প্রতিদিন আমাদের সামাজিক কাঠামো বদলে যাচ্ছে। সমাজের মূল শিরদাঁড়া যৌথ পরিবারে ভাঙন ধরেছিল আগের থেকেই। এখন সেখানে ঢুকে পড়েছে নিউক্লিয়ার ফ্যামিলির কনসেপ্ট old age rehabilitation। আমাদের ভারতীয় সমাজ চিরকালই বৃদ্ধ বয়সকে শ্রদ্ধা এবং সম্মানের চোখে দেখেছে। বার্ধক্য বোঝা নয়, বরঞ্চ বার্ধক্য অভিজ্ঞতায় পরিপূর্ণ। কিন্তু তবু বৃদ্ধ বয়স সবসময়েই একটু নিবিড়তা, যত্ন, নিশ্চয়তা খোঁজে। অথচ নিউক্লিয়ার ফ্যামিলির ভাবনা ঢুকে পড়ার ফলে বার্ধক্য অবহেলিত হচ্ছে না কি?
কথা হচ্ছিল কলেজ স্ট্রিটের বহু পুরোনো বাসিন্দা অমর ভট্টাচার্য-র সঙ্গে। কলেজ স্ট্রিটের পৈত্রিক বাড়ি ছেড়ে বিপত্নীক অমর বর্তমানে ছেলের কাছে বেঙ্গালুরু থাকেন। তিনি বললেন, বেঙ্গালুরু আমার একেবারেই ভালোলাগে না। সময় কাটতে চায় না। ছেলে-বউমা হয়তো আমার কোনও অযত্ন করে না, তবু ওই জায়গাটায় আমি কেমন নিঃসঙ্গ বোধ করি। বন্ধুবান্ধবরা সব এখানে। ওখানে আমার দম বন্ধ হয়ে আসে। জীবনে বাঁচতে গেলে তো একটা কিছু করা দরকার। কিন্তু ওখানকার পরিস্থিতিতে নতুন করে এই বুড়ো বয়সে কী করব ভেবে পাই না। এদিকে ছেলে নাছোড়বান্দা। এখানে একা থাকতে দেবে না।’
একই সমস্যা যাদবপুরের রমলা ঘোষ-এর। তিনি জানালেন, ‘স্বামী মারা যেতে আমি একমাত্র মেয়ের কাছে মুম্বইতে থাকি। মেয়ে-জামাই খুব ভালো। তবু আমার মন বসে না। বিশেষ করে ওরা দুজনেই মাঝে মাঝে চাকরিসূত্রে বিদেশে যায়। সেই সময়গুলো আমার অসহ্য লাগতে থাকে। এদিকে আমি না জানি মারাঠি ভাষা, না বলতে পারি হিন্দি বা ইংরেজি। যাদবপুরের জন্য মনটা সবসময় ছটফট করে।’
এই ধরনের সমস্যার ক্ষেত্রে বার্ধক্য হয়তো সেভাবে অবহেলিত হচ্ছে না। কিন্তু শেষ বয়সে এসে নিজের অপছন্দের জীবন কাটানোর মধ্যে একধরনের অপারগতা কাজ করছে। জীবনজ্যোতি সরকার এবং মঞ্জুলা সরকার ছেলের বাড়িতে থাকছেন মাস তিনেক হল। কলকাতা ছেড়ে ওনাদের নতুন ঠিকানা এখন চেন্নাই। মুশকিল হল ওনারাও ভাষা নিয়ে সমস্যায় পড়েছেন। তাছাড়া এখানকার সামাজিক লাইফস্টাইল একেবারেই কলকাতার মতো নয়। তার উপর সবসময় নিজেদের ছোটোখাটো চাহিদার কথা ব্যস্ত ছেলেকে বলতেও ইচ্ছে করে না। জীবনবাবু জানালেন, ‘সপ্তাহখানেক আগে আমার স্ত্রী একটু অসুস্থ হয়ে পড়ে। ছেলে তখন অফিসের মিটিং-এ, মোবাইল সুইচ অফ। আমি পড়লাম মুশকিলে। কীভাবে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাব, কার থেকে সাহায্য পাব কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলাম না।’
হঠাৎ করে এভাবে নিজেদের শিকড় উপড়ে ফেলতে বাধ্য হওয়া এখন জীবনবাবু বা অমরবাবুর মতো অনেকের ক্ষেত্রেই খুব বড়ো সমস্যার কারণ। সবসময় একটা সংকোচ নিয়ে বেঁচে থাকা, এই বুঝি ছেলে-মেয়েরা বিরক্ত হল। ছোটো ছোটো চাহিদার জন্যও ছেলে-মেয়েদের ‘উপর নির্ভর করে থাকা অবশ্যই কষ্টকর। আর আজকের এই দুরন্ত জীবনে কেরিয়ার সামলাতে ব্যস্ত হয়ে পড়া সন্তানরাই বা আর কত দিক সামলাবে! তারা সাধ্যমতো চেষ্টা করলেও কিছুতেই কাউকে খুশি করতে পারে না। ফলে তৈরি হয় ব্যবধান এবং দু-পক্ষের মধ্যে অভিমানের সম্পর্ক। কখনও কখনও এই অভিমানকে অতিক্রম করা কষ্টসাধ্য হয়ে ওঠে।
সন্তানদের সমস্যা
সন্তানরা কেরিয়ার, সংসার এবং সোশ্যাল লাইফ সামলাতে হিমসিম খেয়ে যায়। অফিসে টার্গেট ফুলফিল করার চাপ, বাড়িতে দায়িত্ব পালনের প্রেশার। এত অত্যধিক স্ট্রেস নিতে গিয়ে মানসিক ও শারীরিক বিভিন্ন সমস্যার শিকার হয়ে পড়ছে তারা। সমস্যা সামলাতে নতুন ভাবনার আলো ঢুকে পড়েছে। কলকাতার এক অভিজাত পাড়ায় পাশাপাশি বেশ কয়েকটি বাড়ির আজকের প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা সকলেই চাকরি অথবা বিবাহসূত্রে বিদেশে থাকে। ব্যাগ গুছিয়ে সন্তানদের সঙ্গে থাকতে যাননি তাদের মা-বাবারা। ফলে সন্তানরা পড়েছে বিপদে। একদিকে মা-বাবার প্রতি দায়িত্ববোধ অন্যদিকে কেরিয়ার। এই টানাপোড়েনে তৈরি হচ্ছিল সমস্যা old age rehabilitation। কিন্তু সমস্যার সমাধানও বের করে ফেলেন এরা নিজেরাই। বৃদ্ধ-বয়স্ক মা-বাবাদের নিয়ে তৈরি করে ফেলেন একটা ছোটো ক্লাব। ফলে একাকিত্ব এবং অন্যান্য দৈনন্দিন সমস্যার হাত থেকে রেহাই মেলা অনেকটা সহজ হয়ে ওঠে। ইলেকট্রিক বিল, ফোন বিল, বাজার, রান্না ইত্যাদির ক্ষেত্রেও ক্লাবের তরফ থেকে লোক ঠিক করা হয়। এমনকী রুটিনমাফিক ডাক্তারি চেক-আপ করানোর জন্য লোকের ব্যবস্থা করা হয়। ছেলে-মেয়েরাও পরিবারের সঙ্গে ফোন বা আধুনিক যোগাযোগ ব্যবস্থা যেমন ইন্টারনেট ইত্যাদির মাধ্যমে সবসময় সংযুক্ত থাকে। এইভাবে প্রতিবেশী বাবা-মায়েরা নিজেরাই নিজেদের বন্ধু হয়ে উঠে, একা থাকার ঝঞ্ঝাট, নিজের পুরোনো বাসস্থান ছেড়ে অন্য কোথাও থাকার সমস্যা ইত্যাদিকে দূরে সরিয়ে দিয়েছেন। দেখুন না, এমন সমাধান আপনার পাড়ার ক্ষেত্রেও সম্ভব কিনা!
সন্তানের কাছে থাকতে যাওয়ার আগে
বৃদ্ধ বাবা-মা, সন্তানের কাছে পাকাপাকি ভাবে থাকতে যাওয়ার আগে নিজেদের অবস্থা যাচাই করে নিন।
১) ভালো করে ভেবে নিন নিজেদের পরিস্থিতি এবং পারিপার্শ্বিক অবস্থা। আপনি কোন লোকালিটিতে থাকেন, আপনার প্রতিবেশী, দোকান-পাট, ডাক্তার ইত্যাদি অন্যান্য আবশ্যিক সুবিধাগুলির যোগান চট করে পেতে পারেন কিনা তাও বুঝে নিন। যদি দেখেন, একা জীবন কাটানোর মতো সাহস এবং উপায় আপনার কাছে আছে, তবে পুরোনো বাসস্থান বদল না করাই ভালো।
২) সন্তানের উপরে অত্যধিক নির্ভরশীল না হওয়াই ভালো। ওদের উপরে অযথা প্রত্যাশার বোঝা চাপিয়ে দেবেন না।
৩) নিজের সমাজিক জীবনকে আরও একটু বদলে ফেলুন। যোগ দিন পাড়ার ক্লাবে বা কোনও সোশ্যাল অরগানাইজেশনে।
৪) বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে আড্ডা মারুন। একা লাগছে? কুছ পরোয়া নেহি, ইন্টারনেট আর কম্পিউটারের দৌলতে পৃথিবী এখন হাতের মুঠোয়। সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং-এর মাধ্যমে সামাজিক সম্পর্ক স্থাপনে অংশ নিন, বৃহত্তর সমাজের অংশ করে তুলুন নিজেকে।
৫) সন্তানের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখুন। আপনার সমস্যাগুলি সম্বন্ধে সে যেন ওয়াকিবহাল থাকে।
সন্তানরাই বা কী করবেন
১) বাবা-মায়ের সুখ-সুবিধার দিকে নজর রাখুন। বৃদ্ধ বয়সে বাড়িঘর ছেড়ে আপনার কাছে গিয়ে থাকতে ওদের বাধ্য না করাই ভালো। এতে সমস্যা বাড়বে।
২) ওঁদের প্রয়োজন কীভাবে মেটানো যায়, সে সম্পর্কে ব্যবস্থা নিন।
৩) নিজেদের কাজ, তার গুরুত্ব, সামাজিক জীবন ইত্যাদি নিয়ে খোলাখুলি ওঁদের সঙ্গে আলোচনা করুন।
৪) সময় পেলেই ওঁদের সঙ্গে ছুটি কাটাতে চেষ্টা করুন। ওঁরা যে আপনার জীবনে কতটা গুরুত্বপূর্ণ, তা বুঝিয়ে বলুন।
৫) একান্তই যদি নতুন শহরে, ছেলে-মেয়ের সঙ্গে গিয়ে থাকা ছাড়া আর কোনও উপায় না থাকে, তবে চেষ্টা করুন সম্পর্কের উষ্ণতা এবং উদারতা যেন বজায় থাকে। অফিসের কাজ গুছিয়ে নিয়েও বাবা-মায়ের সঙ্গে কোয়ালিটি সময় কাটানো খুব জরুরি। নতুন জায়গায় খাপ খাইয়ে নিতে বাবা-মায়েদের কিছু সময় অবশ্যই দিন। জীবনধারণের আধুনিক উপায়গুলি ওদের শিখিয়ে দিন। সন্তানদের জীবনের সঙ্গে বাবা-মায়েদের জীবন যেন একাত্ম হয়ে থাকে। একইসঙ্গে এই একাত্মতার মধ্যে ইন্ডিভিজুয়ালিটি বজায় রাখুন। এতে সম্পর্ক ভালো থাকবে।