টেরা অর্থ মাটি এবং কোটা অর্থ পোড়া। বিষ্ণুপুরের আনাচেকানাচে শৈল্পিক সুষমায় টেরাকোটা মন্দিরগুলি যেন স্থাপত্যের রূপকথা শোনায়। তাদের প্রতিটিই নিজস্বতা, বৈশিষ্ট্য, নান্দনিকতা ও শিল্পকলায় স্বতন্ত্র।
এখানকার প্রধান দ্রষ্টব্য আনুমানিক ১৬০০ সালে, বীর হাম্বির প্রতিষ্ঠিত রাসমঞ্চ। এর স্থাপত্যরীতিতে বাংলা, বৌদ্ধ, ইসলামিক, মিশরীয় রীতির মিশেল। বিগ্রহহীন রাসমঞ্চটি ৩৫ ফুট উঁচু এবং ৮০ ফুট লম্বা। মঞ্চের ওপরের অংশটি পিরামিড আকৃতির, মধ্য অংশটি কুঁড়েঘরের মতো, নীচের দিকের খিলানগুলি ইসলামিক স্থাপত্যরীতির। নীচের বেদি মাকড়া পাথরের ও ওপরের স্থাপত্য ইটের তৈরি। ১৬০০-১৯৩২ সাল পর্যন্ত এখানে রাধাকৃষ্ণের রাস উৎসব হতো।
মল্লরাজাদের আমলে রাসপূর্ণিমার দিন এখানকার যাবতীয় রাধাকৃষ্ণ বিগ্রহকে এখানে এনে আলো ফুল বিভূতিতে সজ্জিত করা হতো, জনসাধারণের দর্শনের জন্য। আশ্চর্য এই ইমারত বর্তমানে আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার রক্ষণাবেক্ষণে রয়েছে। রোদ্দুরের আলোছায়ায় অপরূপ নকশা আঁকা হয় চত্বরটিতে, যা ছবি-তুলিয়েদের কাছে বেশ লোভনীয় উপাদান নিঃসন্দেহে। অতীতে রাসের সময় জেগে উঠত ঝামাপাথর-ইটের এই রাসমঞ্চ। বীর হাম্বিরের যুদ্ধজয়ে বিজয় উৎসব, শ্রাবণ সংক্রান্তিতে ঝাপান উৎসব। রাজবাড়ির সামনে সাপুড়েরা এসে হরেক খেলা দেখান।
দলমাদল কামানটি না দেখলে অসম্পুর্ণ থেকে যায় বিষ্ণুপুর ভ্রমণ। দলমাদল অর্থাৎ শত্রুদের ধ্বংস। দলমাদল সবচেয়ে বৃহৎ কামানগুলির অন্যতম। সুবিখ্যাত কামানটির দৈর্ঘ্য ১২ ফুট ৫ ইঞ্চি, পরিধি ১১ ইঞ্চি, ওজন ১১২ কুইন্টাল। বিষ্ণুপুরের অস্ত্রশালাতেই মাকড়া পাথর গলিয়ে লোহা বার করে তৈরি হয়েছিল কামানটি। মল্লরাজ গোপাল সিংহ এইটি নির্মাণ করান। জগন্নাথ কর্মকার নামের এক ব্যাক্তি, বিজাপুরের মালিক-ই-ময়দান কামানের অনুরূপ করে কামানটি তৈরি করেছিলেন।
কথিত আছে, ১৭৪২ সালে মারাঠা দস্যু, ভাস্কর পণ্ডিতের বর্গীবাহিনীকে এই কামান দেগেই ছত্রখান করেছিলেন রাজবাড়ির কুলদেবতা স্বযং মদনমোহন। ফাঁকা চত্বরের মাঝে লোহার রেলিং ঘেরা কামানটির গায়ে ফরাসি ভাষায় একটি লিপি খোদিত রয়েছে, যার থেকে জানা যায় যে, সেইকালেই কারুকার্যমণ্ডিত কামানটির নির্মাণখরচ ছিল ১ লাখ ৮৫ হাজার টাকা।