বদলি বাতাসে আকণ্ঠ তৃষ্ণা, একঘেয়ে ক্যানভাসে কচি সবুজের ব্যতিক্রম… প্রতীক্ষা রিনরিন। শিমুলে, পলাশে সোহাগে ঝিম হয়ে থাকা সময়ে মহুয়ামিলন।
ফাল্গুনে হাওয়ায় এবারের সফরে অন্য আমেজের পরশ। গত ফেব্রুয়ারি মাসে যাওয়ার তারিখটা চলে এলো গুনগুনিয়ে। ৯ জন ফোটোগ্রাফারের সঙ্গে আমি দশম হয়ে চললাম লাল পাহাড়ির দেশে। আমি ছাড়া এই গ্রুপের সবাই ছবি তোলেন। আমার জীবনে প্রথম ফোটোগ্রাফি ট্যুর।
রাতের দুলুনি ট্রেন ভালোই নিয়ে এলো ‘বরাভূম’ স্টেশনে। প্রথমবার আসা রাঙামাটির দেশে। স্টেশন চত্বর লাগোয়া চায়ের দোকানে সকালের চা পান। নতুন জায়গার সঙ্গে যেন চায়ের একটা অপত্য সম্পর্ক আছে! চায়ের ভাঁড় হাতে তাকিয়ে দেখি এলোমেলো নিঃসঙ্গ স্টেশনখানা ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা জঙ্গল গায়ে জড়িয়ে আছে। চা শেষ করে দুটি গাড়িতে ভাগাভাগি করে চড়ে বসলাম— গন্তব্য বাঘমুণ্ডি।
গাড়ি ছাড়ার পর মন আর বশে থাকল না। দুই চোখ আতিপাতি করে তাকে খুঁজতে লাগল। আমি তাকে অবহেলাই করেছি এতদিন। আজ তৃষিত নয়নে দেখতে চাই… ফিরে এসো প্লিজ! কালো মসৃণ পিচের রাস্তা বাঁক ঘুরতেই হালকা রোদের সকালে বহুদূরে আবছা লালচে মরচে আভা। তারপর ওয়াইড লেন্থে মাইলের পর মাইল জুড়ে প্রগাঢ় লালের আহ্বান। সে এক অপরূপ দৃশ্য!
আমি হিতাহিত জ্ঞানশূন্য অবস্থায় পাশে বসা মুধুজার কাঁধ খামচে চিৎকার করে বললাম, ‘দেখেছিস পলাশ ! পলাশ!’ মেন্টর তখন মুচকি হেসে বলল, ‘তোমাকে তো আগেই বলেছি পুরো লালে লাল দেখাব।’ অন্যদের তাকানোতে মনে হল আমি একটু বেশিই যেন বাড়াবাড়ি করে ফেলেছি মনে হয়।
সকালের অলস রোদ্দুরে গাড়ি পর পর দুটো হেয়ার পিন বাঁক নিতেই উন্মুক্ত পাখি পাহাড়, পিরামিডসদৃশ তেকোণা। নীচে তখন তুমুল লালের আলোড়ন। গাড়ির ড্রাইভার নিপেন মাহাতো এগিয়ে চলেছে নির্বিকার মুখে। পলাশ ততক্ষণে রাস্তার একেবারে কাছে এসে ঘিরে ধরেছে ফ্রেম। যেখানে সারাদিন কুয়াশা ওড়ে, নীলাভ রঙের পাহাড় থেকে আলগা হয়ে বেরিয়ে আসে বৃক্ষ, পল্লব, ফুল, পাখি, সেখানে যক্ষী পাহারা দেয়। আমি জঙ্গলের ক্ষার মাটি ঝরনা থেকে কেটে বার করে এনেছি আমার পুরুলিয়াকে৷ একটা ভিউ পয়েন্টে গাড়ি থামতেই নেমে পলাশের গা জড়িয়ে ধরতেই পলাশ টুপটাপ করে আমার মুখে শরীরে ঝরে পড়ল। বুঝলাম আমি অলরেডি পলাশে হিপনোটাইজড !
মাথার ওপর লাল পলাশের চন্দ্রাতপ, পায়ের নীচে সবুজপাতার গালিচা মাড়িয়ে পৌঁছে গেলাম বাঘমুন্ডি পঞ্চায়েত অফিসের উলটো দিকে আগে থেকে বুক করা রাখা আবাসনে। এখন এটাই আমাদের দিন তিনেকের বর্তমান ঠিকানা। হোটেলের চারপাশের খোলামেলা ধানকাটা রিক্ত প্রান্তরে মন হুহু করা ফাল্গুনি হাওয়া যেন শিশ দিচ্ছে। সাধারণ মানের আবাসনের প্রতিটি ঘর পুরুলিয়ার পরবের নামে রাখা। ভাদু, টুসু, করম, জিতুয়া, বাঁদনা ও রোহিনী।
সকলেই ফ্রেস হয়ে ব্রেকফাস্ট শেষ করে চললাম তিন কিলোমিটার দূরে চড়িদা গ্রাম দেখতে। পুরুলিয়ার আদি নৃত্যশৈলী ‘ছৌ’ নাচে ব্যবহৃত মুখোশের জন্মস্থান হল এই চড়িদা গ্রাম। গ্রামে ঢুকেই যে যার মতো ছবি তোলায় ব্যস্ত হয়ে গেল।
আমি উঁকি দিয়ে দেখি প্রায় অন্ধকার একটি খুপরি ঘরে বৃদ্ধ এক শিল্পী। তাঁর পরনে ফুটিফাটা গেঞ্জি, খয়াটে চেহারার নুব্জ্য বৃদ্ধশিল্পী একমনে নিপুণ হাতে মুখোশের জাল বুনে চলেছেন। মনটা ভারাক্রান্ত হয়ে দূরে সরতে চাইল! কিন্তু এই নীরব শিল্পকর্মের দৃশ্য আমার সঙ্গীরা লেন্সবন্দী করতে ছাড়ল না। এরই মধ্যে তারা খুঁজে পায় ক্লাসিক্যাল বিউটি। পরে এই সব ছবিই তাদের পুরস্কারের বাহক হয়।
বিকেল তিনটে নাগাদ বেরিয়ে পড়লাম কিছুটা দূরে বামনকাটা পাহাড়ের গায়ে তুর্গা ফলস দেখতে। খেয়ালবশত তরতর করে নেমে যাচ্ছি কিশোরী বেলায় ! তুর্গা প্রবল হাতছানি দিচ্ছে, কুসুম গাছ চেনাচ্ছে। পাথর বেয়ে নির্দ্বিধায় চলে এলাম বেশ উঁচুতে ঝরনার একদম কোলের কাছে।
পলাশের উৎসবে আমি তো একাই। একার মাঝে কী অকপট এই অরণ্যবোধ। অবর্ণনীয় গাঢ় সবুজ ছায়াপথ পরম মমতায় ঢেকে রাখছে আমায়। পা ছুঁয়ে বসলাম ঝরনার ধার ঘেঁষে। মনের গভীর তলদেশ স্পর্শ করা দাহ জুড়ানো কুলকুল ধ্বনি। ফলসের চারপাশে দর্শক শুধুই পলাশ। পলাশের সোহাগ, তার উচ্ছ্বাস, তাকে পাওয়ার পূর্ণতা আদরে আদরে লাল করে দিচ্ছে। ক্রমশ পথ ধুয়ে গেল চাঁদের আলোয়, ফিরছি অন্ধকারের জ্যোৎস্না মেখে। মাঝেমধ্যে দু-একজন পথচারী। কাল ভোরে আবার দেখা হবে পলাশ!
(ক্রমশ…)