তফাত শুধু চোখে

জানলার বাইরে একটা দোয়েল শিস দিচ্ছে অনবরত। সেটা কানে আসতেই ভেঙে গেল ঘুমটা। মোবাইলে টাইম দেখে লাফিয়ে উঠলাম। সাড়ে ন’টা বেজে গিয়েছে! দশটা থেকে আমার মিটিং!

মাস চারেক হল কলকাতা শহরে এসেছি একটা মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানিতে চাকরি নিয়ে আদতে উত্তরবঙ্গের বাসিন্দা। দক্ষিণ কলকাতার এক এলিট পাড়ায়, কোম্পানি থেকে দেওয়া হয়েছে দু’কামরার ফ্ল্যাট। সারাদিন কাজের চাপ থাকে বিস্তর। সকালে নাকে-মুখে গুঁজে বেরিয়ে যাই, ফিরি রাতে। প্রতিবেশীদের সম্পর্কে কোনও ধারণা নেই আমার। চিনিও না সেভাবে কাউকে। শুধু আবাসনের সেক্রেটারির সঙ্গে পরিচয় আছে একটু-আধটু।

গত তিনদিন যাবৎ সম্পূর্ণ ঘরবন্দি। প্যান্ডেমিকের ভয়ে সারা দেশে চলছে লকডাউন। অফিসেরও ঝাঁপ বন্ধ। শুরু হয়েছে ওয়ার্ক ফ্রম হোম। একটু পরেই গুগল-এ মিট করতে হবে এক জাঁদরেল ক্লায়েন্টকে। ঝটপট ফ্রেশ হয়ে রাতের ট্র্যাক প্যান্টের উপরেই পরে ফেললাম একটা আয়রন করা শার্ট। গলায় ঝোলালাম টাই। কফি মাগ হাতে নিয়ে অন করলাম ল্যাপটপ।

পাক্কা এক ঘণ্টা চলল মিটিং। আপাতত কিছুক্ষণ বিরতি, তারপর আবার বসতে হবে কাজ নিয়ে ঘরদোর সাফ-সুতরো করতে হবে এরই মাঝে। ব্যবস্থা করতে হবে খাবারেরও। একজন মাঝবয়সি মহিলা এসে সকালে ঝাড়পোঁছ, রান্না এসব করে দিয়ে যেতেন। কিন্তু কোভিডের কল্যাণে তাঁর আসা বন্ধ। অগত্যা সব কাজ সামলাতে হবে আমাকেই। মা-বাবা অনেক করে বলেছিল বাড়ি ফিরে যেতে। কিন্তু আমিই যাইনি ইচ্ছে করে। ভেবেছিলাম কয়েকটা দিন একাকিত্বের স্বাদ নেব। নিজের সঙ্গে সময় কাটাব কিছুটা।

ঘর থেকে বেরিয়ে এসে দাঁড়ালাম ব্যালকনিতে। আমাদের বিল্ডিং-এর উলটো দিকেই আছে একটা দোতলা বাড়ি। ছাদের উপর সারি সারি টব সাজানো। ফুটে আছে রং-বেরঙের ফুল। হাতে একটা খুরপি জাতীয় কিছু নিয়ে একটা মেয়ে টবে মাটি দিচ্ছে। চুপচাপ দাঁড়িয়ে দেখছিলাম আমি। মেয়েটা একমনে তার কাজ করছে। হ্যাংলার মতো দাঁড়িয়ে আছি ভেবে বিরক্ত লাগল নিজেরই। ঢুকে গেলাম ঘরে। ভাণ্ডারে খাবার বাড়ন্ত। অতএব ছুটতে হল পাড়ার মুদিখানায়। ভাগ্যিস সেটা খোলা ছিল।

(২)

–দাদা যা দরকার বেশি করে নিয়ে যান। এই লকডাউন এত সহজে উঠবে না মনে হয়।

–হুম, তাই তো দেখছি।

–সব মাল প্রায় শেষের পথে। গণপতির দিব্যি দাদা এই ক’দিন যা ব্যাবসা করেছি, সারা জিন্দেগিতে তা করিনি। পাবলিক এমন করছিল যেন করানো ভাইরাস গলির মোড়ে দাঁড়িয়ে আছে, এখুনি এসে অ্যাটাক করবে। যে যত পারো জিনিস কিনে দৌড় লাগাও ঘরে। কথাটা বলেই একটা ফিচেল হাসি হাসল দোকানদার শ্যামাচরণ।

তার দোকানের পাশেই ফাঁকা জায়গায় কিছু আনাজপাতি আর মুরগির ডিম-মাংস নিয়ে বসেছে আরও দু’জন। মোটামুটি হপ্তাখানেকের রসদ কিনে, একটা সিগারেট ধরিয়ে গল্প শুনছিলাম শ্যামাচরণের। রাস্তাঘাট ফাঁকা। সিগারেটে লম্বা টান দিতেই নজরে এল মেয়েটা। একটু আগে ছাদের উপর দেখেছিলাম যাকে। শ্যামাচরণের দোকানের দিকেই এগিয়ে আসছে।

একটা ব্যাগ আর লিস্ট শ্যামাচরণের হাতে ধরিয়ে সে দাঁড়িয়ে রইল আমার পাশে। আমি আড় চোখে দেখছিলাম তাকে। গায়ে রং বেশ চাপা। পিঠ পর্যন্ত ছড়িয়ে আছে কোঁকড়ানো চুল। নাক মুখ ঢাকা পড়েছে মাস্ক-এ। সেও তাকাল আমার দিকে। কী অসম্ভব গভীর দুটো চোখ! কালো কুচকুচে মণি, বড়ো বড়ো আঁখিপল্লব! কালো হরিণ-চোখ বোধহয় একেই বলে। জিনিসগুলো নিয়ে চলে গেল সে। আমিও আধপোড়া সিগারেটটা ফেলে, পা বাড়ালাম বাড়ির দিকে।

সারাদিন কাজের ফাঁকে বহুবার মনে পড়েছে মেয়েটার কথা, তার দুটো গভীর কালো চোখের কথা। আমার আঠাশ বছরের জীবনে বহু মেয়েকে দেখেছি আমি। দু’একজনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ভাবে মিশিনি যে, তাও নয়। কিন্তু কোনও মেয়ের চোখে এতখানি গভীরতা কখনও দেখিনি আমি।

বেশ কদিন কেটে গেল লকডাউন-এর। একা থাকার যন্ত্রণাটা এখন টের পাচ্ছি ভালো রকম। ঘরের কাজ, অফিসের ভিডিও চ্যাট, অ্যাসাইনমেন্ট একসঙ্গে সামলাতে নাভিশ্বাস উঠেছে প্রায়। দুপুরে একটা ওয়েবসিরিজ দেখতে দেখতে তন্দ্রা মতো এসেছিল। হঠাৎ শুনলাম কলিং বেলের শব্দ। একটু অবাক হলাম, এই সময় আবার কে এল? দরজাটা খুলেই থতমত খেয়ে গেলাম একদম! সামনে দাঁড়িয়ে আছে সেই মেয়েটা, যাকে প্রায়ই দেখি উলটোদিকের বাড়ির ছাদে। যার রহস্যময় দু’টো চোখ বুকে জ্বালা ধরিয়েছে আমার। পরনে একটা শ্যাওলা সবুজ লং ফ্রক। সেই চাপা রং, কোঁকড়ানো চুল। আজও মুখের বেশির ভাগ অংশ ঢেকে আছে মাস্ক-এ। শুধু দেখা যাচ্ছে চোখ দুটো।

একটু থমকালাম আমি। নাহ্, চোখ দুটো তো অতটা কালো নয়, সেদিন যতটা মনে হয়েছিল! গভীরও নয় তেমন। একটু খয়েরি আভা আছে। খেলে বেড়াচ্ছে চপলতা। তবে কি আমারই দেখার ভুল? আমাকে ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে থাকতে দেখে সে বলল, কী দেখছেন অমন হাঁ করে? জীবনে কখনও মেয়ে দেখেননি?

এমন মন্তব্য শুনে বিব্রত হলাম আমি। সঙ্গে থাকা দু’জন মহিলাও হাসলেন মুখ টিপে। মেয়েটা প্রায় সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠল, আমরা নব দিগন্ত এনজিও থেকে আসছি। লকডাউন-এ বিপদে পড়া দুঃস্থ মানুষদের হাতে খাবার, ওষুধ তুলে দিচ্ছি আমরা। আপনার কাছে এসেছিলাম কিছু সাহায্যের আশায়। আমাদের ক্ষমতা সীমিত। আপনারা সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলে, আরও বেশি সংখ্যক মানুষের কাছে পৌঁছোতে পারব।

অলরেডি ইমেজে গ্যামাক্সিন পড়েছে। সেটা যাতে আর না ছড়ায় তাই একটা কড়কড়ে পাঁচশো টাকার নোট এনে তুলে দিলাম তার হাতে। সে টাকা নিয়ে চলে গেল হাসি মুখে কিন্তু আমার মনের খচখচানিটা রয়ে গেল রাতভর।

আজকাল ব্যালকনিতে দাঁড়াতেও সংকোচ হয়। কী জানি যদি সে মনে করে তাকে দেখার জন্যেই দাঁড়িয়ে থাকি ওখানে। তারও পর আবার আছে চোখের রহস্য! এতটা ভুল কীভাবে দেখলাম আমি?

ক’দিন পর এক রবিবারের বিকেলে শ্যামাচরণের দোকান থেকে টুকটাক জিনিস নিয়ে ফিরছি, এমন সময় শুনি একটা মেয়ের কণ্ঠ, এই যে শুনছেন? একটু আসবেন এদিকে? পেছন ফিরে দেখি সেই মেয়েটা। আজ মুখে মাস্ক নেই, তাই তার ঈষৎ টিকালো নাক, পুরু ঠোঁট আমার নজর এড়াল না।

অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, আমাকে ডাকছেন?

চেহারায় অবাঙালি ছাপ থাকলেও স্পষ্ট বাংলায় উত্তর দিল সে, হ্যাঁ, আপনাকে। আমার নাম জুলি। সেদিন যে-ডোনেশন দিয়েছিলেন তার রসিদটা আপনাকে দেওয়া হয়নি। যদি একটু আসেন, তাহলে দিয়ে দেব।

রসিদের কোনও প্রয়োজন ছিল না। নিছক কৌতূহলের বশে এগিয়ে গেলাম। বাড়ির সামনের ছোট্ট সবুজ লনে বেতের চেয়ারে বসে আছেন একজন বয়োজ্যেষ্ঠ ভদ্রলোক। হাতে বিদেশি জার্নাল।

মিঃ রঙ্গনাথন, অবসরপ্রাপ্ত সরকারি আমলা। আমার উত্তরবঙ্গে বাড়ি শুনে হাসিমুখে বললেন, তোমার মতো আমিও পরিযায়ী। জন্ম কেরলের কোদিনহি গ্রামে। চাকরিসূত্রে এসেছিলাম কলকাতায়, থেকে গেলাম পাকাপাকি।

কোদিনহি নামটা কোথায় যেন শুনেছি, বেশ চেনা চেনা লাগছে। আমি আর জুলি বসেছিলাম মুখোমুখি। চা পানের অনুরোধ ফেলতে না পেরে গল্প শুনছিলাম রঙ্গনাথনের। কথার মাঝে চায়ের ট্রে হাতে আমার সামনে এসে দাঁড়াল একজন। তাকে দেখেই আমার চক্ষু একেবারে চড়কগাছ!

রঙ্গনাথন প্রসন্নমুখে বললেন, জুলিকে তো তুমি চেনো! এ আমার আর এক মেয়ে মিলি।

ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের পেটের ভেতরে যেভাবে ঢুকে গিয়েছিল হাইজ্যাক করা এরোপ্লেন, ঠিক সেভাবেই কী একটা যেন ঢুকল আমার ভেতরেও। কেঁপে গেলাম আপাদমস্তক। ইয়েস! মনে পড়েছে, কেরালার কোদিনহি গ্রাম, খবরের কাগজে পড়েছিলাম, কোনও এক অজানা কারণে পৃথিবীর মধ্যে সব থেকে বেশি যমজ সন্তানের জন্ম দেয় ওই গ্রামের মানুষ।

আকাশ ছেয়ে গিয়েছে কালো মেঘে। শুরু হয়েছে এলোমেলো হাওয়া। আমি একবার মিলিকে দেখছি, একবার জুলিকে। হুবহু এক চেহারা। তফাত শুধু চোখে।

ভালোবাসার আগে না বলব না

ঘুড়ি উড়ছে। আকাশ ছেয়ে আছে ঘুড়িতে। লাল, নীল, হলুদ, সবুজ নানা রং-এর, নানা মাপের, নানা নামের, পেটকাটি, চাঁদিয়াল, বগ্গা, ভোকাট্টা, হাতে হাতে… কেউ নেবে?

মেরে না নাক ফাটিয়ে দেব। ছাড় বলছি।

সুতো যার, ঘুড়ি তার। সুতো আমি ধরেছি, ঘুড়ি তাই আমার…

না না, আমার ঘুড়ি। আমি আগে ধরেছি…

এইসব চিৎকার, সঙ্গে বিশ্বকর্মা পুজোর মাইকে হিন্দি গান ঊনিশে পা দেওয়া বিল্টুর মনেও দোল দিয়ে যায়। সময়টা বিকেলের দিকে, সূর্য অস্ত যেতে আরও খানিক্ষণ।

বিল্টু ঘুড়ি ওড়ায় না। কিন্তু ওড়ানোর নেশ তাকে টানে। ওই যে একটা ঘুড়ি কেটে সুতো এলিয়ে পড়ছে, তার পিছনে অনেক ছেলে ছুটছে। অনেক দিন আগের এই দৃশ্য বিল্টুর অন্ধকার চোখকে আরও ঘোলাটে করে, অন্ধকার আরও অন্ধকার। পুরোনো পরিত্যক্ত বাড়িটার একটা ঘরে হিস্ হিস্ শব্দ। ভুলও হতে পারে! তবু ভয়, সেঁটে থাকা এক কোণে।

ওরা আসছে, উন্মত্ত জনতা, পল্টুদার লোকজন, পল্টুদার কথায় ওঠে বসে। ওরা চাইলে বিল্টুকে খুনও করতে পারে। বিল্টু একা, ভীষণ একা। ওর দোষ রাত্রির ঘন-কৃষ্ণ চুলে, নদীর গতিপথ খুঁজে পেয়েছিল। ওই যে ওখানে, ধর শুযোরের বাচ্চাকে! পাড়ার মেয়ের ইজ্জত… ওদের হাতে ভোজালি। পল্টুদার হতে থ্রি নট থ্রি।

আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নামছে। সে দিন নামেনি বড়ো ভ্যাপসা গরম ছিল। একটু বৃষ্টি, বৃষ্টির জলে ধুয়ে যাচ্ছে রাস্তা, ঘরবাড়ি। প্রিটোরিয়া স্ট্রিটের বাড়িগুলো কেমন করে যেন বদলে গেছে এক বছরে। বিশাল ফ্ল্যাট, দোকান৷ এইখানে লতিফের বাড়ি ছিল। বিল্টুর বন্ধু, ডান গালে একটা তিল, ৫ ফুট লম্বা। কঞ্চির মতো বাঁকা লতিফরা কোথায়, জানতে খুব কৌতূহল হয়। এক টানা লম্বা দৌড়, এখনও ভোর হয়নি। বিল্টুকে আর দেখা যাচ্ছে না, দৌড়… দৌড়…

আর একটু পায়ে দিই তোকে। তুই তো কিছুই খেলি না। রাত্রির সাথে কী করে বিয়ে দিই বলত তোর! রাত্রির মায়ে এই কথায় বিল্টু লজ্জা পায়। রাত্রির দিকে তাকায়। রাত্রি হাসে, কী নির্লজ্জ! রাত্রির জন্মদিনে সেটা ছিল নিছকই ঠাট্টা, মজা।

মা মারা গেল, বিল্টুর মা। বাবা গেছে অনেক ছোটো বয়সে। বাবার পেনশনের টাকায় সংসার চলে কোনও ভাবে। দারিদ্র, চরম দারিদ্র, কোনও রকমে নিজের পেট চালিয়ে নেওয়া। টাইফয়েড হল। সারা রাত বসে মাথার কাছে, মাথায় জলপট্টি, ওষুধ খাওয়ানো- রাত্রি ক্রমশ সুন্দর হয়ে ওঠে।

অন্ধকারও এত সুন্দর হয়! কী করে বিল্টু? কীভাবে রাত্রির যোগ্য করে তুলবে নিজেকে? ভালো রেজাল্ট করল, কলেজে ভর্তি হল। কলেজ ভালো লাগে না। সমস্ত মন জুড়ে রাত্রি। হা ঈশ্বর, তুমি কী নিষ্ঠুর! হিংস্র পশুর দল ঘুরে বেড়াচ্ছে, ওদের উত্তপ্ত নিঃশ্বাসে এই পৃথিবীর বাতাস দূষিত হচ্ছে। রাজনৈতিক আশ্রয়ে পোষিত এই জন্তুর দলই এখন সব। এদের হাতেই আজকের সমাজ, সংস্কৃতি, গণতন্ত্র– রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে এই কথাগুলোই বলছিল বিল্টু।

আসলে এত কথা বলতে চায়নি সে। কিন্তু ভিতর থেকে কথাগুলো বেরিয়ে এল। রাজনীতিতে যোগ দেবার পর এটাই বিল্টুর প্রথম ভাষণ। অনেক হাতাহাতি, দূরে পর্দা, চোখের চাহনিতে বিষ। পার্কে ওরা দুজন, সন্ধের অন্ধকার। চারিদিক থেকে ঘিরে ধরেছে পল্টুদার সাকরেদরা।

রাত্রিকে তুলে নিল ওরা, টেনে হিঁচড়ে নিয়ে গেল। বিল্টুকে মেরে ফাটিয়ে দিল। কী করবে বিল্টু একা? ওরা অনেক। তাও বুকে ভর দিয়ে একটা আধলা ইট কুড়িয়ে নিল। লক্ষ করে ছুড়লও। একজন লুটিয়ে পড়ল। রাত্রিকে ছেড়ে দলটা বিল্টুর দিকে তেড়ে এল।

ছোটো কাকার এক গুরুমা ছিলেন। সন্ন্যাসিনী মাথায় দীর্ঘ জটা, গেরুয়া শাড়ি, গলায় রুদ্রাক্ষের মালা, হাতের ত্রিশূলটি লাল সিঁদুরে লেপা, দেখলেই কেমন যেন ভয় ভয় হয়! তক্তাপোষের উপর উপবিষ্ট গেরুয়া বসনধারী গুরুমা, হাতের ত্রিশূলটি দেয়ালে হেলান দিয়ে রাখা। বিল্টু একবার গুরুমাকে দেখে, একবার ত্রিশূল। গুরুমার দৃষ্টি এড়ায় না, কাছে ডাকল বিল্টুকে। মাথায় হাত দিয়ে বললেন, ভয় কি তুইও যা আমিও তাই। সাহস রাখ মনে, তুই পারবি ঠিক পারবি।

বিল্টু খেয়াল করল কথাগুলো যেন গুরুমাকে দিয়ে কেউ বলাচ্ছেন। বিল্টু এ কথার কোনও মানে বুঝতে পারল না। শুধু জিজ্ঞাসু চোখে তাকিয়ে রইল গুরুমার দিকে।

 

ছয় সাত বছরের একটি ছেলেকে ডাকলেন সন্ন্যাসী। তার হাতে একটি মিষ্টি দিলেন, অথচ ছেলেটি নিতে চাইল না। তার মা ইশারায় নিতে নির্দেশ দিতে সন্ন্যাসী মায়ের দিকে চাইলেন, প্রশান্ত দৃষ্টি, তারপর চোখ বন্ধ হল, ধ্যানমগ্ন হলেন সন্ন্যাসী। ঘরে ধূপ, ধুনো জ্বলছে, আধ্যাত্মিক পরিবেশ। সারা ঘরে ভর্তি পাড়া-প্রতিবেশী, আত্মীয়স্বজন অধিকাংশই নিমন্ত্রিত। সবার চেষ্টা সন্ন্যাসীর কৃপা পাওয়া! প্রসাদের ব্যবস্থা করে রাখা হয়েছে, ছাদের এক কোণে। প্যান্ডেল করে রান্না হচ্ছে। এক কথায় এলাহি আয়োজন। শুধু মজুমদারমশাই অনুপস্থিত৷ ব্যস্ত মানুষ তাঁর কী বসে থাকা চলে? অন্তত চারটে জায়গায় প্রোজেক্টের কাজ চলছে। ম্যানেজার আছে, সব তো আর ম্যানেজারকে দিয়ে হয় না, নিজেকে উপস্থিত থাকতে হয়। এছাড়া প্রোমোটিং ব্যাবসায় ছেলেদের থুড়ি, বখাটে ছেলেদের উৎপাত আছে। সেখানে মজুমদারমশাইয়ে উপস্থিতিই শেষ কথা।

সন্ন্যাসীর সৌম্য দর্শন, সারা মুখে প্রশান্তি, দাড়িতে আচ্ছাদিত। প্রথম দর্শনেই চোখ জুড়িয়ে আসে। গৃহকর্তার অনুরোধে তিনদিন থাকতে রাজি হয়েছেন সন্ন্যাসী। একটি ঘরে তাঁর থাকার ব্যবস্থা। সন্ধের পর সবাই চলে গেছে, শুধু সন্ন্যাসীর ঘরে আলো জ্বলছে। তিনি জেগে পদ্মাসনে উপবিষ্ট। ঘরে কেউ প্রবেশ করল, অথচ সন্ন্যাসীর কোনও ভ্রুক্ষেপ নেই। কেউ এসে তাঁর সামনে দাঁড়াল। সন্ন্যাসী চোখ খুললেন, মুখে স্মিত হাসি, কে তুমি?

আমাকে ফাঁকি দেওয়া অত সহজ নয়, তুমি বিল্টুদা! কেন পালিয়ে বেড়াচ্ছ?

গৃহকর্ত্রীর চোখে জল, ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। একবার পিছনে দেখলেন সন্ন্যাসীর দুই চোখ মুদিত, যেন কিছুই ঘটেনি। খুব ভোরে ঘুম ভাঙল সন্ন্যাসীর। না ঘুম হয়নি, শুধু চোখ বুজে থাকা। জানলার কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন। বাইরে এখন অন্ধকার, সূর্যের আলো ফোটেনি। ভোরের মিষ্টি হাওয়ায় সন্ন্যাসীর চুল অবিন্যস্ত।

ঘরে আর একজনের উপস্থিতি টের পেলেন। একটুও না ঘুরে সন্ন্যাসী বলে চলেন,

-আমাকে চিনে ফেলার পর আর আমার থাকা চলে না রাত্রি, আমি চলে যাই। সন্ন্যাসী হবার পর সব খবরই তোমার রেখেছিলাম, বিশ্বাস করো রাত্রি। তোমাকে দেখার বাসনা আমার হয়েছিল কিন্তু আমাদের তা হতে নেই। এই পৃথিবীর সবটাই পূর্ব নির্দিষ্ট। ঘটনাগুলো ঘটবেই। আমি যাই রাত্রি। এই কাগজটা রাখো। তোমার জন্যই রেখেছিলাম, দেওয়া হয়নি। এত বছর সঙ্গে নিয়ে ঘুরেছি, জানতাম তোমার সাথে দেখা হবে। ভালো থেকো রাত্রি।

 

মজুমদারবাবু উঠেছেন বেশ দেরিতে। উঠেই খবরটা শুনেছেন। ভ্রু-জোড়া কুঁচকে গেছে! আত্মীয়স্বজন-কে একে একে জানিয়ে দিয়েছেন, সন্ন্যাসীর চলে যাওয়ার সংবাদ। তারপর রাত্রিকে পেলেন৷

-সন্ন্যাসীর ঘরে দেখা হল ?

প্রশ্নে ঘোর ভাঙল রাত্রির। বলল,

-তুমি জানতে?

-জানতাম, তাই তো নিয়ে এসেছিলাম। শুধু তোমার জন্য, বিশ্বাস করো, শুধু তোমার জন্য।

-আমাকে আরও কষ্ট দেবার জন্য!

কোনও কথার উত্তর না দিয়ে মজুমদারবাবু ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।

কাগজের ভাঁজ খোলে রাত্রি, তাতে লেখা

নক্ষত্রের চোখ শুধু ধাওয়া করে আমাকে, আমার রাত্রি…।

আর পড়তে পারছে না রাত্রি। দু’চোখ বেয়ে টপ টপ করে জল পড়ছে।

মাউথ অর্গান

ছুটতে ছুটতে ট্রেনটা ধরল অভীক। দিনের শেষ ট্রেন। এটা ধরতে না পারলে ফিরতে পারত না সে। সকালে বাবার শরীরটা খারাপ দেখে এসেছে। হার্টের রোগী বাবা। হঠাৎ কিছু হলে মায়ের পক্ষে একা সামলানো মুশকিল। অন্যদিন হলে এতটা ঝুঁকি নিত না। ছেলেবেলার বন্ধু তাপসের কোয়ার্টারেই থেকে যেত।

তাপস বর্ধমান স্টেশনের রেলপুলিশের বড়োবাবু। সে একাই থাকে এখানে। ওর কাছে থাকলে ছেলেবেলা কিছুটা ফেরত পাওয়া যায়। শেষ কামরায় খুব ভিড়। ভেতরে ঢোকা যাচ্ছে না। শরীরের অনেকটা কামরার বাইরে। একটু ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করতেই কাঁধের ব্যাগ খুলে প্ল্যাটফর্মে। গাড়ির যথেষ্ট গতি এখন। চলন্ত অবস্থায় নামা আত্মহত্যার সামিল। মুখ ঘুরিয়ে ব্যাগটার দিকে তাকাল অভীক। স্টেশনের বোতল কুড়োনো একটা ছেলে ব্যাগটা তুলছে।

ছেলেটাকে ভালো করে লক্ষ্য করল ও। গায়ে চেক জামা, নীল হাফ প্যান্ট, মাথায় কোঁকড়া চুল। গবেষণার কিছু কাগজপত্র, বই, নতুন কেনা দামি মোবাইল, পাঁচশো টাকা ও তার সাধের মাউথ অর্গানটা আছে ব্যাগের মধ্যে। পাবে তো ব্যাগটা? বিশেষ করে ওর মাউথ অর্গানটার জন্য মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল।

বছর তিনেক আগে ওরা চার বন্ধু মিলে ব্যাঙ্কক-পাটায়া বেড়াতে গিয়েছিল। সেখানেই কিনেছিল ওটা। বেশ দামি। ওর অনেক দিনের শখ ছিল বিদেশি মাউথ অর্গানের। সাংহাই কোম্পানির চেঞ্জার অর্গানটা। দুটো দিকেই বাজানো যায়। এত সুরেলা আওয়াজ হয় যে, আশপাশে একটা ভালো লাগার পরিবেশ তৈরি হয় সুরের ঝরনাধারায়।

ভিড় ঠেলে একটু ভেতরে ঢুকল ও। তাপসকে ফোন করে সব জানাল। ব্যাগটার বিষয়ে আশ্বাস দিল তাপস। ও এখনি যাচ্ছে বলল। তবে চলন্ত ট্রেনে ওঠার জন্য খুব বকাবকি করল ওকে। মশাগ্রাম স্টেশনে ও জানলার ধারে বসার জায়গা পেল একটা। চোখ বুজে হাওয়ার আদর খেতে লাগল।

অভীক বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি নিয়ে গবেষণা করছে। বিষয়- গ্রামীণ উন্নয়নে ক্ষুদ্র ঋণের প্রভাব। স্বনির্ভর গোষ্ঠী বিষয়টায় জুড়ে গেছে বলে বিগত তিন বছর হুগলি জেলার গ্রামগুলোতে চষে বেড়িয়েছে তথ্য সংগ্রহের জন্য। ঘোড়ার মুখের তথ্য সমৃদ্ধ করেছে ওর লেখা। সবই প্রাথমিক তথ্য নির্ভর লেখা। কোনও গৌণ তথ্যের ওপর নির্ভর করেনি। এতে গবেষণার বিষয় আরও বাস্তবোচিত ও গ্রহণযোগ্য হবে। এটা ওর বিশ্বাস।

প্রতি শনিবার স্কুল করে ও বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগে চলে আসে। স্যারের সাথে সারা সপ্তাহের কাজ নিয়ে আলোচনা করে। গ্রন্থাগারে যায়। নোটস নেয়। এসব করতে করতে একদম শেষ ট্রেন হয়। আজ ও স্যারের কাছে এসেছিল অন্য শনিবারের মতোই। কিন্তু কী থেকে কী হয়ে গেল! মনখারাপের কালো মেঘ ওর সারা হৃদয় জুড়ে।

পরদিন আরামবাগের একটা গ্রামে ফিল্ড ভিজিট সেরে ও বর্ধমানে পৌঁছোল প্রায় সন্ধেয। তাপস অফিসেই ছিল। হারানো ব্যাগটা এগিয়ে দিল তাপস। অভীক দেখল সব ঠিক আছে। শুধু মাউথ অর্গানটা নেই। চা টিফিন করে ওরা বের হল হারানো অর্গান উদ্ধারে। যদি বুঝিয়ে ফেরত পাওয়া যায়! বড়ো ব্যথা ওর বুকের ভেতর। ওর সর্বক্ষণের সঙ্গী ছিল ওটা। বন্ধু বিচ্ছেদের কষ্ট যেন সারা মন জুড়ে।

হাঁটতে হাঁটতে ওরা গিয়ে পৌঁছোল ছেলেটার আস্তানায়। হঠাৎ কানে এল সুর। সি শার্প-এ অগোছালো সুর। কিছু রিড মিস হচ্ছে। তবুও এক অদ্ভুত ভালোলাগা আছে সুরটায়। শুনেই বোঝা যায় কত ভালোবাসা নিয়ে বাজাচ্ছে। অভীক বুঝল সব। উৎসের দিকে একটু এগোতেই নজরে এল, সেই কালকের ছেলেটা চোখ বুজে তন্ময় হয়ে বাজিয়ে চলেছে অভীকের প্রিয় মাউথ অর্গানটা। আধো অন্ধকারে যেন আত্মমগ্ন ও। ওর সারা শরীর জুড়ে অদ্ভুত এক আনন্দ খেলা করছে। মুখে যেন সব পাওয়ার আলপনা। বুকের মধ্যে মোচড় দিয়ে উঠল অভীকের। অদ্ভুত এক ভালোলাগায় মনটা ছেয়ে গেল ওর। অনেক না-পাওয়ার মাঝে ছেলেটা একটা বাঁচার অবলম্বন খুঁজে পেয়েছে যেন। ওর এই পাওয়াটুকু আর কেড়ে নিতে চায় না অভীক । বাজাক মাউথ অর্গান ওর প্রাণের সুরে সুখের অঞ্জলিতে। তাপসের হাত ধরে ফেরার পথ ধরল অভীক মাউথ অর্গানের সুর পিছনে ফেলে।

 

দুটি গল্প-গাথা

এক মুঠো জীবন

নীল রঙের দরজা। তাতে আটকে রাখা চিঠির বাক্স। এক পাশে খড়খড়ি দেওয়া জানলা। বন্ধ। সবুজ রং ছিল এক সময়। এখন বিবর্ণ। সময়ের ছোপ ধরা দেয়ালের পলেস্তরা খসে পড়ছে অনেক দিন হল। তালা বন্ধ দরজার কাঠ ক্ষয়ে গেছে অনেকটাই। নতুন করে টুকরো কাঠ লাগিয়ে চেষ্টা করা হয়েছে কাঠামোটা ধরে রাখার। কিন্তু সময়টাকে ধরে রাখা যায়নি।

দেয়ালের কালশিটে দাগগুলো বলিরেখার মতোই স্পষ্ট। দুপুরের রোদ নরম চাদরের মতো জড়িয়ে আছে বাড়িটাকে। চিঠির বাক্স এখন ফাঁকাই পড়ে থাকে। চিঠি আসে না অনেক দিন। ধুলো জমেছে অনেক। পোকামাকড়ের ঘরবসতি তার এলাকা বিস্তারে ব্যস্ত। কেউ খুলেও দেখে না চিঠির বাক্স।

সে অনেক কাল আগের কথা। নিঝুম দুপুরে হঠাৎ খুলে যেত দরজা। চুড়ির মৃদু শব্দ। আধখোলা দরজার ভিতর থেকে কেউ দ্রুত হাতে তুলে নিত চিঠি। রঙিন খামে ঠিকানা লেখা। পরক্ষণেই বন্ধ হয়ে যেত দরজা। তারপর সারা দুপুর শুধুই ঠোঁটের কোণে লুকিয়ে থাকা হাসি। কোনও দিন চোখ ভরা জল। বারংবার, ফিরে ফিরে পড়া সাদা পাতার বুকে রাবীন্দ্রিক ছন্দে লেখা নীল অক্ষরের বিরহগাথা অথবা নিছকই কেজো কথায় ফিকে হয়ে যাওয়া অনুভূতিমালা।

আতরগন্ধী চিঠির ঘ্রাণে স্মৃতিমেদুর বিকেলগুলোয় বয়ে যেত বাসন্তী বাতাস। আকাশে ভেসে বেড়াত ঘুড়ি। রঙিন চিঠিগুলো যেন একটু আগেই সযত্নে রক্ষিত কারুকাজ করা বাক্সের ডালা খুলে চলে গেছে ওই সই-মেঘেদের কাছাকাছি, গোপন কথাটি বলার জন্য। হারিয়ে গেছে পোস্টকার্ড, ইনল্যান্ড বা খামে-ভরা চিঠির সুষমা।

চাইনিজ কালিতে হাতের লেখার শিল্প, অসাবধানতায় পড়ে যাওয়া দু-এক ফোঁটা কালির দাগ এখন কল্পনাতেও আসে না। এখন কাঠের তৈরি চিঠির বাক্সের বদলে ইনবক্স-এ মেসেজ আর ইমোজির মজা। তবু কেউ হয়তো এখনও বইয়ের ফাঁকে রাখা, হাতে-লেখা বিবর্ণ চিঠিটাকে মাঝে মাঝে খুলে নিয়ে পড়ে।

হয়তো তার একটা চিঠির বাক্স আজও আছে গোপন… যার রং নীল।

                                                                                                      লেখক : অয়ন সেন

 

জ্ঞানপাপী

Bengali story

পেটে অসহ্য যন্ত্রণা! যেন গত দশ বছরে পাকানো বিয়ার বেলি ছাপিয়ে নাভিকুণ্ডলী শিরাদাঁড়া-টা ছুঁয়ে ফেলবে! ইমার্জেন্সিতে স্ট্রেচার থেকে বেডে দেওয়ার পরেও মনে হচ্ছে, পৃথিবীটা ঘুরছে। আর সেই ফাঁকে দেখা দিয়ে যাচ্ছে কত মুখ। সেই ক্লাস এইটে ইস্কুলের পাট চুকিয়ে দেওয়ার সময়ে ভূগোল বই-এ জগা পড়েছিল সে কথা। কিন্তু ওই হাওড়া স্টেশনে ল্যাম্পপোস্ট-এর গায়ে কে.সি পালের নিজে হাতে লেখা, সূর্য‌ পৃথিবীর চারিদিকে ঘোরে এটাই সত্যি মনে হয়েছিল। কিন্তু আজ যমরাজের ডাকে প্রায় সাড়া দিতে দিতে অজস্র মাউথফুল গালি দিতে গিয়ে মনে পড়ে গেল

গ্যালিলিও… বেডে শুয়ে ভাবল গালি দিয়ে লি-ও লি-ও করে কুত্তাকে বিস্কুট খাওয়ানোর নাম করে মনে রাখত নামটা। এখনও চোখ বন্ধ করেও যেন নাগরদোলা। আজ তো মাল-ই খায়নি। তবে ওই গ্যালিলিও মালটা ঠিকই বলেছে বটে। সব ঘোরে, শুধু সূর্য এক জায়গায় খাম্বার মতো দাঁড়িয়ে। সিগারেট-ও সকাল থেকে একটাই। জিভটা এত মোটা লাগছিল যে, কিছু খেতেই ইচ্ছে হচ্ছিল না।

স্ট্রেচারে করে নিয়ে আসার সময়ে শুনতে পেয়েছিল, কে একটা বলল, আরে ডা. গাঙ্গুলী লন্ডন থেকে এফআরসিএস, যেন ঈশ্বর। ভাবতে ভাবতে নার্স এসে ঠুসে দিল ইঞ্জেকশন। জগা দেখতে পায়নি তাই। নাহলে পেটের ব্যাথায় নয়, ইঞ্জেকশনের সিরিঞ্জ দেখেই হার্টফেল করে মরে যেত। রোগ সারাতে অবশেষে সেই লন্ডনফেরত ঈশ্বর এলেন।

কী করলে ঠিক হব ডাক্তারবাবু?

মদ আর সিগারেট খাওয়া এক্কেবারে কমিয়ে দিতে হবে।

এটা বলার জন্য আপনি এত লেখাপড়া করে সময় নষ্ট করলেন? লন্ডনে ডাক্তারি শেখার খরচও নেহাত কম নয়! সকলে সুযোগও পায় না।

মা-নে?

লে হালুয়া! এটা কে না জানে! আমি দাদা কেলাস এইট পাশ, দীনবন্ধু ইস্কুল থেকে… পরশু যে-রিকশাওয়ালাটা আমাকে নিয়ে আসছিল, মাল খেয়ে টাল হয়ে গাছের গায়ে সল্লিড ধাক্কা। ওকে আমিও একই কথা বলেছি। পয়সাও নি-ই নি… আপনি লন্ডনে ডাক্তারি পাশ দিয়েছেন, আমার থেকে টাকাও নেবেন, অনেক। তাহলে এখন বলুন, মদ আর সিগারেট এই দুটোকে রেখে আমি ভালো হব আর ভালো থাকব কী করে? তবে না বুঝব আপনি ডাক্তারের ডাক্তার!

আমি পারব না।

এই কে আছিস! চ রে আমাকে বাড়ি নিয়ে চ… এর দ্বারা কিস্যু হবে না, অনেক হইচে!

ডাক্তারবাবু স্টেথো নামিয়ে রাখলেন টেবিলের ওপর।

 

 লেখক : আর্য চ্যাটার্জী

পাপ

বোতলের অনেকটা তরল একসঙ্গে গলায় ঢালে বাচ্চু। আজ আর কিছুই ভালো লাগছে না। দুদিন ভালো করে খাওয়া হয়নি। সিগারেট খেলে বুকের ভেতরটা জ্বালা করে আজকাল। চলতে গেলে পা কাঁপে। অথচ বাচ্চুর চেহারা বেশ ভালোই ছিল। আগে নিয়মিত ব্যায়াম করত। পঞ্চাশ ইঞ্চি বুক ছিল। এখন সেসব স্বপ্ন মনে হয়। বাবা মারা যাওয়ার পর অভাব আর দারিদ্র্য যেন ওর জীবনের সঙ্গী হয়ে গেছে। পড়াশোনাটা ভালো করে করলে হয়তো একটা চাকরি পাওয়া যেত। একসময়ে স্বাস্থ্যের গৌরবে সে অচিরেই হয়ে উঠেছিল পাড়ার হিরো। কিন্তু এই হিরোই একসময় হয়ে উঠল এক চলমান ত্রাস। একজন অ্যান্টি সোশ্যাল। বাচ্চা থেকে বুড়ো সবাই বাচ্চুকে ভয় পেত। আর পাড়ার মেয়েদের তো নিশ্চিন্তে ঘোরাফেরা করার উপায়ই ছিল না। অথচ জীবনটা কীরকম বদলে গেল। মা সেই কোন ছোটোবেলায় মারা গেছে। তারপর বাবাও চলে গেল। একটা ছোটো বোনকে রেখে গেল বাচ্চুর জিম্মায়। রোজগারের কোনও নিশ্চয়তা নেই। কোনওমতে দিন চলে। কখনও রাজনৈতিক দলের হয়ে কাজ করে। আবার কখনও হয় বড়ো ব্যবসাদারের ভাড়া করা গুণ্ডা। দুবার জেলও খেটেছে বাচ্চু। বোনটা পাড়ার এক বুড়ি পিসিমার কাছেই মানুষ। এখন শরীরটাও চলে না। ক্ষমতায় এখন অন্য রাজনৈতিক দল। স্বাভাবিক কারণেই এখন বাচ্চুর রোজগারও কম হয়। বোনটা তো অসুখে ভুগে ভুগে কঙ্কালের রূপ নিয়েছে।

নেশার পাত্রটা শেষ করে চোখদুটো খুলল সে। রোখ চেপে যাওয়া গলায় বলল ‘ওঠ’। পাশে বসা মনু বলল, ‘গুরু বোতলটা শেষ করে গেলে হতো না?’

ক্লান্তস্বরে বাচ্চু বলল, ‘না ওটা ফেলে দে। আজ একবার শেঠ বাজোরিয়ার কাছে যেতে হবে। কিছু টাকার দরকার বুঝলি? বোনটাকে ওষুধপত্র না দিলে ও মরে যাবে।’

‘কাজ ছাড়া কি শেঠ টাকা দেবে?’

‘ওর বাপ দেবে। ওর জন্য আমি কম খুন, জখম করেছি?’

‘ওর তো এখন পেয়ারের লোক বিল্লে, যাকে তুমি হাতে ধরে বানিয়েছ।’ প্যান্টের পকেটে রাখা রামপুরী চাকুটা একবার অনুভব করল বাচ্চু। চোখদুটো লাল। দাঁতে দাঁত চেপে রাগে গর্জন করে উঠল। তারপর বলল, ‘আমি যদি টাকা না পাই তবে দুটোকে সাফ করে দেব।’

‘গুরু তার চেয়ে চামেলির ওখানে চলো। ও যদি কিছু টাকা দিতে পারে।’

‘ওই ভোগলালসার টাকা আমি ছুঁই না। তার থেকে কাঁচড়াপাড়ায় চল দেখি আমার ছোটো মামার থেকে কিছু পাই কিনা।’

স্বপনলালের চায়ের দোকানের পিছনে ওরা এতক্ষণ বসে ছিল। দোকান থেকে বেরোতে বেরোতে কী যেন একটু ভেবে নিয়ে মনুকে বলল, ‘তুই এখন যা, আমাকে একটু একা থাকতে দে।’

নানা জায়গায় ঘুরতে ঘুরতে চামেলির বস্তির সামনে এসে দাঁড়াল বাচ্চু। রাস্তার কলের জলে দু’চার জন মেয়েমানুষ বুকে গামছা জড়িয়ে স্নান করছিল। ফুটপাথের ওপর দু’চারটে বাচ্চা খেলা করছে। অদ্ভুত এদের জীবন। দুঃখটা কেমন সহজ করে মেনে নিয়েছে। কোনও আশা নেই প্রত্যাশা নেই শুধু কোনও রকমে বেঁচে থাকা। চামেলির ঘরের বাইরে টুলের ওপর ওর স্বামী বসে চা খাচ্ছিল। একটু হেসে বলল, ‘কি খবর বাচ্চুদা?’

বাচ্চু সে কথার জবাব না দিয়ে বলল, ‘চামেলি কোথায়?’

‘ঘরেই আছে। একটু ব্যস্ত আছে।’

চামেলির এই দেহদান বাচ্চুর একটুও ভালো লাগে না। পয়সার জোর থাকলে বড়ো বড়ো উপদেশ দেওয়া যায়। চামেলির চারটে বাচ্চা, তার ওপর ওর স্বামীর কোনও রোজগার নেই। মাঝে মাঝে ভাবে বাচ্চু, জীবনটা কি এতই সুন্দর যা কোনওভাবে বাঁচিয়ে রাখতেই হয়।

একটা সিগারেট ধরাল বাচ্চু। মাথাটা খুব ধরেছে। কী করবে সে। তারপর বলল, ‘আমি ঘুরে আসছি।’

চামেলির স্বামী বলল, ‘সেই ভালো, জানি না তো কতক্ষণ লাগবে।’

রাত বারোটার পর যখন চামেলির ঘরে ঢুকল বাচ্চু, চামেলি তখন ক্লান্ত। বড়ো বড়ো হাই উঠছে। বাচ্চাগুলো জড়াজড়ি করে ঘুমিয়ে আছে তেলচিটে বিছানাটাতে। চামেলি বলল, ‘হঠাৎ পথ ভুল করে এখানে?’

চৌকির ওপর বসতে বসতে বাচ্চু বলল, ‘বোনটার খুব অসুখ। তাই বেরিয়েছিলাম টাকার সন্ধানে।’

‘কী হয়েছে নীতার?’ অনেক জানার আগ্রহ চামেলির মুখে।

‘জানি না। তবে আজ ক’দিন ধরে কিছু খাচ্ছে না।’

‘ডাক্তার দেখিয়েছ?’

‘হ্যাঁ, ছোটোখাটো ডাক্তার দেখিয়েছি, কিছুই ধরতে পারছে না।’

‘কোনও বড়ো ডাক্তার দেখাও।’

একটু হাসল বাচ্চু, বলল, ‘খাবার পয়সা নেই ডাক্তার দেখাব!’

‘আমি পয়সা দেব, তুমি নীতাকে বাঁচাও।’

‘সে হয় না চামেলি। তোমার রোজগারের লজ্জা আমাকে দিনরাত কুরে কুরে খাবে।’

‘তবুও তুমি না কোরো না। আমি যদি আমার সমস্ত লজ্জা, ঘৃণা ত্যাগ করে আমার বাচ্চাদের বাঁচিয়ে রাখতে পারি, তবে নীতাকেও বাঁচাতে পারব। আমি বড়ো বড়ো শেঠের কাছে যাব। অনেক টাকা আনব।’

বাচ্চু হঠাৎ চামেলির মুখ চেপে ধরে, রাগে ওর শরীর জ্বলছে। বলে, ‘না। ওই পয়সাওয়ালা লোকদের ভোগের সামগ্রী হতে দেব না তোকে। এবার, যদি না পাই তবে ছিনিয়ে নেব। ওইসব বাড়ির মেয়েদের লাজলজ্জা আছে, আমাদের মা-বোনেদের নেই?’ চামেলির ঘর ছেড়ে রাস্তায় নেমে পড়ল বাচ্চু। মাথাটা কেমন ঘুরছে, কান গরম।

দুদিন পর বাড়ি ফিরল বাচ্চু। নীতার অবস্থার আরও অবনতি হয়েছে। ঘরের এককোণে নেতিয়ে পড়ে আছে মেয়েটা। জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে। চারদিন কিছু খায়নি। পাড়ার ডাক্তার জীবেনবাবু কোনও বড়ো ডাক্তারকে দেখাতে বলেছেন।

‘এখন কী করবে করো।’ পিসিমা রাগে গজগজ করতে করতে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল। বাচ্চু নীতার মাথায় হাত দিল। জ্বরটা এখনও আছে। চোখের দু’ধারে শুকনো জলের দাগ। অচৈতন্যের মতো পড়ে আছে। কষ্টের ছাপ ওর মুখে।

বাচ্চু ডাকল, ‘নীতা’।

নীতা চোখ খুলে চেয়ে রইল।

‘খুব কষ্ট হচ্ছে না রে?’

নীতা কিছু বলল না।

‘একটু ফলের রস খাবি?’

নীতা মাথা নাড়ল।

‘একটু কিছু খেয়ে নে,’ মাথায় হাত বোলাল বাচ্চু।

‘ভীষণ কষ্ট হচ্ছে দাদা।’

‘কোথায় কষ্ট হচ্ছে বল।’

নীতা নিজের পেটের ওপর দৃষ্টি নামাল।

আবার বাচ্চু বলল, ‘খুব ব্যথা হচ্ছে নীতা?’

‘হ্যাঁ দাদা, ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। আচ্ছা দাদা তুই বাড়ি আসিস না কেন? আমার কথা তোর একটুও মনে পড়ে না?’

বাচ্চুর চোখ ফেটে জল এল। ওর পেটে হাত বোলাতে বোলাতে বলল, ‘তোর জন্য বড়ো ডাক্তারের কাছে যেতে হবে। অনেক টাকার দরকার তাই কাজ করি।’

‘তুই কত রোগা হয়ে গেছিস দাদা। আমার জন্য তোর কত পরিশ্রম।’

‘কথা বলিস না নীতা, ব্যথা বাড়বে।’

‘আমার একটুও ভালো লাগছে না দাদা, ব্যথাটা বাড়ছে। আমি মা-বাবার কাছে যাব। মা আমাকে কত ভালোবাসবে, আদর করবে। কত সুন্দর বই কিনে দেবে। আমি বাবার সঙ্গে বেড়াতে যাব। কত মজা হবে।’

জ্বরের ঘোরে ভুল বকতে থাকে নীতা। পিসিমা ঘরে ঢুকে বলল, ‘ব্যথাটা বাড়ল বুঝি? কী যে হল। আমি একটু গরম তেল মালিশ করে দেখি।’

বাচ্চু হঠাৎ উঠে দাঁড়াল। নীতার অসহ্য কষ্ট আর দেখতে পারছে না। সমস্ত শরীরের ভেতর ওর অক্ষমতার জন্য একটা যন্ত্রণা বয়ে গেল। নীতাকে বাঁচতেই হবে। ওকে এরকম ভাবে মরতে দেবে না বাচ্চু। যে করেই হোক টাকা চাই।

শেঠ বাজোরিয়ার বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াল বাচ্চু। গেটের দারোয়ান বাধা দিতেই বলল, ‘সাহেব ডেকেছে।’

আরও কয়েকবার বাচ্চু এবাড়িতে এসেছে। বাড়ির ভেতরে ঢুকেই চাকরকে বলল, ‘শেঠ সাহেবকে বল আমি এসেছি।’

চাকর ফিরে এসে জানাল, ‘সাহেব এখন বাইরে যাবে এখন দেখা হবে না।’ বাচ্চুর মাথায় তখন খুন চেপে গেছে। চাকরকে হাত দিয়ে সরিয়ে জোরে জোরে পা ফেলে সোজা বাজোরিয়ার বেডরুম-এ ঢুকল। শেঠ বাজোরিয়া তখন পোশাক বদলাচ্ছিল। ওকে দেখেই বলল, ‘তুই বেডরুম-এ কেন এলি?’

সারা শরীরে এক প্রচণ্ড হিংস্রতা ঘিরে আছে বাচ্চুর। বলল, ‘শেঠ আমার কিছু টাকার দরকার।’

‘রুপিয়া কি এমনিই আসে যে বললেই দিয়ে দেব!’

‘আমার বোনের খুব অসুখ শেঠ, কিছু টাকা দাও। হাতজোড় করছি।’

‘বোনের অসুখ তো আমি কী করব? যা না সরকারি হাসপাতালে।’

‘তোমার অনেক কাজ করেছি শেঠ, আমি আবার কাজ করে শোধ করে দেব।’

‘না তোকে আমার দরকার নেই। আমি তোর মতো কুত্তাকে আর ডাকব না। বেরিয়ে যা আমার ঘর থেকে।’

বাচ্চু আর থাকতে পারল না। মাথায় খুন চেপে গেছে। পকেট থেকে রামপুরী চাকুটা বার করল। তারপর চিৎকার করে উঠল, ‘টাকা আমার চাই।’

‘আচ্ছা ঠিক আছে। তুই বস আমি আসছি।’ বাজোরিয়া বারান্দায় রাখা টেলিফোন তুলে বলল, ‘হ্যালো লালবাজার আমি…’ আর বলা হল না। প্রচণ্ড শক্তিতে বাচ্চু তখন ওর গলা টিপে ধরেছে। একটা গোঙানি ভেসে এল বাজোরিয়ার মুখ দিয়ে। তারপর বাচ্চুর হাতের রামপুরী চাকুর আঘাতে লুটিয়ে পড়ল বাজোরিয়ার দেহ। বাজোরিয়ার দেহটা নিথর হয়ে যেতেই বাচ্চুর হুঁশ এল। এটা সে কি করল! লোকটাকে সে মেলে ফেলল! এতটা যে খুন চেপে যাবে ও আগেও ভাবেনি। কিন্তু আর এখন কিছু ভাবার নেই। দুদ্দাড় করে সিঁড়ি দিয়ে নেমে রুদ্ধশ্বাসে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল বাচ্চু।

রাত অনেক হয়ে গেছে চারিদিক নিঃস্তব্ধ, রাস্তার কুকুরগুলো ঘেউ ঘেউ করছে। শীতের রাত্রি লোক চলাচলও কম। বাচ্চু চামেলির ঘরের দরজার কড়া নাড়ল। চামেলি জেগেই ছিল। খুব সেজেছে আজ চামেলি। ভালো নাইলন শাড়ি, কপালে লাল টিপ। চামেলির স্বামী ঘরে নেই। মাল টেনে কোথাও পড়ে আছে বোধহয়, বাচ্চাগুলো এককোণে শুয়ে ঘুমুচ্ছে।

দরজা খুলেই চামেলি জিজ্ঞেস করল, ‘এত রাতে কী ব্যাপার?’

বাচ্চু বলল, ‘আমাকে একটু জল দাও চামেলি। অনেকটা পথ হেঁটে এসেছি।’ বাচ্চু তখনও হাঁপাচ্ছে।

চামেলি বলল, ‘বসো আমি জল আনছি।’

জল খেয়ে বাচ্চু বলল, ‘আজকে একটা খারাপ কাজ করে ফেলেছি।’

‘আবার মারামারি করেছ? না তোমাকে নিয়ে আর পারা গেল না। তুমি না থাকলে নীতার কি হবে ভেবে দেখেছ একবার?’

চিৎকার করে উঠল বাচ্চু– ‘ওকথা বোলো না চামেলি। ওকথা বোলো না।’

তারপর চামেলির হাতদুটো জড়িয়ে ধরে বলল, ‘তুমি না একদিন বলেছিলে– নীতাকে বাঁচাবে।’

‘হ্যাঁ বলেছিলাম।’

‘তবে তুমি ওকে বাঁচাও চামেলি। আমার একান্ত অনুরোধ, বলো তুমি রাখবে?’

‘হ্যাঁ, সেই ভেবেই তো…। এখুনি বাজোরিয়া শেঠের গাড়ি আসবে, আমাকে নিয়ে যাবে ওর বাগান বাড়িতে দিন সাতেক থাকতে হবে, কিন্তু অনেক টাকা দেবে, জানো!’

বাচ্চুর শিরা দুটো দবদব করছে। মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে। এখন সে কী করবে? কোথায় পালাবে। কিছু কূলকিনারা পাচ্ছে না।

বাজোরিয়ার নামটা যেন তার বুকের ভেতর হাতুড়ি পিটছে। ওকেই তো কিছুক্ষণ আগে নিজের হাতে খুন করে এসেছে সে। ওতো আর কোনওদিন আসবে না চামেলিকে নিতে।

চামেলি পান খেতে খেতে বলল, ‘ও এখনও এল না লোকটা। টাকাটা পেয়ে নিই, তারপর দেখো আমি নীতাকে বাঁচাবই।’

বাচ্চুর মাথা ঘুরছে। এ কী করল সে! ওই টাকাও আর পাওয়া যাবে না। শুধু বাজোরিয়ার নয়, সে যে নীতারও প্রাণ নিয়ে ফেলেছে। সমস্ত পৃথিবী কাঁপছে। হাত মুঠি করে নিজের ভেতরের সমস্ত শক্তি সঞ্চয় করে সে বলল, ‘ওই শেঠ আর আসবে না চামেলি। আমি বাজোরিয়াকে খুন করে এসেছি নিজের হাতে।’ কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে বাচ্চু।

‘এ তুমি কি করলে বাচ্চুদা। আমি যে অনেক কষ্টে এ টাকার বন্দোবস্ত করেছিলাম।’

‘আর বোলো না চামেলি। আমি নিজের হাতে দুটো প্রাণ নষ্ট করে দিলাম, আমাকে তুমি ক্ষমা করো।’

রাত্রির মধ্যম যাম। অনেকক্ষণ দুজনে চুপ করে বসে থাকে। তারপর উদভ্রান্তের মতো ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যায় বাচ্চু। বড়ো রাস্তা পেরোলে ওপারেই সরকারি হাসপাতাল। আরও একটু এগোলেই মোড়ের মাথায় থানা।

 

দেব ও কার্তিক

একটু আগেই রংচটা ক্ষয়াটে মোবাইলটায় কেসের খবর এল। শেষ টানটা দিয়ে ভসভস করে নাকমুখ দিয়ে ধোঁয়া ছাড়ল কার্তিক। চোখ বুজে কয়েক মিনিট বসে রইল। ধুনকিটা মাথায় ঠেলছে। বেশ আরাম। এবার ওঠা যেতে পারে। কলকেটা উপুড় করে ছাইটুকু মাটিতে ফেলল, তারপর পেল্লায় একটা হাই তুলে রয়েসয়ে নিজের সাইকেল ভ্যানটার কাছে গেল। ভ্যানের চেহারাও কার্তিকের মতোই। একেবারে খ্যাঁচাখোঁচা। মাঝরাস্তায় ফেলে দিয়ে আসলে চোরেও ছুঁয়ে দেখবে না, উলটে সারানোর পয়সা রেখে যেতে পারে। মাডগার্ড নেই, ঢিলে চেন বারবার পড়ে যায়। চাকার টায়ারে কার্তিকের বয়েসের থেকে বেশি গ্যাটিস মারা। তিনটে রিঙেই টাল রয়েছে। লগবগ করতে থাকে চালানোর সময়। মনে হয় বুঝি চাকাগুলো খসে গেল। ব্রেক নামকা ওয়াস্তে। ইচ্ছে হলে ধরে, কখনও ধরে না। হর্নের আওয়াজ ডিম ফুটে বেরোনো চড়ুইয়ের মতো। ভ্যানের তক্তাগুলো সব ঢিলে হওয়ার কারণে হর্ন দিতে লাগে না। গাড়ি চললে তার বিচিত্র আওয়াজে লোকে এমনিই বুঝতে পারে পিছন থেকে কিছু একটা আসছে। তার সঙ্গে কার্তিক মাঝেমধ্যেই মুখে হুই হুইইইইই করে শব্দ করে হর্নের বদলে। কিন্তু এই ভ্যানটা আছে বলেই না কার্তিকের গাঁজার পয়সা ছাড়াও পেটে কিছুটা চাল, ডাল, তেল পড়ার পয়সা জোটে।

আসলে কার্তিকের বুদ্ধি কম। আর যাদের বুদ্ধি কম, তাদের অনুভূতিও কম। সুতরাং কার্তিকের অনুভূতিটুতি সেই ছোটোবেলা থেকেই একটু ফিকে। বাবা-মা, ভাই-বোন, বেয়াই, মুনাই, জগাই-মাধাই সব হারিয়ে বত্রিশ বছর বয়েসের কার্তিক একেবারেই একা। হদিশপুরের ফরালপট্টি নামের একটা আধা গ্রাম মার্কা মফসসল পাড়ার একেবারে শেষপ্রান্তে, বাঁশবাগান শুরুর মুখে ও থাকে। ওর সঙ্গে থাকে শুধু এই ভ্যানটা আর একচিলতে জমির ওপর টালির ছাউনি দেওয়া ছিটেবেড়ার এক ঘুপচি ঘর। ঘরের এককোণে একটা নড়বড়ে পায়ার খাটিয়া, খাটিয়ার তেলচিটে বালিশের তলায় রগরগে ল্যাংটো মেয়ের ছবিওলা খাস্তা হয়ে যাওয়া দুটো ছবির বই। নারকোলের দড়িতে ঝোলানো কয়েকটা জামা প্যান্ট, লুঙ্গি। অন্য কোণে জনতা স্টোভ, কুচকুচে কালো হাঁড়ি, কড়াই, বাটি, খুন্তি আর থালা। ব্যস কার্তিকের সংসার কমপ্লিট।

উঠোন থেকে ভ্যানটা বাইরে এনে সিটে চেপে বসে লগবগ করতে করতে চলল কার্তিক। ওর গন্তব্য এখন হদিশপুর রেলস্টেশন। আজ আবার একটা কেস ঘটেছে। কেস শব্দটা কার্তিক শিখেছে জিআরপি-র কাছ থেকে। এখন শব্দটা ওর মনেও সেঁটে গেছে। কারণ কেস মানেই পয়সা। বেশ ভালো পয়সা।

আসলে হদিশপুর, মোল্লাবাজার আর ভাঙনহাটি এই তিনটে রেলস্টেশনের মধ্যে যদি কেউ লাইনে কাটা পড়ে কিংবা গলা দেয় তাহলে সেই বডি হদিশপুর মর্গে পৌঁছানোর দায়িত্ব কার্তিকের। জিআরপি-র লোক বডি কাপড়, প্লাস্টিক দিয়ে মুড়ে দেয়। তারপর সেটাকে ভ্যানে চাপিয়ে মর্গে জমা দেওয়া পর্যন্ত কার্তিকের কাজ। সাত বচ্ছর হয়ে গেল এই কাজে। তার আগে ওই ভ্যানে করেই পাড়ার বাড়িতে বাড়িতে কাঁচাসবজি বেচত। কিন্তু বুদ্ধি কম থাকলে আর যাই হোক ব্যাবসা হয় না। কার্তিকেরও হল না। খদ্দেররা প্রায় সবাই ঠকাত কিংবা পরে দাম দেব বলে আর কেউ দিত না। ব্যাবসা লাটে। তারপর কিছুদিন স্টেশনের সামনে নাড়ুর মুরগির দোকানে মুরগি ছাড়ানোর কাজ করল। সেটাও হল না, একদিন তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে মুরগির গলার সঙ্গে নিজের ডানহাতের আঙুলটাও নামিয়ে ফেলল বটিতে। ছেড়ে দিল কাজ। শেষে পাড়ার বন্ধু শ্যামল বাঁচাল। বলল, ‘দেখ ভাই, ভগবান তোর ঘটে ছাগলের নাদির সাইজেরও ঘি দেয়নি। সুতরাং ওসব ব্যাবসা ফ্যাবসা তোর দ্বারা হবে না। বরং আমার খোঁজে একটা কাজ আছে করবি?’

এই কাজ প্রথম দিকে করতে জান বেরিয়ে যেত, ঘেন্নায়, ভয়ে। ভেবেছিল ছেড়ে দেবে। কিন্তু শালা খিদের ভয় এত মারাত্মক যে…। শ্যামল বলল, ‘খবরদার কাজটা ছাড়িস না। এটা কিন্তু হাফ সরকারি চাকরি। তোকে কেউ কোনওদিনও ছাড়াবে না। আর ঠাকুরের আশীর্বাদে কাটা পড়া, গলা দেওয়ার কেস তো দিনে দিনে বাড়ছে বৈ কমছে না। তুই না খেয়ে থাকলে কেউ দুবেলা ভাত দেবে না। প্রথমদিকে এট্টু চাপ যাবে, তারপর সয়ে যাবে দেখবি। আরেকটা জিনিস শিখিয়ে দিচ্ছি। সেটা করে বেরোবি, একটুও পবলেম হবে না আর। সেই জিনিসটা হল মহাদেবের প্রসাদ। মাথায় ঠেকিয়ে টানতে হয়।’

কার্তিক শিখে নিল কীভাবে কলকে ধরতে হয়, মশলা ঠুসতে হয়, ছিলিম টানতে হয়। বুকের খাঁচায় আপ্রাণ ধোঁয়া নিয়ে বমকে চেপে রেখে তারপর ভুসভুস করে ছাড়তে হয়। সত্যি সত্যি,

চার-পাঁচ টান দিয়ে কাজে নামলে আর কোনও ঘেন্না, ভয় লাগত না। তবে নেশাটা বেড়ে গেল অনেকটাই। ফলে শরীরটা দড়ি পাকিয়ে দু-টাকা প্যাকেটের কালো আমলকির মতো হয়ে গেল। সে হোক গে। যে ক’দিন বাঁচতে হবে দুবেলা খেতে পেলেই হল, শরীর দিয়ে কী হবে? বিয়ে থা তো আর এজন্মে হবে না।

টিপিকাল গেঁয়ো মফসসলের ঘেয়ো রাস্তার ওপর দিয়ে লটবহর নিয়ে ভ্যান চালাতে চালাতে আকাশের দিকে দেখল কার্তিক। ভাদ্র মাসের বিকেল চারটে। আজ সারাদিন খুব গুমোট। দরদরিয়ে ঘাম হচ্ছে। বৃষ্টি হলে ভালো হয়। হবে কি?

আরও খানিকটা এগোনোর পর মেন রাস্তাতেই চলচিত্রম সিনেমা হলের সামনে ভ্যান সমেত থমকে গেল ও। হেব্বি চমকে গেল। উরেশশাললাহ– গুরুর বই চলছে! প্রায় মাসখানেক হল ভাঙনহাটিতে কোনও কেস হয়নি বলে আসা হয়নি। তাই জানাও ছিল না যে গুরুর বই দিয়েছে এখন। দেবকে মনে মনে গুরু মানে কার্তিক। শালা যেমন ফিগার আর তেমনি ঝাড়পিট করতে পারে। মিঠুনের পর এমন ঝাড়পিট আর কেউ পেরেছে? সিনেমা হলের দেয়ালে বিশাল বড়ো দেবের পোস্টার। রক্তমাখা দেব একটা মেয়েছেলের বডি কোলে নিয়ে চিৎকার মারছে। মেয়েছেলেটা কি নায়িকা? মরে গেছে? হেব্বি অ্যাকশন হবে নিশ্চয়ই। ইশশ কতদিন গুরুর বই দেখা হয়নি। কাউন্টারের সামনে তেমন ভিড় নেই। তার মানে হপ্তাখানেক নিশ্চয়ই পেরিয়ে গেছে বইটা।

দেবের প্রচুর বই দেখেছে কার্তিক। আর যেদিনই দেখেছে সেদিনই ওর গাঁজার ধোঁয়ামাখানো ঘিলুতে রাত্তিরে ভর করেছে দেব। ঘরের এককোণে বাঁশের খুঁটিতে ঝোলানো এই টুকুন একটা ঘষা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে লম্পর আলোয় একা একা দেব সেজে কম ঝাড়পিট করেছে গুন্ডাদের সঙ্গে? কচুকাটা করেছে সবক’টাকে। কখনও দুহাতে বন্দুক ঘুরিয়ে কখনও তলোয়ার ঘুরিয়ে। তারপর কোয়েল, শ্রাবন্তী, মুমতাজ, নুসরতের সঙ্গে নেচেছে। নাচতে নাচতে কিংবা অ্যাকশন করতে করতে কখন যে মাটিতে ঘুমিয়ে পড়েছে নিজেরও খেয়াল থাকেনি। বাংলার একনম্বর হিরো হল দেব। ওর ঘরের ছিটেবেড়ার দেয়ালে একটা দেবের পোস্টারও রয়েছে।

খুব খুঁটিয়ে পোস্টারের এদিক-ওদিক দেখে নেহাৎ অনিচ্ছায় প্যাডেলে আবার চাপ দিল কার্তিক। বইটা দেখা হল না। খুব আপশোশ লাগছে। মন পড়ে রইল চলচিত্রম হলের দেয়ালে আর মিনিট পনেরোর মধ্যে কার্তিক পৌঁছে গেল হদিশপুর জিআরপি অফিসে। ঢোকামাত্র বড়োবাবুর পেল্লায় ধমক। ‘শুয়োরের বাচ্চা, আসতে ইচ্ছে করে না নাকি রে তোর? এইটুকু রাস্তা আসতে কতক্ষণ লাগে? সেই বিকেল থেকে বডি পড়ে রয়েছে।’

এই খিস্তিটুকুতে জলখাবারও হয় না কার্তিকের। পেটভরা তো দূরের কথা। সামান্য বিগলিত হাসল।

‘তোকে তো বলেও কিছু লাভ নেই। সবসময় ধুনকিতে রয়েছিস।’ বড়োবাবুর কথায় আশপাশের কনস্টেবলগুলো হেসে উঠল।

‘দে বডিটা তুলে দে।’ বড়োবাবুর আদেশমাত্র অফিসের বাইরের ঘরটা থেকে প্লাস্টিক মোড়া বডিটা দুজন জমাদার ধরাধরি করে তুলে দিল কার্তিকের ভ্যানে।

‘তাড়াতাড়ি পৌঁছে দিস। আবার রাস্তায় বডি সমেত লাট খেয়ে পড়ে থাকিস না। আজ বৃষ্টি হতে পারে,’ বলে একটা একশো টাকার নোট আর একটা কাগজ ধরিয়ে দিল ছোটোবাবু। টাকাটা কার্তিকের ভ্যানভাড়া আর কাগজটা মর্গে বডির সঙ্গে জমা করতে হবে। এসব মুখস্ত হয়ে গেছে কব্বে…। মেয়েছেলের বডি, জেনে নিয়েছে কার্তিক।

ফেরার পথে আবার ঠিক সেইখানেই থেমে পড়ল কার্তিক। চলচিত্রমের সামনে। সেই পোস্টারটার গায়ে এখন দুটো বাম্পার চোখ ঝলসানো লাইট ফেলা রয়েছে। আরও ফাটাফাটি লাগছে গুরুকে। বইটা সত্যিই দেখা হবে না! কথাটা মনে আসতেই মেজাজটা খিঁচড়ে গেল। শালা কপালটাই খারাপ।

দু-তিনবার মেঘ ডাকল চাপা স্বরে। সন্ধে নেমে গেছে। এখনও ভাঙনহাটি মর্গ মেন রাস্তা ধরে অনেকটা। প্রায় ঘন্টাখানেক তো বটেই। ভাবতে ভাবতে গায়ে দুফোঁটা জল পড়ল আকাশ থেকে। আর বৃষ্টির সঙ্গে কয়েকফোঁটা বুদ্ধিও এসে টুপ করে পড়ল কার্তিকের মাথায়। ভ্যান থেকে নেমে শোয়ানো বডিটার সামনে এল ও। আগাপাশতলা প্লাস্টিক দিয়ে মোড়া। তার ওপর আবার একটা প্লাস্টিক টানটান করে তার কোণাগুলো দড়ি দিয়ে এমন করে বাঁধা রয়েছে যে, বাইরে থেকে কারও বোঝার উপায় নেই ভেতরে কী রয়েছে। এইভাবেই বরাবর বডি নিয়ে যায় কার্তিক, নইলে রাস্তায় লোকে ডিস্টার্ব করে। দুনিয়ার প্রশ্ন লোকের।

খুব ধীরেসুস্থে সাবধানে ভ্যানটাকে হাতে ঠেলে সিনেমা হলের চত্বরে ঢুকিয়ে নিল কার্তিক। চত্বরটা ফাঁকা। হলের সামনেও লোকজন কেউ প্রায় নেই। বই শুরু হয়ে গেছে বোধহয়। নাকি শেষ? ভ্যানটাকে এককোণে রেখে গুটিগুটি পায়ে টিকিট কাউন্টারের কাছে গেল। মুখ নামিয়ে বলল, ‘দাদা বই শুরু হয়ে গেছে?’

‘এই একটু আগে হল। কটা চাই?’

‘একটা দিন।’ লুঙ্গির গেঁজ থেকে একশো-র ভাঁজ দেওয়া নোটটা আরও ভাঁজ করে শেষ পর্যন্ত গলিয়েই দিল কার্তিক। সত্তর টাকা আর একটা লাল রঙের টিকিট ফেরত এল হাতে। টিকিট হাতে নিয়ে ভেতরে ঢোকার আগে আরেকবার পিছন ফিরে ভ্যানটাকে দেখল কার্তিক। চুপ করে দাঁড়িয়ে রয়েছে ওটা, আর সামনে একটা নেড়িকুকুর ওটার দিকে তাকিয়ে লেজ নাড়ছে।

আবার মেঘ ডাকল। প্ল্যান মনে মনে ছকা হয়ে গেছে। বই দেখে তারপর বডি নিয়ে মর্গে যাবে। দেরি হওয়ার কারণ জিজ্ঞেস করলে বলতে হবে বৃষ্টিতে রাস্তায় আটকে গেছিলাম। ব্যস। জয়গুরু বলে অন্ধকার হলে ঢুকে পড়ল কার্তিক। এই হলে আগেও অনেকবার বই দেখেছে ও। সিট নাম্বার বলে কিছু নেই। যে আগে ঢুকবে তার নিজের পছন্দের মতো সিটে বসে পড়বে। ঘষা ধোঁয়াটে স্ক্রিন। সামনের দিকের বেশ কিছু চেয়ার ভেঙে মুখ থুবড়ে পড়ে রয়েছে। বোঝাই যায় এই অবদান দর্শকদের। আসলে এই হলটায় কিছুদিন আগেও তেড়ে পানু চলত। বাইরে পোস্টার থাকত আশির দশকের কিছু সস্তার হিন্দি ছবির। সেই ছবি শুরুও হতো, কিন্তু চলার কিছুক্ষণ পরেই চালু হয়ে যেত সাউথ ইন্ডিয়ান ব্লু। মাঝেমধ্যেই সেই ছবি অদ্ভুত ভাবে উলটে যেত কিংবা পুরোটা অন্ধকার হয়ে যেত। তখনই দর্শকের অশ্রাব্য খিস্তি। চেয়ারে লাথি। অনেক সময়ে দর্শকের হুকুমে একই সিন দুবার করেও চালাতে হতো প্রজেক্টরদের। এইসব ছবির দর্শক ছিল সব ভ্যানওলা, রিকশাওলা কিংবা সবজিওলা, মিস্তিরি আর স্কুলকলেজে পড়া কিছু উঠতি বয়েসের ছেলে। পুলিশকে প্রতি সপ্তাহে নমস্কারি দিয়ে আসতে হতো হল কর্তৃপক্ষকে।

তবু মাঝেমধ্যে রেড পড়ত আচমকা। যেসব দর্শকরা পিছনের দরজা দিয়ে পালাতে পারত না, ধরা পড়ত। হলের লোকের সঙ্গে পুলিশ ভ্যানে উঠতে হতো তাদেরও। বেশ কয়েকদিন বন্ধ থাকত হলটা। তারপর আবার যেই কে সেই। কিছুদিন আগে একটা বড়োসড়ো কেস খাওয়ার পর হলটা এখন পানু ছেড়ে বাংলা বই চালাচ্ছে। হল ভরতি নয়। সিটে বসে পড়ল কার্তিক। ওই তো গুরু… উহ্ কী দেখাচ্ছে দেবকে। পাশে একজন লুঙ্গি আর গেঞ্জি পরে সিটের ওপর পা তুলে বিড়ি টানছিল, তাকে জিজ্ঞেস করল কার্তিক। ‘কখন শুরু হল?’

‘এই তো এট্টু আগে।’

‘যাক তার মানে বেশি লস হয়নি।’ খানিকক্ষণের মধ্যেই ডুবে গেল ছবিতে।  মারকাটারি বই। উহহ না দেখলে যে কী লস হতো…। হেব্বি অ্যাকশন। দেবের নায়িকাটাকে অনেকগুলো গুন্ডা মিলে ছিঁড়েখুঁড়ে খাওয়ার জন্য তুলে নিয়ে পালাচ্ছিল। পাহাড়ের ধারে একটা জায়গায় শুইয়ে দিয়ে সবে জামাকাপড় ছিঁড়তে শুরু করেছে তখনই বাইকে করে গুরু এসে গেল। হাতে একটা লোহার রড। তারপর পনেরো-ষোলোটা গুন্ডার সঙ্গে একা ঝাড়পিট করল গুরু। রডের বাড়িতে, লাথিতে, ঘুসিতে সবকটাকে শুইয়ে দিল। কিন্তু লাস্টে তবু পারল না হিরোয়িনকে বাঁচাতে। আসলে ভিলেন দেবকে লক্ষ্য করে গুলি ছুড়েছিল। নায়িকাটা সামনে চলে আসায় দেব বেঁচে গেল কিন্তু মেয়েছেলেটার বুকে গুলি লাগল। মরে গেল মেয়েটা।

নায়িকাকে বুকে জড়িয়ে দেব এমন চিৎকার করে কাঁদছিল যে কার্তিকের চোখেও জল চলে এসেছিল। ইচ্ছে করছিল ভিলেনটাকে নিজের হাতে ক্যালাতে। তারপর দেব স্রেফ মুঠো পাকিয়ে একটা ঘুসি মারল ভিলেনটাকে। মালটা সেই ঘুসিতেই পাহাড় থেকে পুরো খাদে। সব্বাই হাততালি দিল। কার্তিকও। কিন্তু মনের ভেতর থেকে কষ্টের দলাটা নামল না। এত সুন্দর মেয়েটা মরেই গেল শালা। নায়িকাটার নাম জানে না কার্তিক। কিন্তু দেবের মতোই কাঁদতে ইচ্ছে করছিল ওর। খুব কাঁদতে ইচ্ছে করছিল। খুব কষ্ট নিয়ে হলের বাইরে আসতেই তুমুল চমক।

ওর ভ্যানটার সামনে ভিড়ে ভিড়। কয়েকটা কুকুর বিটকেল চিল্লাচ্ছে। আর ওর ভ্যানে শুইয়ে রাখা বডিটাকে টেনে নামানোর জন্য প্লাস্টিকটাকে সবকটা মিলে এমনভাবে টানাটানি করছে যে, প্রায় ছিঁড়ে ফালাফালা হয়ে গেছে ওটা। বডির বেশ খানিকটা দেখা যাচ্ছে এখন। সামনে দাঁড়ানো সবকটা লোকও বেজায় চিৎকার করছে। চুপ করে কিছুক্ষণ দাঁড়াল কার্তিক। এবার কী করা উচিত ভাবার চেষ্টা করল। ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি হচ্ছে। ‘কোন শুয়োরের বাচ্চা রেখে গেছে আমরা কী করে জানব?’ একজন চিল্লাল।

‘আরে কেউ বুঝতে পারত নাকি? কুকুরগুলো টানাটানি করে প্লাস্টিকটা ছিঁড়ল বলেই তো বোঝা গেল ভেতরে বডি রয়েছে। কী ঝামেলা বলুন তো এখন পুলিশের ঠেলা…।’

কার্তিক একবার ভাবল বডি ছেড়ে কেটে পড়বে। কিন্তু কুকুরগুলো এমনভাবে বডিটার পা ধরে কামড়ে নামাতে চাইল যে আর নিজের মাথার ঠিক রাখতে পারল না কার্তিক। আর দেরি করলে মেয়েছেলেটাকে সবার সামনে খুবলে খাবে ওগুলো।

আই সা..ল..লা..হ বলে দুহাত ছড়িয়ে দিগ্বিদিগ্ জ্ঞান হারিয়ে কুকুরগুলোর দিকে ছুটে গেল কার্তিক। কুকুরগুলো কার্তিকের এমন মারমুখী চেহারা দেখে একটু থমকাল, তারপর আবার বডিটার এদিক-ওদিক কামড়ে ভ্যান থেকে নামানোর চেষ্টা করল। সামনে দাঁড়ানো লোকগুলো যেন তামাশা দেখছে। সামনে পড়ে থাকা একটা কাঠের টুকরো তুলে এলোপাতাড়ি ঘোরাতে শুরু করল, দমাদ্দম পেটাতে শুরু করল যেটাকে সামনে পেল, অবিকল…

মিনিট কয়েকের মধ্যে রণে ভঙ্গ দিয়ে একটু দূরে দাঁড়িয়ে চেল্লাতে থাকল কুকুরগুলো। আর কার্তিক বড়ো বড়ো নিঃশ্বাস ফেলতে ফেলতে ভ্যানে শোয়ানো শরীরটাকে আবার গুছিয়ে নিয়ে ভ্যান টেনে চুপচাপ চলে যেতে গেল, ঠিক তখনই ওকে আটকাল ভিড়ের কয়েকটা লোক।

‘এই ভাই এই, এটা কোথায় নিয়ে যাচ্ছিস?’

‘মর্গে।’ মেজাজ নিয়ে উত্তর দিল কার্তিক। কুকুরগুলোর হাত থেকে মেয়েছেলেটাকে বাঁচাতে পেরে মনটা ফুলে উঠেছে। ভাগ্যিস ঠিক সময়ে এসে পড়েছিল। নইলে…

‘মানে?’ সবাই তাকাল ওর দিকে।

‘বই দেখতে ঢুকেছিলাম। এই বডি আর ভ্যান আমার। এই যে আমার কাছে জিআরপি-র কাগজ রয়েছে। বডিটা মর্গে…’

আর কথা শেষ হল না। কারও একটা সলিড থাপ্পড় এসে পড়ল কার্তিকের গালে। টাল সামলাতে না পেরে মাটিতে মুখ থুবড়ে পড়ে গেল কার্তিক।

শুরু হল অবিরাম লাথি, ঘুসি… আর খিস্তি। ‘শালা বাইরে লাশ রেখে সিনেমা মারাতে এসেছ… পাতাখোর…তোর রস বার করছি…’ মার খেতে খেতে বারবার দেবের কথা মনে পড়ছিল কার্তিকের। হেব্বি ইচ্ছে করছিল গুরুর মতো ইয়াআআ করে দুহাত ছড়িয়ে উঠে দাঁড়িয়ে সবকটাকে ক্যালাতে। একটু আগে যেভাবে কুকুরগুলোকে…। পারল না। মাটিতে কুঁকড়ে বসে একবার চোখ মেলল কার্তিক। তাকাতেই দেখল ওর পাশে বসা সেই লুঙ্গি পরা লোকটাও পা তুলছে ওকে লাথি মারবে বলে… আবার চোখ বন্ধ করে ফেলল।

অনেক রাত্তির। বৃষ্টি পড়ছে অঝোরে। বারবার বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। হু হু ফাঁকা রাস্তার এক ধারে থুবড়ে শুয়ে ছিল কার্তিক। জবজবে ভিজে। নড়াচড়া করতেও কষ্ট হচ্ছে। গোটা গায়ে অসহ্য ব্যথা।

বাঁ-চোখে কিছুই প্রায় দেখতে পাচ্ছে না। চোখটা পাবলিকের মারের চোটে গেছে বোধ হয়। অনেক উঁচুতে ল্যাম্পপোস্টের হলদেটে আলোটা বৃষ্টির ধোঁয়ায় ঝাপসা। হামাগুড়ি দিয়ে ভ্যানের চাকা ধরে কোনও মতে উঠে দাঁড়াল। এমন ক্যালানি বাপের জন্মে খায়নি ও। উহহ্…। মুখ ফুলে ঢোল। ঠোঁটের কষে রক্ত জমাট বেঁধে রয়েছে। একেবারে গুরুর মতো অবস্থা। বিদ্যুতের আলোয় ওর মুখটা অদ্ভুত লাগছে। হঠাৎ দাঁত কিড়মিড় করে বাঁহাতের তর্জনী তুলে কাউকে তীব্র শাসাল কার্তিক। তারপর রাস্তার মাঝখানে এসে দাঁড়াল। তুমুল বৃষ্টি পড়ছে। ছেঁড়াখোঁড়া প্লাস্টিকটা দিয়েই কোনওমতে ঢাকা দেওয়া ভ্যানের ওপর শোওয়ানো বডিটা। আজ আর মর্গে পৌঁছোতে পারেনি ও। শরীরে কুলোয়নি। তুমুল ক্যালানি খাওয়ার পর ভ্যান চালিয়ে খানিকটা যাওয়ার পরেই রাস্তার একধারে কেতরে পড়েছিল। মোবাইলটাও হারিয়েছে বলে কাউকে খবর দিতে পারেনি। কাল কপালে অশেষ দুঃখ আছে। কাজটা আর থাকবে না নিশ্চয়ই। কিন্তু কিছু করার ছিল না। শরীরে দিচ্ছিল না অত দূর ভ্যান টেনে যাওয়ার।

ভ্যানটার দিকে কিছুক্ষণ অপলক তাকিয়ে থাকল কার্তিক। মাথার ভেতর অনেক ভাবনা আসছে। ঝিমঝিম করছে মাথাটা। বারবার ক্যালানি খাওয়ার দৃশ্যটা মনে পড়ছে আর ভেতরটা রাগে জ্বলেপুড়ে যাচ্ছে। রাগটা বাড়তে বাড়তে একসময় প্রায় ঘোর লাগিয়ে দিল কার্তিকের সরষের দানার সাইজের ঘিলুতে। আস্তে আস্তে ভ্যানের চারদিকটায় পাক দিল। তারপর বেঘোরেই ভ্যানের সামনে এসে দড়িগুলো খুলে একটানে প্লাস্টিকটা সরিয়ে দিল ও। বডিতে জড়ানো কাপড়টা খুলতে এই জীবনে প্রথমবার খানিকটা যেন চমকালো কার্তিক। মুখ ঝুঁকিয়ে মেয়েটার মুখ খুব সামনে থেকে দেখল। চোখদুটো খোলা। মুখের কোথাও আঘাতের চিহ্ন নেই। কী সুন্দর মুখটা! হয়তো সুইসাইড নয়, ট্রেনে ধাক্বা খেয়ে দূরে ছিটকে পড়েছিল। আবার বিদ্যুৎ চমকানোয় মুখটা একঝলক দেখতে পেল। খুব চেনা মুখ… কোথায় যেন… দেবের নায়িকাটার মতো…?

হঠাৎ যেন মাথাটা পুরো এলোমেলো হয়ে গেল কার্তিকের। একদৃষ্টে অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইল মেয়েটার শরীরের দিকে। বুকের খাঁচা বেলুনের মতো ফুলছে নামছে উত্তেজনায়। শুয়োরের বাচ্চা… ইয়ায়ায়ায়ায়া… করে

দু-হাত ছড়িয়ে উঠে দাঁড়াল একবার, অবিকল দেবের স্টাইলে। তারপরেই মেয়েটার সামনে হাঁটু গেড়ে দুমড়ে নেতিয়ে বসে পড়ল। আকাশের দিকে মুখ তুলে করুণ কুকুরের মতো সুর করে বিকৃত কান্নার আওয়াজ তুলল। দু-হাত ছড়িয়ে কান্নার অভিনয় করতে করতে হঠাৎ সত্যি সত্যিই একটা মোচড় দেওয়া দুঃখ হল সামনে শুয়ে থাকা অচেনা মেয়েটার জন্য। নিজের বেখেয়ালেই কয়েক ফোঁটা জল বেরিয়ে এল ওর চোখ থেকে, অকারণে। কিন্তু নায়কদের সত্যি সত্যি কাঁদতে নেই বলেই বোধ হয় বৃষ্টির জল সঙ্গে সঙ্গে ধুইয়ে দিল সেই কান্না। বারবার বিদ্যুৎ চমকাচ্ছিল। কার্তিক চোখ বুজে বসে রইল সেই বৃষ্টিতে। আর মৃত মেয়েটার অবাক খোলা চোখের ভেতর বৃষ্টির জল গড়িয়ে পড়তে থাকল অবিরাম।

 

জ্যামিতিক

‘একটা চতুষ্কোণ মাটি দরকার, বুঝলেন?’ নীলাভ মাংকি-ক্যাপটাকে কপালের নীচে আকর্ষণ করল। অসম্ভব ঠান্ডা পড়েছে। বাতাস ভারী হয়ে আছে। শ্বাস নিতে কষ্ট হয়। তাছাড়া, মর্নিংওয়াক শব্দটায় যতটা আরাম এবং স্বাস্থ্যচর্চা মিশে আছে, বাস্তব অবশ্য অন্য কথা বলে। এই হাত, পা, এই শরীর এতটাই জড় যে, সামান্য নড়াচড়াও ভীতিকর। মানস হাতের রুপো বাঁধানো লাঠিটা জোরে ঠুকল মাটিতে, ‘কী হল? দাঁড়িয়ে পড়লেন যে।’

‘আসলে, ভাবছি। ক’দিন যাবৎ একটা কথাই ভাবছি’ নীলাভ মানসের চোখের দিকে তাকায় ‘একটা বাড়ি করতে পারিনি এখনও! আমার একটু মাটি চাই। দেড়-দুকাঠা হলেও হবে। খোঁজ আছে নাকি?’

‘বাড়ি? সাতকুলে কেউ নেই আপনার, বাড়ি করবেন কার জন্য?’

মানস থমকে গেল।‘আমার জন্যই। একটা বাড়ির স্বপ্ন দেখছি। খুব লোভ হচ্ছে জানেন! ভাবতেও ভালো লাগে! নিজের বাড়ি!’ নীলাভ অপ্রস্তুত হাসি লুকিয়ে ফেলার চেষ্টা করে।

মানস হেসে ফেলে। ‘এটা আবার ব্যাপার নাকি? হয়ে যাবে। ঠিক আছে। জানা রইল।’ মানস ভিজে ঘাসের উপর ফের লাঠি ঠুকল। শব্দ হল না। ভেজা মাটি কোনও শব্দ করে না। লাঠিটা দেখতে দেখতে বাস্তবের মাটিতে পা রাখছিল নীলাভ– ‘আচ্ছা! আজ দেখছি লেঠেল হয়ে বেরিয়েছেন! শখ?নাকি প্রয়োজন?’‘আরে, প্রয়োজন ছাড়া কি আর…! বুড়ো হতে কার ভালো লাগে বলুন? ক’দিন ধরেই যন্ত্রণা হচ্ছে পায়ে। তো, গিন্নি লাঠিটা এগিয়ে দিলেন, সঙ্গে রাখো। আরাম হবে। দেখছি কথাটা মিথ্যে নয়। আসলে, ভারটা অন্যের উপর রাখলে স্বস্তি মেলে।’ মানসের হাসি দেখতে দেখতে নীলাভর ঠোঁটও প্রসারিত হতে থাকে। স্থির লক্ষ্যে পৌঁছোনোর আগেই অবশ্য থেমে যায় নীলাভ। সত্যিই কি বার্ধক্য এসে গেছে? তাই কি চট করে ঠান্ডা লেগে যায়?

‘সব কিছু পালটে গেল কীরকম। এই শহরে তেত্রিশ বছর কাটিয়ে দিলাম। যখন এসেছিলাম চব্বিশ পঁচিশের টগবগে ঘোড়া!’ নীলাভ কুয়াশার ভেতর দৃষ্টি নিক্ষেপ করার চেষ্টা করে।

‘আমি যে পাঁচবছর ধরে আছি, আমারই তাই মনে হয়। পড়শি পর্যন্ত পালটে যায় মশাই। শহর একেই বলে।’ হা-হা শব্দে হাসে মানস। নীলাভ মনে মনে হাসে। মানস ভাড়াটের কথা বলছে। পাঁচ বছরের মধ্যে বাড়ি বানিয়েছে। ভাড়াটে বসিয়েছে। সারাদিন খ্যাঁচম্যাচ্! ধুর! নিজের বাড়িতে নিজের সঙ্গে বাস করার আনন্দ বুঝবে না মানস। বাড়ির সঙ্গে গৃহস্থের যা সম্পর্ক, ভাষার সঙ্গে বর্ণমালার সেই সম্পর্ক।

মানসের হাসির শব্দে জগিং-এ ব্যস্ত তরুণী চমকে তাকাল। দু-একজন স্বাস্থ্য অন্বেষণকারী ওঁদের দেখছে বুঝে লজ্জিত হয় নীলাভ– ‘আস্তে! আস্তে!’

‘ওঃ! ভাষার সঙ্গে বর্ণমালা আর গৃহস্থের সঙ্গে বাড়ি? দারুণ!’

‘কথাটা চুরি করেছি। গণিতশাস্ত্রবিদ ইউক্লিডের কথা এটা। অবশ্য একটু অন্যভাবে বলা।

‘তো, কী বলছিলেন? গৃহস্থ আর বর্ণমালা…?’

নীলাভ হাসল। ‘দেখুন, এসব তত্ত্বের জন্য যুক্তিতর্ক দরকার হয় না। একে স্বতঃসিদ্ধ মেনে নিতে পারেন। সত্য বলে ভাববেন।’

‘না না! তা বলছি না। তবে, কথাটা বেশ।’ মানস লাঠিখানা মাটির উপর থেকে তুলে নেয়। নীলাভ একটু দাঁড়াল। ইদানীং হাঁপ ধরে যাচ্ছে সহজেই। দুপাক হাঁটতেই মাঠটাকে বিশাল এবং ভয়ংকর বলে মনে হচ্ছে। যেন বিরাট শূন্যতা গিলে খেতে আসছে। যেন হারিয়ে যাবে নীলাভ এই মহাশূন্যতায়। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে শারীরিক ও মানসিক অবস্থার পরিবর্তন হচ্ছে। কেন পালটে যাচ্ছে শরীর, বা কেন মানসিক অবস্থা পরিবর্তিত হয়ে যায় তার কোনও যুক্তিতর্ক নেই। প্রশ্ন নেই। এসব হল স্বতঃসিদ্ধ।। এলিমেন্টস নামক বইতে ইউক্লিড একথা বলেছেন।

মানস গিন্নির দেওয়া লাঠিখানাকে ফের ভেজা মাটির উপর বসিয়ে দিয়ে হাঁটতে শুরু করেছে। একটা লাঠি তো নীলাভরও দরকার ছিল। কিন্তু কে এগিয়ে দেবে সেই স্বস্তি-দণ্ড? মানস জানে সাতকুলে কেউ নেই নীলাভর। যদি থাকত, তবে এই কুয়াশাভরা মাঠে রুপোর লাঠি আজ নীলাভর হাতেও থাকত।

এখনও কুয়াশা ছড়িয়ে আছে মাঠ জুড়ে। দূরে দূরে দু-একটা ধোঁয়ামূর্তি নজরে আসে। শুদ্ধ বাতাস শহরে নেই। চারপাশে কি কুয়াশা? নাকি ধোঁয়াশা?

‘আজ মেয়ে-জামাই আসছে গোরখপুর থেকে। ওখান থেকে নেপালে গেছিল। মায়ের জন্য নানাবিধ গিফ্ট আসছে। ওর মা-তো গত কাল থেকেই টেনশনে… কী আনবে ওরা…!’ মানসের সুখী মুখে লালচে গোলাপ ফুটেছে। এই তো জীবন! সুখ নিয়ে বেঁচে থাকা। মানস হাসিহাসি মুখ করে, ‘গিন্নি বায়না ধরেছেন জামাইকে মালাই চিংড়ি খাওয়াবেন। নারগিসি কোফতা বানাবেন! হই হই কান্ড। বুঝেছেন?’

বুঝল নীলাভ। মানস এখন ফিরতে চাইছে। কাজ আছে বাড়িতে। ফিরে আসতে গিয়ে শর্টকাট করতে চাচ্ছিল মানস। নীলাভ কথাবার্তায় ভুলিয়ে সোজাপথে নিয়ে এল মানসকে। শর্টকাট অপছন্দ নয়। তবে, ওই পথটা বড়ো কঠিন পথ। একটা অস্বস্তিকর অবস্থা তৈরি হয়। মাস ছয়েক আগে একদিন অবশ্য গেছিল। আজ আর গেল না। একদিন গেলে কদিন যাবৎ অস্বস্তিটা জাপটে থাকে শরীর-মনে। বড্ড কষ্ট হয়। ভয় হয়। যেন স্বপ্নে দেখা নিঃসঙ্গ পথ। আলো নেই। আশ্রয় নেই। শূন্যতা কেবল। ভালো লাগে না। আবার, ভুলেও থাকা যায় না।

বাজারের রাস্তা ধরল মানস। বাজার ছাড়িয়ে ডানদিকের সরু গলিতে ঢুকে পড়ল নীলাভ। এবার শর্টকাট। তার আস্তানাটা আবার কাছে নয়। সোজাপথে সময় লাগবে।

বাসার কাছাকাছি আসতেই সীমন্তর সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। মেসবাড়ির মেস-ম্যানেজার সে-ই। বাজার সেরে ফিরছে। নীলাভকে দেখে দাঁড়াল। ‘নীলাভদা যে! আজ বিফোর টাইমে!’

হাসে নীলাভ। ‘কী আনলে। কী মাছ?’

‘মাছ নয়। মাংস। সবাই ধরে বসল।’

‘কেন? কোনও ব্যাপার আছে বুঝি?’

‘না, মানে ওই আর কী…!’ সীমন্ত এদিক-ওদিক তাকায়।

ছেলেটা স্পষ্ট হল না। অথচ ভেতরে একটা কথা আছে ঠিক। বেশ। খেতে বসে জানা যাবে।

বারান্দায় টিনের চেয়ার টেনে বসল নীলাভ। কাগজফুল গাছে অনেক ফুল ফুটেছে। আসলে বোগেনভিলিয়া। তারা ছেলেবেলায় কাগজফুল বলেই জানত। এমন প্রাণময় গাছটার এমন একটা জড় নাম কেন ছিল? লিপ্তা বলেছিল, এই ফুলে পুজো হয় না। কেন হয় না? লিপ্তা জবাব দিতে পারেনি। অবশ্য অনেক কথারই জবাব দিতে পারেনি লিপ্তা। কখনও পারেনি। ভরাট ঠোঁট টিপে দাঁড়িয়েছিল মাত্র। যুগলপ্রসাদ রোদে দাঁড়িয়ে খবরের কাগজ পড়ছিল। ছেলেটা চমৎকার বাংলা বলে। মাঝে মধ্যে তৎসম শব্দও ব্যবহার করে। ডাকল নীলাভ ‘এই যে যুগল!

ঠান্ডা কীরকম?’

‘ঠান্ডা?’ যুগল পেছন ফিরে তাকাল ‘উত্তরোত্তর বেড়ে চলেছে। আর কদিন পর শৈত্যপ্রবাহ শুরু হবে।’

কিছু বলতে মুখ খুলেছে নীলাভ, দীপংকর চ্যাঁচাল– ‘খাবার রেডি। ফটাফট এসে পড়ুন সবাই।’

খেতে বসে আসল কথাটা জানা গেল। সীমন্তর ছেলে হয়েছে। আজই। সকালে ফোন এসেছে। আগামিকাল সীমন্ত যাচ্ছে বালুরঘাটে শ্বশুরবাড়িতে। ছেলেকে দেখতে।

খুশি হওয়ারই কথা। খুশিই হল নীলাভ। সীমন্তর চনমনে মুখের দিকে তাকিয়ে অন্যমনস্ক হয়ে পড়ল ও। বারান্দায় কে জল ফেলে রেখেছে। পড়তে পড়তে বেঁচে গেল। যে-যার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়বে। একমাত্র ওর কোনও কাজ নেই। ধীরেসুস্থে স্নান সেরে খবরের কাগজ নিয়ে বসবে। কাগজফুল গাছটা বাতাসে ফুলপাতা দুলিয়ে চলেছে খসখস শব্দে। যেন বই-এর পৃষ্ঠা উলটে যাচ্ছে নিজে থেকে। কত ঘটনা কত মিলন-বিচ্ছেদের কাহিনি লেখা আছে সেইসব পৃষ্ঠায়।

আজ সবাই খুশি। সীমন্তর ছেলে এল। মানসের মেয়ে-জামাই এল। চিংড়ি রেঁধেছে মানসের বউ। স্বাভাবিক। খুশি হওয়ারই কথা। একটা জ্যামিতিক কোণ পুরো হল।

বাইকের শব্দে চটকা ভেঙে গেল। যুগলপ্রসাদ অফিসে গেল। দিবাকর সাইকেল বের করে আনছে বারান্দায়। ভূদেবের অফিস কাছেই। জিৎ, দেবনাথ ব্যাগ ঝুলিয়ে মেট্রো ধরতে দৌড়োচ্ছে। এই লোকটা কখনও হাসে না। ঠিক এইরকম একটা স্কুটার ছিল নীলাভর। এটা কার? সজীবের। সজীব স্কুটার ঠেলে নামাচ্ছে। নীলাভ হাটবাজার, অফিস… সর্বত্র স্কুটার নিয়ে চলত। অবশ্য লিপ্তা ছিল। পিছনে বসে জাপটে ধরে থাকত। জীবনটা বেহিসেবি হয়ে গেল নীলাভর! হিসেব করে চলতে শেখা হল না!’

অন্যদিন সন্ধে রাতে শুয়ে পড়ে। আজ ইচ্ছে হল না। নানা ভাবনায় মাথাটা গরম। প্রেশারটা চেকআপ করাতে হবে। একটু শুয়ে থাকলে হয়তো ভালো লাগবে। নাঃ! বসে থাকাই ভালো। অস্থির নীলাভ ফের শুয়ে পড়ে। কে ডাকে? অর্ণব স্যার? চার পাঁচজন ছেলেকে ডেকে ব্ল্যাকবোর্ডের সামনে দাঁড়িয়ে কী বোঝাচ্ছে?

‘দ্যাখ, একটা সরলরেখা অন্য দুটো সরলরেখাকে ছেদ করলে, একপাশের দুই কোণের সমষ্টি যদি একশো আশি ডিগ্রির কম হয়, তাহলে সরলরেখা দুটোকে দুই পাশে বাড়ালে কোথাও না কোথাও মিলবেই।’ চক দিয়ে খসখস শব্দে সরলরেখা টানে অর্ণব স্যার! সেই শব্দে চোখ মেলে তাকায় নীলাভ। স্বপ্ন দেখছিল! আর ঘুম হবে না। উঠে জল খেল নীলাভ। কনকনে ঠান্ডাজল গলা কেটে ফেলল ধারালো অস্ত্রের মতো। মধুমিতা ঠান্ডা জল খেতে দিত না। ফ্লাস্ক রাখত টেবিলে। গরম জলের ফ্লাস্ক। কিন্তু এতদিন পর ছেলেবেলার স্যার কেন এল স্বপ্নের ভেতর? কী শেখাল এতক্ষণ ধরে? কেন বলল না নীলাভর জীবনের খামতির কথাটা? কেন নীলাভর জীবনের দুটো কোণের সমষ্টি একশো আশি ডিগ্রি হয়নি? একটা চতুষ্কোণ মাটি পাওয়া হল না। তার ভিতরে ঘর। তার ভিতরে সংসার। মধুমিতাও কি এভাবেই ভাবে? হয়তো ভাবে, হয়তো ভাবে না। সে তো সাহিত্যের ছাত্রী! একটু নরম, একটু লাজুক। স্কুটারের পেছনে বসতে ভয় পেত। মুকুন্দপুরে বন্ধুর বাড়িতে যাচ্ছিল। সিল্কের শাড়ি পিছলে মধুমিতা…! লজ্জায় কেঁদে ফেলেছিল। বন্ধুর বউ বকুনি দিয়েছিল। ‘বউ পড়ে গেল, আপনি হাসছেন?’

বাড়িতে ফিরেও রাগ পড়েনি মধুমিতার। অনেক কষ্টে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে হয়েছে। অঝোর বৃষ্টি পড়ছিল সে রাতে। মধুমিতা বিরহের গান গেয়েছিল। ভালো গাইত ও। নীলাভ চেয়েছিল মধু গানের চর্চা রাখুক। ভালো গাইত।

দু-চারজন ছাত্রীও জুটে গেল। সে সময়ই এল লিপ্তা।

গাঢ় অন্ধকারের দিকে জোনাকি খুঁজল নীলাভ। টর্চটা কোথায়? এত অন্ধকার কেন? আজ কি অমাবস্যা? এই যে টর্চ…! লিপ্তার চটক ছিল। স্মার্টনেসও। গুছিয়ে শাড়ি পরত লং কোটের সঙ্গে। মনে মনে কি এমনই একটা অন্বেষণ ছিল? নিজের মনকে বুঝতে পারেনি নীলাভ!

চোখ বুজে ফেলল। ভালো লাগছে না। বরং বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালে ভালো লাগবে। …নাঃ! খুব ঠান্ডা বাইরে। অসুখ হলে কে দেখবে? অথচ প্রবল ঠান্ডা বলে কিস্যু ছিল না। আগুন জ্বলত শরীর-মনে। দাউদাউ আগুন। লিপ্তার হাজব্যান্ড তখন চণ্ডীগড়ে। কোয়ার্টার পায়নি। টু বিএইচকে ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে চার বন্ধু থাকত। লিপ্তাকে সেখানে নেওয়ার সুবিধে ছিল না। এদিকে লিপ্তার তখন অখন্ড অবসর। গান শিখতে আসত মধুমিতার কাছে। আর নীলাভ? কী করে যেন সব ভুলে যেতে থাকল। এমনকী গোল্ডিকেও!

মধুমিতা যখন সব বুঝল, তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। ততদিনে মুক্তির সন্ধান করছে নীলাভ। মধুমিতার হাত থেকে মুক্তি। প্রথম প্রথম ঝগড়াঝাঁটি। তারপর স্পষ্টভাষায় মুক্তি চাইল নীলাভ। লিপ্তাকে ছাড়া ওর আর পৃথিবী বলতে কিছুই কি ছিল?

উঃ! কী মশা বাইরে! নীলাভ ফের মশারির ভেতরে ঢুকে পড়ে। কখন ভোর হবে।… স্তব্ধ হয়ে গেছিল মধুমিতা। তারপর জড়তা ভেঙেছিল। ‘মুক্তি চাইছ যখন, যাও। একদিন বুঝবে কত কঠিন কাজ করলে আজ। কিন্তু আরও কঠিন কাজ রয়ে গেল। আর কখনও ফিরে আসতে পারবে না।’

ইচ্ছেও ছিল না ফিরে আসার। বাড়িটা তো মধুমিতার। উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া। সে বাড়ি কখনও নীলাভর ছিল না। খোলামেজাজে বেরিয়ে এসেছিল। মুক্তি! আবার বাঁধা পড়ার জন্য মুক্ত!

মাত্র সাতদিন আগেই শ্যামবাজার পাঁচমাথার মোড় থেকে লিপ্তার পছন্দমতো জাংক জুয়েলারি সেট কিনে দিয়েছিল নীলাভ। ফেডেড জিন্সের সঙ্গে দারুণ মানিয়েছিল লিপ্তাকে।

‘একি? ঘুমোননি এখনও?’ দিবাকর বাথরুমে যাচ্ছে।

‘ক’টা বাজল দিবাকর?’

‘মর্নিং ওয়াক? দেরি আছে। সবে আড়াইটে। ঘুমোন।’

বাথরুমে জলের শব্দ। ছলছল শব্দে বয়ে যাচ্ছে জল। এভাবে বয়ে গেল একটা জীবন। মধুমিতা কখনও কিছু দাবি করেনি। ওর এতটা আত্মসম্মানজ্ঞানের সন্ধান আগে পায়নি নীলাভ। বুঝতেই পারেনি। এখনও কি মধু আগের মতই আছে? আর লিপ্তা? ভয় পেয়ে গেছিল নীলাভর পাগলামিতে। অথচ বুঝতে দেয়নি। বর চণ্ডীগড়ে নাকি ফ্ল্যাট কিনেছে। লিপ্তা চলে গেল সংসারের খোঁজে। সেই চতুষ্কোণ মাটির গল্প। নাকি নীলাভকে বিশ্বাস করতে পারেনি? যে লোক অতি সহজে চতুষ্কোণ মাটি ভেঙে ফেলে বেরিয়ে আসতে পারে তাকে বিশ্বাস করেনি লিপ্তা। মানস কী যেন বলছিল? সাতকুলে কেউ নেই, মাটি দিয়ে কী করবে? সত্যি! কী করবে তুমি? কে থাকবে তোমার মাটিতে? বৃত্তাকার ঘেরাটোপে তুমি এক স্বতন্ত্র নিঃসঙ্গ সত্তা নীলাভ!

ওফ্! এত মশা! মশারির গায়ে আটকে গুনগুন করে চলেছে। ওর দিকে আঙুল তুলছে মশারা। অভিযোগের বাণ ছুড়ছে! মাথা ধরে যায়!

শেষ রাতে ঘুমিয়ে পড়ল নীলাভ। মানস ডাকতে এসেছে। উঠে গরম পোশাক চাপিয়ে কুয়াশার ভেতরে নেমে গেল ওরা। বকবক করছিল মানস।

‘নাতনিটি বুঝলেন, পাকা দি গ্রেট। পটপট কথা বলে। খুদে ঠাকুমা। বলে, একা একা বের হবে না কিন্তু। পড়ে গেলে কে ধরবে? ভাবুন!’ হাঃ হাঃ শব্দে হাসে মানস। সেই হাসিতে সুখের গন্ধ ওড়ে।

মানস জোরে হাঁটতে পছন্দ করে। পায়ের যন্ত্রণাটা হয়তো নেই। আজ তো লাঠিও আনেনি। নীলাভ তাল রাখতে পারছিল না। শরীর বশে নেই। হাঁটু যেন ভেঙে পড়ছে।

‘শরীর ভালো নয় নাকি? চলুন, ফিরে যাই। আমার বাড়ি চলুন। গরম চা হয়ে যাবে এক রাউন্ড।’

না। আর কেন। লোভ হয় ঠিকই। কিন্তু সামলাতে জানতে হয়। সেটা জানা ছিল না বলেই হয়তো জ্যামিতিটা সম্পূর্ণ হল না। মানস বার তিনেক কথা চালাতে চেষ্টা করল। কিন্তু নীলাভর তরফ থেকে প্রত্যুত্তর না পেয়ে নীরব হয়ে গেল। ধীর পায়ে হাঁটছিল নীলাভ। মানস অবাক হল। নীলাভ আজ সোজা পথ ধরছে না। শর্টকাট করবে নাকি? গতকালও যেতে চায়নি। আজ নিজে থেকে….? কিছু বলছিল মানস। নীলাভ শুনতে পায়নি। বিষম উত্তেজনায় ধড়ফড় করছিল বুক। কেন যাচ্ছে এপথে? অদৃশ্য এক সুতো যেন প্রবল আকর্ষণে নিয়ে যাচ্ছে ওকে। ছ-মাস আগে একবার এই রাস্তায় ঢুকেছিল। তাকাতে পারেনি। আজ তাকাবে। পূর্ণ দৃষ্টি মেলে দেখবে।

বাড়ির চেহারাটা অন্যরকম হয়ে গেছে! দোতলাই আছে অবশ্য। গোল্ডিকে দেখেছে একদিন। সঙ্গে গোল্ডির বউ ছিল। কেনাকাটা করছিল। মধু এখন শাশুড়ি। ছেলে, ছেলের বউ নিয়ে মধুমিতা সুখী? সবটাই হল মানিয়ে নেওয়া। সুখ তো সোজা পথেই আসে। শর্টকাটে তাকে পাওয়া যায় না।

‘কী ভাবছেন?’

‘কিছু বললেন?’

‘বলছি, এসব জায়গায় কত বাড়ি উঠেছে। ক’মাস আগেও ফাঁকা ছিল। প্রোমোটর-রাজ শুরু হয়ে গেছে।’

ঠিক। ফাঁকা ছিল এদিকটা। বারান্দায় দাঁড়ালে অনেকটা দেখা যেত। পাড়ার দোকানি, পাশের বাড়ির বকুল, পলাশ… চিনে ফেলবে কি নীলাভকে? কেন চিনবে না? নিশ্চয়ই ওরা দেখেছে ওকে। একই জায়গায় যখন বসবাস!

‘মশাই, প্রোমোটররা যা সব হয়েছে…’ মানস বকবক চালিয়ে যাচ্ছে।

এক ঝলকের জন্য তাকাল নীলাভ! বাড়িটার সামনে দিয়ে চলে যেতে যেতে একবার চোখ তুলল ও। কেউ কি ছিল জানলায়? পর্দাটা নড়ছে না? না। কেউ নেই! কাকে আশা করেছিল নীলাভ!

‘ওই বাড়িটা’ আঙুল তুলে দেখাল নীলাভ ‘ওই যে হলদে… দোতলা বাড়িটা… ওই বাড়িতে… আমার…!’

‘রিলেটিভ? চেনা লোক?’

রিলেটিভ? কি জানি! রিলেশন না থাকলে রিলেটিভ হয়? বলা যায়? নীলাভ আঙুলটা নামাতে ভুলে যায়।

‘আগে সাদা রং ছিল। হাতির দাঁতের মতো রং। দোতলার বারান্দায় জাফরি ছিল।’

‘ও।’

‘ছেলেটা খুব ছোটো তখন। বছর পাঁচেক। খুব হাসত। একটা দাঁত পড়েছিল। ফোকলা। বললে বিশ্বাস করবেন না কোলে নিলে কাঁধের কাছটা লালা ফেলে ফেলে ভিজিয়ে দিত।’ হাঃ হাঃ শব্দে হাসতে থাকে নীলাভ। এই ঘটনার মধ্যে অবিশ্বাস্য ব্যাপারের অন্বেষণ করতে নীলাভর মুখের দিকে অবাক হয়ে তাকায় মানস।

‘এত পরিচিত যখন, গেলেই পারেন, সময়ও কাটে।’ গলায় মাফলার জড়াতে জড়াতে পরামর্শ দেয় মানস।

‘যাব? যাওয়া যায়?’ ভীষণ বিস্ময়ে মানসকে দেখে নীলাভ। মধুমিতা বলেছিল এ কাজটা আরও কঠিন। সত্যি কথা। গেট খুলে ডোরবেলে আঙুল রাখা যাবে? কে খুলবে দরজা? কে দাঁড়াবে দরজা খুলে? গোল্ডি? গোল্ডির বউ? নাকি…

কে যেন বলেছিল শূণ্যস্থানে কোনও বস্তু থাকলে তা তার চারপাশের জায়গাটাকে দুমড়ে মুচড়ে দেয়। বাঁকিয়ে দেয়। কোথায় যাবে নীলাভ? ওর জন্য কোনও সহজ পথ নেই। কোনও সরলরেখা নেই। সবটাই বক্ররেখা! কতদিন শূণ্যস্থানে থাকবে নীলাভ? চারপাশ যে দুমড়ে মুচড়ে গেল! কেন এত দেরি হল সবকিছু বুঝতে? অর্ণব স্যার তো কবেই বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। বুঝেও ছিল। কিন্তু বুঝেছিল কি সত্যি? তাহলে প্রয়োগ করতে পারেনি কেন? কেন লিপ্তার দিকে অমন প্রবলবেগে ভেসে যাচ্ছিল ও?

হঠাৎই শীত করে ওঠে নীলাভর। এতক্ষণে যেন টের পেল শীতকাল এসে গেছে! জল বরফ হয়ে যাচ্ছে! প্রবল শৈত্যপ্রবাহের মধ্যে দুঃসহ ভীতি এসে হাত পা নখ বের করে তাড়া করে। বিশাল ফাঁকা মাঠ হুহু শূণ্যতার মধ্যে টেনে নিতে থাকে নীলাভকে।

মানস কিছু বলছিল। শুনতে পেল না নীলাভ।

মানসের পাশে পাশে হেঁটে যায় এক উদ্বাস্তু। একা নিঃসঙ্গ!

 

জন্মের গল্প

বছর তিনেক ধরে আমার স্বভাবে একটা উল্লেখযোগ্য বদল এসেছে, অন্যমনস্কতা বেড়েছে ভীষণ ভাবে। বিশেষ করে অফিস ছুটির পর। কখন যে বাস, ট্রেন ধরে আমাদের স্টেশনের কাছাকাছি চলে আসি, হুঁশ থাকে না। সম্বিৎ ফেরে লোকাল ট্রেনটা যখন ব্রিজের ওপর এসে পড়ে। গমগম আওয়াজ শুনে এগিয়ে যাই গেটের দিকে। ব্রিজ পার হলেই দেবনগর স্টেশন, জন্মাবধি এই অঞ্চলেই আমার বসবাস।

আজ আমাকে অন্যমনস্কতা সেভাবে গ্রাস করতে পারেনি। ডাউন লোকাল প্ল্যাটফর্মে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে লাফিয়ে উঠে পড়েছি, এটাই আপ-এ যাবে। কামরায় তাড়াতাড়ি ওঠার সুবাদে পেয়েছি জানলার পাশের সিট। অন্যমনস্ক হওয়ার জন্য আদর্শ বসার জায়গা। কিন্তু হতে পারছি কই! মনের মধ্যে একটা অস্থিরতা কাজ করছে, চাপা টেনশন। উদ্বেগটা গল্পের প্লট খুঁজে পাওয়া নিয়ে। গত তিনবছর ধরে আমার একটা বিশেষ পরিচয় তৈরি হয়েছে, আমি একজন লেখক। নামি বাণিজ্যিক পত্রপত্রিকায় আমার লেখা নিয়মিত ছাপা হয়। এখন অবধি গল্পকার। উপন্যাসে হাত দিইনি। কবিতা আমার ঠিক আসে না। প্রবন্ধ লেখার মতো পাণ্ডিত্য আমার নেই। গল্প লেখা শুরু করেছিলাম কলেজবেলায়, কয়েকজন সাহিত্যপ্রেমী বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে। দু’তিনটের বেশি লিখিনি। বন্ধুরা ভালো বলেছিল। তবে চর্চাটা আর এগিয়ে নিয়ে যাইনি। কারণ আমাদের নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবার। বাবা বড়োবাজারের এক ওষুধের হোলসেলারের খাতা লেখে। দাদার লেখাপড়ায় আগ্রহ ছিল না। হায়ার সেকেন্ডারি-র পর বিভিন্ন বিজনেস ট্রাই করে যাচ্ছিল। পুঁজির জোর নেই, ফেল করছিল বিজনেসগুলো। বাড়িতে মা, শ্বশুরবাড়ি ফেরত পিসি আর বোন, তখন স্কুলে পড়ে সে। একার রোজগারে ছ’জনের খাওয়াপরা চালাতে হিমসিম খেয়ে যাচ্ছিল বাবা। এরপর বোনের কলেজে পড়া, বিয়ে দেওয়া এসব আছে।

গল্প লেখার শৌখিনতা সরিয়ে রেখে পড়াশোনায় মন দিয়েছিলাম। কেমিস্ট্রিতে অনার্স নিয়ে বেরিয়েই ঢুকে গিয়েছিলাম এখনকার চাকরিতে। একটা কেমিক্যাল ফ্যাক্টরির ল্যাব অ্যাসিস্ট্যান্ট আমি। আমার চাকরির টাকায় একটু স্বস্তির বাতাস বইতে শুরু করেছিল সংসারে। এদিকে দাদাও ফুড প্রোডাক্ট সাপ্লাইয়ের বিজনেসে মোটামুটি দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। তার সুফল অবশ্য সংসারের গায়ে তেমন লাগেনি, দাদা দ্রুত বিয়ে করে নিয়েছিল বহুদিন অপেক্ষায় থাকা প্রেমিকাকে। তবু বলব দুই ভাই দাঁড়িয়ে যাওয়াতে আমাদের পরিবার নিত্যদিনের আর্থিক অনটন থেকে অনেকটাই মুক্ত হতে পেরেছিল।

ছুটির দিনগুলো সত্যিকারের অবসরের দিন মনে হতো। তখনই আমার মাথায় আবার গল্প লেখার পোকাটা নড়ে উঠেছিল। ভাবলাম, ছুটির সময়টা পাড়ায় আড্ডা না মেরে ভালো কাজে লাগাই। লিখে ফেললাম একটা গল্প। কাকে পড়াই? কেমন হয়েছে জানতে হবে তো। কলেজের সেই সব সাহিত্য অনুরাগী বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। কাউকে খুঁজে নিয়ে পড়ানোর চেয়ে একটা সহজ কাজ করে ফেলা যাক, গল্পটা পাঠিয়ে দিলাম সবচেয়ে নামি পত্রিকা ‘প্রিয়ভাষা’-র ঠিকানায়। আমি যে পাঠিয়েছি, কেউ তো জানতে যাচ্ছে না। মনোনীত না হলে লজ্জার কিছু নেই।

আমাকে অবাক করে গল্পটা ছাপা হয়ে গেল। লেখাটা পাঠানোর পর থেকেই প্রিয়ভাষার প্রতিটি সংখ্যার ওপর নজর রাখতাম।

যে-সংখ্যায় বেরোল আমার গল্প, দু’কপি কিনে ফিরলাম বাড়ি। এক কপি বাবার হাতে দিয়ে বলেছিলাম, এতে আমার লেখা একটা গল্প বেরিয়েছে।

সূচিপত্র ঘেঁটে গল্পের প্রথম পাতাটা বার করে ফেলল বাবা। তারপর আমার দিকে এমন ভাবে তাকিয়ে ছিল, যেন অচেনা কেউ! মুখে কিছু বলল না, পত্রিকাটা হাতে নিয়ে উঠে গিয়েছিল রান্নাঘরের দিকে। মায়ের উদ্দেশ্যে বলেছিল, মাধবী, তোমার ছেলে কী কান্ড ঘটিয়েছে দ্যাখো!

আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে গলাটা সামান্য কেঁপে গিয়েছিল বাবার। আসলে আমাদের বংশে এতবড়ো কান্ড কেউই ঘটায়নি। একেবারেই সাদামাটা গৌরবহীন বংশ।

বাবাকে যে-কপিটা দিয়েছিলাম, কদিনের মধ্যেই দুমড়ে-মুচড়ে একসা করে ফেলল। চেনাপরিচিতদের ধরে ধরে দেখাচ্ছে, পড়াচ্ছে ছেলের গল্প। এমনটা হবে আন্দাজ করেই আমি দু’কপি পত্রিকা কিনেছিলাম। প্রিয়ভাষার মতো বড়ো পত্রিকায় গল্পটা বেরোনোর ফলে চেনা, অচেনা মানুষের থেকে প্রচুর ফিডব্যাক পেলাম। কলেজের সেইসব সাহিত্য অনুরাগী বন্ধুরাও আমার ফোন নাম্বার জোগাড় করে নিজেদের উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছিল। উৎসাহিত হয়ে শুরু করে দিলাম একের পর এক গল্প লেখা। ছোটো, বড়ো, মাঝারি সব ধরনের কমার্শিয়াল পত্রপত্রিকায় ছাপা হতে লাগল। আমাদের এলাকার শিক্ষিত, বিদগ্ধ মহলে যথেষ্ট গুরুত্ব পেতে লাগলাম।

গত তিনবছর ধরে জাগ্রত অবস্থায় আমি গল্প নিয়ে ভেবে যাই। কখনও গভীর ভাবে, অফিসে কাজের সময় আলতো ভাবে। অফিস ছুটির পর ভাবনাটা সবচেয়ে বেশি জমাট বাঁধে। টানা আটঘণ্টার ডিউটি শেষ হওয়ার ফলে মনটা থাকে উৎফুল্ল, আইডিয়াগুলো দৌড়ে দৌড়ে এসে ঢুকে পড়ে মাথায়।

আমি যেহেতু কোম্পানির ল্যাবে আছি, তাই শিফটিং ডিউটি। ছ’টা দু’টো, দু’টো দশটা। সপ্তাহন্তর ডিউটির শিফট বদলে যায়। জেনারেল ডিউটি নয় বলে বাস, ট্রেন মোটামুটি ফাঁকা পাই। ভাবনায় বিশেষ বিঘ্ন ঘটে না। কিন্তু আজ এখন অবধি গল্প নিয়ে ভাবা শুরু করতে পারিনি। ইতিমধ্যে দু’টো স্টেশন পার করেছে ট্রেন। ক’দিন ধরেই এমনটা হচ্ছে। আসলে হয়েছে কি, এ বছরই প্রথমবার আমি পুজোসংখ্যায় গল্প লেখার আমন্ত্রণ পেয়েছি। ‘প্রিয়ভাষা’ থেকে নয়, প্রায় ওরকমই নামি একটি ম্যাগাজিনের সম্পাদক চিঠি দিয়ে লেখা চেয়ে পাঠিয়েছেন। গল্পটা কত তারিখের মধ্যে দিতে হবে লেখা আছে তাতে। চিঠি দিয়ে লেখা চাওয়াটাও আমার জীবনে প্রথমবার। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আমি যেচে পাঠিয়েছি, কয়েকবার মৌখিক আবেদনে দু’একজন সম্পাদক লেখা চেয়েছেন। ‘চিঠি’ মানে তো রীতিমতো অফিশিয়াল ব্যাপার! আর তাতেই বিরাট চাপে পড়ে গেছি আমি। কেমন যেন নার্ভাস লাগছে, সময় মতো যদি না দিতে পারি গল্পটা! আর তো কোনওদিন লিখতে বলবেন না সম্পাদক। পুজোসংখ্যায় লেখার সুযোগ হারানোর মানে, এক লাফে অনেকটা বিখ্যাত হওয়ার চান্স মিস করা। এমনটা কিছুতেই হতে দেওয়া যায় না।

কোনও গল্প লেখার প্রাথমিক পর্যায়টা আমার কাছে এই রকম, চার পাঁচটা প্লট মনের চারপাশে ঘুরঘুর করে। সবই অপূর্ণ, অস্পষ্ট। বলতে পারা যায় প্রায় বিষয়ের আকার। শুধুমাত্র গল্প হয়ে ওঠার ইঙ্গিতটুকু আছে সেখানে। যে-কোনও একটাকে বেছে নিয়ে মনে মনে পূর্ণতা দেওয়ার চেষ্টা করি। গল্পটা কোথা থেকে শুরু করব, এগোবে কেমন ভাবে, শেষ করব কোথায়… ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ভাবতে থাকি। যদি দেখি বেছে নেওয়া প্লটটাকে গল্প হিসেবে ঠিকঠাক দাঁড় করাতে পারছি না, সেটাকে তখনকার মতো সরিয়ে রেখে অন্য একটা প্লটকে নিয়ে আসি সামনে। ভাবনার এই প্রক্রিয়ায় হঠাৎই, বলতে গেলে আমার অজান্তে একটা প্লট পূর্ণতা পেয়ে যায়। লিখতে বসে যাই গল্পটা। কিন্তু এই প্রসেস কাজ করছে না পুজোসংখ্যার গল্পটা লিখতে গিয়ে। বাড়তি উত্তেজনা আর লিখিত আকারে দেওয়া সম্পাদকের ডেডলাইন আমার ভাবনার ধরনটাকে এলোমেলো করে দিচ্ছে। মনে মনে প্রণাম জানাচ্ছি সেই সব লেখকদের, যাঁরা বহুবছর ধরে ডেডলাইন মেনটেইন করে লিখে চলেছেন। আমার বোধহয় বড়ো লেখক হওয়া হল না।

ব্রিজের ওপর উঠে পড়ল ট্রেন। ছোটো খালব্রিজ। রোজকার সেই গমগম শব্দ আজ যেন আরও বেশি গম্ভীর শোনাচ্ছে। যেন ব্রিজটা বলছে, সময় পেরিয়ে যাচ্ছে তরুণ লেখক। নিজেকে প্রমাণ করার জন্য হাতে মাত্র পাঁচটা দিন।

প্ল্যাটফর্মে নেমে খেয়াল করি বেশ মেঘ করেছে আকাশে! ট্রেন হাওড়া ছাড়ার সময় এত মেঘ ছিল না। বিকেল চারটেতেই দেবনগরে সকাল সন্ধে। গা-ছাড়া ভাব নিয়ে প্ল্যাটফর্ম পার হচ্ছি, তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে কী হবে! লিখতে বসা হবে না। সাদা পাতার সামনে বসে ভাবতে হবে। ইদানীং আবার না লিখে চুপচাপ বসে থাকতে দেখলে বউদি তাড়া দেয়। বলে, কী এত ভাবছ বলো তো! তোমার বড্ড খুঁতখুঁতানি বাই। আরে বাবা, তোমার লেখাটাই এত সুন্দর, যা লিখবে লোকে গোগ্রাসে পড়বে। …বলার পর বউদি আমার জন্য চা বানানোর উদ্যোগ নেবে। মানা করলে বলবে, তুমি খেলে আমারও একটু খাওয়া হয় আর কি। আমার লেখা নিয়ে বউদির এই যে এত উৎসাহ, এর একটা কিঞ্চিৎ বাস্তব দিকও আছে। লিখে টুকটাক রোজগার হয় আমার। সেই টাকাটা বোন, বউদি কিছুতেই আমার মূল রোজগারের সঙ্গে মেশাতে দেবে না। লেখা ছাপা হয়েছে দেখলেই, দু’জনেই নানান বায়না করতে থাকে। শৌখিনতার বায়না। লিপস্টিক, পারফিউম, ঝুটোগয়না ইত্যাদি। মা, বাবা, দাদার জন্যেও কিছু কিনে আনে, আমার জন্যেও। এই খাতে খরচ করতে আমারও ভালো লাগে। পুজোসংখ্যায় গল্পটা লিখতে পারলে টাকা অনেক বেশি পাব। শুনেছি পুজোর লেখায় বেশি দেয়। সম্পাদকের চিঠিতে অবশ্য অ্যামাউন্টের উল্লেখ নেই।

প্ল্যাটফর্মের শেড পেরোতে চলেছি, চোখ গেল সিমেন্টের বেঞ্চের নীচে, একটা বাচ্চাকে শুইয়ে রাখা আছে। ছ’সাত মাসের বাচ্চাদের আলাদা করে চেনা যায় না, তা সত্ত্বেও এই বাচ্চাটা কার, বুঝতে আমার কোনও অসুবিধে হচ্ছে না। জবার পুত্রসন্তান। বাচ্চাটার পিঠের কাঁথা, গায়ের জামা আমি চিনি। কারণ, জবা এঁটুলির মতো করে কোলে নিয়ে ঘোরে। কখনওই কাছছাড়া করে না। বাচ্চাটা এখানে এইভাবে পড়ে আছে কেন? জবা গেল কোথায়? প্ল্যাটফর্ম প্রায় ফাঁকা। দূরে দূরে এক দু’জন প্ল্যাটফর্মবাসীকে দেখা যাচ্ছে। প্যাসেঞ্জার বলতে আমি এখন একাই। লোকাল ট্রেনটা থেকে আরও যারা নেমেছিল, পা চালিয়ে বাড়ির পথ ধরেছে। গল্প মাথায় না আসার হতাশায় আমি শ্লথ হয়ে পড়েছিলাম। এখন বাচ্চাটাকে এই অবস্থায় দেখে চলে যেতে মন চাইছে না। একটা আশঙ্কা ঘিরে ধরেছে আমাকে, বাচ্চাটাকে কেউ যদি চুরি করে পালিয়ে যায়! প্ল্যাটফর্ম থেকে কিছু তুলে নিয়ে চম্পট দেওয়া খুবই সহজ। লোকাল ট্রেন এসে দাঁড়াবে, ছাড়ার মুখে বাচ্চাটাকে কোলে তুলে কেউ যদি উঠে পড়ে কামরায়, চট করে চলে যাবে নাগালের বাইরে। জবাপাগলি ফিরে এসে বাচ্চাটাকে না দেখতে পেয়ে যে কী মূর্তি ধারণ করবে, কল্পনা করতেই ভয় পাচ্ছি আমি।

আপাতত বাড়ি যাওয়া স্থগিত রেখে বেঞ্চটায় গিয়ে বসলাম। জবার বাচ্চার পাহারায় বহাল হলাম আর কি! পায়ের খানিক দূরেই কাঁথার ওপর শান্ত হয়ে শুয়ে আছে বাচ্চাটা। হাত-পা একটু আধটু নাড়ছে। মুখটায় হাসিহাসি ভাব। পরিস্থিতি মোটামুটি স্থিতিশীল। হঠাৎ যদি কান্নাকাটি শুরু করে দেয়, কী করব জানি না। বাচ্চাটাকে কোলে তুলে ভোলানোর প্রবৃত্তি আমার নেই। জবাপাগলি স্নানটান করে বলে তো মনে হয় না। শুধুমাত্র বৃষ্টিতে ভিজলে অথবা মাছ চুরি করতে পুকুরে নামলে স্নান করা হয় ওর। এই যার স্বভাব সে তার বাচ্চাকে তেলটেল মাখিয়ে স্নান করাবে, আশা করাই বৃথা। বাচ্চাটার গায়ের কাঁথা, জামা ছ’মাস ধরে এই একটাই দেখে আসছি। কাঁথা, জামা, বাচ্চাটা মিলিয়ে সাক্ষাৎ একটা উৎকট গন্ধের মণ্ড। যতই কাঁদুক ওকে আমি হাতে নিতে পারব না।

জবার এই অপরিষ্কার থাকার কারণেই লোকে ওকে পাগলি বলে। মাথায় অল্পবিস্তর ছিট থাকলেও, পুরো পাগলি সে নয়। যথেষ্ট সেয়ানা। বিশেষ করে পাওনাগণ্ডা বুঝে নেওয়ার ক্ষেত্রে। জবাকে নিয়ে একটা গল্প লিখেছি। তখন বাচ্চাটা হয়নি। বাচ্চা সমেত জবাকে নিয়ে আরও একটা দারুণ গল্প হতে পারে। তবে সে ঝুঁকি আমি নিচ্ছি না। আগের গল্পটা লিখে বিরাট ফেঁসে গেছি। সন্তানের প্রতি জবার নিরেট অবসেশন, এটাই আমার জবাকে নিয়ে পরের গল্পের মেন থিম হওয়ার কথা। ওকে খুঁটিয়ে খেয়াল করেই বিষয়টা আমার মাথায় এসেছে। সেই অবজার্ভেশন থেকেই আমি আন্দাজ করতে পারছি, খুব বেশি সময় বাচ্চাটাকে পাহারা দিতে হবে না, জবা এল বলে।

আমার এখন অদ্ভুত দশা! কয়েকহাত দূরে পড়ে রয়েছে গল্পের প্লট, পাহারা দিচ্ছি, কিন্তু এক লাইনও লেখা যাবে না। জবাকে নিয়ে লেখা আগের গল্পের আফটার শক এখনও কাটিয়ে উঠতে পারিনি। এরকম হেনস্থা আগেও আর একজনের বেলায় হয়েছে, তার নাম সাধন। আসলে আমাদের এই মফসসলে সাধন, জবার মতো বিচিত্র চরিত্ররাই আমার লেখার রসদ। পুরোটা বানিয়ে লিখতে পারি না। এই বিচিত্রদের মধ্যে যারা শিক্ষিত, তাদের নিয়ে সমস্যা কম। আমাকে খুব একটা বিব্রত করে না। মুখোমুখি দেখা হয়ে গেলে অর্থপূর্ণ হেসে হয়তো বলল, অমুক পত্রিকায় তোমার গল্পটা পড়লাম (মানে যে গল্পটা তাকে নিয়ে লেখা)। আমার চোখে পড়েনি লেখাটা, দু’চারজন পড়ে আমাকে পড়তে বলল। কেউ হয়তো আর একটু এগিয়ে বলল, সবই তো বোঝা যাচ্ছে, আমার নাম পালটে দিয়েও তুমি কিছু আড়াল করতে পারোনি। তবে ভালোই হয়েছে গল্পটা।

যে সব শিক্ষিত চরিত্রদের অবলম্বনে গল্প লিখি আমি, তারা জানে গল্পে সত্যির মিশেল না থাকলে লেখা প্রাণ পায় না। তাছাড়া চরিত্রের নাম, ঘটনাস্থল সবই তো পালটে দিই, সরাসরি অভিযোগ করারও সুযোগ থাকে না তাদের। কিন্তু সে দলে তো সাধন, জবারা পড়ে না। বই বা সাহিত্য থেকে যোজন দূরত্ব দু’জনের। সাধন তবু খানিকটা স্কুলবেলা কাটিয়েছে। জবা স্কুলের চৌকাঠ ডিঙোয়নি। সাধনের মা হসপিটালের আয়া। ছেলের লেখাপড়া হল না বলে একটা চায়ের দোকান করে দিয়েছে। দোকানে নিয়ম করে বসে না সাধন। তার নেশা নাচ। পাতি হিন্দি সিনেমার নাচ। কলোনি এলাকার জলসায়, বিয়ের অনুষ্ঠানে লাউড স্পিকারে মিউজিক সহযোগে নাচে। সাধনের বিয়ে দিয়েও ঘরমুখী করতে পারল না মা। বউটির স্বভাবগুণ ভালো, বরকেও ভীষণ ভালোবাসে।

সাধন একদিন স্টেজে নাচতে উঠেছে, খবর এল অন্তঃসত্ত্বা বউ ভীষণ অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি। নাচ বন্ধ করল না সাধন। পারফর্মেন্স শেষ করে ছুটল হাসপাতালে। বউ চোখ বুজে শুয়ে আছে, যেন মরেই গেছে! আকুল আশায় সাধন কান রাখে বউয়ের বুকে। হার্টবিট শুনতে পায়। খুশি ছড়িয়ে পড়ে সাধনের মুখে। নিজের অজান্তেই বউয়ের হার্টবিটের সঙ্গে আলতো করে তাল দিতে থাকে পায়ে। …মোটামুটি এই রকম ছিল গল্পটা। নামি পত্রিকায় বেরিয়েছিল। আমাদের এলাকার পাঠকদের সাধনকে আইডেন্টিফাই করতে অসুবিধে হয়নি। সাধনের মতো অখ্যাতর জীবনের গল্প বেরিয়েছে বিখ্যাত কাগজে! এই আবেগের উত্তেজনা কন্ট্রোল করতে না পেরে জনৈক পাঠক খবরটা তুলে দিল সাধনের কানে, লেখক পরিচয়সহ।

একদিন সাধনের দোকানের সামনে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি, ছিটকে বেরিয়ে এসেছিল সে। আমার হাত আঁকড়ে ধরে বলেছিল, গুরু, তুমি শুনলাম আমাকে নিয়ে একটা স্টোরি লিখেছ বইয়ে! চট করে ব্যাপারটা স্বীকার করিনি। গম্ভীর মুখে জানতে চেয়েছিলাম, তুমি কি গল্পটা পড়েছ? এমনটা জিজ্ঞেস করার কারণ, সাধন যদি অভিযোগ তোলে গল্পে ওকে ছোটো করা হয়েছে, তখন বলতে হবে, ও গল্প তোমাকে নিয়ে নয়। দেখছ না, ছেলেটার নাম আলাদা, থাকেও অন্য জায়গায়। ওই রাস্তায় গেল না সাধন। সে তখন আনন্দে আত্মহারা। বলেছিল, না, আমি পড়িনি। একজন দিদিমণি আমাকে বলল। স্কুলে পড়ায়, সে তো আর ঢপ দেবে না। তুমি মাইরি ‘সাজন’ সিনেমার সঞ্জয় দত্তর মতো। আমার সঙ্গে আড্ডা মারতে আসতে, কত গল্প করেছি, ধরতেই পারিনি তুমি রাইটার। চলো চলো, চা খাবে চলো।

সেই যে আমাকে খাতির করা শুরু করল সাধন, আজও উৎসাহে ভাটা পড়েনি। রাস্তাঘাটে আমাকে দেখতে পেলেই হাঁকডাক করে এগিয়ে আসে। চকরাবকরা ড্রেস, ভাবভঙ্গি, কথাবার্তায় ফিল্মি স্টাইল। আশপাশের মানুষজন বেশ অবাক হয়। বিশেষ করে যারা আমার লেখক পরিচয় জানে। ভাবে, লুচ্চা টাইপের ছেলেটার কী করে এই সাহস হয়, এরকম একজন মানী ব্যক্তির সঙ্গে এভাবে কথা বলতে? সাধনের অবশ্য সে সবের কোনও ভ্রূক্ষেপ নেই। যেখানেই দেখা হোক, গল্প জুড়ে দেয়। নিজের জীবনের গল্প। জোরজার করে চা, সিগারেট খাওয়ায়। আমি টের পাই ওর মনোবাসনা, সাধন চায় ওকে নিয়ে আরও একটা গল্প লিখি আমি। ওর তুচ্ছ জীবন নিয়ে অসাধারণ কোনও গল্প। একজন দিদিমণি এসে সেই গল্পের খোঁজ দেবে ওকে। বেচারি জানে না ওর জীবনের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য অংশটা আগের গল্পে লেখা হয়ে গেছে আমার। বাকি যা পড়ে আছে, সমস্তটাই বোরিং। পরিচিত। পাঠক ওই গল্প জানে। সাধনকে ইদানীং এড়িয়ে চলি। দূর থেকে যদি দেখতে পাই, ধরে নিই অন্য রাস্তা।

জবাকে নিয়ে আমার সমস্যা আরও মারত্মক। মেয়েটা তিনবার সরকারি হোম থেকে পালিয়ে এসেছে। কোনও এক অদ্ভুত কারণে আমাদের দেবনগর জায়গাটাই জবার পছন্দ। শেষবার হোমের কর্মচারীরা ওকে নিতে আসেনি। ভীষণ বিরক্ত হয়েছিল জবার ওপর। প্রথমদিকে এই প্ল্যাটফর্মই ছিল জবার স্থায়ী ঠিকানা। ট্রেন থেকে নেমে প্যাসেঞ্জার হয়তো কুলি খুঁজে পাচ্ছে না, জবা লাগেজ তুলে নিয়ে রিকশা স্ট্যান্ডে দিয়ে আসে। বিনিময়ে টাকা নেয়। কখনও এর বাগানের ফল, ওর পুকুরের মাছ, খেত থেকে চুরি করে আনা সবজি ঘুরে ঘুরে বিক্রি করে স্টেশন লাগোয়া বাজারে। কখনও আবার কেটারিং-এর কাজে যায়। দোকান পরিষ্কার কিংবা রং করাতেও ওকে হাত লাগাতে দেখা গেছে। এভাবেই নিজের পেট চালায়। তবে যেটাকে ‘চুরি’ বললাম, সেটা ‘ডাকাতি’ বলাই বোধহয় ভালো। চুরিতে বাধা দিতে এলে এমন খিস্তি খেউড় করে, ইট-পাটকেল ছোড়ে, মালিক ভয়ে চুপ করে যায়।

ওকে নিয়ে যে-গল্পটা লিখেছিলাম, তাতে একটা ভয়ংকর ঘটনার কথা ছিল। সত্যিই ঘটেছিল জবার জীবনে। লাস্ট লোকাল থেকে কিছু ছেলে নেমে প্ল্যাটফর্মে ঘুমন্ত জবাকে রেপ করতে গিয়েছিল। ছেলেগুলো জানত না জবা রেললাইনের পাথর থলেতে পুরে তার ওপর কাপড় জড়িয়ে মাথার বালিশ করে শোয়। পাথর ভরা থলে দিয়ে এইসান মার মেরেছিল ছেলেগুলোকে, একজন হসপিটালে, বাকিরা প্রাণ হাতে করে পালিয়েছিল। এই ঘটনা সম্বলিত গল্পটা পড়ে সাধনের দিদিমণির মতো কোনও এক পাঠক জবাকে জানায়, চিনিয়ে দেয় লেখককে। এক সকালে বাজার করছি, সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল জবা। কোমরে গিঁট বেঁধে উঁচু করা পরা রংজ্বলা ম্যাক্সি, গামছাও বাঁধা কোমরে, চুলে চিরুনির চলাচল নেই বহুদিন। এটাই রোজকারের ড্রেস। সেদিন একমুখ হেসে বলেছিল, তুই নাকি কাগজে আমার নামে খবর লিখেছিস!

আমি ‘হ্যাঁ, মানে, না, ইয়ে, আসলে’ বলে পাশ কাটিয়ে তাড়াতাড়ি পা চালিয়েছিলাম। জবা গল্প, উপন্যাস, কবিতা, কাকে বলে জানে না। ছাপার অক্ষরে যা কিছু বেরোয়, ‘খবর’ বলেই মনে করে। আরও একটা বড়ো সমস্যা, জবার ভোকাবুলারিতে ‘তুমি’ সম্বোধন প্রয়োগ হয় না। যেসব রাশভারী কাস্টমারকে চুরি করে আনা মাছ, সবজি বিক্রি করে, তাদের আর মালিকশ্রেণির লোককে ‘আপনি’ ডাকে। বাকি সবাইকে তুই। যেহেতু ওকে নিয়ে লিখেছি, জবা ধরেই নিয়েছে আমি আপনজন। ‘তুই’ বলে তো ডাকবেই।

আপনজন হওয়ার যে কত ঝক্বি, বুঝতে পারলাম তারপর থেকে। দু’টো দশটার ডিউটি থাকলে সকালের বাজারটা আমি করি। একবার যদি জবার চোখে পড়ে যাই, সঙ্গে সঙ্গে এগিয়ে আসে। মুঠোতে বা গামছার কোঁচড়ে যা থাকে, মাছ, পেয়ারা, লেবু, ধনেপাতা, কলমি শাক… যেদিন যেমন চুরি করতে পারে, আমাকে অন্যদের তুলনায় সস্তায় দিতে চায়। বলে, নে না বাবু, পুরোটাই নে। কুড়িটাকা দিবি। তুই আমার চেনা লোক বলেই এত কমে দিচ্ছি।

‘বাবু’ সম্বোধনটা সম্মান জানানোর জন্য করছে, নাকি আমার নতুন নামকরণ করেছে জবা, বলার ধরন দেখে বুঝতে পারি না। জবার জিনিস না নেওয়ার থাকলেও, অনেক সময় নিতে হয়। একগাদা অদরকারি সবজিপাতি নিয়ে এলে মা রাগ করে। নিজের অসহায়তার কথা বলতে পারি না। বললেও বুঝবে না মা। কখনও দেখা যায় নিজের জিনিসপত্র সব বেচে ফেলে বাজারে এমনিই ঘুরঘুর করছে জবা, অথবা কোনও মাছওলা, সবজিওলাকে হেল্প করছে কাজে। আমাকে দেখতে পেলে মাঝে মাঝে উঠে আসে। পাশে হাঁটতে থাকে ডিঙি মেরে মেরে। এটাই ওর হাঁটার স্টাইল। নানা রাজ্যের গল্প বলে। সাধনের মতো ওকে নিয়ে আর একটা গল্প লিখিয়ে নেওয়ার প্রত্যাশায় বলে না। জবার সেই বোধ নেই। নিজের জীবনটাকে তুচ্ছও মনে করে না। আমাকে নিজের লোক মনে করে গল্পগুলো বলে। বেশিরভাগ চুরির গল্প। মালিক বাধা দেওয়াতে কী কী খিস্তি করেছে সেগুলো শোনায়। আমি আতঙ্কে মরি, এই বুঝি পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়া লোকটা ওর কথাগুলো শুনে ফেলল! আমাদের একসঙ্গে হেঁটে যেতে দেখলে লোকজন ঘুরে ঘুরে তাকায়। সাধনের সঙ্গে হাঁটতে দেখলে যতটা অবাক হয়, জবার বেলায় তার চেয়ে অনেক বেশি। কারণ, জবার পোশাক-আশাক পাগলির মতো তো বটেই, ডিঙি মেরে হাঁটাটাও পিকিউলিয়ার, রাস্তায় যারা হাঁটছে, সবার থেকে আলাদা। পায়ে আবার চটি পরে না।

ওর চুরির বিবরণের মধ্যেই আমাকে একদিন জানিয়েছিল, প্ল্যাটফর্মে আর থাকছে না। ঘর ভাড়া নিয়েছে স্টেশন ধারে। আমি বলেছিলাম, এবার একটা বিয়ে করে ফেল। লজ্জা পেয়ে হেসেছিল জবা, ভঙ্গিটা আর-পাঁচটা স্বাভাবিক মেয়ের মতোই। পাগলামির ছিঁটেফোটা নেই তাতে। মাঝে কিছুদিন যাবৎ খেয়াল করি বাজারে, রেলের প্ল্যাটফর্মে, আশপাশের কোনও এলাকাতেই জবাকে দেখা যাচ্ছে না। গেল কোথায় মেয়েটা? প্রশ্নটা বাজারের কাউকে করিনি। এখান থেকে বিদেয় হলে বাঁচা যায়। বেশ কয়েক মাস বাদে দেখি জবা কোলে বাচ্চা নিয়ে ঘুরছে। চেহারায় বিয়ের কোনও সাক্ষর নেই, মানে সিঁদুর, শাঁখা, পলা… আমি সামনে দিয়ে হেঁটে গেলাম, খেয়ালই করল না। বাচ্চাটার দিকেই সমস্ত মনোযোগ!

মাছওলা রবিনের কাছে মাছ কেনার সময় জিজ্ঞেস করলাম, জবা কার বাচ্চা কোলে নিয়ে ঘুরছে? কেন, ওর নিজের? বলেছিল রবিন।

জানতে চেয়েছিলাম, বিয়ে করল কবে? বাচ্চার জন্য ওদের আবার বিয়ে করতে লাগে নাকি! তাচ্ছিল্যের গলায় বলেছিল রবিন। ব্যাপারটা কিন্তু তুচ্ছ মনে হয়নি আমার। হাইফাই সোসাইটিতে আজকাল ‘সিঙ্গল মাদার’ প্রায়ই শোনা যায়। সেলিব্রিটিরা ‘সিঙ্গল মাদার’ হলে লেখালিখি হয় কত! সাহসিনীর সম্মান পায় নারীটি। এর উলটো দিকে, সমাজের প্রান্তসীমায় থাকা জবা একই রকম কাজ করে ফেলল, কোনও শাবাশি নেই! শুধুই তাচ্ছিল্য আর অবজ্ঞা! রবিনের থেকে মাছ নিয়ে রাস্তায় এসে দেখি, জবা বসে আছে রেলের ইলেকট্রিক পোস্টের বেদিতে। ওর সামনে গিয়ে বলি, কী রে, তোর বাচ্চা? ছেলে না মেয়ে?

একগাল হেসে জবা বলেছিল, ছেলে।

ওর বাবা কোথায়? একটু ঝুঁকি নিয়ে কথাটা জিজ্ঞেস করেছিলাম। খেঁচিয়ে উঠতেই পারত। কেন-না, এই প্রশ্ন নিশ্চয়ই অনেকেই ওকে করেছে। ক্ষেপে যায়নি। শান্ত গলায় বলেছিল, ওর বাবা নেই। বাবার কী দরকার!

দরকার নেই কেন বলছিস? আমার প্রশ্নের কোনও উত্তর দেয়নি জবা। মুখে নানারকম আওয়াজ করে বাচ্চাটাকে আদর করতে লেগেছিল।

দিন যায়। জবাকে আর আগের মতো বাজারের এপ্রান্ত-ওপ্রান্ত করতে দেখা যায় না। হঠাৎ হঠাৎ চোখে পড়ে, কোলে সবসময় বাচ্চা। একদিন একদম সামনে থেকে দেখলাম, জবার চেহারা খুব খারাপ হয়ে গেছে। শরীরে ঝিমানো ভাব। হাঁটাচলায় আগের সেই চনমনে ব্যাপারটা নেই। কোলে বাচ্চাটা ঠিক আছে। একটু বড়োও লাগছে। মা কিন্তু অতীব শীর্ণ।

ফের রবিনকেই জিজ্ঞেস করলাম, জবার কোনও রোগভোগ হল নাকি? চেহারা তো বেশ ভেঙে গেছে দেখছি। আর বোলো না, অতিরিক্ত আদরে পাগলিটা বোধহয় বাচ্চাটাকে মেরেই ফেলবে। ছেলেটা হওয়ার পর থেকে সারাক্ষণ কোলে নিয়ে ঘুরছে। এক মুহূর্ত কাছছাড়া করে না। নিজের কাজ কারবারও বন্ধ করে দিয়েছে। আর ওকে দেখতে পাও বাজারে কিছু বিক্রি করতে?

মাথা নেড়ে ‘না’ বুঝিয়ে ছিলাম আমি। রবিন ফের বলেছিল, নিজে কী খায়, কতটুকু খেতে পায়, কে জানে? ও না খেলে বুকের দুধও তো হবে না। বাচ্চাটা খাবে কী? এ নিয়ে তুমি যদি কিছু বলতে যাও, টাকা দিয়ে সাহায্য করতে চাও, তক্ষুনি তেড়ে আসবে। টাকাপয়সার জন্য কোনওদিনই কারুর কাছে হাত পাতে না জবা, বিরাট প্রেস্টিজ জ্ঞান! বাচ্চাটার ভালোর জন্য কিছু বলতে গেলে গালাগাল শুনতে হবে। ইতিমধ্যেই শুনেছে অনেকে। ও বোঝে উলটো। মনে করে বাচ্চার ওপর নজর দেওয়া হচ্ছে। নজর কাটাতে নানান ঠাকুরের থানে ঘুরে বেড়াচ্ছে। মাদুলি, তাবিজ পরিয়ে যাচ্ছে বাচ্চাটাকে। …রবিন আরও অনেক কিছু বলে যাচ্ছিল। মন খারাপ হয়ে গিয়েছিল আমার। মাছবাজার থেকে উঠে এসে ফের রেলের পোস্টের নীচে বাচ্চা কোলে বসে থাকতে দেখেছিলাম উশকোখুশকো চুলের জবাকে। একেবারে প্রেতিনীর চেহারা! মুখের ‘মা মা’ হাসিতে অবশ্য কোনও অন্ধকার লেগে নেই। বাচ্চাটার সঙ্গে আদরের খুনশুটি করে যাচ্ছে। সেদিন আর ওকে কিছু বলতে ইচ্ছে করেনি। সরে গিয়েছিলাম সামনে থেকে।

দিন দুয়েক বাদে ছ’টা দু’টোর ডিউটি সেরে বাড়ি ফিরছি, স্টেশনরাস্তায় দেখি আমার সামনে হাঁটছে জবা। মন্থর হাঁটা। বাচ্চাটা তো কোলে আছেই। পা চালিয়ে ওর পাশে চলে গিয়েছিলাম। জবাকে বলেছিলাম, কী রে, কেমন আছিস? বাচ্চা মানুষ করতে গিয়ে চেহারাটা তো একেবারেই গেছে দেখছি! ওর বাবা খোঁজটোজ নেয়?

কেন নেবে? সে তো বাবা হতে চায়নি। আমি মা হতে চেয়েছিলাম। বলেছিল জবা।

আমি বললাম, তবু সে লোকটা তো বাবা। তার কোনও দায়দায়িত্ব নেই? গায়ে হাওয়া লাগিয়ে ঘুরে বেড়াবে, তুই বাচ্চাটাকে মানুষ করতে গিয়ে হাড্ডিসার হয়ে যাবি! নিজেকে দেখেছিস আয়নায়?

ও সব ঠিক হয়ে যাবে। বাচ্চাটা একটু বড়ো হয়ে গেলেই কাজে নেমে পড়ব। এখন তো কোথাও রেখে যেতে পারি না। কারুর কাছে দিতেও পারি না, সবাই নজর দেয়।

বাচ্চার প্রতি জবার যা অন্ধ বাৎসল্য, ওকে বোঝালেও বুঝবে না, বাচ্চাটা বড়ো হওয়ার আগেই জবা মরে যেতে পারে। ও কথায় না গিয়ে জবাকে বলেছিলাম, মা হওয়ার যখন ইচ্ছেই হয়েছিল তোর, বিয়েটা করে নিতে পারতিস। তাহলে লোকটা এইভাবে পালিয়ে বেড়াতে পারত না। বাচ্চা মানুষ করতে মা-বাবা দু’জনকেই লাগে। উত্তরে জবা বলেছিল, বিয়ে ফিয়ে বহুত ঝামেলার ব্যাপার, আমার মা হওয়ার ইচ্ছে হয়েছিল, হয়ে গেছি ব্যস। মা হওয়ার ইচ্ছেটা কখন, কীভাবে এল তোর মনে? জিজ্ঞেস করেছিলাম জবাকে। আসলে অশিক্ষিত মেয়েটা মাতৃত্বের আকাঙক্ষাটা কীভাবে প্রকাশ করে, সেটাই দেখতে চাইছিলাম। শিক্ষিতরা তো অনেক গুরুগম্ভীর ব্যাখ্যা দেয়। কিন্তু জবা যা বলল, বোধবুদ্ধি গুলিয়ে গিয়েছিল আমার।

একটা ঘটনার কথা বলেছিল জবা, মহাদেবের কেটারিং-এর হয়ে কাজে গিয়েছিল চাপাডাঙায়। বিয়ের কাজ। রাত হয়ে গিয়েছিল ফিরতে, পেটে ভালোমন্দ খাবার, ম্যাটাডোরে বাসনপত্রের মাঝে বসে ঢুলছিল জবা। মাকালতলায় এসে বিগড়ে গেল গাড়ি। ড্রাইভার চেষ্টা করছিল সারানোর। জবা ম্যাটাডোর থেকে নেমে মাঠের ধারে শিরীষগাছের নীচে গিয়ে বসেছিল। সেখানেই ঘুমিয়ে পড়ে। রাতে স্বপ্ন দেখে, গাছটা তাকে যেন বলছে জবা রে, এবার মা হ। মা হয়ে যা জবা। মেয়েমানুষ যখন হয়েছিস, মা হবি না কেন? মা হওয়ায় দারুণ সুখ, খুব আনন্দ… ঘুম ভাঙতে জবা দেখেছিল ভোর হয়ে গেছে। তাকে ফেলে চলে গেছে কেটারিং কোম্পানির গাড়ি। তাতে রাগ হয়নি জবার, মা হওয়ার ইচ্ছেতে মন তখন টইটুম্বুর। গাছটাকে প্রণাম করে পায়ে হেঁটে মাকালতলা থেকে ফিরেছিল দেবনগরে।

জবার ভাষায়, কিছু হারামি সবসময় ওঁত পেতে বসে থাকে ওকে পাওয়ার জন্য, তাদেরই একটাকে ঘরে তুলেছিল জবা। কিছুদিন পর যখন বুঝল বাচ্চা এসে গেছে পেটে, হারামিটাকে তাড়িয়ে দিয়েছে। …ঘটনাটা অবান্তর, কিন্তু চিত্তাকর্ষক। বিষয়টাকে নিয়ে গল্প লেখাই যায়। দ্রুত বাসনাটাকে আমি ত্যাগ করেছিলাম। সাধন, জবা এদের নিয়ে দ্বিতীয় গল্প লিখে ঝামেলা বাড়াতে চাই না। একটা করে লেখাতেই রাস্তাঘাটে বিরক্ত করে মারে। দু’টো লিখলে আমাকে এতটাই আপনজন ভাববে, চলে আসতে পারে বাড়িতে।

নাঃ, এবার কিন্তু বেশ চিন্তাই হচ্ছে। এখনও কেন ফিরছে না জবা? আকাশে যা মেঘ করেছে, বৃষ্টি নামল বলে। তবু ভালো, বাচ্চাটা এখনও কেঁদে ওঠেনি। যতবারই চোখ যাচ্ছে ওর দিকে, দেখছি, মুখে নানারকম আওয়াজ তুলে নিজের মনে হাত-পা নেড়ে যাচ্ছে। …বৃষ্টি এসেই গেল। জোর কদমে শুরু হয়েছে। শেডের শেষের দিকে আছি বলে প্ল্যাটফর্মে বৃষ্টি পড়ে ছিটকে আসছে জল। একটু বাদে প্ল্যাটফর্মও ভাসবে। শেডে অনেক ফুটোফাটা আছে, ওপর থেকে জল নামার পাইপও ভাঙা। বাচ্চাটাকে এবার তুলে আনতেই হবে, নয়তো ভিজে যাবে পুরোপুরি। বেঞ্চ থেকে নেমে বাচ্চাটাকে দু’হাতে তুলে ধরি, উৎকট গন্ধটা আছে ঠিকই, তবে শিশুর গায়ের সেই অদ্ভুত ঘোরলাগা গন্ধটা পুরোপুরি চাপা পড়ে যায়নি।

আমাকে চমকে দিয়ে সামনে এসে দাঁড়াল জবা। ভিজে একেবারে সপসপে হয়ে গেছে। খুব হাসছে, নুয়ে পড়ে হাসছে। আমাকে দেখেই ওর হাসি। বলে ওঠে, তোকেই তো ওর বাপের মতো লাগছে! জবা যেন একদলা কাদা ছুড়ে মারল আমার গায়ে। রাগ হচ্ছে ভীষণ। ওকে কিছু বলেও তো লাভ নেই। কাকে কী বলতে হয় জানে না। বাচ্চাটাকে এগিয়ে দিয়ে বললাম, কোথায় থাকিস? বাচ্চাটা তো এক্ষুনি ভিজে যেত।

বাচ্চাকে কোলে নিল জবা। বলতে থাকল, আর বলিস না মাইরি, বাচ্চাটাকে রেখে একটা প্যাসেঞ্জারের মাল তুলে দিতে গেছি রিকশায়, পুলিশ আটকে রেখে দিল। বাজারে হারানদার সোনার দোকানে চুরি হয়েছে, আমার কাছে এটা ওটা জানতে চাইছে পুলিশ। বলছি, বাচ্চাকে রেখে এসেছি স্টেশনে, কথা কানেই নিচ্ছে না!

অঝোরে বৃষ্টি সত্ত্বেও শেড থেকে বেরিয়ে বাড়ির উদ্দেশে হাঁটা দিলাম। খেয়াল করলাম জবার ছোড়া কাদাটা আলকাতরার মতোন নাছোড়! এত বৃষ্টিতেও ধুয়ে যাচ্ছে না।

পরের দিন ঘুম ভাঙল একদম ভোরে। অদ্ভুত একটা স্বপ্ন দেখলাম। মাকালতলার যে শিরীষ গাছটার কথা বলেছিল জবা, গাছটা আমি চিনি। পিছনে মাঠ। অল্প বয়সে ম্যাচ খেলতে গেছি। স্বপ্নে দেখছি, সেই গাছতলায় শুয়ে আছি আমি। গাছটা বলছে, বাচ্চাটাকে নিয়ে গল্প লেখ। গল্পটা তো এসে গেছে মাথায়। কেন দেরি করছিস? গল্পটা যে মাথাতেই মরে যাবে…

ধড়মড় করে উঠে বসলাম বিছানায়। হাতে মাত্র চারটে দিন। পুজোসংখ্যায় গল্পটা দিতে হবে। বাথরুম ঘুরে এসে বসে পড়েছি লেখার টেবিলে। প্রথম লাইনটা লিখলাম, বছর তিনেক ধরে আমার স্বভাবে একটা উল্লেখযোগ্য বদল এসেছে…

 

শীতল পরশ

সকাল থেকেই কেমন যেন গুমোট আবহাওয়া। আকাশে মেঘের ঘনঘটা। গাছের পাতা একেবারে স্তব্ধ। হাওয়ার লেশমাত্র নেই। সবমিলিয়ে বেশ একটা দমচাপা পরিবেশ।

এমনিতেই ক’দিন ধরে বাপ-ছেলের গন্ডগোলের জেরে মালার প্রাণ একেবারে ওষ্ঠাগত। বেচারা সবসময় ভয়ে-ভয়েই থাকে এই বুঝি আবার যুদ্ধ লাগল। তার উপর এরকম একটা ঝিমোনো পরিবেশে দমবন্ধ হয়ে আসছিল মালার। আজ মনটা কেমন যেন কু গাইছে তার। বোধহয় বড়ো কিছু হওয়ার একটা অশনি সংকেত পাচ্ছিল সে। যতই হোক মায়ের মন তো।

যা ভাবা ঠিক তাই। অতনু অফিস বেরোবার সময় রমাকান্তের মুখোমুখি। তিনি তখন প্রাতর্ভ্রমণ সেরে অন্যান্য দিনের মতোই বাজার করে ঘরে ঢুকছেন।

ছেলেকে দেখামাত্রই ভ্রূকুঞ্চিত করে, ‘কিছু ভাবলে?’

রমাকান্তের এই অ্যাটিটিউড-টাই পছন্দ নয় অতনুর। সবসময় একটা বসিং বসিং ব্যাপার। নিজের সিদ্ধান্ত অন্যের উপর জোর করে চাপিয়ে দেওয়া। কথা বলার ভঙ্গিও এতটাই খারাপ যে, যে-কোনও মানুষেরই মাথা গরম হওয়ার জন্য যথেষ্ট।

‘ভাবার কী আছে। তোমাকে তো আগেই বলেছি। বিয়ে আমি স্টেলাকেই করব।’ রাগত স্বরে জবাব দেওয়া মাত্রই গর্জে ওঠে রমাকান্ত। ‘রাসকেল! দুটো পয়সা উপায় করছ বলে কি ধরাকে সরা জ্ঞান করছ নাকি? শুনে নাও, ও মেয়ে কখনওই আমার বাড়ির বউ হয়ে আসবে না। এটাই আমার শেষ কথা।’

‘আনব না! তোমার গোঁড়ামো নিয়ে তুমিই থাকো। এই একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে শুধুমাত্র জাতপাতের দোহাই দিয়ে একটা মেয়েকে চিট করা, আমার পক্ষে সম্ভব নয়। সরি, যাকে এতদিন ভালোবেসে এসেছি, শুধুমাত্র তোমার অনর্থক জেদের কারণে তাকে আমি ছাড়তে পারব না’, বলেই পাশ কাটিয়ে অফিসের উদ্দেশ্যে রওনা দেয় অতনু।

অতনু আর রমাকান্তকে মুখোমুখি দেখেই বুকটা ছ্যাঁৎ করে উঠেছিল মালার। কেবল নির্বাক শ্রোতার মতো বাপ-ছেলের এই প্রহসন শুনতে শুনতে সে রীতিমতো ক্লান্ত। কাকে বোঝাবে? কে বুঝবে তার কথা। কেবলমাত্র ওই দীপ্তি ছাড়া। দীপ্তি, অতনুর ছোটো বোন। ওর থেকে বছর পাঁচেকের ছোটো। সেও তো বাবার ভয়ে তটস্থ। এই কোরো না সেই কোরো না। সন্ধে হলে মেয়েরা বাইরে বেরোবে কেন? কোনও ছেলের সাথে বন্ধুত্ব করবে না। ছেলেদের সঙ্গে মেয়েদের কখনওই বন্ধুত্ব হয় না।

অতনু যাওয়ার পর মাথা ধরে সোফার উপর বসে পড়ে মালা। মাইগ্রেন-এর ব্যথাটাও বেড়েছে বেশ কয়েকদিন হল। তার উপর এ-এক চিন্তা। এর যে শেষ কোথায় কে জানে! যত বয়স বাড়ছে লোকটা যেন আরও খিটখিটে হয়ে উঠছে। রিটায়ারমেন্ট-এরও আর মাত্র বছর চারেক বাকি। এখনই মাঝেমধ্যে শরীর বিগড়োচ্ছে, নতুন বিজনেসের কারণে অফিসে ইরেগুলার। রিটায়ার হওয়ার পর তাহলে কী হবে? তখন তো সারাদিন বাড়িতেই থাকবে। ভেবেই আতঙ্কে শিউরে ওঠে মালা। কী করবে এই লোকটাকে নিয়ে। এতদিন না হয় সে সবকিছু মুখ বুজে সহ্য করেছে। কিন্তু ছেলেমেয়েরা? আর কেনই বা তারা মুখ বুজে এইসব অন্যায় সহ্য করবে। না, আজ যেভাবেই হোক, অতনুর বাবার সঙ্গে কথা বলতেই হবে, যদি কিছু বোঝানো যায়। আজ তো অফিস যাবে না ঠিক করেছে, যে-কোনও সময় একবার…।

দুপুরবেলা রমাকান্তকে খেতে দিয়ে পাশে বসে মালা বলেই ফেলে কথাটা, ‘বলছি মেয়েটাকে একবার দেখতে দোষ কী? লেখাপড়া জানা মেয়ে। বাবুর অফিসে ভালো পদে আছে। শুনেছি দেখতেও ভালো। ব্যবহারটাও। অন্য জাতের হওয়াটা তো দোষের নয় বলো?’

চুপচাপ মাথা গুঁজে খেয়ে যাচ্ছিল রমাকান্ত। জাতপাতের কথা শোনামাত্রই ভাতের থালা ঠেলে সরিয়ে দিয়ে ফুঁসে ওঠে, ‘ছেলের হয়ে ওকালতি করতে এসেছ? তোমার জন্যই আজ বাবুর এই বাড়বাড়ন্ত। আমিও দেখছি ও কী করে ওই বেজাতের মেয়েকে বিয়ে করে!’

খেয়ে নেওয়ার জন্য মালার বারংবার অনুরোধ একপ্রকার উপেক্ষা করেই কলতলার দিকে চলে যায় রমাকান্ত। সে কোনও কিছুর বিনিময়েই স্টেলাকে মেনে নেবে না। তাই বোধহয় সবকিছু জেনেশুনে আজও ছেলের জন্য মেয়ে দেখে চলেছে।

সন্ধে সাতটা নাগাদ থমথমে মুখে ঘরে ফেরে অতনু। ছেলের চোখমুখ দেখেই হাত থেকে ব্যাগটা নিয়ে নেয় মালা। বলে, ‘তুই আগে বোস। জল দিই একটু জল খা। শরীরটা খারাপ লাগছে নাকি রে বাবু? সারাদিন ঠিকঠাক খেয়েছিস তো?’

‘শোনো মা, শোনো। আমার কিছু হয়নি। শরীর ঠিক আছে। তুমি আমার কাছে বসো, তোমার সাথে কথা আছে।’

‘কথা! কী কথা রে? পরে বলিস। আগে ঘরে যা, হাত-মুখ ধুয়ে একটু রেস্ট নে। তারপর না হয়…।’

‘না মা ঘরে যাব না। বলছি আমি একটা ফ্ল্যাট দেখেছি।’

‘কী দেখেছিস!’

‘ফ্ল্যাট।’

‘কী বলছিস বাবু। তুই কি পাগল হলি। তোর বাবার জন্য তুই আমাদের থেকেও…’ চোখে জল চলে আসে মালার।

‘না মা। শোনো আগে। এভাবে বোলো না। তুমি তো চাও, আমি একটু ভালো থাকি। শান্তিতে থাকি। রোজ বাবার এই গঞ্জনা, অশান্তি আমি আর সহ্য করতে পারছি না। একদিকে বাবার জেদ, অহংকার, অন্যদিকে ‘ওর’ ওই এক গোঁয়ারতুমি, বাবা আর্শীবাদ না করলে বিয়ের পিঁড়িতে বসবে না। দুজনের জেদাজেদিতে আমি হাঁপিয়ে উঠছি মা। অন্য জায়গায় গেলে অন্তত একটা দিক থেকে তো রেহাই মিলবে। এই বাড়িতে তো প্রাণখুলে শ্বাসও নেওয়া যায় না।

‘সবই তো বুঝলাম বাবু, কিন্তু তোকে ছেড়ে…’ কথা শেষ করতে পারে না মালা। দু-চোখ বেয়ে জল নেমে আসে।

‘আরে কাঁদছ কেন? আগে কথাটা শোনো। আমি কাছাকাছিই ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়েছি। যখনই মনে হবে তুমি আর ছুটকি চলে আসবে।’

ছেলের কথা ভেবে নিজেকে খানিক ধাতস্ত করে মালা, ‘যাবি কবে?’

মায়ের হাতদুটো ধরে অতনু জবাব দেয়, ‘আজই মা।’

‘আজই’, কাঁপা গলায় বলে ওঠে মালা।

একপ্রকার বুকের ওপর পাথর চাপা দিয়েই ছেলেকে বিদায় জানায় মালা। যাওয়ার সময় কয়েকটা প্রয়োজনীয় জিনিস এবং নিজের পোশাকআশাক ছাড়া কিছু সঙ্গে নেয়নি অতনু। রমাকান্ত বাড়ি ফিরলে ছেলের বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়া নিয়ে চলে আর এক প্রস্থ। আর সেটাই বোধহয় স্বাভাবিক– যার সম্বল কেবলমাত্র অহং আর জেদ, সেই অহংকারে আঘাত হানা– পারতপক্ষে ব্যাপারটা তার পক্ষে মেনে নেওয়া বেশ কঠিন।

ওদিকে রমাকান্ত অফিসে বেরোলেই সংসারের সমস্ত কাজকর্ম গুছিয়ে মালা সোজা ছেলের বাড়িতে। ঘরগোছানো, ছেলের জন্য রান্না করা। কখনও বা রান্না করে তার জন্য নিয়ে যাওয়া। কখনও দীপ্তির হাতে পাঠানো। তাছাড়া ফোন তো রয়েইছে। দেখতে দেখতে এইভাবেই বেশ কয়েকটা দিন কেটে গেল। এরই মধ্যে স্টেলার সঙ্গে পরিচয়ও হয়েছে। মা-মেয়ের বেশ ভালোই লেগেছে তাকে।

মাসখানেক হয়ে গেল বাবা-ছেলের দেখাসাক্ষাৎ নেই।

তার আড়াল-আবডালে যে কী চলছে, কিছুই জানতে বাকি রইল না রমাকান্তের। তবুও সবকিছু জেনেশুনে একপ্রকার না জানার ভান করা আর কী! হয়তো কিছুটা মন ও বয়সের ভারে, আবার কিছুটা কাজের চাপে। কথা ছিল অতনু আর রমাকান্ত দুজনে মিলে ব্যাবসাটা দাঁড় করাবে। কিন্তু নিজের জেদের কারণে সব জায়গায় একা একা দৌড়োনো, এই বয়সে বেশ সমস্যাই হচ্ছিল।

তাই অনেক ভেবেচিন্তে রমাকান্তই মালাকে বলে, ‘মালা অনেকদিন তো হল, তোমার সুপুত্তুরকে বলো বাড়ি ফিরতে।’

কথাটা শুনেই অবাক হয়ে রমাকান্তের দিকে তাকায় মালা।

‘আরে কী হল! তোমাকেই বলছি। এরকম অবাক হলে কেন? বলছি তোমার সপুত্তুরকে বলো এবার বাড়ি ফিরতে।’

‘আমাকে বললে?’

‘তবে কাকে বলছি, এখানে তুমি ছাড়া আর কেউ আছে নাকি?’

নিজেকে খানিক সামলে নেয় মালা, ‘যেতে যখন তুমি বলেছ, আসতেও তুমিই বোলো। তোমারই তো ছেলে। তুমি না বললে কী আর সে…।’

কোনও জবাব না দিয়েই রমাকান্ত উপরে ঘরের দিকে চলে যায়। সন্ধে সাতটা নাগাদ কাউকে কিছু না জানিয়ে সোজা অতনুর ভাড়া নেওয়া ফ্ল্যাটে হাজির রমাকান্ত। অতনু তখন সবেমাত্র অফিস থেকে ফিরেছে। উইদাউট এনি ইনফরমেশন বাবার হঠাৎ আগমনে, বেশ আশ্চর্য হয় অতনু।

‘চলো অনেক হয়েছে। জিনিসপত্র গোছাও আর বাড়ি চলো।’

‘না বাবা। আমি এখানেই ঠিক আছি। জাতপাত, বৈষম্য এসবের থেকে অনেক দূরে। এখানে আমি নিজের মতো ভাবতে পারি, সিদ্ধান্ত নিতে পারি। জোর করে কেউ কিছু চাপিয়ে দেয় না আমার উপর। আজ তোমার মনে হয়েছে তাই আনতে এসেছ, কাল মনে হলেই আবার লাথি মারবে। তোমার আমার মত কোনওদিনই মিলবে না। ভবিষ্যতে স্টেলাকে নিয়েও প্রবলেম হবে। আজ আমাকে অপমান করছ। বিয়ের পর স্টেলাকে করবে। সেটা আমি কখনওই মেনে নিতে পারব না। আমি যেমন আছি, ভালো আছি। প্লিজ আমাকে আমার মতো থাকতে দাও।’

‘এটা কী ধরনের অসভ্যতা। ইগো দেখাচ্ছ আমাকে। ইগো! একটা বেজাতের মেয়ের জন্য আমাকে অপমান করছ। রমাকান্ত সান্যালকে। এত বড়ো স্পর্ধা তোমার। দ্যাখো এবার আমি কী করতে পারি’, বলেই রাগে গটগট করতে করতে উলটো পায়ে ফিরে গেল রমাকান্ত।

বাড়ি ফেরার পর থেকেই মুখ গম্ভীর করে বসে থাকে রমাকান্ত। মালার বহুবার জিজ্ঞাসা করাতেও কোনও সদুত্তর মেলে না। কেবলই কী যেন ভাবতে থাকে।

দিন সাতেক পর একটি নামকরা দৈনিক পত্রিকাতে বড়ো বড়ো হরফে লেখা বেরোয়, ‘আমি শ্রী রমাকান্ত সান্যাল, মন্দিরতলা ফার্স্ট লেন, কামরাবাদ, সোনারপুর এলাকার বাসিন্দা, সজ্ঞানে আইন মারফত আমার পুত্র অতনু সান্যালকে (২৯) কে ত্যাজ্য করলাম। আমার স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি, কোনও কিছুতেই তার অধিকার রইল না।’

শ্রী রমাকান্ত সান্যাল

সকালেই সুশীলার ফোন। ‘কীরে দিদি, জামাইবাবু এটা কী করল?’ কিছু বোধগম্য হওয়ার আগেই রমাকান্তের চায়ের জন্য হাঁকডাকে ফোনটা কেটে দিতে হয়েছিল মালাকে। তারপর চা করার সময় উলটো দিকের বাড়ির গীতাও তার রান্নাঘর থেকে কী যেন একটা বলার চেষ্টা করছিল। প্রথমে বুঝতে পারেনি মালা। তারপর দুই নম্বর পাতায় আজকের খবরের কাগজটা দেখাল। চা দেওয়া হয়ে গেলে কৌতূহলবশত পাতাটা ওলটাতেই চক্ষু ছানাবড়া মালার। ‘এটা কী করল অতনুর বাবা। রাগ মেটাতে শেষপর্যন্ত এই পদক্ষেপ নিল লোকটা। কাগজটা হাতে করে জড়বতের মতো বসে রইল মালা। পাড়াপড়শি থেকে শুরু করে আত্মীয়স্বজন, সকলের প্রশ্নের জবাব দিতে দিতে সারাদিন পরিশ্রান্ত হয়ে গেল মালা। এখন ফোন ধরাও প্রায় ছেড়ে দিয়েছে সে। রিং হতেই থাকে। দীপ্তি থাকলে কখনওসখনও ধরে নয়তো কেটেই যায়।

দু-একজন শুভাকাঙক্ষীর পরামর্শে মালা আবারও স্বামীকে বোঝানোর চেষ্টা করে। ‘অনেক হয়েছে। এই বয়সে ছেলের বিরুদ্ধে কোর্টকাছারি করছ, সেটা কি ভালো দেখাচ্ছে। লোকে যে ছি ছি করছে।’

‘যা করছি ঠিক করছি। আমার ঘরের মান-সম্মান, সংস্কৃতি কোনও কিছুই আমি ক্ষুণ্ণ হতে দেব না। না পোষালে তুমিও যেতে পারো।’

এই ঘটনার পর থেকে মালা প্রায় নিজেকে ঘরবন্দি করে ফেলেছে। ওদিকে পাড়াপড়শি, আত্মীয়স্বজন ব্যাপারটা বেশ তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করছে। ঘরের শান্তির জন্য নিজের আত্মসম্মান শিকেয় তুলে দিয়ে সর্বদা স্বামী নামক জীবের হ্যাঁ তে হ্যাঁ মেলানো এ যেন তার জীবনের এক এবং একমাত্র কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অথচ দুটো মানুষ একেবারে দুই মেরুর। পছন্দ, চিন্তাভাবনা কোনও কিছুই মেলে না তাদের। তৎসত্ত্বেও জীবনের তিরিশটা বছর কাটিয়েছে একে-অপরের সঙ্গে। বিয়ের পর থেকেই লক্ষ্যহীনভাবে কেবলই পতিদেবতার কথা মতো কাজ করেছে।

সংসারে কোনওদিনই তার ইচ্ছে বা মতামত প্রাধান্য পায়নি। প্রথমদিকে রমাকান্তকে বদলানোর বহু চেষ্টা করেছে মালা। কিন্তু লাভের লাভ কিছুই হয়নি। সারাজীবন স্বামীর মিথ্যে অহংকারের তুষ্টির জন্য নিজের ইচ্ছের বলিদান দিয়ে এসেছে সে।

ভাগ্যের পরিহাসে এখনও তার জন্য অনেক কিছু অপেক্ষা করছে এই ধারণা মালার বদ্ধমূল ছিলই। এরই মধ্যে দীপ্তির পড়াশোনা কমপ্লিট হয়েছে। জোরকদমে মেয়ের বিয়ের জন্য দেখাশোনা শুরু করেছে রমাকান্ত। ব্যাবসার চাপ, পাত্র খোঁজা, অফিস– সব নিয়ে রমাকান্ত বেশ ব্যস্ত হয়ে পড়ে।

অঙ্কুশকে মনে ধরে রমাকান্তের। এক অফিস কলিগের ছেলের বিয়েতে তার সঙ্গে আলাপ। তারপর বন্ধু কেশবের থেকে জানতে পারে, অঙ্কুশ বেশ বড়োমাপের বিজনেসম্যান। শহরে বেশ নামডাকও আছে তার। ছেলে হিসেবেও নাকি ভীষণ ভালো, ভদ্র নম্র। যদি দীপ্তির এখানে বিয়ে হয়ে যায় তাহলে দীপ্তির ভাগ্য ফিরে যাবে।

বন্ধু কেশবকে সঙ্গে করে একদিন সোজা অঙ্কুশের বাড়িতে হাজির হয় রমাকান্ত। কেশবের সাহায্য নিয়ে যদি তার বাবার সাথে কথা বলে পাকাপাকি একটা ব্যবস্থা করা যায়।

সেইমতো প্রথমে সৌজন্যমূলক কথাবার্তার পর সম্বন্ধর কথা উঠতেই, অঙ্কুশের বাবা একেবারে সরাসরিই প্রশ্ন করে বসলেন, ‘কাগজে আপনিই নোটিশ ছাপিয়েছিলেন না? ছেলের সাথে কী এমন ঝগড়া?’

রমাকান্ত কী বলবে ভেবে পাচ্ছিল না। কোনওমতে কিছুটা থেমে জবাব দিল, ‘তেমন কিছু নয়। ব্যস ছেলের আর আমার মতের মিল একদমই হতো না। তারপর কথা বাড়তে বাড়তে…।’

‘ক্ষমা করবেন রমাকান্তবাবু। যে বাড়িতে বাপ-ছেলের সম্পর্ক আদালত পর্যন্ত গড়ায়, সে বাড়ির মেয়েকে আমি ছেলের বউ করে আনতে পারব না।’

অগত্যা মুখ চুন করে ফিরে আসে রমাকান্ত। তারপর থেকে যত সম্বন্ধ হয়েছে, ছেলের প্রসঙ্গ উঠতেই সে সম্পর্ক ভেঙ্গে গেছে।

মহা ফাঁপড়ে পড়েছে রমাকান্ত। কায়িক এবং মানসিক পরিশ্রমে কয়েকদিনেই আরও বুড়িয়ে গেছে সে। স্বাস্থ্যও ক্রমশ খারাপের দিকে যাচ্ছে।

বাল্যবন্ধু উমাচরণবাবু রমাকান্তের এই অবস্থা দেখে ঘর বয়ে এসে তাকে বুঝিয়ে গেলেন। ‘রমাকান্ত যুগ বদলেছে। তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মানুষের চিন্তাভাবনাও বদলাচ্ছে। এখনও সেই সেকেলে চিন্তাভাবনা নিয়ে বসে থাকলে চলবে কেন ভাই? দুনিয়াটা কত এগিয়ে গেছে বলোতো। মানুষের থেকে কি জাতপাত বড়ো হতে পারে? মনের এই সংকীর্ণতা থেকে বেরিয়ে এসে দ্যাখো, দুনিয়াটা তোমাকে স্বাগত জানাবে।’

‘কিন্তু বছরের পর বছর চলে আসা পরম্পরা, সামাজিক নিয়মে বাঁধা মন, এত সহজে কি শিকল কেটে বেরিয়ে আসতে পারবে?’ বিষাদময় কণ্ঠে জবাব দেয় রমাকান্ত।

‘জীবনের পঞ্চাশ-ষাটটা বছর তো এটা ভেবেই কাটিয়ে দিলে যে, লোকে কী বলবে? সংসারের কথা না ভেবে লোকের কথা ভাবলে বেঁচে থাকা মুশকিল হয়ে দাঁড়াবে, তা তো হাতেনাতে টের পেয়েছ। নতুন প্রজন্ম যদি পুরোনো নিয়মের বাইরে বেরিয়ে ভালো কিছু করতে চায়, তাতে বাধা দেওয়া কেন বাপু। লাইফটা যখন তোমার ছেলের, সে কার সাথে সংসার করবে না করবে সিদ্ধান্তটা তারই হওয়া উচিত। চেষ্টা তো করো। একবার মেয়েটার সঙ্গে দেখা করো। দ্যাখো তো ছেলের পছন্দটা কেমন।’

‘ঠিক আছে। চেষ্টা করব’, পাশের ঘরে বসে থাকা মালা ও দীপ্তি রমাকান্তের এই কথা শোনা মাত্রই আনন্দে আত্মহারা হয়ে উঠল। মালার চোখ ভরে এল জলে। দীপ্তি তো লাফিয়ে লাফিয়ে দাদাকেও ফোনে সব জানিয়ে দিল।

পরের দিন সন্ধেবেলা অতনুর রুমের ডোরবেলটা বেজে উঠল। সামনেই বড়োদিন। ভিতরে কয়েকজন বন্ধুবান্ধব মিলে তারই আয়োজন চলছে। ঠিক সেই সময় ডোরবেল বেজে ওঠাতে বেশ বিরক্তই হল তারা। ডোরবেলটা আবারও বেজে উঠল। দরজা খুলে বোকার মতো দাঁড়িয়ে রইল অতুন। সামনে বাবা। সে জানত বাবা আসবে, তবে এত তাড়াতাড়ি আশা করেনি। কোনও কথা সরছিল না তার মুখে। মিনিট দুয়েক-তিনেক এভাবে কেটে গেল। অতনুর কোনও সাড়াশব্দ না পেয়ে ভিতর থেকে কে যেন বলে উঠল, ‘কে এল রে অতনু?’

বন্ধুর আওয়াজে সম্বিৎ ফিরে পেল অতনু।

‘ওহ! বাবা তুমি, ভিতরে এসো।’

ভিতরে ঢুকেই রমাকান্তের চোখে পড়ল ড্রইংরুমে আট-দশজন অতনুর বন্ধুর মধ্যে তিনটি মেয়েও রয়েছে। নিজেদের মধ্যে হাসি-ঠাট্টা চলছিল। তাকে দেখামাত্রই যেন আনন্দে ভাটা পড়ে গেল। প্রথমেই সামনে বসা তিনটি মেয়ের দিকে নজর পড়ল রমাকান্তের। বোধহয় প্রবীণ চোখ বিশেষ কাউকে খোঁজার চেষ্টা করছিল।

‘বাবা ভিতরের ঘরে চলো।’

রমাকান্ত ভিতরের ঘরে গিয়ে চেয়ারে বসল।

‘এরা এক্ষুনি চলে যাবে। তুমি বসো, আমি আসছি।’

‘ঠিক আছে। আমি কিছুক্ষণ বসছি। তাড়াহুড়ো করার দরকার নেই। ওরা যাক, তারপর এসো।’ নিজের বিনম্র ব্যবহারে রমাকান্ত নিজেই অবাক হয়ে যায়। তার স্বভাব তো এমন নয়! বরং উলটোটাই। কোনওদিন তো তলিয়ে দেখেনি। উমাচরণ বোঝানোর পর কাল থেকে যত পিছন ফিরে তাকিয়েছে তত যেন নিজেকে দোষী বলে মনে হয়েছে। বারবার বাড়ির সকলের করুণ মুখগুলো ভেসে উঠেছে চোখের সামনে।

পাখার হাওয়ায় পর্দাটা উড়ছে। ফাঁক দিয়ে ড্রইংরুমের কিছুটা অংশ দেখা যাচ্ছে। তিনটি মেয়ের মধ্যে দুটিতে মিলে একটি মেয়েকে সমানে ক্ষ্যাপাচ্ছে। ওদের হাবভাবে, রমাকান্তের আর বুঝতে বাকি থাকল না ওই মেয়েটিই স্টেলা। বেশ সুন্দর, স্মার্টও। বাচ্চাদের নিজেদের মধ্যে খুনসুটি ভালোই লাগছিল তার। কোথাও একটা মনে হচ্ছিল এরা কত সুন্দর, প্রাণবন্ত। কত সহজ করে নিয়েছে এরা জীবনটাকে। সুন্দরভাবে একে অপরের সুখ-দুঃখ শেয়ার করতে পারে। নিজের কথা সবার সামনে বলার ক্ষমতা রাখে এরা। মনে পড়ে যায় স্ত্রী মালা এবং মেয়ে দীপ্তির কথা।

নতুন প্রজন্মে জাতিধর্মকে ছাপিয়ে গিয়ে মানব সম্বন্ধকে প্রাধান্য দেওয়া, মহিলা পুরুষদের সমতুল্য ভাবা– জাতিধর্মের বন্ধন থেকে বেরিয়ে এই ধরনের নতুন নতুন বিচার ঘুরতে থাকে রমাকান্তের মনে। পুরোনো ধ্যানধারণার উপর নতুন ধ্যানধারণা ভারী হয়ে দাঁড়ায়। এমন সময়, স্টেলা ঘরে ঢুকে পায়ে হাত দিয়ে নমস্কার করতেই চমকে ওঠে রমাকান্ত। আশীর্বাদ করার জন্য হাতটা বাড়াতে গিয়েও…।

‘কেমন আছ বাবা?’ প্রশ্নটা শোনামাত্রই স্টেলার দিকে অবাক নয়নে তাকিয়ে থাকে রমাকান্ত। কত আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে মেয়েটি বাবা বলে ডাকছে। আবার মিষ্টি স্বরে, ‘বাবা তোমাকে খুব ক্লান্ত লাগছে। একটু শরবত বানিয়ে দিই?’

‘না না কিছু লাগবে না।’

‘না, তা বললে তো হবে না। জানি তুমি লেবু দেওয়া চা খেতে ভালোবাসো, কিন্তু এই গরমে চা খেলে শরীর খারাপ করবে যে। আমি বরং শরবত বানিয়ে নিয়ে আসি।’

রমাকান্তর বিস্ময়ের শেষ থাকল না। এত সহজে কেউ আপন হয়ে উঠতে পারে! এইটুকু একটা পুঁচকে মেয়ে, শরীরে ভয়ের লেশমাত্র নেই। কোথায় তার নামে বাঘে-গরুতে একঘাটে জল খায়, বাড়ির লোক দু-ঠোঁট এক করতে পারে না, আর এই মেয়েটি কিনা দিব্যি শাসন করে চলে গেল। বলে কিনা, গরমে চা খেতে হবে না, শরবত খাও!

খানিক পরে স্টেলা এসে শরবত দিয়ে গেল। যাবার সময় বলে গেল, ‘আমরা সবাই যাচ্ছি বাবা।’ বলে আবার একটা প্রণামও করে গেল। মনে হল কোনও ঠান্ডা হাওয়া বয়ে গেল।

মেয়েটিকে দেখে রমাকান্তের মনে প্রশ্ন ঘুরতে থাকল, সত্যিই কি মানুষের থেকে বংশের মানমর্যাদা, জাতপাত বড়ো হতে পারে? প্রত্যেকবারই এক জবাব পেয়েছে সে।‘না’। ‘কখনওই নয়’। বন্ধুদের ছেড়ে অতনু যতক্ষণে ঘরে ঢুকল, ততক্ষণে তার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়ে গেছে। লোকের কথা ভেবে সিদ্ধান্ত না নিয়ে মনের কথা শুনে চলাই শ্রেয়। তাতে সকলে মিলে ভালো থাকা যায়। সুতরাং তার বাড়ির বউ হওয়ার যোগ্য পাত্রী স্টেলা ছাড়া আর কেউ হতেই পারে না।

 

মৃত তারার আলো

অনেকদিন থেকেই ঘ্যানঘ্যান করছিল শৌনক। এতদিন এটা ওটা বলে দেওরকে পাশ কাটিয়ে এসেছে নিবেদিতা। সৌমেনেরও ইচ্ছে ছিল না এতদূরে স্রেফ বেড়াতে আসার। এমনিতেই সে উদ্ভিদ গোত্রের মানুষ। একবার যেখানে শিকড় চালিয়ে বসল সাধ্য কার তাকে সেখান থেকে নড়ায়। কলেজ থেকে ফিরে চা জলখাবার খেয়ে ল্যাপিতে ফেসবুক খুলে সেই যে একবার বিছানায় আধশোওয়া হল, তারপর বোধহয় ঘরে আগুন দিলেও তার হুঁশ ফেরানো যাবে না। বন্ধুরা টিটকিরি দেয় ক্রিকেট খেললে সে নাকি অনায়াসেই রাহুল দ্রাবিড় হতে পারত। বেডিং বেঁধে বসে যেত ক্রিজে। আচ্ছা আচ্ছা ফাস্ট বোলারের কালঘাম ছুটে যেত তাকে টলাতে।

সৌমেনকে নিয়ে এক একবার নিজেরও বিরক্তি ধরে নিবেদিতার। মনে পড়ে যায় কলেজ লাইফের এক্সারশনের দিনগুলোর কথা। শুধু নতুন নতুন জুলজিক্যাল স্পিসিসই নয় বলতে গেলে সেই ক’টা দিনই যেন তাকে এক নতুন পৃথিবীরও খোঁজ দিয়েছিল। দুটো বছর দেদারে ঘুরেছে তারপর। দীঘা, জুনপুট বা হাজারদুয়ারির সেই দিনগুলোর কথা মনে পড়লে একান্তে আজও আনমনা হয়ে যায় সে। জুনপুটের সেই রাত। হাজার বছর অতীতের মৃত তারাদের আলোতে মাখামাখি চিকচিকে বালির বিছানায় শুয়ে গ্রহান্তরের গল্প শোনা…

এইরকম সময় কতবার মনে হয়েছে নিবেদিতার, যদি তারা ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ত বা প্রফেশনাল কোনও কোর্স তাহলে বাড়িতে বলে কয়ে হয়তো আটকে রাখা যেত আরও দু’ একটা বছর। ছুটির দিনে সৌমেন যখন অনেক রাত অবধি হুইস্কি নিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে হুল্লোড় করে তখন আরওই ফাঁকা ফাঁকা লাগে। প্রায় মাঝরাতে সৌমেনের বেঁহুশ বেসামাল শরীরটা টলতে টলতে এসে ধপ করে পড়ে যায় বিছানায়। প্রাণপণে নাক মুখ কুঁচকে শুয়ে থাকে নিবেদিতা। সেই মুহূর্তেই মনে পড়ে যায়– ছ’বছরেরও বেশি হয়ে গেল বিয়ে হয়েছে তাদের।

শৌনককে দেখে তাই আরওই ভাবে নিবেদিতা– সৌমেনেরই তো আপন ভাই। কিন্তু একেবারে অন্য মেরু। ইলেকট্রিক্যালে বি.টেক করার পর প্রায় বছরখানেক বসেছিল বাড়িতে। ক্যাম্পাসিংয়ে চাকরি পায়নি। পাগলের মতো পরীক্ষা দিয়ে যাচ্ছিল সরকারি চাকরির। একদিন হুট করেই ডিভিসির চিঠি এল। এখন এক্সিকিউটিভ ইঞ্জিনিয়ারের পদে রয়েছে শৌনক। দু’ বছর চাকরি করার পর এই সবে গেল বছর বিয়েও করেছে। কলেজের ইয়ারমেট অঙ্গনাকেই।

সেম এজে বিয়ে করলে শৌনক, অঙ্গনাকে চোখ টিপে বলেছিল নিবেদিতা, অঙ্গনা তোমায় মানে তো? নাকি বউয়ের কথায় উঠছ বসছ আজকাল?

এসব আবার কী কথা বউদি, শৌনকের কথার সুরে বিস্ময়, ফ্র্যাংকলি স্পিকিং, তোমার কাছে এমনটা এক্সপেক্ট করিনি আমি…

অঙ্গনা অবশ্য বুঝেছে। শৌনককে রাগাচ্ছে নিবেদিতা। সেও হাসছে বড়ো জায়ের কথায়। কিন্তু শৌনক হঠাৎ সিরিয়াস, দ্যাখো, হোল ওয়ার্ল্ড খুঁজলেও কখনও এমন কাউকে পাওয়া যাবে না, যার সঙ্গে আমার একেবারে হুবহু মেলে। যে দশটা জিনিস আমার চয়েসে একদম এক্সেলেন্ট তার দশটাই কখনওই অঙ্গনার পছন্দ হতে পারে না। ওরও সব ডিসিশন আমার ঠিক মনে হবে এমন নয়। দেখতে হবে ফ্রিকোয়েন্সি ম্যাচ করছে কিনা। ওটা হলেই কাফি। তারপরে একটা লিবারাল স্পেস রাখতে হবে। আমাকে তুমি চেঞ্জ করতে আসবে না কখনও। আমিও যাব না তোমার যেসব ব্যাপার আমার অপছন্দ তাতে ইন্টারফেয়ার করতে…

আমরা কেউ কাউকে ডমিনেট করতে যাই না দিদি, এবারে মুখ খোলে অঙ্গনা, ওর এই মেন্টালিটিটাই আমার ভালো লেগেছিল কলেজে প্রথম মিশতে গিয়ে। ইনফ্যাক্ট আমিই শৌনকের চাইতে মাস তিনেকের বড়ো। বাড়িতে অ্যাজ ইট ইজ একটা হালকা আপত্তিও ছিল তাই। কিন্তু আমি কেয়ার করিনি। বলেই দিয়েছিলাম বিয়ে করতে হলে শৌনককেই করব। আর ওকে যদি ভুলে যেতে হয় আমায়, দেন ইউ অলসো ফরগেট অ্যাবাউট মাই ম্যারেজ ফর এভার…

অঙ্গনার কথা শুনতে শুনতে ভাবছিল নিবেদিতা– সবাই তো আর অঙ্গনা হতে পারে না।

তা বলে লিবারাল স্পেসের মানে এই নয় যে অঙ্গনা কারুর সঙ্গে শুতে চলে গেলে আমি টলারেট করব, বেশি সিরিয়াস হয়ে গেলে শৌনক যে আর আলগা ভদ্রতার ধার ধারে না অনেকবারই টের পেয়েছে নিবেদিতা। চশমাটা চোখ থেকে নামিয়ে বলে যায় সে, তেমন আমিও যদি প্রায়দিনই ড্রিংক করে রাস্তায় গড়াগড়ি দিই ও অফকোর্স সেটা হজম করবে না।

অঙ্গনার কাছে শুনেছে নিবেদিতা। শৌনকও মদ খায়। মাঝেমধ্যে অনেকটাই। কিন্তু অদ্ভুত সীমা রেখে।

বিয়ের এক বছরের মাথায় দিনকয়েকের ছুটিতে কলকাতার বাড়িতে এসে উঠেছিল শৌনক আর অঙ্গনা। তখনই হয়েছিল এত কথা। নিবেদিতা হঠাৎ অকারণেই বলে উঠেছিল, না আসলে সেম এজে বিয়ে তো বেশি হয় না। এখন অবশ্য হচ্ছে কিছু। আর তোমরা যেমন একজন আরেকজনের জন্যে ওয়েট করে বসেছিলে তেমনও হয় না ম্যাক্সিমাম কেসে। মেয়েদের বিয়ে হয়ে যায় আগেই। কলেজ লাইফের প্রেম টেকে খুব রেয়ার…

আরও কিছু হয়তো বলে ফেলতে যাচ্ছিল নিবেদিতা। কিন্তু সামলে নিল শেষ মুহূর্তে।

আমার কিন্তু তা মনে হয় না। আমাদের ক্লাসে ইনক্লুডিং আমি আর অঙ্গনা মোট সাতটা পেয়ার ছিল। পাঁচটা পেয়ারেরই বিয়ে হয়েছে। ফেলিওর মাত্র দুটো… বউদির কথার জবাবে বলে উঠেছিল শৌনক।

শৌনক, একটা কথা বলি এখানে, দিদির কথাটা আমি একেবারে কনডেম করব না, শৌনককে থামিয়ে দিয়ে এবারে বলেছিল অঙ্গনা, দেখ, ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ছেলেমেয়েদের সঙ্গে বাকিদের কমপেয়ার করলে চলবে না। দিদি যেটা বলছেন সেটাও ঠিক। জেনারেল গ্র্যাজুয়েশনের পর পরই একটা ছেলে চাকরি পেয়ে যায় খুব কমই। ক’ বছর লাগবে তার এস্টাব্লিশড হতে কোনও শিওরিটি নেই। আর মেয়েদের মোটামুটি গ্র্যাজুয়েশন হয়ে গেলেই বাড়ি থেকে বিয়ের কথা ভাবতে শুরু করে। তাই সিরিয়াস থাকলেও অনেক মেয়ে বাড়ির প্রেশারে অ্যাট লাস্ট ভেঙে পড়ে। একটা ইঞ্জিনিয়ার ছেলের জন্য বরং মেয়ের বাড়ি তাও বছরখানেক ওয়েট করতে রাজি থাকে…

হ্যাঁ এটা অবশ্য ঠিক। আমি ভাবিনি এ দিকটা, স্বীকার করেছিল শৌনক।

অঙ্গনার কথা শুনতে শুনতে অস্বস্তি হচ্ছিল নিবেদিতার। মেয়েটা যথেষ্ট স্মার্ট। কলেজ ক্যম্পাসিংয়ে শৌনকের আগেই চাকরি পেয়ে গিয়েছিল। সেক্টর ফাইভের একটা সফটওয়্যার কোম্পানিতে। বিয়ের পর চাকরি ছেড়ে না দিলে এতদিনে আরও উঁচুতে উঠতে পারত। হাঁ করলে হাই ধরতে পারে এসব মেয়েরা। নিবেদিতার কথায় কি কিছু আন্দাজ করে ফেলল মেয়েটা? এই প্রসঙ্গটা এখন তুলতে না গেলেই হয়তো ভালো হতো।

ছুটি শেষে অফিসে ফেরার আগে বরাবরের মতোই দাদা বউদিকে কয়েকদিনের জন্য ডিভিসি ঘুরে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করেছিল শৌনক। এবারে আর সে একা নয় খুব ধরেছিল অঙ্গনাও, একদিনের জন্যে মাইথন খুব ভালো আউটিং হবে দাদা। ডিভিসির ব্যারেজ, ডিয়ার পার্ক, দামোদরে বোটিং। খুব ভালো লাগবে…

হ্যাঁ, টানা দিন তিন চারেকের লিভ পেলেই যাব। শৌনকও বলছে অনেকদিন থেকেই। যাব এবারে অফকোর্স, চেলো রাইসের প্লেট থেকে এক টুকরো মাটন কাঁটায় গেঁথে নিতে নিতে বলেছিল সৌমেন।

পিটার ক্যাটের সোফায় বসে বসে ভাবছিল নিবেদিতা। শৌনকরা চলে গেলেই মাইথনের কথাও বেমালুম ভুলে যাবে সৌমেন। আর অন্তত এই একটা কথা কখনও তাকে মনে করিয়ে দিতে চায় না নিবেদিতাও।

কিন্তু মানুষ ভেবে রাখে এক আর হয় আর এক। কলকাতার হেড অফিস যে আচমকা সৌমেনকে দুর্গাপুর এনএসএইচএম-এর ম্যানেজমেন্ট বিভাগের হেড করে সেখানে বদলি করতে চলেছে সে কথা সৌমেন নিজেও জানতে পারেনি সপ্তাখানেক আগেও। দুর্গাপুরের কলেজে এতদিন যিনি ওই বিভাগের দায়িত্ব সামলাচ্ছিলেন সেই প্রফেসরের আকস্মিক মৃত্যুতেই সংস্থা বিপাকে পড়ে। আর যেসব ম্যানেজমেন্টের ফ্যাকাল্টি রয়েছে ওখানকার কলেজে বয়স বা অভিজ্ঞতা কোনওটার ভিত্তিতেই তাদের কাউকেই এই দায়িত্ব দিতে চাইছিল না হেড অফিস। অগত্যা কলকাতার কলেজ থেকে অন্তত কোনও অ্যাসোসিয়েট প্রফসরকেও বদলি করতেই হতো। দায়িত্বটা স্বভাবতই এসে পড়ল সৌমেন সর্বাধিকারীর ঘাড়ে। তবে আশ্বাস মিলল, বছর দুয়েক বাদে তাকে আবার কলকাতাতেই ফিরিয়ে আনা হবে। মুরারীপুকুরের বাড়ি কেয়ারটেকারের জিম্মায় রেখে অগত্যা সৌমেন আর নিবেদিতাকে চলে আসতে হল দুর্গাপুর। ভিরিঙি মোড়ের কাছাকাছি নাচন রোডে একটা ভালো বাড়ি ভাড়া পাওয়া গেল।

দুর্গাপুরে আসার সপ্তাখানেকের মধ্যেই একদিন ডিনারে বসে সৌমেন নিজেই বলল, বুঝলে নিবু, অনেকদিন থেকেই শৌনক বলছে তাছাড়া সেবার আমাদের ওখানে গিয়ে অঙ্গনাও খুব রিকোয়েস্ট করছিল, তা ভাবছি এত কাছে যখন এসেই পড়তে হল একবার ওদের ওখান থেকে ঘুরেই আসি। তুমি কী বলো? তাছাড়া এমনিও আমরা সেই হনিমুনের পরে আর বাইরে কোথাও যাইনি। শৌনককে জানিয়ে দিই যে আমরা একটা শনিবার দেখে যাচ্ছি…

ভাতের দলা মুখে তুলতে গিয়ে সহসা নিথর হয়ে গেল নিবেদিতা। দুর্গাপুরে এসে এখনও কলিগদের সঙ্গে সেভাবে সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি সৌমেনের। শনি-রোববারের সন্ধেগুলোয় তাই আর হুইস্কির আসর বসেনি এখনও অবধি। অথবা এমনও হতে পারে– সৌমেনের মনে হয়েছে এতদিন সে ছিল এক সাধারণ ফ্যাকাল্টি। কিন্তু আজ সে ডিপার্টমেন্টাল হেড। জুনিয়র ফ্যাকাল্টিদের আগের মতোই বাড়িতে ডেকে আনাটা শোভন না-ও দেখাতে পারে। তাছাড়া এসব দিক বাদ দিলেও নতুন জায়গায় এসে সৌমেন হঠাৎ সংসারের খুঁটিনাটি বিষয়ে অত্যন্ত সচেতন হয়ে উঠেছে। নতুন বাসা কিভাবে সাজিয়ে গুছিয়ে নেবে সেই ব্যাপারে আজকাল মাথাও ঘামাচ্ছে বেশ। সন্ধেগুলো আর ফেসবুক নিয়ে কাটায় না সেইভাবে। এতদিনে যদি সে স্ত্রীর একাকিত্বজনিত একঘেয়েমিকে একটুও উপলব্ধি করে থাকে, তবে সে তো খুবই আনন্দের বিষয়। কিন্তু নিবেদিতা আচমকা কোনও জবাব দিতে পারল না সৌমেনের কথায়। মাথা নীচু করে আবার মাছের কাঁটা বাছতে লাগল।

একটুক্ষণ চুপ করে থেকে অপরাধীর মতো গলায় সৌমেন আবার বলতে থাকে, আমি বুঝেছি তোমার ব্যাপারটা। আসলে কি জানো, কলকাতায় অনেক বন্ধুবান্ধব ছিল। বাড়িতে ছিল চব্বিশ ঘণ্টার কাজের লোক। আর বাড়ির যা কিছু টুকিটাকি সব মা-বাবাই গুছিয়ে দিয়ে দিয়েছিলেন। সংসারের কোনও দিকে যে মাথা ঘামানোর দরকার আছে আমার সেই কথাটাই তাই এতকাল খেয়াল হয়নি সেভাবে। কিন্তু এখানে এসে নতুন বাড়িতে ঢুকে ফিল করলাম অনেক কিছু গোছগাছ করতে হবে নিজের মতো করে। আর আমার নিজেকেই এবার অনেক দায়িত্ব নিতে হবে। তখনই ফিল করতে পারলাম তোমার কেসটাও। আমি তো সকালে উঠে এতদিন কলেজে চলে গেছি। সারাটা দিন কলেজে কাটিয়ে বাড়ি ফিরে আবার নিজের জগতে ঢুকে গেছি। কিন্তু সারাদিন তুমি…

সৌমেনের কথা শুনতে পাচ্ছে না নিবেদিতা। তার চোখের সামনে ক্রমশ ভেসে উঠছে একটা মৃত তারার মিটমিটে আলো। যে আলোটা আকাশের বুক থেকে হয়তো নিভে গেছে সাড়ে সাতশো বছর আগেই। কিন্তু হাজার আলোকবর্ষ দূরের তারাটা থেকে সেই আলোটুকু এইমাত্র এসে পৌঁছল পৃথিবীতে, যে আলোর যাত্রা শুরু হয়েছিল তারার জীবনকালে।

মরে যাওয়া তারার গল্প শুনিয়েছিল জয়দীপ। জুনপুটের সেই রাতে। তারপর কেটে গেল আজ আটটা বছর। আট বছর আগের একটি দিন। জীবনানন্দের নাম জানা ছিল কিন্তু সম্যক পরিচয় হয়েছিল জয়দীপের সূত্রেই।

বালিয়াড়ির বুকে পাশাপাশি শুয়েছিল নিবেদিতা আর জয়দীপ। সমুদ্রের ছলাৎ ছলাৎ শব্দ ভেসে আসছিল যেন কোন অনাদির বুক চিরে।

তোর আর আমার যদি বিয়ে না-ও হয় কোনওদিন, দীর্ঘক্ষণের নিস্তব্ধতা ভেঙে বলেছিল জয়দীপ, তবু এই অনন্ত নক্ষত্রলোকের কাছে অমর হয়ে রয়ে যাবে আমাদের এই সহবাস…

জয়দীপের মুখে হাত চেপে ধরেছিল নিবেদিতা। মৃত তারার আলোয় তার সিঁথিতে তখনও জ্বলজ্বল করছে জয়দীপের দেওয়া কালীঘাটের সিঁদুর। স্বামী-স্ত্রীর পরিচয়ে রেজিস্ট্রির কাগজপত্তর নিয়েই তারা এসেছে জুনপুটে। জুনপুটের এই রাত তাদের মধুচন্দ্রিমার প্রথম রাত। এমন রাতে এসব কী অনাসৃষ্টির কথা বলছে জয়দীপ!

নিবেদিতার হাত নিজের মুখের উপর থেকে সরিয়ে দিয়েছিল জয়দীপ। সমুদ্রের কোলাহলের সঙ্গে মিশে যেন বহুদূর থেকে ভেসে আসছিল তার উদাস কণ্ঠস্বর, পৃথিবী ছাড়া এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের আর কোথাও কি প্রাণ থাকতে পারে না নিবেদিতা?

আমার তো মনে হয় না আছে বলে। থাকলে কি আর এতদিনে খোঁজ পাওয়া যেত না? সহজ সুরেই উত্তর দিয়েছিল নিবেদিতা। ততদিনে এমন অদ্ভুত সব কথার সঙ্গে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে সে।

এই বিরাট আকাশের কতটুকুই বা আমরা জানি! ওই যে তারাটা জ্বলছে আকাশের ওই কোণায়, একদিকে আঙুল দিয়ে দিক নির্দেশ করেছিল জয়দীপ, ওই তারাটা আর সত্যি সত্যিই ওখানে আছে কিনা কে বলতে পারে?

এবারে সত্যিই অবাক হয়েছিল নিবেদিতা, মানে! তারাটাকে দিব্যি দেখতে পাচ্ছি। আর তুই বলছিস ওটা নাও থাকতে পারে ওখানে?

হ্যাঁ, ঠিক তাই, একটু থেমে আবার শুরু করেছিল জয়দীপ, হয়তো ওই তারাটা থেকে পৃথিবীতে আলো এসে পৌঁছোতে সময় লেগে যায় একহাজার বছর। তাই এইমাত্র যে আলোটা দেখছি আমরা আসলে সেটা সেই হাজার বছরের পুরোনো আলো। হয়তো সাড়ে সাতশো বছর আগেই নিভে গেছে তারাটা। কিন্তু আরও আড়াইশো বছর আলোটাকে অমনি দেখা যাবে…

শুনতে শুনতে ঘোর লেগে আসছিল।

জয়দীপ বলে যাচ্ছিল, আমাদের এই ছায়াপথেই আছে সূর্যের মতো কত নক্ষত্র। সূর্যেরই মতো তাদেরও কত গ্রহ উপগ্রহ। আবার এই ছায়াপথ আকাশের কতটুকুই বা। তারও বাইরে আরও কত দূর দূরান্তে এমন আরও কত অজস্র ছায়াপথ। আরও কত লক্ষ কোটি নক্ষত্র। তাদের গ্রহ উপগ্রহ। আমরা হয়তো জানি না কিন্তু এই বিশালতার আর কোথাও প্রাণ থাকা কি সত্যিই অসম্ভব?

জয়দীপের এই প্রশ্নের কোনও উত্তর ছিল না তার কাছে। সে শুধু মুগ্ধ বিস্ময়ে তাকিয়েছিল ছেলেটার মুখের দিকে। আবছা অন্ধকারে জয়দীপকে বহু আলোকবর্ষ দূরের মানুষ মনে হচ্ছিল। তার সেই অনন্ত অনুসন্ধিৎসাও যেন গ্রহান্তরের বিস্ময়। মৃত তারার পাণ্ডুর আলো মেখে জয়দীপের গালের চাপদাড়ি যেন পৌরাণিক দেবতার দাড়ির মতো সবুজ হয়ে গেছে। সেই সবুজ দাড়িতে হাত বোলাতে বোলাতে জয়দীপ বলেছিল, আড়াইশো বছর পরে ওই তারাটা পৃথিবীর মানুষের কাছেও মরে যাবে। কিন্তু তখনও হয়তো ওর জন্ম মুহূর্তের আলোটাও আকাশের সব কোণায় কোণায় পৌঁছবে না। হয়তো আরও দূরে অন্য কোনও এক ছায়াপথের এমন এক ছোট্ট গ্রহের উন্নত প্রাণী সেদিনও দেখতে পাবে তারাটাকে। মরে যাওয়ার পরেও তাই অনন্তকাল আকাশের দূর দূরান্তে বেঁচেই থাকবে তারাটা…

কি অপূর্ব এক মাদকতায় ভেসে যাচ্ছিল নিবেদিতা। জয়দীপের কথাগুলোর খানিক খানিক তাকে স্পর্শ করছিল আবার খানিক খানিক হারিয়ে যাচ্ছিল সামুদ্রিক ঝিমেল বাতাসে। জয়দীপ বলে চলেছিল, সেই গ্রহের বাসিন্দাদের হয়তো আছে আরও হাজারগুন উন্নত যন্ত্রপাতি। এই পৃথিবী থেকে আলো যেতে সেখানে সময় লাগে দশ হাজার বছর। ঠিক এই মুহূর্তে তুই আর আমি এই যে শুয়ে আছি জুনপুটের বালিতে এই ছবিটা সেই গ্রহের প্রাণীরা দেখতে পাবে আরও দশ হাজার বছর বাদে। ততদিনে আমরা আর কেউই বেঁচে নেই। হয়তো পৃথিবীটাই ধবংস হয়ে গেছে পারমাণবিক বোমায়। কিন্তু আমাদের এই সহবাসের ছবিটা অনন্তকাল আকাশের বিভিন্ন দূর দূরান্তের গ্রহ থেকে দেখাই যাবে। তাই বলছিলাম যদি তোর আর আমার কখনও ছাড়াছাড়ি হয়েও যায় আমাদের এই মুহূর্তের ভালোবাসাটুক…

হাত দিয়ে আবার জয়দীপের মুখ চেপে ধরেছিল নিবেদিতা।

আজ মনে হয় জুনপুটের সেই রাতে মৃত তারার আলো মেখে সবুজ হয়ে ওঠা দাড়িগোঁফের জয়দীপ যেন সত্যি সত্যিই স্বর্গের দেবতাদের মতো দিব্যদৃষ্টি লাভ করেছিল। নাহলে সে কেমন করে জানতে পারল সত্যিই একদিন ছাড়াছাড়ি হয়ে যাবে তাদের। বাড়ির চাপের মুখে ভেঙে পড়তে হবে নিবেদিতাকে। বিয়ে করতে হবে বয়সে প্রায় বছর সাতেকের বড়ো কর্মজীবনে সুপ্রতিষ্ঠিত সৌমেনকে।

বিয়ের পর বছরখানেক ফোনে যোগাযোগ ছিল কলেজের বান্ধবী সায়ন্তনীর সঙ্গে। তার মুখেই খবর পেত নিবেদিতা– জয়দীপ কেমন বিবাগি ধরনের হয়ে গেছে। কবিতা লেখার হাত ছিল কলেজে থাকতেই। আর ততদিনে নাকি একেবারে কবি বনে গেছে জয়দীপ। চাকরি বাকরির হাল হদিশ না করে শুধু নাকি লিখে যাচ্ছে ছোটো বড়ো সব লিটল ম্যাগাজিনে।

নাম বলতে পারিস? কোথায় কোথায় লেখে জয়দীপ? কলেজ স্ট্রিটে গিয়ে তাহলে একদিন… বলেছিল নিবেদিতা।

জানি না রে। লিটল ম্যাগাজিনের খোঁজ আর কে রাখে বল? নিউজ পেপার বা রেপুটেড ম্যাগাজিনে লিখলে তাও হয়তো চোখে পড়ত, নির্লিপ্ত গলায় বলেছিল সায়ন্তনী, কী আর হবে এসব করে? পয়সা আসবে? অথচ কত ব্রাইট ছেলে ছিল। আর কীভাবে নিজেকে স্পয়েল করছে আজকাল…

ফোনের এপাশে তখন নীরবতা।

ওপাশ থেকে তারপরেই মুখ ঝামটা দিয়েছিল সাযন্তনী, তোর কী রে এসব ভেবে? মাসিমা মেসোমশাই দেখেশুনে ভালোই বিয়ে দিয়েছেন। জাস্ট ভুলে যা। ফরগেট। আমারই ভুল হয়েছে। তোকে ওর কথা বলে। শোন, আর যদি কখনও তুই জয়দীপ শব্দটা উচ্চারণ করিস আমি দেন অ্যান্ড দেয়ার ফোনটা কেটে দেব। আর কখনও ধরবও না তোর ফোন। সে নিজের জীবনটাকে নষ্ট করছে, করতে দে। নইলে তোর ম্যারেড লাইফটা শেষ হয়ে যাবে। সৌমেনদা জানতে পারলে…

শেষ খবরটা অবশ্য সেই সায়ন্তনীই দিয়েছিল। বেড়াতে গিয়ে পাথরের খাঁজে খাঁজে অনেক নীচে নেমে গিয়েছিল জয়দীপ। উঠে আসতে আর কেউই দেখেনি…

সায়ন্তনীর গলাও ধরে এসেছিল সেদিন, যতই বল, একসঙ্গে কাটিয়েছি তো তিনটে বছর। শেষের দিকে যেমনই বাউন্ডুলে ছন্নছাড়া হয়ে যাক না কেন সত্যিকারের ভালো ছেলে তো ছিল এককালে…

শৌনক, তোমার ক্যামেরার অপটিক্যাল জুমটা আর একটু বাড়াও তো। যতটা বাড়ানো যায়, প্রাণপণে স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করে নিবেদিতা। কণ্ঠস্বরে যেন এতটুকুও উত্তেজনা প্রকাশ না পেয়ে যায়। প্রায় খাড়া একটা পাথরের ওপর দাঁড়িয়ে আছে সে। শৌনক রয়েছে পাশেই। সৌমেন আর অঙ্গনা দিব্যি বোল্ডারের মতো পাথর বেয়ে নেমে গেছে জলের একদম কাছে। এখান থেকে প্রায় পুতুলের মতো ছোটো দেখায় তাদের। নিবেদিতা শুরুতে নামতে চায়নি অত নীচে।

তোমরা ঘুরে এস না। আমি ততক্ষণ এখানে বসেই ওয়েট করছি না হয়। বলেছিল সে।

কিন্তু সবাই জোরাজুরি করল।অঙ্গনা বলল, আমাকে খেয়াল রাখবেন দিদি। কীভাবে নামব আমি। আপনি জাস্ট ফলো করে যান।

নিবেদিতা এড়ানোর চেষ্টা করছিল যদিও, শাড়ি পরে কি আর পারব? তুমি সালোয়ার-কামিজ পরে যতটা এফিশিয়েন্টলি পারবে নামতে…

তখন সৌমেন বলল, ভয়ের কিছু নেই। ধাপ ধাপ আছে বেশ পাথরগুলো। সিঁড়ির মতো নেমে যাবে। কোনওটা একটু খাড়া মনে হলে জাস্ট অ্যাভয়েড করে পাশের পাথর বেয়ে নামবে।

শেষে শৌনক বলল, ঠিক আছে। অঙ্গনা আর দাদা আগে নেমে যাক। আমি তোমার সঙ্গে থাকছি। কোনও প্রবলেম হলে আমি থাকছি পাশে।

অগত্যা নামতেই হল। আর এখানে এসে প্রথমে যেমন আড়ষ্ট লাগছিল, অঙ্গনাদের সঙ্গে কথায়বার্তায় ঠাট্টাইয়ার্কিতে সেই ভাবটা আপনা থেকেই কেটেও গিয়েছিল একসময়। শৌনকের কোয়ার্টারটা পড়ে ঝাড়খণ্ডে। আবার কাজের জায়গাটা বেঙ্গলেই। অফিস ঘুরিয়ে দেখাল শৌনক। আন্ডারগ্রাউন্ডে যেখানে টারবাইন রয়েছে সেখানে দাদা-বউদিকে নিয়ে যাওয়ার জন্য বিশেষ পাসও করিয়ে রেখেছিল। অফিস দেখার পর লাঞ্চ সারতে গাড়ি চেপে যাওয়া হল আবার ঝাড়খন্ড। মাইথন হোটেলের খাওয়াদাওয়া একটু কস্টলি হলেও কোয়ালিটি বেশ ভালো। দুপুরে সাদা ভাত খেতেই ভালোবাসে নিবেদিতা। পাতলা করে মাছের ঝোল সঙ্গে থাকলে বেশ হয়। সেসব আর এখানে কোথায়! ডাল ফ্রাই আর চিকেন নিল সে। শৌনক খেল হায়দ্রাবাদি মাটন বিরিয়ানি। অঙ্গনা আর সৌমেন ফ্রায়েড রাইস আর চিকেন বাটার মসালা নিয়েছিল। ভরদুপুরে এরা যে কী করে এত রিচ খেতে পারে!

খাওয়াদাওয়ার পর ড্যাম দেখতে আসা হয়েছে। পাথরের ধাপে নামতে গোড়ায় যতটা ভয় লাগছিল দু’ কদম চলার পর নিবেদিতা দেখল ব্যাপারটা অত মাথাব্যথার কিছুই নয়। বরং বেশ মজারই। ঠাট্টা করে বললও শৌনককে, এডমন্ড হিলারি পাহাড়ে উঠে বিশ্বজয় করেছিলেন আর আমরা খাদে নেমে মাইথন জয় করছি।

যা বলেছ, হাসল শৌনক। ক্যামেরাটা নিবেদিতার হাতে দিয়ে বলল, ফটো তুলতে পারো এখানে। দূরের পাহাড়ের বা ড্যামের। সিনিক বিউটি পাবে এনাফ…

ছবি তুলতে বরাবরই খুব ভালোবাসে নিবেদিতা। তাও দোনামোনা করছিল ক্যামেরাখানা হাতে নিতে, দ্যাখো, আমার হাতে দিচ্ছ। ক্যালাস ভাবে নামতে গিয়ে যদি পা হড়কায় তোমার এত কস্টলি ক্যামেরাখানাই কিন্তু যাবে তখন।

কিচ্ছু হবে না। তুমি ক্যামেরার ফিতেটা গলায় ঝুলিয়ে নাও বরং।

দূরের খাদের পাথরের দিকে ক্যামেরা তাক করল নিবেদিতা। কিছুটা গাছপালা নিয়ে ভালো ছবি আসতে পারে। ক্যামেরা চোখে লাগানোর আগেই মনে হচ্ছিল একটা লোক ঘুরে বেড়াচ্ছে পাথরের ধাপে ধাপে। আঙুল তোলে সে, একটা লোককে ওইখানে ঘুরতে দেখছ শৌনক। বাপ রে, শখ বলিহারি। কোথায় চলে গেছে।

তার নির্দেশ করা দিকে তাকিয়ে শৌনক বলল, কই আমি তো কাউকেই দেখতে পাচ্ছি না। না না একদম ফাঁকা। কোথায় লোক। আর ওদিকে যাবেই বা কেন। জল নেই শুধুই পাথর। অবশ্য অ্যাডভেঞ্চারের জন্যে যেতেও পারে। কিন্তু কেউ নেই তো…

সে কি তুমি দেখতে পাচ্ছ না! ওই তো হেঁটে যাচ্ছে। এবার দাঁড়াল। এই আমাদের দিকে মুখ ঘুরিয়ে তাকিয়ে আছে এখন, নিবেদিতা স্পষ্ট দেখতে পায় একটা মানুষের মতো অবয়ব।

শৌনক বলে, তুমি দেখতে পাচ্ছ? আমি দেখতে পাচ্ছি না কেন? কেস খেয়েছে। পাওয়ার বেড়েছে বোধহয়…

ক্যামেরাখানা শৌনকের দিকে এগিয়ে দিয়ে নিবেদিতা বলে, জুমটা একটু বাড়িয়ে দাও। আমি লোকটার ছবি নিয়ে তোমায় দেখাচ্ছি।

শৌনক অপটিক্যাল জুম বাড়িয়ে দেয় খানিকটা।

কিন্তু লেন্সে চোখ রেখেই ভয়ানক চমকে উঠল নিবেদিতা। সঙ্গে সঙ্গে চোখ থেকে ক্যামেরা নামিয়ে আবার শৌনকের দিকে বাড়িয়ে দিল সে। উত্তেজনায় তার সারা শরীর কাঁপছে। আকাশির উপর নেভি ব্লু স্ট্রাইপ দেওয়া ওই শার্টটা তার অনেক কাল আগের চেনা। তাছাড়া চোখমুখও…

কণ্ঠস্বরকে যথাসম্ভব সংযত রেখে বলে ওঠে নিবেদিতা, শৌনক, তোমার ক্যামেরায় অপটিক্যাল জুমটা আর একটু বাড়াও তো। যতটা বাড়ানো যায়…

শৌনক এবারে আশ্চর্য হয়, তুমি কি লোকটার ফুল সাইজ ফটো নেবে নাকি? একটা অচেনা লোকের ফটো নিয়ে কি হবে বেকার!

শৌনক। শৌনক, তোমায় যা বলছি তাই করো, নিবেদিতার গলায় এবার সুস্পষ্ট আদেশের সুর।

বউদির গলায় এমন জোর কখনও শোনেনি শৌনক। সে আশ্চর্য হয়। কিছুই বুঝতে পারে না। তবু অপটিক্যাল জুমটা যথাসম্ভব বাড়িয়ে বউদির হাতে দেয় ক্যামেরাখানা।

লেন্সে চোখ রেখে এবার নিবেদিতার সারা শরীর কাঁপতে থাকে। উত্তেজনায়, নাকি ভয়ে সে নিজেও জানে না। স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে সে মানুষটাকে। চোখ মুখ নাকের প্রত্যেকটা রেখা এখন পরিষ্কার। আর সারা গালে সবুজ রঙের দাড়ি। কোনও মানুষের দাড়ি এত সবুজ হতে দেখেনি নিবেদিতা। দূরের পাহাড়ের ঢাল থেকে জয়দীপ হাসছে তার দিকে তাকিয়ে। বিকেলের মরা রোদ জয়দীপের মুখে চোখে। সেই রোদে সবুজ দাড়ি আর তপ্ত কাঞ্চন শরীরের জয়দীপকে পুরাণের গল্পে বর্ণিত দেবরাজ ইন্দ্রের মতোই অপরূপ সুন্দর দেখাচ্ছে। তার শরীরও পৃথিবীর মানুষের মতো নয়। যেন অপার্থিব এক জ্যোতি নির্গত হচ্ছে তার অবয়ব থেকে। আরও আশ্চর্য এত বছর পরেও তার চেহারা সেই পুরোনো দিনের মতোই রয়ে গেছে। এই আট বছরে অনেক মেদ জমেছে নিবেদিতার শরীরে। কিন্তু জয়দীপ সেই জুনপুটের দিনগুলোর মতোই নির্মেদ বলিষ্ঠ। আট বছর আগেকার হাফস্লিভ শার্টটাও অত উজ্জ্বল থাকতে পারে না এতদিন ধরে। আকাশির ওপর সেই নেভি ব্লু স্ট্রাইপের দাগগুলো ঠিক তেমনি আছে।

কতক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পেরেছিল নিবেদিতা মনে ছিল তা তার। হয়তো দু’ এক মুহূর্তই।

শৌনক জড়িয়ে না ধরলে টলে পড়ে যেত সে। শৌনকের চিৎকারে অঙ্গনা আর সৌমেন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব উঠে এসেছে পাথরের ধাপে ধাপে দৌড়ে।

শৌনক বলে, পড়ে যাওয়ার আগে ক্যামেরার শাটার টিপেছিল বউদি। আমার স্পষ্ট মনে আছে।

অঙ্গনা বলল, দেখ তো ফটোটা একবার…

কিন্তু ফটোয় শুধু একটা বড়ো পাথর। জুম করার কারণেই পাথরের প্রত্যেকটা দাগ স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে।

শৌনক বলে, আমি ঠিকই দেখেছিলাম। কেউ ছিল না ওখানে।

শুধু নিবেদিতা দেখতে পেয়েছিল জয়দীপকে।

অনেক আলোকবর্ষ দূরের মানুষ হয়ে গেছে আজ জয়দীপ। সেই দূরত্ব থেকে আলো পৃথিবীতে এসে পৌঁছোতে লেগে যায় অনেক বছর। যতদিন বাঁচবে নিবেদিতা, এমন করেই মাঝে মাঝে দেখতে পাবে বহু আলোকবর্ষ দূরান্তের সেই মানুষটাকে।

মৃত তারার আলো যেমনি করে অনন্তকাল পরিক্রমা করে চলে অনন্ত আকাশে।

 

পড়ার জন্য সীমাহীন গল্প-নিবন্ধসাবস্ক্রাইব