মফস্সলের বাইরে এই জায়গাটা এখনও আদিম রয়ে গেছে। আদিগন্ত বিস্তৃত গাছের সারির নীচে মখমলের মতো পুরু ঘাসে ভর্তি শান্ত নিরিবিলি নির্জন এক স্থান। অনেকগুলি ছোটো ছোটো ঢিবি অর্ধচন্দ্রের মতো বিস্তৃত সমস্ত এলাকা জুড়ে। ঢিবির পশ্চিমদিকে খনন করা পরিখার মাঝে বাঁধ দিয়ে পুকুর তৈরি করে নেওয়া হয়েছে। উপর থেকে দেখলে অনেকটা ঘোড়ার নালের মতো দেখায়। অপূর্ব তার সৌন্দর্য। একটু গভীর ভাবে নিরীক্ষণ করলে বোঝা যায় শত্রু বাহিনীর আক্রমণ থেকে আত্মরক্ষার উদ্দেশ্যেই এমন নিরাপত্তা বেষ্টনীর নির্মাণ করা হয়েছিল।
সবুজ ধানে ভরা জমির আল পেরিয়ে ঢিবিতে উঠতে গিয়ে হাঁপিয়ে উঠল রেহান। একটা বড়ো গাছের নীচে গিয়ে বসে পড়ল। এত হাঁপিয়ে গেল কেন ও! বয়স কি তাহলে ওর ক্ষমতার উপর থাবা ফেলছে? ভাবছিল রেহান। এদিকে সন্ধে নেমে এসেছে। আকাশে গোলাকার রুপোর থালার মতো চাঁদ উঁকি দিচ্ছে গাছের ফাঁক দিয়ে। এলোমেলো ভাবে বয়ে চলা বাতাস গাছের পাতায় ধাক্কা খেয়ে শনশন্ শব্দে ঝরে পড়ছে নীচের দিকে।
শরতের মৃদু হাওয়ায় মৃত হলুদ পাতাগুলো উড়ে এসে পড়ছিল রেহানের মাথার উপরে। চোখ বন্ধ বেশ কিছুক্ষণ জিরিয়ে নিয়ে উঠে পড়ল সে। আস্তে আস্তে হাঁটতে শুরু করল ঢিবিটার উপরে যাওয়ার জন্য। অন্ধকার বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে চাঁদের আলো আরও স্পষ্ট হচ্ছিল। মাথার উপরে ঘন গাছের ডালপালার আস্তরণ ভেদ করে চুঁইয়ে চুইয়ে তিরের ফলার মতন পড়ছিল চাঁদের আলোর শিখা। সেই আলোয় নীচের ঘন সবুজ ঘাসের ডগাগুলো ঝিকিয়ে উঠছিল ছুরির ফলার মতন। চাঁদের আলো আর গাছপালা নিয়ে ঢিবিটায় সুন্দর মায়াবী পরিবেশ। বুনো গাছের গন্ধ আর নির্জনতায় ভরা এই ঢিবিটা যেন পৃথিবীর আদিমতা এখনও শেষ হয়ে যেতে দেয়নি।
ঢিবিটার উপরে গিয়ে খানিকটা আকাশের দেখা পেল রেহান। এখানে বেশ খানিকটা ফাঁকা জায়গা। ঢিবির আশে পাশের ঢালু জায়গায় বড়ো বড়ো গাছপালা দিয়ে ঢাকা থাকলেও এখানে গাছ নেই। আকাশের দিকে তাকিয়ে মোহিত হয়ে গেল রেহান। অপরূপ জ্যোৎস্নার রূপ। মেঘমুক্ত আকাশ থেকে যেন জ্যোৎস্নার ফুল ঝরে পড়ছে। রূপকথার পরিবেশ তৈরি হয়েছে সমস্ত চরাচর জুড়ে। চাঁদের আলোর শুভ্রতায় মনে হচ্ছে যেন এক্ষুনি আকাশ থেকে রূপকথার পরিরা ডানা মেলে নেমে আসবে। সমস্ত আকাশজুড়ে খণ্ড খণ্ড রূপোলি মেঘের দলের আনাগোনা। বহুদিন আকাশের দিকে তাকায়নি রেহান। আজকের রাতের আকাশের দৃশ্য দেখে মন ভালো হয়ে গেল ওর। মনের মধ্যে জমে থাকা কষ্টটা আচমকা গলে জল হয়ে গেল। মনটা বেশ ফুরফুরে লাগছিল।