শান্তি

আরও চাই, আরও, আরও। টাকাপয়সা, সম্মান, ক্ষমতা, জনপ্রিয়তা সব কিছুই হিসেবে কম পড়ছে। তাই আরও বেশি বেশি করে চাই। এই সুখে হবে না, আরও সুখ চাই। এই পরিমাণ শান্তিতে চলবে না, নিরবচ্ছিন্ন শান্তি চাই। যেটুকু আয়ত্তের বাইরে আছে সেটুকুকে পেতে আয়ত্তের মধ্যে থাকা জিনিসকেও বাজী ধরতে রাজি আছি।

গোপালের বিয়ে দেবার জন্য ওর মা-বোন-দিদি সব উঠে পড়ে লেগেছে। বিয়ের জন্য গোপাল নিজে যত না আগ্রহী, উদ্যোগী ওর বাড়ির লোকজন তার হাজারগুণ। গোপালের মা বলেন, ‘মেয়েগুলোর বিয়ে হয়ে যাবার পর বাড়িটা কীরকম যেন খাঁখাঁ করে। একটা চুড়ির রিনিঝিনি নেই, একটা নূপুরের নিক্বণ নেই। যেন ভূতের বাড়ি। নাতি-নাতনির মুখ বোধহয় আর দেখে যেতে পারব না।’

গোপাল বলে, ‘দাঁড়াও না মা, আর একটু সবুর করো না, আমার আর একটা পদোন্নতি হোক তারপর না হয়…’

গোপালের মা ওর মুখের কথা ছোঁ মেরে কেড়়ে নিয়ে বলে, ‘পদ বাড়ানোর প্রস্তুতি আর বিয়ের প্রস্তুতি একই সঙ্গে চলুক না, ক্ষতি কি? তোর পদোন্নতি হতে হতে আমাদেরও মেয়ে রেডি হয়ে যাবে। আরও দেরি করে মেয়ে দেখতে বেরোলে, তোর বিয়ের বয়স পার হয়ে যাবে।’

সুতরাং প্রায় প্রত্যেকটা ছুটির দিনেই মা-দিদি-বোনেরা একজোট হয়ে একটা না একটা মেয়ে দেখতে যাওয়া চাই-ই। এটা যেন ওদের কাছে একটা সাপ্তাহিক উৎসবে পরিণত হয়েছে। সকাল থেকেই সাজোসাজো রব। ইতিমধ্যে নয় নয় করে তেরোটা মেয়ে দেখা হয়ে গেছে। কিন্তু পছন্দ যেন আর হয় না। এদেরই মধ্যে একজনকে গোপালের মনেও ধরেছিল কিন্তু মা-দিদি-বোনের যুক্তফ্রন্ট সেটাকে পত্রপাঠ নাকচ করে দিয়েছে।

দেখতে দেখতে গোপালের বিয়ে হয়ে গেল। এলাহি আয়োজন হল, প্রচুর লোক খেল। বাড়িতে এখন দিনরাত হইচই লেগেই আছে। দিদি, বোন প্রায়ই আসে। নতুন বউকে নিয়ে হোটেল, রেস্টুরেন্ট, বাজার কিংবা সিনেমা হলে যায়। গোপালও যায় মাঝে মাঝে। শাশুড়ি-বউমার যুগলমূর্তি প্রায়ই চোখে পড়ে এখানেওখানে। বাড়িতে হাসাহাসি, দাপাদাপি, হুটোপাটি, লুটোপুটি লেগেই আছে। নতুন বউমা নতুন মাকে পেয়ে সেকি উচ্ছ্বসিত। তার চেয়েও বেশি উচ্ছ্বসিত নতুন মা তার নতুন মেয়েকে খুঁজে পেয়ে। যেন আক্ষরিক অর্থেই জন্মজন্মান্তরের পর আকস্মিক ভাবেই কোনও এক অজানা গ্রহের ফেরে মা-মেয়ের দেখা। বউমা ‘মা’ ‘মা’ বলতে অজ্ঞান। শাশুড়িও একই রকম বউমা ভক্ত। দুজনে যেন একে-অপরকে কিছুতেই চোখের আড়াল করতে পারে না। গোপালের বাড়ি এখন সুখের হাট। লোকে দেখে হিংসে করে।

সস্তার জিনিস যেমন প্রথম দর্শনে চেনা যায় না, দুদিন ব্যবহারেই তার আসল রূপ প্রকাশ পায়, তার চাকচিক্যের অবসান ঘটে, তেমনি শাশুড়ি-বউমার চিরন্তন স্বাভাবিক সম্পর্ক ধরা পড়ল মাসখানেক বাদে।

এখন কাক, চিল, আদি পক্ষীকুল গোপালের বাড়ির ছাদ, পাঁচিল এড়িয়ে চলে। মফসসলের এই মধ্যবিত্ত পাড়াটার আপাত শান্ত চেহারাটা হঠাৎই বড়ো অশান্ত হয়ে ওঠে শাশুড়ি-বউয়ের নিত্য কলহে। অশান্তি, চিৎকার, চ্যাঁচামেচি লেগেই আছে। কান পাতা দায়। কী নিয়ে যে অশান্তি তা বোধগম্য নয়। কোনও ইস্যু নেই। শাশুড়ি-বউয়ের ঝগড়া না, দুই সতিনের ঝগড়া তাও চট করে বোঝার উপায় নেই। সেই একমেবদ্বিতীয়ম ছেলে-স্বামীর ওপর আধিপত্য বিস্তারের গল্প, যা প্রতিদিন হাজার হাজার ঘর ভেঙে টুকরো টুকরো করে দিচ্ছে। শাশুড়ি ভাবে, যে-ছেলেকে, যে-গোপালকে এই সেদিন জন্ম দিলাম বত্রিশটা নাড়ি ছিঁড়ে, মাসের পর মাস বুকের দুধ খাইয়ে মানুষ করলাম, আধপেটা খেয়ে না খেয়ে পুজোয় নিজের জামাকাপড় না কিনে লেখাপড়া শেখালাম, সেই গোপাল আমার শেষ পর্যন্ত কিনা পর হয়ে গেল! হতচ্ছাড়া অলক্ষুনে মাগিটা আমার অমন মাতৃভক্ত, গোবেচারা গোপালটাকে ছিনতাই করে নিল! দিনরাত অত গুজুর গুজুর, ফুসুর ফুসুর কীসের? আমার ভোলাভালা ছেলেটার মাথা খাচ্ছে! দিনরাত কুযুক্তি দিচ্ছে, আমার বিরুদ্ধে সব সময় নালিশ করছে! ছেলের বিয়ের আগে বাড়িতে আমার কত শান্তি ছিল! ওই মাগিটা আসার পর থেকে ছেলেও আমার বিগড়ে গেল, বাড়ি থেকেও শান্তি উধাও!

চেহারা কিংবা শিক্ষার পালিশ গোপালের মায়ের কোনওদিনই ছিল না। তাই চিন্তার ও ভাষাদৈন্য অচিরেই প্রকট হয়ে ওঠে। বউমা সম্পর্কে তার তিক্ত ভাবনাটাই মুখের কদর্য ভাষায় বেরিয়ে পড়ে মাঝেমধ্যেই। ‘বাড়ি থেকে বেরিয়ে যা হতচ্ছাড়ি মাগি! গোপালের আবার বিয়ে দেব আমি। খাল কেটে আমিই ঘরে কুমির এনেছি! বলি সংসারটা কি শুধু স্বামীটাকে নিয়ে? আরে মূর্খ, স্বামীটাকে পেলি কোত্থেকে? তুই জন্ম দিয়েছিস? আমি কি বাইরের লোক? তোর বাপ-মায়ের সঙ্গে কি তুই এইরকম আচরণ করতিস? পাঠাবার সময় বাপ-মা শিখিয়ে দেয়নি শ্বশুরবাড়িতে কীরকম ভাবে থাকতে হয়, শ্বশুর-শাশুড়ির সঙ্গে কীরকম ব্যবহার করতে হয়? আমরা তো জীবনে শ্বশুর-শাশুড়ির মুখের ওপর কোনওদিন কথা বলিনি, কোনও কথার প্রতিবাদ করিনি, চিরটাকাল তাদের দাসী হয়ে থেকেছি। আমারই ভিটেয় থেকে আমাকেই অপমান? ছেলে মানুষ করলাম শেষ বয়সে এসে বউয়ের লাথিঝাঁটা খাবার জন্য! এর চেয়ে তো মরণও ভালো ছিল আমার!’

মায়ের সঙ্গে উপযুক্ত সঙ্গত করে ননদেরা, ‘মা, একি চেহারা হয়েছে তোমার? সেই কাঁচা সোনার বরন কোথায় গেল? ওই ডাইনি বউটার কীর্তি নিশ্চয়ই! তাড়াও হতচ্ছাড়িকে।’

ভাইয়ের বউয়ের দিকে আঙুল তুলে বলে, ‘তুই এই বাড়ির নখের যুগ্যি নস, দূর হয়ে যা এখনই, নইলে গলা ধাক্বা দিয়ে বের করে দেব, এই বলে দিলাম। চিরকালের জন্য এবাড়ির ভাত খাওয়া ঘুচিয়ে দেব।’

ছেলে-বউ একসঙ্গে বেশিক্ষণ কাটালে, গল্প করলে বা হাসাহাসি করলে শাশুড়ি সহ্য করতে পারেন না। কোনও না কোনও ছুতোয় ছেলেকে অন্য কোনও কাজে ব্যস্ত করে তোলেন অথবা নিজেই দুজনের মাঝে বসে পড়ে অপ্রয়োজনীয় গল্প জুড়ে দেন। রসভঙ্গ করেন। ছেলে-বউ সব বুঝেও কিছু বলতে পারে না।

ছেলে-বউ কোথাও বেড়াতে যাবে শুনলেই শাশুড়ির গাত্রদাহ ও রক্তচাপ হাজারগুন বেড়ে যায়। শরীর খারাপ বা অন্য কোনও ছুতোয় তিনি তা বানচাল করার চেষ্টা করেন। এই করেই সেবারে ওদের দীঘা যাওয়া ক্যানসেল হয়ে গেল। বাড়ি থেকে বেরোবার ঘণ্টাখানেক আগে শাশুড়িমা বুকে হাত দিয়ে শুয়ে পড়লেন। ছোটাছুটি, ডাক্তার ডাকাডাকি সবই করতে হল বেচারা গোপালকে। দীঘা যাওয়া মাথায় উঠে গেল। ডাক্তার এসে বললেন আশ্বাসের কথা, ‘তেমন কিছুই হয়নি… একটু বিশ্রাম।’

ততক্ষণে দীঘার বাস ডায়মন্ডহারবার পৌঁছে গেছে। গোপালের মধুচন্দ্রিমা উচ্ছেচন্দ্রিমায় রূপান্তরিত হয়েছে।

গোপালের মা, বউয়ের দিক থেকে ছেলের মন একশো আশি ডিগ্রি ঘোরানোর আপ্রাণ চেষ্টা করেন। গোপাল চা করতে গেলে, জামাকাপড় কাচতে গেলে বা এঁটো বাসনপত্র তুলতে গেলে অর্থাৎযে-কাজগুলোকে সচরাচর অন্যায়ভাবে শুধুমাত্র মেয়েলি কাজ বলে মনে করা হয়, সেগুলো করতে গেলে মা বাধা দেন। বলেন, ‘তুই এসব কাজ করছিস কেন? এগুলো তো মেয়েদের কাজ, তোর বউয়ের কাজ! এতে তো তোর বউ আরও প্রশ্রয় পেয়ে যাবে, মেয়েদের কাজ ছেলেদের করতে নেই। তুই বোকাসোকা ভালোমানুষ বলে তোকে দিয়ে হাবিজাবি কাজগুলো করিয়ে নিচ্ছে। একদিন ওর কাজ করে দিলে দ্বিতীয় দিন আর ও সেই কাজ করতে চাইবে না। সারাজীবন ধরেই তোকে বউয়ের গোলামি করে যেতে হবে।’

গোপাল মায়ের কথা ঠিক বুঝে উঠতে পারে না। মায়ের কথা মেনে নিতে ওর বড়ো কষ্ট হয়। অথচ তীব্র প্রতিবাদও করতে পারে না। ছোটোবেলা থেকেই ও জেনে এসেছে বড়োরা বিশেষ করে মা-বাবা কখনও সন্তানের অমঙ্গল চান না। তাঁরা যা বলেন বা করেন সবই সন্তানের ভালোর জন্যই। তাঁদের মুখের ওপর কথা বলতে নেই। অথচ ও বেশ বুঝতে পারে স্ত্রীর ক্ষেত্রে মা যা যা বলেন তা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বেঠিক, চরম বিদ্বেষপূর্ণ, শত্রুতাপূর্ণ। সে কী করবে, তার কী করা উচিত কিছুতেই ঠিক করতে পারে না। এক চরম নিষ্ঠুর তীব্র অন্তর্দ্বন্দ্বে ভোগে সে। সে দেখেছে বিয়ের আগে পর্যন্ত মা যা যা বলে এসেছে বা করে এসেছে সবই তার স্বার্থের অনুকূলে। তাই রাতারাতি মায়ের এই ভোলবদল সে কিছুতেই নিজের কাছে ব্যাখ্যা করতে পারে না। যদিও শাশুড়ি-বউ-এর সম্পর্কের চিরকালীন কূটনৈতিক জটিলতা ও পরিপক্ব সাংসারিক বুদ্ধির অভাবই তিক্ততার জন্য দায়ী।

ভালো কথায় কাজ হচ্ছে না দেখে মা এবার অন্য রাস্তা ধরেন। গোপালকে দিনরাত কথায় কথায় তুচ্ছতাচ্ছিল্য, অপমান করেন। বলেন, ‘বউকে প্রশ্রয় দিচ্ছিস। তোর প্রশ্রয়েই বউ এত বাড় বেড়েছে। বউকে শাসন করার ক্ষমতা নেই, স্ত্রৈণ কোথাকার! বউয়ের কথায় ওঠবোস করিস। মনে রাখিস, বউ গেলে বউ আসবে, মা গেলে মা আসবে না। যে মা তোকে জন্ম দিল, এই এতটুকু থেকে মানুষ করল, দুদিনের বউকে পেয়ে সেই মাকে ভুলে গেলি? নেমকহারাম কোথাকার! একেই বলে কলিকাল। এমন ছেলে থাকার চেয়ে বাঁজা হওয়াও ভালো ছিল। জন্মের পরই যে কেন তোকে গলায় নুন দিয়ে মেরে ফেলিনিরে হতভাগা!’

গোপালের ওপর মায়ের এই মানসিক অত্যাচারের কারণ হল যে, তিনি চান এসব অপমানের মাধ্যমে গোপালকে এমন মানসিক অশান্তির মধ্যে ফেলা যে, সে যেন ভাবে এসবের জন্য বউ-ই দায়ী, কারণ, বিয়ের আগে মা তার সঙ্গে ভালো ব্যবহারই করত কিন্তু বিয়ের পর মায়ের আচরণ পালটে গেল। এই কথা ভেবে গোপাল যাতে মায়ের অত্যাচারের হাত থেকে বাঁচতে বউয়ের ওপর অত্যাচার করে, মায়ের মনে এমনই আশা। কিন্তু গোপাল মায়ের এই কৌশল বুঝে ফেলে। তাই সে মায়ের কৌশলের ফাঁদে পা দেয় না।

কম যায় না গোপালের বউ-ও। শাশুড়িমাকে সে সতিন জ্ঞান করে। তাকে মন্দ ভাষা বলতেও বউয়ের বুক কাঁপে না। তিরিশ বছরের বড়ো এক মহিলার সঙ্গে সমানে টক্বর দেবার বা তাকে ওই ভাষায় গালাগাল করার সাহস কোত্থেকে আসে তা ভেবে গোপাল অবাক হয়ে যায়। গোপাল মাঝে মাঝে ভাবে, ‘এ নিজের মায়ের সঙ্গেও কেমন আচরণ করে!’

গোপালকেও বউ ছেড়ে কথা বলে না। শাশুড়ি-ননদের হাতে হেনস্তার জন্য সে সর্বদা গোপালকেই দায়ী করে।

‘তুমিই তো যত নষ্টের গোড়া! বিয়ে করে এনেছিলে কি মাকে দিয়ে পদে পদে অপমান করাবে বলে? বউয়ের সম্মান রাখতে পার না, কী ধরনের স্বামী তুমি? অমন স্বামী থাকার থেকে না থাকা ঢের ভালো ছিল। এর চেয়ে আইবুড়ি হয়ে সারাজীবন কাটানো অনেক সুখের হতো। ব্যক্তিত্বহীন নপুংসক কোথাকার! মায়ের ন্যাওটা হয়েই তো সারাজীবন থাকতে পারতে। বিয়ে করার শখ হল কেন? অতই যদি মাকে ছেড়ে থাকতে কষ্ট, তাহলে রাতটাও তো মায়ের সঙ্গেই কাটাতে পারতে!’

বউ আরও বলে, ‘এখানে তোমার মায়ের সঙ্গে আমি থাকতে পারব না। অন্য কোথাও চলো, বাড়ি ভাড়া করো, ফ্ল্যাট কেনো, নইলে বাপের বাড়ি চলে যাব, পুলিশের কাছে তোমার নামে বধূ নির্যাতনের অভিযোগ করব। মহিলা সমিতিতে অভিযোগ করব, কোর্টে নারী নির্যাতনের মামলা করব। জেলের খাবার খাওয়াব তোমায়, এই বলে দিলাম!’

ইতিমধ্যে বউয়ের বাপ আর তিন দাদা এসে চমকে দিয়ে গেছে গোপালকে। তিন দাদা তিনটে আলাদা আলাদা রাজনৈতিক দলের ঘাটে নোঙর বেঁধেছে। সে কী তড়পানি! ‘অনেক খরচা করে বোনের বিয়ে দিয়েছি পড়ে পড়ে লাথিঝাঁটা খাবার জন্য নয়। অমন মা থাকার চেয়ে না থাকা ভালো। দরকার হলে বুড়িটাকে লাথি মেরে বাড়ি থেকে বের করে দাও। আমাদের আদরের একমাত্র বোনের ওপর কোনওরকম অত্যাচার সহ্য করব না। মাকে যদি শায়েস্তা করতে না পারো তাহলে তোমাকে কীভাবে শায়েস্তা করতে হয় তা আমরা বুঝে নেব!’

মা, বউ দুজনেই দিনরাত আত্মহত্যা করার ভয় দেখায়। বউ যদি সকালে আত্মহত্যা করার ভয় দেখায় তাহলে মা দেখায় বিকেলে, মা যদি দিনের বেলায় তো বউ রাতে। এ যেন একদলের মিছিল বা বন্ধের ডাকের বদলে অন্য দলের পালটা ডাক। আত্মহত্যা করার ভয় দেখিয়ে দুজনেই এক ঢিলে দুই পাখি মারতে চায়– গোপালকে চাপের মধ্যে রেখে নিজ নিজ স্বার্থসিদ্ধি করা এবং অপর পক্ষের আত্মহত্যার হুমকিকে নস্যাৎ করে দেওয়া। কিন্তু মনস্তত্ত্বের এই সূক্ষ্ম ও জটিল উপধারাগুলো উপলব্ধি করার মতো সূক্ষ্মতর বুদ্ধি উচ্চশিক্ষিত গোপালের থাকলেও তা এখন কাজ করে না।

ইতিমধ্যে মা একদিন ঘরের দরজা বন্ধ করে বউয়ের শাড়ি গলায় পেঁচিয়ে সিলিং ফ্যান থেকে ঝুলতে আপ্রাণ চেষ্টা করেও চরম ব্যর্থ হয়েছেন। বাইরে থেকে গোপাল দরজায় দমাদ্দম লাথি মারতে থাকে আর চিৎকার করতে থাকে, ‘বাঁচাও বাঁচাও’। পাড়ার ক্লাবের ছেলেরা দৌড়ে আসে, আশেপাশের বাড়ির লোকেরা হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসে। সকলের ঠেলাঠেলি, লাথালাথিতে দরজা ভেঙে যায়। দেখা যায় গোপালের মা গলায় গোপালের বউয়ের শাড়ি বেঁধে ‘অজ্ঞান’ অবস্থায় মাটিতে পড়ে আছে। ‘মা মা’ বলে ককিয়ে চিৎকার করে ওঠে গোপাল। সকলে মিলে কেউ ফ্রিজ থেকে, কেউ বাথরুম থেকে জল এনে মায়ের চোখে মুখে ঝাপটা মারতে থাকে। আস্তে আস্তে জ্ঞান ফেরে মায়ের।

পালটা হিসেবে পরের দিনই বউ কেরোসিন তেলের জ্যারিকেন খুলে সারা গায়ে ঢেলে আগুন লাগাবার আপ্রাণ চেষ্টা করেও চরম ব্যর্থ হয়। পরপর চারচারটে দেশলাই কাঠি জ্বেলেও শাড়িতে ঠেকাবার আগেই নিভে যায়। এই বিশাল পরিমাণ সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে গোপাল ছাড়ে না। দৌড়ে গিয়ে ছোঁ মেরে দেশলাই কেড়ে নিয়ে সে যাত্রা বউ ও নিজেকে বাঁচাতে সক্ষম হয়। বলাবাহুল্য এ দুটো ঘটনাই বাড়িতে গোপালের উপস্থিতিতে ঘটেছিল। মন্দজনে বলাবলি করে দুটোই নাকি চিৎপুরের কোনও এক হিট যাত্রা পালার অংশ থেকে ধার নেওয়া।

গোপাল দিনরাত আতঙ্কে থাকে, এই বুঝি কিছু একটা হয়ে গেল। এই বুঝি মা আবার ঝুলে পড়ল, এই বুঝি বউ নিজের গায়ে আগুন লাগিয়ে দিল। অফিসে কাজে মন দিতে পারে না, ক্লাবে আড্ডা দিতে যেতে পারে না, না জানি বাড়ি গিয়ে কী দেখবে! ঘনঘন মোবাইল চেক করে, কোনও দুঃসংবাদ এল কিনা। মনে শান্তি নেই, চোখে ঘুম নেই, কাজে মন নেই। চব্বিশ ঘণ্টা তাকে একটাই আতঙ্ক তাড়া করে বেড়ায়– এই বুঝি, এই বুঝি… মনে মনে সে দুজনের যে-কোনও একজনের মৃত্যু কামনা করে– মা অথবা বউ, বউ অথবা মা, যে-কোনও একজনকে যেতেই হবে, তা না-হলে সে নিজে বাঁচবে না। অথচ দুজনের কেউ একজন আত্মহত্যা করেছে ভাবলেই সে শিউরে ওঠে, কী অস্বাভাবিক অন্তর্দ্বন্দ্ব! এক এক সময় ভাবে, দরকার নেই দুজনের কাউকেই, দুজনেই চরম স্বার্থপর, যে যার নিজেরটাই শুধু বোঝে, তার কথা কেউ ভাবে না, ভাবলে এই রকম আচরণ করত না। কেউ তাকে ভালোবাসে না।

গোপাল ঠিক বুঝতে পারে না কার দোষ। মায়ের কথা শুনলে মনে হয় সব দোষ বউয়ের। আবার বউয়ের সব কথা শুনলে মনে হয় যত নষ্টের গোড়া ওই মা। মা না বউ, বউ না মা, মা না বউ, বউ না মা। ওঃ, গোপাল আর পারে না, ও কি পাগল হয়ে যাবে? এখন ও সবসময় ভাবে, কেন যে মরতে বিয়ে করতে গেলাম!

বন্ধুরা অনেকেই বলে, ‘গোপাল, শাশুড়ি-বউয়ের ঝগড়া নিত্যসত্য, জীবনের অঙ্গ, আমাদের জীবনেও আছে বা ছিল, সব ঠিক হয়ে যাবে।’ কেউবা বলে, ‘যদি সত্যিই বাঁচতে চাস তবে বউকে নিয়ে আলাদা হয়ে যা। কিন্তু বউকে নিয়ে আলাদা হয়ে গেলে বৃদ্ধা মাকে দেখবে কে? বাবা মারা গেছেন মায়ের কোলে আড়াই বছরের গোপালকে রেখে। তারপর থেকে মা-ই বাবা, মা-ই মা।

জ্ঞানবয়সে বাবার স্বাদ পায়নি গোপাল। বাবা কি জিনিস সে জানে না। স্কুলে বন্ধুবান্ধবদের কাছে যখন তাদের বাবাদের গল্প শুনত, তখন ওর খুব দুঃখ হতো। ওদের বাবারা অফিস থেকে ফেরবার সময় টফি, চকোলেট, ক্যাডবেরি, আইসক্রিম, নতুন নতুন খেলনা নিয়ে আসে। অফিস থেকে ফিরে কত আদর করে বাবারা। ছুটির দিনে ওদের সঙ্গে ফুটবল, ক্রিকেট খেলে। কার বাবা কাকে কত ভালোবাসে এই নিয়ে ওর বন্ধুবান্ধবদের মধ্যে প্রায়ই ঝগড়া হতো। গোপাল ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকত সেই দিকে। ওর শিশুমন কল্পনা করার চেষ্টা করত ফোটোর বাবা অফিস থেকে ফিরে জামাকাপড় না ছেড়েই ওকে কোলে তুলে নিল। চুমোয় চুমোয় ভরিয়ে দিল ওর মুখচোখ। তারপর পকেট থেকে বার করল মুঠো মুঠো চকোলেট, লজেন্স, ক্যাডবেরি।

ছোটোবেলায় গোপাল প্রায়ই স্বপ্ন দেখত বাবা ওকে পার্কে বেড়াতে নিয়ে গেছে। নাগরদোলা চড়াচ্ছে, ওকে ওপরে ছুড়ে দিয়ে লুফছে, ওর সঙ্গে ফুটবল, ক্রিকেট, লুকোচুরি খেলছে, ওকে বকছে, শাসন করছে, পড়াচ্ছে। সকালে ঘুম ভাঙার পর বাবার ওপর ওর খুব রাগ, অভিমান হতো। বাবা কেন ওকে ফেলে, মাকে ফেলে ‘তারা’ হয়ে গেল, বাবা খুব দুষ্টু!

বাবার অকাল মৃত্যুর পর মা-ই ওদের তিন ভাইবোনকে অতিকষ্টে মানুষ করেছে, লেখাপড়া শিখিয়েছে। সমাজে পরিচয় দেবার মতো করে তৈরি করেছে। বাবা বেসরকারি অফিসে চাকরি করতেন। তাই বাবার অফিসে অনেক চেষ্টা করেও মায়ের কোনও চাকরি হয়নি। তবে অফিসেরই কেউ কেউ বাঁকা পথে চাকরি পেতে সাহায্য করার বদলে টাকাপয়সা এবং আরও অনেক কিছুই চেয়েছিল। শেষ পর্যন্ত কয়েকটা টিউশনি আর রান্নার কাজ ধরে মা নড়বড়ে সংসারটাকে কোনওরকমে দাঁড় করায়।

মা যে লোকের বাড়ি রান্নার কাজ করত তা মা কাউকে কোনওদিন বলত না। বাড়িতেও কেউ জানত না, গোপালও না। ‘পড়াতে যাচ্ছি’ বলে গোপালের মা বাড়ি থেকে বেরোত। একদিন গোপালের মামা হঠাৎ অফিস থেকে গোপালদের বাড়িতে এসে হাজির। মামার বাড়ির দাদুর খুব শরীর খারাপ, দাদুর ইচ্ছা এখনই মাকে নিয়ে যেতে হবে। তাই মামা নিজেই এসে হাজির। গোপালকে পাঠানো হল মায়ের ছাত্রীর বাড়ি। সেখানে গিয়ে গোপাল শুনল, ‘তোর মা রান্না করে চলে গেছে’। গোপাল ব্যাপারটা বুঝতে পারেনি। ভেবেছিল মা ভালো রান্না করতে পারে বলে হয়তো আবদার করে মাকে দিয়ে কিছু রান্না করিয়ে নিয়েছে। পরে একদিন মাকে জিজ্ঞেস করাতে মা ওর মুখে হাত দিয়ে চেপে ধরেছিল। বলেছিল, ‘আর কাউকে ওসব কথা কোনওদিন বলিসনি’। নাঃ, গোপাল আর কোনওদিন ও কথা মুখেও আনেনি। বাড়িতেও কাউকে বলেনি। যদিও কথাটার অন্তর্নিহিত অর্থের মাথামুন্ডু সে তখন কিছুই বোঝেনি।

সেই মাকে একা অসহায় ভাবে ফেলে রেখে সে কেমন করে শুধুমাত্র ব্যক্তিগত সুখের সন্ধানে ফ্ল্যাট কিনে চলে যাবে?

ঘাড়টা সামনের দিকে ঝুঁকে পড়েছে। জিভটা মাকালীর মতো আধফুটের মতো বেরিয়ে এসেছে। চোখদুটো কোটর ঠেলে প্রায় বাইরে বেরিয়ে এসেছে। যেন ড্যাবডেবিয়ে গোপালের দিকেই তাকিয়ে আছে, বলছে, তুমিই, হ্যাঁ হ্যাঁ তুমিই দায়ী। বাড়িতে লোকে লোকারণ্য। এটা মফসসল এলাকা। এখানে কেউ খুন হলে বা আত্মহত্যা করলে এখনও জমাট ভিড় হয়। সবাই ফিসফিসিয়ে গোপালের বউ সীমার আত্মহত্যার সম্ভাব্য কারণ নিয়ে আলোচনা করছে। এরকম একটা পরিণতির ধারণা যে অনেকের মধ্যেই ছিল তার ইঙ্গিত দিচ্ছে। এরই মধ্যে হুড়মুড়িয়ে পুলিশ এসে হাজির।

আচমকাই গোপালের ঘুমটা ভেঙে যায়। এই শীতেও তার সারা শরীরে ঘামের স্রোত বয়ে যায়। ও ভাবে, ওঃ সীমা তাহলে আত্মহত্যা করেনি। বিছানায় শুয়ে শুয়েই ও ভাবতে চেষ্টা করে, এটা সত্যিই স্বপ্ন তো!

এর আগেও একদিন গোপাল স্বপ্ন দেখেছে ওর মা বিষ খেয়ে হ্যাঁচোড়প্যাচোড় করছে আর পাড়া মাথায় করে চ্যাঁচাচ্ছে, ‘গোপাল আমি বিষ খেয়েছি, আমি চললাম, তুই বউকে নিয়ে সুখে থাকিস।’

গোপাল, ‘আর হবে না মা, আর কখনও হবে না, এবারের মতো ক্ষমা করে দাও’ বলে কান্নাকাটি করছে। হঠাৎ মা দুম করে মাটিতে পড়ে গেল আর চমকে উঠে গোপালেরও ঘুম ভেঙে গেল।

গোপাল নিখোঁজ। আগের দিন রাতে মা-বউতে তুলকালাম হয়েছে। মুখের সীমান্ত পেরিয়ে গতকাল যুযুধান দুইপক্ষে তুমুল হাতাহাতি হল। শেষ পর্যন্ত তা রক্তারক্তিতে গড়াল। শাশুড়ি গ্যাস আভেনে রুটি সেঁকতে সেঁকতে গরম খুন্তি দিয়ে বউকে ঘা কতক দিতেই বউ মড়াকান্না জুড়ে দিয়ে শাশুড়ির মাথায় সাঁড়াশির বাড়ি দমাদ্দম লাগিয়ে দিল। দুপক্ষই রক্তারক্তি। প্রবল চিৎকার চ্যাঁচামেচিতেও পাড়ার কেউ এল না। কারণ এটা এ বাড়ির নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। দুর্গাপুজোয় ভিড় হয়, ট্রাফিক জ্যাম হয়, নিত্যপুজোয় ওসব কিছু হয় না। রাতবিরেতে ডাক্তার, হাসপাতাল সবই হল। হাতে, মাথায় ব্যান্ডেজ বেঁধে দুপক্ষ মাঝরাতে বাড়ি ফিরল।

স্বভাবতই পরের দিন শাশুড়ি, বউ উভয়েরই ঘুম ভাঙল বেশ দেরিতে। উঠে দেখল, গোপাল নেই। ভাবল, হয়তো দোকান বাজার গেছে, এখনই ফিরবে। কিন্তু বেলা গড়ায়, গোপালের দেখা নেই। ভাবল, রাগ করে বেরিয়ে গেছে, রাগ পড়লেই ফিরে আসবে। সকাল গড়িয়ে বিকেল, বিকেল গড়িয়ে সন্ধে, সন্ধে গড়িয়ে রাত হল, কিন্তু গোপালের দেখা নেই। খবরটা সারা পাড়া ছড়িয়ে পড়েছে। গোপালের শ্বশুরবাড়ি পর্যন্ত খবর পৌঁছে গেছে। বন্ধুবান্ধব, পাড়াপড়শি, আত্মীয়স্বজন সবাই মিলে তন্নতন্ন করে খোঁজ করে গোপালের। কিন্তু না, কোনও হদিশই নেই।

– গোপাল কি মা-বউয়ের ওপর রাগ করে বিবাগি হয়ে গেল?

– গোপাল কি বাড়িতে দিনরাত অশান্তির জেরে দু-চার দিনের জন্য কোথাও আত্মগোপন করল?

গোপালের অন্তর্ধানে কিন্তু বাড়ির অশান্তি থেমে থাকল না, বরং তা অন্য মাত্রা নিল। মা-বউকে বলল, ‘তুই আমার ছেলেকে খেয়েছিস!’ আর বউ মাকে বলল, ‘তোর জন্যই ও বাড়ি ছেড়ে চলে গেল।’

তিন দিনের দিন– আশেপাশের এলাকা দুর্গন্ধে ভরে যায়। মানুষজন নাকে রুমাল দিয়ে হাঁটতে থাকে, ভাবে বেড়াল বা রাস্তার কুকুর মরেছে। কিন্তু বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ে দুর্গন্ধের তীব্রতা। পুলিশ আসে। গোপালের বাড়ির উলটোদিকে একটা পরিত্যক্ত কারখানা থেকে উদ্ধার হয় গোপালের পচাগলা ঝুলন্ত দেহ।

‘বউকে দুলাখ টাকা দিয়ে গেলাম। টাকাটা কো-অপারেটিভ ব্যাংকে আছে। বউ যেন টাকাটা পায়। মা, তুমি আমাকে ক্ষমা কোরো। তোমাকে খুব ভালোবাসি। দিদিকে, বোনকেও খুব ভালোবাসি। সবাইকে নিয়ে সুখে শান্তিতে বাঁচার চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু পারলাম না, হেরে গেলাম। পুলিশ যেন কাউকে না ধরে। আমার মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী নয়।’ পরের দিন বালিশের ওয়াড়ের ভেতর থেকে উদ্ধার হল গোপালের সুইসাইড নোট।

গোপালের বাড়িতে এখন চরম ‘শান্তি’ বিরাজ করছে। গোপাল তো এটাই চেয়েছিল! তাই না?

 

নীরবে

আমরা দুজন একটি গাঁয়ে থাকি, সেই আমাদের একটিমাত্র সুখ..

ছেলেকে স্কুলে পৌঁছে দিয়ে ফেরার পথেই অর্ণবের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল তৃয়ার। একেবারে মুখোমুখি। একমুখ দাড়ি আর ঢলঢলে পাঞ্জাবিতে বেশ অচেনাই লাগছিল তাকে। তবু তৃয়া চিনেই ফেলে, প্রায় আঠারো বছর পরেও। সেই আগের চঞ্চল, ডায়নামিক অর্ণব বদলে গেছে অনেকটাই। অবাক হয়ে লক্ষ্য করছিল তৃয়া। সেদিন দুজনে হেঁটে গিয়েছিল কিছুটা পথ। তৃয়ার মনে পড়ে যাচ্ছিল কলেজের সেই সব দামাল দিনগুলোর কথা। তখনও তো তারা হেঁটে গিয়েছিল কত কত পথ একসঙ্গে, পায়ে পা, হাতে হাত মিলিয়ে কথা ফুরোত না দুজনেরই।

অর্ণব একের পর এক সুনীল, শক্তি, কিটস, শেলি আবৃত্তি করত আর তৃয়া মুগ্ধ হয়ে শুনত। দুজনে মিলে গড়ে তুলেছিল তাদের নিজস্ব জগৎ। কখনও বা উদাত্ত গলায় গেয়ে উঠত অর্ণব –

এই তো হেথায় কুঞ্জ ছায়ায় স্বপ্ন মধুর মোহে, এই জীবনের যেকটি দিন পাব, তোমায় আমায় হেসে খেলে

খিল খিল করে হেসে উঠত তৃয়া। তারপর দুজনে সেই মধুর স্বপ্ন দেখত দুচোখ ভরে।

হাঁটতে হাঁটতে আড়চোখে অর্ণবকেই দেখছিল তৃয়া। একটু বেশিই বয়স্ক দেখাচ্ছে না! অথচ তারা তো একই বয়সি। তেমন কথা বলছে না অর্ণব আগের মতো। তৃয়াই বলে চলছে তার স্বামীর কথা, সন্তানের কথা, আরও কত কী! অর্ণবের কি কোনও গল্পই নেই?

চা খাবি? এখানে একটা আড্ডা-ঘর খুলেছে, ওই কফি হাউসের ছোটো সংস্করণ আর কি! দার্জিলিং টি-টা দারুণ বানায়। এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে জিজ্ঞাসু চোখে তাকাল তৃয়া।

না রে! চা খাই না এখন আর, অল্প হাসল অর্ণব।

চা খাস না! এত নেশা ছিল! অবাক হয় তৃয়া।

সে তো কত কিছুরই নেশা ছিল, বলেই থমকাল অর্ণব।

তৃয়ার বুকের ভেতরটা হঠাৎই কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগল। অর্ণব-কে তা বুঝতে না দিয়ে হালকা গলায় বলে উঠল, হ্যাঁ রে, কিছু নেশা শেষ অবধি টানা যায় না।

আচমকা দুজনের মাঝখানে একটা নিস্তব্ধতা চলে এল। এ নীরবতা ভাঙার সাধ্য তৃয়ার অন্তত নেই।

(২)

ব্যাপার কী! ক’দিন খুব অন্যমনস্ক দেখছি। মাথায় একটা হালকা চাঁটি মারল সৈকত। চমক ভেঙে সৈকতের চোখের দিকে তাকাল তৃয়া। ওর চোখ জুড়ে কৌতুক।

তৃয়াও হেসে জবাব দিল, ভাবছি।

ভাবছ! তা কী ভাবা হচ্ছে ম্যাডাম? আমার পক্ষে না বিপক্ষে? হাসতে হাসতেই বলল সৈকত।

ছেলেটা মহা ফাজিল। বাড়িতে থাকলে সারাক্ষণ মাতিয়ে রাখে। অন্য কিছু ভাবারই অবকাশ পায় না তৃয়া।

যদি বিপক্ষে ভাবি… তৃয়া চোখ নামাল।

সে কি ম্যাডাম! পুরোনো প্রেম আবার এল কি ফিরিয়া?

সৈকত কি বুঝে নিল কিছু! তৃয়া সৈকতের এলোমেলো চুলগুলো আরও খানিকটা ঘেঁটে দিয়ে বলল, পাগল একটা!

হেসে উঠল সৈকত। তৃয়ার কপালে স্নেহ চুম্বন আঁকতে আঁকতে বলে উঠল- তুই জীবন ছাইড়া গেলে মাইনষে কইবে মরা জীবন রে..

সৈকত-কে আঁকড়ে ধরল তৃয়া, প্রবল ভাবে।

(৩)

আবার দেখা যদি হল সখা প্রাণের মাঝে আয়…

অ্যাই অর্ণব! এত হনহন করে যাচ্ছিস কোথায়?

তোর সঙ্গে পরে কথা বলছি তৃয়া, একটু ব্যস্ত আছি।

অবাক হয় তৃয়া। ঠিক অবাক অবশ্য নয়, গলাটা কেমন ব্যথা ব্যথা করছে। গত দুদিন ধরেই অর্ণব এটা করে চলেছে। যখনই ডাকছে তৃয়া, সময় নেই ওর। অথচ তৃয়া টের পাচ্ছে সমস্ত কলেজ জুড়ে অর্ণবের তীব্র উপস্থিতি। শুধু তৃয়া ডাকলেই…

অভিমান করে তৃয়া। এড়িয়ে চলারও চেষ্টা করে। পারে কি? উলটে কী এক অমোঘ টানে আরও কাছে কাছে চলে আসে অর্ণবের। তৃয়া অপেক্ষা করে ওই একটি মাত্র ডাক শোনার জন্য!

(৪)

সুখের সংসার বলতে ঠিক যা বোঝায় তৃয়ার সংসারটাও ঠিক তেমনই। তবু হঠাৎ হঠাৎ এই সুখের মধ্যিখানে অর্ণব নামের একটা কাঁটা অনবরত খোঁচাতে থাকে। তৃয়া রক্তাক্ত হয়, জখম হয় সৈকতও। অথচ এই রক্তক্ষরণ বন্ধের উপায় জানা নেই কারাওরই। সৈকতের ভালোবাসার কাছে সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণ করার পরও, তৃয়া বুঝতে পারে কোথায় যেন কিছু শূন্যস্থান এখনও রয়ে গেছে। আজও কোনও অলস দুপুরে বা একাকী রাতে ছাদে দাঁড়ালে এক রাশ হিমেল বাতাস কোত্থেকে এসে, তৃয়ার সব কিছু উড়িয়ে নিয়ে চলে যায়। দু’গাল বেয়ে লোনা জল হু হু করে গড়িয়ে যেতে থাকে। তৃয়া আর আটকায় না তাকে। সে জানে এই শূন্যস্থান একমাত্র পূরণ করতে পারে অর্ণব। শুধু একটিবার দেখা হোক।

 

দীর্ঘ দিবস দীর্ঘ রজনী ,দীর্ঘ বরষমাস…

ঝগড়া, ভুল বোঝাবুঝি, চিত্কার নাহ্ তাদের সম্পর্কের মধ্যে এগুলো কোনওদিনই অযাচিত ভাবে ঢুকে পড়েনি। শুধু তৃয়া যেদিন টের পেল অর্ণব স্বেচ্ছায় দূরে চলে যেতে চাইছে, আর পিছু ডাকেনি সে। হয়তো কেঁদেছে, তবে সে কান্নার খবর অর্ণব পায়নি। হয়তো অভিমান করেছে, মনে মনে অসম্ভব যুদ্ধ করেছে, আঁচড়ে কামড়ে দিয়েছে অর্ণবকে শুধু ধরা দেয়নি আর কিছুতেই। কোনওদিন জানতে চায়নি তৃয়া, কেন? দাঁতে দাঁত চেপে থেকে গেছে এতগুলো দিন।

বাবা-মায়ের পছন্দ করা ছেলে সৈকতকে হয়তো ভালোবেসেছে একদিন। তবু! এখনও কলেজের ওই রাস্তাগুলো দিয়ে কোনও সময় চললে অজান্তেই ঘাড় ঘোরায় তৃয়া। কেউ কি ডাকছে? ওই তো ওই ছেলেটা! অর্ণব না! ভুলতে চেয়ে কিছুতেই আর ভুলে যেতে পারেনি তৃয়া, কিছুতেই না।

আজ এতগুলো বছর পর অর্ণবকে দেখে পুরোনো সবকিছুই আবার যেন চোখের সামনে চলে আসছিল। সামনের দিকে হাঁটতে হাঁটতে পিছিয়ে যাচ্ছিল তৃয়া… ওই তো সেদিন কলেজের সামনের সেই বিরাট খেলার মাঠে বসে তারা দুজন ভিড়, কোলাহলের মধ্যেই দুজনে দুজনাতে মগ্ন। কখনও হাতে হাত ছুঁয়ে হেঁটে যাচ্ছে চেনা-অচেনা পথ পেরিয়ে অলীক সুখের দিকে। সে হাঁটা আর আজকের হাঁটার সঙ্গে তেমন মিল খুঁজে পেল না তৃয়া। তখন হাঁটতে গিয়ে সময়ে খেয়াল থাকত না দুজনেরই। আজ বারবার হাত ঘড়িটার দিকে তাকাচ্ছে তৃয়া। ছেলের ছুটি ১-টায়, সৈকতও আজ আগেই ফিরবে। আইনক্স-এ জঙ্গল বুক-এর টিকিট কাটা।

অবাক হয় সে। গলার মধ্যে সেই আঠারো বছর আগেকার কষ্ট কষ্ট ব্যথাটা আর নেই তো! অর্ণবের কথা জানতে ইচ্ছে করে তার। কী করে সে এখন? চাকরি জুটিয়েছে আদৌ? বিয়ে করেছে? অর্ণবের অদ্ভুত শীতলতার কাছে আজও তৃয়া নিজেকে খুলতে পারে না। দুজনে হাঁটতে হাঁটতে এগিয়ে যায় আরও কিছুটা দূর।

তুই এখনও কবিতা লিখিস? জানতে চায় তৃয়া।

ম্লান হাসে অর্ণব, কবিতা আর ধরা দেয় না রে। হারিয়ে গেছে অক্ষর, আঠারো বছর আগে।

একদিন হারাবে অক্ষর, সেদিনও কি প্রেম থাকবে? শব্দ বদলে ভালোবাসা দেব, শুধু তুই ছুঁয়ে থাকলে মন্ত্রের মতো — উচ্চারণ করে তৃয়া।

তোর এখনও মনে আছে? এবার যেন অর্ণবের অবাক হওয়ার পালা।

ওই একটা ডায়ারিতে লিখে রেখেছিলাম, মাঝে মধ্যে চোখে পড়ে, তাই হয়তো মনে আছে। চোখ নামাল তৃয়া।

অর্ণব হাসল। হয়তো বুঝে নিল শুধু এই কবিতাটিই না, অর্ণবের লেখা প্রায় সব কবিতাই হুবহু বলে দিতে পারে তৃয়া আজও।

তুই আজও গান গাস? আচমকাই জানতে চায় অর্ণব।

গা-ন! ধুর, সময় কোথায়? ছেলে যা দুষ্টু। তৃয়া হাসে। সৈকত বলে, জানিস তো! আবার শুরু করার কথা… কিন্তু!

কিন্তু কী?

আর নতুন করে কোনও কিছু শুরু করতে ইচ্ছে করে না রে। তৃয়ার গলায় সামান্য হতাশা কি ঝরে পড়ল?

অর্ণব হাসল আবার। আড়চোখে তৃয়াকে দেখল সে। বারবার ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছে মেয়েটা। পুরোদস্তুর সংসারি হয়ে উঠেছে। আগের চাইতে অনেক বেশি সুন্দরী আর পরিণত লাগছে তাকে। ভালো লাগল অর্ণবের। এই পরিপূর্ণতা সে কোনওদিনই দিতে পারত না তৃয়াকে, কোনওদিনই না।

ইদানীং সৈকতকে আরও বেশি করে আঁকড়ে ধরতে মন চায় তৃয়ার। অফিসে থাকলে ঘনঘন ফোন বেজে ওঠে সৈকতের, কখন আসবে? সৈকত বুঝতে পারে আর তাদের মধ্যে কোনও কাঁটা নেই। তার অজান্তেই কে যেন সরিয়ে নিয়েছে ওটা, তাদের মাঝখান থেকে। সৈকত স্ত্রী-র কাছে কিছু জানতে চায় না। কিছু জানারও নেই তার। সৈকত শুধু জানে তারা বাঁচবে একসঙ্গে আরও দীর্ঘ দীর্ঘ বছর।

 

মম দুঃখবেদন মম সফল স্বপন তুমি ভরিবে সৌরভে..

আর বেশি দূর এগোনো যাবে না রে, ছেলেটার ছুটির আগে স্কুলের গেটের কাছে পৌঁছোতে হবে, নইলে কান্নাকাটি শুরু করে দেবে। হালকা গলায় বলে উঠল তৃয়া।

ওহ্ যাবি? তা যা, হঠাৎ যেন চমক ভাঙল অর্ণবের।

সরাসরি তৃয়া-র দিকে তাকাল অর্ণব। একটু হাসল। কিছুই তো জানতে চাইলি না?

জেনে গেছি যে! তৃয়ার গলায় হাসি ঝরে পড়ল।

কী জেনে গেছিস? জানতে চাইল অর্ণব।

সে আর তোর শুনে কাজ নেই। আমি চলি রে। খুব ভালো থাকিস। বলেই হাতটা বাড়িয়ে দিল তৃয়া।

হাত বাড়িয়ে আবার সেই পুরোনো স্পর্শ খুঁজে পেল অর্ণব। কিন্তু সেই অতীতের উষ্ণতার দেখা মিলল না। হাত ছেড়ে তৃয়া হাঁটতে শুরু করল, যেখানে তার ছেলে অপেক্ষা করছে। সৈকত-কেও হোয়াটসঅ্যাপ-এ মিস ইউ লিখে পাঠিয়ে দিল তৃয়া। হাঁটতে হাঁটতেই শুনতে পেল অর্ণব বলছে, একবার কিছু বলার সুযোগ দিতে পারতিস! তৃয়া? একবার শুনে যা…

তৃয়া এই ডাকটার জন্যই তো এতদিন অপেক্ষা করছিল। কিন্তু আজ আর কিছু শুনতেই ইচ্ছে করল না তার। তৃয়া তার হাঁটার গতি বাড়িয়ে দিল।

পাপ

বোতলের অনেকটা তরল একসঙ্গে গলায় ঢালে বাচ্চু। আজ আর কিছুই ভালো লাগছে না। দুদিন ভালো করে খাওয়া হয়নি। সিগারেট খেলে বুকের ভেতরটা জ্বালা করে আজকাল। চলতে গেলে পা কাঁপে। অথচ বাচ্চুর চেহারা বেশ ভালোই ছিল। আগে নিয়মিত ব্যায়াম করত। পঞ্চাশ ইঞ্চি বুক ছিল। এখন সেসব স্বপ্ন মনে হয়। বাবা মারা যাওয়ার পর অভাব আর দারিদ্র্য যেন ওর জীবনের সঙ্গী হয়ে গেছে। পড়াশোনাটা ভালো করে করলে হয়তো একটা চাকরি পাওয়া যেত। একসময়ে স্বাস্থ্যের গৌরবে সে অচিরেই হয়ে উঠেছিল পাড়ার হিরো। কিন্তু এই হিরোই একসময় হয়ে উঠল এক চলমান ত্রাস। একজন অ্যান্টি সোশ্যাল। বাচ্চা থেকে বুড়ো সবাই বাচ্চুকে ভয় পেত। আর পাড়ার মেয়েদের তো নিশ্চিন্তে ঘোরাফেরা করার উপায়ই ছিল না। অথচ জীবনটা কীরকম বদলে গেল। মা সেই কোন ছোটোবেলায় মারা গেছে। তারপর বাবাও চলে গেল। একটা ছোটো বোনকে রেখে গেল বাচ্চুর জিম্মায়। রোজগারের কোনও নিশ্চয়তা নেই। কোনওমতে দিন চলে। কখনও রাজনৈতিক দলের হয়ে কাজ করে। আবার কখনও হয় বড়ো ব্যবসাদারের ভাড়া করা গুণ্ডা। দুবার জেলও খেটেছে বাচ্চু। বোনটা পাড়ার এক বুড়ি পিসিমার কাছেই মানুষ। এখন শরীরটাও চলে না। ক্ষমতায় এখন অন্য রাজনৈতিক দল। স্বাভাবিক কারণেই এখন বাচ্চুর রোজগারও কম হয়। বোনটা তো অসুখে ভুগে ভুগে কঙ্কালের রূপ নিয়েছে।

নেশার পাত্রটা শেষ করে চোখদুটো খুলল সে। রোখ চেপে যাওয়া গলায় বলল ‘ওঠ’। পাশে বসা মনু বলল, ‘গুরু বোতলটা শেষ করে গেলে হতো না?’

ক্লান্তস্বরে বাচ্চু বলল, ‘না ওটা ফেলে দে। আজ একবার শেঠ বাজোরিয়ার কাছে যেতে হবে। কিছু টাকার দরকার বুঝলি? বোনটাকে ওষুধপত্র না দিলে ও মরে যাবে।’

‘কাজ ছাড়া কি শেঠ টাকা দেবে?’

‘ওর বাপ দেবে। ওর জন্য আমি কম খুন, জখম করেছি?’

‘ওর তো এখন পেয়ারের লোক বিল্লে, যাকে তুমি হাতে ধরে বানিয়েছ।’ প্যান্টের পকেটে রাখা রামপুরী চাকুটা একবার অনুভব করল বাচ্চু। চোখদুটো লাল। দাঁতে দাঁত চেপে রাগে গর্জন করে উঠল। তারপর বলল, ‘আমি যদি টাকা না পাই তবে দুটোকে সাফ করে দেব।’

‘গুরু তার চেয়ে চামেলির ওখানে চলো। ও যদি কিছু টাকা দিতে পারে।’

‘ওই ভোগলালসার টাকা আমি ছুঁই না। তার থেকে কাঁচড়াপাড়ায় চল দেখি আমার ছোটো মামার থেকে কিছু পাই কিনা।’

স্বপনলালের চায়ের দোকানের পিছনে ওরা এতক্ষণ বসে ছিল। দোকান থেকে বেরোতে বেরোতে কী যেন একটু ভেবে নিয়ে মনুকে বলল, ‘তুই এখন যা, আমাকে একটু একা থাকতে দে।’

নানা জায়গায় ঘুরতে ঘুরতে চামেলির বস্তির সামনে এসে দাঁড়াল বাচ্চু। রাস্তার কলের জলে দু’চার জন মেয়েমানুষ বুকে গামছা জড়িয়ে স্নান করছিল। ফুটপাথের ওপর দু’চারটে বাচ্চা খেলা করছে। অদ্ভুত এদের জীবন। দুঃখটা কেমন সহজ করে মেনে নিয়েছে। কোনও আশা নেই প্রত্যাশা নেই শুধু কোনও রকমে বেঁচে থাকা। চামেলির ঘরের বাইরে টুলের ওপর ওর স্বামী বসে চা খাচ্ছিল। একটু হেসে বলল, ‘কি খবর বাচ্চুদা?’

বাচ্চু সে কথার জবাব না দিয়ে বলল, ‘চামেলি কোথায়?’

‘ঘরেই আছে। একটু ব্যস্ত আছে।’

চামেলির এই দেহদান বাচ্চুর একটুও ভালো লাগে না। পয়সার জোর থাকলে বড়ো বড়ো উপদেশ দেওয়া যায়। চামেলির চারটে বাচ্চা, তার ওপর ওর স্বামীর কোনও রোজগার নেই। মাঝে মাঝে ভাবে বাচ্চু, জীবনটা কি এতই সুন্দর যা কোনওভাবে বাঁচিয়ে রাখতেই হয়।

একটা সিগারেট ধরাল বাচ্চু। মাথাটা খুব ধরেছে। কী করবে সে। তারপর বলল, ‘আমি ঘুরে আসছি।’

চামেলির স্বামী বলল, ‘সেই ভালো, জানি না তো কতক্ষণ লাগবে।’

রাত বারোটার পর যখন চামেলির ঘরে ঢুকল বাচ্চু, চামেলি তখন ক্লান্ত। বড়ো বড়ো হাই উঠছে। বাচ্চাগুলো জড়াজড়ি করে ঘুমিয়ে আছে তেলচিটে বিছানাটাতে। চামেলি বলল, ‘হঠাৎ পথ ভুল করে এখানে?’

চৌকির ওপর বসতে বসতে বাচ্চু বলল, ‘বোনটার খুব অসুখ। তাই বেরিয়েছিলাম টাকার সন্ধানে।’

‘কী হয়েছে নীতার?’ অনেক জানার আগ্রহ চামেলির মুখে।

‘জানি না। তবে আজ ক’দিন ধরে কিছু খাচ্ছে না।’

‘ডাক্তার দেখিয়েছ?’

‘হ্যাঁ, ছোটোখাটো ডাক্তার দেখিয়েছি, কিছুই ধরতে পারছে না।’

‘কোনও বড়ো ডাক্তার দেখাও।’

একটু হাসল বাচ্চু, বলল, ‘খাবার পয়সা নেই ডাক্তার দেখাব!’

‘আমি পয়সা দেব, তুমি নীতাকে বাঁচাও।’

‘সে হয় না চামেলি। তোমার রোজগারের লজ্জা আমাকে দিনরাত কুরে কুরে খাবে।’

‘তবুও তুমি না কোরো না। আমি যদি আমার সমস্ত লজ্জা, ঘৃণা ত্যাগ করে আমার বাচ্চাদের বাঁচিয়ে রাখতে পারি, তবে নীতাকেও বাঁচাতে পারব। আমি বড়ো বড়ো শেঠের কাছে যাব। অনেক টাকা আনব।’

বাচ্চু হঠাৎ চামেলির মুখ চেপে ধরে, রাগে ওর শরীর জ্বলছে। বলে, ‘না। ওই পয়সাওয়ালা লোকদের ভোগের সামগ্রী হতে দেব না তোকে। এবার, যদি না পাই তবে ছিনিয়ে নেব। ওইসব বাড়ির মেয়েদের লাজলজ্জা আছে, আমাদের মা-বোনেদের নেই?’ চামেলির ঘর ছেড়ে রাস্তায় নেমে পড়ল বাচ্চু। মাথাটা কেমন ঘুরছে, কান গরম।

দুদিন পর বাড়ি ফিরল বাচ্চু। নীতার অবস্থার আরও অবনতি হয়েছে। ঘরের এককোণে নেতিয়ে পড়ে আছে মেয়েটা। জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে। চারদিন কিছু খায়নি। পাড়ার ডাক্তার জীবেনবাবু কোনও বড়ো ডাক্তারকে দেখাতে বলেছেন।

‘এখন কী করবে করো।’ পিসিমা রাগে গজগজ করতে করতে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল। বাচ্চু নীতার মাথায় হাত দিল। জ্বরটা এখনও আছে। চোখের দু’ধারে শুকনো জলের দাগ। অচৈতন্যের মতো পড়ে আছে। কষ্টের ছাপ ওর মুখে।

বাচ্চু ডাকল, ‘নীতা’।

নীতা চোখ খুলে চেয়ে রইল।

‘খুব কষ্ট হচ্ছে না রে?’

নীতা কিছু বলল না।

‘একটু ফলের রস খাবি?’

নীতা মাথা নাড়ল।

‘একটু কিছু খেয়ে নে,’ মাথায় হাত বোলাল বাচ্চু।

‘ভীষণ কষ্ট হচ্ছে দাদা।’

‘কোথায় কষ্ট হচ্ছে বল।’

নীতা নিজের পেটের ওপর দৃষ্টি নামাল।

আবার বাচ্চু বলল, ‘খুব ব্যথা হচ্ছে নীতা?’

‘হ্যাঁ দাদা, ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। আচ্ছা দাদা তুই বাড়ি আসিস না কেন? আমার কথা তোর একটুও মনে পড়ে না?’

বাচ্চুর চোখ ফেটে জল এল। ওর পেটে হাত বোলাতে বোলাতে বলল, ‘তোর জন্য বড়ো ডাক্তারের কাছে যেতে হবে। অনেক টাকার দরকার তাই কাজ করি।’

‘তুই কত রোগা হয়ে গেছিস দাদা। আমার জন্য তোর কত পরিশ্রম।’

‘কথা বলিস না নীতা, ব্যথা বাড়বে।’

‘আমার একটুও ভালো লাগছে না দাদা, ব্যথাটা বাড়ছে। আমি মা-বাবার কাছে যাব। মা আমাকে কত ভালোবাসবে, আদর করবে। কত সুন্দর বই কিনে দেবে। আমি বাবার সঙ্গে বেড়াতে যাব। কত মজা হবে।’

জ্বরের ঘোরে ভুল বকতে থাকে নীতা। পিসিমা ঘরে ঢুকে বলল, ‘ব্যথাটা বাড়ল বুঝি? কী যে হল। আমি একটু গরম তেল মালিশ করে দেখি।’

বাচ্চু হঠাৎ উঠে দাঁড়াল। নীতার অসহ্য কষ্ট আর দেখতে পারছে না। সমস্ত শরীরের ভেতর ওর অক্ষমতার জন্য একটা যন্ত্রণা বয়ে গেল। নীতাকে বাঁচতেই হবে। ওকে এরকম ভাবে মরতে দেবে না বাচ্চু। যে করেই হোক টাকা চাই।

শেঠ বাজোরিয়ার বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াল বাচ্চু। গেটের দারোয়ান বাধা দিতেই বলল, ‘সাহেব ডেকেছে।’

আরও কয়েকবার বাচ্চু এবাড়িতে এসেছে। বাড়ির ভেতরে ঢুকেই চাকরকে বলল, ‘শেঠ সাহেবকে বল আমি এসেছি।’

চাকর ফিরে এসে জানাল, ‘সাহেব এখন বাইরে যাবে এখন দেখা হবে না।’ বাচ্চুর মাথায় তখন খুন চেপে গেছে। চাকরকে হাত দিয়ে সরিয়ে জোরে জোরে পা ফেলে সোজা বাজোরিয়ার বেডরুম-এ ঢুকল। শেঠ বাজোরিয়া তখন পোশাক বদলাচ্ছিল। ওকে দেখেই বলল, ‘তুই বেডরুম-এ কেন এলি?’

সারা শরীরে এক প্রচণ্ড হিংস্রতা ঘিরে আছে বাচ্চুর। বলল, ‘শেঠ আমার কিছু টাকার দরকার।’

‘রুপিয়া কি এমনিই আসে যে বললেই দিয়ে দেব!’

‘আমার বোনের খুব অসুখ শেঠ, কিছু টাকা দাও। হাতজোড় করছি।’

‘বোনের অসুখ তো আমি কী করব? যা না সরকারি হাসপাতালে।’

‘তোমার অনেক কাজ করেছি শেঠ, আমি আবার কাজ করে শোধ করে দেব।’

‘না তোকে আমার দরকার নেই। আমি তোর মতো কুত্তাকে আর ডাকব না। বেরিয়ে যা আমার ঘর থেকে।’

বাচ্চু আর থাকতে পারল না। মাথায় খুন চেপে গেছে। পকেট থেকে রামপুরী চাকুটা বার করল। তারপর চিৎকার করে উঠল, ‘টাকা আমার চাই।’

‘আচ্ছা ঠিক আছে। তুই বস আমি আসছি।’ বাজোরিয়া বারান্দায় রাখা টেলিফোন তুলে বলল, ‘হ্যালো লালবাজার আমি…’ আর বলা হল না। প্রচণ্ড শক্তিতে বাচ্চু তখন ওর গলা টিপে ধরেছে। একটা গোঙানি ভেসে এল বাজোরিয়ার মুখ দিয়ে। তারপর বাচ্চুর হাতের রামপুরী চাকুর আঘাতে লুটিয়ে পড়ল বাজোরিয়ার দেহ। বাজোরিয়ার দেহটা নিথর হয়ে যেতেই বাচ্চুর হুঁশ এল। এটা সে কি করল! লোকটাকে সে মেলে ফেলল! এতটা যে খুন চেপে যাবে ও আগেও ভাবেনি। কিন্তু আর এখন কিছু ভাবার নেই। দুদ্দাড় করে সিঁড়ি দিয়ে নেমে রুদ্ধশ্বাসে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল বাচ্চু।

রাত অনেক হয়ে গেছে চারিদিক নিঃস্তব্ধ, রাস্তার কুকুরগুলো ঘেউ ঘেউ করছে। শীতের রাত্রি লোক চলাচলও কম। বাচ্চু চামেলির ঘরের দরজার কড়া নাড়ল। চামেলি জেগেই ছিল। খুব সেজেছে আজ চামেলি। ভালো নাইলন শাড়ি, কপালে লাল টিপ। চামেলির স্বামী ঘরে নেই। মাল টেনে কোথাও পড়ে আছে বোধহয়, বাচ্চাগুলো এককোণে শুয়ে ঘুমুচ্ছে।

দরজা খুলেই চামেলি জিজ্ঞেস করল, ‘এত রাতে কী ব্যাপার?’

বাচ্চু বলল, ‘আমাকে একটু জল দাও চামেলি। অনেকটা পথ হেঁটে এসেছি।’ বাচ্চু তখনও হাঁপাচ্ছে।

চামেলি বলল, ‘বসো আমি জল আনছি।’

জল খেয়ে বাচ্চু বলল, ‘আজকে একটা খারাপ কাজ করে ফেলেছি।’

‘আবার মারামারি করেছ? না তোমাকে নিয়ে আর পারা গেল না। তুমি না থাকলে নীতার কি হবে ভেবে দেখেছ একবার?’

চিৎকার করে উঠল বাচ্চু– ‘ওকথা বোলো না চামেলি। ওকথা বোলো না।’

তারপর চামেলির হাতদুটো জড়িয়ে ধরে বলল, ‘তুমি না একদিন বলেছিলে– নীতাকে বাঁচাবে।’

‘হ্যাঁ বলেছিলাম।’

‘তবে তুমি ওকে বাঁচাও চামেলি। আমার একান্ত অনুরোধ, বলো তুমি রাখবে?’

‘হ্যাঁ, সেই ভেবেই তো…। এখুনি বাজোরিয়া শেঠের গাড়ি আসবে, আমাকে নিয়ে যাবে ওর বাগান বাড়িতে দিন সাতেক থাকতে হবে, কিন্তু অনেক টাকা দেবে, জানো!’

বাচ্চুর শিরা দুটো দবদব করছে। মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে। এখন সে কী করবে? কোথায় পালাবে। কিছু কূলকিনারা পাচ্ছে না।

বাজোরিয়ার নামটা যেন তার বুকের ভেতর হাতুড়ি পিটছে। ওকেই তো কিছুক্ষণ আগে নিজের হাতে খুন করে এসেছে সে। ওতো আর কোনওদিন আসবে না চামেলিকে নিতে।

চামেলি পান খেতে খেতে বলল, ‘ও এখনও এল না লোকটা। টাকাটা পেয়ে নিই, তারপর দেখো আমি নীতাকে বাঁচাবই।’

বাচ্চুর মাথা ঘুরছে। এ কী করল সে! ওই টাকাও আর পাওয়া যাবে না। শুধু বাজোরিয়ার নয়, সে যে নীতারও প্রাণ নিয়ে ফেলেছে। সমস্ত পৃথিবী কাঁপছে। হাত মুঠি করে নিজের ভেতরের সমস্ত শক্তি সঞ্চয় করে সে বলল, ‘ওই শেঠ আর আসবে না চামেলি। আমি বাজোরিয়াকে খুন করে এসেছি নিজের হাতে।’ কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে বাচ্চু।

‘এ তুমি কি করলে বাচ্চুদা। আমি যে অনেক কষ্টে এ টাকার বন্দোবস্ত করেছিলাম।’

‘আর বোলো না চামেলি। আমি নিজের হাতে দুটো প্রাণ নষ্ট করে দিলাম, আমাকে তুমি ক্ষমা করো।’

রাত্রির মধ্যম যাম। অনেকক্ষণ দুজনে চুপ করে বসে থাকে। তারপর উদভ্রান্তের মতো ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যায় বাচ্চু। বড়ো রাস্তা পেরোলে ওপারেই সরকারি হাসপাতাল। আরও একটু এগোলেই মোড়ের মাথায় থানা।

 

চ্যাঁচানি পিসি

দালাল যেদিন আমায় ঘর দেখাতে নিয়ে যায়, সেই দিনই আমি চ্যাঁচানি পিসিকে দেখি। টাইমকল থেকে ছ্যারছ্যার করে জল পড়ছে। পাশে উবু হয়ে বসে তিনি বাসন মাজছেন। চটা উঠে যাওয়া সিমেন্টের চাতাল। একদিকে ডাঁই করা কাঠের ভাঙা তক্তা, প্লাস্টিকের বস্তা, মরচে ধরা আধখানা টিন, বইয়ের একগোছা ছেঁড়া পাতা, আরও কত কী। চাতালটার এখানে সেখানে ছিটিয়ে ছেতরে পড়ে রয়েছে পায়রার গু। দেখেই মন খারাপ হয়ে গিয়েছিল।

বাড়িটার বয়েস একশো বছর তো হবেই। যেখানে সেখানে পুলটিস মারা। দরজা দিয়ে ঢুকেই চোখেমুখে অন্ধকার জড়িয়ে যায়। সরু গলি। খানিকটা গিয়ে ডানহাতে সিঁড়ি। তার মুখে একটা বইয়ের দোকান। সেখানে আলো জ্বলছে। বাঁদিকের দোকানেও আলো। কিন্তু অন্ধকার এত বেশি যে মনে হয় যেন দোকানের ভেতরে মশারি খাটানো আছে। সেখানে আলো একেবারে জবুথবু অবস্থায় পড়ে আর বেরোনোর পথ পায়নি।

বাঁহাতি মোড় নিয়ে ডানদিকে ঘুরলেই ওই চাতাল। তার তিন কোণে তিনটে দোকান। বাসন মাজতে মাজতে পিসি চোখ তুলে আমাদের দিকে তাকিয়েছিলেন। ট্যারা চোখ। তার চেয়েও ধাক্বা লেগেছিল যেটা তা হল ওর পরনে একটা শুধু ফ্যাকাশে কামিজ। নীচে কিছু নেই। উবু হয়ে বসার ফলে কামিজের অনেকটা খসে গিয়ে রোগা পা দাবনা অব্দি দেখা যাচ্ছে। চোখ সরিয়ে নিতে নিতে খেয়াল হল একদম কিছু নেই তা নয়। একটা লাল রঙের ইজেরের খানিকটা উঁকি মারছে।

চাতালের পাশে সরু হাঁটাচলার জায়গাটা একটা খোলা কোলাপসিবল গেট টপকে আর একটা গলির রূপ ধারণ করেছে। আবার অন্ধকার। আরও একটা সিঁড়ি। কাঠের রেলিং ঘুরে ওপরে উঠেছে। এই ছোট গলিটা পেরিয়ে একফালি ফাঁকা জায়গা। সেখানে পাশাপাশি দুটো দোকানঘর। তার মধ্যে যেটা বন্ধ তার সামনে আমাকে ফেলে দালাল বলেছিল, দাঁড়ান, তালাটা খুলি।’

আমি বললাম, ‘এ কোথায় নিয়ে এলেন বলুন তো!’

সে ঘটাং ঘটাং করে ঠুকে তালা খুলে হড়হড় করে শাটার তুলতে তুলতে বলল, ‘বইপাড়ায় ঘর নিয়ে ব্যাবসা করতে গেলে ওসব ভাবলে চলবে? আপনার যা বাজেট তাতে এ যা দিচ্ছি, রাজা জিনিস বুঝলেন। যদি টিকে যেতে পারেন তাহলে এখান থেকেই মা লক্ষ্মী হাত ঝেড়ে দেবে। একটুকরো জায়গার জন্যে লোকে মাথা খুঁড়ছে। একবার নোঙর ফেলতে পারলেই হল। দোকানের ভেতরটা ভালো করে দেখুন। আশি স্কোয়ার ফুট। ফলস সিলিং করা আছে, ওপরে বই রাখতে পারবেন। সলিড একেবারে। ভাড়া কম, সেলামি কম, আর কী চাই?’

‘না আসলে এত ভেতরে তো, তাই।’

‘সামনে নিতে গেলে তো আপনার পড়তায় আসবে না দাদা। ফুটপাতের ধারের গুমটিগুলো দেখেছেন? পঞ্চাশ-ষাট স্কোয়ার ফুট– স্টাটিংই আছে সাত-আট লাখ থেকে। এখান থেকে লাগান না। কত এঁদো গলি থেকে বেরিয়ে রাজা-উজির হয়ে গেল সব। পঁচিশ বচ্ছর ধরে কলেজ স্ট্রিটে ব্রোকারি করছি। কম তো দেখলাম না।’

এদিকেও একটা সিঁড়ি আছে লাল সিমেন্টের। উঁচুতে তাকালাম। দোতলায় কতগুলো সাইনবোর্ড দেখা যাচ্ছে। তার মানে ওখানেও দোকান বা গোডাউন আছে। তিনতলার এদিকটায় জাল দিয়ে ঘেরা। বারান্দা হতে পারে। তার ওপরে আশি স্কোয়ার ফুটেরও কম মাপের আকাশ। দমচাপা লাগছিল সব মিলিয়ে। বললাম, ‘এখানে কি কোনও কাস্টমার আসবে? জায়গাটা যেন কেমন। ঢোকার মুখে আলো নেই, একজন কলতলায় বসে বাসন ধুচ্ছে–।’

দালাল এমন হাসল যেন আমি ছেলেমানুষি কথা বলছি। ‘ওঃ, চ্যাঁচানি পিসি? ওকে নিয়ে ভাববেন না। স্ক্রু ঢিলে আছে। ওই কলটা ওর। কলের পাশে যে-তিনটে দোকান– ওগুলো ওর ভাগে। যা ভাড়া পায় তাই দিয়ে চলে। বেশি পায় না যদিও। কবেকার ভাড়াটে সব। পিসি থাকে গলির ভেতরের দোতলায়। এ বাড়ির তিন শরিক। কারও সাথে কারও সম্পক্ব নেই। সামনের দিকেরগুলো যাদের তারা ওদিকেই তিনতলায় থাকে। এই বাড়িওলা থাকে এদিকের ওপরে। ঘর পছন্দ হলে বলুন, ডাইরেক্ট কথা বলিয়ে দিচ্ছি।’

ঘরটা নিয়ে নিয়েছিলাম। বাবার একটা বইয়ের দোকান ছিল। বইয়ের সঙ্গে লেখাপড়ার কাজে আসে এমন সব জিনিসও বিক্রি হতো। যেমন হয় আর কী। বয়েস হয়ে গিয়েছে, আর বসতে ভালো লাগছে না, এসব বলে বাবা আমাকে সেখানে ভিড়িয়ে দিল। সাত বছর ধরে আমি সেটাই চালিয়েছি। তবে এত ছোট ব্যাপারে মনটা আটকে থাকতে চাইছিল না। বই ঘাঁটতে আমার ভালো লাগে। ভাবলাম বই বানালে কেমন হয়। বছর দেড়েক হল নিজে একটা পাবলিকেশন খুলেছি। গল্প, উপন্যাস, ভ্রমণকাহিনি ছেপেছি, প্রবন্ধের বইও। কয়েকটা বইয়ের, কাগজে রিভিউ বেরোল। প্রকাশনার নাম জানল লোকে। কলেজ স্ট্রিট থেকে ফোনে অর্ডার হলে বই পৌঁছে দিতাম। ছোটদের বইয়ের কাটতি ভালো জেনে সেদিকেও যাব ভাবছিলাম। বাবাকে অনেক বলেকয়ে, বুঝিয়ে দোকানটা বিক্রি করে দিলাম। বাবার হাতে খানিকটা রেখে আমার হাতে কিছুটা পুঁজি এল। বিয়ে করেছি। ছেলে-বউ আছে। বউ একটা মন্টেসরি স্কুলে পড়ায়। আমার বেলায় পঁয়ত্রিশ পেরিয়ে পাল্লাটা ঝুঁকির দিকেই চলে গেল বেশি, কিন্তু তখনই ঠিক করেছিলাম এই ব্যাবসাটা কলেজ স্ট্রিটে বসেই করতে হবে। দালালের পিছন পিছন ঘুরে শেষে এই বাড়ি।

এখানে চ্যাঁচানি পিসির সঙ্গে আমার কথা হওয়ার কোনও দরকার ছিল না। দালাল বলেছিল ওকে নিয়ে ভাববেন না। কিন্তু না ভেবে রেহাই নেই। সত্যি বলতে কী ওকে দেখলেই হাত-পা চিড়বিড় করে। বারোটায় যখন দোকানে আসি তখন তিনি খাওয়াদাওয়া শেষ করে বাসন ধুচ্ছেন কলতলায়। বিকেল চারটেয় আবার জল আসে। পিসি থালা বাটি গেলাস হাঁড়ি কড়াই নিয়ে সেখানে হাজির। বাসন ধুচ্ছেন কলতলায়। শুধু বাসন নয়, নিজেকেও রগড়ে ধোবেন। একজন পঞ্চাশ-পঞ্চান্নর হাড়সর্বস্ব মহিলা সর্ব অঙ্গ ভিজিয়ে বইয়ের দোকানের মাঝখানের চাতালে বসে চান করছেন এ দৃশ্য যে কী শুকনো হতে পারে, তা টের পাই। যাওয়া আসার পথে দেখে মনে হয় আড়াল করে দাঁড়াই। কোনও খদ্দের যদি আসে এখন? কিংবা লেখক কেউ? লজ্জার একশেষ হবে। তখন ওরই ভাড়াটে এক দোকানদারের স্টাফ পাশ দিয়ে যেতে যেতে বলে যায়– ‘আহা মন্দাকিনী। রাজ কাপুর দেখে যেতে পেল না রে। রাম তেরি গঙ্গা মইলি হো গয়ি…।’

চ্যাঁচানি তো কারও নাম হতে পারে না। পিসির আসল নাম যে কী সেটা ওরই ভাড়াটে ডিএম পাবলিশার্সের মালিকের সঙ্গে একবার কথা বলতে গিয়ে জানলাম। বললেন, ‘ওর নাম লাবণি, লাবণি দত্ত। ভাড়ার রসিদে ওই নামেই সই করে। এখানকার ছেলেছোকরারা বলে চ্যাঁচানি পিসি। বলবে নাই বা কেন। অষ্টপ্রহর কিছু না কিছু নিয়ে চ্যাঁচাচ্ছে।’

সাবধানে বললাম, ‘উনি তো আপনাদের বাড়িওয়ালি। কিছু বলেন না কেন?’

‘কী আর বলব। যবে থেকে এসেছি তবে থেকে তো এই দেখছি।’

আমি চুপ করে গেলাম। এখানে আরও যারা আছে তারাও পুরোনো। পিসিকে কেউ সামনাসামনি কিছু বলে না। বলতে গেলেই চিৎকার। কেউ গলির ভেতরে ধপাস করে বইয়ের বস্তা নামাল। পিসি সঙ্গে সঙ্গে চেঁচিয়ে উঠবে– ‘অ্যাই কে? কে রে? গায়ের জোরে বস্তা ফেলেছিস! আস্তে আস্তে নামানো যায় না? এটা তোর বাবার বাড়ি নয় বুঝলি! একেই ওখানকার মেঝেটা ফেটে রয়েছে, তার মধ্যে ইচ্ছে করে বদমাইশি। সারাতে গেলে তুই পয়সা দিবি?’

আমি সব শুনি। তবে খেয়াল করে দেখেছি গলির মেঝের একটা জায়গা সত্যিই অনেকটা বসে গিয়েছে। পুরোনো বাড়ি। ধেড়ে ধেড়ে ইঁদুর ঘুরঘুর করে। ওরাই ফাঁকফোকর থেকে মাটি তুলে আলগা করে দিয়েছে। গলিটায় কোনও আলো নেই। অন্ধকারে কেউ কোনওদিনও পড়ে পা মচকাবে।

ডিএমের মালিক বলেছিলেন, ‘আপনার বাড়িওয়ালা প্রভাত দত্ত হল ওর দাদা, জ্যাঠার বড়ো ছেলে। বাড়ি ভাগাভাগি হয়েছে অনেকদিন। শুনেছি আগে থেকেই ঝামেলা চলছিল। যে যার অংশ বুঝে নেওয়ার পর থেকে তিন শরিকের মধ্যে কথাবার্তা বন্ধ। কেউ কারও খোঁজও নেয় না। এই চ্যাঁচানি পিসির বাপ-মা তো কবেই স্বর্গে রওনা দিয়েছে। থাকার মধ্যে আছে এক দিদি-জামাইবাবু। বছরে বারদুয়েক আসে ব্যারাকপুর থেকে। আসবেই বা কী করতে। সেখানে তারা সুখেই রয়েছে। দয়া যেটুকু করে, এর ভাগের দোকানগুলোর ভাড়ায় হাত দেয় না। বয়েসকালে বিয়ে-থা হয়নি। বিয়ে হওয়ার কথাও নয়। ওই তো চেহারার ছিরি। আগেও ভালো কিছু ছিল বলে মনে হয় না। একাই রাঁধেবাড়ে, খায়। একা থেকে থেকে মাথাটা গেছে আর কী। কথা বলার লোক পায় না। চ্যাঁচায়!’

আমি ভাবছিলাম ভাগ্যিস এই মহিলা আমার বাড়িওয়ালি নয়।

আমার দোকানে কোনও কর্মচারী নেই এখনও। এই কোম্পানিতে আমিই মালিক, আমিই শ্রমিক। বিক্রিবাটা তেমন জমেনি। তবু রিটেল কোনও কাউন্টার থেকে বইয়ের নাম লেখা স্লিপ এলে বই দিই। ফোনে বললে দৌড়ে গিয়ে বই পৌঁছে দিয়ে আসি। চালান লিখি, বিল কাটি, টাকা তুলে আনি। বিজ্ঞাপন দেখে, খুঁজেপেতে কাস্টমার আসে খুব কম। ওই কালো ঝুল গলি পেরিয়ে যারা এসে পৌঁছোয়, দেবতাজ্ঞানে তাদের সামলাই। যাদের বই রয়েছে সেই লেখকদের মধ্যে কেউ কেউ এসে পড়েন কখনও। আর টাকা নিয়ে বই ছাপিয়ে দেব কিনা জানতে বা কথা বলতেও আসেন দু-একজন। হ্যাঁ বলে দিয়েছি কয়েকজনকে। নইলে তো প্রেসে ধার ধারালো হয়ে উঠবে। আমি ধরে নিই যারা টাকা দেবে তারা আমার টেম্পোরারি পার্টনার। বাইরে চায়ের দোকান আছে। লোকজন এলে সেখানে গিয়ে বললে চা দিয়ে যায়, কিন্তু কেউ জল চাইলেই আমি সিঁটিয়ে যাই।

পাশের দোকানটা বর্ণলিপি পাবলিকেশন। মাঝবয়েসি কর্মচারী বসে থাকেন একজন। তিনিই বলেছিলেন, ‘খাওয়ার জল ওই কল থেকেই আপনাকে ভরতে হবে তমালবাবু। তবে খবরদার। পিসি যতক্ষণ কলতলায় থাকবে ততক্ষণ ওদিকের ধারও মাড়াবেন না। খালি দেখলেই বোতল নিয়ে দৌড়ুবেন। আমরাও তাই করি। নাহলে ও চিল্লিয়ে মাত করে দেবে একেবারে।’

তাও টের পেয়েছি অনেক দিন আগেই। বিকেলে কেউ জলের বোতল কলের মুখে বসালেই হল। সঙ্গে সঙ্গে চিৎকার– ‘অ্যাই, জল ভরছে কে? কার এত আস্পদ্দা! আমার এখনও বাসন ধোয়া বাকি।’

আসলে বাসন মাজা হয়ে গেছে। শুচিবাই থাকার ফলে উনি একই বাসন বারবার ধুতে থাকেন। এই সময় পিসিকে দেখা যায় না। শুধু তার কন্ঠস্বরটি দোতলার সিঁড়ি থেকে এমন করে নামতে থাকে যে ঝনঝনিয়ে বাসন গড়ালে তার চেয়ে মধুর শোনাত। কোনও কোনও দিন কলের সামনেই ওই চিৎকারে পায়রারা ভয় পেয়ে উড়ে যায় ঘুলঘুলি কী কার্নিশ থেকে। ঝগড়ার রেওয়াজি গলা ছাড়া এ সম্ভব নয়।

আমার দোকানঘরের সামনে দাঁড়িয়ে একজন একদিন আঁতকে উঠলেন। চুঁচড়ো থেকে বই নিতে এসেছেন। কখনওসখনও মফসসলের দোকানিরা বা তাদের লোক আসে আমার এখানে। পিসিকে তাদের চেনার কথা নয়। তিনি বললেন, ‘কোথাও কি গোলমাল হচ্ছে কিছু? দেখে আসবেন একবার?’

আমি বললাম, ‘তেমন কিছু নয়। ওই জল ভরা নিয়ে–।’

‘সে কী! কাজের জায়গায় এরকম চ্যাঁচামেচি হলে তো মুশকিল। বিজনেস করবেন কী করে? একে তো বাড়ির বাইরে আপনাদের কোনও সাইনবোর্ড নেই, খুঁজে খুঁজে টাইম কাবার। তার ওপর–। আর জায়গা পেলেন না!’

চুপ করে থাকি। হাসি দিয়ে বিজনেস সামলাবার চেষ্টা করি। তবে এও দেখেছি, পিসি যখন কলতলায় গিয়ে বসে, সেই সময়টি বেছে নিয়ে এখানকার দোকানের কয়েকজন আধ ডজন বোতল হাতে হাজির হয়। তারা পিসির ওই গলাবাজির চোটপাট চেটে চেটে খেতে চায়। হ্যা হ্যা করে হাসে। বোতল বসানোর ছুতোয় বাসন ছুঁয়ে দিতে চায়, বোতলের তলানি জল ছুড়ে দিতে চায় পিসির গায়ে। তিনিও চ্যাঁচাতে থাকেন– ‘যাও, যাও বলছি, দূর হয়ে যাও এখান থেকে। জেনেশুনে পেছনে লাগা, না! আবার দাঁত ক্যালানো হচ্ছে? শয়তান বদমাইশের দল, মেরে হাত ভেঙে দোব একদম বলে দিচ্ছি।’

আমার বাড়িওলা পীযূষ দত্তকে দেখেছি কখনও এরকম ঘটনার মধ্যে পড়ে গেলেও তিনি পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছেন। বোনের হয়ে দুটো কথা বললে হয়তো থামত। থামে না।

একদিন জল ভরতে গিয়ে দেখলাম কলে লাল বালতি, বাসনের পাঁজা। না বলে জল নেওয়া যাবে না। পিসি দোতলায় তার ঘরে আছে ভেবে ওপরে উঠলাম।

একটা পাঁচিল গেঁথে আমাদের ওদিকটা থেকে এদিকটা আলাদা করা আছে। লালচে ইটের দাঁতকপাটি বেরিয়ে পড়েছে সে পাঁচিলের। পাশে সিমেন্টের একটা খিলানের অর্ধেক। বৃষ্টির জল পড়ে শ্যাওলায় আঁকা নকশা ফুটেছে তার শরীরে। কত কাণ্ড করে যে বাড়িটা ভেঙে ভাগ করেছে এরা। সিঁড়ির যেখানে আমি দাঁড়িয়ে তাতে আমার নাকের প্রায় ডগায় শোয়ানো একটা মেঝে। লোহার শিক লাগানো কাঠের রেলিং। অর্থাৎ এটা দোতলার ভেতরের বারান্দা। একটা বেড়াল থাবায় মুখ নামিয়ে বসে আছে। এককোণে একটা স্টোভ, কেরোসিন তেলের জার, কাঠের ডাঁটির একটা বড়ো ছাতা দেয়ালে হেলান দিয়ে, সিলিঙের কড়িবরগা থেকে দড়ি বাঁধা একটা হ্যারিকেন ঝুলছে, রেলিঙের খুঁটি থেকে দেয়ালের পেরেকে টাঙানো আর একটা দড়িতে এলিয়ে রয়েছে কয়েকটা ময়লা কাপড়, সেই দেয়ালেই লোহার ব্র্যাকেটে বাল্ব, দরজার পাশের দেয়ালে বাঁধানো ছবিতে উলটে আঁচড়ানো চুলে এক পুরুষ। চৌকো চোয়াল। সাদা-কালো ছবি হলদেটে হয়ে গেছে। মনে হচ্ছিল সব মিলিয়ে মৃণাল সেনের সিনেমার কোনও স্টিল ফ্রেম দেখছি। এমন সময় সেই ফ্রেমের ভেতর থেকে বেড়ালটা মুখ তুলে ডেকে উঠল– মিঁউ।

‘কী ব্যাপার? এখানে এসেছেন কেন?’

দরজায় আধময়লা কামিজ উঁকি দিয়েছে। বললাম, ‘আমার ওখানে একদম জল নেই। একটা বোতল যদি ভরে নেওয়া যেত।’

‘আপনি কি আমার পারমিশন নিতে এসছেন?’

‘হ্যাঁ।’

খোলা ঠোঁটদুটো টপ করে নেমে এসে কেমন গুম ধরে গেল মুখে। উনি কামিজের দু’পাশের চেরা জায়গা দু’হাতে চেপে ধরলেন। তারপর বললেন, ‘যান, নিয়ে নিন জল।’

‘আপনার জিনিসপত্র সব ওখানে রয়েছে। সরাতে গেলে হাত ছোঁয়াতে হবে।’

‘বললাম তো ভরে নিন। সরিয়ে দিন ওগুলো।’

কী মনে হল, সেই ছবিটার দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘ওটা কি আপনার বাবার ছবি?’

‘হ্যাঁ, কেন?’

‘না এমনি। তাই মনে হচ্ছিল। ঘরের ভেতরে রাখলে পারতেন।’

‘ঘরে অন্ধকার।’

অদ্ভুত যুক্তি। আমি আর কিছু না বলে ফিরে আসছিলাম। তখন উনি বললেন, ‘জল নেওয়ার জন্য আমাকে বলতে আসতে হবে না। আপনার যখন দরকার নিয়ে নেবেন।’

আমি নেমে জল ভরে নিয়ে এসে কাউন্টারে বসি। বাইরে কত লোক, বই বোঝাই রিকশা ভ্যান, দোকান উপচে রাস্তায় বই, হাঁকাহাঁকি, হাত ধরে টানাটানি– কী বই লাগবে বলুন। আর এই জায়গাটা ঘুমন্ত পুরী। এরকম রোজই। বৃষ্টিতে, রোদ্দুরে, শীতে ভিজে ভিজে।

এক একদিন বসে বসে ঝিম ধরে যায়, চোখের পাতা নেমে আসে। তখন ওই রাজকন্যের চিৎকারে চটকা ভাঙে। সিগারেট ধরাই। ভাবি আরও কয়েকটা কাউন্টারে বই বিক্রির ব্যবস্থা করতে হবে, লাইব্রেরিতে ক্যাটালগ পাঠাতে হবে, বাংলাদেশের অর্ডার পেতে হবে। পারব কি আমি? দোকানের ভাড়া, সেই সাউথ থেকে মেট্রোয় যাওয়া-আসার খরচ, ইলেকট্রিকের বিল। মাত্র তেরোটা বই নিয়ে এখানে জায়গা হাঁকিয়ে বসাটা বোধহয় ঠিক হয়নি। এই বাড়িটায় সব টেক্সট বইয়ের দোকান। সেখানে আমার পাবলিকেশনের বই মেলানো যাবে না। যাদের সঙ্গে মেলানো যায় তারা তো রথী-মহারথী। কম্পিটিশন তো দূরের কথা, টিকে থাকতে পারব কিনা সেই সন্দেহই চোঁয়া ঢেকুর হয়ে উঠে আসছে এই কয়েক মাসে। বড়ো লেখকদের বই পেতে গেলে অনেক টাকা দিতে হয়। বই ভালো করে ছাপতে গেলেও খরচ বেশি। বেশি ছাপলে খরচ কমে কিন্তু আমার দৌড় তিনশো কী পাঁচশো। লাইব্রেরি নামি প্রকাশকদের বই কেনে, বাংলাদেশের অর্ডারও তাই, কলকাতার বাইরে থেকে কদাচিৎ কেউ কিনতে আসে। এত কিছু আগে বুঝিনি। এখানে এসে মালুম হচ্ছে। আমার বউয়ের স্কুলে পড়ানোর ভরসায় তো এখানে আসিনি আমি। নিজেই নিজের দোকানের ছোট্ট সাইনবোর্ডটার দিকে তাকিয়ে থাকি। কায়দা করে পাবলিকেশনের নাম দিয়েছি ‘সোনার তরী’। শেষে ডুববে না তো?

এসব ভাবতে ভাবতে কোনও দিন ঘটাং করে আওয়াজ শুনে পিছন ফিরে দেখি পাশের গোডাউন থেকে বই বের করতে এসেছে কেউ। দুটো ছেলে। এরা যে– দোকানে কাজ করে সেটা রাস্তার ওপরে। ওরা নিজেদের মধ্যে কথা বলছে। বলছে মানে প্রত্যেক কথার আগে পরে একটা করে খিস্তি। বাংলা ভাষাকে উদার প্রমাণ করতে এসব আমরা আপন করে নিয়েছি। কোনও শ্রেণিবৈষম্য নেই। বলার স্বাধীনতা আছে, না শোনার স্বাধীনতা নেই। তাই খিস্তি হজম করছিলাম। ঠিক তখন ওপর থেকে চেঁচিয়ে উঠলেন পিসি। ‘অ্যাই কে রে? তপন, না? এখানে দাঁড়িয়ে আবার নোংরা কথা বলছিস! ওসব এখানে চলবে না।’

তপন ছেলেটি মুখ তুলে বারান্দায় তাকাল। ‘তোমার ওখানে তো নেই পিসি আমি। এ তো আমাদের বাড়িওলার এরিয়া। আমি এপারে রয়েছি।’

এবার আরও জোরে চিৎকার ধেয়ে এল। ‘খারাপ কথার আবার এপার-ওপার কী অ্যাঁ! বেশি ওস্তাদ হয়েছ, না। বই বিক্রি করিস, সে তো বিদ্যের জিনিস রে, গালাগাল দিতে লজ্জা করে না!’

তপন পাশের ছেলেটার দিকে তাকিয়ে চোখ মটকে হাসল। গলা নামিয়ে বলল, ‘বহুত ঢেমনি এই বুড়িটা, দেখবি একটা মজা?’

মোবাইলে খুটখাট করছে তপন। একবার আড়চোখে আমাকে দেখল। তারপর গান বেজে উঠল ফোনে। ও মধু… ও মধু… আই লাভ ইউ… আই লাভ ইউ…। সঙ্গে তপনের খিক খিক হাসি।

আমি ভাবছিলাম, পিসির তো এতদিনে জেনে যাওয়া উচিত ছিল যে বই বিক্রি হয় বলেই বইপাড়ায় সকলে সাধুভাষায় কথা বলবে না। হতে পারে একদিন বিদ্যাসাগর সংস্কৃত কলেজের প্রিন্সিপালের চাকরি ছেড়ে দিয়ে কলেজ স্ট্রিটেই বইয়ের দোকান খুলে বসেছিলেন। কিন্তু এখন বই এখানে একটা প্রোডাক্ট। বাংলা ভাষায় যাকে বলে মাল।

হঠাৎ চমকে উঠলাম আমি। তপন ও অন্য ছেলেটিও অবাক হয়ে গেছে। দোতলায় অন্ধকার বারান্দা থেকে আর চিৎকার নয়, গান ভেসে আসছে। ‘দূরদেশি সেই রাখাল ছেলে… আমারে বাটের বটের ছায়ায়… সারাটা দিন গেল খেলে…।’ গলা খ্যানখ্যানে, সুর কিছু এলোমেলো কিন্তু ওটা গানই।

তপন কাঁধ ঝাঁকাল। ‘কী গো পিসি, এ আবার কী শুরু করলে?’

গান থামল। ‘কেন, তুই গান বাজাচ্ছিস, আমি গান গাইছি। কী অসুবিধে?’

‘আরে আমারটা শোনো, শরীর চাঙ্গা হয়ে যাবে।’

‘আরে তুই আমারটা শোন, তোর মন ভাল হয়ে যাবে। দূরদেশি সেই রাখাল ছেলে…।’

অন্য ছেলেটি এবার তপনকে বলল, ‘চল চল মাল ওঠা। সব পাগলের কারবার এখানে।’

লাবণি দত্ত থামেননি। পুরোটাই গাইলেন।

অনেক দিন পর গানটা শুনতে পেলাম। মাঠে ফুটবল পিটিয়ে বাড়ি ফেরার পথে সন্ধেবেলা কাদের বাড়িতে যেন হারমোনিয়ামে বাজত এই গান। আজ এই পুরনো ভাঙা ছায়াময় বাড়িটাতে যেন ঘুরে ঘুরে ভেসে ভেসে একটা কোনও ঝরা পাতা হয়ে গানটা নেমে আসে।

পরের মাসে বাড়িওলার কাছে ভাড়া দিতে গিয়ে বললাম, ‘আমাদের দোকানের আগে যে– প্যাসেজটা, সেটা বড্ড অন্ধকার। অনেকে ওটা দেখে ওখান থেকেই ফিরে যায়, একটা আলো লাগানো গেলে…।’

পীযূষ দত্ত টাকা গুনতে গুনতে বললেন, ‘ও বাবা, ও ব্যাপারে আমি কিছু করতে পারব না। আপনি লাবুকে, মানে আমার বোনকে বলে দেখতে পারেন। ওটা তো ওর অংশ। যদি রাজি হয়–। তবে আপনার পাশের বর্ণলিপি আগে বলেছিল শুনেছি, হয়নি।’

আমি নেমে এলাম। আলোটা লাগানো খুবই দরকার। ন’মাস হয়ে গেল এখানে এসেছি। কাউকে বলে দিলেও জায়গাটা চিনে আসতে পারে না। সন্ধে নেমে এলে তো কথাই নেই, দিনের বেলাতেও এরকম ঘটে। এ তল্লাটের অনেক বাড়ির ভেতরেই খুপরি দোকানঘর আর অফিস রয়েছে। তারা কী করে ম্যানেজ করে জানি না। আমাকে আমার ব্যাবসার কথা ভাবতে হবে।

খাওয়া শেষে, বাসন ধোওয়ার পর, দুপুর একটা নাগাদ পিসি বাড়ির একেবারে বাইরের দরজার মুখে রোয়াকটায় গিয়ে বসে থাকেন। রোজকার ব্যাপার। ভাবলাম তখনই গিয়ে আলোর কথাটা বলব। গিয়েছিলাম, কিন্তু বলা হল না। দেখি পিসি ডান হাতে চড় তোলার ভঙ্গিতে খালি পায়ে রাস্তায় নেমে ছুটছেন। সামনে দু-তিনটে দামড়া লোকও খ্যাক খ্যাক করে হাসতে হাসতে এঁকেবেঁকে ছুটে পালাচ্ছে। তাদের কেউই এ বাড়ির কোনও দোকানের লোক নয়। বাইরের। হয়তো কাস্টমার নেই কোনও, কাজ নেই অন্য, তাই সময় কাটাতে পিসিকে বেছে নিয়েছে ওরা। পিসি চেঁচাচ্ছেন– ‘এক চড়ে মাথা ভেঙে দোব। অসভ্য কোথাকার। বাড়িতে মা-বোন নেই তোমাদের?’

টানা রিকশাওলা, অন্য দোকানদার, রাস্তার লোক, ভ্যানওলারা রগড় দেখছে। আমি পা চালিয়ে পিসির সামনে গিয়ে রাস্তা আটকালাম। খানিকটা ধমকেই বলে ফেললাম, ‘এটা কী করছেন আপনি? কেন দৌড়াচ্ছেন এভাবে?’

পিসি থতমত হয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছেন। হাতটা নামিয়ে নিয়ে বললেন, ‘কী বাজে বাজে কথা বলছে ওরা, জানেন না আপনি। কাউকে কিছু বলি না, চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকি, তাও ইচ্ছে করে আমায় খোঁচাবে। পিছনে লাগবে।’

বললাম, ‘ওরা তো চায় আপনিও রেগে গিয়ে ওদের বাজে কথা বলুন। তাতেই মজা। আপনিও সব ভুলে ওদের পিছনে ছুটবেন! চলুন, এক্ষুনি ফিরে চলুন। আসুন আমার সঙ্গে। আপনিই না সেদিন গান গাইছিলেন!’

ট্যারা চোখ রাস্তার দিকে রেখে, কামিজটা সেই দু’হাতে চেপে ধরে আমার সামনে সামনে হেঁটে বাড়ির ভেতরে ঢুকে পড়লেন তিনি। আরও কিছুটা ধমক দিয়ে বললাম, ‘এটা কী পরে থাকেন আপনি! আর কিছু নেই আপনার?’

বোধহয় চ্যাঁচাতে গিয়ে কষ জমেছিল। সিঁড়ি বেয়ে ওঠার মুখে পিসি হাত দিয়ে ঠোঁট মুছলেন। আমি দোকানে বসতে যাচ্ছিলাম। উনি বললেন, ‘আপনি ওখানে কেন গেছিলেন?’

মাথা নাড়ালাম। ‘আমি আপনার কাছেই যাচ্ছিলাম। আর সেকথা বলে কী হবে।’

‘কী কথা? বলুন।’

‘এই প্যাসেজটায় যদি একটা আলো লাগাতে দিতেন। লোকজন আসা-যাওয়ায় সুবিধে হতো একটু। আপনার ভাড়াটেদের তো এই সমস্যা ভোগ করতে হয় না।’

গলার স্বর হালকা হয়ে উঠে যাচ্ছে ওপরে। শুনতে পেলাম উনি বলছেন, ‘লাইট কিনে নিয়ে আসুন। লাগাবে কে? মিস্ত্রিকে ডাকুন। জানেন কোথায় পাবেন? বেরিয়ে দেখুন ভারবি পাবলিশার্স কোথায়। ওই বাড়ির একদম শেষমাথায় বাপ-ছেলে থাকে, ইলেকট্রিকের কাজ করে। বলবেন চ্যাঁচানি পিসির বাড়ি। ঠিক চলে আসবে।’

আলো লাগানো হল। গলির অন্ধকারটা ছিঁড়ে গেল। যদিও তাতে আমার কতদূর কী সুবিধে হবে বোঝা যাচ্ছিল না। বাড়িতে বউয়ের সঙ্গে কথা বললাম কয়েকদিন পর। শ্রাবন্তী বলল, ‘বাবার বইয়ের দোকানটা তবু ছিল, সেটাও বিক্রি করলে। কী যে তোমার মাথায় চাপল! বাবা-মাও এই নিয়ে বলতে ছাড়ছে না। বলারই কথা। এখন যদি ব্যাবসাটা না দাঁড়ায় তাহলে কী হবে?’

বললাম, ‘সেই তো ভাবছি। আমি তো খারাপ বই করিনি। কিন্তু বিক্রি তেমন হচ্ছে না। এ ব্যাবসায় ইনভেস্টমেন্ট বেশি, রিটার্ন এত স্লো! আরও যে বই করব, ফান্ডই তো জমছে না। কলেজ স্ট্রিটে গিয়ে না পড়ে তো বুঝতে পারিনি। তাছাড়া বাজারও খুব খারাপ। দেখি। তেমন বুঝলে সব বিক্রি করে চলে আসতে হবে।’

শ্রাবন্তী আবার বলল, ‘মাস গেলে টাকা তো লাগে সংসারে। সেটা যদি না আসে, চলবে কী করে?’

দোকানে বসে শ্রাবন্তীর কথাগুলোই ভাবছিলাম। তিন-চারজন এসে দাঁড়াল কাউন্টারের সামনে। ‘এটা নতুন হয়েছে, না? মালিক কোথায়?’

চিনি না এদের, তবে কাস্টমার যে নয় তা বোঝাই যাচ্ছে। বললাম, ‘বলুন কী ব্যাপার?’

‘ব্যাপার কিছু না, দুর্গা পুজোর ডোনেশান। এই পাশের গলি। পাশশো টাকা।’

‘পাঁচশো!’ চমকে উঠি। ‘এত তো আমি পারব না দাদা।’

‘না বলবেন না। নতুন বলেই দিতে হবে, পুরানো হলে দেখবেন অ্যামাউন্টটা কমে ফিক্স হয়ে গেছে।’

‘অ্যাই কে রে? চাঁদা চাইতে এসেছে কারা? কোন পুজো?’

একজন মুখ তুলে জায়গামতোই তাকাল। ‘আমরা পিসি। মুখটা বাড়াও। চিনতে পারবে।’

পিসি তরতর করে নেমে এলেন। ‘ওনার কাছে বেশি নিতে পারবে না তোমরা। একশো টাকা নিয়ে বিদেয় হও।’

‘কী বলছ পিসি! একশো টাকায় কী হয়?’

‘যা বলছি শোনো। ওতে যা হয় তাই হওয়াও।’ বলে তিনি চোখ দুটো আমার দিকে রাখার চেষ্টা করছিলেন। ‘আপনি এর বেশি দেবেন না কিন্তু।’

‘আঃ পিসি, এমন কেলোর কীত্তি করো না মাঝে মাঝে। কিছু বলতে গেলেই তো আবার চ্যাঁচাবে।’ বলতে বলতে ওরা বিলের পাতা ছিঁড়ল। ‘আর কী হবে, দিন ওই একশো। সিনিয়র সিটিজেনের কথা রাখলাম।’

ওরা চলে যাওয়া অবধি পিসি দাঁড়িয়েই রইলেন। তারপর আমায় বললেন, ‘কলেজ স্ট্রিটে ব্যাবসা করতে এসেছেন তো। অনেক কিছু দেখতে হবে।’

চেয়ারে বসে পড়েছি। ভালো লাগছিল না এসব। তবু বললাম, ‘ব্যাবসাটা যদি ঠিকঠাক হতো, তাও না হয় দেখতাম। এখন তো ভাবছি কেন এলাম।’

পিসি মুখটা গলির দিকে ফিরিয়ে নিলেন। ‘এই বই ছাপার ব্যাবসা তো আপনার বাপ-ঠাকুদ্দার নয়।’

‘না, কেন বলুন তো?’

‘আমি সেই জ্ঞান হওয়া থেকে এসব দেখছি বুঝলেন। কত পাবলিশার এ বাড়িতে এল আর গেল। আমার বাবাও প্রকাশক ছিল, জানেন? পড়ার বই নয়, গল্প-উপন্যাস-কবিতা এসব ছাপত। কত লেখক এসেছেন তখন। পয়লা বৈশাখে বই বেরোত। কিন্তু বাবা শেষ অবধি পেরে ওঠেনি। এখন যেটা যূথিকা প্রকাশনীর ঘর, ওটাই আমাদের কাউন্টার ছিল। পরে তিনটে ঘরই এক এক করে ভাড়া দিয়ে দিল। বাবা বলত ছোটো প্রকাশকের ব্যাবসা করা খুব কঠিন। পাট তুলে দিল। বইগুলো উইয়ে খেল। আপনি পারবেন তো?’

আমি বললাম, ‘এত ভেতরে বসে বসে কী করতে পারব তাই ভাবছি। বাইরে একটা বোর্ড অবধি নেই যে কেউ নাম দেখে ঢুকবে?’

পিসি বললেন, ‘আপনার খুব চিন্তা হচ্ছে, না? থাকতে থাকতে লোকে জেনে যাবে ঠিক। খুঁজে খুঁজে আসবে দেখবেন। এই তো গলিতে আলো লাগালেন, সামনের দিকে আমাদের যে শরিক থাকে ওরা আপনাকে বোর্ড দিতে দেবে না। আমি তো দুপুরবেলা আর সন্ধেবেলা বাইরে দাঁড়িয়ে থাকি, কেউ জিজ্ঞেস করলে দেখিয়ে দেব– এই দিকে সোনার তরী। আপনি ভালো ভালো বই করুন। বিক্রি বাড়ানোর বুদ্ধি বের করুন। আমার বাবার মতো হবেন না। পালিয়ে গেলে কিছু করতে পারবেন না। আর শুনুন, আমার আর এবেলা কলে কাজ নেই। যান জল ভরে নিন।’

আমি অবাক হওয়াটা ঝেড়ে ফেলতে পারছিলাম না। তার মধ্যেই পিসি চলে গেলেন। একটু পরেই শুনতে পেলাম দোতলার সেই বারান্দা থেকে ভাঙা গলার গান ভেসে আসছে। ‘এই আকাশে… আমার মুক্তি আলোয় আলোয়…।’

আমি কাউন্টার ছেড়ে দোকানের সামনের ছোট্ট জায়গাটায় দাঁড়াই। ওপরে তাকিয়ে ফালি আকাশটা দেখি। একঝলক চোখে পড়ে, একটা পায়রা পাকসাট দিচ্ছে। ওখান থেকে কোনও পক্ষীরাজ ঘোড়া উড়ে এসে নামবে না আমার জন্য। কিন্তু আমি যতটুকু দেখতে পাচ্ছি আকাশ তো ততটুকু নয়। খামোখা পালাতে যাব কেন?

 

জ্যামিতিক

‘একটা চতুষ্কোণ মাটি দরকার, বুঝলেন?’ নীলাভ মাংকি-ক্যাপটাকে কপালের নীচে আকর্ষণ করল। অসম্ভব ঠান্ডা পড়েছে। বাতাস ভারী হয়ে আছে। শ্বাস নিতে কষ্ট হয়। তাছাড়া, মর্নিংওয়াক শব্দটায় যতটা আরাম এবং স্বাস্থ্যচর্চা মিশে আছে, বাস্তব অবশ্য অন্য কথা বলে। এই হাত, পা, এই শরীর এতটাই জড় যে, সামান্য নড়াচড়াও ভীতিকর। মানস হাতের রুপো বাঁধানো লাঠিটা জোরে ঠুকল মাটিতে, ‘কী হল? দাঁড়িয়ে পড়লেন যে।’

‘আসলে, ভাবছি। ক’দিন যাবৎ একটা কথাই ভাবছি’ নীলাভ মানসের চোখের দিকে তাকায় ‘একটা বাড়ি করতে পারিনি এখনও! আমার একটু মাটি চাই। দেড়-দুকাঠা হলেও হবে। খোঁজ আছে নাকি?’

‘বাড়ি? সাতকুলে কেউ নেই আপনার, বাড়ি করবেন কার জন্য?’

মানস থমকে গেল।‘আমার জন্যই। একটা বাড়ির স্বপ্ন দেখছি। খুব লোভ হচ্ছে জানেন! ভাবতেও ভালো লাগে! নিজের বাড়ি!’ নীলাভ অপ্রস্তুত হাসি লুকিয়ে ফেলার চেষ্টা করে।

মানস হেসে ফেলে। ‘এটা আবার ব্যাপার নাকি? হয়ে যাবে। ঠিক আছে। জানা রইল।’ মানস ভিজে ঘাসের উপর ফের লাঠি ঠুকল। শব্দ হল না। ভেজা মাটি কোনও শব্দ করে না। লাঠিটা দেখতে দেখতে বাস্তবের মাটিতে পা রাখছিল নীলাভ– ‘আচ্ছা! আজ দেখছি লেঠেল হয়ে বেরিয়েছেন! শখ?নাকি প্রয়োজন?’‘আরে, প্রয়োজন ছাড়া কি আর…! বুড়ো হতে কার ভালো লাগে বলুন? ক’দিন ধরেই যন্ত্রণা হচ্ছে পায়ে। তো, গিন্নি লাঠিটা এগিয়ে দিলেন, সঙ্গে রাখো। আরাম হবে। দেখছি কথাটা মিথ্যে নয়। আসলে, ভারটা অন্যের উপর রাখলে স্বস্তি মেলে।’ মানসের হাসি দেখতে দেখতে নীলাভর ঠোঁটও প্রসারিত হতে থাকে। স্থির লক্ষ্যে পৌঁছোনোর আগেই অবশ্য থেমে যায় নীলাভ। সত্যিই কি বার্ধক্য এসে গেছে? তাই কি চট করে ঠান্ডা লেগে যায়?

‘সব কিছু পালটে গেল কীরকম। এই শহরে তেত্রিশ বছর কাটিয়ে দিলাম। যখন এসেছিলাম চব্বিশ পঁচিশের টগবগে ঘোড়া!’ নীলাভ কুয়াশার ভেতর দৃষ্টি নিক্ষেপ করার চেষ্টা করে।

‘আমি যে পাঁচবছর ধরে আছি, আমারই তাই মনে হয়। পড়শি পর্যন্ত পালটে যায় মশাই। শহর একেই বলে।’ হা-হা শব্দে হাসে মানস। নীলাভ মনে মনে হাসে। মানস ভাড়াটের কথা বলছে। পাঁচ বছরের মধ্যে বাড়ি বানিয়েছে। ভাড়াটে বসিয়েছে। সারাদিন খ্যাঁচম্যাচ্! ধুর! নিজের বাড়িতে নিজের সঙ্গে বাস করার আনন্দ বুঝবে না মানস। বাড়ির সঙ্গে গৃহস্থের যা সম্পর্ক, ভাষার সঙ্গে বর্ণমালার সেই সম্পর্ক।

মানসের হাসির শব্দে জগিং-এ ব্যস্ত তরুণী চমকে তাকাল। দু-একজন স্বাস্থ্য অন্বেষণকারী ওঁদের দেখছে বুঝে লজ্জিত হয় নীলাভ– ‘আস্তে! আস্তে!’

‘ওঃ! ভাষার সঙ্গে বর্ণমালা আর গৃহস্থের সঙ্গে বাড়ি? দারুণ!’

‘কথাটা চুরি করেছি। গণিতশাস্ত্রবিদ ইউক্লিডের কথা এটা। অবশ্য একটু অন্যভাবে বলা।

‘তো, কী বলছিলেন? গৃহস্থ আর বর্ণমালা…?’

নীলাভ হাসল। ‘দেখুন, এসব তত্ত্বের জন্য যুক্তিতর্ক দরকার হয় না। একে স্বতঃসিদ্ধ মেনে নিতে পারেন। সত্য বলে ভাববেন।’

‘না না! তা বলছি না। তবে, কথাটা বেশ।’ মানস লাঠিখানা মাটির উপর থেকে তুলে নেয়। নীলাভ একটু দাঁড়াল। ইদানীং হাঁপ ধরে যাচ্ছে সহজেই। দুপাক হাঁটতেই মাঠটাকে বিশাল এবং ভয়ংকর বলে মনে হচ্ছে। যেন বিরাট শূন্যতা গিলে খেতে আসছে। যেন হারিয়ে যাবে নীলাভ এই মহাশূন্যতায়। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে শারীরিক ও মানসিক অবস্থার পরিবর্তন হচ্ছে। কেন পালটে যাচ্ছে শরীর, বা কেন মানসিক অবস্থা পরিবর্তিত হয়ে যায় তার কোনও যুক্তিতর্ক নেই। প্রশ্ন নেই। এসব হল স্বতঃসিদ্ধ।। এলিমেন্টস নামক বইতে ইউক্লিড একথা বলেছেন।

মানস গিন্নির দেওয়া লাঠিখানাকে ফের ভেজা মাটির উপর বসিয়ে দিয়ে হাঁটতে শুরু করেছে। একটা লাঠি তো নীলাভরও দরকার ছিল। কিন্তু কে এগিয়ে দেবে সেই স্বস্তি-দণ্ড? মানস জানে সাতকুলে কেউ নেই নীলাভর। যদি থাকত, তবে এই কুয়াশাভরা মাঠে রুপোর লাঠি আজ নীলাভর হাতেও থাকত।

এখনও কুয়াশা ছড়িয়ে আছে মাঠ জুড়ে। দূরে দূরে দু-একটা ধোঁয়ামূর্তি নজরে আসে। শুদ্ধ বাতাস শহরে নেই। চারপাশে কি কুয়াশা? নাকি ধোঁয়াশা?

‘আজ মেয়ে-জামাই আসছে গোরখপুর থেকে। ওখান থেকে নেপালে গেছিল। মায়ের জন্য নানাবিধ গিফ্ট আসছে। ওর মা-তো গত কাল থেকেই টেনশনে… কী আনবে ওরা…!’ মানসের সুখী মুখে লালচে গোলাপ ফুটেছে। এই তো জীবন! সুখ নিয়ে বেঁচে থাকা। মানস হাসিহাসি মুখ করে, ‘গিন্নি বায়না ধরেছেন জামাইকে মালাই চিংড়ি খাওয়াবেন। নারগিসি কোফতা বানাবেন! হই হই কান্ড। বুঝেছেন?’

বুঝল নীলাভ। মানস এখন ফিরতে চাইছে। কাজ আছে বাড়িতে। ফিরে আসতে গিয়ে শর্টকাট করতে চাচ্ছিল মানস। নীলাভ কথাবার্তায় ভুলিয়ে সোজাপথে নিয়ে এল মানসকে। শর্টকাট অপছন্দ নয়। তবে, ওই পথটা বড়ো কঠিন পথ। একটা অস্বস্তিকর অবস্থা তৈরি হয়। মাস ছয়েক আগে একদিন অবশ্য গেছিল। আজ আর গেল না। একদিন গেলে কদিন যাবৎ অস্বস্তিটা জাপটে থাকে শরীর-মনে। বড্ড কষ্ট হয়। ভয় হয়। যেন স্বপ্নে দেখা নিঃসঙ্গ পথ। আলো নেই। আশ্রয় নেই। শূন্যতা কেবল। ভালো লাগে না। আবার, ভুলেও থাকা যায় না।

বাজারের রাস্তা ধরল মানস। বাজার ছাড়িয়ে ডানদিকের সরু গলিতে ঢুকে পড়ল নীলাভ। এবার শর্টকাট। তার আস্তানাটা আবার কাছে নয়। সোজাপথে সময় লাগবে।

বাসার কাছাকাছি আসতেই সীমন্তর সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। মেসবাড়ির মেস-ম্যানেজার সে-ই। বাজার সেরে ফিরছে। নীলাভকে দেখে দাঁড়াল। ‘নীলাভদা যে! আজ বিফোর টাইমে!’

হাসে নীলাভ। ‘কী আনলে। কী মাছ?’

‘মাছ নয়। মাংস। সবাই ধরে বসল।’

‘কেন? কোনও ব্যাপার আছে বুঝি?’

‘না, মানে ওই আর কী…!’ সীমন্ত এদিক-ওদিক তাকায়।

ছেলেটা স্পষ্ট হল না। অথচ ভেতরে একটা কথা আছে ঠিক। বেশ। খেতে বসে জানা যাবে।

বারান্দায় টিনের চেয়ার টেনে বসল নীলাভ। কাগজফুল গাছে অনেক ফুল ফুটেছে। আসলে বোগেনভিলিয়া। তারা ছেলেবেলায় কাগজফুল বলেই জানত। এমন প্রাণময় গাছটার এমন একটা জড় নাম কেন ছিল? লিপ্তা বলেছিল, এই ফুলে পুজো হয় না। কেন হয় না? লিপ্তা জবাব দিতে পারেনি। অবশ্য অনেক কথারই জবাব দিতে পারেনি লিপ্তা। কখনও পারেনি। ভরাট ঠোঁট টিপে দাঁড়িয়েছিল মাত্র। যুগলপ্রসাদ রোদে দাঁড়িয়ে খবরের কাগজ পড়ছিল। ছেলেটা চমৎকার বাংলা বলে। মাঝে মধ্যে তৎসম শব্দও ব্যবহার করে। ডাকল নীলাভ ‘এই যে যুগল!

ঠান্ডা কীরকম?’

‘ঠান্ডা?’ যুগল পেছন ফিরে তাকাল ‘উত্তরোত্তর বেড়ে চলেছে। আর কদিন পর শৈত্যপ্রবাহ শুরু হবে।’

কিছু বলতে মুখ খুলেছে নীলাভ, দীপংকর চ্যাঁচাল– ‘খাবার রেডি। ফটাফট এসে পড়ুন সবাই।’

খেতে বসে আসল কথাটা জানা গেল। সীমন্তর ছেলে হয়েছে। আজই। সকালে ফোন এসেছে। আগামিকাল সীমন্ত যাচ্ছে বালুরঘাটে শ্বশুরবাড়িতে। ছেলেকে দেখতে।

খুশি হওয়ারই কথা। খুশিই হল নীলাভ। সীমন্তর চনমনে মুখের দিকে তাকিয়ে অন্যমনস্ক হয়ে পড়ল ও। বারান্দায় কে জল ফেলে রেখেছে। পড়তে পড়তে বেঁচে গেল। যে-যার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়বে। একমাত্র ওর কোনও কাজ নেই। ধীরেসুস্থে স্নান সেরে খবরের কাগজ নিয়ে বসবে। কাগজফুল গাছটা বাতাসে ফুলপাতা দুলিয়ে চলেছে খসখস শব্দে। যেন বই-এর পৃষ্ঠা উলটে যাচ্ছে নিজে থেকে। কত ঘটনা কত মিলন-বিচ্ছেদের কাহিনি লেখা আছে সেইসব পৃষ্ঠায়।

আজ সবাই খুশি। সীমন্তর ছেলে এল। মানসের মেয়ে-জামাই এল। চিংড়ি রেঁধেছে মানসের বউ। স্বাভাবিক। খুশি হওয়ারই কথা। একটা জ্যামিতিক কোণ পুরো হল।

বাইকের শব্দে চটকা ভেঙে গেল। যুগলপ্রসাদ অফিসে গেল। দিবাকর সাইকেল বের করে আনছে বারান্দায়। ভূদেবের অফিস কাছেই। জিৎ, দেবনাথ ব্যাগ ঝুলিয়ে মেট্রো ধরতে দৌড়োচ্ছে। এই লোকটা কখনও হাসে না। ঠিক এইরকম একটা স্কুটার ছিল নীলাভর। এটা কার? সজীবের। সজীব স্কুটার ঠেলে নামাচ্ছে। নীলাভ হাটবাজার, অফিস… সর্বত্র স্কুটার নিয়ে চলত। অবশ্য লিপ্তা ছিল। পিছনে বসে জাপটে ধরে থাকত। জীবনটা বেহিসেবি হয়ে গেল নীলাভর! হিসেব করে চলতে শেখা হল না!’

অন্যদিন সন্ধে রাতে শুয়ে পড়ে। আজ ইচ্ছে হল না। নানা ভাবনায় মাথাটা গরম। প্রেশারটা চেকআপ করাতে হবে। একটু শুয়ে থাকলে হয়তো ভালো লাগবে। নাঃ! বসে থাকাই ভালো। অস্থির নীলাভ ফের শুয়ে পড়ে। কে ডাকে? অর্ণব স্যার? চার পাঁচজন ছেলেকে ডেকে ব্ল্যাকবোর্ডের সামনে দাঁড়িয়ে কী বোঝাচ্ছে?

‘দ্যাখ, একটা সরলরেখা অন্য দুটো সরলরেখাকে ছেদ করলে, একপাশের দুই কোণের সমষ্টি যদি একশো আশি ডিগ্রির কম হয়, তাহলে সরলরেখা দুটোকে দুই পাশে বাড়ালে কোথাও না কোথাও মিলবেই।’ চক দিয়ে খসখস শব্দে সরলরেখা টানে অর্ণব স্যার! সেই শব্দে চোখ মেলে তাকায় নীলাভ। স্বপ্ন দেখছিল! আর ঘুম হবে না। উঠে জল খেল নীলাভ। কনকনে ঠান্ডাজল গলা কেটে ফেলল ধারালো অস্ত্রের মতো। মধুমিতা ঠান্ডা জল খেতে দিত না। ফ্লাস্ক রাখত টেবিলে। গরম জলের ফ্লাস্ক। কিন্তু এতদিন পর ছেলেবেলার স্যার কেন এল স্বপ্নের ভেতর? কী শেখাল এতক্ষণ ধরে? কেন বলল না নীলাভর জীবনের খামতির কথাটা? কেন নীলাভর জীবনের দুটো কোণের সমষ্টি একশো আশি ডিগ্রি হয়নি? একটা চতুষ্কোণ মাটি পাওয়া হল না। তার ভিতরে ঘর। তার ভিতরে সংসার। মধুমিতাও কি এভাবেই ভাবে? হয়তো ভাবে, হয়তো ভাবে না। সে তো সাহিত্যের ছাত্রী! একটু নরম, একটু লাজুক। স্কুটারের পেছনে বসতে ভয় পেত। মুকুন্দপুরে বন্ধুর বাড়িতে যাচ্ছিল। সিল্কের শাড়ি পিছলে মধুমিতা…! লজ্জায় কেঁদে ফেলেছিল। বন্ধুর বউ বকুনি দিয়েছিল। ‘বউ পড়ে গেল, আপনি হাসছেন?’

বাড়িতে ফিরেও রাগ পড়েনি মধুমিতার। অনেক কষ্টে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে হয়েছে। অঝোর বৃষ্টি পড়ছিল সে রাতে। মধুমিতা বিরহের গান গেয়েছিল। ভালো গাইত ও। নীলাভ চেয়েছিল মধু গানের চর্চা রাখুক। ভালো গাইত।

দু-চারজন ছাত্রীও জুটে গেল। সে সময়ই এল লিপ্তা।

গাঢ় অন্ধকারের দিকে জোনাকি খুঁজল নীলাভ। টর্চটা কোথায়? এত অন্ধকার কেন? আজ কি অমাবস্যা? এই যে টর্চ…! লিপ্তার চটক ছিল। স্মার্টনেসও। গুছিয়ে শাড়ি পরত লং কোটের সঙ্গে। মনে মনে কি এমনই একটা অন্বেষণ ছিল? নিজের মনকে বুঝতে পারেনি নীলাভ!

চোখ বুজে ফেলল। ভালো লাগছে না। বরং বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালে ভালো লাগবে। …নাঃ! খুব ঠান্ডা বাইরে। অসুখ হলে কে দেখবে? অথচ প্রবল ঠান্ডা বলে কিস্যু ছিল না। আগুন জ্বলত শরীর-মনে। দাউদাউ আগুন। লিপ্তার হাজব্যান্ড তখন চণ্ডীগড়ে। কোয়ার্টার পায়নি। টু বিএইচকে ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে চার বন্ধু থাকত। লিপ্তাকে সেখানে নেওয়ার সুবিধে ছিল না। এদিকে লিপ্তার তখন অখন্ড অবসর। গান শিখতে আসত মধুমিতার কাছে। আর নীলাভ? কী করে যেন সব ভুলে যেতে থাকল। এমনকী গোল্ডিকেও!

মধুমিতা যখন সব বুঝল, তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। ততদিনে মুক্তির সন্ধান করছে নীলাভ। মধুমিতার হাত থেকে মুক্তি। প্রথম প্রথম ঝগড়াঝাঁটি। তারপর স্পষ্টভাষায় মুক্তি চাইল নীলাভ। লিপ্তাকে ছাড়া ওর আর পৃথিবী বলতে কিছুই কি ছিল?

উঃ! কী মশা বাইরে! নীলাভ ফের মশারির ভেতরে ঢুকে পড়ে। কখন ভোর হবে।… স্তব্ধ হয়ে গেছিল মধুমিতা। তারপর জড়তা ভেঙেছিল। ‘মুক্তি চাইছ যখন, যাও। একদিন বুঝবে কত কঠিন কাজ করলে আজ। কিন্তু আরও কঠিন কাজ রয়ে গেল। আর কখনও ফিরে আসতে পারবে না।’

ইচ্ছেও ছিল না ফিরে আসার। বাড়িটা তো মধুমিতার। উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া। সে বাড়ি কখনও নীলাভর ছিল না। খোলামেজাজে বেরিয়ে এসেছিল। মুক্তি! আবার বাঁধা পড়ার জন্য মুক্ত!

মাত্র সাতদিন আগেই শ্যামবাজার পাঁচমাথার মোড় থেকে লিপ্তার পছন্দমতো জাংক জুয়েলারি সেট কিনে দিয়েছিল নীলাভ। ফেডেড জিন্সের সঙ্গে দারুণ মানিয়েছিল লিপ্তাকে।

‘একি? ঘুমোননি এখনও?’ দিবাকর বাথরুমে যাচ্ছে।

‘ক’টা বাজল দিবাকর?’

‘মর্নিং ওয়াক? দেরি আছে। সবে আড়াইটে। ঘুমোন।’

বাথরুমে জলের শব্দ। ছলছল শব্দে বয়ে যাচ্ছে জল। এভাবে বয়ে গেল একটা জীবন। মধুমিতা কখনও কিছু দাবি করেনি। ওর এতটা আত্মসম্মানজ্ঞানের সন্ধান আগে পায়নি নীলাভ। বুঝতেই পারেনি। এখনও কি মধু আগের মতই আছে? আর লিপ্তা? ভয় পেয়ে গেছিল নীলাভর পাগলামিতে। অথচ বুঝতে দেয়নি। বর চণ্ডীগড়ে নাকি ফ্ল্যাট কিনেছে। লিপ্তা চলে গেল সংসারের খোঁজে। সেই চতুষ্কোণ মাটির গল্প। নাকি নীলাভকে বিশ্বাস করতে পারেনি? যে লোক অতি সহজে চতুষ্কোণ মাটি ভেঙে ফেলে বেরিয়ে আসতে পারে তাকে বিশ্বাস করেনি লিপ্তা। মানস কী যেন বলছিল? সাতকুলে কেউ নেই, মাটি দিয়ে কী করবে? সত্যি! কী করবে তুমি? কে থাকবে তোমার মাটিতে? বৃত্তাকার ঘেরাটোপে তুমি এক স্বতন্ত্র নিঃসঙ্গ সত্তা নীলাভ!

ওফ্! এত মশা! মশারির গায়ে আটকে গুনগুন করে চলেছে। ওর দিকে আঙুল তুলছে মশারা। অভিযোগের বাণ ছুড়ছে! মাথা ধরে যায়!

শেষ রাতে ঘুমিয়ে পড়ল নীলাভ। মানস ডাকতে এসেছে। উঠে গরম পোশাক চাপিয়ে কুয়াশার ভেতরে নেমে গেল ওরা। বকবক করছিল মানস।

‘নাতনিটি বুঝলেন, পাকা দি গ্রেট। পটপট কথা বলে। খুদে ঠাকুমা। বলে, একা একা বের হবে না কিন্তু। পড়ে গেলে কে ধরবে? ভাবুন!’ হাঃ হাঃ শব্দে হাসে মানস। সেই হাসিতে সুখের গন্ধ ওড়ে।

মানস জোরে হাঁটতে পছন্দ করে। পায়ের যন্ত্রণাটা হয়তো নেই। আজ তো লাঠিও আনেনি। নীলাভ তাল রাখতে পারছিল না। শরীর বশে নেই। হাঁটু যেন ভেঙে পড়ছে।

‘শরীর ভালো নয় নাকি? চলুন, ফিরে যাই। আমার বাড়ি চলুন। গরম চা হয়ে যাবে এক রাউন্ড।’

না। আর কেন। লোভ হয় ঠিকই। কিন্তু সামলাতে জানতে হয়। সেটা জানা ছিল না বলেই হয়তো জ্যামিতিটা সম্পূর্ণ হল না। মানস বার তিনেক কথা চালাতে চেষ্টা করল। কিন্তু নীলাভর তরফ থেকে প্রত্যুত্তর না পেয়ে নীরব হয়ে গেল। ধীর পায়ে হাঁটছিল নীলাভ। মানস অবাক হল। নীলাভ আজ সোজা পথ ধরছে না। শর্টকাট করবে নাকি? গতকালও যেতে চায়নি। আজ নিজে থেকে….? কিছু বলছিল মানস। নীলাভ শুনতে পায়নি। বিষম উত্তেজনায় ধড়ফড় করছিল বুক। কেন যাচ্ছে এপথে? অদৃশ্য এক সুতো যেন প্রবল আকর্ষণে নিয়ে যাচ্ছে ওকে। ছ-মাস আগে একবার এই রাস্তায় ঢুকেছিল। তাকাতে পারেনি। আজ তাকাবে। পূর্ণ দৃষ্টি মেলে দেখবে।

বাড়ির চেহারাটা অন্যরকম হয়ে গেছে! দোতলাই আছে অবশ্য। গোল্ডিকে দেখেছে একদিন। সঙ্গে গোল্ডির বউ ছিল। কেনাকাটা করছিল। মধু এখন শাশুড়ি। ছেলে, ছেলের বউ নিয়ে মধুমিতা সুখী? সবটাই হল মানিয়ে নেওয়া। সুখ তো সোজা পথেই আসে। শর্টকাটে তাকে পাওয়া যায় না।

‘কী ভাবছেন?’

‘কিছু বললেন?’

‘বলছি, এসব জায়গায় কত বাড়ি উঠেছে। ক’মাস আগেও ফাঁকা ছিল। প্রোমোটর-রাজ শুরু হয়ে গেছে।’

ঠিক। ফাঁকা ছিল এদিকটা। বারান্দায় দাঁড়ালে অনেকটা দেখা যেত। পাড়ার দোকানি, পাশের বাড়ির বকুল, পলাশ… চিনে ফেলবে কি নীলাভকে? কেন চিনবে না? নিশ্চয়ই ওরা দেখেছে ওকে। একই জায়গায় যখন বসবাস!

‘মশাই, প্রোমোটররা যা সব হয়েছে…’ মানস বকবক চালিয়ে যাচ্ছে।

এক ঝলকের জন্য তাকাল নীলাভ! বাড়িটার সামনে দিয়ে চলে যেতে যেতে একবার চোখ তুলল ও। কেউ কি ছিল জানলায়? পর্দাটা নড়ছে না? না। কেউ নেই! কাকে আশা করেছিল নীলাভ!

‘ওই বাড়িটা’ আঙুল তুলে দেখাল নীলাভ ‘ওই যে হলদে… দোতলা বাড়িটা… ওই বাড়িতে… আমার…!’

‘রিলেটিভ? চেনা লোক?’

রিলেটিভ? কি জানি! রিলেশন না থাকলে রিলেটিভ হয়? বলা যায়? নীলাভ আঙুলটা নামাতে ভুলে যায়।

‘আগে সাদা রং ছিল। হাতির দাঁতের মতো রং। দোতলার বারান্দায় জাফরি ছিল।’

‘ও।’

‘ছেলেটা খুব ছোটো তখন। বছর পাঁচেক। খুব হাসত। একটা দাঁত পড়েছিল। ফোকলা। বললে বিশ্বাস করবেন না কোলে নিলে কাঁধের কাছটা লালা ফেলে ফেলে ভিজিয়ে দিত।’ হাঃ হাঃ শব্দে হাসতে থাকে নীলাভ। এই ঘটনার মধ্যে অবিশ্বাস্য ব্যাপারের অন্বেষণ করতে নীলাভর মুখের দিকে অবাক হয়ে তাকায় মানস।

‘এত পরিচিত যখন, গেলেই পারেন, সময়ও কাটে।’ গলায় মাফলার জড়াতে জড়াতে পরামর্শ দেয় মানস।

‘যাব? যাওয়া যায়?’ ভীষণ বিস্ময়ে মানসকে দেখে নীলাভ। মধুমিতা বলেছিল এ কাজটা আরও কঠিন। সত্যি কথা। গেট খুলে ডোরবেলে আঙুল রাখা যাবে? কে খুলবে দরজা? কে দাঁড়াবে দরজা খুলে? গোল্ডি? গোল্ডির বউ? নাকি…

কে যেন বলেছিল শূণ্যস্থানে কোনও বস্তু থাকলে তা তার চারপাশের জায়গাটাকে দুমড়ে মুচড়ে দেয়। বাঁকিয়ে দেয়। কোথায় যাবে নীলাভ? ওর জন্য কোনও সহজ পথ নেই। কোনও সরলরেখা নেই। সবটাই বক্ররেখা! কতদিন শূণ্যস্থানে থাকবে নীলাভ? চারপাশ যে দুমড়ে মুচড়ে গেল! কেন এত দেরি হল সবকিছু বুঝতে? অর্ণব স্যার তো কবেই বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। বুঝেও ছিল। কিন্তু বুঝেছিল কি সত্যি? তাহলে প্রয়োগ করতে পারেনি কেন? কেন লিপ্তার দিকে অমন প্রবলবেগে ভেসে যাচ্ছিল ও?

হঠাৎই শীত করে ওঠে নীলাভর। এতক্ষণে যেন টের পেল শীতকাল এসে গেছে! জল বরফ হয়ে যাচ্ছে! প্রবল শৈত্যপ্রবাহের মধ্যে দুঃসহ ভীতি এসে হাত পা নখ বের করে তাড়া করে। বিশাল ফাঁকা মাঠ হুহু শূণ্যতার মধ্যে টেনে নিতে থাকে নীলাভকে।

মানস কিছু বলছিল। শুনতে পেল না নীলাভ।

মানসের পাশে পাশে হেঁটে যায় এক উদ্বাস্তু। একা নিঃসঙ্গ!

 

ছায়া ছায়া পাপ

এই ভর সন্ধেবেলায় হঠাৎ বাবুর ঘরে ডাক পড়ল কেন ভেবে পেল না দেবু। সন্ধের গা ঢাকা অন্ধকারে ত্রিপলের ছাউনি দেওয়া লরি থেকে ষোলো বস্তা চিনি আর আট টিন সরষের তেল সবে গুনে গেঁথে ঢুকিয়েছে গোডাউনে, এমন সময় দিনুদা এল, ‘এই দেবা– বাবুর সঙ্গে দেখা করিস একবার।’

সরষের তেলের টিন গুনতিতে ব্যস্ত দেবু ঘাড় না ফিরিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘বাবু কোথায়?’

‘গদিতে।’ এটুকু বলেই পিছন ফিরল দিনুদা। এমনিতেই কম কথার মানুষ। তবু ঝড়াং করে পিছন ফিরতে মনটা ‘কু’ গাইল দেবুর। চট্ করে গোনাগুনতির কাজটা ভোম্বলকে বুঝিয়ে দিয়ে সঙ্গ নিল দিনুদার। হাজার হোক বাবুর খাস লোক বলে কথা!

‘কী ব্যাপার দিন্দা?’

‘কী ব্যাপার– আমি কোথ্থেকে জানব? কত্তাবাবুর কথা তো জানিস!’ উত্তর আরও ভাসাভাসা করে দিনুদা এগিয়ে গেল চত্বর ছেড়ে।

গদি বলতে গোডাউন চত্বর-এর এমুড়ো ওমুড়ো ছড়িয়ে ছিটিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা খানদশেক লরি আর ম্যাটাডোর ভ্যানের ফাঁকফোকর দিয়ে দেখতে পাওয়া যাচ্ছে যে ব্রিটিশ আমলের অ্যাসবেস্টস শেড দেওয়া ঘরটি তার কথাই বোঝাচ্ছে। দেখতে তেমন আহামরি না হলে কী হয়– ওই ঘরটিই এই আমোদঘাটার সামন্তবাড়ির প্রাণভোমরা। এখান থেকেই নকুল সামন্ত’র মাকড়সার জাল বিস্তার। ওদিকে কাশ্মীর, পঞ্জাব, হরিয়ানা, দিল্লি থেকে শুরু করে এদিকে অন্ধ্রপ্রদেশ, ওড়িশা, ঝাড়খণ্ড আর পাশের রাজ্য বিহার পর্যন্ত বাবুর সাম্রাজ্য ছড়ানো। সেই ঘরে ডাক পড়েছে দেবুর। বুক একটু ধড়াস ধড়াস তো করবেই।

ঘরে ঢোকবার আগে দরজার কাচে নিজের ধুলোমাখা চেহারাটা একবার জরিপ করে নিল তাই। অন্ধকার মাখামাখি হয়ে কাচের গায়ে নিজেকে পরিষ্কার দেখতে পেল না। পাশে এখন কেউ নেই দেবুর। থাকলে নির্ঘাত বুকের ধুকপুকুনি শুনতে পেত।

একটু ইতস্তত করে কাচের দরজাটা আলগা হাতে ঠেলল। ভেতরে পা রাখতে ঠান্ডা এক ছোঁয়া পেল শরীরে। ঘরে মিহি করে এসি চলছে।

ধোপদুরস্ত ধুতি-পাঞ্জাবিতে বাবুর দুধসাদা গায়ের রং খোলতাই হয়েছে খুব। ঠিক মাঝবয়েসি এক রাজা যেন। মাথার কোঁকড়ানো চুল পরিপাটি করে আঁচড়ানো। ডান আর বাঁ-হাতের আঙুলগুলোয়  রংবেরঙের পাথর বসানো আংটি। সোনার ঘড়িতে ঘরের আলো চমকায়। মুখে অনবরত চিবিয়ে চলা সুগন্ধি পান। গন্ধে ঘর ম’ ম’ করছে।

একটা তাকিয়ায় কনুই রেখে মোবাইল কানে চেপে কার সঙ্গে বাবু কথা বলে চলেছে নীচুগলায়। দেবুকে ঘরের মধ্যে ঢুকতে দেখে আঙুলের ইশারায় বসতে বলল সামনের নীচু বেঞ্চটায়। শরীরের অস্বস্তি চেপে সাবধানে বসল দেবু। সামনে শুধু ওর নয়, ওরই মতো অন্তত একশো লোকের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা– আমোদঘাটার মুকুটহীন সম্রাট নকুল সামন্ত। বিনবিন করে কপালে ঘাম ফুটছে এই এসির ঠান্ডাতেও, টের পেল দেবু।

ঘরে এখন কেবল দু’জন। প্রথমে একটু ভয়ই করছিল। কে জানে কীসের জন্য এমন জরুরি তলব। দু’একদিনের মধ্যে বেফাঁস কিছু করে ফেলেছে কিনা মনে করবার চেষ্টা করল প্রাণপণে। কথায় বলে, বাবুর চোখ আর বাঘের চোখ!

এমন সময় কত্তাবাবুর নীচুগলায় বলা কথাগুলো শুনতে পেল, ‘গোডাউনের কাজকম্ম কেমন চলছে দেবু?’

টাকরার কাছে শুকিয়ে আসছিল যেন। চেষ্টা করে বলতে পারল, ‘আজ্ঞে ভালোই। এই তো আমোদপুরের লরি আনলোডিং হচ্ছিল!’

নাকের সামনে থেকে মাছি তাড়ানোর মতো ভঙ্গি করে বাবু থামিয়ে দিল ওকে, ‘জানি-জানি। সেজন্যে ডাকিনি তোকে!’ তবে কীসের জন্যে এই অসময়ে ডাক? দমবন্ধ হয়ে আসছিল দেবুর। আজ ঘাড়ে মুণ্ডু নিয়ে ফিরতে পারলে হয়। নকুল সামন্ত মনে হয় মানুষের মন পড়তে পারে। পাশে রাখা ঠান্ডা জলের বোতলটা হাত বাড়িয়ে ওর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘একটা কাজ করতে হবে দেবা!’

‘আজ্ঞে বলুন!’ গলা রীতিমতো কাঁপছিল ওর। হাতের বোতলটাও।

‘ব্যাপারটা কিন্তু খুব গোপনীয়!’ ফিসফিসে গলায় বলা বাবুর কথাগুলো কানের কাছে হিম হয়ে এল কেমন।

‘কেউ জানবে না আজ্ঞে!’ জলে ভেজানো গলায় বাবুকে আশ্বস্ত করবার চেষ্টা করল দেবু।

‘ঠিক বলছিস?’ সামন্তকত্তার গলায় আশঙ্কা আর উৎকণ্ঠার মিশেল।

‘আজ্ঞে ঠিক।’ একটু জোরের সঙ্গে বলল দেবু।

‘তবে এদিকে আয়।’ তাকিয়া ছেড়ে সোজা হয়ে বসল কত্তা। দেবুও বেঞ্চ ছেড়ে ফরাসের একধারে উঠে এল। পাঁচ বছর চাকরি করছে বাবুর এখানে। কোনওদিন এমন করে সামন্তবাবুর কাছটিতে বসতে পারবে ভাবেনি দেবু।

আরও মিনিট কুড়ি পার করে যখন কত্তার কাছ থেকে ছাড়া পেল তখন দেবুর বুকপকেটে দুটো একশো টাকার নোট। কড়কড়ে। দোমড়ানো মোচড়ানোর কোনও সিন নেই। একেবারে বাবুরই মতো ঝকঝকে। ফিট। যা শুনেছে সব মনে মনে রাখবার দাম। পরে আরও পাওয়া যাবে। নকুল সামন্ত ফালতু বকোয়াস করে না। ভূতগ্রস্ত মানুষের মতো এলোমেলো পায়ে গদিঘর থেকে নিজের ডেরার দিকে চলল দেবু ওরফে দেবিদাস পুরকাইত। আজ, এই এখন থেকে পরীক্ষা শুরু হল ওর।

দুই

‘দিন যায়, রাত না ফুরায়।’ ছেলেবেলায় দেখা কৃষ্ণযাত্রায় বিরহিণী রাধার গানের বাণী যেন অক্ষরে অক্ষরে মিলে যাচ্ছে রিখিয়ার জীবনে। মাঝে মাঝে একলা ঘরে সাজপোশাক ছেড়ে সামন্তবাড়ির বউমা দেয়ালজোড়া বেলজিয়াম কাচের আয়নার সামনে দাঁড়ায়। একেবারে একা।

নিজের অপ্সরা-শরীরের যেখানে যে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলি দেবার সেগুলিকে নিপুণহাতে যিনি তৈরি করে পাঠিয়েছেন, তাঁকে ধন্যবাদ দেবার পাশাপাশি নানাভাবে অভিসম্পাতও দেয় রিখিয়া। কী দরকার ছিল ভগবানের ওকে এত সুন্দর করে গড়ে তোলবার! মাথায় প্রপাতের মতো একঢাল চুল, টানাটানা চোখ, সুগোল দুটি স্তন এবং সুশোভন শ্রোণিদেশ– এসব কী কাজে লাগল ভগবান?

যে-মানুষটার কোনও ক্ষমতা-ই নেই, সেই মানুষটা বিছানার সঙ্গী হয়ে আছে এই সত্যটা অনেক দাম দিয়ে বুঝতে হল রিখিয়াকে। নিশ্চুপ পড়ে থেকে সামন্তবাড়ির একমাত্র উত্তরাধিকারী দীপেনের আঁচড় কামড় সহ্য করতে করতে গোটা বছর ধরে এই অভিজ্ঞতা অর্জন করতে হল রিখিয়াকে।

গরিব বাবার একমাত্র মেয়ে। তায় যথেষ্ট সুন্দরী। কলেজের ক্লাস শুরু করতে না করতেই উঠেপড়ে লেগেছিল অচিনপুরের কৃষ্ণদাস বৈরাগ্য। খোঁজ খোঁজ করতে করতে কোনওমতে আমোদঘাটার ডাকসাইটে ব্যবসায়ী নকুল সামন্তর নজরে মেয়েকে এনে ফেলা হতেই, বাবা হাত তুলে সোজা হরিদ্বারের পথে। মেয়ে ভাসল কি ডুবল পিছু ফিরে আর দেখার প্রয়োজন মনে করল না। শুধু বড়ো সামন্ত’র অঢেল পয়সা, রঙিন আলোর রোশনাই, গ্রামসুদ্ধ লোক খাওয়ানো আর মেয়ের সর্বাঙ্গ মুড়ে দেওয়া গয়না দেখেই সিদ্ধান্ত নিয়ে নিল, এ বিয়ে সুখের না হয়েই যায় না। হায়– এত সহজেই যদি সব সুখ কেনা যেত বাবা!

অনেক দুঃখে মনের অসুখ মনেই চেপে রাখে রিখিয়া। সব ছেড়ে যে-মানুষটা ওকে সুখী মনে করে অনেক দূরে সরে গেছে, সেই বাবার উপরও কোনও অভিমান রাখেনি। শুধু একটাই প্রশ্ন মাঝে মাঝে বিব্রত করে রিখিয়াকে, মা বেঁচে থাকলেও এতটাই নির্লিপ্ত থাকতে পারত বাবা? কে জানে, হয়তো পারত।

গত বৈশাখে ওর বিয়ের পর থেকে এবছর অঘ্রাণ পর্যন্ত মাত্র দুবার ফোন করেছে বাবা। হাসি হাসি মুখে নিজের কাল্পনিক সৌভাগ্যের কিছুটা হলেও সত্যি খবর পৌঁছে দিয়েছে রিখিয়া। ফোনের ওপারে মানুষটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বলেছে, ‘সব তোর কপাল মা! নইলে নকুল সামন্তর ছেলের সঙ্গে বিয়ে– হয়!’

হাসি বজায় রাখবার চেষ্টা করতে করতেই রিখিয়া বলেছে, ‘সত্যি বাবা– সবই আমার কপাল। সঙ্গে তোমার আশীর্বাদও ছিল তো!’

মানুষটা কী বুঝল কে জানে। কৃষ্ণনাম করতে করতেই ফোন রেখে দিয়েছিল। সেই শেষ। ইচ্ছা করেই আর রং মিলন্তির খেলায় নামেনি ও। এ বছর বৈশাখ পার হয়ে অঘ্রাণ আসতে এত দেরি হল কেন নিজের মনেই সে প্রশ্ন করে মাঝে মাঝে। বিশাল ফ্রেঞ্চ উইনডোর ধারে একলা দাঁড়িয়ে বিধুর প্রকৃতির কাছে জানতে চায় রিখিয়া, ‘ও অঘ্রাণ– অচিনপুরের মাঠে কি ধান পেকেছে এখন? ঝরতি পড়তি ধানের শিষ এখনও কি আগের মতো তুলে নিয়ে গর্তে ঢোকে মেঠো ইঁদুর? বলো না ও অঘ্রাণ, এখনও কি বাসস্ট্যান্ডের পাশে ‘সত্যনারায়ণ টকিজ’-এর অন্ধকার হলে পাশাপাশি বসে পরস্পরের শরীরের ওম-এ উত্তাপ খুঁজে নিতে থাকে সুদর্শন, দেবিকা, সৌভিক কিংবা দয়াময়ীর মতো আমার বন্ধুরা– আগেকারই মতো?

ও অঘ্রাণ, তুমি কি বলতে পারো একটা শূন্য কলশির সঙ্গে ঘর করতে হলে মেয়েদের আরও কত কী মেনে নিতে হয়? অথচ কলশিটা বিশ্বাসই করতে চায় না তার শূন্যতা। এরপর কী করবার থাকে আর?’

প্রশ্নের পর প্রশ্ন ভাসে বাতাসে। উত্তর আসে না। চেষ্টা করতে করতে হাল ছেড়ে দেয় রিখিয়া। সামন্তবাড়িতে শাঁখ বাজল। শাশুড়ি-মা সন্ধে দিলেন। খাটের উপর হারমোনিয়ামের সামনে এসে বসল রিখিয়া। মনের আগল খুলে দিল গানের সুরে, বাণীর নির্যাসে, ‘আমায় অনেক দিয়েছ নাথ।’ শাশুড়ি-মা’র পায়ের শব্দ ঘরের দরজার বাইরে এসে থামল।

তিন

বিকেলের পড়ন্ত রোদের এক আলাদা মায়া আছে। একটু পরেই পাটে বসতে চলেছেন সূর্যদেব। হিমের আঁশমাখা সেই রোদ একটু একটু করে গায়ে মাথায় মেখে নিলে একধরনের আমেজ আসে শরীরে। বাঁধের উপর দাঁড়িয়ে সেই রোদের আমেজ নিচ্ছিল সায়ন।

একসময় দামোদর ছিল গোটা রাজ্যের দুঃখ। দুঃস্বপ্নের নদ। এখন বললে লোকে হাসবে। নদের খাত জুড়ে বালি আর বালি। লরির পর লরি দাঁড়িয়ে। সেই বালি তুলে নিয়ে বাজারে ঢেলে দিয়ে আসবে। তৈরি হবে আকাশচাটা ফ্ল্যাটবাড়ি। আশ্চর্য এক লেনদেনের সম্পর্ক যেন। তুমি দেবে আর আমি নেব। অথবা উলটোটা। বাঁধের একপাশে বটগাছের কোল ঘেঁষে তৈরি হয়েছে চায়ের দোকানটি। সেটি বেশ পরিচ্ছন্ন দেখে একপলকেই পছন্দ হয়ে গেল সায়নের। ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের হোস্টেল হলেও যথেষ্ট পরিচ্ছন্ন ওদের রোজের থাকা-খাওয়ার পরিবেশ। সেই অভ্যাস বাইরেও। চায়ের দোকানি উনোনে আঁচ দিয়েছিল। ধোঁয়া কুণ্ডলি পাকিয়ে পাকিয়ে এলাকা ছাড়া হয়ে নদীগর্ভের দিকে। গরম চায়ের আহ্বানে এই বাঁধের দিকের দোকানটিতে। নাহলে আমোদঘাটায় চায়ের দোকানের কমতি নেই। তবে রিখিয়ার এসএমএস অনুযায়ী লোকালয় থেকে যতটা সম্ভব দূরে থাকাই ভালো। আপাতত সেই চেষ্টাতেই সায়ন।

‘এখানে কাদের বাড়ি এসেছেন?’

বাঁধের পাশের মাঠটিতে ছেলেদের ব্যাটিং, বোলিং আর ফিল্ডিং দেখতে দেখতে এতই মগ্ন হয়ে পড়েছিল সায়ন যে, প্রশ্নটা শুনতেই ভুল হয়ে গেল প্রথমে। দ্বিতীয়বার আবার জিজ্ঞেস করতে তবে শুনতে পেল।

ঘাড় ঘুরিয়ে সাদা প্যান্ট শার্টের সঙ্গে মাথায় কাউন্টি ক্যাপ চাপানো ভদ্রলোককে দেখতে পেল সায়ন। ঝোঁকের মাথায় বাঁধের দিকটায় চলে এসেছে বটে কিন্তু এমন একটা সমস্যা যে হতে পারে সেটা ভেবে দেখেনি। অথচ পরিষ্কার নির্দেশ আছে কোনওমতেই সামন্তবাড়ির নাম নেওয়া চলবে না।

অগত্যা আমতা আমতা করে বলল, ‘এই চা খেতে আর কী!’ সম্ভবত এমন উত্তর প্রত্যাশা করেনি কাউন্টি ক্যাপ। তাই সংক্ষিপ্ত প্রতিক্রিয়া হল ‘অহ্!’

একটু থেমে আবার জিজ্ঞেস করল লোকটা, ‘থাকেন কোথায়?’

এতো মহা ফ্যাসাদ হল। টুকটুক করে খুঁটিনাটি সব জানতে চাইছে। তাড়াতাড়ি ধরি মাছ না ছুঁই পানি গোছের একটা জবাব দিল সায়ন, ‘কলকাতা!’

কাউন্টি পরা লোকটা বেশ খানিকক্ষণ হাঁ করে ওর দিকে তাকিয়ে রইল। বোধহয় সায়নের মাথার ঠিক – বেঠিকত্ব নিয়ে সন্দেহ হল। ট্রাউজারের পকেট থেকে রুমাল বার করে মুখ মুছতে মুছতে মাঠের দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে এনে সায়নকে ভালো করে মেপে নিয়ে বলল, ‘ধান্দা যে অন্যকিছু আছে সেটা বুঝলাম। সেজন্যেই এমন ভাসানো জবাব। ঠিক হ্যায়, আমিও কালো ঘোষ। এত সহজে আমার চোখকে ফাঁকি দিতে পারা যাবে না।’

কথা বলতে বলতে নিজের বড়াই করা লোকটার স্বভাব বুঝতে ঠিকই পারল সায়ন। কিন্তু এখনই লোকটির থেকে দূরত্ব তৈরি করতে না পারলে ওর সমূহ বিপদ। এটুকু বুঝতে দেরি হল না মোটেই।

রিখিয়ার জরুরি এসএমএস পাবার পর ওর মনে হয়েছিল এসব বড়োলোকের বাড়ির বউয়ের খামখেয়ালিপনা ছাড়া কিছু নয়। সঙ্গে সতর্কবার্তা সামন্তবাড়ির কেউ কোনও অবস্থাতেই যেন জানতে না পারেন সায়নের ধারণাটাকেই পোক্ত করেছিল শুধু। কিন্তু এখানে এই আমোদঘাটায় এসে রিখিয়ার সঙ্গে বারদুয়েক মোবাইলে কথা বলবার পর সেই ধারণাটা ভেঙে চৌচির হয়ে গেছে।

‘বিনোদিনী গার্লস উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়’- এর চৌকাঠ টপকে অচিনপুর মহাবিদ্যালয়ে পা দেওয়া সদ্য যুবতি রিখিয়া নামের মেয়েটি যে ভিতরে ভিতরে এতখানি দুঃসাহসী হয়েছে, মনটাকে করেছে ইস্পাতের মতো দৃঢ়- সেকথা জেনে এখন নিজেরই কেমন ভয় ভয় লাগছে সায়নের।

অথচ বিয়ের রাতে সব বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিতে দিতে এমন একটা পরিস্থিতি যে তৈরি হতে পারে, স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি কেউ। দিব্যি সকলের সঙ্গে হেসে হেসে কথা বলেছে মেরুন-রঙা বেনারসি আর আগাপাশতলা গয়নার অ্যাড-এর মতো কনের থ্রোন-এ বসে থাকা পরিটি। কই, কোথাও তো কোনও সিঁদুরে মেঘ নজরে পড়েনি। বরং বরের রাজপুত্তুরের মতো চেহারা নিয়ে দেবিকা আর দয়াময়ীরা যখন ঠাট্টা তামাশা করেছে, তখনও লজ্জায় মুখ নামিয়ে নিয়েছিল রিখিয়া। সেটাও নজর এড়ায়নি ওদের। অথচ এক বছরের একটু বেশি সময়ের মধ্যে সবকিছু পালটে যায় কী করে। এ এক আশ্চর্য রহস্য!

সে রহস্য যাই হোক। এখন এই ভদ্রলোককে অবিলম্বে পাশ কাটানো দরকার। না হলে সব বরবাদ হতে সময় লাগবে না বিশেষ। মাথায় একটা প্ল্যান আসতে সেটারই প্রয়োগ শুরু করে দিল সায়ন।

‘ছেলেগুলি কিন্তু দারুণ!’

‘মানে?’ ঘাবড়ে যেয়ে ভদ্রলোক চোখ তুললেন ওর দিকে।

‘মানে বুঝলেন না? প্রত্যেকেই দারুণ প্লেয়ার!’ বিশদ হল সায়ন।

‘বলছেন?’ প্রশংসায় আপ্লুত হয়ে পড়েছেন ভদ্রলোক বুঝতে ভুল হল না ওর।

‘বলব না মানে–! মাঠের দিকে যে তাকাবে সে-ই বলবে। ওয়েল ডিসিপ্লিন্ড!’

কালো ঘোষ এতক্ষণে হাতে চাঁদ পেল যেন।

‘এই– লাখ কথার এক কথা বলেছেন! আরে বাব্বা– ডিসিপ্লিন না থাকলে চলবে কেন? নিজের হাতে তৈরি করেছি মশাই এদের! ফি বছর এখান থেকেই তিন-চারজন ডিস্ট্রিক্ট টিমে–!’

ভদ্রলোককে আর বাড়তে দেওয়া উচিত নয়। মাঠের একেবারে দূরতম প্রান্তে প্রায় নদীর কাছাকাছি লং অন-এ ফিল্ডিংরত ছোকরাকে দেখিয়ে বলল, ‘কেবল ওই যে ছেলেটিকে ফিল্ডিং করতে দেখছেন– ওই ছোকরার নড়াচড়া বেশ স্লো। দেখুন-দেখুন!’ সায়নের পাশে এসে চোখের উপর হাত এনে ছোকরাকে ভালো করে লক্ষ করল কালো ঘোষ। তারপর সায়নের দিকে ফিরে বলল, ‘গুরু লোক ভাই আপনি! ঠিকই ধরেছেন। ও ব্যাটা হিরন্ময়– চিরকালের ফ্ল্যাটফুটেড!’

কথা বলতে বলতে মাঠের দূরতম প্রান্তে নদীর কাছাকাছি যাবার জন্যে হাঁটা দিলেন ভদ্রলোক।

মনে মনে হিরন্ময় নামের ছেলেটির কাছে ক্ষমা চেয়ে নিল সায়ন, ‘ক্ষমা করিস ভাই। এছাড়া আর উপায় ছিল না আমার। এখন আমায় অন্য একজনকে সময় দিতে হবে।’ চায়ের দোকানি ততক্ষণে চা-এর কাপ হাতে ডাকাডাকি শুরু করে দিয়েছে। নদীর বুক থেকে হামাগুড়ি দিয়ে ততক্ষণে কাকের ডানায় অন্ধকার উঠে আসছে।

 

চার

 নেহাত দেবার কপাল খারাপ তাই। নইলে এসব পরের বউয়ের ওপর নজরদারি করবার লোক-ই নয় ও। তার সঙ্গে স্বয়ং বড়ো সামন্তর কথাও মাথায় রাখতে হচ্ছে।

দেবার প্রাণভোমরা বাপঠাকুরদার ভিটেটুকু পর্যন্ত হাতফেরতা হতে হতে এখন বড়ো সামন্তর হেফাজতে। কোন কুক্ষণে মোদোমাতাল বাপটা টিপছাপ দিয়ে ওকে রাস্তায় বসিয়ে রেখে গেছে এমন করে ,কিছুই জানা নেই। আসল সত্যিটুকু জানে শুধু নকুলবাবু। সামন্তগুষ্টির এখনকার চাঁই। সে যে মুখ ফুটে বলবে, সে গুড়ে বালি।

ঝ্যাঁটা মারো, জুতোপেটা করো অমন মদখেকো বাপকে। নেশার জন্যে যে কিনা ছেলে-বউয়ের কথা ভাবে না। কোথায় থাকবে, কীভাবে থাকবে ভাবনা নেই। শুধু নিজের নেশার বস্তুটি চাই। নেশার ঘোরে মা-র গায়ে বাবার হাত তোলা ছায়া ছায়া মনে পড়ে দেবার। তারপর তো এক বর্ষায় মা বর ছেড়ে, ছেলেকে ছেড়ে দূর আকাশের বাসিন্দা হয়ে গেল। দেবু তখন এগারো কি বারো। সেই শুরু সামন্তর তাঁবেদারি। চলছে তো চলছেই। দিনের পর দিন, মাসের পর মাস। বছরের পর বছর। দেবুর মুখে রা’টি নেই। যদি বাবুর মতিগতি ফেরে। যদি কোনওদিন দেয়ালের চোরা কুঠুরি থেকে ঈশ্বর বিশ্বম্ভর পুরকাইতের নামের বাড়ির দলিল দেবুর দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বাবু বলে, ‘এই দেবা– এটা নিয়ে যা!’

আরও কিছুক্ষণ হয়তো চলত চিন্তার নদীতে দেবিদাসের সাঁতার, যদি না জঙ্গলের বাইরে ঘাসজমিতে উতলমাতাল ঝড় উঠত। ঘাসবনে দুটি ছায়াশরীরের তুমুল ওলটপালট। কেউ কাউকে যেন ছাড়তেই চায় না। চকাস্ চকাস্ শব্দ। সব, সবই ঘটে চলেছে মাত্র কয়েকহাত দূরে। অথচ শব্দ করবার উপায় নেই। এমনকী পায়ের গোছে বিছুটি পাতার ঘষা লেগে জ্বলছে বেশ। তবু হাত পা নট্ নড়নচড়ন। পাছে নড়াচড়ার এই চক্বরে ধরা পড়ে যায় ওর গোয়েন্দাগিরি।

বাবুর কড়া নির্দেশ বউদিমণি কোথায় যাচ্ছে, কী করছে সব খবর দিতে হবে। এদিকে একজোড়া শরীরের হাঁসফাঁস করা শ্বাসপ্রশ্বাসের শব্দ। বউদিমণির মুখে সুখের একটানা ‘উঁ’ ‘উঁ’ শব্দ। এসব কীসের ঠিকই বোঝে দেবু। আর বোঝে বলেই ওর যন্ত্রণা বেশি। বিয়ের পর মেয়েমানুষ কীসে সুখী হয় সবচেয়ে বেশি, তা কি বাবু জানে না?ওর মতো উদ্গান্ডু বোঝে আর আমোদঘাটার বেতাজ বাদশা নকুল সামন্ত বোঝে না এটা বিশ্বাস করে না দেবু।

সামন্তদের আড়তের দেড়তলায় আট ফুট বাই দশ ফুট যে -খুপরি ঘরটায় এতদিন থেকে এল দেবু, মাঝে মাঝে একলা সময়ে সেই ঘরটাই কেমন অচেনা মনে হয়। যেন গিলে খেতে আসে রাক্ষুসে হাঁ করে। অনেক রাতে নিজের চেনা শরীরের মধ্যে অচেনা এক শরীর জেগে উঠলে কেমন হন্যে হয়ে ওঠে দেবু। হাত বাড়িয়ে সরু বিছানায় পাশে কোনও জ্যান্ত শরীরের স্পর্শ পেতে চায়। ঘুম ভেঙে সেই ‘অন্য’ আর একজনের মুখোমুখি হয়। প্রশ্ন করে নিজেকে, ‘তোর কীসের এত জ্বালারে দেবা? গড়িয়ে গড়িয়ে বছরগুলো তো কাটালি এখন আর মাত্র ক’টা বছর কাটিয়ে দিলেই তো–!’ প্রশ্নটার ঝুঁটি ধরে ঝাঁকুনি দেয় আদত দেবা, ‘কী বললি হতচ্ছাড়া! এ জ্বলন কীসের তা যদি জানতিস!’ হাজার বোঝালেও বুঝতে চায় না শরীরের মধ্যে জেগে ওঠা অবুঝ অথচ তেজিয়ান সেই ঘোড়া। ঘাসে ঢাকা মাঠে দৌড় শুরু করবার জন্যে ছটফট করতে থাকে।

বাধ্য হয়ে বাকি রাতটুকু উপুড় হয়ে শুয়ে থেকে নিজেকে সামলাবার চেষ্টা করে যায়। বড্ড কষ্ট হতে থাকে তখন। গোটা শরীর যেন তেতে আগুন হয়ে ওঠে। জঙ্গলের মধ্যে মশার কামড় কিংবা বিছুটি লেগে যে জ্বলন তার চেয়েও ভয়ংকরতর এক জ্বলুনিতে জ্বলতে থাকে দেবু।

বড়ো কত্তা যতই ওকে নতুনবউদির ওপর নজর রাখবার কথা বলুক, এসব কথা দেবা কখনও জানাবে না। মেয়েমানুষের জ্বলন বলে কথা! যদি ঘরের ওষুধে না সারে তাহলে তো বাইরের ডাক্তার ডাকতেই হয়। এর মধ্যে কোনও দোষ দেখতে পায় না দেবু। ক্ষমতা থাকলে ছোটোকত্তা দীপুবাবুকে সামলে নিক বড়োবাবু। তা নয়– যত্তোসব!

আস্তে আস্তে নতুনবউদির কথা ভেবে মনটা নরম হয়ে এল খুব। আহারে, কতই-বা বয়স! কত স্বপ্ন নিয়ে সোয়ামির ঘর করতে এসেছিল গরিবের ঘর থেকে। পয়সার জোরে আর যা-ই হোক মন তো কিনতে পারেনি কত্তা!

ততক্ষণে ঘাসবনে ঝড় থেমেছে। আকাশে চাঁদ না থাকলেও দেবুর সামনে তখন বনজ্যোৎস্না। দুটি তৃপ্ত হৃদয় অস্ফুটে তাদের মনের কথা বলে। সবটা না হলেও সেই কথার টুকরোটাকরা পাখনা মেলে উড়ে আসতে থাকে কানে।

‘এভাবে কতদিন চালাবে বলো রিখি?’

চট্ করে একথার জবাব দেওয়া মুশকিল। নতুনবউদিও অনেক সময় নিয়ে বলল, ‘দেখি কতদিন চালানো যায়।’

‘ব্যাপারটা তোমার পক্ষে খুব রিস্কি হয়ে যাবে না তো?’

‘হলে হবে। পরোয়া করি না। বাড়ির কথা এরা জানাজানি হতে দেবে ভেবেছ!’

নতুনবউদির ভয়হীন গলা শুনে চমকে উঠল দেবু। মেয়ের সাহসকে পেন্নাম জানাতে হয়! এ তো দেখছি বাঘের ঘরে ঘোগের বাসা! ‘জানাজানি হলে কী হতে পারে ভেবে দেখেছ?’ ছেলেটির গলায় অজানা আশঙ্কা।

‘কী আবার হবে– শূলে চড়াবে নয়তো ফাঁসি। তবু এই নিত্য যমযন্ত্রণার চেয়ে ঢের ভালো হবে!’ প্রায় কান্নাজড়ানো গলায় বউদিমণির জবাব শুনতে শুনতে জঙ্গলে একহাত জিভ কাটল দেবু। এসব কি বলছ গো বউদি! তোমার দুখ্যু আমি বুঝি। হাজার প্রশ্নেও আমার মুখ থেকে একটি কথাও বেরোবে না আর– দেখে নিয়ো! পাশাপাশি পড়ে থাকা দুটি ছায়াশরীর আবার মুহূর্তের অবকাশে এক হয়ে যায়। জঙ্গলের মধ্যে মানুষপ্রমাণ শর গাছ। তার মধ্যে এক নিঃশব্দপ্রায় দেবতা। দুটি চোখ মুদে। স্বর্গীয় এক দৃশ্যের মধ্যে ডুব দিয়েছে। ঘাসবন থেকে আর একবার চকাস্ করে ভেসে আসা শব্দ শুনল দেবু। অদ্ভুত এক তৃপ্তির হাসি ফুটে উঠল ওর ঠোঁটে। ঘরছাড়া, দিকহারানো একটি ছেলে এবং একটি মেয়ে বিপদ মাথায় নিয়ে কেমন করে বাঁচতে হয় শিখিয়ে দিয়ে গেল যেন।

জামাকাপড় পরে নেবার ঘসঘস আওয়াজ হল। আবছা অন্ধকারে চুড়ির রিনরিন। আরও একটু পরে নতুন বউদির গলা শুনতে পেল, ‘আবার কবে দেখা হবে– জানিয়ে দিয়ো!’

ছেলেটির গলা স্বপ্নালু মানুষের মতো শোনায়, ‘পরের বার কবিতা সংকলনটা নিয়ে আসব।’

‘সত্যি?’ বউদিমনির গলায় চাপা উচ্ছ্বাস।

‘সত্যি! ওটাতো তোমাকেই উৎসর্গ করেছি রিখি!’

এমন জটিল বাংলা শব্দ ‘উৎসর্গ’ বাবার জন্মে শোনেনি দেবু। তবু আবার এক চকাস্ শব্দ ওকে বুঝিয়ে দিল সেটা ভালো কিছুই হবে।

কতক্ষণ আবেশে বুঁদ হয়েছিল খেয়াল ছিল না দেবুর। সম্বিত ফিরল যখন অদ্ভুত এক সুগন্ধ ছড়িয়ে বউদিমণি চলে গেল মাঠ ফাঁকা করে। ওকে উতলমাতাল করে রেখে।

আবিষ্টের মতো দুটি হাত কপালে ছোঁয়াল দেবু। আহা গো বউদিমণি, তোমার কষ্ট আর কেউ না বুঝুক এই ছাই-ফেলতে ভাঙা কুলো দেবা বোঝে। তুমি সব্বোসুখি হও গো। প্রাণ থাকতে আমি তোমার সুখের রাস্তায় কাঁটা হয়ে দাঁড়াব না কখনও!

শরগাছের বন ছেড়ে বেশ কয়েক পা এগিয়ে এসেছে দেবিদাস, এমন সময় মোবাইলে আলো জ্বলে উঠল। স্বয়ং বড়োকত্তা। খুব সন্তর্পণে কথা বলতে লাগল দুজন।

‘কী রে, সব ঠিক আছে?’

‘হুঁ।’ উত্তর সংক্ষিপ্ত করল দেবু।

‘বউমা?’

‘এই তো আট চক্বর শেষ করে মাঠ থেকে বাড়ির দিকে গেল।’ যতদূর সম্ভব গলা স্বাভাবিক রেখে উত্তর দিল দেবু ওরফে দেবিদাস পুরকাইত।

সামন্তবাড়ির লক্ষ্মী সহায় থাকলে ওর ভাগ্য ফিরতেও দেরি হবার কথা নয়। চাই কি, বসতবাড়িটার হাতবদলও হয়ে যেতে পারে। খুশি খুশি মুখে ফোনশুদ্ধ দুটি হাত আকাশে বসে থাকা অথচ এখনও অদেখা মানুষ নাকি দেবতাটির উদ্দেশে, এবার তুলল দেবু।

কাঠগোলাপের গন্ধ

‘আমি সাইকেলে চেপে রাষ্ট্রপতির কাছে যাব, বুঝলে।’

উদয়কাকার মুখোমুখি সোফায় বসে আছি। তিনি আমার দিকে তাকিয়ে আছেন কিনা বুঝতে পারছি না। চোখে কড়া পাওয়ারের চশমা। তার পুরু কাচে মণিদুটো ভেসে রয়েছে। শার্টের নীচে ধুতি জড়িয়েছেন লুঙ্গির মতো করে। এক পা মেঝেয়, অন্য পা তার ওপরে পেঁচিয়ে রেখেছেন। ফোকলা মুখের দু’পাশে গাল বসে গিয়েছে। সেই গালে কয়েক দিনের সাদা কুচো দাড়ি।

আমার চোখ চলে গেল তার কাঁধ পেরিয়ে দরজার দিকে। সেখানে সাগ্নিক এসে দাঁড়িয়েছে। কাকা আমার দিকে ফিরে বসে আছেন বলে ছেলেকে দেখতে পেলেন না। সাগ্নিকও কথাটা শুনেছে। কেন-না আমার দিকে তাকিয়ে চোখ মটকে হাসল। ভাবখানা এমন– শুনলেন তো বাবার কথা!

আমি বললাম, ‘বয়স কত হল আপনার? সত্তর তো পেরিয়ে গেছেন। এখনও সাইকেল চালাতে পারেন আপনি?’

‘সেভেন্টি সিক্স। এখনও পারি তো। কিন্তু ওরা চালাতে দেয় না।’

বুঝলাম ওরা বলতে বাড়ির লোক। বলতেই হল, ‘সে আপনার কথা চিন্তা করে বলেই বলে, বারণ করে। এই বয়সে আর সাইকেল না-ই বা চালালেন। রাস্তাঘাটের যা অবস্থা।’

উদয়কাকা বললেন, ‘হ্যাঁ, রোজই তো কত লোক মারা যাচ্ছে অ্যাক্সিডেন্টে। খবরের কাগজে পড়ি। আমারও তো কতকাল বেঁচে থাকা হয়ে গেল। এখন থাকলেই বা কী, গেলেই বা কী। কিন্তু রাষ্ট্রপতির কাছে যাওয়াটা খুব দরকার।’

‘কী দরকার আমাদের বলা যাবে কি?’ বলতে বলতে সাগ্নিক এবার ঘরে ঢুকে এল।

উদয়কাকা ঘাড় ঘুরিয়েছিলেন। ছেলে এসে সোফার পাশের চেয়ারে বসল। তিনি বললেন, ‘বলে তোদের বোঝানো যাবে না।’

‘কেন? যাবে না কেন? আমরা কি মূর্খ?’

ছেলে ও বউমাকে নিয়ে উদয়কাকার কাছ থেকে বেশ কিছু কথা আমি আগেই শুনেছি। প্রশংসার কথা নয় সেসব। গোলমাল আঁচ করে তাড়াতাড়ি বললাম, ‘আপনার চোখের অবস্থা তো ভালো নয়। সাইকেল চালাবেন কী করে?’

এবার বুঝলাম কাকার চোখের মণিদুটো ছেলের দিক থেকে আমার দিকে ঘুরল। ‘হ্যাঁ, দুটো চোখেই গ্লুকোমা। দুটোতেই অপারেশন হয়েছে। কিছু তো হল না। ওষুধ দিয়ে দিয়ে ঠিক রাখতে হয়। তবে সাইকেল তো চালাব দিনেরবেলায়। রাতে তো চালাব না।’

‘চোখ সারিয়ে নিন না। তারপর না হয় দেখা যাবে।’

‘নাঃ, আর কত দিন বসে থাকব? আর সময় পাব কিনা তা তো জানি না।’

আমি হেসে ফেললাম। ‘তা রাষ্ট্রপতির কাছে যাবেন, সাইকেলেই যেতে হবে কেন? ট্রেনে যাবেন। রাজধানীতে উঠে সোজা রাজধানী।’

মাথা নাড়তে থাকলেন উদয়কাকা। ‘না, তা হবে না। আমি যা বলতে চাই, সাইকেলে গেলে তার গুরুত্বটা বোঝানো যাবে। কথাগুলো বলা দরকার। তুমি আমায় উৎসাহ দাও অত্রি। এবার বেরিয়ে পড়তে হবে।’

এ তো আচ্ছা লোক। আমাকেও জড়িয়ে নিচ্ছে। এ কি কোনও সাইকেল চালানোর কম্পিটিশন যে উৎসাহ দেব!

আমার এখন পঁয়তাল্লিশ। উদয়কাকার ছেলে আমার চেয়ে দু-তিন বছরের ছোটোই হবে। বছর পঁচিশ-তিরিশ কি তারও আগে দেখতাম পাড়ার মাঠে একজন সাইকেল নিয়ে এসেছে। ক্লাবের সঙ্গে কথা বলে সে একটা ব্যানার টাঙিয়ে দিত। সেখানে লেখা থাকত– কাহারও কোনওরূপ সাহায্য না লইয়া বাহাত্তর ঘণ্টা অবিরাম সাইকিলিং। দিনরাত সেই লোক সাইকেল চালিয়ে যেত। তার বুকে-পিঠে সেফটিপিন দিয়ে সাঁটা থাকত কয়েকখানা সার্টিফিকেট। আর সেসবের ফাঁকে ফাঁকে দশ টাকা, পাঁচ টাকার নোট। সে সাইকেলেই খেত, তার ওপর বসেই নীচে থেকে কায়দা করে বালতি তুলে মাথায় জল ঢেলে স্নান সারত। পেচ্ছাপ করার সময় মাঠের ধারে কাপড় ঘেরা একটা জায়গায় চলে যেত। সাইকেলে বসেই ঘুমোত কিনা জানি না। কারণ সেটা দেখার জন্য অনেক রাত অবধি অপেক্ষা করে আমরা বন্ধুবান্ধবরা বাড়ি চলে আসতে বাধ্য হতাম। শুধু পাড়ায় নয়। বেপাড়ার মাঠে কিংবা রাস্তার ধারেও এ জিনিস দেখেছি। একবার সাইকেল না চালানোও দেখেছিলাম। মানে একজন সাইকেল নিয়ে একজায়গাতেই দাঁড়িয়ে ছিল সারাক্ষণ। মাঝে মাঝে সামান্য প্যাডেল করত। বোধহয় তার মেয়াদ কম ছিল। চব্বিশ ঘণ্টা হবে। সবই তখন বিস্ময়। আমরা গিয়ে দাঁড়ানোয় ওরা নিশ্চয়ই উৎসাহ পেত। কিন্তু ছিয়াত্তর বছরের এক বুড়ো মানুষকে সাইকেল চালিয়ে দিল্লি যাওয়ার ব্যাপারে এই রবিবারের সকালবেলায় আমি কী বলব! উঠে পড়লাম।

উদয়ভানু পালের সঙ্গে আমার মোলাকাত হয়েছিল বছর তিনেক আগে এলাহাবাদের কুম্ভমেলায়। আমি থাকি বেহালা থানার পিছনে বারিকপাড়ায়। আর উনি ঠাকুরপুকুরের কাছে গৌরনগরে। যদিও দেখা হল কুম্ভে। এরকম তো হয়। বেহালার কত লোক হয়তো ওই কুম্ভেই গিয়েছিল। কারও সঙ্গে কারও দেখা হয়নি।

বাবা-মাকে নিয়ে যাব। মেয়ের পরীক্ষা বলে বউয়েরও যাওয়ার উপায় ছিল না। যাব কিন্তু কোথাও থাকার জায়গা পাচ্ছি না। এক সাংবাদিক বন্ধুকে ধরলাম। সে এক আশ্রমের কথা বলে হাতে একটা চিরকুট ধরিয়ে দিল। সেখানে ওই উদয়ভানু পালের নাম লেখা। বন্ধু বলল, ‘আমি আশ্রমে কথা বলে নিয়েছি। তোরা এর সঙ্গে গিয়ে দেখা করলেই ব্যবস্থা হয়ে যাবে।’

ব্যবস্থা হয়েছিল। আমি আর বাবা এক তাঁবুতে। মা মেয়েদের জায়গায়। উদয়কাকা বাবার চেয়ে দু’বছরের ছোটো। দেখলাম দু’দিনেই দুজনের বেশ জমে গিয়েছে। আমার সঙ্গেও গল্প করতেন। রান্নার ঠাকুর থেকে বাজার করার লোক অবধি সকলকে ডেকে ডেকে আলাপ করিয়ে দিয়েছিলেন। একদিন দেখলাম কয়লা কিনতে যাচ্ছেন। আর একদিন দেখলাম টেম্পোরারি পায়খানার দরজা খুলে গিয়েছে বলে নিজে হাতে সারাচ্ছেন। খাওয়ার সময় মাটিতে পাত পড়ত। তার আগেই উদয়কাকা এসে আমাদের বলে যেতেন। বিকেলের চা আর বিস্কুট নিয়ে আসতেন নিজের হাতে করে। তখনও দেখেছি সময় সময় চোখের ড্রপ নিতে। পরে জেনে অবাক হলাম উনি ওই আশ্রমের কেউ নন। এক মাস জমাদার আর অন্য কাজের লোকদের কাজকম্ম দেখাশোনার জন্য এসেছেন। ফ্রি সার্ভিস। নিজে নিজে তো আসতে পারতেন না তাই আশ্রমের মারফত হয়ে আসা। হেলথে চাকরি করতেন। জিবি রায়-তে ছিলেন, আরজি কর-এও।

তখনই জানতে চেয়েছিলাম, ‘এসব করতে কুম্ভে এলেন আপনি!’

উনি বললেন, ‘কেন, কী হয়েছে। সবাই তীর্থ করতে আসে, আমি কাজ করতে এসেছি। ভালো লাগলে এই আশ্রমেরই দীক্ষিত হয়ে যাব। যেখানে খুশি যাওয়া যাবে। রিটায়ারের পর থেকে তো আমি বেকার।’

ফিরে আসার পর উদয়কাকার যাতায়াত শুরু হয়েছিল আমাদের বাড়ি। একলাই আসতেন বেশিরভাগ। বারদুয়েক কাকি এসেছিলেন। বাবা-মাও গিয়েছে কয়েকবার। আমিও। দেড় বছর হল বাবা মারা গিয়েছে। উদয়কাকার আসাও কমেছে। আমারও অফিস আছে। সংসার আছে। জ্বর-পেটখারাপ আছে। মেয়ের টিউশনি আছে। মায়ের ডাক্তার আছে। পুজোর বাজার আছে। এরমধ্যেই একদিন সাগ্নিকের ফোন। ‘বাবার মনে হয় মাথাখারাপ হয়ে গেছে। আপনি একদিন আসতে পারবেন অত্রিদা?’

মাথাখারাপের ব্যাপারটা বিশ্বাস করিনি। ভেবেছিলাম সাংসারিক কোনও গোলমাল হয়েছে। এসে দেখি সাইকেল ও রাষ্ট্রপতি।

সপ্তাহ তিনেক পরেই উদয়কাকা আমাদের বাড়িতে এসে হাজির। শুধু এসেছেন বললে ভুল হবে। সাইকেলে সওয়ার হয়ে এসেছেন। আমার বউ নবীনা দরজা খুলতেই তিনি বললেন, ‘অত্রিকে একবার বাইরে আসতে বলবে বউমা?’

বেরোতেই তিনি সাইকেলের সিটে এমনভাবে চাপড় মারলেন যেন ঘোড়ার পিঠ থাবড়াচ্ছেন। ‘কেমন দেখছ? হারকিউলিস। এ জিনিস আর এখন পাবে না। তুমি চালিয়েও দেখতে পারো। এখনও যথেষ্ট মজবুত।’

জিনিসটা কতটা শক্তপোক্ত রয়েছে তার সাক্ষাৎ প্রমাণ দিতে উনি সাইকেল চালিয়ে এতটা চলে এলেন! বললাম, ‘ভেতরে আসুন। সাইকেলটা সিঁড়ির নীচে রাখুন।’

উদয়কাকা ঢুকতে ঢুকতে বলে যাচ্ছিলেন, ‘আমাদের দেশ ছিল ময়মনসিংহ। কিশোরগঞ্জ সাব ডিভিশন। গ্রাম জঙ্গলবাড়ি। তোমার বাবা জানতেন। বলেছিলাম।’

আমিও জানি। এখন আবার সে কথা তুললেন কেন কে জানে। নবীনাকে চা করতে বললাম। মা দোতলায়। অস্টিও আর্থ্রাইটিসে কাবু। উদয়কাকা ডাইনিং রুমের চেয়ারেই বসে পড়লেন। হাঁফাচ্ছেন। চিবুকের তলা দিয়ে নেমে যাওয়া শিরাদুটো কাঁপছে।

বললাম, ‘আপনার সাইকেলটা সত্যি ভালো আছে দেখলাম। অত পুরোনো বলে মনেই হয় না।’

উদয়কাকা ছেলেমানুষের মতো খুশি হলেন। ‘আছেই তো। সিক্সটি থ্রি-তে কেনা। তখন আমরা মানকুন্ডুতে থাকি। বাবা ওখানেই তখন প্র্যাকটিস করতেন তো। আমি সবে চাকরি পেয়েছি আরজি কর-এ। ডেলি প্যাসেঞ্জারি করি। বাবা মারা যাওয়ার পরে যখন কলকাতায় চলে এলাম তখন অনেকদিন সাইকেলটা বস্তাবন্দি ছিল। তারপর ঝেড়েমুছে, তেলটেল দিয়ে দাঁড় করালাম। পিছনের চাকার টায়ারটিউব নষ্ট হয়ে গেছিল। সারালাম। ছেলেকে এই সাইকেলেই চালানো শিখিয়েছিলাম।’

এইসময় আমার মেয়ে দোতলা থেকে নেমে এল। তাকে দেখেই উদয়কাকা কাছে ডাকলেন। ‘এসো দিদিভাই, কেমন আছ তুমি? লেখাপড়া কেমন চলছে?’

সঞ্জনা মাথা নেড়ে হেসে বলল, ‘ভালো।’

‘কোন ক্লাস হল তোমার?’

‘এইট।’

‘বেশ বেশ। তা তুমি তো দেখছি মাথায় অনেকখানি লম্বা হয়ে গেছ। বাবাকে ধরে ফেলো এবার।’

মেয়ে আমার দিকে তাকাল। ‘ধরে ফেলতাম তো। বললাম আমাকে একটা সাইকেল কিনে দাও। দিচ্ছে না।’

‘অ্যাঁ, সে কী! এ তো ভারি অন্যায়। কেন দিচ্ছে না?’

নবীনা বলল, ‘দেব যে, চালাবে কোথায়? রাস্তায় ছাড়া জায়গা তো নেই। যেভাবে গাড়ি চলে, ভয় করে। তাছাড়া ও এখন বড়ো হচ্ছে কাকা। একা একা এই বয়েসের মেয়েকে ছাড়া যায়, বলুন? দেখছেন তো চারদিকে কী অবস্থা!’

উদয়কাকার মুখ ভারী হয়ে এল। ‘শুধু এই বয়েসের কেন? কোন বয়েসের মেয়েই বা নিরাপদে থাকতে পারছে বউমা? আমাদের সব দাঁত নখ বেরিয়ে পড়েছে।’

সঞ্জনা এখন সবই বুঝতে পারে। সে কোনও কথা না বলে সরে যেতে চাইছিল। উদয়কাকা বললেন, ‘তোকে একটা মজার কথা বলি শুনে যা মা। এই একটু আগে তোর বাবাকে বলছিলাম। আমাদের দেশের বাড়ি ছিল ময়মনসিংহ। তোর ঠাকুমারও কিন্তু তাই।’

‘জানি তো। বাংলাদেশে।’

‘ঠিক বলেছিস। তা বুঝলি, আমার বাবা ইংরাজি শেখাতেন– আমার মানুষরা গান গায়। মাই মেন সিং। মানে কী হল? ময়মনসিং।’ হা হা করে নিজেই হেসে উঠলেন উদয়কাকা। তারপর থেমে বললেন, ‘জগদীশচন্দ্র বসু, আলাউদ্দিন খাঁ, উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী, নীহাররঞ্জন রায়, ফণিভূষণ চক্রবর্তী, শৈলজারঞ্জন মুখোপাধ্যায়, জয়নাল আবেদিন– সব ময়মনসিংহ। আরও কতজন আছেন। গর্ব হয় না, বল? কী সব মানুষ!’

সঞ্জনা চলে যেতে আমি বললাম, ‘আপনার বাবা তো ফুটবল প্লেয়ার ছিলেন, না কাকা?’

চা শেষ করে কাপ নামিয়ে উত্তেজিত গলায় তিনি বললেন, ‘অ্যাই, তখন যে তোমায় বলছিলাম না দেশের কথা, কেন জানো? সাইকেল চালিয়ে আসতে আসতে, এই তোমাদের বাড়ির কাছেই, হঠাৎ কাঠগোলাপের গন্ধ পেলাম। দেখি এক বাড়ির পাঁচিলের ওপাশে গাছটা মাথা তুলেছে। মোটা মোটা পাতা হাওয়ায় দুলছে। এর আগে যে তোমাদের বাড়ি এসেছি, তখন বোধহয় ফুল ফোটেনি গাছটায়। আমাদের গ্রামের বাড়িতে একটা কাঠগোলাপের গাছ ছিল। হলুদ-সাদা, গোলাপি-সাদা ফুল। তার গন্ধ এত সুন্দর। হঠাৎ কোথাও কাঠগোলাপের গন্ধ পেলে ছেলেবেলা মনে পড়ে যায়। বাবার কথাও মনে পড়ে গেল। ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল থেকে পাশ করে বাবা এখানে এসে সুরেন্দ্রনাথে ভর্তি হন। এসেই খেলা। ইউনিভার্সিটি চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর হরপ্রসাদ শাস্ত্রী প্লেয়ারদের সঙ্গে ছবি তুলেছিলেন। তাতে আমার বাবাও আছেন। বাবার নাম ছিল দেবেন্দ্র পাল। সবাই বলত ডি পাল। গ্রিয়ার স্পোর্টিংয়ে খেলতেন। গ্রিয়ার স্পোর্টিং ছিল মিত্তিরদের। পুরো নামটা মনে পড়ছে না। ওই যাদের লক্ষ্মীবিলাস তেল গো–।’

লক্ষ্মীবিলাস বলতে এবার আমার নাকে কবেকার একটা গন্ধ ভেসে এল। মাকে মাখতে দেখেছি ছোটোবেলায়। ঘন, খয়েরি রং। কবিরাজি দোকানের ভেতরে গেলে ওই গন্ধটা পাওয়া যায়। সেসব দোকান আর নেই বললেই চলে। লক্ষ্মীবিলাসও ধুয়ে গিয়েছে।

উদয়কাকা তখনও বলে যাচ্ছিলেন, ‘খেলতে খেলতে বাবা পরে যান ইস্টবেঙ্গলে। সেন্টার ফরোয়ার্ড পজিশনে খেলতেন। নাইন্টিন টোয়েন্টি থ্রি কী ফোর হবে, মোহনবাগানকে হারান এক গোলে। বাবাই গোল করেছিলেন। পরে যদিও ব্ল্যাকওয়াচ টিমের কাছে হেরে যান।

সে যাই হোক। বাবা পরে ডাক্তারিও পড়েছিলেন। জাহাজের ডাক্তার ছিলেন। সারা পৃথিবী ঘুরেছেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বর্মায়। যশোরে যখন ছিলেন তখন বিধানচন্দ্র রায় গেছিলেন সেই হাসপাতালে। বাবা রোজ ব্যায়াম করতেন। ভালো স্বাস্থ্য ছিল। বলতেন, দ্যাখ, আমি খেলেওছি, আবার ডাক্তারিও করেছি। মনের জোর থাকলে মানুষ কী না করতে পারে। এক জায়গায় নিজেকে বদ্ধ রাখলেই মুশকিল। কোনও কাজ করার ইচ্ছে থাকলে সেটা করে ফেলার দিকেই যেতে হবে তোমায়। আর আমায় দ্যাখো অত্রি, জীবনের বেশিটাই চাকরিতে চলে গেল। এক এই সাইকেল চালানো ছাড়া আর কোনও যোগ্যতা আছে আমার, বলো?’

কাকাকে এগিয়ে দেওয়ার জন্য বাড়ি থেকে বেরিয়ে হাঁটছিলাম। উনি সাইকেল নিয়ে পাশে পাশে। বললাম, ‘এই যে আপনি বেরিয়ে পড়তে চাইছেন, আপনার বাড়ির লোকেদের তাতে দুশ্চিন্তা হবে না? তারা কখনও আপনাকে এভাবে ছেড়ে দিতে পারে?’

উদয়কাকা বললেন, ‘ছেলে-বউমা দুজনেই চাকরি করে। তাদের সন্তান হয়নি, তাতে নিশ্চয়ই দুঃখ আছে। তা নিয়ে আমি বা তোমার কাকিমা কোনও কথা বলি না। কিন্তু বউমা রান্নাবান্না, বাজারহাট, ঘর সাজানো গোছানো– সব নিয়ে তার শাশুড়ির সঙ্গে খিটখিট করে। মশারি টাঙানো নিয়ে পর্যন্ত ছেলে তার মায়ের সঙ্গে ঝগড়া করে। একদিন বলল, তোমাদের জঙ্গলে রেখে আসা উচিত।’

আমি বললাম, ‘সব সংসারেই এরকম কিছু না কিছু হয় উদয়কাকা।’

উনি মানলেন না। বললেন, ‘একসঙ্গে থাকতে গেলে ভাব ভালোবাসা রেখে থাকতে হবে তো। সে কি তারা বোঝে? ছেলে দারুণ সেতার বাজাত। আমি সেতার বয়ে নিয়ে নিয়ে যেতাম তাকে শেখাতে। ভেবেছিলাম সে বড়ো শিল্পী হবে। হয়নি। বাজনা ছেড়েই দিয়েছে। ডালহৌসিতে একটা চাটার্ড ফার্মে কাজ করে। এই চাকরির কী মানে? ওই অর্থের মানে কী? ছেড়ে দিলেই বা কী আসে যায়? আবার শুরু করতে পারে না নতুন করে? বেঁচে থাকার কারণটা কী? আমি বেরিয়ে পড়লে প্রভা হয়তো চিন্তা করবে। কিন্তু ওরা সত্যি সত্যি চিন্তা করবে আমার জন্য? বিশ্বাস হয় না। ওই যে আশ্রমের হয়ে আমি কাজ করতাম– কত জায়গায় তো গেছি– গয়ায়, হরিদ্বারে, উজ্জ্বয়িনীতে, নৈমিষ্যারণ্যে– কখনও খোঁজ নিয়েছে আমার? জানতে চেয়েছে বাবা কেমন আছ? গয়ার রাস্তায় দেখেছিলাম একটা ছেলে চিরুনি বাজাচ্ছে মুখ দিয়ে, আর একজন মাটির হাঁড়ি। রাগ যোগিয়া বাজাচ্ছে বুঝলে! যে যা পয়সা দেয়। ভেবেছিলাম ওদের বাড়ি নিয়ে আসব তুলে। তা তো হওয়ার নয়। কিন্তু ওরা রাস্তার ধারে বসেও পারছে তো! একবার বালামৌ স্টেশনে আটকে পড়েছিলাম। পরদিন সকালের ট্রেনে নৈমিষ্যারণ্যে যাব। সেখানে যিনি স্টেশনমাস্টার ছিলেন তিনি রিটায়ারের পরও পাশেই থাকেন। জমি কিনেছেন। নিজে হাতে ধান চাষ করেন। আমাদের সেই চালের ভাত রেঁধে খাওয়ালেন। ইচ্ছে থাকলে পারে না লোকে?’

জানতে চাইলাম, ‘সাগ্নিক বলছিল আপনি এখন আর আশ্রমের কাজেও যান না, সত্যি?’

‘নাঃ, যাই না আর। রিটায়ারমেন্ট-এর পর অনেকগুলো বছর শুধু শুধুই কেটে গেছে। তারপর ওই আশ্রমে গেলাম। কাজ করতে চেয়েছিলাম। বলে বটে মানুষের মধ্যে ঈশ্বরের বাস কিন্তু মানুষকেও দ্যাখে না, ঈশ্বরকেও দ্যাখে না। শুধুই আড়ম্বর। ঈশ্বরে বিশ্বাস রাখাও খুব শক্ত। যে কৃষ্ণ ভজনা করে সে চতুর। যে জানে সে ভজনা করে তার আবার ভজনা কীসের?’

কাকার কথা শুনে বুঝলাম ওখানেও কোথাও একটা কাঁটা আছে। আমি আর খোঁচালাম না। কথা ঘুরিয়ে দেওয়ার জন্য বললাম, ‘আপনি যে সাইকেল চালিয়ে দিল্লি যাবেন ভাবছেন, কতটা রাস্তা জানেন?’

‘জানি তো। বাই রোড এক হাজার চারশো ঊনআশি কিলোমিটার। নিরামিষ খাই। হাতে-পায়ে যা জোর আছে তাতে করে দিনে কুড়ি কিলোমিটার চালাতে পারব মনে হয়। আমি মিস্ত্রির সাথে কথাও বলেছি। একটা ছাতা লাগাতে হবে সিটের সঙ্গে। কিছু জিনিসপত্র রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। এক্সট্রা ক্যারিয়ার লাগবে।’

সেরেছে। ইনি তো দেখছি অনেক এগিয়ে গিয়েছেন। বললাম, ‘আপনি রাষ্ট্রপতির কাছে যেতে চাইছেন কেন? কারণটা কী?’

উদয়কাকা দাঁড়িয়ে পড়লেন। ‘শোনো, আমার এক বন্ধু ছিল– সত্য গুপ্ত। একসঙ্গেই চাকরি করতাম জিবি রায়-তে। সে ব্যাচেলার লোক। ছবি কেনার নেশা ছিল শুধু। তাই দিয়ে ঘর সাজাত। ভীষণ মুখ খারাপ করত, সোজা কথা সোজা বলে দিত। মানে কোনও সত্যই তার মুখে গুপ্ত থাকত না। একবার ইনজেকশনের স্টকে একটা গরমিল ধরা পড়ল। সত্য তো যা তা বলতে শুরু করল। কয়েকজন ধরা পড়ে পড়ে। তাকে বদলি করে দিল দূরে। সে যাবে না। মাইনে বন্ধ। কাউকে ধরাকরাও করবে না। ওর হয়ে আমি রাইটার্সে ধরনা দিলাম। তখন হেল্থ মিনিস্টার ননী ভট্টাচার্য। রাইটার্স থেকে আমায় বলল, উদয়বাবু আপনার বন্ধুকে ঠোঁট সেলাই করতে বলুন। আপনি এত হাঁটাহাঁটি করেছেন বলে দূরের বদলি ক্যানসেল করে ওকে মেডিকেলে দেওয়া হল।’

একটু থামলেন উদয়কাকা। তারপর আবার বললেন, ‘কত তো দেখলাম। সবাই চায় অন্যের ঠোঁট যেন বন্ধ থাকে। কিন্তু আর তো পারা যাচ্ছে না অত্রি। এই আমাদের দেশ! রোজ কাগজে, টিভিতে দেখছি আর শিউরে উঠছি। রোজ ধর্ষণ আর খুন, দাঙ্গাও হচ্ছে– সে খবর লুকিয়ে যাচ্ছে– কিন্তু হচ্ছে তো। চারপাশ একেবারে দুর্নীতিতে ছয়লাপ হয়ে গেছে। ঘুষ ছাড়া কেউ নড়ে না। যে যাকে পারছে ঠকাচ্ছে। টাকার লোভে মানুষ পাতালে তলিয়ে যাচ্ছে। টেকনোলজির যে এত উন্নতি, তা দিয়ে গরিব মানুষের কিছু হচ্ছে কি? কারা ফল পাচ্ছে তার?’

আমার কেমন রাগ হয়ে গেল। বললাম, ‘এসব তো অনেকদিন ধরেই ঘটছে। আপনাদের সময় সবাই কি সাধুপুরুষ ছিল?’

‘না, মোটেও নয়। কিন্তু এত নোংরামি ছিল না। তুমি হিসেব নিয়ে দ্যাখো। এত পাবে না। যত দিন যাচ্ছে, সব দিকেই মানুষের বিকৃতি বেড়েই চলেছে। ঈশ্বরে বিশ্বাস নেই কারও। ধর্মেও নয়। এখন পাপ করেঞ্জভাবে ভগবানের সামনে গিয়ে দাঁড়ালেই সব মাফ। কাল আবার নতুন পাপ করা যাবে। আর ঠোঁট সেলাই করে রাখা যাচ্ছে না অত্রি।’

‘আপনি কি এসব কথা বলতে যাবেন রাষ্ট্রপতিকে?’

‘হ্যাঁ। বলব– কী হচ্ছে এসব?’

‘কী লাভ হবে বলে? উনি তো হাত ধরে সকলকে আইনের পথে, সততার পথে, ন্যায়ের পথে নিয়ে আসতে পারবেন না।’

‘জানি পারবেন না। কিন্তু আমার উদ্বেগ আমি জানাতে পারব না?’

আমি মানুষটাকে ভালো করে দেখলাম। ওর কি সত্যিই মাথায় গোলমাল দেখা দিচ্ছে? না কি নিজের বিশ্বাসের এতটাই জোর যে অনায়াসে এসব কথা বলে যাচ্ছেন?

তখন উনি বললেন, ‘শোনো অত্রি, আমি এখনকার ছেলেমেয়েদের জীবনের উদ্দেশ্য বুঝি না। গরিব-বড়োলোক, শিক্ষিত-অশিক্ষিত– সবার রুচি একইরকম লাগে। তারা ভবিষ্যতে কী করবে আমি জানি না। কিন্তু আমি এখনই এসব কথা বলতে চাই। আর বললে রাষ্ট্রপতিকেই বলব।’

‘রাষ্ট্রপতি আপনার সঙ্গে দেখা করবেন কেন?’

উদয়কাকা যেন খুব অবাক হওয়ার মতো একটা কথা শুনছেন, এভাবে তাকিয়ে রইলেন আমার দিকে। তারপর বললেন, ‘কেন দেখা করবেন না? একজন সিনিয়র সিটিজেন আরেকজন সিনিয়র সিটিজেনের সঙ্গে দেখা করবেন না?’

আমার কথা এবার বন্ধই হয়ে গেল। এই লোককে আর কী বলা যেতে পারে! ফিরে যাব ভাবছি, তখন উদয়কাকা নাক টেনে বলে উঠলেন, ‘আহা! আবার সেই গন্ধ। পাচ্ছ তুমি? কাঠগোলাপের গন্ধ। ওই যে গাছটা। এখন আর এ গাছ দেখাই যায় না। রেয়ার হয়ে গেছে। এক একটা শব্দ, গান, গন্ধ– কী যে করে দেয়।’

আমি কোনও গন্ধ পাইনি। সে কথা ওকে বলা গেল না। উদয়কাকা চলে যাওয়ার পর আমি তার কথাই ভাবতে ভাবতে বাড়ি ফিরে এলাম। উনি যা নিয়ে বলছেন তা তো আমরাও জানি। কিন্তু কিছু বলতে পারি কই? আর সাইকেল ও রাষ্ট্রপতির ব্যাপারটাকে তো লোকে খ্যাপামিই বলবে।

মাস খানেক পর একদিন সকাল ন’টায় সাগ্নিকের ফোন। ‘অত্রিদা, বাবাকে পাওয়া যাচ্ছে না। সাইকেলটাও নেই। আসবেন প্লিজ?’

স্কুটার বের করে পৌঁছলাম উদয়কাকার বাড়ি। সাগ্নিক বলল, ওরা ভেবেছিল কাছেই কোথাও গেছে। সাইকেলটা নেই দেখে সন্দেহ বেড়েছে।

আমি বললাম, ‘এত আগ বাড়িয়ে ভাবছ কেন? হয়তো এদিক-ওদিকেই গেছেন সত্যি। এর আগে তো একদিন আমার বাড়িতেই গেছিলেন সাইকেলে।’

সাগ্নিক তখন বলল, ‘না, এবার তা নয়। একটা ব্যাগে জামাকাপড় ভরে নিয়ে গেছেন। চোখের ড্রপটাও।’

চুপ করে রইলাম। উদয়কাকা এভাবে সবাইকে বিপদে ফেলল? সাগ্নিককে বললাম, ‘স্কুটার তো রয়েইছে, একবার বেরিয়ে দেখি চলো।’

বেরিয়ে পড়লাম। কিন্তু তখনই মনে হতে লাগল– কোথায় খুঁজব? বিশেষ করে যদি কেউ ইচ্ছে করেই হারায়। কোন রাস্তায় গিয়েছেন তা কি বোঝা যাবে? সাগ্নিক মাঝে মাঝে মোবাইল থেকে বাড়িতে ফোন করছিল। ওদিক থেকেও কোনও খবর নেই। আশপাশের তল্লাট হাঁটকেও উদয়কাকার দেখা মিলল না। ঘুরতে ঘুরতে ডায়মন্ডহারবার রোডের অনেকখানি চলে গেলাম। আচমকা সাগ্নিক চেঁচিয়ে উঠল– ওই বাঁদিকে চলুন তো। ওই যে, ওই সাইকেলটা।’

স্পিড বাড়িয়ে কাছাকছি পৌঁছে দুজনেই হতাশ। নাঃ, দূর থেকে দেখে ভুল হয়েছিল। চুলটা ওইরকমই খোঁচা খোঁচা, গড়নটাও লম্বাটে ধাঁচের, বয়েসও কাছাকাছিই হবে, কিন্তু ইনি উদয়ভানু পাল নন।

সাগ্নিক বলল, ‘ঘুরিয়ে নিন। আপনাকে আর কষ্ট দেব না। দেখি অপেক্ষা করে। না হলে সেই থানাপুলিশ করতে হবে।’

ফিরে আসছিলাম। কেন জানি মনে হল, ওই বুড়ো লোকটা না হয় উদয়কাকা নন, কিন্তু উনিই বা সাইকেল নিয়ে যাচ্ছেন কোথায়? কোনও কাজে বেরিয়েছেন? না কি উনিও দিল্লি যাচ্ছেন? এরা কি এক এক করে বেরিয়ে পড়ছে না কি? এই রাস্তায়? তা হলে কি অন্য কোথাও? অন্য কারও সঙ্গে দেখা করতে?

থানায় খবর দিতেই হয়েছিল সাগ্নিককে। আত্মীয়স্বজনের বাড়ি। হাসপাতাল। মর্গ। সেই আশ্রমেও গিয়েছিল। তাদের শাখাপ্রশাখাকেও জানানো হয়েছিল। উদয়কাকার খোঁজ পাওয়া যায়নি। এমনকী চার-পাঁচ মাস পেরিয়ে যাওয়ার পরেও কোনও খবর পাওয়া গেল না।

এ সময়ের মধ্যে কোথাও কিছু বদলায়নি। দিন ও রাত নিজেদের নিয়মেই আসাযাওয়া চালু রেখেছে। কত অয়েলক্লথ কেনা হয়েছে, কত শবযাত্রা গিয়েছে। সরু গলি ও বড়োরাস্তায় কত উৎসব হয়েছে। এখন শুধু আমি মাঝে মাঝেই কাগজ পড়ার সময় রাষ্ট্রপতির ছবি দেখলেই বাড়তি ঝুঁকে পড়ি। কোনওদিন হয়তো দেখব ছবি ছাপা হয়েছে– হাস্যমুখ রাষ্ট্রপতির সঙ্গে হাত মিলিয়ে ফোকলা গালে হাসছেন উদয়কাকা। সাইকেল বুড়োর গালে সাদা কুচো কুচো দাড়ি। চোখে পুরু কাচের চশমা।

তেমন কিছু দেখতে পাই না। কে জানে। এত বড়ো দেশ। হয়তো উদয়কাকা ঘুরতে ঘুরতে যাচ্ছেন সাইকেল নিয়ে। আরও অনেকের সঙ্গে দেখা করবেন। কথা বলবেন। একদম শেষে পৌঁছবেন রাইসিনা হিলে। বলেছেন যখন, তখন যাবেন নিশ্চয়ই। অপেক্ষায় থাকি।

 

একটি মৃত্যু

সকালে অতুলবাবু খবরের কাগজটা হাতে নিয়ে সবে বসেছেন, রতনবাবু ডাক দিলেন,

-অতুল আছো নাকি ?

অতুলবাবুর সঙ্গে রতনবাবুর ভালোই সম্পর্ক। বিপদে আপদে সর্বদাই থাকেন। পাশেই বাড়ি, ইন্ডিয়ান স্টাটিস্টিক্যালে চাকরি করেন, লাইব্রেরিতে। স্বভাবে খুবই ভালো, হোমিওপ্যাথি ডাক্তারিও করেন। অতুলবাবুর বাড়ির মাঝে রাস্তা , তার ওপারে রতনবাবুর বাড়ি।বেশ ভালো বাড়ি৷ বাবার অনেক টাকা ছিল, তা দিয়েই বানানো। নিজে কিছু করেননি । দুই মেয়ে,একজন কলেজে,একজন স্কুলে । স্ত্রী বেশ সুন্দরী, নাম রমলা। বর্ধমানের মেয়ে। এই নিয়েই সংসার রতনবাবুর।আজ ছুটি, মহরম। তাই সকালেই গল্প করতে চলে এলেন।

অতুলবাবুর কাগজটা আর পড়া হল না।অতুলবাবুর একটা বইয়ের দোকান আছে।বাড়িতে ড্রয়িং রুম থেকে শোবার ঘর— সব জায়গায় বই খাতা ভর্তি। অগোছালো ঘর , মেঝের ওপর বই খাতার স্তুপ। তার মাঝে অতুলবাবু বসে খবরের কাগজ পড়েন রোজ। রতনবাবুর এই পরিবেশটাই নাকি খুব ভালোলাগে।

-হ্যাঁ আসুন-

দরজাটা খুলেই অতুলবাবু চমকে উঠলেন। রতনবাবুর চোখে মুখে উদ্বেগের ছায়া।

-কী ব্যাপার?

-বড়ো মেয়েটা কাল থেকে বাড়ি আসেনি। সকালে কলেজ গেছে, আজ ছুটি…

-দেখো কোনও বন্ধুর বাড়িতে. . .

-এ কী বলছ অতুল, আমার মেয়ে এমন না ।

-আরে না না তা বলিনি , বলছি কোনও বান্ধবীর বাড়ি যদি গিয়ে থাকে।

-ফোনটাও ধরছে না, সব খবর নিলাম কোথাও নেই।

রতনবাবু কেঁদে ফেললেন ।

-আরে একী করছ? আগে খুঁজে দেখি কী হল।

রতনবাবুর মেয়ে সুছন্দা ভালো মেয়ে, দেখতে শুনতেও ভালো, কোনও দিন কোনও ব্যাপারে কারওর সঙ্গে জড়িয়ে পড়েনি।

পড়াশোনা ছাড়া কোনও গল্পগুজব করতে দেখিনি, হঠাৎ কী হল কাল, যে বাড়ি ফিরল না!

-গতকাল ওর জন্মদিন ছিল, ওর মা পায়েস করে বসে ছিল সারা রাত। মেয়ে এই আসবে এই আসবে করে ঘুমোতেই যায়নি। সকালে পর্যন্ত অপেক্ষা করেও মেয়ে আসেনি৷ হাউমাউ করে কান্না জুড়ে দিয়েছে, আমি কী করি বলো তো?

-হাসপাতালটা খোঁজ নেওয়ার দরকার।

– হ্যাঁ ওর মামা আসছে দেখি যাব।

– আমি কি যাব ?

অনিচ্ছা সত্বেও কথাটা বলতে হল , কারণ রতনবাবু  খুব পুরোনো বন্ধু । ছুটির দিন, অতুল ভেবেছিলেন বাড়িতে একটু আরাম করবেন, বিকালে বইয়ের দোকানে যাবেন, কিন্তু হল না।

-চলো তোমার সঙ্গে যেতেই হবে, তোমার যা মনের অবস্থা দেখছি…

-চলো না ভাই, তুমি গেলে একটু সাহস পাই।

-সে আর বলতে।

অতুল মনে মনে ভাবলেন, বইয়ের দোকানে আর যাওয়া হল না , এ যা দেখছি সারাদিনের ব্যাপার ।

-রতন তোমার মেয়ের কোনও ছেলে বন্ধু ছিল না তুমি জানো তো? জানি এসব কথা এ সময় তোমার শুনতে ভালো লাগছে না কিন্তু জানো তো এখনকার মেয়েরা খুব চাপা গোছের হয়।

-তা হয়তো হবে. . .

দরজায় আবার কে যেন বেল দিচ্ছে। উঠে দরজা খুলে দেখলেন, রতনবাবুর স্ত্রী ও ছোটো মেয়ে সুনন্দা।দুজনেরই কাঁদো কাঁদো মুখ ।

-দাদা একটু দেখুন না কী হল? মেয়েটা তো এমন নয়, কোনও দিন এমন হয়নি, কী যে করি?

– আরে বৌদি চিন্তা কেন করছেন? আমি দেখছি কী করা যায়।

সাহস দিলেন বটে কিন্তু কী করবেন তিনি নিজেই জানেন না । ওদেরকে বাড়িতে বসিয়ে , তিনি আর রতনবাবু বেরিয়ে পড়লেন৷ প্রথমে সরকারি হাসপাতালগুলোতে খোঁজ করতে গেলেন।আর জি কর, মেডিকেল,নীলরতন- কোথাও সুছন্দার খোঁজ পেলেন না । সুছন্দা মানে রতনবাবুর হারিয়ে যাওয়া মেয়ে ।
হতাশ হয়ে রাতে ফিরে এলেন বাড়িতে,রতনবাবুকে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে।

ঘরে ঢুকলেন,সারাদিন খাওয়া দাওয়া নেই, শরীরটাও ভালো ঠেকছে না। মর্গে মর্গে ঘুরে ঘুরে গা ঘিন ঘিন করছে অতুলের। বউ বলল,

-ভালো করে স্নান করে নাও, খেয়ে নিয়ে চিন্তা করো কী করবে ? দুদিন হল মেয়ের কোনও খোঁজ নেই যখন, তখন দেখতে হবে ক’দিন, নইলে পুলিশে খবর দেওয়া ছাড়া আর কোনও রাস্তা দেখছি না ।

রতনবাবুর কথা ভাবতে ভাবতে সবে খেতে বসতে যাবেন, টেলিফোনটা বেজে উঠল।

-হ্যালো।

-দাদা আমি সুছন্দার মা বলছি ,

-কী ব্যাপার ?

-ওনাকে কি বাড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে গেছিলেন?

-হ্যাঁ

-কিন্তু ওনাকে তো দেখতে পাচ্ছি না-

-সেকি! সেকি আবার কোথায় গেল! বাথরুমটা দেখুন।

– না নেই!

-তাহলে হয়তো আবার বেরিয়েছে। ঠিক আছে রাখুন, আমি খেয়ে উঠে দেখছি।

খাওয়া আর হল না। রতনবাবু কোথায় গেলেন দেখতে হবে । এই বা-বেটি মিলে কী শুরু করল ? এক বার বাপ্, একবার বেটি।
যাইহোক বেরিয়ে পড়লেন, ফোন করলেন বার কয়েক৷ কোনো রেসপন্স নেই । রাত হয়ে আসছে, দিশাহীন ঘুরে বেড়ালেন অতুল। থানাতেও গেলেন। যদি ডাইরি করতে এসে থাকেন । কিন্তু না, তা আসেননি । মুদিদোকান, বাজার, সব ঘুরে রতনবাবুর বাড়ি গেলেন। অতুলবাবুকে দেখেই রতনবাবুর স্ত্রী আরও কান্না জুড়ে দিল।

-কী হল? রতনবাবু এখনও আসেননি?

-না,

-তাহলে?

-দেখুন তো কী করে বসল মেয়েটা !

-কী হয়েছে ?

-ফোন এসেছিল

-কার ?

-সুছন্দার .

– ভালো খবর তো?

-জানি না দাদা, এভাবে কোনও দিন ওকে দেখিনি, ওর বাবা হয়তো একটু বেশি শাসন করত, তাই বলে ও আমাদের কিছু না বলে, এমন কাণ্ড করবে, জানা ছিল না!

-কী হয়েছে, বলুন তো?

-সুছন্দা বিয়ে করেছে।

-যাক তবু একটা খবর তো পাওয়া গেল৷ এখন রতনবাবু — তিনি আবার কোথায় গেলেন? আচ্ছা আমি বাড়ি যাই, চিন্তা করবেন না।রতনবাবু নিশ্চয়ই ফিরে আসবেন কিছুক্ষণ পরেই৷

বাড়ি এসে অতুলবাবু খাওয়া শেষ করে টিভিটা চালিয়ে বসেছেন ,হঠাৎ কলিংবেল । দরজা খুলে দেখেন,রতনবাবুর স্ত্রী এসে হাজির ।

– কী ব্যাপার?

-দাদা ওকে এখনও ফোনে পাচ্ছি না।

-সে কী! দাঁড়ান আমি করে দেখি৷ হয়তো রাগের মাথায় ধরছে না।

বহুবার চেষ্টা করলেন অতুল, কিন্তু কোনো রেসপন্স নেই৷ এ আবার কী সমস্যা? মেয়ের খবর পাওয়া গেল তো  বাবা হাওয়া!

-দাদা মেয়ে ফোনে জানাল যে সে কাল বিয়ে করে শিলিগুড়িতে আছে, ছেলের পিসিমার বাড়ি।
কিন্তু এখন বাবা ! তার তো কোনও খবর নেই ।

বাইরে শোরগোল শুনে উঠে পড়লেন আতুলবাবু । মোড়ের মাথায় খুব ভিড় , পুলিশ ঢুকছে রতনবাবুর বাড়িতে। অতুলবাবুর সঙ্গে সঙ্গে রতনবাবুর স্ত্রীও বেরিয়ে এলেন । হাউমাউ করে উঠলেন – পুলিশ কেন?
একজন পুলিশ অফিসার বললেন,
-শুনুন, একটি লোক মেট্রো রেলে ঝাঁপ মেরেছে।পকেট থেকে এই চিরকুট পাওয়া গেছে।
-এইটা যে ওনার বাড়ি কী করে জানলেন?
-পকেটে শুধু এটা নয়, মোবাইলটাও ছিল৷ কীভাবে যেন মোবাইলটা অক্ষত আছে৷ওখান থেকেই ঠিকানা বার করেছি।তাই সরাসরি বাড়িতেই চলে এলাম৷

-কিন্তু আমরাও তো বারবার ফোন করছি, কেঁদে উঠলেন রতনবাবুর স্ত্রী৷
অতুলবাবু পুলিশ ভদ্রলোকের দিকে হাত বাড়িয়ে বললেন,

-কই চিরকুটটা দেখি৷

সেটা একটা ছোট্ট চিঠি৷ লেখা–

বাবা ,
আমি তোমার মুখ রাখতে পারলাম না কিন্তু আমি কী করব? আমি যে ভুল করে ফেলেছি বাবা, আমি অন্তঃসত্তা। বিয়ে না করলে আরও কাউকে মুখ দেখতে পারব না । তাই আমাকে ক্ষমা করো, আমি ভালো থাকব।
   সুছন্দা।

শীতল পরশ

সকাল থেকেই কেমন যেন গুমোট আবহাওয়া। আকাশে মেঘের ঘনঘটা। গাছের পাতা একেবারে স্তব্ধ। হাওয়ার লেশমাত্র নেই। সবমিলিয়ে বেশ একটা দমচাপা পরিবেশ।

এমনিতেই ক’দিন ধরে বাপ-ছেলের গন্ডগোলের জেরে মালার প্রাণ একেবারে ওষ্ঠাগত। বেচারা সবসময় ভয়ে-ভয়েই থাকে এই বুঝি আবার যুদ্ধ লাগল। তার উপর এরকম একটা ঝিমোনো পরিবেশে দমবন্ধ হয়ে আসছিল মালার। আজ মনটা কেমন যেন কু গাইছে তার। বোধহয় বড়ো কিছু হওয়ার একটা অশনি সংকেত পাচ্ছিল সে। যতই হোক মায়ের মন তো।

যা ভাবা ঠিক তাই। অতনু অফিস বেরোবার সময় রমাকান্তের মুখোমুখি। তিনি তখন প্রাতর্ভ্রমণ সেরে অন্যান্য দিনের মতোই বাজার করে ঘরে ঢুকছেন।

ছেলেকে দেখামাত্রই ভ্রূকুঞ্চিত করে, ‘কিছু ভাবলে?’

রমাকান্তের এই অ্যাটিটিউড-টাই পছন্দ নয় অতনুর। সবসময় একটা বসিং বসিং ব্যাপার। নিজের সিদ্ধান্ত অন্যের উপর জোর করে চাপিয়ে দেওয়া। কথা বলার ভঙ্গিও এতটাই খারাপ যে, যে-কোনও মানুষেরই মাথা গরম হওয়ার জন্য যথেষ্ট।

‘ভাবার কী আছে। তোমাকে তো আগেই বলেছি। বিয়ে আমি স্টেলাকেই করব।’ রাগত স্বরে জবাব দেওয়া মাত্রই গর্জে ওঠে রমাকান্ত। ‘রাসকেল! দুটো পয়সা উপায় করছ বলে কি ধরাকে সরা জ্ঞান করছ নাকি? শুনে নাও, ও মেয়ে কখনওই আমার বাড়ির বউ হয়ে আসবে না। এটাই আমার শেষ কথা।’

‘আনব না! তোমার গোঁড়ামো নিয়ে তুমিই থাকো। এই একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে শুধুমাত্র জাতপাতের দোহাই দিয়ে একটা মেয়েকে চিট করা, আমার পক্ষে সম্ভব নয়। সরি, যাকে এতদিন ভালোবেসে এসেছি, শুধুমাত্র তোমার অনর্থক জেদের কারণে তাকে আমি ছাড়তে পারব না’, বলেই পাশ কাটিয়ে অফিসের উদ্দেশ্যে রওনা দেয় অতনু।

অতনু আর রমাকান্তকে মুখোমুখি দেখেই বুকটা ছ্যাঁৎ করে উঠেছিল মালার। কেবল নির্বাক শ্রোতার মতো বাপ-ছেলের এই প্রহসন শুনতে শুনতে সে রীতিমতো ক্লান্ত। কাকে বোঝাবে? কে বুঝবে তার কথা। কেবলমাত্র ওই দীপ্তি ছাড়া। দীপ্তি, অতনুর ছোটো বোন। ওর থেকে বছর পাঁচেকের ছোটো। সেও তো বাবার ভয়ে তটস্থ। এই কোরো না সেই কোরো না। সন্ধে হলে মেয়েরা বাইরে বেরোবে কেন? কোনও ছেলের সাথে বন্ধুত্ব করবে না। ছেলেদের সঙ্গে মেয়েদের কখনওই বন্ধুত্ব হয় না।

অতনু যাওয়ার পর মাথা ধরে সোফার উপর বসে পড়ে মালা। মাইগ্রেন-এর ব্যথাটাও বেড়েছে বেশ কয়েকদিন হল। তার উপর এ-এক চিন্তা। এর যে শেষ কোথায় কে জানে! যত বয়স বাড়ছে লোকটা যেন আরও খিটখিটে হয়ে উঠছে। রিটায়ারমেন্ট-এরও আর মাত্র বছর চারেক বাকি। এখনই মাঝেমধ্যে শরীর বিগড়োচ্ছে, নতুন বিজনেসের কারণে অফিসে ইরেগুলার। রিটায়ার হওয়ার পর তাহলে কী হবে? তখন তো সারাদিন বাড়িতেই থাকবে। ভেবেই আতঙ্কে শিউরে ওঠে মালা। কী করবে এই লোকটাকে নিয়ে। এতদিন না হয় সে সবকিছু মুখ বুজে সহ্য করেছে। কিন্তু ছেলেমেয়েরা? আর কেনই বা তারা মুখ বুজে এইসব অন্যায় সহ্য করবে। না, আজ যেভাবেই হোক, অতনুর বাবার সঙ্গে কথা বলতেই হবে, যদি কিছু বোঝানো যায়। আজ তো অফিস যাবে না ঠিক করেছে, যে-কোনও সময় একবার…।

দুপুরবেলা রমাকান্তকে খেতে দিয়ে পাশে বসে মালা বলেই ফেলে কথাটা, ‘বলছি মেয়েটাকে একবার দেখতে দোষ কী? লেখাপড়া জানা মেয়ে। বাবুর অফিসে ভালো পদে আছে। শুনেছি দেখতেও ভালো। ব্যবহারটাও। অন্য জাতের হওয়াটা তো দোষের নয় বলো?’

চুপচাপ মাথা গুঁজে খেয়ে যাচ্ছিল রমাকান্ত। জাতপাতের কথা শোনামাত্রই ভাতের থালা ঠেলে সরিয়ে দিয়ে ফুঁসে ওঠে, ‘ছেলের হয়ে ওকালতি করতে এসেছ? তোমার জন্যই আজ বাবুর এই বাড়বাড়ন্ত। আমিও দেখছি ও কী করে ওই বেজাতের মেয়েকে বিয়ে করে!’

খেয়ে নেওয়ার জন্য মালার বারংবার অনুরোধ একপ্রকার উপেক্ষা করেই কলতলার দিকে চলে যায় রমাকান্ত। সে কোনও কিছুর বিনিময়েই স্টেলাকে মেনে নেবে না। তাই বোধহয় সবকিছু জেনেশুনে আজও ছেলের জন্য মেয়ে দেখে চলেছে।

সন্ধে সাতটা নাগাদ থমথমে মুখে ঘরে ফেরে অতনু। ছেলের চোখমুখ দেখেই হাত থেকে ব্যাগটা নিয়ে নেয় মালা। বলে, ‘তুই আগে বোস। জল দিই একটু জল খা। শরীরটা খারাপ লাগছে নাকি রে বাবু? সারাদিন ঠিকঠাক খেয়েছিস তো?’

‘শোনো মা, শোনো। আমার কিছু হয়নি। শরীর ঠিক আছে। তুমি আমার কাছে বসো, তোমার সাথে কথা আছে।’

‘কথা! কী কথা রে? পরে বলিস। আগে ঘরে যা, হাত-মুখ ধুয়ে একটু রেস্ট নে। তারপর না হয়…।’

‘না মা ঘরে যাব না। বলছি আমি একটা ফ্ল্যাট দেখেছি।’

‘কী দেখেছিস!’

‘ফ্ল্যাট।’

‘কী বলছিস বাবু। তুই কি পাগল হলি। তোর বাবার জন্য তুই আমাদের থেকেও…’ চোখে জল চলে আসে মালার।

‘না মা। শোনো আগে। এভাবে বোলো না। তুমি তো চাও, আমি একটু ভালো থাকি। শান্তিতে থাকি। রোজ বাবার এই গঞ্জনা, অশান্তি আমি আর সহ্য করতে পারছি না। একদিকে বাবার জেদ, অহংকার, অন্যদিকে ‘ওর’ ওই এক গোঁয়ারতুমি, বাবা আর্শীবাদ না করলে বিয়ের পিঁড়িতে বসবে না। দুজনের জেদাজেদিতে আমি হাঁপিয়ে উঠছি মা। অন্য জায়গায় গেলে অন্তত একটা দিক থেকে তো রেহাই মিলবে। এই বাড়িতে তো প্রাণখুলে শ্বাসও নেওয়া যায় না।

‘সবই তো বুঝলাম বাবু, কিন্তু তোকে ছেড়ে…’ কথা শেষ করতে পারে না মালা। দু-চোখ বেয়ে জল নেমে আসে।

‘আরে কাঁদছ কেন? আগে কথাটা শোনো। আমি কাছাকাছিই ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়েছি। যখনই মনে হবে তুমি আর ছুটকি চলে আসবে।’

ছেলের কথা ভেবে নিজেকে খানিক ধাতস্ত করে মালা, ‘যাবি কবে?’

মায়ের হাতদুটো ধরে অতনু জবাব দেয়, ‘আজই মা।’

‘আজই’, কাঁপা গলায় বলে ওঠে মালা।

একপ্রকার বুকের ওপর পাথর চাপা দিয়েই ছেলেকে বিদায় জানায় মালা। যাওয়ার সময় কয়েকটা প্রয়োজনীয় জিনিস এবং নিজের পোশাকআশাক ছাড়া কিছু সঙ্গে নেয়নি অতনু। রমাকান্ত বাড়ি ফিরলে ছেলের বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়া নিয়ে চলে আর এক প্রস্থ। আর সেটাই বোধহয় স্বাভাবিক– যার সম্বল কেবলমাত্র অহং আর জেদ, সেই অহংকারে আঘাত হানা– পারতপক্ষে ব্যাপারটা তার পক্ষে মেনে নেওয়া বেশ কঠিন।

ওদিকে রমাকান্ত অফিসে বেরোলেই সংসারের সমস্ত কাজকর্ম গুছিয়ে মালা সোজা ছেলের বাড়িতে। ঘরগোছানো, ছেলের জন্য রান্না করা। কখনও বা রান্না করে তার জন্য নিয়ে যাওয়া। কখনও দীপ্তির হাতে পাঠানো। তাছাড়া ফোন তো রয়েইছে। দেখতে দেখতে এইভাবেই বেশ কয়েকটা দিন কেটে গেল। এরই মধ্যে স্টেলার সঙ্গে পরিচয়ও হয়েছে। মা-মেয়ের বেশ ভালোই লেগেছে তাকে।

মাসখানেক হয়ে গেল বাবা-ছেলের দেখাসাক্ষাৎ নেই।

তার আড়াল-আবডালে যে কী চলছে, কিছুই জানতে বাকি রইল না রমাকান্তের। তবুও সবকিছু জেনেশুনে একপ্রকার না জানার ভান করা আর কী! হয়তো কিছুটা মন ও বয়সের ভারে, আবার কিছুটা কাজের চাপে। কথা ছিল অতনু আর রমাকান্ত দুজনে মিলে ব্যাবসাটা দাঁড় করাবে। কিন্তু নিজের জেদের কারণে সব জায়গায় একা একা দৌড়োনো, এই বয়সে বেশ সমস্যাই হচ্ছিল।

তাই অনেক ভেবেচিন্তে রমাকান্তই মালাকে বলে, ‘মালা অনেকদিন তো হল, তোমার সুপুত্তুরকে বলো বাড়ি ফিরতে।’

কথাটা শুনেই অবাক হয়ে রমাকান্তের দিকে তাকায় মালা।

‘আরে কী হল! তোমাকেই বলছি। এরকম অবাক হলে কেন? বলছি তোমার সপুত্তুরকে বলো এবার বাড়ি ফিরতে।’

‘আমাকে বললে?’

‘তবে কাকে বলছি, এখানে তুমি ছাড়া আর কেউ আছে নাকি?’

নিজেকে খানিক সামলে নেয় মালা, ‘যেতে যখন তুমি বলেছ, আসতেও তুমিই বোলো। তোমারই তো ছেলে। তুমি না বললে কী আর সে…।’

কোনও জবাব না দিয়েই রমাকান্ত উপরে ঘরের দিকে চলে যায়। সন্ধে সাতটা নাগাদ কাউকে কিছু না জানিয়ে সোজা অতনুর ভাড়া নেওয়া ফ্ল্যাটে হাজির রমাকান্ত। অতনু তখন সবেমাত্র অফিস থেকে ফিরেছে। উইদাউট এনি ইনফরমেশন বাবার হঠাৎ আগমনে, বেশ আশ্চর্য হয় অতনু।

‘চলো অনেক হয়েছে। জিনিসপত্র গোছাও আর বাড়ি চলো।’

‘না বাবা। আমি এখানেই ঠিক আছি। জাতপাত, বৈষম্য এসবের থেকে অনেক দূরে। এখানে আমি নিজের মতো ভাবতে পারি, সিদ্ধান্ত নিতে পারি। জোর করে কেউ কিছু চাপিয়ে দেয় না আমার উপর। আজ তোমার মনে হয়েছে তাই আনতে এসেছ, কাল মনে হলেই আবার লাথি মারবে। তোমার আমার মত কোনওদিনই মিলবে না। ভবিষ্যতে স্টেলাকে নিয়েও প্রবলেম হবে। আজ আমাকে অপমান করছ। বিয়ের পর স্টেলাকে করবে। সেটা আমি কখনওই মেনে নিতে পারব না। আমি যেমন আছি, ভালো আছি। প্লিজ আমাকে আমার মতো থাকতে দাও।’

‘এটা কী ধরনের অসভ্যতা। ইগো দেখাচ্ছ আমাকে। ইগো! একটা বেজাতের মেয়ের জন্য আমাকে অপমান করছ। রমাকান্ত সান্যালকে। এত বড়ো স্পর্ধা তোমার। দ্যাখো এবার আমি কী করতে পারি’, বলেই রাগে গটগট করতে করতে উলটো পায়ে ফিরে গেল রমাকান্ত।

বাড়ি ফেরার পর থেকেই মুখ গম্ভীর করে বসে থাকে রমাকান্ত। মালার বহুবার জিজ্ঞাসা করাতেও কোনও সদুত্তর মেলে না। কেবলই কী যেন ভাবতে থাকে।

দিন সাতেক পর একটি নামকরা দৈনিক পত্রিকাতে বড়ো বড়ো হরফে লেখা বেরোয়, ‘আমি শ্রী রমাকান্ত সান্যাল, মন্দিরতলা ফার্স্ট লেন, কামরাবাদ, সোনারপুর এলাকার বাসিন্দা, সজ্ঞানে আইন মারফত আমার পুত্র অতনু সান্যালকে (২৯) কে ত্যাজ্য করলাম। আমার স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি, কোনও কিছুতেই তার অধিকার রইল না।’

শ্রী রমাকান্ত সান্যাল

সকালেই সুশীলার ফোন। ‘কীরে দিদি, জামাইবাবু এটা কী করল?’ কিছু বোধগম্য হওয়ার আগেই রমাকান্তের চায়ের জন্য হাঁকডাকে ফোনটা কেটে দিতে হয়েছিল মালাকে। তারপর চা করার সময় উলটো দিকের বাড়ির গীতাও তার রান্নাঘর থেকে কী যেন একটা বলার চেষ্টা করছিল। প্রথমে বুঝতে পারেনি মালা। তারপর দুই নম্বর পাতায় আজকের খবরের কাগজটা দেখাল। চা দেওয়া হয়ে গেলে কৌতূহলবশত পাতাটা ওলটাতেই চক্ষু ছানাবড়া মালার। ‘এটা কী করল অতনুর বাবা। রাগ মেটাতে শেষপর্যন্ত এই পদক্ষেপ নিল লোকটা। কাগজটা হাতে করে জড়বতের মতো বসে রইল মালা। পাড়াপড়শি থেকে শুরু করে আত্মীয়স্বজন, সকলের প্রশ্নের জবাব দিতে দিতে সারাদিন পরিশ্রান্ত হয়ে গেল মালা। এখন ফোন ধরাও প্রায় ছেড়ে দিয়েছে সে। রিং হতেই থাকে। দীপ্তি থাকলে কখনওসখনও ধরে নয়তো কেটেই যায়।

দু-একজন শুভাকাঙক্ষীর পরামর্শে মালা আবারও স্বামীকে বোঝানোর চেষ্টা করে। ‘অনেক হয়েছে। এই বয়সে ছেলের বিরুদ্ধে কোর্টকাছারি করছ, সেটা কি ভালো দেখাচ্ছে। লোকে যে ছি ছি করছে।’

‘যা করছি ঠিক করছি। আমার ঘরের মান-সম্মান, সংস্কৃতি কোনও কিছুই আমি ক্ষুণ্ণ হতে দেব না। না পোষালে তুমিও যেতে পারো।’

এই ঘটনার পর থেকে মালা প্রায় নিজেকে ঘরবন্দি করে ফেলেছে। ওদিকে পাড়াপড়শি, আত্মীয়স্বজন ব্যাপারটা বেশ তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করছে। ঘরের শান্তির জন্য নিজের আত্মসম্মান শিকেয় তুলে দিয়ে সর্বদা স্বামী নামক জীবের হ্যাঁ তে হ্যাঁ মেলানো এ যেন তার জীবনের এক এবং একমাত্র কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অথচ দুটো মানুষ একেবারে দুই মেরুর। পছন্দ, চিন্তাভাবনা কোনও কিছুই মেলে না তাদের। তৎসত্ত্বেও জীবনের তিরিশটা বছর কাটিয়েছে একে-অপরের সঙ্গে। বিয়ের পর থেকেই লক্ষ্যহীনভাবে কেবলই পতিদেবতার কথা মতো কাজ করেছে।

সংসারে কোনওদিনই তার ইচ্ছে বা মতামত প্রাধান্য পায়নি। প্রথমদিকে রমাকান্তকে বদলানোর বহু চেষ্টা করেছে মালা। কিন্তু লাভের লাভ কিছুই হয়নি। সারাজীবন স্বামীর মিথ্যে অহংকারের তুষ্টির জন্য নিজের ইচ্ছের বলিদান দিয়ে এসেছে সে।

ভাগ্যের পরিহাসে এখনও তার জন্য অনেক কিছু অপেক্ষা করছে এই ধারণা মালার বদ্ধমূল ছিলই। এরই মধ্যে দীপ্তির পড়াশোনা কমপ্লিট হয়েছে। জোরকদমে মেয়ের বিয়ের জন্য দেখাশোনা শুরু করেছে রমাকান্ত। ব্যাবসার চাপ, পাত্র খোঁজা, অফিস– সব নিয়ে রমাকান্ত বেশ ব্যস্ত হয়ে পড়ে।

অঙ্কুশকে মনে ধরে রমাকান্তের। এক অফিস কলিগের ছেলের বিয়েতে তার সঙ্গে আলাপ। তারপর বন্ধু কেশবের থেকে জানতে পারে, অঙ্কুশ বেশ বড়োমাপের বিজনেসম্যান। শহরে বেশ নামডাকও আছে তার। ছেলে হিসেবেও নাকি ভীষণ ভালো, ভদ্র নম্র। যদি দীপ্তির এখানে বিয়ে হয়ে যায় তাহলে দীপ্তির ভাগ্য ফিরে যাবে।

বন্ধু কেশবকে সঙ্গে করে একদিন সোজা অঙ্কুশের বাড়িতে হাজির হয় রমাকান্ত। কেশবের সাহায্য নিয়ে যদি তার বাবার সাথে কথা বলে পাকাপাকি একটা ব্যবস্থা করা যায়।

সেইমতো প্রথমে সৌজন্যমূলক কথাবার্তার পর সম্বন্ধর কথা উঠতেই, অঙ্কুশের বাবা একেবারে সরাসরিই প্রশ্ন করে বসলেন, ‘কাগজে আপনিই নোটিশ ছাপিয়েছিলেন না? ছেলের সাথে কী এমন ঝগড়া?’

রমাকান্ত কী বলবে ভেবে পাচ্ছিল না। কোনওমতে কিছুটা থেমে জবাব দিল, ‘তেমন কিছু নয়। ব্যস ছেলের আর আমার মতের মিল একদমই হতো না। তারপর কথা বাড়তে বাড়তে…।’

‘ক্ষমা করবেন রমাকান্তবাবু। যে বাড়িতে বাপ-ছেলের সম্পর্ক আদালত পর্যন্ত গড়ায়, সে বাড়ির মেয়েকে আমি ছেলের বউ করে আনতে পারব না।’

অগত্যা মুখ চুন করে ফিরে আসে রমাকান্ত। তারপর থেকে যত সম্বন্ধ হয়েছে, ছেলের প্রসঙ্গ উঠতেই সে সম্পর্ক ভেঙ্গে গেছে।

মহা ফাঁপড়ে পড়েছে রমাকান্ত। কায়িক এবং মানসিক পরিশ্রমে কয়েকদিনেই আরও বুড়িয়ে গেছে সে। স্বাস্থ্যও ক্রমশ খারাপের দিকে যাচ্ছে।

বাল্যবন্ধু উমাচরণবাবু রমাকান্তের এই অবস্থা দেখে ঘর বয়ে এসে তাকে বুঝিয়ে গেলেন। ‘রমাকান্ত যুগ বদলেছে। তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মানুষের চিন্তাভাবনাও বদলাচ্ছে। এখনও সেই সেকেলে চিন্তাভাবনা নিয়ে বসে থাকলে চলবে কেন ভাই? দুনিয়াটা কত এগিয়ে গেছে বলোতো। মানুষের থেকে কি জাতপাত বড়ো হতে পারে? মনের এই সংকীর্ণতা থেকে বেরিয়ে এসে দ্যাখো, দুনিয়াটা তোমাকে স্বাগত জানাবে।’

‘কিন্তু বছরের পর বছর চলে আসা পরম্পরা, সামাজিক নিয়মে বাঁধা মন, এত সহজে কি শিকল কেটে বেরিয়ে আসতে পারবে?’ বিষাদময় কণ্ঠে জবাব দেয় রমাকান্ত।

‘জীবনের পঞ্চাশ-ষাটটা বছর তো এটা ভেবেই কাটিয়ে দিলে যে, লোকে কী বলবে? সংসারের কথা না ভেবে লোকের কথা ভাবলে বেঁচে থাকা মুশকিল হয়ে দাঁড়াবে, তা তো হাতেনাতে টের পেয়েছ। নতুন প্রজন্ম যদি পুরোনো নিয়মের বাইরে বেরিয়ে ভালো কিছু করতে চায়, তাতে বাধা দেওয়া কেন বাপু। লাইফটা যখন তোমার ছেলের, সে কার সাথে সংসার করবে না করবে সিদ্ধান্তটা তারই হওয়া উচিত। চেষ্টা তো করো। একবার মেয়েটার সঙ্গে দেখা করো। দ্যাখো তো ছেলের পছন্দটা কেমন।’

‘ঠিক আছে। চেষ্টা করব’, পাশের ঘরে বসে থাকা মালা ও দীপ্তি রমাকান্তের এই কথা শোনা মাত্রই আনন্দে আত্মহারা হয়ে উঠল। মালার চোখ ভরে এল জলে। দীপ্তি তো লাফিয়ে লাফিয়ে দাদাকেও ফোনে সব জানিয়ে দিল।

পরের দিন সন্ধেবেলা অতনুর রুমের ডোরবেলটা বেজে উঠল। সামনেই বড়োদিন। ভিতরে কয়েকজন বন্ধুবান্ধব মিলে তারই আয়োজন চলছে। ঠিক সেই সময় ডোরবেল বেজে ওঠাতে বেশ বিরক্তই হল তারা। ডোরবেলটা আবারও বেজে উঠল। দরজা খুলে বোকার মতো দাঁড়িয়ে রইল অতুন। সামনে বাবা। সে জানত বাবা আসবে, তবে এত তাড়াতাড়ি আশা করেনি। কোনও কথা সরছিল না তার মুখে। মিনিট দুয়েক-তিনেক এভাবে কেটে গেল। অতনুর কোনও সাড়াশব্দ না পেয়ে ভিতর থেকে কে যেন বলে উঠল, ‘কে এল রে অতনু?’

বন্ধুর আওয়াজে সম্বিৎ ফিরে পেল অতনু।

‘ওহ! বাবা তুমি, ভিতরে এসো।’

ভিতরে ঢুকেই রমাকান্তের চোখে পড়ল ড্রইংরুমে আট-দশজন অতনুর বন্ধুর মধ্যে তিনটি মেয়েও রয়েছে। নিজেদের মধ্যে হাসি-ঠাট্টা চলছিল। তাকে দেখামাত্রই যেন আনন্দে ভাটা পড়ে গেল। প্রথমেই সামনে বসা তিনটি মেয়ের দিকে নজর পড়ল রমাকান্তের। বোধহয় প্রবীণ চোখ বিশেষ কাউকে খোঁজার চেষ্টা করছিল।

‘বাবা ভিতরের ঘরে চলো।’

রমাকান্ত ভিতরের ঘরে গিয়ে চেয়ারে বসল।

‘এরা এক্ষুনি চলে যাবে। তুমি বসো, আমি আসছি।’

‘ঠিক আছে। আমি কিছুক্ষণ বসছি। তাড়াহুড়ো করার দরকার নেই। ওরা যাক, তারপর এসো।’ নিজের বিনম্র ব্যবহারে রমাকান্ত নিজেই অবাক হয়ে যায়। তার স্বভাব তো এমন নয়! বরং উলটোটাই। কোনওদিন তো তলিয়ে দেখেনি। উমাচরণ বোঝানোর পর কাল থেকে যত পিছন ফিরে তাকিয়েছে তত যেন নিজেকে দোষী বলে মনে হয়েছে। বারবার বাড়ির সকলের করুণ মুখগুলো ভেসে উঠেছে চোখের সামনে।

পাখার হাওয়ায় পর্দাটা উড়ছে। ফাঁক দিয়ে ড্রইংরুমের কিছুটা অংশ দেখা যাচ্ছে। তিনটি মেয়ের মধ্যে দুটিতে মিলে একটি মেয়েকে সমানে ক্ষ্যাপাচ্ছে। ওদের হাবভাবে, রমাকান্তের আর বুঝতে বাকি থাকল না ওই মেয়েটিই স্টেলা। বেশ সুন্দর, স্মার্টও। বাচ্চাদের নিজেদের মধ্যে খুনসুটি ভালোই লাগছিল তার। কোথাও একটা মনে হচ্ছিল এরা কত সুন্দর, প্রাণবন্ত। কত সহজ করে নিয়েছে এরা জীবনটাকে। সুন্দরভাবে একে অপরের সুখ-দুঃখ শেয়ার করতে পারে। নিজের কথা সবার সামনে বলার ক্ষমতা রাখে এরা। মনে পড়ে যায় স্ত্রী মালা এবং মেয়ে দীপ্তির কথা।

নতুন প্রজন্মে জাতিধর্মকে ছাপিয়ে গিয়ে মানব সম্বন্ধকে প্রাধান্য দেওয়া, মহিলা পুরুষদের সমতুল্য ভাবা– জাতিধর্মের বন্ধন থেকে বেরিয়ে এই ধরনের নতুন নতুন বিচার ঘুরতে থাকে রমাকান্তের মনে। পুরোনো ধ্যানধারণার উপর নতুন ধ্যানধারণা ভারী হয়ে দাঁড়ায়। এমন সময়, স্টেলা ঘরে ঢুকে পায়ে হাত দিয়ে নমস্কার করতেই চমকে ওঠে রমাকান্ত। আশীর্বাদ করার জন্য হাতটা বাড়াতে গিয়েও…।

‘কেমন আছ বাবা?’ প্রশ্নটা শোনামাত্রই স্টেলার দিকে অবাক নয়নে তাকিয়ে থাকে রমাকান্ত। কত আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে মেয়েটি বাবা বলে ডাকছে। আবার মিষ্টি স্বরে, ‘বাবা তোমাকে খুব ক্লান্ত লাগছে। একটু শরবত বানিয়ে দিই?’

‘না না কিছু লাগবে না।’

‘না, তা বললে তো হবে না। জানি তুমি লেবু দেওয়া চা খেতে ভালোবাসো, কিন্তু এই গরমে চা খেলে শরীর খারাপ করবে যে। আমি বরং শরবত বানিয়ে নিয়ে আসি।’

রমাকান্তর বিস্ময়ের শেষ থাকল না। এত সহজে কেউ আপন হয়ে উঠতে পারে! এইটুকু একটা পুঁচকে মেয়ে, শরীরে ভয়ের লেশমাত্র নেই। কোথায় তার নামে বাঘে-গরুতে একঘাটে জল খায়, বাড়ির লোক দু-ঠোঁট এক করতে পারে না, আর এই মেয়েটি কিনা দিব্যি শাসন করে চলে গেল। বলে কিনা, গরমে চা খেতে হবে না, শরবত খাও!

খানিক পরে স্টেলা এসে শরবত দিয়ে গেল। যাবার সময় বলে গেল, ‘আমরা সবাই যাচ্ছি বাবা।’ বলে আবার একটা প্রণামও করে গেল। মনে হল কোনও ঠান্ডা হাওয়া বয়ে গেল।

মেয়েটিকে দেখে রমাকান্তের মনে প্রশ্ন ঘুরতে থাকল, সত্যিই কি মানুষের থেকে বংশের মানমর্যাদা, জাতপাত বড়ো হতে পারে? প্রত্যেকবারই এক জবাব পেয়েছে সে।‘না’। ‘কখনওই নয়’। বন্ধুদের ছেড়ে অতনু যতক্ষণে ঘরে ঢুকল, ততক্ষণে তার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়ে গেছে। লোকের কথা ভেবে সিদ্ধান্ত না নিয়ে মনের কথা শুনে চলাই শ্রেয়। তাতে সকলে মিলে ভালো থাকা যায়। সুতরাং তার বাড়ির বউ হওয়ার যোগ্য পাত্রী স্টেলা ছাড়া আর কেউ হতেই পারে না।

 

গণেশ এসেছে

গণেশ এসেছে। এসে চেয়ারে না বসে, বসেছে চেয়ারের হাতলে। কাঠের এই চেয়ার বহু বছরের পুরোনো। শক্তপোক্ত, দু’পাশে হাতল। হাতলগুলো চওড়া। চেয়ারটাকে রাখা হয়েছে খাটের গা ঘেঁষে। যাতে ডাক্তারবাবু, আত্মীয়স্বজন, বাড়ির লোকজন রোগীর কাছে বসতে পারে। গত চার মাস, না চার মাস নয়, গত চার মাস এগারো দিন এই ব্যবস্থা চলেছে। প্রথম প্রথম এঘর, ওঘর থেকে মোড়া, চেয়ার, এমন কী টুল পর্যন্ত টেনে আনা হচ্ছিল। পরে দেখা গেল, সিচুয়েশনের অবনতি হচ্ছে। ঘরে ডাক্তার, ভিজিটর বসবার জন্য পাকাপাকি ব্যবস্থা রাখতে হবে। বারান্দায় রাখা চেয়ারটাকে মুছে-টুছে ঘরে আনা হল। আজ থেকে আর এই চেয়ারের দরকার হবে না।

গণেশ যখন এল তখনও আলো ফোটেনি। ফুটব ফুটব করছে। দূরে একটা দুটো কাক ডেকে উঠল। আড়মোড়া ভাঙা ডাক। রাস্তা দিয়ে ঝনঝন আওয়াজ করে চলে গেল দুধের গাড়ি। রমাকান্তবাবু পাশ ফিরতে গেলেন। একটু পারলেন, বেশিটা পারলেন না। পাশ ফেরবার শক্তি মানুষটার আর নেই। শ্বাস নিতেও কেমন যেন অসুবিধে হচ্ছে। মনে হচ্ছে, কেউ নব ঘুরিয়ে ঘরের বাতাসের পরিমাণ কমিয়ে দিয়েছে। খানিক আগে বুকের ভিতরে একধরনের চাপা ধড়ফড়ানি শুরু হয়েছে। শরীর জানান দিয়ে দিচ্ছে, সময় ফুরিয়ে গেল… সময় ফুরিয়ে গেল…। পরিস্থিতি যা তাতে মনে হয়, আজই কিছু একটা হয়ে যাবে। কখন হবে? বেলাবেলি? নাকি দুপুরের পর? দুপুরের পর হলে ভালো। বাড়ির সবার খাওয়া-টাওয়া হয়ে যাবে। নইলে রাত পর্যন্ত আটকে থাকা। মরা বাড়িতে হাজার ফ্যাঁকড়া। এইটা করা যাবে না, ওইটা করা যাবে না।

মাধবীর আলসারের সমস্যা আছে। বেশিক্ষণ কিছু না খেলে পেটে ব্যথা হয়। তারও তো বয়স কম হল না। স্বামীর মৃত্যুর পর আলসারে কাবু স্ত্রীদের জন্য কি কোনও ছাড় আছে? হালকা কিছু খেতে পারে? পারা উচিত। যাই হোক, সবথেকে ভালো হয় ঘটনা বিকেলের দিকে ঘটলে। তবে সে তো আর কারও হাতে নেই যে সকলকে স্নানটান করিয়ে, মাছের ঝোল ভাত, কাঁচা আমের চাটনি খাইয়ে, ছোট্ট একটা ভাতঘুম দিয়ে তবে ঘটবে। মৃত্যু কখন আসে কেউ বলতে পারে না। জন্ম-মৃত্যু খুবই অনির্দিষ্ট একটা বিষয়। তারা স্বেচ্ছাচারী। নিজের খুশি মতো চলতে পছন্দ করে।

রমাকান্তবাবু ঠোঁটের ফাঁকে হাসতে চেষ্টা করলেন। একটু পারলেন, একটু পারলেন না। আর কোনও কিছুই সবটা পারবার সময় নেই।

মুক্তি… মুক্তি। রোগ, যন্ত্রণা থেকে মুক্তি। মুক্তি দীর্ঘ জীবন বয়ে নিয়ে যাওয়ার পরিশ্রম আর ক্লান্তি থেকে। মুক্তি বেঁচে থাকবার যাবতীয় গ্লানি, অবহেলা থেকে। আহ্! রমাকান্তবাবু আবার হাসবার চেষ্টা করলেন। মুক্তির হাসি।

মুক্তি শুধু নিজের নয়, মুক্তি বাড়ির লোকেদেরও। তারাও এবার যবনিকাপতন চায়। নিজের মধ্যে একথা বলাবলিও করছে। পরশু রাতেই বড়ো ছেলে শুভ দরজার ওপাশে দাঁড়িয়ে তার বউকে চাপা গলায় বলছিল। শুভ ভেবেছিল, বাবা ঘুমিয়ে পড়েছে। শুনতে পাচ্ছে না। রমাকান্তবাবু সবই শুনেছেন, জেগে ছিলেন। শুনতে ভালোই লেগেছে। এখন আর স্ত্রী ছেলেমেয়ে, পুত্রবধূ, জামাইরা কী বলল সেটা আসল কথা নয়, আসল কথা হল, এখনও তারা কাছে আছে। তাদের চোখে দেখা যায়, গলা শোনা যায়, ছোঁয়া পাওয়া যায়। কয়েকমাস ধরেই এই অনুভূতিটা হচ্ছে। বারবার মনে হয়েছে, বেশিদিন নয়, এবার দূরে চলে যেতে হবে। অনেক দূরে। কতদূরে তাও ঠিক মতো জানা নেই। হাজার চেষ্টা করলেও ভালোবাসার মানুষদের সঙ্গে আর দেখা হবে না, গলা শোনা যাবে না। বিগত কটাদিন বেশিরভাগ সময়ে রমাকান্তবাবু আধো ঘুম আধো জাগরণের মধ্যে কাটিয়েছেন। চোখ বুজে পড়ে থেকেছেন। সবাই ভেবেছে, রোগী ঘুমোচ্ছে। শরীর বোধহয় খানিকটা ভালো। রমাকান্তবাবু ভুল ভাঙাননি। ভাঙাতে গেলেও বিশ্বাস করবে না। ভাববে, অসুস্থ মানুষ ভুল বকে। ঘুমোলেও বলে ‘জেগে ছিলাম’। তার থেকে চুপ করে থাকাই ভালো।

মৃত্যুপথযাত্রী মানুষের কাছে ঘুম আর জেগে থাকার মধ্যে বিশেষ ফারাক নেই। কে বুঝবে একথা? এ এক ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা। সবাইকে বলবার মতোও নয়। বোঝানো তো যায়ই না। আর দরকারই বা কি? সেদিনও রমাকান্তবাবু তাই ছিলেন। বড়োছেলে আর তার বউয়ের কথা কানে এসেছে সব।

শুভ তার বউকে বলেছিল, ‘উফ্ আর কতদিন বলো তো? এ তো আর টানা যাচ্ছে না। টাকার পর টাকা গলে যাচ্ছে। ডাক্তারবাবু তেমনি। আরে বাবা, যদি চান্স না থাকে তাহলে এত দামি দামি মেডিসিন দেবার মানে কী? আর কতদিন বলো তো?’

বউমা বিরক্ত গলায় বলল, ‘আমাকে বলছ কেন? বাবা তোমার, কবে মরবে, কবে বাঁচবে তুমিই জানো। আমি কী করে বলব?’

বড়োছেলে মুখে ‘ফুঃ’ ধরনের আওয়াজ করে বলল, ‘এমন ভাবে বলছ ঝুমা, যেন তোমার বাবার মৃত্যুর ডেট তুমি জেনেশুনে বসে আছো। বাবা হলেই সব জানা যায়?’

ঝুমা ঝাঁঝিয়ে উঠল, ‘আমার বাবার কথা আসছে কোথা থেকে? আমার বাবাকে টানছ কেন? বালাই-ষাট সে মরবে কীসের জন্য? সে তো আর শ্বশুরমশাইয়ের মতো চার মাস বিছানায় কেতরে নেই। ডাক্তার, বদ্যির পিছনে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকাও খসাচ্ছে না, ছেলেমেয়ে, পুত্রবধূ, জামাইদের ছুটিয়েও মারছে না। সে আছে নিজের মতো।’

বড়োছেলে বলল, ‘আচ্ছা, আচ্ছা ঠিক আছে, তোমার বাবা হলেন বিরাট পরোপকারী। আমার বলাটাই ভুল হয়েছে। আই অ্যাম সরি।’

ঝুমা গজগজ করে বলল, ‘কথায় কথায় আমার বাবাকে টানবে না। নিজের বাবাকে নিয়ে ঝামেলায় পড়েছ, যা বলবার তাকে বলো।’

‘কী বলব?’

ঝুমা রাগ রাগ গলায় বলল, ‘কী আবার বলবে, অনেক সমস্যা করেছেন এবার শেষ করুন।’

শুভ অবাক গলায় বলল, ‘বাবাকে বলব, শেষ করুন! মানে তুমি মরে যাও! এসব কী বলছ ঝুমা!’

ঝুমা নিজেকে সামলে নিতে নিতে বলল, ‘মরে যাও বলবে কেন? বলবে…  বলবে, এবার ভালো হয়ে ওঠো। তোমার সেবাযত্ন করতে করতে তো বাড়িশুদ্ধ সবার নাজেহাল অবস্থা। টাকাপয়সাও তো জলের মতো বেরিয়ে যাচ্ছে। এত বয়স হয়েছে, এটা বুঝতে পারছ না?’

বড়োছেলে চুপ করে থেকে চাপা গলায় বলে, ‘অ্যাই ঝুমা, ঝুমা, অ্যাই ঝুমা…’

‘ধেড়ে বয়েসে বারবার বউয়ের নাম বলে আহ্লাদ করছ কেন? কী বলবার বলে ফেল।’

বড়োছেলে ফিসফিস করে বলে, ‘একটা কাজ করো না।’

ঝুমা সন্দেহ ভরা গলায় বলল, ‘কী কাজ? শ্বশুরমশাইকে বিষ খাওয়াব?’

শুভ বলল, ‘উফ্ তোমার মুখে কিছু আটকায় না। তুমি ডাক্তারবাবুকে জিজ্ঞেস করবে?’

ঝুমা বলল, ‘কী জিজ্ঞেস করব?’

শুভ কিছু একটা বলল। রমাকান্তবাবু শুনতে পেলেন না। যদিও গত চার মাস ধরে কান খুব ভালো সার্ভিস দিয়েছে। প্রকৃতির কি এটাই মজা? শরীরের সব অঙ্গ কাহিল করে দিয়ে একটাকে তরতাজা করে রাখে? তার বেলায় যেমন শ্রবণ ক্ষমতাকে রেখেছে? মনে হচ্ছে, যুবক বয়েসের কান ফিরে পেয়েছেন। দূরের কথাও শুনতে সমস্যা নেই।

ঝুমা খানিকটা জোর গলায় বলল, ‘একথা তুমি জিজ্ঞেস করতে পারছ না? ডাক্তারবাবুকে ফোন করে  জিজ্ঞসা  করো।’

শুভ ‘শ্শ্শ্’ আওয়াজ করে বলল, ‘এই আস্তে, বাবা শুনতে পাবে।’

‘শুনতে পাবে না। অনেকক্ষণ থেকে ঘুমোচ্ছে। আজকাল তো বেশিরভাগ সময়টা ঘুমিয়েই থাকে। জিজ্ঞেস করলে বলে ঘুম হয় না। তুমি বরং এখনই ডক্টর রায়কে ফোন করো।’

শুভ আমতা আমতা করে বলল, ‘আমার বলাটা কি ঠিক হবে ঝুমা?’

ঝুমা অবাক গলায় বলল, ‘কেন? হবে না কেন? তুমি তার ছেলে। তুমি জিজ্ঞেস করতেই পারো। তাছাড়া তুমি তো আর মরবার কথা বলছ না। বলবে, দেখুন ডাক্তারবাবু আমাদের তো একটা প্ল্যানিং করতে হবে। উনি আর কতদিন এভাবে কষ্ট পাবেন যদি জানতে পারি সুবিধে হয়… এত টাকাপয়সা খরচ… জোগাড়ও তো করতে হবে। তার থেকে বড়ো কথা… আমরা এই কষ্ট চোখে দেখতে পারছি না। আমার স্ত্রী তো… আমার স্ত্রী তো রোজ কান্নাকাটি করে।’

‘তুমি আমার মরণাপন্ন বাবার জন্য কান্নাকাটি করো? এতবড়ো একটা মিথ্যে কথা বলা কি ঠিক হবে ঝুমা?’

ঝুমা চাপা গলায় স্বামীকে ধময় দেয়।

‘চুপ করো। বেশি ঢঙ দেখিও না। তোমার মা কী বলছেন?’

শুভ বলল, ‘কী বলেছেন?’

রমাকান্তবাবু কান খাড়া করলেন। মাধবী বলেছে! সে আবার কী বলল!

ঝুমা বলল, ‘কাল বিকেলে ঘরে ডেকে আমাকে বলল, বউমা তোমার শ্বশুরমশাইয়ের হাগামোতার কাপড় আমি আর ধুতে পারব না। এক-দুদিন হলে হয়, মাসের পর মাস হলে হয় না। খোকাকে বলো, লোক রাখতে। সে বড়ো হয়েছে, রোজগারপাতি করে। বাবার হাগামোতার পিছনে পয়সা খরচ করতে পারবে না এমন নয়। সংসারে অনেক ঝি-গিরি  করেছি, আর নয়। তোমার শ্বশুরমশাই চলে গেলে, নিজের মতো একটু হাত-পা ছড়িয়ে থাকব। নিজের স্ত্রী-ই তো এসব বলছে। আমি কেন কাঁদতে যাব?’

শুভ বলল, ‘আচ্ছা আচ্ছা, চুপ করো। আর মায়ের নিন্দে করতে হবে না। আমি দেখছি।’

শুধু স্ত্রী, বড়োছেলে-বউমা নয়, রমাকান্তবাবুর মেয়ে জামাইও খুব অসুবিধেতে রয়েছে। কাজকর্ম ফেলে তাদের ছুটে ছুটে আসতে হচ্ছে। তার ওপর টাকাপয়সা নিয়েও একটা টেনশন আছে। থাকাটাই স্বাভাবিক। শুভ যে-কোনও সময় তার দিদির কাছে হাত পাততে পারে। বলা যায় না, হয়তো আয়া রাখবার টাকাটাই চেয়ে বসতে পারে। এই ক’দিনে রমাকান্তবাবুকে নিয়ে মেয়ে জামাইয়ের মধ্যেও ঝগড়াঝাঁটি হয়েছে। সেদিন তো পাশের ঘরে দুজনে খুব একচোট চ্যাঁচামেচি করল। করবারই কথা। একজন যদি চার মাস ধরে ‘মরছি মরব’ করে শুয়ে থাকে তাহলে সকলেরই সমস্যা। তার ওপর রমাকান্তবাবুর জামাই কোনও হাবিজাবি লোক নয়। সে নামকরা মানুষ। তার একটা পরিচয় আছে। কলেজে পড়ায়। সেটা বড়ো কথা নয়, বড়ো কথা হল তাকে প্রায়ই টিভিতে দেখা যায়। আলোচনায় চান্স পায়। নির্যাতিত, নিপীড়িত, মানুষের জন্য গলা ফাটায়। কখনও সরকারের বিরুদ্ধে, কখনও বিরোধীদের বিরুদ্ধে। যে- চ্যানেল যার কথা বলতে বলে সেই চ্যানেলে গিয়ে তাই বলে। যাওয়ার আগে দাড়ি, চুল শ্যাম্পু করে ফুরফুরে করে নেয়। রঙচঙে জামা পরে। মাথা ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে ঝগড়া করে। রমাকান্তবাবু যখন সুস্থ ছিলেন, মুগ্ধ হয়ে জামাইয়ের প্রোগ্রাম দেখতেন। গিন্নি ঝামেলা করত। রিমোট টিপে সিরিয়াল দেখতে চলে যেত।

‘আহা করো কী, শ্যামলের কথা শুনছি।’

গিন্নি ধাতিয়ে উঠত, ‘রাখও তোমার জামাইয়ের কথা। খালি বকবক আর বকবক। কে আমার বক্তিতে দেওয়ার লোক এল রে! ওর লেকচার কেন শুনতে যাব? দেশের জন্য কোন কম্মটা করেছে তোমার জামাই? এমন ভাবে দাড়ি নেড়ে কথা বলে মনে হয়, টেগার্ট সাহেবকে বোম মারবে।’

‘মেয়ে কিন্তু রাগ করবে। সে রাতে ফোন করে জিজ্ঞেস করবে, তার বরের কথা শুনেছি কিনা।’

গিন্নি আরও রেগে যেত।

‘বনির আশকারাতেই তো জামাইটা গোল্লায় গেল। ঘরের কাজ করে না, কলেজে যায় না, খালি ক্যামেরায় মুখ দেখানোর জন্য ছোকছোকানি। ছিছি। এই সব ছেলেকে মারতে হয় চড়।’

সেদিন মেয়ে জামাইয়ের ঝগড়া পুরোটা না হলেও, কিছু কথা ভেসে আসছিল। আজকাল কেমন শীত শীত করে। রক্তের জোর কমে গেছে। সেদিন শীত ভাবটা বেশি ছিল। চাদর গায়ে দিয়ে গুটিয়ে শুয়েছিলেন রমাকান্তবাবু। সেই অবস্থাতেই শুনলেন, জামাই বনির ওপর চ্যাঁচাচ্ছে।

‘কী মনে করছ কী? আমার কোনও কাজ নেই? কলেজ, সেমিনার, ছাত্রছাত্রী, টিভি সব ফেলে এখানে এসে তোমার বাবার নাড়ি ধরে থাকব আর আহা উহু করব?’

বনি বলল, ‘রোজ কোথায় আসছ? সপ্তাহে তো মোটে একদিন আসো। বড়োজোর দু’বার। তাতেই এত বিরক্ত! দাদা তো সব সময় রয়েছে। সবকিছু সামলাচ্ছে।’

জামাই রাগি গলায় বলল, ‘তোমার দাদার কাজটা কী? দশটা পাঁচটার অফিস করেই খালাস। তাও মাথার কোনও কাজ নেই। মাথা থাকলে তো কাজ থাকবে। মাছি-মারা কেরানি।’

বনি বলল, ‘ইস্ আমার দাদার মাথা নেই, আর ওনার বিরাট মাথা।’

জামাই বলল, ‘তাছাড়া তোমার দাদা রমাকান্ত রায়ের ডাইরেক্ট পুত্র। পুত্র, পিতার রোগশয্যার পাশে সর্বদা থাকবে এটা আর নতুন কথা কী?’

বনি তেড়েফুঁড়ে বলল, ‘এখন পুত্রই সব করবে, আর সেদিন যে বড়ো বলছিলে, অ্যালার্ট থেকো বনি। তোমার বাবা মনে হচ্ছে আর বেশিদিন নেই। যে-কোনও সময় ফুটুস হবেন, এরপরেই কিন্তু সম্পত্তির ভাগবাটোয়ারা নিয়ে গোলমাল লাগবে। তোমার মায়ের পোরশনটা বাদ দিলে বাকিটা কিন্তু তুমি আর তোমার দাদা ফিফটি ফিফটি। কই তখন তো ডাইরেক্ট পুত্র বলে দাদাকে পুরো সম্পত্তি দেওয়ার কথা বলোনি। বলেছিলে?’

জামাইয়ের সব কথা কানে এল না। ছেঁড়া ছেঁড়া কিছু শুনতে পেলেন।

‘আমি তো আইনের কথা বলেছি বনি… নারীর সমঅধিকারের কথা… তুমি মেয়ে বলে তোমাকে বঞ্চনা আমি সমর্থন করব না… কোনও নারীর ওপর অন্যায় আমি মানি না… শুধু তুমি নও… টিভির অনুষ্ঠানে কি আমি মুখ দেখাতে যাই?… যাই বলো?… ন্যায়ের কথা বলতে যাই…।’

বনি দাবড়ে ওঠে, ‘বাজে কথা বন্ধ করো। বাবাকে নিয়ে আর পারছি না। খুব জ্বালাতনে পড়লাম। তুমি দাদাকে বুঝিয়ে হাসপাতালে পাঠিয়ে দাও। হাসপাতালে সেজেগুজে দেখতে যাব। না গেলেও কিছু নয়।’

‘খেপেছ? হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তাব দিলেই তোমার দাদা টাকা চেয়ে বসবে। আমার কাছে টাকা কোথায়? তোমাদের ফিফটি আগে পাই তারপর…।’

অন্য সময় হলে এসব কথা শুনে মাথায় আগুন ধরে যেত। ইচ্ছে করত, পিছনে একটা লাথি মেরে জামাইকে বাড়ি থেকে বের করে দিই। যাবার সময় মেয়েকেও গলাধাক্বা লাগাই। জীবনের এই পর্যায়ে কোনও কথাতেই আর রাগ হয় না। এখন আত্মীয়স্বজন, কাছের মানুষের গালমন্দও ভালো লাগে। মনে হয়, সবই মায়া।

বাইরে আলো ফুটছে। ঘরেও আলো এসেছে। পায়ের কাছে জানালাটা খুলে দিতে পারলে ভালো হতো। ঠান্ডা হাওয়া ঢুকত। বুক ভরে শ্বাস নেওয়া যেত। শুধু কাক নয়, আরও নানারকম পাখির ডাক ভেসে আসছে। কোথায় একটা ঘুঘু ডাকছে না? এত সকালে কি ঘুঘু ডাকে? নাকি ভুল শুনছেন? মৃত্যুর দোরগোড়ায় এসে ভুল শোনাটা আশ্চর্যের কিছু নয়। ডান হাতটা খাট থেকে ঝুলে পড়েছে। রমাকান্তবাবু হাতটা তুলতে গেলেন। ঝিনঝিন করে উঠল। ভারী লাগছে। মৃত্যুকালে শরীরের ওজন কি বেড়ে যায়? হতে পারে। আবার না-ও হতে পারে। যে-পেশি দিয়ে নিজের হাতটাকে তুলবেন তার শক্তিও তো ক্ষীণ হয়ে এসেছে। ইস্, কেউ হাতটা তুলে দিতে পারলে ভালো হতো।

এমন সময় গণেশের দিকে আবার নজর পড়ল রমাকান্তবাবুর।

গণেশটা কী করছে? মিটিমিটি হাসছে কেন? এসে হাতটা তুলে দিতে পারে তো? বেটা চেয়ারের হাতলেই বা বসেছে কেন? হারামজাদার বদভ্যাসটা গেল না। কখনও ভদ্র সভ্য হয়নি। স্কুলে এসে বেঞ্চের মাথায় বসত। বাইরে গেলে পাঁচিলের টঙে উঠে পা দোলাত। একবার গাছে বসে পেয়ারা খেতে গিয়ে পড়ে গেল। পা ভাঙল। কোন ক্লাসে যেন? সিক্স? নাকি সেভেন? বকাঝকা কম খায়নি। তাও শিক্ষা হয় না ছেলেটার।

‘কী রে রমা, কেমন আছিস?’

রমাকান্তবাবু একথার জবাব দিলেন না। বিরক্ত গলায় বললেন, ‘চেয়ারের হাতলে বসেছিস কেন? নেমে বস। কেউ দেখলে কী ভাববে।’

গণেশ ফিচ্ করে হেসে বলল, ‘হাতলে বসলেই তো মজা। কেউ দেখলে বয়েই গেছে।’

রমাকান্তবাবু বিড়বিড় করে বললেন, ‘মারব, একটা চড়। এটা তোর নলিনীবালা হাই স্কুলের ক্লাসঘর নয় যে বেঞ্চের মাথায় থাকবি। এটা ভদ্রলোকের বাড়ি।’

গণেশ মাথা কাত করে চোখ পিটপিট করে বলল, ‘ভদ্রলোকটা কে?’

রমাকান্তবাবু চোখ পাকিয়ে বললেন, ‘কেন! তোর কি আমাদের ভদ্রলোক বলে মনে হচ্ছে না?’

গণেশ হাতল থেকে নেমে খাটের পাশে এসে বসল। রমাকান্তবাবু হাঁই হাঁই করে উঠলেন, ‘অ্যাই করিস কী! করিস কী! জুতো পরে রোগীর বিছানায় বসছিস! কোনও কাণ্ডজ্ঞান নেই! জুতো খোল, আগে জুতো খোল। মাধবী যদি দেখে…।’

গণেশ থমকে গিয়ে বলল, ‘উফ্ বড্ড জ্বালাস।’

গণেশ জুতো খুলে খাটের তলায় রাখল। ছোটো মাপের স্কুলের জুতো। ধুলো মাখা। ডান পায়ের বুড়ো আঙুলের কাছে তাপ্পি। গণেশটা বিরাট পাজি। শুধু স্কুলের জুতো নয়, স্কুল ড্রেসও পরে এসেছে। খাকি রঙের হাফপ্যান্ট, নীল রঙের জামা। তার কি অন্য কোনও পোশাক নেই? এত বছর পর বন্ধুর বাড়ি এলি, একটু সেজেগুজে, চুল আঁচড়ে আসতে অসুবিধে কোথায়? বদের ধাড়ি একটা। বেটা খাটে পা গুটিয়ে আরাম করে বসেছে দ্যাখো, যেন একটু পরেই ক্যারাম খেলা শুরু হবে।

রমাকান্তবাবুর গায়ে হাত রেখে নরম গলায় গণেশ বলল, ‘বললি না তো আছিস কেমন?’

রমাকান্তবাবুর রাগ হচ্ছে। এই ছেলে তো মহা ঝামেলা পাকাচ্ছে। একটু পরেই মাধবী ঘরে আসবে। সে এসে যদি দেখে রোগীর বিছানায় কেউ বসে আছে, রাগারাগি করবে। গত মাস পর্যন্ত মাধবী এ ঘরেতেই ক্যাম্প খাট পেতে শুত। ঘুমের অসুবিধে হয় বলে নিজের ঘরে চলে গেছে। ঠিকই করেছে। চার মাস ধরে রাতে রোগীর ঘরে শুয়ে থাকা অসম্ভব। স্বামী হলেও অসম্ভব। ঘণ্টায় ঘণ্টায় ওঠো রে, জল দাও রে, গায়ের চাদর ঠিক করো রে, বুকে পিঠে হাত বুলিয়ে দাও রে, ইউরিন পট ধরো রে, ওষুধ খাওয়াও রে। তাহলে ঘুমোবে কখন? শুভ বলেছিল, ‘এক কাজ করা যাক। মা যখন শুচ্ছে না, আমি একজন নার্সকে বলি। রাতে এসে বাবার ঘরে থাকবে। যদি তোমরা রাজি হও বলতে পারি।’

নার্স মেয়েটি এসেছিল। কম বয়েস এবং দেখতে শুনতে ভালো। ঝুমা তাকে পত্রপাঠ বিদায় করে। স্বামীকে সে বিশ্বাস করে না।

তারপর থেকে রাত একাই কাটান রমাকান্ত। ভালোই লাগে। একা থাকলে, নিজের সঙ্গে মুখোমুখি হওয়া যায়।

গণেশ ঝুঁকে পড়ে বলল, ‘কেমন আছিস বলবি না?’

রমাকান্তবাবু রাগ দেখিয়ে বললেন, ‘দেখতেই তো পাচ্ছিস। বারবার এক কথা জিজ্ঞেস করিস কেন?’

গণেশ হেসে বলল, ‘আমার তো মনে হচ্ছে ভালোই আছিস।’

রমাকান্তবাবু বললেন, ‘অবশ্যই ভালো আছি। একটু শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে এই যা।’

গণেশ বলল, ‘ও কিছু নয়, একটু পরেই ঠিক হয়ে যাবে। আমি যখন জলে ডুবে যাচ্ছিলাম তখনও শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল। পরে ঠিক হয়ে গেল।’

রমাকান্তবাবু বললেন, ‘বুঝলাম। এবার আমার হাতটা তুলে দে দেখি।’

গণেশ হেসে বলল, ‘থাক। খাট থেকে হাত ঝুলিয়ে মরলে একটা নাটক নাটক ভাব হবে।’

রমাকান্তবাবু চোখ পাকিয়ে বললেন, ‘ফাজলামি করবি না গণেশ। ফাজলামির জন্য তোর সঙ্গে কতবার মারপিট করেছি মনে পড়ে? ক্লাস এইটে একবার আমার পেনসিল নিয়ে পালিয়েছিলি। তোকে ল্যাং মেরে ফেলে দিয়েছিলাম। তোর মাথা ফুলে আলু হয়ে গেল। মনে পড়ছে?’

গণেশ হেসে বলল, ‘না, মনে পড়ছে না। আমি তো আর তোর মতো মরতে বসিনি, যে পুরোনো কথা মনে পড়বে।’

ঘরের আলো আরও বেড়ে গেছে। আজ বোধহয় খুব রোদ উঠবে। এও একটা মুশকিল। সবাইকে গরমে বেরোতে হবে। শুভটার আবার অ্যালার্জির ধাত। বেশি গরমে গায়ে অ্যালার্জি বেরোয়। অবশ্য এখন তো ডেডবডি ঘাড়ে করে শ্মশানে নিয়ে যাবার ব্যাপার নেই। কাচে ঢাকা গাড়ি আছে। তাও একটা ছোটাছুটি তো থাকে। ঘর বার করতে হয়।

‘আমার অসুখের খবর তোকে কে দিল গণেশ?’

‘বাবলুদা।’

‘বাবলুদা! হার্ট অ্যাটাকে যে মারা গেছে সেই বাবলুদা?’

গণেশ একটা হাই তুলে বলল, ‘হ্যাঁ। রঞ্জনাও বলল। রঞ্জনাকে মনে আছে? বিষ খেয়েছিল।’

রমাকান্তবাবু একটু চুপ করে থেকে নিচু গলায় বললেন, ‘মনে আছে।’

গণেশ ফিচ করে হেসে বলল, ‘তোর সঙ্গে প্রেম ছিল না? বিয়ে করলি না কেন? বেচারি এভাবে মরত না।’

রমাকান্তবাবু গণেশের দিকে এক মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে বললেন, ‘রঞ্জনা তোকে কিছু বলে?’

গণেশ নাক টেনে বলল, ‘বলে না। তবে বুঝি তোর ওপর খুব অভিমান। পাগলি একটা। সেই কবে কলেজের প্রেম…। এখনও জিইয়ে রেখেছে।’

রমাকান্তবাবু বললেন, ‘ওরা সব আছে কেমন?’

গণেশ বলল, ‘ভালো আছে।’

রমাকান্তবাবু আবার একটু চুপ করে থেকে বললেন, ‘তুই কেন এসেছিস?’

গণেশ সহজ ভাবে বলল, ‘তোকে নিতে এসেছি। অনেকটা পথ। দুজনে গল্প করতে করতে চলে যাব।’

‘তুই কি আমাকে বিকেল পর্যন্ত সময় দিবি গণেশ? বাড়ির সবাই খেয়ে-টেয়ে নিত… সারাদিন ধকল যাবে… বিকেল বিকেল হলে রোদটাও কম হতো…।’

গণেশ বলল, ‘না, মৃত্যু সময় দেয় না। আমাকেও দেয়নি।’

মাধবী ঘরে ঢুকলেন। ঢুকেই থমকে দাঁড়ালেন। কেমন একটা গন্ধ না?

রমাকান্তবাবু হেসে বললেন, ‘এসো মাধবী। তোমার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিই। আমার স্কুলের বন্ধু গণেশ। খুব পাজি। বেটা ক্লাস এইটে পড়বার সময় জলে ডুবে ফট করে মরে গেল। সাঁতার জানত তবু মরল। ডাক্তারবাবু বললেন, গণেশ নাকি সাঁতার দেবার সুযোগই পায়নি। মাঝপুকুরে পেৌঁছোতেই হার্টফেল করে। বেঁচে থাকা কী কঠিন বলো মাধবী। সব আয়োজন, প্রস্তুতি নিয়েও বাঁচা যায় না।’ কথা শেষ করে জোরে হেসে উঠলেন রমাকান্ত। বললেন, ‘যাবার আগে ওকে একটা জোর ধমক দাও তো মাধবী। রোগীর বিছানায় ওঠবার জন্য ওর ধমক খাওয়া উচিত।’

মাধবী চিৎকার করে কেঁদে উঠলেন। তিনি ঘরে ঢুকেই বুঝতে পেরেছেন, রমাকান্তবাবু মারা গেছেন। ঘরে মৃত্যুর মিষ্টি গন্ধ ছড়িয়ে চলে গেছেন।

পরদিন সকালে রমাকান্তবাবুর খাটের তলা থেকে এক জোড়া জুতো পাওয়া গেল। ছোটো জুতো। ধুলোমাখা, ডানপায়ে তাপ্পি।

পড়ার জন্য সীমাহীন গল্প-নিবন্ধসাবস্ক্রাইব