বহুদিনের ইচ্ছা ছিল হিমাচলে ঘুরে আসার। নানা কারণে তা হয়ে উঠছিল না। খানিকটা অবসর পেয়ে প্রিয়জনদের সঙ্গে ২০২৪-এর অক্টোবরের দ্বিতীয় সপ্তাহের শুরুতেই দশ দিনের ছুটিতে বেরিয়ে পড়েছিলাম। প্রথমে হাওড়া থেকে বিকেলে রাজধানী এক্সপ্রেস ধরে এক রাতের জার্নি করে সকাল সাড়ে দশটায় দিল্লি পৌঁছালাম। দিল্লি প্ল্যাটফর্মের জনসমুদ্র ঠেলে বাইরে বেরিয়ে পার্কিং-এ এসে ছোটো গাড়ির জন্য অপেক্ষা করছিলাম। আমাদের পিক আপ করার ছোটো গাড়ি আগে থেকেই বুকিং করা ছিল। আধ ঘণ্টা পর রাজধানীর ট্র্যাফিক জ্যাম কাটিয়ে গাড়ি এসে পৌঁছাল। তড়িঘড়ি করে লাগেজ সহ গাড়িতে উঠলাম।

আমাদের গাড়ির চালক লালকেল্লাকে পিছনে ফেলে সাঁ সাঁ করে ছুটল পাহাড়ি শহর সিমলার উদ্দেশে। আমাদের অনলাইনে হোটেল বুক করা ছিল। ছোটো গাড়িতে প্রায় এগারো ঘণ্টা জার্নির পর রাত এগারোটায় হোটেলে পৌঁছালাম। গাড়ির ড্রাইভার জানাল যে, কাল সকাল আটটা থেকে সাড়ে আটটার মধ্যে প্রস্তুত থাকতে, সিমলার স্থানীয় কিছু জায়গা ঘুরিয়ে দেখাবেন। আমরা তার কথায় সায় দিলাম। দীর্ঘপথ জার্নি করে আমাদের অবসন্ন শরীর রাতের খাবার খেয়ে বিছানায় এলিয়ে পড়েছিল।

সিমলার হোটেলে প্রথম দিন সকালে যথারীতি সাড়ে সাতটায় ঘুম ভাঙল। স্নান সেরে ব্রেকফাস্ট করে আমরা ড্রাইভারের পূর্বের কথামতো প্রস্তুত ছিলাম। আমাদের সঙ্গে নিয়ে গাড়ি ছুটল পাহাড়ি রাস্তার অজানা বাঁকে বাঁকে। পাহাড়ি গন্ধ গায়ে মেখে পাহাড়ের প্রতিটি বাঁকের রহস্যময় অবর্ণনীয় সৌন্দর্য উপভোগ করতে বেশ ভালোই লাগছিল। পাহাড়ের উন্নত শিরে সূর্যের উজ্জ্বল আলো পড়ে সোনালি রঙের আভা ছড়িয়ে পড়ছিল দিকে দিকে। গাড়ির জানলা দিয়ে ঠান্ডা হিমেল হাওয়া ঝাপটা দিচ্ছিল চোখে মুখে। হোটেল থেকে প্রায় কুড়ি কিলোমিটার জার্নি করে পৌঁছালাম কুফরি। ওখানে বিভিন্ন পয়েন্ট দেখার জন্য আমরা ঘোড়া ভাড়া করে কয়েক কিলোমিটার পথ পেরোলাম। রৌদ্রোজ্জ্বল দিন থাকায় মাহাশু পিকে বদ্রীনাথ ও কেদারনাথ রেঞ্জ দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল।

কুফরি ভ্যালিতে এসে বরফ না পেয়ে একটু হতাশ হয়েছিলাম। কুফরিতে বরফ ছিল না। স্থানীয়দের মুখে শুনলাম যে, অক্টোবরের মাঝামাঝি কুফরিতে বরফ পড়ে। তবে ঘোড়া থেকে নেমে প্রায় সাতশো মিটার পথ হেঁটে কুফরি ভ্যালিতে কিছুটা চড়াই উতরাই পেরিয়ে নাগ মন্দির দর্শন করলাম। ভ্যালিতে নানারকম খাবার, পোশাকের দোকান, উপহার সামগ্রীর দোকান পসরা সাজিয়ে বসেছিল। ঠান্ডার মধ্যে উষ্ণ চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে প্রাকৃতিক শোভা দেখতে ভালোই লাগছিল। পুরো কুফরি ভ্যালি ঘুরে ফিরে আমরা ভ্যালির একটু নীচে জিপসি ভাড়া করে কুফরি ফান ওয়ার্ল্ডে পৌঁছালাম। ওখানে গিয়ে টিকিট কেটে কিছু ফান অ্যাক্টিভিটিজ জিপ লাইন, কার রেসিং, জিপ সাইক্লিং করলাম। বাচ্চাদের জন্য ফান ওয়ার্ল্ডে বিভিন্ন রকম অ্যাক্টিভিটিজ এখানে আছে। হিমালয়ের বিভিন্ন ভিউ পয়েন্ট এখান থেকে ভালো দেখা যাচ্ছিল। এখানে লোকজনের যাতায়াত অনেকটাই হালকা ছিল। কুফরি ফান ওয়ার্ল্ড ঘুরে এসে আমরা ঘোড়ার পিঠে চড়ে গাড়ি পার্কিং-এ ফেরত এলাম।

আমাদের ড্রাইভার সময় নষ্ট না করে পাহাড়ি পথের বুক চিরে গাড়ি ছোটাল। ফেরার পথে ঘণ্টাখানেক জার্নি করার পর রাস্তার একপাশে গাড়ি থামল। রাস্তার উপরেই পড়ল গ্রিন ভ্যালি ভিউ পয়েন্ট। পর্যটকদের ভিড় এখানে একটু বেশি। গ্রিন ভ্যালির সৌন্দর্য চোখ জুড়ানো। যে দিকেই চোখ যায় সবুজের সমারোহ। হিমালয়ের নানা নাম না জানা গাছ পুরো উপতক্যায় আধিপত্য বিস্তার করেছে। গ্রিন ভ্যালি দেখে আমরা হোটেলের কাছাকাছি আসতে বিকেল গড়িয়ে গেল। ঘড়িতে প্রায় তিনটে। ড্রাইভার আমাদের পরামর্শ দিল বিকেলে সিমলা ম্যাল ঘুরে দেখতে।

গাড়ি পার্কিং-এ দাঁড়াতে আমরা নেমে সিমলা ম্যালে যাওয়ার রাস্তা ধরলাম। এক মিনিট হাঁটার পর সিমলা ম্যালে-র লিফট-এ পৌঁছালাম। লিফট সোজা ম্যালে নিয়ে এল। লিফট থেকে বেরিয়ে ম্যালে পর্যটকদের অন্যতম দর্শনীয় স্থান ক্রাইস্ট চার্চ। গির্জার ভিতর স্থাপত্যশৈলী মুগ্ধ করল আমাদের সকলকে। শান্ত পরিবেশ বরাবর আমার ব্যক্তিগত পছন্দ। খুব একটা ভিড় ছিল না। তিন-চারজন পর্যটক ক্যান্ডেল জ্বালাচ্ছিলেন। এই গির্জাটি ভারতের দ্বিতীয় প্রাচীনতম গির্জা। গির্জাটি রিজের উপর ১৮৫৭ সালে স্থাপিত হয়। কলোনিয়াল আর্কিটেকচারের প্রতিফলন এখানে সুস্পষ্ট।

হাতে কিছু সময় বেশি থাকার জন্য আমরা গির্জা থেকে কিছু পথ হেঁটে পৌঁছালাম রোপওয়েতে করে জাখু টেম্পল। এই মন্দিরটি জাখু পাহাড়ের উপর অবস্থিত। এই মন্দিরে হনুমান পূজিত হন। হনুমানের মূর্তির উচ্চতা প্রায় ১০৮ ফুট। স্থানীয় লোকজনের মুখে শুনলাম, রামায়ণে কথিত লঙ্কা যুদ্ধের সময় লক্ষ্মণের প্রাণ ফেরাতে সঞ্জীবনী বুটি আনার জন্য ভগবান হনুমান কিছুক্ষণ এখানে বিশ্রাম নিয়েছিলেন। সেইজন্যই নাকি এই মন্দির প্রতিষ্ঠা করা হয়। মন্দির প্রাঙ্গণ বেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। এখানে পাইন, দেওদার গাছের সমারোহ দু-চোখকে প্রশান্তি দিচ্ছিল। অনবদ্য ভিউ এককথায় অবর্ণনীয়। এখানে ভিড় একটু বেশি ছিল। কিছুক্ষণ সময় কাটিয়ে আমরা ম্যালে ফিরলাম।

ধীর পায়ে সন্ধ্যা নামছে। হালকা হালকা ঠান্ডা হাওয়া বইতে শুরু করেছে। প্রায় সাড়ে পাঁচটা বেজে গেছে। সিমলা ম্যাল আলোয় ঝলমল করছে। ম্যালে বসে আমরা গরম গরম মোমোর স্বাদ নিলাম। এককথায় অতুলনীয় স্বাদ। আমরা এক ঘণ্টা সময় নিয়ে ম্যাল ঘুরে বাড়ির সদস্যদের জন্য বেশ কিছু জিনিসপত্র কিনলাম। তারপর লিফট ধরে আমরা গাড়ি পার্কিং-এ এসে পৌঁছালাম। গাড়ির চালক আমাদের অপেক্ষাতেই ছিলেন। গাড়ি হোটেলের উদ্দেশে ছুটল। ড্রাইভার আমাদের বলল যে আগামীকাল সিমলা কালীবাড়ি নিয়ে যাবে। সে সিমলা কালীবাড়ি থেকে আনান্দলে হয়ে মানালি হোটেলে নিয়ে যাবে আমাদের। সকাল আটটার মধ্যে আমরা যেন প্রস্তুত থাকি৷

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...