এককালে মায়ানমার এবং এই পার্বত্য অঞ্চল মিলিয়ে প্রায় পাঁচশোর অধিক জিরাফ মহিলা বসবাস করত। এখন হয়তো সেই সংখ্যা অর্ধেকের কমে পৌঁছেছে। কারণ এত ভারী এই ধাতব বলয় বহন করে, এই মহিলারা নাকি মাথা ঝুঁকে হাঁটতেও পারে না। গলা এবং ঘাড়ের পেশিগুলো দুর্বল হয়ে ওদের স্পাইনাল কর্ড খুবই ক্ষতিগ্রস্থ হয়। দীর্ঘকাল ধরে এই ভারী ওজনের ধাতব বলয় বহন করার ক্ষমতা না থাকায়, রাতে শান্তিতে একটু ঘুমোতেও পারে না। শারীরিক দুর্বলতায় এদের অনেকেরই অকালমৃত্যু ঘটে। এইসব নানা কারণে বর্তমান প্রজন্মের কায়ান নারীদের মধ্যে এই প্রথা এবং ঐতিহ্যগত সংস্কৃতি, ওদের মনে সেভাবে দাগ ফেলতে না পারায়, এই সম্প্রদায় নাকি এখন প্রায় বিলুপ্তির পথে। কারণ নতুন প্রজন্মের বহু মেয়ে প্রতিবাদস্বরূপ নিজেদের অন্য কাজে নিযুক্ত করার লক্ষ্যে আপন দেশে ফিরে যাচ্ছে।
এই ধাতব রিং পরার প্রকৃত কোনও ইতিহাস সম্পর্কে জানতে চাইলে মুচকি হেসে থুয়ানথং জানালেন- সেভাবে কোনও বইয়ের পাতায় এই সম্প্রদায়ের ইতিহাস লিপিবদ্ধ নেই। তবে বেশ কিছু লোককাহিনি আজও চর্চিত রয়েছে বিশ্বজুড়ে। সেই কাহিনিটি হল, এক যুবতী নারী একবার জঙ্গলে বেড়াতে গিয়ে বৃষ্টির সময় একটি গুহায় আশ্রয় নিয়েছিল। সেখানে বসবাসকারী এক ড্রাগনের প্রেমে পড়ে যায়। ভালোবাসার নিদর্শন হিসেবে সেই ড্রাগন, মেয়েটিকে তিনটি ডিম উপহার দিয়েছিল। আর সেই তিনটি ডিম ফুটে নাকি তিনটি উপজাতি বের হয়। নামকরণের পরে এই কায়ান উপজাতি, সেই থেকে তাদের মায়ের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে ড্রাগনের মতো লম্বা গলা প্রসারিত করার কথা ভাবে।
থুয়ানথং আরও জানালেন— আরও দুটি সম্ভাব্য কারণ ওদের সংস্কৃতির ইতিহাস থেকে জনশ্রুতি হিসাবে পাওয়া গেছে। যার মধ্যে একটি হল, কায়ান পুরুষরা যখন জঙ্গলে শিকার করতে যেত অন্য উপজাতির পুরুষেরা যাতে নারীদের অপহরণ করতে না পারে তার জন্য মহিলাদের গলায় এবং পায়ে এমন বেড়ি লাগানো হত। কারণ এই ভারী ওজনের বেড়ি শরীরে থাকলে মহিলাদের খুব সহজে গ্রাম থেকে বের করে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে না।
আর দ্বিতীয় কারণ হিসাবে বললেন, এই কায়ান সম্প্রদায়ের আদি বাসস্থান ছিল মায়ানমারের কায়াহ রাজ্যে। এককালে ওখানে বাঘের খুব উৎপাত ছিল। প্রায়দিনই বাঘ গ্রামের মহিলা ও শিশুদের তুলে নিয়ে যেত। বাঘ যেহেতু শিকারের সময় গলা কামড়ে নিয়ে যায়, তাই তা রুখতে ওই নারী ও শিশুদের গলায় এই ধরণের মোটা বেড়ি পরিয়ে রাখা হতো।
উনি আরও জানালেন— আজকাল বহু পর্যটক এখানে আর আসতে চান না, এড়িয়ে যেতে চান। কারণ তাদের কাছে এই নারীদের পুতুলের মতো ব্যবহার করাটা নাকি মানব চিড়িয়াখানার মতো মনে হয়। এই একবিংশ শতকে পা রেখে কোনও ভাবেই তারা এই কষ্টদায়ক প্রথাকে মেনে নিতে চান না। এইসব অজানা তথ্য জানানোর জন্য থুয়ানথং-কে অশেষ ধন্যবাদ এবং কৃতজ্ঞতা জানিয়ে আবার আমি গ্রামের অভ্যন্তরে কায়ান নারীদের বিপণিতে প্রবেশ করলাম।
বেশ কয়েক ঘণ্টা কায়ান মহিলাদের সঙ্গে কাটালাম। ওদের শান্ত স্নিগ্ধ সৌন্দর্যের মিশেলে অচেনা দৃষ্টিগুলো আমার শরীরে বেঁধে! ওদের কষ্টমাখা হাসির আড়ালে সুখ ও অসুখে আমার শরীরময় কষ্টের ঝংকার উঠল, যেখানে পলক ফেলতেও মায়া জাগে। আমার সন্ধিৎসু চোখ, ওদের সবার ওষ্ঠাগ্রে আসন্ন হাসি বুঝিয়ে দিল— আমরা এই নিয়েই বেশ আছি, ভালো আছি, সুখে আছি।
বেশকিছু পছন্দের হস্তশিল্প কিনলাম। তবে একটা ব্যাপারে আশ্চর্য লাগল— এই কায়ান নারীদের চারপাশে ওদের উপজাতির কোনও পুরুষ বা বালক খুঁজে পাইনি। টনি জানাল, এই উপজাতির পুরুষরা কোনও কাজকর্ম করে না। এরা প্রায় সবাই তাদের স্ত্রী এবং বাড়ির মহিলাদের কষ্টার্জিত অর্থে শুয়ে বসে খেয়ে আনন্দ ফুর্তিতে দিন কাটায়।
আজকের যুগে এমন উন্নত দেশেও, নারী-শোষণের ঝলক সত্যিই বিস্ময়কর! যদিও প্রায় সব নারীর স্বীকারোক্তি- এই বেড়ি তারা স্ব-ইচ্ছেতেই গলায় ধারণ করেছে। কেউ জোর করে পরতে বলেনি। তবুও সারাদিন ধরে এই গ্রাম বেড়িয়ে যখন টনির সঙ্গে গাড়িতে চেপে চিয়াং মাইয়ের হোটেলে ফিরছিলাম, মনটা খুবই বিষণ্ণ ছিল। যাওয়ার পথে টনির সঙ্গে অনেক গল্প করলেও, ফেরার পথে আমি সম্পূর্ণ নীরব ছিলাম। হৃদয়ে শূন্যতা অনুভব করছিলাম বারবার।
যদিও প্রত্যেক জাতির ধর্ম, সংস্কৃতি ও আবেগের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়েও বারবার মনে হচ্ছিল— ধর্ম, সংস্কৃতি এবং প্রথার দোহাই দিয়ে কায়ান সম্প্রদায়ের নারীদের প্রতি এই অন্যায় সত্যিই মেনে নেওয়া খুব মুশকিল। বিশেষ করে সরকারি উদ্যোগে এই সম্প্রদায়কে দীর্ঘকাল যাবৎ অভিবাসী হিসাবে চিহ্নিত করে, ক্রীতদাসী বানিয়ে, পর্যটকের কাছ থেকে অর্থ উপার্জন করে, এই গ্রামের সফল বাণিজ্যকরণ মোটেই সুখকর উদ্যোগ নয়। তাই হয়তো বহু বিদেশি পর্যটক এই গ্রামকে মানুষের চিড়িয়াখানা আখ্যা দিয়ে এড়িয়ে যান!
(সমাপ্ত)