজের পায়ে দাঁড়াবে। আর যা পড়ে রইল তা তো আর্থিক লাভ আর ক্ষতি। পুরো জীবনটাই যার ক্ষতির খাতে চলে গেল এ টাকাগুলো তার আর কী সৌভাগ্য আনবে।

সোজা অসম মোড়ে না গিয়ে একটু ঘুর পথেই গৌড়িয় মঠের সামনে আসে নম্রতা। এখন সুন্দর ব্রিজ হয়েছে। শহরের মাঝ বরাবর তির তির করে বয়ে যাচ্ছে নিস্তরঙ্গ করলা নদী। ধীরে ধীরে ব্যাগ থেকে দীপককে লেখা নিজের চিঠিটা বের করে। তারপর টুকরো টুকরো করে ভাসিয়ে দেয় করলার জলে। ভেসে যাক সব অতীত, গ্লানি। আজ নিজেকে উদাত্ত আকাশের মতো মুক্ত মনে হচ্ছে। মাঝে মাঝে মনকেমন করা মুহূর্তে আসত সে।

এই শহরটা বড়ো মায়াবি। না তার জন্মভূমি নয়। স্বামীর ভিটের অনুভূতি নেই তার। তবে বড়ো আপন। অনেক মন কেমন করা মুহূর্তে এই জলশহরের রাস্তা, নদী, গাছ, মন্দির তাকে বলেছে তুমি কেঁদো না আমরা আছি! এগিয়ে যাও। বাঁচো। হেরো না। আজ শহরটা আরও ঝকঝকে হয়েছে। কিন্তু আনাচে কানাচে জুড়ে সেই আন্তরিকতার ছাপ আজও আছে! ভালো থেকো জলশহর! জানি না আবার আসব কিনা! কিন্তু আমি তোমাকে ভুলব না। এই তোমরা আমার কেউ না হয়ে যে অনেক কিছু!

 

গেরস্থালি

ঘড়ির ঢং ঢং আওয়াজে অসীমার টনক নড়ল। এক্ষুনি রঞ্জন ওর বন্ধুকে নিয়ে এসে পড়বে। রঞ্জন বারবার বলে গিয়েছিল চা-জলখাবার তৈরি করে রাখতে। অসীমা তড়িঘড়ি চোখ মুছে ঠান্ডা জলের ছিটে দিয়ে রান্নাঘরে গেল। নিজের মুখটা না দেখলেও বুঝতে পারল কেঁদে কেঁদে চোখ ফুলে গেছে— জ্বালা করছে। কী যে করবে কিছুই বুঝছে না, সংসারটা কেমন যেন এলোমেলো হয়ে গেল এই ক’মাসে। অসীমা জীবনের নেগেটিভ দিক, অভাব-অস্বচ্ছলতা কোনওদিন দেখেনি। আজ যেন ও মাঝপুকুরে হাবুডুবু খাচ্ছে। খড়কুটোও নেই যা আঁকড়ে ধরবে। বাবার কথা আজ এত বেশি মনে পড়ছে। বাবার জন্যই ব্যাবসায়ী হয়ে ওঠা রঞ্জনের। কিন্তু কী থেকে কী হয়ে গেল!

‘সীমা… সীমা,’ বলতে বলতে রঞ্জন বাজারের থলে নিয়ে ঢুকল রান্নাঘরে। অসীমা মুখ তুলে তাকিয়ে হাসার চেষ্টা করল কিন্তু তার আগেই রঞ্জন অসীমার মুখের দিকে তাকিয়ে গম্ভীর হয়ে গেল। হাতের ব্যাগ নামিয়ে কাছে এসে নিবিড় ভাবে জিজ্ঞাসা করল ‘কী হয়েছে?’ অসীমা ট্রেতে চা-বিস্কুট নিয়ে রঞ্জনকে দিল, ‘আজ আবার সরকারবাবু এসেছিলেন।’

‘কী বললেন? চিৎকার করেননি তো!’

‘না, শুধু বললেন তাড়াতাড়ি ঘরগুলো ছেড়ে দিতে।’ রঞ্জন কিছু না বলে শুকনো মুখে ট্রে নিয়ে বাইরে চলে এল। অসীমা জানিয়ে দিল, ‘একটু বাদেই রুটি তরকারি দিচ্ছি।’ বলল বটে কিন্তু ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়ল। ওর কিছুই ভালো লাগছে না। কানের মধ্যে বাড়িওয়ালার কথাগুলোই ধাক্বা দিচ্ছে। এক মাসের মধ্যে ঘর ছেড়ে না দিলে কোর্টের কাগজ হাতে ধরিয়ে দিয়ে যাবে। রঞ্জনকে তো সব কথা ইচ্ছে করেই বলেনি। মানুষটাকে তো দেখছে, এত চেষ্টা করছে তবু আশার আলো দেখছে কোথায়? বিগত পাঁচ-ছ’মাস ধরে ব্যাবসার ভরাডুবি। মাথায় প্রায় আকাশ ভেঙে পড়েছে। তার উপর বাড়িওয়ালার হুমকি। ‘শুধু নিজেদের নিয়ে ভাবছেন, আমার ছেলের বিয়ে, ঘর দরকার, তাই ভদ্রভাবে বলছি, উঠে যান।’

অসীমারা গত তিনমাস বাড়িভাড়ার টাকাটাও দিতে পারেনি ঠিকমতো। আসলে রাগটা সেখানেই, তাই বাহানা জুড়ে দিয়েছে। আবার কোর্টের ভয় দেখাচ্ছে। হাতে কাঁচা পয়সা এসেছে তো, তাই গুমরও বেড়ে গেছে সরকারবাবুর। আজ যে সমাজে সরকারবাবু উঠে যাচ্ছে রঞ্জন একদিন সেখানেই ছিল। সরকারবাবুর বখে যাওয়া ছেলেটা হঠাৎ শুরু করেছে প্রোমোটারি ব্যাবসা। একসময়ে সরকারবাবু সরকারি চাকরি করতেন, সেই সুবাদে উপর মহলের সঙ্গে বেশ ভালো যোগাযোগ আছে। তাই ছেলের হয়ে সুপারিশ করাটা সরকারবাবুর কাছে জলভাত। মাত্র কয়েক মাস হল বেশ জমজমাট শুরু করেছে। উঠোনের ওপাশের ঘরটা আর বৈঠকখানা নেই, হয়ে গেছে অফিস ঘর। বড়ো বড়ো করে সাইনবোর্ডে লেখা ‘নতুন ফ্ল্যাট বাড়ি তৈরির জন্য যোগাযোগ করুন। প্রোমোটার – সনাতন সরকার। যোগাযোগের সময় সকাল : ১১টা – ৪টা।’

এতদিন অসীমা জানত না সরকারবাবুর ছেলের নাম। এখন সাইনবোর্ডের সুবাদে জেনে গেছে। সেই ছেলের বিয়ে। সরকারবাবুর স্ত্রীকে ব্যক্তিগত অনুরোধ করেছিল অসীমা। কিন্তু মহিলার বাচনভঙ্গির সামনে অসীমা খুবই অসহায় বোধ করছিল। উপর থেকে নীচে নেমে এসেছিল মাথা হেঁট করে। ঘরে এসে কেঁদে ফেলেছিল, আবার আপশোশও হয়েছিল রঞ্জনকে না বলে উপরে বাড়িওয়ালার কাছে গিয়েছিল আর্জি জানাতে। মাত্র কয়েক মাস আগেও অসীমারও তখন বোধহয় এখনকার মতো ছিল না। পতি গরবে গরবিনি ছিল সে। কী যে হল।

দশবছর আগে সে যখন নতুন বউ হয়ে শ্বশুড়বাড়িতে এল তখন শুধু দু’চোখে স্বপ্ন। বড়োলোক ঘরের মেয়ে অসীমা। বাবার আদুরে মেয়ের আবদারে সবাই অস্থির। সেই অসীমা এল শ্বশুরঘর করতে। তুলনায় রঞ্জন মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলে। অসীমাদের মতন বড়োলোকি ব্যাপার না থাকলেও সম্পন্ন গৃহস্থ যৌথ পরিবার ছিল রঞ্জনদের। দুপক্ষই জানত অসীমা-রঞ্জনের মেলামেশার কথা। আপত্তি থাকলেও উভয়পক্ষই রাজি হয়েছিল এ বিয়েতে। রঞ্জনের মা-বাবা, দাদা-বউদির মনে ছিল একরাশ দ্বিধা। পারবে তো অত বড়ো ঘরের মেয়ে এই সাধারণ ঘরে এসে মানিয়ে নিতে। অসীমাকে নিয়ে রঞ্জন যেদিন প্রথম তার মায়ের কাছে এসেছিল, সেদিনটা অসীমার আজও মনে আছে। রঞ্জনের মাকে প্রণাম করতে গিয়ে উনি সহাস্যে বলেছিলেন ‘বসো মা, এই ছোট্ট ঘরে তোমায় স্বাগত জানাই। বাড়িটা তোমাদের মতো বড়ো নয় কিন্তু আমাদের সকলের মন অনেক বড়ো, তোমার এখানে থাকতে কষ্ট হতে পারে কিন্তু আদর-ভালোবাসায় কোনও খামতি হবে না।’

এই কথা শুনে অসীমা কেমন যেন বিহ্বল হয়ে গিয়েছিল। এমনভাবে কেউ তো বলেনি। তার দুচোখে তখন রঙিন স্বপ্ন-উচ্চাশা। রঞ্জন যেন অতিরঞ্জিত হয়ে তার জীবনে ছড়িয়ে-মাখিয়ে আছে। অসীমা, রঞ্জনের মাকে মৃদু স্বরে জানিয়েছিল, ‘এই ছোট্ট ঘর-বাড়িই হবে তার সোনার সংসার।’

কোথায় গেল তার সোনার সংসার, স্বপ্ন! সব কেমন তালগোল পাকিয়ে গেল। ওই ছোটো বাড়িতে কিছুদিনের মধ্যেই তার দমবন্ধ হয়ে আসতে লাগল। স্বামীর বাঁধাধরা চাকরি। বাঁধাধরা সময়। অসীমা ব্যবসায়ীর মেয়ে। বাবা-কাকা, খুড়তুতো ভাইদের সচ্ছলতা দেখতেই অভ্যস্ত। গোনা টাকায় কোনওদিন জীবনযাপন করেনি সে। সারাদিনই বাড়ি জমজমাট। সকালে বাবা-জেঠু কারখানায় যায় তো দুপুরে বাড়ি আসে, ওই সময় দুই দাদা আর কাকা যায়। বাবা-জেঠু সারাটা দুপুর বাড়িতে ভাত খেয়ে দিবানিদ্রা দিয়ে আবার বিকেল চারটের চা-পর্ব চুকিয়ে বের হয়। দাদা-কাকারা মর্জি মতো বাড়ি আসে। আড্ডা মারে, কারুর জন্য অপেক্ষায় বসে থাকতে হয় না। কিংবা বাড়িতে অতিথি এলে কারখানা-দোকান যেখানে হোক ফোন করলে কেউ না কেউ এসে হাজির, এভাবেই বড়ো হয়েছে অসীমা।

এখানে রঞ্জন সকাল আটটা বাজতে না বাজতেই নাকেমুখে গুঁজে অফিস ছোটে। বাড়ি আসতে সেই সন্ধ্যা। যতই বাড়িতে জা-শাশুড়ি থাকুক, ভালো লাগে না অসীমার। রাতে রঞ্জনকে এ নিয়ে অভিযোগ জানালে রঞ্জন হেসে বলে, ‘সীমা, আমরা প্রায় পাঁচ বছর মেলামেশা করে তবেই বিয়ে করেছি, তুমি জানো আমার কাজের ধারা। অফিসের পর তুমি আমি এক জায়গায় মিট করতাম তারপর সারা সন্ধ্যা হইচই করে কাটিয়ে তোমায় বাড়ি দিয়ে আমি ফিরতাম। এখন সারারাত তুমি আমার কাছে, তবু তোমার আক্ষেপ। প্লিজ অবুঝ হয়ো না। এটাই তো জীবন, আমরা সবাই পরিবারবদ্ধ হয়ে বাস করি, চাকরিজীবী।’ অসীমা কিছুই বলার সুযোগ পায় না কিন্তু তার মন মানে না।

অসীমার বাবা এ বাড়িতে এলে প্রায়শই রঞ্জনকে ব্যাবসা করার কথা বলেন। অসীমার নামে যে মোটা অঙ্কের ফিক্স ডিপোজিট আছে তা থেকে লোন নিয়ে, ব্যাবসা শুরু করতে বলেন। কিন্তু রঞ্জনের তাতে সায় নেই। তার এক বোনের বিয়ে হয়নি এখনও। অসীমার সবসময় ভয় করত যদি রঞ্জন ওই টাকাটা চেয়ে বসে বোনের বিয়ের জন্য। বাবা-মায়ের প্ররোচনায় অসীমা বারবার বলত রঞ্জনকে ব্যাবসা করার জন্য। শ্বশুরবাড়ি গেলে শালারাও সবাই বোঝাত রঞ্জনকে ব্যাবসার পজিটিভ দিকগুলো। সকলের তাড়নাতেই বোধহয় রঞ্জন ব্যাবসা করা নিয়ে ভাবতে শুরু করল। সাথিও পেয়ে গেল ললিতকে। শ্বশুরমশাই কাপড়ের ব্যাবসায়ী। তাই কাপড়ের ব্যাবসা করাই সুবিধা। এমন ভাবনা চিন্তা নিয়েই ললিত-রঞ্জন শুরু করল কাপড়ের ব্যাবসা। মাঝারি মাপের একটা দোকান-ঘর ভাড়া নিল বড়ো রাস্তার উপরেই। মাস ছয়েকের মধ্যে রঞ্জন ইস্তফা দিল চাকরিতে। বাড়িতে সবাই ব্যাবসাটাকে খুব একটা ভালোভাবে না নিলেও কিছু বলল না।

অসীমার নিস্তেজভাব উধাও। সেই আবার ছটফটে হইচই করা, ননদের সাথে আড্ডা। যেমনটি ছিল বিয়ের পরপরই। রঞ্জনও বেশ খুশি। মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলে বলে অনেক ইচ্ছাই মনের কোণে চেপে রাখতে হয়। খুব শখ ছিল বাড়ির জন্য একট ফোর-হুইলার থাকবে। সে শখ পূর্ণ হয়নি। শখ ছিল মাকে, বাবাকে, বাড়ির সবাইকে নিয়ে সন্ধে হলে মাঝেমধ্যে লং ড্রাইভে যাবে। দারুণ জমজমাটি পরিবার হবে তাদের। পরিবারটা রঞ্জনদের জমজমাটি কিন্তু সাধ আর সাধ্য এক হয়ে ওঠেনি। এজন্য অবশ্য আক্ষেপ নেই। কাপড়ের ব্যাবসা শুরুর ঠিক দেড়বছরের মাথায় রঞ্জন এক্সপোর্ট পারমিট পেয়ে গেল। বাড়িতে বাবাকে বলতে খুব খুশি। তিনিই মনে করিয়ে দিলেন, ‘তোমার বোনের বিয়ের গুরুদায়িত্ব কিন্তু তোমার। তুমি ব্যাবসা করছ, দাদা চাকরিজীবী। তাই এখন তোমার ওপর আমার, দাদার অনেকটাই ভরসা।’

শ্বশুর মশাইয়ের এই ধরনের আশাভরসার কথা অসীমার মন কিন্তু সোজাভাবে নিল না। সে চেয়েছিল ব্যাবসার প্রথম লাভের টাকাটায় রঞ্জন একটা গাড়ি কিনুক। ইনস্টলমেন্টে ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু শ্বশুর মশাইয়ের কথায় যেন অসীমার বাড়া ভাতে ছাই পড়ল। সে চাইল সবাই যা টাকা দেবে, তার স্বামীও তাই দেবে। এই নিয়ে অশান্তি। রঞ্জন বাবা-দাদার পক্ষ নিয়ে কথা বলতে গেলে এক ঝটকায় অসীমা থামাল তাকে, ‘কার পয়সায়, কার সাহায্যে ব্যাবসা করছ? আমার এফডি, বাবার যোগাযোগ না থাকলে তুমি পারতে আজ এমন কাজ করতে?’

অসীমার গলার স্বর বেশ উঁচু পর্দায় ছিল। ভাসুর-শ্বশুর সবই শুনতে পেল। তারাই রঞ্জনকে আলাদা ডেকে এনে কি পরামর্শ দিল কে জানে, একমাসের মধ্যে হঠাৎই রঞ্জন বাড়ি বদল করল, উঠে এল ভাড়া বাড়িতে। অসীমা খুবই অবাক হয়েছিল, বিরক্তও। কেন রঞ্জন বাড়ি বদল করছে এবং ভাড়াবাড়িতে যাচ্ছে এ নিয়ে বহু বার জিজ্ঞাসা করলেও কোনও সদুত্তর পায়নি। নিজেদের বাড়ি, নিজেদের শ্বশুরবাড়ি ছেড়ে ভাড়াবাড়িতে যেতে অসীমার যথেষ্ট আপত্তি ছিল কিন্তু রঞ্জনের কঠিন মুখ, কঠোর ব্যবহার, অসীমার কেমন যেন সব গুলিয়ে গেল, এ রঞ্জনকে সে চেনে না। সে চুপচাপ নিজের জিনিসপত্র গুছিয়ে নিয়ে চলে এসেছিল। আসার সময় সবাই প্রাণহীন পুতুলের মতো দাঁড়িয়েছিল। অসীমা-রঞ্জন আলাদা ভাড়া বাড়িতে উঠে এল। রঞ্জনের জন্যই অসীমা ভাড়া বাড়িতে এসে স্বপ্ন দেখত নিজেদের বাড়ির। রঞ্জনের পরিবারের অন্যান্য লোকেরা কষ্ট পেয়েছিল অসীমার আচরণে। রঞ্জনের মা কিছু বুঝতে না পেরে অসীমাকে বলেছিলেন, ‘ছোটো বাড়ি মা, একদিন এতটা ছোটো মনে হবে না। মেয়ের বিয়ে হয়ে যাবে। একটা ঘর ফাঁকা। তোমার যদি মনে হয় তুমি ওই ঘরটাও ব্যবহার করতে পারো। এভাবে চলে যেও না। সবাই একসঙ্গে থাকো, আনন্দে থাকো।’ কিন্তু অসীমা তখন অন্য জগতের মানুষ। দর্পে মাটিতে পা পড়ছে না।

অসীমা-রঞ্জন আলাদা সংসার পাতল। নতুন ভাড়া বাড়িতে যাওয়ার তিন-চার মাসের মধ্যে অসীমার বাবার স্ট্রোক হল। বাবা প্রতিমাসে মেয়েকে একটা থোক টাকা দিতেন, সেটা ঝপ করে বন্ধ হয়ে গেল। অসীমা মানিয়ে নিল, রঞ্জনের টাকাতেও তাদের দুজনের সংসার হেসেখেলে চলে যাচ্ছিল। রঞ্জন মা-বাবাকেও প্রতিমাসে কিছু টাকা দিতে চেয়েছিল। ওনারা সবিনয়ে তা ফিরিয়ে দিয়েছেন।

সে যাই হোক, রঞ্জন-ললিত মিলেমিশে উদ্যোগী হয়ে কাপড়ের ব্যাবসাটা ভালোই চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল। মাঝেমধ্যে দুই বন্ধু নিজেদের পরিবার নিয়ে একসঙ্গে বেড়াতে যাওয়া, ডিনার করা। বেশ কাটছিল। ললিতের মেয়েটা দারুণ ছটফটে। ললিতের বউ মেধা। বেশ নরম স্বভাবের মেয়ে। কিন্তু রঞ্জনের কথা অনুযায়ী খুব বুদ্ধিমতি ও হিসেবি। অসীমা নিজে বিএ পাশ। তাই প্রচ্ছন্ন গর্বও ছিল। মেধা বেশিদূর পড়েনি, স্কুলের গন্ডিও পেরোয়নি। একসাথে মেলামেশায় মেধা বুঝতে পারত অসীমা খুব অহংকারী। তবু অল্প সময়ের জন্য একসঙ্গে থাকা তাই খুব পছন্দের না হলেও মেয়েকে নিয়ে ব্যস্ত থাকত হাসি মুখে। এই বন্ধু জায়াকে রঞ্জন কিন্তু বেশ পছন্দ করত।

রঞ্জন-ললিতের ব্যাবসা বেশ তরতর করে এগিয়ে চলছিল। কারও জীবনে কোনও ছন্দপতন নেই। কিন্তু এভাবে চলতে চলতে একসময় সব কেমন অন্যরকম হয়ে গেল। দোকানটা সাধারণত সামলাত রঞ্জন। ললিত যেত অর্ডার আনতে। টাকা আনতে। এমনই কোনও একদিন সন্ধ্যাবেলায় এক বিদেশি অর্ডার নিয়ে মনের আনন্দে স্কুটারে দোকানের দিকে আসছিল। হঠাৎ একটা ট্রাক ব্রেকফেল করে ললিতের স্কুটার আর একটা গাড়িকে পুরো পিষে দিয়ে ধাক্বা মারল দেয়ালে।

মেধার কান্না, বিলাপ খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু রঞ্জনের কান্নাও যে চোখে দেখা যায় না। বন্ধুর জন্য এত হাহাকার। বারবার একই কথা, ‘ললিত, তুই প্রমিস করেছিলি দুজনে একসঙ্গে থাকব, পাশাপাশি বাড়ি বানাব, দুজনে ছোটো দুটো গাড়ি কিনব সব মিথ্যে, তুই মিথ্যুক ললিত। আমায় না বলে তুই চলে যেতে পারলি!’ দোকান বন্ধ করে রঞ্জন চুপচাপ বাড়িতে বসে থাকে। অসীমা অনেক বোঝায় কিন্তু কিছুই হয় না। বেশ অনেকটা সময় কেটে গেল রঞ্জনের বন্ধুশোক ভুলতে। বাস্তবে ফিরে আসতে গিয়ে প্রথম ধাক্বা খেল রঞ্জনের এক্সপোর্ট বিজনেসে। ললিত যে-অর্ডারটা নিয়ে স্কুটারে আসছিল তা ডেলিভারি দেওয়ার কথা ছিল দুসপ্তাহের মধ্যে। তা হয়নি। বিদেশি অর্ডার। অন্য কাউকে দিয়ে দিয়েছে কোম্পানি। বেশ বড়ো একটা ক্ষতি হয়ে গেল রঞ্জনের। বিদেশিদের কাছে একবার ব্ল্যাক লিস্টেড হয়ে গেলে পরবর্তী কাজ পাওয়া দুষ্কর। ললিতের কাজের দায়িত্ব এখন একাই বহন করতে হচ্ছে রঞ্জনকে, সে দিশাহারা।

এরপরেই রঞ্জনের ব্যাবসায় শুরু হল শনির দশা। দোকান কর্মচারীদের হাতে দিয়ে সারাদিন বাইরে থাকা। ক্ষতির পর ক্ষতি। লজ্জার মাথা খেয়ে বাবাকেও বলেছিল দোকানে বসার জন্য। উনি রাজি হননি। ফলে যা হবার তা হল। কর্মচারীরা সব ধুয়ে মুছে সাফ করে দিল অল্প দিনের মধ্যেই। ললিত-রঞ্জনের সংসারে নেমে এল অন্ধকারের ছায়া। দোকানটা বন্ধ হয়ে গেল।

বেশ বেলা হয়ে গেল, তবু অসীমা বাইরে এসে জলখাবার দিয়ে গেল না। রঞ্জন কয়েকবার হাঁকাহাঁকি করেও সাড়া পেল না, নিজে উঠে ভেতরে গিয়ে অবাক, রান্না ঘরেও নেই। গেল কোথায়! শোবার ঘরে গিয়ে দেখে অসীমা বিছানায়। চোখের কোনে জল, রঞ্জন অসীমার পাশে গিয়ে বসল। আলতো করে মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, ‘সীমা ওঠো, কখন আমায় আর গোপালকে জলখাবার দেবে। আজ প্রথম ও আমাদের বাড়িতে এসেছে, কী ভাবছে বলোতো। ঠিক আছে তুমি শুয়ে থাকো, আমি আর গোপাল সামনের দোকান থেকে কচুরি-তরকারি খেয়ে নিচ্ছি। তোমার জন্যও নিয়ে আসব।’ হঠাৎ অসীমা রঞ্জনের দিকে ঘুরে বসল, ‘আমি এই বাড়িতে আর থাকব না।’

‘কোথায় যাব? এত অগোছালো অবস্থায় রয়েছি আমরা। তুমি একটু ধৈর্য ধরো। যে-বাড়ি ছেড়ে মা-বাবাকে দূরে ঠেলে আমরা দুজনে চলে এসেছি, সেখানে কি আর ফিরে যাওয়া যায়!’ রঞ্জন কথাগুলো বলে কপালে হাত দিয়ে নিরাশ ভঙ্গিতে বসে পড়ল। অসীমা বলে, ‘তুমি জানো না,  ছেলেমেয়েরা যতই অন্যায় অবুঝ কাজ করুক না কেন, মা-বাবা দুঃখ পেলেও তাদের কখনওই মন থেকে দূরে ঠেলে না। প্রতিদিন ঈশ্বরের কাছে তাদের মঙ্গল কামনাই করে। তুমি মা-বাবার কাছে যাও। আমরা ওই বাড়িতেই ফিরে যাব।’

‘তা হয় না সীমা। যেদিন আবার আমার ব্যাবসা ঠিকঠাক চলবে, আমরা হইচই করে সেদিন আবার ও বাড়ি যাব। অসীমা কিছু না বলে একটু মুখ বেঁকিয়ে চলে গেল। রঞ্জন শুনতে পেল, ‘যার বাড়ি ভাড়া তিন মাস বাকি, সে আবার দোকান চালানোর স্বপ্ন দেখে, বড়ো ব্যবসাদার হবে। কিচ্ছু হবে না।’

রঞ্জন কেমন যেন চুপ মেরে গেল। জীবনের প্রতিকূল সময়ে তার সীমা আজ কোথায় তাকে সাহস জোগাবে তা না, আরও নিরাশ করে দিচ্ছে। রঞ্জনের মনটা বেশ খারাপ হয়ে গেল। সে তো এমনটা চায়নি। সে অসীমাকে ভালোবেসে বিয়ে করেছে। কত বছরের প্রেম, বড়োলোকের মেয়ে। রঞ্জন সবার সঙ্গে মিলেমিশেই থাকতে চেয়েছিল। কিন্তু যেদিন অসীমা একবাড়ি লোকের সামনে উঁচু গলায় টাকার কথা বলেছিল, সেদিনই তো বাবা তাকে ডেকে নিয়ে আড়ালে বুঝিয়ে বলেছিলেন, ‘সবার আগে সম্মান, শান্তি। এই বাড়িতে সবাই আমরা শান্তিতে সম্মান নিয়ে বাঁচি। এমন কথা কেউ কোনওদিন বলেনি যাতে অন্যের মর্যাদা ক্ষুণ্ণ হয়। হ্যাঁ, ঝগড়া হয় তবে তা মনে দাগ কাটার মতন নয়। ওটা তো বাসনে বাসনে ঠোকাঠুকির মতন। কিন্তু আত্মসম্মান বোধে আঘাত দিয়ে কথা এ বাড়িতে কেউ কাউকে বলে না। আজ বউমা যা বলল, তুমি যদি সুসম্পর্ক বজায় রাখতে চাও, বউমাকে নিয়ে আলাদা হয়ে যাও কারণ ওর দায়িত্ব তোমারই। আমরা তোমার ভালো চাই। তুমি আমাদেরই সন্তান। তোমার মঙ্গল হোক।’ বাবার এই কথার পর রঞ্জন একটা কথাও বলেনি। ও বাড়ি বদল করেছিল।

পরের দিন রঞ্জন সকাল-সকাল উঠে স্নান করে নিল। সাড়ে ন’টা নাগাদ গোপাল এসে ডাকতেই রঞ্জন হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে গেল, অসীমাকে কিছুই বলল না। বাড়ি থেকে বেরিয়ে দু’বন্ধু গেল ব্যাংকে। গোপালের জানাশোনা। গোপাল ছোটোবেলার বন্ধু। যোগাযোগ ছিল না, গত মাসেই হঠাৎ দেখা তারপর কত গল্প, স্মৃতিচারণ, কেউ কাউকে ছাড়তেই চায় না। কথায় কথায় গোপাল জানাল ও কাপড়ের ব্যাবসা করে। সোজাসুজি আহমেদাবাদ থেকে কাপড়ের রিল আনায়, তারপর ব্লিচ করে বিভিন্ন দোকানে রঙিন থান শাড়ির অর্ডার সাপ্লাই করে। বেশ ভালো লাভজনক ব্যাবসা। রঞ্জন ইতস্তত করে গোপালকে তার দুরাবস্থার কথা, ব্যাবসায়ে ক্ষতির কথা জানাল। গোপাল কথা দিয়েছিল রঞ্জনকে সে সাধ্যমতন সাহায্য করবে। এজন্যই তাদের আজ ব্যাংকে আসা।

সকালবেলাই রঞ্জন কোথায় গেল, ভাবতে গিয়ে অসীমার সব কাজে বেশ দেরি হল। চা বানিয়ে নিয়ে বসতে গিয়েই শুনতে পেল দরজায় ধাক্বার শব্দ, সঙ্গে কথা বলারও আওয়াজ। অসীমা বুঝল রঞ্জনের সঙ্গে কেউ আছে কিন্তু দরজা খুলে যাকে দেখল, চমকে গেল, মেধা। ভিতরে আসতে বলল। মেধাকে বেশ রোগা লাগছে, মুখটা শুকনো। অসীমা ওদেরকে চা দিল, মেধা চা নিয়ে অল্প হেসে অসীমাকে জিজ্ঞাসা করল, ‘কেমন আছ?’  অসীমা শুকনো গলায় বলল, ‘দেখতেই পাচ্ছ। থাকা আর না থাকা সমান। নুন আনতে পান্তা ফুরোচ্ছে।’ রঞ্জন দুজনের এই কথোপকথনে মাথা হেঁট করে বসে চা খেতে লাগল। এক দমবন্ধ করা পরিবেশ সৃষ্টি হয়ে রইল।

সবাই চা শেষ করলে অসীমা চায়ের কাপ নিয়ে উঠতে উদ্যোগী হতেই মেধা নীরবতা ভাঙল। ‘ললিত চলে যাওয়াতে শুধু আমরা নই, তোমরাও বেশ অসুবিধার সামনে পড়ে গেছ। মনে হয় সবাই মিলে যদি এই ব্যাবসাটাই আবার অন্যভাবে শুরু করি।’

অসীমা রঞ্জনের দিকে তাকাল। ওরা দুজনেই ভেবেছিল মেধা হয়তো ললিতের ভাগের টাকাটা চাইতে এসেছে। কিন্তু মেধার উদ্দেশ্য শুনে দুজনেই চুপচাপ। মেধা আবার বলতে শুরু করল, ‘নিজের খরচ কমালেও বাচ্চাটার খরচ তো কমানো যায় না। তাই ভাবছি আমার তো তিনটে ঘর, যদি একটা ঘরে একজন সেলাই জানা লোক রেখে কাজ করাই আর কাঁচামাল তো রঞ্জনদাই আনবে, তাহলে বোধহয় দুটো সংসারেই সাশ্রয় হবে।’ রঞ্জন বা অসীমা কেউ-ই মেধাদের কথা ভাবেনি। নিজেদের অস্তিত্ব নিয়েই ব্যস্ত ছিল। কিন্তু মেধার চিন্তা ভাবনা ওদের দুজনের মাথা হেঁট করিয়ে দিল। গোপালের সঙ্গে ব্যাংকে গিয়ে মোটামুটি একটা ব্যবস্থা হয়েছে। তাছাড়া গোপালও বলেছে যদি যৌথ ব্যাবসায় উদ্যোগী হয় তারা দুজনে মিলে। মেধার ভাবনাচিন্তা রঞ্জনকে আরও বেশি উসকে দিল কাপড়ের ব্যাবসার দিকে। রঞ্জন-গোপাল-মেধা আর যদি অসীমাও তার সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয় এই কাজে তাহলে আর বাইরে থেকে লোক রাখতে হয় না। কথামতন কাজ, রঞ্জনের উৎসাহ সব থেকে বেশি। রঞ্জন হঠাৎই ভাবল, কেন অসীমা এমনভাবে ভাবল না! মেধা ললিতের পথে হাঁটতে অর্থাৎ ব্যাবসা করতেই আগ্রহী। আর অসীমা, উৎসাহ তো দেয়ই না উলটে রাগ ঝগড়া। রঞ্জনের মধ্যে এক দোলাচল শুরু হয়। মেধা জানে, ভালোবাসা মানে সবসময় পাশে পাশে সশরীরে থাকতে হবে তার কোনও মানে নেই। তার অবর্তমানেও তারই ধ্যানধারণা নিয়ে চলাই ভালোবাসা। জীবনের সঠিক জীবনসঙ্গী সে-ই, যে এটা উপলব্ধি করতে পেরেছে। ললিত আজ নেই তবু মেধা চলতে চাইছে ললিতেরই স্বপ্নকে বাস্তব করতে।

রঞ্জন মেধাকে বলল, ‘অসীমাও তোমার সঙ্গে কাজের দেখভাল করবে। তিনজনে মিলে আর গোপালের সাহায্যে আমরা আগের মতন গড়ে তুলব। আমাদের ব্যাবসা ঠিক দাঁড়িয়ে যাবে।’ তাকিয়ে দেখল অসীমা হাসছে, চোখে জল।

অসীমা এতদিনে বুঝতে পারল শুধু টাকা-সম্পত্তি জীবনের শেষ কথা নয়। মানুষের জন্য মানুষের এগিয়ে আসা, দুঃসময়ে তার পাশে থাকা, মানবিকতার হাত এগিয়ে দেওয়াতেই চরম সুখ। অল্পশিক্ষিত মেধার যে সহজাত বুদ্ধি ও তৎপরতা আছে, কলেজ পাঠ শেষ করা অসীমার মধ্যে সেই বোধের অস্তিত্ব ছিল না এতদিন। অসীমা আজ নিজেকে নতুন করে আবিষ্কার করল।

 

ইতি ঊর্মি

সকাল এখন আটটা। ব্রেকফাস্ট টেবিলে আমার বিপরীতে অমর। আমাদের সংসারের তৃতীয়জন অর্থাৎ ঊর্মি আজ টেবিলে নেই। ঊর্মির কথা মনে পড়তেই ল্যান্ডফোন বিশেষ সুরে বেজে ওঠে। ফোন ধরতেই ও-প্রান্ত থেকে ব্যারিটোন ভেসে আসে এটা কি ঊর্মি দাশগুপ্তর বাড়ি?

—হ্যাঁ, বলছি, জবাব দিই আমি।

—আপনি?

—ওর মা, মিসেস দাশগুপ্ত।

—শুনুন মিসেস দাশগুপ্ত, ময়দান থানা থেকে বলছি, আপনার মেয়েকে সেন্সলেস অবস্থায় ময়দানে পাওয়া গেছে। ওকে আমরা উডল্যান্ডসে ভর্তি করিয়েছি। পকেটে ভাগ্যিস মোবাইলটা ছিল। ওটা থেকেই আপনাদের নম্বর পেলাম। শিগগির একবার নার্সিংহোমে আসুন।

লাইন কেটে যায়।

পুরো ঘটনাটা ভালো করে বুঝে উঠতে আমার বেশ কিছুটা সময় লাগে। গতকাল রাতে ঊর্মি বাড়ি ফেরেনি। থানা, পুলিশ, নার্সিংহোম শব্দগুলি একসঙ্গে আমাকে কিংকর্তব্যবিমূঢ় করে ফেলে। আমি ঘামতে থাকি। ইদানীং সামান্য উত্তেজনাতেই প্রেসারটা বেড়ে যায়।

বিপরীতে বসে থাকা অমর নির্বিকার চিত্তে টোস্টে একটা কামড় বসিয়ে কফির মধ্যে ঠোঁট ছোঁয়ায়। মাথাটা ঝাঁ করে জ্বলে ওঠে। হাতে থাকা স্যান্ডউচটা ধাঁই করে ছুড়ে মারি ওর মুখে। আচমকা আঘাতে অমর ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়। চলকে পড়ে কফি। থতমত খেয়ে বলে, কী-কী মানে কী হল!

—কী হল! তোমার মেয়েকে ময়দানে আনকনসাস অবস্থায় পুলিশ পেয়েছে। ওকে ওরা উডল্যান্ডসে ভর্তি করেছে।

—সে কী! বিস্ময়ে চোখ কপালে ওঠে ওর। বলে, চলো চলো, এক্ষুনি চলো। তাড়াহুড়ো করে উঠতে গিয়ে অমর টেবিলে এমন জোরে ধাক্কা মারে যে টেবিলের কফিমাগ, ব্রেড, ডিমের পোচ, জলের জাগ, ইত্যাদি ছিটকে পড়ে আমার গায়ে।

রাগে পিত্তি জ্বলে যায় আমার। এখন ঝগড়াঝাঁটির সময় নয়। দাঁত কিড়মিড় করে কেবল বলি, আচ্ছা অপদার্থ ব্যাটাছেলে একটা!

—বেবি, ইয়ে মানে, কিছু মনে কোরো না, আমি ইচ্ছে করে…, ঘাবড়ে গেলে তোতলানো অমরের পুরোনো অভ্যাস।

—চোপ, একদম চোপ। এক্ষুনি তৈরি হয়ে নাও। গ্যারাজ থেকে গাড়ি বার করো। আর হ্যাঁ, তোমার ক্রেডিট কার্ড, ঊর্মির মেডিক্লেম কার্ডটা নিতে ভুলো না। যাও শিগগির।

—হ্যাঁ, হ্যাঁ, এই যে যাই, ধ্যাতানি খেয়ে অমর ছোটে। আমিও তৈরি হয়ে নিই চটপট! এমন একটা মানুষের সঙ্গে জীবন কাটানো সম্ভব? অমরটা চিরকাল নার্ভাস। কোনও ঘটনা ফেস করার মতন মানসিক জোর নেই। কী করে অফিস সামলায় কে জানে? ইদানীং একটু ঘাবড়ে গেলেই হুইস্কি নেয়। আর হুইস্কি পান করে আরও বোদাটে মেরে যায়। মাথা একদম কাজ করে না। তখন বলে, বেবি, প্লিজ ডু সামথিং। কী করব বুঝে উঠতে পারছি না। হাত-পা কেমন ঠান্ডা মেরে যাচ্ছে। একটা যা তা।

গাড়ি ড্রাইভ করতে করতে অমর বলে, বেবি, ঊর্মির ইন ফ্যাক্ট কী হয়েছে বলল পুলিশ?

—বলল, ওকে আনকনসাস অবস্থায় ময়দানে আজ ভোরে পাওয়া গেছে। নিশ্চয়ই ভালো কিছু ঘটেনি, জবাব দিই আমি।

অমর খানিক থম মেরে থেকে আচমকা উত্তেজিত কণ্ঠে চেঁচিয়ে ওঠে, এইসব, সবকিছুর জন্য তুমি দায়ী। তুমিই মেয়েটাকে জাহান্নমে পাঠাচ্ছ। উত্তেজনায় লাল হয়ে ওঠে মুখ-চোখ।

আমারও মাথা গরম হয়ে যায়, মুখ সামলে কথা বলো অমর। সাবধানে গাড়ি চালাও। ইদানীং মাঝেমধ্যেই ও কেমন বেপরোয়া ভঙ্গিতে জ্বলে উঠছে। বিয়ের পর প্রথম প্রথম এরকম করত। একবার শ্যামলদাকে দিয়ে আচ্ছা করে কড়কে দিয়েছিলাম। এতদিন ঠিক ছিল। আবার বিগড়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে ওই উকিল বন্ধুটাই মাথা খাচ্ছে ওর। কী সাম চ্যাটার্জী যেন। ওটাকে একটু সাইজ করতে হবে।

গাড়ি পার্কিং লটে দাঁড় করিয়ে ছুটে যাই আমরা। দেখি ক্যালকাটা পুলিশের এক সাবইন্সপেক্টর আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে। সামনাসামনি আসতেই বলল, আপনারা মি. অ্যান্ড মিসেস…

—দাশগুপ্ত, কথা শেষ করি আমি, হোয্যার ইজ আওয়ার চাইল্ড?

—আসুন আমার সঙ্গে, বলে অফিসার লিফটের দিকে এগোন। ওকে অনুসরণ করে একটি কেবিনের সামনে পৌঁছোই, উনি ইঙ্গিতে বোঝান ওটাই ঊর্মির কেবিন। ধন্যবাদ দিয়ে দরজা ঠেলে ঢুকে দেখি ঊর্মি আনকনসাস। পাশে একটি নার্স বসে। আমাদের দেখে উঠে দাঁড়ায়।

দ্রুত ঊর্মির সামনে যাই। ঠোঁট ফুলে উঠেছে, নীলচে বাদামি জমাট রক্ত। গালে, গলায় দাঁতের দাগ, বুঝতে বাকি থাকে না কিছু। অমরের দিকে তাকাই।

—ঊর্মি, মাই চাইল্ড, হাউমাউ করে কেঁদে ঝাঁপিয়ে পড়ে অমর ওর বুকে। কাঁদতে থাকে অবুঝ শিশুর মতো। ওকে টেনে সরিয়ে আনার চেষ্টা করি। নার্স বলে ওঠে, আরে আরে করছেন কী, শি নিডস কমপ্লিট রেস্ট। আপনারা ডক্টরের সঙ্গে দেখা করুন।

—কে দেখছেন ওকে? আমি প্রশ্ন করি। অমর চোখের জল মোছে। ডক্টর সোম। আসুন আমার সঙ্গে, নার্স এগিয়ে যায়। সোম-এর ঘরে নিয়ে গিয়ে প্রাথমিক পরিচয়টুকু দিয়ে ও চলে যায়।

—প্লিজ বি সিটেড। ডক্টর সোম বলেন, আচ্ছা, মি. দাশগুপ্ত, আপনার মেয়ে কোনও ড্রাগস নিত?

অমর বা আমি কেউই এ প্রশ্নের জন্য তৈরি ছিলাম না। দুজনে দুজনার মুখের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালাম। উত্তর আমিই দিলাম, না, সেরকম তো কোনওদিন দেখিনি। এ প্রশ্ন করছেন কেন?

—মেয়েটি ডেডলি আনকনসাস। ওর ব্লাড স্যাম্পল নিয়ে টেস্টের জন্য পাঠিয়েছি। প্রাথমিক পর্যায় জানা গেছে কোনও উচ্চ ক্ষমতাযুক্ত ড্রাগ ওর শরীরে মারাত্মক প্রভাব ফেলেছে। ড্রাগটা ল্যাবে আইডেন্টিফাই করার চেষ্টা চলছে।

—বললাম, আপনি ডাক্তার, আপনার কাছে কিছু লুকোনো উচিত নয়। ইদানীং ঊর্মি ড্রিংকস নিত একটু আধটু। তবে ড্রাগস যে নিত না সে ব্যাপারে আমি শিওর।

—খোঁজ নিন ভালো করে। ওর ঘর সার্চ করুন। বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে কথা বলে দেখুন। আজকালকার হাইপ্রোফাইল অ্যাফ্লুয়েনট ঘরের ছেলেমেয়েরা প্রায়ই এইসব নেশার কবলে পড়ে জীবন শেষ করে ফেলছে। মনে রাখবেন, ইয়োর চাইল্ড ইজ দ্যা মোস্ট প্রেশাস ব্লেসিং অন ইউ। একটা বাচ্চার জন্য চাইল্ডলেস কাপলসরা কী মর্মবেদনায় জ্বলে পুড়ে মরছেন তা তো দেখছি।

আমি চুপ করে থাকি। অমরের অবস্থা বুঝি এক্ষুনি ফেটে পড়বে। ইদানীং আবেগটাবেগ একদম চেপে রাখতে পারে না। স্থান কাল পাত্র বিবেচনা না করেই বার্স্ট করে, অত্যধিক অ্যালকোহল ইনটেকের ফল। কিন্তু মনে যে আশঙ্কা উঁকি মারছে সেটা সম্বন্ধে নিঃসন্দেহ হওয়া প্রয়োজন। বলি, ইজ শি ওকে অ্যাজ আ উয়োম্যান?

ডক্টর সোম কঠিন স্বরে বলেন, আই অ্যাম সরি টু সে মিসেস দাশগুপ্ত, শি ওয়াজ ব্রুটালি রেপড অ্যাজ অ্যান আনফ্রেমড প্রপার্টি। সম্ভবত, বাই আ গ্যাং অফ পার্সনস। আওয়ার এগজামিনেশন ইজ গোয়িং অন।

—ওহ্ মাই গড! শোনামাত্র অমর চেঁচিয়ে ওঠে পাগলের মতো। দুহাতে মুখ ঢাকে। আমার পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যায়। আমার মেয়ে এত বড়ো বোকামি করল? কিন্তু কেন? আমারই মতো ফাস্ট লাইফ চায় ও। হ্যাঁ, ওর চাওয়াকে প্রশ্রয় দিয়েছি আমি। তবে সেজন্য প্রয়োজনীয় সাবধানতা নিতেও কি শেখাইনি ওকে? অমরটা কেঁদেই চলে।

—শান্ত হোন, এ সময় ভেঙে পড়লে চলবে না। ডক্টর সোম বলেন, থানায় যান। পুলিশের সঙ্গে কো-অপারেট করুন। ইয়োর কেস হ্যাজ অলরেডি বিন লজড।

মাথা ঠান্ডা রেখে বললাম, এখন আমাদের কী করণীয়?

—মেডিক্লেম কার্ড আছে নিশ্চয়ই? ওটা রেখে যান, সঙ্গে আপনাদের ভিজিটিং কার্ড। অমর ওগুলি এগিয়ে দেয়, ফের দুহাতে মুখ ঢাকে। বলে, উফ্ আমি, আমি ভাবতে পারছি না।

ডক্টর সোম এগিয়ে এলেন। অমরের কাঁধে হাত রেখে বললেন, ভেঙে পড়বেন না মি. দাশগুপ্ত। ঘটনা এর থেকেও খারাপ হতে পারত। মেয়েকে ফেরত না-ও পেতে পারতেন। দুষ্কৃতিরা ওকে বিক্রি করে দিতে পারত। কিংবা শরীর থেকে অপারেট করে কিডনি, আই, ব্লাড ইত্যাদি বের করে নিতে পারত। ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দিন সেসব কিছুই ঘটেনি। মেয়েকে ফিরে পেয়েছেন আপনারা। নাও প্লিজ গো হোম, অ্যান্ড কিপ ক্লোজ কনট্যাক্ট উইথ আস। ওর জ্ঞান আসলে জানানো হবে।

ডক্টর সোমকে ধন্যবাদ জানিয়ে অমর আর আমি থানা হয়ে বাড়ি ফিরে এলাম। মানসিক ভাবে দারুণ বিপর্যস্ত আমি। ঊর্মির এই মারাত্মক পরিণতিটা মন থেকে কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলাম না।

একটু আগে সন্ধ্যা নেমেছে। এইমাত্র ডক্টর সোম ফোনে জানালেন যে, ঊর্মির জ্ঞান ফিরেছে। বারবার বাবার কথা বলছে। এক্ষুনি ওর চোখের সামনে দুএকটি প্রিয়জনের মুখ বড়ো প্রয়োজন।

সাধারণত অফিস ছাড়তে আমার আটটা-সাড়ে আটটা বাজে। কিন্তু এরকম ফোন পাওয়ার পর আর অফিসে থাকা সম্ভব নয়। গাড়ি নিয়ে দ্রুত নার্সিংহোমের দিকে রওনা দিই।

গাড়ির গতি বাড়ে। বুকটা হু হু করে ওঠে ঊর্মির জন্য। চোখের কোল ভিজে যায়। ওর এই পরিণতির জন্য কি আমি দায়ী? ওকে তো সব সময় বোঝাতাম আমি। তা ছাড়া নিজের ভালো-মন্দ বোঝার মতন বয়স ওর হয়েছে। একুশ বছর বয়স নেহাত কম নয়! মানুষ হতে গেলে যতটুকু প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা প্রয়োজন তাতে খামতি ছিল না। তবু মেয়েটা এমন বেপরোয়া হয়ে উঠল কেন?

—আচ্ছা বেবির কি উচিত ছিল না, একটু সংযত জীবন যাপন করা? নারীমুক্তি নারী স্বাধীনতায় ও বিশ্বাসী। স্বেচ্ছাচারিতাকে ও পলিশড স্বাধীনতার মোড়কে মুড়ে নিয়েছে। মায়ের অসংযত জীবনযাত্রা কি ঊর্মির মনে কোনও প্রভাব ফেলেনি? নিশ্চয়ই ফেলেছে। মা হিসাবে কতটুকু কর্তব্য করেছে বেবি? সেই ছোট্টবেলা থেকে তো মেট্রনের দাযিত্বে বাচ্চা। মাত্র চার মাসের বাচ্চাকে ফেলে অফিস জয়েন করেছিল, আমার বারংবার বারণ সত্ত্বেও। তিন বছর বয়স থেকেই ও ক্রেশে। ক্লাস ওয়ান থেকে রেসিডেন্সিয়াল স্কুলে। বন্ডিংটা তৈরি হবে আর কী করে?

গাড়িটা পার্কিং লটে রেখে চারতলায় ঊর্মির কেবিনে যাই। দরজা ঠেলে ঢুকতেই ঊর্মি, আমার দিকে তাকাল, অস্ফুটে উচ্চারণ করলে, বাপী। বলেই জ্ঞান হারাল।

দ্রুত ওর কাছে যাই। মাথায় হাত বুলোতে থাকি। চোখ দুটো আমার কেন যে এত অবাধ্য?

কতক্ষণ এভাবে কাটে জানি না। ঈশ্বরকে ডাকি, ভগবান, ওকে সুস্থ করে তোলো তুমি। নার্সের তাগাদায় বাইরে আসি। ডক্টর সোমের চেম্বারে যাই। বসুন মি. দাশগুপ্ত, বলেন ভদ্রলোক। এখন কেমন বুঝছেন?

—বেটার দ্যান বিফোর। সকালে বেশ কয়েকবার জ্ঞান এসেছে এবং গেছে। সিডেটিভ দেওয়া হয়েছে মাইল্ড। আমরা চাইছি পেশেন্ট যতটা সম্ভব মেন্টাল রেস্টে থাক। জেগে উঠলেই আতঙ্কে চেঁচিয়ে উঠছে।

—ওর শরীরের ড্রাগটা আইডেন্টিফাই হয়েছে?

—হ্যাঁ, অতি পরিচিত একটা ওষুধ, কমনলি নোন অ্যাজ ক্লাব ড্রাগস। সম্ভবত ওর অজান্তেই ড্রিংকসে কেউ মিশিয়ে দিয়েছিল। শুনলাম ও সেদিন কলকাতার এক ডিসকো ঠেক-এ মাঝ রাত অবধি ছিল।

—ড্রাগটা কি খুব মারাত্মক?

—ইয়েস, ভিক্টিমের বিন্দুমাত্র বাধা দেবার ক্ষমতা থাকে না।

পুলিশ এসেছিল শুনলাম। আমি আবার প্রশ্ন করি।

—হ্যাঁ, ওরা তদন্তের স্বার্থে কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করছিল বলে শুনলাম। আমি তখন ছিলাম না, রাউন্ডে বেরিয়েছিলাম।

—ঊর্মির এ অবস্থায় ওদের অ্যালাউ করলেন কেন? অনুযোগ তীব্র হয় আমার।

—বারণ করে দিয়েছি, পেশেন্ট সম্পূর্ণ সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত ওরা আর ডিস্টার্ব করবে না, বললেন ডক্টর সোম।

—থ্যাংক ইউ ডক্টর।

—ইটস অল রাইট। মনে জোর রাখুন, সব ঠিক হয়ে যাবে। ইট ইজ আ গ্রেট শক ফর হার। শি নিডস প্রপার কাউন্সেলিং। ওকে শারীরিক ভাবে একটু সুস্থ করে সে ব্যবস্থা আমরা করব।

ডক্টর সোমের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ফের ঊর্মির কাছে যাই। ও এখনও অচেতন। মাথায় হাত বুলোই। নীরবে চোখের জল ফেলি। একসময় নার্সিংহামে ছেড়ে গাড়িতে এসে বসি। নিজেকে এত দুঃখিত, এত অসহায় আগে কখনও মনে হয়নি।

ড্রাইভ করতে করতে মনে হয়, ঊর্মিকে বড়ো করে তোলার ব্যাপারে কোথায় যেন একটা ফাঁক থেকে গেছে। আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্যের পিছনে ছুটতে ছুটতে সন্তানকে যথেষ্ট সময় দিতে পারিনি। যদিও মেয়ের এডুকেশনাল ব্যাপারগুলি বরাবরই বেবির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী হয়েছে। বেবির ইচ্ছাতেই ঊর্মি রেসিডেন্সিয়াল স্কুলে। ইউনিভার্সিটিতে পড়াকালীন গার্লস হস্টেলে। ঊর্মি ছুটিতে বাড়ি আসলে বেবি অসন্তুষ্ট হতো।

গাড়িটা ক্লাবে পার্ক করি। আজ আর কারুর সঙ্গে নয়, একা একাই মদ্যপান করব। কোনার দিকে এক টেবিলে বসে দুটি ড্রিংকসের অর্ডার দিই।

ড্রিংকস নিতে নিতে মনে হয়, আমি নিশ্চিত, ঊর্মির আজকের পরিণতির জন্য বেবিই দায়ী। হ্যাঁ ঠিক তাই, বেবিই দায়ী। একবার শক্ত হাতে হাল ধরতে গিয়ে যা অবস্থা হয়েছিল, ল্যাজে-গোবরে একদম। ক্যালকাটা পুলিশের কোন ইন্সপেক্টর নাকি ওর দাদা, সেই দিনটার কথা ভাবলে আজও গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। কী অপমান!

শালা, এমন হড়কানি দিল, পিলে চমকে যাবার জোগাড়। ব্যাটা বলে কিনা, মি. দাশগুপ্ত, আপনার স্ত্রী যে কমপ্লেন দিয়েছেন তাতে এক্ষুনি ফোরনাইনটি এইট-এ ধারায় কেস স্টার্ট করতে পারি, সেটা জানেন কি? অ্যারেস্ট করে আজ সারা রাত লকআপে রাখব, কাল কোর্টে চালান করব। নব্বই দিনের আগে জামিন পাবেন না। আর উনি আমাকে আপনার সম্পর্কে যা যা বললেন, তা যদি কোর্টে বলেন, কম সে কম বছর দশেক জেলের ঘানি ঘোরাতে হবে। যাবেন নাকি?

—কোথায়? সভয়ে প্রশ্ন করি আমি।

—ঘানি টানতে?

আমি চুপ করে থাকি। লজ্জায় মনে হচ্ছে, গলায় দড়ি দিই। নিজের স্ত্রী তার স্বামীর বিরুদ্ধে… উফ্ ভগবান!

শালা আইসি বলে, স্ত্রীকে আর ডিস্টার্ব করবেন না। ওকে ঘাঁটালে কী হতে পারে বুঝতে পারছেন নিশ্চয়ই? যান, বাড়ি যান এখন। কমপ্লেনটা আমার কাছে থাকল, দেখবেন এটা যেন আমাকে ব্যবহার করতে না হয়।

ধ্যাতানি খেয়ে গরুচোরের মতো বাড়ি ফিরে এসেছিলাম সেদিন। সেই থেকে আর কোনওদিন বেবির সঙ্গে আমার সংঘর্ষ হয়নি। আমি আমার মতো থাকি, ও ওর মতো। বেবি কী একটা এনজিও চালায়। তাছাড়া নানারকম মিটিং-ফিটিং নিয়ে ব্যস্ত থাকে। বছর খানেক কথাবার্তা বন্ধ ছিল। পরে বন্ধুবান্ধব, লোকজনের নিন্দামন্দের কথা ভেবে আমাকে আপস করতে হল, বিশেষ করে ঊর্মির মুখ চেয়ে। ঊর্মি তুই কি বুঝবি না মা, আমার যন্ত্রণার কথা? এই নীরব রক্তক্ষরণের কথা? চোখ ফেটে জল আসে আমার।

—স্যার, আর কিছু? দেখলাম অর্ডার নেওয়ার জন্য ছেলেটি আগ্রহী চোখে তাকিয়ে টু মোর প্লিজ, জবাব দিলাম আমি। বেয়ারা সোডা বরফ মিশিয়ে ড্রিংকস তৈরি করে দিল। গেলাসে ঠোঁট ঠেকাই আমি। আমার মনে হয়, বেবির সঙ্গে দাম্পত্যের এই ফাটলের প্রভাব আমি কোনওদিন ঊর্মির ওপর পড়তে দিইনি। আমার কর্পোরেট লাইফের তুমুল ব্যস্ততার মধ্যেও যখন যতটা পেরেছি সময় দিয়েছি ওকে।

আশ্চর্য! গত তিন-চার বছরে ঊর্মি কত দ্রুত বদলে গেল! যা সব বন্ধুবান্ধব জুটল। কী তাদের অদ্ভুত সাজগোজ, কানে দুল, নাকে দুল, চুলে রং। ঊর্মিকে কত বুঝিয়েছি, যে-ফাস্ট লাইফ তুমি লিড করছ, ইটস নট অফ ইয়োর কালচার। টেক ইয়োর লাইফ সিরিয়াসলি, সব সময় সাবধানে থাকবে। একজন প্রাপ্তবয়স্কা মেয়েকে বাবা হিসাবে এর বেশি আর কী বলা যায়?

বছর খানেক হল ঊর্মি কেন সাইলেন্ট হয়ে গেছিল। প্রশ্ন করলে কোনও উত্তর দিত না। বকাবকি করলেও কোনও প্রতিক্রিয়া ছিল না। কেবলই হাত খরচের টাকা বাড়াতে বলত। একুশ বছরের একটি মেয়ের পাঁচ হাজার টাকা হাত খরচে পোষায় না? কী করে ও অত টাকা নিয়ে একটা কল সেন্টারে কাজ করে, শুনেছি। ওখানে মাইনেপত্তর ভালো। এত টাকা উড়িয়ে কী সুখের সন্ধানে তুই মেতে ছিলি মা? একটিবার আমার কথা ভাবলি না?

কিন্তু সেদিন ডিসকো ঠেক-এ ঊর্মিকে কারা নিয়ে গিয়েছিল? কে ওর ড্রিংকসে ক্লাব ড্রাগস মিশিয়েছিল? এভাবে কারা রেপ করল ওকে? পুলিশ কি পারবে কালপ্রিটগুলোকে ফিক্স আপ করতে? হাজার প্রশ্নেরা আমাকে তাড়া করে। পাগলা কুকুরের মতো আমার ভিতর ছুটতে থাকি আমি। উত্তেজনায় মদের মাত্রা বাড়ে। এক সময় সব কেমন জেবড়ে যায়।

শ্রদ্ধেয় বাবা ও মা,

এ চিঠি যখন তোমরা পাবে আমি তখন অনেক অনেক দূরে। এখন রাত্রি তিনটে। একটু আগে ঘুম ভেঙেছে। বোধ হয় ঘুমের ওষুধের ক্রিয়া শেষ। আজ ষষ্ঠ দিন। শরীরের ব্যথা অনেকটা কমেছে, বেশ সুস্থ বোধ করছি। কয়েকটি ক্ষত থেকে যাবে মনে হচ্ছে।

এ কয়দিনে আমাকে নিয়ে পেপারে যা লেখালেখি হয়েছে তাতে পাড়ায় মুখ দেখাতে পারব না। তাই এ-পাড়া ছেড়ে চলে যাব মনস্থ করেছি। যাবার আগে তোমাদের সব জানানো উচিত বলে লিখে যাচ্ছি এ চিঠি।

কীভাবে যে এত সব ঘটে গেল বুঝতে পারলাম না। রাত দশটা থেকে এগারোটার মধ্যে কোনও না কোনও পরিচিত মুখ পেয়ে যাব এই আশায় ডিসকো ঠেক-এ আমি গেছিলাম। এক পেগ হুইস্কি নেবার পর ইচ্ছা করল একটু নাচতে। ডান্স ফ্লোরে একটা ছেলে হেসে নাচতে ডাকে। ছেলেটা স্মার্ট। নাচতে নাচতেই পরিচয় দেয়, ওর নাম জাভেদ। নিউ মার্কেটে ওর নাকি লেদার গুডসের দোকান আছে।

নাচ শেষ করে একটু দম নেবার জন্য বসি। আর একটা পেগের অর্ডার দিই। আমার সামনে এক জোড়া ছেলে মেয়ে দারুণ নাচছিল। সম্ভবত সেই সময়ে পাশে থাকা চাপ দাড়িওলা লোকটা আমার ড্রিংকসে কিছু মিশিয়ে দিয়েছিল। আশ্চর্য, তাতে ড্রিংকসের স্বাদ, গন্ধ, বর্ণের বিন্দুমাত্র পরিবর্তন হয়নি।

পরের গান শুরুর মুহূর্তে আমার মনে হয়, মাথাটা কেমন ঝিমঝিম করছে। ক্রমশ বনবন করে ঘুরতে থাকে মাথাটা। দাঁড়িয়ে থাকা অসম্ভব হয়ে পড়ে। চোখের সামনে চারপাশ দ্রুত ঝাপসা হয়ে আসে। খেয়াল হয়, জাভেদ, পাশের চাপদাড়ি, আরও দু-তিনজন ছুটে এসেছে আমাকে সাহয্যের জন্য। ধরাধরি করে আমাকে কোথাও নিয়ে যেতে চায়। বিপদ বুঝতে পেরে আমি প্রাণপণে বাধা দিতে থাকি, চেঁচাতে থাকি, হেল্প, হেল্প। অনেক কিছু বলতে চেষ্টা করি। কিন্তু গলা দিয়ে কোনও শব্দ বের হয় না। টের পাই প্রতিরোধের সমস্ত শক্তি দ্রুত হারিয়ে ফেলছি। ছেলেগুলোর কথা কানে আসে ভাসা ভাসা, হঠ যাইয়ে হঠ যাইয়ে সামনে সে। মাই সিস্টার ইজ ফিলিং সিক।

আশ্চর্য! কেউ ওদের কোনও বাধা দিল না। সবাই নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত। যতদূর মনে পড়ে ওরা পাঁচজন আমাকে লিফটে করে নামিয়ে ধরাধরি করে একটা বড়ো গাড়িতে তোলে। বোলেরো কিংবা টাটা সুমো হতে পারে। একজন বলল, জলদি ভাগ হিয়াসে।

গাড়ি প্রচণ্ড গতিতে ছুটছিল। গাড়ির মধ্যেই ওরা আমার শরীর থেকে জামাকাপড় টেনেহিঁচড়ে খুলছিল হিংস্র ভাবে। জানোয়ারগুলো ক্ষুধার্ত নেকড়ের মতো কাড়াকাড়ি করে ছিড়েখুঁড়ে খেতে চাইছিল আমার দেহ। একজন জিন্সটা খোলার চেষ্টা করছিল। আমার বিন্দুমাত্র প্রতিরোধ ক্ষমতা তখন নেই। ক্রমশ জ্ঞান হারালাম। যখন জ্ঞান হল, দেখি আমি নার্সিংহোমে। পুরোপুরি শেষ হয়ে গেছি।

বাবা, তোমার যন্ত্রণা আমি বুঝি। এও বুঝি তুমি নিজেকে কতটা অসহায় বোধ করো। তোমার প্রতি আমার কোনও অভিযোগ নেই। তোমার আর মায়ের মধ্যে যে বিরাট এক শূন্যতা তা আমাকে বারবার কষ্ট দিয়ে এসেছে। জানি এতে তোমার কোনও দোষ নেই। কেন যে এত মদ খাও তাও বুঝেছি। তবে এত মদ খেও না বাবা। অন্তত আমার কথা ভেবে মদ খাওয়াটা কমাও।

আমার দুঃখ কেবল একটাই তোমরা আমার যন্ত্রণার খোঁজ কখনও নাওনি। আমার মনে পড়ে না, তোমরা দুজন একসঙ্গে স্কুলে আমাকে দেখতে এসেছ কখনও। জীবনে কোনওদিন একসঙ্গে আমাকে বেড়াতে নিয়ে গেছ। যে কটা জন্মদিন পালন করেছ, সেগুলিও কেমন যেন মেকি, ফাঁকা ফাকা, এলোমেলো।

মা, তোমাকে বলি, আমাকে তুমি কোনওদিন ভালোবাসোনি। চিরকাল নিজেকেই ভালোবেসেছ। নিজের সুখ, নিজের ভোগ নিয়ে মত্ত থেকেছ। তোমার বহু ঘটনার সাক্ষী আমি নিজে। সেসব কথা এখানে লিখতে চাই না। তবে বলতে লজ্জা নেই, পুরুষের প্রতি আসক্তি তোমার আজও কমেনি।

মা, তুমি আমার জন্য যতটুকু করেছ তা কেবল মিনিমাম কর্তব্যবোধ। আমার এই ছোট্ট জীবনে যতটুকু উপলব্ধি করেছি তাতে মনে হয়, দাম্পত্যে যদি ভালোবাসা না থাকে সেক্ষেত্রে তাদের সন্তান নেওয়া কোনওদিনই উচিত নয়। তুমি এ ঘটনার পর যে কবার দেখা করতে এসেছ, কেবল একটা কথাই জিজ্ঞাসা করেছ, আমার মেয়ে হয়ে তুই এত বড়ো ভুল করলি কী করে? মা, কীভাবে তোমাকে বোঝাই যে, ইট ওয়াজ অ্যান অ্যাক্সিডেন্ট।

বাবা, তুমি চিরকালই আমাকে বড়ো ভালোবাসো। তবু চিরকালই কেন যেন আমি নিজেকে খুব একা বলে বোধ করেছি। আজ তোমার মধ্যে আমি নিজের অসহায়তা, একাকিত্ব, যন্ত্রণা সব উপলব্ধি করতে পারছি বাবা।

বাবা, কাল তুমি এসেছিলে। বারবার আমার হাতখানা ধরে বলেছ, তোকে বাঁচতে হবে মা, বাঁচতে হবে নতুন করে। এসব দুর্ঘটনা ভুলে, এ থেকে শিক্ষা নিয়ে উঠে দাঁড়াতে হবে তোকে। জীবনে তুই যত বড়ো পথ দেখেছিস, জীবন তার থেকে অনেক অনেক বড়ো।

নিজের ভুল আমি বুঝতে পেরেছি বাবা। বুঝেছি, মুহূর্তের অসাবধানতা আগুনের ফুলকির মতো জ্বালিয়েপুড়িয়ে ছারখার করে দিতে পারে জীবন। তবে আমি বাঁচব বাবা। অন্তত একটি বার প্রাণপণে বাঁচার চেষ্টা করব আমি।

এ মুহূর্তে আমার মুখময় অন্ধকার। এখানে থাকা আমার পক্ষে অসম্ভব। তাই এখান থেকে অনেক দূরে চলে যাচ্ছি আমি। কোনও নতুন শহরে নতুন করে জীবন গড়ে তুলতে চাই। যেখানে আমার চারপাশে থাকবে না কোনও পরিচিত লোকজন, থাকবে না এই কালিমাখা অতীত।

তোমরা আমার খোঁজ কোরো না। প্রয়োজনে আমিই তোমাদের খোঁজ নেব। বিদায়, ভালো থেকো তোমরা। বাবা, আমার জন্য চোখের জল ফেলো না। তোমার কথাকে সম্মান দিয়ে যদি নতুন করে নিজেকে গড়ে তুলতে পারি তবেই ফিরব, নতুবা নয়।

প্রণাম

ইতি,

তোমাদের ঊর্মি।

চিঠি শেষ। ভোরের আলো উঠি উঠি। ব্যাগ গোছানোই আছে। বাবা-মা নিশ্চয়ই এখন গভীর ঘুমে। বাড়ির পিছনের গেট খুলে নিঃশব্দে পথে নামে ঊর্মি।

ক্রমশ ভোর হচ্ছে। ভোর এত সুন্দর! এত স্নিগ্ধ! পাখিরা ডাকছে। সকালের প্রশান্তি তার হৃদয়ে ছড়িয়ে দিচ্ছে এক আশ্চর্য অনুভব। সামনে দূরের আকাশ, ক্রমশ লাল হয়ে উঠেছে ওটা।

মা

ক্রিং… ক্রিং… ক্রিং…

শোবার ঘর থেকে দৌড়ে এসে ফোনটা ধরে প্রিয়া।

‘হ্যালো।’

হ্যালো বলতেই অপরপ্রান্ত থেকে ভেসে ওঠে প্রিয়ার ছোটোপিসি সুশীলার গলা।

‘পিসি! এত রাতে ফোন করছ, কিছু হয়েছে নাকি?’

‘হয়েছে তো বটেই। কিন্তু তোকে যে কীভাবে বলি। শুনলেই তুই তো আবার রাগারাগি করবি। আমার উপরেই ঝাঁপিয়ে পড়বি। ব্যাপারটা কীভাবে নিবি কে জানে?’

‘দ্যাখো পিসি হেঁয়ালি ছাড়ো, পরিষ্কার করে বলো তো কী হয়েছে?’

বেশ ত্রস্তকণ্ঠেই সুশীলা বলে ওঠে, ‘প্রিয়া, একটু আগেই বড়দি ফোন করে বলল, দাদা নাকি আবার

বিয়ে করেছে।’

‘কী যা তা বলছ… মাথার ঠিক আছে তো তোমার?’

‘যা তা বলছি না রে। দিদিই নাকি কোনও এক ডিভোর্সি মহিলার সঙ্গে দাদার বিয়েটা দিয়েছে।’

এত রাতে ফোনের আওয়াজ শুনে বুকটা ধড়াস করে উঠেছিল প্রিয়ার। ভয় পেয়েছিল কোনও খারাপ সংবাদ নয়তো! তার ভাবনাটাই সত্যি হল, কোনও মৃত্যুসংবাদ না পেলেও এই বয়সে তার বাবার বিয়েটা তার কাছে মৃত্যুসংবাদের থেকে কম শকিং নয়। পিসির কাছ থেকে কথাটা শোনা মাত্রই হকচকিয়ে মাটিতেই বসে পড়েছিল প্রিয়া। এ তার কাছে এক বিশাল লজ্জার ঘটনা। শাশুড়ি, বড়ো-জা, ননদ এমনকী স্বামী নীলাদ্রিকেই বা কী করে মুখ দেখাবে। তাদের সকলের কাছে তো হাসির পাত্রী হয়ে দাঁড়াবে সে। একী করল বাবা। কিছুতেই নিজেকে সামলাতে পারছিল না প্রিয়া, অঝোর নয়নে কেঁদে চলেছিল।

প্রিয়ার বিয়ের সময়তেও তার বড়োপিসির এহেন কথার জন্য বেশ গোল বেধে গিয়েছিল বাড়িতে। প্রিয়া রেগেমেগে পিসিকে দু-চার কথা শুনিয়েও দিয়েছিল। আজ এতদিন পরে প্রিয়া হাড়েহাড়়ে টের পাচ্ছে ওই মহিলা সেদিন সেই মুহূর্তের জন্য চুপ করলেও মনে মনে বদ্ধপরিকর ছিল তার একাকী, নিঃসঙ্গ দাদার আবার বিয়ে দিয়েই ছাড়বে। মনে মনে পিসিকে দুষতে থাকে প্রিয়া। ‘পিসিকে না হয় ছেড়েই দেওয়া গেল, কিন্তু বাবা…! বাবা একবারও তার কথা ভাবল না। ভাবল না যে, এই ঘটনা তার বিবাহিত মেয়ের জীবনে কতটা প্রভাব ফেলবে? সবাই বলত বাবা নাকি মেয়ে অন্ত প্রাণ। তাহলে বাবা এমন অবিবেচক হল কেন? ভারি অভিমান হল প্রিয়ার।

সংসার বলতে তো ছিল চারটে প্রাণী। প্রিয়া, প্রিয়ার বাবা নরেনবাবু, মা মোহিনীদেবী এবং অন্ধ, বিকলাঙ্গ ভাই হেমেন। বাড়ির একমাত্র ছেলে এমন হওয়ায় সবার মধ্যে একটা চাপা কষ্ট ছিল ঠিকই, কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে মোহিনীদেবীর ভালোবাসা সংসারে যেন এক আশ্চর্য সুখশান্তির বাতাবরণ তৈরি করে রেখেছিল। কিন্তু সেই সুখের সংসারে হঠাৎই একদিন বাধ সেধে বসে এক মারণ ব্যাধি। ক্যানসারে আক্রান্ত হলেন মোহিনীদেবী। ব্যস, দু’বছরের মধ্যেই সব শেষ। তখন প্রিয়া তেরো আর হেমেন বছর নয়েকের। তারপর কেটে গেছে দশটা বছর। সময় তার নিয়মেই বয়ে গেছে। এরই মধ্যে বাবা-মেয়ে মিলে সংসারের সব দায়িত্ব সামলেছে। পাশাপাশি প্রিয়া স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেছে। বছর তিনেক হল একটি সম্ভ্রান্ত পরিবারে তার বিয়েও হয়েছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সবকিছু বদলালেও বদলায়নি মোহিনীদেবীর প্রতি সকলের ভালোবাসা।

তার নিজের বিয়ের পরেও কেটে গেছে তিন-তিনটে বছর। মাস আষ্টেকের একটি মেয়েও আছে। সবই তো ঠিক চলছিল। ভাইকেও বাড়ির পুরোনো কাজের লোক মিনতিদি বেশ যত্ন নিয়েই দেখাশোনা করছিল। তাহলে আজ কী এমন ঘটে গেল যে, এই বয়সে বাবাকে এমন হঠকারী সিদ্ধান্ত নিতে হল? এই কথাগুলি বেশ ভাবিয়ে তুলেছিল প্রিয়াকে।

অনেকক্ষণ প্রিয়া আসছে না দেখে ঘর থেকে নীলাদ্রি ডাকতে থাকে প্রিয়াকে। নীলাদ্রির ডাক শুনে সম্বিত ফিরে পায় প্রিয়া। কোনওরকমে চোখমুখ মুছে নিজেকে সামলে নিয়ে সাড়া দেয়, ‘হ্যাঁ আসছি। এক্ষুনি আসছি।’

প্রিয়াকে দেখেই চমকে ওঠে নীলাদ্রি। ‘কী হল এমন উদ্ভ্রান্ত দেখাচ্ছে কেন তোমায়, চোখ দুটো এত লাল লাগছে কেন? কেঁদেছ নাকি? কার ফোন এসেছিল?

নীলাদ্রির প্রশ্নের পর প্রশ্ন শুনে হাজার চেষ্টা সত্ত্বেও নিজেকে সামলাতে না পেরে নীলাদ্রিকে জড়িয়ে ধরে হাউহাউ করে কেঁদে ওঠে সে। শত চেষ্টা করেও কিছুতেই তার কান্না থামাতে পারে না নীলাদ্রি। খানিকবাদে প্রিয়া নিজেই ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলে, ‘জানো, বাবা আবার বিয়ে করেছে!’

অবিন্যস্ত, অগোছালো, বেদনাতুর প্রিয়াকে দেখেই নীলাদ্রি বুঝে গিয়েছিল আকাশে কালো মেঘের ঘনঘটা, সুতরাং বৃষ্টি তো নামারই ছিল। আকস্মিক এই ঘটনায় কিছুটা আশ্চর্য হলেও পরিস্থিতি সামলাতে ইয়ার্কির ছলে নীলাদ্রি বলে ওঠে, ‘সেকি বাবা বিয়ে করেছেন? এই বয়েসে? তা আমাদের নিমন্ত্রণ করলেন না কেন?’

রেগেমেগে প্রিয়া বলে ওঠে, ‘সবটাতে ইয়ার্কি ভালো লাগে না। ভেবে দেখেছ এরপর লোকের কাছে আমরা মুখ দেখাব কী করে?’

পরিস্থিতি হালকা করতে হাসতে হাসতে নীলাদ্রি বলে, ‘না দ্যাখো, সাদা চুলে টোপর পরে বাবাকে কেমন দেখতে লাগে, সেটা দেখার ইচ্ছে জাগাটা কি অন্যায় বলো? নাকি বাবা, বিয়ের আগে ডাই করেছিলেন কে জানে। কিছুই তো জানতে পারলাম না, জানলে না হয় একটু ফেসিয়াল, টেসিয়াল…’

নীলাদ্রির কথা শোনামাত্রই আরও জোরে কেঁদে ওঠে প্রিয়া।

‘আচ্ছা, আচ্ছা, সরি, বাবা আর ইয়ার্কি করব না, কিন্তু দ্যাখো ব্যাপারটা যখন ঘটেই গেছে তখন মেনে নেওয়াটাই কি…’

নীলাদ্রির কথার ইঙ্গিত বুঝেই একপ্রকার গর্জে ওঠে প্রিয়া। ‘তোমার সঙ্গে কথা বলাটাই আমার ভুল হয়েছে।’ এই বলে গজগজ করতে করতে ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য দরজার দিকে এগিয়ে যায় সে।

ভাবগতিক খারাপ দেখে পরিস্থিতি আয়ত্তে আনতে প্রিয়ার হাত ধরে টেনে বিছানায় বসায় নীলাদ্রি। নিজেও তার পাশে বসে তার হাত দুটি ধরে বলে, ‘আচ্ছা বলো তুমি এখন কী চাইছ?’

নীলাদ্রির এই স্নেহস্নিগ্ধ আচরণে প্রিয়ার চোখ জলে ভরে যায়। একটু শান্ত হয়ে বলে, ‘তুমি বলো বাবা এটা কী করল? একবারও আমার কথা ভাবল না। ভাবল না যে, এসব জানলে শ্বশুরবাড়িতে সবার কাছে আমি কতটা হাস্যকর হয়ে উঠব। শুধু তাই নয় বাবা যে দেখাত মার মৃত্যুর পরেও বাবা মাকে কতটা ভালোবাসে, বাবার পৃথিবী নাকি মায়ের স্মৃতি জুড়েই, তাহলে সবই লোক দেখানো, মিথ্যে!’

প্রিয়া কাঁদতে কাঁদতেই বলতে থাকে, ‘তুমি তো জানো আমি ওদের কতটা ভালোবাসি। আমার বিয়ের পর আমি কতটা চিন্তায় থাকতাম। ঘরের কাজ, বাইরের কাজ সব বাবাকে একা হাতে সামলাতে হতো। প্রথমে বাবাকে হেল্প করার মতো কেউ ছিল না। ভাইয়ের পক্ষে তো নিজেরটাই নিজের সামলানো সম্ভব নয়। কাজেই সবসময় ওদের জন্য চিন্তা হতো। তারপর পাশের বাড়ির রমামাসি ওদের গ্রাম থেকে মিনতিদিকে এনেছিল আমাদের বাড়িতে। ব্যস তারপর থেকে তো বাবাকে আর সংসারের দিকে তাকাতে হয়নি। তাহলে, আজ কেন এই ডিসিশন?’

কথার মধ্যেই নীলাদ্রি বলে ওঠে, ‘প্লিজ আর কেঁদো না। শরীর খারাপ করবে। একটু জল খাবে?’

একটু চুপ করে থেকে আবার বলতে শুরু করে প্রিয়া। ‘রোজকার মতো কালকেও দু’তিনবার ফোন করেছি বাবাকে। অথচ ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারিনি যে, বাবা এরকম একটা কাণ্ড ঘটাতে চলেছে। শুধু বলেছিল পিসির সঙ্গে নাকি কী দরকার আছে তাই পিসির বাড়ি যাবে। বাবার মনে এই ছিল!’

কথা বলতে বলতে দেয়াল ঘড়িটার দিকে চোখ যায় নীলাদ্রির। রাত আড়াইটে বেজে গেছে দেখে নীলাদ্রি বলে, ‘প্রিয়া অনেক রাত হয়েছে, কাল সকালে মিষ্টুর ভ্যাকসিনের ডেট আছে। শুয়ে পড়ো প্লিজ। একটু ঘুমিয়ে নাও। কাল না হয় যা হোক একটা…।’

মেয়ের কথা শুনে মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত প্রিয়া একটু স্থির হয়ে গা এলিয়ে দেয় বিছানায়। মেয়েকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ বলে ওঠে, ‘বাবার সঙ্গে আমি আর কোনও সম্পর্ক রাখব না। আমি জানব মার সঙ্গে সঙ্গে বাবাও এ পৃথিবী থেকে চলে গেছে।’

কথাগুলি শুনে নীলাদ্রি বলে, ‘ছিঃ প্রিয়া, উনি না তোমার বাবা। আজ না হয় একটা তোমার অপছন্দের কাজ করেছেন, কিন্তু এতদিন তো তাঁর কর্তব্য তিনি যথাযথ ভাবে পালন করে এসেছেন। সম্পর্ক রাখবে না মনে হলে রেখো না, কিন্তু এরকম বাজে কথা বোলো না। অনেক রাত হয়েছে, এবার ঘুমিয়ে পড়ো।’

নীলাদ্রি কিছুক্ষণের মধ্যে ঘুমিয়ে পড়লেও সারারাত প্রিয়া দু-চোখের পাতা এক করতে পারল না। দেখতে দেখতে রাত গড়িয়ে সকাল হয়ে এল। অন্যান্য দিনের মতোই বাড়ির সকলে যে-যার কাজে ব্যস্ত। শ্বশুর, ভাসুর অফিস যাবার জন্য আর শাশুড়ি, বড়ো-জা তাদের টিফিন, খেয়ে যাওয়ার রান্না নিয়েই ব্যস্ত। অন্যান্য দিন প্রিয়াও তাদের সঙ্গে এই কাজে হাত লাগায়, কিন্তু মেয়েকে নিয়ে ডাক্তারখানায় যাবার জন্য আজ তার হেঁশেল থেকে ছুটি। তাই সকালে প্রিয়াকে কারওরই মুখোমুখি হতে হল না।

তবে ওইটুকু সময়ের মধ্যেই সবার চোখকে ফাঁকি দিতে পারলেও শ্বাশুড়ি স্নিগ্ধাদেবীর চোখকে ফাঁকি দিতে পারল না প্রিয়া। ক্ষণিকের দেখাতেই তিনি প্রিয়ার চোখ-মুখ দেখে বুঝে গিয়েছিলেন, তাঁর প্রাণবন্ত, ফুটফুটে ছোটোবউমাটির কিছু একটা হয়েছে। সাধারণত শ্বাশুড়ি-বউয়ের সম্পর্ক কোনও দিনই মধুর হয় না। কিন্তু অবিশ্বাস্য শোনালেও প্রিয়া আর তার শ্বাশুড়ির সম্পর্ক ব্যতিক্রমীই বলা যেতে পারে। স্নিগ্ধাদেবীর কোনও মেয়ে না থাকার কারণে তিনি তাঁর দুই বউকেই মেয়ের মতো ভালোবাসেন, তবে ছোটোবউমা প্রিয়াকে একটু বেশিই স্নেহ করেন। ছটফটে, মিষ্টি স্বভাবের এই মেয়েটির, শাশুড়ির মন জয় করতে একটুও সময় লাগেনি। আর এই কারণেই বড়ো-জা সহেলির প্রচ্ছন্ন রাগও আছে। তবে সেটা মনে মনে। এমনিতে প্রিয়া আর বড়ো-জায়ের মধ্যে বেশ মিল, তবে মাঝেমধ্যে সংসারের নিয়মে যেমন ঘটি-বাটি ঠোকাঠুকি হয়, তেমনি আর কী। কিন্তু সেটা কোনওদিন বাড়াবাড়ির পর্যায়ে পৌঁছোয় না।

ডাক্তারখানা থেকে ফেরার পর থেকেই প্রিয়াকে চুপচাপ দেখে বড়ো-জা সহেলি তাকে ডেকে প্রশ্ন করল, ‘কী হয়েছে রে তোর? এত চুপচাপ আছিস যে!’

একটু চুপ থেকে প্রিয়া উত্তর দিল, ‘কই কিছু হয়নি তো, মাথাটা একটু ধরেছে এই যা।’

দুপুরবেলাতেও খাবার টেবিলে একই জিনিস, যে প্রিয়া একমুহূর্ত বকবক না করে থাকতে পারে না, সেই প্রিয়া এত শান্ত, অথচ আজ আবার নীলাদ্রিও বাড়িতে। অফিস যায়নি। বাড়ি থাকলে সারাক্ষণ দুজনের খুনশুটি চলতেই থাকে, খানিক বাদে বাদেই শাশুড়ির কাছে ছুটে যায় স্বামীর বিরূদ্ধে নালিশ করতে। আজ হঠাৎ করে তার স্বভাবে এতটা পরিবর্তন সত্যিই বাড়ির লোকের কাছে বিস্ময়কর বই-কি।

খাওয়া শেষ হতেই স্নিগ্ধাদেবী ছোটোছেলে আর বউমাকে ডেকে বললেন, ‘সত্যি করে বল তো তোদের কী হয়েছে রে? দ্যাখ সহেলির মতো আমাকে বোঝাতে যাস না। তোকে পেটে ধরেছি, আর ওকে পেটে না ধরলেও ওর শিরা-উপশিরা সব চিনি। কী হয়েছে বলে ফেল।’

ছলছলে চোখে মাথা হেঁট করে বসে থাকে প্রিয়া।

খানিক চুপ থেকে নীলাদ্রি বলে, ‘মা, ওর বাবা কাল হঠাৎ বিয়ে করে বসেছেন। তাই…।’

স্নিগ্ধাদেবী যথেষ্ট বুদ্ধিমতী মহিলা। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, ‘বউমা, তোমার রাগ হওয়াটা হয়তো স্বাভাবিক। কিন্তু একবার বাবার জায়গায় নিজেকে রেখে দ্যাখো তো, বাড়িতে বিকলাঙ্গ ছেলে, যে নিজেরটুকু নিজে করে নেওয়ার ক্ষমতা রাখে না, তার উপর অফিস, এই বয়সে একটা মানুষের পক্ষে কি সবদিক সামলানো সম্ভব? এতদিন তুমি ছিলে, দুজনে মিলে কোনওরকমে পরিস্থিতি সামলেছ, কিন্তু এখন তুমি নেই…।’

কথা শেষ হওয়ার আগেই জল ভর্তি চোখে প্রিয়া বলে ওঠে, ‘কিন্তু মিনতিদি তো আছে!’

‘হ্যাঁ আছে। কিন্তু সে তো আদপে একজন কাজের লোক ছাড়া কিছু নয়। তার উপর তুমিই তো বলতে, ইদানীং মিনতি মাঝেমাঝেই ছুটি নেয়। তাহলে সেই অবস্থাতে তিনি অফিস সামালাবেন না ঘর সামলাবেন। বাড়িতে কথা বলার কেউ নেই। সারাদিন পরিশ্রম করে আসার পর মুখের সামনে যে কেউ একগ্লাস জল ধরবে, সেরকমও কেউ নেই। তিনিও তো একটা মানুষ। চোখের সামনে অমন সমর্থ ছেলে অকেজো হয়ে পড়ে আছে, যার কোনও ভবিষ্যৎ নেই… এমন অবস্থায় তারও তো মনের দুটো কথা বলার লোক চাই। আমার তো মনে হয় এই সিদ্ধান্ত ওনার অনেক আগেই নেওয়া উচিত ছিল। তোমার তো খুশি হওয়া উচিত, যে তোমার বাবা-ভাইকে দেখাশোনা করার মতো একজন লোক এসেছে।’

শাশুড়ির কথায় খানিকটা হলেও মন হালকা হয় প্রিয়ার। গত দেড় দিনের ধকলে সে প্রচণ্ড ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। বিছানায় শুতেই ঘুমিয়ে পড়ল প্রিয়া।

এরপর দেখতে দেখতে সপ্তাহখানেক কেটে গেছে। বহুবার চেষ্টা করেও বাবাকে ফোন করে উঠতে পারেনি প্রিয়া, নাম্বার ডায়াল করেও ফোনটা কেটে দিয়েছে।

হঠাৎ একদিন বিকালে বড়োপিসির আগমন। কলিংবেলের আওয়াজ শুনে দরজা খুলতেই বড়োপিসিকে দেখে বেশ অবাকই হল প্রিয়া। হাতে বেশ কয়েকটা প্যাকেট আর ব্যাগ।

‘কিরে ভিতরে আসতে বলবি না?’

মনে মনে রাগ থাকলেও বলে, ‘হ্যাঁ এসো।’

ঘরে ঢুকে সোফার উপর বসে পড়ে বলে, ‘নে এগুলো, তোর জন্যই এনেছি।’

‘আমার জন্য? কী এগুলো।’ প্রিয়া অবাক হয়ে তাকায় পিসির দিকে। মনে মনে ভাবে আর যাই হোক বড়োপিসি তার জন্য এতগুলো টাকা খরচ করবে না। ছোটোপিসি হলেও না হয়…। পিসির হঠাৎ এই দরদের কারণ জিজ্ঞাসা করার আগেই, পিসি যেই ব্যাগটা থেকে নারকেলনাড়ু বার করেছিল সেই ব্যাগটার উপর নজর যায় প্রিয়ার। কেমন যেন চেনা চেনা লাগছে। হ্যাঁ সে ঠিকই ধরেছে। এই ব্যাগটাতেই তো তার বাবা দোকান-বাজার করে। এটা থেকে প্রিয়া যেন তার বাবার গায়ের গন্ধ পেল। উৎসুক হয়ে প্রিয়া জিজ্ঞাসা করে, ‘এটা তো বাবার ব্যাগ পিসি, তাহলে কি বাবাও এসেছে?’

‘হ্যাঁ এসেছে তো। কিন্তু তোর সামনে আসতে ইতস্তত বোধ করছে। এই সমস্ত জিনিস তো তোর নতুন মা-ই পাঠিয়েছে তোর জন্য। তোর বাবা তো তোর সঙ্গে দেখা করার জন্য ছটফট করছে রে।’

মা-বাবা দুজনেই বাইরে অপেক্ষা করছিল।

পিসির কথা শুনে সমস্ত রাগ-অভিমান ভুলে দরজার দিকে ছুটে যায় প্রিয়া।

মেয়েকে দেখামাত্রই মেয়ের দিকে অপরাধীর মতো এগিয়ে এসে নরেনবাবু বলেন, ‘আমায় ক্ষমা করে দিস মা, আমি তোর অপরাধী।’

এ ক’দিনে আরও যেন শীর্ণ হয়ে গেছে বাবার চেহারাটা। প্রিয়ার মনে হয় বাবাও যেন এক দুর্নিবার মানসিক সংঘর্ষের মধ্যে দিয়ে চলেছে। রাগ নয়, এই মুহূর্তে ভারি মায়া হল প্রিয়ার। যে-অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে মানুষটা, তাতে যে-কোনও সময় কোনও ভারি অসুখে পড়তে পারে। কে দেখবে তখন বাবাকে। ভাবতে গিয়ে মনটা কেমন ভিজে যায়। বাবার হাত দুটো ধরে ধরা গলায় প্রিয়া বলে, ‘না, বাবা এমন করে বোলো না। আমি শুধু নিজের কথাই ভেবেছি, একবারও তোমাদের কথা ভাবিনি। ভাবিনি যে তোমরা কতটা কষ্টে ছিলে।’

হঠাৎই প্রিয়া অনুভব করে পিঠে কারও একটা নরম হাতের স্পর্শ। ভারি মায়াময় সেই হাত। ঘুরে তাকাতেই এক বছর পঞ্চাশের স্নিগ্ধ চেহারার মহিলাকে দেখতে পায় প্রিয়া। অপ্রস্তুত অবস্থা কাটিয়ে মহিলা বলে ওঠে, ‘প্রিয়া আমি সোমলতা। আমি জানি, তোমার মায়ের জায়গাটা আমি কখনও নিতে পারব না, ভরে দিতে পারব না তোমার মনে তাঁর অভাববোধ। কিন্তু দুটো অচেনা মানুষ, মেরুর দুই প্রান্তে দাঁড়িয়ে বন্ধুও কী হতে পারে না? হবে আমার বন্ধু?’

প্রিয়া বিমূঢ় হয়ে যায়। কোনও কথা সরছে না মুখে। কিন্তু সোমলতার আন্তরিকতা তাকে কোথাও যেন নাড়িয়ে দিয়ে যায়। সমাজ আর সংস্কারে বাঁধা পড়া মনটা যেন শিকল ভেঙে বেরোতে চায়। বাবা ছোটো থেকেই তার আদর্শ ছিল, মানুষটা ব্যতিক্রমী বলে। আজ সেই বাবাকেই যেন আবার ফিরে পায় প্রিয়া।

অন্ধের দিনরাত্রি

এস্থার ঘড়ির দিকে তাকাল। বেশ কয়েক সেকেন্ড ধরে হয়তো অ্যালার্ম-টা বাজছে। এত তাড়াতাড়ি সকালে ওঠার অভ্যাস আগে একেবারেই ছিল না। সকাল আটটার আগে ওর ঘুমই ভাঙত না। কিন্তু এখানে এটা শোভনীয় নয়! এটা শ্বশুরবাড়ি। মাত্র দুদিন হল তার বউভাত হয়েছে। একেবারে নতুন বউ। কিন্তু এ-বাড়ির প্রতিটা সদস্য যেভাবে তাকে আপন করে নিয়েছে, এস্থারেরও মনে হচ্ছে, পরিবর্তে ওদের জন্যও তার কিছু হলেও করা উচিত।

প্রসূনের মুখেই শুনেছিল, প্রসূনের মা সুনন্দা খুব সকালে উঠে পড়েন সংসারের কাজ সামলাতে। সুনন্দার নাকি ওটাই বরাবরের অভ্যাস। এস্থার দেখল ঘড়িতে সাড়ে পাঁচটা বেজে গেছে, তার মানে শাশুড়ি এতক্ষণে উঠে পড়েছেন। বাড়ির সকলের সকাল সকাল চা পানের অভ্যাস। সেও তাড়াতাড়ি রাতের পোশাক বদলে চোখমুখে জল দিয়ে ফ্রেশ হয়ে রান্নাঘরের দিকে পা বাড়াল।

এস্থার কল্পনাও করেনি প্রসূনের মা-বাবা এত সহজে প্রসূনের সঙ্গে তার বিয়েতে রাজি হয়ে যাবেন। কারণ সব সময় প্রসূনের মুখে শুনেছে, এদের পরিবার খুব গোঁড়া ব্রাহ্মণ আর সেখানে এস্থার খ্রিস্টান পরিবারের মেয়ে কিন্তু বউভাতের দিনই তার মনের এই শঙ্কা ভুল প্রমাণিত হয়েছে। এক মুহূর্তের জন্যেও ওর মনে হয়নি, ও অন্য ধর্মের এবং ভিন্ন জাতের।

জাতি, ধর্ম কখনওই স্নেহ, ভালোবাসার মধ্যে দেয়াল হয়ে উঠতে পারে না, তার জ্বলন্ত উদাহরণ প্রসূনের পরিবার। এই সবই ভাবতে ভাবতে এস্থার রান্নাঘরে ঢুকতে যাবে, হুঁশ ফিরল প্রসূনের একমাত্র পিসির চিৎকারে, আরে আরে… বউমা এ কী অনর্থ করতে যাচ্ছো…।

প্রসূনের বিধবা পিসি সুমিত্রা বেশিরভাগ সময়ে নিজের শ্বশুরবাড়ি ছেড়ে ভাইয়ের সংসারেই পড়ে থাকেন। সকাল সকাল উঠে পড়েন এবং হাতে জপের মালা নিয়ে একটা ধুনুচি জ্বালিয়ে আসন পেতে হলঘরটায় বসে থাকেন। ভান করেন জপ করছেন কিন্তু আসলে নজর রাখেন বাড়ির কে কী করছে। হলঘরটা থেকে সব ঘরগুলো পরিষ্কার দেখা যায়।

সুমিত্রার চিৎকারে, ভাইয়ের বউ সুনন্দা তাড়াতাড়ি বাথরুম থেকে দৌড়ে এসে ঘরে ঢোকে। এস্থারও হঠাৎ পিসিমার চিৎকারে স্থানুবৎ রান্নাঘরের দরজায় কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে যায়, ভয়ে ওর মুখ ফ্যাকাশে হয়ে ওঠে।

সুনন্দা কিছু জিজ্ঞাসা করার আগেই পিসিমা এস্থারকে উদ্দেশ্য করে বলেন, এই বাড়িতে পা দিয়ে তুমি আমার ভাইয়ের নাক কাটিয়েছ সমাজে। জাত-কুল সব নষ্ট হয়েছে। এখন আবার স্নান না করেই রান্নাঘরে ঢুকে আমাদের ধর্মও নষ্ট করার ইচ্ছে রয়েছে? ধর্ম নিয়ম বলে কিছু আছে তো নাকি? অবশ্য তোমরা মোমবাতি জ্বালানো ছাড়া আর কী-ই বা জানো? কিন্তু সুনন্দা, তুমি… তোমার তো এই পরিবারে এতগুলো বছর কেটে গেল, এখনও কি তুমি নিয়মগুলো শিখতে পারলে না?

সুনন্দা উত্তর না দিয়ে চুপ করে থাকে। পিসিমা আবার বলেন, বউমাকে বুঝিয়ে দাও এ সংসারের কিছু রীতি নিয়ম আছে। এখানে কী কী করা যাবে আর কী না, সেটা ওকে পরিষ্কার করে বলে দাও। ছেলের মোহ-তে এতটাও অন্ধ হয়ে যেও না যে বাড়ির পুরোনো নিয়ম বদলে ফেলতে হবে।

এস্থার ভয়ে রান্নাঘরের দরজাতেই কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। প্রথম দুদিন সুনন্দা ওকে কোনও কাজ করতে দেয়নি। আজ এস্থার নিজে থেকেই ঠিক করে নিয়েছিল শাশুড়িকে যতটা সম্ভব সাহায্য করবে। সে কিছুতেই বুঝতে পারছিল না কাল অবধি যে-পিসিমা তার প্রশংসায় পঞ্চমুখ ছিলেন, আজ এমন কী দোষ করে ফেলল যে তার উপর পিসিমা এতটা রেগে উঠলেন?

সুনন্দা ভয় মিশ্রিত গলায় উত্তর দিলেন, ও তো একেবারে নতুন দিদি, আস্তে আস্তে সব শিখে যাবে। আপনি চিন্তা করবেন না। আমি নিজে হাতে করে সব শিখিয়ে দেব। এবারের মতো ওকে ক্ষমা করে দিন।

হ্যাঁ শিখতে তো হবেই। তোমার ছেলে শুধু বেজাতের বউ-ই নয় অন্য ধর্মেরও মেয়ে বাড়ি নিয়ে এসেছে। সব শুনে সুনন্দা চুপচাপ ওখান থেকে চলে যেতে যেতে এস্থারকেও ইশারা করলেন সঙ্গে আসার জন্য।

ননদের চোখের আড়াল হতেই সুনন্দা, এস্থারকে কাছে টেনে নিয়ে স্নেহবশত ওর মাথায় হাত রাখলেন, দিদির কথায় কষ্ট পেও না। একটু কড়া কড়া কথা বলেন ঠিকই কিন্তু মনের দিক থেকে খুবই ভালো মানুষ। তুমি বরং স্নানটা সেরে নাও, ততক্ষণ আমি পুজোটা করে নিচ্ছি। তারপর দুজনে মিলে চা-জলখাবার করব, বলে সুনন্দা পুজোর ঘরের দিকে চলে গেলেন।

এত সকালবেলায় স্নানের কথা এস্থার ভাবতেও পারে না। কিন্তু শ্বশুরবাড়ির সকলের মন জিততে গেলে সকালেই তাকে স্নান করতে হবে। প্রসূন আগেই বলে দিয়েছে, এস্থারকে নিয়ে কোনও অভিযোগ পরিবারের মুখ থেকে শুনতে সে রাজি নয়। কারণ এই ব্যাপারে ও স্ত্রীকে কোনও সাহায্যই করতে পারবে না।

 

সকালের ঘটনায় এস্থার কিছুটা নিরাশ হয়ে পড়েছিল। মনের মধ্যে কোথাও যেন বাড়ির সদস্যদের প্রতি একটা বিতৃষ্ণার মনোভাব উঁকি মারার চেষ্টা চালাচ্ছিল। এস্থার জোর করে মন থেকে নেতিবাচক মনোভাব সরিয়ে রেখে স্নানে চলে গেল। স্নান সেরে তৈরি হয়ে বাইরে এসে দেখল সকলে খাবার টেবিলে এসে বসেছে।

শাশুড়িমা চা-জলখাবার বানিয়ে টেবিলে পরিবেশন করে দিয়েছেন। সকলেই খাওয়ায় মনোনিবেশ করেছে। একা সুনন্দা সকলকে পরিবেশন করছেন। কেউ লুচি চাইছে তো কেউ তরকারি। কেউ আর এক কাপ চায়ের ফরমায়েশ করছে। এমনকী সুনন্দার একমাত্র মেয়ে শিল্পীও মা-কে দুপুরে কী খাবে তার ফরমায়েশ জানাচ্ছে। বেচারি সুনন্দা একা হিমশিম খাচ্ছেন!

এসব দেখে এস্থার ভিতরে ভিতরে প্রচণ্ড রেগে উঠলেও মুখে কিছু না বলে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। সকলের ওর উপর চোখ পড়লেও, কেউই মুখে কিছু বলল না। এমনকী প্রসূনও না! সুনন্দা রান্নাঘরে ছিলেন। সকলের ব্যবহারে এস্থার এতটাই মনে আঘাত পাচ্ছিল যে, ওর চোখে জল এসে গেল। সুনন্দা এস্থারকে দেখতে পেয়ে বললেন, এস্থার তুমিও চা খেয়ে নাও।

সুনন্দার কথা শেষ হতেই টেবিলে চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে প্রসূনের ঠাকুমা বলে ওঠেন, বউমা, এখন তুমি বাড়ির বউ শুধু নও, শাশুড়ি হয়ে গেছ। সুতরাং তোমার দাযিত্ব এখন যে, ভুল করেও এমন কিছু কোরো না যেটা নিয়ে পরে তোমাকে পস্তাতে হতে পারে। এটা তোমার বাপের বাড়ি নয়, যেখানে সবকিছু সবাই মেনে নেবে।

ঠিক আছে মা, মাথা নীচু করে সুনন্দা উত্তর করলেন।

প্রসূনের ঠাকুমা আবার বললেন, আর একটা কথা বউমা, কাল আমার গুরুদেবকে বাড়িতে নিমন্ত্রণ করেছি। যা যা ব্যবস্থা করার সব করে রেখো। পুজোর সমস্ত সামগ্রী গুরুদেব নিজেই নিয়ে আসবেন। পুরো বাড়ি শুদ্ধ করে দেবেন এবং একই সঙ্গে এই ছুঁড়িটার নাম বদলে ওকেও শুদ্ধ করে দেবেন।

মায়ের কথা শুনেই সুমিত্রা জপের মালা আঙুলে ঘোরাতে ঘোরাতে ঈশ্বরের আরাধনায় সামান্য বিরাম টেনে জিজ্ঞেস করলেন, নাম বদলে… কিন্তু কেন?

তোরও কি জ্ঞানগম্যি সব লোপ পেল সুমি? ছুঁড়িটার নাম মুখে এলেও জিভ মনে হয় অশুদ্ধ হয়ে গেছে। এছাড়া গুরুদেবও বলেছেন, নাম বদলালেই প্রসূনের বিবাহিত জীবন সুখময় হতে পারবে, ভবিষ্যতে নয়তো বিচ্ছেদের সম্ভাবনা থাকবে। তাছাড়াও ছুঁড়িটার কারণে পরলোকে আমাদের পূর্বপুরুষদের উপর যে-কলঙ্ক লেগেছে, সেটাও গুরুদেব যজ্ঞ করে দূর করে দেবেন। ওনাদের ওখানে তাহলে আর নরকবাস করতে হবে না। একই সঙ্গে শিল্পীর বিয়ের জন্যও গ্রহশান্তির ব্যবস্থা করাবার কথা বলছিলেন গুরুদেব। এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে থেমে যান সুনন্দার শাশুড়ি গায়ত্রীদেবী।

একটু দম নিয়ে এবার ছেলেকে উদ্দেশ্য করে বললেন, প্রদীপ, ব্যাংক খুললেই সকাল সকাল গিয়ে এক লক্ষ টাকা তুলে আনিস। পুজোর জন্য লাগবে।

টাকার অঙ্ক শুনেই প্রসূনের বাবা আঁতকে উঠে মায়ের দিকে তাকিয়ে ধরা গলায় বললেন, মা এক লক্ষ টাকা, তাও শুধু পুজোর জন্য! একটু বেশি নয় কি?

ভাইয়ের কথা শুনে সুমিত্রা বলে উঠলেন, বেশি কোথায় রে ভাই। এটা খুবই কম! আমাদের পরিবারের উপর গুরুদেবের আশীর্বাদ রয়েছে। এছাড়া মা গুরুদেবের পরমভক্ত, তাই এতটা কমে এই পুজোপাঠ করতে রাজি হয়েছেন তিনি। তুই আর সুনন্দা তো ছেলের প্রতি অন্ধ হয়ে একটা বিধর্মী মেয়েকে বাড়ির বউ করে নিয়ে এসেছিস। তোদের জন্য আমাদের পরলোকগত পূর্বপুরুষদের সারাজীবন কষ্ট পেতে হবে।

প্রসূন এতক্ষণ চুপ করে থেকে বাবার মুখে চিন্তার আনাগোনা লক্ষ করছিল। ও বাবাকে নিশ্চিন্ত করতে বলল, বাবা, তোমাকে কোথাও যেতে হবে না, আমি আমার অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা তুলে আনব।

এস্থার অবাক হয়ে যায় প্রসূনের ব্যবহারে। এতদিন ধরে ওর সঙ্গে মেলামেশা করছে, প্রসূনের এরকম অন্ধবিশ্বাস আগে কখনও সে দেখেনি। সেই সঙ্গে প্রসূনের পুরো পরিবার এতটা শিক্ষিত এবং আধুনিক হয়ে কীভাবে এই অন্ধবিশ্বাসের অন্ধকার গারদে স্বেচ্ছায় বন্দি থেকে গেছে, সেটা এস্থারের কিছুতেই বোধগম্য হল না। তার খালি মনে হচ্ছিল, এই ধরনের মানসিকতার মানুষগুলো কী করে প্রসূনের সঙ্গে তার বিয়েতে রাজি হয়েছিল।

 

আসলে এস্থারের এটা অজানাই ছিল যে, এই গোঁড়া ব্রাহ্মণ পরিবার তাকে বউ হিসেবে এইজন্যই মেনে নিয়েছিল, যাতে তাদের একমাত্র রোজগেরে ছেলে বিয়ের পরে আলাদা না থাকতে শুরু করে দেয়। তাছাড়া এস্থারও খুব বড়ো চাকরি করে। ফলে ছেলে, বউমা দুজনকেই প্রযোজনে কাজে লাগবে। এছাড়াও বাড়ির একমাত্র মেয়েরও বিয়ে দিতে হবে সুতরাং সেখানেও টাকার দরকার পড়বে।

এইসব নানা কথা চিন্তা করতে করতে হঠাৎ এস্থারের খেয়াল হল যখন গুরুদেব আর গ্রহশান্তির কথা হচ্ছিল, তখন সে কথা শুনে শাশুড়িমা-র মুখটা কেমন যেন ফ্যাকাশে হয়ে পড়েছিল আর শিল্পীর মধ্যেও একটা অস্থিরতা এস্থার টের পেয়েছিল।

যে-মেয়ে হেসে হেসে এতক্ষণ সকলের সঙ্গে গল্প করছিল, গ্রহশান্তির কথা শুনেই তার মুখের এই ভাবান্তর, ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়া এবং শিল্পীর পিছনে সুনন্দারও চলে যাওয়াটা এস্থারকে ভাবিয়ে তুলছিল। এস্থারও একটু বসে নিজের ঘরে যেতে গিয়ে শিল্পীর ঘরের সামনে পৌঁছোতেই, সুনন্দা আর শিল্পীর কথোপকথন তার কানে এল।

শিল্পী বলছে, মা আমি গ্রহশান্তির জন্য কিছুতেই পুজোয় বসব না, তাতে আমার বিয়ে হোক আর নাই হোক।

সুনন্দা মেয়েকে বোঝাবার চেষ্টা করতে করতে বলছেন, শিল্পী, ঠাকুমা আগে থেকেই তোমার গ্রহশান্তির জন্য গুরুদেবকে বলে রেখেছেন, সুতরাং তোমাকে তো পুজোতে বসতেই হবে। এই পুজোর ফলে তোমার ভালো বাড়িতে বিয়ে হবে। স্বামী, শ্বশুরবাড়ি সব ভালো হবে।

এস্থার আর অপেক্ষা করতে পারল না, দরজা ঠেলে ঘরের ভিতর ঢুকে এল। শাশুড়িকে সরাসরি জিজ্ঞেস করল, মা কী হয়েছে, গ্রহশান্তির কথা শুনে শিল্পী এত কাঁদছে কেন? সুনন্দা উত্তর করলেন না। একই ভাবে মেয়েকে বোঝাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন।

হঠাৎই শিল্পী নিজের রাগ সামলাতে না পেরে সুনন্দার উপর চেঁচিয়ে উঠল, মা তুমি কেন বুঝতে পারছ না, পুজোর পর প্রতিবার আমি অজ্ঞান হয়ে যাই। আমার সারা গায়েহাতে প্রচণ্ড ব্যথা করে। মা, আমার ভীষণ ভয় লাগে। প্লিজ মা আমি পুজোতে বসব না।

শিল্পীর কথার থেকে বেশি ওর চোখে, মনের ভয়টা পরিষ্কার ফুটে উঠেছিল। শিল্পীর অবস্থা দেখে স্বাভাবিক কণ্ঠেই এস্থার শাশুড়িকে জিজ্ঞেস করল, মা, শিল্পীর পুজোতে বসা কি খুব দরকার?

এস্থার, তোমার এ বাড়িতে মাত্র তিন-চারদিনই হয়েছে। সুতরাং প্রশ্ন করা ছেড়ে কালকে গুরুদেবের সেবায় এবং খাওয়াদাওয়ার আযোজনে আমাকে সাহায্য কোরো। আর প্রসূনকে বোলো এক লক্ষের একটু বেশি টাকা তুলতে। কারণ পুজোর খরচ ছাড়াও গুরুদেবকে দক্ষিণাও দিতে হবে, যাতে শিল্পীর জন্য ভালো সম্বন্ধ আসে।

শাশুড়ির কথা শুনে এস্থার বুঝে গিয়েছিল, সময় থাকতে তাকেই সঠিক পদক্ষেপ নিতে হবে। নয়তো তার সংসার ভেঙে গুঁড়িয়ে যাবে, সেই সঙ্গে তার নিজের পরিচয়, অস্তিত্ব সবই ধুলোয় চাপা পড়ে যাবে।

এই পরিবারের লোকেদের চোখে অন্ধবিশ্বাসের এমন ঠুলি পরানো আছে, যা বার করে ফেলাটা খুব সহজ নয়। এস্থার এও জানে সে চেষ্টা করলেই সফল হবে এমন কোনও নিশ্চয়তাও নেই। তাই শুদ্ধিকরণ, নামকরণ, বিয়ের জন্য গ্রহশান্তির পুজো এসব যে কতটা বুজরুকি তা জেনেও, পরের দিন সকালে উঠে এস্থার, শাশুড়িকে সাহায্য করার জন্য তৈরি হয়ে নিল।

 

যথাসময়ে গুরুদেব পাঁচ শিষ্যকে সঙ্গে করে এস্থারের শ্বশুরবাড়িতে এসে উপস্থিত হলেন। এস্থার বাদে সকলে গুরুদেবের পা ছুঁয়ে আশীর্বাদ নিল। সবার হয়ে গেলে গায়ত্রীদেবী এস্থারকে ইশারা করলেন, গুরুদেবের পা ছুঁয়ে আশীর্বাদ নিতে।

আশীর্বাদ দেওয়ার নামে গুরুদেব যেভাবে এস্থারকে স্পর্শ করলেন, তাতে এস্থারের সারা শরীর শিউরে উঠল। গুরুদেবের শিষ্যদের দৃষ্টিও ক্ষুধার্ত পশুর মতো মনে হল এস্থারের। সেই মুহূর্তে গায়ত্রীদেবী পুজো শুরু করে দেওয়ার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করতেই এক রহস্যময় হাসি খেলে গেল গুরুদেবের মুখে। এস্থারকে দেখিয়ে বললেন, আমি প্রথমে এই মেয়েটিকে শুদ্ধ করে তবে পুজোয় বসব। পুজোর ঘরে আমরা দুজন ছাড়া আর কেউ থাকবে না, বলে গুরুদেব সকলকে বাইরে যেতে বলে পুজোর ঘরের দরজা বন্ধ করে দিলেন।

প্রায় দুঘন্টা পর গুরুদেব ও এস্থার ঘর থেকে বেরোতেই তৎক্ষণাৎ শিষ্যদের নিয়ে গুরুদেব পুজোয় বসে পড়লেন। পুজো করতে করতে বারবার এস্থারের সঙ্গে কাটানো সময়ের প্রতিটা মুহূর্ত গুরুদেবের মনে পড়তে লাগল। এরকম অবস্থার সম্মুখীন আগে কখনও তাঁকে হতে হয়নি।

এস্থার চালাকি করে আগে থেকেই মোবাইলে ভিডিও ক্যামেরা অন করে এমন ভাবে লুকিয়ে রেখেছিল যাতে ঘরের মধ্যে যা-যা ঘটবে সব মোবাইল ক্যামেরায় রেকর্ড হতে থাকবে। গুরুদেব কীভাবে পুজোর সামগ্রীর সঙ্গে আনা মাদক পুরিয়া এস্থারকে খেতে দিয়েছেন, এস্থার অজ্ঞান হয়ে পড়েছে ভেবে তার সঙ্গে অশালীন আচরণ করতে উদ্যত হয়েছেন, এস্থার কীভাবে ওঁর মুখ থেকে সব সত্য বার করে আনতে ওঁকে বাধ্য করেছে সব মোবাইলে রেকর্ড হয়েছে। গুরুদেব ভালো করেই জানেন, এই সত্যি প্রকাশ পেলে জেলের ঘানি টানা থেকে তাঁকে কেউ বাঁচাতে পারবে না।

তাড়াতাড়ি পুজো সেরে ওই বাড়ি থেকে কখন বেরোবেন ভাবতে ভাবতে অস্থির হয়ে পড়ছিলেন গুরুদেব। কারণ এস্থারের দেওয়া হুমকি তখনও কানে বাজছিল গুরুদেবের। সকলের অগোচরে বদ্ধ ঘরের আড়ালে এস্থার তাঁকে সাবধান করে দিয়েছিল, চুপচাপ শান্তিপূর্ণ ভাবে পুজো সেরে এ-বাড়ি থেকে বেরিয়ে যান, নয়তো পুলিশ ডেকে ভিডিও সমেত আপনাকে ধরিয়ে দেব। ভিডিও সামনে এলেই সকলে বুঝতে পারবে আপনার পুরোটাই সাজানো একটা চক্র যার প্রধান পাণ্ডা আপনি। পুজো, ধর্ম, গ্রহশান্তির নাম করে বাড়ির মেয়েদের সতীত্ব নষ্ট করা, তাদেরকে নিজের শিকার বানাবার সঙ্গে সঙ্গে পুরো পরিবারকে আর্থিক ভাবে লুঠে নেওয়া ইত্যাদি কারসাজি আমি সবার সামনে নিয়ে আসব যাতে জেলে যাওয়া থেকে আপনাকে কেউ আটকাতে না পারে।

পুজো শেষ করেই গুরুদেব শিষ্যদের নিয়ে তাড়াতাড়ি বেরোবার জন্য হুড়োহুড়ি করতে গায়ত্রীদেবী একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, এত তাড়াহুড়ো কেন করছেন গুরুদেব? এখনও তো এই ছুঁড়ির নামকরণ এবং আমার নাতনির গ্রহশান্তির পুজো করেননি।

গুরুদেব এস্থারের দিকে তাকিয়ে উত্তর করলেন, নামকরণের কোনও দরকার নেই। খুবই শুভলগ্নে ওদের বিয়ে হয়েছে। এই মেয়ে ঈশ্বরের আশীর্বাদ। এই বাড়িতে ওর পা পড়তেই বাড়ির সব বাধাবিঘ্ন দূর হয়ে গেছে। সমস্ত গ্রহও সুস্থানে বিচরণ করছে। সুতরাং গ্রহশান্তি করাবারও আর কোনও দরকার নেই। আর এই পুজোর জন্য আমি কোনও দক্ষিণাও গ্রহণ করব না। এই বলে গুরুদেব শিষ্যদের নিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলেন।

মুহূর্তে এস্থার অনুভব করল বাড়ির সকলের দৃষ্টি তার উপরে। সকলেরই চোখের ভাষা একদম বদলে গেছে। হঠাৎ করেই ভালোবাসার ফল্গুধারা সকলের চোখ থেকে প্রবাহিত হতে দেখে মনে মনে হাসল এস্থার। নিজের মনেই বলল, এদের অন্ধবিশ্বাস এখনও কাটেনি ঠিকই কিন্তু এই অন্ধবিশ্বাসের কারণে না-তো শিল্পীর বিয়ে আটকাবে আর না-তো এই মেয়ের উপর গুরুদেবের দৈহিক অত্যাচার চলতে থাকবে, যা এতদিন ধরে এ বাড়িতে চলে এসেছে।

 

পড়ার জন্য সীমাহীন গল্প-নিবন্ধসাবস্ক্রাইব