ইতি ঊর্মি

সকাল এখন আটটা। ব্রেকফাস্ট টেবিলে আমার বিপরীতে অমর। আমাদের সংসারের তৃতীয়জন অর্থাৎ ঊর্মি আজ টেবিলে নেই। ঊর্মির কথা মনে পড়তেই ল্যান্ডফোন বিশেষ সুরে বেজে ওঠে। ফোন ধরতেই ও-প্রান্ত থেকে ব্যারিটোন ভেসে আসে এটা কি ঊর্মি দাশগুপ্তর বাড়ি?

—হ্যাঁ, বলছি, জবাব দিই আমি।

—আপনি?

—ওর মা, মিসেস দাশগুপ্ত।

—শুনুন মিসেস দাশগুপ্ত, ময়দান থানা থেকে বলছি, আপনার মেয়েকে সেন্সলেস অবস্থায় ময়দানে পাওয়া গেছে। ওকে আমরা উডল্যান্ডসে ভর্তি করিয়েছি। পকেটে ভাগ্যিস মোবাইলটা ছিল। ওটা থেকেই আপনাদের নম্বর পেলাম। শিগগির একবার নার্সিংহোমে আসুন।

লাইন কেটে যায়।

পুরো ঘটনাটা ভালো করে বুঝে উঠতে আমার বেশ কিছুটা সময় লাগে। গতকাল রাতে ঊর্মি বাড়ি ফেরেনি। থানা, পুলিশ, নার্সিংহোম শব্দগুলি একসঙ্গে আমাকে কিংকর্তব্যবিমূঢ় করে ফেলে। আমি ঘামতে থাকি। ইদানীং সামান্য উত্তেজনাতেই প্রেসারটা বেড়ে যায়।

বিপরীতে বসে থাকা অমর নির্বিকার চিত্তে টোস্টে একটা কামড় বসিয়ে কফির মধ্যে ঠোঁট ছোঁয়ায়। মাথাটা ঝাঁ করে জ্বলে ওঠে। হাতে থাকা স্যান্ডউচটা ধাঁই করে ছুড়ে মারি ওর মুখে। আচমকা আঘাতে অমর ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়। চলকে পড়ে কফি। থতমত খেয়ে বলে, কী-কী মানে কী হল!

—কী হল! তোমার মেয়েকে ময়দানে আনকনসাস অবস্থায় পুলিশ পেয়েছে। ওকে ওরা উডল্যান্ডসে ভর্তি করেছে।

—সে কী! বিস্ময়ে চোখ কপালে ওঠে ওর। বলে, চলো চলো, এক্ষুনি চলো। তাড়াহুড়ো করে উঠতে গিয়ে অমর টেবিলে এমন জোরে ধাক্কা মারে যে টেবিলের কফিমাগ, ব্রেড, ডিমের পোচ, জলের জাগ, ইত্যাদি ছিটকে পড়ে আমার গায়ে।

রাগে পিত্তি জ্বলে যায় আমার। এখন ঝগড়াঝাঁটির সময় নয়। দাঁত কিড়মিড় করে কেবল বলি, আচ্ছা অপদার্থ ব্যাটাছেলে একটা!

—বেবি, ইয়ে মানে, কিছু মনে কোরো না, আমি ইচ্ছে করে…, ঘাবড়ে গেলে তোতলানো অমরের পুরোনো অভ্যাস।

—চোপ, একদম চোপ। এক্ষুনি তৈরি হয়ে নাও। গ্যারাজ থেকে গাড়ি বার করো। আর হ্যাঁ, তোমার ক্রেডিট কার্ড, ঊর্মির মেডিক্লেম কার্ডটা নিতে ভুলো না। যাও শিগগির।

—হ্যাঁ, হ্যাঁ, এই যে যাই, ধ্যাতানি খেয়ে অমর ছোটে। আমিও তৈরি হয়ে নিই চটপট! এমন একটা মানুষের সঙ্গে জীবন কাটানো সম্ভব? অমরটা চিরকাল নার্ভাস। কোনও ঘটনা ফেস করার মতন মানসিক জোর নেই। কী করে অফিস সামলায় কে জানে? ইদানীং একটু ঘাবড়ে গেলেই হুইস্কি নেয়। আর হুইস্কি পান করে আরও বোদাটে মেরে যায়। মাথা একদম কাজ করে না। তখন বলে, বেবি, প্লিজ ডু সামথিং। কী করব বুঝে উঠতে পারছি না। হাত-পা কেমন ঠান্ডা মেরে যাচ্ছে। একটা যা তা।

গাড়ি ড্রাইভ করতে করতে অমর বলে, বেবি, ঊর্মির ইন ফ্যাক্ট কী হয়েছে বলল পুলিশ?

—বলল, ওকে আনকনসাস অবস্থায় ময়দানে আজ ভোরে পাওয়া গেছে। নিশ্চয়ই ভালো কিছু ঘটেনি, জবাব দিই আমি।

অমর খানিক থম মেরে থেকে আচমকা উত্তেজিত কণ্ঠে চেঁচিয়ে ওঠে, এইসব, সবকিছুর জন্য তুমি দায়ী। তুমিই মেয়েটাকে জাহান্নমে পাঠাচ্ছ। উত্তেজনায় লাল হয়ে ওঠে মুখ-চোখ।

আমারও মাথা গরম হয়ে যায়, মুখ সামলে কথা বলো অমর। সাবধানে গাড়ি চালাও। ইদানীং মাঝেমধ্যেই ও কেমন বেপরোয়া ভঙ্গিতে জ্বলে উঠছে। বিয়ের পর প্রথম প্রথম এরকম করত। একবার শ্যামলদাকে দিয়ে আচ্ছা করে কড়কে দিয়েছিলাম। এতদিন ঠিক ছিল। আবার বিগড়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে ওই উকিল বন্ধুটাই মাথা খাচ্ছে ওর। কী সাম চ্যাটার্জী যেন। ওটাকে একটু সাইজ করতে হবে।

গাড়ি পার্কিং লটে দাঁড় করিয়ে ছুটে যাই আমরা। দেখি ক্যালকাটা পুলিশের এক সাবইন্সপেক্টর আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে। সামনাসামনি আসতেই বলল, আপনারা মি. অ্যান্ড মিসেস…

—দাশগুপ্ত, কথা শেষ করি আমি, হোয্যার ইজ আওয়ার চাইল্ড?

—আসুন আমার সঙ্গে, বলে অফিসার লিফটের দিকে এগোন। ওকে অনুসরণ করে একটি কেবিনের সামনে পৌঁছোই, উনি ইঙ্গিতে বোঝান ওটাই ঊর্মির কেবিন। ধন্যবাদ দিয়ে দরজা ঠেলে ঢুকে দেখি ঊর্মি আনকনসাস। পাশে একটি নার্স বসে। আমাদের দেখে উঠে দাঁড়ায়।

দ্রুত ঊর্মির সামনে যাই। ঠোঁট ফুলে উঠেছে, নীলচে বাদামি জমাট রক্ত। গালে, গলায় দাঁতের দাগ, বুঝতে বাকি থাকে না কিছু। অমরের দিকে তাকাই।

—ঊর্মি, মাই চাইল্ড, হাউমাউ করে কেঁদে ঝাঁপিয়ে পড়ে অমর ওর বুকে। কাঁদতে থাকে অবুঝ শিশুর মতো। ওকে টেনে সরিয়ে আনার চেষ্টা করি। নার্স বলে ওঠে, আরে আরে করছেন কী, শি নিডস কমপ্লিট রেস্ট। আপনারা ডক্টরের সঙ্গে দেখা করুন।

—কে দেখছেন ওকে? আমি প্রশ্ন করি। অমর চোখের জল মোছে। ডক্টর সোম। আসুন আমার সঙ্গে, নার্স এগিয়ে যায়। সোম-এর ঘরে নিয়ে গিয়ে প্রাথমিক পরিচয়টুকু দিয়ে ও চলে যায়।

—প্লিজ বি সিটেড। ডক্টর সোম বলেন, আচ্ছা, মি. দাশগুপ্ত, আপনার মেয়ে কোনও ড্রাগস নিত?

অমর বা আমি কেউই এ প্রশ্নের জন্য তৈরি ছিলাম না। দুজনে দুজনার মুখের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালাম। উত্তর আমিই দিলাম, না, সেরকম তো কোনওদিন দেখিনি। এ প্রশ্ন করছেন কেন?

—মেয়েটি ডেডলি আনকনসাস। ওর ব্লাড স্যাম্পল নিয়ে টেস্টের জন্য পাঠিয়েছি। প্রাথমিক পর্যায় জানা গেছে কোনও উচ্চ ক্ষমতাযুক্ত ড্রাগ ওর শরীরে মারাত্মক প্রভাব ফেলেছে। ড্রাগটা ল্যাবে আইডেন্টিফাই করার চেষ্টা চলছে।

—বললাম, আপনি ডাক্তার, আপনার কাছে কিছু লুকোনো উচিত নয়। ইদানীং ঊর্মি ড্রিংকস নিত একটু আধটু। তবে ড্রাগস যে নিত না সে ব্যাপারে আমি শিওর।

—খোঁজ নিন ভালো করে। ওর ঘর সার্চ করুন। বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে কথা বলে দেখুন। আজকালকার হাইপ্রোফাইল অ্যাফ্লুয়েনট ঘরের ছেলেমেয়েরা প্রায়ই এইসব নেশার কবলে পড়ে জীবন শেষ করে ফেলছে। মনে রাখবেন, ইয়োর চাইল্ড ইজ দ্যা মোস্ট প্রেশাস ব্লেসিং অন ইউ। একটা বাচ্চার জন্য চাইল্ডলেস কাপলসরা কী মর্মবেদনায় জ্বলে পুড়ে মরছেন তা তো দেখছি।

আমি চুপ করে থাকি। অমরের অবস্থা বুঝি এক্ষুনি ফেটে পড়বে। ইদানীং আবেগটাবেগ একদম চেপে রাখতে পারে না। স্থান কাল পাত্র বিবেচনা না করেই বার্স্ট করে, অত্যধিক অ্যালকোহল ইনটেকের ফল। কিন্তু মনে যে আশঙ্কা উঁকি মারছে সেটা সম্বন্ধে নিঃসন্দেহ হওয়া প্রয়োজন। বলি, ইজ শি ওকে অ্যাজ আ উয়োম্যান?

ডক্টর সোম কঠিন স্বরে বলেন, আই অ্যাম সরি টু সে মিসেস দাশগুপ্ত, শি ওয়াজ ব্রুটালি রেপড অ্যাজ অ্যান আনফ্রেমড প্রপার্টি। সম্ভবত, বাই আ গ্যাং অফ পার্সনস। আওয়ার এগজামিনেশন ইজ গোয়িং অন।

—ওহ্ মাই গড! শোনামাত্র অমর চেঁচিয়ে ওঠে পাগলের মতো। দুহাতে মুখ ঢাকে। আমার পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যায়। আমার মেয়ে এত বড়ো বোকামি করল? কিন্তু কেন? আমারই মতো ফাস্ট লাইফ চায় ও। হ্যাঁ, ওর চাওয়াকে প্রশ্রয় দিয়েছি আমি। তবে সেজন্য প্রয়োজনীয় সাবধানতা নিতেও কি শেখাইনি ওকে? অমরটা কেঁদেই চলে।

—শান্ত হোন, এ সময় ভেঙে পড়লে চলবে না। ডক্টর সোম বলেন, থানায় যান। পুলিশের সঙ্গে কো-অপারেট করুন। ইয়োর কেস হ্যাজ অলরেডি বিন লজড।

মাথা ঠান্ডা রেখে বললাম, এখন আমাদের কী করণীয়?

—মেডিক্লেম কার্ড আছে নিশ্চয়ই? ওটা রেখে যান, সঙ্গে আপনাদের ভিজিটিং কার্ড। অমর ওগুলি এগিয়ে দেয়, ফের দুহাতে মুখ ঢাকে। বলে, উফ্ আমি, আমি ভাবতে পারছি না।

ডক্টর সোম এগিয়ে এলেন। অমরের কাঁধে হাত রেখে বললেন, ভেঙে পড়বেন না মি. দাশগুপ্ত। ঘটনা এর থেকেও খারাপ হতে পারত। মেয়েকে ফেরত না-ও পেতে পারতেন। দুষ্কৃতিরা ওকে বিক্রি করে দিতে পারত। কিংবা শরীর থেকে অপারেট করে কিডনি, আই, ব্লাড ইত্যাদি বের করে নিতে পারত। ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দিন সেসব কিছুই ঘটেনি। মেয়েকে ফিরে পেয়েছেন আপনারা। নাও প্লিজ গো হোম, অ্যান্ড কিপ ক্লোজ কনট্যাক্ট উইথ আস। ওর জ্ঞান আসলে জানানো হবে।

ডক্টর সোমকে ধন্যবাদ জানিয়ে অমর আর আমি থানা হয়ে বাড়ি ফিরে এলাম। মানসিক ভাবে দারুণ বিপর্যস্ত আমি। ঊর্মির এই মারাত্মক পরিণতিটা মন থেকে কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলাম না।

একটু আগে সন্ধ্যা নেমেছে। এইমাত্র ডক্টর সোম ফোনে জানালেন যে, ঊর্মির জ্ঞান ফিরেছে। বারবার বাবার কথা বলছে। এক্ষুনি ওর চোখের সামনে দুএকটি প্রিয়জনের মুখ বড়ো প্রয়োজন।

সাধারণত অফিস ছাড়তে আমার আটটা-সাড়ে আটটা বাজে। কিন্তু এরকম ফোন পাওয়ার পর আর অফিসে থাকা সম্ভব নয়। গাড়ি নিয়ে দ্রুত নার্সিংহোমের দিকে রওনা দিই।

গাড়ির গতি বাড়ে। বুকটা হু হু করে ওঠে ঊর্মির জন্য। চোখের কোল ভিজে যায়। ওর এই পরিণতির জন্য কি আমি দায়ী? ওকে তো সব সময় বোঝাতাম আমি। তা ছাড়া নিজের ভালো-মন্দ বোঝার মতন বয়স ওর হয়েছে। একুশ বছর বয়স নেহাত কম নয়! মানুষ হতে গেলে যতটুকু প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা প্রয়োজন তাতে খামতি ছিল না। তবু মেয়েটা এমন বেপরোয়া হয়ে উঠল কেন?

—আচ্ছা বেবির কি উচিত ছিল না, একটু সংযত জীবন যাপন করা? নারীমুক্তি নারী স্বাধীনতায় ও বিশ্বাসী। স্বেচ্ছাচারিতাকে ও পলিশড স্বাধীনতার মোড়কে মুড়ে নিয়েছে। মায়ের অসংযত জীবনযাত্রা কি ঊর্মির মনে কোনও প্রভাব ফেলেনি? নিশ্চয়ই ফেলেছে। মা হিসাবে কতটুকু কর্তব্য করেছে বেবি? সেই ছোট্টবেলা থেকে তো মেট্রনের দাযিত্বে বাচ্চা। মাত্র চার মাসের বাচ্চাকে ফেলে অফিস জয়েন করেছিল, আমার বারংবার বারণ সত্ত্বেও। তিন বছর বয়স থেকেই ও ক্রেশে। ক্লাস ওয়ান থেকে রেসিডেন্সিয়াল স্কুলে। বন্ডিংটা তৈরি হবে আর কী করে?

গাড়িটা পার্কিং লটে রেখে চারতলায় ঊর্মির কেবিনে যাই। দরজা ঠেলে ঢুকতেই ঊর্মি, আমার দিকে তাকাল, অস্ফুটে উচ্চারণ করলে, বাপী। বলেই জ্ঞান হারাল।

দ্রুত ওর কাছে যাই। মাথায় হাত বুলোতে থাকি। চোখ দুটো আমার কেন যে এত অবাধ্য?

কতক্ষণ এভাবে কাটে জানি না। ঈশ্বরকে ডাকি, ভগবান, ওকে সুস্থ করে তোলো তুমি। নার্সের তাগাদায় বাইরে আসি। ডক্টর সোমের চেম্বারে যাই। বসুন মি. দাশগুপ্ত, বলেন ভদ্রলোক। এখন কেমন বুঝছেন?

—বেটার দ্যান বিফোর। সকালে বেশ কয়েকবার জ্ঞান এসেছে এবং গেছে। সিডেটিভ দেওয়া হয়েছে মাইল্ড। আমরা চাইছি পেশেন্ট যতটা সম্ভব মেন্টাল রেস্টে থাক। জেগে উঠলেই আতঙ্কে চেঁচিয়ে উঠছে।

—ওর শরীরের ড্রাগটা আইডেন্টিফাই হয়েছে?

—হ্যাঁ, অতি পরিচিত একটা ওষুধ, কমনলি নোন অ্যাজ ক্লাব ড্রাগস। সম্ভবত ওর অজান্তেই ড্রিংকসে কেউ মিশিয়ে দিয়েছিল। শুনলাম ও সেদিন কলকাতার এক ডিসকো ঠেক-এ মাঝ রাত অবধি ছিল।

—ড্রাগটা কি খুব মারাত্মক?

—ইয়েস, ভিক্টিমের বিন্দুমাত্র বাধা দেবার ক্ষমতা থাকে না।

পুলিশ এসেছিল শুনলাম। আমি আবার প্রশ্ন করি।

—হ্যাঁ, ওরা তদন্তের স্বার্থে কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করছিল বলে শুনলাম। আমি তখন ছিলাম না, রাউন্ডে বেরিয়েছিলাম।

—ঊর্মির এ অবস্থায় ওদের অ্যালাউ করলেন কেন? অনুযোগ তীব্র হয় আমার।

—বারণ করে দিয়েছি, পেশেন্ট সম্পূর্ণ সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত ওরা আর ডিস্টার্ব করবে না, বললেন ডক্টর সোম।

—থ্যাংক ইউ ডক্টর।

—ইটস অল রাইট। মনে জোর রাখুন, সব ঠিক হয়ে যাবে। ইট ইজ আ গ্রেট শক ফর হার। শি নিডস প্রপার কাউন্সেলিং। ওকে শারীরিক ভাবে একটু সুস্থ করে সে ব্যবস্থা আমরা করব।

ডক্টর সোমের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ফের ঊর্মির কাছে যাই। ও এখনও অচেতন। মাথায় হাত বুলোই। নীরবে চোখের জল ফেলি। একসময় নার্সিংহামে ছেড়ে গাড়িতে এসে বসি। নিজেকে এত দুঃখিত, এত অসহায় আগে কখনও মনে হয়নি।

ড্রাইভ করতে করতে মনে হয়, ঊর্মিকে বড়ো করে তোলার ব্যাপারে কোথায় যেন একটা ফাঁক থেকে গেছে। আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্যের পিছনে ছুটতে ছুটতে সন্তানকে যথেষ্ট সময় দিতে পারিনি। যদিও মেয়ের এডুকেশনাল ব্যাপারগুলি বরাবরই বেবির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী হয়েছে। বেবির ইচ্ছাতেই ঊর্মি রেসিডেন্সিয়াল স্কুলে। ইউনিভার্সিটিতে পড়াকালীন গার্লস হস্টেলে। ঊর্মি ছুটিতে বাড়ি আসলে বেবি অসন্তুষ্ট হতো।

গাড়িটা ক্লাবে পার্ক করি। আজ আর কারুর সঙ্গে নয়, একা একাই মদ্যপান করব। কোনার দিকে এক টেবিলে বসে দুটি ড্রিংকসের অর্ডার দিই।

ড্রিংকস নিতে নিতে মনে হয়, আমি নিশ্চিত, ঊর্মির আজকের পরিণতির জন্য বেবিই দায়ী। হ্যাঁ ঠিক তাই, বেবিই দায়ী। একবার শক্ত হাতে হাল ধরতে গিয়ে যা অবস্থা হয়েছিল, ল্যাজে-গোবরে একদম। ক্যালকাটা পুলিশের কোন ইন্সপেক্টর নাকি ওর দাদা, সেই দিনটার কথা ভাবলে আজও গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। কী অপমান!

শালা, এমন হড়কানি দিল, পিলে চমকে যাবার জোগাড়। ব্যাটা বলে কিনা, মি. দাশগুপ্ত, আপনার স্ত্রী যে কমপ্লেন দিয়েছেন তাতে এক্ষুনি ফোরনাইনটি এইট-এ ধারায় কেস স্টার্ট করতে পারি, সেটা জানেন কি? অ্যারেস্ট করে আজ সারা রাত লকআপে রাখব, কাল কোর্টে চালান করব। নব্বই দিনের আগে জামিন পাবেন না। আর উনি আমাকে আপনার সম্পর্কে যা যা বললেন, তা যদি কোর্টে বলেন, কম সে কম বছর দশেক জেলের ঘানি ঘোরাতে হবে। যাবেন নাকি?

—কোথায়? সভয়ে প্রশ্ন করি আমি।

—ঘানি টানতে?

আমি চুপ করে থাকি। লজ্জায় মনে হচ্ছে, গলায় দড়ি দিই। নিজের স্ত্রী তার স্বামীর বিরুদ্ধে… উফ্ ভগবান!

শালা আইসি বলে, স্ত্রীকে আর ডিস্টার্ব করবেন না। ওকে ঘাঁটালে কী হতে পারে বুঝতে পারছেন নিশ্চয়ই? যান, বাড়ি যান এখন। কমপ্লেনটা আমার কাছে থাকল, দেখবেন এটা যেন আমাকে ব্যবহার করতে না হয়।

ধ্যাতানি খেয়ে গরুচোরের মতো বাড়ি ফিরে এসেছিলাম সেদিন। সেই থেকে আর কোনওদিন বেবির সঙ্গে আমার সংঘর্ষ হয়নি। আমি আমার মতো থাকি, ও ওর মতো। বেবি কী একটা এনজিও চালায়। তাছাড়া নানারকম মিটিং-ফিটিং নিয়ে ব্যস্ত থাকে। বছর খানেক কথাবার্তা বন্ধ ছিল। পরে বন্ধুবান্ধব, লোকজনের নিন্দামন্দের কথা ভেবে আমাকে আপস করতে হল, বিশেষ করে ঊর্মির মুখ চেয়ে। ঊর্মি তুই কি বুঝবি না মা, আমার যন্ত্রণার কথা? এই নীরব রক্তক্ষরণের কথা? চোখ ফেটে জল আসে আমার।

—স্যার, আর কিছু? দেখলাম অর্ডার নেওয়ার জন্য ছেলেটি আগ্রহী চোখে তাকিয়ে টু মোর প্লিজ, জবাব দিলাম আমি। বেয়ারা সোডা বরফ মিশিয়ে ড্রিংকস তৈরি করে দিল। গেলাসে ঠোঁট ঠেকাই আমি। আমার মনে হয়, বেবির সঙ্গে দাম্পত্যের এই ফাটলের প্রভাব আমি কোনওদিন ঊর্মির ওপর পড়তে দিইনি। আমার কর্পোরেট লাইফের তুমুল ব্যস্ততার মধ্যেও যখন যতটা পেরেছি সময় দিয়েছি ওকে।

আশ্চর্য! গত তিন-চার বছরে ঊর্মি কত দ্রুত বদলে গেল! যা সব বন্ধুবান্ধব জুটল। কী তাদের অদ্ভুত সাজগোজ, কানে দুল, নাকে দুল, চুলে রং। ঊর্মিকে কত বুঝিয়েছি, যে-ফাস্ট লাইফ তুমি লিড করছ, ইটস নট অফ ইয়োর কালচার। টেক ইয়োর লাইফ সিরিয়াসলি, সব সময় সাবধানে থাকবে। একজন প্রাপ্তবয়স্কা মেয়েকে বাবা হিসাবে এর বেশি আর কী বলা যায়?

বছর খানেক হল ঊর্মি কেন সাইলেন্ট হয়ে গেছিল। প্রশ্ন করলে কোনও উত্তর দিত না। বকাবকি করলেও কোনও প্রতিক্রিয়া ছিল না। কেবলই হাত খরচের টাকা বাড়াতে বলত। একুশ বছরের একটি মেয়ের পাঁচ হাজার টাকা হাত খরচে পোষায় না? কী করে ও অত টাকা নিয়ে একটা কল সেন্টারে কাজ করে, শুনেছি। ওখানে মাইনেপত্তর ভালো। এত টাকা উড়িয়ে কী সুখের সন্ধানে তুই মেতে ছিলি মা? একটিবার আমার কথা ভাবলি না?

কিন্তু সেদিন ডিসকো ঠেক-এ ঊর্মিকে কারা নিয়ে গিয়েছিল? কে ওর ড্রিংকসে ক্লাব ড্রাগস মিশিয়েছিল? এভাবে কারা রেপ করল ওকে? পুলিশ কি পারবে কালপ্রিটগুলোকে ফিক্স আপ করতে? হাজার প্রশ্নেরা আমাকে তাড়া করে। পাগলা কুকুরের মতো আমার ভিতর ছুটতে থাকি আমি। উত্তেজনায় মদের মাত্রা বাড়ে। এক সময় সব কেমন জেবড়ে যায়।

শ্রদ্ধেয় বাবা ও মা,

এ চিঠি যখন তোমরা পাবে আমি তখন অনেক অনেক দূরে। এখন রাত্রি তিনটে। একটু আগে ঘুম ভেঙেছে। বোধ হয় ঘুমের ওষুধের ক্রিয়া শেষ। আজ ষষ্ঠ দিন। শরীরের ব্যথা অনেকটা কমেছে, বেশ সুস্থ বোধ করছি। কয়েকটি ক্ষত থেকে যাবে মনে হচ্ছে।

এ কয়দিনে আমাকে নিয়ে পেপারে যা লেখালেখি হয়েছে তাতে পাড়ায় মুখ দেখাতে পারব না। তাই এ-পাড়া ছেড়ে চলে যাব মনস্থ করেছি। যাবার আগে তোমাদের সব জানানো উচিত বলে লিখে যাচ্ছি এ চিঠি।

কীভাবে যে এত সব ঘটে গেল বুঝতে পারলাম না। রাত দশটা থেকে এগারোটার মধ্যে কোনও না কোনও পরিচিত মুখ পেয়ে যাব এই আশায় ডিসকো ঠেক-এ আমি গেছিলাম। এক পেগ হুইস্কি নেবার পর ইচ্ছা করল একটু নাচতে। ডান্স ফ্লোরে একটা ছেলে হেসে নাচতে ডাকে। ছেলেটা স্মার্ট। নাচতে নাচতেই পরিচয় দেয়, ওর নাম জাভেদ। নিউ মার্কেটে ওর নাকি লেদার গুডসের দোকান আছে।

নাচ শেষ করে একটু দম নেবার জন্য বসি। আর একটা পেগের অর্ডার দিই। আমার সামনে এক জোড়া ছেলে মেয়ে দারুণ নাচছিল। সম্ভবত সেই সময়ে পাশে থাকা চাপ দাড়িওলা লোকটা আমার ড্রিংকসে কিছু মিশিয়ে দিয়েছিল। আশ্চর্য, তাতে ড্রিংকসের স্বাদ, গন্ধ, বর্ণের বিন্দুমাত্র পরিবর্তন হয়নি।

পরের গান শুরুর মুহূর্তে আমার মনে হয়, মাথাটা কেমন ঝিমঝিম করছে। ক্রমশ বনবন করে ঘুরতে থাকে মাথাটা। দাঁড়িয়ে থাকা অসম্ভব হয়ে পড়ে। চোখের সামনে চারপাশ দ্রুত ঝাপসা হয়ে আসে। খেয়াল হয়, জাভেদ, পাশের চাপদাড়ি, আরও দু-তিনজন ছুটে এসেছে আমাকে সাহয্যের জন্য। ধরাধরি করে আমাকে কোথাও নিয়ে যেতে চায়। বিপদ বুঝতে পেরে আমি প্রাণপণে বাধা দিতে থাকি, চেঁচাতে থাকি, হেল্প, হেল্প। অনেক কিছু বলতে চেষ্টা করি। কিন্তু গলা দিয়ে কোনও শব্দ বের হয় না। টের পাই প্রতিরোধের সমস্ত শক্তি দ্রুত হারিয়ে ফেলছি। ছেলেগুলোর কথা কানে আসে ভাসা ভাসা, হঠ যাইয়ে হঠ যাইয়ে সামনে সে। মাই সিস্টার ইজ ফিলিং সিক।

আশ্চর্য! কেউ ওদের কোনও বাধা দিল না। সবাই নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত। যতদূর মনে পড়ে ওরা পাঁচজন আমাকে লিফটে করে নামিয়ে ধরাধরি করে একটা বড়ো গাড়িতে তোলে। বোলেরো কিংবা টাটা সুমো হতে পারে। একজন বলল, জলদি ভাগ হিয়াসে।

গাড়ি প্রচণ্ড গতিতে ছুটছিল। গাড়ির মধ্যেই ওরা আমার শরীর থেকে জামাকাপড় টেনেহিঁচড়ে খুলছিল হিংস্র ভাবে। জানোয়ারগুলো ক্ষুধার্ত নেকড়ের মতো কাড়াকাড়ি করে ছিড়েখুঁড়ে খেতে চাইছিল আমার দেহ। একজন জিন্সটা খোলার চেষ্টা করছিল। আমার বিন্দুমাত্র প্রতিরোধ ক্ষমতা তখন নেই। ক্রমশ জ্ঞান হারালাম। যখন জ্ঞান হল, দেখি আমি নার্সিংহোমে। পুরোপুরি শেষ হয়ে গেছি।

বাবা, তোমার যন্ত্রণা আমি বুঝি। এও বুঝি তুমি নিজেকে কতটা অসহায় বোধ করো। তোমার প্রতি আমার কোনও অভিযোগ নেই। তোমার আর মায়ের মধ্যে যে বিরাট এক শূন্যতা তা আমাকে বারবার কষ্ট দিয়ে এসেছে। জানি এতে তোমার কোনও দোষ নেই। কেন যে এত মদ খাও তাও বুঝেছি। তবে এত মদ খেও না বাবা। অন্তত আমার কথা ভেবে মদ খাওয়াটা কমাও।

আমার দুঃখ কেবল একটাই তোমরা আমার যন্ত্রণার খোঁজ কখনও নাওনি। আমার মনে পড়ে না, তোমরা দুজন একসঙ্গে স্কুলে আমাকে দেখতে এসেছ কখনও। জীবনে কোনওদিন একসঙ্গে আমাকে বেড়াতে নিয়ে গেছ। যে কটা জন্মদিন পালন করেছ, সেগুলিও কেমন যেন মেকি, ফাঁকা ফাকা, এলোমেলো।

মা, তোমাকে বলি, আমাকে তুমি কোনওদিন ভালোবাসোনি। চিরকাল নিজেকেই ভালোবেসেছ। নিজের সুখ, নিজের ভোগ নিয়ে মত্ত থেকেছ। তোমার বহু ঘটনার সাক্ষী আমি নিজে। সেসব কথা এখানে লিখতে চাই না। তবে বলতে লজ্জা নেই, পুরুষের প্রতি আসক্তি তোমার আজও কমেনি।

মা, তুমি আমার জন্য যতটুকু করেছ তা কেবল মিনিমাম কর্তব্যবোধ। আমার এই ছোট্ট জীবনে যতটুকু উপলব্ধি করেছি তাতে মনে হয়, দাম্পত্যে যদি ভালোবাসা না থাকে সেক্ষেত্রে তাদের সন্তান নেওয়া কোনওদিনই উচিত নয়। তুমি এ ঘটনার পর যে কবার দেখা করতে এসেছ, কেবল একটা কথাই জিজ্ঞাসা করেছ, আমার মেয়ে হয়ে তুই এত বড়ো ভুল করলি কী করে? মা, কীভাবে তোমাকে বোঝাই যে, ইট ওয়াজ অ্যান অ্যাক্সিডেন্ট।

বাবা, তুমি চিরকালই আমাকে বড়ো ভালোবাসো। তবু চিরকালই কেন যেন আমি নিজেকে খুব একা বলে বোধ করেছি। আজ তোমার মধ্যে আমি নিজের অসহায়তা, একাকিত্ব, যন্ত্রণা সব উপলব্ধি করতে পারছি বাবা।

বাবা, কাল তুমি এসেছিলে। বারবার আমার হাতখানা ধরে বলেছ, তোকে বাঁচতে হবে মা, বাঁচতে হবে নতুন করে। এসব দুর্ঘটনা ভুলে, এ থেকে শিক্ষা নিয়ে উঠে দাঁড়াতে হবে তোকে। জীবনে তুই যত বড়ো পথ দেখেছিস, জীবন তার থেকে অনেক অনেক বড়ো।

নিজের ভুল আমি বুঝতে পেরেছি বাবা। বুঝেছি, মুহূর্তের অসাবধানতা আগুনের ফুলকির মতো জ্বালিয়েপুড়িয়ে ছারখার করে দিতে পারে জীবন। তবে আমি বাঁচব বাবা। অন্তত একটি বার প্রাণপণে বাঁচার চেষ্টা করব আমি।

এ মুহূর্তে আমার মুখময় অন্ধকার। এখানে থাকা আমার পক্ষে অসম্ভব। তাই এখান থেকে অনেক দূরে চলে যাচ্ছি আমি। কোনও নতুন শহরে নতুন করে জীবন গড়ে তুলতে চাই। যেখানে আমার চারপাশে থাকবে না কোনও পরিচিত লোকজন, থাকবে না এই কালিমাখা অতীত।

তোমরা আমার খোঁজ কোরো না। প্রয়োজনে আমিই তোমাদের খোঁজ নেব। বিদায়, ভালো থেকো তোমরা। বাবা, আমার জন্য চোখের জল ফেলো না। তোমার কথাকে সম্মান দিয়ে যদি নতুন করে নিজেকে গড়ে তুলতে পারি তবেই ফিরব, নতুবা নয়।

প্রণাম

ইতি,

তোমাদের ঊর্মি।

চিঠি শেষ। ভোরের আলো উঠি উঠি। ব্যাগ গোছানোই আছে। বাবা-মা নিশ্চয়ই এখন গভীর ঘুমে। বাড়ির পিছনের গেট খুলে নিঃশব্দে পথে নামে ঊর্মি।

ক্রমশ ভোর হচ্ছে। ভোর এত সুন্দর! এত স্নিগ্ধ! পাখিরা ডাকছে। সকালের প্রশান্তি তার হৃদয়ে ছড়িয়ে দিচ্ছে এক আশ্চর্য অনুভব। সামনে দূরের আকাশ, ক্রমশ লাল হয়ে উঠেছে ওটা।

আমেরিকান ডায়মন্ড

সরলা মাসি একেবারে খাঁটি বাঙাল। খাসা হাতের রান্না। ‘বাঙালরা আনাজপাতির খোসাও ছাড়ে না’ কথাটা ব্যাঙ্গাত্মক শোনালেও, কোনও ঘটি মাইয়ার পক্ষে ওই খোসাকেই অতুলনীয় সুস্বাদু করে তোলা প্রায় অসম্ভব। আমার রান্নার লোক। বহুদিন হয়ে গেল রয়েছে এবাড়িতে। তার টানটান বাঙাল ভাষার সঙ্গে রসিকতা তো তুলনাহীন। বেশ মজায় কাটে সকালটা। সেদিন সকালে রান্নাবান্না নিয়ে মাসির সঙ্গেই কথা বলছি, সেই সময় পাশের বাড়ি থেকে সোমার চিৎকার, ‘কেয়া আছিস? আয় শিগগির একটা জিনিস দেখে যা।’

ক্ষণিক বিলম্ব না করেই জবাব দিলাম, ‘আসছি আসছি।’ কারণ, খুব ভালো করেই জানি সাড়া না দিলে এক্ষুনি বাড়িতে চড়াও হবে। কালই মুম্বই থেকে ওর বর ফিরেছে। নিশ্চয়ই ওর জন্য অনেক কিছু এনেছে। সেটা দেখানোর জন্যই এত তৎপর। যাবার জন্য উঠে দাঁড়াতেই মাসি বেশ মজা করেই বলল, ‘যাও তোমারে হোয়াগ কইরা ডাকতাসে, কত কী দ্যাহাইব।’

‘ওঃ মাসি তুমিও না। ও যদি একটু দেখিয়ে শান্তি পায়।’

‘যাও যাও। তোমারে কেডা আটকাইতাসে।’

খানিক হেসে বললাম, ‘ঠিক আছে তুমি রান্না করো। আমি আসছি।’

সোমার বাড়িতে ঢোকা মাত্রই একপ্রকার পাকড়াও করে সোফায় নিয়ে গিয়ে বসিয়েই হাতে একটা সালোয়ার কামিজ ধরিয়ে দিয়ে বলল, ‘দ্যাখ কী সুন্দর, না?’

‘দারুণ রে, কাপড়টাও খুব ভালো। কৌশিক এনেছে না?’

‘আর কে আনবে বল? ওই একজনই তো আছে আমার ডার্লিং। দ্যাখ না এইবার তো তিনটে নাইটিও নিয়ে এসেছে। এটা তো আমি কাল রাতেই পরেছিলাম। কী সেক্সি না।’ সোমার চোখেমুখে খুশি ফুটে উঠল। ‘মাসে একবারই তো বাড়িতে আসে। যা যা নিয়ে আসে সব ওকে পরে পরে দেখাতে হয়, না হলেই তেনার মুখভার।’

‘তবে একটা কথা মানতেই হবে কৌশিকের আনা নাইটিগুলো সত্যিই অন্যরকম। এগুলো পরলে অটোমেটিক একটা রিচ লুক চলে আসবে।’ হাসতে হাসতে বললাম বটে, কিন্তু কেন জানি না খটকা একটা ছিলই। আমরা যে-স্ট্যান্ডার্ডে বিলং করি সেখানে এইধরনের ড্রেস একেবারেই খাপ খায় না। যে-কোনও কিছুর জন্যই যথাযথ পরিবেশ থাকাটা জরুরি। সেই পরিবেশ আমাদের মতো মধ্যবিত্ত ফ্যামিলিতে কোথায়? ছোট্ট পরিসরে ফ্যামিলির সঙ্গে থাকতে গেলে এমন ভাবনাই ভুল। সেখানে কৌশিকের এমন পছন্দ…! ওর ব্যাকগ্রাউন্ডও তো তেমন সাউন্ড বলে মনে হয় না যে বলব,

বংশপরম্পরায় পাওয়া। তারপরেই মনে হল দূর এসব কী নিয়ে পড়লাম আমি, নিজেকে সংযত করলাম।

সোমা তখনও স্বামীর নাম জপে চলেছে। সেই সময় আমার বাড়ির টেলিফোনটা বেজে উঠল। বাড়ি যাওয়ার একটা ছুতো পেয়ে গেলাম। ‘আমি আসি রে। কে ফোন করছে কে জানে। মাসিও তো রান্না সেরে বাড়ি ফিরবে। সব দেখে-টেখে নিই। যাই।’ বলেই বেরিয়ে এলাম। বাড়ি ঢুকতে ঢুকতেই ফোনটা কেটে গিয়েছিল।

ফিরে আসার পরেও মনটা ওই নাইটির মধ্যেই আটকে রইল। শুধু কেন কেন কেন – মনের মধ্যে হাজারো প্রশ্ন। স্বামীর এত প্রশংসা – কেন কী দেখাতে চায় ও? ওর স্বামী ওকে কত ভালোবাসে, নাকি কৌশিক এখন অনেক টাকা রোজগার করছে, সেটা জানানোটাই প্রধান উদ্দেশ্য।

কদিন আগেও তো কৌশিক স্টেজ-শো করে বেড়াত। সুদর্শন হওয়ার সুবাদে দু-একজন পরিচালকের দয়ায় সিরিয়ালে ছোটোখাটো রোলে অভিনয় করত। হঠাৎ বউয়ের কথা শুনে নতুন ব্যাবসা শুরু করে এত টাকা উপায় করে ফেলল যে, ঘরের প্রয়োজনীয় আসবাব থেকে শুরু করে গাড়ি পর্যন্ত কিনে ফেলল।

ভাবনায় এতটাই মশগুল হয়ে গিয়েছিলাম যে, বুঝতেই পারিনি, মাসি এর আগেও আমাকে ডেকেছে। এবার বেশ জোরেই বলে উঠল, ‘কী ভাবতাস কও তো। তহন থেইকা ডাকতাসি।’

‘ও! হ্যাঁ হ্যাঁ। বলো কী বলছ?’

‘কইতাসি, রান্না হইয়া গেসে। আমি আইতাসি।’

দুপুরে খাবার পর শুয়ে শুয়ে টিভিতে খবর দেখছি, ফোনটা আবার বেজে উঠল। রিসিভার তুলে ‘হ্যালো’ বলতেই ওপার থেকে ভেসে এল খুনশুটি মেশানো স্বর, ‘হাই জানু, কী করছ?’

‘আরে টিভি দেখছিলাম…’ কথা শেষ হওয়ার আগেই ওপার থেকে বলতে শুরু করল, ‘টিভির দোহাই কেন দিচ্ছ ডিয়ার, বলোই না অজিত ছাড়ছিল না, তাই ফোন ধরতে এত দেরি করলে।’ স্বভাবসিদ্ধ ভাবেই বলে যাচ্ছিল রাইমা।

‘রাইমা, সত্যি তুই আর শোধরালি না।’

‘শোধরাতে চাইলে তবে না শোধরাব। মুম্বইতে এসে তো আরও বিগড়ে গেছি। তুইও আয় তোকেও বিগড়োনোর সব পথ বাতলে দেব। অ্যায়েশ কাকে বলে দেখবি তখন।’

‘কী করে যাব বল। জানিসই তো অজিতের ব্যাবসার চক্বরে এখন আর কোথাও যাওয়া হয়ে ওঠে না। এখন তো বিজনেসের খানিকটা দায়িত্ব আমার কাঁধেও চাপিয়ে দিয়েছে। সময়ের অভাবে এখন আর স্ক্রিপ্টও লিখতে পারি না।’ মনটা খারাপ হয়ে গিয়েছিল আমার।

‘ডোন্ট ওরি কেয়া, ম্যায় হু না। সামনের মাসেই কলকাতায় আসছি। তোকে দিয়েই পুরো স্ক্রিপ্ট লেখাব ভেবেছি। কলকাতায় তো সময় দিতে পারবি নাকি?’

‘আরে হ্যাঁ হ্যাঁ এখানে হলে আমি ঠিক সময় বার করে নেব। তুই শুধু জানাস কবে আসবি, সেইমতো তোর থাকার ব্যবস্থা করব আমি।’ এক ঝটকায় মনটা ভালো হয়ে গেল।

‘না না, আমি হোটেলেই থাকব। কেন আমার আনন্দটা মাটি করতে চাইছিস বলতো।’ বেশ অবাক হয়েই বললাম, ‘মানে। ঠিক বুঝলাম না।’

‘জীবনকে কীভাবে উপভোগ করতে হয়, সেটা এখনও শিখিসনি তুই।’

‘তুই কী বলছিস কিছুই বুঝতে পারছি না।’ বোকার মতো বলে বসলাম।

‘স্টুপিড কোথাকার। তোকে বুঝতেও হবে না। যখন কলকাতায় আসব সময় নিয়ে তোকে সব বোঝাব। চল ফোন রাখছি। আমার স্পেশাল খাবার এসে গেছে।’

‘স্পেশাল খাবার! হ্যাঁ তো ঠিক আছে না খেতে খেতেও তো…’ ততক্ষণে ফোনটা কেটে গেছে। রাইমাটা কী যে করে! যাকগে আমার জন্য এটাই ভীষণ খুশির খবর যে, ও কলকাতায় আসছে। হিন্দির পাশাপাশি বাংলাতে অনেক সিরিয়াল, টেলিফিল্ম বানিয়েছে ও।

সাত বছর আগে সেই যে সিরিয়ালের শ্যুটে মুম্বই গেল, ওখানকার হয়েই থেকে গেল। মাঝে ওর বাংলা সিরিয়ালের জন্য বার চার-পাঁচেক স্ক্রিপ্টও লিখেছি। তখন থেকেই আমাদের বন্ধুত্ব। অনেকে তো ভাবত, আমরা দুই বোন। আজ ও উচ্চতার শিখরে পৌঁছে গেছে। একডাকে সবাই চেনে। বলা যেতে পারে সেলিব্রিটি। এত কিছুর পরেও কিন্তু আমাকে ভোলেনি। ওখানে গিয়ে বহুবার আমাকে ডেকে পাঠিয়েছে, কিন্তু সংসারের জন্য সম্ভব হয়নি। এখন যখন রাইমা এখানে আসছেই, কাজের জন্য বেশ কিছুদিন থাকার প্ল্যানও আছে, তখন আমারও কাজ করতে অসুবিধা নেই।

সেইদিন রাতেই অজিতকে, রাইমার শহরে আসা থেকে আমার স্ক্রিপ্ট লেখা সব কিছুই জানালাম। আনন্দে উচ্ছ্বসিত অজিত, আমার হাতদুটো ধরে বলেছিল, ‘বিশ্বাস করো কেয়া, আমি বুঝতে পারছিলাম, আমার ব্যাবসার চক্বরে তোমার ট্যালেন্ট চাপা পড়তে বসেছে। হয়তো তোমাকে বলতে পারিনি, মনে মনে ভীষণ অনুশোচনা হতো। যাক, আজ আমি খুব খুশি।’

এখন শুধু রাইমা আসার অপেক্ষা।

দিনকতক পরে শহরে পৌঁছে একটি পাঁচতারা হোটেলে উঠল সে। হোটেলে চেক-ইন করার পরেই ফোন করে ডেকে নিল আমাকে। তৈরি হয়ে বেরোতে যাব, সেই সময় সোমা এসে হাজির। ঘরে ঢুকে কোনও দিকে না দেখেই হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে বলল, ‘দ্যাখ, আংটিটা। কাল শপিং করতে গিয়েছিলাম। সামনে জুয়েলারি শপ দেখে লোভে পড়ে ঢুকে গেলাম। কিনে ফেললাম আর কী। কেমন হয়েছে রে?’

কোনওরকমে দেখে বললাম, ‘ভালো হয়েছে।’

আমার দেখার ধরনটা ঠিক ওর পছন্দ হল না। মুখটা কেমন একটু বাঁকিয়েই বলল, ‘কোথায় এমন যাচ্ছিস যে একটু ভালো করে দেখবি সেই সময়ও নেই তোর।’

‘হ্যাঁ সত্যিই সময় নেই রে। সিরিয়ালে স্ক্রিপ্ট লেখার একটা কাজ পেয়েছি। প্রোডিউসারের সঙ্গেই দেখা করতে যাচ্ছি। সরি রে আমি ফিরে তোর সঙ্গে কথা বলব।’

জানি এসব টিভি সিরিয়াল, অ্যাক্টিং ওর একেবারেই পছন্দের নয়। সেই কারণেই কৌশিকের পিছনে সর্বক্ষণ পড়ে থাকত। এসব ছোটোখাটো কাজ ছেড়ে যাতে মোটা টাকা উপার্জন করতে পারে, সেরকম কাজ করার কথাই বলত। আজ অবশ্য প্রপার্টি ডিলিং-এ ভালোই ইনকাম করছে সে। সোমার খুশি থাকার কারণই হল তাই। কৌশিক সোমাকে এত টাকা দেয়, যখন যা খুশি কিনে ফেলে।

‘অজিতদা জানে যে তুই…’

দরজায় তালা দিতে দিতেই বললাম, ‘আরে হ্যাঁ হ্যাঁ।’ সোমা মুখ ব্যাজার করে চলে গেল। আমিও তর্কে না জড়িয়ে হোটেলের দিকে রওনা দিলাম।

হোটেলে পৌঁছেই দেখলাম রাইমাকে ঘিরে সাত-আটজন বসে রয়েছে। আমাকে দেখেই উঠে এসে জড়িয়ে ধরে স্বাগত জানাল সে।

‘হাই, মাই সুইটহার্ট… অনেকদিন পর দেখা হল আমাদের।’

‘সত্যিই অনেকদিন হয়ে গেল। তোকে ভীষণ মিস করতাম।’

‘ওহ্ রিয়েলি, সো সুইট। আয় বস।’ ওর পাশেই বসাল আমাকে।

‘আলাপ করিয়ে দিই, এ হল আমার সুইটহার্ট, কেয়া। আমার অনেক দিনের পুরোনো বন্ধু আর খুব ভালো রাইটারও… দশ বছর তো হয়েই গেছে না আমাদের বন্ধুত্বের… কী রে কেয়া তাই তো?’

হেসে উত্তর দিলাম, ‘বেশি হবে।’ সবার চোখেই তার প্রতি বেশ একটা সমীহ নজরে পড়ল।

‘কেয়া, ইনি হলেন ডাইরেক্টর বিনয়, ইনি মিউজিক ডিরেক্টর শতদ্রু। আর এরা রাহুল, সুমিত, প্রিয়ংকা আর শামসের। এরা সবাই শিল্পী তো বটেই, সঙ্গে আমার সমস্ত কাজ এরাই দেখাশোনা করে। আমাকে কিছু করতেই দেয় না।’

বুঝতেই পারলাম এরা সবাই রাইমার সহকারী। ‘রাহুল খাবারদাবারের ব্যবস্থা করো। অর্ডার দেওয়া হয়েছে তো?’ প্রশ্ন করল রাইমা।

‘হ্যাঁ, ম্যাডাম এক্ষুনি চলে আসবে।’

মিনিট চল্লিশ পর খাওয়াদাওয়ার শেষে রাইমা সবাইকে সবার কাজ বুঝিয়ে বাইরে পাঠিয়ে দিল। ঘরে এখন ও আর আমি। ‘দ্যাখ পরের সিরিয়ালে আমি বাছা বাছা অভিনেতা-অভিনেত্রীদের নিয়ে কাজ করার কথা ভাবছি। সেইমতো কথাও হয়েছে কয়েকজনের সঙ্গে। সুতরাং স্ক্রিপ্ট-টা কিন্তু ফাটাফাটি হওয়া চাই।’ ওর কথা বলার স্টাইল দেখেই মনে হল ও ওর কাজের প্রতি কতটা যত্নশীল।

ওর দিকে অবাক হয়ে তাকিয়েছিলাম। তারপর কিছু রিসার্চ পেপার দিল আমাকে, যেগুলোকে বেস করেই স্ক্রিপ্ট তৈরি করতে হবে আমাকে।

ওর কথা শেষ হয়ে যাওয়ার পর বলেই ফেললাম, ‘এই কয়েক বছরেই ইন্ড্রাস্ট্রির খুঁটিনাটি সব কিছু বিষয়ে দারুণ অভিজ্ঞ হয়ে গেছিস।’

‘ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ করব আর সেই জায়গা সম্পর্কে অভিজ্ঞতা থাকবে না তা কখনও হয় বল? তুইও আমার সঙ্গে থাক, তোকেও সব শিখিয়ে-পড়িয়ে নেব।’ বলেই আমার দিকে তাকিয়ে রইল।

‘মনেই হচ্ছে না যে, তুই আমার সেই পুরোনো বন্ধু রাইমা।’

‘মনে হবে কী করে। আমি তো সত্যিই আর আগের মতো নেই।’ কথাটা শেষ করে আবার হেসে ফেলল সে।

‘আচ্ছা ঠিক আছে, এসব প্রসঙ্গ ছাড়। বলতো, অজিত তোর ঠিকঠাক দেখাশোনা করে তো?’

ওর চোখের দুষ্টু চাহনি দেখেই বুঝেছিলাম, এবার আমাকে রাগাবার ধান্ধায় আছে।

বললাম, ‘খুব ভালো করেই দেখাশোনা করে, খেয়াল রাখে…, আমাকে দেখে কী মনে হচ্ছে না?’

‘আচ্ছা আর একটা কথা বল?’ ঠোঁটের কোণায় সেই শয়তানি হাসি।

‘আবার কী?’ বেশ বিরক্ত হয়েই বললাম।

‘না, বলছি রোজরোজ একই মাছের ঝোল-ভাত খেয়ে তুই বোর হয়ে যাস না। না মানে, নতুন কিছু খেতে ইচ্ছে করে না তোর?’

‘এই, তোর এই কথাগুলোই আমার ভালো লাগে না। ভালো কিছু বলতে পারিস না?’

‘দ্যাখ সেটাই তো বলছি, আমার একই কথা যেমন তোর ভালো লাগে না, সেইরকমই রোজরোজ একই জিনিস… মনে হয় না, নতুন কিছু করে দেখাই? বিলিভ মি, এই বিন্দাস লাইফ উপভোগ করতে শিখেছি মুম্বই গিয়ে। এখানে তো বেশিরভাগই মুখোশধারী।’ কথার মাঝেই ফোনের কি-বোর্ডে তার ফাইলকরা নেলপেইন্ট লাগানো আঙুলগুলো খেলা করে বেড়াচ্ছিল। আধুনিক জীবনের জনসংযোগ ব্যাবস্থা।

‘দ্যাখ সেই সকালে এসেছি, এখন সন্ধে হয়ে গেছে। কত কাজ, ক্লান্তি আসাটাই তো স্বাভাবিক বল। এখন মাইন্ড রিফ্রেশ করার জন্য তো আর জয়পুর থেকে বরকে আসতে বলতে পারি না। যখন খিদে পায়, তখনই খাওয়া উচিত, বাড়ি ফিরে ঘরের খাবারই খাব এটা তো অযৌক্তিক ভাবনা, তাই না। বল এব্যাপারে তোর কী অভিমত।’

‘রাইমা, ক্ষ্যামা দে বাবা। ওহ্ তুই আর তোর চিন্তাভাবনা।’ আমার কথা শেষ হওয়ার আগেই দরজায় নক করে রাহুল ভিতরে এল।

‘বলুন ম্যাডাম।’

‘জয় কোথায়?’ বলেই আগ্রহী ভাবে দরজার দিকে তাকিয়ে রইল।

‘জয় পরশুদিনের শুটিং-এর প্রয়োজনীয় কিছু জিনিস আনতে গেছে। মিনিট পাঁচেক আগেই ফোন করেছিল। আসার সময় হয়ে এসেছে।’

‘ঠিক আছে। এলেই আমার কাছে পাঠিয়ে দিও। তুমি একটু ড্রিংকস বানাও।’

‘ঠিক আছে ম্যাডাম।’ বলেই সে তার কাজে লেগে গেল।

রাহুলকে ড্রিকংস বানাতে বলার পর মুচকি হেসে হঠাৎই আমাকে প্রশ্ন করে বসল, ‘এনজয় করেছিস কখনও? জীবন কাকে বলে জানিস?’

‘এ আবার কেমন কথা হল! গতবারই তো গৌহাটিতে গিয়ে দারুণ মজা হল। অজিত, আমি, মা, বাবা, অজিতের বন্ধুর ফ্যামিলি।’

রাইমা মাথা চাপড়ে বলল, ‘ধ্যাত তেরি কা। তোর দ্বারা কিস্সু হবে না।’ রাহুল ততক্ষণে ড্রিংক তৈরি করে দিয়ে চলে গেছে।

‘চল আজ আমরা দুজনে একসাথে জীবনটা উপভোগ করব।’ বলেই রাইমা আমার হাতে একটা আলতো চাপ দিল।

‘মানে!’ বিস্ময় ভরা নজরে তাকিয়ে থাকলাম ওর দিকে।

‘জয় বলে যে-ছেলেটাকে ডেকে পাঠালাম, দেখবি দারুণ হ্যান্ডসাম আর খুব চার্মিং। রাজস্থানের ছেলে… টুকটাক অভিনয় করত। অ্যাক্টিং-টা একেবারেই পারত না। আমি ওকে প্রোডাকশন কন্ট্রোলার-এর কাজটা দিলাম। ওকে দেখে যে কত অ্যাক্টর ফিদা হয়ে আমার কাছে কাজের জন্য আসে জানিস না। তাছাড়া আমার স্পেশাল কাজে তো লাগেই।’ রাইমার উপর কেমন যেন নেশা চড়ে বসল।

মনে মনে কুঁকড়ে গেলাম। কিন্তু মুখে কিছু প্রকাশ করলাম না। কিছু বলতে গেলে যদি ও রেগে যায়। খানিক চুপ থেকে আবার বলতে শুরু করল রাইমা, ‘জানিস কেয়া, আমার সিরিয়ালে প্রথম যে-ভদ্রলোক টাকা বিনিয়োগ করেছিলেন, তিনি তো আমাকে দেখে একেবারে পাগল। ওই ভদ্রলোকের স্ত্রী রঞ্জনা আবার জয়কে দেখে নাছোড়। ওকে ওর চাই-ই। কতবার তো রঞ্জনা আর আমি জয়কে একসাথে শেয়ার করেছি।’

হাঁ হয়ে গেলাম আমি। আমাকে দেখে বলল, ‘অবাক হওয়ার কিছু নেই। ভালোভাবে বাঁচতে গেলে, নিজেকে ভালো রাখতে গেলে এগুলো দরকার। জাস্ট ফর রিল্যাক্সেশন। অবশ্য আমিও ওর জন্য কম করি না। কাজের দরুন প্রতি মাসে চল্লিশ হাজার আর আমার মাইন্ড ফ্রেশ রাখার জন্য প্রতিবার দশ-কুড়ি হাজার দিই। সঙ্গে ওর বউয়ের জন্য কাপড়চোপড়। এছাড়া যখন যা সঙ্গে থাকে।’ এসব শুনে সামনের মানুষটা যে ওর সম্পর্কে ঠিক কেমন ধারণা করতে পারে, সেদিকে বিন্দুমাত্রও ভ্রূক্ষেপ নেই রাইমার।

ওর সত্যিটা মানতে কষ্ট হলেও, নিজেকে সংযত করে বললাম, ‘দ্যাখ, প্রত্যেকটা মানুষই নিজের মতো করে বাঁচতে চায়। তুই তোর পৃথিবীতে খুশি, আমি আমার ফ্যামিলি নিয়ে। যাক এসব কথা এখন থাক। তুই এনজয় কর, আমি চললাম।’ বলে উঠে দাঁড়িয়ে পড়লাম।

আমাকে উঠতে দেখেই বলল, ‘হ্যাভ এ চেঞ্জ ডিয়ার। একবার ওকে দেখলে তোর আর ছেড়ে যেতেই ইচ্ছে করবে না। আমি তো তোকে অজিতকে ছাড়তে বলছি না। তোদের স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কও থাকল আর এক্সট্রা… মাঝে মাঝে তো এটা হতেই পারে নাকি।’ এক পেগ শেষ হওয়ার পর আর এক পেগ তুলে নিল রাইমা। ঠিক তখনই দরজায় নক করে ভিতরে ঢুকে এল জয়। দরজার দিকে পিছন করে বসেছিলাম বলে মুখটা ঠিক দেখতে পেলাম না।

‘কাম ডার্লিং, কাম।’ রাইমা ওর হাত ধরে নিয়ে একেবারে বিছানায় গিয়ে গা-ঘেঁষে বসল। অবশ্য গা-ঘেঁষে বললে বোধহয় ভুল হয়, কারণ রাইমার অর্ধেক শরীরটাই তখন জয়ের কোলে।

‘আমার বন্ধুর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিই… কেয়া।’ মুখ তুলে আগন্তুককে দেখেই আমার চোখ কপালে উঠে গেল। ভুল দেখছি না তো। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। জয়েরও একই অবস্থা। কোনও কিছু বোঝার আগেই রাইমা জয়কে জড়িয়ে ধরে জয়ের শার্টের বাটন খুলতে শুরু করল। আর নিজেও প্রায় অর্ধনগ্ন হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল ওর উপর।

‘উঃ ডিয়ার জয়… জয়… জয়…’

বুঝতে আর কিছু বাকি রইল না আমার। কৌশিক-ই তাহলে জয়। নাম ভাঁড়িয়ে কাজ করছে এখানে। তা হলে এটাই ওর প্রপার্টি ডিলিং-এর বিজনেস! মাথা ঘুরছিল। কী করব ভেবে পাচ্ছিলাম না। বারবার সোমার সেই হাসি মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠছিল। কৌশিক খুব ভালোবাসে। নতুন নতুন নাইটি, শাড়ি, দামি গিফট এনে দেয়। এই তার ভালোবাসার নমুনা! ওদের দিকে আর তাকাতে ইচ্ছে করছে না। কোনওরকমে আসছি বলে হোটেল রুম থেকে বেরিয়ে এলাম। মনে হল জয় নিজেকে ছাড়ানোর জন্য আপ্রাণ ছটফট করছে।

‘উঃ ছটফট করছ কেন। মুড খারাপ কোরো না আমার।’ রাইমার এই অস্ফুট স্বর সারা রাস্তা কানে বাজতে থাকল আমার। মাথায় তীব্র যন্ত্রণা শুরু হয়েছে। চেনামুখের আড়ালে লুকিয়ে থাকা এই রক্তমাংসের কদর্যতা সহ্য করতে পারছিলাম না আমি। ভাবলাম বাড়ি ফিরে স্নান করব। মাথাটা ঠান্ডা হবে।

বাড়ি ফেরার পথেই মোড়ের দোকানে রমলার সঙ্গে দেখা। রমলা ও-বাড়ির কাজের লোক। থাকা-খাওয়া সবই ওখানে। ও-ই বোধহয় আমার ফেরার খবরটা দিয়েছে। জিরোব বলে সবে ফ্যানটা চালিয়েছি, অমনি দরজায় ধাক্বা। খুলে দেখি ‘সোমা’। ওকে দেখেই হঠাৎ করে কেমন যেন শিউরে উঠলাম।

‘কীরে ভূত দেখলি নাকি। এমন চমকে উঠলি কেন?’

‘না না এমনি। বস। আমি হাতমুখ ধুয়ে আসি।’

ফিরে এসে দেখলাম হাতের আংটিটা নিয়েই নাড়াচাড়া করছে। দেখেও না দেখার ভান করলাম। ঘরে ঢোকামাত্রই জিজ্ঞাসা করল, ‘যে-কাজে গিয়েছিলি সব ঠিক হয়ে গেছে?’ উত্তরের আশা না করে হাতটা বাড়িয়ে দিল আমার দিকে। ‘তখন তো ঠিক করে দেখলিই না। এই দ্যাখ ডায়মন্ড রিং এটা।’

প্রসঙ্গ এড়িয়ে গিয়েই প্রশ্ন করলাম, ‘কৌশিক কোথায় রে? ফেরেনি এখনও?’

‘না সকালে বলেই বেরিয়েছে কী যেন বড়ো একটা ডিল আছে, দুদিন ফিরতে পারবে না। কেন রে কিছু হয়েছে নাকি?’

‘নাঃ। এমনিই, কী আর হবে?’

একবার মনে হল ওকে সবকিছু জানিয়ে দিই, ওরও জানাটা প্রয়োজন। আবার পরক্ষণেই ওর মুখের হাসিটা চোখের সামনে ভেসে উঠল। চুপ হয়ে গেলাম।

ওকে দেখে ভীষণ মায়া হল। বেচারি। একজন মধ্যবিত্ত মহিলার পক্ষে পাঁচতারা হোটেলের অন্দরমহলে কী হচ্ছে, সেটাও তো জানা সম্ভব নয়। আর বড়ো বড়ো লোকেদের মাইন্ড রিল্যাক্সেশন – এসব তো ওর ভাবনাচিন্তার উর্দ্ধে।

টুকটাক শপিং ছাড়া মেয়েটা আর যায়ই বা কোথায়, যে স্বামীর স্বেচ্ছাচারিতার কথা জানতে পারবে। স্বামীর প্রতি অন্ধ বিশ্বাস। সেই বিশ্বাসের উপরই দাঁড়িয়ে আজ ও কত সুখী। সেই খুশিতে বাধ সাধতে ইচ্ছে হল না। কাজেই আমিও ওকে খুশি করতে আংটিটা হাতে নিয়ে ভালো করে দেখতে লাগলাম। কখন যে হিরের দ্যুতি ঠিকরে এসে চোখের কোণায় জল জমিয়ে দিয়েছে বুঝিনি।

 

কলকাতার জিগোলো

।।১।।

গাড়িটা এটিএম-এর সামনে এসে দাঁড়াল। গাড়ি থেকে নেমে এল এক স্মার্ট সুদর্শনা যুবতি। সে নিজেই ড্রাইভ করছিল।

এটিএম-এর সামনে দাঁড়িয়েছিল সিকিউরিটি গার্ড যুবকটি। সে যেন তার জন্যই অপেক্ষায়। ভদ্রমহিলাকে স্যালুট করে সে বলল– গুড ইভিনিং ম্যাডাম।

যুবতিটি মৃদু হেসে প্রত্যুত্তর দিল– গুড ইভিনিং। কেমন আছো ঋষভ?

– ভালো। ক’দিন এটিএম-এ আসেননি ম্যাডাম?

– হ্যাঁ, ক’দিন আসা হয়নি। অফিস অফিস করে কেটে গেছে। তবে টাকার-ও বোধহয় অতটা প্রয়োজন হয়নি। নইলে এটিএম-এ না এসে পারা যায়? তুমি আমার আসা যাওয়ার হিসাব রাখো নাকি?

– না না, ঠিক হিসাব রাখা নয়। আমাদের তো এটিএম-কেন্দ্রিকই চাকরি। কিছু কাস্টমার মাঝেমাঝেই আসেন। তাদের আসারও নির্দিষ্ট সময় আছে। আপনি তাদেরই একজন।

যুবতিটি ঋষভের পাশে দাঁড়াল। পারফিউমের মিষ্টি গন্ধে তার সারাদিনের একাকিত্বের ক্লান্তি এক নিমেষে ভেসে গেল। যুবতিটি এলে এমনই হয় বারবার। ঋষভ কি করে তাকে বলবে–সে দীর্ঘদিন এটিএম-এ না এলে মনের মধ্যে এক ধরনের আকুলতা তৈরি হয়। অথচ সে যুবতিটির প্রায় কিছুই জানে না। এমনকী নামও নয়। জানতে ইচ্ছা হলেও উপায় নেই। কোনও কাস্টমারের ব্যক্তিগত বিষয়ে প্রশ্ন করার হক তার নেই। কাস্টমারদের় এটিএম থেকে টাকা তোলার তারা শুধু নীরব দর্শক। কাস্টমারের টাকা তোলার সময় পারতপক্ষে স্ক্রিনে চোখ রাখে না তারা।

আট বাই দশ-বারো সাইজের ঘরে এটিএম বক্স-এর পিছনে এক টুকরো ড্রেসিংরুম আর একটি মাত্র বসার টুল নিয়ে অফিস পরিধিতে সে একমাত্র কর্মী। কথা বলার সঙ্গী বলতে কেউ নেই। এখানে উপরওয়ালার রক্তচক্ষু নেই। তারা নিধিরাম সর্দারের মতো ঢালতরোয়ালহীন। শুধু অর্থদাতা যন্ত্র আগলে পড়ে থাকা। নিজেই নিজের বস আর আর্দালি। এই বসকে কেউ পাত্তা দেয় না। তাকে গুরুত্ব দিয়ে কী-ই বা লাভ? এটিএম-এর ছোট্ট রুমটায় ঢুকে বড়োজোর কাস্টমাররা আড়চোখে তার দিকে তাকায়। তবে হ্যাঁ, অর্থদাতা যন্ত্রের যান্ত্রিক গোলোযোগ দেখা দিলে দু’-চার জন কথা বলে। ব্যাংকের অপদার্থতার অভিযোগ তার মুখের উপর ছুড়ে দিয়ে চলে যায়। হয়তো বা কেউ বলে– ফালতু সব লোকজন। সত্যিই তো, কে দেবে তার মতো একজন তুচ্ছ ব্যক্তিকে পাত্তা। অথচ যুবতি যেন একটু আলাদা–ঋষভের সাথে এক আধটা কথা বলে।

এটিএম-এ সাধারণত রাত সাড়ে ন’টা থেকে দশটার মধ্যে আসে। তখন প্রায় দিনই অন্য কাস্টমার থাকে না। প্রথম প্রথম একটু আধটু হাসত। নিউ টাউনের এমন জনমানবশূন্য জায়গায় অন্তত একটি লোকের দেখা মিলছে ভেবে হয়তো হাসত। এখন কখনও দু’দণ্ড দাঁড়িয়ে কথা বলে আর নরম চোখে মৃদু হাসে। সেই হাসি ঋষভের শরীর মন জুড়ে ছড়িয়ে দেয় ভালোলাগা অনুভূতি। যুবতি চলে যাওয়ার পরও এটিএম ঘর মেখে থাকে পারফিউম আর মেয়েলি গন্ধে। ঋষভ কাস্টমার না থাকলে ঘরটার মধ্যে ঘুরে ঘুরে যুবতির রেখে যাওয়া গন্ধ শোঁকে। কখনও এটিএম-এর কি-বোর্ডে নাক ঘষে। তারপর আস্তে আস্তে ঢুকে যায় নির্জনতার গহ্বরে। ফিরে পায় নিজেকে। রাত বাড়ার সাথে আরও গুটিয়ে যায় নিজের গণ্ডির খোলসে।

– ঋষভ।

– অ অ, টাকা তোলা হয়ে গেছে ম্যাডাম?

– তুমি কোন ভাবের ঘোরে ঘুরে এলে? টাকা তুলেছি কিনা দেখতে পাওনি?

ঋষভের সম্বিত ফিরল। সে মাথা নীচু করে থাকল। বুঝতে পারল যুবতি তার সামনেই আসা অবধি দাঁড়িয়ে আছে। সে ভাবনার ঘোরে ডুবেছিল এতক্ষণ। মাথা চুলকাতে চুলকাতে লাজুক হাসি হেসে বলল,

– টাকা তুলবেন না ম্যাডাম?

– না। তুমি আমাকে সারাক্ষণ ম্যাডাম, ম্যাডাম করো কেন? আমি তোমার বসও নই দণ্ডমুণ্ডের কর্তাও নই।

– তা নন কিন্তু আমরা সব কাস্টমারকে স্যার বা ম্যাডাম বলে সম্বোধন করি। আজকাল তো অনেক সবজিওয়ালাও খরিদ্দারকে স্যার বলে। সুবিধাও কম নয়, সব ভাষাভাষি লোকেদের একটি শব্দ দিয়েই জুড়ে দেওয়া যায়। খরিদ্দাররাও খুশি হয়।

– ঋষভ, তুমি বেশ গুছিয়ে কথা বলো তো। একটা কথা বলবে?

– বলুন ম্যাডাম।

– আমি এই এটিএমটায় প্রায় দু’আড়াই বছর ধরে নিয়মিত আসি। তোমার সাথে আমার সম্পর্কও বেশ ভালো অথচ তুমি আমার নাম পর্যন্ত জানতে চাওনি কখনও। কেন?

– পেশাগত কারণে আমরা কোনও খরিদ্দারের প্রতি অহেতুক উৎসাহ দেখাই না। যদি না সন্দেহজনক কিছু থাকে।

– আমার নাম জানতে তোমার ইচ্ছা হয় না ঋষভ?

সে মাথা নীচু করে। কী বলবে? শুধু নামই বা কেন আরও অনেক কিছু জানতে ইচ্ছা হয়। অথচ সে তো জানে বাতুলতার পরিণতি কী ভয়ংকর হতে পারে। অভাবী সংসারে ঠেকা দেওয়া সামান্য চাকরিটার ভবিষ্যৎ বিপন্ন হতে পারে। তার দিকে তাকিয়ে থাকা মুখগুলোর কথা ভেবে সে কখনও অতটা মরিয়া হতে পারবে না। ঋষভ তার সীমার গণ্ডি ভালো করে জানে।

মৃদুস্বরে যুবতি বলল– আমি মেয়েমানুষ। আমরা পুরুষদের না বলা কথা বুঝতে পারি। চোখের ভাষা বুঝতে অসুবিধা হয় না। ঋষভ, আমাকে তোমার ভালোলাগে?

অপ্রত্যাশিত প্রশ্নের অভিঘাতে ঋষভ চমকে উঠল। অন্ধ আবেগে অনেক কথা বলতে চেয়েছে সে কিন্তু বলা হয়নি কখনও। নিয়ন জ্যোৎস্না মাখা যুবতির মুখের দিকে তাকিয়ে সে বলল– আপনি এলে দু’টো কথা বলে প্রাণ বাঁচে। মনে হয় কেউ অন্তত আমাদের মানুষ ভাবে।

যুবতি মেয়েটি ঠোঁটে কমনীয় হাসি ঝুলিয়ে বলল আজ আমি টাকা তুলতে আসিনি। তোমাকে নিতে এসেছি। চলো আমার সঙ্গে।

– আমি! ডিউটি ছেড়ে কোথায় যাব? কেন যাব? আপনি কি জানেন আমাদের চাকরি কত ঠুনকো?

– হ্যাঁ, তুমি আমার সঙ্গে যাবে। কলকাতার কত এটিএম-ই তো নিরাপত্তারক্ষী ছাড়া অরক্ষিত থাকে। তুমি এক রাতের জন্য শুধু আমার সঙ্গে হারিয়ে যাবে। তোমার ক্লান্তি থেকে মুক্তি।

– কিন্তু কেন যাব?

– সব কথা এখানে বলা হয়ে গেলে রাতভর কী বলব তোমার সাথে। তোমার চাকরির কোনও সমস্যা হলে আমি দেখব। আর কথা নয়। ঋষভ, গাড়িতে ওঠো।

ঋষভের মনে হল সামনে দাঁড়িয়ে নারী মরীচিকা। তবু নারীর ডাকে তার জাটিঙ্গা পাখি হতে ইচ্ছা হচ্ছে। হয়তো পুড়ে, পালক নিকষ কালো হয়ে যাবে। কিন্তু সে মনের থেকে কিছুতেই মায়াটান কাটাতে পারছে না। ঐন্দ্রজালিক জাদুকাঠিতে সম্মোহিত মানুষের মতো অচেনা যুবতির পিছু পিছু ঋষভ গাড়িতে উঠল।

জ্যোতি বসু নগরী দিয়ে গাড়ি ছুটছে এয়ারপোর্টের দিকে। তীব্রবেগে পিছনে ছুটে যাচ্ছে এক একটি বাতিস্তম্ভ। যুবতির হাতে স্টিয়ারিং, গাড়িটি যেন পক্ষীরাজ ঘোড়া। তার মুখে ঝুলে মৃদু হাসি। চোখেমুখে উচ্ছ্বাস। সত্যিই আজ একই দিনে অনেকগুলো পালক জুটেছে তার ঝুঁটিতে। গাড়ি এসে দাঁড়াল নীল আলো মাখা অনিমিখ-এর এইচআইজি কমপ্লেক্স-এ।

ড্রয়িংরুমে একা বসে আছে ঋষভ। খানিকটা জড়োসড়ো হয়ে একটি সোফার মধ্যে প্রায় ডুবে আছে সে। এমন আধুনিক সাজানো-গোছানো ফ্ল্যাটে আগে কখনও আসেনি। দামি আসবাবপত্রে পরিকল্পিত সাজানো ঘরদোর, ফ্ল্যাটের এমন রুম ঋষভ দেখেছে টিভি-তে, সিনেমায়। গোটা ঘরটায় ইন্টেরিয়র ডিজাইনারের পেশাদারিত্বের ছোঁয়া। কিন্তু ঘরটা প্রাণহীন অচঞ্চল। বাড়িতে বোধহয় মালকিন বাদে আর কেউ থাকে না। তালা খুলে তারা দু’জনে রুমে ঢুকেছে। ঋষভকে ড্রয়িং রুমে বসতে বলে মেয়েটি চলে গেল অন্দরমহলে। অন্দরমহল মনে আসতেই ঋষভের মনে হল তার ভাবনার মধ্যে একটা প্রাচীন বনেদি বাড়ির ছায়া আছে। ফ্ল্যাট তেমনটি কেমন করে হবে? ফ্ল্যাট মানেই তো কয়েকটি ঘরের সমষ্টি। বেশি হলে ডাইনিং, ড্রয়িংরুম। অবশ্য ছোটো বড়ো সব ফ্ল্যাটেই ডাইনিং, কিচেন, বাথরুম থাকে। এ বাড়ির ভিতর সে আন্দাজ করতে পারছে না। যুবতি হয়তো সারাদিনের ক্লান্তির আভরণ ছেড়ে বেরিয়ে আসবে। তার পোশাকটা কী হবে? ভাবতেই ঋষভের গা ঘিনঘিন করে উঠল। নিজের শরীরে এখনও সারাদিনের ডিউটি করা ইউনিফর্ম। ইউনিফর্মে সিকিউরিটি এজেন্সির ব্যাচ। মানুষটার পরিচয় আটকে আছে শুধুমাত্র এজেন্সির লোগোতে। ঘরের ম-ম করা সুবাসকে ছাপিয়ে যাচ্ছে নিজের জামা প্যান্টের বাসি দুর্গন্ধ। তার অস্তিত্ব কী? তার অস্বস্তি ক্রমিক হারে বেড়ে যাচ্ছিল ঘরময় আভিজাত্যের নিস্তব্ধতায়। তার অস্তিত্বহীন অস্তিত্বের সংকটে।

ডোরবেল বেজে উঠল। ঋষভ ভাবছিল খুলবে কি খুলবে না। তখনই ড্রয়িংরুমে বেরিয়ে এল যুবতি। সাদা রঙের হাফ প্যান্ট আর উপরে টপ্ পরেছে। আধুনিকা মেয়েটির আয়নায় নিজেকে দেখে ঋষভ আরো গুটিয়ে গেল। দরজার পাশে দাঁড়িয়ে মেয়েটি জিজ্ঞেস করল,

– কে?

বাইরের থেকে উত্তর এল – হোম ডেলিভারি ম্যাডাম।

দরজা খুলে সে বলল, – ডাইনিং টেবিলে রেখে যাও।

সাদা রঙের হোটেল ইউনিফর্ম পরা একটি লোক পলি-প্যাকেটে খাবার হাতে ঋষভের সামনে দিয়ে ডাইনিং টেবিলের দিকে চলে গেল। লোকটা তার দিকে কোনও আগ্রহ দেখাল না। তার দিকে একবার তাকিয়ে ডাইনিং রুমে ঢুকে গেল। মনে হল অভ্যস্ত চোখ। ডাইনিং রুমের দিকে যেতে যেতে মালকিন লোকটিকে জিজ্ঞেস করল,

– ক্যাসা লাপোসতোলে পেয়েছ?

– হ্যাঁ, ম্যাডাম। ম্যানেজার অনেক ফোনাফোনি করে জোগাড় করেছে। ওয়াইনটা জোগাড় করা খুব কঠিন। খাবার সার্ভ করে দেব ম্যাডাম?

– না, থাক। তুমি এখন এসো।

– গুড নাইট ম্যাডাম। পেমেন্ট নিয়ে ডেলিভারি বয় চলে গেল। সে চলে যাওয়ার পর গৃহকর্ত্রী একটা বারমুডা আর টি-শার্ট এনে বলল– ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে এসো।

পুরুষহীন বাড়িতে পুরুষদের পোশাক দেখে ঋষভ একটু অবাকই হল।

– কিন্তু আমাকে কেন ডেকে এনেছেন? সে আবার জানতে চাইল।

– ঋষভ, সব কথা হবে। আগে তুমি ফ্রেশ হয়ে এসো। দেরি হলে খাবার ঠান্ডা হয়ে যাবে। মাইক্রোওভেন অন করো, খাবার গরম করো, ওসব পারব না। এই উঠে পড়ো তো শিগ্গির।

ডাইনিং টেবিলে তারা দু’জন মুখোমুখি বসেছে। যুবতিটি কাচের গ্লাসে ওয়াইন ঢালতে ঢালতে ঋষভকে বলল – গোমড়া মুখে থেকো না। তুমি এখনও আমার নাম জানতে চাইলে না।

– হ্যাঁ ম্যাডাম, আপনার নাম জানা হয়নি।

– আমি হিমিকা। হিমি বলে ডাকতে পারো। আমি খুশিই হব। আজ রাতে তুমি আমার অতিথি।

– কিন্তু আমাকে ডিউটি থেকে তুলে আনার উদ্দেশ্যটা কী?

হিমিকা ঋষভের নীল চোখের দিকে তাকিয়ে থাকল। ঋষভের নীল চোখের মায়াজাল তাকে পাগল করে দেয়। অথচ কোনও দিন সামাজিক অবস্থানের খাতিরেই প্রকাশ করতে পারেনি। ঋষভকে দেখলে তার মনে হয় ইউরোপীয় রক্ত বইছে তার ধমনিতে। টিকোলো নাক আর রেশমি চুলে ঋষভ গড়পড়তা ভারতীয়দের থেকে কোথায় যেন আলাদা। চোখের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে ঋষভের বুঝতে অসুবিধা হল না রাত কুহেলিকা হিমিকা কি ভাবছে। তাকে ঘিরে এমন ভাবনা অনেকেরই হয়। তারা ঋষভের মধ্যে আভিজাত্যের যোগসূত্র খুঁজতে চায়। এখানেই সবাই ভুল করে বসে। সেই অর্থে শিক্ষাদীক্ষা বা ধনসম্পত্তির উত্তরাধিকার তার নেই বা বিখ্যাত পূর্বপুরুষের রেখে যাওয়া কোনও সংরক্ষিত উত্তরণপথ। হিমিকা তার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে কৌতূহল আর চাপতে পারল না – ঋষভ, তুমি কোথায় পেলে এমন ব্লু আই?

– জানি না ম্যাডাম।

– আবার ম্যাডাম বললে! আমি বলছিলাম, তোমার বাবা-মা কার চোখ এমন নীল?

– আমার বাবা-মা’র চোখ আপনার মতো গভীর কালো। তবে লোকে মশকরা করে বলে আমার শরীরে নাকি ইউরোপীয় রক্ত বইছে।

– তাই নাকি? হিমিকা নিজের কল্পনার সমর্থন পায়।

– আমি একটি মফসসল শহরের ছেলে। কোনও কোনও শিশু এখনও চোখ কটা-নীল, ফর্সা চামড়া নিয়ে জন্মায় ওখানে। কোনও এক সময়ে ফরাসি বেনিয়া রক্ত মিশে গিয়েছিল কয়েক পুরুষ আগের মহিলাদের জঠরে। এখনও তলে তলে ধারা বইছে। সুযোগ পেলেই জিন থেকে ছিটকে বেরিয়ে আসে বেনিয়াদের লালসার ফল। রং যাই হোক না কেন এ তো একধরনের উপজাতপ্রাপ্তি।

– নিজেকে ওভাবে ভাবছ কেন? চেহারা তো মানুষের সম্পদই। শুধু জানতে হয় সম্পদের সদ্ব্যবহার। নারীমন বোঝ ঋষভ? বলতে বলতে বাঁহাতে ঋষভের হাত চেপে ধরল হিমিকা। অন্য হাতে গ্লাস ভরিয়ে দিল নীল মদিরায় – কাছে এসো ঋষভ। আজ রাতে তোমার আগুনে আমাকে গলিয়ে দাও লাভার মতো। স্রেফ্ তোমাতে ভাসার জন্য তোমাকে এমনভাবে নিয়ে এসেছি। আমি আর পারছি না ঋষভ। হিমিকা উঠে গিয়ে ঋষভকে জড়িয়ে ধরে পাগলের মতো ঠোঁটে চুমু খেতে লাগল। মদিরার নীল নেশায় ঋষভ ক্রমশ ডুবে গেল তার নারীক্ষুধার কাছে। যাবতীয় পৌরুষত্বের সংযম ভেসে গেল বাঁধভাঙা জলোচ্ছ্বাসে।

গড়ে ওঠা জ্যোতি বসু নগরে অর্ধেক আকাশ জুড়ে অর্ধেক চাঁদ। পড়ে থাকা ফাঁকা জমি রাতের আঁধারে বিষন্নতায় ঢাকা। দাঁত মুখ খিঁচোনো নির্মীয়মান বাড়িঘর রাতের কোটরে কেমন নির্জীব। রাত দ্বিপ্রহরে বিমানবন্দরগামী বাবুদের গাড়ি উল্কাপাতের মতো ছুটে যাচ্ছে। ঋষভের অনুরোধে জানালা খুলেছে হিমিকা। হিমিকার ঘর রৌদ্র ছোঁয় না বা বলা যেতে পারে এসি ঘরে সে জানালা খোলার তাগিদ অনুভব করে না। খোলা জানালা দিয়ে রাতের নরম হাওয়া তেরো তলার ঘরে ঢুকছে। জানালার পাশে বসে আছে দুই আদিম নরনারী। দিদির বয়সি হিমিকাকে আরও বুকের কাছে টেনে এনে ঋষভ বলল – শুধু এ জন্যই আমাকে ডেকে এনেছ?

– আজ আমার প্রাপ্তির দিন, ভোগের দিন।

– ভোগের দিন না হয় বুঝলাম কিন্তু ভোগেই কি প্রাপ্তি ঘটে?

– না, আনন্দ উপভোগের এটা একটা দিক। প্রাপ্তি অন্য জায়গায়। আমি এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর পদে প্রোমোশনের চিঠি আজই হাতে পেয়েছি।

– সত্যিই আনন্দের দিন তোমার হিমি।

হিমিকা বাইরের দিকে তাকিয়ে কেমন উদাসীন হয়ে গেল। নিশ্চুপে কেটে গেল অনন্ত প্রহর। তাকে ভাবনায় ডুবে থাকতে দেখে ঋষভ ডাকল, – হিমি।

– ও হ্যাঁ, বিনিময়ে আমাকে দিতে হয়েছে কত জানো?

– না, আমি কী করে জানব? আমার জানার পরিধি শুধু আট ফুট বাই বারো ফুট ঘর।

– আমি কাজ করি একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে। চাকরিতে ঢোকার দিন থেকেই কোম্পানি টার্গেট বেঁধে দেয়। টার্গেটে পৌঁছোও তো টিকে থাকো। না পৌঁছোও তো পিছনে ঘন্টাধবনি– কেটে পড়ো। কেটে পড়ো। লক্ষ্যে পৌঁছোলেও নিস্তার নেই। টার্গেটের পরিধি আরও বেড়ে যাবে। সামনে খুঁড়োর কলের মতো অনেক রঙিন স্বপ্ন। গাড়ি, বাড়ি, পয়সা ওড়ানো ক্লাবের মেম্বারশিপ, বিদেশ ভ্রমণ এমন অনেক রঙিন ফানুস। সামনে ঝোলানো একটি মাত্র টোপ প্রোমোশন। আখের ছিবড়ার মতো রক্তশূন্য অবস্থায় জিভ বের করে কেউ সত্যি সত্যিই হয়তো পৌঁছাবে চূড়ায়। আবার এমনও হতে পারে যার ভাগ্যে শিকে ছিঁড়বে সে হয়তো ঘোড়সওয়ারদের মধ্যেই নেই। সেখানে অন্য সমীকরণ, অন্য কেউ। বুঝলে ঋষভ, এই ডার্ক হর্সকে কেউ চেনে না। কিন্তু সে-ই জয়ী হবে। আমি জোকা থেকে ম্যানেজমেন্টে পিজি করে এখানে ঢুকেছি। তখন আমার কত আর বয়স হবে? পঁচিশের নীচে। এখন? না থাক, মেয়েদের বয়স গুপ্ত থাকাই ভালো। আমাকে দেখে তোমার যত বয়স মনে হয় ধরে নাও সেটাই আমার বয়স। চূড়ায় পৌঁছানোর জন্য বিয়ে করার সময় বের করতে পারিনি। এ তো এক ধরনের নেশা। প্রথম প্রথম সম্পদের মোহ টানে। তারপর বলতে পারো ক্ষমতা, পজিশনের মোহে মানুষ অন্ধ হয়ে যায়। তখন সমাজ টমাজ কাউকে চিনতে চায় না। ছোটে, দমবন্ধ করে নিজেকে বাজি রেখে ছোটে। আমিও ছুটেছিলাম। বেশ কয়েক বছর ধরেই আড়াই হাতের মধ্যে ফসকেই যাচ্ছিলাম। অথচ আমার পারফর্মেন্স, সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা বা নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষমতার মধ্যে কোনও ঘাটতি ছিল না। বেশ কয়েক জন অযোগ্য লোকও আমাকে সুপারসিড করে গেল। আমার দুর্বলতা নিয়ে অনেক ভেবেছি আর হতাশায় ডুবে যাচ্ছিলাম। মানসিক অবসাদে রাত আমাকে সর্ব অর্থে গ্রাস করে নিত। একাকিত্ব, অবসাদ সব কিছু থেকে মুক্তি পেতে প্রতি রাতে আমি তুলে আনতাম পেশাদার জিগোলোদের।

ঋষভ আবছা আলোয় হিমিকার মুখের দিকে তাকাল। অনেক ইংরাজি শব্দই তার বোধগম্য নয়। জিগোলো শব্দটা তার কানে ঠকাস করে লাগল। মুখে কিছু বলল না।

হিমিকা আবার বলতে শুরু করল – পরে আমি বুঝেছি রোগটা মনের, শরীরের নয়। রাতের অতিথিরা কী করবে? একদিন মরিয়া হয়ে দেখা করলাম ম্যানেজিং ডিরেক্টর-এর সাথে। তাকে সরাসরি জিজ্ঞেস করলাম,

– স্যার, হোয়াট ইজ মাই ডেফিসিয়েন্সি টু গেট প্রমোশন?

সে রিভলবিং চেয়ারে মৃদু দুলে দুলে বলল– ইউ আর দ্য মোস্ট এফিশিয়েন্ট অফিসার। কিন্তু মিস্ ব্যানার্জী যোগ্যতাই কি সব উন্নতির মাপকাঠি? পৌরাণিক যুগ থেকেই চলে আসছে বিনিময় প্রথা। কিছু পেতে গেলে কিছু দিতে হয়।

– আমাকে কী দিতে হবে?

– ইউ আর অ্যান ইনটেলিজেন্ট বিউটিফুল গার্ল। ইউ ক্যান হ্যাভ আ সলিটরি মিটিং টু ডিসাইড ইয়োর ফিউচার। মিস্ ব্যানার্জী, একটা সিদ্ধান্তে জীবনের মোড় ঘুরে যেতে পারে।

এমডি একটা বুড়ো ভাম। ওর লালসার চোখ দেখে আমার গা ঘিনঘিন করে উঠেছিল। কিন্তু পরক্ষণে মনে হল শরীরের সতীত্ব কি আমার আছে? আমি তো পয়সার বিনিময়েই কামনা হতাশা ঝলসাই প্রতি রাতে। আর একদিন বুড়োর সাথে নির্জন অবসর কাটালেই যদি খুলে যায় উন্নতির সিঁড়ি, দোষের কি? ঋষভ, সাফল্য অবশেষে এসেছে। আজ রাতে তুমি আনকোরা আলট্রা ফ্রেশ উত্তাপে আমাকে পাগল করে দিয়েছ। ইউ আর ট্রুলি…।

ঋষভ হাঁ করে তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। হিমিকাকে তার অত্যাশ্চর্য মনে হয়।

সকাল সাড়ে আটটা। ঋষভ চালক আসনের পাশে বসতে গেল। হিমিকা তাকে বলল

– পিছনের সিটে বসো। হিমিকা গাড়ি চালাচ্ছে। আর একটাও কথা বলল না ঋষভের সাথে। ঋষভ সিকিউরিটি গার্ডের ইউনিফর্মের মধ্যে আরও গুটিয়ে যেতে লাগল। হু হু করে ছুটছে গাড়ি। গাড়িটা এসে থামল এটিএম-এর সামনে। ঋষভ নেমে চালক আসনের কাছে এসে বলল – আর কি দেখা হবে?

হিমিকা তার সামনে এগিয়ে দিল একটা প্যাকেট

– এটা ধরো।

– কী আছে এতে?

– তোমার রাতের চার্জ।

– সে কি হিমি, তুমি আমাকে টাকা দিচ্ছ!

– আমি বিনা পয়সায় কাজ করাই না। খুশি হয়ে অন্যদের থেকে একটু বেশিই দিয়েছি।

– ম্যাডাম, আমি…।

ঋষভ কথা শেষ করতে পারল না। গাড়ির চাকা গড়াল। তার চোখের সামনে গাড়িটা দ্রুত অদৃশ্য হয়ে গেল। হাতের মুঠোয় টাকার প্যাকেট নিয়ে কাঁদবে না ছুড়ে ফেলবে কিছুতেই বুঝতে পারছিল না ঋষভ। তার হাত-পা কেমন অসাড় মনে হল।

এটিএম-এ ঢুকতে বাধা পেল সে – সারা রাত কোথায় ছিলে? যমদূতের মতো সামনে দাঁড়িয়ে সিকিউরিটি সুপারভাইজার। জাঁদরেল গোঁফের নীচে কঠিন কঠোর চেহারা। সে প্রাক্তন সেনাকর্মী। চাকরি থাকার সময় যা না গোঁফের বহর ছিল এখন বুড়ো বয়সে আরো পোক্ত হয়েছে। বুড়োকে আড়াল আবডালে সিকিউরিটি গার্ডরা বলে ঢ্যাঁড়স। সেই সিকিউরিটি সুপারভাইজার যে কত ভয়ংকর হতে পারে তা হাতেনাতে টের পাচ্ছে ঋষভ।

সুপারভাইজার গোঁফে পাক দিতে দিতে বলল,

– রাত বারোটায় আমি রাউন্ড আপে এসেছিলাম কিন্তু এটিএম খোলা হাট। তোমার দেখা নেই। বুঝেশুনে বড়ো নৌকায় পাল তুলেছ ভাই। তবে উড়ে উড়ে মধু খাবে আর সিকিউরিটি গার্ডের চাকরি করবে, দু’টো একসাথে তো হবে না। এই ধরো তোমার টার্মিনেশন লেটার। আর ডুবে ডুবে জল খেতে হবে না।

ঋষভের চাকরিটা ঠুনকো চুড়ির মতো চলে গেল।

।।২।।

– ঋষভ, কেমন আছ?

সে প্রথমে হতচকিত হয়ে গেল। ভদ্রমহিলার মুখের দিকে তাকিয়ে চিনতে পারল – ম্যাডাম, আপনি এখানে? টাকা তুলতে এসেছেন?

– না, টাকাপয়সা নয়। তোমাকে খুঁজতে খুঁজতে দু’বছর কেটে গেছে। কাল হঠাৎ আবিষ্কার করলাম তুমি এটিএম-এর সামনে দাঁড়িয়ে আছো। তখনই আসতাম কিন্তু কোন মু্খে তোমার সামনে দাঁড়াই? কালকে সাহস পাইনি। রাতভোর নিজের সীমাহীন অপরাধের কৈফিয়ত দিতে হয়েছে মনের কাছে। হতাশা বা উন্নতির সর্পিলরেখার দোহাই দিয়েও আমার কর্মের কোনও সদুত্তর দিতে পারিনি। তবু মরিয়া হয়েই তোমার কাছে এসেছি। তোমার গভীর নীল চোখের সরলতার কাছে আমি আগেই হেরেছি ঋষভ।

– ম্যাডাম, এখন আমি ডিউটিতে আছি। কাল ডে-শিফটে ডিউটি। চাইলে সন্ধ্যায় আমি আপনার ফ্ল্যাটেও যেতে পারি। দেয়ার উই ক্যান নেগোশিয়েট দ্য ডিল।

বিস্মিত চোখে ঋষভের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকল হিমিকা খানিকক্ষণ। তারপর বলল– আমার ফ্ল্যাটটা একটা শয়তানের গুহা। আমি চাই না ওখানে আর আমাদের এভাবে দেখা হোক। ফোন নম্বর বলো, কথা বলে মিটিং প্লেস ঠিক করব।

প্রিন্সেপঘাটে আগেই এসে বসে আছে হিমিকা। বিকেলের পড়ন্ত সূর্যের আলো খানিকটা কেটে কেটে পড়ছে জেমস প্রিন্সেপ-এর স্মৃতিসৌধের উপর। খোদ কলকাতায় বিজ্ঞানপ্রযুক্তির বিদ্যাসাগর সেতু আর ঐতিহাসিক স্থাপত্যে সূর্যের আলোর আচ্ছন্নতা ভেঙে দিল ঋষভ – হাই ম্যাডাম, হাউ লং? ঋষভ এসেছে। কালো গেঞ্জি-জিন্স আর পায়ে নর্থস্টার শু-তে তাকে শার্প-স্মার্ট লাগছে।

হিমিকা বলল – অনেকক্ষণ। নির্ধারিত সময়ের বেশ খানিকটা আগেই।

– তা বলুন ম্যাডাম, কেন আমাকে খুঁজছেন।

– আমি জানি ঋষভ, তোমার প্রতি আমি অন্যায় করেছি। পেশাগত জীবনে যেখানেই পৌঁছাই না কেন, আমার স্বীকার করতে দ্বিধা নেই– আমি ক্লেদাক্ত। তবু ভিতরে ভিতরে তোমার জন্য আমি দুর্বলতা অনুভব করি। আমার মনে হয়েছে তুমিই পারো আমাকে ফিরিয়ে আনতে। আমাকে একটু আশ্রয় দেবে ঋষভ?

– ম্যাডাম, টু ইয়ার্স ব্যাক আই হ্যাভ বিন অ্যান ইনোসেন্ট ইয়ুথ। কিন্তু আপনি আমার সামনে অনেকগুলো রাস্তা খুলে দিয়েছিলেন। আয়ের রাস্তা আর নরকের রাস্তা। বাস্তবে আপনি ছিলেন আমার প্রথম খরিদ্দার। কৃতজ্ঞতা বোধ থেকে বিনা পয়সায় আজ বিকালে আপনার সাথে সঙ্গ দিতে এলাম। যদিও আমার সঙ্গদান থেকে বেডরুম শেয়ারের আলাদা আলাদা রেট আছে। তা বলতে পারেন দু’বছর আগের থেকে রেটটা একটু হাই। আর প্রোফাইল বুঝে রেট হেরফের হয় বটে। হাজার থেকে দশ হাজার। এখন অন-লাইনে শরীর বিকিকিনি হয়। রাস্তায় না দাঁড়িয়েও ঘরে বসে ডিল হয়। হাতে একটা সেলফোন – ব্যস যৌনতার জগৎ হাতের মুঠোয়। একান্ত প্রয়োজন হলে স্টাইলিশ কালো ব্যান্ড হাতে চিরাচরিত পদ্ধতিতে পথের পাশে রেলিং-এ এসে ইশারাময় শরীর খোঁজা। কেউ কেউ বোল্ড পত্রমিতালির বিজ্ঞাপন দেয়। আপনার মতো মেয়েদের কাছে বিজ্ঞাপনের বক্তব্য মানে অন্য কিছু। তাই না?

– ঋষভ! একি কথা বলছ?

– ওকে। আই নো ইউ ক্যান্ট অ্যাকসেপ্ট মি লাইক দিস। আপনি সেই সরল নীল চোখের ঋষভকে খুঁজছেন। সে তো আর নেই। আপনি কি কখনও জানতে চেয়েছেন আমি কেমন আছি?

হিমিকা মাথা নীচু করে রইল। এমন প্রশ্নের সামনে তাকে পড়তে হবে তার কল্পনায় ছিল না। সে বলল – আমার নেশা কাটতে বেশ খানিকটা সময় লেগেছিল। তারপর যখন ফিরে এলাম তখন তোমার বদলি হয়ে গেছে। পাগলের মতো রাস্তার অলিগলিতে কোথায় খুঁজিনি তোমায়?

– আপনি ভুল শুনেছেন। আমার বদলি হয়নি। কর্তব্যে অবহেলার জন্য সিকিউরিটি গার্ডের সামান্য চাকরিটা চলে যায়। মাস গেলে ন্যূনতম মজুরি আর ওভারটাইম মিলিয়ে চার-পাঁচ হাজার টাকা আসত। এক রাতের ফুর্তির ধাক্বায় তা বন্ধ হয়ে গেল। একটা অভাবের সংসারে হঠাৎ চার-পাঁচ হাজার টাকার রোজগার বন্ধ হয়ে গেলে তার অভিঘাত কত ভয়ংকর হতে পারে ভাবতে পারেন ম্যাডাম?

হিমিকা কোনও উত্তর খুঁজে পেল না।

– আমি জানি আপনি কোনও দিন এতটা মাপা জীবন দেখেননি। আমার সেই অর্থে কোনও যোগ্যতা বা বিদ্যা নেই যা দিয়ে তৎক্ষণাৎ কিছু একটা জুটিয়ে নিতে পারতাম। ভালো থাকার ইচ্ছা আছে সব মানুষের কিন্তু ভালো থাকার রসদ উপার্জনের মুরোদ নেই অধিকাংশ মানুষের। অনেকে তাই চাহিদাপূরণের সহজ পথ বেছে নেয়। অপরাধের উৎসভূমি বিস্তৃত হয়। আমারও হয়েছিল। তখন আপানার কথা মনে পড়ে গেল। আমার নীল চোখে নাকি নারীহূদয় বশ করার জাদু আছে। চেহারার সদ্ব্যবহার জানলে নাকি আয়ের রাস্তা খুলে যায়। আপনার কাছেই প্রথম শুনেছিলাম জিগোলো শব্দটা। তখন মানে জানতাম না। কিন্তু রাতের শয্যাসঙ্গী হওয়ার বিনিময়ে আপনি আমাকে টাকা দিয়েছিলেন। তাই একটা ভাবার্থ মনে হয়েছিল। অভিধানে জিগোলোর মানে প্রৌঢ়া বা বৃদ্ধা স্ত্রীলোকের অর্থপুষ্ট তরুণ প্রণয়ী। আমার শরীর আছে – যৌবন আছে, তা হলে ক্ষুধার কাছে মার

খাওয়া কেন?

– ঋষভ!

– জানেন, প্রথমে জানতাম না কারা জিগোলো। কোথায় থাকে তারা। কোন মেয়ে পয়সার বিনিময়ে যৌন সঙ্গী খুঁজছে। শুধু একটা সিনেমা থেকে জেনেছি পার্ক স্ট্রিট জিগোলোদের স্বর্গরাজ্য। তারা হাতে কালো রুমাল বাঁধে। একদিন সত্যি সত্যিই কালো রুমাল বেঁধে দাঁড়িয়ে পড়লাম পার্ক স্ট্রিটে। কিছু সময় যেতে না যেতে কয়েকটা ছেলে আমাকে ঘিরে ধরল – এখানে কী চাই?

আমি ঘাবড়ে গেলাম– না মানে…

হো হো করে হেসে উঠল তারা – মুরগি, …কক্-কক্। ব্লাডি হোর, উড বি মেল এসকর্ট। পার্ক স্ট্রিট শুধুমাত্র ক্যালকাটা জিগোলো ক্লাব সদস্যদের জন্য। হেই রাসটিক গাই, এখানে ফের এলে বটল শুদ্ধু নিপল ধরিয়ে দেব। তারা আমাকে প্রায় ঘাড় ধাক্বা দিয়ে পার্ক স্ট্রিট থেকে তাড়িয়ে দিল। চকচকে লালটুস চেহারার যুবকের দল। বেশভূষায় হিপি হিপি ভাব। অনর্গল ইংরাজিতে কথা বলে। ফিরে এলাম সেদিন। কিন্তু পেটে খিদে থাকলে পশুরা বিপদ অগ্রাহ্য করেও ফিরে আসে, আমাকেও ফিরতে হয়েছিল। পরদিন থেকে দাঁড়াতে শুরু করলাম পার্ক স্ট্রিটের আশেপাশে। কখনও ফ্রি-স্কুল স্ট্রিটে, কখনও লিনডসে স্ট্রিটে। ক’দিন যেতে না যেতে আমার মতো ছুটকো পাবলিকদের চিনতে শুরু করলাম। শহরের রাস্তা সবার অথচ ভিতরে ভিতরে করে খাওয়ার এলাকা ভাগ থাকে। প্রথম প্রথম এরাও আমাকে এক চুল জায়গা ছাড়তে চায়নি। কিন্তু সমস্যাটা কি জানেন ম্যাডাম?

– কী? হিমিকা শুকনো গলায় জানতে চাইল।

– কে বা কারা খরিদ্দার তাই চিনি না। রাস্তায় দাঁড়িয়ে আঠারো থেকে পঞ্চান্ন বছরের মহিলাদের মনে হতো প্লেবয় খুঁজছে। আবার তাদের বেশভূষা চাল-চলনে ভড়কে যেতাম। আমার মফসসল শহরের গাঁইয়া চেহারা প্রকট হয়ে উঠত। একজন বয়স্ক জিগোলোর সাথে পরিচয় হল। সে বলল – তুমি ভাই সারা জীবন বঁড়শিতে একটাও গাঁথতে পারবে না। এ তো মাছ নয় যে ফাতনা ডুবিয়ে তোমায় টেনে নেবে। এদের পেটে খিদে নেই। চোখে খিদে। শরীর অভুক্ত। তোমাকে চোখের অভুক্ত  চাহনি পড়তে হবে। চালচলনে চেকনাই চাই। অর্ধেক কথা হবে চোখে চোখে।

– তুমি দুষ্টু লোকটার কথা শুনে পালটে গেলে ঋষভ?

হায় ভগবান!

– আমার তো কোনও ভার্জিনিটির অহংকার ছিল না। তা আপনার কাছে আগেই খুইয়েছি। আমার দরকার ছিল একজন অভিজ্ঞ লোকের টিপস। লোকটার পরামর্শে ইংরেজি শিখতে লাগলাম। আর সামর্থ্যের মধ্যে সাজগোজ পালটে ফেললাম। মানুষের পোশাক এক ধাক্বায় বদলে দেয় অনেকটা। একটু ব্যক্তিত্ব যোগ করতে পারলেই কেল্লাফতে। ওর পেশাগত নাম পিটার। পিটার আমাকে ইন্দ্র, ইন্দ্রজিৎ বলে ডাকত। বলত – পুরুষরা সব সময় ইন্দ্রর মতো। যা পেতে ইচ্ছা হয় তা যেনতেনপ্রকারেণ আদায় করে নেবে। নারীকে জয় করায় কোনও পাপ নেই। পুরুষ বহুগামী। যথা সময়ে ঋষি হয়ে গেলেই হল। পৌরাণিক যুগ থেকে পুরুষরা এরকমই স্বার্থপর আত্মকেন্দ্রিক সাধু। প্রথম প্রথম পিটার আমাকে দু’চারটে খরিদ্দার ধরে দিত। তবে কমিশনের ব্যাপারে পিটারের কোনও আপস নেই। অন্যের গতর খাটানো পয়সা কে না খায়। হোটেল ম্যানেজারগুলো এক একটা তিলে খচ্চর। ফরেনারদের সাথে মোটা টাকার ডিল হয়। আমরা পাই সামান্যই। ম্যানেজার হারামিগুলো মেরে দেয় সিংহভাগ।

– ঋষভ, আমার আর শুনতে ভালো লাগছে না।

– ফিরে যখন এসেছেন তখন কষ্ট করে না হয় একটু শুনলেন ম্যাডাম। এখন আমি সমাজের উচ্চবিত্ত মহিলাদের সাথে কাজ চলার মতো কমিউনিকেটিভ ইংলিশ শিখেছি। আঠারো থেকে পঞ্চান্ন বছরের স্টুডেন্ট, ওয়ার্কিং লেডি, হাউস ওয়াইফ, উইডো, ডিসস্যাটিসফায়েড লেডি– সবাই আমাদের খরিদ্দার। আইটি সেক্টরের অনেক ওয়ার্কিং লেডি আজকাল আর লিভ টুগেদারের ঝামেলাও চায় না। তারা সব ফ্যান্টাস গাইদের হায়ার অ্যান্ড ফায়ার করতে অভ্যস্ত। টাকায় রেডিমেড আনন্দ পেলে কে পোহায় হ্যাপা-বিয়ে-শাদি-লিভ টুগেদার-এর? সবাই মেতে থাকতে চায় সেল্ফ-অ্যাপোতে। নিজেকে নিয়ে মেতে থাকা। সংসার নামক সনাতনী জোয়ালটি কে বইতে চায়? পিটার আমাকে পিএসএল পদ্ধতি-র মতো আধুনিক এবং পৌরাণিক কামসূত্র শিখিয়েছে। নাও আই নো দ্যা আর্ট অফ স্যাটিসফায়িং ওমেন।

– চুপ করো, চুপ করো। আমি আর শুনতে চাই না।

– আমি আবার একটা সিকিউরিটি গার্ডের চাকরি নিয়েছি। এজেন্সি আমার অনুরোধে পার্ক স্ট্রিটের এটিএম-এ পোস্টিং দিয়েছে। বলতে পারেন এই পোস্টিংটা আমার সোনায় সোহাগা হয়েছে। প্রতিদিন ইভিনিং ডিউটি করি আর এটিএমের সামনে দাঁড়িয়ে থাকি উপোসি চোখের খোঁজে। চাকরিটা এখন আমার গৌণ আয়ের জায়গা, তবু ইউনিফর্মে ঢেকে রাখি নষ্ট আমিটাকে। আর কিছু খরিদ্দার ছাড়া ইন্দ্রজিৎকে কে চেনে বলুন? ম্যাডাম, আমি এখন শুধু মেয়েদের কামনাময় চোখ খুঁজি। আপনার চোখ এখন স্বাভাবিক। অসুস্থ অস্থিরতা নেই। চোখের অস্থিরতার কাছে আমরা জিগোলোরা বিকিয়ে যাই। কেউ আনন্দ করতে গিয়ে বিকিয়ে যায় – কেউ বা পেটের টানে। আমি জানি না পুরুষ যৌনকর্মী বলে অভিধানে কোনও শব্দ আছে কিনা, বা বেশ্যার পুংলিঙ্গ কী হবে? কিন্তু আমার বলতে দ্বিধা নেই আমি বাস্তবে একজন জিগোলো। প্রয়োজন হলে ডাকবেন, আপনার ক্ষেত্রে অল্প টাকায় কাজ করে আসব। আপনি ফিরে যান ম্যাডাম।

হিমিকা হাঁটুতে চিবুক ঠেকিয়ে চুপচাপ বসে আছে। তার নিজেকে মনে হচ্ছে সাপ-লুডোর নিরানব্বই-এ সাপে খাওয়া ঘুঁটি। যাবতীয় বিষন্নতা শরীরে ভর করেছে। তবু মরিয়া হয়ে সে ঋষভের হাত জড়িয়ে বলল – বুকের পাথরটা একটু নেমেছে ঋষভ?

– বিষের ব্যথা কখনও নামে?

– তোমার সব দুঃখ যন্ত্রণার ভার আমাকে বইতে দেবে…

– তা হয় না ম্যাডাম। আপনি ফিরে যান। আমাদের আর কোনওদিন না দেখা হওয়াই মঙ্গল। জিগোলোদের কখনও প্রেমে পড়তে নেই। জিগোলো একট ব্যাধি।

হিমিকা ফোঁপাতে ফোঁপাতে দ্রুত পায়ে হাঁটা লাগাল। তার চলে যাওয়া দেখতে দেখতে ঋষভের বুকের মধ্যে হঠাৎ কান্না দলা পাকিয়ে উঠল। মনে হল একটা আলোর বিন্দু এসেছিল। এখন ক্রমশ বিলীন হয়ে যাচ্ছে। তার তীব্র ইচ্ছে হল হিমিকার হাত ধরে নতুন করে বাঁচতে। দৌড়ে গিয়ে পিছন থেকে ডাকতে – হিমি, যেও না। চলো আমরা গঙ্গার পাড় দিয়ে হাঁটি। শুনেছি গঙ্গা সব গ্লানি ধুয়ে দেয়।

 

অনাহূত

আজ মনটা বেশ ফুরফুরে। আকাশে-বাতাসে উৎসবের আমেজ। রাতের চোখজুড়ানো আলোর রোশনাইয়ের রেশ চোখেমুখে লেগে রয়েছে। ছেলেমেয়ে দুটোর স্কুলও ছুটি। আনন্দ করে দিনটা কাটানো যাবে। গেলও তাই। বিকেলে হঠাৎ ভাই ফোনে জানাল, এবার সে ভাইফোঁটায় আসতে পারবে না। অফিস থেকে নাকি ছুটি পায়নি। মুহুর্তেই মনটা কেমন যেন ভার হয়ে গেল। হুট করে ছেলেমেয়ে দুটোকে নিয়ে অতদূর যাওয়াও তো সম্ভব নয় আমার পক্ষে। গুম হয়েই বসেছিলাম। সাত-পাঁচ ভাবছি, এমন সময় সাহেবের বায়না মা ব্রেডরোল বানিয়ে দাও। অগত্যা সবকিছু ভুলে রান্নাঘরে ছুটলাম।

ঠিক সেই সময় তনুর আওয়াজ কানে ভেসে এল, ‘মা রামলাল জেঠু এসেছে।’ মনে হল ওনাকে বসতে বলে তনু কোথাও পালাল।

‘ওফ্, বোর করতে চলে এসেছে।’ কথাটা নিজেকে শুনিয়েই যেন বলল, এমন ভাব করে সাহেব দৌড়ে সোজা পড়ার ঘরে গিয়ে বই নিয়ে বসে পড়ল।

উনি এতটাই ‘বোরিং’ যে বাচ্চারাও ওনার সংস্পর্শ এড়িয়ে চলতেই পছন্দ করে। সন্দীপও অফিস থেকে ফেরেনি।

ব্রেডরোল বানাবার পুর তৈরি করছিলাম। তাড়াতাড়ি হাত ধুয়ে রান্নাঘর থেকে বেরোব কী, উনিই রান্নাঘরে হাজির। এদিক-ওদিক দেখে জোরে একটা নিশ্বাস টেনে বললেন, ‘বাহ্। দারুণ গন্ধ। মনে হচ্ছে আজ স্পেশাল কিছু হচ্ছে ?’

‘হ্যাঁ, বাচ্চাদের আবদার আর কী!’

‘আজ তাহলে সন্ধের জলখাবারটা ভালোই জুটবে, কী বলো কাকলি। আমিও তো ওদের মতোই বাচ্চা নাকি।’ বলেই এমন ভাবে হাসতে শুরু করলেন যেন আমি ওনার খাস ইয়ার দোস্ত।

আর কোনও পথ না দেখে কড়া চাপিয়ে ব্রেডরোল বানাতে শুরু করলাম। ততক্ষণে উনি সাহেবের ঘরে পৌঁছে গেছেন। ‘আচ্ছা সাহেববাবা পড়াশোনা করছে। তাহলে তো ডিসটার্ব করা যাবে না’ বলে বাইরে বেরিয়ে সোফায় বসেই উচ্চস্বরে শ্যামা

সংগীত ধরলেন ‘শ্যামা মা কী আমার কালো রে, শ্যামা মা কী আমার কালো…’।

ওনার হাত থেকে বাঁচতে সাহেবের এই ধারালো অস্ত্র বরাবরের মতো এবারেও সফল। খাবারের প্লেট ওনার হাতে ধরিয়ে, নিজেকে মানসিক ভাবে প্রস্তুত করতে শুরু করলাম ওনার ‘জরুরি’ কথা শোনার জন্য। ওনার গ্রাম, খেতখামার, পঞ্চায়েত নিয়ে– সেই ঘ্যারঘ্যারে রেকর্ড আবার বাজতে শুরু করল। এই নিয়ে সাহেবও কম ঠাট্টাতামাশা করে না। কখনও কখনও বলেই বসে, ‘তা জেঠু সবকিছু যখন এতই মিস করো, তাহলে সেখানে গিয়েই থাকলে পারো। অনর্থক এখানে পড়ে আছো কেন?’

‘অপারগই বলতে পারো আমায়। খেতখামার, ঘরবাড়ি কিছুই তো আর নেই। তাই গ্রাম ছেড়ে চলে এলাম এখানে। নতুন করে পড়াশোনা শুরু করলাম। বড়ো হওয়ার মনোবাসনা তো ছিলই, মাথাটা সাহায্য করল। ইঞ্জিনিয়র হয়ে গেলাম।’

মাথাটাও সাহায্য করল শুনে সাহেবের সে কী হাসি। একা বসে ওনার কথা শুনতে শুনতে সাহেবের টিপ্পনিগুলো মনে পড়ে গেল। অজান্তেই কখন ঠোঁটের কোনায় হাসি ফুটে উঠেছে নিজেও বুঝতে পারিনি। মনে হয়, রামলালবাবু তখন ওনার পিতার মৃত্যু নিয়ে কিছু বলছিলেন, যা এর আগে বহুবার শুনিয়েছিলেন। মৃত্যুপ্রসঙ্গ চলাকালীন এমন অযাচিত হাসি তিনি বোধহয় মন থেকে মানতে পারেননি। হঠাৎ-ই ওনার থমথমে মুখ দেখে বুঝতে পেরে সংযত হলাম।

‘সন্দীপ তো এখনও এল না। ভাবছিলাম ওর সাথে বসে এককাপ চা খাব।’

বুঝলাম চা না খেয়ে উনি এক পা-ও নড়বেন না। কাজেই চুপচাপ চা বানিয়ে এনে দিলাম। এক-দেড় ঘন্টা বাদে যখন গেলেন তখন মাথাটা বেশ ধরে গেছে। সাহেবের ঘরে গিয়ে দেখলাম হাতটা গালে দিয়ে বসে কী যেন ভাবছে। জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কী রে গালে হাত দিয়ে আকাশপাতাল কী ভাবছিস।’

দার্শনিকের মতো জবাব দিল, ‘জানো মা, জেঠুর বাড়িতে আসার একটা ভালো দিকও আছে।’ বলেই বইটা হাতে নিয়ে দেখিয়ে দিল, ‘দ্যাখো এই কঠিন চ্যাপ্টারটা মুখস্ত হয়ে গেল।’

মাথাটা এত ধরেছিল যে ওর কথায় কোনও প্রতিক্রিয়াও করতে পারলাম না। গিয়ে শুয়ে পড়লাম। খানিক পরে সন্দীপ ফিরতেই সমস্ত রাগ গিয়ে পড়ল ওর উপর। ‘কেমন লোকেদের সঙ্গে আত্মীয়তা তোমার? যাকে কেউ পাত্তা দেয় না, সে যখন-তখন কথা নেই বার্তা নেই বাড়ি বয়ে চলে আসে।’

‘রামলালদা এসেছিল বুঝি?’ মৃদুস্বরে প্রশ্ন করে সন্দীপ।

‘তাছাড়া আর কে! দেড় ঘন্টা ধরে বসে ছিল। ভব্যতা-টব্যতা কিছু জানে না। চা-জলখাবার খেল তবে গেল এখান থেকে।’

‘আর ক’টা দিনের-ই তো ব্যাপার কাকলি। তারপর তো ওর বউ-বাচ্চা চলে আসবে। তখন দেখবে যাওয়া-আসা এমনিই কমে যাবে। একা থাকে। যদি একটু চা-জলখাবার খায়, তাতে কী এমন ক্ষতি বলো তো!’

‘হ্যাঁ, তা তো বলবেই। নিজেকে সহ্য করতে হলে বুঝতে।’ গজগজ করতে করতে গ্যাস অন করলাম।

‘জেঠু চলে গেছে?’ ঘরে ঢুকেই প্রশ্ন করল তনু।

‘আমার তো ভয় হচ্ছিল ফিরেও যদি দেখি জেঠু আছে। তাহলে তো সেই একই গল্প আবার শোনাবে।’

এগারো বছরের ছোট্ট তনুও বুঝে গেছে একঘেয়ে জিনিসটা কী! ভোপাল থেকে বদলি হয়ে যখন নতুন এসেছিলেন, তখন সাহেব আর তনু ওনার কোল ঘেঁষে বসে পড়ত গল্প শোনার জন্য। আর এখন দেখলেই দৌড়োয়। ছেলের পড়াশোনার জন্য রামলালবাবুর স্ত্রী ভোপালেই থেকে গেছেন। পড়াশোনা শেষ হলে এবার ফিরবেন। ততদিন এই মহাশয়কে সহ্য করতে হবে।

আমাদের পড়শি মধুলিকারও জবাব নেই। যখনই আসবে খোঁচা ওকে দিতেই হবে। ‘কী কাকলি আজ রামলালবাবু আসেননি।’ ভাবটা এমন যেন উনি রোজ আসেন।

তারপর বলবে, ‘তুমিও পারো। এরকম একটা লোককে কী করে আশকারা দাও কে জানে। দেখলেই গাঁইয়া ভূত মনে হয়। মাথায় চপচপে তেল। টেরিকাটা সিঁথি। পোশাক-আশাকেরও কোনও ছিরিছাঁদ নেই। সন্দীপদা যে কী করে ওনার বন্ধু হলেন…।’

একদিন সন্ধ্যাবেলা সিরিয়াল দেখতে বসেছি। দারুণ ক্লাইম্যাক্স। বাড়ির মুখরা বড়োবউ ঝগড়ার সময় শাশুড়িকে ছোটোলোক বাড়ির মেয়ে বলে বসেছে। সেই নিয়েই ড্রামা বেশ জমে উঠেছে। এমন সময় কলিংবেল-এর আওয়াজ। একবার ভাবলাম, দূর সিনটা দেখে তারপরই যাব। পরমুহূর্তেই মনে হল, যদি সেরকম কেউ হয় তাহলে কিছু মনে করতে পারে। একপ্রকার বিরক্ত হয়ে দরজা খুলতে গেলাম। দরজা খুলে দেখি, রামলালবাবু। রাগে গা-টা জ্বলছিল। তার উপর ঘরে ঢুকেই লাটসাহেব বলে বসলেন, ‘কাকলি এক কাপ চা হবে নাকি?’

কোনওমতে রাগ সংবরণ করে বললাম, ‘চা যে শেষ হয়ে গেছে দাদা।’

‘চা শেষ হয়ে গেছে কী বলছ! কালই তো অফিস থেকে ফেরার পথে মোড়ের মাথার টি-জংশন থেকে আড়াইশো চা কিনল সন্দীপ। মোড়ের মাথাতেই দেখা হল ওর সঙ্গে। আমিও তো সঙ্গে গেলাম।’ বেশ আশ্চর্য হয়েই বলে গেলেন উনি।

ক্ষণিকের জন্য হকচকিয়ে গেলেও আগেই মনস্থির করেছিলাম আজ কোনও মতেই ওনাকে এন্টারটেইন করব না। বললাম, ‘হ্যাঁ, দেখেছেন ঠিকই। চা কিনেছে বটে, তবে সে চা আর বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছোয়নি। পথেই হোঁচট খেয়ে সব পড়ে গেছে।’

‘ওঃ তাই। সকালে তো দেখা হল, কই কিছু বলল না-তো সন্দীপ। কোথাও লাগে-টাগেনি তো?’ উদ্বেগ প্রকাশ করলেন রামলালবাবু। উত্তেজিত হয়েই বললাম, ‘এতে আর বলার কী আছে। কিছু হলে তো জানতেনই।’

মাথাটা নাড়িয়ে বললেন, ‘তা বটে। ঠিক আছে কাকলি তাহলে আমি নিয়ে আসছি।’

প্রত্যুত্তরে বললাম, ‘না না, আপনাকে আর কষ্ট করতে হবে না। আসলে আমারও একটু বেরোনোর আছে।’

এই ঘটনার পরে উনি যতবার এসেছেন, আমার থেকে এরকম ব্যবহারই পেয়েছেন। প্রথম প্রথম এজন্য আমারও খারাপ লাগত। পরে মনে হল, যাকে আমি পছন্দই করি না, তার সাথে সদ্ব্যবহার কীসের। তেল চপচপে মাথার, পান চিবোনো ওই লাল দাঁতের নির্লজ্জ হাসি, দেখলেই গা-টা রিরি করে উঠত। সম্ভবত উনিও বুঝতে পেরেছিলেন। আসা-যাওয়াও অনেক কমিয়ে দিয়েছিলেন। মাঝেমধ্যে সন্দীপ জোর করে ধরে নিয়ে আসত। চা-জলখাবার খেয়ে চলে যেতেন। এতে অবশ্য আমি ভীষণ আশ্বস্ত হয়েছিলাম।

সেদিন স্নান সেরে জামাকাপড় ধুচ্ছি। কলিংবেলটা ক্রমাগত বেজেই যাচ্ছে। সমানে চিৎকার করছি আসছি আসছি তৎসত্ত্বেও আগন্তুকের কানে ঢুকছে না।

দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলে দেখি, রামলালবাবু। দরদর করে ঘামছেন। দরজা বন্ধ করতে করতে বললাম, ‘সন্দীপ বাড়িতে নেই৷’ উনি ইশারা করে কিছু বলতে চাইছিলেন দেখে দাঁড়িয়ে গেলাম।

‘কাকলি বাচ্চারা কোথায়?’

‘স্কুল ছাড়া কোথায় থাকবে এসময়ে?’

কোনও জবাব না দিয়ে হাঁফাতে হাঁফাতে বললেন, ‘তুমি এক্ষুনি আমার সাথে চলো। সন্দীপের অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে।’

শোনা মাত্র মাথাটা ঘুরে গেল। চারিদিকে কেবল অন্ধকার মনে হল। উনি কোনওমতে আমাকে ঘরে এনে বসালেন। এক গ্লাস জল দিয়ে বললেন, ‘ভয় পেয়ো না, মারাত্মক কিছু হয়নি।’ জানি না কেন ওনার কথা ঠিক বিশ্বাস হল না। অতি বড়ো দুঃসংবাদ

দেওয়ার সময়ও,সান্ত্বনা দিতে লোকে এসব বলে। মনটা বড়ো কু-গাইতে থাকল।

কোনওমতে নিজেকে সামলে নিয়ে ছুটলাম হাসপাতালে। রামলালবাবুই তালা লাগালেন। আমার যেন সমস্ত শক্তি ফুরিয়ে যাচ্ছে। যন্ত্রের মতো কী যে করছি আমি নিজেই জানি না।

‘একটা বাচ্চা ছুটতে ছুটতে হঠাৎই সন্দীপের স্কুটারের কাছে চলে এসেছিল। বাচ্চাটাকে বাঁচাতে গিয়েই যত বিপত্তি। ব্যালেন্স রাখতে না পেরে ও-ই স্কুটার থেকে পড়ে গেল। সেইসময়ই পাশ দিয়ে একটা ট্যাক্সি এসে ধাক্বা মারে। উঠে দাঁড়াতে পারছিল না।’ শুনে আমার গাল বেয়ে ঝরঝর করে জল নেমে আসছিল। মনের মধ্যে তোলপাড় হচ্ছিল।

‘ওই অবস্থাতেই ১০-১৫ মিনিট পড়েছিল সন্দীপ। লোক জড়ো হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু কেউ এগিয়ে এসে সাহায্য করেনি।। ভাগ্য ভালো, সেই সময় আমি ওই পথ দিয়েই যাচ্ছিলাম। নয়তো…’

ওনার কথাও ঠিক করে কানে আসছিল না। শুধু উপরওয়ালার উদ্দেশ্যে একটা প্রার্থনাই করে চলেছি, ‘ভগবান সন্দীপ যেন ঠিক থাকে, সুস্থ থাকে।’

রামলালবাবু আবারও বলে উঠলেন, ‘কাকলী, সন্দীপের সামনে কিন্তু তোমাকে শক্ত থাকতে হবে। ভেঙে পড়লে চলবে না।’ বোঝালেন ঠিকই, কিন্তু হাসপাতালের বেডে ওকে শুয়ে থাকতে দেখেই চোখ ফেটে জল চলে এল।

এমন সময় সন্দীপের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা এক নার্স জিজ্ঞাসা করল, ‘আপনিই কী ওনার স্ত্রী? ডাক্তারবাবু পেশেন্টের বাড়ির লোকদের খুঁজছিলেন।’

চোখের জল মুছতে মুছতে সম্মতি প্রকাশ করলাম, ‘হ্যাঁ।’

‘দেখুন ভয়ের কিছু নেই। তবে ওনার বাঁ-পায়ের কন্ডিশন তেমন ভালো নয়। এখুনি অপারেশন করতে হবে।’

ডাক্তারের অভয়বাণী শুনে নিশ্চিন্ত হতে পারলাম না। মনের মধ্যে ওঠা হাজারও আশঙ্কা থেকে নিষ্কৃতি পেলাম না। রামলালবাবুর হাতে প্রেসক্রিপশন দিয়ে ওষুধগুলো আনার জন্য বলে গেল নার্স।

খানিক পরেই ওর জ্ঞান ফিরে এল।

‘কাকলি।’

‘এই তো আমি। তোমার পাশেই আছি।’ সন্দীপের কাঁধে  হাত রেখে বললাম।

তারপরেই ছটফট করতে লাগল, ‘খুব কষ্ট হচ্ছে।’

‘সব ঠিক হয়ে যাবে। তুমি ভয় পেয়ো না।’ বলেই ছুটে গেলাম নার্সের কাছে। উনি এসে যন্ত্রণার ইঞ্জেকশন দিয়ে গেলেন। তার খানিক পরেই সন্দীপ ঘুমিয়ে পড়ল।

‘কাকলি, এই নাও ওষুধগুলো রাখো। আর হ্যাঁ এই ফলগুলোও। ডাক্তার বললে দিও। আমি দেখি অফিসে বলে ওর জন্য টাকাপয়সার কিছু ব্যবস্থা করতে পারি কিনা।’ বলেই হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে গেলেন।

বাচ্চাদের কথা একদমই খেয়াল ছিল না। রামলালবাবু যাওয়ার বেশ খানিকক্ষণ পর মনে পড়ল। তাড়াহুড়োতে ওদের কথা মনেই হয়নি। এতক্ষণে তো দুজনেই স্কুল থেকে চলে এসেছে। ঘরে তালা দেখে কোথায় যাবে, কী করবে? ভাবতে পারছিলাম না। মনে পড়ে গেল মধুলিকার কথা। তাইতো ওকেও তো ফোন করে বাচ্চাদের রাখতে বলতে পারি। দেরি না করে নাম্বার ডায়াল করলাম। ফোনে সমস্ত কিছু জানালাম ওকে।

‘ওহ্ তাই। খুবই দুঃখের খবর। বেশি চোট আঘাত পায়নি তো?’

‘বাঁ-পা গুরুতর জখম হয়েছে অপারেশন করতে হবে।’

‘আহা-রে, আমাদের কোনও সাহায্য লাগবে না তো?’

ও ‘না’ এর উপর এমন জোর দিয়ে বলল যে, কান্না পেয়ে গেল।

‘যদি বাচ্চারা এলে একটু দেখতে,’ বুঝতে পারছিলাম না কীভাবে ওকে বলব, বাচ্চাদের একটা রাত ওর বাড়িতে রাখতে।

‘তুমি চিন্তা কোরো না, ওরা ফিরলেই আমি জানিয়ে দেব যে তোমরা মেডিকিওর হাসপাতালে আছো,’ বলেই ফোনটা রেখে দিল। আর কোনও কিছু বলার সুযোগই দিল না।

পাগলের মতো কেবিনের মধ্যেই ছটফট করতে শুরু করলাম। এ অবস্থায় সন্দীপকে একা ছেড়ে যাওয়াটা কি ঠিক হবে? এরা তো যখন-তখন ওষুধের জন্য প্রেসক্রিপশন ধরাচ্ছে। এরপর ওটি। কিন্তু বাচ্চারা! আবার পরমুহূর্তেই মনে হল, না ওরা যথেষ্ট বুদ্ধিমান, নিজেদের ঠিক সামলে নিতে পারবে। ঘরে তালা দেখে নিশ্চয়ই একবার পাশের কাউকে জিজ্ঞাসা করবে। পরক্ষণেই মনে হল, আচ্ছা আচ্ছা লোক এ-রকম খবর শুনলে ঘাবড়ে যায়, সেখানে ওরা তো শিশু। ইশ্ এই বিপদের সময় যদি ভাইটা কাছে থাকত। অন্তত পাশে দাঁড়ানোর মতো…। কারওর একটা গলার অস্ফুট স্বরে ভাবনায় ভাটা পড়ল। পিছন ফিরে দেখি রামলালবাবু।

‘সাহেব আর তনুকে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে এসেছি। খাবারও বেড়ে দিয়ে এসেছি। সাহেববাবা আসার জন্য বায়না ধরেছিল। কোনওমতে বুঝিয়ে সুঝিয়ে তবে আসতে পারলাম।’

মনে পড়ে যাচ্ছিল, কথায় কথায় রামলালবাবুকে নিয়ে সাহেবের ব্যঙ্গ, ওনার চলনবলন সবকিছু নকল করে দেখানো, ওঁকে এড়িয়ে চলা। লজ্জায় মনে মনে কুঁকড়ে গেলাম।

কৃতজ্ঞতাভরা স্বরে বললাম, ‘দাদা, আপনি যে আমার কী উপকার করলেন, আপনি জানেন না। বাচ্চাদের কথা ভেবে খুব দুশ্চিন্তা হচ্ছিল।’ বলেই একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম।

‘ছি ছি, এভাবে বোলো না। এ তো আমার কর্তব্য।’ বলেই আমার হাতে একটা মোটা খাম ধরিয়ে দিলেন। বললেন, ‘টাকাটা রাখো। আপাতত যা পারলাম জোগাড় করেছি। অপারেশনটা তো হোক। পরে না হয় অফিসে একটা বন্দোবস্ত…।’

চোখ দুটো ভিজে গেল আমার। টাকাটা হাতে নিয়ে ছুটলাম হাসপাতালের অ্যাকাউন্টস্ ডেস্ক-এ।

অপারেশন শেষে সন্দীপকে বেডে দেওয়ার পর রামলালবাবু আমায় বললেন, ‘এবার বাড়ি যাও। বাচ্চারা অনেকক্ষণ একা আছে। আমি এখান থেকে এক পাও নড়ব না, চিন্তা কোরো না। যাও।’

বাড়ি ফিরে দেখলাম তনু কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়েছে, আর সাহেব গালে হাত দিয়ে বিছানার এককোণে বসে রয়েছে। চোখদুটো লাল। আমাকে দেখামাত্রই দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরল। কাঁপা কাঁপা গলায় প্রশ্ন করল, ‘বাবা কেমন আছে মা? বাবা ঠিক হয়ে যাবে তো?’

বললাম, ‘বোকা ছেলে, বাবা কেন ঠিক হবে না?’

‘দেখিসনি সাহাকাকুর যখন পা ভেঙে গিয়েছিল, ডাক্তার কেমন প্লাস্টার করে দিয়েছিল। সাহাকাকু এখন ঠিক হয়ে গেছে না, ঠিক আগের মতোই? বাবাও খুব শিগগিরিই ঠিক হয়ে যাবে।’

‘তবে যে মধুমাসি বলে গেল বাবার বড়ো অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে। খুব বিপদ!’ সহজভাবে বলে গেল সাহেব।

‘না না। মধুমাসি তাহলে ভুল শুনেছে।’

মধুলিকার আচরণ এটাই শেখাল যে বন্ধুবেশী এরকম প্রতিবেশীর থেকে দূরে থাকাই ভালো। যারা কোনও কাজেই আসে না।

পরের দিন গোটা পাড়ায় সাহেবের বাবার অ্যাক্সিডেন্টের খবরটা ছড়িয়ে পড়ল। হাসপাতালে যাওয়ার জন্য রেডি হচ্ছি ঠিক তখনই এক এক করে পাড়ার পাঁচ-সাত জন বউ হাজির। এক একজনের, এক এক রকমের কথা। ‘বাচ্চাকে কী করে ছেড়ে দেয় মানুষ? আমাদের দেশের ট্রাফিক ব্যবস্থাও তো খুব খারাপ।  সবই অদৃষ্ট।’ জোরকদমে আলোচনা আর সহানুভূতির ঝড় বইতেই থাকল। কেউ আর যাবার নাম করে না। রামলালবাবুই এই পরিস্থিতি থেকে বাঁচালেন আমাকে। ঘরে ঢুকেই বললেন, ‘কাকলি রেডি তো? চলো, দেরি হয়ে যাবে যে।’

আমিও তৎপর হয়ে উঠে পড়লাম, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ চলুন, চলুন।’

আমার সঙ্গে সঙ্গে তারাও উঠে পড়ল। যেতে যেতে শান্তাদি বলে গেলেন, ‘দ্যাখো রামলালবাবু তো যথাসাধ্য করছেনই। তবুও যদি প্রয়োজন পড়ে বোলো।’

‘হ্যাঁ হ্যাঁ বলব।’ আরও দু-তিনটে গলা শুনলাম। রামলালবাবুর স্কুটারে চেপে আমি আর তনু হাসপাতালে পৌঁছোলাম। বিকেলে সন্দীপের বন্ধুবান্ধব, অফিস কলিগরা এল দেখতে। সবাইয়ের একই কথা,কিছু দরকার লাগলে বোলো। ভেবে অবাক হয়ে যাই, দরকার হলে কেন, কেউ কি এগিয়ে এসে বলতে পারে না, নিঃসংকোচে বলো কী দরকার! একমাত্র রামলালবাবু ছাড়া। ওনাকে তো কোনও কথা বলতেই হয়নি। তার আগেই উনি বুঝেশুনে সব কাজ করে নেন। যেন সত্যিই বন্ধু নয়, সন্দীপ ওনার মায়ের পেটের ভাই। একটা দিনও রাত্তিরে উনি আমাকে হাসপাতালে থাকতে দেননি, সবসময় ছেলেমেয়ের দোহাই দিয়ে বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছেন।

অন্যান্য দিনের মতোই সেদিনও রামলালবাবু ফল, ওষুধপত্র নিয়ে আসার পরে কিছু টাকা দিতে গিয়েছিলাম। তাইতেই উনি ভীষণ রেগে গেলেন। ‘আমি তো তোমাদের কোনও দিন পর ভাবিনি কাকলি। তাহলে এসব কথা উঠছে কেন?’

ওনার কথা শুনে অতীতের ঘটা একটা ঘটনা চোখের সামনে ভেসে উঠল। আমি-ই তাচ্ছিল্য করে বলতাম, ‘সাহেববাবা, সাহেববাবা করে একেবারে গলে পড়ছে। রোজ রোজ আমাদের বাড়িতে ভালোমন্দ গিলে যাচ্ছে, অথচ বাচ্চাগুলোর জন্য একটা চকোলেট নিয়ে আসতেও ইচ্ছে হয় না, নীচ মানসিকতা।

আজ উনি আমাদের জন্য যা করছেন, অতি নিকটাত্মীয় হলেও বোধহয় এমনটা সম্ভবপর হতো না। নিজের ভাইকেও তো দেখলাম, অফিসের দোহাই দিয়ে কাটিয়ে দিল। আর অন্যান্য আত্মীয়দের তো কথাই আলাদা। কেউ নিয়মরক্ষা করতে মুখটা দেখিয়ে গেল মাত্র। আবার কেউ কেউ তো ফোনেই দায়িত্ব সেরে দিয়েছে।

রামলালবাবু যাওয়ার পর সন্দীপ বেশ ভাবুক হয়ে ওঠে। ‘সত্যি রামলালদা যদি না থাকত, কী হতো কে জানে। ও না থাকলে হয়তো হাসপাতাল পর্যন্তই পৌঁছোনো হতো না আমার।’ একটা চাপা শ্বাস নিয়ে চুপ করে যায় সন্দীপ।

ওনার সম্পর্কে বলার মতো ভাষা সত্যিই আমার জানা নেই। ওনাকে কী ভেবেছিলাম, আর উনি আসলে কী…। সত্যিই অসময়ে না পড়লে মানুষ চেনা বড়ো দায়। আজ অকপটে স্বীকার করতে বাধা নেই, উনিই আমাদের পরম বন্ধু।

অথচ ওই মানুষটাকে নিয়েই কতবার দ্বন্দ্ব বেধেছে আমাদের স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে। বারবার প্রশ্ন তুলেছি ওদের বন্ধুত্ব নিয়ে। আর জবাবে বারংবার একই উত্তর পেয়েছি, ‘মানুষ চিনতে আমার ভুল হয় না কাকলি। ও এত সহজসরল বলেই তোমরা ওকে উপেক্ষা করো। আজ পর্যন্ত কোনও কিছুর জন্য ঈর্ষা, প্রতিদ্বন্দ্বিতা বা প্রতিহিংসার মনোভাব দেখিনি ওর মধ্যে।’

সন্দীপের কথাটা যে কতটা সত্যি, আজ আমি বুঝতে পারি। নয়তো আমার এত খারাপ ব্যবহার করা সত্ত্বেও…।

সন্দীপ আগের তুলনায় অনেকটা ভালো হতে ছুটি দিলেন ডাক্তার। পায়ে প্লাস্টার নিয়ে আরও মাস তিনেক কাটাতে হবে তাকে। রামলালবাবু ট্যাক্সি ডেকে বাড়ি পৌঁছে দিলেন আমাদের। তারপর নিজে অফিস চলে গেলেন। অফিস ফেরত সোজা এলেন আমাদের বাড়িতে।

‘এখন কেমন?’ ঢুকেই ঠিক আগের ভঙ্গিতেই প্রশ্ন করলেন আমাকে।

‘ঠিক আছে। আসুন।’

তনুও খেলতে যাচ্ছিল। রামলালবাবুকে দেখে আজ আর বেরোল না। সাহেব বই নিয়ে বসেছিল। ওনাকে দেখে উঠে এল। সবাইকে কাছে পেয়ে রামলালবাবু আবার পুরোনো ফর্মে। সেই ওনার ছোটোবেলার ঘটনা, খেতখামার, জমি, বাড়ি, গ্রামের হাজারও কথা। তবে আজ শ্রোতাবর্গ অনেক বড়ো। প্রতিবেশীদের দু-একজনও এসেছে সন্দীপ-কে দেখতে। সবাই মন দিয়ে ওনার কথা শুনছিলাম। আর ভাবছিলাম, সত্যিই তো জীবনে কতই না কষ্ট পেয়েছেন উনি। বাবার মৃত্যুর পর কাকারা জোর করে জমি-জিরেত কেড়ে নিয়ে পথে বসিয়েছিল ওনাকে। সেই জায়গা থেকে আজকের হরদয়াল ইন্ডাস্ট্রির ইঞ্জিনিয়ারের সফর কতটা সংঘর্ষের সেটা ভেবেই ওনার প্রতি শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে যাচ্ছিল আমার।

‘জেঠু তুমি বলেই পেরেছ। সমস্ত বাধা অতিক্রম করে পড়াশোনা শিখেছ, নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছ। আমি তো এখনও মায়ের বকা না খেলে বই হাতে করি না।’ ছেলের মুখে একথা শুনে আমি বেশ অবাক।

‘সময় সব কিছু শিখিয়ে দেয় সাহেববাবা।’

সন্দীপ আমার মুখের দিকে তাকিয়েছিল। হয়তো আমার মনের অবস্থা আঁচ করতে পারছিল। পরিস্থিতিটাও বেশ গম্ভীর হয়ে উঠেছিল। কিছুক্ষণের জন্য সব নিস্তব্ধ। কারও মুখে যেন বাক্যি সরছে না। সবাইকে চুপ থাকতে দেখে রামলালবাবু ভাবলেন, ওনার কথায় আমরা বুঝি বোর ফিল করছি। তাই তিনি ওঠার উপক্রম করলেন। ঠিক সেই সময়েই মুখ দিয়ে অকপটে বেরিয়ে গেল, ‘বসুন না দাদা। এক্ষুনি বাড়ি ফিরে কী করবেন? আমি আপনার জন্য তাড়াতাড়ি কড়া করে এক কাপ চা বানিয়ে আনছি।’

দোসর

নিলির রাতে ওঠার অভ্যেস একেবারে ছিল না বললেই চলে। এই শেষ সাত মাস মারণরোগে আক্রান্ত শাশুড়ির দৌলতে সে অভ্যেসের দফারফা। যতই রাতের আয়া থাক অন্তত একটিবার করে উঠে শাশুড়ির ঘরে উঁকি মেরে আসাটা তার কর্তব্য। বাইরের লোকের ওপরে কতইবা ভরসা করা যায়? আর ঠিক তখনই যায় মাথাটা গরম হয়ে। আয়াটি দিব্যি এসি চালিয়ে ভোঁসভোঁসিয়ে ঘুমোচ্ছে। সবদিন না হোক বেশিরভাগ দিনই এই দৃশ্য। মাস গেলে হাতেগরম  ১২ হাজারটি টাকা। সকালেরটাকে তবু ১০ হাজার দেওয়া যায়। কিন্তু রাতেরটা তো হাসতে হাসতে ডাকাতি করে। রাতের খাবারের আগে-পরের ওষুধগুলো ছাড়া আর কোনও ওষুধই নেই। সেই আবার সকালে। কাজের মধ্যে ওই একটু জল খাওয়ানো, কাশলে মুখের সামনে কফদানিটা ধরা, শ্বাসকষ্টটা বাড়লে বুকে-পিঠে হাত বোলানো এইটুকু। নিলি তো বলেই ছিল রাতের আয়ার প্রয়োজন নেই। কিন্তু অরিজিৎ সে কথা শুনলে তো? একমাত্র ছেলে। এটুকু তো করতেই হবে। নিলিও আর বাধা দেয়নি।

রাত নিশুতি। ঘুম ভাঙল নিলির। খাটের ধারে মশারিতে অরিজিতের একটা পা ঝুলছে। পিকলুটা মাঝখানে উপুড় হয়ে ন্যাতার মতো পড়ে আছে। অন্যদিন ঘুমন্ত পিকলুকে দেখলে নিলির বেশ মায়া হয়। ঘুমন্ত ছেলের গালে একটা চুমু খেয়ে মাথাটায় হাত বুলিয়ে দেয়। কিন্তু আজ আর তেমন কোনও অনুভূতিই হচ্ছে না নিলির। কী যেন ভাবল সে। আঁচল দিয়ে ঘাড়-গলায় জমে ওঠা ঘামটা মুছে নিল। বর্ষায় এই এক ঝামেলা। বৃষ্টির ভয়ে জানলাও খুলে রাখা যায় না আবার জানলা বন্ধ করে রাখলেও পাখার হাওয়া ক্রমশ গরম হয়ে ঘরটাকে গুমোট করে তোলে। মশারির বাইরে থেকেই অরিজিতের পা-টাকে খাটের ওপর তুলে দিল নিলি। বাড়িতে এসি থেকেও এসির সুখ নিলিদের কপালে জোটে না। সে ঘরতো এখন আরোগ্য নিকেতন।

–দক্ষিণের ঘরে এসি লাগাবার দরকারটা কী? জানলা খুললেই তো ফুরফুর করছে হাওয়া। তাছাড়া মায়ের যদি ঠান্ডা লেগে যায়?

নিলির কথাগুলো এক ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়েছিল অরিজিৎ।

–গরমে ঘাম বসে যদি সর্দিগর্মি বাধায়, তখন কে দেখবে? তাছাড়া ডাক্তারই তো পারমিশন দিয়েছে ওই ঘরে এসি বসাবার জন্য। তুমি জানো না?

নিলি জানে। এ কথা সত্যি। তবু প্রতিবাদ করল।

–তবে তো মাকে এ ঘরে শিফ্ট করলেই পারতে। এসিই যখন আছে। বেকার বেকার দক্ষিণের ঘরটা…

নিলি অরিজিৎকে ওয়ালেটটা এনে দিল। অফিস বেরোবে। অরিজিৎ নীচু গলায় বলল,

–আর তো মাত্র ক’টা দিন নিলি। খুব জোর একবছর। তারপর তো পুরো ফ্ল্যাটটাই আমাদের তিনজনের।

নিলির বুকে বাজল কথাগুলো। একটু অসহিষ্ণুই হয়ে পড়েছিল সে। এমন করে না বললেই পারত। পরিস্থিতিটাকে সামাল দিতে পিকলুকে ডাক দিল। তাড়াতাড়ি তৈরি করে দিল ছেলেকে। বাপ-ছেলেতে বেরিয়ে গেল হাত ধরাধরি করে। ছেলেকে পুলকারে পুরে দিয়ে অরিজিৎ চলে যাবে অফিস।

বাথরুমের দরজাটা বন্ধ করে আলোটা বাইরে থেকে নিভিয়ে দিল নিলি। দু-একটা কুকুরের ডাক আর নাইট গার্ডের কান জ্বালানো বাঁশি ছাড়া তৃতীয় কোনও শব্দ নেই পাড়াটাতে। ডানহাতেই দক্ষিণের ঘর। আলতো করে দরজা ভেজানো। শাশুড়ি ঘুমোচ্ছে। তন্দ্রাচোখে ঈষৎ টলমল পায়ে সে ঘরের আলো জ্বালাতেই চমকে উঠল নিলি। ঘরের দেয়ালে আলো ফুটতেই খাঁ খাঁ করে উঠল গোটা ঘরটা। বিছানার ওপর মৃত্যুপথযাত্রী শাশুড়িও যেন হেসে উঠল খিলখিলিয়ে। গুমোট হাওয়া এসে ধাক্বা দিয়ে গেল নিলিকে। দমটা বন্ধ হয়ে আসছে। ভয়?

না কি…!

সম্বিত ফিরল নিলির। ভয় পাওয়ার কথা ছিল না তার। একটু আগেই পাশে ঘুমিয়ে থাকা অরিজিৎকে দেখে এসেছে সে। অন্ধকারে কি খেয়াল করেনি কিছুই? নাকি মাঝে মাঝে অভ্যেসটাই সত্যি হয়ে উঠে ভুলিয়ে দেয় আসল সত্যিটাকে? এসি বন্ধ, দক্ষিণের জানলাগুলোও আটকানো। ঘি, ফল, আতপ চাল, ফুলের মালা, ধূপের গন্ধ সবকিছু মিলেমিশে এক অদ্ভূত গন্ধের জন্ম দিয়েছে। কোথাও একটু যেন অগরুর গন্ধও মিশে আছে। সে কি ঘরে না কি নিলির নাকে? নিলির ঘোরতর আপত্তি সত্ত্বেও কে যেন শাশুড়ির সারা শরীরে অগরু ছড়িয়ে দিয়েছিল।

মাত্র দু’দিন কেটেছে। বেঁচে মরে থাকার অভিশাপ থেকে মুক্তি পেয়েছে অনিমা বিশ্বাস ওরফে অরিজিতের মা, ওরফে নিলির শাশুড়ি, ওরফে পিকলুর ঠাকুমা। রাতের আয়ারও ছুটি মিলেছে। বিছানায় সাদা চাদরের ওপর ফ্রেমে বাঁধানো অনিমার হাসিমুখ। মাথায় গরদ আঁচলের ঘোমটা। নিলি যেদিন এ বাড়িতে প্রথম পা রাখল সেদিন তোলা হয়েছিল। ঠিক সেই দিনের মতো হেসেই যেন নিলিকে দেখছে তার শাশুড়ি। ফুলের মালাটুকু শুধু একটু ছায়া টেনেছে মুখে। নিলির চোখ ঘুরে ঘরের কোণ। ব্যাগে-বাস্কেটে হরেকরকমের ফল। একেকবার একেকজন শোক জানাতে আসছেন আর কলাটা, আপেলটা, সবেদাটা, আমটা, আঙুরটা, চালটা, ঘিটা ঘর ভরে দিয়ে যাচ্ছেন। ফল কেটে অতিথিদের আপ্যায়ন করতে করতে নিলির প্রাণান্তকর অবস্থা। কত আর করা যায় একা হাতে? অর্ধেক তো গরমে পচেই যাচ্ছে। আম ছাড়া পিকলুটা একটা ফলও দাঁতে কাটে না। আর এদিকে লোকের পর লোক।

এই তো আজই দুপুরে, অরিজিৎ সবে হবিষ্যি সেরে উঠেছে, অমনি কলিংবেলে একশো পাখির কিচিরমিচির। নিলি দরজা খুলল। চোখভরা শোক নিয়ে ঢলঢল মুখে ছোটো মাসিশাশুড়ি। সঙ্গে ছেলে বুবলা আর তার বউ পিঙ্কি। বুবলার দু’হাত ভর্তি ফলপাকুড়-সবজি। পিঙ্কির হাতে দুটো বড়ো বড়ো মিষ্টির প্যাকেট। ঘর থেকে বেরিয়ে আসতে আসতে অরিজিৎ বলল,

–কে এসেছে গো?

দেখল ছোটোমাসি ততক্ষণে নিলিকে টপকে বারান্দা পেরিয়ে ঘরে এসে পড়েছে।

–ও ছোটোমাসি এসো এসো।

কথাটা শেষ হতেই ঘরমুখো অরিজিৎকে নিজের দিকে ফিরিয়ে বুকে জাপটে ধরে ছোটোমাসির সে কী কান্না!

– সঅঅঅব শেষ হয়ে গেল রে অরিইইই, সঅঅব শেষ হয়ে গেল। এখন তোদের কী হবে রেএএএ…।

বুবলা, পিঙ্কি নিজেদের ঝোলাগুলো নিলির হস্তগত করে চুপ। নিলির একটু বিরক্তই লাগল। সেই গেঁয়ো মা-পিসিমাদের মতো কাঁদতে কাঁদতে টিপিক্যাল সংলাপ আওড়ানো অসহ্য লাগে নিলির। মা-মাসিদের শোকপ্রকাশ করতে হলে কী এই ডায়লগগুলোই বলতে হয়? ভুরুদুটো কুঁচকে গেলেও মুখটাকে ঠিক করে নিল নিলি। যতই হোক মায়ের পেটের মেজোবোন তো। দিদির শেষ সময়ে মেয়ের কাছে ব্যাঙ্গালুরুতে ছিল বলে আসতে পারেননি। কালই ফিরেছেন।

শেষ দু’দিনে জমা হওয়া সব শোকই নিজের আঁচল আর অরিজিতের গায়ের সাদা চাদরটায় উপচিয়ে এখন ক্ষান্ত হয়েছেন। গুছিয়ে বসেছেন ছোটো মাসিশাশুড়ি।

–হ্যাঁরে অরি, তোরা দিদির মাথার কাছে একটা আস্ত মোচা রেখেছিলি তো?

–মোচা? আকাশ থেকে পড়ল অরিজিৎ।

নিলিও হতবাক। অরি বলল,

–না তো। কেন বলো তো?

–সে কী? তোদের কেউ বলেনি? বউমা, তুমিও জানো না?

অকস্মাৎ আক্রমণে নিলিও ঘাবড়ে তুতলে উঠল। –না-না তো ছোটোমাসি। জানি না…

ছোটোমাসি শরীরটাকে খানিক বাঁপাশে দুলিয়ে বলে উঠল,

–দ্যাকো দিকি, ওরে দিদি আমার বারবেলায় গেচে। দোষ পেয়েচে নিশ্চই। তা তোরা দোষ ঘোচাবি না? তার ওপর কথায় বলে, শনিবারের মড়া দোসর ডাকে।

–মানে? সে আবার কী? অরি বলল।

–মানে শনি-মঙ্গলবারে কেউ মরলে সে একা যায় না। সঙ্গে কাউকে না কাউকে নেয়ই।

ডিসগাস্টিং, মুখে আনল না। মনে মনেই গজরাল নিলি। কোথায় একটু সাহস জোগাবে তা না। উলটে আরও ভয় দেখাচ্ছে।

মাসি বলে চলেছে,

–অরি, বউমা, এ’কদিন তোমরা কোত্থাও বেরুবে না। সাবধানে থাকবে।

–কিন্তু ছোটোমাসি আপনার বোনপোকে তো নেমন্তন্ন করতে বেরোতেই হবে।

নিলির কথায় অরিজিৎও তাল ঠুকল,

–হ্যাঁ, তাছাড়া এগারো দিন ধরে তো আর অফিস কামাই করা যায় না।

–অঅঅ…। ছোটোমাসি বেশ ভালোই বুঝলেন যে তাঁর জ্ঞানগর্ভ বাক্যি ধোপেও টেকবার নয়। তাই শেষমেশ অন্যপথ ধরলেন।

–তবে সাবধানে চলাফেরা কোরো আর কী। অবিশ্যি তোদের কিছু হবে না। অরি আমাদের মেজদির একমাত্র বংশধর। মা হয়ে ছেলেকে কী আর…

ছোটোমাসি নিজেই থেমে গেলেন। নইলে নিলি তৈরি হয়েই ছিল প্রসঙ্গ পালটাবার জন্য। এর ফাঁকে পিঙ্কি আবার বুড়ি পিসিমাদের মতো ফুট কাটল,

–সে নয় হল মা, কিন্তু পিকলু আছে, বউদি আছে। ওদেরও তো একটা…’।

ছেলের বউয়ের কথাটাকে মাঝখান থেকে পট করে পাকড়ে ছোটোমাসি বলে উঠল,

–ও-ও নিয়ে চিন্তা নেই বউমা। শুশুড়ির শেষ সময়ে নিলি মা যা করেচে, লোকের মুখে তো শুনিচি। সেবার বুচন না কি মেজদিকে দেখতে এসেছিল, তা সে বাড়ি গিয়ে তো নিলির প্রশংসায় পঞ্চমুখ।

নিলি ঘোমটাটা আরও একটু ভালো করে টেনে নিল। ছাতি ফুলছে ঠিকই। লজ্জাও করছে। ছোটোমাসির যেন সবকিছুতেই বাড়াবাড়ি।

ছোটোমাসি বলে চলেছে,

–সে তো গিয়ে বললে, ও ছোটোপিসি ভাবতে পারবে না মেজোপিসি কী সুখে আছে। পান থেকে চুনটি তার খসছে না। শাশুড়িকে এসি-তে রেখে নিজেরা গরমে পচছে। কাঁড়ি-কাঁড়ি টাকা খরচা করে দিনরাতের আয়া রেখেছে। শুধু কী তাই? আয়া রেখেও সে বউয়ের শান্তি নেইকো। তারা ঠিক সময়ে ওষুধপত্তর দিচ্চে কি না, ঠিকঠাক খাওয়াচ্চে কি না, পেচ্ছাপ-পায়খানা ঠিকমতো হচ্ছে কি না, তারপর চেক-আপ কবে হবে স-অ-ব সব্বোদিকে নজর তার।

নিলির মুখে মৃদুমৃদু হাসি। অরিও যেন একটু স্বস্তি পাচ্ছে। দক্ষিণের ঘরটার ওপর নিলির যতই লোভ থাক, এসি-তে না থাকতে পারার কষ্ট থাক, তবু শাশুড়িকে সে অবহেলা করেনি। বাড়ি বয়ে এসে লোকে যদি বউয়ের প্রশংসা করে, তাহলে কোন স্বামীর না বুক ফোলে? আলতো করে অরিজিৎ একবার সগর্ব চাউনি হানল নিলির দিকে। নিলিও নতুন বউয়ের মতো লজ্জায় রাঙা হয়ে পদ্মপাতা চোখদুটিকে নামিয়ে নিল। অরি নিজে কতক্ষণই বা বাড়ি থাকত? সেই সকাল সাড়ে সাতটায় পিকলুকে সাথে করে বেরোত আর ফিরত সেই রাত আটটা-ন’টায়। কোনও কোনওদিন এগারোটাও বেজে গেছে। মুখে একটু রাগ-ঝাঁঝ দেখিয়েছে বটে কিন্তু পুত্রবধূর কর্তব্যে বিন্দুমাত্র অবহেলা করেনি নিলি। নইলে এই বাজারে কে আর কার বেকার প্রশংসা করে যায় বাড়ি বয়ে এসে, সে যতই নিকটাত্বীয় হোক না কেন?

বিকেল হতেই ছোটোমাসিরা চলে গেছে। তারপর রাত অবধি নিলির বুকটা খুশির বাষ্পে ভরে ছিল। এসি ছাড়া ঘরটাতেই কেমন একটা ফুরফুরে হাওয়া দিচ্ছিল, ওই দক্ষিণের ঘরের মতো। এমন করে নিলির সুখ্যাতি আর কেউ কোনওদিন করেনি। এমনকী অরিজিৎও না। সে তো খালি বউকে খিটখিট করতেই দ্যাখে। বেশ হয়েছে, নিজেরই ছোটোমাসি বোনপোর মুখে একেবারে ঝামা ঘষে দিয়ে গেছে। নিজের বউকে তো আর চিনল না সে। বাইরের লোকই চিনুক।

রাত্রে বিছানার একধারে অরিজিৎ আর মাঝখানে পিকলু শুয়ে আছে। পিকলুর হাতে রংচঙা রুবিক কিউব। বাক্স উলটে উলটে রংগুলোকে মেলানোর চেষ্টা করছে। অরি একটা ঢেকুর তুলল। নিলি এসে শাশুড়ির সুপুরি কাটার জাঁতিখানা দিয়ে গেল। বলে গেল,

–বালিশের তলায় রেখে দাও।

মশারির খুঁট টাঙাচ্ছে নিলি। অরি বলল,

–জানো, ভাবছি নেক্সট ইয়ার কাশ্মীর টুরটা করেই ফেলব। নিলির হাত দেয়ালের পেরেক পর্যন্ত পৌঁছেই আটকে গেল।

–হঠাৎ?

–এ বছর তো হওয়ারই কথা ছিল। তুমি কত আশা করেছিলে।

–উফ্ফ্ফ্, পারি না-আ-আ-আঃ, ভাগ্যিস ছোটোমাসি তোমার বউয়ের এত প্রশংসা করল!

–তা-আ-আ কেন? আমি কী আর জানি না মায়ের জন্য তুমি কত করতে?

–থাক। শুয়ে পড়ো। কাল কলেজ স্ট্রিট থেকে কার্ডগুলো আনতে হবে তো?

–হুঁউউউ। সে তো আনতেই হবে।

–কিন্তু সঙ্গে কাকে নেবে? এসময়ে তো একলা যেতে নেই।

অরিজিৎ হো হো করে হেসে উঠল। বলল,

–ভাগ্যিস, আমার ছোটোমাসি আমার বউয়ের এত প্রশংসা করল! একেবারে শিষ্যা হয়ে গেলে যে।

–বাজে বোকো না। তুমি একলা যাবে না। তার চেয়ে বরং ওই কেবিলের ছেলেটাকে নিয়ে যাও। কী শকু না হকু!

– ধুসসস্! ওদের আর কাজ নেই না কি?

–মোট কথা তুমি একা যাবে না ব্যস।

অরিজিৎ মিটিমিটি হাসল।

–একা যাব কেন? আমার একটা শক্তসমর্থ ব্যাটা থাকতে? কী রে যাবি তো আমার সঙ্গে?

পিকলুর গালটাকে টিপে দিল অরিজিৎ।

পিকলুও মিষ্টিহাসিতে মুখ ভরিয়ে ঘাড়টাকে একবার নেড়ে দিল। নিলি ফুঁসে উঠল,

–তোমার কী মাথাটা সত্যিই গেছে? মশারির মধ্যে ঢুকে

পড়ল নিলি।

–ওইটুকু একটা ছেলেকে এ অবস্থায় কেউ সঙ্গে নিয়ে যায়?

–ওইটুকুউউ! ক্লাস টু, নিলি। কী রে পিকলু। কী বলছে তোর মা? তুই না কি ওইটুকু!

পিকলু একবার মায়ের দিকে প্যাটপেটিয়ে চাইল। অরিজিৎ বলল,

–তাছাড়া ও সব জানুক, বুঝুক। পট করে আমরা কোনওদিন মরেই গেলাম। তখন শ্রাদ্ধের কার্ড ছাপাতে কোথায় যাবে ও? জানতে হবে না ওকে?

–উফ্…! এতো বাজে বকতে পারো না তুমি!

অরি পিকলুর মুখের কাছে মুখ এনে বলল,

–কীরে পিকলু, আমরা যখন বুড়োবুড়ি হব, অসুস্থ হয়ে বিছানায় পড়ে থাকব, তুই তখন দেখবি না? সেবা করবি না?

পিকলু খানিক বাপ-মায়ের মুখ চেয়ে প্রশ্ন করল, –ঠাম্মার মতো? নিলির ঠোঁটে হাসি। অরি বলল,

–ধর তাই। দেখবি না আমাদের?

পিকলুর সপাটে উত্তর, –না।

অরি থমকাল। নিলি ভুরু কুঁচকালো। অরি জিজ্ঞেস করল,

–কেন বাবু? তুই ছাড়া তো তখন আমাদের আর কেউ থাকবে না। তাও তুই দেখবি না?

উত্তর একটাই,

–না, দেখব না।

অরি কিংবা নিলি কেউই ছোট্ট পিকলুর কাছ থেকে এমন একখানা হৃদয়বিদারক জবাব আশা করেনি। কোনও মা-বাবাই তা করে না। তবু পিকলু বলল।

–কেন রে? আমরা কী করেছি?

অরির প্রশ্ন।

উত্তরে পিকলু বলল,

–আমার বউ বিরক্ত হবে। রাগ করবে।

নিলি ধাক্বা খেল। ছেলেটা এসব কী হাবিজাবি বলছে? অরি আশ্চর্য। জানতে চাইল,

–মানে?

আদুরে গলায় পিকলু বলল,

–আমার বউও তখন তার ফ্রেন্ডকে ফোন করে বলবে, বুড়িটা হাড়মাস জ্বালিয়ে খেল। মরেও মরে না। কোত্থাও বেড়াতে যেতে পারি না। কবে যে এসব ঝামেলা থেকে রেহাই পাব?

চোখ ফেটে জল এল অরিজিতের। পিকলুর কাছ থেকে উঠে বসল সে। নিলির মুখের দিকে তাকাল। নিলির চোখদুটোও ছলছল করে উঠেছে। ভবিষ্যতের শোকে না কি পাপের লজ্জায়? অরির চোখের দিকে তাকিয়েই চোখটা নামিয়ে নিল নিলি। অরিজিৎ বলল, –আলোটা নিভিয়ে দাও নিলি। তাহলে চোখ তুলে তাকাতে পারবে।

ঘরের আলো নিভে যেতেই বাইরের বিদ্যুতের আলোয় ঝলসে উঠল এক ‘ছোটো পরিবার সুখী পরিবার’।

বিদ্যুতের মতোই কথাগুলো কানে বাজছিল অনেকক্ষণ ধরে।

–নিলি, এই নিলি, নিলিইই…।

আচমকাই চোখটা খুলে গেল নিলির। চোখের ঝাপসা ভাবটা কাটতেই দেখল কাছা গলায় অরিজিৎ দাঁড়িয়ে ওর মুখের সামনে। নিলির সারা শরীর ঘামে ভিজে গেছে।

–কী হয়েছে তোমার? ফ্যান চালাওনি কেন? এসিটাও বন্ধ। এখানে এসে ঘরের আলো জ্বালিয়ে ঘুমোচ্ছ কেন? শরীর

খারাপ লাগছে?

কেন? কোথায় এসে পৌঁছেছে নিলি? চেতনা ফিরতে দেখল শাশুড়ির শেষ শয্যাতে এসে বসেছে সে। পাশেই ফ্রেমে বাঁধানো শাশুড়িমায়ের হাসিমুখ। ছ্যাঁত করে উঠল বুকটা। ছিল তো দরজার সামনে দাঁড়িয়ে। তারপর সেখান থেকে কখন কীভাবে কে তাকে টেনে আনল শাশুড়িমায়ের সামনে? ঘুমের ঘোর? পিকলুর বলা কথাগুলো? না কি…

কড়কড় করে বাইরের পৃথিবীটাকে ফালা ফালা করে দিয়ে গেল কেউ। নিলি দেখল, ফুলে ঢাকা শাশুড়িমায়ের মুখটা অবিকল ওর নিজের মুখের মতো।

কক্ষচ্যুত এক নক্ষত্র

( এক )

আরশির সামনে বেদানার রসে ভরা গেলাসটা ঠক করে নামাতেই বিভাবরীর চোখে পড়ল শ্রীয়ের কঠিন মুখটা। চোখের কোণ দিয়ে দেখলেন, আরশি এক চুমুক দিয়ে গেলাসটা নামিয়ে রাখল। বিভাবরী উঠে গিয়ে বিট নুনের কৌটোটা নিয়ে এলেন। বেদানার রসে এক চিমটি বিটনুন মিশিয়ে দিয়ে গেলাসটা আরশির হাতে তুলে দিলেন। আরশি বাধ্য মেয়ের মতো এক চুমুকে গেলাসটা শেষ করে নামিয়ে রেখে অল্প হাসল।

বড়ো বিষণ্ণ সে হাসি। এমনটা তো হবার কথা ছিল না! আরশি আর শ্রী দুই বোন একে অন্যকে চোখে হারায়। আর তাই জন্যই আরশি এত বড়ো পদক্ষেপটা নিতে পেরেছে। কিন্তু শ্রী! সে এত বদলে গেল কেন? চশমার কাচ মুছতে মুছতে বিভাবরী বাগানের দিকে চেয়ে থাকেন।

গেট খোলার শব্দ হয়, মালতীর ছেলেটা এসেছে। হাতের ঠোঙাটা বাড়িয়ে দিয়ে বলে, এই নাও ঠাকুমা, কাঁচা তেঁতুল।

শ্রী এসে দাঁড়িয়েছে, তেঁতুল কেন রে?

তা আমি কী জানি! মামাবাবু অফিস যাবার সময় বলল গাছ থেকে পেড়ে দিয়ে আসতে। আমাকে একটা দশ টাকার কয়েনও দিয়েছে। মালতীর ছেলে সাদা দাঁত ঝিকিয়ে হাসে।

শ্রীর মুখে কালির পোঁচ। দুম দুম করে পা ফেলে সে ভিতরে চলে যায়। বিভাবরী ঠোঙাটা নিয়ে হতভম্বের মতো দাঁড়িয়ে থাকেন।

( দুই )

স্নিগ্ধ এত জোরে বাইক চালিও না, আমার ভয় করে।

তীব্র হাওয়ায় আরশির আকুতি উড়ে গেল। স্নিগ্ধ বাইকের স্পিড আরও বাড়িয়ে দিল। ব্রিজের উপর দিয়ে বাইকটা উড়ে যাচ্ছিল যেন, নীচে দামোদর নদী তিরতির করে বয়ে যাচ্ছে। সেদিকে তাকিয়ে আরশির ভয় আরও বেড়ে গেল। আরশির সাদা ওড়নাটা পাখির ডানার মতো দুপাশে উড়ছিল।

লুকিং গ্লাস দিয়ে আরশির ভয় পাওয়া মুখটা দেখতে দেখতে স্নিগ্ধ চিৎকার করে ওঠে, তোমার উড়তে ইচ্ছা করে না আরশি? পাখির মতো ডানা মেলে?

এই স্নিগ্ধকে চিনতে পারে না আরশি। গম্ভীর প্রফেসর স্নিগ্ধময় মিত্র আর এই স্নিগ্ধ আকাশ পাতাল তফাৎ। হঠাৎ একটা ধাক্কা, বাইকটা ছিটকে পড়ে রাস্তায়। রক্তে ভেসে যাচ্ছে, রক্তের মধ্যে স্নিগ্ধ ছটফট করতে করতে স্থির হয়ে গেল। স্নিগ্ধর নাম ধরে চিৎকার করে উঠল আরশি।

স্নিগ্ধ এখনও তোর স্বপ্নে আসে? আমি তো ভাবলাম তোর পুরোটাই দখল করে নিয়েছে উজান। অন্ধকার ঘরে আরশিকে শুয়ে থাকতে দেখে লাইট জ্বালাতে এসেছিল শ্রী। সুযোগ পেয়ে খোঁচাটা দিতে ভুলল না।

আরশি ককিয়ে উঠল, দিদি, উজানদা আমার জামাইবাবু, তাকে আমি দাদার মতো শ্রদ্ধা করি।

হ্যাঁ তাই তো তেঁতুল খাবার শখ হলে উজানকে জানাস, বাড়িতে দুজন মেয়েমানুষ থাকা সত্ত্বেও। রাত্রে জল খাবার নাম করে তোর ঘরে আসে, আমি বুঝি জানতে পারি না?

স্তম্ভিত হয়ে যায় আরশি। এই তার প্রাণের থেকে প্রিয় দিদি? যার জন্য কিনা সে সমাজ, লোকলজ্জা, ভবিষ্যৎ কিছুর তোয়াক্কা করেনি? হ্যাঁ উজানদা, মাঝে মাঝেই রাত্রে ঘরে ঢুকে চুপটি করে দাঁড়িয়ে থেকে চলে যায়, পাশে জেঠিমা শোয়। উজানদা এক অমোঘ টানে বারে বারে আরশির কাছে ছুটে আসে, কারণ ওদের সন্তান আরশির গর্ভে তিলে তিলে বেড়ে উঠছে। উত্তেজনা, উদ্বেগ অনাগত সন্তানের পিতা হিসাবে থাকা তো স্বাভাবিক। এটা তো দিদির মধ্যেও থাকা উচিত ছিল। দিদি এমন বদলে গেল কেন? আরশির চোখ দিয়ে জমাট মুক্তোর বিন্দু টুপটাপ করে ঝরে পড়তে লাগল।

( তিন )

ট্রাফিকে গাড়িটা অনেকক্ষণ আটকে ছিল। উজান মোবাইলটা হাতে নিয়ে আরশির বেবি বাম্পের ছবিটা দেখছিল। অনেক সাধ্য সাধনা করে ছবিটা আদায় করেছে। বাড়িতে কথা প্রায় হয় না দুজনের। তবে অফিস থেকে উজান অজস্র টেক্সট পাঠায়। প্রথম দিকে কৃতজ্ঞতার ভাগটাই বেশি ছিল। শ্রীর পরপর তিনটে মিসক্যারেজের পর আরশি এগিয়ে না এলে আজকের এই দিনটা আসতই না।

ডক্টর দুবে বলেই দিয়েছিলেন, এই কেসটা সলভ করা খুব সহজ না। আপনারা রাজি থাকলে সারোগেট মাদার খোঁজ করুন, চাইলে আমিও হেল্প করতে পারি। অভাবী ঘরের প্রচুর মেয়ে মোটা অর্থের বিনিময়ে একাজ করছে।

শ্রী আর উজানের স্বপ্ন অন্য সম্পূর্ণ অচেনা কারুর জঠরে প্রতিপালিত হবে? ওরা দুজনেই ব্যাপারটা মানতে পারেনি। দিশাহারা অবস্থা তখন ওদের। মা বরং আধুনিক মানুষ, বলেছিলেন, একটা বাচ্চা দত্তক নিলেই তো সমস্যার সমাধান হয়? আমাদের দেশে কত অনাথ বাচ্চা, একজনকেও যদি কাছে টেনে নিই ক্ষতি কীসের! বরং শিক্ষিত নাগরিক হিসাবে এটাই আমাদের কর্তব্য হওয়া উচিত।

বাবু, মালা নেবেন?

বাচ্চা ছেলেটা ফুলের মালা নিয়ে ঘুরে ঘুরে বিক্রি করছিল। জানলার কাচে টোকা দিতেই উজান একটা জুঁইয়ের মালা কিনে নিল। তারপর কী মনে হতে দুটো মালা নিল। আসলে আরশি জুঁইফুল খুব ভালোবাসে। ওর ডিপিতে আজও স্নিগ্ধর সঙ্গে একটা ছবি আছে পরনে সাদা কেরালা কটনের শাড়ি, মুক্তোর গয়না, আর খোঁপায় জুঁই ফুলের মালা। ছেলেটাকে টাকা দেবার সঙ্গে সঙ্গেই সিগন্যালের সবুজ আলো জ্বলে উঠল।

ড্রাইভ করতে করতে উজান ভাবছিল, কৃতজ্ঞতাটা একসময় মায়ায় বদলে গেল। মেয়েটার কষ্ট যন্ত্রণাক্লিষ্ট মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে বুকের মধ্যে কবে যে-টলটলে একটা মায়ার সরোবর তৈরি হয়ে গেল! আর এখন কি শুধুই মায়া! উজানের চাহিদা যে-আকাশছোঁয়া!

আরশি, এভাবে মন ভরে নাকি? বেবি বাম্প-সহ তোমার পুরো ছবি দাও। একথা বলল কেন কাল? আরশি কি কেঁপে গিয়েছিল! ওর আঙুল কি কয়েক মুহূর্ত থমকে গিয়েছিল কী প্যাডের উপর? নাহলে কিছু সময় পরে কেন উত্তর দিয়েছিল, এ হয় না উজানদা, আমাকে দেখতে চেও না প্লিজ।

জুঁইফুল? এ আমি পছন্দ করি না, গন্ধটা তীব্র লাগে। যার জন্য এনেছ তাকেই দিও। আর হ্যাঁ, এবার থেকে সব জিনিসই দুটো করে আনবে নাকি? চায়ের কাপ হাতে তুলে দিতে দিতে তাচ্ছিল্যে শ্রীর ঠোঁটটা বেঁকে গেল। বারান্দার টেবিল ঘিরে বাকি তিনটে মানুষ পাথরের মূর্তির মতো বসে থাকে। চায়ের কাপ শীতার্ত কুয়াশায় ঢেকে যাচ্ছে।

( চার )

আমি কিন্তু এই গরমে কোথাও যেতে পারব না, তাছাড়া পুজোর ভোগ রাঁধার জন্য ওই পারিবারিক পচা পুকুরে ডুব দিতেও পারব না। বাবার কাজের সময় ওখানে স্নান করে সারা গায়ে যা ইনফেকশন হয়েছিল! শ্রী স্পষ্ট জানিয়ে দিল সে গ্রামের বাড়িতে যাবে না।

এদিকে সাত মাসের পুজোটা পারিবারিক মন্দিরেই দিতে হয়, তেমনটাই বসু পরিবারের নিয়ম। বিভাবরী টের পাচ্ছেন পরিস্থিতি ক্রমশ জটিল হচ্ছে। তিনি এও টের পাচ্ছেন, শ্রী যত উজানকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে, উজান আশ্রয় খুঁজছে আরশির মধ্যে। আরশিকে তিনি খুব একটা বুঝতে পারেন না, সারাদিন বই মুখেই কাটিয়ে দেয়। অল্প বয়সে স্বামীকে হারাল, সাধ আহ্লাদ ওরও কি নেই? নাহলে উজান শেষ মুহূর্তে নেপাল যাওয়াটা ক্যানসেল করল কেন? খুব ক্রিটিক্যাল অবস্থা তো না আরশির। তবু সেদিন রাত্রে শুয়ে মেয়েটা কেন বলেছিল, জেঠিমা, দিদিরা বারোদিন বাইরে থাকলে ভয়ে কাঁটা হয়ে থাকতাম। উজানদা থাকলে ভরসা পাই। আজ খুব নিশ্চিন্তে ঘুমাব জানো তো! তার মানে ওদের না যাওয়ায় আরশির ভূমিকা ছিল?

সংসারে নতুন অতিথি আসছে, আনন্দে ভেসে যাওয়ার কথা কিন্তু সবাই থমথমে মুখে রোবটের মতো ঘুরে বেড়াচ্ছে। শ্রী একদিন বলেই ফেলেছিল, এর থেকে বাচ্চা না হয় না-ই আসত।

শ্রীকে ওর মায়ের জিম্মায় রেখে ওরা সবাই কুসুমপুরে এসেছে। ওদের আসার খবর পেয়ে জীর্ণ বাড়িটা ঘষে-মেজে পরিষ্কার করে রেখেছে মানদা আর বসন্ত মিলে। সারা বছর জমি বাড়ি, ঠাকুরপালা ওরাই সামলায়। কালকে মা অন্নপূর্ণার পুজো। গ্রামেও এখন আধুনিকতার ছোঁয়া, টিভি সিরিয়ালের দৌলতে সারোগেসি ব্যাপারটা আর নতুন না। অনেকেই আরশিকে দেখে গেল। আরশিও আজ খুব খুশি, উজান সিঁড়ির অন্ধকারে টেনে নিয়ে প্রথমে ওর বেবি বাম্পে তারপর ওর ঠোঁটে চুমু খেয়েছে। আরশি আর উজানের চোখে স্বপ্ন উপচে পড়ছে। বিভাবরী, বউ-মেয়েদের সঙ্গে বসে পুজোর জিনিসপত্র গুছিয়ে রাখছিলেন।

উজান বলে উঠল, একটু চা হলে মন্দ হতো না।

বিভাবরীও বলেন, যা বলেছিস, আমারও মাথাটা ধরেছে কিন্তু এখন হাত জোড়া, একটু অপেক্ষা করতে হবে।

আরশি চা বানাতে উঠে যায় হাসিমুখে। রান্নাঘরে পা দেবার একটু পরেই বীভৎস চিৎকার আর তারপরেই ভারী কিছু পড়ে যাবার আওয়াজ। আরশির তেমন ক্ষতি না হলেও বাচ্চাটাকে বাঁচানো যায়নি।

আরশির নিজেকে বারেবারে দোষী মনে হয়েছে। বার্নারটা এমন দাউদাউ করে জ্বলে উঠল যে, সে হুড়মুড় করে বেরিয়ে আসতে গিয়ে চৌকাঠে হোঁচট খেল।

শ্রী আগের মতোই বোনকে কাছে টেনে নিয়েছে। উজান সিদ্ধান্ত নিয়েছে একটি শিশুকে দত্তক নেবে।

আরশি এখন অনেকটাই সুস্থ, হায়দরাবাদে নতুন অফিসে জয়েন করতে যাবার আগের দিন সবার সঙ্গে দেখা করতে এল।

বিভাবরীকে বারান্দার এক কোণে টেনে নিয়ে চোখে চোখ রেখে জিজ্ঞেস করল, আপনি কেমিস্ট্রির ভালো ছাত্রী ছিলেন তাই না? অ্যাস্ট্রিঞ্জেন্ট লোশনের মধ্যে মিশে থাকা ইথানলের ফোঁটাগুলোই আমাদের কক্ষচ্যুত হওয়ার হাত থেকে বাঁচিয়ে দিল।

আরশির শীতল দৃষ্টির সামনে বিভাবরীর নিজেকে কক্ষচ্যুত এক নক্ষত্র মনে হল।

 

 

ব্যথার বর্ণমালা

তিরিশ বছর পর সেই সেন্টেনারি বিল্ডিংয়ে সিঁড়িতেই বসে পড়লাম আমি। রাই আজই এই কলেজ স্ট্রিট ক্যাম্পাসে প্রথম ক্লাসে এল। আমি বাংলা পড়েছি বলে নয়, রাই ওর নিজের পছন্দেই বাংলা পড়ছে। আমি একপ্রকার জোর করেই ওর সঙ্গী হয়েছি। বলেছি, চল না, তোকে ইউনিভার্সিটির গেটে এগিয়ে দিয়ে আমি অফিস যাব ’খন। আমার আজ অত তাড়া নেই। রাই বলেছে, তুমি চাপ নিচ্ছ কেন আমি কি কচি খুকি নাকি?

আসলে আমি এসেছি এক অমোঘ টানে। তিরিশ বছর আগে আমিও যে বাংলা পড়তে এসেছিলাম এখানে। এই আশুতোষ বিল্ডিংয়ে আমাদের ক্লাস ছিল। সবই প্রায় একইরকম আছে। শুধু শাড়িতে সজ্জিত দীপারা হারিয়ে গেছে। এ যুগের দীপারা স্কিন টাইট জিন্সে আর টাইট টপে, লেগিংস আর কুর্তিতে বেশি স্বচ্ছন্দ ও সাবলীল। ওদের ভিড়ে সালোয়ারে শোভিত দীপাও আছে কয়েকজন। আমার মেয়ে রাই-ও তাদের দলে।

রাইকে আমার ছাত্রাবস্থার সব গল্পই বলেছি। তবে দীপার কথা রাই জানে না। রাইয়ের মা কেয়াকেও বলিনি। বলব কী? সে বড়ো ব্যথার অধ্যায়। আমার জীবনের সেই করুণ কাহিনি শুনিয়ে মেয়ের করুণা কুড়োতে চাইনি আমি।

বললে কেয়া, দীপার কথা তুলে উঠতে বসতে খোঁচা দিতে ছাড়ত না। সে আমার বুকের অতলে ঘুমিয়ে থাকা গভীর গোপন ইতিবৃত্ত। সত্যি বলতে কী, তিরিশ বছর আগের এই বাংলা ডিপার্টমেন্টের সেই অপরূপা দীপাই আজ আমাকে এখানে টেনে এনে বসিয়ে দিল। রাই হাত নেড়ে আশুতোষ বিল্ডিংয়ে ঢুকে উঠে গেল। আর আমি এক মর্মান্তিক স্মৃতির ভারে বসে পড়লাম সেন্টেনারি বিল্ডিংয়ের সিঁড়িতে।

দুই হাঁটুতে দুই কনুই ঠেকিয়ে দুই হাতের বেষ্টনিতে মাথা নত করে কপালের ভার ছেড়ে দিয়ে চোখ বুজলাম। কী আশ্চর্য! চোখ বুজতেই আমার চোখের সামনে স্পষ্ট দৃশ্যমান হল তিরিশ বছর আগের এক রোববারের দুপুর। সেই আউট্রাম ঘাটে। একেবারে চলচ্চিত্রের মতো ঘটনা পরম্পরা! আমার হৃৎপিণ্ড কাঁপিয়ে দিয়ে দীপা বলল, চল নৌকো চড়ি। দীপা উঠে দাঁড়িয়ে শাড়ির পাটে খানিক আঙুল চালিয়ে নিয়ে ফের বলল, নে ওঠ।

নৌকো চড়বি কী রে? প্রশান্ত আসবে না? সত্যিই যেন ব্যাপারটা আমার অবাক লাগল। আসলে এর চেয়ে সুখের আর কী হতে পারে? না ঠিক সুখ বলা যায় কি? একটা খুশির হাওয়ায় ভেতরটা দুলে উঠেছিল নৌকো চড়ার কথা শোনামাত্র। সস্তার সুখ আমি চাইনে। বড়ো কথা যখন জানিই দীপার প্রেমিক আছে।

দুপুর দুপুর ইউনিভার্সিটি থেকে বেরিয়ে আউট্রামের জলপুলিশ অফিসের কাছাকাছি গঙ্গামুখী কাঠের বেঞ্চিতে বসে আছি, আমি আর দীপা। প্রশান্ত এল না। তার জন্যে দীপার খুব একটা এল-গেল বলে মনে হল না। কেন কে জানে? কথা দিয়ে নির্দিষ্ট সময়ের দু-দুটো ঘন্টা পরেও ওর প্রেমিক এল না। তা নিয়ে দীপার উদ্বেগ তো ছাড়, সামান্য ভাবনা হল বলেও বোঝা যায়নি। তার ওপর নৌকো চড়তে চায় শুনে সত্যিই অবাক লাগল আমার!

কথার ফাঁকে আমিই বলেছি, কী হল তোর প্রশান্তর? এটুকু নেহাতই সৌজন্য। যার অনারে আসা সে-ই এল না। এ নিয়ে আমার যেন বড়ো আফশোশ হচ্ছিল। বুকে হাত দিয়ে বলতে গেলেই তো সত্যিটা ফাঁস হয়ে যাবে। পারব সত্যিটাকে ঢেকে দিতে? আসলে প্রশান্ত না আসুক, মনেপ্রাণে আমি সেটাই যে চাই, দীপাকে কি তা বুঝতে দেওয়া যায়?

দীপার সঙ্গে আজকে এই মুহূর্তগুলোর পুরোপুরি আনকোরা স্বাদ আমার। এর আগে কি কোনওদিন ভাবতে পেরেছি যে, এমন একটা দিনও আসতে পারে? দীপা আমার এত কাছাকাছি ঘন্টা দুয়েক বসার পরেও একান্ত নিভৃতে নৌকোতেও না জানি আরও কতক্ষণ থাকবে। তবে? বোকার মতো আমি এটা কী করে চাই যে প্রশান্ত এসে এই অনন্য মুহূর্তগুলো কেড়ে নিক? আর আমি বাঁয়ে চলে যাই।

দীপা না জানলেও এটা তো ঠিক যে, দীপার কাছে থাকলে আমি সব ভুলে যাই স্মৃতি বিস্মৃতির পরোয়া করি না। তাছাড়া কোন পুরুষই বা না চায় দীপার মতো ষোলোকলা পূর্ণ নারীর সঙ্গে দিনের চার-পাঁচ ঘন্টার আপস সান্নিধ্য? উপরি পাওনার মোহ যখন মানুষের সহজাত, তখন তো কোনও প্রশ্নই আসে না। অনেকে আদর্শের কথা বললেও আমি অত আদর্শবান হতে পারিনে।

সমরের মুখে শুনেছিলাম কথাটা প্রথম। বিশ্বাস হয়নি। তারপর এর-ওর মুখে গোপন মূল্যবান খবরের মতো ছড়াতে দেখে সেদিন দুপুরের দিকে সোজা চলে গেলুম বুবুনদিদের বাড়ি।

বুবুনদির বাবা নেই। তবে পৈতৃক ভিটেবাড়ি অর্থাৎ ঠাকুরদার আমলের মোটা মোটা থাম্বা দেওয়া অদ্ভুত বাড়িতে অনেকগুলি ঘর। এখন সব ভাড়া দেওয়া আছে। তবু বুবুনদির নিজস্ব একটা আলাদা ঘর আছে। সে ঘরে সচরাচর কেউ আসে না। বুবুনদির ছোটো ভাই বা বোনেরা, মাসিমা, কেউই।

মোমের আদলে ছিপছিপে গড়নের বুবুনদি। বিলুদার সঙ্গে বুবুনদির সম্পর্কের কথা কারুরই যেমন অজানা ছিল না, তেমনি কারুরই জানতে বাকি নেই, সেই সম্পর্ক ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে। কেন? জানতে চেয়েছি। বুবুনদি বলেনি কিছুই। তবে সমরের মুখে যা শুনেছি, তার সত্যি-মিথ্যে আমাকে জানতে হবে। গিয়ে দেখি বুবুনদি বাড়ি নেই। খানিক আগেই বেরিয়েছে কোথায়। মাসিমা বললেন জানি না।

কথা না বাড়িয়ে গিয়ে বুবুনদির ঘরে টান টান হয়ে শুয়ে থাকলাম। বুবুনদির ঘরের সব আসবাবে, বিছানায় একটা বহু ব্যবহারের ছাপ। সারা সংসারেই একটা অস্বচ্ছলতার অনাবিল ছবি ফুটে ওঠে। বুবুনদির বাবা বেঁচে থাকতে তাদেরই এই চত্বরের সবচেয়ে অবস্থাপন্ন বলে মনে হয়েছে। একটা বিদেশি ফার্মের স্টেনো ছিলেন বুবুনদির বাবা। আমি ইংরেজি নিয়ে আসতাম এ বাড়ি।

কেউ জানত না, তখন আমার মনে হয়েছে বুবুনদির মধ্যে একটা অলক্ষ্য মাতৃত্ব আছে। বুবুনদির কাছে নিরাপদ মনে হয়েছে, সে যা-ই ঘটুক না কেন। সেই আমারই মধ্যে কখন যে ধীরে ধীরে কামনার রক্ত গরম হয়ে উঠেছিল! বুঝলাম সেদিন, যেদিন অনাবশ্যক ভাবে বুবুনদিকে জড়িয়ে ধরে গলার কণ্ঠায় চুমু খেয়ে বসলাম। কিছু বলেনি সেদিন বুবুনদি আমায়। আর তার জন্যেই আমার বাড় বেড়ে গেল। একটা পাপবোধ ভেতরে ভেতরে দানা বেঁধে উঠতে লাগল।

বুবুনদির কাছে গেলেই সেই একই ভাবনায় কেঁপে উঠত বুকের ভেতরটা। সেরকম একদিন আরও। হুট করে জড়িয়ে ধরে বুবুনদির বুকের রেখায় অনবরত চুমু খেতে লাগলাম। এক ঝটকায় নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বুবুনদি বলেছিল, অসভ্য কোথাকার! এভাবে কেউ দিদিকে আদর করে? লজ্জায় অপমানে বিপন্ন ফেরারির মতো পালিয়ে এসেছি সেদিন।

ছোটো বোন শিলুকে দিয়ে খবর পাঠালেও বুবুনদির সামনে গিয়ে দাঁড়াতে পারিনি। প্রাণ খুলে সেই থেকে বুবুনদি বলে আর ডাকতে পারিনি। ভাবলে নিজের ওপর ঘৃণায় গা শিরশির করে ওঠে। কলজে চুঁইয়ে অনবরত ঘৃণার ঘাম নেমে আসে। সেই বুবুনদিকে নিয়ে এমন একটা ভযংকর কথা এ-মুখ সে-মুখ হচ্ছে। বুবুনদির কাছেই তার সত্যিটুকু জেনে নিতে হবে। বুবুনদির বিছানায় শুয়ে থাকতে থাকতে আচ্ছন্নের মতো ঘুম এসে যাচ্ছিল।

সন্ধের পর বুবুনদি এল। আলোর সুইচ চেপে দিয়ে আমাকে দেখে বলল, কখন এসেছিস? আমি সে কথাকে পাশ কাটিয়ে গেলাম।

—সরাসরি বললাম, তোমাকে নিয়ে কীসব কথা চালাচালি হচ্ছে খবর রাখো?

ভাবলেশহীন বুবুনদি বলল, আমি জানি। যা শুনেছিস সব সত্যি।

—তার মানে? সহসা আর কোনও কথা বেরোল না আমার মুখ থেকে।

বুবুনদিই বলল, আবার তুই জানতে চেয়েছিলি না, তোর বিলুদা কেন আসে না? এজন্যই আসে না। তারপর স্বগতোক্তির মতো বলল, ইডিওলজি ধুয়ে জল খাই আর এত বড়ো সংসারটা ডুবে যাক।

—তাই বলে তুমি ছবি আঁকিয়েদের সামনে ওভাবে…

—চুপ কর, হালকা ধমকে উঠেছিল বুবুনদি। দেহ ভাঙতে রাস্তায় বেরোলে খুশি হতিস?

বাঁচার জন্য বুবুনদি কোনও কিছুরই তোয়াক্কা করেনি। তাকে নিরাবরণ দাঁড়াতে হয় ছবি আঁকিয়েদের সামনে। দীপার সামনে এলেও আমি ওই সব ছেঁদো আদর্শের তোয়াক্কা করি না। করি না বলেই অন্যের প্রেমিকা জেনেও নিছক আদর্শের জন্য দীপার সঙ্গে একই মন নিয়ে মেলামেশাতে পিছপা হই না। হওয়ার সাধ্যিও নেই আমার। কেবল দীপার চোখ দুটো যেন এক অমোঘ শাসনে বেঁধে রাখে আমার সম্পূর্ণ সত্তাকে। কেন? তা জানিনে।

—কী হল ওঠ! নৌকায় চড়ার জন্য এবারে তাড়া দেখিয়ে আমার হাতে হেঁচকা টান দিয়ে আমায় দাঁড় করাল দীপা।

—আমি বললাম, হঠাৎ ক্ষেপে গেলি কেন নৌকোয় চড়ার জন্য?

—তুই আয় তো বলেই, দীপা খেয়াঘাটের দিকে সিঁড়ি ভাঙতে লাগল। আমিও পিছু নিলাম। আবারও বললাম, তোর প্রশান্ত তাহলে এলই না।

—ধুর, ছাড় তো ওর কথা। নিজের প্রেমিক সম্পর্কে এত নিস্পৃহতা, উদাসীনতা কারও থাকতে পারে? দীপাকে না দেখলে বিশ্বাস হতো না আমার।

দীপার পেছন পেছন আমি খেয়াঘাটের সিঁড়ি ভাঙছিলাম। পিছনে ঘাড় ঘুরিয়ে দীপা জিজ্ঞেস করল, এর আগে নৌকো চড়েছিস কোনওদিন?

আমি বললাম, না।

—কেন চড়িসনি!

—বা রে! আমরা তো নর্থ বেঙ্গলেই ছিলাম বেশি।

সিঁড়ি শেষ হতেই প্যাচপ্যাচে কাদার ওপর জোড়া জোড়া ইট পাতা, এক হাত মতো ফারাকে ফারাকে।

—দীপা বলল, আমার হাতটা একটু ধর। আমি চট করে ধরে ফেললাম হাতটা। সাবধানে পায়ে পায়ে এগোতে থাকলাম।

দীপাকে আজ আমি যেন নতুন করে চিনছি। আবিষ্কার করছি। মাঝে মাঝেই দীপা আমার শূন্যবুক ভরে দিয়ে তাকিয়েছে। দীপা এত অদ্ভুত তাকাতে পারে? ছেলেমানুষের মতো আমার মনে হয়েছে দীপাকে যদি আমি নিজের করে পাই, আর ও যদি আমার দিকে এভাবে তাকায়, তাহলে সাতজন্ম আমার ক্ষিদেই পাবে না!

এখনও পর্য‌ন্ত খুব একটা হইচই কথার ফুলঝুরি উড়িয়েছে, তা না। অল্পস্বল্প যে দু-চার কথা বলেছে আর ছেলেমানুষি হেসেছে, তাতে আমার মনে হয়েছে, দীপাকে এখন আমি অনেক শক্ত কথাও অবলীলায় বলে দিয়ে স্টেডি থাকতে পারব, মুখ থুবড়ে পড়ার ভয় নেই কোনও। শক্ত কথা বলতে তো ওই একটাই কথা আমার মনে ঘুরপাক খায়। তা হল, দীপা আমার মধ্যেই প্রশান্তকে খুঁজে নিক না।

—এসব ভাবা খুবই অন্যায়। বুঝি সেটা। দীপা ঘুণাক্ষরেও টের পেলে কেলোর একশেষ হবে। বলবে, তলে তলে তুই এতটা উত্তীয়!

—এতটার কী আছে? তোকে ভালো লাগে, তোকে ভালোবাসি, ব্যস। মোদ্দা কথা, তোকে ছাড়া আমি  সিনেমার হেমামালিনীকেও কল্পনা করতে পারব না।

—কল্পনা করতে পারব না, আবদার আর কি! কুমির তোমার জলকে নেমেছি, ছেলেখেলা যেন।

—কোনও কিছুই ছেলেখেলা নয়। বস্তুত, দীপার প্রেমিক আছে, ভেবে নিজেকে সচেতন করে গুটিয়ে নেওয়ার আগেই তো ভরাডুবি হয়ে গেছে। ছেলেখেলা তো দীপাই করেছে গোড়া থেকে। নইলে প্রথম দিন করিডোরে অপরিচিতের দিকে ওভাবে কেউ তাকায়? প্রাণান্ত ইশারা করে কেউ হাসে ওভাবে? অন্তত নিজের একজন প্রেমিক যখন আছে! আমার বুকে কার্তিকের হিম জমাট বেঁধে আছে সেই থেকে। দীপার জন্যই তো। দীপা ছাড়া অন্য কারুর তোপে কি সে হিম ছাড়বে বুক থেকে?

মেয়েদের মধ্যে সুমিতার সঙ্গেই প্রথম আলাপ হয়েছিল। সুমিতাই দীপাকে ডেকে পরিচয় করিয়েছিল আমার সঙ্গে। দু’চার কথা বিনিময় হয়েছে সবে, তখুনি অসীম এসে সুমিতাকে ডেকে নিল। সুমিতা চলে গেলেও দীপা যাওয়ার কোনও লক্ষণই দেখাল না যখন, তখন আমিই বা কী করে হুট করে চলে আসি? দীপার মতো মেয়ে সামনে দাঁড়ালে অনেক আচ্ছা আচ্ছা কলিজাও শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাবে। তবু সৌজন্যের খাতিরে কিছু একটা বলে তো আমাকে রেহাই পেতে হবে।

সহসা ওর দিকে তাকিয়ে সামান্য হেসে বলতে গেলাম, আপনাকে আগেই দেখেছি। কিন্তু কথা শেষ হওয়ার আগেই সে হাসি বিপন্ন ম্লান হয়ে ঠোঁটের আগায় ঝুলে পড়ল। দীপা দমকে হঠাৎ এমন ভাবে হেসে উঠল, মনে হল কাচের জার মেঝেয় পড়ে ভেঙে চৌচির হল। আমার অস্বাভাবিক ভেতরটা কি ও বুঝতে পারল? এভাবে হেসে উঠল যে!

দীপার ফর্সা দুপাটি দাঁত এক হতেই সে বলল, আমাকে আপনি কেন? সংকোচের কাঁটা সরে গেল অনেকটা।

—সহসা বললাম, এখানে সবাই তুই-তুকারি করে। আমি চট করে কাউকে তুই বলতে পারি না। আমার আসে না।

দীপা বলল, আমাকে তুমি তুমিই বলো।

—তার মানে? তুমি বলবে আর আমি বাধ্য শিশুর মতো তোমার কথাকে শিরোধার্য করে তোমাকে তুমি তুমি করে তোমার ওপর আমার দুর্বলতাকে সাড়ম্বরে জানান দিই আর কী!

আমার মনের ভেতরে কেন জানি এসব বুদবুদের মতো ভেসে উঠতেই আমি বলে বসলাম, এখানে সবাই যখন তুই বলতে পারে, তখন আমাকেও তো চেষ্টা করে পারতে হবে। কথাগুলোকে এমন ধীরে-সুস্থে বললাম, যেন দীপার মতো অমন ডানাকাটা পরি গোছের একটা সুন্দরী মেয়েকেও মনে হতে থাকে, কই তেমন তো কিছু দেখলাম না আমার চোখে! এমনই উন্নাসিক ভাবে তাকাতে গেলাম ওর দিকে। কিন্তু সত্যিকারের আগুনে কি আর শিশির ভেবে হাত রাখা যায়?

আমার দিকে দীপার অদ্ভুত প্রগল্ভ চাউনি দেখে একটা তীব্র সুখ যন্ত্রণার আকারে বুকের রক্তে আঘাত করতেই সারাৎসার রক্ত নুয়ে পড়ছিল। তখনও কি জানতাম, এই দীপার একজন প্রেমিক আছে?

মেয়েদের চোখে আমি নাকি মুখচোরা গোছের। একথা বহুবার আমার কানে এসেছে। সুমিতা, দীপা ওরাও তাই ভেবেছে নিশ্চয়ই। তবে যে-অর্থে ওরা আমায় মুখচোরা ভাবে, সেদিক দিয়ে কারুর চাইতে কম যাই না আমি। তবু চট করে কারুর সঙ্গে তেমন ভাবে জমিয়ে নিতে পারি না।

সেই আমার সঙ্গে দীপার মতো সপ্রতিভ চরিত্রের মেয়ের পরিচয় হওয়াটা নিতান্তই দৈবাৎ। আরও বেশি দৈবাৎ ঘটনাটা ঘটে গেল ফ্রেশার্স ওয়েলকামের দিন। কাউকে জানাইনি কথাটা। আগের দিন ঠিক করে ফেললাম মনে মনে। বলেও ফেলতে পারতাম। কিন্তু তুষার, অসীম, সুমিতার সঙ্গে দীপাও ছিল। রহস্যময় ভাবে কথাটা তাই চেপে গেলাম বেমালুম।

এখানে আমার এ বিষয়ে কেউ জানে না কিছু। তাই সামান্যও ধারণা বা আঁচ করতে পারেনি কেউ। সে নিয়ে আমাদের মধ্যে কোনও কথাও ওঠেনি। তলে তলে ব্যবস্থা পাকা করেছি আমি একা। দীপা না থাকলে হয়তো শেষ পর্য‌ন্ত কাউকে না কাউকে বলেই ফেলতাম কথাটা। প্রথমদিন আলাপের পর দীপার সঙ্গে আমার আর কোনও কথাই হয়নি বলতে গেলে।

ইউনিভার্সিটিতে সবার সামনে মাঝেমধ্যে আমার সুপ্ত বাকপটুতার আত্মপ্রকাশ ঘটলেও, দীপা এসে গেলেই আমার ক বর্ণ কথাও নিতান্তই মূল্যহীন মনে হয়েছে। কেবলই মনে হয়েছে, যা বলেছি সে তো হাজার হাজার লোকের মুখের কথা। দীপাকে আমি এমন কথা শোনাই, যা শুনে দীপা চমকে যাবে। সম্পূর্ণ আলাদা গোছের, সম্পূর্ণ আনকোরা, দারুণ মূল্যবান, অথচ সহজ হৃদয়গ্রাহী। যে-কথা এর আগে কেউ বলেনি। এসব ভেবে বাকহীন জড়ের মতো সবার কথার মধ্যে বসে থেকেছি। মাঝেমধ্যে দু-চার কথায় সায় দিয়েছি। দীপার সঙ্গে সরাসরি কোনও কথা হয়নি। ও-ও বলেনি। আমিও সহসা পারিনি কিছু বলতে।

পরদিন নবীন বরণে এসেছি অনেক আগে থেকেই। তখনও কাউকে বলিনি কিছু। কাউকে বলে ফেললে হয়তো ভেতরটা অনেক হালকা হয়ে যেত। তবু সবাইকে চমকে দেওয়ার একটা তীব্র স্পৃহা কাজ করল মনে মনে। টেনশনটা সেজন্যই বাড়ছিল আরও বেশি। যতই সময় এগিয়ে আসতে লাগল, ততই কী হয়! কী হয়! ভয়ে গলা শুকিয়ে আসছিল।

তখন অনেকেই এসে পড়েছে। দীপাও এই এল। হালকা আকাশি রঙের ফিনফিনে হাওয়ার মতো পাতলা গোছের শাড়িটায় কালচে বুটি। এই শাড়িটার জন্য দীপার শরীরের প্রভা আরও বেশি ফুটেছে নাকি? দু-একটা বিশেষ তারা যেমন আকাশে কখনও সখনও দেখা যায়।

সুমিতা, সোনালি, তুষার, বিমল ওরা এদিক ওদিক যাচ্ছে আসছে, কলকল করছে। আমিই কখনও ওদের কাছ থেকে খাপছাড়া হয়ে একা হয়ে যাচ্ছি। কেবলই মনে হচ্ছে শরীরে রক্ত চলাচল স্বাভাবিক হচ্ছে না। সুমিতার কখন এলির উত্তর দিতে গিয়ে তখন অস্পষ্ট গলা ক্ষীণ কেঁপে গেছিল। এখন হাত নেড়ে ইঙ্গিতে বোঝানোর চেষ্টা ছাড়া কোনও উপায় থাকবে না।

দীপাকে আজ যে-সারপ্রাইজ দেব, সেটা ওর পছন্দসই হবে কিনা তা নিয়ে যত ভয় ও সংশয়। একজনের গান আরেকজনের কাছে কান্না মনে হতে পারে। আবার কারও কান্না কারও কাছে গানের মতো মনে হতে পারে।

একসময় এমন ছিল, বুবুনদিকে আমার যখন তখন চমকে দিতে ইচ্ছে করত। শুধু মনে হতো, নতুন আরও নতুন ভাবে চমকে দিই বুবুনদিকে। তখন জানতাম না, পৃথিবীতে চমকে ওঠার মতো কোনও টাটকা ঘটনা আর নেই। সব ঘটনার রংই বিবর্ণ ফিকে হয়ে গেছে। নতুন করে রং চড়ালেও তাতে আর কোনও রোমাঞ্চ নেই।

বুবুনদি তুমি জানো না। তোমাকে চমকে দেওয়ার জন্যে আমি তোমার ঘরে খাটের নীচে গিয়ে লুকিয়ে ছিলাম। বিলুদা এসেছিল তোমার ঘরে। তোমার সঙ্গে বিলুদাকে সেদিন ভালো দেখিনি আমি। লোকটা ভালো ছিল না। তুমি ভালো থেকো। ভালোবাসা নিও।

সেন্টেনারি হলে সবাই ঢুকে পড়েছে। আমি ঢোকার মুখে টেনশন কাটাতে সিগারেটে ঘনঘন টান দিচ্ছিলাম। দীপা তুমি কখনওই জানতে পারবে না, তোমাকে শুধুমাত্র তোমাকে একটা ছোট্ট সারপ্রাইজ দেবার জন্য আমার ভেতরে এখন কী ভয়াবহ ভূমিকম্পে ধস পেয়ে যাচ্ছে সব। সিগারেটটাকে টোকা দিয়ে ছুড়ে চোখ ফেরাতেই দেখি দীপা। তন্ত্রীতে কোথায় আকস্মিক বাধাপ্রাপ্ত রক্তের বেগ ধুন্ধুমার ঘটিয়ে দিচ্ছে সারা শরীর জুড়ে। আমি চোখ ফেরালাম।

দীপা ওর অদ্ভুত চাউনিতে হাসির আলো ছড়িয়ে দিয়ে এগিয়ে এল আমার দিকে। এসেই বলল, এখানে একা। কী করছিস? তুই নাকি গান গাইছিস? কাউকে বলিসনি তো তুই গান জানিস! ইউনিয়নের শ্যামসুন্দরদা বলল, তোমাদের বাংলার উত্তীয় গান গাইবে। সত্যি?

—আমি হ্যাঁ বুঝিয়ে মাথা নাড়লাম। ভেতরটা তখনই আমার নিস্তরঙ্গ স্বাভাবিক হয়ে গেল। দীপা বলল, চ, ভেতরে আয়। আমি দীপার সঙ্গে ভেতরে গেলাম।

 

দুই

যেমন দৈবাৎ পরিচয় হয়েছিল, তেমনই দৈবাৎ ঘনিষ্ঠতাও হয়ে গেল দীপার সঙ্গে সেই ফ্রেশার্স ওয়েলকামের দিন থেকে। দীপা যেখানে, সেখানে আমি। আমি যেখানে দীপা সেখানে। বাংলার সবাই আমাদের নিয়ে নানা কথা ছুড়ে দিতে লাগল। দীপা ভ্রূক্ষেপ করত না। আমি মাঝে মাঝে রাগ দেখাতাম। এমন ভাব দেখাতাম যে, এখনই একটা রিভলবার পেলে ছয়ঘোরা করে একেকটার বুকে সিঁধিয়ে দিতাম। সেটা শুধুই আলগা, বাইরের। ভেতরে ভেতরে দারুণ ইচ্ছে করত, গিয়ে সবার পিঠ চাপড়ে বলি, সাবাশ বচ্চে, আউর বোলো, চিলহা চিলহা কর বোলো। সারি দুনিয়া কো মালুম করা দো, দীপাকে সাথ মেরা কেয়া সিলসিলা।

একটা ছোট্ট কথাই শুধু বলা হয়নি দীপাকে। কীভাবে বলব? কী কথা দিয়ে শুরু করে আসল কথার দ্বীপে গিয়ে দাঁড়াব? কীভাবে সাজিয়ে বললে দীপার সবচেয়ে বেশি পছন্দ হবে, ভেতরে ভেতরে এই নাট্যরঙ্গের ডামাডোলেই আর বলা হয়নি কিছুই। দীপার মতো মেয়ে আগ বাড়িয়ে কোনওদিনই একথা বলবে না। এ আমার দৃঢ় বিশ্বাস। আমাকেই বলতে হবে।

আবার মনে হয়েছে, সব শুনে দীপা যদি বলে, না রে উত্তীয়, এ আমি চাইনি। আমি বন্ধুত্ব চেয়েছি। তুই আমাকে ভুল ভেবেছিস। এসব নেহাতই প্রেমিক মনের অহেতুক ভয়। দীপা আমাকেই ভালোবাসে। একথা আমি চোখ বুজে বাঁহাতে লিখে দিলেও একটা বর্ণেরও হেরফের হবে না। আমি হলফ করে বলতে পারি। কত কথা মনে হয়েছে বলব। দীপার কাছে যেতেই মনে হয়েছে, কথা নেই কোনও। বস্তুত, কোনও কথা থাকে না, সেটাই স্বাভাবিক মনে হয়েছে বারবার।

রবিঠাকুরের গান পছন্দ করে দীপা। কেবলই মনে হয়েছে দীপাকে একটা রেয়ার গান শোনাই। দীপার সঙ্গে আমার রুচি ও পছন্দের আদ্যোপান্ত মিল। কোনও কবিতা ভালো লেগে গেলে মুখস্থ করে ফেলেছি। দীপাকে শুনিয়েছি। ও খুশি হয়েছে। খুব সহজে খুশি না হওয়াটাই যেন দীপার বিশেষত্ব। কিন্তু যখন মনে হয়েছে, দীপা সত্যিই মুগ্ধ হয়েছে, তখন সুখের যন্ত্রণায় বুকের ভেতরটা ভরে গেছে।

দীপা আমার ছোটোখাটো, খুচখাচ সব ব্যাপারেই নজর রেখেছে। একটুতেই ডাক দিয়েছে। চোখ পাকিয়ে শাসনের ধরন নিয়েছে। তখন আরও বেশি করে আমার মনে হয়েছে, দীপা তুই আমার। একচেটিয়া সুখের আধিপত্য নিয়ে বিশ্ব সংসারে আমি একাই এসেছি। তার মূলে তুই।

কিন্তু, রামেন্দ্রসুন্দরের ওপর বইটা যেদিন হারিয়ে ফেললাম, দীপা সেদিন আমায়, তুই একটা যা তা, ইরেসপন্সিবল কোথাকার এসব মুখের ওপর বলে দিয়েছে। কারও কাছ থেকে যেন চেয়ে এনেছিল বইটা। তারপর ক্লাসে আমার কাছে দিয়ে বলেছিল, তোর কাছে রাখ। রেখেছিলাম। তবে ভাবতে পারিনি বইটা হারিয়ে যাবে।

আমায় সঙ্গে করে দীপা গোটা ক্লাস রুম, ক্যান্টিন, করিডোর, লাইব্রেরি, যেখানে যেখানে গেছি তখনও পর্য‌ন্ত, সব জায়গায় খুঁজেছে। আগ বাড়িয়ে একে তাকে জিজ্ঞেস করেছে। তত বেশি করে রেগে গেছে আমার ওপর। বারবার ওর মুখে শুনতে হয়েছে, তুই একটা কী রে? এত ইরেসপন্সিবল! সামান্য একটা বই দায়িত্বে রাখতে পারলি না?শুনে লজ্জায়, অপমানে আমার কর্ণমূল আরক্তিম হয়ে উঠেছিল।

দীপাকে কোন মুখে কী বলব? কিছু বলার থাকে আর? দীপা আর কোনওদিন আমার কাছে আর কিছু রাখতে দেবে না। কোথায় হারালাম বইটা, কিছুতেই মনে করতে পারলাম না। মনেই ছিল না। দীপা চাইতেই তখন মনে পড়ল।

আজ যাওয়ার সময় দীপা আমায় ডাকল না। সব দিন ডাকতে হয় না। সঙ্গে থাকি, যাই বাসস্টপ পর্যন্ত। বাস এলে দীপা উঠে যায়। আমি হ্যারিসন রোড ধরে হাঁটা শুরু করি। নিজের প্রতি একটা মিহি ঘৃণা, একটা তাচ্ছিল্য শরীরময় দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছিল। দীপার কাছে আমি ছোটো হয়ে যাই, দীপা আমাকে অপদার্থ ভাবুক, তা কি মনের ভুলেও ভেবেছি? বরং মনে মনে উলটোটাই চেয়েছি। সাবলীল সুপুরুষের সবক’টা গুণ খুঁজে পাক দীপা আমার মধ্যে। আবিষ্কার করুক এক অনন্য নবীনকে।

দীপার কী দোষ? ওকে তো বইটার জন্য অন্যের কাছে কৈফিয়ত দিতে হবে। জবাবদিহি করতে হবে। সে তো আমারই জন্য। দীপা কারও কাছে সহজে ছোটো হওয়ার মেয়ে নয়। সেখানে যদি যার বই সে দু’কথা বলার সুযোগ পেয়ে যায়, আর দীপাকে তা শুনতে হয়, তাহলে কল্পনাতীত কেলেঙ্কারি ঘটে যাবে। দীপা আমাকে আরও যা মুখে আসবে বলে দেবে। কথা বন্ধ করে দেবে। না দীপা তুই কথা বন্ধ করে দিস না। আমার কথা তো ছোঁয়াচ পেয়ে উজ্জ্বলতা পায়, তুই বুঝিস না?

পরদিন ইউনিভার্সিটি এসেছি। ভয়ে ভয়ে গা আড়াল করে থাকতে ইচ্ছে করছিল। দীপার চোখের আড়ালে আড়ালে থাকতে চাই। পারলাম না। দীপা আমার কাছে এসে বসল। দীপার মুখোমুখি অপরাধীর মতো বসেছিলাম। তাকাতে পারছিলাম না ওর দিকে। আমি অপার অভিমানে মুখ ঘুরিয়ে নিলাম। দীপা ওর ডান হাতের তর্জনী দিয়ে আমার গ্রীবা ঘুরিয়ে আনল। বলল, আমার ওপর তুই রাগ করছিস না রে? তাকা আমার দিকে।

আমি অপলক তাকিয়ে থাকলাম দীপার চোখে। পর্যাপ্ত অভিমানে ক্রমে দু’চোখ জলে ভার হয়ে এল আমার। আমি অস্পষ্ট কাঁপা গলায় বললাম, কই না তো।

দীপা এবার ঝুঁকে এল আমার কানের কাছে। তারপর পরম গোপনীয়তার সতর্কতায় ফিসফিস করে বলল, কাল মেট্রোতে ম্যাটিনির দুটো টিকিট কেটে রাখিস। আমি ঠিক সময়মতো চলে যাব।

দীপা বলেছে, স্টুডিওটার সামনে দাঁড়াস। এদিক ওদিক যাস না কোথাও। অন্য কোথাও যাইনি আমি। টিকিট দুটো কেটেও নিয়েছি। শীতের রোদ। তবু বেশ কড়া। তা হোক। তবু নড়িনি। আমি অনেক আগেই এসে পড়েছি। দীপার আসার এখনও অনেক দেরি।

ধারবাহী জনস্রোত, ফুটপাতে হকারদের চিৎকার, ডবল ডেকারের পেছন থেকে কালো ধোঁয়া ছেড়ে মোড় নেওয়া, অনন্তকাল ধরে বয়ে চলা দ্রুতগতি যানগুলোকে আমার তীক্ষ্ণ নজর ছেঁকে ধরছিল। এদিকে আমার বাঁহাতের কবজিতে সময় এগিয়ে মেট্রোর ম্যাটিনিকে ছুঁয়ে ফেলতে চাইছে। আনমনা গালে হাতের প্রলেপ দিতে গিয়ে মনে পড়ল, তাড়াহুড়োয় দাড়িটা কাটা হয়নি। গালভরা খোঁচা খোঁচা দাড়ি রয়ে গেছে। কালো মুখে এই দাড়ি দীপার কাছে মোটেই নয়ন সুখকর হবে না।

দীপা কেন আসছে না? আমি তো স্টুডিওর সামনে থেকে একচুলও নড়িনি। চোখে রোদ পড়ছে। তবু সানগ্লাসটা নামিয়ে রেখেছি। খালি চোখেই দীপাকে দূর থেকে লক্ষ্য করতে সুবিধে হবে।

হলের বাইরে দর্শকদের ভিড় পাতলা হয়ে গেছে। শো শুরু হওয়ার পরেও ঠায় একঘণ্টা অপেক্ষা করেছি। একটার পর একট সিগারেট খেয়েছি। দীপা আসেনি। চোখের শিরা বুক থেকে রক্ত টেনে জড়ো করছিল। একটুতেই ঝরে পড়বে বুঝতে পেরে অতি সন্তর্পণে ঢোক গিলে গিলে বুকের রক্ত বুকে ফেরাতে চেয়েছি।

দীপা এল না কেন? কী এমন ঘটতে পারে যার জন্য এল না? সিনেমা দেখার কথা তো দীপাই বলেছে। আমি তো বলতে যাইনি। তোষামোদ করতে যাইনি। তোকে যেতেই হবে এমন মাথার দিব্যি দিয়ে তো রাজি করাইনি। তুই তো নিজেই গদগদ হয়ে বললি। নাকি বই হারিয়ে ফেলার প্রতিশোধ নিল? আর আমাকে একটা নিরেট গবেট ভেবে পুরোটাই কৌতুক করে মজা পেতে চাইল দীপা?

দীপার শরীরে কি মহম্মদ বিন তুঘলকের রক্ত আছে? এসব সবই আমার রাগের মাথার ভাবনা। কেন-না দীপা আসেনি বলে কিন্তু ওর ওপরে রাগের চেয়ে অভিমানই হচ্ছে বেশি। যাকে ভালোবাসা যায়, তাকে অনাবশ্যক রূঢ় কথা বলা, মাঝেমধ্যে তাকেই শত্রু প্রতিপন্ন করার পেছনে একটা সূক্ষ্ম তৃপ্তি আছে। আর কারও না থাক, আমার আছে। রাগের মুহূর্তে হাবিজাবি মনে আসে। আসলে দীপাকে আমি খুব ভালো চিনেছি। বই হারিয়ে ফেলার প্রতিশোধ নেবে, এত নীচু মন ওর না। ও হয়তো কোনও কারণে আটকে গেছে।

দীপা আবার ভুলে যায়নি তো? ভুল তো মানুষেরই হয়। আমারও তো মনের ভুলে বইটা গেল। কিন্তু সিনেমার কথা দীপা যখন খেয়ালে বা কথার কথায় বলেনি, তখন ভুলে যায় কী করে? বড়ো কথা, নিজে থেকে ওভাবে কথাটা বলে কেউ ভুলে যেতে পারে? সদ্য সদ্য কালকের বলা কথা আজই ভুলে যাওয়ার মতো ভুলো মন দীপার না। নিশ্চয়ই কোনও বড়ো কারণে আসতে পারেনি। এসব ভেবে সান্ত্বনা পেতে ইচ্ছে করল না। ভেতরে ভেতরে কেবলই দীপার ওপর তীব্র রাগ ফুঁসে উঠছিল। কাল ইউনিভার্সিটিতে এসে দীপা নিশ্চয়ই কোনও মোক্ষম কারণ দেখাবে।

—মেয়েদের কত অসুবিধে, কত রকম ট্রাবল ফেস করতে হয় তুই তার কী বুঝবি? হেনাতেনা সাতসতেরো অনেক কথাই বলবে, বোঝাতে চাইবে। যত যাই বলুক, বোঝাতে চাক, আমি কোনও কথাই বিশ্বাস করি না মুখের ওপর বলে দেব। নিজেই সিনেমা দেখার কথা বলে, আমাকে উসকে দিয়ে না আসার জন্য দরকার হলে দীপার মুখের ওপর আরও রূঢ় কথা বলে দিতে আমার একটুও বাধবে না।

—আমি তোকে চিনি না, কোনওদিন তোর সঙ্গে আমার পরিচয় হয়নি। যার কথার দাম নেই, তার সব কিছুই মূল্যহীন। বাঃ বেশ জব্বর শিক্ষা দিলি ভাই। আরও কুকথা মুখে যা আসবে বলে দেব। অত ছাড়াছাড়ি নেই। অবশ্য দীপা এনিয়ে ন্যাকা গাওনা গাইতে এলে তবেই শোনাব। নিজে থেকে ঘটা করে এসব শোনাতে যাওয়ার কোনও ঠেকা নেই আমার। তার চেয়ে দীপা আসেনি তার জন্য আমার কষ্ট হয়েছে খুব, আমি ভীষণ রেগে গেছি, সাড়ম্বরে এসব জানান দেওয়াটাই বেশি বোকামি হবে। বরং এমন ভাব দেখাব যে, তুই আসিসনি আরে তাতে কী হয়েছে? আমি একজন অস্ট্রেলিয়ান মহিলাকে নিয়ে দিব্যি দেখেছি। তুই ভাবিস কী আমায়?

দীপার সঙ্গে চোখাচোখি হলে প্রথমটায় এমন ভাব দেখাতে হবে যেন এই প্রথম দেখছি মেয়েটিকে। তারপর ও তেমন উৎসাহ দেখালে, দেখাবে নিশ্চয়ই। তখনই সেই ভাবটা আনতে হবে, আরে এ তো আমাদের বাংলারই সেই মেয়েটা না? ব্যস তার বেশি কেরামতি দেখানোর দরকার নেই। ভেতরে ভেতরে এমনই একটা সতর্কীকরণ নিয়ে পরদিন ইউনিভার্সিটিতে ঢুকলাম।

—আমি জানতাম, দেখা হলে দীপা প্রথমেই বলবে, এই এই কারণে কাল সিনেমায় যেতে পারিনি রে। তুই নিশ্চয়ই এসেছিলিস? শুধু শুধু তোকে কষ্ট দিলাম। আমিও সেয়ানা ঘুঘুর মতো চরম নির্লিপ্ততায় ভ্রূ কুঁচকে জিজ্ঞেস করব, কী ব্যাপার বল তো? কীসের কষ্ট?

দীপা তখন নিশ্চয়ই বলবে, ওই যে কাল তোকে সিনেমার কথা বলে যেতে পারলাম না।

—আরে হ্যাঁ। সত্যিই তো তুই বলেছিলি! কী কাণ্ড দেখ, আমি তো ভুলেই মেরেছি। ভাগ্যিস তুই যাসনি। গেলে কী কেলেঙ্কারি হতো বলতো? মুহূর্তে ভাবলাম, এইটেই সেরা মেডিসিন। দীপাকে এই ক্যাপসুলই গিলিয়ে দেব।

—কী ব্যাপার? দীপা কি আসেনি নাকি? নাহ, পরপর তিনটে ক্লাসে দীপাকে দেখলাম না। একবার ভাবলাম, জিজ্ঞেস করি সুমিতাকে। আবার ভাবলাম, না, কানাকানি হবে। তুষার, বিমল যদি জানতে পারে, আমি দীপার বিরহে কাতর, তাহলে আর রক্ষে নেই।

সুমিতাকে আলাদা করে ডেকে দীপার কথা জিজ্ঞেস করা যায় না? কিছু জানে নাকি ও? না তা হয় না। সুমিতা বলবে, তা একথা জিজ্ঞেস করার জন্য তুই আমায় ক্যান্টিনের জমাটি আড্ডা থেকে ডেকে আনলি? আবার ফিরে গিয়ে মালা, কণাকে বলবে। মালা, কণা বলবে তুষার আর বিমলকে। ব্যস, তবে তো হয়ে গেল।

দীপার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা হওয়ার পর থেকে বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে থেকেও তখনই আমি একা হয়ে গেছি। তা আজ ধ্রুব সত্যির মতো বুঝে গেলাম। আরও বিলক্ষণ বুঝে গেলাম, এই ইউনিভার্সিটির জগতে সবার চাইতে দীপার চোখে আমি সম্পূর্ণ আলাদা। কিন্তু কাল সিনেমায় এল না, আজ ক্লাসে এল না। কেবলই মনে হচ্ছে, দীপা আসেনি, আজ ছুটির দিনে আমরা সবাই না জেনে এসে পড়েছি। নিজেকে ভীষণ একা আর নিঃসঙ্গ অসহায় মনে হচ্ছে।

দীপা আমার এক কপর্দকও ধরে ফেলেছে। আমি তোর কাছে ধরা পড়ে গেছি রে দীপা, সে কথা আর নতুন করে কোনও ভাবেই বুঝতে হবে না। তুই এসে দেখে যা! সিনেমায় না আসার জন্য দীপার ওপর আমার সমস্ত রাগ, ক্ষোভ, অনুযোগ, অভিমান গলে জল হয়ে কঠিন কষ্ট হয়ে বুকের রক্তে মিশে গেছে।

কাল ইউনিভার্সিটিতে এসে দীপাকে না দেখা পর্য‌ন্ত আমি একটাও স্বাভাবিক নিঃশ্বাস নিতে পারব কিনা সে নিয়ে ভয় তো ছিলই। আবার সম্ভবপর আতঙ্কে আঁতকেও উঠেছি, কালও যদি দীপা না আসে?

আজ সাতদিন হয়ে গেল দীপা আসছে না। সাতদিন দীপাকে দেখি না। মনে হচ্ছে কত যুগ! দীপার মুখটা অচেনা হয়ে যাবে না তো? পেছন থেকে ইতিহাসের সেই মেয়েটাকে দেখে চমকে উঠেছি। দীপা না? ভুল ভেঙে গেছে। সবাই কি আর দীপা হয়? না সব দীপার জন্য আমি সাতদিন ধরে অস্থিরতায় কষ্ট পাচ্ছি? ট্রামে, বাসে, ট্রেনে রাস্তায় বিপুল জনস্রোতে কত হাজার হাজার দীপা হারিয়ে যাচ্ছে প্রতিক্ষণে। সেই দীপাদের দলে ইউনিভার্সিটির বাংলার দীপা নেই। থাকতে পারে না। থাকলে সে আমার চোখকে ফাঁকি দিয়ে মিলিয়ে যাবে, অত সস্তা না।

দীপার সঙ্গে এই সাতদিনে একবার তো দেখা হতে পারত। ইউনিভার্সিটি না এলেও কি কোনও কাজে রাস্তায় বেরোয়? নিদেনপক্ষে মাথা ধরার ট্যাবলেট আনতে যাচ্ছি বলেও তো একবার বিকেলে বেরোতে পারে। রাস্তার মধ্যে আচমকা উত্তীয় বলে ডেকে ছুট্টে কাছে এসে তো বলতে পারত, এই অসুবিধে তাই ক্লাসে যাচ্ছি না রে। তুই খুব একা হয়ে গেছিস না রে? একি তুই কাঁদছিস!

একা রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে কেবলই আঁতকে পেছন ফিরে তাকিয়েছি। দীপা ডাকল না? দীপা ডাকে না। আজ সাতদিন দীপার ডাক শুনিনি। অনেক রাত পর্য‌ন্ত শুয়ে শুয়ে দীপাকেই ভেবেছি শুধু। ঈশ্বরকে ডেকেছি মনে মনে দীপাকে যেন ঘুমের মধ্যে স্বপ্নে দেখি।

দীপাকে স্বপ্নে দেখিনি। দীপার আসার সময় পেরিয়ে গেছে জেনেও দীপার বাসস্টপে দাঁড়িয়ে থেকেছি। ফেরার পথেও দীপার বাসস্টপে এসে দাঁড়িয়েছি। দীপার বাস এলেই উঠে গেছি। গিয়ে নেমেছি হরিশ মুখার্জি রোডে। ঠিকানা জানি না। তাই গোটা হরিশ মুখার্জি রোডে চক্কর দিয়েছি, কোনও বাড়ির জানালা থেকে বা ঝুলবারান্দা থেকে দীপা আমাকে দেখে ফেলতেও তো পারে। উত্তীয় বলে ডেকে বলতেও তো পারে, তুই এখানে? এইটে আমাদের বাড়ি। ডানদিকে গেট ঠেলে ঢোক। সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে আয়।

ইউনিভার্সিটির গেটের কাছে ফুচকাওয়ালার কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছি। দীপা এর কাছে ফুচকা খায়। ক্লাসে বসে শুধু মনে হয়, এই তো আমি বসে আছি, এই বুঝি পেছন থেকে দীপা এসে আচমকা পিঠে হাত রাখল। এই বুঝি মায়াবী চোখ পাকিয়ে বলল, এখনও রাগ পড়েনি? একি! কী বোকা রে! তুই কাঁদছিস?

ক্লাসের ভেতর সুমিতা, মালা, কণা, সোনালি, তুষার, বিমল সবার সঙ্গে আমিও বসেছিলাম। সুমিতা গাইছিল, তুষার বেঞ্চে তাল ঠুকছিল। আমি আস্তে উঠে বেরিয়ে এলাম। তারপর নেহাতই পায়চারি করার ঢঙে অন্য একটা ফাঁকা ক্লাসে ঢুকে পড়লাম। বুক কাঁপতে লাগল অনর্থক ভয়ে কেউ লুকিয়ে আমায় লক্ষ্য করছে না তো? এদিক ওদিক তটস্থ চোখ ঘুরিয়ে নিয়ে ব্ল্যাক বোর্ডের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। তারপর পকেট থেকে একটা চক বার করলাম। হাত কাঁপছিল। তবুও লিখলাম, দীপা, তুই আসছিস না কেন রে? লিখেই মুছে ফেললাম।

ক্লাস থেকে বেরিয়ে এসে মুখের, গলার ঘাম মুছে ফেললাম। অস্বাভাবিক মাথা, কপালের দু’পাশের শিরায় যন্ত্রণা ঢিপঢিপ করতে লাগল। চোখে জ্বালা জ্বালা ভাব। কান্না ছাড়াও এক ধরনের জল বেরিয়ে আসছিল চোখ থেকে। কাউকে কিছু না বলে রাস্তায় নেমে এলাম। দীপার বাসস্টপ হয়ে আর হরিশ মুখার্জি রোডে যাওয়ার সাহস হল না। আচ্ছন্নের মতো এক অন্য মাদকতায় বেধড়ক মাতালের মতো টলতে টলতে সোজা বাড়ি চলে এলাম।

সকালের দিকে অরুণ ডাক্তার এসে দেখে প্রেসক্রিপশন করে গেছে। চিনিদা গাদাখানেক ট্যাবলেট, ক্যাপসুল নিয়ে এসেছে। ডান হাতের ফাঁড়া আজ কেটে গেছে। টাকুদা কাল আসবে বাঁহাতে সূচ ফোটাবে। আজ তেরো দিনের দিন জ্বর নেই। তবে দাঁড়ালে বুক কাঁপে। পা কাঁপে। জানালা দিয়ে বাইরেটা দেখি মনে হয়, হাঃ! পালটে গেছে সব কিছু। বাইরের জল, হাওয়া, আলো সব পালটে গেছে। অনেক দেখা পুরোনো জিনিসও নতুন আঃ কী সুন্দর!

দীপাকে দেখলে নতুন মনে হবে। দীপা তোকে ভীষণ দেখতে ইচ্ছে করে। তোকে কতদিন দেখিনি রে। তুই সাতদিন এলি না কেন? তোকে অনেক খুঁজেছি। এখন আমার অসুখ। সেদিনই দুপুরের পরে দীপাকে স্বপ্নে দেখলাম। জ্বরের ঘোরে কখন ঘুমিয়ে পড়েছি। দেখলাম দীপার সারা শরীর সবুজ। সারা গায়ে নক্ষত্র ফুটে আছে। সবুজ নক্ষত্র। আকাশ থেকে মেঘ সরিয়ে দীপা নেমে আসছে। বৃষ্টিতে ভিজলে যেমন শরীর থেকে টপটপ করে জল ঝরে পড়ে, তেমনই দীপার শরীর থেকে নক্ষত্র ঝরে পড়ছে।

—আমি চেঁচিয়ে বললাম, দীপা আমি এখানে, এই এখানে। আমাকে দেখতে পাচ্ছিস?

দীপা নেমে এসে আমার কপালে, গলার কাছে হাত রাখল। বলল, তোকেই তো দেখতে এলাম। কেমন আছিস?

—ভালো, এখন ভালো আছি। তুই এতদিন কোথায় ছিলি? রোজ আসবি তো?

—আসব, রোজ আসব।

ঘুম ভেঙে যেতে দেখি, সত্যি সত্যিই দীপা এসেছে। তবে ওর শরীর সবুজ না। যেমন ছিল তেমনই। সঙ্গে সুমিতাও এসেছে। আমার বিছানার কাছে ওরা বসে আছে। আমি চোখ খুলতেই দীপা বলল, কী? কেমন সারপ্রাইজ দিলাম? দেখলি তো চলে এলাম সোজা। স্টেশনে নেমে জিজ্ঞেস করতেই বাড়ি পেয়ে গেলাম। কলেজের কাছে বাড়ি, তা তো জানতামই। তোর মুখে শুনেছি অনেকবার।

সুমিতা বলল, আমরা তো অবাক দু’সপ্তাহ তোর কোনও পাত্তা নেই। তাই আজ যাই কাল যাই করে চলেই এলাম।

দীপা সোজা আমার বাড়ি চলে আসতে পারে! বিস্ময়ে মুখে কথা ফুটল না সহসা আমার। দীপা কাছে এসে আমার রোগা বুকে হাত রাখল। তারপর কপালে। অল্প ঘাম হচ্ছিল তখন। দীপা বলল, এই তো ঘাম দিচ্ছে। জ্বর নেই আর। আমি অসহায় হাসলাম শুধু।

মা এ ঘরে ওদের জন্য চা, লুচি তরকারি জলখাবার এনে দিল। চা খেতে খেতে দীপা বলল, ঠিক দু’সপ্তাহ পর তেইশ তারিখ আমরা বিকেসির নেতৃত্বে আমাদের বাংলার দশজন শান্তিনিকেতনে যাচ্ছি। তুইও যাচ্ছিস আমাদের সঙ্গে। ততদিনে আমি শরীরে ভালোমতো জুত পেয়ে গেলাম।

 

তিন

বিকেল বিকেল পৌঁছোলাম শান্তিনিকেতনে। স্টেশনে নেমে রিকশা নিলাম। বেশ শীত পড়ে গেছে। আমি আর বিমল উঠলাম একটা রিকশায়। তুষারটা ঠিক ঝোপ বুঝে নিয়ে কণার পাশে গিয়ে উঠে বসেছে। দু’জন অধ্যাপক এক রিকশায়। সোনালি, মালা, মিত্রা, অসীম, চঞ্চল ওরাও সুবিধে মতো ভাগাভাগি করে চেপেছে। দীপা আর সুমিতা একটা রিকশায়।

কয়েক মিনিটের পথ স্টেশন থেকে টুরিস্ট লজ। এটুকু পথেই রিকশাওয়ালারা নিজেদের মধ্যে রেস শুরু করে দিল। দীপার রিকশা আমাদের আগে আগে যাচ্ছিল। আমি দু’চার হিড়িক দিতেই আমাদের কম বয়সি সারথি ছাড়িয়ে গেল দীপাদের রথ। ঢালাও পিচের রাস্তা মোড় নিল। খানিকটা রাঙামাটির মোরাম বিছানো রাস্তা পেরিয়ে এসে উঠলাম লজে।

জানলা খুলতেই চোখ জুড়িয়ে গেল। বহু দূর পর্য‌ন্ত মাঠ, ধানখেত। ধান কাটা হয়ে গেছে। ধানের গোড়া পড়ে আছে। নানান গাছগাছালি, খেজুর গাছের মাথায় সন্ধের অন্ধকার ভোকাট্টা ঘুড়ির মতো এসে লটকে যাচ্ছে। শীতের ফিনফিনে হাওয়া আসছিল দেখে জানালা বন্ধ করে দিলাম। মেয়েটা এসে তাড়া লাগাল। চলো চলো বেরিয়ে পড়ি, বেড়িয়ে আসি। ওরা একেবারে সেজেগুজে রেডি।

একটা সবজে অদ্ভুত সুন্দর শাড়ি পরেছে দীপা। বলল, কী রে উত্তীয়, তুই বেরুবি না? গড়িমসি করছিস যে! তুষার, বিমল ওরাও ঝটপট তৈরি হয়ে নিল। ওরাও তাড়া লাগাল, চ’ চ’ নে ওঠ। শেষে ফিরতে রাত হয়ে যাবে।

অগত্যা বেরতেই হল। দু’জন স্যার ঘরে বসে জমিয়ে নিয়েছেন। বললেন, বেশি দেরি কোরো না তোমরা।

লাল কাঁকুড়ে মাটির পথ। দুপাশে বিস্তৃত মাঠ। মাঠের বুক চিরেও রাস্তা গেছে। চাঁদের আবছা আলোয় বেশ ভালোই ঠাহর হচ্ছে। মনে মনে বললাম, এই তো সেই রবিঠাকুরের গ্রাম ছাড়া ওই রাঙামাটির পথ। বাড়ি-ঘরগুলো বেশ ছিমছাম সাজানো। সব বাড়ির সামনেই এক চিলতে ফুলের বাগান। আলাদা রুচির ছাপ। আমরা সবাই হাত ধরাধরি করে হাঁটতে লাগলাম।

দীপার বাঁ হাত ধরেছে সুমিতা। ডান হাত আমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, উত্তীয়, ধরবি তো ধর। নইলে কাউকেই দেব না ধরতে। মুহুর্তে বিদ্যুতের বেগে দীপার হাতটা ধরে ফেললাম।

দীপার নরম পেলব হাতটা স্পর্শে মনে হল, দীপা আমায় কোনও কষ্টই দেয়নি। যেটুকু কষ্ট বলে মনে হয়েছে, সেটুকু এই সুখ, আনন্দের অঙ্কুর ছিল। আমি তখনও জানতাম না, দীপার প্রেমিক আছে। জানলাম তখন, যখন তুষার পাশ থেকে টিপ্পনী কাটল। বলল, একবারে হাত ধরে গদগদ ! আর কত ঝোলাবি ব্যাটাকে?

শুনে দীপা রেগে গেল। বলল, আর যাই বল, উত্তীয়কে নিয়ে এসব আমি সহ্য করব না। সে রকম মন নিয়ে ওর সঙ্গে আমি মিশি না। ও শুধুই আমার বন্ধু। তার চেয়ে বড়ো কথা অনেক আগে থেকেই আমি প্রেম করি। আমার প্রেমিক আছে।

কথাটা শোনা মাত্র আমার বুকের রক্ত ছলাৎ করে পিছলে গেল বীভৎস যন্ত্রণায়। কাউকে বুঝতে দিলাম না। দীপার হাত থেকে আমার হাত তখনই আলগা ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে। দু’হাতে নিজের বুক চেপে ধরলাম। ভেতরে অসহ্য যন্ত্রণা। কাছেপিঠে বুবুনদি নেই। বুবুনদি এখান থেকে বহু দূরে আছে এখন। তবু চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করল, বুবুনদি তোমাকে এখন একটা দারুণ সারপ্রাইজ দিতে পারি। আমি যে-মেয়েটিকে ভালোবেসেছি, তার একজন প্রেমিক আছে।

চার

ঘন্টা হিসেবে নৌকা চুক্তি করল দীপা। বেলা পড়ে এসেছে। নিরুত্তাপ রোদের জন্য বেশ ভালো লাগছিল। দূরে কোনও খেয়াঘাটের লঞ্চের ভোঁ শব্দটা যেন জল সাঁতরে এদিকে ভেসে আসছিল। হাওয়া এসে জলের বুক ছুঁয়ে ঘুরপাক খাচ্ছে। নৌকা ছেড়ে যেতেই সিগারেট জ্বালালাম একটা। আজকের নায়ক আমি। আমি  উত্তীয় সেন। স্বপ্নের ঘোরের মতো তাবত দৃশ্যপট ছেয়ে থাকল। আমার চোখের সামনে সিগারেটের ধোঁয়া মুখ ছাড়া হয়ে বাতাসে মিশেই যেন নাচের মুদ্রায় ঘুরপাক খাচ্ছিল।

পরদিন ইউনিভার্সিটি থেকে বেরিয়ে দীপার সঙ্গে বাসস্টপে যেতে যেতে দীপা বলল, কাল একবার আসবি তুই?

—কেন? কাল তো রোববার!

—বলছি তো সেজন্যই।

—মানে? মানে কাল প্রশান্ত আসবে।

—অ! তোর ইয়ে কিন্তু তাতে আমি কেন?

—তোর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেব, ভালো হবে।

—তাই? তা আসছে কোথায়?

—আউট্রামে তিনটের মধ্যে আসবে। তুই দুটোর সময় কফি হাউসের সামনে থাকবি। আমি ওখানেই তোকে খুঁজব, তারপর যাব ’খন।

—তা তোর প্রশান্ত আসছে, তাতে আমার কী? আমি কীসের আনন্দে ছুটির দিন দুপুরবেলা ছুটে আসব? ওর সঙ্গে পরিচয় না করলেই বা আমার কী আসবে যাবে?

—না না এসব বলিনি দীপাকে। এসব কথা আমার মনের মধ্যে একমুহূর্ত চড়ুইয়ে ঝাঁকের মতো কিচিরমিচির করে উঠেছিল। দীপার ওপর এখন অনীহা ভাব দেখালে ধরা পড়ে যাব আরও বেশি করে।

দীপা উঠে দাঁড়াতে যাচ্ছিল। তখনই নৌকা দু’পাশে বেশ জোরে দুলে উঠল। বেসামাল হচ্ছিল দীপা। একপাশে কাত হতেই হাত বাড়িয়ে ধরে ফেললাম ওকে।

হ্যাঁ! দীপা এখন আমার বুকে পরম নির্ভরতায় মুখ রেখে, চোখ বুজে বড়ো বড়ো করে নিঃশ্বাস নিচ্ছে। গলায় একটা অদ্ভুত আদুরে সুর এনে দীপা বলল, আমার চোখ খুলতে ভয় করছে। যদি জলে পড়ে যেতাম?

—বাঃ রে! আমি আছি, মাঝিরাও আছে। দীপাকে এমনভাবে ব্যাপারটা বোঝাতে চাইলাম, যেন তুই জলে পড়ে গেলে জলের তলা থেকেও তোকে তুলে আনতে পারি আমি। আসলে আমি যে সাঁতারই জানি না, সেকথা দীপার সঙ্গে এই শঙ্খবেলার মুহূর্তে মনে না আসাই ভালো।

সূর্যটা অস্ত যাবে এক্ষুনি। পশ্চিম আকাশটা যেন রক্ত রঙের আবির মেখে হাসছে।

—দীপা বলল, কী চার্মিং তাই না রে।

—তার চেয়ে আর বেশি কোথায়?

এর বেশি বললে বাড়াবাড়ি হবে। দীপা বন্ধু ভাবে আমায়। সে জন্যই তো প্রশান্তর সঙ্গে পরিচয় করাতে চায়। কিন্তু আশ্চর্য প্রশান্ত এল না। জানি তো এখন আর প্রশান্ত আসছেই না। তাই নির্ভয়ে আরও একবার দীপাকে প্রশান্তর কথা জিজ্ঞেস করাই যায়। যার অনারে আসা, মাঝেমধ্যে তার জন্য একটু আধটু আফশোশ না দেখালে দীপা যদি আমাকে নির্লজ্জ ভাবে? যদি ধরতে পেরে যায় আমার ভেতরটা?

—কী রে তোর প্রশান্ত যে শেষ পর্য‌ন্ত এলই না। ঠিক মতো বলছিলি তো? লুকিয়ে কখন চারদিকে অন্ধকার নেমে এসেছে। জ্যোৎস্না তখনও পরিষ্কার হয়নি।

দীপা আমার কানের কাছে সেই একই রকম ভাবে ঝুঁকে এল। তারপর সেই একইরকম ভাবে পরম গোপনীয়তায় ওষ্ঠ ও অধর ডুবিয়ে দিয়ে বলল, তুই এত বোকা কেন? আমার প্রশান্ত বলে কেউ নেই রে। আমি তো তোকেই…। তারপর আর কোনও কথা বেরোলো না দীপার মুখ থেকে। ওর উষ্ণ নিঃশ্বাসের ঝড়ে সাঁই সাঁই সুখের বিদ্যুৎ খেলে গেল আমার তন্ত্রীতে তন্ত্রীতে।

দীপা এবার আমার মুখোমুখি বসল। বলল, তোকে নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করছিলাম। আসলে তুই যে আমাকে পাগলের মতো ভালোবাসিস, আমি অনেক আগেই তা বুঝতে পেরেছি। তাই পরীক্ষা করে দেখলাম, প্রশান্তর কথা বললেও তুই আসিস কিনা। আমি জানতামই যে তুই না করবি না। আর না এসে থাকতেও পারবি না।

—তার মানে? দীপা আমার সব কিছু ধরে ফেলেছে? এত সহজেই আমার ভেতরটা ও আঁচ করতে পেরেছে? আমার চালাকি সব ধরে ফেলেছে নাকি? নইলে আমার ওপর এমন অন্ধ ধারণা হয় কী করে?

মুহূর্তে ভেবে নিলাম, আমি তোর সব ধারণা পালটে দেব রে দীপা। আমি তোকে সত্যিই পাগলের মতো ভালোবেসেছি। তোর জন্য আমার কষ্ট হয়েছে। তবু সে সব এখন আমি উপেক্ষাও করতে পারি। হ্যাঁ এই মুহূর্তে আমার অন্তরাত্মা আমাকে সেই শলাই দিচ্ছে।

—আমি সহসা বলেই ফেললাম, তোর ধারণাটা পুরোপুরি ভুল রে দীপা। তুই শুধুই বন্ধু আমার। আসলে আমার একজন প্রেমিকা আছে। তোকে বলিনি কোনওদিন…

রাই এসে আমার চুল ঘেঁটে দিয়ে বলল, বাবা, তুমি এখনও এখানে বসে আছো? অফিস গেলে না?

রাইয়ের সাড়া পেয়ে আমি মাথা তুলতে পারছিলাম না। তিরিশ বছর আগের সেই দীপা আমাকে মাথা তুলে দাঁড়াতে দিচ্ছিল না।

গোবর্ধনের নতুন অ্যাসাইনমেন্ট

গত রাত্রি থেকে গোবর্ধন সরকার খুব ঝামেলায় আছে। খুশির মেজাজটা টেনশনে মিলেমিশে এখন একটা ঘোলাটে অবস্থায়। খবরটা পাওয়ার পর থেকে নিজেকে আর কন্ট্রোলে রাখতে পারছে না সে। কাল রাত্রিতে ভালো করে ঘুমটাই হল না। আজ তো সকালে পাখি ডাকার আগেই উঠে পড়েছে। সামনে একটা বড়ো চ্যালেঞ্জ।

দৈনিক জবর খবর-এর সম্পাদক স্বযং ফোন করে আর্টিকেলটা লিখতে বলেছেন। হাতখরচ-এর উপর একটা তথ্য নির্ভর আর্টিকেল লিখতে হবে। খবরটা শুনে তাৎক্ষণিক আনন্দ যা পেয়েছিল, পরে বিষয়টার গুরুগম্ভীরতা দিকটির কথা ভেবে, এখন টেনশনে এসে ঠেকেছে।

এতদিন স্বল্প পরিচিত কিছু সাপ্তাহিক বা পাক্ষিক কাগজে ফ্রিল্যান্সার কালচারাল রিপোর্টার হিসাবে খবর লিখেছে। সে সব খবরে মাথা খাটাবার বিশেষ কিছু নেই। কোনও ইনকাম ট্যাক্স অফিসারের স্ত্রীর গানের সিডি উদ্বোধনের অনুষ্ঠানের কভারেজ বা কাউন্সিলরের মেয়ের নাচের স্কুলের অনুষ্ঠান এই সবই বেশি। আর এতে মাথার পরিশ্রম তো নেই-ই উপরন্তু পাওনা, খাবারের বড়ো বড়ো প্যাকেট, নানান সব গিফট। কখনও সখনও ককটেল পার্টিও জুটে যায় ভাগ্যে।

অবিবাহিত গোবর্ধনের রাত্রের খাবারটা প্রায় এভাবেই হয়ে যায়। না হলে ভজার দোকান থেকে দশ টাকায় চারটে রুটি নিয়ে ঘরে ঢোকে। চিনি, গুড়, জ্যাম যা থাকে তা দিয়ে ডিনার।

বাবার আমলে নেপাল হালদার লেনের ভাড়া করা ঘর দুটোর দখল নিয়ে দুভাই-এর সংসার। তার একটা ঘরে প্লাইউড দিয়ে পার্টিশন করা আধখানা অংশ গোবর্ধনের ভাগে জুটেছে। বাকি অর্ধেকে থাকে দাদার ছেলে, মানে ওর ভাইপো বাপি। বাদ বাকি পুরো একটা ঘর দাদা-বউদির দখলে। ভাড়া বাড়িটাতে ওদের জন্য সেপারেট ল্যাট্রিন বাথরুম আছে। আর ঘর দুটোর লাগোয়া বারান্দার একটা অংশ ঘিরে নিয়ে তৈরি হয়েছে রান্নাঘর।

গোবর্ধনের এসব নিয়ে বিশেষ মাথা ব্যথা নেই। ষোল বাই বারোর অর্ধেক, আট বাই বারো ঘরটাই অনেকটা। একটা চার-ছয়ের তক্তাপোষ, তিন-দুই-এর সস্তা কাঠের টেবিল, একটা ফোল্ডিং চেয়ার আর একটা টিনের বড়ো বাক্স, আসবাবপত্র এই পর্যন্ত। টিনের বাক্সটা তক্তাপোষের তলায় ঢোকানো আছে। তার মধ্যেই যাবতীয় মূল্যবান সম্পত্তি। জামা-কাপড়, দুচারটে বই, অনুষ্ঠান কভার করে পাওয়া নানান গিফট আইটেম, আরও যতসব হাবিজাবি। গিফট আইটেমগুলোর বেশির ভাগই পূর্ণ-র মোড়ে বন্ধুর গিফট স্টোর্সে দিয়ে দেয় বিক্রির জন্য। তাতেও মাসে হাজার বারোশো হয়ে যায়।

গোবর্ধন ভোর সকালেই স্নান সেরে নিয়েছে। দেয়ালে টাঙানো সরস্বতী, মা কালী, গণেশ ও আরও কিছু ঠাকুর দেবতার ফটোয় প্রণাম সেরে ধূপকাঠি জ্বালিয়ে সারা ঘরে ঘুরিয়ে দেয়ালের ফাটলে গুঁজে দেয় ধূপকাঠিটা। ঘরে বেশ একটা শান্তির আবহাওয়া। কিন্তু গোবর্ধনের মনটা বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে। পাখিদের কাকলি জনমানবের কলরবে চাপা পড়ে গিয়েছে, বেলা বাড়ছে। কী লিখবে, কাদের নিয়ে লিখবে আর কোথা থেকে যে শুরু করবে ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না সে। আসলে গোবর্ধন নিজের খরচের মধ্যে হাতখরচ আর মূল খরচের পার্থক্যটা ঠিক করতে পারে না।

প্রতিদিন সকালে স্নান সেরে ঠাকুরকে ধূপ দেখিয়ে একবাটি মুড়ি বাতাসা দিয়ে খেয়ে নেয় সে। তারপর ঢকঢক করে এক বোতল জল। বাড়ির সামনের টেপাকল থেকে নিয়ম করে তিন বোতল জল সকালে ভরে রাখে গোবর্ধন। এক বোতল সকালের জন্য, এক বোতল রাত্রির প্রয়োজনে আর একটা এক্সট্রা। এরপর জামা কাপড় গায়ে চড়িয়ে কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে সারা দিনের জন্য বেরিয়ে পড়া।

পকেটের রেস্ত বুঝে কখনও কালীঘাট ট্রামডিপোর সামনের ফুটপাতের হোটেলে ভাত-ডাল-মাছ বা কখনও ডালহৌসির অফিস পাড়ায় ফুটপাতের হোটেলে ফ্রায়েড রাইস চিলি চিকেন। পাঁচ সাতটা কাগজের কল্যাণে রাতের খাওয়ার খরচটা বেশির ভাগ দিনই বেঁচে যায়। মোটামুটি এই খাওয়ার খরচ ছাড়া মেট্রোর স্মার্ট কার্ডে মাসে পাঁচশ টাকা আর মোবাইলে দুশো টাকা রিচার্জ করলেই হয়ে যায়। এছাড়া আছে মেট্রো রুটের বাইরে এদিক ওদিকে যাওয়ার বাস ভাড়া। নিজের পয়সায় চা-সিগারেট-মদ কোনওটাই সে খায় না। এর মধ্যে মূল খরচ বাদ দিয়ে হাতখরচ-এর আলাদা হিসেব কষা বেশ কঠিন।

তবে গোবর্ধন শুনেছে অফিসবাবু, বাড়ির বউদি, স্কুল কলেজ পডুয়া, পড়াশোনা শেষ করে ঘুরে বেড়ানো বেকার ছেলে-মেয়ে সকলেরই একটা আলাদা হাতখরচ আছে। নিজের খরচের মধ্যে হাতখরচের ভেদাভেদ না করায় ও হাতখরচের বিশেষ তাৎপর্য না থাকায় এতদিন এ বিষয়ে গোবর্ধনের কোনও আগ্রহ ছিল না। এখন সেটা নিয়ে যত মাথা ব্যথা।

এতদিন ধরে দৌড়ঝাঁপের পরে দৈনিক জবর খবর-এ একটা লেখার সুযোগ পাওয়া গেল, সেটা ঠিক মতো নামাতে পারলে কাগজের সঙ্গে পাকাপাকি ভাবে জুড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা। কিন্তু এমন একটা সাবজেক্ট দিল, যে-বিষয়ে তার জ্ঞান নিতান্তই সামান্য। সমস্যাটা সেখানেই। তবে একবার প্রয়োজনীয় তথ্যগুলো পেয়ে গেলেই আট দশটা নিজস্ব পেটেন্ট শব্দ জুড়ে দিয়ে খসখস করে ঘন্টা দুয়েকের মধ্যেই ঝক্কাস লেখাটা নামিয়ে ফেলতে পারবে এ বিশ্বাস তার আছে। কিন্তু এসব তথ্য জোগাড় করবে কোথা থেকে? এখন সেটাই ভাবনার! রাস্তায় বেরিয়ে এবার থেকে চোখটা ঝানু গোয়েন্দার মতো জাগ্রত রাখতে হবে। দুচার জনের সঙ্গে গল্প করার ছলে তাদের হাতখরচের কথাটা জেনে নেওয়া যেতেই পারে। তাহলেই লিখতে পারবে এক্কেবারে আঁখো দেখা হাল।

গোবর্ধন আর দেরি না করে জলের বোতল দুহাতে উপরে তুলে ধরে ঢকঢক করে মুখে ঢেলে নেয়। তারপর বোতলটা টেবিলের পাশে নামিয়ে রেখে কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে বেরিয়ে পড়ে। রাস্তায় বেরিয়ে পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে টিপে দেখে নেয়, কটা বাজল। আটটা চল্লিশ।

নেপাল হালদার লেন থেকে বেরিয়ে এসে কালিঘাট ফায়ার ব্রিগেড পার হয়ে হাজরার মোড়ের কাছে যতীন দাস পার্কের সামনে এসে দাঁড়ায়। পার্কের রেলিং এর ধারে ইট বাঁধানো জায়গায় একটু ছায়া দেখে বসে। পার্কের রেলিং ধরে পনেরো বিশ জনের লাইন। সকলেই হাতে মোবাইল নিয়ে নাড়াচাড়া করছে। গোবর্ধনও মোবাইল বের করে ফ্রি নেট সারভিস কানেক্ট করে কিছুক্ষণ ঘাঁটাঘাঁটি করে। ফেসবুকে আপডেট দেয়, দু-চার জনকে হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজও পাঠায়। এখানে বসে বসেই গোবর্ধন মাথার মধ্যে এক্সেল ফাইল-এর মতো ছকটা এঁকে ফেলে।

মানুষগুলোকে কতগুলো ক্যাটাগরিতে ফেলা যায় ভেবে নিয়ে তাদের এক একটা রো-তে ফেলেছে। তাদের কার কোন কোন খাতে কত খরচ হয়? হাতখরচের মাসিক বাজেট কত হতে পারে? এগুলোকে এক একটা কলাম করে মনে মনে ছকটা সাজিয়ে নেয়।

হাজরার মোড়ে বসে ছকটা সাজিয়ে নিয়ে গোবর্ধন প্রথমে আশুতোষ কলেজের সামনের চা-জল খাবারের স্টলগুলোয় সময় কাটিয়ে সারাদিন চক্কর খেয়েছে পরিচিত বন্ধু-বান্ধবদের অফিস-বাড়িতে। কথায় কথায় কলেজ পড়ুয়া ছাত্র-ছাত্রীদের কাছ থেকে, বন্ধুপত্নীদের থেকেও হাতখরচের ব্যাপারটা আন্দাজ করেছে। কিন্তু সকলের হিসাব যেন কেমন অসম্পূর্ণ। হিসেবে একটা অঘোষিত রহস্য আছে, সেটা কেউই খোলসা করে বলতে চায় না! গোবর্ধন মনে মনে ভাবে, এই না বলা খরচগুলো তাকে সাংবাদিকের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দিয়ে খুঁজে নিতে হবে।

তথ্য সংগ্রহের উদ্দেশ্যে কলেজের পুরোনো বন্ধু রজতের অফিসে আসা। অনেকদিন পর দেখা, গল্পে কথায় অনেকটা সময় কেটে গিয়েছে, ছটা বাজে প্রায়। এবার যেন বন্ধুটি উঠবার জন্য উশখুশ করছে। আরও দু-চার জন অফিসের সহকর্মী পাশে এসে জড়ো হয়েছে। তারা রজতকে ওঠবার জন্য তাড়া লাগায়। অগত্যা গোবর্ধনও উঠে পড়ে। একসাথেই সকলে অফিস থেকে বের হল ঠিকই কিন্তু তারপর কখন যেন গোবর্ধনকে ফেলে রেখে অন্যরা সব দলছুট হয়ে গেল।

গোবর্ধন রহস্যের গন্ধ পেয়ে দূরত্ব বজায় রেখে পিছু নেয় ওদের। ওরা সব ললিত গ্রেট ইস্টার্ন হোটেল পার হয়ে ডেকার্স লেনের গলিতে ঢুকল! পিছু পিছু এগিয়ে যায় সে। যেমন ধারণা ঠিক তেমন, দল বেঁধে সব পিংপং বার-এ ঢুকল। এখানে গানবাজনা হয়। পয়সা ফেললে সব কিছুই পাওয়া যায়। গোবর্ধন হিসেব কষে, রজত তো এই খরচের ব্যাপারটা বলেনি, চেপে গিয়েছে। কিন্তু এই খরচটা তো হাতখরচের মধ্যেই ধরতে হবে।

এখানে লাইন দিয়ে অনেকগুলো বার আছে। সেগুলো পার হয়ে গোবর্ধন পিয়ারলেস-ডেকার্স লেনের মোড়ে এসে দাঁড়ায়, এক কাপ চা নিয়ে সময় কাটায় অন্যদের অপেক্ষায়। এখানে তাদের অনেক সাংবাদিক বন্ধুই আড্ডা দিতে আসে। এখনও কাউকে দেখা যাচ্ছে না, হয়তো কিছু পরেই এসে পড়বে। গোবর্ধন চা শেষ করে আর অপেক্ষা না করে, পা বাড়িয়ে ধর্মতলা মোড়ে পিআরও সেবাব্রতের অফিসে পৌঁছোয়। নিয়ম করে মাঝেমধ্যেই এখানে ঢুঁ মারে সে। অনেক প্রেসমিটের ইনভিটেশন এখানে ডাইরেক্ট পেয়ে যায়।

আজ ছয়-আট ঘরটা প্রায় ভর্তি। পরিচিত দু-চারজন সাংবাদিককে পেয়ে গিয়ে গোবর্ধন কুশল বিনিময় করে। বসার জায়গা না পেয়ে সে দরজার কাছেই দাঁড়িয়ে থাকে।

সেবাব্রত আগ বাড়িয়ে বলে, কাল একটা ফিলমের প্রিমিয়ার শো কাম প্রেসমিট আছে। বড়ো মিডিয়া হাউসকে ডাকতে বলেছে, তোমাকে ডাকতে পারলাম না। দ্যাখো, এদেরকেও ডাকিনি।

গোবর্ধন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শোনে। সেখানে উপস্থিত অল্পবয়সি মেয়েটিকে উদ্দেশ্য করে সেবাব্রত বলে, তুই কালকে ওই ব্ল্যাক ড্রেসটা পরে আসবি। একদম সেক্স বম্ব লাগবে, সবাই তোকে দেখে হাঁ করে থাকবে।

গোবর্ধন ঘাবড়ে যায়। প্রেসমিটে সেক্স বম্বের আবার কী প্রয়োজন! যাক, পরে আসব তবে, বলে কেটে পড়ে সে। এখন নতুন যুগ আর পরিবর্তন-উন্নয়ন পত্রিকার অফিসে যাবে একবার। কাছাকাছিই অফিস পত্রিকা দুটোর, আটটা সাড়ে আটটা পর্যন্ত থাকে অনেকেই।

পরিবর্তন-উন্নয়ন পত্রিকা অফিসে ঢোকবার মুখে সুলেখার সঙ্গে দেখা। সেবাব্রতের অফিসে পরিচয় হয়েছিল সুলেখার সঙ্গে। তারপর ওখানেই পরে বেশ কয়েক বার দেখা হয়েছে, গল্প করেছে। বেশ মিশুকে, মালটি ট্যালেন্টেড মেয়ে গল্প কবিতা চিত্রনাট্য লেখে। তিন চারটে শর্ট ফিল্ম ডিরেক্টও করেছে। বেশ কিছু বড়ো মাপের লোকজনের সঙ্গে জানাশোনা আছে ওর। কেউ নেতা-মন্ত্রী বা কেউ বড়ো ব্যবসাদার। গায়ের রংটা একটু চাপা হলেও সুলেখার হাইট ভালো, বেশ সেক্সি ফিগার। হাতে ধরা সিগারেটে টান দিয়ে এগিয়ে আসে গোবর্ধনের দিকে।

—বর্ধনদা কেমন আছেন?

গোবর্ধন ইতিবাচক মাথা নাড়ায়। সুলেখার মুখে বর্ধনদা সম্বোধনটা বেশ লাগল শুনতে। কেউ তো এভাবে ডাকে না। মেয়েটা বুদ্ধি করে গো বাদ দিয়ে তাকে একটু জাতে তুলে দিল।

—যান ঘুরে আসুন। আমি এখানে অপেক্ষা করছি, একসঙ্গে ফিরব।

গোবর্ধন হাসি মাখা খুশি মনে এগিয়ে যাওয়ার সময় বলে যায়, বেশ তাই হবে।

মিনিট দশেক পরে গোবর্ধন বেরিয়ে এসে দেখে রাস্তার রেলিং-এ ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে সুলেখা আরও একটা সিগারেট ধরিয়েছে। গোবর্ধন মনে মনে ভাবে, মেয়েটার তো বেশ হাতখরচ হয়রে বাবা। সিগারেটের পিছনেই না কত খরচা!

গোবর্ধনকে দেখে সুলেখা এগিয়ে আসে।

—কাজ মিটল? কদিন ধরে আপনার কথা ভাবছিলাম কিন্তু নাম্বারটা পাচ্ছিলাম না। কী ভাগ্য, আজ হঠাৎ দেখা হয়ে গেল।

তাকে খুঁজছে জেনে গোবর্ধন বিস্মিত হয়! আমাকে আবার বিশেষ কী প্রয়োজন? কোথাও ভুল কিছু করেছি নাকি?

—না না, সে রকম কিছু নয়। আপনাকে আমারই দরকার। একটা ফিচার ফিলম করছি। প্রোডিউসার ফাইনাল। এখন স্ক্রিপ্ট নিয়ে ভাবছি। চলুন না ই-মলের উপরে একটু বসি। স্ক্রিপ্ট নিয়ে আলোচনা হবে।

গোবর্ধন আমতা আমতা করে বলে, আমি! আমি তোমার ফিলমে কী কাজে লাগব? সুলেখা হাত ধরে টেনে নিয়ে চলে।

—আরে বাবা চলুন না। একটা সুন্দরী মেয়ের সঙ্গে বসে কফি খাবেন, গল্প করবেন। তাতেও কিন্তু কিন্তু!

এমন লোভনীয় প্রস্তাবে গোবর্ধনকে ম্রিয়মান দেখে সুলেখা বলে, আজকের খরচা আমার। গোবর্ধন লজ্জা পায়।

—না না তা কেন, দুজনে ভাগ করে নেব।

সুলেখা বলে, না তার কোনও প্রয়োজন নেই। পরের দিনটা আপনার।

গোবর্ধন মনে মনে ভাবে তাহলে আজকের পরে আবার কফি হাউসে বা রেস্টুরেন্টে বসবে ওর সঙ্গে। অবিবাহিত গোবর্ধনের মনে রোমান্স উঁকি ঝুঁকি মারে। ই-মলের উপর তলায় ফুড কোর্টে বসে সুলেখা কফি অর্ডার করে, সঙ্গে দুটো ফিশফ্রাই। দুজনে টেবিলে সামনা সামনি বসেছে।

গোবর্ধন কথা পাড়ে, তোমার ফিলমের জনার কী? গল্প ঠিক হয়েছে?

সুলেখা মুখ বেঁকিয়ে বলে, ঠিক হয়নি এখনও, হয়ে যাবে একটা। তবে হ্যাঁ প্রোডিউসার ফাইনাল। ছিপে গেঁথে নিয়েছি। বর্ধমানে রাইস মিল, কোল্ড স্টোরেজ আছে। কলকাতাতেও প্রোমোটিং করছে। ভালো পলিটিক্যাল কানেকশন আছে, শুনেছি ওদের টাকা পয়সাও এর হাত দিয়ে খরচা হয়। গত সপ্তাহে মন্দারমনিতে গিয়েছিলাম একসঙ্গে। ওখানেই সব ফাইনাল হল। এই ফিলমটার পাশাপাশি একটা ডেইলি নিউজপেপার পাবলিশ করার কথা হয়েছে। চেনাজানা সব সাংবাদিক বন্ধুরা থাকবে সঙ্গে। আপনি থাকছেন তো? গোবর্ধন যেন হাতে চাঁদ পায়।

—হ্যাঁ হ্যাঁ তোমার পেপারে থাকব না মানে! থাকতেই হবে। মুখে এসব বললেও প্রোডিউসারের সঙ্গে মন্দারমনি যাওয়ার ব্যাপারটা জেনে মনের মধ্যে কেমন যেন একটা খচখচ করছে। আবার নিজেই ভাবে, যাক গে যার যা ইচ্ছে সে তা করুক তার কী!

—তাহলে কালচারাল পেজের এডিটর হচ্ছেন আপনি।

গোবর্ধন সলজ্জ ভাবে বলে, আমি কিন্তু পলিটিক্যাল আর্টিকেলও লিখি।

—সম্পাদকীয় কলমে মাঝেমধ্যেই লিখবেন। নিজেদেরই তো পেপার। গোবর্ধন খুশি আর উত্তেজনায় সুলেখার হাতের উপর হাত রাখে।

—আমি আছি তোমার সঙ্গে। এখন থেকে পেপারের ব্যাপারে যে-কোনও প্রয়োজনে, যখন খুশি আমায় ফোন করবে।

সুলেখা গোবর্ধনের হাতটা আলতো করে ধরে হাতের উপর থেকে নামিয়ে দেয়। চোখের কোণে উঁকি দেয় দুষ্টুমি।

—বর্ধনদা, আপনার লেখা কোনও ভালো গল্প আছে? মানে এই মিডিল ক্লাস সোসাইটির প্রবলেম, কারেন্ট কোনও ইসু্, টানটান উত্তেজনা, শেষে একটা মনকাড়া সলিউশন।

—আছে আছে, এই সবে লেখাটা শুরু করেছি। দু-এক দিনের মধ্যেই শেষ হয়ে যাবে।

—তাহলে ওই লেখাটা নিয়ে আমি ফিলম করছি। ফাইনাল। দুজনে মিলে আলোচনা করে স্ক্রিপ্টটা লিখব। গোবর্ধন খুশিতে উত্তেজিত হয়ে ওঠে।

—আমি স্ক্রিপ্টও লিখব?

—বাঃ আপনার গল্প, আপনিই তো ক্যারেক্টারগুলো ভালো করে চিনবেন। আপনিই তো সেটআপ, এক্সপোজিশন, স্ট্রাগল, কনফ্লিক্ট, ক্লাইম্যাক্স, রেজিলিউশন ভালো ভাবে বুঝবেন। আমার ফ্ল্যাটে এক্সট্রা রুম আছে। ওখানে আরামসে বসে লিখতে পারবেন। একসঙ্গে খেয়ে নেব। প্রয়োজনে রাত্রিতে থেকেও যেতে পারবেন। সুলেখার চোখেমুখে দুষ্টুমি খেলে যায়।

গোবর্ধন ঢোঁক গিলে বলে, আগে স্ক্রিপ্ট লেখাটা তো শুরু হোক। সে দেখা যাবেখন। আমার তো কালীঘাটে বাড়ি, রাত্রি হলেও ফিরতে তেমন অসুবিধা হবে না।

ওয়েটার এসে বিল দিয়ে গেল, তিনশো আশি টাকা। সুলেখা ব্যাগ খুলে টাকা বের করতে যায়। গোবর্ধন চেঁচিয়ে ওঠে, না না তুমি দেবে কেন? আমি দেব, সঙ্গে একজন পুরুষ মানুষ থাকতে, তুমি…।

সুলেখা গোবর্ধনের হাত চেপে ধরে রেখে পাঁচশো টাকার নোট বের করে দেয় বিল পেমেন্টের জন্য। গোবর্ধন দেখল ওরকম আরও অনেকগুলো পাঁচশো টাকার নোট সুলেখার ব্যাগে আছে। তার কাছে থাকা একমাত্র পাঁচশ টাকার নোটটা আস্তে আস্তে মানিপার্সে ঢুকিয়ে রাখে।

গোবর্ধন বলে, পরের দিনের খরচা কিন্তু আমার। জোরাজুরি করবে না সেদিন।

দুজনে দুজনের ফোন নাম্বার, হোয়াটসআপ নাম্বার আদান প্রদান করে টেবিল ছেড়ে ওঠে।

বাড়ি ফিরে লিখতে বসে, হাতখরচের নতুন পাওয়া পয়েন্টগু-লো লিখতে থাকে গোবর্ধন। এই যেমন সুলেখার সিগারেটের খরচ, রজত ও তার বন্ধুদের বারে যাওয়া ও তৎ-পরবর্তী খরচ আর দুজনে মিলে একান্তে বসলে রেস্টুরেন্টে কফি-স্ন্যাক্স-এর খরচ।

গোবর্ধন বুঝে গিয়েছে এতদিন হাতখরচের ব্যাপারে মাথা না ঘামালেও আগামী দিনে তার কিছু হাতখরচ হবেই, সেটা পাক্কা। আর তার জন্য একটা বাজেট করতে হবে। এই যে সুলেখা বলল ওই বিজনেস পার্সন-এর সঙ্গে মন্দারমনি গিয়েছিল। তা যাওয়া আসা, হোটেল-রিসর্ট-এ থাকার খরচটা কি সুলেখার? না যার সঙ্গে গিয়েছিল তার? এমন খরচা তারও তাহলে ভবিষ্যতে হতে পারে।

লেখাটা বেশ অনেকটা এগিয়েছে। কিন্তু আগামী দিনে হাতখরচের সংস্থান করার চিন্তাটা চেপে বসেছে গোবর্ধনের মাথায়। হাতখরচের বাজেট রাখতে গেলে উপার্জন বাড়াতে হবে। উপার্জন যত বেশি হবে, হাতখরচও তত বেশি করা যাবে। ভাবে রজতের তাহলে বেশ উপার্জন, তাই না ফি সন্ধেয় বারে বসে খরচা করতে পারে।

রজতের বাঁশদ্রোণীতে দোতলা বাংলো টাইপের বাড়ি। গাড়ি বাইক দুটোই আছে। গত বছর মেয়েকে পঞ্চাশ-ষাট লাখ টাকা খরচা করে প্রাইভেট মেডিকেল কলেজে ভর্তি করেছে। ওর বউ বেশ সুন্দরী, সুন্দর ফিগার, বয়সে প্রায় তার বউদিরই মতো। তবুও এখনও…। নিশ্চয় সে নিয়মিত জিমে, বিউটি পার্লারে যায়। এসবেও তো খরচা আছে।

পরদিন গোবর্ধন হাতখরচের ব্যাপারে অজানা আরও অনেক কিছু তথ্য হাতে পেল। আশুতোষ কলেজের পাশে লাইন দিয়ে বসে থাকা ছেলে-মেয়েগুলোর কথা, ওখানে দাঁড়িয়ে থেকে আড়ি পেতে শুনছিল। ওদের অনেকেই মনের সুখে বসে সিগারেটে সুখটান দিচ্ছে, ছেলে-মেয়ে নির্বিশেষে। তবে মেয়েদের সংখ্যাটাই যেন বেশি। ওদের মধ্যে কয়েক জন ছেলে-মেয়ে একসঙ্গে হুক্কা বারে যাওয়ার প্ল্যান করছিল। সেটা আবার কী? গোবর্ধন দাঁড়িয়ে ভাবতে ভাবতে ওরা বুক করা ক্যাবে চেপে বেরিয়ে গেল।

আরও বড়ো বিস্ময় অপেক্ষা করছিল গোবর্ধনের জন্য। নিউটাউনের দিকে এসেছিল একটা রিপোর্টিং-এর জন্য। আজই সকালে ফেসবুকে জেনেছে সুলেখার জন্মদিন কাল, একটা কিছু গিফট দিতেই হয়। কিছু একটা কেনার উদ্দেশ্যে সিটি সেন্টার-এ এসেছিল। কিন্তু যা দেখল তাতে তো নিজের চোখকেও বিশ্বাস করতে পারছে না! –

মামাতো ভাই অতীন-এর বউ মিতা, এ কার সঙ্গে এসেছে মলে! ওর থেকে অল্প বয়সের ছেলেটির হাত ধরে ঘনিষ্ঠ ভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে। অতীন গোবর্ধনের সমবয়সি। অতীন-মিতা নিঃসন্তান। অতীন মুম্বইতে বড়ো মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির রিজিওনাল ম্যানেজার। মিতা রাজ্য সরকারের অফিসে অফিসার। গোবর্ধন ঘুরে ঘুরে ওদের পিছনে পিছনে ঘুরতে থাকে।

মিতা একটা দামি ব্র‌্যান্ডের শোরুম থেকে ছেলেটির জন্য প্যান্টশার্ট কিনে কার্ডে পেমেন্ট করল। ছেলেটি মিতাকে হাগ করে আলতো কিস করে। গোবর্ধন ভাবে এসবেও তো হাতখরচই হচ্ছে। সুলেখার জন্য কিছু একটা কিনতে যে এখানে এসেছিল, সেটাই প্রায় ভুলতে বসেছিল। হঠাৎ সম্বিত ফেরে। কিন্তু সে কিনবেটা কী? টপ, জিনস, শার্ট, ট্রাউজার না শাড়ি? সুলেখার প্রোপোরশনেট শরীর সে সামনে বসে দেখেছে কিন্তু পোশাকের সাইজ আন্দাজ করা মুশকিল।

শাড়িই ভালো, কোনও মাপজোক-এর প্রয়োজন নেই, সকলের জন্যই সমান। একটা শাড়ি পছন্দ করে ভালো করে গিফট প্যাক করিয়ে নেয় গোবর্ধন। পকেট থেকে ডেবিট কার্ডটা বের করে দেয় পেমেন্ট করার জন্য। তারও একটা ব্যাংক অ্যাকাউন্ট আছে, একটা ডেবিট কার্ডও আছে। তবে আজই প্রথম সেটা ইউজ করল। পয়সা খরচের সঙ্গে সঙ্গে কেমন যেন একটা সুখানুভুতি হচ্ছে গোবর্ধনের। এটাই বোধহয় গোবর্ধনের প্রথম হাতখরচ।

সুলেখাকে চমকে দেবে বলে পরের দিন সকাল সকাল উঠে স্নান সেরে, পরিষ্কার জামা কাপড় পরে লেক মার্কেট থেকে ফুলের তোড়া মিষ্টি কিনে নিয়েছে। আগের দিনের কেনা গিফটটা নিয়ে সুলেখার ফ্ল্যাটে যাবে বলে বেরিয়ে পড়ে। বাইপাসের ধারে সারি সারি নতুন সুন্দর ফ্ল্যাটগুলোতে বাস করছে কত না স্বপ্ন।

গড়িয়ার বাইপাস যেন এখন ফুল বাগিচার মধ্যে বিছানো এক সুরম্য পথ, যা পৌঁছে দেবে তাকে তার ঘুম কাড়া স্বপ্নের কাছে। এইসব ফ্ল্যাটের কোনও একটাতেই থাকে সুলেখা। মেট্রো থেকে নেমে হাঁটতে হাঁটতে এগিয়ে চলেছে গোবর্ধন। গত রাত্রে লেখাটাও শেষ হয়েছে। চাপমুক্ত। হালকা মনে একটা স্বপ্নিল সুখানুভুতি নিয়ে এগিয়ে চলেছে সে। এই ভালো লাগার মধ্যেও কেন যে বুকটা দপদপ করে নাচছে। এমন তো তার আগে কখনও হয়নি!

ফ্ল্যাটের গেটে নাম লিখিয়ে ছতলা ফ্ল্যাটের চার তলায় উঠে আসে লিফট বেয়ে। তার সঙ্গে সঙ্গে শরীরের রক্তচাপও যেন উপরে চড়ছে উত্তেজনায়। ফ্ল্যাটের সামনে দাঁড়িয়ে কলিং বেল টিপতে সুলেখা এসে দরজা খুলে দাঁড়ায়। সদ্য ঘুমছাড়া জড়ানো চোখ। পরনে হাউস কোট, উপর থেকে বুকের কাছ পর্যন্ত কয়েকটা বোতাম খোলা।

গোবর্ধনের দৃষ্টি হঠাৎ সুলেখার মুখ ছাপিয়ে বুকের খাঁজে আর পাশের দৃশ্যমান গোলকে এসে থামে। গোবর্ধন নিজেকে সামলে চোখ সরিয়ে মুখ তুলে বলে, শুভ জন্মদিন।

কিছু ভাববার আগে, প্রত্যুত্তর-এর বদলে সুলেখা হ্যাঁচকা টানে গোবর্ধনকে ভিতরে টেনে ঢুকিয়ে নিয়ে দরজা বন্ধ করে দেয়। কখন যে ছাড়া পাবে এখান থেকে বলা যায় না। আজ হাতখরচের উপর লেখা আর্টিকেলটা দৈনিক জবর খবর-এর অফিসে জমা দেওয়ার ছিল, সঙ্গেই এনেছে। কিন্তু সে সময় কি আজ আর পাবে!

তবে লেখাটা শুরুর সময় যে উত্তেজনা ছিল গোবর্ধনের, সেটা এখন অনেকটা স্তিমিত। এখন গোবর্ধনের নতুন অ্যাসাইনমেন্ট। এখন তো সুলেখার ফিলমের স্ক্রিপ্ট লিখতে হবে, সুলেখার নিউজ পেপারের এডিটোরিয়াল করতে হবে। সুলেখার জন্য আরও কত কী যে করতে হবে! গোবর্ধনের বুঝি এতদিনে একটা ফুলটাইম কাজ জুটল।

 

শেষ মানেই প্রশ্ন

রজতের মনটা বেশ খুশি খুশি। কয়েকদিন আগে থেকেই প্রায় সব কিছু গোছানো হয়ে গেছে, এবার যা আছে শুধুই টুকটাক। তবে হাসপাতালের কাজগুলোই বাকি। অফিসে বসে বসেই ল্যাপটপে নিজের মেলটা একবার চেক করে নার্সিংহোমের সাইটে গিয়ে সব কিছু দেখে নিল। যাক নামটা না লিখলেও বাকি সব কিছু লিখে দিয়েছে।

একবার ওদের ম্যানেজারকে ফোন করতে হবে, শুক্রবার আর শনির বিকালটা এখানে বসবে না। বাড়ির আর একটু কাছে আরেকটা নার্সিংহোমেও কথা হয়েছে, সকালে ওখানে বসবে, সেই সঙ্গে ওই দু’দিনের বিকালটাও। সকালেই অদিতির সাথে কথা হয়েছে। কথায় কথায় বলেছে, তাহলে ডাক্তারবাবু গ্রামের মায়া শেষ? একটু থতমত খেলেও উত্তর দেবার চেষ্টা করেছে, তা কেন হবে? কাজ করলাম তো, এবার তো একটু নিজের কথা ভাবতে হবে। তাছাড়া মা আছে, তুমিও আছো।

—আমি! হাসালে।

—কেন?

—বাদ দাও, কলেজ আছে।

আর কথা না বাড়িয়ে রজত মোবাইল পকেটে ঢুকিয়ে নেয়, সিগারেট খেতে ইচ্ছে করছে। কিছু সময় পর একবার মাকে ফোন করবার জন্য মোবাইলটা বের করতে যাবে এমন সময়, সেন্টারের একজন এএনএম সিস্টার মহুয়া ম্যাডাম রুমের দরজাটা খুলে জিজ্ঞেস করলেন, স্যার আসব?

রজত ঘাড় তুলে বলে, ও হ্যাঁ আসুন, কী ব্যাপার?

—একটা পেশেন্ট এসেছে, ইনজুরি আছে।

মোবাইল ঘাঁটতে ঘাঁটতেই রজত বলে, মেল না ফিমেল?

—আদিবাসীদের মেয়ে

একটু চমকে উঠল রজত। নামে হেল্থ সেন্টার হলেও এটা আসলে একটা গ্রামের ছোটো হাসপাতাল, তবে গ্রামের কয়েকজন প্রভাবশালী মানুষের জন্য প্রতিদিন চব্বিশ ঘন্টাই ডাক্তার থাকেন। এখন যেমন রজত আছে। তবে সেভাবে তো আদিবাসীরা এই সেন্টারে ডাক্তার দেখাতে খুব একটা আসে না। জিজ্ঞেস করল, লোকাল?

—সম্ভবত না, বাইরের।

কিছুটা পরিষ্কার হল। এই গ্রামে বাইরের রাজ্য থেকে অনেক আদিবাসী চাষবাসের কাজ করতে আসে। তাদেরই কেউ এসেছে হয়তো। জিজ্ঞেস করল, ছোটো না বড়ো? গৌতম নেই? কিছু ফুটলে বা কাটলে স্টিচ করে দিতে বলো।

গৌতম এই হেল্থ সেন্টারের গ্রুপ ডি কর্মী হলেও কিছু কিছু কাজ দারুণ শিখে নিয়েছে, যা স্টিচ করছে বড়ো কম্পাউন্ডারকেও হার মানাবে। কয়েকদিন আগেই এক মন্ত্রী সপরিবারে পাশের রাস্তা দিয়ে যাবার সময় কোনও কারণে মন্ত্রীর স্ত্রী একটু অসুস্থ হয়ে সন্ধেবেলা এই হাসপাতালে আসতে বাধ্য হন। গৌতম যেভাবে তাকে তাড়াতাড়ি সুস্থ করে দেয়, তা একরকম অবিশ্বাস্য। গৌতমের খুব নামও হয়, সেদিন আবার রজত কোনও একটা মিটিং-এ কলকাতায় ছিল।

স্বভাবতই গৌতম নেই শুনে মেজাজটা একটু বিগড়ে গেল রজতের। একটু ঝাঁঝিয়ে বলে উঠল, তাহলে নতুন ডাক্তারবাবুকে বলুন৷ আমার তো আজকের দিনটাই….।

—স্যার উনি তো স্কুল হেল্থের ডিউটিতে গেছেন।

—ও তাই তো, এখনও ফেরেননি?

—না, স্কুলটাতে অনেক স্টুডেন্ট। আমি ওই গ্রামের সেকেন্ড এএনএমকে ফোন করেছিলাম, হাইস্কুল- এমনিতেই দু’দিন লাগবে। তার মধ্যে উঁচু ক্লাসের কিছু স্টুডেন্টের কাউন্সেলিং আছে।

—তাহলে আপনিই ড্রেসিং করে ছেড়ে দিন।

শেষের কথাগুলো শুনেই এএনএম ম্যাডাম একটু বিরক্ত হয়ে বলে উঠলেন, স্যার, সেটা পারলে তো কোনও সমস্যাই ছিল না, মেয়েটির ভ্যাজাইনাল পেনিট্রেশন হয়েছে।

শেষের কথাগুলো শুনেই রজত একটু চমকে ওঠেন, পেনিট্রেশন! আপনি ভুল বলছেন না তো?

মহুয়া ম্যাডাম একটা লম্বা শ্বাস ছেড়ে বলে উঠলেন, স্যার জেনিটাল পার্টে ভালো রকমের ইনজুরি, তলপেটে রক্তের সাথে আরও কিছু থাকতে পারে।

—থাকলেও কিছু করবার নেই। আমার হাতে তো কিছু নেই। বিএমওএইচ, সেখান থেকে সিএমওএইচের কানে খবর যাবার আগেও অন্য খবর হয়ে যাবে। মেয়েটার সেন্স আছে?

—সেন্স আছে, তবে খুব টেনস্ড, কেমন যেন গুটিয়ে আছে।

—সেটাই স্বাভাবিক, বয়স কত?

—এগারো বারো।

একটা লম্বা শ্বাস ফেলে রজতবাবু এবার উঠে দাঁড়িয়ে বলে উঠল, চলুন।

রজত এই গ্রামে বছর দুই পোস্টিং পেয়েছে। বাইরের রাজ্য থেকে মাস্টার ডিগ্রি করে আসার পর বাবার কথামতো এই সরকারি চাকরি নিয়ে কিছু অভিজ্ঞতা তো হয়েছেই কিন্তু এমন অভিজ্ঞতা আগে হয়নি। আশেপাশের বেশ কয়েকটা গ্রাম থেকে পেশেন্ট আসে, ভিড় হয়। কয়েকটা পলিটিক্যাল ঝামেলা হয়েছে। মাথা ফাটা, হাত ভাঙা এসব বেশ কমন ব্যাপার। কিন্তু এই রকম ঘটনা তো এখানে কোনও দিন শোনেনি।

রজত আর সময় নষ্ট না করে ছোটো অপারেশন থিয়েটারের দিকে পা বাড়ায়। অবশ্য কয়েকটা ল্যানসেট, মসকিউটো ফরসেপ আর কয়েকটা নিডল হোল্ডার থাকলেই যদি কোনও ঘরকে অপারেশন থিয়েটার বলা যায়!

 

( )

জানলার ওপাশেই আস্তে আস্তে বিকেল নামছে। নিজের অফিসের চেয়ারে বসে থাকতে থাকতে একটু দূরে মাঠগুলোতে চোখ আটকে গেল। এবছর ভালো জল দিয়েছে। কয়েকদিন আগেই গ্রামের একটা লোককে ডেকে পাঠাতে হয়েছিল। ব্যাটা কিছুতেই তার মেয়েটাকে বড়ো হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছিল না। কিশোরী মেয়ে কয়েক মাস ধরে সাইকেল বন্ধ। রজত সিস্টের সন্দেহ করছিল। কিন্তু ডেকে ধমকাতেই লোকটি কীরকম অদ্ভুত ভাবে বলে উঠল, সবই তো বুঝলাম ডাক্তারবাবু কিন্তু লিয়ে ট কে যাবেক, উয়ার মা তো যেতি পারবেক নাই। আমি ইখন তো যাব নাই, বোরোর জল দিছে, রোয়া টো হয়ি যাক। না হলে তো লেবারগুলো পালাবেক।

—কিন্তু তার আগে তোমার মেয়ের সমস্যা তো আরও বাড়বে, এটা নিয়ে টানা চার মাস হল।

—ডাক্তারবাবু আপনি কী বুঝবেন? কেউ যদি জেনে যায় বিটিটর মেয়েলি কোনও রোগ আছে, বিয়ে হবেক নাই। আপনিই দেখে ওষুধ দেন।

তখনই ধমকায় রজত। কয়েকদিনের মধ্যে যদি বড়ো হাসপাতালে না নিয়ে যাও তবে আমি নিজেই গ্রামের সবাইকে বলে দেব।

এই লেবারগুলোই খুব সমস্যার। বাইরের রাজ্য থেকে এসে এখানে চাষের কাজ করে। সকাল সকাল ওরা মাঠে কাজে নেমে পড়ে। সবাই নাকি ঝাড়খণ্ডের বিভিন্ন গ্রাম থেকে আসে। শাড়ির উপর একটা জামা পরে মাঠে নেমে ধান পোঁতে, কাটে, ঝাড়ে, মাথায় করে নিয়ে যায়। কাজ করতে করতেই কোনও এক পাশে বসে নিজেদের দুধের ছেলে-মেয়েকে দুধ খাওয়ায়।

এদের পুরুষগুলোকে মদ খেয়ে বিভিন্ন জায়গায় শুয়ে থাকতেও দেখা যায়। তবে হেল্থ সেন্টারের সিস্টার দিদিমণিদের ওরা এলেই একটু রাগ হয়। রজতকে সোজাসুজি কিছু না বললেও নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে, ওই এল, এবার কথায় কথায় ওষুধ দাও, না হলে প্যাড দাও। এদের আবার একটা দিলে মন ভরে না।

—কিন্তু এইরকম সমস্যা তো কোনও দিন হয়নি। নাকি বলেনি?

অদিতি অবশ্য সব কিছু শুনে বেশ গম্ভীর ভাবে বলে, ব্যাপারটা কিন্তু খুব গোলমেলে। আমি কয়েকদিন আগে একটা খবর পড়ছিলাম, একটা পুরো হাসপাতাল নাকি এইরকম একটা ঘটনার জন্য ভেঙে তছনছ করে দেয়। ওদের কারওর নাম বেরিয়ে গেছিল। তুমি কিন্তু সাবধানে থাকবে।

সেই সময় অতটা পাত্তা না দিলেও পরে মাথায় কথাগুলো নাড়াচাড়া করবার সময় একটু অন্যরকম লাগল। তবে বিএমওএইচ স্যার সব শুনে খুব একটা পাত্তা না দিয়ে বলেন, শুনুন, একটা অফ দ্যা রেকর্ড কথা বলি– এ দেশে এই ধরনের ঘটনা যত হয় সব যদি ব্যবস্থা করতে হয়, তবে আমাদের অন্য কোনও কাজ আর করতে হবে না। তার থেকে ট্রিটমেন্ট করে ছেড়ে দিন।

কথাগুলো রজতের ভালো লাগেনি। একটু জোর দিয়ে বলেও ছিল, এটা কী করে হবে স্যার? ফুল পেনিট্রেশন, মনে হচ্ছে সিমেন লেগে আছে, বিভিন্ন জায়গায় ইনজুরি আছে, এটা তো ঠিক কথা নয়।

বিএমওএইচ স্যার সব কিছু শুনে বলেন, আপনি এক কাজ করুন মেডিকেল কলেজে রেফার করে দিন, ওরা প্রয়োজন পড়লে ফরেনসিকও করতে পারবে।

কথাগুলো ঠিকই বলেছেন কিন্তু তার জন্য তো একটু থানাতেও খবর দিতে হবে। বিরক্তিকর অবস্থা, শেষ দিন, আর যত উটকো ঝামেলা। থানাতে ফোন করবার আগেই একবার গৌতমের সাথে কথা বলা দরকার। কিন্তু গৌতমকে ফোন করতেই ওদিক থেকে শুনল, হ্যাঁ দাদা আপনাকেই ফোন করতে যাচ্ছিলাম। আমাকে আজ রাতে একটু বাড়ি যেতে হবে, ফোন এসেছিল। বাবার শরীরটা ভালো নেই, আমি আমার এক বন্ধুকে ফোন করেছি, তাও একটু যেতে হবে। আপনি কোনও চিন্তা করবেন না, আমি কাল সকালের মধ্যে ফিরে আসব।

রজত আর কোনও কথা বলতে পারে না। গৌতমের বাড়িটা কাছেই এটা ওর কাছে একটা সুবিধা। কিন্তু অফিসিয়ালি তো এই সেন্টারের…।

এবার মাথা ব্যথা করছে। আর কোনও উপায় নেই, আবার সিগারেট খেতে ইচ্ছে করছে। থানাতে ফোন করে একটা ব্যবস্থা করতে হবে। কিন্তু অফিসার ফোন ধরেই বলে উঠলেন, শুনুন ডাক্তারবাবু, দুটো গাড়ি, একটা ডেপুটেশনে গেছে আরেকটা পেট্রোলিং-এ। তবে ওটাও…। ঠিক আছে, বুঝতেই তো পারছেন অনেকটা দূর, তাও দেখছি।

পুলিশ দেখবার আগেই অবশ্য পঞ্চায়েত অফিস থেকে প্রধান সাহেব ফোন করলেন, ডাক্তারবাবু, পুলিশ-ফুলিশ কেন টানছেন, কী এমন হয়েছে, ওসব ছোটোখাটো ব্যাপারে পুলিশ এলে গ্রামের বদনাম হবে। আপনারা শহরের লোক কী বুঝবেন!

—কিন্তু ওটা তো ছোটোখাটো ব্যাপার নয়, গ্রামের কাজ করতে আসা একটা আদিবাসী মেয়েকে আপনাদের গ্রামের কেউ বা কয়েকজন মিলে রেপ করেছে। মেয়েটার সারা শরীরে কাটার দাগ, সিমেনের চিহ্ণ, সেটা কীভাবে ছোটো ঘটনা হবে?

মুচকি হাসলেন প্রধান সাহেব। ডাক্তারবাবু, ওরা আসে ঠিকই কিন্তু শুধুমাত্র আমাদের গ্রামেই তো ওরা কাজ করে না, আশেপাশে চল্লিশটা গ্রামে ওরা কাজ করে। আপনি কি গ্রামের সব ছেলেদের বীর্য পরীক্ষা করে বেড়াবেন?

—তা কেন ওই মেয়েটি তো লোকটিকে চেনে, দেখেওছে।

—ধরুন মেয়েটি দেখেনি, ধরুন চেনে না, ধরুন মেয়েটি চোখে কম দেখে, অথবা মেয়েটি বলবে না। আপনি কীভাবে সব কিছু ম্যানেজ করবেন? তাছাড়া ডাক্তারবাবু আরেকটা কথা বলি, আপনি মাত্র এই কয়েক বছর আছেন, কেউ কিছু ঝামেলা ঝঞ্ঝাট করে না। কিন্তু আজ করবে না বলেই যে, কাল করবে না এটা তো কেউ বলতে পারে না। করতেই পারে, ধরুন কোনও একটা ওষুধ খুঁজতে এল আপনার সেন্টার দিতে পারল না। গ্রামের লোক একটু বোঝে কম, ভেঙে দিল সব। কীই বা করতে পারবেন বলুন। তারপর দেখুন পেশেন্ট আসে, তাদের মধ্যে কেউ যদি বড়ো কোনও জায়গায় অথবা ধরুন আমার কাছেই এসে বলে, ডাক্তারবাবু এক্কেবারে ভালো নয়, শরীরে খুব বেশি হাত দেয়। তখন তো সেই পুলিশকে সঙ্গে নিয়ে আমাকে আপনার সেন্টারে যেতে হবে।

তখন কথাগুলো শুনে সাময়িক একটু ভয় লাগলেও অদিতিকে ফোন করে কথাগুলো বলবার পর, তার কথা শুনে একটু ভরসা পায় রজত, জোর পায়।

গ্রামের কয়েকজনকে ফোন করে গাড়ির ব্যবস্থা করতে বলে। প্রথমে সবাই শুনে গাড়ি দিতে রাজি হলেও, পরে একে একে সবাই জবাব দিতে আরম্ভ করে। রজত সেন্টারের সিস্টারদের সাথে কথা বলে সবাইকে বোঝানোর কথা বলে। ফোনে সবাই সব কিছু শুনে হ্যাঁ হ্যাঁ বললেও কিছুক্ষণ পরেই কেউ আবার ফোন করে কোনও একটা বাহানা করে, কেউ আবার আর কোনও জবাবই দেয় না। রজতের খারাপ লাগে, ভয় লাগে। মেয়েটার কিছু হয়ে যাবে না তো?

বিকাল গড়িয়ে সন্ধের মুখে সিস্টার মহুয়াদি এসে বলেন, স্যার মেয়েটা একটু ঠিক হলেও কেমন একটা আওয়াজ করছে, উঠতে পারছে না। কিন্তু মা বাবার সাথে দেখা করবার কথা বলছে।

এবার রজত একটু শান্তি পায়। কিন্তু কে বা কারা মেয়েটার ওরকম অবস্থা করল সেটা তো জানতে হবে। যেমন করে হোক বড়ো হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। কিন্তু নিয়ে যাবে কীভাবে? একটু পরেই সন্ধে নামবে, পঁচিশ-ত্রিশ কিলোমিটার রাস্তা, কীভাবে যাবে?

রজত কিছুক্ষণ বসেই একজন সিস্টারকে ডেকে বলল, ম্যাডাম, আপনার বাড়িতে একবার ফোন করে জানিয়ে দিন, অবশ্য আপনার যদি কোনও আপত্তি না থাকে তো।

—ঠিক বুঝলাম না।

একটা লম্বা শ্বাস ছাড়ে রজত। যদি আপত্তি না থাকে আমি মেয়েটিকে আমার বাইকে বড়ো হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছি। ওকে মাঝে বসাব, আপনি পিছনে বসবেন।

—কিন্তু স্যার মেয়েটি তো বাড়ি যাবার জন্যে বায়না করছে, ওর বাবা-মাও এসেছে। ওরা আবার বলছে কালকেই ওদের দেশে ফিরে যাবে, আমরা যেন মেয়েটাকে ছেড়ে দিই।

—ছেড়ে দিই!

—হ্যাঁ স্যার, খুব কান্নাকাটি করছে। আপনার সাথেও দেখা করবার জন্যে খুব জোর করছে। আমি কোনওরকমে ঠেকিয়ে রেখেছি।

—সবই বুঝলাম। কিন্তু একে যদি না নিয়ে যাই, আমার পরে যারা আসবে তাদের সমস্যা হবে আরও বেশি।

কথাগুলো বলে রজত আবার কিছু সময় চুপ করে থেকে বলে, ভ্যালিয়াম জাতীয় কিছু ইঞ্জেকশন আছে? পুশ করে দিন। তারপর পিছনের দরজা দিয়ে…।

 

( )

এবার শান্তি হল রজতের। মেয়েটিকে ভর্তি করা গেল, ট্রিটমেন্ট আরম্ভ হল। হাসপাতালের বাইরের একটা চায়ের দোকানে দাঁড়িয়ে চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে রজত সিস্টারকে বলে উঠল, ম্যাডাম দু’জনে যেতে ভয় করবে না তো?

—কীসের ভয়?

—এই এতটা রাস্তা বাইকে আমার সাথে যেতে হবে তো।

সিস্টার কোনও জবাব না দিয়ে হেসে ওঠেন। রজত তার মুখের দিকে তাকিয়ে বলে, মহুয়া ম্যাডাম, কাল ফার্স্ট হাফে কিছু ওষুধ ড্যামেজ দেখাবেন, তার মধ্যে কয়েকটা ভ্যালিয়াম ইঞ্জেকশনও দেবেন। আর ডিসপোসাল সিরিঞ্জটা একটু ধুয়ে নিয়ে ডাস্টবিনে ফেলবেন।

চারদিকে তখন অন্ধকার, মহুয়া ম্যাডাম রজত স্যারের কথাগুলো শুনে তার মুখের দিকে তাকান।

রজতের মুখ তখন সিগারেটের ধোঁয়ায় অস্পষ্ট।

মুশকিল আসান

সুচিত্রা কিছুতেই মনের আনন্দ গলার স্বরে লুকিয়ে রাখতে পারছিল না সেটা ফোনের মধ্যেও বুঝতে পারছিলেন সুনন্দাদেবী।

কী বউমা, এত সকালে তোমার ফোন? কোনও ভালো খবর আছে বুঝি? সুনন্দা উৎসুক কণ্ঠে ফোনের ওপারে থাকা সুচিত্রাকে প্রশ্ন করলেন।

হ্যাঁ মা, তুমি এবার ঠাকুমা হতে চলেছ।

বউমা, সত্যি বলছ? সত্যিই আমি এবার ঠাকুমা হব? আমি ভাবতে পারছি না, সকাল সকাল এরকম একটা আনন্দের খবর আমার জন্য অপেক্ষা করছিল। কবে থেকে এই খবরটা শুনব বলে বসে আছি। সকালবেলাতেই তুমি আমার মন ভালো করে দিলে। ভালো থাকো, সুখে থাকো। সুনন্দাদেবী আশীর্বাদ দেওয়ার ভঙ্গিতে বউমাকে বললেন।

হ্যাঁ মা…, আশ্বাস দিল সুচিত্রা।

আমি জানি নাতি আসতে চলেছে আমার। তা তোমার মা-কে খবরটা জানিয়েছ? উনিও শুনে খুব খুশি হবেন। সুনন্দা মনে করান বউমাকে।

না! তোমার সঙ্গে কথা বলেই মা-কে ফোন করব। কিন্তু একটা কথা বলো তো, নাতি-ই যে আসতে চলেছে সে ব্যাপারে তুমি এত নিশ্চিত কী করে হলে? নাতনিও তো আসতে পারে। হেসে উত্তর করে সুচিত্রা।

না না, আমি জানি আমার ঘরে প্রথম নাতিই আসবে, আসতেই হবে। কিন্তু বউমা তুমি নিজের যত্ন করবে। ভারী ওজনদার জিনিস এখন একদম তুলবে না। তোমার কাজের মেয়েটা ঠিকঠাক আসছে তো? সুনন্দার চিন্তা ওনার গলার আওয়াজেও প্রকাশ পায়।

তুমি একদম চিন্তা কোরো না। রীণা রোজই কাজে আসছে। এখন ছুটি নেওয়াটাও ওর অনেক কমেছে। শাশুড়িকে শান্ত করার উদ্দেশ্যে সুচিত্রা কথাগুলো বলে।

এখন ওকে একেবারেই ছুটি দিও না। এই সময় তোমার বিশ্রাম করাটা খুব দরকার। বিশেষ করে শুরুর সময়টা এবং শেষের তিনটে মাস খুবই সাবধান।

হ্যাঁ মা, আমি জানি। তুমি নিশ্চিন্ত থাকো। আমি নিজের খেয়াল অবশ্যই রাখব। বলে সুচিত্রা ফোন কেটে দিল।

আগের দিনই সুচিত্রা সম্পূর্ণ নিশ্চিত হয়েছে নিজের প্রেগন্যান্সি সম্পর্কে। সকালে অজয় অফিস বেরিয়ে যাওয়ার পর নিজের পরিচিত গাইনির কাছে গিয়ে একবার পরীক্ষা করিয়ে কনফার্ম হয়ে, অজয়কে ফোনে ব্যাপারটা জানিয়েছে।

আজকে তাই সকালে উঠেই প্রথমে শাশুড়ির সঙ্গে কথা বলার পর মা-কে ফোন করল সুচিত্রা।

মা, একটা ভালো খবর দিতে চাই।

ভালো খবর? আমার দিদা হওয়ার খবর নাকি? অনিমা নিজের মনেই মুচকি হাসলেন।

তুমি কী করে জানলে আমি এই খবরটা দিতেই ফোন করেছি? অন্য খবরও তো হতে পারত। এই যেমন অজয়ের প্রোমোশন…, চুপ করে যায় সুচিত্রা।

শোন চিত্রা, আমি তোর মা। তোর গলা শুনেই বুঝেছি কী ভালো খবর তুই দিতে চলেছিস। আমি প্রচণ্ড খুশি হয়েছি। ভাবতে পারছি না আমার সেই ছোট্টা চিত্রা আজ তারই মতো সুন্দর একটা মেয়ের মা হতে চলেছে। দেখবি তোর মেয়ে নিজের দিদার মতোই বুদ্ধিমতী এবং তোর মতো সুন্দরী হবে। গর্বিত কণ্ঠে অনিমা বলেন।

মা, তোমারও না সবেতে বাড়াবাড়ি। তুমি কী করে এতখানি শিয়োর হচ্ছ যে তোমার নাতনিই হবে? কপট ধমক দেয় সুচিত্রা নিজের মা-কে।

চিত্রা, আমার মন বলছে দেখিস। আর আমিও চাই তোর ফুটফুটে একটা মেয়ে হোক। এখন ফোন রাখ, আমি তোর বাবাকে সুখবরটা দিয়ে আসি।

 

প্রেগন্যান্সির প্রথম দেড়-দু’মাস সুচিত্রার শরীর প্রায়শই খারাপ থাকত। বমি ভাব, খাবার দেখলেই অনিচ্ছা, অরুচি, মাথা ঘোরা এসব লেগেই থাকত। এই সময়টা অজয় ছুটি নিয়ে প্রায়শই বাড়িতে থেকে যেত সুচিত্রার খেয়াল রাখার জন্য। কাজের মেয়েটিও যথেষ্ট খেয়াল রাখত বউদির।

এরপর আস্তে আস্তে সুচিত্রার শরীর নতুন পরিস্থিতি মানিয়ে নিতে শুরু করল। তখন সুচিত্রা নিজেই নিজের যত্ন নিতে তৎপর হল যাতে অজয়ের উপর বেশি চাপ না পড়ে। ও যখন পাঁচ মাসের গর্ভবতী তখন একদিন বারান্দায় চেয়ারে বসে প্রকৃতির শোভায় নিজেকে মগ্ন করে রেখেছিল সুচিত্রা। হঠাৎ-ই গাড়ির আওয়াজে চোখ চলে গেল ফ্ল্যাটের মূল ফটকের বাইরে। দেখল মা গাড়ি থেকে নামছেন। সঙ্গে ব্যাগ এবং মাটিতে নামানো একটি সুটকেস। তার মানে সুচিত্রা বুঝল মা ওর কাছে থাকতেই এসেছেন। রীণাকে ডেকে তাড়াতাড়ি মায়ের কাছে পাঠাল সুচিত্রা, সুটকেসটা নিয়ে মা-কে সঙ্গে করে আনার জন্য।

রীণার সঙ্গে অনিমা ফ্ল্যাটে ঢুকে এলে আনন্দে মা-কে জড়িয়ে ধরল সুচিত্রা। মা, তুমি কী করে আসতে পারলে? তোমার ক্লাস নেওয়ার কী হবে? তুমি এখানে থাকলে কলেজের ক্লাস কী করে নেবে? প্রশ্নবাণে জর্জরিত করে তুলল মা-কে সুচিত্রা।

দাঁড়া দাঁড়া একটু বসতে দে, তারপর তোর প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছি। বলে অনিমাদেবী হাঁফাতে থাকেন। শেষ তিনদিন নিজের সংসার গুছিয়ে প্ল্যান করতে গিয়ে নিঃশ্বাস নেওয়ার সময় পর্যন্ত পাননি। মেয়ের কাছে পৌঁছে এখন নিশ্চিন্ত বোধ করছেন। একটু জিরিয়ে নিয়ে মেয়েকে সম্বোধন করে বললেন, ওদের ক্লাস নিতে কোনও অসুবিধে হবে না। এখন তো সব ক্লাস অনলাইনেই হচ্ছে। তাই ভাবলাম, এই সময়টা চিত্রা তোর কাছে থাকাটা খুব দরকার। সুচিত্রা আনন্দে মায়ের গলা জড়িয়ে ধরল।

খুব ভালো করেছ মা এখানে চলে এসে। অজয় অফিস চলে গেলে আমার একটু ভয় ভয়ই করে। খালি মনে হয় কোনও একটা এমারজেন্সি হলে কী করব। রীণা যদিও অজয় আসা অবধি আমার কাছেই এখন থাকছে। অজয় ফিরলে তবে ও বাড়ি যায়।

সন্ধেবেলায় অজয় বাড়ি ফিরে শাশুড়িকে দেখে খুব খুশি হল। সারাদিন বাইরে কাজে থাকতে হয়, সুতরাং সুচিত্রা-কে নিয়ে ওর দুশ্চিন্তা লেগেই থাকে। শাশুড়ি এসে যাওয়াতে ও খুব নিশ্চিন্ত বোধ করল। সুচিত্রারও আনন্দের কোনও শেষ ছিল না। ও জানত মা ওর কাছে থাকা মানে রোজ মায়ের হাতের খাবার খাওয়া যাবে।

মা আসার পর ১০ দিন দেখতে দেখতে কেটে গেল। অনিমাদেবী গর্ভবতী মেয়ের জন্য প্রয়োজনীয় নানা ধরনের খাবার বানাতেন। সুচিত্রা যখন তাঁর গর্ভে তখনকার গল্প শোনাতেন। মেয়ের শরীর ভালো রাখতে কিছু কিছু কাজও মেয়েকে দিয়ে করাতেন। সুচিত্রার দিনগুলো ভালো ভাবেই কাটতে লাগল। অনিমাদেবী নিজে যথেষ্ট শিক্ষিতা। কলেজের লেকচারার, ফলে ডিসিপ্লিন মেনে চলতেন নিজেও এবং আশা করতেন অন্যরাও সেটা মেনে চলবে। সুচিত্রার চরিত্র যদিও মায়ের বিপরীত, তবু মা-মেয়ের ভালোবাসার বন্ধনে কোনও খামতি অনিমাদেবী রাখেননি। দিনগুলো বেশ কাটতে লাগল।

সময় কেটে যাচ্ছিল। সুচিত্রার শরীর ভারী হয়ে উঠল। আগের মতো লাফালাফি করে কাজ করতে আর পারে না। কিন্তু মা সঙ্গে থাকাতে কোনও দুশ্চিন্তা হতো না। অনিমাদেবীও মেয়ের বিশ্রামের পুরো খেয়াল রাখতেন।

এরই মধ্যে একদিন অজয়ের মা ছেলেকে ফোন করলেন বউমার খোঁজ নিতে। অজয়, আমি আসছি তোদের ওখানে। নাতিকে দেখার জন্য মন ছটফট করছে।

কিন্তু মা, তোমার নাতি এখন কোথায় এসেছে? কৌতুকের ভঙ্গিতে অজয় বলে।

দূর পাগল ছেলে… এখন আসেনি ঠিকই কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই তো আসতে চলেছে। গর্ভে থাকা অবস্থায় যদি নাতির সেবা না করি তাহলে ও-ই বা কেন আমাকে ঠাম্মা বলে মেনে নেবে? যা, ফোন রাখ আমাকে প্যাকিং করতে হবে। বলে ফোন কেটে দিলেন সুনন্দা।

 

সপ্তাহের শেষে সুনন্দা ছেলের বাড়ি পৌঁছোলে অনিমাদেবী আর সুচিত্রা স্বাগত জানাল ওনাকে। অজয়ের মা-ও অনিমাদেবীকে জড়িয়ে ধরলেন, ভালোই হল অনিমা, তোমার সঙ্গে কয়েকটা দিন কাটাতে পারব।

উপরে উপরে দুই বেয়ানের ভাব-ভালোবাসার কথা হলেও ভিতরে ভিতরে দুজনেরই মনে প্রতিযোগিতামূলক মানসিকতা। তার প্রমাণ পাওয়া যেতে লাগল কিছুদিন পর থেকেই।

অনিমাদেবীর বরাবরই অভ্যাস ভোর পাঁচটায় উঠে পড়া। সুচিত্রার কাছে আসা থেকেই মেয়েকে নিয়ে ভোরবেলা সামনের পার্কে আধঘন্টা হেঁটে আসতেন। সুচিত্রারও ভালো লাগত। সারাদিনটা খুব ফ্রেশ মনে হতো নিজেকে। সুনন্দাও কয়েকদিন এসব দেখে অনিমাদেবীর আগেই ভোরে উঠে পড়া শুরু করলেন। সুচিত্রাকে ডেকে তুলে কয়েকটা প্রয়োজনীয় আসন শিখিয়ে বলে দিলেন, ভোরবেলায় বাইরে হাঁটার বদলে আসনগুলো করলেই সুচিত্রার এই অবস্থায় বেশি উপকার হবে। এদিকে অনিমাদেবীও মেয়েকে জোর করতেন পার্কে হাঁটার জন্য।

সুচিত্রার হতো মুশকিল, কার কথা শুনবে সিদ্ধান্ত নিতে পারত না। এদিকে অনিমাদেবীও বেয়ানের এই দখলদারি অপছন্দ করতে শুরু করলেন। একদিন ধৈর্য হারিয়ে একটু রূঢ় ভাবেই বলে ফেললেন, বেয়ান, চিত্রা তো আমার মেয়ে আমি ওকে এই ভোরেই হাঁটতে নিয়ে যাব। আপনি বরং ওর আসন করার সময়টা বদলে দিন।

সুনন্দাও দমবার পাত্রী নন, কঠোর স্বরেই বললেন, কিন্তু অনিমা তুমিও বুঝতে চাইছ না, আসন করার এটাই উপযুক্ত সময়। আমিও অজয় পেটে থাকতে শাশুড়িমায়ের কথামতো যোগব্যায়াম করতাম। এর ফল তো তুমি দেখতেই পাচ্ছ! হেলদি ছেলে জন্মেছে, আজ যে-তোমার জামাই। বাধ্য হয়ে সে এবারের মতো অনিমাদেবীকে রণে ভঙ্গ দিতেই হয়।

সুচিত্রার মুখে সব শুনে অজয় নিজের মা-কে বোঝাল, মা সকালেই বরং সুচিত্রা পার্কে হেঁটে আসুক কারণ তখন পার্ক ফাঁকা থাকে। তুমি বিকেলে সুচিত্রাকে দিয়ে আসনগুলো করিও। বিকেলে ওর ভরপুর এনার্জিও থাকে। দুই বেয়ানের সম্পর্ক ভালো রাখার এই প্রয়াসে অজয় তখনকার মতো জয়ী হলেও, জয়ের আনন্দ বেশিদিন স্থায়ী হল না।

অনিমাদেবী সুচিত্রাকে যেটাই করতে বলতেন, অজয়ের মা ঠিক বিপরীত একটা কিছুর উপদেশ দিতেন। অথচ দুজনেই সুচিত্রার ভালোর জন্য বললেও উদ্দেশ্য একে অপরকে নীচু করা এবং নিজেকে উপরে রাখা। সুচিত্রা আর অজয়ের মনে হতো কয়েকদিনের মধ্যেই হয়তো পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে উঠবে। কিন্তু কিছুদিন পরেই বুঝতে পারল, এটা ঠিক হওয়ার নয়। এই প্রতিযোগিতা চলতেই থাকবে।

একদিন অনিমা মেয়ের জন্য বিট-গাজরের জুস করে সকাল সকাল মেয়ের সামনে রাখলেন। চিত্রা এটা খেয়ে নে। এটা খুব উপকারী।

সঙ্গে সঙ্গে সুনন্দাদেবী এগিয়ে এসে বলে উঠলেন, বউমা, ওসব জুস-টুস খেয়ে কিছু হবে না। সকালবেলায় বেদানা, আপেল এগুলো চিবিয়ে খাও। এতে ফাইবারও যেমন আছে তেমনি শরীরও এর থেকে শক্তি পাবে। এছাড়া রক্ত বাড়াতেও সাহায্য করবে।

দুজনের কাণ্ড দেখে সুচিত্রা হতচকিত হয়ে গেল। দুজনের হাত থেকেই জিনিসগুলো নিয়ে পাশে টেবিলে নামিয়ে রাখল। দুজনের উদ্দেশ্যেই বলল, ঠিক আছে এগুলো সবকটাই আমার খুব পছন্দের। জুস, ফল সব আমি খেয়ে নেব কিন্তু একটু পরে। আমার একটু শুতে ইচ্ছে করছে, তোমরা দুজন যাও না, বাইরে থেকে একটু হেঁটে এসো।

ওদের বাইরে পাঠিয়ে সুচিত্রা লম্বা একটা নিঃশ্বাস নিয়ে অজয়কে ডাকল। পাশের ঘর থেকে বেরোতে বেরোতে অজয় বলল, এ তো মহা মুশকিল হল চিত্রা। সকাল থেকে দুজনে মিলে তোমার পিছনে পড়ে যায়। এদিকে রাত বারোটার আগে ঘর ছেড়ে যায়ও না। আমাদের নিজেদের পার্সোনাল টাইম বলে কিছু আর রইল না।

পুরো আমার মনের কথা বলেছ অজয়। যে-কোনও ছোটো ছোটো ব্যাপার নিয়ে এদের তর্ক-বিতর্ক লেগেই থাকে। আমার মা লেকচারার বলে মনে করেন ওনার নলেজ সবথেকে বেশি। আর এদিকে তোমার মায়ের ধারণা হল তোমাকে যেহেতু ভালো ভাবে মানুষ করেছেন, তাই ওনার সব পরামর্শ শুনতে আমরা বাধ্য।

সত্যি চিত্রা, তোমার সঙ্গে দুটো ভালোবাসার কথা বলব সে উপায় পর্যন্ত আমাদের নেই। বুঝতে পারছি না নিজেকে সেরা প্রতিপন্ন করার চক্করে এদের ঠান্ডাযুদ্ধে আর কতদিন আমাদের মানসিক শান্তি ভঙ্গ হবে?

মাঝেমধ্যে দুই বেয়ানের মধ্যে তর্কের বিষয় হয়ে উঠত সুচিত্রার ভবিষ্যৎ শিশু। ছেলে হবে না মেয়ে তাই নিয়ে দুজনের অমত সুচিত্রা এবং অজয়কে তিষ্ঠতে পর্যন্ত দিত না। সারাটা দিন হয় সুচিত্রা নয়তো অজয়কে ওদের দুজনের সঙ্গে সঙ্গে থাকতে হতো। বেচারা নিজেদের মধ্যে অবসর যাপন করার সময় পর্যন্ত পেত না ওরা।

একদিন ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেলে অজয় সুচিত্রাকে বলল, চিত্রা এবার আমাদের কিছু ভাবতে হবে। এটা একটা বড়ো সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। যেমন করেই হোক এর একটা সমাধান বার করতেই হবে।

একটা কৌশল করলে কেমন হয়? আমি বলছি কী করতে হবে। বলে অজয়ের কানে কানে সুচিত্রা কিছু বলতেই, অজয়ের ঠোঁটে হাসি খেলে যায়।

পরের দিন সকাল সকাল জলখাবারের টেবিলে সকলে বসে কথা হচ্ছে, তার মাঝেই অনিমাদেবীর মোবাইলটা বেজে ওঠে। সুচিত্রা সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে মায়ের দিকে তাকালে অনিমা ইশারায় জানান, সুচিত্রার বাবা ফোন করেছেন।

হ্যালো, এত সকালে ফোন করেছ? সব ঠিক আছে তো? অনিমাদেবীকে চিন্তিত দেখায়।

না, তোমার কথা খুব মনে হচ্ছিল। সুচিত্রার বাবার গলা ভেসে আসে।

এরই মধ্যে এমন কী হল যে, আমার কথা এত মনে পড়ছে? এই তো ক’দিন হল এসেছি। কপট রাগত স্বরে অনিমা স্বামীকে বলেন।

এই তো নয় ম্যাডাম, দু’মাস কেটে গেছে সে খেয়াল আছে? অনিমা, গত রোববার থেকে আমার শরীরটা খুব খারাপ।

সে কী! কী হয়েছে? আগে ফোন করোনি কেন? অনিমা চিন্তিত হয়ে ওঠেন।

হঠাৎ ব্লাডপ্রেশার হাই হয়ে মাথা ঘুরে বাথরুমে পড়ে গিয়েছিলাম। ডান পায়ে হাঁটুতে খুব লেগেছে। হাঁটাচলা করতে পারছি না। বাড়িতে ছেলে, বউমা আছে ঠিকই কিন্তু বউমাকে দিয়ে তো সব কাজ করানো যায় না। ছেলে একটা লাঠি কিনে এনে দিয়েছে কিন্তু তোমার কাঁধের ভর আমাকে সাহস জোগাতে পারবে। আমি ভিতরে ভিতরে খুব ভেঙে পড়ছি।

এত কিছু হয়ে গেছে তোমরা আমাকে কিছু জানাওনি? সঙ্গে সঙ্গে ফোন করে দিলে আমি তখনই চলে আসতাম। চোখে জল চলে আসে অনিমাদেবীর।

ঠিক আছে অনিমা। আমি অজয়কে তোমার টিকিট কাটতে বলে দিয়েছি। তুমি শুধু এখানে চলে এসো। তাহলেই আমি তাড়াতাড়ি ভালো হয়ে উঠব।

চিন্তা কোরো না, কালকেই আমি রওনা দিচ্ছি। আমি তো চিত্রার জন্যই এখানে আটকে ছিলাম, চিত্রার দিকে তাকিয়ে অনিমাদেবী বললেন।

চিত্রার শাশুড়িমা তো আছেন ওখানে। কিছুদিন উনিই দেখাশোনা করুন ওদের বউমার। আর তুমি আমার দেখাশোনা করো। বলে কৌতুকের হাসি খেলে যায় সুচিত্রার বাবার ঠোঁটে।

স্বামীর কথা শুনে অনিমাদেবী হেসে ফেলেন, তুমি আর বদলালে না। আচ্ছা আমি আসছি।

অজয় টিকিট সেদিনই কেটে নিয়ে এল। পরের দিন অনিমাদেবী মেয়েকে নানা পরামর্শ দিয়ে নিজের বাড়ি ফিরে গেলেন। সুচিত্রা আর অজয় হাঁফ ছেড়ে বাঁচল।

সুচিত্রার মা চলে যাওয়াতে বাড়িতেও শান্তি ফিরে এল। শাশুড়ি যতটা প্রয়োজন ততটাই মাথা গলাতেন। অজয়রাও নিজেদের জন্য সময় বার করে একসঙ্গে কাটাতে লাগল।

একমাস এভাবেই কেটে গেল। সুচিত্রার তখন আট মাস চলছে। ধীরে ধীরে কোনওরকম পরিশ্রম করা মুশকিল হয়ে উঠতে লাগল সুচিত্রার পক্ষে। রীণা বাড়ির সব কাজই করে দেয়। সুনন্দাদেবীর কাজ হল, খালি বউমার খেয়াল রাখা।

সবকিছুই ঠিকঠাক চলছিল। একদিন অনিমাদেবী মেয়েকে ফোন করে জানালেন, চিত্রা এখন তোর বাবা সম্পূর্ণ সুস্থ। আমি দু’তিন দিনে তোর কাছে আসছি। এই সময় তোর পাশে থাকাটা খুব দরকার।

কিন্তু মা, আমি ভালো আছি। তোমার এভাবে তাড়াহুড়ো করে আসার কোনও দরকার নেই।

কে বলল, দরকার নেই। এটা তোর প্রথম প্রেগন্যান্সি, আমার তোর কাছে থাকাটা খুব দরকার। তোর শাশুড়ি যে কতটা করছেন আমি খুব বুঝতে পারছি। তোকে আর তোর ভাইকে আমি জন্ম দিয়েছি। আমি জানি এসময় মেয়েরা তাদের মা-কে পাশে চায়। নে, এখন ফোন রাখ। জিনিসপত্র গোছাতে হবে যাওয়ার জন্য।

ফোন রেখে সুচিত্রা শোওয়ার ঘরে এসে আশঙ্কিত গলায় বলল, এবার কী হবে অজয়? আবার সেই মহাভারতের যুদ্ধ শুরু হতে চলেছে!

কী হয়েছে সেটা তো বলো। অজয় সুচিত্রার ঘাবড়ে যাওয়ার কারণটা জানতে চায়।

মা আবার এখানে আসছে। বাবা পায়ের চোট লাগার অভিনয় আর কতদিনই বা চালাতে পারে। এক মাসের মধ্যেই আমাদের সব কৌশল ভেস্তে গেল। সুচিত্রাকে খুবই হতাশ লাগছিল।

সান্ত্বনা দেওয়ার স্বরে অজয় বলল, কোনও কিছুই বৃথা হয় না চিত্রা। দ্যাখো ওই কৌশলই এবার আমাকে আমার মায়ের উপরে প্রয়োগ করতে হবে। তুমি বিশ্রাম করো, আমি কিছু একটা ভাবছি।

 

পরের দিন অজয় নিজের মায়ের ঘরে ঢুকে মা-কে বলল, মা তোমার মনে আছে গতবছর দেরাদুনে আয়োজিত টপ বিজনেস উইমেন সামিটে তোমার যাওয়ার কথা ছিল। তুমি ওখানে ওয়ার্কশপ এবং সেমিনারে অংশ নিতে খুব আগ্রহী ছিলে। কিন্তু শেষ মুহূর্তে অরোরা আন্টির শরীর খারাপ হয়ে পড়াতে তোমরা দু’জনে যেতে পারোনি।

হ্যাঁ, মনে আছে। সিমির শরীর খারাপ হয়ে গিয়েছিল সেবার। ওকে ছেড়ে আমার একা যাওয়ার কোনও ইচ্ছে ছিল না। আমাদের প্ল্যান ক্যান্সেল করতে হয়েছিল।

তাই জন্য বলছি, এবারে অরোরা আন্টি ফুল ফর্মে রয়েছেন। উনি রিজার্ভেশন করাতে যাচ্ছেন। তুমি বলো তোমার কী প্ল্যান?

না রে অজয়, এবার আমি যেতে পারব না। আমার নাতি আসতে চলেছে। পরের বছর বরং প্ল্যান করব। নিঃশ্বাস ছাড়েন সুনন্দদেবী।

কিন্তু মা, আন্টি বলছিলেন পরের বছর উনি ইংল্যান্ডে যাবেন ছেলের কাছে। ওই সময় থাকবেন না। সুতরাং তোমার এটাই সুযোগ। আর নাতির চিন্তা কেন করছ? তোমার অনুপস্থিতিতে চিত্রার মা ওর দেখাশোনা করে নেবেন। দু’তিনদিনের মধ্যেই উনি চলে আসবেন।

কিন্তু অজয়…।

কোনও কিন্তু নয় মা। বেশি চিন্তা কোরো না শুধু প্ল্যানিং-এ লেগে পড়ো। দ্বিতীয়বার এই সুযোগ আর পাবে না। বেশ জোরের সঙ্গেই বলে অজয়।

তাহলে সিমিকে বলে দে আমারও রিজার্ভেশন যেন করে, বলে নিজের জিনিসপত্র এক জায়গায় করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন সুনন্দা।

অজয় আর সুচিত্রা স্বস্তির নিঃশ্বাস নেয়। যতদিনে অজয়ের মা ফিরবেন, ততদিনে সুচিত্রার সন্তান ভূমিষ্ঠ হয়ে যাবে। সুতরাং সুচিত্রাকে আর দুই মায়ের মধ্যে পড়ে বলির পাঁঠা হতে হবে না।

 

পড়ার জন্য সীমাহীন গল্প-নিবন্ধসাবস্ক্রাইব