জেদের বশে বাচ্চার অভদ্র আচরণ এবং অনাবশ্যক অভদ্র ভাষা ব্যবহার করা, অনেক অবিভাবককেই সহ্য করতে হয়। এতে দোষ শুধু কি বাচ্চাদেরই, না বড়োরাও এর জন্য অনেকটাই দায়ী?
প্রায়শই আমরা শুনতে পাই, ‘বাচ্চারা আজকাল একেবারেই বাচ্চাদের মতো ব্যবহার করে না।’ অনেক সময় সকলের সামনে বাচ্চা এমন কথাও বলে বসে, যাতে সেখানে উপস্থিত বড়োদের রীতিমতো লজ্জায় পড়তে হয়। আসলে বাচ্চার আচরণের অনেকটাই নির্ভর করে বাচ্চাটির সঙ্গে তার অভিভাবকদের সম্পর্ক এবং ব্যবহারের উপর। বাচ্চরা অনেক সময় যে যে অসভ্যতা করে সেগুলি হল–
বাড়ির কথা সকলের সামনে বলে দেওয়া
অনেক সময় বাচ্চা বাড়ির ভিতরের কথা যেমন মা-বাবার মধ্যে সম্পর্কের কথা অথবা বাইরে প্রকাশ্য নয় এমন কথা, সকলের সামনে বলে বসে। এতে মা-বাবাকে লোকজনের সামনে লজ্জায় পড়ে যেতে হয়।
বাড়িতে নিন্দে করা হলে বাইরে বলে দেওয়া
বাচ্চা নিজে থেকে যেমন লজ্জাজনক কিছু বলে ফেলে তেমনই বাড়িতে কাউকে নিয়ে বড়োদের আলোচনাও বাচ্চার মাথায় গেঁথে যায় এবং সেটা বাচ্চা-র মুখ থেকে এমন সময় প্রকাশ হয়ে পড়ে যা বড়োদের জন্য অস্বস্তিকর হয়ে উঠতে পারে।
দরজার কলিংবেল বাজতেই সাত বছরের ছেলেটি দৗড়ে গেল দরজা খুলতে। ওখান থেকেই চেঁচিয়ে বলল, ‘মা কাকু এসেছে।’
‘কোন কাকু?’
ছেলেটি স্থান-কাল-পাত্র ভুলে উত্তর দিল, ‘আরে তোমরা যাকে বলো, যে ঠিক খাওয়ার সময়ই দেখে দেখে উপস্থিত হয়, সেই কাকু এসেছে। খাব না-খাব না করতে থাকে কিন্তু দিলে পুরোটাই খেয়ে নেয়।’
এটা বলার নয় যে ওই ভদ্রলোকের সামনে ছেলেটির মা-কে কতটা লজ্জায় পড়তে হয়েছিল।
অনেক সময় বাড়ির সদস্যদের মধ্যে ঝগড়া হলেও বাচ্চা তার সম্পূর্ণ বিবরণ বাইরের লোকেদের কাছে প্রকাশ করে ফেলে। এই ধরনের পরিস্থিতি এড়াতে চাইলে, বড়োদের উচিত বাচ্চার সামনে এমন কোনও বিষয় নিয়ে চর্চা না করা যেটা বাচ্চার শোনার কোনও প্রয়োজন নেই। যে-ধরনের কথা বাচ্চার জন্য উপযুক্ত সেটাই শুধু ছোটোদের সামনে বলা উচিত।
কটূক্তি করা
কিছু কিছু বাচ্চা ছোটো থেকেই গালিগালাজ দিতে শিখে যায়। ওই বয়সে বাচ্চার সঠিক বুদ্ধি বিকশিত হয় না এবং গালিগালাজ করা যে শোভন নয়, সেটাও তার অজ্ঞাত থাকে। এই ক্ষেত্রে অভিভাবকদের খেয়াল রাখা প্রয়োজন যে বাচ্চা কোথা থেকে বা কার থেকে এই ধরনের ভাষা শিখছে। তারা নিজেরাই এর জন্য দায়ী নয়তো? অনেক পরিবারেই দেখা যায় রাগের মাথায়, গালাগালি দিয়ে কথা বলার অভ্যাস রয়েছে।
বাড়ির আর্থিক পরিস্থিতি বাইরের লোকের কাছে বলা
বাড়িতে হাজারও সমস্যা থাকলেও, সেই পরিস্থিতি প্রকাশ না করেই মানুষ সমাজে নিজের একটা পৃথক ছবি ধরে রাখার চেষ্টা করে যায়। অনেক সময় বাচ্চারা এই সমস্যাগুলো বাইরের লোকের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে বলে ফেলে।
বাড়ির আর্থিক অবস্থা অনেক সময় ঠিক না হওয়ার কারণে কোনও অনুষ্ঠান বা গেট-টুগেদার থাকলে বাড়ির অনেক মহিলাই বান্ধবীর শাড়ি বা গয়না ধার করে পরে অনুষ্ঠান অ্যাটেন্ড করেন। হয়তো শাড়ি বা গয়নাটির সৗন্দর্যের কারণে প্রশংসিত-ও হন। কিন্তু সেখানে উপস্থিত বাড়ির বাচ্চাটি এই ক্ষেত্রে অনেক সময় বলে ফেলে মায়ের বা দিদির শাড়িটি বা গয়নাটি অমুকের কাছ থেকে চেয়ে নিয়ে আসা। এই ক্ষেত্রে পরিবারের সম্মান ধুলোয় মিশে যাওয়ার মতো হয়। বাড়ির আর্থিক অবস্থার কথা সকলের কাছেই পরিষ্কার হয়ে যায়।
জোরে জোরে কথা বলা
অনেক বাচ্চাই খুব তাড়াতাড়ি রেগে যায় আর চিৎকার করে কথা বলে। বাড়ির লোকেরা হয়তো তার জেদ মেনেও নেন তাকে চুপ করাবার জন্য কিন্তু একবার এই অভ্যাস হয়ে গেলে বাইরের লোকের সঙ্গেও বাচ্চা একইরকম ব্যবহার করে।
বাড়িতে অনেক সময়েই অতিথিরা আসেন অথবা নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে অপরের বাড়িতেও মাঝেমধ্যেই যেতে হয়। অপর ব্যক্তিদের সামনে বাচ্চারা নিজের প্রতি অ্যাটেনশন ড্র করতে অনেক সময় মিথ্যা বায়না শুরু করে দেয় এবং চ্যাঁচামেচি করতে থাকে। এতে মা-বাবারা লজ্জার হাত থেকে বাঁচতে অনেক সময় মিথ্যা বায়নাও মেনে নিতে বাধ্য হন।
শপিং-এর জন্য জেদ করা
মা-বাবার সঙ্গে বাইরে বেরিয়ে অথবা শপিং করতে গিয়ে অনেক সময়েই চোখে পড়ে কিছু একটা কিনে দেওয়ার জন্য বাচ্চা বায়না করছে কিন্তু মা বাবা কিছুতেই সেটা কিনে দিতে রাজি নন। এতে বাচ্চা কেঁদেকেটে মাটিতে শুয়ে পড়ছে, জেদ দেখাচ্ছে। এমনও হয় উত্তেজিত হয়ে গিয়ে বাচ্চা মা-কে বা বাবাকে মারছে এমনও দৃশ্য চোখে পড়ে। এতে পাবলিক প্লেসে মা-বাবাকে লজ্জার মুখে পড়তে হয়।
খারাপ শব্দের ব্যবহার
বাড়িতে শাসন না থাকলে অথবা অতিরিক্ত আদরে বাচ্চা শুধু বাড়িতেই নয় বাইরে এমনকী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গিয়েও সহপাঠীদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করে এবং খারাপ শব্দও না বুঝেই বলে ফেলে।
বাচ্চাকে শেখান সঠিক ব্যবহার
- সন্তানের জন্মের সঙ্গে সঙ্গে কীভাবে বাচ্চাকে বড়ো করবেন, সেই দায়িত্বটা পুরোটাই কিন্তু বর্তায় মা-বাবার উপর। বাড়ি থেকেই বাচ্চা প্রথম শিক্ষালাভ করে সুতরাং প্রাথমিক ভাবে কী ধরনের শিক্ষা বাচ্চাকে দেওয়া হবে সেটা পুরোটাই নির্ভর করে অভিভাবকদের উপর।
- ছোটো থেকেই বাচ্চার মধ্যে সু-অভ্যাস গড়ে তুলুন
- সাইকোলজিস্ট-দের মতে প্রথম ৬ বছরে বাচ্চা যা শেখে তার ছাপ পড়ে সারাজীবনের উপর। সুতরাং শৈশব থেকেই বাড়িতে বাচ্চাকে সু-অভ্যাসের শিক্ষা দেওয়া উচিত।
সঠিক সঙ্গী নির্বাচন
বাচ্চারা স্কুলে এবং বাড়ির আশেপাশে কাদের সঙ্গে মিশছে বা বন্ধুত্ব করছে সেটা খেয়াল রাখা খুব দরকার। যদি কোনও বাচ্চার ব্যবহার খারাপ হয় অথবা কারও বাড়ির পরিবেশ খুব খারাপ হয়, তাহলে নিজের বাচ্চাকে তার সঙ্গে মিশতে দেবেন না।
বাচ্চার মুখে খারাপ কথা শুনলে তৎক্ষণাৎ জিজ্ঞেস করুন কার কাছ থেকে সে এই ধরনের কথা শিখছে। আশেপাশে কারও বাচ্চা হলে তার মা-বাবাকে ব্যাপারটা জানান। যদি স্কুল যেতে বাচ্চা খারাপ কথা শিখে আসে, তাহলে পেরেন্ট-টিচার্স মিটিং-এ বিষয়টা নিয়ে আলোচনা করুন।
বাচ্চাকে সময় দিন। আধুনিক যুগে মা-বাবা সকলেই নিজের নিজের কাজ পেশা নিয়ে ব্যস্ত। বাচ্চাকে দেওয়ার মতো সময় কারও কাছেই নেই। কিন্তু এই ব্যস্ত জীবনেও তাদের উচিত হচ্ছে সন্তানকেও কিছুটা করে সময় দেওয়া। তাদের সঙ্গে আনন্দ উপভোগ করা। বাচ্চার শিক্ষার শুরু হয় মা-বাবার হাত ধরেই। পরিবারের সদস্যদের মধ্যে সম্পর্ক এবং ব্যবহার কীরকম, সেটারও সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে বাচ্চার শৈশব কীভাবে গঠিত হবে তার উপর।
সুতরাং বাড়িতে সকলের সঙ্গে বিশেষ করে বড়োদের সঙ্গে সু-সম্পর্ক বজায় রাখাটা একান্ত জরুরি যাতে বাচ্চার শিক্ষায় এবং জীবনে তার প্রভাব না পড়ে।