দ্বিতীয় দিন সকাল আটটায় আমরা প্রস্তুত কালীবাড়ি যাবার উদ্দেশ্যে। সিমলা ছাড়ার আগে কালী মন্দির দর্শন করলাম আমরা। সিমলা ম্যাল থেকে কিছুটা হাঁটা দূরত্বে এই মন্দিরটি। হিন্দু সম্প্রদায়ের জনপ্রিয় এই কালীবাড়ি বান্টন পাহাড়ের কোলে অবস্থিত। মন্দিরের বাহ্যিক কাঠামোয় হিন্দু শৈলীর স্থাপত্য লক্ষণীয়। মন্দিরটি কিছুটা দক্ষিণেশ্বরের কালী মন্দিরের আদলে যেন তৈরি। এখানে দেবীমা-র কাঠের মূর্তি। মন্দির প্রাঙ্গণে ভক্তরা ভক্তিভরে পুজো দিতে ব্যস্ত। আমরাও পুজো দিলাম।

মন্দিরের চারপাশের দৃশ্য অবর্ণনীয়। সূর্যের আলোয় সোনালি পর্বতের উন্নত শির, সবুজ বনানী, পাহাড়ি নিস্তব্ধতাকে ভেঙে পাখিদের ডাক— এসবই মন ভরিয়ে দেওয়ার মতো। মন্দিরটির আশপাশে কিছু আবাসন রয়েছে পর্যটকদের থাকার জন্য। মন্দির সংলগ্ন একটা ক্যান্টিনও রয়েছে যেখানে অনায়াসে আহার গ্রহণ করা যায়। মন্দিরের আশপাশে বানরদের উপদ্রবও আছে। গাছের এই ডাল থেকে ওই ডাল নির্ভয়ে বিচরণ করছে তারা।

এরপর আমাদের গন্তব্য ছিল আনন্দালে। সিমলা কালীবাড়ি থেকে ছোটো গাড়িতে এখানে আসতে প্রায় পনেরো মিনিট লাগল। পাহাড়ের কোলে এক টুকরো মনোরম সমতল ভূখণ্ড আনন্দালে। ব্রিটিশ আমল থেকেই এই স্থানটি ক্রীড়াক্ষেত্র হিসাবে পরিচিত। এই স্থানটির জনপ্রিয়তা ক্রমবর্ধিত হয়েছে। গলফ, ক্রিকেট, পোলো, রেসিং ইত্যাদি খেলা এখানে হয়। দেওদার এবং ওক গাছ আনন্দালেকে ঘিরে রেখেছে। অপূর্ব সুন্দর এখানকার সবুজ পরিবেশ। স্থানীয়রা এই স্থানটিকে “দি হার্ট অফ সিমলা’ বলেন। এই উপত্যকা সংলগ্ন একটি আর্মি হেরিটেজ মিউজিয়াম এবং একটি সেনানিবাস আছে, যা সব পর্যটকদেরই আকর্ষণের বিষয়। বিনামূল্যে যে কেউ এই মিউজিয়ামে প্রবেশ করতে পারেন।

এখান থেকে যখন আমরা বেরোলাম তখন দুপুর বারোটা। আমাদের গাড়ি আবার চলতে শুরু করল। কিছুদূর গিয়ে রাস্তার পাশে একটা সুসজ্জিত রেস্টুরেন্টে গাড়িচালক আমাদের লাঞ্চ করার পরামর্শ দিলেন। উনিও এখানেই আমাদের সঙ্গে লাঞ্চ সারলেন। ঘণ্টাখানেকের মধ্যে আমাদের খাওয়া শেষ করে রওনা দিলাম মানালির উদ্দেশে।

মানালি যাওয়ার রাস্তাতেই শ্রীমহাদেবী তীর্থ বৈষ্ণোমাতা মন্দির পড়ল। মন্দিরটি কুল্লু-মানালি ২১ নম্বর জাতীয় সড়কে অবস্থিত। খরস্রোতা বিয়াস নদীর তীরে এই মন্দির প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৬৬ সালে। ড্রাইভার রাস্তার পাশে গাড়ি নিরাপদ দূরত্বে রেখে মন্দিরের উলটো দিকে চা পান করতে গেল। আমরা মন্দির দর্শন করার জন্য মন্দিরের ভিতরে প্রবেশ করলাম। কথিত আছে ভগবান শিবের স্ত্রী পার্বতীকে উৎসর্গ করা হয় এই মন্দির। এখানে বেশ ভিড়। মন্দিরে প্রবেশ করে শুনলাম নবরাত্রির জন্য এই জনসমাগম। পাহাড়ি শৈলীর সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে মন্দিরের স্থাপত্য এবং বাহ্যিক কারুকার্য অসাধারণ। মন্দিরের কাঠের বারান্দা থেকে চারপাশের দৃশ্য মনোমুগ্ধকর। মন্দিরটির তিনতলা কাঠামো কারুশিল্প সুরুচিবোধের পরিচায়ক। মন্দিরের অভ্যন্তর কক্ষগুলি ঝাড়বাতি, খোদাই করা পেইন্টিং এবং আসবাবপত্র দিয়ে সুসজ্জিত।

সমগ্র মন্দিরের ভিতর ঊনিশটি ছোটো ছোটো বিভিন্ন দেবতার মন্দির আছে। মন্দির প্রাঙ্গণে একটি শিব মন্দিরও আছে। মন্দিরটি ট্রাস্ট দ্বারা পরিচালিত হয়। এখানে তীর্থযাত্রীদের জন্য বিনামূল্যে একটি লঙ্গর এবং একটি আকুপ্রেশার চিকিৎসা কেন্দ্রও রয়েছে। মন্দিরের ভিতর একটি ছোটো দোকানও আছে, যেখানে পুজোর উপকরণ সহ আরও নানান দ্রব্য সামগ্রী বিক্রি করা হচ্ছে। মন্দিরের উপর থেকে কুল্লু উপত্যকা এবং প্রাণচঞ্চল বিয়াস নদীর দৃশ্য এককথায় অপূর্ব। বিয়াসের বুকে তখন রিভার রাফটিং চলছিল। আমরা মন্দির থেকে বেরিয়ে বিয়াসের তীরে চায়ের দোকানে চা পান করে আবার যাত্রা শুরু করলাম।

মানালির হোটেল আমাদের অনলাইন বুক করাই ছিল। পাহাড়ের বুক চিরে গাড়ি ছুটল। সবুজ গাছগাছালি, অজানা পাহাড়ের বাঁকে বাঁকে রহস্যময় সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে আমরা প্রায় সাড়ে সাত ঘণ্টার পথ অতিক্রম করে মানালির হোটেলে পৌঁছালাম। দীর্ঘ জার্নি করে রাত আটটায় হোটেলে পৌঁছে, ডিনার করে যথাসময়ে শুয়ে পড়লাম। সকাল ন’টার মধ্যেই আমাদের ড্রাইভার বেরোনোর পরামর্শ দিয়েছিলেন।

মানালিতে প্রথম দিন আমাদের গন্তব্য ছিল রোটাং পাস। সকালে হালকা ব্রেকফাস্ট সেরে আমরা বেরিয়ে পড়লাম। আমাদের হোটেল থেকে প্রায় ৩৮ কিমি দূরে রোটাং পাস, হিমাচল প্রদেশের উচ্চ গিরিপথ। ড্রাইভারের মুখে শুনেছিলাম রোটাং পাস যাওয়ার জন্য ৬০টি পেট্রোল যান এবং ৪০টি ডিজেল যানের অনুমতি রয়েছে। এর বেশি যানবাহন যাওয়ার অনুমতি নেই। হিমালয়ের চোখ ধাঁধানো নৈসর্গিক সৌন্দর্য, বিয়াস নদীর ঝংকার শুনতে শুনতে আমরা প্রায় দেড় ঘণ্টা পাহাড়ি পথ অতিক্রম করে রোটাং পাসে পৌঁছালাম। পথে ছোটো বড়ো কিছু টানেল পড়ল।

পথে হিমাচলের দীর্ঘতম অটল টানেলও পড়ল। ড্রাইভার জানাল, ফেরার পথে আমরা এখানে কিছুক্ষণ দাঁড়াব। আবহাওয়া ভালো থাকতে থাকতে রোটাং পাস দেখে আসা ভালো। যে-কোনও মুহূর্তে খারাপ আবহাওয়ার কারণে এই পাস বিপজ্জনক হতে পারে। এই রেঞ্জ অতিক্রম করতে গিয়ে অনেকের মৃত্যু হয়েছে বলে, স্থানীয়রা এই জায়গাকে ‘রোটাং’ বা ‘ডেথ প্লেস’ বলে। বাংলায় যার অর্থ ‘মৃতদেহের ভূমি’। এই গিরিপথটি হিমালয়ের পীরপাঞ্জাল রেঞ্জের। এটি কুল্লু উপত্যকাকে হিমাচলের লাহৌল এবং স্পিতি উপত্যকার সঙ্গে সংযুক্ত করেছে। এটির উচ্চতা প্রায় ১৩,০৫৮ ফুট।

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...