রাসপূর্ণিমার রাত। কুয়াশার পাতলা আস্তরণ ভেদ করে নেমে আসছে কিঞ্চিৎ ম্লান জ্যোৎস্না, জানলার ফাঁক বেয়ে চুঁইয়ে ঢুকছে ঘরের মধ্যে। সেই ফাঁক বেয়ে সোহিনী তাকাল পাশের দোতলা বাড়ির চিলেকোঠার দোচালা ছাদের দিকে। সেটি তখন ভেসে যাচ্ছে জ্যোৎস্নার স্নিগ্ধধারায়।
তিন বছরের ছোটো মেয়ে শ্রেয়াকে ততক্ষণে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছিল সোহিনী। বড়ো ছেলে সিঞ্চন তখন পাশের ঘরে তার বাবার কাছে বসে অঙ্ক কষছিল। বছর দশ বয়স হল সিঞ্চনের, সামনেই ক্লাস ফাইভের ফাইনাল পরীক্ষা। এদিকে সোহিনী-সৌরাশিস-এর বিয়ের বারো বছর পূর্ণ হতে আর মাত্র দু'মাস বাকি। সোহিনীর দিদি সোনালি ইতিমধ্যেই ক্যান্ডেল-লাইট ডিনারের দাবি পেশ করেছে সৌরাশিসের কাছে।
জ্যোৎস্নার মাধুর্য সোহিনীর মনে একের পর এক নস্টালজিয়ার ঢেউ তুলতে শুরু করেছিল। স্মৃতির সরণি বেয়ে সে তখন বারো বছর আগের এমনই এক রাসপুর্ণিমার আনন্দময় রাতে পৌঁছে গিয়েছিল তার মাসির বাড়ির জ্যোৎস্নাপ্লাবিত ছাদে। সেই প্রথম সোহিনী তার জীবনে প্রেমের উষ্ণ স্পর্শ অনুভব করেছিল।
সোহিনীর মাসতুতো দিদি নয়না আর তার নিজের দিদি সোনালি পালা করে নাক ডাকিয়ে ঘুমোচ্ছিল, অন্যদিকে সোফায় চাদরমুড়ি দিয়ে শুয়েও তার ঘুম আসছিল না। দিব্যেন্দুদার বন্ধু সোহম দারুণ তেজোদ্দীপ্ত পুরুষালি কণ্ঠের অধিকারি। তার মনের পর্দায় বার বার ভেসে উঠছিল সেই মুখ অথচ ওদের নাক ডাকার দমকে বার বার তা হারিয়েও যাচ্ছিল। তাই বাধ্য হয়ে হালকা চাদরে শরীর ঢেকে সোহিনী উঠে চলে গেল ছাদে।
পাশাপাশি দুটো ছাদ মাঝখানে ফুট তিনেকের ব্যারিয়ার। এপাশে নয়নাদিদের মানে তার মাসির বাড়ির ছাদ, ওপাশে নয়নাদির জ্যাঠামশায়ের বাড়ির ছাদ। দিব্যেন্দুদা আর অজয়দা তাঁরই দুই ছেলে। দুই ছাদেই তখন জ্যোৎস্নার প্লাবন। মফস্সল এলাকা। গাছপালা পুকুরে ভরা। ছাদ থেকেই দেখা যায় দু'-দুটো পুকুর, স্বচ্ছ কাচের মতো জল— জ্যোৎস্নায় ঝকঝক করছে। দুই পুকুরের মাঝখান দিয়ে পায়ে চলার মেঠো পথ বিস্তৃত হয়ে দূরের বাস রাস্তায় গিয়ে মিশেছে। ল্যাম্পপোস্টের টিমটিমে আলো পূর্ণিমার জ্যোৎস্নায় ম্লান লাগছিল। হঠাৎ দিব্যেন্দুদাদের ছাদে একটি ছায়ামূর্তি দেখে ভয় পেয়ে গেল সোহিনী। গ্রাম-গঞ্জে রাতে নাকি ভূত দেখা যায় বলে শুনেছে সে, এও কি সেইরকম কিছু নাকি! মূর্তিটা ব্যারিয়ার পর্যন্ত এগোতেই চিনতে পারল সোহিনী। আরে এ তো দিব্যেন্দুদার বন্ধু সেই সোহম, যার কথা মনে মনে ভাবছিল সে!