ক্লাস সিক্স-এর ছাত্র অর্ণব, তিন দিন হল বাড়ি ফেরেনি। খাতা কিনতে গিয়ে আর ফেরেনি। বাড়ি থেকে পুলিশে জানানো হয়েছে কিন্তু লাভ হয়নি। চতুর্থ দিনে হঠাৎই একজন ভদ্রলোক এসে অর্ণব-কে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে যায়। উনি জানান মর্নিং ওয়াক করতে গিয়ে লেকের ধারে বেঞ্চিতে ওকে শুয়ে থাকতে দেখেন। পোশাক-আশাক দেখে সন্দেহ হওয়াতে পাশে বসে জিজ্ঞেস করতেই অর্ণবই সবকিছু খুলে বলে। পরীক্ষায় নম্বর কম পাওয়ায় বাবার বকুনি আর মার খাওয়ার ভয়ে বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছে।

ছোট্ট রিমা এখন ক্লাস থ্রি-তে পড়ে। কখনও গলায় কিছু আটকেছে বলে দাবি করে তো কখনও পেট ব্যথার ওজর। সবসময় চুপচাপ, ভয়ে ভয়ে থাকে। ঠিক করে খাবারও খায় না, একটু কিছু বললেই কেঁদে ফেলে। অথচ ডাক্তারের পরামর্শে সবকিছু পরীক্ষা করানোর পরে দেখা যায় সবই নর্মাল। আসলে এই দুটি বাচ্চাই নিজের আভিভাবকদের সুপার পেরেন্ট সিন্ড্রোমের শিকার।

ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্টদের মতে, বহু অভিভাবকই নিজের সাফল্যের জন্য বাচ্চার উপর প্রেশার দেন এবং নিজেদের অজান্তেই বাচ্চাকে স্ট্রেস এবং ডিপ্রেশনের শিকার করে তোলেন। এই সব পেরেন্ট-রা নিজের বাচ্চাকে অপরের বাচ্চাদের থেকে সব ক্ষেত্রে এগিয়ে থাকতে দেখতে চান। পড়াশোনা, খেলাধূলা, আরও নানা ধরনের অ্যাক্টিভিটিতে বাচ্চাকে পুশ করতে থাকেন। বাস্তব থেকে সরে গিয়ে যখন এই সন্তানরাই মা-বাবার আশা পূরণ করতে পারে না, তখন বাচ্চাদের মনে দ্বিধা, অবসাদ, দুঃখের পরিস্থিতি তৈরি হয়।

সাইকোলজিস্টদের মতে সাধারণ পরিবারের বাচ্চাদের থেকে ধনী পরিবারের বাচ্চারা ৩ গুণ বেশি চিন্তা এবং ডিপ্রেশনে ভোগে। এই বাচ্চাদের ভুল রাস্তায় পা দেওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। অনেকেই ড্রাগ নেওয়া শুরু করে। কখনও কখনও বাচ্চাদের নিজেদের উপরেই ঘৃণা তৈরি হয়। সুস্থ বিকাশের জন্য বাচ্চার যে-ধরনের পরিবেশের দরকার হয় সেটা তারা পায় না। স্কুলের লম্বা সময় কাটানোর পর, কোচিং ক্লাসের পড়া, নানা ধরনের অ্যাক্টিভিটির ক্লাস করার পরে, বাচ্চারা নিজের ক্রিয়েটিভিটি প্রকাশের অথবা লুকোনো ট্যালেন্ট দেখাবার সুযোগ এবং সময়, কোনওটাই পায় না।

সব মা-বাবাই চান তাদের সন্তান শুধু যে ক্লাসের পড়াতেই সব থেকে এগিয়ে থাকবে তা নয়, অন্যান্য অ্যাক্টিভিটিতেও পারদর্শিতা অর্জন করবে। পড়াশোনায় ভালো হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে, কালচারাল ফিল্ডই বলুন বা স্পোর্টস– সব ক্ষেত্রেই বাচ্চাকে টপ্ পজিশনে থাকার জন্য অভিভাবকেরা জোর দিতে থাকেন।

আপনিও যদি সুপার পেরেন্ট সিন্ড্রোম-এর শিকার হয়ে থাকেন, তাহলে মনোবিদদের দেওয়া এই টিপসগুলির উপর চোখ রাখুন এবং নিজের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করুন।

ভালোবাসা দিয়ে বোঝান

বাচ্চার ভবিষ্যৎ নিয়ে অভিভাবকদের চিন্তা করাটা খুবই স্বাভাবিক। অনেক সময় মনোবল কম হওয়ার কারণে অনেক অভিভাবক নিজেকে অসুরক্ষিত ভাবে এবং এই মনোভাব বাচ্চার উপরেও প্রয়োগ করা শুরু করে। এই পরিস্থিতিতে বাচ্চা নিজের উপর বিশ্বাস হারাতে থাকে। সুতরাং অভিভাবকদের উচিত, ভালোবাসার ছত্রছায়ায় বাচ্চাকে রেখে ভরসা দেওয়া যে, সে মা-বাবার কাছে সবদিক থেকে সুরক্ষিত। সব সময় আনন্দে থাকা এবং মুখে হাসি বজায় রাখা হল পজিটিভ মনোভাবের পরিচয়। অভিভাবককে দেখে বাচ্চাও শিখবে হাসিমুখে থাকতে। এতে বাচ্চার মধ্যে আত্মবিশ্বাস এবং অভিভাবকদের উপর ভরসা বাড়বে, যে সে যেমনই হোক, মা-বাবার সে প্রিয় পাত্র।

অপরের সঙ্গে তুলনা নয়

কোনও বন্ধু বা আত্মীয়স্বজনের বাচ্চার সঙ্গে নিজের বাচ্চার তুলনা কখনও করা উচিত নয়। কোনও পরীক্ষা বা প্রতিযোগিতায় যদি বাচ্চা কম নম্বর পায় বা অন্য বাচ্চাদের কাছে হেরে গিয়ে থাকে, তাহলে প্রথম হওয়া বাচ্চা বা জিতে যাওয়া বাচ্চাদের সঙ্গে তার তুলনা কখনওই করা উচিত নয়। বরং আদর করে বোঝানো উচিত, একবার হেরে গেলে কোনও ক্ষতি নেই, পরের বার আবার চেষ্টা করলেই হল। সাফল্য যে তার আসবেই সেই ভরসা বড়োদেরই বাচ্চাকে দিতে হবে। এতে বাচ্চার আত্মসম্মানে আঘাত লাগবে না।

উপদেশ দেওয়া বন্ধ করতে হবে

কথোপকথন অনেক সময় সমস্যার সমাধান করে কিন্তু এমনও হওয়া উচিত নয় যে বড়োরা খালি উপদেশ দেবার নামে চাপ সৃষ্টি করবে আর বাচ্চাকে সব শুনতে হবে। যদি এমনই পরিবেশ বাড়িতে হয়ে থাকে তাহলে নিশ্চিত ভাবে বলা যায়, বাচ্চা বড়োদের কোনও কথাই শুনবে না।

বাচ্চার ক্ষমতা এবং সীমা বুঝতে হবে

বাচ্চাকে একের পর এক ক্লাস অথবা টিউশন জয়েন করিয়ে অভিভাবকেরা ঠিক কি ভুল করছেন সেটা বাচ্চার দৃষ্টিকোণ দিয়ে বিচার করাটা বাঞ্ছনীয়। এমন না হয় যে অন্যের দেখাদেখি বা অন্যের সঙ্গে তুলনা করতে গিয়ে মা-বাবা বাচ্চার উপর প্রেশার দিয়ে ফেলছেন। বাচ্চার নেওয়ার ক্ষমতা বা বোঝার শক্তি কতটা, সেটা না যাচাই করেই তাকে এগিয়ে যাওয়ার জন্য জোর দিতে গিয়ে অভিভাবকেরা, বাচ্চাদের ক্ষতি করেন। অপরের সন্তানের যোগ্যতা বিচার করে তার সঙ্গে নিজের বাচ্চার তুলনা করা কখনওই সঙ্গত নয়। বরং অপরের বাচ্চাকে ছেড়ে দিয়ে নিজের বাচ্চার মধ্যে যা যা গুণ আছে সেগুলোই আরও ভালো ভাবে চর্চা করার সুযোগ করে দেওয়া দরকার। ধৈর্য ধরে ধীরে ধীরে যে অগ্রসর হতে পারে, তার জেতার সম্ভাবনাও তত বেশি থাকে।

বাচ্চার ইচ্ছেকে সম্মান করুন

বাচ্চাকে শাসন করা এবং আজ্ঞানুসারী হতে শেখানো খুবই দরকার এতে কোনও সন্দেহ নেই। কিন্তু কখনও কখনও বাচ্চাদের প্রতি বড়োদের উদারতা দেখানোও খুব প্রয়োজন। বাচ্চা যদি কখনও একলা থাকতে চায়, ইন্টারনেট অথবা মোবাইলে কারও সাথে চ্যাটিং করার ইচ্ছা প্রকাশ করে তাহলে মা-বাবার সেটা করতে দেওয়া উচিত। যদি বড়োরা বোঝেন যে বাচ্চা কিছু অন্যায় করছে তাহলে অতিরিক্ত শাসন বা অত্যাচার করার বদলে, বাচ্চাকে বুঝিয়ে বলুন। মাঝেমধ্যে তাকে পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়ে, স্বতন্ত্র ভাবে কাজ করার সুযোগ দিতে হবে এবং ভরসাও রাখতে হবে তার উপর।

ভালো কাজের প্রশংসা করুন

বাচ্চা ভুল করলে বড়োরা বকাবকি করেন কিন্তু ভালো কাজ করলে প্রশংসা করতে ভুলে যান কী করে? বাচ্চার প্রশংসা খালি ওর স্কুলের রিপোর্ট কার্ড অবধি সীমিত রাখা উচিত নয়। পড়াশোনা ছাড়াও সব ক্ষেত্রেই ওর পারফর্মেন্সের প্রশংসা করুন এবং বাচ্চাকে কিছু না কিছু উপহার দিন। একই সঙ্গে কাছে টেনে নিয়ে আদর করুন।

বাচ্চাটি যদি বন্ধুদের সঙ্গে মিলেমিশে কোনও ভালো কাজ করে, অপরের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করে, অপরের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়, তাহলেও বাচ্চার প্রশংসা করুন নয়তো সে ভালো কিছু করার উৎসাহ হারিয়ে ফেলতে পারে।

হেরে যাওয়ারও দরকার আছে

বাচ্চাকে এমনভাবে তৈরি করা দরকার যাতে জীবনে শুধুমাত্র জিত হাসিল করার জন্য নয়, বরং ভালো কিছু করার লক্ষ্যে এবং একজন ভালো মানুষ হওয়ার লক্ষ্যে সে যেন কাজ করে যায়। জীবনে সাফল্য সবসময় আসে না, তাই বলে বাচ্চার প্রচেষ্টা-কে হেয় না করে তাকে এগিয়ে যাওয়ার জন্য উদ্বুদ্ধ করতে হবে।

অনেক অভিভাবকেরা বাচ্চার সঙ্গে খেলার সময়, বাচ্চাকে খুশি করতে ইচ্ছে করেই হার স্বীকার করে নেন। এটা কখনওই করা উচিত নয়। বাচ্চাকে সবসময় চেষ্টা করার জন্য প্রেরণা দিতে হবে, নয়তো বাচ্চা কষ্ট না করেই সব ব্যাপারে জেতার চেষ্টা করবে। জেতার সঙ্গে সঙ্গে জীবনের হার-টাকেও সহজ ভাবে যাতে সে মেনে নিতে পারে, সেটা ছোটো থেকেই তাকে শেখাতে হবে।

বাড়ির পরিবেশ দায়ী

বাচ্চার শিক্ষা শুরু হয় বাড়ি থেকেই। বড়োদের মধ্যে থেকেই আত্মবিশ্বাস, বিবেচনাবোধ, সাহস, দৃঢ়তা এবং ইতিবাচক ভাবনা নিয়ে বেড়ে ওঠে সে। বাড়িতে বড়োদের অসম্মান করা, ঝগড়াঝাঁটি, গালিগালাজ, মা-বাবার মদ-সিগারেটে আসক্তি ইত্যাদি বাচ্চার মনকে প্রভাবিত করে। বাচ্চা যা দেখে তাই শেখে।

বড়োদের ফ্রাসট্রেশন বাচ্চার উপর বার না করা

অফিস এবং বাড়ির টেনশন বাচ্চার সামনে প্রকাশ হওয়া উচিত নয়। এতে সে ওই পরিবেশ এড়ানোর চেষ্টা করবে এবং বাড়িতে সময় না দিয়ে বাইরে থাকাই পছন্দ করবে বেশি। বাচ্চা অভিভাবকদের আনন্দে থাকতে দেখতে চায়, যাতে তারা নিজেদের সমস্যা বড়োদের কাছে খুলে বলতে পারে। বাইরের ঘটনায় হওয়া টেনশন বা রাগের কারণে বাচ্চার উপর হাত তোলা কখনও বাঞ্ছনীয় নয়।

নিজের সঙ্গে তুলনা কখনও করবেন না

নিজের শৈশবে যা কিছুর অভাব ঘটেছে সেগুলো মা-বাবা হয়ে যাওয়ার পর, বাচ্চাকে দিতেই হবে এমন কোনও নিয়ম নেই। মা-বাবা ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, গায়ক বা গোল্ড মেডেলিস্ট হতে পারেন, নামি খেলোয়াড় হওয়াও অসম্ভব নয়। তাই বলে বাচ্চাকেও মা-বাবার পেশায় যেতে হবে, এই আশা রাখাটা উচিত নয়। বাচ্চার নিজের শখ এবং সীমাবদ্ধতা আছে। প্রয়োজনের অতিরিক্ত প্রত্যাশা করা ঠিক নয়। নিজের কর্তব্য শুধু পালন করে যেতে হবে। বাচ্চার প্রতিভা বিকশিত করার জন্য সঠিক পরিবেশ তৈরি করাটার দায়িত্ব অভিভাবকদেরই।

 

 

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...