ব্যাংকক-পাটায়া ঘুরে আসার পর মনে সুখ নেই রাতুলের, রীতিমতো দমে আছে সে। ফুটবলের মাঠে চার-পাঁচজনকে কাটিয়ে অনবদ্য শটে গোল করার পর মাঠভর্তি দর্শক যদি হাততালি না দেয় তাহলে ফুটবলারের যে-অবস্থা হয়, রাতুলের অবস্থা তার চেয়ে কম করুণ নয়।

তবে দুঃখ থাকলে দুঃখ থেকে বেরোনোর পথও আছে। সেই উদ্দেশ্যেই সে দুপুরে একটু রেস্ট নিয়ে বৈশাখীকে নিয়ে বেরিয়ে পড়েছে সমীরণদার বাড়ির উদ্দেশে। রাতুল দু’শোভাগ নিশ্চিত, কেউ হাততালি না দিলেও এই একটা লোক হাততালি দেবেই দেবে, তার দুঃখ ভুলিয়ে দেবে। সমীরণদা তার বাল্যজীবনের আইডল, ভ্রমণের আনন্দ কী সমীরণদাই তাকে প্রথম শিখিয়েছিল, তার চোখ খুলিয়েছিল।

রাতুল আর বৈশাখী দু’জনেই আইটি ফার্মে কাজ করে, সকালে নাকেমুখে গুঁজে একসঙ্গে বেরিয়ে যায়, ফিরতে ফিরতে রাত ন’টা-সাড়ে ন’টা, কাজের চাপ থাকলে কখনও কখনও তারও পর। ফলে ছুটির দিনগুলোয় বাড়ি থেকে নড়তেই ইচ্ছে করে না বৈশাখীর। সে আসতেই চাইছিল না, রাতুল এক রকম জোর করেই এনেছে তাকে, তাই মুখ সামান্য ভার তার।

রাতুল আর বৈশাখীর অফিস একই বিল্ডিংয়েই, ফ্লোরটাই শুধু যা আলাদা। বছর তিন আগে তাদের পরিচয়ের গাড়ি স্টার্ট নিয়ে সম্প্রতি বিয়ের স্টেশন পর্যন্ত পেৌঁছেছে। ব্যাংকক-পাটায়াতে তারা হানিমুন ট্রিপেই গিয়েছিল। ভ্রমণের যদি গ্রেড করতে হয়, ফরেন টুর বলে এটাকে এ গ্রেডের টুরের তকমা লাগাতেই হয়। এ গ্রেডের টুর রাতুলের জীবনে এই প্রথম। এখনও তার হ্যাংওভার কাটছে না, চোখের সামনে বেড়ানোর পর পর ছবিগুলো ভেসে যাচ্ছে, কিন্তু কাউকে শেয়ার করতে পারছে না। কোনও মানে হয়?

‘আরে মুড অফ কেন বৈশাখী? বি জোভিয়াল।’ ট্যাক্সিতে উঠে রাতুল চাগানোর চেষ্টা করল বৈশাখীকে, ‘সমীরণদার সঙ্গে তোমার তো পরিচয় নেই, আজ দেখবে কী মজার মানুষ। বিয়ের পর বউকে প্রেগন্যান্ট অবস্থায় অযোধ্যাপাহাড়ে বারো কিলোমিটার দৌড় করিয়েছিল।’

বৈশাখী সচকিত হল, ‘অ্যাঁ!’

‘হুঁ, কুলির পেছন পেছন। বউদির ভয় হচ্ছিল, কুলি যদি মাল নিয়ে পালায়।’

বৈশাখীর মুখের ভার সামান্য কাটল।ড্রাইভার রাতুলকে বলে গাড়ি স্টার্ট করতে যাবে বাধা পড়ে গেল, ট্যাক্সির জানালায় মুখ বাড়িয়েছে পাশের বাড়ির রানিবউদি। একগাল হেসে জিজ্ঞেস করল, ‘সেজেগুজে কপোতকপোতী কোথায় চললে?’

এসে গিয়েছে পাড়ার গেজেট! রাতুলরা হানিমুন থেকে ফেরার পর রানিবউদি এসেছিল তাদের বাড়িতে, কিন্তু তাদের ভ্রমণের গল্প শোনার চেয়ে তার কৌতূহল বেশি ছিল ওখান থেকে তারা কী গিফ্ট আইটেম এনেছে সেদিকেই। অনেক কষ্টে কম্পিউটারে বেড়ানোর কয়েকটি ছবি তাকে দেখাতে পেরেছিল বৈশাখী। তারপরেই তার মনে পড়ে যায়, শতদ্রুদার খাওয়ার টাইম হয়ে গিয়েছে, পরে এসে দেখবে বলে তড়িঘড়ি চলে যায়। রাতুল ড্রাইভারকে একমিনিট দাঁড়াতে বলে সমীরণদার কথা বলে সেকথা তুলল। ‘বউদি বললে আসবে, কই এলে না তো?’

রানিবউদি ‘যাব যাব’ বলে ফোটোর কথা পাস কাটিয়ে চলে গেল সমীরণদার কথায়, ‘সমীরণদা বছর পাঁচ আগে এপাড়া ছেড়ে রাসবিহারীর দিকে উঠে যাওয়ার পর আর একদিনও তো এদিক মাড়াল না, তার সঙ্গে হঠাৎ কী দরকার পড়ল তোমার?’

হুঁ, দরকারটা বলি, আর তুমি সারা পাড়া রাষ্ট্র করে বেড়াও! রানিবউদির বাচ্চাকাচ্চা হয়নি, এই বয়েসে হওয়ার আর চান্সও নেই, তাই শতদ্রুদা অফিস বেরিয়ে গেলে তার অঢেল সময়। রাতুল নতুন টেকনিক নিল, ঠাট্টার চালে বলল, ‘বলব না।’

‘উঁ?’

রাতুল রাগের ভান করল, ‘আগে আমাদের বাড়ি যাবে, ছবিগুলো সব দেখবে, তার পর বলব। ঠিক আছে?’

‘আচ্ছা তাই।’ রানিবউদি সারেন্ডার করে আবার সমীরণদার কথা পাড়ল, ‘সমীরণদার বিয়েতে খুব আনন্দ করেছিলাম আমরা।রাতুল সমীরণদার কাছে যাচ্ছ, আমাদের কথা বোলো, কেমন?’

‘পারব না।’ রাতুল চোখ কাঁপাল, ‘এত বড়ো একটা ট্রিপ দিয়ে এলাম, ভালো করে ছবিগুলো পর্যন্ত দেখলে না! যাও ওসব হবে-টবে না।’

রানিবউদি হেসে ফেলল, ‘বললাম তো যাব। বাবারে বাবা।’

‘বাবা-টাবা বললে শুনব না।’ রাতুল আরও শর্ত লাগাল, ‘শুধু স্টিল ফোটোগুলো দেখলে হবে না, ভিডিয়োগুলোও সব দেখতে হবে, তারপর তোমার সঙ্গে কথা।’

‘আবার ভিডিয়ো? তোমার বিয়ের ভিডিয়ো দেখতেই তো তিনদিন কাবার হয়ে গিয়েছিল, আবার বেড়ানোর? আমায় মারবে নাকি রাতুল?’ বউদি খিলখিল করে হেসে উঠল।

‘তুমি হাসছ!’ এবার সত্যি সত্যি রাগ হয়ে গেল রাতুলের, ‘আচ্ছা, ঠিক আছে।’

‘অ্যাই দ্যাখো বোকা ছেলে, রাগ করে। ইয়ার্কিও বোঝে না!’ বউদি আস্বস্ত করল, ‘ঠিক আছে, আজ রাতেই যাব তোমাদের বাড়ি। তোমরা ফিরলেই যাব। ঠিক আছে?’

রানিবউদি কথা শেষ করে বৈশাখীকে একঝলক মিষ্টি হাসি উপহার দিয়ে সরে দাঁড়াল, ড্রাইভার গাড়ি স্টার্ট করল। পাড়ার গলি পেরিয়ে গাড়ি চলে এল মেনরোডে। বৈশাখী দেখছিল রাতুলকে, মুখের গুমোটটা আবার ফিরে এসেছে তার, গম্ভীরভাবে বলল, ‘তুমি কী বলো তো, লোকে দেখবে না তবু জোর করে ফোটো দেখিয়েই ছাড়বে?’

‘কেন তাতে অসুবিধেটা কী আছে?’ রাতুল বলল, ‘আমরা কষ্ট করে এত হাজার হাজার টাকা খরচ করে বেড়িয়ে এলাম, জাস্ট ফোটোগুলো দেখবে, এটুকু হেল্প করতে পারবে না?’

‘তাদের বয়েই গেছে।’ বৈশাখীর গলায় শ্লেষ, ‘তুমি কী ব্যাংকক দেখাচ্ছ, লোকে এখন কথায় কথায় তার চেয়েও দূরে দূরে ট্রিপ দিয়ে আসছে। আমার পাশের টেবিলের মিতা সেদিন আমায় শুনিয়ে বলছিল, এখন সিঙ্গাপুর-থাইল্যান্ড ছ্যা-ছ্যা হয়ে গিয়েছে, দু’দিন পরে পুরী-দিঘার মতো অবস্থা হবে। তাই সে ঠিক করেছে, বিয়ের পরে নিউজিল্যান্ডে হানিমুন ট্রিপ দেবে। শুঁটকি মেয়ের বিয়ে হয় কিনা তারই ঠিক নেই, বলে নিউজিল্যান্ড!

রাতুল হেসে ফেলল। তারও একই অবস্থা।তাই অনেক দুঃখেই সে সমীরণদাকে সিলেক্ট করেছে।

‘তাই বলো!’ বৈশাখীর মুখখানা হাসি হাসি হয়ে এল, ‘বেড়িয়ে এসে পেট ফুলছে, তাই ছুটির দিনটা বরবাদ করে আমাকে টানতে টানতে সমীরণদার বাড়িতে নিয়ে যাচ্ছ? উফ্, তুমি পারোও বটে।’

‘না না ভ্যাট।’ রাতুল লজ্জা পেল, ‘ইন ফ্যাক্ট, সমীরণদার অনেক গল্প শুনেছি এক সময়। বেড়ানোর গল্প, বুঝলে, সমীরণদা বিয়ের পর দু’দিন অন্তর বউদিকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ত, যেখানে যত পাহাড়-জঙ্গল ছিল একেবারে চষে ফেলত।’

‘মরেছে।’ বৈশাখী ভয় পেল, ‘আমারও সেই হাল করবে নাকি? পাহাড়-জঙ্গলে বাঘ থাকে, বিষাক্ত সাপখোপ থাকে, আমি নেই বাবা।’

‘ইয়ার্কি কোরো না তো! শোনোই না!’ রাতুল বলে চলল, ‘আমাদের তো তখন বয়েস কম, ক্লাস ফাইভ-সিক্সে পড়তাম, সমীরণদা বউদিকে নিয়ে বেড়িয়ে ফিরলেই তাদের বাড়ির ছাদে আমাদের সভা বসত। বসে বসে হাঁ করে শুনতাম তাদের বেড়ানোর গল্প। সমীরণদা এত সুন্দর করে রসিয়ে রসিয়ে গল্প বলত ভাবতে পারবে না।’

বৈশাখী হাসছে, ‘তারই পালটা দিতে যাচ্ছ বুঝি? এতদিন বসে বসে সমীরণদার গল্প শুনেছ, এবার তুমি শোনো, উঁ? পুরো বাচ্চাদের মতো হাবভাব তোমার!’

‘ধ্যাত!’

বৈশাখী থামছে না, ‘শোনো ক্রেডিট নেওয়ার জন্য তুমিও তো তোমার গডফাদারের মতো পাড়ার একটা বাচ্চা-টাচ্চা ধরে ট্রাই করতে পারতে।তাহলে আর কষ্ট করে আমাকে অতদূরে যেতে হতো না।’

‘বাচ্চারা শুনবে গল্প? এখনকার বাচ্চাদের সে অভ্যাসই হয়নি।বাড়িতেই তো দাদার একপিস ছেলে আছে জোজো। গল্প শুনবে কী, বেড়ানোর ছবিগুলো পর্যন্ত ভালো করে দেখল না, টিভির কার্টুন চ্যানেল আর কম্পিউটারের গেমস নিয়েই ব্যস্ত। দু’টো ছবি দেখতে না দেখতেই তার ধৈর্য শেষ। তার চেয়ে সমীরণদাই ভালো।’ সঙ্গে অ্যালবামগুলো এনেছে সে, ছবিগুলোও এক কপি রাইট করে এনেছে, দিয়ে আসবে, তার বিশ্বাস, সমীরণদা খুশিই হবে।

‘তুমি নিশ্চিত সমীরণদা তোমার গল্প শুনবে?’ বৈশাখী তর্ক তুলল।

‘হান্ড্রেড পারসেন্ট। সমীরণদা কী লেভেলের ভ্রমণপাগল ভাবতেই পারবে না।’ রাতুল উচ্ছ্বসিত হল, ‘শুধু ভ্রমণপাগল নয়, সমীরণদার একটা ক্লিয়ার ভ্রমণদর্শনও ছিল, প্রায়ই রবীন্দ্রনাথকে কোট করে বলত, ‘দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া, ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া, একটি ধানের শিষের উপরে একটি শিশিরবিন্দু।’ ঘরের কাছে ঘোরার এত জায়গা থাকতে লোকে কেন যে দূরে দূরে যায়।’

‘ওসব এখন ব্যাকডেটেড আইডিয়া।’ বৈশাখী এক কথায় উড়িয়ে দিল কথাটা।

‘কী বলছ!’ রাতুল অবাক ও বিরক্ত।

‘রাইট। প্যাকেজ টুর আর কনডাক্টেড টুর এসে সব বদলে দিয়েছে। বাঙালি এখন সারা পৃথিবী চক্বর দিয়ে বেড়াচ্ছে, তোমার পাহাড়-জঙ্গলে বসেঞ্জথাকার পার্টি এখন কেউ নেই।’ বৈশাখী শ্লেষভরা প্রশ্ন ছুড়ল, ‘এত যে সমীরণদা সমীরণদা করছ তোমার বিয়েতেই তো এল না, উঁ?’

‘সে তো শরীর খারাপ হয়েছিল বলে আসতে পারেনি।’ রাতুল দুর্বল ব্যাখ্যা দিল, ‘ফোনে নেমতন্ন করেছিলাম তো।’

‘তাতে কী হয়েছে? এখন তো ফোনে ফোনেই নেমতন্ন করা চালু হয়ে গিয়েছে। আত্মীয়দেরও লোকে এখন ফোনেই নেমতন্ন করছে।’ বৈশাখী স্পষ্ট জানিয়ে দিল, ‘শোনো তোমাকে বলে দিচ্ছি, দিজ ইজ ফার্স্ট অ্যান্ড দিজ ইজ লাস্ট। বারবার তোমার সঙ্গে আসতে পারব না। এর পর থেকে এলে তুমি একাই আসবে, ও কে?’

‘কনডাক্টেড টুরই তোমাদের সর্বনাশ করে দিয়েছে, বুঝলে? মনটাই নষ্ট হয়ে গিয়েছে তোমাদের।’ রাতুল আর ক্ষোভ চেপে রাখতে পারল না, ‘তোমাকে দেখে কে বলবে এতবড়ো একটা টুর দিয়ে এলে। তোমাদের কি ইচ্ছেও হয় না কারও সঙ্গে তা শেয়ার করার? এ কী রকম বেড়ানো তোমাদের কে জানে! যাচ্ছ তো দেখবে বউদিকে!’

‘তোমার পাহাড়-জঙ্গলের বউদি?’ বৈশাখীও রেগে গেল, ‘বউদিই তোমার টেস্ট খারাপ করে দিয়েছে, তাই দার্জিলিং আর সিকিম সিকিম করে লাফাচ্ছিলে! যত্ত থার্ডগ্রেডের পাবলিক হানিমুন করতে যায় সেখানে।’

‘থার্ডগ্রেড!’ রাতুল আহত হল।

‘তাছাড়া কী? আমি জোর না করলে যেতে?’ বৈশাখী ঝাঁ-ঝাঁ করে উঠল, ‘বউদি দেখাচ্ছ, জীবনে ভেবেছিলে গ্র্যান্ড প্যালেস দেখতে পাবে? কোরাল আইল্যান্ডে বোটিং করতে পারবে? কুল বার, জাজ ক্লাব, স্কাই ট্রেন কাকে বলে জানতে? মেরিন পার্ক, টাইগার জু? পাহাড়-জঙ্গলে কী আছে তোমার? ঘণ্টা!’

রাতুল স্তম্ভিত হয়ে গেল। ‘পাহাড়-জঙ্গলে কিছু নেই? কিন্তু বউদিকে দেখে কে বলবে তা? সমীরণদার সঙ্গে বেড়িয়ে আসার পরে চেহারটাই বদলে যেত বউদির। আনন্দে একেবারে কলকল করছে। পাড়ার বাচ্চাদের নাচতে নাচতে ধরে নিয়ে আসত তাদের বাড়িতে, বলত, চল গল্প শুনবি তোর সমীরণদার!’

দিনের আলোটি পড়ার অপেক্ষা, বাড়ির ছাদে গুছিয়ে বসে সমীরণদা ভ্রমণের গল্প জুড়ত, বউদি আলুরদম-লুচি করে খাওয়াত সকলকে। গল্পে গল্পে রাত গড়িয়ে যেত, এক একদিন ছাদ আলো করে চাঁদ উঠত, তখন কী যে আনন্দ, কী রোমাঞ্চ, ঘর থেকে ছুটে বেরিয়ে পড়ার কী যে বিপুল তৃষ্ণায় তাদের বুকটা টনটন করে উঠত বৈশাখী কী জানবে তার? ব্যাংকক-পাটায়া ঘুরলেই কি বউদির মতো আলুরদম-লুচি বানানো যায়? এখনও যেন তার টেস্ট লেগে আছে রাতুলের মুখে।

রাতুল গুম মেরে গেল।

 

 

আধঘণ্টা পরের কথা। রাতুলরা এখন দাঁড়িয়ে আছে রানি ভবানী রোডে সমীরণদার ফ্ল্যাটের গেটে। সেকেন্ড ফ্লোরের তিনশো তিন নাম্বার ফ্ল্যাট সমীরণদার, বেল বাজিয়ে অপেক্ষা করছে।রাতুলের কাঁধে লেদারের ব্যাগ, তাতে বড়ো বড়ো দু’টো অ্যালবাম, বৈশাখীর হাতে মিষ্টির প্যাকেট। দু’জনে দু’দিকে তাকিয়ে আছে।

মিনিটখানেক। আইহোলে ছায়া পড়ল, তার পর দরজা খুলে কোলাপসিবল গেট টেনে সমীরণদা বলল, ‘আয় রাতুল!’

রাতুল ঘরে এল। পিছনে বৈশাখী। দু’জনের মুখই থমথম করছে। বউদির সম্পর্কে বৈশাখীর মন্তব্য ভালোই গায়ে লেগে গিয়েছে রাতুলের। রেগেমেগে সে একবার ভেবেছিল ফিরেই যাবে, কিন্তু সমীরণদাকে কথা দেওয়া আছে বলে এসেছে।

সমীরণদার পরনে হাতাওয়ালা গেঞ্জি আর পাজামা। বৈশাখীকে দেখছিল সে, রাতুলকে শুধোল, ‘এই বুঝি তোর নতুন বউ?’

রাতুল কষ্ট করে মুখে হাসি টানল, ‘হুঁ।’

‘হুঁ কী রে? সগর্বে বল। বুকফুলিয়ে বল।’ সমীরণদা মজা করল, ‘কী নাম এর?’

‘বৈশাখী।’

‘বাহ্।’ বলতে বলতে সমীরণদার পাকা চোখে ধরা পড়ে গেল, ‘কী ব্যাপার? মুখ হাঁড়ি, আসতে আসতে ঝগড়া করেছিস নাকি দু’জনে?’

রাতুল চট করে একবার বৈশাখীকে আড়চেখে দেখে নিয়ে মাথা নাড়াল, ‘না না!’

‘লজ্জা পাচ্ছিস কেন?’ সমীরণদা আবারও ঠাট্টা জুড়ল, ‘মাঝেমাঝে ঝগড়া হওয়া ভালো, ঝগড়া বেশ স্বাস্থ্যকর অভ্যাস। বোস বোস! ঝগড়ার এখন ইন্টারভ্যাল, ঠিক আছে?’

রাতুলের মুখের গুমোট কিছুটা কাটল, বৈশাখীর দিকে চেয়ে বলল, ‘মিষ্টিটা দাও।’

বৈশাখী মিষ্টির প্যাকেটটা বাড়িয়ে দিয়ে সোফায় বসে ভালো করে দেখল সমীরণদাকে। সে মনে মনে একটা আন্দাজ করেছিল, দেখল মাঝারি হাইট, মাঝারি রং, মাঝারি কাটিংয়ের মুখচোখের বাইরে একটাই একটু অন্য রকম সমীরণদার, মাথার চুলে পাক ধরতে শুরু করেছে। অথচ বেশি বয়েস নয় ভদ্রলোকের, চল্লিশের কোঠায়। ভাবতে ভাবতে তাকে চমকে দিয়ে তার পাশে বসেই রাতুল বলে উঠল, ‘কী ব্যাপার সমীরণদা, এই বয়েসে মাথার চুল পেকে গেল কী করে তোমার?’

সমীরণদা হাসল, ‘সেটা বয়েসকেই জিজ্ঞেস কর।’

রাতুলও হাসল, বলল, ‘যা-ই বলো, পাকাচুলে তোমায় ঠিক যেন মানায় না। আমাদের কাছে তোমার ইমেজই আলাদা। এই তো আসতে আসতে ওকে বলছিলাম, সমীরণদা ছিল আমাদের ছেলেবেলার হিরো।’

‘ছিল, এখন আর নেই। পাকাচুল দেখেছে যে!’ সমীরণদা বৈশাখীর দিকে ফিরল, ‘আবার মিষ্টি আনতে গেলে কেন?’

কেন আবার? হানিমুন ট্রিপের গল্প শোনানোর জন্য। কেউ শুনবে না, ঘাড়ে পড়ে শুনিয়েই ছাড়বে। বৈশাখী হাসি চেপে সুন্দর উত্তর দিল, ‘মনে করুন এটা আমাদের বিয়ের মিষ্টি।’

‘ভেরি সরি। সমীরণদা জিভ কাটল, তোমাদের বিয়েতে যাওয়ার খুব ইচ্ছে ছিল, শরীরটা হঠাৎ করে…’

‘শুনেছি।’ বৈশাখী বলল, ‘আপনি বসুন। আপনার কথা, বউদির কথা অনেক শুনেছি ওর মুখে। আপনারা নাকি খুব বেড়াতেন, দু’দিন ছাড়া ছাড়া বেরিয়ে পড়তেন। ইন্টারেস্টিং।’

‘ওকে কি বেড়ানো বলে?’ সমীরণদা ক্রেডিটটা নিতেই চাইল না, সোফায় গুছিয়ে বসে জুড়ল, ‘এদিকে গোবরডাঙা ওদিকে লিলুয়া… এই তো দৌড় ছিল আমাদের! এখন বললে লোকে হাসবে।’

থার্ডগ্রেডের লোকের ফোর্থগ্রেডের ভ্রমণ? মুখের মতো জবাব! জ্বালাটা একটু কমল রাতুলের, চাপা শ্লেষের সুরে বৈশাখীকে শোনাল, ‘এই হল সমীরণদা, বুঝলে?’

‘বুঝলাম।’ বৈশাখীর ভুরুতে বাঁক।

‘তুমি তো আসতেই চাইছিলে না!’ রাতুল ফিরল সমীরণদার দিকে, ‘আমি বললাম চলো, সমীরণদাকে একবার দেখলেই বুঝবে কেমন মানুষ। চাঁদনী রাতে তোমার বাড়ির ছাদে বসে বেড়ানোর গল্প… উফ্, কী ফার্স্টক্লাস ছাদটা ছিল তোমাদের বাড়ির সমীরণদা, তুমি চলে এলে ওখান থেকে।’

‘হুঁ, ছাদটা রিয়েলি সুন্দর ছিল। চারপাশ খোলা, ছোট্টখাট্ট, নিরিবিলি।’ সমীরণদা অন্যমনস্ক হল, ‘এখন ভাবি ওখানে থাকলেই বোধ হয় ভালো ছিল।’

‘বলো বলো।’ রাগতাপ শেষ রাতুলের, উৎসাহে টগবগ করছে, ‘সেই যে আমাদের বেড়ানোর নেশা ধরিয়ে দিলে সমীরণদা, তার পর থেকে ভবিষ্যৎ একেবারে ঝরঝরে… বেড়িয়ে বেড়িয়ে পকেট হালকা।’

এই তো আস্তে আস্তে কী রকম টার্গেটে চলে যাচ্ছে রাতুল। মিষ্টি বেরিয়েছে, অ্যালবাম বেরোল বলে। কিন্তু পাহাড়-জঙ্গলের লোক সইতে পারবে তো? এদের পক্ষে বড্ড বেশি হাইভোল্টেজ হয়ে যাবে না তো? মিতার কথা মনে পড়ল বৈশাখীর, ঠোঁটে হাসি ফুটছে তার।

‘কী হল হাসছ যে?’ রাতুল তাকাল।

‘না না এমনি।’

‘ও’ বলে রাতুল আবার ঘুরে গেল সমীরণদার দিকে, ‘এমন নেশা ধরিয়েছ কী বলব সমীরণদা, ক’দিন আগেই হানিমুন করে এলাম, আবার মনে হচ্ছে বেরিয়ে পড়়ি।’

উফ্ আর তর সয় না। বৈশাখী তাড়াতাড়ি ‘দাঁড়াও না’ বলে রাতুলকে থামিয়ে সমীরণদার দিকে চেয়ে কথা ঘোরাল, ‘কই বউদিকে ডাকুন, আলাপটা সেরে নিই।’

সঙ্গে সঙ্গে ঘরের পরিবেশ বদলে গেল। কয়েক সেকেন্ড ফ্যালফ্যাল করে বৈশাখীর দিকে চেয়ে থেকে রাতুলের দিকে দৃষ্টি স্থির করল সমীরণদা, ‘তোরা খবর পাসনি?’

রাতুল চমকে গেল, ‘না তো।’

‘শুনিসনি কিছু?’

রাতুল দাঁড়িয়ে হাত ঘষতে ঘষতে বলল, ‘তোমার সঙ্গে তো বছরখানেক আগে লাস্ট টেলিফোনে কথা হয়েছিল, তার পর ফোন করব করব করে আর করা হয়নি।জানব কী করে?’

‘তাও তো বটে। জানবিই বা কী করে?’ সমীরণদা ভেঙে পড়ল, ‘তোর বউদি আমায় ছেড়ে চলে গিয়েছে রাতুল। ছেলেকে নিয়ে আলাদা থাকে।’

রাতুল আর্তনাদ করে উঠল, ‘যাহ্।’

‘বিশ্বাস হচ্ছে না? সত্যিই রে, তোদের বউদি বোর হয়ে গিয়েছিল আমার সঙ্গে থাকতে থাকতে। শুধু বাইরে বাইরে যাত্রা করলেই কি সংসার চলে রে? সংসারটাও একটা যাত্রা, সময়ে তারও টিকিট কাটতে হয়, রিজার্ভেশন করতে হয়, ঠিকঠাক সব অ্যারেঞ্জমেন্ট করতে হয়। চিরকালই তো আমি উড়নচণ্ডী রয়ে গেলাম, বদলালাম না। লোকে এখন কোথায় কোথায় চলে যাচ্ছে, আমি নাকে দড়ি দিয়ে শুধু ঝোপেঝাড়ে আর থার্ডক্লাস সব জায়গায় ঘুরিয়েই মারলাম তোদের বউদিকে।’ সমীরণদা থামল।

প্রচণ্ড একটা গুমোটে ছেয়ে গেল ঘরটা। কারও মুখে কথা নেই। রাতুল দেখছে বৈশাখীকে, বৈশাখী দেখছে রাতুলকে। দু’জনের মুখেই স্পষ্ট অবিশ্বাসের ছাপ। শুধু ঘোরাঘুরির অপরাধে বউদির মতো নারী ভ্রমণপাগল স্বামীকে ছেড়ে যায়? যেতে পারে? অ্যাবসার্ড!

কেটে গেল আরও কয়েক সেকেন্ড, তার পর সমীরণদাই নীরবতা ভাঙল, নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, ‘ছাড় ওসব কথা, তোদের কথা বল। কোথায় হানিমুন করলি রাতুল?’

সমীরণদার এই প্রশ্নটা শোনার জন্যই তো এতদূর ছুটে আসা। কিন্তু রাতুলের মুখে কথা নেই, তীব্র অস্বস্তিতে মুখখানা ছেয়ে গিয়েছে তার, অসহায়ভাবে চেয়ে আছে বৈশাখীর দিকে। ভাবখানা এমন, আমাকে বাঁচাও।

এতক্ষণ ভ্রমণদর্শন আওড়াচ্ছিলে না? একটি ধানের শিষের উপরে একটি শিশিরবিন্দু? হঠাৎ রাগ হয়ে গেল বৈশাখীর, রাতুলের দিকে চেয়ে গলা চড়াল, ‘আমার দিকে তাকাচ্ছ কেন? আমি কী বলব?’

‘আহ্, এক্সাইটেড হচ্ছো কেন?’ রাতুল ব্যস্ত হল, ‘আস্তে।’

‘ইন্টারভ্যাল শেষ?’ সমীরণদা পরিস্থিতি হালকা করার চেষ্টা করল, ‘ঠিক আছে হানিমুন থাক, ঝগড়াই কর দু’জনে, আমি দেখি। তোদের বউদির সঙ্গে ভালো করে জীবনে ঝগড়াই করতে পারলাম না বলে আজ আমার এই হাল।’

বৈশাখী চুপ, কিন্তু রাতুল চুপ করে থাকতে পারল না, বলেই ফেলল, ‘বউদি সত্যিই তোমাকে ছেড়ে চলে গেছে সমীরণদা?’

‘এখনও তোদের বিশ্বাস হচ্ছে না?’ সমীরণদা বিষণ্ণভাবে ঘাড় দোলাল, ‘শোন রাতুল, আমি মিথ্যেও বলছি না, একবর্ণ বাড়িয়েও বলছি না, এতবড়ো একটা পৃথিবীতে আমাকে ইচ্ছেমতো ঘুরে বেড়ানোর ব্ল্যাংকচেক দিয়ে তোদের বউদি সত্যি সত্যি চলে গেছে। কিন্তু মজাটা কী জানিস, ভদ্রমহিলা চলে যাওয়ার পর আমার বেড়ানোর ইচ্ছেটাই পার্মানেন্টলি চলে গেছে, তাই আজকাল ঘরেই বসে থাকি।’

সহানুভূতিতে মন ভরে উঠল বৈশাখীর। কী দেখতে এল তারা এখানে? কী শুনতে এল? বিচ্ছেদের তাপে মানুষটাই তো জ্বলেপুড়ে গিয়েছে, মাথার চুল পেকে গিয়েছে, উত্তপ্ত রৌদ্রকিরণে শিশিরবিন্দুর এখন শুধু উবে যাওয়ার পালা। বৈশাখীর গলাটা ব্যথা করে উঠল, ঢোক গিলে জিজ্ঞেস করল, ‘কোত্থাও যান না?’

‘নাহ্। শুধু অফিস আর বাড়ি। ভালোই লাগে না কোথাও যেতে। ইচ্ছেটাই মরে গিয়েছে, বুঝলে?’ বলে একটু বিরতি, তারপর উৎসহভরা চোখে বৈশাখীদের দেখতে দেখতে সমীরণদা বলল, ‘তবে আজ তোমাদের দেখে আবার ইচ্ছেটা জেগে উঠেছে জানো? খুব ইচ্ছে করছে তোমাদের হানিমুনের টুরের গল্পটা শুনতে। বেশ গুছিয়ে বলো তো শুনি।’

‘আমি? না না ও বলবে।’ বৈশাখী চমকে উঠে রাতুলকে দেখাল।

‘আমি?’ রাতুল শিউরে উঠল।

‘হ্যাঁ বলো। বলবে বলেই তো এসেছিলে, এখন চুপ করে আছ কেন?’

রাতুল জোরে জোরে মাথা ঝাঁকাল, ‘থাক না সমীরণদা।’

‘থাকলে আমার চলবে কী করে রাতুল?’ সমীরণদা ছেলেমানুষের মতো হয়ে গেল, রীতিমতো বায়না জুড়ল, ‘বল না বাবা, বল না তোদের গল্প। কতকাল যে বেড়াইনি। খুব ইচ্ছে করছে শুনতে।’

রাতুল অপরাধীর মতো মাথা নিচু করে ফেলল। কথা বলল না।

‘কী রে কী ভাবছিস? শুরু কর।’ অনেক দিন পরে ইচ্ছে জেগেছে সমীরণদার। গল্পের লোভে তার চোখদু’টো চকচক করছিল, রাতুলকে ঠেলা দিয়ে বলল, ‘চুপ করে থাকিস না প্লিজ। এতদিন তোদের গল্প শুনিয়েছি, তার একটা রিটার্ন দে অন্তত। কোথায় কোথায় ঘুরলি, উঁ?’

তবু মুখ ফুটল না রাতুলের, কাঠের মতো বসে রইল। লোকটা এত করে বলছে, কোনও মানে হয়? বৈশাখী আর মেজাজ ঠিক রাখতে পারল না, বিরক্তিতে ফেটে পড়ল, ‘খুব তো সমীরণদা সমীরণদা করছিলে, বউদি বউদি করছিলে, এখন বলো, সমীরণদা জানতে চাইছে বলো, গুরুকে দক্ষিণা দাও। কী এনেছ বার করো?’

‘না না।’ রাতুল সিঁটিয়ে গেল একেবারে, চোরাই মাল লুকোনোর মতো করে তাড়াতাড়ি ব্যাগটা পিঠের দিকে ঠেলে দিল।

‘বুঝেছি, এ এখন বলবে না, শুনবে।’ আর রাতুলকে পীড়াপীড়ির দিকে গেল না সমীরণদা, ঘুরে গেল বৈশাখীর দিকে, চোখ ওপর নীচে করে বলল, ‘আমার কী করে এই অবস্থা হল জানার ভীষণ ইচ্ছে হচ্ছে ওর বুঝলে বৈশাখী? চিরকাল আমার মুখে গল্প শুনে এসেছে, হ্যাবিটটা যাবে কোথায় ব্যাটার?’

‘না না! ছি ছি!’ মুখখানা লাল হয়ে গেল রাতুলের।

‘আরে লজ্জা পাচ্ছিস কেন? সত্যি কথাটাই তো বলছি। ভাবছিস, কী এমন হল বউদি দাদাকে ছেড়ে চলেই গেল! আড়ালের আসল গল্পটা কী? বল ভাবছিস না?’

রাতুল আর্তনাদ করে উঠল, ‘না না!’

‘ভাবছিস। আমার চোখে তুই ধুলো দিবি রাতুল?’ সমীরণদা থামল, তার পর বড়ো করে শ্বাস নিয়ে গলার স্বর বদলে বলল, ‘গল্পটা বলতে পারলে ভালোই হতো বুঝলি? বুকটা একটু হালকা হতো। কিন্তু জানিসই তো, ছাদ ছাড়া আমার আবার গল্প ঠিক খোলে না। এই ফ্ল্যাটবাড়ির ছাদটা বড্ড বড়ো, সব সময় লোকজনের ভিড়। ভেরি সরি রাতুল, এই গল্পটা তুই মিস করলি।’

বলতে বলতে সমীরণদা হা-হা করে হেসে উঠল।

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...