সুন্দরবন হল বঙ্গোপসাগর উপকুলবর্তী পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বন বা লবণাক্ত বনাঞ্চল। সুন্দরবনের মোট আয়তন প্রায় ১০হাজার বর্গ কিলোমিটার, যা যৌথভাবে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে অবস্থিত। সবুজের অফুরন্ত সমারোহে অনন্ত বনভমি আর মাকড়সার জালের মতো নদী-খাল-খাঁড়ির আয়ত্বে সুন্দরবন যেন প্রকৃতির এক আশ্চর্য জগৎ।

দোবাঁকি ক্যাম্প

মাতলা নদী পেরিয়ে বিদ্যেধরী হয়ে দোবাঁকি খালে এসে মাঝ বরাবর দাঁড়িয়ে পড়ে বড় বড় লঞ্চগুলি। কেন? কারণ জাহাজের নিজস্ব ডিঙি নৌকায় সওয়ার হয়ে যেতে হয় দোবাঁকি ব্যাঘ্রপ্রকল্প। কয়েক ধাপ সিঁড়ি উঠে, সবুজরঙা প্রবেশপথের শিরে লেখা দোবাঁকি ক্যাম্প। দু দিকে ১২ ফুট উঁচু পর্যন্ত তারের জাল দিয়ে ঘেরা, মাটি থেকে প্রায় ২০ ফুট উঁচু টানা ৪৯৬ মিটার লম্বা ঝুলন্ত সেতুর ভেতর দিয়ে পায়ে হেঁটে কিছুটা এগিয়ে তিনতলা নজরমিনার। একটি মিষ্টি জলের পুকুর রয়েছে ওপাশে। সেখানে ফিঙে, বক, মাছরাঙা পাখিদের মাছ শিকারের নজরদারি। জলের পাড়ে চোখে পড়তে পারে আলসেমির রোদ্দুর পোয়াচ্ছে ঘোড়েল বা গোসাপ।

দোবাঁকি ক্যানোপি ওয়াক এর ফাঁকে, জালির ফোকর দিয়ে আমাদের নজরে পড়ছিল, বনদফতর নির্মিত কৃত্রিম নুনের চৌবাচ্ছায় নুন চাটতে এসেছে এক দঙ্গল চিতল। এখনও পর্যন্ত জলযাত্রা পথে, এই প্রথম কোনও চরে উঠে এবং পশুর দেখা পেয়ে সুন্দরবন বেড়াতে আসা সার্থক মনে হল। আমাদের এতেই উত্তেজনা। জালির ফোকর দিয়ে ক্যামেরার জুম লেন্স গলিয়ে এনতার ছবি তোলাও হল।

নজরমিনারে দাঁড়িয়ে সরকার অনুমোদিত সুন্দরবন বনভূমি প্রদর্শক ছেলেটি এখানকার জনজীবনের গল্প শোনাচ্ছিলেন। এপ্রিল-মে মাসে মধু সংগ্রহের আগে প্রথমে বাঁদররা সারা গায়ে কাদামাটি লেপে মৌচাকগুলি ভাঙে। মধু টপটপ মাটিতে পড়ে গড়াতে থাকে। বাঁদরেরা পরম সুখে সেই মধু চেটেপুটে খায়। এদিকে ব্যাঘ্রমশাই কোথা থেকে উদয় হয়ে থাবা মেরে বাঁদরদের সপাটে মেরে ফেলে, বাকি মধু ও বাঁদরের মাংস খেয়েদেযে চলে যায়।

জানা ছিল, তবু আবারও শুনলাম, গভীর অরণ্যে মধু সংগ্রহের সময় হলেই হেতালের ঝোপের আড়ালে ঘাপটি মেরে অপেক্ষায় থাকে বাঘবাহাদুর। জানে ওই সময় মউল আসবে মধু সংগ্রহ করতে। ওই সময় ঘাড় মটকানোর অনায়াস শিকার তাদের কাছে। বাঘ যেহেতু নিজস্ব কায়দায় সবসময় পেছন থেকে আক্রমণ করে, তাই সুন্দরবনে জীবিকা সন্ধানে আসা মানুষজন মাথার পেছনে একরকম মুখাবয়াব আঁকা মুখোশ পরে থাকেন। কিন্তু এত সাবধানতা অবলম্বন করেও বাঘের কবল থেকে নিস্তার পায় কজন! ভাবি কী মর্মান্তিক।

এখানকার কোর এলাকায় ভয়াল জঙ্গলে নিতান্তই পেটের টানে কাঠ সংগ্রহ, মাছ ধরা, কাঁকড়া ধরা, মধু আহরণ করতে এসে সুন্দরবনের গহনে ঘুরে বেড়ানো সে-সব মানুষ, তাদের কেউ কেউ এমন করে হঠাৎই হারিয়ে যান নরখাদক বাঘের কবলে। অসহায় পড়ে থাকেন তাদের পথ চেয়ে থাকা পরিবার। গুমরে ওঠে কষ্ট, সেই সমস্ত পরিবারের মা, স্ত্রী, সন্তানদের কথা ভেবে। আমরা শহুরে ক্লাব-কালচার-ইঁদুরদৌড়ে টিকে থাকা ব্যাস্ত মানুষেরা এইসব খবরও রাখি না।

দোবাঁকি নজরমিনার ও ক্যানোপি ওয়াক ছাড়াও রয়েছে বনবিবি মন্দির। বাঘের সাম্রাজ্যে পুজিত হন বনবিবি ও দক্ষিণ রায়। দোবাঁকি না গেলে সুন্দরবন দর্শনও বাকি থেকে যায়। পর্যটকদের কাছে একটা চালু কথা আছে, আপনি বাঘ দেখতে না পেলেও বাঘ কিন্তু আপনার ওপর ঠিক নজর রেখেছে।

কীভাবে যাবেন : কলকাতা থেকে নানা ভাবে সুন্দরবন যাওয়া যায়। তবে ক্যানিং এবং সোনাখালি বা বাসন্তী থেকে সুন্দরবন যাওয়ার প্রবণতা বেশি দেখা যায়।

কী দেখবেন : সুন্দরবন কয়েকটি দ্বীপ নিয়ে গড়ে উঠেছে। এর মধ্যে যে-সমস্ত দ্বীপে যাওয়ার ছাড়পত্র মেলে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল সজনেখালি, সুধন্যখালি, পাখিরালয়, পিরখালি, চোরাগাজিখালি, দোবাঁকি, বুড়ি ডাবরি, ঝিঙাখালি, নেতিধোপানি, মরিচঝাঁপি।

কোথায় থাকবেন : সুন্দরবন ভ্রমণের চিরাচরিত প্রথা হল সারাদিন লঞ্চে ঘুরে রাত্রিবাসও লঞ্চে। বর্তমানে রাত্রিবাসের জন্য অনেকগুলি হোটেল, ক্যাম্প, বনবাংলো হয়েছে। প্রতিটি ভাড়ার সঙ্গে সাধারণত সাইটসিযিং, স্পট ভিজিট, পারমিটের খরচ ধরা থাকে।

 

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...