মায়ানদী

‘এই ছেঁড়া মাতলা!’

শান্তনুর এত বিস্ময়ের কারণ খুঁজে পেল না মারুনা। মাতলার একটা ছোটো শাখা নিশ্চয়ই, তাই ছেঁড়া মাতলা। কিন্তু শান্তনুর কথায় মনে হচ্ছে এই নদীর অনুষঙ্গে কোনও স্মৃতি মনে পড়ে গেছে ওর! যাকে বলে অ্যাসোসিয়েশন মেমরি। চোখটা জ্বালা-জ্বালা করে উঠল তার। তাদের সব জার্নিতেই কি পিয়ালীর ব্যাগেজ বয়ে বেড়াতে হবে?

গতকাল থেকেই লক্ষ্য করেছে যে-কোনও স্পটে পৌঁছেই শান্তনু বলছে ‘এখানে আমরা এসেছিলাম।’ এমনকী ছবি তুলতে তুলতে বলল ‘ঠিক এই সিঁড়িটার সামনে পিয়ালীর একটা ছবি আছে। স্মাইল!’ মারুনার হাসিটা বেঁকে গিয়েছিল ধেবড়ে যাওয়া কাজলের মতো। শান্তনুর এই হৃদয়হীন ব্যবহারের কোনও অর্থই খুঁজে পায়নি মারুনা। মারুনা তো সেধে ওর জীবনে আসেনি, পিয়ালীকেও তাড়ায়নি।

মানুষের জীবনের প্রথম আতান্তরটি বোধহয় ‘ওই যাঃ, পাখি উড়ে গেল, দুশ যাঃ!’ উড়ে গেল, না উড়িয়ে দিল কেউ, মারুনা বুঝতে পারেনি। শান্তনুর সঙ্গে এই দেড়বছরের একত্রযাপনে কখনও এসেছে এমন সঙ্কট? আসেনি। সে বরাবরই অজস্র মনোযোগ পেয়েছে, অজস্র আদর, তার মনে হতে শুরু করেছিল সে একেশ্বরী। কিন্তু সুন্দরবনে না এলে সে যে এত দীন– তা তো বুঝতেই পারত না।

আপনজন হোটেল, পাখিরালয়, ঘাটে নেমে জায়গাটার কোনও বিশেষত্ব খুঁঝে পায়নি। ঘাটের কাছে, যেমন হয় আর পাঁচটা পর্যটন কেন্দ্রে, হরেক জিনিসের দোকান, ডাব খাবার ভিড়, সেগুলো ফেলে বাঁদিকে গিয়ে একটা ছোট্ট কাঠের সাঁকো পেরিয়ে ওদের হোটেল। বিশাল বড়ো, আর ছিরিছাঁদহীন, বাথরুম-টাথরুম খুব খারাপ নয়, কিন্তু পুরোটাই জেনারেটর নির্ভর। বাপরে! এই মার্চ মাসে দোলের সময় এখানে আসে কেউ? মারুনার মনে হল ওরাই এ মরশুমের শেষ পর্যটক।

আসলে এবার ওদের অন্য কোথাও যাবার কথা ছিল। কখনওই সুন্দরবন নয়। কিন্তু মারুনার একটা ইন্টারন্যাশনাল সেমিনার হবার কথা ছিল জানুয়ারিতে, সেই জন্য লম্বা কোনও টুর আগে থেকে বুক করা হয়নি। অথচ সেই সেমিনার জানুয়ারিতে হল না, পেছিয়ে গেল, মাঝখান থেকে লম্বা টুরও হল না। মারুনা প্রস্তাব দিয়েছিল, ‘চলো গাড়ি নিয়ে লং-ড্রাইভে বেরিয়ে পড়ি’ শান্তনু অন্যমনস্ক গলায় বলেছিল, ‘তুমি তো গান জানো না!’

কথাটা ঠক করে লেগেছিল মারুনার বুকে। ও জানে, এরপর অবধারিতভাবে পিয়ালীর গানের প্রসঙ্গ আসবে। পিয়ালী দারুন গান গাইত, রবীন্দ্রসংগীত থেকে সেমি ক্লাসিক্যাল সবই। মারুনা চুপ করে শুনবে, কোনও কথা বলতে পারবে না, কারণ কথাটা তো সত্যি। পিয়ালী তো সত্যিই দারুণ গান গাইত। ওর গান শুনে মারুনাও তো মুগ্ধ হয়েছে, এখনও হয়। ওর একটা গান এখন এফএম, টিভি, পুজো প্যান্ডেল সর্বত্র বাজছে, বলিউডে বড়ো ব্রেক পেয়েছে যে-গানটা গেয়ে ‘নাজুক কলহাইয়া মোরি’।

মারুনার তবু চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করেছে, ‘আমি গান জানি না বলেই তো আমাকে বিয়ে করেছ তুমি। এখন তা হলে আমাকে নিয়ে লং-ড্রাইভে যেতে অসুবিধে কোথায়?’

বড়ো টুর হল না, লং-ড্রাইভ হল না, ফেব্রুয়ারিতে মারুনার মা অসুস্থ হলেন হঠাৎ, তাঁকে নিয়ে নার্সিংহোম, ঘর ছোটাছুটি– শান্তনুই করল বেশি। মার্চ আসতে দুজনের মনের অবস্থাই সাংঘাতিক, কোথাও একটা যেতেই হবে। শহরের সব ট্র্যাভেল এজেন্সিতে খোঁজ নিয়ে দেখা গেল বেদুইন ট্রাভেলসেরই, দোলে সুন্দরবন প্যাকেজে দুটো সিট পড়ে আছে। ঝটপট সেটাই বুক করে ফেলল শান্তনু।

সত্যি বলতে কি, বিয়ের পর এই তাদের প্রথম বাইরে যাওয়া। পিয়ালী শান্তনুকে ছেড়ে মুম্বই গিয়েছিল অনেকদিন, সেখানে কে এক মিউজিক ডিরেক্টর পবন চতুর্বেদীর সঙ্গে লিভ-ইন করছিল, এটাও জানা ছিল। এসব সত্ত্বেও সে শান্তনুকে ডিভোর্স দিতে রাজি ছিল না। মুম্বইয়ে সুবিধে করতে না পারলে কলকাতায় ফিরে আসবে, তাই শান্তনুকে কুশন হিসেবে রাখতে তার ইচ্ছে হয়তো অস্বাভাবিক কিছু নয়। কিন্তু শান্তনু তা মেনে নেবে কেন? শুরু হল টানাপোড়েন। শান্তনু না চাইলেও অ্যাডাল্টরির অভিযোগ আনতে হল। যেহেতু ওটাই স্ট্রং গ্রাউন্ড। অভিযোগ সম্পূর্ণ সত্যি হলেও শান্তনু যে কেন পিয়ালীকে সর্বসমক্ষে ব্যভিচারিণী বলতে চায়নি, তা মারুনার কাছে স্পষ্ট নয়, যেমন স্পষ্ট নয়, পিয়ালী ফেরত নিতে এলেও জরুরি ডকুমেন্টস ছাড়া, তার ব্যবহূত জিনিসপত্র, কসমেটিক্স, ব্যাগ, শাড়ি, অন্য পোশাক, টুকটাক গয়না কিছুই কেন শান্তনু ফেরত দেয়নি, এমনকী পিয়ালীর লঁজারি পর্যন্ত।

ছোট্ট ফ্ল্যাট নয়, বেশ বড়ো বাড়ি শান্তনুর, মাস্টারদা সূর্য সেন মেট্রো স্টেশনে নেমে সামান্য হাঁটলেই বাড়িটা। বাড়ি ঘিরে বিশাল বাগান, এমনকী একটা পুকুর পর্যন্ত আছে। সেই বিশাল বাড়ির একটি ঘরে ঠাসা শুধু পিয়ালীর জিনিস। ওটা আগে ওদের বেডরুম ছিল। এখন শান্তনু তার আর মারুনার জন্য অন্য একটি ঘর সাজিয়ে নিয়েছে। মারুনার প্রতি তার যত্ন ও আদরের কোনও ত্রুটি নেই। মারুনার প্রতিটি সুবিধে অসুবিধের দিকে তার সদাসতর্ক দৃষ্টি। কিন্তু ওই যে তালাবন্ধ ঘরটা, ঘরে ঠাসা পিয়ালীর জিনিস। সারাক্ষণ মারুনার মনের সবটুকু জুড়ে আছে ওই স্মৃতির ঘর। এখানেও যেন সেই ঘরটা সঙ্গে বয়ে এনেছে ওরা। শান্তনু সেটা সারাক্ষণ পিঠে বয়ে বেড়াচ্ছে, আর মারুনা একটুও স্বস্তি পাচ্ছে না, একটুও আনন্দ পাচ্ছে না তাদের বিবাহিত জীবনের প্রথম যৗথ ভ্রমণে। তার খালি মনে হচ্ছে বেড়াতে না এলেই ভালো হতো। বাড়িই ভালো।

নদী এখানে অনেকটা চওড়া হয়ে গেছে, বিকেলের হলুদ আলো গাছগুলোর মাথা আলগোছে ছুঁয়ে আছে। সূর্য ডুবতে বেশি দেরি যে নেই, তা বোঝা যাচ্ছে সবার চোখেমুখে চাপা টেনশন দেখে। সূর্যাস্তের ছবি তুলতেই হবে। বন্দুকের ট্রিগারে হাত রাখার মতো সবাই ক্যামেরা নিয়ে তৈরি। বেশিরভাগই আলাদা ক্যামেরা আনে না আজকাল, মোবাইলেই তোলে। মারুনাও তার মোবাইল বার করে ফেলল। সূর্য, নদী, অরণ্য– নৈর্ব্যক্তিক এই ছবিগুলো অন্তত পিয়ালীর কথা বলবে না।

‘দ্যাখো, দ্যাখো, আমি জাস্ট ভাবতে পারছি না!’

শান্তনু আচমকা এত প্রাবল্যের সঙ্গে তার পিঠে হাত রাখল যে আর একটু হলেই তার মোবাইলটা হাত ফসকে জলে পড়ে যাচ্ছিল। খুব বিরক্ত হয়ে সে পেছন ফিরে বলল ‘যাচ্ছিল মোবাইলটা। এত এক্সাইটমেন্টের হয়েছেটা কী? ঘন্টার পর ঘন্টা ধরে সেই তো জল আর জল দেখে যাচ্ছি।’

শান্তনু নাটকীয় গলায় বলল,

‘জল শুধু জল, দেখে দেখে চিত্ত তোর হয়েছে বিকল– তাই না রে? ওরে অবোধ বালিকা, এক্সাইটেড হব না! ওই যে গাইডটা দেখছ, সকাল থেকে আমাদের পেছনে ফেউয়ের মতো লেগে আছে, ওই যে, কলকেতার বাবুরা হাঁ করে যার জ্ঞানবাণী গিলে যাচ্ছে, ওই লোকটা কে জানো?’

‘কে? ডোনাল্ড ট্র্যাম্প? না রয়েল বেঙ্গল টাইগার?’

‘তার চেয়ে বেশি। সকাল থেকে তাই ওকে এত চেনা-চেনা লাগছিল। আরে সেবার যখন পিয়ালীকে নিয়ে এখানে এসেছিলাম, এই লোকটাই গাইড ছিল। ওর নাম হচ্ছে আশুতোষ খাঁড়া। পিয়ালী ওর কাছ থেকে একটা রুটম্যাপ লিখে নিয়েছিল। লোকটার হাতের লেখা মুক্তোর মতো। পিয়ালী ওকে দুশো টাকা দিয়েছিল আলাদা করে।’

পিয়ালী, পিয়ালী, পিয়ালী! উঃ! মারুনার মুখ নিমেষে ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। তবু সে যথাসাধ্য নিজেকে সামলে নিয়ে বলল ‘কাগজটা কোথায়?’

‘মানে?’

‘ওই যে বললে কাগজে রুটম্যাপ লিখে দিয়েছিল’,

শান্তনুর মুখ হাজার দীপশিখায় জ্বলে ওঠে। ‘আছে। আমি দিইনি তো কিছু ফেরত। আমার সঙ্গে থাকার প্রতিটি মুহূর্ত, আমার সূত্রে যা যা অর্জন করেছে পিয়ালী, সব, সব  রেখে দিয়েছি। ওই তালা বন্ধ ঘরে আছে। ওয়াল ক্যাবিনেটের বাঁদিকের তিন নম্বর খোপে পেয়ে যাবে।’

মারুনা যেন এতক্ষণে একটা আঁকড়ে ধরার মতো কিছু পায়। ওয়াল ক্যাবিনেটের তিন নম্বর খোপে যেন ওর সুখের ঘরের চাবি আছে। সে বেশ গুছিয়ে মোবাইল ক্যামেরা তাক করে পশ্চিম আকাশের দিকে, মুরুবি৩ চালে বলে ‘একি! সূর্যাস্তের ছবি তুলবে না?’

সকাল থেকে যতটা খারাপ গেছে, সন্ধেটা তার তুলনায় অনেক অনেক ভালো কাটল। হোটেলটা খুব খারাপ না। অনেকখানি জায়গা জুড়ে। যদিও কোনও ছিরিছাঁদ নেই, এল শেপের স্কুলবাড়ির মতো। তার ওপর লোডশেডিং-এর দৗরাত্ম্য। বাথরুমে একরাশ অজানা পোকা, গা ধুতে গিয়ে চোখে নাকে ঢুকে গেল। তিনতলার ঘর, ছাদ রোদে তেতে আগুন হয়ে আছে। গা ধুয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়াতে বেশ আরাম হল। সারা হোটেলে নাকি দুটো মাত্র এসি ঘর, যারা আগে বুক করে এসেছে তারা পাবে। নীচে এ নিয়ে চ্যাঁচামেচি শোনা গেল খুব। ম্যানেজারকে যাচ্ছেতাই করে কথা শুনিয়ে এল কয়েকজন। ‘আগে জানালে আমরাও এসি বুক করে আসতে পারতাম। কেন সেই অপশনটাও দেওয়া হল না!’

কিছুক্ষণ চলল এরকম, তারপর সব শান্ত হয়ে এল। আসন্ন সন্ধের মায়া ছড়িয়ে পড়ল আকাশে। বারান্দা থেকে দেখল সন্ধেলাগা নদীর ওপর চাঁদ উঠল, সোনার থালার মতো চাঁদ। মারুনার আচমকা মনে পড়ল আজ পূর্ণিমা। যে সে পূর্ণিমা নয়, দোলপূর্ণিমা। দোল আর পরের শনি-রবি এই মিলিয়েই তো ট্রিপটা সম্ভব হয়েছে তাদের। আজ দোল, অথচ এক ফোঁটা আবিরও কেউ কারও কপালে ছোঁয়ায়নি। ফোনে কয়েকটা মেসেজ এসেছে, ‘হ্যাপি হোলি’। এছাড়া সারাদিনে মনেই পড়েনি আজ দোল। প্রতিবার দোলে তাদের বাড়িতে উৎসবের মেজাজ, মা পূর্ণিমার শিন্নি দেয় একদিকে, অন্যদিকে মামাতো, মাসতুতো, পিসতুতো ভাইবোনেরা মিলে রং মেখে হুল্লোড় করে। এখানে না এলে এবারও সেখানেই থাকত। বুকে একটা চিনচিনে ব্যথা উঠেই মিলিয়ে গেল। মহাসমারোহে দোল পালন করতে না পারা, শান্তনুর লাগাতার পিয়ালী – পিয়ালী– সব মুছে গেল মুহূর্তে। নদী আর তার বুকে মস্ত চাঁদ, মারুনার সমস্ত না-পাওয়াকে তুচ্ছ করে দিল। বারান্দায় আরও অনেকে চেয়ার পেতে বসে গজল্লা করছিল। তাদের কথাও মারুনার কানে গেল না। কতক্ষণ যে সে ওইভাবে বসেছিল কে জানে। হঠাৎ ট্রাভেলসের একটা ছেলে এসে প্লেটে প্লেটে চাউমিন দিয়ে গেল, আর সেটা দেখেই নিশ্চয়ই শান্তনু বেরিয়ে এল ঘর থেকে, ছেলেটাকে বলল, ‘চা দেবে না?’

‘এটা খেয়ে নিন, চা আসছে।’ বাব্বা! ছেলেটার গলা কী গম্ভীর! খেতে খেতে সেই গম্ভীর গলা চড়িয়ে ছেলেটা বলে গেল, ‘চা খেয়ে নীচের লনে আসবেন। যাত্রা হবে।’

‘কী যাত্রা ভাই?’

‘বনবিবির পালা।’

শান্তনুর সামনে বসে খেতে রীতিমতো অস্বস্তি হচ্ছিল মারুনার। হয়তো বলে বসবে, সেবার পিয়ালীর সঙ্গে যখন এসেছিল, বিকেলে ঠিক এই টিফিনই খেয়েছিল। তাকে আশ্বস্ত করে শান্তনু কিছু বলল না, চাউমিনটা চেটেপুটে খেয়ে নিল, তারপর বারান্দা থেকে নীচের লনে উঁকি মেরে বলল, ‘দেখেছ, স্টেজ বাঁধা হয়ে গেছে।’

মারুনাও উঁকি মারল নীচে। খুব নীচু মঞ্চ, স্টেজের পেছনে কয়েকজন বসে মেক-আপ করছে। যারা স্টেজ বাঁধছিল, তারাও মেক-আপ নিতে বসে গেল একটু পরে। একজন ব্যানার টাঙিয়ে দিল একটা, তাতে লেখা ‘মা নৃত্যাঞ্জলি অপেরা’। দেখে মজা লাগল মারুনার।

‘যাবে না নীচে? ওঃ তোমার তো আবার গান-টানে ইন্টারেস্ট নেই।’

মারুনার বুক ধক্ করে উঠল। গান থেকে পিয়ালীতে যেতে এক সেকেন্ডও লাগবে না শান্তনুর। বিয়ের পর এই তাদের প্রথম যৗথ ভ্রমণ, যাকে মধুচন্দ্রিমা বলাই দস্তুর, একেবারে পলিটিক্যালি কারেক্ট, চাঁদও উঠেছে সঙ্গতি রেখে– তবু সারাক্ষণ পিয়ালী-পিয়ালী জপে কেন যে কানের পোকা বার করে দিচ্ছে লোকটা? হয় ও অতিবোকা, নয় অতি হূদয়হীন, নয় যে কী ভেবে পেল না মারুনা। সে শান্তনুকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে নেমে এল নীচে।

স্নান সেরে লংস্কার্ট আর কুর্তি পরেছিল। চুল খোলা, চোখে কোহল, ঠোঁটে লিপবাম, বডি পারফিউমের গন্ধটা তাকে ঘিরে রেখেছে। লনে সারি সারি পাতা চেয়ারে চাঁদের নীচে বসে তার নিজেকে খুব ভালোবাসতে ইচ্ছে করছিল। যেন শান্তনুর সঙ্গে নয়, সে একাই এসেছে। একটু পরে যাত্রা শুরু হল। গরিব বিধবা মায়ের সন্তান দুখে, সে কীভাবে বনবিবির কৃপায় বাঘের হাত থেকে রক্ষা পেল– এই প্রচলিত লোকগল্প নিয়েই পালা। যাত্রা ফর্মটা তার কোনওদিন দেখা না থাকায় প্রথম প্রথম হাসি পাচ্ছিল। কিন্তু কিছুক্ষণ পর সে লোকশিল্পের শক্তি টের পেল। গানে, অভিনয়ে গোটা সুন্দরবনের লোকজীবন, নদী, অরণ্য, নোনামাটি তার মধ্যে ঢুকে যাচ্ছিল। শেষে যখন দুখে গান ধরল ‘এই মায়ানদী ক্যামনে হব পার’– অকারণেই তার চোখে জল চলে এল। হঠাৎ সে চমকে উঠে দেখল শান্তনু কখন এসে মন দিয়ে তার ছবি তুলছে।

পালার শেষে দুখে সকলের কাছে গিয়ে টাকা সংগ্রহ করছিল। মারুনা দেখল দুখে আসলে একটি ছোটো মেয়ে। ভারি সুন্দর দেখতে আর গানের গলার তো তুলনা হয় না। সে একবার ভাবল শান্তনুকে বলবে মেয়েটার ছবি তুলতে। ভয়ে বলল না। শান্তনু যদি বলে বসে পিয়ালীও সেবার এমন আবদার করেছিল।

রাতের খাওয়াটা ভালোই হল। যদিও মেনু নিয়ে অনেকেই নাক সিঁটকেছে। ফ্রায়েড রাইস, চিলি চিকেনের সঙ্গে বেগুনি! ছোঃ! ফিশফ্রাই করতে পারল না! আর ওটা চিলি চিকেন হয়েছে? মারুনা আদৗ রাঁধতে জানে না, তাই খাওয়া নিয়ে সে কোনও সমালোচনায় যায় না। তার তো ভালোই লেগেছে। একটু বেশিই খাওয়া হয়ে গেছে। সে শান্তনুকে বলে ফেলল ‘চলো না, একটু হেঁটে আসি।’

শান্তনু কী যেন বলতে গিয়ে থেমে গেল। তারপর বলল, ‘চলো যাই।’

হাঁটতে হাঁটতে তারা বাজার ছাড়িয়ে অনেকটা চলে এল। বাজার এলাকাটুকু ছাড়া পাখিরালয় একটা সাধারণ গ্রাম, রাত দশটা বাজতে না বাজতেই নিঝুম হয়ে গেছে। ওরা দুজন, নদী আর চাঁদ ছাড়া কেউ নেই চরাচরে। মারুনার ভয় করছিল একটু। সে শান্তনুর পাঞ্জাবি টেনে বলল ‘চলো ফিরি।’

শান্তনু তখনি আঙুল দেখিয়ে বলল ‘ওই জেটিটা’।

মারুনা ওর আঙুল অনুসরণ করে দেখল একটা পরিত্যক্ত জেটি, এই দ্বীপ থেকে কেমন বিচ্ছিন্ন হয়ে নদীর বুকে প্রসারিত হয়ে আছে। যেন পৃথিবীর মাটির নয়, জেটিটা নদীর আর চাঁদের। মারুনার খুব ইচ্ছে হল ওখানে গিয়ে দাঁড়াতে। ও শান্তনুর হাত ধরে টানল, ‘চলো না, ওই জেটিটায় গিয়ে একটু দাঁড়াই।’

শান্তনু এর উত্তরে কী একটা বলতে গিয়ে থেমে যায় আবার। মারুনা বুঝতে পারে আবার পিয়ালীকে নিয়ে কিছু একটা মনে পড়ে গেছে ওর। কিন্তু হঠাৎ খেয়াল হয়েছে, এধরনের কথায় মারুনা হার্ট হচ্ছে, তাই হয়তো বলতে পারছে না। হঠাৎ মাথাটা গরম হয়ে যায়। চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে ও জেটির দিকে ছুটে যায়। শান্তনু আঁতকে ওঠে ‘মারুনা শোনো, ওটা ভাঙা জেটি, যে-কোনও মুহূর্তে ভেঙে পড়তে পারে।’

মারুনা ছুটতে ছুটতেই বলে ‘ভাঙুক, তোমার সঙ্গে আমার সম্পর্কটাও তো তাই, ভেঙে পড়বে যে-কোনও মুহূর্তে।’

শান্তনু ছুটে এসে ওকে জড়িয়ে ধরে নিবিড় করে। ‘না ভাঙবে না। তুমি আমায় ছেড়ে যাবে না, জানি আমি।’

কান্না থেমে যায় মারুনার। কি নির্লজ্জ লোক রে বাবা! মারুনা কি কুকুর নাকি এত অপমান সয়ে পড়ে থাকবে? ‘আমি যাব, চলে যাব, বারবার এভাবে পিয়ালীর কথা বললে।‘

‘আর বলব না মারুনা, ক্ষমা, ক্ষমা, শুধু একটা কথা, শেষবারের মতো।’

জেটিটা প্রবল টানে মারুনাকে। তবু সে থমকে যায় শান্তনুর কথা শোনার জন্যে।

‘এই জেটিতে দাঁড়িয়েই পিয়ালী ওই বাস্টার্ডটার কথা আমাকে বলেছিল, যেটার সঙ্গে ও থাকে মুম্বইতে। আমি চাই না মারুনা, তুমি ওই জেটিতে যাও।’

কান্নায় জড়িয়ে আসে শান্তনুর গলা। চাঁদের আলো পড়ে সেই চোখের জলে। মারুনা অবাক হয়ে দেখে শান্তনুর চোখে নদী, তার এপার-ওপার দেখতে পায় না সে।

সেই দিনগুলি

মনটা ভালো নেই দীপ্তির। ফোনটা বেজে চলেছে, কিন্তু তুলতে ইচ্ছে করছে না। তুললেই কথা বলতে হবে। কিন্তু যে ফোন করছে সে নাছোড়বান্দা। ছাড়বার পাত্র নয়। অগত্যা দীপ্তিকে ফোনটা ধরতেই হল, ‘হ্যালো!’

‘হাই, কে দীপ্তি?’

‘হ্যাঁ।’

‘বাবা! কী ব্যাপার তোর? দেড় বছর তোর সঙ্গে কোনও কন্ট্যাক্ট নেই। চিনতে পারছিস তো? আমি সূচি।’

‘হ্যাঁ-হ্যাঁ, গলাটা তোর একই আছে। কিন্তু এতদিন কোথায় ছিলি?’

দীপ্তি সাধারণ ভাবেই প্রশ্নটা ছুড়ে দেয়, কিন্তু গলার স্বরে উৎসাহের অভাব লক্ষ্য করে সূচি।

‘কী হয়েছে রে তোর দীপ্তি? গলার স্বরটা কেমন যেন লাগছে। রাগ করিস না প্লিজ। আমারই দোষ, এতদিন তোকে কন্ট্যাক্ট করতে পারিনি। কিন্তু বিশ্বাস কর, প্রতিটা মুহূর্তে তোর কথা আমার মনে হয়েছে। তোর জন্যই মলয়ের সঙ্গে আমার বিয়েটা হওয়া সম্ভব হয়েছিল।’

‘এখন তুই কোথা থেকে বলছিস?’

‘সবে পরশু দেশে ফিরেছি। জানিস-ই তো মলয়ের সঙ্গে আয়ারল্যান্ড চলে গিয়েছিলাম। ওর ওখানে কোম্পানির সঙ্গে দেড় বছরের কন্ট্র্যাক্ট ছিল। আমিও ওখানে একটা চাকরি খুঁজে জয়েন করে নিয়েছিলাম। তবে এত সব দৌড়াদৌড়ির মধ্যে আমার মোবাইলটা শ্বশুরবাড়িতেই রয়ে গিয়েছিল। গতকাল শহরে পৌঁছেছি। আজ সকালে প্রথম তোকেই ফোন করলাম। এবার দেখবি একদিন তোর বাড়িতে উপস্থিত হয়েছি। এখন বল তো, তোর বাড়ির সকলে কেমন আছে? কাকু-কাকিমা, সৌরভদা আর উজ্জ্বল?’

এক নিশ্বাসে সবকিছু বলে দেবার পর সুচি খেয়াল করে দীপ্তি যেন মুখে তালা দিয়ে রেখেছে। ওর কোনওরকম প্রতিক্রিয়া সুচি বুঝতে পারে না।

ধৈর্য হারায় সূচি, ‘কীরে কী হল তোর? তখন থেকে আমি একাই বকবক করে যাচ্ছি। তুই তো কিছুই বলছিস না… কী হয়েছে? সব ঠিক আছে তো?’ সূচির আওয়াজে ওর অধৈর্য ভাবটা স্পষ্ট ফুটে ওঠে।

‘সবকিছু বদলে গেছে রে সুচি এই দেড় বছরে… বাবা আর নেই, মা বিছানায় পড়ে, প্যারালিসিস। দাদা সারাদিন মদ খেয়ে পড়ে থাকে। মদের নেশা ওকে গ্রাস করছে। বউদি ছোট্ট পারিজাতকে নিয়ে বাপের বাড়ি চলে গেছে…’

‘আর উজ্জ্বল?’

‘উজ্জ্বল ঠিক আছে। এখন ক্লাস নাইনে পড়ছে। কিন্তু ভবিষ্যতে ওর-ও যে কী হবে এখনও জানি না। সুচি, বাড়িতে কিছুই ঠিক নেই… বলতে বলতে, দীপ্তির চোখের জল বাঁধ মানে না।

‘কাঁদিস না দীপ্তি… বি ব্রেভ… কলেজে সবথেকে সাহসী বলে পরিচিত, অন্যের যে-কোনওরকম সমস্যায় এগিয়ে এসে তার সমাধান বার করতে যে এক মুহূর্ত ভাবত না, সেই দীপ্তির কাছে নিজের সমস্যার কোনও সমাধান নেই, এমন কখনওই হতে পারে না… কাম অন ইয়ার। এই কথাটা আগে তুই সবাইকে বলতিস এখন আমি বলছি, সমস্যার সমাধান অবশ্যই আছে। চল, আমি পরের সপ্তাহে আসছি। একদম চিন্তা করিস না, সব ঠিক হয়ে যাবে।’ ফোনটা কেটে গেল।

কলিংবেল-টা বেজে ওঠে। শাড়ির আঁচলে চোখের জলটা মুছে নিয়ে দীপ্তি সদর দরজাটা খুলে দেয়। রোজকার সেই চিরপরিচিত দৃশ্য। মদ এবং সুগন্ধির চেনা গন্ধটা এসে নাকে ঢুকল দীপ্তির। নেশার ঘোরে সৌরভ দরজায় ঠেসান দিয়ে কোনওমতে দাঁড়িয়ে। ওকে ঘিরে আরও চার-পাঁচজন বন্ধু যারা নিজেরাও কেউ সুস্থ নয়, কম-বেশি সকলেই নেশায় বুঁদ। দাদার হাত ধরে দীপ্তি ঘরের ভিতর নিয়ে আসার চেষ্টা করে। এই সুযোগে কেউ দীপ্তির হাত-টা ছুঁয়ে নেয়, কারও গরম নিঃশ্বাস এসে পড়ে দীপ্তির পিঠে। পেছন থেকে কেউ দীপ্তির কোমরটা জড়িয়ে ধরার চেষ্টা করে। এক ঝটকায় হাতটা সরিয়ে দীপ্তি দরজাটা বন্ধ করে দেয়। বোনের সম্মান রাখাটা দাদার কর্তব্য কিন্তু সেই দাদা নিজেই যেখানে বেহুঁশ সেখানে বন্ধুদের ও প্রতিরোধ করবে কী ভাবে? দীপ্তির চোখটা আবার জলে ভিজে আসে।

বাবার মৃত্যুর পর, ব্যাবসার সব দায়িত্ব, টাকাপয়সা সবকিছুই সৌরভের দায়িত্ব হয়ে দাঁড়ায়। ব্যাংকের ভালো চাকরি ছেড়ে দিয়ে পুরোপুরি ব্যাবসায় মন দেয় সৌরভ। ব্যাবসাও বাড়তে থাকে, সেই সঙ্গে টাকাও। কাঁচা টাকা হাতে আসতেই বন্ধু-বান্ধবের সংখ্যাও বাড়তে থাকে, সৌরভের পা মাটিতে থাকে না। দামি গাড়ি, দামি শখ, বিদেশি মদ অভ্যাসে দাঁড়িয়ে যায় সৌরভের। মা জয়ন্তী স্বামীর মৃত্যুর পর মানসিক ভাবে সম্পূর্ণ ভেঙে পড়েন। সৌরভের বিয়ে আগে থেকেই ঠিক হয়ে ছিল কিন্তু জয়ন্তীর মানসিক ও শারীরিক অবস্থার কারণে বিয়ে আটকে যায়। পাত্রীর বাবা রমানাথবাবু চিন্তিত হয়ে পড়েন। অনেক বুঝিয়ে জয়ন্তীকে সুস্থ করে তোলা হয়। রমানাথবাবু জয়ন্তীকে বলে তাড়াতাড়ি ছেলের বিয়ে দিয়ে দিতে অনুরোধ জানান যাতে বাড়ির পরিবেশ কিছুটা হলেও বদলায়। বিয়ে হলে ছেলেও বাড়িমুখো হবে এটাও ওনার বিয়ের জন্য তাড়া দেওয়ার আর একটা উদ্দেশ্য ছিল।

অনেক ভেবেচিন্তে বিয়ের দিন স্থির করা হল। কিন্তু বিয়ের দিন মদের নেশায় সৌরভ বিয়ের আয়োজন ঠিকমতো করা হয়নি বলে রমানাথবাবুর সঙ্গে গণ্ডগোল পাকিয়ে বসল।

ছেলের ব্যবহারে লজ্জিত জয়ন্তী, রমানাথবাবুর হাত ধরে ক্ষমা চাইতে গেলে, পাত্রী সঞ্চিতা উঠে এসে জয়ন্তীর হাত ধরে থামায়। সঞ্চিতা জয়ন্তীর অবস্থা দেখে নিজেই লজ্জিত বোধ করে। ছেলের জন্য মায়ের এই অপমান মেনে নিতে অসুবিধা হয় ওর। শান্তস্বরে জয়ন্তীকে বলে, ‘কাকীমা, এটা আপনি কী করছেন? এরকম ছেলের জন্য আপনি কেন ক্ষমা চাইছেন? সৌরভের স্ট্যাটাস আমাদের থেকে একটু বেশিই মনে হয় উঁচু হয়ে গিয়েছে। আমিই এই বিয়ে করতে অস্বীকার করছি।’

পরিস্থিতি সামলে শেষমেশ সঞ্চিতা, জয়ন্তীর বাড়িতে বউ হয়ে এল। কিন্তু সৌরভকে বদলাতে পারল না সঞ্চিতা। মেয়ে হয়ে যাওয়ার পরও সৌরভকে সঠিক রাস্তায় ফিরিয়ে আনার সব চেষ্টা বিফল হলে, বিয়ের তিন বছরের মাথায় সঞ্চিতা ছোট্ট পারিজাতকে নিয়ে বাপের বাড়ি চলে গেল।

এই ধাক্বা জয়ন্তী সহ্য করতে পারলেন না। সেরিব্রাল হয়ে পক্ষাঘাতে সম্পূর্ণ ভাবে শয্যাশায়ী হয়ে পড়লেন।

সকালে সৌরভ অন্য মানুষ। মদের ঘোর কেটে গিয়ে হুঁশ ফিরে আসলে নিজের ব্যবহারের জন্য লজ্জিত হতো। মা, দীপ্তি, উজ্জ্বল সকলের কাছেই ক্ষমা চাইতে দ্বিধা করত না। কিন্তু হলে কী হবে? সন্ধে হলেই বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে আকণ্ঠ গিলে পুরো মদ্যপ অবস্থায় বাড়ি ফিরত।

মাঝেমধ্যে দীপ্তি সৌরভকে বোঝাবার চেষ্টা করত, ‘দাদা, তুই আর কারও কথা না ভাব, বউদি আর পারিজাতকে তো বাড়িতে নিয়ে আসতে পারিস। তাছাড়া উজ্জ্বল এখনও ছোটো আছে। কী অবস্থায় রাত্রে বাড়ি ফিরিস একবারও ভেবেছিস কি? আর তোর বন্ধুবান্ধবগুলোও বা কী? ওদের সঙ্গে মিশিস কেন?’

‘ওদের সম্পর্কে কিছু বলিস না। বাবার ব্যাবসাটা দাঁড় করাতে ওরাও আমাকে অনেক সাহায্য করেছে, নয়তো আমি ব্যাবসার কী-ই বা জানতাম। ওদের জন্যই এত তাড়াতাড়ি ব্যাবসার এতটা উন্নতি করতে পেরেছি।

আর ওরা সবাই ভালো বাড়ির ছেলে। কমবেশি সকলেই ড্রিংক করে। ওদের নিজেদের উপর যথেষ্ট কন্ট্রোল আছে। শুধু আমারই একটু বেহাল অবস্থা হয় ড্রিংক করলে। কেন, তোর মনে হয় না যে আমার বন্ধুরা তোকে ছোটো বোনের মতো ভালোবাসে?’

মনে মনে হাসে দীপ্তি। কাকে বলবে সত্যিটা কী? সৌরভের মদ্যপ বন্ধগুলোর চোখে লোভ, লালসা ছাড়া আর কিছু নজরে পড়েনি দীপ্তির। ওদের সামনে যেতে ভয়ে, ঘৃণায় দীপ্তির ভিতরটা কুঁকড়ে যায়। কিন্তু কাকে বলবে এই কথাগুলো? সৗরভ মানতে রাজিই নয় যে ওর বন্ধুরা দীপ্তিকে নিজেদের লালসার শিকার বানাতে পারে। দাদা নিজে সুস্থ থাকলে তবেই না বোনের কষ্টটা বুঝতে সক্ষম হবে। সুতরাং সকলের অলক্ষে চোখের জল ফেলা ছাড়া দীপ্তির উপায় কী?

সুচি কথামতো পরের সপ্তাহেই দীপ্তির বাড়ি এসে হাজির হল। সুচিকে দেখে দীপ্তির এতদিনকার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেল। ধীরে ধীরে সব ঘটনা সূচি দীপ্তির কাছ থেকে জেনে নিল। গলা জড়িয়ে দুই বন্ধু অনেকক্ষণ কাঁদল।

চোখের জল ফুরিয়ে এলে, সূচি সোজা হয়ে বসল। দীপ্তির মুখটা দুহাত দিয়ে ধরে সূচি বলল, ‘চোখের জল মুছে ফেল, দীপ্তি। এই সমস্যার কোনও না কোনও বিহিত নিশ্চয়ই আছে। হার স্বীকার কেন করবি? এবার একটু হাস তো।’

‘দীপ্তি, তোর মনে আছে মলয় কী প্রচণ্ড গুটখা খেত? ডাক্তারের বারণ সত্ত্বেও কিছুতেই নেশাটা ছাড়তে পারছিল না। প্রবলেমটা তোকে বলতেই তুই মজা করে যে সমাধানটা দিয়েছিলি সেটা যে কতটা কাজ দিয়েছিল সেটা কি কেউ ভাবতে পেরেছিল? ঘটনাটা ভাবলে এখনও আমার হাসি পায়।’

ঘটনাটা মনে আসতে দীপ্তির মুখে হাসি ফুটে ওঠে। ওর কথামতো, সুচি একটা বিয়েবাড়িতে যাওয়ার সময় মলয়ের পকেট থেকে গুটখার প্যাকেটগুলো বার করে কনডোমের কয়েকটা প্যাকেট রেখে দিয়েছিল মলয়ের অজান্তে। বিয়েবাড়িতে গিয়ে গুটখা পকেট থেকে বার করতে গিয়ে সকলের সামনে কনডোমের প্যাকেট হাতে উঠে আসতে সকলের ঠাট্টার পাত্র হতে হয়েছিল মলয়কে। ব্যাস পকেটে গুটখা রাখার অভ্যাস ছাড়তে বাধ্য হয়েছিল মলয়। শেষমেশ দীপ্তির পরামর্শে সুচি মলয়কে কিছুদিন নেশামুক্তি কেন্দ্রে নিয়ে গেলে মলয়ের গুটখার নেশা একেবারেই চলে যায়।

দীপ্তিকে হাসতে দেখে সুচির মুখও হাসিতে ভরে ওঠে।

চোখে-মুখে জল দিয়ে সুচি একটু ফ্রেশ হয়ে নিয়ে নিজের ব্যাগ খুলে একটা ক্যামেরা বার করে দীপ্তির দিকে এগিয়ে দিল, ‘এই নে, এটা তোর জন্য, ভিডিও ক্যামেরা।’

‘বাবাঃ, এটা তো খুব দামি ক্যামেরা। এত দাম দিয়ে আমার জন্য এটা আনার কী দরকার ছিল?’ দীপ্তি কৃত্রিম রাগ দেখায়।

‘কী দরকার ছিল…?’ সুচি দীপ্তিকে ভেংচি কাটে। ‘ফালতু বকবক বন্ধ কর। ক্যামেরার ফাংশনগুলো দ্যাখ। দারুণ ভিডিও তোলা যায় ক্যামেরাটায়।’

ইতিমধ্যে উজ্জ্বলও স্কুল থেকে এসে পড়ে। সুচি আর সঙ্গে ভিডিও ক্যামেরা দেখে ও আরও উত্তেজিত হয়ে ওঠে, ‘সুচিদি এটা বিদেশ থেকে এনেছ? কি দারুণ ক্যামেরাটা। আমি এটা দিয়ে ছবি তুলব।’

‘বাবাঃ! উজ্জ্বল, তুই কত লম্বা হয়ে গিয়েছিস। বেশ একটা বড়োবড়ো ভাব চলে এসেছে।’

‘দিদি, আমি চেঞ্জ করে আসছি। এসে আমি তোমাদের কথাবার্তা সব ভিডিও করব,’ বলে উজ্জ্বল বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।

‘দীপ্তি, আমি ভাবছি এটা দিয়ে তোর সমস্যারও একটা সমাধান করা যাবে।’

দীপ্তি অবাক চোখে তাকায় সুচির দিকে, ‘কীভাবে সেটা সম্ভব?’

‘রাত্রে যখন সৌরভদা বাড়ি ফিরবে তখন লুকিয়ে আড়াল থেকে দাদা এবং দাদার বন্ধুদের কীর্তি সব শ্যুট করতে হবে। সকালে পুরো ভিডিওটা সৌরভদার সামনে টিভির পর্দায় চালিয়ে দিলেই দাদা বুঝতে পারবে ওর বন্ধুরা কীরকম এক-একটা রত্ন,’ সুচি মনের মধ্যে থাকা সমাধানটা দীপ্তির কাছে স্পষ্ট করে।

উজ্জ্বল আর সুচি সৗরভের বাড়ি ফেরার আগেই ক্যামেরা নিয়ে রেডি হয়ে যায়। সুচি বরের থেকে তিনদিনের ছুটি নিয়েই দীপ্তির বাড়ি এসেছিল। বিয়ের আগেও বহুবার দুই বন্ধু একে অপরের বাড়ি রাত কাটিয়েছে। কখনও কখনও সপ্তাহ কেটে গেলেও নিজের বাড়ি ফেরার ইচ্ছে হতো না। দু’জনের বাড়িতেই এটা নিয়ে বাদবিবাদ কখনও হয়নি কারণ সকলেই জানত দু’জনে হরিহরাত্মা। মলয়ও তাই সুচির ইচ্ছায় বাদ সাধেনি।

রাত এগারোটার কাছাকাছি ডোরবেল বেজে উঠতেই সুচি আর উজ্জ্বল, দীপ্তিকে ইশারা করে দরজাটা খুলতে। ওরা দুজন পর্দার পেছনে জায়গা করে নেয় যেখান থেকে সদর দরজাটা পরিষ্কার দেখা যায়। সুচি হাতের ক্যামেরাটার রেকর্ডিং অন করে দেয়।

দরজা খুলতেই সৗরভকে ধরে ওর এক বন্ধু দীপ্তির দিকে এগিয়ে আসে, ‘এই নাও, তোমার ভাইকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে গেলাম।’ আর একটি ছেলে দরজা দিয়ে ঢোকার চেষ্টা করে, ‘আমার হাত ধরে তুমি নিয়ে চলো সখী… আমাদেরও একটু এভাবে ধরে ঘরে নিয়ে যেতে পারো তো সোনা।’ ছিটকে সরে আসে দীপ্তি। পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে সুচির হাতটা নিশপিশ করতে থাকে।

অন্য আরও তিনবন্ধু দরজা ঠেলে সৌরভের সঙ্গে ভিতরে ঢুকে পড়ে। তারই মধ্যে একজন দীপ্তিকে জোর করে জড়িয়ে ধরে। সৌরভের কোনওদিকে খেয়াল নেই। নেশায় বুঁদ অবস্থায় সোফার উপরেই এলিয়ে পড়ে। বোনের প্রতি বন্ধুদের অভব্য ব্যবহার কিছুই চোখে পড়ে না ওর।

দীপ্তি উজ্জ্বলকে ডাকে। সবাই ঘরে ঢুকে পড়াতে ও ভয় পেয়ে যায়। উজ্জ্বল লেবুর জল নিয়ে ঘরে ঢুকে সৗরভের দিকে গেলাসটা বাড়িয়ে দেয়।

‘লেবুর জল আমাদেরও একটু দাও উজ্জ্বলবাবু। তোমার দিদিকে দেখে আমাদের নেশা আরও চেপে বসছে। আমরাও তোমার দিদিকে বড়ো ভালোবাসি…,’ বলতে বলতে একটি ছেলে দীপ্তির হাত ধরে টেনে কোলে বসাতে যায়।

‘আমার দিদির হাত ছাড়ুন,’ উজ্জ্বলের তীক্ষ্ন কণ্ঠস্বরে ছেলেটি দীপ্তির হাত ছেড়ে দিয়ে উজ্জ্বলকে জোরে ধাক্বা মেরে ফেলে দেওয়ার চেষ্টা করে।

সুচি আর চুপ থাকতে পারে না। একবার ভাবে পুলিশ ডাকবে কিন্তু তাহলে সৌরভদাকেও পুলিশ ছাড়বে না… দীপ্তি কীভাবে এগুলো রোজ সহ্য করে। পরক্ষণেই মন ঠিক করে নেয়। ভয় ঝেড়ে ফেলে ক্যামেরাটা নামিয়ে টেবিলের উপর রেখে বসবার ঘরে ঢোকে। ক্যামেরাতে প্রুফ রেকর্ড করাই আছে সুতরাং লোকগুলোকে বাড়ির বাইরে বার করতেই হবে। কঠিন গলায় সুচি চেঁচিয়ে ওঠে, ‘কী হচ্ছে এখানে? আপনাদের লজ্জা করে না? সৌরভের বন্ধু হয়ে ছোটো বোনের সঙ্গে এরকম ব্যবহার করছেন। কাকিমা বিছানা ছেড়ে উঠতে পারেন না, উজ্জ্বল এখনও ছোটো, স্কুলে পড়ে আর সৌরভদা বেহুঁশ হয়ে পড়ে আছে… আর আপনারা এই সুযোগে বাড়ির ভিতর ঢুকে এসে যাচ্ছেতাই আচরণ করছেন। এই মুহূর্তে আপনারা বাড়ি থেকে বেরিয়ে যান, নয়তো আমি এখুনি পুলিশ ডাকব,’ সুচি মোবাইল উঠিয়ে ডায়াল করতে আরম্ভ করে।

সুচির রণচণ্ডী মূর্তি দেখে আর পুলিশের হাতে পড়ার ভয়ে, সৌরভ ছাড়া সকলে উঠে পড়ে দরজার দিকে পা বাড়ায়। দরজা দিয়ে বেরোতেই উজ্জ্বল দৌড়ে এসে দরজা বন্ধ করে দেয়। সুচিকে ধন্যবাদ জানিয়ে দীপ্তি আর উজ্জ্বল সৌরভকে শোবার ঘর অবধি নিয়ে যেতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।

সকালে একটু দেরি করেই ঘুম ভাঙল সৌরভের। মাথাটাও ভারী ভারী ঠেকছে। গতকাল রাতে মাত্রাটা একটু বেশিই হয়ে গিয়েছিল। বন্ধুগুলো না থাকলে কী যে হতো কে জানে? মনে হল ওদের একবার ফোন করে ধন্যবাদ জানানো দরকার। মুখে চোখে জল দিয়ে ঘরে ঢুকতে যাবে, চোখে পড়ল খাবার টেবিলে বসে দীপ্তি সুচির সঙ্গে গল্প করছে।

‘আরে সুচি না, তুই কখন এলি? হঠাৎ কোথায় চলে গিয়েছিলি? কোনও খবর নেই এতদিন পর? মানসকে পেয়ে আমাদেরই ভুলে গিয়েছিলি?’ মস্তিষ্কে জোর দিয়ে সৌরভ সুচির বরের নামটা মনে করার চেষ্টা করে।

‘দাদা, মানস নয়, মলয়। মলয়ের সঙ্গে দেড় বছরের জন্য বিদেশ চলে গিয়েছিলাম। কিন্তু এখানে এসে দেখছি সবকিছুই কেমন বদলে গেছে। তুমি এখানে থেকেও না থাকারই সমান… নিজের লোকেদেরই তুমি ভুলে গেছ…,’ সুচি গলার দৃঢ়তা বজায় রাখে। জানে যেমন করেই হোক সৌরভের বিবেককে জাগাতে হবে।

‘সুচি তুই কী বলতে চাইছিস?’ সৌরভ সুচির পাশের চেয়ারটা টেনে ওর মুখোমুখি হয়।

‘তোমাদের বাড়ির পরিবেশ খুব বদলে গেছে। …কাকু বেঁচে নেই। কাকিমা বিছানায় পড়ে। বউদি, পারিজাতকে নিয়ে বাপের বাড়ি চলে গেছে আর তুমি…?

‘হ্যাঁ, তুই ঠিকই বলেছিস সুচি। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সবকিছু এভাবেই বদলে যায়…’ সৌরভ চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়, ‘তুই একটু বস সুচি আমি ব্রাশ করে ফ্রেশ হয়ে আসছি।’

দীপ্তি চা তৈরি করে ডাইনিং টেবিলে এনে রাখল। ইতিমধ্যে সুচি ডাইনিং হলে রাখা টিভি-টার সঙ্গে ভিডিও ক্যামেরাটা অ্যাটাচ্ করে রেখেছিল। সৗরভ এসে চেয়ার টেনে চায়ে চুমুক মারতেই সুচি সামনে এসে দাঁড়াল, ‘দাদা, টিভির রিমোট-টা ধরো। টিভিটা অন করো, ভিডিও ক্যামেরায় একটা ভালো ভিডিও বানিয়েছি। ক্যামেরাটা বিদেশ থেকে দীপ্তির জন্য এনেছি… তুমি ভিডিও-টা দেখে বলো আমি কেমন বানাতে পেরেছি শর্ট ফিল্ম-টা। আমি ততক্ষণ দীপ্তিকে রান্নাঘরে একটু হেল্প করে দিই,’ বলে সুচি দীপ্তির সঙ্গে রান্নাঘরের দিকে চলে গেল।

সৗরভ চায়ের কাপটা টেনে নিয়ে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে টিভি-টা অন করে দিল। চোখ টিভির পর্দার দিকে। নড়েচড়ে বসল সৗরভ। ভাবতে পারেনি পর্দায় ওরই ছবি ফুটে উঠবে। টিভির পর্দায় নিজের অবস্থা, নিজেরই ড্রইংরুমে বন্ধুদের হাতে দীপ্তি আর উজ্জ্বলের হেনস্থা দেখে লজ্জায়, রাগে সৗরভের মুখ লাল হয়ে উঠতে লাগল। যে বন্ধুদের ও অগাধ বিশ্বাস করেছে, যাদের বিরুদ্ধে একটা কথাও শুনতে চায়নি দীপ্তির মুখ থেকে, তারা যে এত বড়ো বিশ্বাসঘাতক হতে পারে নিজের চোখে না দেখলে, ও কি এটা কোনওদিন বিশ্বাস করত? নিজের দুঃখ, লজ্জা ঢাকবার জন্য সৗরভ দু’হাত দিয়ে নিজের মুখ ঢেকে নেয়। নিজের ওপরেই ঘৃণা বোধ করে সৗরভ।

সুচি এসে দাঁড়ায় টেবিলের পাশে। টিভি বন্ধ করে দেয় টেবিল থেকে রিমোটটা নিয়ে। ভিডিও-টা শেষ হয়ে গিয়েছিল।

‘সরি… দাদা’, বলে সৌরভের মুখ থেকে হাতটা সরিয়ে দেয় সুচি। ‘দীপ্তি আর কাকিমার বারণ সত্ত্বেও তুমি বন্ধুদের অগাধ বিশ্বাস করে এসেছ। কোনওদিন ওদের আসল চেহারাটা জানারও চেষ্টা করোনি। এর জন্য দীপ্তিকে কী কী সহ্য করতে হয়েছে নিজের চোখেই দেখলে। বাধ্য হয়ে আমাকে এটা করতে হয়েছে… আমি এর জন্য সত্যিই দুঃখিত।’

‘তুই কেন ক্ষমা চাইছিস? দোষ তো আমি করেছি। এত বড়ো অন্যায় করেছি। চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে তুই ভালো কাজই করেছিস। আমার জন্য দীপ্তিকে অসম্মানিত হতে হয়েছে, উজ্জ্বলের উপরেও না জানি এই সব ঘটনার কী প্রতিক্রিয়া হয়েছে কে জানে? মদের নেশায় আমি এতটাই নীচে নেমে গেছি যে বাড়ির লোকদের ছেড়ে আমি বাইরের লোককে বিশ্বাস করেছি। ওদের বোঝানোতেই সঞ্চিতাকেও বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে আমিই প্ররোচিত করেছি। ছোট্ট পরি-কে নিয়ে চলে যেতে ও বাধ্য হয়েছে। রোজ ভাবি মদ ছোঁব না কিন্তু সন্ধে হলে কী যে হয়… জানি না… আমার কী ভবিষ্যৎ?’

‘দাদা, এতটাও ভেঙে পোড়ো না,’ সুচি বোঝাবার চেষ্টা করে, ‘তুমি মনে জোর আনলে অবশ্যই মদ ছাড়তে পারবে… যাবে আমার সঙ্গে দাদা?’

‘কোথায়?’

‘দাদা আজকেই চলো আমার সঙ্গে যেখানে গুটখার নেশা ছাড়াবার জন্য মলয়কেও নিয়ে গিয়েছিলাম। আমাদের বাড়ির কাছেই নেশা ছাড়াবার রিহ্যাব। যাবে তো দাদা?’

সৗরভ সম্মতিসূচক মাথা নাড়ে। দীিঀ৫ এসে পিছনে দাঁড়িয়েছিল সৗরভ বুঝতে পারেনি। আনন্দে দীপ্তি পিছন থেকেই দাদার গলা জড়িয়ে ধরে। চোখ দিয়ে বইতে থাকে আনন্দাশ্রু। সৌরভ চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে দীপ্তিকে বুকে টেনে নেয়। ভাই-বোনের ভালোবাসা দেখে সুচির চোখেও জল চলে আসে।

সুচির দু’বছরের বিবাহবার্ষিকীর দিন দীপ্তি সকাল থেকেই উপস্থিত। দুই বন্ধুর কথার যেন কোনও শেষ নেই। মলয় দু’জনকে কিছুটা প্রাইভেসি ছেড়ে দিতে বাইরের ছোটোখাটো কাজগুলো সারতে বেরিয়েছে। অনুষ্ঠান তো সেই সন্ধেবেলা। ক্যাটারার বলাই আছে সুতরাং বাড়িতে রান্নার কোনও ঝামেলা নেই।

‘হ্যাঁরে দীপ্তি, সৗরভদা তো এখন সম্পূর্ণ সুস্থ তাই না,’ একা পেয়ে সুচি প্রশ্নটা ছুড়ে দেয় বন্ধুর দিকে, ‘বউদিকে কবে বাড়ি নিয়ে আসছিস? তাড়াতাড়ি করে বউদিকে বাড়ি আন তবেই না আমি আমার বউদিকে বাড়ি নিয়ে আসতে পারব।’

‘মানে? কী যে বকিস, কোনও মাথামুন্ডু থাকে না।’

‘সেই! এখন আমার কথা তোর ফালতুই মনে হবে,’ কপট রাগ দেখায় সুচি, ‘তুই তো জানিস না দীপ্তি, আমার জ্যেঠুর ছেলে সিদ্ধার্থ দিল্লিতে চাকরি করে। ও আমাকে প্রচণ্ড ভালোবাসে আর তোকেও।’

‘আমাকে?’ আশ্চর্য হয় দীপ্তি।

‘হ্যাঁ, কলেজে ছিলাম যখন তখন দু’তিনবার ও কলেজে আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছে। তখনই ও তোকে আমার সঙ্গে দেখেছে। তাছাড়া তোর অনেক গল্পই আমি ওর সঙ্গে করেছি যার মধ্যে মলয়ের গুটখার নেশা ছাড়াবার ঘটনাটাও রয়েছে। বিকেলে সিদ্ধার্থ-ও আসছে।’

লজ্জায় দীপ্তির মুখ রাঙা হয়ে ওঠে। সুচির কাছে মনের ভাব লুকোবার জন্য উঠে অন্যত্র যাওয়ার চেষ্টা করলে, সুচি দীপ্তিকে বুকে জড়িয়ে ধরে।

রক্তের রাজনীতি

উত্তরপ্রদেশের রাজনীতির ধরনটাই একটু ভিন্ন। নানা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়ারা এখানে ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হয়ে যায় গোড়া থেকেই। এখানে অঙ্কুরিত হয় বৃহত্তর রাজনীতির ক্ষেত্রে পদার্পণ করার স্বপ্ন। ক্ষমতা দখলের খেলায় খুব সহজেই মেতে ওঠে ইয়ং জেনারেশন। বদলে যায় তাদের জীবনদর্শন। জীবনযাপন আর সাদামাটা থাকে না তখন।

মণীশ যখন প্রথম এরকমই একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে গ্র‌্যাজুয়েশন করতে এসেছিল, সে ভাবেনি জীবন তার জন্য ঠিক কী কী নির্দিষ্ট করে রেখেছে। ফার্স্ট ইয়ার-এ র‌্যাগিং-এর সময়টাতেই প্রথম সিনিয়রদের মুখোমুখি হতে হয়েছিল মণীশকে। সেখানেই প্রথম সে দেখেছিল দেবেন্দ্র ওরফে দেব-কে। ইউনিয়নের জিএস হওয়ার দরুন সবাই চিনত দেব-কে। তার ব্যক্তিত্বকে এড়িয়ে যাওয়ার উপায় নেই কারও। রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থাকবে বলেই সে এমএ-টাও এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই করবে ঠিক করেছিল। দেব-এর পড়াশোনার ব্যাপারে যত না আগ্রহ, তার চেয়ে বেশি আগ্রহ ছিল পাকাপাকি রাজনীতিতে চলে আসার। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ে শুরু থেকেই সে নিজেকে চোখে পড়ার মতো জনপ্রিয়তার স্তরে তুলে এনেছিল।

র‌্যাগিং-এ খুব বেশি নাজেহাল হতে হয়নি মণীশ-কে। কারণ দেব-এর চোখে পড়ে গিয়েিল সে, ভালো টেবিল টেনিস খেলার জন্য। দেব বড়ো ভাইয়ে মতোই মণীশকে আগলাতে শুরু করেছিল, সেই ফার্স্ট ইয়ার থেকেই। তারপর থেকে নানা প্রযোজনে মণীশ, দেব ভাইয়া-কে পাশে পেয়েছে। কখনও তাকে সাহায্য না করে ফেরায়নি দেব। মণীশ যে-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে, সেখান থেকে তার বাড়ি বেশ খানিকটা দূরে। একটু মফস্সল বললেও ভুল হয় না। দেব-ই ব্যবস্থা করে দিয়েিল, যাতে কোনও কোনও দিন বাড়ি ফিরতে না পারলেও, সে হোস্টেলে দেব-এর ঘরে থেকে যেতে পারে।

গ্রাজুয়েশন শেষ করার পর মণীশ বেশ কিছুটা মানসিক অবসাদে ভুগছিল। তার পরিবারের অর্থনৈতিক অবস্থা তেমন ভালো নয়। একটা ট্রেন দুর্ঘটনায় বাবার পা কাটা গিয়েছিল। বোন-কে খুব কষ্ট করে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়াচ্ছে বাবা, তাঁর শেষ সম্বল ফিক্সড ডিপোজিট ভেঙে। এই অবস্থায় মণীশ

এমএ-তে ভর্তি হবে, নাকি একটা চাকরি খুঁজবে সেটা নিয়ে সে কিছুতেই সিদ্ধান্ত নিতে পারছিল না। টাকার খুব প্রযোজন তার। দু-একটা টিউশনি করে কিছু টাকা সে আয় করে ঠিকই কিন্তু পরিবারের প্রযোজন মেটাতে সেটা যথেষ্ট নয়। বোন রিঙ্কুর জন্য এখনই একটা ল্যাপটপ-এর প্রযোজন। কিন্তু সেই টাকাটাও জোগাড় করতে হিমশিম খেতে হচ্ছে মণীশকে। চাকরির চেষ্টা যে সে করছে না তা নয়, কিন্তু ভালো চাকরি পাওয়াও তো মুখের কথা নয়।

এসব ক্ষেত্রে তার একমাত্র ভরসা দেব ভাইয়া। দোনামোনা করে দেব-এর

হোস্টেল-এর দিকেই পা বাড়ায় মণীশ। হোস্টেলের ঘরে বসে দেব তখন তার চ্যালাচামুণ্ডাদের নিয়ে কলেজের ইলেকশনের ব্যাপারে আলোচনা করছে। ইশারায় মণীশকে বসতে বলে কাজের কথাগুলো সেরে নেয় ছেলেগুলোর সঙ্গে। তারপর ওরা চলে গেলে, মণীশকে বলে

বল ভাই, সকাল সকাল আজ কী মনে করে?

দেব ভাইয়া আর কী বলব তোমায়, তুমি তো সবই জানো।

আরে নির্দ্বিধায় বল। তুই আমার নিজের ভাইয়ে মতো। দাদাকে বলবি না তো কাকে বলবি?

আসলে তুমি তো জানোই, বোনের এটা ইঞ্জিনিয়ারিং-এর সেকেন্ড ইয়ার। ওকে এবার একটা ল্যাপটপ না কিনে দিলেই নয়। খুব মেধাবী আমার বোনটা। আমার মতো নয়।

হ্যাঁ জানি রে। তা রিঙ্কু তো আমারও বোন। তার জন্য কিছু করতে পারলে আমারও ভালো লাগবে।

আমি অল্প কিছু টাকা জমিয়েছি, কিন্তু…

ওই টাকাটা তুই রেখে দে। রাখিতে একটা মোবাইল কিনে দিস। আপাতত তোর দেব ভাইয়া ওর জন্য ল্যাপটপ-এর ব্যবস্থা করছে।

কথাটা বলে দেব সত্যি সত্যি পকেট থেকে ফোন বের করে মণীশের অ্যাকাউন্ট-এ পঁচিশ হাজার টাকা ট্রান্সফার করে দিল। কৃতজ্ঞতায় প্রায় নুয়ে পড়েছে মণীশ। পায়ে হাত দিতে যায় দেব-এর। দেব তাড়াতাড়ি তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে।

পাগল, তুই আমার ভাই।

সে জানি দেব ভাইয়া, কিন্তু এটা ধার হিসেবে নিচ্ছি আমি। টাকাটা আমি শোধ দিয়ে দেব যত তাড়াতাড়ি পারি।

ধুর বোকা। বললাম না রিঙ্কু আমারও বোন। এটা আমি আমার বোনকে উপহার দিলাম।

এরকম ভালোবাসা পেয়ে মণীশ সত্যিই অভিভত। প্রায়ই এমন হয়, দেব তাকে ভালো ভালো হোটেলে খাওয়ায়, মাঝে মাঝে পাঁচশো-হাজার এমনিই পকেটে গুঁজে দেয়। মণীশ বুঝতে পারে না, কী এমন দেখল দেব ভাইয়া তার মধ্যে, যে এত ভালোবাসে!

বোন ল্যাপটপ পেয়ে তো দারুণ খুশি। দাদাকে জড়িয়ে ধরে আনন্দে কেঁদেই ফেলল। মা শুধু একবার অবাক হয়ে আড়ালে জিজ্ঞেস করেছিলেন, হ্যাঁ রে মণীশ, এত টাকা কীভাবে জোগাড় করলি?

সত্যি-মিথ্যের মাঝামাঝি একটা উত্তর দিয়ে পাশ কাটিয়ে গিয়েছিল মণীশ।

এর কিছুদিন পর দেব ভাইয়া কলেজে ডেকে পাঠাল মণীশকে।

বুঝলি মণীশ জোর ক্যাম্পেন করতে হবে তোকে আমার হয়ে এবারও ইলেকশনটা জিততেই হবে। দেখিস সব জায়গায় যেন ঠিকঠাক পোস্টার লাগানো হয়।

ইলেকশনে এবারও দেবের জয় নিশ্চিত ছিল। মণীশও দারুণ খুশি এই জয়ে দেবকে কাঁধে তুলে তারা গোটা ক্যাম্পাস ঘুরল, বিজয় মিছিলে।

এর কিছুদিন পর রাখি। মণীশ ঠিক করল রিঙ্কুকে রাখিতে একটা ভালো মোবাইল ফোন কিনে উপহার দেবে। সেইমতো একটা ফোন কিনে বোনের কাছে রাখি পরতে বসল মণীশ। রিঙ্কু খুশিতে দিশেহারা হয়ে উঠল। বলল,

তোমার মতো দাদা যেন জন্ম জন্ম ধরে পাই।

এই আনন্দঘন ঘটনার দিনদুয়েক পরে, হঠাত্-ই দেবের ফোন।

মণীশ, ভাই একবার ক্যাম্পাসে আয় তো, একটু জরুরি কথা আছে।

হ্যাঁ ভাইয়া, এখুনি যাচ্ছি আমি।

ক্যাম্পাসে পৌঁছে দেখে সকলে প্রস্তুতি নিচ্ছে বিধানসভা অভিযানের। দলের একটি ছেলেকে অপোনেন্ট পার্টির ছেলেরা মারধর করেছে। তাদের শাস্তি আর অধ্যক্ষের পদত্যাগের দাবিতে এই অবস্থানের পরিকল্পনা। দেব, মণীশকে আলাদা করে একটু সাইডে ডেকে নিয়ে গিয়ে বলল এসব সিরিয়াস কিছু না, চল একটু স্লোগান দিবি, দুটো মিডিয়ার সামনে বাইট দেব, তারপর খাওয়া দাওয়া করে ফিরে আসব।

মণীশ এসব ব্যাপারে আগে কখনও থাকেনি। কিন্তু বিষয়টা যে এতটাই অন্যরকম, সেই অভিজ্ঞতা অর্জন করার লোভ সে সামলাতে পারল না। এভাবেই দেবের সংস্পর্শে আস্তে আস্তে সেও পরোক্ষ ভাবে রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়তে লাগল।

মাস খানেক পরে ঘটল আরও এক অভাবনীয় ঘটনা। বাজারে সবজি কিনতে এসেছিল মণীশ। সেই সময় মোবাইলটা বেজে উঠতেই দেখে দেবের ফোন। ডান হাতে সবজির বোঝাটা নিয়ে বাঁ হাতে ফোনটা ধরতেই ওপাশে দেবের অস্থির কণ্ঠ ভেসে এল।

কোথায় আছিস? জরুরি দরকার। না, না ফোনে বলা যাবে না। হোস্টেলে চলে আয়।

হোস্টেলে পৌঁছে আজ একটু যেন অন্যরকম লাগল দেবকে। গোটা ঘরে অস্থির ভাবে পায়চারি করছে। আর তার খুব ক্লোজ, জনাদুয়েক ছেলে রয়েছে ঘরে। মণীশকে দেখে বেশ উত্তেজিত হয়ে ওঠে দেব।

ভাই এসেছিস! বোস। খুব মন দিয়ে শোন যা বলছি।

হ্যাঁ বলো ভাইয়া

তুই আমার জন্য কী করতে পারিস?

আরে, এ কেমন প্রশ্ন ভাইয়া। তোমার জন্য জান হাজির।

একটা ছেলেকে তুলতে হবে। পারবি?

তুলতে মানে?

কথাটা বলার সময় একটু যেন ঘাবড়ে গেল মণীশ। কী বলছে দেব ভাইয়া, কিছুই তার মাথায় ঢুকছে না! দেব ভাইয়া তার অবাক হওয়া মুখের দিকে তাকিয়ে একটু যেন শ্লেষের সঙ্গে বলে,

বড্ড সরল তুই মণীশ। আমি যে এই ছাত্র সংগঠনটা করছি, এটাই তো শেষ নয়। আমার একটা বড়ো ফোকাস আছে, তুই জানিস। এবার আমি যুব সংগঠনের সেক্রেটারি হতে চাই। কিন্তু এই পথে একটা বাধা আছে। আমার পথের কাঁটা। অপোনেন্ট পার্টির এই ছেলেটাকে তুই-ও এক-আধবার দেখেছিস। সুরজিত্। এই ছেলেটা ক্রমশ পপুলার হওয়ার চেষ্টা করছে। শালাকে এমন শিক্ষা দেব, যাতে ও আর কখনও মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারে। তোর হেল্প চাই, ভাই।

কাঁপা গলায় মণীশ বলে কী ভাবে সাহায্য করতে বলছ আমায়?

কিছু না। তুই যখন টেবল টেনিস খেলতিস কমন রুমে, আমি তোকে খুব ভালো ভাবে লক্ষ্য করতাম, দারুণ রিফ্লেক্স তোর। পারলে তুই-ই পারবি। সুরজিত্ হালওয়াই সরাই-এ থাকে। রোজ ভোরবেলা জগিং করতে আসে দিলবাগ-এ। ঠিক পাঁচটায় রোজ ও দিলবাগ-এর গেট-এ পেঁছোয়। ওখানেই একটা গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করবি তুই আর এই দুজন।

ঘরে যেন পিনপতন নিস্তব্ধতা। দেব যে দুজনের কথা বলছে, তাদের দিকে এক বার দ্রুত চোখ বুলিয়ে নেয় মণীশ। তার বুকের ভিতর ঢিপঢিপ আওয়াজটা যে দ্রুততর হচ্ছে, সে টের পায়। দেব পকেট থেকে একটা রামের নিপ বের করে ছোট্ট চুমুক দেয়। তারপর আবার মণীশকে বলে,

সুরজিত্ জগিং করতে করতে গাড়ির পাশে এলেই, তুই ঝট করে বেরিয়ে ওর মুখে কাপড় বেঁধে তুলে নিবি গাড়িতে। তোর মুখে মাস্ক থাকবে। তোর ভয় নেই।

আমতা আমতা করে মণীশ বলার চেষ্টা করল,

কিন্তু দেব ভাইয়া, এটা তো অপহরণ।

তো?

না আমি এসব কখনও করিনি।

সব কিছুরই একটা প্রথমবার হয় মণীশ। তুই পারবি।

দরদর করে ঘামছে মণীশ। ঠিক তখনই একটা মোক্ষম কথা বলল দেব।

কাজটা করার পরই তোর

অ্যাকাউন্ট-এ পাঁচ হাজার টাকা ঢুকে যাবে। আর এখন পাঁচ। ভেবে দ্যাখ, কড়কড়ে দশ হাজার টাকা। ছেড়ে দিবি?

মণীশের অভাবের সংসারে দশ হাজার টাকার ভ্যালু সে জানে। মায়ে চোখের ছানিটা অপারেশন না করালেই নয়। সে আর কিছু ভাবতে পারে না। খপ করে দেবের হাতটা ধরে নিয়ে বলে,

কবে করতে হবে কাজটা ভাইয়া?

মুখে একটা নিষ্ঠুর হাসি খেলে যায় দেবের। বলে,

কালই। বাকিটা তোকে আমার এই দুই শিষ্য বুঝিয়ে দেবে।

ঠিক পাঁচটার সময় একটা কালো রঙের অলটো পিক আপ করল দেব-কে। ভেতরে আগের দিনের দুজন, আছে। আর অপরিচিত একজন ড্রাইভার। ঠিক হয়ে আছে সুরজিত্-কে গাড়িতে তোলার পরই একজন ভালো ভাবে বেঁধে ফেলবে তার মুখ আর হাত দুটো। কিছুটা দূর গিয়ে একটা সিনেমা হলের সামনে গাড়ি থেকে নেমে পড়বে মণীশ। তার পরিবর্তে অন্য একজন গাড়িত উঠবে। ব্যস তার দাযিত্ব শেষ।

ভেতরে ভেতরে উত্কণ্ঠা টের পাচ্ছে মণীশ। এরকম কাজ আগে কোনওদিন করা তো দূরে থাক, ভাবেওনি যে সে করতে পারে। তাকে চিরকাল তার বাবা-মা একটু খাটো নজরেই দেখে এসেছে। পড়াশোনায় খুবই সাধারণ সে। নিজে হাতে এই প্রথম অনেকগুলো টাকা রোজগার করেছে একদিনের কাজে।

পাশের ছেলেটা সিগারেট খেতে খেতে গাড়ির সাইড মিরর দিয়ে খেয়াল রাখছিল জগিং করতে করতে সুরজিত্ আসছে কিনা। এবার সে মুখ দিয়ে একটা ইঙ্গিতপূর্ণ আওয়াজ করতেই, সচকিত হয়ে উঠল মণীশ। একটা নেভি ব্লু ট্র‌্যাক সুট পরে ধীর পায়ে জগিং করতে করতে গাড়ির পাশে আসতেই, তার মুখ চেপে ধরে সবলে তাকে গাড়িতে ঢুকিয়ে নিল মণীশ। সুরজিত্ ঘটনার আকস্মিকতায় এবং মুখ বাঁধা অবস্থায় গোঙাতে লাগল। মাস্ক পরা আগন্তুকদের সে ভালো চিনতে পারছে না। শুধু মণীশের চোখের নীচে বড়ো আঁচিলটা খুব চেনা মনে হতে লাগল তার।

মণীশের বুকের ভেতর কে যেন হাতুড়ি পিটছে। সে অধীর হয়ে রইল সিনেমা হলটার সামনে গাড়িটা না পেঁছোনো অবধি। তারপর দরজা খুলে নেমে যেতেই অন্য একজন তার জায়গায় উঠে পড়ল। গাড়িটা একরাশ ধুলো উড়িয়ে গোমতী নদীর দিকে চলে গেল।

সবে সকাল হচ্ছে। একটা ফাঁকা চায়ে দোকানে বেঞ্চ-এ বসে চা-এর অর্ডার দিল মণীশ। তারপর খুব মৃদু গলায় ফোন করে দেবকে জানাল কাজটা হয়ে গেছে। মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই ব্যাংক অ্যালার্ট এল। তার অ্যাকাউন্ট-এ এখন সদ্য উপার্জিত দশ হাজার টাকা।

আর অতটা খারাপ লাগছে না মণীশের। এটা জাস্ট একটা কাজ। ক্রাইম তো নয়। তাছাড়া ছেলেটাকে হয়তো ওরা একটু শাসানি দেবে, হুমকি দেবে, চড়চাপড় মেরে ছেড়ে দেবে। যাতে সে আর দেবের বিরুদ্ধে ফণা না তুলতে পারে। দেবের এখন অনেক ওপর লেভেল-এ চেনাজানা। যেভাবে রাজনীতির সোপানে সে তরতর করে উপরে উঠছে, ভবিষ্যতে তার বড়োসড়ো নেতা হওয়া কেউ আটকাতে পারবে না।

কিন্তু যতটা নিশ্চিন্তে থাকবে ভেবেছিল মণীশ, তা আর পারা গেল না। দিন দুয়ে পরে গোমতী নদীতে লাশ ভেসে উঠল সুরজিতের। মিডিয়া, পুলিশ, তোলপাড়। খবরটা পাওয়া মাত্র ছুটতে ছুটতে দেবের কাছে গিয়ে পৌঁছোল মণীশ।

দেব ভাইয়া, এরকম তো হবার কথা ছিল না! দেব তখন তার ইয়ার দোস্তদের সঙ্গে হোস্টেল-এর পেছনের মাঠের ঝুপসি অন্ধকারে মদের আসর বসিয়েে। লাইটার জ্বেলে সে মণীশের মুখের খুব কাছে ধরে বলল,

ন্যাকা আমার। জলে নামব আর চুল ভিজবে না। রাজনীতিতে এসব হয়?

কিন্তু ওকে মারার কথা তো বলোনি ভাইয়া! আমি… আমি কিছুতেই করতাম না এই কাজ, তুমি ওকে জানে মারবে জানলে।

চুব বে! শত্রুর শেষ রাখতে নেই। যা করেছিস বেশ করেছিস মেরা শের। আয় বুকে আয়। তোকে কত ভালোবাসি জানিস ভাই আমার। নে মদ খা। অ্যায়ে কর।

দেব নেশাগ্রস্ত। মণীশকেও বাকিরা প্রচুর মদ খাওয়াল সে রাতে। মদ খাওয়ার পর মণীশের খারাপ লাগাটা কমে গেল। দেবের হোস্টেলের ঘরে শুয়ে শুয়ে সে জড়ানো গলায় বলল

মিডিয়া, পুলিশ, এসব কুত্তাদের চিত্কার কী করে সামলাবে ভাইয়া?

তুই কিছু ভাবিস না ভাই। ওসব আমার বাঁ হাতের খেল। তুই শুধু কটা দিন আন্ডারগ্রাউন্ড-এ চলে যা।

মাসখানেক কেটে গেছে। একটা কন্ট্রাক্টে কিছু কাজের অফার পেয়েছে, এই বলে কিছুদিন বাড়ির বাইরে রইল মণীশ। ঘরে নিয়মিত টাকা পৌঁছোনোর ব্যবস্থা করেছে দেব। পরিবারের সবাই খুব খুশি মণীশ উপার্জন করছে শুনে। সুরজিত্-এর খবরটা ধামাচাপা পড়ার পর আবার যখন সব স্বাভাবিক, আবার প্রকাশ্যেই দেবের সঙ্গে দেখাসাক্ষাত্ শুরু হল মণীশের।

একদিন কমনরুমে দেবের সঙ্গে টেবিল টেনিস খেলছিল মণীশ। ক্যাম্পাস এখন ফাঁকা। দেওয়ালির ছুটিতে বেশির ভাগ ছাত্ররাই যে-যার বাড়িতে গেছে। খেলতে খেলতে হালকা ভাবেই দেব বলল, এবার আর-একটা দাযিত্ব দেব তোকে ভাই। তুই ছাড়া আমার ভরসাযোগ্য কে আছে বল? খেলা থামিয়ে সরাসরি দেবের মুখের দিকে তাকায় মণীশ।

কী হয়েছে, আমায় বলো ভাইয়া। কী দায়িত্ব?

কিছু না, খুব সাধারণ একটা কাজ। একজনকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিতে হবে ভাই। শুট করতে হবে।

এত সহজ স্বাভাবিক ভাবে কথাগুলো বলছিল দেব, যে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যাচ্ছিল মণীশ। সে নার্ভাস হয়ে বলল, কী বলছ ভাইয়া, আমি কী করে… মানে মার্ডার!

হ্যাঁ ভাই। মার্ডার। শুট করতে হবে।

কঠিন হয়ে উঠেছে দেবের চোয়াল, তবু তার মুখে ঝুলে আছে একটা নিষ্ঠুর হাসি। সরাসরি মণীশের চোখের দিকে চোখ রেখে তাকে জরিপ করছে দেব।

মণীশ কোনও রকমে তোতলাতে তোতলাতে বলে,

আমি তো বন্দুক চালাতেই পারি না ভাইয়া। আমি পারব না।

দেবের পা দুটো ধরে বসে পড়ে মাটিতে মণীশ।

দেব তাকে তুলে দাঁড় করায় কাঁধ দুটো ধরে।

তোকে আমার লোক ট্রেনিং দিয়ে দেবে। তুই কাল থেকে দশ দিনের জন্য আমার ফার্ম হাউসে থাকবি। ওখানেই হবে তোর ট্রেনিং। টার্গেট যেন মিস না হয়।

আমি পারব না ভাইয়া। হাত জোড় করে মণীশ।

পারতে তো তোকে হবেই। আর পারলেই ৫০ হাজার টাকা সোজা ঢুকে যাবে তোর অ্যাকাউন্ট-এ।

না ভাইয়া। এ কোন অন্ধকারে তুমি আমায় টেনে নামাচ্ছ। ছেড়ে দাও আমায়।

একটা পৈশাচিক হাসি হেসে ওঠে দেব। তারপর বলে,

ভাই এটা এমনই একটা অন্ধকার, যেখানে ঢোকা সহজ, বেরোনোটাই কঠিন। এই দ্যাখ এটা।

বলার সঙ্গে সঙ্গে দেব তার মোবাইলটা অন করে একটা ভিডিয়ো প্লে করল মণীশের সামনে। সেদিনের গাড়ির অপহরণের ভিডিয়ো। মণীশের মুখে মাস্ক থাকলেও তাতে মুখের নীচের দিকটা ঢাকা পড়েছে। কিন্তু প্রমাণ হিসেবে জ্বলজ্বল করছে তার চোখের নীচের বড়ো আঁচিলটা। মানুষের চোখও তার একটা আইডেন্টিফিকেশন। মণীশ পালাতে পারবে না। সে ক্রমশ ডুবে যাচ্ছে পাঁকে। যে-পাঁক থেকে তার নিস্তার নেই।

টার্গেট মিস যেন না হয়। এটাই মন্ত্রের মতো এই কদিনে মাথায় ঢুকিয়ে নিয়েে মণীশ। আজ সেই দিন। সেই গাড়ি। সেই একই সওয়ারি। স্থান কাল পাত্র শুধু আলাদা। পাত্র বলা ভুল হল। পাত্রী। দেবের গার্ল ফ্রেন্ড। গদ্দারি দেব সহ্য করতে পারে না। তাকে আর একটা অন্য লোকের সঙ্গে বিছানায় দেখে খুন চেপে গেছে দেবের মাথায়। মেয়েটি দেবের অনেক কুকীর্তি এবং প্ল্যান জেনে ফেলেছে। তাই, চিরতরে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দিতে চায় সে তার প্রেমিকাকে। আর আজ তাকে মারার বরাতটাই পেয়েছে মণীশ।

প্ল্যান মাফিক নিখুঁত কাজ করল মণীশ॥ গাড়ির পাশ দিয়ে হেঁটে যওয়ার সময় পেছন থেকে শুট করল মেযোকে। গুলিটা এফোঁড় ওফোঁড় হয়ে গেল মেযোর শরীর। কিন্তু সাইলেন্সার লাগানো বন্দুকের আওয়াজ কারও কানে গেল না। মাটিতে লুটিয়ে পড়ে রক্তাক্ত কবুতরির মতো ছটফট করছিল যখন মেযো, গাড়িটা তখন স্পিডে বেরিয়ে গেল। সন্ধ্যার মুখে স্ট্রিট লাইটগুলো তখন সবে একটা একটা করে জ্বলতে শুরু করেছে।

আর কোনও অপরাধ বোধ হচ্ছে না মণীশের। দেবের হোস্টেলের ঘরে ঢুকে চিল্ড বিয়ার খেতে খেতে, সে গা এলিয়ে ভাবছিল ৫০ হাজার টাকা দিয়ে কী কী করবে। বোনের মাস দুয়ে পর ইঞ্জিনিয়ারিং-এর ফাইনাল। খুব পরিশ্রম করছে রিঙ্কু। তাকে খুশি দেখলে বড্ড ভালো লাগে মণীশের।

কিন্তু সব ভালো বোধহয় চিরস্থায়ী হয় না। কিছুদিন পরই বিশ্ববিদ্যালয়গুলো উত্তপ্ত হয়ে উঠল সিএএ অর্থাত্ নাগরিকত্ব প্রমাণের বিষয়টি নিয়ে পরিষ্কার দুদলে ভাগ হয়ে গেল মানুষ মতাদর্শের নিরীখে। যুব ও ছাত্ররাজনীতির ক্ষেত্রেও এর প্রভাব পড়ল। সরকারের পক্ষে ও বিপক্ষে ভাগ হয়ে মারামারি শুরু হল বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে। এরকমই একদিন, গেট ক্র‌্যাশ করে নানা কলেজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির প্ল্যান করে ফেলল দেব। যড়যন্ত্রে সামিল করল মণীশকেও। টুকরো টুকরো দলে ভাগ হয়ে তারা ছড়িয়ে পড়ল নানা কলেজে বিশৃঙ্খলা তৈরি করবে বলে। বিকেলের দিকে গেটের মুখে দেশনায়কের মতো পুলিশের জিপে ওঠার আগে, মিডিয়াকে বাইট দিল দেব, আমাদের লড়াই চলছে চলবে… ছাত্রদের ছত্রভঙ্গ করে দিল পুলিশ। মণীশ বিপদ বুঝে বাড়িতে চলে এল।

এর কিছুক্ষণ পরই বাড়ির সামনে একটা শোরগোল শুরু হল। গাড়ির আওয়াজ পেয়ে জানলা দিয়ে উঁকি মারতেই দেখে, একটা পুলিশের জিপ ও একটা অ্যাম্বুল্যান্স এসে হাজির। দরজা খুলে বেরোতেই মণীশের বাকরুদ্ধ অবস্থা। অ্যাম্বুল্যান্স-এর দরজা খুলে যাকে নামানো হল মাটিতে সে রিঙ্কু। তার চোখ দুটো বন্ধ। রক্তে ভেসে যাচ্ছে গোটা দেহ। টুপি খুলে এসআই এগিয়ে এলেন।

হাসপাতালে যাওয়ার পথেই মৃতু্য হয়েে ওনার। কলেজের বইখাতা ঘেঁটে ঠিকানা পেলাম। আজ একদল ছেলে চড়াও হয়েিল এদের ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে। দুদলের মধ্যে সংঘর্ষ বাঁধে। ইটের আঘাতে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন ইনি। তারপর আমরা রেসকিউ করে হাসপাতাল নিয়ে যাওয়ার পথেই…

মণীশ হাঁটু মুড়ে মাটিতে বসে পড়ে। হাউ হাউ করে কাঁদছে সে। মা-ও বেরিয়ে এসেছেন ঘরের ভিতর থেকে। বাবা ক্রাচটা ধরে থরথর করে কাঁপছেন। কাকে সামলাবে মণীশ। এ তো তারই পাপের শাস্তি পেল তার ফুলের মতো বোনটা! রিঙ্কুর নিথর রক্তাক্ত দেহটাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকে সে। হাতে রক্ত লেগে যায় তার। এ রক্ত কি সারাজীবনেও ধুতে পারবে মণীশ!

লাভার্স মিট

একাকী দাঁড়িয়ে থাকে তন্বী। বারান্দার রংচটা গ্রিলটা ধরে। বারান্দার গ্রিলটা যেন তন্বীর প্রাণের বন্ধু হয়ে গিয়েছে। বর্ষার দিনে মুঠোতে শক্ত করে ধরে, এক দৃষ্টিতে দ্যাখে কীভাবে বৃষ্টির ফোঁটা আকাশ থেকে ঝরে মাটিতে পড়ে ভেঙে চুরমার হয়ে যাচ্ছে। আর বৃষ্টির ফোঁটা ফোঁটা জল ভূমির ঢাল ধরে ছোটো ড্রেন, হাইড্রেন হয়ে হু হু করে বইছে। হয়তো নদী হবে বলে।

সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে অভ্যাসমতো বারান্দায় গিয়ে এক মনে কী যে ভাবে তন্বী কে জানে? পাখির কিচিরমিচির শব্দে প্রতিদিন ভোরে ঘুম ভাঙে তন্বীর। ঘরের ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে আকাশকুসুম ভাবে। উঠোনের কাঁঠাল আর পেয়ারা গাছটা সকাল-সন্ধে পাখির কলকাকলিতে মুখর। পাখিদের সংসার যেন তন্বীর খুব চেনা হয়ে গিয়েছে। কাঁঠাল গাছটাকে বর্ষার আগাছা আর বিভিন্ন লতাগুল্ম আঁকড়ে ধরে থাকে। বৃষ্টিস্নাত সবুজ গাছের পাতায় জল গড়িয়ে পড়ে। গাছ-গাছালি বেশ ঝাঁকড়া হয়ে যায় এই সময়টায়। বিভিন্ন ঋতুতে গাছগুলোর বিভিন্ন রুপ দেখেছে। আর সকাল-সন্ধে পাখিদের সংসার, আনাগোনা সব এখন নখদর্পণে তন্বীর।

সকালের পাখির ডাকে ঘুম ভাঙে। ঘুম ভাঙানিয়া পাখপাখালি সারাদিন কী ব্যস্ত থাকে। আবার কোথায় উড়ে চলে যায় দূর আকাশে। মন দিয়ে পাখিদের খুনসুটি দেখে। কখনও পাখি হতে ইচ্ছা করে তন্বীর। আবার সন্ধ্যায় আকাশ-পথ চিনে কীভাবে যে ওরা ফেরত আসে বাসায়, তার কূলকিনারা খোঁজার চেষ্টা করে। এই পাখিগুলোর ব্যস্ত আনাগোনা দেখতে দেখতে কখনও হিংসা হয়। ভাবতে থাকে এরা তো কেউ বেকার নয়।

বৃষ্টিভেজা কচি সবুজ পাতা তন্বীর খুব প্রিয়। রাতের খাবার সেরে প্রতিদিন ব্যালকনিতে দাঁড়ানো যেন নিয়ম হয়ে গিয়েছে। দৈত্যের মতো আবাসানগুলো শহরের আকাশ, মেঘ, সব যেন গিলে খাচ্ছে। তবুও একফালি আকাশ এখনও দেখা যায়। আর শীতের বেলায় ধবল কাঞ্চনজঙ্ঘার রূপ। আগে তো হিমালয়ে আকাশ ছুঁই ছুঁই চড়াগুলো বারান্দা থেকে দেখা যেত স্পষ্ট। কয়েকটা বছরে কেমন যেন বদলে গেল শহরটা। জ্যোত্স্না রাতে চাঁদটা বেশ কিছুক্ষণ দেখা যায় এক টুকরো মেঘের ফাঁকে। রাত বাড়লে হারিয়ে যায়। শহরের নিয়ন আলোয় আকাশের তারাগুলো আত্মগোপন করে। আজ রোহনের কথা মনে পড়ছে খুব। চাঁদের মায়াবি আলো এসে পড়ে তন্বীর চোখেমুখে। সন্ধ্যার দিকে বেশ কিছু ছাত্রছাত্রী টিউশন পড়তে আসত।

বেশ কিছু দিন আগে স্থানীয় একটি নার্সারি স্কুলে শিক্ষিকার পদে কাজ করত সে। কিন্তু বেসরকারি স্কুলের ফাইফরমাশ খাটতে খাটতে জেরবার হয়ে যায়। এক সময় সেই কাজটা ছেড়ে দেয়। ভোরবেলায় ঘুম ঘুম চোখের ঘোর কাটাতে বাইরের আলোতে কিছুক্ষণ কাটিয়ে নেয়। আবার রাতের খাবার সেরে বেশ কিছুক্ষণ একাগ্র চিত্তে দাঁড়িয়ে থাকে গ্রিলটা ধরে। শিলিগুড়ি শহরের ব্যস্ততম রাস্তার ধারে অপূর্ব কাঠের দ্বিতল ঘরে তন্বীদের বাস। এই শহরে কিছুদিন আগেও ছবির মতো কাঠের কারুকাজ করা সুন্দর ঘরগুলো শহরের অহংকার ছিল। তন্বীদের পুরোনো কাঠের ঘরটা এখনও প্রমোটারদের থাবা থেকে বেঁচে আছে।

বাবা বলাই চৌধুরী-রা তিন ভাই। তাদের মধ্যে বড়ো তন্বীর বাবা। আর দুই ভাইয়ে একজন থাকে বিদেশে। আর একজন দিল্লিতে কর্মরত। বহুদিন শিলিগুড়িতেই আসেনি কেউ। তন্বী কাকুদের চিনতেই পারবে না। তবে অ্যালবামে ছবি দেখেছে সবার।

বার্মা টিকের কাঠের দ্বিতল বাড়িটার অধিকাংশ রুম জরাজীর্ণ। নীচের ঘরগুলোর মধ্যে একটায় বইয়ের দোকানের গোডাউন। কিছু ভাড়া পাওয়া যায়। সেই টাকা দিয়ে মাঝেমধ্যে ঘর মেরামত করা হয়। শহরের ব্যস্ততম রাস্তার পাশে এক সময় এই কাঠের ঘরটা ছিল দেখবার মতো। পঁক পঁক রিকশার হর্নের শব্দ শুনতে কান অভ্যস্ত হয়ে গিয়েে তন্বীর। শিলিগুড়ি রিকশার শহর নামে খ্যাত।

উঠোন থেকে লোহার প্যাঁচানো সিঁড়িটা বেয়ে উপরের কাঠের বারন্দায় উঠতে হয়। তারপর সার-সার দুটি ঘর। বন বাংলোর মতো একটা অনুভূতি হয় রুমে ঢুকলে। এই দুটো ঘরেই তন্বীদের সংসার। বাকি ঘরগুলো ভাম, বিড়ালদের বাস, ব্যবহার হয় না। ফুল বাগিচায় সাজানো গোছানো উঠোন। লাল টুকটুকে জবা ফুল ফুটে থাকে উঠোনময়। নয়নতারা, টগর, বেলি আর রাতে রজনীগন্ধার সুবাসে মনটা ভরে ওঠে।

তন্বীর মা পুজো অর্চনা নিয়ে থাকেন। প্রতিবেশীরা ফুল তুলতে আসেন। খুব সখের বাগান তাঁদের। একটা বাংলা শর্ট ফিল্মের শুটিংও হয়েছিল।

তন্বীর বাবা বলাই চৌধুরী যজমানি করে রোজগার করেন। তাঁর একমাত্র কন্যাসন্তানকে মানুষ করেছেন বহু কষ্টে। বড়ো সাধ ছিল মেয়ে একটা সরকারি চাকরি করবে। রোজ সকালে ফুলের সাজি আর সিঁদুরগোলা পাত্র নিয়ে পুজো করতে বার হয়ে যান তিনি। তন্বীর মা রুমা ফুলের সাজি আর একটা ছোটো বাটিতে সিঁদুর গুলে রাখেন পরিপাটি করে।

রেল লাইন পার হলেই লোকাল বাসস্ট্যান্ড। সকালের দিকে স্ট্যান্ডে থাকা বাসগুলোতে ফুল, ধূপ দিয়ে পুজো করেন বলাইবাবু। এছাড়াও বেশ কিছু বাঁধা দোকান, সেলুনে পুজো সেরে দুপুরে ঘরে ফেরেন। হাটবারে ওঁদের বাড়ির দেযাল লাগোয়া জায়গায় শাকসবজির পসরা নিয়ে বসে সবজি বিক্রেতারা। এক পা বাড়ালেই হাটবাজার, সবই হাতের মুঠোয়।

বৃষ্টির দিনে আজ মনটা কেমন করে উঠল তন্বীর। খুব রোহনের কথা মনে পড়ছে। হঠাৎ ভোর রাতে ঘুম ভেঙে গেছে। রোহনের স্বপ্ন দেখেছে সে। বহুদিন রোহনের সঙ্গে দেখা হয় না। ছোটোবেলার প্রিয বন্ধু যেন স্বপ্নে ধরা দিল ভোর রাতে। বেশ কয়েক বছর হল রোহন আর এ শহরে আসেনি।

অঝোরে বৃষ্টি পড়ছে। কখনও মেঘের বুক চিরে বিদ্যুৎ ঝিলিক। গাছের শাখায় শাখায় কচিপাতা গজিযে উঠছে। বৃষ্টি ভেজা সবুজ গাছের পাতায় টলটলে বৃষ্টির ফোঁটা, দেখতে ভীষণ ভালো লাগে তার। মনে পড়ে যাচ্ছে সেদিনটার কথা। কলেজ পথে একদিন রোহনের চারচাকা গাড়িতে ফুলবাড়ি ক্যানাল ধরে গাজলডোবা গিয়েছিল।

টুকটুকে পুতুল পুতুল চেহারার তন্বী খুব আকর্ষণীয় ছিল। তাদের অজান্তে ভালোবাসার একটা অজানা স্রোত প্রবাহিত ছিল। দুটো পরিবার আসতে পেয়েছিল। তিস্তা ক্যানাল বর্ষার অতি বৃষ্টিতে টইটুম্বুর। দুপাশে ঘন লকলকে সবুজ ছুঁয়ে গাজোলডোবায় পৌঁছে গিয়েছিল সেদিন। ওদের মনের ভেতর বইত ভালোবাসার অন্তঃসলিলা। কলেজ লাইফ বেশ কেটেছে। কলেজ জীবনের স্মৃতি ফিল্মের রোলের মতো ভেসে আসছে। কিছুটা নিজেকে সামলে নিয়ে রোজকার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে তন্বী।

ইতিহাসে মাস্টার ডিগ্রি কমপ্লিট করে ঘরে বসে আছে তন্বী। কোনও চাকরি জোটেনি। সংবাদপত্রের বিজ্ঞাপনে নজর রাখে। দরখাস্তও করে। সাফল্য আসেনি এখনও। আসলে শিক্ষকতার পেশায বিএড খুব জরুরি। কিন্তু দরিদ্র ব্রাহ্মণ পরিবারের মেয়ে তন্বী, লাখ লাখ টাকা দিয়ে ভর্তি হওয়া আকাশকুসুম কল্পনা।

এদিকে সরকারি, বেসরকারি বিভিন্ন দফতরে অ্যাপ্লাই করেই চলেছে। কিন্তু সুযোগ আসেনি একটাও। কিছুদিন আগে একটা নার্সারি স্কুলে শিক্ষকতার চাকরি জুটিযেছিল। কিন্তু বেসরকারি স্কুলের সঙ্গে তাল মেলাতে পারেনি।

সামনের বড়ো রাস্তাটা পার হলেই রোহনদের বিশাল বাড়ি। প্রশস্ত উঠোন। যখন ছোটো ছিল ওরা একসঙ্গে খেলাধূলা করত। প্রাইমারি থেকে কলেজে পড়া পর‌্যন্ত ওরা দুজন দারুণ জুটি। রোহন পড়াশোনায খুব ভালো। উচ্চমাধ্যামিকে স্কুলের টপার হয়েছিল। তন্বীও মনযোগী ছাত্রী ছিল। ছোটোবেলার খেলার সাথি ওরা। কলেজেও একসঙ্গে পড়েছে। রোহনদের বাড়ির সহযোগিতা দারুণ ভাবে পেযেছে তন্বী। আসলে তন্বীর বাবা রোহনদের পরিবারের কূল-পুরোহিত। রোহনের বাবার বিয়েও পুরোহিত ছিলেন বলাইবাবু।

বেশিরভাগ সময় রোহনদের বাড়িতে কাটাত তন্বী। রোহনের মা মিতার খুব পছন্দের মেয়ে ছিল সে। রোজ স্কুল শেষে যখন রোহনদের বাড়িতে খেলতে আসত, মাথার ঘন কালো কোঁকড়া চুলে কৃষ্ণচড়ার ঝুঁটি বেঁধে দিতেন রোহনের মা। আত্মীয-কুটুমদের মধ্যে কানাঘুষো হত, তন্বীকে বউ করে নিয়ে আসবে ঘোষ পরিবার। কিন্তু তন্বীর মা আবার খুব গোঁড়া। ধর্মকর্ম পুজো নিয়ে থাকেন। বলবার সাহস হয় না মিতার।

রোহনের বাবা বাদল ঘোষ শহরের নামজাদা ব্যবসাযী। কযেটা গোডাউন রযেে। বাদল ঘোষ ধনেমানে বড়ো হলে কী হবে, লেখাপড়া ছিটেফোঁটাও জানেন না। স্কুলছুট হয়ছিলেন। সে আর এক গল্প। পণ্ডিত স্যারের কানমলা খেযে নাকি আর স্কুলমুখো হননি। কিন্তু এখন এই শহরের বেশ ধনী ব্যবসায়ী। বাদল ঘোষের বাবাও ব্যবসায়ী ছিলেন। ব্যাবসাটা ওদের পরিবারের মজ্জাগত। এখন বাদলবাবু ফুলে-ফেঁপে কলাগাছ। এদিকে রাজনীতির সঙ্গেও যুক্ত।

রোহন কলেজে অনার্সে ভালো ফল করেছে। রোহনের বাবা খুব খুশি। এই আনন্দে ঠিক করেছেন রোহনকে কলকাতায হোস্টেলে রেখে পড়াবেন। ব্যাবসার সুত্রে পরিচিত এক বন্ধুর বাড়িতে কিছুদিন ছিল রোহন। কিন্তু মন বসেনি। মাঝপথে সব ছেড়ে চলে আসে। সুযোগ পেলেই তন্বীকে নিয়ে শুকনার জঙ্গল দেখতে বেরিয়ে পড়ে। রংটঙের টযট্রেনের নির্জন ষ্টেশনে বসে চলে ওদের প্রেমালাপ। কখনও দিনের শেষে ধূমাযিত কফি কাপে চুমুক দিতে দিতে, ভালোবাসায বুঁদ হয়ে যায দুজনে। কিছুক্ষণ কাটিয়ে আবার মোমো শপে গরম মোমো খেযে বাড়ি ফেরে।

এদিকে তন্বী ইতিহাসে এমএ করছে বিশ্ববিদ্যালয থেকে। মাঝপথে রোহন সব ছেড়ে চলে আসায, রোহনের বাবা-মায়ের মন খুব খারাপ। তন্বীদের সঙ্গে রোহনদের একটা ঘরোযা সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। পাড়াপড়শি, আত্মীযমহলে আলোচনা করে অনেকে। তন্বীও ফের ভর্তি হতে বলে রোহনকে। যাইহোক রোহন নেক্সট ইয়ার বেঙ্গালুরুতে বিজনেস ম্যনেজমেন্টে ভর্তি হয়। এখন ওখানেই থাকে। বেশ মন বসে গিয়েছে। চিরবসন্তের শহরে এক অন্য জগতের পড়াশোনা নিয়ে মজে গেছে। শিলিগুড়ি আর আসতেই চায় না রোহন। টাকা পযসার তো আর অভাব নেই। বাবা টাকা পাঠান।

এখন অফিসের কাজে ব্যস্ত হয়ে গিয়েছে। বিজনেস ম্যনেজমেন্ট পাশ করে নামকরা বেসরকারি কোম্পানির ম্যানেজিং ডিরেক্টরের পদে আসীন। বেকার বসে থাকতে হল না আর। প্রথম দিকে তন্বীর খোঁজ খবর নিত। ফোন করত নিয়ম করে। কিছুদিন হল সেসব পাট যেন চুকে গেছে।

রোহনের বাবা বাদল ঘোষের বাড়িতে ঘটে গিয়েছে অঘটন। পুলিশ রেড হয়েছে। রেশন দুর্নীতিতে আপাদমস্তক ডুবে গিয়েছেন বাদলবাবু। রাজনীতির কেউকেটা হয়ে নাকি পার পাওয়া যাচ্ছে না।

কোনও অভিযোগের ভিত্তিতে গুদামে, বাড়িতে পুলিশ প্রশাসন রেড করে বেআইনি শস্য উদ্ধার করেছে। দুর্নীতির শিকড় নাকি বহুদূর। মন্ত্রী-আমলারাও যুক্ত। আসলে এদেশে শস্য নিয়ে দুর্নীতি মারাত্মক। আর এরাই আবার রাজনীতির হর্তা-কর্তা-বিধাতা। কিন্তু পাপ তো বাপকেও ছাড়ে না। কাজেই বলাই ঘোষ গ্রেফতার হয়েছেন। তদন্তে কী হবে কেউ জানে না!

বিভিন্ন সংবাদপত্রে রেশন দুর্নীতি নিয়ে কযেকদিন ধারাবাহিক লেখাও বার হয়েছে। রোহনের কানে সব খবর গিয়েে। লজ্জায় ঘৃণায় রোহনের মাথা হেঁট হয়ে গিয়েছে। তারপর থেকে আর শিলিগুড়ির বাড়ি আসা যাওয়া ছেড়ে দিয়েছে। কীভাবে বন্ধু আত্মীয়দের মুখ দেখাবে রোহন! চায়ের দোকান থেকে ঘরে-বাইরে আড্ডায় এখন মুখরোচক খবর, বলাই ঘোষের দুর্নীতি।

এরকম বিপর্যয়ের মুখে একদিন রোহনের ফোন আসে। তন্বীর মুখে সে ঘটনার সত্যাসত্য জানতে চায়। তন্বী রোহনকে সান্ত্বনা দেয়। তারপর বহুদিন আর ফোন করা হয়নি। মনে হয় রোহন এড়িয়ে যাচ্ছে। তন্বী খুব বাস্তববাদী। মনে মনে ঘরের বারন্দার গ্রিলটা ধরে ভাবে কতো কী। আবার এগিয়ে যেতে হবে। জীবনের আর এক নাম লড়াই। ছোটো থেকে দেখেছে বাবাকে, কী ভাবে জীবনসংগ্রাম করে তাকে মানুষ করেছেন।

সব কিছু মানিয়ে নেওয়ার অভ্যাস ধীরে ধীরে গড়ে উঠেছে তন্বীর। জীবন যন্ত্রণার বহু করুণ-কাহিনির সাক্ষী সে নিজে। হয়তো আরও পথ যেতে হবে তাকে। জীবনটাকে চ্যালেঞ্জ হিসাবেই নিতে চায় তন্বী। তাই হতাশার কোনও ঠাঁই নেই তন্বীর অভিধানে। সম্পর্কে এইভাবেই দূরত্ব তৈরি হয়। রোহন তন্বীর সঙ্গে যোগাযোগ না রাখলেও সে রোহনকে মন থেকে ঝেড়ে ফেলতে পারেনি।

এদিকে বলাই ঘোষের জামিন হয়েে কিন্তু কেস চলছে। বলাই ঘোষ বিচারাধীন। তাঁর অনুগামীরা জামিনের দিন ফুলের মালা দিয়ে সংবর্ধিত করেছেন। সংবাদে সচিত্র এমন সংবাদ পড়ে অনেক কিছু ভাবতে থাকে তন্বী। ওদের বাড়ির বারান্দা থেকে দেখা যায় মহকুমা শাসকের দফতরের জাতীয পতকাটা পতপত করে উড়ছে। আর ওইখানেই আদালত। তন্বী এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে হাঁ করে পতাকাটার দিকে। আনমনা হয়ে যায়।

তন্বীর বাবার বয়স হচ্ছে। সেদিন পুজো করতে গিয়ে মাথা ঘুরে পড়ে গিয়েছিলেন। মুখ দিয়ে ফেনা বার হচ্ছিল। পাতলা ছিপছিপে চেহারার মানুষ। লো-প্রেশারের রোগী। অনেকবার তন্বীর মা বলেছেন মেযোর জন্য পাত্র খুঁজতে। কিন্তু তন্বী নারাজ। মা যতবার বলেছেন, তন্বী তুই সব খুলে বল। তন্বী ততবার বলেছে, আমি নিজের পায়ে দাঁড়াব, কিছু একটা করব।

এমন সময় একটা কলিং বেলের শব্দে তন্বী দরজা খুলে দেখে পিয়ন কাকু। বহুদিন পর দেখা। আসলে আজকাল চিঠিপত্তর তেমন আর আসে না। একটা বাদামি খাম তার হাতে ধরিয়ে দিল লোকটি। খামের মুখ খুলে দেখে ইন্টারভিউ লেটার। গ্যাংটকে ভেনু। সময় তারিখ সব দেওয়া আছে। মনটা বেশ চনমনে হয়ে উঠল। মাকে সব বলল। বাবাও ফিরেছেন পুজোর কাজ সেরে।

সপ্তাহে নিয়ম করে একটা খবরের কাগজ রাখে তারা। সাপ্তাহিক কাগজে দেশবিদেশের খবর থাকে। বেশ কিছুদিন আগে একটা ভালো মাইনের চাকরির বেসরকারি কোম্পানির বিজ্ঞাপন দেখে অবেদন করেছিল। পদটি অফিস সহকারীর। এক নামকরা ওয়াটার পাম্প কোম্পানির অফিস অ্যাসিস্ট্যান্ট। সারা দেশ জুড়ে বিভিন্ন শহরে এই কোম্পানির মূল অফিস। হিল এরিযায নতুন অফিস খুলবে। তরাই-ডুযার্স, অসম, সিকিম এলাকার চা-বাগিচায় ওয়াটার পাম্পের ডিমান্ড রযেছে।

বাবাকে সঙ্গে নিয়ে ইন্টারভিউ-এর জন্য প্রস্তুতি নিয়ে সেভক রোডের কাছে একটা টাটা সুমোতে চেপে বসে তন্বী। বেলা দশটার মধ্যে গ্যাংটকে পৌঁছে ইন্টারভিউ বোর্ডের মুখোমুখি হতে হবে। সাক্ষাত্ প্রার্থীরা একটা হোটেলের করিডরে অপেক্ষা করছে। এই হোটেলটা থেকে দূর পাহাড়ের উপত্যকার মাঝে তিস্তা নদী দেখা যায়। হোটেলের পিছনের দিকে কনফারেন্স রুমে বসবার ব্যবস্থা। কাগজপত্র ভেরিফিকেশন হবার পর ইন্টারভিউ-এর সময় হল। কযেজনের পর ডাক পড়ল তন্বীর।

শীতশীত আবহাওয়া। আজ যদিও আকাশে সূর‌্যের দেখা মিলেছে। ফাইল নিয়ে বোর্ডের সামনে চেযারে বসতেই, সারা শরীরে কেমন শিহরণ অনুভব করল সে। খুব চেনা মানুষ ইন্টারভিউ বোর্ডের হেড। ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি, গোলাপি হাফ সোয়েটার। চশমার ফাঁকে বুদ্ধিদীপ্ত চোখদুটো ঘুরছে। চোখ আর জোড়াভুরু দুটো খুব চেনা। পাশে বসে এক আধুনিকা। কাগজপত্র মিলিয়ে বেশ কিছুক্ষণ আলাপের ছলে ভদ্রমহিলা অনেক কিছু প্রশ্ন করলেন। কিন্তু সেই চেনা মানুষটির যখন প্রশ্নের পালা এল কোনও প্রশ্ন না করে, ওকে বলে শেষ করলেন।

রুম থেকে বেরিয়ে আসতেই বাবা জিজ্ঞেস করলেন, ইন্টারভিউ কেমন হল তন্বী? তন্বী বাবার কথা এড়িয়ে বলল, হয়েছে চলো, দেরি হয়ে যাবে। লাস্ট বাসটা ধরতে হবে।

কিছু একটা গড়বড় হয়েছে, বাবা সহজেই বুঝলেন। খানিকটা হেঁটে বাজারের বাসস্ট্যান্ডে কিছু শুকনো খাবার কিনে, বাসের জানলার দিকে সিট নিয়ে বসল তন্বী। মেঘমুক্ত আকাশে স্পষ্ট দেখা যায তিস্তার মূল স্রোতে কত অনামি জলধারা এসে মিশছে। সাদা পেঁজা তুলোর মতো মেঘ, সবুজ উপত্যকায ঘুরে বেড়াচ্ছে।

গ্যাংটক ছাড়িয়ে বাসটা পাহাড়ের পাকদণ্ডি পথে ছুটছে। জানলার দিকে তাকিয়ে রোহনের স্মৃতি রোমন্থন করতে করতে, এক সমযে সিটে হেলান দিয়ে ঘুমিযে পড়েছে তন্বী। হঠাত্ বাসটা বাঁক নিয়ে ব্রেক কষলে এক ঝটকায় ঘুমটা ভেঙে যায তন্বীর।

এখন রাস্তাটা তিস্তা নদী ঘেঁষে চলেছে। সামনেই তিস্তা বাজার জনবসতি। বাসের জানলা থেকেই দেখা যাচ্ছে প্রধান নদী তিস্তায়, রঙ্গিত নদী মিশছে। সিকিম থেকে রঙ্গিত, তিস্তা বাজারে তিস্তার মূল প্রবাহে মেশে।

তিস্তা-রঙ্গিতের সঙ্গমস্থল লাভার্স মিট দেখতে দেখতে কেমন নস্টালজিক হয়ে যায তন্বী।

রোহনের আজকে না চেনার ভান নাকি কোম্পানির প্রোটোকল কোনটা সঠিক ভাবতে থাকে তন্বী। কখনও নিজেকে সান্ত্বনাও দেয়। ভাবতে থাকে এমনটাই কাঙ্খিত ছিল। অভিমানে গাল বেয়ে দুফোঁটা মুক্তো দানা ঝরে পড়ে। রোহনের সাথে হঠাত্ দেখা হওয়া যেন স্মৃতির দরজা ধরে এক ঝলক ফিরে দেখার অপেক্ষা। কে জানে যদি আবার সেই দিনগুলো ফিরে আসে!

সহমর্মিতা

খোলা হাওয়ায় শ্রীরাধা বুক ভরে নিঃশ্বাস নিল। শহরের শেষপ্রান্তে থাকা ঝিলটায় পৌঁছোতে গেলে এই একটাই রাস্তা ধরতে হয়। এদিকটা বেশ নির্জন। চারিদিকে নিবিড় সবুজ গাছগাছালি তাদের শাখা-প্রশাখা বিস্তার করেছে। পিচ বাঁধানো ঢালাই মসৃণ রাস্তা। একটাই বেশ বড়ো হাসপাতাল রয়েছে এই চত্বরে, ঝিলের থেকে কিছুটা দূরত্বে। আর কোনও লোকবসতি নেই এই দিকটায়।

আজ অনেক দিন পর গৌতমের সঙ্গে বাইকে শ্রীরাধা বাড়ি ছাড়িয়ে এতটা দূরে এসেছে, একান্তে কিছুটা সময় কাটাবে বলে। জায়গাটা বরাবরই তার বড়ো প্রিয়। চারপাশের নিসর্গ দেখতে দেখতেই সময় কাটিয়ে দেওয়া যায়। তাই গৌতম যখন এখানে আসার কথা বলল, দ্বিধা করেনি শ্রীরাধা মুহূর্তে রাজি হয়ে গিয়েছিল।

ঝিলের চারপাশে কিছু কিছু আগাছার ভিড় থাকলেও একটু পরিষ্কার দেখে ওরা দুজনে একটা কাগজ বিছিয়ে ঘাসের উপর বসল। গৌতম একটু কাছে ঘেঁষে আসতে চাইলে, শ্রীরাধা কপট রাগ দেখিয়ে ওকে দূরত্ব রেখে বসতে বলল। দুজনেই পা মেলে বসল ঘাসের উপর। হঠাৎই ঝিলের জলে একটা মৃদু কম্পন আর তার সঙ্গে ঝুপ একটা শব্দ শুনে, শ্রীরাধা একটু সজাগ হয়ে উঠল।

মনে হচ্ছে জলে কেউ পাথর ফেলল। নিশ্চয়ই আশেপাশে কেউ আছে আর আড়াল থেকে আমাদের লক্ষ্য করছে।

এখানে কেউ প্রায় আসে না। অনেক সময় জলের উপরে মাছ লাফিযে ওঠে। তারই আওয়াজ তুমি শুনে থাকবে। গৌতম নিশ্চিন্ত করতে চায় শ্রীরাধাকে।

শ্রীরাধার শরীর থেকে একটা মিষ্টি গন্ধ এসে গৌতমের দেহ-মনে নেশা ধরিয়ে দিয়েে। নিজেকে সংযত রাখতে কষ্ট হচ্ছিল গৌতমের। কিন্তু শ্রীরাধার যা ব্যক্তিত্ব তাতে কোনও ভাবেই ওর মতের বিরুদ্ধে যাওয়া চলে না। তাই ধীরে ধীরে ওর চুলের লম্বা বিনুনিটা হাতে নিয়ে খেলতে খেলতে হালকা করে জিজ্ঞেস করে, তোমার পারফিউম-টার নাম কী?

উত্তর দেয় না শ্রীরাধা। মৃদু হেসে গৌতমের কাঁধে মাথা রাখে সে। সুযোগ বুঝে গৌতমের চোখদুটো শ্রীরাধার রূপ-মাধুর‌্য পান করতে ব্যস্ত হয়ে ওঠে। এভাবেই কাটে কিছুটা সময়।

কী দেখছ এমন করে?

তোমার চোখ।

এতে দেখার কী আছে? তোমার সবেতেই বেশি বেশি।

ওই চোখে কী শুধু আমিই জানি।

থামো তো, বাড়িয়ে বলাটা তোমার স্বভাব। এবার চলো উঠি। আর একটু পরেই সন্ধে নামবে। বলে শ্রীরাধা উঠে পড়ল। শাড়িটা ঠিকঠাক করে গুছিযে নিল। সেই সময় দমকা একটা হাওয়ার বেগ ওর আঁচলটা উড়িয়ে নিয়ে গৌতমের মুখ ঢেকে দিল।

গৌতম আঁচলটা হাত দিয়ে ধরতেই শ্রীরাধা বলে উঠল, আঁচলটা প্লিজ ছেড়ে দাও, কেউ দেখে ফেলবে।

আজকের দিনটাই ভালোবাসার জন্য। আমারও প্রাণভরে তোমাকে ভালোবাসতে ইচ্ছে করছে।

প্লিজ ছাড়ো, দেরি হয়ে যাচ্ছে।

ঠিক আছে ম্যাডাম আজ ছেড়ে দিচ্ছি, বলে শ্রীরাধার কোমরের খোলা অংশ হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে গৌতম গভীর চুম্বনে শ্রীরাধাকে সিক্ত করল।

ওদের এই ভালোবাসার সাক্ষী থাকে ঝিলের জল, আশেপাশের গাছপালা আর এক দম্পতি যুগল। ডক্টর সৌম্য বোস এবং ডক্টর শীলা বোস। ঝিলের অনতিদূরেই তাঁদের হাসপাতালটি। কখনও কখনও দুজনের কাজ একই সমযে শেষ হলে, নিজেদের ক্লান্তি দূর করতে, স্বামী-স্ত্রী এই ঝিলটির ধারে এসে বসে কিছুক্ষণ সময় কাটিযে যান।

গৌতম-শ্রীরাধা ওখান থেকে চলে যাওয়ার পর শীলা তাঁর স্বামীকে বললেন, এই ছেলেটিকে আমি চিনি। আমার বাপেরবাড়ির পাড়ায় থাকে। খুব বাজে ছেলে। এক কথায় বলা যায় ধনী বাপের উচ্ছন্নে যাওয়া ছেলে। পড়াশোনা কতদূর করেছে জানা নেই, তবে নিত্য নতুন মেয়েে ফাঁসাতে ওস্তাদ। একবার তো এই ছেলেটির দুশ্চরিত্র স্বভাবের কারণে, একটি মেয়ে আত্মহত্যা করারও চেষ্টা করেছিল।

ছাড়ো তো ছেলেটার কথা, ওদের সঙ্গে আমাদের তো কোনও লেনদেন নেই, ডা. সৌম্য স্ত্রীকে বলেন।

এই ঘটনার পর ছয়-সাত মাস কেটে গেছে। সৌম্য এবং শীলা দুজনেরই সেদিন নাইট ডিউটি। হঠাৎই একটা ট্যাক্সি এসে থামে হাসপাতালের সামনে। এক দম্পতি একটি মেয়েে নিয়ে ট্যাক্সি থেকে নেমে হাসপাতালে ঢোকেন। দুজনে মেয়েটিকে ধরে, ধীরে ধীরে এমারজেন্সি-তে ডাক্তারের কাছে নিয়ে আসেন। সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে ডাক্তারবাবু দম্পতির দিকে চাইলে, মহিলা এগিয়ে আসেন।

ডাক্তারবাবু, এ আমার মেয়ে আজ দুপুর থেকে ওর পেটে প্রচন্ড যন্ত্রণা হচ্ছে আর সেই সঙ্গে খুব ব্লিডিং-ও হচ্ছে।

ডাক্তার সঙ্গে সঙ্গে মেয়েির ব্লাড প্রেশার চেক করে একটা ফোন করলেন। ডক্টর শীলা, প্লিজ তাড়াতাড়ি একবার এমারজেন্সি-তে আসুন। একটা ক্রিটিক্যাল কেস এসেছে।

দুমিনিটের মধ্যেই স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ শীলা এসে সেখানে পেঁছোলেন। ঝড়ের গতিতে মেয়েিকে বিছানায় শুইযে পর্দা টেনে দিলেন। একটু পরেই বেরিয়ে এসে জানালেন, মাত্রাতিরিক্ত ব্লিডিং হচ্ছে। এখুনি অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যেতে হবে। সার্জারি করতে হবে।

অপারেশনের নাম শুনেই মেয়েটির মা-বাবা ঘাবড়ে গেলেন। ভদ্রলোক জিজ্ঞেস করলেন, ডক্টর, ভয়ে কোনও কারণ আছে নাকি?

এখনই কিছু বলা যাচ্ছে না। আপনারা ফর্মালিটিজগুলো সেরে, ওটি-র সামনে অপেক্ষা করুন।

ওটি-তে সৌম্যও স্ত্রী-কে জয়েন করলেন। একটু পরেই একজন নার্স বাইরে এসে জিজ্ঞেস করলেন, ওটি-তে থাকা অসুস্থ মেয়েটির অভিভাবক কি আপনারা? নার্স একটি কাগজ এগিয়ে দিল ভদ্রলোকটির দিকে, তাড়াতাড়ি করে এটাতে সাইন করে দিন। অপারেশন করতে হবে। এখনই করুন।

কী হয়েে সিস্টার?

এখন কথা বলার সময় নেই। যা প্রশ্ন আছে অপারেশনের পরে ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করে নেবেন। মেয়েিকে ডিসচার্জ করার আগে এক বোতল রক্ত আমাদের ব্লাড ব্যাংক-এ জমা করতে হবে। এখন আমরা আমাদের স্টক থেকে রক্ত দেওয়ার ব্যবস্থা করেছি।

নার্স চলে গেলে একজন অ্যাটেনডেন্ট-এর সঙ্গে গিয়ে ভদ্রলোক এক বোতল নিজের রক্ত জমা দিয়ে আবার এসে স্ত্রীয়ের পাশে, ওটি-র সামনের বেঞ্চটাতে বসলেন।

হঠাৎ করে শ্রীরাধার কী হল? ভালোই তো ছিল। ভিতরের টেনশন কিছুতেই চেপে রাখতে পারছিলেন না শ্রীরাধার বাবা।

অপারেশন টেবিলে শ্রীরাধাকে শুইয়ে দিয়ে শীলা জিজ্ঞেস করলেন, যার সঙ্গে তুমি প্রায়শই ওই ঝিলটায় যাও এটা তারই কীর্তি, তাইতো?

চোখের জল বাধ মানে না শ্রীরাধার। হ্যাঁ ডক্টর, আমার একটা ভুলের জন্য এই পরিণতি হবে আমি ভাবতে পারিনি। আমাকে প্লিজ বাঁচাবার চেষ্টা করবেন না। আমার মরে যাওয়াই উচিত।

আমি তোমার মতো বোকা এবং দাযিত্বজ্ঞানহীন নই। আমার কী কর্তব্য সেটা আমি ভালোই জানি।

কিন্তু এই কলঙ্কের বোঝা নিয়ে আমি কী করে বাঁচব? আপনি আমাকে এখন বাঁচিয়ে দিতে পারেন ঠিকই কিন্তু পরেও তো আবার আমি আত্মহত্যা করতেই পারি। দয়া করে আমাকে মরতে দিন।

ঘাবড়ে যেও না, আমি তোমার বদনাম হতে দেব না। এখান থেকে সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে তুমি বাড়ি যাবে। নিজের পড়াশোনার ওপর বেশি ফোকাস রাখো। এখন থেকে মা-বাবার সম্মানের কথাটা মাথায় রেখো দয়া করে। সম্মতিসূচক মাথা হেলায় শ্রীরাধা। আর কথা বোলো না, এখনই অ্যানাস্থেশিযার প্রভাব ধীরে ধীরে শুরু হয়ে যাবে। তার পরেই আমি অপারেশন শুরু করব।

প্রায় দুঘন্টা পর ওটি থেকে শীলা বাইরে বেরোতেই, শ্রীরাধার মা-বাবা দৌড়ে এলেন। জিজ্ঞেস করলেন, এখন আমাদের মেয়ে কেমন আছে?

ভালো আছে। আপনারা ঠিক সময়ে মেয়েটির হাসপাতালে নিয়ে এসেছিলেন, নয়তো বেশি ব্লিডিং হওয়ার ফলে প্রাণটাও যেতে পারত। অপারেশন সাকসেসফুল। এখন আর কোনও ভয় নেই আপনাদের মেয়ে।

কিন্তু ডক্টর, আমার মেয়ের কী হয়েছে ? শ্রীরাধার বাবা জিজ্ঞেস করলেন।

আপনারা আমার কেবিনে আসুন।

শ্রীরাধার মা-বাবা ডা. শীলার সঙ্গে ওনার চেম্বারে গিয়ে বসলেন। শীলা, শ্রীরাধার ফাইলে দেওয়া বিবরণ চোখের সামনে খুলে ধরলেন। পেশেন্টের বাবার দিকে সরাসরি তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন, আপনি ফাইলে মেয়ে বয়স লিখিয়েেন সতেরো অর্থাৎ নাবালিকা। আপনারা কি জানতেন, শ্রীরাধা গর্ভবতী ছিল?

কিন্তু এটা কী করে সম্ভব?

তার উত্তর তো একমাত্র শ্রীরাধাই দিতে পারবে। ওর একটি ফার্টিলাইজড এগ গর্ভাশয় অবধি পৌঁছোতে পারেনি। ফ্যালোপিয়ন টিউবেই আটকে ছিল। গর্ভের আকার বড়ো হতেই নালি ফেটে গিয়ে ব্লিডিং শুরু হয়েছিল। আমরা নালির ওই অংশ কেটে বাদ দিয়ে দিয়েছি। এখন আর ভয় পাওয়ার কোনও কারণ নেই।

ডাক্তারের কথা শুনে শীলার মা-বাবার মুখে আশ্চর্য হওয়ার অভিব্যক্তি ফুটে উঠল। মুহূর্তের মধ্যে ওঁরা লজ্জায় মাথা নীচু করে নিলেন।

সপ্তাহ খানিক পর শ্রীরাধার ডিসচার্জ হওয়ার কথা। শীলার অ্যাসিস্ট্যান্ট এসে জিজ্ঞেস করল, ডিসচার্জ ফাইলে কী লিখব ম্যাডাম? আপনি বলেছিলেন ডিসচার্জ ফাইল তৈরি করার সময় আপনাকে একবার জিজ্ঞেস করতে।

ওকে, পেশেন্টকে যে ডিসচার্জ স্লিপটা দেওয়া হবে, তুমি তাতে সব সত্যিটা লেখো। আর হাসপাতালের ফাইলে লেখো ডান দিকের ফ্যালোপিয়ন টিউব ফেটে যাওয়ার পরে, সেটা আপারেশন করে বার করে দেওয়া হয়েছে। একটা নোট লিখে দিও যে, সার্জারির ডিটেল রিপোর্ট গাইনিকোলজিস্টের ফাইলে রয়েছে। এই ডিটেল পেপার্স-এর ফাইল আমাকে দিয়ে দিও। এই পুরো ব্যাপারটা যেন আমাদের দুজনের মধ্যেই থাকে। তুমি নিজে একজন মেয়ে হয়ে নিশ্চয়ই এটার গুরুত্ব বুঝতে পারছ।

কথোপকথনের মধ্যেই সৌম্য এসে স্ত্রীয়ের কেবিনে ঢুকেছিলেন। চুপচাপ বসে স্ত্রীয়ের কথা শুনছিলেন। অ্যাসিস্ট্যান্ট ঘর থেকে বেরিয়ে যেতেই শীলাকে বললেন, এটা তুমি কী করছ? হাসপাতালের ফাইলেই অপারেশন নোটস থাকতে দাও। এটা তোমার করা উচিত নয়। পেশেন্টের প্রতি সহানুভূতি রয়েছে বলে, তুমি হাসপাতালের নিয়ম ভাঙতে পারো না।

সৌম্য তুমি যা বলছ, তা একদম ঠিক। কিন্তু ভেবে দ্যাখো মেয়েটি নাবালিকা, বাচ্চা মেয়ে বললেও ভুল হবে না। ওর এই অবৈধ প্রেগন্যান্সি যদি একবার ছড়িয়ে পড়ে, তাহলে মেয়েটির বদনামের শেষ থাকবে না। মেয়েটির ভবিষ্যৎও নষ্ট হয়ে যাবে। আমি ডাক্তার হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে একজন নারী। আমি মেয়েটির ব্যথা খুব ভালো বুঝতে পারি।

শীলা, শ্রীরাধার মা-বাবাকে ডেকে পাঠালেন নিজের কেবিনে। হাসপাতালের নিয়মকানুন বুঝিয়ে বললেন, দেখুন আপনাদের ফাইলে আমাকে সত্যিটা লিখতেই হবে। ফাইল আপনাদের সুতরাং ওটা নিয়ে আপনারা যা খুশি করতে পারেন। চাইলে নষ্ট করেও দিতে পারেন। আপনাদের মেয়ে ভালোর জন্য আমার পক্ষে যতখানি সম্ভব আমি সেটা করেছি। এবার ওর ভবিষ্যৎ আপনাদের হাতে।

মা জিজ্ঞেস করলেন, শ্রীরাধা ভবিষ্যতে আদৌ মা হতে পারবে কি?

হ্যাঁ, মা হতে পারবে। ওর একটা ফ্যালোপিয়ন টিউব সম্পূর্ণ ঠিক আছে।

কিন্তু অপারেশনের দাগ তো পেটে থেকেই যাবে। বিয়ের পর যদি ওর স্বামী দেখে কিছু সন্দেহ করে?

আমি ল্যাপ্রোস্কোপিক পদ্ধতিতে সার্জারি করেছি। ছোট্ট একটুখানি জায়গা কাটতে হয়েছে। সুতরাং পেটে কোনও বড়ো দাগ থাকবে না, তাড়াতাড়ি সেরে উঠবে। শ্রীরাধার বিয়ে এখনও অনেক দেরি আছে। আমি ওর সঙ্গে কথা বলেছি, ও এখন পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত থাকতে চায়। মাস্টার্স করে তবেই বিয়ে করবে আপনাদের মেয়ে হাসপাতাল থেকে ডিসচার্জ করে দেওয়ার পর বাড়ি এসে শ্রীরাধা মায়ের কাছে কান্নায় ভেঙে পড়ল। লজ্জা যেন ওকে গ্রাস করে নিচ্ছিল। মা, আমি আর কারও কাছে মুখ দেখাতে পারব না! বেঁচে থেকে আমি কী করব?

খবরদার রাধা এমন বোকার মতো কথা মাথাতেও আনবি না। একটা দুর্ঘটনা ভেবে ভুলে যা। এটা নিয়ে কারও সঙ্গে কোনও আলোচনা করবি না। এমনকী বিয়ে পর স্বামীর সঙ্গেও না। এখন মন দিয়ে পড়াশোনা কর। আমরা খুব ধুমধাম করে তোর বিয়ে দেব, চিন্তা করিস না।

শ্রীরাধার মা স্বামীকেও বললেন, এই ব্যাপার নিয়ে রাধাকে তুমি কিচ্ছু বলবে না। আমি ওর সঙ্গে কথা বলেছি। এই পুরো ঘটনায় ও খুব লজ্জিত। ও এখন পড়াশোনা নিয়ে থাকতে চায়। ভাগ্য ভালো যে, এরকম একজন ভালো লেডি ডক্টর-এর সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ হয়েছিল। যিনি আমাদের সম্মান বাঁচাবার জন্য যতখানি সম্ভব সহযোগিতা করেছেন।

এই ঘটনার পর আট বছর কেটে গেছে। আজ শ্রীরাধা নিজের স্বামীর সঙ্গে আবার ডা. শীলার হাসপাতালে এসে হাজির হয়েে। আড়াই মাসের গর্ভবতী সে। ওর ডাক্তারই শ্রীরাধাকে, ডা. শীলা বোসের কাছে রেফার করেছেন।

শ্রীরাধা আর তার স্বামীর সঙ্গে কথার শেষে, শ্রীরাধার স্বামীকে কেবিনের বাইরে অপেক্ষা করতে বলে ডা. শীলা চেক-আপের জন্য শ্রীরাধাকে বেডে শুইযে দিলেন। পরীক্ষা করে বললেন, পেটের দাগটা তো একেবারেই মিলিয়ে গেছে দেখছি। এখন ক’মাস চলছে?

আড়াই মাস চলছে ম্যাম।

বাচ্চা একদম ঠিক আছে। খাওয়া-দাওয়ার খেযাল রাখতে হবে আর অ্যাক্টিভ থাকবার চেষ্টা করবে সবসময়। এতে নর্মাল ডেলিভারি হতে সুবিধা হবে। কমপ্লিট রেস্টের কোনও দরকার নেই তোমার। তোমার স্বামী বাইরে বসে ছটফট করছেন, তোমাকে খুবই ভালোবাসেন, তাই না?

হ্যাঁ ম্যাম। আমার অতীতের ঘটনা ওনাকে কিছুই জানাইনি। আমি তো আত্মহত্যা করব বলেই ঠিক করে ফেলেছিলাম, আপনিই আমাকে মরার হাত থেকে বাঁচিয়েছেন। আপনার জন্যই এত সুন্দর জীবন পেয়েছি। এই ঋণ কোনও দিন আমি শোধ করতে পারব না। শ্রীরাধার চোখ জলে ভরে আসে।

আচ্ছা ঠিক আছে। এখন শিগগির স্বামীর কাছে যাও। ও বেচারা উত্কণ্ঠায় ছটফট করে মরছে। হাসতে হাসতে শীলা বললেন।

চোখে জল নিয়ে শ্রীরাধা কেবিন থেকে বাইরে এল। ওকে দেখে স্বামী রথীন দৌড়ে এল, কী হল শ্রীরাধা, সব ঠিক আছে তো? তোমার চোখে জল কেন?

রথীন এটা হচ্ছে আনন্দের অশ্রু। শ্রীরাধার শরীর আর বাচ্চা দু-ই একদম ঠিক আছে। পরের বার মিষ্টি নিয়ে আসতে ভুলো না শ্রীরাধা। ওরা দুজনের কেউই খেয়াল করেনি, কখন ডা. শীলাও শ্রীরাধার পিছনে এসে দাঁড়িয়েছেন। ওনার কথাতে দুজনের চমক ভাঙে। রথীন আর শ্রীরাধা হাসিমুখে শীলাকে ধন্যবাদ জানিয়ে হাসপাতালের বাইরে বেরিয়ে আসে। নবজাতকের আগমনের স্বপ্নে দুজনেই বিভোর হয়ে ওঠে।

শেষযাত্রা

তিনি একমনে ছবি আঁকছিলেন। ক্যানভাস জুড়ে শুধু নীল আর নীল। আকাশ আর সমুদ্র মিশে গেছে। তার মধ্যে দিয়ে একটা নৌকো চলছে। নৌকো না বলে কলার ভেলা বলাই ভালো। এই বিরাট সমুদ্রে তার কখন তলিয়ে যাবার কথা। তবু চলছে। তিনি নৌকোটার গায়ে বাদামি রঙের পোঁচ দিতে লাগলেন জোরে জোরে। না, না, নৗকোটাকে কিছুতেই ডুবতে দেওয়া যাবে না।

ক্যানভাসে যেমন, জানলার বাইরেও তেমন সমুদ্র, ঢেউয়ের পরে ঢেউ আছড়ে পড়ছে সৈকতে। দূরে দূরে নৌকো, জাহাজও দেখা যাচ্ছে। সমুদ্রের ধারে মেলার মতো ভিড়। বড়া পাও, পাপড়ি চাট, কুলফির পসরা। ঘোড়া নিয়ে দর কষাকষি। বেলুন কিনে দেবার জন্যে বাচ্চাদের মার হাত ধরে ঝুলোঝুলি। জানলা দিয়ে দৃশ্যটা দেখে তাঁর হাত ক্যানভাসের ওপর থমকে গেল। ছোটোবেলায়, খুব ছোটোবেলায়, মা তাঁর হাত ধরে জুহু বিচে নিয়ে আসত। কিন্তু সেটা বিকেলে বা সন্ধেবেলা নয়, খুব ভোররাতে। কার কাছ থেকে শুনেছিল নামিদামি ফিল্ম স্টার আর প্রডিউসাররা একটু নির্জনতার জন্যে নাকি এই সময়টা হাঁটতে আসে বিচে। মা আসত তাদের এক ঝলক দেখার জন্য নয়, ফিলমে একটা ব্রেক পাওয়ার জন্য। মা তখনও ভাবত, আগের মতোই সুন্দরী আছে, একটা, জাস্ট একটা ব্রেক পেলেই মাকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হবে না। তখন জুহুতেই তাদের বিরাট বাংলো, বিদেশি গাড়ি, সুববু বিদেশে পড়াশোনা করবে। মা তাকে সুববু বলে ডাকত। বাবা-ই সুববু ডাকতে শুরু করেছিল প্রথম থেকে, বাবার দেখাদেখি মা। শুভলক্ষ্মী থেকে সুববু। শুভলক্ষ্মী নামটা অবশ্য সিনেমায় চলেনি। মেহেরা সাবের কথাটা এখনও কানে বাজে ‘ম্যায় কেয়া মইথোলজিকাল ফিল্ম বানাউঙ্গা যাঁহা হিরোইন কা নাম শুভলক্ষ্মী হোগা। আরে মেরে ফিল্ম মে তো তুমকো বিকিনি ভি পেহননা হোগা। বিকিনি অউর শুভলক্ষ্মী –নেহি চলেগা। তুমহারা নাম রাখা হু কায়রা, ভেরি সেক্সি নেম, তুমহারি তরহা’

এইভাবে শুভলক্ষ্মী নামটা হারিয়ে গেলেও সুববু রয়ে গেল সারাজীবন। বাবার ওই একটাই জিনিস মা ফেলে দেয়নি কখনও। শুধু সুববু নামটা নয়, সুববুও তো বাবারই দান। বাবা বলে যে লোকটাকে জানেন তিনি, ফর্ম ভরার সময় কতবার লিখতে হয়েছে, শিবদাস আয়েঙ্গার। সেই শিবদাস একটা নয়, দু দুটো সন্তান দিয়েছিল ললিতাকে। জন্মের কয়েক মাসের মধ্যে চলে গিয়েছিল প্রথম সন্তান, সুববুর দাদা। তার নাম রাখা হয়েছিল শিবললিত, শিবদাসের শিব আর ললিতার ললিত মিশিয়ে তৈরি সে নাম। শিবললিতকে সুববু দেখেনি, সে আসার আগেই চলে গিয়েছিল সেই ছেলে, আর সুববু হবার বছর খানেকের মধ্যে বাবা চলে গেল। মারা যায়নি, অন্য একটা মেয়ের সঙ্গে ভেগে গেল। মা বলত মরে গেলেই ভালো হতো এর চেয়ে। বাবা কিন্তু মরেনি। সেই শীলা বলে মেয়েটাকে ছেড়ে একটা কোংকনী মেয়ের সঙ্গে থিতু হয়েছিল শেষমেশ। লুকিয়ে লুকিয়ে দেখা করতে আসত সুববুর সঙ্গে স্টুডিওয়। টাকা চাইত না, কিচ্ছু না। শুধু সুববু বলে ডেকে মাথায় হাত রাখত আর বলত নিজের টাকা পয়সার খেয়াল রাখতে, ললিতার ওপর সব ছেড়ে না দিতে।

সমুদ্রে আরও একটু নীল রং দিতে দিতে তাঁর আজ হঠাৎ মনে হল, বাবার বদলে মা যদি তাকে ছেড়ে চলে যেত, তাঁর জীবনটা একদম অন্যরকম হতো। পালিয়ে যাবার মতো আশিক তো কম ছিল না মা-র জীবনে। কিন্তু মা তাদের কাউকে চাইত কি আদৌ? ফিল্ম ছাড়া মার মাথায় কোনওদিন কিছু ছিল না। তাই অন্ধকার বিচে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকত একটা ব্রেকের আশায়। সুববুকে একা রেখে যেতে হবে বলে সঙ্গে নিত। আর তাই অতো ছোটোবেলাতেও সুববু বুঝে গেছিল, সাধারণ চোখে যা সুন্দর লাগে, ফিল্ম লাইনে তার কোনও দাম নেই। শরীরের ধকটাই আসল এখানে আর কচ্চি কলি হলে তো কোনও কথাই নেই।  সুন্দরী হলেও তখন মা-র শরীরে এসব কোনওটাই ছিল না। দু দুটো বাচ্চার জন্ম, অভাব, নিত্য অশান্তি মা-র সব গ্ল্যামার কখন যে শুষে নিয়েছিল, মা বুঝতে পারেনি। অথচ সুববু, তখন মাত্র তিন-চার বছরের মেয়ে হলেও বুঝতে পেরেছিল মা কোনওদিন সিনেমায় চান্স পাবে না, বুঝে গিয়েছিল মার মুখের দিকে ছুড়ে দেওয়া লোকজনের উপেক্ষিত দৃষ্টি দেখে। ওইসময় কাঁচা ঘুম ভাঙ্গিয়ে নিয়ে যেত বলে এমনিই তার ভালো লাগত না। আরও খারাপ লাগত তখন কোনও বেলুনওলা থাকত না বলে। সে মনে মনে চাইত মা তাকে বিকেলে বা সন্ধের সময় বেড়াতে নিয়ে যাক, আর পাঁচটা বাচ্চার মতো সে যখন বেলুনের জন্য বায়না করতে পারে। বেলুন পায়নি সত্যি, কিন্তু সিনেমায় রোল পেয়েছিল। মার কোলে থাকা তার গাল টিপে একজন প্রডিউসার বলেছিল তার পরের ফিল্মে এইরকম একটা বাচ্চার রোল আছে, ললিতা কি দেবে তার বাচ্চাকে?

তুলি থামিয়ে তিনি বাইরের দিকে তাকালেন। মুম্বাইতে আটটার আগে সন্ধে নামে না। আকাশে এখনও অনেক আলো, সমুদ্র কি তীব্র নীল, হাওয়ায় একগোছা বেলুন উড়ছে। সব, সব আগের মতো আছে। শুধু তাঁর জীবনটাই এমন ঘেঁটে গেল কেন?

ফোনটা বাজছে। ঠিক বাজছে না, কাঁপছে। ভাইব্রেশনে দেওয়া আছে।  আওয়াজটা শুনবেন না বলে ভাইব্রেশনে দিয়ে রেখেছেন। খুব মৃদু সরোদ বাজছে সাউন্ড সিস্টেমে। এ রাগটা তিনি চেনেন, মারুবেহাগ। ভালোবাসার রাগ। আগে চিনতেন না কোনটা মারুবেহাগ, কোনটা দেশ, কোনটা কেদার। অবিনাশ চিনিয়েছে। ভালোবাসার রাগ থেকে ভালবাসা –সব। ওই শিখিয়েছে কাজের সময় ক্লাসিকাল ইন্সট্রুমেন্টাল চালিয়ে রাখতে, এতে নার্ভ ঠান্ডা থাকে, কাজে মন বসে, স্ট্রেস কমে। স্ট্রেসের কারণগুলো জীবন থেকে ছেঁটে ফেলবেন বলেই তো এই স্টুডিও অ্যাপার্টমেন্টে এসে উঠেছেন, রং তুলি গান আর খুব দরকারি জিনিসগুলো নিয়ে। এখন অনেকটা পথ পেরিয়ে এসে বুঝতে পারছেন, জীবনে কোন কোন জিনিসগুলো সত্যি দরকারি। সারাজীবন তো মা চালিয়েছে, মা ঠিক করে দিয়েছে সব। নিজের সত্যি কী দরকার, কাকে দরকার, বুঝতেই পারেননি।

মা যখন আর পারল না, প্যারালিসিসে শরীরের ডান দিকটা, এমনকী কথা বলার ক্ষমতাও নষ্ট হয়ে গেল, ততদিনে তো ভিকি মালহোত্রা তাঁর জীবনে এসে গেছে। মার বদলে ভিকি ঠিক করত সব তাঁর জন্য। ছবি সাইন করা থেকে পার্টির পোশাক, ডায়েট চার্ট থেকে জিম রেজিম– সব। ওর ওপর নির্ভর করতে শুরু করেছিলেন তিনি কিন্তু তার থেকেও বড়ো কথা, ভিকির জীবনটাই তাঁকে ঘিরে আবর্তিত হতে শুরু করেছিল। সেটা এতটাই যে ও নিজের ১৪ বছরের বিবাহিত বউ, ফুটফুটে দুই ছেলেমেয়ে সবাইকে ছেড়ে তাঁর সাথে লিভ ইন করতে শুরু করল।

মা তখন উঠতে পারে না, কথা বলতে পারে না কিন্তু বুঝতে তো পারে সব কিছু। নিজের মেয়ে এভাবে হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে, সেটা সে একেবারেই মেনে নিতে পারছিল না। ওষুধ না খেয়ে, খাবার না খেয়ে, নানাভাবে জেদ অশান্তি করে সে প্রতিবাদ জারি রেখেছিল। বাধ্য হয়ে মাকে ছেড়ে অন্য একটা ফ্ল্যাটে, মার চোখের আড়ালে থাকতে শুরু করলেন ভিকির সঙ্গে। সমাজ, তারকাদেরও সমাজ থাকে একটা, সেখান থেকে চাপ আসছিল। সবাই ভাবছিল কায়রার মাথা খারাপ হয়ে গেছে, নইলে কেউ ভিকি মালহোত্রার মতো ফ্লপ প্রডিউসারের সঙ্গে জড়ায়। ভিকি তো স্রেফ চেনে টাকা, আগের বউটাও তো রাইজিং স্টার ছিল, সনিয়া কপূর। ওর টাকা, শরীর, কেরিয়ার, সব ছিবড়ে করে এখন ভিকি কায়রার দিকে ঝুঁকেছে। এটাই ওর আসল ব্যাবসা, সুন্দরী নায়িকাদের সিঁড়ির মতো ব্যবহার করা। এমনিতে তো একটা সিনেমাও চলে না।

এসব বিষে মুম্বাইয়ের বাতাস ভারি হচ্ছিল যখন, ঠিক তখনই তিনি ভিকিকে বিয়ে করলেন। আর বিয়ের দিন রাতে, মা চলে গেল। সেটাও নিঃশব্দে নয়, মেয়ের উপেক্ষার প্রতিশোধ মা নিল সুইসাইড করে। একজন প্যরালিসিস মহিলা কীভাবে এত স্লিপিং পিল জোগাড় করতে পারে– সেটা নিয়ে গুজগুজ ফুসফুস চলতে চলতে পুলিশ পর্যন্ত পৗঁছোল। বলা হল পথের কাঁটা সরিয়ে দেওয়ার জন্য মাকে ঠান্ডা মাথায় খুন করেছে কায়রা আর ভিকি। খুন করার হলে মাকে তো অনেক আগেই খুন করা উচিত ছিল তাঁর। করতে পারলে জীবনটা অনেক সুন্দর করে বাঁচা যেত। তাঁর জীবনের প্রথম, হয়তো একমাত্র প্রেমকে ওভাবে গলা টিপে মারতে হতো না। শাওন কুমার, আসল নাম শ্রাবণ মুখার্জি, বাংলার ছেলে, তীব্র ভাবে চেয়েছিল তাঁকে। পুণের এক মন্দিরে গোপনে বিয়েও হয়ে গিয়েছিল তাঁদের মালা বদল করে, মা ঠিক জেনে গেল। গুন্ডা বাহিনী নিয়ে হাজির হল মন্দিরে, শাওনকে খুনই করত, কায়রা মা-র হাতে পায়ে ধরে, বিয়ে ভাঙার প্রমিস করে শাওনকে বাঁচান। শাওন সেই নবলব্ধ জীবন নিয়ে আর তাঁর দিকে ফিরেও তাকায়নি, তিনি নানাভাবে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছেন। শাওন ফোন ধরেনি, দেখা হলে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে।

এক, সব পুরুষ এক। মেয়েদের মন ওরা বোঝে না। ওরা জানে শুধু মেয়ে-শরীর আর নিজেদের ইগো। মার মৃত্যু নিয়ে অনেক জল ঘোলা হয়েছিল। নীচ থেকে ওপর সবার মুখ বন্ধ করতে অনেক টাকা খসল, অনেক টেনশন ছুটোছুটি। বিয়ের প্রথম বছরটা এইভাবেই কেটে গেল। যেই ভাবতে শুরু করলেন এবার একটু থিতু হয়েছেন, ভিকির ভালোবাসায় বাকি জীবনটা শান্তিতে কেটে যাবে, তখনই ভিকি স্বমূর্তি ধরল। মদ, উঠতি নায়িকাদের কাজের টোপ দিয়ে ফস্টিনস্টি, সবই তাঁর টাকায়। বাধা দিলে অকথ্য গালাগাল, এমনকী মারধোর।

কিন্তু এত ঝড়ঝাপটার কোনও প্রভাব কায়রার কাজে পড়েনি। মা তার চারপাশে কেমন একটা বায়ুনিরোধক বর্ম তৈরি করে গেছিল, সেটা খুব কাজে লেগেছে সারাজীবন। এই যে এখন কোলাবার বাড়ি থেকে বেরিয়ে একা রয়েছেন, এখান থেকেই শুটিং-এ যাচ্ছেন। এখন তো বেছে বেছে ছবি করা। খুব পাওয়ারফুল চরিত্র পেলে তবেই করেন। সেসব নিজেই সামলে নিচ্ছেন। কিন্তু ভিকির সঙ্গে আর নয়।  এনাফ ইজ এনাফ। শুধু মেয়েটার জন্যে বুকের মধ্যে চিন চিনে ব্যথা। এই মেয়েকে আঁকড়েই তো ভিকির সঙ্গে কাটালেন এতগুলো বছর। কিন্তু আর নয়।

ফোনটা আবার কাঁপছে, চিংকি, তাঁর মেয়ে ফোন করছে। ওর ভালো নাম তিনিও রেখেছেন শুভলক্ষ্মী, তাঁর সেই হারিয়ে যাওয়া নামটা। নামটা যেন তাঁর উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া কোনও দামি গহনার মতো, যা কেবল একজনের হাত থেকে আরেকজনের হাতে চলে যাবে, কিন্তু ব্যবহার হবে না। কারণ তিনি  জানেন এই নামটাও বদলে যাবে, চিংকিও সিনেমায় নামছে যে। ওর বাবারই বিশেষ আগ্রহ। এতদিন কায়রার পয়সায় খেয়েছে, এবার কায়রার মেয়ের পয়সায় খাবে।

চিংকিকে অনেক বুঝিয়েছেন তিনি, বলেছেন তাঁর সঙ্গে বেরিয়ে আসতে। মেয়ে আসেনি। এখন কেন ফোন করছে? মাকে কীসের দরকার?

অবিনাশ বলেছিল আসবে দেখা করতে। তিনি বারণ করেছেন। অবিনাশকে দেখলে তিনি নিজেকে ধরে রাখতে পারবেন না। আর এই বয়সে সে ধাক্বা সামলাতে পারবেন? কিন্তু এখন মনে হচ্ছে অবিনাশকে ডেকে পাঠাবেন। ফোনটা তাঁকে খুব অস্থির করে দিয়েছে। অবিনাশকে সব বলা দরকার।

চিংকির ডেবিউ এ বছর শেষের দিকে, ওর অপোজিটে আছে শাওনকুমারের ছেলে অঙ্কিত। তাঁর আদৗ ইচ্ছে ছিল না চিংকি সিনেমায় নামুক। তিনি চেয়েছিলেন ও আগে পড়াশোনাটা শেষ করুক। সেই ৪ বছর বয়স থেকে তিনি লাইট ক্যামেরা অ্যাকশন শুনে আসছেন, এই ইন্ডাস্ট্রির হাড়ে হদ্দ জানেন। তাঁর কাছে খিদে একটা মোটিভেশন ছিল, কাজ না পেলে না খেয়ে মরতে হবে। চিংকির সামনে তো তা নেই, ওর মতো নরম আদুরে মেয়ে এই লাইনের ওঠাপড়া নিতে পারবে না। এই নিয়েই ভিকির সঙ্গে খিটিমিটি শুরু তাঁর। তাও হয়তো মেনে নিতেন, যদি না অঙ্কিতের অপোজিটে কাস্ট করা হতো চিংকিকে। নিউ কামার পেয়ারদের নিয়ে ইন্ডাস্ট্রি নানা গসিপ বাজারে ছাড়ে ছবি হিট করাবার জন্যে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সেটা সত্যি হয়ে যায়। রোমান্টিক সিন করতে করতে সত্যিকারের রোমান্সে জড়িয়ে পড়ে নতুন হিরো হিরোইন। হায় ভগবান! সেরকম যদি হয়! ওরা যে ভাইবোন!

মন্দিরে বিয়ের আগেই শাওনের সন্তান এসেছিল তাঁর গর্ভে। মা যখন সব শেষ করে দিল, তখন জেদ করে শাওনের সন্তানকে অ্যাবর্ট করেননি কায়রা, আর সেই খবরটা শাওনের  নিঃসন্তান স্ত্রী রিতার কানে পৌঁছোয়। এক দুপুরে রিতা এসে তাঁর কাছে প্রায় ভিক্ষে চায় অনাগত সন্তানকে। তাঁকে বোঝায় একে বড়ো করে তুলতে গেলে সমাজ তাঁর বিরুদ্ধে থাকবে চিরকাল, তার থেকে শাওন আর রিতার বৈধ সন্তান হিসেবে বড়ো হোক সে। তিনি রাজি হয়ে যান, এর থেকে ভালো লালন তিনি কি দিতে পারতেন? সমস্ত পৃথিবী জানে অঙ্কিত শাওন আর রিতার ছেলে। শুধু তাঁরা তিনজন ছাড়া। আর মা জানত। ভিকিও না। জানলে হয়তো ওকে বোঝানো যেত।

চিংকি ফোন করে বলল ‘মা, আজ পার্টিতে কী পরে যাব?’ সেই আদুরে গলা। এমনভাবে বলছে যেন কিছুই ঘটেনি, তিনি চলে আসেননি বাড়ি ছেড়ে। শুনে গলে যাচ্ছিলেন, হঠাৎ মন কু গাইল ‘কীসের পার্টি রে সপ্তার মাঝে?’

‘অঙ্কিত থ্রো করছে মা, প্রাইভেট পার্টি’

‘না’

‘কি না?’

‘ওখানে যেও না সোনা, আগে ছবি রিলিজ করুক, প্লিজ মার কথা শোনো, প্লিজ চিংকি’

‘কিন্তু মা’

‘কোনও কিন্তু না মা’।

‘আচ্ছা মা তুমি বারণ করলে যাব না কিন্তু একটা ফোন বারবার আসছে দুবাই থেকে, একটা ওয়েডিং রিসেপশনে এক নাইট অ্যাপিয়ারেন্স। হিউজ পে করবে’। থরথর করে কেঁপে উঠল শরীর। দুবাই, ওয়েডিং রিসেপশন, এক নাইট অ্যাপিয়ারেন্স– এই শব্দগুলো ভীষণ চেনা। সারাজীবন কতভাবে মোকাবিলা করতে হয়েছে এগুলোকে। ভীষণ মা-র অভাব বোধ করলেন এই মুহূর্তে। মা বাঘিনীর মতো আগলে রাখত তাঁকে। আর তিনি এই সময় কেন যে চলে এলেন মেয়েটার পাশ থেকে? আসলে ভিকিকে আর সহ্য করা যাচ্ছিল না। ও মেয়েটাকে শেষ করে দেবে। কে জানে ওই হয়তো ডিল করছে। পিম্প!

তিনি শক্ত গলায় বললেন ‘সোনা, যা বলছি মাথা ঠান্ডা করে শোনো। এখন কোনও পার্টিতে যেও না, যেই ডাকুক। আর ওই নম্বরটা দাও। লিখে নিচ্ছি’ নম্বরটা লিখে অবিনাশকে ফোন করলেন কায়রা।

সাদা ফুলে ঢাকা গাড়িটা জনসমুদ্রের মধ্যে দিয়ে এগিয়ে চলেছে। পেছনের গাড়িতে কালো চশমায় চোখ ঢাকা চিংকি ভাবছিল মাকে এত লোক ভালোবাসত? মা তো সে হওয়ার পর দীর্ঘদিন কোনও ছবি সাইন করেনি, কিন্তু বারো বছর পরে যখন করল, সে ছবি সুপার ডুপার হিট। কী একটা যেন ছিল মার মধ্যে। যেমন অভিনয়, তেমনি সৌন্দর্য। সেই মা মাত্র পঞ্চান্ন বছরে চলে গেল! মেনে নিতে পারেনি ফ্যানেরা। একজন নাকি সুইসাইড করেছে। আচ্ছা, মা কি কিছু দেখতে পাচ্ছে? তাকে ঘিরে এই উন্মাদনা? এত লোকের ভালোবাসা? যাকে এত লোক ভালোবাসত, সে ভালোবাসত তাকে, শুধু তাকে?

কেমন অবিশ্বাস্য লাগে, অথচ কথাটা সত্যি। তাকে বাঁচাতেই তো চলে গেল মা। ওই অদৃশ্য হাতের বিরুদ্ধে আঙুল যেই তুলবে, তাকেই সরিয়ে দেওয়া হবে। অবিনাশ আংকল বলেছে সব তাকে। বাথটবে পড়ে থাকা নিস্পন্দ শরীর কাটাছেঁড়া করে কী পাওয়া গেছে, সেই তথ্য আর কখনও সামনে আসতে দেওয়া হবে না, চিংকি জানে। আর শুধু দুবাই কানেকশন নয়, তার বাবা লোকটা, মানে ভিকি মালহোত্রা এর মধ্যে আছে। নইলে এত তাড়াতাড়ি ওরা মা-কে মেরে ফেলতে পারত না। অবিনাশ আংকল তাকে বলেছে ‘তোমার মার শেষ ইচ্ছে শুধু সাদা ফুল নয়। তুমি জানো কায়রা চায়নি তুমি সিনেমায় নামো। কিন্তু সে জানত একবার ঢুকলে এখান থেকে বেরনো অসম্ভব, অনেকটা বাঘের পিঠে চড়ার মতো। তাই সে বারবার বলেছে চিংকি যেন নিজের জীবনের সিদ্ধান্ত নিজে নেয়, কারও হাতের পুতুল হয়ে না থাকে।’

চিংকি চোখের জল মুছে মোবাইলে একটা ফোন করে। যাকে ফোন করছে, সে ঠিক তার পেছনের গাড়িতে সাদা পাঞ্জাবি পাজামায় আপাদমস্তক শোকের প্রতিমূর্তি হয়ে বসে আছে। সমস্ত মিডিয়ায় বিবৃতি দিয়ে চলেছে সে কতটা শোকার্ত কায়রাকে হারিয়ে। চিংকি ওর শোকের বুদবুদ এক লহমায় ফুটো করে দেয় একটা কথা বলে।

‘আপ মম কি ফিউনারেল মে না জায়ে তো আপকো  লিয়ে আচ্ছা হোগা। সবাই জেনে গেছে মম কীভাবে মারা গেছে। পাবলিক খুব ফিউরিয়াস হয়ে আছে। তোমাকে  ওরা ছাড়বে না।’

সেদিন চ্যানেলে চ্যানেলে চর্চার বিষয় ছিল কায়রার শেষযাত্রায় ভিকির অনুপস্থিতি। মুখাগ্নির সময় চিংকির সঙ্গে অঙ্কিতও কেন এগিয়ে এসেছিল, সেটা নিয়েও জল্পনা কল্পনা চলছে। এটাও কি নতুন ছবির প্রমোশানের মধ্যে পড়ে? খানিকটা দূরে বসে থাকা অবিনাশের মনে হচ্ছিল, কায়রাকে কি এতদিনে একটু শান্তি দিতে পারল? আর ওই জনসমুদ্র, কলরব থেকে অনেক অনেক দূরে সমুদ্রের ধারে এক বৃদ্ধ, একা একা, একটার পর একটা রঙিন বেলুন আকাশে উড়িয়ে চলেছিলেন, আর বিড়বিড় করে কীসব বলছিলেন। কেউ যদি কান পাতত, তবে শুনতে পেত ‘সুববু, শুভলক্ষ্মী, মা আমার, তুই ছোটোবেলায় যে বেলুনগুলো ওড়াতে চেয়েছিলি– নীল লাল, হলুদ, ববি প্রিন্ট– সমস্ত বেলুন তোর সঙ্গে দিয়ে দিলাম। এদের সঙ্গে তুই  মনের আনন্দে  উড়ে যা।’

আপসনামা

কুড়ি পাতা দীর্ঘ আট পরিচ্ছদের গল্পটার ফোটোকপির বদলে হাতে লেখা মূল পাণ্ডুলিপি চেয়ে নেওয়ায় মনটা একটু খুঁত খুঁত করছিল। তবে আনন্দও হচ্ছিল। লিটিল ম্যাগাজিন হলেও, এই প্রথম কেউ বাড়ি বয়ে এসে লেখা চেয়ে নিয়ে যাচ্ছে, তাও শারদ সংখ্যার জন্য। তখন কি ঘুণাক্ষরে আঁচ পেয়েছিল, এই অমল চক্রবর্তীই পুজোর পর শ্রীতমা ফোন করলে কিছুতেই নেটওয়ার্ক পাবে না এবং বিরাটাকার গল্পটা ‘পরিব্রাজক’-এর দফতরে না পৌঁছে নিরুদ্দেশ হয়ে যাবে। হতচ্ছাড়া নির্ঘাত অন্যত্র নিজের নামে ছাপিয়েছে।

আর একটা সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। বন্ধুপ্রেম। অমলের পরম বান্ধব মৃত্যুঞ্জয় ঘোষের সাথে শ্রীতমার একটা মনোমালিন্য হয়েছিল। এমন তস্করবৃত্তির প্রেরণা নিজের যশলোভ, না বন্ধুর প্রতিশোধস্পৃহা কে জানে। বন্ধুটি তো কবি, গল্পকার, ঔপন্যাসিক, সম্পাদক, সঞ্চালক, সংগঠক ইত্যাদি ইত্যাদি অনেক কিছু। সাড়ে ষাট হাজার শব্দের একটা স্বাস্থ্যকর সুপুষ্ট গল্প তার কাজে লাগবে বেশি। অবশ্য সবটাই অনুমান। হতেই পারে শ্রীতমাকে খানিকটা হয়রান করে মজা পাওয়াটাই একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল। তারপর থেকে কাউকে লেখা দিলে ভীষণ দুশ্চিন্তায় থাকতে হয়। কিন্তু লেখা চাইলে দেবে না এত হুপো দেখানোর জায়গায় পৗঁছোয়নি শ্রীতমা। তাছাড়া বড়ো পত্রিকায় লেখাগুলো পড়া হয় কিনা, তাই নিয়েও সংশয় থাকে। তাই বিশ্বাস করতেই হয় কাউকে না কাউকে। যেমন এখন করছে গৌরব পাত্র নামে এক মাঝবয়সি লেখককে এবং দেবপ্রিয় দামকে।

দেবপ্রিয় দামের প্রযোজনা সংস্থায় শ্রীতমা যোগাযোগ করেছিল কন্যা ও নিজের মডেলিং-এর জন্য। সে সব কিছু না হলেও শ্রীতমার একটি কবিতার বই কিনেছিল দেবপ্রিয়। সেখান থেকেই বইটা পড়ে অমল চক্রবর্তী, শ্রীতমার কবিতার প্রতি আগ্রহ দেখায়। সেই সূত্রেই অমলের পত্রিকা ‘পরিব্রাজক’এর সঙ্গে সম্পর্ক শুরু ছড়া ও কবিতা দিয়ে। অমলের বন্ধু হিসাবেই আলাপ মৃত্যুঞ্জয়ের সাথে। আলাপ থেকে প্রলাপ। প্রলাপের পর বিলাপ। এক সময় – শ্রীতমার তখন একুশ, কারও সাথে অ্যাফেয়ার আছে শুধু এই গুজবটুকুর জন্য ওর জীবনের শ্রেষ্ঠ অনুভূতিটা পূর্ণতা পায়নি। সঙ্কল্প সরে গিয়েছিল নীরবে। আজ চল্লিশ ছুঁই ছুঁই বয়সে সে বিবাহিতা এবং এক সন্তানের জননী – এগুলোও অধুনার প্রেমপ্রার্থীদের নিরস্ত করার পক্ষে যথেষ্ট নয়। এক নাছোড়বান্দা ছোকরাকে তো রুঢ়ভাবেই কাটাতে হয়েছে, কারণ ভালো ব্যবহার প্রশয় দেওয়ার সমার্থক হয়ে যাচ্ছিল। সমাজ এতটাই বদলেছে যে নিজেকে সেকেলে লাগে। অবশ্য তলিয়ে দেখলে আধুনিকতার বুলি আসলে আদিম রিপুর ছদ্মবেশ।

মৃত্যুঞ্জয় ঘোষ ওর চেয়ে বছর দুই তিন বড়োই, এখনকার প্রজন্মের মধ্যে পড়ে না। তবে আঁতেল সমাজে নাম লেখানো ব্যাটাছেলেদের ছোঁকছোঁকানির লাইসেন্স থাকে। প্রথম আলাপ অমল চক্রবর্তীর সাথে শ্রীতমার ফ্ল্যাটে ‘পরিব্রাজক’ সঙ্গে এনে। এক কাপ চা-ও স্পর্শ করেনি। দুর্দান্ত গরমে শরবত দিতে চাইলে বাধা দিয়ে বলেছিল, ‘ওসব মেয়েলি ড্রিংক’। পরে শ্রীতমাও বার কয়েক রহড়ায় ওর বাড়ির আড্ডায় গিয়েছিল। ক্রমশ ফোনে কথা হলে শ্রীতমাকে মদ্যপান ও চুম্বনের ওপর থিসিস শোনানো শুরু করে।

ধরা যাক মৃত্যুঞ্জয় শ্রীতমাদের বাড়ির কাছাকাছি এসেছে শুনে শ্রীতমা ভদ্রতার খাতিরে বলল, ‘তাহলে দেখা করে যান।’ প্রশ্ন এসেছে, ‘গেলে কী খাওয়াবেন?’

‘আগে খবর দিয়ে এলে আয়োজন রাখতাম। এখন না হয় চা পান করবেন টা সহযোগে। শরবত মেয়েলি পানীয় হতে পারে, কিন্তু চা তো দেখেছি আপনি ঘন ঘন খান।’

‘ধুর মশাই, আপনার কাছে গেলে চা খাব কেন? অন্য জিনিস চাই।’

বিব্রত করেই আনন্দ। সত্যি সত্যি এসে হানা দেয়নি কোনও দিন শ্রীতমাকে বাড়িতে একা পেতে।

শ্রীতমার কবিতার বই হাতে পেয়ে ক্যাটকেটে তির্যক মন্তব্য করলেও একটা দায়সারা প্রশংসাসূচক সমালোচনা লিখে দিয়েছিল। সেটা কোথাও ছাপেনি, শংসাপত্রের মতো নিজেরই সংগ্রহে রাখতে হয়েছে। শ্রীতমার একখানা কবিতাও চেয়ে নিয়ে মৃত্যুঞ্জয় একটি ক্ষুদ্র পত্রিকায় পাঠিয়েছিল। সেটা চটপট ছেপে বেরোনোর পর ফোন করে বলে, ‘আপনার বইয়ের রিভিউ লেখা হল, কবিতা ছাপা হল, আমার তো কিছু প্রাপ্য হয়।’

চড়াক করে মাথায় রক্ত উঠলেও ইঙ্গিতটা উপেক্ষা করতে হল, উদ্ভব অফিস থেকে ফিরেছে।

‘আপনার লেখা তো আমার পাঠানোর অপেক্ষা রাখে না। তবে আপনার বইয়ের রিভিউ আমাকে দিয়ে করাতে চাইলে করতে পারি।’

‘আপনার ভাষায় বলি, আমি হালুম করলাম। পাওনাটাও সেই মতো হয়।’

আর ন্যাকা সেজে থাকা সম্ভব নয়। পরের দিন দুপুরে একটা বার্তা পাঠায় মুঠোফোন থেকে, ‘আপনার সহযোগিতার দাম দিতে না পারায় আমি দুঃখিত।’

সঙ্গে সঙ্গে ফিরতি কল। ঝাড়া পঁয়ত্রিশ মিনিট ধরে বক্তৃতা উপদেশের বন্যা। মৃত্যুঞ্জয় ঘোষ যা করে, মনে ধান্দা নিয়ে নয়। সে যে রসিকতা করেছে সেগুলো আদি রসাত্মক হতে পারে কিন্তু তাতে নাকি যৗনতা নেই। কথাটার মাথা-মুণ্ড বোঝা গেল না। কিন্তু প্রশ্নও করল না শ্রীতমা। লোকটা দর্পিত ভাবে নিজের চরিত্রের সাফাই দিয়ে গেল– ‘সঙ্গ পেলাম না বলে অন্যদের মতো আপনার লেখা প্রকাশে ব্যাগড়াও দেব না। আপনার বাড়ি থেকে আমার বাড়ি কতই বা দূর? সেরকম মতলব থাকলে তো বাড়িতেই যেতে পারতাম। আপনাকে একা পাওয়া কি অসুবিধার ছিল?’… ইত্যাদি। শেষে যোগ করল, ‘কিন্তু ভেবে দেখুন আপনি যদি এটুকুও না নিতে পারেন, তা হলে লোকে আপনার জন্য করবে কেন?’

অতর্কিত আক্রমণের মুখে পড়ে সেদিন আমতা আমতা করে গিয়েছে শ্রীতমা। ঘণিষ্ঠতার স্পষ্ট ইঙ্গিত দিয়েও এমন কথা ঘোরাল যেন শ্রীতমার চিন্তাটাই অপরিচ্ছন্ন। জবাব খুঁজে না পাওয়ার পেছনে কি এই ভয়টাও কাজ করেছিল, প্রভাব খাটিয়ে যদি শ্রীতমার সদ্য তৈরি হওয়া লেখার জায়গাগুলো নষ্ট করে দেয়? ফোন রাখার পর জুতসই জবাবটা মনে মনে সাজানো গেল, ‘আপনার অশালীন রসিকতা বরদাস্ত করে আমায় এগোতে হবে না, নিজের কলমের জোরেই যত দূর পারি যাব।’ আগেও বলবে ভেবেছিল,বলেনি। এবারেও শুনেই গেল। একতরফা।

এর কদিন পরেই তার বন্ধুটি পুজো সংখ্যার জন্য কবিতা নয়, ঐ বড়োসড়ো গল্পটা যাকে নভেলেটও বলা যায়, নিয়ে গিয়েছিল। পুজোর আগে পর্যন্ত ফোন করলে বলেছে, ‘আপনার কপি আপনার বাড়ি গিয়ে দিয়ে আসব।’ কিন্তু পরে যখন অন্য সূত্রে শ্রীতমা পত্রিকাটির শারদ-সংখ্যা প্রকাশের খবর পেল, তখন অমল চক্রবর্তী ফোনের টাওয়ার পাওয়া ছেড়ে দিল।’ ‘হ্যালো, হ্যালো। শুনতে পাচ্ছি না’ পরিব্রাজকের প্রধান সম্পাদককে ফোন করে প্রশ্ন করায় সে তো আকাশ থেকে পড়ল। এমন কোনও লেখা তাদের দফতরে জমাই পড়েনি। বিশুদ্ধ হাপিশ! অন্য কোথাও অন্য কোনও শিরোনামে, স্থান-কাল-পাত্র বদলে, লেখকের নাম বদলে প্রকাশিত হয়েছে কিনা তদন্ত করে দেখা হয়নি। এর পেছনে তার চুম্বন রসিক বন্ধুর কোনও ইন্ধন ছিল কিনা সেটাও প্রমাণিত নয়।

তবে ব্যাপারটা শ্রীতমা, দেবপ্রিয়কে জানায়। মনে হয় দেবপ্রিয় একটু অস্বস্তিতে পড়েছিল। শ্রীতমাকে মডেল বা অভিনেত্রী হিসাবে না হলেও লেখিকা হিসাবে পথ খুলে দেওয়ার ব্যক্তিগত রাস্তাগুলো দেখছিল। অন্তত ব্যাপারটা শ্রীতমার কাছে এমনই। সেই সাথে শ্রীতমার প্রতি মানুষটার একটা আলগা ভালোলাগা যে কাজ করছে, সেটা টের পেলেও তেমন আপত্তিকর বলে মনে হয়নি। শ্রীতমাকে অপমান করেনি, ছুতোনাতায় গায়ে হাত দেবার চেষ্টা করেনি, রুঢ় ব্যবহারও করেনি। বস্তুত দেবপ্রিয় ফোন করলে শ্রীতমা খুশিই হয়। গলাটা বেশ আশ্বাস জাগানো।

‘হ্যালো। শ্রীতমা বলছি।’

‘আরে গুড মর্নিং। কী খবর বলুন?’

‘খবর নিতেই তো ফোন করা। ওই লেখাগুলোর কোনও গতি হয়েছে?’

‘সুখবরটা আমিই জানাতাম। তার আগেই আপনার ফোন এল। ‘পিঁপড়ের রানি’ গল্পটা বাল্যবন্ধুতে পাঠিয়েছিলাম। সুরেন্দ্র নস্কর নামে আমার এক বন্ধুরও লেখা পাঠিয়েছিলাম। ওরা সুরেন্দ্রর কবিতাটা নিয়ে খুঁতখুঁত করছে, কিন্তু আপনার গল্পটা পড়েই পছন্দ করেছে। তা দেখা কবে হচ্ছে?’

‘যবে অ্যাপয়েন্টমেন্ট পাব।’

‘আরে, সুন্দরী নায়িকার অ্যাপয়েন্টমেন্ট পাওয়াটাই তো সৌভাগ্যের। কাল, না কাল একটা কাজ আছে, পরশু আসুন। আছেন কেমন বলুন। কেমন ঘুরলেন?’

‘আমার যে শনি-রবি ছাড়া বেরোনোর উপায় নেই। তাও চূর্ণীর বাবা অফিস গেলে হয়ে গেল। জানেন তো মা বাবাকে নিয়ে বেড়াতে গিয়েছিলাম। মায়ের অ্যাক্সিডেন্টে হিপজয়েন্ট ভেঙে যায়। নড়াচড়া অসম্ভব। ট্রাভেল এজেন্টকে যা দেওয়া হয়েছে, তা তো ফেরত হলই না, কাশ্মীরের কোথাও কিছু না দেখে কাটরায় বাড়তি হোটেল ভাড়া গুণে ফেরার দিন পর্যন্ত বসে রইলাম। কী ভাবে যে একটা গাড়ি নিয়ে জম্মু এসে ফেরার ট্রেনে উঠেছি, তা ভাবলে এখনও অবাক লাগে…!’

‘কেন, বিকেলে কী অসুবিধা?’ লোকটা মায়ের অত বড়ো দুর্ঘটনার কথা শুনেও গ্রাহ্য করল না। শ্রীতমার কথা শেষ করতে না দিয়ে এত বিপর্যয়ের মধ্যেও বলছে দেখা করতে!

‘দুপুর সোয়া দুটো থেকে আড়াইটের মধ্যে চূর্ণী স্কুল থেকে ফেরে। ওকে নাইয়ে খাইয়ে সব সারতে বিকেল সোয়া তিনটে ছাড়িয়ে যায়। মেয়েকে কার জিম্মা করে যাব? যাঁর দায়িত্বে রেখে বেরোতাম, তিনি তো নিজে পাশও ফিরতে পারছেন না। যতক্ষণ আয়া আছে, আছে। তারপর বাকি সময়টা আয়া তো আমিই। খড়দা থেকে বেহালা শখের বাজার– একটুখানি রাস্তা তো নয়। চূর্ণীকে সঙ্গে নিয়ে বেরোতে পারি, কিন্তু ও টায়ার্ড থাকে। ওর কোনও কাজ হলে না হয় কষ্ট দেওয়া যেত। তিন চারটে ট্রান্সপোর্ট চেঞ্জ করে বেহালা যেতেই হয়তো ছ’টা বেজে যাবে। ফিরতে–’

‘আরে, বাচ্চা আনলে আপনার সাথে অভিসারটা হয় কী করে? আজ পর্যন্ত ঠিকমতো প্রেমালাপটাই তো হল না। চলে আসুন সময় করে।’

শ্রীতমা এবার হোঁচট খেল। ভদ্রলোক তাকে অনেকবার সুন্দরী বলেছে। চূর্ণী অর্থাৎ কাজু সম্পর্কেও প্রথম বার উচ্ছ্বাস দেখিয়েছিল। ইন্টারনেটে বিজ্ঞাপন দেখে যেহেতু কন্যার মডেলিং-এর উদ্দেশ্যেই যোগাযোগ, তাই রূপের প্রশংসাটা শংসাপত্র হিসাবেই নিয়েছে বরাবর। শ্রীতমাকে সংস্কার ত্যাগ করে তথাকথিত সাহসী হবার প্রস্তাব দিলেও ব্যবহারের মধ্যে এমন এক মার্জিত ভাব থাকে, যে অসভ্যতা মনে হয় না। আসলে মনে হলে চলবেও না। আলগোছে এড়িয়ে না চটিয়ে যদি সখ্যতা বজায় রাখা যায়। রূপের জন্য দরাজ সার্টিফিকেট দিলেও এবং একাধিক বিজ্ঞাপনের জন্য অফিসে ডেকে বিস্তর আলাপ আলোচনা করলেও আজ পর্যন্ত মা মেয়ে কাউকেই কাজ করায়নি। কেবল শ্রীতমার প্রথম কাব্যগ্রন্থ সাগ্রহে কিনে নিয়েছিল প্রথম সাক্ষাতেই। সেই সূত্রেই পরিব্রাজক এবং জোচ্চুরি কাণ্ড।

চমক সামলে হেসে উঠল শ্রীতমা, ‘দূর মশাই, আমার প্রেমে পড়লে কি অমল চক্রবর্তীর মতো তস্করের সঙ্গে সম্পর্ক রাখতেন? ভয়েস ওভার করার মতো মেল ভয়েস কি নেই বাজারে?’

‘অমলের সঙ্গে অনেকদিন পর কাল যোগাযোগ হল। ওই ফোন করেছিল।’

‘আমার গল্পটার খোঁজ নিয়েছেন?’

‘না, না। সেসব কথা হয়নি। সে এখন বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে নানান ডক্যুমেন্ট্রিতে কমেন্ট্রি করে।’

‘বাঃ! চুরির পুরস্কার? ভালো। ওই যে ডোর বেল বাজছে। মেয়ে চলে এসেছে। দেখছেন, আপনার সাথে কথা বলতে বলতে নীচেই নামা হয়নি। বেচারা ভারী ব্যাগ নিয়ে একাই উঠে এসেছে। ঠিক আছে…’

দরজা খুলে মেয়েকে ঢুকিয়ে নিল শ্রীতমা। ‘রাখছি এখন। চূর্ণীর জন্য কোনও অ্যাসাইনমেন্ট থাকলে দেখুন না। মেয়েটাকে যে দেখে অটো-অটো করে। কিন্তু কোনও কাজই মেটিরিয়ালাইজ করছে না।’

‘ওকেও লাগবে আর একটা অ্যাডে। আগে আপনাকে কাস্ট করি। নেচার কিওরের অ্যাডে আপনাকে লাগতে পারে।’

‘আচ্ছা। ওকে খাওয়াতে হবে। পরে কথা হবে।’

‘আমি কল ব্যাক করব? ধরুন এক ঘণ্টা পরে?’

‘করুন। রাখছি। বাই।’

‘কার ফোন?’ মায়ের গলা। শোবার ঘর থেকে। এসি চালাতে হয়েছে বলে দরজা বন্ধ থাকার কথা। এখন দেখছে খোলা। বোধ হয় বাবা খুলে এসেছে।

সুন্দর মুখের জয় নাকি সর্বত্র। কিন্তু শ্রীতমার ক্ষেত্রে তো বিড়ম্বনা। ওর লেখা যারা পছন্দ করে অথবা যারা করে না, প্রায় সব পুরুষ কবি লেখকই, শ্রীতমা সৌন্দর্যের খাতিরে সুবিধা পাচ্ছে এমন ইঙ্গিত করতে ছাড়ে না। শ্রীতমার কবিতার বইয়ের প্রথম সংস্করণ প্রায় নিঃশেষিত, সবটাই যদিও নিজে ফেরি করে। সেটা নাকি ওর মুখ দেখে, কবিতার গুণে নয়। এমন মন্তব্য কবি নির্মল সমাদ্দারের মতো বরিষ্ঠ মানুষেরও, যাঁর স্নেহ-ছত্রচ্ছায়ায় একাধিক স্তাবক প্রতিপালিত। নির্মলকাকু যথেষ্ট সম্মানিত ও প্রতিষ্ঠিত। তাঁর গাত্রদাহ কীসের? ওঁর পারিষদবর্গ কুড়ি বছর ধরে লিটল ম্যাগাজিনে ঘষ্টেও বেশি দূর এগোতে পারেনি বলে, নাকি শ্রীতমা কবিতার পাশাপাশি গদ্য লিখিয়ে হিসাবেও স্বীকৃতি পেয়ে যাচ্ছে বলে? কোনও নামি বাণিজ্যিক পত্রিকায় গল্প বার হওয়ার কথা জানলেই অভিনন্দন জানাতে গিয়েও বেশির ভাগ কেমন হিংস্র হয়ে ওঠে। স্বয়ং কবিতার বইয়ের প্রকাশকের মন্তব্য, ‘তোমার বই বি ডাবল ও কে – বুক দেখে বিক্রি হয়নি, হয়েছে বয় হ্রস্ব-উ ক – দেখে।’ মাথাটার ভেতরটা দাউ দাউ করে জ্বলে উঠলেও না বোঝার ভান করতে হয়।

শ্রীতমার হাবেভাবে মাঝেমাঝে একটু অপরিণত মনস্কতা ফুটে ওঠে। নিজেও বুঝতে পারে। কাউকে তোয়াজ করে না, বরং একটু অসহিষ্ণু, কিন্তু লেখার জন্য ব্যকুলতা গোপন থাকে না। এটাই কি অপমানের আমন্ত্রক? এ যাবৎ দেবপ্রিয় দামকে তো হিতৈষী বলেই মনে হয়েছে। হঠাৎ কথাবার্তায় এমন লাগাম ছাড়া ভাবগতিক? এর সাথেও সম্পর্ক টিঁকলে হয়। দেবপ্রিয় চেয়েছিল বলেই কয়েকটা লেখার ফোটোকপি দিয়ে এসেছিল, সেখান থেকেই একখানা ‘বাল্যবন্ধু’-তে প্রকাশিতব্য। গল্পটা সন্ধ্যাতারাতেও মনোনীত, কিন্তু কত বছর পরে ছাপবে কেউ জানে না। ‘বাল্যবন্ধু’ টাকা না দিলেও চটপট বার করে দেবে। এই অবস্থায় দেবপ্রিয়কে অসন্তুষ্ট না করাই মঙ্গল।

সারা দিন নানা কাজের ব্যস্ততা, রাতে আয়ার বদলে নাইট ডিউটি। ব্যস্ততার মধ্যেও খচ্খচানিটা বিঁধে রইল। রাত বারোটায় ফোন।

‘বলুন।’

‘বড্ড অসময়ে ফোন করলাম না? কথা বলা যাবে?’

‘এতক্ষণে আপনার এক ঘণ্টা হল? অসময় তো বটেই, বলুন।’

‘নাথিং স্পেসিফিক। ওই নেচার কিওরের অ্যাডটার ব্যাপারে আপনাকে একবার আসতে হবে। পেমেন্ট বেশি নয়। হাজার টাকা। ডাবিংও করতে হবে। ডায়ালগ আছে। ওরাই শিখিয়ে দেবে। এমন কিছু নয়। আপনার আবার উইক-ডে-তে প্রবলেম। একটু দুপুর করেও যদি আসতে পারতেন। ঠিক আছে শনিবারেই আসুন।’

‘বেশ কয়েকবার তো দেখলেন। কোনওটাই শেষ পর্যন্ত মেটিরিয়ালাইজ করল না। আবার বেকার দৌড়াদৗড়ি না হয়। তাছাড়া শনিবার কলেজ স্ট্রিটে গিয়ে কয়েকজনকে লেখা দিতে হবে।’

‘কখন যাবেন?’

‘বিকেল পাঁচটা সাড়ে পাঁচটা নাগাদ পৌঁছোতে হবে।’

‘তার আগেই আমার সাথে দেখা করে যান না। কাজটা ফেলে রাখতে চাই না। আর আপনাকেও অনেক দিন দেখিনি।’

শ্রীতমা নিরুত্তর।

‘কিছু বলছেন না যে।’

‘শনিবার আসুক, দেখব।’

‘শনিবার তো কাজের কথা হবে। একটু অকাজের কথাও তো হওয়া দরকার। আমার তো আপনাকে দেখতে ভীষণ ইচ্ছা করে। একটা ইনোসেন্স আর সেক্স অ্যাপিলের দারুণ কম্বিনেশন। আর এখন কাশ্মীর থেকে ফিরে কাশ্মীর কি কলি হয়েছেন কিনা দেখতে আরও ইচ্ছা করছে।’

‘আপনার কি মনে নেই যে আমার মায়ের অ্যাক্সিডেন্টের জন্য কাশ্মীর ঘোরাই হয়নি? তাছাড়া শর্মিলার তখন বয়স ছিল ষোলো সতেরো। আমি এখন চল্লিশ। এই ভুঁড়িদার চেহারা আপনার ফ্যান্টাসির সাথে মিলবে না।’

শ্রীতমা ওপাশে কোমরতলি ভাঙা মায়ের দিকে তাকাল। এখনও ঘুমোয়নি। মেয়েটাও দিদা আর মায়ের মাঝখানে শুয়ে উশখুশ করছে। ওর গ্রীষ্মের ছুটিতে বেড়াতে গিয়েই বিপত্তি। জানলাহীন বসার ঘরে উদ্ভব মশা তাড়ানো তরল জ্বালিয়ে শুয়ে আছে। এমনিতে মশারি ছাড়া শুতেই চায় না। ফ্ল্যাটের একমাত্র বাতানুকুল ঘরখানা শাশুড়ির জন্য ছেড়ে দিয়ে নিজে কষ্ট করছে। মাকে গাড়িতে তোলা নামানো ছাড়াও বাথরুম ইত্যাদির ব্যাপারেও যেভাবে শ্রীতমাকে সাহায্য করেছে, নিজের ছেলেও পারে না। কলকাতায় ফিরে অবধি তার বিশ্রাম নেই। গাড়ি অ্যাম্বুল্যান্স দৌড়াদৌড়ি তো আছেই, জটিল অপারেশনের অনেকটা খরচই আপাতত উদ্ভব দিয়েছে। মা-বাবা চিকিৎসা বিমার টাকা না পেলে ফেরত নেবে না পণ করে আছে। সারা দিন অফিস ডাক্তার ওষুধ-পত্র করে ফিরে এসে মেয়েকে নিয়ে বসে। তারপর বালিশে মাথা ঠেকাতেই ঘরের বাতাস ওর নাকের গর্জনে মন্দ্রিত হতে থাকে। মেয়ে বাবাকে পাশে না পেয়ে ঘুমোবে না বলে একদিন এই গরমের মধ্যেই বসার ঘরের সরু ডিভানে পাশে শুয়ে উদ্ভবকে সারা রাত এক কাতে রেখেছিল। আর শ্রীতমা!  অসুস্থ মাকে আর মেয়েকে পাশে নিয়ে ঠান্ডা হাওয়া খেতে খেতে মাঝরাতে পরপুরুষের সঙ্গে হেজাচ্ছে? কীসের জন্য? ক্যামেরার সামনে আসার তাগিদটা তো মরেই গেছে, তবু সুযোগ এলে না করতে পারে না বলে? নাকি তার লেখা কবিতা গল্পগুলো যাতে মাঝপথে হারিয়ে না যায়, সেই দুর্ভাবনায়? ওর তো এক্ষুনি ফোন কেটে দেওয়া উচিত। মায়ের নাক বিরতি দিয়ে ডাকছে। কাজু চুপচাপ শুয়ে। উদ্ভবের নাকের শব্দ মাঝে মাঝে ফুঁসে উঠে স্তিমিত হয়ে যাচ্ছে। বসার ঘর থেকে আসা সেই আওয়াজ শ্রীতমাকে কিছুটা আশ্বস্তর সাথে অনেকটা অপরাধবোধে বিক্ষত করছে।

‘কোথায় ভুঁড়ি? ওটুকু না থাকলে তো আইটেম গার্লদের বাজার পড়ে যেত। ওই পেটের নাভিতে চুমু খাওয়াতেই তো মজা।’

‘হোয়াট? আর ইউ ড্রাংক?’ গলাটা চড়ে গিয়েছিল। দাঁতে দাঁত ঘষে গলা নামিয়ে আনল শ্রীতমা। ‘এরকম সর্বনেশে ইচ্ছা হলে তো আপনার সাথে দেখা করাই চলবে না। রাখছি।’

‘এতেই সর্বনাশ বললে কী করে হয়? একটু ইনহিবিশন ত্যাগ করে দেখুন, আপনারও ভালো লাগবে। আর আমি ড্রিংক করি না। যা বলছি পরিষ্কার মাথাতেই বলছি।’

‘পরে কথা হবে গুড নাইট।’

‘গুড নাইট। শনিবার আসার আগে ফোন করে নেবেন। দেখি বাল্যবন্ধু যদি ছাপায় তাহলে জানাব।’

বালিশের ফাঁকে চলভাষ ঢোকানোর পর মায়ের প্রশ্ন, ‘কার ফোন তপা?’

‘আমার কয়েকটা লেখা আছে এর কাছে। আসলে প্রযোজক। আবার হোটেলও আছে শঙ্করপুরে। এখনও পর্যন্ত তোমার নাতনিকে বা আমাকে কোনও কাজ দেয়নি। তবে কয়েকটা পত্রিকায় যোগাযোগ আছে। সেই সূত্রে আমার একটা ছোটোদের গল্প বাল্যবন্ধুতে পাঠিয়েছিল। শুনছি এ মাসেই বেরোবে।’

‘এত রাতে ফোন করে কী এত বকছিল?’

‘আমার মতো বেকার তো নয়। সারা দিন ব্যাবসার কাজে ব্যস্ত। শুটিং-ফুটিংও থাকে। কখনও কখনও সারা রাতই হয়তো জেগে থাকতে হয়।’

মনটা আবার খচ্খচ্ করছে। লোকটা বলল শনিবার যাওয়ার আগে ফোন করতে। তাছাড়া আগে বলেছিল ‘বাল্যবন্ধু’-তে গল্প বেরোচ্ছেই। এখন ‘যদি’ যোগ করল কেন? এভাবে ‘গুড নাইট’ বলে ফোন কেটে দেওয়া কি ঠিক হল? মৃত্যুঞ্জয়ের উপদেশ মনে পড়ল। সামান্য রসিকতাও যদি না নিতে পারে তাহলে লোকে আনস্পোর্টিং ভেবে সাহায্যের হাত গুটিয়ে নেবে। দেবপ্রিয়র মতো একজন হিতৈষীর রসিকতায় বিরূপ প্রতিক্রিয়া জানানোটা কি ঠিক হল? নির্ঘাত রসিকতাই। লোকটার বউ আছে, ছেলে আছে। আর অমন ডাকসাইটে প্রযোজক চাইলেই অনেক অল্পবয়সি সুন্দরী মেয়ে পেতে পারে। হয়তো শ্রীতমার জন্য সত্যিই একটু কোমল জায়গা আছে, অমলের জোচ্চুরির জন্য একটা সংকোচবোধও আছে। কলকাতায় ফিরে এসে শ্রীতমাই তো ফোন করে জানল যে দেবপ্রিয় তার লেখা পাঠিয়েছে যেটা ছাপতেও চলেছে। লোকটা তো পাওনা গণ্ডার হিসাব বুঝে নিয়ে কাজটা করেনি। আজ সকালে শ্রীতমা ফোন না করলে এখন এতসব কথা হতোই না। প্রার্থী যদি তেজ দেখায়, তাহলে ‘নিশ্চিত’ প্রকাশিত হচ্ছেগুলো ‘যদি তবে’র গেরোয় পড়ে যাবে। মাথার বালিশের পাশ থেকে মোবাইল তুলে খানিকক্ষণ ভেবে নিয়ে একটা ‘স্পোর্টিং’ বার্তা পাঠাল, ‘সর্বনেশে কথা শুনতে মন্দ লাগে না, যদি সেগুলো কথার জায়গাতেই থাকে।’

মিনিট কয়েকের মধ্যে ফিরতি দুটো বার্তা। টুংটাং টুংটাং। ‘এ ব্যথা কী যে ব্যথা বোঝে কি আনজনে, আমার আঙুলের আর ঠোঁটের আদর রইল ওই বুকে আর নাভিতে। যদি এসএমএস করার থাকে এক্খুনি করুন। সকালে ফোন সুইচ অন করার পর আর কারও চোখে পড়লে অসুবিধা আছে।’

কান-মাথা গরম হয়ে গেল। শ্রীতমার চলভাষ সারা রাত জাগ্রত থাকে। যা কোনওদিন করে না, তাই করল আজ– সুইচ অফ।

‘কাকে মেসেজ করলে মা?’ কাজু জেগে আছে!

সত্যিই কি শ্রীতমার এই লোকটার সাহায্য দরকার? সে ‘সন্ধ্যাতারা’য় যেসব গল্প ও ছড়া দিয়ে এসেছিল, সেগুলোর মধ্যে দুটো মনোনীত হবার চিঠি পেয়েছে জমা দেওয়ার এগারো মাস পরে। তার পরেও সাত মাস পেরোল। পত্রিকা অফিসে খোঁজ নিয়ে জেনেছে আরও অন্তত বছরখানেক অপেক্ষা করতে হবে। এই গল্পটাও মনোনীত জানল তখন, যখন সেটা অন্যত্র প্রকাশ পেতে চলেছে। এখন সন্ধ্যাতারার ভরসায় বাল্যবন্ধু থেকে গল্পটা তুলেও নেওয়া যাচ্ছে না। কিন্তু শুধু এইটুকুর জন্য মাত্রা ছাড়ানো, মুখোশ খোলা পুরুষটাকে টুইয়ে চলা? ছিঃ!

কিন্তু কিছু প্রাপ্তির জন্য একটু উদার হওয়ার অভিনয় কি খুব দোষের? গত দু বছরে এইভাবে শ্রীতমা অনেককেই শত্রু করেছে। তাদের ক্ষেত্রে সরে আসা ছাড়া উপায় ছিল না। তারা আগেই নিজেদের পাওনাটা আদায়ের তালে থাকত। দেবপ্রিয় কি একটু ব্যতিক্রম নয়? এই লোকটাকে যে ভালো মানুষ বলে শ্রীতমা বিশ্বাস করতে শুরু করেছে। একটা নির্ভরতাও তৈরি হচ্ছে। এই সময় সব কিছু একদিনের ফোনের বাচালতায় নষ্ট করে ফেলতে হবে? নিশ্চই দেবপ্রিয় দাম নিজের কাঁচা আবেগ দেখিয়ে ফেলার জন্য লজ্জিত হবে। হয়তো দেখা হলে ঘুণাক্ষরেও এসব প্রসঙ্গ উল্লেখ করবে না। ভিড়ের মধ্যে সুযোগ খোঁজা পুরুষ যেমন আছে, ভিড় ঠেলে এগিয়ে যেতে সাহায্য করার মতো ভদ্রলোক কি ও দেখেনি ট্রেনে বাসে? কিন্তু….?

মা বোধহয় এখনই বেডপ্যান চাইবে। নড়ছে। মেয়ে কচি হাতে গলায় বেড় দিয়ে গায়ে পা চাপিয়ে বলল, ‘মা, তুমি শুধু গল্প লিখে যাও। আমায় বলো না।’

সকাল বেলা আয়া আসার আগে যথারীতি মাকে বেডপ্যান দিতে হল। শ্রীতমা দু জোড়া একবার ব্যবহারযোগ্য গ্লাভস্ বারবার ব্যবহারের জন্য রেখে দিয়েছে। একটা ও নিজে পরে আর একটা যে আয়া আসে তাকে দেয়। আয়া থাকলে রান্নার মেয়ের খুব একটা দরকার পড়ে না। একটু হাতে হাতে সাহায্য করলে নিজেই চালিয়ে নিতে পারে। তবু পুরোনো রান্নার মহিলা এসে টুকি দেওয়ায় হাতছাড়া করবে না বলে তাকেও বহাল করেছে এই বিপুল খরচের মধ্যে। উদ্ভবই বলেছে।

সকালে বর বেরিয়ে যেতে কম্পিউটারে বসেছে শ্রীতমা লেখা নিয়ে। মাঝে কয়েকদিন খুব উঠে পড়ে লেগেছিল মেয়ের মডেলিং কেরিয়ার গড়বে বলে। নিজেরও ছবি পাঠিয়েছে কয়েক জায়গায়। কেউ ঘরোয়া ছবি চায়, তো কেউ পোর্টফোলিও। বিশেষ সুবিধা না হওয়ায় এখন সে উৎসাহে ভাঁটা পড়েছে। এখন ও লেখালিখি নিয়েই ভাবতে চায়। কিন্তু সেখানেও প্রতি পদক্ষেপে আপোস। মাঝারি পত্রিকাও ভাব করে যেন বিশাল কিছু। তারা কেউ লেখার শিরোনাম বদলে দেয় তো কেউ কবিতার পিণ্ডি চটকে প্রকাশ করে। কেউকেটা নয় বলে অপছন্দসই সম্পাদনাও মাথা পেতে নেয়। আর শ্রীতমার গল্পের প্রতি উচ্ছ্বাস দেখিয়েও গৗরবদার যা মেজাজ। খোঁজ নিলেই বলেন, তাড়া থাকলে লেখা তুলে নাও।

শ্যামের বাঁশি। দেবপ্রিয় ল্যান্ডলাইন থেকে ফোন করছে।

‘তাহলে শনিবার আসছেন তো।’

মুখ ফসকে বেরিয়ে গেল, ‘ফোনটা ড্রিম শেয়ার করছে না দেবপ্রিয় করছে?’

‘দু জনেই। কাজ তো আছেই। প্রেমটাও আছে।’

‘….আসলে আমি একটা ট্রাভেলগ লিখছি। সিকিম ভ্রমণের ওপর। কাশ্মীর দর্শন তো রসাতলে গেল। লেখাটা রবিবারের মধ্যে শেষ করতে হবে, মানে শনিবার বেরোলে অসুবিধা–’

‘আচ্ছা, আপনি লেখার বাইরে কিছু ভাবতে পারেন না, না? আমায় দেখতে ইচ্ছা করে না? আর আপনি কমিট করাতেই কিন্তু অ্যাডটা নিয়ে এগিয়েছি।’

লোকটা নিজের টপিক থেকে সরছে না। একটু চুপ করে থেকে শ্রীতমা বলল, ‘যেতে পারি। কিন্তু বেশিক্ষণ বসব না। কলেজ স্ট্রিটে যেতেই হবে।’

লেখার প্রবাহ ঝিমিয়ে গেল। যেচে বিপদ ডেকে আনছে না তো। উদ্ভবকে জানাতে হবে। একটা ছোটো পত্রিকায় শ্রীতমার খাতিরে দেবপ্রিয় একটা বিজ্ঞাপন দেওয়ার পর উদ্ভব ঠাট্টা করেছিল, দেবপ্রিয় দামকে বিয়ে করলে তোমার বেশ সুবিধা হতো। কিন্তু ইদানীং রাত বিরেতে ফোন এলে বিরক্তি চাপা থাকে না। এতদিন পরস্পরের অনুরাগী বা অনুরাগিনীদের নিয়ে দুজনে খোঁচাহীন নির্দোষ রসিকতাই করে এসেছে। মাঝে মাঝে শ্রীতমাই কপট সন্দহের ভান করে। বারো বছরের দাম্পত্যে কোনও দিন তৃতীয় ব্যক্তি বা সন্দেহের মতো বিষয় দানা বাঁধেনি। এখন সাহিত্যিক পরিচিতি লিপ্সার অপরাধে কি সিনেমা সিরিয়ালে এই বহু ব্যবহূত ক্লিশে বিষয়টার অনুপ্রবেশ ঘটছে? শ্রীতমার একটাই জোরের জায়গা সে বরকে কিছুই গোপন করে না। নিজের পুরোনো কিছু একতরফা অন্ভুূতির কথা লুকোয়নি। কেউ বিরক্ত করলে তো নয়ই। কিন্তু কিছু পাবার আশায় এভাবে? ঠিক পাওয়ার আশাও নয়, যেহেতু একটু সহযোগিতা পেয়েছে তাই সম্পূর্ণ এড়িয়ে যেতেও ভদ্রতায় বাধছে। নাঃ! পানি না ছুঁয়ে মাছ ধরার খেলা ওর জন্য নয়।

মা কিচ্ছু খাচ্ছে না। শরীর ভয়ানক দুর্বল। অন্যের হাতের রান্না পছন্দ না হলেও উপায় নেই। এই অনশনে শরীর আরও বিগড়োলে কে দায়িত্ব নেবে? বাবা? থাক, তার কথা না বলাই ভালো। একেই সারাটা দিন অস্বস্তি আর উশখুশানির মধ্যে কাটছে। দুপুরে মেয়ে স্কুল থেকে ফিরলে তাকে খাইয়ে দাইয়ে স্নান করিয়ে বুকে জড়িয়ে শুয়ে থাকাটা শ্রীতমার ভীষণ প্রিয় ব্যাপার। অনেক অশান্তি অতৃপ্তির উপশম ঘটে বুকের ওপর ছোট্ট হাতের স্পর্শে, পেটে তুলে দেওয়া আলতো পায়ের চাপে। আজ যে এতেও স্বস্তি হচ্ছে না। খানিকক্ষণ আদর করল। ঘাড়ে মুখ গুঁজে ‘বুজকু-বুজকু, মাম্মাম্ মাম্মাম্’ গন্ধ নিল। তবুও না।

বাড়ির যা অবস্থা দুই শোবার ঘর বিশিষ্ট ফ্ল্যাটে বরের সঙ্গে দুটো কথা বলারও অবকাশ ঘটছে না। ডাক্তার, ওষুধ, টেস্ট-রিপোর্ট, মেডিক্লেম, আয়া, ঝি, রাঁধুনি এসবের ফাঁকে কাজুর পড়া, ইউনিট টেস্ট, উদ্ভবের অফিসে আবার ট্রান্সফারের গুঞ্জন। বেশ হয় কলকাতার বাইরে বদলি হলে। যে নগরটিকে নিজের কেরিয়ার, সন্তানের ভবিষ্যতের জন্য একদা গন্তব্য আর বর্তমানে আশ্রয় করেছে, সেখান থেকে পালিয়ে যেতে ইচ্ছা করছে। লেখালিখির জগতে সেরা রাজনীতিকরা বিরাজমান। পৃষ্ঠ দংশন, লেঙ্গি মারা, ঈর্ষা, হরেক কিসিমের নোংরামি। এসবের মধ্যে টিঁকে থাকার চামড়া বা কৗশল কোনওটাই শ্রীতমার নেই। আবার এমন বিরাট মাপের প্রতিভাও ও নয়, যে পর্বত সরিয়ে জায়গা করে নেবে। আর এত দৌড়েই বা কী হবে? পারবে সুনীল, শীর্ষেন্দু, সুচিত্রাদের মতো বছরে ডজন ডজন গল্প, সাত আটখানা করে উপন্যাস, ছোটোদের গোয়েন্দা কাহিনি লিখতে, যদি তেমন বরাত পায়ও? আসলে পারবে না ভাবলেই কান্না পায়।

উদ্ভব আজকাল শ্রীতমার দেহের ভাষা খেয়াল করে না। একটা ভালো মতো চটকাই মটকাই দিলেই পাগলি বউটা শান্ত হয়ে যায়, ভালো করেই জানে। তবু কেন যে না দেখার ভান করছে? আগে বউয়ের সামান্যতম ভাবান্তরও ওর নজর এড়াত না। কোনও দিন কোনও কথায় আহত হলে শ্রীতমা যতই স্বাভাবিক ব্যবহার করুক, ও যে রাগ করে আছে এটা ইঙ্গিতেও প্রকাশ করতে হতো না। এখন ওর চূড়ান্ত অস্থিরতা, বিরক্তি কোনওটাই যেন চোখে পড়ছে না। উদ্ভবের মতো মানুষ বছরের পর বছর পারে নিস্পৃহ থাকতে। শ্রীতমা এগিয়ে না গেলে এমনটাই চলতে থাকবে কোনও সুস্পষ্ট কারণ ছাড়াই। ঘুমের মধ্যে কখনও স্ত্রী-র ঘনিষ্ঠ হবার অনীহা প্রকাশ পেলে মাসের পর মাস আর কাছে আসে না। এখন তো বাড়ি ভর্তি মানুষ। পালানোর অনেক পরিসর। কিন্তু শ্রীতমার যে আদর ছাড়াও আশ্রয় দরকার এই সংকটে।

উদ্ভব অফিস থেকে ফিরেছে। মাকে আজকাল ডিভানে খানিকটা ঠেকের ব্যবস্থা করে দিলে সন্ধে বেলায় টিভি দেখতে পারে। বাবার দখলে রিমোট থাকে। তাই নিয়ে এক দিকে স্ত্রী আর এক দিকে নাতনিকে যুঝে চলে। গ্লোকোমা আক্রান্ত চোখ দিয়ে একটা মানুষ এত টিভিই বা দেখে কী করে, আর এত বই-ই বা পড়ে কী করে? শ্রীতমা বরকে ছোটো ঘরটায় ডাকল, ‘শোনো।’

‘কী?’

‘তুমি তো এখন আমার সাথে কথা বলার সময়ই পাও না। গলা ধরে এল।’

উদ্ভবের ভাবান্তর নেই।

‘ওই দেবপ্রিয় দাম। …এতদিন তো বেশ নিঃস্বার্থ হিতৈষীই মনে হচ্ছিল। এখন দুটো লেখা দুটো পত্রিকায় পাঠিয়েই গলার সুর বদলে গেছে। তাও তো রবিবারের ‘হট্টমেলা’ থেকে পরমার্থ সেনের কাছে ঠোক্বর খেয়ে তো ছড়াটা বাউন্সই করেছে। ‘বাল্যবন্ধু’-তে’ পাঠানো গল্পটাও এখন দেনা পাওনায় আটকে যেতে পারে। চোখ দিয়ে কয়েক ফোঁটা নেমে এল।

‘পৃথিবীতে একশো জনের মধ্যে নববইজন পুরুষ মেয়েদের একই রকম নজরে দেখে। তুমি যদি বোকা সেজে থাকো আমার কী করার আছে? তুমি কম্প্রোমাইজ করে লেখিকা হতে চাও না নিজের জোরে, সেটা নিজেই ঠিক করবে।’

‘একটা অ্যাডে কাস্ট করার কথাও বলছিল।’

‘তাহলে আর কী? যা ইচ্ছা করো। যে লোক রাত সাড়ে বারোটার সময় কোনও ভদ্রমহিলাকে ফোন করে গ্যাঁজায়, সে কী ধরনের মানুষ তা যদি তুমি এই চল্লিশ বছরেও না বোঝ, তাহলে কিছু বলার নেই।’

‘সারাদিন অন্য কাজে ব্যস্ত থাকে। তাছাড়া ফিল্ম লাইনের লোক। সারা রাত জেগে থাকাটাও স্বাভাবিক।’

‘তাহলে আমায় প্রশ্ন করছ কেন?’

‘আর কাকে করব?’

‘আমার উত্তর তো আমি দিয়েই দিয়েছি। জাস্ট যোগাযোগ রাখবে না। নম্বরটাই ডিলিট করে দাও। ফোন এলে রিসিভ কোরো না।’

‘বলছিল এই জুনেই বাল্যবন্ধু-তে বেরোবে। অন্য দিকে ‘সন্ধ্যাতারা’য় লেখা জমা দেওয়ার এক বছর পর চিঠিতে কনফার্ম করার পরেও সাত মাস পেরিয়ে গেল। শুনছি পুজো পর্যন্ত সব সংখ্যা তৈরি। তারপর ভূত-স্পেশাল। কবে আমার গল্প বেরোবে কোনও ঠিক নেই। লিটল ম্যাগগুলোতেও দলাদলি। ‘দিনকাল’-এ যে আমার গল্প ছাপল অজস্র ভুল করে, সেন্টেন্সগুলো পর্যন্ত এলোমেলো করে দিয়ে গল্পের বারোটা বাজিয়ে। বড়ো পত্রিকা বলে ওরা চাইলেই আমি আবার লেখা দিতে এক পায়ে খাড়া– এটা কম্প্রোমাইজ নয়? তাই এই লোকটাকে চটাতে পারছি না। লেখার কয়েকটা জায়গা বন্ধ হয়ে যেতে পারে। ইনফ্লুয়েন্শিয়াল…’

উদ্ভব উত্তর না দিয়ে স্নানঘরে চলে গেল।

শনিবার কলেজ স্ট্রিটের উদ্দেশে বাস ধরল। ট্রেন জার্নিটা ভিড়ের জন্য এড়াতেই চায়। তাছাড়া স্টেশনগুলোর চত্তরে বড়ো কটু গন্ধ। শহর ও শহরতলির সমস্ত রাস্তা ঘাটই অবশ্য পুরুষ মানুষের জল বিয়োগ ক্ষেত্র। এই গন্ধের জন্য হাঁটতে চলতে নাকে-মুখে কাপড় চাপা দিয়ে শ্বাস বন্ধ করে প্রাণায়াম করে যেতে হয়। সময় অনেক বেশি লাগলেও তাই বাসটাই ধরতে চায়। বেরোতে বেরোতে প্রায় তিনটে বেজে গেল। এখন বেহালা যাবার প্রশ্নই ওঠে না। ফোন।

‘আসছেন তো?’

‘দেরি হয়ে গেছে অনেক। সামনের সপ্তাহে না হয় উইক ডে দেখেই সময় করে যাব।’

‘নেচার কিওয়ের অ্যাডটাও তো ফাইনাল করা দরকার। পরের শনি নয়তো রবি শ্যুটিং। আজই ফাইনাল করে নিতাম।’

‘আ..চ্ছা। আমার কিন্তু দেরি হবে। আর যখন পৌঁছোব, তখন বসার সময় বেশি থাকবে না।’

‘হ্যাঁ হ্যাঁ। মিনিট পনেরো থেকে আধ ঘণ্টার ডিসকাশন।’

‘আপনার অ্যাড দেওয়া ‘ক্রমাগত’টাও অবশ্য সঙ্গে রয়েছে।’

‘ওটা এমন কিছু না। আপনি আসুন।’

দোনোমনো করে শ্যামবাজারে নেমে মেট্রো ধরল। কালীঘাটে নামতে হবে। সেখান থেকে অটো বদলে বা টানা বাস পেলে বেহালা শখের বাজার। আজ কফি হাউসে যাওয়া খুব জরুরি ছিল। একটা পত্রিকা হাতে পাওয়ার কথা, আর দুটোতে লেখা দেওয়ার। আর শনিবার গেলে অনেকের সাথে দেখা হয়। লেখার পরিসর বাড়তে পারে। নিছক আড্ডা মারতে যাওয়ার তাগিদ নেই। তাছাড়া ওই মাছের বাজারকে মাত দেওয়া শোরগোলে গলা তুলে কথা বলায় কোনও সুখ নেই। কেউ কেউ অবশ্য এজন্য শ্রীতমাকে ধান্দাবাজ ইঙ্গিত করে।

শখের বাজারে নেমে অনেকটা হাঁটতে হয়। জেমস্ লং সরণি পেরিয়ে বাঁদিকে কিছুটা গলির ভেতর হাঁটলে, তবে মহাশয়ের বাড়ি তথা দফতর। হাঁটতে হাঁটতে মোবাইলে বার্তা আসার শব্দ পেল। মোবাইল কোম্পানির বা অন্য কোনও প্রমোশনাল মেসেজ হতে পারে। দেখা হল না। জৈষ্ঠের আকাশে আলো ম্লান হয়নি তখনও। আধ ঘণ্টার মধ্যে হয়ে গেলে কলেজ স্ট্রিটটাও ছুঁয়ে আসার চেষ্টা করবে।

গেট দিয়ে ঢুকে লম্বা প্যাসেজ পেরিয়ে দারোয়ানকে বলে সিঁড়ি ভেঙে দোতলায় উঠতে হয়। অফিসের রিসেপশনের মতো জায়গাটা ফাঁকাই দেখেছে এযাবত। ভেতরের ঘরে বসে মালিক। দারোয়ান দোতলার অফিসের বাইরের ঘরে শ্রীতমাকে বসিয়ে তিনতলা গিয়ে ফিরে এসে বলল, ‘স্যার চান করছেন। এক ঘণ্টা বসতে হবে।’

পাঁচবার ফোন করে ডেকে এনে এ কী রসিকতা! ফোন বার করে দেখল রাস্তায় আসা মেসেজটা দেবপ্রিয়ই করেছে। সেটা না পড়ে অসহিষ্ণু ভাবে ফোন করল। দূর! বাথরুমে গেলে কি মোবাইল ধরতে পারবে? অবশ্য বাড়ির লোক ধরতে পারে। কাটতে যাচ্ছিল। ওপাশ থেকে পরিচিত গলা, ‘হ্যালো। কোথায়?’

‘আপনার অফিসে। কিন্তু আমাকে ডেকে আপনি এখন কী করছেন?’

‘স্নান করছি। মিনিট পনেরো কুড়ি বসুন।’

‘আমার তাড়া আছে। এমনিতেই দেরি হয়ে গেছে।’

লাইন কেটে মেসেজটা পড়ল। ‘আজ আমার আঙুল আর ঠোঁট– আদরে পাগল করে দেবে ঠিক তো?’

চড়াং! কাজের দোহাই দিয়ে ডেকে এনে বাথরুম থেকে পরনারীকে এই বার্তা? এরপর বসে থাকার একটাই অর্থ হয়। তরতর করে নীচে গিয়ে দারোয়ানকে বলল শ্রীতমা, ‘আমায় বেরিয়ে যেতে হবে। একটা বই আপনার স্যারের জন্য রেখে যাচ্ছি। এক টুকরো কাগজ দিতে পারবেন? চিঠি লিখে দিয়ে যাব।’

কাঁপা হাতে নোটপ্যাডের পাতায় লিখল, ‘দেবপ্রিয়বাবু, আজ আমার পক্ষে অপেক্ষা করা আর সম্ভব হল না। ‘ক্রমাগত’র কপি রেখে গেলাম। আপনার সহযোগিতার জন্য ধন্যবাদ। এসএমএসটা আমার সঙ্গে রইল।’

এর আগের বার্তাগুলো মুছে ফেলেছে। এটাকে না মুছে একটা ফোল্ডারে সেভ করে রাখবে। ভাগ্যিস লোকটা স্নানে ঢুকেছে। উর্দ্ধ্বশ্বাসে ছুটল ডায়মন্ড হারবার রোডের দিকে। বড়ো রাস্তায় পৗঁছেই একটা ডাবের খোলায় হোঁচট খেয়ে সপাটে আছাড়। সর্বনাশ! বাড়ির এই অবস্থায় ওরও কিছু হলে আর দেখতে হবে না। বাঁ হাতের কবজির ষন্ত্রণায় প্রথমটায় খেয়াল করেনি তালুটাও সামান্য ছড়ে গেছে।

সাড়ে ছটা। এখন আর কফিহাউস নয়। সোজা বাড়ি। সামনে যে বাস এল তাতেই চড়ে পড়ল। শিয়ালদা যাচ্ছে। ভালোই।

বাসে পরের স্টপেই জায়গা পেল মহিলা সিটে। তবে জানলার দিকে নয়। বসতে না বসতেই আবার চলভাষে সুরধবনি। কাঁপা হাতে ফোন ধরে যথাসম্ভব ঠান্ডা গলায় বলল, ‘বলুন।’

‘কী বলি বলুন তো। কীভাবে স্যরি বলব?’

‘বলতে হবে না। শুধু বুঝুন বেকারদের সময়ও দামি। আর স্যরি যদি বলতেই হয়, আপনার মেসেজটার জন্য বলুন।’

‘মেসেজ মানে? ওহ্! হো হো হো! এই ব্যাপার? হঠাৎ এত সিরিয়াস হয়ে গেলেন? এতদিন তো…’

‘এতদিন কী? আপনার রসিকতাকে রসিকতা হিসাবেই দেখেছি।…’

‘এভাবে পৃথিবীর সাথে মানাবেন কী করে? সুমনের একটা গান আছে, …। আমার নিজেরও একটা কবিতা আছে, শুনবেন…’

‘…নিজের ই-ইল্লিসিট ইচ্ছাকে …র-র্যাশনালাইজ করার জন্য হাজারটা উদ্ধৃতি দেওয়া যায়। আর নেচার কিওর অ্যাডটার জন্য বোধহয় আমাকে আর দরকার লাগবে না।’

‘ওটার জন্য তো আপনার সিলেকশন হয়েই আছে। আপনি এখন নিজে রাজি না থাকলে–’

‘প্রফেশনালি কাজ তো হবার নয়।’

‘আপনি চাইলেই হতে পারে।’

ছিছিঃ! শ্রীতমা এখনও লোকটার মুখের ওপর উচিত কথা না শুনিয়ে নিজেকে খেলো করে যাচ্ছে? নিজের লেখায় যে এত আপসহীন, এত সাহসী, এত অকপট, লেখাগুলোর প্রতি অপত্যস্নেহে সেই মানুষ এত দুর্বল? দেবপ্রিয় দামের কত বড়ো হাত?

‘চুপ করে আছেন যে?’

‘আপনার সঙ্গে এখনও কথা বলছি, ইজন্ট ইট স্ট্রেঞ্জ? সুরেন্দ্র নস্করের কাছেও কি একই এক্সপেক্টেশন রাখেন?’

কী জবাব এল বোঝা গেল না বাসের আওয়াজে। বোধহয় সুরেন্দ্র আর শ্রীতমা এক নয় সেটাই বোঝাতে চাইল।

‘ওই ভদ্রলোক আপনার বন্ধু। তিনি ভাগ্যবান। বিকজ ইউ আর নট আ গে আই থিংক। আমাকে বন্ধু ভাবতে পারলেন না। গিভ এ্যান্ড টেক চলে এল। আমি দেখতে ভালো, এটা কি আমার দোষ?’

‘ও হো হো হো। আচ্ছা, আপনি সুন্দর কে বলেছে? কতজন বলেছে?’

মনে হল সপাটে গালে চড় পড়ল। দাঁত চিপে বলল, ‘অনেকেই। আর একজন মিথ্যুক তো অনেকবার বলেছে।

আবার হাসি, উপদেশ। খেলো মেলোড্রামা ভরা স্থূল বার্তা পাঠিয়ে এখন এমন ভাবে হাসছে যেন শ্রীতমার মতো অপরিণত মেয়ে আর হয় না। এখনও কেন লোকটাকে বাজে বকার সুযোগ দিয়ে যাচ্ছে? কেন গল্প, উপন্যাসের নায়িকাদের মতো, সিদ্ধান্তহীনতায় না ভোগা ঋজু চরিত্রের মানুষের মতো কড়া কথা বলে ফোন কেটে দিতে পারছে না? অ্যাড ফিল্ম না বাল্যবন্ধু পত্রিকা? দুটোই তো গেল। নাকি নিজের বোকার মতো বিশ্বাসের মর্যাদা রাখার মরিয়া চেষ্টা, বন্ধুত্বের লোভ?

কথা যখন শেষ হল তখন খেয়াল করল, তার ডান কাঁধে ভর দিয়ে তার গোপন অঙ্গটিকে একরকম শ্রীতমার কাঁধে চেপে ধরে জুত করে একটা লোক দাঁড়িয়ে আছে। শ্রীতমা ফোন কেটে সচকিত হতেই জানোয়ারটা ঝট্ করে সরে গেল।

‘ইতর কোথাকার! কেটে ফেলতে হয়! বাসে কী এমন ভিড় যে ঠিকভাবে দাঁড়ানো যায় না?’

ঘেন্নায় অপমানে উদ্গত অশ্রু সামলাতে গিয়ে গলা কন্কন্ করে উঠল। শ্রীতমা সত্যিই অপরিণত। তার বয়সি মহিলাদের সাথে বাসে ট্রেনে এমন বজ্জাতি করার সাহস চট্ করে দেখানো যায় না। ও একাই চেঁচিয়ে গেল। বাসে কেউ কিছু বলল না। কন্ডাক্টর বোবা।

দেবপ্রিয়র প্রতি আর কোনও বিদ্বেষ নেই। বাসের এই নরকের কীটটা দেবপ্রিয়র মতো বুকে পেটে চুমু খাওয়ার আবেদন করেনি। সুযোগ বুঝে নিজের নোংরা প্রত্যঙ্গটা ওর কাঁধে ঠেকিয়ে দিয়েছে। পোশাকের আবরণ সত্ত্বেও ঘেন্না আর রাগে গা রিরি করছে।

যে মানুষটা দু বছরের পরিচয়ের ভিত্তিতে শ্রীতমাকে ছোঁয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিল, হয়তো মতলবই করেছিল, সে তো স্নান করে পরিষ্কার হয়ে তৈরি হচ্ছিল অভিসারের জন্য। নৈতিকতার খাতিরে তার কাছ থেকে সব সহযোগিতার রাস্তা বন্ধ করে দিয়ে এসে ভাগ্যের কাছে কী প্রতিদান পেল?

অন্ধকার হয়ে এসেছে। বাসের জানলা দিয়ে ভেসে আসা উন্মুক্ত পুরুষ ইউরিনালের গা গোলানো দূষিত গন্ধ নাকে মুখে ঝাপটা মারছে অনুমতির তোয়াক্বা না করে।

রুমাল

মাথা নীচু করে ক্লাসে ঢুকতেই শুনতে পেলাম একজন ক্লাসমেট-এর মন্তব্য— শালা ভিখারির বাচ্চাটা এসে গেছে।

আর একজনের কটূক্তি শব্দভেদী বানের মতো অতর্কিতে ছুটে এল আমার দিকে– ব্যাটার হিরো হওয়ার শখ একেবারে ঘুচে গেছে।

আমি ওদের কথায় কান না দিয়ে পাস কাটিয়ে লাস্টবেঞ্চের এক কোণে বসলাম। এখন শুধু কটূক্তি শোনার পালা, র্যালা মারার দিন আমার শেষ। আমি শেকসপিয়রের জুলিয়াস সিজারের মতো পরাজিত রোমান সম্রাট। আমার চারপাশে ব্রুটাসের দল আমাকে হেনস্থা করার জন্য ওত পেতে আছে। আমার পরাজয়েই তাদের সুখ। তাদের আনন্দ।

রাগে আমার গা রি রি করছে। অথচ কিছু করার নেই। ক্লাসের সমস্ত সিলিং ফ্যানগুলো ফুল স্পিডে চলা সত্ত্বেও আমার গা দিয়ে দরদর করে ঘাম ঝরছে। অথচ এটা গ্রীষ্মকাল নয়, ভরা শ্রাবণ। শরৎ আসতে আর দেরি নেই। এর মধ্যেই একটু ঠান্ডা ভাব এসে গেছে। ভোরের দিকে শীত শীত মনে হয়। আকাশে বাতাসে পুজো পুজো গন্ধ। ভোরের দিকে শিউলির গন্ধ টের পাই।

কী শীত কী গ্রীষ্ম, সব সময়েই আমার গা দিয়ে ঘাম ঝরে। মনে হয় আমার শরীরে নুনের পরিমাণ একটু বেশি আছে। যাই হোক,

জিন্স-এর ট্রাউজারের পকেটে হাত ঢুকিয়ে ঘাম মোছার জন্য রুমালটা বার করতে যেতেই শূন্য হাতটা উঠে এল। অর্থাৎ আমার রুমাল হাওয়া। বেশ মনে আছে বাড়ি থেকে বেরোবার সময় সুগন্ধি লাল রুমালটা পাঞ্জাবির বাঁ পকেটে যত্ন করে রেখেছিলাম। পকেটে এখনও সেন্টের গন্ধ ম-ম করছে। এই, এই একটা জিনিস পকেটে রাখতে কখনও ভুল করি না। ও আমার নিত্য সহচর। একান্ত আপন।

একবার ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের গার্ডেনে কলেজ থেকে কাট মেরে আমি আর নন্দিতা বসে গল্প করছিলাম। একবার গল্প শুরু হলে বাড়ি ফেরার কথা আমাদের মনেই থাকত না। হঠাৎ অস্তমিত সূর্যের কিরণ চোখে এসে পড়তেই নন্দিতা তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়িয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল– এই রে দেরি হয়ে গেছে। তাড়াতাড়ি চল বাড়ি ফিরতে হবে। বাড়িতে বলেছি অনার্সের স্পেশাল ক্লাস আছে। দেরি হলেই মা চিন্তা করবে।

নন্দিতা সবুজ ঘাসের ওপর যে রুমালটা পেতে বসেছিল সেটা না নিয়েই উঠে পড়েছিল। আমি ওর অলক্ষ্যে সেই রুমালটা কুড়িয়ে পকেটে পুরেছিলাম। যেন সাত রাজার ধন এক মানিক কুড়িয়ে পেয়েছি। ট্রেনে জানলার ধারে বসে গরমে ঘাম মুছতে গিয়ে তার মনে পড়েছিল রুমালটার কথা। মনে পড়া মাত্রই সে তার নিজস্ব ভঙ্গিতে বলে উঠেছিল, ‘এইরে ভিক্টোরিয়ার মাঠে রুমালটা ফেলে এসেছি।’

আমি আমার রুমালটা ওর দিকে বাড়িয়ে দিয়ে চাপাস্বরে বলেছিলাম, ‘ওটা আমার পকেটে আছে।’

–তা হলে তোরটা কেন, আমার রুমালটা দে।

–ওটা আর তোকে দেব না। তুই যখন আমার পাশে থাকবি না তখন এই রুমালটার সুগন্ধ তোর কথা আমায় মনে করিয়ে দেবে। তোর ঘামে ভেজা শরীরের সুগন্ধ ওই রুমালটার মধ্যেই খুঁজে পাব।

আমার কথা শুনে নন্দিতা বলেছিল, ‘রুমাল নিলে কিন্তু প্রেম টেকে না। ছাড়াছাড়ি হয়।’

বলেছিলাম, ‘সেই জন্যই তো এখন থেকে তোর একটা স্মৃতি নিয়ে রাখলাম।’

আমার বেশ মনে আছে বাড়ি থেকে বেরোবার সময় রুমালটা পকেটে রেখেছিলাম। সেটা কোথায় হারিয়েছি কে জানে। আজ যে এরকম অঘটন হবে বুঝতেই পারিনি। সকালে কার মুখ দেখে উঠেছিলাম কে জানে।

আজ শনিবার। মনে হয় আজ আমার ওপর শনির কোপ পড়েছে। বাড়ি থেকে বেরোবার সময় যথারীতি মা তারার ফটোকে ভক্তি ভরে প্রণাম করেছি। তবে কোন পাপে আমার এই দশা হল। মনে করতে চেষ্টা করলাম আজ সকাল থেকে এ পর্যন্ত কী কী পাপ করেছি। যতদূর মনে পড়ে একটাও মিথ্যে কথা বলিনি। কাউকে কটু কথা বলিনি। এমনকী কারও বাড়া ভাতে ছাই দিইনি। বরং শেওড়াফুলি স্টেশনের বুকিং কাউন্টারের সামনে বসা ভিখারিকে আজ এক টাকার একটা কয়েন দিয়েছি। তাকে দেখলেই কেন জানি না আমার মৃত ঠাকুমার কথা মনে পড়ে। আমার ঠাকুমার মুখের সঙ্গে তার হুবহু মিল আছে।

হঠাৎ মনে পড়ে গেল আজ সকালে ঘুম থেকে উঠেই পাশের বাড়ির মাকুন্দ নিতাইয়ের মুখ দেখেছি। লোকে বলে ওর মুখ দেখলেই নাকি দিনটা খারাপ যায়। হলও তাই। একটা অপয়া লোকের মুখ দেখার জন্যই আমার রুমাল হারিয়ে গেছে। রুমাল হারানোর কথা ভাবতে গিয়ে হঠাৎ আমার মাথার বাঁদিকে মৃদু যন্ত্রণা শুরু হল। চোখে অন্ধকার দেখলাম। একটা অ্যানাসিন পেলে হতো। হাতের কাছে তা যখন নেই, তখন জলই খাওয়া ভালো। ফোলিও ব্যাগের চেনটা খুলে প্লাস্টিকের বোতল বার করে ঢকঢক করে খানিকটা জল খেয়ে নিলাম। তাতেও আমার যন্ত্রণা কমল না বরং বেড়ে গেল। যন্ত্রণাটা মাথার না মনের কিছুই বুঝে উঠতে পারলাম না।

আমার পাশে বসা সুনীতি ব্যানার্জী হঠাৎ বলে উঠল, ‘কিরে ভাস্কর তোর মুখটা অমন শুকনো লাগছে কেন? কি হয়েছে তোর? এনিথিং রঙ?’

ওর কথা কানে ভেসে আসতেই আমার তন্ময়তা কাটল। আমি এতক্ষণ একটা ঘোরের মধ্যে ছিলাম। বুঝতেই পারিনি কখন ইংরেজির প্রফেসর পড়ানো শেষ করে ক্লাস থেকে চলে গেছেন। কখন গুলতানি শুরু হয়েছে ক্লাসে।

বললাম, ‘জানিস আজ আমার রুমালটা হারিয়ে গেছে। ওটা আমার ভীষণ পয়া ছিল।’

ব্যস পাগলকে দিয়েছি সাঁকো নাড়া দিতে। সুনীতি আমার কথা শুনে ব্ল্যাক বোর্ডের কাছে গিয়ে গলা চড়িয়ে বক্তৃতার ঢঙে বলল, ‘লেডিজ এ্যান্ড জেন্টলম্যান, আজ আমাদের ভাস্কর স্যান্যালের রুমাল হারিয়ে গেছে। ওর মন খারাপ। তাই ওর শোকাচ্ছন্ন মনের শান্তির জন্য এসো আমরা এক মিনিট নীরবতা পালন করি।’

তার কথা শুনে ক্লাস শুদ্ধু সকলের সে কি হাসি। চন্দননগরের মেয়ে কস্তুরী সিন্হা হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ল। আমার এখন ইচ্ছে করছে এক ঘুসি মেরে ওর বত্রিশ পাটি দাঁত ফেলে দিতে। ও আগে বিধান কলেজে পড়ত। হঠাৎ কি খেয়াল হল ওখানে এক বছর পড়ে আমাদের কলেজে উড়ে এসে জুড়ে বসেছে। অনেকের মুখে শুনেছি রিষড়ার বিধান কলেজের অনেক ছেলের মাথা খেয়ে আমাদের কলেজে ঢুকেছে। এক নম্বর ছেলেবাজ।

কস্তুরী আমাদের কলেজে ভর্তি হওয়ার পর থেকেই অনেকেরই চিত্তচাঞ্চল্য বেড়ে গেছে। চারটে বাজলেই যারা পালাই পালাই করত, তারা পাঁচটা পর্যন্ত কলেজে থাকে। আসলে কস্তুরীর মেয়েদের চাইতে ছেলে বন্ধু বেশি। কস্তুরী যেখানে ছেলেরাও সেখানে। এ যেন সেই চিটে গুড়। যেখানে রাজ্যের মাছি ভন ভন করে। অথচ কস্তুরীকে দেখতে এমন কিছু আহামরি নয়। খুবই সাধারণ। গায়ের রং কালো, মুখটা লম্বা মতন, চোখ দুটো বড়ো বড়ো। দেহে মেদের পরিমাণ বেশি। দূর থেকে দেখলে মনে হবে একেবারে সাক্ষাৎ মা কালি। তবু কি আশ্চর্য সে আমাদের কলেজের অনেক ছেলের চোখে বিশ্ব সুন্দরী, মিস ইউনিভার্স। টিফিনের সময় ক্যান্টিনে গেলেই কলেজের ছেলেগুলো ওর সামনে মাছির মতো লেপটে থাকে।

ওদের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা লেগে যায় কস্তুরীর পাশের চেয়ারে কে বসবে। পাশে বসলে কস্তুরীর শরীরের অল্প বিস্তর স্পর্শ সুখ ফাউ পাওয়া যায়। আমি ওই প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ভুলেও অংশগ্রহণ করি না। ওরা যখন অফ পিরিয়ডে খোশ মেজাজে গল্প করে আমি তখন এক কোণে বসে বাংলা অনার্সের রেফারেন্স বইয়ের ভেতর ডুবে থাকি। ওদের আলোচনার বিষয় হল পরচর্চা আর রাজনীতি যা আমার একেবারেই ভালো লাগে না। আমি আসলে হই হট্টগোল পছন্দ করি না। তা ছাড়া যেখানে একজন মেয়ের সঙ্গ অনেকে কামনা করে, আমি তাদের থেকে সব সময় দূরে থাকি।

তবু চক্ষুলজ্জার মাথা খেয়ে কস্তুরী যখন ইংরেজি সাহিত্যের ইতিহাস সম্পর্কে আলোচনা করতে আসে, আমার তখন বুকের মধ্যে ধুক-পুকুনি শুরু হয়। আমি তখন ইষ্টনাম জপ করতে থাকি। ক্লাসের ছেলেগুলো বিষদৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। মনে হয় কস্তুরী ওদের যেন ব্যক্তিগত সম্পত্তি। ওদের জিনিসে ভাগ বসাব এমন ইচ্ছে আমার কখনও হয়নি। কস্তুরী যদি সেধে আমার সঙ্গে গল্প করতে আসে আমি কী করব?

একদিন লাইব্রেরি রুমে ও আমাকে বলেছিল, ‘তোমার গায়ে প্রেম প্রেম গন্ধ। তুমি অনেক মেয়ের সঙ্গে প্রেম করবে।’

বলেছিলাম, ‘প্রেমের আবার আলাদা গন্ধ আছে না কি?’

কস্তুরী বলেছিল, ‘তোমার কথাবার্তায়, চালচলনে তো অনুভব করা যায়। তা ছাড়া তুমি তো আমাদের পাত্তাই দাও না।’

বলেছিলাম, ‘ওটা তোমাদের ভুল ধারণা। তোমাদের সঙ্গে নিজেকে ঠিক খাপ খাওয়াতে পারি না। তা ছাড়া আমি একটু নির্জনতা পছন্দ করি।’

কস্তুরী তখন বলেছিল, ‘বলো কোন নির্জন জায়গায় তুমি যেতে চাও? জু গার্ডেন, মিলেনিয়াম পার্ক, ভিক্টোরিয়া, প্রিন্সেপ ঘাট। যেখানে শুধু আমি আর তুমি সারাদিন মজা করে কাটাব।’

বলেছিলাম, ‘ঠিক আছে। পরে ভেবে বলব।’

হঠাৎ রঙ্গমঞ্চে গদা হাতে ভীমের প্রবেশের মতো পলিটিক্যাল সায়েন্সের প্রফেসর এন দে, এসে হাজির। উনি সাধারণত ঘন্টা পড়ার সঙ্গে সঙ্গে আসেন না। আজ হঠাৎ এসে গেলেন। ওকে ঢুকতে দেখে ক্লাসের সব ছেলে মেয়েরা হাসি বন্ধ করে ক্লাস নোটের খাতা খুলে বসল। ভয়ে কস্তুরীর মুখ এতটুকু হয়ে গেল।

প্রফেসর এন দে তাঁর চেয়ারে বসে প্রথমেই বললেন, ‘আমি জানতে চাই তোমাদের হাসির কারণটা কি?’

শঙ্কর উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘স্যার আমাদের ভাস্কর স্যান্যাল

মা-আ-নে…’

প্রফেসর এন দে আমার দিকে ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন, ‘কি ব্যাপার ভাস্কর।’

আমি উঠে দাঁড়িয়ে মাথা নীচু করে বললাম, ‘স্যার আমার একটা রুমাল হারিয়ে গেছে। শুনে ওরা সবাই হাসছিল।’

আমার কথা শুনে ক্লাসের সকলকে উদ্দেশ্য করে এন দে বললেন, ‘মনে রেখো এটা কলেজ। ক্লাবঘর নয়। আর যেন কখনও এরকম না হয়। তোমাদের মনে রাখা উচিত পাশের ঘরে আর একটা ক্লাস চলছে। অসভ্যতা তোমাদের এখনও গেল না।’

কলেজ ছুটির পর মন খারাপ করে বাড়ি ফিরলাম। আজ কিছুই ভালো লাগছে না। না ভালো লাগছে টিফিন খেতে, না ভালো লাগছে পার্ট টু-এর পড়া করতে। মাকে শরীর খারাপের অজুহাত দেখিয়ে রাতে কিছু না খেয়েই বিছানায় শুয়ে পড়লাম। বারবার লাল রুমালটার কথা মনে পড়ল। নন্দিতার সব চিঠি পুড়িয়ে ফেললেও রুমালটা ফেলে দিতে পারিনি। লেডিস রুমালটা আমার রক্ত মাংস, মেদ মজ্জার সঙ্গে একাত্ম হয়েছিল। আজ সেটা হারিয়ে যেতে মনে হচ্ছে এত দিন নন্দিতার যে স্মৃতি উজবুকের মতো বয়ে বেড়িয়েছি, আজ তা থেকে মুক্তি পেলাম। স্বপ্নে দেখতে পেলাম নন্দিতার লাল রুমালটা রাজপথে অযত্নে পড়ে আছে। পথচারীরা রুমালটা মাড়িয়ে আমার প্রেমকে দুপায়ে থেঁতলে চলে যাচ্ছে।

হঠাৎ মাঝরাতে বাড়ির ফোনটা বেজে উঠতেই ঘুমটা ভেঙে গেল। মিউজিক থামার পর ফোনটা ধরতেই ক্লাসমেট সুনীতি ব্যানার্জীর গলা ভেসে এল, ‘হ্যালো ভাস্কর সুখবর আছে।’

–সুখবর?

–হ্যাঁ, নন্দিতার সঙ্গে বলাই-এর ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে।

–কেন ?

–বলাই এখন রীনার প্রেমে মেতেছে। বড়োলোকের প্রেম মানেই চায়ের ভাঁড়ে চুমুক দিয়ে ফেলে দেওয়া।

–খবরটা দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ। গুড নাইট, বলে আমি বিরক্ত হয়ে ফোনটা ছেড়ে দিয়ে শুয়ে পড়লাম।

সোমবার প্রফেসর প্রতাপরঞ্জন হাজরার ক্লাস ছিল এগারোটায় কিন্তু আমি চলে এলাম পৌনে দশটায়। এত আগে আমার কলেজে আসার কথা নয়। কিন্তু কেন জানি না আমি খানিকটা ঘোরের মধ্যে এক ঘন্টা আগে চলে এসেছি। ঘোরের মধ্যেই কখন জিন্স-এর ট্রাউজারের বদলে পাজামা পাঞ্জাবি পরেছি খেয়াল নেই। এই কেন-র উত্তর আমার জানা নেই। কে জানে কেন আজ সকাল হতেই একজনের মুখ আমার অবচেতন মনে ভেসে উঠেছিল। তাকে দেখার জন্যই কি আজ আমি সাত তাড়াতাড়ি কলেজে চলে এসেছি। কে জানে হয় তো তাই। কিন্তু যে আমাকে বিট্রে করেছে তার জন্য কেন এত ভেবে মরছি। ভালোবাসা কি এতই ঠুনকো।

যাইহোক সাত তাড়াতাড়ি যখন কলেজে এসেই পড়েছি তখন রেফারেন্স বই দেখে নোটটা লিখে ফেলা যাক। কারণ বইটা আর একদিন রাখলেই লাইব্রেরিতে আমাকে ফাইন দিতে হবে। এখনও কলেজে কোনও ছাত্র আসেনি। নিরিবিলিতে রেফারেন্স বই দেখে যতটা লেখা যায়। সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠে একেবারে কোণের ক্লাস রুমের ভেজানো দরজা ঠেলতেই চোখ পড়ল লাস্ট বেঞ্চে কে যেন আধশোয়া অবস্থায় রয়েছে। আধো আলো আধো অন্ধকারে দূর থেকে দেখা গেল বেঞ্চের নীচে গোলাপি ফলস্ পাড় ঝুলছে।

বুকটা আমার ছ্যাঁত করে উঠল। অশরীরী প্রেতাত্মা নয় তো? দু’বছর আগে পার্ট ওয়ানের একজন ছাত্রী ফাইনাল পরীক্ষায় রেজাল্ট খারাপ হয়েছিল বলে গলায় ওড়নার ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যা করেছিল। যে ঘরে সে আত্মহত্যা করেছিল আমি এখন সেই ঘরের দরজার সামনে একা দাঁড়িয়ে। মেয়েটার নাম সুমনা রায়। শ্রীরামপুরে বাড়ি। খুব হাসিখুশি মেয়ে ছিল। অনেকেই নাকি সন্ধের পর তাকে তিন তলার ছাদে ঘুরতে দেখেছে। কাঁধে শান্তিনিকেতনি চামড়ার ব্যাগ, চুলে বিনুনি। দু’বছর আগে মারা গেলেও সে এখনও কোন্নগর হীরালাল পাল কলেজের মায়া ছাড়তে পারেনি।

আমি যে এক ছুটে তাড়াতাড়ি নীচে নেমে যাব তার উপায় নেই। কে যেন আমার পায়ে পেরেক ঠুকে এখানে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। হঠাৎ নারী কণ্ঠের মৃদু গোঙানির শব্দ ভেসে আসতেই চমকে উঠলাম। আমি মনে মনে সাহস সঞ্চয় করে এগিয়ে দেখলাম নন্দিতা হাঁটু মুড়ে কপালে হাত রেখে শুয়ে আছে। মাথার নীচে বইয়ের ব্যাগ। জল ভরা প্ল্যাস্টিকের বোতল রয়েছে পাশের বেঞ্চিতে। মেহগনি গাছের ফাঁক দিয়ে একফালি রোদ্দুর জানলা দিয়ে টপকে তার মেক-আপ করা মুখে এসে পড়েছে।

আমি তার যন্ত্রণা কাতর মুখটা দেখে বললাম, ‘এই তোর কি হয়েছে?’

আমাকে দেখে তার কাজল টানা চোখ দিয়ে টসটস করে জল পড়তে লাগল। এর আগে নন্দিতাকে কলেজে অনর্গল কথা বলতে দেখেছি, হাসতে দেখেছি। কখনও এরকম কাঁদতে দেখিনি। কাঁদলেও যে তোকে কত মধুর লাগে তা এই প্রথম দেখলাম। সে চোখের জল মুছে বলল, আজ সকাল থেকে এ্যাপেন্ডিসাইটিসের ব্যথাটা হচ্ছে।

বললাম, ‘ডাক্তার দেখাসনি কেন?’

‘দেখিয়েছিলাম। পার্ট টু পরীক্ষা হলেই অপারেশন করতে হবে’, বলে নন্দিতা কপাল থেকে হাতটা সরাল।

হাতটা সরাতেই তার লাল কাচের চুড়ির শব্দে মল্লার রাগ বেজে উঠল। কোথা থেকে একটা পায়রা ডানা ঝাপটিয়ে ভেন্টিলেটারে গিয়ে বসল। মুখে মুখ লাগিয়ে তার প্রেমিকার সঙ্গে বকবকম শুরু করে দিল।

 

আমি তার পায়ের কাছে বসে বললাম, ‘তোর পেটে একটু হাত বুলিয়ে দিই। দেখবি ভালো লাগবে।’

 

সে কোনও কথা না বলে শুধু তার পেটের কাছ থেকে শাড়ির অাঁচলটা সরিয়ে দিল। যন্ত্রণা কমানোর উদ্দেশ্যে আমি তার মাখনের মতো নরম ফরসা পেটে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললাম, ‘জানিস তোর রুমালটা কাল হারিয়ে গেছে।’

সে কথা শুনে নন্দিতা উঠে বসে আমার গলা জড়িয়ে ধরে বলল, ‘রুমাল হারিয়েছে তো কী হয়েছে? আমাকে তো পেয়েছিস।’

আমি কিছু বলার আগেই সে তার উষ্ণ চুম্বনে আমার ঠোঁট দুটো পুড়িয়ে দিল। ভুলিয়ে দিল রুমাল হারানোর কষ্টটা।

দেশভক্ত

স্কুল থেকে এসে ব্যাগটা খাটে ছুড়ে দিয়ে এনসিসি-র ড্রেসটা খুলতে থাকে উপল। মা পেছন থেকে এসে বলে, ওই ঘেমো জামাকাপড়গুলো বিছানায় তুলবি না, যত রাজ্যের নোংরা লেগে আছে।

উপল ঘেমো শরীরেই মাকে জড়িয়ে ধরে, জানে মা এতে আরও বেশি রেগে যায়। মা-র এই রাগটুকু উপল উপভোগ করে, পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হয়ে নিলেই মা খুশি। গরিবের সংসারে পঞ্চব্যাঞ্জন না হোক, শাকপাতা দিয়ে মা যা রান্না করে, তাই উপলের অমৃত লাগে।

দেরি না করে কলপাড়ে হুড়োহুড়ি করে স্নানটা সেরে নেয় উপল। দুষ্টুমি করে চাতালে বসে থাকা কাকটাকে ভিজিয়ে দেয়। কা কা করে উড়ে কাকটা প্রতিবাদ করে যায়।

মা রান্নাঘরের দাওয়ায় বসে উপলের সুন্দর, সুঠাম চেহারা দেখে! ছেলেটা দেখতে দেখতে বড়ো হয়ে গেল। শরীরচর্চায় খুব উত্সাহ, পুলিশ বা মিলিটারিতে যাওয়ার ইচ্ছে আছে। সবসময় বলে, দেশের জন্য কিছু করর, লড়াইয়ে ময়দানে সামনের সারিতে থাকব। ছেলের এরকম ইচ্ছেতে মায়ের মন সায় দেয় না। তবে বড়ো হচ্ছে, ওর মতকেও তো গুরুত্ব দিতে হবে।

গত বছর, পাড়ার ক্লাবের পাশের ঝিলে একটা ছেলে ডুবে যাচ্ছে শুনে, এক ডাকে বেরিয়ে গেছিল, গিয়ে দ্যাখে আশেপাশের লোকেরা ঘিরে মজা দেখছে, কারুর নামার সাহস হচ্ছে না। উপল এক লাফে জলে নেমে, খাবি খেতে খেতেও ওকে উদ্ধার করে এনেছিল।

স্কুলের শারীরশিক্ষার শিক্ষক দীপেনবাবু উপলকে বিশেষ স্নেহ করেন। উপলের সততা, সুন্দর ব্যবহার আর টিম স্পিরিট সকলের নজর কাড়ে। বিবেকানন্দ মিশন স্কুলের দশম শ্রেণির ছাত্র উপল, স্যারদের ডান হাত। কোনও কাজেই পিছপা হয় না। কারও বিপদ শুনলে ওইটুকু ছেলে ঝাঁপিয়ে পড়ে।

চন্দনা ওদের ক্লাসের ফার্স্ট গার্ল। উপল যা যা পারে, চন্দনা তা পারে না বলে উপলের ওপর ওর বাড়তি আগ্রহ। উপলের বোন আইরিন একই স্কুলে ক্লাস ফাইভে পড়ে। দাদা যে সকলের প্রিয়, এতে ওর প্রচ্ছন্ন গর্ব আছে। চন্দনা ক্লাসের অন্য ছেলেদের কাছে ঘেঁষতে দেয় না। কিন্তু উপল কিছু বলুক, একবার বললেই করে দেবে।

মাধ্যমিকে উপল টায়-টায় ফার্স্ট ডিভিশন পেল, চন্দনার সবেতেই লেটার মার্কস। আরও ভালো স্কুলে একাদশে ভর্তি হতে পারত। বেচারি, উপলের জন্য একই স্কুলে রয়ে গেল।

কৈশোর অতিক্রম করে উপলের ব্যাপারে চন্দনার আগ্রহ এখন নিখাদ ভালোবাসায় পরিণত হয়েে। কীসে উপলের ভালো হয়, পড়াশোনায় ওকে কতটা সাহায্য করা যায় এসবই চন্দনার ধ্যানজ্ঞান। উপল স্কুলের ফুটবল, ক্রিকেট দলের সদস্য, পাড়ার ক্লাবে জিমও করে, লক্ষ্য এখনও পর‌্যন্ত স্থির। চন্দনা চায় উপল পড়াশোনা করে শিক্ষকতা বা ব্যাংক-এ চাকরি করুক। তবু উপলের পছন্দের উপর প্রভাব খাটাতে পারে না। যাহোক দুটো বছর একসঙ্গে পড়াশোনা করবে, চন্দনার কাছে এই-ই অনেক।

চন্দনা বিজ্ঞান নিয়েে, উপল কমার্স। টিউশনির ব্যস্ততা চন্দনার অনেক বেশি, তাও নিয়ম করে উপলের খোঁজ নেয়। বাংলা, ইংরেজি তো ওদের দুজনেরই আছে। যত প্রশ্নোত্তর চন্দনা তৈরি করে, নোটস সব উপলকে দেয়। মনের আশা, ওগুলো পড়ে যদি উপল একটু ভালো রেজাল্ট করে।

এদিকে পাড়ায় ব্লাড ডোনেশন ক্যাম্প হোক কিংবা কোথাও রিলিফ দেওয়ার ব্যাপার সবার আগে হাজির উপল। মা মনে মনে ভাবে, তাদের মতো ছাপোষা সংসারে ছেলেটা যেন কেমন অন্যরকম। সারাদিনের খাটাখাটনির পর, ক্লান্ত শরীরে উপলের বাবার আর কিছু ভাবার ক্ষমতা থাকে না। এভাবেই দিন গড়িয়ে চলে।

উপলদের পাড়ায় এক বৃদ্ধ দম্পতি আছেন, উপল তাঁদের দাদু-ঠাকুমা বলে ডাকে। কদিন আগে ঠাকুমা পড়ে গিয়ে আর উঠতে পারেন না। কে তুলবে? কে নিয়ে যাবে? উপল হাজির ঠাকুমার সেবায়। প্লাস্টার করিয়ে আনা, রোজকার নিত্যকর্মে সাহায্য করা, এমনকী রান্না করে খাওয়ানো অবধি, উপল একাই করেছে।

মা-র মনে মনে শংকা হয়, এত উদার, এত ভালো ছেলে। কোনও স্বার্থপরতা ওকে স্পর্শ করেনি। যেন দেবতা, মানুষ নয়!

ঠাকুমা তো সুস্থ হয়ে সে কথা জনে জনে বলেন, আমার নিজের ছেলে-বউ,

নাতি-নাতনিরা খোঁজ নিল না। এই প্রাণটুকু কে বাঁচালে? ওই তো উপল।

দেখতে দেখতে দুবছর অতিক্রান্ত হল উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা সামনে। চন্দনার অভিভাবকরা চান ও ডাক্তারি পড়ুক, তাই এসময় তার চাপটা একটু বেশি। উপল যথা পূর্বং তথা পরং। সবকিছুর সঙ্গে মানিয়ে ওর পড়াশোনা।

পরীক্ষার রেজাল্ট বেরোনোর পর দেখা গেল, উপল টেনেটুনে ফার্স্ট ডিভিশন আর চন্দনা সবেতে লেটার পেয়েছে। উপল জানে চন্দনা ডাক্তারিতেও চান্স পাবে। ওর দিক থেকে চন্দনাকে দখল করে রাখার কোনও চেষ্টা নেই। সময় গড়িয়ে যা হবার হবে, আগে ওর লক্ষ্যপূরণ।

দেশের-দশের কাজ করার সুযোগ আছে, এমন একটা চাকরি পাওয়া খুব জরুরি। পুলিশ, মিলিটারি দুইয়েই প্র‌্যাক্টিক্যাল পরীক্ষা খুব কঠিন হয়, উপল জানে। শরীরকে তৈরি রাখতে হয়, কতজন দৌড়ানোর ট্র‌্যাকে অজ্ঞান হয়ে যায়। তবে, স্নাতক হয়ে পরীক্ষাগুলো দেবে, তাহলে সুযোগও বাড়বে।

চন্দনা এখন কলকাতা মেডিকেল কলেজের স্টুডেন্ট, মাঝে মাঝে উপল ওকে কলেজেও পেঁছে দেয়। চন্দনার বাবা-মা-ও উপলকে মেনে নিয়েেন, ওর সততা, সুন্দর ব্যবহারের জন্য। উপলের মায়ের অবশ্য আশংকা, অমন মেধাবী মেয়ে তার সাধারণ ছেলেকে শেষ অবধি বিয়ে করবে তো? মায়ের চিন্তা ছেলে যেন কোনও ভাবে দুঃখ না পায়। তবে সাদাসিধে চন্দনাকে ভালোও লাগে। মেযোর সরলতা সবাইকে মুগ্ধ করে। সবচেয়ে বড়ো কথা, এই পরিবারের ওপর ওর টান, যেন এটা ওর নিজেরই পরিবার।

উপল সিটি কলেজে যায়, কলেজ টিমের হয়ে ইন্টারকলেজ কম্পিটিশনে খেলে।

লং-জাম্প-এ ডিস্ট্রিক্ট চ্যাম্পিয়ন। কলেজ মিটে কলকাতা কমিশনিয়ারেট-এর কর্তাব্যক্তিরা উপলের শারীরিক সক্ষমতার প্রশংসা করে, ওকে চাকরির প্রস্তাবও দেয়।

উপল মেঘ না চাইতে জল পায়, খুশি হয়ে আইরিনের জন্য ফ্রক আর বাড়ির জন্য মিষ্টির প্যাকেট নিয়ে ঘরে ঢোকে। মা মিষ্টি হাতে নিয়ে চোখের জলে ভাসেন। খুশি হবেন নাকি দুঃখ পাবেন, বুঝে উঠতে পারেন না। আইরিন নতুন ফ্রক পেয়ে তিড়িংবিড়িং করে লাফাতে থাকে। মায়ের পীড়াপীড়িতে চন্দনাকে কলেজ ফেরত আসতে বলে, একসঙ্গে খাওয়াদাওয়া করে সেলিব্রেট করবে বলে।

 

পার্ট-টু পরীক্ষার রেজাল্ট বেরোতে উপল কলকাতা পুলিশের ট্র‌্যাফিক গার্ডে সার্জেন্ট হিসেবে জয়ে করে। নিয়মমাফিক সব শারীরিক পরীক্ষা উপলকেও দিতে হয়। চন্দনা অবশ্য তেমন খুশি নয়। তারা যখন ঘরে আরাম করবে, উপলকে তখন রোদে গরমে ডিউটি করতে হবে। মনে মনে ভাবে আরও পড়তে পারত। মুখে কিছু বলে না। ওর আনন্দের সঙ্গে তার নিজের আনন্দকে মিলিয়ে নিতে হবে, এতেই তার সুখ।

চাকরিসূত্রে উপলকে কলকাতা চষে বেড়াতে হয়। শুধু ইন্টার অফিস মিট থাকলে খেলার জন্য ছাড় পায়। কখনও গার্ডেনরিচ তো কখনও বেহালার রাস্তায় ট্র‌্যাফিক সামলাতে দেখা যায় তাকে। বেনিয়ম করে গাড়ি দাঁড় করানো, কি ঘুস নেওয়া, এসবে দেখা যায় না উপলকে। চাকরি জগতেও তার বিরল স্বভাবের নিদর্শন চলতে থাকে। চন্দনা এমবিবিএস ফাইনাল দেবে এ বছর, হাজার ব্যস্ততাতেও উপলের খবর রাখে। ওর ক্ষমতায় যতটুকু কুলায় পরামর্শ দেয়।

সেদিন হেদুয়ার সামনে ডিউটি করছিল উপল। উলটো দিকে বেথুন থেকে কলেজ ফেরত মেযো বেরোচ্ছিল। রাস্তায় দাঁড়িয়ে তিন রোমিও ওদের দিকে বিশ্রী অঙ্গভঙ্গি করছিল। উপলের ব্যাপারটা নজরে আসে। ডিউটির পোশাকে সরাসরি মারধর তো করতে পারে না। গিয়ে ধমক দিয়ে এলাকা ছাড়া করেছিল ছেলেগুলোকে। তখনকার মতো চলে গেলেও,ওরা উপলকে পরে দেখে নেবে বলে শাসিয়ে ছিল।

উপলের কষ্ট হয় এই ভেবে, যে আইরিনও তো দুদিন পরেই কলেজ যাতায়াত করবে আর এইসব ইভটিজারদের খপ্পরে পড়বে। এরা মেয়েের নূ্যনতম সম্মানটুকু করে না, এরা কি আমাদের দেশের পরম্পরা, ঐতিহ্য জানে? কোন ধাতু দিয়ে গড়া, নরকের কীট সব!

চন্দনাকে ফোনে ওইদিনের অভিজ্ঞতা শেয়ার করায়, ওর ভয় দ্বিগুন হল। এমনিতেই উপলকে নিয়ে সবসময় ভয়ে ভয়ে থাকে। উপল চন্দনার মধ্যে ওর মায়ের ছায়া দ্যাখে। সকলের স্বাভাবিক চলাফেরা নিশ্চিন্ত করার জন্য, পুলিশের যে বিশেষ ভূমিকা আছে, ওকথা অস্বীকার করার উপায় নেই। চোখের সামনে অপরাধ দেখে যে চুপ করে বসে থাকা যায় না, তা চন্দনাকে বোঝাতে পেরেছিল।

উপল জোর করে বাবাকে ভিআরএস নেওয়া করিয়েছে। সংসারের পুরো দাযিত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েে। আইরিনকে অনেক দূর পড়ানোর স্বপ্ন দ্যাখে। পরদিন পুলিশ মিট উপলক্ষ্যে ধানবাদ যেতে হবে। আজকে নাইট ডিউটি কলেজ স্ট্রিটে। পরদিন রাতে ধানবাদ যাওয়ার ট্রেন। বিকেলে চন্দনার সঙ্গে দেখা করে নিতে হবে। দু-তিন দিনের জন্য বাইরে গেলে এটা উপলের আবশ্যিক কর্তব্যের মধ্যে পড়ে।

চন্দনাকে বাড়িতেই ডেকে নিল উপল। চন্দনার এ বাড়িতে যাতায়াত এখন স্বাভাবিক ব্যাপার। চন্দনা এল। একটা গোলাপি রঙের সালোয়ার কামিজ পরেছে। আজ কেন যেন উপলের দুচোখ ভরে চন্দনাকে দেখতে ইচ্ছে করছে। চন্দনা অবাক হয় উপলের এই আবেগ দেখে।

মায়ের বানানো লুচি তরকারি দিয়ে দুজনে বিকেলের জলখাবার সারে। দুজনেই হাক্লান্ত, ক্ষিদেও পেয়েছিল বেশ। খেয়ে নিযে উপলের চুলের গোছা নেড়ে দিয়ে চন্দনা বেরোল। বারবার পেছন ফিরে দেখছিল। বেরোনর আগে, ধানবাদ পৌঁছে খবর দেওয়ার কথা বলেছিল। চন্দনা চলে যেতে, আইরিনকে কটা অঙ্ক বুঝিয়ে রাতের ডিউটিতে যাওয়ার জন্য তৈরি হয়ে নিল উপল।

 

মা আজ পাড়ায় কীর্তন শুনতে যাবেন। তাও ছেলের কাচা পোশাক, সবকিছু গুছিয়ে দিলেন। কী মনে হতে উপল ঢিপ করে মাকে একটা প্রণাম করে নিল। সংসার চালানোয় মায়ের নিপুণতা উপলকে মুগ্ধ করে। চন্দনাকে ঘিরেও স্বপ্নের বীজ বোনে। বড়ো শ্রীমযী চন্দনা, অফুরন্ত ভালোবাসা দেয় তাকে।

আজ ডিউটিতে উপল ছাড়াও আরও দুজন সার্জেন্ট আছে। রাতের রাস্তা আস্তে আস্তে ফাঁকা হচ্ছে, ভারী গাড়ির আনাগোনা এসময় বেশি। দুজন সঙ্গী কাছের দোকানে চা খেতে গেল। উপল সতর্ক চোখে তাকিয়ে আছে। হঠাত্, ওকি!

বাইকের পেছনে একজন তরুণী, চালাচ্ছে এক যুবক। পাশে একটা গাড়ি থেকে বাইকটাকে ডিসটার্ব করা হচ্ছে। তরুণীর ওড়নাটাকেও টেনে ধরেছে।

গাড়িটাকে দাঁড় করাল উপল। ভেতর থেকে মদ্যপদের খিস্তি, খেউড় ভেসে আসছে। ওরা নেমে এসে উপলের ওপর চড়াও হল। চারজনে মিলে লাগাতার মেরে চলেছে ওকে। একা অভিমনু্য় যেন জগতের সব লাঞ্ছনা মুছে দিতে চাইছে। নাক দিয়ে রক্ত ঝরছে, পা ভেঙে গিয়েে, কেউ সাহায্য করতে এগিয়ে আসছে না। এমনকী, যে-বাইকআরোহীদের বাঁচাতে সে এগিয়েিল, তারাও না। উপলের দৃষ্টি ক্রমশ ঝাপসা হচ্ছে। চোখের সামনে ভাসছে চন্দনার মুখ, কানে বাজছে আইরিনের দাদা ডাক, মায়ের কাতরতা। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের অভিমনু্যর মতোই ক্ষতবিক্ষত, রক্তস্নাত হয়ে পথেই পড়ে রইল সে।

সঙ্গী দুজন ফিরে আসার আগেই শয়তানগুলো পালিয়েে। পুলিশের গাড়িতে চলেছে ভারতমাতার সাহসী সন্তান। নারী লাঞ্ছনার প্রতিবাদে যে নিজের প্রাণটাই বাজি রেখেছে। কাছাকাছি কলকাতা মেডিকেল কলেজে নিয়ে যাওয়া হল উপলকে। ডিউটি নার্স ওকে দেখেই চমকে উঠলেন। কারণ চন্দনার সঙ্গে উপলকে আগে দেখেছেন আর ও যে পুলিশে আছে সে কথাও জানেন।

ওয়ার্ডবয়ে সাহায্যে দ্রুত ট্রমা কেয়ারের আইসিইউতে নিয়ে চললেন। এক ফাঁকে ফোনে চন্দনাকে সব জানালেন। ডাক্তারি শপথ কি আর প্রিয়জনদের ক্ষেত্রে খাটে? আবেগ কি প্রশমিত করা যায়? চন্দনাও পারল না, শোকে মূর্ছিতাপ্রায় হয়ে বান্ধবীদের সঙ্গে এসে পৌঁছোল। ওর স্যারেরাও জান-প্রাণ লড়িয়ে দিলেন। প্রশাসনিক মহল থেকেও বিশেষ তত্পরতা দেখা গেল। ঘটনাস্থলে প্রচুর ব্লিডিং হয়েিল। তাই অরগ্যানস-এ, বিশেষ করে মাথায় অক্সিজেনের ঘাটতি এমন পর‌্যায় পৌঁছেছে যে, কোনও ওষুধই ঠিকমতো কাজ করছে না। উপল গভীর কোমায় চলে যাচ্ছে। উপলের আত্মীয়পরিজনেরাও এসেছেন ওর মাকে সামলানোর জন্য।

দৈনন্দিন জীবনে যে-যার সমস্যায় ব্যস্ত থাকে কিন্তু বিপদ এলে রক্তের সম্পর্ককে উপেক্ষা করা যায় না। ডাক্তারির অভিজ্ঞতায় চন্দনাও বুঝতে পারছে, শেষের সে ক্ষণ আসন্ন। আগামী চিরবিচ্ছেদের আশঙ্কার মধ্যেও ওর চোয়াল শক্ত হয়, রাস্তার গুন্ডাগুলোর কথা ভেবে। আইসিইউ-এর কাচের বাইরে উপলের দিকে স্থির চোখে তাকিয়ে আছে চন্দনা।

চোখের সামনে অদৃশ্য পর্দায় ভেসে উঠছে তাদের ছোটোবেলা, কৈশোর ও যৌবনে একসঙ্গে কাটানো মুহূর্তগুলো। ভেতরে নদীর পাড় ভাঙা টের পাচ্ছে, কেমন জীবন হবে তার উপলকে ছাড়া? মাসিমা, আইরিনকেই বা কীভাবে সামলাবে? ভাবনার ছন্দপতন হল বোস স্যার কাঁধে হাত রাখলেন, হি ইজ নো মোর মাই চাইল্ড, বলে মাথা নীচু করলেন।

ওরা উপলকে ঢেকে দিচ্ছে, এক ছুটে ঢুকল চন্দনা। শেষবারের মতো উপলের চুলে বিলি কেটে দিতে হবে না! ও তো সব দুঃখ, কষ্ট, যন্ত্রণা, অপমান থেকে বহুদূরে আরামে ঘুমোতে যাচ্ছে।

স্কুল জীবনের বন্ধুবান্ধবরাও অনেকে খবর পেয়ে এসেছে, চন্দনার সঙ্গে সঙ্গে থাকছে। শোকেরও তো সুযোগ নেই! পোস্টমর্টেম না হলে তো বডি দেবে না। চন্দনার বাবা-মাও আছেন, সবারই বাড়ি ফেরা স্থির হল। পরদিন আসতে হবে।

চোখের জলে ভেসে, বাবা-মার কাঁধে ভর দিয়ে চন্দনা বেরিয়ে আসে তার রোজকার ফেরার করিডর দিয়ে যে-করিডরে উপলও অনেক দিন তাকে সঙ্গ দিয়েে। মাসিমাকে দূর থেকে দেখতে পায়, উপলের মামাদের সঙ্গে। ওদের দাযিত্ব তো উপল তার ওপরে ছেড়েই অকালে বিদায় নিল।

পরদিন কাচের গাড়িতে উপল চলল সেইসব রাস্তা দিয়ে যে-রাস্তায় একনিষ্ঠতার সঙ্গে ডিউটি করেছে সে। পেরিয়ে যায় ওর কলেজ, থানায় গার্ড অফ অনার নিয়ে চলল পঞ্চভূতে লীন হতে।

চন্দনা মাসিমার সঙ্গে সেঁটে আছে, আইরিনই দাদার মুখাগ্নি করল। ইলেকট্রিক চুল্লির অন্ধকারে মিলিয়ে গেল, আলোকিত এক প্রাণ তার সমস্ত জাগতিক সম্ভাবনা নিয়ে চন্দনা চোখের জল মুছে শক্ত হল। তার এখন অনেক কাজ। প্রথম কাজ হল উপলের ওপর ঘটে যাওয়া জঘন্য অপরাধের প্রতিবিধান করা। প্রশাসন কী কী পদক্ষেপ করছে, তার ওপর কড়া নজর রাখবে সে। সঙ্গে উপলের চাকরির জায়গার পাওনা-গন্ডা পরিবার ঠিকমতো পাচ্ছে কিনা দেখা। ডিউটিরত অবস্থায় যখন ঘটনা ঘটেছে, তখন বিশেষ ক্ষতিপূরণও মাসিমা পাবেন।

খবর এল অপরাধী চারজন ধরা পড়েছে, তবে জেল-আদালতে চক্কর কাটা ছাড়া তো কোন সুরাহা হবে না। চন্দনা ওর এক বান্ধবীকে আইরিনকে পড়াবার দাযিত্ব দিয়েে। সবকিছুর মাঝে উপলের তার বোনকে ঘিরে দেখা স্বপ্নটা নষ্ট না হয়ে যায়। আদালতে সাক্ষ্য দেওয়ার লোকই তো পাওয়া যাচ্ছে না! এক চলমান শহরে, ছুটে চলে যাওয়া সাক্ষীদের কোথায় পাওয়া যাবে?

ওদিকে অপরাধী পক্ষ, সমাজে প্রভাবশালী হওয়ায়, টাকা ছড়িয়ে মিথ্যে সাক্ষী ধরে ধরে নিয়ে আসছে। চন্দনা ওর নেটওয়ার্ককে কাজে লাগিয়েে, ওই বাইকআরোহী আর মেযোকে খুঁজে বার করার জন্য। প্রাইভেট ডিটেক্টিভও লাগিয়েে। পুলিশ চেষ্টা করছে কিন্তু চন্দনা ভরসা রাখতে পারছে না। প্রভাবশালীদের হস্তক্ষেপে যদি খোঁজার আন্তরিকতা না থাকে। আদালতে সরকারি উকিল ছাড়াও ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় ভালো উকিল ঠিক করে রেখেছে।

নিজস্ব নেটওয়ার্কের মাধ্যমে ওই বাইকআরোহী আর মেযোর খোঁজ পেয়েে। একদিন লুকিয়ে দেখা করতে গেল। বুঝিয়ে বলল, উপলের মা, বোনের কথা। তার নিজের দুঃখের কথা। মেযো লজ্জা, অপমান, অনাগত আশংকায় কিছুতে রাজি হচ্ছে না সাক্ষ্য দিতে। চন্দনা অনেক চেষ্টা করল, ওর বিবেককে জাগ্রত করার। শেষে সব পরিস্থিতি চন্দনা সামলাবে, পুলিশও পাশে থাকবে এসব বলে যখন ফিরছে দূর থেকে দেখল ওই বাড়িতে কারা যেন ঢুকছে।

পরদিন অপরাধীদের সনাক্তকরণ প্যারেডে আনা হল, ম্যাজিস্ট্রেটের কক্ষে। গোপন জবানবন্দিতে মেযো জানাল, অপরাধী বলে যাদের আনা হয়েে তাদের সে চেনে না। কোনও দিন দেখেনি আর ঘটনার সময় ঘটনাস্থলে ভালো আলো ছিল না বলে, পরিষ্কার ভাবে সে কিছু বোঝেনি। তাকে যেন ভবিষ্যতে আর বিরক্ত করা না হয়।

শেষ আশাও বিফলে যাওয়ায় চন্দনা মাথা নীচু করে বসে আছে। এ সময় ওর কাঁধে কে হাত রাখল। আরে আইরিন! নিঃশব্দে কাঁদছে আইরিন। শক্ত করে ধরেছে চন্দনার হাত। সব আশ্বাস যেন ওই হাতেই আছে। আইরিনের মধ্যেই যেন উপলকে দেখতে পেল চন্দনা।

উড়ান

জুনি মোবাইলে সময়টা দেখে নিল। এখনও সময় আছে পার্লার পৌঁছোনোর। আগে থেকেই অ্যাপয়েন্টমেন্ট করা, সুতরাং সময়মতো ওকে পৌঁছোতে হবে। নতুন নতুন বিয়ের পর ওর এইসব সাজগোজ, পার্লারে বসে রূপচর্চা খুব ভালো লাগত। এখন পানিশমেন্ট মনে হয়! আগে এইসব করার জন্য একটা মন ছিল ওর, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে শরীর, মনে কেমন একটা শিথিলতা চলে এসেছে জুনির।

ওর বয়স এখন মাত্র সাতাশ। বড়ো বড়ো চোখ, পাতলা ঠোঁট, টিকালো নাক, কালো ঘন চুল যা কিনা স্টেপ করে কাটা, গায়ের রং একটু মাজা, যেটাকে আমরা শ্যামবর্ণ বলে থাকি। সব মিলিয়ে বেশ চোখে পড়ার মতো ব্যক্তিত্ব।

জুনি মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে। তিন বোন, জুনি মেজো। বড়ো আর ছোটো বোন অপরূপ সুন্দরী, গায়ের রং দুধে আলতা বলতে যা বোঝায়, সেখানে জুনির গায়ের রংটাই একটু চাপা। এর জন্য মনে মনে জুনি একটু বিব্রত হতো। অথচ ওর চোখের মধ্যে এমন একটা আকর্ষণ ছিল যে, সৌমেন একবার দেখেই জুনিকে বিয়ে করতে মনস্থ করে ফেলে।

বিয়ের পাঁচ বছর পরেও জুনি আজও বুঝতে পারেনি, ওদের বিয়েতে সৌমেনের মা-বাবা আদৌ খুশি হয়েছিলেন কিনা। ওর এই একই প্রশ্ন সৌমেনকে নিয়ে। জুনি কি আদৌ সৌমেনকে খুশি করতে পেরেছে?

পার্লারে মেয়েটির দক্ষ হাত জুনির সারা মুখে মাসাজ করছে। ছোট্ট গদিপাতা বেঞ্চটায় শুয়ে আরামে চোখ বুজল জুনি, অতীতের ঘটনাগুলো চোখের সামনে এসে ভিড় করছে। সৌমেনের সঙ্গে ওর বিয়ে আজও স্বপ্ন মনে হয় জুনির। বিয়ের দিন নিজের শাড়ি, গয়না দেখে জুনি বেশ বুঝতে পারছিল ওর বোনেদের, এমনকী বান্ধবীদেরও ওকে দেখে ঈর্ষাবোধ হচ্ছে। সৌমেনদের বাড়ি থেকে পাঠানো হয়েছিল বিয়ের পুরো সরঞ্জাম। লাল বেনারসিতে ঠাসা জরির বুনন, সোনার তারের কাজ। ওড়নাতেও শাড়ির সঙ্গে মানানসই কাজ করা।

গা ভর্তি গয়না, যার বেশিরভাগটাই শ্বশুরবাড়ি থেকেই আসা। বিয়ের দিন হিরের সেট দিয়ে শ্বশুরমশাই আশীর্বাদ করে গেলেন। সত্যি, কনেকে দেখে রাজকুমারীই মনে হচ্ছিল।

নতুন বউ হয়ে শ্বশুরবাড়িতে প্রবেশ করার সময় বুকের ভিতরটা কেমন যেন ভয়ে কাঁপছিল। এই বিশাল বাড়িতে সৌমেন থাকে। এ তো পুরো রাজপ্রাসাদ। জুনি ভয়ে সিঁটিয়ে ছিল। বউভাতের দিন রাতে বউভাতের ধড়াচুড়া ছাড়ার পর, এক ফাঁকে শাশুড়ি এসে ঘরে ঢুকেছিলেন। সৌমেন অতিথিদের ছাড়তে নীচে গিয়েছিল। একটা প্যাকেট ধরিয়ে শাশুড়ি বলেছিলেন, শাড়ি ছেড়ে এটা পরে নিও। আশা করি, আজ রাত্রে কী করতে হয় সেটা তুমি জানো? প্যাকেটের ভিতর সাদা ফাইন কাগজে মোড়া সুন্দর একটা নাইটি, যেটা বিদেশ থেকে কেনা বলেই মনে হয়েছিল জুনির। শাশুড়ির কথা শুনে জুনির গাল, কান সব লাল হয়ে উঠেছিল।

অবশ্য সৌমেন ভালোবাসার পাকদণ্ডি বেয়ে খুব যত্ন করে ধৈর্য্য সহকারে জুনিকে চলতে শিখিয়েছিল। সৌমেনের বাড়ির আদবকায়দা, রীতি-রেওয়াজ, পোশাক পরার ঢং একেবারেই জুনির বাপের বাড়ি থেকে আলাদা ছিল। ধীরে ধীরে জুনি নিজেকে শ্বশুরবাড়ির আদলেই ঢেলে সাজিয়ে তোলে।

একমাস পরে যখন ও বাপের বাড়ি কয়েকদিনের জন্য থাকতে এল, সকলে ওকে দেখে অবাক হয়ে গেল। নিজেদের বাড়ির মেয়েকেই যেন চেনা যাচ্ছে না। অতি সাধারণ থেকে রাজেন্দ্রানী। শুঁয়োপোকার খোলস ত্যাগ করে যেমন পূর্ণাঙ্গ প্রজাপতির আবির্ভাব ঘটে। কিন্তু এই নতুন ডানা নিয়ে কতদিন সে উড়তে পারবে, সেটা তখনও সকলের অজানাই ছিল।

শ্বশুরবাড়ি ফিরে আসতেই টিকিট কাটাই ছিল, সৌমেনের সঙ্গে সারা পৃথিবী ঘুরে বেড়াবার জন্য বেরিয়ে পড়ল জুনি। মোট দুই মাসের টুর। দেখতে দেখতে দিনগুলো যেন পার হয়ে গেল। জুনির কাছে এটা রূপকথার সফর ছাড়া আর কিছুই ছিল না। ও আর সৌমেন। প্রথম মদ্যপান বিদেশেই। তখন ও বুঝতেও পারেনি এই আসক্তি ধীরে ধীরে বাড়তে বাড়তে একদিন অভ্যাসে পরিণত হবে।

বাড়িতে ফিরে প্রথমেই খেয়াল করল, ওর বাড়ি থেকে আনা পুরোনো জামাকাপড় আর একটাও নেই। সবই আধুনিক পোশাকে বদলে ফেলা হয়েছে। শাশুড়ি একটা ফর্দ তৈরি করে জুনির হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন, এ বাড়ির বউ, মেয়েের এগুলো শিখে রাখাটা অত্যন্ত জরুরি। আমি ব্যবস্থা করে দিয়েছি, কাল থেকেই শুরু করো।

অগত্যা দুই-তিন মাস ধরে চলল ড্রাইভিং, সুইমিং, ঘোড়ায় চড়া সবকিছু শেখার পালা। জন্মদিনে উপহার হিসেবে গাড়ি কিনে দিল সৌমেন। নিজে ড্রাইভ করে বাপের বাড়ি পেঁছোলে, জুনির মা-বাবা মেয়ের ভাগ্য দেখে, আনন্দে কেঁদেই ফেললেন।

স্বাভাবিক ভাবেই ভগবানের আশীর্বাদ বলেই মেনে নিলেন জুনির কপালকে। এত ভালো শ্বশুরবাড়ি আজকালকার দিনে ক’টা মেয়ের ভাগ্যে জোটে? বাড়ির বউকে এতটা স্বাধীনতা কে দেয়? সৌমেনের মা-বাবা মেয়েবউয়ের মধ্যে তফাত করতেন না। কিন্তু জুনির মনে হতো স্বাধীনতার উপর সকলের মৌলিক অধিকার রয়েছে। স্বাধীনতা দেওয়ার কী আছে? এটা আবার কেউ কাউকে দেয় নাকি? আধুনিক জীবন কাটাবার জন্য জুনির সম্পূর্ণ স্বাধীনতা ছিল ঠিকই কিন্তু কিছু শর্ত এবং নিয়মের গণ্ডিও মেনে চলতে হতো। মনে মনে নিজেকে পুরো স্বাধীন বলে ভাবতে পারত না জুনি। বিয়ের পাঁচ বছর পরে আজও পারে না। পার্লারে বেঞ্চটাতে শুয়ে ব্যঙ্গের হাসি ফুটে ওঠে জুনির ঠোঁটের কোণায়।

পার্লার থেকে বেরিয়ে রাস্তায় রোল কিনে খেতে ইচ্ছে করল। কিন্তু মনে পড়ল ডায়েটিশিয়ান এইসব ফাস্টফুড খেতে একেবারে বারণ করে দিয়েছেন।

বাড়ি ফিরে বিস্বাদ সেদ্ধ খাবার কোনও মতে গলা দিয়ে নামিয়ে নিজের ঘরে চলে এল জুনি একটু আরাম করতে।

সন্ধেবেলায় একটা সোশ্যাল ফাংশনে যাওয়ার কথা শাশুড়ির সঙ্গে। শাশুড়ির জন্য একটা বক্তৃতাও তৈরি করার কথা। সেটা করতে করতেই পাঁচটা বেজে গেল। ইচ্ছে করছিল একটু কফি খাবার। রান্নাঘরের দিকে পা বাড়াতেই রান্নার ঠাকুর এসে এক গেলাস কিছু পানীয় ধরিয়ে দিল জুনির হাতে, এটা খেযে নাও দিদি। মা বলেছেন রাঙাআলু আর গাজরের রসটা বিকেলে চায়ের বদলে তোমাকে দিতে।

বাধ্য হয়ে ওষুধের মতো খেয়ে নিয়ে জুনি তৈরি হতে ঘরে চলে এল।

পেস্তা রঙের একটা জামদানি শাড়ির সঙ্গে ম্যাচ করে পান্নার একটা হালকা সেট বেছে নিল। কপালে বড়ো একটা টিপ পরে, আয়নায় নিজেকে দেখে সন্তুষ্ট হল।

গাড়িতে বসে রাস্তায় যেতে যেতে বক্তৃতা পুরো পড়ে শাশুড়িকে বুঝিয়ে দিল।

ফাংশনে কিছু ভালো লাগছিল না জুনির। সে কলমের জোরে বক্তৃতাটা তৈরি করেছিল ঠিকই কিন্তু মনে মনে জানত মনের কথা কলম দিয়ে শুধু নয়, হৃদয় দিয়ে লিখতে হয়। বক্তৃতার বিষয়টা ছিল, আমার অধিকারের প্রাধান্য বেশি, নাকি পরিবারের প্রতি দায়িত্বের…

হনিমুন থেকে ফেরার পর জুনির শরীরটা তেমন ভালো যাচ্ছিল না। সৌমেনের, প্রেমে তখনও হাবুডাবু খাবার অবস্থা। জুনিকে এক মুহূর্ত চোখের আড়াল হতে দেয় না। এক প্রকার জোর করেই সৌমেন জুনিকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেল। ফ্যামিলি ডাক্তার, জুনিকে পরীক্ষা করেই বললেন, সৌমেন মিষ্টির ব্যবস্থা করো, নতুন সদস্য আসতে চলেছে।

লজ্জায় জুনির গাল লাল হয়ে উঠল কিন্তু সৌমেন খুব খুশি হয়েে বলে মনে হল না। গাড়িতে বসতেই বলল, ওষুধ যেটা দিয়েিলাম ঠিকমতো খাওনি নাকি?

জুনি ভেবে উত্তর দিল, মনে হয় যে রাতে তোমার সঙ্গে বসে হুইস্কি খেয়েছিলাম… একটু জোরেই বলে ওঠে সৌমেন, হাউ ক্যান ইউ বি সো ইরেসপন্সিবল?

জুনি চুপ হয়ে গিয়েছিল। পুরো রাস্তা আসতে আসতে ভাবছিল হয়তো সৌমেন নতুন দায়িত্ব নিতে ঘাবড়াচ্ছে। জুনিও মাতত্বের স্বাদ পেতে পাগল হয়ে উঠেছিল এমনটাও নয়। কিন্তু যে আসতে চলেছে তাকে অস্বীকার করার ইচ্ছে জুনির ছিল না।

বাড়ি ফিরে চায়ে চুমুক দিতে দিতে সৌমেন মা-কে সব কিছু খুলে বলতেই, জুনির মনে হল শাশুড়ির মুখে বিদ্রুপের ভাব ফুটে উঠল। তিনি ব্যঙ্গ করেই বললেন, মধ্যবিত্ত বাড়ির মেয়েদের নিয়ে এই এক মুশকিল। অবশ্য এদের কাছ থেকে কী-ই বা আশা করা যায়। বিয়ে হয়ে যাওয়া মানেই ছেলেপুলের মা হয়ে বসা।

জুনির চোখে জল চলে এল। সৌমেন সেটা উপেক্ষা করেই বলল, বাচ্চা নেব কি নেব না, সেটা আমাদের দুজনেরই সম্মতিতে হওয়া উচিত। আমার অজান্তেই এতসব ঘটেছে এটা সত্যিই দুঃখের। কিন্তু এই দায়িত্ব নিতে আমি এখন তৈরি নই। এখন তো সবে জীবন শুরু করেছি।

অ্যাবর্শন-এর ঘটনাই প্রথম জুনির চোখ খুলে দিল। ও বুঝতে পারল ডানা তাকে দেওয়া হয়েে ঠিকই কিন্তু কতটা সে উড়বে সেটার রিমোট কন্ট্রোল তার শ্বশুরবাড়ির হাতে রয়েছে।

নার্সিংহোমে সবকিছুই ঠিক ভাবে হয়ে গেল। শরীরে কোনও ব্যথাই বোধ করল না জুনি। কিন্তু মনের ভিতরের ক্ষতটা দগদগে হয়ে উঠল। কেউ জানল না জুনির যন্ত্রণার কথা। ও কাকেই বা বলবে? এই ভাবে প্রথম ঘটনা, দ্বিতীয় ঘটনা, ঘটনাগুলো ভিড় করতে শুরু করল জুনির মনে। রোজই নতুন নতুন রং ঢেলে সাজানো হতো জুনির পাখা দুটোতে কিন্তু কেউই একবারের জন্যও জুনিকে জিজ্ঞেস করত না, রংগুলো আদৌ তার পছন্দ কিনা।

অথচ সবার চোখে জুনির মতো ভাগ্যবতী অন্য কোনও মেয়ে নজরে আসত না। সবার শ্বশুরবাড়িতেই নানা রকমের নিষেধ মানামানির ব্যাপার থাকে। অথচ জুনির কাছে আধুনিক পোশাক থেকে শুরু করে দেশবিদেশ ঘোরা, নিজের পছন্দ মতন কাজ করা, দামি পার্লারে গিয়ে রূপচর্চা করানো এত স্বাধীনতা কোন শ্বশুরবাড়ি থেকে দেয়? জুনির এই সুখ সকলের মনে ঈর্ষাই জাগাত।

বাপের বড়ি যাবে বলে তৈরি হচ্ছিল জুনি। হালকা নীল রঙের চিকন কাজের সুতির সালোয়ার কামিজ পরেছিল সে। গলায় পাতলা একটা সোনার চেন আর হাতে দুটো করে সোনার চুড়ি। তৈরি হয়ে ঘরের বাইরে আসতেই মুখোমুখি হতে হল সৌমেন আর শ্বশুরমশাইযে।

একী জুনি! এই পোশাকে মা-বাবার সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছ? ভালো শাড়ি কি নেই? হতভম্ব হয়ে জুনিকে প্রশ্নটা ছুড়ে দিলেন শ্বশুরমশাই।

সৌমেনও বাবার সঙ্গে গলা মেলাল, বাবা ঠিকই বলেছে। ভদ্র পোশাকে যাও, এটা পরার মতো পোশাক হল? বম্বের কলানিকেতন থেকে যে-শাড়িটা কিনে দিয়েিলাম সেই সিল্কটা পরে যাও। যাও চেঞ্জ করে এসো।

কলের পুতুলের মতো জুনি আবার নিজের ঘরে চলে এল। সৌমেনের দেওয়া প্রত্যেকটা শাড়ি যেমন দামি তেমনি সুন্দর। কিন্তু জুনি কাউকে এটা বোঝাতে পারে না, এত দামি শাড়ি আর দামি দামি গয়না ওর আর বাপের বাড়ির সকলের মধ্যে একটা দেয়াল তুলে দেয়। ওর এই দামি শাড়ি, গয়না দেখে তাদের মনে একটা হীনম্মন্যতা জন্ম নেয়। প্রাণখুলে কেউই তেমন আর কোনও কথা বলতে পারে না।

গলির মুখে গাড়ি দাঁড় করিয়ে জুনি পা টিপে টিপে বাড়ির ভেতর ঢোকে। জুনির মা ঠিকই টের পান মেয়ে আসা, কী রে জুনি, তুই এলি?

জুনি আবার সেই পুরোনো জুনি হয়ে ওঠে, উফ মা তুমি কী করে বুঝতে পারো বলো তো?

রান্নাঘরে এসে ঢোকে জুনি। মা রান্নায় ব্যস্ত। হাত ধুযে একটা প্লেট নিযে রান্না করে রাখা ছানার কোফতা তুলে খেতে শুরু করে দেয়।

জুনি, সাবধানে খা। এত দামি শাড়ি, একটু ঝোল পড়লেই শাড়িটা খারাপ হয়ে যাবে, মা সাবধান করলেন জুনিকে।

মা আর জুনির গলার আওয়াজ পেযে আরও দুই বোন এসে রান্নাঘরে ঢুকল। দিদি ফোড়ন কাটল, সেই ভালো জুনি, তুই ডাইনিং টেবিলে বসে কাঁটা-চামচ দিয়ে বরং খা। মা আমরা তো আছি বাসন ধুযে রান্নাঘর পরিষ্কার করার জন্য।

ছোটোবোন বলল, দি, তোকে কী দিই বলতো পা রাখার জন্য? তোর মাটিতে পা একেবারে মানায় না।

জুনি ওদের বক্রোক্তি গায়ে মাখল না। প্লেট-টা ধুযে বলল, চল, বাচ্চাগুলোর জন্য খেলনা নিযে এসেছি, দিয়ে দিই।

বিদেশ থেকে আনা খেলনাগুলো দুই বোনের ছেলেমেয়েের মধ্যে ভাগ করে দিল জুনি। ছোটো বোন হেসে বলল, দি, এত দামি দামি খেলনা প্লিজ আনিস না। খারাপ হয়ে গেলে আমরা ঠিকও তো করতে পারব না।

জুনি কী করে বলবে, সৌমেনের পছন্দ করা এসব খেলনা। জুনির কথা ওখানে কে শুনবে?

খেতে বসে মায়ের হাতের কচু শাক, লাউয়ে ঘন্ট, ছানার কোফতার ডালনা আর মাংস গোগ্রাসে জুনিকে খেতে দেখে মা হেসে ফেললেন। বললেন, কী রে শ্বশুরবাড়িতে খেতে দেয় না বুঝি? দেশবিদেশের কত রকমের খাবার খেযে বেড়াস। ওগুলো খেয়ে তোর মন ভরে না বুঝতে পারছি।

রাতটা মায়ের কাছে কাটাবারই কথা বলে এসেছিল জুনি। কিন্তু ঠিক সন্ধেবেলায় সৌমেনের ফোন এল, বড়ো পিসিমা হঠাত্ এসেছেন, তোমাকে বাড়ি চলে আসতে হবে। আমি ড্রাইভার পাঠিয়ে দিচ্ছি। ফোন রেখে দিল সৌমেন।

ড্রাইভার এসে বেল দিতেই জুনি দরজা খুলে দিল। ড্রাইভারের হাত দিয়ে শাশুড়ি সবার জন্য জামাকাপড় আর প্রচুর মিষ্টি পাঠিয়েছেন দেখল জুনি। বোনেদের হাতে উপহারগুলো তুলে দিতে দিতে জুনি স্পষ্ট বুঝতে পারল আনন্দে, লোভে ওদের চোখ চকচক করছে। জুনির ঠোঁটের মলিন একটুকরো হাসিটা সকলের চোখ এড়িয়ে গেল। মা কিছুটা ধরতে পারলেন ঠিকই, ইচ্ছে হল মেয়ে গলা জড়িয়ে ধরে জিজ্ঞেস করেন, হ্যাঁ রে তুই ভালো আছিস তো জুনি? কিন্তু পরক্ষণেই দামি শাড়ি, জামাকাপড়, মিষ্টির মোহ তাঁরও চোখকে পর্দার আস্তরণে ঢেকে দিল।

জুনি ভালো মতোই জানত সৌমেন আর ওর মা-বাবা কিছুতেই ওকে বাপের বাড়িতে রাত্রিবাস করতে দেবে না।

বাড়ি ঢুকতেই শাশুড়ি জড়িয়ে ধরলেন জুনিকে, সৌমেনের পিসিমা তোমাকে দেখবেন বলে একেবারে অস্থির হয়ে উঠেছেন। তাড়াতাড়ি শাড়ি বদলে বসবার ঘরে এসো।

জুনি আবার শাড়ি বদলে বসবার ঘরে ঢুকে পিসিমার পা ছুঁয়ে প্রণাম করল। জুনির মাথা থেকে পা অবধি পর‌্যবেক্ষণ করলেন পিসিমা, ভালো খবরটা কবে দিচ্ছ? খাওয়াদাওয়া করো ঠিকমতন?

সোফায় এসে বসল জুনি। এবার পিসিমা এসে পাশে বসে হাত দিয়ে জুনির মুখটা তুলে ধরলেন, বললেন, বাঃ শ্বশুরবাড়ির রং তো দেখছি ভালোই লেগেছে তোমার গায়ে এখানকার সুখসুবিধে পেয়ে কেমন লাগছে তোমার?

চুপচাপ বসে রইল। কী উত্তর দেবে বুঝে ঠিক করতে পারল না জুনি।

রাতে মদ্যপান করতে করতে সময়ে খেয়াল ছিল না জুনির। চোখ বুজে আসছিল। গেলাস ভর্তি এই পানীয়টাই একমাত্র ওকে শান্তি দিতে পারে। আলাদা জগতে বিচরণ করতে পারে, যেখানে সে ছাড়া আর কেউ থাকে না। নিজের ইচ্ছেমতন যা খুশি করতে পারে।

সকালে যখন ঘুম ভাঙল জুনির তখন বাইরে রোদ ঝলমল করছে। সৌমেন অফিসের জন্য তৈরি হচ্ছিল। জুনিকে দেখে বলল, এত কেন খাও যখন ওটা তোমার সহ্য হয় না?

মৃদু হাসল জুনি, তাহলে পান করার কী অর্থ নেশাই যদি না হল তো…

একাকিত্ব আর শূন্যতা ধীরে ধীরে জুনিকে গ্রাস করতে আরম্ভ করল। কিন্তু বাইরে থেকে কেউই সেটা বুঝতে পারল না। সে নিজের মতো করে জীবনটাকে বোঝার চেষ্টা করছিল কিন্তু সেটা কারওরই বোধগম্য হচ্ছিল না।

একদিন জুনি সৌমেনকে বলল, আমিও তোমার সঙ্গে অফিস যেতে চাই। সৌমেন খুশিই হল। ও রাজি হয়ে গেল। জুনি রোজ সৌমেনের সঙ্গে অফিস যেতে আরম্ভ করল। কিন্তু ওখানেও তার বিশেষ কিছুই করার ছিল না। দাবার ঘুঁটির মতো জুনির অবস্থা। এক কথায় বলতে গেলে সবকিছুই তার কিন্তু কোনও কিছুই যেন তার নিয়ন্ত্রণে নয়।

মরুভমির মতো হয়ে উঠল জুনির জীবনটা। জায়গায় জায়গায় মরীচিকা দেখা গেলেও জল কোথাও নেই সুতরাং তেষ্টা মিটবে কী করে? কয়েক মাস পরে নিজেই অফিস যাওয়া ছেড়ে দিল। অফিসে ওর পরিচিতি বলতে একটাই ছিল, সৌমেনের ওয়াইফ।

সৌমেনের কাকার ছেলের বিয়েতে বাড়িশুদ্ধু সবাই উপস্থিত ছিল। ককটেল পার্টি চলছিল। লাল রঙের অফ শোল্ডার গাউন আর রুবির গয়নার সেট-টায় অপরূপা হয়ে উঠেছিল জুনি। হালকা মিউজিকের সঙ্গে সকলেই ডান্স করছিল। কারও কারও হাতে গেলাস। দুটো পেগ আগেই খাওয়া হয়ে গিয়েিল জুনির। সৌমেনকে জড়িয়ে ধরল সে। কানের কাছে মুখ নিযে এসে বলল, সৌমেন আমি উড়তে চাই, আমাকে খাঁচায় বন্ধ করতে চেও না। আমি একটা সাধারণ মেয়ে আমাকে অসাধারণ করে তোলার জেদ ছেড়ে দাও।

কিছু উত্তর দেওয়ার আগেই সৌমেন খেয়াল করল ডান্স ফ্লোরে প্রায় সকলেরই চোখ ওদের উপর। জুনি কথাগুলো আস্তে বলতে চাইলেও আশেপাশে সকলের কানেই পেঁছেছে কথাগুলো। আরও কিছু না বলে বসে, এই ভয়ে সৌমেন ওর হাত ধরে একটু জোর করেই বাইরে এনে গাড়িতে তুলে দেয়। তারপর সোজা ড্রাইভ করে বাড়ি চলে আসে। সারারাত সৌমেনের ঘুম আসে না। কেন জুনি এরকম বলল? কী অভাব রেখেছে সৌমেন? কোথায় ভুল করে বসল সে? নিজেকেই নিজে প্রশ্ন করতে লাগল বারবার সৌমেন।

সকালে জুনি ঘুম থেকে উঠতেই সৌমেন জিজ্ঞাসা করল, তুমি সত্যি করে কী চাও জুনি? সবাই তোমার মতো জীবন পেতে চায় অথচ তোমার কাছে এরকম জীবনের কোনও কদরই নেই।

কী উত্তর দেবে জুনি? শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল জানলার বাইরে। মনের মধ্যে তোলপাড় হতে থাকল, সত্যিই কি বাস্তবে জুনি এমনটাই চেয়েছিল?

সোশ্যাল ফাংশন অ্যাটেন্ড করা, এলিট ক্লাবের মেম্বার হয়ে সৌমেনের সঙ্গে পার্টি অ্যাটেন্ড করতে যাওয়া, কোনও অনুষ্ঠানে অতিথির আসন অলংকৃত করতে শাশুড়ির সঙ্গে সেখানে গিয়ে বসে থাকা, পার্লার যাওয়া নয়তো শপিং আর নয়তো বাড়িতে চুপচাপ হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকা। এটাই জীবন হয়ে উঠেছিল জুনির। জীবনের সব রং হারিয়ে গিয়েছিল তার জীবন থেকে।

তখনই একদিন খবরের কাগজে বিজ্ঞাপনটা চোখে পড়ে। স্থানীয় কলেজে লেকচারারের পোস্ট। ইতিহাসের লেকচারার চাইছে। যে-বিষয়ে ও নিজে পড়াশোনা করেছে। কাউকে কিছু জিজ্ঞাসা না করেই আবেদন পাঠাল। সাক্ষাত্কারও চুপচাপ দিয়ে এল। জয়েনিং লেটার হাতে পেয়ে সৌমেনকে জানাল। সৌমেন বাড়ির সবাইকে।

রাতদিন হাজার প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হতো জুনিকে।

কী দরকার ছিল এরকম চাকরি নেওয়ার। পদে পদে, যেখানে ধাক্কা খেতে হবে?

যা রোজগার হবে তার থেকে বেশি টাকা পেট্রোলেই চলে যাবে?

রোদে বৃষ্টিতে সেই দৌড়ঝাঁপ করতে হবে, তখনই বুঝতে পারবে কত ধানে কত চাল। চাকরি করার যখন এতই শখ নিজেই যাওয়া আসা করবে আর নিজের খরচ নিজেই চালাবে।

এরকম হাজারো শব্দবাণ রোজ জুনির উপর বর্ষাতে আরম্ভ করল বাড়িতে। আর চুপচাপ মুখ বুঝে সব সহ্য করতে থাকল জুনি। ভুল তো করেছিল প্রথম থেকেই। ওড়বার জন্য দুটো ডানার রিমোট কন্ট্রোলটা স্বামী আর শ্বশুর-শাশুড়িকে দিয়ে রেখেছিল। কিন্তু আর নয়। নিজের উড়ান এবার সে নিজেই ঠিক করবে। মুখ থুবড়ে পড়লেও আবার উঠে দাঁড়াবে। জীবনের রামধনু রং-কে নিজের চোখে পরখ করতে উতলা হয়ে উঠেছিল জুনি।

পার্লার থেকে বেরোতে বেরোতে জুনি ভাবছিল, রাস্তা যখন আমার তখন সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকারও আমার। আমার ছোটো ছোটো স্বপ্নপূরণ করাটাই আমার মনের একান্ত ইচ্ছা। এটাই আজ থেকে সত্যি আমার জীবনে। নিজের মনের ভেঙে পড়া ডানা দুটোকে আবার জোড়া লাগাতে তত্পর হয়ে উঠল জুনি। এখনও অনেকটা পথ যাওয়া বাকি!

পড়ার জন্য সীমাহীন গল্প-নিবন্ধসাবস্ক্রাইব