পরিতোষের ধৈর্য এত কমে যাচ্ছে! পূর্ণিমা বেশ বিরক্তই হচ্ছেন মাঝেমধ্যে। সকালবেলা এত কীসের হাঁকডাক? বেশ তো চায়ের কাপ, খবরের কাগজ নিয়ে বসেছে, তবু পূর্ণিমা, পূর্ণিমা। রান্নাঘর থেকে হাত মুছে বেরোতে না বেরোতেই মুখোমুখি পরিতোষের। পূর্ণিমা একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেলেও চুপ করে তাকিয়ে রইলেন স্বামীর মুখের দিকে। দ্যাখো দ্যাখো কী লিখেছে! সম্পত্তির জন্য ভাড়াটে গুন্ডা দিয়ে বুড়ো বাবা-মাকে খুন করিয়ে শেষ রক্ষা হয়নি। কুপুত্তুর পুলিশের হাতে ধরা পড়ে সব কবুল করেছে। বুঝেছ, ধর্মের কল বাতাসে নড়ে। পূর্ণিমাকে পড়ে শোনানোর পরই পরিতোষ কেমন যেন উদাস হয়ে গেলেন। তাঁর নিজেরও তিন ছেলেমেয়ে।

আরে বাবা এত ভাবাভাবির কী আছে। কোন কালচারের লোকজন এমন করেছে সেটা তো দেখবে। শিক্ষিত না অশিক্ষিত সেটাও তো ভাবা উচিত। পরিতোষ ঝাঁঝিয়ে উঠলেন, থামো তো, বলছি বাড়ি সম্পত্তি অর্থাৎ নিশ্চিত ভাবে বড়োলোক! তাছাড়া এমবিএ করেছে ছেলে, বিদেশ থেকে। বলতে বলতে যেন হাঁফিয়ে উঠলেন। বপকে আজকাল মাঝেমাঝেই এমন চাপ অনুভব হয় পরিতোষের। পূর্ণিমা তাই দেখে তাড়াতাড়ি এক গেলাস জল মুখের সামনে এগিয়ে ধরে বললেন- কাগজে কি পড়ার আর কিছুই থাকে না? খেলা, সিনেমা, রাজনীতি, তা না যত্তসব আজে বাজে খবরে আগে দৃষ্টি যায়! আর কদিন বাদেই তোমার রিটায়ারমেন্ট। নিজের বাড়ি-বউ-ছেলেমেয়ে পেনশনের মোটা টাকা- তোমার ভাবনা বা দুশ্চিন্তা কেন হয়? কী চাও তুমি?

পরিতোষ আবার এক ঢোঁক জল খেয়ে বললেন, এক পয়সাও আর কাউকে দেব না। ছেলেমেয়েদের যথেষ্ট পড়াশানো করিয়েছি, এবার নিজেরা বুঝে নিক। পূর্ণিমা চমকে উঠলেন, কী বলছ। পাপুর বিয়ে হয়ে গেছে। ঘরে বউ আছে। দুদিন পরে মেয়ে অর্থাৎ পাপিয়ার বিয়ে!আর কয়েকদিন আগেই তো পিকলু বলছিল আরও পড়বে।

-ব্যস চুপ। যথেষ্ট পড়িয়েছি, ইঞ্জিনিয়র হয়েছে, এবার যা করার নিজের টাকায় করো। আমার পেনশনের এক নয়া পয়সাও কাউকে দেব না। পরিতোষ উঠে বাইরে হাঁটা দিলেন।

আজ সকাল থেকে পরিতোষের মন ভালো নেই। সকালে মর্নিংওয়াকে গিয়ে দেখেন রতন চুপচাপ বসে আছে। খুঁচিয়ে জিজ্ঞাসা করায় হাউমাউ করে কেঁদে উঠল। হঠাৎ স্থির হয়ে গিয়ে কঠিন গলায় বলে উঠল, ছেলে বলেছে, পরিবার নিয়ে চাকরির জায়গায় চলে যাচ্ছে। বউ-বাচ্চা নিয়ে দুকামরার ছোটো অফিস-ফ্ল্যাটে খুবই অসুবিধা হয় বেশি লোক হলে। ছেলের এটুকু কথাতেই রতন বুঝে নিয়েছে ছেলে-বউ কী বলতে চাইছে। জমানো টাকা যেটুকু ছিল স্ত্রীর অসুখে বেরিয়ে গেছে, চাকরির কোনও পেনশন নেই। নিজের বাড়ি ছিল। বন্ধক রেখে ছেলেকে বিদেশ পাঠিয়েছিল, মানুষ হবে বলে। হায় রে!

রতনের মুখে ওই ঘটনা শুনে এবং বাড়ি গিয়ে খবরের কাগজ পড়ে পরিতোষের মনমেজাজ সবই তিরিক্ষে হয়ে গেল। সেই যে বাসের পিছনে একবার লেখা দেখেছিলেন। টাকা আপন, সবই পর টাকার টুঁটি চেপে ধর। সেদিন বিড়বিড় করে বলেছিলেন, দেশটা উচ্ছন্নে গেল! আজ চকিতে মনে পড়ে গেল সে কথা। ওই কথাগুলোই ঠিক। পূর্ণিমা জানতেন পরিতোষ একবার যা ভেবে নিয়েছেন তা-ই করবেন।

গত রাতে পিকলু আবদার করেই বলেছিল, বাবা, স্পনসরশিপের টাকাতেই বিদেশ যাব। কিন্তু আরও অন্যান্য খরচার জন্য প্রায় ২ লাখ টাকা লাগবে। মাত্র চার-পাঁচ বছরের ব্যাপার। তারপর সব টাকা সুদে-আসলে আমাদের ঘরেই আসবে। পিকলু থামল, বাবার নিশ্চুপ মুখের দিকে তাকাল। তারপর মা-র দিকে। মায়ের চাহনি দ্বিধাবিভক্ত। পিকলু বুদ্ধিমান ছেলে। যা বোঝার সে বুঝে নিল।

রাতের সব কাজ সেরে পরিতোষের পাশে বসে পূর্ণিমা বেশ অভিমান করে বললেন, কী হয়েছে তোমার? যদি ছেলেদের সাথে এমন ব্যবহার করো, তাহলে সংসার টিকবে কী করে? রাতে টেবিলেও এলে না। ছেলেরা তোমার জন্য অপেক্ষা করে ছিল। দিন রাত কী ভাবছ? পরিতোষ ধীর-ঠান্ডা গলায় বলে উঠলেন, আমার জন্য কেউ অপেক্ষা করেনি, অপেক্ষায় ছিল আমি টাকা দেব কিনা সেটা জানার জন্য। অবাক চোখে পূর্ণিমা তাকালেন স্বামীর দিকে। এ মানুষটাকে তিনি চেনেন না! এ কোন পরিতোষ! হলটা কী!

পরের দিন সকালে খাবার টেবিলে বসেই পাপু জিজ্ঞাসা করল পিকলুর কথা টাকার কথা। পূর্ণিমা চুপ। আবার প্রশ্ন করতে পিকলুই ঝাঝিযে উঠল, দাদা চুপ কর।

চুপ করব কেন? তোর বিদেশ যাওয়া হবে না? টাকার জন্য আটকে যাবি?

পরিতোষ বেশ জোর গলায় বলে উঠলেন, ইঞ্জিনিয়র করে দিয়েছি। তোমাদের দুজনের জন্য লাখ লাখ টাকা খরচ করেছি। আর নয়। এবার যা করবে, তা নিজেরাই করো। পিকলু মাথা হেঁট করে পাঁউরুটি চিবোতে থাকল। পাপু বেশ থতমত খেয়ে গেল বাবার এই আচরণে। নীচু স্বরে বলল সে, আমার ভাইয়ের বিদেশ যাওয়া টাকার জন্য আটকে যাবে? এ হতে পারে না। আমি দেখছি কী ব্যবস্থা করা যায়। পরিতোষ তাড়াতাড়ি করে খাওয়া শেষ করে উঠে গেলেন। নিজের মনেই, অথচ সবাই যেন শুনতে পায়, এমন স্বরে বলে চলে গেলেন, আমি কারুর কাছ থেকে কিছু আশা করি না, কেউ যেন আমার কাছ থেকে কিছু প্রত্যাশা না করে। সবাইকে বড়ো করে দিয়েছি, মানুষ করেছি, আর নয়।

মা, বাবার কী হয়েছে? পিকলুর প্রশ্ন শুনে পূর্ণিমা ঘুরে তাকালেন, চোখ ভর্তি জল নিয়ে জানি না, কী যে হয়েছে, বুঝি না। কাল রাতে শোবার সময় বললেন, পূর্ণিমা, আর টাকা-পয়সা কাউকে নয়। সব নিজেদের নিজেদের, বলে শুয়ে পড়লেন।

কি! আমরা বাবার টাকার ব্যাপারে লোভী?

ভাই-বোন, ছোটো থেকে এক সাথে বড়ো হওয়া, নিজের পায়ে দাঁড়ানো, সব কিছুতেই যে তোমরা মা। বাবা কি বোঝে না! আমি তো এই বাবাকে চিনতেই পারছি না, পাপু উঠে চলে গেল।

পিকলু মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল, বাবার দোষ কোথায়? দিনরাত কাগজে-টিভিতে খবর, সম্পত্তির লোভে বাবা-মাকে হেনস্তা, কখনও খুন। আকছার এমন খবর পড়া-শোনা-দেখার পর বৃদ্ধ, পেনশনভোগী মানুষটা নিজেকে কতটা ঠিক রাখতে পারে? চোখের সামনে রতন জ্যাঠার ছেলেটাকে দ্যাখো। কত ভালো মানুষ রতন জ্যাঠা, তার ছেলের এই ব্যবহার! বাবা তো ভয় পাবেই, এমন ঘটনা শুনে।

 

পরের মাসেই পিকলু চলে গেল বিদেশে। বোন পাপিয়াও ক্যাম্পাস-ইন্টারভিউ দিয়ে চাকরি পেয়ে খুশি। নিজেকে নিয়ে সে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। সেই সকালে বেরিয়ে বাড়ি আসতে আসতে প্রায়দিনই আটটা বেজে যায়। এ নিয়ে পূর্ণিমার সঙ্গে মাঝেমধ্যে মন কষাকষি হয়। পাপিয়া মাকে বুঝিয়ে হাল ছেড়ে দেয়, এখন অফিসে সকাল নটা থেকে বিকেল সাড়ে পাঁচটা পর্যন্ত থাকতেই হয়। তারপর ওভারটাইম থাকলে তো কথাই নেই।

পূর্ণিমা হাল ছেড়ে দিয়েছেন। সারাদিন একা একা থাকতে হয় তাঁকে। একদিন রাতে পরিতোষের কাছে পূর্ণিমা কথাটা পাড়লেন- মেয়ের বিয়ের ব্যাপারে কী চিন্তাভাবনা করছ? বয়স বাড়ছে। চাকরি করছে, এবার খোঁজখবর শুরু করো। পরিতোষ শুনলেন চুপচাপ।

দিনকয়েক পরে এক রাতে খাবার টেবিলে পরিতোষ সবাইকে জানালেন, কাল পাপিয়াকে দেখতে আসবে। পাপিয়া বেশ অবাক হয়ে গেলেও বাবাকে কিছু বলল না। পরে মাকে বলল, বেশি আয়োজন কোরো না। প্রথমবার দেখতে আসছে, চা, বিস্কুট দিলেই হবে। মা হেসে কিছুই বললেন না। মেয়ে অফিস গেলে নিজেই বসে গেলেন মিষ্টি তৈরি করতে। গোলাপজাম, নারকেল বরফি, নিমকি, সিঙাড়া, কাটলেট আর পনির মানচুরিয়ান। এছাড়া ঘরে জলজিরার শরবত তো আছেই।

সন্ধ্যায় যথা সময়ে পাত্রপক্ষ হাজির হলেন পরিতোষের বাড়িতে। পাত্র প্রমোদ বেশ সম্রান্ত পরিবারের ছেলে। সঙ্গে এসেছেন মা সৌদামিনী। বসামাত্রই সৌদামিনী শুরু করে দিলেন তার ছেলের প্রশংসা। ছেলেকে সিএ তৈরি করতে কত খরচ হয়েছে, তার হিসেবও তিনি দিতে ভুললেন না। পরিতোষ আর থাকতে না পেরে বলে উঠলেন, এগুলো তো সব মা-বাবারই কর্তব্য, সন্তানকে মানুষ করার জন্য যতটা প্রয়োজন তাদের দিকে হাত বাড়িযে দেওয়ার। আপনি টাকা-পযসার কথা কী যেন বলছিলেন? প্রমোদের মা বেশ হকচকিয়ে গেলেন পরিতোষের কথা এবং গলার গম্ভীর স্বর শুনে। পরিতোষ না থেমেই বলে উঠলেন, আমার মেয়ের বিয়ের জন্য যদি কোনও পণ, মানে টাকা পয়সার লেনদেনের কথা আপনারা বলেন, তাহলে এখানে আমার মেয়ে বিয়ে দেব না। ব্যস কথাবার্তার এখানেই ইতি। পূর্ণিমা স্বামীকে একলা পেয়ে ক্ষোভে ফেটে পড়লেন- কী ভেবেছ তুমি, এভাবে পাত্রপক্ষকে বললে কেউ কি আর বিয়ের কথা এগোবে!

পরিতোষ শান্ত গলায় পূর্ণিমাকে জবাব দিলেন, মেয়ের বিয়ে দেব, বেচব না। পূর্ণিমা মুখে আঁচল চাপা দিয়ে কাঁদতে লাগলেন, মেয়ে বিয়েতে কোন বাবা না খরচ করে? তুমি কী রকম মানুষ! পরিতোষ উঠে চলে গেলেও পূর্ণিমা একা বসে কাঁদতেই থাকলেন। হঠাৎ কাঁধে মৃদু চাপ পড়তেই ঘুরে দেখলেন পাপিয়া-কে। মায়ের হাত ধরে নরম গলায় সে বলল, মা বাবা তো ঠিকই করেছে, তুমি কাঁদছ কেন? আমার শিক্ষাদীক্ষার কি কোনও দাম নেই? তুমি চিন্তা কোরো না, আমার জীবনসঙ্গী আমি নিজেই খুঁজে নেব। তুমি একটু ধৈর্য ধরো। মেয়ের আশ্বাসবাণীতেও মা শান্ত হলেন না, নিজের মনেই কেঁদে চললেন।

 

এরপর ছমাস কেটে গেছে। একদিন বিকেলে পাপিয়া তাড়াতাড়ি বাড়ি এল,

মা-বাবা দুজনেই সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে মেয়ের দিকে তাকালেন। পাপিয়া হেসে বলল, আজ তোমাদের সঙ্গে একজনের আলাপ করিয়ে দেব, তাই তাড়াতাড়ি বাড়ি চলে এলাম। এসো অমৃত, ভেতরে এসো।

পূর্ণিমা-পরিতোষ দুজনেই দরজার দিকে তাকালেন। দরজায় দাঁড়িয়ে একজন সুদর্শন যুবক। বয়সটা পাপিয়ার তুলনায় কিঞ্চিত বেশি। পরিচয়পর্বের পর জানা গেল লোকটি পাপিয়ার থেকে অন্তত বারো তেরো বছরের বড়ো এবং সে দক্ষিণ ভারতীয়। অপ্রস্তুত অবস্থাটা কাটিয়ে পূর্ণিমা পাপিয়াকে টানতে টানতে ভেতরে নিয়ে গিয়ে বকুনির স্বরে বলে উঠলেন, এ কী করছিস তুই! ছেলেটি আমাদের স্বজাতি নয়, তোর থেকে এত বড়ো এমন একজনকে তুই ভালোবাসিস!

মা! পূর্ণিমার হাতটা চেপে ধরল পাপিয়া। কী আসে যায়, অমৃত খুবই মেধাবী ছেলে, ও বিজ্ঞানী। আজকাল নর্থ-ইন্ডিয়ান,সাউথ-ইন্ডিয়ান এসব পরিচয়ে কিছু এসে যায় না মা। আমরা কি ইডলি-ধোসা খাই না? হোটেলে গিয়ে রসম-ভাত খাই না? অমৃত তো রাজমা কিংবা অড়হড়ডাল-ভাত বেশ পছন্দ করে। আলুর পরোটা ওরও খুব প্রিয়, তোমারও প্রিয়, মা। আমরা দুজনে দুজনকে বুঝি, ভালোবাসি। আমি সারা জীবন ওর সঙ্গে সুখে থাকব। তুমি বাধা দিও না। বলতে বলতে পাপিয়ার দুচোখ জলে ভরে উঠল।

মেয়েকে বিহ্বল দেখে পূর্ণিমা বললেন, তোর সুখই আমার কাছে সব থেকে বড়ো পাওয়া, তুই যা ভালো বুঝিস কর মা, আমার কিছুই বলার নেই। পাপিয়া চোখের জল মুছে হাসতে হাসতে মাকে নিয়ে বাইরের ঘরে এসে দেখল, বাবা আর অমৃত দুজনে খোসগল্পে মেতেছে। সেদিন রাতে অমৃত ওদের বাড়িতে খেয়ে গেল, বেশ তৃপ্তি করে। পূর্ণিমা-পরিতোষ বেশ খুশি হলেন অমৃতর ব্যবহারে।

 

এই ঘটনার তিন মাসের মধ্যেই পাপিয়া-অমৃতর রেজিস্ট্রি হয়ে গেল, ছোট্ট এক পারিবারিক অনুষ্ঠানের মধ্যে দিয়ে। পিকলু আসতে পারেনি। এজন্য সে দারুণ আপসোস করে দিদিকে মেল পাঠিয়েছে। বলেছে সে ফিরে এলে আবার অনুষ্ঠান হবে। পূর্ণিমা একটু নিমরাজি ছিলেন বিয়েতে তেমন ঘটা না হওয়ার জন্য কিন্তু অমৃতই বুঝিয়েছিল, শুধু শুধু খরচা করার কোনও মানে হয় না। পরিতোষ কিন্তু বেশ নিশ্চিন্ত এমন জামাই পেয়ে। সময় পেলেই অমৃতকে নিয়ে আড্ডা দিতে বসে যান। পাপুও তাই।

আস্তে আস্তে অমৃত-পাপিয়ার যাওয়া-আসা এ বাড়িতে কমে গেল। কাজের চাপ বেড়ে যাচ্ছে সকলের। এক বছরের মধ্যে পাপুও অন্য চাকরি নিয়ে পিকলুর কাছে চলে গেল সপরিবারে। চার বছরের কনট্র্যাক্ট। বাড়িটা একদম ফাঁকা। পরিতোষ চুপচাপ থাকেন, পূর্ণিমারও একইরকম অবস্থা।

বাড়িটা যেন খাঁ-খাঁ করছে। একসময় বাড়িটা ভরে থাকত। তিন ভাইবোনের হাসি ঝগড়া কান্নায়। বিশেষ করে পিকলুর। সবার ছোটো, অল্পেতেই বায়না। পাপু সব সময় পিকলুর পক্ষ নিত। দুভাই একদিকে, তো পাপিয়া একা। বেশ ছিল দিনগুলো। পরিতোষ না বুঝেই মেয়ের পক্ষ নিতেন। কি হইচই আনন্দের দিন ছিল সেগুলো।

একবার বেশ মনে আছে পূর্ণিমার, দুই ভাই কোথা থেকে কটা পেয়ারা নিয়ে এসেছে, বোধহয় রতনদাদের বাগান থেকে, এনে বাপ-ব্যাটারা মিলে সব খেয়ে নিয়েছে। হঠাৎ পাপিয়া সকুল থেকে ফিরেছে। দেখেই চিৎকার, আমার ভাগ কই? সবাই মুখ মুছে চুপচাপ। পাপিয়া ছুটে রান্নাঘরে গিয়ে নালিশ জানাতেই, পূর্ণিমা খুন্তি হাতে দুই ছেলের দিকে ছুটে গেলেন। পিকলু ছুটে পালাতে পালাতে জানাল, বাবা দুটো পেয়ারা খেয়েছে। রেগে পরিতোষের দিকে তাকাতে গিয়ে হেসে ফেলেছিলেন পূর্ণিমা।

বেচারা মাথা হেঁট করে বলির পাঁঠার মতো বসে আছে। সেবার পাপিয়া অভিমানে দু-তিন দিন বাবার সাথে কথা বলেনি। সেদিন রাতেই অবশ্য পরিতোষ মেয়ের মান ভাঙাতে একটা নতুন গল্পের বই কিনে এনেছিলেন। পাপিয়া ছুঁয়েও দেখেনি। সে রাত কাটলেও পরের দিনও পাপিয়া যখন কারুর সাথে কথা বলেনি, তখন দু-ভাই বেশ ভড়কে গিয়েছিল। চুপচাপ দুজনে দুটো পেয়ারা জোগাড় করে এনে দিয়েছিল। বাপরে কী জেদ ছিল মেয়ের। দেখতে বেশ শান্ত কিন্তু দারুণ একরোখা। কত সুখ-স্মৃতি।

 

আচমকা একদিন, পরিতোষ-পূর্ণিমা রাতের খাওয়া সেরে শুয়ে গল্প করতে করতে ঘুমিয়ে পড়লেন। পরের দিন পূর্ণিমা সকালে উঠে অবাক! পরিতোষ রোজ ভোরবেলায় মর্নিংওয়াক করতে যান, আজ কী হল! এত ঘুমোচ্ছেন কেন?

তোমার হল কী! শরীর খারাপ নাকি? সাড়া না পেয়ে এবার একটু ধাক্কা দিতেই মানুষটার মাথাটা এক পাশে হেলে পড়ল।

 

পাপিয়া-অমৃত এল। ছেলেরা কেউ আসতে পারল না বাবার শেষকৃত্যে। পাপিয়ারা কয়েকদিন মায়ের কাছে থেকে গেল। দিনদিন বাড়িটা যেন পূর্ণিমাকে গ্রাস করে নিচ্ছে। পরিতোষের মৃত্যুর মাস চারেক পর পূর্ণিমা ছেলেদের আইএসডি করে খবর পাঠালেন একবার অন্তত তারা যেন আসে। এই বাড়ির কোনও ব্যবস্থা করতে হবে। যে যার সম্পত্তির ভাগ যেন বুঝে নেয়। পাপু-পিকলু সোজাসাপটা বলল, মা আমরা দুভাই কিছু চাই না। শুধু তোমায় চাই। তুমি পাপিয়া্কে দাও। কিংবা তোমার ইচ্ছামতো বাড়িটা কোনও অনাথালয় বা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানকে দান করে দিয়ে, তুমি আমাদের কাছে চলে এসো। বাবার আত্মা শান্তি পাবে।

পূর্ণিমার দুচোখে জল। পরিতোষের ছবির সামনে দাঁড়িয়ে নিজেই বলে উঠলেন, দ্যাখো, যে-সম্পত্তির জন্য তুমি ছেলেদের দূরে পাঠালে, যে-টাকাপয়সা তুমি কাউকে দিলে না, নিজের ভবিষ্যতের জন্য ভয় পেলে, সেই পয়সা আজ কারুর কাজে লাগল না। ছেলেরা শুধু মাকেই চায়। সময় বড়ো কম। আমি চলে যাব, আমি ওদের কাছেই থাকব। সব দিয়ে দেব গরিবদের। আমার সন্তানরাই আমার সম্পদ।

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...