প্রান্তবেলায় একা

প্রতিদিন আমাদের সামাজিক কাঠামো বদলে যাচ্ছে। সমাজের মূল শিরদাঁড়া যৌথ পরিবারে ভাঙন ধরেছিল আগের থেকেই। এখন সেখানে ঢুকে পড়েছে নিউক্লিয়ার ফ্যামিলির কনসেপ্ট old age rehabilitation। আমাদের ভারতীয় সমাজ চিরকালই বৃদ্ধ বয়সকে শ্রদ্ধা এবং সম্মানের চোখে দেখেছে। বার্ধক্য বোঝা নয়, বরঞ্চ বার্ধক্য অভিজ্ঞতায় পরিপূর্ণ। কিন্তু তবু বৃদ্ধ বয়স সবসময়েই একটু নিবিড়তা, যত্ন, নিশ্চয়তা খোঁজে। অথচ নিউক্লিয়ার ফ্যামিলির ভাবনা ঢুকে পড়ার ফলে বার্ধক্য অবহেলিত হচ্ছে না কি?

কথা হচ্ছিল কলেজ স্ট্রিটের বহু পুরোনো বাসিন্দা অমর ভট্টাচার্য-র সঙ্গে। কলেজ স্ট্রিটের পৈত্রিক বাড়ি ছেড়ে বিপত্নীক অমর বর্তমানে ছেলের কাছে বেঙ্গালুরু থাকেন। তিনি বললেন, বেঙ্গালুরু আমার একেবারেই ভালোলাগে না। সময় কাটতে চায় না। ছেলে-বউমা হয়তো আমার কোনও অযত্ন করে না, তবু ওই জায়গাটায় আমি কেমন নিঃসঙ্গ বোধ করি। বন্ধুবান্ধবরা সব এখানে। ওখানে আমার দম বন্ধ হয়ে আসে। জীবনে বাঁচতে গেলে তো একটা কিছু করা দরকার। কিন্তু ওখানকার পরিস্থিতিতে নতুন করে এই বুড়ো বয়সে কী করব ভেবে পাই না। এদিকে ছেলে নাছোড়বান্দা। এখানে একা থাকতে দেবে না।’

একই সমস্যা যাদবপুরের রমলা ঘোষ-এর। তিনি জানালেন, ‘স্বামী মারা যেতে আমি একমাত্র মেয়ের কাছে মুম্বইতে থাকি। মেয়ে-জামাই খুব ভালো। তবু আমার মন বসে না। বিশেষ করে ওরা দুজনেই মাঝে মাঝে চাকরিসূত্রে বিদেশে যায়। সেই সময়গুলো আমার অসহ্য লাগতে থাকে। এদিকে আমি না জানি মারাঠি ভাষা, না বলতে পারি হিন্দি বা ইংরেজি। যাদবপুরের জন্য মনটা সবসময় ছটফট করে।’

এই ধরনের সমস্যার ক্ষেত্রে বার্ধক্য হয়তো সেভাবে অবহেলিত হচ্ছে না। কিন্তু শেষ বয়সে এসে নিজের অপছন্দের জীবন কাটানোর মধ্যে একধরনের অপারগতা কাজ করছে। জীবনজ্যোতি সরকার এবং মঞ্জুলা সরকার ছেলের বাড়িতে থাকছেন মাস তিনেক হল। কলকাতা ছেড়ে ওনাদের নতুন ঠিকানা এখন চেন্নাই। মুশকিল হল ওনারাও ভাষা নিয়ে সমস্যায় পড়েছেন। তাছাড়া এখানকার সামাজিক লাইফস্টাইল একেবারেই কলকাতার মতো নয়। তার উপর সবসময় নিজেদের ছোটোখাটো চাহিদার কথা ব্যস্ত ছেলেকে বলতেও ইচ্ছে করে না। জীবনবাবু জানালেন, ‘সপ্তাহখানেক আগে আমার স্ত্রী একটু অসুস্থ হয়ে পড়ে। ছেলে তখন অফিসের মিটিং-এ, মোবাইল সুইচ অফ। আমি পড়লাম মুশকিলে। কীভাবে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাব, কার থেকে সাহায্য পাব কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলাম না।’

হঠাৎ করে এভাবে নিজেদের শিকড় উপড়ে ফেলতে বাধ্য হওয়া এখন জীবনবাবু বা অমরবাবুর মতো অনেকের ক্ষেত্রেই খুব বড়ো সমস্যার কারণ। সবসময় একটা সংকোচ নিয়ে বেঁচে থাকা, এই বুঝি ছেলে-মেয়েরা বিরক্ত হল। ছোটো ছোটো চাহিদার জন্যও ছেলে-মেয়েদের ‘উপর নির্ভর করে থাকা অবশ্যই কষ্টকর। আর আজকের এই দুরন্ত জীবনে কেরিয়ার সামলাতে ব্যস্ত হয়ে পড়া সন্তানরাই বা আর কত দিক সামলাবে! তারা সাধ্যমতো চেষ্টা করলেও কিছুতেই কাউকে খুশি করতে পারে না। ফলে তৈরি হয় ব্যবধান এবং দু-পক্ষের মধ্যে অভিমানের সম্পর্ক। কখনও কখনও এই অভিমানকে অতিক্রম করা কষ্টসাধ্য হয়ে ওঠে।

সন্তানদের সমস্যা

সন্তানরা কেরিয়ার, সংসার এবং সোশ্যাল লাইফ সামলাতে হিমসিম খেয়ে যায়। অফিসে টার্গেট ফুলফিল করার চাপ, বাড়িতে দায়িত্ব পালনের প্রেশার। এত অত্যধিক স্ট্রেস নিতে গিয়ে মানসিক ও শারীরিক বিভিন্ন সমস্যার শিকার হয়ে পড়ছে তারা। সমস্যা সামলাতে নতুন ভাবনার আলো ঢুকে পড়েছে। কলকাতার এক অভিজাত পাড়ায় পাশাপাশি বেশ কয়েকটি বাড়ির আজকের প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা সকলেই চাকরি অথবা বিবাহসূত্রে বিদেশে থাকে। ব্যাগ গুছিয়ে সন্তানদের সঙ্গে থাকতে যাননি তাদের মা-বাবারা। ফলে সন্তানরা পড়েছে বিপদে। একদিকে মা-বাবার প্রতি দায়িত্ববোধ অন্যদিকে কেরিয়ার। এই টানাপোড়েনে তৈরি হচ্ছিল সমস্যা old age rehabilitation। কিন্তু সমস্যার সমাধানও বের করে ফেলেন এরা নিজেরাই। বৃদ্ধ-বয়স্ক মা-বাবাদের নিয়ে তৈরি করে ফেলেন একটা ছোটো ক্লাব। ফলে একাকিত্ব এবং অন্যান্য দৈনন্দিন সমস্যার হাত থেকে রেহাই মেলা অনেকটা সহজ হয়ে ওঠে। ইলেকট্রিক বিল, ফোন বিল, বাজার, রান্না ইত্যাদির ক্ষেত্রেও ক্লাবের তরফ থেকে লোক ঠিক করা হয়। এমনকী রুটিনমাফিক ডাক্তারি চেক-আপ করানোর জন্য লোকের ব্যবস্থা করা হয়। ছেলে-মেয়েরাও পরিবারের সঙ্গে ফোন বা আধুনিক যোগাযোগ ব্যবস্থা যেমন ইন্টারনেট ইত্যাদির মাধ্যমে সবসময় সংযুক্ত থাকে। এইভাবে প্রতিবেশী বাবা-মায়েরা নিজেরাই নিজেদের বন্ধু হয়ে উঠে, একা থাকার ঝঞ্ঝাট, নিজের পুরোনো বাসস্থান ছেড়ে অন্য কোথাও থাকার সমস্যা ইত্যাদিকে দূরে সরিয়ে দিয়েছেন। দেখুন না, এমন সমাধান আপনার পাড়ার ক্ষেত্রেও সম্ভব কিনা!

সন্তানের কাছে থাকতে যাওয়ার আগে

বৃদ্ধ বাবা-মা, সন্তানের কাছে পাকাপাকি ভাবে থাকতে যাওয়ার আগে নিজেদের অবস্থা যাচাই করে নিন।

১) ভালো করে ভেবে নিন নিজেদের পরিস্থিতি এবং পারিপার্শ্বিক অবস্থা। আপনি কোন লোকালিটিতে থাকেন, আপনার প্রতিবেশী, দোকান-পাট, ডাক্তার ইত্যাদি অন্যান্য আবশ্যিক সুবিধাগুলির যোগান চট করে পেতে পারেন কিনা তাও বুঝে নিন। যদি দেখেন, একা জীবন কাটানোর মতো সাহস এবং উপায় আপনার কাছে আছে, তবে পুরোনো বাসস্থান বদল না করাই ভালো।

২) সন্তানের উপরে অত্যধিক নির্ভরশীল না হওয়াই ভালো। ওদের উপরে অযথা প্রত্যাশার বোঝা চাপিয়ে দেবেন না।

৩) নিজের সমাজিক জীবনকে আরও একটু বদলে ফেলুন। যোগ দিন পাড়ার ক্লাবে বা কোনও সোশ্যাল অরগানাইজেশনে।

৪) বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে আড্ডা মারুন। একা লাগছে? কুছ পরোয়া নেহি, ইন্টারনেট আর কম্পিউটারের দৌলতে পৃথিবী এখন হাতের মুঠোয়। সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং-এর মাধ্যমে সামাজিক সম্পর্ক স্থাপনে অংশ নিন, বৃহত্তর সমাজের অংশ করে তুলুন নিজেকে।

৫) সন্তানের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখুন। আপনার সমস্যাগুলি সম্বন্ধে সে যেন ওয়াকিবহাল থাকে।

সন্তানরাই বা কী করবেন

১) বাবা-মায়ের সুখ-সুবিধার দিকে নজর রাখুন। বৃদ্ধ বয়সে বাড়িঘর ছেড়ে আপনার কাছে গিয়ে থাকতে ওদের বাধ্য না করাই ভালো। এতে সমস্যা বাড়বে।

২) ওঁদের প্রয়োজন কীভাবে মেটানো যায়, সে সম্পর্কে ব্যবস্থা নিন।

৩) নিজেদের কাজ, তার গুরুত্ব, সামাজিক জীবন ইত্যাদি নিয়ে খোলাখুলি ওঁদের সঙ্গে আলোচনা করুন।

৪) সময় পেলেই ওঁদের সঙ্গে ছুটি কাটাতে চেষ্টা করুন। ওঁরা যে আপনার জীবনে কতটা গুরুত্বপূর্ণ, তা বুঝিয়ে বলুন।

৫) একান্তই যদি নতুন শহরে, ছেলে-মেয়ের সঙ্গে গিয়ে থাকা ছাড়া আর কোনও উপায় না থাকে, তবে চেষ্টা করুন সম্পর্কের উষ্ণতা এবং উদারতা যেন বজায় থাকে। অফিসের কাজ গুছিয়ে নিয়েও বাবা-মায়ের সঙ্গে কোয়ালিটি সময় কাটানো খুব জরুরি। নতুন জায়গায় খাপ খাইয়ে নিতে বাবা-মায়েদের কিছু সময় অবশ্যই দিন। জীবনধারণের আধুনিক উপায়গুলি ওদের শিখিয়ে দিন। সন্তানদের জীবনের সঙ্গে বাবা-মায়েদের জীবন যেন একাত্ম হয়ে থাকে। একইসঙ্গে এই একাত্মতার মধ্যে ইন্ডিভিজুয়ালিটি বজায় রাখুন। এতে সম্পর্ক ভালো থাকবে।

এ তো নয় শুধু ছুটোছুটি খেলা

সম্প্রতি করোনার কারণে লকডাউন চলাকালীন স্কুল সব বন্ধ থাকায় গতানুগতিক নিয়মে পরিবর্তন এসেছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও এই দীর্ঘ ছুটিতে এবং এই লকডাউন-এর আগেও বাচ্চাদের স্কুলে গরমের ছুটি পড়়ার আগে থেকেই শহরের লিডিং সংবাদপত্রগুলিতে প্রচুর বিজ্ঞাপন দেখতে পাওয়া যেত এবং প্যামফ্লেট ছাপিয়েও বিলি করা হতো।

এই পরম্পরা আজও একই ভাবে বিদ্যমান। বিজ্ঞাপনে, ছুটিতে কোথায় ক্যাম্প করা হচ্ছে, সেখানে কী কী সুবিধা দেওয়া হচ্ছে, বাচ্চাদের বিভিন্ন অ্যাকটিভিটির একটা বিস্তৃত বিবরণ ইত্যাদি দেওয়া থাকে। এগুলি অবশ্যই বেশ একটা মোটা অর্থের বিনিময়ে। অনেক বাবা-মা-ই চান এইসব অরগানাইজেশনে নিজেদের বাচ্চাদের নাম নথিভুক্ত করাতে, যাতে ছুটিতেও স্কুলের মতোই কড়া শাসনের মধ্যেই বাচ্চারা থাকে। এখন বাচ্চাদের নানারকম গঠনমূলক creative activity কাজে ব্যস্ত রাখার জন্য যে-রকম বহু হালফিল ফ্যাশনের অরগানাইজেশন শহরগুলিতে গজিয়ে উঠেছে তেমনি মা-বাবাদের কাছেও তাদের বাচ্চাদের সেখানে পাঠানো ধীরে ধীরে খুবই জনপ্রিয় হয়ে উঠছে।

কিন্তু একটা কথা বলতেই হবে যে, প্রায়শই অভিভাবকেরা এটা ভুলে যান, বাচ্চাদের লম্বা ছুটির সময়টুকুই সেই স্বর্ণমুহূর্ত, যেখানে মা-বাবারা তাদের বাচ্চাদের সঙ্গে একটু ভালো সময় অতিবাহিত করবার সুযোগ পান। তাই সন্তানকে বাইরের কোনও গঠনমূলক অরগানাইজেশনে না-পাঠিয়ে নিজেদের অমূল্য সময় বাচ্চাদের সঙ্গে ভাগ করে নিতে পারলেই সবথেকে ভালো হয় এবং বাড়ির পরিবেশেই তাকে খেলার মাধ্যমে বিভিন্ন শিক্ষায় শিক্ষিত creative activity করে পারদর্শী করে তোলা সম্ভব হয়।

বিশেষকরে যে-সব অভিভাবকেরা চাকুরিজীবী, তাদের কাছে বাচ্চাদের স্কুলের লম্বা ছুটিটুকুই একমাত্র সময়, যখন তারা সন্তানদের হূদয়ের কাছাকাছি আসার বড়ো একটা সুযোগ পান। এইসময়েই গতানুগতিক দৈনন্দিন সংসারের একঘেয়েমি কাটিয়ে উঠে বাচ্চাদের সঙ্গে একাত্মতা অনুভব করার সুযোগ লাভ করেন। অভিভাবকেরা তাদের কাজের সময় এবং অবসর সময় বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে ভাগ করে নিতে পারেন এবং মা-বাবা উভয়ে পরামর্শ করে অফিসে ছুটির দরখাস্ত ফেলতে পারেন। বাচ্চাদের মনেও, মা-বাবার সঙ্গে একটা পুরো দিন কাটানোর সুন্দর অনুভূতির প্রভাব পড়ে।

সন্তানের সঙ্গে অভিভাবকদের হূদয়ের বন্ধন যত দৃঢ় হবে ততই পারিবারিক বন্ধনের শিকড় গভীর পর্যন্ত বিস্তৃত হবে। এখনকার এই ব্যস্ত জীবনে বাড়িতে একসঙ্গে থাকলেও, সকলকে একসঙ্গে নিয়ে কোয়ালিটি টাইম অতিবাহিত করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। তাই বাচ্চাদের ছুটি পড়লেই তাদের সঙ্গে নিয়ে কিছুটা ভালো সময় কাটিয়ে নেওয়ার সুযোগ কখনওই হাতছাড়া করা উচিত নয়। খেলাধুলো, বাগানের পরিচর্যা, বাড়ির কাজকেই ফ্যামিলির সকলের মধ্যে মজাদার ভাবে ভাগ করে দেওয়া, আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে বেড়াতে যাওয়া অথবা হইহই করে সকলে মিলে পিকনিকে যাওয়ার মধ্যে দিয়েই সন্তানকে সময় দেওয়া এবং এর মাধ্যমেই নানা শিক্ষায় তাদের শিক্ষিত করে তোলা উচিত অভিভাবকদের।

বাচ্চাদের জন্য কী ভালো

প্রকৃতির সান্নিধ্যে রেখে বাচ্চাদের বড়ো করে তোলা উচিত এবং বাচ্চাদের কাছে সুস্থ নির্মল পরিবেশে নিঃশ্বাস নিতে পারার সুযোগ যদি থাকে তাকে হাতছাড়া করা কখনওই উচিত নয়। ধরুন সন্তানের লম্বা ছুটির অবসরে বাড়ির সকলে মিলে বাইরে ঘুরতে যাওয়ার কোনও প্ল্যান রয়েছে। বাচ্চাদের সামিল করুন ছুটির প্ল্যান সাজাবার সময়। মনে হতে পারে যে প্ল্যান বানাতে বাচ্চাদের ইচ্ছে জানার কী প্রয়োজন। কিন্তু প্রয়োজন অবশ্যই আছে। বাড়ির চার দেয়ালে বন্ধ থাকার থেকে বাইরের পরিবেশ বাচ্চাদের কাছে সবসময়ই প্রিয়। বেড়াতে যাওয়ার আগে নিজেরাও যেমন জায়গাটি সম্পর্কে বিস্তারিত জানুন তেমনি বাচ্চাদের কাছেও জায়গাটি সম্পর্কে বর্ণনা দিন ও তাদের আগ্রহ এবং আকর্ষণ বাড়়াতে সাহায্য করুন। তাদের জায়গাটির নাম বলে, জায়গাটি সম্পর্কে নিজে থেকে তথ্য সংগ্রহ করতে পরামর্শ দিন। এতে বাচ্চাদের আগ্রহ আরও বাড়বে। যদি ঐতিহাসিক কোনও জায়গা অথবা বিখ্যাত টুরিস্ট স্পট হয়ে থাকে তাহলে তার উপর লেখা বই পড়া অথবা তৈরি ফিলম দেখতে বাচ্চাদের উদ্বুদ্ধ করুন। বাচ্চাদেরই বলুন নেট সার্ফ করে বার করতে, কোন কোন দর্শনীয় জায়গায়, তারা যেতে পছন্দ করবে এবং সেখানে পৌঁছে তারা কী কী অ্যাক্টিভিটি বেছে নেবে?

বাচ্চারা এখন আউটডোর খেলাধুলোর জগৎটা প্রায় ভুলতে বসেছে বললেই চলে। তাদের অধিকাংশ সময় জুড়ে জায়গা করে নিয়েছে টিভি এবং ভিডিও গেমস। শহুরে একঘেয়ে জীবনের মেকি জীবনযাত্রাকে পিছনে ফেলে মাঝেমধ্যে অভিভাবকদের উচিত শিশুকে গ্রামের জীবনের সঙ্গেও পরিচয় করানো। গ্রামের জীবনটাই আমাদের আসল পরিচয় এবং শহরে এই জীবনের একাংশও খুঁজে পাওয়া যায় না। গ্রাম্য পরিবেশে গাছে উঠে টাটকা ফল পেড়ে খাওয়া, খেতের টাটকা শাকসবজি, পুকুরে নেমে সাঁতার কাটা অথবা পাড়ের ধারে বসে সবুজ প্রকৃতিকে উপভোগ করা ইত্যাদি বাঁধনছাড়া ক্রিয়াকলাপ বাচ্চাদের মন এবং শরীর, দুই-ই ফ্রেশ রাখে। গ্রামের পরিবেশে কিছুদিন কাটাতে পারলে আমরা আমাদের ঐতিহ্যের ইতিহাসের সঙ্গে সন্তানকে পরিচিত করাতে পারি এবং তারাও জীবনের মূল্যবোধের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করতে পারে।

মনে রাখা দরকার, বাচ্চাদের সময় দেওয়ার আর একটি উপায় হল, বাচ্চাদের সঙ্গে নিয়ে খেতে বসা। স্কুল চলাকালীন পরিবারের সকলের একসঙ্গে খাওয়াদাওয়া করা সম্ভব হয় না। তাই ছুটির সময়টাকেই একসঙ্গে কাটাবার উপযুক্ত সময় হিসেবে বাছুন। বাচ্চাদের সঙ্গে খাবারের মেনু ঠিক করুন, খাবার বানাবার সময় বাচ্চাদের সঙ্গে নিয়ে বানান, যাতে তারা পূর্ণ সহযোগিতা করার সুযোগ পায়।

খেলার ছলে, পড়াশোনার ক্ষেত্রে বুদ্ধিটাকে শান দেওয়ারও এটাই হল উপযুক্ত সময়। বাচ্চাদের জন্য বিভিন্ন বিষয়ের উপর বই বাছুন। লাইব্রেরিতে যেতে বাচ্চাদের আগ্রহ জোগান যাতে তাদের পছন্দের বিষয়ের উপর বই পড়তে পারে। পরের বছর আপনার সন্তান যে ক্লাসে প্রোমোশন পাবে সেই ক্লাসের বই অগ্রিম কিনে এনে তাকে মাঝেমধ্যে বইটির বিষয়গুলির সঙ্গে পরিচিত করান।

এছাড়াও ছুটির লম্বা সময়টাকে একটি কিংবা দুটি ‘থিম-এ’ ভাগ করে নিন। ‘থিম’ শব্দটা খুবই চটকদার এবং সকলের কাছে এখন প্রিয়। বাচ্চারা সহজেই আকর্ষণ বোধ করবে। বাচ্চাদের পছন্দের বিষয় বাছুন এবং সেটাকেই কেন্দ্রে রেখে কী কী করবেন তার তালিকা প্রস্তুত করুন। বিষয় যে-কোনও কিছুই হতে পারে যেমন, হস্তশিল্প, বই, সিনেমা এমনকী মিউজিকও। আপনার ‘থিম’ অনুযায়ী বিভিন্ন জায়গায় বাচ্চাদের নিয়ে যান এবং বিস্তারিতভাবে ওদের সঙ্গে আলোচনাও করুন।

ইনডোর অ্যাকটিভিটির মাধ্যমেও বাচ্চাদের গঠনমূলক প্রতিভাকে তুলে ধরা যায়। ওদের সঙ্গে বসে একসঙ্গে রং-তুলি দিয়ে কিছু আঁকুন, ওদের স্কুলের প্রোজেক্টে হাত লাগান। সবজি বিভিন্ন আকারে কেটে কীভাবে ভেজিটেবেল ব্লকপ্রিন্ট করানো যায় তার ট্রেনিং দিন। বাড়িতে যদি কোনও গৃহপালিত পশু থেকে থাকে তাহলে তার খাওয়ানো, ঘোরানো, শোয়ানো ইত্যাদির দায়িত্ব সন্তানকে দিন। প্রথম প্রথম অসুবিধা হলেও পরে আর অসুবিধা থাকবে না এবং পশুপ্রেমও এতে বৃদ্ধি পাবে।

রিসার্চ করে দেখা গেছে ছুটির সময় যেসব বাচ্চারা অলসভাবে দিন না কাটিয়ে রীতিমতো খেলাধুলো, বইপড়া ইত্যাদি করে সময় কাটিয়েছে তারা স্কুল খোলার পর পড়াশুনোতেও ভালো ভাবে মন দিতে পারছে এবং পরীক্ষাগুলোতেও ভালো রেজাল্ট করছে।

বাগানের কাজেও বাচ্চাদের ব্যস্ত রাখতে অথবা কিছুটা সময় কাটাতে দিতে পারেন। চাইলে দু-একজন বন্ধুকেও, নিজের সন্তানকে সঙ্গে নিতে বলুন। সকলকে সঙ্গে নিয়ে ওদের পছন্দের কোনও খাবার তৈরি করুন কারণ শারীরিক পরিশ্রমের পর লোভনীয় খাওয়া ওদের পাওনা হয়। বাড়ির কিছু কিছু দায়িত্ব ওদের উপর ছাড়ুন। বাচ্চারা যা খেতে ভালোবাসে ওদেরকে সঙ্গে করেই সেগুলি বানান যাতে ওদের মনে হয় ওরা নিজেরাই খাবারটা বানিয়েছে আর আপনি শুধু সাধ্যমতো ওদের সাহায্য করেছেন। ওদের বসিয়েই সারা সপ্তাহে কী কী স্পেশাল খাবার তৈরি করা হবে তার একটা লিস্ট চটপট বানিয়ে ফেলুন।

রান্নাঘরেও ওদের ক্রিয়েটিভ মনটাকে সক্রিয় রাখতে চেষ্টা করুন। যেমন ধরুন, একটা ট্রে-তে একটু চিনি ছড়িয়ে দিন। এক কাপ গলানো চকোলেট, একটা আইসিং সুগার টিউব, কিছু বিস্কুট এবং কাপ-কেক এনে বাচ্চাদের হাতে দিন। বাচ্চারা বিস্কুট এবং কেকগুলিকে চকোলেটে ডুবিয়ে আইসিং সুগার টিউবের সাহায্যে নানা ডিজাইনে সাজিয়ে সারভিং প্লেটে সাজাতে পারলে নিজেরাই দেখবেন, প্রচণ্ড আনন্দ পাচ্ছে। ওদের কাজে বাহবা দিন। নিজেদেরই তৈরি কুকিজ বাচ্চাদের এবং বড়োদের খাওয়াতে বেশি করে উৎসাহ দিন।

বাড়িতে বাচ্চাদের হয় নিজেদের মতো করে থাকতে দিন নয়তো কখনও শেখান বাড়ির অন্যান্য ছোটো ছোটো কাজগুলি কীভাবে নিজেরা নিজেদের হাতে করতে পারে। যেমন, নিজেদের ঘর পরিষ্কার রাখা, খাবার টেবিল সাজানো, রান্নাঘরের ছোটোখাটো কাজগুলি করা ইত্যাদি। ছোটো হলেও আপনার সংসারে তাদের যে প্রয়োজন রয়েছে, প্রতিটি মুহূর্তে সেটা ওদের বুঝতে দিন আপনার ওদের প্রতি ব্যবহারে।

নানা সমীক্ষায় দেখা গেছে যেসব বাচ্চাদের ওপর পড়াশোনা ও কাজের মাত্রাতীত বোঝা চাপানো হয়েছে, তারা নানারকম মানসিক অসুবিধার শিকার হয়ে পড়ে, যেমন স্ট্রেস, ডিপ্রেশন ইত্যাদি। তাই পড়াশোনার সঙ্গে সঙ্গে কিছুদিনের একটা লম্বা ছুটিরও বাচ্চাদের দরকার রয়েছে। কোনও বাচ্চার অভিনয়ের দিকে ঝোঁক, কারও বা মিমিক্রি-তে, কেউ বা পাপেট অথবা কাগজ রং, পেনসিল ইত্যাদি দিয়ে ছবি আঁকতে ভালোবাসে। কারও বা নাচ-গানে সহজাত আকর্ষণ থাকে। যার যে-বিষয়ে আগ্রহ, তাকে সেই বিষয়টিকে creative activity নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট অথবা আলোচনা করতে সাহায্য করুন। নতুন নতুন পন্থার সঙ্গে তাকে পরিচয় করান যাতে স্বতঃস্ফূর্তভাবে তার ক্রিয়েটিভ মনটা প্রকাশ হতে পারে।

সবশেষে একটা কথা মনে রাখা অবশ্যই দরকার যে, বাচ্চাদের তাদের ঠাকুমা-ঠাকুরদা, আত্মীয়স্বজন, বন্ধু-বান্ধব সকলের সঙ্গে সম্পর্কের বন্ধন দৃঢ় করা উচিত। সকলের বাড়িতে যাওয়া-আসার সুযোগ করে দিতে হয় বাচ্চাদের। এতে সম্পর্ক অটুট হয়। বাড়ির চার দেয়ালের একঘেয়েমি এবং মানসিক চাপও অনেকটা লাঘব হয় এতে।

সুতরাং আনন্দে থাকুন এবং বাচ্চাদেরও আনন্দে ছুটি কাটাতে দিন।

 

সম্পর্কের আবর্তে

মা আর মেয়ে—যুগ যুগ ধরে চলে আসা এ এক আশ্চর্য Mother-Daughter relation সম্পর্ক। বাড়ির আর সকলের থেকে শিশুকন্যাটির সব থেকে কাছের মানুষ হয়ে ওঠে তার ‘মা’। প্রতিদিনের একটু একটু করে বড়ো হয়ে ওঠা কিন্তু সমস্তটাই তার মা-কে ঘিরে। এইভাবেই সে ধীরে ধীরে মায়ের উপর হয়ে ওঠে নির্ভরশীল। বিশ্বাস করতে শেখে মা-কে কারণ তার কাছে মা-ই হচ্ছে একমাত্র ভরসার জায়গা। মায়ের কাছেই শিক্ষার নতুন পাঠে তার প্রবেশ।

মেয়ে পা-রাখে শৈশবে। স্কুল জীবনের প্রারম্ভ। মায়ের নিশ্চিত আশ্রয়ের গণ্ডি ছাড়িয়ে বাইরের জগতে প্রথম পদক্ষেপ। প্রথম প্রথম আগের থেকে বেশি করে আঁকড়ে ধরে মা-কে। তারপর মুঠি আলগা হতে শুরু করে। বন্ধুবান্ধব নতুন আরও অনেক সম্পর্কের ভিড়ে মা ও মেয়ের সম্পর্ক নেয় নতুন এক মোড়।

মায়ের স্নেহ মিশ্রিত শাসন শুরু হয়। এরসঙ্গে মায়ের কাছ থেকে মেয়ে জীবনের শিক্ষারও প্রথম পাঠ নিতে শিখতে শুরু করে। জীবনের পাঠক্রমে শাসন এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। শিশু যা এতদিন নিজের ইচ্ছেমতন করে এসেছে হঠাৎ করে সেখানে বাধা পেতে শুরু করে। ‘এটা কোরো না’, ‘ওটা করে আসা তোমার উচিত হয়নি’, ‘আমাকে জিজ্ঞাসা না করে এটা করবে না বা ওখানে যাবে না’—এরকম মায়ের নানা ‘মানা’-র সম্মুখীন হতে হয় মেয়েটিকে। একদিকে যেমন নিজস্ব স্বতন্ত্রতা তৈরি হতে থাকে তেমনি নানা খুনসুটির মধ্যে দিয়ে ভালোবাসার সম্পর্ক শিকড়বাকড় ছড়িয়ে মা ও মেয়ের বন্ধনকে আরও দৃঢ় করে তোলে। মায়ের সাজগোজের জিনিস কন্যাসন্তানকে শিশু বয়সে সবথেকে বেশি আকর্ষণ করে। মায়ের লিপস্টিক, শাড়ি, গয়না এমনকী মায়ের চটিতে পা গলিয়েই কেটে যায় তার শৈশব। মা বাড়িতে হয়ে ওঠে মেয়ের খেলার সাথী।

অনেক সময় মায়ের প্রতি সামান্য ঈর্ষাও হয়তো মেশে ছোট্ট মেয়েটির মনে। মা কেন এত সাজগোজ করবে, তার কেন এই প্রসাধনের জিনিসগুলো নেই, শুধুমাত্র মা-এর ববহারের জন্যই কেন এগুলি কেনা হয়— এরকম বহু অযথা প্রশ্ন শিশুমনে উদয় হয়। এরজন্য অনেক সময়ে ছোট্ট মেয়েটি মায়ের প্রতি বিদ্রোহীও হয়ে ওঠে।

এ সমস্ত আচরণগুলি-ই কিন্তু কন্যা সন্তানের বাইরের মনোভাব মাত্র। এর মধ্যে দিয়েই মা ও মেয়ের বন্ধুত্ব, Mother-Daughter relation ভালোবাসা স্নেহ বাড়তে থাকে। মায়ের জিনিসপত্র নাড়াচাড়া করতে, করতে কখন যেন সে কৈশোরের দোরগোড়ায় এসে পৌঁছোয়। কিশোরী মেয়ের খেয়াল রাখা, তাকে সমস্ত বিপদ থেকে রক্ষা করা যেমন মায়ের অধিকারের মধ্যে পড়ে তেমনি মেয়েটিও কেমন করে নিজের অজান্তেই মায়ের দিকে আসা প্রতিটি বিপদের সামনে নিজেকে ঢাল হিসাবে তৈরি করতে থাকে। বাড়িতে এবং বাড়ির বাইরে মায়ের প্রতি যে-কোনও ধরনের রূঢ় আচরণ মেয়েটির মনকে নাড়া দেয়। তার ক্ষমতায় অন্যায়ের প্রতিবাদও করে সে।

এরপর কৈশোরের হাত ধরে আসে যৌবন। মা ও মেয়ে উভয়েরই জীবনের কঠিনতম সময়। এই পর্যায়ে মেয়েরা হয় মুক্তপ্রাণ। সবকিছুই তার চোখে তখন সুন্দর, নতুন। সমাজের কুৎসিত রূপটাকেও আস্বাদ করার ব্যাকুলতা তার মধ্যে হয়ে ওঠে প্রবল। মেয়ের প্রতি মায়ের সজাগ দৃষ্টি আরও প্রসারিত হয়। প্রতিমুহূর্তে পদস্খলনের ভয়। মায়ের মন মেয়ের জন্য সবসময় দুশ্চিন্তাগ্রস্ত থাকে। ফলে শাসনের মাত্রা বাড়তে থাকে। মেয়ের মনে মা-ই হয়ে ওঠে তার জীবনের পরম শত্রু। এতদিন যে-মেয়ের জীবন ছিল মায়ের কাছে খোলা পাতা, হঠাৎ একটা দমকা হাওয়ার বেগ সেটাই এলোমেলো করে দেওয়ার উপক্রম করে। এই সময়ে মা ছাড়া আর সকলকে মনে হয় বন্ধু। জীবনের অনেক নতুন অনুভূতি মেয়েরা এইসময়ে মায়ের কাছে গোপন রাখতে চেষ্টা করে। মায়ের মনেও যে অভিমান জন্মায় না এমন নয়, কিন্তু মায়ের মন বুঝতে পারে তার সেই ছোট্ট মেয়েটি মাতৃকবচের সুরক্ষার বেড়ায় ধীরে ধীরে বেড়ে উঠেছে। শুধুমাত্র মাতৃস্নেহে বেঁধে রাখার সময় সে পেরিয়ে এসেছে। যুবতি মনে অন্য সম্পর্কে পা রাখার আকাঙক্ষা তার মনে তৈরি হয়েছে।  অভিমান ঝেড়ে ফেলে মা নেমে পড়ে জীবনযুদ্ধে। মনে তখন মায়ের নতুন উদ্যোগ। এতে মায়ের প্রতি মেয়ের রাগ কমে না, বাড়েই। মায়ের দায়িত্ব থেকে, মাকে টলাতে না পেরে মেয়েরাও মায়ের প্রতি কিছুটা ঈর্ষাকাতর হয়ে পড়ে। কোথা থেকে মা পায় এত শক্তি–এই প্রশ্ন ওঠে প্রতিটি যুবতি মনেই।

মেয়ের বিয়ে হয়ে যায়। মায়ের প্রতীক্ষা শেষ হয়। মেয়ে চলে যায় অন্য সংসারে মায়ের মন শূন্য করে। মায়ের কাছে মেয়ের চলে যাওয়াটা শরীরের একটা অংশ কেটে বাদ দিয়ে ফেলার মতোই বেদনাদায়ক। তবুও মায়ের মনে সান্ত্বনা যে মেয়ে নিজের সংসারে গেছে, যেখানে তার আদরের মেয়ে সমান আদর-যত্নে স্বামীর সংসারে রাজত্ব করবে। শত কষ্টেও মেয়ের সুখের কথা ভেবে মায়ের মুখে হাসি লেগে থাকে। দূর থেকেই মেয়েকে আশীর্বাদ করে, মেয়ের খোঁজখবর রাখে। বয়সের ভার যেন মায়ের অস্তিত্বকে ধীরে ধীরে গ্রাস করতে চায়।

নিজের সংসারে এসে, সংসারের দায়িত্ব নিতে নিতে মেয়ে উপলব্ধি করতে পারে, তার জীবনে মায়ের অবদান কতখানি। মায়ের মতো প্রিয় বান্ধবীর জায়গা কেউ যে নিতে পারবে না সেটা বুঝতে তার কষ্ট হয় না। মায়ের স্নেহ, শাসন সবটাই সন্তানের কাছে কতটা প্রয়োজনীয়, এতটা সময় পেরিয়ে যাওয়ার পর মেয়ে বুঝতে পারে। মায়ের সঙ্গে নাড়ির টানটা নতুন করে অনুভব করে। মায়ের সতর্কতা, শাসনের কড়া বুলিই যে তাকে চোরাগলির অন্ধকার থেকে বাঁচিয়ে এসেছে, সেটাতে কৃতজ্ঞ বোধ করে। মন চলে যায় মায়ের কাছে, ফিরে আসে ছোটোবেলার স্মৃতি।

মেয়ের হাত ধরে, মা জীবনের এতটা পথ পার করিয়ে দিয়েছে। ঝড়, জল মেয়েকে স্পর্শ করতে পারেনি। মেয়েকে রাস্তা দেখাবার প্রয়োজন আর নেই। সেই পাঠ তার শেষ হয়েছে। আজ প্রয়োজন মেয়ের, মায়ের পাশে দাঁড়াবার। তার এই সফরে মেয়েই একমাত্র বন্ধু হয়ে পাশে দাঁড়াতে পারে। কৈশোরে অজান্তে যে মেয়ে মায়ের ঢাল হয়ে সমাজে দাঁড়াতে চেয়েছিল আজ সত্যি করেই মায়ের ঢাল হয়ে দাঁড়ায়। নতুন বন্ধুত্ব, হূদয়ের বন্ধন নতুন করে আবার স্থাপিত হয়। মায়ের ভালোমন্দের দায়িত্ব, দেখাশোনা করার দায়িত্ব মেয়ে নিজেই তুলে নেয় নিজের হাতে। জীবনের প্রান্তবেলায় মা ও মেয়ের সম্পর্কের সমীকরণ Mother-Daughter relation কিছুটা বদলে যায়। শাসন এবং দায়িত্বের গাম্ভীর্যে মেয়েই হয়ে ওঠে ‘মা’।

 

হ্যাপি ম্যারেজ

স্বামীকে নিজের থেকে দূরে সরিয়ে রাখবেন না।

মালবিকার সংসার Happy married life । বিয়ের প্রথম পাঁচ বছর সবকিছু যেন স্বপ্নের মতো। স্বামী, দুই সন্তানকে নিয়ে একেবারে ‘হ্যাপি ফ্যামিলি’ মালবিকার। স্বামী অলোককে নিয়ে তার গর্বের অন্ত নেই। সংসার ও স্ত্রীর প্রতি সদা দায়িত্ববান ও যত্নশীল। কোনও কিছুরই ত্রুটি নেই। সেই অলোকের মধ্যে পরিবর্তন। দেরি করে বাড়ি ফেরা এবং নানা আছিলায় ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়া। একদিন মালবিকার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ল, যখন জানতে পারল অন্য এক মহিলার প্রতি আকৃষ্ট তার স্বামী। শপিং মলে বান্ধবীর হাত ধরে অলোককে ঘুরতে দেখেছে মালবিকার মাসতুতো বোন।

প্রিয়া ও প্রশান্তের ম্যারেজ লাইফ দশ বছরের বেশি পুরোনো। দু’বছর আগে প্রশান্ত চাকরিতে প্রোমোশন পেয়ে অন্যত্র বদলি হয়ে যায়। কলকাতার নামি স্কুলের শিক্ষকতার চাকরি এবং ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার কারণে স্বামীর সঙ্গে যেতে পারেনি প্রিয়া। দূরে একাকী থাকার ফলে ক্রমশ দূরত্ব বাড়তে থাকে তাদের মধ্যে। নতুন শহরে, নিঃসঙ্গ প্রশান্ত খুঁজে নেয় আর-এক মনের মানুষকে, যা ফাটল ধরিয়ে দেয় প্রিয়া-প্রশান্তের দশ বছরের সুখের সংসারে।

প্রিয়া বা মালবিকার সংসার শুধু নয়, এই ঘটনা আজ শহুরে জীবনের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে গেছে। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে দূরত্ব, মানসিক ব্যবধানের একাধিক কারণ রয়েছে। অনেকাংশে স্ত্রীরাও এর জন্য দায়ী। কখনও স্বামীদের উদাসীনতাও ব্যবধানের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। বাড়ির কর্তৃদের দ্বারা তৈরি সমস্যাগুলি একেবারে অচেনা নয়। একটু চোখ ও মন খোলা রাখলেই সমস্যাটির কারণ চিহ্নিত করা যায় এবং তা দূর করার সহজ পন্থাটিও বের করে ফেলা যায়। তবে এক্ষেত্রে স্ত্রীদের অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে এবং সহমর্মিতা ও সহানুভূতির সঙ্গে স্বামীর সমস্যার বিষয়টি বিবেচনা করতে হবে।

স্ত্রীদের চালচলন, লাইফস্টাইল, সম্পর্কের ক্ষেত্রে বড়ো বাধা

 সংসারে স্ত্রীদের কর্তৃত্ব ফলানো, সন্দেহ বা অবিশ্বাস, অবহেলা, পজেসিভনেস সমস্যার জট তৈরি করে। খুঁতখুঁতে মানসিকতা, অতিরিক্ত ঈর্ষা, লোভ, স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের উপর প্রভাব ফেলে। আর এই সমস্যাগুলি দৈনন্দিন রুটিনে পরিণত হলে, দূরত্ব আরও বাড়তে থাকে। শারীরিক ও মানসিকভাবে স্ত্রীর সঙ্গে এই ব্যবধানটা অন্য মহিলার প্রতি আকৃষ্ট করে তোলে স্বামীদের।

স্বামীদের কীভাবে বশে রাখতে হয়, প্রাচীনকাল থেকেই মা-দিদিমারা তাদের পরবর্তী প্রজন্মকে সেই টিপস্ দিয়ে আসছেন। বর্তমানের ইন্টারনেটের যুগেও সে পরামর্শগুলি এখনও কার্যকর, যা মেনে চললে দাম্পত্য কলহের অনেক সুরাহা সম্ভব। স্বামী-স্ত্রীর কেমিস্ট্রিতে তৃতীয়পক্ষের আগমনের সম্ভাবনা আটকানোর পরামর্শ রইল আপনাদের জন্য।

প্রয়োজনীয় ৭-টি টিপস

(১) যত্নশীল হন। স্বামীর প্রয়োজনীয়তার দিকে খেয়াল রাখুন। স্বামী যখন ঘরে থাকবে বাড়তি মনোযোগ দেবেন। স্বামীর সাফল্যে ভাগীদার হন ও তার কাজের প্রশংসা করুন।

(২) ভোজন, স্বামীকে বশে রাখার সহজ রাস্তা। কী পছন্দ করে, কী করে না, সেদিকে খেয়াল রেখে, খাবারের টেবিলের মেনু সেইমতো সাজান। পরিমিত ও সুস্বাদু খাবার, সঠিক উদরপূর্তির মাধ্যমে সহজেই হূদয় জয় করে নিতে পারেন।

(৩) স্বামী-স্ত্রীর কেমিস্ট্রি সম্পর্কের ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। চেষ্টা করবেন যথাসম্ভব কাছে থাকতে, সময় দিতে। চাকরির জন্য আলাদাভাবে থাকা, বাপের বাড়িতে দীর্ঘদিন কাটানো স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে দূরত্ব তৈরি করে। প্রয়োজনে কিছুটা ত্যাগও স্বীকার করতে হবে এহেন পরিস্থিতি কাটাতে।

(৪) সন্দেহ, অবিশ্বাস, সম্পর্কে জটিলতা তৈরি করে। অন্ধকার বয়ে আনে বৈবাহিক জীবনে। তাবলে কি স্বামীকে অন্ধের মতো বিশ্বাস করবেন? একেবারেই না। স্বামীর কাজকর্মের প্রতি ওয়াকিবহাল থাকাটা জরুরি। আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধবদের সাহায্য নিতে পারেন এব্যাপারে।

(৫) স্ত্রীদের সাপোর্টিভ ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। স্বামীর খুঁটিনাটি বিষয়ে বিরক্তি প্রকাশ করবেন না। ডমিনেট করার মানসিকতা ঝেড়ে ফেলুন। হাসিমুখে, সুন্দরভাবে স্বামীর সামনে দাঁড়ান। স্ত্রীদের খুঁতখুঁতে, সন্দেহবাতিক মানসিকতা, অবহেলা এবং সান্নিধ্যের অভাবে বিরক্ত হয়ে অনেক সময় স্বামীরা বাইরে সময় কাটানো বেশি পছন্দ করেন। যার পরিণতিতে অন্য মহিলার মধ্যে ভালোবাসা খোঁজার চেষ্টা থাকাটা স্বাভাবিক ঘটনা।

(৬) স্বামীর বিশেষ ইচ্ছেতে কখনও না বলবেন না। হতে পারে আপনি ব্যস্ত, বিভিন্ন সমস্যায় জর্জরিত কিংবা শরীর ভালো নয় বা ক্লান্ত, সেক্ষেত্রে সরাসরি ‘না’ নয়। বিনয়ের সঙ্গে বলতে পারেন ‘অন্য কোনও সময়ে’। তারপর সময় সুযোগ বুঝে স্বামীকে ডেকে নিন নিজের কাছে। অন্তরঙ্গ হয়ে তৈরি করুন রোমান্টিক পরিবেশ। একে-অপরের মধ্যে মিশে যান। মনে রাখবেন এব্যাপারে স্বামী যেন কখনওই মনে না করে সে অবহেলিত।

(৭) সন্তানদের প্রতি যত্ন নিন। কিন্তু স্বামীকে অবহেলা করে নয়। প্রত্যেক বাবা-মার উচিত সন্তানদের প্রতি নজর দেওয়া। তবে কখনওই নিজেদের সখ-আহ্লাদ-চাহিদাকে বাদ দিয়ে নয়। সন্তান ও স্বামীর মধ্যে ভারসাম্য রাখা অত্যন্ত জরুরি। বাচ্চাদের কাজে স্বামীকেও সঙ্গী করে নিন। তাহলে তিনিও অনুভব করতে পারবেন সন্তানদের লালন-পালন কতটা কঠিন ও সময়সাপেক্ষ। আপনার কাজের চাপ, শারীরিক ও মানসিক ধকলের কথা মাথায় রেখেই অ্যাডজাস্ট করার কথা স্বামীও ভাববেন।  উপরোক্ত টিপসগুলি মেনে চললে পশ্চিমী দুনিয়ার মতো যখন-তখন ডিভোর্স নয়, আপনার দাম্পত্য জীবন হয়ে উঠবে দীর্ঘ ও সুখের। আধুনিকতা মানে নিজের সংস্কৃতি, সভ্যতার ভালো গুণগুলি ভুলে গিয়ে পশ্চিমী কালচারকে অন্ধের মতো অনুকরণ, অনুসরণ করা নয়।

দাম্পত্য জীবনকে সুখের করে তুলতে Happy married life স্ত্রীর ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। টিপসগুলি মানলে বারমুখী মনোভাবসম্পন্ন স্বামীকেও নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। টিকে থাকতে বর্তমান যুগের সঙ্গে পা মেলাতে হবে আমাদের সবাইকে। কিন্তু কখনওই মানুষের স্বাভাবিক ও সহজাত প্রকৃতিকে পালটে নয়, তাহলে আপনার জীবনে জটিলতা বাড়বে। বাড়বে দাম্পত্যকলহ, ডিভোর্সের প্রবণতা।

 

সন্দেহ প্রবণতা

অন্যকিছু বিষয়ের মতো, সন্দেহ প্রবণতারও Scepticism ভালো-মন্দ দুটি দিক আছে। এখন আপনাকে জানতে হবে, কোন ক্ষেত্রে কতটা সন্দেহ ইতিবাচক আর কোন ক্ষেত্রে খারাপ এবং ক্ষতিকারক।

ভালো দিক : অনেক সময় আমরা বলে থাকি, আমার সন্দেহ যে সঠিক ছিল, আজ তা প্রমাণিত হল। অর্থাৎ, এক্ষেত্রে সন্দেহ ইতিবাচক রূপ নিল। কারণ, সন্দেহ সত্য উদঘাটন করতে সাহায্য করেছে। যেমন কেউ আপনার চাহিদা কিংবা দুর্বলতার কথা ভেবে প্রলোভিত করতে পারে। তাই, অপরিচিত, অল্প-পরিচিত কিংবা হঠাৎ হাত মেলানো কোনও শত্রুর পরামর্শে প্রথমেই বিশ্বাস করে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়া ঠিক নয়। এমনকী, তাদের দেওয়া খাবার খাওয়ার আগে, কিছুটা সন্দেহ রেখে, ভালো ভাবে যাচাই করে নেওয়া উচিত। প্রযোজনে কিছু খাবার অন্যের পাত্রে তুলে দিয়ে ওই ব্যক্তির খাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করা ভালো। বিশেষ করে সফর পথে কোনও অপরিচিত পুরুষ অথবা মহিলার দেওয়া খাবার কিংবা পানীয় না খাওয়া ভালো। এক্ষেত্রে সন্দেহ ইতিবাচক।

কিংবা ধরুন কেউ যদি টাকা বা অন্যকিছু ধার চায়, তাহলে সে সঠিক সময়ে ধার শোধ করতে পারবে কিনা এ বিষয়ে সন্দেহ রেখে তার সম্পর্কে খোঁজখবর নিয়ে তারপর সিদ্ধান্তে আসা ভালো।

আবার কেউ যদি অর্থের বিনিময়ে চাকরি পাইয়ে দেওয়া, স্কুল-কলেজে ভর্তি করিয়ে দেওয়ার কথা বলে, তাহলে তার প্রতি সন্দেহ প্রকাশ করা ভালো লক্ষণ।

অথবা ধরুন রাতে কেউ দরজায় নক্ করল। আপনি কারণ জিজ্ঞাসা করাতে সে জানাল, থানা থেকে আসছি, দরকার আছে, দরজা খুলুন, তাহলে তার বা তাদের প্রতি সন্দেহ রেখে থানায় ফোন করে খোঁজখবর নেওয়া ভালো। এক্ষেত্রেও সন্দেহ প্রকাশ করা ভালো লক্ষণ।

অন্যদিকে, কেউ আপনাকে ইমোশনালি ঠকাচ্ছে কিনা কিংবা ঠকাতে পারে কিনা, সেই বিষয়ে সন্দেহ রাখা কোনও অন্যায় নয়। যাকে আপনি দীর্ঘদিন ধরে চেনেন, জানেন, তার সম্পর্কে হঠাৎ যদি কেউ গুরুতর অভিযোগ জানায়, সে ক্ষেত্রে অভিযোগকারীকে তৎক্ষণাত বিশ্বাস না করে, কিছুটা সন্দেহ রাখা ভালো। অর্থাৎ, সন্দেহ যদি সত্য-মিথ্যা যাচাইয়ের জন্য হয়, ক্ষতির হাত থেকে নিজেকে বাঁচানোর জন্য হয়, তাহলে তা ভালো দিক।

The tendency of doubt

ক্ষতিকারক দিক : Suspicion বা সন্দেহের যেমন কিছু ভালো দিক আছে, ঠিক তেমনই অত্যন্ত খারাপ দিকও আছে। অর্থাৎ, যিনি অবিবেচকের মতো সবাইকে, সব ক্ষেত্রে সন্দেহ প্রকাশ করেন কিংবা সন্দেহের মাত্রা ছাড়িয়ে যায়, তখন তা অত্যন্ত ক্ষতিকারক। অর্থাৎ, এ ক্ষেত্রে সন্দেহ প্রবণতা একটা রোগে রূপান্তিরিত হয় এবং চিকিৎসার প্রযোজন হয়। আর এই ক্ষতিকারক সন্দেহ প্রবণতা বেশি লক্ষ্য করা যায় দাম্পত্য সম্পর্কের ক্ষেত্রে। সবচেয়ে মজার কথা, এই সন্দেহ প্রবণতার রোগে নারী-পুরুষ উভয়ে আক্রান্ত হতে পারেন।

সম্পর্কের ক্ষেত্রে সন্দেহ যতক্ষণ হালকা থাকে অর্থাৎ, ভালোবাসার মানুষটিকে আগলে রাখার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে, ততক্ষণ ক্ষতিকারক নয়। কিন্তু সম্পর্ক যেখানে বিশ্বাসের সরু সুতোয় আটকে থাকে, সেখানে সঙ্গী অন্য কারওর সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করে নিতে পারে কিংবা অবৈধ সম্পর্ক গড়ে উঠেছে এমন সন্দেহ অত্যন্ত অস্বাস্থ্যকর। এক্ষেত্রে সন্দেহের বশে সঙ্গীর স্বাভাবিক চলাফেরা, অন্যের সঙ্গে কথা বলা কিংবা হইহুল্লোড় করা নিয়ন্ত্রণ করা কিংবা পুরোপুরি আটকে দেওয়া মানেই মানসিক অসুস্থতার লক্ষণ প্রকাশ পায়।

অনেকে এমনও আছেন, অন্যের কোনও কথাই তাঁরা বিশ্বাস করতে পারেন না। অহেতুক অন্যের প্রতি অতিরিক্ত সন্দেহ Scepticism প্রকাশ করেন। এক্ষেত্রে যিনি এমনটি করেন, তাকে সবাই এড়িয়ে চলেন, এমনকী ঘৃণ্য মানুষ বলেও মনে করেন অনেকে। তাই, অতিরিক্ত সন্দেহ প্রবণ মানুষটি ধীরে ধীরে ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত হন এবং একমসয় তাকে একাকিত্ব গ্রাস করে। শুধু তাই নয়, অতিরিক্ত সন্দেহ প্রবণতা সম্পর্ক নষ্ট করে, ঝগড়া-অশান্তি তৈরি করে, সংসার ভাঙে, এমনকী খুন কিংবা আত্মহত্যার ঘটনা পর্যন্ত ঘটিয়ে ফেলতে পারে।

অতএব, সন্দেহ প্রবণতা যদি রোগে পরিণত হয়, তাহলে দেরি না করে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে চিকিৎসা শুরু করুন। আর, চেষ্টা করুন আনন্দে থাকার। ভালো গান শুনুন, বই পড়ুন এবং শরীরচর্চা করে মন বড়ো করুন।

শিশুর বিকাশের সঠিক পন্থা

সন্তানের জন্মের পরেই মায়েদের চিন্তা শুরু হয়ে যায়। কী করে বাচ্চাকে বড়ো করবে, কবে থেকে শিশু চলাফেরা শুরু করবে ইত্যাদি ইত্যাদি। । সত্যি কথা বলতে সন্তানকে বড়ো করে তোলাটা গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। শিশুর শারীরিক এবং মানসিক বিকাশের Child Development জন্যে বড়োদের আদর ভালোবাসার খুবই প্রয়োজন।

বাচ্চাদের প্রতি মা-বাবার যে-দায়িত্ব, সেটা ডিউটি মনে করে নয় বরং ভালোবেসে পালন করা উচিত। বড়োদের এই ভালোবাসাই সঠিক ভাবে বাচ্চাদের মানুষ করে তুলতে সাহায্য করে। অরুণিমা চাকরি করে। ওর ৩ বছরের একটি মেয়ে আছে। মেয়েকে বাড়িতে রেখে অরুণিমাকে অফিস যেতে হয়। ওর কাছে ওর সন্তানের তিল তিল করে বেড়ে ওঠাটা একটা বিস্ময়। কথায় কথায় ও বলছিল, ‘রোজ অফিস থেকে বাড়ি ফিরে মনে হয় আমার মেয়ের মধ্যে রোজই কোনও না কোনও পরিবর্তন হচ্ছে। রোজই নতুন নতুন জিনিস ওর মধ্যে লক্ষ্য করি। ওর কথা বলার স্টাইল, ভালোবাসা প্রকাশ করার স্টাইল, সবকিছুর মধ্যেই পরিবর্তন এসেছে মনে হয়। অফিসের সারাদিনের ক্লান্তি, মেয়েকে দেখে এক নিমেষে গায়েব হয়ে যায়।’

চাইল্ড স্পেশালিস্টদের মতে প্রথম ৪ বছর পর্যন্ত বাচ্চারা জীবনের ৮০ শতাংশ জিনিস শিখে ফেলে। বাকি ২০ শতাংশ শেখে সারা জীবন ধরে। শিশুর নিষ্পাপ সরলতার সঙ্গে সঙ্গে তার মধ্যে কাজ করে নতুন কিছু শেখা এবং জানার আগ্রহ। শিশুর বয়স যখন এক বছরের কম থাকে তখন হাতের সামনে যা পায়, তাই মুখের মধ্যে পুরে দেওয়ার একটা প্রবণতা থাকে তাদের। কারণ এই সময়টাতে শিশুর টেস্ট অর্গ্যান বিকশিত হওয়া শুরু হয়।

গুটি থেকে প্রজাপতি

চোখের সামনে বাচ্চাদের বড়ো হয়ে উঠতে দেখাটা মা-বাবার কাছে যথেষ্ট আনন্দের। প্রথমবার বাচ্চাকে কোলে নিলে মনে হয় সারা জীবনের যতটা আনন্দ পাওনা ছিল, তা মুহূর্তে পাওয়া হয়ে গেল। জন্ম থেকে নিয়ে শিশুদের ব্যবহারে রোজই পরিবর্তন আসে। খুব তাড়াতাড়ি তারা সবকিছু শিখতে থাকে। বাচ্চার উপযুক্ত দেখভাল দায়িত্ব মনে না করে, আনন্দ উপভোগ করার জন্যে শুধু করুন। বাচ্চার উপর রাগারাগি করা উচিত নয়। বাচ্চার সার্বিক বিকাশের ক্ষেত্রে স্পর্শর, একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। কোথাও থেকে ফিরে আসার পর শিশুকে জড়িয়ে ধরে আদর করা, তাকে কোলে তুলে নেওয়ায় তার প্রতি ভালোবাসার অনুভূতিই ফুটিয়ে তোলা হয়। শিশুর নিজেরও মনে হয় সে সকলের আদরের, সকলেই তাকে ভালোবাসে। কথা বলতে না শিখলেও বাচ্চারা বুঝতে পারে তার প্রতি অন্যদের কী মানসিকতা। বাচ্চাকে আদর করতে গেলে দেখা যায় সেও তার ছোট্ট হাতটি তুলে বড়োদের গলা জড়িয়ে ধরছে। মায়ের স্পর্শ বাচ্চাদের কাছে সবচেয়ে প্রিয়। ঘুমের মধ্যেও বাচ্চা মায়ের গায়ের গন্ধ আর স্পর্শ ঠিকই বুঝতে পারে। এছাড়াও বাচ্চাদের সঙ্গে সর্বক্ষণ কথা বলতে থাকলে বাচ্চারা খুব তাড়াতাড়ি কথা বলতে শেখে।

প্রতিদিনই একটু করে বড়ো হওয়া

জন্মের পর থেকে প্রথম ৫ বছর বাচ্চাদের গ্রোথ অথবা বিকাশ হয় খুব তাড়াতাড়ি। শেখার আসল সময় এটাই। খাওয়াদাওয়া থেকে শুরু করে হাঁটতে শেখা, শিরদাঁড়া সোজা করে বসা, কথা বলা, অন্যের সঙ্গে বন্ধুত্ব করা সবই শিশু এই বয়সের মধ্যেই শেখে। প্রতিদিনই নানা ধরনের পরিবর্তন চোখে পড়ে তাদের মধ্যে। এই সময় শিশুর মনে নানারকম প্রশ্ন উদয় হয় এবং অভিভাবকের দায়িত্ব সেই সব প্রশ্নের সঠিক সমাধান করে দেওয়া। সঠিক উত্তর দেওয়া। বাচ্চাকে উপযুক্ত মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে গেলে, বড়োরা যে ব্যবহার বাচ্চাদের থেকে আশা করেন, ঠিক সেই ব্যবহারই বড়োদের বাচ্চাদের সঙ্গেও করা উচিত।

যদি বড়োরা ভাবেন নিজেদের সন্তান সকলের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করুক, তাহলে বড়োদেরও কর্তব্য বাচ্চার সামনে সকলের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করা। কখনও কারও সঙ্গে চেঁচিয়ে কথা বলা উচিত নয় এবং অপ্রীতিকর শব্দও ব্যবহার করা বাঞ্ছনীয় নয়। আসল কথা হল বাচ্চারা একতাল নরম মাটির মতো। তার চিন্তাধারা, তাকে সঠিক রাস্তায় পরিচালনা করার দায়িত্ব অভিভাবকদের। এর মধ্যে বাচ্চার খাওয়াদাওয়ার অভ্যাস থেকে শুরু করে সবার সঙ্গে তার ব্যবহার কী হবে– সবই গুরুত্বপূর্ণ। এই সময়ের মধ্যে বাচ্চা যে-শিক্ষা পেয়ে বড়ো হবে, সারা জীবন সেটাই সে অবলম্বন করে চলবে। ভালোবাসা এবং শাসনের মধ্যে কী প্রভেদ সেটাও এই সময়ে বাচ্চারা ধীরে ধীরে শেখে।

খাওয়াদাওয়ার অভ্যাস

৫ বছর বয়সের মধ্যে বাচ্চাকে দুধ ছাড়াও অন্যান্য পুষ্টিকর খাবার খাওয়ার অভ্যাসও ধীরে ধীরে করাতে হয়। বাড়ির তৈরি সব খাবারই এইসময় একটু একটু করে খাওয়াবার অভ্যাস করানো উচিত। সবুজ শাকসবজি, মরশুমি ফল, বাচ্চার মস্তিষ্ক গঠনের সঙ্গে সঙ্গে মানসিক ও শারীরিক ভাবে শিশুকে সুস্থ রাখতেও খুবই প্রয়োজন। বড়োরা নিজেদের কাজ বাঁচাবার জন্য বাজার থেকে খাবার কিনেও বাচ্চাকে খাওয়ান। ফলে বাইরের খাবারের প্রতি বাচ্চার আসক্তি জন্মায়। পরে চেষ্টা করলেও তাকে হেলদি খাবারের অভ্যাস করানো সম্ভব হয় না। তাই বাড়ির ভাত, ডাল, রুটি, সবজি, মাছ ইত্যাদির অভ্যাস ছোটো থেকেই বাচ্চাদের করাতে হয়।

সুরক্ষিত পরিবেশ

বাচ্চার সুরক্ষার জন্যে বাড়ির পরিবেশও সুরক্ষিত রাখা খুবই দরকার। যতদিন পর্যন্ত বাচ্চা বড়ো না হয় ততদিন বেছে বেছে বাড়ির আসবাব কেনা উচিত। খুব শার্প কর্নার-যুক্ত অথবা খুব উঁচু আসবাব বাড়িতে রাখা উচিত নয় কারণ প্রায়সই দেখা যায় উঁচু খাট থেকে বাচ্চারা পড়ে গিয়ে শরীরে অথবা মাথায় চোট পায়।

বাচ্চাকে বাড়িতে একলা রেখে বেরোনো কখনও উচিত নয়। ইলেকট্রিক প্লাগ পয়েন্ট টেপ দিয়ে বন্ধ রাখলে বাচ্চা ওর মধ্যে আঙুল ঢোকাতে পারবে না, কারণ জিজ্ঞাসু স্বভাবের জন্যে বাচ্চারা প্লাগ পয়েন্টে হামেশাই আঙুল ঢোকাবার চেষ্টা করে। মোবাইল চার্জার প্লাগ পয়েন্টে লাগিয়ে রেখে চলে যাওয়া উচিত নয়। রান্নাঘরে ধারালো জিনিসপত্র যেমন বঁটি, ছুরি, কাঁচি যেন বাচ্চাদের হাতের বাইরে রাখা থাকে। গ্যাস সিলিন্ডার ব্যবহারের পর রেগুলেটর অফ করে দেওয়াই বাঞ্ছনীয়।

খেলনা এবং বন্ধু

বাচ্চাদের খেলনা কেনার সময় বিশেষ খেয়াল রাখুন। ১ বছরের কম বয়সি বাচ্চারা হাতে যা পায়, মুখে দেবার চেষ্টা করে। এইজন্যে ওদের জন্যে ভালো কোম্পানির খেলনা কিনে দেওয়া উচিত। তাছাড়াও এমন খেলনা হওয়া উচিত যেটাতে বাচ্চাদের কোনওরকম বিপদের সম্ভাবনা থাকবে না। সময় পেলেই বাচ্চাদের পার্কে নিয়ে যান সেখানে স্বাধীনভাবে তাদের খেলতে দিন কিন্তু নিজের চোখের আড়ালে যেতে দেবেন না। স্বাধীনভাবে খেলাধুলো করলে বাচ্চাদের শারীরিক এবং মানসিক বিকাশ Child Development হয়। এছাড়া নিজের বয়সি বাচ্চাদের সঙ্গে পার্কে মেশার এবং বন্ধুত্ব করার সুযোগও হয়, ফলে যে-কোনও কাজ খুব তাড়াতাড়ি শেখে বাচ্চারা। তাছাড়াও দেখা গেছে একা একা বাচ্চারা খেতে না চাইলেও সমবয়সি বন্ধুদের সঙ্গে থাকলে খাওয়া নিয়ে সাধারণত কোনও ঝামেলা বাচ্চারা করে না।

খেয়াল রাখুন

১)   বাচ্চাদের পুষ্টিকর খাবার খেতে দিন। খাবারে মরশুমি ফল এবং সবুজ শাকসবজি রাখুন। এছাড়াও বাচ্চাকে দুধ, দই, ছানা পর্যাপ্ত পরিমাণে দিন।

২)   স্পর্শর মাধ্যমে ওকে বুঝতে দিন যে আপনারা ওকে কতটা ভালোবাসেন। এতে বাচ্চা নিজেকে সুরক্ষিত মনে করবে। বাচ্চার সামগ্রিক বিকাশের জন্যে মানসিক সুরক্ষার অনুভূতি প্রচণ্ড জরুরি।

৩)   বাচ্চার পুরো ঘুম যাতে হয় সেই খেয়াল রাখবেন।

৪)   বাচ্চা যদি বোতলের দুধ খায় তাহলে খেয়াল রাখবেন বোতল যাতে ভালো করে পরিষ্কার এবং স্টেরিলাইজ করা হয়।

৫)   ধারালো এবং ক্ষতি করতে পারে এমন বস্তু বাচ্চার হাতের বাইরে রাখুন।

৬)   বাচ্চাকে নিজের এজ গ্রুপের বাচ্চাদের সঙ্গে মিশতে দিন। তাতে বাচ্চা তাড়াতাড়ি শিখতে পারবে।

৭)   বাচ্চার পোশাক সুতির এবং পরিষ্কার হওয়া উচিত।

৮)   বাচ্চার ছাড়া জামাকাপড় ডেটলে ভিজিয়ে রেখে পরিষ্কার করে কেচে তোলা বাঞ্ছনীয়।

৯)   বাচ্চার মালিশের তেল, শ্যাম্পু, ক্রিম, সাবান ভালো কোম্পানির হওয়া উচিত।

১০)  সুযোগ পেলেই বাচ্চাকে বাড়ির বাইরে ঘুরিয়ে আনুন।

১১)  বাচ্চার সঙ্গে সবসময় কথা বলুন। মুখে বলতে থাকুন আপনি ওকে কতটা ভালোবাসেন।

১২)  যাদের সাথে বাচ্চা কমফর্টেবল ফিল না করে তাদের কোলে বাচ্চাকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে দেবেন না।

 

সহজে নিন শিশুর যত্ন

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সমাজ বদলেছে। মেয়েরাও উচ্চশিক্ষা নিয়ে কেরিয়ার গড়ছে। পুরুষদের সঙ্গে কোনওভাবেই সেখানে তফাত করা চলে না। তবুও বাড়ির ভিতরের চিত্রটার অতটা রদবদল হয়নি। চাকরিতে ঢুকলেও মেয়েরাই কিন্তু বাড়ি, সংসার সন্তান সবই দক্ষ হাতে সামলাচ্ছে। কিন্তু কর্মক্ষেত্রের চাপ সহ্য করে সংসারের চাপে, কিছুটা হলেও উভয়ের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করতে গিয়ে একটা অপরাধবোধ জন্ম নিচ্ছে মেয়েদের মনে। কেরিয়ার গড়তে গিয়ে তারা কি ঠিকভাবে সংসার, সন্তানের প্রতি দায়িত্ব child care পালন করতে পারছে? এই অপরাধ বোধ আরও বাড়তে থাকে যখন সন্তানের জন্মের এক-দুই মাসের মধ্যেই সন্তানকে বাড়িতে রেখে মা-কে বাধ্য হতে হয় অফিস জয়েন করতে।

আগে সংযুক্ত পরিবারে ‘মা’ ছাড়াও বয়োজ্যেষ্ঠরাও থাকতেন শিশুর যত্ন child care নেওয়ার জন্যে। কিন্তু এখন নিউক্লিয়ার ফ্যামিলিতে শুধুই বাবা, মা আর সন্তান। তাই শিশুর জন্মের পরও তার দেখাশোনা, যত্নের পুরো দায়িত্বটাই মায়ের উপরেই বর্তায়। এই ক্ষেত্রে শিশুর দেখাশোনা অথবা কেরিয়ার এই দুটোর মধ্যে একটাকেই বেছে নিতে হয় মেয়েদের। আমাদের যা সমাজব্যবস্থা তাতে স্বাভাবিক ভাবেই শিশুর যত্নের দায়িত্ব মায়েরই উপর, তা সেই ‘মা’ যত বড়োই চাকরি করুক না কেন অথবা যত অর্থই উপার্জন করুক না কেন।

সুজাতা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে উঁচু পদে বহাল। মেটারনিটি লিভ কষ্ট করে দু’মাস নিতে পেরেছে। এখন ওর মেয়ে মাত্র ২৬ দিনের হয়েছে। বাড়িতে স্বামী ছাড়া আর কেউ নেই। স্বামীও পারবে না ছুটি নিতে। অফিসের নিয়ম মেনে অগত্যা ওর কাছে দুটো রাস্তা খোলা রয়েছে। এক– ভালো একজন পরিচারিকা পাওয়া। সুজাতা অফিস চলে গেলে যে কিনা বাচ্চার যত্ন করতে পারবে দায়িত্বের সঙ্গে। আর দ্বিতীয় রাস্তা হল আপাতত চাকরি ছেড়ে দিয়ে নিজেই সন্তানের যত্নের পুরো দায়িত্বটা একাই পালন করা। শেষমেশ দ্বিতীয় রাস্তাটাই সুজাতা বেছে নিয়েছে কারণ ভরসা করতে পারবে এমন কাউকে সুজাতা এখনও খুঁজে পায়নি।

সুজাতার মতন হাজার হাজার মায়েরা সন্তানের দেখাশোনা করার জন্যে চাকরি ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন। তাদের মনে একটাই অপরাধের বোঝা যে তারা কেরিয়ার নিয়ে কিছু ভাবতে পারেননি। আবার অনেকে বেবি সিটারের ভরসায় বাচ্চাকে বাড়িতে রেখে দিয়ে চাকরিতে জয়েন করেন। মনে মনে তারা নিজেদেরই দোষারোপ করেন যে কেরিয়ারে নিজের ভবিষ্যৎ গড়ার জন্যে নিজের সন্তানকে তারা অবহেলা করেছেন। এছাড়া চাকুরিরতারা করবেনটাই বা কী?

এই প্রশ্নের কোনও সঠিক উত্তর নেই। এই সব ক্ষেত্রে পরিবেশ, মনের ইচ্ছা, কোনটাকে ইমপর্টেন্স দেওয়া জরুরি ইত্যাদির একটা বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। মাতৃত্ব, যে-কোনও মেয়ের জীবনেই একটা পরিবর্তন নিয়ে আসে। অনেক মেয়ে রয়েছেন যারা সদ্য মা হয়েও দক্ষতার সঙ্গে সব ম্যানেজ করে কেরিয়ার এগিয়ে নিয়ে যেতে আগ্রহী। আবার অনেকে যে-কোনও মূল্যে নিজের সন্তানের যত্নকেই child care প্রাধান্য দিতে চান।

প্রত্যেক চাকুরিরতাই চান সন্তান হওয়ার পরেও তাদের যাতে চাকরি ছাড়তে না হয় কিন্তু পরিস্থিতি সবসময় চাহিদামতো হয় না। বাড়ি থেকে অফিসের দূরত্ব, অফিসে কাজের সময়সীমা, নিউক্লিয়ার ফ্যামিলিতে সদস্যের অভাব এইসব কিছুই চাকরির অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। এই কারণগুলোর জন্যেই সদ্য-মায়ের পক্ষে বাচ্চাকে একলা বাড়িতে রেখে কর্মক্ষেত্রে যাওয়া সম্ভব হয় না। তবুও কয়েকটি উপায় আছে যাতে নিশ্চিত হয়ে মায়েরা নিজেদের চাকরি বজায় রাখতে পারেন।

সঠিক কোম্পানি বাছা – প্রথমে এমন কোম্পানি বাছা উচিত যেখানে কাজের সময়, অন্যান্য কোম্পানির তুলনায় কম। অফিসের টাইম-টা ফ্লেক্সিবল হলে সুবিধা হবে।

একটা রুটিন তৈরি করুন – সন্তানের জন্মের পরে যখন অফিস জয়েন করার কথা ভাববেন, নিজেই একটা রুটিন তৈরি করে নিন। এটা মনে রাখবেন আপনাকেই ঠিক করে নিতে হবে কোন সময় থেকে কোন সময় অবধি কী কী কাজ আপনি করতে পারবেন। এই ভাবে টাইম ম্যানেজমেন্ট করে আপনি নিজের অনেক অসুবিধে দূর করতে পারবেন।

নিজেকে গুছিয়ে নিন – অগোছালো অভ্যাস বর্জন করুন। ছোটো ছোটো জিনিসের জন্যে আলাদা বাক্স অথবা জায়গার ব্যবস্থা রাখুন। এর ফলে জিনিস চট্ করে খুঁজে পাওয়া অনেক সহজ হবে। বাচ্চার জিনিসপত্র এক জায়গায় গুছিয়ে রাখুন। বাকি জিনিসের জন্য আলাদা করে জায়গা করুন যাতে হঠাৎ করে কোনও প্রয়োজনীয় জিনিস খুঁজতে হলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা না পেরিয়ে যায়।

জীবনসঙ্গীর সাহায্য নিন – সন্তান ছোটো অবস্থায় জীবনসঙ্গীর সাহায্য নিন। ওনাকে বলুন ছোটোখাটো কাজগুলো করে নিতে কারণ উনিও বুঝবেন আপনার পক্ষে একা সবকিছু সামাল দেওয়া অসম্ভব।

বাচ্চার দেখাশোনার জন্যে মহিলা রাখুন – বাচ্চাকে ডে-কেয়ারে রাখতে না চাইলে, কোনও পরিষ্কারর পরিচ্ছন্ন মহিলাকে বাড়িতে রাখুন যে কিনা আপনার অনুপস্থিতিতে মায়ের মতোই বাচ্চার দেখাশোনা করতে পারবে।

বাচ্চার সংস্পর্শে থাকুন – বাড়িতে বাচ্চাকে রেখে অফিস আসতে হলে অথবা ডে-কেয়ারেও বাচ্চাকে রাখলে দিনে অন্তত ৫-৬ বার ফোনে বাচ্চার খোঁজ-খবর নিন। দুপুরে যদি বাড়ি আসা সম্ভব হয় তাহলে একবার এসে বাচ্চাকে দেখে যাওয়া উচিত হবে।

ভাবনা-চিন্তা করে কাজের গুরুত্ব বুঝুন – সন্তানের জন্মের পর, বিভিন্ন কাজের মধ্যে গুরুত্বের মাপকাঠির সংজ্ঞা পরিবর্তন হয়। কোন কাজ করলে বাচ্চার উপর তার কী প্রভাব পড়বে তা ভেবে দেখা উচিত। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকা দরকার, কথাবার্তা মার্জিত হওয়া উচিত এবং স্নেহপূর্ণ ব্যবহার এই সময় একান্ত ভাবে কাম্য।

এই বিষয়টি নিয়ে অনেকরকম পরীক্ষা করা হয়েছে। তাতে পাওয়া গেছে চাকুরিরতাদের বাচ্চারা সহনশীল বেশি হয়। নিজেদের সমস্যা সহজে সমাধান করার ক্ষমতাও ওদের মধ্যে অনেক বেশি থাকে এবং নিজের ভালো করার ইচ্ছেও তাদের মধ্যে বেশি থাকে।

ইন্সটিটিউট ফর সোশ্যাল অ্যান্ড ইকোনমিক রিসার্চ সমীক্ষা চালিয়েছিল চাকুরিরত মহিলাদের নিয়ে। তাদের মধ্যে বেশিরভাগ মহিলাই জানিয়েছেন, বাচ্চাকে খুব ছোটো থেকেই বেশ কয়েক ঘণ্টার জন্যে একলা রাখতে তারা কমবেশি বাধ্য হয়েছিলেন। এর ফলে তাদের বাচ্চারা খুব শিগগির-ই আত্মনির্ভর এবং স্বাধীন চেতনায় বড়ো হয়ে উঠতে পেরেছে।

 

আপনি যখন অপরের অতিথি

অতিথি দেবতুল্য সুতরাং যে-গৃহে অতিথির Guest পা পড়েছে, সেখানকার গৃহকর্তার সবসময়ই চেষ্টা থাকে, অতিথির যেন কোনও কিছুতেই কষ্ট না-হয়।

কিন্তু এখন প্রচন্ড ব্যস্ততার যুগ তার ওপর নিউক্লিয়ার ফ্যামিলি। কর্তা, গিন্নি উভয়েই ব্যস্ত নিজ নিজ কর্মক্ষেত্রে। নিজেদের জন্যেই একে অপরের কাছে সময় নেই, তার উপর গেস্ট। অনেকেরই মনে পড়তে পারে, ‘অতিথি তুম কব যাওগে’ ছবিটির কথা। অনেকেই আজকাল অতিথিকে আপ্যায়ন করতে বিরক্ত বোধ করে, অতিথি guest বাড়ি থেকে চলে গেলে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। ভুলেও তাদের মুখ থেকে শোনা যায় না, ‘আবার আসবেন’।

কিন্তু মানুষের মনের এতটা পরিবর্তনের কারণ কী? প্রত্যেককেই কখনও না কখনও এরকম একটা মানসিক টানাপোড়েনের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। পরিবর্তনের এই ধারাকে লক্ষ্য রেখে এখন অতিথিদেরও উচিত মানসিকতা বদলানো। অতিথি যেন গৃহকর্তার উপর বোঝা না হয়ে ওঠেন। সুতরাং, সেই ভাবেই অতিথির আচরণ করা উচিত।

আমাদের সকলেরই সুযোগ হয় অন্য বাড়িতে গেস্ট হিসেবে যাওয়ার। সম্পর্কটা ফর্মাল অথবা ইনফর্মাল যাই হোক না কেন, গেস্ট হিসেবে নিজেকে সংযত রাখাটা একান্ত দরকার। ভালো অতিথি হয়ে ওঠাটা খুব একটা মুশকিলের কাজ নয়, কেবল যাদের অতিথি হচ্ছেন, তাদের সুবিধা অসুবিধার খেয়ালটা মাথায় রাখতে হবে। গৃহস্বামীর যাতে অসুবিধা না হয়, অতিথির সে বিষয়ে সচেতন হওয়া বাঞ্ছনীয়।

অতিথি হয়ে কারও বাড়িতে গেলে, গৃহস্বামী যতই নিজেদের শোবার ঘর, প্রিয় খাবার টেবিলের চেয়ার অতিথির জন্যে ছেড়ে দিক না কেন, গেস্ট হয়ে উচিত সেগুলি ব্যবহার না করা। তার বদলে গেস্টরুমে থাকুন এবং খাবার ঘর, বসবার ঘরে গৃহকর্তার প্রিয় জায়গাটি ছেড়ে দিয়ে অন্য চেয়ার বেছে নিন। এতে দেখবেন গৃহস্বামী খুশিই হবেন।

বাড়ির নিয়মকানুন নিজের মতো করে বদলে ফেলবেন না।ভুলবেন না, আপনি অন্যের বাড়িতে রয়েছেন। সেই বাড়ির সময় ধরে আপনার চলা উচিত। ইচ্ছেমতো শুয়ে থাকলাম, যতক্ষণ ইচ্ছে হল বাথরুম এনগেজ রাখলাম, বাড়ির খবরের কাগজ নিজে আগে নিয়ে, সময় নিয়ে পড়তে শুরু করলাম, যখন ইচ্ছে চা-জলখাবার চেয়ে বসলাম ইত্যাদি আচরণ থেকে বিরত থাকুন। সেই বাড়ির নিয়ম অনুযায়ী চলুন। বাড়ির গাড়ি যদি ব্যবহার করতে চান আগে থেকে গৃহস্বামীর মত নিন এবং ব্যবহারের পর পেট্রোল অথবা ডিজেল যাই হোক না কেন ভরিয়ে দিন।

কারও গৃহে আশ্রয় নেওয়ার আগে থেকেই আপনার কী শেডিউল গৃহস্বামীকে জানিয়ে রাখুন।

কোথাও, কারও বাড়িতে থাকতে হলে পৌঁছোবার অনেক আগেই গৃহকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করুন এবং নিশ্চিত হোন যে সেই সময় ওই বাড়িতে গিয়ে পড়লে কারও অসুবিধা হবে কিনা। গৃহকর্তার সেই সময় কোনও কাজ নেই, আপনার জন্যই তার অখন্ড অবসর কাটছে এমন ধরে নেওয়াটা একবারেই যুক্তিযুক্ত নয় এবং খুব ইম্প্র্যাক্টিক্যাল চিন্তাভাবনা। না বলে নিজেদের ইচ্ছেমতো পৌঁছোলেই হাসিমুখে তারা আপনাকে আপ্যায়ন জানাবে, এই ধারণাটাই ভুল। আজকের ব্যস্ত জীবনশৈলীতে সকলেই নিজেদের কাজ নিয়ে ব্যস্ত।

যতদিন অন্যের বাড়িতে থাকবেন, আগে থেকে গৃহকর্তাকে আপনার প্ল্যান সম্পর্কে জানিয়ে রাখবেন। কবে কোথায় লাঞ্চ, ডিনার আছে, কোনদিন আপনি বাড়ির সকলের সঙ্গে বসে খাবেন না– সবকিছুই আগে থেকে জানিয়ে রাখলে তারাও সেইভাবে নিজেদের প্ল্যান মাফিক এগোতে পারবে।

অতিথি হিসেবে অপরের সমালোচনা করা ঠিক নয়। সবসময় মনে রাখবেন যেখানে আছেন সেটা আপনার নিজের বাড়ি নয়। এই বাড়ি অপরের সুতরাং এখানকার নিয়মকানুনও আলাদা। রান্না আপনার পছন্দের না-হলেও গৃহকর্ত্রীর হাতের রান্নার প্রশংসা করুন, তাঁর ঘর সাজাবার তারিফ করুন। কেউই নঞ্চর্থক উক্তি শোনা পছন্দ করেন না। অন্যের বাড়িতে কিছু অপছন্দের হলেও মানিয়ে চলার চেষ্টা করুন। যদি সহ্যের ক্ষমতার বাইরে কিছু ঘটে তাহলে মার্জিত ভাবে আপনার অসুবিধার কথা গৃহকর্তাকে জানান। জামাকাপড় ইস্তিরি করার দরকার পড়লে গৃহকত্রীর উপর দায়িত্ব না চাপিয়ে, নিজে সেই দায়িত্ব পালন করুন। নিজের কাজ নিজে করে নিন। কারণ অতিথি বাড়ি এলে গৃহকর্ত্রীর কাজ স্বাভাবিকের থেকে অনেক বেশি হয়ে যায়।

বাচ্চাদের শাসন করুন। সাধারণত কোথাও বেড়াতে গেলে বাচ্চারা কী করছে, মা-বাবা খেয়ালই করেন না। নিজেদের বাড়িতে হয়তো শাসনে বাচ্চাদের রাখলেও অন্য বাড়িতে গিয়ে লাগাম আলগা করে দেয় অনেক অভিভাবকই। অন্য বাড়িতে বাচ্চাদের আরও বেশি করে শাসন করা উচিত। কোনওরকম দুষ্টুমি বরদাস্ত করা উচিত নয়। অন্য বাড়িতে গিয়ে দেয়ালে লেখা, আঁকিবুকি করতে দেখলে শাসন করুন সন্তানকে। লক্ষ্য রাখুন গৃহকর্তার কোনও জিনিসে যেন বাচ্চারা হাত না দেয় এবং সেই বাড়ির বাচ্চাদের সঙ্গেও তারা যেন ঝগড়াঝাঁটি না-করে।

অন্যের অসুবিধা না করে নিজের ইচ্ছাকে দমন করুন। অতিথি কখন ঘুম থেকে উঠবে, কখন রাত্রে বাড়ি ফিরবে তার জন্যে অপেক্ষা করা খুবই বিরক্তিকর। আপনি হয়তো ছুটিতে বেড়াতে গেছেন কিন্তু যে-বাড়িতে গেস্ট হিসেবে রয়েছেন তাদের ছুটি নাও থাকতে পারে। সুতরাং দেরি করে শোয়া বা বেলা অবধি বিছানা আঁকড়ে পড়ে থাকা সমীচীন নয়। এক্ষেত্রে গৃহকর্তা ভেবে পাবেন না আপনি উঠে জলখাবার খাবেন নাকি দ্বিপ্রাহরিক খাবার খাবেন! বাড়ির নিয়ম মেনে চলুন। যদি বাড়ির সকলের তাড়াতাড়ি ঘুমোবার অভ্যাস থাকে তাহলে রাত্রে ঠিক সময়ে ডিনারের জন্যে বাড়ি ফিরুন।

সাহায্যের হাত বাড়ান। বাড়িতে অতিথি guest মানেই কাজের অতিরিক্ত বোঝা। যেখানে সম্ভব গৃহকর্তাকে সাহায্য করুন। নিজের কাজ নিজে করুন কারণ গৃহকর্তা অথবা সেই বাড়ির পরিচারক-পরিচারিকার পক্ষে শুধুমাত্র আপনার জন্যে সারাদিন বসে থাকা সম্ভব নয়। বসে থেকে লোককে অর্ডার করা অত্যন্ত অশালীন ব্যবহার বলে বিবেচিত হবে। অতিথি বলে নিজের ঘর নোংরা রাখবেন না। দিনের দিন নিজের হাতে ঘর পরিষ্কার রাখুন।

সকলের প্রশংসা করুন। গৃহকর্তা অনেক সময়েই নিজের সাধ্যের বাইরে গিয়ে অতিথি সেবায় মন দেন। অতিথির সেবা-যত্নে যাতে কোনও ত্রুটি না থাকে তার খেয়াল রাখেন। সুতরাং গৃহকর্তার চেষ্টা যে সফল, সেটা বোঝানোটা অতিথিরই উচিত। সুতরাং সেখানে থাকাকালীন আপনি অত্যন্ত আনন্দ পেয়েছেন সেটা বোঝানোর দায়িত্ব আপনার। তাই গৃহকর্তা এবং তাঁর বাড়ির সকলকে উপহার হিসেবে কিছু না কিছু দিন। বাড়িতে বাচ্চারা থাকলে চকোলেট, বই খুবই ভালো অপশন উপহার হিসেবে। এছাড়া পেন্টিং, ঘর সাজাবার জিনিস এসব কিছুও উপহার হিসেবে খুবই ভালো বিবেচিত হতে পারে।

বাড়িয়ে দাও তোমার হাত

কথায় বলে, ‘শুধু ভালোবাসায় চিঁড়ে ভেজে না’। তাই, পিতৃত্বের অহংকারকে সার্থক করতে হলে, সন্তান প্রতিপালনে মায়ের মতো বাবাকেও নিতে হবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। শিশু মাতৃগর্ভে থাকাকালীন এবং পৃথিবীর আলো দেখার পর, কীভাবে তার যত্ন নিতে হবে, তা এক শিক্ষণীয় বিষয়। আর এই জ্ঞান বা শিক্ষা যদি সঠিকভাবে শিশুর পিতার না থাকে, তাহলে কী করুণ পরস্থিতি হতে পারে, তা ‘শাদি কা সাইড এফেক্ট’ ছবিতে সার্থক ভাবে তুলে ধরা হয়েছে।

এখন পরিবার ছোটো হয়েছে কিন্তু স্বপ্ন বা ইচ্ছে বদলায়নি। সব দম্পতিই চান তাদের দাম্পত্যের অস্তিত্ব বা উত্তরাধিকারী। কিন্তু সন্তানের যত্ন নেওয়া এবং বড়ো করে তোলার গুরুদায়িত্বের কথা ভেবে অনেক মহিলাই দুর্ভাবনায় থাকেন। তাকে একা সমস্ত দায়িত্ব পালন করতে হবে, এই ভয়ে আজকাল মা হতে দেরি করেন অনেকে। আসলে, শুনতে অপ্রিয় হলেও সত্যিটা এই যে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সন্তানের যত্ন-আত্তির দায়িত্ব নিতে হয় মা-কেই, বাবা শুধু অর্থের জোগান দিয়ে কর্তব্য পালন করেন। তাই, বিয়ের বছর পাঁচের পর যদিওবা সন্তানলাভ হল, একা সমস্ত দায়িত্ব পালনের ঝামেলার কারণে, ‘এর থেকে আগের জীবনই ভালো ছিল’ এমন আক্ষেপও করতে দেখা গেছে অনেক মহিলাকে। আসলে আধুনিক জীবনশৈলীতে গ্রাম কিংবা শহর সর্বত্রই স্বামী এবং স্ত্রী দুজনেই কর্মজীবন নিয়ে ব্যস্ত। কাজেই, সন্তান প্রতিপালনের ক্ষেত্রে স্বামী যদি স্ত্রীর মতো সমানভাবে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে না দেন, তাহলে সংসারে অশান্তি বাধবেই এবং বাচ্চাও অবহেলিত হবে। অতএব, পিতৃত্বের অহংবোধ তখনই সার্থক হবে, যদি সন্তানের লালনপালনের অর্ধেক দায়িত্ব মাথায় তুলে নিতে পারেন। অবশ্য এরজন্য সঠিক পরিকল্পনা এবং তার বাস্তব রূপায়ণ করতে হবে।

বার্থ প্ল্যান

স্বামীকে প্রথমেই নিজের ‘মেল ইগো’ দূরে সরিয়ে রাখতে হবে। নতুন ‘অতিথি’কে আমন্ত্রণ জানানোর আগে, একা সিদ্ধান্ত না নিয়ে স্ত্রীকে শুভাকাঙক্ষী ভেবে আলোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। প্রথমেই গুরুত্ব দিতে হবে বয়সকে। খুব কম বয়সেও নয় এবং বেশি বয়সেও নয়, স্বামী-স্ত্রীর বয়স তিরিশের আশেপাশে হলেই বার্থ প্ল্যান বা ইস্যু প্ল্যান করা উচিত। দ্বিতীয়ত, স্বামী-স্ত্রীর মাসিক উপার্জনের বিষয়টিকেও গুরুত্ব দিতে হবে। কারণ, সন্তান হওয়ার আগে-পরে যে বিপুল অর্থের প্রয়োজন, সেই বিষয়ে যাতে কোনও সমস্যায় না পড়তে হয়, তারজন্য মাসে অন্তত তিরিশ হাজার টাকা পারিবারিক আয় থাকা বাঞ্ছনীয়।

বাজেট তৈরি করুন

বার্থ প্ল্যান বা ইস্যু প্ল্যান করার পরই তৈরি করতে হবে বাজেট।সংসারে তৃতীয় সদস্য আসার আগে স্বামী-স্ত্রী যেমন ইচ্ছে খরচ করলেও, ইস্যু প্ল্যান করার পর খরচ কমিয়ে সঞ্চয় বাড়াতে হবে। কারণ, আজকাল স্ত্রীর সন্তানধারণ করার পর থেকে সন্তান প্রসব করা পর্যন্তই শুধু খরচ করতে হয় এক থেকে দেড় লক্ষ টাকা। এরপর সন্তান প্রতিপালনের খরচ তো আছেই। অতএব, স্ত্রীর আয় থাকলেও, এই বিপুল পরিমাণ খরচের বেশিরভাগ অর্থ যোগান দিতে হয় সন্তানের পিতাকে। তাই, আদর্শ পিতা হওয়ার জন্য প্রথমেই দরকার আর্থিক প্রস্তুতি।

গুরুদায়িত্ব

নিজের সন্তানকে পৃথিবীর আলো দেখাবার জন্য গুরুদায়িত্ব নিতে হয় বাবাকে। স্ত্রীর গর্ভে সন্তান আসার খবর পাওয়ার পর থেকেই স্বামী হিসাবে এবং বাবা হিসাবে সর্বদা সতর্ক থেকে কর্তব্য পালন করতে হয়। স্ত্রীকে সবসময় আনন্দে রাখতে হয়, পুষ্টিকর খাবার খাওয়াতে হয়, স্ত্রী যাতে কোথাও পড়ে না যায়, সে ব্যাপারে সবসময় সতর্ক থাকতে হয়। এই সময় হালকা কাজ ছাড়া কোনওরকম ভারী কাজ করতে দেওয়া উচিত নয় স্ত্রীকে। রান্না করা, বাসন মাজা, বিছানা করা প্রভৃতি কাজগুলো হয় নিজে করুন, নয়তো বাড়িতে চব্বিশ ঘণ্টার কাজের মহিলা রেখে স্ত্রীকে বিশ্রাম নেওয়ার সুযোগ করে দিন। স্ত্রীর যদি সর্দি, কাশি, মাথা ধরা কিংবা পেট ব্যথার সমস্যা দেখা দেয়, তাহলে তা নিরাময়ের জন্য সাধারণ ওষুধ খেতে দেবেন না কিংবা খাওয়াবেন না। কারণ এই সময় স্ত্রীর রোগ নিরাময়ের জন্য যে-কোনও সাধারণ ওষুধ সেবনে গর্ভের ভ্রূণের উপর ক্ষতিকারক প্রভাব পড়তে পারে। তাই চিকিৎসকের পরামর্শ মতো ওষুধ খাওয়াতে হবে স্ত্রীকে।

স্ত্রীর গর্ভাবস্থায় শারীরিক মিলনের ক্ষেত্রে স্বামীকে সংযত থাকতে হবে। মনে রাখতে হবে, গর্ভাবস্থায় প্রথম তিন মাস এবং সাত মাসের পর শারীরিক মিলন একেবারে বন্ধ রাখতে হবে। খুব ইচ্ছে হলে শুধু মাঝের সময়টুকুতে হালকা সেক্স করতে পারেন, তাও নিয়ম মেনে এবং নির্দিষ্ট পশ্চারে। স্ত্রীর গর্ভাবস্থায় মেডিকেল চেক-আপ ভীষণ জরুরি। বাচ্চার পজিশন এবং হার্টবিট ঠিক আছে কিনা তা আল্ট্রাসোনোগ্রাফির মাধ্যমে চেক-আপ করাতে হবে। ডেলিভারির জন্য বাড়ির কাছের কোনও ভালো নার্সিংহোম কিংবা হাসপাতালে আগে থেকে সমস্ত ব্যবস্থা করে রাখতে হবে। যে-কোনও একজন গাইনিকোলজিস্ট-এর আন্ডার-এ রেখে স্ত্রীর চিকিৎসা করাতে হবে। অনেক মহিলা প্রসবকালীন যন্ত্রণার কথা ভেবে ভয়ে অস্থির থকেন। আপনার স্ত্রীরও যদি এমন পরিস্থিতি দেখেন, তাহলে আগে থেকে কাউন্সেলিং-এর মাধ্যমে ভয় কাটাতে হবে। আর এরপরও যদি ভয় না কাটে কিংবা স্ত্রীর যদি কোনওরকম হার্টের অসুখ থাকে তাহলে সিজারিয়ান ডেলিভারির সিদ্ধান্ত নিতে হবে। ডেলিভারির সময় এগিয়ে এলে নার্সিংহোম কিংবা হাসপাতালে সহজে নিয়ে যাওয়ার জন্য আগে থেকে কোনও গাড়ি কিংবা অ্যাম্বুলেন্স-এর ব্যবস্থা করে রাখতে হবে। ডেলিভারির আগের মুহূর্তে স্ত্রী যাতে অসহায়ত্ব অনুভব না করে, তারজন্য পাশে থেকে সাহস জোগাতে হবে। পুত্র কিংবা কন্যাসন্তান যেই আসুক, তাকে হাসিমুখে বরণ করে নিয়ে স্ত্রীর মাতৃত্বকে মর্যাদা দিতে হবে। এ প্রসঙ্গে জানিয়ে রাখি, শুধু প্রি-ডেলিভারি পর্বেই নয়, পোস্ট-ডেলিভারি পর্বকেও যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে দেখতে হবে। মা এবং বাচ্চার শারীরিক সুস্থতা, আহার এবং আরামের ব্যবস্থাও করতে হবে। রাতে বাচ্চাকে খাওয়ানো এবং ন্যাপি বদলানোর জন্য স্ত্রীকে যথাসম্ভব সাহায্য করতে হবে। এভাবেই প্রতি মুহূর্তে স্ত্রীর পাশে থেকে আন্তরিক সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়ে পিতৃত্বকে সার্থক করে তুলতে হবে।

পরামর্শ

  • শুধু জ্ঞানের বাণী নয়, স্ত্রী এবং সন্তানের সঠিক সেবাযত্ন করে ‘অভিভাবকত্ব’ শব্দটিকে মর্যাদা দিন
  • সন্তানের জন্ম দেওয়ার আগে পরে স্ত্রীকে কোনও ভারী কাজ করাবেন না
  • প্রেগন্যান্ট স্ত্রীকে কোনও ভয়ংকর দুর্ঘটনা কিংবা অস্বাভাবিক কিছুর গল্প শোনাবেন না কিংবা দেখাবেন না
  • প্রেগন্যান্ট স্ত্রীর সামনে ধূমপান করবেন না, এতে গর্ভস্ত সন্তানের ক্ষতি হবে
  • প্রেগন্যান্ট অবস্থায় কেউ-কেউ বেশি ইমোশনাল হয়ে পড়েন কিংবা মেজাজ খিট্খিটে হয়ে যায়। তাই স্ত্রীর এই বিষয়টিকে সহানুভূতির সঙ্গে দেখতে হবে এবং যতটা সম্ভব ভালো ব্যবহার করতে হবে
  • প্রি-ডেলিভারি এবং পোস্ট ডেলিভারির বাজেট করে অর্থ সঞ্চয় করুন। সন্তানের শিক্ষাখাতেও অর্থ বরাদ্দ রাখুন
  • নিজেকে আদর্শ স্বামী এবং সার্থক পিতা হিসাবে প্রমাণ করার জন্য সেবা ও ভালোবাসার হাত বাড়িয়ে দিন।

সম্পর্কে প্রাইভেসি কখন, কতটা?

এমন বহু দম্পতি রয়েছেন যাঁরা পরস্পরের ই-মেল, সোশাল মিডিয়া এমনকী, ফোনের পাসওয়ার্ডও পরস্পরের সঙ্গে শেয়ার করেন। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে সম্পর্ক যতই গভীর হোক না কেন, একটা সম্মানজনক Privacy কি থাকা উচিত?

মনোবিদদের মতে Privacy জরুরি একটি জিনিস।ব্যক্তিগত চিন্তাভাবনা এমনই একটি স্পর্শকাতর বিষয়,যা ভুল মানুষের সঙ্গে শেয়ার করলে জীবনে জটিলতা বাড়তে পারে।অনেকেই আবার মনে করেন স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কে কোনও গোপনীয়তা থাকা উচিত নয়। আদর্শ দাম্পত্য সম্পর্ক বলতে এরকমই একটা ছবি, অনেকের চোখের সামনে ভাসে।বিশ্বাসটাই যেখানে মূলধন, সেখানে কোনও আড়াল-আবডাল কেন থাকবে! আবার ভিন্ন মতটা হল, দুজন মানুষ যখন দেহে মনে পৃথক– তখন এটুকু প্রাইভেসি থাকবে না-ই বা কেন?

একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে অন্তত ৭০ শতাংশ স্বামী-স্ত্রী পরস্পরের পিন নাম্বার, পাসওয়ার্ড তো জানেনই, এমনকী তাঁরা ফিঙ্গারপ্রিন্টও অদলবদল করেন। স্বামীর ব্যাংক-এর এটিএম, ক্রেডিট কার্ড ডিটেইলস সবই স্ত্রীয়ের নখদর্পণে। উলটোটাও অনেক সময় ঘটে। সমীক্ষায় এও দেখা গেছে, এই পাসওয়ার্ড বা পিন জানিয়ে দেওয়া নিয়ে দম্পতিদের তেমন কোনও আপত্তিও নেই।

কিন্তু সমস্যা তৈরি হয় তখনই, যখন পারস্পরিক সম্পর্ক খারাপ হয়ে যায়।তখন একে অন্যের প্রাইভেসির অপব্যবহার করেন। সন্দেহের বশে পার্টনারের ফোন চেক করা কখনওই রুচিসম্মত নয়।আবার সম্পর্ক খারাপ বলেই স্বামীকে ধনেপ্রাণে শেষ করতে রাতারাতি তার ব্যাংক-এ জমা টাকা তুলে নেওয়াও কাজের কথা নয়।

স্বামী-স্ত্রী বা প্রেমিক-প্রেমিকার এই পাসওয়ার্ড শেয়ার করার বিষয়টি যদিও একান্ত ব্যক্তিগত চয়েস, তবু কোথাও যেন এর আড়ালে রয়েছে এক ধরনের দখলদারি মানসিকতা। নিজের একান্ত ব্যক্তিগত বিষয়গুলো অপর একজন মানুষের কাছে কতটা খুলে দেওয়া উচিত, তা অবশ্যই একবার ভেবে দেখা উচিত।

মনোবিদরা বলেন সম্পর্কের মধ্যে আস্থা থাকাটা যেমন একান্ত জরুরি, ততটাই জরুরি কিন্তু পরস্পরকে স্পেস দেওয়া।এই ব্যক্তিগত স্পেসটা নির্ধারণ করে দুজন মানুষ পরস্পরের প্রতি কতটা সম্মানসুচক মানসিকতা রাখেন।কিছুটা Privacy রাখলে প্রকারান্তরে সম্পর্কটাকেই সম্মান জানানো হয়।

বিশ্বাস গড়ে উঠতে বহু বছর সময় লাগে। সেই সময়টা দিতে হবে এবং তারপরেও সচেতন থাকা দরকার।নতুন সম্পর্কে পাসওয়ার্ড শেয়ার না করাই ভালো। সদ্য প্রেমে পড়ে থাকলে আবেগে ভেসে গিয়ে নিজের যাবতীয় গোপন তথ্য দিয়ে বসবেন না। কারণ এই সম্পর্ক কতদিন টিকবে আপনি  নিজেও জানেন না৷  কোনও কারণে সম্পর্ক ভেঙে গেলে আপনার পাসওয়ার্ডগুলোও কিন্তু বেহাত হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

এমনকী, লং টার্ম সম্পর্কেও পাসওয়ার্ড শেয়ার করা যায় কিনা, তা নির্ভর করে ওই দম্পতির পারস্পরিক রসায়নের উপর। দশ বছর একসঙ্গে থাকলেও সেই কেমিস্ট্রিটা না-ও থাকতে পারে৷ সে ক্ষেত্রে পাসওয়ার্ড শেয়ারের প্রশ্নই ওঠে না! সম্পর্কে সুস্হতা জরুরি। পাসওয়ার্ড নয়। ব্যাক্তিগত ডিটেইলস শেয়ার করলেই যে ঘনিষ্ঠতা বাড়বে, নাহলে নয়– এমন ভুল ধারণা মনে পুষে রাখবেন না।

পড়ার জন্য সীমাহীন গল্প-নিবন্ধসাবস্ক্রাইব