প্রায় কুড়ি মিনিট দূরত্বে একটা কফি শপে অনিন্দ্য দোয়েলকে নিয়ে এল। দোয়েল এমনিতেই স্মার্ট, সুন্দরী। কিন্তু আজ যেন দোয়েলকে সদ্য ফোটা গোলাপের মতো প্রাণবন্ত দেখাচ্ছিল।
অনিন্দ্য দোয়েলকে বসিয়ে রেখে বলল— ‘তুমি একটু বসো। আমি একটা ফোন কল করে আসছি। কিছুক্ষণ পর অনিন্দ্য ফিরে এসে বলল— ‘বোর ফিল হচ্ছে!’
একদম না। অনিন্দ্যদা, তুমি কী যেন বলবে বলছিলে!
বলব। তুমি ছাড়া আর কার সঙ্গে মনের কথা শেয়ার করব! সারপ্রাইজ তাড়াতাড়ি দিলে মজাটাই থাকে না। একটু ধৈর্য ধরো।
অনিন্দ্য কফি শপের ভিতর এদিক ওদিক বারবার চেয়ে দেখছিল। একটি ছেলে এসে অনিন্দ্যকে বলল— ‘স্যার, আপনাদের কী লাগবে?’
অনিন্দ্য বলল— ‘হুম, দুকাপ কফি।’
অনিন্দ্যর অনুসন্ধানী চোখের দিকে তাকিয়ে দোয়েল বলল— ‘অনিন্দ্যদা, তুমি কি কাউকে খুঁজছ?
অনিন্দ্য বলল— ‘না, না।’
কফি শপের ছেলেটি দুকাপ কফি দিয়ে গেল। দোয়েল কফির কাপে চুমুক দেবে এমন সময় একটি মেয়ে অনিন্দ্যর গলা পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে বলল— ‘অনিন্দ্য, আমি এসে গেছি। আজ সকালের ফ্ল্যাইটে কলকাতা ফিরলাম। হাউ আর ইউ ডারলিং?’
মেয়েটির বয়স পঁচিশের ঊর্ধ্বে নয়। গায়ে পেস্তা রঙের স্লিভলেস টপ, হাঁটু পর্যন্ত লম্বা কালো জিন্স। গায়ের রং খুব ফরসা বলা চলে না। বুদ্ধিদীপ্ত মুখ। নুডুলসের মতো কোঁকড়ানো চুল ঘাড় পর্যন্ত নেমে এসেছে। লম্বা প্রায় পাঁচ ফুট আট ইঞ্চি। কাঁধে লেদারের ভ্যানিটি ব্যাগ।
মেয়েটি ভ্যানিটি ব্যাগটা রেখে দোয়েলকে দেখে জিজ্ঞাসা করল, ‘হু ইজ শি অনিন্দ্য?’
অনিন্দ্য বলল— ‘কফি খেতে খেতে বলছি। বসো আগে। মেয়েটিকে বসিয়ে সে কফির অর্ডার দিল। দুমিনিটের মধ্যেই কফি চলে এল।’
দোয়েলের উদ্দেশ্যে অনিন্দ্য মেয়েটির দিকে হাত বাড়িয়ে বলল— ‘আলাপ করিয়ে দিই। ওর নাম শর্মিষ্ঠা বসু। বাড়ি কলকাতা। বর্তমানে সিঙ্গাপুরে পিএইচডি করছে। ফেসবুকে আমার সঙ্গে আলাপ হয়। আমরা একে অপরকে ভালোবাসি। সামনেই আমরা বিয়ে করতে চলেছি। আমার দোয়েল ছাড়া সাতকুলে কেউ নেই। দোয়েল সেন আমার অফিসের সহকর্মী এবং সহমর্মী।’
শর্মিষ্ঠা উচ্ছ্বসিত গলায় বলল— ‘তুমিই দোয়েল! অনিন্দ্যর মুখে কতবার যে তোমার নামটা শুনেছি কী বলব! নাইস টু মিট ইউ। আমাদের বিয়েতে তোমাকে থাকতেই হবে।’
দোয়েল এই পরিস্থিতিতে কী বলবে বা কী তার বলা উচিত হবে, ভেবে পেল না। বাইরের আকাশে ঘন কালো মেঘের মতো দোয়েলের মনের আকাশেও ঘন কালো মেঘে ছেয়ে গেছে। সে ঠোঁটের কোণে এক টুকরো হাসি এনে বলল— ‘দারুণ সারপ্রাইজ অনিন্দ্যদা। তুমি শর্মিষ্ঠার কাছে আমাকে এতটা গুরুত্ব দিয়ে। তোমাদের বিবাহিত জীবন সুখের হোক। অনেক দেরি হয়ে গেল। আমি আসি।’ অনিন্দ্য আর শর্মিষ্ঠার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে দোয়েল বাড়ি ফেরার বাসে উঠল।
সন্ধ্যা ছটা। বাসটা নিউ আলিপুরে স্টপেজ দিতেই দোয়েল নেমে পড়ল। অন্ধকারও চুপিসাড়ে রাস্তায় নেমেছে। হালকা বৃষ্টি শুরু হয়েছে। রাস্তাটা আজ বেশ ফাঁকা লাগছে দোয়েলের। তার মনের জমাটবাঁধা মেঘ অঝোরধারার শ্রাবণ হয়ে ঝরে পড়তে চাইছে। সে চলতে চলতে বারবার পিছন ফিরে তাকাচ্ছিল। দোয়েলের মনে সেই অনামি ছেলেটার মুখ ভেসে উঠল, যাকে আজ সকালে সে অপমান করেছে।
ফ্ল্যাটের কাছে এসে দোয়েল লক্ষ্য করল যে, ছেলেটি বারান্দা এবং জানলা কোথাও নেই। নেই কোনও গানের আওয়াজ। দোয়েলের কাছে ছেলেটি অপমানিত হয়ে আর হয়তো কোনও দুঃসাহসিক পদক্ষেপ নেবে না। দোয়েলের চোখের পাতা ভিজে আসছিল। তার চোখের জলকে ধুয়ে দিতে আকাশভাঙা বৃষ্টি নামল।